You dont have javascript enabled! Please enable it! draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

অসমাপ্ত আত্মজীবনী

পর্ব -১

আমার জন্ম হয় এই টুঙ্গিপাড়া শেখ বংশে। শেখ বোরহানউদ্দিন নামে এক ধার্মিক পুরুষ এই বংশের গোড়াপত্তন করেছেন বহুদিন পূর্বে। শেখ বংশের যে একদিন সুদিন ছিল তার প্রমাণস্বরূপ মোগল আমলের ছোট ছোট ইটের দ্বারা তৈরি চকমিলান দালানগুলি আজও আমাদের বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি করে আছে। বাড়ির চার ভিটায় চারটা দালান। বাড়ির ভিতরে প্রবেশের একটা মাত্র দরজা, যা আমরাও ছোটসময় দেখেছি বিরাট একটা কাঠের কপাট দিয়ে বন্ধ করা যেত। একটা দালানে আমার এক দাদা থাকতেন। এক দালানে আমার এক মামা আজও কোনোমত দিন কাটাচ্ছেন। আর একটা দালান ভেঙে পড়েছে, যেখানে বিষাক্ত সর্পকুল দয়া করে আশ্রয় নিয়েছে। এই সকল দালান চুনকাম করার ক্ষমতা আজ তাদের অনেকেরই নাই। এই বংশের অনেকেই এখন এ বাড়ির চারপাশে টিনের ঘরে বাস করেন। আমি এই টিনের ঘরের এক ঘরেই জন্মগ্রহণ করি।
শেখ বংশ কেমন করে বিরাট সম্পদের মালিক থেকে আস্তে আস্তে ধ্বংসের দিকে গিয়েছিল তার কিছু কিছু ঘটনা মুরুব্বিদের কাছ থেকে এবং আমাদের দেশের চরণ কবিদের গান থেকে আমি জেনেছি। এর অধিকাংশ যে সত্য ঘটনা এ সম্বন্ধে আমার কোন সন্দেহ নাই। শেখ বংশের সব গেছে, শুধু আজও তারা পুরাতন স্মৃতি ও পুরানো ইতিহাস বলে গর্ব করে থাকে।
শেখ বোরহানউদ্দিন কোথা থেকে কিভাবে এই মধুমতীর তীরে এসে বসবাস করেছিলেন কেউই তা বলতে পারে না। আমাদের বাড়ির দালানগুলির বয়স দুইশত বৎসরেরও বেশি হবে। শেখ বোরহানউদ্দিনের পরে তিন চার পুরুষের কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না। তবে শেখ বোরহানউদ্দিনের ছেলের ছেলে অথবা দু’এক পুরুষ পরে দুই ভাইয়ের ইতিহাস পাওয়া যায়। এঁদের সম্বন্ধে অনেক গল্প আজও শোনা যায়। এক ভাইয়ের নাম শেখ কুদরতউল্লাহ, আর এক ভাইয়ের নাম শেখ একরামউল্লাহ। আমরা এখন যারা আছি তারা এই দুই ভাইয়ের বংশধর। এই দুই ভাইয়ের সময়েও শেখ বংশ যথেষ্ট অর্থ ও সম্পদের অধিকারী ছিল। জমিদারির সাথে সাথে তাদের বিরাট ব্যবসাও ছিল।
শেখ কুদরতউল্লাহ ছিলেন সংসারী ও ব্যাবসায়ী; আর শেখ একরামউল্লাহ ছিলেন দেশের সরদার, আচার-বিচার তিনিই করতেন।
শেখ কুদরতউল্লাহ ছিলেন বড় ভাই। এই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাদেশ দখল করে এবং কলকতা বন্দর গড়ে তোলে। ইংরেজ কুঠিয়াল সাহেবেরা এই দেশে এসে নীল চাষ শুরু করে। শেখ কুদরতউল্লাহ সম্বন্ধে একটা গল্প আজও অনেকে বলাবলি করে থাকে এবং গল্পটা সত্য। খুলনা জেলার আলাইপুরে মি. রাইন নামে একজন ইংরেজ কুঠিয়াল সাহেব নীল চাষ শুরু করে এবং একটা কুঠি তৈরি করে। আজও সে কুঠিটা আছে। শেখদের নৌকার বহর ছিল। সেইসব নৌকা মাল নিয়ে কলকাতায় যেত। মি. রাইন নৌকা আটক করে মাঝিদের দিয়ে কাজ করাত এবং অনেক দিন পর্যন্ত আটক রাখত। শুধু শেখদের নৌকাই নয় অনেকের নৌকাই আটক রাখত। কেউ বাঁধা দিলে অকথ্য অত্যাচার করত। তখনকার দিনের ইংরেজের অত্যাচারের কাহিনী প্রায় সকলেরই জানা আছে। শেখরা তখনও দুর্বল হয়ে পড়ে নাই। রাইনের লোকদের সাথে কয়েক দফা দাঙ্গাহাঙ্গামা হল এবং কোর্টে মামলা দায়ের হল। মামলায় প্রমাণ হল রাইন অন্যায় করেছে। কোর্ট শেখ কুদরতউল্লাহকে বলল, যত টাকা ক্ষতি হয়েছে জরিমানা করুন, রাইন দিতে বাধ্য। ঐ যুগে এইভাবেই বিচা হত। শেখ কুদরতউল্লাহ রাইনকে অপমান করার জন্য ‘আধা পয়সা’৩জরিমানা করল। রাইন বলেছিল, ‘যত টাকা চান দিতে রাজী আছি, আমাকে অপমান করবেন না। তাহলে ইংরেজ সমাজ আমাকে গ্রহণ করবে না; কারণ, ‘কালা আদমি’ আধা পয়সা জরিমানা করেছে’। কুদরতউল্লাহ শেখ উত্তর করেছিল বলে কথিত আছে, ‘টাকা আমি গুনি না, মেপে রাখি। টাকার আমার দরকার নাই। তুমি আমার লোকের উপর অত্যাচার করেছ; আমি প্রতিশোধ নিলাম’। কুদরতউল্লাহ শেখকে লোকে ‘কদু শেখ’ বলে ডাকত। আজও খুলনা ও ফরিদপুরের বৃদ্ধ মানুষ বলে থাকে এই গল্পটা মুখে মুখে। ‘কুদরতউল্লাহ শেখের আধা পয়সা জরিমানার’, দু’একটা গানও আছে। আমি একবার মিটিং করতে যাই বাগেরহাটে, আমার সাথে জিল্লুর রহমান এডোভোকেট ছিল। ট্রেনের মধ্যে আমার পরিচয় পেয়ে এক বৃদ্ধ এই গল্পটা আমাকে বলেছিলেন। খুলনা জেলায় গল্পটা বেশ পরিচিত।
শেখ কুদরতউল্লাহ ও একরামউল্লাহ শেখের মৃত্যুর দুই এক পুরুষ পর থেকেই শেখ বাড়ির পতন শুরু হয়। পর পর কয়েকটা ঘটনার পরেই শেখদের আভিজাত্যটাই থাকল, অর্থ ও সম্পদ শেষ হয়ে গেল।

পর্ব -২
ইংরেজরা মুসলমানদের ভাল চোখে দেখত না। প্রথম ঘটনা, রাণী রাসমণি হঠাৎ জমিদার হয়ে শেখদের সাথে লড়তে শুরু করলেন, ইংরেজও তাঁকে সাহায্য করল। কলকাতার একটা সম্পত্তি ও উল্টাডাঙ্গার আড়ত শেখদের সম্পত্তি ছিল। এই সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন শেখ আছিমুদ্দিন। আবার জমিদারি নিয়েও রাসমণির স্টেটের সাথে দাঙ্গাহাঙ্গামা লেগেই ছিল। শেখ বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে শ্রীরামকান্দি গ্রামে তমিজুদ্দিন নামে এক দুর্ধর্ষ লোক বাস করত। সে রাসমণি স্টেটের পক্ষ অবলম্বন করেছিল। সে ভাল যোদ্ধা ছিল। একবার দুইপক্ষে খুব মারামারি হয়। এতে রাসমণির লোক পরাজিত হয়। শেখদের লোকদের হাতে তমিজুদ্দিন আহত অবস্থায় ধরা পড়ে এবং শোনা যায় যে, পরে মৃত্যুবরণ করে। মামলা শুরু হয়। শেখদের সকলেই গ্রেফতার হয়ে যায়। পরে বহু অর্থ খরচ করে হাইকোর্ট থেকে মুক্তি পায়।
এরপরই আর একটা ঘটনা হয়। টুঙ্গিপাড়া শেখ বাড়ির পাশেই আরেকটা পুরানা বংশ আছে, যারা কাজী বংশ নামে পরিচিত। এদের সাথে শেখদের আত্মীয়তাও আছে। আত্মীয়তা থাকলেও রেষারেষি কোনোদিন যায় নাই। কাজীরা অর্থ-সম্পদ ও শক্তিতে শেখদের সাথে টিকতে পারে নাই, কিন্ত লড়ে গেছে বহুকাল। যে কাজীদের সাথে আমাদের আত্মীয়তা ও ঘনিষ্টতা ছিল তারা শেখদের সমর্থন করত। কাজীদের আর একটা দল রাণী রাসমণির সাথে যোগদান করে। তারা কিছুতেই শেখদের আধিপত্য সহ্য করতে পারছিল না। তাই তারা এক জঘন্য কাজের আশ্রয় নিল শেষ পর্যন্ত। অধিকাংশ কাজী শেখদের সাথে মিশে গিয়েছিল। একটা দল কিছুতেই শেখদের শেষ না করে ছাড়বে না ঠিক করেছিল। বৃদ্ধ এক কাজী, নাম সেরাজতুল্লা কাজী। তার তিন ছেলে ও এক মেয়ে ছিল। ছেলেরা এক ষড়যন্ত্র করে এবং অর্থের লোভে বৃদ্ধ পিতাকে গলা টিপে হত্যা করে শেখ বাড়ির গরুর ঘরের চালের উপরে রেখে যায়। এই ঘটনা শুধু তিন ভাই এবং তাদের বোনটা জানত। বোনকে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছিল। শেখ বাড়িতে লাশ রেখে রাতারাতিই থানায় যেয়ে খবর দেয় এবং পুলিশ সাথে নিয়ে এসে লাশ বের করে দেয় এবং বাড়ির সকলকে গ্রেফতার করিয়ে দেয়। এতে শেখদের ভীষণ অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়।
আমার দাদার চাচা এবং রেণুর দাদার বাবা কলকাতা থেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে চলে আসেন বাড়িতে। কলকাতার সম্পত্তি শেষ হয়ে যায়। তারপর যখন সকলে গ্রেফতার হয়ে গেছে, কেউই দেখার নাই-বড় বড় ব্যাবসায়ী, মাঝি ও ব্যাপারীরা নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে উধাও হতে শুরু করল। এর পূর্বে তমিজুদ্দিনের খুনে যথেষ্ট টাকা খরচ হয়ে গেছে। জমিদারিও নিলাম হয়ে প্রায় সবই চলে যেতে লাগল। বহুদিন পর্যন্ত মামলা চলল। নিচের কোর্টে সকলেরই জেল হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত কলকাতা হাইকোর্টে মামলা শুরু হল। আমাদের এডভোকেট হাইকোর্টে দরখাস্ত করল সিআইডি দ্বারা মামলা আবার ইনকোয়ারি করাতে। কারণ, এ মামলা ষড়যন্ত্রমূলক। হাইকোর্ট মামলা দেখে সন্দেহ হলে আবার ইনকোয়ারি শুরু হল। একজন অফিসার পাগল সেজে আমাদের গ্রামে যায় আর খোঁজ খবর নেয়। একদিন রাতে সেরাজতুল্লাহ কাজীর তি ছেলের মধ্যে কি নিয়ে ঝগড়া হয় এবং কথায় কথায় এক ভাই অন্য ভাইকে বলে, ‘বলেছিলাম না শেখদের কিছু হবে না, বাবাকে অমনভাবে মারা উচিত হবে না’। অন্য ভাই বলে, ‘তুই তো গলা টিপে ধরেছিলি তাই তো বাবা মারা গেল’। বোনটা বলল, ‘বাবা একটু পানি চেয়েছিল, তুই তো তাও দিতে দিলি না’। সিআইডি এই কথা শুনতে পেল ওদের বাড়ির পিছনে পালিয়ে থেকে। তার কয়েকদিন পরেই তিন ভাই ও বোন গ্রেফতার হল এবং স্বীকার করতে বাধ্য হল তারাই তাদের বাবাকে হত্যা করেছে।
শেখরা মুক্তি পেল আর ওদের যাবজ্জীবন জেল হল। শেখরা মামলা থেকে বাঁচল, কিন্ত সর্বস্বান্ত হয়েই বাঁচল। ব্যবসা নাই, জমিদারি শেষ, সামান্য তালুক ও খাস জমি, শেখ বংশ বেঁচে রইল শুধু খাস জমির জন্য। এদের বেশ কিছু খাস জমি ছিল। আর বাড়ির আশপাশ দিয়ে কিছু জমি নষ্কর ছিল। খেয়ে পরার কষ্ট ছিল না বলে বাড়িতে বসে আমার দাদার বাবা চাচারা পাশা খেলে দিন কাটাতেন। সকলেই দিনভয় দাবা আর পাশা খেলতেন, খাওয়া ও শোয়া এই ছিল কাজ। এরা ফার্সি ভাষা জানতেন এবং বাংলা ভাষার উপরও দখল ছিল। রেণুর দাদা আমার দাদার চাচাতো ভাই, তিনি তাঁর জীবনী লিখে রেখে গিয়েছিলেন সুন্দর বাংলা ভাষায়। রেণুও তাঁর কয়েকটা পাতা পেয়েছিল যখন তার দাদা সমস্ত সম্পত্তি রেণু ও তার বোনকে লিখে দিয়ে যান তখন। রেণুর বাবা মানে আমার শ্বশুর ও চাচা তাঁর বাবার সামনেই মারা যান। মুসলিম আইন অনুযায়ী রেণু তাঁর সম্পত্তি পায় না। রেণুর কোনো চাচা না থাকার জন্য তার দাদা সম্পত্তি লিখে দিয়ে যান। আমাদের বংশের অনেক ইতিহাস পাওয়া যেত যদি তাঁর জীবনীটা পেতাম। কিন্ত কে বা কারা সেটা গায়েব করেছে বলতে পারব না, কারণ অনেক কথা বের হয়ে যেতে পারে। রেণু অনেক খুঁজেছে, পায় নাই। এ রকম আরও অনেক ছোটখাটো গল্প আছে, কতটা সত্য আর কতটা মিথ্যা বলতে পারি না।
পর্ব-৩
যাহোক, শেখদের দুর্দিন আসলেও তারা ইংরেজদের সহ্য করতে পারত না। ইংরেজকে গ্রহণ করতে না পারায় এবং ইংরেজী না পড়ায় তারা অনেকে পেছনে পড়ে গেল। মুসলমানদের সম্পত্তি ভাগ হয় অনেক বেশি। বংশ বাড়তে লাগল, সম্পত্তি ভাগ হতে শুরু করল, দিন দিন আর্থিক অবস্থাও খারাপের দিকে চলল। তবে বংশের মধ্যে দুই একজনের অবস্থা ভালই ছিল।
.
আমার দাদাদের আমল থেকে শেখ পরিবার ইংরেজী লেখাপড়া শুরু করল। আমার দাদার অবস্থা খুব ভাল ছিল না। কারণ দাদারা তিন ভাই ছিলেন, পরে আলাদা আলাদা হয়ে যান। আমার দাদার বড় ভাই খুব বিচক্ষণ লোক ছিলেন; তিনি দেশের বিচার-আচার করতেন। আমার দাদা হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেন। আমার বড় চাচা এন্ট্রান্স পাস করে মারা যান। আমার আব্বা তখন এন্ট্রান্স পড়েন। ছোট্ট ছোট্ট ভাইবোন নিয়ে আমার আব্বা মহাবিপদের সম্মুখীন হন। আমার দাদার বড় ভাইয়ের কোনো ছেলে ছিল না। চার মেয়ে ছিল। আমার বাবার সাথে তাঁর ছোট মেয়ের বিবাহ দেন এবং সমস্ত সম্পত্তি আমার মাকে লিখে দেন।
.
আমার নানার নাম ছিল শেখ আবদুল মজিদ। আমার দাদার নাম শেখ আবদুল হামিদ। আর ছোট দাদার নাম শেখ আবদুর রশিদ। তিনি পড়ে ইংরেজের দেয়া ‘খান সাহেব’ উপাধি পান। জনসাধারণ তাঁকে ‘খান সাহেব’ বলেই জানতেন। আমার আব্বার অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হলেও দুই চাচার লেখাপড়া, ফুফুদের বিবাহ সমস্ত কিছুই তাঁর মাথার উপর এসে পড়ল। বাধ্য হয়ে তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে চাকরির অন্বেষণে বের হলেন। মুসলমানদের তখনকার দিনে চাকরি পাওয়া দুষ্কর ছিল। শেষ পর্যন্ত দেওয়ানি আদালতে একটা চাকরি পান, পরে তিনি সেরেস্তাদার হয়েছিলেন। যেদিন আমি ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়তে যাই আমার আব্বাও সেইদিন পেনশন নিয়ে বাড়ি চলে যান।
.
একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার তের বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব’। রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়েসে মারা যান। তারপর, সে আমার মা’র কাছে চলে আসে। আমার ভাইবোনদের সাথেই রেণু বড় হয়। রেণুর বড়বোনেরও আমার আর এক চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিবাহ হয়। এরা আমার শ্বশুরবাড়িতে থাকল, কারণ আমার ও রেণুর বাড়ির দরকার নাই। রেণুদের ঘর আমাদের ঘর পাশাপাশি ছিল, মধ্যে মাত্র দুই হাত ব্যাবধান। অন্যান্য ঘটনা আমার জীবনের ঘটনার মধ্যেই পাওয়া যাবে।
পর্ব-৪
আমার জন্ম হয় ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ তারিখে। আমার আব্বার নাম শেখ লুৎফর রহমান। আমার ছোট দাদা খান সাহেব শেখ আবদুর রশিদ একটা এম ই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের অঞ্চলের মধ্যে সেকালে এই একটা মাত্র ইংরেজি স্কুল ছিল, পড়ে এটা হাইস্কুল হয়, সেটি আজও আছে। আমি তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত এই স্কুলে লেখাপড়া করে আমার আব্বার কাছে চলে যাই এবং চতুর্থ শ্রেণীতে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হই। আমার মায়ের নাম সায়রা খাতুন। তিনি কোনোদিন আমার আব্বার সাথে শহরে থাকতেন না। তিনি সমস্ত সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন আর বলতেন, ‘আমার বাবা আমাকে সম্পত্তি দিয়ে গেছেন যাতে তাঁর বাড়িতে আমি থাকি। শহরে চলে গেলে ঘরে আলো জ্বলবে না, বাবা অভিশাপ দেবে।’
.
আমরা আমার নানার ঘরেই থাকতাম, দাদার ও নানার ঘর পাশাপাশি। আব্বার কাছে থেকেই আমি লেখাপড়া করি। আব্বার কাছেই আমি ঘুমাতাম। তাঁর গলা ধরে রাতে না ঘুমালে আমার ঘুম আসত না। আমি বংশের বড় ছেলে, তাই সমস্ত আদর আমারই ছিল। আমার মেজো চাচারও কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না। আমার ছোট দাদারও একমাত্র ছেলে আছে। তিনিও ‘খান সাহেব’ খেতাব পান। এখন আইয়ুব সাহেবের আমলে প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য আছেন। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সভ্যও ছিলেন, নাম শেখ মোশাররফ হোসেন।
.
১৯৩৪ সালে যখন আমি স্পতম শ্রেণীতে পড়ি তখন ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। ছোট সময়ে আমি খুব দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম। খেলাধুলা করতাম, গান গাইতাম এবং খুব ভাল ব্রতচারী করতে পারতাম। হঠাৎ বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হয়ে আমার হার্ট দুর্বল হয়ে পড়ে। আব্বা আমাকে নিয়ে কলকাতায় চিকিৎসা করাতে যান। কলকাতার বড় বড় ডাক্তার শিবপদ ভট্টাচার্য, এ কে রায় চৌধুরী আরও অনেককেই দেখান এবং চিকিৎসা করাতে থাকেন। প্রায় দুই বছর আমার এইভাবে চলল।
.
১৯৩৬ সালে আব্বা মাদারীপুর মহকুমায় সেরেস্তাদার হয়ে বদলি হয়ে যান। আমার অসুস্থতার জন্য মাকেও সেখানে নিয়ে আসেন। ১৯৩৬ সালে আবার আমার চক্ষু খারাপ হয়ে পড়ে। গ্লকোমা নামে একটা রোগ হয়। ডাক্তারদের পরামর্শে আব্বা আমাকে নিয়ে আবার কলকাতায় রওয়ানা হলেন চিকিৎসার জন্য। এই সময় আমি মাদারীপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেনীতে ভর্তি হয়েছিলাম লেখাপড়া করার জন্য। কলকাতা যেয়ে ডাক্তার টি. আহমেদ সাহেবকে দেখালাম। আমার বোন কলকাতায় থাকত, কারণ ভগ্নিপতি এজিবিতে চাকরি করতেন। তিনি আমার মেজোবোন শেখ ফজলুল হক মণির মা। মণির বাবা পূর্বে সম্পর্কে আমার দাদা হতেন। তিনিও শেখ বংশের লোক। বোনের কাছেই থাকতাম। কোন অসুবিধা হত না। ডাক্তার সাহেব আমার চক্ষু অপারেশন করতে বললেন। দেরি করলে আমি অন্ধ হয়ে যেতে পারি। আমাকে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন। ভোর ন’টায় অপারেশন হবে। আমি ভয় পেয়ে পালাতে চেষ্টা করতে লাগলাম, কিন্ত পারলাম না। আমাকে অপারেশন ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। দশ দিনের মধ্যে দুইটা চক্ষুই অপারেশন করা হল। আমি ভাল হলাম। তবে কিছুদিন লেখাপড়া বন্ধ রাখতে হবে, চশমা পরতে হবে। তাই ১৯৩৬ সাল থেকেই চশমা পরছি।
.
চোখের চিকিৎসার পর মাদারীপুর ফিরে এলাম, কোন কাজ নেই। লেখাপড়া নেই, খেলাধুলা নেই, শুধু একটা মাত্র কাজ, বিকালে সভায় যাওয়া। তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন ইংরেজের আতঙ্ক। স্বদেশী আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে। আমার মনে হত, মাদারীপুরে সুভাষ বোসের দলই শক্তিশালী ছিল। পনের-ষোল বছরের ছেলেদের স্বদেশীরা দলে ভেড়াত। আমাকে রোজ সভায় বসে থাকতে দেখে আমার উপর কিছু যুবকের নজর পড়ল। ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরুপ ধারণা সৃষ্টি হল। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম। এই সভায় যোগদান করতে মাঝে মাঝে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর যাওয়া-আসা করতাম। আর স্বদেশী আন্দোলনের লোকদের সাথেই মেলামেশা করতাম। গোপালগঞ্জের সেই সময়ের এসডিও, আমার দাদা খান সাহেবকে একদিন হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন, এ গল্প আমি পড়ে শুনেছি।
পর্ব-৫
১৯৩৭ সালে আবার আমি লেখাপড়া শুরু করলাম। এবার আর পুরানো স্কুলে পড়ব না, কারণ আমার সহপাঠীরা আমাকে পিছনে ফেলে গেছে। আমার আব্বা আমাকে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমার আব্বাও আবার গোপালগঞ্জ ফিরে এলেন। এই সময় আব্বা কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি মাস্টার সাহেবকে আমাকে পড়াবার জন্য বাসায় রাখলেন। তাঁর জন্য একটা আলাদা ঘরও করে দিলেন। গোপালগঞ্জের বাড়িটা আমার আব্বাই করেছিলেন। মাস্টার সাহেব গোপালগঞ্জে একটা ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন, যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠাতেন সকল মুসলমান বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রবিবার আমরা থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাউল উঠিয়ে আনতাম এবং এই চাল বিক্রি করে তিনি গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার ও অন্যান্য খরচ দিতেন। ঘুরে ঘুরে জায়গিরও ঠিক করে দিতেন। আমাকেই অনেক কাজ করতে হত তাঁর সাথে। হঠাৎ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। তখন আমি এই সেবা সমিতির ভার নেই এবং অনেক দিন পরিচালনা করি। আর একজন মুসলমান মাস্টার সাহেবের কাছেই টাকা পয়সা জমা রাখা হত। তিনি সভাপতি ছিলেন আর আমি ছিলাম সম্পাদক। যদি কোন মুসলমান চাউল না দিত আমার দলবল নিয়ে তার উপর জোর
১০
করতাম। দরকার হলে তাঁর বাড়িতে রাতে ইট মারা হত। এজন্য আমার আব্বার কাছে অনেক সময় শাস্তি পেতে হত। আমার আব্বা আমাকে বাধা দিতেন না।
আমি খেলাধুলাও করতাম। ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতাম। খুব ভাল খেলোয়াড় ছিলাম না, তবুও স্কুলের টিমের মধ্যে ভাল অবস্থান ছিল। এই সময় আমার রাজনীতির খেয়াল তত ছিল না।
আমার আব্বা খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত। ছোটকাল থেকে আমি সকল কাগজই পড়তাম। স্কুলে ছেলেদের মধ্যে আমার বয়স একটু বেশি হয়েছে, কারণ প্রায় চার বৎসর আমি লেখাপড়া করতে পারি নাই। আমি ভীষণ একগুঁয়ে ছিলাম। আমার একটা দল ছিল। কেউ কিছু বললে আর রক্ষা ছিল না। মারপিট করতাম। আমার দলের ছেলেদের কেউ কিছু বললে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। আমার আব্বা মাঝে মাঝে অতিষ্ট হয়ে উঠতেন। কারণ ছোট শহর, নালিশ হত; আমার আব্বাকে আমি খুব ভয় করতাম। আর একজন ভদ্রলোককে ভয় করতাম, তিনি আবদুল হাকিম মিয়া। তিনি আমার আব্বার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। একসঙ্গে চাকরি করতেন, আমাকে কোথাও দেখলেই আব্বাকে বলে দিতেন, অথবা নিজেই ধমকিয়ে দিতেন। যদিও আব্বাকে ফাঁকি দিতে পারতাম, তাঁকে ফাঁকি দিতে পারতাম না। আব্বা থাকতেন শহরের একদিকে, আর তিনি থাকতেন অন্যদিকে। হাকিম সাহেব বেঁচে নাই, তাঁর ছেলেরা লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়েছে। একজন কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে বড় চাকরি করেন, আর একজন সিএসপি৬হয়েছে। তখন গোলাপলগঞ্জে এমএলএ৭ ছিলেন খন্দকার শামসুদ্দীন আহমেদ সাহেব। তিনি নামকরা উকিলও ছিলেন। তাঁর বড় ছেলে খন্দকার মাহবুব উদ্দিন ওরফে ফিরোজ আমার বন্ধু ছিল। দুইজনের মধ্যে ভীষণ ভাব ছিল। ফিরোজ এখন হাইকোর্টের এডভোকেট। দুই বন্ধুর মধ্যে এত মিল ছিল, কেউ কাউকে না দেখলে ভাল লাগত না। খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আমার আব্বার বন্ধুত্ব ছিল। অমায়িক ব্যবহার তাঁর। জনসাধারণ তাঁকে শ্রদ্ধা করত ও ভালবাসত। তিনি মরহুম শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক সাহেবের কৃষক শ্রমিক পার্টির৮ সদস্য ছিলেন। যখক হক সাহেব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং মুসলীম লীগে৯যোগদান করলেন, খন্দকার সাহেবও তখন মুসলিম লীগে যোগদান করেন। যদিও কোনো দলেরই কোনো সংগঠন ছিল না। ব্যাক্তিগত জনপ্রিয়তার উপরই সবাই নির্ভর করত। মুসলিম লীগ তো তখন শুধু কাগজে-পত্রে ছিল।

১৯৩৮ সালের ঘটনা। শেরে বাংলা তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং সোহরাওয়ারদী শ্রমমন্ত্রী। তাঁরা গোপালগঞ্জে আসবেন। বিরাট সভার আয়োজন করা হয়েছে। এগজিবিশন হবে ঠিক হয়েছে। বাংলার এই দুই নেতা একসাথে গোপালগঞ্জে আসবেন। মুসলমানদের মধ্যে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হল। স্কুলের ছাত্র আমরা তখন। আগেই বলেছি আমার
১১
বয়স একটু বেশি, তাই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করার ভার পড়ল আমার উপর। আমি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করার ভার পড়ল আমার উপর। আমি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করলাম দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে। পড়ে দেখা গেল, হিন্দু ছাত্ররা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী থেকে সরে পড়তে লাগল। ব্যাপার কি বুঝতে পারছি না। এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম, সেও ছাত্র, সে আমাকে বলল, কংগ্রেস১০ থেকে নিষেধ করেছে আমাদের যোগদান করতে। যাতে বিরূপ সম্বর্ধনা হয় তারও চেষ্টা করা হবে। এগজিবিশনে যাতে দোকানপাট না বসে তাও বলে দেওয়া হয়েছে। তখনকার দিনে শতকরা আশিটি দোকান হিন্দুদের ছিল। আমি এ খবর শুনে আশ্চর্য হলাম। কারণ, আমার কাছে তখন হিন্দু মুসলমান বলে কোন জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলদের সাথে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। একসাথে গান বাজনা, খেলাধুলা, বেড়ান-সবই চলত।
আমাদের নেতারা বললেন, হক সাহেব মুসলিম লীগের সাথে মন্ত্রীসভা গঠন করেছেন বলে হিন্দুরা ক্ষেপে গিয়েছে। এতে আমার মনে বেশ একটা রেখাপাত করল। হক সাহেব ও শহীদ সাহেবকে সম্বর্ধনা দেয়া হবে। তার জন্য যা কিছু প্রয়োজন আমাদের করতে হবে। আমি মুসলমান ছেলেদের নিয়েই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করলাম, তবে কিছু সংখ্যক নমশূদ্র শ্রেণীর হিন্দু যোগদান করল। কারণ, মুকুন্দবিহারী মল্লিক তখন মন্ত্রী ছিলেন এবং তিনিও হক সাহেবের সাথে আসবেন। শহরে হিন্দুরা সংখ্যায় খুবই বেশি, গ্রাম থেকে যথেষ্ট লোক এল, বিশেষ করে নানা রকম অস্ত্র নিয়ে, যদি কেউ বাধা দেয়। যা কিছু হয়, হবে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও হতে পারত।
হক সাহেব ও শহীদ সাহেব এলেন, সভা হল। এগজিবিশন উদ্বোধন করলনে। শান্তিপূর্ণভাবে সকল কিছু হয়ে গেল। হয় সাহেব পাবলিক হল দেখতে গেলেন। আর শহীদ সাহেব গেলেন মিশন স্কুল দেখতে। আমি মিশন স্কুলের ছাত্র। তাই তাঁকে সম্বর্ধনা দিলাম। তিনি স্কুল পরিদর্শন করে হাঁটতে হাঁটতে লঞ্চের দিকে চললেন, আমিও সাথে সাথে চললাম। তিনি ভাঙা ভাঙা বাংলায় আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিলেন, আর আমি উত্তর দিচ্ছিলাম। আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার নাম এবং বাড়ি কোথায়। একজন সরকারি কর্মচারী আমার বংশের কথা বলে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি আমাকে ডেকে নিলেন খুব কাছে, আদর করলেন এবং বললেন, ‘তোমাদের এখানে মুসলিম লীগ করা হয় নাই’? বললাম, ‘কোনো প্রতিষ্টান নাই। মুসলিম ছাত্রলীগও১১নাই’। তিনি আর কিছুই বললেন না, শুধু নোটবুক বের করে আমার নাম ও ঠিকানা লিখে নিলেন। কিছুদিন পড়ে আমি একটি চিঠি পেলাম, তাতে তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন এবং লিখেছেন কলকাতা গেলে যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি। আমিও তাঁর চিঠির উত্তর দিলাম। এইভাবে মাঝে মাঝে চিঠিও দিতাম।
এই সময় একটা ঘটনা হয়ে গেল। হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একটু আড়াআড়ি চলছিল। গোপালগঞ্জ শহরের আশপাশও হিন্দু গ্রাম ছিল। দু’একজন মুসলমানের উপর অত্যাচারও হল। আবদুল মালেক নামে আমার এক সহপাঠী ছিল। সে খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেবের আত্মীয় হত। একদিন সন্ধ্যায়, আমার মনে হয় মার্চ বা এপ্রিল মাস হবে, আমি ফুটবল
১২
মাঠ থেকে খেলে বাড়িতে এসেছি, আমাকে খন্দকার শামসুল হক ওরফে বসু মিয়া মোক্তার সাহেব (পরে মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন) ডেকে বললেন, ‘মালেককে হিন্দু মহাসভা১২সভাপতি সুরেন ব্যানারজির বাড়িতে ধরে নিয়ে মারপিট করছে। যদি পার একবার যাও। তোমার সাথে ওদের বন্ধুত্ব আছে বলে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আস’। আমি আর দেরি না করে কয়েকজন ছাত্র ডেকে নিয়ে ওদের ওখানে যাই এবং অনুরোধ করি ওকে ছেড়ে দিতে। রমাপদ দত্ত নামে এক ভদ্রলোক আমাকে দেখেই গাল দিয়ে বসল আমিও তার কথার প্রতিবাদ করলাম এবং আমার দলের ছেলেদের খবর দিতে বললাম এর মধ্যে রমাপদরা থানায় খবর দিয়েছে। তিনজন পুলিশ এসে হাজির হয়ে গিয়েছে। আমি বললাম, ‘ওকে ছেড়ে দিতে হবে, নাহলে কেড়ে নেব’। আমার মামা শেখ সিরাজুল হক (একই বংশের) তখন হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতেন। তিনি আমার মা ও বাবার চাচাতো ভাই। নারায়ণগঞ্জে আমার এক মামা ব্যবসা করেন, তার নাম শেখ জাফর সাদেক। তার বড় ভাই ম্যাট্রিক পাস করেই মারা যান। আমি খবর দিয়েছি শুনে দলবল নিয়ে ছুটে এসেছেন। এর মধ্যেই আমাদের সাথে মারপিট শুরু হয়ে গেছে। দুই পক্ষে ভীষণ মারপিট হয়। আমরা দরজা ভেঙে মালেককে কেড়ে নিয়ে চলে আসি।
শহরে খুব উত্তেজনা। আমাকে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। সেদিন রবিবার। আব্বা বাড়ি গিয়েছিলেন। পরদিন ভোরবেলায় আব্বা আসবেন। বাড়ি গোপালগঞ্জ থেকে চোদ্দ মাইল দূরে। আব্বা শনিবার বাড়ি যেতেন আর সোমবার ফিরে আসতেন, নিজেরই নৌকা ছিল। হিন্দু নেতারা রাতে বসে হিন্দু অফিসারদের সাথে পরামর্শ করে একটা মামলা দায়ের করল। হিন্দু নেতারা থানায় বসে এজহার ঠিক করে দিলেন। তাতে খন্দকার শামসুল হক মোক্তার সাহেব হুকুমের আসামি। আমি খুন করার চেষ্টা করেছি, লুটপাট দাঙ্গাহাঙ্গামা লাগিয়ে দিয়েছি। ভোরবেলায় আমার মামা, মোক্তার সাহেব, খন্দকার শামসুদ্দীন আহমেদ এমএলএ সাহেবের মুহুরি জহুর শেখ, আমার বাড়ির কাছের বিশেষ বন্ধু শেখ নুরুল হক ওরফে মানিক মিয়া, সৈয়দ আলী খন্দকার, আমার সহপাঠী আবদুল মালেক এবং অনেক ছাত্রের নাম এজহারে দেয়া হয়েছিল। কোনো গণ্যমান্য লোকের ছেলেদের বাকি রাখে নাই। সকাল ন’টায় খবর পেলাম আমার মামা ও আরও অনেককে গ্রেফতার করে ফেলেছে। আমাদের বাড়িতে কি করে আসবে- থানার দারোগা সাহেবদের একটু লজ্জা করছিল। প্রায় দশটার সময় টাউন হল মাঠের ভিতর দাঁড়িয়ে দারোগা আলাপ করছে, তার উদ্দেশ্য হল আমি যেন সরে যাই। টাউন হলের মাঠের পাশেই আমার বাড়ি। আমার ফুফাতো ভাই, মাদারীপুর বাড়ি। আব্বার কাছে থেকেই লেখাপড়া করত, সে আমাকে বলে, ‘মিয়াভাই, পাশের বাসায় একটু সরে যাও না’। বললাম, ‘যাব না, আমি পালাব না। লোকে বলবে, আমি ভয় পেয়েছি’।
এই সময় আব্বা বাড়ি থেকে ফিরে এসেছেন। দারোগা সাহেবও তাঁর পিছে পিছে বাড়িতে ঢুকে পড়েছেন। আব্বার কাছে বসে আস্তে আস্তে সকল কথা বললেন। আমার গ্রেফতারি পরোয়ানা দেখালেন। আব্বা বললেন, ‘ নিয়ে যান’। দারোগা বাবু বললেন,
১৩
‘ও খেয়েদেয়ে আসুক, আমি একজন সিপাহি রেখে যেতেছি, এগারটার মধ্যে যেন থানায় পৌঁছে যায়। কারণ, দেরি হলে জামিন পেতে অসুবিধা হবে’। আব্বা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মারামারি করেছ?’ আমি চুপ করে থাকলাম, যার অর্থ ‘করেছি’।
আমি খাওয়া-দাওয়া করে থানায় চলে এলাম। দেখি আমার মামা, মানিক, সৈয়দ আরও সাত-আটজন হবে, তাদেরকে পূর্বেই গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে এসেছে। আমার পৌঁছার সাথে সাথে কোর্টে পাঠিয়ে দিল। হাতকড়া দেয় নাই, তবে সামনেও পুলিশ পিছনেও পুলিশ। কোর্ট দারোগা হিন্দু ছিলেন, কোর্টে পৌছার সাথে সাথে আমাদের কোর্ট হাজতের ছোট কামরার মধ্যে বন্ধ করে রাখলেন। কোর্ট দারোগার রুমের পাশেই কোর্ট হাজত। আমাকে দেখে বলেন, ‘মজিবর খুব ভয়ানক ছেলে। ছোরা মেরেছিল রমাপদকে। কিছুতেই জামিন দেওয়া যেতে পারে না’। আমি বললাম, ‘বাজে কথা বলবেন না, ভাল হবে না’। যারা দারোগা সাহেবের সামনে বসেছিলেন, তাদের বললেন, ‘দেখ ছেলের সাহস’। আমাকে অন্য সকলে কথা বলতে নিষেধ করল। পড়ে শুনলাম, আমার নামে এজহার দিয়েছে এই কথা বলে যে, আমি ছোরা দিয়ে রমাপদকে হত্যা করার জন্য আঘাত করেছি। তার অবস্থা ভয়ানক খারাপ, হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছে। প্রকৃতপক্ষে রমাপদের সাথে আমার মারামারি হয় একটা লাঠি দিয়ে, ও আমাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে চেষ্টা করলে আমিও লাঠি দিয়ে প্রত্যাঘাত করি। যার জন্য ওর মাথা ফেটে যায়। মুসলমান উকিল মোক্তার সাহেবরা কোর্টে আমাদের জামিনের আবেদন পেশ করল। একমাত্র মোক্তার সাহেবকে টাউন জামিন দেয়া হল। আমাদের জেল হাজতে পাঠানোর হুকুম হল। এসডিও হিন্দু ছিল, জামিন দিল না। কোর্ট দারোগা আমাদের হাতকড়া পরাতে হুকুম দিল। আমি রুখে দাঁড়ালাম, সকলে আমাকে বাধা দিল, জেলে এলাম। সাবজেল, একটা মাত্র ঘর। একপাশে মেয়েদের থাকার জায়গা, কোনো মেয়ে আসামী না থাকার জন্য মেয়েদের ওয়ার্ডে রাখল। বাড়ি থেকে বিছানা, কাপড় এবং খাবার দেবার অনুমতি দেয়া হল। শেষ পর্যন্ত সাত দিন পড়ে আমি প্রথম জামিন পেলাম। দশ দিনের মধ্যে আর সকলেই জামিন পেয়ে গেল।
হক সাহেব ও সোহরাওয়ারদী সাহেবের কাছে টেলিগ্রাম করা হল। লোকও চলে গেল কলকাতায়। গোপালগঞ্জে ভীষণ উত্তেজনা চলছিল। হিন্দু উকিলদের সাথে আব্বার বন্ধুত্ব ছিল। সকলেই আমার আব্বাকে সম্মান করতেন। দুই পক্ষের মধ্যে অনেক আলোচনা হয়ে ঠিক হল মামলা তারা চালাবে না। আমাদের ক্ষতিপুরণ দিতে হবে পনের শত টাকা। সকলে মিলে সেই টাকা দিয়ে দেওয়া হল। আমার আব্বাকেই বেশি দিতে হয়েছিল। এই আমার জীবনে প্রথম জেল।
১৯৩৯ সালে কলকাতা যাই বেড়াতে। শহীদ সাহেবের সাথে দেখা করি। আবদুল ওয়াসেক সাহেব আমাদের ছাত্রদের নেতা ছিলেন। তাঁর সাথেও আলাপ করে তাঁকে
১৪
গোপালগঞ্জে আসতে অনুরোধ করি। শহীদ সাহেবকে বললাম, গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করব এবং মুসলিম লীগও গঠন করব। খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেব এমএলএ তখন মুসলিম লীগে যোগদান করেছেন। তিনি সভাপতি হলেন ছাত্রলীগের। আমি হলাম সম্পাদক। মুসলিম লীগ গঠন হল। একজন মোক্তার সাহেব সেক্রেটারি হলেন, অবশ্য আমিই কাজ করতাম। মুসলিম লীগ ডিফেন্স কমিটি একটা গঠন করা হল। আমাকে তার সেক্রেটারি করা হল। আমি আস্তে আস্তে রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করলাম। আব্বা আমাকে বাধা দিতেন না, শুধু বলতেন, লেখাপড়ার দিকে নজর দেবে। লেখাপড়ায় আমার একটু আগ্রহও তখন হয়েছে। কারণ, কয়েক বৎসর অসুস্থতার জন্য নষ্ট করেছি। স্কুলেও আমি ক্যাপ্টেন ছিলাম। খেলাধুলার দিকে আমার ঝোঁক ছিল। আব্বা আমাকে বেশি খেলতে দিতে চাইতেন না। কারণ আমার হার্টের ব্যারাম হয়েছিল। আমার আব্বাও ভাল খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি অফিসারস ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন। আর আমি মিশন স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলাম। আব্বার তিম ও আমার টিমে যখন খেলা হত তখন জনসাধারণ খুব উপভোগ করত। আমাদের স্কুল টিম খুব ভাল ছিল। মহকুমায় যারা ভাল খেলোয়াড় ছিল, তাদের এনে ভর্তি করতাম এবং বেতন ফ্রি করে দিতাম।
১৯৪০ সালে আব্বার টিমকে আমার স্কুল টিম প্রায় সকল খেলায় পরাজিত করল। অফিসারস ক্লাবের টাকার অভাব ছিল না। খেলোয়াড়দের বাইরে থেকে আনত। সবই নামকরা খেলোয়াড়। বৎসরের শেষ খেলায় আব্বার টিমের সাথে আমার টিমের পাঁচ দিন ড্র হয়। আমরা তো ছাত্র; এগারজনই রোজ খেলতাম, আর অফিসারস ক্লাব নতুন নতুন প্লেয়ার আনত। আমরা খুব কান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আব্বা বললেন, ‘কাল সকালেই খেলতে হবে। বাইরের খেলোয়াড়দের আর রাখা যাবে না, অনেক খরচ’। আমি বললাম, ‘আগামীকাল সকালে আমরা খেলতে পারব না, আমাদের পরীক্ষা’। গোপাল্গঞ্জ ফুটবল ক্লাবের সেক্রেটারি একবার আমার আব্বার কাছে আর একবার আমার কাছে কয়েকবার হাঁটাহাঁটি করে বললেন, ‘তোমাদের বা ব্যাটার ব্যাপার, আমি বাবা আর হাঁটতে পারি না’। আমাদের হেডমাস্টার তখন ছিলেন বাবু রসরঞ্জন সেনগুপ্ত। আমাকে তিনি প্রাইভেটও পড়াতেন। আব্বা হেডমাস্টার বাবুকে খবর দিয়ে আনলেন। আমি আমার দলবল নিয়ে এক গোলপোস্টে আর আব্বা তার দলবল নিয়ে অন্য গোলপোস্টে। হেডমাস্টার বাবু বললেন, ‘মুজিব, তোমার বাবার কাছে হার মান। আগামীকাল সকালে খেল, তাদের অসুবিধা হব’’। আমি বললাম, ‘স্যার আমাদের সকলেই ক্লান্ত, এগারজনই সাড়া বছর খেলেছি। সকলের পায়ে ব্যাথা, দুই-চার দিন বিশ্রাম দরকার। নতুবা হেরে যাব’। এবছর তো একটা খেলায়ও আমরা হারি নাই, আর ‘এ জেড খান শিল্ডের’ এই শেষ ফাইনাল খেলা। এ. জেড. খান এসডিও ছিলেন, গোপালগঞ্জেই মারা যান। তাঁর ছেলদের মধ্যে আমির ও আহমদ আমার বাল্যবন্ধু ও সাথী। আমির ও আমি খুব বন্ধু ছিলাম। আমিরুজ্জামান খান এখন রেডিও পাকিস্তানে চাকরি করেন। ওর বাবা মারা যাবার পর যখন গোপালগঞ্জ থেকে চলে আসে তখন ওর জন্য আমি খুব আঘাত পেয়েছিলাম। হেডমাস্টার বাবুর কথা
১৫
মানতে হল। পরের দিন সকালে খেলা হল। আমার টিম আব্বার টিমের কাছে এক গোলে পরাজিত হল।
১৯৪১ সালে আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেব। পরীক্ষায় পাস আমি নিশ্চয়ই করব, সন্দেহ ছিল না। রসরঞ্জন বাবু ইংরেজির শিক্ষক, আমাকে ইংরেজি পড়াতেন। আর মনোরঞ্জন বাবু অঙ্কের শিক্ষক, আমাকে অঙ্ক করাতেন। অঙ্ককে আমার ভয় ছিল। কারণ ভুল করে ফেলতাম। অঙ্কের জন্যই বোধহয় প্রথম বিভাগ পাব না। পরীক্ষার একদিন পূর্বে আমার ভীষণ জ্বর হল এবং মামস হয়ে গলা ফুলে গেল। একশ’ চার ডিগ্রি জ্বর উঠেছে। আব্বা রাতভর আমার কাছে বসে রইলেন। গোপালগঞ্জ টাউনের সকল ডাক্তারই আনালেন। জ্বর পড়ছে না। আব্বা আমাকে পরীক্ষা দিতে নিষধ করলেন। আমি বললাম, যা পারি শুয়ে শুয়ে দেব। আমার জন্য বিছানা দিতে বলেন। প্রথম দিনে বাংলা পরীক্ষা। সকালের পরীক্ষায় মাথাই তুলতে পারলাম না, তবুও কিছু কিছু লিখলাম। বিকালে জ্বর কম হল। অন্য পরীক্ষা ভালই হল। কিন্ত দেখা গেল বাংলায় আমি কম মার্কস পেয়েছি। অন্যান্য বিষয়ে দ্বিতীয় বিভাগের মার্কস পেয়েছি। মন ভেঙে গেল।
তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি। খেলার দিকে আর নজর নাই। শুধু মুসলিম লীগ, আর ছাত্রলীগ। পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নাই। খবরের কাগজ ‘আজাদ’, যা লিখে তাই সত্য বলে মনে হয়।
পরীক্ষা দিয়ে কলকাতায় যাই। সভা-সমাবেশে যোগদান করি। মাদারীপুর যেয়ে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করি। আবার পড়তে শুরু করলাম। পাস তো আমার করতে হবে। শহীদ সাহেবের কাছে এখন প্রায়ই যাই। তিনিও আমাকে স্নেহ করেন। মুসলিম লীগ বললেই গোপালগঞ্জে আমাকে বোঝাত। যুদ্ধের সময় দেশের অবস্থা ভয়াবহ। এই সময় ফজলুল হক সাহেবের সাথে জিন্নাহ সাহেবের মনোমালিন্য হয়। হক সাহেব জিন্নাহ সাহেবের হুকুম মানতে রাজী না হওয়ায় তিনি মুসলিম লীগ ত্যাগ করে নয়া মন্ত্রিসভা গঠন করলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখারজির সাথে। মুসলিম লীগ ও ছাত্রকর্মীরা তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করল। আমিও ঝাঁপিয়ে পড়লাম। এই বৎসর আমি দ্বিতীয় বিভাগে পাস করে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে বেকার হোস্টেলে থাকতাম। নাটোর ও বালুরঘাটে হক সাহেবের দলের সাথে মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থীদের দুইতা উপনির্বাচন হয়। আমিও দলবল নিয়ে সেখানে হাজির হলাম এবং ক্লান্ত পরিশ্রম করলাম, শহিদ সাহেবের হুকুম মত।
একটা ঘটনার দিন-তারিখ আমার মনে নাই, ১৯৪১ সালের মধ্যেই হবে, ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্স, শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রণ জানান হয়েছে। তাঁরা হলেন কবি
১৬
কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ূন কবির, ইব্রাহিম খাঁ সাহেব। সে সভা আমাদের করতে দিল না, ১৪৪ ধারা জারি করল। কনফারেন্স করলাম হুমায়ূন কবির সাহেবের বাড়িতে। কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব গান শোনালেন। আমরা বললাম, এই কনফারেন্সে রাজনীতি আলোচনা হবে না। শিক্ষা ও ছাত্রদের কর্তব্য সম্বন্ধে বক্তৃতা হবে। ছাত্রদের মধ্যেও দুইটা দল হয়ে গেল। ১৯৪২ সালে আমি ফরিদপুর যেয়ে ছাত্রদের দলাদলি শেষ করে ফেলতে সক্ষম হলাম এবং পাকিস্তানের জন্যই যে আমাদের সংগ্রাম করা দরকার একথা তাঁরা স্বীকার করলেন। তখন মোহন মিয়া সাহেব ও সালাম খান সাহেব জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন।
১৯৪২ সালে মিস্টার জিন্নাহ আসবেন বাংলাদেশে, প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সম্মেলনে যোগদান করার জন্য। সম্মেলন হবে পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমায়। আমরা ফরিদপুর থেকে বিরাট এক কর্মী বাহিনী নিয়ে রওয়ানা করলাম। ছাত্রলীগ কর্মীই বেশি ছিল। সৈয়দ আকবর আলী সাহেবের বাড়িতে অভ্যর্থনা কমিটির অফিস করা হয়েছিল। আমি প্রায় সকল সময় শহীদ সাহেবের কাছে কাছে থাকতে চেষ্টা করতাম। আনোয়ার হোসেন তখন ছাত্রদের অন্যতম নেতা ছিলেন। তাঁর সাথে কলকাতায় আমার পরিচয় হয়। শহীদ সাহেব আনোয়ার সাহেবকে খুব ভালোবাসতেন। ছাত্রদের মধ্যে দুইটা দল ছিল। চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরীও তখন ছাত্র আন্দোলনের একজন নেতা ছিলেন। ওয়াসেক সাহেব ও ফজলুল কাদের চৌধুরীর সাথে গোলমাল লেগেই ছিল। ওয়াসেক সাহেব ছাত্রদের রাজনৈতিক পিতা ছিলেন বললে অন্যায় হবে না। বহুদিন তিনি ‘অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগে’র সভাপতি ছিলেন। ছাত্রজীবন শেষ করেছেন বোধহয় পনের বছর পূর্বে। তবুও তিনি পদ ছাড়বেন না। কেউ তাঁর মতের বিরুদ্ধে কথা বললেই তিনি বলতেন, ‘কে হে তুমি? তুমি তো ছাত্রলীগের সদস্য বা কাউন্সিলার নও; বের হয়ে যাও সভা থেকে’। প্রথমে কেউই কিছু বলত না তাঁকে সম্মান করে। প্রথম গোলমাল হয় বোধহয় ১৯৪১ বা ১৯৪২ সালে চুঁচুঁড়া সম্মেলনে। ফজলুল কাদের চৌধুরী ও আমরা ভীষণভাবে প্রতিবাধ করলাম, শেষ পর্যন্ত শহীদ সাহেবের হস্তক্ষেপে গোলমাল হল না। আমি ও আমার সহকর্মীরা ফজলুল কাদের চৌধুরীর দলকে সমর্থন করে বের হয়ে এলাম। তখন সাদেকুর রহমান (এখন সরকারের বর চাকরি করেন) প্রাদেশিক ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, পড়ে আনোয়ার হোসেন সম্পাদক হন। বগুড়া সম্মেলনে আমরা উপস্থিত হয়েও সভায় যোগদান করি না, কারণ অল ইন্ডিয়া মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মাহমুদাবাদের রাজা সাহেব ওয়াদা করলেন শীঘ্রই তিনি এডহক কমিটি করে নির্বাচন দেবেন। এডহক কমিটি করলেন সত্য, তবে তা কাগজপত্রেই রইল।
এই সময় ইসলামিয়া কলেজে আমি খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছি। অফিসিয়াল ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে তাদের পরাজিত করলাম। ইসলামিয়া কলেজই ছিল বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। পরের বছরও ১৯৪৩ সালে ইলেকশনে আনোয়ার সাহেবের অফিসিয়াল ছাত্রলীগ পরাজিত হল। তারপর আর তিন বৎসর কেউই
১৭
আমার মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে ইলেকশন করে নাই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের ইলেকশন হত। আমি ছাত্রনেতাদের নিয়ে আলোচনা করে যাদের ঠিক করে দিতাম তারাই নমিনেশন দাখিল করত, আর কেউ করত না। কারণ জানত, আমার মতের বিরুদ্ধে কারও জিতবার সম্ভাবনাও ছিল না। জহিরুদ্দিন আমাকে সহায্য করত। সে কলকাতার বাসিন্দা, ছাত্রদের উপর তার যথেষ্ট প্রভাব ছিল। নিঃস্বার্থ কর্মী বলে সকলে তাকে শ্রদ্ধাও করত। চমৎকার ইংরেজি, বাংলা ও উর্দুতে বক্তৃতা করতে পারত। জহির পরে ইসলামিয়া কলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তবুও আমার সাথে বন্ধুত্ব ছিল। কিছুদিনের জন্য সে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় রেডিওতে চাকরি নিয়ে চলে আসায় আমার খুবই অসুবিধা হয়েছিল।
১৯৪৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আরম্ভ হয়েছে। লক্ষ লক্ষ লোক মারা যাচ্ছে। এই সময় আমি প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য হই। জনাব আবুল হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের সম্পাদক হন। তিনি সোহরাওয়ারদী সাহেবের মনোনীত ছিলেন। আর খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেবের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন খুলনার আবুল কাশেম সাহেব। হাশিম সাহেব তাঁকে পরাজিত করে সাধারণ সম্পাদক হন। এর পূর্বে সোহরাওয়ারদী সাহেবই সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এই সময় থেকে মুসলিম লীগের মধ্যে দুইটা দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। একটা প্রগতিবাদী দল, আর একটা প্রতিক্রিয়াশীল। শহীদ সাহেবের নেতৃত্বে আমরা বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা মুসলিম লীগকে জনগণের লীগে পরিণত করতে চাই, জনগণের প্রতিষ্টান করতে চাই। মুসলিম লীগ তখন পর্যন্ত জনগণের প্রতিষ্টানে পরিণত হয় নাই। জমিদার, জোতদার ও খান বাহাদুর নবাবদের প্রতিষ্টান ছিল। কাউকেও লীগে আসতে দিত না। জেলায় জেলায় খান বাহাদুরের দলেরাই লীগকে পকেটে করে রেখেছিল।
খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেবের নেতৃত্বে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে ঢাকার এক খাজা বংশের থেকেই থেকেই এগারজন এমএলএ হয়েছিল। ১৯৪৩ সালে, খাজা নাজিমুদ্দীন সাহবে যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন তিনি তাঁর ছোট ভাই খাজা শাহাবুদ্দীন সাহেবকে শিল্পমন্ত্রী করলেন। আমরা বাধা দিলাম, তিনি শুনলেন না। শহীদ সাহেবের কাছে আমরা যেয়ে প্রতিবাধ করলাম, তিনিও কিছু বললেন না। সোহরাওয়ারদী সাহেব সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী হলেন। দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। গ্রাম থেকে লাখ লাখ লোক শহরের দিকে ছুটছে স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে। খাবার নাই, কাপড় নাই। ইংরেজ যুদ্ধের জন্য সমস্ত নৌকা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে। ধান, চাল সৈন্যদের খাওয়াবার জন্য গুদাম হব্দ করেছে। যা কিছু ছিল ব্যাবসায়ীরা গুদামজাত করেছে। ফলে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা দশ টাকা মণের চাউল চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি করছে। এমন দিন নাই রাস্তায় লোকে মরে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। আমরা কয়েকজন ছাত্র শহীদ সাহেবের কাছে যেয়ে বললাম, ‘কিছুতেই জনসাধারণকে বাঁচাতে পারবেন না, মিছামিছি বদনাম নেবেন’। তিনি বললেন, ‘দেখি চেষ্টা করে কিছু করা যায় কি না, কিছু লোক তো বাঁচাতে চেষ্টা করব’।
১৮
তিনি রাতারাতি বিরাট সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট গড়ে তুললেন। ‘কন্ট্রোল’ দোকান খোলার বন্দোবস্ত করলেন। গ্রামে গ্রামে লঙ্গরখানা করার হুকুম দিলেন। দিল্লিতে যেয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে ভয়াবহ অবস্থার কথা জানালেন এবং সাহায্য দিতে বললেন। চাল, আটা ও গম বজরায় করে আনাতে শুরু করলেন। ইংরেজের কথা হল, বাংলার মানুষ মরে তো মরুক, যুদ্ধের সাহায্য আগে। যুদ্ধের সরঞ্জাম প্রথম স্থান পাবে। ট্রেনে অস্ত্র যাবে, তারপর যদি জায়গা থাকে রিলিফের খাবার যাবে। যুদ্ধ করে ইংরেজ, আর না খেয়ে মরে বাঙালি; যে বাঙালির কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন বাংলাদেশ দখল করে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায়, তখন বাংলার এত সম্পদ ছিল যে, একজন মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী গোটা বিলাত শহর কিনতে পারত। সেই বাংলাদেশের এই দুরবস্তা চোখে দেখেছি যে, মা মরে পড়ে আছে, ছোট বাচ্চা সেই মরা মার দুধ চাটছে। কুকুর ও মানুষ একসাথে ডাস্টবিন থেকে কিছু খাবার জন্য কাড়াকাড়ি করছে। ছেলেমেয়েদের রাস্তায় ফেলে দিয়ে মা কোথায় পালিয়ে গেছে। পেটের দায়ে নিজের ছেলেমেয়েকে বিক্রি করতে চেষ্টা করছে। কেউ কিনতেও রাজী হয় নাই। বাড়ির দুয়ারে এসে চিৎকার করছে, ‘মা বাঁচাও, কিছু খেতে দাও, মরে তো গেলাম, আর পারি না, একটু ফেন দাও’। এই কথা বলতে বলতে ঐ বাড়ির দুয়ারের কাছেই পড়ে মরে গেছে। আমরা কি করব? হোস্টেলে যা বাঁচে দুপুরে ও রাতে বুভুক্ষদের বসিয়ে ভাগ করে দেই, কিন্ত কি হবে এতে ?
এই সময় শহীদ সাহেব লঙ্গরখানা খোলার হুকুম দিলেন। আমিও লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অনেকগুলি লঙ্গরখানা খুললাম। দিনে একবার করে খাবার দিতাম। মুসলিম লীগ অফিসে, কলকাতা মাদ্রাসায় এবং আরও অনেক জায়গায় লঙ্গরখানা খুললাম। দিনভর কাজ করতাম, আর রাতে কোনোদিন বেকার হোস্টেলে ফিরে আসতাম, কোনোদিন লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে থাকতাম। আমার আরও কয়েকজন সহকর্মী ছিলেন। যেমন পিরোজপুরের নূরুদ্দিন আহমেদ-যিনি পরে পূর্ব বাংলার এমএলএ হন। নিঃস্বার্থ কর্মী ছিলেন-যদিও তিনি আনোয়ার হোসেন সাহেবের দলে ছিলেন, আমার সাথে এদের গোলমাল ছিল, তবুও আমার ওকে ভাল লাগত। বেকার হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন প্রফেসর সাইদুর রহমান সাহেব (বহু পরে ঢাকার জগন্নাথ কলেজের প্রিন্সিপাল হন) আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। হোস্টেল রাজনীতি বা ইলেকশনে আমার যোগদান করার সময় ছিল না। তবে তিনি আমার সাথে পরামর্শ করতেন। প্রিন্সিপাল ছিলেন ড. আই. এইচ. জুবেরী। তিনিও আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। যে কোন ব্যাপারে তাঁদের সঙ্গে সোজাসুজি আলাপ করতাম এবং সত্য কথা বলতাম। শিক্ষকরা আমাকে সকলেই স্নেহ করতেন। আমি দরকার হলে কলেজের এসেম্বলি হলের দরজা খুলে সভা শুরু করতাম। প্রিন্সিপাল সাহেব দেখেও দেখতেন না। মুসলমান প্রফেসররা পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করতেন। হিন্দু ও ইউরোপিয়ান টিচাররা চুপ করে থাকতেন, কারণ সমস্ত ছাত্রই মুসলমান। সামান্য কিছু সংখ্যক ছাত্র পাকিস্তানবিরোধী ছিল, কিন্ত সাহস করে কথা বলত না।

১৯
এই সময় রিলিফের কাজ করার জন্য গোপালগঞ্জ ফিরে আসি। গোপালগঞ্জ মহকুমার একদিকে যশোর জেলা। একদিকে খুলনা জেলা, আর একদিকে বরিশাল জেলা। বাড়িতে এসে দেখি ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ সবই প্রায় না খেতে পেয়ে কঙ্কাল হতে চলেছে। গোপালগঞ্জের মুসলমানরা ব্যবসায়ী এবং যথেষ্ট ধান হয় এখানে। খেয়ে পড়ে মানুষ কোনোমতে চলতে পারত। অনেকেই আমাকে পরামর্শ দিল, যদি একটা কনফারেন্স করা যায় আর সোহরাওয়ারদী সাহেব ও মুসলিম লীগ নেতাদের আনা যায় তবে চোখে দেখলে এই তিন জেলার লোকে কিছু বেশি সাহায্য পেতে পারে এবং লোকদের বাঁচাবার চেষ্টা করা যেতে পারে। আমাদের সহকর্মীদের নিয়ে বসলাম। আলোচনা হল, সকলে বলল, এই অঞ্চলে কোনোদিন পাকিস্তানের দাবির জন্য কোনো বড় কনফারেন্স হয় নাই। তাই কনফারেন্স হলে তিন জেলার মানুষের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি হবে। এতে দুইটা কাজ হবে, মুসলিম লীগের শক্তিও বাড়বে, আর জনগণও সাহায্য পাবে। সকল এলাকা থেকে কিছু সংখ্যক কর্মীকে আমন্ত্রণ করা হল। আলোচনা করে ঠিক হল, সম্মেলনের ‘দক্ষিণ বাংলা পাকিস্তান কনফারেন্স’ নাম দেয়া হবে এবং তিন জেলার লোকদের দাওয়াত করা হবে। সভা আহবান করা হল অভ্যর্থনা কমিটি করার জন্য। বয়স্ক নেতাদের থেকে একজনকে চেয়ারম্যান ও একজনকে সেক্রেটারি করা হবে। প্রধান যারা ছিলেন তাদের মধ্যে কেউ রাজি হন না, কারণ খরচ অনেক হবে। দেশে দুর্ভিক্ষ, টাকা পয়সা তুলতে পারা যাবে না। শেষ পর্যন্ত সকলে মিলে আমাকেই অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান এবং যশোর জেলার মৌলভী আদসারউদ্দিন মোল্লা নামে একজন বড় ব্যবসায়ী, তাঁকে সম্পাদক করা হল।
আমি কলকাতায় রওয়ানা হয়ে গেলাম, নেতৃবৃন্দকে নিমন্ত্রণ করার জন্য। যখন সোহরাওয়ারদী সাহেবকে দাওয়াত করতে গেলাম, দেখি খাজা শাহাবুদ্দীন সেখানে উপস্থিত আছেন। শহীদ সাহেব বললেন, ‘আমি খুবই ব্যস্ত, তুমি বুঝতেই পারো, নিশ্চয়ই চেষ্টা করব যেতে। শাহাবুদ্দীন সাহেবকে নিমন্ত্রণ কর উনিও যাবেন’। অনিচ্ছা সত্ত্বেও শাহাবুদ্দীন সাহেবকে বলতে হল, তিনিও রাজি হলেন। তমিজুদ্দিন খান তখন শিক্ষামন্ত্রী, ফরিদপুর বাড়ি, তাঁকেও অনুরোধ করলাম, তিনিও রাজি হলেন। মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ এবং হাবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী সাহেবকেও দাওয়াত দিলাম। জনাব মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী (লাল মিয়া), তখন কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেছেন এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগ রিলিফ কমিটির সম্পাদক। আমি তাঁর সাথেই রিলিফের কাজ করতাম, আমাকে খুবই বিশ্বাস করতেন। তিনি যথেষ্ট টাকা, ঔষধ ও কাপড় জোগাড় করেছিলেন। তাঁর সাথে সাথেই আমাকে থাকতে হত। আর প্রত্যেক মহকুমায় কাপড় পাঠাতে হত। যুদ্ধের সময় মালপত্র বুক করা কঠিন ছিল, দশ দিন ঘোরাঘুরি করলে কিছু কিছু কাপড় পাঠাবার মত জায়গা পাওয়া যেত। অনেক সময় হিসাব-নিকাশও দেখতে হত। নিজের হাতে কাপড়ের গাঁটও বাঁধতে হত। আমি কোন কাজেই ‘না’ বলতাম না। যাহোক, তাঁকেও
২০
গোপালগঞ্জ যেতে অনুরোধ করলাম, তিনিও রাজি হলেন। দিন তারিখ ঠিক করে আমি বাড়ি রওয়ানা হয়ে এলাম। সামান্য কিছু টাকা তুললাম শহর থেকে। আমি গ্রামে বের হয়ে পড়লাম, কিছু কিছু অবস্থাশীল লোক ছিল মহকুমায়, তাদের বাড়িতে যেয়ে কিছু কিছু টাকা তুলে আনলাম। কাজ শুরু হয়ে গেছে। লোকজন চারিদিকে নামিয়ে দিয়েছি। অতিথিদের খাবারের ভার আব্বাই নিলেন। তবে পাক হবে এক সরকারি কর্মচারীর বাড়িতে। পড়ে দুই পক্ষ হয়ে গেল। গোলমাল শুরু হলে শেষ পর্যন্ত গোপালগঞ্জে আমাদের বাড়িতেই বন্দোবস্ত হল। প্যান্ডেল করলাম নৌকার বাদাম দিয়ে। যাদের বড় বড় নৌকা ছিল তাদের বাড়ি থেকে দুই দিনের জন্য বাদামগুলি ধার করে আনলাম। পাঁচ হাজার লোক বসতে পারে এত বড় প্যান্ডেল করলাম, খরচ খুব বেশি হল না।
এদিকে এই কনফারেন্স বন্ধ করার জন্য অনেকেই চেষ্টা করতে আরম্ভ করল। টেলিগ্রাম করল সকল আমন্ত্রিত নেতাদের কাছে। কনফারেন্সের মাত্র তিন দিন সময় আছে, আমার কাছে তমিজুদ্দিন সাহেব ও শাহাবুদ্দীন সাহেব টেলিগ্রাম করেছেন, কনফারেন্স বন্ধ করা যায় কি না ? আমি টেলিগ্রাম করলাম, বন্ধ করা অসম্ভব। সোহরাওয়ারদী সাহেব আসতে পারবেন না বলে টেলিগ্রাম করেছেন। তিনি বোধহয় ফুড কনফারেন্সে দিল্লি বা অন্য কোথাও যাবেন। সকলে আমাকে বলল, কলকাতায় রওয়ানা হতে, কারণ যদি কেউ না আসে তবে ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে। বহু দূর দূর থেকে লোক আসবে। কনফারেন্স দুই দিন চলার কথা ছিল, তা দুর্ভিক্ষের জন্য সম্ভব হবে না। সকালে কর্মী সম্মেলন, বিকালে জনসভা হবে বলে ঠিক হল। আমি আমার সহকর্মীদের ওপর ভার দিয়ে কলকাতা রওয়ানা করলাম। তমিজুদ্দিন সাহেব পূর্বেই খুলনায় রওয়ানা হয়ে গেছেন। শাহাবুদ্দীন সাহেব, মওলানা তর্কবাগীশ ও লাল মিয়া সাহেবকে নিয়ে খুলনায় এলাম। খুলনায় তমিজুদ্দিন সাহেব সরকারি লঞ্চে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছেন। আমরা লঞ্চে উঠলাম এবং জানতে চাইলাম, কেন তিন দিন পূর্বে কনফারেন্স বন্ধ করতে বললেন? জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, জনাব ওয়াহিদুজ্জামান কিছুদিন পূর্বেও হক সাহেবের সাথে ছিলেন, সদ্য মুসলিম লীগে যোগদান করেছেন, তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না যে আমি চেয়ারম্যান হয়েছি আর গোপালগঞ্জে কনফারেন্স হবে। তাঁর কিছু করার নাই আর বলারও নাই। যদিও ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত তাঁরা আমাকে ও মুসলিম লীগকে বাধা দিয়েছেন। আবার সালাম খান সাহেব, জেলা লীগের সম্পাদক, বাড়ি গোপালগঞ্জ, তাঁরও আপত্তি রয়েছে এত বড় কনফারেন্স হবে তাঁকে বলা হয় নাই বা তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করা হয় নাই। তিনিও খবর দিয়েছেন, যাতে নেতারা না আসেন।
আমাকে সকল নেতাই জানতেন ভাল কর্মী হিসাবে, আমাকে সকলে স্নেহও করতেন। শহীদ সাহবেও বলে দিয়েছেন সকলকে কনফারেন্সে যোগদান করতে। আমাকে অপমান করলে, আবার একবার মত দিয়ে না গেলে কলকাতায় ছাত্রদের নিয়ে যে গোলমাল করব সে ভয়ও অনেকের ছিল। সকলকে নিয়ে আমি গোপালগঞ্জ উপস্থিত হলাম। নেতারা বিরাট সম্বর্ধনা পেলেন। ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে গোপালগঞ্জ শহর মুখরিত হয়ে
২১
উঠল। নেতারা জনসমাগম দেখে খুবই আনন্দিত হলেন। সভা হবে, কিন্ত প্যান্ডেল গত রাতে ঝড়ে ভেঙে গিয়েছে। নোউকার বাদামগুলি ছিড়ে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে। সেই ভাঙা প্যান্ডেলে সভা হল। রাতেই সকলে বিদায় নিলেন। আমার অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে গেল। এত টাকা আমি কোথায় পাব? বাদামগুলি ছিঁড়ে গেছে, এখন তো কেউই এক টাকাও দিবে না। নেতারাও কেউ জিজ্ঞাসা করলেন না। যাদের বাদাম এনেছিলাম, তারা অনেকেই আমাকে স্নেহ করত। তারা অনেকেই অর্থশীল, আর তাদের ছেলেরা প্রায়ই আমার দলে। অনেকে ছেড়া বাদাম নিয়ে চলে গেল, আর কিছু লোক উসকানি পেয়ে বাদাম নিতে আপত্তি করল। তারা টাকা চায়, ছেঁড়া বাদাম নেবে না, আমি কি করব? মুখ কালো করে বসে আছি। অতিথিদের খাবার বন্দোবস্ত করার জন্য আমার মা ও স্ত্রী গ্রামের বাড়ি থেকে গোপালগঞ্জের বাড়িতে এসেছে তিন দিন হল। আমার শরীরও খারাপ হয়ে পড়েছে অত্যাধিক পরিশ্রমে। বিকালে ভয়ানক জ্বর হল। আব্বা আমাকে বললেন, ‘তুমি ঘাবড়িয়ে গিয়েছ কেন?’ আব্বা পূর্বেও বহু টাকা খরচ করেছেন এই কনফারেন্স উপলক্ষ্যে। বড়লোক তো নই কি করে আব্বাকে বলি। আব্বা নিজেই সমাধান করে দিলেন। যাদের ব্যবসা ভাল না, তাদের কিছু কিছু টাকা দিয়ে বিদায় দিলেন। একজন ব্যাবসায়ী যার আট, দশটা বাদাম নষ্ট হয়েছে তিনি পুরা টাকা দাবি করলেন, না দিলে মামলা করবেন। আব্বা বললেন, ‘কিছু টাকা আপনি নিয়ে এগুলি মেরামত করায়ে নেন। মামলার ভয় দেখিয়ে লাভ নাই। যারা পরামর্শ আপনাকে দিয়েছে, তারা জানে না আপনার বাদাম যে এনেছি তা প্রমাণ করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে’। আমার জ্বর ভয়ানকভাবে বেড়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোক উকিলের নোটিশ দিয়েছিলেন। কিন্ত সাহস করে আর মামলা করেন নাই।
রেণু কয়েকদিন আমাকে খুব সেবা করল। যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছে ছোটবেলায়। ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়। জ্বর একটু ভাল হল। কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী। লেখাপড়া তো মোটেই করি না। দিনরাত রিলিফের কাজ করে কূল পাই না। আব্বা আমাকে এ সময় একটা কথা বলেছিলেন, ‘বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখ, ‘sincerity of purpose and honesty of purpose’থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না’। একথা কোনোদিন আমি ভুলি নাই।
আর একদিনের কথা, গোপালগঞ্জ শহরের কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি আমার আব্বাকে বলেছিলেন, আপনার ছেলে যা আরম্ভ করেছে তাতে তার জেল খাটতে হবে। তার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে, তাকে এখনই বাধা দেন। আমার আব্বা যে উত্তর করেছিলেন তা আমি নিজে শুনেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের কাজ করছে, অন্যায় তো করছে না; যদি জেল খাটতে হয়, খাটবে; তাতে আমি দুঃখ পাব না। জীবনটা নষ্ট নাও তো হতে পারে, আমি ওর কাজে বাধা দিব না। আমার মনে হয়, পাকিস্তান না আনতে পারলে মুসলমানদের
২২
অস্তিত্ব থাকবে না’। অনেক সময় আব্বা আমার সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করতেন। আমাকে প্রশ্ন করতেন, কেন পাকিস্তান চাই? আমি আব্বার কথার উত্তর দিতাম।
একদিনের কথা মনে আছে, আব্বা ও আমি রাত দুইটা পর্যন্ত রাজনীতির আলোচনা করি। আব্বা আমার আলোচনা শুনে খুশি হলেন। শুধু বললেন, শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক সাহেবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যাক্তিগত আক্রমণ না করতে। একদিন আমার মা’ও আমাকে বলেছিলেন, ‘বাবা যাহাই কর, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলিও না’। শেরে বাংলা মিছামিছিই ‘শেরে বাংলা’ হন নাই। বাংলার মাটিও তাঁকে ভালবেসে ফেলেছিল। যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেছি, তখনই বাধা পেয়েছি। একদিন আমার মনে আছে একটা সভা করছিলাম আমার নিজের ইউনিয়নে, হক সাহেব কেন লীগ ত্যাগ করলেন, কেন পাকিস্তান চান না এখন? কেন তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখারজির সাথে মিলে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন? এই সমস্ত আলোচনা করছিলাম, হঠাৎ একজন বৃদ্ধ লোক যিনি আমার দাদার খুব ভক্ত, আমাদের বাড়িতে সকল সময়ই আসতেন, আমাদের বংশের সকলকে খুব শ্রদ্ধা করতেন, দাঁড়িয়ে বললেন, ‘যাহা কিছু বলার বলেন, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলবেন না। তিনি যদি পাকিস্তান না চান, আমরাও চাই না। জিন্নাহ কে ? তার নামও তো শুনি নাই। আমাদের গরিবের বন্ধু হক সাহেব’। এ কথার পর আমি অন্যভাবে বক্তৃতা দিতে শুরু করলাম। সোজাসুজিভাবে আর হক সাহেবকে দোষ দিতে চেষ্টা করলাম না। কেন পাকিস্তান আমাদের প্রতিষ্টা করতে হবে তাই বুঝালাম। শুধু এইটুকু না, যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কালো পতাকা দেখাতে গিয়েছি, তখনই জনসাধারণ আমাদের মারপিট করেছে। অনেক সময় ছাত্রদের নিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি মার খেয়ে। কয়েকবার মার খাওয়ার পরে আমাদের বক্তৃতার মোড় ঘুরিয়ে দিলাম। পূর্বে আমার দোষ ছিল, সোজাসুজি আক্রমণ করে বক্তৃতা করতাম। তার ফল বেশি ভাল হত না। উপকার করার চেয়ে অপকারই বেশি হত। জনসাধারণ দুঃখ পেতে পারে ভেবে দাবিটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করতাম।
পাকিস্তান দুইটা হবে, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে। একটা বাংলা ও আসাম নিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র; আর একটা ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে-পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, সীমান্ত ও সিন্ধু প্রদেশ নিয়ে। অন্যটা হবে হিন্দুস্তান। ওখানেও হিন্দুরাই সংখ্যাগুরু থাকবে তবে সমান নাগরিক অধিকার পাবে হিন্দুস্তানের মুসলমানরাও। আমার কাছে ভারতবর্ষের একটা ম্যাপ থাকত। আর হাবীবুল্লাহ বাহার সাহেবের ‘পাকিস্তান’ বইটা এবং মুজিবুর রহমান খাঁ সাহেবও ‘পাকিস্তান’ নামে একটা বিস্তৃত বই লিখেছিলেন সেটা; এই দুইটা বই আমার প্রায় মুখস্থের মত ছিল। আজাদের কাটিংও আমার ব্যাগে থাকত।
সিপাহি বিদ্রোহ এবং ওহাবি আন্দোলনের ইতিহাসও আমার জানা ছিল। কেমন করে ব্রিটিশরাজ মুসলমানদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল, কি করে রাতারাতি মুসলমানদের সর্বস্বান্ত করে হিন্দুদের সাহায্য করেছিল, মুসলমানরা ব্যবসা-বাণিজ্য,
২৩
জমিদারি, সিপাহিরা চাকরি থেকে কিভাবে বিতাড়িত হল- মুসলমানদের স্থান হিন্দুদের দ্বারা পূরণ করতে শুরু করেছিল ইংরেজরা কেন ? মুসলমানরা কিছুদিন পূর্বেও দেশ শাসন করেছে তাই ইংরেজকে গ্রহণ করতে পারে নাই। সুযোগ পেলেই বিদ্রোহ করত। ওহাবি আন্দোলন কি করে শুরু করেছিল হাজার হাজার বাঙালি মুজাহিদরা? বাংলাদেশ থেকে সমস্ত ভারতবর্ষ পায়ে হেঁটে সীমান্ত প্রদেশে যেয়ে জেহাদে শরিক হয়েছিল। তিতুমীরের জেহাদ, হাজী শরীইয়তুল্লাহর ফরায়জি আন্দোলন সম্বন্ধে আলোচনা করেই আমি পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাস বলতাম। ভীষণভাবে হিন্দু বেনিয়া ও জমিদারদের আক্রমণ করতাম। এর কারণও যথেষ্ট ছিল। একসাথে লেখাপড়া করতাম, একসাথে খেলতাম, একসাথে বেড়াতাম, বন্ধুত্ব ছিল হিন্দুদের অনেকের সাথে। আমার বংশও খুব সম্মান পেত হিন্দু মুসলমানদের কাছ থেকে। কিন্ত আমি যখন কোনো হুন্দু বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যেতাম, আমাকে অনেক সময় তাদের ঘরের মধ্যে নিতে সাহস করত না আমার সহপাঠীরা।
একদিনের একটা ঘটনা আমার মনে দাগ কেটে দিয়েছিল, আজও সেটা ভুলি নাই। আমার এক বন্ধু ছিল ননীকুমার দাস। একসাথে পড়তাম, কাছাকাছি বাসা ছিল, দিনভরই আমাদের বাসায় কাটাত এবং গোপনে আমার সাথে খেত। ও ওর কাকার বাড়িতে থাকত। একদিন ওদের বাড়িতে যাই। ও আমাকে ওদের থাকার ঘরে নিয়ে বসায়। ওর কাকীমাও আমাকে খুব ভালবাসত। আমি চলে আসার কিছু সময় পড়ে ননী কাঁদো কাঁদো অবস্থায় আমার বাসায় এসে হাজির। আমি বললাম ‘ননী কি হয়েছে?’ ননী আমাকে বলল, ‘তুই আর আমাদের বাসায় যাস না। কারণ, তুই চলে আসার পড়ে কাকীমা আমাকে খুব বকেছে তোকে ঘরে আনার জন্য এবং সমস্ত ঘর আবার পরিষ্কার করেছে পানি দিয়ে ও আমাকেও ঘর ধুতে বাধ্য করেছে’। বললাম, ‘যাব না, তুই আসিস’। আরও অনেক হিন্দু ছেলেদের বাড়িতে গিয়েছি, কিন্ত আমার সহপাঠীরা আমাকে কোনোদিন একথা বলে নাই। অনেকের মা ও বাবা আমাকে আদরও করেছেন। এই ধরনের ব্যবহারের জন্য জাতক্রোধ সৃষ্টি হয়েছে বাঙালি মুসলমান যুবকদের ও ছাত্রদের মধ্যে। শহরে এসেই এই ব্যবহার দেখেছি। কারণ আমাদের বাড়িতে হিন্দুরা যারা আসত প্রায় সকলেই আমাদের শ্রদ্ধা করত। হিন্দুদের কয়েকটা গ্রামও ছিল, যেগুলির বাসিন্দারা আমাদের বংশের কোনো না কোনো শরিকের প্রজা ছিল।
হিন্দু মহাজন ও জমিদারদের অত্যাচারেও বাংলার মুসলমানরা অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল। তাই মুসলমানরা ইংরেজদের সাথে অসহযোগ করেছিল। তাদের ভাষা শিখবে না, তাদের চাকরি নেবে না, এই সকল করেই মুসলমানরা পিছিয়ে পড়েছিল। আর হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে ইংরেজকে তোষামোদ করে অনেকটা উন্নতির দিকে অগ্রসর হয়েছিল। যখন আবার হিন্দুরা ইংরেজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল তখন অনেকে ফাসিকাশষ্ঠে ঝুলে মরতে দ্বিধা করে নাই। জীবনভর কারাজীবন ভোগ করেছে, ইংরেজকে তাড়াবার জন্য। এই সময় যদি এই সকল নিঃস্বার্থ স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ত্যাগী পুরুষরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাথে সাথে হিন্দু ও মুসলমানদের মিলনের চেষ্ঠা করতেন এবং মুসলমানদের
২৪
উপর যে অত্যাচার ও জুলুম হিন্দু জমিদার ও বেনিয়ারা করেছিল, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন, তাহলে তিক্ততা এত বাড়ত না। হিদু নেতাদের মধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং নেতাজী সুভাষ বসু এ ব্যাপারটা বুঝেছিলেন, তাই তাঁরা অনেক সময় হিন্দুদের হুঁশিয়ার করেছিলেন। কবিগুরও তাঁর লেখার ভেতর দিয়ে হিন্দুদের সাবধান করেছিলেন। একথাও সত্য, মুসলমান জমিদার ও তালুকদাররা হিন্দু প্রজাদের সঙ্গে একই রকম খারাপ ব্যবহার করত হিন্দু হিসাবে নয়, প্রজা হিসাবে। এই সময় যখনই কোনো মুসলমান নেতা মুসলমানদের জন্য ন্যায্য অধিকার দাবী করত তখনই দেখা যেত হিন্দুদের মধ্যে অনেক শিক্ষিত, এমনকি গুণী সম্প্রদায়ও চিৎকার করে বাধা দিতেন। মুসলমান নেতারাও ‘পাকিস্তান’ সম্বন্ধে আলোচনা ও বক্তৃতা শুরু করার পূর্বে হিন্দুদের বিরুদ্ধে গালি দিয়ে শুরু করতেন।
এই সময় আবুল হাশিম সাহেব মুসলিম লীগ কর্মীদের মধ্যে একটা নতুন প্রেরণা সৃষ্টি করেন এবং নতুনভাবে যুক্তিতর্ক দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেতেন যে পাকিস্তান দাবি হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দু মুসলমানদের মিলানোর জন্য এবং দুই ভাই যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সুখে বাস করতে পারে তারই জন্য। তিনি আমাদের কিছু সংখ্যক কর্মীকে বেছে নিয়েছিলেন, তাদের নিয়ে রাতে আলোচনা সভা করতেন মুসলিম লীগ অফিসে। হাশিম সাহেব পূর্বে বর্ধমানে থাকতেন, সেখান থেকে মুসলিম লীগ অফিসে একটা রুমে এসে থাকতেন, কলকাতায় আসলে। মুসলিম লীগ অফিসটা শহীদ সাহেব ভাড়া নিয়েছিলেন। তাঁকেই ভাড়া দিতে হয়েছে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। হাশিম সাহেব আমাদের বললেন, একটা লাইব্রেরি করতে হবে, তোমাদের লেখাপড়া করতে হবে। শুধু হিন্দুদের গালাগালি করলে পাকিস্তান আসবে না। আমি ছিলাদ শহীদ সাহেবের ভক্ত। হাশিম সাহেব শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিলেন বলে আমিও তাঁকে শ্রদ্ধা করতাম, তাঁর হুকুম মানতাম। হাশিম সাহেবও শহীদ সাহেবের হুকুম ছাড়া কিছু করতেন না। মুসলিম লীগের ফান্ড ও অর্থ মানে শহীদ সাহেবের পকেট। টাকা পয়সা তাঁকেই জোগাড় করতে হত। সে সম্বন্ধে পরে আলোচনা করব। হাশিম সাহেব বলতেন, মুসলিম লীগকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে। গ্রাম থেকে প্রতিষ্টান গড়ে তুলতে হবে। উপরের তলার প্রতিষ্টান করলে চলবে না। জমিদারদের পকেট থেকে প্রতিষ্টানকে বের করতে হবে। তিনি শহীদ সাহেবের সাথে পরামর্শ করে সমস্ত বাংলাদেশ ঘুরতে আরম্ভ করলেন। চমৎকার বক্তৃতা করতেন। ভাষার উপর দখল ছিল। ইংরেজি বাংলা দুই ভাষায় বক্তৃতা করতে পারতেন সুন্দরভাবে।
এই সময় ছাত্রদের মধ্যে বেশ শক্তিশালী দুইটা দল সৃষ্টি হল। আমি কলকাতায় এসেই খবর পেলাম, আমাদের দিল্লি যেতে হবে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ সম্মেলনে’ যোগদান করতে। তোড়জোড় পড়ে গেল। যারা যাবেন নিজের টাকায়ই যেতে হবে। আনোয়ার হোসেন সাহেব তাঁর দলবল থেকে কয়েকজনকে নিলেন। টাকাও বোধহয় জোগাড় করলেন।
২৫
আমি ও ইসলামিয়া কলেজ ইউনিয়নের সেক্রেটারি মীর আশরাফউদ্দিন ঠিক করলাম, আমরাও যাব আমাদের নিজেদের টাকায়। আমাদের পূর্বেই ডেলিগেট করা হয়েছিল। মীর আশরাফউদ্দিন ওরফে মাখন, বাড়ি ঢাকা জেলার মুন্সীগঞ্জ মহকুমার কাজী কসবা গ্রামে। আমার খালাতো বোনের ছেলে, ওর বাবা-মা ছোটবেলায় মারা গেছেন। যথেষ্ট টাকা রেখে গেছেন। ওর বাবা তখনকার দিনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। শহীদ সাহেবকে বললাম, ‘আমরা দিল্লি কনফারেন্সে যোগদান করব’। তিনি বললেন, ‘খুব ভাল, দেখতে পারবে সমস্ত ভারতবর্ষের মুসলমান নেতাদের’। আমরা দুইজন ও আনোয়ার সাহেবের দলের কয়েকজন একই ট্রেনে ভিন্ন ভিন্ন গাড়িতে রওয়ানা করলাম। তাদের সাথে আমাদের মিল নাই। দুই মামু-ভাগ্নের যা খরচ লাগবে দিল্লিতে তা কোনমতে বন্দোবস্ত করে নিলাম। টাকার বেশি প্রয়োজন হলে আমি আমার বোনের কাছ থেকে আনতাম। বোন আব্বার কাছ থেকে নিত। আব্বা বলে দিয়েছিলেন তাকে, আমার দরকার দলে টাকা দিতে। আব্বা ছাড়াও মায়ের কাছ থেকেও আমি টাকা নিতে পারতাম। আর সময় সময় রেণুও আমাকে কিছু টাকা দিতে পারত। রেণু যা কিছু জোগাড় করত বাড়ি গেলে এবং দরকার হলে আমাকেই দিত। কোনদিন আপত্তি করে নাই, নিজে মোটেই খরচ করত না। গ্রামের বাড়িতে থাকত, আমার জন্যই রাখত।
হাওড়া থেকে আমরা দিল্লিতে রওয়ানা করলাম। এই প্রথমবার আমি বাংলাদেশের বাইরে রওয়ানা করলাম। দিল্লি দেখার একটা প্রবল আগ্রহ আমার ছিল। ইতিহাসে পড়েছি, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে শুনেছি, তাই দিল্লির লালকেল্লা, জামে মসিজিদ, কুতুব মিনার ও অন্যান্য ঐতিহাসিক জায়গাগুলি দেখতে হবে। নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায় যাব। আমরা দিল্লি পৌছালে মুসলিম লীগ স্বেচ্ছাসেবক দল আমাদের পৌঁছে দিল এংলো এরাবিয়ান কলেজ প্রাঙ্গণে। সেখানে আমাদের জন্য তাঁবু করা হয়েছে। তাঁবুতে আমরা দুইজন ছাড়াও আলীগড়ের একজন ছাত্র এবং আরেকজন বোধহয় এলাহাবাদ বা অন্য কোথাকার হবে। আনোয়ার সাহেবের দলবল অন্য একটা তাঁবুতে রইলেন। বিরাট প্যান্ডেল করা হয়েছে। আমরা ডেলিগেট কার্ড নিয়ে সভায় উপস্থিত হলাম। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের জন্য আলাদা জায়গা রাখা হয়েছে। প্রথম দিন কনফারেন্স হয়ে যাওয়ার পরে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে হাতির পিঠে নিয়ে এক বিরাট শোভাযাত্রা বের হল। আমরাও সাথে সাথে রইলাম। লোকে লোকারণ্য, রাস্তায় রাস্তায় পানি খাওয়ার বন্দোবস্ত রেখেছে। বোধহয় এই সময় পানি না রাখলে বহু লোক মারা যেত। দিল্লির পুরানা শহর আমরা ঘুরে বিকালে ফিরে এলাম। রাতে আবার কনফারেন্স শুরু হল। এই সময়কার একজনের কথা আজও আমি ভুলতে পারি না। উর্দুতে তিন ঘন্টা বক্তৃতা করলেন। যেমন গলা, তেমনই বলার ভঙ্গি। উর্দু ভাল বুঝতাম না, কলকাতার উর্দু একটু বুঝলেও এই উর্দু বোঝা আমার পক্ষে বেশ কষ্টকর। বক্তৃতা করেছিলেন নবাব ইয়ার জং বাহাদুর। তিনি হায়দ্রাবাদের লোক ছিলেন। স্টেট মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। তাঁর বক্তৃতা না বুঝলেও সভা ছেড়ে উঠে আসা কষ্টকর ছিল।

