২০০
দেখতে এসেছিল। আমি ওদের বললাম, “রাতে হোটেলে খেতে যাব। কোন হোটেলে যাব বলে যান। আপনারা পূর্বেই সেই হোটেলে বসে থাকবেন। আলাপ আছে”। আমাদের কেন বদলি করেছে, ঢাকা জেল থেকে ফরিদপুর জেলে, এর মধ্যেই বলে দিলাম। বেশি সময় তাদের থাকতে দিল না থানায়। হোটেলের নাম বলে বিদায় নিল। আমি বললাম, “রাত আটটা থেকে সাড়ে আটটায় আমরা পৌছাব”। নতুন একটা হোটেল হয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রোডের উপরে, হোটেলটা দোতলা।
আমি সুবেদার সাহেবকে বললাম যে, “আমাদের খাওয়া-দাওয়া দরকার, চলুন, হোটেলে খাই। সেখান থেকে জাহাজঘাটে চলে যাব”। সে রাজি হল। আমার কথা ফেলবে না এ বিশ্বাস আমার ছিল। আর আমাদের তো খাওয়াতে হবে। একজন সিপাহি দিয়ে মালপত্র স্টেশনে পাঠিয়ে দিল আর আমরা যথাসময়ে হোটেলে পৌছালাম। দোতলায় একটা ঘরে বসার ব্যবস্থা ছিল। সেখানে আমাদের খাবার বন্দোবস্ত করে রেখেছে। আমরা বসে পড়লাম। আট-দশজন কর্মী নিয়ে জোহা সাহেব বসে আছেন। আমরা আস্তে আস্তে খাওয়া-দাওয়া করলাম, আলাপ-আলোচনা করলাম। ভাসানী সাহেব, হক সাহেব ও অন্যান্য নেতাদের খবর দিতে বললাম। খবরের কাগজে যদি দিতে পারে চেষ্টা করবে। বললাম, সাপ্তাহিক ইত্তেফাক তো আছেই। আমরা যে আগামীকাল থেকে আমরণ অনশন করব, সেকথাও তাদের বললাম, যদিও তারা পূর্বেই খবর পেয়েছিল। নারায়ণগঞ্জের কর্মীদের ত্যাগ ও তিতিক্ষার কথা কোনো রাজনৈতিক কর্মী ভুলতে পারে না। তারা আমাকে বলল, “২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে নারায়ণগঞ্জে পূর্ণ হরতাল হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তো আছেই, আপনাদের মুক্তির দাবিও আমরা করব”। এখানেই আমাকে নেতারা প্রশ্ন করল, “মহিউদ্দিনকে বিশ্বাস করা যায় কি না! আবার বাইরে এসে মুসলিম লীগ করবে না তো”। আমি বললাম, “আমাদের কাজ আমরা করি, তার কর্তব্য সে করবে। তবে মুসলিম লীগ করবে না। সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। সে বন্দি, তার মুক্তি চাইতে আপত্তি কি! মানুষকে ব্যবহার, ভালবাসা ও প্রীতি দিয়েই জয় করা যায়, অত্যাচার, জুলুম ও ঘৃণা দিয়ে জয় করা যায় না”।
রাত এগারটায় আমরা ষ্টেশনে আসলাম। জাহাজ ঘাটেই ছিল, আমরা উঠে পড়লাম। জাহাজ না ছাড়া পর্যন্ত সহকর্মীরা অপেক্ষা করল। রাত একটার সময় সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বললাম, “জীবনে আর দেখা না হতেও পারে। সকলে যেন আমাকে ক্ষমা করে দেয়। দুঃখ আমার নাই। একদিন মরতেই হবে, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যদি মরতে পারি, সে মরাতেও শান্তি আছে”।
জাহাজ ছেড়ে দিল, আমরা বিছানা করে শুয়ে পড়লাম। সকালে দুইজনে পরামর্শ করে ঠিক করলাম, জাহাজে অনশন করি কি করে? আমাদের জেলে নিতে হবে অনশন করার পূর্বে। সমস্ত দিন জাহাজ চলল, রাতে গোয়ালন্দ ঘাটে এলাম। সেখান থেকে ট্রেনে রাত চারটায় ফরিদপুর পৌছালাম। রাতে আমাদের জেল কতৃপক্ষ গ্রহণ করল না। আমরা দুইজনে জেল সিপাহিদের ব্যারাকের বারান্দায় কাটালাম। সকালবেলা সুবেদার
২০১
সাহেবকে বললাম, “জেল অফিসাররা না আসলে তো আমাদের জেলে নিবে না, চলেন কিছু নাশতা করে আসি”।নাশতা খাবার ইচ্ছা আমদের নাই। তবে যদি কারও সাথে দেখা হয়ে যায়, তাহলে ফরিদপুরের সহকর্মীরা জানতে পারবে, আমরা ফরিদপুর জেলে আছি এবং অনশন ধর্মঘট করছি। আধা ঘন্টা দেরি করলাম, কাউকেও দেখি না- চায়ের দোকানের মালিক এসেছে, তাকে আমি আমার নাম বললাম এবং খবর দিতে বললাম আমার সহকর্মীদের। আমরা জেলের দিকে রওয়ানা করছি, এমন সময় আওয়ামী লীগের এক কর্মী, তার নামও মহিউদ্দিন-সকলে মহি ভাই বলে ডাকে, তার সঙ্গে দেখা। আমি যখন ফরিদপুরে ১৯৪৬ সালের ইলেকশনে ওয়ার্কার ইনচারজ ছিলাম, তখন আমার সাথে সাথে কাজ করেছে। মহি সাইকেলে যাচ্ছিল, আমি তাকে দেখে ডাক দিলাম নাম ধরে, সে সাইকেল থেকে আমাকে দেখে এগিয়ে আসল। আইবি নিষেধ করছিল। আমি শুনলাম না, তাকে এক ধমক দিলাম এবং মহিকে বললাম, আমাদের ফরিদপুর জেলে এনেছে এবং আজ থেকে অনশন করছি সকলকে এখবর দিতে। আমরা জেলগেটে চলে আসলাম, মহিও সাথে সাথে আসল।
আমরা জেলগেটে এসে দেখি, জেলার সাহেব, ডেপুটি জেলার সাহেব এসে গেছেন। আমাদের তাড়াতাড়ি ভিতরে নিয়ে যেতে বললেন। তাঁরা পূর্বেই খবর পেয়েছিলেন। জায়গাও ঠিক করে রেখেছেন, তবে রাজবন্দিদের সাথে নয়, অন্য জায়গায়। আমরা তাড়াতাড়ি ওষধ খেলাম পেট পরিষ্কার করবার জন্য। তারপর অনশন ধর্মঘট শুরু করলাম। দুই দিন পর অবস্থা খারাপ হলে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। আমাদের দুইজনেরই শরীর খারাপ। মহিউদ্দিন ভুগছে প্লুরিসিস রোগে, আর আমি ভুগছি নানা রোগে। চার দিন পরে আমাদের নাক দিয়ে জোর করে খাওয়াতে শুরু করল। মহাবিপদ! নাকের ভিতরে নল দিয়ে পেটের মধ্যে পর্যন্ত দেয়। তারপর নলের মুখে একটা কাপের মত লাগিয়ে দেয়। একটা ছিদ্রও থাকে। সে কাপের মধ্যে দুদের মত পাতলা করে খাবার তৈরি করে পেটের ভিতর ঢেলে দেয়। এদের কথা হল, ‘মরতে দেব না’।
আমার নাকে একটা ব্যারাম ছিল। দুই তিনবার দেবার পরেই ঘা হয়ে গেছে। রক্ত আসে আর যন্ত্রণা পাই। আমরা আপত্তি করতে লাগলাম। জেল কতৃপক্ষ শুনছে না। খুবই কষ্ট হচ্ছে। আমার দুইটা নাকের ভিতরই ঘা হয়ে গেছে। তারা হ্যান্ডকাপ পরানোর লোকজন নিয়ে আসে। বাধা দিলে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে জোর করে ধরে খাওয়াবে। আমাদের শরীরও খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। পাঁচ-ছয় দিন পরে বিছানা থেকে ওঠার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। আমরা ইচ্ছা করে কাগজি লেবুর রস দিয়ে লবণ পানি খেতাম। কারণ এর মধ্যে কোনো ফুড ভ্যালু নাই। আমাদের ওজনও কমতে ছিল। নাকের মধ্যে দিয়ে নল দিয়ে খাওয়ার সময় নলটা একটু এদিক ওদিক হলেই আর উপায় থাকবে না। সিভিল সার্জন সাহেব,
২০৩
ডাক্তার সাহেব ও জেল কতৃপক্ষ আমাদের কোনো অসুবিধা না হয়, তার চেষ্টা করছিলেন। বারবার সিভিল সার্জন সাহেব অনশন করতে নিষেধ করছিলেন। আমার ও মহিউদ্দিনের শরীর অতিশয় দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন আর বিছানা থেকে উঠবার শক্তি নাই। আমার হার্টের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে বুঝতে পারলাম। প্যালপিটিশন হয় ভীষণভাবে। নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। ভাবলাম আর বেশি দিন নাই। একজন কয়েদিকে দিয়ে গোপনে কয়েক টুকরা কাগজ আনালাম। যদিও হাত কাঁপে তথাপি ছোট ছোট করে চারটা চিঠি লিখলাম। আব্বার কাছে একটা, রেণুর কাছে একটা, আর দুইটা শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবের কাছে। দু’একদিন পরে আর লেখার শক্তি থাকবে না।
২১ শে ফেব্রুয়ারি আমরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটালাম, রাতে সিপাহিরা ডিউটিতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গোলমাল হয়েছে। কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মরে গেছে। রেডিওর খবর। ফরিদপুরে হরতাল হয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীরা শোভাযাত্রা করে জেলগেতে এসেছিল। তারা বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না’, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’, ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’, আরও অনেক স্লোগান। আমার খুব খারাপ লাগল। কারণ, ফরিদপুর আমার জেলা, মহিউদ্দিনের নামে কোনো স্লোগান দিচ্ছে না কেন? শুধু ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’, বললেই তো হত। রাতে যখন ঢাকার খবর পেলাম তখন ভীষণ চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়লাম। কত লোক মারা গেছে বলা কষ্টকর। তবে অনেক লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে শুনেছি। দু’জনে পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে আছি। ডাক্তার সাহেব আমাদের নড়াচড়া করতে নিষেধ করেছেন। কিন্ত উত্তেজনায় উঠে বসলাম। দুইজন কয়েদি ছিল আমাদের পাহারা দেবার এবং কাজকর্ম করে দেবার জন্য। তাড়াতাড়ি আমাদের ধরে শুইয়ে দিল। খুব খারাপ লাগছিল, মনে হচ্ছিল চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। গুলি করার তো কোন দরকার ছিল না। হরতাল করবে, সভা ও শোভাযাত্রা করবে, কেউ তো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় না। কোনো গোলমাল সৃষ্টি করার কথা তো কেউ চিন্তা করে নাই। ১৪৪ ধারা দিলেই গোলমাল হয়, না দিলে গোলমাল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। অনেক রাতে একজন সিপাহি এসে বলল, ছাত্র মারা গেছে অনেক। বহু লোক গ্রেফতার হয়েছে। রাতে আর কোন খবর নাই। ঘুম তো এমনিই হয় না, তারপর আবার এই খবর। পরের দিন নয়-দশটার সময় বিরাট শোভাযাত্রা বের হয়েছে, বড় রাস্তার কাছেই জেল। শোভাযাত্রীদের স্লোগান পরিষ্কার শুনতে পেতাম, হাসপাতালের দোতলা থেকে দেখাও যায়, কিন্ত আমরা নিচের তলায়। হর্ন দিয়ে একজন বক্তৃতা করছে। আমাদের জানাবার জন্যই হবে। কি হয়েছে ঢাকায় আমরা কিছু কিছু বুঝতে পারলাম। জেল কতৃপক্ষ আমাদের কোনো খবর দিতে চায় না। আমরা যেন কোন খবর না পাই, আর কোন খবর না দিতে পারি বাইরে, এই তাদের চেষ্টা। খবরের কাগজ তো একদিন পরে আসবে, ঢাকা থেকে।
২২ তারিখে সারা দিন ফরিদপুরে শোভাযাত্রা চলল। কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী এক জায়গায় হলেই স্লোগান দেয়। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা রাস্তায় বেড়ায় আর স্লোগান দেয়। ২২ তারিখে খবরের কাগজ এল, কিছু কিছু খবর পেলাম। মুসলিম লীগ সরকার কত বড়
২০৪
অপরিণামদর্শিতার কাজ করল। মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয় নাই। জনাব নূরুল আমিন বুঝতে পারলেন না, আমলাতন্ত্র তাঁকে কোথায় নিয়ে গেল। গুলি হল মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের এরিয়ার ভেতরে, রাস্তায়ও নয়। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গ করলেও গুলি না করে গ্রেফতার করলেই তো চলত। আমি ভাবলাম, দেখব কি না জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নাই। মানুষের যখন পতন আসে তখন পদে পদে ভুল হতে থাকে। বাংলাদেশের মুসলিম লীগ নেতারা বুঝলেন না, কে বা কারা খাজা সাহেবকে উর্দুর কথা বললেন, আর কেনই না তিনি বললেন! তাঁরা তো জানতেন, উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলে মিস্টার জিন্নাহর মত নেতাও বাধা না পেয়ে ফিরে যেতে পারেন নাই। সেখানে খাজা সাহেব এবং তার দলবলের অবস্থা কি হবে? একটা বিশেষ গোষ্টী- যারা ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করতে শুরু করেছেন, তাঁরাই তাঁকে জনগণ থেকে যাতে দূরে সরে পড়েন তার বন্দোবস্ত করলেন। সাথে সাথে তাঁর সমর্থক নূরুল আমিন সাহেবও যাতে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান সে ব্যবস্থাও করালেন। কারণ ভবিষ্যতে এই বিশেষ গোষ্টী কোনো একটা গভীর ষড়যন্ত্রের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। যদিও খাজা সাহেবের জনসমর্থন কোনোদিন বাংলাদেশে ছিল না।
খবরের কাগজে দেখলাম, মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ এমএলএ, খয়রাত হোসেন এমএলএ, খান সাহেব ওসমান আলী এমএলএ এবং মোহাম্মদ আবুল হোসেন ও খোন্দকার মোশতাক আহমদসহ শত শত ছাত্র ও কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। দু’একদিন পরে দেখলাম কয়েকজন প্রফেসর, মওলানা ভাসানী, শামসুল হক সাহেব ও বহু আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। নারায়ণগঞ্জ খানসাহেব ওসমান আলীর বাড়ির ভিতরে ঢুকে ভীষণ মারপিট করেছে। বৃদ্ধ খান সাহেব ও তাঁর ছেলেমেয়েদের উপর অকথ্য অত্যাচার হয়েছে। সমস্ত ঢাকায় ও নারায়ণগঞ্জে এক ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগের কোন কর্মীই বোধহয় আর বাইরে নাই।
আমাদের অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে এসেছে যে, যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যুর শান্তি ছায়ায় চিরদিনের জন্য স্থান পেতে পারি। সিভিল সার্জন সাহেব দিনের মধ্যে পাঁচ-সাতবার আমাদের দেখতে আসেন। ২৫ তারিখ সকালে যখন আমাকে তিনি পরীক্ষা করছিলেন হঠাৎ দেখলাম, তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেছে। তিনি কোনো কথা না বলে, মুখ কালো করে বেরিয়ে গেলেন। আমি বুঝলাম, আমার দিন ফুরিয়ে গেছে। কিছু সময় পরে আবার ফিরে এসে বললেন, “এভাবে মৃত্যুবরণ করে কি কোনো লাভ হবে? বাংলাদেশ যে আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করে”। আমার কথা বলতে কষ্ট হয়, আস্তে আস্তে বললাম, “অনেক লোক আছে। কাজ পড়ে থাকবে না। দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসি, তাদের জন্যই জীবন দিতে পারলাম, এই শান্তি”। ডেপুটি জেলার সাহেব বললেন, “কাউকেও খবর দিতে হবে কি না? আপনার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী কোথায়? আপনার আব্বার কাছে কোনো টেলিগ্রাম
২০৫
করবেন?”বললাম, “দরকার নাই। আর তাদের কষ্ট দিতে চাই না”। আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি, হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। হার্টের দুর্বলতা না থাকলে এত তাড়াতাড়ি দুর্বল হয়ে পড়তাম না। একজন কয়েদি ছিল, আমার হাত-পায়ে সরিষার তেল গরম করে মালিশ করতে শুরু করল। মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল।
মহিউদ্দিনের অবস্থাও ভাল না, কারণ প্লুরিসিস আবার আক্রমণ করে বসেছে। আমার চিঠি চারখানা একজন কর্মচারীকে ডেকে তাঁর কাছে দিয়ে বললাম, আমার মৃত্যুর পরে চিঠি চারখানা ফরিদপুরে আমার এক আত্মীয়ের কাছে পৌঁছে দিতে। তিনি কথা দিলেন, আমি তাঁর কাছ থেকে ওয়াদা নিলাম। বারবার আব্বা, মা, ভাইবোনদের চেহারা ভেসে আসছিল আমার চোখের সামনে। রেণুর দশা কি হবে? তার তো কেউ নাই দুনিয়ায়। ছোট ছেলেমেয়ে দুইটার অবস্থাই বা কি হবে? তার তো কেউ নাই দুনিয়ায়। ছোট ছেলেমেয়ে দুইটার অবস্থাই বা কি হবে? তার তো কেউ নাই দুনিয়ায়। ছোট ছেলেমেয়ে দুইটার অবস্থাই বা কি হবে? তবে আমার আব্বা ও ছোট ভাই ওদের ফেলবে না, এ বিশ্বাস আমার ছিল। চিন্তাশক্তিও হারিয়ে ফেলেছিলাম। হাচিনা, কামালকে একবার দেখতেও পারলাম না। বাড়ির কেউ খবর পায় নাই, পেলে নিশ্চয়ই আসত।
মহিউদ্দিনের তো কেউ ফরিদপুর নাই। বরিশালের এক গ্রামে তার বাড়ি। ভাইরা বড় বড় চাকরি করেন। এক ভাই ছাড়া কেউ বেশি খবর নিতেন না। তিনি সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তাঁকে আমি জানতাম। যাহোক, মহিউদ্দিন ও আমি পাশাপাশি দুইটা খাট পেতে নিয়েছিলাম। একজন আরেকজনের হাত ধরে শুয়ে থাকতাম। দু’জনের চুপচাপ পড়ে থাকি। আমার বুকে ব্যথা শুরু হয়েছে। সিভিল সার্জন সাহেবের কোন সময় অস্ময় ছিল না। আসছেন, দেখছেন, চলে যাচ্ছেন। ২৭ তারিখ দিনেরবেলা আমার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়ল। বোধহয় আর দু’একদিন বাঁচতে পারি।
২৭ তারিখ রাত আটটার সময় আমরা দুইজন চুপচাপ শুয়ে আছি। কারও সাথে কথা বলার ইচ্ছাও নাই, শক্তিও নাই। দুইজনেই শুয়ে শুয়ে কয়েদির সাহায্যে ওজু করে খোদার কাছে মাপ চেয়ে নিয়েছি। দরজা খুলে বাইরে থেকে ডেপুটি জেলার এসে আমার কাছে বসলেন এবং বললেন, “আপনাকে যদি মুক্তি দেওয়া হয়, তবে খাবেন তো?”বললাম, “মুক্তি দিলে খাব, না দিলে খাব না। তবে আমার লাশ মুক্তি পেয়ে যাবে”। ডাক্তার সাহেব এবং আরও কয়েকজন কর্মচারী এসে গেছে চেয়ে দেখলাম। ডেপুটি জেলার সাহেব বললেন, “আমি পড়ে শোনাই, আপনার মুক্তির অর্ডার এসে গেছে রেডিওগ্রামে এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের অফিস থেকেও অর্ডার এসেছে। দুইটা অর্ডার পেয়েছি”। তিনি পড়ে শোনালেন, আমি বিশ্বাস করতে চাইলাম না। মহিউদ্দিন শুয়ে শুয়ে অর্ডারটা দেখল এবং বলল যে, তোমার অর্ডার এসেছে। আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। ডেপুটি সাহেব বললেন, “আমাকে অবিশ্বাস করার কিছু নাই। কারণ, আমার কোনো স্বার্থ নাই; আপনার মুক্তির আদেশ সত্যিই এসেছে”। ডাক্তার সাহেব ডাবের পানি আনিয়েছে। মহিউদ্দিনকে দুইজন ধরে বসিয়ে দিলেন। সে আমাকে বলল, “তোমাকে ডাবের পানি আমি খাইয়ে দিব”। দুই চামচ ডাবের পানি দিয়ে মহিউদ্দিন আমার অনশন ভাঙিয়ে দিল। মহিউদ্দিনের কোনো অর্ডার আসে নাই এখনও। এটা আমার আরও পীড়া দিতে লাগল। ওকে ছেড়ে যাব কেমন
২০৬
করে? মুক্তির আদেশ এলেও জেলের বাইরে যাবার শক্তি আমার নেই। সিভিল সার্জন সাহেবও ছাড়বেন না। মাঝে মাঝে ডাবের পানিই আমাকে খেতে দিচ্ছিল। রাত কেটে গেল। সকালে একটু খেলেও ডাব খেতে দিল। আমি অনেকটা সুস্থ বোধ করতে লাগলাম, কিন্ত মহিউদ্দিনকে ফেলে যাব কেমন করে? দু’জন একসাথে ছিলাম। আমি চলে গেলে ওর উপায় কি হবে, কে দেখবে? যদি ওকে না ছাড়ে! ওর অবস্থা তো আমারই মত, তবে কেন ছাড়বে না! আমি তো পাকিস্তান হওয়ার পর থেকে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ দলের নেতাদের ‘দুশমন’ হয়ে পড়েছি, কিন্ত মহিউদ্দিন তো জেলে আসার পূর্ব দিন পর্যন্তও মুসলিম লীগের বিশিষ্ট সদস্য ছিল। রাজনীতিতে দেখা গেছে একই দলের লোকের মধ্যে মতবিরোধ হলে দুশমনি বেশি হয়।
সকাল দশটার দিকে খবর পেলাম, আব্বা এসেছেন। জেলগেটে আমাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই কতৃপক্ষ তাঁকে ভিতরে নিয়ে আসলেন। আমাকে দেখেই আব্বার চোখে পানি এসে গেছে। আব্বার সহ্য শক্তি খুব বেশি। কোনোমতে চোখের পানি মুছে ফেললেন। কাছে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং বললেন, “তোমার মুক্তির আদেশ হয়েছে, তোমাকে আমি নিয়ে যাব বাড়িতে। আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম তোমার মা, রেণু, হাচিনা ও কামালকে নিয়ে, দুই দিন বসে রইলাম, কেউ খবর দেয় না, তোমাকে কোথায় নিয়ে গেছে। তুমি ঢাকায় নাই একথা জেলগেট থেকে বলেছে। যদিও পরে খবর পেলাম, তুমি ফরিদপুর জেলে আছ। তখন যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ। নারায়ণগঞ্জ এসে যে জাহাজ ধরব তারও উপায় নেই। তোমার মা ও রেণুকে ঢাকায় রেখে আমি চলে এসেছি। কারণ, আমার সন্দেহ হয়েছিল তোমাকে ফরিদপুর নেওয়া হয়েছে কি না! আজই টেলিগ্রাম করব, তারা যেন বাড়িতে রওয়ানা হয়ে যায়। আমি আগামীকাল বা পরশু তোমাকে নিয়ে রওয়ানা করব বাকি খোদা ভরসা। সিভিল সার্জন সাহেব বলেছেন, তোমাকে নিয়ে যেতে হলে লিখে দিতে হবে যে, ‘আমার দায়িত্বে নিয়ে যাচ্ছি’। আব্বা আমাকে সান্তনা দিলেন এবং বললেন, তিনি খবর পেয়েছেন মহিউদ্দিনও মুক্তি পাবে, তবে একসাথে ছাড়বে না, একদিন পরে ছাড়বে।
পরের দিন আব্বা আমাকে নিতে আসলেন। অনেক লোক জেলগেটে হাজির। আমাকে স্ট্রেচারে করে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া হল এবং গেটের বাইরে রেখে দিল, যদি কিছু হয় বাইরে গিয়ে হোক, এই তাদের ধারণা। আমাকে কয়েকজন বয়ে নিয়ে গেল আলাউদ্দিন খান সাহেবের বাড়িতে। সেখানে কিছু সময় রাখল। বিকালে আমার বোনের বাড়িতে নিয়ে আসল। রাতটা সেখানে কাটালাম। আত্মীয়স্বজনসহ অনেক লোক আমাকে দেখতে আসল। আব্বা আমার কাছেই রইলেন। পরের দিন সকালে আমার এক বন্ধু ট্যাক্সি নিয়ে এল। সে নিজেই ড্রাইভ করে আমাকে ভাঙ্গায় নিয়ে আসল। আব্বা একটা বড় নৌকা ভাড়া করলেন। আমার ফুপুর বাড়ি রাস্তার পাশেই। তিনি রাস্তায় চলে এসেছেন আমাকে দেখতে। আব্বাকে
২০৭
বললেন, তাঁদের বাড়ি নূরপুর গ্রামে থাকতে। আব্বা বললেন, এখান থেকে নৌকায় বড়বোনের বাড়ি দত্তপাড়া যাবেন। সেখানে আরও একদিন থাকবেন। একটু সুস্থ হলে বড়বোনকে সাথে নিয়ে বাড়িতে যাবেন। আমি অনেকটা সুস্থ বোধ করছি, যদিও খুবই দুর্বল।
দররপাড়া মাদারীপুর মহকুমায়, সেখান থেকে একদিন একরাত লাগবে গোপালগঞ্জ পৌছাতে নৌকায়। সিন্ধিয়া ঘাটে কর্মীরা বসে আছে খবর পেয়ে। আমাকে দেখেই তারা স্টিমারে গোপালগঞ্জ রওয়ানা করল। আমি কয়েক ঘন্টা পরে গোপালগঞ্জ পৌঁছে দেখি, বিরাট জনতা, সমস্ত নদীর পাড় ভরে গেছে। আমাকে তারা নামাবেই। আব্বা আপত্তি করলেও তারা শুনল না। আমাকে কোলে করে রাস্তায় শোভাযাত্রা বের করল এবং আবার নৌকায় পৌঁছে দিল। আব্বা আর দেরি না করে আমাকে নিয়ে বাড়িতে রওয়ানা করলেন। কারণ, আমার মা, রেণু ও বাড়ির সকলে আমার জন্য ব্যস্ত হয়ে আছে। আমার ভাইও খবর পেয়ে খুলনা থেকে রওয়ানা হয়ে চলে এসেছে।
পাঁচ দিন পর বাড়ি পৌছালাম। মাকে তো বোঝানো কষ্টকর। হাচু আমার গলা ধরে প্রথমেই বলল, ‘আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’। ২১ শে ফেব্রুয়ারি ওরা ঢাকায় ছিল, যা শুনেছে তাই বলে চলেছে। কামাল আমার কাছে আসল না, তবে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি খুব দুর্বল, বিছানায় শুয়ে পড়লাম। গতকাল রেণু ও মা ঢাকা থেকে এসে আমার প্রতীক্ষায় দিন কাটাচ্ছিল। এক এক করে সকলে যখন আমার কামরা থেকে বিদায় নিল, তখন রেনু কেঁদে ফেলল এবং বলল, “তোমার চিঠি পেয়ে আমি বুঝেছিলাম, তুমি কিছু একটা করে ফেলবা। আমি তোমাকে দেখবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কাকে বলব নিয়ে যেতে, আব্বাকে বলতে পারি না লজ্জায়। নাসের ভাই বাড়ি নাই। যখন খবর পেলাম খবরের কাগজে, তখন লজ্জা শরম ত্যাগ করে আব্বাকে বললাম। আব্বা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাই রওয়ানা করলাম ঢাকায়, সোজা আমাদের বড় নৌকায় তিনজন মাল্লা নিয়ে। কেন তুমি অনশন করতে গিয়েছিল? এদের কি দয়া মায়া আছে? আমাদের কারও কথাও তোমার মনে ছিল না? কিছু একটা হলে কি উপায় হত? আমি এই দুইটা দুধের বাচ্চা নিয়ে কি করে বাঁচতাম? হাচিনা, কামালের অবস্থা কি হত? তুমি বলবা, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট তো হত না? মানুষ কি শুধু খাওয়া পরা নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়? আর মরে গেলে দেশের কাজই বা কিভাবে করতে”? আমি তাকে কিছুই বললাম না। তাকে বলতে দিলাম, কারণ মনের কথা প্রকাশ করতে পারলে ব্যাথাটা কিছু কমে যায়। রেণু খুব চাপা, আজ যেন কথার বাঁধ ভেঙে গেছে। শুধু বললাম, “উপায় ছিল না”। বাচ্চা দুইটা ঘুমিয়ে পড়েছে। শুয়ে পড়লাম। সাতাশ-আঠাশ মাস পরে আমার সেই পুরানা জায়গায়, পুরানা কামরায়, পুরানা বিছানায় শুয়ে কারাগারের নির্জন প্রকোষ্টের দিনগুলির কথা মনে পড়ল। ঢাকার খবর সবই পেয়েছিলাম। মহিউদ্দিনও মুক্তি পেয়েছে। আমি বাইরে এলাম আর আমার সহকর্মীরা আবার জেলে গিয়েছে।
পরের দিন সকালে আব্বা ডাক্তার আনালেন। সিভিল সার্জন সাহেবের প্রেসক্রিপশনও ছিল। ডাক্তার সকলকে বললেন, আমাকে যেন বিছানা থেকে উঠতে না দেওয়া হয়। দিন
২০৯
দশেক পরে আমাকে হাঁটতে হুকুম দিল শুধু বিকেলবেলা। আমাকে দেখতে রোজই অনেক লোক বাড়িতে আসত। গোপালগঞ্জ, খুলনা ও বরিশাল থেকেও আমার কিছু সংখ্যক সহকর্মী এসেছিল।
একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, “হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি”। আমি আর রেণু দু’জনই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, “আমি তো তোমারও আব্বা”। কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভূলে যায়! আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। আজ দুইশত বৎসর পরে আমরা স্বাধীন হয়েছি। সামান্য হলেও কিছুটা আন্দোলনও করেছি। স্বাধীনতার জন্য। ভাগ্যের নিষ্টুর পরিহাস আজ আমাকে ও আমার সহকর্মীদের বছরের পর বছর জেল খাটতে হচ্ছে। আরও কতকাল খাটতে হয়, কেইবা জানে? একেই কি বলে স্বাধীনতা? ভয় আমি পাই না, আর মনও শক্ত হয়েছে। যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই পাকিস্তানই করতে হবে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম। গোপালগঞ্জ মহকুমার যে কেউ আসে, তাঁদের এক প্রশ্ন, “আপনাকে কেন জেলে নেয়? আপনিই তো আমাদের পাকিস্তানের কথা শুনিয়েছেন”। আবার বলে, “কত কথা বলেছিলেন, পাকিস্তান হলে কত উন্নতি হবে। জনগণ সুখে থাকবে, অত্যাচার জুলুম থাকবে না। কয়েক বছর হয়ে গেল দুঃখই তো আরও বাড়ছে, কমার লক্ষণ তো দেখছি না। চাউলের দাম কত বেড়ে গেছে”। কি উত্তর দেব! এরা সাধারণ মানুষ। কি করে এদের বোঝাব। গ্রামের অনেক মাতবর শ্রেণীর লোক আছেন, যারা বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান। কথা খুব সুন্দরভাবে বলতে পারেন। এক কথায় তো বোঝানোও যায় না। পাকিস্তান খারাপ না, পাকিস্তান তো আমাদেরই দেশ। যাদের হাতে ইংরেজ ক্ষমতা দিয়ে গেছে তারা জনগণের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থই বেশি দেখছে। পাকিস্তানকে কি করে গড়তে হবে, জনগণের কি করে উন্নতি করা যাবে সেদিকে ক্ষমতাসীনদের খেয়াল নাই। ১৯৫২ সালে ঢাকায় গুলি হওয়ার পরে গ্রামে গ্রামে জনসাধারণ বুঝতে আরম্ভ করেছে যে, যারা শাসন করছে তারা জনগণের আপনজন নয়। খবর নিয়ে জানতে পারলাম, ২১শে ফেব্রুয়ারি গুলি হওয়ার খবর বাতাসের সাথে সাথে গ্রামে গ্রামে পৌঁছে গেছে এবং ছোট ছোট হাটবাজারে পর্যন্ত হরতাল হয়েছে। মানুষ বুঝতে আরম্ভ করেছে যে, বিশেষ একটা গোষ্টী (দল) বাঙালিদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়।
ভরসা হল, আর দমাতে পারবে না। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে উপায় নাই। এই আন্দোলনে দেহসের লোক সারা দিয়েছে ও এগিয়ে এসেছে। কোনো কোনো মওলানা সাহেবরা
২১০
ফতোয়া দিয়েছিলেন বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে। তাঁরাও ভয় পেয়ে গেছেন। এখন আর প্রকাশ্যে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পাচ্ছেন না। জনমত সৃষ্টি হয়েছে, জনমতের বিরুদ্ধে যেতে শোষকরা ভয় পায়। শাসকরা যখন শোষক হয় অথবা শোষকদের সাহায় করতে আরম্ভ করে তখন দেশের ও জনগণের মঙ্গল হওয়ার চ্যেয়ে অমঙ্গলই বেশি হয়।
মার্চ মাস পুরাটাই আমাকে বাড়িতে থাকতে হল। শরীরটা একটু ভাল হয়েছে, কিন্ত হার্টের দুর্বলতা আছে। আব্বা আমকে ছাড়তে চান না। ডাক্তারও আপত্তি করে। রেণুর ভয় ঢাকায় গেলে আমি চুপ করে থাকব না, তাই আবার গ্রেফতার করতে পারে। আমার মন রয়েছে ঢাকায়, নেতারা ও কর্মীরা সকলেই জেলে। সংগ্রাম পরিষদের নেতারা গোপনে সভা করতে যেয়ে সকলে একসাথে গ্রেফতার হয়ে গেছে। ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মীরা অনেকেই জেলে বন্দি। আওয়ামী লীগের কাজ একেবারে বন্ধ। কেউ সাহস করে কথা বলছে না। লীগ সরকার অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে দিয়েছে। যা কিছুই হোক না কেন বসে থাকা চলবে না।
এই সময় মানিক ভাইয়ের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম। তিনি আমাকে অতিসত্বর ঢাকায় যেতে লিখেছেন। চিকিৎসা ঢাকায়ই করা যাবে এবং ঢাকায় বসে থাকলেও কাজ হবে। আমি আব্বাকে চিঠিটা দেখালাম। আব্বা চুপ করে থাকলেন কিছু সময়। তারপর বললেন, যেতে চাও যেতে পার। রেণুও কোনো আপত্তি করল না। টাকা পয়সারও দরকার। খবর পেয়েছি, আমার বিছানাপত্র কাপড়চোপড় কিছুই নাই। আবার নতুন করে সকল কিছু কিনতে হবে। আমার কিছু টাকা দরকার। কয়েক মাসের খরচও তো লাগবে। ঢাকা থেকে আবদুল হামিদ চৌধুরী ও মোল্লা জালালউদ্দিন খবর দিয়েছে তাতীবাজারে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছে। আমি তাঁদের কাছে উঠতে পারব। ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে আর উঠতে চাই না, কারণ সেখানে এত লোক আসে যায় যে, নিজের বলতে কিছুই থাকে না। তবে ওখানে থাকার আকর্ষণও আছে। শওকত মিয়ার মত মুরব্বি থাকলে চিন্তা করতে হয় না। আমার শরীর ভাল না, চিকিৎসা করাতে হবে। রেণুও কিছু টাকা আমাকে দিল গোপনে। আব্বার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা করলাম, এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। হাচিনা ও কামাল আমাকে ছাড়তে চায় না, ওদের উপর আমার খুব দুর্বলতা বেড়ে গেছে। রওয়ানা করার সময় দুই ভাইবোন খুব কাঁদল। আমি বরিশাল হয়ে ঢাকায় পৌছালাম। পূর্বেই খবর দিয়েছি, জালাল আমাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে নিয়ে যেতে আসল ওদের বাসায়। আমার জন্য একটা কামরাও ঠিক করে রেখেছে।
শামসুল হক সাহেব আওয়ামী লীগের অফিস নবাবপুর নিয়ে এসেছেন। এই বাড়ির দুইটা কামরায় মানিক ভাই তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে কিছুদিন ছিলেন। মানিক ভাই, আতাউর
২১১
রহমান সাহেব ও আরও অনেকের সাথে দেখা করলাম। ডাক্তার নন্দীর কাছে যেয়ে নিজেকে দেখালাম। তিনি ঔষধ লিখে দিলেন। আওয়ামী লীগ অফিসে যেয়ে দেখি একখানা টেবিল, দুই তিনখানা চেয়ার, একটা লম্বা টুল। প্রফেসার কামরুজ্জামান অফিসে বসেন। একটা ছেলে রাখা হয়েছে, যাকে অফিস পিয়ন বলা যেতে পারে। শামসুল হক সাহেব জেলে। আমি জয়েন্ট সেক্রেটারি। ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডাকলাম। তাতে যে বার-তেরজন সদস্য উপস্থিত ছিলেন তারা আমাকে এক্টিং জেনারেল সেক্রেটারি করে প্রতিষ্টানের ভার দিলেন। আতাউর রহমান সাহেব অন্যতম সহ-সভাপতি ছিলেন, তিনি সভাপতিত্ব করলেন।
ঢাকায় তখন একটা ত্রাসের রাজত্ব ছলছে। ভয়ে মানুষ কোনো কথা বলে না। কথা বললেই গ্রেফতার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলিতে একই অবস্থা। আওয়ামী লীগ অফিসে কেউই আসে না ভয়ে। আমি ও কামরুজ্জামান সাহেব বিকালে বসে থাকি। অনেক চেনা লোক দেখলাম, নবাবপুর দিয়ে যাবার সময় আমাদের অফিসের দিকে আসলেই মুখ ঘুরিয়ে নিতেন। দু’একজন আমাদের দলের সদস্যও ছিল। আমার সাতেহ কেউ দেখা করতে আসলে আমি বলতাম, অফিসে আমার সাথে দেখা করবেন, সেখানেই আলাপ করব।
শহীদ সাহেব যখন এসেছিলাম, তাঁর এক ভক্তের কাছ থেকে একটা টাইপ রাইটিং মেশিন নিয়ে অফিসের জন্য দিয়ে গিয়েছিলেন। ঢাকার একজন ছাত্র সিরাজ, এক হাত দিয়ে আস্তে আস্তে টাইপ করতে পারত। তাকে বললাম, অফিসে কাজ করতে, সে রাজি হল। কাজ করতে করতে পরে ভাল টাইপ করা শিখেছিল। একজন পিয়ন রাখলাম, প্রফেসার কামরুজ্জামান সাহেবের বাসায় থাকত।
এই সময় একজন এডভোকেট আমাদের অফিসে আসলেন। তিনি বললেন, “আমি আপনাদের দলের সভ্য হতে চাই। আমার দ্বারা বেশি কাজ পাবেন না, তবে অফিসের কাজ আমি বিকালে এসে করে দিতে পারি”। আমি খুব খুশিই হলাম। ভদ্রলোক আস্তে আস্তে কথা বলেন, আমার বয়সীই হবেন। আমার খুব পছন্দ হল। আমি তাঁকে অনুরোধ করলাম, অফিসের ভার নিতে। তিনি বললেন, কোর্টের কাজ শেষ করে বাড়ি যাওয়ার পূর্বে রোজই আসব। সত্যই তিনি আসতে লাগলেন এবংকাজ করতে লাগলেন। পুরানা অফিস সেক্রেটারি ভদ্রলোক কেটে পড়েছেন। পরে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় আমি প্রস্তাব করলাম, তাঁকে অফিস সেক্রেটারি করতে। সকলেই রাজি হলেন। আজ ষোল বৎসর তিনি অফিস সেক্রেটারি আছেন। কোনোদিন কোনো পদের জন্য কাউকেও তিনি বলেন নাই। আমার সাথে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বও হয়ে গিয়েছে। তিনি কোনোদিন সভায় বক্তৃতা করেন না। তাঁকে অফিসের কাজ ছাড়া কোনো কাজেও কেউ বলেন নাই। তিনিও চান না অন্য কাজ করতে। অফিসের খরচও তাঁর হাতে আমি দিয়েছিলাম। হিসাব-নিকাশ তিনিই রাখতেন। আমাদের আয়ও কম, খরচও কম। কোনোদিন কোনো সরকার তাঁকে খারাপ চোখে দেখে নাই। আর গ্রেফতারও করে নাই। এবারেই তাঁকে কয়েকদিনের জন্য গ্রেফতার করে এনেছিল। তাঁর শরীরও ভাল না। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তাঁর মত অফিস সেক্রেটারি পেয়েছিল বলে অনেক কাজ হয়েছে। তাঁর নামটা বলি নাই, মিস্টার মোহাম্মদউল্লাহ। শহীদ সাহেব
২১২
ও ভাসানী সাহেবও তাঁকে ভালবাসতেন এবং বিশ্বাস করতেন। অফিসের কাজ কখনও পড়ে থাকত না।
যাহোক, দুই তিনটা জেলা ছাড়া জেলা কমিটিও গঠন হয় নাই। প্রতিষ্টান গড়ার সুযোগ এসেছে। সাহস করে কাজ করে যেতে পারলে প্রতিষ্টান গড়ে উঠবে। কারণ, জনগণ এখন মুসলিম লীগ বিরোধী হয়ে গেছে। আর আওয়ামী লীগ এখন একমাত্র বিরোধী দল, যার আদর্শ আছে এবং নীতি আছে। তবে সকলের চেয়ে বড় অসুবিধা হয়েছে টাকার অভাব।
এদিকে মুসলিম লীগের কাগজগুলি শহীদ সাহেবের বিবৃতি এমনভাবে বিকৃত করে ছাপিয়েছে যে মনে হয় তিনিও উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হোক এটাই চান। আমি সাধারণ সম্পাদক হয়েই একটা প্রেস কনফারেন্স করলাম। তাতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে, রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে এবং যারা ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ হয়েছেন তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরন দান এবং যারা অন্যায়ভাবে জুলুম করেছে তাঁদের শাস্তির দাবি করলাম। সরকার যে বলেছেন, বিদেশী কোন রাষ্ট্রের উসকানিতে এই আন্দোলন করেছে, তার প্রমাণ চাইলাম। ‘হিন্দু ছাত্ররা’কলকাতা থেকে এসে পায়জামা পরে আন্দোলন করেছে, একথা বলতেও কৃপণতা করে নাই মুসলিম লীগ নেতারা। তাদের কাছে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ছাত্রসহ পাঁচ ছয়জন লোক মারা গেল গুলি খেয়ে, তারা সকলেই মুসলমান কি না? এত ছাত্র কলকাতা থেকে এল. একজনকেও ধরতে পারল না যে সরকার, সে সরকারের গদিতে থাকার অধিকার নাই। পার্টির কাজে আতাউর রহমান খান সাহেবের কাছ থেকে সকল রকম সাহায্য ও সহানুভূতি আমি পেয়েছিলাম। ইয়ার মোহাম্মদ খানও আমাকে সাহায্য করেছিলেন কাজ করতে। আমরা এক আলোচনা সভা করলাম, তাতে ঠিক হল আমাকে করাচি যেতে হবে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সাথে সাক্ষাৎ করে রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি করতে হবে। শহীদ সাহেবের সাথেও আলাপ-আলোচনা করা দরকার। তাঁর সাহায্য আমাদের খুব প্রয়োজন।
পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও করাচিতে আওয়ামী লীগ গঠন করা হয়েছে। তবে নবাব মামদোতের দল জিন্নাহ মুসলিম লীগে যোগদান করায়, জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ করা হয়েছে পাঞ্জাবে। আমরা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আমাদের প্রতিষ্টানের নাম পরিবর্তন করব না। জিন্নাহ সাহেবের নাম কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্টানের সাথে রাখা উচিত না। কোনো লোকের নামই রাজনৈতিক প্রতিষ্টান হতে পারে না। আমাদের ম্যানিফেস্টোও আমরা পরিবর্তন করব না। তখন পর্যন্ত আমরা এফিলিয়েশন নেই নাই। সোহরাওয়ারদী সাহেব তাতে অসন্তষ্ট হয়েছেন। এ সমস্ত বিষয় নিয়েও তাঁর সাথে আলোচনা করা দরকার হয়ে
পড়েছে। তিনি আমাকে চিঠিও লিখেছেন হায়দ্রাবাদ (সিন্ধু) থেকে। তখন তিনি ‘পিণ্ডি কনসপিরেসি’ মামলায় আসামিদের পক্ষ সমর্থন করেছিলেন। মে মাসে আমি করাচি পৌছালাম। আমাকে করাচি আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহমুদুল হক ওসমানী ও জেনারেল সেক্রেটারি শেখ মঞ্জুরুল হক দলবল নিয়ে অভ্যর্থনা করল। আমি ওসমানী সাহেবের বাড়িতে উঠলাম। আওয়ামী লীগ কর্মীদের এক সভা ডাকা হয়েছিল। সেখানে আমাকে ইংরেজিতেই বক্তৃতা করতে হল। উর্দু বক্তৃতা আমি করতে পারতাম না, তাঁরাও বাংলা বুঝতেন না।
আমি পৌছেই খাজা সাহেবের কাছে একটা চিঠি পাঠালাম, তাঁর সাথে দেখা করার অনুমতি চেয়ে। তিনি আমার চিঠির উত্তর দিলেন এবং সময় ঠিক করে দিলেন দেখা করার অনুমতি দিয়ে।
আমানুল্লাহ নামে এক বাঙালি ছাত্র করাচিতে লেখাপড়া করত, সে আমার সেক্রেটারি হিসাবে সকল কাজকর্ম করে দিত। সর্বক্ষণ আমার সাথেই থাকত। সে করাচি আওয়ামী লীগের সভ্যও ছিল। সমস্ত কাজ করতে পারত, কোনো বিশ্রামের প্রয়োজন তার ছিল না বলে মনে হত। করাচির কফি হাউসই ছিল করাচির রাজনৈতিক কর্মীদের প্রধান আড্ডাখানা। সেখানেও সে আসর গরম করে রাখত এবং একাই লড়ত বাংলাদের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য। জনাব ওসমানী ও মঞ্জুর ঠিক করল আমাকে এক প্রেস কনফারেন্স করে পূর্ব পাকিস্তানে কি ঘটেছিল এবং কি ঘটছে তা বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করতে হবে এখানে। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানে একতরফা প্রপাগান্ডা হয়েছে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্বন্ধে।
