This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
এগারোটি সেক্টরের বিজয় কাহিনী
মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি
প্রারম্ভ
একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিতভাবে স্বাধিকার আন্দোলনে মত্ত নিরস্ত্র বিক্ষুব্ধ জনতার ওপরে হিংস্র হায়েনার মতাে ঝাপিয়ে পড়ে। ঢাকা সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাত সাড়ে এগারােটার সময় বেরিয়ে পড়ে হত্যাযজ্ঞে। ফার্মগেইট এলাকায় পাকসেনারা বিদ্রোহী জনতা কর্তৃক প্রথম বাধাপ্রাপ্ত হয়। এবং সেই সময়েই প্রথম পাকসেনারা মেশিনগানের অবিরাম গুলিবর্ষণ শুরু করে। সহস্র মানুষের জয় বাংলা’ ধ্বনি পাকবাহিনীর গুলিবর্ষণে স্তব্ধ হয়ে যায়। তারপর পাকসেনারা যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই নির্বিচারে হত্যা করেছে। নিউমার্কেট এলাকা, শাখারি বাজার, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, ফুটপাতে শুয়ে থাকা ছিন্নমূল মানুষ, নিরীহ রিক্সাওয়ালা, বস্তিতে বসবাসকারী দরিদ্র জনগণ ও সারাদিন পরিশ্রমের পর কর্মক্লান্ত দোকানদার— কেউই ওদের মৃত্যু পরওয়ানা থেকে রেহাই পায়নি।
অপারেশনাল প্ল্যান (অপারেশন সার্চ লাইট) অনুযায়ী পাকবাহিনী রাত প্রায় ১-৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাসভবন আক্রমণ করে। সমভাবে পিলখানাস্থ ইপিআর (বর্তমানে বিডিআর)* সদর দপ্তরের বাঙালি সৈনিকদের এবং রাজারবাগস্থ বাঙালি পুলিশদের আক্রমণ করা হয়। বাংলাদেশে তখন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ছ’টি নিয়মিত ব্যাটালিয়ন, পনের হাজার ইপিআর ও প্রায় চল্লিশ হাজার পুলিশ ছিল। এছাড়া ছিল ইউনিভার্সিটি অফিসার ক্যাডেট কোরের অস্ত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছাত্ররা এবং সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার আনসার ও মুজাহিদ। পাকবাহিনী প্রথমে বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা এবং পরে এদেরকে আক্রমণ করে। অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের সময় পাকসেনাদের নির্বিচারে বাঙালি হত্যা বাঙালি সৈনিকদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। বাঙালি সৈনিকেরা জাতীয়তাবাদী চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে এবং তাদের মধ্যে সংগ্রামী মনােভাব গড়ে ওঠে। ইতিহাস চিরকাল সাক্ষ্য দেবে বাঙালি জাতির মহা দুর্যোগময়কালে অমিত তেজ, অসীম সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের সুমহান অঙ্গীকারে বাঙালি সৈন্যরা প্রতিরােধ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে হানাদার বাহিনীর মােকাবেলা করেছে। স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত তিতুমীর, সূর্য সেন ও বাঘা যতীনের উত্তরসূরি
————————————————–
* সর্বশেষ বিডিআর বাহিনীর নাম পরিবর্তন করে বর্ডারগার্ড অব বাংলাদেশ-বিজিবি করা হয়েছে।
বংশধর লক্ষ লক্ষ মৃত্যুঞ্জয়ী তরুণ দুর্জয় আক্রোশে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছে এবং বিজাতীয় দখলদার শক্তিকে পদানত করেছে।
ঢাকা সেনানিবাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ১৪তম ডিভিশন অবস্থান করছিল। ১৫ এপ্রিলের মধ্যে ৯ম ও ১৬তম ডিভিশনকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আনা হয়। ঢাকায় ৫৭ ব্রিগেড, যশােরে ১০৭ ব্রিগেড, রংপুরে ২৩ ব্রিগেড ও কুমিল্লায় ৫৩ ব্রিগেড অবস্থিত ছিল। এসব ব্রিগেডের অধীনে মােট ১২টি ইনফেন্ট্রি ব্যাটালিয়ন, ১টি আর্মড রেজিমেন্ট, ১ টি কমাণ্ডে ব্যাটালিয়ন, ৫টি ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি ও ১টি ১২০ মিলিমিটার মর্টার রেজিমেন্ট ছিল। ৯ম ডিভিশনকে কুমিল্লা-সিলেট এলাকায় এবং ১৬ তম ডিভিশনকে উত্তর বাংলায় মােতায়েন করা হয়। ১৪তম ডিভিশনকে ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, যশাের ও খুলনা এলাকার দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তীকালে পাকবাহিনীর ৩৬তম ও ৩৯তম ডিভিশন গঠিত হয়। এছাড়া পাকবাহিনীর সহযােগী দালাল রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস সমবায়ে আধা সামরিক বাহিনীর প্রায় ৫০ হাজার সদস্য পাকবাহিনীর সঙ্গে মিলে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।
এপ্রিলের শেষে মুক্তিবাহিনীর আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণের মুখে ভারত সীমান্ত এলাকায় ঘাঁটি স্থাপন করে। ৪ এপ্রিল মুক্তিবাহিনী তেলিয়াপাড়া সদর দপ্তরে উর্ধ্বতন বাঙালি সামরিক অফিসারগণ এক বৈঠকে মিলিত হন। ঐতিহাসিক কারণেই এই বৈঠকটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধকে সংহত করার লক্ষে সীমান্তের ওপারে হাজার হাজার দেশপ্রেমিক তরুণের সামরিক প্রশিক্ষণের ওপরে গুরুত্ব আরােপ করা হয়। সিদ্ধান্ত মােতাবেক অচিরেই সীমান্ত এলাকায় বহুসংখ্যক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও যুব শিবির গড়ে ওঠে। ৪ এপ্রিলের এই বৈঠকে কর্নেল (পরে জেনারেল) এম এ জি ওসমানী, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মােশাররফ, লে. কর্নেল সালাহউদ্দিন রেজা, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর মইনুল হাসান চৌধুরী ও লে. কর্নেল আব্দুর রব উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে কর্নেল এম এ জি ওসমানী বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক মনােনীত হন।
স্বাধীনতা যুদ্ধকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার উদ্দেশে এবং ঐতিহাসিক প্রয়ােজনে জনগণের নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যগণ প্রবাসী সরকার গঠন করেন। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে। এই স্মৃতিবিজড়িত স্থানের নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। এক বিশাল জনসমাবেশে বহু বিদেশি সাংবাদিকের উপস্থিতিতে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকার বিশ্ববাসীর কাছে আত্মপ্রকাশ করে। এই নতুন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান মনােনীত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়ােগ করা হয়। খােন্দকার মােশতাককে আইন, সংসদীয় ও পররাষ্ট্র দপ্তর, কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র দপ্তর এবং মনসুর আলীকে অর্থ দপ্তরের দায়িত্ব দেয়া হয় ।
জেনারেল ওসমানীকে এই অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ঘােষণা করা হয় । অধ্যাপক ইউসুফ আলী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ এবং নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। মুক্তিবাহিনীর একটি দল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার প্রদান করে।
বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশকে মােট চারটি সেক্টরে ভাগ করা হয়। চট্টগ্রাম সেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত হন মেজর জিয়াউর রহমান। মেজর খালেদ মােশাররফ নিযুক্ত হন কুমিল্লা সেক্টরের অধিনায়ক। মেজর শফিউল্লাহ সিলেট সেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব নেন এবং কুষ্টিয়া সেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত হলেন। মেজর ওসমান চৌধুরী।
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপিত হয় কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রােডে। প্রবীণ অফিসার মেজর জেনারেল (তখন অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল) রবকে জেনারেল ওসমানীর চীফ অব স্টাফ নিয়ােগ করা হয়। গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খােন্দকার (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত এয়ার ভাইস মার্শাল) সহকারী চীফ অফ স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীকালে সদ্য কমিশনপ্রাপ্ত তরুণ অফিসার শেখ কামালকে জেনারেল ওসমানীর এ ডি সি হিসেবে নিয়ােগ করা হয়। মেজর নুরুল ইসলাম (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল) প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের স্টাফ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এই সময়ে মুক্তিযুদ্ধকে সুসংহত করার জন্যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকবৃন্দ। ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও যুব শিবির এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সকল মুক্তিযােদ্ধাকে একটি একক কম্যাণ্ডে আনার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করা হয়। রাজনৈতিক সমর্থন, গােলাবারুদ ও রসদ সরবরাহ, হানাদার বাহিনীর শক্তি, প্রকৃতি ও মনােভাব সাপেক্ষে যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজি তৈরি করা, মুক্তিযুদ্ধে যােগদানকারী সকল সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিবর্গকে যথােপযুক্ত দায়িত্বে নিয়ােগ করা এবং যুদ্ধ এলাকা নির্ধারণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।
এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জুলাই মাসের ১১ তারিখ থেকে সকল সেক্টর অধিনায়কদের নিয়ে বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তরে দশদিনব্যাপী এক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই অধিবেশনে সেক্টরসমূহের সীমানা চিহ্নিতকরণ, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলাঘাঁটি স্থাপন ও পাক সেনাদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য রণনীতি প্রণয়ন করা হয়। জাতীয় পরিষদ সদস্যদের নিজ নিজ এলাকায় রাজনৈতিক দায়িত্ব দেওয়া হয়। গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ওপরে জোর দেয়া হলেও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নিয়মিত ব্যাটালিয়ন সমন্বয়ে তিনটি ব্রিগেড গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এছাড়া যুদ্ধের বিভিন্ন দিক, পাকবাহিনীর মনােবল ভেঙে দেওয়ার জন্য মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, পাকবাহিনীর সহযােগী দালালদের খতম করা ও তাদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করা, অস্ত্রশস্ত্র, যানবাহন, খাদ্যদ্রব্য, ঔষধপত্র সরবরাহসহ নানাবিধ সমস্যা বিশদভাবে আলােচিত হয়। সমগ্র
বাংলাদেশকে মােট এগারােটি সেক্টরে বিভক্ত করা হয় এবং প্রতিটি সেক্টরের সীমানা নির্ধারিত হয়। সেক্টর কমান্ডারগণ অধিবেশন শেষে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যান এবং সুসংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন।
মুক্তিবাহিনীর প্রথম ব্রিগেড ‘জেড ফোর্স’ ৭ জুলাই গঠিত হয়। মেজর জিয়ার নামের প্রথম ইংরেজি অক্ষর দিয়ে এই ব্রিগেডের নামকরণ করা হয় ‘জেড ফোর্স’। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল, তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের সমন্বয়ে এই ব্রিগেড় গঠিত হয় । মেজর মইনুল হাসান চৌধুরী প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। পরে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মেজর জিয়াউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন এবং প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়কত্ব করেন। প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের অন্যান্য অফিসার ছিল ক্যাপ্টেন বজলুল গণি পাটোয়ারী, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত আলী খান, ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন হাফিজ, ক্যাপ্টেন কাইউম, লে, আনিস ও লে. ওয়াকার। তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়কত্ব করেন মেজর শাফায়াত জামিল। ক্যাপ্টেন মহসিন, ক্যাপ্টেন আনােয়ার, ক্যাপ্টেন আকবর, লে. নুরুন্নবী, লে, মনজুর, লে. ফজলে হােসেন, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আশরাফুল আলম এই ব্যাটালিয়নে যুদ্ধ করেছেন। মেজর আমিনুল হক অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। অন্য অফিসাররা ছিল ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী, ক্যাপ্টেন সাদেক হােসেন, লে, মােদাসসের, লে. মাহবুব, লে. এমদাদ, লে, মুনিব, লে. ওয়ালী ও লে, বাকের। ‘জেড ফোর্স’ কামালপুর, বাহাদুরাবাদ, চিলমারী, গােবিন্দগঞ্জ ও নকসী বি ও পি আক্রমণে বিশেষ সাফল্য অর্জন করে।
নবম, দশম ও চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল নিয়ে ৭ অক্টোবর গঠিত হয় কে ফোর্স’। ‘কে ফোর্স’ অধিনায়ক মেজর খালেদ মােশাররফ-এর নামের ইংরেজি প্রথম অক্ষর দিয়ে এই ব্রিগেডের নামকরণ করা হয়। ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিন, ক্যাপ্টেন মাহবুব, লে. হারুন, লে. কবীর, ক্যাপ্টেন গাফফার, মেজর সালেক চৌধুরী, লে. দিদার, ক্যাপ্টেন আকবর, ক্যাপ্টেন ইমাম, ক্যাপ্টেন শহীদ, লে. ইমামুজ্জামান, মেজর মতিন, মেজর হায়দার, লে. মিজান, লে, দিদারুল আলম ও লে. জিল্লুর রহমান কে ফোর্সে’ যুদ্ধ করেছেন। বিখ্যাত বেলােনিয়া যুদ্ধ, মন্দভাগ, শালদা নদী যুদ্ধ ও কসবা যুদ্ধে কে ফোর্স বিশেষ সাফল্য অর্জন করে।
অক্টোবর মাসেই ‘এস ফোর্স গঠন করা হয়। মেজর শফিউল্লাহ ‘এস ফোর্সের অধিনায়ক ছিল এবং তাঁর নামানুসারে এই ব্রিগেডের নামকরণ করা হয় এস ফোর্স। ক্যাপ্টেন আজিজ, ক্যাপ্টেন আবুল হােসেন ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রউফ ‘এস ফোর্স সদর দপ্তরে পদস্থ ছিলেন। প্রথমে দ্বিতীয় ও পরে নবগঠিত এগারাে ইস্ট বেঙ্গল সমন্বয়ে এস ফোর্স গঠিত হয়। মেজর মইনুল হাসান চৌধুরী, লে, সাইদ, লে. আবুল হােসেন, মেজর মতিউর রহমান, লে. আনিসুল হাসান, লে. বদিউজ্জামান, লে. সেলিম, লে, ইব্রাহিম, লে. গােলাম হেলাল মাের্শেদ, মেজর নাসিম, লে. কবীর, লে. মইনুল হােসেন, লে, শামসুল হুদা বাচ্চু, ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া, লে. নজরুল, লে. নাসের ও মেজর নুরুজ্জামান এস ফোর্সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘এস ফোর্স’ বিশেষ অবদান রেখেছে।
মুক্তিবাহিনীতে নিয়মিত সৈনিক ছাড়াও হাজার হাজার অনিয়মিত সৈনিক ছিল— যারা দেশপ্রেমের ত গিদে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিল বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবক, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কলকারখানার শ্রমিক, কৃষক ও সকল স্তরের মেহনতি মানুষ। এঁরা প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্যে বীরােচিত সংগ্রামে লড়েছেন, শরীরের শেষ রক্তবিন্দু বিসর্জন দিয়েছেন। এদের সবাইকে নিয়েই মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়েছিল। সরকারিভাবে মুক্তিবাহিনী দুই প্রধান অঙ্গে বিভক্ত ছিল : নিয়মিত বাহিনী ও গণবাহিনী। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদদের নিয়ে নিয়মিত বাহিনী গড়ে ওঠে। এদেরকে সরকারিভাবে বলা হতাে এম এফ বা মুক্তিফৌজ। গণবাহিনী গড়ে ওঠে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা, ও শিল্পী-বুদ্ধিজীবী তথা সর্বস্তরের জনগণের সমন্বয়ে। এদেরকে এফএফ বা ফ্রিডম ফাইটারস্ বলা হতাে। সম্মুখ। সমরে না গিয়ে এরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা পদ্ধতিতে বিভিন্ন অপারেশনে লিপ্ত থাকতেন।
১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর নাগাল্যাণ্ডের ডিমাপুরে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খােন্দকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জন্ম হয়। নাগাল্যাণ্ড, অরুণাচল, ত্রিপুরা রাজ্য ও আসামের বিস্তীর্ণ পাহাড়ী এলাকায় বাঙালি বৈমানিকেরা কয়েকটিমাত্র ডাকোটা, অটার ও এলুভেট হেলিকপ্টার নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। এসব অফিসারের মধ্যে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম, ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন, স্কোয়াড্রন লিডার শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন আকরাম, ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন, ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন, ক্যাপ্টেন মুকিত ও ক্যাপ্টেন সাত্তারের নাম সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। মাত্র ৬৭ জন এয়ারম্যান (পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে বাঙালি এয়ারম্যান, যারা মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিয়েছিল) নবগঠিত বিমান বাহিনীতে যােগদান করেছিলেন। ডাকোটা বিমানকে পাঁচ হাজার পাউণ্ড বােমা বহন করার উপযােগী করা হয় এবং হেলিকপ্টারকে রকেট ও ভারী মেশিনগানে সজ্জিত করা হয়। ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত রণাঙ্গনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। নারায়ণগঞ্জের গােদনাইল জ্বালানি ঘাঁটির উপরে আক্রমণ, চট্টগ্রামেও অনুরূপ হামলা ও সিলেট অপারেশন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর দক্ষতার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠন করা হয়। পঁচিশে মার্চের আগে পাকিস্তান নৌবাহিনীর চাকরিরত বাঙালিরা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেছিলেন। এইসব নৌসেনা নিয়েই গঠিত হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনী। পাকবাহিনীর কাছ থেকে দখল করা ছােটো আকারের ৬টি নৌযান নিয়ে ৯ নভেম্বর প্রথম বঙ্গবন্ধু নৌবহরের উদ্বোধন করা হয়। চট্টগ্রাম ও চালনা এলাকাসহ ও দখলকৃত এলাকার জলপথে কম্যান্ডো তৎপরতায় নৌসেনারা বিশেষ পারদর্শিতার পরিচয় দেয়।
বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর কর্তৃত্বের বাইরে মুজিব বাহিনী’ নামে একটি বাহিনী গড়ে ওঠে শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তােফায়েল আহমেদের তত্ত্বাবধানে। ভারতীয় জেনারেল ওবানের সহযােগিতায় সম্ভবত রাজনৈতিক
১৪
কারণে এই বাহিনীর জন্ম হয়। এদের ওপরে জেনারেল ওসমানীর কোনাে কর্তৃত্ব ছিল
প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার তরুণ মুজিব বাহিনীতে যােগ দেন এবং গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন। কাদের সিদ্দিকী সম্পূর্ণ নিজস্ব লােকবল নিয়ে মধুপুর-ময়মনসিংহ সড়কের দক্ষিণ থেকে কালিয়াকৈরের উত্তর পর্যন্ত বিশাল জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা, পূর্বে ভালুকা, গফরগাঁও ও শ্রীপুর, পশ্চিমে টাঙ্গাইল-মধুপুর সড়ক পর্যন্ত প্রায় ১৫০০ বর্গমাইল এলাকা মুক্ত রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী বা জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে এই বাহিনীর কোনাে সম্পর্ক ছিল না। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ এলাকার পশ্চিম দিক থেকে যমুনার তীর পর্যন্ত বিরাট চর এলাকা, উত্তরে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট থেকে দক্ষিণে নাগপুর পর্যন্ত ধলেশ্বরী ও যমুনার চর অঞ্চল মিলে বিশাল এলাকা কাদের সিদ্দিকীর করায়ত্তে ছিল।
বাংলাদেশ সরকারের কর্তৃত্বের বাইরে আরও অনেক বাহিনী গড়ে ওঠে। সিরাজগঞ্জের লতিফ মির্জার বাহিনী, ঝিনাইদহ-মাগুরার আকবর হােসেনের বাহিনী, ফরিদপুরের হেমায়েত বাহিনী, পিরােজপুরের রফিক বাহিনী, বরিশালের কুদুস মােল্লা, শিক্ষক আব্দুল গফুর ও আফতাব বাহিনীর নাম সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের সাহায্য ছাড়াই সম্পূর্ণ নিজস্ব শক্তিতে এই সব বাহিনী গড়ে ওঠে এবং অসংখ্য রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে অংশগ্রহণ করে।
দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে অসির সঙ্গে মসিও যুক্ত হয়েছে সমান তালে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিপুল জনমত সৃষ্টির উদ্দেশে প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য পত্রপত্রিকা। বিদেশী সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের ভূমিকাও সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। শিল্পী কামরুল হাসানের আঁকা ইয়াহিয়া খানের পােস্টার ‘এই জানােয়ারদের হত্যা করতে হবে এবং প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান পরিচালিত ছায়াছবি ‘স্টপ জেনােসাইড’ চিরকাল সাড়া জাগাবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠানমালা ও স্বাধীনতার গান সর্বকালের কিংবদন্তী হয়ে বাঙালি জাতির স্মৃতিতে চিরভাস্বর থাকবে।
এক নম্বর সেক্টর
এক নম্বর সেক্টর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা ও নােয়াখালী জেলার মুহুরী নদীর পূর্ব পর্যন্ত সমগ্র এলাকা নিয়ে গঠিত হয়। সেক্টরটি বিভক্ত করা হয় পাঁচটি সাব-সেক্টরে ;
১. ঋষিমুখ সাব-সেক্টর : কমান্ডার ছিল ক্যাপ্টেন শামসুল ইসলাম।
২. শ্রীনগর সাব-সেক্টর : কমান্ডার ছিল প্রথমে ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, পরে কিছুদিন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান এবং শে েক্যাপ্টেন মাহফুজুর রহমান।
৩. মনুঘাট সেক্টর : কমান্ডার ছিল ক্যাপ্টেন মাহফুজুর রহমান। ৪. তবলছড়ি সাব-সেক্টর : কমান্ড করেছেন সুবেদার আলী হােসেন।
৫. ডিমাগিরী সাব-সেক্টর : কমান্ড করেছেন জনৈক সুবেদার ।
সেক্টর হেড কোয়ার্টারের অবস্থান ছিল হরিনাতে। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে স্বল্পকাল মেজর শওকত দায়িত্ব পালন করলেও বস্তুত জুলাই মাস থেকে মেজর রফিকুল ইসলাম সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি সে দায়িত্ব অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে পালন করেন। সেক্টরের অ্যাডজুটেন্টের দায়িত্ব স্বল্পকালের জন্যে পালন করেন ফ্লাইং অফিসার সাখাওয়াৎ হােসেন এবং তারপর ক্যাপ্টেন এনামুল হক চৌধুরী। কোয়ার্টার মাস্টারের দায়িত্বে ছিল যথাক্রমে নায়েক সুবেদার সােবহান ও নির্বাহী প্রকৌশলী জনাব ইসহাক।