২৬
শরীর আমার খারাপ হয়ে পড়ে। দিনেরবেলায় ভীষণ গরম, রাতে ঠাণ্ডা। সকালে আর বিছানা থেকে উঠতে পারি নাই। বুকে, পেটে, আর সমস্ত শরীরে বেদনা। দুই তিন দিন পায়খানা হয় নাই। অসহ্য যন্ত্রণা আমার শরীরে। দুপুর পর্যন্ত না খেয়ে শুয়েই রইলাম। মাখন আমার কাছেই বসে আছে। ডাক্তার ডাকতে হবে, কাউকেই চিনি জানি না। একজন স্বেচ্ছাসেবককে বলা হল, তিনি বললেন, ‘আভি নেহি, থোড়া বাদ’। তাকে আর দেখা গেল না, ‘থোড়া বাদই রয়ে গেল’। বিকালের দিকে মাখন খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমারও ভয় হল। এই বিদেশে কি হবে? টাকা পয়সাও বেশি নাই। মাখন বলল, ‘মামা, আমি যাই ডাক্তার যেখানে পাই, নিয়ে আসতে চেষ্টা করি। এভাবে থাকলে তো বিপদ হবে’। শহিদ সাহেব কোথায় থাকেন জানি না, অন্যান্য নেতাদের বলেও কোন ফল হয় নাই। কে কার খবর রাখে? মাখন যখন বাইরে যাচ্ছিল ঠিক এই সময় দেখি হেকিম খলিলুর রহমান আমাকে দেখতে এসেছেন। তিনি জানেন না, আমি অসুস্থ। খলিলুর রহমানকে আমরা ‘খলিল ভাই’ বলতাম। ছাত্রলীগের বিখ্যাত কর্মী ছিলেন। আলীয়া মাদ্রাসায় পড়তেন এবং ইলিয়ট হোস্টেলে থাকতেন।
ইলিয়ট হোস্টেল আর বেকার হোস্টেল পাশাপাশি, আমরা ঠাট্টা করে বলতাম ‘ইডিয়ট হোস্টেল’। খলিল ভাই আলীয়া মাদ্রাসা থেকে পাস করে দিল্লিতে এসেছেন এক বৎসর পূর্বে, হাকিম আজমল খাঁ সাহেবের হেকিমি বিদ্যালয়ে হেকিমি শিখবার জন্য। আমার অবস্থা দেখে তিনি বললেন, কি সর্বনাশ কাউকে খবরও দাও নাই! তিনি মাখনকে বললেন, আপনার ডাক্তার ডাকতে হবে না, আমি ডাক্তার নিয়ে আসছি। আধ ঘন্টার মধ্যে খলিল ভাই একজন হেকিম নিয়ে উপস্থিত হলেন। তিনি আমাকে ভালভাবে পরীক্ষা করে কিছু ওষুধ দিলেন। তাঁকে খলিল ভাই পূর্বেই আমার রোগের কথা বলেছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, ভয় নাই। ওষুধ খাওয়ার পড়ে তিন বার আপনার পায়খানা হবে, রাতে আর কিছুই খাবেন না। ভোরে এই ওষুধটা খাবেন। বিকালে আপনি ভাল হয়ে যাবেন। তিনি যা বললেন, তাই হল।
পরের দিন সুস্থ বোধ করতে লাগলাম। কনফারেন্সও শেষ হয়ে যাবে। খলিল ভাই আমাদের সাথেই দুই দিন থাকবেন। আমাদের দিল্লির সকল কিছু ঘুরে ঘুরে দেখাবেন। এই সময় আর একটা ঘটনা ঘটল। বরিশালের নূরুদ্দিন আহমেদের সাথে আনোয়ার সাহেবের ঝগড়া হয়েছে। নূরুদ্দিন রাগ করে আমাদের কাছে চলে এসেছে। তার টাকা পয়সাও আনোয়ার সাহেবের কাছে। তাকে কিছুই দেয় নাই, একদম খালি হাতে আমার ও মাখনের কাছে এসে হাজির। বলল, ‘না খেয়ে মরে যাব, দরকার হয় হেঁটে কলকাতা যাব, তবু ওর কাছে আর যাব না’। এই নূরুদ্দিন সাহেবকেই মাখন ইসলামিয়া কলেজ ইউনিয়নের ইলেকশনে জেনারেল সেক্রেটারি পদে পরাজিত করেছিল। নূরুদ্দিনকে ছাত্ররা ভালবাসত কিন্ত সে আনোয়ার সাহেবের দলে ছিল বলে তাকে পরাজিত হতে হয়েছিল। আইএ পড়লেও দলের নেতা আমিই ছিলাম। আমরা একই হোস্টেলে থাকতাম। বললাম, ‘ঠিক আছে তোমার ওর কাছে যাওয়া লাগবে না, যেভাবে হয় চলে যাবে’। যদিও ওর
২৭
জন্য টিকিট করার টাকা আমাদের কাছে নাই। তিন দিন থাকব ঠিক হল। খাবার খরচ বেশি, হোটেলে খেতে হয়। দুই দিনের মধ্যেই খলিল ভাইকে নিয়ে দিল্লির লালকেল্লা, দেওয়ানি আম, দেওয়ানি খাস, কুতুব মিনার, নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগাহ, নতুন দিল্লি দেখে ফেললাম। কিছু টাকা খরচ হয়ে গেল। হিসাব করে দেখলাম, তিনজনের টিকিট করার টাকা আমাদের নাই। দুইখানা টিকিট করা যায়, কিন্ত না খেয়ে থাকতে হবে। খলিল ভাই একমাত্র বন্ধু, তবে তিনি তখনও ছাত্র তার কাছেও টাকা পয়সা নাই। যাহোক, আর দেরি না করে স্টেশনে এসে হাজির হলাম। তিনজনে পরামর্শ করে ঠিক করলাম, একখানা টিকিট করব এবং কোনো ‘সারভেন্ট’ ক্লাসে উঠে পড়ব। ধরা যদি পড়ি, হাওড়ায় একটা বন্দোবস্ত করা যাবে।
প্রথম শ্রেণীর প্যাসেঞ্জারদের গাড়ির সাথেই চাকরদের জন্য একটা করে ছোট্ট গাড়ি থাকে। সাহেবদের কাজকর্ম করে এখানেই এসে থাকে চাকররা। দিল্লি যাওয়ার সময় আমরা ইন্টারক্লাসে যাই। এখন টাকা ফুরিয়ে গেছে, কি করি? একখানা তৃতীয় শ্রেণীর টিকিট কিনলাম হাওড়া পর্যন্ত। আর দুইখানা প্লাটফর্ম টিকিট কিনে স্টেশনের ভিতরে আসলাম। মাখনের চেহারা খুব সুন্দর। দেখলে কেউই বিশ্বাস করবে না ‘চাকর’ হতে পারে। আমরা শুনলাম, খান বাহাদুর আবদুল মোমেন সাহেব এই বগিতে যাবেন। নূরুদ্দিন খোঁজ এনেছে। ভাবলাম, বিপদে পড়লে একটা কিছু করা যাবে। নূরুদ্দিনকে খান বাহাদুর সাহেব চিনতেন। তিনি রেলওয়ে বোর্ডের মেম্বারও ছিলেন। আমরা তাঁর গাড়ির পাশের সারভেন্ট ক্লাসে উঠে পড়লাম। মাখনকে বললাম, তুমি উপরে উঠে শুয়ে থাক। তোমাকে দেখলে ধরা পড়ব। এই সকল গাড়িতে বোধহয় কোনো রেলওয়ে কর্মচারী আসবে না। নূরুদ্দিনকে সামনে দিব যদি কেউ আসে। একবার এক চেকার সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কোন সাহেবের লোক’? নূরুদ্দিন ঝট করে উত্তর দিল, ‘মোমেন সাহেব কা’। ভদ্রলোক চলে গেলেন। কিছু কিছু ফলফলাদি নূরুদ্দিন কিনত, আমরা তিনজন খেতাম। ভাত বা রুটি খাবার পয়সা নাই। তিনজনে ভাত খেতে হলে তো এক পয়সাও থাকবে না।
কোনোমতে হাওড়া পৌছালাম, এখন উপায় কি? পরামর্শ করে ঠিক হল, মাখন টিকিট নিয়ে সকলের মালপত্র নিয়ে বের হয়ে যাবে। মালপত্র কোথাও রেখে তিনখানা প্লাটফর্ম তিকিট নিয়ে আবার ঢুকবে। আমরা একসাথে বের হয়ে যাব।
গাড়ি থামার সাথে সাথে মাখন নেমে গেল, আমরা দুইজন ময়লা জামা কাপড় পড়ে আছি। দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না যে আমরা দিল্লি থেকে আসতে পারি। চশমা খুলে লুকিয়ে রেখেছি। মাখন তিনখানা প্লাটফর্ম টিকিট নিয়ে ফিরে এসেছে। তখন প্যাসেঞ্জার প্রায়ই চলে গেছে। দুই চারজন আছে যাদের মালপত্র বেশি। তাদের পাশ দিয়ে আমরা দুইজন ঘুরছি। মাখন আমাদের প্লাটফর্ম টিকিট দিল, তিনজন একসঙ্গে বেরিয়ে গেলাম। তখন হিসাব করে দেখি, আমাদের কাছে এক টাকার মত আছে। আমরা বাসে উঠে হাওড়া থেকে বেকার হোস্টেলে ফিরে এলাম। না খেয়ে আমাদের অবস্থা কাহিল হয়ে গেছে।
২৮
সেই সময় হতে নূরুদ্দিনের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব হয়। পরে আমাদের বন্ধুত্বের ‘খেসারত’ তাকে দিতে হয়েছে। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে মার্শাল ল’ জারি হওয়ার পরে কর্মীদের তাদের দুঃখ কষ্টের কথা অন্য কোনো নেতাদের কাছে বললে কানও দিত না। একমাত্র শহীদ সাহেবই দুঃখ কষ্ট সহানুভূতির সাথে শুনতেন এবং দরকার হলে সাহায্যও করতেন। নূরুদ্দিন পরে ‘অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগে’র অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক হয়। আনোয়ার সাহেব যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে যাদবপুর হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর যাবতীয় খরচ শহীদ সাহেব বহন করতেন।
১৯৪৪ সালে ছাত্রলীগের এক বাৎসরিক সম্মেলন হবে ঠিক হল। বহুদিন সম্মেলন হয় না। কলকাতায় আমার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা কিছুটা ছিল-বিশেষ করে ইসলামিয়া কলেজে কেউ আমার বিরুদ্ধে কিছুই করতে সাহস পেত না। আমি সমানভাবে মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগে কাজ করতাম। কলকাতায় সম্মেলন হলে কেউ আমাদের দলের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবে না। যাহোক, শহীদ সাহেব আনোয়ার সাহেবকেও ভালবাসতেন। আনোয়ার সাহেব অনেকটা সুস্থ হয়েছেন। ঢাকার ছাত্রলীগ ও আমাদের সাথের কেউ আনোয়ার সাহেবকে দেখতে পারত না। একমাত্র শাহ আজিজুর রহমান সাহেবই ঢাকায় আনোয়ার সাহেবের দলে ছিলেন।
শাহ সাহেব চমৎকার বক্তৃতা করতেন। বগুড়ায় তাঁকে আমি প্রথম দেখি। আনোয়ার সাহেব কলকাতা ও ঢাকায় কনফারেন্স করতে সাহস না পেয়ে কুষ্টিয়ায় শাহ আজিজুর রহমানের নিজের জেলায় বার্ষিক প্রাদেশিক সম্মেলন ডাকলেন। এই সময় আনোয়ার সাহেব ও নূরুদ্দিনের দলের মধ্যে ভীষণ গোলমাল শুরু হয়ে গেছে। আনোয়ার সাহেব আমার কাছে লোক পাঠালেন এবং অনুরোধ করলেন, তাঁর সাথে এক হয়ে কাজ করতে। তিনি আমাকে পদের লোভও দেখালেন। আমি বললাম, আমার পদের দরকার নাই, তবে সবার সাথে আলোচনা করা দরকার। নূরুদ্দিন সাহেবের দলও আমার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালায়। একপক্ষ আমাকে নিতেই হবে, কারণ আমার এমন শক্তি কলকাতা ছাড়া অন্য কোথাও ছিল না যে ইলেকশনে কিছু করতে পারব। ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে চট্টগ্রামে চলে গেছেন। জহির সাহেব ছাত্র আন্দোলন নিয়ে মাথা ঘামান না, মুসলিম লীগেরই কাজ করেন।
কলকাতায় যে সকল ছাত্র-কর্মী ছিল তারা প্রায়ই হাশিম সাহবের কাছে যাওয়া-আসা করে। তাঁর কাছে যেয়ে ক্লাস করে, এইভাবে তাদের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। যে সমস্ত নিঃস্বার্থ কর্মী সে সময় কাজ করত তাদের মধ্যে নূরুদ্দিন, বর্ধমানের খন্দকার নূরুল আলম ও শরফুদ্দিন, সিলেটের মোয়াজ্জেম আহমদ চৌধুরী, খুলনার একরামুল হক, চট্টগ্রামের মাহাবুব আলম, নূরুদ্দিনের চাচাত ভাই এস.এ. সালেহ অন্যতম ছিল। শেষ পর্যন্ত এদের সাথেই আমার মিল হল, কারণ আমরা সকলেই শহীদ সাহেব ও আবুল
২৯
হাশিম সাহেবের ভক্ত ছিলাম। আনোয়ার সাহেবের দল হাশিম সাহেবকে দেখতে পারতেন না। কিন্তু শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিলেন। শহীদ সাহেব অবস্থা বুঝে আমাদের দুই দলের নেতৃবৃন্দকে ডাকলেন একটা মিটমাট করাবার জন্য। শেষ পর্যন্ত মিটমাট হয় নাই। এই সময় শহীদ সাহেবের সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয়। তিনি আনোয়ার সাহেবকে একটা পদ দিতে বলেন, আমি বললাম কখোনই হতে পারে না। সে প্রতিষ্টানের মধ্যে কোটারি করেছে, ভাল কর্মীদের জায়গা দেয় না। কোনো হিসাব-নিকাশও কোনোদিন দাখিল করে না। শহীদ সাহেব আমাকে হঠাৎ বলে বসলেন, ‘Who are you? You are nobody.’আমি বললাম ‘If I am nobody, then why you have invited me? You have no right to insult me. I will prove that I am somebody. Thank you Sir. I will never come to you again.’এ কথা বলে চিৎকার করতে করতে বৈঠক ছেড়ে বের হয়ে এলাম। আমার সাথে সাথে নূরুদ্দিন, একরাম, নূরুল আলমও উঠে দাঁড়াল এবং শহীদ সাহেবের কথার প্রতিবাদ করল। বর্তমান বুলবুল একাডেমির১৩সেক্রেটারি মাহমুদ নূরুল হুদা সাহেব শহীদ সাহেবের খুব ভক্ত ছিলেন। সকল সময় শহীদ সাহেবের কাছে থাকতেন। আমরা তাঁকে ‘হুদা ভাই’ বলে ডাকতাম। হুদা ভাইয়ের ব্যবহার ছিল চমৎকার। কারও কোনো বিপদ হলে, আর খবর পৌঁছে দিলে যত রাতই হোক না কেন হাজির হতেন। হুদা ভাই ঐ সময় উপস্থিত ছিলেন। আমি যখন বিখ্যাত ৪০ নম্বর থিয়েটার রোড থেকে রাগ হয়ে বেরিয়ে আসছিলাম শহীদ সাহেব হুদা ভাইকে বললেন, ‘ওকে ধরে আনো’। রাগে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। হুদা ভাই দৌড়ে এসে আমাকে ধরে ফেললেন। শহীদ সাহেবও দোতলা থেকে আমাকে ডাকছেন ফিরে আসতে। আমাকে হুদা ভাই ধরে আনলেন। বন্ধুবান্ধবরা বলল, শহীদ সাহেব ডাকছেন, বেয়াদবি কর না, ফিরে এস’। উপরে এলাম। শহীদ সাহেব বললেন, ‘যাও তোমরা ইলেকশন কর, দেখ নিজেদের মধ্যে গোলমাল কর না’। আমাকে আদর করে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘তুমি বোকা, আমি তো আর কাউকেই একথা বলি নাই, তোমাকে বেশি আদর ও স্নেহ করি বলে তোমাকেই বলেছি’। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তিনি যে সত্যিই আমাকে ভালবাসতেন ও স্নেহ করতেন, তার প্রমাণ আমি পেয়েছি তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার দিন পর্যন্ত। যখনই তাঁর কথা এই কারাগারে বসে ভাবি, সেকথা আজও মনে পড়ে। দীর্ঘ বিশ বৎসর পরেও একটুও এদিক ওদিক হয় নাই। সেইদিন থেকে আমার জীবনে প্রত্যেকটা দিনই তাঁর স্নেহ পেয়েছি। এই দীর্ঘদিন আমাকে তাঁর কাছ থেকে কেউই ছিনিয়ে নিতে পারে নাই এবং তাঁর স্নেহ থেকে কেউই আমাকে বঞ্চিত করতে পারে নাই।
শহীদ সাহেবের বাড়িতে দুই দল বসেও যখন আপোস হল না, তখন ইলেকশনে লড়তে হবে। ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব চট্টগ্রাম জেলা মুসলিম লীগ, ছাত্রলীগ কর্মীদের সাহায্য নিয়ে দখল করতে সক্ষম হলেন। খান বাহাদুররা জেলা লীগ কনফারেন্সে পরাজিত হলেন। ১৯৪৩ সাল থেকে চট্টগ্রামের এই কর্মীদের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, আজ পর্যন্ত সে বন্ধুত্ব অটুট আছে। চট্টগ্রামের এম.এ.আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, আজিজুর
৩০
রহমান, ডা.সুলতান আহমেদ (এখন কুমিল্লায় আছেন), আবুল খায়ের চৌধুরী এবং আরও অনেকে ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগ প্রতিষ্টানে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। অনেকেই ছিটকে পড়েছেন। আজিজ ও জহুর আজও সক্রিয় রাজনীতি করছেন। জহুর শ্রমিক আন্দোলন করেন এবং সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি। এম.এ.আজিজ (এখন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক) পাকিস্তান হওয়ার পড়ে অনেকবার ও অনেক দিন জেলে কষ্ট ভোগ করেছেন। ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব তখন এদের নেতা ছিলেন। পড়ে তিনি মুসলিম লীগেই থেকে যান। আজিজ ও জহুর আওয়ামী লীগে চলে আসেন। চৌধুরী সাহেব খুবই স্বার্থপর হয়ে ওঠেন এবং একগুঁয়েমি করতেন, সেজন্য যারা তাঁকে চট্টগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, পরে তারা সকলেই তাঁকে ত্যাগ করেন।
চট্টগ্রামে টেলিগ্রাম করলাম কুষ্টিয়ায় ছাত্রলীগের প্রতিনিধি পাঠাতে। লোক পাঠালাম সমস্ত হেলায়। নূরুদ্দিন,একরাম, শরফুদ্দিন, খন্দকার নূরুল আলম, আমি ও আমার সহকর্মীরা রাতদিন কাজ করতে আরম্ভ করলাম। আমাদের অর্থের খুব অভাব, কারণ হাশিম সাহবের টাকা পয়সা ছিল না। শহীদ সাহেব আমাদের সামান্য সাহায্য করেছিলেন। আমরা নিজেরা চাঁদা তুললাম এবং দলবল নিয়ে কুষ্টিয়া পৌছালাম। কিউ.জে.আজমিরী ও হামিদ আলী নামে দুইজন ভাল কর্মী ছিল। আজমিরী ভীষণ রাগী ছিল। কথায় কথায় মারপিট করে ফেলত, শক্তিও ছিল, সাহসও ছিল। আজমিরী হাশিম সাহেবের আত্মীয়। ফরিদপুর কুষ্টিয়ার কাছে। ফরদপুরে ছাত্রদের দুই ভাগ ছিল। এক ভাগ আমার সাথে আর একভাগ মোহন মিয়া সাহেবের সমর্থক। মোহন মিয়া সাহেব আনোয়ার সাহেবকে সমর্থন করতেন। কুষ্টিয়ায় যখন আমরা পৌছালাম তখন দেখা গেল যত কাউন্সিলার এসেছে তার মধ্যে শতকরা সত্তরজন আমাদের সমর্থক। দুই দলের নেতৃবৃন্দের এক জায়গায় বসা হল, উদ্দেশ্য আপোস করা যায় কি না? বগুড়ার ফজলুল বারীকে (এখন পূর্ব বাংলার গভর্নর মোনেম খান সাহেবের মন্ত্রী হয়েছেন) সভাপতি করে আলোচনা চলল। কথায় কথায় ঝগড়া, তারপর মারামারি হল, শাহ সাহেব অনেক গুন্ডা জোগাড় করে এনেছিলেন। আমরা বলেছিলাম, যদি গুণ্ডামি করা হয়, তবে কলকাতায় তাকে থাকতে হবে না। শেষ পর্যন্ত আপোস হল না। কুমিল্লার ছাত্রলীগ নেতারা আমাদের সাথেই ছিলেন। সকালে শোনা গেন তাঁরা আনোয়ার সাহেবের দলের সাথে মিশে গেছেন, কারণ তাদের তিনটা পদ দেয়া হয়েছে। রফিকুল হোসেনকে আমাদের দলই কলকাতা থেকে কাউন্সিলার করে। তিনি আমাদের সকল পরামর্শ সভায়ও যোগদান করতেন। শফিকুল ইসলামও বেকার হোস্টেলে থাকত। আমাদের সাথেই আনোয়ার সাহেবের দলের বিরুদ্ধে কাজ করত। আর আবদুল হাকিম সাহেব তো আমার ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। তখন থেকেই একসাথে কাজ করেছি। সকালবেলা এরা দল ত্যাগ করল। তথাপি আমরা সংখ্যায় অনেক বেশি। কোনো ভয় নাই, আনোয়ার সাহবের দল পরাজিত হবেই।
সিনেমা হলে কাউন্সিল অধিবেশন হবে। জনাব হামুদুর রহমান সাহেব (এখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি) সভাপতির আসন গ্রহণ করবেন। তিনি এডহক কমিটির সদস্য
৩১
ছিলেন। অল ইন্ডিয়া মুসলিম ছাত্রলীগ ফেডারেশনের পক্ষ হতে তিনি সভাপতিত্ব করবেন এটা আমাদেরই দাবী ছিল। আমরা যখন হলে ঢুকলাম তখন দেখলাম অনেক বাইরের লোক হলে বসে আছে। আমরা সভাপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। আমাদের পক্ষ থেকে একরামুল হক বৈধতার প্রশ্ন তুলল এবং দাবি করল, ‘সকল প্রতিনিধি, হল থেকে বের হয়ে যাবে, দুইটা গেট খোলা থাকবে, দুই পক্ষ থেকে দুইজন করে চারজন প্রতিনিধি প্রত্যেকের কার্ড পরীক্ষা করে হলে আসতে দিবে’।
এই সময় হলের উপর তলার বারান্দায় বাইরের ছাত্ররা অনেক এসেছে, তারা দর্শক। একজন ছাত্র, হাফপ্যান্ট পরা চিৎকার করে বলছে, ‘আমি জানি এরা অনেকেই ছাত্র না, বাইরের লোক। শাহ আজিজ দল বড় করবার জন্য এদের এনেছে’। পড়ে খবর নিয়ে জানলাম, ছেলেটির নাম কামারুজ্জামান (পড়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পূর্ব বাংলা পরিষদের সদস্য হয়েছিল)। জনাব হামুদুর রহমান সাহেব আমাদের কথা মানলেন না, তিনি সভার কাজ শুরু করে দিলেন। যেখানে বিশজন ছাত্রকে কো-অপ্ট করা হবে কনফারেন্স শুরু হবার সময়, সেখানে তিনি ভোটে দিয়ে দিলেন। আমরা বাইরের লোকদের বের করে দিতে অনুরোধ করতে থাকলাম। ভীষণ চিৎকার শুরু হল, আমরা দেখলাম মারপিট হবার সম্ভাবনা আছে। কয়েকজন বসে পরামর্শ করে আমাদের সমর্থকদের নিয়ে সভা ত্যাগ করলাম প্রতিবাদ করে। আমরা ইচ্ছা করলে আর একটা প্রতিষ্টান করতে পারতাম। প্রায় সমস্ত জেলায়ই আমাদের সমর্থক ছিল। তা করব না ঠিক করলাম, তবে কলকাতায় এদের কোন সভা করতে দেব না। কলকাতা মুসলিম ছাত্রলীগের নামেই আমরা কাজ করে যেতে লাগলাম। অল বেঙ্গল নেতাদের কোনো স্থান ছিল না।
১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আর কোন ইলেকশন এরা করে নাই। মুসলিম ছাত্রলীগ দুই দলে ভাগ হয়ে গেল, একদল পরিচিত হত শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেবের দল বলে, আরেক দল পরিচিত হত খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব এবং মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের দল বলে। আমরা মওলানা আকরম খাঁ সাহেবকে সকলেই শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতাম। তাঁর বিরুদ্ধে আমাদের কিছুই বলার ছিল না।
এই সময় একটা আলোড়ন সৃষ্টি হল। হাশিম সাহেব শহীদ সাহেবের সাথে পরামর্শ করে মুসলিম লীগের একটা ড্রাফট ম্যানিফেস্টো বের করলেন। মুসলিম লীগ রাজনৈতিক প্রতিষ্টান এবং এর রাজনৈতিক দাবিও থাকবে, ভবিষ্যতে পাকিস্তান পেলে অর্থনৈতিক কাঠামো কি হবে তাও থাকতে হবে। জমিদারি প্রথা বিলোপসহ আরও অনেক কিছু এতে ছিল। ভীষণ হৈচৈ পড়ে গেল। আমরা যুবক, ছাত্র ও প্রগতিবাদীরা এটা নিয়ে ভীষণভাবে প্রোপাগান্ডা শুরু করলাম। পাকিস্তান আমাদের আদায় করতে হবে এবং পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো কি হবে তার একটা সুস্পষ্ট রূপরেখা থাকা দরকার। হাশিম সাহেব আমাদের নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ক্লাস করতেন। ঢাকায় এসে কয়েকদিন থাকতেন এবং কর্মীদের নিয়ে আলোচনা সভা করতেন। কলকাতা লীগ অফিসে
৩২
তিনি থাকতেন, ঢাকার লীগ অফিসেও তিনি থাকতেন। কর্মীদের সাথে তিনি ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ রাখতেন। আমি তাঁর সাথে কয়েক জায়গায় সভা করতে গিয়েছি।
এই সময়কার একজন ছাত্রনেতার নাম উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে; কারণ, তিনি কোনো গ্রুপে ছিলেন না এবং অন্যায় সহ্য করতেন না। সত্যবাদী বলে সকলে তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। নেতাদের সকলেই তাঁকে স্নেহ করতেন। তাঁর নাম এখন সকলেই জানেন, জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী বার এট ল’। এখন ঢাকা হাইকোর্টের জজ সাহেব। তিনি দুই গ্রুপের মধ্যে আপোস করতে চেষ্টা করতেন। শহীদ সাহেবও চৌধুরী সাহেবের কথার যথেষ্ট দাম দিতেন। জনাব আবদুল হাকিম এখন হাইকোর্টের জজ হয়েছেন। তিনি টেইলর হোস্টেলের স-সভাপতি ছিলেন, ছাত্র আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। জজ মকসুমুল হাকিম সাহেব ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন না। বেকার হোস্টেলের প্রিমিয়ার হয়েছিলেন, ভাল ছাত্র ছিলেন, লেখাপড়েয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।
এই সময় শহীদ নজীর আহমেদ নিহত হবার পরে ঢাকার ছাত্রদের নেতৃত্ব দিতেন জনাব শামসুল হক সাহেব, শামসুদ্দিন আহমেদ, নোয়াখালীর আজিজ আহমেদ ও খোন্দকার মোশতাক আহমদ এবং আরও অনেকে। এরা সকলেই শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিলেন। পরে হাশিম সাহেবেরও ভক্ত হন। এরা সকলেই ছাত্র আন্দোলনের সাথে সাথে মুসলিম লীগ সংগঠনকে কোটারির হাত থেকে বাঁচাবার জন্য মুসলিম লীগের কাজে যোগদান করেছিলেন। ঢাকায় প্রাদেশিক লীগের একটা আঞ্চলিক শাখা অফিস হাশিম সাহেব খোলেন ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে। কমিউনিস্ট পার্টির মত হোলটাইম ওয়ার্কার হিসাবে এরা অনেকেই যোগদান করেন। শামসুল হক সাহেব এই অফিসের ভার নেন। আমরাও কলকাতা অফিসের হোলটাইম ওয়ার্কার হয়ে যাই। যদিও হোস্টেলে আমার রুম থাকত, তবু আমরা প্রায়ই লীগ অফিসে কাটাতাম। রাতে একটু লেখাপড়া করতাম। সময় সময় কলেজে পারসেন্টেজ রাখতাম। পাকিস্তান না আনতে পারলে লেখাপড়া শিখে কি করব? আমাদের অনেকের মধ্যে এই মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছিল।
কলকাতার আহমেদ আলী পারকে মুসলিম লীগ কাউন্সিল সভা হবে, তখন দুই পক্ষের মোকাবেলা হবে। আমরা হাশিম সাহেবকে জেনারেল সেক্রেটারি করব এবং ম্যানিফেস্টো পাস করাব। অন্য দল হাশিম সাহেবকে সেক্রেটারি হতে দেবে না। নেতাদের মধ্যে অনেকেই শহীদ সাহেবের সমর্থক ছিলেন। তারা শহীদ সাহেবকে সমর্থন করতেন কিন্ত হাশিম সাহেবকে দেখতে পারতেন না। শেষ পর্যন্ত মওলানা আকরম খাঁ সাহেব, শহীদ সাহেব ও খাজা নাইমুদ্দীন সাহেব বসে একটা প্যানেল ঠিক করলেন। হাশিম সাহেবই সেক্রেটারি থাকবেন তবে ম্যানিফেস্টো এবার পাস হবে না। একটা সাব-কমিটি করা হবে, তাদের রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করে ম্যানিফেস্টো ঠিক হবে। আমার মনে হয়, ম্যানিফেস্টো সম্বন্ধে এই সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছিল। আর কি কি সিদ্ধান্ত হয়েছিল আমার ঠিক মনে নাই। যাহোক, শহীদ সাহেব বললেন, ‘এখন গোলমাল করার সময় নয়। পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করতে হবে। নিজেদের মধ্যে গোলমাল হলে পাকিস্তান দাবির সংগ্রাম পিছিয়ে যাবে’।
৩৩
এই সময় বাংলায় মুসলিম লীগ সরকারের পতন হয়। গভর্নর শাসন ক্ষমতা নিজের হাতে নেন। শহীদ সাহেব দেখলেন যুদ্ধের সময় অধিক লাভের আশায় ব্যবসায়ীরা কালো বাজারে কাপড় বিক্রি করার জন্য গুদামজাত করতে শুরু করছে। একদিকে খাদ্য সমস্যা ভয়াবহ, শহীদ সাহেব রাতদিন পরিশ্রম করছেন, আর একদিকে অসাধু ব্যবসায়ীরা জনগণের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে শুরু করেছে। শহীদ সাহেব সমস্ত কর্মচারীদের হুকুম দিলেন, মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের আড্ডাখানা বড়বাজার ঘেরাও করতে। সমস্ত বড়বাজার ঘেরাও করা হল। হাজার হাজার গজ কাপড় ধরা পড়ল, এমনকি দালানগুলির নিচেও এক একটা গুদাম করে রেখেছিল তাও বাদ গেল না। এমনি করে সমস্ত শহরে চাউল গুদামজাতকারীদের ধরবার জন্য একইভাবে তল্লাশি শুরু করলেন। মাড়োয়ারিরাও কম পাত্র ছিল না। কয়েক লক্ষ টাকা তুলে লীগ মন্ত্রিসভাকে খতম করার জন্য কয়েকজন এমএলএকে কিনে ফেলল। ফলে এক ভোটে লীগ মন্ত্রিত্বকে পরাজয়বরণ করতে হল। যদিও এটা অনাস্থা প্রস্তাব ছিল না। খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব চ্যালেঞ্জ দিলেন এই কথা বলে যে, আগামীকাল আমি আস্থা ভোট নেব, যদি আস্থা ভোট না পাই তবে পদত্যাগ করব। স্পিকার ছিলেন নওশের আলী সাহেব। পরের দিন তিনি এ ব্যাপারে রুলিং দিলেন, মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হয়ে গেছে, আর আস্থা ভোটের দরকার নেই।
আমি কিছু সংখ্যক ছাত্র নিয়ে সেখানে উপস্থিত ছিলাম। খবর যখন রটে গেল লীগ মন্ত্রিত্ব নাই, তখন দেখি টুপি ও পাগড়ি পরা মাড়োয়ারিরা বাজি পোড়াতে শুরু করেছে এবং হৈচৈ করতে আরম্ভ করেছে। সহ্য করতে না পেরে, আরও অনেক কর্মী ছিল, মাড়োয়ারিদের খুব মারপিঠ করলাম, ওরা ভাগতে শুরু করল। জনাব মোহাম্মদ আলী বাইরে এসে আমাকে ধরে ফেললেন এবং সকলকে বুঝাতে শুরু করলেন। হিন্দু নেতারাও বাইরে এসে প্রতিবাদ করল। যাহোক, কিছু সময় পর সব শান্ত হয়ে গেল, আমরা ফিরে এলাম। এই সময় বোধহয় দেড় বছরের মত মুসলিম লীগ শাসন করে, যদিও গভর্নরই সর্বময় ক্ষমতার মালিক ছিলেন। আমি নিজে জানি, শহীদ সাহেব কলকাতা ক্লাবের সদস্য ছিলেন। রাতে একবার দুই এক ঘন্টার জন্য কলকাতায় থাকলে ক্লাবে যেতেন, কিন্ত যেদিন তিনি সিভিল সাপ্লাইয়ের মন্ত্রী হন, তারপর থেকে এক মুহূর্তও সময় পান নাই কলকাতা ক্লাবে যেতে। রাত বারটা পর্যন্ত তিনি অফিস করতেন। আমি ও নূরুদ্দিন রাত বারটার পরেই শহীদ সাহেবের সাথে দেখা করতে এবং রাজনীতি সম্বন্ধে আলোচনা করতে প্রায়ই তাঁর বাড়িতে যেতাম। কারণ, দিনেরবেলায় তিনি সময় পেতেন না। তিনি আমাদের এই সময়ের কথা বলে দিয়েছিলেন।
এর পূর্বে আমার ধারণা ছিল না যে, এমএলএরা এইভাবে টাকা নিতে পারে। এরাই দেশের জনগণের প্রতিনিধি! আমার মনে আছে, আমাদের উপর ভার পড়ল কয়েকজন এমএলএকে পাহার দেবার, যাতে তারা দল ত্যাগ করে অন্য দলে না যেতে পারে। আমি তাদের নাম বলতে চাই না, কারণ অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছে। একজন এমএলএকে মুসলিম লীগ অফিসে আটকানো হল। তিনি বারবার চেষ্টা করেন বাইরে যেতে, কিন্তু আমাদের জন্য পারছেন না। কিছু সময় পরে বললেন,‘আমাকে বাইরে যেতে দিন, কোনো ভয় নেই। বিরোধী দল টাকা দিতেছে, যদি কিছু টাকা নিয়ে আসতে পারি আপনাদের ক্ষতি কি? ভোট আমি মুসলিম লীগের পক্ষেই দিব’। আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলাম তাঁর দিকে। বৃদ্ধ লোক, সুন্দর চেহারা, লেখাপড়া কিছু জানেন, কেমন করে এই কথা বলতে পারলেন আমাদের কাছে? টাকা নেবেন একদল থেকে অন্য দলের সভ্য হয়ে, আবার টাকা এনে ভোটও দেবেন না। কতটা অধঃপতন হতে পারে আমাদের সমাজের। এই ভদ্রলোককে একবার রাস্তা থেকে আমাদের ধরে আনতে হয়েছিল। শুধু সুযোগ খুঁজছিলেন কেমন করে অন্য দলের কাছে যাবেন।

এই সময় ফজলুর রহমান সাহেব আমাকে ডাকলেন, তিনি চিফ হুইপ ছিলেন। আমাকে বললেন,‘আপনাকে এই বারটার সময় আসাম-বেঙ্গল ট্রেনে রংপুর যেতে হবে। মুসলিম লীগের একজন এমএলএ, যনি ‘খান বাহাদুর’ও ছিলেন তাঁকে নিয়ে আসতে হবে। টেলিগ্রাম করেছি, লোকও পাঠিয়েছি, তবু আসছেন না, আপনি না গেলে অন্য কেউই আনতে পারবে না। শহীদ সাহেব আপনাকে যেতে যেতে বলেছেন। আপনার জন্য টিকিট করা আছে’। কয়েকখানা চিঠি দিলেন। আমি বেকার হোস্টেলে এসে একটা হাত ব্যাগে কয়েকটা কাপড় নিয়ে সোজা স্টেশনে চলে আসলাম। খাওয়ার সময় পেলাম না। যুদ্ধের সময় কোথাও খাবার পাওয়াও কষ্টকর। ট্রেনে চেপে বসলাম। তখন ট্রেনের কোন সময়ও ঠিক ছিল না, মিলিটারিদের ইচ্ছামত চলত। রাত আটটায় রংপুর পৌছাব এটা ছিল ঠিক সময়, কিন্তু পৌছালাম রাত একটায়। পথে কিছু খেতেও পারি নাই, ভীষণ ভিড়। এর পূর্বে রংপুরে আমি কোনোদিন যাই নাই। শুনলাম স্টেশন থেকে শহর তিন মেইল দূরে। অনেক কষ্ট করে একটা রিকশা জোগাড় করা গেল। রিকশাওয়ালা খান বাহাদুর সাহেবের বাড়ি চিনে, আমাকে ঠিকই পৌছে দিল। আমি অনেক ডাকাডাকি করে তাঁকে তুললাম, চিঠি দিলাম। তিনি আমাকে জানেন। বললেন,‘আগামীকাল আমি যাব। আজ ভোর পাঁচটায় যে ট্রেন আছে সে ট্রেনে যেতে পারব না’। আমি বললাম,‘তাহলে আপনি চিঠি দিয়ে দেন, আমি ভোর পাঁচটার ট্রেনেই ফিরে যেতে চাই’। তিনি বললেন,‘সেই ভাল হয়’। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন না কিছু খাব কি না, পথে খেয়েছি কি না। বললেন,‘এখন তো রাত তিনটা বাজে, বিছানার কি দরকার হবে?’ বললাম,‘দরকার নাই, যে সময়টা আছে বসেই কাটিয়ে দিব। ঘুমালে আর উঠতে পারব না খুবই ক্লান্ত’। একদিকে পেট টনটন করছে, অন্যদিকে অচেনা রংপুরের মশা। গতরাতে কলকাতায় বেকার হোস্টেলে ভাত খেয়েছি। বললাম, এক গ্লাস পানি পাঠিয়ে দিলে ভাল হয়। তিনি তার বাড়ির পাশেই কোথাও রিকশাওয়ালারা থাকে, তার একজনকে ডেকে বললেন, আমাকে যেন পাঁচটার ট্রেনে দিয়ে আসে। আমি চলে এলাম সকালের ট্রেনে।
কলকাতায় পৌছালাম আরেক সন্ধায়। রাস্তায় চা বিস্কুট কিছু খেয়ে নিয়েছিলাম। রাতে আবার হোস্টেলে এসে ভাত খাই। ভীষণ কষ্ট পেয়েছি, ক্ষেপেও গিয়েছি। ফজলুর
৩৫
রহমান সাহেবকে বললাম,‘আর কোনোদিন এই সমস্ত লোকদের কাছে যেতে বলবেন না’।
একদিন পরে তিনি এসেছিলেন। তাঁকে পাহার দেয়ার জন্য লোক রাখা হয়েছিল। তবু পিছনের দরজা দিয়ে এক ফাঁকে তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন। খোঁজাখুঁজি করেও তাঁকে আর পাওয়া যায় নাই। আমরা ছাত্র ছিলাম, দেশকে ভালবাসতাম, দেশের জন্য কাজ করতাম, এই সকল জঘন্য নীচতা এই প্রথম দেখলাম, পরে যদিও অনেক দেখেছি, কিন্ত এই প্রথমবার। এই সমস্ত খান বাহাদুরদের দ্বারা পাকিস্তান আসবে, দেশ স্বাধীন হবে, ইংরেজকে তাড়ানোও যাবে, বিশ্বাস করতে কেন যেন কষ্ট হত! মুসলিম লীগ প্রতিষ্টান পূর্বে ছিল খান সাহেব, খান বাহাদুর ও ব্রিটিশ খেতাবধারীদের হাতে, আর এদের সাথে ছিল জমিদার, জোতদার শ্রেনীর লোকেরা। এদের দ্বারা কোনোদিন পাকিস্তান প্রতিষ্টা হত না। শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব যদি বাংলার যুবক ও ছাত্রদের মধ্যে মুসলিম লীগকে জনপ্রিয় না করতে পারতেন এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে টেনে আনতে না পারতেন, তাহলে কোনোদিনও পাকিস্তান আন্দোলন বাংলার কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারত না। যদিও এই সমস্ত নেতাদের আমরা একটু বাঁধা দিতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্ত সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করতে পারি নাই। যার ফলে পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথেই এই খান বাহাদুর ও ব্রিটিশ খেতাবধারীরা তৎপর হয়ে উঠে ক্ষমতা দখল করে ফেলল। কি কারণে এমন ঘটল তা পরবর্তী ঘটনায় পরিষ্কার হয়ে যাবে।
শহীদ সাহেব মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার পরে মুসলিম লীগ প্রতিষ্টানের দিকে মন দিলেন। যুদ্ধের প্রথম ধাক্কা সামলিয়ে ইংরেজ যুদ্ধের গতির পরিবর্তন করে ফেলল। এই সময় কংগ্রেস ‘ভারত ত্যাগ কর আন্দোলন’ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। পাকিস্তান আন্দোলনকেও শহীদ সাহেব এবং হাশিম সাহেব জনগণের আন্দোলনে পরিণত করতে পেরেছিলেন। ইংরেজের সাথেও আমাদের লড়তে হবে, এই শিক্ষাও হাশিম সাহবে আমাদের দিচ্ছিলেন। আমাদেরও ইংরেজের বিরুদ্ধে একটা জাত ক্রোধ ছিল। হিটলারের ফ্যাসিস্ট নীতি আমরা সমর্থন করতাম না, তথাপি যেন ইংরেজের পরাজিত হওয়ার খবর পেলেই একটু আনন্দ লাগত। এই সময় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে ভারতবর্ষের হিন্দু ও মুসলমান সৈন্যদের দলে নিয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছেন। মনে হত, ইংরেজের থেকে জাপানই বোধহয় আমাদের আপন। আবার ভাবতাম, ইংরেজ যেয়ে জাপান আসলে স্বাধীনতা কোনোদিনই দিবে না। জাপানের চীন আক্রমণ আমাদের ব্যাথাই দিয়েছিল। মাঝে মাঝে সিঙ্গাপুর থেকে সুভাষ বাবুর বক্তৃতা শুনে চঞ্চল হয়ে উঠতাম। মনে হয়ত, সুভাষ বাবু একবার বাংলাদেশে আসতে পারলে ইংরজেকে তাড়ান সহজ হবে। আবার মনে হয়ত, সুভাষ বাবু আসলে তো পাকিস্তান হবে না। পাকিস্তান না হলে দশ কোটি
৩৬
মুসলমানের কি হবে? আবার মনে হত, যে নেতা দেশ ত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারেন তিনি কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারেন না। মনে মনে সুভাষ বাবুকে তাই শ্রদ্ধা করতাম।
অখণ্ড ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না এটা আমি মনে প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিন্দু নেতারা ক্ষেপে গেছেন কেন? ভারতবর্ষেও মুসলমান থাকবে এবং পাকিস্তানেও হিন্দুরা থাকবে। সকলেই সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের হিন্দুরাও স্বাধীন নাগরিক হিসাবে বাস করবে। ভারতবর্ষের মুসলমানরাও সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের মুসলমানরা যেমন হিন্দুদের ভাই হিসাবে গ্রহণ করবে, ভারতবর্ষের হিন্দুরাও মুসলমানদের ভাই হিসাবে গ্রহণ করবে। এই সময় আমাদের বক্তৃতার ধারাও বদলে গেছে। অনেক সময় হিন্দু বন্ধুদের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা এ নিয়ে আলোচনা হত। কিছুতেই তারা বুঝতে চাইত না। ১৯৪৪-৪৫ সালে ট্রেনে, স্টিমারে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে তুমুল তর্ক-বিতর্ক হত। সময় সময় এমন পর্যায়ে আসত যে, মুখ থেকে হাতের ব্যবহার হবার উপক্রম হয়ে উঠত। এখন আর মুসলমান ছেলেদের মধ্যে মতবিরোধ নাই। পাকিস্তান আনতে হবে এই একটাই স্লোগান সকল জায়গায়।
একদিন হক সাহেব আমাদের ইসলামিয়া কলেজের কয়েকজন ছাত্র প্রতিনিধিকে খাওয়ার দাওয়াত করলেন। দাওয়াত নিব কি নিব না এই নিয়ে দুই দল হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, ‘কেন যাব না, নিশ্চয়ই যাব। হক সাহেবকে অনুরোধ করব মুসলিম লীগের ফিরে আসতে। আমাদের আদর্শ যদি এত হালকা হয় যে, তাঁর কাছে গেলেই আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলে যাব, তাহলে সে পাকিস্তান আন্দোলন আমাদের না করাই উচিত’। আমি খুলনার একরামুল হককে সাথে নিলাম, যদিও সে ইসলামিয়ায় পড়ে না। তথাপি তার একটা প্রভাব আছে। আমাকে সে মিয়াভাই বলত। আমরা ছয়-সাতজন গিয়েছিলাম। শেরে বাংলা আমাদের নিয়ে খেতে বসলেন এবং বললেন, ‘আমি কি লীগ ত্যাগ করেছি? না, আমাকে বের করে দেয়া হয়েছে? জিন্নাহ সাহেব আমাকে ও আমার জনপ্রিয়তাকে সহ্য করতে পারেন না। আমি বাঙালি মুসলমানদের জন্য যা করেছি জিন্নাহ সাহেব সারা জীবনে তা করতে পারবেন না। বাঙালিদের স্থান কোথাও নাই, আমাকে বাদ দিয়ে নাজিমুদ্দীনকে নেতা করার ষড়যন্ত্র’। আমরাও আমাদের মতামত বললাম। একরামুল হক বলল, ‘স্যার, আপনি মুসলিম লীগে থাকলে আর পাকিস্তান সমর্থন করলে আমরা বাংলার ছাত্ররা আপনার সাথে না থেকে অন্য কারও সাথে থাকতে পারি না’। ‘পাকিস্তান’ না হলে মুসলমানদের কি হবে?’ শেরে বাংলা বলেছিলেন, ‘১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব কে করেছিল, আমিই তো করেছিলাম! জিন্নাহকে চিনত কে ?’ আমরা তাঁকে আবার অনুরোধ করে সালাম করে চলে আসলাম। আরও অনেক আলাপ হয়েছিল, আমার ঠিক মনে নাই। তবে যেটুকু মনে আছে সেটুকু বললাম। তাঁর সঙ্গে স্কুল জীবনে একবার ১৯৩৮ সালে দেখা হয়েছিল ও সামান্য কথা হয়েছিল গোপালগঞ্জে। আজ শেরে বাংলার সামনে বসে আলাপ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
৩৭
এদিকে মুসলিম লীগ অফিসে ও শহীদ সাহেবের কানে পৌঁছে গিয়েছে আমরা শেরে বাংলার বাড়িতে যাওয়া-আসা করি। তাঁর দলে চলে যেতে পারি। কয়েকদিন পড়ে যখন আমি শহীদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাই তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘কি হে, আজকাল খুব হক সাহেবের বাড়িতে যাও, খানাপিনা কর?’বললাম, ‘একবার ফিয়েছি জীবনে’। তাঁকে সমস্ত ঘটনা বললাম। তিনি বললেন, ‘ভালই করছ, তিনি যখন ডেকেছেন কেন যাবে না?’ আরও বললাম, ‘আমরা তাঁকে অনুরোধ করেছি মুসলিম লীগে আসতে’। শহীদ সাহেব বললেন, ‘ভালই তো হত যদি তিনি আসতেন। কিন্ত আসবেন না, আর আসতে দিবেও না’। তাঁর সাথে কয়েকজন লোক আছে, তিনি আসলে সেই লোকগুলির জায়গা হবে না কোথাও। তাই তাঁকে মুসলিম লীগের বাইরে রাখতে চেষ্টা করছে’।
শহীদ সাহেব ছিলনে উদার, কোন সংকীর্ণতার স্থান ছিল না তাঁর কাছে। কিন্ত অন্য নেতারা কয়েকদিন খুব হাসি তামাশা করেছেন আমাদের সাথে। আমি খুব রাগী ও একগুঁয়ে ছিলাম, কিছু বললে কড়া কথা বলে দিতাম। কারও বেশি ধার ধারতাম না। আমাকে যে কাজ দেওয়া হত আমি নিষ্টার সাথে সে কাজ করতাম। কোনোদিন ফাঁকি দিতাম না। ভীষণভাবে পরিশ্রম করতে পারতাম। সেইজন্য আমি কড়া কথা বললেও কেউ আমাকে কিছুই বলত না। ছাত্রদের আপদে-বিপদে আমি তাদের পাশে দাঁড়াতাম। কোন ছাত্রের কি অসুবিধা হচ্ছে, কোন ছাত্র হোস্টেলে জায়গা পায় না, কার ফ্রি সিট দরকার, আমাকে বললেই প্রিন্সিপাল ড. জুবেরী সাহেবের কাছে হাজির হতাম। আমি অন্যায় আবদার করতাম না। তাই শিক্ষকরা আমার কথা শুনতেন। ছাত্ররাও আমাকে ভালবাসত। হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট সাইদুর রহমান সাহেব জানতেন, আমার অনেক অতিথি আসত। বিভিন্ন জেলার ছাত্রনেতারা আসলে কোথায় রাখব, একজন না একজন ছাত্র আমার সিটে থাকতই। কারণ, সিট না পাওয়া পর্যন্ত আমার রুমই তাদের জন্য ফ্রি রুম। একদিন বললাম, ‘স্যার, কোনো ছাত্র রোগগ্রস্ত হলে যে কামরায় থাকে, সেই কামরাটা আমাকে দিয়ে দেন। সেটা অনেক বড় কামরা দশ-পনেরজন লোক থাকতে পারে’। বড় কামরাটায় একটা বিজলি পাখাও ছিল। নিজের কামরাটা তো থাকলই। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, দখল করে নাও। কোনো ছাত্র যেন নালিশ না করে’। বললাম, ‘কেউই কিছু বলবে না। দু’একজন আমার বিরুদ্ধে থাকলেও সাহস পাবে না’।
বেকার হোস্টেলে কতগুলি ফ্রি রুম ছিল, গরিব ছাত্রদের জন্য। তখনকার দিনে সত্যিকার যার প্রয়োজন তকেই তা দেওয়া হত। আজকালকার মত টেলিফোনে দলীয় ছাত্রদের রুম দেওয়ার জন্য অনুরোধ আসত না। ইসলামিয়া কলেজে গরিব ছেলেদের সাহায্য করবার জন্য একটা ফান্ড ছিল। সেই ফান্ড দেখাশোনা করার ভার ছিল বিজ্ঞানের শিক্ষক নারায়ণ বাবুর। আমি আর্টসের ছাত্র ছিলাম, তবু নারায়ণ বাবু আমাকে খুব ভালবাসতেন। তিনি যদিও জানতেন, আমি প্রায় সকল সময়ই ‘পাকিস্তান’,‘পাকিস্তআন’ করে বেড়াই। ইসলামিয়া কলেজের সকল ছাত্রই মুসলমান। একজন হিন্দু শিক্ষককে সকলে এই কাজের ভার দিত কেন? কারণ, তিনি সত্যিকারের একজন শিক্ষক ছিলেন। হিন্দুও
৩৮
না মুসলমানও না। যে টাকা ছাত্রদের কাছ থেকে উঠত এবং সরকার যা দিত, তা ছাড়াও তিনি অনেক দানশীল হিন্দু-মুসলমানদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে জমা করতেন এবং ছাত্রদের সাহায্য করতেন। এই রকম সহানুভূতিপরায়ণ শিক্ষক আমার চোখে খুব কমই পড়েছে।
এই সময় আমি বাধ্য হয়ে কিছুদিনের জন্য ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পদে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত হই। অনেক চেষ্টা করেও দুই গ্রুপের মধ্যে আপোস করতে পারলাম না। দুই গ্রুপই অনুরোধ করল, আমাকে সাধারণ সম্পাদক হতে, নতুবা তাদের ইলেকশন করতে দেওয়া হোক। পূর্বের দুই বৎসর নির্বাচন বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় করেছি। ইলেকশন আবার শুরু হলে আর বন্ধ করা যাবে না। মিছামিছি গোলমাল, লেখাপড়া নষ্ট, টাকা খরচ হতে থাকবে। আমি বাধ্য হয়ে রাজি হলাম এবং বলে দিলাম তিন মাসের বেশি আমি থাকব না। কারণ, পাকিস্তান ইস্যুর ওপর ইলেকশন আসছে, আমাকে বাইরে কাজ করতে হবে। কলেজে আসতেও সময় পাব না। আমি তিন মাসের মধ্যেই পদত্যাগপত্র দিয়ে আরেকজনকে সাধারণ সম্পাদক করে দিই।
১৯৪৫ সালের গোড়ার থেকেই ইলেকশনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ইলেকশন হবে, সমস্ত ভারতবর্ষব্যাপী মুসলমানরা ‘পাকিস্তান’ চায় কি চায় না তা নির্ধারন করতে। কারণ, কংগ্রেস দাবী করে যে, তারা হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন। নজির হিসাবে তারা বলেন, মওলানা আবুল কালাম আজাদ কংগ্রেসের সভাপতি। একথা সত্য যে, কয়েকজন খ্যাতনামা মুসলমান নেতা তখন পর্যন্ত কংগ্রেসে ছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল যে, ভারতবর্ষ এক থাকলে দশ কোটি মুসলমানের উপর হিন্দুরা অত্যাচার করতে সাহস পাবে না। তাছাড়া কতগুলি প্রদেশে মুসলমান সংখ্যাগুরু আছে। আর যদি পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান দুইটা রাষ্ট্র হয়, তবে হিন্দুস্থানে যে সমস্ত মুসলমানরা থাকবে তাদের অস্ত্বিত্ব থাকবে না। অন্যদিকে মুসলিম লীগের বক্তব্য পরিষ্কার, পাকিস্তানের হিন্দুরাও সমান নাগরিক অধিকার পাবে। আর হিন্দুস্থানের মুসলমানরা সমান নাগরিক অধিকার পাবে। লাহোর প্রস্তাবে একথা পরিষ্কার করে লেখা আছে।
লাহোর প্রস্তাবঃ ২৩ মার্চ ১৯৪০
1. While approving and endorsing the action taken by the Council and the Working Committee of the All-India Muslim League as indicated in their resolutions dated the 27th of August, 17th& 18th of September and 22nd of October 1939, and 3rd of February 1940 on the constitutional issue, this session of the All-India Muslim League emphatically reiterates that the scheme of Federation embodied in the Government of India Act, 1935 is totally unsuited to and unworkable in the peculiar conditions of this country and is altogether unacceptable to Muslims of India.

2. It further records its emphatic view that while the declaration dated the 18th of October 1939, made by the Viceroy on behalf of His Majesty’s Government is reassuring is so far as it declares that the policy and plan on which the Government of India Act 1935, is based will be reconsidered in consultation with the various parties, interest and communities in India, Muslims India will not be satisfied unless the whole constitutional plan is reconsidered de novo, and that no revised plan would be acceptable to the Muslims unless it is framed with their approval and consent.

3. Resolved that it is the considered view of this session of the All-India Muslim League that no constitutional plan would be workable in the country or acceptable to the Muslims unless it is designed on the following basic principles, viz, that geographically contiguous units are demarcated into regions which should be so constituted with such territorial readjustments as may be necessary that the areas in which the Muslims are numerically in a majority as in the north-western and eastern zones of India should be grouped to constitute ‘Independent states’ in which the constituent units shall be autonomous and sovereign.

4. That adequate, effective and mandatory safeguards should be specifically provided in the constitution for the minorities in the units and in the regions for the protection of their religious, cultural, economic, political, administrative and other rights and interests in consultation with them.

5. This session further authorises the Working Committee to frame a scheme of constitution is accordance with these basic principles, providing for the assumption finally by the respective region of all powers such as defence, extreme, external affairs, communications, customs and such others matters as may be necessary.

দৈনিক আজাদই ছিল একমাত্র বাংলা খবরের কাগজ, যা মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করত। এই কাগজের প্রতিষ্টাতা ও মালিক মওলানা আকরম খাঁ সাহেব ছিলেন বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি। তিনি আবুল হাশিম সাহেবকে দেখতে পারতেন না। আবুল হশিম সাহেবকে শহীদ সাহেব সমর্থন করতেন বলে মওলানা সাহেব তাঁর উপর ক্ষেপে গিয়েছিলেন। আমাদেরও ঐ একই দশা। তাই আমাদের কোনো সংবাদ ছাপা হত না। মাঝে মাঝে জনাব মোহাম্মদ মোদাব্বের সাহেবের মারফতে কিছু সংবাদ উঠত। পড়ে সিরাজুদ্দিন হোসেন (বর্তমানে দৈনিক ইত্তেফাক-এর বার্তা সম্পাদক) এবং আরও দু’একজন বন্ধু আজাদ অফিসে চাকরি করত। তারা ফাঁকে ফাঁকে দুই একটা সংবাদ ছাপাত। দৈনিক মর্নিং নিউজের কথা বাদই দিলাম। ঐ পত্রিকা যদিও পাকিস্তান আন্দোলনকে পুরাপুরি সমর্থন করত, তবুও ওটা একটি গোষ্টীর সম্পত্তি ছিল, যাদের শোষক শ্রেণী বলা যায়। আমাদের সংবাদ দিতেই চাইত না। ঐ পত্রিকা হাশিম সাহেবকে মোটেই পছন্দ করত না। ছাত্র ও লীগ কর্মীরা হাশিম সাহেবকে সমর্থন করত, তাই বাধ্য হয়ে মাঝে মাঝে সংবাদ দিত। আমরা বুঝতে পারলাম, অন্ততপক্ষে একটা সাপ্তাহিক খবরের কাগজ হলেও আমাদের বের করতে হবে, বিশেষকরেকর্মীদেরমধ্যে নতুন ভাবধারার প্রচার করার জন্য। হাশিম সাহেবের পক্ষে কাগজ বের করা কষ্টকর। কারণ টাকা পয়সার অভাব। শহীদ সাহেব হাইকোর্টে ওকালতি করতে শুরু করেছেন। তিনি যথেষ্ট উপার্জন করতেন, ভাল ব্য্যরিস্টার হিসাবে কলকাতায় নামও ছিল। কলকাতায় গরিবরাও যেমন শহীদ সাহেবকে ভালবাসতেন, মুসলমান ধনীক শ্রেণীকেও শহীদ সাহেব যা বলতেন, শুনত। টাকা পয়সার দরকার হলে কোনোদিন অসুবিধা হতে দেখি নাই। হাশিম সাহেব শহীদ সাহেবের কাছে প্রস্তাব করলেন কাগজটা প্রকাশ করতে এবং বললেন যে, একবার যে খরচ লাগে তা পেলে পরেআর জোগাড় করতে অসুবিধা হবে না। নুরুদ্দিন ও আমি এই দুইজনই শহীদ সাহেবকে রাজি করতে পারব, এই ধারণা অনেকেরই ছিল।

আমরা দুইজন একদিন সময় ঠিক করে তাঁর সাথে দেখা করতে যাই এবং বুঝিয়ে বলি বেশি টাকা লাগবে না, কারণ সাপ্তাহিক কাগজ। আমাদের মধ্যে ভাল ভাল লেখার হাত আছে, যারা সামান্য খরচ পেলেই কাজ করবে। অনেককে কিছু না দিলেও চলবে। আরও দু’একবার দেখা করার পরে শহীদ সাহেব রাজি হলেন।

মুসলিম লীগ অফিসের নিচের তলায় অনেক খালি ঘর ছিল। তাই জায়গার অসুবিধা হবে না। হাশিম সাহেব নিজেই সম্পাদক হলেন এবং কাগজ বের হল। আমরা অনেক কর্মীই রাস্তায় হকারী করে কাগজ বিক্রি করতে শুরু করলাম। কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস সাহেবই কাগজের লেখাপড়ার ভার নিলেন। সাংবাদিক হিসাবে তাঁর যথেষ্ট নাম ছিল। ব্যবহারও অমায়িক ছিল। সমস্ত বাংলাদেশেই আমাদের প্রতিনিধি ছিল। তারা কাগজ চালাতে শুরু করল। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে কাগজটা খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করতে লাগল। হিন্দুদের মধ্যেও অনেকে কাগজটা পড়তেন। এর নাম ছিল ‘মিল্লাত’।

৪১
হাশিম সাহেবের গ্রুপকে অন্য দল কমিউনিস্ট বলতে শুরু করল, কিন্ত হাশিম সাহেব ছিলেন মওলানা আজাদ সোবহানীর একজন ভক্ত। তিনি বিখ্যাত ফিলোসফার ছিলেন। মওলানা আজাদ সোবহানী সাহেবকে হাশিম সাহেব আমন্ত্রণ করে এনেছিলেন কলকাতায়। আমাদের নিয়ে তিনি ক্লাস করেছিলেন। আমার সহকর্মীরা অধিক রাত পর্যন্ত তাঁর আলোচনা শুনতেন। আমার পক্ষে ধৈর্য ধরে বসে থাকা কষ্টকর। কিছু সময় যোগদান করেই ভাগতাম। আমি আমার বন্ধুদের বলতাম, ‘তোমরা পণ্ডিত হও, আমার অনেক কাজ। আগে পাকিস্তান আনতে দাও, তারপরে বসে বসে আলোচনা করা যাবে’। হাশিম সাহেব তখন চোখে খুব কম দেখতেন বলে রক্ষা। আমি পিছন থেকে ভাগতাম, তিনি কিন্ত বুঝতে পারতেন! পরের দিন দেখা করতে গেলেই জিজ্ঞাসা করতেন, ‘কি হে, তুমি তো গতরাতে চলে গিয়েছিলে’। আমি উত্তর দিতাম, ‘ কি করব, অনেক কাজ ছিল’। কাজ তো থাকতই ছাত্রদের সাথে, দল তো ঠিক রাখতে হবে।

ইলেকশনের দিন ঘোষণা হয়ে গেছে। মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন হবে। কাউন্সিল সভা ডাকা হল, কলকাতা মুসলিম ইন্সটিটিউটে। মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ডে নয়জন সদস্য থাকবে। তার মধ্যে দুইজন এক্স-অফিসিও, আর মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি থেকে একজন, আর একজন এমএলএদের মধ্য থেকে, বাকি পাঁচজনকে কাউন্সিল নির্বাচিত করবে। পূর্বের থেকেই দলে দুই গ্রুপ হয়ে গেছে। তথাপি পাকিস্তান ইস্যুর ওপর নির্বাচন, এ সময় গোলমাল না হওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। আমরা ভালভাবেই বুঝতাম, চারজনের মধ্যে একজন প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি যথা মওলানা আকরম খাঁ সাহেব, একজন মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির হিসাবে খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব, আর পার্লামেন্টারি পার্টি একজন প্রতিনিধি দিবেন এবং একজন আপার হাউজের মুসলিম লীগ গ্রুপ থেকে নির্বাচিত হবে। নাজিমুদ্দীন সাহেব পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা ছিলেন, এমএলএ ও এমএলসিরা১৪তাঁরই ভক্ত বেশি ছিল। শহীদ সাহেব ডেপুটি লিডার হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে প্রতিনিধি না করে নাজিমুদ্দীন সাহেব ফজলুর রহমান সাহেবকে পাঠালেন। শহীদ সাহেবকে বললেন, আপনাকে নির্বাচিত করে লাভ কি? আপনি তো কাউন্সিল থেকে ইলেকশন করে বোর্ডের মেম্বার হতে পারবেন। ফজলুর রহমান সাহেব পারবেন না, তাই তাঁকেই সদস্য করলাম। আপার হাউস মুসলিম লীগ গ্রুপ থেকে বোধহয় নূরুল আমিন সাহেবকে নিলেন। এইভাবে নয়জনের মধ্যে চারজন তাঁর দলেরই হয়ে গেল। যেভাবেই হোক আর একজনকে তিনি ইলেকশনের মাধ্যমে পার করে নিতে পারবেন। এতেই গোলমাল শুরু হয়ে গেল। আমরা প্রতিবাদ করলাম এবং বললাম, শহীদ সাহেবকে এমএলএদের পক্ষ থেকে কেন নেওয়া হবে না? তাঁকে অপমান করা হয়েছে। কারণ, তিনি ডেপুটি লিডার মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির। এটা একটা ষড়যন্ত্র! শহীদ সাহেব আমাদের
৪২
বোঝাতে চেষ্টা করলেন, ‘ঠিক আছে, এতে কি হবে!’ আমরা বললাম, ‘আপনি আর উদারতা দেখাবেন না। নাজিমুদ্দীন সাহেবের মনে রাখা উচিত ছিল যে, তিনি আজ মুসলিম লীগ পার্টির নেতা ও এমএলএ হয়েছেন একমাত্র আপনার জন্য। পটুয়াখালীতে শেরে বাংলা তাঁকে পরাজিত করে রাজনীতি থেকে বিদায় দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের কোনো জেলা থেকেই তিনি হক সাহেবের সাথে ইলেকশন করে জিততে পারতেন না, যদি না আপনি তাঁকে আপনার একটা সিট থেকে পদত্যাগ করে পাস করিয়ে নিতেন। তাও আবার কলকাতা না হলে আপনিও পারতেন না।
শহীদ সাহেব ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কলকাতা থেকে দুইটা সিটে এমএলএ হন। নাজিমুদ্দীন সাহেব পটুয়াখালী থেকে পরাজিত হয়ে ফিরে আসলেন। তাঁর রাজনীতি থেকে সরে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না। শহীদ সাহেব হক সাহেবকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বললেন, আমি নাজিমুদ্দীন সাহেবকে কলকাতা থেকে বাই ইলেকশনে পাস করিয়ে নেব। যদি হক সাহেব পারেন, তাঁর প্রতিনিধি দিয়ে মোকাবেলা করাতে পারেন। হক সাহেবও লোক দাঁড় করিয়েছিলেন নাজিমুদ্দীন সাহেবের বিরুদ্ধে। নাজিমুদ্দীন সাহেবই শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করলেন, শহীদ সাহেবের দয়ায়। সেই নাজিমুদ্দীন সাহেব শহীদ সাহেবকে অপমানই করলেন। যাহোক, আমাদের পক্ষ থেকে পাঁচজনই আমরা কাউন্সিলে দাঁড় করাব, নাজিমুদ্দীন সাহেবের দলের কাউকেও হতে দেব না। কারণ, আমাদের ভরসা ছিল কাউন্সিলে শহীদ সাহেব সংখ্যাগুরু।
মওলানা আকরম খাঁ সাহেব একটা আপোস করার চেষ্টা করলেন। মওলানা সাহেবের বাড়িতে শহীদ সাহেব ও মওলানা সাহেবের আলোচনা হল। শহীদ সাহেব নরম হয়ে গেছেন দেখলাম। তিনি বললেন, ‘এখন পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম, গোলমাল করে কি হবে, একটা আপোস হওয়াই ভাল’। আমরা বললাম, চারজনের মধ্যে দুইজন তো নাজিমুদ্দীন সাহেবের ছিলেন, তিনি নিজে ও মওলানা সাহেব। কেন আর দুইজনের মধ্যে একজন আপনার গ্রুপ থেকে দিলেন না, আপনাকে না দিত। আমরা বললাম, কিছুতেই হবে না।
দিন তারিখ আমার মনে নাই, তবে ঘটনাটা মনে আছে। বিকালে কলকাতা এসেম্বলি পার্টি রুমে এমএলএ, এমএলসি ও লীগ নেতাদের বৈঠক হবে, সেখানে আপোস হবে। আমরাও খবর পেলাম। বেকার হোস্টেল ও অন্যান্য হোস্টেলে খবর দিয়ে দুই তিনশত ছাত্র নিয়ে আমিও উপস্থিত হলাম। দরজা বন্ধ করে সভা হচ্ছিল। আমি দরজায় যেয়ে বললা, ‘আমাদের কথা আছে, শুনতে হবে। শেষ পর্যন্ত নেতারা রাজি হলেন। দরজাগুলি খুলে দিলেন। ছাত্ররা ভিতরে বসল। আমিই প্রথম বক্তা, প্রায় আধা ঘন্টা বক্তৃতা করলাম এবং শহীদ সাহেবকে বললাম, ‘আপোস করার কোনো অধিকার আপনার নাই। আমরা খাজাদের সাথে আপোস করব না। কারণ, ১৯৪২ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে নিজের ভাইকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। আবার তার বংশের থেকে এগারজনকে এমএলএ বানিয়েছিলেন। এদেশে তারা ছাড়া আর লোক ছিল না? মুসলিম লীগে কোটারি করতে আমরা দিব না। আমরাই হক সাহেবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি, দরকার হয় আপনাদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করব’। শহীদ সাহেবকে বাধ্য করে সভা থেকে উঠিয়ে নিয়ে চলে এসেছিলাম।

৪৩
আমার পরে ফজলুল কাদের চৌধুরী ও ফরিদপুরের লাল মিয়া সাহেবও আমাকে সমর্থন করে বক্তৃতা করেন। রাতে আমাদের সভা হল। আমরা প্রায় রাতভরই শহীদ সাহেবের সাথে রইলাম। শহীদ সাহেবের কাছে জনাব নাজিমুদ্দীন সাহেব জানতে চেয়েছেন, আপোস হবে কি না তাকে জানাতে। তিনি শহীদ সাহেবকে ফোনের মাধ্যমে অনুরোধ করলেন, আমরা বুঝতে পারলাম। শহীদ সাহেব বললেন, ‘যা হয় আগামীকাল সকাল নয়টার মধ্যে জানিয়ে দিব’। আমাদের সকাল আটটার মধ্যে তাঁর বাসায় আসতে বলে দিলেন। এই সময় নূরুদ্দিন, একরাম, নূরুল আলম, শরফুদ্দিন, জহির, আমরা প্রায় সকল সময় একসাথেই থাকি; ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেবও দলবল নিয়ে কলকাতায়ই ছিলেন। চট্টগ্রামের ছাত্রদের মধ্যে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন।
আমরা সকালে শহীদ সাহেবের বাড়িতে যথাসময়ে হাজির হলাম। তিনি রাতে অনেকের সাথে আলাপ করেছিলেন। তিনি আমাদের নিয়ে বসলেন, আমি তাঁর কাছেই বসলাম। শহীদ সাহেব বললেন, ‘বুঝতে পারছি না তোমরা পাঁচটা সিটই দখল করতে পারবে কি না?’ আমি বললাম, ‘স্যার, বিশ্বাস করেন আমরা নিশ্চয়ই জিতব, খোদার মর্জি থাকলে আমাদের পরাজিত হবার কোনো কারণ নাই’। আমি টেলিফোন তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বললাম, ‘বলে দেন খাজা সাহেবকে ইলেকশন হবে’। শহীদ সাহেব নাজিমুদ্দীন সাহেবকে টেলিফোন করে বললেন, ‘ইলেকশনই হবে। যাই হোক না কেন, ইলেকশনের মাধ্যমেই হবে। সকলেই তো মুসলিম লীগার, আমরা কেন উপরের থেকে চাপাতে যাব’। নাজিমুদ্দীন সাহেব কি যেন বললেন। শহীদ সাহেব বললেন, ‘আর হয় না। আপনারা ভাল ব্যবহার করেন নাই’।
আমরা বিদায় নিয়ে চলে এলাম। রাতে জেলা প্রতিনিধিরা লীগ অফিসে আসলেন। একজনের কথা আমার বিশেষভাবে মনে আছে, তিনি হলেন নোয়াখালী জেলা মুসলিম লীগের সেক্রেটারি মুজিবুর রহমান মোক্তার সাহেব। তিনি জেলার নেতাদের কাছে একটা চমৎকার বক্তৃতা করেন। সমস্ত নোয়াখালী জেলা শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিল।
হাশিম সাহেবের নেতৃত্বে আমাদের অফিস ভালভাবে চলছিল। আমরা শিয়ালদহে ও হাওড়ায় লোক রাখলাম- কাউন্সিলারদের অভ্যর্থনার জন্য, থাকার জায়গারও বন্দোবস্ত করলাম। ছাত্রকর্মীরা কলেজ হোস্টেল ছেড়ে বের হয়ে পড়েছে, যার যার জেলার কাউন্সিলারদের সাথে দেখা করার জন্য। দুই দিন পর্যন্ত রাতদিন ভীষণভাবে কাজ চলল। মওলানা রাগীব আহসান ও জনাব ওসমান সাহেব ছিলেন কলকাতা মুসলিম লীগের নেতা। কলকাতা মুসলিম লীগের সকলেই শহীদ সাহেবের ভক্ত। তারাও গাড়ি ও কর্মী নিয়ে প্রচারে নেমে পড়ল। সভার দিন দেখা গেল, শত শত কর্মীরা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ক্যানভাস করতে লাগল। মাঝে মাঝে ‘শহীদ সোহররাওয়ারদী জিন্দাবাদ’, ‘আবুল কাশেম জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিচ্ছিল।
শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব পরামর্শ করে পাঁচজনের নাম ঠিক করলেনঃ ১. হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদী, ২. আবুল হাশিম, ৩. মওলানা রাগীব আহসান, ৪. আহমদ হোসেন
৪৪
এবং ৫. লাল মিয়া আমাদের পক্ষের, অন্য পক্ষ থেকে নাজিমুদ্দীন সাহেবও পাঁচজনের নাম দিলেন। এই সময় ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য হবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন ও ভীষণ ক্যানভাস শুরু করেন। আমিও তাঁর জন্য তদ্বির করেছিলাম। শহীদ সাহেবও প্রায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। লাল মিয়াকে বাদ দিয়ে ফজলুল কাদের চৌধুরীকে নেওয়া হবে, তখনও ফাইনাল হয় নাই। এই অবস্থায় রাতে ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব নাজিমুদ্দীন সাহেবের সাথে দেখা করলেন এবং তাঁকে নমিনেশন দিলে তিনি চট্টগ্রাম গ্রুপ নিয়ে তাঁর দলে যোগদান করবেন বলে প্রস্তাব দিলেন। শহীদ সাহেব রাতেই খবর পেলেন এবং বললেন, ‘কিছুতেই ওকে নমিনেশন দেওয়া হবে না, কারণ এই বয়সেই ওর এত লোভ’। ওদিকে নাজিমুদ্দীন সাহেবও তাঁকে তাঁর দল থেকে নমিনেশন দিতে রাজি হলেন না। শেষ পর্যন্ত চৌধুরী সাহেব শহীদ সাহেবের দলকেই ভোট দিলেন। তাঁর দলের সকলেই শহীদ সাহেবের ভক্ত। এম.এ.আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, আবুল খায়ের সিদ্দিকী, আজিজুর রহমান চৌধুরী সকলেই শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিলেন। চৌধুরী সাহেবের এই ব্যবহারে তারাও কিছুটা মনোক্ষুন্নই হয়েছিলেন। এরা সবাই ছিলেন আমার ব্যক্তিগত বন্ধু।
কাউন্সিল সভা যখন শুরু হল, মওলানা আকরম খাঁ সাহেব কিছু সময় বক্তৃতা করলেন। তারপরই আবুল হাশেম সাহেব সেক্রেটারি হিসাবে বক্তৃতা দিতে উঠলেন। কিছু সময় বক্তৃতা দেওয়ার পরই নাজিমুদ্দীন সাহেবের দলের কয়েকজন তাঁর বক্তৃতার সময় গোলমাল করতে আরম্ভ করলেন। আমরাও তার প্রতিবাদ করলাম, সাথে সাথে গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেল। সমস্ত যুবক সদস্যই ছিল শহীদ সাহেবের দলে, আমাদের সাথে টিকবে কেমন করে! নাজিমুদ্দীন সাহেবকে কেউ কিছু বলল না। তবে তাঁর দলের সকলেরই কিছু কিছু মারপিট কপালে জুটেছিল। আমি ও আমার বন্ধু আজিজ সাহেব দেখলাম, শাহ আজিজুর রহমান সাহেব ছাত্রলীগের ফাইল নিয়ে নাজিমুদ্দীন সাহেবের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ও আজিজ পরামর্শ করছি শাহ সাহেবের কাছ থেকে এই খাতাগুলি কেড়ে নিতে হবে, আমাদের ছাত্রলীগের কাজে সাহায্য হবে। নাজিমুদ্দীন সাহেব যখন চলে যাচ্ছিলেন, শাহ সাহেবও রওয়ানা করলেন, আজিজ তাঁকে ধরে ফেলল। আমি খাতাগুলি কেড়ে নিয়ে বললাম, কথা বলবেন না, চলে যাবেন। আজকাল শাহ সাহেবের সাথে কথা হয় ও দেখা হয় তখন সেই কথা মনে করে হাসাহাসি করি। শাহ সাহেব ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং ন্যাশনাল এসেম্বলিতে আওয়ামী লীগ পার্টির নেতা এবং বিরোধী দলের ডেপুটি লিডার হন। তাঁর সাথে আমার মতবিরোধ ১৯৫৮ সালের মার্শাল ল’ জারি হওয়া পর্যন্ত চলে।
মওলানা সাহেব পরের দিন পর্যন্ত সভা মুলতবি রাখলেন এবং দশটায় ভোটগ্রহণ শুরু হবে বলে ঘোষণা করলেন। ব্যালট করা হল। পাশের রুমে বাক্স রাখা হল। একজন পাঁচটা করে ভোট দিতে পারবে। আমি ভিতরের গেটে দাঁড়িয়ে ক্যানভাস করছিলাম, মওলানা সাহেবের কাছে কে যেন নালিশ করেছে। তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি ওখানে
৪৫
কি করছ ছোকরা?’ আমি বললাম, ‘আমিও একজন সদস্য, ছোকরা না’। মওলানা সাহেব হেসে চলে গেলেন।
সন্ধ্যা পর্যন্ত ভোট গণনা হয়ে গেল। শহীদ সাহেবের দলের পাঁচজনই জিতলেন। আমি ফুলের মালা জোগাড় করেই রেখেছিলাম, আরও অনেকেই মালা জোগাড় করে রেখেছিল। আমি যখন শহীদ সাহেবের গলায় মালা দিলাম, শহীদ সাহেব আমাকে আদর করে বললেন, তুমি ঠিক বলেছিলে। লাল মিয়া সাহেবকে নিয়ে আমাদের ভয় ছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেককে অনুরোধ করেছিলাম, তাঁকে একটা ভোট দিতে। ফরিদপুর জেলার মাত্র সামান্য কয়েকটা ভোটই শহীদ সাহেবের দল পেয়েছিল। লাল মিয়া সাহেব, আমি ও আরও কয়েকজন ভোট দিয়েছি, আর সকল ভোটই তমিজুদ্দিন সাহেব, মোহন মিয়া ও সালাম সাহেবের নেতৃত্বে নাজিমুদ্দীন সাহেবের দল পেয়েছিল। লাল মিয়া সাহেবের জন্য দুই চারটা ভোট ফরিদপুর থেকে আমি জোগাড় করেছিলাম। লাল মিয়া সাহেব মোহন মিয়া সাহেবের সহোদর ভাই হলেও তিনি লাল মিয়ার সাথে প্রতিদ্বন্ধিতা করেছিলেন।
অন্য কথায় যাওয়ার পূর্বে আর একটা কথা না বললে অন্যায় হবে। লাল মিয়া সাহেব পার্লামেন্টারি বোর্ডের মেম্বার হওয়ার পরে ফরিদপুরের সদস্য নমিনেশনের সময় ভাইয়ের পক্ষ অবলম্বন করেন। আমাদের দলের লোককে নমিনেশন দিতে রাজি হন নাই। ফরিদপুরের ছয়টা সিটের মধ্যে অনেক ঝগড়া করে মাত্র দুইটা সিট আমরা পেয়েছিলাম। একটা রাজবাড়ীর খান বাহাদুর ইউসুফ হোসেন চৌধুরীর সিট, আরেকটা মাদারীপুরের ইস্কান্দার আলী সাহেবের। মোহন মিয়া নির্বাচনে দত্তপাড়ার শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী ওরফে বাদশা মিয়ার কাছে পরাজিত হন। বাদশা মিয়া ফল ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথেই ঘোষণা করলেন, আমার জয় মুসলিম লীগের জয় ও পাকিস্তানের জয়। লাল মিয়া ও মোহন মিয়া সকল সময়ই ভিন্ন দলে থাকতেন। প্রথমে লাল মিয়া সাহেব কংগ্রেস করতেন, মোহন মিয়া সাহেব মুসলিম লীগ করতেন। আবার মুসলিম লীগে যখন যোগদান করলেন, এক ভাই রইলেন শহীদ সাহেবের দলে, আরেক ভাই খাজা নাজিমুদ্দীনের দলে। আবার পাকিস্তান আমলে আইয়ুবের মার্শাল ‘ল আসলে, এক ভাই আইয়ুব খান সাহেবের দলে, আর এক ভাই বিরোধী দলে। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাঁদের ক্ষমতা ঠিকই থাকে। এই অপূর্ব খেলা আমরা দেখেছি জীবনভর! রাতেরবেলা দুই ভাই এক, নিজেদের স্বার্থের বেলায় মুহূর্তের মধ্যেই এক হয়ে যান।
এই সময় আমাদের উপর মুসলিম লীগ থেকে হুকুম হল, জেলায় জেলায় চলে গিয়ে ইলেকশন অফিসের ভার নিতে। প্রত্যেক জেলায় ও মহকুমায় ইলেকশন অফিস ও কর্মী শিবির খোলা হবে। জেলায় জেলায় ভাল ভাল কর্মীদের কর্মী শিবিরের চার্জ নিতে হবে।
৪৬
আমার কয়েকটা জেলার কথা মনে আছে। কামরুদ্দিন সাহেব ঢাকা জেলা, শামসুল হক সাহেব ময়মনসিংহ, খোন্দকার মোশতাক আহমদ কুমিল্লা, একরামুল হক খুলনা এবং আমাকে ফরিদপুর জেলার ভার দেওয়া হয়েছিল। আমরা রওয়ানা হয়ে চলে এলাম সাইকেল, মাইক্রোফোন, হর্ন, কাগজপত্র নিয়ে। জেলা লীগ আমাদের সাথে সহযোগিতা করবে। আমরা প্রত্যেক মহকুমায় ও থানায় একটা করে কর্মী শিবির খুলব। আমাকে কলেজ ছেড়ে চলে আসতে হল ফরিদপুরে। ফরিদপুর শহরে মিটিং করতে এসেছি মাঝে মাঝে, কিন্ত কোনদিন থাকি নাই। আমাকে ভার দেওয়ার জন্য মোহন মিয়া সাহেব ক্ষেপে যান। সকলকে সাবধান করে দেন, কেউ যেন আমাকে বাড়ি ভাড়া না দেয়। তিনি মুসলিম লীগের সভাপতি, কিন্ত আমাকে চান না। আমি আবদুল হামিদ চৌধুরী ও মোল্লা জালালউদ্দিনকে সকল কিছু দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। হামিদ ও জালাল ফরিদপুর কলেজে পড়ত, তাদেরও লেখাপড়া ছেড়ে আসতে হল। শহরের উপরে কেউই বাড়ি দিতে রাজি হল না। আমার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় শহর থেকে একটু দূরে তার একটা দোতলা বাড়ি ছিল, ভাড়া দিতে রাজি হল। বাধ্য হয়ে আমাকে সেখানে থাকতে হল। সেখানে আমরা অফিস খুললাম, কর্মীদের ট্রেনিং দেয়ার বন্দোবস্ত হল। সমস্ত জেলায় ঘুরতে শুরু করলাম। মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও রাজবাড়ীতে অফিস খুলে দিলাম, কাজ শুরু হল। থানায় থানায়ও অফিস করলাম। এই সময় মাঝে মাঝে আমাকে কলকাতায় যেতে হত। শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব কিছুদিন পূর্বে একবার গোপালগঞ্জ এসেছিলেন। বিরাট সভা করে গিয়েছিলেন। এই সময় সালাম সাহেবের দল শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেবকে সংবর্ধনা দিতে রাজি হয় নাই, কারণ আমার অনুরোধে তাঁরা এসেছিলেন। তাঁর দলবল প্রশ্ন করল, আমি মুসলিম লীগের একজন সদস্য মাত্র। অফিসিয়াল লীগের কেউই নই, এই নিয়ে ঝগড়া হয়ে গেল গোপালগঞ্জে। শহীদ সাহেব আসবেন, তাঁকে সংবর্ধনা দিব, যদি কেউ পারে যেন মোকাবেলা করে। আমি রাতে লোক পাঠিয়ে দিলাম। যেদিন দুপুরে শহীদ সাহেব আসবেন সেদিন সকালে কয়েক হাজার লোক সড়কি, বল্লম, দেশী অস্ত্র নিয়ে হাজির হল। সালাম সাহেবের লোকজনও এসেছিল। তিনি বাধা দেবার চেষ্টা করেন নাই। তবে, শহীদ সাহেব, হাশিম সাহেব ও লাল মিয়া সাহেবের বক্তৃতা হয়ে গেলে সালাম সাহেব যখন বক্তৃতা করতে উঠলেন তখন ‘সালাম সাহেব জিন্দাবাদ’ দিলেই আমাদের লোকেরা ‘মুর্দাবাদ’ দিয়ে উঠল। দুই পক্ষে গোলমাল শুরু হল। শেষ পর্যন্ত সালাম সাহেবের লোকেরা চলে গেল। আমাদের লোকেরা তাদের পিছে ধাওয়া করল। শহীদ সাহেব মিটিং ছেড়ে দুই পক্ষের ভিতর ঢুকে পড়লেন। তখন দুই পক্ষের হাতেই ঢাল, তলোয়ার রয়েছে। কতজন খুন হবে ঠিক নাই। শহীদ সাহেব দুই এইভাবে খালি হাতে দাঙ্গাকারী দুই দলের মধ্যে চলে আসতে পারেন দেখে সকলেই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। হাশিম সাহেব পূর্বেই আমার বাড়িতে চলে গেছেন। এই ঘটনার জন্য শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব সালাম সাহেবের উপর ক্ষেপে গিয়েছিলেন।
৪৭
আবার শহীদ সাহেব মাদারীপুর হয়ে গোপালগঞ্জ এলেন জনমত যাচাই করতে। অনেক লোক ইলেকশনে দাঁড়াতে চায়, কার বেশি জনপ্রিয়তা দেখতে হবে। পূর্বেকার এমএলএ খন্দকার শামসুদ্দীন আহমেদ সাহেবও মুসলিম লীগে চলে এসেছেন, পেনশনপ্রাপ্ত ডেপুটি পুলিশ কমিশনার খান বাহাদুর সামসুদ্দোহা, আবদুস সালাম খান সাহেব এবং আরও দুই একজন ছিলেন। সালাম সাহেব ব্যক্তিগতভাবে গোপালগঞ্জে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। শতকরা আশি ভাগ লোকই তাঁকে চায়। সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ ছিল না। আমার আব্বাকে শহীদ সাহেব জিজ্ঞাসা করলে আব্বা বলেছিলেন, সালাম সাহেবকে লোকে চায়। তবে সালাম সাহেব ও খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেব উভয়ই উপযুক্ত প্রার্থী। শহীদ সাহেব বললেন আমাকে, জনসাধারণ তো সালাম সাহেবকে চায়, তোমার আব্বাও তো তাকে সমর্থন করেন। আমি বললাম, যাকে লোকে চায়, তাকেই দিবেন, আমার কোনো আপত্তি নাই। এর পূর্বেই সালাম সাহেবের সাথেই আমার কথা হয়েছিল। কিন্ত হাশিম সাহেব কিছুতেই রাজি হলেন না। এর কারণ জানি না। শেষ পর্যন্ত আমিও হাশিম সাহেবকে বলেছিলাম, সালাম সাহেবকে নমিনেশন দিতে। সেজন্য আমার উপর রাগ করেছিলেন তিনি। শহীদ সাহেব রিপোর্ট দিলেন, সালাম সাহেবই সকলের চেয়ে জনপ্রিয়। তিনি সালাম সাহেবকে নমিনেশন দিতে প্রস্তাব করেছিলেন। লাল মিয়া ও হাশিম সাহেব বেকে বসলেন। এই সমউ কিছু টাকা পয়সার ছড়াছড়ি হচ্ছিল। আমি খবর পেতাম, যদিও চোখে দেখি নাই। শেষ পর্যন্ত খান বাহাদুর শামসুদ্দোহা সাহেবকে কেটে দিয়ে খন্দকার শামসুদ্দীন আহমেদকে নমিনেশন দিল। সালাম সাহেব ইলেকশন করলে বোধহয় নির্বাচিত হতে পারতেন, কিন্ত মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন করলেন না। কারণ পাকিস্তানের উপর ভোট। খন্দকার শামসুদ্দীন আহমেদও নমিনেশন পেতে পারেন না, কারণ মাত্র কয়েক মাস পূর্বে তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করেন। তিনি মুসলিম লীগের নমিনেশন পেলেন কারণ তাঁর চাচাতো ভাই খাজা শাহাবুদ্দীন সাহেবের মেয়েকে বিবাহ করেন। তাই নাজিমুদ্দীন সাহেব, চৌধুরী খালিকুজ্জামান সাহেবকে বলে নমিনেশন নিয়ে আসেন।
শহীদ সাহেব ছিলেন উদার, নীচতা ছিল না, দল মত দেখতেন না, কোটারি করতে জানতেন না, গ্রুপ করারও চেষ্টা করতেন না। উপযুক্ত হলেই তাকে পছন্দ করতেন এবং বিশ্বাস করতেন। কারণ, তাঁর আত্মবিশ্বাস ছিল অসীম। তাঁর সাধুতা, নীতি, কর্মশক্তি ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে চাইতেন। এজন্য তাঁকে বারবার অপমানিত ও পরাজয়বরণ করতে হয়েছে। উদারতা দরকার, কিন্ত নীচ অন্তঃকরণ ব্যক্তিদের সাথে উদারতা দেখালে ভবিষ্যতে ভালর থেকে মন্দই বেশি হয়, দেশের ও জনগণের ক্ষতি হয়।
আমাদের বাঙালিদের দুইটা দিক আছে। একটা হল ‘আমরা মুসলমান, আর একটা হল, আমরা বাঙালি’। পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যেই রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাঁকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন,
৪৮
সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্ত বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুন থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমু দুনিয়ায় খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়ছে নিজের দোষে। নিজেকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।
অনেক সময় দেখা গেছে, একজন অশিক্ষিত লোক লম্বা কাপড়, সুন্দর চেহারা, ভাল দাড়ি, সামান্য আরবি ফার্সি বলতে পারে, বাংলাদেশে এসে পীর হয়ে গেছে। বাঙালি হাজার হাজার টাকা তাকে দিয়েছে একটু দোয়া পাওয়ার লোভে। ভাল করে খবর নিয়ে দেখলে দেখা যাবে এ লোকটা কলকাতার কোন ফলের দোকানের কর্মচারী বা ডাকাতি বা খুনের মামলার আসামী। অন্ধ কুসংস্কার ও আলৌকিক বিশ্বাসও বাঙালির দুঃখের আর একটা কারণ।
বাঙালিরা শহীদ সাহেবকে প্রথম চিনতে পারে নাই। যখন চিনতে পারল, তখন আর সময় ছিল না। নির্বাচনের সব খরচ, প্রচার, সংগঠন তাঁকেই এককভাবে করতে হয়। টাকা বোধহয় সামান্য কিছু কেন্দ্রীয় লীগ দিয়েছিল, বাকি শহীদ সাহেবকেই জোগাড় করতে হয়েছিল। শত শত সাইকেল তাঁকেই কিনতে হয়েছিল। আমার জানা মতে পাকিস্তান হয়ে যাবার পরেও তাঁকে কলকাতায় বসে দেনা শোধ করতে হয়। আমি পূর্বেই বলেছি, শহীদ সাহেব সরল লোক ছিলেন। তিনি ধোঁকায় পড়ে গেলেন। পার্লামেন্টারি বোর্ডে তাঁর দল সংখ্যাগুরু থাকা সত্ত্বেও নিজের লোককে তিনি নমিনেশন দিতে পারলেন না। নাজিমুদ্দীন সাহেবের দল পরাজিত হওয়ার পরে তারা অন্য পন্থা অবলম্বন করলেন। ঘোষণা করলেন, তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করবেন না অর্থাৎ শহীদ সাহেবই দলের নেতা হবেন। তিনি শহীদ সাহেবকে অনুরোধ করলেন যারা পূর্ব থেকে মুসলিম লীগে আছে তাদের নমিনেশন দেওয়া হোক, কারণ এরা সকলেই শহীদ সাহেবকে সমর্থন করবেন। খাজা সাহেব যখন নির্বাচন করবেন না তখন আর ভয় কি? শহীদ সাহেব এই কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে পুরানা এমএলএ প্রায় সকলকেই নমিনেশন দিয়ে দেন। বোধহয় তখন বাংলাদেশে একশত উনিশটা সিট মুসলমানদের ছিল। এই চাতুর্যে প্রায় পঞ্চাশজন খাজা সাহেবের দলের লোক নমিনেশন পেয়ে গেল। আবার কেন্দ্রীয় লীগে খাজা সাহেবের সমর্থক বেশি ছিলেন। লিয়াকত আলী খান, খালিকুজ্জামান, হোসেন ইমাম, চুন্দ্রিগড় সাহেব সকলেই শহীদ সাহেবকে মনে মনে ভয় করতেন। কারণ সকল বিষয়েই শহীদ সাহেব এঁদের থেকে উপযুক্ত ছিলেন। কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বোর্ডও প্রায় ত্রিশজনের নমিনেশন পালটিয়ে দিলেন। এদের মধ্যে দুই একজন শহীদ সাহেবেরও সমর্থক ছিলেন, একথা অস্বীকার করা যায় না।
নির্বাচনের পরে দেখা গেল একশত উনিশটার মধ্যে বোধহয় একশত ষোলটা সিট লীগ দখল করল। সংখ্যা দু’একটা ভুল হতে পারে, আমার ঠিক মনে নাই। এই একশত ষোলোজনের
৪৯
মধ্যে নাজিমুদ্দীন সাহেবের দলই বেশির ভাগ, যদিও তারা শহীদ সাহেবকে লিডার বানাতে বাধ্য হল, কিন্ত তলে তলে তাদের গ্রুপিং চলল। শহীদ সাহেব গ্রুপ করতেন না, তিনি উপযুক্ত দেখেই মন্ত্রী করলেন। নাজিমুদ্দীন সাহেবের দলের অনেককে পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ও হুইপ করলেন। জনাব ফজলুর রহমানকেও মন্ত্রী করলেন।
যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের পক্ষ থেকে মিস্টার চার্চিল ভারতে ক্রিপস মিশন পাঠিয়ে ছিলেন, কিন্ত কোন ফল হয় নাই। যুদ্ধের পরে যখন মিস্টার ক্লিমেন্ট এটলি লেবার পার্টির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী হন তখন তিনি ১৯৪৬ সালের ১৫ই মার্চ তারিখে ক্যাবিনেট মিশন পাঠাবার কথা ঘোষণা করলেন; তাতে তিনজন মন্ত্রী থাকবেন, তাঁরা ভারতবর্ষে এসে বিভিন্ন দলের সাথে পরামর্শ করে ভারতবর্ষকে যাতে তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা দেওয়া যায় তার চেষ্টা করবেন। ভারতবর্ষে বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি নিয়ে যত তাড়াতাড়ি হয় একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে-বড়লাটের সাথে পরামর্শ করে। এই ক্যাবিনেট মিশনের সদস্য ছিলেন, লর্ড পেথিক লরেন্স, সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া, স্যার স্ট্যাফোরড ক্রিপস, প্রেসিডেন্ট অব দ্য বোর্ড অব ট্রেড এবং মিস্টার এ.ভি. আলেকজান্ডার, ফার্স্ট লর্ড অব এডমাইরালটি (Lord Pethick Lawrence, Secretary of State for India, Sir Stafford Cripps, President of the Board of Trade, and A. V. Alexander, First Lord of the Admiralty)-এঁরা ভারতবর্ষে এসে বড় লাটের সাথে এবং রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে পরামর্শ করে একটা কর্মপন্থা অবলম্বন করবেন। মিস্টার এটলির বক্তৃতায় মুসলমানদের পাকিস্তান দাবির কথা উল্লেখ তো নাই-ই বরং সংখ্যালঘুদের দাবিকে তিনি কটাক্ষ করেছিলেন। মিস্টার এটলি তাঁর বক্তৃতার এক জায়গায় যা বলেছিলেন, তাই তুলে দিলামঃ ‘Mr. Atlee declares that minorities cannot be allowed to impede the progress of majorities.’মিস্টার এটলির বক্তৃতায় কংগ্রেস মহল সন্তোষ প্রকাশ করলেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এই বক্তৃতার তীব্র সমালোচনা করলেন।
ক্যাবিনেট মিশন ২৩শে মার্চ তারিখে ভারতবর্ষে এসে পৌঁছালেন। তাঁরা ভারতবর্ষে এসে যে সকল বিবৃতি দিলেন তাতে আমরা একটু বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। আমরা দলবল বেঁধে শহীদ সাহেবের কাছে যেতাম, তাঁকে বিরক্ত করতাম, জিজ্ঞাসা করতাম, কি হবে? শহীদ সাহেব শান্তভাবে উত্তর দিতেন, ‘ভয়ের কোন কারণ নাই, পাকিস্তান দাবি ওদের মানতেই হবে’। আমরা দিনেরবেলা তাঁর দেখা পেতাম খুব অল্পই, তাই রাতে এগারটার সময় নূরুদ্দিন ও আমি যেতাম। কথা শেষ করে আসতে আমাদের অনেক রাত হয়ে যেত।
আমরা প্রায়ই হাঁটতে হাঁটতে থিয়েটার রোড থেকে বেকার হোস্টেলে ফিরে আসতাম, দু’একদিন আমরা রিপন স্ট্রিটে মিল্লাত অফিসে এসে চেয়ারেই শুয়ে পড়তাম। ‘মিল্লাত’
৫০
কাগজের নতুন প্রেস হয়েছে, অফিস হয়েছে, হাশিম সাহেব সেখানেই থাকতেন। খন্দকার নূরুল আলম তখন মিল্লাত কাগজের ম্যানেজার হয়েছেন। তখন লীগ অফিসের থেকে আমাদের আলোচনা সভা মিল্লাত অফিসেই বেশি হত। মুসলিম লীগ অফিসে এমএলএরা ও মফস্বলের কর্মীরা এসে থাকতেন। বরিশালের ফরমুজুল হক সাহেব মুসলিম লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন, তিনি অফিসেই তাঁর ফ্যামিলি নিয়ে থাকতেন। শহীদ সাহেব তাঁকে মাসে মাসে বেতন দিতেন।
হঠাৎ খবর আসল, জিন্নাহ সাহেব ৭,৮,৯ এপ্রিল দিল্লিতে সমস্ত ভারতবর্ষের মুসলিম লীগপন্থী কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের কনভেনশন ডেকেছেন। বিগত নির্বাচনে বাংলাদেশ ও মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশগুলিতে মুসলিম লীগ একচেটিয়াভাবে জয়লাভ করেছে। তবে অধিকাংশ মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত পাঞ্জাব, সিন্ধু ও সীমান্ত প্রদেশে মুসলিম লীগ এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ট হতে পারে নাই। তাই শুধুমাত্র বাংলাদেশে জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার গঠন হয়েছে। পাঞ্জাবে খিজির হায়াত খান তেওয়ানার নেতৃত্বে ইউনিয়নিস্ট সুরকার, সীমান্তে ডা. খান সাহেবের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার, সিন্ধুতে জনাব আল্লাহ বক্সের নেতৃত্বে মুসলিম লীগবিরোধী সরকার গঠিত হয়েছে। চারটা মুসলমান সংখ্যাগুরু প্রদেশের মধ্যে মাত্র বাংলাদেশেই এককভাবে মুসলিম লীগ সরকার গঠন করেছে। অন্যান্য প্রদেশে মুসলিম লীগবিরোধী দল হিসাবে আসন গ্রহণ করেছে। সমস্ত ভারতবর্ষে তখন এগারটা প্রদেশ ছিল।
শহীদ সাহেব স্পেশাল ট্রেনের বন্দোবস্ত করতে হুকুম দিলেন। বাংলা ও আসামের মুসলিম লীগ এমএলএ ও কর্মীরা এই ট্রেনে দিল্লি যাবনে। ট্রেনের নাম দেওয়া হল ‘পূর্ব পাকিস্তান স্পেশাল। হাওড়া থেকে ছাড়বে। আমরাও বাংলাদেশ থেকে দশ-পনেরজন ছাত্রকর্মী কনভেশনে যোগদান করব। এ ব্যাপারে শহীদ সাহেবের অনুমতি পেলাম। সমস্ত ট্রেনটাকে সাজিয়ে ফেলা হল মুসলিম লীগ পতাকা ও ফুল দিয়ে। দুইটা ইন্টারক্লাস বগি আমাদের জন্য ঠিক করে ফেললাম। ছাত্ররা দুষ্টামি করে বগির সামনে লিখে দিল, ‘শেখ মুজিবর ও পার্টির জন্য রিজার্ভড’; এ লেখার উদ্দেশ্য হল, আর কেউ এই ট্রেনে যেন না ওঠে। আর আমার কথা শুনলে শহীদ সাহেব কিছুই বলবেন না, এই ছিল ছাত্রদের ধারণা। যদিও ছাত্রদের নেতা ছিল নূরুদ্দিন। তাকেই আমরা মানতাম।
শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেবের কামরায় দুইটা মাইক্রোফোন লাগিয়ে দেওয়া হল। হাওড়া থেকে দিল্লি পর্যন্ত প্রায় সমস্ত স্টেশনেই শহীদ সাহেব ও তাঁর দলবলকে সম্বর্ধনা জানাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশে মুসলিম লীগের জয়ে সমস্ত ভারতবর্ষের মুসলমানদের মধ্যে একটা বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে। জহিরুদ্দিনকে হাশিম সাহেবের কামরার কাছেই থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল। কারণ, তাকে সমস্ত পথে উর্দুতে বক্তৃতা করতে হবে। সেই একমাত্র বক্তা যে উর্দু, বাংলা ও ইংরেজিতে সমানে বক্তৃতা করতে পারত। কলকাতার কোনো মহল্লায় সভা হলে জহির উর্দু ও আমি বাংলায় বক্তৃতা করতাম। নূরুদ্দিন, জহিরুদ্দিন, নূরুল আলম, শরফুদ্দিন, কিউ.জে.আজমিরী, আনোয়ার হোসেন (এখন ইস্টার্ন ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বড় কর্মকর্তা), শামসুল হক সাহেব, খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও অনেক লীগ কর্মীর মধ্যে মুর্শিদাবাদের কাজী আবু নাছের, আমার মামা শেখ জাফর সাদেক আরও অনেকে পূর্ব থেকেই প্রস্তুত হয়েছিলেন, দিল্লি যাবার অনুমতিও পেয়েছিলেন। এছাড়া যে সকল ছাত্র আমাদের হাওড়া স্টেশনে বিদায় দিতে এসেছিল, তারাও স্পেশাল ট্রেনে ভাড়া লাগবে না শুনে এক কাপড়েই ট্রেনে চেপে বসল। প্রায় আট-দশজন হবে, তাদের ‘না’ বলার ক্ষমতা আমাদের ছিল না। তারা ভাল কর্মী। ‘নরায়ে তকবির’, ‘মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ‘মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জিন্দাবাদ’, ‘শহীদ সোহরাওরাদী জিন্দাবাদ’ ধ্বনির মধ্যে ট্রেন ছেড়ে দিল।
সমস্ত ট্রেনে মাইক্রোফোনের হর্ন লাগানো ছিল। জহির, আজমিরী ও আমি বেশি স্লোগান দিতাম মাইক্রোফোন থেকে। প্রত্যেক স্টেশনে আমাদের গাড়ি থামাতে হত- যদিও সব জায়গায় গাড়ি দাঁড় করাবার কথা ছিল না। হাজার হাজার লোক শহীদ সাহেবকে ও বাংলার মুসলিম লীগকে সম্বর্ধনা দেওয়ার জন্য হাজির হয়েছিল। সকালে যখন পাটনায় পৌছালাম তখন দেখি সমস্ত পাটনা স্টেশন লোকে লোকারণ্য। তারা ‘বাংলাকা মুসলমান জিন্দাবাদ’, শহীদ সোহরাওয়ারদী জিন্দাবাদ’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’, এই রকম নানা স্লোগান দিতে থাকে। আমাদের প্রত্যেকের খাওয়ার বন্দোবস্ত করেছে বিহার মুসলিম লীগ এবং প্রত্যেককে একটা করে ফুলের মালা উপহার দিয়েছে। আমাদের ট্রেন যে সময় মত দিল্লিতে পৌছাতে পারবে না এটা আমরা বুঝতে পারলাম। অনেক দেরি হবে। আমরাও যেখানেই কিছু লোক স্লোগান দেয়, সেখানেই ট্রেন থামিয়ে দেই। এজন্য শহীদ সাহেব রাগ করলে আমি বললাম, কয়েক ঘন্টা ধরে লোকগুলি দাঁড়িয়ে আছে। আপনাকে দেখার জন্য কত দূর দূর থেকে এরা এসেছে! আর আমরা এক মিনিটের জন্য ট্রেন না থামালে কত বড় অন্যায় হবে। যাহোক, এমনি করে সারা রাত জনসাধারণ ছোট ছোট স্টেশনেও জমা হয়ে আছে। আমাদের ট্রেন দেখলেই তারা বুঝতে পারত। এলাহাবাদ স্টেশনে আমাদের সমস্ত ট্রেনটাকে নতুন করে ফুল দিয়ে তারা সাজিয়ে দিয়েছিল। পথে পথে বিহার ও ইউপি থেকে অনেক ছাত্র আমাদের ট্রেনে উঠে পড়েছিল। তাদের অনেকের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল, পাকিস্তান হওয়া পরেও আমাদের বন্ধুত্ব বজায় ছিল। এদের অনেকে পাকিস্তানে চলে এসেছে।
দিল্লি যখন পৌছালাম তখন দেখা গেল, যেখানে সকালে আমরা পৌছাব সেখানে বিকালে পৌছালাম। আট ঘন্টা দেরি হয়েছে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কনভেনশন বন্ধ করে রেখেছেন আমাদের জন্য। সকাল ন’টায় শুরু হবার কথা ছিল, আমাদের ট্রেন থেকে সোজা সভাস্থলে নিয়ে যাওয়া হল। দিল্লির লীগ কর্মীরা আমাদের মালপত্রের ভার নিলেন। আমরা বাংলায় স্লোগান দিতে দিতে সভায় উপস্থিত হলাম। সমস্ত সদস্য জায়গা থেকে
৫২
উঠে সম্বর্ধনা জানাল। জিন্নাহ সাহেব যেখানে বসেছেন, তাঁর কাছেই আমাদের স্থান। যখন উর্দু স্লোগান উঠত, আমরাও তখন বাংলা স্লোগান শুরু করতাম।
জিন্নাহ সাহেব বক্তৃতা করলেন, সমস্ত সভা নীরবে ও শান্তভাবে তাঁর বক্তৃতা শুনল। মনে হচ্ছিল সকলের মনেই একই কথা, পাকিস্তান কায়েম করতে হবে। তাঁর বক্তৃতার পরে সাবজেক্ট কমিটি গঠন হল। আট তারিখে সাবজেক্ট কমিটির সভা হল। প্রস্তাব লেখা হল, সেই প্রস্তাবে লাহোর প্রস্তাব থেকে আপাতদৃষ্টিতে ছোট কিন্ত মৌলিক একটা রদবদল করা হল। একমাত্র হাশিম সাহেব আর সামান্য কয়েকজন যেখানে পূর্বে ‘স্টেটস’ লেখা ছিল, সেখানে ‘স্টেট’ লেখা হয় তার প্রতিবাদ করলেন; তবুও তা পাস হয়ে গেল। ১৯৪০ সালে লাহোরে যে প্রস্তাব কাউন্সিল পাস করে সে প্রস্তাব আইনসভার সদস্যদের কনভেনশনে পরিবর্তন করতে পারে কি না এবং সেটা করার অধিকার আছে কি না এটা চিন্তাবিদরা ভেবে দেখবেন। কাউন্সিলই মুসলিম লীগের সুপ্রিম ক্ষমতার মালিক। পরে আমাদের বলা হল, এটা কনভেনশনের প্রস্তাব, লাহোর প্রস্তাব পরিবর্তন করা হয় না। জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদীকে ঐ প্রস্তাব পেশ করতে জনাব মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ অনুরোধ করলেন, কারণ তিনিই বাংলার এবং তখন একমাত্র মুসলিম লীগ প্রধানমন্ত্রী।
কাউন্সিল প্রস্তাব
Whereas in this vas subcontinent of India a hundred million Muslims are the adherents of a faith which regulates every department of their life-educational, social, economic and political-whose code is not confined merely to spiritual doctrines and tenets or rituals and ceremonies and which stands in sharp contrast to the exclusive nature of Hindu Dharma and Philosophy which has fostered and maintained rigid caste system for thousands of years, resulting in the degradation of 60 million human beings to the position of untouchables, creation of unnatural barriers between man and man and superimposition of social and economic inequalities on a large body of the people of this country and which threatens to reduce Muslims, Christians and other minorities to the status of irredeemable helots, socially and economically;
Whereas the Hindu caste system is a direct negation of nationalism, equality, democracy and all the noble ideals that Islam stands for;
Whereas, different historical backgrounds, traditions, cultures social and economic orders of the Hindus and the Muslims made impossible the evolution of a single Indian Nation inspired by
৫৩
Common aspirations and ideals and whereas after centuries they still remain two distinct major nations;
Whereas, soon after the introduction by the British of the policy of setting up political institutions in India on the lines of western democracies based on majority rule which means that the majority of the nation or society in spite of their opposition as amply demonstrated during the two and half years’ regime of ‘Congress Governments in the Hindu majority provinces under the Government of India Act, 1935, when the Muslims were subjected to untold harassment and oppression as a result of which they were convinced of the futility and ineffectiveness of the so-called safeguards provided in the constitution and in the Instructions to the Governors and were driven to the irresistible conclusion that in a United India Federation, is established, the Muslims even in Muslims majority provinces, could meet with no better fate and their rights and interests could never be adequately protected against the perpetual Hindu majority at the centre;
Whereas the Muslims are convinced that a view to saving Muslim India from the domination of the Hindus and in order to afford them full scope to develop themselves according to their genius, it is necessary to constitute a sovereign, independent state comprising Bengal and Assam in the North-East zone and in Punjab, North-West Frontier Province, Sind and Baluchistan in the North-West zone;
This convention of the Muslim League legislators of India, central and provincial, after careful consideration, hereby declares that the Muslim nation will never submit to any constitution for a United India and will never participate in any single constitution-making machinery set up for the purpose, and any formula devised by the British government for transferring power from the British to the people of India, which does not conform to the following just and equitable principles calculated to maintain internal peace and tranquility in the country, will not contribute to the solution of the Indian problem:
1. That the zones comprising Bengal and Assam in the North-East and the Punjab, North-West Frontier Province, Sind
৫৪
Baluchistan in the North-West of India, namely Pakistan Zones, where the Muslims are in a dominant majority, be constituted into one sovereign independent state and that an unequivocal undertaking be given to implement the establishment of Pakistan without delay.
2. That two separate constitution making bodies be set up by the peoples of Pakistan and Hindustan for the purpose of framing their respective constitutions.
3. That the minorities in Pakistan and Hindustan be provided with safeguards on the line of the All India Muslim League resolution passed on March 23, 1940 at Lahore.
4. That the acceptance of the Muslim League demand for Pakistan and its implementation without delay are the sine qua non for the Muslim League co-operation and participation in the formation of an interim Government at the centre.