আমি যথাসময়ে প্রধানমন্ত্রী খাজা সাহেবের সাথে দেখা করতে তাঁর অফিসে হাজির হলাম। প্রধানমন্ত্রীর এসিস্ট্যাট সেক্রেটারি মিস্টার সাজেদ আলী আমাকে অভ্যর্থনা করলেন। তাঁকে আমি পূর্ব থেকে জানতাম, তিনি কলকাতার বাসিন্দা। পূর্বে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রীর পিএ ছিলেন। আমাকে নিয়ে বসলেন তাঁর কামরায়। আমার জন্য বিশ মিনিট সময় ধার্য করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। আমাকে খাজা সাহেব তাঁর কামরায় নিজে এগিয়ে এসে নিয়ে বসালেন। যথেষ্ট ভদ্রতা করলেন, আমার শরীর কেমন? আমি কেমন আছি, কতদিন থাকব-এইসব জিজ্ঞাসা করলেন। তিনিও জানতেন, ব্যাক্তিগতভাবে তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি। আমি যে ভাল কর্মী সে কথা তিনি নিজেই স্বীকার করতেন এবং আমকে স্নেহও করতেন। আমি তাঁকে অনুরোধ করলাম, “মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, আবুল হাশিম, মওলানা তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, খান সাহেব ওসমান আলীহস সমস্ত কর্মীকে মুক্তি দিতে। আরও বললাম, জুডিশিয়াল ইনকোয়ারি বসাতে, কেন গুলি করে ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছিল?” তিনি বললেন, “এটা প্রাদেশিক সরকারের হাতে, আমি কি করতে পারি?”আমি বললাম, “আপনি মুসলিম লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, আর পূর্ব বাংলায়ও মুসলিম লীগ সরকার, আপনি তাদের নিশ্চয়ই বলতে পারেন। আপনি তো চান না যে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হোক, আর আমরাও তা চাই না। আমি করাচি পর্যন্ত এসেছি আপনার সাথে দেখা করতে, এজন্য যে প্রাদেশিক সরকারের কাছে দাবি করে কিছুই হবে না।
২১৪
তারা যে অন্যায় করেছে সেই অন্যায়কে ঢাকবার জন্য আরও অন্যায় করে চলেছে”। তিনি বিশ মিনিটের জায়গায় আমাকে এক ঘন্টা সময় দিলেন। আমি তাঁকে বললাম যে, “আওয়ামী লীগ বিরোধী পার্টি। তাকে কাজ করতে সুযোগ দেওয়া উচিত। বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না। আপনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তা আমি জানি”। তিনি স্বীকার করলেন, আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল। আমি তাঁকে বললাম, “ আওয়ামী লীগ বিরোধী দল আপনি স্বীকার করে নিয়েছেন, একথা আমি খবরের কাগজে দিতে পারি কি না?” তিনি বললেন, “নিশ্চয়ই দিতে পার”। তিনি আমাকে বললেন, প্রদেশের কোন কাজে তিনি হস্তক্ষেপ করেন না, তবে তিনি চেষ্টা করে দেখবেন কি করতে পারেন। আমি তাঁকে আদাব করে বিদায় নিলাম। তিনি যে আমার কথা ধৈর্য ধরে শুনেছেন এ জন্য তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। দুই দিন পরে প্রেস কনফারেন্স করলাম। আমার লেখা বিবৃতি পাঠ করার পরে প্রেস প্রতিনিধিরা আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, অনেক প্রশ্নই আমাকে করলেন। আমি তাদের প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পেরেছিলাম এবং পূর্ব বাংলার অবস্থা তাদের বুঝিয়ে বুঝিয়ে বলতে পেরেছিলাম। এখানে এক প্রশ্নের উত্তরে তাদের বলেছিলাম, “প্রায় ত্রিশটা উপনির্বাচন বন্ধ করে রাখা হয়েছে। যে কোন একটায় ইলেকশন হোক, আমরা মুসলিম লীগ প্রার্থীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করতে সক্ষম হব”।
তখনও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ ও শিক্ষিত সমাজের ধারণা, আওয়ামী লীগের কোনো জনপ্রিয়তা নাই। মুসলিম লীগ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্টতা পাবে। পাঞ্জাবে নির্বাচনের ফলাফল দেখে তাদের এই ধারণা হয়েছে। তাঁরা বাংলার জনসাধারণকে জানেন না, আর তাদের সম্বন্ধে ধারণাও নাই। সরকার সমর্থক কাগজগুলি এমনভাবে প্রচার করে চলেছে যে, সত্য চাপা পরে আছে। পূর্ব বাংলার সঠিক অবস্থা, পশ্চিম পাকিস্তানকে কোনোদিন বলা হয় নাই। স্বায়ত্তশাসনের দাবি সম্বন্ধেও প্রশ্ন করা হয়েছিল, আমি তাদের পাকিস্তানের ভৌগলিক অবস্থা চিন্তা করতে অনুরোধ করেছিলাম। প্রায় দুই ঘণ্টা প্রেস কনফারেন্স চলেছিল। আমার মনে হল, তাঁরা কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন। পাকিস্তান টাইমস ও ইমরোজ খুব ভালভাবে ছাপিয়েছিল আমার প্রেস কনফারেন্সের জবাবগুলি। মুসলিম লীগের অনেক পুরানা সহকর্মীদের সাথে সাক্ষাৎও হয়েছিল। শেখ মঞ্জুরুল হক দিল্লিতে মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ডের সালারে সুবা ছিল। এখন আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি হয়েছে। দিল্লিতে তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। আমি এই প্রথম করাচি দেখলাম; ভাবলাম এই আমাদের রাজধানী! বাঙালিরা কয়জন তাদের রাজধানী দেখতে সুযোগ পাবে! আমরা জন্মগ্রহণ করেছি সবুজের দেশে, যেদিকে তাকানো যায় সবুজের মেলা। মরুভুমির এই পাষাণ বালু আমাদের পছন্দ হবে কেন? প্রকৃতির সাথে মানুষের মনেরও একটা সম্বন্ধ আছে। বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মত উড়ে বেড়ায়। আর পলিমাটির বাংলার মানুষের মন ঐ
২১৫
রকমই নরম, ঐ রকমই সবুজ। প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যে আমাদের জন্ম, সৌন্দর্যই আমরা ভালবাসি।
মঞ্জুর তার জিপে করে আমাকে নিয়ে হায়দ্রাবাদ চলল। কিছুদূর যাওয়ার পরই মরুভূমি চোখে পড়ল। অনেক মাইল পর্যন্ত বাড়িঘর নাই, মাঝে মাঝে দু’একটা ছোট ছোট বাজারের মত। দেখলাম, সামান্য কয়েকজন লোক বসে আছে। মঞ্জুরকে বললাম, “তোমরা এই মরুভুমিতে থাক কি করে”? উত্তর দিল “বাধ্য হয়ে। মোহাজের হয়ে এসেছি, এই তো আমাদের বাড়িঘর, এখানেই মরতে হবে। দিল্লি তো তুমি দেখছ, এ রকম মরুভুমি তুমি দেখ নাই? প্রথম প্রথম খারাপ লেগেছিল, এখন সহ্য হয়ে গেছে। আমরা মোহাজেররা এসেছি, ভবিষ্যতে আসলে দেখ করাচিকেও আমরা ফুলে ফুলে ভরে ফেলব”।
আমরা বিকালে পৌছালাম। মঞ্জুর নিজেই ড্রাইভ করছিল। সে চমৎকার গাড়ি চালাতে পারে। মঞ্জুরের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। অনেক উত্থান-পতন হয়েছে, বন্ধুত্ব যায় নাই। পরে যতবার করাচি গিয়েছি, ছায়ার মত আমার কাছেই রয়েছে। যাহোক, সোজা ডাকবাংলোতে পৌছালাম। শহীদ সাহেব বাইরে গেছেন, রাতে ফিরবেন। আমরা দুইজনে একটা হোটেলে চলে আসলাম, সেখানে হাতমুখ ধুয়ে খাওয়া-দাওয়া করে রাত নয়টার সময় ডাকবাংলোতে এসে দেখি তখনও তিনি ফেরেন নাই। আমরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে লাগলাম। রাত দশটায় তিনি ফিরলেন। আমাকে দেখে বললেন, “খুব প্রেস কনফারেন্স করছ পশ্চিম পাকিস্তানে এসে”। বললাম, “কি আর করি”। আমি যে হায়দ্রাবাদ আসব তিনি জানতেন। অনেকক্ষণ পর্যন্ত আলোচনা হল।
তিনি পূর্ব বাংলার কথা জিজ্ঞাসা করলেন, নেতারা সকলেই জেলে আছেন, কি আর ভাল থাকবেন! নাজিমুদ্দীন সাহেবের সাথে আমার যে আলাপ হয়েছিল তাও বললাম। একুশে ফেব্রুয়ারি যা যা ঘটেছিল তাও জানালাম। বললাম, রাষ্ট্রভাষা সম্বন্ধে তাঁর মতামত খবরের কাগজে বের হয়েছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “কি বের হয়েছে”? আমি বললাম। “আপনি নাকি কোন রিপোর্টারকে বলেছেন যে, উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত”। তিনি ক্ষেপে গেলেন এবং বললেন, “এ কথা তো আমি বলি নাই। উর্দু ও বাংলা দুইটা হলে আপত্তি কি ? একথাই বলেছিলাম”। আরও জানালেন যে, গুলি ও অত্যাচারের প্রতিবাদও তিনি করেছেন। আমি তাঁকে জানালাম, “সে সব কথা কোনো কাগজে পরিষ্কার করে ছাপান হয় নাই। পূর্ব বাংলার জনসাধারণ আপনার মতামত না পেয়ে খুবই দুঃখিত হয়েছে”। তিনি আমাকে পরের দিন বিকালে আসতে বললেন, কারণ সকালে কোর্ট আছে। ‘পিন্ডি ষড়যন্ত্র’ মামলার বিচার হায়দ্রাবাদ জেলের ভিতরে হচ্ছে। তিনি সন্ধ্যার দিকে হায়দ্রাবাদ থেকে মোটরে করাচি যাবেন। আমিও সাথে যেতে পারব। মঞ্জুর বলল যে, সে সকালেই চলে যাবে। আমরা দুইজন হোটেলে চলে আসলাম। মঞ্জুর সকালবেলা মিস্টার মাসুদকে খোঁজ করে নিয়ে আসল। মাসুদ সাহেব নিখিল ভারত স্টেট মুসলিম লীগের সেক্রেটারি ছিলেন। এখন হায়দ্রাবাদে এসে বাড়ি করেছেন। শহীদ সাহেবের ভক্ত এবং আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। মঞ্জুর তাঁর কাছে আমাকে রেখে রওয়ানা করল। মাসুদ সাহেব
২১৬
আমাকে নিয়ে বেলা একটা পর্যন্ত ঘুরলেন। একসাথে খাওয়া-দাওয়া করলাম এবং অনেকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
দু’টার সময় আমি মালপত্র নিয়ে শহীদ সাহেবের কাছে চলে আসলাম। শহীদ সাহেব কয়েকখানা বিস্কুট ও হরলিক্স খেলেন। এই তাঁর দুপুরের খাওয়া। এক এডভোকেট পেশোয়ার থেকে এসেছিল, অন্য এক আসামির পক্ষে। রাতে শহীদ সাহেব তাকে এবং আমাকে নিয়ে খানা খান। আমি বললাম, “এভাবে চলে কেমন করে?”তিনি বললেন, “বিস্কুট, মাখন, রুটিও আছে, এই খেয়েই হয়ে যায় দুপুরবেলা”। কোনো লোকজনও নাই। নিজেই সকল কিছু করেন। আমরা আবার আলাপ শুরু করলাম। তিনি বললেন, “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কোনো এফিলিয়েশন নেয় নাই। আমি তো তোমাদের কেউ নই”। আমি বললাম, “প্রতিষ্টান না গড়লে কার কাছ থেকে এফিলিয়েশন নেব। আপনি তো আমাদের নেতা আছেনই। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ আপনাকে তো নেতা মানে, এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণও আপনাকে সমর্থন করে”। তিনি বললেন, “একটা কনফারেন্স ডাকব, তার আগে পুরব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এফিলিয়েশন নেওয়া দরকার”। আমি তাঁকে জানালাম, “আপনি জিন্নাহ আওয়ামী লীগ করেছেন, আমরা নাম পরিবর্তন করতে পারব না। কোনো ব্যাক্তির নাম রাজনৈতিক প্রতিষ্টানের সাথে যোগ করতে চাই না। দ্বিতীয়ত আমাদের ম্যানিফেস্টো আছে, গঠনতন্ত্র আছে, তার পরিবর্তন করা সম্ভবপর নয়। মওলানা ভাসানী সাহব আমাকে ১৯৫৯ সালে আপনার কাছে পাঠিয়েছিলেন। তখনও তিনি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠনের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তাঁরও কোনো আপত্তি থাকবে না, যদি আপনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র মেনে নেন’।
অনেক আলোচনার পরে তিনি মানতে রাজি হলেন এবং নিজ হাতে তাঁর সম্মতির কথা লিখে দিলেন। কারণ, আমাকে ফিরে যেয়ে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় তা পাস করিয়ে এফিলিয়েশনের জন্য দরখাস্ত করতে হবে। আমি বললাম, “আপনার হাতের লেখা থাকলে কেউই আর আপত্তি করবে না। মওলানা সাহেবের সাথে জেলে আমার কথা হয়েছিল। তাতে আমাদের ম্যানিফেস্টো, নাম ও গঠনতন্ত্র মেনে নিলে এফিলিয়েশন নিতে তাঁর আপত্তি নাই”। আমি আর একটা অনুরোধ করলাম, তাঁকে লিখে দিতে হবে যে, উর্দু ও বাংলা দুইটাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসাবে সমর্থন করেন। কারণ অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। মুসলিম লীগ এবং তথাকথিত প্রগতিবাদীরা প্রোপাগান্ডা করছেন তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি বললেন, “নিশ্চয়ই লিখে দেব, এটা তো আমার নীতি ও বিশ্বাস”। তিনি লিখে দিলেন।
মামলা শেষ হলেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানে আসবেন, কথা দিলেন। বললেন, এক মস থাকবেন এবং প্রত্যেকটা জেলায় একটা করে সভার ব্যবস্থা করতে হবে। সময় নষ্ট করা যাবে না। তবে বিপদ হয়েছে, কতদিন এই মামলা চলে বলা যায় না। তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করলাম, “পিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলা সত্য কি না? আসামিদের রক্ষা করতে পারবেন কি না? আর ষড়যন্ত্র করে থাকলে তাদের শাস্তি হওয়া উচিত কি না?” তিনি বললেন, “ওসব প্রশ্ন কর না, আমি কিছুই বলব না, কারণ এডভোকেটদের শপথ নিতে হয়েছে, কোন কিছু
২১৭
কাউকেও না বলতে এ মামলা সম্বন্ধে”। তিনি একটু রাগ করেই বললেন, আমি চুপ করে গেলাম।
বিকালে করাচি রওয়ানা করলাম, শহীদ সাহেব নিজে গাড়ি চালালেন, আমি তাঁর পাশেই বসলাম। পিছনে আরও কয়েকজন এডভোকেট বসলেন। রাস্তায় এডভোকেট সাহেবরা আমাকে পূর্ব বাংলার অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। বাংলা ভাষাকে কেন আমরা রাষ্ট্রভাষা করতে চাই? হিন্দুরা এই আন্দোলন করছে কি না? আমি তাঁদের বুঝাতে চেষ্টা করলাম। শহীদ সাহেবও তাঁদের বুঝিয়ে বললেন এবং হিন্দুদের কথা যে সরকার বলছে, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা তা তিনিই তাঁদের ভাল করে বুঝিয়ে দিলেন। আমার কাছে তাঁরা নজরুল ইসলামের কবিতা শুনতে চাইলেন। আমি তাঁদের ‘কে বলে তোমার ডাকাত বন্ধু’, ‘নারী’, ‘সাম্য’- আরও কয়েকটা কবিতার কিছু কিছু অংশ শুনালাম। কবিগুরু রবিন্দ্রনাথের কবিতাও দু’একটার কয়েক লাইন শুনালাম। শহীদ সাহেব তাঁদের ইংরেজি করে বুঝিয়ে দিলেন। কবিগুরুর কবিতার ইংরেজি তরজমা দু’একজন পড়েছেন বললেন। আমাদের সময় কেটে গেল। আমরা সন্ধ্যারাতে করাচি পৌছালাম। শহীদ সাহেব আমাকে ওসমানী সাহেবের বাড়িতে নামিয়ে দিলেন এবং সকালে ১৩ নম্বর করাচি রোডে যেতে বললেন।
তাঁর সাথে দেখা করতে গেলে তিনি বললেন, আমাকে লাহোর হয়ে ঢাকায় যেতে। তিনি লাহোরে খাজা আবদুর রহিম বার-এট-ল এবং রাজা হাসান আখতারকে টেলিগ্রাম করে দিবেন বললেন। লাহোরেও প্রেস কনফারেন্স করতে এবং কর্মীদের সাথে আলোচনা করতে বললেন। অনেক দিন হয়ে গেছে, দেরি না করে ট্রেনে আমি লাহোর রওয়ানা করলাম। খাজা আবদুর রহিম পূর্ব আইসিএস ছিলেন (ইয়খন ওকালতি করেন), খুবই ভদ্রলোক। আমাকে তাঁর কাছে রাখলেন, ‘জাভেদ মঞ্জিলে’। তিনি জাভেদ মঞ্জিলে থাকতেন। ‘জাভেদ মঞ্জিল’ কবি আল্লামা ইকবালের বাড়ি। কবি এখানে বসেই পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আল্লামা শুধু কবি ছিলেন না, একজন দার্শনিকও ছিলেন। আমি প্রথমে তাঁর মাজার জিয়ারত করতে গেলাম এবং নিজেকে ধন্য মনে করলাম। আল্লামা যেখানে বসে সাধনা করেছেন সেখানে থাকার সুযোগ পেয়েছি।
খাজা সাহেব ও লাহোরের শহীদ সাহেবের ভক্তরা প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করলেন। আমি অনেকের সাথে দেখা করেছিলাম। হামিদ নিজামীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। পূর্বে যখন লাহোর এসেছিলাম, তিনি আমাকে খুব আদর আপ্যায়ন করেছিলেন। তিনি নিজেই প্রেস কনফারেন্সে উপস্থিত থাকবেন বললেন এবং সকলকে ফোন করে দিলেন। প্রেস কনফারেন্সে সমস্ত দৈনিক কাগজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এমনকি এপিপি’র প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। আমার বক্তব্য পেশ করার পরে আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, আমি তাঁদের প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পেরেছিলাম। আমরা যে উর্দু ও বাংলা দু’টাই রাষ্টড়ভাষা চাই, এ ধারণা তাঁদের ছিল না। তাঁদের বলা হয়েছে শুধু বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছি আমরা। পাকিস্তান আন্দোলনে যে সমস্ত নেতা ও কর্মী মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানের জন্য কাজ করেছে তারাই আওয়ামী লীগ প্রতিষ্টান
২১৮
গড়েছে তা আমি প্রমাণ করতে পেরেছিলাম। আমি যখন এক এক করে নেতাদের নাম বলতে শুরু করলাম তখন তাঁরা বুঝতে পারলেন বলে মনে হল। লাহোরের আওয়ামী লীগ নেতারা আমাকে অনেক ধন্যবাদ দিলেন। আমি তাঁদের বললাম, আমি মুখে যা বলি, তাই বিশ্বাস করি। আমার পেটে আর মুখে এক কথা। আমি কথা চাবাই না, যা বিশ্বাস করি বলি। সেজন্য বিপদেও পড়তে হয়, এটা আমার স্বভাবের দোষও বলতে পারেন, গুণও বলতে পারেন। একটা কথা লাহোরে পরিষ্কার করে বলে এসেছিলাম, ইলেকশন হলে খবর পাবেন মুসলিম লীগের অবস্থা। তারা এমনভাবে পরাজিত হবে যে আপনারা ভাবতেও পারবেন না।
এক বিপদ হল, সাত দিন পরে একদিন প্লেন লাহোর থেকে ঢাকায় আসে। তিন দিন পরে যে প্লেন ছাড়বে সে প্লেনে যাওয়ার উপায় নাই। কাজ শেষ হয় নাই, আর টিকিটও পাওয়া যাবে না। পরের সাপ্তাহেও প্লেন যাবে না, শুনলাম প্রায় সতের-আঠার দিন আমাকে লাহোরে থাকতে হবে। খাজা আবদুর রহিম ও রাজা হাসান আখতার রাওয়ালপিন্ডি ও মারী বেড়াতে যাবেন। আমাকেও যেতে বললেন। আমি রাজি হলাম। একদিন রাওয়ালপিন্ডিতে দেরি করে দেখে নিলাম আমাদের মিলিটারি হেডকোয়ার্টারস, আরও দেখলাম সেই পার্ক- যে পার্কে লিয়াকত আলী খানকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। পরের দিন সকালে মারী পৌছালাম। মারীতে রীতিমত শীত। গরম কাপড় প্রয়োজন, রাতে কম্বলের দরকার হয়েছিল। রাওয়ালপিন্ডিতে গরমে আমার মুখ আগুনে পুড়লে যেমন গোটা গোটা হয়, তাই দু’একটা হয়েছিল। মারী পিণ্ডি থেকে ত্রিশ-পয়ত্রিশ মাইল দূরে, কিন্ত কি সুন্দর আবহাওয়া! বড় আরাম লাগল। পাহাড়ের উপর ছোট্ট শহর। পাঞ্জাবের বড় বড় জমিদার ও ব্যবসায়ীদের অনেকের নিজেদের বাড়ি আছে। গরমের সময় ছেলেমেয়ে নিয়ে মারীতে থাকেন। আমার খুব ভাল লাগল। সবুজে ঘেরা পাহাড়গুলি, তার উপর শহরটি। একদিন থাকলাম, ইচ্ছা হয়েছিল আরও কিছুদিন থাকি। পরের দিনই আমাদে চলে আসতে হল। লাহোরে পীর সালাহউদ্দিন আমার সাথী ছিলেন। তাঁকে নিয়ে ঘোরাফেরা করতাম। নওয়াই ওয়াক্ত, পাকিস্তান টাইমস, ইমরোজ ও অন্যান্য কাগজে আমার প্রেস কনফারেন্সের বক্তব্য খুব ভালভাবে ছাপিয়েছিল। সরকার সমর্থক কাগজগুলি আমার বক্তব্যের বিরুদ্ধে সমালোচনাও করেছিল। আমি রাষ্ট্রভাষা বাংলা, রাজবন্দিদের মুক্তি, গুলি করে হত্যার পরিবাদ, স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক সমস্যার উপর বেশি জোর দিয়েছিলাম।
লাহোর থেকে প্লেনে ঢাকা আসলাম। তখন সোজা করাচি বা লাহোর থেকে প্লেন আসত না। দিল্লি ও কলকাতা হয়ে প্লেন আসত। ঢাকা এসেই ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডাকলাম। মওলানা সাহেবের সাথে যোগাযোগ করলাম। সোহরাওয়ারদী সাহেবের মতামত সকলকে জানালাম। সকলেই এফিলেশন নিতে রাজি হলেন। সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব নেওয়া হল।
২১৯
সাপ্তাহিক ইত্তেফাক তখন খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। মানিক ভাই সর্বস্ব দিয়ে কাগজটি চালাচ্ছেন। আমি তাঁকে দরকার মত সাহায্য করছি। আতাউর রহমান সাহেবও সাহায্য করতে ক্রটি করেন নাই।
এই সময় মওলানা সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সরকার তাঁর কেবিন খরচ দিতে রাজি হল না। ওয়ার্ডে রাখতে রাজি আছে। কেবিনে থাকতে দিতে আপত্তি নাই, তবে খরচটা বাইরে থেকে দিতে হবে আমাদের। মওলানা ভাসানী বন্দি, টাকা পয়সা কোথায় পাবেন? সরকারের খরচ দেওয়া উচিত, তবুও দেবে না। কতটুকু নিচ হলে এ কাজ করতে পারে একটা সরকার। আমাকে মওলানা সাহেব খবর দিলেন, কি করবেন? মহাবিপদে পড়লাম, টাকা কোথায় পাব, আর কেইবা আমাদের সাহায্য করবে? দশ দিনে প্রতিদিন প্রায় একশত পঞ্চাশ টাকা করে লাগবে। কেবিনে থাকলে ঔষধ এবং অন্যান্য জিনিস নিজের কিনতে হবে। তবুও আমি মওলানা সাহেবকে কেবিনে যেতে বললাম এবং টাকার বন্দোবস্তে লাগালাম। আতাউর রহমান সাহেবও কিছু সাহায্য করবেন বললেন। আমার এক সরকারি কর্মচারী বন্ধু এবং আনোয়ারা খাতুনও মাঝে মাঝে সাহায্য করতেন। তবে একজনের কথা স্বীকার করা দরকার। হাজী গিয়াসউদ্দিন নামে একজন বন্ধু ছিলেন আমার। তিনি ব্যবসা করতেন। কোনোদিন আওয়ামী লীগের সভ্য হন নাই; তবে আমাকে ভালবাসতেন। তাঁর বাড়ি কুমিল্লায়। যখন আর কোথাও টাকা জোগাড় করেত পারি নাই, তখন তার কাছে গেলে কখনও আমাকে খালি হাতে ফিরে আসতে হয় নাই। দশ দিনের মধ্যেই টাকা জোগাড় করতে হত। দেরি হলেই মওলানা সাহেবের কাছে নোটিশ আসত আর মওলানা সাহেব আমাকে চিঠি দিতেন হাসপাতাল থেকে। দু’একবার মওলানা সাহেবের সাথে আমি হাসপাতালে সাক্ষাৎও করেছি। তবে কথা বেশি বলতে পারতাম না। গেলেই পুলিশ বা আইবি কর্মচারী বলতেন, তাদের চাকরি থাকবে না। ফলে আমি বাধ্য হয়ে চলে আসতাম। এই সময় ঢাকার বংশাল এলাকার অনেক কর্মী জনাব আবদুল মালেক ও হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগে যোগদান করে। তারা নিজেরাও টাকা তুলে সাহায্য করত। তখন কর্মীরাই আওয়ামী লীগে টাকা দিয়ে কাজ চালাত।
মওলানা সাহেব যখন হাতপাতালে তখন আমি জেলায় জেলায় সভা করার জন্য প্রোগ্রাম করলাম। আতাউর রহমান খান ও আবদুস সালাম খানের মধ্যে তখন মনে মনে রেষারেষি চলছিল। সালাম সাহেবও সহ-সভাপতি, তাঁকে কোন গুরুত্ব দেওয়া হয় না, শুধু আতাউর রহমান খানকে দেওয়া হয়। তাই তিনি বলতে আরম্ভ করলেন, তিনি হাইকোর্টের এডভোকেট আর আতাউর রহমান জজ কোর্টের এডভোকেট, বয়সেও তিনি বড়, আর রাজনীতিতেও তিনি সিনিয়র, তবু তাঁকে গুরুত্বও দেওয়া হয় না। আমি তাঁকে বুঝাতে শুরু করলাম। বললাম, “আতাউর রহমান খান সাহেব পূর্বের থেকেই ঢাকায় আছেন, ঢাকার জনগণ তাঁকে জানে। আপনি ঢাকায় নতুন এসেছেন। এতে কিছুই আসে যায় না”। ওয়ার্কিং কমিটির সভায় একদিন আতাউর রহমান সাহেব সভাপতিত্ব করতেন, আর অন্য দিন
২২০
আবদুস সালাম খান করতেন। মওলানা সাহেব বন্দি। আমি পড়লাম বিপদে। সালাম সাহেব কর্মীদের সাথে মিশতে জানতেন না। দরকার মত তাঁকে পাওয়া কষ্টকর ছিল। কিন্ত আতাউর রহমান সাহেবকে যে কোন সময় ডাকলে পাওয়া যেত। কাজী গোলাম মাহাবুব আত্মগোপন করে থাকার সময় ও পরে জেলে গেলে আতাউর রহমান সাহেব রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক হন। ফলে তিনি কর্মী ও ছাত্রদের সাথে ঘনিষ্টভাবে মেলামেশা করার সুযোগ পান। যে কোনো সময় আতাউর রহমান সাহেবকে পেতাম। ফলে আমিও তাঁর দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছিলাম। তিনি কোনো সময় কোনো কাজে আপত্তি করতেন না। তাঁর নিজের উদ্যোগ খুব কম ছিল, তবুও ডাকলে পাওয়া যেত। আমি বাইরে প্রকাশ করতাম না যে, আতাউর রহমান সাহেবকে আমি বেশি পছন্দ করি। আমি সালাম সাহেবকে বললাম, আতাউর রহমান সাহেবকে নিয়ে আওয়ামী লীগ গড়তে উত্তরবঙ্গে যাচ্ছি। আপনি আমার সাথে ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনা যাবেন। তিনি রাজি হলেন।
আতাউর রহমান সাহেব ও আমি পাবনা, বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুরে প্রোগ্রাম করলাম। নাটোর ও নওগাঁয় কমিটি করতে পেরেছিলাম, কিন্ত রাজশাহীতে তখনও কিছু করতে পারি নাই। দিনাজপুরে সভা করলাম, সেদিন বৃষ্টি ছিল। তাই লোক বেশি হয় নাই। রাতে এক কর্মীসভা করে রহিমুদ্দিন সাহেবের নেতৃত্বে একটা জেলা কমিটি করলাম। এইভাবে বিভিন্ন জেলায় কমিটি করতে পারলাম। কিন্ত রাজশাহীতে পারলাম না। পাবনায়ও কেউ এগিয়ে আসল না। থাকার জায়গা পাওয়া কষ্টকর ছিল। পরে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও আবদুর রব ওরফে বগাকে দিয়ে একটা কমিটি করলাম। অন্য কোন লোক পাওয়া গেল না বলে, কয়েকজন ছাত্রের নাম দিয়ে দিলাম। পাবনায় ছাত্রলীগের কর্মীরা দুই ঘন্টার নোটিশে এক সভা ডাকল টাউন হল মাঠে। মাইক্রোফোন ছিল না। আমি ও আতাউর রহমান সাহেব মাইক্রোফোন ছাড়াই সভা করলাম। এইভাবে উত্তরবঙ্গ সেরে আবার দক্ষিণ বঙ্গে রওয়ানা করলাম। কুষ্টিয়া, যশোরে ভাল কমিটি হল। খুলনায় কোন বয়েসী লোক পাওয়া গেল না। আমার সহকর্মী যুবক শেখ আবদুল আজিজ সভাপতি এবং মমিনুদ্দিনকে সেক্রেটারি করে জেলা আওয়ামী লীগ গঠন করলাম।সালাম সাহেব আপত্তি করছিলেন। আমি বললাম, “বয়স্ক লোক না পাওয়া গেলে প্রতিষ্টান গড়ব না মনে করেছেন! দেখবেন এরাই একদিন এই জেলার নেতা হয়ে কাজ করতে পারবে”। যেখানে এডভোকেট সাহেবরা যেতে পারে নাই, সে সমস্ত জেলায় আমি একলাই যেতাম এবং সভা করতাম, কমিটি গঠন করতাম। জুন, জুলাই, আগস্ট মাস পর্যন্ত আমি বিশ্রাম না করে প্রায় সমস্ত জেলা ও মহকুমা ঘুরে আওয়ামী লীগ শাখা গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
শামসুল হক সাহেব পূর্বেই ময়মনসিংহে কমিটি গঠন করেছিলেন। জনাব আবুল মনসুর আহমদ সাহেব কলকাতা থেকে ফিরে এসেছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি হলেন এবং হাশিমউদ্দিন সাহেবকে সেক্রেটারি করলেন। হাশিমউদ্দিন আহমদ সাহেব, রফিকুদ্দিন ভূঁইয়া, হাতেম আলী তালুকদার রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় গ্রেফতার হয়ে রাজবন্দি হিসাবে জেলে ছিলেন। নোয়াখালীতে আবদুল জব্বাদ খদ্দর সাহেব জেলা কমিটি গঠন
২২১
করেছেন। চট্টগ্রামে আবদুল আজিজ, মোজাফফর আহম্মদ, জহুর আহমদ চৌধুরী ও কুমিল্লায় আবদুর রহমান খান, লাল মিয়া ও মোশতাক আহমদ আওয়ামী লীগ গঠন করেছেন। আমি এই সমস্ত জেলায়ও ঘুরে প্রতিষ্টানকে জোরদার করেত চেষ্টা করলাম। আগস্ট মাসের শেষের দিকে বরিশাল হয়ে বাড়ি যেতে হল, টাকা পয়সার খুব অভাব হয়ে পড়েছে। কিছুদিন বাড়িতে থাকলাম, তারপর ঢাকায় ফিরে এলাম। ল’পড়া ছেড়ে দিয়েছি। আব্বা খুবই অসন্তুষ্ট, টাকা পয়সা দিতে চান না। আমার কিছু একটা করা দরকার। ছেলেমেয়ে হয়েছে, এভাবে কতদিন চলবে! রেণু কিছুই বলে না, নীরবে কষ্ট সহ্য করে চলেছে। আমি বাড়ি গেলেই কিছু টাকা লাগবে তাই জোগাড় করার চেষ্টায় থাকত। শেষ পর্যন্ত আব্বা আমাকে টাকা দিলেন, খুব বেশি টাকা দিতে পারেন নাই, তবে আমার চলবার মত টাকা দিতে কোনোদিন আপত্তি করেন নাই। আমার নিজের বেশি কোনো খরচ ছিল না, একমাত্র সিগারেটই বাজে খরচ বলা যেতে পারে। আমার ছোট ভাই নাসের ব্যবসা শুরু করেছে খুলনায়। সে আমার ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করে। বাড়ি থেকে তার কোনো টাকা পয়সা নিতে হয় না। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে কিছু টাকা বাড়িতে দিতেও শুরু করেছে।
ঢাকায় ফিরে এসে পূর্ব পাকিস্তান শান্তি কমিটির সভায় যোগদান করলাম। আতাউর রহমান খান সাহেব সভাপতি। আমরা ‘যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই’- এই আমাদের স্লোগান। সেপ্টেম্বর মাসের ১৫-১৬ তারিখে খবর এল দক্ষিণ-পূর্ব-এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীর দেশগুলির প্রতিনিধিরা শান্তি সম্মেলনে যোগদান করবে। আমাদেরও যেতে হবে পিকিং-এ, দাওয়াত এসেছে। সমস্ত পাকিস্তান থেকে ত্রিশজন আমন্ত্রিত। পূর্ব বাংলার ভাগে পড়েছে মাত্র পাঁচজন। আতাউর রহমান খান, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, উর্দু লেখক ইবনে হাসান ও আমি। সময় নাই, টাকা পয়সা কোথায়? পাসপোর্ট কখন করব? টিকিট অবশ্য পাওয়া যাবে যাওয়া-আসার জন্য শান্তি সম্মেলনের পক্ষ থেকে।
আমরা পাসপোর্টের জন্য দরখাস্ত করলাম, পাওয়ার আশা আমাদের খুবই কম। কারণ, সরকার ও তার দলীয় সভ্যরা তো ক্ষেপে অস্থির। কমিউনিস্ট না হলে কমিউনিস্ট চীনে যেতে চায়? শান্তি সম্মেলন তো না, কমিউনিস্ট পার্টির সভা, এমনি নানা কথা শুরু করে দিল। মিয়া ইফতেখারউদ্দিন সাহেব চেষ্টা করছেন করাচিতে, আমাদের পাসপোর্টের জন্য। পাসপোর্ট অফিসার ভদ্রলোক বললেন, “আমি লিখে পড়ে সব ঠিক করে রেখেছি, হুকুম আসলেই দুই মিনিটের মধ্যে পেয়ে যাবেন”। তিনি নিজেও করাচিতে খবর দিলেন। আমরা পূর্ব বাংলা সরকারের হোম ডিপার্টমেন্টে খবর নিতে লাগলাম। আতাউর রহমান সাহেবও জয়েন্ট সেক্রেটারি ও সেক্রেটারির সাথে দেখা করলেন। কেউই কিছু বলতে পারে না। আমরা চেষ্টায় রইলাম, বিওএসি অফিসে খোঁজ নিলাম। তারা আমাদের জানালেন,
২২২
আপনাদের টিকিট এসে গেছে। তবে পাসপোর্ট না আনলে টিকিট ইস্যু করতে পারব না, সিটও রিজার্ভ করা যাবে না। সপ্তাহে একদিন বিওএসি;র প্লেন ঢাকায় আসে। শুনলাম, ২৩ কি ২৪ তারিখ ঢাকা-রেঙ্গুন হয়ে হংকং যাবে।
জানলাম পিকিংয়ে ভীষণ শীত, গরম কাপড় লাগবে। কিন্ত গরম কাপড় আমার ছিল না। তবে হংকং থেকেও কিনে নেওয়া যাবে। খুব নাকি সস্তা। ২২-২৩ তারিখে আমরা আশা ছেড়ে দিলাম। বোধহয় ২৪ তারিখ একটা প্লেন ঢাকায় আসবে। সরকার থেকে খবর এসেছে আমাদের পাসপোর্ট দেওয়া হবে। আমরা বুঝলাম এটা দেয়া না, শুধু মুখ রক্ষা করা। পাসপোর্ট পেলাম একটায়। কখন বাড়িতে যাব, কাপড় আনব আর কখনই বা প্লেনে উঠব। আতাউর রহমান সাহেব টেলিফোন করলেন বিওএসি অফিসে, প্লেনের খবর কি? তারা বলল, প্লেনের কোন খবর নাই। তবে কয়েক ঘন্টা লেট আছে। মনে আশা এল, তবে বোধহয় যেতে পারব। আমরা দেরি করতে লাগলাম, আতাউর রহমান সাহেবের বাড়িতে। এক ঘন্টার মধ্যে খবর দেবে বলেছে, ঠিক কত ঘন্টা লেট আছে। মানিক ভাই বলতে শুরু করেছে, তাঁর যাওয়া হবে না, কারণ ইত্তেফাক কে দেখবে? টাকা কোথায়? ইত্তেফাকে লিখবে কে? কিছু সময় পরে খবর পেলাম চব্বিশ ঘন্টা প্লেন লেট। আগামী দিন বারটায় প্লেন আসবে, একটায় ছাড়বে। আমরা একটু আশ্বস্ত হলাম। কিছু সময় পাওয়া গেল। আওয়ামী লীগের কাজ চালাবার জন্য কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। বাসায় এলাম, মোল্লা জালাল ও হামিদ চৌধুরী আমার সকল কিছু ঠিক করে দিল। আওয়ামী লীগ অফিস হয়ে মানিক ভাইয়ের কাছে ইত্তেফাক অফিসে চললাম। মানিক ভাইকে অনেক করে বললাম, একটু একটু করে রাজি হলেন, তবে ঠিক করে বলতে পারছেন না। আমাদের কথা ছিল, সকাল দশটায় আমরা আতাউর রহমান সাহেবের বাড়ি থেকে একসাথে এয়ারপোর্টে রওয়ানা করব। খন্দকার ইলিয়াস আমার ব্যক্তিগত বন্ধু, যুগের দাবী সাপ্তাহিক কাগজের সম্পাদক। দুজনেই এক বয়সী, একসাথে থাকব ঠিক করলাম। মানিক ভাইকে নিয়ে বিপদ! কি যে করে বলা যায় না।
সকালে প্রস্তুত হয়ে আমি মানিক ভাইয়ের বাড়িতে চললাম। তখন ঢাকায় রিকশাই একমাত্র সম্বল। সকাল আটটায় যেয়ে দেখি তিনি আরামে শুয়ে আছেন। অনেক ডাকাডাকি করে তুললমা। আমাকে বলেন, “কি করে যাব, যাওয়া হবে না, আপনারাই বেড়িয়ে আসেন”। আমি রাগ করে উঠলাম। ভাবীকে বললাম, “আপনি কেন যেতে বলেন না, দশ-পনের দিনে কি অসুবিধা হবে? মানিক ভাই লেখক, তিনি গেলে নতুন চীনের কথা লিখতে পারবেন, দেশের লোক জানতে পারবে। কাপড় কোথায় ? সুটকেস ঠিক করেন। আপনি প্রস্তুত হয়ে নেন। আপনি না গেলে আমাদের যাওয়া হবে না”। মানিক ভাই জানেন যে, আমি নাছোড়বান্দা। তাই তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নিলেন। আমরা আতাউর রহমান সাহেবের বাড়িতে উপস্থিত হলাম। প্লেন সময় মতই আসছে। আজ আমাদের এগারটার মধ্যে পৌছাতে হবে। অনেক ফরমালিটিজ আছে। টিকিট অনেক পূর্বেই নিয়েছি। আমাদের সিটও রিজার্ভ আছে। আমরা পৌঁছার কিছু সময় পড়েই বিওএসি’র প্লেন এসে নামল। কিছু কিছু বন্ধুবান্ধব আমাদের
২২৩
বিদায় দিতে এসেছে। শান্তি কমিটির সেক্রেটারি আলী আকসাদ কয়েকটা ফুলের মালাও নিয়ে এসেছে। আমাদের মালপত্র, পাসপোর্ট যথারীতি পরীক্ষা করা হল। এই প্লেনেই মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরী ও আরও দুই তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা চীন চলেছেন। শুনলাম, পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা করাচি থেকে হংকং রওয়ানা হয়ে গিয়েছেন, সেখানেই আমাদের সাথে দেখা হবে এবং একসাথে চীনে যাব। প্লেন প্রথমে রেঙ্গুন পৌছাবে। রাতে রেঙ্গুন আমাদের থাকতে হবে। আমরা অনেক সময় পাব। বিকাল ও রাতটা রেঙ্গুনে থাকতে হবে। আতাউর রহমান সাহেব বললেন, “রেঙ্গুনে ব্যারিস্টার শওকত আলীর বড় ভাই থাকেন, তাঁর বিরাট ব্যবসা আছে। ঠিকানাও আমার জানা আছে”।
আমরা রেঙ্গুনে পৌঁছার পড়েই বিওএসি’র বিশ্রামাগারে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল। ব্রহ্মদেশ ও বাংলাদেশ একই রকমে ফুলে ফলে ভরা। ব্রহ্মদেশে তখন ভীষণ গোলমাল, স্বাধীনতা পেলেও চারিদিকে অরাজকতা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জাপান ও চীনের কাছ থেকে জনসাধারণ অনেক অস্ত্র পেয়েছিল। নিজেদের ইচ্ছামত এখন তা ব্যবহার করতে শুরু করেছে। কমিউনিস্ট ও ‘কারেন’রা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। গৃহযুদ্ধে দেশটা শেষ হতে চলেছে। আইনশৃঙ্খলা বলে কোন জিনি নাই। যে কোন সময় এমনকি দিনেরবেলায়ও রেঙ্গুন শহরে রাহাজানি ও ডাকাতি হয়। সন্ধ্যার পরে সাধারণত মানুষ ভয়েতে ঘর থেকে বের হয় না। যাদের অবস্থা ভাল অথবা বড় ব্যবসায়ী তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। যে কোন মুহূর্তে তাদের ছেলেমেয়েদের ধরে নিয়ে যেতে পারে। আর যে টাকা দূরবৃত্তরা দাবি করবে, তা না দিলে হত্যা করে ফেলবে। প্রায়ই এই সকল ঘটনা ঘটছে। আমাদের হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে। কোথাও বের হলে বলে যেতে বলেছে। হোটেলকে রক্ষা করার জন্য রীতিমত সশস্ত্র সিপাহি রাখা হয়েছে। আমরা বিদেশী মানুষ, আমাদের আছেই বা কি?
হোটেলে পৌঁছেই আতাউর রহমান সাহেব রয়্যাল স্টেশনারির মালিক আমজাদ আলীকে টেলিফোন করলেন। তখন তিনি বাইরে ছিলেন, কিন্ত কিছু সময় পরে ফিরে এসে খবর পেয়ে হোটেলে উপস্থিত হলেন। আমাদের পেয়ে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত। বিদেশে আপনজন বা দেশের লোক পেলে কেই বা খুশি না হয়! তাঁর নিজের গাড়ি আছে, আমাদের নিয়ে তিনি বেড়াতে বের হলেন। প্রথমেই তাঁর দোকানে নিয়ে গেলেন। রেঙ্গুনের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ট দোকান ছিল রয়্যাল স্টেশনারি। মনে হল যেন, সবকিছু ঝিমিয়ে পড়েছে। আস্তে আস্তে । তিনি আমাদের রেঙ্গুনের অবস্থা বললেন। তবে যা কিছু হোক, রেঙ্গুন তিনি ছাড়বেন না। রেঙ্গুন শহর ও তার আশেপাশের কুড়ি মাইলই মাত্র বার্মা সরকারের হাতে আছে। সরকার কিছুতেই বিদ্রোহীদের দমাতে পারছে না। যাহোক, ভদ্রলোক তাঁর বাড়িতেও আমাদের নিয়ে গেলেন এবং স্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভদ্রমহিলা অমায়িক ও ভদ্র। রাতে আমাদের তার ওখানেই খেতে হবে। কোনো আপত্তি শুনলেন না।
আমাদের নিয়ে আমজাদ সাহেব বের হয়ে পড়লেন রেঙ্গুন শহর দেখাতে। বড় বড় কয়েকটা প্যাগোডা (বৌদ্ধ মন্দির) দেখলাম। একটার ভিতরেও আমরা যেয়ে দেখলাম।
২২৪
সকলের চেয়ে বড় প্যাগোডা কয়েক মাইল দূরে। ফিরে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে তাই যাওয়া চলবে না, পথে বিপদ হতে পারে। আতাউর রহমান সাহেবের আর এক পরিচিত লোক আছেন, তিনিও পূর্ব বাংলার লোক। একবার মন্ত্রীও হয়েছিলেন। তাঁর বাড়িতে আমরা উপস্থিত হলাম। তিনি বাড়ি ছিলেন না, অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পরে উপর থেকে এক ব্রহ্ম মহিলা মুখ বের করে বললেন, বাড়িতে কেউ নাই। দরজা খুলতে পারবেন না। কারণ, আমাদের চিনেন না। কাগজ চাইলাম। তিনি বললেন, “দরজা খুলব না, কাগজ বাইরেই আছে, লিখে জানালা দিয়ে ফেলে যান”। এই ব্যবহার কেন? আমজাদ সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, “এইভাবে গাড়িতে করে ব্যান্ডিটরা আসে। বাড়ির মালিকের নাম ধরে ডাক দিলে আগে লোকেরা সাধারণত দরজা খুলে দিত। ব্যান্ডিটরা দরজা খুললেই হাত-মুখ বেঁধে বন্দুক ও পিস্তল দেখিয়ে সবকিছু লুট করে নিয়ে যায়। এ রকম ঘটনা প্রায়ই রেঙ্গুন শহরে ঘটছে, তাই কেউই এখন আর দরজা খোলে না- জানাশোনা লোক না দেখলে।
রেঙ্গুন শহরের একদিন শ্রী ছিল। এখনও কিছুটা আছে, তবে লাবণ্য নষ্ট হয়ে গেছে। আমজাদ সাহেব কয়েক ঘন্টা আমাদের নিয়ে অনেক জায়গা দেখালেন। পরে আমাদের বার্মা ক্লাবে নিয়ে গেলেন। স্বাধীন হওয়ার পূর্বে এই ক্লাবে ইউরোপিয়ান ছাড়া কেউ সদস্য হতে পারত না। এমনকি ভিতরে যাওয়ার হুকুম ছিল না। লেকের পাড়ে এই ক্লাবটা অতি চমৎকার। আমজাদ সাহেবকে সকলেই চিনে এবং শ্রদ্ধা করে। দিনভর বেড়িয়ে রাতে আমাদের পৌঁছে দিলেন হোটেলে এবং বিশেষ করে অনুরোধ করলেন ফেরার পথে দুই একদিন থেকে বেড়িয়ে যেতে। আমি ও ইলিয়াস এক রুমে ছিলাম। রেঙ্গুন শান্তি কমিটির কয়েকজন সদস্য আমাদের সাথে দেখা করতে আসলেন। অনেকক্ষণ আলোচনা হল। তাদের নেতা আমাদের জানালেন, পূর্বেই শান্তি কমিটির কয়েকজন সদস্য চীন চলে গিয়েছেন। আরও সদস্য যাবেন, তবে পাসপোর্ট এখনও পান নাই। কিছু সদস্য পালিয়ে চলে গিয়েছেন, একথাও জানালেন।
খুব ভোরে আমাদের রওয়ানা করতে হল। আমরা ব্যাংকক পৌছালাম। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক, বেশ বড় এয়ারপোর্ট তাদের। এখানে আমরা চা-নাশতা খেলাম। এক ঘন্টা পরে হংকং রওয়ানা করলাম। সোজা হংকং, আর কোথাও প্লেন থামবে না। আমার প্লেনে ঘুমাতে কোনো কষ্ট হয় না। থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ চীন সাগর পাড়ি দিয়ে বেলা একটায় হংকংয়ের কাইতেক বিমান ঘাঁটিতে পৌছালাম। ‘সিনহুয়া’ সংবাদ প্রতিষ্টানের প্রতিনিধিরা আমাদের অভ্যর্থনা করল। ইংরেজিতে ‘নিউ চায়না নিউজ এজেন্সি’ বলা হয় সংবাদ প্রতিষ্টানটাকে। কৌলন হোটেলে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দশ-বারজন প্রতিনিধি আগেই পৌঁছে গেছেন। ঐদিন সন্ধ্যায় ও পরের দিন ভোরের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতিনিধি সকলেই পৌছাবে। পরের দিন ভোরে আমাদের সভা হল, সভায় পীর মানকী শরীফকে নেতা করা হল।
রাতে ও দিনে হংকং ঘুরে দেখলাম। হংকংয়ের নাম ইংরেজরা রেখেছে ‘ভিক্টোরিয়া’। নদীর এক পাড়ে হংকং, অন্য পাড়ে কৌলন। আমরা সকলেই কিছু কিছু গরম কাপড় কিনে
২২৫
নিলাম। আমাদের টাকা বেশি নাই, কিন্ত জিনিসপত্র খুব সস্তা। তবে সাবধান হয়ে কিনতে হবে। এক টাকা দামের জিনিস পঁচিশ টাকা চাইবে, আপনাকে এক টাকাই বলতে হবে, লজ্জা করলে ঠকবেন। জানাশোনা পুরানা লোকের সাহায্য ছাড়া মালপত্র কেনা উচিত না। হংকংয়ের আরেকটা নাম হওয়া উচিত ছিল ‘ঠগবাজ শহর’। রাস্তায় হাটবেন পকেটে হাত দিয়ে, নাহলে পকেট খালি। এত সুন্দর শহর তার ভিতরের রূপটা চিন্তা করলে শিউরে উঠতে হয়। এখন ইংরেজের কলোনি। অনেক চীনা অর্থশালী লোক পালিয়ে হংকং এসেছে। বাস্তুহারা লোকেরা পেটের দায়েও অনেক অসৎ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এক পাকিস্তানী বন্ধুর সাথে আলাপ হয়েছিল। সিন্ধুতে তার বাড়ি ছিল, এখন হংকংয়ে আছে। তার সাথে বসে বসে অনেক গল্প শুনলাম। পরে অনেকবার হংকংয়ে যেতে হয়েছে এবং কয়েকদিন থাকতেও হয়েছে। হংকং এত পাপ সহ্য করে কেমন করে, শুধু তাই ভাবি!