এই সেক্টরে এফ এফ বাহিনীকে দেশের অভ্যন্তরে পাঠানাে, গেরিলা বেইস তৈরি ইত্যাদি কাজে যাঁদের নিরলস তৎপরতা দেখা গেছে, তাঁরা হলেন : ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান, সংসদ সদস্য এম এ হান্নান, সংসদ সদস্য মান্নান, হাবিলদার সিরাজুল ইসলাম পাটোয়ারী এবং এমপি জনাব মনসুর। | সেক্টর বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় দুই হাজার। এইসব সৈনিকের মধ্যে ছিল চৌদ্দশত ই পি আর, দুইশত পুলিশ, তিনশত সেনাবাহিনী এবং একশত নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর সদস্য। গণবাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় আট হাজার। এইসব গেরিলাকে ১৩৭ টি গ্রুপে দেশের অভ্যন্তরে পাঠানাে হয়।
এক নম্বর সেক্টরে ২৪ মে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর এক বড়াে রকমের সংঘর্ষ হয়। ২ মে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার পতন ঘটলেও মুক্তিবাহিনী তাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিল। মেজর জিয়া ক্যাপ্টেন অলিকে নিয়ে একটি কোম্পানি এবং একটি ৩ ইঞ্চি মর্টার সেকশন দিয়ে ২৪ মে চাঁদগাজী আক্রমণ করলেন।
মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে পাকসেনারা চাঁদগাজী ছাড়তে বাধ্য হলাে। অল্প সময়ে অথচ বড়াে রকমের সেই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর সুবেদার মফিজ, সুবেদার মেজর ফকিরউদ্দিন এবং নায়েক সুবেদার হামিদ অপূর্ব বীরত্বের পরিচয় দেন।
১ জুন ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা ক্যাপ্টেন অলির কাছ থেকে চাঁদগাজী প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নেন। এখানে মুক্তিবাহিনীর আর একটি কোম্পানি এসে যােগ দিলাে।
৬ জুন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুটি কোম্পানি সকাল ১০টায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থান চাঁদগাজী আক্রমণ করে। এই সময় মেজর জিয়া চাঁদগাজী ঘাঁটিতেই অবস্থান করছিলেন। উভয়পক্ষে দু’ঘণ্টাব্যাপী ব্যাপক সংঘর্ষ চলে। মুক্তিবাহিনী রাইফেল ছাড়াও মর্টার এবং মেশিনগান ব্যবহার করে। সংঘর্ষে পাকসেনাদের ৭৫ জন নিহত এবং বেশ কিছু আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা চরম ক্ষতি স্বীকার করে ছাগলনাইয়ার দিকে পালিয়ে যায়। ১৫ জুন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানকে চাঁদগাজীতে পাঠানাে হলাে। ১৬ জুন পাকসেনারা সকাল ১০টায় পুনরায় চাদগাজী দখলের জন্যে অগ্রসর হলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান তার বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন । উভয় পক্ষের সংঘর্ষে পাকিস্তানিদের ৫০ জনের মতাে প্রাণ হারায় এবং তারা পিছু সরতে বাধ্য হয়।
১৭ জুন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন ৭টায় দুটি ফ্লাঙ্কে ট্যাঙ্ক আর্টিলারি এবং মর্টার সজ্জিত হয়ে পুনরায় চাঁদগাজী মুক্তিবাহিনীর অবস্থান আক্রমণ করে। এই সংঘর্ষ ১৮ জুন ভাের পাঁচটা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। পাকিস্তানিদের এই ব্যাপক হামলায় ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা, মতিউর রহমান তাঁদের স্ব স্ব বাহিনী নিয়ে অত্যন্ত সার্থকতার সঙ্গে মােকাবেলা করেন। মুক্তিবাহিনীর বেশ কিছু ক্ষতি হলেও পাকসেনারা ৪৫ জনের মৃতদেহ ফেলে পেছনে সরে যেতে বাধ্য হয়।
১৯ জুন সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় পাকসেনারা চাঁদগাজী আক্রমণ করে। পাকসেনারা পাঁচটি হেলিকপ্টারযােগে ২টি পদাতিক বাহিনীর ব্যাটালিয়ন মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের পেছনের দিকে নামিয়ে দেয়। স্পীডবােটযােগে মুহুরী নদী দিয়ে একটি কোম্পানি অগ্রসর হতে থাকে, অপরদিকে পাকিস্তানিদের ‘রিয়ার হেড কোয়ার্টার থেকে ব্যাপকভাবে আর্টিলারি মর্টার এবং অন্যান্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে আক্রমণ করা হয়। মুক্তিবাহিনী ১৯ জুন ভাের ৪টা পর্যন্ত তাদের অবস্থানে টিকে থাকার চেষ্টা করে কিন্তু পাকসেনারা চারদিক থেকে চেষ্টা করে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ঘিরে ফেলার। শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী পেছনে সরে আসে। এই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করলেও পাকসেনাদের ১৫০ জন নিহত এবং বেশকিছু সংখ্যক আহত হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায় । এই তারিখেই চাঁদগাজী পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় ।
এদিকে ক্যাপ্টেন মাহফুজ ১০ জুন হিয়াকু-রামগড় সড়কে পাকিস্তানিদের অ্যামবুশ করে ৪ জনকে হত্যা করেন। ক্যাপ্টেন মাহফুজ একটি প্লাটুন নিয়ে হিয়াকু-রামগড় সড়কে দুটি কলামের একটিতে নিজে এবং অপর কলামে নায়েক সুবেদার রহমতুল্লাহকে দিয়ে সড়কের পাশে আখক্ষেতে ওত পেতে বসেছিলেন। দেখা গেল,
পাকসেনা ভর্তি দুটি মাইক্রোবাস দ্রুতগতিতে হিয়াকু থেকে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। প্রথম মাইক্রোবাসটিতে একজন লে. কর্নেল ও দু’জন মেজরসহ কয়েকজন গার্ড ছিল। পেছনেরটিতে ছিল শুধু জোয়ানরাই । সেদিন সকাল ৮ টায় পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর রাইফেলের আওতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে একসাথে সবগুলাে গান গর্জে ওঠে । গুলির পরপরই সামনের মাইক্রোবাসটি মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। পেছনের গাড়িটিও থেমে যায় এবং পাকসেনারা তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে পাল্টা গুলি চালায়। ক্যাপ্টেন মাহফুজ বেশ কিছুক্ষণ ক্রমাগত গুলি চালিয়ে তার বাহিনী উইথড্র করে নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে যান। পরে স্থানীয় লােকজনের কাছ থেকে জানা যায়, শত্রুপক্ষের একজন লে. কর্নেল ও দু’জন মেজরসহ ৫ জন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। পাকিস্তানিরা আর সামনে অগ্রসর না হয়ে হিয়াকু ফিরে যায়।
২৩ জুন ক্যাপ্টেন মাহফুজ একটি প্লাটুন নিয়ে করলিয়াটিলা (চিকনছড়া) এবং হিয়াকুর মধ্যস্থল থেকে পাকসেনাদের অ্যামবুশ করেন। ‘ইনফরমার মারফত ক্যাপ্টেন মাহফুজ ২২ জুনেই খবর পেলেন পরদিন হিয়াকু থেকে রামগড়ে পাকসেনাদের দুটি গাড়ি আসবে। মুক্তিবাহিনীর প্লাটুনটি ২৩ জুন ভােরবেলা করলিয়াটিলাতে পৌছে সড়কের উপর ৩টি ট্যাঙ্কবিধ্বংসী মাইন বসিয়ে রেখে সড়কের পাশে বসে রইলাে। ওই দিন সকাল ৬টায় পাকসেনাদের দুটি গাড়ি আসতে দেখা গেল। সামনের গাড়ির প্রথম সিটে একজন মেজরকে বসে থাকতে দেখা গেল দূর থেকে । দুটি গাড়িতে সৈনিক ছিল ২০ জনের মতাে। ৬টা বেজে কয়েক মিনিট হয়েছে, পাকিস্তানিদের প্রথম গাড়িটি বিকট শব্দ করে উল্টে পড়ল। ৩টি মাইনের দুটিরই বিস্ফোরণ ঘটে। দ্বিতীয় গাড়িটি ঘটনাস্থলে আসার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন মাহফুজ, সুবেদার সাবেদ আলী, হাবিলদার নাসির আলী একযােগে গােলাবর্ষণ শুরু করেন। উভয়পক্ষে বেশ কিছুক্ষণ গােলাগুলি চলে। ক্যাপ্টেন মাহফুজ তাঁর নিজ প্লাটুনটি নিয়ে নিরাপদে ঘাঁটিতে ফেরেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে পাকসেনাদের ১জন অফিসারসহ বেশ কয়েকজন সৈন্য হতাহত হয়।
এদিকে ১ জুলাই ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা একটি প্লাটুন নিয়ে রাত ৩টায় পাক অবস্থান দেবীপুর বি ও পি আক্রমণ করেন। উভয়পক্ষের সংঘর্ষে পাকসেনাদের ১২ জন নিহত এবং ৫ জন আহত হয়। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সিপাই ফজলুর রহমান শহীদ হন। এই সংঘর্ষে হাবিলদার আবুল হােসেন, সিপাই তােহা মিয়া বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
৩ জুলাই ক্যাপ্টেন মাহফুজ পুনরায় পাকসেনাদের অ্যামবুশ করেন। তিনি সংবাদ পেয়েছিল, পাকসেনারা চট্টগ্রাম থেকে বাঙালি সুন্দরী যুবতী মেয়েদেরকে নিয়ে প্রথমে হিয়াকু এবং সেখান থেকে রামগড়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নদীর পাড় থেকে শিকল বাঁধা অবস্থায় মেয়েদের স্নান করতে দেখা গেছে। স্নান করতে একটু দেরি হলেই পাকসেনারা তাদের ঘাঁটি থেকে শিকল ধরে টানাটানি করত। অনেক সময় শিকলের। টানাটানিতে প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায় রক্তাক্ত দেহে সেই মেয়েদেরকে ঘাঁটিতে পৌছতে
হতাে। এইসব করুণ দৃশ্য দেখে তখনই আক্রমণের উদ্যোগ নিলেন মুক্তিযােদ্ধারা। যখনই শুনল পাকিস্তানিরা বাঙালি মেয়েদের নিয়ে আসছে তখন ক্যাপ্টেন মাহফুজ ২০ জনের একটি দল নিয়ে ৩ জুলাই চিকনছড়াতে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ওই দিন সকাল থেকে বেলা প্রায় ১২ টা পর্যন্ত সড়ক দিয়ে ৫/৬ টি গাড়ি যাতায়াত করল কিন্তু পাকিস্তানিদের তখনাে দেখা পাওয়া গেল না। বেলা ১২ টার কয়েক মিনিট পরই একটি মাইক্রোবাসে সামনে একজন অফিসার, আর পেছনে ৬ জন মেয়ে এবং তাদের পেছনে ৪ জন সশস্ত্র গার্ডকে দেখা গেল। মাইক্রোবাসটি ৫০ গজের মধ্যে এলে প্রথমে ড্রাইভারকে লক্ষ করে একটি রাইফেল গর্জে উঠল । লক্ষ্য অব্যর্থ। ড্রাইভার চিৎকার করে গাড়ির ব্যালান্স হারিয়ে ফেললে গাড়িটি উল্টে যায়। দ্বিতীয়বারে মুক্তিবাহিনীর সব কটি গানই একসঙ্গে আঘাতের পর আঘাত হানতে থাকে। পাক অফিসারটি ছিল ক্যাপ্টেন। সে গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে গুলি চালাতে থাকে। সেদিন একটি পাকিস্তানিও জীবন নিয়ে ফিরতে পারেনি। মুক্তিবাহিনী নিরাপদে নিজ ঘটিতে ফিরে আসে। শােনা যায়, ৪ জন মেয়ে সেদিন বেঁচে গিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল।
১৯ জুলাই ক্যাপ্টেন মাহফুজ করুইয়া বাজারের পাক অবস্থান আক্রমণ করেন । পাকসেনারা দু’শয়ের মতাে ভারতে গমনরত শরণার্থী ধরে যথেচ্ছ অত্যাচার চালাচ্ছিল। শরণার্থীদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই অধিক। এই মেয়েদের ওপর পাকসেনারা দিনের পর দিন পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছিল। পাকিস্তানিদের পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি একজন মেজরের কম্যাণ্ডে একটি এল’ প্যাটার্নের হাইস্কুলে অবস্থান। করছিল। ক্যাপ্টেন মাহফুজ মুক্তিবাহিনীর ৪৫ জনের একটি দল নিয়ে ১৯ জুলাই রাত দেড়টার দিকে ৪টি মর্টার, ২টি রকেট লাঞ্চার এবং অবশিষ্ট এল এম জি নিয়ে একযােগে পাক অবস্থানের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেন। উভয়পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়। এই সময় ক্যাপ্টেন মাহফুজ চিৎকার করে বলতে থাকেন, বাঙালি শরণার্থীরা পালিয়ে আসুন। আধঘণ্টা গুলি বিনিময় চলে। এই সময়ের মধ্যে প্রায় ১৫০ জনের মতাে শরণার্থী নিরাপদ স্থানে সরে যেতে পারলেও বেশ কিছু সংখ্যক শরণার্থী গােলাগুলিতে নিহত হয়। পাকসেনাদের ৩০ জন নিহত হয় বলে জানা যায় । মুক্তিবাহিনী কোনাে ক্ষতি স্বীকার না করেই নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে।
২৭ জুলাই হিয়াকুতে পাকবাহিনীর হেড কোয়ার্টারের ওপর ক্যাপ্টেন মাহফুজ মাত্র একটি প্লাটুন নিয়ে আক্রমণ করেন। হিয়াকু পাক অবস্থান থেকে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান। ছিল ১২ মাইল দূরে। বিকেল ৪টায় মুক্তিবাহিনীর দলটি মর্টার এবং রকেট লাঞ্চারসহ একসঙ্গে পাকসেনাদের এম টি পার্কের ওপর আঘাত হানে। পাকসেনাদের মূল ঘাঁটিতে আক্রমণ হতে পারে এ ছিল তাদের কল্পনাতীত। পাকসেনারা সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হয়। মুক্তিবাহিনীর গুলিতে ৪ জন সৈন্যকে নিহত হতে দেখা গেল ঘটনাস্থলেই। মাত্র ১৫ মিনিটের আক্রমণে এম টি পার্ক প্রায় বিধ্বস্ত হয়। পাকসেনারা ছােটো দলটিকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। ক্যাপ্টেন মাহফুজ পাকসেনাদের মতলব বুঝতে পেরে পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে তার বাহিনী নিয়ে দ্রুত পেছনে সরে আসেন। নিজেদের অবস্থানে
ফেরার পথে মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের বসানাে বেশকিছু মাইন উদ্ধার করে। নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে পৌছে সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকের কাছে তাদের কর্মতৎপরতার রিপাের্ট পাঠান।
এক নম্বর সেক্টরে ২৯ আগস্ট আমলিকাতে (উপেন্দ্র লাল চাকমা বিওপি-র বিপরীতে) মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকসেনাদের এক বড়াে রকমের সংঘর্ষ হয়। পাকিস্তানিরা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বাঙ্কার প্রস্তুত করে তাতে ৬০ জনের মতাে অবস্থান করছিল। ক্যাপ্টেন মাহফুজ মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি এবং ভারতীয় বাহিনীর ৪নং গার্ডস্-এর একটি কোম্পানি লে. কর্নেল হিম্মত সিংহের কম্যাণ্ডে অগ্রসর হয়। গন্তব্যস্থলের দিকে। ওই তারিখে রাত ৮টা ৩০ মিনিটে ক্যাপ্টেন মাহফুজ তাঁর কোম্পানিকে তিনটি কলামে বিভক্ত করে নিয়ে পাকসেনাদের ওপর হামলা চালালেন। ভারতীয় বাহিনী মর্টার এবং এম জি সাপাের্ট দিল । সীমান্ত থেকে কর্নেল হিম্মত সিং ক্যাপ্টেন মাহফুজের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করে চললেন। আধ ঘণ্টা স্থায়ী এই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর তিনটি কলামই তিন দিক থেকে বাঙ্কারগুলাের ওপর গ্রেনেড চার্জ করতে থাকে। পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে চরম মার খেয়ে শােভাপুরের দিকে পালিয়ে যায় । আমলিকা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এই দিনেই সংঘর্ষে ২৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে ১ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ এবং দু’জন গুরুতররূপে আহত হন। | এই সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা আরও বৃদ্ধি পায় সেপ্টেম্বর মাসে। সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক প্রতিটি সাব-সেক্টর ঝটিকা সফর করে মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত আক্রমণকে আরও তীব্র করার নির্দেশ দিলেন।
ছাগলনাইয়া বিওপি তে ৪০ জনের মতাে পাকসেনা অবস্থান করছিল। ক্যাপ্টেন। মাহফুজ একটি কোম্পানি নিয়ে ১৫ অক্টোবর রাত ৮ টা ৩০ মিনিটে ছাগলনাইয়া বিওপি আক্রমণ করলেন। মিত্র বাহিনীর ৮ নং বিহার রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি ফায়ার। সাপাের্ট দেয়। বিহার রেজিমেন্টের কম্যাণ্ডিং অফিসার লে. কর্নেল ও পি বিসলা নিজে সবকিছুর তত্ত্বাবধান করলেন। ক্যাপ্টেন মাহফুজ তিন দিক থেকে ক্রমাগত ব্যাপক। আক্রমণ চালিয়েও পাকিস্তানিদের নড়াতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি তার বাহিনী নিয়ে পিছু হটলেন। সংঘর্ষে সিপাই তােহা মিয়া প্রমুখ বীরত্বের পরিচয় দিলেও মুক্তিবাহিনীর ৮জন গুরুতররূপে আহত হন এবং শহীদ হন ৩ জন। পাকিস্তানিদের হতাহতের সংখ্যা জানা যায়নি। অবশ্য মুক্তিবাহিনীর এই আক্রমণের তিন দিন পর পাকসেনারা বিওপি ছেড়ে চলে যায়। পাকিস্তানিরা বুঝেছিল তাদের পক্ষে ওই বিওপি তে টিকে থাকা সম্ভব নয়।
অক্টোবর মাসেই প্রথাগত যুদ্ধের জন্যে অগ্রবর্তী দল হিসেবে লে, রকিব, লে. শওকত এবং লে. ফারুকের নেতৃত্বে একটি করে কোম্পানি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। লে. শওকতকে পাঠানাে হলাে চট্টগ্রামের নাজিরহাট এলাকাতে, লে. রকিবকে জোরারগঞ্জে এবং লে. ফারুককে সীতাকুণ্ড এলাকাতে। নভেম্বর মাসে
২০
এক নম্বর সেক্টরে ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ করা গেল। ৩ নভেম্বর একটি কনফারেন্স হলাে উদয়পুরে। সভাতে সেক্টর কমান্ডার মেজর রকিব, সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহফুজ এবং ২ নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম, মিত্রবাহিনীর ডিভিশনাল কমান্ডার লে. জেনারেল সগত সিং, মেজর জেনারেল হীরা, ব্রিগেডিয়ার সান্দু, ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। কনফারেন্সে প্রথাগত যুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা হয়। সভায় সিদ্ধান্ত অনুসারে ক্যাপ্টেন মাহফুজকে পূর্বাঞ্চলের (মুহুরী নদীর পূর্বদিক) এবং পশ্চিমাঞ্চলের (মুহুরী নদীর পশ্চিমদিক) দায়িত্ব দেওয়া হলাে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে। এই পরিকল্পনার প্রেক্ষিতে ৬ নভেম্বর ক্যাপ্টেন নাহফুজ লে, মনসুরকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিবাহিনীর ৬টি কোম্পানিসহ অগ্রসর হয়ে সলিয়াদীঘি পর্যন্ত প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করলেন। অপরদিকে পশ্চিমাঞ্চলে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম তার ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে অগ্রসর হলেন। লে, মুরশেদও একটি কোম্পানি নিয়ে যােগ দিলেন ক্যাপ্টেন জাফরের সঙ্গে।
এদিকে ৪ নভেম্বর একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেল— মুক্তিবাহিনীর একটি চরম ক্ষতি হয়ে গেল । ঋষিমুখ সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা সন্ধ্যা ৮ টা ৩০ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন। ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা এই সময় ৩টি কোম্পানি নিয়ে বেলােনিয়া অবস্থান করছিলেন। অনেকে বলেন, ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা পারিবারিক কারণেই আত্মহত্যা করেন। বিজয়ের চরম লগ্নে এই দেশপ্রেমিক বীর অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। বাংলার স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য দেখে যাওয়ার সুযােগ তার আর হলাে না।
যাহােক, সলিয়াদীঘি এলাকাতে মুক্তিবাহিনী বেশ দৃঢ়ভাবে প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তুলল। মুক্তিবাহিনীর এই অবস্থানে ১১তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি ৭ নভেম্বর ভাের ৪টা ৪৫ মিনিটে আক্রমণ চালায়। অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে অবস্থানরত ই পি আর হাবিলদার শহীদ তাঁর প্লাটুন নিয়ে পাকসেনাদের প্রতিরােধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু পাকিস্তানিদের অকস্মাৎ তীব্র হামলার মুখে ইপিআর হাবিলদার শহীদসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী হয়ে যান। গুলিবিদ্ধ আহত শহীদকে বন্দী অবস্থায় দিনের পর দিন অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েও তাঁর মুখ থেকে কোনাে সংবাদ সংগ্রহ করতে না পেরে পাকিস্তানিরা তার ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়াতেই থাকে। হাবিলদার শহীদের দেহের অংশবিশেষ পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। এমতাবস্থায়ও পাকসেনারা তাঁর ওপর অত্যাচার চালাতে ছাড়েনি। শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে হাবিলদার শহীদকে বেয়ােনেটের খোঁচায় হত্যা করে। দেশ হানাদারমুক্ত হলে হাবিলদার শহীদের সঙ্গে বন্দী তার শ্যালকের কাছ থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়। সলিয়াদীঘিতে সংঘর্ষ অব্যাহত রইলাে। ৭ নভেম্বর তারিখেই বেলা ৩টায় ২টি পাকিস্তানি জঙ্গী বিমান মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর হামলা চালায়। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হাতাহাতি সংঘর্ষ হয়। মুক্তিবাহিনী সবদিক দিয়ে প্রস্তুত ছিল, ফলে পাকসেনারা শেষ পর্যন্ত ৩০ জনের মৃতদেহ ফেলে পালিয়ে যায়।
৮ নভেম্বর এক নম্বর সেক্টর হেড কোয়ার্টারের সৈন্য, ২নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের কিছু সংখ্যক সৈন্য এবং মিত্রবাহিনীর ২য় রাজপুত ও ৩য় ডােগাররা ২টি কোম্পানি সম্মিলিতভাবে পরশুরামে আক্রমণ চালিয়ে পরশুরাম শত্রুমুক্ত করে।
৯ নভেম্বর ক্যাপ্টেন মাহফুজ ও সুবেদার ফকরুদ্দিনসহ মুক্তিবাহিনীর একটি দল সলিয়াদীঘিতে পাকসেনাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকসেনারা পেছনে সরে যেতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানিদের মজবুত ঘাঁটি বেলােনিয়া আক্রমণের জন্যে মুক্তিবাহিনী ৫ নভেম্বর দিন ধার্য করে। বেলােনিয়া সংঘর্ষ সম্পর্কে মেজর রফিক তার “A Tale of Millions” বইতে লিখেছেন : Pakistan’s total strength in Belonia was two Battalions of infantry and militia. One Battalion was deployed in the northern half and the other in the southern half. They were welldug-in with protective Minefields. Any conventional attack would be suicidal and extremely costly in terms of human lives. The plan was to penetrate somewhere through a gap in enemy defence, at night and get welldug-in before daylight. The enemy at the northern portion would be isolated and cut off from receiving supplies or reinforcements. They would thus be forced either to surrender or be gradually annihilated in a few days.
The night was dark and cold. A long column of troops moved forward. It started raining. With that came a strong wind making us shiver to the bones. Biting our lips we moved from east to west-through the bulge. Bad weather came as a blessing in disguise. There were no enemy patrols any where nor did the enemy expect any attack that night. The noise of our movement as well as of digging the trenches was covered by the crying of the wind. By next morning all the companies had reached their positions and were dug-in in their deferences. We were almost frozen. Rains stopped and like a gift from God, a blazing sun came up the sky. Manpower was immediately mobilised from nearby refugee camps and villages to carry our defence stores, ammunition, food and other supplies. A 4 miles road had to be made through the hills and the paddy fields to enable our vehicles to move forward. Thousands of people voluntrarily worked day and night. On the 3rd day, most of our vehicles could pass through. Response from the civilians was unique. A college professor carried a headload of C.I. sheets for our bunkers from a distance of 4 miles. Then he literally ran back to bring more. A boy of 6 years burst into tears when he was told that he was too young to carry any load.