This convention further emphatically declares that any attempt to impose a constitution on a United India basis or to force any interim arrangement at the centre contrary to the Muslim demand, will leave the Muslims no alternative but to resist such imposition by all possible means for their survival and national existence.

জনাব সোহরাওয়ারদীর বক্তৃতার পরে প্রায় বিশ-পঁচিশজন নেতা বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বক্তৃতা করেন এবং প্রস্তাবটা সমর্থন করেন। জনাব আবুল হাশিম সাহেবও চমৎকার বক্তৃতা করেছিলেন। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে পাস হওয়ার পরে জনাব লিয়াকত আলী খান একটা শপথনামা পেশ করেন এবং সমস্ত প্রদেশের আইনসভার মুসলিম লীগ দলীয় সদস্যরা এতে দস্তখত করেন।

কনভেনশন সমাপ্ত হওয়ার পরে যারা হাওড়া স্টেশনে আমাদের বিদায় জানাতে এসে ট্রেনে উঠে পড়েছিল তারা মহাবপদের সম্মুখীন হল। কি করে কলকাতা ফিরে আসবে? স্পেশাল ট্রেন তো আর কলকাতা ফিরে যাবে না। কি করি, ভেবে আর কূল পাই না। আমরা পূর্ব থেকে প্রস্তুত হয়ে এসেছিলাম দিল্লি থেকে আজমীর শরীফে খাজাবাবার দরগাহ জিয়ারত করব, আবার আজমীর থেকে আগ্রায় তাজমহল দেখতে যাব। ১৯৪৩ সালে তাজমহল না দেখে ফিরে যেতে হয়েছিল। এবার যেভাবে হয় দেখতেই হবে। ছোটকাল

৫৫
থেকে আশা করে রয়েছি, সুযোগ আবার কখন হবে কে জানে? যাহোক, আমি আরও কয়েকজন সহকর্মী শহীদ সাহেবের শরণাপন্ন হলাম এবং ছাত্রদের অসুবিধার কথা বললাম। শহীদ সাহেব বললেন, ‘কেন, একজন তো টাকা নিয়ে গেছে, এদের ভাড়া দেবার কথা বলে। তোমার সাথে আলোচনা করে টাকা দিতে বলেছি’। বললাম, ‘জানি না তো স্যার, সে তো চলে গিয়েছে’। শহীদ সাহেব রাগ করলেন। তিনি ছাত্র নন, তার নাম আজ আর আমি বলতে চাই না। শহীদ সাহেব আবারও কিছু টাকা দিলেন। হিসাব করে প্রত্যেককে পঁচিশ টাকা করে, এতেই হয়ে যাবে। খন্দকার নূরুল আলম ও আমি সকলকে পঁচিশ টাকা করে দিয়ে রসিদ নিয়ে নিলাম, প্রত্যেকের কাছ থেকে। তারা বিদায় হয়ে কলকাতায় চলে গেল। আমরা আট-দশজন জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেবের সাথে আজমীর শরীফ রওয়ানা করলাম। চৌধুরী সাহেব সাথে আছেন, টাকার দরকার পড়লে অসুবিধা হবে না। আবার দিল্লি শহরকে ভাল করে দেখে নিলাম। শত শত বৎসর মুসলমানরা দিল্লি থেকে সমস্ত ভারতবর্ষ শাসন করেছে। তখন কি জানতাম, এই দিল্লির উপর আমাদের কোনো অধিকার থাকবে না। দিল্লির লালকেল্লা, কুতুব মিনার, জামে মসজিদ আজও অনন্য মুসলিম শিল্পের নিদর্শন ঘোষণা করেছে। পুরানা দিল্লি ও তার আশপাশে যখনই বেড়াতে গিয়েছি দেখতে পেয়েছি সেই পুরানা স্মৃতি।

আমরা দলবলে আজমীর শরীফ যাবার উদ্দেশ্যে ট্রেনে চড়ে বসলাম। কত গল্পই না শুনেছি বাড়ির গুরুজনদের কাছ থেকে। ‘খাজাবাবার দরগায় গিয়ে যা চাওয়া যায়, তাই পাওয়া যায়, যদি চাওয়ার মত চাইতে পারো’। আমরা যখন আজমীর শরীফ স্টেশনে পৌছালাম দেখি বহু লোক তাদের কাছে থাকবার জন্য আমাদের অনুরোধ করেছিলাম। ভাবলাম, ব্যাপার কি? আমাদের এত আদর কেন? আমরা কারও দাওয়াত কবুল করছি না, কারণ চৌধুরী সাহেবই আমাদের প্রতিনিধি। তিনি যা করবেন তাই আমাদের করতে হবে। তিনি মালপত্র নিয়ে প্রথম শ্রেণী থেকে নেমে আসলেন এবং একজন ভদ্রলোককে বললেন, চলুন আপনার ওখানেই যাওয়া যাবে। তিনি তাড়াতাড়ি গাড়ি ডেকে আমাদের নিয়ে চললেন। আমাদের জন্য কামরার অভাব নাই। গোসল করলাম, খাওয়া-দাওয়া করলাম। পরে বুঝতে পারলাম, এরাই খাদেম। আজমীর শরীফের খাদেমদের যথেষ্ট ভদ্রতাবোধ আছে দেখলাম, তারা কিছুই চেয়ে নেয় না। থাকার বন্দোবস্ত করবে, খাবার ব্যবস্থা করবে, সাথে লোক দেবে, যে খরচগুলি কররা একটা নিয়ম আছে সেগুলিই শুধু আপনাকে দিতে হবে। ফিরে আসার সময় আপনারা যা দিবেন, তাই তারা গ্রহণ করবে। শুনেছি, যে টাকা তারা গ্রহণ করে, তার একটা অংশ নাকি দিতে হয় দরগাহ কমিটিকে। কারণ কমিটির যথেষ্ট খরচ আছে। খাজাবাবার দরগায় কোন লোক না খেয়ে থাকে না। পাক হতে থাকে, মানুষ খেতে থাকে।

আমরা দরগায় রওয়ানা করলাম, পৌঁছে দেখি এলাহী কাণ্ড! শত শত লোক আসে আর যায়। সেজদা দিয়ে পরে আছে অনেক লোক। চিৎকার করে কাঁদছে, কারো কারো বা দুঃখে দুই চক্ষু বেয়ে পানি পড়ছে। সকলের মুখে একই কথা, ‘খাজাবাবা,দেখা দে’।
৫৬
খাজাবাবার দরগার পাশে ভসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান হচ্ছে। যদিও বুঝতাম না ভাল করে, তবুও মনে হত আরও শুনি। আমরা দরগাহ জিয়ারত করলাম, বাইরে এসে গানের আসরে বসলাম। অকেক্ষণ গান শুনলাম, যাকে আমরা ‘কাওয়ালী’বলি। কিছু কিছু টাকা আমরা সকলেই কাওয়ালকে দিলাম।ইচ্ছা হয় না উঠে আসি। তবুও আসতে হবে। আমরা তারাগড় পাহাড়ে যাব, সেখানে কয়েকটি মাজার আছে। তাঁরা খাজাবাবার খলিফা ছিলেন। তারাগড় পাহাড় অনেক উঁচুতে, আমাদের উঠতে হবে তার উপরে। কি করে এই পাহাড় অতিক্রম করে মুসলমান সৈন্যরা পৃথ্বীরাজকে যুদ্ধে পরাজিত করেছিল? সেই যুদ্ধে, যখন হাওয়াই জাহাজের জন্ম হয় নাই।

ইতিহাসের ছাত্রদের জানা আছে, খাজাবাবা কেনই বা এই জায়গা বেছে নিয়েছিলেন। সে ইতিহাসও খাদেম সাহেবের প্রতিনিধি আমাদের শোনাল। খাদেম সাহেব একজন প্রতিনিধি আমাদের সাথে দিয়েছিল। আমরা তারাগড়ে উঠলাম। অনেক্ষণ সেখানে ছিলাম। তারাগড় পাহাড় থেকে বহুদুর পর্যন্ত দেখা যায় শুধু মরুভূমি। আর একদিকে আজমীর শহর। সেখান থেকে নেমে আসলাম যখন তখন দুপুর পার হয়ে গেছে। আমরা খাদেম সাহেবের আস্তানায় এসে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আবার বেরিয়ে পড়লাম, আনার সাগরে যাবার উদ্দেশ্যে।

বিরাট লেক, সকল পাড়েই শহর গড়ে উঠেছে আজকাল। একপাশে মোগল আমলের কীর্তি পড়ে আছে। এখানে এসে বাদশা ও বেগমরা বিশ্রাম করতেন। বাদশা শাহজাহানের কীর্তিই সকলের চেয়ে বেশি। বাদশা ও বেগম যেখানে থাকতেন সে জায়গাটা আজও আছে। সাদা মর্মর পাথরের দ্বারা তৈরি। আমরা সমস্ত সন্ধ্যা সেখানেই কাটালাম। সন্ধ্যার পর আস্তে আস্তে শহরের দিকে রওয়ানা করলাম। পানির দেশের মানুষ আমরা, পানিকে বড় ভালবাসি। আর মরুভূমির ভিতর এই পানির জায়গাটুকু ছাড়তে কত যে কষ্ট হয় তা কি করে বোঝাব! আমাদের বন্ধুদের মধ্যে একজন বলেছিল, রাতটা এখানে কাটালে কেমন হয়? সত্যিই ভাল হত, কিন্তু উপায় নাই। রাতে কাউকেও থাকতে দেওয়া হয় না, এই জায়গাটায়। আবার থাকতে চেষ্টা করলে যদি পুলিশ বাহাদুররা গ্রেফতার করে নিয়ে যায় তবে কে এই বিভূঁই বিদেশে আমাদের হাজত থেকে রক্ষা করবে!
সন্ধ্যার পরে খাজাবাবার দরগাহে ফিরে এলাম। কিছু সময় সেখানে থেকে আবার আমাদের আস্তানায় চলে এলাম। খাদেম সাহেব আমাদের জন্য খুব ভাল খাবার বন্দোবস্ত করেছে। রাতটা আরামেই ঘুমালাম।
আজমীর শরিফকে বিদায় দিয়ে আবার আমরা ট্রেনে উঠে বসলাম আগ্রার দিকে, যেখানে মমতাজ বেগম শুয়ে আছেন তাজমহলকে বুকে করে। বহুদিনের স্বপ্ন তাজমহল দেখব। মোগল শিল্পের ও স্থাপত্যকলার শ্রেষ্ট নিদর্শন এই তাজ। বাদশা শাহজাহানের অমর প্রেমের নিদর্শন এই তাজ। পৃথবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম এই তাজ। আমাদের নিজেদের মধ্যে তাজ দেখা নিয়ে অনেক আলোচনা হল। দুনিয়ার বহু দেশ থেকে বহু লোক শুধু তাজ দেখার জন্য ভারতবর্ষে আসত তাজমহলের কথা জানে না, এমন মানুষ দুনিয়ায় খুব
৫৭
বিরল। আমাদের দেরি আর সইছে না। মনে হচ্ছে ট্রেন খুব আস্তে আস্তে চলছে, কারণ তাজ দেখার উদগ্র আগ্রহ আমাদের পেয়ে বসেছে। আমরা তো ভাবি নাই ঠিক পূর্ণিমার দিনে আগ্রা পৌছাব। আমরা হিসাব করে দিন ঠিক করে আসি নাই। মনে মনে পূর্ণিমাকে ধন্যবাদ দিলাম, আর আমাদের কপালকে ধন্যবাদ না দিলে অন্যায় হত, তাই তাকেও দিলাম। আমরা আগ্রায় পৌছালাম সকালের দিকে। দুই দিন আমরা আগ্রায় থাকব। কোন একটা হোটেলে উঠব ঠিক করলাম। লোক তো আমরা কম না, প্রায় বার চৌদ্দজন। অনেক টাকা খরচ করতে হবে। মোসাফিরখানা হলেই আমাদের সুবিধা হত। আগ্রা স্টেশনে পৌছালাম, অনেক হোটেলের লোকই তাদের হোটেলে থাকতে আমাদের অনুরোধ করল। এক ভদ্রলোক এলেন, তিনি বললেন, ‘আপনারা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, একটা বাঙালি হোটেল আছে, সেখানেই আপনাদের সুবিধা হবে’। চৌধুরী সাহেব বললেন, ‘আপনাদের হোটেলে তাঁবু আছে? আমরা অনেক লোক’। তিনি বললেন, ;তাঁবু খাঁটিয়ে দিতে পারব’। ঠিক হল, আগ্রা হোটেলেই যাব। চৌধুরী সাহেব একটা রুম নিলেন, আমাদের জন্য দুইটা তাঁবু ঠিক করে দেওয়া হল। আমরা খাটিয়া পেলেই খুশি। শুধু প্রয়োজন আমাদের গোসল করার পানি, আর পায়খানা। হোটেলের মালিক বাঙালি, খুব ভদ্রলোক, আমাদের অভ্যর্থনা করলেন। আমাদের যাবতীয় বন্দোবস্ত করতে ম্যানেজারকে হুকুম দিলেন। কত টাকা দিতে হবে চৌধুরী সাহেবই ঠিক করলেন, তিনিই দিয়েছিলেন। আমাদের কিছুই দিতে হয় নাই।
তাড়াতাড়ি আমরা গোসল করে কিছু খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম, মন তো মানছে না, তাজ দেখার উদগ্র আগ্রহ। টাঙ্গা ভাড়া করে তাজ দেখতে রওয়ানা করলাম। প্রখর রৌদ্র। কি দেখলাম ভাষায় প্রকাশ আমি করতে পারব না। ভাষার উপর আমার সে দখলও নাই। শুধু মনে হল, এও কি সত্যি! কল্পনা যা করেছিলাম, তার চেয়ে যে এ অনেক সুন্দর ও গাম্ভীর্যপূর্ণ। তাজকে ভালভাবে দেখতে হলে আসতে হবে সন্ধ্যায় সূর্য অস্ত যাবার সময়, চাঁদ যখন হেসে উঠবে তখন। আমরা বেশি দেরি করলাম না, কারণ আগ্রা দুর্গ ও ইতিমাদ-উদ-দৌলা দেখতে হবে সন্ধ্যার পূর্বেই। যখন সূর্য অসৎ যাবে তার একটু পূর্বেই ফিরে আসতে হবে তাজমহলে। টাঙ্গাগুলিকে আমরা দাঁড় করেই রেখেছিলাম।
ইতিমাদ-উদ-দৌলা-বেগম নূরজাহানের পিতার কবর। আমরা আগ্রা দুর্গে এলাম। দেওয়ানি আম, মতি মসজিদ, মছি ভবন, নাগিনা মসজিদ সবই ঘুরে ঘুরে দেখলাম। দেওয়ানি খাস ও জেসমিন টাওয়ার দেখতেও ভুল করলাম না। দিল্লির লালকেল্লার সাথে এর যথেষ্ট মিল আছে। মোগল আমলের শিল্প একই রকমের, দেখলেই বোঝা যায়। যমুনার দিকে বারান্দায় কতগুলি পাথর ছিল। সেই পাথরের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে তাজকে দেখা যেত। এখন আর পাথরগুলি নাই। একটা কাঁচ লাগান আছে। এই কাচের মধ্যেও পরিষ্কারভাবে তাজকে দেখা যায়। আমরা সকলেই দেখলাম, শীশ মহল দেখে রওয়ানা করলাম। আমাদের যে ভদ্রলোক ঘুরে দেখাচ্ছিলেন, তিনি অনেক কথাই বলছিলেন। কিছু সত্যি, কিছু গল্প, তবে একটা কথা সত্য, মোগলদের পতনের পরে বারবার লুটতরাজ হয়েছে। জাঠ ও মারাঠি এবং শেষ আঘাত হেনেছে ইংরেজ। জাঠ ও মারাঠিরা কিছু কিছু লুট করেই চলে গিয়েছিল,

৫৮

পান্ডুলিপির একটি পৃষ্টার চিত্রলিপি

৫৯
কিন্ত ইংরেজ সবকিছু লুট করেই নিয়ে গিয়েছে ভারতবর্ষ থেকে। লর্ড স্থানীয় লোকরাই এই লুটের প্রধান কর্ণধার ছিলেন। ভারতবর্ষ ও পাকিস্তানের অনেক জায়গায়ই মোগল শিল্পের অনেক নিদর্শন আছে। আমরা ইতিমাদ-উদ-দৌলা দেখে ফিরে চললাম তাজমহল দেখতে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। দিল্লির লালকেল্লা পূর্বেই দেখেছি, তাই আগ্রা দুর্গ দেখতে আমাদের সময় লাগার কথা না।
সূর্য অস্তাচলগামী, আমরাও তাজমহলের দরজায় হাজির। অনেক্ষণ থাকব, রাত দশটা পর্যন্ত দরজা খোলা থাকে, তারপর দারোয়ান সাহেবরা এসে ঘন্টা দিয়ে জানিয়ে দিবে সময় হয়ে গেছে। তাজকে ত্যাগ করতে হবে, রাতের জন্য। আমরা বসে পড়লাম, একটা জায়গা বেছে নিয়ে কয়েকজন নামাজ পড়তে গেলেন। আজানের ধ্বনি কানে এসেছে। পাকিস্তান হওয়ার পরও আজান হয় কি না জানি না। এই দিনে অনেক লোক দেশ-বিদেশ থেকে এসেছে। বাঙালি, মারাঠি, পাঞ্জাবি-মনে হল ভারতবর্ষের সকল জায়গার লোকই এসেছে। আমাদের পথপ্রদর্শককে জিজ্ঞাসা করলাম, এত ভিড় কি সকল সময়ই থাকে? বললেন, না, পূর্ণ চন্দ্রের সময়ই অনেক লোক বিশেষ করে আসে। সূর্য যখন অস্ত গেল, সোনালি রঙ আকাশ থেকে ছুতে আসছে। মনে হল, তাজের যেন আর একটা নতুন রুপ। সন্ধ্যার একটু পরেই চাঁদ দেখা দিল। চাঁদ অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে আসছে আর সাথে সাথে তাজ যেন ঘোমটা ফেলে দিয়ে নতুন রূপ ধারণ করেছে। কি অপূর্ব দেখতে! আজও একুশ্য বৎসর পরে লিখতে বসে তাজের রূপকে আমি ভুলি নাই, আর ভুলতেও পারব না। দারোয়ান দরোজা বন্ধ করার পূর্ব পর্যন্ত আমরা তাজমহলেই ছিলাম।
পরের দিন সকালবেলা আমাদের যেতে হবে ফতেহপুর সিক্রিতে। চৌধুরী সাহেব একটা মোটর বাস ঠিক করেছিলেন। ফতেহপুর সিক্রি ও সেকেন্দ্রা দেখে বিকালে ফিরে আসব এবং রাতেই আমাদের রওয়ানা করতে হবে তুন্দলার পথে। তুন্দলা একটা জংশন। দিল্লি থেকে তুন্দলা হয়ে ট্রেন হাওড়া যায়। হাওড়াগামী ট্রেন ধরা হবে। সকালবেলায় মোটর বাস এসে হাজির। আমরা তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে গাড়িতে চেপে বসলাম। চৌধুরী সাহেব এলেই গাড়ি ছেড়ে দিল। মাত্র আটাশ মাইল পথ; কত সময়ই বা লাগবে! মোগলদের স্থাপত্য শিল্পের গল্প করতে করতেই আমরা এসে পড়লাম ফতেহপুর সিক্রিতে। আকবর বাদশা নিজেই ফতেহপুর সিক্রি নির্মাণ করেছিলেন। এখানে সম্রাট আকবর তাঁর রাজধানী করেছিলেন। আগ্রার দুর্গের সাথে এর বিশেষ পার্থক্য ছিল না। তবে ফতেহপুর সিক্রি অনেক বড়। এই ফতেহপুর সিক্রির সামনেই যে বিরাট ময়দান দেখা যায় এর নামই খানওয়া। এখানেই সম্রাট বাবর সংগ্রাম সিংহকে পরাজিত করে ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তি গড়ে তুলেছিলেন। কেন যে আকবর বাদশা এখানে দুর্গ তৈরি করেন তা বলা কষ্টকর। এ বিষয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিকের বিভিন্ন মত। আমরা আগ্রা গেট পার হয়ে ভিতরে এলাম, সামনে বুলন্দ দরোজা। এটাই হল দুর্গের প্রধান গেট। একশত চৌত্রিশ ফিট উঁচু বুলন্দ দরোজা পার হয়েই আমরা প্রথম দেখতে পেলাম সেলিম চিশতীর দরগাহ। তাঁর মাজার জিয়ারত করে আমরা দুর্গের ভিতর প্রবেশ করব। দরগাহ জিয়ারত করলাম। সেলিম চিশতী ছিলেন
৬০
বাদশাহ আকবরের পীর। আজমীরের খাজাবাবার দরগায় দেখলাম গান বাজনা চলছে সমানে, এখানেও দেখলাম সেই একই অবস্থা। আমাদের বাংলাদেশের মাজারে গান বাজনা করলে আর উপায় থাকত না। খাজাবাবা মঈনুদ্দিন চিশতী ও সেলিম চিশতী দুইজনই নাকি গান ভালবাসতেন। আমরা এক এক করে এবাদতখানা থেকে আরম্ভ করে আবুল ফজলের বাড়ি, হামামখানা, ধর্মশালা, মিনা মসজিদ, যোধাবাঈ মহল ও সেলিম গড় দেখতে শুরু করলাম।
এক একজনে এক একটা জায়গা দেখতে চায়। আমি দেখতে চেয়েছিলাম তানসেনের বাড়ি। শেষ পর্যন্ত তানসেনের বাড়ি দেখতে গেলাম। তাঁর বাড়িটা প্রাসাদের বাইরে, পাহাড়ের ওপর ছোট্ট একটা বাড়ি। বোধহয় সঙ্গীত সাধনায় ব্যাঘাত হবে, তাই তিনি দূরে থাকতেই ভালবাসতেন। আমার মন যেন সান্ত্বনা পেল না তানসেনের বাড়ি দেখে। যা হোক, বহুদিনের কথা, এ বাড়িতে তিনি ছিলেন কি না শেষ পর্যন্ত তাঁরই বা ঠিক কি? সম্রাট তো এত অর্থ খরচ করে যে প্রাসাদ ও দুর্গ তৈরি করলেন, দু’বছরের বেশি থাকতে পারেন নাই, আবার আগ্রা দুর্গে ফিরে যেতে হয়েছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, পানির অভাবের জন্য। আমার মন স্বীকার করতে চায় না যে, পানির জন্য তিনি চলে যান। মনে হয় অন্য কোন কারণ ছিল। আট বর্গমাইল জায়গা নিয়ে ফতেহপুর সিক্রি, রাজপ্রাসাদ ও দুর্গ গড়ে তোলেন-যার মধ্যে দুই হাজার নয়শত ঘর ছিল। আগ্রা দুর্গে ছিল প্রায় পাঁচশত ঘর। ফতেহপুর সিক্রিতে সম্রাটের সমস্ত অমাত্যবৃন্দের থাকার জায়গা হয়েও ষাট হাজার সৈন্য থাকতে পারত। সম্রাট আকবরের শক্তি এবং সামর্থ্য ছিল। তিনি এদের জন্য পানির ব্যবস্থা করতে পারেন নাই, পানির কষ্টেই তিনি ফতেহপুর সিক্রি ছেড়ে আসেন, এটা যেন বিশ্বাস করতে মন চাইল না।
আমাদের আবার সন্ধ্যায় ট্রেন ধরতে হবে। লোকাল ট্রেন আগ্রা থেকে তুন্দলা পর্যন্ত যায়। ফতেহপুর সিক্রির পাশেই একতা ডাকবাংলো আছে। আমরা সকলেই কিছু খেয়ে নিয়ে রওয়ানা করলাম সেকেন্দ্রায়, যেখানে সম্রাট আকবর চিরনিদ্রায় শায়িত। এই সমাধি স্থান তিনি নিজেই ঠিক করে গিয়েছিলেন। দিল্লি থেকে শুরু করে অনেক রাজা-বাদশার সমাধি আমি দেখেছি, কিন্ত সেকেন্দ্রায় আকবরের সমাধির ভাবগম্ভীর ও সাদাসিধে পরিবেশটা আমার বেশ লেগেছিল। সমস্ত জায়গাটা জুড়ে অনেক রকমের গাছপালায় ভরা, ফল ও ফুলের গাছ! সমাধিটা সাদা পাথরের তৈরি।
আমাদের সময় হয়ে এসেছে, ফিরতে হবে। চৌধুরী সাহেব তাড়া দিলেন। আমরাও গাড়িতে উঠে বসলাম। আগ্রায় ফিরে এসেই মালপত্র নিয়ে রওয়ানা করলাম তুন্দলা স্টেশনে। এসে দেখি বাংলাদেশের অনেক সহকর্মীই এখানে আছেন। অনেক ভিড়। মালপত্র চৌধুরী সাহেবের প্রথম শ্রেণীর গাড়িতে ফেলে আমরা তাড়াতাড়ি উঠে পড়তে চেষ্টা করলাম। যখন সকলেই উঠে শ্রেণীর গাড়িতে ফেলে আমরা তাড়াতাড়ি উঠে পড়তে চেষ্টা করলাম। যখন সকলেই উঠে গেছে ট্রেনে, আমি আর উঠতে না পেরে ফার্স্ট ক্লাসের দরোজার হাতল ধরে দাঁড়ালাম। আমার সাথে আরেক বন্ধু ছিল। পরের স্টেশনে যে কোন বগিতে উঠে পড়ব। অনেক ধাক্কাধাক্কি করলাম, প্রথম শ্রেণীর ভদ্রলোক দরজা খুললেন না। ট্রেন ভীষণ জোরে চলছে, আমাদের ভয় হতে লাগল, একবার হাত ছুটে গেলে আর উপায়
৬১
নাই। আমি দুই হাতলের মধ্যে দুই হাত ভরে দিলাম, আর ওকে বুকের কাছে রাখলাম। মেলট্রেন-স্টেশন কাছাকাছি হবে না। আমাদের কিন্ত অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ছিল। বাতাসে হাত-পা অবশ হতে চলেছে। আর কিছু সময় চললে আর উপায় নাই। কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ ট্রেন থেমে গেল। আমরা নেমে পড়লাম। ‘আনোয়ার’‘আনোয়ার’ বলে ডাকতে শুরু করলাম। মধ্যম শ্রেণীতে আনোয়ার ছিল, ওর কাছেই আমার বিছানা। আমাদের জন্য আনোয়ার খুব উদ্বগ্ন ছিল। জানালা দিয়ে কোনক্রমে ট্রেনের ভিতর উঠলাম। ট্রেন ছেড়ে দিল। পরের দিন সন্ধ্যায় আমরা হাওড়া স্টেশনে পৌছালাম। সকলের সকল কিছুই আছে, আমার সুটকেসটা হারিয়ে গেছে। শুধু বিছানাটা নিয়ে কলকাতা ফিরে এলাম।
এরপর ভাবলাম কিছুদিন লেখাপড়া করব। মাহিনা বাকি পড়েছিল, টাকা পয়সার অভাবে। এত টাকা বাড়ি না গেলে আব্বার কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। এক বৎসর মাহিনা দেই নাই। কাপড় জামাও নতুন করে বানাতে হবে। প্রায় সকল কাপড়ই চুরি হয়ে গেছে। বাড়িতে এসে রেণুর কাছে আমার অবস্থা প্রথমে জানালাম। দিল্লি ও আগ্রা থেকে রেণুকে চিঠিও দিয়েছিলাম। আব্বাকে বলতেই হবে। আব্বাকে বললে তিনি অসন্তষ্ট হলেন মনে হল। কিছুই বললেন না। পরে বলেছিলেন, ‘বিদেশ যখন যাও বেশি কাপড় নেওয়া উচিত নয় এবং সাবধানে থাকতে হয়’। টাকা দিয়ে আব্বা বললেন, ‘কোনো কিছুই শুনতে চাই না। বিএ পাস ভালভাবে করতে হবে। অনেক সময় নষ্ট করেছে, ‘পাকিস্তানের আন্দোলন’ বলে কিছুই বলি নাই। এখন কিছুদিন লেখাপড়া কর’। আব্বা, মা, ভাইবোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘অমঙ্গল অশ্রুজন’ বোধহয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে। বলল, ‘একবার কলকাতা গেলে আর আসতে চাও না। এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ি এস’।
কলকাতা এসে মাহিনা পরিশোধ করে যে বইপত্রগুলি বন্ধুবান্ধবরা পড়তে নিয়েছিল, তার কিছু কিছু চেয়ে নিলাম। কলেজে যখন ক্লাস করতে যেতাম প্রফেসর সাহেবরা জানতেন, আর দু’একজন বলতেনও, ‘কি সময় পেয়েছ কলেজে আসতে’। আমি কোনো উত্তর না দিয়ে নিজেই হাসতাম, সহপাঠীরাও হাসত। পড়তে চাইলেই কি আর লেখাপড়া করা যায়! ক্যাবিনেট মিশন তখন ভারতবর্ষে। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ তাদের দাবি নিয়ে আলোচনা করছে ক্যাবিনেট মিশনের সাথে। আমরাও পাকিস্তান না মানলে, কোনোকিছু মানব না। মুসলিম লীগ ও মিল্লাত অফিসে রোজ চায়ের কাপে ঝড় উঠত। মাঝে মাঝে মিটিং হয়, বক্তৃতাও করি। এই সময় ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ গ্রহণ করবে। তাতে দেশ রক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে এবং বাকি সব বিষয়ই প্রদেশের হাতে দেওয়া হয়েছিল। পরে কংগ্রেস চুক্তিভঙ্গ করে, যার ফলে ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান পরিত্যাক্ত হয়। এমনভাবে ক্যাবিনেট মিশন আলোচনা করছিল, আমাদের মনে হচ্ছিল ইংরেজ সরকার কংগ্রেসের হাতে শাসন ক্ষমতা দিয়ে চলে যেতে পারলে বাঁচে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কংগ্রেস ও ব্রিটিশ সরকারকে ভালভাবে জানতেন ও বুঝতেন, তাই তাঁকে ফাঁকি দেওয়া সোজা ছিল না।