বোধহয় হংকং থেকে ২৭ তারিখে রেলগাড়িতে ক্যান্টেন পৌছালাম। সেনচুন স্টেশন কমিউনিস্ট চীনের প্রথম স্টেশন। ব্রিটিশ এরিয়ার পরে আর ব্রিটিশ রেল যায় না। আমরা হেঁটে হেঁটে পুল পার হয়ে স্টেশনে পৌছালাম। শান্তি কমিটির স্বেচ্ছাসেবক ও স্বেচ্ছাসেবিকারা আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানাল। কোন চিন্তা নাই। মালপত্র সব কিছুর ভার তারা গ্রহণ করেছেন। আমাদের জন্য ট্রেনে খাবার ও থাকার সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে। দুই তিনজনের জন্য একজন করে ইন্টারপ্রেটার রয়েছে। এদের সকলেই প্রায় স্কুল, কলেজের ছেলেমেয়ে। আমি ট্রেনের ভিতর ঘুরতে শুরু করলাম। ট্রেনে এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত যাওয়া যায়। নতুন চীনের লোকের চেহারা দেখতে চাই। ‘আফিং’ খাওয়া জাত যেন হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। আফিং এখন আর কেউ খায় না, আর ঝিমিয়েও পড়ে না। মনে হল, এ এক নতুন দেশ, নতুন মানুষ। এদের মনে আশা এসেছে, হতাশা আর নাই। তারা আজ স্বাধীন হয়েছে, দেশের সকল কিছুই আজ জনগণের। ভাবলাম, তিন বছরের মধ্যে এত বড় আলোড়ন সৃষ্টি এরা কি করে করল! ক্যান্টন পৌছালাম সন্ধ্যার পরে। শত শত ছেলেমেয়ে ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির। শান্তি কমিটির কর্মকর্তারা আমাদের রেলস্টেশনে অভ্যর্থনা করলেন। পার্ল নদীর পাড়ে এক বিরাট হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাতেই আবার ডিনার, শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে। চীনের লোকেরা বাঙালিদের মত বক্তৃতা করতে আর বক্তৃতা শুনতে ভালবাসে।
খাবার শুরু হবার পূর্বে বক্তৃতা হল। আমাদের পক্ষ থেকে পীর সাহেব বক্তৃতা করলেন। হাততালি কথায় কথায়, আমদেরও তালি দিতে হল। ভোরেই রওয়ানা করতে হবে পিকিং। আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে পৌছাতে। তাই কনফারেন্স বন্ধ রাখা হয়েছে। কারণ, অনেক দেশের প্রতিনিধিরাই সময় মত পৌছাতে পারে নাই। ক্যান্টন থেকে প্লেনে যেতে হবে দেড় হাজার মাইল। সকালে নাশতা খেয়ে আমরা রওয়ানা করলাম। দিনেরবেলা
২২৬
প্লেনে দেড় হাজার মাইল চীনের ভূখণ্ডের উপর দিয়ে যাবার সময় সেদেশের সৌন্দর্য দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম।
ক্যান্টন প্রদেশ বাংলাদেশের মতই সুজলা সুফলা। শত শত বছর বিদেশীরা এই দেশকে শোষণ করেই এর সম্পদের শেষ করতে পারে নাই। নয়া চীন মন প্রাণ দিয়ে নতুন করে গড়তে শুরু করেছে। বিকেলবেলা আমরা পৌছালাম পিকিং এয়ারপোর্টে। পিকিং শান্তি কমিটির সদস্যরা, ভারতবর্ষেরও কয়েকজন প্রতিনিধি এবং ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা উপস্থিত হয়েছে। আমাদের পরিচয় পর্ব শেষ করে পিকিং হোটেলে নিয়ে আসা হল। এই সেই পিকিং, চীনের রাজধানী। পূর্বে অনেক জাতি পিকিং দখল করেছে। ইংরেজ বা জাপান অনেক কিছু ধ্বংসও করেছে। অনেক লুটপাট করেছে, দখল করার সময়। এখন সমস্ত শহর যেন নতুন রূপ ধরেছে। পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি পেয়ে প্রাণভরে হাসছে।
আমাদের পিকিং হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করেছে। এই হোটেলটাই সবচেয়ে বড় এবং সুন্দর। আতাউর রহমান সাহেব, মানিক ভাই ও আমি এক রুমে। বড় ক্লান্ত আমরা। রাতে আর কোথাও বের হব না। আমাদের দলের নেতা পীর সাহেব বলে দিয়েছেন, কোনো মুসলমান হোটেলের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে। রাতে বাসে চড়ে সেখানে যেতে হবে খাবার জন্য। ভীষণ শীত বাইরে, যেতে ইচ্ছা আমাদের ছিল না, তবুও উপায় নাই। প্রায় দুই মাইল দূরে এই হোটেলটা। আমরা পৌঁছার সাথে সাথে খাবার আয়োজন করে ফেলেছে। মনে হল হোটেলের মালিক খুব খুশি হয়েছেন। চীনা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা তারা জানে না। ইন্টারপ্রেটার সাথেই আছে। খেতে শুরু করলাম, কিন্ত খাবার উপায় নাই। ভীষণ ঝাল। দু’এক টুকরা রুটি মুখে দিয়ে বিদায় হলাম। যা কিছু খেয়েছিলাম তার ধাক্কা চলল, পেটের ব্যাথার শুরু হল। রুমে আঙ্গুর ও অন্যান্য ফলফলারি ছিল, তাই খেয়ে আর চা খেয়ে রাত কাটালাম। মানিক ভাই বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন, তিনি আর যাবেন না ঐ হোটেলে খেতে। পিকিং হোটেলেই সব কিছু পাওয়া যায়। যা খেতে চাইবেন, তাই দিবে। মানিক ভাই আর কয়েকজন পরের দিন দুপুরে পিকিং হোটেলে খেয়ে শুয়ে পড়লেন। আমি ও আতাউর রহমান সাহেব দুপুরেও বাধ্য হয়ে খেলাম ঐ হোটেলে। রাতে দেখা গেল পাঁচ ছয়জন আছেন পীর সাহেবের সাথে। পরের দিন পীর সাহেব ও তাঁর সেক্রেটারি হানিফ খান (এখন কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি) ছাড়া আর কেউ মুসলমান হোটেলে খেতে গেলেন না। পিকিং হোটেলে ভাত, তরকারি, চিংড়ি মাছ, মুরগি, গরুর মাংস, ডিম সবকিছুই পাওয়া যায়। কয়েক মিনিট দেরি করলে এবং বলে দিলে ঐসব খাবার পাক করে এনে হাজির করে। আমাদের এখন আর কোনো অসুবিধা হয় না। কয়েকদিন পূর্বে কলকাতা থেকে বিখ্যাত লেখক বাবু মনোজ বসু এবং বিখ্যাত গায়ক ক্ষিতীশ বোস এসেছেন। তাঁরা বাঙালি খানার বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন। তাদের সাথে আমাদের আলাপ হওয়ার পরে আরও সুবিধা হয়ে গেল।
আমাদের হাতে দুই-তিন দিন সময় আছে। ১লা অক্টোবর নয়া চীনের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৪৯ সালের ১লা অক্টোবর এরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। চীন থেকে পালিয়ে চিয়াং কাইশেকের দল ফরমোজায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল।
২২৭
শান্তি সম্মেলন শুরু হবে ২রা অক্টোবর থেকে। ভাবলাম, সম্মেলন শুরু হবার আগে দেখে নিই ভাল করে পিকিং শহরকে। পিকিং শহরের ভিতরেই আর একটা শহর, নাম ইংরেজিতে ‘ফরবিডেন সিটি’। সম্রাটরা পূর্বে অমাত্যবর্গ নিয়ে এখানে থাকতেন। সাধারণ লোকের এর মধ্যে যাওয়ার হুকুম ছিল না। এই নিষিদ্ধ শহরে না আছে এমন কিছুই নাই। পার্ক, লেক, প্রাসাদ সকল কিছুই আছে এর মধ্যে। ভারতে লালকেল্লা, ফতেহপুর সিক্রি এবং আগ্রাকেল্লাও আমি দেখেছি। ফরবিডেন সিটিকে এদের চেয়েও বড় মনে হল। এখন সকলের জন্য এর দরজা খোলা, শ্রমিকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, পার্ক, লেকসহ সবকিছুই আজ জনসাধারণের সম্পত্তি। হাজার হাজার লোক আসছে, যাচ্ছে। দেখলাম ও ভাবলাম, রাজ-রাজড়ার কাণ্ড সব দেশেই একই রকম ছিল। জনগণের টাকা তাদের আরাম আয়েশের জন্য ব্যয় করতেন, কোনো বাধা ছিল না।
পরের দিন গ্রীষ্ম প্রাসাদ গেলাম, যাকে ইংরেজিতে বলা হয়, ‘সামার প্যালেস’। নানা রকমের জীব জানোয়ারের মূর্তি, বিরাট বৌদ্ধ মন্দির, ভিতরে বিরাট লেক, লেকের মধ্যে একটা দ্বীপ। এটাকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ট প্রমোদ নগরী বলা চলে।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল রেজা পিকিং হোটেলে আমাদের সাথে দেখা করতে এলেন। তিনি বললেন, আমাদের কোন অসুবিধা হলে বা কোনো কিছুর দরকার হলে তাঁকে যেন খবর দেই। তিনি আমাদের খাবার দাওয়াতও করেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে গল্প শুনলাম অনেক। কালোবাজার বন্ধ, জনগণ কাজ পাচ্ছে। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বন্ধ হয়ে গেছে। কঠোর হাতে নতুন সরকার এইসব দমন করেছে। যে কোন জিনিস কিনতে যান, এক দাম। আমি একাকী বাজারে সামান্য জিনিসপত্র কনেছি। দাম লেখা আছে। কোনো দরকষাকষি নাই। রিকশায় চড়েছি। কথা বুঝতে পারি না। চীনা টাকা যাকে ‘ইয়েন’ বলে, হাতে করে বলেছি, “ভাড়া নিয়ে যাও কত নেবা”। তবে যা ভাড়া, তাই নিয়েছে, একটুও বেশি নেয় নাই।
এবারের ১লা অক্টোবর তৃতীয় স্বাধীনতা দিবস। শান্তি সম্মেলনের ডেলিগেটদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের ঠিক পিছনে উঁচুতে মাও সে তুং, চ্যু তে, মাদাম সান ইয়েৎ সেন (সুং চিং লিং), চৌ এন লাই, লিও শাও চী আরও অনেকে অভিবাদন গ্রহণ করবেন। জনগণ শোভাযাত্রা করে আসতে লাগল। মনে হল, মানুষের সমুদ্র। পদাতিক, নৌ, বিমান বাহিনী তাদের কুচকাওয়াজ ও মহড়া দেখাল। তারপরই শুরু হল, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, ইয়াং পাইওনিয়ারের মিছিল, শুধু লাল পতাকাসহ। একটা জিনিস আমার চোখে পড়ল। এতবড় শোভাযাত্রা কিন্ত শৃঙ্খলা ঠিকই রেখেছে। পাঁচ-সাত লক্ষ লোক হবে মনে হল। পরের দিন খবরের কাগজে দেখলাম, পাঁচ লাখ। বিপ্লবী সরকার সমস্ত জাতিটার মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে নতুন চিন্তাধারা দিয়ে।
আমি জানতাম না মাহাবুব এখানে আছে। মাহাবুব তৃতীয় সেক্রেটারি পাকিস্তান রাষ্ট্রদূতের অফিসে। আমার সাথে কিছুদিন ল’ পড়েছে। তার আব্বাকেও আমি জানতাম; জনাব আবুল কাশেম, সাবজজ ছিলেন। চট্টগ্রামে বাড়ি। বড় স্বাধীনচেতা লোক ছিলেন।
২২৮
সত্য কথা বলতে কখনও ভয় পেতেন না। মাহাবুবও দেখলাম তার স্ত্রীকে নিয়ে চলেছে স্বাধীনতা দিবসে যোগদান করতে। আমি মাহাবুবকে দূর থেকে ডাক দিলাম। হঠাৎ পিকিংয়ে নাম ধরে কে ডাকছে, একটি আশ্চর্য হল বলে মন হল। আমাকে দেখে খুবই খুশি হল। কাগজে দেখেছে আমি এসেছি। বিকালে হোটেলে এল, তার স্ত্রীও এলেন। আমাকে নিয়ে নিজেই শহরের অনেকগুলি জায়গা দেখাল। রাতে খাবার দাওয়াত ছিল বলে বেশি সময় থাকতে পারলাম না। পরদিন আবার দেখা হবে। যে কয়দিন পিকিংয়ে ছিলাম, রাতে আমি ওদের সাথেই খেতাম। বাংলাদেহসের খাবার না খেলে আমার তৃপ্তি কোনোদিনই হয় নাই। মাহাবুবের বেগম আমাকে একটা ক্যামেরা উপহার দিলেন। টাকার প্রয়োজন ছিল, তাই মাহাবুব কিছু টাকাও আমাকে দিল। বলল, হংকং থেকে কিছু জিনিস কিনে নাও, খুব সস্তা। আমার স্ত্রীর কথাও বলল, “কিছু দিতে পারলাম না তাকে। এই টাকা থেকে ভাবীর জন্য উপহার নিও”। বেগম মাহাবুব আমাকে একটা ঘটনা বললেন। একদিন তিনি স্কুল থেকে আসছিলেন রিকশায়, কলম পড়ে গিয়েছিল রিকশার মধ্যে। বাড়ি এসে খোঁজাখুঁজি করে দেখলেন, কলম পাওয়া গেল না। তখন ভাবলেন রিকশায় পড়ে গিয়েছে, আর পাওয়া যাবে না। পরের দিন রিকশাওয়ালা নিজে এসে কলম ফেরত দিয়ে গিয়েছিল। এ রকম অনেক ঘটনাই আজকাল হচ্ছে। অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে চীনের জনসাধারণের মধ্যে। বেগম মাহাবুব ও মাহাবুবের আদর আপ্যায়নের কথা কোনোদিন ভুলতে পারি নাই। চীনের পাকিস্তান দূতাবাসে মাহাবুবই একমাত্র বাঙালি কর্মচারী।
শান্তি সম্মেলন শুরু হল। তিনশত আটাত্তর জন সদস্য সাইত্রিশটা দেশ থেকে যোগদান করেছে। সাইত্রিশটা দেশের পতাকা উড়ছে। শান্তির কপোত এঁকে সমস্ত হলটা সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। প্রত্যেক টেবিলে হেডফোন আছে। আমরা পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা একপাশে বসেছি। বিভিন্ন দেশের নেতারা বক্তৃতা করতে শুরু করলেন। প্রত্যেক দেশের একজন বা দুইজন সভাপতিত্ব করতেন। বক্তৃতা চলছে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে অনেকেই বক্তৃতা করলেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আতাউর রহমান খান ও আমি বক্তৃতা করলাম। আমি বাংলায় বক্তৃতা করলাম। আতাউর রহমান সাহেব ইংরেজি করে দিলেন। ইংরেজি থেকে চীনা, রুশ ও স্পেনিশ ভাষায় প্রতিনিধিরা শুনবেন। কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না? ভারত থেকে মনোজ বসু বাংলায় বক্তৃতা করেছেন। পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ায় অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য। আমার বক্তৃতার পরে মনোজ বসু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ?ভাই মুজিব, আজ আমরা দুই দেশের লোক, কিন্ত আমাদের ভাষাকে ভাগ করতে কেউ পারে নাই। আর পারবেও
২২৯
না। তোমরা বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দিতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছ আমরা বাংলা ভাষাভাষী ভারতবর্ষের লোকেরাও তার জন্য গর্ব অনুভব করি”।
বক্তৃতার পর, খন্দকার ইলিয়াস তো আমার গলাই ছাড়ে না। যদিও আমরা পরামর্শ করেই বক্তৃতা ঠিক করেছি। ক্ষিতীশ বাবু পিরোজপুরের লোক ছিলেন, বাংলা গানে মাতিয়ে তুলেছেন। সকলকে বললেন, বাংলা ভাষাই আমাদের গর্ব। (বক্তৃতার কপি আমার কাছে আছে পরে তুলে দেব), কতগুলি কমিশনে সমস্ত কনফারেন্স ভাগ হয়ে ভিন্ন ভিন্ন রুমে বসা হল। আমিও একটা কমিশনের সদস্য ছিলাম। আলোচনায় যোগদানও করেছিলাম। কমিশনগুলির মতামত জানিয়ে দেওয়া হল, ড্রাফট কমিটির কাছে। প্রস্তাবগুলি ড্রাফট করে আবার সাধারণ অধিবেশনে পেশ করা হল এবং সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হল।
মানিক ভাই কমিশনে বসতেন না বললেই চলে। তিনি বলতেন, প্রস্তাব ঠিক হয়েই আছে। কনফারেন্সের শেষ হওয়ার পর, এক জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। বিরাট জনসভায় প্রত্যেক দেশের প্রতিনিধি-দলের নেতারা বক্তৃতা করলেন এবং সকলের এক কথা, “শান্তি চাই, যুদ্ধ চাই না”। বিভিন্ন ধর্মের লোকেরাও যোগদান করেছিল আলাদা আলাদাভাবে শোভাযাত্রা করে। চীনে কনফুসিয়ান ধর্মের লোকেরা সংখ্যায় বেশি। তারপর বৌদ্ধ, মুসলমানের সংখ্যাও কম না, কিছু খ্রিস্টানও আছে। একটা মসজিদে গিয়েছিলাম, তারা বললেন, ধর্ম কর্মে বাধা দেয় না এবং সাহায্যও করে না। আমার মনে হল, জনসভায় তাহেরা মাজহারের বক্তৃতা খুবই ভাল হয়েছিল। তিনি একমাত্র মহিলা পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বক্তৃতা করেছিলেন। তাঁর বক্তৃতার পরে পাকিস্তানের ইজ্জত অনেকটা বেড়েছিল।
ভারতবর্ষের প্রতিনিধিদের ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের সাথে কাশ্মীর নিয়ে অনেক আলোচনা হওয়ার পরে একটা যুক্ত বিবৃত দেওয়া হয়েছিল। তাতে ভারতের প্রতিনিধিরা স্বীকার করেছিলেন, গণভোটের মাধ্যমে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত। এতে কাশ্মীর সমস্যা সমস্ত প্রতিনিধিদের সামনে আমরা তুলে ধরতে পেরেছিলাম।
আমরা ভারতের প্রতিনিধিদের খাবার দাওয়াত করেছিলাম। আমাদেরও তারা দাওয়াত করেছিল। আমাদের দেশের মুসলিম লীগ সরকারের যারা এই কনফারেন্সে যোগদান করেছিল তারা মোটেই খুশি হয় নাই। কিন্ত এই সমস্ত কনফারেন্সে যোগদান করলে দেশের মঙ্গল ছাড়া অমঙ্গল হয় না। পাকিস্তান নতুন দেশ, অনেকের এদেশ সম্পর্কে ভাল ধারণা নাই। যখন পাকিস্তানের পতাকা অন্যান্য পতাকার পাশে স্থান পায়, প্রতিনিধিরা বক্তৃতার মধ্যে পাকিস্তানের নাম বরাবর বলে তখন অনেকের পাকিস্তান সম্বন্ধে আগ্রহ হয় এবং জানতে চায়।
রাশিয়ার প্রতিনিধিদেরও আমরা খাবার দাওয়াত করেছিলাম। এখানে রুশ লেখক অ্যাসিমভের সাথে আলাপ হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এই সম্মেলনেই আমি মোলাকাত করি তুরস্কের বিখ্যাত কবি নাজিম হিকমতের সাথে। বহুদিন দেশের জেলে ছিলেন। এখন তিনি দেশত্যাগ করে রাশিয়ায় আছেন। তাঁর একমাত্র দোষ তিনি কমিউনিস্ট। দেশে তাঁর
২৩০
স্থান নাই, যদিও বিশ্ববিখ্যাত কবি তিনি। ভারতের ড. সাইফুদ্দিন কিচলু, ডাক্তার ফরিদী ও আরও অনেক বিখ্যাত নেতাদের সাথেও আলাপ হয়েছিল। আমি আর ইলিয়াস সুযোগ বুঝে একবার মাদাম সান ইয়েৎ সেনের সাথে দেখা করি এবং কিছু সময় আলাপও করি।
একটা জিনিস আমি অনুভব করেছিলাম, চীনের সরকার ও জনগণ ভারতবর্ষ বলতে পাগল। পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্ব করতে তারা আগ্রহশীল, তবে ভারতবর্ষ তাদের বন্ধু, তাদের সবকিছুই ভাল। আমরাও আমাদের আলোচনার মাধ্যমে তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি, পাকিস্তানের জনগণ চীনের সাথে বন্ধুত্ব আগ্রহশীল। পিকিংয়ের মেয়র চেং পেংয়ের সাথেও ব্যাক্তিগতভাবে আলাপ হয়েছিল আমার কাছু সময়ের জন্য।
আমরা পে ইয়ং পার্ক ও স্বর্গ মন্দির (টেম্পেল অব হেভেন) দেখতে যাই। চীন দেশের লোকেরা এই মন্দিরে পূজা দেয় যাতে ফসল ভাল হয়। এখন আর জনগণ বিশ্বাস করে না, পূজা দিয়ে ভাল ফসল উৎপাদন সম্ভব। কমিউনিস্ট সরকার জমিদারি বাজেয়াপ্ত করে চাষিদের মধ্যে জমি বিলি বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। ফলে ভূমিহীন কৃষক জমির মালিক হয়েছে। চেষ্টা করে ফসল উৎপাদন করছে, সরকার সাহায্য করছে। ফসল উৎপাদন করে এখন আর অকর্মণ্য জমিদারদের ভাগ দিতে হয় না। কৃষকরা জীবনপণ করে পরিশ্রম করছে। এক কথায় তারা বলে, আজ চীন দেশ মজুরদের দেশ, শোষক শ্রেনী শেষ হয়ে গেছে।
এগার দিন সম্মেলন হওয়ার পরে দেশে ফিরবার সময় হয়েছে। শান্তি কমিটি আমাদের জানালেন ইচ্ছা করলে আমরা চীন দেশের যেখানে যেতে চাই বা দেখতে চাই তারা দেখাতে রাজি আছেন। খরচপাতি শান্তি কমিটি বহন করবে। আতাউর রহমান খান সাহেব ও মানিক ভাই দেশে ফিরবার জন্য ব্যস্ত হয়েছেন। তাঁরা বিদায় নিলেন। ইলিয়াস ও আমি আরও কয়েকটা জায়গা দেখে ফিরব ঠিক করলাম। কয়েকজন একসাথে গেলে ভাল হয়। পীর মানকী শরীফ ও পাকিস্তানের কয়েকজন নেতার সাথে আমরা দুইজনে যোগ দিলাম। ভাবলাম, আমাদের দেশের সরকারের যে মনোভাব তাতে ভবিষ্যতে আর চীন দেখার সুযোগ পাব কি না জানি না। তবে বেশি দেরি করারও উপায় নাই। বেশি দিন দেরি হলে সরকার সোজা এয়ারপোর্ট থেকে সরকারি অতিথিশালায় নিয়ে যেতে পারেন। যাহোক, ইউসুফ হাসান অন্য একটা দলে যোগদান করেন। আমরা অন্যদলে ট্রেনে যাব ঠিক হল। পিকিং থেকে বিদায় নিয়ে প্রথমে তিয়েন শিং বন্দরে এলাম। পীর সাহেবকে নিয়ে এক বিপদই হল, তিনি মন্দির, প্যাগোডা আর মসজিদ, এইসব দেখতেই বেশি আগ্রহশীল। আমরা শিল্প কারখানা, কৃষকদের অবস্থা, সাংস্কৃতিক মিলনের জায়গা ও মিউজিয়াম দেখার জন্য ব্যস্ত। তিনি আমাদের দলের নেতা, আমাদের তাঁর প্রোগ্রামই মানতে হয়। তবুও ফাঁকে ফাঁকে আমরা দুইজন এদিক ওদিক বেড়াতে বের হতাম। আমাদের কথাও এরা বোঝে না, এদের কথাও আমরা বুঝি না। একমাত্র উপায় হল ইন্টারপ্রেটার।
তিয়েন শিং সামুদ্রিক বন্দর। এখানে আমরা অনেক রাশিয়ান দেখতে পাই। আমি ও ইলিয়াস বিকালে পার্কে বেড়াতে যেয়ে এক রাশিয়ান ফ্যামিলির সাথে আলাপ করতে চেষ্টা করি। কিন্ত ইন্টারপ্রেটার না থাকার জন্য তা সম্ভব হল না। মনের ইচ্ছা মনে রেখে আমাদের বিদায় নিতে হল, ইশারায় শুভেচ্ছা জানিয়ে। ইচ্ছা থাকলেও উপায় নাই। আমরাও তাদের ভাষা জানি না, তাঁরাও আমাদের ভাষা জানে না। রাতে আমাদের জন্য যে খাবার বন্দোবস্ত করেছিল সেখানে একজন ইমাম সাহেব ও কয়েকজন মুসলমানকে দাওয়াত করা হয়েছিল। মুসলমানরা ও ইমাম সাহেব জানালেন তারা সুখে আছেন। ধর্মে-কর্মে কোনো বাধা কমিউনিস্ট সরকার দেয় না। তবে ধর্ম প্রচার করা চলে না।
দুই দিন তিয়েন শিং থেকে আমরা নানকিং রওয়ানা করলাম। গাড়ির প্রাচুর্য বেশি নাই। সাইকেল, সাইকেল রিকশা আর দুই চারখানা বাস। মোটরগাড়ি খুব কম। কারণ, নতুন সরকার গাড়ি কেনার দিকে নজর না দিয়ে জাতি গঠন কাজে আত্মনিয়োগ করেছে।
আমার নিজের একটা অসুবিধা হয়েছিল। আমার অভ্যাস, নিজে দাড়ি কাটা। নাপিত ভাইদের বোধহয় দাড়ি কাটতে কোনোদিন পয়সা দেই নাই। ব্লেড আমার কাছে যা ছিল শেষ হয়ে গেছে। ব্লেড কিনতে গেলে শুনলাম, ব্লেড পাওয়া যায় না। বিদেশ থেকে ব্লেড আনার অনুমতি নাই। পিকিংয়েও চেষ্টা করেছিলাম পাই নাই। ভাবলাম, তিয়েন শিং-এ নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। এত বড় শিল্প এলাকা ও সামুদ্রিক বন্দর! এক দোকানে বহু পুরানা কয়েকখানা ব্লেড পেলাম, কিন্ত তাতে আর দাড়ি কাটা যাবে না। আর এগুলো কেউ কিনেও না। চীন দেশে যে জিনিস তৈরি হয় না, তা লোকে ব্যবহারত করবে না। পুরানা আমলের ক্ষুর দিয়ে দাড়ি কাটা হয়। আমার আর উপায় রইল না, শেষ পর্যন্ত হোটেলের সেলুনেই দাড়ি কাটতে হল। এরা শিল্প কারখানা বানানোর জন্যই শুধু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে। আমাদের দেশে সেই সময়ে কোরিয়ার যুদ্ধের ফলস্বরুপ যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছিল তার অধিকাংশ ব্যয় হল জাপানি পুতুল, আর শৌখন দ্রব্য কিনতে। দৃষ্টিভঙ্গির কত তফাৎ আমাদের সরকার আর চীন সরকারের মধ্যে! এদেশে একটা বিদেশী সিগারেট পাওয়া যায় না। সিগারেট তারা তৈরি করছে নিকৃষ্ট ধরনের, তাই বড় ছোট সকলে খায়। আমরাও বাধ্য হলাম চীনা সিগারেট খেতে। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হয়েছিল কড়া বলে, আস্তে আস্তে রপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
নানকিং অনেক পুরানা শহর। অনেক দিন চীনের রাজধানী ছিল। এখানে সান ইয়েৎ সেনের সমাধি। আমরা প্রথমেই সেখানে যাই শ্রদ্ধা জানাতে। পীর সাহেব ফুল দিলেন, আমরা নীরবে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম এই বিপ্লবী নেতাকে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও চীনের মাঞ্চু রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছেন এবং বিপুল ত্যাগ স্বীকার করেছেন। রাজতন্ত্রকে খতম করে দুনিয়ায় চীন দেশের মর্যাদা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিও বুঝতে পেরেছিল চীন জাতিকে বেশি দিন দাবিয়ে রাখা যাবে না, আর শোষণ করা চলবে না।
২৩২
নানকিং থেকে আমরা সাংহাই পৌছালাম। এটা দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ট শহর ও ব্যবসা কেন্দ্র। বিদেশী শক্তিগুলি বারবার একে দখল করেছে। নতুন চীন সৃষ্টির পূর্বে এই সাংহাই ছিল বিদেশী শক্তির বিলাসীদের আরাম, আয়েশ ও ফুর্তি করার শহর। হংকংয়ের মতই এর অবস্থা ছিল। নতুন চীন সরকার কঠোর হস্তে এসব দমন করেছে। সাংহাইতে অনেক শিল্প কারখানা আছে। সরকার কতগুলি শিল্প বাজেয়াপ্ত করেছে। যারা চিয়াং কাইশেকের ভক্ত ছিল, অনেকে পালিয়ে গেছে। আর কতগুলি শিল্প আছে যেগুলি বাজেয়াপ্ত করে না, তবে শ্রমিক ও মালিক যুক্তভাবে পরিচালনা করে। আমাদেরকে দুনিয়ার অন্যতম বিখ্যাত টেক্সটাইল মিল দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এটা তখন জাতীয়করণ করা হয়েছে। শ্রমিকদের থাকার জন্য অনেক নতুন দালান করা হয়েছে। তাঁদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য স্কুল করা হয়েছে, চিকিৎসার জন্য আলাদা হাসপাতাল করা হয়েছে। বিরাট এলাকা নিয়ে কলোনি গড়ে তুলেছে। আমি কিছু সময় পীর সাহেবের সাথে সাথে দেখতে লাগলাম। পরে ইলিয়াসকে বললাম, “এগুলা তো আমাদের দেখাবে, আমি শ্রমিকদের বাড়িতে যাব এবং দেখব তারা কি অবস্থায় থাকে। আমাদের হয়ত শুধু ভাল জিনিসই এরা দেখাবে, খারাপ জিনিস দেখাবে না”। ইলিয়াস বলল, “তাহলে তো ওদের বলতে হয়”। বললাম, “আগেই কথা বল না, হঠাৎ বলব এবং সাথে সাথে এক শ্রমিকের বাড়ির ভিতরে যাব”।
পির সাহেব তাঁর পছন্দের অন্য কিছু দেখতে গেলেন। আমরা ইন্টারপ্রেটারকে বললাম, “এই কলোনির যে কোনও একটা বাড়ির ভিতরটা দেখতে চাই। এদের ঘরের ভিতরের অবস্থা আমরা দেখব”। আমাদের একটু অপেক্ষা করতে বলে ভিতরে চলে গেল ইন্টারপ্রেটার এবং পাঁচ মিনিটের ভিতরেই এক ফ্ল্যাটে আমাদের নিয়ে চলল। আমরা ভিতরে যেয়ে দেখলাম, এক মহিলা আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছনে। তিনি আমাদের অভ্যর্থনা করলেন, ভিতরে নিয়ে বস্তে দিলেন। দুই তিনটা চেয়ার, একটা খাট, ভাল বিছানা- এই মহিলাও শ্রমিক। মাত্র এক মাস পূর্বে বিবাহ হয়েছে, স্বামী মিলে কাজ করতে গেছে। বাড়িতে একলাই আছে, স্বামী ফিরে আসলে তিনিও কাজ করতে যাবেন। তিনি বললেন, “খুবই দুঃখিত, আমার স্বামী বাড়িতে নাই, খবর না দিয়ে এলেন, আপনাদের আপ্যায়ন করতে পারলাম না, একটু চা খান”। তাড়াতাড়ি চা বানিয়ে আনলেন। চীনের চা দুধ চিনি ছাড়াই আমরা খেলাম। ইন্টারপ্রেটার আমাদের বললেন, “ভেতরে চলুন, দুইখানা কামরাই দেখে যান”। আমরা দুইটা কামরাই দেখলাম। এতে একটা মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি ভালভাবে বাস করতে পারে। আসবাবপত্রও যা আছে তাতে মধ্যবিত্ত ঘরের আসবাবপত্র বলতে পারা যায়। একটা পাকের ঘর ও একটা গোসলখানা ও পায়খানা। আবার ফিরে এসে বসলাম। ইলিয়াসকে বললাম, “এদের বাড়ি দেখতে এসে বিপদে পড়লাম। সামান্য কয়েকদিন পূর্বে ভদ্রমহিলার বিবাহ হয়েছে, আমাদের সাথে কিছুই নাই যে উপহার দেই। এরা মনে করবে কি? আমাদের দেশের বদনাম হবে”। ইলিয়াস বলল, “কি করা যায়, আমি ভাবছি”। হঠাৎ আমার হাতের দিকে নজর পড়ল, হাতে আংটি আছে একটা। আংটি খুলে ইন্টারপ্রেটারকে
২৩৩
বললাম, “আমার এই সামান্য উপহার ভদ্রমহিলাকে দিতে চাই। কারণ, আমার দেশের নিয়ম কোনো নতুন বিবাহ বাড়িতে গেলে বর ও কনেকে কিছু উপহার দিতে হয়”। ভদ্রমহিলা কিছুতেই নিতে রাজি নয়, আমরা বললাম, “না নিলে আমরা দুঃখিত হব। বিদেশীকে দুঃখ দিতে নাই। চীনের লোক তো অতিথিপরায়ণ শুনেছি, আর দেখছিও”। আংটি দিয়ে বিদায় নিলাম। পীর সাহেবের কাছে হাজির হলাম এবং গল্পটি বললাম। পীর সাহেব খুব খুশি হলেন আংটি দেওয়ার জন্য।
পরের দিন সকালবেলা শ্রমিক মহিলা আর তার স্বামী কিংকং হোটেলে আমার সাথে দেখা করতে আসেন। হাতে ছোট্ট একটা উপহার। চীনের লিবারেশন পেন। আমি কিছুতেই নিতে চাইলাম না, কিন্ত শেষ পর্যন্ত নিতে হল। এটা নাকি তাদের দেশের নিয়ম। সাংহাইয়ের শান্তি কমিটির সদস্যরা তখন উপস্থিত ছিল।
দুই-তিন দিন সমানে চলল ঘোরাফেরা। যদিও সাংহাইয়ের সে শ্রী নাই, বিদেশীরা চলে যাওয়ার পরে। তবুও যেটুকু আছে তার মধ্যে কৃত্রিমতা নাই। ঘষামাজা করে রঙ লাগালে যে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয় তাতে সত্যিকারের সৌন্দর্য নষ্ট হয়। নিজস্বতা চাপা পড়ে। এখন সাংহাইয়ের যা কিছু সবই চীনের নিজস্ব। এতে চীনের জনগণের পূর্ণ অধিকার। সমুদ্রগামী জাহাজও কয়েকখানা দেখলাম।
নতুন নতুন স্কুল, কলেজ গড়ে উঠেছে চারিদিকে। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ভার সরকার নিয়েছে। চীনের নিজস্ব পদ্ধতিতে লেখাপড়া শুরু করা হয়েছে।
সাংহাই থেকে আমরা হ্যাংচোতে আসলাম। হ্যাংচো পশ্চিম হ্রদের পাড়ে। একে চীনের কাশ্মীর বলা হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ফলে ফুলে ভরা এই দেশটা। লেকের চারপাশে শহর। আমাদের নতুন হোটেলে রাখা হয়েছে, লেকের পাড়ে। ছোট ছোট নৌকায় চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে চীন দেশের লোকেরা। তারা এখনে আসে বিশ্রাম করতে। লেকের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মধ্যে দ্বীপ আছে। হ্যাংচো ও ক্যান্টন দেখলে মনে হবে যেন পূর্ব বাংলা। সবুজের মেলা চারিদিকে। পীর সাহেব একদিন শুধু প্যাগোডা দেখলেন, পরের দিনও যাবেন অতি পুরাতন প্যাগোডাগুলি দেখতে। আমি ও ইলিয়াস কেটে পড়লাম। নৌকায় চড়ে লেকের চারিদিকে ঘুরে দেখতে লাগলাম। দ্বীপগুলির ভিতরে সুন্দরভাবে বিশ্রাম করার ব্যবস্থা রয়েছে। মেয়েরা এখানে নৌকা চালায়। নৌকা ছাড়া বর্ষাকালে এখানে চলাফেরার উপায় নাই। বড়, ছোট সকল অবস্থার লোকেরই নিজস্ব নৌকা আছে। আমি নৌকা বাইতে জানি, পানির দেশের মানুষ। আমি লেকে নৌকা বাইতে শুরু করলাম।
এক দ্বীপে আমরা নামলাম, সেখানে চায়ের দোকান আছে। আমরা চা খেয়ে লেকে ভ্রমণ শেষ করলাম। হ্যাংচো থেকে ক্যান্টন ফিরে এলাম। ক্যান্টন থেকে হংকং হয়ে দেশে ফিরব। এবার ক্যান্টনকে ভালভাবে দেখবার সুযোগ পেলাম। চীন দেশের লোকের মধ্যে দেখলাম নতুন চেতনা। চোখে মুখে নতুন ভাব ও নতুন আশায় ভরা। তারা আজ গর্বিত যে তারা স্বাধীন দেশের নাগরিক। এই ক্যান্টনেই ১৯১১ সালে সান ইয়েৎ সেনের দল আক্রমণ করে। ক্যান্টন প্রদেশের লোক খুবই স্বাধীনতাপ্রিয়। আমরা চীন দেশের জনগণকে ও
২৩৪
মাও সে তুং-এর সরকারকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ইতিহাস বিখ্যাত চীন দেশ থেকে বিদায় নিলাম। আবার হংকং ইংরেজে-কলোনি, কৃত্রিম সৌন্দর্য ও কৃত্রিম মানুষ, চোরাকারবারিদের আড্ডা। দুই-তিন দিন এখানে থেকে তারপর দেশের দিকে হাওয়াই জাহাজে চড়ে রওয়ানা করলাম। ঢাকায় পৌছালাম নতুন প্রেরণা ও নতুন উৎসাহ নিয়ে। বিদেশে না গেলে নিজের দেশকে ভালভাবে চেনা কষ্টকর।
আমরা স্বাধীন হয়েছি ১৯৪৭ সালে আর চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯ সালে। যে মনোভাব পাকিস্তানের জনগণের ছিল, স্বাধীনতা পাওয়ার সাথে সাথে আজ যেন তা ঝিমিয়ে গেছে। সরকার তা ব্যবহার না করে তাকে চেপে মারার চেষ্টা করেছে। আর চীনের সরকার জনগণকে ব্যবহার করছে তাদের দেশের উন্নয়নমূলক কাজে। তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য হল, তাদের জনগণ জানতে পারল ও অনুভব করতে পারল এই দেশ এবং এদেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্টীর আর তারা যেন কেউই নন। ফলে দেশের জনগণের মধ্যে ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। একটা মাত্র পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল সাদা চামড়ার জায়গায় কালা চামড়ার আমদানি হয়েছে।
চীনের জনগণ সরকারের কাজে সাহায্য করছে এটা বুঝতে কষ্ট হল না। জনমত দেখলাম চীন সরকারের সাথে। চীন সরকার নিজেকে ‘কমিউনিস্ট সরকার’ বলে ঘোষণা করে নাই, তারা তাদের সরকারকে ‘নতুন গণতন্ত্রের কোয়ালিশন সরকার’ বলে থাকে। কমিউনিস্ট ছাড়াও অন্য মতাবলম্বী লোকও সরকারের মধ্যে আছে। যদিও আমার মনে হল কমিউনিস্টরা নিয়ন্ত্রণ করছে সকল কিছুই। আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসাবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুজিপাতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের করতব্য বিশ্বশান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা। যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে যারা আবদ্ধ ছিল, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যাদের সর্বস্ব লুট করেছে-তাদের প্রয়োজন নিজের দেশকে গড়া ও জনগণের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তির দিকে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। বিশ্বশান্তির জন্য জনমত সৃষ্টি করা তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
আমি ঢাকায় এসে পার্টির কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। মওলানা ভাসানী ও আমার সহকর্মীদের অনেকে আজও জেল থেকে মুক্তি পান নাই। বন্দি মুক্তি আন্দোলন জোরদার করা কর্তব্য হয়ে পড়েছে। পল্টন ময়দানে সভা দিলাম। আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে এক বিরাট সভা হল। আমি সরকারের জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলাম। ১৯৫২ সালের
২৩৫
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পরে এই আমার প্রথম সভা, যদিও আমাদের মুক্তির পরে ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে ছাত্রলীগ এক সভা করেছিল সদ্য কারামুক্ত কর্মীদের এখানে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভাও কয়েকটা হয়েছিল বিভিন্ন বাড়িতে।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্টানকে গরার কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। সোহরাওয়ারদী সাহেবকে খবর দিলাম, পূর্ব বাংলায় আসবার জন্য। তিনি আমাকে পূর্বেই কথা দিয়েছিলেন এক মাস সমস্ত জেলা হেডকোয়ার্টারে একটা করে সভা হবে এবং বড় বড় কতগুলি মহকুমায়ও সভার বন্দোবস্ত করা হল। তিনি ঢাকায় আসলেন, ঢাকায় জনসভায়ও বক্তৃতা করলেন। পাকিস্তান হওয়ার পরে বিরোধী দলের এত বড় সভা আর হয় নাই। তিনি পরিষ্কার ভাষায় রাষ্ট্রভাষা বাংলা, বন্দি মুক্তি, স্বায়ত্তশাসনের সমর্থনে বক্তৃতা করলেন। সিলেট থেকে শুরু করে দিনাজপুর এবং বগুড়া থেকে বরিশাল প্রত্যেকটা জেলায়ই আওয়ামী লীগ কর্মীরা সভার আয়োজন করেছিল। একমাত্র রাজশাহীতে জনসভা হয় নাই, তবে নাটোরে হয়েছিল। রাজশাহীতে তখনও জেলা কমিটি করতে আমি পারি নাই। রাজশাহীর অনেক নেতা নাটোরে শহীদ সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করলেন এবং তাঁকে রাজশাহী নিয়ে গেলেন, সেখানে বসে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্টান গড়া হল। এই সময় প্রায় প্রত্যেকটি মহকুমায় ও জেলায় আওয়ামী লীগ সংগঠন গড়ে উঠেছে। শহীদ সাহেবের সভার পরে সমস্ত দেশে এক গণজাগরণ পড়ে গেল। জনসাধারণ মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী লীগ দলে যোগদান করতে শুরু করেছিল। শহীদ সাহেবের নেতৃত্বের প্রতি জনগণের ও শিক্ষিত সমাজের আস্থা ছিল। জনগণ বিশ্বাস করত শহীদ সাহেব একমাত্র নেতা যিনি দেশের বিকল্প নেতৃত্ব দিতে পারবেন এবং তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করতে পারলে দেশের ও জনগণের উন্নতি হবে। দেশের মধ্যে দুর্নীতি, অত্যাচার ও জুলুম চলছে। কোনো সুষ্টু উন্নতিমূলক কাজে সরকার হাত না দিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতি শুরু করেছে। আমলাতন্ত্র ও ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতি শুরু করেছে। খাজা সাহেবের দুর্বল শাসনব্যবস্থার জন্য তাদের মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, গোলাম মোহাম্মদ, নবাব গুরমানির মত পুরানা সরকারি কর্মচারীরা রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছে। পাঞ্জাবি আমলাতন্ত্রকে খুশি করার জন্য চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে অর্থমন্ত্রী করে খাজা সাহেব নিজেই ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। জনগণের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে এবং তারা শহীদ সাহেবের নেতৃত্বের উপর আস্থা প্রকাশ করতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক দল ছাড়া গণতন্ত্র সফল হতে পারে না। এই সময় মুসলিম লীগ দলের মোকাবেলায় একমাত্র আওয়ামী লীগই বিরোধী দল হিসাবে গড়ে উঠতে লাগল। পশ্চিম পাকিস্তানেই একদম নিঃস্বার্থ নেতা ও কর্মী আওয়ামী লীগ গঠন করতে এগিয়ে এলেন পীর মানকী শরীফের নেতৃত্বে।