The reaction of the enemy was slow. At first he look it for another ambush laid by the muktifouz. A company was sent to clear the area we had occupied. The mistake cost him 29 lives. The rest of them withdrew, leaving the dead behind. Next day, now 7, two sabre jets strafd our defences for the whole day. Only one civilian carrying some C. I sheets for us was killed owing to strafing. Surprisingly, the enemy did not launch any determined
counter-attack. It was clear he was on the defensive. There was no attempt to extricate in circled troops in the northern half. An intercepted wireless message read like this : “Make your own arrangement to escape from Belonia.” A few tried to escape through our defence. They were killed. The rest were eliminated by Nov 11.১
এদিকে ক্যাপ্টেন মাহফুজ তার বাহিনী নিয়ে ২০ নভেম্বর মােহাম্মদপুর (চাদগাজীর কাছে) নামক স্থানে প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তুললেন। এই বাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনীর ৬ নং জাঠ রেজিমেন্ট এসে যােগ দেয়। এই বাহিনীর কমান্ডার ছিল লে. কর্নেল হাসাবানিস । এই তারিখে পাকসেনারা ট্যাঙ্ক সজ্জিত হয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর পুনরায় ব্যাপকভাবে হামলা চালায়। উভয় পক্ষের তুমুল সংঘর্ষে পাকিস্তানিরা বেশ ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করলেও মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকজন শহীদ হলেন। ৬ নং জাঠ রেজিমেন্টের একজন নায়েকও এখানে মৃত্যুবরণ করেন। মুক্তিবাহিনী পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানিদের ওপর ব্যাপকভাবে হামলা চালায়। এই ব্যাপক আক্রমণে পাকসেনারা পিছু সরতে থাকে। এদিকে পাকসেনাদের বসানাে মাইনে। চাঁদগাজী পর্যন্ত পৌছতে প্রায় ২০ জনের মতাে অগ্রসরমান মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন । ক্যাপ্টেন মাহফুজ তাঁর বাহিনী নিয়ে ২৫ নভেম্বর চাঁদগাজী পর্যন্ত পৌঁছে যান।
মুক্তিবাহিনী চাঁদগাজী পৌছলে পাকসেনারা আর্টিলারির সাহায্যে প্রতিরােধ করার চেষ্টা করে। উভয় পক্ষই চরম ক্ষতির সম্মুখীন হতে থাকে। মুক্তিবাহিনী আপ্রাণ চেষ্টা করেও পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষাব্যুহ ভেদ করে সামনে অগ্রসর হতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে মিত্রবাহিনীর ট্যাঙ্ক সাহায্য চাওয়া হয়। পাকসেনারা বেলােনিয়া থেকে রেজুমিয়া সেতু পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার সৈনিক দিয়ে পাঁচ মাইল পাকা বাঙ্কার করে মাইন ফিল্ড প্রস্তুত করে। পাকসেনাদের এই মাইন ফিল্ডের জন্যে মুক্তিবাহিনীকে চরমভাবে ক্ষতি স্বীকার করতে হয়।
এদিকে নভেম্বরের ২১/২২ তারিখে মুক্তিবাহিনী একই সঙ্গে পাক ঘাঁটি চম্পকনগর বিওপি এবং বল্লভপুর আক্রমণ করে। ক্যাপ্টেন মাহফুজ একটি কোম্পানি নিয়ে চম্পকনগর এবং লে, হামিদ একটি কোম্পানি নিয়ে বল্লভপুরের দিকে অগ্রসর হন। মিত্রবাহিনীর ১৪ তম রাজরীফ বাহিনীর একটি কোম্পানি সীমান্ত থেকে আর্টিলারির সাপাের্ট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতীয় কমান্ডার ছিল কর্নেল ও পি শৰ্মা এবং আর্টিলারিতে ছিল মেজর বাজোয়া। সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক নিজে সকল দিক তত্ত্বাবধান করেন। আক্রমণের সময় নির্ধারিত হয় ওই তারিখ রাত ৩টা ৩০ মিনিট। ক্যাপ্টেন মাহফুজ তাঁর কোম্পানিটিকে তিন ভাগে ভাগ করেন—একটি সুবেদার আব্দুল গনি, একটি সুবেদার লনি মিয়া এবং অপর কলামে নায়েক সুবেদার রহমতউল্লাহ এই তিনজনের নেতৃত্বে বাহিনীকে প্রস্তুত করা হয়। ক্যাপ্টেন মাহফুজ এবং সুবেদার গনি সম্মুখভাগে থাকেন। বাঁ-দিকে সুবেদার লনি মিয়া এবং ডান দিকে থাকেন নায়েক সুবেদার রহমতুল্লাহ। রাত ৩ টা ২৫ মিনিটে ভারতীয় সীমান্ত থেকে আর্টিলারির গােলাবর্ষণ শুরু হয়। গােলাবর্ষণ স্থায়ী হয় ৫ মিনিট। আর্টিলারির গােলাবর্ষণ বন্ধ
হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন মাহফুজ তাঁর বাহিনী নিয়ে চার্জ করলেন। উভয় পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ চলল। মুক্তিবাহিনীর সৈনিকদের মুখে তখন মাঝে মাঝেই ‘জয় বাংলা ধ্বনি। সকাল ৬টা পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী আক্রমণ অব্যাহত রাখে। এরপর পাকসেনারা আর্টিলারি ফায়ারের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। বেলা ৩টা পর্যন্ত উভয় পক্ষের গুলি বিনিময় স্থায়ী হয়। মুক্তিবাহিনী অনেক চেষ্টা করেও খুব বেশি সফলতা অর্জন করতে পারল না। অবশেষে মুক্তিবাহিনী পেছনে সরে আসে। এই একটানা দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে ৫০ জন পাকসেনা নিহত এবং বেশ কয়েক জনের আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। মুক্তিবাহিনীর ৩ জন শহীদ এবং কয়েকজন আহত হন । ২
সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক অলৌকিকভাবেই নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। বল্লভপুরে লে, তাহেরও তার বাহিনী নিয়ে একই সময়ে আক্রমণ করেন। তিনি অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পাক অবস্থানের অত্যন্ত নিকটে চলে যান। পাকসেনাদের সাহায্যকারী দল লে, তাহেরকে প্রায় চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। এই সময় লে. তাহের বারবার তাঁর হেড কোয়ার্টারের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছিলেন। কিন্তু কোনাে সাহায্য না আসায় লে. তাহের অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তার বাহিনী নিয়ে পেছনে সরতে শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত নিরাপদ স্থানে সরে আসেন। আশ্চর্যের বিষয়, এমনি প্রচণ্ড গােলাবৃষ্টির মধ্যে একজন মুক্তিবাহিনীও সেদিন প্রাণ হারাননি।
এই সময় এক নম্বর সেক্টরে সর্বাত্মক সংঘর্ষে চূড়ান্ত বিজয়ের অপেক্ষা করা হচ্ছিল। দুই নং সেক্টরের ‘কে ফোর্স’ ১ ডিসেম্বর ফেনী শহর মুক্ত করে। ৪র্থ এবং ১০ম বেঙ্গল ফেনী থেকে অগ্রসর হয়ে রেজুমিয়া সেতুতে উপস্থিত হয়। এক নম্বর সেক্টরের ক্যাপ্টেন মাহফুজও তাঁর বাহিনী নিয়ে অপর বাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হন। এই যৌথ বাহিনী ফেনী-চট্টগ্রাম সড়ক দিয়ে একটি কলাম ডান দিকে মুহুরী নদী ধরে এবং অপর কলাম বাঁ-দিকের সড়ক ধরে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অন্যদিকে ১ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকসেনারা ছাগলনাইয়া ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এই সংঘর্ষে ভারতীয় বিএসএফ বাহিনীও অংশ নেয়।
৪র্থ ও ১০ম বেঙ্গল এবং ক্যাপ্টেন মাহফুজের সম্মিলিত বাহিনী রেজুমিয়া সেতু থেকে অগ্রসর হয়ে ৯ ডিসেম্বর জোরারগঞ্জে এসে পৌছায়। মিত্রবাহিনীর ৩২তম বিহার রেজিমেন্ট লে. কর্নেল হরগােবিন্দ সিংহের নেতৃত্বে এখানে এসে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যােগ দেয়। এই প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকসেনারা আর্টিলারি সাপাের্টে পেছনে সরতে থাকে। জোরারগঞ্জের সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর ১২ জন শহীদ হন। পাকসেনারা রেল এবং অন্যান্য সেতু ধ্বংস করে অব্যাহতভাবে পেছনে সরতে থাকল। তারা শুভপুর সেতুটিও ধ্বংস করে। পূর্বে পাঠানাে লে, রফিক এবং লে. ফারুক তাঁদের বাহিনী নিয়ে জোরারগঞ্জে একত্রিত হন। মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার আনন্দ স্বরূপের নেতৃত্বে ৮৩তম মাউন্টেন ব্রিগেড চাঁদগাজী থেকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যােগ দেয়। এই ব্রিগেডে অন্যান্যের সঙ্গে ৮ নং বিহার, ৬নং জাঠ, ৩২ নং বিহার, ৩১ নং জাঠ এবং ১৯ নং কুমাউ ব্যাটালিয়নও ছিলাে। সম্মিলিত বাহিনী চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।৩
২৪
সীতাকুণ্ড দখলের জন্য ক্যাপ্টেন মাহফুজ এবং মিত্রবাহিনীর মেজর গুরুং ডান দিক থেকে তাঁদের বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। সরাসরি সম্মুখভাবে চলল লে. কর্নেল হরগােবিন্দ সিংহের বাহিনী। মিত্র ও মুক্তিবাহিনী চন্দ্ৰকান্তের মন্দিরে এসে পৌঁছলে পাকসেনারা আর্টিলারির সাহায্যে ব্যাপকভাবে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। পাকিস্তানিদের ব্যাপক হামলায় মিত্রবাহিনীর ও পি ক্যাপ্টেন মােহাম্মদ আলী ও মুক্তিবাহিনীর ই পি আর সুবেদার হাফিজ শহীদ হলেন। পাকিস্তানীদের ব্যাপক হামলার মুখেও মুক্তি ও মিত্রবাহিনী ১১ ডিসেম্বর সীতাকুণ্ড নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এল। সীতাকুণ্ড বিজয়ের পর হাজার হাজার মানুষ যৌথবাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে আসে। স্বাগত জানায় নানা প্রকার আহার সামগ্রী আর ফুলের পসরা দিয়ে। সম্মিলিত বাহিনী ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সীতাকুণ্ডতেই অবস্থান করে।
১৬ ডিসেম্বর সম্মিলিত বাহিনী কুমিরা পৌঁছায়। এদিকে হাটহাজারীতে ২নং সেক্টর ট্রপস অবস্থান করছিল। ১৬ ডিসেম্বর সকালেই সম্মিলিত বাহিনী কুমিরা দখল করে নেয়। লে. শওকত তাঁর বাহিনীর নিয়ে নাজিরহাট থেকে এসে ক্যাপ্টেন মাহফুজের সঙ্গে যােগ দিলেন। এই বাহিনী একই তারিখে আরাে অগ্রসর হয়ে চট্টগ্রামের আনােয়ারা জুট মিলে অবস্থান নেয়। সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক তার বাহিনীর সকলের সঙ্গে দেখা করলেন। সন্ধ্যার দিকে কাপ্টেন মাহফুজ তার বাহিনী নিয়ে স্টেডিয়ামে পৌছান। ৮৩তম মাউন্টেন ব্রিগেডের হেড কোয়ার্টার হলাে চট্টগ্রাম ক্লাবের বিপরীতে রেলওয়ের একটি ভবনে। সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক অবস্থান নিলেন। সার্কিট হাউসে। ক্যাপ্টেন মাহফুজ নৌ-ভবনে তার অফিস স্থানান্তরিত করলেন। বস্তুত ১৬ ডিসেম্বর রাতেই চট্টগ্রাম হানাদারমুক্ত হয়।
তথ্য নির্দেশ
১ মেজর রফিক-উল-ইসলাম, বীর উত্তম (অব.)
রচিত ‘এ টেল অব মিলিয়নস’।
২. সাক্ষাঙ্কার মিজানুর রহমান, বীর প্রতীক।
৩. শামসুল হুদা চৌধুরী, রণাঙ্গনে মেজর শফিউল্লাহ ।
দুই নম্বর সেক্টর
দুই নম্বর সেক্টরের অপারেশনাল এলাকা ছিল নােয়াখালী, আখাউড়া-ভৈরব রেললাইন পর্যন্ত কুমিল্লা জেলা, সিলেটের হবিগঞ্জ মহকুমা, ঢাকা ও ফরিদপুরের কিছু অংশ । সেক্টর কমাণ্ডারের দায়িত্ব অর্পিত হয় মেজর খালেদ মােশাররফের ওপর। পরে এর দায়িত্ব নেন মেজর হায়দার । এই সেক্টরের অধীনে ৩৫ হাজারের মতাে গেরিলা সৈনিক যুদ্ধ করেছেন। নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৬ হাজার। নিয়মিত বাহিনীর তিনটি রেগুলার বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন ছিল যা পরবর্তীকালে ‘কে-ফোর্স’ (খালেদ ফোর্স) নামে পরিচিতি পায়। ৯ম বেঙ্গল, ১০ম বেঙ্গল এবং ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কে ফোর্সের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দৈনিক বাংলার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তৎকালীন মেজর খালেদ মােশাররফ বলেছেন, “এই সেক্টরের অধীনে ছিল ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুর ও নােয়াখালীর অংশ। কে-ফোর্সের অধীনে ছিল তিনটি রেগুলার ব্যাটালিয়ন ‘ফোর্থ বেঙ্গল, নাইনথ বেঙ্গল এবং টেনথ বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন। সেক্টর দুই-এর অধীনে প্রায় ৩৫ হাজার গেরিলা কাজ করেছেন। এই সেক্টরের অধীনে গেরিলা তৎপরতা যেমন তীব্র ছিল, তেমনি বিশেষ কয়েক জায়গায় নয় মাসের সম্মুখ যুদ্ধেরও কোনাে বিরতি হয়নি। শালদা নদী, গঙ্গাসাগর, বেলােনিয়া, ফেনী, মিয়াবাজার, চৌদ্দগ্রাম এবং কসবায় সবসময় পাকসেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষ লেগেই ছিলাে।১ সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশে ক্যাপ্টেন আক্তার মতিনগরে প্রথম যে হাসপাতাল স্থাপন করলেন তার উল্লেখ প্রয়ােজন। এই হাসপাতালটি পরে সরিয়ে বিশ্রামগঞ্জে ২০০ বেডে রূপান্তরিত করা হয়। প্রবাসী বাঙালি লণ্ডনে এফআরসিএস অধ্যয়নরত ডা. মবিন এবং ডা. জাফরুল্লাহ দেশের ডাকে চলে এসে এই হাসপাতালে যােগ দেন। আর যারা ছিল তাঁরা হলেন বেগম সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে, মেডিক্যাল ছাত্রী ডালিয়া, আসমা, রেশমা, ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, সবিতা এবং শামসুদ্দিন।
অপারেশনের সুবিধার জন্যে সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মােশাররফ তার সেক্টর এলাকাকে ছয়টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করেন :
১. গঙ্গাসাগর, আখাউড়া এবং কসবা সাব-সেক্টর : কমান্ডার ছিল ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন। তাঁর সঙ্গে ছিল ক্যাপ্টেন মাহবুব, লেফটেন্যান্ট ফারুক ও লেফটেন্যান্ট হুমায়ুন কবীর । এই এলাকায় চতুর্থ বেঙ্গলের একটি কোম্পানি এবং ইপিআর-এর দুটি কোম্পানি ছিল। এঁদের সঙ্গে মর্টারেরও একটি দল ছিল। এই
সাব-সেক্টর কসবা, আখাউড়া, সাইদাবাদ, মুরাদনগর, নবীনগর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত অপারেশন চালাতাে। মন্দভাগ সাব-সেক্টর : এই সাব-সেক্টরটি কমান্ড করেছেন ক্যাপ্টেন গাফফার। তার অধীনে চার্লি কোম্পানি এবং একটি মর্টারের দল ছিলাে। এই সাব-সেক্টর
বাহিনী মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন থেকে কুটি পর্যন্ত অপারেশন চালাতাে।
৩. শালদা নদী সাব-সেক্টর : এই সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিল মেজর আবদুস
সালেক চৌধুরী। এর অধীনে বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি এবং ইপিআর বাহিনীর একটি কোম্পানি ছিলাে। এই সাব-সেক্টর ট্রুপস শালদা নদী, নয়নপুর এবং বুড়িচং এলাকা পর্যন্ত অপারেশন চালাতাে।
৪.. মতিনগর সাব-সেক্টর : এই সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিল লেফটেন্যান্ট দিদারুল আলম। মেলাঘর হেড কোয়ার্টারের কিছু ট্রপস এবং ই পি আর বাহিনীর একটি কোম্পানি লেফটেন্যান্ট দিদারুল আলমের সঙ্গে ছিলাে। এই বাহিনী গােমতীর
উত্তর বাধ থেকে কোম্পানিগঞ্জ পর্যন্ত অপারেশন চালাতাে।
৫. গােমতীর দক্ষিণে ছিল নির্ভয়পুর সাব-সেক্টর : এই সাব-সেক্টরটি কমান্ড
করেছেন ক্যাপ্টেন আকবর এবং লেফটেন্যান্ট মাহবুব। এই সাব-সেক্টর বাহিনী কুমিল্লা থেকে চাদপুর এবং লাকসাম পর্যন্ত অপারেশন চালাতাে।
৬. রাজনগর সাব-সেক্টর : এটি ছিল গােমতীর সর্ব দক্ষিণে । কমান্ডার ছিল ক্যাপ্টেন | জাফর ইমাম, ক্যাপ্টেন শহীদ এবং লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামান। এই সাব-সেক্টর বাহিনী বেলােনিয়া, লাকসামের দক্ষিণ এলাকা এবং নােয়াখালী পর্যন্ত অপারেশন চালাতাে। চতুর্থ বেঙ্গলে ‘ব্রেভাে কোম্পানি, ইপিআর বাহিনী এবং গণবাহিনীর একটি করে কোম্পানি কাজ করেছে।
৭ সেপ্টেম্বর মেজর খালেদ মােশাররফের কমান্ডে কে-ফোর্স গঠনের পর সেপ্টেম্বরে দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর মতিনের ওপর। মেজর খালেদের নামানুসারেই এই ব্রিগেডের নামকরণ করা হয় ‘কে-ফোর্স’। ২২ অক্টোবর কসবা সংঘর্ষে মেজর খালেদ মােশাররফ গুরুতররূপে আহত হলে কে ফোর্সের কমান্ড নিলেন মেজর সালেক। এই সময় মেজর মতিনও অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে সেক্টরের কমান্ড দেওয়া হলাে মেজর হায়দারের ওপর। কে-ফোর্সের দশম বেঙ্গল কমান্ড করেছেন মেজর জাফর ইমাম। অন্যান্য অফিসার ছিল ক্যাপ্টেন মুখলেসুর রহমান, ক্যাপ্টেন ইমামুজ্জামান, লেফটেন্যান্ট মিজান, লেফটেন্যান্ট দিদারুল আলম, ও লেফটেন্যান্ট জিলুর রহমান প্রমুখ। নবম বেঙ্গল কমান্ড করেন মেজর আইনউদ্দিন। অন্যান্য অফিসারের মধ্যে লেফটেন্যান্ট হারুনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। চতুর্থ বেঙ্গল কমান্ড করেছেন মেজর গাফফার ।
দুই নম্বর সেক্টরেও মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা ব্যাপকভাবে শুরু হয়। জুলাই মাসে পাকসেনারা কসবা এবং মন্দভাগ পুনর্দখলের প্রস্তুতি নেয়। তারা কুটিতে ৩১তম বেলুচ
২৭
রেজিমেন্ট এবং গােলন্দাজ বাহিনীর সমাবেশ ঘটায়। মন্দভাগ সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন গাফফার তার বাহিনী নিয়ে শত্রুসেনার মােকাবেলার জন্যে প্রস্তুত হন।
১৯ জুলাই পাকসেনাদের ৩১তম বেলুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি শালদা নদী দিয়ে মন্দভাগের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এই সংবাদ পেয়ে নায়েক সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুন পাকসেনাদের অগ্রবর্তী দলটিকে বাধা দেয়ার জন্যে অগ্রসর হয়। সুবেদার ওহাব তাঁর প্লটুন নিয়ে মন্দভাগ বাজারের নিকট পৌছে অতর্কিতে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করেন। উভয়পক্ষের গুলি বিনিময়ে পাকসেনাদের অন্তত ৬০ জন হতাহত হয় বলে জানা যায়। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতায় পাকসেনারা নদীতে ঝাঁপ দেয়া শুরু করলে অধিকাংশই জলে ডুবে মারা যায়। নিহত পাকিস্তানিদের মধ্যে ৩১তম বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল কাইয়ুম, ৫৩তম গােলন্দাজ বাহিনীর ক্যাপ্টেন বােখারী এবং আরও ৩/৪ জন অফিসারসহ বেশ কয়েকজন জুনিয়র কমিশন্ড় অফিসার ছিল বলে পরে জানা যায়। আরও শােনা যায়, পঁচিশে মার্চের পর থেকে কুমিল্লা শহরে একাধিক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জঘন্যতম নায়ক ছিল এই নিহত ক্যাপ্টেন বােখারী।
দুই নম্বর সেক্টর ট্রুপস মে মাস থেকে যে তৎপরতা চালাচ্ছিল তা সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। মে মাসে পাকসেনারা বেলােনিয়া অধিকার করার চেষ্টা করে। সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মােশাররফ ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে পাকসেনাদের অগ্রগতি রােধ করার নির্দেশ দেন। ছাগলনাইয়াতে তখন পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ চলছিল। পাকসেনারা ফেনীর দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ছাগলনাইয়ার ওপর এবং একই সঙ্গে চট্টগ্রাম সড়কের ওপরও আক্রমণ চালায়। সংঘর্ষে পাকিস্তানিরা ২০/২৫ জনের মৃতদেহ ফেলে রেখে পেছনে সরে যায়। পাকিস্তানিরা পেছনে সরে গেলেও কয়েকদিন পর পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে ছাগলনাইয়ার দক্ষিণ থেকে ফেনীচট্টগ্রাম পুরনাে সড়ক ধরে অগ্রসর হয়ে আকস্মিকভাবেই ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকসেনাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে মুক্তিবাহিনী বেশকিছু সংখ্যায় হতাহত হয়ে পেছনে সরে রাজনগরে প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করে। এই পেছনে সরে যাওয়াকে পাকসেনারা অত্যন্ত ভীতির চোখে দেখল। তাই পাকসেনারা ভীত হয়ে বেলােনিয়া ছেড়ে মূল প্রতিরক্ষা ঘাঁটি প্রস্তুত করল ফেনীতে। মুক্তিবাহিনীর বেলােনিয়া রক্ষার জন্যে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে একটি কলাম বান্দুয়াতে (ফেনী থেকে ২ মাইল উত্তরে) এবং লে. ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে আরেকটি কলাম অপরদিকে প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করে। মূল সেক্টর বাহিনী দিয়ে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের কম্যাণ্ডে মুন্সীরহাটে আর একটি মজবুত ঘাঁটি গড়ে তােলা হয়। বেলােনিয়া বাঙ্ক সামরিক দিক থেকে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এই বাঙ্কের দৈর্ঘ্য ছিল ১৭ মাইল এবং প্রস্থ ছিল ১৬ মাইল। বান্দুয়ার অবস্থান সম্পর্কে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন :
২৮
“১৭ মে পর্যন্ত আমাদের মুন্সীরহাটের ডিফেন্স এবং বান্দুয়ার অবস্থানটি বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এ জায়গাটিকে আমরা এ জন্যে প্রতিরক্ষা ঘাঁটির জন্যে মনােনীত করেছিলাম যে, জায়গাটির সামনে এমন কতকগুলাে প্রাকৃতিক বাধাবিঘ্ন ছিল যেগুলাে শত্রুসেনার অগ্রসর হওয়ার পথে বিরাট বাধাস্বরূপ। এতে শত্রুসেনাদের নাজেহাল করার যথেষ্ট সুযােগ ছিল। আমাদের অবস্থানটি মুহুরী নদীর পাশ ঘেঁষে পশ্চিম দিক থেকে বেলােনিয়া নদী ছেড়ে পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই ব্যহটি কমপক্ষে ৪ মাইল চওড়া। আমরা এই অবস্থানটি এইভাবে পরিকল্পনা করেছিলাম যাতে শত্রুসেনারা বাধ্য হয়ে আমাদের ঘাঁটি আক্রমণ করার সময় প্রতিরক্ষাব্যুহের সম্মুখ দিক ছাড়া আর কোনাে উপায়ে অন্য কোনাে দিক থেকে আসার রাস্তা না পায়। আমাদের মুন্সীরহাটের প্রধান ঘাঁটি সম্বন্ধে শত্রুদের ধোঁকা দেয়ার জন্য বান্দুয়া রেলওয়ে স্টেশনের কাছে এবং সিলােনিয়া নদীর ওপর একটি অগ্রবর্তী ঘাঁটি স্থাপনের নির্দেশ দেই। এটা ছিল একটি ডিলেয়িং পজিশন। এই পজিশনের সামনের রাস্তা ও রেলের সেতুগুলাে ধ্বংস করে দেয়া হয়, যাতে শত্রুদের অগ্রগমনে আরাে বাধার সৃষ্টি হয়। শত্রুসেনাদের অগ্রগমনের রাস্তার পশ্চিম ও পূর্ব পাশে রাস্তার দিকে মুখ করে আমরা বেশ কতকগুলাে উঁচু জায়গায় এবং পুকুরের উঁচু বাঁধে মজবুত বাঙ্কার তৈরি করি এবং তাতে সব সময় হালকা মেশিনগান প্রস্তুত রাখি। এ এমন এক রকমের ফাঁদ যার ভেতরে একবার অগ্রসর হলে দু’পাশের গুলিতে শত্রুসেনার পক্ষে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।২
৭ জুন সকালেই পাকসেনাদের ফেনী থেকে বেলােনিয়ার দিকে অগ্রসর হওয়ার সংবাদ পাওয়া গেল। ১০ জুন পাকসেনারা প্রবলভাবে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ শুরু করে ক্রমশ অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। শত্রুসেনারা বান্দুয়া সেতুর উপর একটি বাঁশের পুল নির্মাণ করে যেমনি পার হওয়ার চেষ্টা করছিলাে ঠিক সেই সময়। মুক্তিবাহিনীর অগ্রবর্তী ডিলেয়িং পজিশনের সৈনিকরা পাকসেনাদের ওপর গুলি চালায়। এতে প্রথম সারিতে যেসব শত্রুসেনা সেতু অতিক্রম করার চেষ্টা করে তারা সবাই গুলি খেয়ে পানিতে পড়ে যায়। অকস্মাৎ এই আক্রমণে পাকিস্তানিরা ৪০/৫০ জন সাথীকে হারিয়ে পিছু হটতে শুরু করে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই পাকসেনারা পুনরায় প্রবলভাবে। গােলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় তীব্র আক্রমণ চালায়। ডিলেয়িং পজিশনের সৈনিকরা শত্রুদের আরাে বহুসংখ্যক লােককে হতাহত করে সাহসিকতার সঙ্গে আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে। কিন্তু আক্রমণ যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে তখন ডিলেয়িং পজিশনের সৈনিকগণ পজিশন ছেড়ে প্রধান ঘাঁটি মুন্সীরহাটে চলে আসে। শত্রুরা কিছুটা সফলতা লাভ করায় তারা আরাে প্রবলবেগে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং সকল বাধা পেরিয়ে সিলােনিয়া নদীপথ পর্যন্ত অগ্রসর হয়। এখানে এসে পাকসেনারা নদী পার হওয়ার পর সকল প্রস্তুতি নেয়। মুক্তিবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি থেকে ৮০০ গজ সামনে আনন্দপুর নামক গ্রামে শত্রুসেনারা তাদের সমাবেশ ঘটাতে থাকে। নদী পার হওয়ার কিছু পূর্ব মুহূর্তে কামানের সাহায্যে তারা মুক্তিবাহিনীর মূল ঘাঁটির