৬২
পাণ্ডুলিপির একটি পৃষ্টার চিত্রলিপি
৬৩
২৯ জুলাই জিন্নাহ সাহেব অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ কাউন্সিল সভা বোম্বে শহরে আহ্বান করলেন। অর্থের অভাবের জন্য আমি যেতে পারলাম না। জিন্নাহ সাহেব ১৬ আগস্ট তারিখে ‘ডাইরেক্ট একশন ডে’ ঘোষণা করলেন। তিনি বিবৃতির মারফত ঘোষণা করেছিলেন, শান্তিপূর্ণভাবে এই দিবস পালন করতে। ব্রিটিশ সরকার ও ক্যাবিনেট মিশনকে তিনি এটা দেখাতে চেয়েছিলেন যে, ভারতবর্ষের দশ কোটি মুসলমান পাকিস্তান দাবি আদায় করতে বদ্ধপরিকর। কোনো রকম বাধাই তারা মানবে না। কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নেতারা এই ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’, তাঁদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করা হয়েছে বলে বিবৃতি দিতে শুরু করলেন।
আমাদের আবার ডাক পড়ল এই দিনটা সুষ্টুভাবে পালন করার জন্য। হাশিম সাহেব আমাদের নিয়ে সভা করলেন। আমাদের বললেন, ‘তোমাদের মহল্লায় যেতে হবে, হিন্দু মহল্লায়ও তোমরা যাবে। তোমরা বলবে, আমাদের এই সংগ্রাম হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে, আসুন আমরা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই দিনটা পালন করি’। আমরা গাড়িতে মাইক লাগিয়ে বের হয়ে পড়লাম। হিন্দু মহল্লায় ও মুসলমান মহল্লায় সমানে প্রোপাগান্ডা শুরু করলাম। অন্য কোন কথা নাই, ‘পাকিস্তান’ আমাদের দাবি। এই দাবি হিন্দুর বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে। ফরোয়ার্ড ব্লকের কিছু নেতা আমাদের বক্তৃতা ও বিবৃতি শুনে মুসলিম লীগ অফিসে এলেন এবং এই দিনটা যাতে শান্তিপূর্ণভাবে হিন্দু মুসলমান এক হয়ে পালন করা যায় তার প্রস্তাব দিলেন। আমরা রাজি হলাম। কিন্ত হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের প্রপাগান্ডারকাছে তারা টিকতে পারল না। হিন্দু সম্প্রদায়কে বুঝিয়ে দিল এটা হিন্দুদের বিরুদ্ধে।
সোহরাওয়ারদী সাহেব তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী। তিনিও বলে দিলেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে যেন এই দিনটা পালন করা হয়। কোনো গোলমাল হলে মুসলিম লীগ সরকারের বদনাম হবে’। তিনি ১৬ই আগস্ট সরকারি ছুটি ঘোষণা করলেন। এতে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা আরও ক্ষেপে গেল।
১৫ই আগস্ট কে কোথায়, কোন এরিয়ায় থাকবে ঠিক হয়ে গেল। ১৬ই আগস্ট কলকাতার গড়ের মাঠে সভা হবে। সমস্ত এরিয়া থেকে শোভাযাত্রা করে জনসাধারণ আসবে। কলকাতার মুসলমান ছাত্ররা ইসলামিয়া কলেজে সকাল দশটায় জড়ো হবে। আমার উপর ভার দেওয়া হল ইসলামিয়া কলেজে থাকতে। শুধু সকাল সাতটায় আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব মুসলিম লীগের পতাকা উত্তোলন করতে। আমি ও নূরুদ্দিন সাইকেলে করে বিশ্ববিদ্যালয় উপস্থিত হলাম। পতাকা উত্তোলন করলাম। কেউই আমাদের বাধা দিল না। আমরা চলে আসার পরে পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল শুনেছিলাম। আমরা কলেজ স্ট্রিট থেকে বউবাজার হয়ে আবার ইসলামিয়া কলেজে ফিরে এলাম। কলেজের দরজা ও হল খুলে দিলাম। আর যদি আধা ঘণ্টা দেরি করে আমরা বউবাজার হয়ে আসতাম তবে আমার ও নূরুদ্দিনের লাশও আর কেউ খুঁজে পেত না। ভাবসাব যে
৬৪
খারাপ আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যখন ফিরে আসি। নূরুদ্দিন আমাকে কলেজে রেখে লীগ অফিসে চলে গেল। বলে গেল, শীঘ্রই ফিরে আসবে।
বেকার হোস্টেল থেকে মাত্র কয়েকজন কর্মী এসে পৌঁছেছে। আমি ওদের সভাকক্ষ খুলে টেবিল চেয়ার ঠিক করতে বললাম। কয়েকজন মুসলিম ছাত্রী মন্নুজান হোস্টেল থেকে ইসলামিয়া কলেজে এসে পৌঁছেছেন। এরা সকলেই মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। এর মধ্যে হাজেরা বেগম (এখন হাজেরা মাহমুদ আলী), হালিমা খাতুন (এখন নূরুদ্দিন সাহেবের স্ত্রী), জয়নাব বেগম (এখন মিসেস জলিল), সাদেকা বেগম (এখন সাদেকা সামাদ) তাদের নাম আমার মনে আছে। এরা ইসলামিয়া কলেজে পৌঁছার কয়েক মিনিটের মধ্যে দেখা গেল কয়েকজন ছাত্র রক্তাক্ত দেহে কোনোমতে ছুতে এসে ইসলামিয়া কলেজে পৌঁছেছে। কারও পিঠে ছোঁড়ার আঘাত, কারও মাথা ফেটে গেছে। কি যে করব কিছুই বুঝতে পারছি না। কারণ, এ জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। মেয়েরা এগিয়ে এসে বললেন, ‘যারা জখম হয়েছে, তাদের আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। পানির বন্দোবস্ত করেন’। কোথায় এরা কাপড় পাবে ব্যান্ডেজ করতে? যার যার ওড়না ছিঁড়ে, শাড়ি কেটে ব্যান্ডেজ করতে শুরু করল। কাছেই হোস্টেল, তাড়াতাড়ি খবর দিলাম। এদের ব্যান্ডেজ করেই একজন পরিচিত ডাক্তার ছিলেন তাঁর বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে শুরু করলাম।
একজন ছাত্র বলল, দ বেঁধে আসলে হিন্দুরা আক্রমণ করছে না, তবে একজন দু’জন পেলেই আক্রমণ করছে। আরও খবর এল, রিপন কলেজে ছাত্ররা পতাকা উত্তোলন করতে গেলে তাদের উপর আক্রমণ হয়েছে।
ইসলামিয়া কলেজের কাছেই সুরেন ব্যানারজি রোড, তারপরেই ধর্মতলা ও ওয়েলিংটন স্কয়ারের জংশন। এখানে সকলেই প্রায় হিন্দু বাসিন্দা। আমাদের কাছে খবর এল, ওয়েলিংটন স্কোয়ারের মসজিদে আক্রমণ হয়েছে। ইসলামিয়া কলেজের দিকে হিন্দুরা এগিয়ে আসছে। কয়েকজন ছাত্রকে ছাত্রীদের কাছে রেখে, আমরা চল্লিশ পঞ্চাশজন ছাত্র প্রায় খালি হাতেই ধর্মতলার মোড় পর্যন্ত গেলাম। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা কাকে বলে এ ধারণাও আমার ভাল ছিল না। দেখি শত শত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক মসজিদ আক্রমণ করছে। মৌলভী সাহেব পালিয়ে আসছেন আমাদের দিকে। তাঁর পিছে ছুটে আসছে একদল লোক লাঠি ও তলোয়ার হাতে। পাশেই মুসলমানদের কয়েকটা দোকান ছিল। কয়েকজন লোক কিছু লাঠি নিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়াল। আমাদের মধ্যে থেকে কয়েকজন ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ দিতে শুরু করল। দেখতে দেখতে অনেক লোক জমা হয়ে গেল। হিন্দুরা আমাদের সামনা সামনি এসে পড়েছে। বাধা দেওয়া ছাড়া উপায় নাই। ইট পাটকেল যে যা পেল তাই নিয়ে আক্রমণের মোকাবেলা করে গেল। আমরা সব মিলে দেড় শত লোকের বেশি হব না। কে যেন পিছন থেকে এসে আত্মরক্ষার জন্য আমাদের কয়েকখানা লাঠি দিল। এর পূর্বে শুধু ইট দিয়ে মারামারি চলছিল। এর মধ্যে একটা বিরাট শোভাযাত্রা এসে পৌছাল। এদের কয়েক জায়গায় বাধা দিয়েছে, রুখতে পারে নাই। তাদের সকলের হাতেই লাঠি। এরা এসে আমাদের সঙ্গে যোগদান করল। কয়েক মিনিটের জন্য হিন্দুরা ফিরে গেল,
৬৫
আমরাও ফিরে এলাম। পুলিশ কয়েকবার এসে এর মধ্যে কাঁদানে গ্যাস ছেড়ে চলে গেছে। পুলিশ টহল দিচ্ছে। এখন সমস্ত কলকাতায় হাতাহাতি মারামারি চলছে। মুসলমানরা মোটেই দাঙ্গার জন্য প্রস্তুত ছিল না, একথা আমি বলতে পারি।
আমরা রওয়ানা করলাম গড়ের মাঠের দিকে। এমনিই আমাদের দেরি হয়ে গেছে। লাখ লাখ লোক সভায় উপস্থিত। কালীঘাট, ভবানীপুর, হ্যারিসন রোড, বড়বাজার সকল জায়গায় শোভাযাত্রার উপর আক্রমণ হয়েছে। শহীদ সাহেব বক্তৃতা করলেন এবং তাড়াতাড়ি সকলকে বাড়ি ফিরে যেতে হুকুম দিলেন। কিন্ত যাদের বাড়ি বা মহল্লা হিন্দু এরিয়ার মধ্যে তারা কোথায় যাবে? মুসলিম লীগ অফিসে লোকে লোকারণ্য। কলকাতা সিটি মুসলিম লীগ অফিসেরও একই অবস্থা। বহু লোক জাকারিয়া স্ট্রিটে চলে গেল। ওয়েলেসলী, পার্ক সার্কাস, বেনিয়া পুকুর এরিয়া মুসলমানদের এরিয়া বলা চলে। বহু জখম হওয়া লোক এসেছে; তাদের পাঠাতে হয়েছে মেডিকেল কলেজ, ক্যাম্বল ও ইসলামিক হসপিটালে। মিনিটে মিনিটে টেলিফোন আসছে, শুদু একই কথা, ‘আমাদের বাঁচাও, আমরা আটকা পড়ে আছি। রাতেই আমরা ছেলেমেয়ে নিয়ে শেষ হয়ে যাব’। কয়েকজন ফোনের কাছে বসে আছে, শুধু টেলিফোন নাম্বার ও ঠিকানা লিখে রাখবার জন্য। লীগ অফিস রিফিউজি ক্যাম্প হয়ে গেছে, ইসলামিয়া কলেজও খুলে দেওয়া হয়েছে। কলকাতা মাদ্রাসা যখন খুলতে যাই, তখন দারোয়ান কিছুতেই খুলতে চাইছে না। আমি দৌড়ে প্রিন্সিপাল সাহেবের কাছে গেলে তিনি নিজেই এসে হুকুম দিলেন দরজা খুলে দিতে। আশেপাশে থেকে কিছু লোক কিছু কিছু খবর দিতে লাগল। বেকার হোস্টেল, ইলিয়ট হোস্টেল পূর্বেই ভরে গেছে। এখন চিন্তা হল টেইলর হোস্টেলের ছেলেদের কি করে বাঁচাই। কোন কিছুই জোগাড় হচ্ছে না। কিছু ছাত্র দুপুরে চলে এসেছে। কিছু আটকা পড়েছে। বিল্ডিংটা এমনভাবে ছিল যে, একটা মাত্র গেট। চারপাশে হিন্দু বাড়ি, আগুন দিলে সমস্ত হিন্দু মহল্লা শেষ হয়ে যাবে। রাতে কয়েকবার গেট ভাঙবার চেষ্টা করেছে, পারে নাই। সোহরাওয়ারদী সাহেবকে ধরতে পারছি না। ফোন করলেই খবর পাই লালবাজার আছেন। লালবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টার। নূরুদ্দিন অনেক রাতে একটা বড় গাড়ি ও কিছু পুলিশ জোগাড় করে তাদের উদ্ধার করে আনার ব্যবস্থা করেছিল। অনেক হিন্দু তালতলায়, ওয়েলেসলী এরিয়ায় ছিল। তাদের মধ্যে কিছু লোক গোপনে আমাদের সাহায্য চাইল। অনেক কষ্টে কিছু পরিবারকে আমরা হিন্দু এরিয়ায় পাঠাতে সক্ষম হলাম, বিপদ মাথায় নিয়ে।বেকারহোস্টেলের আশেপাশে কিছু কিছু হিন্দু পরিবার ছিল, তাদেরও রক্ষা করা গিয়েছিল। এঁদের সুরেন ব্যানারজি রোডে একবার পৌঁছে দিতে পারলেই হয়।
আমি নিজেও খুব চিন্তাযুক্ত ছিলাম। কারণ, আমরা ছয় ভাইবোনের মধ্যে পাঁচজনই তখন কলকাতা ও শ্রীরামপুরে। আমার মেজোবোনের জন্য চিন্তা নাই, কারণ সে বেনিয়া পুকুরে আছে। সেখানে এক বোন বেড়াতে এসেছে। এক বোন শ্রীরামপুরে ছিল। একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের ম্যাট্রিক পড়ে। একেবারে ছেলেমানুষ। একবার মেজো জনের বাড়ি, একবার আমার ছোটবোনের বাড়ি এবং মাঝে মাঝে আমার কাছে বেড়িয়ে বেড়ায়। কারো
৬৬
কথা বেশি শোনে না। খুবই দুষ্ট ছিল ছোটবেলায়। নিশ্চয়ই গড়ের মাঠে এসেছিল। আমার কাছে ফিরে আসে নাই। বেঁচে আছে কি না কে জানে! শ্রীরামপুরের অবস্থা খুবই খারাপ। যে পাড়ায় আমার বোন থাকে, সে পাড়ায় মাত্র দুইটা ফ্যামিলি মুসলমান।
কলকাতা শহরে শুধু মরা মানুষের লাশ বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। মহল্লার পর মহল্লা আগুনে পুড়ে গিয়েছে। এক ভয়াবহ দৃশ্য! মানুষ মানুষকে এইভাবে হত্যা করতে পারে, চিন্তা করতেও ভয় হয়! এক এক করে খবর নিতে চেষ্টা করলাম। ছোট ভগ্নিপতি হ্যারিসন রোডে টাওয়ার লজে থাকে। সেখানে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িতে যেয়ে খবর নিলাম, সে চলে গেছে কারমাইকেল হোস্টেলে। নাসের মেজোবোনের কাছেও নাই, আমার কাছেও নাই। আমার সবচেয়ে ছোট ভগ্নিপতি সৈয়দ হোসেনকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল, ‘নাসের ভাই ১৬ই আগস্ট আমার এখানে এসেছিল, থাকতে বললাম থাকল না, আমিও জোর করলাম না। কারণ আমার জায়গাটাও ভাল না। আমাদেরও পালাতে হবে’।
তারপরে আর খোঁজ নাই, কি করে খবর নিই! লেডী ব্র্যাবোরন কলেজে রিফিউজিদের থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। দোতলয়া মেয়েরা, আর নিচে পুরুষরা। কর্মীদের ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। আমাকেও মাঝে মাঝে থাকতে হয়। মুসলমানদের উদ্ধার করার কাজও করতে হচ্ছে। দু’এক জায়গায় উদ্ধার করতে যেয়ে আক্রান্তও হয়েছিলাম। আমরা হিন্দুদেরও উদ্ধার করে হিন্দু মহল্লায় পাঠাতে সাহায্য করেছি। মনে হয়েছে, মানুষ তার মানবতা হারিয়ে পশুতে পরিণত হয়েছে। প্রথম দিন ১৬ই আগস্ট মুসলমানরা ভীষণভাবে মার খেয়েছে। পরের দুই দিন মুসলমানরা হিন্দুদের ভীষণভাবে মেরেছে। পরে হাসপাতালের হিসাবে সেটা দেখা গিয়েছে।
এদিকে হোস্টেলগুলিতে চাউল, আটা ফুরিয়ে গিয়েছে। কোন দোকান কেউ খোলে না, লুট হয়ে যাবার ভয়েতে। শহীদ সাহবের কাছে গেলাম। কি করা যায়? শহীদ সাহেব বললেন, ‘নবাবজাদা নসরুল্লাহকে (ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহ সাহেবের ছোট ভাই, খুব অমায়িক লোক ছিলেন, শহীদ সাহেবের ভক্ত ডেপুটি চিফ হুইপ ছিলেন) ভার দিয়েছি, তার সাথে দেখা কর’। আমরা তাঁর কাছে ছুটলাম। তিনি আমাদের নিয়ে সেন্ট জেভিয়ারস কলেজে গেলেন এবং বললেন, ‘চাউল এখানে রাখা হয়েছে তোমরা নেবার বন্দোবস্ত কর।আমাদের কাছে গাড়ি নাই। মিলিটারি নিয়ে গিয়েছে প্রায় সমস্ত গাড়ি। তবে দেরি করলে পরে গাড়ি বন্দোবস্ত করা যাবে’। আমরা ঠেলাগাড়ি আনলাম, কিন্ত ঠেলবে কে? আমি, নূরুদ্দিন ও নূরুল হুদা (এখন ডিআইটির ইঞ্জিনিয়ার) এই তিনজনে ঠেলাগাড়িতে চাউল বোঝাই করে ঠেলতে শুরু করলাম। নূরুদ্দিন সাহেব তো ‘তালপাতার সেপাই’- শরীরে একটুও বল নাই। আমরা তিনজনে ঠেলাগাড়ি করে বেকার হোস্টেল, ইলিয়ট হোস্টেলে চাউল পৌঁছে দিলাম। এখন কারমাইকেল হোস্টেলে কি করে পৌছাই? অনেক দূর, হিন্দু মহল্লা পার হয়ে যেতে হবে। ঠেলাগাড়িতে পৌঁছান সম্পূর্ণ অসম্ভব। নূরুদ্দিন চেষ্টা করে একটা ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি জোগাড় করে আনল। আমরা তিনজন কিছু চাল নিয়ে কারমাইকেল হোস্টেলে পৌঁছে ফিরে আসলাম।
৬৭
শ্রীরামপুরে কোনো গোলমাল হয় নাই শুনলাম, কিন্ত নাসের কোথায়? লোক পাঠালাম শ্রীরামপুরে খবর আনতে। দাঙ্গা ও লুটতরাজ একটু বন্ধ হয়েছে। নাসের কলকাতায় এসেছিল ১৬ই আগস্ট। নাসেরের একটা পা ছোটকালে টাইফয়েড হয়ে খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল। পা টেনে টেনে হাঁটতে হয়। সেই পা দেখিয়ে এম্বুলেন্সে উঠে পড়ে। দিনভর এম্বুলেন্সে থাকে, সন্ধ্যায় হাওড়া থেকে ট্রেনে উঠে শ্রীরামপুর যায়। ট্রেনে তিন ঘন্টা লাগে। কয়েকবার ট্রেনে আক্রমণ হয়েছে। কোনোমতে বেঁচে গিয়েছে। একটা কথা সত্য, অনেক হিন্দু মুসলমানদের রক্ষা করতে যেয়ে বিপদে পড়েছে। জীবনও হারিয়েছে। আবার অনেক মুসলমান হিন্দু পাড়াপড়শীকে রক্ষা করতে যেয়ে জীবন দিয়েছে। আমি নিজেই এর প্রমাণ পেয়েছি। মুসলিম লীগ অফিসে যেসব টেলিফোন আসত, তার মধ্যে বহু টেলিফোন হিন্দুরাই করেছে। তাদের বাড়িতে মুসলমানদের আশ্রয় দিয়েছে, শীঘ্রই এদের নিয়ে যেতে বলেছে, নতুবা এরাও মরবে, আশ্রিত মুসলমানরাও মরবে।
একদল লোককে দেখেছি দাঙ্গাহাঙ্গামার ধার ধারে না। দোকাল ভাঙছে, লুট করছে, আর কোনো কাজ নাই। একজনকে বাধা দিতে যেয়ে বিপদে পড়েছিলাম। আমাকে আক্রমণ করে বসেছিল। কারফিউ জারি হয়েছে, রাতে কোথাও যাবার উপায় নাই। সন্ধার পরে কোন লোক রাস্তায় বের হলে আর রক্ষা নাই। কোন কথা নাই, দেখামাত্র শুধু গুলি। মিলিটারি গুলি করে মেরে ফেলে দেয়। এমনকি জানালা খোলা থাকলেও গুলি করে। ভোরবেলা দেখা যেত অনেক লোক রাস্তায় গুলি খেয়ে মরে পড়ে আছে। কোনো কথা নেই শুধু গুলি।
একবার আমার ও সিলেটের মোয়াজ্জম চৌধুরীর (এখন কনভেনশন মুসলিম লীগের এমএনএ) উপর ভার পড়েছে রাতে পার্ক সার্কাস ও বালিগঞ্জের মাঝে একটা মুসলমান বস্তি আছে-প্রত্যেক রাতেই হিন্দুরা সেখানে আক্রমণ করে-তাদের পাহারা দেওয়ার জন্য। কারণ, বন্দুক চালানোর লোকের নাকি অভাব। আমি ও মোয়াজ্জেম বন্দুক চালাতে পারতাম। আমার ও মোয়াজ্জেমের বাবার বন্দুক ছিল। আমরা গুলি ছুঁড়তে জানতাম।
সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় খবর এল মিল্লাত অফিস থেকে ঐ এলাকায় যাবার জন্য। আমরা রওয়ানা করে তাড়াতাড়ি ছুটতে লাগলাম, কোন গাড়ি নাই। আমাদের পায়ে হেঁটেই পোউছাতে হবে। কেবলমাত্র লোয়ার সার্কুলার রোড পার হয়ে আমরা ছোট রাস্তায় ঢুকেছি, অমনিই কারফিউর সময় হয়ে গেছে। কবরস্থানের পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। গাড়ির শব্দ পেলেই আমরা লুকাই, আবার হাঁটি। অনেক কষ্ঠে পার্ক সার্কাস ময়দানের পিছনে এলাম। ময়দান পার হই কি করে? অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টার পর ময়দানের পিছন দিয়ে ‘সওগাত’ প্রেসের মালিক ও সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সাহেবের বাড়ির কাছে পৌছালাম। সেখান থেকে আর একটা রাস্তা পার হয়ে এক বন্ধুর বাড়িতে ঢুকলাম। কিন্ত এখন কি করি? বন্ধুর বাবা ও মা আমাদের কিছুতেই বার হতে দিতে রাজি হলেন না। কারণ, রাস্তার মোড়েই মিলিটারি পাহারা দিচ্ছে। তারা ছায়া দেখলেও গুলি করে। উপায় নাই। রাতে আমাদের সেখানেই কাটাতে হল। আমরা জায়গামত পৌছাতে পারলাম না। যদিও সে
৬৮
রাতে কোনো গোলমাল হয় নাই। প্রায় মেইল দেড়েক পথ অতিক্রম করেছিলাম। যে কোনো সময় গুলি খেয়ে মরতে পারতাম।
পার্ক সার্কাস এরিয়ায় বিচারপতি সিদ্দিকী, জনাব আবদুর রশিদ, জনাব তোফাজ্জল আলী (ভূতপূর্ব মন্ত্রী), আরও অনেকে ডিফেন্স পার্টির নেতৃত্ব দিতেন। আমরা ছিলাম স্বেচ্ছাসেবক। শিয়ালদহ ও হাওড়া স্টেশনে হিন্দু ও মুসলমানদের ক্যাম্প করা হয়েছিল-যাতে বাইরে থেকে কেউ এসেই হিন্দু বা মুসলমান মহল্লায় না যায়। কারণ মুসলমানরা হিন্দুদের মহল্লায় এবং হিন্দুরা মুসলমান মহল্লায় গেলে আর রক্ষা নাই। কলকাতায় মহিলাদের মধ্যে জনাব সোহরাওয়ারদীর মেয়ে মিসেস সোলায়মান, নবাবজাদা নসরুল্লাহর মেয়ে ইফফাত নসরুল্লাহ, বেগম আক্তার আতাহার আলী, সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদিকা নূরজাহান বেগম, বেগম রশিদ, রোকেয়া কবীর এবং মন্নুজান হোস্টেলের ও ব্র্যাবোরন কলেজের মেয়েরা খুবই পরিশ্রম করেছেন। রাতদিন রিফিউজি সেন্টারে এরা কাজ করতেন মেয়েদের ভিতর, আমাদের করতে হত পুরুষদের মধ্যে। রাতে অসুবিধা হত, তবুও হাজেরা মাহমুদ আলী, হালিমা নূরুদ্দিন আরও কয়েকজনকে সারা রাত পরিশ্রম করতে দেখেছি। কলকাতার অবস্থা খুবই ভয়াবহ হয়ে গেছে। মুসলমানরা মুসলমান মহল্লায় চলে এসেছে। হিন্দুরা হিন্দু মহল্লায় চলে গিয়েছে। বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা করার জায়গা ছিল একমাত্র এসপ্লানেড, যাকে আমরা চৌরঙ্গী বলতাম। এখন অবস্থা হয়েছে আরও খারাপ। বেশ কিছুদিন কোনো গোলমাল নাই। হঠাৎ এক জায়গায় সামান্য গোলমাল আর ছোরা মারামারি শুরু হয়ে গেল। শহীদ সাহেব সমস্ত রাতদিন পরিশ্রম করছেন, শান্তি রক্ষা করবার জন্য। কলকাতায় চৌদ্দ-পনের শত পুলিশ বাহিনীর মধ্যে মাত্র পঞ্চাশ-ষাটজন মুসলমান, অফিসারদের অবস্থাও প্রায় সেই রকম। শহীদ সাহেব লীগ সরকার চালাবেন কি করে? তিনি আরও এক হাজার মুসলমানকে পুলিশ বাহিনীতে ভর্তি করতে চাইলে তদানীন্তন ইংরেজ গভর্নর আপত্তি তুলেছিলেন। শহীদ সাহেব পদত্যাগের হুমকি দিলে তিনি রাজি হন। পাঞ্জাব থেকে যুদ্ধ ফেরত মিলিটারি লোকদের এনে ভর্তি করলেন। এতে ভীষণ হৈচৈ পড়ে গেল। কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার কাগজগুলি হৈচৈ বেশি করল।
কলকাতার দাঙ্গা বন্ধ হতে না হতেই আবার দাঙ্গা শুরু হল নোয়াখালীতে। মুসলমানরা সেখানে হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুট করল এবং আগুন লাগিয়ে দিল। ঢাকায় তো দাঙ্গা লেগেই আছে। এর প্রতিক্রিয়ায় শুরু হল বিহারে ভয়াবহ দাঙ্গা। বিহার প্রদেশের বিভিন্ন জেলায় মুসলমানদের উপর প্ল্যান করে আক্রমণ হয়েছিল। এতে অনেক লোক মারা যায়, বহু ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। দাঙ্গা শুরু হওয়ার তিন দিন পরেই আমরা রওয়ানা করলাম পাটনায়। বহু স্বেচ্ছাসেবক রওয়ানা হয়ে গিয়েছে। অনেক ডাক্তারও কলকাতা থেকে গিয়েছিল। আমার কলকাতার এক সহকর্মী মিস্টার ইয়াকুব, খুব ভাল ফটোগ্রাফার, সে ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছে।
৬৯
ঘুরে ঘুরে অনেক ফটো তেলেছিল বিহার থেকে। জহিরুদ্দিন, নূরুদ্দিন ও আমি যেদিন যাই সেদিন জনাব ফজলুল হক সাহেবও পাটনায় রওনা দিলেন। শহীদ সাহেব পাটনায় মুসলিম লীগ নেতাদের খবর দিলেন যে কোন সাহায্য প্রয়োজন হলে বেঙ্গল দরকার দিতে রাজি আছে। বিহার সরকারকেও তিনি একথা জানিয়ে দিলেন। আমরা যখন পাটনায় নামলাম, অবস্থা দেখে রীতিমত ভয় লাগতে লাগল। কাউকেও চিনি না, কোথা থেকে কোথায় যাই! তবে জহির পাটনায় কয়েকবার গিয়েছে। আমরা মিস্টার ইউনুস, মন্ত্রী বিহার সরকারের, তাঁর একটা হোটেল আছে- ‘গ্রান্ড হোটেল’, সেই হোটেলে গিয়ে হাজির হলাম। সেখানে মওলানা রাগীব আহসান সাহেব অফিস খুলেছেন, বেঙ্গল মুসলিম লীগের তরফ থেকে। আবদুর রব নিশতার সাহেব সেদিন আসলেন। আমরা একসাথে কনফারেন্স করলাম, কি করা যায়! তিন দিন পরে, নূরুদ্দিন কলকাতায় চলে গেল। জহির পাটনায় রইল। আমরা বললাম, বিহারে আমরা কি সাহায্য করতে পারি? শহীদ সাহেব বলেছেন, ট্রেন ভরে আসানসোলে রিউফিউজিদের পৌছে দিলে বাংলা সরকার তাদের সকল দায়িত্ব নিতে রাজি আছে। জনাব আকমল (আইসিএস) আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কেমন করে শহীদ সাহেবের পক্ষ থেকে কথা বলতে পারেন?’আমার অল্প বয়স দেখে তিনি বিশ্বাস করতেই চাইলেন না যে, শহীদ সাহেব আমার সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করতে পারেন। আমি তাঁকে বললাম, ‘আমি শহীদ সাহেবের মতামত জানি এবং তাঁর পক্ষ থেকে কথাও কিছু বলতে পারি’। অনেকে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। আমি শহীদ সাহেবের ফোন নাম্বার দিয়ে বললাম, ‘টেলিফোন করে দেখতে পারে,’।
সকালবেলা আবার বসবার কথা। আকমল সাহেব আমাকে বললেন, ‘আজ থেকেই আমরা আসানসোলে লোক পাঠাব’। যে সমস্ত লোক গ্রাম থেকে শহরে আসছে তাদের জায়গা দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। আঞ্জুমানে ইসলামিয়া ও আর যে সমস্ত জায়গা করা হয়েছিল সেখানে আর জায়গা নাই। সীমান্ত থেকে মানকী শরীফের দল, আলীগড় থেকে আমাদের বন্ধু মোস্তফা ও সৈয়দ আহমেদ আলীসহ বহু ছাত্র কর্মী এসেছে। কলকাতা থেকে ছাত্র, ডাক্তার, ন্যাশনাল গার্ড মিলে প্রায় হাজার লোক পাটনায় জমা হয়েছে। দূর দূর গ্রাম থেকে দুর্গতদের উদ্ধার করে আনা হচ্ছে। আমি হাজার খানেক রিফিউজি নিয়ে রওয়ানা করলাম আসানসোলের দিকে। আসানসোল মুসলিম লীগ নেতা মওলানা ইয়াসিন সাহেবকে টেলিগ্রাম করা হয়েছে। তিনি দুইখানা ট্রাক ও কিছু ভলানটিয়ার নিয়ে স্টেশনে হাজির ছিলেন। লোকগুলিকে প্লাটফর্মেই রাখা হল। অনেক লোক জখম ছিল। নূরুদ্দিন শহীদ সাহেবকে পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলেছে। পাটনা থেকেও খবর দেওয়া হয়েছে শহীদ সাহেবকে। তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও এসডিওকে হুকুম দিয়েছেন, এদের জায়গা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করতে।
নূরুদ্দিন কলকাতা থেকে আমাকে সাহায্য করবার জন্য কিছু স্বেচ্ছাসেবক ও কিছু ডাক্তার পাঠিয়েছে। এসডিও ছিলেন একজন ইউরোপিয়ান। তিনি যুবক ও খুবই ভদ্রলোক। শহীদ সাহেব হুকুম দিয়াছেন, যে সমস্ত ব্যারাক যুদ্ধের সময় করা হয়েছিল সৈন্যদের থাকবার জন্য সেগুলির মধ্যে রিফিউজিদের রাখতে। সরকার থেকে খাবার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল।
৭০
তার বিলি বন্টনের জন্য এসডিও, আসালসোল মুসলিম লীগ নেতারা ও আমি একটা বৈঠক করলাম। প্রথমে ক্যাম্প খোলা হল ‘নিগাহ’ নামে একটা ছোট্ট গুদামে। সেখানে হাজার খানেক লোক ধরবে। পরে কান্দুলিয়া ক্যাম্প খোলা হল। এতে প্রায় দশ হাজার লোকের জায়গা হবে। আমি এই ক্যাম্পের নাম দিলাম, ‘হিজরতগঞ্জ’। মওলানা ইয়াসিন নামটা গ্রহণ করলেন এবং খুশি হলেন। আসানসোল স্টেশনে ও পরে রাণীগঞ্জ স্টেশনে মোহাজেরদের নামানো হত, পরে ট্রাকভরে ক্যাম্পগুলিতে নিয়ে আসা হত। আমার সাথে সকল সময়ের জন্য কাজ করতেন মওলানা ওয়াহিদ সাহেব। আমরা একসাথে পড়তাম, এখন তিনি শাহাজাদপুরের পীর সাহেব।
আমাদের খাওয়া-দাওয়ার কোনো বন্দোবস্ত ছিল না। মোহাজিরদের জন্য যা পাক করতাম, তার থেকেই কিছু খেয়ে নিতাম। দোকানপাট কিছুই ছিল না। শত শত লোক রোজই আসছে। দিনে একবেলার বেশি খেতে দিতে পারতাম না। একটা হাসপাতাল করেছিলাম। ময়মনসিংহের ডা. আবদুল হামিদ এবং গফরগাঁয়ের ডা, হজরত আলী এই হাসপাতালে কাজ করতেন। আসানসোলের এসডিও মিস্টার রোজ চার পাঁচ দিন পরে একজন বৃদ্ধ মেম সাহেবকে নিয়ে আসলেন। তিনি আমাদের কাজের প্ল্যান করে দিয়ে সাহায্য করবেন। কারণ, এই ভদ্রমহিলা যুদ্ধের সময় ব্রহ্মদেশ থেকে যখন লোক পালিয়ে আসহিল তখন সরকারি ক্যাম্পের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি যে প্ল্যান দিলেন, তাতে কাজের সুবিধাই হল।
ছয়-সাত দিন পর, বাংলা সরকার জনাব সলিমুল্লাহ ফাহমীকে বিহার মোহাজেরদের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী নিয়োগ করলেন। তিনি আসানসোলে এসে আমার খোঁজ করেন। পরে ময়রা ক্যাম্পে এসে আমাকে পেলেন। তিনি ক্যাম্পগুলিকে সরকারের তত্ত্বাবধানে নিয়ে গেলেন। মুসলিম লীগ স্বেচ্ছাসেবকরাও কাজ করলেন। আমি ও সলিমুল্লাহ সাহেব পরামর্শ করে মোহাজেরদের থেকে সুপারিন্টেনডেন্ট, এসিসট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট, রেশন ইনচারজ, দারোয়ান ও অন্যান্য কর্মচারী নিযুক্ত করলাম।
এক জায়গায় খানা পাকানো সম্ভবপর হচ্ছে না। রেশন কার্ড করে প্রত্যেক ফ্যামিলিকে বিনা পয়সায় চাল, জ্বালানি কাঠ, মরিচ, পিয়াজ সবকিছুই সাত দিনের জন্য দিয়ে দেওয়া হবে। শুধু মাংস একদিন পর পর দেওয়া হবে। মোহাজেররা এই বন্দোবস্তে খুশি হলেন। এই সমস্ত ঠিক করতে এক মাস হয়ে গেল। এই সময় বিহার থেকে জাফর ইমাম সাহেব মোহাজেরদের বাংলাদেশের লোকেরা কেমন রেখেছে দেখবার জন্য এলেন। আমার সাথেও দেখা করলেন, আমাদের অফিসে। আমরা একোটা অফিস খুলেছিলাম, তার পাশেই আমরা থাকতাম। আমাদের পাকের বন্দোবস্তও হয়েছিল ঐখানেই। আমাদের সংগঠন এবং ব্যবস্থাপনা দেখে তিনি আমাকে ও আমাদের সহকর্মীদের অনেক ধন্যবাদ দিয়েছিলেন। মোহাজেরদের সাথে দেখা করে তাদের সুবিধা ও অসুবিধার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন।
পরে ময়রা ও মাধাইগঞ্জে ক্যাম্প খুললাম। এই দুই ক্যাম্পে প্রায় দশ হাজার মোহাজের দেওয়া হয়েছিল। অনেক শিক্ষিত ভদ্র ফ্যামিলিও এসেছিলেন। মোহাজেরদের আর আসানসোল
৭১
এরিয়ার জায়গা দেওয়া সম্ভব হবে না। আমরা এর পরে বিষ্ণুপুর, অন্ডাল, বর্ধমানেও কিছু কিছু মোহাজের পাঠালাম। আমার সাথে যে সমস্ত কর্মী ছিল, আহার নিদ্রার অভাব ও কাজের চাপে প্রায় সকলেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাই অনেককে পূর্বেই কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছি। আমারও জ্বর হয়ে গিয়েছিল। এই সময় মোহাম্মদ আলী ও এ.এফ.এম. আবদুর রহমান মন্ত্রী ছিলেন। তারা বেগম সোলায়মান, ইফফাত নসরুল্লাহ ও আরও কয়েকজন কর্মচারীসহ আসানসোলে আসেন। আমাকে পূর্বেই খবর পাঠিয়েছিল। আমিও আসানসোলে তাঁদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তাঁদের নিয়ে ক্যাম্পগুলি দেখান হয়েছিল। সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাঁদের সাথেই কলকাতা রওয়ানা হয়ে আসতে বাধ্য হলাম। বেগম সোলায়মান আমার শরীর ও চেহারার অবস্থা দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন।
দেড় মাস পরে আমি কলকাতায় হাজির হলাম, অসুস্থ শরীর নিয়ে। বেকার হোস্টেলে এসেই আমি আরও অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমার জ্বর মোটেই ছাড়ছিল না। শহীদ সাহেব খবর পেয়ে এত কাজের ভিতরেও আমার মত সামান্য কর্মীর কথা ভোলেন নাই। ট্রপিক্যাল স্কুল অব মেডিসিনের ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডে আমার জন্য সিট ঠিক করে খবর পাঠিয়ে দিলেন। পনের দিন হাসপাতালে ছিলাম, তিনি ফোন করে প্রিন্সিপালের কাছ থেকে খোঁজ নিতেন। সেই জন্যই প্রিন্সিপাল আমাকে দেখতে আসতেন। আমি ভাল হয়ে আবার হোস্টেলে ফিরে এলাম।
আসানসোলে ইউরোপিয়ান ভদ্রমহিলার কাছ থেকে এবং নিজ হাতে কাজ করে যে অভিজ্ঞতা পেয়েছিলাম, পরবর্তী জীবনে তা আমার অনেক উপকার করেছিল, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে। এই সময় মনস্থির করলাম, আমাকে বিএ পরীক্ষা দিতে হবে। ড. জুবেরী আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন, তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি বললেন, ‘তুমি যথেষ্ট কাজ করেছ পাকিস্তান অর্জন করার জন্য। তোমাকে আমি বাধা দিতে চাই না। তুমি যদি ওয়াদা কর যে এই কয়েক মাস লেখাপড়া করবা এবং কলকাতা ছেড়ে বাইরে কোথাও চলে যাবা এবং ফাইনাল পরীক্ষার পূর্বেই এসে পরীক্ষা দিবা, তাহলে তোমাকে আমি অনুমতি দিব’। তখন টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেছে। আমি ওয়াদা করলাম, প্রফেসর তাহের জামিল, প্রফেসর সাইদুর রহমান এবং প্রফেসর নাজির আহমদের সামনে। আমি অনুমতি নিয়ে আমার এক বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী- তার নাম ছিল শেখ শাহাদাত হোসেন, ১৯৪৬ সালে বিএ পাস করেছে, এখন হাওড়ার উলটোডাঙ্গায় চাকরি করে, ওর কাছে চলে গেলাম, সমস্ত বইপত্র নিয়ে।
পরীক্ষার কিছুদিন পূর্বে কলকাতায় চলে আসি। হোস্টেল ছেড়ে দিয়েছি। আমার ছোটবোনের সামী বরিশালের এডভোকেট আবদুর রব সেরনিয়াবত তখন পার্ক সার্কাসে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছেন। আমার বোনও থাকত, তার কাছেই উঠলাম। কিছুদিন পরে
৭২
রেণুও কলকাতায় এসে হাজির। রেণুর ধারণা, পরীক্ষার সময় সে আমার কাছে থাকলে আমি নিশ্চয়ই পাস করব। বিএ পরীক্ষা দিয়ে পাস করলাম।
শেখ শাহাদাত হোসেন দুই মাসের ছুটি নিয়ে আমাকে পড়তে সাহায্য করেছিল। পরে জীবনে অনেক ক্ষতি আমার সে করেছে। এর জন্য তাকে কোনোদিনই কিছু বলি নাই। ওর বাড়ি আমার বাড়ির কাছাকাছি।
হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের সভাপতি হতে চাইলেন। কারণ, মওলানা আকরম খাঁ সাহেব পদত্যাগ করেছিলেন। শহীদ সাহেব রাজি হন নাই। মওলানা সাহেবকে অনুরোধ করে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করিয়েছিলেন।হাশিম সাহেব রাগ করে লীগ সেক্রেটারি পদ থেকে ছুটি নিয়ে বর্ধমানে চলে গিয়েছিলেন। যখন তিনি কলকাতা আসতেন মিল্লাত প্রেসেই থাকতেন। হাশিম সাহেব এই সময় ছাত্র ও যুবকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অনেক হারিয়ে ফেলেছিলেন। আমাদের অনেকেরই মোহ তাঁর উপর থেকে ছুটে গিয়েছিল।
সে অনেক কথা। তিনি কলকাতা আসলেই শহীদ সাহেবের বিরুদ্ধে সমালোচনা করতেন। এর প্রধান কারণ ছিল মিল্লাত কাগজকে কাগজকে দৈনিক করতে সাহায্য না করে তিনি দৈনিক ইত্তেহাদ কাগজ বের করেছিলেন-নবাবজাদা হাসান আলী সাহেবের ব্যবস্থাপনা এবং আবুল মনসুর আহমদ সাহেবের সম্পাদনায়। মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের দৈনিক আজাদও ক্ষেপে গিয়েছিল শহীদ সাহেবের উপর। কারণ, পূর্বে একমাত্র আজাদ ছিল মুসলমানদে দৈনিক। এখন আর একটা কাগজ বের হওয়াতে মওলানা সাহেব যতটা নন তাঁর দলবল খুব বেশি রাগ করেছিল।
১৯৪৬ সালের শেষের দিকে ভারতের রাজনীতিতে এক জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার বদ্ধপরিকর, যে কোনোমতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব মুসলিম লীগ গ্রহণ করেছিল। কিন্ত কংগ্রেস প্রথমে গ্রহণ করে পরে পিছিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কংগ্রেসকে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে বড়লাট লর্ড ওয়েভেল ঘোষণা করলেন। লর্ড ওয়েভেল মুসলিম লীগের সাথে ভাল ব্যবহার না করায়, মুসলিম লীগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদান করতে অস্বীকার করে। কংগ্রেস পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে সরকারে যোগদান করে। যদিও লর্ড ওয়েভেল ঘোষণা করেছিলেন, মুসলিম লীগের জন্য পাঁচটা মন্ত্রিত্বের পদ খালি রইল, ইচ্ছা করলে তারা যে কোন মুহূর্তে যোগদান করতে পারে। সরকারে যোগদান না করে একটু অসুবিধায় পড়েছিল মুসলিম লীগ। শেষ পর্যন্ত জনাব সোহরাওয়ারদী লর্ড ওয়েভেলের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং মুসলিম লীগ যাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদান করতে পারে সেই সম্বন্ধে আলোচনা করেন। মি. জিন্নাহ তাঁকে অনুমতি দিয়েছিলেন আলোচনা চালাতে। শেষ পর্যন্ত জিন্নাহ-ওয়েভেল আলোচনা করে মুসলিম লীগ সরকারে যোগদান করতে রাজি হয়। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে লিয়াকত আলী
৭৩
খান, আই আই চুন্দ্রিগড়, আবদুর রব নিশতার, রাজা গজনফর আলী খান এবং যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল মুসলিম লীগের তরফ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন ভারত সরকারে যোগদান করেন। মুসলিম লীগ যদি কেন্দ্রীয় সরকারে যোগদান না করত তবে কংগ্রেস কিছুতেই পাকিস্তান দাবি মানতে চাইত না।
১৯৪৭ সালের জুন মাসে ঘোষণা করা হল ভারতবর্ষ ভাগ হবে। কংগ্রেস ভারতবর্ষকে ভাগ করতে রাজি হয়েছে এই জন্য যে, বাংলাদেশ ও পাঞ্জাব ভাগ হবে। আসামের সিলেট জেলা ছাড়া আর কিছুই পাকিস্তানে আসবে না। বাংলাদেশের কলকাতা এবং তার আশপাশের জেলাগুলিও ভারতবর্ষে থাকবে। মওলানা আকরম খাঁ সাহেব ও মুসলিম লীগ নেতারা বাংলাদেশ ভাগ করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করলেন। বর্ধমান ডিভিশন আমরা না-ও পেতে পারি। কলকাতা কেন পাব না? কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা বাংলাদেশ ভাগ করতে হবে বলে জনমত সৃষ্টি করতে শুরু করল। আমরাও বাংলাদেশ ভাগ হতে দেব না, এর জন্য সভা করতে শুরু করলাম। আমরা কর্মীরা কি জানতাম যে, কেন্দ্রীয় কংগ্রেস ও কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ মেনে নিয়েছে এই ভাগের ফর্মুলা? বাংলাদেশ যে ভাগ হবে, বাংলাদশের নেতারা তা জানতেন না। সমস্ত বাংলা ও আসাম পাকিস্তানে আসবে এটাই ছিল তাদের ধারণা। আজ দেখা যাচ্ছে, মাত্র আসামের এক জেলা- তাও যদি গণভোটে জয়লাভ করতে পারি। আর বাংলাদেশে মুসলিম সংখ্যাগুরু জেলাগুলি কেটে হিন্দুস্থানে দেওয়া হবে। আমরা হতাশ হয়ে পড়লাম। কলকাতার কর্মীরা ও পসচিমবঙ্গের কর্মীরা এসে আমাদের বলত, তোমরা আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, আমাদের কপালে কি হবে খোদাই জানে! সত্যি দুঃখ হতে লাগল ওদের জন্য। গোপনে গোপনে কলকাতার মুসলমানরা প্রস্তুত ছিল, যা হয় হবে, কলকাতা ছাড়া হবে না। শহীদ সাহেবের পক্ষ থেকে বাংলা সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব মোহাম্মদ আলী ঘোষণা করেছিলেন, কলকাতা আমাদের রাজধানী থাকবে। দিল্লি বসে অনেক পূর্বেই যে কলকাতাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে একথা তো আমরা জানতামও না, আর বুঝতামও না,
এই সময় শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের তরফ থেকে এবং শরৎ বসু ও কিরণশংকর রায় কংগ্রেসের তরফ থেকে এক আলোচনা সভা করেন। তাঁদের আলোচনায় এই সিদ্ধান্ত হয় যে, বাংলাদেশ ভাগ না করে অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করা যায় কি না? শহিদ সাহেব দিল্লিতে জিন্নাহর সাথে সাক্ষাৎ করে এবং তাঁর অনুমতি নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। বেঙ্গল মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি এক ফর্মুলা সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে। যতদূর আমার মনে আছে, তাতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে। জনসাধারণের ভোটে একটা গণপরিষধ হবে। সেই গণপরিষদ ঠিক করবে বাংলাদেশ হিন্দুস্থান না পাকিস্তানে যোগদান করবে, নাকি স্বাধীন থাকবে। যদি দেখা যায় যে, গণপরিষদের বেশি সংখ্যক প্রতিনিধি পাকিস্তানে যোগদানে পক্ষপাতী, তবে বাংলাদেশ পুরাপুরিভাবে পাকিস্তানে যোগদান করবে। আর যদি দেখা যায় বেশি সংখ্যক লোক ভারতবর্ষে
৭৪
থাকতে চায়, তবে বাংলাদেশ ভারতবর্ষে যোগ দেবে। যদি স্বাধীন থাকতে চায়, তাও থাকতে পারবে। এই ফর্মুলা নিয়ে জনাব সোহরাওয়ারদী ও শরৎ বসু দিল্লিতে জিন্নাহ ও গান্ধীর সাথে দেখা করতে যান। শরৎ বসু নিজে লিখে গেছেন যে জিন্নাহ তাঁকে বলেছিলেন, মুসলিম লীগের কোনো আপত্তি নাই, যদি কংগ্রেস রাজি হয়। ব্রিটিশ সরকার বলে দিয়েছে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একমত না হলে তারা নতুন কোনো ফর্মুলা মানতে পারবেন না। শরৎ বাবু কংগ্রেসের নেতাদের সাথে দেখা করতে যেয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। কারণ, সরদার বল্লব ভাই প্যাটেল তাঁকে বলেছিলেন, ‘শরৎ বাবু পাগলামি ছাড়েন, কলকাতা আমাদের চাই’। মহাত্মা গান্ধী ও পণ্ডিত নেহেরু কোন কিছুই না বলে শরৎ বাবুকে সরদার প্যাটেলের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর মিস্টার প্যাটেল শরৎ বাবুকে খুব কঠিন কথা বলে বিদায় দিয়েছিলেন। কলকাতা ফিরে এসে শরৎ বসু খবরের কাগজে বিবৃতির মাধ্যমে একথা বলেছিলেন এবং জিন্নাহ যে রাজি হয়েছিলেন একথা স্বীকার করেছিলেন।
যুক্ত বাংলার সমর্থক বলে শহীদ সাহেব ও আমাদের অনেক বদনাম দেবার চেষ্টা করেছেন অনেক নেতা। যদিও এই সমস্ত নেতারা অনেকেই তখন বেঙ্গল মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে এই ফর্মুলা গ্রহণ করেছিলেন। জিন্নাহর জীবদ্দশায় তিনি কোনোদিন শহীদ সাহেবকে দোষারোপ করেন নাই। কারণ, তাঁর বিনা সম্মতিতে কোনো কিছুই তখন করা হয় নাই। যখন বাংলা ও আসাম দুইটা প্রদেশই পাকিস্তানে যোগদান করুক, এর জন্যই আমাদের আন্দোলন ছিল, তখন সমস্ত বাংলা পাকিস্তানে আসলে ক্ষতি কি হত তা আজও বুঝতে কষ্ট হয়! যখন বাংলাদেশ ভাগ হবে এবং যতটুকু পাকিস্তানে আসে তাই গ্রহণ করা হবে এটা মেনে নেওয়া হয়েছে- তখন সে প্রশ্ন আজ রাজনৈতিক কারণে মিথ্যা বদনাম দেয়ার জন্যই ব্যবহার করা হয়। বেশি চাইতে বা বেশি পেতে চেষ্টা করায় কোন অন্যায় হতে পারে না। যা পেয়েছি তা নিয়েই আমরা খুশি হতে পারি। খাজা নাজিমুদ্দীণ সাহেব ১৮৪৭ সালের ২২শে এপ্রিল ঘোষণা করেছিলেন, ‘যুক্ত বাংলা হলে হিন্দু মুসলমানের মঙ্গলই হবে’। মওলানা আকরম খাঁ সাহেব মুসলিম লীগের সভাপতি হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমার রক্তের উপর দিয়ে বাংলাদেশ ভাগ হবে। আমার জীবন থাকতে বাংলাদেশ ভাগ করতে দেব না। সমস্ত বাংলাদেশই পাকিস্তানে যাবে’। এই ভাষা না হলেও কথাগুলির অর্থ এই ছিল। আজাদ কাগজ আজও আছে। ১৯৪৭ সালের কাগজ বের করলেই দেখা যাবে।
এই সময় বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন তলে তলে কংগ্রেসকে সাহায্য করছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল তিনি ভারত ও পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল একসাথেই থাকবেন। জিন্নাহ রাজি হলেন না, নিজেই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হয়ে বসলেন। মাউন্টব্যাটেন সম্বন্ধে বোধহয় তাঁর ধারণা ভাল ছিল না। মাউন্টব্যাটেন ক্ষেপে গিয়ে পাকিস্তানের সর্বনাশ করার চেষ্টা করলেন। যদিও র‍্যাডক্লিফকে ভার দেওয়া হল সীমানা নির্ধারণ করতে, তথাপি তিনি নিজেই গোপনে কংগ্রেসের সাথে পরামর্শ করে একটা ম্যাপ রেখা তৈরি করেছিলেন বলে অনেকের ধারণা। জিন্নাহ গভর্নর জেনারেল হোক, এটা আমরা যুবকরা মোটেও
৭৫
চাই নাই। তিনি প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হবেন, পরে প্রেসিডেন্ট হবেন, এটাই আমরা আশা করেছিলাম। লর্ড মাউন্টব্যাটেন পাকিস্তানের বড়লাট থাকলে এতখানি অন্যায় করতে পারতেন কি না সন্দেহ ছিল! এটা আমার ব্যক্তিগত মত। জিন্নাহ অনেক বুদ্ধিমান ছিলেন আমাদের চেয়ে, কি উদ্দেশ্যে নিজেই গভর্নর হয়েছিলেন তা তিনিই জানতেন।
পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথেই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে জনাব সোহরাওয়ারদীর বিরুদ্ধে দিল্লিতে এক ষড়যন্ত্র শুরু হয়। কারণ, বাংলাদেশ ভাগ হলেও যতটুকু আমরা পাই, তাতেই সিন্ধু, পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের মিলিতভাবে লোকসংখ্যার চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের লোক সংখ্যা বেশি। সোহরাওয়ারদীর ব্যাক্তিত্ব, অসাধারণ রাজনৈতিক জ্ঞান, বিচক্ষণতা ও কর্মক্ষমতা অনেককেই বিচলিত করে তুলেছিল। কারণ, ভবিষ্যতে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চাইবেন এবং বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কারও থাকবে না। জিন্নাহ সোহরাওয়ারদীকে ভালবাসতেন। তাই তাঁকে প্রথমেই আঘাত করতে হবে। এদিকে সাম্প্রদায়িক গোলমাল লেগেই আছে কলকাতায়। অন্যদিকে পার্টিশন কাউন্সিলের সভা। কংগ্রেস কলকাতায় ছায়া মন্ত্রিসভা গঠন করেছে। আর একদিকে গোপনে শহীদ সাহেবকে নেতৃত্ব থেকে নামিয়ে নাজিমুদ্দীনকে বসাবার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে কলকাতা ও দিল্লিতে। পাঞ্জাব ভাগ হল, সেখানে নির্বাচনের প্রশ্ন আসল না। নবাব মামদোত পূর্ব পাঞ্জাবের লোক হয়েও পশ্চিম পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী হলেন। লিয়াকত আলী খান ভারতবর্ষের লোক হয়েও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন। আর সোহরাওয়ারদী পশ্চিমবঙ্গের লোক হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে হলে আবার তাঁকে নির্বাচন করতে হবে বলা হল। যেখানে সমগ্র বাংলাদেশের মুসলিম লীগ এমএলএরা সর্বসম্মতিক্রমে শহীদ সাহেবকে নেতা বানিয়েছিলেন এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী আছেন-এই অবস্থার মধ্যে দিল্লি থেকে হুকুম আসল আবার নেতা নির্বাচন হবে। শহীদ সাহেব শাসন চালাবেন, মুসলমানদের রক্ষা করবেন, না ইলেকশন নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন! সিলেটের গণভোটেও শহীদ সাহেবকে যেতে হল। আমাদের মত হাজার হাজার কর্মীকে সিলেটে তিনি পাঠালেন। টানা বন্দোবস্ত করতে হয়েছিল তাকেই বেশি। এস.এম. ইস্পাহানী সাহেব বেঙ্গল মুসলিম লীগের কোষাধাক্ষ্য হিসাবে বহু টাকা দিয়েছিলেন, আমার জানা আছে। কারণ, শহীদ সাহেব তাঁর সাথে যখন আলোচনা করেন ৪০ নম্বর থিয়েটার রোডে, তখন আমি উপস্থিত ছিলাম। আমরা যখন সিলেটে পৌছালাম এবং কাজের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লাম, তখন শহীদ সাহেব সিলেটে আসেন। আমার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয় করিমগঞ্জ মহকুমায় এক বিরাট জনসভায়। আমিও সেই সভায় বক্তৃতা করেছিলাম।
মওলানা তর্কবাগীশ, মানিক ভাই (ইত্তেফাকের সম্পাদক), ফজলুল হক ও আমি পাঁচশত কর্মী নিয়ে একদিন সিলেটে পৌছি। আমাদের জন্য সিলেটের গণভোট কমিটির
৭৬
কিছুই করতে হয় নাই-শুধু কোন এলাকায় কাজ করতে হবে, আমাদের সেখান পৌছিয়ে দিতে হয়েছে। যাবতীয় খরচপত্রের ব্যবস্থা শহীদ সাহেব করে দিয়েছিলেন। কারো মুখাপেক্ষী আমাদের হতে হবে না। শামসুল হক সাহেব ঢাকা থেকেও বহু কর্মী নিয়ে সেখানে পৌঁছে ছিলেন। শহীদ সাহেবের অনুরোধে দানবীর রায়বাহাদুর আর.পি. সাহা হিন্দু হয়েও কয়েকখানা লঞ্চ সিলেটে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এই লঞ্চগুলি ব্যবহার করা হয়েছিল মুসলিম লীগ কর্মী এবং পাকিস্তানের পক্ষে। কারণ, যানবাহন খুবই প্রয়োজন ছিল। শহীদ সাহেবের বন্ধু ছিলেন রায়বাহাদুর, তাঁর কথা তিনি ফেলতে পারেন নাই। রায়বাহাদুর আজও পাকিস্তানী। মির্জাপুর হাসপাতাল, ভারতশ্বরী হোমস গার্লস হাইস্কুল, কুমুদিনী কলেজ তাঁরই দানে টিকে আছে।
সিলেট গণভোটে জয়লাভ করে আমরা কলকাতায় ফিরে এলাম। দেখি, মুসলিম লীগের এক দল ঠিক করেছেন নাজিমুদ্দীন সাহেবকে শহীদ সাহেবের সাথে নেতা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাবেন। কেন্দ্রীয় লীগ দিল্লি থেকে হুকুম দিয়েছেন ইলেকশন করতে। জনাব আই আই চুন্দ্রিগড় কেন্দ্রীয় লীগের পক্ষ থেকে এই নির্বাচনে সভাপতিত্ব করবেন। এদিকে দু’দেশের সম্পদের ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে যে গোলমাল চলেছে, সেদিকে কারো খেয়াল নাই। নেতা নির্বাচন নিয়ে সকলেই ব্যস্ত। নাজিমুদ্দীন সাহেব নির্বাচনের সময় নমিনেশন দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন লন্ডন ও দিল্লিতে। শহীদ সাহেব সমস্ত নির্বাচনটা নিজে চালিয়েছিলেন, টাকা পয়সার বন্দোবস্ত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি একদিনের জন্যও বিশ্রাম পান নাই। কলকাতা, নোয়াখালী ও বিহারের দাঙ্গা বিধ্বস্তদের সহায়তা দান, মুসলিম লীগের সংগঠন, দিল্লি কলকাতা দৌড়াদৌড়ি সকল কিছুই তাঁকে করতে হয়েছিল। আর যখন পাকিস্তান কায়েম হয়েছে তখন নেতা হবার জন্য আর একজনকে আমদানি করা যে কত বড় অন্যায় সেকথা ভবিষ্যৎ বিচার করবে। শহীদ সাহেবের বিরোধীদের প্রপাগান্ডা হল তিনি পশ্চিম বাংলার লোক; তিনি কেন পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হবেন? শহীদ সাহেব তো কোনদিন দুই গ্রুপ চিন্তা করেন নাই, তাই নাজিমুদ্দীন সাহেবের সমর্থকদেরও নমিনেশন দিয়েছিলেন, মন্ত্রী করেছিলেন, পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি, চিফ হুইপ, স্পিকার অনেক পদই দিয়েছিলেন। এরা সকলেই তলে তলে শহীদ সাহেবের বিরুদ্ধাচারণ করছিলেন। অন্যদিকে, পশ্চিম বাংলার মুসলিম লীগ এমএলএরা ভোট দিতে পারবেন না, কারণ তারা হিন্দুস্তানে পড়ে গিয়েছেন। তাঁর নিজের দল হাশিম সাহেবের নেতৃত্বে ঘরে বসে আছেন, শহীদ সাহেবকে সমর্থন করবেন না। হাশিম সাহেব কোনো কর্মীকে নির্দেশ দিলেন না। অনেককেই নিষেধ করে দিলেন এবং তলে তলে বলে দিলেন, শহীদ সাহেবকে সমর্থন না করতে। শহীদ সাহেবের এদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই। কোন চেষ্টাই করছেন না। কাউকেই অনুরোধ করছেন না, ভোট দিতে। তাঁকে বললে, তিনি বলতেন, ‘ইচ্ছা হয় দিবে, না হয় না দিবে, আমি কি করব?’
৭৭
শহীদ সাহেবের পক্ষে মোহাম্মদ আলী, জনাব তোফাজ্জল আলী, ডা. মালেক, মিস্টার সবুর খান, আনোয়ারা খাতুন, ফরিদপুরের বাদশা মিয়া, রংপুরের খয়রাত হোসেন কাজ করছিলেন। মন্ত্রী জনাব শামসুদ্দিন আহমদ (কুষ্টিয়া) চেষ্টা করছিলেন শহীদ সাহেবের বিপক্ষে। একমাত্র ফজলুর রহমান সাহেব-তখন মন্ত্রী ছিলেন, শহীদ সাহেবকে বলেছিলেন, তার পক্ষে নাজিমুদ্দীন সাহেবকে ভোট দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নাই। আমার কথাটা ভাল লেগেছিল। যা হোক, এর পরেও শহীদ সাহেবের পক্ষে ভোট বেশি ছিল। শেষ পর্যন্ত সিলেট জেলার সতেরজন এমএলএ কলকাতা পৌছাল, তারাও ভোট দিবেন। ডা. মালেক সিলেট গিয়েছিলেন, শহীদ সাহেবের পক্ষে কাজ করতে। তাকে সিলেটের এমএলএরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন শহীদ সাহেবের প্রোগ্রাম কি ?
ডা. মালেক বলেছিলেন, প্রথম কাজ হবে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করা। ফল হল উল্টা, তিনজন এমএলএ ছাড়া আর সকলেই ছিলেন সিলেটের জমিদার। তাঁরা ঘাবড়িয়ে গিয়েছিলেন। হোটেল বিল্টমোরে তাঁদের রাখা হয়েছিল। আমরা এদের শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ধরে এনেছিলাম। শহীদ সাহেবের কাছে সিলেটের এমএলএরা দাবি করলেন, তিনটি মন্ত্রীত্ব দিতে হবে সিলেটে। শহীদ সাহেব বললেন, ‘আমি কোন ওয়াদা করি না। তাঁদের যা প্রাপ্য তাই পাবেন’। অন্যদিকে নাজিমুদ্দীনের পক্ষে ওয়াদা দেয়া হয়েছিল। দু’একজন ছাড়া সিলেটের এমএলএরা নাজিমুদ্দীন সাহেবকে ভোট দিলেন, তাতে শহীদ সাহেব পরাজিত হলেন। যেদিন নির্বাচন হবে তার পূর্বের দিন রাত দুইটার সময়-আমি তখন শহীদ সাহেবের বাড়িতে, শহীদ সাহেব বারান্দায় শুয়ে আছেন। ডা. মালেক এসে বললেন, ‘আমাদের অবস্থা ভাল মনে হচ্ছে না, কিছু টাকা খরচ করলে বোধহয় অবস্থা পরিবর্তন করা যেত’। শহীদ সাহেব মালেক সাহেবকে বললেন, ‘মালেক, পাকিস্তান হয়েছে, এর পাক ভূমিকে নাপাক করতে চাই না। টাকা আমি কাউকেও দেব না, এই অসাধু পন্থা অবলম্বন করে নেতা আমি হতে চাই না। আমার কাজ আমি করেছি’।মালেক সাহেব বললেন, ‘ঠিক, ঠিক বলেছেন স্যার, আমারও ঘৃণা করে’। সেইদিন থেকে শহীদ সাহেবকে আমি আরও ভালবাসতে শুরু করলাম। শহীদ সাহেব ইহজগতে নাই, তবে মালেক ভাই আজও জীবিত আছেন। আমরা তিনজনই তখন ছিলাম, আর কেউ ছিল না।
আমার মনে আছে শহীদ সাহেবকে সকালবেলা আমি বলেছিলাম, ‘আমাদের এমএলএদের ওরা ভাগিয়ে নিয়ে শাহাবুদ্দীন সাহেবের বাড়িতে রেখেছে। আপনি কলকাতা মুসলিম লীগকে খবর দেন, আমরা ওদের কেড়ে আনব, আমাদের কাছে ওরা দাঁড়াতে পারবে না’। শহীদ সাহেব হেসে দিয়ে বললেন, ‘না দরকার নাই, মানুষ হাসবে। তুমি ছেলেমানুষ বুঝবা না’। কলকাতায় তখনও দাঙ্গা চলছিল। ইচ্ছা করলে কারফিউ জারি করে নির্বাচন কয়েকদিনের জন্য বন্ধ করে দিতে পারতেন। কারণ, তখনও তিনি প্রধানমন্ত্রী আছেন। পদের লোভ যে তাঁর ছিল না, এটাই তার প্রমাণ। কোনোমতে পদ আঁকড়িয়ে থাকতে হবে, এটা তিনি কোনোদিন চাইতেন না। আর ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন
৭৮
না। পাকিস্তানের রাজনীতি শুরু হল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন প্রকাশ্যে কেউ সাহস পায় নাই। যেদিন মারা গেলেন ষড়যন্ত্রের রাজনীতি পুরাপুরি প্রকাশ্যে শুরু হয়েছিল।
নাজিমুদ্দীন সাহেব নেতা নির্বাচিত হয়েই ঘোষণা করলেন, ঢাকা রাজধানী হবে এবং তিনি দলবলসহ ঢাকায় চলে গেলেন। একবার চিন্তাও করলেন না, পশ্চিম বাংলার হতভাগা মুসলমানদের কথা। এমনকি আমরা যে সমস্ত জিনিসপত্র কলকাতা থেকে ভাগ করে আনব তার দিকেও ভ্রুক্ষেপ করলেন না। ফলে যা আমাদের প্রাপ্য তাও পেলাম না। সরকারি কর্মচারীরা ঝগড়া গোলমাল করে কিছু কিছু মালপত্র স্টিমার ও ট্রেনে তুলতে পেরেছিলেন, তাই সম্বল হল। কলকাতা বসে যদি ভাগ বাটোয়ারা করা হত তাহলে কোনো জিনিসের অভাব হত না। নাজিমুদ্দীন সাহেব মুসলিম লীগ বা অন্য কারোর সাথে পরামর্শ না করেই ঘোষণা করলেন ঢাকাকে রাজধানী করা হবে। তাতেই আমাদের কলকাতার উপর আর কোনো দাবী রইল না। এদিকে লর্ড মাউন্টব্যাটেন চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়েছিলেন, কলকাতা নিয়ে কি করবেন? ‘মিশন উইথ মাউন্টব্যাটেন’ বইটা পড়লে সেটা দেখা যাবে। ইংরেজ তখনও ঠিক করে নাই কলকাতা পাকিস্তানে আসবে, না হিন্দুস্তানে থাকবে। আর যদি কোনো উপায় না থাকে তবে একে ‘ফ্রি শহর’ করা যায় কি না? কারণ, কলকাতার হিন্দু-মুসলমান লড়বার জন্য প্রস্তুত। যে কোন সময় দাঙ্গাহাঙ্গামা ভীষণ রূপ নিতে পারে। কলকাতা হিন্দুস্তানে পড়লেও শিয়ালদহ স্টেশন পর্যন্ত পাকিস্তানে আসার সম্ভাবনা ছিল। হিন্দুরা কলকাতা পাবার জন্য আরও অনেক কিছু ছেড়ে দিতে বাধ্য হত।
এই বইতে আরও আছে, একজন ইংরেজ গভর্নর হয়ে ঢাকা আসতে রাজি হচ্ছিল না, কারণ ঢাকায় খুব গরম আবহাওয়া। তার উত্তরে মাউন্টব্যাটেন যে চিঠি দিয়েছিলেন তাতে লেখা ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানে দুনিয়ার অন্যতম পাহাড়ি শহর, থাকার কোন কষ্ট হবে না’। অর্থাৎ দার্জিলিংও আমরা পাব। তাও নাজিমুদ্দীন সাহেবের এই ঘোষণায় শেষ হয়ে গেল। যখন গোলমালের কোনো সম্ভাবনা থাকল না, মাউন্টব্যাটেন সুযোগ পেয়ে যশোর জেলায় সংখ্যাগুরু মুসলমান অধ্যুষিত বনগাঁ জংশন অঞ্চল কেটে দিলেন। নদীয়ায় মুসলমান বেশি, তবু কৃষ্ণনগর ও রানাঘাট জংশন ওদের দিয়ে দিলেন। মুর্শিদাবাদে মুসলমান বেশি কিন্ত সমস্ত জেলাই দিয়ে দিলেন। মালদহ জেলায় মুসলমান ও হিন্দু সমান সমান তার আধা অংশ কেটে দিলেন, দিনাজপুরে মুসলমান বেশি, বালুরঘাট মহকুমা কেটে দিলেন যাতে জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং হিন্দুস্তানে যায় এবং আসামের সাথে হিন্দুস্তানের সরাসরি যোগাযোগ হয়। উপরোক্ত জায়গাগুলি কিছুতেই পাকিস্তানে না এসে পারত না। এদিকে সিলেটে গণভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ট করিমগঞ্জ মহকুমা ভারতবর্ষকে দিয়েছিল। আমরা আশা করেছিলাম, আসামের কাছাড় জেলা ও সিলেট জেলা পাকিস্তানের
৭৯
ভাগে না দিয়ে পারবে না। আমার বেশি দুঃখ হয়েছিল করিমগঞ্জ নিয়ে। কারণ, করিমগঞ্জে আমি কাজ করেছিলাম গণভোটের সময়। নেতারা যদি নেতৃত্ব দিতে ভুল করে, জনগণকে তার খেসারত দিতে হয়। যে কলকাতা পূর্ব বাংলার টাকায় গড়ে উঠেছিল সেই কলকাতা আমরা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলাম। কেন্দ্রীয় লীগের কিছু কিছু লোক কলকাতা ভারতে চলে যাক এটা চেয়েছিল বলে আমার মনে হয়। অথবা পূর্বেই গোপনে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। সোহরাওয়ারদী নেতা হলে তাদের অসুবিধা হত তাই তারা পিছনের দরজা দিয়ে কাজ হাসিল করতে চাইল। কলকাতা পাকিস্তানে থাকলে পাকিস্তানের রাজধানী কলকাতায় করতে বাধ্য হত, কারণ পূর্ব বাংলার লোকেরা দাবি করত পাকিস্তানের জনসংখ্যায়ও তারা বেশি আর শহর হিসাবে তদানীন্তন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ট শহর কলকাতা। ইংরেজের শাসনের প্রথমদিকে কলকাতা একবার সারা ভারতবর্ষের রাজধানীও ছিল।
এই সময়ে আরও কয়েকটা ঘটনা ঘটে আমাদের কর্মীদের মধ্যে। আমাদের যে মিল্লাত প্রেসটা ছিল- সেটা হাশিম সাহেব পরিচালনা করতেন। কথা উঠল, প্রেসটা কি করা যায়? হাশিম সাহেব পূর্বেই দেনা হয়ে পড়েছেন বলে একটা রঙিন মেশিন বক্রি করে দেন, তাতে দায়দেনা শোধ হয়ে যায়। তিনি শামসুল হক সাহেবকে ঢাকা থেকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘কলকাতায় কর্মীরাও অনেকে ঢাকা চলেছে, আমি পাকিস্তানে যাব না। তোমরা প্রেসটা ঢাকায় নিয়ে একে কেন্দ্র করে দলটা ঠিক রাখ, আর কাজ চালিয়ে যাও’। শামসুল হক সাহেব আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করে রাজি হলেন, ঢাকার লীগ অফিস ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে প্রেসটা বসানো হবে। মিল্লাত কাগজ চলবে, আমরা এক একজন এক একটা বিভাগের ভার নেব। শামসুল হক সাহেব ঢাকায় এসে সবকিছু ঠিক করে কলকাতা গেলেন। হাশিম সাহেব আবার কলকাতার কর্মীদের বললেন, ‘তোমরা তো কলকাতায় থাকলে, তোমাদেরই বোধহয় প্রেসটা থাকা দরকার। কারণ, হিন্দুস্তানে তোমরা কিইবা করবা! যাদের বাড়ি পাকিস্তানে পড়েছে তাদের আর প্রয়োজন কি, পাকিস্তান তো হয়েই গেছে’। কলকাতার কর্মীরা বলে বসল, ঠিকই তো কথা। যখন হক সাহেব এই কথা শুনলেন, কিছুই না বলে ফিরে এলেন। আমি তখন হাশিম সাহেবের কাছে বেশি যাই না। কারণ, তিনি আমাকে শহীদ সাহেবের সমর্থক বলে বিশ্বাস করতেন না, আর আমিও শহীদ সাহেবের সাথে তাঁর ব্যবহার সমর্থন করি না। একে আমি বিশ্বাসঘাতকতা বলতাম।
একদিন নূরুদ্দিন, নূরুল আলম ও কাজী ইদ্রিস সাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন বেঙ্গল রেস্টুরেন্টে, আমার বাসার কাছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপার কি’? এরা আমাকে বলল, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে, হাশিম সাহেব প্রেস বিক্রি করে ফেলতে চান, আমরা চাঁদা তুলে প্রেস করেছি, মুখ দেখাব কি করে’? আমি বললাম, ‘আমি কি করব?’ সকলে বলল, ‘তোমাকে বাধা দিতে হবে’। বললাম, ‘আমি কেন বাধা দেব? আমি পাকিস্তানে চলে যাব।
৮০
আর কবে দেখা হবে ঠিক নাই। আমার প্রয়োজন কি? তোমরা হাশিম সাহেবের খলিফা, আমার নাম তো পূর্বেই কাটা গেছে, আর কেন?’সকলে বলল, ‘তুমি বললেই আর ভয়েতে বিক্রি করবে না’। বললাম, ‘ঠিক আছে আমি অনুরোধ করতে পারি’।
পরের দিন মিল্লাত প্রেসে গিয়ে হাশিম সাহেবের সাথে দেখা করি। পাশের ঘরে আমার সহকর্মীরা চুপ করে বসে আছে; শুনবে আমাদের কথা। আমি খুব শান্তভাবে তাঁকে বললাম, ‘প্রেসটা নাকি বিক্রি করবেন?’ বললেন, ‘উপায় কি, প্রত্যেক মাসেই লোকসান যাচ্ছে, কি করি? আর চালাবে কে ?’ আমি বললাম, ‘খন্দকার নূরুল আলম তো ম্যানেজার হয়ে এতকাল চালাল। খরচ কমিয়ে ফেলল। প্রেসটা বিক্রি করে দিলে কর্মচারীদের থাকবে কি? আর আমরা মুখ দেখাতে পারব না। সমস্ত বাংলাদেশ থেকে চাঁদা তুলেছি, লোকে আমাদের গালি দিবে’। হাশিম সাহেব হঠাৎ রাগ করে ফেললেন এবং বললেন, ‘আমাকে বেচতেই হবে, কারণ দেনা শোধ করবে কে?’ আমি বললাম, ‘কয়েক মাস পূর্বে যে প্রেসটা বিক্রি হল তাতে দেনা শোধ হয় নাই?’তিনি ভীষণ রেগে গেলেন, আমারও রাগ হল। উঠে আসার সময় বলে এলাম, ‘প্রেস বিক্রি করতে গেলে আমি বাধা দেব, দেখি কে আসে এই মিল্লাত প্রেসে?’হাশিম সাহেব খুব দুঃখ পেলেন আমার কথায়। পরের দিন ঐ সমস্ত বন্ধুরা আবার আমার কাছে এসে বলল, ‘হাশিম সাহেব খানা খান না। শুধু বলেন, ‘মুজিব আমাকে অপমান করল!’ তুই আবার দেখা কর, আর বলে দে, যা ভাল বোঝেন করেন’। আমি বললাম, ‘তোমরা খেলা পেয়েছ!’
আমি শহীদ সাহেবের কাছে এখন রোজই যাই। তাঁর সাথে মাঝে মাঝে সভা সমিতিতে যাই-যেখানে সাম্প্রদায়িক সৎভাব সৃষ্টির জন্য সভা হয়। শহীদ সাহেবকে বললাম, সকল ইতিহাস। তিনি আমার উপর রাগ করলেন, কেন আমি খারাপ ব্যবহার করলাম হাশিম সাহেবের সাথে! কত বড় উদার ছিলেন শহীদ সাহেব। আমি হাশিম সাহেবের কাছে যেয়ে বললাম, ‘আপনি মনে কিছু করবেন না, আমার এভাবে কথা বলা অন্যায় হয়েছে। আপনি যা ভাল বোঝেন তাই করুন। আমার কিছুই বলার নাই’। হাশিম সাহেব হিন্দুস্তানে থাকবেন, আমি চলে আসব পাকিস্তানে। আমার বাড়িও পাকিস্তানে। আমি যাওয়াতে তিনি খুশি হয়েছিলেন। তাঁর সাথে ভিন্ন মত হতে পারি, কিন্ত তাঁর কাছ থেকে যে রাজনীতির শিক্ষা পেয়েছি, সেটা ভোলা কষ্টকর। আমার যদি কোনো ভুল হয় বা অন্যায় করে ফেলি, তা স্বীকার করতে আমার কোনোদিন কষ্ট হয় নাই। ভুল হলে সংশোধন করে নেব, ভুল তো মানুষের হয়েই থাকে। আমার নিজেরও একটা দোষ ছিল, আমি হঠাৎ রাগ করে ফেলতাম। তবে রাগ আমার বেশি সময় থাকত না।
আমি অনেকের মধ্যে একটা জিনিস দেখেছি, কোন কাজ করতে গেলে শুধু চিন্তাই করে। চিন্তা করতে করতে সময় পার হয়ে যায়, কাজ আর হয়ে ওঠে না। অনেক সময় করব কি করব না, এইভাবে সময় নষ্ট করে এবং জীবনে কোন কাজই করতে পারে না। আমি চিন্তাভাবনা করে যে কাজটা করব ঠিক করি, তা করেই ফেলি। যদি ভুল হয়, সংশোধন করে নেই। কারণ, যারা কাজ করে তাদেরই ভুল হতে পারে, যারা কাজ করে না তাদের ভুলও হয় না।
৮১
এই সময় শহীদ সাহেবের সাথে কয়েক জায়গায় আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। মহাত্মা গান্ধীর সাথে শহীদ সাহেব হিন্দু-মুসলমান শান্তি কায়েম করার জন্য কাজ করছিলেন। তখন মুসলমানদের উপর মাঝে মাঝে আক্রমণ হচ্ছিল। সেদিন রবিবার ছিল। আমি সকালবেলা শহীদ সাহেবের বাসায় যাই। তিনি আমাকে বললেন, ‘চল, ব্যারাকপুর যাই। সেখানে খুব গোলমাল হয়েছে। মহাত্মা গান্ধীও যাবেন’। আমি বললাম, ‘যাব স্যার’। তাঁর গাড়িতে উঠলাম, নারকেলডাঙ্গা এলাম। সেখান থেকে মহাত্মাজী, মনু গান্ধী, আভা গান্ধী ও তাঁর সেক্রেটারি এবং কিছু কংগ্রেস নেতাও সাথে চললেন। ব্যারাকপুরের দিকে রওয়ানা করলাম। হাজার হাজার লোক রাস্তার দু’পাশে ভিড় করেছে, তাদের শুধু এক কথা, ‘বাপুজী কি জয়’। ব্যারাকপুর পৌঁছে দেখি, এক বিরাট সভার আয়োজন হয়েছে। মহাত্মাজী রবিবার কারও সাথে কথা বলেন না, বক্তৃতা তো করবেনই না। মনু গান্ধী ও আভা গান্ধী ‘আলহামদু’ সূরা ও ‘কুলহু’ সূরা পড়লেন। তারপরে রামবন্দনা গান গাইলেন। মহাত্মাজী লিখে দিলেন, তার বক্তৃতা সেক্রেটারি পড়ে শোনালেন। সত্যই ভদ্রলোক জাদু জানতেন। লোকে চিৎকার করে উঠল, হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই। সমস্ত আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়ে গেল এক মুহূর্তের মধ্যে।
এর দু’দিন পরেই বোধহয় ঈদের নামাজ হল। মুসলমানরা ভয় পেয়ে গেছে ঈদের নামাজ পড়বে কি পড়বে না? মহাত্মাজী ঘোষণা করলেন, যদি দাঙ্গা হয় এবং মুসলমান্দের উপর কেউ অত্যাচার করে তবে তিনি অনশন করবেন। মহল্লায় মহল্লায় বিশেষ করে হিন্দি ভাষাভাষী লোকেরা শোভাযাত্রা বের করে স্লোগান দিতে লাগল, ‘মুসলমানকো মাত মারো, বাপুজী অনশন কারেগা। হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই’। ঈদের দিনটা শান্তিতেই কাটল। আমি আর ইয়াকুব নামে আমার এক ফটোগ্রাফার বন্ধু পরামর্শ করলাম, আজ মহাত্মাজীকে একটা উপহার দিব। ইয়াকুব বলল, ‘তোমার মনে আছে আমি আর তুমি বিহার থেকে দাঙ্গার ফটো তুলেছিলাম’? আমি বললাম, ‘হ্যাঁ মনে আছে’। ইয়াকুব বলল, ‘সমস্ত কলকাতা ঘুরে আমি ফটো তুলেছি। তুমি জান না তার কপিও করেছি। সেই ছবিগুলি থেকে কিছু ছবি বেছে একটা প্যাকেট করে মহাত্মাজীকে উপহার দিলে কেমন হয়’। আমি বললাম, ‘চমৎকার হবে। চল যাই, প্যাকেট করে ফেলি’। যেমন কথা, তেমন কাজ। দুইজনে বসে পড়লাম। তারপর প্যাকেটটা এমনভাবে বাঁধা হল যে, কমপক্ষে দশমিনিট লাগবে খুলতে। আমরা তাঁকে উপহার দিয়েই ভাগব। এই ফটোর মধ্যে ছিল মুসলমান মেয়েদের স্তন কাটা, ছোট শিশুদের মাথা নাই, শুধু শরীরটা আছে, বস্তি, মসজিদে আগুনে জ্বলছে, রাস্তায় লাশ পড়ে আছে, এমনই আরও অনেক কিছু। মহাত্মাজী দেখুক, কিভাবে তাঁর লোকেরা দাঙ্গাহাঙ্গামা করেছে এবং নিরীহ লোককে হত্যা করেছে।
আমরা নারকেলডাঙ্গায় মহাত্মাজীর ওখানে পৌছালাম। তাঁর সাথে ঈদের মোলাকাত করব বললাম। আমাদের তখনই তাঁর কামরায় নিয়ে যাওয়া হল। মহাত্মাজী আমাদের কয়েকটা আপেল দিলেন। আমরা মহাত্মাজীকে প্যাকেটটা উপহার দিলাম। তিনি হাসিমুখে
৮২
গ্রহণ করলেন। আমরা অপরিচিত সেদিকে তাঁর ভ্রুক্ষেপ নাই। তবে বুঝতে পারলাম, তাঁর নাতনী মনু গান্ধী আমার চেহারা দেখেছে ব্যারাকপুর সভায়, কারণ আমি শহীদ সাহেবের কাছে প্লাটফর্মে বসেছিলাম। আমরা উপহার দিয়ে চলে এলাম তাড়াতাড়ি হেঁটে। শহীদ সাহেব তখন ওখানে নাই। বন্ধু ইয়াকুবের এই ফটোগুলি যে মহাত্মা গান্ধীর মনে বিরাট দাগ কেটেছিল তাতে সন্দেহ নাই। আমি শহীদ সাহেবকে পরে এ বিষয়ে বলেছিলাম।
আমাদের পক্ষে কলকাতা থাকা সম্ভবপর না, কারণ অনেককে গ্রেফতার করেছে। জহিরুদ্দিনের বাড়ি তল্লাশি করেছে। আমাদেরও ধরা পড়লে ছাড়বে না। ভাগতে পারলে বাঁচি। একটা অসুবিধা ছিল, আমি ও আমার ভগ্নিপতি আবদুর রব সাহেব একটা রেস্টুরেন্ট করেছিলাম পার্ক সার্কাসে। সে বাড়ি গিয়েছে, আমার বোন ও রেণুকে পৌঁছে দিতে। আসতে দেরি করছে। আমি দেখাশোনা করি না, ম্যানেজার সব শেষ করে দিচ্ছে। তাকে টেলিগ্রাম করে দিয়ে আমি রওয়ানা করব ঠিক করলাম। শহীদ সাহেবের কাছে বিদায় নিতে গেলাম। তাঁকে রেখে চলে আসতে আমার মনে খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমার মন বলছিল, কতদিন মহাত্মাজী শহীদ সাহেবকে রক্ষা করতে পারবেন? কয়েকবার তাঁর উপর আক্রমণ হয়েছে। তাঁকে হিন্দুরা মেরে ফেলতে চেষ্টা করছে। বিজ্ঞান কলেজের সামনে তাঁর গাড়ির উপর বোমা ফেলে গাড়িটি পুড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি কোনোমতে রক্ষা পেয়েছিলেন। শহীদ সাহেবকে বললাম, ‘চলুন স্যার পাকিস্তানে, এখানে থেকে কি করবেন?’ বললেন, ‘যেতে তো হবেই, তবে এখন এই হতভাগা মুসলমানদের জন্য কিছু একটা না করে যাই কি করে? দেখ না, সমস্ত ভারতবর্ষে কি অবস্থা হয়েছে, চারদিকে শুধু দাঙ্গা আর দাঙ্গা। সমস্ত নেতা চলে গেছে, আমি চলে গেলে এদের আর উপায় নাই। তোমরা একটা কাজ কর দেশে গিয়ে, সাম্প্রদায়িক গোলমাল যাতে না হয়, তার চেষ্টা কর। পূর্ব বাংলায় গোলমাল হলে আর উপায় থাকবে না। চেষ্টা কর, যাতে হিন্দুরা চলে না আসে। ওরা এদিকে এলেই গোলমাল করবে, তাতে মুসলমানরা বাধ্য হয়ে পূর্ব বাংলায় ছুটবে। যদি পশ্চিম বাংলা, বিহার ও আসামের মুসলমান একবার পূর্ব বাংলার দিকে রওয়ানা হয়, তবে পাকিস্তান বিশেষ করে পূর্ব বাংলা রক্ষা করা কষ্টকর হবে। এত লোকের জায়গাটা তোমরা কোথায় দিবা আমার তো জানা আছে। পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্যই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতে দিও না’। বললাম, ‘ঢাকা যেতে হবে, শামসুল হক সাহেব খবর দিয়েছেন। রাজনৈতিক কর্মীদের একটা সভা হবে। পরে আবার একবার এসে দেখা করব’। বললেন, ‘এস’।
নূরুদ্দিন এল না, কারণ সামনের তার এমএ পরীক্ষা। পরীক্ষার পরই চলে আসবে। নূরুদ্দিনের নানা অসুবিধা, তার স্ত্রী তখন মেডিকেল কলেজে পড়ে। তাকেও আনতে হবে।
আমি ভাবতাম, পাকিস্তান কায়েম হয়েছে, আর চিন্তা কি? এখন ঢাকায় যেয়ে ল’ ক্লাসে ভর্তি হয়ে কিছুদিন মন দিয়ে লেখাপড়া করা যাবে। চেষ্টা করব, সমস্ত লীগের কর্মীদের নিয়ে যাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা না হয়।
৮৩
আব্বা, মা ও রেণুর কাছে কয়েকদিন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা এলাম। পূর্বে দু’একবার এসেছি বেড়াতে। পথ ঘাট ভাল করে চিনি না। আত্মীয়স্বজন, যারা চাকরিজীবী, কে কোথায় আছেন, জানি না। ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে প্রথমে উঠব ঠিক করলাম। শওকত মিয়া মোগলটুলী অফিসের দেখাশোনা করে। মুসলিম লীগের পুরানা কর্মী। আমার বন্ধুও। শামসুল হক সাহেব ওখানেই থাকেন। মুসলিম লীগ ও অন্যান্য দলের কর্মীদের সভা ডেকেছেন শামসুল হক সাহেব-রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে। আমাকে খবর দিয়েছেন পূর্বেই। তাই কয়েকদিন পূর্বেই এসে হাজির হতে হল। ঘোড়ার গাড়ি ঠিক করলাম, ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে পৌঁছে দিতে। দেখলাম, রসিক গাড়ওয়ান মোগলটুলী লীগ অফিস চেনে। আমাকে বলল, ‘আপনি লীগ অফিসে যাইবেন, চলেন সাব আমি চিনি’। পয়সাও বেশি নিল বলে মনে হল না। অনেক গল্প শুনেছি এদের সম্পর্কে। কিন্ত আমার সাথে দরকষাকষিও করল না। শামসুল হক সাহেব ও শওকত সাহেব আমাকে পেয়ে খুবই খুশি। শওকত আমাকে নিয়ে কি যে করবে ভেবেই পায় না। তার একটা আলাদা রুম ছিল। আমাকে তার রুমেই জায়গা দিল। আমি তাকে শওকত ভাই বলতাম। সে আমাকে মুজিব ভাই বলত। তিন-চার দিন পরেই কনফারেন্স হবে। বহু কর্মী এসেছে বিভিন্ন জেলা থেকে। অনেকেই মোগলটুলীতে উঠেছে। শামসুল হক সাহবে বললেন, ‘জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না, কোথায় কনফারেন্স করব? সরকার নাকি এটাকে ভাল চোখে দেখছে না। আমাদের কনফারেন্স যাতে না হয় সেই চেষ্টা করছে এবং গোলমাল করে কনফারেন্স ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে’। আমি বললাম, ‘এত তাড়াতাড়ি এরা আমাদের ভুলে গেল হক সাহেব’। হক সাহেব হেসে দিয়ে বললেন, ‘এই তো দুনিয়া!’
বিকালে হক সাহেব আমাদের নিয়ে বসলেন-কনফারেন্সে কি করা হবে সে সম্বন্ধে আলোচনা করতে। একটা যুব প্রতিষ্টান গঠন করা দরকার, যাতে তরুণ কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে না যান। আমি হক সাহেবকে বললাম, ‘যুব প্রতিষ্টান একটা করা যায়, তবে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচী গ্রহণ করা উচিত হবে কি না চিন্তা করে দেখেন। আমরা এখনও মুসলিম লীগের সভ্য আছি’। হক সাহেব বললেন, ‘আমরা রাজনৈতিক প্রতিষ্টান গড়ছি না’। হক সাহেব খুবই ব্যস্ত, হল ঠিক করার জন্য। শেষ পর্যন্ত ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস-চেয়ারম্যান খান সাহেব আবুল হাসানাত সাহেবের বাড়িতে কনফারেন্স হবে ঠিক হল। বিরাট হল এবং লন আছে। তিনি রাজি হলেন, আর কেউই সাহস পেলেন না আমাদের জায়গা দিতে।
কনফারেন্স শুরু হল। জনাব আতাউর রহমান খান ও কামরুদ্দিন সাহেন এই কনফারেন্স যাতে কামিয়াব হয় তার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। কামরুদ্দিন সাহেবের সাথে আমার পূর্বেই পরিচয় ছিল। আতাউর রহমান সাহেবের সাথে এই প্রথম পরিচয় হয়। প্রথম অধিবেশন শেষ হওয়ার পরে সাবজেক্ট কমিটি গঠন হল। আমাকেও কমিটিতে রাখা হল। আলোচনার মাধ্যমে বুঝতে পারলাম, কিছু কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন কর্মীও যোগদান করেছে। তারা তাদের
৮৪

পাণ্ডুলিপির একটি পৃষ্টার চিত্রলিপি
৮৫
মতামতও প্রকাশ করতে শুরু করেছে। প্রথমে ঠিক হল, একটা যুব প্রতিষ্টান গঠন করা হবে, যে কোন দলের লোক এতে যোগদান করতে পারবে। তবে সক্রিয় রাজনীতি থেকে যতখানি দূরে রাখা যায় তার চেষ্টা করা হবে। এই প্রতিষ্টানকে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্টান হিসাবে গণ্য করতে হবে। এই প্রতিষ্টানের নাম হবে ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ’। আমি বললাম, এর একমাত্র কর্মসূচী হবে সাম্প্রদায়িক মিলনের চেষ্টা, যাতে কোনো দাঙ্গাহাঙ্গামা না হয়, হিন্দুরা দেশ ত্যাগ না করে-যাকে ইংরেজিতে বলে ‘কমিউনাল হারমনি,’ তার জন্য চেষ্টা করা। অনেকেই এই মত সমর্থন করল, কিন্ত কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন দলটা বলল, আরও প্রোগ্রাম নেওয়া উচিত, যেমন অর্থনৈতিক প্রোগ্রাম। আমরা বললাম, তাহলে তো রাজনৈতিক প্রতিষ্টান হয়ে যাবে। অনেক সমালোচনার পরে ঠিক হল, একটা সাব-কমিটি করা হবে, তাঁরা কর্মসূচী প্রণয়ন করবেন এবং গণতান্ত্রিক যুবলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির কাছে তা পেশ করবেন। সে কর্মসূচী তাঁরাই গ্রহণ করা বা না করার অধিকারী থাকবেন। সতেরজন সদস্য নিয়ে কমিটি করা হল এবং কো-অপ্ট করার ক্ষমতা দেওয়া হল। হিসাব করে দেখা গেল আমাদের মতাবলম্বী লোকই সংখ্যাগরিষ্ট। কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন লোকও কয়েকজন কমিটির সভ্য হলেন। কয়েকদিন পরে কার্যকরী কমিটির এক সভায় ড্রাফট কারযসূচী পেশ করা হল, যাকে পরিপূর্ণ একটা পার্টির ম্যানিফেস্টো বলা যেতে পারে। আমি ভীষণভাবে বাধা দিলাম এবং বললাম কোনো ব্যাপক কর্মসূচী এখন গ্রহণ করা হবে না। একমাত্র ‘কমিউনাল হারমনি’র জন্য কর্মীদের ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া আর কোনো কাজই আমাদের নাই। দুই মাস হল দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন কোন দাবি করা উচিত হবে না। মিছামিছি আমরা জনগণ থেকে দূরে সরে যাব। কমিউনিস্ট নেতারা তখন ভারতবর্ষে স্লোগান দিয়েছে, ‘স্বাধীনতা আসে নাই, সংগ্রাম করে স্বাধীনতা আনতে হবে’। আমাদের দেশের কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন সহকর্মীরা সেই আদর্শই কর্মসূচীর মাধ্যমে গ্রহণ করতে চায়। এই সকল কর্মসূচী নিয়ে জনগণের কাছে গেলে আমাদের উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলবে এবং যে কাজ এখন বিশেষ প্রয়োজন, সাম্প্রদায়িক মিলনের কথা বললেও লোকে আমাদের কথা শুনতে চাইবে না। প্রথম সভায় পাস করতে পারল না, আমরা সংখ্যাগরিষ্ট ছিলাম। তবে হক সাহেব মধ্যপন্থা অবলম্বন করায় আমাদের অসুবিধা হতে লাগল।
এই সময় আমি কিছুদিনের জন্য কলকাতায় যাই। আমাদের রেস্টুরেন্টটা বিক্রি হয়েছে কি না, না হলে ঢাকায় কোনো দোকানের সাথে বদল করা যায় কি না সে বিষয়টা দেখতে। কলকাতায় যেয়ে দেখি, রব সাহেব রেস্টুরেন্ট বিক্রি করে দিয়েছে। যাক বাঁচা গেল। শহীদ সাহেব পূর্ব পাঞ্জাব, দিল্লি, জয়পুর, আলোয়ার ঘুরে কলকাতায় এসেছেন; তিনি খুবই চিন্তিত, এই সমস্ত জায়গায় ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছে। ভারতবর্ষ ও পাকিস্তানে তিনিই একমাত্র মুসলিম নেতা যিনি সাহস করে এই সমস্ত জায়গায় গিয়ে সচক্ষে সকল অবস্থা
৮৬
দেখে এসেছেন। আমাকে দেখে খুবই খুশি হলেন এবং বললেন, ‘সত্যিই পূর্ব বাংলার মুসলমানরা কত সভ্য ও ভাল, কোনো দাঙ্গাহাঙ্গামা হচ্ছে না। তবে হিন্দুরা চলে আসছে, এরাই বিপদ ঘটাবে। আমি শীঘ্রই পূর্ব বাংলায় যাব এবং কয়েকটা সভা করব, যাতে হিন্দুরা না আসে’। শহীদ সাহেব ঢাকা হয়ে খাজা নাজিমুদ্দীনের সাথে পরামর্শ করে বরিশালে সভা করতে যাবেন ঠিক হল।
আমি চলে এলাম ঢাকায়। বরিশালে এক বিরাট সভার আয়োজন হল। শহীদ সাহেব ঢাকায় এসে নাজিমুদ্দীন সাহেবের কাছেই থাকতেন। আমরা স্টিমারে বরিশাল রওয়ানা করলাম। কলকাতা থেকে প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষও এসেছেন। বরিশালে বিকালে সভা শুরু হল, কয়েকজন বক্তৃতা করেছেন। আমাকেও বক্তৃতা করতে হবে, রাত তখন আট ঘটিকা হবে, এমন সময় একটা টুকরা কাগজ আমার হাতে দিল। আমি শহীদ সাহেবের পাশে বসেছিলাম। তাতে রব সাহেব (আমার ভগ্নিপতি) লিখেছে, ‘মিয়া ভাই, আব্বার অবস্থা খুবই খারাপ, ভীষণ অসুস্থ। তোমার জন্য বিভিন্ন জায়গায় টেলিফোন করা হয়েছে, যদি দেখতে হয় রাতেই রওয়ানা করতে হবে। হেলেন[লেখকের ছোটবোন] চলে গিয়াছে তোমাদের বাড়িতে’। আমি শহীদ সাহেবকে চিঠিটা পড়ে শোনালাম। তিনি আমাকে রওয়ানা করতে হুকুম দিলেন। তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্লাটফর্ম থেকে নেমে রব সাহেবকে দেখলাম, দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কখন খবর পেয়েছ?’বলল, ‘গতকাল খবর পেয়েছি। হেলেন রওয়ানা হয়েছে, আমি তোমার জন্য দেরি করছি। কারণ, জানি শহীদ সাহেব যখন আসবেন, তুমিও আসবে’। আমি সোজা মালপত্র নিয়ে রওয়ানা করলাম স্টেশনে আর আধা ঘন্টা সময় আছে স্টিমার ছাড়তে। স্টিমার ধরতে না পারলে আবার আগামীকাল রাতে স্টিমার ছাড়বে।
আমি স্টিমারে চড়ে বসলাম, সমস্ত রাত বসে রইলাম। নানা চিন্তা আমার মনে উঠতে লাগল। আমি তো আমার আব্বার বড় ছেলে। আমি তো কিছুই বুঝি না, কিছুই জানি না সংসারের। কত কথা মনে পড়ল, কত আঘাত আব্বাকে দিয়েছি, তবু কোনদিন কিছুই বলেন নাই। সকলের পিতাই সকল ছেলেকে ভালবাসে এবং ছেলেরাও পিতাকে ভালবাসে ও ভক্তি করে। কিন্ত আমার পিতার যে স্নেহ আমি পেয়েছি, আর আমি তাঁকে কত যে ভালবাসি সে কথা প্রকাশ করতে পারব না।

ভরবেলা পাটগাতি স্টেশনে স্টিমার এসে পৌছাল। আমার বাড়ি থেকে প্রায় আড়াই মাইল হবে। স্টেশন মাস্টারকে ও অন্যান্য লোকদের জিজ্ঞাসা করলাম, তারা কিছু জানে কি না আমার আব্বার কথা? সকলেই এক কথা বলে, ‘আপনার আব্বার খুব অসুখ শুনেছি’। নৌকায় গেলে অনেক সময় লাগে। মালপত্র স্টেশন মাস্টারের কাছে রেখে হেঁটে রওয়ানা করলাম। মধুমতী নদী পার হতে হল। সোজা মাঠ দিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা করলাম। পথঘাটের বালাই নাই। সোজা চষা জমির মধ্য দিয়ে হাঁটলাম। বাড়ি পৌঁছে দেখি আব্বার কলেরা হয়েছে। অবস্থা ভাল না, ডাক্তার আশা ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। আমি পৌছেই ‘আব্বা’ বলে ডাক দিতেই চেয়ে ফেললেন। চক্ষু দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা।
৮৭
আমি আব্বার বুকের উপর মাথা রেখে কেঁদে ফেললাম; আব্বার হঠাৎ যেন পরিবর্তন হল কিছুটা। ডাক্তার বলল, নাড়ির অবস্থা ভাল মনে হয়। কয়েক মুহূর্তের পরেই আব্বা ভালর দিকে। ডাক্তার বললেন, ভয় নাই। আব্বার প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। একটু পরেই প্রস্রাব হল। বিপদ কেটে যাচ্ছে। আমি আব্বার কাছে বসে রইলাম। এক ঘন্টার মধ্যেই ডাক্তার বললেন, আর ভয় নাই। প্রস্রাব হয়ে গেছে। চেহারাও পরিবর্তন হচ্ছে। দুই তিন ঘন্টা পরে ডাক্তার বাবু বললেন, আমি এখন যাই, সমস্ত রাত ছিলাম। কোনো ভয় নাই বিকালে আবার দেখতে আসব।
আমি বাড়িতে রইলাম কিছুদিন। আব্বা আস্তে আস্তে আরোগ্য লাভ করলেন। যে ছেলেমেয়েরা তাঁদের বাবা মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত তাদের মত হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নাই। আর যারা বাবা মায়ের স্নেহ আর আশীর্বাদ পায় তাদের মত সৌভাগ্যবান কয়জন!
আমি ঢাকায় এলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, আইন পড়ব। বই পুস্তক কিছু কিনলাম। ঢাকায় এসে শুনলাম গণতান্ত্রিক যুবলীগের এক সভা হয়ে গেছে। কার্যকরী কমিটির নতুন সভ্য কো-অপ্ট করা হয়েছে। পূর্বে ছিলাম সতেরজন এখন হয়েছি চৌত্রিশজন। কারণ, আমাদের সংখ্যালঘু করার ষড়যন্ত্র। আমাদের অনেকে নোটিশও পায় নাই। অন্য কোনো কাগজ না ছাপলেও কলকাতার ইত্তেহাদ কাগজ আমাদের সংবাদ ছাপত। ইত্তেহাদেও নোটিশ ছাপানো হয় নাই। আমি আপত্তি তুললাম এবং বললাম, সতেরজন সদস্য, কেমন করে আরও সতেরজন কো-অপ্ট করতে পারে? সভা ডাকা হোক। কিছুদিন পরে খবর পেলাম, ময়মনসিংহে সভা ডাকা হয়েছে। সকলে নোটিশ পেয়েছে, আমাকে দেওয়া হয় নাই, নোয়াখালীর আজিজ মোহাম্মদ ঢাকা সিটি মুসলিম লীগের সেক্রেটারি ছিলেন, তিনি নোটিশ পেয়ে আমাকে বললেন, আগামী দিনই সভা হবে সকাল নয়টায়। দেখলাম আমরা তিনজন সভ্য ঢাকায় আছি। আজিজ সাহেব, ঢাকার শামসুল হুদা সাহেব (এখন কনভেনশন মুসলিম লীগ করেন) ও আমি। ঠিক করলাম তিনজনই যাব এবং বাধা দিব। অন্য কোন জেলায় খবর দেওয়ার সময় হবে না। রাতেই আমাদের রওয়ানা করতে হবে। কারণ একটা মাত্র ট্রেন ছাড়ে রাত দশটায়, ভোর তিনটায় পৌঁছায় ময়মনসিংহ। ভোর পর্যন্ত আমরা স্টেশনেই ছিলাম। হক সাহবের কোনো খবর নাই। তিনি সভায় আসেন নাই। আমরা সভায় উপস্থিত হলা এবং বৈধতার প্রশ্ন তুললাম। আমাকে ও অনেককে নোটিশ দেওয়া হল না কেন? তারা একটা ম্যানিফেস্টো করে এনেছেন। আমরা বললাম, নোটিশ দিয়ে সভা ডাকা হোক ঢাকায় এবং সেখানে ম্যানিফেস্টো গ্রহণ করা হবে কি হবে না ঠিক করা হবে। এত তাড়াহুড়া করা উচিত হবে না। আর আমরা কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্টানে যোগদান করতে পারি না। কারণ মুসলিম লীগের এখনও কাউন্সিল
৮৮
সদস্য আমরা। অনেক তর্কবিতর্ক হল, তারপর যখন দেখলাম যে, কিছুতেই শুনছে না, সকলেই প্রায় কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন বা তাঁদের সমর্থকরা উপস্থিত হয়েছে তখন বাধ্য হয়ে আমরা সভা ত্যাগ করলাম। আর বলে এলাম, মুসলিম লীগের কোনো কর্মী আপনাদের এই ষড়যন্ত্রে থাকবে না। যুবলীগও আজ থেকে শেষ। আপনাদের ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা আমাদের জানা আছে। আমাদের নাম কোথাও রাখবেন না।
মোগলটুলীতে যুবলীগের অফিস ছিল। আমরা বোর্ডটা নামিয়ে দিলাম। এর মধ্যেই তারা ম্যানিফেস্টো ছাপিয়ে ফেলেছে। অফিসও নিয়ে এসেছে। শওকত মিয়াই এই অফিসের কর্তা। তিনি হুকুম দিলেন, যুবলীগের সকল কিছু এখান থেকে নিয়ে যেতে। কে নিবে? কাউকেও দেখা গেল না। পুলিশ অফিসে তল্লাশি দিল। আমাদের নামও আইবি খাতায় উঠল। ১৫০ নম্বর মোগলটুলী থেকে পাকিস্তানের আন্দোলন হয়েছে, সেই লীগ অফিসেই এখন গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারীরা পাহার দিতে শুরু করল গোপনে গোপনে। আমরা সকলে শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিলাম। এটাই আমাদের দোষ। আমরা সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য যাতে বজায় থাকে তার চেষ্টাই করতে থাকলাম।
মানিক ভাই তখন কলকাতায় ইত্তেহাদ কাগজের সেক্রেটারি ছিলেন। আমাদের টাকা পয়সার খুবই প্রয়োজন। কে দিবে? বাড়ি থেকে নিজেদের লেখাপড়ার খরচটা কোনোমতে আনতে পারি, কিন্ত রাজনীতি করার টাকা কোথায় পাওয়া যাবে? আমার একটু স্বচ্ছল অবস্থা ছিল, কারণ আমি ইত্তেহাদ কাগজের পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ছিলাম। মাসে প্রায় তিনশত টাকা পেতাম। আমার কাজ ছিল এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে টাকা পয়সা আদায় করা, আর ইত্তেহাদ কাগজ যাতে চলে এবং নতুন এজেন্ট বিভিন্ন যায়গায় নিয়োগ করা যায় সেটা দেখা। বেশি দিন ছিলাম না। তবু অসুবিধা হওয়ার কথা না, কারণ কাগজে নাম আছে, টাকা বাড়ি থেকেও কিছু পাওয়া যাবে।
‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগে’র নাম বদলিয়ে ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ করা হয়েছে। শাহ আজিজুর রহমান সাহেবই জেনারেল সেক্রেটারি রইলেন। ঢাকায় কাউন্সিল সভা না করে অন্য কোথাও তারা করলেন গোপনে। কার্যকারী কমিটির সদস্য প্রায় অধিকাংশই ছাত্র নয়, ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। ১৯৪৪ সালে সংগঠনের নির্বাচন হয়েছিল, আর হয় নাই। আমরা ঐ কমিটি মানতে চাইলাম না। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ও জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। তারা এই প্রতিষ্টানের সাথে জড়িত নয়। আমি মুসলিম ছাত্রলীগ কর্মীদের সাথে আলাপ-আলোচনা শুরু করলাম। আজিজ আহমেদ, মোহাম্মদ তোয়াহ, অলি আহাদ, আবদুল হামিদ চৌধুরী, দবিরুল ইসলাম, নইমুদ্দিন, মোল্লা জালালউদ্দিন, আবদুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মতিন খান চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আরও অনেক ছাত্রনেতা একমত হলেন, আমাদের একটা প্রতিষ্টান করা দরকার। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তারিখে ফজলুল হক মুসলিম হলের এসেম্বলি হলে এক সভা ডাকা হল, সেখানে স্থির হল একটা ছাত্র প্রতিষ্টান করা হবে। যার নাম হবে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। নইমউদ্দিনকে কনভেনর করা হল। অলি
৮৯
আহাদ এর সভ্য হতে আপত্তি করল। কারণ সে আর সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্টান করবে না। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নাম দিলে সে থাকতে রাজি আছে। আমরা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম এবং বললাম, ‘এখনও সময় আসে নাই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দেশের আবহাওয়া চিন্তা করতে হবে। নামে কিছুই আসে যায় না। আদর্শ যদি ঠিক থাকে, তবে নাম পরিবর্তন করতে বেশি সময় লাগবে না। কয়েক মাস হল পাকিস্তান পেয়েছি। যে আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান পেয়েছি, সেই মানসিক অবস্থা থেকে জনগণ ও শিক্ষিত সমাজের মত পরিবর্তন করতে সময় লাগবে’।
প্রতিষ্টানের অফিস করলাম ১৫০ নম্বর মোগলটুলী। মুসলিম লীগ নেতারা কয়েকবার চেষ্টা করেছেন এই অফিসটা দখল করতে, কিন্ত শওকত মিয়ার জন্য পারেন না। আমরা ‘মুসলিম লীগ ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ নাম দিয়ে সাইন বোর্ড লাগিয়ে দিয়েছিলাম। এখন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অফিসও করা হল। শওকত মিয়া টেবিল, চেয়ার, আলমারি সকল কিছুই বন্দোবস্ত করল। তাকে না হলে, আমাদের কোন কাজই হত না তখন। আমরা যে কয়েকজন তার সাথে মোগলটুলীতে থাকতাম, আমাদের কাহয়া থাকার ভার তার উপরই ছিল। মাসে যে যা পারতাম, তার কাছে পৌঁছে দিতাম। সেই দেখাশোনা করত।
ছাত্রলীগ প্রতিষ্টান গঠন করার সাথে সাথে বিরাট সাড়া পাওয়া গেল ছাত্রদের মধ্যে। এক মাসের ভিতর আমি প্রায় সকল জেলায়ই কমিটি করতে সক্ষম হলাম। যদিও নইমউদ্দিন কনভেনর ছিল, কিন্ত সকল কিছুই প্রায় আমাকেই করতে হত। একদল সহকর্মী পেয়েছিলাম, যারা সত্যিকারের নিঃস্বার্থ কর্মী। পূর্ব পাকিস্তান সরকার প্রকাশ্যে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে সাহায্য করত। আর আমাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা লাগিয়ে দিত। অন্যদিকে খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ড ভেঙে দিতে হুকুম দিলেন। জহিরুদ্দিন, মির্জা গোলাম হাফিজ এবং আরও কয়েকজন আপত্তি করল। কারণ, পাকিস্তানের জন্য এবং পাকিস্তান হওয়ার পরে এই প্রতিষ্টান রীতিমত কাজ করে গিয়েছে। রেলগাড়িতে কর্মচারীর অভাব, আইনশৃঙ্খলা ও সকল বিষয়ই এই প্রতিষ্টান কাজ করেছে। হাজার হাজার ন্যাশনাল গার্ড ছিল। এদের দেশের কাজে না লাগিয়ে ভেঙে দেওয়ার হুকুমে কর্মীদের মধ্যে ভীষণ বিদ্বেষ ভাব দেখা গেল। ন্যাশনাল গার্ডের নেতারা সম্মেলন করে ঠিক করলেন তারা প্রতিষ্টান চালাবেন। জহিরুদ্দিনকে সালারে-সুবা করা হল। জহিরুদ্দিন ঢাকায় আসার কিছুদিন পরেই তাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হল মোগলটুলী অফিস থেকে। দেড় মাস কি দুই মাস পরে জহিরুদ্দিন মুক্তি পেল। অনেক নেতা ভয় পেয়ে গেল। মিস্টার মোহাজের, যিনি বাংলার ন্যাশনাল গার্ডের সালারে-সুবা ছিলেন তাকে নাজিমুদ্দীন সাহেব কি বললেন, জানি না। তিনি খবরের কাগজে ঘোষণা করলেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে, ন্যাশনাল গার্ডের আর দরকার নাই। এই রকম একটা সুপ্রতিষ্টিত প্রতিষ্টান জাতীয় সরকার দেশের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার না করে দেশেরই
৯০
ক্ষতি করলেন। এই সংগঠনের কর্মীরা যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করেছেন, অনেক নেতার চেয়েও বেশি। অনেকে আমাদের বললেন, এদের দিয়ে যে কাজ করাব, টাকা পাব কোথায়? এরা টাকা চায় নাই। সামান্য খরচ পেয়েই বৎসরের পর বৎসর কাজ করতে পারত। আস্তে আস্তে এদের আনসার বাহিনীতে নিয়োগও করতে পারতেন। এদের অনেক দিন পর্যন্ত ট্রেনিংও দেওয়া হয়েছিল। আমাদের এই সমস্ত নেতাদের লীলাখেলা বুঝতে কষ্ট হয়েছিল। ন্যাশনাল গার্ডদের বেতনও দেওয়া হত না। ন্যাশনাল গার্ড ও মুসলিম লীগ কর্মীদের মধ্যে যে প্রেরণা ছিল পাকিস্তানকে গড়বার জন্য তা ব্যবহার করতে নেতারা পারলেন না।
জনগণ ও সরকারি কর্মচারীরা রাতদিন পরিতশ্রম করত। অনেক জায়গায় দেখেছি একজন কর্মচারী একটা অফিস চালাচ্ছে। একজন জমাদার ও একজন সিপাহী সমস্ত থানায় লীগ কর্মীদের সাহায্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করছে। জনসাধারণ রেলগাড়িতে যাবে টিকিট নাই, টাকা জমা দিয়ে গাড়িতে উঠেছে। ম্যাজিকের মত দুর্নীতি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
আস্তে আস্তে সকল কিছুতেই ভাটি লাগল, শুধু সরকারের নীতির জন্য। তারা জানত না, কি করে একটা জাগ্রত জাতিকে দেশের কাজে ব্যবহার করতে হয় এবং জাতিকে গঠনমূলক কাজে লাগান যায়। হাজার হাজার কর্মী এদিক ওদিক ছিটকে পড়ল। কাজও ছিল এবং কর্মীও ছিল কিন্ত তাঁদের ব্যবহার করা হল না। এর একটা বিশেষ কারণ হল, যাদের কাছে ক্ষমতা এল তারা জনসাধারণের ওপর আস্থা রাখতে পারেন নাই। কারণ, জনসাধারণের সাথে এদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। যে কয়েকজন লোক প্রদেশের শাসন ক্ষমতা হাতে পেলেন, তারা সকলেই প্রায় ইংরেজ ঘেষা নেতা ছিলেন। ইংরেজকে তেল দিয়ে স্যার, খান বাহাদুর, খান সাহেব উপাধি নিয়েছেন। এরা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতে শুরু করলেন ইংরেজ আমলের আমলাতন্ত্ররের উপর। আমলাতন্ত্রের কর্ণধাররা যা বলতেন তাই শুনতেন। এই সকল কর্মচারীরা অনেকেই ইংরেজকে খুশি করার জন্য গাঁয়ে পড়ে প্রমোশনের লোভে স্বাধীনতার জন্য যে সমস্ত নিঃস্বার্থ কর্মী সংগ্রাম করেছে তাদের উপর অকথ্য অত্যাচার করেছেন, যার ভূরি ভূরি প্রমাণ আজও আছে।
স্বাধীনতা পাওয়ার সাথে সাথে এরা অনেকেই দুই তিন ধাপ প্রমোশন পেলেন এবং এতে মাথা অনেকের খারাপ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আর স্যার ও খান বাহাদুরের দল এদের হাতের পুতুলে পরিণত হল। স্বাধীন দেশের স্বাধীন জনগণকে গড়তে হলে এবং তাদের আস্থা অর্জন করতে হলে যে নতুন মনোভাবের প্রয়োজন ছিল তা এই নেতৃবৃন্দ গ্রহণ করতে পারলেন না। এদিকে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য রাজনৈতিক প্রতিষ্টান মুসলিম লীগকে তাঁদের হাতের মুঠায় নেবার জন্য এক নতুন পন্থা অবলম্বন করলেন। পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরে মুসলিম লীগও দুই ভাগ হল। এক ভাগ রইল ভারতবর্ষে নাম হল ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’, আরে ভাগের নাম হল ‘পাকিস্তান মুসলিম লীগ’।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বড়লাট হওয়ার ফলে আর মুসলিম লীগের সভাপতি থাকতে পারেন নাই। তাই চৌধুরী খালিকুজ্জামান সাহেবকে পাকিস্তান মুসলিম লীগের ভার দেওয়া হল। তিনি পাকিস্তান মুসলীম লীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ প্রতিষ্টান ভেঙে দিয়ে
৯১
একটা এডহক কমিটি করলেন। পাঞ্জাবও ভাগ হয়েছিল, কিন্ত পাঞ্জাব মুসলিম লীগ ভাঙলেন না। সিন্ধুও না, সীমান্তও না, একমাত্র বাংলাদেশ। কারণ, এখানে সোহরাওয়ারদী সাহেবের সমর্থক বেশি। তাই নতুন করে লীগ গঠন করতে হবে নাজিমুদ্দীন সাহেবের সমর্থকদের নিয়ে। মওলানা আকরম খাঁ সাহেবকে চিফ অরগানাইজার করলেন। আমরা তাড়াতাড়ি একশত বারজন কাউন্সিল সদস্যের দস্তখত নিয়ে একটা রিক্যুইজিশন সভা আহ্বান করার দাবি করলাম। মোহাম্মদ আলী, তোফাজ্জল আলী, ডাক্তার মালেক, আবদুস সালাম খান, এম.এ. সবুর, আতাউর রহমান খান, কামরুদ্দিন, শামসুল হক, আনোয়ারা খাতুন, খয়রাত হোসেন ও অনেকে এতে দস্তখত করলেন। আমি ঘুরে ঘুর দস্তখত জোগাড় করলাম। দু’একটা জেলায়ও আমাকে যেতে হয়েছিল। রিক্যুইজিশন সভার জন্য যে কয়েকজন সদস্যের দরকার তাদের দস্তখত নিয়ে নোটিশ তৈরি করা হল। মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের কাছে পৌছাতে হবে এই নোটিশটা। কেউই যেতে রাজি হল না। শেষ পর্যন্ত আমার উপরই ভার পড়ল। এই সময় আমাদের আলোচনা সভা জনাব তোফাজ্জেল আলী সাহেবের বাড়িতেই হত। কি করি আমারও লজ্জা করতে লাগল তাঁর সামনে যেয়ে নোটিশটা দিতে। আমি শেষ পর্যন্ত তাঁর কলতাবাজার আজাদ অফিসে হাজির হলাম। খবর দিলে তিনি আমাকে কামরায় ডেকে পাঠালেন। আমি তাঁকে সালাম করে তাঁর হাতে নোটিশ দিলাম এবং তিনি যে নোটিশটা পেলেন তা লিখে দিলে খুশি হব বললাম। মওলানা সাহেব লিখে দিলেন। তিনি আমার সাথে খুব ভাল ব্যবহার করলেন এবং কেমন আছি জিজ্ঞাসা করলেন। আমি তাঁর কাছ থেকে ভাগতে পারলে বাঁচি। তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে ছুটলাম।
পরের দিন আজাদ কাগজে তিনি নোটিশটা এবং যারা দস্তখত করেছে তাদের নাম ছেপে দিলেন এবং এক বিবৃতির মারফত ঘোষণা করলেন যে, রিক্যুইজিশন সভা আহবান করার ক্ষমতা কারও নাই, কারণ পুরানা প্রতিষ্টান ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এখন তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের এডহক কমিটির সভাপতি। অর্থাৎ আমরা কেউই আর মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সভ্য নই। এভাবে মুসলিম লীগ থেকেও আমরা বিতাড়িত হলাম। অনেকেই চুপ করে গেল, আমরা রাজি হলাম না। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে দেখব।
ফেব্রুয়ারি ৮ই হবে, ১৯৪৮ সাল। করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার (কন্সটিটিউয়েন্ট এসেম্বলি) বৈঠক হচ্ছিল। সেখানে রাষ্ট্রভাষা কি হবে সেই বিষয়ও আলোচনা চলছিল। মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকেই রাষ্টড়ভাষা করার পক্ষপাতী। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লীগ সদস্যরও সেই মত। কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি করলেন বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কারণ, পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা হল বাংলা। মুসলিম লীগ সদস্যরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন
৯২
মজলিস এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমুদ্দন মজলিস যুক্তভাবে সভা আহবান করে একটা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করল। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কিছু শাখা জেলায় ও মহকুমায় করা হয়েছে। তমদ্দুন মজলিস একটা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্টান যার নেতা ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাশেম সাহেব। এদিকে পুরানা লীগ কর্মীদের পক্ষ থেকে জনাব কামরুদ্দিন সাহেব, শামসুল হক সাহেব ও অনেকে সংগ্রাম পরিষদে যোগদান করলেন। সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস ঘোষণা করা হল। জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম। আমি ফরিদপুর, যশোর হয়ে দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করে ঐ তারিখের তিন দিন পূর্বে ঢাকায় ফিরে এলাম। দৌলতপুরে মুসলিম লীগ সমর্থক ছাত্ররা আমার সভায় গোলমাল করার চেষ্টা করলে খুব মারপিট হয়, কয়েকজন জখমও হয়। এরা সভা ভাঙতে পারে নাই, আমি শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা করলাম। এ সময় জনাব আবদুস সবুর খান আমাদের সমর্থন করেছিলেন। বরিশালের জনাব মহিউদ্দিন আহমদ তখন নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সদস্য, মুসলিম লীগ ও সরকারের পুরা সমর্থক। কাজী বাহাউদ্দিন আহমদ আমাদের দলের নেতা ছিলেন। আমি কলেজেই সভা করেছিলাম। মহিউদ্দিন সাহেব বাধা দিতে চেষ্টা করেন নাই। ঢাকায় ফিরে এলাম। রাতে কাজ ভাগ হল- কে কোথায় থাকব এবং কে কোথায় পিকেটিং করার ভার নেব। সামান্য কিছু সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাড়া শতকরা নব্বই ভাগ ছাত্র এই আন্দোলনে যোগদান করল। জগন্নাথ কলেজ, মিটফোর্ড, মেডিকেল স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বিশেষ করে সক্রিয় অংশগ্রহণ করল। মুসলিম লীগ ভাড়াটিয়া গুণ্ডা লেলিয়ে দিল আমাদের উপর। অধিকাংশ লোককে আমাদের বিরুদ্ধে করে ফেলল। পুরান ঢাকার কয়েক জায়গায় ছাত্রদের মারপিটও করল। আর আমরা পাকিস্তান ধ্বংস করতে চাই এই কথা বুঝাবার চেষ্টা করল।
১১ই মার্চ ভোরবেলা শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পোস্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে কোনো পিকেটিংয়ের দরকার হয় নাই। সমস্ত ঢাকা শহর পোস্টারে ভরে ফেলা হল। অনেক দোকানপাট বন্ধ ছিল, কিছু খোলাও ছিল। পুরান ঢাকা শহরে পুরাপুরি হরতাল পালন করে নাই। সকাল আটটায় জেনারেল পোস্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের উপর ভীষণভাবে লাঠিচার্জ হল। একদল মার খেয়ে স্থান ত্যাগ করার পর আরেকদল হাজির হতে লাগল। ফজলুল হক ধলে আমাদের রিজার্ভ কর্মী ছিল। এইভাবে গোলমাল, মারপিট চলল অনেকক্ষণ। নয়টায় ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনের দরজায় লাঠিচার্জ হল। খালেক নেওয়াজ খান, বখতিয়ার (এখন নওগাঁর এডভোকেট), শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এম.এ.ওয়াদুদ গুরতররুপে আহত হল। তোপখানা রোডে কাজী গোলাম মাহাবুব, শওকত মিয়া ও আরও অনেক ছাত্র আহত হল। আবদুল গনি রোডের দরজায় তখন আর ছাত্ররা অত্যাচার ও লাঠির আঘাত সহ্য করতে পারছে না। অনেক কর্মী আহত হয়ে গেছে এবং সরে পড়েছে। আমি জেনারেল পোস্ট অফিসের দিক থেকে
৯৩
নতুন কর্মী নিয়ে ইডেন বিল্ডিংয়ের দিকে ছুটছি, এর মধ্যে শামসুল হক সাহেবকে ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। গেট খালি হয়ে গেছে। তখন আমার কাছে সাইকেল। আমাকে গ্রেফতার করার জন্য সিটি এসপি জিপ নিয়ে বারবার তাড়া করছে, ধরতে পারছে না। এবার দেখলাম উপায় নাই। একজন সহকর্মী দাঁড়ান ছিল তার কাছে সাইকেল দিয়ে চার পাঁচজন ছাত্র নিয়ে আবার ইডেন বিল্ডিংয়ের দরজায় আমরা বসে পড়লাম এবং সাইকেল যাকে দিলাম তাকে বললাম, শীঘ্রই আরও কিছু ছাত্র পাঠাতে। আমরা খুব অল্প, টিকতে পারব না। আমাদের দেখাদেখি আরও কিছু ছাত্র ছুটে এসে আমাদের পাশে বসে পড়ল। আমাদের উপর কিছু উত্তম মধ্যম পড়ল এবং ধরে নিয়ে জিপে তুলল। হক সাহেবকে পূর্বেই জিপে তুলে ফেলেছে। বহু ছাত্র গ্রেফতার ও জখম হল। কিছু সংখ্যক ছাত্রকে গাড়ি করে ত্রিশ-চল্লিশ মাইল দূরে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে আসল। কয়েকজন ছাত্রী মার খেয়েছিল। অলি আহাদও গ্রেফতার হয়ে গেছে। তাজউদ্দীন, তোয়াহ ও অনেককে গ্রেফতার করতে পারে নাই। আমাদের প্রায় সত্তর-পচাত্তরজনকে বেঁধে নিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিল সন্ধ্যার সময়। ফলে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠল। ঢাকার জনগণের সমর্থনও আমরা পেলাম।
তখন পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার অধিবেশন চলছিল। শোভাযাত্রা রোজই বের হচ্ছিল। নাজিমুদ্দীন সাহেব বেগতিক দেখলেন। আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে। ওয়াদুদ ও বখতিয়ার দু’জনই ছাত্রলীগ কর্মী, তাঁদের ভীষণভাবে আহত করে জেল হাসপাতালে রাখা হয়েছে। এই সময় শেরে বাংলা, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, তোফাজ্জল আলী, ডা. মালেক, সবুর সাহেব, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন ও আরও অনেকে মুসলিম লীগ পার্টির বিরুদ্ধে ভীষণভাবে প্রতিবাদ করলেন। আবার শহীদ সাহবের দল এক হয়ে গেছে। নাজিমুদ্দীন সাহেব ঘাবড়িয়ে গেলেন এবং সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলাপ করতে রাজি হলেন।
আমরা জেলে, কি আলাপ হয়েছিল জানি না। তবে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে কামরুদ্দিন সাহেব জেলে আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বললেন, নাজিমুদ্দীন সাহেব এই দাবিগুলো মানতে রাজি হয়েছে: এখনই পূর্ব পাকিস্তানের অফিসিয়াল ভাষা বাংলা করে ফেলবে। পূর্ব পাকিস্তান আইনসভা থেকে সুপারিশ করবেন, যাতে কেন্দ্রে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হয়। সমস্ত মামলা উঠিয়ে নিবেন, বন্দিদের মুক্তি দিবেন এবং পুলিশ যে জুলুম করেছে সেই জন্য তিনি নিজেই তদন্ত করবেন। আর কি কি ছিল আমার মনে নাই। তিনি নিজেই হোম মিনিস্টার, আবার নিজেই তদন্ত করবেন এ যেন এক প্রহসন।
আমাদের এক জায়গায় রাখা হয়েছিল জেলের ভিতর। যে ওয়ার্ডে আমাদের রাখা হয়েছিল, তার নাম চার নম্বর ওয়ার্ড। তিনতলা দালান। দেওয়ালের বাইরেই মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচ দিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল দশটায় মেয়েরা স্কুলের ছাদে উঠে স্লোগান দিতে শুরু করত, আর চারটায় শেষ করত। ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা একট ক্লান্তও হত না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই,’‘পুলিশি জুলুম চলবে না’-নানা ধরনের স্লোগান। এই সময় শামসুল হক সাহেবকে আমি বললাম, ‘হক সাহেব ঐ দেখুন, আমাদের
৯৪
পাণ্ডুলিপির একটি পৃষ্টার চিত্রলিপি
৯৫
বোনেরা বেরিয়ে এসেছে। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে পারবে না’। হক সাহেব আমাকে বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ, মুজিব’।
আমাদের ১১ তারিখে জেলে নেওয়া হয়েছিল, আর ১৫ তারিখ সন্ধ্যায় মুক্তি দেওয়া হয়। জেলগেট থেকে শুভাযাত্রা করে আমাদের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে নিয়ে যাওয়া হল। ১৩ তারিখ সন্ধ্যায় কারাগারের ভিতর একটা গোলমাল হয়। একজন অবাঙালি জমাদার আমাদের ওয়ার্ডে তালা বন্ধ করতে এসেছেন। আমরা আমাদের জায়গায় এই সময় বসে থাকতাম। জমাদার সাহেব এক দুই গণনা করে দেখতেন, আমরা সংখ্যায় ঠিক আছি কি না। হিসাব মিললে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিতেন। সন্ধার সময় জেলখানার সমস্ত কয়েদিদের গণনা করে বাইরে থেকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে বন্ধ করা হয়। জমাদার কয়েকবার গণনা করলেন, কিন্ত হিসাব ঠিক হচ্ছে না। পাশের আরেকটা রুমেও আমাদের কিছু ছাত্র ছিল, তাদের গণনা ঠিক হয়েছে। ছোট ছোট কয়েকজন ছাত্র ছিল, তারা কারও কথা শুনতে চাইত না। গণনার সময় এক জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যেত। আমি ও শামসুল হক সাহেব সকলকে ধমকিয়ে বসিয়ে রাখতাম। আমরা দুইজন ও আবদুল মান্নান (এখন নবকুমার হাইস্কুলের হেডমাস্টার) এই তিঞ্জনই একটু বয়েসে বড় ছিলাম। খাওয়ার ভাগ বাটোয়ার ভার মান্নান সাহেবের উপরই ছিল। হিসাব যখন মিলছে না তখন জমাদার সাহেব রাগ করে ফেললেন এবং কড়া কথা বললেন। এতে ছাত্ররা ক্ষেপে জায়গা ছেড়ে উঠে পড়ল এবং হৈচৈ শুরু করল। আমি ও হক সাহেব আবার সকলকে এক জায়গায় বসিয়ে দিলাম। জমাদার সাহেব গণনা করলেন এবং হিসাব মিলল। কিন্ত দরজার বাইরে যেয়ে তিনি হঠাৎ বাঁশি বাজিয়ে দিলেন এবং পাগলা ঘন্টা বেজে গেল। পাগলা ঘন্টার অর্থ বিপদ সংকেত। এ অবস্থায় জেল সিপাহিরা যে যে অবস্থায় থাকুক না কেন, বন্দুক লাঠিসোটা নিয়ে ভিতরে আসে এবং দরকার হলে মারপিট শুরু করে। এই সময় আইন বলে কিছুই থাকে না। সিপাহিরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে, যদিও সুবেদার হাওলাদার তাদের সাথে থাকে। জেলার ও ডেপুটি জেলার সাহেবরাও ভিতরের দিকে ছুটতে থাকেন।
আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না, কি হয়েছে। যে বাঙালি সিপাহী আমাদের ওখানে ডিউটিতে ছিল সে তালা বন্ধ করে ফেলেছে। জমাদার তার কাছে চাবি চাইল। সে চাবি দিতে আপত্তি করল। এ নিয়ে দুইজনের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হল, আমরা দেখতে পেলাম। সিপাহী চাবি নিয়ে এক দৌড়ে দোতলা থেকে নিচে নেমে গেল। জমাদারের ইচ্ছা ছিল দরজা খুলে সিপাহি চাবি নিয়ে এক দৌড়ে দোতলা থেকে নিচে নেমে গেল। জমাদারের ইচ্ছা ছিল দরজা খুলে সিপাহিদের নিয়ে ভিতরে ঢুকে আমাদের মারপিট করবে। জেলার, ডেপুটি জেলার বা সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব ভিতরে আসবার পূর্বেই আমরা বুঝতে পেরে সকলকে তাড়াতাড়ি যার যার জায়গায় বস্তে বলে শামসুল হক সাহেব ও আমি দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের না মেরে ভিতরে যেন কেউ না আসতে পারে এই উদ্দেশ্যে। এ কথাও সকলকে বলে দিলাম যে, আমরা মার না খাওয়া পর্যন্ত কেউ হাত তুলবে না। যদি আমাদের আক্রমণ করে এবং মারপিট করে তখন টেবিল, চেয়ার, থালা, বাটি যা আছে তাই দিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। হক সাহেব ও আমি দুইজনই একগুঁয়ে ছিলাম।
৯৬
দরকার হলে সমানে হাতও চালাতে পারতাম, আর এটা আমার ছোট্টকাল থেকে বদ অভ্যাসও ছিল। সিপাহি যদি চাবি না নিয়ে ভাগত তবে আমাদের মার খেতে হত, সে সম্বন্ধে সন্দেহ ছিল না। কারণ, আমরা তো একটা রুমে বন্ধ। এর মধ্যে বহু সিপাহি চলে এসেছে, তারা অসভ্য গালাগালি করছিল। এমন সময় জেলার সাহেব ও ডেপুটি জেলার জনাব মোখলেসুর রহমান আমাদের গেটে এসে দাঁড়িয়ে সিপাহিদের নিচে যেতে হুকুম দিলেন। কিছু সময়ের মধ্যে জেল সুপারিনটেনডেন্ট মি. বিলও এসে হাজির হলেন এবং ঘটনা শুনে সিপাহিদের যেতে বললেন। সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবকে শামসুল হক সাহেব সমস্ত ঘটনা বললেন। এই বিল সাহেবই ১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে রাজবন্দিদের উপর গুলি করে কয়েকজন দেশপ্রেমিককে হত্যা করেছিলেন। পরে আমরা বুঝতে পারলাম একটা ষড়যন্ত্র হয়েছিল, আমাদের মারপিট করার জন্য। পরের দিন ডেপুটি জেলার মোখলেসুর রহমান সাহেব আমাদের জেলের আইনকানুন ও নিয়ম সম্বন্ধে অনেক কিছু বললেন। আমি যদিও কয়েকদিন হাজত খেটেছিলাম ছোটবেলায়, তবু জেলের আইনকানুন কিছুই বুঝতাম না, আর জানতাম না। দু’একখানা বই পড়ে যা কিছু সামান্য জ্ঞান হয়েছিল জেল সম্বন্ধে। একথা সত্য, আইনকানুন ছাত্রর একটু কমই মানত জেলখানায়। শামসুল হক সাহেব, মান্নান সাহেব ও আমি-এই তিনজনই সকলকে বুঝিয়ে রাখতাম। এদের মধ্যে অনেক স্কুলের ছাত্রও ছিল। নয় কি দশ বছরের একটা ছেলেও ছিল আমাদের সাথে। তার বাবা তার সাথে জেলগেটে দেখা করতে এসেছিল এবং তাকে বলেছিল, ‘তোকে আজই বের করে নিব’। ছেলেটা তার বাবাকে বলেছিল, ‘অন্যান্য ছাত্রদের না ছাড়লে আমি যাব না’। সে যখন এই কথা ফিরে এসে আমাদের বলল, তখন সকলে তাকে আদর করতে লাগল এবং তার নামে ‘জিন্দাবাদ’ দিল। তার নাম আজ আর আমার মনে নাই, তবে কথাগুলো মনে আছে। ভীষণ শক্ত ছেলে ছিল। গ্রেফতারকৃত একজন ছাত্রেরও মনোবল নষ্ট হয় নাই। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যে কোনো ত্যাগ তারা স্বীকারে প্রস্তুত ছিল।
১৬ তারিখ সকাল দশটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রসভায় আমরা সকলেই যোগদান করলাম। হঠাৎ কে যেন আমার নাম প্রস্তাব করে বসল সভাপতির আসন গ্রহণ করার জন্য। সকলেই সমর্থন করল। বিখ্যাত আমতলায় এই আমার প্রথম সভাপতিত্ব করতে হল। অনেকেই বক্তৃতা করল। সংগ্রাম পরিষদের সাথে যেসব শর্তের ভিত্তিতে আপোস হয়েছে তার সকলগুলিই সভায় অনুমোদন করা হল। তবে সভা খাজা নাজিমুদ্দীন যে পুলিশি জুলুমের তদন্ত করবেন, তা গ্রহণ করল না; কারণ খাজা সাহেব নিজেই প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আমি বক্তৃতায় বললাম, ‘যা সংগ্রাম পরিষদ গ্রহণ করেছে, আমাদেরও তা গ্রহণ করা উচিত। শুধু আমরা ঐ সরকারি প্রস্তাবটা পরিবর্তন করতে অনুরোধ করতে
৯৭
পারি, এর বেশি কিছু না’। ছাত্রএয়া দাবি করল, শোভাযাত্রা করে আইন পরিষদের কাছে গিয়ে খাজা সাহেবের কাছে এই দাবিটা পেশ করবে এবং চলে আসবে। আমি বক্তৃতায় বললাম, তাঁর কাছে পৌঁছে দিয়েই আপনারা আইনসভার এরিয়া ছেড়ে চলে আসবেন। কেউ সেখানে থাকতে পারবেন না। কারণ সংগ্রাম পরিষদ বলে দিয়েছে, আমাদের আন্দোলন বন্ধ করতে কিছুদিনের জন্য। সকলেই রাজি হলেন।
এক শোভাযাত্রা করে আমরা হাজির হয়ে কাগজটা ভিতরে পাঠিয়ে দিলাম খাজা সাহেবের কাছে। আমি আবার বক্তৃতা করে সকলকে চলে যেতে বললাম এবং নিজেও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে চলে আসবার জন্য রওয়ানা করলাম। কিছু দূর এসে দেখি, অনেক ছাত্র চলে গিয়েছে। কিছু ছাত্র ও জনসাধারণ তখনও দাঁড়িয়ে আছে আর মাঝে মাঝে স্লোগান দিচ্ছে। আবার ফিরে গিয়ে বক্তৃতা করলাম। এবার অনেক ছাত্রও চলে গেল। আমি হলে চলে আসলাম। প্রায় চারটায় খবর পেলাম, আবার বহু লোক জমা হয়েছে, তারা বেশিরভাগ সরকারি কর্মচারী ও জনসাধারণ, ছাত্র মাত্র কয়েকজন ছিল। শামসুল হক সাহেব চেষ্টা করছেন লোকদের ফেরাতে। মাঝে মাঝে হলের ছাত্ররা দু’একজন এমএলএকে ধরে আনতে শুরু করেছে মুসলিম হলে। তাদের কাছ থেকে লিখিয়ে নিচ্ছে, যদি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে না পারেন, তবে পদত্যাগ করবেন। মন্ত্রীরাও বের হতে পারছেন না। খাজা সাহেব মিলিটারির সাহায্যে পেছন দরজা দিয়ে ভেগে গিয়েছিলেন। বহু লোক আবার জড়ো হয়েছে। আমি ছুটলাম এসেম্বলির দিকে। ঠিক কাছাকাছিযখন পৌঁছে গেছি তখন লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করতে শুরু করেছে পুলিশ। আমার চক্ষু জ্বলতে শুরু করেছে। পানি পড়ছে, কিছুই চোখে দেখি না। কয়েকজন ছাত্র ও পাবলিক আহত হয়েছে। আমাকে কয়েকজন পলাশী ব্যারাকের পুকুরে নিয়ে চোখে মুখে পানি দিতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পরে একটু আরাম পেলাম। দেখি মুসলিম হলে হৈচৈ। বাগেরহাটের ডা. মোজাম্মেল হক সাহেবকে ধরে নিয়ে এসেছে। তিনি এমএলএ। তাঁকে ছাত্ররা জোর করছে লিখতে যে, তিনি পদত্যাগ করবেন। আমাকে তিনি চিনতেন, আমিও তাঁকে চিনতাম। আমি ছাত্রদের অনুরোধ করলাম, তাঁকে ছেড়ে দিতে। তিনি লোক ভাল এবং শহীদ সাহেবের সমর্থক ছিলেন। অনেক কষ্টে, অনেক বুঝিয়ে তাঁকে মুক্ত করে বাইরে নিয়ে এলাম। একটা রিকশা ভাড়া করে তাঁকে উঠিয়ে দিলাম। হঠাৎ খবর এল, শওকত মিয়া আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। তাড়াতাড়ি ছুটলাম তাকে দেখতে। সত্যই সে হাতে, পিঠে আঘাত পেয়েছে। পুলিশ লাঠি দিয়ে তাকে মেরেছে। আরও কয়েকজন সামান্য আহত হয়েছে। সকলকে বলে আসলাম, একটু ভাল হলেই হাসপাতাল ত্যাগ করতে। কারণ, পুলিশ আবার গ্রেফতার করতে পারে।
সন্ধ্যার পরে খবর এল ফজলুল হক হলে সংগ্রাম পরিষদের সভা হবে। ছাত্ররাও উপস্থিত থাকবে। আমার যেতেত একটু দেরি হয়েছিল। তখন একজন বক্তৃতা করছে আমাকে আক্রমণ করে। আমি দাঁড়িয়ে শুনলাম এবং সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। তার বক্তৃতা শেষ হলে আমার বক্তব্য বললাম। আমি যে আমতলার ছাত্রসভায় বলেছিলাম, কাগজ
৯৮
দিয়েই চলে আসতে এবং এসেম্বলি হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে সকলকে চলে যেতে অনুরোধ করেছিলাম এবং বক্তৃতাও করেছিলাম, একথা কেউ জানেন কি না? যা হোক, এখানেই শেষ হয়ে গেল, আর বেশি আলোচনা হল না এবং সিদ্ধান্ত হল আপাতত আমাদের আন্দোলন বন্ধ রাখা হল। কারণ, কয়েকদিনের মধ্যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথম ঢাকায় আসবেন পাকিস্তান হওয়ার পরে। তাঁকে সম্বর্ধনা জানাতে হবে। আমরা ছাত্ররাও সম্বর্ধনা জানাব। প্রত্যেক ছাত্র যাতে এয়ারপোরটে একসাথে শোভাযাত্রা করে যেতে পারে তার বন্দোবস্ত করা হবে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন শুধু ঢাকায়ই সীমাবদ্ধ ছিল না। ফরিদপুর ও যশোরে কয়েক শত ছাত্র গ্রেফতার হয়েছিল। রাজশাহী, খুলনা, দিনাজপুর ও আরও অনেক জেলায় আন্দোলন হয়েছিল। নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ চেষ্টা করেছিল এই আন্দোলনকে বানচাল করতে, কিন্ত পারে নাই। এই আন্দোলন ছাত্ররাই শুরু করেছিল সন্দেহ নাই। কিন্তু এই আন্দোলনের পরে দেখা গেল জনসাধারণও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে বদ্ধপরিকর-বিশেষ করে সরকারি কর্মচারীরাও একে সমর্থন দিয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে একদল গুণ্ডা আক্রমণ করলে পলাশী ব্যারাক থেকে সরকারি কর্মচারীরা এসে তাদের বাধা দিয়েছিল। যার ফলে গুণ্ডারা মার খেয়ে ভাগতে বাধ্য হয়েছিল। পরে দেখা গেল, ঢাকা শহরের জনসাধারণের মনোভাবের অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। সরকার থেকে প্রপাগান্ডা করা হয়েছিল যে, কলকাতা থেকে হিন্দু ছাত্ররা পায়জামা পরে এসে এই আন্দোলন করছে। যে সত্তর-পচাত্তরজন ছাত্র বন্দি হয়েছিল তার মধ্যে একজনও হিন্দু ছাত্র ছিল না। এমনকি যারা আহত হয়েছিল তার মধ্যেও একজন হিন্দু ছিল না। তবু তখন থেকেই ‘যুক্ত বাংলা ও ভারতবর্ষের দালাল, কমিউনিস্ট ও রাষ্ট্রদ্রোহী’-এই কথাগুলি বলা শুরু হয়, আমাদের বিরুদ্ধে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে। এমনকি সরকারি প্রেসনোটেও আমাদের এইভাবে দোষারোপ করা হত।
বাংলা পাকিস্তানের শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ লোকের মাতৃভাষা। তাই বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তবুও আমরা বাংলা ও উর্দু দুইতা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলাম। পাঞ্জাবের লোকেরা পাঞ্জাবি ভাষা বলে, সিন্ধুর লোকেরা সিন্ধি ভাষায় কথা বলে, সীমান্ত প্রদেশের লোকেরা পশতু ভাষায় কথা বলে, বেলুচরা বেলুচি ভাষায় কথা বলে। উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের ভাষা নয়, তবুও যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ভায়েরা উর্দু ভাষার জন্য দাবি করে, আমরা আপত্তি করব কেন? যারা উর্দু ভাষা সমর্থন করে তাদের একমাত্র যুক্তি হল উর্দু ‘ইসলামিক ভাষা’। উর্দু কি করে যে ইসলামিক ভাষা হল আমরা বুঝতে পারলাম না।
দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আরব দেশের লোকেরা আরবি বলে। পারস্যের লোকেরা ফার্সি বলে, তুরস্কের লোকেরা তুর্কি ভাষা বলে, ইন্দোনেশিয়ার লোকেরা ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কথা বলে, মালয়েশিয়ার লোকেরা মালয়া ভাষায় কথা বলে, চীনের মুসলমানরা চীনা ভাষায় কথা বলে। এ সম্বন্ধে অনেক যুক্তিপূর্ণ কথা বলা চলে।
৯৯
শুধু পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোঁকা দেওয়া যাবে ভেবেছিল, কিন্ত পারে নাই। যে কোনো জাতি তার মাতৃভাষাকে ভালবাসে। মাতৃভাষার অপমান কোনো জাতিই কোনো কালে সহ্য করে নাই। এই সময় সরকারদলীয় মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুর জন্য জান মান কোরবানি করতে প্রস্তুৎ হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্ত জনসমর্থন না পেয়ে একটু ঘাবড়িয়ে পড়েছিলেন। তারা শেষ ‘তাবিজ’ নিক্ষেপ করলেন। জিন্নাহকে ভুল বোঝালেন। এরা মনে করলেন, জিন্নাহকে দিয়ে উর্দুর পক্ষে বলাতে পারলেই আর কেউ এর বিরুদ্ধাচরণ করতে সাহস পাবে না। জিন্নাহকে দলমত নির্বিশেষে সকলেই শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর যে কোন ন্যায়সঙ্গত কথা মানতে সকলেই বাধ্য ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের জনমত কোন পথে, তাঁকে কেউই তা বলেন নাই বা বলতে সাহস পান নাই।
১৯ মার্চ জিন্নাহ ঢাকা আসলে হাজার হাজার লোক তাঁকে অভিনন্দন জানাতে তেজগাঁ হাওয়াই জাহাজের আড্ডায় হাজির হয়েছিল। আমার মনে আছে, ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল। সেদিন আমরা সকলেই ভিজে গিয়েছিলাম, তবুও ভিজে কাপড় নিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করার জন্য এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করেছিলাম। জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঘোড় দৌড় মাঠে বিরাট সভায় ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’। আমরা প্রায় চার পাঁচ শত ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সেই সভায়। অনেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিল , ‘মানি না’। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন বক্তৃতা করতে উঠে তিনি যখন আবার বললেন, ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’-তখন ছাত্ররা তাঁর সামনেই বসে চিৎকার করে বলল, ‘না, না, না’। জিন্নাহ প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করেছিলেন, তারপর বক্তৃতা করেছিলেন। আমার মনে হয়, এই প্রথম তাঁর মুখের উপরে তাঁর কথার প্রতিবাদ করল বাংলার ছাত্ররা। এরপর জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন আর কোনোদিন বলেন না, উর্দুই একমাত্র রাষ্টভাষা হবে।
ঢাকায় জিন্নাহ দুই দলের ছাত্রনেতাদের ডাকলেন। বোধহয় বাংলা ভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদেরও ডেকেছিলেন। তবে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের দুইজন করে প্রতিনিধির সাথে দেখা করলেন। কারণ, তিনি পছন্দ করেন নাই, দুইতা প্রতিষ্টান কেন হবে এই মুহূর্তে! আমাদের পক্ষ থেকে মিস্টার তোয়াহা আর শামসুল হক সাহেব ছিলেন, তবে আমি ছিলাম না। জিন্নাহ আমাদের প্রতিষ্টানের নামটা পছন্দ করেছিলেন। নিখিল পূর্ব পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের নাম যখন আমাদের প্রতিনিধি পেশ করেন, তখন তাঁরা দেখিয়ে দিলেন যে, এদের অধিকাংশ এখন চাকরি করে, অথবা লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। তখন জিন্নাহ তাদের উপর রাগই করেছিলেন। শামসুল হক সাহেবের সাথে জিন্নাহর একটু তর্ক হয়েছিল, যখন তিনি দেখা করতে যান বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার বিষয় নিয়ে-শামসুল হক সাহেব আমাকে এসে বলেছিলেন। শামসুল হক সাহেবের সৎ সাহস ছিল, সত্য কথা বলতে কাউকেও ভয় পেতেন না।
জিন্নাহ চলে যাওয়ার কয়েকদিন পরে ফজলুল হক হলের সামনে এক ছাত্রসভা হয়। তাতে একজন ছাত্র বক্তৃতা করেছিল, তার নাম আমার মনে নাই। তবে সে বলেছিল, ‘জিন্নাহ
১০০
যা বলবেন, তাই আমাদের মানতে হবে। তিনি যখন উর্দুই রাষ্ট্রভাষা বলেছেন তখন উর্দুই হবে’। আমি তার প্রতিবাদ করে বক্তৃতা করেছিলাম, আজও আমার এই একটা কথা মনে আছে। আমি বলেছিলাম, ‘কোন নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে। যেমন হযরত ওমরকে (রা.) সাধারণ নাগরিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি বড় জামা পরেছিলেন বলে। বাংলা ভাষা শতকরা ছাপ্পান্নজন লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যাই হোক না কেন, আমরা প্রস্তুত আছি’। সাধারণ ছাত্ররা আমাকে সমর্থন করল। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও যুবকরা ভাষার দাবি নিয়ে সভা ও শোভাযাত্রা করে চলল। দিন দিন জনমত সৃষ্টি হতে লাগল। কয়েক মাসের মধ্যে দেখা গেল, নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কোনো সমর্থক রইল না। কিছু নেতা রইল, যাদের মন্ত্রীদের বাড়ি ঘোরাফেরা করা আর সরকারের সকল কিছুই সমর্থন করা ছাড়া কাজ ছিল না।
ভাষা আন্দোলনের পূর্বে মোহাম্মদ আলী, তোফাজ্জল আলী এবং ডা. মালেক সাহেবের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ এমএলএদের মধ্যে এক গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ, খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব শহীদ সাহেবের কোনো সমর্থককে মন্ত্রিত্ব দেন নাই। এমনকি পার্লামেন্টারি সেক্রেটারিও করেন নাই। তাদের সংখ্যাও কম ছিল না। প্রায়ই তোফাজ্জল আলী সাহেবের বাড়িতে এদের সভা হত। দেখা গিয়েছিল, এদের সমর্থক সংখ্যা এমন পর্যায়ে এসে পড়েছে যে, ইচ্ছা করলে নাজিমুদ্দীন সাহেবের বিরুদ্ধে অনাস্থা দিলে পাস হয়ে যেতে পারে। এদের পক্ষ থেকে দুই একজন এমএলএ কলকাতায়ও গিয়েছিল, শহীদ সাহেবকে আনতে। শহীদ সাহেব ঢাকায় পৌছলেই অনাস্থা প্রস্তাব এরা পেশ করবে বলে কথাবার্তা চলেছিল। কিন্ত শহীদ সাহেব রাজি হন নাই। তিনি এদের বলেছিলেন, ‘আমি এখন গোলমাল সৃষ্টি করতে চাই না। নাজিমুদ্দীন সাহেবই কাজ করুক’। আরও বলেছিলেন, ‘সেই পুরানা এমএলএদের কথা বলছ? কিছুদিন পূর্বে আমার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। আজ আবার নাজিমুদ্দীন সাহেবের বিরুদ্ধে ভোট দিবে, কাল আবার আমার বিরুদ্ধে দিতে পারে। এ সমস্তের দরকার নাই, আমার অনেক কাজ এবং সে কাজ আমি না করলে মুসলমানদের ভারত ত্যাগ করতে হবে এবং লক্ষ লক্ষ লোক মারা যাবে। আমার একমাত্র চেষ্টা ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে এবং পাকিস্তানে মুসলমান-হিন্দুদের মধ্যে স্থায়ী একটা শান্তি কায়েম করতে পারি কি না?’
এদিকে জিন্নাহ সাহেব মোহাম্মদ আলী সাহেবকে ডেকে এক ধমক দিলেন, দল সৃষ্টি করার জন্য। আর বললেন, রাষ্ট্রদূত হয়ে বার্মায় যেতে। মোহাম্মদ আলী, তোফাজ্জল
১০১
আলী সাহেবের বাড়িতে এসে আমাদের সমস্ত ঘটনা বললেন এবং তিনি যে বার্মা যেতে রাজি হয়েছেন, সেকথাও জানালেন। কিছুদিন পরে ডা. মালেকও মন্ত্রীত্ব পাবেন বলে ঠিক হল। শেষ পর্যন্ত তোফাজ্জল আলী সাহেব বাকি ছিলেন। তিনি একদিন আমাকে বললেন, ‘মুজিব দেখলে তো, মোহাম্মদ আলী সাহেব চলে গেলেন, ডা. মালেকও মন্ত্রী হয়ে যাচ্ছে, আমাকেও ডেকেছে মন্ত্রীত্ব নিতে। কি করি বল তো? একলা তো আর বাইরে থেকে কিছু করা যাবে না। তোমার মত আমার নেওয়া দরকার’। আমি দেখলাম, তাঁকে বাধা দিয়ে আর কি হবে? সকলেই তো নাজিমুদ্দীন সাহেবের দলে মিলে গেছে। আমি তাঁকে বললাম, ‘তবুও তো আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর কেউ তো জিজ্ঞাসাও করল না। কি আর আপনি একলা করতে পারবেন, মন্ত্রিত্ব নিয়ে নেন, আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। যে আদর্শ ও পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করেছি, সে আদর্শ কায়েম না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালাব’। তিনি যে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এই ভদ্রতার জন্য তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করেছি এবং তাঁর সাথে আমার সম্বন্ধ কোনোদিন নষ্ট হয় নাই। তিনিও আমাকে সকল সময়ই ছোট ভাইয়ের মত দেখেছেন। যদিও পরে আমরা দুইজন দুই রাজনৈতিক দলে ছিলাম।
মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের বিবৃতির পরে আর আমরা মুসলিম লীগের সদস্য থাকলাম না। অর্থাৎ আমাদের মুসলিম লীগ থেকে খেদিয়ে দেওয়া হল। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, মুসলিম লীগকে একটা প্রগতিশীল প্রতিষ্টানে পরিণত করা। টাঙ্গাইলে দুইটা আইনসভার আসন খালি হয়েছিল। আমাদের ইচ্ছা ছিল, নাজিমুদ্দীন সাহেবের বিরুদ্ধে লোক দেওয়া যায় কি না? মওলানা ভাসানী সাহেব আসাম থেকে চলে এসে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে বাস করছিলেন। তাঁর শরনাপন্ন হলাম। কিন্ত মওলানা সাহেব এক সিট নিজে এবং এক সিট নাজিমুদ্দীন সাহেবকে দিয়ে নির্বাচন করে এমএলএ হলেন। পরে নির্বাচনী হিসাব দাখিল না করার জন্য মওলানা সাহেবের নির্বাচন বেআইনি ঘোষণা হয়েছিল।
আমাদের ভাষা আন্দোলনের সময় মওলানা সাহেব সমর্থন করেছিলেন। টাঙ্গাইলে মুসলিম লীগ কর্মীদের এক সভা ডাকা হল, কি করা যায় ভবিষ্যতে! আলোচনা হবার পরে ঠিক হল, আরেকটা সভা করা হবে নারায়ণগঞ্জে। সেখানে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হবে। মওলানা ভাসানী, আবদুস সালাম খান, আতাউর রহমান খান, শামসুল হক সাহেব আরও অনেক মুসলিম লীগ কর্মী ও নেতা যোগদান করবেন বলে ঠিক হল। সভার আয়োজন করেছিল সালমান আলী, আবদুল আউয়াল, শামসুজ্জোহা ও আরও অনেকে। খান সাহেব ওসমান আলী এমএলএও সমর্থন দিয়েছিলেন। সভার পূর্বে ১৪৪ ধারা জারি করা হল। আমরা পাইকপাড়া ক্লাবে সভা করলাম। বিভিন্ন জেলার অনেক নেতাকর্মী উপস্থিত হয়েছিলেন। এই সময় শামসুজ্জোহার উপর মুসলিম লীগের ভাড়াটিয়া গুণ্ডারা আক্রমণ করেছিল। দুঃখের বিষয়, এই কর্মীরাই নারায়ণগঞ্জে মুসলিম লীগ গঠন করেছিল এবং পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল।এখন যারা এদের উপর আক্রমণ করেছিল তাদের প্রায় সকলেই পাকিস্তান ও মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ছিল। প্রত্যেক জেলা
১০২
ও মহকুমায় মুসলিম লীগ ভেঙে দিয়ে এডহক কমিটি গঠন করেছিল। প্রায় সমস্ত জায়গায় মুসলিম লীগ কমিটিতে শহীদ সাহবের সমর্থক বেশি ছিল বলে অনেক লিগ ও পাকিস্তানবিরোধী লোকদের এডহক কমিটিতে নিতে হয়েছিল। কিন্ত জনসাধারণ মুসলিম লীগ বলতে শুধু পুরানা লীগ কর্মীদেরই বুঝত।
মওলানা ভাসানী সাহেবের সভাপতিত্বে এই সভা হল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, প্রথমে দুইজন প্রতিনিধি করাচিতে জনাব খালিকুজ্জামান সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করবেন এবং আমাদের দাবি পেশ করবেন। আমাদের দাবি ছিল, পুরানা মুসলিম লীগকে কাজ করতে দেওয়া হোক। যদি না শোনেন, তবে আমাদের রসিদ বই দেওয়া হোক এবং যাতে নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় তার বন্দোবস্ত করা হোক। দেখা যাবে, জনসাধারণ কাদের চায়? তখনকার দিনে করাচি যাওয়া এত সোজা ছিল না। কলকাতা-দিল্লি হয়ে করাচি যেতে হত। ঠিক হল, জনাব আতাউর রহমান খান এবং বেগম আনোয়ারা খাতুন এমএলএ যাবেন করাচিতে। তাঁরা করাচিতে গেলেন এবং চৌধুরী খালিকুজ্জামানের সাথে সাক্ষাৎ করলেন এবং আমাদের দাবিদাওয়া পেশ করলেন। খালিকুজ্জামান সাহেব বলে দিলেন, ‘পুরানা কথা ভুলে যান, যারা খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেবকে সমর্থন করবেন, তারাই মুসলিম লীগের সদস্য থাকবেন’। রসিদ বইয়ের কথায় বললেন, ‘কাগজ পাওয়া যায় না, তাই রসিদ বই পাওয়া কষ্টকর। আকরম খাঁ সাহেব ও পূর্ব পাকিস্তান এডহক কমিটিকে বলবেন, তারা যদি ভাল মনে করেন তবে পাবেন’। দুইজনই ফিরে এলেন এবং আমাদের কাছে বললেন, মিছামিছি কতগুলি টাকা খরচ করা হল, কোনো কাজ হল না। খালিকুজ্জামান সাহেব ভাল করে কথা বলতেও চান নাই।
শহীদ সাহেবও এই সময় ঢাকা আসলেন এবং মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও আরও কয়েক জায়গায় সভা করলেন, তাতে ফল খুব ভাল হল। হিন্দুদের দেশত্যাগ করার যে একটা হিড়িক পড়েছিল তা অনেকটা বন্ধ হল এবং পশ্চিম বাংলা ও বিহার থেকেও মুসলমানরা অনেক কম আসতে লাগল। এই সমস্ত সভায় এত বেশি জনসমাগম হত এবং শহীদ সাহেবকে অভ্যর্থনা করার জন্য এত লোক উপস্থিত হত যে তা কল্পনা করাও কষ্টকর। এতে নাজিমুদ্দীন সাহেবের সরকার ঘাবড়িয়ে গিয়েছিলেন। এবার শহীদ সাহেব নবাবজাদা নসরুল্লাহ সাহেবের বাড়িতে উঠেছিলেন। নবাবজাদা শহীদ সাহেবকে সমর্থনও করতেন এবং শ্রদ্ধাও করতেন। শহীদ সাহেবকে বিদায় দিলাম গোপালগঞ্জ থেকে। সবুর সাহেব খুলনায় শহীদ সাহেবকে অভ্যর্থনা করলেন। কারণ, সবুর সাহেব তখনও শহীদ সাহবের কথা ভুলতে পারেন নাই। তাঁকে সমর্থন করতেন এবং আমাদেরও সাহায্য করতেন। শহীদ সাহেব খুলনায় হিন্দু-মুসলমান নেতাদের নিয়ে এক ঘরোয়া বৈঠক করলেন এবং সাম্প্রদায়িক শান্তি যাতে বজায় থাকে সে সম্বন্ধে সকলকে চেষ্টা করতে বললেন। গোপালগঞ্জে বিরাট সভায় শহীদ সাহেব ও আমাকে খালি গলায়ই বক্তৃতা করতে হয়েছিল। কারণ মাইক্রোফোন জোগাড় করতে পারি নাই। খুলনা থেকে যে আনব সে সময়ও আমাদের হাতে ছিল না, কারণ তিনি হঠাৎ প্রোগ্রাম করেছিলেন।
১০৩
এইবার যখন শহীদ সাহেব পূর্ব পাকিস্তানে এলেন, আমরা দেখলাম সরকার ভাল চোখে দেখছে না। পূর্বে সরকারি কর্মচারীরা শহীদ সাহেবের থাকবার বন্দোবস্ত যাতে ভালভাবে হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতেন। কিন্ত এবার তারা দূরে দূরে থাকতে চায়। দু’একজন গোপনে বলেই ফেলেছিল, ‘উপরের হুকুম, যাতে তারা সহযোগিতা না করে’। গোয়েন্দা বিভাগের তৎপরতাও বেড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছিল। সত্যই পাকিস্তানের মঙ্গলেরে জন্যই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা উচিত, তা না হলে যদি একবার মোহাজের আসতে শুরু করত, তাহলে অবস্থা কি শোচনীয় হত যারা চিন্তাবিদ তারা তা অনুধাবন করতে পারবেন। সংকীর্ণ মন নিয়ে যারা রাজনীতি করেন তাদের কথা আলাদা। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার ও অন্যান্য প্রদেশগুলোতে এখনও লক্ষ লক্ষ মুসলমান রয়েছে-যাদের দান পাকিস্তান আন্দোলনে কারও চেয়ে কম ছিল না। তাদের কথা চিন্তা করে আমাদের শান্তি বজায় রাখা উচিত বলে আমরা মনে করতাম। সত্য কথা বলতে কি, পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান শহীদ সাহেবের উপদেশ গ্রহণ করেছিল। ফলে কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা হয় নাই। এমনকি মুসলমানরা হিন্দুদের অনুরোধ করেছিল, যাতে তারা দেশ ত্যাগ না করে। আমি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য অনেক জায়গায় ঘুরেছি। আমার জানা আছে এ রকম অনেক ঘটনা। দুঃখের বিষয়, পশ্চিমবঙ্গের প্রগতিশীল হিন্দু ভাইরাও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে পারেন নাই। মাঝে মাঝে গোলমাল হয়েছে, নিরীহ মুসলমানদের ঘরবাড়ি, জানমাল ধ্বংস করেছে অনেক জায়গায়।