শহীদ সাহেব পশ্চিম ও পূর্ব বাংলায় ঘুরে ঘুরে প্রতিষ্টান গড়তে সাহায্য করতে লাগলেন। প্রত্যেকটা জনসভার পরেই আমি জেলা ও মহকুমার নেতাদের ও কর্মীদের নিয়ে আলোচনা সভা করে শক্তিশালী প্রতিষ্টান গঠনে সাহায্য করতে লাগলাম। শহীদ
২৩৬
সাহেবের পুরানা ভক্তরা প্রায়ই আওয়ামী লীগে যোগদান করতে লাগল; বিশেষ করে যুবক শ্রেণীর কর্মীরা এগিয়ে এল মুসলিম লীগ সরকারের অত্যাচারের মোকাবেলা করার জন্য। শত শত কর্মী জেলের মধ্যে দিনযাপন করছে নিরাপত্তা আইনে। প্রথমে জেলায় জেলায় চেষ্টা করেছে আমাদের সভায় গোলমাল সৃষ্টি করার জন্য, পরে আর পারে নাই। জনমত আওয়ামী লীগ ও শহীদ সাহেবের পক্ষে ছিল। এই সময় শহীদ সাহেব মওলানা ভাসানী ও অন্য রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির জন্য প্রবল জনমত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মওলানা ভাসানীও এই সময় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন সারা পূর্ব পাকিস্তানে।
১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠন হলেও আজ পর্যন্ত কোন কাউন্সিল সভা হতে পারেও নাই, কারণ প্রতিষ্টানের কর্মকর্তাদের সকলকেই প্রায় কারাগারে দিন অতিবাহিত করতে হয়েছে। আমি সমস্ত জেলা ও মহকুমা আওয়ামী লীগকে নির্দেশ দিলাম তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন শেষ করতে হবে। তারপর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সংগঠনের কর্মকর্তা নির্বাচন করবে এবং গঠনতন্ত্র ও ম্যানিফেস্টো গ্রহণ করবে। আমি দিনরাত সমানভাবে পরিশ্রম শুরু করলাম। শহীদ সাহেব যে সমস্ত মহকুমায় যেতে পারেন নাই আমি সেই সকল মহকুমায় সভা করে পার্টি গড়তে সাহায্য করলাম। জনগণ ও কর্মীদের থেকে সারা যে পেলাম তা প্রথমে কল্পনা করতে পারি নাই। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্টান গড়বার কাজে সাহায্য করছিল এই জন্য যে, শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া সরকারের জুলুমকে মোকাবেলা করা কষ্টকর। আওয়ামী লীগ গড়ে উঠবার পূর্ব পর্যন্ত একমাত্র ছাত্রলীগই সরকারের অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত এবং জনগণ ও ছাত্রদের দাকবি দাওয়া তুলে ধরত। ছাত্র প্রতিষ্টান হিসাবে তাদের নেতা ও কর্মীদের অনেক অসুবিধা ভোগ করতে হয়েছে। মুসলিম লীগ সরকার ছাত্রলীগ প্রতিষ্টানকে খতম করার জন্য চেষ্টার ক্রটি করে নাই। গণতান্ত্রিক যুবলীগও অলি আহাদের নেতৃত্বে জনমত সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছিল।
১৯৫৩ সালের প্রথম দিক থেকে রাজনৈতিক ও ছাত্রকর্মীরা মুক্তি পেতে শুরু করল। শামসুল হক সাহবেও মুক্তি পেলেন, তখন তিনি অসুস্থ। তাঁর যে কিছুটা মস্তিষ্ক বিকৃতি হয়েছে কারাগারের বন্দি থেকে, তা বুঝতে কারও বাকি রইল না। তিনি কোনো গোলমাল করতেন না, তবে কিছু সময় কথা বললেই বোঝা যেত যে, এক কথা বলতে অন্য কথা বলতে শুরু করেন। আমরা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। একজন নিঃস্বার্থ দেশকর্মী, ত্যাগী নেতা আজ দেশের কাজ করতে যেয়ে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্টে থেকে পাগল হয়ে বের হলেন। এ দুঃখের কথা কোথায় বলা যাবে? পাকিস্তান আন্দোলনে তাঁর অবদান যারা এখন ক্ষমতায় আছেন, তাদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। বাংলাদেশে যে কয়েকজন কর্মী সর্বস্ব দিয়ে পাকিস্তান আন্দোলন করেছে তাদের মধ্যে শামসুল হক সাহেবকে সর্বশ্রেষ্ট
২৩৭
কর্মী বললে বোধহয় অন্যায় হবে না। ১৯৪৩ সাল থেকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্টানকে জমিদার, নবাবদের দালানের কোঠা থেকে বের করে জনগণের পর্ণকুটিরে যারা নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে শামসুল হক সাহেব ছিলেন অন্যতম। একেই বলে কপাল, কারণ সেই পাকিস্তানের জেলেই শামসুল হক সাহেবকে পাগল হতে হল।
আমি অনেকের সাথে পরামর্শ করে তাঁর চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে চেষ্টা করলাম, কিন্ত তিনি রাজি হলেন না। উল্টা আমার উপর ক্ষেপে গেলেন। আমি তখন তাঁকে প্রতিষ্টানের জেনারেল সেক্রেটারির ভার নিতে অনুরোধ করলাম। কার্যকরী কমিটির সভা ডেকে তাঁকে অনুরোধ করলাম, কারণ এতদিন আমি একটিং জেনারেল সেক্রেটারি হিসাবে কাজ করছিলাম। ভাবলাম, কাজের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লে তিনি ভাল হয়ে যেতে পারেন। তিনি সভায় উপস্থিত হলেন এবং বললেন, “আমি প্রতিষ্টানের জেনারেল সেক্রেটারির ভার নিতে পারব না, মুজিব কাজ চালিয়ে যাক”। আজেবাজে কথাও বললেন, যাতে সকলেই বুঝতে পারলেন যে, তাঁর মাথায় কিছুটা গোলমাল হয়েছে। আমি কাজ চালিয়ে যেতে লাগলাম। ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় হক সাহেবকে সভাপতিত্ব করার জন্য জোর করেই উপস্থিত করলাম। তিনি এমন এক বক্তৃতা করলেন যাতে সকলেই দুঃখ পেলাম। কারণ তিনি নিজেকে সমস্ত দুনিয়ার খলিফা বলে ঘোষণা করলেন। আমরা হতাশ হয়ে পড়লাম, কি করে তাঁর চিকিৎসা করানো যাবে? আরও অসুবিধায় পড়লাম, হক সাহেবের স্ত্রী প্রফেসর আফিয়া খাতুন বিদেশে লেখাপড়া করতে যাওয়ায়। তিনি থাকলে হয়ত কিছুটা ব্যবস্থা করা যেত।
ইয়ার মোহাম্মদ খান আমাকে সাহায্য করতে লাগলেন। তাঁর সমর্থন ও সাহায্য না পেলে খুবই অসুবিধা ভোগ করতে হত। মানিক ভাই ইত্তেফাক কাগজকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। সাপ্তাহিক কাগজ হলেও শহরে ও গ্রামে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান অবজারভার কাগজও আমাদের সংবাদ কিছু কিছু দিত। মুসলিম লীগ সরকার জনপ্রিয়তা দ্রুত হারিয়ে ফেলেছিল। আমি বুঝতে পারলাম, এখন শুধু সুষ্টু নেতৃত্ব ও সুশৃঙ্খল প্রতিষ্টানের প্রয়োজন। এই সুযোগ আমি ও আমার সহযোগীরা পুরাপুরি গ্রহণ করলাম এবং দেশের প্রায় শতকরা সত্তরটা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্টান গড়ে তুলতে সক্ষম হলাম। যুবক কর্মীরা আমার দিকে ঝুঁকে পড়ল। কারণ আমিও তখন যুবক ছিলাম। ভাসানী সাহেব ও আওয়ামী লীগ কর্মীরা অনেকেই মুক্তি পেলেন। আমি মওলানা ভাসানী ও আতাউর রহমান খানের সাথে কাউন্সিল সভা সম্পর্কে পরামর্শ করলাম। কাউন্সিল সভা তাড়াতাড়ি করা প্রয়োজন একথা তাঁরাও স্বীকার করলেন। প্রথম কাউন্সিল সভা ডাকা হল ঢাকায়। হল পাওয়া খুবই কষ্টকর। ইয়ার মোহাম্মদ খানের সাহায্যে মুকুল সিনেমা হল পেতে কষ্ট হল না। কাউন্সিল সদস্যদের থাকার জন্য কোন জায়গা না পেয়ে বড় বড় নৌকা ভাড়া করলাম সদরঘাটে। ঠিক হল সোহরাওয়ারদী সাহেব কাউন্সিলে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন।
কাউন্সিল সভার দিন যতই ঘনিয়ে আসছিল আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রবীন নেতা এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন, যাতে আমাকে জেনারেল সেক্রেটারি না করা হয়। আমি এ
২৩৮
সম্বন্ধে খোঁজখবর রাখতাম না, কারণ প্রতিষ্টানের কাজ, টাকা জোগাড়, কাউন্সিলারদের থাকার বন্দোবস্তসহ নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হত। আবদুস সালাম খান, ময়মনসিংহের হাশিমউদ্দিন আহমদ, রংপুরের খয়রাত হোসেন, নারায়ণগঞ্জের আলমাস আলী ও আবদুল আউয়াল এবং আরও কয়েকজন এই ষড়যন্ত্রের নায়ক ছিলেন। প্রতিষ্টানের জন্য টাকা পয়সা এরা দিতেন না, বা জোগাড় করতেন না। প্রতিষ্টানের কাজও ভালভাবে করতেন না। তবে আমি যাতে জেনারেল সেক্রেটারি না হতে পারি তার জন্য অর্থ ব্যয়ও করতেন। সালাম সাহেবের অসন্তুষ্ট হবার প্রধান কারণ ছিল আমি নাকি তাঁকে ইমপরটেন্স না দিয়ে আতাউর রহমান খান সাহেবকে দেই। আমি এ সমস্ত পছন্দ করতাম না, তাই আতাউর রহমান সাহেবকে কাউন্সিল সভার প্রায় পনের দিন পূর্বে একাকী বললাম, “আপনি জেনারেল সেক্রেটারি হতে রাজি হন; আমার পদের দরকার নাই। কাজ তো আমি করছি এবং করব, আপনার কোনো অসুবিধা হবে না”। আতাউর রহমান সাহেব বললেন, “আমি এত সময় কোথায় পাব? সকল কিছু ছেড়ে দিয়ে কাজ করার উপায় নাই। এখন যে জেনারেল সেক্রেটারি হবে তার সর্বক্ষণের জন্য পার্টির কাজ করতে হবে। আপনি ছাড়া কেউ এ কাজ পারবে না, আপনাকেই হতে হবে”। আমি বললাম, “কয়েকজন নেতা তলে তলে ষড়যন্ত্র করছে। তারা বলে বেড়ান একজন বয়েসী লোকের জেনারেল সেক্রেটারি হওয়া দরকার। দুঃখের বিষয় এই ভদ্রলোকদের এতটুকু কৃতজ্ঞতা বোধ নাই যে, আমি জেল থেকে বের হয়ে রাতদিন পরিশ্রম করে প্রতিষ্টানের একটা রূপ দিয়েছি”। আতাউর রহমান সাহেব বললেন, “ছেড়ে দেন ওদের কথা, কাজ করবে না শুধু বড় বড় কথা বলতে পারে সভায় এসে”। আমি বললাম, “চিন্তা করে দেখেন; একবার যদি আমি ঘোষণা করে দেই যে, আমি প্রার্থী তখন কিন্ত আর কারও কথা শুনব না”। তিনি বললেন্ “আপনাকেই হতে হবে”। আতাউর রহমান সাহেব জানতেন, তাঁর জন্যই সালাম সাহেব আমার উপর ক্ষেপে গেছেন। মওলানা সাহেব আমাকে জেনারেল সেক্রেটারি করার পক্ষপাতী। তাঁকেও আমি বলেছিলাম, আমি ছাড়া অন্য কাউকে ঠিক করতে, তিনি রাজি হলেন না এবং বললেন, “তোমাকেই হতে হবে”। শহীদ সাহেব করাচিতে আছেন, তিনি এ সমস্ত বিষয় কিছুই জানতেন না।
১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে জনাব আবুল হাশিম পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। তাঁর অনেক সহকর্মী আওয়ামী লিগে যোগদান করেছেন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর তাঁকে গ্রেফতারও করা হয়। এই সময় জেলে তিনি অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের সাথে প্রতিষ্টান সম্বন্ধে আলোচনা করতে সুযোগ পান।
আমার বিরোধী গ্রুপ অনেক চেষ্টা করেও কোনো প্রার্থী দাঁড় করাতে পারছিলেন না। কেউই সাহস পাচ্ছিল না, আমার সাথে প্রতিদ্বন্ধিতা করতে। কারণ তাঁরা জানেন, কাউন্সিলাররা আমাকেই ভোট দিবে। ভদ্রলোকেরা তাই নতুন পন্থা অবলম্বন করলেন। তাঁরা আবুল হাশিম সাহেবের কাছে ধরনা দিলেন এবং তাঁকে আওয়ামী লীগে যোগদান করতে ও সাধারণ সম্পাদক হতে অনুরোধ করলেন। হাশিম সাহেব রাজি হলেন ও বললেন, তাঁর কোনো
২৩৯
আপত্তি নাই, তবে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় হতে হবে। তিনি মওলানা ভাসানী সাহেবকে খাবার দাওয়াত করলেন। তাঁকে যে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা এ ব্যাপারে অনুরোধ করেছেন তাও বললেন এবং মওলানা সাহেবের মতামত জানতে চাইলেন। মওলানা সাহেব তাঁকে বললেন, “সাধারণ সম্পাদক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় করা যাবে কি না সন্দেহ, কারণ মুজিবের আপনার সম্বন্ধে খুব খারাপ ধারণা। তবে যদি সভাপতি হতে চান, আমি ছেড়ে দিতে রাজি আছি”। মওলানা সাহেব একথা আমাকে বলেছিলেন।
কাউন্সিলের প্রথম অধিবেশন হওয়ার পরে মওলানা ভাসানী ঘোষণা করলেন, আমাদের চারজনের নাম- সর্বজনের আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম খান, আবুল মনসুর আহমদ ও আমি। এই চারজন আলাদা বসে সর্বসম্মতিক্রমে একটা লিস্ট করে আনবে কর্মকর্তাদের নামের। কাউন্সিল সভার একদিন পূর্বে আমার বিরোধী গ্রুপ আতাউর রহমান সাহেবকে অনুরোধ করলেন সাধারণ সম্পাদক হতে। আতাউর রহমান সাহেব একটু নিমরাজি হয়ে পড়েলেন এবং আমাদের সাথে পরামর্শ করবেন বলে দিলেন। আতাউর রহমান সাহেব আমাদে ডেকে বললেন, তাঁদের অনুরোধের কথা। আমি তাঁকে বলে দিলাম এখন আর সময় নাই, পূর্বে হলে রাজি হতাম। তাঁদের কাউকে প্রতিদ্বন্ধিতা করতে বলেন। আতাউর রহমান সাহেব তাঁদের জানিয়ে দিলেন। তাঁরা মওলানা সাহেবের কাছে অনুরোধ করলে, তিনি চারজনের উপর কমিটির নাম প্রস্তাব করার ভার দেয়ার কথা বললেন। তবে তা সর্বসম্মতিক্রমে হতে হবে। আলোচনা সভা বেশি সময় চলল না, কারণ অন্য কোনো নাম তাঁরা প্রস্তাব করতে পারলেন না। আমি কাউন্সিল সভায় উপস্থিত হয়ে ভাসানী সাহেবকে জানিয়ে দিলাম, নির্বাচন হবে। একমত হতে পারা গেল না। আতাউর রহমান সাহেব আমাকে সমর্থন করলেন। আমরা ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র নিয়ে সমস্ত রাত আলোচনা করলাম সাবজেক্ট কমিটিতে। কাউন্সিল সভায় ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র গ্রহণ করা হল এবং নির্বাচনও সর্বসম্মতিক্রমে হয়ে গেল। মওলানা ভাসানী সভাপতি, আতাউর রহমান সাহেব সহ-সভাপতি, আমি সাধারণ সম্পাদক (ম্যানিফেস্টো আমার কাছে এখন নাই, পরে তুলে দিব)। এখন আওয়ামী লীগ একটা সত্যিকারের রাজনৈতিক প্রতিষ্টান হিসাবে জনগণের সামনে দাঁড়াল। ম্যানিফেস্টো বা ঘোষণাপত্র না থাকলে রাজনৈতিক প্রতিষ্টান চলতে পারে না।
এর পূর্বে আমরা লাহোরে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কনফারেন্সে যোগদান করি। সেখানে জমিদারি প্রথা বিলোপ এবং অন্যান্য প্রোগ্রাম নিয়ে নবাব মামদোতের সাথে একমত হতে না পারায় নবাব সাহেব আওয়ামী লীগ ত্যাগ করলেন।
পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরাট প্রভেদ রয়েছে। সেখানে রাজনীতি করে সময় নষ্ট করার জন্য জমিদার, জায়গিরদার ও বড় বড় ব্যাবসায়ীরা। আর পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতি করে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। পশ্চিম পাকিস্তানে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত না থাকার জন্য জনগণ রাজনীতি সম্বন্ধে বা দেশ সম্বন্ধে কোনো চিন্তাও করে না। জমিদার বা জায়গিরদার অথবা তাদের পীর সাহেবরা যা বলেন, সাধারণ মানুষ তাই বিশ্বাস করে।
২৪০
বহুকাল থেকে বাংলাদেশে কৃষক আন্দোলন হওয়াতে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের চেয়ে অনেকটা বেশি। এছাড়াও স্বাধীনতা আন্দোলনেও বাঙালিরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে দীর্ঘকাল যাবৎ গ্রাম্য পঞ্চায়েত প্রথা, তারপর ইউনিয়ন বোর্ড, লোকাল বোর্ড ও ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড থাকাতে জনগণের মধ্যেও রাজনৈতিক শিক্ষা অনেক পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল। শিক্ষিতের সংখ্যা বেশি না থাকলেও বাঙালিরা অজ্ঞ বা অসচেতন ছিল না। ভালমন্দ বিচার করার ক্ষমতা তাদের ছিল এবং এর প্রমাণও করেছিল ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান দাবির উপর সাধারণ নির্বাচনের সময়।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্টানকে জনগণ ও শিক্ষিত সমাজ সমর্থন দিল। মুসলিম লীগের ভিতর তখন ষড়যন্ত্রের রাজনীতি চরম আকার ধারণ করেছিল। ব্রিটিশ আমলের আমলাদের রাজনীতিতে স্থান দিয়ে তারা ষড়যন্ত্রের জালে আটকা পড়েছিল। তাই প্রতিষ্টানের ভিতর আত্মকলহ দেখা দিল প্রবলভাবে। ছোট ছোট উপদলে ভাগ হয়ে পড়েছিল দলটি। নীতির কোন বালাই ছিল না, একমাত্র আদর্শ ছিল ক্ষমতা আঁকড়িয়ে থাকা। জেলায় ও মহকুমার পুরানা নেতাদের কোনো সংগ্রামী ঐতিহ্য যেমন ছিল না, তেমনি দুনিয়া যে এগিয়ে চলেছে সেদিকে খেয়াল ছিল না কারও। শুধু ক্ষমতায় থাকা যায় কি করে সেই একই চিন্তা।
এদিকে পূর্ব বাংলার সম্পাদকে কেড়ে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে কত তাড়াতাড়ি গড়া যায়, একদল পশ্চিমা তথাকথিত কেন্দ্রীয় নেতা ও বড় সরকারি কর্মচারী গোপনে সে কাজ করে চলেছিল। তাদের একটা ধারণা ছিল, পূর্ব বাংলা শেষ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে থাকবে না। তাও যত তাড়াতাড়ি পারা যায় পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তুলতে হবে।
আওয়ামী লীগ যখন হিসাব-নিকাশ বের করে প্রমাণ করল যে, পূর্ব বাংলাকে কি করে শোষণ করা হচ্ছে তখন তারা মরিয়া হয়ে উঠল এবং আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের উপর চরম অত্যাচার করতে আরম্ভ করল। এদিকে জনগণ মুসলিম লীগ প্রতিষ্টান ও সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠেছিল। পূর্ব বাংলায় তখন মুসলিম লীগের নাভিশ্বাস শুরু হয়েছে।
খাজা সাহেবের আমলে পাঞ্জাবে এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। তাতে হাজার হাজার লোক মারা যায়। লাহোরে মার্শাল ল’ জারি করা হয়। আহমদিয়া বা কাদিয়ানি বিরোধী আন্দোলন থেকে এই দাঙ্গা শুরু হয়। কয়েকজন বিখ্যাত আলেম এতে উসকানি দিয়েছিলেন। কাদিয়ানিরা মুসলমান না’ এতাই হল এই সকল আলেমদের প্রচার। আমার এ সম্বন্ধে বিশেষ কোনো ধারণা নাই। তবে একমত না হওয়ার জন্য যে অন্যকে হত্যা করা হবে, এটা যে ইসলাম পছন্দ করে না এবং একে অন্যায় মনে করা হয়- এটুকু ধারণা আমার আছে। কাদিয়ানিরা তো আল্লাহ ও রসুলকে মানে। তাই তাদের তো কথাই নাই, এমনকি বিধর্মীর উপরও অন্যায়ভাবে অত্যাচার করা ইসলামে কড়াভাবে নিষেধ
২৪১
করা আছে। লাহোরে ও অন্যায় জায়গায় জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে স্বামী, স্ত্রী, ছেলেমেয়েকে একসাথে ফেলে দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। যারা এই সমস্ত জঘন্য দাঙ্গার উসকানি দিয়েছিল তারা আজও পাকিস্তানের রাজনীতিতে সশরীরে অধিষ্টিত আছে।
পাকিস্তান হবে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী বা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান নাগরিক অধিকার থাকবে। দুঃখের বিষয়, পাকিস্তান আন্দোলনের যারা বিরুদ্ধাচরণ করেছিল, এখন পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র ধুয়া তুলে রাজনীতিকে তারাই বিষাক্ত করে তুলেছে। মুসলিম লীগ নেতারাও কোনো রকম অর্থনৈতিক ও সমাজনৈতিক প্রোগ্রাম না দিয়ে একসঙ্গে যে স্লোগান দিয়ে ব্যস্ত রইল, তা হল ‘ইসলাম’। পাকিস্তানের শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ যে ভরসা নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন, তথা পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে কোন নজর দেওয়াই তারা দরকার মনে করল না। জমিদার ও জায়গিরদাররা যাতে শোষণ করতে পারে সে ব্যাপারেই সাহায্য দিতে লাগল। কারণ, এই শোষক লোকেরাই এখম মুসলিম লীগের নেতা এবং এরাই সরকার চালায়।
অন্যদিকে পূর্ব বাংলার বৈদেশিক মুদ্রা থেকে প্ল্যান প্রোগ্রাম করেই পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে সাহায্য করতে লাগল। ফলে একদল শিল্পপতি গড়ে তুলতে শুরু করল, যারা লাগাম ছাড়া অবস্থায় যত ইচ্ছা মুনাফা আদার করতে লাগল জনসাধারণের কাছ থেকে এবং রাতারাতি কোট কোটি টাকার মালিক বনে গেল। করাচি বসে ইমপোরট ও এক্সপোর্ট ব্যবসার নাম করে লাইসেন্স বিক্রি করে বিপুল অর্থ উপার্জন করে আস্তে আস্তে অনেকে শিল্পপতি হয়ে পড়েছে। এটাও মুসলিম লীগ সরকারের কীর্তি এবং খাজা সাহেবের দুর্বল নেতৃত্বও এর জন্য কিছুটা দায়ী। কারণ তিনি কোনোদিন বোধহয় সরকারি কর্মচারীদের অযৌক্তিক প্রস্তাবও প্রত্যাখান করতে পারেন নাই। এদিকে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর মত ঘুঘু সরকারি কর্মচারীকে অর্থমন্ত্রী করে তিনি তাঁর উপর নির্ভর করতে শুরু করেছিলেন শুনেছি; ঠিক কি না বলতে পারি না, তবে কিছুটা সত্য হলেও হতে পারে। মরহুম ফজলুর রহমান সাহেবও তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। তিনি চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে বাধা দিতে চেষ্টা করেছিলেন। খাজা সাহেবের মন্ত্রীদের মধ্যে দুইটা দল হয়েছিল। ফজলুর রহমান সাহেব একটা দলের নেতৃত্ব করতেন, যাকে ‘বাঙালি দল’ বলা হত। আরেকটা দল চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে ছিল যাকে ‘পাঞ্জাবি দিল’ বলা হত। বাঙালি তথাকথিত নেতারা কেন্দ্রীয় রাজধানী, মিলিটারি হেডকোয়ার্টারগুলি, সমস্ত বড় বড় সরকারি পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য পাঞ্জাবি ভাইদের হাতে দিয়েও গোলাম মোহাম্মদ ও চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে খুশি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। গণপরিষদে বাঙালিরা ছয়টা সিট পশ্চিম পাকিস্তানের ‘ভাইদের’ দিয়েও খুশি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তারা ইচ্ছা করলে পূর্ব বাংলার জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে পারতেন। তাঁরা তা না করে তাঁদের গদি রক্ষা করার জন্য এক এক করে সকল কিছু তাঁদের পায়ে সমর্পণ করেই গদি রাখতে পারলেন না। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বুঝতে পেরেছেন, এদের কাছ থেকে যতটুকু নেওয়ার নেওয়া হয়েছে। এখন নতুন লোকদের
২৪২
নেওয়া প্রয়োজন, পুরানরা আর দিতে চাইবে না। কারণ, এরা এদের চিনতে পেরেছে বোধহয়। পূর্ব বাংলার নেতাদের দিয়ে এমন সকল কাজ করিয়েছে যে, এদের আর পূর্ব বাংলার জনগণ বিশ্বাস করবে না। ধাক্কা দিলেই এরা পড়ে যাবে। যেমন খাজা সাহেবকে দিয়ে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বক্তৃতা করিয়ে তাঁর উপর বাঙালিদের যতটুকু আস্থা ছিল তাও খতম করতে সক্ষম হয়েছিল। এবার তাই নতুন চাল চালতে শুরু করল। ঘাগু ব্রিটিশ আমলের সরকারি আমলাদের কূটবুদ্ধির কাছে এরা টিকবে কেমন করে? জনগণের আস্থা হারিয়ে এরা সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল আমলাতন্ত্রের উপরে, যারা সকলেই প্রায় পশ্চিম পাকিস্তানে তথা পাঞ্জাবের অধিবাসী।
১৯৫৩ সালের এপ্রিল মাসে গভর্নর জেনারেল জনাব গোলাম মোহাম্মদ ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের সভাপতি, গণপরিষদ ও পার্লামেন্টের সংখ্যাগুরু দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনকে বরখাস্ত করে আমেরিকায় পাকিস্তানের রাষ্টড়দূতে মোহাম্মদ আলী বগুড়াকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করলেন, যদিও মোহাম্মদ আলী গণপরিষদেরও সদস্য ছিলেন না। এমনকি মুসলিম লীগেরও সভ্য ছিলেন না। ১৯৪৮ সাল থেকে তিনি পাকিস্তানের বাইরেই ছিলেন, দেশের মানুষের কোন খবরই রাখতেন না।
আমার মনে আছে, এই দিন আওয়ামী লীগ ঢাকার পল্টন ময়দানে এক সভা করছিল। সোহরাওয়ারদী সাহেব বক্তৃতা করছিলেন। বহু জনসমাগম হয়েছিল। শহীদ সাহেব যখন বক্তৃতা করছিলেন, তখন কে একজন এসে খবর দিল, এই মাত্র রেডিওর খবর বলেছে নাজিমুদ্দীন সাহেবকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। শহীদ সাহেব জনসাধারণকে বললেন, “আজ পাকিস্তানের একটা বিরাট খবর আছে”। সভা শেষে যখন শহীদ সাহেবকে নিয়ে ফিরছিলাম, তিনি বললেন, “নাজিমুদ্দীন সাহেবকে বরখাস্ত করেছে, তবে এতে খুশি হবার কিছু নাই”। আমি শহীদ সাহেবকে বললাম, “এটা খাজা সাহেব আর তাঁর দলবলের প্রাপ্য”। শহীদ সাহেব বললেন, “হ্যাঁ, শাসনতন্ত্র না দিয়ে এবং সাধারণ নির্বাচন না করে এরা পাকিস্তানকে ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে জড়িয়ে ফেলেছে”। আরও অনেক বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছিলাম। যাহোক, অগণতান্ত্রিকভাবে খাজা সাহেবকে ডিসমিস করার প্রতিবাদ মুসলিম লীগ নেতারা করলেন না। এক এক করে তাঁদের নেতাকে ছেড়ে দিয়ে ক্ষমতার লোভে মোহাম্মদ আলী সাহেবকে নেতা মেনে নিলেন। এমন কি মুসলিম লীগের সভাপতির পদও খাজা সাহেবকে ত্যাগ করতে হল। মুসলিম লীগ নেতারা মোহাম্মদ আলী বগুড়াকে নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি করে নিলেন, একজনও প্রতিবাদ করলেন না। আমার মনে আছে, এমন অগণতান্ত্রিকভাবে নাজিমুদ্দীন সাহেবকে বরখাস্ত করার প্রতিবাদ একমাত্র পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগই করেছিল।
পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী জনাব নুরুল আমিন খাজা সাহেবের বিশ্বস্ত ভক্ত ছিলেন। তিনি ও অন্যান্য প্রদেশের মুসলিম লীগ প্রধানমন্ত্রীরাও মোহাম্মদ আলী সাহেবকে আনুগত্য জানালেন এবং একমাত্র নেতা হিসাবে গ্রহণ করে নিলেন। এই ঘটনার পরে আর কোনো শিক্ষিত মানুষ বা বুদ্ধিজীবীদের মুসলিম লীগের উপর আস্থা থাকার কারণ ছিল না। এটা
২৪৩
যে একটা সুবিধাবাদী ও সুযোগ সন্ধানীদের দল তাই প্রমাণ হয়ে গেছে। গোলাম মোহাম্মদ বড়লাট হয়ে এ সাহস কোথা থেকে পেয়েছিলেন? বড় বড় সরকারি কর্মচারী এবং এক অদৃশ্য শক্তি তাঁকে অভয় দিয়েছিল এবং সরকার হলে তাঁর পেছনে দাঁড়াবে সে প্রতিশ্রুতিও তিনি পেয়েছিলেন। মুসলিম লীগ নেতা ও কর্মীদের চরিত্র সম্বন্ধে তাঁর ধারণা ছিল। খাজা সাহেবের সমর্থকরা একে একে মোহাম্মদ আলী সাহেবের মন্ত্রীত্বে যোগদান করলেন। খাজা সাহেব নিজেও এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহস পেলেন না। ১৯৪৬ সালে যেমন চুপটি করে ঘরে বসে পড়েছিলেন, এবারও তিনি বিশ্রাম গ্রহণ করলেন-যদি কোনোদিন সুযোগ আসে তখন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবেন, এই ভরসায়।
মোহাম্মদ আলীর (বগুড়া) মধ্যে কোনো রাজনৈতিক চেতনা ছিল না। তাঁর মধ্যে কোনো গভীরতাও ছিল না। শুধু আমেরিকা থেকে তিনি আমেরিকানদের মত কিছু হাবভাব ও হাঁটাচলা ও কাপড় পরা শিখে এসেছিলেন। গোলাম মোহাম্মদ যা বলেন, তাতেই তিনি রাজি। আর আমেরিকানরা যে বুদ্ধি দেয় সেইটাই তিনি গ্রহণ করে চলতে লাগলেন। আমেরিকান শাসকগোষ্টীরা যেমন সকল কিছুর মধ্যে কমিউনিস্ট দেখতেন, তিনিও তাই দেখতে শুরু করলেন। প্রথমে তিনি শহীদ সাহেবকে তাঁর ‘রাজনৈতিক পিতা’ বলে সম্বোধন করলেন, পরে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করলেন।
মওলানা ভাসানী, আমি ও আমার সহকর্মীরা সময় নষ্ট না করে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্টান গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। পূর্ব বাংলার জেলায়, মহকুমায়, থানায় ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে এক নিঃস্বার্থ কর্মীবাহিনী সৃষ্টি করতে সক্ষম হলাম। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্ররা মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে মন প্রাণ দিয়ে রুখে দাঁড়াল। দেশের মধ্যে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করেছিল। শাসনযন্ত্র শিথিল হয়ে গিয়েছিল। সরকারি কর্মচারীরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারত। খাদ্য সংকট সরম আকার ধারণ করে। বেকার সমস্যা ভীষণভাবে দেখা দিয়েছে। শাসকদের কোন প্ল্যান প্রোগ্রাম নাই। কোনোমতে চললেই তারা খুশি। পূর্ব বাংলার মন্ত্রীরা কোথাও সভা করতে গেলে জনগণ তাদের বক্তৃতা শুনতেও চাইত না। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির কথা কেউই ভুলে নাই। আমরা তাড়াতাড়ি শাসনতন্ত্র করতে জনমত সৃষ্টি করতে লাগলাম। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা না মেনে নিলে আমরা কোনো শাসনতন্ত্র মানব না। এসময় ফজলুর রহমান সাহেব আরবি হরফে বাংলা লেখা পদ্ধতি চালু করতে চেষ্টা করছিলেন। আমরা এর বিরুদ্ধেও জনমত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কোনো কোনো মুসলিম লীগ নেতা এককেন্দ্রিক সরকার গঠনের জন্য তলে তলে প্রোপাগান্ডা করছিলেন। আওয়ামী লীগ ফেডারেল শাসনতন্ত্র ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির ভিত্তিতে প্রচার শুর করে জনগণকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিল।
২৪৪
বিনা বিচারে কাউকে বন্দি করে রাখা অন্যায়। ফলে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছিল। প্রগতিশীল যুবক কর্মীরাও আওয়ামী লীগে যোগদান করতে আরম্ভ করছিল। ১৯৫৩ সালের মাঝামাঝি পূর্ব বাংলায় সাধারণ নির্বাচন হবে ঘোষণা করা হল। আওয়ামী লীগ ও মুসলিম লীগের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ রইল না। ‘গণতান্ত্রিক দল’নামে একটা রাজনৈতিক দল করা হয়েছিল, তা কাগজপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। জনাব এ.কে.ফজলুল হক সাহেব তখন পর্যন্ত এডভোকেট জেনারেল ছিলেন হাইকোর্টের। পাকিস্তান হওয়ার পরে আর তিনি কোনো রাজনীতি করেন নাই। ১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি এডভোকেট জেনারেলের পদ থেকে পদত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। মুসলিম লীগের মধ্যে তখন কোন্দল শুরু হয়েছিল ভীষণভাবে । মোহন মিয়া সাহেব নূরুল আমিন সাহেবের বিরুদ্ধে গ্রুপ সৃষ্টি করেন এবং হক সাহেবকে মুসলিম লীগের সভাপতি করতে চেষ্টা করে পরাজিত হন। কারজন হলে দুই গ্রুপের মধ্যে বেদম মারপিটও হয়। নূরুল আমিন সাহেবের দলই জয়লাভ করে, ফলে মোহন মিয়া ও তাঁর দলবল লীগ থেকে বিতাড়িত হলেন।
এরপর আমি হক সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে আওয়ামী লীগে যোগদান করতে অনুরোধ করলাম। চাদপুরে আওয়ামী লীগের এক জনসভায় তিনি যোগদানও করলেন। সেখানে ঘোষণা করলেন, “যারা চুরি করবেন তাঁরা মুসলিম লীগে থাকুন, আর যারা ভাল কাজ করতে চান তাঁরা আওয়ামী লীগে যোগদান করুন”। আমাকে ঘিরে জনসভায় বললেন, “মুজিব যা বলে তা আপনারা শুনুন। আমি বেশি বক্তৃতা করতে পারব না, বুড়া মানুষ”। এ বক্তৃতা খবরের কাগজেও উঠেছিল।
এই সময় আওয়ামী লীগের মধ্যে সেই পুরাতন গ্রুপ যুক্তফ্রন্ট করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আবদুস সালাম খান, ময়মনসিংহের হাশিমউদ্দিন ও আরও কয়েকজন এজন্য প্রচার শুরু করলেন। এদিকে তথাকথিত প্রগতিশীল এক গ্রুপও বিরোধী দলের ঐক্য হওয়া উচিত বলে চিৎকার আরম্ভ করলেন। অতি প্রতিক্রিয়াশীল ও অতি প্রগতিবাদীরা এই জায়গায় একমত হয়ে গেল। কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দল তখন ছিল না- একমাত্র আওয়ামী লীগ ছাড়া- যার নাম জনসাধারণ জানে। ভাসানি সাহেব ও আমি পরামর্শ করলাম, কি করা যায়! তিনি আমাকে পরিষ্কার ভাষায় বলে দিলেন, যদি হক সাহেব আওয়ামী লিগে আসেন তবে তাঁকে গ্রহণ করা হবে এবং উপযুক্ত স্থান দেওয়া যেতে পারে। আর যদি অন্য দল করেন তবে কিছুতেই তাঁর সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট করা চলবে না। যে লোকগুলি মুসলিম লীগ থেকে বিতাড়িত হয়েছে তারা এখন হক সাহেবের কাঁধে ভর করতে চেষ্টা করছে। তাদের সাথে আমরা কিছুতেই মিলতে পারি না। মুসলিম লীগের সমস্ত কুকার্যের সাথে এরা ১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জড়িত ছিল। এরা বাংলাকে রাষ্টড়ভাষা করার বিরোধিতাও করেছে। মওলানা সাহেব আমাদের অনেকের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। আমাকে বলে দিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সদস্যদের মধ্যে যেন যুক্তফ্রন্ট সমর্থকরা মাথা তুলতে না পারে।
২৪৫
ওয়ার্কিং কমিটির সভায় এ সম্বন্ধে অনেক আলোচনা হল। বেশি সংখ্যক সদস্যই যুক্তফ্রন্টের বিরোধী। কারণ, যাদের সাথে নীতির মিল নাই, তাদের সাথে সাময়িকভাবে কোনো ফল পাওয়া যেতে পারে, তবে ভবিষ্যতে ঐক্য থাকতে পারে না। তাতে দেশের উপকার হওয়ার চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়ে থাকে। আওয়ামী লীগের মধ্যে যারা এই একতা চাচ্ছিল, তাদের উদ্দেশ্য মুসলিম লীগকে পরাজিত করা এবং ক্ষমতায় যে কোনোভাবে অধিষ্টিত হওয়া। ক্ষমতায় না গেলে চলে কেমন করে, আর কতকাল বিরোধী দল করবে!