ওপর আক্রমণ আরম্ভ করে। পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে আর্টিলারির সাহায্যে বৃষ্টির মতাে গােলা নিক্ষেপ করা হচ্ছিল। তখনই কিছুসংখ্যক পাকসেনা নদী পার হয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ২০০/৩০০ গজ ভেতরে চলে আসে। কিছুসংখ্যক তখনাে নদী পার হচ্ছিল। এমনি একটা অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর মর্টার ও মেশিনগান গর্জে ওঠে। মুক্তিবাহিনীর এই অকস্মাৎ পাল্টা জবাবে শত্রুসেনারা প্রচুর সংখ্যায় হতাহত হতে থাকে। কিন্তু তবুও পাকসেনারা বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে প্রবলবেগে সামনে এগিয়ে আসতে থাকে। এক পর্যায়ে পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর পাতা মাইন ফিল্ডের মুখে এসে পড়ে। পাকসেনাদের পায়ের চাপে একটার পর একটা মাইন ফাটতে থাকে। শত্রুসেনারা মাইনের আঘাতে তখন ছিন্নবিচ্ছিন্ন হচ্ছিল । এদিকে মুক্তিবাহিনীর পাতা মেশিনগানগুলাে থেকেও ক্রমাগত গুলিবর্ষণ হচ্ছিল বৃষ্টির মতাে। কিন্তু তবুও দেখা গেল এই চরম বিপর্যয়ের মধ্যেও গুটিকয়েক শত্রুসেনা মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি বাঙ্কারের নিকটে এসে গেছে। এদিকে মুক্তিযােদ্ধারা গ্রেনেড হাতে প্রস্তুতই ছিল। গ্রেনেডের আঘাতে পাকসেনারা সমূলে ধ্বংস হয়। এমনি অবস্থার মধ্যে পাকসেনারা আর সামনে অগ্রসর হতে সাহস করেনি। পেছনে যারা ছিল তারা পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে পেছনের দিকে পালাতে শুরু করে। শত্রুসেনাদের পালাতে দেখে মুক্তিযােদ্ধারা উল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠে এবং আরাে বিপুল বিক্রমে গুলি চালিয়ে তাদেরকে হত্যা করতে থাকে। পশ্চাদপসরণরত শত্রুদের ওপর ক্রমাগত মর্টারের আঘাত হেনে মুক্তিবাহিনী ব্যাপকভাবে শত্রুসেনাদের হত্যা করে। মুক্তিবাহিনীর এই ব্যাপক আক্রমণের মুখে খুব কম সৈন্যই সিলােনিয়া নদীর অপর পারে পিছু হটে যেতে সক্ষম হয়। বিপর্যস্ত ও পর্যুদস্ত অবশিষ্ট সৈনিকরা যাতে নিরাপদে তাদের আনন্দপুর ঘাঁটি পর্যন্ত পৌঁছতে পারে তাই পিছু হটার সময় পাকসেনারা আর্টিলারির সাহায্যে বৃষ্টির মতাে গােলাবর্ষণ করতে থাকে।
এই সংঘর্ষের পর পাকসেনাদের ৩০০-এর মতাে মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। জানা যায়, পাকসেনারা এই সংঘর্ষে এক ব্যাটালিয়ানেরও অধিক সৈন্যকে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে মােতায়েন করেছিল ।
পাকসেনাদের অব্যাহত চাপের মুখে সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মােশাররফ মন্দভাগ সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন গাফফারকে ৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানি নিয়ে বেলােনিয়াতে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে সাহায্যের নির্দেশ দিলেন। ক্যাপ্টেন গাফফার সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশ অনুযায়ী তার কোম্পানি নিয়ে বেলােনিয়া এলাকাতে চলে যান।
১৭ জুলাই রাত ৮টায় বেলােনিয়াস্থ মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর পাকিস্তানিরা ব্যাপকভাবে আক্রমণ করে। সংঘর্ষ শুরু হওয়ার আধঘণ্টা পরই পাকিস্তানিরা তিনটি হেলিকপ্টারযােগে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ঠিক পেছনেই ছত্রীসেনা নামিয়ে দেয়। পাকসেনারা ঠিক সম্মুখভাগে মুহুরী ও সিলােনিয়া নদী দিয়েও অগ্রসর হতে থাকে। তারা চারদিক থেকে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। এই সঙ্কটময় মুহূর্তে
৩০
ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম, ক্যাপ্টেন শহীদ এবং লে. ইমামুজ্জামান অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে স্ব স্ব বাহিনী নিয়ে শত্রুদের মােকাবেলা করতে থাকেন। আক্রমণটা প্রথম পড়ে গাফফারের অবস্থানের ওপর। মুক্তিবাহিনী অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে পাকসেনাদের সে আক্রমণ প্রতিহত করে তাদেরকে পেছনে সরে যেতে বাধ্য করে। পাকসেনারা ক্রমশ অগ্রসর হয়ে লে. ইমামুজ্জামানের অবস্থানের ওপরও ট্যাঙ্কসহ হামলা চালায়। পাকিস্তানিদের আক্রমণের তীব্রতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। প্রবল চাপের মুখে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে ।–
“বুঝতে পারলাম তারা যদি আমাদের এভাবে ঘিরে রাখতে পারে তাহলে তাদের বিপুল শক্তিতে দিনের আলােতে ট্যাঙ্ক ও কামানের গােলায় আমাদের সৈন্যদের সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেবে। আমি ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে তার অবস্থান থেকে ডানে বা বামে সরে গিয়ে শত্রুদের এড়িয়ে পেছনে এসে চেতুলিয়াতে নতুন প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরির নির্দেশ দিই। এই নির্দেশ অনুযায়ী রাত ১টায় ক্যাপ্টেন শহীদ এবং ক্যাপ্টেন গাফফার তাঁদের স্ব স্ব দল নিয়ে শত্রুদের এড়িয়ে যখন চেতুলিয়াতে নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থানে পৌঁছে তখন সকাল প্রায় ১০টা হবে। আমি নিজেও যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলাম লে, ইমামুজ্জামান ও তাঁর দলটির না পৌছানাের জন্যে। আমরা রাতে এসব ঘাঁটি ত্যাগ করে চেতুলিয়াতে নতুন ব্যুহ রচনা করলেও, এ সম্বন্ধে পাকসেনারা সকাল ১০ পর্যন্ত জানতে পারেনি। প্রায় ১টা পর্যন্ত রেকি’ শেষ করে যখন চেতুলিয়াতে ফেরত আসি ঠিক সেই মুহূর্তে শত্রুদের আরাে ৩/৪ খানা হেলিকপ্টার আসে এবং আমাদের অবস্থানের ৭০০/৮০০ গজ ডানে রেলওয়ে লাইনের উঁচু বাঁধের পেছনে অবতরণ করে। এছাড়া পরে আরা দুটো হেলিকপ্টার আসে যেগুলাে আমাদের বামে আধ মাইল দূরে। একটা পুকুরের বাঁধের পেছনে অবতরণ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে সেদিক থেকে ভয়ঙ্কর গােলাগুলির আওয়াজ শােনা যায়। বােঝা গেল শত্রুরা আমার ট্রপসদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে অথচ তখনও আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান কিছুতেই তৈরি হয়নি। বাম দিক থেকে গােলাগুলির আওয়াজ আরাে প্রচণ্ডতর হচ্ছিল। আমি তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিই। এবং ক্যাপ্টেন জাফর ও ক্যাপ্টেন গাফফারকে নির্দেশ দিই সেই মুহূর্তে তাদের নিজ নিজ কোম্পানি নিয়ে বর্তমান অবস্থান পরিত্যাগ করার জন্যে। আমি এবং আমার সমস্ত সৈন্য অবস্থানটি পরিত্যাগ করার আধঘণ্টার মধ্যে শত্রুরা সেদিন আক্রমণ চালায়। বামদিক থেকে যে গুলির আওয়াজ আসছিল, তা ছিল লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামানের বাহিনীর সঙ্গে পাকসেনাদের সংঘর্ষের আওয়াজ। পাকসেনারা যখন হেলিকপ্টারযােগে বামে অবতরণ করছিল সে সময় লে. ইমামুজ্জামানের সৈন্যদের সামনে তারা পড়ে যায়। লে, ইমামুজ্জামান শত্রুদের প্রচণ্ড আঘাত হেনে পরে বামদিক দিয়ে পেছনে হটে আসে এবং আমাদের সঙ্গে মিলিত হয়। এভাবেই বেলােনিয়ার পতন ঘটে।”
সেপ্টেম্বর মাসে দুই নম্বর সেক্টরেও আক্রমণ অব্যাহত ছিল। বেলােনিয়ার পতন ঘটলেও মুক্তিবাহিনী প্রতিটি সাব-সেক্টরেই তাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখে। মন্দভাগ, শালদা নদী, কসবা ইত্যাদি প্রতিটি সাব-সেক্টরেই বিরামহীন সংঘর্ষ চলতে থাকে।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন এলাকাতে পাকসেনাদের সঙ্গে ‘ক্তিবাহিনীর এক বড়াে রকমের সংঘর্ষ হয়। পাকসেনা নিয়ন্ত্রিত। শালদা স্টেশন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এই স্টেশনের সঙ্গে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ঢাকা ও সিলেটের রেল যােগাযােগ ছিল। সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মােশাররফ শালদা। রেলওয়ে স্টেশন দখল করতে চাইলেন। এদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩৩তম বেলুচ রেজিমেন্টের প্রায় একটি ব্রিগেড সৈন্য কুটি ও কসবা এলাকাতে মজবুত প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করে অবস্থান করতে থাকে। শালদা নদীর দক্ষিণে নয়নপুরেও ৩০তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট অবস্থান নেয়। মেজর খালেদ মােশাররফের পরিকল্পনা অনুসারে মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি ক্যাপ্টেন গাফফারের কমান্ডে শালদা নদীর উত্তর বাঁকে অবস্থান নিলাে। ক্যাপ্টেন আশরাফ তার কোম্পানি নিয়ে মন্দভাগ থেকে অগ্রসর হয়ে নয়নপুর সড়কের কাছাকাছি পজিশন নিলেন। মেজর সালেক চৌধুরী শালদা নদী অতিক্রম করে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের পশ্চিমে একটি গােডাউন সংলগ্ন এলাকাতে অবস্থান নিলেন। ক্যাপ্টেন পাশা আর্টিলারি বাহিনী নিয়ে রইলেন মন্দভাগে । সুবেদার জব্বার তার মর্টার সেকশন নিয়ে বাঁকের পেছনে সাপাের্ট সেকশন হিসেবে রইলেন। সার্বিক কমান্ডে রইলেন সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মােশাররফ নিজে।
সেপ্টেম্বরের শেষ। সকাল ৬ টা ৩০ মিনিট। ক্যাপ্টেন এ এম পাশা পাকসেনাদের ওপর আর্টিলারি গােলা নিক্ষেপ করলেন। এরপরই মুক্তিবাহিনী চারদিক থেকে পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। পাকসেনারা ছিল প্রস্তুত। ফলে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে তারা বুড়িচং, কসবা, কুটি ও চাদলা থেকে আর্টিলারির ফায়ার শুরু করে। ক্যাপ্টেন আশরাফ তার বাহিনী নিয়ে নয়নপুরে পাকিস্তানিদের ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতায় পাকসেনারা ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে নয়নপুর ছেড়ে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের মূল ঘাঁটিতে আশ্রয় নেয়। ক্যাপ্টেন আশরাফ নয়নপুর তার নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেন। ক্যাপ্টেন গাফফারও তাঁর বাহিনী নিয়ে নয়নপুরের সেতু পর্যন্ত পৌঁছে যান। মেজর সালেক চৌধুরী তেমন সুবিধা করতে পারছিলেন না। পাকিস্তানিরা তীব্রভাবে মেজর সালেকের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। সংঘর্ষ চলল সকাল ৯টা পর্যন্ত। ইতােমধ্যে মেজর সালেকের গােলা প্রায় শেষ হয়ে আসায় তাকে পেছনে সরে মন্দভাগে চলে আসতে হলাে। পাকিস্তানিদের তীব্র আক্রমণের মুখে মুক্তিবাহিনী শেষ পর্যন্ত শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন দখল করতে ব্যর্থ হয়। যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে পাকিস্তানিরা চরমভাবে মার খেলেও মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ সাফল্য আসেনি। নয়নপুরে পাক অবস্থান কাট-অফ না করার জন্যে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে পাকসেনারা অতি সহজেই নয়নপুর ছেড়ে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনে তাদের মূল বাহিনীর সঙ্গে একত্র হয় এবং এর ফলে পাকিস্তানিদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে মেজর সালেক সামনে অগ্রসর হতে ব্যর্থ হন।
এই সংঘর্ষের পর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মােশাররফ মেজর সালেক এবং ক্যাপ্টেন আশরাফকে সেক্টর হেড কোয়ার্টারে নিয়ে গেল এবং শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন এলাকার সমুদয় দায়িত্ব ক্যাপ্টেন গাফফারের ওপর অর্পণ করলেন।
৮ অক্টোবর শালদা রেলওয়ে স্টেশন এলাকাতে পাকিস্তানিদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর পুনরায় এক বড়াে রকমের সংঘর্ষ হলাে। ক্যাপ্টেন গাফফার তার হেড কোয়ার্টার মন্দভাগেই রাখলেন। তিনি শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন এলাকা দখলের জন্যে পরিকল্পনা করলেন। পরিকল্পনাটি ছিল এ রকম : একটি কোম্পানিকে চার প্লাটুনে বিভক্ত করে এক একজন কমান্ডারের নেতৃত্বে শত্রু-ঘাটি ক্রমাগত আক্রমণ করতে হবে । আর যখনই পাকসেনারা বিভক্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীকে শায়েস্তা করার জন্যে অগ্রসর হবে ঠিক তখনই মুক্তিবাহিনীর মূল দুটি কোম্পানি শালদা নদী স্টেশন আক্রমণ করবে। অন্যদিকে উপরােক্ত প্লাটুনের কিছু সৈন্য পাকিস্তানিদের ব্যস্ত রাখবে এবং অবশিষ্ট অংশ নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে আক্রমণে অংশ নেবে।
এই পরিকল্পনা অনুসারে অক্টোবরের ৭ তারিখে পাকিস্তানি শত্রুঘাঁটি বড়দাসুয়া, চাঁদলা, কায়েমপুর ও গােবিন্দপুর আক্রমণ করা হয়। পাকিস্তানিরা মুক্তিবাহিনীকে লক্ষ করে সারা রাত গােলাবর্ষণ অব্যাহত রাখে। ওই তারিখ রাতেই পূর্ব-পরিকল্পনা অনুসারে নায়েক সুবেদার সিরাজ, সুবেদার মঙ্গল মিয়া এবং সুবেদার বেলায়েত স্ব স্ব প্লাটুন নিয়ে উত্তর ও পশ্চিম দিক সামনে রেখে পূর্বদিকে পজিশন নেয়। সুবেদার ওহাব তার কোম্পানি নিয়ে সুবেদার মঙ্গলের পেছনে রইলেন। মুক্তিবাহিনী পাক অবস্থান বড়দাসুয়া, চাদলা, কায়েমপুর ও গােবিন্দপুর আক্রমণ করে এবং পূর্ব নির্ধারিত স্ব স্ব স্থানে অবস্থান করতে থাকে।
৮ অক্টোবর সকাল ৮টায় শালদানদীর মূল শত্রুঘাঁটির তিনদিক থেকে চারটি অবস্থানের ওপর আক্রমণ করা হয়। মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণে পাকসেনারা দুটি অবস্থান হারিয়ে অবশিষ্ট দুটি ঘাটিতে অবস্থান নেয়। সুবেদার বেলায়েত অতি দ্রুত তাঁর বাহিনী নিয়ে শালদা নদী অতিক্রম করে পাকসেনাদের পরিত্যক্ত বাঙ্কারে অবস্থান নেন। সুবেদার বেলায়েতের এই অবস্থানের ফলে পাকসেনারা বাজার এলাকা থেকে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের অবস্থানের সঙ্গে সংযােগ হরিয়ে ফেলে। সকাল ৯টায় পাকসেনারা পেছনে সরে নয়নপুরে চলে যেতে বাধ্য হয়। এভাবে শত্রুমুক্ত হয় মুক্তিবাহিনীর আকাঙিক্ষত শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন। পাকসেনারা রেলওয়ে স্টেশন পুনর্দখলের জন্যে বাজারের গােডাউন এলাকাতে পাল্টা আক্রমণ করে। এই অবস্থানে ছিল সুবেদার বেলায়েত। পাকিস্তানি গােলার আঘাতে বিজয়ের চরমলগ্নে সুবেদার বেলায়েত শহীদ হলেন। বহু চেষ্টা করেও সেদিন পাকসেনারা শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়। এই বিজয় ক্যাপ্টেন গাফফারের পরিকল্পনা অনুসারেই সম্ভব হয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর এই বিজয়কে সকল শ্রেণীর মানুষ স্বাগত জানালেন। বাহিনী প্রধান এম এ জি ওসমানী এক রিপাের্টে লিখলেন :
IN LIEU OF MESSAGE FORM OPS IMMEDIATE
DTG FROM : EAST COM GS (X)
151400
SECRET TO: DELTA SECTOR
A-1015 INFO : ALPHA BRAVO CHARLIE ECHO ONE FOXTROT JULLIET SECTORS OPS BRANCH (BY HAND)
From C-in-C Bangladesh Forces for Capt. Gaffar Commd 4 E. BENGAL Comm Co Bangladesh (,) quote (.) one (,) heartiest congratulations on execellent performance Tiger your bn in capturing are SALDANADI NORTH and retaining Liberated position repulsing enemy every counter attack inflicting heavy cas on 30 Punjab at the cost of only (1) killed and 7 (7) wounded to yourself (,) well done keep it up (,) convey above to all ranks and fwd recommendations qallantry awards by special courier (.) two, (,) this is not your only gallant and skillful leadership attaining brilliant success against odds (,) in recognition your consistantly distinguished leadership in battle beating enemy everytime despite determined enemy hids with air support Gov. of the People’s Republic of Bangladesh approves immediate galliantry Award High order to you (.) Three (,) Comd. ‘K’ Force only (.) cogratulations (.) fwd citation on printed forms as per our 1015 A of 30 (30) July 71 for this immediate award also for others deserving recognition (.) four (.) for all Bangladesh comds and Bns E. BENGAL (.) Looking fwd to similar cood news of your victory over enemy (.) gallantry awarded recommandation awaited from all except Z. Force comm 3 and 4 sectors (.) expidite despatch by special courier (.) unquote (.) Jackpot sectors only (.) confirm delivery to all addressees.
Sd/ Iligible Commander-in-Chief
20-11-713
এদিকে কসবা-গঙ্গাসাগর-আখাউড়া সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কমান্ড করছিলেন। পাকসেনারা কসবা এবং লাতমুরাতে দৃঢ় ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে অবস্থান করছিল। সামরিক দিক থেকে কসবা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মেজর খালেদ মােশাররফ ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনকে তাঁর বাহিনী নিয়ে কসবা দখলের নির্দেশ দিলেন। কসবাতে পাকিস্তানিদের একটি কোম্পানি মজবুত করে অবস্থান করছিল। ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন নবম বেঙ্গলের দুটি কোম্পানি নিয়ে আর্টিলারি বাহিনীর সাহায্যে উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে শত্রু-ঘাঁটি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন।
৩৪
২২ অক্টোবরের পর ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন কসবা আক্রমণ করলেন। রণাঙ্গনের সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মােশাররফ নিজে যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন। এই যুদ্ধে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আর্টিলারি সাপাের্ট ছিল। উভয়পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ চলছিল, হঠাৎ করেই একটি শেলের প্রিন্টারের আঘাতে মেজর খালেদ মােশাররফ গুরুতররূপে আহত হয়ে পড়েন। মেজর খালেদ মােশাররফ আহত অবস্থায় রণাঙ্গনে উপস্থিত অফিসারদের নিয়ে এক জরুরি সভা করলেন। সভাতে তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। মেজর খালেদকে আগরতলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলাে। ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন তার বাহিনী নিয়ে কসবা শত্রুমুক্ত করলেন।
দুই নম্বর সেক্টরে লাতমুরা নামক স্থানে নভেম্বর মাসে প্রথমে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানিদের এক সংঘর্ষ হয়। লাতমুরাতে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন (বর্তমানে লে. কর্নেল) তাঁর নবম বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি করতে থাকেন। পাকসেনারা টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে লাতমুরা ছাড়তে বাধ্য হয়। নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে এই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর একজন অফিসারসহ ৪০ জন যােদ্ধা প্রাণ হারান এবং ৬০ জন আহত হন বলে জানা যায়।
৬ নভেম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মােশাররফ সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে তাঁর হেড কোয়ার্টার মেলাঘরে ডেকে পাঠালেন। তিনি ক্যাপ্টেন জাফরের সঙ্গে বিস্তারিত আলােচনা করে তাঁকে বেলােনিয়া রেলস্টেশন থেকে ফেনী পর্যন্ত শত্রুঘাঁটি ধ্বংস করার জন্য দায়িত্ব দেন। এই সময় পাকসেনারা পরশুরাম, চিতলিয়া, ফুলগাজী, মুন্সীরহাট, বেলােনিয়া ও ফেনীতে দৃঢ় ঘাঁটি তৈরি করে অবস্থান করছিল।
৮ নভেম্বর ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম দশম বেঙ্গলের এবং ক্যাপ্টেন মােরশেদ দ্বিতীয় বেঙ্গলের একটি করে কোম্পানি নিয়ে বেলােনিয়ার পথে অগ্রসর হলেন।৪
এই সংঘর্ষ সম্পর্কে এই রণাঙ্গনের নায়ক ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম সাপ্তাহিক বিচিত্রার এক নিবন্ধে লিখেছেন : পরশুরাম ও বেলােনিয়া থেকে শুত্রুদের হটানাের ব্যাপারে মিত্র বাহিনীর জেনারেল হীরা আমায় এক রকম চ্যালেঞ্জ করলেন। আমি দৃঢ়ভাবেই সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। আত্মপ্রত্যয় নিয়ে সামরিক কৌশলের অন্যতম কৌশল হিসেবে গােপন অনুপ্রবেশ দ্বারা শত্রুদের গােপনে অবরােধ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। রাত আনুমানিক ১০টা ৩০ মিনিটে আমাদের অনুপ্রবেশের কাজ শুরু করলাম। আমরা এমন একটা এলাকা ঘেরাও করার অভিযানে নেমেছি যার তিনটি দিকই ছিল ভারত সীমান্ত দ্বারা বেষ্টিত। আমরা তাই ভারতের একপ্রান্তের সীমান্ত থেকে পরশুরাম-চিতলিয়ার মাঝ দিয়ে অগ্রসর হয়ে ভারত সীমান্তের অপর প্রান্ত পর্যন্ত অবরােধ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। অবরােধের কাজ শুরু হল। অন্ধকার রাতে মুহুরী নদী ও সিলােনিয়া নদীর কোথাও বুক পানি, কোথাওবা পিচ্ছিল রাস্তার বাধা পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি সবাই। আমরা আমাদের নির্ধারিত স্থানে হাজির হলাম এবং এর ফলে শত্রুদের পরশুরাম ও চিতলিয়া ঘাঁটি পুরােপুরি আমাদের অবরােধের মাঝে আটকা পড়ল। শত্রুদের চিতলিয়া ঘাঁটির দিক থেকে যাতে কোনাে প্রকার আক্রমণ না আসতে পারে আমরা তার জন্য।
প্রতিরােধ গড়ে তুললাম। ভাের হলাে, আমরাও সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে গেলাম। শত্রুরা আমাদের অবরােধের মাঝে। এ সফলতার খবরটা জেনারেল হীরাকে জানাতে ইচ্ছে হলাে। শত্রুদেরকে যে আমরা পুরােপুরি জালে আটকিয়েছি ওয়্যারলেসে জেনারেল হীরাকে জানালাম। খবরটা শুনে জেনারেল হীরা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। বেলােনিয়া থেকে রেললাইনের সঙ্গে সমান্তরালভাবে কাঁচা রাস্তাও চলে এসেছে ফেনী পর্যন্ত। এই রাস্তার পাশেও আমাদের বেশকিছু বাঙ্কার গড়ে উঠেছে। বাঙ্কারে বসে। সবাই সামনের দিকে চেয়ে আছি। হঠাৎ দূর থেকে একটা ট্রলির আওয়াজ অস্পষ্ট শুনতে পেলাম। শব্দটা চিতলিয়ার দিক থেকেই আসছে বলে মনে হলাে। রেললাইন ও সড়কের কাছের বাঙ্কারে যারা ডিউটিতে ছিল তাদের মধ্যে নায়েক সুবেদার এয়ার আহমদ ছিল খুবই সাহসী। আমরা পরিষ্কারভাবে দেখতে পেলাম একজন অফিসার ও কয়েকজন সৈন্য বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে এগিয়ে আসছে। ঐলিটা একেবারে কাছে এসে গেল। নায়েক সুবেদার এয়ার আহমদ ও তাঁর সঙ্গীদের হাতের অস্ত্রগুলাে একসঙ্গে গর্জে উঠল । শত্রুরা অনেকেই পালাতে চাইলাে কিন্তু আমরা তা সম্ভব হতে দিলাম না। নায়েক সুবেদার এয়ার আহমদ আনন্দে বাঙ্কার ছেড়ে উঠে দৌড়ে গেল অদূরে পড়ে থাকা শত্রুদের মৃত অফিসারটির কাছে। গােলাগুলির কথা সে যেন মূহুর্তের জন্যে ভুলে গেল। অফিসারের পকেট থেকে সে পিস্তলটি উঠিয়ে নিলাে, তারপর তাকে টেনে নিয়ে আসতে লাগল নিজ বাঙ্কারের দিকে, ঠিক তক্ষুনি শত্রুদের চিতলিয়া ঘাঁটির দিক থেকে একটি বুলেট এসে বিধল এয়ার আহমদের মাথায়। চোখের সামনেই দেখতে পেলাম ওর শরীরটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল। সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল ।৫