এই সময় খাদ্য সমস্যা দেখা দিয়েছিল কয়েকটা জেলায়। বিশেষ করে ফরিদপুর, কুমিল্লা ও ঢাকা জেলার জনসাধারণ এক মহাবিপদের সম্মুখীন হয়েছিল। সরকার কর্ডন প্রথা চালু করেছিল। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় কোনো খাদ্য যেতে দেওয়া হত না। ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার লোক, খুলনা ও বরিশাল ধান কাটবার মরশুমে দল বেঁধে দিনমজুর হিসাবে যেত। এরা ধান কেটে ঘরে উঠিয়ে দিত। পরিবর্তে একটা অংশ পেত। এদের ‘দাওয়াল’ বলা হত। হাজার হাজার লোক নৌকা করে যেত। আসবার সময় তাদের অংশের ধান নিজেদের নৌকা করে বাড়িতে নিয়ে আসত। এমনিভাবে কুমিল্লা জেলার দাওয়ালরা সিলেট জেলায় যেত। এরা প্রায় সকলেই গরিব ও দিনমজুর। প্রায় দুই মাসের জন্য ঘরবাড়ি ছেড়ে এদের যেতে হত। যাবার বেলায় মহাজনদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে সংসার খরচের জন্য দিয়ে যেত। ফিরে এসে ধার ধোধ করত। দাওয়ালদের নৌকা খুবই কম ছিল। যাদের কাছ থেকে নৌকা নিত তাদেরও একটা অংশ দিতে হত। যখন এবার দাওয়ালরা ধান কাটতে গেল, কেউ তাদের বাধা দিল না। এরা না গেলে আবার জমির ধান তুলবার উপায় ছিল না। একসাথেই প্রায় সব ধান পেকে যায়, তাই তাড়াতাড়ি কেটে আনতে হয়। স্থানীয়ভাবে এত কৃষাণ একসাথে পাওয়া কষ্টকর ছিল। বহু বৎসর যাবৎ এই পদ্ধতি চলে আসছিল।
১০৪
ফরিদপুর, ঢাকা ও কুমিল্লা জেলার হাজার হাজার লোক এই ধানের উপর নির্ভর করত। দাওয়ালরা যখন ধান কাটতে যায়, তখন সরকার কোনো বাধা দিল না। যখন তারা দুই মাস পর্যন্ত ধান কেটে তাদের ভাগ নৌকায় তুলে রওয়ানা করল বাড়ির দিকে তাদের বুভুক্ষ মা-বোন, স্ত্রী ও সন্তানদের খাওয়াবার জন্য, যারা পথ চেয়ে আছে, আর কোনো মতে ধার করে সংসার চালাচ্ছে- কখন তাদের, স্বামী, ভাই, বাবা ফিরে আসবে ধান নিয়ে, পেট ভরে কিছুদিন ভাত খাবে, এই আশায়- তখন নৌকায় রওয়ানা করার সাথে সাথে তাদের পথ রোধ করা হল। ‘ধান নিতে পারবে না, সরকারের হুকুম’, ধান জমা দিয়ে যেতে হবে, নতুবা নৌকাসমেত আটক ও বাজেয়াপ্ত করা হবে। সহজে কি ধান দিতে চায়? শেষ পর্যন্ত সমস্ত ধান নামিয়ে রেখে লোকগুলিকে ছেড়ে দেওয়া হল। এ খবর পেয়ে আমার পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব হল না। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ করলাম। সভা করলাম, সরকারি কর্মচারীদের সাথে সাক্ষাৎ করলাম কিন্ত কোনো ফল হল না। এদিকে খোন্দকার মোশতাক আহমদ এই কর্ডনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা শুরু করেছে বলে আমি খবর পেলাম। অনেক সভা-সমিতি, অনেক প্রস্তাব করলাম কোনো ফল হল না। এই লোকগুলি দিনমজুর। দুই মাস পর্যন্ত যে শ্রম দিল, তার মজুরি তাদের মিলল না। আর মহাজনদের কাছ থেকে যে টাকা ধার করে এনেছিল এই দুই মাসের খরচের জন্য, খালি হাতে ফিরে যাওয়ার পরে দেনার দায়ে ভিটাবাড়িও ছাড়তে হল।
এ রকমের শত শত ঘটনা আমার জানা আছে। এদিকে এদিকে ফরিদপুর, ঢাকা ও কুমিল্লা জেলার অনেক নৌকার ব্যবসায়ী ছিল যারা বড় নৌকায় করে ধান-চাউল ঐ সমস্ত জেলা থেকে এনে বিক্রি করত, তাদের ব্যবসাও বন্ধ হল এবং অনেক লোক নৌকায় খেটে খেত তারাও বেকার হয়ে পড়ল। এদের মধ্যে অনেকেই আজ রিকশা চালায়। একমাত্র গোপালগঞ্জ মহকুমার কয়েক হাজার লোক খুলনা, যশোর ও অন্যান্য জায়গায় রিকশা চালিয়ে এবং কুলির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করার চেষ্টা করতে লাগল। আমরা যখন ভীষণভাবে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলাম, সরকার হুকুম দিল ধান কাটতে যেতে আপত্তি নাই। তবে ধান আনতে পারবে না। নিকটতম সরকারি গুদামে জমা দিতে হবে এবং সেই গুদাম থেকে কর্মচারীরা একটা রসিদ দেবে, দাওয়ালরা দেশে ফিরে এসে সেই পরিমাণ ধান নিজের জেলার নিকটতম গুদাম থেকে পাবে। দাওয়ালরা ধান কাটতে না গেলে একমাত্র খুলনা জেলায়ই অর্ধেক জমির ধান পড়ে থাকবে, একথা সরকার জানত। ১৯৪৮ সালের শেষে অথবা ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে এই হুকুম সরকার দিল। দুঃখের বিষয়, ধান গুদামে নেওয়া হয়েছিল, কিন্ত অধিকাংশ দাওয়াল ফিরে এসে ধান পায় নাই। কোন রকম পাকা রসিদ ছিল না, সাদা কাগজে লিখে দিয়েই ধান নামিয়ে রাখত। সেই রসিদ নিয়ে দেশের গুদামে গেলে গালাগালি করে তাড়িয়ে দিত। অথবা সামান্য কিছু ব্যয় করলে কিছু ধান পাওয়া যেত। এতে দাওয়ালরা সর্বস্বান্ত হয়ে গেল।
এই সময় একটা ঘটনা ঘটে গেল খুলনায়। ফরিদপুর জেলার দাওয়ালদের প্রায় দুইশত নৌকা আটক করল ধানসমেত। তারা রাতের অন্ধকারে সরকারি হুকুম না মেনে ‘আল্লাহু
১০৫
আকবর’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়ে নৌকা ছেড়ে দিল দিন নিয়ে। দশ-পনের মাইল চলার পরে পুলিশ বাহিনী লঞ্চ নিয়ে তাদের ধাওয়া করে বাধা দিল, শেষ পর্যন্ত গুলি করে তাদের থামান হল। দাওয়ালরাও বাধা দিয়েছিল, কিন্ত পারে নাই। জোর করে নদীর পাড়ে এক মাঠের ভিতর সমস্ত ধান নামান হয়েছিল এবং লোকদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। যদিও সরকারি গুদামে সে ধান ওঠে নাই। পরের দিন ভীষণভাবে বৃষ্টি হয়ে সে ধান ভেসে যায়। আমি খবর পেয়ে খুলনা এলাম, তখনও অনেক নৌকা আটক রয়েছে ধানসহ। এই সময় দাওয়ালদের নিয়ে সভা করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বাড়িতে শোভাযাত্রা সহকারে উপস্থিত হলাম। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন প্রফেসর মুনীর চৌধুরীর বাবা জনাব আবদুল হালিম চৌধুরী। তিনি আমার সাথে আলাপ করলেন এবং বললেন, তাঁর কিছুই করার নাই, সরকারের হুকুম। তবে তিনি ওয়াদা করলেন, সরকারের কাছে টেলিগ্রাম করবেন সমস্ত অবস্থা জানিয়ে। আমি দাওয়ালদের নিয়ে ফিরে আসলাম। আমি নিজেও টেলিগ্রাম করলাম। দাওয়ালদের বললাম, ভবিষ্যতে যেন তারা এভাবে আর ধান কাটতে না আসে, একটা বোঝাপড়া না হওয়া পর্যন্ত। খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব তখন বড়লাট। কারণ, জিন্নাহ মারা যাবার পরে তাঁকে গভর্নর জেনারেল করা হয়েছিল।
এই সময় আরেকতা অত্যাচার মহামারীর মত শুরু হয়েছিল। ‘জিন্নাহ ফান্ড’ নামে সরকার একটা ফান্ড খোলে। যে যা পারে তাই দান করবে এই হল হুকুম। ‘জিন্নাহ ফান্ডে’ টাকা দিতে কেউই আপত্তি করেছে বলে আমার জানা নাই। যাদের অর্থ আছে তারা খুশি হয়েই দান করেছে। অনেক গরিবও ‘জিন্নাহ ফান্ডে’ টাকা দিয়াছে। কিন্ত কিছু সংখ্যক অফিসার সরকারকে খুশি করার জন্য জোরজুলুম করে টাকা তুলতে শুরু করেছিল। যে মহকুমা অফিসার বেশি তুলতে পারবেন, তিনি ভেবেছেন তাড়াতাড়ি প্রমোশন পাবেন।
আমার মহকুমায় এটা ভীষণ রূপ ধারণ করেছিল। খাজা সাহেব গোপালগঞ্জ আসবেন ঠিক হয়েছে। তখনকার মহকুমা হাকিম সভা করে এক অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করেছেন। যেখানে ঠিক করেছে যে গোপালগঞ্জ মহকুমায় প্রায় ছয় লক্ষ লোকের বাস, মাথাপ্রতি এক টাকা করে দিতে হবে, তাতে ছয় লক্ষ টাকা উঠবে। আর যাদের বন্দুক আছে, তাদের আলাদাভাবে দিতে হবে। ব্যাবসায়ীদের তো কথাই নেই। বড় নৌকাপ্রতিও প্রত্যেককে দিতে হবে। তিনি সমস্ত ইউনিয়িন বোর্ডের প্রেসিডেন্টদের হুকুম দিয়েছেন, যে না দিবে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। চারিদিকে জোরজুলুম শুরু হয়েছে। চৌকিদার, দফাদার নেমে পড়েছে। কারও গরু, কারও বদনা, থালা, ঘটিবাটি কেড়ে আনা হচ্ছে। এক ত্রাসের রাজত্ব। জনাব ওয়াহিদুজ্জামান সাহেবই নাজিমুদ্দীন সাহেবকে দাওয়াত করে এনেছেন। এখন তিনি মুসলিম লীগে আছেন। গোপালগঞ্জ মুসলিম লীগ যারা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত করেছেন, এখন আর তারা নাই। এডহক কমিটি করা হয়েছে। মহকুমা হাকিম সাহেবের সাথে যোগসাজেশে তারা কাজ করেছে।
১০৬
আমি খুলনা থেকে গোপালগঞ্জ পৌছালাম। গোপালগঞ্জ শহরে স্টিমার যায় না। দুই মাইল দূরে হরিদাসপুর নামে একটা ছোট্ট স্টেশন পর্যন্ত আসে। হরিদাসপুর থেকে নৌকায় গোপালগঞ্জ যেতে হয়। আমি একটা নৌকায় উঠলাম। মাঝি আমাকে চিনতে পেরেছে। নৌকা ছেড়ে দিয়ে আমাকে বলে, ‘ভাইজান, আপনি এখন এসেছেন, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। পাঁচজন লোক আমরা, হুকুম এসেছে পাঁচ টাকা দিতে হবে। দিনভর কোনোদিন দুই টাকা, কোনোদিন আরও কম টাকা উপার্জন করি, বলেন তো পাঁচ টাকা কোথায় পাই? গতকাল আমার বাবার আমলের একটা পিতলের বদনা ছিল, তা চৌকিদার টাকার দায়ে কেড়ে নিয়ে গেছে’। এই কথা বলে কেঁদে ফেলল। সমস্ত ঘটনা আমাকে আস্তে আস্তে বলল। মাঝির বাড়ি টাউনের কাছেই। সে চালাক চতুরও আছে। শেষে বলে, ‘পাকিস্তানের কথা তো আপনার কাছ থেকেই শুনেছিলাম, এই পাকিস্তান আনলেন’। আমি শুধু বললাম, ‘এটা পাকিস্তানের দোষ না’।
গোপালগঞ্জ নেমে আমার বাসায় পৌঁছার সাথে সাথে অনেক লোক এসে জমা হতে লাগল, আর সকলের মুখে একই কথা। ব্যাবসায়ীরা এল বিকালে কয়েকজন, পুরানা মুসলিম লীগের নেতারা এলেন। আমি বিকেলেই সমস্ত মহকুমায় আমার পুরানা সহকর্মীদের খবর দিলাম, পরের দিন প্রায় সকলে এসে হাজির হল। এক আলোচনা সভা করলাম। আমি বললাম, ‘আমাদের বাধা দিতে হবে। এটা সরকারের ট্যাক্স না। লোকে ট্যাক্স দিতে বাধ্য, কিন্ত কোন আইনে চাঁদা জোর করে তুলতে পারে?’আমি পৌছাবার পূর্বেই বোধহয় তিন লাখ টাকার মত তুলে ফেলেছে। সঠিক হিসাব দিতে পারব না। মহকুমা হাকিম ও মুসলিম লীগ এঢক কমিটি ঠিক করেছে যে টাকা অভ্যর্থনায় খরচ হবে তা বাদ দিয়ে বাকি সমস্ত টাকা খাজা সাহেবকে তোড়ায় করে দেওয়া হবে। ‘জিন্নাহ ফান্ডে’র জন্য। যদি সম্ভব হয় কিছু টাকা মসজিদের জন্য রাখা হবে। গোপালগঞ্জে একটা ভাল মসজিদ করা হচ্ছিল।
আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, এ টাকা নিতে দেওয়া হবে না। তাঁর অভ্যর্থনায় যা ব্যয় হয়, তা বাদে বাকি টাকা মসজিদ আর গোপালগঞ্জে কলেজ করার জন্য রেখে দিতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে, আমরা বাধা দেব। সরকার হয় সভায় গোলমাল হবে। এ খবর চলে গেল সমস্ত মহকুমায়। টাকা তোলা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। আমার পৌঁছার সাথে সাথে জনসাধারণের সাহস বেড়ে গেল। গোপালগঞ্জের জনসাধারণ আমাকেই দেখেছে পাকিস্তান আন্দোলন করতে। এরা আমাকে ভালবাসে। আমার সাথে এক যুবক কর্মীবাহিনী ছিল, যারা আমার হুকুম পেলে আগুনেও ঝাঁপ দিতে পারত।
খাজা সাহেব পৌছাবার দুই দিন পূর্বে মহকুমা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সাথে পরামর্শ করলেন এবং আমাকে গ্রেফতার করা যায় কি না অনুমতি চাইলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিষেধ করে বলে দিলেন, তিনি একদিন পূর্বেই উপস্থিত হবেন এবং আমার সাথে আলাপ করবেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন মি. গোলাম কবির। তিনি খুবই বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ছিলেন, কলকাতা থেকে আমাকে চিনতেন। আমাকে ‘তুমি’ বলে কথা বলতেন,
১০৭
আর আমিও ‘কবির ভাই’ বলতাম। তিনি গোপালগঞ্জে এসেই আমাকে খবর দিলেন। তাঁর সাথে দেখা করতে যেয়ে দেখি, জেলার সুপারিনটেনডেন্টও উপস্থিৎ আছেন। আমি তাঁকে সকল বিষয় বললাম এবং আমাদের দাবিগুলি পেশ করলাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘গভর্নর জেনারেল রাজনীতিবিদ নন, তিনি রাষ্ট্রপ্রধান। কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্টানের সাথেও জড়িত নন। তিনি তো অতিথি, তাঁকে অসম্মান করা কি উচিত হবে?’আমি বললাম, ‘কে বলেছে আপনাকে, যে তাঁকে অসম্মান করতে চাই! তাঁকে সকলেই অভ্যর্থনা করবে, শুধু এটুকু কথা তাঁর সাথে আলোচনা করে আমাকে জানিয়ে দেন যে, তিনি হুকুম দিবেন এই অত্যাচার করে টাকা তোলার ব্যাপারে তদন্ত করবেন এবং দোষীকে শাস্তি দিবেন। দ্বিতীয়ত, টাকা তাঁকেই দেওয়া হবে, আমরা কোনো দাবি করব না; শুধু তিনি টাকাটা কলেজ করতে দিয়ে দেবেন। তিনিই আমাদের কলেজ করে দিবেন’। কবির সাহেব আমাকে বললেন, ‘তুমি কথা দাও, কোনো গোলমাল হবে না’। আমি বললাম, ‘কবির ভাই, আপনি পাগল হয়েছেন! আমি জানি না যে, তিনি প্রধানমন্ত্রী নন, এখন বড়লাট হয়েছে। কোনো গোলমাল হবে না, আমাদের পক্ষ থেকে। আপনি তাঁর সাথে পরামর্শ করে আমাকে জানিয়ে দিবেন সকাল দশটার মধ্যে, যাতে সকলে মিলে ভালভাবে তাঁকে অভ্যর্থনা করতে পারা যায়’।
পরের দিন সকালবেলা খাজা সাহেবের বজরা গোপালগঞ্জ এল এগারটার সময়। আমাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হল তাঁর বজরায়। খাজা সাহেব পাশের রুমে বসেছিলেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কবির সাহেব তাঁর পক্ষ থেকে আমাকে বললেন, আমার দাবিগুলো ন্যায়সঙ্গত। তিনি নিশ্চয়ই বিবেচনা করে দেখবেন। গোপালগঞ্জ শহরে কলেজ নাই। একটা কলেজ হওয়া দরকার, তিনি স্বীকার করলেন।
এর মধ্যে আর একটা ঘটনা হয়ে গেল। জনসাধারণ মনে করেছে আমাকে গ্রেওফতার করে নিয়া গিয়েছে, কারণ পুলিশ কর্মচারী তার সরকারি কাপড় পরে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। কর্মীরা স্লোগান দিতে শুরু করে এবং পুলিশ কর্ডন ভেঙে অগ্রসর হতে থাকে। পুলিশ লাঠিচার্জ করে বসেছে, ভীষণ গোলমাল শুরু হয়েছে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে খবর দিল, আমাকে ঘটনাস্থলে পাঠাতে। আমি দৌড়াতে দৌড়াতে সেখানে উপস্থিত হলাম এবং সকলকে বললাম, ‘আমাকে গ্রেফতার করে নাই। খাজা সাহেব আমাদের দাবিগুলো বিশেষভাবে বিবেচনা করে দেখবে’। আমি খাজা সাহেবকে দাওয়ালদের অসুবিধার কথা বলবার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটকে অনুরোধ করেছিলাম। কবির সাহেব নিজেও খুব চিন্তিত ছিলেন দাওয়ালদের ব্যাপার নিয়ে। কারণ ফরিদপুরে যে দুর্ভিক্ষ হবে সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ ছিল না।
বিরাট সভা হল, সকলেই গভর্নর জেনারেলকে অভ্যর্থনা করলেন। তিনি মসজিদটার দ্বার উদঘাটনও করেছিলেন। খাজা সাহেব তদন্ত করেছেন কি না জানি না, তবে টাকা তিনি নেন নাই। কলেজ করার জন্য দিয়ে গিয়েছিলেন। ‘জিন্নাহ ফান্ডে’র নামে টাকা তোলা হয়েছিল বলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নামেই কলেজ করা হয়েছিল। আজও কলেজটা আছে, ভালভাবে চলছে।
১০৮
দিনটা আমার ঠিক মনে নাই। তবে ঘটনাটা মনে আছে ১৯৪৮ সালের ভিতর হবে। সোহরাওয়ারদী সাহেব ঢাকায় এসেছিলেন এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে এক ছাত্রসভায় বক্তৃতা করেছিলেন। তখন ময়মনসিংহের সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব সহ-সভাপতি ছিলেন হলের (এখন সৈয়দ নজরুল সাহেব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। আমি জেলে থাকার জন্য ভারপ্রাপ্ত সভাপতি।) শহীদ সাহেবের বক্তৃতা এত ভাল হয়েছিল যে, যারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতেন তারাও ভক্ত হয়ে পড়লেন। এদিকে মন্ত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় বা হলের কাছেও যেতে পারতেন না। শহীদ সাহেব যখন পরে আবার ঢাকায় আসলেন, তখন কতগুলি সভার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল যাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কায়েম থাকে। প্রথম সভার জায়গা ঠিক হল টাঙ্গাইল। স্টিমারে মানিকগঞ্জ হয়ে যেতে হবে, পথে আরও একটা সভা হবে। শামসুল হক সাহেব সভার বন্দোবস্ত করেছিলেন। শহীদ সাহেব প্লেন থেকে ঢাকায় নেমে সোজা বেগম আনোয়ারা খাতুন এমএলএ ছিলেন, তাঁর বাড়িতে আসলেন। সেখানেই দুপুরবেলা খেলেন। সন্ধ্যায় বাদামতলী ঘাট থেকে জাহাজ ছাড়বে। মওলানা ভাসানী ও আমি সাথে যাব। আমরা শহীদ সাহেবকে নিয়ে জাহাজে উঠলাম। মওলানা সাহেবও উঠেছিলনে। জাহাজ ছয়টায় ছাড়বার কথা, ছাড়ছে না। খবর নিয়ে জানলাম, সরকার হুকুম দিয়েছে না ছাড়তে। প্রায় দুই ঘন্টা জাহাজ ঘাটে বসে রইল। কাদের সর্দার,, জনাব কামরুদ্দিন সাহেবও উপস্থিত ছিলেন। রাত আটটায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও ডিআইজি পুলিশ সাহেবের হাতে একটা কাগজ দিলেন, তাতে লেখা, ‘তিনি ঢাকা ত্যাগ করতে পারবেন না’। তবে যদি কলকাতা ফিরে যান, সরকারের আপত্তি নাই। তিনি ঢাকায় যে কোনো জায়গায় থাকতে পারেন তাতেও আপত্তি নাই। শহীদ সাহেব জাহাজ ছেড়ে নেমে আসলেন, আমিও তাঁর মালপত্র নিয়ে সাথে সাথে এলাম। কোথায় থাকবেন? আর কেইবা জায়গা দেবেন? কোন হোটেলও নাই। বেগম আনোয়ারার সাহস আছে, কিন্ত তাদের বাড়িটায় জায়গা নাই। আতাউর রহমান, কামরুদ্দিন সাহেবের বাড়িরও সেই অবস্থা। কামরুদ্দিন সাহেব ক্যাপ্টেন শাহজাহান ও তাঁর স্ত্রী বেগম নূরজাহানের সাথে সাক্ষাৎ করলেন, কারণ তাঁদের বাড়িটা সুন্দর এবং থাকার মত ব্যবস্থাও আছে। বেগম নূরজাহান (এখন প্রফেসর) বললেন, ‘এ তো আমাদের সৌভাগ্য। শহীদ সাহেবকে আমি বাবার মত ভক্তি করি। আমাদের বাড়িতেই থাকবেন তিনি, নিয়ে আসুন’। সেইদিন এই উপকার বেগম নূরজাহান না করলে সত্যিই দুঃখের কারণ হত। পাকিস্তান সত্যিকারের যিনি সৃষ্টি করেছিলেন, সেই লোকের থাকার জায়গা হল না। দুই দিন শহীদ সাহেব ছিলেন তাঁর বাসায়, কি সেবাই না ভদ্রমহিলা করেছিলেন, তা প্রকাশ করা কষ্টকর। মেয়েও বোধহয় বাবাকে এত সেবা করতে পারে না। ক্যাপ্টেন শাহজাহানও যথেষ্ট করেছেন। দুই দিন পরে শহীদ সাহেবকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে জাহাজে তুলে দিলাম। আমি সাথে যেতে চেয়েছিলাম এগিয়ে দিতে। তিনি রাজি হলেন না। বললেন, ‘দরকার নাই। আর লোকজনও আছে আমার অসুবিধা হবে না’। আমি বিছানা করে সকল কিছু গুছিয়ে দিয়ে বিদায় নিতে
১০৯
গেলে বললেন, ‘তোমার উপরও অত্যাচার আসছে। এরা পাগল হয়ে গেছে। শাসন যদি এইভাবে চলে বলা যায় না, কি হবে!’ আমি বললাম, ‘স্যার, চিন্তা করবেন না, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার শক্তি খোদা আমাকে দিয়েছেন। আর সে শিক্ষা আপনার কাছ থেকেই পেয়েছি’।
এই অত্যাচারের প্রতিবাদ করার মত ক্ষমতা তখন আমাদের ছিল না। আর আমরা প্রস্তুতও ছিলাম না। ছাত্ররা সামান্য প্রতিবাদ করেছিল। নেতৃত্ব দেওয়ার মত কেউ আমাদের ছিল না। আমরা যদি ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতাম, নিশ্চয়ই সারা পেতাম। জনসাধারণ শহীদ সাহেবকে ভালবাসতেন। আমরা কয়েকজন প্রস্তাব করলে ঢাকার পুরানা নেতারা নিষেধ করলেন। আমরা ঢাকায় নতুন এসেছি, পরিচিত হতেও পারি নাই ভালভাবে। মওলানা ভাসানী ঐ জাহাজেই চলের গেলেন এবং সভায় যোগদান করেছিলেন। ঐদিন যদি শামসুল হক সাহেব ঢাকায় থাকতেন তবে আন্দোলন আমরা করতে পারতাম বলে আমার বিশ্বাস ছিল।
১৯৪৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করেন এবং খাজা নাজিমুদ্দীনকে গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে জনাব নূরুল আমিন সাহেব। এই সময়ও কিছু সংখ্যক এমএলএ শহীদ সাহেবকে পূর্ব বাংলায় এসে প্রধানমন্ত্রী হতে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি রাজি হন নাই। গণপরিষদে একটা নতুন আইন পাস করে শহীদ সাহেবকে গণপরিষদ থেকে বের করে দেওয়া হল।
আমি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সংগঠনের দিকে নজর দিলাম। প্রায় সকল কলেজ ও স্কুলে প্রতিষ্টান গড়ে উঠল। বিভিন্ন জেলায়ও শক্তিশালী সংগঠন গড়ে উঠতে লাগল। সরকারি ছাত্র প্রতিষ্টানটি শুধু খবরের কাগজের মধ্যে বেঁচে রইল। ছাত্রলীগই সরকারের অন্যায় কাজের প্রইবাদ ও সমালোচনা করেছিল। কোন বিরুদ্ধ দল পাকিস্তানে না থাকায় সরকার গণতন্ত্রের পথ ছেড়ে একনায়কত্বের দিকে চলছিল। প্রধানমন্ত্রী জনাব লিয়াকত আলী খান সর্বময় ক্ষমতার মালিক হলেন। তিনি কোনো সমালোচনাই সহ্য করতে পারছিলেন না।
দুই চারজন কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন ছাত্র ছিল যারা সরকারকে পছন্দ করত না। কিন্ত তারা এমন সমস্ত আদর্শ প্রচার করতে চেষ্টা করত যা তখনকার সাধারণ ছাত্র ও জনসাধারণ শুনলে ক্ষেপে যেত। এদের আমি বলতাম, ‘জনসাধারণ চলেছে পায়ে হেঁটে, আর আপনারা আদর্শ নিয়ে উড়োজাহাজে চলছেন। জনসাধারণ আপনাদের কথা বুঝতেও পারবে না, আর সাথেও চলবে না। যতটুকু হজম করতে পারে ততটুকু জনসাধারণের কাছে পেশ করা উচিত’। তারা তলে তলে আমার বিরুদ্ধাচরনও করত, কিন্ত ছাত্রসমাজকে দলে ভেড়াতে পারত না।
এই সময় রাজশাহী সরকারি কলেজে ছাত্রদের উপর খুব অত্যাচার হল। এরা প্রায় সকলেই ছাত্রলীগের সভ্য ছিল। একুশজন ছাত্রকে কলেজ থেকে বের করে দিল এবং রাজশাহী
১১০
জেলা ত্যাগ করার জন্য সরকার হুকুম দিল। অনেক জেলায় ছাত্রদের উপর অত্যাচার শুরু হয়েছিল এবং গ্রেফতারও করা হয়েছিল। ১৯৪৯ সালে জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারি মাসে দিনাজপুরেও ছাত্রদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। জেলের ভিতর দবিরুল ইসলামকে ভীষণভাবে মারপিট করেছিল- যার ফলে জীবনের তরে স্বাস্থ্য নষ্ট হয়েছিল। ছাত্ররা আমাকে কনভেনর করে ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ পালন করার জন্য একটা কমিটি করেছিল। একটা দিবসও ঘোষণা করা হয়েছিল। পূর্ব বাংলার সমস্ত জেলায় জেলায় এই দিবসটি উদযাপন করা হয়। কমিটির পক্ষ থেকে ছাত্রবন্দিদের ও অন্যান্য বন্দিদের মুক্তি দাবি করা হয় এবং ছাত্রদের উপর হতে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করা হয়।
এই প্রথম পাকিস্তানে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির আন্দোলন এবং জুলুমের প্রতিবাদ। এর পূর্বে আর কেউ সাহস পায় নাই। তখনকার দিনে আমরা কোনো সভা বা শোভাযাত্রা করতে গেলে একদল গুণ্ডা ভাড়া করে আমাদের মারপিট করা হত এবং সভা ভাঙার চেষ্টা করা হত। জুলুম প্রতিরোধ দিবসে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়ও কিছু গুণ্ডা আমদানি করা হয়েছিল। আমি খবর পেয়ে রতেই সভা করি এবং বলে দেই, গুণ্ডামির প্রশ্রয় দেওয়া হলে এবার বাধা দিতে হবে। আমাদের বিখ্যাত আমতলায় সভা করার কথা ছিল; কতৃপক্ষ বাধা দিলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে মাঠে মিতিং করলাম। একদল ভাল কর্মী প্রস্তুত করে বিশ্ববিদ্যালয় গেটে রেখেছিলাম, যদি গুণ্ডারা আক্রমণ করে তারা বাধা দিবে এবং তিন দিক থেকে তাদের আক্রমণ করা হবে যাতে জীবনে আর রমনা এলাকায় গুণ্ডামি করতে না আসে- এই শিক্ষা দিতে হবে। আশ্চর্যের বিষয় সরকারি দল প্রকাশ্যে গুণ্ডাদের সাহায্য করত ও প্রশ্রয় দিত। মাঝে মাঝে জগন্নাথ কলেজ, মিটফোর্ড ও মেডিকেল স্কুলের ছাত্ররা শোভাযাত্রা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওয়ানা করলেই হঠাৎ আক্রমণ করে মারপিট করত। মুসলিম লীগ নেতারা একটা ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করতে চেষ্টা করছিল যাতে কেউ সরকারের সমালোচনা করতে না পারে। মুসলিম লীগ নেতারা বুঝতে পারছিলেন না, যে পন্থা তারা অবলম্বন করেছিলেন সেই পন্থাই তাঁদের উপর একদিন ফিরে আসতে বাধ্য। ওনারা ভেবেছিলেন গুণ্ডা দিয়ে মারপিট করেই জনমত দাবাতে পারবেন। এ পন্থা যে কোনোদিন সফল হয় নাই, আর হতে পারে না- এ শিক্ষা তারা ইতিহাস পড়ে শিখতে চেষ্টা করেন নাই।
এই সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার নবীনগর থানার কৃষ্ণনগরে জনাব রফিকুল হোসেন এক সভার আয়োজন করেন- কৃষ্ণনগর হাইস্কুলের দ্বারোদঘাটন করার জন্য। আর্থিক সাহায্য পাওয়ার জন্য জনাব এন. এম. খান সিএসপি তখনকার ফুড ডিপার্টমেন্টের দাইরেক্টর জেনারেল ছিলেন, তাঁকেই নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল, তিনি রাজিও হয়েছিলেন। সেখানে বিখ্যাত গায়ক আব্বাসউদ্দিন আহম্মদ, সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন আহম্মদ গান গাইবেন। আমাকেও নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। জনাব এন. এম.খান পাকিস্তান হওয়ার পূর্বে
১১১
এই মহকুমায় এসডিও হিসাবে অনেক ভাল কাজ করার জন্য জনপ্রিয় ছিলেন। আমরা উপস্থিত হয়ে দেখলাম এন.এম.খান ও আব্বাসউদ্দিন সাহেবকে দেখবার জন্য হাজার হাজার লোক সমাগম হয়েছে। বাংলার গ্রামে গ্রামে আব্বাসউদ্দিন সাহেব জনপ্রিয় ছিলেন। জনসাধারণ তাঁর গান শুনবার জন্য পাগল হয়ে যেত। তাঁর গান ছিল বাংলার জনগণের প্রাণের গান। বাংলার মাটির সাথে ছিল তাঁর নাড়ির সম্বন্ধ। দুঃখের বিষয়, সরকারের প্রচার দপ্তরে তাঁর মত গুণী লকের চাকরি করে জীবিকা অর্জন করতে হয়েছিল। সভা শুরু হল, রফিকুল হোসেন সাহেবের অনুরোধে আমাকেও বক্তৃতা করতে হল। আমি জনাব এন. এম. খানকে সম্বোধন করে বক্তৃতায় বলেছিলাম, ‘আপনি এদেশের অবস্থা জানেন। বহুদিন বাংলাদেশে কাজ করেছেন, আজ ফুড ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর জেনারেল আপনি, একবার বিবেচনা করে দেখেন এই দাওয়ালদের অবস্থা এবং কি করে এরা বাঁচবে! সরকার তো খাবার দিতে পারবে না- যখন পারবে না, তখন এদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিতেছে কেন? দাওয়ালদের নানা অসুবিধার কথা বললাম, জনসাধারণকে অনুরোধ করলাম, স্কুলকে সাহায্য করতে। জনাব খান আশ্বাস দিলেন তিনি দেখবেন, কিছু করতে চেষ্টা করবেন। তিনি সন্ধ্যায় চলে যাবার পর গানের আসর বসল। আব্বাসউদ্দিন সাহেব, সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন সাহেব গান গাইলেন। অধিক রাত পর্যন্ত আসর চলল। আব্বাসউদ্দিন সাহেব ও আমরা রাতে রফিক সাহেবের বাড়িতে রইলাম। রফিক সাহেবের ভাইরাও সকলেই ভাল গায়ক। হাসনাত, বরকতও ভাল গানই ফাইত। এরা আমার ছোট ভাইয়ের মত ছিল। আমার সাতেহ জেলও খেটেছে। পরের দিন নৌকায় আমরা রওয়ানা করলাম, আশুগঞ্জ ষ্টেশনে ট্রেন ধরতে। পথে পথে গান চলল। নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে। তাঁরই শিষ্য সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন তাঁর নাম কিছুটা রেখেছিলেন। আমি আব্বাসউদ্দিন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে’। আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম।
আমরা রাতে ঢাকা এসে পৌছালাম। ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে যেয়ে শুনলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীরা ধর্মঘট শুরু করেছে এবং ছাত্ররা তার সমর্থনে ধর্মঘট করছে। নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীরা বহুদিন পর্যন্ত তাদের দাবি পুরণের জন্য কতৃপক্ষের কাছে আবেদন-নিবেদন করেছে একথা আমার জানা ছিল। এরা আমার কাছেও এসেছিল।
১১২
পাকিস্তান হওয়ার পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রেসিডেন্সিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এখন এটাই পূর্ব বাংলার একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্র অনেক বেড়ে গিয়েছিল। কর্মচারীদের সংখ্যা বাড়ে নাই। তাদের সারা দিন ডিউটি করতে হয়। পূর্বে বাসা ছিল, এখন তাদের বাসা প্রায়ই নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কারণ নতুন রাজধানী হয়েছে, ঘরবাড়ির অভাব। এরা পোশাক পেত, পাকিস্তান হওয়ার পরে কাউকেও পোশাক দেওয়া হয় নাই। চাউলের দাম ও অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। চাকরির কোনো নিশ্চয়তাও ছিল না। ইচ্ছামত তাড়িয়ে দিত, ইচ্ছামত চাকরি দিত।
আমি তাদের বলেছিলাম, প্রথমে সংঘবদ্ধ হোন, তারপর দাবিদাওয়া পেশ করেন, তা নাহলে কতৃপক্ষ মানবে না। তারা একটা ইউনিয়ন করেছিল, একজন ছাত্র তাদের সভাপতি হয়েছিল। আমি আর কিছুই জানতাম না। জেলায় জেলায় ঘুরছিলাম। ঢাকায় এসে যখন শুনলাম, এরা ধর্মঘট করেছে তখন বুঝতে বাকি থাকল না, কতৃপক্ষ এদের দাবি মানতে অস্বীকার করেছে। তবু এত তাড়াতাড়ি ধর্মঘটে যাওয়া যাওয়া উচিত হয় নাই। কারণ, এদের কনো ফান্ড নাই। মাত্র কয়েকদিন হল প্রতিষ্টান করেছে। কিন্ত কি করব, এখন আর উপায় নাই। সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম, ছাত্ররা এদের প্রতি সহানুভূতিতে ধর্মঘট শুরু করে দিয়েছে। কর্মচারীরা শোভাযাত্রা বের করেছিল। ছাত্ররাও করেছিল। আমি কয়েকজন ছাত্রনেতাকে নিয়ে ভাইস-চ্যান্সেলর সাহেবের কাছে দেখা করতে যেয়ে তাঁকে সব বুঝিয়ে বললাম। বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ সকল কর্মচারীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দেবেন ঠিক করেছেন। বিকেলে আবার ফজলুল হক হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিপিদের নিয়ে সাক্ষাৎ করলাম এবং তাঁকে অনুরোধ করলাম, এই কথা বলে যে, ‘আপনি আশ্বাস দেন, ওদের ন্যায্য দাবি কতৃপক্ষের কাছ থেকে আদায় করে দিতে চেষ্টা করবেন এবং কাউকেও চাকরি থেকে বরখাস্ত করবেন না এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কারও বিরুদ্ধে গ্রহণ করবেন না’। অনেক আলচনা হয়েছিল, পরের দিন তিনি রাজি হলেন। আমাদের বললেন, ‘আগামীকাল ধর্মঘট প্রত্যাহার করে চাকরিতে যোগদান করলে কাউকেও কিছু বলা হবে না এবং আমি কতৃপক্ষের কাছে ওদের ন্যায্য দাবি মানাতে চেষ্টা করব’।
আমরা তাঁর কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এলাম, তখন বিকাল তিনতা বেজে গিয়েছে। আমরা ওদের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করে ঘোষণা করলাম, কাল থেকে ছাত্ররা ধর্মঘট প্রত্যাহার করবে। কারণ বহু কর্মচারীও ধর্মঘট প্রত্যাহার করবে; ভাইস-চ্যান্সেলরের আশ্বাস পেয়ে তারা রাজি হয়েছে। অনেক কর্মচারী দূরে দূরে থাকে, সকলকে খবর দিতে বললাম, যতদূর সম্ভব। পরের দিন ছাত্ররাও ক্লাসে যোগদান করেছে; কর্মচারীরাও অনেকেই যোগদান করেছে। যারা বারটার মধ্যে এসে পৌছাতে পেরেছে তাদের কতৃপক্ষ গ্রহণ করেছে। আর যারা বারটার পরে এসেছে তাদের যোগদান করতে দেওয়া হয় নাই। অনেককে খবর পেয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকেই আসতে হয়েছিল। শতকরা পঞ্চাশজন কর্মচারী দেরি করে আসতে বাধ্য হয়েছিল, কারণ বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর দিয়ে তাদের আনাতে হয়েছিল। আমাকে ও আমার সহকর্মীদের কাছে কর্মচারীরা এসে
১১৩
সব কথা খুলে বলল। একে একে আবার সকলে জড়ো হল। আমরা মিথ্যেবাদী হয়ে যাবার উপক্রম হলাম। সকলকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রেখে আবার আমরা ভাইস-চ্যান্সেলারের বাড়িতে উপস্থিত হলাম এবং বললাম, ‘কি ব্যাপার?’ তিনি বললেন, ‘আমি যখন আগামীকাল কাজে যোগদান করতে বলেছি, তার অর্থ এগারটায় যোগদান করতে হবে, এক মিনিট দেরি হয়ে গেলে তাকে নেওয়া হবে না’। আমরা তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তিনি বুঝেও বুঝলেন না। এর কারণ ছিল সরকারের চাপ। আমরা বললাম, সামান্য দু’এক ঘন্টার জন্য কেন গোলমাল সৃষ্টি করলেন? তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না, আমরা তাঁকে আরও বললাম, ‘আপনি পূর্বেই তো বলতে পারতেন এগারটার মধ্যেই যোগদান করতে হবে। আপনি তো বলেছিলেন, আগামীকালের মধ্যে যোগদান করলে চলবে’। তিনি আর আলোচনা করতে চাইলেন না। আমরা বলে এলাম, তাহলে ধর্মঘটও চলবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছাত্র-কর্মচারীদের যুক্ত সভা হল। সভায় আমি সমস্ত ঘটনা বললাম এবং আগামীকাল থেকে ছাত্র-কর্মচারীদের ধর্মঘট চলবে, যে পর্যন্ত না এদের ন্যায্য দাবি মানে। শোভাযাত্রা হল, আবার পরের দিন সকাল এগারটায় শোভাযাত্রা শুরু হবে বলে ঘোষণা করা হল। এবার আমাকে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হল। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধার ও শিক্ষাবিদ সরকারের চাপে এই রকম কথার মারপ্যাঁচ করতে পারে এটা আমার ভাবতেও কষ্ট হয়েছিল। রাতে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ সভার পরে ঘোষণা করল, ‘বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হল। হল থেকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চলে যেতে হবে। আর যে সমস্ত কর্মচারী ধর্মঘটে যোগদান করেছে তাদের বরখাস্ত করা হল’। আমি সলিমুল্লাহ হলে ছিলাম। সেই মুহূর্তেই সভা ডাকা হল এবং সভায় ঘোষণা করা হল, হল ত্যাগ করা হবে না। ফজলুল হক হলেও সন্ধ্যায় এই ঘোষণা করা হয়। একটা কমিটি করা হয়েছিল, কর্মচারীদের জন্য একটা ফান্ড করা হবে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে টাকা তুলে সাহায্য করা হবে। কারণ, এদের প্রায় সকলেই বিশ-ত্রিশ টাকার বেশি বেতন পেত না। সংসার চালাবে কি করে? এদের মধ্যে কয়েকজনকে টাকা তোলার ভার দেওয়া হয়েছিল।
পরদিন দেখা গেল শতকরা পঞ্চাশজন ছাত্র রাতে হল ত্যাগ করে চলে গিয়েছে। তার পরদিন আরও অনেকে চলে গেল। তিন দিন পর দেখা গেল আমরা ত্রিশ-পয়ত্রিশজন সলিমুল্লাহ হলে আছি আর বিশ-পঁচিশজন ফজলুল হক হলে আছে। পুলিশ হল ঘেরাও করে রেখেছে। এক কামরায় আলোচনা সভায় বসলাম। আমাদের পক্ষে আর পুলিশকে বাধা দেওয়া সম্ভব হবে না। সকলে একমত হয়ে ঠিক হল, হল ত্যাগ করার এবং নিম্ন কর্মচারীদের জন্য টাকা তুলে সাহায্য করা, তা না হলে তারাও ধর্মঘট চালাতে পারবে না। চার দিন পরে আমরাও হল ত্যাগ করতে বাধ্য হলাম এবং চাঁদা তুলে এদের সাহায্য করতে লাগলাম। দশ-পনের দিন পর দেখা গেল এক একজন করে কর্মচারী বন্ড দিয়ে কাজে যোগদান করতে শুরু করেছে। এক মাসের মধ্যে প্রায় সকলেই যোগদান করল। ধর্মঘট শেষ হয়ে গেল। এই সময় আমি ও কয়েকজন কর্মী দিনাজপুর যাই। কারণ, কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করে জেলে রেখেছে এবং দবিরুল ইসলামকে জেলের ভিতর মারপিট করেছে। ১৪৪ ধারা
১১৪
জারি ছিল। বাইরে সভা করতে পারলাম না। ঘরের ভিতর সভা করলাম। আমরা হোস্টেলেই ছিলাম। আবদুর রহমান চৌধুরী তখন ছাত্রলীগের সেক্রেটারি ছিল। আমরা যখন ঢাকা ফিরে আসছিলাম বোধহয় আবদুল হামিদ চৌধুরী আমার সাথে ছিল। ট্রেনের মধ্যে খবরের কাগজে দেখলাম, আমাদেরসহ সাতাশজন ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেছে। এর মধ্যে দিনাজপুরের দবিরুল ইসলাম, অলি আহাদ, মোল্লা জালালউদ্দিন (এখন এডভোকেট), আবদুল হামিদ চৌধুরীকে চার বৎসরের জন্য আর অন্য সকলকে বিভিন্ন মেয়াদে। তবে এই চারজন ছাড়া আর সকলে বন্ড ও জরিমানা দিলে লেখাপড়া করতে পারবে। মেয়েদের মধ্যে একমাত্র লুলু বিলকিস বানুকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তিনি ছাত্রলীগের মহিলা শাখার কনভেনর ছিলেন। এক মাসের মধ্যে প্রায় সকল কর্মচারীই গোপনে গোপনে কাজে যোগদান করল। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, ছাত্ররা নাই। এই সুযোগে কতৃপক্ষ নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীদের মনোবল ভাঙতে সক্ষম হয়েছিল।
এই সময় বাইরে পুরানা লীগ কর্মী ও নেতারা আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে কি করা যাবে? একটা নতুন দল গঠন করা উচিত হবে কি না? আমার মত সকলকে বললাম, শুধুমাত্র ছাত্র প্রতিষ্টানের উপর নির্ভর করে রাজনীতি করা যায় না। সরকারি মুসলিম লীগ ছাড়া কংগ্রেসেরও একতা প্রতিষ্টান ছিল। তবে গণপরিষদে ও পূর্ব বাংলার আইনসভায় এদের কয়েকজন সভ্য ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এদের সকলেই হিন্দু, এরা বেশি কিছু বললেই ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ আখ্যা দেওয়া হত। ফলে এদের মনোবল একেবারে ভেঙে গিয়েছিল। সাপ্রদায়িক হাঙ্গামারও ভয় ছিল। কংগ্রেসকে মুসলমান সমাজ সন্দেহের চোখে দেখত। একজন মুসলমান সভ্যও তাদের ছিল না। এদিকে মুসলিম লীগের পুরানা নামকরা নেতারা সকলেই সরকার সমর্থক হয়ে গিয়েছিলেন। মন্ত্রিত্ব, পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি কিছু না কিছু অনেকের কপালেই জুটেছিল। নামকরা কোনো নেতাই আর ছিল না, যাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো যায়।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তখন সদ্য আসাম থেকে চলে এসেছে। তাঁকে পূর্ব বাংলার জনসাধারণ তেমন জানত না। শুধু ময়মনসিংহ, পাবনা ও রংপুরের কিছু কিছু লোক তাঁর নাম জানত। কারণ তিনি আসামেই কাটিয়েছেন। তবে শিক্ষিত সমাজের কাছে কিছুটা পরিচিত ছিলেন। একজন মুসলিম লীগের নেতা হিসাবে তিনি আসামের ‘বাঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এবং জেলও খেটেছিলেন। টাঙ্গাইলের লোকেরা তাঁকে খুব ভালবাসত। শামসুল হক সাহেব তাঁকে ভালভাবে জানতেন। কারণ, হক সাহেবের বাড়িও সেখানে। তিনি মওলানা সাহেবের সাথে পাকাপাকি আলোচনা করবেন ঠিক হল। পূর্বেও তিনি পুরানা মুসলিম লীগ কর্মীদের সভায় যোগদান করেছিলেন। কিছুদিনের জন্য তিনি আসাম গিয়েছিলেন। ফিরে আসলেই আমরা কর্মিসভা করে একটা
১১৫
রাজনৈতিক প্রতিষ্টান গঠন করব ঠিক হল। সীমান্ত প্রদেশের পীর মানকী শরীফ একটা প্রতিষ্টান গড়েছেন। তার নাম দিয়েছেন, ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। সীমান্ত প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী খান আবদুল কাইয়ুম খান মুসলিম লীগ থেকে পুরানা কর্মীদের বাদ দিয়েছেন এবং অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে দিয়েছেন। অনেক লীগ কর্মীকে জেলে দিতেও দ্বিধাবোধ করেন নাই। এখন তিনি ‘সীমান্ত শার্দূল’ বনে গিয়েছেন। পাকিস্তান আন্দোলনে সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফফার খান ও দাক্তার খান সাহেবের মোকাবেলা করতে পারেন নাই। দলে সীমান্ত প্রদেশে কংগ্রেস সরকার গঠন হয়। একমাত্র পির মানকী শরীফই লাল কোর্তাদের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগকে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবু পীর সাহেবের জায়গাও মুসলিম লীগে হয় নাই। পীর মানকী শরীফ সভাপতি এবং খান গোলাম মোহাম্মদ খান লুন্দখোর সাধারণ সম্পাদক হয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন।
১৯৪৯ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে অথবা এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে টাঙ্গাইলে উপনির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। আমরা ঠিক করলাম, শামসুল হক সাহেবকে অনুরোধ করব মুসলিম লীগের প্রাথীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়তে। শামসুল হক সাহেব শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন, কিন্ত টাকা পাওয়া যাবে কোথায়? হক সাহেবেরও টাকা নাই, আর আমাদেরও টাকা নাই। তবু যেই কথা সেই কাজ। শামসুল হক সাহেব টাঙ্গাইল চলে গেলেন, আমরা যে যা পারি জোগাড় করতে চেষ্টা করলাম। কয়েক শত টাকার বেশি জোগাড় করা সম্ভব হয়ে উঠল না। ছাত্র ও কর্মীরা ঘড়ি, কলম বিক্রি করেও কিছু টাকা দিয়েছিল।
এদিকে ছাত্রনেতাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর প্রতিবাদ করা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করেছে, ১৭ই এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে। ছাত্রলীগ ও অন্যান্য ছাত্র কর্মী- যারা ঢাকায় ছিল, ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে বসে এক সভা করে ঠিক করল যে, ১৭ তারিখ থেকে প্রতিবাদ দিবস পালন করা হবে। ছাত্ররা ধর্মঘট করবে যে পর্যন্ত কতৃপক্ষ তাদের উপর থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রত্যহার না করে। কিছু সংখ্যক কর্মী টাঙ্গাইল রওয়ানা হয়ে গেল। বেশিরভাগ পুরানা লীগ কর্মী। মুসলিম লীগের মন্ত্রীরা ও এমএলএরা টাকা-পয়সা, গাড়ি, সকল কিছু নিয়েই টাঙ্গাইলে উপস্থিত হয়েছিল। মুসলিম লীগ প্রার্থী করটিয়ার বিখ্যাত জমিদার খুররম খান পন্নী- যার প্রজাই হল অধিকাংশ ভোটার। তাঁর সাথে আছে সরকারি ক্ষমতা এবং অর্থবল। আমাদের প্রার্থী গরিব, কিন্ত নিঃস্বার্থ, ত্যাগী কর্মী; আর আছে আদর্শ ও কর্মক্ষমতা। তখন কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানও আমাদের পিছনে নাই। কর্মীরা পায়ে হেঁটে, না খেয়ে নির্বাচন শুরু করল। ঢাকায় ছাত্ররা ব্যস্ত ধর্মঘট নিয়ে। ঠিক হল সকলেই টাঙ্গাইল চলে যাবে, আমি ১৯ এপ্রিল টাঙ্গাইল পৌছাব।
১৬ এপ্রিল খবর পেলাম, ছাত্রলীগের কনভেনর নইমউদ্দিন আহমেদ, ছাত্রলীগের আরেক নেতা আবদুর রহমান চৌধুরী (এখন এডভোকেট)- ভিপি সলিমুল্লাহ হল, দেওয়ান
১১৬
মাহবুব আলী (এখন এডভোকেট) আরও অনেকে গোপনে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেয়ে বন্ড দিয়েছেন। যারা ছাত্রলীগের সভ্যও না, আবার নিজেদের প্রগতিবাদী বলে ঘোষণা করতেন, তাঁরাও অনেকে বন্ড দিয়েছেন। সাতাশজনের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই বন্ড দিয়েছে। কারণ ১৭ তারিখের মধ্যে বন্ড না দিলে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকবে না।
ছাত্রলীগের কনভেনর ও সলিমুল্লাহ হলের ভিপি বন্ড দিয়েছে খবর রটে যাওয়ার সাথে সাথে ছাত্রদের মনোবল একদম ভেঙে গিয়েছিল। আমি তাড়াতাড়ি কয়েকজনকে নিয়ে নইমউদ্দিনকে ধরতে চেষ্টা করলাম। কিন্ত তাকে পাওয়া কষ্টকর, সে পালিয়ে গিয়েছিল। সে এক বাড়িতে লজিং থাকত। সন্ধার কিছু পূর্বে তাকে ধরতে পারলাম। সে স্বীকার করল আর বলল, ‘কি করব, উপায় নাই। আমার অনেক অসুবিধা’। তার সাথে আমি অনেক রাগারাগি করলাম এবং ফিরে এসে নিজেই ছাত্রলীগের সভ্যদের খবর দিলাম, রাতে সভা করলাম। অনেকে উপস্থিত হল। সভা করে এদের বহিষ্কার করা হল এবং রাতের মধ্যে প্যামপ্লেট ছাপিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিলি করার বন্দোবস্ত করলাম। কাজী গোলাম মাহাবুবকে (এখন এডভোকেট) জয়েন্ট কনভেনর করা হয়েছিল। সে নিঃস্বার্থভাবে কাজ চালিয়েছিল।
তখন ভোরবেলায় আইন ক্লাস হত। আইন ক্লাসের ছাত্ররা ধর্মঘট করল। দশটায় পিকেটিং শুরু হল। ছাত্রকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় শুয়ে পড়ল। একজন মাত্র ছাত্রী সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। তার নাম নাদেরা বেগম। প্রফেসর মুনীর চৌধুরীর ভগ্নি। নাদেরা একাই ছেলেদের সাথে দরজায় বসেছিল। মাত্র দশ-পনেরজন ছাত্র নিখিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সমর্থক। এই কয়েকজন বারবার ছাত্রদের উপর দিয়ে একবার ভিতরে একবার বাইরে যাওয়া-আসা করতে লাগল এবং এর মধ্যে একজন নাদেরাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিয়েছিল। সাধারণ ছাত্ররা এদের ওপর ক্ষেপে গেল। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম এবং সকলকে নিষেধ করলাম গোলমাল না করতে। আমি তাদের বললাম, ‘আপনারা ক্লাস করতে চান, ভিতরে যান, আমাদের আপত্তি নাই। তবে বারবার যাওয়া-আসা করবেন না। আর আজেবাজে কথা বলবেন না’।
তারা আমার কথা না শুনে আবার বের হয়ে এল এবং ভিতরে ফিরে যেতে লাগল যারা পিকেটিং করছিল, তাদের উপর পা দিয়ে। আর মাই কিছু করতে পারলাম না, সাধারণ ছাত্র তখন অনেক জমা হয়েছে। তারা এদের আক্রমণ করে বসল। এরা পালিয়ে দোতলায় আশ্রয় নিল, যে যেখানে পারে। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে ক্রুব্ধ ছাত্রদের বাধা দিলাম। যাহোক, ধর্মঘট হয়ে গেল। সভা হল, ধর্মঘট চলবে ঠিক হল। এ সময় ড. ওসমান গনি সাহেব সলিমুল্লাহ হলের প্রভোস্ট ছিলেন। তিনি এক্সিকিউটিভ কমিটি সভায় আমাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করলেন। তাঁকে সমর্থন করলেন, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, কিন্ত কমিটির অন্যান্য সদস্য রাজি হলেন না। ১৮ তারিখে ধর্মঘট হয়েছিল, আবার ১৯ তারিখে ধর্মঘট হবে ঘোষণা করা হল। ছাত্রদের মধ্যে উৎসাহ কমে গেছে বলে আমার মনে হল। ১৮ তারিখ বিকালে ঠিক করলাম, ধর্মঘট করে বোধহয় কিছু করা
১১৭
যাবে না। তাই ১৮ তারিখে ছাত্র শোভাযাত্রা করে ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে গেলাম এবং ঘোষণা করলাম, ‘আমরা এখানেই থাকব, যে পর্যন্ত শাস্তিমূলক আদেশ প্রত্যাহার না করা হয়’। একশজন করে ছাত্র রাতদিন ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে বসে থাকবে। তাঁর বাড়ির নিচের ঘরগুলিও দখল করে নেওয়া হল। একদল যায়, আর একদল থাকে। ১৮ তারিখে রাত কেটে গেল, শুধু আমি জায়গা ত্যাগ করতে পারছিলাম না। কারণ শুনলাম, তিনি পুলিশ ডাকবেন। ১৯ তারিখ বিকাল তিনটায় জেলা মুয়াজিস্ট্রেট, এসপি বিরাট একদল পুলিশ বাহিনী নিয়ে হাজির হলেন। আমি তাড়াতাড়ি সভা ডেকে একটা সংগ্রাম পরিষদ করতে বলে দিলাম। সকলের মত আমাকেও দরকার হলে গ্রেফতার হতে হবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পাঁচ মিনিট সময় দিলেন আমাদের স্থান ত্যাগ করে যেতে। আমি আটজন ছাত্রকে বললাম, তোমরা এই আটজন থাক, আর সকলেই চলে যাও। আমি ও এই আটজন স্থান ত্যাগ করব না। ছাত্র প্রতিনিধিদের ধারণা, আমি গ্রেফতার হলে আন্দোলন চলবে, কারণ আন্দোলন ঝিমিয়ে আসছিল। একে চাঙ্গা করতে হলে, আমার গ্রেফতার হওয়া দরকার। আমি তাদের কথা মেনে নিলাম। পাঁচ মিনিট পরে এসে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের গ্রেফতারের হুকুম দিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ (এখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) আটকা পড়েছে। তাকে নিষেধ করা হয়েছে গ্রেফতার না হতে। তাজউদ্দীন বুদ্ধিমানের মত কাজ করল। বলে দিল, ‘আমি প্রেস রিপোর্টার’। একটা কাগজ বের করে কে কে গ্রেফতার হল, তাদের নাম লিখতে শুরু করল। আমি তাকে চোখ টিপ মারলাম। আমাদের গাড়িতে তুলে একদম জেলগেট নিয়ে আসল।
পরের দিন থেকেই জনগণের মধ্যে আন্দোলনও দানা বেঁধে উঠল। পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হল। যাদের আমি নিষেধ করেছিলাম, তারাও প্রায় তিনদিনের মধ্যে গ্রেফতার হয়ে গেল। খালেক নেওয়াজ খান, কাজী গোলাম মাহাবুব, আজিজ আহমেদ, অলি আহাদ, আবুল হাসানাত, আবুল বরকত কে.জি. মোস্তফা, বাহাউদ্দিন চৌধুরী আর আরও অনেকে। এরাই ছিল প্রথম শ্রেনীর কর্মী। বুঝতে আর বাকি রইল না যে, আন্দোলন আর চলবে না। কর্মীরা গ্রেফতার হওয়ার পরে আর আন্দোলন চলল না। ক্লাস শুরু হয়ে গেল, আমরা জেলে রইলাম। বোধহয় ত্রিশ-পয়ত্রিশজন ছাত্রনেতা গ্রেফতার হয়েছিল। আমাদের ঢাকা জেলের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের দোতলায় রাখা হয়েছিল। কয়েকজনকে উচ্ছ শ্রেনীর মর্যাদা দিয়েছিল। আর কয়েকজনকে দেওয়া হয় নাই। তাতে আমাদের খুব অসুবিধা হতে লাগল। খাওয়া-দাওয়ার কষ্টও হয়েছিল। তবুও আমরা ঠিক করলাম, এক জায়গায় থাকব এবং যা কিছু পাই ভাগ করে খাব।
জেলে যারা আছে, তাদের মধ্যেও দুইটা গ্রুপ ছিল। তিনজন ছিল উগ্রপন্থী। এদের অন্য ছাত্র বন্দিরা কমিউনিস্ট বলত। এই তিনজনের মধ্যে একজন ছাত্রলীগের সভ্য ছিল
১১৮
না। আর সকলেই ছাত্রলীগের সভ্য। আমাদের খেলাধুলা করে সময় কেটে যেত। আমার কাছে বরকত থাকত। রাতে বরকত গান গাইত, চমৎকার গাইতে পারত। বইপত্রও কিছু আনা হয়েছিল, জেল লাইব্রেরিতেও বই কিছু ছিল। কিছু সময় সকলেই লেখাপড়া করত। সকলেই ছাত্র, খুব দুষ্টামি করত। আমি ও আজিজ আহমেদ ছিলামদ এদের মধ্যে বয়েসে বড়। ডাক্তার সাহেবরা জেলে মেডিকেল ডায়েট দিতে পারতেন। এরা দল বেঁধে ডাক্তার সাহেবের জীবন অতিষ্ট করে তুলত। বরকত ছিল দুষ্টু বেশি। ডাক্তার সাহেব আসলেই বলত, ‘আমার পায়ে ব্যাথা, কিছু দুধ ও দিম পাস করে দেন’। সকলেই হেসে ফেলত তার কথায়। রাজনীতি নিয়ে চলত ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা।
একমাত্র বাহাউদ্দিন চৌধুরীর বাবা-মা ঢাকায় ছিলেন। সকলের চেয়ে বয়সে ছোট ছিল সে, আমি খুব স্নেহ করতাম। বাহাউদ্দিনের মা অনেক খাবার দিতেন। সকলকে দিয়েই সে খেত। তবু রাতে সে যখন ঘুমাত তখন দলবল বেঁধে ওর খাবারগুলো খেয়ে ফেলত, না হয় সরিয়ে রাখত। বাহাউদ্দিন কিছু না বলে চুপ করে আমাকে বলত। আমি সকলের সঙ্গে রাগ করতাম। কিন্ত কেউই স্বীকার করত না। রাতে যারা তাস খেলত তারাই এই কাজ করত। বরকত আমার কাছে মিছা কথা বলত না, সব বলে দিত।
খালেক নেওয়াজকে নিয়ে আর এক মহাবিপদ ছিল। ওর গায়ে বড় বড় লোম ছিল। সমস্ত গা লোমে ভরা। ছাত্ররা ছারপোকা ধরে চুপি চুপি ওর শরীরে ছেড়ে দিত। ওর মুখও খুব খারাপ ছিল, অকথ্য ভাষায় গালাগালি করত। আমরা বিকালে ভলবল খেলতাম। তখন সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন আমীর হোসেন সাহেব। আমাদের খুবই স্নেহ করতেন। যা প্রয়োজন, চাইলেই তিনি আমাদের দিতেন এবং সকলকে হুকুম দিয়েছিলেন আমাদের যেন কোন অসুবিধা না হয়।
একদিন আমার হাতের কব্জি সরে গিয়েছিল, পড়ে যেয়ে। ভীষণ যন্ত্রণা, সহ্য করা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। আমাকে বোধহয় মেডিকেল কলেজে পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছিল। একজন নতুন ডাক্তার ছিল জেলে। আমার হাতটা ঠিকমত বসিয়ে দিল। ব্যথা সাথে সাথে কম হয়ে গেল। আর যাওয়া লাগল না। বাড়িতে আমার আব্বা ও মা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। রেণু তখন হাচিনাকে নিয়ে বাড়িতেই থাকে। হাচিনা তখন একটু হাঁটতে শিখছে। রেণুর চিঠি জেলেই পেয়েছিলাম। কিছু টাকাও আব্বা পাঠিয়ে ছিলেন। রেণু জানত, আমি সিগারেট খাই। টাকা পয়সা নাও থাকতে পারে। টাকার দরকার হলে লিখতে বলেছিল।
জুন মাসের প্রথম থেকে দু’একজন করে ছাড়তে শুরু করে। এখন আর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গোলমাল নাই। শামসুল হক সাহেব মুসলিম লীগ প্রার্থী খুররম খান পন্নীকে পরাজিত করে এমএলএ হয়েছেন। মুসলিম লীগের প্রথম পরাজয় পাকিস্তানে। মুসলিম লীগকে কোটারি করার ফল তাদের পেতে হল। আমরা জেলের মধ্যে খুবই চিন্তিত ছিলাম। হক সাহেব আমার উপর অসন্তুষ্টও হয়েছিলেন; কেন আমি গ্রেফতার হয়েছিলাম, টাঙ্গাইল না যেয়ে! পরে যখন সমস্ত খবর পেলেন তখন দেখতে পেলেন, আমার কোনো উপায় ছিল না।
১১৯
১৯৪৭ সালে যে মুসলিম লীগকে লোকে পাগলের মত সমর্থন করছিল, সেই মুসলিম লীগ প্রার্থীর পরাজয়বরণ করতে হল কি জন্য? কোটারি, কুশাসন, জুলুম, অত্যাচার এবং অর্থনৈতিক কোন সুষ্টূ পরিকল্পনা গ্রহণ না করার ফলে। ইংরেজ আমলের সেই বাঁধাধরা নিয়মে দেশ শাসন চলল। স্বাধীন দেশ, জনগণ নতুন কিছু আশা করেছিল, ইংরেজ চলে গেলে তাদের অনেক উন্নতি হবে এবং শোষণ থাকবে না। আজ দেখছে ঠিক তার উল্টা। জনগণের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছিল। এদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই আমাদের শাসকগোষ্টীর। জিন্নাহর মৃত্যুর পর থেকেই কোটারি ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়েছে। লিয়াকত আলী খান এখন সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী। তিনি কাউকেও সহ্য করতে চাইছিলেন না। যদিও তিনি গণতন্ত্রের কথা মুখে বলতেন, কাজে তার উল্টা করছিলেন। জিন্নাহকে পূর্ব বাংলার জনগণ ভালবাসত এবং শ্রদ্ধা করত। ঘরে ঘরে জনসাধারণ তাঁর নাম জানত। লিয়াকত আলী খান প্রধানমন্ত্রী। এইটুকু শিক্ষিত সমাজ জানত এবং আশা করেছিল জিন্নাহ সাহেবের এক নম্বর শিষ্য নিশ্চয়ই ভাল কাজ করবেন এবং শাসনতন্ত্র তাড়াতাড়ি দিবেন। জিন্নাহ সাহেব শাসনতন্ত্র দিয়ে গেল কোনো গোলমাল হওয়া বা ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা থাকত কি না সন্দেহ ছিল। যাই তিনি করতেন জনগণ মেনে নিতে বাধ্য হত। জিন্নাহ সাহেব বড়লাট হয়ে প্রচণ্ড ক্ষমতা ব্যবহার করতেন। খাজা সাহেব কোন ক্ষমতাই ব্যবহার করতেন না। তিনি অমায়িক ও দুর্বল প্রকৃতির লোক ছিলেন। ব্যক্তিত্ব বলে তাঁর কিছুই ছিল না।
লিয়াকত আলী আমাদের এই আন্দোলন ভাল চোখে দেখছিলেন না। পূর্ব বাংলার নেতারা তাঁকে ভুল বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিন সাহেব সরকারি কর্মচারীদের উপর নির্ভর করতেন এবং তাদের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে অত্যাচার করতে শুরু করলেন। টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে পরাজিত হয়েও তাদের চক্ষু খুলল না। সরকারি দল তাদের সভায় ঘোষণা করল, ‘যা কিছু হোক, শামসুল হক সাহেবকে আইনসভায় বস্তে দেওয়া হবে না’। তারা নির্বাচনী মামলা দায়ের করল। শামসুল হক সাহেব ইলেকশন জয়লাভ করে ঢাকা আসলে ঢাকার জনসাধারণ ও ছাত্রসমাজ তাঁকে বিরাট সম্বর্ধনা জানাল। বিরাট শোভাযাত্রা করে তাঁকে নিয়ে ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করল। আমরা জেলে বসে বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করলাম। শামসুল হক সাহেব ফিরে আসার পরেই পুরানা লীগ কর্মীরা মিলে এক কর্মী সম্মেলন ডাকল ঢাকায়- ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করার জন্য। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন সে সভা আহবান করা হয়েছিল।
আমাদের মধ্যে অনেককেই মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত শুধু আমি ও বাহাউদ্দিন চৌধুরী রইলাম। বাহাউদ্দিন চৌধুরীর বয়স খুব অল্প। তাকে না ছাড়বার কারণ হল, সন্দেহ করছিল সে কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন হয়ে পড়ছিল। এই সময় অনেককেই কমিউনিস্ট বলে
১২০
জেলে ধরে আনতে শুরু করেছিল, নিরাপত্তা আইনে। যাকে আমরা বিনা বিচারে বন্দি বলি। এদের মধ্যে অনেকেই ইংরেজ আমলে বহুদিন জেল খেটেছে।
কারাগারের যন্ত্রণা কি এইবার বুঝতে পারলাম। সন্ধ্যায় বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিলেই আমার খারাপ লাগত। সূর্য আস্ত যাওয়ার সাথে সাথে সমস্ত কয়েদির কামরায় কামরায় বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দেওয়া হয় গণনা করার পর। আমি কয়েদিদের কাছে বসে তাদের জীবনের ইতিহাস ও সুখ দুঃখের কথা শুনতে ভালবাসতাম। তখন কয়েদিদের বিড়ি তামাক খাওয়া আইনে নিষেধ ছিল। তবে রাজনৈতিক বন্দিদের নিষেধ ছিল না। নিজের টাকা দিয়ে কিনে এনে খেতে পারত। একটা বিড়ির জন্য কয়েদিরা পাগল হয়ে যেত। কিন্ত কতৃপক্ষ যদি কাউকেও বিড়ি খেতে দেখত তাহলে তাদের বিচার হত এবং শাস্তি পেত। সিপাহিরা যদি কোনো সময় দয়াপরবশ হয়ে একটা বিড়ি বা সিগারেট দিত কতই না খুশি হত! আমি বিড়ি এনে এদের কিছু কিছু দিতাম। পালিয়ে পালিয়ে খেত কয়েদিরা।
কর্মী সম্মেলনের জন্য খুব তোড়জোর চলছিল। আমরা জেলে বসেই সে খবর পাই। ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে অফিস হয়েছে। শওকত মিয়া সকলের খাওয়া ও থাকার বন্দোবস্ত করত। সে ছাড়া ঢাকা শহরে কেইবা করবে? আর একজন ঢাকার পুরানা লীফকর্মী ইয়ার মোহাম্মদ খান সহযোগিতা করেছিলেন। ইয়ার মোহাম্মদ খানের অর্থবল ও জনবল দুইই ছিল। এডভোকেট আতাউর রহমান খান, আলী আমজাদ খান এবং আনোয়ারা খাতুন এমএলএ সহযোগিতা করছিলেন। আমরা সম্মেলনের ফলাফল সম্বন্ধে খুবই চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিলাম। আমার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল, আমার মত নেওয়ার জন্য। আমি খবর দিয়েছিলাম, ‘আর মুসলিম লীগের পিছনে ঘুরে লাভ নাই, এ প্রতিষ্টান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্টানে পরিণত হয়েছে। এরা আমাদের মুসলিম লীগে নিতে চাইলেও যাওয়া উচিত হবে না। কারণ এরা কোটারি করে ফেলেছে। একে আর জনগণের প্রতিষ্টান বলা চলে না। এদের কোনো কর্মপন্থাও নাই’। আমাকে আরও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমি ছাত্র প্রতিষ্টান করব, না রাজনৈতিক প্রতিষ্টান গঠন হলে তাতে যোগদান করব? আমি উত্তর পাঠিয়েছিলাম, ছাত্র রাজনীতি আমি আর করব না, রাজনৈতিক প্রতিষ্টানই করব। কারণ বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে।
কিছুদিন পূর্বে জনাব কামরুদ্দিন সাহেব ‘গণআজাদী লীগ’ নাম দিয়ে একটা প্রতিষ্টআন করেছিলেন, কিন্ত তা কাগজপত্রেই শেষ। যাহোক, কোথায়ও হল বা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হুমায়ূন সাহেবের রোজ গার্ডেন বাড়িতে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছিল। শুধু কর্মীরা না, অনেক রাজনৈতিক নেতাও সেই সম্মেলনে যোগদান করেন। শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আল্লামা মওলানা রাগীব আহসান, এমএলএদের ভিতর থেকে জনাব খয়রাত হোসেন, বেগম আনোয়ারা খাতুন, আলী আহমদ খান ও হাবিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে ধনু মিয়া এবং বিভিন্ন জেলার অনেক প্রবীন নেতাও যোগদান করেছিলেন। সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্টান গঠন করলেন; তার নাম
১২১
দেওয়া হল, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, জনাব শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং আমাকে করা হল জয়েন্ট সেক্রেটারি। খবরের কাগজে দেখলাম, আমার নামের পাশে লেখা আছে ‘নিরাপত্তা বন্দি’। আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্টানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্টান হবে, যার একটা সুষ্টু ম্যানিফেস্টো থাকবে। ভাবলাম, সময় এখনও আসে নাই, তাই যারা বাইরে আছেন তারা চিন্তাভাবনা করেই করেছেন।
আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন হওয়ার কয়েকদিন পরেই আমার ও বাহাউদ্দিনের মুক্তির আদেশ এল। বাইরে থেকে আমার সহকর্মীরা নিশ্চয়ই খবর পেয়েছিল। জেলগেট গিয়ে দেখি বিরাট জনতা আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্য এসেছে মওলানা ভাসানী সাহেবের নেতৃত্বে। বাহাউদ্দিন আমাকে চুপি চুপি বলে, ‘মুজিব ভাই, পূর্বে মুক্তি পেলে একটা মালাও কেউ দিত না, আপনার সাথে মুক্তি পাচ্ছি, একটা মালা তো পাব’। আমি হেসে দিয়ে বললাম, ‘আর কেউ না দিলে তোমাকে আমি মালা পরিয়ে দিতাম’। জেলগেট থেকে বের হয়ে দেখি, আমার আব্বাও উপস্থিত। তিনি আমাকে দেখবার জন্য বাড়ি থেকে এসেছেন। আমি আব্বাকে সালাম করে ভাসানী সাহেবের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁকেও সালাম করলাম। সাথে সাথে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ, ছাত্রলীগ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি উঠল। জেলগেটে এই প্রথম ‘আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ’ হল। শামসুল হক সাহেবকে কাছে পেয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানালাম এবং বললাম, ‘হক সাহেব, আপনার জয়, আজ জনগণের জয়’। হক সাহেব আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, ‘চল, এবার শুরু করা যাক’। পরে আওয়ামী মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ নামে পরিচিত হয়।
আওয়ামী লীগের কয়েকজনকে সহ-সভাপতি করা হয়েছিল। জনাব আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম খান, আলী আহমদ খান, আলী আমজাদ খান ও আরও একজন কে ছিলেন আমার মনে নাই। আওয়ামী লীগের প্রথম ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয় ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে। শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক সাহেব তাতে যোগদান করেছিলেন। একটা গঠনতন্ত্র সাব-কমিটি ও একটা কর্মপন্থা সাব-কমিটি করা হল। আমরা কাজ করা শুরু করলাম। শওকত মিয়া বিরাট সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিল। টেবিল, চেয়ার সকল কিছুই বন্দোবস্ত করল। আমি জেল থেকে বের হওয়ার পূর্বে একটা জনসভা আওয়ামী লীগ আরমানিটোলা ময়দানে ডেকেছিল। মওলানা ভাসানী সেই প্রথম ঢাকায় বক্তৃতা করবেন। শামসুল হক সাহেবকে ঢাকার জনগণ জানত। তিনি বক্তৃতাও ভাল করতেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ যাতে জনসভা না করতে পারে সে জন্য মুসলিম লীগ গুণ্ডামির আশ্রয় গ্রহণ করে। যথেষ্ট জনসমাগম হয়েছিল, সভা যখন আরম্ভ হবে ঠিক সেই মুহূর্তে একদল ভাড়াটিয়া লোক মাইক্রোফোন নষ্ট করে দিয়েছিল এবং প্যান্ডেল ভেঙে ফেলেছিল। অনেক কর্মীকে মারপিটও করেছিল। ঢাকার নামকরা ভীষণ প্রকৃতির লোক বড় বাদশা বাবুবাজারে (বাদামতলী ঘাট) থাকে। বড় বাদশার লোকবল ছিল, তার নামে দোহাই দিয়ে ফেরত এই সমস্ত
১২২
এলাকায়। তাকে বোঝান হয়েছিল, আওয়ামী লীগ যারা করেছে এবং আওয়ামী লীগের সভা করছে তারা সবাই ‘পাকিস্তান ধ্বংস করতে চায়’-এদের সভা করতে দেওয়া চলবে না। বাদশা মিয়াকে লোকজন জোগাড় করে সভা ভাঙবার জন্য পাঁচশত টাকা দেওয়া হয়েছিল।
বাদসা মিয়া খুব ভালো বংশের থেকে এসেছে, কিন্ত দলে পড়ে এবং ঢাকার হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় শরিক হয়ে খারাপ রাস্তায় চলে গিয়েছিল। দাঙ্গা করে অনেক মামলার আসামীও হয়েছিল। সভায় গোলমাল করে সে চলে গেলে ঐ মহল্লার বাসিন্দা জনব আরিফুর রহমান চৌধুরী তার কাছে গিয়ে বললেন, ‘বাদশা মিয়া, আমাদের সভা একবার ভেঙে দিয়েছে। আমরা আবার সব কিছু ঠিক ওরে সভা আরম্ভ করছি। আপনি আমাদের কথা প্রথমে শুনুন, যদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বলি বা দেশের বিরুদ্ধে বলি তারপরে সভা ভাঙতে পারবেন’। চৌধুরী সাহেবের ব্যবহার ছিল অমায়িক। খেলাফত আন্দোলন থেকে রাজনীতি করছেন। দেশের রাজনীতি করতে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন বরিশালের উলানিয়ার জমিদারি বংশে। বাদশা মিয়া তার দলবল নিয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সভার বক্তৃতা শুনতে লাগল। কয়েকজন বক্তৃতা করার পর বাদশা মিয়া প্লাটফর্মের কাছে এসে বলল, ‘আমার কথা আছে, আমাকে বলতে দিতে হবে’। কে তাকে বাধা দেয়, বলতে গেলে আরমানিটোলা ময়দান তার রাজত্বের মধ্যে। বাদশা মিয়া মাইকের কাছে যেয়ে বলল, ‘আমাকে মুসলিম লীগ নেতারা ভুল বুঝিয়েছিল আপনাদের বিরুদ্ধে। আপনাদের সভা ভাঙতে আমাকে পাঁচশত টাকা দিয়েছিল, এ টাকা এখনও আমার পকেটে আছে। আমার পক্ষে এ টাকা গ্রহণ করা হারাম। আমি এ টাকা আপনাদের সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি’। এ কথা বলে টাকাগুলি (পাঁচ টাকার নোট) ছুঁড়ে দিল। সভার মধ্যে টাকাগুলি উড়তে লাগল। অনেকে কুড়িয়ে নিল এবং অনেক ছিঁড়ে ফেলল। বাদশা মিয়া আরও বলল, ‘আজ থেকে আমি আওয়ামী লীগের সভ্য হলাম, দেখি আরমানিটোলায় কে আপনাদের সভা ভাঙতে পারে?’জনসাধারণ ফুলের মালা বাদশা মিয়ার গলায় পরিয়ে দিল। জনগণের মধ্যে এক নতুন আলোড়নের সৃষ্টি হল। মুসলিম লীগ গুণ্ডামির প্রশ্রয় নিয়েছিল একথা ফাঁস হয়ে পড়ল। আওয়ামী লীগের সভা ভাঙতে টাকাও দিয়েছিল একথাও জনগণ জানতে পারল। যদিও এতে তাদের লজ্জা হয় নাই। এই গুণ্ডামির পথ অনেক তিন তারা অনুসরণ করেছে যে পর্যন্ত না আমরা বাধ্য করতে পেরেছি তাদের তা বন্ধ করতে। তারা ঠিক করেছিল, বিরুদ্ধ দল গঠন করেত দেওয়া হবে না। তারা যে জনসমর্থন হারাচ্ছে, কেন তার সংশোধন না করে তারা বিরুদ্ধ দলের উপর নির্যাতন শুরু করল এবং গুণ্ডামির আশ্রয় নিল?
আমি জেল থেকে বের হয়েছি, আব্বা আমার জন্য ঢাকায় এসেছেন, আমাকে বাড়ি নিয়ে যাবেন। আমি আব্বাকে বললাম, ‘আপনি বাড়ি যান, আমি সাত-আট দিনের মধ্যে আসছি’।
১২৩
আমার টাকা দরকার, বাড়ি না গেলে টাকা পাওয়া যাবে না। বৃদ্ধা মা, আর স্ত্রী ও মেয়েটিকে দেখতে ইচ্ছা করছিল। আমি ফরিদপুরের সালাম সাহেবকেও খবর দিলাম গোপালগঞ্জে একটা সভা করব, তিনি যেন উপস্থিত থাকেন। গোপালগঞ্জে আওয়ামী মুসলিম লীগ সংগঠন হয়ে গেছে। পুরানা মুসলিম লীগ কমিটিকেই আওয়ামী লীগ কমিটিতে পরিণত করে ফেলা হয়েছিল। কারণ, পাকিস্তান সরকার আমাদের বিরোধীদের দিয়ে একটা মহকুমা মুসলিম লীগ অরগানাইজিং কমিটি গঠন করেছিল।
গোপালগঞ্জে খবর দিয়ে আমি বাড়িতে রওয়ানা করলাম। বোধহয় জুলাই মাসের মাঝামাঝি হবে, জনসভা ডাকা হয়েছিল। সালাম খান সাহেব উপস্থিত হলেন, আমিও বাড়ি থেকে আসলাম। সভায় হাজার হাজার জনসমাগম হয়েছিল। হঠাৎ সকালবেলা ১৪৪ ধারা জারি কর হয়। আমরা সভা মসজিদ প্রাঙ্গণে করব ঠিক করলাম। তাতে যদি ১৪৪ ধারা ভাঙতে হয়, হবে। বিরাট মসজিদ এবং সামনে কয়েক হাজার লোক ধরবে। সালাম সাহেবও রাজি হলেন। আমরা যখন সভা শুরু করলাম, তখন এসডিও মসজিদে ঢুকে মসজিদের ভিতর ১৪৪ ধারা জারি করলেন। আমরা মানতে আপত্তি করলাম, পুলিশ মসজিদে ঢুকলে মারপিট শুরু হল। পুলিশ লাঠিচার্জ করল এবং দুই পক্ষেই কিছু আহত হল। আমি ও সালাম সাহেব সভাস্থান ত্যাগ করতে আপত্তি করলাম। আমাদের গ্রেফতার করা হল। জনসাধারণও মসজিদ ঘিরে রাখল। গুলি করা ছাড়া আমাদের কোর্টে বা থানায় নেওয়া সম্ভবপর হবে না, পুলসিহ অফিসার বুঝতে পারল। যতদূর জানা গিয়েছিল, পুলিশ কর্মচারীরা মসজিদের ভিতর ১৪৪ ধারা জারি করতে রাজি ছিল না। এসডিও সাহেব জোর করেই করেছিলেন। মহকুমা পুলিশ অফিসার যখন বুঝতে পারলেন অবস্থা খুবই খারাপ, গোলমাল হবেই, জনসাধারণ রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে, তখন আমার ও সালাম সাহেবের কাছে এসে অনুরোধ করলেন, ‘গোলমাল হলে অনেক লোক মারা যাবে। আপনারা তো এখনই জামিন পেয়ে যাবেন, এদের বলে দেন চলে যেতে এবং রাস্তা ছেড়ে দিতে। আমরা আপনাদের কোর্টে নিয়ে যাব এবং এখনই জামিন দিয়ে দেব’।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে, বহুদুর থেকে লোকজন এসেছে। বৃষ্টি হচ্ছে, সন্ধ্যার অন্ধকারে কি হয় বলা যায় না। জনসাধারণের হাতেও অনেক লাঠি ও নৌকার বৈঠা আছে। মহকুমা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বিশেষ করে আমাকে বক্তৃতা করে লোকজনকে বোঝাতে বললেন। সালাম সাহেব ও গোপালগঞ্জ মহকুমার নেতাদের সাথে আলাপ-আলোচনার করে ঠিক হল আমি বক্তৃতা করে লোকদের চলে যেতে বলব। আমি বক্তৃতা করলাম, বলার যা ছিল সবই বললাম এবং রাস্তা ছেড়ে দিতে অনুরোধ করলাম। মসজিদ থেকে কোর্ট তিন মিনিটের রাস্তা মাত্র। পুলিশ ও আমরা কয়েক ঘন্টা আটক আছি। জনসাধারণ শেষ পর্যন্ত আমাদের রাস্তা দিল। আমাদের সাথেই জিন্দাবাদ দিতে দিতে কোর্ট এল। রাত আট ঘটিকার সময় আমাদের জামিন দিয়ে ছেড়ে দেয়া হল। তারপর জনগণ চলে গেল। এটা আমাদের আওয়ামী লীগের মফস্বলের প্রথম সভা এবং সে উপলক্ষে ১৪৪ ধারা জারি।