অতি প্রগতিবাদীদের কথা আলাদা। তারা মুখে চায় ঐক্য। কিন্ত দেশের জাতীয় নেতাদের জনগণের সামনে হেয়প্রতিপন্ন করতে এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্টানগুলি যাতে জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলে, চেষ্টা করে সেজন্য। তাহলেই ভবিষ্যতে জনগণকে বলতে পারে যে, এ নেতাদের ও তাদের দলগুলি দ্বারা কোনো কাজ হবে না। এরা ঘোলা পানিতে মাছ ধরবার চেষ্টা করতে চায়।
মুসলিম লীগ জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এই দলটার কোনো নীতির বালাই নাই। ক্ষমতায় বসে করে নাই এমন কোন জঘন্য কাজ নাই। পরিষ্কারভাবে জনগণ ও পূর্ব বাংলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এই দল হতে যে লোকগুলি বিতাড়িত হয়েছিল তারা এই জঘন্য দলের সভ্যদের মধ্যেও টিকতে পারে নাই। এরা কতটুকু গণবিরোধী হতে পারে ভাবতেও কষ্ট হয়। এরা নীতির জন্য বা আদর্শের জন্য মুসলিম লীগ ত্যাগ করে নাই, ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল ক্ষমতার লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে। এই বিতাড়িত মুসলিম লীগ সভ্যরা পাকিস্তান হওয়ার পরে একদিনের জন্যও সরকারের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করে নাই। এমনকি সরকার থেকে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণও করেছে। তারা চেষ্টা করতে লাগল যাতে হক সাহেবের জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের সাথে দরকষাকষি করতে পারে।
হক সাহেব আওয়ামী লীগে যোগদান করবেন ঠিক করে ফেলেছিলেন। এমনকি অনেকের কাছে বলেওছিলেন। এই লোকগুলি হক সাহেবের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে তাঁকে বোঝাতে লাগল, আলাদা দল করে যুক্তফ্রন্ট করলে সুবিধা হবে। আওয়ামী লীগ তাঁকে উপযুক্ত স্থান দিবে না। সোহরাওয়ারদী সাহেব তাঁকে প্রধানমন্ত্রী নাও করতে পারেন, এমনই নানা কথা। তাদের নিজের দল হলে আওয়ামী লীগ বাধা দিলেও মুসলিম লীগের সাথে মিলতে পারবে নির্বাচন পরে। মুসলিম লীগও কিছু আসন নির্বাচনে দখল করতে পারবে। প্রথমে আওয়ামী লীগের সাথে মিলে নির্বাচন করে নেওয়া যাক, তারপর দেখা যাবে। পথ খোলা থাকলে যে কোনো পন্থা অবলম্বন করা যাবে। যদিও হক সাহেবকে আমরা জানিয়ে দিয়েছিলাম, তিনি পূর্ব বাংলা প্রাদেশি আইন পরিষদে আওয়ামী লীগের নেতা হবেন, শহীদ সাহেব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইনসভার নেতা থাকবেন।
এই সময় ভাসানী সাহেব আমাকে চিঠি দিলেন আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সভা ডাকতে ময়মনসিংহে। আমার সাথে তিনি এই সম্বন্ধে আগে কোনো পরামর্শ করেন নাই। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি হাশিমউদ্দিন যুক্তফ্রন্ট চায়। আমি তাঁকে পছন্দ করতাম
২৪৬
না, তা তিনি জানতেন। গোপনে গোপনে সালাম সাহেবের সাথে মিশে তিনি কিছু ষড়যন্ত্রও করতেন। আমার সমর্থক ময়মনসিংহ জেলার বিশিষ্ট কর্মী রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া ও হাতেম আলী তালুকদার ও আরও অনেকে তখনও কারাগারে বন্দি।
মওলানা ভাসানীর খেলা বোঝা কষ্টকর। ময়মনসিংহ কনফারেন্সে বেশ একটা বোঝাপড়া হবে বলে আমি ধারণা করলাম। তবু আমি কনফারেন্স ডেকে বলে দিলাম, সভাপতি হিসাবে মওলানা ভাসানী আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন সভা ডাকতে। শহীদ সাহেবকে দাওয়াত করা হল এবং তাঁকে সভায় উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করা হল। শহীদ সাহেব আমাকে জানিয়ে দিলেন সভার দুই দিন পূর্বে তিনি ঢাকায় পৌছাবেন। সমস্ত জেলায় জেলায় আমি চিঠি পাঠিয়ে দিলাম। হাশিমউদ্দিন সাহেবকে নির্দেশ দিলাম, সমস্ত কাউন্সিলারদের থাকার বন্দোবস্ত করতে এবং হোটেল ঠিক করতে যেখানে সদস্যরা নিজেদের টাকা দিয়েই খাবে। যদিও জেলা কমিটির উচিত ছিল বাইরের জেলার সদস্যদের খাবার ব্যবস্থা করা।
আবুল মনসুর আহমদ সাহেব জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি সকল কিছুই ছেড়ে দিয়েছেন হাশিমউদ্দিন সাহেবের কাছে। আমি যে সেখানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অফিস করব সে বন্দোবস্ত করা হয় নাই। সমস্ত জেলায় খবর দেওয়া হয়েছে যেন সকলে উপস্থিত থাকে। আমার জানা আছে যেখানে সভা হোক না কেন শতকরা দশ ভাগ ভোটও আমার মতের বিরুদ্ধে যাবে না। অনেক জেলার কর্মীদের জন্য থাকবার বন্দোবস্ত করা হয় নাই। এই অবস্থায় আবদুর রহমান সিদ্দিকী নামে একজন কর্মীর সাহায্য পেয়েছিলাম। ছোট ছোট হোটেল ভাড়া করে বিভিন্ন জেলার সভ্যদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
সভার তিন-চার দিন পূর্বে মওলানা সাহেব খবর দিলেন, তিনি সভায় উপস্থিত হতে পারবেন না। কিন্ত কে সে কারণ কিছুই জানান নাই। আমি জানতাম, কোনো রকম বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তিনি সরে থাকতে চেষ্টা করতেন। আমি ও খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস বাধ্য হয়ে রওয়ানা করলাম তাঁকে ধরে আনতে বগুড়া জেলার পাঁচবিবি গ্রাম হতে। সময়ও খুব অল্প, অনেক কাজ পড়ে আছে। বিভিন্ন জেলার কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। পার্টির যুক্তফ্রন্ট সমর্থকরা লোক পাঠিয়েছে বিভিন্ন জেলায়। খোন্দকার মোশতাক আহমদও যুক্তফ্রন্ট সমর্থক। ইলিয়াস ও আমি বাহাদুরবাদ ঘাট পার হয়ে ফুলছড়ি ঘাটে ট্রেনে উঠেছি, এমন সময় বগুড়া থেকে একটা ট্রেন আসল। আমি দেখলাম, মওলানা সাহেবের মত একজন লোক দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় বসে আছেন। ইলিয়াসকে বললাম, “দেখ তো কে”? ইলিয়াস উকি দিয়ে বলল, “ঐ তো মওলানা সাহেব”।আমাদের ট্রেন ছাড়ার সময় হয়েছে। তাড়াতাড়ি মালপত্র নিয়ে নেমে পড়লাম এবং মওলানা সাহেবের কাছে পৌছালাম। তিনি বেশি কোনো কথা বা বলে হাঁটতে লাগলেন, আমরাও তাঁর সাথে হাঁটতে লাগলাম এবং হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করলাম, “ব্যাপার কি? আপনি সভা ডাকতে বললেন, এখন আবার উপস্থিত হবেন না কেন?”তিনি বললেন, “তোমরা জান না, ঐক্যফ্রন্ট করবার জন্য তোমাদের নেতারা পাগল হয়ে গেছে। আমি কিছুতেই ঐ সমস্ত নীতিছাড়া
২৪৭
নেতাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে চাই না। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে যুক্তফ্রন্ট করার সংখ্যা বেশি। ভোটে পারা যাবে না। আমি আর রাজনীতি করব না। আমার তো কিছুই নাই। আমি তো নির্বাচনে দাঁড়াব না। কারও ক্যানভাস করতেও পারব না, তাই আর রাজনীতি করার ইচ্ছা নাই। কাউন্সিল সভায় যোগদানও করতে পারব না”। আমি রাগ করে তাঁকে বললাম, “আপনি তো আমাদের সাথে পরামর্শ না করে ময়মনসিংহে কাউন্সিল সভা ডাকতে বলেছেন, কাউন্সিল সভা তো আরও কিছুদিন পরে ঢাকায় ডাকার কথা ছিল। তবে কাউন্সিলের মতামত আপনি জানেন না। আপনিও ইচ্ছা করলে ঐক্যফ্রন্ট করার পক্ষে প্রস্তাব পাস করাতে পারবেন কি না সন্দেহ! আওয়ামী লীগের সভ্যরা বিতাড়িত মুসলিম লীগ নেতাদের কাছে বহু অত্যাচার সহ্য করেছে এবং তারা জানে এরা বিরোধী দল করতে আসে নাই। আওয়ামী লীগের কাঁধে পাড়া দিয়ে ইলেকশন পাস করতে চায়, তারপর তাদের পথ বেছে নেবে। আপনি যদি উপস্থিত না হন তবে আমি টেলিগ্রাম করে সভা বন্ধ করে দিয়ে এই পথেই বাড়ি চলে যাব”।
মওলানার সঙ্গে আলাপ করতে করতে চরের ভিতর দিয়ে ‘সর্দারের চর’ নামে একটা গ্রামে পৌছালাম এবং তাঁর এক মুরিদ মুসা মিয়ার বাড়িতে পৌছালাম। মুসা মিয়া খুবই গরিব মানুষ, মাত্র ছোট্ট ছোট্ট দুইখানা কুঁড়েঘর তার সম্বল। একটা গাছতলায় আমাদের সুটকেস ও বিছানা নিয়ে একটা মাদুরের উপর বসে পড়লাম। ভদ্রলোক আমাদের নিয়ে মহাবিপদে পড়লেন। কি যে করবেন বুঝে পান না। গরিব হতে পারেন, কিন্ত এত বড় প্রাণ আমার জীবনে খুবই কম দেখেছি। ট্রেন নাই ঢাকায় ফিরে যাবার। ভাসানী সাহেবও কিছু বলছেন না। রাতে সেখানে থাকতে হবে। মুসা মিয়ার বোধহয় যা কিছু ছিল তা ব্যয় করে আমাদের জন্য চায়ের বন্দোবস্তও করলেন। রাতে তার এক পাশের বাড়িতে- সেও মওলানা সাহেবের ভক্ত, সেখানে কাটালাম। তার বাড়িতে একটা ছোট আলাদা ঘর ছিল। মওলানা সাহেবের সাথে নরম গরম আলাপ হওয়ার পরে তিনি সভায় আসবেন বলে দিলেন। ইলিয়াসও মওলানা সাহেবের সাথে অনেক আলোচনা করল। পরের দিন সকালে আমরা দুইজন রওয়ানা করে ফিরে আসলাম। মোহাম্মদউল্লাহ সাহেব, কোরবান আলী, হামিদ চৌধুরী, মোল্লা জালালউদ্দিন পূর্বেই পৌঁছে গিয়েছে। শহীদ সাহেবকে অভ্যর্থনা করবার জন্য ঢাকায় আসতে হল। তাঁকে নিয়ে ময়মনসিংহে পৌছালাম। আওয়ামী লীগ অফিস করবার জন্য কোন স্থান না পেয়ে হামিদ, জালাল ও মোহাম্মদউল্লাহ আজিজুর রহমান সাহেবের বাসায় একটা কামরা নিজেরাই ঠিক করে নিয়েছিল। আমার একলার জন্য থাকার বন্দোবস্ত করেছিল হাশিমউদ্দিনের বাড়িতে। আমি কেমন করে অন্যান্য কর্মকর্তাদের রেখে হাশিমউদ্দিন সাহেবের বাড়িতে থাকি? পূর্বে যখন গিয়েছি, আমি হাশিমউদ্দিন সাহেবের বাড়িতেই থাকতাম। খালেক নেওয়াজ, শামসুল হক, রশিদ ময়মনসিংহের বিশিষ্ট কর্মী, তারা হাশিমউদ্দিনকে পছন্দ না করলেও আমাকে ভালবাসত। তাদের সাহায্যও পেলাম কাউন্সিলারদের থাকার বন্দোবস্ত করতে। অলকা সিনেমা হলে সম্মেলন হবে। রাতে
২৪৮
আমি খবর পেলাম, হাশিমউদ্দিন বাইরের লোক হলের মধ্যে পূর্বেই নিয়ে রাখবে অথবা আওয়ামী লীগ কাউন্সিলার নামেও কিছু বাইরের লোক নিবে যাতে তারা সংখ্যাগুরু হতে পারে।
আমি ভোর পাঁচটায় আবুল মনসুর আহমদ সাহেবকে এ বিষয়ে জানালাম এবং বললাম, “তাকে নিষেধ করবেন এ সমস্ত করতে। কারণ গোলমাল হলে লোকে মন্দ বলবে”।আবুল মনসুর সাহেব বললেন, “আমি তো কিছুই জানি না, তবে দেখব”। আমি সকালবেলায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিলাম, এক একজন সেক্রেটারি এক একটা দরজায় থাকবে এবং তাদের প্রত্যেকের সাথে আটজন করে কর্মী থাকবে। আমার দস্তখত করা কার্ড ছাড়া কাউকে ভিতরে যেতে দেওয়া হবে না। বিভিন্ন জেলা থেকে ভাল ভাল যুবক কর্মীদের গেটে থাকতে নির্দেশ দিলাম। ফল ভালই হল; বাইরের লোক কেউই ভেতরে যেতে পারল না। কেউ কেউ কয়েকবার চেষ্টা করেছে, লাভ হয় নাই। কর্মীদের মনোভাব দেখে আর অগ্রসর হতে সাহস পায় নাই। আমি সেক্রেটারির রিপোর্ট পেশ করলাম। শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব বক্তৃতা করলেন। আমার যতদূর মনে হয় বিশেষভাবে নিমন্ত্রণ পেয়ে মিয়া ইফতিখারউদ্দিন সভায় যোগদান করেছিলেন; শেষে তিনি বক্তৃতাও করলেন। ‘বৈদেশিক নীতি ও যুক্তফ্রন্ট’ এই দুইটা বিষয় নিয়ে খুবই আলোচনা হল। সাবজেক্ট কমিটিও বসেছিল, কিন্ত কোনো মীমাংসা হল না। আমি কাউন্সিল সভায় বৈদেশিক নীতির উপর প্রস্তাব আনলাম। আওয়ামী লীগের বৈদেশিক নীতি হবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। আবদুস সালাম খান এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করে বক্তৃতা করলেন এবং অতি প্রগতিবাদী বলে আমাকে আক্রমণ করলেন। আমি তাঁকে অতি প্রতিক্রিয়াশীল বলে যথোপযুক্ত জবাব দিলাম। প্রস্তাব পাস হয়ে গেল, অবস্থা দেখে তিনি আর ভোটাভুটি চাইলেন না।
এর পরই শুরু হল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলির ঐক্যফ্রন্ট করা হবে কি হবে না সেই বিতর্ক! ঐক্যফ্রন্ট সমর্থকরা প্রস্তাব আনলেন, আমি বিরোধিতা করে বক্তৃতা করে জিজ্ঞাসা করলাম, “আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য বিরোধী কোনো দল আছে কি না? যাদের নীতি ও আদর্শ নাই তাদের সাথে ঐক্যফ্রন্ট করার অর্থ হল কতকগুলি মরা লোককে বাঁচিয়ে তোলা। এরা অনেকেই দেশের ক্ষতি করেছে। রাজনীতি এরা ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য করে, দেশের কথা ঘুমের ঘোরেও চিন্তা করে না”।আমার বক্তৃতায় একটু ভাবপ্রবণতা ছিল। কারণ এদের মধ্যে অনেকে ১৯৪৮,১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনকে দমাবার জন্য সকল রকম চেষ্টা করেছে। লীগ সরকার আমাদের দিনের পর দিন কারাগারে বিনা বিচারে বন্দি করে রেখেছিল। ভাসানী সাহেবও ঐক্যফ্রন্টের খুব বিরোধী, শহীদ সাহেবও বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন না। ঐক্যবাদীরা একটু ঘাবড়িয়ে গেল। তবে আতাউর রহমান সাহেব ও আমি একমত, “যুক্তফ্রন্ট চাই না’-এ প্রস্তাব হওয়া উচিত না। জনগণ মনে করবে আওয়ামী লীগই একতা চায় না। আমি আমার বন্ধুদের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, তারা কি কারও কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়েছেন যে, গাঁয়ে পড়ে প্রস্তাব করতে চান? যুক্তফ্রন্টের
২৪৯
প্রস্তাব আসলে ভোটে পরাজিত হয়ে যেত। শেষ পর্যন্ত অবস্থা বিবেচনা করে শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবকে ভার দেওয়া হল, তাঁরা যা ভাল বিবেচনা করেন তাই করবেন। তবে দুইজনের একমত হতে হবে এবং ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের সাতেহ আলোচনা করবেন, যখন এ সম্বন্ধে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। আমার বন্ধুরা জানতেন, শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব পরিষ্কার ভাষায় বলে দিলেন, যদি ফজলুল হক সাহেব আওয়ামী লীগে আসেন তাঁকে তার মাথা পেতে গ্রহণ করবেন এবং পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী বানাবার চেষ্টা করবেন। পূর্ব বাংলা আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি দলের নেতাও তিনি হবেন। শহীদ সাহেব আমাকে বলেছিলেন, “বৃদ্ধ নেতা, বহু কাজ করেছেন জীবনে, শেষ বয়েসে তাঁকে একবার সুযোগ দেওয়া উচিত দেশ সেবা করতে”।
মওলানা ভাসানী আমাকে বলে দিলেন, তিনি যুক্তফ্রন্ট করবেন না। হামিদুল হক চৌধুরী ও মোহন মিয়ার সাথে একসাথে রাজনীতি করার কোনো কথাই ওঠে না। নূরুল আমিন সাহেব যে দোষে দোষী এরাও সেই দোষেই দোষী। আমাকে নির্বাচন অফিস করা এং কাকে নমিনেশন দেওয়া হবে সে সকল বিষয়ে সবকিছু ঠিক করার জন্য নির্দেশ দিলেন। আমি মওলানা সাহেবকে বললাম, “আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করবে, ভয়ের কোনো কারণ নাই। আর যদি সংখ্যাগুরু না হতে পারি আইনসভায় আওয়ামী লীগই বিরোধী দল হয়ে কাজ করবে। রাজনীতি স্বচ্ছ থাকবে, জগাখিচুড়ি হবে না। আদর্শহীন লোক নিয়ে ক্ষমতায় গেলেও দেশের কাজ হবে না। ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার হতে পারে”।মওলানা সাহেব একমত হলেন, আমাকে বিভিন্ন জেলায় সভার ব্যবস্থা করতে বললেন। তিনি ও আমি প্রত্যেক জেলায় ও মহকুমায় ঘুরব, কোথায় কাকে নমিনেশন দেওয়া হবে ঠিক করব। শহীদ সাহেবও কয়েকদিনের মধ্যে করাচি থেকে ফিরে আসবেন এবং সমস্ত নির্বাচনের ভার নিবেন। আওয়ামী লীগের একটা জিনিসেরই অভাব ছিল, সেটা হল অর্থবল। তবে নিঃস্বার্থ এক বিরাট করমীবাহিনী ছিল, যাদের মূল্য টাকায় দেওয়া যায় না। টাকা বেশি দরকার হবে না, প্রার্থীরা যে যা পারে তাই খরচ করবে। জনমত আওয়ামী লীগের পক্ষে।
সালাম সাহেব কিন্ত হাল ছাড়েন নাই। তিনি তখন কিছুটা কনসান্সকিপার হয়ে পড়েছিলেন, হক সাহেবের। হক সাহেব রাতারি নিজের দল সৃষ্টি করলেন। তার নাম দিলেন, কৃষক শ্রমিক দল। দেশে কোথাও কোনো সংগঠন নাই, কয়েকজন লীগ থেকে বিতাড়িত নেতা হামিদুল হক চৌধুরী সাহেব ও মোহন মিয়ার নেতৃত্বে আর কিছু পুরানা হক সাহেবের ভক্ত এসে জুটল। এরা রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে সংসার ধর্ম পালন করছিলেন। কারণ, এরা প্রায়ই পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধীতা করেছিলেন। জনাব আবুল হাশিম সাহেবও হক সাহেবকে পরামর্শ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগে যোগদান না করে নিজের দল সৃষ্টি করতে। সালাম সাহেবও হক সাহেবকে আওয়ামী লীগে যোগদান করার জন্য বেশি জোর দেন নাই। কারণ, আওয়ামী লীগে সালাম সাহেবের অবস্থা ভাল ছিল না। সালাম
২৫০
সাহেব আমাকে একদিন বললেন, ‘’আরকতকালবিরোধীদলকরাযায়,ক্ষমতায়নাগেলেজনগনেরআস্তাথাকবেনা।যেভাবেহয়ক্ষমতায়যেতেহবে।যুক্তফ্রন্টকরলেনিশ্চয়ইক্ষমতায়যেতেপারবে।’’এককথারউত্তরেআমিতাঁকেবকেছিলাম, ‘’ক্ষমতায়যাওয়াযেতেপারে,তবেজনসাধারনেরজন্য কিছু করা সম্ভব হবে না,আর এ ক্ষমতা বেশি দিন থাকবেও না।যেখানেআদর্শের মিল মিল নাই সেখানে ঐক্যও বেশি দিন থাকে না।‘’তিনিএকমতহতেপারেননাই।তাঁকেনিয়েবিপদ,কারনক্ষমতায়তাঁরযেতেইহবে,যেভাবেইহোক।তাঁরধারন, আওয়ামীলীগএককসংখ্যাগরিষ্ট হলে তিনি নেতা হতে পারবেন না,তার চেয়ে হক সাহেবের সঙ্গে থাকলে তাঁর নেতৃত্ব মানতে আপত্তি হবে না। হক সাহেবকে আওয়ামী লীগে আনতে কেউ ত আপত্তি করে নাই।তবে যেসব লোক তাঁর সঙ্গে জুটেছে তাঁরা হক সাহেবের সর্বনাশ করবে এবং সাথে সাথে দেশের এবং আওয়ামী লীগেরও সর্বনাশ করবে এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ আমার ছিল না। তাই আমি বিরোধীতা করতে লাগলাম।যুক্তফ্রন্ট করবার পক্ষে জনমত সৃষ্টি কিছুটা হয়েছিল সত্য,কিন্তু সেটা ভাবাবেগের উপর।জনসাধারন মুসলিম লীগ ও আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দলের নাম জনসাধারন জানত না।
শহীদ সাহেবও সভা করতে আরম্ভ করলেন।তিনি জানতেন,যুক্তফ্রন্ট হলে কি হবে! অতটা ব্যস্ত ছিলেন না। একদিন শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব আলাপ করছিলেন, আমিও তাদের সাথে ছিলাম।এ সম্মন্ধে আলচনা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আমি বলেছিলাম, ‘’ইলেকশনএলায়েন্সকরলেকরাযেতেপারে।যেখানেহকসাহেবেরদলেরভাললোকথাকবে,সেখানেআওয়ামীলীগনমিনেশনদিবে না।আর যেখানে আওয়ামী লীগের ভাল নমিনি থাকবে সেখানে তাঁরা নমিনেশন দিবে না।যার যার পার্টির পোগ্রাম নিয়ে ইলেকশন করবে।’’ভাসানীসাহেবতাতেওরাজীনন।তিনিবললেন, আওয়ামীলীগএককভাবেইলেকশনলড়বে,আমাকেকাজচালিয়েযেতেবললেন।১৯৫৩সালেরনভেম্বরমাসহবে,শহীদসাহেবভাসানী সাহেব ও আমাকে বললেন, করাচি যেতে হবে কয়েকদিনের জন্য; কিছু টাকা জোগাড় করতে হবে। এবার ফিরে এসে আর পশ্চিম পাকিস্থানে যাবেন না ইলেকশন শেষ না করে——তাও বললেন।
মাওলানা সাহেব ও আমি জেলায় জেলায় সভা করতে বের হয়ে গেলাম।শহীদ সাহেব যেদিন ঢাকা আসবেন তার দু’একদিন পূর্বে আমরা ঢাকায় পৌছাব।এবার আমরা উত্তরবঙ্গ সফরে রওনা করলাম। উত্তরবঙ্গ সফর শেষ করে কুষ্টিয়া জেলায় তিনটা সভা করে ঢাকায় পৌছাব।খুবই ভাল সাড়া পেলাম।কোথায় কাকে নমিনেশন দেয়া হবে সে সুপারিশ করার জন্য জেলা কর্মকর্তাদের জানিয়ে দিলাম। তাঁরা নাম ঠিক করে আমাকে জানাবে।যাদের জেলা কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে সুপারিশ করবে তাদের মনোনয়ন দেয়া হবে। যেখানে একমত হতে পারবে না,সেখানে পূর্ব পাকিস্থান আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনোনয়ন করবে। তবে শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব একমত হয়ে যাকে ইচ্ছা
২৫১
তাকে ¬নমিনেশন দিতে পারবেন। যেদিন ভাসানী সাহেব ও আমি কুষ্টিয়া পৌছালাম সেদিনই টেলিগ্রাম পেলাম,আতাউর রহমান সাহেব ও মানিক মিয়া আমাদের দুইজনকে ঢাকায় যেতে অনুরুধ করেছেন।আমি রাতে আতাউর রহমান খান সাহেবের কাছে টেলিফোন করলাম কুষ্টিয়া থেকে।তিনি জানালেন,সভা বন্ধ করে দিয়ে ফিরে আসতে। আমি তাঁকে বুঝিয়ে বললাম যে, আগামীকাল সভা, এখন বন্ধ করলে কর্মীরা মারা খাবে। পার্টির অবস্থাও খারাপ হয়ে যাবে। খান সাহেব পীড়াপীড়ি শুরু করলেন।তখন আমি তাঁকে বুঝিয়ে বললাম, মাওলানা সাহবেওকে পাঠিয়ে দিতেছি আজ,আমি সভাগুলিতে বক্তৃতা করে তিন দিন পরেই পৌছাব।তিনি রাজি হলেন।আতাউর রহমান সাহেবও আমাদের সাথে প্রথমে একমত ছিলেন যে,যুক্তফ্রন্ট করা উচিত হবে না। দুঃখের বিষয়,তাঁর নিজের কোনো মতামত বেশি সময় ঠিকে থাকে না। যে যা বলে,তাতেই তিনি হ্যা হ্যা করেন। এক কথায়, ‘’তাঁরহাতধরলে,তিনিনাবলতেপারেননা।‘’মাওলানাসাহেবঢাকায়রওনাকরেগেলেন।আমিমিটিংগুলিশেষকরেরওনা হব।এমন সময় খবর পেলাম,হক সাহেব ও মাওলানা ভাসানী দস্তখত করে যুক্তফ্রন্ট করে ফেলেছেন।
আমি বুঝতে পারলাম না, ভাসানী সাহেব কি করে দস্তখত করলেন।শহীদ সাহেবের অনুপস্থিতিতে কি পোগ্রাম হবে? সংগঠনের কি হবে? নমিনেশন কোন পদ্ধতিতে দেয়া হবে? কেনই বা মওলানা সাহেব এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন? কিছুই বুঝতে পারলাম না। ঢাকায় ফিরে এসে ইয়ার মোহাম্মদ কাহ্নের বাড়িতে মাওলানা সাহেবের সাথে দেখা করতে গেয়াম। নিচের কামরায় আওয়ামী লীগের অফিস/অফিস যেয়ে যখন বসেছি,তখন কর্মীরা আমায় খবর দিল,কিভাবে কি হয়েছে।আবুল মনসুর আহমদ সাহেব বিচক্ষন লোক সন্দেহ নাই।তিনি ব্যবপারটা বুঝতে পারলেন এবং তাড়াতাড়ি কফিলুদ্দিন চৌধুরীর সাহায্যে একুশ দফা পোগ্রামে দস্তফত করিয়ে নিলেন হক সাহেবকে দিয়েন।তাতে আওয়ামী লীগের স্বায়ত্বশাসন,বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা,রাজবন্ধুদের মুক্তি এবং আরও কতকগুলি মূল দাবী মেনে নেওয়া হল। আমরা যারা এদেশের রাজনীতির সাথে জড়িত আছি তাঁরা জানি,এই দস্তখতের কোনো অর্থ নাই অনেকের কাছে। আমি মাওলানা সাহেবেনের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি বললেন, দেখ মুজিব, আমি যুক্তফ্রন্টে দস্তখত করতে আপত্তি করেছিলাম তুমি ফিরে না আসা পর্যন্ত; আতাউর রহমান ও মানিককে আমি বললাম যে,মুজিব সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগের, তার সাথে পরামর্শ না করে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। আতাউর রহমান ও মানিক বলল যে,তারা দুইজনে তোমার দায়িত্ব নিল।আমরা যা করবম্মুজিব টা মেনে নেবে। তাই হক সাহেব যখন আমার কাছে এসে আমাকে অনুরোধ করলেন, তখন আমি দস্তখত করতে বাধ্য হলাম।আমি তাঁকে বললাম, ‘’আমারকথাছেড়েদিন, শহীদসাহেবেরজন্যদুইদিনদেরীকরলেকিঅন্যায়হত? তিনিতোদুইতিনদিনেরমধ্যেঢাকায়আসবেন।পূর্বেআমাকেএককথাবলেছিলেন, আজকরলেনতারউলটা।আমাকেএগিয়েদিয়েনিজেদস্তখতকরেবসলেন।কোনপন্থায়নমিনেশনহবে? কিভাবেকাজচলবে?
২৫২
দায়িত্ব কে নিবে এই নির্বাচনের, কিছুই ঠিক না করে ঘোষণা করে দিলেন ‘আমিআরহকসাহেবযুক্তফ্রন্টকরলাম!’যাকরেছেনভালইকরেছেন,আমিআরকিকরব! আরযখনআতাউররহমানসাহেবওমানিকভাইআমারভারনিয়েছেনদাবিকরে, তখনতাদেরকথাআমিফেলিবাকেমনকরে! এতেদেশেরযদি মঙ্গল হয় ভাল।আর যদি ক্ষতি হয় আপরাই দায়ী হবেন,আমি তো পার্টির সেক্রেটারি ছাড়া আর কিছুই না/ আপনারা নেতা, যখন যুক্তফ্রন্ট করেছেন —– এখন যাতে টা ভালভাবে চলে তার বন্দোবস্ত করুন।‘’মাওলানাসাহেববললেন, ‘’আমিবলেদিয়েছি,শহীদসাহেবএসেসকলকিছুঠিককরবেন।নমিনেশন বা নিয়মকানুন যা করতে হয় তিনিই করবেন।‘’
আমার মতের বিরুদ্ধে হলেও যখন নেতারা ভাল বুঝে এটা করেছেন তাতে দেশের ভাল হতে পারে।আমি চেষ্টা করতে লাগলাম যাতে যুক্তফ্রন্ট সুন্দর ও সুষ্টু ভাবে চলে। দুই দিন না যেতেই প্রথম খেলা শুরু হল। নামও শুনি নাই এমন দলের আবির্ভাব হল। হক সাহেব খবর দিলেন ‘নেজামেইসলামপার্টি’নামেএকটাপার্টিরসাথেপূর্বেইতিনিদস্তখতকরেছেন।তাদেরওযুক্তফ্রন্টেনিতেহবে।আমিমাওলানাসাহবকেজিজ্ঞেসকরলেতিনিবললেন, ‘’আমিতকিছুইজানিনা।‘’আমিবললাম, ‘’ঐপার্টিকোথায়, এরপ্রেসিডেন্টসেক্রেটারিকারা? সংগঠন কোথায় যে এদের নিতে হবে? এদের নিলে ‘গনতান্ত্রিকদল’যেএকটাদলআছেকাগজেরমারফৎদু’একবারদেখেছিতাদেরওনিতেহবে।এদেরমধ্যেতবুভাল দুই চারজন প্রগতিশীল কর্মীও আছে। কিন্তু আমাদের নিজেদের মধ্যে অনেকে গনতান্ত্রিক দলকে নেয়া হয়, টা চায় না।‘’
শহীদ সাহেব এসে অফিস ঠিক করলেন। তাঁকে যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান করতে কেউই আপত্তি করল না। আওয়ামী লীগ থেকে আতাউর রহমান খান ও কৃষক শ্রমিক পার্টি হতে কফিলুদ্দিন চৌধুরীর জয়েন্ট সেক্রেটারী এবং কামরুদ্দিন আহমদকে অফিস সেক্রেটারি করা হল। একটা সীয়ারীং কমিটিও করা হল। তিন পার্টির সমসংখ্যক সদস্য নিয়ে বোর্ড করা হল, যারা নমিনেশন দিবেন। শহীদ সাহেবকে চেয়ারম্যান করা হল, আর ঠিক হল সর্বসম্মতিক্রমে নমিনেশন দিতে হবে। কোন রকম ভোটাভুটি হবে না। শহীদ সাহেব কার্যবলী ঠিক করে ফেললেন রাত দিন পরিশ্রম করে। তিনি অফিসের ভেতরই একটা কামরায় থাকার ব্যবস্থা করলেন। রাতদিন সেখানেই থেকে সকল কিছু ঠিকঠাক করে কাজ শুরু করলেন। নমিনেশনের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হল। ফর্ম ছাপিয়ে দেওয়া হল, তাতে প্রার্থী কোন পার্টির সদস্য তাও লিখা থাকবে এবং পারটিকে কপি দিতে হবে। শহীদ সাহেব টাকা পয়সার অভাব অনুভব করতে লাগলেন।
যারা নমিনেশন পাওয়ার জন্য দরখাস্ত করবেন তাদের একটা ফি জমা দিতে হবে। নমিনেশন না দিলেও ঐ টাকা ফেরত দেওয়া হবে না। যত লোক নমিনেশনের জন্য দরখাস্ত করেছিল তাতে প্রায় এক লক্ষ টাকার মত জমা পড়েছিল। শহীদ সাহেব নিজে কয়েকটা মাইক্রোফোন জোগাড় করে এনেছিলেন। আমাদের যানবাহন বলতে কিছুই ছিল না। শহীদ সাহেব একটা পুরানা জিপ কিনেছিলেন।
২৫৩
আওয়ামী লীগের প্রার্থীর অভাব ছিল না। প্রত্যেকটা নিরবাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী ছিল,যারা ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত নিজ নিজ এলাকায় কাজ করেছে। হক সাহেবের কৃষক শ্রমিক দলের প্রার্থীর অভাব থাকায় বিভিন্ন নিরবাচনী এলাকা থেকে যারাই ইলেকশন করতে আশা করে তারাই কৃষক শ্রমিক দলে নাম লিখিয়ে দরখাস্ত করেছিল/ কোনদিন রাজনীতি করে নাই, অথবা রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছিল অথবা মুসলিম লীগে দরখাস্ত করেছে,নমিনেশন না পেয়ে কৃষক শ্রমিক দলে নাম লিখিয়ে নমিনেশন পেয়েছে।
অনেক প্রার্থী—–যারা জেল খেটেছে মুসলীম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, তাদের নমিনেশন দেওয়া যায় নাই।যেমন চট্রগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজকে নমিনেশন দেওয়া যায় নাই। তার পরিবর্তে একজন ব্যবসায়ীকে নমিনেশন দেওয়া হয়েছিল। খন্দকার মোশতাক আহমদের মত জেলখাটা কর্মীকেও নমিনেশন দেওয়া হয় নাই। নোয়াখালীর আব্দুল জব্বার খদ্দর প্রথম থেকেই আওয়ামী লীগে কাজ করেছেন, তাকেও বাদ দিতে হয়েছিল। নেজামে ইসলাম দল কয়েকজন মাওলানা সাহেবের নাম নিয়ে এসেছে, তাঁরা দরখাস্তও করে নাই। তাদের সব কয়েকজনকে নমিনেশন দিতে হবে। এই দল একুশ দফায় দস্তখতও করে নাই।তবে এই দলের প্রতিনিধি একটা লিস্ট দাখিল করলেন,যাদের নমিনেশন দেওয়া যাবে না। কারন তাঁরা সকলেই নাকি কমিউনিস্ট। এরা কিছু আওয়ামী লীগের জেলখাটা সদস্য আর কিছু কিছু গনতান্ত্রিক দলের সদস্য। এর প্রতিবাদে আমি বললাম, ‘’আমারওএকটালিস্টআছে, তাদেরনমিনেশনদেওয়াহবে না, কারন এরা পাকিস্থানের বিরোধিতা করেছে।‘’
এদের দাবী এমন পর্যায়ে চলে গেল যে নিঃস্বার্থ কর্মী ও নেতাদের নমিনেশন না দিয়ে যারা মাত্র চার-পাঁচ মাস পূর্বে পর্যন্ত মুসলীম লীগ করেছে অথবা জীবনে রাজনীতি করে নাই,তাদেরি নমিনেশন দিতে হবে। মাঝে মাঝে হক সাহেবের কাছ থেকে ছোট্ট্র ছোট্ট্র চিঠিও এসে হাজির হয়। তাঁর চিঠিকে সম্মান না করে পারা যায় না। আবার কৃষক শ্রমিক পার্টি ও নেজামে ইসলামের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যরা সভা ছেড়ে উঠে চলে যায়, হক সাহেবের সাথে পরামর্শ করার কথা বলে। এইভাবে চলতে লাগল। মাওলানা ভাসানী সাহেবকে অনেক কষ্ট করে ঢাকায় আনলাম। তিনি এসেই আবার বাহিরে চলে যেতে চাইলেন। আমরা তাঁকে সব কথা বললাম।তিনি উত্তর দিলেন, ‘’ঐসমস্তলোকেরসাথেকিকরেকাজকরাযায়, আমিএরধারধারিনা।তোমাদেরযুক্রফ্রন্টমানিনা।আমিচললাম।‘’আমারসাথেখুবইকথাকাটাকাটিহল।তাঁকেবললাম, ‘’নমিনেশননিয়ে আলোচনার সময় অন্য দলের লোকেরা আলোচনা করতে চলে যায় হক সাহেবের কাছে, আর আমরা কোথায় যাই? শহীদ সাহেব তো চেয়ারম্যান, তিনি তো পক্ষ অবলম্বন করতে পারেন না। আপনি ঢাকায় থাকেন, আগামিকাল শহীদ সাহেবের সাথে আপনার আলোচনা হওয়া দরকার।‘’তিনি চুপ করে রইলেন। আমাকে তাড়াতাড়ি সভায় যেতে হবে। আতাউর রহমান সাহেবও চুপ করে থাকেন। আমাকেই সকল সময় তর্ক বিতর্ক করতে হয়।
২৫৪
(ছবি) পান্ডুলিপির একটি পৃষ্টার চিত্রালিপি……
২৫৫
প্রত্যেকটা প্রার্থীর খবরা খবর নিতে হয়। কফিলুদ্দিন চৌধুরী সাহব কৃষক শ্রমিক পার্টির সদস্য হলেও তাঁর দলের নেতাদের ব্যবহারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের ভাল প্রার্থী হলে তাঁকে সমরথন করতেন । তাই তাঁর উপরে ক্ষেপে গিয়েছে তাঁর দলের লোকেরা। আতাউর রহমান সাহেবও ক্ষেপে যেয়ে অনেক সময় বলতেন, ‘’এদেরসাথেকথাবলতেআমারঘৃনাকরে।‘’
মাওলানা সাহেব আবার ঢাকা ত্যাগ করলেন কাউকেও কিছু না বলে। আমি খবর পেয়ে রেলস্টেশনে তাহাঁর সাথে দেখা করতে পেরেছিলাম। ঢাকায় থাকার জন্য অনেক অনুরোধ করলাম, তিনি শুনলেন না। এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে যায় যায়, শুধু শহীদ সাহেবের ধৈর্য, সহনশীলতা ও বিচক্ষনতা যুক্তফ্রন্টকে রক্ষা করতে পেরেছিল।
*
তিন চারটা জেলায় তখনও নমিনেশন দেয়া হয় নাই। আমাকে ঢাকা ত্যাগ করতে হল, কারন আমার নমিনেশনের কাগজ দাখিল করতে হবে গোপালগঞ্জ ইলেকশন অফিসে। মাত্র একদিন সময় থাকতে রওনা করলাম। আমি না থাকার জন্য এই সমস্থ জেলায় আমার অনেক ত্যাগী সহকর্মীকে নমিনেশন দেওয়া হয় নাই। এম্নকি শহীদ সাহেবের অনুরোধও তাঁরা রাখেন নাই। মাওলানা ভাসানীর দরকারের সময় এই আত্নগোপনের মনোভাব কোনদিন পরিবর্তন হয় নাই। ভবিষ্যতে অনেক ঘটনা তাঁর প্রমান হয়েছে।
আমি গোপালগঞ্জ যেয়ে দেখি, মুসলিম লীগ মনোনীত প্রার্থী ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব ময়দানে সদলবলে নেমে পড়েছেন। তিনি নিজের জীবনেই বহু অর্থের মালিক হয়েছেন। লঞ্চ, স্পিডবোট, সাইকেল, মাইক্রোফোন কোনো কিছুরই তাঁর অভাব নাই। আমার একটা মাইক্রোফোন ছাড়া আর কিছুই নাই। গোপালগঞ্জ ও কোটালীপাড়া এই দুই থানা নিয়ে আমাদের নির্বাচনী এলাকা। রাস্তাঘাট নাই। যাতায়াতের খুবই অসুবিধা। আমার নির্বাচন চালাবার জন্য মাত্র দুইখানা সাইকেল ছিল। কর্মীরা যার যার নিজের সাইকেল ব্যবহার করত।আমার টাকা পয়সার অভাব ছিল। বেশি টাকা খরচ করার সামর্থ আমার ছিল না। আমার ফ্যামেলীর কয়েকখানা ভাল দেশী নৌকা ছিল তাই ব্যবহার করতে হল। ছাত্র ও যুবক কর্মীরা নিজেদের টাকা খরচ করে আমার জন্য কাজ করতে শুরু করল। কএকটা সভায় বক্তৃতা করার পর বুঝতে পারলাম, ওয়াহিদুজামান সাহেব শোচনীয় ভাবে পরাজয় বরণ করবেন। টাকায় কুলাবে না, জনগন আমার পক্ষে। আমি যে গ্রামেই যেতাম, জনসাধারন শুধু আমাকে ভোট দেয়ার ওয়াদা করতেন না, আমাকে বসিয়ে পানদানের পান এবং কিছু টাকা আমার সামনে নজরানা হিসাবে হাজির করত এবং না নিলে রাগ করত। তারা বলত, এ টাকা নির্বাচনের খরচ বাবদ দিচ্ছে।
আমার মনে আছে খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েকঘন্টা রাস্থায় দাঁড়িয়ে আছে শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, ‘’বাবাআমারএই
২৫৬
কুঁড়েঘরে তোমায় একটু খানি বসতে হবে।‘’আমিতাঁরহাতধরেইতাঁরবাড়িতেযাই।অনেকলোকআমারসাথে, আমাকেমাঠিতেএকটাপাটিবিছিয়েবসতেদিয়েএকবাটিদুধ , একটাপান ও চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, ‘’খাওবাবা, আরপয়সাকয়টাতুমিনেও, আমারতোকিছুইনাই।‘’আমারচোখেপানিএল/ আমিদুধএকটুমুখেনিয়ে।সেইপয়সারসাথেআরোওকিছুটাকাতাঁরহাতেদিয়েবললাম, ‘’তোমারদোয়াআমারজন্যযথেষ্ট, তোমারদোয়ারমূল্যটাকাদিয়েশোধকরাযায়না।;; টাকা সে নিল না , আমার মাথায় মুখে হাত দিয়ে বলল, গরিবের দোয়া তোমার জন্য আছে বাবা।‘’নিরবেআমারচক্ষুদিয়েদুইফোটাপানিগড়ীয়েপড়েছিল, যখনতাঁরবাড়িথেকেবেরিয়েআসি /সেদিনইআমিমনেমনেপ্রতিজ্ঞাকরেছিলাম, ‘’মানুষরেআমিধোঁকাদিতেপারবনা।‘এরকমআরওঅনেকঘটনাঘটেছিল। আমি পায়ে হেঁটেই এক ইউনিয়ন থেকে অন্য ইউনিয়নে যেতাম। আমাকে রাস্থায় রাস্তায় । গ্রামে গ্রামে দেরি করতে হত। গ্রামের মেয়েরা আমাকে দেখতে চায়। আমি ইলেকশনে নামার পূর্বেই জানতাম না, এ দেশের লোক আমাকে কত ভালোবাসে। আমার মনের একটা বিরাট পরিবর্তন এই সময় হয়েছিল।
জামান সাহেব ও মুসলিম লীগ যখন দেখতে পারলেন তাদের অবস্থা ভাল না, তখন এক দাবার ঘুটি চাললেন। অনেক বড় বড় আলেম, পীর ও মাওলানা সাহেবদের হাজির করলেন। গোপালগঞ্জে আমার নিজের ইউনিয়নে পূর্ব বাংলার এক বিখ্যাত আলেম মওলানা শামসুল হক সাহেব জন্মগ্রহন করেছেন। আমি তাঁকে ব্যক্তিগত ভাবে খুবই শ্রদ্ধা করতাম। তিনি ধ্রম সম্মন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন।আমার ধারণা ছিল, মওলানা সাহেব আমার বিরুদ্ধাচরন করবেন না। কিন্তু এর মধ্যে তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করলেন এবং আমার বিরুদ্ধে ইলেকশনে লেগে পড়লেন। ঐ অঞ্চলের মুসলমান জনসাধারন তাঁকে খুবই ভক্তি করত। মওলানা সাহেব ইউনিয়নের পর ইউনিয়নে স্পিডবোট নিয়ে ঘুরতে শুরু করলেন এবং এক ধর্ম সভা ডেকে ফতোয়া দিলেন আমার বিরুদ্ধে যে, ‘’আমাকেভোটদিলেইসলামথাকবেনা, ধর্মশেষহয়েযাবে।‘সাথেশরষিনারপীরসাহেবসকলেইআমারবিরুদ্ধেনেমেপড়লেনএবংযতরকমফতোয়াদেওয়াযায়তাহা দিতে কৃপনতা করলেন না। দুই চারজন ছাড়া প্রায় সকল মওলানা,মৌলভী সাহেবরা এবং তাদের তালবেলেমরা নেমে পড়ল। একদিকে টাকা, অন্যদিকে পীর সাহেওবরা, পীর সাহেবদের সমর্থকরা টাকার লোভে রাতের আরাম ও দিনের বিশ্রাম ত্যাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন আমাকে পরাজিত করার জন্য। কিছু সংখ্যক সরকারি কর্মচারীও এতে সক্রিয় অংশগ্রহন করল। ঢাকা থেকে পুলিশের প্রধানও গোপালগঞ্জে হাজির হয়ে পরিস্কারভাবে তাঁর করমচারীদের হুকুম দিলেন মুসলিম লীগকে সমর্থন করতে। ফরিদপুর জেলার ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট জনাব আলতাফ গওহয় সরকারের পক্ষে কার করতে রাজি না হওয়ায় সরকার তাঁকে বদলি করে আরেকজন কর্মচারী আনলেন। তিনি আমার এলাকায় যেয়ে নিজেই বক্তৃতা করতে শুরু করলেন এবং ইলেকশনের তিন দিন পূর্বে সেন্টারগুলি
২৫৭
এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে গেলেন,যেখানে জামান সাহেবের সুবিধা হতে পারে। আমার পক্ষে জনসাধারন,ছাত্র ও যুবকেরা কজা করতে শুরু করল নিঃস্বার্থভাবে। নির্বাচনের চার দিন পূর্বে শহীদ সাহেব সরকারি দলের ঐসব অপকীর্তির খবর পেয়ে হাজির হয়ে দুটি সভা করলেন। আর নির্বাচনের কয়েকদিন পূর্বে শামসুল হক মোক্তার সাহেব, রহমত জাঙ, শহীদুল ইসলাম ও ইমদাদকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। নির্বাচনের মাত্র তিন দিন পূর্বে আরও প্রায় পঞ্চাশজনের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট দেওয়া হয়। শামসুল হক মোক্তার সাহেবকে জনসাধারন ভালবাসত। তাঁর কর্মীরা খুব নামকরা ছিল। আরও অনেকে গ্রেফতার করার ষড়যন্ত্র আমার কানে আসলে তাদের আমি শহরে আসনে নিষেধ করে দিলাম। আমার নির্বাচনী এলাকা ছাড়া আশেপাশের দুই এলাকাতে আমাকে যেতে হয়েছিল— যেমন যশোরের আবদুল হাকিম সাহেবের নির্বাচনী এলাকায়, ইনি পরে স্পিকার হন; এবং আবদুল খালেকের এলাকায়,ইনি পরে কেন্দিয় মন্ত্রী হন।
নির্বাচনে দেখা গেল ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব প্রায় দশ হাজার ভোটে পরাজিত হয়েছেন। জনসাধাওন আমাকে শুধু ভোটই দেয় নাই, প্রায় পাঁচ হাজার টাকা নজরানা হিসাবে দিয়েছিল নির্বাচনে খরচ চালানোর জন্য। আমার ধারণা হয়েছিল,মানুষকে ভালবাসলে মানুষও ভালবাসে।যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন,তবে জনসাধারন আপনার জন্য জীবন দিতেও পারে। মওলানা শামসুল হক সাহেব পরে তাঁর ভুল বুঝতে পেরে সক্রিয় রাজনীতি হতে সরে পড়েছিলেন। এই নির্বাচনে মুসলীম লীগ শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়। নির্বাচনের কিছুদিন পূর্বে শহীদ সাহেব বিবৃতির মারফতে বলেছিলেন, ‘মুসলিমলীগনয়টিরবেশিসিটপেলেআমিআশ্চর্যহব।‘তিনশতেরমধ্যেমুসলিমলীগনয়টাআসনইপেয়েছিল।২৬
দুনিয়ার ইতিহাসে একটি ক্ষমতাসীন দলের এভাবে পরাজয়ের খবর কোনোদিন শোয়া যায় নাই। বাঙ্গালিরা রাজনীতির জ্ঞান রাখে এবং রাজনৈতিক চেতনাশীল। এবারও তারা তাঁর প্রমান দিল। ১৯৪৬ সালে পাকিস্থান ইস্যুর উপর সাধারণ নিরবাচনেও তারা টা প্রমান করেছিল। এবারের নির্বাচনে মুসলিম লীগের অনেক বড় বড় এবং হোমরা চোমরা নেতারা, এদের মধ্যে অনেকেই আবার কেন্দ্রীয় আইসভার সদস্য ছিলেন, যারা শুধু পরাজিতই হন নাই, তাঁদের জামানতের টাকাও বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। এমনকি পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী জনাব নুরুল আমিনও পরাজিত হন। এতে শাসকগোষ্টী,শোষকগোষ্টি এবং আমরারা অনেকেই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তবু আশা ছাড়েন নাই। তাঁরা চক্রান্তমূলক নতুন কর্মপন্থা গ্রহণ করতে চেষ্টা করতে লাগলেন—-বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্থানের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা—- যারা পূর্ব বাংলায় কারখানা ও ব্যবসা পেতে বসেছেন এবং যথেষ্ট টাকাও মুসলিম লীগকে প্রকাশ্যভাবে দিয়ে সাহায্য করেছেন তাঁরা ভয়ানক অসুবিধায় পড়ে গেলেন। তাঁরা জানেন, তাঁদের পিছনে দাড়াবার জন্য এখনও কেন্দ্রীয় সরকার মুসলীম লীগের হাতে আছে। যারা পরাজিত হলেন তাঁরা গনতান্ত্রিক পন্থায় বিশ্বাস কোনোদিন করতেন না, তাই
২৫৮
তাই জনগনের এই রায় মেনে নিলেন না। ষড়যন্ত্রের রাজনীতি আরম্ভ করলেন। পূর্ব বাংলা ছেড়ে সকলেই প্রায় করাচিতে আশ্রয় নিলেন। পশ্চিম পাকিস্থানের নেতারা, শিল্পপতিরা ও আমলারা এদের বিপর্যয়ে খুবই ব্যথা পেলেন, কারন এ রকম ‘সুবোধবালক’তাঁরাকিআরভবিষ্যতেপাবেন; যারাপূর্ব বাংলার সম্পদ পশ্চিম পাকিস্থানে দিয়ে দেবেন, একটু প্রতিবাদও করবেন না! শুধু একটা জিনিস তাঁরা পেলেন সন্তুষ্ট তাকেন, ‘মন্ত্রিত্ব’এবংক্ষমতারএকটুভাগ।কেন্দ্রেরক্ষমতাসীনদলজানেনপূর্বপাকিস্থানআওয়ামীলীগস্বায়ত্বশাসনেরজন্যজনমতসৃষ্টিকরেছে।পূর্বওপশ্চিম পাকিস্থানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন বেড়ে চলছে—চাকরি,ব্যবসা,বানিজ্য মিলিটারিতে বাঙ্গালিদের স্থান দেয়া হচ্ছে না—- এ সম্মন্ধে আওয়ামী লীগ সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে কতগুলি প্রচারপত্র ছাপিয়ে বিলি করেছে সমস্থ দেশে। সমস্থ পূর্ব বাংলায় গানের মারফতে গ্রাম্য লোক কবিরা প্রচারে নেমেছেন।