এই পরই হলাে উভয় পক্ষের তুমুল সংঘর্ষ। পাকসেনারা চিতলিয়া ও পরশুরাম থেকে এই সময়ে ব্যাপকভাবে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর আর্টিলারির সাহায্যে তাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখল।
১০ নভেম্বর বিকাল ৪টায় পাক জঙ্গী বিমান মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর বােমা নিক্ষেপ করে। এই বিমান হামলায় মুক্তিবাহিনীর তেমন উল্লেখযােগ্য কোনাে ক্ষতি হয়নি। ১১ নভেম্বর পাক জঙ্গী বিমান পুনরায় হামলা চালালাে। “বেলা ৩টা ৫০ মিনিটে হঠাৎ দেখলাম তিনটি শত্রুর বিমান আমাদের এলাকায় উড়ে আসছে। এসেই ওরা সে এলাকার ওপর বােম্বিং শুরু করল। আগুন ধরে গেল অনেক ঘরবাড়িতে। চারদিকে দাউ দাউ করে বাড়িঘরে আগুন জ্বলছে। ওরা বেশ নিচু হয়েই বােম্বিং করছিলাে। যদিও আমাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র ছিল বহু। কিন্তু বিমান বিধ্বংসী কামান আমাদের ছিল না। আমরা তাই শেষ রক্ষা হিসেবে এমএমজিকে এ কাজে ব্যবহার করতে লাগলাম । যেহেতু ওরা জানতে আমাদের কোনাে বিমানবিধ্বংসী কামান নেই তাই নিশ্চিত হয়ে নিচু দিয়ে বিমান চালাচ্ছিল। সবাই অপেক্ষায় আছি, কখন আমাদের এমএমজি’র আওতায় বিমানগুলাে আসে। একসময় এমএমজি’র আওতায় এসে গেল বিমানগুলাে,
৩৭
মুহর্তে গর্জে উঠল এমএমজি। দুটি বিমান উড়ে চলে গেল ওদের সীমানায়। আর একটি ফিরে যেতে পারল না। শূন্যে ঘুরপাক খেয়ে ছিটকে পড়ল মাটিতে। সব জোয়ানরা চেঁচিয়ে উঠল উল্লাসে । মিত্রবাহিনীর জেনারেল হীরা ওয়ারলেসে আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানালেন। সেদিন রাতে আমরা মিত্রবাহিনীর সহযােগিতায় শত্রুদের বেলােনিয়া ও পরশুরাম ঘাঁটির ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালালাম। এরা আমাদের এ হামলার মুখে বেশিক্ষণ টিকতে পারল না। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল ওরা। আমাদের আক্রমণে প্রাণ দিল শত্রুদের শতকরা ৮০ ভাগ সৈন্যই। রাতের মধ্যেই আমরা পরশুরাম ও বেলােনিয়া দখল করতে সক্ষম হলাম ।৬
পাকসেনারা চরমভাবে মার খেলাে এখানে। বহু অস্ত্র ও গােলাবারুদসহ বন্দী হলাে ৫৪ জন পাকসেনা। মুক্তিবাহিনী পরশুরাম ও বেলােনিয়া মুক্ত করে অগ্রসর হলাে চিতলিয়া দখলের জন্যে। ইতােমধ্যে পাকসেনারা চিতলিয়া ছেড়ে মুন্সিরহাটে আশ্রয় নিলাে।
মুক্তিবাহিনী সামনের দিকে অগ্রসর হলাে ক্রমশ। ক্যাপ্টেন গাফফার নীলক্ষেতে ঘাঁটি করে চলেছেন। পাকসেনারা প্রতিকূল অবস্থা দেখে ফুলগাজী ছেড়ে বান্দুয়া রেলওয়ে স্টেশনে ঘাঁটি স্থাপন করল। মুক্তিবাহিনী অগ্রসর হয়ে কালিরহাট ও পাঠানগরে শত্রুদের সামনে রেখে প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করে। মুক্তিবাহিনীর এই অবস্থানের দক্ষিণে সােনাগাজীতে গেরিলা বাহিনীর বেশ একটা বড়াে দল পূর্ব থেকেই অবস্থান করছিল। পাকসেনাদের ওপর তিন দিকে থেকে চাপ সৃষ্টি করা হলাে। তারা মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে নােয়াখালীর বেগমগঞ্জ হয়ে লাকসামে পালিয়ে গেল।
দুই নম্বর সেক্টরের কে ফোর্সের দশম বেঙ্গল রেজিমেন্ট মিত্রবাহিনীর ৮৩তম ব্রিগেডের সহযােগিতায় ফেনী শহর মুক্ত করে। ৭ ডিসেম্বর এই বাহিনী নােয়াখালী সদর মুক্ত করে। নােয়াখালী সদরে রাজাকার ও আল-বদর বাহিনী সম্মিলিত বাহিনীকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু যৌথ বাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই বাহিনী পুরােপুরি নােয়াখালী মুক্ত করে ৯ ডিসেম্বর। একই তারিখে তারা চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। ফেনী থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব ছিল ৬৫ মাইল। সম্মিলিত বাহিনী ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত কুমিরা থেকে ৪ মাইল দূরে পৌছে যায়। একই তারিখে বেলা ১২টার দিকে এই বাহিনী কুমিরার কাছাকাছি এসে পৌছায়। অন্যদিকে ৮
ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে ৯ম বেঙ্গল এবং ক্যাপ্টেন আবদুল গাফফারের নেতৃত্বে ৪র্থ বেঙ্গলও চট্টগ্রামের দিকে এগুতে থাকে।
ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম তার বাহিনী নিয়ে ১৪ ডিসেম্বর কুমিরার সন্নিকটে এসে পৌছান। এখানে পাকসেনাদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত সুদৃঢ়। মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার আনন্দ সরূপ ক্যাপ্টেন জাফরকে দশম বেঙ্গলের চার্লি কোম্পানি ও মিত্রবাহিনীর দলকে। রেখে কুমিরা পাহাড় পার হয়ে হাটহাজারী অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যাবার অনুরােধ করেন। ক্যাপ্টেন জাফর লে. দিদারুল আলমের কম্যাণ্ডে দশম বেঙ্গল চার্লি কোম্পানি এবং মিত্রবাহিনী রেখে অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে হাটহাজারী অভিমুখে রওয়ানা হলেন।
৩৮
পাকসেনারা তখন হাটহাজারী পুলিশ স্টেশনে অবস্থান করছিল। ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তিবাহিনী হাটহাজারী এসে পৌঁছে। অপরদিকে চতুর্থ বেঙ্গল চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক ধরে হাটহাজারীর অনতিদূরে অবস্থান নেয়। নবম বেঙ্গলও ইতােমধ্যে পৌঁছে যায়। ১৫ ডিসেম্বর হাটহাজারীতে অবস্থানরত পাকিস্তানিদের ওপর মুক্তিবাহিনী ব্যাপকভাবেই আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি অফিসার মেজর হাদী ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের একটি কোম্পানিসহ আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিবাহিনী অগ্রসর হয়ে নয়াপাড়া পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। অপরদিকে ১৫ ডিসেম্বরে লে, দিদারুল তার কোম্পানি নিয়ে মিত্রবাহিনীর সহযােগিতায় কুমিরার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। সম্মিলিত আক্রমণে পাকসেনারা কুমিরা ছেড়ে ফৌজদারহাট এসে অবস্থান নেয়। মুক্তিবাহিনী অগ্রসর হয়ে ফৌজদারহাটে আক্রমণ চালায়।
১৬ ডিসেম্বর তারিখেই যৌথবাহিনীর কাছে চট্টগ্রামে অবস্থানরত পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করে। চট্টগ্রাম হানাদারমুক্ত হয়।
তথ্য নির্দেশ
১. দৈনিক বাংলা, ২৬ মার্চ, ১৯৭২
২. সাক্ষাৎকার : ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ বীরউত্তম, পিএসসি।
৩. সাক্ষাৎকার : লে. কর্নেল আব্দুল গাফফার, বীর উত্তম (অবঃ)।
৪. সাক্ষাৎকার : লে. কর্নেল জাফর ইমাম, বীর বিক্রম (অবঃ)। ৫. লে. কর্নেল জাফর ইমাম, সংগ্রামের এক প্রান্তরে, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ৮ ফেব্রুয়ারি,
১৯৭৩, প্রথম বর্ষ : ৩৩ সংখ্যা।
৬. পূর্বোক্ত।
তিন নম্বর সেক্টর
তিন নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব অর্পিত হয় মেজর কে এম শফিউল্লাহর ওপর। এই সেক্টরের আওতাভুক্ত ছিল উত্তরে সিলেটের চুড়ামনকাঠি (শ্রীমঙ্গলের নিকট) এবং দক্ষিণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিংলারবিল পর্যন্ত। অভ্যন্তরীণ অপারেশনাল এলাকা ছিল সিলেটের মৌলভীবাজার মহকুমার আংশিক, হবিগঞ্জ মহকুমা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার অংশ, নারায়ণগঞ্জ মহকুমার অংশ এবং কিশােরগঞ্জ মহকুমার অংশবিশেষ। সেক্টর কমান্ডার মেজর কে এম শফিউল্লাহ মে মাস থেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে গেরিলা পদ্ধতিতে অপারেশন পরিচালনার নির্দেশ দিলেন।
এই সেক্টরের অধীন বেশকিছু গেরিলা বেইস গড়ে উঠেছিল। সিলেট জেলাতে ছিল চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ ও বানিয়াচং; ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমাতে ছিল নাসিরনগর, সরাইল, মুকুন্দপুর ও নবীনগর। কিশােরগঞ্জ মহকুমাতে ছিল কুলিয়ার চর, বাজিতপুর, কটিয়াদী, পাকুন্দিয়া, হােসেনপুর ও কিশােরগঞ্জ সদর । ঢাকা জেলায় ছিল রায়পুরা, শিবপুর, নরসিংদী, কাপাসিয়া, মনােহরদী, কালিয়াকৈর, জয়দেবপুর ও কালিগঞ্জ। ময়মনসিংহে ছিল গফরগাঁও এবং ভালুকা ।
এই সেক্টরে নভেম্বর মাস পর্যন্ত গেরিলার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৩০ হাজার।
এই সেক্টরের কমান্ডার কে এম শফিউল্লাহ সমগ্র এলাকাতে সুষ্ঠু অপারেশন চালাবার জন্যে তার এলাকাকে ১০টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করেন : ১. আশ্রমবাড়ি সাব-সেক্টর এবং ২. বাঘাইবাড়ি সাব-সেক্টর : এ দুটি সাব-সেক্টরই কমান্ড করেছেন প্রথমে ক্যাপ্টেন
আজিজ এবং পরে ক্যাপ্টেন এজাজ। ৩. হাতকাটা সাব-সেক্টর : কমান্ডার ছিল ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান। ৪. পঞ্চবটী সাব-সেক্টর : কমান্ডার ছিল ক্যাপ্টেন নাসিম। ৫, মনতলা সাব-সেক্টর এবং ৬. বিজয়নগর সাব-সেক্টর : কমান্ড করেছেন ক্যাপ্টেন এম এস এ ভূঁইয়া। ৭. কালাছড়া সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিল লে. কর্নেল মজুমদার। ৮. কলকলিয়া সাব-সেক্টর : কমান্ডার ছিল লে, মােরশেদ। ৯. বামুটিয়া সাব-সেক্টর : কমান্ড করেছেন লেফটেন্যান্ট সাইদ।১
বাংলাদেশ সেনা সদর দফতর থেকে সেপ্টেম্বর মাসে ‘এস ফোর্স’ গঠনের নির্দেশ এলেও বস্তুত অক্টোবর মাসেই ‘এস ফোর্সের জন্ম হয়। মেজর শফিউল্লাহর
৪০
নামানুসারেই ব্রিগেডের নাম হয় ‘এস ফোর্স’। এস ফোর্সের জন্মের পর সেক্টর কমান্ডার কে এম শফিউল্লাহ এস ফোর্সের দায়িত্ব নিলেন। এবং সেক্টরের দায়িত্ব পড়ল মেজর নুরুজ্জামানের ওপর।
প্রাথমিক পর্যায়ে এস ফোর্স নিম্নোক্তভাবে বিন্যস্ত করা হলাে : এস ফোর্স কমান্ডার : মেজর কে এম শফিউল্লাহ। ব্রিগেড মেজর : ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমান। ডি কিউ ; ক্যাপ্টেন আবুল হােসেন। সিগনাল অফিসার : ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রউফ। বস্তুত এস-ফোর্সে দুটি রেগুলার ব্যাটালিয়ানই ছিল : ২য় ইস্ট বেঙ্গল এবং ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যাদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়েছে তাঁরা হলেন : কমান্ডিং অফিসার : মেজর মইনুল হােসেন চৌধুরী । অ্যাডজুটেন্ট : লেফটেন্যান্ট মােহাম্মদ সাইদ। মেডিক্যাল অফিসার : লে, আবুল হােসেন। ‘এ’ কোম্পানি কমান্ডার : মেজর মতিউর রহমান এবং লে. আনিসুল হাসান।
‘বি’ কোম্পানি কমান্ডার : লে. বদিউজ্জামান এবং লে. সেলিম মােহাম্মদ কামরুল হাসান।
‘সি’ কোম্পানি কমান্ডার: লে, মােহাম্মদ ইব্রাহীম। ‘ডি’ কোম্পানি কমান্ডার : লে. গােলাম হেলাল মােরশেদ। ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যাদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়েছে, তাঁরা হলেন: কমান্ডিং অফিসার : মেজর নাসিম। অ্যাডজুটেন্ট: লে. কবীর। মেডিক্যাল অফিসার : লে. মইনুল হােসেন। ‘এ’ কোম্পানি কমান্ডার : লে. শামসুল হুদা (বাচ্চু)। ‘বি’ কোম্পানি কমান্ডার : ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়া। ‘সি’ কোম্পানি কমান্ডার : লে : নজরুল ইসলাম এবং ‘ডি’ কোম্পানি কমান্ডার : লে : আবুল হােসেন নাসের।
‘এস ফোর্স’ গঠনের পর তিন নম্বর সেক্টরকে পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস করা হয় এবং সেক্টরটিকে এস ফোর্স থেকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক করা হয়। তিন নম্বর সেক্টরকে। নিম্নলিখিতভাবে বিন্যস্ত করা হয় :
সেক্টর কমান্ডার : মেজর নুরুজ্জামান। স্টাফ অফিসার : নুরুদ্দিন মাহমুদ এবং এম এ মহি।
কোম্পানি যারা কমান্ড করেছেন তাঁরা হলেন ক্যাপ্টেন মতিন, ক্যাপ্টেন এজাজ আহমদ চৌধুরী, লে, সাদেক, লে, মজুমদার এবং লে, জাহাঙ্গীর। এঁরা প্রত্যেকেই দুটি
৪১
করে কোম্পানি কমান্ড করেছেন। বেসামরিক অফিসারদের মধ্যে আলকাস মিয়া এবং আশেক হােসেনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
এই সেক্টরের অধীনে দুটি হাসপাতাল গড়ে ওঠে। একটি ৩০ বেডের হেজামারাতে এবং অপরটি ১০ বেডের আশ্রম বাড়িতে।২
তিন নম্বর সেক্টরের প্রতিটি সাব-সেক্টরে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা অব্যাহত ছিল। ১৪ মে লে. মােরশেদ মাত্র ১২ জন সঙ্গী নিয়ে মাধবপুরে এক অ্যামবুশে পাকিস্তানিদের বিপুল ক্ষতিসাধন করেন। মাধবপুর পতনের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট সড়ক নির্দ্বিধায় ব্যবহার করতে শুরু করে। এই সড়কের বেশ কয়েকটি স্থান এই সেক্টর ট্রুপস ধ্বংস করে দিলেও পাকসেনারা বিকল্প সড়ক প্রস্তুত করে যাতায়াত শুরু করে।
১৪ মে লে. মােরশেদ তেলিয়াপাড়া থেকে ১২ জন মুক্তিবাহিনীর একটি দল নিয়ে রাত দুটোর দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট সড়কের বিকল্প সড়কে গােপনে দুটি ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন বসিয়ে ওত পেতে বসে থাকেন। একে অন্ধকার, তার ওপর ছিল বৃষ্টি। মুক্তিযােদ্ধারা সেই অন্ধকার রাতে বৃষ্টিতে ভিজে শত্রুর অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকল। পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত পাকসেনাদের কোনাে খবর না পেয়ে লে, মােরশেদ তার বাহিনী নিয়ে নিকটবর্তী এক গ্রামে বিশ্রামের জন্যে রওয়ানা হন। এর কিছুক্ষণ পরই পাকিস্তানিদের একটি ব্যাটালিয়ন সিলেট থেকে ঢাকার পথে অগ্রসর হতে থাকে । সামনে ছিল একটি জিপ। তারা নির্ভাবনায় অগ্রসর হচ্ছিল। মুক্তিযােদ্ধারা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় অবস্থা অবলােকন করতে থাকে। যা আশা করা গিয়েছিল ঠিক তাই হলাে। প্রথম জিপটি বিকল্প পথ দিয়ে যেতে থাকলে মাইন বার হয়ে গাড়িটি ধ্বংস হয় । দ্বিতীয় গাড়িটি এই অবস্থা দেখে দ্রুত পার হয়ে যাবার চেষ্টা করে, কিন্তু সেটিও মাইনের আঘাতে ধ্বংস হয়। যে ক’জন পাকসেনা বেঁচে যায় তারা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে গ্রামটি ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। লে. মােরশেদ প্রথমে চুপচাপ ছিল কিন্তু যখন দেখলেন পাকসেনারা তাঁদের ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে তখন তাঁরাও গুলি চালিয়ে আত্মরক্ষা করে পিছু হটতে থাকেন। পাকসেনাদের দুটি গাড়ি এবং বেশকিছু সৈন্য হতাহতের পরও প্রায় ৪০০ সৈন্য মুক্তিযােদ্ধাদের পিছু ধাওয়া করে। লে, মােরশেদ সুদক্ষ সৈনিকের ন্যায় অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে তাঁর দলের সবাইকে নিয়ে ‘ট্যাকটিক্যাল উইথড্র করে নিরাপদে নিজ ঘাটিতে ফিরে যেতে সমর্থ হন।
এই এ্যামবুশে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন ব্যবহার করা হয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এটাই ছিল প্রথম ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইনের ব্যবহার।৩
এদিকে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান মাত্র ১৩ জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে নালুয়া চা-বাগানে। সিলেট সড়কের উপর এক অ্যামবুশ পাতেন। সে অ্যামবুশে পাকসেনাদের ৩টি গাড়ি ধ্বংস, ২টি গাড়ি বিকল এবং ৬৫ জনের মতাে সৈন্য নিহত হয়। ক্যাপ্টেন মতিউর তার ১০ জনের দলটি নিয়ে মাইন বসিয়ে নালুয়া চা-বাগানের নিকট সিলেট সড়কের দু’পাশে শত্রুর আগমন অপেক্ষায় বসে থাকেন। ওই দিন দুপুরে পাকিস্তানিদের একটি
৪২
কোম্পানি সিলেট থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। ঠিক দুটোয় পাকিস্তানিরা মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশে পড়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর অস্ত্রগুলাে একই সঙ্গে গর্জে ওঠে। এই অ্যামবুশে বেশ কিছুসংখ্যক পাকসেনা নিহত এবং বসিয়ে রাখা মাইনে গাড়ি ধ্বংস হয়। ক্যাপ্টেন মতিউর তার ছােট্ট দল নিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে টিকে থাকা সম্ভব নয় মনে করে পিছু হটে নিরাপদ স্থানে চলে যান।
১৬ মে পাকসেনাদের ওই দলটি তেলিয়াপাড়াতে পুনরায় মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশে পড়লে প্রায় ৪০ জনের মতাে সৈন্য প্রাণ হারায়। নালুয়া চা-বাগানের নিকট পাকিস্তানিরা চরমভাবে মার খেলে তাদের সাহায্যার্থে চুনারুঘাট থেকে তাদের কিছু সৈন্য এগিয়ে আসে। তাদের সম্মিলিত বাহিনী দ্রুত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এদিকে ক্যাপ্টেন মতিন তাঁর বাহিনী নিয়ে তেলিয়াপাড়াতে শত্রুর অপেক্ষায় ওত পেতে বসে ছিলেন। ভীত সন্ত্রস্ত পাকসেনারা ক্যাপ্টেন মতিনের পাতা মরণফাঁদে পা দিল। ক্যাপ্টেন মতিন তাঁর দল নিয়ে একযােগে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এই আক্রমণে পাকসেনাদের একটি গাড়ি ধ্বংস এবং ৪০ জন্য সৈন্য নিহত হয়। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
১৯ মে পুনরায় পাকসেনারা তেলিয়াপাড়াতে মুক্তিবাহিনীর ফাঁদে পা দিল। সিলেট সড়কে পাকসেনারা বারবার মার খেয়ে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছিল। এখন তাদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্যে প্রায় দুই কোম্পানি সৈন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট অভিমুখে রওয়ানা হয়। লে. মােরশেদ তেলিয়াপাড়া থেকে ১৫ জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে ১৯ মে তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের নিকটবর্তী সিলেট সড়কে ৪টি ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন বসিয়ে সড়কের পাশে শত্রুর প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করতে থাকেন। পাকিস্তানিরা দ্রুতবেগে অগ্রসর হচ্ছিল। মাইন না ফাটায় পাকসেনাদের প্রথম গাড়িটি নির্বিঘ্নে পার হয়ে যায়। দ্বিতীয় গাড়িটি ওই স্থানে আসার সঙ্গে সঙ্গে মাইন বাস্ট হলে পর পর দুটি গাড়ি ধ্বংস হয়। পেছনের গাড়িগুলাে থেমে যায় এবং পাকসেনারা গাড়ি থেকে নেমে ফাঁকা মাঠে পজিশন নেবার চেষ্টা করে। লে. মােরশেদ মুক্তিবাহিনীর দলটি নিয়ে সুযােগের। অপেক্ষায় ছিলেন। তাদের গাড়ি থেকে নামার মুহূর্তেই মুক্তিবাহিনীর মেশিনগান এবং অপর গানগুলাে একসঙ্গে গর্জে ওঠে। অকস্মাৎ এবং বেপরােয়া আক্রমণে পাকসেনাদের প্রায় এক কোম্পানি সৈন্য নিহত হয় এবং তিনটি গাড়ি ধ্বংস হয়। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর একজন মুজাহিদ পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে। অবশ্য পরে সে তাদের হাত থেকে পালিয়ে আসতে সমর্থ হয়। লে. মােরশেদ একটি গাড়ি এবং বেশকিছু অস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার করেন। ইতােমধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পাকসেনাদের উদ্ধারকারী দল এসে আহত-নিহতদের গাড়িতে তুলে, অপর সৈন্যদের উদ্ধার করে ফিরে যায়।
এই সেক্টরের গেরিলা বাহিনী বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত প্রবেশ করে পাকিস্তানিদের নিশ্চিত নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল। জুলাই মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত
৪৩
গেরিলা বাহিনী বেপরােয়াভাবে রায়পুরা, নরসিংদী, কাপাসিয়া, মনােহরদী, কুলিয়ারচর, কটিয়াদী ইত্যাদি এলাকাতে তাদের তৎপরতা অব্যাহত রাখে।
রায়পুরের নিকটবর্তী বেলাবাে নামক স্থানে ১৪ জুলাই ঘটল এক মর্মান্তিক ঘটনা। এই এলাকায় সুবেদার বাশার তাঁর বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানিদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিবাহিনীর অস্তিত্ব ঘােষণা করছিলেন। ওই তারিখে পাকসেনারা লঞ্চযােগে নদীপথে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান বেলাবাে দখলের জন্যে অগ্রসর হতে থাকে। সুবেদার বাশার পাকসেনাদের আগমন টের পেয়ে তাঁর দল নিয়ে বেলাবাের নিকটবর্তী টোক নাম স্থানে ওদের আগমন অপেক্ষায় ওত পেতে থাকেন। দালালের সহযােগিতায় পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর এই অবস্থানের কথা পূর্বেই জেনে গিয়েছিল। চতুর পাকসেনারা লঞ্চের অধিকাংশ সৈন্যকে নৌকাযােগে পূর্বেই পাঠিয়ে দিয়েছিল । সুবেদার বাশার নৌকায় যে পাকসেনারা আসতে পারে সেকথা ভাবেননি। তিনি অপেক্ষা। করছিলেন লঞ্চের জন্য। শূন্য লঞ্চটি এক সময় মুক্তিবাহিনীর রাইফেল ব্রেঞ্চের মধ্যে এলেই মুক্তিযােদ্ধারা সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার খুলে দেয়। পাকসেনারা এর জন্যে প্রস্তুত ছিল । নৌকাযােগে অগ্রগামী পাকসেনা এবং পেছনে অগ্রসরমান পাকসেনা একই সময়। সুবেদার বাশারের ওপর আক্রমণ শুরু করে। সুবেদার বাশার অবস্থা বুঝলেন—বুঝলেন মৃত্যু তার অনিবার্য। কিন্তু তবুও শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত লড়াই অব্যাহত রাখবেন বলে ঠিক করলেন। উভয়পক্ষের সংঘর্ষ কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হয়। সুবেদার বাশারসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা সেদিন শহীদ হন এবং অবশিষ্টরা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পেছনে সরে যেতে সমর্থ হয়। মুক্তিযােদ্ধারা পরে হলুদের ক্ষেতের ভেতর থেকে সুবেদার বাশারের মৃতদেহ উদ্ধার করলে দেখা যায় তার পেটের ক্ষতস্থান নিজের শার্ট দিয়ে। বাঁধা। এলএমজিটি তার পাশেই পড়ে ছিল। বহু মূল্যবান কাগজপত্র ছিন্ন ভিন্ন অবস্থায় ইতস্তত পড়ে থাকতে দেখা গেছে। মনে হয় সুবেদার বাশার মৃত্যুর মুহূর্তে বাংলাদেশ সম্পর্কিত যাবতীয় কাগজপত্র ধ্বংস করেছিলেন। ১৪ জুলাই এ যুদ্ধে ৭ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন।
তিন নম্বর সেক্টরেও মুক্তিবাহিনী ক্রমাগত অভিযান চালিয়ে পাকিস্তানিদের নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছিল। প্রায় এক কোম্পানি পাকিস্তানি সেনা রেলগাড়িযােগে আখাউড়া থেকে মুকুন্দপুর হয়ে হরশপুর যাচ্ছে— এ খবর জানতে পেরে লে, মােরশেদ মুকুন্দপুর ও হরপুরের মাঝামাঝি রেলের উপর ট্যাঙ্কবিধ্বংসী মাইন বসিয়ে প্রায় ৩০০ গজ দূরে অপেক্ষা করতে থাকেন। সঙ্গে লে. আনিসও ছিলেন। ইলেকট্রিক ডেটোনেটর দিয়ে মাইনের বিস্ফোরণ ঘটানাে হয়। কারণ পাকিস্তানিরা মাইনের ভয়ে ভীত ছিল । আর তাই ইঞ্জিনের সামনে দুটি বালি বােঝাই মালগাড়ির বগি দিয়ে রেলগাড়ি চালাতাে। ঘটনা ঘটলাে ১৩-১৪ সেপ্টেম্বর । দু’জন পাকিস্তানি অফিসারসহ একটি কোম্পানি আখাউড়া থেকে মুকুন্দপুর হয়ে হরশপুরের দিকে যাত্রা করে। রাত তখন ৪টা। লে, মােরশেদ এবং তাঁর সঙ্গীরা ওত পেতে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ইঞ্জিনের সামনের দুটি বালি বােঝাই মালগাড়ি বগি পার হয়ে যাবার পরপরই মাইনের সুইচ অন করা