১২৪
পাণ্ডুলিপির একটি পৃষ্টার চিত্রলিপি

১২৫
পরের দিন আওয়ামী লীগের অফিস করা হল। গোপালগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী মুসলিম লীগের কনভেনর করা হয়েছিল কাজী আলতাফ হোসেন এবং চেয়ারম্যান করা হয়েছিল মুসলিম লীগের সভাপতি কাজী মোজাফফর হোসেন এডভোকেটকে। এই সময়ের একটা সামান্য ঘটনা মনে হচ্ছে। আমি ও কাজী আলতাফ হোসেন সাহেব ঠিক করলাম, মওলানা শামসুল হক সাহেবের (যিনি এখন লালবাগ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল) সাথে দেখা করব। মওলানা সাহেবের বাড়িও আমার ইউনিয়নে। জনসাধারণ তাকে আলেম হিসাবে খুবই শ্রদ্ধা করত। আমরা দুইজন রাত দশটায় একটা এক মাঝির নৌকায় রওয়ানা করলাম। নৌকা ছোট্ট, একজন মাঝি। মধুমতী দিয়ে রওয়ানা করলাম। কারণ, তাঁর বাড়ি মধুমতীর পাড়ে। মধুমতীর একদিকে ফরিদপুর, অন্যদিকে যশোর ও খুলনা জেলা। নদীটা এক জায়গায় খুব চওড়া। মাঝে মাঝে, সেই জায়গায় ডাকাতি হয়, আমাদের জানা ছিল। ঠিক যখন আমাদের নৌকা সেই জায়গায় এসে হাজির হয়েছিল আমি তখন ক্লান্ত ছিলাম বলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পানির দেশের মানুষ নৌকায় ঘুমাতে কোনো কষ্ট হয় না। কাজী সাহেব তখনও ঘুমান নাই। এই সময় একটা ছিপ নৌকা আমাদের নৌকার কাছে এসে হাজির হল। চারজন লোক নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞাসা করল, আগুন আছে কি না? আগুন চেয়েই এই ডাকাতরা নৌকার কাছে আসে, এই তাদের পন্থা। আমাদের নৌকার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘নৌকা যাবে কোথায়?’ মাঝি বলল, টুঙ্গিপাড়া, আমার গ্রামের নাম। নৌকায় কে? মাঝি আমার নাম বলল। ডাকাতরা মাঝিকে বৈঠা দিয়ে ভীষণভাবে একটা আঘাত করে বলল, ‘শালা আগে বলতে পার নাই শেখ সাহেব নৌকায়’। এই কথা বলে নৌকা ছেড়ে দিয়ে তারা চলে গেল। মাঝি মার খেয়ে চিৎকার করে নৌকার হাল ছেড়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। মাঝির চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কাজী সাহেব জেগে ছিলেন, তার ঘড়ি টাকা আংটি সব কিছু লুকিয়ে ফেলেছিলেন ভয়ে। কাজী সাহেব শৌখিন লোক ছিলেন, ব্যবসায়ী মানুষ, টাকা পয়সাও ছিল অনেক। আমি জেগে উঠে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কি? কাজী সাহেব ও মাঝি আমাকে এই গল্প করল। কাজী সাহেব বললেন, ‘ডাকাতরা আপনাকে শ্রদ্ধা করে, আপনার নাম করেই বেঁচে গেলাম, না হলে উপায় ছিল না’। আমি বললাম ‘বোধহয় ডাকাতরা আমাকে ওদের দলের একজন বলে ধরে নিয়েছে’। দুইজনে খুব হাসাহাসি করলাম, কিন্ত বিপদ হল মাঝিকে নিয়ে। কারণ, যে আঘাত তাকে করেছে তাতে তার পিঠে খুবই ব্যথা হয়েছে। বাধ্য হয়ে কিছুদূর এসে আমাদের এক গ্রামের পাশে নৌকা রাখতে হল। যেখানে খুব ভোরে পৌছাব সেখানে প্রায় সকাল দশটায় পৌছালাম। মওলানা সাহেব মাদ্রাসায়, তাঁর সাথে আলাপ করে আমাদের বাড়িতে এলাম।
আমি কয়েকদিন বাড়িতে ছিলাম। আব্বা খুবই দুঃখ পেয়েছেন। আমি আইন পড়ব না শুনে বললেন, ‘যদি ঢাকায় না পড়তে চাও, তবে বিলাত যাও। সেখান থেকে বার এট ল’ ডিগ্রি নিয়ে এস। যদি দরকার হয় জমি বিক্রি করে তোমাকে টাকা দিব’। আমি বললাম, ‘এখন বিলাত গিয়ে কি হবে, অর্থ উপার্জন করতে আমি পারব না’। আমার ভীষণ জেড হয়েছে মুসলিম লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম,
১২৬
এখন দেখি তার উল্টা হয়েছে। এর একটা পরিবর্তন করা দরকার। জনগণ আমাদের জানত এবং আমাদের কাছেই প্রশ্ন করত। স্বাধীন হয়েছে দেশ, তবু মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর হবে না কেন? দুর্নীতি বেড়ে গেছে, খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। বিনা বিচারে রাজনৈতিক কর্মীদের জেলে বন্ধ করে রাখা হচ্ছে। বাংলাকে রাষ্টড়ভাষা হিসাবে মুসলিম লীগ নেতারা মানবে না। পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প কারখানা গরা শুরু হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে না। রাজধানী করাচি। সব কিছুই পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব বাংলায় কিছু নাই। আব্বাকে সকল কিছুই বললাম। আব্বা বললেন, ‘আমাদের জন্য কিছু করতে হবে না। তুমি বিবাহ করেছ, তোমার মেয়ে হয়েছে, তাদের জন্য তো কিছু একটা করা দরকার’। আমি আব্বাকে বললাম, ‘আপনি তো আমাদের জন্য জমিজমা যথেষ্ট করেছেন, যদি কিছু না করে পারি, বাড়ি চলে আসব। তবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া চলতে পারে না’। আমাকে আর কিছুই বললেন না। রেণু বলল, ‘এভাবে তোমার কতকাল চলবে’। আমি বুঝতে পারলাম, যখন আমি ওর কাছে এলাম। রেণু আড়াল থেকে সব কথা শুনছিল। রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্ত কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা পয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়।
আমি ঢাকায় রওয়ানা হয়ে আসলাম। রেণুর শরীর খুব খারাপ দেখে এসেছিলাম। ইত্তেহাদের কাজটা আমার ছিল। মাঝে মাঝে কিছু টাকা পেতাম, যদিও ইত্তেহাদের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়েছিল। পূর্ব বাংলা সরকার প্রায়ই ব্যান্ড করে দিয়েছিল। এজেন্টরা টাকা দেয় না। পূর্ব বাংলা সরকার প্রায়ই ব্যান্ড করে দিয়েছিল। এজেন্টরা টাকা দেয় না। পূর্ব বাংলায় কাগজ যদিও বেশি চলত।
ঢাকায় এসে ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলন যাতে তাড়াতাড়ি হয় তার ব্যবস্থা করলাম। এর পূর্বে আর কাউন্সিল সভা হয় নাই। নির্বাচন হওয়া দরকার, আর আমিও বিদায় নিতে চাই। ঢাকার তাজমহল সিনেমা হলে কনফারেন্স হল আমার সভাপতিত্বে। আমি আমার বক্তৃতায় বললাম, ‘আজ থেকে আমি আর আপনাদের প্রতিষ্টানের সভ্য থাকব না। ছাত্র প্রতিষ্টানের সাথে জড়িত থাকার আর আমার কোনো অধিকার নাই। আমি আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। কারণ আমি আর ছাত্র নই। তবে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ যে নেতৃত্ব দিয়েছে, পূর্ব বাংলার লোক কোনোদিন তা ভুলতে পারবে না। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য যে ত্যাগ স্বীকার আপনারা করেছেন এদেশের মানুষ চিরজীবন তা ভুলতে পারবে না। আপনারাই এদেশে বিরোধীদল সৃষ্টি করেছেন। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না’। এটাই ছিল বক্তৃতার সারাংশ। একটা লিখিত ভাষণ আমি দিয়েছিলাম, আমার কাছে তার কপি নাই। নির্বাচন হয়েছিল, দবিরুল ইসলাম তখন জেলে ছিল। তাকে সভাপতি ও খালেক নেওয়াজ খানকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল। দবিরুল সম্বন্ধে কারও আপত্তি ছিল না, তবে খালেক নেওয়াজ খান সম্বন্ধে অনেকের আপত্তি
১২৭
ছিল। কারণ সে কথা একটু বেশি বলত। শেষ পর্যন্ত আমি সকলকে বুঝিয়ে রাজি করলাম। আমার বিদায়ের সময়ের অনুরোধ কেউই ফেলল না। আমি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, আমার মনোনীত প্রার্থী খালেক নেওয়াজ প্রতিষ্টানের মঙ্গলের চেয়ে অমঙ্গলই বেশি করেছিল। সে চেষ্টা করত সত্য, কিন্ত কোন সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা তার ছিল না। আর অন্যের কথা শুনত, নিজে ভাল কি মন্দ বিবেচনা করত না, বা করার ক্ষমতা ছিল না। একমাত্র ঢাকা সিটি ছাত্রলীগের সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদের জন্য প্রতিষ্টানের সমূহ ক্ষতি হতে পারে নাই। পরে ওয়াদুদ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সম্পাদক হয়েছিল। যদিও আমি সদস্য ছিলাম না, তবু ছাত্রনেতারা আমার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। প্রয়োজন মত বুদ্ধি পরামর্শ দিতে কার্পণ্য করি নাই। এরাই আমাকে ছাত্রলীগের প্রতিষ্টাতা হিসাবে শ্রদ্ধা করেছে।
শামসুল হক সাহেব অনেক পরিশ্রম করে একটা ড্রাফট ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্রের খসড়া করেছেন। আমাদের নিয়ে তিনি অনেক আলোচনা করেছিলেন। আমরা একমত হয়ে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম। কয়েকদিন পর্যন্ত সভা হল। দুই একবার শামসুল হক সাহেবের সাথে ভাসানী সাহেবের একটু গরম গরম আলোচনা হয়েছিল। একদিন শামসুল হক সাহেব ক্ষেপে গিয়ে মওলানা সাহেবকে বলে বসলেন, ‘এ সমস্ত আপনি বুঝবেন না। কারণ, এ সমস্ত জানতে হলে অনেক শিক্ষার প্রয়োজন, তা আপনার নাই’। মওলানা সাহেব ক্ষেপে মিটিং স্থান ত্যাগ করলেন। আমি শামসুল হক সাহেবকে বুঝিয়ে বললে তিনি বুঝতে পারলেন, কথাটা সত্য হলেও বলা উচিত হয় নাই। ফলে হক সাহেব নিজে গিয়ে মওলানা সাহেবকে অনুরোধ করে নিয়ে আসলেন। শামসুল হক সাহেবের রাগ বেশি সময় থাকত না।
মওলানা ভাসানী সাহেবকে ভার দেওয়া হয়েছিল ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের নমিনেশন দিতে। তিনি যে সমস্ত লোককে নমিনেশন দিয়েছিলেন তা আমার মোটেই পছন্দ ছিল না। তাঁকে আমি বললাম, ‘আপনি এ সমস্ত লোক কোথায় পেলেন, আর ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য করলেন; এরা তো সুযোগ পেলেই চলে যাবে’। মওলানা সাহেব বললেন, ‘আমি কি করব? কাউকেই তো ভাল করে জানিও না, চিনিও না। তোমার ছাত্ররা যাদের নাম দিয়েছে, তাদেরই আমি সদস্য করেছি’। আমি বললাম, ‘দেখবেন বিপদের সময় এরা কি করে’। ওয়ার্কিং কমিটি ড্রাফট ম্যানিফেস্টো গ্রহণ করল এবং কাউন্সিল সভা ডেকে একে অনুমোদন করা হবে ঠিক হল। ড্রাফট ম্যানিফেস্টো ছাপিয়ে দেওয়া হবে, কারও কোন প্রস্তাব থাকলে তাও পেশ করা হবে। জনমত যাচাই করার জন্য আমরা ড্রাফট রাখলাম। তাতে পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দিবার প্রস্তাব করা হল। কেবলমাত্র দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকবে। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে এ কথাও বলা হল। আরও অনেক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রোগ্রাম নেওয়া হয়েছিল।
আমরা প্রতিষ্টানের কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। মওলানা সাহেব, শামসুল হক সাহেব ও আমি ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমায় প্রথম সভা করতে যাই। জামালপুরের উকিল হায়দার আলী মল্লিক সাহেব আওয়ামী লীগ গঠন করেছেন। ছাত্রনেতা হাতেম
১২৮
আলী তালুকদার যথেষ্ট পরিশ্রম করেছিল এই সভা কামিয়াব করার জন্য। আমরা যখন সভায় উপস্থিত হলাম তখন বিরাট জনসমাগম হয়েছে দেখতে পারলাম। যখনই সভা আরম্ভ হবে, দশ-পনেরজন লোককে চিৎকার করতে দেখলাম। আমরা ওদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সভা আরম্ভ করলাম। জামালপুরের নেতারা ঠিক করেছিল শামসুল হক সাহেব সভাপতিত্ব করবেন আর মওলানা সাহেব প্রধান বক্তা হবেন। সভা আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথেই ১৪৪ ধারা জারি করা হল। পুলিশ এসে মওলানা সাহেবকে একটা কাগজ দিল। আমি বললাম, ‘মানি না ১৪৪ ধারা, আমি বক্তৃতা করব’। মওলানা সাহেব দাঁড়িয়ে বললেন, ‘১৪৪ ধারা জারি হয়েছে। আমাদের সভা করতে দেবে না। আমি বক্তৃতা করতে চাই না, তবে আসুন আপনারা মোনাজাত করুন, আল্লাহু আমিন’। মওলানা সাহেব মোনাজাত শুরু করলেন। মাইক্রোফোন সামনেই আছে। আধ ঘন্টা পর্যন্ত চিৎকার করে মোনাজাত করলেন, কিছুই বাকি রাখলেন না, যা বলার সবই বলে ফেললেন। পুলিশ অফিসার ও সেপাইরা হাত তুলে মোনাজাত করতে লাগল। আধা ঘন্টা মোনাজাতে পুরা বক্তৃতা করে মওলানা সাহেব সভা শেষ করলেন। পুলিশ ও মুসলিম লীগ ওয়ালারা বেয়াকুফ হয়ে গেল।
রাতে এক বাড়িতে খেতে গেলেন মওলানা সাহেব। রাগ, খাবেন না। তিনি থাকতে কেন শামসুল হক সাহেবের নাম প্রস্তাব করা হল সভাপতিত্ব করার জন্য। এক মহাবিপদে পড়ে গেলাম। মওলানা সাহেবকে আমি বুঝাতে চেষ্টা করলাম, লোকে কি বলবে? তিনি কি আর বুঝতে চান? তাঁকে নাকি অপমান করা হয়েছে! শামসুল হক সাহেবও রাগ হয়ে বলেছেন, মওলানা সাহেব সকলের সামনে একথা বলছেন কেন? এই দিন আমি বুঝতে পারলাম মওলানা ভাসানীর উদারতার অভাব, তবুও তাঁকে আমি শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতাম। কারণ, তিনি জনগণের জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত। যে কোন মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয় তারা জীবনে কোন ভাল কাজ করতে পারে নাই- এ বিশ্বাস আমার ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, এদেশে রাজনীতি করতে হলে ত্যাগের প্রয়োজন আছে এবং ত্যাগ আমাদের করতে হবে পাকিস্তানের জনগণকে সুখী করতে হলে। মুসলিম লীগ সরকার নির্যাতন চালাবে এবং নির্যাতন ও জুলুম করেই ক্ষমতায় থাকতে চেষ্টা করবে। নির্যাতনের ভয় পেলে বেশি নির্যাতন ভোগ করতে হয়। এখনও মুসলিম লীগের নামে মানুষকে ধোঁকা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে কিছুটা; কিন্ত বেশি দিন ধোঁকা দেওয়া চলবে না। মুসলিম লীগের নামের যে মোহ এখনও আছে, জনগণকে বুঝাতে পারলে এবং শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলতে পারলে মুসলিম লীগ সরকার অত্যাচার করতে সাহস পাবে না।
আমরা ঢাকায় ফিরে এলাম এবং আরমানিটোলা ময়দানে এক জনসভা ডাকলাম। কারণ তখন খাদ্য পরিস্থিতি খুবই খারাপ। লোকের দুরবস্থার সীমা নাই। মওলানা সাহেব সভাপতিত্ব করলেন। আতাউর রহমান খান, শামসুল হক সাহেব ও আমি বক্তৃতা করলাম।
১২৯
মুসলিম লীগ চেষ্টা করেছিল গোলমাল সৃষ্টি করতে। বাদশা মিয়া আমাদের দলে চলে আসায় এবং জনগণের সমর্থন থাকায় তারা সাহস পেল না। এতবড় সভা এর পূর্বে আর হয় নাই। বিরাট জনসমাগম হয়েছে। জনসাধারণ ও ঢাকার লোকের ভুল ভাঙতে শুরু করেছে। আর আমরা যারা বক্তৃতা করলাম সকলেই পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমাদের ‘রাষ্ট্রের দুশমন’ বললে জনগণ মানতে রাজি ছিল না। কারণ আমরাই প্রথম কাতারের কর্মী ছিলাম।
মওলানা ভাসানী এই সভায় ঘোষণা করলেন, ‘জনাব লিয়াকত আলী খান ঢাকায় আসছেন অক্টোবর মাসে, আমরা তাঁর সাথে খাদ্য সমস্যা ও রাজবন্দিদের মুক্তির ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে চাই। যদি তিনি দেখা না করেন আমাদের সাথে, তাহলে আমরা আবার সভা করব এবং শোভাযাত্রা করে তাঁর কাছে যাব’। কয়েকদিন পরেই আমরা কাগজে দেখলাম, লিয়াকত আলী খান ১১ই অক্টোবর ঢাকায় আসবেন। মওলানা সাহেব আমাকে টেলিগ্রাম করতে বললেন, যাতে তিনি ঢাকায় এসে আমাদের একটা ডেপুটেশনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। মওলানা সাহেবের নামেই টেলিগ্রামটা পাঠানো হয়েছিল। জনাব শামসুল হক সাহেব একটু ব্যস্ত ছিলেন, কারণ তাঁর বিবাহের দিন ঘনিয়ে আসছে। আমাকেই পার্টির সমস্ত কাজ দেখতে হত। যদিও তাঁর সাথে পরামর্শ করেই করতাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘প্রতিষ্টানের কাজ তুমি চালিয়ে যাও’। আমাদের মধ্যে এত মিল ছিল যে কোন ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনাই ছিল না। আমি বুঝতে পারতাম মওলানা সাহেব, হক সাহেবকে অপছন্দ করতে শুরু করেছেন। সুযোগ পেলেই তাঁর বিরুদ্ধে বলতেন। আমি চেষ্টা করতাম, যাতে ভুল বোঝাবুঝি না হয়। যদিও মওলানা সাহেব প্রকাশ্যে কিছু বলতে সাহস পেতেন না। এই সময় একজনের অবদান অস্বীকার করলে অন্যায় করা হবে। বেগম আনোয়ারা খাতুন এমএলএ প্রতিষ্টানের জন্য যথেষ্ট কাজ করতেন। দরকার হলে টাকা পয়সা দিয়েই সাহায্য করতেন। আতাউর রহমান সাহেবকে ডাকলেই পাওয়া যেত। তিনি পূর্বে রাজনীতি করেন নাই এবং রাজনৈতিক জ্ঞানও তত ছিল না। লেখাপড়া জানতেন, কাজ করার আগ্রহ এবং আন্তরিকতা ছিল। আমার সাথে তাঁর একটা সম্বন্ধ গড়ে উঠতে লাগল। জেলায় জেলায় সোহরাওয়ারদী সাহেবের সমর্থকরা আওয়ামী লীগে যোগদান করতে শুরু করল। এই সময় কলকাতায় ইত্তেহাদ কাগজ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সোহরাওয়ারদী সাহেব কলকাতা ত্যাগ করে করাচি চলে গিয়েছেন। মানিক ভাই ঢাকা এসে পৌছেছেন প্রায় নিঃস্ব অবস্থায়। তিনিও এসে মোগলটুলীতে উঠেছেন। সোহরাওয়ারদী সাহেব সামান্য কিছু কাপড় ছাড়া আর কিছু নিয়ে আসতে পারেন নাই। ভারত সরকার তাঁর সর্বস্ব ক্রোক করে রেখেছে। অনেকে শুনে আশ্চর্য হবেন, শহীদ সাহেবের কলকাতায় নিজের বাড়ি ছিল না। ৪০ নম্বর থিয়েটার রোডের বাড়ি, ভাড়া করা বাড়ি। তিনি করাচিতে তাঁর ভাইয়ের কাছে উঠলেন, কারণ তাঁর খাবার পয়সাও ছিল না।
ঢাকার পুরানা নেতাদের মধ্যে কামরুদ্দিন সাহেব যোগদান করেন নাই পার্টিতে। তবে আবদুল কাদের সর্দার আমাদের অর্থ দিয়েও সাহায্য করেছিলেন। তাঁর অর্থবল ও জনবল
১৩০
দুইই ছিল। ঢাকার খাজা বংশের সাথে জীবনভর মোকাবেলা করেছেন। গরিবদের সাহায্য করতেন, তাই জনসাধারণ তাঁকে ভালবাসত। আমরা এখনও জেলা কমিটিগুলো গঠন করতে পারি নাই। তবে দু’একতা জেলায় কমিটি হয়েছিল। চট্টগ্রামে এম.এ. আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে এবং যশোরে খড়কীর পীর সাহেব ও হাবিবুর রহমান এডভোকেটের নেতৃত্বে। মশিয়ুর রহমান সাহেব ও খালেক সাহেব সাহায্য করেছিলেন, কিন্ত প্রকাশ্যে তখনও যোগদান করেন নাই। ফরিদপুরে সালাম খান সাহেবের নেতৃত্বে অরগানাইজিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১৯৪৯ সালের ভিতরেই আমরা সমস্ত জেলায় প্রতিষ্টান গড়ে তুলব ঠিক করেছি। ছুটি থাকলেই আমরা সমস্ত জেলায় বের হব। সাড়া যা পাচ্ছি তাতে আমাদের মধ্যে একটা নতুন মনোবলের সৃষ্টি হয়েছিল।
নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান মওলানা সাহেবের টেলিগ্রামের উত্তর দেওয়ারও দরকার মনে করলেন না। আমরা জানতে পারলাম তিনি ১১ অক্টোবর ঢাকায় আসবেন। তিনি প্রেস রিপোর্টারদের কাছে বললেন, ‘আওয়ামী লীগ কি তিনি জানেন না’।
আমরা ১১ই অক্টোবর আরমানিটোলা ময়দানে সভা আহবান করলাম। আমাদের একটা মাইক্রোফোন ছিল, যখন আমাদের কর্মীরা সভার প্রচার করছিল ঘোড়ার গাড়ি করে নবাবপুর রাস্তায়, তখন বেলা তিনটা কি চারটা হবে, একদল মুসলিম লীগ কর্মী-গুণ্ডাও বলতে পারা যায়, আমাদের কর্মীদের মেরে মাইক্রোফোনটা কেড়ে নিয়ে যায়। একটা ঘোড়ার গাড়িতে মাত্র তিনজন কর্মী ছিল। কোন আইনশৃঙ্খলা দেশে নাই বলে মনে হচ্ছিল। কর্মীরা এসে আমাকে খবর দিল মোগলটুলী আওয়ামী লীগ অফিসে। আমি আট-দশজন কর্মী নিয়ে আলোচনা করছিলাম। আমাদের কর্মীরা কয়েকজনের মুখ চিনতে পেরেছে, কারণ পূর্বে একসাথেই কাজ করেছে। আমি বললাম, ‘ এ তো বড় অন্যায়। চল, আমি এদের কাছে জিজ্ঞাসা করে আসি আর অনুরোধ করি মাইক্রোফোনটা ফেরত দিতে। যদি দেয় ভাল, না দেয় কি করা যাবে! থানায় একটা এজাহার করে রাখা যাবে’। আমার সাথে ছাত্রলীগের নূরুল ইসলাম (পরে ইত্তেফাকে কাজ করত), আর চকবাজারের নাজির মিয়া এবং আবদুল হালিম (এখন ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদক। তখন সিটি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ছিল) আমরা ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে ওদের অফিসে রওয়ানা হলাম। কারণ, আমি খবর নিলাম ওরা ওখানেই আছে।কো-অপারেটিভ ব্যাংকের উপর তলায়ই তারা ওঠাবসা করে। আমি সেখানে পৌঁছে দেখলাম, ওদের কয়েকজন দাঁড়িয়ে আলাপ করছে। আমি ইব্রাহিম ও আলাউদ্দিনকে চিনতাম, তারাও মুসলিম লীগের কর্মী ছিল আমাদের সাথে। বললাম, ‘আমাদের মাইক্রোফোনটা নিয়েছ কেন? এ তো বড় অন্যায় কথা! মাইক্রোফোনটা দিয়ে দাও’। আমাকে বলল, ‘আমরা নেই নাই, কে নিয়েছে জানি না’। নূরুল ইসলামের কাছ থেকেই কেড়ে নেবার সময় এরা উপস্থিত ছিল। নূরুল ইসলাম বলল, ‘আপনি তো দাঁড়ান ছিলেন, তখন কথা কাটাকাটি চলছিল’।
এই সময় ইয়ার মোহাম্মদ খান, হাফিজুদ্দিন নামে আরেকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকে নিয়ে রিকশায় যাচ্ছিলেন। আমি ইয়ার মোহাম্মদ সাহেবকে ডাক দিলাম এবং বললাম ঘটানাটা।
১৩১
ইয়ার মোহাম্মদ খান সাহেব ঢাকার পুরানা লোক। বংশমর্যাদা, অর্থ বল, লোকবল সকল কিছুই তাঁর আছে। তিনি বললেন, ‘কেন তোমরা মাইক্রোফোনটা কেড়ে নিয়েছ, এটা কি মগের মুল্লুক’। এর মধ্যে একজন বলে বসল, ‘নিয়েছি তো কি হয়েছে?’ ইয়ার মোহাম্মদ হাত উঠিয়ে ওর মুখে এক চড় মেরে দিলেন। হালিমও এক ঘুষি মেরে দিল। পিছনে ওদের অনেক লোক লুকিয়ে ছিল, তারা আমাদের আক্রমণ করল। হালিম ওদের কাছ থেকে ছুটে ওর মহল্লার দিকে দৌড় দিল লোক আনতে। প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরীর মালিক হুমায়ূন সাহেব বের হয়ে ইয়ার মোহাম্মদ খানকে তাঁর লাইব্রেরীর ভিতরে নিয়ে গেলেন। এরা বাইরে বসে গালাগালি শুরু করল। আমিও রিকশা নিয়ে ছুটলাম আওয়ামী লীগ অফিসে, সেখানেও আমাদের দশ-বারজন কর্মী আছে। ওরা ঠিক পায় নাই- আমি যখন চলে আসি, না হলে আমাকেও আক্রমণ করত। হাফিজুদ্দিন রিকশা নিয়ে ইয়ার মোহাম্মদ খান সাহেবের মহল্লায় খবর দিল। সাথে সাথে তার ভাই, আত্মীয়স্বজন মহল্লার লোক যে যে অবস্থায় ছিল এসে হাজির হল। ভিক্টোরিয়া পার্কে হালিমও তার মহল্লা থেকে লোক নিয়ে হাজির হল। যারা এতক্ষণ ইয়ার মোহাম্মদ খানকে গালাগালি করছিল কে কোথা দিয়ে পালাল খুঁজে পাওয়া গেল না।
খাজা বাড়ির অনেক লোক এদের সাথে ছিল। একজন মন্ত্রীও উপরের তলায় বসে সব কিছু দেখছিলেন, তাঁর দলের কীর্তিকলাপ। আমি এসে দেখলাম, পুলিশ এসে গেছে। ইয়ার মোহাম্মদকে নিয় এরা শোভাযাত্রা করে মহল্লায় যেয়ে মুসলিম লীগ অফিস আক্রমণ করল। কারণ লীগ অফিস রায় সাহেবের বাজারেই ছিল। কয়েকজন গুণ্ডা প্রকৃতির লোক এই মহল্লায় ছিল। গুণ্ডামি করত, ছাত্রদের মারত টাকা খেয়ে। তাদের ধরে নিয়ে মহল্লায় বিচার বসল। ঢাকার মহল্লার বিচার ছিল, মসজিদেনিয়ে হাজির করত এবং বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে মারা হত- এটিই হল এদের কোর্টকাচারী। রায় সাহেবের বাজার দিয়ে কোন ছাত্র শোভাযাত্রা বা আমাদের কর্মীদের দেখলে আক্রমণ এবং মারপিট করা হত। অনেক কর্মী ও ছাত্রকে মার খেতে হয়েছে। এই দিনের পর থেকে আর কোনোদিন এই এলাকায় কেউ আমাদের মারপিট করতে সাহস পায় নাই।
ইয়ার মোহাম্মদ খানও এর পর থেকে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে শুরু করলেন। তাতে আমাদের শক্তিও ঢাকা শহরে বেড়ে গেল। আমিও মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে একদল যুবক কর্মী সৃষ্টি করলাম। এই সময় সমসাবাদ ও বংশালের একদল যুবক কর্মী আওয়ামী লীগে যোগদান করল। সমসাবাদাও আরমানিটোলা ময়দানের পাশেই ছিল। আরমানিটোলার সভার বন্দোবস্ত এখন এরাই করতে শুরু করে। ফলে মুসলিম লীগ শত চেষ্টা করেও আর গোলমাল সৃষ্টি করতে পারছিল না আমাদের সভায়।
১৩২
১১ ই অক্টোবর আরমানিটোলায় বিরাট সভা হল। সমস্ত ময়দান ও আশপাশের রাস্তা লোকে ভরে গেল। শামসুল হক সাহেব বক্তৃতা করার পর আমি বক্তৃতা করলাম। মওলানা পূর্বেই বক্তৃতা করেছেন। আমি শেষ বক্তা। সভায় গোলমাল হবার ভয় ছিল বলে ভাসানী সাহেব প্রথমে বক্তৃতা করেছেন। ভাসানী সাহেব আমাকে বললেন, শোভাযাত্রা করতে হবে সেইভাবে বক্তৃতা কর। আমি বক্তৃতা করতে উঠে যা বলার বলে জনগণকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলাম, ‘যদি কোন লোককে কেউ হত্যা করে, তার বিচার কি হবে?’ জনগণ উত্তর দিল, ‘ফাঁসি হবে?’। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, ‘যারা হাজার হাজার লোকের মৃত্যুর কারণ, তাদের কি হবে?’ জনগণ উত্তর দিল, ‘তাদেরও ফাঁসি হওয়া উচিত’। আমি বললাম, ‘না, তাদের গুলি করে হত্যা করা উচিত’। কথাগুলি আজও আমার পরিষ্কার মনে আছে। তারপর বক্তৃতা শেষ করে বললাম, ‘চলুন আমরা মিছিল করি এবং লিয়াকত আলী খান দেখুক পূর্ব বাংলার লোক কি চায়’।
শোভাযাত্রা বের হল। মওলানা সাহেব, হক সাহেব ও আমি সামনে চলেছি। যখন নবাবপুর রেলক্রসিংয়ে উপস্থিত হলাম, তখন দেখলাম পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে বন্দুক উঁচা করে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা আইন ভাঙবার কোনো প্রোগ্রাম করি নাই। আর পুলিশের সাথে গোলমাল করারও আমাদের ইচ্ছা নাই। আমরা রেল স্টেশনের দিকে মোড় নিলাম শোভাযাত্রা নিয়ে। আমাদের প্ল্যান হল নাজিরবাজার রেললাইন পার হয়ে নিমতলিতে ঢাকা মিউজিয়ামের পাশ দিয়ে নাজিমুদ্দীন রোড হয়ে আবার আরমানিটোলা ফিরে আসব। নাজিরবাজারে এসেও দেখি পুলিশ রাস্তা আটক করেছে, আমাদের যেতে দেবে না। তখন নামাজের সময় হয়ে গেছে। মওলানা সাহেব রাস্তার উপরই নামাজে দাঁড়িয়ে পড়লেন। শামসুল হক সাহেওবও সাথে সাথে দাঁড়ালেন। এর মধ্যেই পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছেড়ে দিল। আর জনসাধারণও ইট ছুড়তে শুরু করল। প্রায় পাঁচ মিনিট এইভাবে চলল। পুলিশ লাঠিচার্জ করতে করতে এগিয়ে আসছে। একদল কর্মী মওলানা সাহেবকে কোলে করে নিয়ে এক হোটেলের ভিতর রাখল। কয়েকজন কর্মী ভীষণভাবে আহত হল এবং গ্রেফতার হল। শামসুল হক সাহেবকেও গ্রেফতার করল। আমার উপরও অনেক আঘাত পড়ল। একসময় প্রায় বেহুশ হয়ে একপাশের নর্দমায় পড়ে গেলাম। কাজী গোলাম মাহাবুবও আহত হয়েছিল, তবে ওর হুঁশ ছিল। আমাকে কয়েকজন লোক ধরে রিকশায় উঠিয়ে মোগলটুলী নিয়ে আসল। আমার পা দিয়ে খুব রক্ত পড়ছিল। কেউ বলে, গুলি লেগেছে, কেউ বলে গ্যাসের ডাইরেক্ট আঘাত, কেউ বলে কেটে গেছে পড়ে যেয়ে। ডাক্তার এল, ক্ষতস্থান পরিষ্কার করল। ইনজেকশন দিয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল, কারণ বেদনায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। প্রায় ত্রিশজন লোক গ্রেফতার হয়েছিল। চট্টগ্রামের ফজলুল হক বিএসসি, আবদুর রব ও রসূল নামে আরেকজন কর্মী মাথায় খুব আঘাত পেয়েছিল। তারাও গ্রেফতার হয়ে গিয়েছিল। আমার আত্মীয়, ফরিদপুরের দত্তপাড়ার জমিদার বংশের সাইফুদ্দিন চৌধুরী ওরফে সূর্য মিয়া আমার কাছেই ছিল এবং আমাকে খুব সেবা করল। সে রাত দুইটা পর্যন্ত জেগে ছিল। এমন সময় মোগলটুলীর আমাদের অফিস, যেখানে আমি আছি, পুলিশ
১৩৩
ঘিরে ফেলল এবং দরজা খুলতে বলছিল। লোহার দরজা, ভিতরে তালা- খোলা ও ভাঙা এত সহজ ছিল না। সাইফুদ্দিন চৌধুরী আমাকে, কাজী গোলাম মাহাবুব ও মফিজকে ডেকে উঠাল এবং বলল, ‘পুলিশ এসেছে তোমাদের গ্রেফতার করতে’।
আমি যখন ঘুমিয়ে ছিলাম, ইনজেকশন নিয়ে, তখন ভাসানী সাহেব খবর দিয়েছিলেন, আমি যেন গ্রেফতার না হই। আমার শরীরে ভীষণ বেদনা, জ্বর উঠেছে, নড়তে পারছি না। কি করি, তবুও উঠতে হল এবং কি করে ভাগব তাই ভাবছিলাম। শওকত মিয়া আগেই সরে গেছে। রাস্তাঘাট তারই জানা। তিনতলায় আমরা থাকি, পাশেই একটা দোতলা বাড়ি ছিল। তিনতলা থেকে দোতলায় লাফিয়ে পড়তে হবে। দুই দালানের ভিতরে ফারাকও আছে। নিচে পড়লে শেষ হয়ে যাব। তবুও লাফ দিয়ে পড়লাম। কাজী গোলাম মাহাবুব ও মফিজও আমাকে অনুসরণ ক্রল। সাইফুদ্দিন রাজনীতি করে না, তাকে কেউ চিনে না। সে একলাই থাকল। আমরা যখন ছাদ থেকে নামছি তখন পাশের বাড়ির সিঁড়ির উপর একটা বালতি ছিল। পায়ে লেগে সেটা নিচে পড়ে গেল। আর বাড়িওয়ালা চিৎকার করে উঠল। আমরা চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পুলিশ দরজা ভাঙতে ব্যস্ত, এদিকে নজর নাই। আমরা বস্তি পার হয়ে বড় রাস্তায় পড়ব এমন সময় পুলিশও দরজা ভেঙে ঢুকে পড়েছে। আমাদের মৌলভীবাজারের ভিতর ঢুকতে হবে। তিনজন পুলিশ এই রাস্তা পাহারা দিচ্ছিল। একবার তিনজন হেঁটে এপাশে আসে, আবার অন্যদিকে যায়। আমরা যখন দেখলাম, তিনজন হেঁটে সামনে অগ্রসর হচ্ছে তখন পিছন থেকে রাস্তা পার হয়ে গেলাম। ওরা বুঝতে পারল না। মৌলভীবাজার পার হয়ে আমরা এগিয়ে এসে এক বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। রাতটা সেখানেই কাটালাম। ভোরে ওদের দুইজনকে বিদায় দিলাম। কারণ, ওদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা নাই। সামনে পেলে গ্রেফতার করতে পারে। আমি আবদুল মালেক সর্দারের মাহুতটুলির বাড়িতে রইলাম। সেখান থেকে আমি পরের দিন সকালে ক্যাপ্টেন শাহজাহানের বাড়িতে উপস্থিত হলাম। তার স্ত্রী বেগম নুরজাহান আমাকে ভাইয়ের মত স্নেহ করতেন। তিনি রাজনীতি করতেন না। আমি আহত ও অসুস্থ, কোথায় যাই- আর কেইবা জায়গা দেয় তখন ঢাকায়! ভদ্রমহিলা আমার যথেষ্ট সেবা করলেন, ডাক্তারের কাছ থেকে ঔষধ আনালেন।
দুই দিন ওখানে ছিলাম। আইবির লোকেরা সন্দেহ করল, আমি এ বাড়িতে থাকতে পারি, কারণ প্রায়ই আমাই এ বাড়িতে আসতাম। দুইজন আইবি অফিসার এদের এখানে এসেছে রাত আটটায়। ঠিক এই সময় একজন কর্মী সেখানে উপস্থিত হয়ে বেগম নূরজাহানকে জিজ্ঞাসা করতে যাবে আমি কোথায়- আইবি অফিসারদের দেখে তার মুখের ভাব এমন হয়ে গেল যে, তাদের আর বুঝতে বাকি রইল না, আমি কোথায় আছি! আমি কিন্ত পাশের ঘরেই শুয়ে এদের আলাপ শুনছি। বেগম নূরজাহান খুবই চালাক ও বিচক্ষণ। তিনি ওদের চা খেতে দিয়ে আমাকে ডেকে দোতলা থেকে নিচে নিয়ে গেলেন এবং বললেন অবস্থাটা। আমি বললাম, ‘একটা চাদর দেন’। কারণ, আমার পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ভাগ্য ভাল, ভদ্রমহিলা নিজেই দিনে এই দুইটাকে ধুয়ে
১৩৪
দিয়েছিলেন। চাদর এনে আমাকে রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। আমি বেরিয়ে আসলাম, আইবিরা তখনও বাড়িতেই বসে আছে। এই অফিসারদের দুইজন গার্ডও বাইরে পাহারা দিচ্ছিল, আমি বুঝতে পারলাম। তাদের চোখকেও আমার ফাঁকি দিতে হল।
তখন মওলানা ভাসানী ইয়ার মোহাম্মদ খানের বাড়িতে থাকতেন। তাঁর সাথে আমার দেখা করা দরকার; কারণ তাঁকে এখনও গ্রেফতার করা হয় নাই। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা দরকার, তিনি কেন আমাকে গ্রেফতার হতে নিষেধ করেছেন? আমি পালিয়ে থাকার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। কারণ, আমি গোপনে রাজনীতি পছন্দ করি না, আর বিশ্বাসও করি না। রিকশা করে এক সহকর্মীর বাড়িতে যেয়ে তাঁকে সাথে নিলাম এবং ইয়ার মোহাম্মদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলাম। পিছন দিক থেকে ঢুকবার একটা রাস্তা আছে, সেই রাস্তায় ছদ্মবেশে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়লাম। পাহারায় থাকা গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা আমাকে চিনতে পারল না। মওলানা সাহেব ও ইয়ার মোহাম্মদ আমাকে দেখে খুব খুশি হন। আমি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছি। মওলানা সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি ব্যাপার, কেন পালিয়ে বেড়াব?’
নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান লীগ সভায় ঘোষণা করলেন, ‘যো আওয়ামী লীগ করেগা, উসকো শের হাম কুচাল দে গা’। তিনি যদিও বলতেন, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, কিন্ত কেনো বিরুদ্ধ দল সৃষ্টি হোক তা তিনি চাইতেন না। তাঁর সরকারের নীতির কোন সমালোচনা কেউ করে তাও তিনি পছন্দ করতেন না। নিজের দলের মধ্যে কেউ বিরুদ্ধাচরণ করলে তাকেও বিপদে ফেলতে চেষ্টা করেছেন, যেমন নবাব মামদোত। পশ্চিম পাঞ্জাব সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মামদোত। জিন্নাহর বিশ্বস্ত একজন ভক্ত ছিলেন। জিন্নাহর হুকুমে নবাবি ছেড়ে দিয়ে তিনি বিরাট সম্পত্তি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। লিয়াকত আলী খান যে মুসলিম লীগ ছাড়া অন্য কোন বিরোধী দল সৃষ্টি হোক চান না, তার প্রমাণ পরে তাঁর বক্তৃতার মধ্যে থেকে ফুটে উঠেছিল। ১৯৫০ সালে মুসলিম লীগ কাউন্সিল সভায়তিনি ঘোষণা করেছিলেন:
I have always said, rather it has always been my firm belief, that the esistence of the league not only the existence of the league, but its strength is equal to the existence and strength of Pakistan. So far, as I am concerned, I had decided in the very beginning, and I reaffirm it today, that I have always considered myself as the Prime Minister chosen by the members of the Constituent Assembly.
তিনি জনগণের প্রধানমন্ত্রী হতে চান নাই, একটা দলের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছেন। রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দল যে এক হতে পারে না, একথাও তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অনেকগুলি রাজনৈতিক দল থাকতে পারে এবং আইনে এটা থাকাই স্বাভাবিক। দুঃখের বিষয়, লিয়াকত আলী খানের উদ্দেশ্য ছিল যাতে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল
১৩৫
পাকিস্তানে সৃষ্টি হতে না পারে’। ‘যো আওয়ামী লীগ করেগা উসকো শের কুচাল দে গা’- একথা একমাত্র ডিকটেটর ছাড়া কোনো গণতন্ত্রে বিশ্বাসী লোক বলতে পারে না। জিন্নাহর মৃত্যুর পরে সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেছিলেন।
মওলানা সাহেব আমাকে বললেন, ‘তুমি লাহোর যাও, কারণ সোহরাওয়ারদী সাহেব লাহোর আছেন। তাঁর এবং মিয়া ইফতিখারউদ্দিনের সাথে সাক্ষাৎ কর। তাঁদের বল পূর্ব বাংলার অবস্থা। একটা নিখিল পাকিস্তান পার্টি হওয়া দরকার। পীর মানকী শরীফের সাথে আলোচনা করে সোহরাওয়ারদী সাহেবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে সারা পাকিস্তানের প্রতিষ্টানে পরিণত করতে পারলে ভাল হয়। সোহরাওয়ারদী সাহেব ছাড়া আর কেউ এর নেতৃত্ব দিতে পারবেন না’।
করাচি থেকে লিয়াকত আলী খান সোহরাওয়ারদী সাহেবকে অকথ্য ভাষায় গাল দিয়ে বলেছেন, ‘ভারত কুকুর লেলিয়ে দিয়েছে’। অথচ জিন্নাহ সাহেব সোহরাওয়ারদী সাহেবকে একদিনের জন্যও মন্দ বলেন নাই। একেই বলে অদৃষ্টের পরিহাস! লিয়াকত আলী খানকে নির্বাচনে পাস করাতে সমগ্র আলিগড়ে মুসলিম ছাত্রদের নামতে হয়েছিল। রফি আহমেদ কিদোয়াই প্রায়ই তাঁকে পরাজিত করে দিয়েছিলেন, যদি মুসলিম ছাত্ররা আলিগড় থেকে না যেত। জিন্নাহর ছায়ায় বসে দিল্লি থেকে বিবৃতি দেওয়া ছাড়া তিনি কি যে করেছেন পাকিস্তান আন্দোলনে, আমার জানা নাই। সোহরাওয়ারদী সাহেব বাংলার প্রধানমন্ত্রী না হলে আর মুসলিম লীগ গড়ে না তুললে কি যে হত তা বলা কষ্টকর। জিন্নাহ সাহেব সেটা জানতেন, তাই তিনি কিছুই বলেন নাই।
সোহরাওয়ারদী সাহেব লাহোরে নবাব মামদোতের মামলা নিয়েছেন। এটাও লিয়াকত আলী সাহেবের কীর্তি। নবাব মামদোতকে বিপদে ফেলার জন্য আর একজনকে সাহায্য করা। কারণ নবাব মামদোত একটু কমই গ্রাহ্য করতেন লিয়াকত আলী খানকে। আমি ভাসানী সাহেবকে বললাম, ‘কি ভাবে যাব? ভারতবর্ষ হয়ে যেতে হবে। আমি যে পাকিস্তানী, তার প্রমাণ লাগবে, তাহলেই পশ্চিম পাকিস্তানে ঢুকতে দিবে। তখনও পাসপোর্ট ভিসা চালু হয় নাই। গরম কাপড়ও বাড়িতে রয়েছে। টাকা পয়সাও হাতে নাই। ওদিকে আবার পূর্ব পাঞ্জাবে মুসলমান পেলেই হত্যা করে। কি করে লাহোর যাব বুঝতে পারছি না। আমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ঝুলছে। খুঁজে বেড়াচ্ছে পুলিশ’। ভাসানী সাহেব বললেন, ‘তা আমি কি জানি! যেভাবে পার লাহোর যাও। সোহরাওয়ারদী সাহেবের সাথে দেখা কর এবং তাঁকে সকল কিছু বল’। ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে ঢাকায় মওলানা ভাসানী, মিয়া ইফতিখারউদ্দিন , আরও অনেকে সোহরাওয়ারদীর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন যদি মুসলিম লীগে কোটারি করা হয়, তবে নতুন পার্টি করা হবে। সোহরাওয়ারদী সাহেব মত দেন। এখন শহীদ সাহেব ও মিয়া সাহেবের সাহায্য প্রয়োজন। তাঁদের সম্পর্ক ভাল।
আমি তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম। আমার একটা গরম আচকান ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আমার মামা জাফর সাদেকের কাছ থেকে সামান্য কিছু টাকা ধার নিলাম। আর ইত্তেহাদ আমার কিছু টাকা পাওনা ছিল সেখান থেকে সামান্য কিছু
১৩৬
পেলাম। তাই নিয়ে রওয়ানা করলাম। লাহোর পর্যন্ত কোনোমতে পৌছাতে পারলে হয়, সোহরাওয়ারদী সাহেব আছেন কোন অসুবিধা হবে না। আমি অনেক কষ্টে লাহোর পৌছালাম। পূর্ব বাংলার পুলিশকে আমার অনেক কষ্টে ফাঁকি দিতে হয়েছিল। আমার জন্য অনেক বাড়ি খানা তল্লাশি হচ্ছিল। বাড়িতেও পুলিশ গিয়ে খবর এনেছে আমি বাড়ি যাই নাই।
লাহোরে তখন ভীষণ শীত। আমার তা সহ্য করা কষ্টকর হচ্ছিল। কোনোদিন লাহোর যাই নাই। মিয়া ইফতিখারউদ্দিন সাহেব ছাড়া কেউ আমাকে চিনত না। সোহরাওয়ারদী সাহেব নবাব মামদোতের বাড়িতে থাকতেন, একথা আমি জানি। এক দোকানের সামনে মালপত্র রেখে আমি নবাব সাহেবের বাড়িতে ফোন করলাম। সেখান থেকে উত্তর এল, সোহরাওয়ারদী সাহেব লাহোরে নাই, বাইরে গেছেন, দুই দিন পরে ফিরবেন। আমার কাছে মাত্র দুই টাকা আছে, কি করব? কোথায় যাব ভাবছিলাম, মালপত্রই বা কোথায় রাখি? বেলা তখন একটা, ক্ষিধেও লেগেছে, সকাল থেকে কিছুই পেটে পড়ে নাই। দুইটা টাকা মাত্র, কিছু খেলেও তো শেষ হয়ে যাবে। অনেক চিন্তা করে মিয়া সাহেবের বাড়িতে ফোন করলাম। মিয়া সাহেব লাহোরে আছেন, কিন্ত বাড়িতে নাই। আমি একটা টাঙ্গা ভাড়া করে মিয়া সাহেবের বাড়ির দিকে রওয়ানা করলাম। ঠিকানা লেখা ছিল। আমি যখন সুটকেস ও সামান্য বিছানা নিয়ে তাঁর বাড়ির সামনে নামলাম, দারোয়ান বলল, সাহেব বাড়িতে নাই। একটা বাইরের ঘরে বসতে দিল। সুটকেসটা বাইরেই একপাশে রেখে দিলাম। আমার নাম ও ঠিকানা কাগজে লিখে দিলাম, মিয়া সাহেব আসলে তাঁকে দিতে। মিয়া সাহেব এসে কাগজটা দেখেই বের হয়ে এলেন, আমাকে চিনলেন এবং খুব আদর করলেন। আমার অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি একটা রুম ঠিক করে দিয়ে গোসল করে নিতে বললেন। একসাথে খানা খাবেন এবং পূর্ব বাংলার অবস্থা শুনবেন। বরিশালের এস. এ. সালেহ মিয়া সাহেবকে ও শহীদ সাহেবকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন এবং আমি যে লাহোর যেতে পারি একথাও জানিয়েছিলেন। সালেহ আমার বাল্যবন্ধু ও নূরুদ্দিন সাহেবের চাচাতো ভাই। পাকিস্তান আন্দোলনে একসাথে অনেক দিন কাজ করেছি। মিয়া সাহেব, বেগম সাহেবা ও আমি একসাথে খানা খেয়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনা করলাম। পূর্ব বাংলার সকল খবর দিলাম। মওলানা ভাসানীর কথাও বললাম, সরকারের অত্যাচারের কাহিনীও জানালাম। মিয়া সাহেব মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেছেন, আমাকে বললেন, ‘দেখ, কিছুদিনের জন্য রাজনীতি আমি ছেড়ে দিয়েছি। সক্রিয় অংশগ্রহণ করব না, আমার নিজের কিছু কাজ আছে’।
তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মুসলিম লীগের অবস্থা কি?’ আমি বললাম, ‘নির্বাচন হলেই মুসলিম লীগকে আমরা পরাজিত করতে পারব এবং সে পরাজয় হবে শোচনীয়’। মিয়া সাহেব বিশ্বাস করতে চাইলেন না। বেগম ইফতিখারউদ্দিন বললেন, ‘হলে হতেও পারে, কারণ কিছুদিন পূর্বেও তো এক আন্দোলন পূর্ব বাংলায় হয়ে গেল’। বেগম সাহেবা
১৩৭
রাজনীতি বুঝতেন এবং দেশ-বিদেশের খবরও রাখেন, যথেষ্ট লেখাপড়াও তিনি করেছেন বলে মনে হল।
রাতে আমার ভীষণ জ্বর হল। মিয়া সাহেব ব্যস্ত হয়ে ডাক্তার ডাকলেন। ঔষধ কিনে দিলেন, দুই দিনেই জ্বর পড়ে গেল। মিয়া সাহেবের বাড়িতে এই একটাই অতিথিদের থাকবার ঘর ছিল। সোহরাওয়ারদী সাহেবের ভাই প্রফেসর শাহেদ সোহরাওয়ারদী লাহোরে আসবেন এবং মিয়া সাহেবের বাড়িতে থাকবেন।তাই দুই দিনের মধ্যেই আমার ছেড়ে যাওয়া উচিত হবে। আলাপ-আলোচনার মধ্যেই সেটা বুঝতে পারলাম।
মিয়া সাহেব আমার জন্য অন্য বন্দোবস্ত করতে রাজি আছেন। সোহরাওয়ারদী সাহেব ফিরে এসেছেন, ফোন করে জানলাম। আজ আর জ্বর নাই। ভীষণ শীত। বেলা এগারটার সময় নবাব সাহেবের বাড়িতে পৌছালাম। শহীদ সাহেব লনে বসে কয়েকজন এডভোকেটের সাথে মামলা সম্বন্ধে আলোচনা করছিলেন। আমিঃ কাছে যেয়ে সালাম করতেই তিনি উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিভাবে এসেছ? তোমার শরীর তো খুব খারাপ, কোথায় আছ?’আমাকে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সকলকে বিদায় দিয়ে আমাকে নিয়ে বসলেন। আমি সকল ইতিহাস তাকে বললাম। প্রত্যেক কর্মী ও নেতাদের কথা জিজ্ঞেস করলেন। পূর্ব বাংলার অবস্থা কি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাও জিজ্ঞেস করলেন। বাংলাকে তিনি যে কতটা ভালবাসতেন তাঁর সাথে না মিশলে কেউ বুঝতে পারত না। শহীদ সাহেব বললেন, তাঁর আর্থিক অবস্থার কথা। মামলাটা না পেলে খুবই অসুবিধা হত। তিনি আমাকে যেতে দিলেন না মিয়া সাহেবের বাসায়। একসাথে খানা খেলাম, নবাব মামদোত উপস্থিত ছিলেন। তাঁকেও আমাদের অবস্থার কথা বললেন। তিনিও পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা এক এক করে জিজ্ঞাসা করলেন।
বিকালবেলা খান গোলাম মোহাম্মদ লুন্দখোর ও পূর সালাহউদ্দিন (তখন ছাত্র) শহীদ সাহেবের সাথে দেখা করতে এলেন। গোলাম মোহাম্মদ খান লুন্দখোরকে সীমান্ত প্রদেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তাঁর সীমান্ত প্রদেশে যাওয়া নিষেধ। তিনি সীমান্ত আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক। আমাকে পেয়ে তিনি খুশি হলেন। শহীদ সাহবে তাঁকে বললেন, একটা হোটেল ঠিক করে দিতে, যেখানে আমি থাকব। অল্প খরচের হোটেল হলেই ভাল হয়। পীর সালাহউদ্দিন তখন পাঞ্জাবের ছাত্রনেতা। কর্মী হিসাবে তার নাম ছিল।
আমি রাতেই মিয়া সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলে চলে এলাম। মিয়া সাহেব বললেন, জায়গা থাকলে তোমাকে হোটেলে যেতে দিতাম না। আমি বললাম, অসুবিধা হবে না।
শহীদ সাহেব আমাকে নিয়ে দোকানে গেলেন এবং বললেন, ‘কিছু কাপড় আমার বানাতে হবে, কারণ দুইটা মাত্র স্যুট আছে, এতে চলে না। তিনি নিজের কাপড় বানানোর হুকুম দিয়ে একটা ভাল কম্বল, একটা গরম সোয়েটার, কিছু মোজা ও মাফলার কিনে নিলেন এবং বললেন,কোনো কাপড় লাগবে কি না। আমি জানি শহীদ সাহেবের অবস্থা।
১৩৮
বললাম, না আমার কিছু লাগবে না। তিনি আমাকে যখন গাড়িতে নিয়ে হোটেলে পৌছাতে আসলেন, জিনিসগুলি দিয়ে বললেন, ‘এগুলি তোমার জন্য কিনেছি। আরও কিছু দরকার হলে আমাকে বোলো’। গরম ফুলহাতার সোয়েটার ও কম্বলটা পেয়ে আমার জানটা বাঁচল। কারণ, শীতে আমার অবস্থা কাহিল হতে চলেছিল।
সকালেই শহীদ সাহেবের কাছে যেতাম আর রাতে ফিরে আসতাম। তাঁর সাথেই কোর্টে যেতাম। নবাব নবাব সাহেবের ভাইদের সাথেও আমার বন্ধুত্ব হয়ে উঠেছিল। এর তিন দিন পরে লুন্দখোর সাহেব আমাকে এসে বললেন, ‘চল, আমরা ক্যাম্বেলপুর যাই। সেখানে সীমান্ত আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সভা হবে। তুমি পীর মানকী শরীফ ও অন্যান্য নেতাদের সাথে আলোচনা করতে পারবে। আমিও তোমার সাথে একমত। আমাদের দুই প্রদেশের আওয়ামী লীগ নিয়ে একটা নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠন করা উচিত- সোহরাওয়ারদী সাহেবের নেতৃত্বে’। আমরা দুইজন শহীদ সাহেবের কাছে এলাম। শহীদ সাহেব বললেন, ‘যাও, আলাপ করে এস। হলে তো ভালই হয়, আমিও পাঞ্জাবে নবাব সাহেবের সাথে আলাপ করছি’।
শহীদ সাহেব আমাকে কিছু টাকা দিলেন। আমরা দুইজন একসাথে লুন্দখোর সাহেবের মোটর গাড়িতে চড়ে ক্যাম্বেলপুর রওয়ানা হলাম রাত দশটায়। লুন্দখোর সাহেব নিজেই গাড়ি চালান। তিনি গাড়ি চালিয়ে রাওয়ালপিন্ডি পৌছালেন ভোর রাতের দিকে। আমরা বিশ্রাম করলাম, সকালে নাশতা করে আবার রওয়ানা করলাম ক্যাম্বল্পুরের দিকে। এগার-বারটার মধ্যে সেখানে পৌছালাম। এই আমার জীবনের প্রথম পাঞ্জাব প্রদেশের ভিতরে বেড়ান। আমার ভালই লাগল পঞ্চনদীর এই দেশটাকে।
পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিম পাঞ্জাবের ভয়াবহ দাঙ্গার স্মৃতি আজও মানুষ ভোলে নাই। লক্ষ লক্ষ মোহাজের এসেছে পশ্চিম পাঞ্জাবে, তবে বেশি অসুবিধা হয় নাই। কারণ পশ্চিম পাঞ্জাব থেকেও লক্ষ লক্ষ হিন্দু এবং শিখ চলে গিয়েছে। মুসলমানরা তা দখল করে নিয়েছে। ক্যাম্বলপুর যাওয়ার পূর্বে আমি একটা বিবৃতি দিয়েছিলাম, পূর্ব বাংলায় কি হচ্ছে তার উপরে; মওলানা ভাসানী, শামসুল হক সাহেবের কারাগারে বন্দিত্ব, রাজনৈতিক কর্মীদের উপর নির্যাতন ও খাদ্য সমস্যা নিয়ে। পাকিস্তান টাইমস, ইমরোজ ভালভাবেই ছাপিয়ে ছিল। কারণ, মিয়া সাহেব তখন এই কাগজ দুইটির মালিক ছিলেন। এই সময় সম্পাদক ও বিখ্যাত কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ও তাঁর সহকর্মী জনাব মাজহারের সাথে আমার পরিচয় হয়। এই দুইজনকে বিদ্বান, বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী বললে ভুল হবে না। বাংলা ভাষা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত- মিয়া সাহেব ও ঐ দুইজনই তখন তা সমর্থন করেছিলেন। আমাদের দাবি যে ন্যায্য একথাও স্বীকার করেছিলেন। আমি বিবৃতি লিখে শহীদ সাহেবকে দেখিয়েছিলাম। তিনি দেখে দিয়েছিলেন।
১৩৯
আমরা ক্যাম্বলপুর পৌছালাম। ডাকবাংলো পীর সাহেবের জন্য রিজার্ভ ছিল। কিন্তু সময়ের মধ্যে পেশোয়ার, মরদান ও অন্যান্য জায়গা থেকে সীমান্ত আওয়ামী লীগের কর্মকর্তা ও সদস্যরা এসে পৌছালেন। এখানে সভা করার উদ্দেশ্য হল জনাব লুন্দখোর পাঞ্জাব ছেড়ে সীমান্ত প্রদেশে যেতে পারেন না। এইখানেই আমার প্রথম পরিচয় হয় পীর মানকী শরীফ, সর্দার আবদুল গফুর, সর্দার সেকেন্দার, ভূতপূর্ব মন্ত্রী শামীম জং ও আরও অনেক নেতার সাথে। তাঁদের সভা অনেকক্ষণ চলল। আমাকে তাঁদের সভায় যোগদান করতে অনুমতি দিয়েছিলেন। ডাকবাংলোয়ই সভা হল।বন্দুকধারী দুইজন পাহারাদার ডাকবাংলো পাহার দিয়েছিল, যাতে গোয়েন্দা বিভাগের কেউ কাছে আসতে না পারে। রাত পর্যন্ত সভা চলল, আমি সভায় বক্তৃতা করলাম ইংরেজিতে। এক ভদ্রলোকে- নাম মনে নাই, পশতুতে সকলকে বুঝিয়ে দিলেন। আমি যে নিখিল পাকিস্তানভিত্তিক প্রতিষ্টান গড়া উচিত বলে প্রস্তাব দিলাম এই নিয়ে আলোচনা শুরু হল। আমি বুঝতে পারলাম, প্রায় সকলেই শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। গোলাম মোহাম্মদ লুন্দখোরের বক্তৃতার পরে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনজন প্রতিনিধি শহীদ সাহেবের সাথে আলোচনা করবেন এবং তাঁকে নেতৃত্ব নিতে অনুরোধ করবেন। রাতে সভা শেষ হল। আটক ব্রিজ পার হতে হলে বিশেষ অনুমতি প্রয়োজন হত। পীর সাহেবের অনুমতিপত্র ছিল, তিনি দলবল নিয়ে রাতেই চলে গেলেন। কয়েকজন ডাকবাংলোয় থাকল। লুন্দখোর সাহেব আমাকে নিয়ে একটা ছোট্ট হোটেলে আসলেন। সেখানে খাওয়া-দাওয়া করে রাত কাটালাম। পাঞ্জাবের শীত যে কি ভয়ানক এই রাতে তা একটু বেশি বুঝলাম।
আমি পূর্ব বাংলার মানুষ, একটা গরম চাদর গায়ে দিয়েই শীতকাল কাটিয়ে দিতে পারি। এখানে তো গরম কাপড়ের ওপর গরম কাপড়, কম্বলের ওপর কম্বল তারপর ঘরের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে হয়; তবুও ঘুম হবে কি না বলা কষ্টকর! পীর সাহেব পূর্ব বাংলার অবস্থা শুনে খুবই দুঃখিত হলেন এবং আমাকে সীমান্ত প্রদেশে কাইয়ুম খান কি কি অত্যাচার করছে তাও বললেন। অনেক নেতা ও কর্মীকে জেলে দিয়েছে। কোন সভা করতে গেলেই ১৪৪ ধারা জারি করছে, লাঠিচার্জ ও গুলি করতে একটুও দ্বিধাবোধ করছে না। অত্যাচার চরম পর্যায়ে চলে গেছে। পূর্ব বাংলার অত্যাচার সীমান্তের অত্যাচারের কাছে কিছুই না বলতে হবে। লুন্দখোরকে জেলে দিয়েছিল। মুক্তি দিয়ে সীমান্ত প্রদেশের সীমানা পার করে দিয়েছে। এখন তিনি লাহোরে আছেন।
পরের দিন সকালে আমরা রওয়ানা করলাম। আমি অনুরোধ করলাম, এত কাছে এসে আটক ব্রিজ ও আটক ফোরট না দেখে যাই কি করে! মাত্র কয়েক মাইল। লুন্দখোর সাহেব রাজি হলেন, আমাকে আটক ব্রিজে নিয়ে গেলেন। আমি ব্রিজ পার হয়ে সীমান্ত প্রদেশে ঢুকলাম। লুন্দখোর সাহেব একজন লোক সাথে দিয়েছিলেন। ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটা ফলের দোকান। ফল কিনে নিয়ে ফিরলাম। আটক ফোরটের ভিতরে যাওয়ার অনুমতি লাগে, কারণ কিছু যুদ্ধবন্দি সেখানে আছে। কয়েকজন শিখকে কাজ করতে দেখলাম দূর থেকে। আমি ফিরে আসার পরে আবার লুন্দখোর সাহেব গাড়ি ছাড়লেন লাহোরের দিকে। আবার
১৪০
রাওয়ালপিন্ডি ফিরে এলাম। এখানেই বিশ্রাম করলাম কিছু সময়। লুন্দখোর সাহেবকে অনেক লোকে জানে দেখলাম। তিনি মাঝে মাঝে গাড়ি রেখে হুক্কা খান। সেখানেই তি গাড়ি থামান-কোনো হোটেল বা রেস্টুরেন্টে ঢুকলে প্রথমেই হুক্কা এনে সামনে দেয় খান সাহেবের। এরা প্রায় সকলেই সীমান্ত প্রদেশের লোক বলে মনে হল। আমরা ঝিলাম, গুজরাট ও গুজরানওয়ালায় থেমে চা খেয়েছি। রাত প্রায় দশটায় লাহরে পৌছালাম। আমাকে হোটেলে দিয়ে তিনি চলে গেলেন এবং বললেন, আগামীকাল সকালে আমাকে নিয়ে সোহরাওয়ারদী সাহেবের কাছে যাবেন এবং কি সিদ্ধান্ত হয়েছে রিপোর্ট দিবেন।
এই সময় পাঞ্জাবের নবাব মামদোতের দলের মুসলিম লীগে স্থান হয় নাই। তিনি তখনও কোন দল করেন নাই। তবে করবেন ভাবছেন, তাঁর প্রোডা মামলা শেষ হবার পরে। অনেক ভাল কর্মী ও নেতা শহীদ সাহেবের কাছে আসা যাওয়া শুরু করেছেন, তাঁরা সকলেই প্রায় পুরানা লীগ কর্মী। শহীদ সাহেব একটা জনসভায় যোগদান করবেন বলে মত দিয়েছেন। আমরা মোটরে গিয়েছিলাম। সারগোদা জেলায় এই সভা হবে। আমাকে বললেন সাথে যেতে। আমার কি কাজ! রাজি হলাম। সারগোদায় অনেক মোহাজের এসেছে, তাদের দুরবস্থার সীমা নাই। শহীদ সাহেব বক্তৃতা করলেন। আমাকে বক্তৃতা করতে অনেকে অনুরোধ করলেন, আমি বললাম, ‘স্যার, না জানি পাঞ্জাবি; ইংরেজিতে কেউ বুঝবে না, কি বক্তৃতা করব!’ তিনি বললেন, থাক, প্রয়োজন নাই। আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল। আমি সালাম বসে পড়লাম। সুদুর সারগোদা জেলায়ও শহীদ সাহেব জনপ্রিয় ছিলেন এইবার প্রথম বুঝলাম।
লাহোরে যে হোটেলে আমি থাকতাম তার দুইটা রুম ভাড়া নিয়ে মিস্টার আজিজ বেগ ও মিস্টার খুরশিদ (যিনি আজাদ কাশ্মীরের প্রেসিডেন্ট ছিলেন) সাপ্তাহিক গার্ডিয়ান কাগজ বের করতেন। এরা পাকিস্তান টাইমসে আমার বিবৃতি দেখেছিলেন এবং বিবৃতির কিছু কিছু অংশ গার্ডিয়ান কাগজে প্রকাশ করেছিলেন। আমি তাঁদের সাথে দেখা করলাম এবং সকল বিষয় আলোচনা করলাম। গার্ডিয়ান প্রতিনিধি আমার সাথে দেখা করে একটা সাক্ষাতের রিপোর্ট বের করলেন। আস্তে আস্তে লাহোরের রাজনীতিবিদরাও জানতে পারলেন, আমি লাহোরে আছি। গোয়েন্দা বিভাগও যে আমার পিছু লেগেছে সে খবরও হোটেলের ম্যানেজার আমাকে বলে দিলেন এবং আরও বললেন, সকল সময়ের জন্য একজন লোক আপনাকে অনুসরণ করছে। আমি তো টাঙ্গায় বা হেঁটে চলতাম, ওরা আমাকে সাইকেলে অনুসরণ করত। পীর সালাহউদ্দিনের মারফতে আমি পাঞ্জাব মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের এক প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাৎ করলাম এবং অল পাকিস্তান ছাত্র প্রতিষ্টান হওয়া দরকার এ বিষয়ও আলোচনা করলাম। মিস্টার ফাহমী, মিস্টার নূর মোহাম্মদ (দিল্লি থেকে এসেছেন) এবং আরও কয়েকজন ছাত্রনেতা তখন প্রতিষ্টানের কর্মকর্তা ছিলেন, তাঁরাও আমার সাথে একমত হলেন। আমি কয়েকদিন তাঁদের ল’কলেজ হোস্টেলে গিয়েও আলাপ করলাম। আমি তাঁদের বললাম, ‘যদিও আমি এখন আর ছাত্র প্রতিষ্টানে নাই, তবুও আপনারা
১৪১
যদি রাজি হন অল পাকিস্তান ছাত্র প্রতিষ্টান করতে, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগকে রাজি করাতে পারব’। তাঁরা রাজি হলেন এবং কিভাবে তা গঠন হবে সে পন্থাও ঠিক হল। তাঁরা একটা গঠনতন্ত্র লিখে আমাকে দিলেন। আমি তাঁদের কথা দিলাম ঢাকা যেয়েই ছাত্রলীগ নেতাদের মাঝে আমি পৌছে দিব আপনাদের মতামত। তারা আপনাদের কাছে চিঠি লিখবে এবং একসাথে পাঞ্জাব ও বাংলা থেকে ঘোষণা বের হবে।
এসময় একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেল। আমি একদিন মিয়া সাহেবের সাথে দেখা করতে পাকিস্তান টাইমসের অফিসে যাই। তখন প্রায় সকাল এগারটা। মিয়া সাহেব সেখানে নাই। আমি কিছু সময় দেরি করলাম। মিয়া সাহেব আসলেন না। আমার কাজ ছিল শহীদ সাহেবের সাথে। হাইকোর্টে যাব তাঁর সাথে দেখা করতে। যখন আমি বের হয়ে কিছুদূর এসেছি, তিন চারজন লোক আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, আমার বাড়ি কোথায়? আমি বললাম, ‘পূর্ব পাকিস্তানে’। হঠাৎ একজন আমার হাত, আর একজন আমার জামা ধরে বলল, ‘তোম পাকিস্তান কা দুশমন হ্যায়’। আরেকজন একটা হান্টার, অন্যজন একটা ছোরা বের করল। আমি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, ‘আপনারা আমাকে জানেন, আমি কে?’তারা বলল, ‘হ্যাঁ, জানতা হ্যায়’। আমি বললাম, ‘কথা শোনেন, কি হয়েছে বলুন, আর যদি লড়তে হয় তবে একজন করে আসুন’। একজন আমাকে ঘুষি মারল, আমি হাত দিয়ে ঘুষিটা ফিরালাম। অনেক লোক জমা হয়ে আছে। কয়েকজন ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে? আমি বললাম, ‘কিছুই তো জানি না। এদের কাউকেও চিনিও না। আমি পূর্ব বাংলা থেকে এসেছি। পাকিস্তান টাইমস অফিসে এসেছিলাম মিয়া সাহেবের সাথে দেখা করতে। এরা কেন আমাকে মারতে চায়, বুঝতে পারলাম না’। কয়েকজন ভদ্রলক ও কয়েকজন ছাত্রও ছিল। তারা ওদের কি যেন বলল, আর একজন ওদের ওপর রাগ দেখাল, ওরা সরে পড়ল। আমি ল’কলেজ হোস্টেলে গেলাম, কাজমীকে খবর দিতে। কাজমী ছিল না হোস্টেলে। একটা টাঙ্গা নিয়ে হাইকোর্টে আসলাম সোহরাওয়ারদী সাহেবের কাছে। কিছুই খেলাম না, ভীষণ রাগ হয়েছে। বিকালে তাঁর সাথে নবাব সাহেবের বাড়িতে যেয়ে সকল ঘটনা বললাম। শহীদ সাহেব নবাব সাহেবকে জানালেন। সন্ধ্যার পূর্বেই হোটেলে চলে এলাম। কাজমী সন্ধ্যার পরে হোটেলে এসে সবকিছু শুনে নিজেই সে জায়গায় চলে গেলে কয়েকজন ছাত্র নিয়ে এবং দোকানদারদের কাছে জিজ্ঞাসা করল। তারা বলেছিল যে, যারা আমাকে আক্রমণ করেছিল তারা ঐ জায়গার কেউ নয়। বাইরের কোথাও থেকে এসেছিল। বোঝা গেল মুসলিম লীগ ওয়ালাদের কাজ। এখানেও গুন্ডা লেলিয়ে দিয়েছে। লুন্দখোর আমাকে বলল, ‘সাবধানে থেকো’।
আমি এই ঘটনা আর কাউকে বললাম না। নবাব সাহেবকে পাঞ্জাবের বড় বড় সরকারি কর্মচারীরা সম্মান করত। আমার উপর আক্রমণের কথাটা সেখানেও পৌঁছে ছিল। আমার
১৪২
অসুবিধা ছিল ভাল উর্দু বলতে পারতাম না। আর সাধারণ পাঞ্জাবিরাও ভাল উর্দু বলতে পারে না। পাঞ্জাবি ও উর্দু মিলিয়ে একটা খিচুড়ি বলে। যেমন আমি বাংলা ও উর্দু মিলিয়ে খিচুড়ি বলতাম। এই সময় পাঞ্জাবে প্রগতিশীল লেখকদের একটা কনফারেন্স হয়। মিয়া সাহেব আমাকে যোগদান করতে অনুরোধ করলেন। আমি যোগদান করলাম। লেখক আমি নই, একজন অতিথি হিসাবে যোগদান করলাম। কনফাররেন্স দুই দিন চলল। লুন্দখোর সাহেবও যোগদান করেছিলেন, বেচারার গাড়িটা বাইরে রেখে সভায় যোগদান করেছিলেন; কে বা কারা গাড়িটায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। লুন্দখোর সাহেবের বাহনটাও নষ্ট হয়ে গেল। ইংরেজরা ১৯৪২ সালের আন্দোলনে তাঁর বাড়িটি পুড়িয়ে দিয়েছিল। কারণ, তখন তিনি সীমান্ত কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। জেল থেকে বের হয়ে মুসলিম লীগে যোগদান করেছিলেন। লুন্দখোর আমাকে বললেন, ‘লাহোরে এ সকল ঘটনা হয়ে থাকে, তবে আমি পাঠান, আমাকে এরা ভয় করে। সামনে কিছুই বলতে বা করতে সাহস পাবে না, তাই পিছন থেকে আঘাত করার চেষ্টা করছে’।
প্রায় এক মাস হয়ে গেল, আর কতদিন আমি এখানে থাকব? “ঢাকায় মওলানা সাহেব, শামসুল হক সাহেব এবং সহকর্মীরা জেলে আছেন। সোহরাওয়ারদী সাহেবকে বললাম। তিনি বললেন, “ঢাকায় পৌঁছার সাথে সাথেই তারা তোমাকে গ্রেফতার করবে। লাহোরে গ্রেফতার নাও করতে পারে”। আমি বললাম, “এখান থেকে গ্রেফতার করেও আমাকে ঢাকায় পাঠাতে পারে। কারণ লিয়াকত আলী সাহেবও ক্ষেপে আছেন। পূর্ব বাংলার সরকার নিশ্চয়ই চুপ করে বসে নাই। তারা কেন্দ্রীয় সরকারকে খবর পাঠিয়েছে পাঞ্জাব সরকারকে হুকুম দিতে। সে খবর এসে পৌঁছাতেও পারে। এখানেও আমি তো চুপ করে নাই। তাই যা হবার পূর্ব বাংলায় হোক, পূর্ব বাংলার জেলে ভাত পাওয়া যাবে, পাঞ্জাবের রুটি খেলে আমি বাঁচতে পারব না। রুটি আর মাংস খেতে খেতে আমার আর সহ্য হচ্ছে না। আর জেলে যদি যেতেই হবে, তাহলে আমার সহকর্মীদের সাথেই থাকব”। শহীদ সাহেব বললেন, তবে যাবার বন্দোবস্ত কর। কি করে কোন পথে যাবা, তিনি জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, “রাস্তা তো একটাই, পূর্ব পাঞ্জাব দিয়ে আমি যাব না। প্লেনে লাহোর থেকে দিল্লি যাব, সেখান থেকে ট্রেনে যাব । ভারতবর্ষ হয়ে যেতে হলে একটা পারমিটও লাগবে। ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার পারমিট দেওয়ার মালিক। লাহোরে তাদের অফিস আছে”। আমি আরও বললাম, “মিয়া সাহেবকে বলেছি, তিনি ডেপুটি হাইকমিশনারকে বলে দেবেন। কারণ, তাঁকে তিনি জানেন”। শহীদ সাহেব আমাকে প্রস্তুত হতে বললেন। এই সময় পূর্ব বাংলার সিএসএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কয়েকজন বন্ধু লাহোরের সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে ছিলেন। তাঁদের সাথে দেখা করতে গেলাম। অনেকের সাথে দেখা হল। একজন সরকারি দলের ছাত্রনেতা ছিলেন, তিনি বাংলা ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন। আমার
১৪৩
সাথে তাঁর পরিচয় ছিল। আমাকে বললেন, “আপনি আমার কাছে চা খাবেন।কারণ আমি বুঝতে পেরেছি লাহোরে এসে, যে বাংলা ভাষার দাবি আপনারা করেছিলেন তা ঠিক ছিল, আমিই ভুল করেছিলাম। বাঙালিদের এরা অনেকেই ঘৃণা করে”। আমি কোন আলোচনা করলাম না সেখানে বসে, কারণ সেটা উচিত না। এরা এখন সকলেই সরকারি কর্মচারী, কেউ কিছু মনে করতে পারেন।
আমি পারমিট পেলাম, দেরি হল না, কারণ মিয়া সাহেব বলে দিয়েছেন। পারমিটে ছিল, তিন দিনের মধ্যে ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে হবে। তিন দিনের বেশি ভারতবর্ষে থাকতে পারব না। আমি হিসাব করে দেখলাম, তিন দিনের মধ্যেই পূর্ব বাংলায় ঢুকতে পারব। শহীদ সাহেব আমার হোটেলের টাকা শোধ করে দিলেন, দিল্লি পর্যন্ত প্লেনের টিকিট কিনে দিলেন। তখন ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ ছিল পাকিস্তানে। আর সামান্য কিছু টাকা দিলেন, যাতে বাড়িতে পৌছাতে পারি। পাকিস্তানের টাকা বেশি নেওয়ার হুকুম নাই। বোধহয় তখন ছিল পঞ্চাশ টাকা পাকিস্তানী এবং পঞ্চাশ টাকা ভারতবর্ষের। ভারতবর্ষের টাকা পাওয়া কষ্টকর। সোহ্রাওয়ারদী সাহেব নবাব্জাদা জুলফিকারকে (নবাব সাহেবের ছোট ভাই) বললেন, আমাকে প্লেনে তুলে দিতে। কারণ, একটা খবর পেয়েছিলেন আমাকে গ্রেফতার করতে পারে এয়ারপোর্টে। আমাকে গ্রেফতার করলে যাতে শহীদ সাহেব তাড়াতাড়ি খবর পেতে পারেন, সেজন্যই তাকে সঙ্গে দেওয়া হয়। আমাকে নিয়ে তিনি এয়ারপোর্টে পৌছালেন। আমার মালপত্র আলাদা করে রাখল দেখলাম। আমাকে একজন কর্মচারী উপরের একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। আমার পারমিট দেখলেন। মালপত্র ভালভাবে তল্লাশি করলেন এবং বললেন, “আপনি এখানে বসুন, কোথাও যাবেন না”। নবাবজাদা জুলফিকার সাহেব আমার কাছে আসলেন এবং বললেন, “মনে হয় কিছু একটা করবে। প্লেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে কিন্তু প্লেন ছাড়ছে না”। প্যাসেঞ্জারদের একবার চড়তে দিল, আবার নামিয়ে নিয়ে আসল। বোধহয় উপরের হুকুমের প্রতীক্ষায় রয়েছে। নবাবজাদা খবর আনলেন এবং বললেন, আপনার ব্যাপার নিয়েই প্নেন দেরি হচ্ছে। এক ঘন্টা পর প্লেন ছাড়ার অনুমতি পেল আমাকে বলল, “আপনি যেতে পারেন”। আমি নবাবজাদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্লেনে উঠলাম এবং তাঁকে অনুরোধ করলাম , শহীদ সাহেবকে ঘটনাটা বলতে। আমি বুঝতে পারলাম, আমাকে যেতে দিবে, না আটক করবে, এই নিয়ে দেরি করছে। বোধহয় শেষ পর্যন্ত দেখল, বাংলার ঝঞ্ঝাট পাঞ্জাবে কেন? তিন দিনের মধ্যেই ভারত ত্যাগ করতে হবে। পূর্ব বাংলা সরকারকে খবর দিলেই আমাকে হয় দরশনায়, না হয় বেনাপোলে গ্রেফতার করতে পারবে। আমি যে ভারতবর্ষে থাকতে পারব না একথা পারমিটে লেখা আছে। কলকাতার সরকারি কর্মচারীরা খবর পেলে আমাকে কলকাতার জেলের ভাতও খাওয়াতে দ্বিধাবোধ করবে না, কারণ আমি শহীদ সাহেবের দলের মানুষ।
সোহরাওয়ারদী সাহেবকে ছেড়ে আসতে আমার খুব কষ্টই হচ্ছিল, কারণ জীবনের বহুদিন তাঁর সাথে সাথে ঘুরছি। তাঁর স্নেহ পেয়েছি এবং তাঁর নেতৃত্বে কাজ করেছি। বাংলাদেশে শহীদ সাহেবের নাম শুনলে লোকে শ্রদ্ধা করত, তাঁর নেতৃত্বে বাংলার লোক
১৪৪
পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়েছিল। যার একটা ইঙ্গিতে হাজার হাজার লোক জীবন দিতে দ্বিধাবোধ করত না, আজ তাঁর কিছুই নাই। মামলা না করলে তাঁর খাওয়ার পয়সা জুটছে না। কত অসহায় তিনি। তাঁর সহকর্মীরা-যারা তাঁকে নিয়ে গর্ববোদ করত, তারা আজ তাঁকে শক্র ভাবছে। কতদিনে আবার দেখা হয় কি করে বলব? তবে একোটা ভরসা নিয়ে চলেছি, নেতার নেতৃত্ব আবার পাব। তিনি নীরবে অত্যাচার সহ্য করবেন না, নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করবেন। পূর্ব বাংলায় আমরা রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করতে পারব এবং মুসলিম লীগের স্থান পূর্ব বাংলায় থাকবে না, যদি একবার তিনি আমাদের সাহয্য করেন। তাঁর সাংগঠনিক শক্তি ও বলিষ্ট নেতৃত্ব জাতি আবার পাবে।
দিল্লি পৌছালাম এবং সোজা রেলস্টেশনে হাজির হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর ওয়েটিংরুমে মালপত্র রাখলাম। গোসল করে কিছু খেয়ে নিয়ে মালপত্র দারোয়ানের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।। টিকিট কিনে নিয়েছি। রাতে ট্রেন ছাড়বে। অনেক সময় হাতে আছে। আমি একটা টাঙ্গা ভাড়া করে জামে মসজিদের কাছে পৌছালাম। গোপনে গোপনে দেখতে চাই মুসলমানদের অবস্থা। পার্টিশনের সময় এক ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল এই দিল্লিতে। দেখলাম, মুসলমানদের কিছু দোকান আছে। কারও সাথে আলাপ করতে সাহস হচ্ছিল না। হাঁটতে হাঁটতে লালকেল্লায় গেলাম। পূর্বেও গিয়েছি, হিন্দুস্তানের পতাকা উড়ছে। ভিতরে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। মুসলমানদের অনেক দোকান ছিল পূর্বে, এখন দু’একটা ছাড়া নাই। বেশি সময় থাকতে ইচ্ছা হল না। বেরিয়ে আসলাম, আর একটা টাঙ্গা নিয়ে চললাম এংলো এরাবিয়ান কলেজের দিকে, যেখানে ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগ কনভেনশনে যোগদান করেছিলাম।
নতুন দিল্লিও ঘুরে দেখলাম। নতুন দিল্লি এখন আরও নতুন রূপ ধারণ করেছে। ভারতবর্ষের রাজধানী। শত শত বৎসর মুসলমানরা শাসন করেছে এই দিল্লি থেকে, আজ আর তারা কেউই নাই। শুধু ইতিহাসের পাতায় স্বাক্ষর রয়ে গেছে। জানি না যে স্মৃতিটুকু আজও আছে, কতদিন থাকবে! যে উগ্র হিন্দু গোষ্টী মহাত্মা গান্ধীর মত নেতাকে হত্যা করতে পারে, তারা অন্য সম্প্রদায়কে সহ্য করতে পারবে কি না? এই দিল্লিতেই মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত নেহেরু ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। খোদা শহীদ সাহেবকে রক্ষা করেছিলেন। নাথুরাম গডসের সহকর্মী মহাত্মা গান্ধী হত্যা মামলার সাক্ষী হিসাবে জবানবন্দিতে এই কথা স্বীকার করেছিল।
আমি রাতের ট্রেনে চড়ে বসলাম। আমার সিট রিজার্ভ ছিল। দ্বিতীয় শ্রেণীতে আরও তিনজন ভদ্রলোক ছিলেন। কারও সাথে আলাপ করতে সাহস হল না। একটা কাগজ নিয়ে পড়তে লাগলাম। তখনও ভারতবর্ষে মাঝে মাঝে গোলমাল চলছিল। তবে মহাত্মাকে হত্যা করার পর কংগ্রেস সরকার বাধ্য হয়েছিল সাম্প্রদায়িক আরএসএস ও হিন্দু মহাসভার
১৪৫
কর্মীদের উপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। মহাত্মা গান্ধী যে মুসলমানদের রক্ষা করবার জন্য জীবন দিলেন তাঁর জন্য তাঁর ভক্তদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। তারা মুসলমানদের সাথে ভাল ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে দেখি দুইজন প্যাসেঞ্জার নেমে গেছেন, একজন আছেন। তিনি পশ্চিম বাংলার লোক। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কোথা থেকে এসেছি? কোথায় যাব? আমি সত্য কথাই বললাম। লাহোর থেকে এসেছি, পূর্ব বাংলায় যাব। আমার বাড়ি ফরিদপুর জেলায়। ভদ্রলোক বললেন, “আমার বাড়িও বরিশাল জেলায় ছিল। এখন চাকরি করি দিল্লিতে”। অনেক আলাপ হল, পূর্ব বাংলার মাছ ও তরকারি, পূর্ব বাংলার আলো-বাতাস। আর জীবনে যেতে পারবেন না বলে আফসোস করলেন, কেউই নাই তাঁর এখন বরিশালে। ভদ্রলোক আমাকে হাওড়ায় নেমে যেতে বললেন, “আপনি আমার বাড়িতে রাতে থাকতে পারেন, কোনো অসুবিধা হবে না”। আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, “কাল সকালে চলে যেতে হবে, সেজন্য রাতটা এক বন্ধুর বাড়িতে থাকব”।
কোথায় যাব ভাবলাম? হোটেলে থাকব না। বন্ধু খন্দকার নূরুল আলমের বাসা চিনি, তার কাছেই যাব। নূরুল আলমের বাড়ি পার্ক সার্কাসে আসলাম। ওর ভাই বাসায় আছে, আলম নাই, বাইরে গেছে। আমাকে খুব যত্ন করে গ্রহণ করল। কিছু সময়ের মধ্যে নূরুল আলম এল। আমাকে পেয়ে কত খুশি। একসাথে খেলাম, তারপর বেড়ালাম। আলম বলল, “কি করি একেবারে একা পড়ে গেছি। বন্ধুবান্ধবও নাই, ঢাকা যেয়েই বা কি হবে? টাকা নাই যে ব্যবসা করব? চাকরি তো নূরুল আমিন সাহেবরা দিবে না, কারণ আমি তো শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেবের দলের লোক ছিলাম”। আমি তাকে কিছুই বলতে পারলাম না, কারণ আমি তাকে আসতে বলব কি অধিকারে। আমারই তো কোনো ঠিক নাই, আগামীকালই জেলের ভাত কপালে থাকতে পারে। তবে নূরুল আলম বলল যে, সে পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনার অফিসে একটা চাকরির জন্য দরখাস্ত করেছে।
টেলিফোন করে জানলাম সকাল এগারটায় খুলনার ট্রেন ছাড়ে, প্রায় সন্ধ্যায় বেনাপোলে পৌঁছে এবং রাত দশটায় খুলনা পৌঁছে। ইন্টারক্লাস টিকিট কাটলাম। কারণ বেনাপোলে আমাকে পুলিশের চোখে ধুলা দিতে চেষ্টা করতে হবে। পূর্ব বাংলা সরকারও খবর রাখে- আমি দু’একদিনের মধ্যে পৌছাব। গোয়েন্দা বিভাগ ব্যস্ত আছে, আমাকে গ্রেফতার করবার জন্য। আমিও প্রস্তুত আছি, তবে ধরা পড়ার পূর্বে একবার বাবা-মা, ভাইবোন, ছেলেমেয়েদের সাথে দেখা করতে চাই। লাহোর থেকে রেণুকে চিঠি দিয়েছিলাম, বোধহয় পেয়ে থাকবে। বাড়ির সকলেই আমার জন্য ব্যস্ত। ঢাকায়াও যাওয়া দরকার, সহকর্মীদের সাথে আলাপ করতে হবে। আমি গ্রেফতার হওয়ার পর যেন কাজ বন্ধ না হয়। কিছু অর্থের বন্দোবস্তও করতে হবে। টাকা পয়সার খুবই অভাব আমাদের। আমি কিছু টাকা তুলতে পারব বলে মনে হয়। সোহরাওয়ারদী সাহেবের কয়েকজন ভক্ত আছে, যাদের আমি জানি, গেলে একেবারে ‘না’ বলতে পারবে না। রানাঘাট এসে গাড়ি থামল অনেকক্ষণ। ভারতবর্ষের কাস্টমস অফিসাররা গাড়ি ও প্যাসেঞ্জারদের মালপত্র তল্লাশি করল, কেউ কোনো নিষিদ্ধ
১৪৬
মালপত্র নিয়ে যায় কি না? আমার মালপত্রও দেখল। সন্ধ্যা হয় হয়, ঠিক এই সময় ট্রেন বেনাপোল এসে পৌছাল। ট্রেন থামবার পূর্বেই আমি নেমে পড়লাম। একজন যাত্রীর সাথে পরিচয় হল। তাকে বললাম, আমার মালগুলি পাকিস্তানের কাস্টমস আসলে দেখিয়ে দিবেন, আমার একটু কাজ আছে। আসতে দেরিও হতে পারে। অন্ধকার দেখে একটা গাছের নিচে আশ্রয় নিলাম। এখানে ট্রেন অনেকক্ষণ দেরি করল। গোয়েন্দা বিভাগের লোক ও কিছু পুলিশ কর্মচারী ঘোরাফেরা করছে, ট্রেন দেখছে তন্নতন্ন করে। আমি একদিক থেকে অন্যদিক করতে লাগলাম। একবার ওদের অবস্থা দেখে ট্রেনের অন্য পাশে গিয়ে আত্মগোপন করলাম। ফাঁকি আমাকে দিতেই হবে। মন চলে গেছে বাড়িতে। কয়েকমাস পূর্বে আমার বড় ছেলে কামালের জন্ম হয়েছে, ভাল করে দেখতেও পারি নাই ওকে। হাচিনা তো আমাকে পেলে ছাড়তেই চায় না। অনুভব করতে লাগলাম যে, আমি ছেলে মেয়ের পিতা হয়েছি। আমার আব্বা ও মাকে দেখতে মন চাইছে। তাঁরা জানেন, লাহোর থেকে ফিরে নিশ্চয়ই একবার বাড়িতে আসব। রেণু তো নিশ্চয়ই পথ চেয়ে বসে আছে। সে তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্ত কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে।
মওলানা সাহেব, শামসুল হক সাহেব ও সহকর্মীরা জেল অত্যাচার সহ্য করছেন। তাঁদের জন্য মনটাও খারাপ। কিছু করতে না পারলেও তাঁদের কাছে যেতে পারলে কিছুটা শান্তি তো পাব। ট্রেন ছেড়ে দিল, আস্তে আস্তে ট্রেন চলছে, আমি এক দৌড় দিয়ে এসে ট্রেনে উঠে পড়লাম। আর এক মিনিট দেরি হলে উঠতে পারতাম কি না সন্দেহ ছিল। ট্রেন চলল, যশোরেও হুঁশিয়ার হয়ে থাকতে হবে। রেলস্টেশনে যে গোয়েন্দা বিভাগের লোক থাকে, আমার জানা আছে। যশোরে ট্রেন থামবার কয়েক মিনিট পূর্বেই আমি পায়খানায় চলে গেলাম। আর ট্রেন ছাড়লে বের হয়ে আসলাম। একজন ছাত্র আমার কামরায় উঠে বসে আছে। আমি পায়খানা থেকে বের হয়ে আসতেই বলল, “আরে, মুজিব ভাই”। আমি ওকে কাছে আসতে বললাম এবং আস্তে আস্তে বললাম, “আমার নাম ধরে ডাকবা না”। সে ছাত্রলীগের সভ্য ছিল, বুঝতে পেরে চুপ করে গেল। অনেক যাত্রী ছিল, বোধহয় কেউ বুঝতে পারে নাই। আর আমাকে তখন বেশি লোক জানত না। ছাত্রটি পথে নেমে গেল।
খুলনার অবস্থা আমার জানা আছে। ছোটবেলা থেকে খুলনা হয়ে আমাকে যাতায়াত করতে হয়েছে। কলকাতায় পড়তাম, খুলনা হয়ে যেতে আসতে হত, রাত দশটা বা এগারটায় হবে এমন সময় খুলনায় ট্রেন পৌছাল। সকল যাত্রী নেমে যাওয়ার পরে আমার পাঞ্জাবি খুলে বিছানার মধ্যে দিয়ে দিলাম। লুঙ্গি পরা ছিল, লুঙ্গিটা একটু উপরে উঠিয়ে বেঁধে নিলাম। বিছানাটা ঘাড়ে, আর সুটকেসটা হাতে নিয়ে নেমে পড়লাম। কুলিদের মত ছুটতে লাগলাম, জাহাজ ঘাটের দিকে। গোয়েন্দা বিভাগের লোক তো আছেই। চিনতে পারল না। আমি রেলরাস্তা পার হয়ে জাহাজ ঘাটে ঢুকে পড়লাম। আবার অন্য পথ দিয়ে রাস্তায় চলে এসে একটা রিকশায় মালপত্র রাখলাম। পাঞ্জাবিটা বের করে গায়ে
১৬৩
দিলাম। রিকশাওয়ালা গোপালগঞ্জের লোক, আমাকে চিনতে পেরে বলল, “ভাইজান না, কোথা থেকে এইভাবে আসলেন”। আমি বললাম, “সে অনেক কথা, পরে বলব। রিকশা ছেড়ে দাও”। ওকে কিছুটা বলব, না বলে উপায় নাই। গোপালগঞ্জের লোক, কাউকেও বলবে না, নিষেধ করে দিলে।
আমার এক ভাই ছিল, সে খুলনায় চাকরি করত। তার বাসায় পৌছালাম, ঠিকানা জানতাম। রিকশাওয়ালাকে দিয়েই আমার মামাকে খবর দিলাম। মামা খুব চালু লোক। সকাল ছয়টায় জাহাজ ছাড়বে। মামাকে জাহাজ ঘাটে পাঠিয়ে দিয়ে তার নামে প্রথম শ্রেণীতে দুইটা সিট রিজার্ভ করালাম যাতে অন্য কেউ আমার কামরায় না উঠে। আমার এক বন্ধু ছিল, জাহান কোম্পানিতে চাকরি করত, তাকে খবর দিলাম। সে বলল যে, জাহাজ ছাড়বার ঠিক দুই মিনিট আগে যেন আমি জাহাজে উঠি। জাহাজে ওঠার সাথে সাথে সে জাহাজ ছেড়ে দেবার বন্দোবস্ত করবে। জাহাজ ঘাটেও গোয়েন্দাদের আমদানি আছে। দুঃখের বিষয় কুয়াশা পড়ায় জাহাজ আসতে দেরি হয়েছিল এবং ছাড়তেও দেরি হবে, প্রায় এক ঘণ্টা অর্থাৎ সকাল সাতটায়। মহাবিপদ! ছয়টায় তো একটু অন্ধকার থাকে, সাতটায় সূর্য উঠে যায়। মামা পূর্বেই মালপত্র নিয়ে উঠে কামরা ঠিক করে রেখেছে। আমি কাছেই এক দোকানে চুপটি করে বসেছিলাম। খুলনার গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা আমাকে চিনে। মামার সাহায্যে আমি প্যান্ট, কোট ও মাথায় হ্যাট লাগ্যে অন্য রূপ ধরেছি। যখন দুইটা সিঁড়ি টেনেছে আর দুইটা বাকি আছে, আমি এক দৌড়ে উঠে পড়লাম। দেখলাম আমার বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে ঘাটে। উঠার সাথে সাথে ওই দুইটা সিঁড়িও টেনে নিল এবং জাহাজ ছেড়ে দিল। দুইজনের চোখে চোখে আলাপ হল, আমি আমার চক্ষু দিয়েই কৃতজ্ঞতা জানালাম।
এবার আশা হল, বাড়ি পর্যন্ত পৌছাতে পারব। আমি কামরাতেই শুয়ে রইলাম। খাবার জিনিস কামরায় আনিয়ে নিলাম। আমি যে জাহাজে উঠেছি অনেকে দেখে ফেলেছে। এই জাহাজই গোপালগঞ্জ হয়ে বরিশাল ও নারায়ণগঞ্জ যায়। গোপালগঞ্জের লোক অনেক ছিল। গোপালগঞ্জ টাউনে জাহাজ যায় না, তিন মাইল দূরে মানিকদহ নামক স্থানে নতুন ঘাট হয়েছে সেখানে থামে। নদী ভরাট হয়ে গেছে। মানিকদহ ঘাটে যখন জাহাজ ভিড়েছে, তখন আমি জানালা দিয়ে চুপটি করে দেখছিলাম। ঘাট থেকে রহমত জান ও ইউনুস নামে দুইজন ছাত্র, যারা খুব ভাল করমী-আমার চোখ দেখেই চিনতে পেরে চিৎকার করে উঠেছে। আমি ওদের ইশারা করলাম, কারণ খবর রটে গেলে আবার পুলিশ গ্রামের বাড়িতে যেয়ে হাজির হবে। রহমত জান ও ইউনুস বরিশাল কলেজে পড়ে। এই জাহাজেই বরিশাল যাবে। ওরা সোজা আমার কাছে চলে এল। জাহাজ ছেড়ে দিয়েছে। আমি ওদের বললাম, “তোমরা চিনলা কেমন করে?” ওরা বলে, “ও চোখ আমাদের বহু পরিচিত”। আমি বললাম, “পুলিশ খবর পেলে রাস্তায় গ্রেফতার করতে চেষ্টা করতে পারে”। ওরা বলে, “ভাইজান, এটা গোপালগঞ্জ; এখান থেকে ইচ্ছা না করলে ধরে নেওয়ার ক্ষমতা কারও নাই”। গোপালগঞ্জের মানুষ বিশেষ করে ছাত্র ও যুবকরা আমাকে ‘ভাইজান’ বলে ডাকে। এমনও আছে, ছেলেও ‘ভাইজান’ বলে, আবার বাবাও ‘ভাইজান’ বলে ডাকে। গোপালগঞ্জ থেকে আমার বাড়ির
১৬৪
নিকটবর্তী জাহাজ ঘাটে যেতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগে। সন্ধার সময় আমাদের জাহাজ ঘাট পাটগাতি পৌছালাম। নৌকায় প্রায় এক ঘন্টা লাগবে। বাড়িতে পৌছালাম, কেউ ভাবতেও পারে নাই আমি আসব। সকলেই খুব খুশি। মেয়েটা তো কোল থেকে নামতেই চায় না, ার ঘুমাতেও চায় না। আব্বাকে বললাম সকল কথা। বাড়িতে পাহারা রাখলাম। বৈঠকখানায় রাতভর লোক জেগে থাকবে, যদি কেউ আসে আমাকে খবর দেবে। আমাদের বাড়ি অনেক বড় এবং অনেক লোক। এখন গ্রেফতার হতে আমার বেশি আপত্তি নাই। তবে ঢাকা যাওয়া দরকার একবার। বেশি দিন যে বাড়ি থাকা চলবে না, তা আব্বা ও রেণুকে বুঝিয়ে বললাম। বোধহয় সাত-আট দিন বাড়িতে রইলাম। বললাম, “বরিশাল হয়ে জাহাজ যায়, এ পথে যাওয়া যাবে না; আর গোপালগঞ্জ হয়েও যাওয়া সম্ভবপর নয়। পথে গ্রেওফতার করে ফেলতে পারে। আমি গোপালগঞ্জের দুই ঘাট পরে জাহাজে উঠব। তারপর কবিরাজপুর থেকে নৌকায় মাদারীপুর মহকুমার শিবচর থেকে জাহাজে উঠব। দু’একদিন আমার বড়বোনের বাড়িতে বেড়িয়ে যাব”। বড়বোনের বাড়ি শিবচর থেকে মাত্র পাঁচ মাইল পথ। রেণু বলল, “কতদিন দেখা হবে না বলতে পারি না। আমিও তোমার সাথে বড়বোনের বাড়িতে যাব, সেখানেও তো দু’একদিন থাকবা। আমি ও ছেলেমেয়ে দুইটা তোমার সাথে থাকব। পরে আব্বা যেয়ে আমাকে নিয়ে আসবেন”। আমি রাজি হলাম, কারণ আমি তো জানি, এবার আমাকে বন্দি করলে সহজে ছাড়বে না। নৌকায় এতদূর যাওয়া কষ্টকর। আমরা বিদায় নিয়ে রওয়ানা করলাম। দুইজন কর্মী আমার সাথে চলল। একজনের নাম শহীদুল ইসলাম, আরেকজনের নাম সিরাজ। ওরা স্কুলের ছাত্র ছিল, আমাকে ভীষণ ভালবাসত। এখন দুইজনই ব্যবসায়ী। শহীদ আজও আমাকে ভালবাসে এবং রাজনীতিতে আমাকে অন্ধভাবে সমর্থন করে। সিরাজ অন্য দল করলেও আমাকে শ্রদ্ধা করে। এরা কবিরাজপুর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল এবং রাতভর পাহারা দিয়েছিল। শীতের দিন ওরা এক কাপড়ে এসেছিল। রেণু নিজের গায়ের চাদর ওদের দিয়েছিল।
আমরা বোনের বাড়িতে পৌছালাম, একদিন দুই দিন করে সাত দিন সেখানে রইলাম। ছেলেমেয়েদের জন্য যেন একটু বেশি মায়া হয়ে উঠেছিল। ওদের ছেড়ে যেতে মন চায় না, তবুও তো যেতে হবে। দেশ সেবায় নেমেছি, দয়া মায়া করে লাভ কি? দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে। আব্বা আমাকে কিছু টাকা দিয়েছিলেন। আর রেণুও কিছু টাকা নিয়ে এসেছিল আমাকে দিতে। আমি রেণুকে বললাম, “এতদিন একলা ছিলে, এখন আরও দু’জন তোমার দলে বেড়েছে। আমার দ্বারা তো কোনো আর্থিক সাহায্য পাবার আশা নাই। তোমাকেই চালাতে হবে। আব্বার কাছে তো সকল সময় তুমি চাইতে পার না, সে আমি জানি। আর আব্বাই বা কোথায় এত টাকা পাবেন? আমার টাকার বেশি দরকার নাই। শীঘ্রই গ্রেফতার করে ফেলবে। পালিয়ে বেড়াতে আমি পারব না। তোমাদের সাথে কবে আর দেখা হয় ঠিক নাই। ঢাকা এস না। ছেলেমেয়েদের কষ্ট হবে। মেজোবোনের বাসায়ও জায়গা খুব কম। কোনো আত্মীয়দের আমার জন্য কষ্ট হয়, তা আমি চাই না। চিঠি লিখ, আমিও লিখব”।
১৬৫
রাতে রওয়ানা করে এলাম, দিনেরবেলায় আসলে হাচিনা কাঁদবে। কামাল তো কিছু বোঝে না। শিবচরে জাহাজ আসে না, চান্দেরচর যেতে হবে, প্রায় দশ মাইল। আমার বড়বোনের দেবর, আমারও বিশিষ্ট বন্ধু ও আত্মীয় সাইফুদ্দিন চৌধুরী সাহেব আমাকে ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। রেণু আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় নীরবে চোখের পানি ফেলছিল। আমি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম না, একটা চুমা দিয়ে বিদায় নিলাম। বলবার তো কিছুই আমার ছিল না। সবই তো ওকে বলেছি। রাতে নৌকা ছেড়ে সকালে চান্দেরচর স্টেশনে পৌছালাম। জাহাজ ছাড়তে দেরি আছে। আমার এক সহকর্মীর বাড়ি নিকটেই। তাকে খবর দিলাম, তার নাম সামাদ মোড়ল। সামাদ খবর পেয়ে ছুটে এল। তাদের বাড়ি নিয়ে খাবার জন্য অনেক অনুরোধ করল, কিন্ত সময় ছিল না। ফেরি স্টিমার তারপাশা পর্যন্ত যায়; তারপর আবার তো গোয়ালন্দ-নারায়ণগঞ্জ মেল স্টিমারে উঠতে হবে। তারপাশা পৌঁছে শুনলাম, মেল কিছু সময় হল ছেড়ে গেছে। ফলে সারা দিন আমাদের থাকতে হল। অনেক রাতে আর একটা জাহাজ আসবে তাতে যেতে পারব। উপায় না, জাহাজ ঘাটের প্লাটফর্মে বসে থাকতে হবে।
পরের দিন সকালবেলায় মুন্সিগঞ্জ পৌছালাম। জাহাজে একজন ছাত্রলীগ কর্মীর সাথে দেখা হয়ে গেল। সে সবকিছু জানত, তার কাছে আমাদের দুইজনের মালপত্র দিয়ে বললাম, “১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে শওকত মিয়ার কাছে চুপ করে পৌঁছে দিতে। নারায়ণগঞ্জ দিনেরবেলায় নামলে আর ঢাকা যেতে হবে না, সোজা জেলখানায়। পরোপকারী শওকত মিয়া যেন আমার জন্য থাকার বন্দোবস্ত করে রাখে। আর যদি পারে সন্ধ্যার সময় যেন নারায়ণগঞ্জে খান সাহেব ওসমান আলীর বাড়িতে আসে। খান সাহেবের বড় ছেলে শামসুজ্জোহাকেও খবর দিতে বলো। সন্ধ্যায় যেন সে বাড়িতে থাকে”।
আমরা মুন্সিগঞ্জে নেমে মীরকাদিম হেঁটে আসলাম। সেখানে এক আত্মীয়ের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করে সন্ধ্যার একটু পূর্বে নৌকায় নারায়ণগঞ্জ রওয়ানা করলাম। সন্ধ্যার পরে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছে রিকশা নিয়ে সোজা খান সাহেবের বাড়িতে পৌছালাম। জোহা সাহেব খবর পায় নাই, তার ছোট ভাই মোস্তফা সারোয়ার তখন স্কুলের ছাত্র। আমাকে জানত। তাড়াতাড়ি জোহা সাহেবকে খবর দিয়ে আনল। আমরা ভিতরের রুমে বসে বসে চা-নাশতা খেলাম। খান সাহেবের বাড়ি ছিল আমাদের আস্তানা। ক্লান্ত হয়ে এখানে গেলেই যা কোনো কর্মীর খাবার ও থাকার ব্যবস্থা হত। ভদ্রলোকের ব্যবসা-বাণিজ্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কিন্ত প্রাণটা ছিল অনেক বড়। জোহা সাহেব এসেই ট্যাক্সি ভাড়া করে আনল, আমাদের তুলে দিল। শওকত মিয়ার জন্য একটু দেরিও করেছিলাম। আমরা ঢাকায় রওয়ানা করার কয়েক মিনিট পরে শওকত মিয়াও নারায়ণগঞ্জ এসে পৌছাল এবং আমাদের চলে যাবার খবর পেয়ে আবার ঢাকায় ছুটল। আমরা পথে ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে রিকশা নিয়ে মোগলটুলী পৌছালাম। দেখি আমাদের মালপত্র পৌঁছে গেছে। শওকত মিয়াও এসে পৌঁছে গেছে। শওকত মিয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মুজিব ভাই, কি করে লাহোরে
১৬৬
পৌছালেন, আর কি করে ফিরে এলেন, বলুন শুনি”। আমি বললাম, “প্রথমে বলেন, মওলানা সাহেব ও হক সাহেব কেমন আছেন? কে কে জেলে আছে। আওয়ামী লীগের খবর কি? শওকত মিয়া যা বলল তাতে দুঃখই পেলাম, কিন্ত অখুশী হলাম না।
আওয়ামী লীগে যে ভদ্রলোকদের মওলানা সাহেব কার্যকরী কমিটির সভ্য করেছিলেন তাঁদের মধ্যে থেকে প্রায় বার-তেরজন পদত্যাগ করেছেন ভয় পেয়ে। যারা অনেক দিনের পুরানা নেতা ছিলেন, তাঁরা শুধু পদত্যাগই করেন নাই, বিবৃতি দিয়ে পদত্যাগ করেছেন, যাতে গ্রেফতার না হতে হয়। শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক সাহেব সদস্য হওয়ার পরপরই একদিন মওলানা সাহেব ও আমাদের সাথে আলাপ করলেন এবং বললেন, “আমি আর্থিক অসুবিধায় আছি। এডভোকেট জেনারেলের চাকরিটা নিচ্ছি। আমার পক্ষে রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা সম্ভব হবে না। আপাতত আমি সদস্য থাকব না। তবে আমার দোয়া ও সমর্থন রইল”। আমরা তাঁর অসুবিধা বুঝতে পারলাম। তিনি কষ্ট করে সভায়ও একদিন এসেছিলেন। এই সময় দেখা গেল আওয়ামী লীগে মওলানা ভাসানী, শামসুল হক সাহেব, আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম খান, আনোয়ারা খাতুন এমএলএ, খয়রাত হোসেন এমএলএ, আলী আহমদ খান এমএলএ, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, ইয়ার মোহাম্মদ খান, নারায়ণগঞ্জের আবদুল আউয়াল, আলমাস আলী ও শামসোজ্জোহা এবং আমি ও আরও কয়েকজন রইলাম, যাদের নাম আমি মনে করতে পারছি না।
শওকত মিয়া আমার জন্য থাকার বন্দোবস্ত করেছে। রাতে সেখানে কাটালাম। দিনে ঘরে থাকি, রাতে সকলের সাথে দেখা করি। কি করা যায় সেই সম্বন্ধে পরামর্শ করি। মানিক ভাই মোগলটুলীতেই আছে, কি করবেন, ঠিক করতে পারছেন না। আবদুল হালিমও আমাকে কয়েকদিন রাখল ওর বাড়িতে। কয়েকজন ভদ্রলোক ওয়াদা করেছিলেন কিছু টাকা বন্দোবস্ত করে দিবেন। একদিন রাতে হঠাৎ আমার এক বন্ধু বড় সরকারি কর্মচারীরা বাড়িতে পৌছালাম, আমাকে দেখে তো অবাক হয়ে গেলেন। তিনি ভয় পাওয়ার লোক ছিলেন না। আমাকে খুবই ভালবাসতেন। তিনি আমাদের অবস্থা জানতেন, তাঁর সহানুভুতিও ছিল আমাদের উপরে। আমি আবদুল হামিদ চৌধুরী ও মোল্লা জালালউদ্দিনকে বললাম, তোমাদের কাছেই থাকব। তারা তখন আলী আমজাদ খান সাহেবের পুরানা বাড়ি খাজে দেওয়ানে নিচের তলায় থাকত। আমি চলে আসলাম ওদের কাছে। দিনভর বই পড়তাম, রাতে ঘুরে বেড়াতাম। ঠিক হল, আরমানিটোলা ময়দানে একটা সভা ডাকা হবে। আমি সেখানে বক্তৃতা করব এবং গ্রেফতার হব। যখন সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে, দু’একদিনের মধ্যে সভা ডাকা হবে, দুপুরবেলা বসে আছি, দেখি পুলিশ বাড়ি ঘেরাও করেছে। দুইজন গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারী সাদা পোশাক পরে ভিতরে আসছেন। আমি যে ঘরে থাকি, সেই ঘরে এসে দরজায় টোকা মারলেন। আমি বললাম, ভিতরে আসুন। তারা ভিতরে আসলে বললাম, “কয়েকদিন পর্যন্ত আপনাদের অপেক্ষায় আছি। বসুন, কিছু খেয়ে নিতে হবে। এখন বেলা দুইটা, কিছুই খাই নাই। খাবার আনতে গেছে”।
১৬৭
হামিদ খাবার আনতে গিয়েছিল হোটেল থেকে, পুলিশ দেখে খাবার নিয়ে ভেগে গেছে। ভদ্রলোকেরা কতক্ষণ দেরি করবে? হামিদ যখন আর আসছে না, জালালও বাইরে গেছে, কখন ফিরবে ঠিক নাই তাই আলী আমজাদ খান সাহেবের বড় ছেলে হেনরীকে খবর দিলাম। হেনরী ছুটে এসেছে। আমি যে কিছুই খাই নাই, একথা শুনে বাড়িতে যেয়ে খাবার নিয়ে আসল। কিছু খেয়ে নিলাম। হেনরীর ছোট ভাই শাহজাহান, বোধহয় সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে, সেও এসেছে এবং তার মামুকে গালাগালি করতে শুরু করেছে। তার মামা এই বাড়ির দোতলায় থাকত। শাহজাহান বলতে লাগল, “আর কেউ পুলিশকে খবর দেয় নাই, মামাই দিয়েছে। বাবা বাড়িতে আসুক ওকে মজা দেখাব”। শাহজাহান আমাকে খুব ভালবাসত, সময় পেলেই আমার কাছে ছুটে আসত। আমি যখন পুলিশের গাড়িতে উঠে চলে যাই, শাহজাহান কেঁদে দিয়েছিল। আমার খুব খারাপ লেগেছিল। শাজাহানের ঐ কান্নার কথা কোনোদিন ভুলতে পারি নাই। পরে খবর পেয়েছিলাম, ওর মামাই টাকার লোভে আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিল। আলী আমজাদ সাহেব ও আনোয়ারা বেগম ওকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
আমাকে লালবাগ থানায় নিয়ে আসল। দুইজন আইবি অফিসার আমাকে ইন্টারোগেশন করতে শুরু করল। প্রায় দুই ঘন্টা পর্যন্ত সে পর্ব চলল। আমি বললাম, “আওয়ামী লীগ করব। আমি লাহোর গিয়েছিলাম কি না? কোথায় ছিলাম? কি কি করেছি? ঢাকায় কবে এসেছি? বাড়িতে কতদিন ছিলাম? ভবিষ্যতে কি করব? সোহরাওয়ারদী সাহেব কি কি বলেছেন? এইসব প্রশ্ন যে কথা বলার সেইটুকু বললাম, যা বলবার চাই না সে কথার উত্তর দিলাম না। আমাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার দেখাল এবং সন্ধ্যার পরে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে গেল। রাতে আমাকে থানায় রাখল। জালাল আমার সুটকেস ও বিছানা থানায় পৌঁছে দিল। সন্ধ্যার পরে আনোয়ারা খাতুন এমএলএ, আতাউর রহমান খান সাহেব আমার বিয়াই দত্তপাড়ার জমিদার শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী এমএলএ আমাকে দেখতে থানায় এসেছিলেন। রাতে জনাব সিদ্দিক দেওয়ান, বোধহয় তখন ইন্সপেক্টর ছিলেন, বাড়ির থেকে বিছানা, মশারি এনে দিলেন। আমার বিছানাও এসে গিয়েছিল, কোনো অসুবিধা হয় নাই। তিনি ও অন্যান্য পুলিশ কর্মচারী আমার সাথে খুবই ভাল ব্যবহার করেছিলেন, যাতে কোনো অসুবিধা না হয় তার দিকে সকলেই নজর দিয়েছিলেন।
পরের দিন দুপুরবেলায় আমাকে ঢাকা জেলে পাঠিয়ে দিল। আমি জেলে আসার পরে শুনলাম, আমাকে ডিভিশন দেয় নাই। সাধারণ কয়েদি হিসাবে থাকতে হবে। তখনও রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য কোনো স্ট্যাটাস্ব দেওয়া হয় নাই। যাকে ইচ্ছা ডিভিশন দিতে পারে সরকার, আর না দিলে কয়েদি হিসাবে জেল খাটতে হবে। সাধারণ কয়েদিরা যা খায় তাই খেতে হবে। দুপুরে কিছুই খেলাম না। আমাকে হাজতে রাখা হয়েছে সাধারণ কয়েদিদের সাথে। আরও দুই তিনজন রাজনৈতিক কর্মীও সেখানে ছিল। তারা আমাকে