এই নির্বাচনে একটা জিনিস লক্ষ্য করা গেছে যে, জনগনকে ‘ইসলামওমুসলমানেরনামে’স্লোগানদিয়েধোঁকাদেয়াযায়না।ধর্মপ্রানমুসলমানরাতাঁদেরধর্মকেভালোবাসে,কিন্তুধর্মেরনামেধোঁকাদিয়েরাজনৈতিককার্যসিদ্ধিকরতেতারাদিবেনা এ ধারণা অনেকেরই হয়েছিল।জনসাধারন চায় শোষনহীন সমাজ ও অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি। মুসলিম লীগ নেতারা এসব বিষয়ে সুশটু পোগ্রাম জনগনের সামনে পেশ না করে বলে চলছে ‘পাকিস্থানধ্বংসহয়েযাবে,মুসলিমলীগপাকিস্থানকায়েমকরেছে, তাইমুসলমলীগপাকিস্থানেরমাতা, পাকিস্থানেরঅর্থমুসলিম লীগ ইত্যাদি’।আওয়ামীলীগওঅন্যান্যনেতারারাষ্ট্রদ্রোহী, হিন্দুদেরদালাল, পূর্ববাংলাওপশ্চিমবাংলাএককরতেচায়—- এরকমনানারকমেরস্লোগানদিতেআরম্ভকরেছিল।জনগনশহীদসোহরাওয়ারদীকেজানতযেতিনিএদেশেরমানুষকেভালবাসতেনএবংমাওলানাভাসানীওপাকিস্থানের জন্য সংরাম ক্রএছেন। আর আমরা যারা পাকিস্থান প্রতিষ্টার জন্য সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেছি তাও জনগনের জানা ছিল,তাই ধোঁকায় কাজ হল না।
একুশ দফা দাবী জনগনের সার্বিক কল্যানের জন্য পেশ করা হয়েছে। টা জনগন বুঝতে পেরেছে। কারন আওয়ামী লীগ ১৯৪৯ সাল থেকে বাংলাদেশে এর অনেকগুলো দাবি প্রচার করেছে। ইলেকশনের কিছুদিন পূর্বে এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গামা হয়েছিল। চন্দ্রঘোনার কর্ণফুলী কাগজের কারখানায় বাঙ্গালিরা প্রায় সকলেই শরমিক, আর অবাঙ্গালিরা বড় বড় কর্মচারী।তাঁদের ব্যবহারও ভাল ছিল না। মুসলিম লীগ নেতারা প্রচার করেছে,আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে অবাঙ্গালিদের পূর্ব বাংলায় থাকতে দেবে না।
আওয়ামী লীগ ও তাঁর কর্মীরা যে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃনা করে। আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক নেতা ও করমি আছেন যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে; এবং তারা জানে সমাজতন্তের পথই একমাত্র জনগনের মুক্তির পথ। ধনতন্ত্রবাদের মাধুওমে সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করতে পারে না। তাঁদের কাছে মুসলমান, হিন্দু,বাঙালি, অবাঙ্গালি সকলেই সমান।
২৫৯
শোষক শ্রেনীকে তারা পছন্দ করে না। পশ্চিম পাকিস্থানেও আওয়ামী লীগের বিরদুদ্ধে এ রকম অপ্রপ্রচার করা হয়েছে।
•
নির্বাচনের ফলাফল বের হওয়ার পর আমি ঢাকা চলে আসলাম। আমাকে রেলশটেশনের বিরাটভাবে অভ্যর্থনা করা হয়েছিল। শোভাযাত্রা করে আমাকে আওয়ামী লীগ অফিসে নিয়ে আসা হল। শহীদ সাহেব আমার জন্য চিন্তায় ছিলে। যদিও আমার গ্রামের বাড়িতে বয়সে আমাকে বলে এসেছিলেন ‘’তোমারচিন্তারকোনোকারননাই, আমিযাদেখলামতাতেতোমারজয়সুনিশ্চিত।‘’
তাড়াতাড়ি যুক্তফ্রন্টের এম এল এদের সভা ডাকা হল আওয়ামী লীগ অফিসে ঐ একই দিন সকালবেলা। নির্বাচনে জয় লাভ করার সাথে সাথে আমাদের কানে আসতে লাগল জনাব মোহাম্মদ আলী বগুড়া হক সাহেবের সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করছেন, পুরানা মুসলিম লীগারদের মারফতে—– যারা কিছুদিন পূর্বে হক সাহেবের দলে যোগদান করে এমএলএ হয়েছেন কৃষক শ্রমিক দলের নামে। আদতে তারা মনে প্রাণে মুসলিম লীগ । সকালবেলা আওয়ামী লীগ সদস্যদের সভা আর বিকালে বার লাইব্রেরি হলে সমস্থ দল মিলে যুক্তফ্রন্ট এমএলএদের সভা। আওয়ামী লীগের সভায় শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব ভাসানী সাহেব উপস্থিত ছিলেন। সভায় রংপুরের আওয়ামী লীগ নেতা খয়রাত হোসেন সাহেব প্রস্তাবের মারফতে বললেন, ‘’জনাবএকেফজলুলহকসাহেবকেনেতানির্বাচনকরারপূর্বেশহীদসাহেবওভাসানিসাহেবতাঁরসাথেপরামর্শকরেমন্ত্রীদেরলিস্টফয়সালাকরাউচিত।একবারতাঁকেযুক্তফ্রন্ট পালামেন্টারি দলে রনেতা করলে তাঁর দলবলের মধ্যে এমন সমস্ত পাকা খেয়লোয়াড় আছে, যারা চক্রান্তের খেলা শুরু করতে পারে। আর একজন ডেপুটি লিডার আমাদের দল থেকে করা উচিত, কারন আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ট দল যুক্তফ্রন্টের মধ্যে।‘’শহীদসাহেববললেন, ‘’তিনিনিশ্চইআমাদের দুইজনের সাথে পরামর্শ করবেন, মন্ত্রীদের নাম ঠিক করার পূর্বে। বৃদ্ধ মানুষ এখন তাঁকে আর আর বিরক্ত করা উচিত হবে না।‘’ভাসানীসাহেবওশহীদসাহেবকেসমর্থনকরলেন।আমিজনাবখয়রাতহোসেনেরসাথেএকমতছিলাম।কিন্তুএইদিনেআরজোরকরলামনা।আমিযখনআমারবাড়িটুঙ্গিপাড়া থেকে নির্বাচনের পরে ফিরে আসি, শহীদ সাহেব আমাকে একাকী ডেকে বললেন, ‘’তুমিমন্ত্রিত্বনেবেকিনা?’’আমিবললাম, ‘’আমিমন্ত্রিত্বচাইনা।পার্টিরঅনেককাজআছে, বহুপ্রার্থীআছেদেখেশুএতাঁদেরকরেনেন।‘’শহীদসাহেবআরকিছুইআমাকেবলেননাই।
ডাহাক বার লাইব্রেরি হলে যুক্তফ্রন্ট এম এলএদের সভা হল। শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব তাতে উপস্থিত ছিলেন। এই সভায় এ কে ফয়জুল হক সাহেওকে সর্বসম্মতিক্রমে নেতা করা হল। আর দ্বিতীয় প্রস্তাবে মুসলিম লীগ দলীয় কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য,
২৬০
যারা পুরানা প্রাদেশিক আইসভার মারফতে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং প্রাদেশিক নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন তাঁদের পদত্যাগ দাবি করা হল। হক সাহেব নেতা নির্বাচিত হওয়ার কিছু সময় পূর্বে বাংলার গভর্নর তাঁকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে আহ্বান করলেন। তিনি রাজি হয়ে এসে, শীগ্রই মন্ত্রিসভার নাম পেশ করবেন বলে বাড়িতে ফিরে গেলেন। সেইদিন সন্ধ্যার পরে শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতে গেলেন। আমিও সাথে ছিলাম। তিন নেতা আলোচনায় বসলেন,এক আলাদা ঘরে। বাইরে থেকে কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতাদের হাবভাব দেখে আমার খুব খারাপ লাগল। চারিদিকে একটা ষড়যন্ত্র চলছে বলে মনে হল। কিন্তু সময় পরে শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব বের হয়ে আসলেন এবং সোজা ইয়ার মোহাম্মদ খানের বাড়িতে পৌছালেন। আতাউর রহমান সাহেবও উপস্থিত হলেন। তারা আমাদের জানালেন, হক সাহেব এখন মাত্র চার পাঁচজন মন্ত্রী নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করবেন; কিছুদিন পরে আরও কিছু সংখ্যক মন্ত্রী নিবেন। এখন আবু হোসেন সরকার, সৈয়দ আজিজুল হক(নান্না মিয়া), আশরাফউদ্দিন চৌধুরী, আতাউর রহমান খান ও আবদুস সালাম খানকে নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করতে চান। আমাদের নেতারা তাঁকে অনুরোধ করে বলেছিলেন, পুরো টিম নিয়ে কাজ শুরু করা উচিত। জনগনের আশা আকাঙ্ক্ষা হল, যুক্তফ্রন্ট তাড়াতাড়ি দেশের জন্য কাজ শুরু করবেন। তাঁরা আরও আপত্তি করলেন, এখন নান্না মিয়াকে না নিয়ে পরে নিলেই ভাল হয়। আর যদি পুরা টিম নিয়ে মন্ত্রিত্ব গঠন করেন তবে তাঁকে এখনই নিতে আপত্তি নাই। তাঁরা বিশেষ করে জোর দিলেন পুরো টিম নিতে। হক সাহেব রাজি না হওয়াতে তাঁরা তাঁকে বলে এসেছেন, আওয়ামী লীগের কেউই এভাবে মন্ত্রিত্বে যেতে পারে না। আপনি আপনার দল নিয়ে মন্ত্রিত্ব গঠন করেন। আওয়ামী লীগ আপনার মন্ত্রিসভায়কে সমর্থন দিবে এবং যখন পুরা মন্ত্রিত্ব গঠন করবেন তখন আওয়ামী লীগ তাতে যোগদান করবে। আওয়ামী লীগের মধ্যে দলাদলি সৃষ্টির এক ষড়যন্ত্র হচ্ছে এটা বুঝতে আর নেতাদের বাকি রইল না।
হক সাহেব শঈদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবকে বলেছিলেন, ‘’আমিশেখমুজিবকেআমারমন্ত্রিত্বেনিবনা।’’তাঁরউত্তরেশহীদসাহেববলেছিলেন, ‘’আওয়ামীলীগেরকাকেনেওয়াহবেনাহবেসেটাতোআমিওভাসানীসাহেবঠিককরব; আপনিযখনবলছেননান্নামিয়াকেছাড়াপনার চলে না,তখন আমরাও তো বলতে পারি শেখ মুজিবকে ছাড়া আমাদের চলে না। সে আমাদের দলের সেক্রেটারি। মুজিব তো মন্ত্রিত্বের প্রার্থী না। এ সকল করা বললে পার্টি থেকে বলতে পারে।‘’
আমি শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেওকে বললাম, ‘’আমাকেনিয়েগোলমালকরারপ্রয়োজননাই।আমিমন্ত্রীহতে চাই না। আমাকে বাদ দিলে যদি পুরা মন্ত্রিত্ব গঠন করতে রাজি হয়, আপনারা তাই করেন।‘’আমরাবয়সেআলাপকরেছি, প্রায়একঘন্টাপরেহকসাহেবখবরপাঠিয়েছেন, তিনিছয়জনকেনিয়েমন্ত্রিত্বগঠনকরতেচানএবংমুজিবকেওনিতেরাজিআছেন।ভাসানীসাহেববলেদিলেন, ‘’আওয়ামীলীগযখন যোগদান করবে, আওয়ামী লীগের সব কয়জন একসাথে যোগদান করবেন। এভাবে ভাঙ্গা ভাঙ্গাভাবে
২৬১
যোগদান করবে না।‘’পরদিনহকসাহেবশপতগ্রহণকরলেন।আবুহোসেনসরকার, সৈয়দআজিজুলহকনান্নামিয়া(কেএসপি) এবংআশরাফউদ্দিনচৌধুরী(নেজামেইসলাম) শপতগ্রহণকরলেন।লাটভবনেরসামনে এক বিক্ষোভ মিছিল হল, ‘স্বজনপীতিচলবেনা’, ‘কোটারিচলবেনা,’এমনিনানারকমেরস্লোগান।যদিএকসাথেপুরামন্ত্রিসভাশপথগ্রহণকরতটাহলেলক্ষলক্ষলোকঅভিনন্দনজানাত।মনেহল, একদিনেরমধ্যেগনজাগরননষ্টহয়েগেছে।জনসাধারনঝিমিয়েপড়েছে।হকসাহেবেরদলবলবলতে শুরু করল, ‘’এসমস্তশেখমুজিবেরকাজ।‘’সত্যকথাবলতেকি, আমিকিছুইজানতামনা।সবখবরেরকাগজেপড়েদেখেছি জনগন ক্ষেপে যাচ্ছিল এবং যারা সংবর্ধনা দিতে গিয়েছিল তারাই উলটা স্লোগান দিয়েছিল নান্না মিয়াকে মন্ত্রী করার জন্য। কারন,তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন না। তাঁর একমাত্র পরিচয় লোকে জানত, ‘হকসাহেবেরভাগিয়েয়’।লোকহিসাবেসৈয়দআজিজুলহকঅমায়িকওভদ্র।আমারসাথেতাঁরব্যক্তিগতসম্মন্দধমধুরছিল।কলকাতাথেকেআমিতাঁকেজানতাম।কোনোদিনআমিতাঁকেরাগহতেদেখিনাই।যাইহোক, হকসাহেবএইসমস্ত কাজ নিজে কিছুই করেন নাই। বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। অন্যের কথা শুনতেন, বিশেষ করে লীগ থেকে বিতাড়িত দলের,যার নেতৃত্ব করতেন ইউসুফ আলী চৌধুরী(মোহন মিয়া) সাহেব। তিনি নিজে মত্রি হতে চান। তিনি জীবনভর মন্ত্রিত্ব ভাংছেন আর গড়েছেন। তাঁর একটা বিশেষ অসুবিধা হল তিনি লেখাপড়া ভাল জানতেন না, তাই কেউওই তাঁর নাম বলেন না। কর্মী হিসাবে তাঁর মত কর্মী এদেশে খুব কম জন্মগ্রহন করেছেন। রাতদিন সমানভাবে পরিশ্রম করতে পারতেম। তাঁকে অনেকে Evil genius বলে থাকেন। যদি ভাল কাজে তাঁর বুদ্ধি ও করমশক্তি ব্যবহার করতেন তাহলে সত্যিকারের দেশের কাজ করতে পারতেন।
*
আমরা মন্ত্রিসভায় যোগদান না করে পার্টি গঠনে কাজে মন দিলাম। শহীদ সাহেব করাচিতে ফিরে গেলেন। তাঁর স্বাস্থ্যও খারাপ হয়ে পড়েছে অত্যাধিক পরিশ্রমে। হক সাহেব করাচিতে বেড়াতে গেলে কেন্দ্রীয় গনপরিষদের পূর্ব বাংলার সদস্যরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘’তাঁরাপদত্যাগকরবেনকিনা,’’তিনিউত্তরে বলেছিলেন, তিনি নিজেই পদত্যাগ করেন নাই, আর তাঁদের করতে হবে কেন?’’যদিওযুক্তফ্রন্টপার্লামেন্টারিপার্টিরপ্রথমসভায়দ্বীতিয়প্রস্তাবেতাঁদেরপদত্যাগকরতেবলাহয়েছিল।করাচিতেমোহাম্মদআলীরনেতৃত্বেমুসলিমলীগনেতারাতাঁরসাথেযোগাযোগকরেতাঁকেজানিয়েদিল, তাঁদের রাগ আওয়ামী লীগারদের বিরুদ্ধে; হক সাহেবকে তাঁরা সমর্থন করবেন এবং যাতে তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারেন তার চেষ্টা করবেন। শুধু আওয়ামী লীগকে যেন দূরে সরিয়ে রাখেন। গোপনে গোপনে আওয়ামী লীগ থেকে সদস্য ভাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছিল, কিন্তু উপায় ছিল না। কেউই দলত্যাগ করতে রাজি না। যাদের মনের মধ্যে মন্ত্রিত্বের
২৬২
খায়েশ ছিল তারাও জনমতের ভয়ে পিছিয়ে পড়েছিল। হক সাহেবকে তার দলবল ধোঁকা দিয়েই চলছে। মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় সরকার দূরবলতা পেলেই যে ঝাঁপিয়ে পড়বে এ সম্মন্ধে সন্দেহ ছিল না, কারন তাঁরা জানত আওয়ামী লীগের সমর্থন ছাড়া সরকার চলতে পারে না। সংসদ সদস্যদের মধ্যের আওয়ামী লীগ সংখ্যাগুরু। সকল দল মিলেও আওয়ামী লীগের সমান হতে পারবে না।
করাচি হতে ফিরবার পথে হক সাহেব কলকাতায় দু একদিনের জন্য ছিলে, সেখানে তার বক্তৃতা বলে কথিত কয়েকটা সংবাদ সংবাদপত্রে ফলাও করে ছাপানো হয়েছিল।২৭ সুযোগ বুঝে মোহাম্মদ আলী বগুড়া ও তাঁর দলবলের বিরুদ্ধাচরন করলেন না। তাঁরা জানিয়ে দিলেন যে, তাঁরা হক মন্ত্রীসভাকে সমর্থন করবেন। হক সাহেব এই অবস্থায় আওয়ামী লীগারদের সাথে আলোচনা করে পুরো মন্ত্রিসভা গঠন করতে আগ্রহ প্রকাশ করতে লাগলেন। এই সময় হক সাহেবের আর এক ভাগিনেয় জনাব মাহবুব মোরশেদ বার এট ল (পরবর্তীকালে পূর্ব বাংলার হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হন) হক সাহেবের সাথে পরামর্শ করে আতাউর রহমান খান ও মানিক মিয়াকে অনুরোধ করলেন যাতে আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসভায় যোগদান করে। তাঁকে সাহায্য করেছিলেন ঢাকার কফিলুদ্দিন চৌধুরী সাহেব ও মির্জা আবদুল কাদের সর্দার। শহীদ সাহেব তখন করাচিতে ভীষনভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তাঁর পক্ষে ঢাকায় আসা সম্পূর্ণ অসম্ভব।
আমি ও মাওলানা সাহেব জনসভা করতে মফস্বলে বের হয়ে গেছি। আমাদের পোগ্রাম জানা ছিল অফিসের। হক সাহেব আতাউর রহমান খান ও মানিক ভাইকে বলেছিলেন যে, আমাকে মন্ত্রী করতে চান। মাওলানা সাহেব ও আমি টাঙ্গাইলে এক কর্মী সম্মেলনে বক্তৃতা করেছিলাম। এই সময়ে টাইঙ্গাইলের এসডিও একটা রেডিওগ্রাম নিয়ে সভায় হাজির হলে। আমাকে জানালেন, প্রধানমন্ত্রী আমাকে ঢাকায় যেতে অনুরুধ করে রেডিওগ্রাম পাঠিয়েছেন। আমি মওলানা সাহেবের সাথে পরামর্শ করলাম। মওলানা সাহেব বললেন, ‘’দরকারহলেতোমাকেমন্ত্রিসভায়যোগদানকরতেহবে।তবেশহীদসাহেবেরসাথেপরামর্শকরেনিও—–এসময়এইভাবেমন্তিত্বেযাওয়াউচিতহবেকিনা? বোধহয়হকসাহেবেরদলকোনোমুশকিলেপড়েছেন, তাইডাকপড়েছে।‘’
আমি সন্ধ্যার দিকে ঢাকায় ফিরে এলাম। বাসায় যেয়ে দেখি রেনু ছেলে মেয়ে নিয়ে গতকাল ঢাকায় এসেছে। সে এখন ঢাকায়ই থাকবে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বন্দোবস্ত হওয়া দরকার। আমি খুশিই হলাম, আমি তো মুসাফিরের মত থাকি। সে এসে সকল কিছু ঠিকঠাক করতে শুরু করেছে। আমার অবস্থা জেন, তাই বাড়ি থেকে কিছু টাকাও নিয়ে এসেছে। আমি হক সাহীর সাথে দেখা করতে গেলে তিনিবললেন, ‘’তোকেমন্ত্রীহতেহবে। আমি তোকে চাই, তুই রাগ করে ‘না’বলিসনা। তোরা সকলে বসে ঠিক কর, কাকে কাকে নেওয়া যেতে পারে ।‘’আমিতাঁকেবললাম, ‘’আমাদেরতোআপত্তিনেই।
২৬৩
শহীদ সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাঁর অনুমতি দরকার। তাঁর অনুমতি দরকার। আর মওলানা সাহেব উপস্থিত নাই, তাঁর সাথেও আলোচনা করতে হবে।‘’আমিইত্তেফাকঅফিসেমানিকভাইওআতাউররহমানখানসাহেবকেনিয়েবসলাম। একটু পরে মোরশেদ সাহেব, কাদের সর্দার সাহেব, কফিলুদ্দিন চৌধুরী সাহেব আসলেন। আলোচনা করে শহীদ সাহেবের সাথে ফোনে আলার করতে চেষ্টা করলাম, তিনি কথা বলতে পারলেন না। তাঁর জামাতা আহমেদ সোলায়মান কথা বললেন, তাঁর মারফতে তিনি জানিয়ে দলেন তাঁর কোনো আপত্তি নাই।
আমি আপত্তি করলাম, মওলানা সাহেবেরও মতামত প্রয়োজন, কারন অনেক পানি এর মধ্যে ঘোলা করা হয়েছে। শহীদ সাহেব, ভাসানী সাহেব যদিও কয়েকজনের নাম পূর্বেই ঠিক করে রেখেছিলেন, তবু আবারও আলোচনা করে মতামত নেওয়া উচিত। এদিকে কৃষক শ্রমিক দল কফিলুদ্দিন চৌধুরী সাহেবকে তাঁদের পার্টি থেকে মন্ত্রিত্ব দিতে রাজি নন। আমরা জানিয়ে দলাম, দরকার হয় তিনি আমাদের দলের পক্ষ থেকে মন্ত্রী হবেন। সত্য কথা বলার জন্য তাঁকে আমরা শাস্তি পেতে দিতে রাজি নয়ই। রাত এগারোটায় হক সাহেবের সাথে পরামর্শ করে দুইখানা জিপগাড়ি নিয়ে আতাউর রহমান সাহেব, মোরশেদ সাহেব, কফিলুদ্দিন চৌধুরো সাহবে, আবদুল কাদের সর্দার ও আমি টাঙ্গাইলের পথে রওয়ানা করলাম। রাস্তা খুওই খারাপ, তখনকার দিনে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল পৌছাতে ছয় ঘন্টা সময় লাগত। চারটা খেয়া পার হতে হত। আমরা খুব ভোরে টাঙ্গাইল পৌছালাম। মওলানা সাহেব আওয়ামী লীগ অফিসের দোতলায় আছেন। আমরা তাঁর সাথে পরামর্শ করলাম। তিনি খুব ক্ষেপে গিয়েছিলেন। পরে মোরশেদ সাহেবের ওকালতিতে তিনি রাজি হলেন। আতাউর রহমান সাহেব তাঁকে নামগুলি দেখালেন। আতাউর রহমান খান,আবুল মনসুর আহমদ, আবদুস সালাম খান, হাশিম উদ্দিন আহমদ ও আমি। কফিলুদ্দিন চৌধুরী সাহেব সম্মন্ধে তাঁরা যখন আপত্তি করছে তখন তিনিও আওয়ামী লীগের পক্ষ হতে মন্ত্রী হবেন। হক সাহেব ছাড়া মোটামোটি বারজন মন্ত্রী হবে, পরে দেখা গেল, আরও কয়েকজন বেড়ে গেল রাতারাতি,
*
১৯৫৪ সালের মে মাস। আমরা সকলে শপথ নিতে সকাল নয়টায় লাট ভবনে উপস্থিত হলাম। আমাদের মন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়া শেষ হল, ঠিক সেই সময় খবর এল আদমজী জুট মিলে বাঙালি ও অবাঙ্গালি শ্রমিকদের মধ্যে ভীষন দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু হয়েছে। ভোররাত থেকে সৈয়দ আজিজুল হক সেখানে উপস্থিত আছেন। রাতেই ইপিআর ফোরস ও পুলিশ বাহিনী সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে। ঢাকার দু একজন বড় সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশের করমচারীরাও উপস্থিত আছেন। আমরা যখন শপত নিচ্ছি ঠিক সেই মুহূর্তে দাঙ্গা শুরু হওয়ার কারন কি? বুঝতে বাকি রইল না, এ এক অশুভ লক্ষণ! হক সাহেব আমাদের নিয়ে সোজা র্বয়ানা করলেন আদমজী জুট মিলে। তখন নারায়ণগঞ্জ হয়ে
২৬৪
লঞ্চে যেতে হত। সোজা রাস্তা হয়েছে, তবে গাড়ি তখনও ভাল্ভাবে চলতে পারে না। ট্রাক ও জিপ কষ্ট করে যেতে পারে। সকলেই রওনা হয়ে গেছেন। আমাকে লাটভবনের সামনে জনতা ঘিরে ফেলল এবং আমাকে নিয়ে শোভাযাত্রা তাঁরা করবে বলে ঠিক করেছে। তাঁদের বুঝিয়ে বিদায় নিতে আধ ঘন্টার মত দেরি হয়ে গেল।
নারায়ণগঞ্জ যেয়ে শুনলাম, হক সাহেব আমার জন্য অপেক্ষা করে ঢাকায় চলে গেছেন। একটা লঞ্চ রেখে গেছেন। আমি পৌছালাম এবং সাথে সাথে যেখানে দাঙ্গা তখনও চলছিল সেখানে উপস্থিত হলাম। আমাকে একটা পুলিশের জিপে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দাঙ্গা তখন অল্প অল্প চলছিল। যেদিকে যাই দেখি রাস্থায় রাস্তায় বস্তিতে বত্রিতে মরা মানুষেড় লাশ পড়ে আছে। অনেকগুলি আহত লোক চিৎকার করছে, সাহায্য করার কেউ নাই। ইপিআর পাহারা দিতেছে, বাঙালি ও অবাঙ্গালিদের আলাদা আলাদা করে দিয়েছে। গ্রাম থেকে খবর পেয়ে হাজার হাজার বাঙালি এগিয়ে আসছে। অবাঙ্গালিদের ট্রাকে করে মিলের বাহিরে থেকে মিলের ভিতরে নিতেছে। আমার বড় অসহায় মনে হল। আমার সাথে মাত্র দুজন আর্মড পুলিশ। এই সময় আরও কয়েকজন পুলিশের সাথে আমার দেখা হল। তাঁদের কাছে আসতে হুকুম দিলাম। এক গাছ তলায় আমি আস্তানা পাতলাম। মিলের চারটা ট্রাক আছে, একটাকে পাওয়া যাচ্ছে না । কিছু সংখ্যক লোক পাওয়া জ্ঞেল, তাঁদের সাহায্যে যারা মরে গেছে তাঁদের রেখে আহত লোক গুলিকে এক জায়গায় করে পানি দিতে শুরু করলাম। আমার দেখাদেখি কয়েকজন করমচারীও কাজে হাত দল। এই সময় মোহন মিয়া সাহেব এসে উপস্থিত হলেন। আমার মনে বল এল। তিনটা টাক হাজির করা হল। ড্রাইভারিরা ভাগতে চেষ্টা করছিল। আমি হুকুম দিলাম, ভাগতে চেষ্টা করলেই গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দেব। আমার মেজাজ দেখে তারা ভয় পেয়ে গেল। ঢায়াক টেলিফোন করা হয়েছে, এম্বুলেন্স পাঠাবার জন্য। মোহন মিয়া ও আমি সকাল এগারটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় তিনশতের মত আহত লোককে হাসপাতালে পাঠাতে পেরেছিলাম। বিভিন্ন জায়গা থেকে যে সমস্ত বাঙালি জনসাধারন জমা হচ্ছিল মিল আক্রমণ করার জন্য তাঁদের কাছে গিয়ে আমি বক্তৃতা করে তাঁদের শান্ত করলাম। তারা আমার কথা শুনল। যদি তারা সঠিক খবর পেত তাহা হলে আমার কথা শুনত কি না সন্দেহ ছিল। সন্ধ্যার একটু পূর্বে আমি সমস্ত এলাকা ঘুরে মৃত লাশের হিসাব করলাম একটা একটা করে গননা করে, তাতে পাচশতের উপর লাশ আমি স্বচক্ষে দেখলাম। আরও শ’খানেকপুকুরেরমধ্যেআছে, তাতেসন্দেহনাই।
সামান্য একটা ঘটনা নিয়ে এই দাঙ্গা শুরু হয়। তিনদিন পূর্বে এক অবাঙ্গালি দারোয়ান্নের সাথে এক বাঙালি শ্রমিকের কথা কাটাকাটি ও মারামারি হয়। তাতে বাঙালি শ্রমিকের এক আঘাতে হটাৎ দারোয়ানটা মারা যায়। এই নিয়ে উত্তেজনা এবং ষড়যন্ত্র শুরু হয়। দারোয়ানরা সবাই অবাঙ্গালি। আর কিছু সংখ্যক শ্রমিকও আছে অবাঙ্গালি। এই ঘটনা নিয়ে বেশ মন কষাকষি শুরু হয়। মিল কর্তৃপক্ষ অবাঙ্গালিদের উসকানি দিতে থাকে। মিল অফিসে কালো পতাকা ওড়াতে অনুমতি দেয়। মিলে কাজ বন্ধ করে দিয়ে বাঙ্গালিদের বেতন নেবার দিন ঘোষণা
২৬৫
করে বলা হয়, বেতন নিতে মিলের ভিতরে আসতে। যখন তারা বেতন নিতে ভিতরে আসে তখন চারদিক থেকে বন্দকধারী দারোয়া ও অবাঙ্গালিরা তাঁদের আক্রমণ করে। এই আকস্মিক আক্রমণের জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। হটাৎ আক্রান্ত হয়ে বহু লোক মারা যায়, পরে আবার বাঙ্গালিরা যারা বাইরে ছিল, তারা অবাঙ্গালিদের আক্রমণ করে এবং বহু লোককে হতায় করে। নতুন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা যে সময় শপত নিচ্ছে সেই সময় বেতন দেবার সময় ঘোষণা করার অর্থ কি? ইপিআর উপস্থিত থাকা সত্বেক একটা গুলি করা হয় নাই। ফলে দাঙ্গা করে পাচশত লোকের উপরে মারা যায় । পুলিশ কর্মচারীরা পূর্বেই খবর পেয়েছিল্ম তবু কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাই? মন্ত্রী সৈয়দ আজিজুল হক সাহেবকে মিষ্টি কথা বলে মিল অফিসে বসুয়ে রেখেছে। দাঙ্গা যে মিলের অন্যদিকে শুরু হয়েছে, সে খবর তাঁকে দেওয়া হয় নাই। হক সাহেব ও অন্যান্য মন্ত্রীরা ঢাকায় চলে এসেছেন, আমি ও মোহন মিয়া উপশ্তিত আছি রাত নয়টা পর্যন্ত/ জনাব মাদানী তখন ঢাকার কমিশনার এবং হাফেজ মোহাম্মদ ইসহাক সিএসপি তিখন চিফ সেক্রেটারি।
আমি যখন মাদানী সাহেবকে বললাম, পঞ্চাশ জন হতে পারে। আমি তাঁকে বললাম, একটা একটা করে গননা করেছি, নিজে গিয়ে দেখে আসুন, পরে মাদানী সাহেব স্বীকার করেছিলেন। রাত নয়টায় আমাকে ও মোহন মিয়াকে জানান হল, মিল এরিয়া মিলিটারিদের হাতে দিয়ে দেয়া হয়েছে। জনাব শামসুদ্দোহা তিখন পুলিশের আইজি। আমাকে এসে বললেন,’’স্যার, সর্বনাশ হয়ে গেছে, মিলিটারিরা সকলে অবাঙ্গালি।‘’আমিহেসেদিয়েবললাম, ‘’সর্বনাশেরকিআরকিছুবাকিআছে। আপনি যখন পুলিশ ও ইপিআর নিয়ে শান্ততি শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারলেন না, তখন আর মিলিটারির হাতে না দিয়ে ইপায় কি?’’তখনইপিআর(ইস্টপাকিস্থানরাইফেলস) প্রাদেশিকগভরমেন্টেরঅধীনেছিল। ঢাকায় যেয়ে দেখি কি হয়েছে! চিফ মিনিস্টার নিশ্চই মত দিয়েছেন। আমরা সোজা চিফ মিনিস্টারের বাড়িতে পৌছালাম। যেয়ে শুনতে পারলাম, আমাকে কেন দাঙ্গা এরিয়ায় রেখে সকলে চলে এসেছে। আমি তাঁর কাছে গেলে তিনি আমাকে খুব আদর করলেন।আমাকে বললেন, ‘’ক্যাবিনেটমিটিংশুরুহওয়ারপূর্বেদেখলাম, মন্ত্রীদেরমধ্যেদু’একজঙ্কেএরমধ্যেহাতকরে নিয়েছেন দোহা সাহবে।। আবদুল লতিফ বিশ্বাস সাহেব মিলিটারিকে কেন ভার দেওয়া হয়েছে তাই নিয়ে চিৎকার করছেন। হক সাহেব আসলেন। সভা শুরু হওয়ার পূর্বেই চিফ সেক্রেটারি ইসহাক সাহেবকে কড়া কথা বলতে শোনা গেল। আমি প্রতিবাদ করলাম এবং বললাম, ও কথা পরে হবে। পূর্বে যারা আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারে নাই এবং এতগুলি লোকের মৃত্যুর কারন তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবহস্থা গ্রহণ করা হোক। এরপর ক্যাবিনেট আলোচনা শুরু হল। অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়, সে কথা আমার পক্ষে বলা উচিত না, কারন ক্যাবিনেটে মিটিংয়ের খবর বাইরে বলা উচিত না।
২৬৬
মিটিং শেষ হবার পর যখন বাইরে এলাম, তখন রাত প্রায় একটা। দেখি সোহরাওয়ারদী সাহেবের ভক্ত কলকাতার পুরানা মুসলিম লীগ কর্মী রজব আলী শেঠ ও আরও অনেক অবাঙালি নেতা দাঁড়িয়ে আছে। তাঁরা আমাকে বললেন, এখনই ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বের হতে। খবর রটে গেছে যে বাঙালিদের অবাঙালিরা হত্যা করেছে। যে কোনো সময় অবাঙালিদের উপর আক্রমণ হতে পারে। তাড়াতাড়ি রজব আলী শেঠ ও আরও কয়েকজনকে নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভিড় জমে আছে তখন পর্যন্ত। আমি গাড়ি থেকে নেমে বক্তৃতা করে সকলকে বুঝাতে লাগলাম এবং অনেকটা শান্ত করতে সক্ষম হলাম। রাত চার ঘটিকায় বাড়িতে পৌছালাম। শপথ নেওয়ার পরে পাঁচ মিনিটের জন্য বাড়িতে আসতে পারি নাই। আর দিনভর কিছু পেটেও পড়ে নাই। দেখি রেণু চুপটি করে না খেয়ে বসে আছে, আমার জন্য।
এই দাঙ্গা যে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য এবং দুনিয়াকে নতুন সরকারের অদক্ষতা দেখাবার জন্য বিরাট এক ষড়যন্ত্রের অংশ সে সম্বন্ধে আমার মনে কোনো সন্দেহ নাই। কয়েকদিন পূর্বে এই ষড়যন্ত্র করাচি থেকে করা হয়েছিল এবং এর সাথে একজন সরকারি কর্মচারী এবং মিলের কোন কোন কর্মচারী প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। যুগ যুগ ধরে পুঁজিপতিরা তাদের শ্রেণী স্বার্থে এবং রাজনৈতিক কারণে গরিব শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গাহাঙ্গামা, মারামারি সৃষ্টি করে চলেছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আদমজী মিলের মালিক গুল মোহাম্মদ আদমজী এসব জানতেন কি না সন্দেহ!
কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকার মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে যে সুযোগ খুঁজতে ছিল এই দাঙ্গায় তা সৃষ্টি করতে সক্ষম হল। মোহাম্মদ আলী মুসলিম লীগ ও পশ্চিমা শিল্পপতিদের যোগসাজশে যে যুক্তফ্রন্টকে ভাঙতে চেষ্টা করছিল আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভায় যোগদান করায় তা সফল হল না। তাই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ও তাদের দালালদের সাহায্যে চেষ্টা করে হতাশ হয়ে পরে অন্য পন্থা অবলম্বন করতে লাগল। এ সুযোগ সৃষ্টি করতে পারত না, যদি প্রথম দিনই যুক্তফ্রন্ট পূরনাঙ্গো মন্ত্রিসভা গঠন করে শাসনব্যবস্থাকে কন্ট্রোল করতে চেষ্টা করত।
যুক্তফ্রন্ট ইলেকশনে জয়লাভ করার পরে বড় বড় সরকারি আমলাদের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার হয়েছিল। অনেকে প্রত্যক্ষভাবে মুসলিম লীগের পক্ষে প্রচার করেছিল। আওয়ামী লীগ প্রথমে মন্ত্রিসভায় যোগদান না করার তাদের প্রাণে পানি এসেছিল। যোগদান করার পরে তাঁরা হতাশ হয়ে পড়ল এবং ষড়যন্ত্রে যোগদান করল। তবে হাফিজ মোহাম্মদ ইসহাক, চিফ সেক্রেটারি এই পরিবর্তনকে আনন্দের সাথে গ্রহণ করেছিলেন।
পরের দিন আবার আমি আদমজী জুটমিলে যাই এবং যাতে শ্রমিকদের খাবার ও থাকার কোন কষ্ট না হয় তার দিকে নজর দিতে সরকারি কর্মচারীদের অনুরোধ করি। সেক্রেটারিয়েটে যেয়ে চিফ সেক্রেটারিকে ডেকে তাঁর সঙ্গে আলাপ করলাম। ঐদিকে কাকে কোন মন্ত্রণালয় দেওয়া হবে তাই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সেখানেও ষড়যন্ত্র আরম্ভ হয়েছে। আওয়ামী লীগারদের যেন ভাল দপ্তর দেওয়া না হয় সে চেষ্টা চলছে। এক মহাবিপদে পড়া গেল। মোহন
২৬৭
মিয়া সাহেবই হক সাহেবের সাথে পরামর্শ করে উলটাপালটা করতে লাগলেন। আমি হক সাহেবকে বললাম, “এ সমস্ত ভাল লাগে না, দরকার হয় মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে চলে যাব”।
পরের দিন দফতর ভাগ করা হল। আমাকে কো-অপারেটিভ ও এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট দফতর দেওয়া হল। এগ্রিকালচার আবার আলাদা করে অন্যকে দিল। জনাব সোবহান সিএসপি, দপ্তর ভাগ বাটোয়ারা করতে মোহন মিয়াকে পরামর্শ দিতেছিলেন। আমি তাঁকে ডেকে বললাম, “আপনি আমাকে জানেন না, বেশি ষড়যন্ত্র করবেন না”। আমি হক সাহেবের কাছে আবার হাজির হয়ে বললাম, “নানা, ব্যাপার কি ? এ সমস্ত কি হচ্ছে, আমরা তো মন্ত্রী হতে চাই নাই আমাদের ভিতরে এসে এ সমস্ত ষড়যন্ত্র চলছে কেন?”তিনি আমাকে ডেকে বললেন, “করবার দে, আমার পোর্টফলিও তোকে দিয়ে দেব, তুই রাগ করিস না, পরে সব ঠিক করে দেব”। বৃদ্ধলোক, তাঁকে আর কি বলব, তিনি আমাকে স্নেহ করতে শুরু করেছেন। দরকার না হলেও ডেকে পাঠাতেন। তিনি খবরের কাগজের প্রতিনিধিদের বলেছেন, “আমি বুড়া আর মুজিব গুণ্ডা, তাই ওর আমি নানা ও আমার নাতি”। আমি সকলের চেয়ে বয়সে ছোট। আর হক সাহেব সকলের চেয়ে বয়েসে বড়। তিনি আমাকে যে কাজই করতে বলতেন, আমি করতে লাগলাম। তাঁর মনটা উদার ছিল, যে কারণে তাঁকে আমি ভক্তি করতে শুরু করলাম। ষড়যন্ত্রকারীরা যখন তাঁর কাছে না থাকত তখন তিনি উদার ও অমায়িক। খুব বেশি বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, তাই এদের উপর তাঁর নির্ভর করতে হত। কিন্ত যেভাবে তিনি আমাকে স্নেহ করতে আরম্ভ করেছিলেন আমার বিশ্বাস হয়েছিল এদের হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করা যাবে। আমি অফিসে যেয়ে ঐ ডিপার্টমেন্ট কি বুঝতে চেষ্টা করলাম, কারণ ডিপার্টমেন্ট সম্বন্ধে আমার বিশেষ কোনো ধারণা ছিল না। এই সময় মন্ত্রীরা সরকারি বাড়িতে উঠে এল, আমিও ঢাকার মিন্টো রোডে সরকারি ভবনে ছেলেমেয়ে নিয়ে উঠলাম।
দু’একদিন পরই হক সাহেব আমাকে বললেন, “করাচি থেকে খবর এসেছে, আমাকে যেতে হবে। তুই ও আতাউর রহমান আমার সাথে চল। নান্না, মোহন মিয়া ও আশরাফউদ্দিন চৌধুরীও যাবে, বেটাদের হাভভাব ভাল না”। আমি প্রস্তুত ছিলাম, কারণ আমাকে যেতেই হত। শহীদ সাহেব অসুস্থ হয়ে আছেন, তাঁকে দেখতে।
আমরা করাচি পৌছালাম। প্রথমেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সাথে আমাদের পূর্ব বাংলার সমস্যা নিয়ে আলোচনা হল। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে আমাদের কি কি সাহায্যের প্রয়োজন তাও জানান হল। পশ্চিম পাকিস্তানে আমাদের বিরুদ্ধে ভীষণভাবে মিথ্যা প্রচার চালানো হয়েছে। যুক্তফ্রন্ট সরকারই নাকি এই দাঙ্গা সৃষ্টি করেছে। একথা কেউ কোনোদিন শুনেছে কি না আমার জানা নাই যে, সরকার নিজেই দাঙ্গা করে বদনাম নিবে? দাঙ্গা বাধিয়েছে যারা পরাজিত হয়েছে তারা। করাচি থেকে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে দুনিয়ার কেছে হেয় করতে
২৬৮
এই দাঙ্গার সৃষ্টি করা হয়। তারা সুযোগ খুজছে কোনো রকমে প্রাদেশিক সরকারকে বরখাস্ত করা যায় কি না? কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটের সাথে আলোচনা হওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া আমাদের তাঁর রুমে নিয়ে বসতে দিলেন। হক সাহেবও আছে সেখানে। মোহাম্মদ আলী বেয়াদবের মত হক সাহেবের সাথে কথা বলতে আরম্ভ করলেন। আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম করছিল। এমন সময় মোহাম্মদ আলী আমাকে বললেন, “ কি মুজিবর রহমান, তোমার বিরুদ্ধে বিরাট ফাইল আছে আমার কাছে”। এই কথা বলে, ইয়াংকিদের মত ভাব করে পিছন থেকে ফাইল এনে টেবিলে রাখলেন। আমি বললাম, “ফাইল তো থাকবেই, আপনাদের বদৌলতে আমাকে তো অনেক জেল খাটতে হয়েছে। আপনার বিরুদ্ধেও একটা ফাইল প্রাদেশিক সরকারের কাছে আছে”। তিনি বললেন, “এর অর্থ”। আমি বললাম, “যখন খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করেন তখন আপনাকে মন্ত্রী করেন নাই। আমরা যখন ১৯৪৮ সালে প্রথম বাংলা ভাষার আন্দোলন করি, তখন আপনি গোপনে দুইশত টাকা চান্দা দিয়েছিলেন, মনে আছে আপনার? পুরানা কথা অনেকেই ভুলে যায়”। হক সাহেব ও সৈয়দ আজিজুল হক সাহেব দেখলেন হাওয়া গরম হয়ে উঠেছে। তখন বললেন, “ এখন আমরা চলি, পরে আবার আলাপ হবে”। আমি এক ফাঁকে হক সাহেবের সাথে যে বেয়াদবের মত কথা বলেছিল, সে সম্বন্ধে দু’এক কথা শুনিয়ে দিয়েছিলাম।
আমি অসুস্থ সোহরাওয়ারদী সাহেবকে দেখতে গেলাম। শহীদ সাহেব বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না, কথা বলতেও কষ্ট হয়। ডাক্তার বাইরের লোকের সাথে দেখা করতে নিষেধ করে দিয়েছেন। আমাদে দেখে তিনি খুব খুশি হলেন। বেবী (শহীদ সাহেবের একমাত্র মেয়ে) আমাকে বলে দিয়েছিল, রাজনীতি নিয়ে আলাপ যেন না করি। তিনি আস্তে আস্তে আমার কাছে রাজনীতি বিষয়েই জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। আমি দু’এক কথা বলেই চুপ করে যাই। তিনি শেষ পর্যন্ত বললেন, “বিরাট খেলা শুরু করেছে মোহাম্মদ আলী ও মুসলিম লীগ নেতারা”।
হক সাহেব আমাকে বললেন, “গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ তাঁর সাথে আমাদের দেখা করতে অনুরোধ করেছেন”। আমরা বড়লাটের বাড়িতে উপস্থিত হলাম। তিনি যে কামরায় শুয়ে শুয়ে দেশ শাসন করতেন, সেই ঘরেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হল। তিনি খুবই অসুস্থ। হাত-পা-সকল সময়ই কাঁপে। কথাও পরিষ্কার করে বলতে পারেন না। তিনি হক সাহেবের সাথে আলাপ করলেন। আমার নাম ধরে জিজ্ঞাসা করলেন, উপস্থিত আছি কি না! হক সাহেব আমাকে দেখিয়ে দিলেন। আমি আদাব করলাম। তিনি আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বসালেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, “লোকে বলে, আপনি কমিউনিস্ট, একথা সত্য কি না?” আমি তাঁকে বললাম, “যদি শহীদ সাহেব কমিউনিস্ট হন, তাহলে আমিও কমিউনিস্ট। আর যদি তিনি অন্য কিছু হন তবে আমিও তাই”। তিনি হেসে দিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, “আপনি এখনও যুবক, দেশের কাজ করতে পারবেন। আমি আপনাকে দোয়া করছি। আপনাকে দেখে আমি খুশি হলাম”। কথাগুলি বুঝতে আমার খুব
২৬৯
কষ্ট হচ্ছিল, কারণ তিনি পরিষ্কার করে বলতে পারেন না। মুখটাও বাঁকা হয়ে গেছে। হাত-পা-শুকিয়ে গিয়েছে। আল্লাহ সমস্ত বুদ্ধি আর মাথাটা ঠিক রেখে দিয়েছেন।
আমরা পরের দিনই খবর পেলাম পূর্ব বাংলায় গভর্নর শাসন দিবে, মন্ত্রিসভা ভেঙে দিবে, এই নিয়ে আলোচনা চলছে। কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলা সরকারের চিফ সেক্রেটারি জনাব ইসহাক সাহেবকে আদেশ দিয়েছে, যাতে আমরা পূর্ব বাংলায় আসতে না পারি- যাতে আমাদের প্লেনের টিকিট করতে না দেওয়া হয়। তিনি অস্বীকার করলেন এই কথা বলে যে, ‘এখনও তাঁরা মন্ত্রী। আইনত তিনি আমাদের আদেশ মানতে বাধ্য’। তাঁকে আরও বলা হয়েছিল, তাঁর রিপোর্ট পরিবর্তন করতে। তিনি তাও করতে আপত্তি করলেন। এটা না করার ফল হিসাবে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং অনেক দিন পর্যন্ত ছুটি ভোগ করতে বাধ্য করেছিল। আমি ও আতাউর রহমান সাহেব এ খবর পেয়েছিলাম। তাই হক সাহেবকে যেয়ে বললাম, “আমরা আজই ঢাকা রওয়ানা করব। কারণ, আজ না যেতে পারলে আরও কয়েকদিন থাকতে হবে। প্লেনের টিকিট পাওয়া যাবে না”। হক সাহেবকে অবস্থা বুঝিয়ে বললে তিনিও নান্না মিয়াকে ডেকে বললেন, তিনিও যাবেন। নান্না মিয়াও রাজি হলেন। মোহন মিয়া ও আশরাফউদ্দিন চৌধুরী সাহেব করাচি থেকে তদ্বির করবেন, কোনো কিছু করা যায় কি না।
আমরা টিকিট করতে হুকুম দিয়ে শহীদ সাহেবের কাছে উপস্থিত হলাম। তাঁকে কিছু কিছু বললাম। তিনি অতি কষ্টে আমাকে বললেন, “দু’একদিনের মধ্যে চিকিৎসার জন্য আমাকে জুরিখ যেতে হবে, টাকার অভাব হয়ে পড়েছে”। আমি বললাম, “ঢাকা যেয়ে কিছু টাকা বেবীর কাছে পাঠিয়ে দিব”। মনে মনে দুঃখ করলাম, আর ভাবলাম, যে লোক হাজার হাজার টাকা উপার্জন করে গরিবকে বিলিয়ে দিয়েছেন আজ তাঁর চিকিৎসার টাকা নাই, একেই বলে কপাল!
বোধহয় ২৯শে মে হবে, আমরা রাতের প্লেনে রওয়ানা করলাম। দিল্লি কলকাতা হয়ে ঢাকা পৌছাবে বিওএসি প্লেন। আমাদের সাথে চিফ সেক্রেটারি হাফিজ ইসহাক ও আইজিপি শামসুদ্দোহা সাহেব ঢাকা রওয়ানা করলেন। দোহা সাহেব কেন এবুং কার হুকুমে করাচি গিয়েছিলেন আমার জানা ছিল না। হক সাহেব পরে আমাকে বলেছেন, তিনিই হুকুম দিয়েছেন। কলকাতা পৌছাবার কিছু সময় পূর্বে জনাব দোহা হক সাহেবকে যেয়ে বললেন, “স্যার আমার মনে হয় আপনার আজ কলকাতা থাকা উচিত। কি হয় বলা যায় না, এদের ভাবসাব ভাল দেখলাম না। রাতেই ইস্কান্দার মির্জা এবং এন.এম.খান ঢাকায় মিলিটারি প্লেনে রওয়ানা হয়ে গেছেন। ঢাকা এয়ারপোর্টে কোনো ঘটনা হয়ে যেতে পারে। যদি কোনো কিছু না হয়, তবে আগামীকাল প্লেন পাঠিয়ে আপনাদের নেওয়ার বন্দোবস্ত করব”। হক সাহেব সবই বুঝতেন, তিনি নান্না মিয়াকে ও আমাকে দেখিয়ে দিয়া বললেন, “ওদের সাথে আলাপ করুন”। আমার কাছে দোহা সাহেব এসে ঐ একই কথা বললেন। আমি তাকে পরিষ্কার বলে দিলাম, “কেন কলকাতায় নামব? কলকাতা আজ আলাদা দেশ। যা হয় ঢাকায়ই হবে”। নান্না মিয়াও একই জবাব দিলেন। আমার
২৭০
বুঝতে বাকি থাকল না, কেন তিনি গায়ে পড়ে এই পরামর্শ দিতে এসেছেন। তিনি যে এই পরামর্শ দিচ্ছিলেন তা করাচি থেকেই ঠিক করেই এসেছেন। পাকিস্তানী শাসকচক্র দুনিয়াকে দেখাতে চায়, ‘হক সাহেব দুই বাংলাকে এক করতে চান, তিনি পাকিস্তানের দুশমন, তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী। আর আমরা তাঁর এই রাষ্ট্রদ্রোহী কাজের সাথী’।
কলকাতা এয়ারপোর্টে নামবার সাথে সাথে খবরের কাগজের প্রতিনিধিরা হক সাহেবকে ঘিরে ফেললে এবং প্রশ্ন করতে শুরু করল। তিনি মুখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, তাঁর মুখ বন্ধ, আর আমাকে দেখিয়ে দিলেন। প্রতিনিধিরা আমার কাছে এলে, আমি বললাম, “এখানে আমাদের কিছুই বলার নাই। যদি কিছু বলতে হয়, ঢাকায় বলা যাবে”। কলকাতা এয়ারপোর্টে আমাদের প্রায় এক ঘন্টা দেরি করতে হল। আবার দোহা সাহেব এসে বললেন, “টেলিফোন করে খবর পেলাম, সমস্ত ঢাকা এয়ারপোর্ট মিলিটারি ঘিরে রেখেছে। চিন্তা করে দেখেন কি করবেন”? আমি তাঁকে বললাম, “ঘিরে রেখেছে ভাল, আমাদের তাতে কি, আমরা ঢাকায়ই যাব। বিদেশে এক মুহূর্তও থাকব না”। প্লেনে উঠে ভাবলাম, দোহা সাহেব পুলিশে চাকরি করেন, তাই নিজেকে খুবই বুদ্ধিমান মনে করেন। আমরা রাজনীতি করি, তাই এই সামান্য চালাকিটাও বুঝতে পারি না!