৪৪
হলাে। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড, বিকট এক শব্দে ইঞ্জিনসহ বেশকিছু কামরা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। জানা যায়, দু’জন অফিসারসহ ২৭ জন পাকসেনা সেদিন নিহত হয়েছে। লে. মােরশেদ সদলবলে একরাশ তৃপ্তি নিয়ে মূল ঘাঁটিতে ফিরে আসেন।
কালেঙ্গা জঙ্গলেও গেরিলাদের তৎপরতা লক্ষণীয়। ২৪ সেপ্টেম্বর ক্যাপ্টেন আজিজের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকসেনাদের ওপর হামলা চালিয়ে একজন অফিসারসহ ৬১ জন পাকসেনাকে হত্যা করে। এই অ্যামবুশ এত চমক্কার হয়েছিল যে পাকিস্তানিরা পজিশন নেওয়ার সময় পর্যন্ত পায়নি। ফলে, এক এক বুলেটে এক একটি খানসেনা ধরাশায়ী হয়। এমন সাফল্যের মাঝেও মুক্তিবাহিনীর একজন শহীদ হন। নায়েক আব্দুল মান্নান এত বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে, সে দাঁড়িয়ে ‘জয় বাংলা বলে চিৎকার করে শত্রু খতম করতে থাকে। এতেও সে ক্ষান্ত না হয়ে কমান্ডারের কাছে বাহবা নেবার জন্যে হঠাৎ করেই সে ক্রল করে শত্রুহের দিকে অগ্রসর হয়— জীবিত খানসেনা ধরে আনার জন্যে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলাে না। পাকিস্তানিদের একটি বুলেট নায়েক আব্দুল মান্নানের দেহ বিদীর্ণ করে দেয়।
অক্টোবর মাস পর্যন্ত এই সেক্টর এলাকাতে গেরিলা তৎপরতা এতাে দ্রুত এবং ব্যাপক বেড়ে গিয়েছিল যে, পাকিস্তানিদের ক্রমশ ভীত হয়ে পড়তে দেখা গেল। লক্ষণীয় যে, এই গেরিলা তৎপরতার জন্যে পাকসেনারা থানা পর্যায় পর্যন্ত নিয়মিত বাহিনীর সৈন্য ছাড়াও তাদের চারপাশে রাজাকার এবং অন্যান্য সহায়ক শক্তি রাখতে শুরু করে। অক্টোবর মাসে আর একটি বিষয় লক্ষ করা গেল— কিছুসংখ্যক বাঙালি ই পি আর বাহিনীর সদস্য যারা বন্দী হয়ে ছিল তাদের ওপর দিনের পর দিন অত্যাচার চালিয়ে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করবে এই মর্মে অঙ্গীকার লিখিয়ে নিয়ে কোনাে কোনাে স্থানে পাকসেনাদের অবস্থানের অগ্রবর্তী দল হিসেবে মােতায়েন করা হয়। দেশের অভ্যন্তরে পাঠানাে গেরিলা সদস্যগণ বাঙালি ইপিআর বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ করে। বাঙালি ইপিআর-এর ছেলেরা এমনি সুযােগ খুঁজছিল। তারা সঙ্গে সঙ্গে গেরিলাদের সকল প্রকারের সাহায্যের আশ্বাস দেয়। মনােহরদী ছিল পাকিস্তানিদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। পাকসেনাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ জন এবং বাঙালি ইপিআর-এর সংখ্যা ছিল ৪০ জন । ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে কথা হল মুক্তিবাহিনী পাক অবস্থান মনােহরদী অবরােধ করলে তারা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যােগ দেবে। ২১ অক্টোবর হাবিলদার আকমল মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি নিয়ে মনােহরদী অবরােধ করে বসল। ইপিআর-এর ৪০ জন সদস্য সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে । এমনি চরম অবস্থায়ও পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করল না। বরং গুলি চালাল। উভয় পক্ষের তুমুল সংঘর্ষে ২৫ জন পাকসেনা নিহত এবং ১১ জন মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। হাবিলদার। আকমল বন্দী পাকসেনাদের তিন নম্বর সেক্টর হেড কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেন।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে তিন নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর শফিউল্লাহ তাঁর বাহিনীকে পুনর্গঠিত করে সেক্টর হেড কোয়ার্টার হেজামারাতে স্থানান্তরিত করলেন।
৪৫
সেনা সদর দফতর থেকে সেপ্টেম্বর মাসেই প্রথাগত যুদ্ধের জন্যে ‘এস ফোর্স গঠনের নির্দেশ এলেও বস্তুত অক্টোবরে এস ফোর্স গঠন করা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে এস ফোর্স এবং তিন নম্বর সেক্টরের দায়িত্বে এককভাবে মেজর শফিউল্লাহ থাকলেও কিছুদিন পরই এস ফোর্সকে তিন নম্বর সেক্টর থেকে পৃথক করা হয়। মেজর শফিউল্লাহ এস ফোর্সের এবং তিন নম্বর সেক্টরের কমান্ড মেজর নুরুজ্জামানের হাতে থাকলেও কার্যত মেজর শফিউল্লাহই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।
তিন নম্বর সেক্টর বাহিনীর সঙ্গে আখাউড়াতে পাকিস্তানিদের প্রচণ্ড লড়াই চলছিল । ৩০ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সংঘর্ষ চলল। এস ফোর্স কমান্ডার লে. কর্নেল শফিউল্লাহ তাঁর ২য় এবং একাদশ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং সেক্টর ট্রপস-এর দুটি কোম্পানি নিয়ােগ করেন। পরিকল্পনা হলাে, একাদশ বেঙ্গল রেজিমেন্ট মেজর নাসিমের নেতৃত্বে সিলেট থেকে অগ্রসরমান পাকসেনার গতিপথ রুদ্ধ করবে। কমান্ডার মেজর নাসিম ৩০ নভেম্বরেই মুকুন্দপুরসহ অন্যান্য এলাকা নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুললেন। সেক্টর ট্রপস-এর দুটি কোম্পানি মেজর মতিনের কম্যাণ্ডে আগরতলা বিমানবন্দরের উত্তর-পশ্চিমাংশে পরিখা খনন করে অবস্থান নিলাে। মেজর মতিনকে এখানে রাখার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সম্মুখভাগ আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত রাখা এবং দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে যেন আগরতলার দিক থেকে পাকিস্তানিরা আঘাত হানতে না পারে। দ্বিতীয় বেঙ্গলের কম্যাণ্ডে ছিল মেজর মইনুল হােসেন চৌধুরী। আক্রমণের সময় নির্ধারিত হলাে ৩০-৩১ নভেম্বর, রাত ১টা। মুক্তিবাহিনী এফ ইউ পি’তে পৌছে ‘এইচ’ আওয়ারেই আক্রমণ করল । ১ ডিসেম্বর সকাল ৬টার মধ্যে আজমপুর রেলওয়ে স্টেশনের উত্তরাংশ মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
ডিসেম্বরের ১-২ তারিখ রাতে পাকিস্তানীরা বিপর্যস্ত অবস্থা কাটিয়ে মুক্তিবাহিনীর ওপর পাল্টা আঘাত হানে। এই আক্রমণে মুক্তিবাহিনী পিছু সরে আসতে বাধ্য হয়। ২ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী পুনরায় পূর্ণোদ্যমে পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ চালালে পাকিস্তানিরা রেলওয়ে স্টেশন ছাড়তে বাধ্য হয়। পাকসেনারা রেলওয়ে স্টেশনের অন্যান্য দিক থেকে সরে গেলেও স্টেশনের সম্মুখভাগে সুদৃঢ় বাঙ্কারের মধ্য থেকে তখনও মুক্তিবাহিনীকে প্রতিরােধ করে যাচ্ছিল। ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত এমনি অবস্থা চলল। ওই তারিখে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘােষণার পর ৪ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর ৫৭ নং মাউন্টেন ডিভিশন আখাউড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আখাউড়ার দক্ষিণ ও পশ্চিমাংশ দিয়ে আখাউড়াকে অবরােধ করে। অবশেষে ৫ ডিসেম্বর ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কম্যাণ্ডের কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। কিছুসংখ্যক পাকসেনা পালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আশ্রয় নেয়। আখাউড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর যারা শহীদ হলেন তাঁরা হলেন: লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান, নায়েক সুবেদার আশরাফ আলী খান, সিপাই আমীর হােসেন, সিপাই রুহুল আমীন, সিপাই শাহাবউদ্দিন, এবং সিপাই মুস্তাফিজুর রহমান।
৪৬
আখাউড়া দখলের পরপরই ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখলের পরিকল্পনা নেয়া হলাে। আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয় দুদিক থেকে— এক. একটি কলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দক্ষিণ থেকে অগ্রসর হয়ে শহরে আসবে, দুই. অপর কলাম উত্তর দিক থেকে সিলেট সড়ক দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে পৌছবে। আর ভারতীয় সেনাবাহিনী আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল লাইন এবং উজানিসর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক ধরে অগ্রসর হবে। অন্যদিকে এস ফোর্স সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক দিয়ে অগ্রসর হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আক্রমণ করবে।
৬ ডিসেম্বর লে. কর্নেল শফিউল্লাহ সেক্টর কমান্ডার মেজর নুরুজ্জামানকে তার বাহিনী নিয়ে মনতলা ও তেলিয়াপাড়া দখলের নির্দেশ দিলেন। এদিকে এস ফোর্স’-এর একাদশ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সামনে অগ্রসর হতে বলা হলাে। ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বলা হলাে একাদশ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে অনুসরণ করতে। একাদশ ইস্ট বেঙ্গলের টাস্ক দেয়া হলাে চান্দুরার উত্তরাংশে একটি রােড ব্লক করতে যাতে সিলেট থেকে পলায়নরত পাকিস্তানিরা এদিকে না আসতে পারে। দ্বিতীয় কাজ হলাে চান্দুরা থেকে সরাইল পর্যন্ত এলাকা শত্রুমুক্ত করা। এই টাস্ককে বাস্তবায়ন করার জন্যে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। মেজর সুবিদ আলী ভূঁইয়া তাঁর নেতৃত্বে একটি কোম্পানিকে চান্দুরার উত্তরাংশের সড়ক ব্লক করতে এবং ব্যাটালিয়নের অবশিষ্ট সৈন্যকে চান্দুরা থেকে সরাইল পর্যন্ত এলাকা শত্রুমুক্ত করে। সামনে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলেন। মেজর ভূইয়া যথাস্থানে অবস্থান নিলেন। ব্যাটালিয়নের অবশিষ্ট সৈন্য হরশপুর দিয়ে চান্দুরার দিকে অগ্রসর হলাে। একাদশ বেঙ্গল পাইকপাড়া নামক স্থানে পৌছলে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার মেজর নাসিম তাঁর টুপসকে চান্দুরা হয়ে শাহবাজপুর, সরাইল ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হতে বললেন। লে. নজরুল তার কোম্পানি নিয়ে এ্যাডভান্স পার্টি হিসেবে হেড কোয়ার্টারের সামনে অগ্রসর হচ্ছিল। ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারের বাহিনী সামনে অগ্রসর হয়ে ইসলামপুর নামক স্থানে এসে অবস্থান নিলাে। হেড কোয়ার্টারে তখন ‘এস ফোর্স কমান্ডার মেজর নাসিমসহ মাত্র ৮ জন সৈনিক অবস্থান করছিলেন। এই সময় ইসলামপুরে একটা বড়াে রকমের দুর্ঘটনা ঘটে গেল। মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত ব্যাপক আক্রমণে পাকিস্তানিরা ক্রমশ পিছু হটছিল। যদিও চান্দুরা-মাধবপুরের মাঝামাঝি স্থানে মেজর এম এস এ ভূঁইয়া তার বাহিনী নিয়ে অবস্থান করছিলেন তথাপি পাকিস্তানিদের একটি গাড়ি তেলিয়াপাড়া থেকে মেজর ভূঁইয়াকে অতিক্রম করে চলে আসে। এই গাড়ির খবর মেজর ভূঁইয়া কিংবা মেজর শফিউল্লাহ কেউই জানতেন না। পাকিস্তানিদের গাড়িকে মেজর শফিউল্লাহ নিজেদের গাড়ি মনে করে ভুল করলেন। গাড়ি থামালে দেখা গেল, গাড়িতে পাকিস্তানি সেনা। লে. কর্নেল শফিউল্লাহ সবাইকে হাত উঠাতে বললে কেউ কেউ হাত উঠালাে। গাড়ির সম্মুখভাগে বসা পাঠান সুবেদার লাফ দিয়ে নেমে লে. কর্নেল শফিউল্লাহর ধরে ফেলে। এই সুযােগে পাকিস্তানিরা তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে গুলি চালানাে শুরু করে। লে. কর্নেল শফিউল্লাহর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ মল্লযুদ্ধ হয়। মুক্তিবাহিনীর পেছনের দল বেশ পেছনে। অপরদিকে সামনের দলও বেশ এগিয়ে
৪৭
গেছে। চরম পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর পেছনের দলটি চলে আসে। উভয়পক্ষে বেশ কিছুক্ষণ গােলাগুলি হয়। শেষ পর্যন্ত লে. কর্নেল শফিউল্লাহ, মেজর নাসিম প্রমুখ বেঁচে গেলেন। এই সংঘর্ষে দু’জন সৈনিক শহীদ হন। মেজর নাসিমসহ ১১জন মারাত্মকভাবে আহত হলেন। পাকিস্তানিদের ১১ জনকে জীবিত ধরা হয়। ব্যাটালিয়ন কমান্ডার মেজর নাসিম আহত হওয়ায় লে. কর্নেল শফিউল্লাহ মেজর মতিন এবং মেজর আজিজকে সঙ্গে নিয়ে-৭ ডিসেম্বর পাইকপাড়া পৌঁছান। এরপর মেজর মতিনকে এই ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব দেয়া হয় ।
এদিকে পাকিস্তানিরা শাহবাজপুর তিতাস নদীর উপরের সেতুটি ধ্বংস করে অপর পাড়ে পাকা বিবরঘাটি প্রস্তুত করে দৃঢ়তার সঙ্গে বসে রইলাে। মেজর সুবিদ আলী ভূঁইয়া তার কোম্পানি নিয়ে ৭/৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের পেছনে সরে যেতে বাধ্য করে শাহবাজপুর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেন। এর পরই পুরাে ব্যাটালিয়ন শাহবাজপুর পৌছে । ৮ ডিসেম্বর সকালে মেজর ভূঁইয়া এবং এস ফোর্সের অগ্রবর্তী দল সরাইল হয়ে আশুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়।
ইতােমধ্যে ভারতীয় বাহিনীর ৫৭তম মাউন্টেন ডিভিশন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌছে যায়। পাকসেনারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সরাইল ছেড়ে আশুগঞ্জ ও ভৈরববাজারে একত্রিত হয়। | ভারতীয় বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আশুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। ভারতীয় বাহিনীর ৩১১তম মাউন্টেন ডিভিশনের তিনটি ব্যাটালিয়নের ১০ নং বিহার রেজিমেন্ট দুর্গাপুরের দক্ষিণে ১৮নং রাজপুত রেজিমেন্ট তালশহরে এবং দুর্গাপুরের মাঝামাঝি জায়গায় (সম্ভবত ৪নং জাঠ রেজিমেন্ট) ডিফেন্স নিলাে।
মুক্তিবাহিনী আশুগঞ্জের সন্নিকটে এসে আর অগ্রসর হতে পারছিল না। পাকিস্তানিরা ভৈরব থেকে অবিরাম আর্টিলারির গােলাবর্ষণ করছিল। ৯ ডিসেম্বর আজবপুর এবং দূর্গাপুরের মুক্তিবাহিনী অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আশুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ৩১১ নং মাউন্টেন ডিভিশনের ব্যাটালিয়নগুলােও সামনে অগ্রসর হতে থাকে। পাকবাহিনীর ১৪নং ডিভিশনের সৈন্যরা ভৈরব-আশুগঞ্জের মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর অগ্রাভিযানকে প্রতিহত করার জন্যে সুদৃঢ় ঘাঁটি নির্মাণ করেছিল। ১০ ডিসেম্বর ১৮ নং রাজপুত রেজিমেন্ট পাকিস্তানি ব্যুহ ভেদ করে আশুগঞ্জে ঢুকে পড়ে। এই অবস্থায় এই রেজিমেন্টকে সাহায্যের জন্যে ১০নং বিহার রেজিমেন্ট ‘এস ফোর্স’ এবং তিন নম্বর টুপস দুর্গাপুরের দিক থেকে আশুগঞ্জের ওপর বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভারতীয় এক স্কোয়াড্রন ট্যাঙ্কও এই সংঘর্ষে অংশ নেয়। অবস্থার অবনতি দেখে পাকসেনারা ভৈরব পুলের আশুগঞ্জ সংলগ্ন অংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। রক্তক্ষয়ী এই ভয়াবহ সংঘর্ষে উভয় পক্ষেরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। মিত্র ও মুক্তিবাহিনী তীব্র আক্রমণ চালিয়েও ভৈরব আশুগঞ্জ দখল করতে না পেরে পেছনে সরে আসে। ডিসেম্বরের ১০/১১ তারিখে পাকিস্তানিরা আশুগঞ্জ ছেড়ে ভৈরবে চলে যায়।
৪৮
১১ ডিসেম্বর ভারতীয় ১৯তম পাঞ্জাবের দু’টি কোম্পানিকে হেলিকপ্টারযােগে নদীর অপর পারে নামিয়ে দেয়া হলাে। বাংলাদেশের আকাশ তখন মুক্ত। ইতিমধ্যেই বাংলার মুক্তিবাহিনীর পাইলটগণ পাকিস্তানিদের সব বিমানই ধ্বংস করে দিয়েছে। ফলে, বিমান তখন খুশিমতাে পাক অবস্থান খুঁজে খুঁজে আক্রমণ চালাতে থাকে। পাকসেনারা অবস্থা বেগতিক দেখে ভৈরব সেতুর অংশবিশেষ ধ্বংস করে দিলাে। আশুগঞ্জের মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত সিদ্ধান্ত অনুসারে মিত্রবাহিনীর ৭৩তম মাউন্টেন ব্রিগেড এবং মুক্তিবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন ভৈরব অবরােধ করে। অপরদিকে ভারতীয় ৩১১তম। মাউন্টেন বিগ্রেড এবং মুক্তিবাহিনীর অবশিষ্ট অংশ ভৈরব পাশ কাটিয়ে নরসিংদীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ৪নং জাঠ রেজিমেন্ট হেলিকপ্টারযােগে নরসিংদী পৌঁছে যায়। ৩১১তম মাউন্টেন ডিভিশনের ১০ বিহার এবং ১৮ রাজপুত ব্যাটালিয়ন পদব্রজে নরসিংদীর দিকে অগ্রসর হয়। মুক্তিবাহিনীর ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং তিন নম্বর সেক্টর ট্রপসও পদব্রজে নরসিংদীর দিকে অগ্রসর হয়। একাদশ বেঙ্গল রইলাে ভৈরব অবরােধ করে।
১২ ডিসেম্বরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল ঢাকার রায়পুরাতে পৌঁছে যায়। ১৩ ডিসেম্বর তারা নরসিংদী পৌছে। ইতােমধ্যে ৪ জাঠ রেজিমেন্ট নরসিংদী শত্রুমুক্ত করে।
নরসিংদী থেকে ৪ জাঠ রেজিমেন্ট নরসিংদী-ডেমরা সড়ক দিয়ে বড়পা পর্যন্ত এসে পৌছায়। লে. কর্নেল শফিউল্লাহ দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে ভুলতা, মুড়াপাড়া, রূপগঞ্জ হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হন। ১৪ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী বালু নদীর পাড়ে এসে পৌছায়। মিত্রবাহিনীর ১০ বিহার রেজিমেন্ট এই সময় রূপসী পৌছে যায়। ১৬ ডিসেম্বর বেলা ১২টা পর্যন্ত ঢাকা-ডেমরা সড়কে পাকিস্তানিদের সঙ্গে সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। একই তারিখে বেলা দুটোর দিকে ডেমরাতে পাকিস্তানিরা যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ডেমরায় পাকিস্তানি কমান্ডার খিলজী মাতুয়াইল নামক স্থানে সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করান। বেলা সাড়ে তিনটের দিকে মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং এবং লে. কর্নেল শফিউল্লাহ ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছেন।
তথ্য নির্দেশ
১. মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ, বীর উত্তম, পিএসসি, (অব:)।
২. সাক্ষাঙ্কার : ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ, বীর উত্তম, পিএসসি, (অব:)।
৩. মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ, বীর উত্তম, পিএসসি, (অব:)।
৪. শামসুল হুদা চৌধুরী, রণাঙ্গনে মেজর শফিউল্লাহ।
৪৯
চার নম্বর সেক্টর
এই সেক্টর সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল খােয়াই-শায়েস্তাগঞ্জ রেললাইন ছাড়া পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট-ডাউকি সড়ক পর্যন্ত প্রায় ১০০ মাইল সীমান্ত এলাকা নিয়ে গঠিত হয়। উত্তরে হবিগঞ্জ মহকুমা থেকে দক্ষিণে কানাইঘাট পুলিশ স্টেশন পর্যন্ত এই সেক্টরের বিস্তৃতি ছিল। সেক্টরটি পাহাড়িয়া এলাকায় ঢাকা। পাথরিয়া পাহাড়, সাতগাঁও পাহাড় ইত্যাদি পাহাড়ের অবস্থানও ছিল এই এলাকায়। প্রায় একশ চা বাগান- এই এলাকার অপর বৈশিষ্ট্য। সুতরাং সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ দিকটা যেমন গেরিলা যুদ্ধের জন্যে অত্যন্ত উপযুক্ত, অপরদিকে তেমনি দুর্গম পথের জন্যে হালকা অস্ত্র এবং সরঞ্জাম নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের অগ্রসর হওয়াও নিরাপদ ছিল।
সেক্টর গঠনের শুরু থেকেই কমান্ডার হিসেবে মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে অফিসার বলতে ছিল সেক্টর কমান্ডার মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত এবং ক্যাপ্টেন এ রব। জুন মাসের শেষের দিকে ক্যাপ্টেন হক, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কাদের এবং ক্যাপ্টেন এনাম এই সেক্টরে যােগদান করেন। কুমিল্লা এবং সিলেট জেলার অধিকাংশ ইপিআর সদস্যই এই সেক্টরে যুদ্ধ করেন।১
সেক্টর কমান্ডার মেজর দত্ত তাঁর সেক্টর এলাকাকে কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত
১. জালালপুর সাব-সেক্টর : কমান্ড করেছেন গণবাহিনীর মাসুদুর রব শাদী । বয়সে তরুণ মাসুদুর রব আটগ্রাম, জাকীগঞ্জ, লুবাছড়া ও কানাইঘাট পর্যন্ত অপারেশন চালিয়েছেন। নভেম্বর মাসে সাব-সেক্টর কমান্ডার মাসুদুর রব সিলেট জেলার অভ্যন্তরে দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
২. বড়পুঞ্জী সাব-সেক্টর : কমান্ডার ছিল ক্যাপ্টেন এ রব। এই সাব-সেক্টর বাহিনী লাতু, বিয়ানীবাজার, শারােপার, বড়গ্রাম, জাকীগঞ্জ, আটগ্রাম, চিকনাগুল ইত্যাদি এলাকাতে ব্যাপকভাবে অপারেশন চালিয়ে পাকিস্তানীদের চরম শিক্ষা দিয়েছে।
তরুণ অফিসার লে. নিরঞ্জন ভট্টাচার্যও এই সাব-সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেছেন।
৩. আমলাসিদ সাব-সেক্টর : কমান্ড করেছেন লেঃ জহির । লেঃ জহির বিশেষ করে কানাইঘাট যুদ্ধে যে বীরত্ব দেখিয়েছেন সেকথা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এই সাব-সেক্টর ট্রুপস মেজর জিয়াউর রহমানের
(বর্তমানে মেজর জেনারেল) গঠিত ‘জেড ফোর্সে’-এর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে।
৪. কুকিতল সাব-সেক্টর : কমান্ডার ছিল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কাদের। এই সাব
সেক্টর বাহিনী দিলকুশা চা-বাগান, কুলাউড়া ও জুরী চা-বাগান এলাকায় পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে অপারেশন চালিয়েছে। পরবর্তীতে পাকিস্তান থেকে ক্যাপ্টেন শরিফুল হক (ডালিম) পালিয়ে এলে তিনি এই সাব-সেক্টরের দায়িত্ব নেন। ক্যাপ্টেন শরিফুল হক বিভিন্ন রণাঙ্গণে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
৫. কৈলাশ শহর সাব-সেক্টর : কমান্ডার ছিল লে. ওয়াকিউজ-জামান। তিনি যুদ্ধের
শেষ দিন পর্যন্ত ন’মৌজার দীর্ঘ এলাকা নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। ৩ ডিসেম্বর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে লে, জামান তাঁর ট্রপস নিয়ে
মিত্রবাহিনীর ৫৯তম ব্রিগেডের সঙ্গে প্রবেশ করেন।
৬. কমলাপুর সাব-সেক্টর : এই সাব-সেক্টরটি কমান্ড করেন ক্যাপ্টেন এনাম।
ক্যাপ্টেন এনাম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন। ধলাই চা-বাগান, রাজঘাট চা-বাগান এবং অন্যান্য পার্শ্ববর্তী চাবাগানগুলােতে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের ব্যাপকভাবে ক্ষতি করে। ৩ ডিসেম্বরের পর এই সাব-সেক্টর ট্রুপস মিত্রবাহিনীর ৮১তম ব্রিগেডের সঙ্গে মৌলভীবাজারে প্রবেশ করে। কয়েক মাসের যুদ্ধে ক্যাপ্টেন এনামের গতিশীল নেতৃত্বে সেক্টর ট্রপস অত্যন্ত সাফল্যের পরিচয় দেয়।
৪নং সেক্টরে গেরিলার সংখ্যা ছিল প্রায় ৯,০০০ এবং নিয়মিত বাহিনী ছিল প্রায় ৪,০০০। সেক্টর হেড কোয়ার্টার ছিল প্রথমে করিমগঞ্জ এবং পরে মাসিমপুর।