১৬৮
তাদের কাছে নিয়ে রাখল। রাতে ওদের সাথেই কিছু খেলাম, কারণ খুবই ক্ষুধা পেয়েছিল। মওলানা সাহেব ও শামসুল হক সাহেব পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে আছেন। তাঁদের ডিভিশন দেওয়া হয়েছে। আমাকে ডিভিশন দেওয়া হয় নাই বলে তাঁদের কাছে রাখা হয় নাই।
খুব ভোরে একজন জমাদার সাহেব এসে বললেন, “চলুন আপনাকে অন্য জায়গায় নিতে হবে”। আমি বললাম, “কোথায় যেতে হবে বলেন, তারপর যাব”। তিনি বললেন, “আপনার ডিভিশন অর্ডার এসে গেছে রাতেই। মওলানা সাহেবের কাছে আপনাকে যাওয়ার হুকুম হয়েছে। এর বেশি আমি জানি না”। আমি অন্যদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। যে দুই তিনজন রাজনৈতিক কর্মী সেখানে ছিল তাদের নিরপত্তা আইনে গ্রেফতার করে নাই। মামলা আছে, দুই একদিনের মধ্যে জামিন পেয়ে যাবে বলে আশা করে। আমি মওলানা সাহেব ও শামসুল হক সাহেবের কাছে এলাম। একই রুমে আমরা থাকব। শামসুল হক সাহেবের কাছে বিছানা করলাম, কারণ আমি সিগারেট খাই। মওলানা সাহেবের সামনে সিগারেট খাই না।
১৯৪৯ সালের ডিসেম্ব্র মাসে আমি জেলে আসলাম। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হয়েছে। আমার তিনবার জেলে আসতে হল, এইবার নিয়ে। মওলানা সাহেবের কাছে সকল কিছুই বললাম। মওলানা সাহেব এক এক করে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। সোহরাওয়ারদী সাহেব কি বলেছেন? পীর মানকী শরীফের মতামত কি? মিয়া সাহেব রাজনীতি করবেন কি না? নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠন হবে কি না? হলে, কতদিন লাগবে? লাহোরে কোথায় ছিলাম? ঢাকার খবর কি? মওলানা সাহেবের কাছে শুনলাম, আমাদের বিরুদ্ধে একটা মামলা দায়ের করা হয়েছে। মওলানা সাহেব, শামসুল হক সাহেব, আবদুর রব, ফজলুল হক বিএসসি ও আমি আসামি। আবদুর রব ও ফজলুল হককে জামিন দিয়েছে। নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে নাই, তাই তারা বাইরে আছে। মামলা শুরু হয় নাই, কারণ আমাকে গ্রেফতার করেত পারে নাই। নাজিরা বাজারে পুলিশের সাথে ১১ই অক্টোবর তারিখে যে গোলমাল হয় তার উপর ভিত্তি করেই মামলা দায়ের হয়েছে।
যে কামরায় আমরা আছি সেখানে আমরা তিনজন ছাড়াও কয়েকজন ডিভিশন কয়েদি আছে। এদের কয়েকজনের বিশ বৎসর জেল, আর কয়েকজনের শাস্তি হয়েছে। এদের আর্থিক অবস্থা ভাল বলে সরকার ডিভিশন দিয়েছে এবং এরাও আমাদের মত খাট, মশারি, বিছানা, সাদা কাপড় পায়। এদের মধ্যে একজনের ম্যানেজার আছে, সে আমাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা এবং দেখাশোনা করে। আমাদের দিন ভালভাবেই কাটছিল। শামসুল হক সাহেব আমার উপর খুব রাগ করেছিলেন। কারণ, কেন আমি শোভাযাত্রা করতে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। শোভাযাত্রা না করলে তো গোলমাল হত না। আর আমাদের জেলে আসতে হত না এই সময়।
শামসুল হক সাহেব মাত্র দেড় মাস পূর্বে বিবাহ করেছিলেন। হক সাহেব ও তাঁর বেগম আফিয়া খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতেন। একে অন্যকে পছন্দ করেই বিবাহ করেছিলেন। আমাকে বেশি কিছু বললে আমি তাঁকে ‘বউ পাগল’ বলতাম। তিনি
১৬৯
ক্ষেপে আমাকে অনেক কিছু বলতেন। মওলানা সাহেব হাসতেন, তাতে তিনি আরও রাগ করতেন এবং মওলানা সাহেবকে কড়া কথা বলে ফেলতেন। মওলানা সাহেবের সাথে আমরা তিনজনই নামাজ পড়তাম। মওলানা সাহেব মাগরিবের নামাজের পরে কোরআন মজিদের অর্থ করে আমাদের বোঝাতেন। রোজই এটা আমাদের জন্য বাঁধা নিয়ম ছিল। শামসুল হক সাহেবকে নিয়ে বিপদ হত। এক ঘন্টার কমে কোনো নামাজই শেষ করতে পারতেন না। এক একটা সেজদায় আট-দশ মিনিট লাগিয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে চক্ষু বুজে বসে থাকতেন।
আমাদের মামলা শুরু হয়ে গেছে, পনের দিন পর পর কোর্টে যেতে হত। কোর্ট হাজতের বারান্দায় আমাদের চেয়ার দেওয়া হত। তাড়াতাড়ি আমাদের আবার পাঠিয়ে দিত।
অনেক সহকর্মী আমাদের সাথে দেখা করতে আসত। ছাত্রলীগ কর্মীরা প্রায় তারিখেই আসত। আতাউর রহমান সাহেব আমাদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করতেন। যেদিন হক সাহেবের সাথে তাঁর বেগম দেখা করতে আসতেন, সেদিন হক সাহেবের সাথে কথা বলা কষ্টকর হত। সত্যই আমার দুঃখ হত। দেড় মাসও একসাথে থাকতে পারল না বেচারী। একে অন্যকে যথেষ্ট ভালবাসত বলে মনে হয়। আমি বেগম হককে ভাবী বলতাম, ভাবী আমাকেও দু’একখানা বই পাঠাতেন। হক সাহেবকে বলে দিতেন, আমার কিছু দরকার হলে যেন খবর দেই। আমি ফুলের বাগান করতাম। তাদের দেখা হবার দিনে ফুল তুলে হয় ফুলের মালা, না হয় তোড়া বানিয়ে দিতাম। হক সাহেব জেলের আবদ্ধ অবস্থা আর সহ্য করতে পারছিলেন না।
তিনি এক নতুন উৎপাত শুরু করলেন। রাতে বারটার পরে জিকির করতেন। আল্লাহু, আল্লাহু করে জোরে জিকির করতে থাকতেন। এক ঘন্টা থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত। অনেক সময় মধ্যরাতেও শুরু করতেন। আমরা দশ-পনেরজন কেউই ঘুমাতে পারতাম না। প্রথম কয়েকদিন কেউ কিছু বলে নাই। কয়েদিরা দিনভর কাজ করে। তারা না ঘুমিয়ে পারে না। মওলানা সাহেবের কাছে গোপনে নালিশ করল এবং বলল এবাদত মনে মনে করলেও তো চলে, আমরা ঘুমাতে পারছি না। মওলানা সাহেব হক সাহেবকে বললেন, মনে মনে এবাদত করতে। হক সাহেব শুনলেন না। আমার খাট আর হক সাহেবের খাট পাশাপাশি। আমার পাশে জয়নামাজ বিছিয়ে তিনি শুরু করতেন। আধ ঘন্টা মাত্র ঘুমিয়েছি, হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। আর শুনতে পাই, কানের কাছে হক সাহেব জোরে জোরে জিকির করছেন। কি করব? আমার তো চুপ করে অত্যাচার সহ্য করা ছাড়া উপায় নাই। যখন আরম্ভ করেন একটানা দশ-পনের দিন পর্যন্ত চলে। একদিন দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পরে হক সাহেবকে বললাম, “এভাবে চলবে কেমন করে? রাতে ঘুমাতে না পারলে শরীরটা তো নষ্ট হয়ে যাবে”। তিনি রাগ করে বললেন, “আমার জিকির করেত হবে, যা ইচ্ছা কর। এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাও। আমি তখন কিছুই বললাম না, কিছু সময় পরে বললাম, রাতে যখন জিকির করবেন আমি উঠে আপনার মাথায় পানি ঢেলে দেব, যা হবার হবে। তিনি রাগ করলেন না, আস্তে আস্তে আমাকে বললেন, “বুঝতে পারছ না কিছুই, আমি সাধনা
১৭০
করছি। একদিন ফল দেখবা”। কি আর করা যাবে নীরবে সহ্য করা ছাড়া! হক সাহেবের শরীর খারাপ হয়ে চলেছে।
আমরা যখন জেলে তখন এক রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হল, কলকাতা ও ঢাকায়। কলকাতায় নিরপরাধ মুসলমান এবং ঢাকায় ও বরিশালে নরপরাধ হিন্দু মারা গেল। কে বা কারা রটিয়ে দিয়েছিল যে, শেরে বাংলা ফজলুল হক সাহেবকে কলকাতায় হত্যা করেছে। আর যায় কোথায়! মুসলমানরাও ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাঁদের অনেক লোককে গ্রেফতার করে আনল ঢাকা জেলে। আমরা যেখানে থাকি সেই পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডেই এদের দিনেরবেলায় রাখত। আমার মনে হয়, সাত-আটশত লোককে গ্রেফতার করেছে। আমি তাদের সাথে বসে আলাপ করতাম। সকলেই অপরাধী নয়, এর মধ্যে সামান্য কিছু লোকই দোষী। সাধারণত দোষী ব্যাক্তিরা গ্রেফতার বেশি হয় না। রাস্তার নিরীহ লোকই বেশি গ্রেফতার হয়। তাদের কাছে বসে বলি, দাঙ্গা করা উচিত না; যে কোনো দোষ করে না, তাকে হত্যা করা পাপ। মুসলমানরা কোনো নিরপরাধীকে অত্যাচার করতে পারে না, আল্লাহ ও রসুল নিষেধ করে দিয়েছেন। হিন্দুদেরও আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। তারাও মানুষ। হিন্দুস্তানের হিন্দুরা অন্যায় করবে বলে আমরাও অন্যায় করব-এটা হতে পারে না। ঢাকার অনে নামকরা গুণ্ডা প্রকৃতির লোকদের সাথে আলাপ হল, তারা অনেকেই আমাকে কথা দিল, আর কোনোদিন দাঙ্গা করবে না। জানি না, তারা আমার কথা রেখেছে কি না? তবে কয়েকজন যে আমার খুবই ভক্ত হয়ে গিয়েছিল তার প্রমাণ আমি জেল থেকে বের হয়ে পেয়েছি। এরা আমাকে রীতিমত ভক্তি করতে শুরু করেছে। আপদে বিপদে আমার পাশেও দাঁড়িয়েছে বিপদ ঘাড়ে নিয়ে। জেল কতৃপক্ষ আমাদের সাথে এদের মেলামেশা পছন্দ করছিল না। একদিন সকালে আমাদের এখান থেকে নিয়ে গেল নতুন বিশ নম্বর সেলে। সেলগুলি খুবই ভাল ছিল, নিচতলায় দশটা সে, আর উপরে দশটা সেল। মওলানা সাহেব দোতলায় একটা সেল নিলেন। আমাকে পাশের সেলে থাকতে বললেন। হক সাহেব আমার পাশের সেলে থাকবেন ঠিক করলেন এবং বললেন, “খুব ভাল হয়েছে। এখন আমি রাতভর জিকির করব, কেউ কিছু বলতে পারবে না”। আমি ভাবলাম, মহাবিপদ! তাঁকে বললাম, “হয় আপনি উপরে থাকেন, না হয় আমি উপরে থাকব। আমার পাশের সেল থেকে যদি শুরু করেন, তবে ঘুমের কাজ হয়েছে”। হক সাহেব রাতগ করে নিচে চলে গেলেন এবং এক পাশের একটা সেল নিলেন। আমি তাঁকে অনেক অনুরোধ করলাম, মওলানা সাহেবও বললেন, কিছুতেই শুনলেন না। এখন থেকে তিনি আরও জোরে জোরে জিকির করতে লাগলেন। আর তার উৎপাতে আমরা ঘুমাতে পারি না।
কয়েকদিন পরে হাজী দানেশ সাহেবকে ঢাকা জেলে এনে আমাদের সাথে রেখেছে। দুই দিন পরেই আবার তাঁকে আমাদে কাছ থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হল। কারণ, সরকারি হুকুমে আমাদের সাথে কাউকেও রাখা চলবে না। বিশেষ করে সরকারের মতে যারা কমিউনিস্ট, তাঁদের সাথে রাখা চলবে না। তাহলে আমরা যদি কমিউনিস্ট হয়ে যাই! জেলের মধ্যে আরও দুই-তিন জায়গায় রাজনৈতিক বন্দিদের রাখা হয়েছে,
১৭১
আলাদা আলাদা করে। এই প্রথম আমি সেলে থাকি। ‘জেলের মধ্যে জেল। তাকেই বলে সেল’। প্রায় দুই মাস পরে যখন দাঙ্গার আসামিরা প্রায়ই জামিন পেয়ে বাইরে গেছে, আর যে সামান্য কয়েকজন আছে তাদের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ড থেকে চার নম্বর ওয়ার্ডে নিয়ে গিয়েছে তখন আমাদের আবার পুরানা পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হল।
তিনতলা বিরাট দালান। তিনতলায় ছোট ছোট ছেলেদের রাখে। আর দো’তলার একপাশে আমরা থাকি, একপাশে জেলের অফিস। নিচের তলায় গুদাম। জেলে যে সমস্ত জিনিস তৈরি করে কয়েদিরা, তা এখানেই রাখে। পূর্ব বাংলার একমাত্র কম্বল ফ্যাক্টরি ঢাকা জেলের ভিতরে। কয়েদিরা সুন্দর সুন্দর কম্বল তৈরি করে। দর্জিদের একটা দল আছে। প্রায় একশত লোক কাজ করে এই দর্জি দফায়। পুলিশ, চৌকিদার ও সরকারের অন্যান্য বিভাগের ইউনিফর্ম এখানে তৈরি হয়। ঢাকা জেলের কাঠের মিস্ত্রিরা ভাল ভাল খাট, টেবিল, চেয়ার তৈরি করে। এখানে বেতের কাজও হয়। একজন ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট এই সকল কাজের দায়িত্ব নিয়ে আছেন। এই ডিপার্টমেন্টকে কয়েদিরা এক কথায় ‘এএসডি’ বলে থাকে। আমি নিচে বেড়াতাম এবং এই সমস্ত জিনিস দেখতাম। দোতলা থেকে নামলেই এই গুদাম। এর পাশেও একটা অফসি।
আমি একটা ফুলের বাগান শুরু করেছিলাম। এখানে কোনো ফুলের বাগান ছিল না। জমাদার সিপাহিদের দিয়ে আমি ওয়ার্ড থেকে ফুলের গাছ আনাতাম। আমার বাগানটা খুব সুন্দর হয়েছিল। এই ওয়ার্ডের দেয়ালের পাশেই সরকারি প্রেস ছিল। এটা জেলের একটা অংশ। ভিতরে দেওয়াল দিয়ে বাইরে একটা দরজা করে দেওয়া হয়েছে। প্রেসের শব্দ পেতাম, কিন্ত প্রেস দেখতে পারতাম না। সকালবেলা যখন কর্মচারীরা আসতেন এবং বিকালের ছুটির পর যখন যেতেন আমি জানালা দিয়ে তাঁদের দেখতাম। ওদের দেখলেই আমার মনে হত যে ওরা বড় জেলে, আর আমরা ছোট্ট জেলে আছি। স্বাধীন দেশের মানুষের ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই, এর চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কি হতে পারে?
পাকিস্তানের নাগরিকদের বিনা বিচারে বৎসরের পর বৎসর কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। ছয় মাস পর পর একটা হুকুমনামা সরকার থেকে আসে। ইংরেজ আমলেও রাজনৈতিক বন্দিদের কতগুলি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হত, যা স্বাধীন দেশে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক বন্দিদের খাওয়া-দাওয়া, কাপড়চোপড়, ঔষধ, খবরের কাগজ, খেলাধুলার সামগ্রী এমনকি এদের ফ্যামিলি এলাউন্সও দেওয়া হত ইংরেজ আমলে। নূরুল আমিন সাহেবের মুসলিম লীগ সরকার সেসব থেকেও বন্দিদের বঞ্চিত করেছেন। সাধারণ কয়েদি হিসাবে অনেককেই রাখা হয়েছিল। রাজনৈতিক বন্দিরা দেশের জন্য ও আদর্শের জন্য ত্যাগ স্বীকার করছে, একথা স্বীকার করতেও তারা আপত্তি করছেন। এমনকি মুসলিম লীগ নেতারা বলতে শুরু করেছে, বিদেশী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে জেল খাটলে সেটা হত দেশ দরদীর কাজ। এখন দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জেল খাটছে যারা, তারা হল ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’। এদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে না। ইংরেজের ‘স্যার’ ও ‘খান বাহাদুর’ উপাধিধারীরা সরকার গঠন করার সুযোগ পেয়ে আজ একথা বলছেন।
১৭২
জনাব লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং জনাব নূরুল আমিন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। এদের আমলে যে নির্যাতন ও নিপীড়ন রাজনৈতিক বন্দিদের উপর হচ্ছে তা দুনিয়ার কোনো সভ্য দেশে কোনোদিন হয় নাই। রাজনৈতিক বন্দিরা যাতে কারাগারের মধ্যে ইংরেজ আমলের সুযোগ-সুবিধাটুকু পেতে পারে তার জন্য অনেক দরখাস্ত, অনেক দাবি করেছে কিন্ত কিছুতেই সরকার রাজি হল না। বাধ্য হয়ে তাঁদের অনশন ধর্মঘট করতে হয়েছিল। ১৯৪৯ সালে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ২০০ দিন রাজনৈতিক বন্দিরা অনশন করে, যার ফলে ঢাকা জেলে শিবেন রায় মারা যান। যারা বেঁচেছিলেন অনেকের স্বাস্থ্য চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গিয়েছিল। অনেকে পরে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হন। অনেকের মাথাও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে তাঁদের অবস্থা কি হয়েছিল তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউই বুঝতে পারবেন না।
১৯৫০ সালে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে খাপড়া ওয়ার্ডের কামরায় বন্ধ করে রাজনৈতিক বন্দিদের উপর গুলি করে সাতজনকে হত্যা করা হয়। যে কয়েকজন বেঁচেছিলেন তাঁদের এমনভাবে মারপিট করা হয়েছিল যে, জীবনের তরে তাঁদের স্বাস্থ্য শেষ হয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন জেলে অত্যাচার চলেছিল। রাজনৈতিক বন্দিরাও তাদের দাবি আদায়ের জন্য কারাগার থেকেই অনশন ধর্মঘট করছিল। রাজনৈতিক বন্দিদের অনেক পরিবারের ভিক্ষা করেও সংসার চালাতে হয়েছে। নিয়তিই বলতে হবে! কারণ যারা ইংরেজের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আন্দামানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করেছেন তাঁদের অনেকেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে স্বাধীন দেশের জেলে দিন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন। লিয়াকত আলী খান তাঁর কথা রাখবার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যারা আওয়ামী লিগ ও বিরোধী দল করবে তাদের ‘শের কুচাল দেঙ্গে’- কথা তিনি ঠিকই রেখেছিলেন। মাথা ভাঙতে না পারলেও মাজা ভেঙে দিয়েছিলেন, জেলে রেখে ও নির্যাতন করে। আমরা তিনজনই এর প্রতিবাদ করেছিলাম। মুসলিম লীগ সরকারের ইচ্ছা থাকলেও আমাদের খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট হয় নাই। কারণ, কিছু সংখ্যক সরকারি কর্মচারীর কিছুটা সহানুভূতি ছিল বলে মনে হয়েছিল। জেল কতৃপক্ষও আমাদের কষ্ট হোক তা চান নাই। আমীর হোসেন সাহেব সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন ঢাকা জেলে। আমাদের যাতে কোন কষ্ট না হয় তার দিকে নজর রাখতেন। মওলানা সাহেব ও আমাকে আমীর হোসেন সাহেব সপ্তাহে একদিন দেখতে আসলেই আমীর হোসেন সাহেবকে অনুরোধ করতাম যাতে অন্য রাজনৈতিক বনিদের কষ্ট না হয়। এদেরও অনেক অসুবিধা ছিল। কারণ, সরকার জেলের ভিতরও গোয়েন্দা রেখে খবর নিত। সেই ভয়েতে এরা কিছুই করতে চাইতেন না। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃতুর পরে লিয়াকত আলী খান সমস্ত ক্ষমতার মালিক হয়ে এক ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর হুকুম মত প্রাদেশিক সরকারের নেতারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিরোধী দলের নেতা ও কর্মীদের উপর। সীমান্ত প্রদেশ ও বাংলার জেল তখন রাজনৈতিক বন্দিতে প্রায় ভর্তি হয়ে গেছে।
১৭৩
আমরা আওয়ামী লীগ গঠন করার সাথে সাথে যে ড্রাফট পার্টি ম্যানিফেস্টো বের করেছিলাম, তাতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের কথা থাকায় লিয়াকত আলী খান আরও ক্ষেপে গিয়েছিলেন। পূর্ব বাংলা সংখ্যাগুরু হওয়া সত্ত্বেও যে উদারতা দেখিয়েছিল দুনিয়ার কোথায়ও তাহার নজির নাই। প্রথম গণপরিষদে পূর্ব বাংলার মেম্বার সংখ্যা ছিল চুয়াল্লিশজন। আর পাঞ্জাবি, সিন্ধু, সীমান্ত ও বেলুচিস্তান নিয়েছিল আঠাশজন। পূর্ব বাংলার কোটার চুয়াল্লিশজন থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের বাসিন্দাদের ছয়জন মেম্বার পূর্ব বাংলা নির্বাচিত করে দেয়। কেউই আপত্তি করে নাই। আমরা সংখ্যাগুরু থাকা সত্ত্বেও রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিকে করা হয়। আমাদের সদস্যরা বা জনগণ আপত্তি করে নাই। কিন্ত যখন দেখলাম, শিল্প কারখানা যা কিছু হতে চলেছে সবই পশ্চিম পাকিস্তানেই গড়ে উঠতে শুরু করেছে, আর কয়েকজন মন্ত্রী ছাড়া পূর্ব বাংলার আর কেউ কোথায়ও নাই, বিশেষ করে বড় বড় সরকারি চাকরিতে পূর্ব বাংলাকে বঞ্চিত করা শুরু হয়ে গেছে।
লিয়াকত আলী খান বাঙালি ও পাঞ্জাবি সদস্যদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে রেখে শাসন করতে চাইছিলেন, কারণ তিনি রিফিউজি। তাঁকে বিশেষভাবে নির্ভর করতে হয়েছিল আমলাতন্ত্রের উপরে-যারা সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানের। এই সকল বড় বড় কর্মচারী সকলেই মুসলমান ছিলেন। পূর্ব বাংলার জনগণ নিজের গ্রামের হিন্দু ও বড় কর্মচারীকে বিশ্বাস না করে মুসলমান হিসাবে পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মচারীদের বিশ্বাস করেছিলেন। তার ফল হল, বাংলার মুসলমানকে ভাই বললে কি হবে, তারা তাদের নিজের অংশকে গড়তে সাহায্য করতে লাগল, বাংলাদেশকে ফাঁকি দিয়ে।
১৯৫০ সালে গ্র্যান্ড ন্যাশনাল কনভেনশন ডাকা হয়েছিল ঢাকায়। পূর্ব বাংলার শিক্ষিত সমাজ, আওয়ামী লীগ সদস্যরা, বিশেষ করে-আতাউর রহমান খান, কামরুদ্দিন আহমদ আরও অনেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। জনাব হামিদুল হক চৌধুরী তখন মন্ত্রীত্বের পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনিও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তান অবজারভার তখন তিনি বের করেছিলেন। এতে অনেক সুবিধা হয়েছিল। গ্রান্ড ন্যাশনাল কনভেনশন থেকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করা হল। লিয়াকত আলী খান ঢাকায় আসলে এক প্রতিনিধিদল তাঁর সাথে দেখা করলেন এবং তাঁকে পূর্ব বাংলার দাবির কথা জানালেন। জনাব লিয়াকত আলী খান এই আন্দোলনকে ভাল চোখে দেখলেন না। সোহরাওয়ারদী সাহেবও চুপ থাকার মত নেতা নন। তিনি জীবনভর সংগ্রাম করেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানে তিনি একটা দল গঠন করতে সক্ষম হয়েছেন। করাচিতে একদল যুবক মোহাজের কর্মী তাঁর সাথে দেখা করে আওয়ামী লীগ গঠন করতে অনুরোধ করলেন। পাঞ্জাব ও সিন্ধের রাজনৈতিক কর্মীরা এগিয়ে আসলেন। নবাব মামদোতের দলও লিয়াকত আলী খানকে মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেছিলেন। জনাব গোলাম মোহাম্মদ পাকিস্তান হওয়ার পূর্বে একজন সরকারি কর্মচারী ছিলেন। তাঁকে অর্থমন্ত্রী করার ফলে আমলাতন্ত্র মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর সাথে সাথে মাথা চড়া দিয়ে উঠেছিল।
১৭৪
চৌধুরী মোহাম্মদ আলী কেন্দ্রীয় সরকারের সেক্রেটারি জেনারেল হয়ে একটা শক্তিশালী সরকারি কর্মচারী গ্রুপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পূর্ব বাংলায় জনাব আজিজ আহমদ চিফ সেক্রেটারি ছিলেন। সত্যিকার ক্ষমতা তিনিই ব্যবহার করতেন। জনাব নূরুল আমিন তাঁর কথা ছাড়া এক পা-ও নড়তেন না।
আমরা দিন কাটাচ্ছি জেলে। তখন আমাদের জন্য কথা বলারও কেউ ছিল বলে মনে হয় নাই। সোহরাওয়ারদী সাহেব লাহোর থেকে একটা বিবৃতি দিলেন। আমরা খবরের কাগজে দেখলাম। আমাদের বিরুদ্ধে মামলাও চলছে। শামসুল হক সাহেবকে নিয়ে মওলানা সাহেব ও আমি খুব বিপদে পড়লাম। তাঁর স্বাস্থ্যও খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। প্রায় বাইশ পাউন্ড ওজন কম হয়ে গেছে। তারপরও রাতভরই জিকির করেন। মাঝে মাঝে গরমের দিন দুপুরবেলা কম্বল দিয়ে সারা শরীর ঢেকে ঘন্টার পর ঘন্টা শুয়ে থাকতেন। মওলানা সাহেব ও আমি অনেক আলোচনা করলাম। আর কিছুদিন থাকলে পাগল হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। দু’একদিন আমার ওপর রাগ হয়ে বলে, “আমাকে না ছাড়লে বন্ড দিয়ে চলে যাব। তোমার ও ভাসানীর পাগলামির জন্য জেল খাটব নাকি?”একদিন সিভিল সার্জন আসলে মওলানা সাহেব ও আমি শামসুল হক সাহেবের অবস্থা বললাম। তার যেভাবে ওজন কমছে তাতে যে কোনো সময় বিপদ হতে পারে। তিনি বললেন, সরকার আমার কাছে রিপোর্ট না চাইলে তো আমি দিতে পারি না অথবা হক সাহেব দরখাস্ত করলে আমি আমার মতামত দিতে পারি। শামসুল হক সাহেব এক দরখাস্ত লিখে রেখেছিলেন, আমি ওটা দিতে নিষেধ করলাম, তিনি আমার কথা রাখলেন। তিনি আর একটা লিখলেন মুক্তি যেয়ে, স্বাস্থ্যগত কারণে। যদিও দুর্বলতা কিছুটা ধরা পড়ে, তবুও উপায় নাই। সিভিল সার্জন সাহেব সত্যিই তাঁর শরীর যে খারাপ হয়ে পড়েছিল তা লিখে দিলেন। পাঁচ-সাত দিন পরেই তার মুক্তির আদেশ আসল। তিনি মুক্তি পেয়ে চলে গেলেন। ভাসানী সাহেব ও আমি রইলাম। কোর্টে হক সাহেবের সাথে আমাদের দেখা হত। সরকার ভাবল, হক সাহেবের মত শক্ত লোক যখন নরম হয়েছে তখন ভাসানী এবং আমিও নরম হব। আমার মেজোবোন (শেখ ফজলুল হক মণির মা) ঢাকায় থাকতেন, আমাকে দেখতে আসতেন। আমি বাড়িতে সকলকে নিষেধ করে দিয়েছিলাম, তবুও আব্বা আমাকে দেখতে আসলেন একবার।
একদিন ভাসানী সাহেব ও আমি কোর্টে যেয়ে দেখি মানিক ভাই দাঁড়িয়ে আছেন, আমাদের সাথে দেখা করার জন্য। আলাপ-আলোচনা হওয়ার পর মানিক ভাই বললেন, “নানা অসুবিধায় আছি, আমাদের দিকে খেয়াল করার কেউই নাই। আমি কি আরফ করত পারব, একটা বড় চাকরি পেয়েছি করাচিতে চলে যেতে চাই, আপনারা কি বলেন”। আমি বললাম, “মানিক ভাই, আপনিও আমাদের জেলে রেখে চলে যাবেন? আমাদের দেখবারও কেউ
১৭৫
বোধহয় থাকবে না”। আমি জানতাম মানিক ভাই চারটা ছেলেমেয়ে নিয়ে খুবই অসুবিধায় আছেন। ছেলেমেয়েদের পিরোজপুর রেখে তিনি একলাই ঢাকায় আছেন। মানিক ভাই কিছু সময় চুপ করে থেকে আমাদের বললেন, “না, যাব না আপনাদের জেলে রেখে”।
মওলানা সাহেব সাপ্তাহিক ইত্তেফাক কাগজ বের করেছিলেন। কয়েক সাপ্তাহ বের হওয়ার পরে বন্ধ হয়ে যায়। কারণ টাকা কোথায়? মানিক ভাইকে বললেন, কাগজটা তো বন্ধ হয়ে গেছে, যদি পার তুমিই চালাও। মানিক ভাই বললেন, কি করে চলবে, টাকা কোথায়, তবুও চেষ্টা করে দেখব। আমি মানিক ভাইকে আমার এক বন্ধু কর্মচারীর কথা বললাম, ভদ্রলোক আমাকে আপন ভাইয়ের মত ভালবাসতেন। কলকাতায় চাকরি করতেন, সোহরাওয়ারদী সাহেবের ভক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের বাসিন্দা নন তবুও বাংলাদেশকে ও তার জনগণকে তিনি ভালবাসতেন। আমার কথা বললে কিছু সাহায্য করতেও পারেন। মানিক ভাই পরের মামলার তারিখে বললেন যে, তিনি কাগজ চালাবেন। কাগজ বের করলেন। অনেক জায়গা থেকে টাকা জোগাড় করতে হয়েছিল। নিজেরও যা কিছু ছিল এই কাগজের জন্যই ব্যয় করতে লাগলেন। কিছুদিনের মধ্যে কাগজটা খুব জনপ্রিয় হতে লাগল। আওয়ামী লিগের সমর্থকরা তাঁকে সাহায্য করতে লাগল। এ কাগজ আমাদের জেলে দেওয়া হত না, আমি কোর্টে এসে কাগজ নিয়ে নিতাম এবং পড়তাম। সমস্ত জেলায় জেলায় কর্মীরা কাগজটা চালাতে শুরু করল। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্টানের কাগজ হিসাবে জনগণ একে ধরে নিল। মানিক ভাই ইংরেজি লিখতে ভালবাসতেন, বাংলা লিখতে চাইতেন না। সেই মানিক ভাই বাংলায় অন্যতম শ্রেষ্ট কলামিস্টে পরিণত হলেন। চমৎকার লিখতে শুরু করলেন। নিজেই ইত্তেফাকের সম্পাদক ছিলেন। তাঁকে ছাত্রলীগের দুই-তিনজন কর্মী সাহায্য করত। টাকা পয়সার ব্যাপারে আমার বন্ধুই তাঁকে বেশি সাহায্য করতেন। বিজ্ঞাপন পাওয়া কষ্টকর ছিল, কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য কোথায়? আর সরকারি বিজ্ঞাপন তো আওয়ামী লীগের কাগজে দিত না। তবুও মানিক ভাই কাগজটাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন একমাত্র তাঁর নিজের চেষ্টায়।