ঢাকায় এসে দেখলাম, বিরাট জনতা আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা সকলের সাথে দেখা করে যার যার বাড়ির দিকে রওয়ানা করলাম। আমরা হক সাহেবের পিএ সাজেদ আলীকে করাচি রেখে এসেছিলাম। যদি কোনো খবর থাকে তাহলে টেলিফোন করে যেন জানিয়ে দেয়।
বাসায় এসে দেখলাম, রেণু এখনও ভাল করে সংসার পাততে পারে নাই। তাকে বললাম, “আর বোধহয় দরকার হবে না। কারণ মন্ত্রীত্ব ভেঙে দিবে, আর আমাকেও গ্রেফতার করবে। ঢাকায় কোথায় থাকবা, বোধহয় বাড়িই চলে যেতে হবে। আমার কাছে থাকবা বলে এসেছিলো, ঢাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ হবে, তা বোধহয় হল না। নিজের হাতের টাকা পয়সাগুলিও খরচ করে ফেলেছে”। রেণু ভাবতে লাগল, আমি গোসল করে ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম করছিলাম। বেলা তিনটায় টেলিফোন এল, কেন্দ্রীয় সরকার ৯২(ক) ধারা জারি করেছে। মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করা হয়েছে। মেজর জেনারেল ইস্কান্দর মির্জাকে পূর্ব বাংলার গভর্নর, আর এন.এম. খানকে চিফ সেক্রেটারি করা হয়েছে।
আমি তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে আতাউর রহমানের বাড়িতে এসে তাঁকে নিয়ে হক সাহেবের বাড়িতে গেলাম এবং তাঁকে অনুরোধ করলাম ক্যাবিনেট মিটিং ডাকতে। কেন্দ্রীয় সরকারের এই অন্যায় আদেশ আমাদের মানা উচিত হবে না এবং এটাকে অগ্রাহ্য করা উচিত। তিনি বললেন, কি হবে বুঝতে পারছি না, অন্যদের সাথে পরামর্শ কর। নান্না মিয়াকে বললাম,
২৭১
তিনি কিছুই বলতে পারছেন না, মনে হল সকলে ভয় পেয়ে গেছেন। আতাউর রহমান সাহেব রাজি ছিলেন, যদি সকলে একমত হতে পারতাম। মন্ত্রীদের পাওয়া গেল না, হক সাহেব দোতলায় বসে রইলেন। আতাউর রহমান সাহেবকে বললাম, “আপনি দেখেন, সকলকে ডেকে আনতে পারেন কি না? আমি আওয়ামী লীগ অফিস থেকে কাগজপত্রগুলি সরিয়ে দিয়ে আসি। অফিস তালা বন্ধ করে দিতে পারে”।
আমি আওয়ামী লীগ অফিসে যেয়ে দরকারি কাগজপত্র সরিয়ে বের হওয়ার সাথে সাথে অন্য পথ দিয়ে পুলিশ অফিসে এসে পাহারা দিতে আরম্ভ করল। আমি আবার নান্না মিয়ার বাড়িতে উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথে আমাকে জানাল, সেখানেও গিয়েছিল। রেণুকে বললাম, “আবার আসলে বলে দিও শীঘ্র আমি বাড়িতে পৌছাব”। বিদায় নেওয়ার সময় অনেককে বললাম, “আমি তো জেলে চললাম, তবে একটা কথা বলে যাই, আপনারা এই অন্যায় আদেশ নীরবে মাথা পেতে মেনে নেবেন না। প্রকাশ্যে এর বাধা দেওয়া উচিত। দেশবাসী প্রস্তুত আছে, শুধু নেতৃত্ব দিতে হবে আপনাদের। জেলে অনেকের যেতে হবে, তবে প্রতিবাদ করে জেল খাটাই উচিত”। সেখান থেকে এসে পথে কয়েকজন কর্মীর সাথে দেখা করতে চেষ্টা করলাম, কাউকেও পাওয়া গেল না। আমি সরকারি গাড়ি ছেড়ে দিয়ে রিকশা ভাড়া করে বাড়ির দিকে রওয়ানা করলাম। দেখলাম, কিছু কিছু পুলিশ কর্মচারী আমার বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। আমি রিকশায় পৌছালাম, তারা বুঝতে পারে নাই। রেণু আমাকে খেতে বলল, খাবার খেয়ে কাপড় বিছানা প্রস্তুত করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জনাব এহিয়া খান চৌধুরীকে ফোন করে বললাম, “আমার বাড়িতে পুলিশ এসেছিল, বোধহয় আমাকে গ্রেফতার করার জন্য। আমি এখন ঘরেই আছি গাড়ি পাঠিয়ে দেন”। তিনি বললেন, “আমরা তো হুকুমের চাকর। গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপনি প্রস্তুত হয়ে থাকুন। আপনাকে গ্রেফতার করার জন্য বারবার টেলিফোন আসছে”। আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন ছেড়ে দিলাম। রেণু আমার সকল কিছু ঠিক করে দিল এবং কাঁদতে লাগল। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেরা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওদের ওঠাতে নিষেধ করলাম। রেণুকে বললাম, “তোমাকে কি বলে যাব, যা ভাল বোঝ কর, তবে ঢাকায় থাকলে কষ্ট হবে, তার চেয়ে বাড়ি চলে যাও”।
বন্ধু ইয়ার মোহাম্মদ খানকে বলে গিয়েছিলাম, যদি রেণু বাড়ি না যায় তা হলে একটা বাড়ি ভাড়া করে দিতে। ইয়ার মোহাম্মদ খান ও আল হেলাল হোটেলের মালিক হাজী হেলাল উদ্দিন রেণুকে বাড়ি ভাড়া করে দিয়েছিল এবং তখন দেখাশোনাও করেছিল। কিছুদিন পরই ইয়ার মোহাম্মদ খান রেণুকে নিয়ে জেলগেটে আমার সাথে দেখা করতে আসলে তাঁকেও জেলগেটে গ্রেফতার করে। ইয়ার মোহাম্মদ খান ঢাকা থেকে এমএলএ হয়েছিলেন।
আধা ঘণ্টা পরে গাড়ি এসে হাজির। অনেক লোকই বাড়িতে ছিল, গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে অনেকেই অন্ধকারে পালিয়ে গেছে। আমি গাড়িতে উঠে রওয়ানা করলাম। গোপালগঞ্জের
২৭২
অল্প বয়েসের এক কর্মী শহিদুল ইসলাম গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছিল। আমি গাড়ি থেকে নেমে তাকে আদর করে বুঝিয়ে বললাম, “কেন কাঁদিস, এই তো আমার পথ। আমি একদিন তো বের হব, তোর ভাবীর দিকে খেয়াল রাখিস”।
জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে আমাকে নিয়ে আসা হল। তিনি বসেই ছিলেন, আমাকে বললেন, “কি করব বলুন! করাচি আপনাকে গ্রেফতার করার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আমরা তো জানি আপনাকে খবর দিলে আপনি চলে আসবেন। জেলের ভয় তো আপনি করেন না”। তাঁর কাছে অনেক টেলিফোন আসছিল, আমার আর তাঁর কামরায় থাকা উচিত না। তাঁকে বললাম, “আমাকে জেলে পাঠিয়ে দেন। খুবই ক্লান্ত, গতরাতেও ঘুম হয় নাই প্লেনে”।
তিনি আমাকে পাশের রুমে নিয়ে বসতে দিলেন। ইদ্রিস সাহেব তখন ঢাকার ডিআইজি। তিনি আসলেন, আমার সাথে খুব ভাল ব্যবহার করলেন। সিগারেট বা অন্য কিছু লাগবে কি না জানতে চাইলেন। আমি তাঁকেও বললাম, তাড়াতাড়ি জেলে পাঠিয়ে দিলেই খুশি হব। তিনি চলে যাওয়ার কয়েক মিনিট পরে একজন ইন্সপেক্টর এসে একটা ওয়ারেন্ট তৈরি করতে লাগলেন। একটা মামলা আমার নামে করা হল;তাতে দেখলাম, ডাকাতি ও খুন করার চেষ্টা, লুটতরাজ ও সরকারি সম্পত্তি নষ্ট, আরও কতগুলি ধারা বসিয়ে দিলেন। জেলা মুয়াজিস্ট্রেট সাহেব ‘ডিভিশন’ লিখে দিলেন। আমি রাত সাড়ে বারোটা কি একটা হবে। জেলগেটে পৌছালাম। দেখি, আমিই একলা আর কাউকেও আনা হয় না। কয়েক মিনিট পরে দেখলাম, মির্জা গোলাম হাফিজ আর সৈয়দ আবদুর রহিম মোক্তারকে আনা হয়েছে। তিনজনকে দেওয়ানি ওয়ার্ডে রাখা হল।
জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিস থেকে আসবার সময় ইদ্রিস সাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক প্রফেসর আবদুল হাই সাহেব কোথায় থাকেন”? আমি তাকে বললাম, “জানলেও বলব না। কি করে আশা করতে পারেন যে, আপনাকে বলব?” দশ-পনের দিনের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রায় তিন হাজার কর্মী ও সমর্থক গ্রেফতার করা হল। অন্যান্য দলের সামান্য কয়েকজন কর্মী, আর কয়েকশত ছাত্র, এবং পঞ্চাশজনের মত এমএলএকে গ্রেফতার করা হল। গণতান্ত্রিক দলের কয়েকজন এমএলএকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। ঢাকা জেলের দেওয়ানি ওয়ার্ডে ও সাত সেলে কোরবান আলী, দেওয়ান মাহবুব আলী, বিজয় চ্যাটারজী, খন্দকার আবদুল হামিদ, মির্জা গোলাম হাফিজ, ইয়ার মোহাম্মদ খান, মোহাম্মদ তোয়াহকে রাখা হয়েছিল। পরে প্রফেসর অজিত গুহ ও মুনীর চৌধুরীকেও গ্রেফতার করে আনা হয়েছিল। হক সাহেবকে নিজ বাড়িতে অন্তরিণ করেছে।
৬ই জুন তারিখে আবু হোসেন সরকার সাহেবের বাড়িতে যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টোরি পার্টির সভা আহবান করা হয়। সামান্য কয়েকজন এমএলএ উপস্থিত হয়েছিলেন। কয়েকজন ভূতপূর্ব মন্ত্রীও এসেছিলেন। পুলিশ এসে সভা করতে নিষেধ করলে সকলে সভা ত্যাগ করে যার যার বাড়িতে রওয়ানা করেন।
২৭৩
পূর্ব বাংলায় গভর্নর শাসন জারি করার দিন প্রধানমন্ত্রী জনাব মোহাম্মদ আলী যে বক্তৃতা রেডিও মারফত করেন, তাতে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক সাহেবকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ এবং আমাকে ‘দাঙ্গাকারী’ বলে আক্রমণ করেন। আমাদের নেতারা যারা বাইরে রইলেন, তাঁরা এর প্রতিবাদ করারও দরকার মনে করলেন না। দেশবাসী ৬ই জুনের দিকে চেয়েছিল, যদি নেতারা সাহস করে প্রগ্রাম দিত তবে দেশবাসী তা পালন করত। যেসব কর্মী গ্রেফতার হয়েছিল তারা ছাড়াও যারা বাইরে ছিল তারাও প্রস্তুত ছিল। আওয়ামী লীগের সংগ্রামী ও ত্যাগী কর্মীরা নিজেরাই প্রতিবাদে যোগ দিতে পারত। যুক্তফ্রন্টের তথাকথিত সুবিধাবাধী নেতাদের মুখের দিকে চেয়ে থেকে তাও তারা করতে পারল না। অনেক কর্মীই চেষ্টা করে গ্রেফতার হয়েছিল। যদি সেইদিন নেতারা জনগণকে আহবান করত তবে এতবড় আন্দোলন হত যে কোনোদিন আর ষড়যন্ত্রকারীরা সাহস করত না বাংলাদেশের উপর অত্যাচার করতে। শতকরা সাতানব্বই ভাগ জনসাধারণ যেখানে যুক্তফ্রন্টকে ভোট দিল ও সমর্থন করল, শত প্রলোভন ও অত্যাচারকে তারা ভ্রুক্ষেপ করল না- সেই জনগণ নীরব দর্শকের মত তাকিয়ে রইল! কি করা দরকার বা কি করতে হবে, এই অত্যাচার নীরবে সহ্য করা উচিত হবে কি না, এ সম্বন্ধে নেতৃবৃন্দ একদম চুপচাপ।
একমাত্র আতাউর রহমান খান কয়েকদিন পরে একটা বিবৃতি দিয়েছিলেন। ৯২(ক) ধারা জারি হওয়ার কয়েকদিন পূর্বে মওলানা ভাসানী বিলাত গিয়েছেন। শহীদ সাহেব অসুস্থ হয়ে জুরিখ হাসপাতালে, আর আমি তো কারাগারে বন্দি। নীতিবিহীন নেতা নিয়ে অগ্রসর হলে সাময়িকভাবে কিছু ফল পাওয়া যায়, কিন্ত সংগ্রামের সময় তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। দেড় ডজন মন্ত্রীর মধ্যে আমিই একমাত্র কারাগারে বন্দি। যদি ৬ই জুন সরকারের অন্যায় হুকুম অমান্য করে (হক সাহেব ছাড়া) অন্য মন্ত্রীরা গ্রেফতার হতেন তা হলেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলন শুর হয়ে যেত। দুঃখের বিষয় যে, যতই হৈচৈ বাঙালিরা করুক না কেন, আর যতই জনসমর্থন থাকুক না কেন, এদের দাবিয়ে রাখতে কষ্ট হবে না। পুলিশের বন্দুক ও লাঠি দেখলে এরা পালিয়ে গর্তে লুকাবে। এই সময় যদি বাধা পেত তবে হাজার বার চিন্তা করত বাঙালিদের উপর ভবিষ্যতে অত্যাচার করতে।
এই দিন থেকেই বাঙালিদের দুঃখের দিন শুরু হল। অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়। ঠিক মনে নাই, তবে দুই-তিন দিন পরে আমাকে আবার নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হল। নিরাপত্তা আইনে বন্দিদের বিনা বিচারে কারাগারে আটক থাকতে হয়। সরকার ভাবল, যে মামলায়
২৭৫
আমাকে গ্রেফতার করেছে, তাতে জামিন হলেও হয়ে যেতে পারে; তাই নিরাপত্তা আইনে তাদের পক্ষে সুবিধা হবে আমাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক রাখা। কি মামলার আসামি করেছে আমার তা মনে নাই। আমি নাকি কাউকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছি বা লুটপাট করতে উসকানি দিয়েছি। খবর নিয়ে জানলাম, জেলগেটে একটা গোলমাল হয়েছিল- আমি মন্ত্রী হওয়ার সামান্য কিছুদিন পূর্বে, সেই ঘটনার সাথে আমাকে জড়িয়ে এই মামলা দিয়েছে।
একদিন আমি আওয়ামী লীগ অফিসে ইফতার করছিলাম। ঢাকায় রোজার সময় জেলের বাইরে থাকলে আমি আওয়ামী লীগ অফিসেই কর্মীদের নিয়ে ইফতার করে থাকতাম। হঠাৎ টেলিফোন পেলাম, চকবাজারে জেল সিপাহিদের সাথে জনসাধারণের সামান্য কথা কাটাকাটি হওয়ায় জেল সিপাহিরা গুলি করেছে। একজন লোক মারা গিয়েছে এবং অনেকে জখম হয়েছে। ঢাকা কারাগার চকবাজারের পাশেই। হক সাহেব মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন, আমি তখনও মন্ত্রী হই নাই। আমি আতাউর রহমান সাহেবকে টেলিফোন করলাম। তাঁর বাসা চকবাজারের কাছে। তিনিও খবর পেয়েছেন, আমাকে তাঁর বাসায় যেতে বললেন। দরকার হলে একসাথে চকবাজার ও জেলখানায় যাওয়া যাবে। আমি পৌছার সাথে সাথে দু’জনে দ্রুত চকবাজারে পৌছালাম। অনেক লোক জমা হয়ে আছে এবং তারা খুবই উত্তেজিত। আমরা উপস্থিত হলে তারা আমাদের ঘিরে ফেলল এবং সকলে একসাথে চিৎকার করতে শুরু করল। সকলেই একসঙ্গে কথা বলতে চায়, কি ঘটনা ঘটেছে জানাতে। আমরা যখন তাদের অনুরোধ করলাম, এক একজন করে বলতে, তখন তারা একটু শান্ত হল এবং ঘটনাটা বলল। একজন ওয়ার্ডারের সাথে এক পানের দোকানদারের কথা কাটাকাটি এবং পরে মারামারি হয়। এই অবস্থায় দু’চারজন ওয়ার্ডারও হাজির হয়ে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডারের পক্ষ নেয়, আর জনসাধারণ দোকানদারের পক্ষ নেয়। সিপাহিরা একটু বেশি মার খায়। তারা ব্যারাকে ফিরে গিয়ে রাইফেল এনে গুলি করতে শুরু করে। এতে অনেক লোক জখম হয় এবং তিনজন আহত লোককে ধরে জেল এরিয়ার ভিতরে নিয়ে যায়। অনেক লোক তখন জমা হয়েছে। আমরা দুইজনই তাদের শান্ত হতে বলে, জেলগেটের দিকে রওয়ানা করেই দেখতে পেলাম, সৈয়দ আজিজুল হক ওরফে নান্না মিয়া (তখন মন্ত্রী) খবর পেয়ে এসেছেন। তাঁর সাথে একজন বিশিষ্ট সরকারি কর্মচারী আছেন। আমরা একসাথে জেলগেটের ভিতরে পৌছালাম। সেখানে জেল সুপারিনটেনডেন্ট ও জেলারের সাথে আলাপ হল। এ সময় আরও দু’একজন মন্ত্রী, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, ডিভিশনাল কমিশনার এসে হাজির হয়েছে। জনসাধারণ মন্ত্রীদের ও আমাদের দেখে একদম জেলগেটের সামনে এসে জড়ো হয়েছে। হাজার হাজার লোক চিৎকার করতে আরম্ভ করেছে।
ঢাকা জেলে তখন একজন এংলো ইন্ডিয়ান সার্জেন্ট ছিল, তার নাম মিস্টার গজ। সত্যি কি না বলতে পারি না, তবে জনতা ‘গজের বিচার চাই, গজ নিজে গুলি করেছে’- ইত্যাদি বলে চিৎকার করতে শুরু করেছে। গজের বাসা জেলগেটের সামনেই। কে যেন বলে দিয়েছে, এটা গজের বাড়ি। জনতা গজের বাড়ি আক্রমণ করে ফেলেছে। যারা উপস্থিত
২৭৬
ছিলেন-মন্ত্রী, নেতা এবং সরকারি কর্মচারী তাঁর আমাকে অনুরোধ করল বাইরে যেতে। এত বড় ঘটনা ঘটে গেছে, একজন আর্মড পুলিশও এক ঘণ্টা হয়ে গেছে, এসে পৌঁছায় নাই। আমি বাইরে যেয়ে জনতার মোকাবেলা করলাম। নিজের হাতে অনেককে ঠেলা ধাক্কা দিয়ে নিবৃত্ত করলাম। কর্মীদের নিয়ে মি.গজের বাড়ির বারান্দা থেকে উন্মত্ত জনতাকে ফেরত আনলাম। একটা গাড়ির উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করলাম গোলমাল না করতে, শান্তি বজায় রাখতে। বললাম, সরকার বিচার করবে অন্যায়কারীর। মাইক্রোফোন নাই। গলায় কুলায় নাই। আবার গজের বাড়ির দিকে জনতা ছুটছে। আবার আমি কর্মীদের নিয়ে জনতার সামনে দাঁড়িয়ে তার বাড়ি রক্ষা করলাম। আওয়ামী লীগের অনেক কর্মীও তখন পৌঁছে গেছে। আমি যখন লোকদের শান্ত করে জেলগেটের দিকে ফেরাই, ঠিক সেই সময় আইজিপি দোহা সাহেব কয়েকজন পুলিশ নিয়ে হাজির হলেন। তিনি আমার হাত ধরে ফেললেন এবং বললেন, “আপনি গ্রেফতার”। আমি বললাম, “খুব ভাল”। জনতা চিৎকার করে উঠে এবং আমাকে কেড়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগল। আমি তাদের বোঝাতে লাগলাম। আবার দুই-তিন মিনিট পরে দোহা সাহেব ফিরে এসে বললেন, “আপনাকে অন্ধকারে চিনতে পারি নাই। ভুল হয়ে গেছে। চলুন জেলগেটে যাই”। আমি তার সাথে জেলগেটের ভিতরে পৌছালাম এবং বললাম, “প্রায় দুই ঘন্টা হয়ে গেছে গোলমাল শুরু হয়েছে, আপনি এখন পুলিশ নিয়ে হাজির হয়েছেন। এতক্ষণ পর্যন্ত শান্তি রক্ষা আমাদেরই করতে হয়েছে। যা ভাল বোঝেন করেন। আমার কি প্রয়োজন। লালবাগ পুলিশ নাইন থেকে জেলগেট এক মাইলও হবে না, আর আপনার পুলিশ ফোরস পৌছাতে এত সময় লাগল”। আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। জনতা একেবারে জেলগেটের সামনে এসে পড়েছে। আমরা দেখলাম, এখন পুলিশ লাঠিচার্জ বা গুলি করতে আরম্ভ করবে। কেউই জনতাকে বোঝাতে চেষ্টা করছে না। সরকারি পাবলিসিটি ভ্যানও আসতে বলা হয় নাই যে মাইক্রোফোন দিয়ে বক্তৃতা করে লোকদের বোঝানো যায়। খালি গলায় চিৎকার করে কাউকেও শোনানো যাবে না। যারা সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবের রুমে বসেছিলেন তাদের বলে জনতাকে নিয়ে এক মিছিল করে রওয়ানা করলাম। আমাদের অনেক কর্মীও বাইরে ছিল। আমি বাইরে এসে জনতাকে বললাম, “চলুন এই অত্যাচারের প্রতিবাদ করার জন্য মিছিল করা যাক”। আমি হাঁটা দিলাম। প্রায় শতকরা সত্তরজন লোক আমার সাথে রওয়ানা করল। আমি সদরঘাট পর্যন্ত দেড় মাইল পথ এদের নিয়ে এলাম।
আওয়ামী লীগ অফিসে যেয়ে পরের দিন পল্টন ময়দানে এক সভা করব ঘোষণা করলাম। এটা খুবই অন্যায়, জেল ওয়ার্ডার কেন জেল এরিয়ার বাইরে যেয়ে গুলি করবে? আর কার অনুমতি নিয়েছে? কে ম্যাগাজিন খুলে দিয়েছে? ওয়ার্ডারদের কাছে তো রাইফেল সব সময় থাকে না। আমি যখন আওয়ামী লীগ অফিসে বসে আলাপ করছিলাম তখন রাত প্রায় দশটা। আবার খবর এল জেলগেটে গুলি হয়েছে। একজন লোক মারা গেছে। আমি আর জেলগেটে যাওয়া দরকার মনে করলাম না। আতাউর রহমান সাহেবকে টেলিফোনে বললাম, সভা ডেকে দিয়েছি, তিনি সম্মতি দিলেন।
২৭৭
পরের দিন পল্টন ময়দানে বিরাট সভা হল। আমি বক্তৃতা করলাম, যে দোষী তাকে শাস্তি দেওয়া উচিত, আর যারা গুলিতে মারা গিয়াছে তাদের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পুলিশ কেন সময় মত উপস্থিত হয় নাই, তারও একটা তদন্ত হওয়া উচিত। এর কয়েকদিন পরে যখন মন্ত্রী হলাম এবং এ ঘটনা সম্বন্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, না হয়ে থাকলে কি করা উচিত এ বিষয়েও আমরা আলোচনা করেছিলাম। মন্ত্রিসভা বরখাস্ত ও গভর্নর শাসন কায়েম হওয়ার পরে আমাকে ঐ জেলগেট দাঙ্গার কেসে আসামি করা হল এবং মামলা দায়ের করা হল। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত এই মামলা চলে। জনাব ফজলে রাব্বী, প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে বিচার হয়।। অনেক মিথ্যা সাক্ষী জোগাড় করেছিল। এমন কি মিস্টার গজের মেয়েও আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছিল। পাবলিক সাক্ষী জোগাড় করতে পারে নাই। জেল ওয়ার্ডের মধ্যে থেকে কয়েকজন সাক্ষী এনেছিল। তার মধ্যে দুইজন ওয়ার্ডার সত্য কথা বলে ফেলল যে, তারা আমাকে দেখেছে গাড়ির উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে এবং লোকদের চলে যেতেও আমি বলেছিলাম, তাও বলল। জেল সুপারিনটেনডেন্ট মিস্টার নাজিরউদ্দিন সরকার কিন্ত সত্য কথা বললেন না, পুলিশ যা শিখিয়ে দিয়েছিল তাই বললেন। এক একজন সাক্ষী এক এক কথা বলল এবং কিছু কিছু সরকারি সাক্ষী একথাও স্বীকার করল যে, আমি জনতাকে শান্তি তক্ষা করতে অনুরোধ করেছিলাম। তাতে ম্যাজিস্ট্রেট আমার বিরুদ্ধে কোনো কিছু না থাকায় আমাকে বেকসুর খালাস দিলেন এবং রায়ে বলেছিলেন যে ‘আমাকে শান্তিভঙ্গকারী না বলে শান্তিরক্ষকই বলা যেতে পারে’। তবে এইবারে বোধহয় আমাদের দশ মাস জেলে থাকতে হল নিরাপত্তা আইনে।
আমি জেলে থাকবার সময় কয়েকটি ঘটনা ঘটল-যাতে আমি ও অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিরা খুবই মর্মাহত হয়ে পড়লাম। গৃহবন্দি হওয়ার কিছুদিন পরেই শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক সাহেবকে দিয়ে তাঁর সমর্থকরা এক বিবৃতি দিয়েছিলেন। তাতে তিনি অন্যায় স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করলেন। তিনি যুক্তফ্রন্টের নেতা, তাঁর এই কথায় আমাদের সকলের মাথা নত হয়ে পড়ল। যারা আমরা জেলে ছিলাম তাদের মনের অবস্থা কি হয়েছিল তা লেখা কষ্টকর। খবরের কাগজে দেখে আমরা আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন, তাঁর মনের দুর্বলতা আসতে পারে। যারা বাইরে ছিলেন তাঁরা কি করলেন! সমস্ত জনসাধারণ আমাদের সমর্থন করেছিল। হাজার হাজার কর্মী কারাগারে বন্দি। আমি ও আমার সাথে যারা বন্দি ছিল তারা এক জায়গায় বসে আলোচনা করলাম এবং স্থির করলাম এই ‘কৃষক শ্রমিক দলে’র সাথে আর রাজনীতি করা যায় না। এদিকে কারাগারে বসেও খবর পেতে লাগলাম যে, কৃষক শ্রমিক দলের কয়েকজন নামকরা নেতা-যারা ১৯৫৩ সালে মুসলিম লীগ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন তাঁরা গোপনে গোপনে মোহাম্মদ আলীর সাথে আলোচনা চালিয়েছেন কিভাবে আবার মন্ত্রিত্ব পেতে পারেন।। দরকার হলে
আওয়ামী লীগের সাথে কোনো সম্পর্ক তাঁরা রাখবেন না। আদমজী মিলের এতবড় দাঙ্গার সাথে জড়িত সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে মিস্টার ইস্কান্দর মির্জা গভর্নর হয়ে রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
অন্যদিকে মুসলিম লীগ নেতাদের মধ্যে গোলমাল শুরু হয়ে গেল। গোলাম মোহাম্মদ ও মোহাম্মদ আলীর সাথে মনকষাকষি শুরু হয়েছে। এখন আর মোহাম্মদ আলী ‘সুবোধ বালক’ নন। তিনি গোলাম মোহাম্মদের ক্ষমতা খর্ব করে গণপরিষদে এক আইন পাস করে নিলেন। গোলাম মোহাম্মদও ছাড়বার পাত্র নন। তিনিও আঘাত করার জন্য প্রস্তুত হলেন। যে অদৃশ্য শক্তি তাঁকে সাহায্য করেছিল নাজিমুদ্দীন সাহেবকে পদচ্যুত করতে, সেই অদৃশ্য শক্তি তাঁর পিছনে আছে, তিনি তা জানেন। সেই অদৃশ্য শক্তিই ধাপে ধাপে গোলমাল সৃষ্টি করার সুযোগ দিচ্ছে। ক্ষমতা দখল করার জন্য এখন খেলা শুরু করে দিয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে গণপরিষদে আইন পাস করে মোহাম্মদ আলী গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদের সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার এক মাস পরে, ২৩ অক্টোবর ১৯৫৪ সালে গোলাম মোহাম্মদ পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে গণপরিষদ ভেঙে দিলেন। গণপরিষদ ছিল সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। কিন্ত দুঃখের বিষয়, এই গণপরিষদের সদস্যরা ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত দেশে কোনো শাসনতন্ত্র ইচ্ছা করেই দেন নাই। গণপরিষদ একদিকে শাসনতন্ত্র তৈরি করার অধিকারী, অন্যদিকে জাতীয় পরিষদ হিসাবে দেশের আইন পাস করারও অধিকারী। ভারত ও পাকিস্তান একই সঙ্গে স্বাধীন হয়। একই সময় দুই দেশে গণপরিষদ গঠন হয়। ভারত ১৯৫২ সালে শাসনতন্ত্র তৈরি করে দেশজুড়ে প্রথম সাধারণ নির্বাচন দেয়। আবার জাতীয় নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে।
আমাদের গণপরিষদের কতক সদস্য কিছু একটা কোটারির সৃষ্টি করে রাজত্ব কায়েম করে নিয়েছে। পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক নির্বাচনে পরাজিত হয়েও এদের ঘুম ভাঙল না। এরা ষড়যন্ত্র করে পূর্ব বাংলার নির্বাচনকে বানচাল করে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করল। মোহাম্মদ আলী জানতেন তাঁর সাথে আর্মি নাই, আর থাকতেও পারে না। গোলাম মোহাম্মদকেই আর্মি সমর্থন করবে। তবুও এত বড় ঝুঁকি নিতে সাহস পেলেন কোথা থেকে ? নিশ্চয়ই অদৃশ্য শক্তিই তাঁকে সাহস দিয়েছিল। পাঞ্জাবের যে কোটারি পাকিস্তান শাসন করছিল, তারা জানে, পূর্ব বাংলার এই ভদ্রলোকদের যতদিন ব্যবহার করা দরকার ছিল, করে ফেলেছে। এদের কাছ থেকে আর কিছু পাওয়ার নাই। আর এরাও পূর্ব বাংলার জনমতের চাপে মাঝে মাঝে বাধা সৃষ্টি করতে শুরু করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানীরা যুক্তফ্রন্টের জয়ের পরে এদের অবস্থাও বুঝতে পেরেছে। এরা যে পূর্ব বাংলার লোকের প্রতিনিধি নয় তাও জানা হয়ে গেছে।
মোহাম্মদ আলী তাহাঁর সহকর্মীদের ত্যাগ করে আবার গোলাম মোহাম্মদের কাছে আত্মসমর্পণ করে কেয়ারটেকার সরকার গঠন করেন। এবারে তিনি পূর্বের চেয়ে বেশি গোলাম মোহাম্মদ ও চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর হাতের মুঠোয় চলে আসলেন। যদিও তিনি
২৭৯
প্রধানমন্ত্রী হলেন, কিন্ত সত্যিকারের ক্ষমতার মালিক ছিলেন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। আইয়ুব খানকে প্রধান সেনাপতি ও ইস্কান্দার মির্জাকে মন্ত্রী করে দেশটাকে আমলাদের হাতে তুলে দেওয়া হল। আইয়ুব সাহেবের মনে উচ্চাকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি পূর্বেই হয়েছিল। তার প্রমাণ আইয়ুব খানের আত্মজীবনী ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স’। তিনি এ বইতে স্বীকার করেছেন যে, ১৯৫৪ সালের ৪ঠা অক্টোবর লন্ডনের হোটেলে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে তাঁর মতামত লিখেছেন। কেন তিনি শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে লিখতে গেলেন? তিনি পাকিস্তান আর্মির প্রধান সেনাপতি, তিনি শক্রর আক্রমণের হাত থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করবেন। সেইভাবে পাকিস্তানের আর্মড ফোরসকে গড়ে তোলাই হল তাঁর কাজ।
গোলাম মোহাম্মদ আর চৌধুরী মোহাম্মদ আলী যে চক্রান্তের খেলা শুরু করেছিলেন, তাঁরা সাহস কোথা থেকে পেয়েছিলেন? নিশ্চয়ই জেনারেল আইয়ুব খান সকল কিছু বুঝেও চুপ করেছিলেন। রাজনীতিবিদরা নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ করে হেয়প্রতিপন্ন হয় এবং পাকিস্তানের জনগণ তাদের উপর থেকে আস্থা হারাতে বাধ্য হয়। এ অবস্থায় নেতাহীন ও নীতিহীন মুসলিম লীগ ক্ষমতায় থাকার জন্য সুযোগ করে নিতে চেষ্টা করতে লাগল। যখন গণপরিষদ ভেঙে দিয়ে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হল তখনই দেখা গেল তথাকথিত লীগ নেতারা অনেকেই আবার মন্ত্রীর গদি অলঙ্কৃত করল। আর মুসলিম লীগের নেতা মোহাম্মদ আলী আবার মন্ত্রিত্ব পেয়ে দলের ও দেশের কথা ভুলে গেলেন।
মোহাম্মদ আলী (বগুড়া) প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানকে একটা ব্লকের দিকে নিয়ে গেলেন। দুনিয়া তখন দু’ইটা ব্লকে ভাগ হয়ে পড়েছে। একটা রাশিয়ান ব্লক বা সমাজতান্ত্রিক ব্লক, আর একটা হল আমেরিকান ব্লক যাকে ডেমোক্রেটিক বা ধনতন্ত্রবাদী ব্লক বলা যেতে পারে- যদিও মরহুম লিয়াকত আলীর সময় থেকেই পাকিস্তান আমেরিকার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। ১৯৫৪ সালের মে মাসে পাকিস্তান-আমেরিকান মিলিটারি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং পরে পাকিস্তান সিয়াটো ও সেন্টো বা বাগদাদ চুক্তিতে যোগদান করে পুরাপুরি আমেরিকার হাতের মুঠোর মধ্যে চলে যায়। এই দুইটা চুক্তিই রাশিয়া ও চীনের বিরোধী বলে তারা ধরে নিল। চুক্তির মধ্যে যা আছে তা পরিষ্কারভাবে কমিউনিস্টবিরোধী চুক্তি বলা যেতে পারে। নয়া রাষ্ট্র পাকিস্তানের উচিত ছিল নিরপেক্ষ ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা। আমাদের পক্ষে কারও সাথে শক্রতা করা উচিত না। সকল রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুভাবে বাস করা আমাদের কর্তব্য। কোনো যুদ্ধ জোটে যোগদান করার কথা আমাদের চিন্তা করাও পাপ। কারণ, আমাদের বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্য সাহায্য করা দরকার, দেশের জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও তা জরুরি।
আমাকে গ্রেফতারের পূর্বেই পাক-আমেরিকান মিলিটারি প্যাক্টর বিরুদ্ধে এক যুক্ত বিবৃতি দেই। আওয়ামী লীগের বৈদেশিক নীতি ছিল স্বাধীন, নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি। আমাদের বিবৃতি খবরের কাগজে বের হবার পরে আমেরিকানরা আমাদের উপরে চটে গেল। হক সাহেবের সাথে এক আমেরিকান সাংবাদিক দেখা করেন এবং তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে এক রিপোর্ট আমেরিকান কাগজে ছাপিয়ে দেন। সেই রিপোর্টটাও মোহাম্মদ আলী তাঁর বিবৃতির
২৮০
মধ্যে উল্লেখ করেন। বিদেশী একজন সাংবাদিকের রিপোর্টের এত দাম মোহাম্মদ আলীর দেওয়ার কারণ, সেই সাংবাদিক ও তিনি দুজনেই আমেরিকান।
গোলাম মোহাম্মদ বেআইনিভাবে গণপরিষদ ভেঙে দিয়েছিলেন। তবু জনগণ এতে খুবি আনন্দিত হয়েছিল। কারণ, গণপরিষদের সদস্যদের হয়ত আট বৎসর পর্যন্ত থাকার আইনত অধিকার থাকলেও ন্যায়ত অধিকার ছিল না। আট বৎসর যে গণপরিষদ দেশকে একটা শাসনতন্ত্র দিতে পারে নাই, নির্বাচনে পরাজিত হয়েও যারা পদত্যাগ না করে ষড়যন্ত্র করে নির্বাচিত সদস্যদের বরখাস্ত করে, তাদের উপর জনগণের আস্থা থাকতে পারে না। যদিও গোলাম মোহাম্মদ দেশপ্রেম উদ্বুদ্ধ হয়ে এ কাজ করেন নাই, করেছিলেন নিজের এবং একটা অঞ্চলের একটা বিশেষ কোটারির স্বার্থ রক্ষা করার জন্য। অন্যায় জেনেও আমি খুশি হয়েছিলাম এই জন্য যে, এই গণপরিষদের সদস্যদের লজ্জা না করলেও আমাদের লজ্জা করত। গণপরিষদের অধিকাংশ সদস্যই মুসলিম লীগার। মুসলিম লীগ নেতারা যখন লেজ গুটিয়ে আত্মসমর্পণ করল একমাত্র মরহুম তমিজউদ্দিন খান সাহেব গণপরিষদের প্রেসিডেন্ট হিসাবে গোলাম মোহাম্মদের এই আদেশের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। আমরা জেলে বসে খবরের কাগজের মারফতে যেটুকু খবর পাই, তাই সম্বল, তাই নিয়েই আলোচনা করি।
কয়েকজন বন্দি মুক্তি পেয়েছেন। এখন আমি, ইয়ার মোহাম্মদ খান, দেওয়ান মাহবুব আলী, বিজয় চ্যাটারজী, অদ্যাপক অজিত গুহ, মোহাম্মদ তোয়াহ ও কোরবান আলী এক জায়গায় থাকি। দিন আমাদের কেটে যাচ্ছে কোনোমতে। অজিত বাবু আমাদের খাওয়া-দাওয়ার দেখাশোনা করতেন। বাবুর্চি তিনি ভালই ছিলেন। অসুস্থ হয়েও নিজেই পাক করতেন। তিনি মুক্তি পাওয়ার পরে তোয়াহ ভার নিল। অজিত বাবুর মত ভাল পাকাতে না পারলেও কোনোমতে চালিয়ে নিত। আমি ও দু’একজন তার পিছু নিতাম। সে রাগ হয়ে মাঝে মাঝে বসে থাকত। আবার অনুরোধ করে তাকে পাঠাতাম। তার রাগ বেশি সময় থাকত না। কোরবান আলীর একটু কষ্ট হত। ভাগে যা পড়ত তাতে তার হত না। শরীরটা বেশ ভাল ছিল, খেতেও পারত।
কোরবানকে একদিন জেলগেটে নিয়ে গেল মুক্তির কথা বলে। আমাদের কাছ থেকে যথারীতি বিদায় নিয়ে মালপত্র সাথে নিয়ে জেলগেটে হাজির হওয়ার পরে একটায় মুক্তির আদেশ এবং সাথে সাথে আর একটা কাগজ বের করলেন একজন আইবি কর্মচারী, তাকে বলা হল, যদি বন্ড দেন, তবে এখনি বাইরে যেতে পারবেন। আর বন্ড না দিলে আবার জেলের মধ্যে ফিরে যেতে হবে। কোরবান ভীষণ একগুঁয়ে। সে ক্ষেপে গিয়ে অনেক কথা শুনিয়ে আবার জেলের মধ্যে ফিরে আসল এবং আমাদের সকল কথা বলল। অনেক দিন
২৮১
কারাগারে বন্দি থাকার পরে মুক্তির আদেশ পেয়ে, জেলগেট থেকে আবার ফিরে আসা যে কত কষ্টকর এবং কত বড় ব্যথা, তা ভুক্তভোগী ছাড়া বোঝা কষ্টকর। পরের দিন জেল কতৃপক্ষকে ডেকে বলে দেওয়া হল আর কোনোদিন যেন এ কাজ না করা হয়। যদি কোনো বন্ড বা মামলা থাকে পূর্বেই জানিয়ে দিতে হবে। মালপত্র নিয়ে জেলগেটে গেলে এবং ফিরে আসতে হলে ভীষণ গোলমাল হবে। রাজনৈতিক বন্দিরা দরখাস্ত করে যাই যে তারা বন্ড দিবে।
কয়েকদিন পরে এক আইবি কর্মচারী আমার সাথে দেখা করতে আসেন। তিনি নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে করেন বলে মনে হল। আমাকে বন্ড দেওয়ার কথা বলতে সাহস পাচ্ছেন না বা লজ্জা করছিলেন। আমি তাঁকে বলেছিলাম, “দয়া করে ঘোরাঘুরি করবেন না। আমার সাথে দেখা করার ইচ্ছা থাকলে আসতে পারেন, তবে লিখে নিয়ে যান-আপনার উপরওয়ালাদের জানিয়ে দিবেন, বন্ড আমার দেওয়ার কথাই ওঠে না। সরকারকেই বন্ড দিতে বলবেন, ভবিষ্যতে আর এই রকম অন্যায় কাজ যেন না করে! আর বিনা বিচারে কাউকেও বন্দি করে না রাখে”। ভদ্রলোক হাসতে লাগলেন এবং বললেন, “আপনাকে তো আমি বন্ড দিতে বলি নাই”। আমিও হেসে ফেললাম।
কারাগারের দিনগুলি কোনোমতে কাটছিল। খবরের কাগজে দেখলাম, আতাউর রহমান খান সাহেব জুরিখ যাচ্ছেন, শহীদ সাহেবের সাথে দেখা করতে। সেখান থেকে বিলাত যাবেন, মওলানা ভাসানীর সাথে দেখা করতে। ভাসানী সাহেবের সাথে আরও তিনজন আওয়ামী লীগ কর্মী গিয়েছিলেন। তারাও আর ফিরে আসতে পারেন নাই। প্রফেসর মোজাফফর আহমেদ, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস আর এডভোকেট জমিরউদ্দিন দেশে ফিরে আসলেই তাঁদের গ্রেফতার করা হত। কিভাবে তারা সেখানে আছেন ভাববার কথা! খরচ কোথায় পাবেন? অনেক বাঙালি বিলাতে ছিল, তারাই নাকি থাকার জায়গা দিয়েছে আর সাহায্যও করেছে।
করাচিতে আতাউর রহমান সাহেব গোলাম মোহাম্মদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্পাদক ছিলেন তখন করাচির মাহমুদুল হক ওসমানী। তিনিও গোলাম মোহাম্মদের সাথে সাক্ষাৎ করে পূর্ব বাংলায় এসে আতাউর রহমান সাহেব, মানিক ভাই ও আরও অনেকের সাথে সাক্ষাৎ করেন। বুঝতে পারলাম, কিছু একটা চলছে। কিন্ত ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের জড়িয়ে পড়া উচিত হবে না। আমি তো বন্দি, কেইবা আমার কথা শুনবে?