চার নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকসেনাদের সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল। ২৪ মে সুতারকান্দিতে পাকসেনাদের সঙ্গে এক বড়াে রকমের সংঘর্ষ হয়। পাকিস্তান বাহিনীর সি-১৩০ বিমানযােগে সৈন্যবৃদ্ধি ও সেই সঙ্গে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা মুক্তিবাহিনীর ওপর ক্রমাগত আক্রমণের ফলে মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। অস্ত্রশস্ত্র এবং গােলাবারুদের অভাব, সৈন্যসংখ্যার স্বল্পতা, অফিসারের অভাব ইত্যাদি কারণেই সেদিন মুক্তিযােদ্ধাদের পিছু হটতে হয়েছে। মুক্তিবাহিনী গােপালগঞ্জ ডিফেন্স ছেড়ে বড়গ্রাম বি ও পি এলাকাতে নতুন ডিফেন্স গড়ে তােলে। মুক্তিবাহিনীর লক্ষ ছিল পাকসেনাদের শেওলাঘাট থেকে কুশিয়ারা নদী অতিক্রম করার সময় কুশিয়ারা নদী এলাকাতেই তাদেরকে বাধা দেওয়া। এই সময় মুক্তিবাহিনীর আধিপত্য না থাকলেও বিয়ানীবাজার ও জাকীগঞ্জ তখনাে মুক্ত ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি শেওলাঘাটে ডিফেন্স নেয় মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকসেনাদের সৈন্যসংখ্যা দ্বিগুণ হয়। মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি বড়গ্রাম থেকে ক্যাপ্টেন এ রবের নেতৃত্বে পাকসেনাদের ওপর মাঝে মধ্যে আক্রমণ করছিল। মে মাসের ২০ তারিখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কুশিয়ারা নদী অতিক্রম করতে সমর্থ হয়।
২৩ মে রাত ১১টা। ক্যাপ্টেন রব তার প্রতিরক্ষা পরিখায় ছিল, এমন সময় দু’জন লােক দৌড়ে এসে তাকে জানালাে— একদল পাকসেনা তাদেরকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। ক্যাপ্টেন রব ঘটনার গুরুত্ব উপলব্ধি করে শাহবাজপুর (লাতু) রেলওয়ে স্টেশনে পাঠানাে একটি প্লাটুনকে যতাে তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন। অন্যান্য সূত্র থেকেও ঘটনার সত্যতা নিরূপণ করা হলাে। দেখা গেল, সত্যিই পাকিস্তানিদের দুটি কোম্পানির অধিক সৈন্য মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
২৪ মে সকাল ৬টা। পাকসেনাদের দুটি কোম্পানি ক্রমশ আরাে এগিয়ে চলল। পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে পূর্বেই জেনেছিল। ক্যাপ্টেন রব তাঁর বাহিনী নিয়ে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলেন। পাকসেনারা রাইফেলের আওতায় আসামাত্র তিনি গুলি ছোড়ার নির্দেশ দিলেন। শুরু হলাে বৃষ্টির মতাে গুলিবর্ষণ । পাকসেনারা ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে পড়ল । কিন্তু সে ছিল কিছুক্ষণ মাত্র। তারপরই পাকিস্তানিরা আর্টিলারি এবং অন্যান্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে পাল্টা আঘাত হানল। পাকসেনাদের দুটি কোম্পানির একটি সুতারকান্দি অপরটি লামাশাল হয়ে বড়গ্রাম আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী সংখ্যায় মাত্র এক কোম্পানি থাকলেও বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে এমনভাবে প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করে অবস্থান করছিল যে, পাকসেনারা চরমভাবে মার খেলাে। মুক্তিবাহিনীর একটি মাত্র এল এম জি-র আক্রমণকে ভেদ করে পাকসেনারা কিছুতেই সামনে অগ্রসর হতে পারছিল না। ওই তারিখে সকাল ৭টা ৩০ মিনিটের সময় পাকসেনারা সম্মুখ এবং ডানদিক থেকে পুনরায় ব্যাপকভাবে হামলা চালায়। বেলা ১০টা পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী সম্মুখযুদ্ধে নিজ ঘাঁটিতে অটুট থাকে। কিন্তু বেলা সাড়ে এগারােটার দিকে দেখা গেল মুক্তিবাহিনীর গােলাবারুদ প্রায় শেষ। অথচ কোনাে দিক থেকে কোনাে সাহায্যও এল না। অবশেষে বাধ্য হয়েই ক্যাপ্টেন রব তার বাহিনী নিয়ে পেছনে সরে গেলেন। বেলা ১২ টার মধ্যে পাকসেনারা সমগ্র এলাকাতে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে। এই যুদ্ধে ৩৯ জন পাকসেনা নিহত এবং ২ জন মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দী হয়, অপরদিকে দু’জন মুক্তিসেনা পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে ও বেশকিছু আহত হয়।
ক্যাপ্টেন রব তার বাহিনী নিয়ে পেছনে সরে এসে ১০ জুন বড়পুঞ্জীতে প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করেন। এই সময় থেকে সেক্টরের প্রতিটি সাব-সেক্টর কমান্ডারগণ ব্যাপকভাবে নিজ নিজ এলাকাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ, এ্যামবুশ, সড়ক-সেতু ধ্বংস, চা-বাগান এলাকায় কর্মকাণ্ড চালাতে থাকেন। অপরদিকে যুবক ছেলেদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়াতে লাগলেন। এই সময় এই সেক্টরের বেশ কয়েকটি লক্ষ ছিল। এক, পাকসেনাদের নির্ভাবনায় থাকতে না দিয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থিতির খবর জানিয়ে দেয়া। দুই, চা-বাগানগুলােকে অকেজো করে দিয়ে পাকিস্তানি অর্থনীতিতে দারুণভাবে চাপ সৃষ্টি করা। তিন, সড়ক-সেতু ধ্বংস করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহজ চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা। মুক্তিবাহিনী সমগ্র সেক্টর এলাকাতে
প্রাথমিক লক্ষ্য তিনটি সামনে রেখে তাদের জয়যাত্রা অব্যাহত রেখে তারা শেওলা, সদাখাল, বারইগ্রাম ও কাংলী ফেরীর উপর আক্রমণ চালিয়ে ফেরী ধ্বংস করে দেয়। রাজকী, ফুলতলা, শেওলা, পৃথুিপাশা, সমনভাগ, সেনারপা, হাসনাবাদ, চূড়ামণি, সাগরনীল ইত্যাদি চা-বাগান বিনষ্ট করে দেয়া হয়। অপরদিকে মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের ঘাঁটি লাতু, বড়লেখা, ফুলতলা ও আটগ্রামের ওপর হামলা অব্যাহত রাখে ।
১৮ জুন সেক্টর হেড কোয়ার্টার থেকে বড়পুঞ্জী সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন রবকে একটি কোম্পানি নিয়ে ভারতীয় বি ও পি কুকিতালে রিপাের্ট করতে বলা হলাে। উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি লাঠিটিলা আক্রমণ করা। ক্যাপ্টেন রব একটি কোম্পানি নিয়ে ১৮ জুন রাতেই কুকিতাল বি ও পি তে পৌঁছেন। পৌছার পরপরই ৭নং রাজপুত রাইফেলস রেজিমেন্টের কম্যাণ্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল দেব সেন ক্যাপ্টেন রবকে লাঠিটিলায় পাকসেনাদের একটি প্লাটুনের খবর ও আক্রমণের বিভিন্ন দিক বুঝিয়ে বললেন। লেঃ কর্নেল দেব সেন তার পক্ষ থেকে সবরকম সাহায্যের আশ্বাস দিলেন, ক্যাপ্টেন রব চাচ্ছিলেন নিজে ‘রেকি করে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে নিজের মন মতাে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে। কিন্তু তিনি সে সুযােগ পেলেন না। মিত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন কুমার ও লে. কর্নেল দেবের ত্বরিত পরিকল্পনায় সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। কিন্তু কোনাে উপায় না দেখে তাকে চুপ থাকতে হলাে।
ক্যাপ্টেন রব রাত ৪টায় (১৯ জুন) তাঁর কোম্পানি নিয়ে লাঠিটিলার দিকে অগ্রসর হলেন। ভাের ৫টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে তিনি তার কোম্পানি নিয়ে লাঠিটিলা পাকঘাটি চারদিক থেকে ঘিরে টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেন। পাকসেনাদের অবস্থান ছিল একটি ছােটো টিলার উপর। টিলাটি এমনভাবে সেলফ করে ক্যামােফ্লাইজ করে রাখা হয়েছিল যে, ১০০ গজ দূরে থেকেও কোনাে কিছু বােঝার উপায় ছিল না। পরিকল্পনা হলাে ৪ জন সিপাই গ্রেনেড নিয়ে যতদূর সম্ভব পাক বাঙ্কারের নিকটে গিয়ে গ্রেনেড ছুঁড়বে এবং তারপরেই পাকসেনাদের পাল্টা জবাবে তাদের শক্তি ও অবস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা জন্মালে মিত্র বাহিনীর আর্টিলারির গােলাবর্ষণ শুরু হবে। এর কিছুক্ষণ পরই ক্যাপ্টেন রব তাঁর বাহিনী নিয়ে লাঠিটিলা বি ও পি চার্জ করবেন। ৪ জন সিপাই পাঠানাে হল। কিছুক্ষণ পর তারা ফিরে এসে পাকসেনাদের অবস্থিতির সঠিক সংবাদ দিতে পারল না। কিছুক্ষণ পর পুনরায় একজন হাবিলদার এবং দু’জন সিপাইকে পাঠানাে হল। ত্রয়ী মুক্তিবাহিনীর একজন সিপাই পাক অবস্থানের খুব নিকটে গিয়ে বাঙ্কার অনুমান করে একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনারা পাল্টা জবাব দিতে থাকে। পাকসেনাদের গুলিতে ৩ জনই গুরুতর আহত হয়ে কোনােমতে হেড কোয়ার্টারে ফিরে আসে। এরপরই ভারতীয় বাহিনী পাক বিওপির ওপর আর্টিলারির আঘাত হানতে থাকে। বিশ মিনিটের মধ্যে প্রায় ৫০০ গােলা পাক বাঙ্কারে নিক্ষেপ করা হয়। আর্টিলারির ফায়ার বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন রব তার বাহিনী নিয়ে বি ও পি চার্জ করেন। মুক্তিবাহিনীর ঘন ঘন ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে পাকসেনারা।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে এবং পরে এদিক-ওদিক পালাবার চেষ্টা করে। পাকসেনারা পালাতে গিয়ে অধিকাংশই বুলেটবিদ্ধ হয়। এই সময় একজন অর্ধনগ্ন মহিলাকেও পালাতে দেখা যায়। রাইফেলের বুলেট তাকেও রেহাই দিল না। বি ও পি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। বি ও পি থেকে প্রচুর গােলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের একজন হাবিলদার এবং একজন সিপাই মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে কেউ নিহত না হলেও ৪ জন আহত হয়। লাঠিটিলা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে । লাঠিটিলার সংঘর্ষে নায়েক শফিউদ্দিনের বীরত্ব ও সাহসিকতা যে কোনাে মানুষ। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। | জুন, জুলাই ও আগস্ট মাস পর্যন্ত এই সেক্টর এলাকাতে ব্যাপকভাবে গেরিলা তৎপরতা চালানাে হয়। সাব-সেক্টরগুলােতে মুক্তিবাহিনীর শক্তিবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তারা আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আগস্ট মাস পর্যন্ত কেবলমাত্র বড়পুঞ্জী সাব-সেক্টরেই নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা দাঁড়ায় এক হাজারে। এই সেক্টরের আওতাধীন গেরিলা বাহিনীকে দেশের অভ্যন্তরে বেশ প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তাদের তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় অধিবাসীরা গেরিলাদের সাহায্য না করে বরং গেরিলাদের ধরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে পাকসেনাদের সঙ্গে পূর্ণ সহযােগিতা করতে থাকে। পাকসেনাদের সহযােগী এইসব রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস এবং দালালদের নানা কীর্তিকলাপ জানা যায়। কোনাে কোনাে এলাকাতে পাকসহযােগী দালালরা গাছের উঁচু ডালে টিন বেঁধে রাখত। গেরিলারা সেই গ্রামে ঢুকলেই শুরু হত টিন বাজানাে। টিনের এই শব্দে সবাই সতর্ক হয়ে যেত এবং পাকসেনারা বুঝতে মুক্তিবাহিনী গ্রামে প্রবেশ করেছে। কোনাে কোনাে গ্রামে মুক্তিবাহিনী প্রবেশ করলে। মসজিদে আজাদ দেওয়া শুরু হতাে। পাকসেনারা বুঝত গ্রামে মুক্তিবাহিনী এসে গেছে। এমনিভাবে পাকসেনারা তৎপরতা চালিয়ে বহু গেরিলাকে ধরে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বলা বাহুল্য, সিলেট এলাকাতেই পাকিস্তানি দালাল ও তার সহযােগীদের এ রকম তৎপরতা ছিল সর্বাপেক্ষা বেশি।
এদিকে এই সেক্টরের কুকিতাল সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শরিফুল হক (ডালিম) তার এলাকাতে পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখলেন। ক্যাপ্টেন শরিফুল হক জুলাই মাসের মাঝামাঝি দিলকুশা ও জুরী এলাকাতে পাকিস্তানি ঘাটির ওপর ব্যাপক হামলা চালিয়ে পাকসেনাদের প্রচুর ক্ষতিসাধন করেন।
জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে দিলকুশায় পাকসেনাদের শক্ত ঘাঁটি তৈরির খবর জানা গেল । সেক্টর হেড কোয়ার্টার থেকে ক্যাপ্টেন হককে নির্দেশ দেওয়া হলাে দিলকুশা আক্রমণের জন্যে। ক্যাপ্টেন শরিফুল হক ছিল আর্টিলারির অফিসার। তিনি তার বাহিনীকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে নিজে দিলকুশা থেকে প্রায় এক মাইল দূরে একটি লম্বা গাছে চড়ে (যেখান থেকে প্রায় সমগ্র দিলকুশা দেখা যায়) ভারতীয় আর্টিলারির কাছে ‘টার্গেট নির্দেশ পাঠানাে শুরু করলেন। মিত্রবাহিনীর আর্টিলারির গােলা সঠিক স্থানে পড়ায় পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল। মুক্তিবাহিনীর জয়ের পূর্ব মুহূর্তে একটি
৫৪
তিন ইঞ্চি মর্টারের গােলা ক্যাপ্টেন হক যে গাছে ছিল সে গাছে এসে পড়ে। ক্যাপ্টেন হক গাছ থেকে পড়ে গুরুতররূপে আহত হলেন। ওদিকে বি ও পি-র নির্দেশ না পেয়ে মিত্র বাহিনীর অনেক গােলা মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন অবস্থানে এসে পড়তে থাকে । পাকসেনারা এ সুযােগের সদ্ব্যবহার করল। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করল দিলকুশা ঘাঁটিতে টিকে থাকবার । কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হলাে । ক্যাপ্টেন শরিফুল হককে আহত অবস্থায় হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হলাে। আগস্ট মাসেই লুবাছড়া, কারাবালা, মােকামটিলা, আমলসিদ ও নমৌজা মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত এইসব এলাকা পাকিস্তানিরা বারবার চেষ্টা করেও কখনাে দখল করতে পারেনি।
চার নম্বর সেক্টরেও মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা অব্যাহত ছিল। এই সেক্টরের অধীন বড়পুঞ্জী সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন রব মুক্তিবাহিনীর পাঁচটি কোম্পানি নিয়ে ১০ আগস্ট শাহবাজপুর (লাতু) রেলওয়ে স্টেশন আক্রমণ করেন। শাহবাজপুর স্টেশনটি পাহাড়ী এলাকায় অবস্থিত ।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি, এক প্লাটুন স্কাউট এবং বেশ কিছুসংখ্যক সশস্ত্র রাজাকার শাহবাজপুর প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে অবস্থান করছিল । ক্যাপ্টেন রব তার সামগ্রিক পরিকল্পনা সেক্টর কমান্ডার মেজর দত্তের কাছ থেকে অনুমােদন করিয়ে নিলেন। তার পরিকল্পনা ছিল একটি কোম্পানি শাহবাজপুর থেকে পাকিস্তানিদের পিছু হটাবার ব্যবস্থা এবং বিয়ানীবাজার থেকে তাদের সাহায্যের সকল পথ রুদ্ধ করবে। এই কোম্পানিরই একটি প্লাটুন শত্রুঘাঁটির ওপর আক্রমণ করবে আর ঠিক তার ১০ মিনিট পরই ব্যাটারি এম জি দিয়ে শত্রুসেনার ওপর আঘাত হানবে এবং ৫ মিনিট গােলাবর্ষণের পরই তিনটি কোম্পানি একযােগে সম্মুখভাগ আক্রমণ করবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী শত্রুদের অন্যান্য স্থানের সাহায্য বন্ধের জন্য একটি কোম্পানিকে শাহবাজপুর-বড়লেখা সড়কে অবস্থান নিতে বলা হলাে।
১০ আগস্ট ভাের পাঁচটার মধ্যে ক্যাপ্টেন রবের নেতৃত্বে পাঁচটি কোম্পানি যথাযথ স্থানে অবস্থান নিলাে। অবস্থানে পৌছবার পরপরই ক্যাপ্টেন রব গােলাবর্ষণের নির্দেশ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলাে আক্রমণ। আক্রমণের ১৫ মিনিট পরই পাকসেনারা পিছু হটবার চেষ্টা করে। সকাল ৭টার মধ্যে শাহবাজপুর রেলওয়ে স্টেশনের বড়াে রকমের একটি অংশ মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। উভয়পক্ষের সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। মুক্তিবাহিনী তাদের করায়ত্ত এলাকায় পাকিস্তানি পতাকা ধ্বংস করে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেয়। এমনি একটি পর্যায়ে হঠাৎ মুক্তিবাহিনীর ওপর পাকিস্তানি আর্টিলারি ফায়ার আসতে থাকে। অথচ পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে পাল্টা পাকিস্তানি কোনাে আক্রমণ আসা সম্ভব ছিল না। জানা যায়, যে কোম্পানি বড়লেখা এলাকাতে অবস্থান নিয়েছিল তারা পাকিস্তানীদের গতিপথ রুদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়। পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে শাহজাদপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকিস্তানি গােলাবৃষ্টির মধ্যে মুক্তিবাহিনী বিপর্যস্ত ও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এমন প্রতিকূল অবস্থাতেও রণাঙ্গন কমান্ডার
৫৫
ধীর মস্তিষ্কে সেক্টর কমান্ডারের সঙ্গে যােগাযােগ করে পরামর্শ চাইলেন। বর্তমান লেঃ কর্নেল রবের ওপর বর্তমান ব্রিগেডিয়ার চিত্তরঞ্জন দত্তের ছিল অগাধ বিশ্বাস আর তাই তাঁকে অবস্থার প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। ক্যাপ্টেন রব তার বাহিনী নিয়ে টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হলাে। বাধ্য হয়েই তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে পেছনে সরে এলেন। এই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের কাছ থেকে প্রচুর গােলাবারুদ উদ্ধার করলেও ৬ জন বীর মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন এবং আহত হন ৫ জন। এই সংঘর্ষে শহীদদের মধ্যে বিশেষ করে খেলাধুলার জগতে অত্যন্ত সুপরিচিত নাম দেশপ্রেমিক সাহসী ইপিআর বাহিনীর হাবিলদার কুতুব, নায়েক মান্নান এবং মুজাহিদ হাবিলদার মােহাম্মদ ফয়েজের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
এই সেক্টরের কৈলাশ শহর সাব-সেক্টর কমান্ডার লেঃ ওয়াকি-উজ-জামান সেপ্টেম্বর মাসেই ন’মৌজা এলাকা নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। এই সেক্টরের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা অন্যান্য স্থান ছিল লুবাছড়া, কারাবালা, মােকামটিলা ও আমলাসিদ।
১৪ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানিদের প্রায় দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য একই সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান বিয়ানীবাজার, বড়লেখা ও জাকীগঞ্জ থানাতে ব্যাপকভাবে আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের সম্ভাব্য আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত থাকায় অপেক্ষাকৃত কম ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তারা চরম মার খেয়ে পেছনে সরে যেতে বাধ্য হলাে। সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর ৭ জন শহীদ এবং বেশ কয়েকজন আহত হন।
অক্টোবর মাসের গােড়াতেই এই সেক্টরে ‘জেড’ ফোর্সের ১ম ও ৮ম বেঙ্গল
রেজিমেন্ট যােগ দেয়। জেড ফোর্সে দুটি রেজিমেন্ট এই সেক্টরে আসায় সেক্টরের শক্তি কয়েক গুণ বেড়ে যায় । ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ৮ম বেঙ্গলের ব্যাপক তৎপরতা পাকিস্তানিদেরকে ভীষণভাবে পর্যুদস্ত করে ছাড়ে। দক্ষিণগুলে ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের সঙ্গে ৮ম বেঙ্গলের কৃতিত্বপূর্ণ সাফল্যের কথা ওই এলাকার জনগণ আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। এই সংঘর্ষে ৮ম বেঙ্গল ১০৫ মিলিমিটার আর্টিলারি ব্যবহার করে। চার নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত দাবি করেছেন, “দক্ষিণগুল জয়ের কারণগুলাের মধ্যে অন্যতম ১০৫ আর্টিলারির সাফল্যজনক ব্যবহার। ১০৫ মিলিমিটার আর্টিলারি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ সিলেট সেক্টরে আমারই তত্ত্বাবধানে ক্যাপ্টেন রশিদ এবং লেঃ সাজ্জাদের পরিচালনায় পরিচালিত হয়েছিল।
চার নম্বর সেক্টরের অন্তর্গত আটগ্রামে ১০ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকসেনাদের একটি বড়াে রকমের সংঘর্ষ হয়। বেশ কিছুদিন থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম এবং জাকীগঞ্জ থেকে এসে রাতের অন্ধকারে ভারত সীমান্ত পেরিয়ে ভারতীয় রেললাইনের উপর গােপনে মাইন পুঁতে রাখছিল । এর ফলে বেশকিছু রেলগাড়ি ও রেলযাত্রী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া ভৌগােলিক অবস্থানের দিক থেকেও আটগ্রাম ও জাকীগঞ্জের গুরুত্ব ছিল অত্যন্ত বেশি। সেক্টর কমান্ডার চিত্তরঞ্জন দত্তের। পরিকল্পনা অনুসারে ক্যাপ্টেন এনামকে দু’ কোম্পানি সৈন্য দিয়ে আটগ্রাম পাঠানাে হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে ক্যাপ্টেন এনামকে কামালপুর যুদ্ধে পাঠানাে হলে লেঃ জহিরকে ওই দু’ কোম্পানির দায়িত্ব দেয়া হয়। লেঃ জহিরকে বলা হলাে সুরমা নদী অতিক্রম করে শত্রুর অগ্রবর্তী ঘাটির পাশে এবং মূল ঘাটি সামনে রেখে রাস্তার দু’পাশে অবস্থান নিতে । লে. জহির চারগ্রাম ও দর্পনগর গ্রামের নিকটে নদী অতিক্রম করে যথারীতি অবস্থান নিলেন। এক কোম্পানি সৈন্য লেঃ গিয়াসকে দেয়া হলাে আটগ্রামজাকীগঞ্জ সড়ক মুক্ত করার জন্যে। ক্যাপ্টেন রব আরও এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে গােটা গ্রামে অবস্থান নিলেন। ৯ নভেম্বর রাতেই মুক্তিবাহিনী সুরমা নদী অতিক্রম করে লক্ষের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে পাকসেনারা গােলাবর্ষণ শুরু করে। আটগ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়মিত সৈন্যর একটি কোম্পানি, একটি রাজাকার কোম্পানি এবং এক কোম্পানি খাইবার স্কাউটস ছিল । গােলাগুলির মধ্যেও মুক্তিবাহিনী তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখে। ক্যাপ্টেন রব তাঁর বাহিনী নিয়ে ১০ নভেম্বর ভাের পাঁচটায় আটগ্রাম পৌছলেন। এই গ্রামে রাজাকারদের একটি ক্যাম্প ছিল। ১২ জনের মতাে রাজাকার দিব্যি আরামে তখনাে ঘুমাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন রব একটি প্লাটুন পাঠিয়ে দিলে রাজাকাররা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। একজন রাজাকার কোনােমতে পালিয়ে আটগ্রামে পাকঘাঁটিতে খবর দেয়। এই সংবাদে ক্যাপ্টেন রব দ্রুত রাস্তার দু’পাশে বাঙ্কার করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুললেন । পাকসেনাদের একটি প্লাটুন ততােক্ষণে গােলাগুলি করতে করতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তারা জানত না মুক্তিবাহিনীর সংখ্যা কতাে। তারা মুক্তিবাহিনীকে অবজ্ঞাভরে গালাগালি দিতে দিতে অগ্রসর হচ্ছিল। ক্যাপ্টেন রব চুপচাপ অপেক্ষা
করছিলেন। পাকসৈন্যরা রাইফেল রেঞ্জের মধ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে গুলিবর্ষণ করে। পাকসেনারা ছিল খােলা মাঠে। ফলে, তারা একে একে ধরাশায়ী হতে লাগল। ক্যাপ্টেন। (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) এ রব তার সাক্ষাৎকারে চমৎকারভাবে এই ঘটনার বর্ণনা করেছেন :
“They were shouting and saying MUJIB KA BACHAY HATIAR CHORADAO, AGOR NA TO KUE ZINDA WAPES NAHI ZAOGAYE’, They were advancing from both sides of the road. They were about a platoon strength. When they come within hundred yards, I ordered to four Light Machine Guns, two from each side of the road. They got a shock of their Lives. Within two minutes 18 of them fall on the ground and the rest of them took shelter of a Nallah and fled away.২
সার্বিক সংঘর্ষে ৪০ জনেরও বেশি পাকসেনা নিহত, ১১ জন রাজাকার বন্দী এবং বেশকিছু আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর ২ জন শহীদ এবং ৫ জন আহত হন। অপরদিকে লেঃ জহির এবং লেঃ গিয়াস তাঁদের বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানিদের ওপর যথারীতি আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। এই সংঘর্ষে শেষ পর্যন্ত ভারতের ৯৯তম মাউন্টেন। ব্যাটালিয়ন এবং ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও জড়িয়ে পড়েছিল। দীর্ঘদিনের ক্রমাগত সংঘর্ষের পর শেষ পর্যন্ত নভেম্বরের ২০/২১ তারিখ রাতে জাকীগঞ্জ ও আটগ্রাম হানাদারমুক্ত হয় ।