১৯৫০ সালের শেষের দিকে মামলার শুনানি শেষ হল। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব যে রায় দিলেন, তাতে মওলানা সাহেব ও শামসুল হক সাহেবকে মুক্তি দিলেন। আবদুর রউফ, ফজলুল হক ও আমাকে তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হল। শাস্তি দিলেই বা কি আর না দিলের বা কি ? আমি তো নিরাপত্তা বন্দি আছিই। মওলানা সাহেবও জেলে ফিরে এলেন, কারণ তিনিও নিরাপত্তা বন্দি। আতাউর রহমান সাহেব, কামরুদ্দিন সাহেব ও আরও অনেকে মামলায় আমাদের পক্ষে ছিলেন। আমাকে ডিভিশন দেওয়া হয়েছিল। আপিল দায়ের করলেও আমাকে খাটতে হল। কিছুদিন পরে আমাকে গোপালগঞ্জ পাঠিয়ে দিল, কারণ গোপালগঞ্জে আরও একটা মামলা দায়ের করেছিল। মওলানা সাহেবের কাছে এতদিন থাকলাম। তাঁকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হল। কিন্ত উপায় নাই, যেতে হবে। আমি সাজাও ভোগ করছি এবং নিরাপত্তা বন্দিও আছি। ঢাকা জেলে আমাকে সুতা কাটতে দিয়েছিল। আমি যা পারতাম তাই করতাম। আমার খুব ভাল লাগত। বসে বসে খেতে
১৭৬
খেতে শরীর ও মন দুইটাই খারাপ হয়ে পড়েছিল। আমাকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে খুলনা মেলে নিয়ে চলল। খুলনা মেল বরিশাল হয়ে যায়। বরিশালে আমার বোন ও অনেক আত্মীয় আছে। বেশি সময় জাহাজ বরিশালে থামে না, আর কাউকে পেলামও না। একজন রিকশাওয়ালে বলেছিলাম, আমার এক খালাতো ভাই, জাহাঙ্গীরকে খবর দিতে। জাহাঙ্গীরকে সকলে চিনে। জাহাজ ছাড়ার সময় দেখি ছুটে আসছে সাইকেল নিয়ে। সিঁড়ি টেনে দিয়েছে। দাঁড়িয়েই দুই মিনিট আলাপ করলাম। ও বলল, এই মাত্র খবর পেয়েছে। জাহাজ ছেড়ে দিল। আমার বাড়ির স্টেশন হয়েই যেতে হয়। আমার বাড়ি থেকে তিন স্টেশন পরেই গোপালগঞ্জ অনেক রাতে পৌঁছে। পাটগাতি স্টেশন থেকে আমরা ওঠানামা করি। আমাকে সকলেই জানে। স্টেশন মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের বাড়র খবর কিছু জানেন কি না? যা ভয় করেছিলাম তাই হল, পূর্বের রাতে আমার মা, আব্বা, রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা হয়ে গেছেন আমাকে দেখতে। এক জাহাজে আম এসেছি। আর এক জাহাজে ওরা ঢাকায় গিয়েছে। দুই জাহাজের দেখাও হয়েছে একই নদীতে। শুধু দেখা হল না আমাদের। এক বৎসর দেখি না ওদের। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বাড়িতে আর কাউকেও খবর দিলাম না। কিছুদিন পূর্বে রেণু লিখেছিল, ঢাকায় আসবে আমাকে দেখতে। কিন্ত এত তাড়াতাড়ি হবে বুঝতে পারি নাই। অনেক রাতে মানিকদহ স্টেশনে পৌছালাম। সেখান থেকে কয়েক মাইল নৌকায় যেতে হয় গোপালগঞ্জ শহরে। আমাকে পাহার দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল কয়েকজন বন্দুকধারী পুলিশ, একজন হাবিলদার, আর তাদের সাথে আছেন দুইজন গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারী, একজন দারোগা আর একজন বোধহয় তার আর্দালি বা বডিগার্ড হবে। আমরা শেষ রাতে গোপালগঞ্জ পৌছালাম। আমাকে পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হল। পুলিশ নাইন থেকে আমার গোপালগঞ্জ বাড়িও খুবই কাছাকাছি। বাড়িতে কয়েকজন ছাত্র থাকে, লেখাপড়া করে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অফিসও আমার বাড়িতে। আমার মনও খারাপ, আর ক্লান্তও ছিলাম। একটা খাট আমাকে ছেড়ে দিল। খুব যত্ন করল। তাড়াতাড়ি আমার বিছানাটও করে দিল। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালবেলা উঠে হাত মুখ ধুয়ে প্রস্তুত হতে লাগলাম। খবর রটে গেছে গোপালগঞ্জ শহরে। পুলিশ লাইনের পাশেই শামসুল হক মোক্তার সাহেব থাকেন, তাঁকে সকলে বসু মিয়া বলে জানেন। তাঁর স্ত্রীও আমাকে খুব স্নেহ করেন, তাঁকে আমি শাশুড়ি বলে ডাকতাম, আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয়াও হতেন। ভদ্রমহিলা অমায়িক ও বুদ্ধিমতী। আমার জন্য তাড়াতাড়ি খাবার পাঠালেন। দশটার সময় আমাকে কোর্টে হাজির করল। অনেক লোক জমা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম দিলেন, আমাকে থানা এরিয়ার মধ্যে রাখতে। পরের দিন মামলার তারিখ। গোপালগঞ্জ সাবজেলে ডিভিশন কয়েদি ও নিরাপত্তা বন্দি রাখার কোনো ব্যবস্থাই নাই। কোর্ট থেকে প্রায় এক মাইল, আমাকে হেঁটে যেতে হবে। অন্য কোনো ব্যবস্থা নাই। কারণ, তখন গোপালগঞ্জে রিকশাও চলত না। অনেক লোক আমার সাথে চলল। গোপালগঞ্জের প্রত্যেকটা জিনিসের সাথে আমি পরিচিত। এখানকার স্কুলে
১৭৭
লেখাপড়া করেছি, মাঠে খেলাধুলা করেছি, নদীতে সাঁতার কেটেছি, প্রতিটি মানুষকে আমি জানি আর তারাও আমাকে জানে। বাল্যস্মৃতি কেউ সহজে ভোলে না। এমন একটা বাড়ি হিন্দু-মুসলমানের নাই যা আমি জানতাম না। গোপালগঞ্জের প্রত্যেকটা জিনিসের সাথে আমার পরিচয়। এই শহরের আলো-বাতাসে আমি মানুষ হয়েছি। এখানেই আমার রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছে। নদীর পাড়েই কোর্ট ও মিশন স্কুল। এখন একটা কলেজ হয়েছে। ছাত্ররা লেখাপড়া ছেড়ে বের হয়ে পড়ল, আমাকে দেখতে। কিছুদূর পরেই দু’পাশে দোকান, প্রত্যেকটা দোকানদারের আমি নাম জানতাম। সকলকে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতে করতেই থানার দিকে চললাম।
থানায় পৌছালেই দারোগা সাহেবরা আমাকে একটা ঘর দিলেন, যেখানে স্বাধীনতার পূর্বে রাজনৈতি কর্মীদের নজরবন্দি রাখা হত। এই মহল্লায় আমি ছোট সময় ছিলাম। তখন নজরবন্দিদের সাথে আলাপ করতাম ও মিশতাম। আমি ছোট ছিলাম বলে কেউ কিছু বলত না। আজ ভাগ্যের পরিহাস আমাকেই সেই পুরানা ঘরে থাকতে হল, স্বাধীনতা পাওয়ার পরে!
থানার পাশেই আমার এক মামার বাড়ি। তিনি নামকরা মোক্তার ছিলেন। তিনি আজ ইহজগতে নাই। আবসুদ সালাম খান সাহেবের ভাই। আবদুর রাজ্জাক খান তাঁর নাম ছিল। অনেক লেখাপড়া করতেন, রাজনীতিও তিনি বুঝতেন। তাঁকে সকলেই ভালবাসত। এই রকম একজন নিঃস্বার্থ দেশসেবক খুম কম আমার চোখে পড়েছে। কোনোদিন কিছু চান নাই। আমি তাঁর উপর অনেক সময় অন্যায় করেছি, কিন্ত কোনোদিন রাগ করেন নাই। সালাম খান সাহেব ও তিনি আপন ভাই ছিলেন না, সৎ ভাই ছিলেন। কিন্ত কেউ বুঝতে পারত না কোনোদিন। সালাম সাহেব যখন আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেছিলেন, তিনি দল ত্যাগ করেন নাই। একজন আদর্শবাদী লোক ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে গোপালগঞ্জ এতিম হয়ে গেছে বলতে হবে। লোকে তাঁকে খুব ভালবাসত ও বিশ্বাস করত। সরকারি কর্মচারীরাও তাঁকে শ্রদ্ধা করত। তাঁকে লোকে ‘রাজা মিয়া’ বলে ডাকত। আমি ‘রাজা মামা’ বলতাম। কোর্ট থেকে বাড়িতে খবর দিয়েছে। আমার খাবার তাঁর বাড়ি থেকেই থানায় আসবে। থানায় পৌছাবার পূর্বেই আমার নানী ও মামী খবর দিলেন, খাবার প্রস্তুত, গোসল হলেই খবর দিতে। আমি থানার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে দেখি মামী ও নানী দাঁড়িয়ে আছেন। আমি সালাম দিলাম। থানার দুই পাশের রাস্তায় অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে আমাকে দেখতে। আমি বাইরে এসে সকলকে আদাব করলাম। তারপর সকলকেই শুভেচ্ছা জানিয়ে যে ঘরে থাকবার বন্দোবস্ত হয়েছে সেই ঘরে চলে যাই। বাড়ি থেকে লোক এসেছিল, সকলকে খবর নিলাম।
বহুদিন সূর্যাস্তের পরে বাইরে থাকতে পারি নাই। জেলের মধ্যে এক বৎসর হয়েছে, সন্ধ্যার পরে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দেয়। জানালা দিয়ে শুধু কিছু জ্যোৎস্না বা তারাগুলি দেখার চেষ্টা করেছি। আজ আর ঘরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে না। বাইরে বসে রইলাম, পুলিশ আমাকে পাহারা দিচ্ছে। পুলিশ কর্মচারী যিনি রাতে ডিউটি করছিলেন, তিনিও এসে বসলেন। অনেক আলাপ হল। বাইরে থেকে দু’একজন বন্ধুবান্ধবও এসেছিল। অনেক
১৭৮
রাতে শুতে যেয়ে দেখি, ঘুমাবার উপায় নাই। এক রুমে আমি আর এক রুমে ওয়ারলেস মেশিন চলছে। খট খট শব্দ; কি আর করা যাবে! আবার বাইরে যেয়ে বসলাম। পরে যখন আর ভাল লাগছিল না, শুতে গেলাম। বাইরে শোবার ইচ্ছা করছিল, কিন্ত উপায় নাই। গোপালগঞ্জের মশা নামকরা। একটু সুযোগ পেলেই আর রক্ষা নাই। ভোর রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়লাম, অনেক বেলা করে উঠলাম। কোর্টে পরের দিন হাজিরা দিলাম, তারিখ পড়ে গেল। কারণ, ফরিদপুর থেকে কোর্ট ইন্সপেক্টর এসেছেন। তিনি জানালেন, সরকার পক্ষের মামলাটি পরিচালনা করবেন সরকারি উকিল রায় বাহাদুর বিনোদ ভদ্র। তিনি আসতে পারেন নাই। এক মাস পরে তারিখ পড়ল এবং আমাকে ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে রাখবার হুকুম হল। আমাকে ফরিদপুর যেতে হবে, সেখান থেকেই মাসে মাসে আসতে হবে, মামলার তারিখের দিনে।
গোপালগঞ্জ মহকুমা যদিও ফরিদপুর জেলায়, কিন্ত কোন ভাল যায়ায়াতের বন্দোবস্ত নাই। খুলনা থেকে গোপালগঞ্জে রোজ দুইবার জাহাজ আসে। বরিশাল থেকেও গোপালগঞ্জ সরাসরি জাহাজে যাওয়া যায়। গোপালগঞ্জ থেকে জাহাজে রওয়ানা করলাম ফরিদপুর। সিন্ধিয়াঘাট নামে একটা স্টেশনে নেমে রাতে সেখানে থাকতে হবে। পরের দিন সকালে লঞ্চে যেতে হবে ভাঙা নামে একটা স্থানে; সেখান থেকে ট্যাক্সিতে যেতে হবে ফরিদপুর। পুরা দেড় দিন লাগে। সন্ধ্যায় সিন্ধিয়াঘাটে পৌছালাম, এখানে একটা ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টের ডাকবাংলো আছে। তিন নদীর মোহনায় এই ডাকবাংলোটাও তিন নদীর পাড়ে। আমি ডাকবাংলোয় রাত কাটাব ঠিক করলাম, পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মচারীরা রাজি হল, কারণ কোথায় রাখবে? এটা একটা বন্দর, ডাকবাংলোর চৌকিদার আমাকে জানত। একটা কামরায় একজন কর্মচারী থাকে আর একটা কামরায় আমাকে দেওয়া হল। পাশের গ্রামেও আমার কয়েকজন ভক্ত ছিল। তারা খবর পেয়ে ছুটে আসল। চৌকিদারকে খাবার বন্দোবস্ত করতে বললাম, সিপাহিরাও তাঁকে সাহায্য করল। কোরবান আলী ও আজহান নামে দুইজন কর্মীর বাড়ি ডাকবাংলোর কাছেই। তারা পীড়াপীড়ি করেত লাগল, তাদের ওখানে খেতে। আমি বললাম, আমার তো কোন আপত্তি নাই। তবে যাওয়া উচিত হবে না তোমাদের বাড়িতে। কারণ যারা আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে চলেছে সরকারের কাছে খবর গেলে তাদের চাকরি থাকবে না। বাড়ি থেকে তরকারি পাক করে দিয়েছিল। অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে রইলাম নদীর দিকে মুখ করে। নৌকা যাচ্ছে আর নৌকা আসছে। পুলিশদের বললাম, “আমার জন্য চিন্তা করবেন না, ঘুমিয়ে থাকেন। আমাকে গলাধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিলেও যাব না”। তারা সকলেই হেসে দিয়ে বলল, “আমরা তোম জানি, আপনার জন্য আমরা চিন্তা করি না”।
বেশি সময় বসতে পারলাম না, কোথাও সারা শব্দ নাই। মাত্র এগারটা বাজে, মনে হল সারা দেশ ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু দু’একখানা নৌকা চলছে, তার শব্দ পাই।
ভোরবেলা উঠলাম, নয়টা-দশটার সময় মাদারীপুর থেকে লঞ্চ আসে। সেই লঞ্চেই ভাঙা যেতে হবে। লঞ্চ এল, আমরা উঠে পড়লাম। অনেক লোকের সাথে পরিচয় হল।
১৭৯
ভাঙ্গায় একটা দেওয়ানি আদালত আছে। এখানে আমার এক দূরসম্পর্কের ভাই ওকালতি করেন। ভাঙ্গার কাছেই নূরপুর গ্রাম। ওখানে আমার ফুপুর বাড়ি। আদালতের ঘাটেই লঞ্চ থামে। ভাই খবর পেয়ে এলেন, দেখা হল। ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে চললাম। ফুফাতো ভাইয়েরা খবর পায় নাই। ট্যাক্সি ঠিক করে ফরিদপুর রওয়ানা করলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রাতে জেলে আমাকে নাকি গ্রহণ করবে না। আমাকে পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হল। রিজার্ভ ইন্সপেক্টর যিনি ছিলেন, তিনি এসে আমার যাতে কোনো কষ্ট না হয় সেদিকে তাঁর লোকদের নজর রাখতে বললেন। আমি কাউকেও খবর দিলাম না। অনেকে আমাকে দেখতে আসল। যদিও ফরিদপুর শহরে আমার অনেক ঘনিষ্ট আত্মীয় রয়েছে। কিন্ত আমার জন্য কারও কোনো কষ্ট হয়, তা আমি কোনোদিন চাই নাই। সকালবেলা চা-নাশতার ব্যবস্থা করেছিল পুলিশ লাইনের সিপাহিরা। আমাকে খেতেই হল। মনে মনে ভাবলাম, আপনারা আমাকে ভালবাসেন, যাদের সাথে একসাথে কাজ করলাম, ‘আমার মত কর্মী হয় না’ এমন কত কথাই না বলেছে পাকিস্তান হওয়ার পূর্বে। তারা আজ আমাকে বিনা বিচারে জেলে তো রেখেছেই, আমার যাতে শাস্তি হয় তার জন্য চেষ্টা করতে একটুও ক্রটি করছে না। তাদের কাছে বিদায় নিয়ে ফরিদপুর জেলে আসলাম। জেল কতৃপক্ষ পূর্বেই ডিআইজি থেকে খবর পেয়েছে। জেলগেটে পৌছালাম সকালবেলা। জেলার ও ডেপুটি জেলার সাহেব অফিসে। ডেপুটি জেলার সাহেবের কামরায় বসলাম। আমার কাগজপত্র দেখলেন। বললেন, আপনার তো সাজাও আছে তিন মাস। আবার নিরাপত্তা আইনেও আটক আছেন। বললাম, বেশি দিন সাজা নাই, এক মাসের বেশি বোধহয় হয়ে গেছে।
আমাকে কোথায় রাখা হবে তাই নিয়ে আলোচনা করলেন। বোধহয় টেলিফোনও করেছিলেন। কয়েকজন রাজনৈতিক বন্দিও একটা ওয়ার্ডে আছেন। আমাকে সেখানে রাখা হবে, না আলাদা রাখতে হবে? শেষ পর্যন্ত হাসপাতালের একটা কামরা খালি করতে হুকুম দিলেন, শুনলাম। আমার বাক্স, কাপড়, জামা তল্লাশি করে দেখা হল। আমি চুপ করে বসে আছি। একজন জমাদার এসে আমাকে বলল, আপনি এই কামরায় আসেন। আমি সেই কামরায় গেলে, সে এসে আমার পকেটে হাত দিল। আমি তাকে বললাম, “আপনি আমার গাঁয়ে হাত দেবেন না। আপনি আমাকে তল্লাশি করতে পারেন না। আইনে নাই। জেলার সাহেব বা ডেপুটি জেলার সাহেব দরকার হলে আমাকে তল্লাশি করতে পারেন”। আমি রাগ করেই কথাটা বললাম, বেচারা ঘাবড়িয়ে গেছে। আমি বললাম, “কার হুকুমে আপনি আমার শরীরে হাত লাগালেন, আমি জানতে চাই!” একথা বলে ডেপুটি জেলারকে বললাম, “ব্যাপার কি? আপনি হুকুম দিয়েছেন”? ডেপুটি জেলার তাকে যেতে বললেন, “মনে কিছু করবেন না। ও জানে না”। ডেপুটি সাহেবকে বললাম, “দেখুন কি আছে আমার কাছে। সিগারেট, ম্যাচ ও রুমাল আছে”। তিনি লজ্জা পেয়েছিলেন। আমাকে তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।
১৮০
আমি এই প্রথম ফরিদপুর জেলে আসলাম। হাসপাতালটা দোতলা। একতলার একটা রুমে আমি একাকী থাকব। অন্য রুমগুলিতে রোগীরা আছে। বারান্দা আছে, বাইরে বস্তে পারব এটাই আমার ভাল লাগল। নিজের জেলা, কিছু কিছু চেনাশোনা লোক আছে। আমাকে একটা ফালতু দিয়েছিল, আমার খেদমত করার জন্য। আমার খাবার আসবে রাজনৈতিক বন্দিদের ওয়ার্ড থেকে। তাঁরা পাঁচ ছয়জন আছনে শুনলাম। বই আমার কাছে যা আছে তাই সম্বল। খবরের কাগজ দিতে বললাম। হাসপাতালের সামনে সামান্য জায়গা ছিল, একটা ফুলের বাগানও ছিল, তাকে যাতে আরও ভাল করা যায় তার ভার নিলাম। সময় তো কাটাতে হবে, ভালই লাগছিল।
রাজনৈতিক বন্দিদের সাথে আমার দেখা হবার উপায় নাই। জেল বেশ বড় না হলেও তারা যেখানে থাকে সেখান থেকে দেখাশোনা হওয়ার উপায় নাই।
আমি তখন নামাজ পড়তাম এবং কোরআন তেলাওয়াত করতাম রোজ। কোরআন শরীফের বাংলা তরজমাও কয়েক খণ্ড ছিল আমার কাছে। ঢাকা জেলে শামসুল হক সাহেবের কাছ থেকে নিয়ে মওলানা মোহাম্মদ আলীর ইংরেজি তরজমাও পড়েছি।
জেলার সাহেব নিজে এসেই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোনো অসুবিধা হলে তাঁকে বলতে। দিনেরবেলা জেলের ভিতর আমি ঘুমাতে চাই না। তবুও আজ ঘুমিয়ে পড়লাম। কারণ ক্লান্ত ছিলাম। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে একটু হাঁটাচলা করলাম। সন্ধ্যার সময় তালা বন্ধ করে দিল। পাঁচজন কয়েদি পাহারা থাকবে আমার কামরায় এবং ফালতু থাকবে আমার কাজকর্ম করার জন্য।কয়েদি পাহারাদাররা দুই ঘন্টা করে এক একজন পাহারা দিত, কামরার ভিতর থেকে। সিপাহি বাইরের থেকে জিজ্ঞাসা করবে, আর পাহারাদাররা চিৎকার করে বলবে, “জানলা বাত ঠিক আছে”। কয়জন কয়েদি আছে তাও বলবে। আমি বলেছিলাম, চিৎকার করতে পারবেন না, সিপাহিরা জিজ্ঞাসা করলে আস্তে বলবেন, আমার ঘুমের যেন অসুবিধা না হয়”। আমার এখানে চিৎকার কম করলে কি হবে, অন্যান্য ওয়ার্ডে ভীষণ চিৎকার করে। ভাগ্য ভাল ওয়ার্ডগুলি দূরে ছিল। তা না হলে উপায় থাকত না।
আমাকে একা রাখা হত শাস্তি দেওয়ার জন্য। কারাগারের অন্ধকার কামরায় একাকী থাকা যে কী কষ্টকর, ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ অনুভব করতে পারবে না। জেল কোডে আছে কোনো কয়েদিকে তিন মাসের বেশি একাকী রাখা চলবে না। কোনো কয়েদি জেল আইন ভঙ্গ করলে অনেক সময় জেল কর্মচারীরা শাস্তি দিয়ে সেলের মধ্যে একাকী রাখে। কিন্ত তিন মাসের বেশি রাখার হুকুম নাই।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে কিছু সময় হাঁটাচলা করে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলাম, এমন সময় একজন আধাবুড়া কয়েদি, সেও হাসপাতালে ভর্তি আছে, আমার কাছে এল এবং মাটিতে বসে পড়ল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার বাড়ি কোথায়? বললেন, “বাড়ি গোপালগঞ্জ থানায়, ভেন্নাবাড়ী গ্রামে, নাম রহিম”। আমি বললাম, আপনার নামই ‘রহিম মিয়া’? রহিম মিয়া নামে তাকে সকলেই জানে। এত বড় ডাকাত গোপালগঞ্জ
১৮১
মহকুমায় আর পয়দা হয় নাই। তার নাম শুনলেই লোকে ভয় পেয়ে থাকত। রহিম মিয়া চুরি বেশি করত। তবে বাধা দিলে ডাকাতি করত। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “রহিম মিয়া আপনিই না আমাদের বাড়িতে চুরি করে সর্বস্ব নিয়ে এসেছিলেন”। রহিম মিয়া কোন কথা না বলে চুপ করে রইলেন অনেকক্ষণ। ১৯৩৮-১৯৩৯ সালে আমার মা, বড়বোন এবং অন্যান্য বোনদের সোয়াশ; ভরি সোনার গহনা এবং আমার মার নগদ কয়েক হাজার টাকা চুরি হয়ে যায়। আব্বা তখন গোপালগঞ্জ ছিলেন। আমাদের বাড়ির দুই চারশত বৎসরের ইতিহাসে কোনোদিন চুরি হয় নাই। এই প্রথম চুরি। রহিম মিয়া আস্তে আস্তে বললেন, “হ্যাঁ আমি চুরি করেছিলাম”। আমি বললাম, “আমাদের বাড়িতেও সাহস করে এলেন কি করে? আমাদের ঘরে বন্দুক আছে। অনেক শরিকদের বাড়িতে বন্দুক আছে। এত বড় বাড়ি, কত লোক”। সে বলল, “গ্রামের লোক এবং আপনাদের বাড়ির লোক সাথে ছিল। আমরা দুই দিন পরে খবর পেয়েছিলাম, আমাদের এক প্রজা, আমাদের গ্রামের মানুষ- অনেক দিন আমাদের বাড়িতে কাজ করেছে, সে তখন কেরায়া নৌকা চালাত, তার নিজের নৌকায় রহিম ও তার দলকে নিয়ে আসে। চুরি হওয়ার তিন দিন পরে সে আমাদের বাড়িতে এসে ঘটনার কথা স্বীকার করে। মালপত্র ধরা না পড়ার জন্য মামলায় কিছু হল না। থানার এক দারোগাই কেস নষ্ট করেছিল। রহিমকে ধরতে পারলে গহনা কিছু পাওয়া যেত। অনেক দিন তাকে ধরতে পারে নাই। আব্বা লড়েছিলেন থানার দারোগার বিরুদ্ধে, সে জন্য দারোগা সাহেবের অনেক বিপদে পড়তে হয়েছিল। তখনকার পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট দারোগার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।
রহিম বলতে লাগল তার ইতিহাস। আজ অনেক দিন জেলে আছে। বলল, “আপনাদের বাড়িতে চুরি করে যখন কিছু হল না, তখন ঘোষণা করলাম, লোকে বলে চোরের বাড়িতে দালান হয় না, আমি দালান দেব। দেশের লোক বুঝতে পারল। কিছুদিন পরে আর একটা ডাকাতি করতে গেলাম বাগেরহাটে। সেখানে ধরা পড়লাম। অনেক টাকা খর করে জামিন নিয়ে দেশে এলাম। তারপর আরেকটা ডাকাতি করতে গেলাম, গোপালগঞ্জের উলপুর গ্রামের রায় চৌধুরীদের বাড়িতে। ডাকাতি করে ফিরবার পথে পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করল। তাদের জানা ছিল আমি কোন পথে ফিরব। এ মামলাটার জামিন নিলাম, তারপরে আবার ডাকাতি করতে গেলাম আর এক জায়গায়। সেখানেও ধরা পড়লাম, আর জামিন পেলাম না। সকল মামলা মিলে আমার পনের-ষোল বৎসর জেল হয়েছে। পাকিস্তান হওয়ার পূর্বে দমদম জেলে ছিলাম। সেখান থেকে রাজশাহী, তারপর ফরিদপুর জেলে এসেছি। জানেন, জীবনে ডাকাতি বা চুরি করতে গিয়ে আমি ধরা পড়ি নাই, কিন্ত আপনাদের বাড়ি চুরি করার পর যেখানেই গেছি ধরা পড়েছি। জেলে বসে চিন্তা করে দেখলাম, আপনাদের বাড়ি আমাদের পুণ্যস্থান ছিল, সেখানে হাত দিয়ে হাত জ্বলে গেছে। আপনার মা’র কাছে ক্ষমা চাইতে পারলে বোধহয় পাপমোচন হত”। আমি বললাম, “রহিম মিয়া, আমার মা ও আব্বা বড় দুঃখ পেয়েছিলেন। কারণ আমাদের সর্বস্ব গেলেও কিছু হত না কিন্ত আমার বিধবা বড়বোনের গহনাই বেশি ছিল। সে একটা ছেলে ও একটা মেয়ে নিয়ে উনিশ বছর
১৮২
বয়েসে বিধবা হয়েছিল”। বলল, “আর জীবনে চুরি করব না। আরও কয়েক বৎসর খাটতে হবে। শরীর ভেঙে গেছে”। আমাকে অনুরোধ করল, কিছু দরকার হলে বলতে, কারণ তার গলায় ‘খোকর’ আছে। তার মধ্যে সোনার গিনি রাখা আছে। আমি বললাম, কোনো প্রয়োজন নাই। মনে মনে বললাম, “হ্যাঁ, সোনার গিনি থাকবে না, তো থাকবে কি? সোয়া শত ভরির গহনা তো সোজা কথা না!” আরও বলল, ফরিদপুর জেলের অনেককে কিনে রেখেছে, কেউ তাকে কিছু বলবে না। ভাবলাম, কেন কিছু বলে না বুঝতে আর বাকি নাই। রহিম মিয়া হাসপাতালে প্রায়ই ভর্তি হয়ে থাকত। শরীর স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সময় পেলেই আমার কাছে আসত। সুখ-দুঃখের অনেক কথাই বলত। আমার মনে হচ্ছিল, বোধহয় একটা পরিবর্তন এসেছে ওর মনে।
জেলার ছিলেন সৈয়দ আহমদ সাহেব। তিনি সকল সময় আমার খোঁজখবর নিতেন। কোন কিছুর অসুবিধা হলে বলতে অনুরোধ করতেন। যদিও সরকার কয়েদিদের দিয়ে ঘানি ঘুরিয়ে তেল করতে নিষেধ করেছেন, তথাপি ফরিদপুর জেলে তখনও ঘানি ঘুরিয়ে তেল করা হচ্ছিল। আমি জেলার সাহেবকে বললাম, “এখনও আপনার জেলে মানুষ দিয়ে ঘানি ঘুরান”?তিনি বললেন, “কয়েকদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাবে। গরু কিনতে দিয়েছি”। কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
ঢাকা ও ফরিদপুর জেলে অনেক বড় চোর ও দুর্দর্শ ডাকাতের সাথে আলাপ হয়েছে। কারও কারও গলার মধ্যে ‘খোকর’ (মানে গর্ত) থাকে। তার মধ্যে লুকিয়ে টাকা সোনার আংটি, গিনি রাখে। দরকার হলে সেগুলি দিয়ে জিনিসপত্র কিনে আনায়। একটু ভালভাবে থাকার জন্য কিছু কিছু খরচও করে। আমার কাছে সিগারেটের কাগজও চেয়ে নিয়েছে অনেকে। একবার ঢাকায় এক কয়েদিকে বললাম, “আমাকে খোকরের কেরামতি দেখালে কাগজ দিব, নতুবা কাগজ দিব না”। বলল, “দেখাব আপনাকে, একটু দেরি করেন”। সিপাহি একটু দূরে গেলে বমি করার ভান করল, তাতে একটা কাঁচা টাকা বের হয়ে আসল। বললাম, “হয়েছে আর দরকার নাই। বুঝতে পেরেছি”।
এক মাস পার হয়ে গেল। আবার গোপালগঞ্জ যাবার সময় হয়েছে। আমাকে সন্ধ্যার পূর্বে গোয়েন্দা বিভাগের একজন কর্মচারী আর বন্দুকধারী সিপাহিরা জেলগেট থেকে নিয়ে গেল। রাতে আমাকে পুলিশ লাইনে থাকতে হল, কারণ ভোর পাঁচটায় ট্যাক্সি ধরে ভাঙ্গায় যেতে হবে। অত ভোরে জেল থেকে কয়েদি দেওয়া সম্ভবপর নয়। পুলিশ লাইনের পাশেই আমার এক বন্ধুর বাড়ি। তাকে খবর দিলে সে আসল আমার সাথে দেখা করতে। অনেকক্ষণ আলাপ করলাম, সে রাজনীতি করে না। তাই কেউ কিছু বলল না। রাতে পুলিশ লাইনের ক্লাবেই ঘুমালাম। খুব ভোরে ভাঙ্গায় রওয়ানা করলাম। ভাঙ্গায় যেতে কয়েক ঘন্টা সময় লাগত। দুইটা ফেরি নৌকা পার হতে হত। রাস্তাও খুব খারাপ ছিল।
১৮৩
আমার দু’একজন আত্মীয়স্বজন উপস্থিত ছিল। তারাই বন্দোবস্ত করল। লঞ্চ বেশি দেরি করবে না। আমরা লঞ্চে উঠে বসলাম, সিন্ধিয়া ঘাটে বিকালে পৌছালাম। রাত এখানে কাটাতে হবে। আমি বললাম, কি দরকার সিন্ধিয়া ঘাটে নেমে, চলুন মাদারীপুর যাই। সেখান থেকেই তো রাত এগারটায় জাহাজ ছাড়বে। ভোররাতে সিন্ধিয়া ঘাট থেকে ওঠা বড় কষ্টকর। সিপাহিরা আপত্তি করল না। অনেকদূর উল্টা যেতে হয়। বিকালে মাদারীপুর পৌছালাম। জাহাজ ঘাটেই ছিল। আমি জাহাজে উঠে সকলের খাওয়ার কথা বাটলারকে বলে দিলাম। সিপাহিরা বলল, কেন এত খরচ করবেন। ঘাটেই হোটেল, জাহাজ ছাড়তে অনেক দেরি, ওখানেই খেয়ে নিব। মাদারীপুর ঘাটে পাঁচ-ছয় ঘন্টা দেরি হবে। আমার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবরা খবর পেল। অনেকে আসল। কিছু সময় আলাপ করলাম, কে কেমন আছে। আমাকে অনেকগুলি মিষ্টি কিনে দিল। সকলকে খেতে দিতে বাটলারকে বললাম। রাত এগারটায় জাহাজ ছাড়ল। আমি এখন স্বাধীন মানুষ- যদিও পুলিশ পাহারায়, তবু কম কিসে, বাইরের হাওয়া তো পাচ্ছি।
সকাল আটটায় হরিদাসপুর স্টেশনে নেমে নৌকায় গোপালগঞ্জ পৌছালাম। সঙ্গের পুলিশদের আমাকে থানায় নিয়ে যেতে বললাম। তাহলে আমাকে রেখে যেখানে হয় তারা যেতে পারবে। গোপালগঞ্জ যেয়ে দেখি থানার ঘাটে আমাদের নৌকা। আব্বা, মা, রেণু, হাচিনা ও কামালকে নিয়ে হাজির। ঘাটেই দেখা হয়ে গেল। এরাও এইমাত্র বাড়ি থেকে এসে পৌঁছেছে। গোপালগঞ্জ থেকে আমার বাড়ি চৌদ্দ মাইল দূরে। এক বৎসর পরে আজ ওদের সাথে আমার দেখা। হাচিনা আমার গলা ধরল আর ছাড়তে চায় না। কামাল আমার দিকে চেয়ে আছে, আমাকে চেনেও না আর বুঝতে পারে না, আমি কে? মা কাঁদতে লাগল। আব্বা মাকে ধমক দিলেন এবং কাঁদতে নিষেধ করলেন। আমি থানায় আসলাম, বাড়ির সকলে আমাদের গোপালগঞ্জের বাসায় উঠল। থানায় যেয়ে দেখি এক দারোগা সাহেব বদলি হয়ে গেছেন, তার বাড়িটা খালি আছে। আমাকে থাকবার অনুমতি দিল সেই বাড়িতে।
তাড়াতাড়ি কোর্টে যেতে হবে। প্রস্তুত হয়ে কোর্টে রওনা করলাম, এবার রাস্তায় অনেক ভিড়। বহু গ্রাম থেকেও অনেক সহকর্মী ও সমর্থক আমাকে দেখতে এসেছে। কোর্টে হাজির হলাম, হাকিম সাহেব বেশি দেরি না করে সাক্ষ্য নিতে শুরু করলেন। পরের দিন আবার তারিখ রাখলেন। আমি আমার আইনজীবীকে বললাম অনুমতি নিতে, যাতে আমার মা, আব্বা, ছেলেমেয়েরা আমার সাথে থানায় সাক্ষাৎ করতে পারেন। তিনি অনুমতি দিলেন। গোপালগঞ্জের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারী এবং যিনি ফরিদপুর থেকে গিয়েছিলেন, তাঁরা আমাকে বললেন, বাইরের লোক দেখা করলে অসুবিধা হবে। আপনার আব্বা, মা, স্ত্রী ও ছেলেমেয়ার দেখা করলে কোনো অসুবিধা হবে না। আমি আমাদের কর্মী ও অন্যান্য বন্ধুদের থানায় যেতে নিষেধ করলাম, কারণ এদের বিপদে ফেলে আমার লাভ কি? কোর্টেই তো দেখা হয়েছে সকলের সাথে। থানায় ফিরে এলাম এবং দারোগা সাহেবের বাড়িতেই আমার মালপত্র রাখা হল। আব্বা, মা, রেণু খবর পেয়ে সেখানেই আসলেন। যে সমস্ত পুলিশ গার্ড এসেছে ফরিদপুর থেকে তারাই আমাকে পাহারা দেবে এবং মামলা
১৮৪
শেষ হলে নিয়ে যাবে। আব্বা, মা ও ছেলেমেয়রা কয়েক ঘণ্টা রইল। কামাল কিছুতেই আমার কাছে আসল না। দূর থেকে চেয়ে থাকে। ও বোধহয় ভাবত, এ লোকটা কে?
পরের দিন সকালবেলা আবার দেখা হল, আমি কোর্ট থেকে ফিরে আসার পরেই আমাকে রওয়ানা করেত হল। বিকালবেলা সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জাহাজে চড়ে সন্ধ্যার পরে সিন্ধিয়া ঘাট পৌছালাম। রাত এখানেই কাটতে হবে। রাতে ডাকবাংলোয় রইলাম। রাতটা ভালভাবেই কেটেছিল। খাওয়া-দাওয়া ভাল ছিল না। তবে ডাকবাংলোয় রইলাম। রাতটা ভালভাবেই কেটেছিলাম। খাওয়া-দাওয়া ভাল ছিল না। তবে বাড়ি থেকে কিছু খাবার দিয়েছিল। খুব সকালবেলা লঞ্চ ধরলাম। সিন্ধিয়া ঘাটেও কয়েকজন কর্মী দেখা করেছিল। লঞ্চ দেরি করে নাই বলে আজ সন্ধ্যার সময়ই ফরিদপুর পৌঁছাতে পেরেছি। আমাকে রাতেই জেলে পৌঁছে দিল। জেলে শুধু তালা আর চাবি। গেটে তালা, ওয়ার্ডে তালা, কামরায় তালা। বাইরে থেকে তালা দেওয়া ঘরে রাত কাটাতে হবে। এইভাবে মামলার জন্য তিন চার মাস আমাকে যাওয়া-আসা করতে হল ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জ যাওয়া-আসা খুবই কষ্টকর ছিল। তাই সরকারের কাছে মাই লিখলাম, আমাকে বরিশাল বা খুলনা জেলে রাখলে গোপালগঞ্জ যাওয়া-আসার সুবিধা হবে। সোজা খুলনা বা বরিশাল থেকে জাহাজে উঠলে গোপালগঞ্জ যাওয়া যায়। কোনো জায়গায় ওঠানামা করতে হয় না। সরকার সেইমত আদেশ দিল, বরিশাল বা খুলনায় আমাকে রাখতে। কতৃপক্ষ আমাকে খুলনা জেলে পাঠিয়ে দিলেন। রাজবাড়ী, যশোর হয়ে খুলনা যেতে হল।
খুলনা জেলে যেয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কোনো জায়গায়ই নাই। একটা মাত্র দালান, তার মধ্যেই কয়েদি ও হাজতি সকলকে একসঙ্গে রাখা হয়েছে। আমাকে কোথায় রাখবে? একটা সেল আছে, সেখানে ভীষণ প্রকৃতির কয়েদিদের রাখা হয়। জেলার সাহেব আমাকে নিয়ে গেলেন ভিতরে। বললেন, “দেখুন অবস্থা, কোথায় রাখব আপনাকে, ছোট জেল”। আমি আবার রাজনৈতিক বন্দি হয়ে গেছি। সাজা আমার খাটা হয়ে গেছে। মাত্র তিন মাস জেল দিয়েছিল। অন্য কোনো রাজনৈতিক বন্দিও এ জেলে নাই। আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কতৃপক্ষ আমাকে পাঠাল কেমন করে এখানে! বোধহয় ছয়টা সেল, সেলগুলির সামনে চৌদ্দ ফিট দেওয়াল। একদিকে ফাঁসির ঘর, অন্যদিকে বত্রিশটা পায়খানা। সমস্ত কয়েদিরা ঐখানেই পায়খানা করে। যে তিন-চার হাত জায়গা আছে সামনে সেখানেও দাঁড়াবার উপায় নাই দুর্গন্ধে। খাবারের কোনো আলাদা ব্যবস্থা করা যাবে না, কারণ উপায় নাই। একটা সেলে আমাকে রাখা হল আর হাসপাতাল থেকে ভাত তরকারি দিবে তাই খেতে হবে, রোগীরা যা খায়। বাড়ি থেকে কিছু চিড়া, মুড়ি, বিস্কুট আমাকে দিয়েছিল। তাই আমাকে খেয়ে বাঁচতে হবে। আমার জীবনটা অতিষ্ট হয়ে উঠল। আমি জেলার সাহেবকে বললাম, “আপনি লেখেন ওপরে। এখানে জায়গা নাই। আমার এখানে থাকা চলবে না। আর যদি রাখতে হয়, থাকার ভাল ব্যবস্থা করতে হবে”।
কয়েকদিনের মধ্যে আবার মামলার তারিখ। জাহাজে উঠে ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোরে গোপালগঞ্জ পৌঁছে দিবে। এই কয়েকদিনের মধ্যেই আমার শরীর অনেকটা খারাপ হয়ে
১৮৫
গেছে। একদিন আমাকে জেল অফিসে ডেকে পাঠানো হল। সিভিল সার্জনরা জেলা জেলের এক্স-অফিসও সুপারিনটেনডেন্ট। এখন খুলনায় মোহাম্মদ হোসেন সাহেব সিভিল সার্জন। তিনি জেল পরিদর্শন করেতে এসে আমার কথা শুনে আমাকে অফিসে নিয়ে যেতে বললেন। আমি যেয়ে দেখি তিনি বসে আছেন। আমাকে বসতে বললেন তাঁর কাছে। আমি বসবার সাথে সাথে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কেন জেল খাটছেন”। আমিও উত্তর দিলাম, “ক্ষমতা দখল করার জন্য”। তিনি আমার মুখের অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “ক্ষমতা দখল করে কি করবেন?’বললাম, “যদি পারি দেশের জনগণের জন্য কিছু করব। ক্ষমতায় না যেয়ে কি তা করা যায়?”তিনি আমাকে বললেন, “বহুদিন জেলের সাথে আমার সম্পর্ক রয়েছে। অনেক রাজবন্দির সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। অনেকের সাথে আলাপ হয়েছে, এভাবে কেউ আমাকে উত্তর দেয় নাই, যেভাবে আপনি উত্তর দিলেন। সকলের ঐ একই কথা, জনগণের উপকারের জঞ্জ জেল খাটছি। দেশের খেদমত করছি, অত্যাচার সহ্য করতে পারছি না বলে প্রতীবাদ করেছি, তাই জেলে এসেছি। কিন্ত আপনি সোজা কথা বললেন, তাই আপনাকে ধন্যবাদ দিলাম”। তারপর আমার সুবিধা অসুবিধার কথা আলোচনা হল। তিনি আমাকে বললেন যে, তিনিও উপরের কর্মকর্তাদের কাছে রাজবন্দিদের অসুবিধার কথা লিখেছেন। শীঘ্রই উত্তর পাবার আশা করেন। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে তাও বললেন। জেল অফিসের পিছনে সামান্য জায়গা ছিল। বিকালে ওখানে আমি হাঁটাচলা করতাম। জেলার সাহেব হুকুম দিয়েছিলেন। এই অন্ধকূপের মধ্যে থাকা সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। জানালা না, মাত্র একটা দরজা, তার সামনেও আবার দেওয়ার দিয়ে ঘেরা। রাজশাহীর একজন সিপাহির ডিউটি প্রায়ই ওখানে পড়ত। চমৎকার গান গাইত। সে আসলেই তার গান শুনতাম।
আমি গোপালগঞ্জে আসলাম, মামলা চলছিল। সরকারি কর্মচারীরা সাক্ষী। সকলেই প্রায় বদলি হয়ে গেছে। আসতে হয় দূর দূর থেকে, এক একজন এক একবার আসেন। আমি জেল থেকে যাই আর সরকারি উকিল ও কোর্ট ইন্সপেক্টর ফরিদপুর থেকে আসেন। বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে এসেছে। বললাম কিছু ডিম কিনে দিতে, কারণ না খেয়ে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে। এক মাসে শরীর আমার একদম ভেঙে গিয়েছে। চোখের অবস্থা খারাও। পেটের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে। বুকে ব্যথা অনুভব করতে শুরু করেছি। রেণু আমাকে সাবধান করল এবং বলল, “ভুলে যেও না, তুমি হার্টের অসুখে ভুগেছিলে এবং চক্ষু অপারেশন হয়েছিল”। ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, আর কি করা যায়। হাচু আমাকে মোটেই ছাড়তে চায় না। আজকাল বিদায় নেওয়ার সময় কাঁদতে শুরু করে। কামালও আমার কাছে এখন আসে। হাচু ‘আব্বা’ বলে দেখে কামালও ‘আব্বা’ বলতে শুরু করেছে। গোপালগঞ্জ থানা এলাকার মধ্যে থাকতে পারি বলে কয়েক ঘন্টা ওদের সাথে
১৮৬
থাকতে সুযোগ পেতাম। কিছুদিন পরে দুইজন সাথী পেলাম। নূরুন্নবী নামে একজন রাজনৈতিক বন্দি রাজশাহী থেকে এসেছে, কোর্টে হাজিরা দিতে। কারণ তার বিরুদ্ধে একটা মামলা আছে খুলনা কোর্টে। রাজশাহীতে যখন রাজবন্দিদের উপর গুলি করে তখন সে ওখানেই ছিল। গুলির আঘাতে তার একটা পা ভীষণভাবে জখম হয় এবং ডাক্তার সাহেবরা পা’টা কেটে ফেলে দেয়। তাকে এখন এক পায়ে হাঁটতে হয়। অল্প বয়স, সুন্দর চেহারা, জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে, কিন্ত মুক্তি দেয় নাই। তার বাড়ি বর্ধমান।
কিছুদিন পরে ঢাকা জেল থেকে কৃষক নেতা বিষ্ণু চ্যাটারজি এলেন, পায়ে ডাণ্ডা বেড়ি দেওয়া অবস্থায়। তাঁর সাজা হয়েছে একটা মামলায়। তার বিচার শুরু হবে। সদা হাসি খুশি মুখ, কোনো দুঃখ নাই বলে মনে হল। একদিন বললেন, “দুঃখ তো আর কিছু নয়, এরা আমাকে ডাকাতি মামলার আসামি করল!”বিষ্ণু বাবুকে ডিভিশন দেয় নাই। তাই কয়েদির কাপড় তাকে পরে থাকতে ও কয়েদির খানা খেতে হয়। নূরুন্নবী সকল সময়ই মুখটা কালো করে থাকত। জীবনের তরে খোঁড়া হয়ে গিয়েছে এই তার দুঃখ। তার কাছ থেকে রাজশাহী জেলের অত্যাচারের করুন কাহিনী শুনলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও একজন ইংরেজ কর্মচারী কি নির্দয়ভাবে গুলি চালাতে হুকুম দিয়েছিল এবং তাতে সাতজন স্বাধীনতা সংগ্রামী রাজনৈতিক বন্দি সকলে মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যারা বেঁচে আছে তাদের অবস্থাও শোচনীয়। কারণ, এমনভাবে তাদের মারপিট করেছে যে জীবনে কিছুই করবার উপায় নাই।
প্রায় তিন মাস হয়েছে খুলনা জেলে এসেছি। নিরাপত্তা আইনের বন্দিরা ছয় মাস পর পর সরকার থেকে একটা করে নতুন হুকুম পেত। আমার বোধহয় আঠার মাস হয়ে গেছে। ছয় মাসের ডিটেনশন অর্ডারের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। নতুন অর্ডার এসে খুলনা জেলে পৌঁছায় নাই। জেল কতৃপক্ষ আমাকে কোন হুকুমের ওপর ভিত্তি করে জেলে রাখবেন? আমি বললাম, “অর্ডার যখন আসে নাই, আমাকে ছেড়ে দেন। যদি আমাকে বন্দি রাখেন, তবে আমি বেআইনিভাবে আটক রাখার জন্য মামলা দায়ের করে দিব”। জেল কতৃপক্ষ খুলনার ম্যাজিস্ট্রেট ও এসপির সাথে আলাপ করলেন, তাঁরা জানালেন তাঁদের কাছেও কোন অর্ডার নাই যে আমাকে জেলে বন্দি করে রাখতে বলতে পারেন। তবে আমার ওপরে একটা প্রডাকশন ওয়ারেন্ট ছিল, গোপালগঞ্জ মামলার। কাস্টাডি ওয়ারেন্ট নাই যে জেলে রাখবে। অনেক পরামর্শ করে তাঁরা ঠিক করলেন, আমাকে গোপালগঞ্জ কোর্টে পাঠিয়ে দিবে এবং রেডিওগ্রাম করবে ঢাকায়। এর মধ্যে ঢাকা থেকে অর্ডার গোপালগঞ্জে পৌছাতে পারবে। আমাজে জাহাহে পুলিশ পাহারায় গোপালগঞ্জ পাঠিয়ে দিল। গোপালগঞ্জ কোর্টে আমাকে জামিন দিয়ে দিল পরের দিন। বিরাট শোভাযাত্রা করল জনগণ আমাকে নিয়ে। বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দিয়েছি। রাতে বাড়িতে পৌছাব। আমার গোপালগঞ্জ বাড়িতে বসে আছি। নৌকা ভাড়া করতে গিয়েছে। যখন নৌকা এসে গেছে, আমি সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওয়ানা করব ঠিক করেছি এমন সময় পুলিশ ইন্সপেক্টর ও গোয়েন্দা কর্মচারী আমার কাছে এসে বলল, “একটা কথা আছে”। কোনো পুলিশ তারা আনে নাই। আমার
১৮৭
কাছে তখনও একশতের মত লোক ছিল। আমি উঠে একটু আলাদা হয়ে ওদের কাছে যাই। তারা আমাকে একটা কাগজ দিল। রেডিওগ্রামে অর্ডার এসেছে আমাকে আবার গ্রেফতার করতে, নিরাপত্তা আইনে। আমি বললাম, “ঠিক আছে চলুন”। কর্মচারীরা ভদ্রতা করে বলল, “আমাদের সাথে আসতে হবে না। আপনি থানায় চলে গেলেই চলবে”। কারণ, আমাকে নিয়ে রওয়ানা হলে একটা গোলমাল হতে পারত। আমি সকলকে ডেকে বললাম, “আপনারা হৈচৈ করবেন না, আমি মুক্তি পেলাম না। আবার হুকুম এসেছে আমাকে গ্রেফতার করতে। আমাকে থানায় যেতে হবে। এদের কোনো দোষ নাই। আমি নিজে হুকুম দেখেছি”। নৌকা বিদায় করে দিতে বললাম। বাক্সে কাপড়চোপড়, বইখাতা বাধা ছিল সেগুলি থানায় পৌঁছে দিতে বললাম। কয়েকজন কর্মী কেঁদে দিল। আর কয়েকজন চিৎকার করে উঠল, “না, যেতে দিব না, তারা কেড়ে নিয়ে যাক”। আমি ওদের বুঝিয়ে বললাম, তারা বুঝতে পারল। গোয়েন্দা বিভাগের অফিসার সাহেব খুবই ভদ্রলোক ছিলেন। তাঁকে আমি বললাম, আপনি আমার সাথে চলুন, তা না হলে ভাল দেখায় না, কোনো গোলমাল হবে না। বাড়িতে আবার লোক পাঠালাম। রাতেই লোক রওয়ানা হয়ে গেল। আগামীকালই বোধহয় আমাকে অন্য কোন জেলে নিয়ে যাবে। নিষেধ করে দিয়েছিলাম, কেউ যেন না আসে, আমাকে পাবে না।
রাতে আবার থানায় রইলাম। থানার করমচারীরাও দুঃখ পেয়েছিল। সতের-আঠার মাস পরে ছেড়ে দিয়েও আবার গ্রেফতার করার কি কারণ থাকতে পারে? পরের দিন লোক ফিরে এসে বলল, রাতভর সকলে জেগেছিল বাড়িতে, আমি যে কোনো সময় পৌঁছাতে পারি ভেবে। মা অনেক কেঁদেছিল, খবর পেলাম। আমার মনটাও খারাপ হল। আমার মা, আব্বা ও ভাইবোন এবং ছেলেমেয়েদের এ দুঃখ না দিলেই পারত। আমি তো সরকারের কাছে বন্ড দেই নাই। আমাকে মুক্তি দিল কেন? হুকুমনামা সময়মত আসে নাই কেন? আমার তো কোনো দোষ ছিল না? এই ব্যবহার আমার সাথে না করলেই পারত। অনেক রাত পর্যন্ত লোকজন থানায় রইল। আমিও বসে রইলাম। ভাবলাম, অনেক দিন থাকতে হবে কারাগারে। দুই দিন গোপালগঞ্জ থানায় আমাকে থাকতে হল। ঢাকা থেকে খবর আসে নাই আমাকে কোন জেলে নিবে। আমার শরীর খুবই খারাপ হয়ে পড়েছিল খুলনা জেলে থাকার সময়। এ ঘটনার পরে আরও একটু খারাপ হল।
দুই দিন পরে খবর এল, আমাকে ফরিদপুর জেলে নিয়ে যেতে। আমি ফরিদপুর জেলে ফিরে এলাম। এবার আমাকে রাখা হল রাজবন্দিদের ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডে দুইটা কামরা; এক কামরায় পাঁচজন ছিল। আরেক কামরায় গোপালগঞ্জের বাবু চন্দ্র ঘোষ, মাদারীপুরের বাবু ফণি মজুমদার ও আমি। এই দুইজনকে আমি পূর্বে থেকেই জানতাম। ফণি মজুমদার পূর্বে ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা ছিলেন। ইংরেজ আমলে আট-নয় বৎসর জেল
১৮৮
খেটেছেন। দেশ স্বাধীন হবার পরেও রেহাই নাই। বিবাহ করেন নাই। তাঁর বাবা আছেন পাকিস্তানে, পেনশন পান। ফণি বাবু দেশ ছাড়তে রাজি হন নাই বলে তিনিও দেশ ছাড়েন নাই। হিন্দু-মুসলমান জাতি ধর্ম-নির্বিশেষে তাঁকে ভালবাসত। কেউ কোন বিপদে পড়লে ফণি মজুমদার হাজির হতেন। কারো বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে ফণি মজুমদারকে পাওয়া যেত। আমাকে অত্যনাত স্নেহ করতেন। সরকার যাদের কমিউনিস্ট ভাবতেন, তারা আছে এক কামরায়। আমরা তিনজন কমিউনিস্ট নই, তাই আমরা আছি অন্য কামরায়।
চন্দ্র ঘোষ ছিলেন একজন সমাজকর্মী। জীবনে রাজনীতি করেন নাই। মহাত্মা গান্ধীর মত একখানা কাপড় পরতেন, একখানা গায়ে দিতেন। শীতের সময়ও তার কোনো ব্যতিক্রম হত না। জুতা পরতেন না, খড়ম পায়ে দিতেন। গোপালগঞ্জ মহকুমায় তিনি অনেক স্কুল করেছেন। কাশিয়ানী থানার রামদিয়া গ্রামে একটা ডিগ্রি কলেজ করেছেন। অনেক খাল কেটেছেন, রাস্তা করেছেন। এই সমস্ত কাজই তিনি করতেন। পাকিস্তান হওয়ার পরে একজন সরকারি কর্মচারী অতি উৎসাহ দেখাবার জন্য সরকারকে মিথ্যা খবর দিয়ে তাঁকে গ্রেফতার করায় এবং তাঁর শাস্তি হয়। শহীদ সোহরাওয়ারদী সাহেব গোপালগঞ্জে এসে ১৯৪৮ সালে সেই কর্মচারীকে বলেছিলেন, চন্দ্র ঘোষের মত মানুষকে গ্রেফতার করে ও মিথ্যা মামলা দিয়ে পাকিস্তানের বদনামই করা হচ্ছে।
চন্দ্র ঘোষ শাস্তি ভোগ করে আবার নিরাপত্তা বন্দি হয়েছেন। আমি গোপালগঞ্জের লোক, আমি সকল খবরই রাখতাম। মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানের আন্দোলন আমি বেশি করেছি এই সমস্ত এলাকায়। দেশের মুসলমান, হিন্দু সকলেই ভালবাসত চন্দ্র ঘোষকে। তাঁর অনেক মুসলমান ভক্তও ছিল। তফসিলী সম্প্রদায়ের হিন্দুরাই তাঁর বেশি ভক্ত ছিল। গোপালগঞ্জের কিছু সংখ্যক তফসিলী সম্প্রদায়ের হিন্দু পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিল, এমনকি কিছু সংখ্যক নমশূদ্র হিন্দু কর্মী আমাদের সাথে সিলেটে গণভোটে কাজ করেছিল। চন্দ্র ঘোষ একটা মেয়েদের হাইস্কুলও করেছিলেন। আমিও অনেক সরকারি কর্মচারীকে বলেছিলাম, এ ভদ্রলোককে অত্যাচার না করতে। কারণ, তিনি কোনোদিন রাজনীতি করেন নাই। সমাজের অনেক কাজ হবে তাঁর মত নিঃস্বার্থ ত্যাগী সমাজসেবক দিয়ে। দেশ স্বাধীন হয়েছে, এদের ব্যবহার করা দরকার। কে কার কথা শোনে! সরকারকে খবর দেওয়া হয়েছিল, হিন্দুরা আইন মানছে না। হিন্দুস্থানের পতাকা তুলেছে। চন্দ্র ঘোষ এদের নেতা। শীঘ্রই আরও আর্মড পুলিশ পাঠাও, আরও কত কি, খোদা জানে! কিন্ত আমি জানি, সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। গোপালগঞ্জে মুসলমানদেরও শক্তি কম ছিল না। সে রকম হলে মুসলমানরা নিশ্চয়ই বাধা দিত। যদি এ সমস্ত অন্যায় করত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও বেধে যেত। তেমন কোনো কিছুই হয় নাই। চন্দ্র ঘোষের গ্রেফতারে হিন্দুরা ভয় পেয়েছিল। বর্ণ হিন্দুরা পশ্চিমবঙ্গের দিকে রওয়ানা করতে শুরু করেছে। যা সামান্য কিছু আছে, তাও যাবার জন্য প্রস্তুত। তাঁকে গ্রেফতারের একমাত্র কারণ ছিল সরকারকে দেখান, ‘দেখ আমি কিভাবে রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ দমন করলাম। পাকিস্তানকে রক্ষা করলাম, ইত্যাদি ইত্যাদি’।
১৮৯
আমি ফরিদপুর জেলে আসলাম, স্বাস্থ্য খারাপ নিয়ে। এসেই আমার ভীষণ জ্বর ; মাথার যন্ত্রণা, বুকে ব্যথা অনুভব করতে লাগলাম। চিকিৎসার ক্রুটি করেছেন না জেল কতৃপক্ষ, তবুও কয়েকদিন খুব ভুগলাম। রাতভর চন্দ্র বাবু আমার মাথার কাছে বসে পানি ঢেলেছেন। যখনই আমার হুঁশ হয়েছে দেখি চন্দ্র বাবু বসে আছেন। ফণি বাবুও অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতেন আমার জন্য। তিন দিনের মধ্যে আমি চন্দ্র বাবুকে বিছানায় শুতে দেখি নাই। আমার মাথা টিপে দিয়েছেন। কখনও পানি ঢেলেছেন, কখনও ওষুধ খাওয়াচ্ছেন।কখনও পথ্য খেতে অনুরোধ করছেন। না খেতে চাইলেন ধমক দিয়ে খাওয়াতেন। আমি অনুরোধ করতাম, এত কষ্ট না করতে। তিনি বলতেন, “জীবনভরই তো এই কাজ করে এসেছি, এখন বুড়াকালে কষ্ট হয় না”। ডাক্তার সাহেব আমাকে হাসপাতালে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্ত চন্দ্র বাবু ও ফণি বাবু দেন নাই, কারণ সেখানে কে দেখবে? অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিরাও আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। কয়েকদিন পরেই আমি আরোগ্য লাভ করলাম। কিন্ত খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম বলে গোপালগঞ্জে মামলার দিনে যেতে পারি নাই। বাড়ির সকলে এসে ফিরে গিয়েছিল। বাড়ি থেকে নৌকায় আসতে হয় ও গোপালগঞ্জে থাকতে হয়, নানা অসুবিধা। আমি গোপালগঞ্জ না যাওয়ায় আব্বা খুব চিন্তিত হয়ে পরে টেলিগ্রাম করেছিলেন।
এদিকে জ্বর থেকে মুক্তি পেলেও হার্ট দুর্বল হয়ে পড়েছে। চোখের অসুখ বেড়েছে। পেটে একটা বেদনা অনুভব করতাম। এইভাবে আরও এক মাস কেটে গেল। গোপালগঞ্জে মামলার তারিখে আবার সেই পুরানা পথ দিয়ে যেতে হল। এবার যেন সিন্ধিয়া ঘাট ডাকবাংলোকে আমার আরও ভাল লাগল। অনেক দিন পরে রাতে ঘরের বাইরে আছি। কত কথাই না মনে পড়ল। ১৯৪৫ সালে এই জায়গাটায় সোহরাওয়ারদী সাহেবকে নিয়ে একরাত কাটিয়েছিলাম। আমার বন্ধু ও সহকর্মী মোল্লা জালালউদ্দিন আমার সাথে ছিল। এখান থেকেই পরের দিন নৌকায় তাঁকে গোপালগঞ্জ নিয়ে যায়। ফরিদপুরের জালাল ও হামিদ আমার সাথে পাকিস্তানের আন্দোলনে কাজ করেছে।
সন্ধ্যার পরে অনেক লোক আমাকে দেখতে আসল। এটা একটা ছোট্ট বন্দর। কয়েকজন ছোটখাটো সরকারি কর্মচারী এখানে থাকতেন। তাঁরাও অনেকে আমার শরীর খারাপ শুনে দেখতে আসলেন। কিছু সময় আলাপ করার পরে একে একে সকলে বিদায় হলেন। ভয় তো কিছুটা আছে, যদি গোয়েন্দারা রিপোর্ট দেয়।
এর মধ্যে একটা ঘটনাও ঘটে গেছে। মাদারীপুরের গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মচারী রিপোর্ট দিয়েছে যে, আমি যখন মাদারীপুর জাহাজে ছিলাম তখন লোক দেখা করেছে আমার সাথে। তাই যারা আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে আসত তারা এখন ভয় পেয়ে গেছে। তারা আমাকে অনুরোধ করেছে যাতে বাইরের লোকের সাথে বেশি আলাপ না
১৯০
করি। আলাপ তো করব না সত্য, কিন্ত যারা আমাকে দেখতে আসে তাদের বাধা দেই কেমন করে? আলাপ তো শুধু এইটুকু ‘আসসালামু আলাইকুল, ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছেন? আপনারা কেমন আছেন’? তাঁরা ভুলে গেছেন, এটা আমার জেলা, এখানে আমার আত্মীয়স্বজন অনেক। রাজনীতি করেছি এ জেলায়। আমি প্রায় থানায়ই পাকিস্তানের জন্য সভা করেছি, অনেকে আমাকে জানে। অন্ততপক্ষে বিশ-ত্রিশজন আর্মড পুলিশ দিয়ে আমাকে পাঠান উচিত ছিল। সোজা সরকারি লঞ্চ দিয়ে ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জ এবং গোপালগঞ্জ কোর্ট থেকে ফরিদপুর আনা নেয়া করা দরকার ছিল। এদের দোষ দিয়ে লাভ কি? যতদূর পারা যায় আমি নিজেই চেষ্টা করি, যাতে এই গরিবদের চাকরির ক্ষতি না হয়।
বেশি সময় বাইরে বসে থাকা উচিত না, আবার জ্বর হলে আর উপায় থাকবে না। ভোররাতে আবার জাহাজ ধরতে হবে, যদিও ঘাট একদম কাছ। গোপালগঞ্জ পৌছালাম। এবারও বাড়ি থেকে সকলে এসেছে। দুই তিনটা বড় নৌকা নিয়ে এসেছে। সকলেই আমার শরীরের অবস্থা দেখে চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়েছিল। মা তো চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলেন। কোর্ট থেকে ফিরে এলাম বিকালে। আগামীকাল আবার তারিখ পড়েছে। কোর্ট ইন্সপেক্টর সাহেবকে বললাম, “দেরি করছেন কেন? সমস্ত সাক্ষী হাজির করেন”। গোপালগঞ্জের পুরানা এসডিও সাক্ষী ছিলেন। তিনি তো আসলেনই না, তখন বোধহয় চট্টগ্রামে ছিলেন। না এসে ভদ্রলোক ভালই করেছেন, কারণ একটা গোলমাল হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। লোক খুব ক্ষেপেছিল।
এক আশ্চর্য ঘটনা দেখলাম, গোপালগঞ্জের পুরানা পুলিশ ইন্সপেক্টর সাহেব সাক্ষী দিতে এসেছেন। বোধহয় এখন ঢাকায় বদলি হয়েছেন। গোপালগঞ্জে তাঁর নাম ছিল খুব, সাধু কর্মচারী হিসাবে। ঘুষ খেতেন না। তিনি সাক্ষী দিতে উঠে একটা মিথ্যা কথাও বললেন না, যা সত্য, যা দেখেছেন তাই বললেন। আমি যে জনগণকে শান্তভাবে চলে যেতে বলেছিলাম, সেকথাও স্বীকার করলেন। সরকারি উকিল ভদ্রলোক খুব চটে গেছেন দেখলাম। কিন্ত বলা তো হয়ে গেছে। আর হাকিম সাহেবও লিখে ফেলেছেন, এখন আর উপায় কি? আমি বুঝলাম, মামলায় বোধহয় কিছু হবে না, তবে ঘুরতে হবে আরও কিছুদিন। পাকিস্তানে এ রকম পুলিশ কর্মচারীও আছে, যারা মিথ্যা কথা বলতে চান না। আমাদের দেশে যে আইন সেখানে সত্য মামলায়ও মিথ্যা সাক্ষী না দিলে শাস্তি দেওয়া যায় না। মিথ্যা দিয়ে শুরু করা হয়, আর মিথ্যা দিয়ে শেষ করতে হয়। যে দেশের বিচার ও ইনসাফ মিথ্যার উপর নির্ভরশীল সেদেশের মানুষ সত্যিকারের ইনসাফ পেতে পারে কি না সন্দেহ!
আবার পরের তারিখ পড়ল। আমি আগের মত থানায় ফিরে এলাম। দুই দিন সকাল ও বিকালে সকলের সাথে দেখা হল। রাজা মামা ও মামী কিছিতেই অন্য কোথাও খাবার বন্দোবস্ত করতে দিলেন না। মামী আমাকে খুব ভালবাসতেন। নানীও আছেন সেখানে। আমার খাবার তাঁদের বাসা থেকেই আসত। বাড়ি থেকে যারা এসেছিল তাদের
১৯১
ফরিদপুর জেলে ফিরে এলাম। দেখি চন্দ্র বাবু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, অবস্থা খুবই খারাপ। তাঁর হার্নিয়া ব্যারাম ছিল। পেটে চাপ দিয়েছিল, হঠাৎ নাড়ি উলটে গেছে। ফলে গলা দিয়ে মল পড়তে শুরু করেছে। যে কোন সময় মারা যেতে পারেন। সিভিল সার্জন সাহেব খুব ভালো ডাক্তার। তিনি অপারশন করতে চাইলেন, কারণ মারা যখন যাবেনই তখন শেষ চেষ্টা করে দেখতে চান। আত্মীয়স্বজন কেই নাই যে, তাঁর পক্ষ থেকে অনুমতিপত্র লিখে দিবে। চন্দ্র ঘোষ নিজেই লিখে দিতে রাজি হলেন। বললেন, “কেউ যখন নাই তখন আর কি করা যাবে!” সিভিল সার্জন সাহেব বাইরের হাসপাতালে নিতে হুকুম দিলেন। চন্দ্র ঘোষ তাঁকে বললেন, “ আমাকে বাইরের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। আমার তো কেউ নাই। আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে একবার দেখতে চাই, সে আমার ভাইয়ের মত। জীবনে তো আর দেখা হবে না”। সিভিল সার্জন এবং জেলের সুপারিনটেনডেন্ট, তাঁদের নির্দেশে আমাকে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া হল। চন্দ্র ঘোষ স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন। দেখে মনে হল, আর বাঁচবেন না, আমাকে দেখে কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, “ভাই, এরা আমাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে বদনাম দিল, শুধু এই আমার দুঃখ মরার সময়! কোনোদিন হিন্দু মুসলমানকে দুই চোখে দেখি নাই। সকলকে আমার ক্ষমা করে দিতে বোলো। আর তোমার কাছে আমার অনুরোধ রইল, মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখ। মানুষে মানুষে কোন প্রাথক্য ভগবানও করেন নাই। আমার তো কেউ নাই, আপন ভেবে তোমাকেই শেষ দেখা দেখে নিলাম। ভগবান তোমার মঙ্গল করুক”। এমনভাবে কথাগুলো বললেন যে সুপারিনটেনডেন্ট, জেলার সাহেব, ডেপুটি জেলার, ডাক্তার ও গোয়েন্দা কর্মচারী সকলের চোখেই পানি এসে গিয়েছিল। আর আমার চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। বললাম, “চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসাবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিষ্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ”। আর কথা বলার শক্তি আমার ছিল না। শেষ বারের মত বললাম, “আল্লাহ করলে আপনি ভাল হয়ে যেতে পারেন”। তাঁকে নিয়ে গেল। সিভিল সার্জন সাহেব বললেন, “আশা খুব কম, তবে শেষ চেষ্টা করছি, অপারেশন করে”।
১৯২
আমরা সকলেই খুন চিন্তায় রইলাম, কি হয়! দুই ঘন্টা প্রে জেল কতৃপক্ষ খবর দিল, অপারেশন করা হয়ে গেছে, অবস্থা ভালই মনে হয়। সন্ধ্যায় আবার খবর পেলাম, বাঁচার সম্ভাবনা আছে, তবে এখনও বলা যায় না। রাতটা অনেক উদ্বেগে কাটালাম, সকালবেলা খবর পেলাম তাঁর অবস্থা উন্নতির দিকে। গলা দিয়ে মল আসছে না। আশা করা যায়, এবারকার মত বেঁচে যাবেন। পরের দিন সরকার থেকে খবর এসেছে তাঁকে মুক্তি দিতে। মুক্তি তিনি পেলেন, তবে কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হবে, যদি বেঁচে যান। বোধহয় পনের দিন হাসপাতালে ছিলেন। আর ভয় নাই, শুধু ঘা এখনও সম্পূর্ণভাবে ভাল হয় নাই। তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অন্তরীণ আদেশ দিলেন। তাঁর গ্রাম রামদিয়ায় তাঁকে থাকতে হবে। চন্দ্র ঘোষ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি বললেম, “যদি পাকিস্তানে থাকতে হয়, তবে গ্রামে অন্তরীণ থাকতে হবে। আর যদি চিকিৎসা করতে কলকাতা যেতে চান, আমাদের আপত্তি নাই। যখন আসবেন, পুলিশকে খবর দিতে হবে”।
চন্দ্র বাবু রাজি হলেন এবং জেলগেটে আসলেন, তাঁর সামান্য জিনিস নিতে। আমাকে যাবার পূর্বে খবর দিয়েছিলেন। তাঁর চলে যাওয়াতে সত্যই আমি দুঃখ পেয়েছিলাম। কয়েকদিন পরে ফণি বাবুও যেন কোথায় চলে গেলেন। এখন এই কামরায় আমি একলা পড়লাম; দিনেরবালায় যদিও দেখা হত অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিদের সাথে। রাতে আমাকে একলাই থাকতে হত। তবে প্রত্যেক রবিবার আমরা এক জায়গায় বসতাম এবং হালকা গল্পগুজব করতাম, যে যা জানে। আমাদের মধ্যে রাজনীতির বেশি আলাপ হত না। কোনো সময় আলোচনা শুরু হলেই তর্ক-বিতর্ক শুরু হত। চারজন ছিলেন একমতাবলম্বী, আমি একা এবং বাবু নেপাল নাহা অন্য মতের। আমাদের রাজনৈতিক দ্রৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। ডা. মারুফ হোসেন আমাদের খাবার ইনচারজ ছিলেন। আমরা তাঁকে ‘ম্যানেজার’ বলতাম। আমাদের কষ্ট হত কারণ যা আমাদের দেওয়া হত, তাতে চলা কষ্টকর ছিল। ফরিদপুর জেলে যথেষ্ট শাক-সবজি হত। তার থেকে কিছু আমাদের মাঝে মাঝে দেওয়া হত।
যাহোক, আরও একবার গোপালগঞ্জ যাই। আমার স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়ে পড়েছিল। হার্ট দুর্বল হয়ে গেছে, চক্ষু যন্ত্রণা বেড়ে গেছে, লেখাপড়া করতে পারছি না। আমার বাম পায়ে একটা রিউম্যাটিকের ব্যথ্যা হয়েছিল। সিভিল সার্জন ও ডাক্তার সাহেব আমাকে খুব ভালভাবে চিকিৎসা করেছিলেন, কিন্ত কোনো উন্নতি হচ্ছে না দেখে আমাকে বললেন, “আপনাকে ঢাকা জেলে পাঠিয়ে দিতে চাই। কারণ চোখের ও হার্টের চিকিৎসা এখানে হওয়া সম্ভব নয়। মেডিকেল কলেজে আপনার ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করা দরকার”। আমি বললাম, “যা ভাল হয়, তাই আপনারা করবেন। আমি কি বলতে পারি!”লেখালেখি করতে কয়েকদিন সময় লাগল। তারপর আরও কিছুদিন পরে সরকার থেকে হুকুম এল আমাকে ঢাকা জেলে পাঠাতে। ফরিদপুর থেকে ট্রেনে গোয়ালন্দ। গোয়ালন্দ থেকে জাহাজে নারায়ণগঞ্জ আসলাম এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্যাক্সিতে করে ঢাকা জেল। জেলগেট থেকে জেল হাসপাতাল।
১৯৩
গোয়ালন্দের জাহাজ তখনও ভাল এবং আরামদায়ক ছিল। সরকার আমাকে ইন্টার ক্লাসে নিয়ে যাওয়ার পাস দিয়েছিলেন। আমি বললাম, “আমি প্রথম ক্লাসে যাব। কারণ, জাহাজে অত্যান্ত ভিড়, আমার ঘুমাতে হবে। আমার টাকা আছে আপনাদের কাছে, সেই টাকা দিয়ে প্রথম শ্রেণীর টিকেট কিনে নেন”। কি করবে? আমার সাথে গোলমাল করে বোধহয় বেশি সুবিধা হবে না। তাঁরা রাজি হলে। এছাড়াও গরিব সরকারি কর্মচারীরা কখনও চায় নাই আমার কোনো অসুবিধা হোক।
আমি যখন ঢাকা জেলে আসলাম তখন ১৯৫১ সালের শেষের দিকে হবে। প্রায় এক মাস জেল হাসপাতালে রইলাম। আমার মালপত্র সেই পুরানা জায়গায় নিয়ে রাখা হয়েছিল। মওলানা ভাসানী সাহেব পূর্বেই মুক্তি পেয়ে গেছেন। কয়েকদিন পরে খবর পেলাম, বরিশালের মহিউদ্দিন সাহেবকে ঢাকা জেলে নিয়ে আসা হয়েছে, নিরাপত্তা আইনে বন্দি করে। সে কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত জেলা মুসলিম লীগের সম্পাদক ছিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জড়িত থাকার জন্য তাকে নাকি সরকার গ্রেফতার করেছে। ১৯৫১ সালে বরিশালে এক ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল। মহিউদ্দিন পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মী ছিল। ছাত্র আন্দোলনে সে আমার বিরুদ্ধ দলে ছিল। আমরা মুসলিম লীগ ত্যাগ করলেও সে ত্যাগ করে নাই। বরিশালে তারই এক সহকর্মী আমার বিশিষ্ট বন্ধু কাজী বাহাউদ্দিন জেলা ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন এবং মহিউদ্দিন সাহেবের বিরুদ্ধ দলে ছিলেন। আমি ও আমার সহকর্মীরা মহিউদ্দিনকে ভাল চোখে দেখতাম না। কারণ, তখন পর্যন্ত সে সরকারের অন্ধ সমর্থক ছিল। মহিউদ্দিনের সাথে আলাপ করে দেখলাম, তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বের হতে পারলে সে আর মুসলিম লীগ করবে না, সেটা আমি বুঝতে পারলাম। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি যে পাকিস্তানের জন্য ক্ষতিকর একথাও সে স্বীকার করল।
ঢাকা জেল হাসপাতালে চিকিৎসা হবে না, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাতে হবে। আমি জানিয়ে দিলাম আমাকে কেবিন দিতে হবে, না হলে আমি যাব না। সরকার কেবিন দিতে রাজি হলেন। আমাকে মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত চলছে। আমার ও মহিউদ্দিনের মধ্যে অনেক ভুল বোঝাবুঝি ছিল পূর্বে, এখন দুইজনই বন্দি। আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। মহিউদ্দিন আমাকে বলল, “তোমার জন্য তো তোমার দল ও ছাত্রলীগ মুক্তি-আন্দোলন করবে। আমার জন্য কেউ করবে না, আমি তো মুসলিম লীগে ছিলাম, আর মুসলিম লীগ সরকারই আমাকে গ্রেফতার করেছে। তুমি তো বোঝ, আমি রাজনৈতিক কর্মী। আমার পক্ষে নিজ হাতে দাঙ্গা করা সম্ভব নয়; আমার নামে মিথ্যা কথা রটাচ্ছে।। কারণ, লীগের মধ্যে দুইটা দল হয়ে গেছে। আমি নূরুল আমিন সাহেবের দলের বিরুদ্ধে, তাই তিনি আমাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করেছেন”। আরও বলল, “তোমার জন্য শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবও আন্দোলন করবেন”। আমি
১৯৪
বললাম, “যা হবার হয়ে গেছে, তাঁরা আমার মুক্তি চাইলে তোমার মুক্তিও চাইবেন। সে বন্দোবস্তও আমি করব, তুমি দেখে নিও”।
কয়েকদিন পরেই আমাকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হল। চক্ষু দুইটা বেশি যন্ত্রণা দিতেছিল। তাই প্রথমে চোখের চিকিৎসা শুরু করলেন ক্যাপ্টেন লস্কর, চোখের বিখ্যাত্ ডাক্তার। কিছুদিনের মধ্যে কিছুটা উপকার হল, আরও কিছুদিন লাগবে। ডা. শামসুদ্দিন সাহেব হার্টের চিকিৎসা শুরু করলেন। বিকালে অনেক লোক আসত আমাকে দেখতে। কারণ, বিকাল চারটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত যে কেউ হাসপাতালে আসতে পারত। তখন সামান্য কয়েকটা কেবিন ছিল। আমার কেবিনটা ছিল দোতলায় ঠিক সিড়ির কাছে। মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা দলে দলে আসত, কেউ কিছু বলতে পারত না। পুলিশরা কেবিনের বাইরে ডিউটি করত। সন্ধ্যার পরে যখন ভিড় কম হত, আমি বাইরে বারান্দায় ঘুরতাম। আমি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম।
ভাসসানী সাহেব জেল থেকে বের হয়ে বসে নাই। হক সাহেব কিছুদিন চুপ করে ছিলেন। শহীদ সাহেবও পূর্ব বাংলায় এসেছেন। ভাসানী সাহেবকে নিয়ে তিনি ময়মনসিংহ, কুমিল্লা আরও অনেক জায়গায় সভা করলেন। প্রত্যেক সভায় মুসলিম লীগ গোলমাল করতে চেষ্টা করেছে। ঢাকার সভায় ১৪৪ ধারা জারি করেছিল, তবুও শহীদ সাহেব আরমানিটোলায় গিয়েছিলেন, কারণ অনেক লোক জমেছিল। শহীদ সাহেব সকলকে অনুরোধ করেছিলেন চলে যেতে। কারণ তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে চান না। শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব আমার মুক্তির জন্য জোর দাবি তুলেছিলেন। আমি যে অসুস্থ, হাসপাতালে আছি সে কথাও বলতে ভোলেন নাই। শহীদ সাহেব ও আতাউর রহমান সাহেব বিশেষ অনুমতি নিয়ে আমাকে দেখতে আসেন হাসপাতালে। অনেক কথা হল, শহীদ সাহেব আমাকে খুব আদর করলেন। ডাক্তার সাহেবদের ডেকে বললেন, আমার দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে। আমি মহিউদ্দিনের কথা তুললাম। শহীদ সাহেব আমার দিকে আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলেন এবং বললেন, “তুমি বোধহয় জান না, এই মহিউদ্দিনই আমার বিরুদ্ধে লিয়াকত আলী খানের কাছে এক মিথ্যা চিঠি পাঠিয়েছিল যখন বরিশালে যাই, শান্তি মিশনের জন্য সভা করতে ১৯৪৮ সালে। আবার সে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও করেছে ১৯৫১ সালে”। আমি বললাম, “স্যার মানুষের পরিবর্তন হতে পারে, কর্মী তো ভাল ছিল, আপনি তো জানেন, এখন জেলে আছে, আমার সাথেই আছে। আমি আপনাকে বলছি আপনি বিশ্বাস করুন, ওর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ভালপথে আনতে পারলে দেশের অনেক কাজ হবে। আমরা উদার হলে তো কোন ক্ষতি নাই। আমার জন্য যখন মুক্তি দাবি করবেন ওর নামটাও একটু নিবেন, সকলকে বলে দিবেন”। শহীদ সাহেব ছিলেন সাগরের মত উদার। যে কোন লোক তাঁর কাছে একবার যেয়ে হাজির হয়েছে, সে যত বড় অন্যায়ই করুক না কেন, তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে।
শওকত সাহেব এবং ছাত্রলীগ কর্মীরা একটা আবেদনপত্র ছাপিয়েছে, ঢাকার বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দিয়ে দস্তখত করে আমার মুক্তি দাবি করে। আমি শওকত মিয়াকে
১৯৫
বললাম, মেহেরবানি করে মহিউদ্দিনের নামটাও আমার নামের সাথে দিবে। ছাত্রলীগে তো ক্ষেপে অস্থির। ছাত্রলীগ নেতারা পালিয়ে অনেক রাতে আমার সাথে মেডিকেল কলেজে দেখা করতে আসত। অনেকে আবার মেডিকেল কলেজের ছাত্র সেজে আমার সাতেহ দেখা করতে আসত। আমি অনেককে বুঝিয়ে রাজি করালাম। কিন্ত বরিশালের ছাত্রলীগ নেতারা আমাকে ভুল বুঝল। যদিও আমি মুক্তি পাওয়ার পরে ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে পেরেছিলাম।
১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে মওলানা ভাসানী ও আমি যখন জেলে, সেই সময় জনাব লিয়াকত আলী খানকে রাওয়ালপিন্ডিতে এক জনসভায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। খাজা নাজিমুদ্দীক সাহেব গভর্নর জেনারেলের পদ ছেড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং গোলাম মোহাম্মদ অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তাঁকে গভর্নর জেনারেল করলেন। লিয়াকত আলী খান যে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করেছিলেন সে ষড়যন্ত্রেই তাঁকে মরতে হল। কে বা কারা লিয়াকত আলী খানকে হত্যা করার পেছনে ছিল আজ পর্যন্ত তা উদঘাটন হয় নাই। আর হবেও না। এই ষড়যন্ত্রকারীরা যে খুব শক্তিশালী ছিল তা বোঝা যায়। কারণ তারা কোনো চিহ্ন পর্যন্ত রাখে নাই। প্রকাশ্যে দিবালোকে জনসমাবেশে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। কি করে হত্যাকারী অত নিকটে স্থান পেল? কি করে পিস্তল তুলে গুলি করল কেউই দেখতে পেল না কেন? গুলির সাথে আততায়ীকে গুলি করে হত্যা করার কারণ কি? অনেক প্রশ্ন আমাদের মনে জেগেছিল। যদিও তাঁরই হুকুমে এবং নূরুল আমিন সাহেবের মেহেরবানিতে আমরা জেলে আছি, তবুও তাঁর মৃত্যুতে দুঃখ পেয়েছিলাম। কারণ ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি না।
পাকিস্তানে যে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে, তাতেই আমাদে রভয় হল। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্ধীকে গুলি করে হত্যা করা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা ভাষায় প্রকাশ করা কষ্টকর। আমরা যারা গণতান্ত্রে বিশ্বাস করি, তারা এই সমস্ত জঘন্য কাজকে ঘৃণা করি। খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব তার মন্ত্রিত্বে একজন সরকারি আমলাকে গ্রহণ করলেন, তার নাম চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। তিনি পাকিস্তান সরকারের সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। তাঁকে অর্থমন্ত্রী করা হল। এরপর আমলাতন্ত্রের প্রকাশ্যে খেলা শুরু হল পাকিস্তানের রাজনীতিতে। একজন সরকারি কর্মচারী হলেন গভর্নর জেনারেল, আরেকজন হলেন অর্থমন্ত্রী। খাজা সাহেব ছিলেন দুর্বল প্রকৃতির লোক। তিনি অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন, তবে কর্মক্ষমতা এবং উদ্যোগের অভাব ছিল। ফলে আমলাতন্ত্র মাথা তুলে দাঁড়াল। বিশেষ করে যখন তাদেরই একজনকে অর্থমন্ত্রী করা হল, অনেকের মনে গোপনে গোপনে উচ্চাশারও সঞ্চার হল। আমলাতন্ত্রের জোটের কাছে রাজনীতিবিদরা পরাজিত হতে শুরু করল। রাজনীতিকদের মধ্যে তখন এমন কোনো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতা মুসলিম লীগে ছিল
১৯৬
না, যারা এই ষড়যন্ত্রকারী আমলাতন্ত্রকে দাবিয়ে রাখতে পারে। নাজিমুদ্দীন সাহেব গণতন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাত করলেন। কারণ জাতীয় পরিষদের সদস্য নন, একজন সরকারি কর্মচারী, তাকে চাকরি থেকে পদত্যাগ করিয়ে মন্ত্রিত্ব দেওয়ার কি অর্থ থাকতে পারে? আমাদের মনে হল একটা বিশেষ প্রদেশের চাপে পড়েই তাঁকে একাজ করতে হয়েছিল। তিনি প্রধামনত্রী হলেও দুইটা গ্রুপ তাঁর ক্যাবিনেটে কাজ করছিল। একটা গ্রুপ পাঞ্জাবিদের আর একটা গ্রুপ বাঙালিদের। পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের নেতারা বাঙালি গ্রুপকে তলে তলে সাহায্য করছিল। খাজা সাহেব বিরাট ভুল করে বসলেন।
প্রধানমন্ত্রী হয়ে কিছুদিন পরে তিনি পূর্ব বাংলায় আসেন। প্রথমবারে তিনি কিছুই বলেন নাই। কিছুদিন পরে, বোধহয় ১৯৫১ সালের শেষের দিকে অথবা ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় তিনি বক্তৃতা করলেন। সেখানে ঘোষণা করলেন, “উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে”। তিনি ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যে ওয়াদা করেছিলেন, সে ওয়াদার খেলাপ করলেন। ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে চুক্তি করেছিলেন এবং নিজেই পূর্ব বাংলা আইনসভায় প্রস্তাব পেশ করেছিলেন যে, পূর্ব বাংলার অফিসিয়াল ভাষা ‘বাংলা’ হবে। তাছাড়া যাতে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হয়, তার জন্য কেন্দ্রীয় আইনসভায় কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করা হবে। এ প্রস্তাব পূর্ব বাংলার আইনসভায় সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। যে ঢাকায় বসে তিনি ওয়াদা করেছিলেন সেই ঢাকায় বসেই উল্টা বললেন। দেশের মধ্যে ভীষণ ক্ষোভের সৃষ্টি হল। তখন একমাত্র রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, ছাত্র প্রতিষ্টান ছাত্রলীগ এবং যুবাদের প্রতিষ্টান যুবলীগ সকলেই এর তীব্র প্রতিবাদ করে।
আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহ ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে। আমার কেবিনের একটা জানালা ছিল ওয়ার্ডের দিকে। আমি ওদের রাত একটার পরে আসতে বললাম। আরও বললাম, খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহাবুব আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে। দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত। রাতে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন পিছনের বারান্দায় ওরা পাঁচ-সাতজন এসেছে। আমি অনেক রাতে একা হাঁটাচলা করতাম। রাতে কেউ আসে না বলে কেউ কিছু বলত না। পুলিশরা চুপচাপ পড়ে থাকে। কারণ জানে আমি ভাগব না। গোয়েন্দা কর্মচারী একপাশে বসে ঝিমায়। বারান্দায় বসে আলাপ হল এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দিয়েছি। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্টান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হল। অলি আহাদ ও তোয়াহ বলল, যুবলীগও রাজি হবে। আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাস করে নেবে। নাজিমুদ্দীন সাহেব উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাই বলেন নাই, অনেক নতুন নতুন যুক্তিতর্ক দেখিয়েছেন। অলি আহাদ যদিও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সদস্য হয় নাই, তবুও আমাকে
১৯৭
ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করত ও ভালবাসত। আরও বললাম, “খবর পেয়েছি, আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি। তোমরা আগামীকাল রাতেও আবার এস”। আরও দু’একজন ছাত্রলীগ নেতাকে আসতে বললাম। শওকত মিয়া ও কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকেও দেখা করতে বললাম। পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হল আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে। আমি আরও বললাম, “আমিও আমার মুক্তির দাবি করে ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করব। আমার ছাব্বিশ মাস জেল হয়ে গেছে”। আমি একথাও বলেছিলাম, “মহিউদ্দিন জেলে আছে, আমার কাছে থাকে। যদি সে অনশন করতে রাজি হয়, তবে খবর দেব। তার নামটাও আমার নামের সাথে দিয়ে দিবে। আমাদের অনশনের নোটিশ দেওয়ার পরই শওকত মিয়া প্যামপ্লেট ও পোস্টার ছাপিয়ে বিলি করার বন্দোবস্ত করবে”।
দুই দিন পরেই দেখলাম একটা মেডিকেল বোর্ড গঠন করে আমাকে এক্সজামিন করতে এসেছে। তারা মত দিলেন আমি অনেকটা সুস্থ, এখন কারাগারে বসেই আমার চিকিৎসা হতে পারে। সরকার আমাকে ঢাকা জেলে পাঠিয়ে দিলেন, ভালভাবে চিকিৎসা না করে। আমি জেলে এসেই মহিউদ্দিনকে সকল কথা বললাম। মহিউদ্দিনও রাজি হল অনশন ধর্মঘট করতে। আমরা দুইজনে সরকারের কাছে পহেলা ফেব্রুয়ারি দরখাস্ত পাঠালাম। যদি ১৫ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমাদের মুক্তি দেওয়া না হয় তাহা হলে ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট করতে শুরু করব। দুইখানা দরখাস্ত দিলাম। আমাকে যখন জেল কতৃপক্ষ অনুরোধ করল অনশন ধর্মঘট না করতে তখন আমি বলেছিলাম, ছাব্বিশ-সাতাশ মাস বিনাবিচারে বন্দি রেখেছেন। কোনো অন্যায়ও করি না। ঠিক করেছি জেলের বাইরে যাব, হয় আমি জ্যান্ত অবস্থায় না হয় মৃত অবস্থায় যাব। “Either I will go out of the jail or my deadbody will go out.”তারা সরকারকে জানিয়ে দিল। বাহিরে খবর দিয়েই এসেছিলাম এই তারিখে দরখাস্ত করব। বাইরে সমস্ত জেলায় ছাত্রলীগ কর্মীদের ও যেখানে যেখানে আওয়ামী লীগ ছিল সেখানে খবর পাঠিয়ে দিয়েছিল। সামান্য কয়েকটা জেলা ছাড়া আওয়ামী লীগ তখনও গড়ে উঠে নাই। তবে সমস্ত জেলায়ই আমার ব্যক্তিগত বন্ধু ও সহকর্মী ছিল। এদিকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদও গঠন করা হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি দিনও ধার্য করা হয়েছে। কারণ, ঐদিনই পূর্ব বাংলার আইনসভা বসবে। কাজী গোলাম মাহাবুবকে সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করা হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে ছাত্ররাই এককভাবে বাংলা ভাষার দাবির জন্য সংগ্রাম করেছিল। এবার আমার বিশ্বাস ছিল, জনগণ এগিয়ে আসবে। কারণ, জনগণ বুঝতে শুরু করেছে যে, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করতে পারলে তাদের দাসত্বের শৃঙ্খলা আবার পরতে হবে। মাতৃভাষার অপমান কোনো জাতি সহ্য করতে পারে না। পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ছাপ্পান্নজন বাংলা ভাষাভাষী হয়েও শুধুমাত্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা বাঙালিরা করতে চায় নাই। তারা চেয়েছে বাংলার সাথে উর্দুকেও রাষ্ট্রভাষা করা
১৯৮
হোক, তাতে আপত্তি নাই। কিন্ত বাঙালির এই উদারতটাই অনেকে দুর্বলতা হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছে। এদিকে বাঙালিরা অনুভব করতে শুরু করেছে যে, তাদের উপর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি চাকরিতেও অবচার চলছে। পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে রাজধানী হওয়াতে বাঙালিরা সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত হতে শুরু করেছে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবি এবং শেষ পর্যন্ত সর্বদলীয় ‘গ্রান্ড ন্যাশনাল কনভেনশনে’ স্বায়ত্তশাসনের দাবি করায় বাঙালিদের মনোভাব ফুটে উঠেছে। পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ নেতারা যতই জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন ততই পশ্চিম পাকিস্তানের কোটারি ও আমলাতন্ত্রের উপর নির্ভর করতে শুরু করেছেন ক্ষমতায় থাকার জন্য। খাজা নাজিমুদ্দীন ও জনাব নূরুল আমিন জনগণকে ভয় করতে শুরু করেছেন। সেইজন্য টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরে অনেকগুলি আইনসভার সদস্যের পদ খালি হওয়া সত্ত্বেও উপনির্বাচন দিতে সাহস পাচ্ছিলেন না।
জনগণের আস্থা হারাতে শুরু করেছিল বলে আমলাতন্ত্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল মুসলিম লীগ নেতারা। তখন পূর্ব বাংলার চিফ সেক্রেটারি ছিলেন আজিজ আহমদ (পুরানা আইসিএস)। তিনি বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ ছিলেন, কাজকর্ম খুব ভাল বুঝতেন। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসাবেই কাজ করতেন। হামিদুল হক চৌধুরী সাহেবের বিরুদ্ধে পোডো মামলায় সাক্ষী হিসাবে তিনি স্বীকার করেছিলেন, তিনি মন্ত্রীদের কাজকর্ম সম্বন্ধে ফাইল রাখতেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে সে ব্যাপারে খবর দিতেন। হামিদুল হক চৌধুরী সাহেব মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, কিন্ত তাঁর সহকর্মীরা ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁরা সাহস পেলেন না কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। আজিজ আহমদের ব্যাক্তিত্বের সামনে অনেকে কথা বলতেও সাহস পেতেন না। মুসলিম লীগ সরকার জনমত যাতে তাদের দিকে থাকে তার চেষ্টা না করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আওয়ামী লীগ এবং বিরুদ্ধ মতবাদের কর্মী ও নেতাদের উপর। যে কোন অজুহাতে নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করতে শুরু করেছিল।
এদিকে জেলের ভেতর আমরা দুইজন প্রস্তুত হচ্ছিলাম অনশন ধর্মঘট করার জন্য। আমরা আলোচনা করে ঠিক করেছি, যাই হোক না কেন, আমরা অনশন ভাঙ্গব না। যদি এই পথেই মৃত্যু এসে থাকে তবে তাই হবে। জেল কতৃপক্ষ বিশেষ করে সুপারিনটেনডেন্ট আমীর হোসেন সাহেব ও তখনকার দিনে রাজবন্দিদের ডেপুটি জেলার মোখলেসুর রহমান সাহেব আমাদের বুঝাতে অনেক চেষ্টা করলেন। আমরা তাঁদের বললাম, আপনাদের বিরুদ্ধে আমাদের বলবার কিছু নাই। আর আমরা সেজন্য অনশন করছি না। সরকার আমাদের বৎসরের পর বৎসর বিনা বিচারে আটক রাখছে, তারই প্রতিবাদ করার জন্য অনশন ধর্মঘট করছি। এতদিন জেল খাটলাম, আপনাদের সাথে আমাদের মনোমালিন্য হয় নাই। কারণ
১৯৯
আমরা জানি যে, সরকারের হুকুমেই আপনাদের চলতে হয়। মোখলেসুর রহমান সাহেব খুবই অমায়িক, ভদ্র ও শিক্ষিত ছিলেন। তিনি খুব লেখাপড়া করতেন।
১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে সকালবেলা আমাকে জেলগেট নিয়ে যাওয়া হল এই কথা বলে যে, আমার সাথে আলোচনা আছে অনশন ধর্মঘটের ব্যাপার নিয়ে। আমি যখন জেলগেটে পৌছালাম দেখি, একটু পরেই মহিউদ্দিনকেও নিয়ে আসা হয়েছে একই কথা বলে। কয়েক মিনিট পরে আমার মালপত্র, কাপড়চোপড় ও বিছানা নিয়ে জমাদার সাহেব হাজির। বললাম, ব্যাপার কি? কতৃপক্ষ বললেন, আপনাদের অন্য জেলে পাঠানোর হুকুম হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, কোন জেলে? কেউ কিছু বলেন না। এদিকে আর্মড পুলিশ, আইবি অফিসারও প্রস্তুত হয়ে এসেছে। খবর চাপা থাকে না। একজন আমাকে বলে দিল, ফরিদপুর জেলে দুইজনকেই এক জেলে পাঠানো হচ্ছে। তখন নয়টা বেজে গেছে। এগারটায় নারায়ণগঞ্জ থেকে জাহাজ ছাড়ে, সেই জাহাজ আমাদেরকে ধরতে হবে। আমি দেরি করতে শুরু করলাম, কারণ তা না হলে কেউই জানবে না আমাদের কোথায় পাঠাচ্ছে! প্রথমে আমার বইগুলি এক এক করে মেলাতে শুরু করলাম, তারপর কাপড়গুলি। হিসাব-নিকাশ, কত টাকা খরচ হয়েছে, কত টাকা আছে। দেরি করতে করতে দশটা বাজিয়ে দিলাম। রওয়ানা করতে আরও আধা ঘন্টা লাগিয়ে দিলাম। আর্মড পুলিশের সেবেদার ও গোয়েন্দা কর্মচারীরা তাড়াতাড়ি করছিল। সুবেদার পাকিস্তান হওয়ার সময় গোপালগঞ্জে ছিল এবং সে একজন বেলুচি ভদ্রলোক। আমাকে খুবই ভালবাসত এবং শ্রদ্ধা করত। আমাকে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করতে দেখেছে। আমাকে দেখেই বলে বসল, “ইয়ে কেয়া বাত হ্যায়, আপ জেলখানা মে”। আমি বললাম, “কিসমত”। আর কিছুই বললাম না। আমাদের জন্য বন্ধ ঘোড়ার গাড়ি আনা হয়েছে। গাড়ির ভিতর জানালা উঠিয়ে ও দরজার কপাট বন্ধ করে দিল। দুইজন ভিতরেই আমাদের সাথে বসল। আর একটা গাড়িতে অন্যরা পিছনে পিছনে ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশে রোডের দিকে চলল। সেখানে যেয়ে দেখি পূর্বেই একজন আর্মড পুলিশ ট্যাক্সি রিজার্ভ করে দাঁড়িয়ে আছে। তখন ট্যাক্সি পাওয়া খুবই কষ্টকর ছিল। আমরা আস্তে আস্তে নামলাম ও উঠলাম। কোন চেনা লোকের সাথে দেখা হল না। যদিও এদিক ওদিক অনেকবার তাকিয়ে ছিলাম। ট্যাক্সি তাড়াতাড়ি চালাতে বলল। আমি ট্যাক্সিওয়ালাকে বললাম, “বেশি জোরে চালাবেন না, কারণ বাবার কালের জীবনটা যেন রাস্তায় না যায়”।
আমরা পৌঁছে খবর পেলাম জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে। এখন উপায়? কোথায় আমাদের নিয়ে যাবে? রাত একটায় আর একটা জাহাজ ছাড়বে। আমাদের নারায়ণগঞ্জ থানায় নিয়ে যাওয়া হল। ওপরওয়ালাদের টেলিফোন করল এবং হুকুম নিল থানায়ই রাখতে। আমাদের পুলিশ ব্যারাকের একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। একজন চেনা লোককে থানায় দেখলাম, তাকে বললাম, শামসুজ্জোহাকে খবর দিতে। খান সাহেব ওসমান আলী সাহেবের বাড়ি সকলেই চিনে। এক ঘন্টার মধ্যে জোহা সাহেব, বজলুর রহমান ও আরও অনেকে থানায় এসে হাজির। আমাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। পরে আলমাস আলীও আমাদের

Next