আতাউর রহমান সাহেব, গোলাম মহাম্মদের কাছ থেকে একটা বার্তা নিয়ে নাকি জুরিখে শহীদ সাহেবের সাথে দেখা করবেন। কি বার্তা হতে পারে অনেক গবেষণা হল। আতাউর রহমান সাহেবের উচিত ছিল প্রথমে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দাবি করা।
২৮২
যদি গোলাম মোহাম্মদ বা মুসলিম লীগ নেতাদের সাথে কোনো আলোচনা করতে হয়, তবে প্রথমেই মওলানা ভাসানীকে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং আমাদের মুক্তি দেওয়ার বন্দোবস্ত করা। আতাউর রহমান সাহেব জুরিখ থেকে ফিরে আসলেন। গোলাম মোহাম্মদ সাহেবও কিছুদিনের মধ্যে প্রোগ্রাম করলেন, ঢাকায় আসবেন। পাকিস্তানের বড়লাট ঢাকায় আসবেন ভাল কথা। পূর্ব বাংলায় তখন গভরনর শাসন চলছে। পূর্বের সরকার পূর্বের সরকার ভেঙে দিয়েছিল। এখন পর্যন্ত সরকার গঠন করতে দেওয়া হয় নাই। এমএলএরা ও কর্মীরা জেলে। আওয়ামী লীগের সভাপতি বিলাতে, জেনারেল সেক্রেটারি কারাগারে বন্দি। অনেকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ঝুলছে। এই অবস্থায় কি করে গোলাম মোহাম্মদকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেবার বন্দোবস্ত করার জন্য আওয়ামী লীগ নেতারা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বুঝতে কষ্ট হতে লাগল। আরও দেখলাম, একটা ফুলের মালা নিয়ে আতাউর রহমান সাহেব, আর একটা মালা হক সাহেব নিয়ে তেজগাঁ এয়ারপোর্টে গোলাম মোহাম্মদ সাহেবকে অভ্যর্থনা করার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত গোলাম মোহাম্মদ সাহেবকে অভ্যর্থনা করার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত গোলাম মোহাম্মদ সাহেবের গলায় দুইজনই মালা দিলেন। কিছুদিন পূর্বের থেকেই আওয়ামী লীগ ও কৃষক শ্রমিক দলের মধ্যে মনকষাকষি চলছিল এই অভ্যর্থনার ব্যাপার নিয়ে। এটা পরিষ্কার হয়ে পড়ল। কৃষক শ্রমিক দল আর রাজনৈতিক প্রতিষ্টান নয়, একমাত্র হক সাহেবের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার উপর নির্ভর করে কিছু সংখ্যক সুবিধাবাদী লোক একজোট হয়েছে ক্ষমতার ভাগ বসানোর জন্য। এদের কোনো সংগঠন নাই, আদর্শ নাই, নীতি নাই। একমাত্র হক সাহেবই এদের সম্বল। তাঁরা গোলাম মোহাম্মদ সাহেবকে কেন মোহাম্মদ আলী (বগুড়া)কেও অভ্যর্থনা করতে পারেন; কিন্ত আওয়ামী লীগ একটা সংগ্রামী প্রতিষ্টান-সেই প্রতিষ্টানের নেতারা কি করে এই অগণতান্ত্রিক ভদ্রলোককে অভ্যর্থনা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আমার বুঝতে কষ্ট হল! আমি ও আমার সহবন্দিরা খুবই মর্মপীড়ায় ভুগছিলাম। আমাদের দুঃখ হল এজন্য যে, আমাদের নেতারাও ক্ষমতার লোভে পাগল হয়ে পড়েছেন। এতটুকু বুঝবার ক্ষমতা আমাদের নেতাদের হল না যে, যুক্তফ্রন্টের দুই গ্রুপকে নিয়ে খেলা শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও কৃষক শ্রমিক দলকে আলাদা আলাদাভাবে তারা যোগাযোগ করছে, যাতে গোলাম মোহাম্মদ সাহেব পূর্ব বাংলায় এসে বিরাট অভ্যর্থনা পেতে পারেন। হলও তাই। কিন্ত তিনি যা করবেন, তা ঠিক করেই রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীকে দিয়ে যে তিনি যুক্তফ্রন্টকে দ্বিধাবিভক্ত করাবেন সে ক্ষমতাও তাকে দেওয়া হয়েছিল। যদিও পরে শুনেছিলাম, গোলাম মোহাম্মদ ওয়াদা করেছিলেন শহীদ সাহেব জুরিখ থেকে ফিরে আসলেই তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে। বড় বড় শিল্পপতিরা ও কিছু সংখ্যক আমলা কিছুতেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে সেটা চাইছিলেন না।
মোহাম্মদ আলী ঢাকায় এসে গোপনে হক সাহেবের দলের সাথে বোঝাপড়া করে ফেলেছেন যে, আওয়ামী লঈগকে না নিলে তাঁর দলকে পূর্ব বাংলায় সরকার গঠন করতে দিবে এবং শহীদ সাহেব যে কেউই নয় যুক্তফ্রন্টের, একথা ঘোষণা করতে হবে। তা হলেই শহীদ সাহেবকেও দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হবে। মোহাম্মদ আলী জানতেন শহীদ সাহেবই
২৮৩
একমাত্র লোক যে তাঁর প্রধানমন্ত্রীর পদের দাবীদার হতে পারেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে শহীদ সাহেব এত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন যে জনগণ তাঁকেই প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেখতে চায়। চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা জানতেন, হক সাহেবের দলের সাথে আপোস করলে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন না দিয়েও পারা যাবে। তবে আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসন ছাড়া আপোস করবে না।
শহীদ সাহেব যখন ফিরে আসলেন রোগমুক্তির পরে, করাচিতে-তাঁকে বিরাট অভ্যর্থনা জনসাধারণ জানাল। একমাত্র জিন্নাহ ছাড়া এত বড় অভ্যর্থনা আর কেউ পায় নাই। পূর্ব বাংলা থেকে প্রায় বিশ-ত্রিশজন নেতাও তাঁকে অভ্যর্থনা দেয়ার জন্য করাচি উপস্থিত হয়েছিলেন। আতাউর রহমান সাহেব, আবুল মনসুর আহমদ সাহেব সকলেই প্রায় উপস্থিত ছিলেন। শহীদ সাহেব পৌছাবার সাথে সাথে কৃষক শ্রমিকের লোকেরা বলে বেড়াতে লাগলেন শহীদ সাহেব যুক্তফ্রন্টের কেউই নয়, হক সাহেবই নেতা। হক সাহেব তাঁকে সমর্থন করেন না, করেন মোহাম্মদ আলীকে। মন্ত্রিসভা গঠনে গোলাম মোহাম্মদ সাহেব শহীদ সাহেবকে বললেন, এ মন্ত্রিসভায় কেউই প্রধানমন্ত্রী নন, এটা কেয়ারটেকার সরকার। শীঘ্রই শহীদ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে, তবে এখন আইনমন্ত্রী হয়ে তাঁকে একটা শাসনতন্ত্র দিতে হবে।
আমাদের নেতারা কি পরামর্শ শহীদ সাহেবকে দিয়েছিলেন জানি না, তবে শহীদ সাহেব ভুল করলেন, লাহোর ও ঢাকায় না যেয়ে, দেশের অবস্থা না বুঝে মন্ত্রিত্বে যোগদান করে। কৃষক শ্রমিক দলের নেতারা যাই বলুক না কেন, ঢাকায় এসে যদি যুক্তফ্রন্ট পার্টির সভা ডাকতে বলতেন এবং সদস্যদের সাথে পরামর্শ করে তারপর কোনো কিছু করতেন তা হলে কারও কিছু বলার থাকত না। জনগণের চাপে কৃষক শ্রমিক দলের নেতারা তাঁকে সমর্থন করতে বাধ্য হত। জনগণ চারদিকে অন্ধকার দেখছিল। তাদের একমাত্র ভরসা ছিল শহীদ সাহেব দেশে ফিরে আসবেন এবং পাকিস্তানের গণতন্ত্র প্রতিষ্টায় নেতৃত্ব নিবেন। আমরা জেলের ভিতরে বসে খুবই কষ্ট পেলাম এবং আমাদের মধ্যে একটা হতাশার ভাব দেখা দিল। আমি নিজে কিছুতেই তাঁর আইনমন্ত্রী হওয়া সমর্থন করতে পারলাম না। এমনকি মন এমনে ক্ষেপে গিয়েছিলাম। অনেকে আমাকে অনুরোধ করেছিল শহীদ সাহেব রোগমুক্ত হয়ে ফিরে এসেছেন দেশে, তাঁকে টেলিগ্রাম করতে। আমি বলে দিলাম, “না, কোনো টেলিগ্রাম করব না, আমার প্রয়োজন নাই”।
রেণু টেলিগ্রাম পেয়েছে। আব্বার শরীর খুবই খারাপ, তাঁর বাঁচবার আশা কম। ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে রওয়ানা করবে আব্বাকে দেখতে। একটা দরখাস্তও করেছে সরকারের কাছে, টেলিগ্রামটা সাথে দিয়ে। তখন জনাব এন.এম.খান চিফ সেক্রেটারি ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে হওয়ার পূর্ব থেকেই তিনি আমাকে স্নেহ করতেন। রাত
২৮৫
আট ঘটিকার সময় আমার মুক্তির আদেশ দিলেন। নয়টার সময় আমাকে মুক্তি দেওয়া হল। সহকর্মীদের, বিশেষ করে ইয়ার মোহাম্মদ খানকে, ভিতরে রেখে বাইরে যেতে কষ্ট হল। কারণ, তিনি আমাকে জেলগেটে দেখতে এসে গ্রেফতার হয়েছিলেন। আমি বিদায় নিবার সময় বলে গেলাম, “হয় তোমরা মুক্তি পাবা, নতুবা আবার আমি জেলে আসব”। আমি জেলগেটে পার হয়ে দেখলাম, রায় সাহেব বাজারের আমাদের কর্মী নূরুদ্দিন দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে বলল, “ভাবী এইমাত্র বাড়িতে রওয়ানা হয়ে গেছেন, আপনার আব্বার শরীর খুবই খারাপ। তিনি বাদামতলী ঘাট থেকে জাহাজে উঠেছেন। জাহাজ রাত এগারটায় নারায়ণগঞ্জ পৌছাবে। এখনও সময় আছে, তাড়াতাড়ি রওয়ানা করলে নারায়ণগঞ্জে যেয়ে জাহাজ ধরতে পারবেন”। তাকে নিয়ে ঢাকার বাড়িতে উপস্থিত হলাম। কারণ, পূর্বে এ বাড়ি আমি দেখি নাই। আমি জেলে আসার পরে রেণু এটা ভাড়া নিয়েছিল। মালপত্র কিছু রেখে আর সামান্য কিছু নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ছুটলাম। তখনকার দিনে ট্যাক্সি পাওয়া কষ্টকর ছিল। জাহাজ ছাড়ার পনের মিনিট পূর্বে আমি নারায়ণগঞ্জ ঘাটে পৌছালাম। আমাকে দেখে রেণু আশ্চর্য হয়ে গেল। বাচ্চারা ঘুমিয়েছিল। রেণু তাদের ঘুম থেকে তুলল। হাচিনা ও কামাল আমার গলা ধরল, অনেক সময় পর্যন্ত ছাড়ল না, ঘুমালও না, মনে হচ্ছিল ওদের চোখে আজ আর ঘুম নাই।
মুক্তির আনন্দ আমার কোথায় মিলিয়ে গেছে। কারণ, আব্বার চেহারা চোখে ভেসে আসছিল। শুধু একই চিন্তা। দেখতে পারব কি পারব না? বেঁচে আছেন, কি নাই! কেবিন ছেড়ে অনেকক্ষণ বাইরে বসে রইলাম। আজ অনেক দিন পরে রাতের হাওয়া আমার গাঁয়ে লাগছে। জেলে তো সন্ধ্যার সময়ই বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দেয়। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়লে রেণু আর আমি অনেকক্ষণ আলাপ করেছিলাম। ভোর রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ি। সমস্ত দিন জাহাজে থাকতে হবে, রাতে বাড়ির ঘাটে পৌছাব। কোন খবর কেউ জানে না। নৌকায় দুই মাইল পথ যেতে হবে। বাড়ির থেকে নৌকাও আসবে না। সমস্ত দিন উৎকণ্ঠায় কাটালাম।
পরের রাতে বাড়িতে পৌঁছে শুনলাম, আব্বাকে গোপালগঞ্জ নিয়ে গিয়েছে। দেশে ডাক্তার নাই। নৌকায় আবার চৌদ্দ মাইল পথ, রাতেই রওয়ানা করলাম। পরের দিন বেলা দশটায় গোপালগঞ্জ যেয়ে আব্বার অবস্থা দেখে একটু শান্ত হলাম। আব্বা আরোগ্যের দিকে। ডাক্তার ফরিদ আহমদ সাহেব ও বিজিতেন বাবু বললেন, “ভয়ের কোন কারণ নাই”। দুইজনই ভাল ডাক্তার। আব্বা আমাকে পেয়ে আরও ভাল বোধ করতে লাগলেন। পরের দিনই টেলিগ্রাম পেলাম, শহীদ সাহেব আমাকে শীঘ্রই করাচিতে ডেকে পাঠিয়েছেন। আতাউর রহমান সাহেব টেলিগ্রাম করেছেন। ঐদিন রওয়ানা করার কোন কথাই উঠতে পারে না।
পরের দিন রাতে আমি খুলনা, যশোর হয়ে প্লেনে ঢাকা পৌছালাম। ঢাকা থেকে করাচি রওয়ানা হয়ে গেলাম। আমি মনকে কিছুতেই সান্ত্বনা দিতে পারছি না। কারণ, শহীদ সাহেব আইনমন্ত্রী হয়েছেন কেন? রাতে পৌঁছে আমি আর তাঁর সাথে দেখা করতে যাই
২৮৬
নাই। দেখা হলে কি অবস্থা হয় বলা যায় না! আমি তাঁর সাথে বেয়াদবি করে বসতে পারি। পরের দিন সকাল নয়টায় আমি হোটেল মেট্রোপোলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, “গত রাতে এসেছ শুনলাম, রাতেই দেখা করা উচিত ছিল”। আমি বললাম, “ক্লান্ত ছিলাম, আর এসেই বা কি করব, আপনি তো এখন মোহম্মদ আলী সাহেবের আইনমন্ত্রী”। তিনি বললেন, “রাগ করছ, বোধহয়”। বললাম, “রাগ করব কেন স্যার, ভাবছি সারা জীবন আপনাকে নেতা মেনে ভুলই করছি কি না?” তিনি আমার দিকে চেয়ে বললেন, “বুঝেছি, আর বলতে হবে না, বিকাল তিনটায় এস, অনেক কথা আছে”।
আমি বিকাল তিনটায় যেয়ে দেখি তিনি একলা শুয়ে বিশ্রাম করছেন। স্বাস্থ্য এখনও ঠিক হয় নাই, কিছুটা দুর্বল আছেন। আমি তাঁর কাছে বসলাম। তিনি আলাপ করতে আরম্ভ করলেন। অনেকক্ষণ আলাপ করলেন, তার সারাংশ হল গোলাম মোহাম্মদ জানিয়ে দিয়েছেন যে, মন্ত্রিসভায় যোগদান না করলে তিনি মিলিটারিকে শাসনভার দিয়ে দেবেন। আমি বললাম, “পূর্ব বাংলায় যেয়ে সকলের সাথে পরামর্শ করে অন্য কাউকেও তো মন্ত্রিত্ব দিতে পারতেন। আমার মনে হয় আপনাকে ট্র্যাপ করেছে। ফল খুব ভালো হবে না, কিছুই করতে পারবেন না। যে জনপ্রিয়তা আপনি অর্জন করেছিলেন, তা শেষ করতে চলেছেন”। তিনি আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন এবং বললেন, “কিছু না করতে পারলে ছেড়ে দেব, তাতে কি আসে যায়!” আমি বললাম, “এই ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে আপনার যোগদান করা উচিত হয় নাই, আপনি বুঝতে পারবেন”। তিনি আমাকে পূর্ব বাংলায় কখন যাবেন তার প্রোগ্রাম করতে বললেন। আমি বললাম, “ভাসানী সাহেব দেশে না এলে এবং রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি না দিয়ে আপনার ঢাকায় যাওয়া উচিত হবে না”। তিনি রাগ করে বললেন, “তার অর্থ তুমি আমাকে পূর্ব বাংলায় যেতে নিষেধ করছ”। আমি বললাম, “কিছুটা তাই”। তিনি অনেকক্ষণ চক্ষু বন্ধ করে রইলেন। পরে আমাকে বললেন, আগামীকাল আসতে, ঠিক বিকাল তিনটায়। আমি থাকতে থাকতে দেখলাম, আবু হোসেন সরকার সাহেবকে হক সাহেবের নমিনি হিসাবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্বে গ্রহণ করা হয়েছে। শহীদ সাহেব কিছুই জানেন না। এবার তিনি বুঝতে পারলেন যে খেলা শুরু হয়েছে।
হক সাহেব লাহোরে এক খবরের কাগজের প্রতিনিধির কাছে বলেছেন, সোহরাওয়ারদী যুক্তফ্রন্টের কেউই নন, আমিই নেতা। অথচ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ট যুক্তফ্রন্টে। হক সাহেব কেএসপি’র দলের নেতা। কেএসপি, নেজামে ইসলাম মিলেও আওয়ামী লীগের সমান হবে না। সোহরাওয়ারদী সাহেব আওয়ামী লীগের নেতা-হক সাহেব একথা কি করে বলতে পারেন! হক সাহেবের দল গোলাম মোহাম্মদকে বলে দিয়েছে যে, তাঁরা সোহরাওয়ারদী সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী চান না, মোহাম্মদ আলী বগুড়াকে চান, এই জন্যই শহীদ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী করা হয় নাই। আর মোহাম্মদ আলী সাহেব বলে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ দলকে বাদ দিয়েই পূর্ব বাংলায় সরকার গঠন করতে হবে। আমি বুঝতে পারলাম, মোহাম্মদ আলী বগুড়া হক সাহেবের মাথায় ভর করেছেন। আর চৌধুরী মোহাম্মদ
২৮৭
আলী শহীদ সাহেবের মাথায় ভর করেছেন। কেএসপি’র নেতারা তখন অনেকেই করাচিতে। কেউই শহীদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে আসেন না। আমার সাথে কেএসপি’র নেতাদের দু’একজনের দেখা হলে আমি তাঁদের জানালাম, আপনারা অনেক কিছুই করেছেন। কথা ছিল, শহীদ সাহেবকে আপনারা পাকিস্তানের নেতা মানবেন, আর আমরা হক সাহেবকে পূর্ব বাংলার নেতা মানব, এখন আপনারা করাচি এসে মুসলিম লীগ নেতা বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে নেতা মানছেন এবং তাঁকেই সমর্থন করছেন। শহীদ সাহেব যাতে প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন তার চেষ্টা করছেন। আমরাও বাধ্য হব হক সাহেবকে নেতা না মানতে, দরকার হলে যুক্তফ্রন্টের সভায় অনাস্থা প্রস্তাব দেব তাঁর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। আমরা হক সাহেবকে ক্ষমতা দেই নাই যে, তিনি যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে মোহাম্মদ আলী সাহেবকে সমর্থন দেবেন এবং মুসলিম লীগ নেতাকে নেতা মানবেন। কৃষক-শ্রমিক দলের নেতারা কথা পেয়েছেন পূর্ব বাংলায় সরকার তাদেরই দেওয়া হবে। আওয়ামী লীগ দিক থেকে কিছু লোক তাঁরা পাবেন, এ আশ্বাসও তাঁরা পেয়েছেন। যদিও শহীদ সাহেবের সাথে তাঁর মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করার ব্যাপার নিয়ে একমত হতে পারি নাই, তবু অন্য কেউ তাঁকে অপমান করুক এটা সহ্য করা আমার পক্ষে কষ্টকর ছিল। আমি শহীদ সাহেবকে বললাম, “যখন হক সাহেব প্রকাশ্যে বলে দিয়েছেন আপনি যুক্তফ্রন্টের কেউই নন, তখন বাধ্য হয়ে প্রমাণ করতে হবে আপনিও যুক্তফ্রন্টের কেউ। কেএসপি ও নেজামে ইসলামী যুক্তফ্রন্টে থাকে থাকুক। আমরা অনাস্থা দিব হক সাহেবের বিরুদ্ধে। তাতে অন্ততপক্ষে আওয়ামী লীগের নেতা হিসাবে তো কথা বলতে পারবেন এবং আওয়ামী লীগ পার্টি পূর্ব বাংলার আইনসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ট। আওয়ামী লীগ ছাড়া কারও পূর্ব বাংলায় সরকার চালাবার ক্ষমতা নাই”। শহীদ সাহেব বললেন, “যতদিন আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্টে আছে ততদিন তো সত্যিই আমি কেউই নই। হক সাহেব যুক্তফ্রন্টের নেতা, তিনি আওয়ামী লীগ, কেএসপি ও নেজামে ইসলাম পার্টির পক্ষ থেকে কথা বলতে পারেন”।
আমি ঢাকায় ফিরে এসে আতাউর রহমান সাহেব, আবুল মনসুর আহমদ ও মানিক ভাইকে নিয়ে বৈঠকে বসলাম এবং সকল কথা তাঁদের বললাম। শহীদ সাহেবের মতামতও জানালাম। ভাসানী সাহেব কলকাতা এসে পৌছেছেন খবর পেয়েছি, কিন্ত কোথায় আছেন জানি না। শহীদ সাহেব এন.এম.খান চিফ সেক্রেটারি সাহেবকে টেলিফোন করেছেন রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে। অনেক কর্মীই আস্তে আস্তে মুক্তি পেতে লাগল। কেএসপি দলের নেতারা রাজবন্দিদের মুক্তির জন্য একটা কথাও বলেন নাই। কারণ, তাদের দলের কেউই জেলে নাই। আওয়ামী লীগ এমএলএ ও কর্মীরা তখনও অনেকে জেলে এবং অনেকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ঝুলছে। আতাউর রহমান সাহেব, আবুল মনসুর আহমদ, মানিক ভাই ও আমি অনেকক্ষণ আলাপ-আলোচনা করলাম। হক সাহেবের নেতৃত্বে অনাস্থা দেওয়া
২৮৮
হবে কি হবে না, এ বিষয়ে। হক সাহেবের চেয়েও তাঁর কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গই বেশি তৎপর মুসলিম লীগের সাথে কোনো নীতি, আদর্শ ছাড়াই মিটমাট করার। কোথায় গেল একুশ দফা, আর কোথায় গেল জনতার রায়। তিনজনই প্রথমে একটু অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। অনাস্থা সম্বন্ধে কোনো আপত্তি নাই, তবে পারা যাবে কি যাবে না এ প্রশ্ন তুলেছিলেন। আমি বললাম, না পারার কোনো কারণ নাই। নীতি বলেও তো একটা কথা আছে। শেষ পর্যন্ত সকলেই রাজি হলে আমি ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহবান করলাম। ওয়ার্কিং কমিটির প্রায় সকল সদস্যই একমত, কেবল সালাম সাহেব ও হাশিমউদ্দিন সাহেব একমত হতে পারলেন না। তবে একথা জানালেন যে, তাঁরা ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত নিশ্চিয়ই মানতে বাধ্য।
আমি ও আতাউর রহমান সাহেব বের হয়ে পড়লাম এমএলএদের দস্তখত নিতে। সতের দফা চার্জ গঠন করলাম। হক সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে কে অনাস্থা প্রস্তাব প্রথমে পেশ করবে, সে প্রশ্ন হল। অনেকেই আপত্তি করতে লাগলেন, আমার নিজেরও লজ্জা করতে লাগল। তাঁকে তো আমিও সম্মান ও ভক্তি করি। কিন্ত এখন কয়েকজন তথাকথিত নেতা তাঁকে ঘিরে রেখেছে। তাঁকে তাদের কাছ থেকে শত চেষ্টা করেও বের করতে পারলাম না। এদের অনেকেই নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস পূর্বে মুসলিম লীগ ত্যাগ করে এসেই ক্ষমতার লড়াইয়ে পরাজিত হয়। ঠিক হল, আমিই প্রস্তাব আনব আর জনাব আবদুল গণি বার এট ল’ সমর্থন করবেন। আমরা তাঁর কাছে সভা ডেকে অনাস্থা প্রস্তাব মোকাবেলা করার জন্য অনুরোধ করলাম। তিনিও সভা ডাকতে রাজি হলেন। আমরা আওয়ামী লীগের প্রায় একশত তেরজন সদস্যের দস্তখত নিলাম। তাতেই আমাদের হয়ে গেল।
টীকা
১. পান্ডুলিপির জন্য ব্যবহৃত খাতাগুলি ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন্স, ঢাকা ডিভিশন, সেন্ট্রাল জেল, ঢাকা, ৯ই জুন ১৯৬৭ ও ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ তারিখে পরীক্ষা করেন। অপরদিকে লেখককে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ১৭ জানুয়ারি ১৯৬৮ থেকে ঢাকা সেনানিবাসে আটক করা হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, লেখক তাঁর এই আত্মজীবনীটি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৯৬৭ সালের দ্বিতীয়ার্ধে রচনা শুরু করেন।
২. গোপালগঞ্জ বর্তমানে জেলা। বাংলাদেশের প্রায় সকল মহকুমাই জেলায় রূপান্তরিত হয়েছে।
৩. এক পয়সা এক টাকার চৌষট্টি ভাগের একভাগ।
৪. একাউন্টয়ান্ট জেনারেল অব বেঙ্গল।
৫. স্বদেশী আন্দোলন বঙ্গভঙ্গকে (Partition of Bengal) রোধ করার সংকল্প নিয়ে ১৯০৫ সালে শুরু হয়ে ১৯০৮ সালে এই আন্দোলন শেষ হয়। গান্ধী-পূর্বকালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যতগুলি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়েছে, এটি ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। বঙ্গবন্ধু এখানে স্বদেশী আন্দোলন বলতে মহত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবিরোধী আন্দোলনকে এবং স্বদেশী বলতে সম্ভবত আন্দোলনের চরমপন্থীদের বুঝিয়েছেন।
৬. সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় জনপ্রশাসনের সরবোচ্চ ক্যাডার।
৭. মেম্বার অব লেজিসলেটিভ এসেম্বলি।
৮. লেখক এখানে ভুলবশত কৃষক প্রজা পার্টির পরিবর্তে কৃষক শ্রমিক পার্টির কথা উল্লেখ করেছেন। অবিভক্ত বাংলায় ১৯৩৫ সালে এ.কে.ফজলুল হক কতৃক কৃষক প্রজা পার্টি প্রতিষ্টিত হয়। অপরদিকে তিনি ১৯৫৩ সালে কৃষক শ্রমিক পার্টি প্রতিষ্টা করেন।
৯. অল-ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ। এটি ১৯০৬ সালে ঢাকায় প্রধানত অবাঙালি মুসলিম অভিজাত নবাব নাইট ও জমিদারদের উদ্যোগে প্রতিষ্টিত রাজনৈতিক দল। এই দলই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে ১৯৫৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্টা করে।
১০. ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। ভারতীয় প্রধান রাজনৈতিক দল। দলটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়।
১১. অবিভক্ত বাংলার মুসলমান ছাত্রদের সংগঠন। তৎকালীন ছাত্রনেতা আবদুল ওয়াসেক এই ছাত্র সংগঠনের নেতা ছিলেন। শাহ আজিজুর রহমান, শেখ মুজিবুর রহমানও এই সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
১২. হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন।
১৩. বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টস। এই সাংস্কৃতিক প্রতিষ্টানটি ১৯৫৫ সালে ঢাকায় প্রতিষ্টিত হয়।
১৪. মেম্বার অব লেজিসলেটিভ কাউন্সিল।
১৫. লাহোর প্রস্তাবে (১৯৪০) মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট প্রদেশদের নিয়ে একাধিক পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির কথা বলা হয়েছিল। কিন্ত দিল্লি কনভেনশনে একটি মাত্র মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করা হয়। সমালোচকদের মতে এই ব্যবস্থায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট ভারতের পশ্চিমাঞ্চল থেকে এক হাজার মাইল ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বিচ্ছিন্ন থাকবে। তাই এ ধরনের একটি রাষ্ট্র হবে অবাস্তব।
১৬. সুভাষ বসুর অনুসারী ভারতীয় রাজনৈতিক দল।
১৭. ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্টার সঙ্গে সঙ্গেই (১ সেপ্টেম্বর) পাকিস্তানী সাংস্কৃতিক দর্শন প্রচার এবং ভিত্তি নির্মাণের লক্ষ্যে তমুদ্দন মজলিস প্রতিষ্টিত হয়। ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তমুদ্দন মজলিস সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
১৮. ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.) একবার মদিনা মনোয়ার জনগণকে টুকরো কাপড় সমভাবে ভাগ করে দেন। ওই কাপড়ের টুকরো এমন ছিল না যাতে কেউ বড় জামা বানাতে পারে। কিন্ত ওমর (রা.) ঐ কাপড় দিয়ে বড় জামা বানালে লোকের সন্দেহ জাগে ও তাঁকে প্রশ্ন করে যে কিভাবে ঐ কাপড় দিয়ে বড় জামা বানালেন। ওমর (রা.)-এর পুত্র এই সন্দেহ দূর করেন এই বলে যে, তিনি তার ভাগের কাপড়টি পিতাকে দান করেছেন যাতে তিনি বড় জামা বানাতে পারেন। যিনি যতই ক্ষমতাশালী হোন না কেন অন্যায় মনে হলে জনগণ যে বিনা দ্বিধায় তাঁকে প্রশ্ন করতে পারে, লেখক সেই প্রসঙ্গটি তুলে এনেছেন।
১৯. পশ্চিম পাঞ্জাবের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নবাব ইফতিখার হোসেন মামদোতের বিরুদ্ধে পাবলিক এন্ড রিপ্রেজেনটেটিভ অফিসেস ডিসকোয়ালিফিকেশন এক্ট ১৯৪৯ (প্রাডো) মামলা রুজু করা হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদী আসামি পক্ষের আইনজীবী ছিলেন। তিনি ঐ মামলায় মামদোতকে সকল অভিযোগ থেকে মুক্ত করতে পারেননি, তবে তাঁকে ক্ষতিপুরন বাবদ অর্থ প্রদানের দায় থেকে অব্যহতি পাইয়ে দিতে সমর্থ হন।
২০. পাবলিক এন্ড রিপ্রেজেনটেটিভ অফিসেস ডিসকোয়ালিফিকেশন এক্ট ১৯৪৯।
২১. রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। ভারতের চরমপন্থী হিন্দুত্ববাদী একটি সংগঠন।
২২. Public Offices Disqualification Order। দেশের অনেক রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য ঘোষণার উদ্দেশ্যে আইয়ুব খানের সামরিক সরকার ১৯৫৯ সালের ৭ আগস্ট এই আদেশ জারি করেন। এখানে লেখক পরবর্তী সময়ের ঘটনা উল্লেখ করেছেন।
২৩. রাওয়ালপিন্ডি কনসপিরেসি কেস নামে পরিচিত। ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের লিয়াকত আলী খান সরকারকে উৎখাতের জন্য এই সাময়িক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল। উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়। পাকিস্তান আর্মির একজন ঊর্ধ্বতন কমান্ডার মেজর জেনারেল আকবর খান কতিপয় সামরিক কর্মকর্তা ও পাকিস্তানের বামপন্থী রাজনৈতিক নেতারা মিলে এই অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেন। এতে ১১ জন সামরিক কর্মকর্তা ও ৪ জন বেসামরিক ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়। ১৮ মাস ধরে গোপনে পরিচালিত এই বিচারে মেজর জেনারেল খান ও কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ দোষী সাব্যস্ত হন। তাঁদের দীর্ঘ মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। হোসেন শহীদ সহরাওয়ারদী পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে দণ্ডপ্রাপ্ত প্রায় সকলের দণ্ড মওকুফ করাতে সমর্থ হন। [সূত্র:উইকিপিডিয়া]
২৪. পাণ্ডুলিপির সঙ্গে বক্তৃতার কপি পাওয়া যায় নাই।
২৫. পাণ্ডুলিপির সঙ্গে ম্যানিফেস্টো পাওয়া যায় নাই।
২৬. ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল (১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্টিত): মুসলিম আসন ২৩৭-যুক্তফ্রন্ট ২২৩ (আওয়ামী লীগ ১৪০; কৃষক শ্রমিক পার্টি ৩৪; নেজামে ইসলামী ১২; যুবলীগ ১৫; গণতান্ত্রিক দল ১০; কমিউনিস্ট পার্টি ৪; ও স্বতন্ত্র ৮ ); মুসলিম লীগ ৯ (১জন স্বতন্ত্র নির্বাচনের পরে মুসলিম লীগে যোগ দেন); খিলাফত-ই-রব্বানী ১; স্বতন্ত্র ৪।
সাধারণ আসন (অমুসলিম সদস্য) ৭২: কংগ্রেস ও অন্যান্য ৭২।
মোট আসন ৩০৯ (মুসলিম লীগ ৯; যুক্তফ্রন্ট ও সহযোগী ২৯১; অন্যান্য ৯)। (সূত্র: রঙ্গলাল সেন, পলিটিক্যাল এলিটস ইন বাংলাদেশ, ইউপিএল, ঢাকা, ১৯৮৬, পৃ. ১২৩-১২৫)।
২৭. ৪ মে ১৯৫৪ পশ্চিমবঙ্গ সফরকালে পূর্ব বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক বলেন: এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, দুই বাংলার জনগণকে একটি মৌলিক সত্য অনুধাবন করতে হবে, সুখে শান্তিতে বাস করতে চাইলে তাঁদের অতি অবশ্যই পরস্পরকে সাহায্য সহযোগিতা করতে হবে। রাজনীতিকরা ভূখণ্ডকে ভাগ করেছেন, কিন্ত সাধারণ মানুষকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যাতে প্রত্যেক শান্তিতে বসবাস করতে পারে। ইতিহাসে ভাষা হচ্ছে ঐক্যসাধনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং দুই বাংলার জনগণ একই ভাষার বন্ধনে আবদ্ধ, তাদের রাজনৈতিক বিভেদ ভুলতে হবে এবং তারা যে এক তা অনুভব করতে হবে। (ইংরেজি থেকে অনুবাদ, সূত্র: মর্নিং নিউজ, ৫ মে ১৯৫৪, উদ্বৃতি, রঙ্গলাল সেন, পলিটিক্যাল এলিটস ইন বাংলাদেশ, ইউপিএল, ঢাকা, ১৯৮৬, পৃ. ১২৯)।
২৮. পাকিস্তানের গভরনর জেনারেল গভরনমেন্ট অব ইন্ডিয়া এক্ট ১৯৩৫ তে ৯২/ক ধারা যুক্ত করেন, যার বলে কতকগুলো বিশেষ ক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেল কোন প্রদেশের গভর্নরকে ঐ প্রদেশের জন্য আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা দিয়ে ঘোষণা জারি করতে পারেন। (সূত্র: হামিদ খান, কন্সটিটিউশনাল এন্ড পলিটিক্যাল হিস্ট্রি অব পাকিস্তান, অক্সফোর্ড, করাচি, ২০০৯, পৃ.১১৩)।
২৯. South East Asia Treaty Organization।
৩০. Central Treaty Organization।
৩১. অনাস্থার পক্ষে একশত তেরজন সদস্যের দস্তখত থাকা সত্ত্বেও ফজলুল হকের বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত গৃহীত হয়নি। আওয়ামী লীগের পয়ত্রিশজন সদস্য সালাম খানের নেতৃত্বে অনাস্থা প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেন, ওপর দিকে অনেকটাই অপ্রত্যাশিতভাবে কৃষক শ্রমিক পার্টি ও নেজামে ইসলামী দলের সদস্যরা জোটবদ্ধভাবে ফজলুল হককে সমর্থন করেন। অনাস্থা প্রস্তাব তাই পরাজিত হয়। (সূত্র: এস. এ. করিম, শেখ মুজিব: ট্রায়াম্ফ এন্ড ট্র্যাজেডি, ২য় সংস্করণ, ইউপিএল, ঢাকা, ২০০৯, পৃ. ৬৩।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন পরিচয়
(১৯৫৫-১৯৭৫)
১৯৫৫
৫ জুন বঙ্গবন্ধু গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ১৭ জুন ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি করে ২১ দফা ঘোষণা করা হয়। ২৩ জুন আওয়ামী লীগের কার্যকরী পরিষদে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা না হলে দলীয় সদস্যরা আইনসভা থেকে পদত্যাগ করবেন। ২৫ আগস্ট করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু বলেন:
Sir, you will see that they want to place the word ‘East Pakistan’ instead of ‘East Bengal’. We have demanded so many times that you should use Bengal instead of Pakistan. The word ‘Bengal’ has a history, has a tradition of its own. You can change it only after the people have been consulted. If you want to change it then we have to go back to Bengal and ask them whether they assept it. So far as the question of One-Unit is concerned it can come in the constitution. Why do you want it to be taken up just now? What about the state language, Bengali? What about joint electorate? What about autonomy? The people of East Bengal will be prepared to consider One-Unit with all these things. So, I appeal to my friends on that side to allow the people to give their verdict in any way, in the form of referendum or in the form of plebiscite.
[অনুবাদ:স্যার আপনি দেখবেন ওরা ‘পূর্ব বাংলা’ নামের পরিবর্তে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে, আপনারা এটাকে বাংলা নামে ডাকেন। ‘বাংলা’ শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য। আপনারা এই নাম আমাদের জনগণের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরিবর্তন করতে পারেন। আপনারা যদি ওই নাম পরিবর্তন করতে চান তাহলে আমাদের বাংলায় আবার যেতে হবে এবং সেখানকার জনগণের কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে তারা নাম পরিবর্তনকে মেনে নেবে কি না। এক ইউনিটের প্রশ্নটা শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। আপনারা এই প্রশ্নটাকে এখনই কেন তুলতে চান? বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করার
২৯৪
ব্যাপারে কি হবে ? যুক্ত নির্বাচনী এলাকা গঠনের প্রশ্নটারই কি সমাধান? আমাদের স্বায়ত্তশাসন সম্বন্ধেই বা কি ভাবছেন? পূর্ব বাংলার জনগণ অন্যান্য প্রশ্নগুলোর সমাধানের সাথে এক ইউনিটের প্রশ্নটাকে বিবেচনা করতে প্রস্তুত। তাই আমি আমার ঐ অংশের বন্ধুদের কাছে আবেদন জানাব তারা যেন আমাদের জনগণের ‘রেফারেন্ডাম’ অথবা গণভোটের মাধ্যমে দেয়া রায়কে মেনে নেন।]
২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ প্রত্যাহার করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৫৬
৩ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ মুখ্যমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে খসড়া শাসনতন্ত্রে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্তির দাবি জানান। ১৪ জুলাই আওয়ামী লীগের সভায় প্রশাসনে সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্বের বিরোধিতা করে একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্ত প্রস্তাব আনেন বঙ্গবন্ধু। ৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে খাদ্যের দাবিতে ভুখা মিছিল বের করা হয়। চকবাজার এলাকায় পুলিশ মিছিলে গুলি চালালে ৩ জন নিহত হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ-এইড দপ্তরের মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন।
১৯৫৭
সংগঠনকে সুসংগঠিত করার উদ্দেশ্যে ৩০ মে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শেখ মুজিব মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২৪ জুন থেকে ১৩ জুলাই তিনি চীনে সরকারি সফর করেন।
১৯৫৮
৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দর মির্জা ও সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ১১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় এবং একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করে হয়রানি করা হয়। প্রায় চৌদ্দ মাস জেলখানায় থাকার পর তাঁকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় জেলগেটের গ্রেফতার করা হয়।
১৯৬০
৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করে তিনি মুক্তি লাভ করেন। সামরিক শাসন ও আইয়ুববিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু গোপন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। এ সময়ই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে কাজ করার
২৯৫
জন্য বিশিষ্ট ছাত্র নেতৃবৃন্দ দ্বারা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্টা করেন। প্রতি মহকুমায় এবং থানায় নিউক্লিয়াস গঠন করেন।
১৯৬২
৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। জুন চার বছরের সামরিক শাসনের অবসান ঘটলে ১৮ জুন বঙ্গবন্ধু মুক্তিলাভ করেন। ২৫ জুন বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যৌথ বিবৃতি দেন। ৫ জুলাই পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু আইয়ুব সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। ২৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু লাহোর যান, এখানে শহীদ সোহরাওয়ারদীর নেতৃত্বে বিরোধীদলীয় মোরচা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠিত হয়। অক্টোবর মাসে গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য তিনি শহীদ সোহরাওয়ারদীর সাথে সারা বাংলা সফর করেন।
১৯৬৩
সোহরাওয়ারদী অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডন অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধু তাঁর সঙ্গে পরামর্শের জন্য লন্ডন যান। ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ারদী বৈরুতে ইন্তেকাল করেন।
১৯৬৪
২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অনুষ্টিত এক সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এই সভায় দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটের মাধ্যমে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায় সম্বলিত প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। দাঙ্গার পর আইয়ুববিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগ গ্রহণ। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ১৪ দিন পূর্বে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৬৫
শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও আপত্তিকর বক্তব্য প্রদানের অভিযোগে মামলা দায়ের। এক বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে হাইকোর্টের নির্দেশে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি মুক্তিলাভ করেন।
১৯৬৬
৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের জাতীয় সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। প্রস্তাবিত ৬ দফা ছিল বাঙালি জাতির
২৯৬
মুক্তি সনদ। ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু ৬ দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সারা বাংলায় গণসংযোগ সফর শুরু করেন। এ সময় তাঁকে সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় বারবার গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধু এ বছরের প্রথম দিন মাসে আটবার গ্রেফতার হন। ৮ মে নারায়ণগঞ্জ পাটকল শ্রমিকদের জনসভায় বক্তৃতা শেষে তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। ৭ জুন বঙ্গবন্ধু ও আটক নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটের সময় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে পুলিশের গুলিতে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় মনু মিয়াসহ ১১ জন শ্রমিক নিহত হয়।
১৯৬৮
৩ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামি করে মোট ৩৫ জন বাঙালি সেনা ও সিএসপি অফিসারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় জেলগেট থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে আটক রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত আসামিদের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে বিক্ষোভ শুরু হয়।
১৯ জুন ঢাকা সেনানিবাসে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের বিচারকার্য শুরু হয়।
১৯৬৯
৫ জানুয়ারি ৬ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন গণআন্দোলনে পরিণত হয়। পরে ১৪৪ ধারা ও কারফিউ ভঙ্গ, পুলিশ-ইপিআর-এর গুলিবর্ষণ, বহু হতাহতের মধ্য দিয়ে গণুভ্যুত্থানের রূপ নিলে আইয়ুব সরকার ১ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠকের আহবান জানায় এবং বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দান করা হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তিদান প্রত্যাখান করেন। ২২ ফেব্রুয়ারি জনগণের অব্যাহত চাপের মুখে কেন্দ্রীয় সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য আসামিকে মুক্তি দানে বাধ্য হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স (সোহরাওয়ারদী উদ্যান) ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। প্রায় ১০ লাখ ছাত্র জনতার এই সংবর্ধনা সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্টানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের ভাষণে ছাত্র সমাজের ১১ দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান।
১০ মার্চ বঙ্গবন্ধু রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন। বঙ্গবন্ধু গোলটেবিল বৈঠকে আওয়ামী লীগের ৬ দফা ও ছাত্র সমাজের ১১ দফা
২৯৭
দাবি উপস্থাপন করে বলেন, ‘গণুসন্তোষ নিরসনে ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই’। পাকিস্তানী শাসকগোষ্টী ও রাজনীতিবিদরা বঙ্গবন্ধুর দাবি অগ্রাহ্য করলে ১৩ মার্চ তিনি গোলটেবিল বৈঠক ত্যাগ করেন এবং ১৪ মার্চ ঢাকার ফিরে আসেন। ২৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন। ২৫ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু তিন সপ্তাহের সাংগঠনিক সফরে লন্ডন গমন করেন।
৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ারদীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। তিনি বলেন, “একসময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্টা হইতে ‘বাংলা’ কথাটার সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে।… একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোন কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুজিয়া পাওয়া যায় নাই।… জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি-আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।
১৯৭০
৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পুনরায় আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হন। ১ এপ্রিল আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের সভায় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানে জনসভায় বঙ্গবন্ধু ৬ দফার প্রশ্নে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান। ১৭ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু তাঁর দলের নির্বাচনী প্রতীক হিসাবে ‘নৌকা’ প্রতীক পছন্দ করেন এবং ঢাকার ধোলাইখালে প্রথম নির্বাচনী জনসভার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। ২৮ অক্টোবর তিনি জাতির উদ্দেশ্যে বেতার- টিভি ভাষণে ৬ দফা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়যুক্ত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান। ১২ নভেম্বরের গোরকিতে উপকূলীয় এলাকায় ১০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটলে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারণা বাতিল করে দুর্গত এলাকায় চলে যান এবং আরতমানবতার প্রতি পাকিস্তানী শাসকদের ঔদাসীন্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। তিনি গোরকি উপদ্রুত মানুষের ত্রাণের জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহবান জানান। ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে।
১৯৭১
৩ জানুয়ারি রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন। আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যরা ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা এবং জনগণের প্রতি আনুগত্য থাকার শপথ গ্রহণ করেন। ৫ জানুয়ারি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বাধিক আসন লাভকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী
২৯৮
ভুট্টো কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠনে তাঁর সম্মতির কথা ঘোষণা করেন। জাতীয় পরিষদ সদস্যদের এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধু পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত হন। ২৮ জানুয়ারি জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। তিন দিন বৈঠকের পর আলোচনা ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের আলোচনা ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহবান করেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক বয়কটের ঘোষণা দিয়ে দুই প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ট দুই দলের প্রতি ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি জানান।
১৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে জনাব ভুট্টোর দাবির তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘ভুট্টো সাহেবের দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ক্ষমতা একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ট দল আওয়ামী লীগের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। ক্ষমতার মালিক এখন পূর্ব বাংলার জনগণ’।
১ মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা দিলে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের জরুরি বৈঠকে ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহবান করা হয়। ৩ মার্চ সারা বাংলায় হরতাল হবার পর বঙ্গবন্ধু অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য প্রেসিডেন্টের প্রতি দাবি জানান।
৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’। ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে শৃঙ্খল মুক্তির আহবান জানিয়ে ঘোষণা করেন, “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রর মোকাবেলা করতে হবে। … রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ”।
তিনি শক্রর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহবান জানান এবং ইয়াহিয়া খানের সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। একদিকে রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়ার নির্দেশ যেত, অপরদিকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়ক থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ যেত, বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলতেন। অফিস, আদালত, ব্যাংক, বীমা, স্কুল-কলেজ, গাড়ি, শিল্প কারখানা সবই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনেছে। ইয়াহিয়ার সব নির্দেশ অমান্য করে অসহযোগ আন্দোলনে বাংলার মানুষের সেই অভূতপূর্ব সারা ইতিহাসে বিরল ঘটনা। মূলত ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসাবে বঙ্গবন্ধুই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন।১৬ মার্চ ঢাকায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়। আলোচনার জন্য জনাব ভুট্টোও ঢাকায় আসেন। ২৪ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো আলোচনা হয়। ২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হবার পর সন্ধ্যায় ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগ। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। আক্রমণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা রাইফেল সদর দফতর ও রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার।
২৯৯
বঙ্গবন্ধু ২৫শে মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন:
This may be my last message, from to-day Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.
[অনুবাদঃ এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহবান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সেনাটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে]
এই ঘোষণা বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়ারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেরিত হয়। এর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বাংলায় নিম্নলিখিত একটি বার্তা পাঠান:
পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি রক্ষা করার জন্য শক্রদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপোস নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শক্রকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।
বঙ্গবন্ধুর। এই বার্তা তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় সারা দেশে পাঠানো হয়। সর্বস্তরের জনগণের পাশাপাশি চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাসে বাঙালি জওয়ান ও অফিসাররা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১.৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং এর তিন দিন পর তাঁকে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়।
২৬ মার্চ জে. ইয়াহিয়া এক ভাষণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করে।
২৬ মার্চ চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম.এ.হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের
৩০০
বৈদ্যনাথলার আম্রকাননে (মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্টিত হয়। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। বাংলাদেশ লাভ করে স্বাধীনতা। তার আগে ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের ফায়জালাবাদ (লায়ালপুর) জেলে বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচার করে তাঁকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার দাবি জানায়। ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতির জনক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদানের দাবি জানান হয়। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। তিনি বাংলাদেশের স্থপতি, কাজেই পাকিস্তানের কোন অধিকার নেই তাকে বন্দি করে রাখার। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বহু রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করেছে।
১৯৭২
৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক চাপে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেদিনই বঙ্গবন্ধুকে ঢাকার উদ্দেশ্যে লন্ডন পাঠানো হয়। ৯ জানুয়ারি লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের সাথে সাক্ষাৎ হয়। লন্ডন থেকে ঢাকা আসার পথে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করেন। বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি.ভি. গিরি ও প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌছালে তাঁকে অবিস্মরণীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে লক্ষ জনতার সমাবেশ থেকে অশ্রিসুক্ত নয়নে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৬ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকারের আমন্ত্রণে তিনি ভারত যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ ১৯৪৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে দেয়া বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে। ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে যান। ১২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ভারতীয় মিত্রবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে।
১ মে তিনি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। ৩০ জুলাই লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর পিত্তকোষে অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপাচারের পর লন্ডন থেকে তিনি জেনেভা যান। ১০ অক্টোবর বিশ্বশান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরী’ পুরুষ্কারে ভূষিত করে। ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তারিখ (৭ মার্চ ১৯৭৩) ঘোষণা করেন। ১৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানের
৩০১
কথা ঘোষণা করেন। ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষর করেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হয়। প্রশাসনিকব্যবস্থার পুনর্গঠন, সংবিধান প্রণয়ন, এক কোটি মানুষের পুনর্বাসন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণ, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত বিনামূল্যে এবং মাধ্যমিক শ্রেনী পর্যন্ত নামমাত্র মূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, মদ, জুয়া, ঘোড়াদৌড়সহ সমস্ত ইসমালবিরোধী কর্মকাণ্ড কার্যকরভাবে নিষিদ্ধকরণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্টা, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন, ১১,০০০ প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্টাসহ ৪০,০০০ প্রাথমিক স্কুল সরকারিকরণ, মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর হাতে ধর্ষিতা মেয়েদের পুনর্বাসনের জন্য নারী পুনর্বাসন সংস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ, বিনামূল্যে/স্বল্পমূল্যে কৃষকদের মধ্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ, পাকিস্তানীদের পরিত্যক্ত ব্যাংক, বীমা ও ৫৮০ টি শিল্প ইউনিটের জাতীয়করণ ও চালু করার মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান, ঘোড়াশাল সার কারখানা, আশুগঞ্জ কমপ্লেক্সের প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য নতুন শিল্প স্থাপন, বন্ধ শিল্প কারখানা চালুকরণসহ অন্যান্য সমস্যার মোকাবেলা করে একটি সুষ্টু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবকাঠামো তৈরি করে দেশকে ধীরে ধীরে একটি সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়াস চালানো হয়। অতি অল্প সময়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্য।
১৯৭৩
জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৯৩ আসন লাভ। ৩ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ, সিপিবি ও ন্যাপের সমন্বয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়। ৬ সেপ্টেম্বর জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য বঙ্গবন্ধু আলজেরিয়া যান। ১৭ অক্টোবর তিনি জাপান সফর করেন।
১৯৭৪
২২ ফেব্রিয়ারি বাংলাদেশকে পাকিস্তান স্বীকৃতি দেয়। ২৩ ফেব্রিয়ারি ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান গমন করেন। ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে এবং বঙ্গবন্ধু ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রথমবারের মত বাংলায় ভাষণ দেন।
১৯৭৫
২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন এবং বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ। ২৪ ফেব্রিয়ারি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন। বঙ্গবন্ধু জাতীয় দলে যোগদানের জন্য দেশের সকল
৩০২
রাজনৈতিক দল ও নেতাদের প্রতি আহবান জানান। বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বাঙালি জাতিকে আত্মনির্ভরশীল হিসাবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তাই স্বাবলম্বিতা অর্জনের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক নীতিমালাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজান। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে মানুষের আহার, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী ঘোষণা দেন যার লক্ষ্য ছিল-দুর্নীতি দমন; ক্ষেতে খামারে ও কলকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি; জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্টা। এই লক্ষ্যে দ্রুত অগ্রগতি সাধিত করবার মানসে ৬ জুন বঙ্গবন্ধু সকল রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী মহলকে ঐক্যবদ্ধ করে এক মঞ্চ তৈরি করেন, যার নাম দেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু এই দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণের আহবান জানিয়ে অভূতপূর্ব সাড়া পান। অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করে। উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। চোরাকারবারি বন্ধ হয়। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার আওতায় চলে আসে।
নতুন আশার উদ্দীপনা নিয়ে স্বাধীনতার সুফল মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবার জন্য দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে। কিন্ত মানুষের সে সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয় না।
১৫ আগস্টের ভোরে হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ বাসভবনে সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চাভিলাষী বিশ্বাসঘাতক অফিসারদের হাতে নিহত হন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুননেছা, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্টপুত্র মুক্তিযোদ্ধা লে. শেখ কামাল, পুত্র লে. শেখ জামাল, কনিষ্ট পুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবত ও তাঁর কন্যা বেবী সেরনিয়াবত, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবত, দৌহিত্র সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, ভ্রাতাস্পুত্র শহীদ সেরনিয়াবত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিল আহমেদ এবং ১৪ বছরের কিশোর আবদুল নাঈম খান রিন্টুসহ ১৬ জনকে ঘাতকরা হত্যা করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মহামানব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ হবার পর দেশে সামরিক শাসন জারি হয়। গণতন্ত্রকে হত্যা করে মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। শুরু হয় হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। কেড়ে নেয় জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকার।
বিশ্বে মানবাধিকার রক্ষার জন্য হত্যাকারীদের বিচারের বিধান রয়েছে, কিন্ত বাংলাদেশে জাতির জনকের আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচারের হাত থেকে রেহাই দেবার জন্য ২৬ শে সেপ্টেম্বর এক সামরিক অধ্যাদেশ (ইনডেমিনিটি অর্ডিন্যান্স) জারি করা হয়। জেনারেল
৩০৩
জিয়াউর রহমান সামরিক শাসনের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নামে এক কুখ্যাত কালো আইন সংবিধানে সংযুক্ত করে সংবিধানের পবিত্রতা নষ্ট করে। খুনিদের বিদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরষ্কৃত করে।
১৯৯৬ সালের ২৩ জুন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের সদস্যগণকে হত্যার বিরুদ্ধে এজাহার দায়ের করা হয়। ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়। ১ মার্চ ’৯৭ ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারকার্য শুরু হয়। ৮ নভেম্বর ’৯৮ জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ৭৬ পৃষ্টার রায় ঘোষণায় ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। ১৪ নভেম্বর ২০০০ সালে হাইকোর্টে মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলে দুই বিচারক বিচারপতি মোঃ রহুল আমিন এবং বিচারপতি এ.বি.এম. খায়রুল হক দ্বিমতে বিভক্ত রায় ঘোষণা করেন। এরপর তৃতীয় বিচারপতি মোঃ ফজলুল করিম ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ২০১০ সালের ২ জানুয়ারি আপিল বিভাগে আসামিদের রিভুই পিটিশন দাখিল এবং তিন দিন শুনানি শেষে ২৭ জানুয়ারি চার বিচারপতি রিভিউ পিটিশনও খারিজ করেন। এদিনই মধ্যরাতের পর ২৮ জানুয়ারি পাঁচ ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ঘাতকদের একজন বিদেশে পলাতক অবস্থায় মারা গেছে এবং ছয়জন বিদেশে পলাতক রয়েছে। এই নৃশংস হত্যাকান্ডের বিচারের দাবি ৩৪ বছর পর বাস্তবায়িত হল।
১৫ আগস্ট জাতির জীবনে এক কলঙ্কময় দিন। এই দিবসটি জাতীয় শোক দিবস হিসাবে বাঙালি জাতি পালন করে।*
*জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, ঢাকা কতৃক প্রকাশিত এলবাম জাতির জনক, ৩য় প্রকাশ, ১৭ মার্চ ২০১০ থেকে উদ্বৃত।