২১ নভেম্বর রাতেই ক্যাপ্টেন রব একটি কোম্পানি নিয়ে সালামটিলা এবং লে. জহির দু’টি কোম্পানি নিয়ে রাজাটিলা আক্রমণ করলেন। ২২ নভেম্বরের মধ্যে পাকিস্তানিদের উক্ত দুটি অবস্থানই মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং তারা পাকিস্তানিদের কাছ থেকে প্রচুর গােলাবারুদ উদ্ধার করেন।
চার নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখেছিল। মুক্তিবাহিনীর সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য কানাইঘাট দখল করা বিশেষ প্রয়ােজন হয়ে পড়ল। সুরমা নদীর পাড়ে কানাইর থানা হেড কোয়ার্টার সামরিক দিক থেকে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২৩ নভেম্বর ‘জেড ফোর্স কমান্ডার লে. কর্নেল জিয়াউর রহমান ক্যাপ্টেন রবকে তাঁর আটগ্রাম ঘাটিতে ডেকে পাঠালেন। নির্দেশ দিলেন কানাইঘাটদরবশত সড়কে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে। ক্যাপ্টেন রব ফিরে এসে তার ট্রপস নিয়ে নভেম্বরের ২৫/২৬ তারিখে বাছড়া চা-বাগান এলাকাতে অবস্থান নিলেন । কানাইঘাট ছিল পাকিস্তানিদের ঘাটি। এই ঘাঁটি দখলের দায়িত্ব জেড ফোর্সের ওপর অর্পিত হলেও শেষ পর্যন্ত চার নম্বর সেক্টর ট্রপস-এর ওপর সে দায়িত্ব অর্পিত হয়। কানাইঘাটদরবশত সড়কে পাকিস্তানিদের আনাগােনা বন্ধ হলাে। যদিও পাকসেনারা ক্যাপ্টেন রবের ওপর ১০৫ মিলিমিটার আর্টিলারি গান দিয়ে ক্রমাগত আঘাত হেনে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। ১ ডিসেম্বর সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল দত্ত পরিকল্পনা কিছুটা রদবদল করে নিয়ে বাহিনীকে অগ্রসর হতে বললেন। লেঃ গিয়াসের নেতৃত্বে একটি কোম্পানিকে দরবশত-কানাইঘাট সড়কে কাট অফ পার্টি হিসেবে রাখা হলাে। উদ্দেশ্য
ছিল দরবশত থেকে যেন পাকিস্তানিদের কোনাে সাহায্য কানাইঘাটে পৌছতে না পারে । লেঃ জহিরের নেতৃত্বে একটি কোম্পানিকে কানাইঘাট-চরখাই সড়কে ‘কাট অফ পার্টি হিসেবে ডিফেন্স নিতে বলা হলাে। উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি ফোর্স যেন চুরখাই থেকে অগ্রসর হয়ে কানাইঘাটে অবস্থানরত পাকিস্তানিদের সাহায্য করতে না পারে। ক্যাপ্টেন রবের নেতৃত্বে দুটো কোম্পানিকে সম্মুখভাগে সরাসরি আক্রমণ চালিয়ে কানাইঘাট দখলের জন্য বলা হল। ডিসেম্বরের ২/৩ তারিখে পরিকল্পনা অনুসারে মুক্তিবাহিনী অগ্রসর হয়ে পৌছল যথাস্থানে। রাত দেড়টা থেকেই পাকিস্তানিরা টের পেয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর আর্টিলারির ফায়ার শুরু করে। মুক্তিবাহিনীর উল্লেখযােগ্য অস্ত্রের মধ্যে ছিল কেবল দুটো ৩ ইঞ্চি মর্টার। ৩ ডিসেম্বর ভাের ৪টায় মুক্তিবাহিনী শত্রুশিবিরের ৩০০ গজের মধ্যে চলে আসে। ভাের ঠিক সাড়ে পাঁচটায় পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর ওপর ব্যাপকভাবে হামলা চালায়। মুক্তিযােদ্ধারাও ত্বরিত সে আক্রমণের জবাব দিল এবং পাকসেনাদের ঘিরে ফেলে তিন দিক থেকে । সকাল ৭টার দিকে পাকসেনারা পিছু হটবার চেষ্টা করলে ক্যাপ্টেন রব পাকসেনাদের সুযােগ না দিয়ে ৭টা ১৫ মিনিটে শত্রুঘাঁটির ওপর চার্জ শুরু করে দেন। পাকিস্তানিরা নিহত হলাে অধিকাংশই । কিছুসংখ্যক পালিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিতে গেলে একে একে তারাও নিহত হলাে বুলেটবিদ্ধ হয়ে। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই সম্পূর্ণ কানাইঘাট মুক্ত হলাে। এই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর ১১ জন শহীদ এবং ২০ জন আহত হন।
লেঃ জহিরের কম্যাণ্ডে একটি কোম্পানিকে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাহায্যে পাঠানাে হলাে। পাকসেনারা দরবশতে জমা হতে লাগল। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা ৭ ডিসেম্বর দরবশত ছেড়ে ডিফেন্স নিলাে হরিপুরে। মিত্র ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে হরিপুরের ওপর আক্রমণ চালিয়েও তেমন সুবিধা করতে পারল না। ১১ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা নদী পেরিয়ে অপর পারে পৌছেই মুক্তিবাহিনীর ওপর প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করে। মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানিদের এই অকস্মাৎ আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত ছিল না। ফলে, রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলাে। ১২ ডিসেম্বর যৌথবাহিনী পুনরায় হরিপুরের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ১৩ ডিসেম্বর হরিপুর সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। সিলেট দখলের যে পরিকল্পনা ছিল, সম্ভবত তা হলাে লেঃ কর্নেল জিয়াউর রহমান ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং চার নম্বর সেক্টর টুপস-এর একটি কোম্পানি নিয়ে সালুটিকর বিমান বন্দরের দিকে অগ্রসর হবেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন হেলিকপ্টারযােগে সিলেট শহরের দক্ষিণ দিকে নামবে। এবং “লেঃ কর্নেল জিয়া ও ভারতীয় বাহিনী সিলেট আক্রমণ করবে যৌথভাবে। চার নম্বর সেক্টর বাহিনী দরবশত এবং খাদিমনগর দখল করে সিলেট আক্রমণ করবে। ভারতীয় একটি গুর্খা ব্যাটালিয়ন ৫নং সেক্টরের একটি কোম্পানি নিয়ে খাদিমনগর হয়ে সিলেট আক্রমণ করবে। ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ৫নং সেক্টর ট্রুপস সম্মিলিতভাবে গােয়াইনঘাট ছাতক হয়ে সিলেটের পেছন দিক থেকে আক্রমণ করবে। একটি কোম্পানি নিয়ে ক্যাপ্টেন এনাম ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় সিলেটের দিকে অগ্রসর
৫৯
হবে মৌলভীবাজার হয়ে। লেঃ ওয়াকি-উজ-জামান এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কাদের সেক্টর ট্রুপস নিয়ে ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় ফেঞ্চুগঞ্জ হয়ে সিলেট আক্রমণ করবে।৩
১১ ডিসেম্বরে হরিপুরের সংঘর্ষের কথা বলতে গিয়ে ব্রিগেডিয়ার দত্ত তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমাকে বলা হলাে হিমুর (পাকিস্তানিদের ঘাঁটি) পেছন দিক থেকে পাকসেনাদের আক্রমণ করতে এবং যেভাবেই হােক হিমু শত্রুমুক্ত করে হরিপুরের ওপর আক্রমণ চালাতে। খাওয়া-দাওয়া সেরে গ্রাম থেকে দু’জন গাইড নিয়ে চললাম হিমুর উদ্দেশে। সারারাত নদী-খাল-বিল পার হয়ে পৌছলাম আটগ্রাম নামক এক গ্রামে। সেখান থেকে হিমুর দূরত্ব প্রায় দু’মাইল। আটগ্রাম পৌছলাম ভাের ৪টায়। সঙ্গে সঙ্গে মৌলভী সাহেবের আযান শােনা গেল। মনটা যেন কেমন করে উঠল। মেজর রব এবং ড. নজরুলকে বললাম এই আযানের কী অর্থ হতে পারে? তর্ক করার সময় তখন ছিল না। গ্রামের পাশেই নদী। এই নদী পার হতে হবে। অনেক কষ্টে দুটো নৌকা যােগাড় করা গেল। ওপারে সবাই পৌছলাম। প্রায় ৭০০/৮০০ গজ দূরে খােলা মাঠ এবং মাঠের মধ্যে অনেকগুলাে উঁচু টিলা। টিলাগুলাে পুরা আটগ্রামকে ঘিরে রেখেছে। সকাল হতে চলেছে। দেখলাম হিমু পর্যন্ত খােলা মাঠ। তাই আটগ্রামেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। সবাই মিলে আবার নদী পার হয়ে আটগ্রামে ফিরে আসলাম। আমার সৈন্যরা কোথায় থাকবে, কী খাবে ইত্যাদি চিন্তা-ভাবনারও সময় পাওয়া গেল না। সকাল প্রায়
৬০
ছয়টায় পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর ৩ ইঞ্চি মর্টারের গােলাবর্ষণ শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ওপর আরম্ভ হলাে মেশিনগান ও এলএমজি’র গুলিবর্ষণ । সৈন্যরা যে পজিশন নেবে তারও সময় নেই। হঠাৎ করে আক্রমণ হওয়ায় আমার সৈন্যরা একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। মৌলভীকে খুঁজতে পাঠালাম, কিন্তু পাওয়া গেল না। চারধার থেকে খবর আসছে শুধু মৃতের এবং আহদের। তাদের সংখ্যা ক্রমাগতই বেড়ে চলেছে। আটগ্রাম ছােট গ্রাম। বৃষ্টির মতাে গােলাগুলি হচ্ছিল। আমাদের এখন কিছুই করবার নেই । চিন্তা করলাম যদি আটগ্রামে থাকি তাহলে সবাই মারা পড়ব। কারণ পাকিস্তানিরা আমাদের অবস্থান জেনে ফেলেছে। তাই সবাইকে যে যেভাবে পারে পেছনে দু’তিন মাইল দূরে আর এক গ্রামে চলে যেতে বললাম। যখন আমরা আটগ্রাম ছেড়ে পেছনের গ্রামের দিকে যাচ্ছিলাম তখন আমাদের কেউ মারা যায়নি বা আহত হয়নি। যদিও আমাদের ওপরে প্রচুর গােলাগুলি হচ্ছিল। যখন সবাই এসে পৌছলাম দেখলাম আমার ১১জন। ছেলে শহীদ হয়েছে এবং ৫ জন হয়েছে গুরুতরূপে আহত।৪
খাদিমনগর ছিল পাকিস্তানিদের শেষ অগ্রবর্তী ঘাঁটি। ১৫ ডিসেম্বর ডানদিক থেকে মিত্রবাহিনী এবং বাঁদিক থেকে সেক্টর ট্রুপস অগ্রসর হতে লাগল। খাদিমনগরের কাছাকাছি ঈদগা থেকে পাকিস্তানিদের বৃষ্টির মতাে গুলি এসে পড়তে লাগল । ১৫ ডিসেম্বর বিকাল ৫টার দিকে ই পি আর হাবিলদার গােলাম রসুল একা ক্রলিং করে অগ্রসর হয়ে পাকিস্তানিদের ওপর গ্রেনেড চার্জ করে। এই গ্রেনেড চার্জে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হওয়া শুরু করে। শেষ পর্যন্ত হাবিলদার গােলাম রসুল ফিরে আসতে পারল না। পাকিস্তানি বুলেটে সে শহীদ হলাে। হাবিলদার গােলাম রসুলের আত্মত্যাগে মুক্তিবাহিনী বিপুল বিক্রমে আক্রমণ চালিয়ে খাদিমনগর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করলেও প্রকৃতপক্ষে সিলেট মুক্ত হয় ১৭ ডিসেম্বরে।
তথ্য নির্দেশ
১. সাক্ষাৎকার : ব্রিগেডিয়ার আব্দুর রব, পিএসসি।
২. পূর্বোক্ত ।
৩. সাক্ষাৎকার : মেজর জেনারেল চিত্তরঞ্জন দত্ত, বীর উত্তম (অবঃ)।
৪. পূর্বোক্ত ।
পাঁচ নম্বর সেক্টর
পাঁচ নম্বর সেক্টর এলাকা ছিল সিলেট জেলার পশ্চিমাঞ্চল সিলেট-ডাউকি সড়ক থেকে সুনামগঞ্জ-ময়মনসিংহ সড়ক পর্যন্ত বিস্তৃত। সেক্টর কমান্ডার ছিল মেজর মীর শওকত আলী। সেক্টর কমান্ডারের সাঙ্কেতিক নাম ছিল ‘টাইগার লিডার’ । সমগ্র এলাকাতে সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্যে সেক্টর এলাকাকে ৬টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়।
১. মুক্তাপুর সাব-সেক্টর : কমান্ডার ছিল সুবেদার নজির হােসেন এবং সেকেণ্ড-ইন কমান্ড ছিল এফ এফ ফারুক।
২. ডাউকি সাব-সেক্টর : কমান্ড করেছেন সুবেদার মেজর বি আর চৌধুরী।
৩. শেলা সাব-সেক্টর : কমান্ডার ছিল ক্যাপ্টেন হেলাল। সহযােগী কমান্ডার ছিল লে, মাহবুবার রহমান এবং লেঃ আব্দুর রউফ।
৪. ভােলাগঞ্জ সাব-সেক্টর : কমান্ডার ছিল লেঃ তাহের উদ্দিন আখঞ্জী। সহযােগী কমান্ডার ছিল লেঃ এস এম খালেদ।
৫. বালাট সাব-সেক্টর : কমান্ড করেছেন যথাক্রমে সুবেদার গনি, ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন এবং এফ এফ এনামুল হক চৌধুরী।
৬. বড়ছড়া সাব-সেক্টর : কমান্ড করেছেন ক্যাপ্টেন মুসলিম উদ্দিন। সেক্টরে অ্যাডজুটেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন চা-বাগানের ম্যানেজার জনাব মােস্তফা। সেক্টর হেড কোয়ার্টার ছিল বাঁশতলাতে। সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার। ইপিআর-এর সংখ্যাও ছিল উল্লেখযােগ্য। মােট বাহিনীর
এক হাজার ছিল নিয়মিত সৈনিক অবশিষ্ট ৯ হাজার ছিল গণবাহিনী। ১ পাঁচ নম্বর সেক্টরটি পুনর্গঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নিয়মিত বা সুসংগঠিত কোনাে । বাহিনী এই সেক্টরে গড়ে ওঠেনি। খাসিয়া ও জয়ন্তিয়া পাহাড় সংলগ্ন এই এলাকা ছিল অত্যন্ত দুর্গম।
রাস্তাঘাটের অভাব, যানবাহনাদির স্বল্পতা, সর্বোপরি প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্যে কোনাে বাহিনী গড়ে তােলা ছিল অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার । বিচ্ছিন্ন অবস্থায় সীমান্ত এলাকায় মুক্তিযােদ্ধারা যে প্রতিরােধ গড়ে তােলার প্রয়াস পাচ্ছিল তা ছিল নগণ্য। অস্ত্রশস্ত্রের স্বল্পতাও লক্ষণীয়। এমনি একটি প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে প্রথম সামরিক অফিসার মেজর শওকতকে সেক্টরের দা!ি ত্ব দিয়ে পাঠানাে হলাে। মেজর শওকত সেক্টরের দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই একে একে সমগ্র এলাকা পরিদর্শন করলেন। পরিদর্শনকালে বাহিনীর পক্ষে জেনারেল গুরবক সিং গিল এই এলাকার তত্ত্বাবধানে ছিলেন।
আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ফজলুর রহমান এই সেক্টরে স্টাফ অফিসার হিসেবে যােগদান করলেন। সমগ্র এলাকাটিতে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেল। মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত রেইড, অ্যামবুশ এবং ছােটোখাটো আক্রমণের ফলে পাকসেনারা আগস্ট মাসের শেষের দিকেই সীমান্ত এলাকা থেকে পিছু হটতে থাকে। কিছু এলাকা মুক্ত হলাে এ মাসেই। পাকসেনারা ডাউকি ছেড়ে রাধানগর (বাংলাদেশের পাঁচ মাইল অভ্যন্তরে), ভােলাগঞ্জ ছেড়ে কোম্পানিগঞ্জের দিকে (বাংলাদেশের আট মাইল অভ্যন্তরে), শেলা সাব-সেক্টর থেকে ছাতকের কাছাকাছি এবং টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ডে (বাংলাদেশের দশ/বারাে মাইল অভ্যন্তরে) অবস্থান নিলাে। বালাট সাবসেক্টর থেকেও ওরা সুনামগঞ্জের দিকে পাঁচ মাইল পেছনে সরে গেলাে। ২
পাঁচ নম্বর সেক্টরেও বিশেষ করে নদীপথে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে সেক্টর কমান্ডার মেজর শওকতের ব্যাপক তৎপরতার ফলে ছাতক, রাধানগর ও টেংরাটিলা ব্যতীত সুরমা নদীর তীর পর্যন্ত প্রায় ২০০ বর্গমাইল এলাকা মুক্ত হয়। ধিরাই, সাচনা এলাকা এবং এমন কি সুরমা নদী দিয়ে পাকিস্তানিদের যাতায়াত প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৯ম ডিভিশনাল কমান্ডার মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “সুরমা নদীতে আমরা ৫টির মতাে পাকিস্তানি জলযান দখল করি। এই জলযানের মধ্যে জাহাজ, বার্জ, স্পিডবােট ইত্যাদি ছিল। ফলে, নদীপথে পাকসেনাদের ছাতক ও সুরমা নদী এলাকাতে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। পাকিস্তানিরা কেবল সিলেট থেকে সড়কপথে ছাতক ও সুনামগঞ্জের সরবরাহ অব্যাহত রাখে। | অক্টোবর মাসে ‘জেড’-ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে এই সেক্টরে আসে । এবং এর ফলে সেক্টরের সামরিক শক্তি ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। অক্টোবর মাস থেকেই সেক্টরের প্রতিটি সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় ।
এই সেক্টরের অধীন বড়ছড়া সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মুসলিম তাঁর সাবসেক্টরটির নাম দিয়েছিল ‘ব্লুসার্ট’ এবং ক্যাপ্টেন মুসলিম এই এলাকার ক্যাপ্টেন ডীন, ক্যাপ্টেন রমজান নামে পরিচিত ছিলেন। ক্যাপ্টেন মুসলিমের দায়িত্ব নেওয়ার পূর্বে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মাহফুজুর রহমান ভূঁইয়া, এম পি সুরঞ্জিত সেন, এম পি সিরাজ প্রমুখ যৌথভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর এস জে বার্থ এবং ক্যাপ্টেন প্রধানের তত্ত্বাবধানে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিলেন। এম পি সুরঞ্জিত সেন সামরিক বাহিনীর সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও একাধিক অপারেশন ও সাংগঠনিক তৎপরতায় যে ভূমিকা পালন করেছেন, তা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
এই সাব-সেক্টরের তত্ত্বাবধানে বেশকিছু গেরিলা বেইস গড়ে ওঠে। গেরিলা অবস্থানগুলাের মধ্যে জয়কলস, ধিরাইল, জগন্নাথপুর, মারকুলি, খালিয়াজুরি, আজমিরীগঞ্জ, ইটনা, মিটামইন, শেরপুর, নবীগঞ্জ, বানিয়াচং, আনন্দনগর, রামজীবনপুর, সাচনা ও নিকলি উল্লেখযােগ্য।
১৯ অক্টোবর মুক্তিবাহিনী পাক অবস্থান সুনামগঞ্জ মহকুমার নিকলি থানা আক্রমণ করে। এখানে পাক সনাদের ১০০ জনের মতাে নিয়মিত বাহিনীর সদস্য অবস্থান করছিল। মুক্তিযােদ্ধা হাবিবুর রহমানের কম্যাণ্ডে ৫০ জন মুক্তিযােদ্ধা ওই তারিখে ভােরবেলা দু’দিক থেকে ‘কঘাঁটি নিকলি আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে কিছুক্ষণের মধ্যে পাকিস্তানিরা নিকলি ছেড়ে সুনামগঞ্জে পালিয়ে যায় । পাক পক্ষের হতাহতের সংবাদ জানা না গেলেও মুক্তিবাহিনীর একজন আহত হওয়া ছাড়া মারাত্মক কোনাে ম য়ক্ষতি হয়নি। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনী ওই তারিখে ২৫টি ৩০৩ রাইফেল, ১২ বােরের একটি রাইফেল এবং বেশকিছু গােলাবারুদ হস্তগত করে। অক্টোবর মাসের মধ্যেই ক্যাপ্টেন মুসলিম তাঁর বাহিনী নিয়ে হামলা চালিয়ে পাক অধিকৃত এলাকা মিটামইন, বাজিতপুর, কটিয়াদি, হােসেনপুর, পাকুন্দিয়া ও তরাইল নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সমর্থ হন।
ক্যাপ্টেন মুসলিম বড়ছড়া সাব-সেক্টরের দায়িত্ব নেওয়ার পূর্বে ৮ আগস্ট সাচনাজামালগঞ্জে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর এক বড়াে রকমের সংঘর্ষ হয়। সিরাজুল ইসলাম নামে এক নির্ভীক দেশপ্রেমিক সাহসী মুক্তিযােদ্ধা মাত্র একটি প্লাটুন নিয়ে পাকসেনাদের মজবুত ঘাঁটি সাচনা আক্রমণ করে। পাকসেনারা বাঙ্কার থেকে ব্যাপকভাবে পাল্টা গুলি চালাতে থাকে। পাকসেনাদের প্রবল গােলাবৃষ্টির মধ্যে মুক্তিবাহিনী সামনে অগ্রসর হতে পারছিল না। কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম তার সাথীদের আক্রমণ অব্যাহত রাখতে বলে নিজে কয়েকটি গ্রেনেড নিয়ে ক্রলিং করে। শত্রুর বাঙ্কারের দিকে এগিয়ে যান । এফ এফ সিরাজুল ইসলাম শত্রুর বাঙ্কারের মুখােমুখি হয়ে গ্রেনেড চার্জ করেন। এই গ্রেনেড আক্রমণে শত্রুসেনাদের দুটি বাঙ্কারই বিধ্বস্ত হয়। পাকিস্তানিরা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম এই সাফল্য ও জয়ের নেশায় ক্রলিং করে তৃতীয় বাঙ্কারের কাছে পৌছে গ্রেনেড চার্জ করার পূর্ব মুহূর্তে এলএমজি’র বুলেট তাঁর দেহ বিদীর্ণ করে দেয়। সিরাজুল ইসলামসহ ৬ জন। মুক্তিযােদ্ধা এখানে শহীদ হন। সিরাজুল ইসলাম শহীদ হওয়ার বেশ কিছুদিন পর, তাঁর বাবার কাছ থেকে, তাঁর লেখা একটি চিঠি উদ্ধার করা হয়। বয়সে তরুণ দেশপ্রেমে সমুজ্জ্বল সিরাজুল ইসলামের চিঠিটি ব্যক্তিগত হলেও স্বাধীনতাকামী যুদ্ধরত লাখাে মুক্তিযােদ্ধার মনের বাসনা চিঠির মধ্যে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। সে কারণেই সিরাজুল ইসলামের সেই চিঠির অনুলিপি এখানে হুবহু তুলে ধরা হলাে।৩
টেকেরঘাট হইতে
তারিখ ৩০-৭-৭১ইং
প্রিয় আব্বাজান, আমার ছালাম নিবেন। আশা করি খােদর কৃপায় ভালই আছেন। বাড়ীর সকলের কাছে আমার শ্ৰেণীমত ছালাম ও স্নেহ রহিলাে। বর্তমানে যুদ্ধে আছি, আলী রাজা, রওশন, সাত্তার, রেনু, ইব্রাহিম, ফুল মিয়া সকলেই একত্রে আছি। দেশের জন্য আমরা সকলেই জান কোরবান করিয়াছি। আমাদের জন্য ও দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য দোয়া করিবেন। আমি জীবনকে তুচ্ছ মনে করি। কারণ, দেশ স্বাধীন না হইলে জীবনের কোন মূল্য
৬৪
আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ফজলুর রহমান এই সেক্টরে স্টাফ অফিসার হিসেবে যােগদান করলেন। সমগ্র এলাকাটিতে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেল। মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত রেইড, অ্যামবুশ এবং ছােটোখাটো আক্রমণের ফলে পাকসেনারা আগস্ট মাসের শেষের দিকেই সীমান্ত এলাকা থেকে পিছু হটতে থাকে । কিছু এলাকা মুক্ত হলাে এ মাসেই। পাকসেনারা ডাউকি ছেড়ে রাধানগর (বাংলাদেশের পাঁচ মাইল অভ্যন্তরে), ভােলাগঞ্জ ছেড়ে কোম্পানিগঞ্জের দিকে (বাংলাদেশের আট মাইল অভ্যন্তরে), শেলা সাব-সেক্টর থেকে ছাতকের কাছাকাছি এবং টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ডে (বাংলাদেশের দশ/বারাে মাইল অভ্যন্তরে) অবস্থান নিলাে। বালাট সাবসেক্টর থেকেও ওরা সুনামগঞ্জের দিকে পাঁচ মাইল পেছনে সরে গেলাে ।২
পাঁচ নম্বর সেক্টরেও বিশেষ করে নদীপথে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে সেক্টর কমান্ডার মেজর শওকতের ব্যাপক তৎপরতার ফলে ছাতক, রাধানগর ও টেংরাটিলা ব্যতীত সুরমা নদীর তীর পর্যন্ত প্রায় ২০০ বর্গমাইল এলাকা মুক্ত হয় । ধিরাই, সাচনা এলাকা এবং এমন কি সুরমা নদী দিয়ে পাকিস্তানিদের যাতায়াত প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৯ম ডিভিশনাল কমান্ডার মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “সুরমা নদীতে আমরা ৫টির মতাে পাকিস্তানি জলযান দখল করি। এই জলযানের মধ্যে জাহাজ, বার্জ, স্পিডবােট ইত্যাদি ছিল। ফলে, নদীপথে পাকসেনাদের ছাতক ও সুরমা নদী এলাকাতে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। পাকিস্তানিরা কেবল সিলেট থেকে সড়কপথে ছাতক ও সুনামগঞ্জের সরবরাহ অব্যাহত রাখে।”
অক্টোবর মাসে ‘জেড’-ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে এই সেক্টরে আসে। এবং এর ফলে সেক্টরের সামরিক শক্তি ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। অক্টোবর মাস থেকেই সেক্টরের প্রতিটি সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
এই সেক্টরের অধীন বড়ছড়া সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মুসলিম তাঁর সাবসেক্টরটির নাম দিয়েছিল ‘ব্লুসার্ট এবং ক্যাপ্টেন মুসলিম এই এলাকার ক্যাপ্টেন ডীন, ক্যাপ্টেন রমজান নামে পরিচিত ছিলেন। ক্যাপ্টেন মুসলিমের দায়িত্ব নেওয়ার পূর্বে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মাহফুজুর রহমান ভূঁইয়া, এম পি সুরঞ্জিত সেন, এম পি সিরাজ প্রমুখ যৌথভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর এস জে বার্থ এবং ক্যাপ্টেন প্রধানের তত্ত্বাবধানে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিলেন। এম পি সুরঞ্জিত সেন সামরিক বাহিনীর সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও একাধিক অপারেশন ও সাংগঠনিক তৎপরতায় যে ভূমিকা পালন করেছেন, তা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
এই সাব-সেক্টরের তত্ত্বাবধানে বেশকিছু গেরিলা বেইস গড়ে ওঠে। গেরিলা অবস্থানগুলাের মধ্যে জয়কলস, ধিরাইল, জগন্নাথপুর, মারকুলি, খালিয়াজুরি, আজমিরীগঞ্জ, ইটনা, মিটামইন, শেরপুর, নবীগঞ্জ, বানিয়াচং, আনন্দনগর, রামজীবনপুর, সাচনা ও নিকলি উল্লেখযােগ্য।
থাকিবে না। তাই যুদ্ধকেই জীবনের পাথেয় হিসাবে নিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে মাকে কষ্ট দিলে আমি আপনাদেরকে ক্ষমা করিব না। পাগলের সব জ্বালা সহ্য করিতে হইবে, চাচা-মামাদের ও বড় ভাইদের নিকট আমার ছালাম । বড় ভাইকে চাকুরীতে। যােগ দিতে নিষেধ করিবেন। জীবনের চেয়ে চাকুরী বড় নয়। দাদুকে দোয়া করিতে বলিবেন। মৃত্যুর মুখে আছি। যে কোন সময় মৃত্যু হইতে পারে এবং মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত। দোওয়া করিবেন মৃত্যু হইলেও যেন দেশ স্বাধীন হয়। তখন দেখবেন লাখ লাখ ছেলে বাংলার বুকে পুত্রহারাকে বাবা বলে ডাকবে। এই ডাকের অপেক্ষায় থাকুন।
আর আমার জন্য চিন্তার কোন কারণ নাই। আপনার দুই মেয়েকে পুরুষের মত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। তবেই আপনার সাধ মিটে যাবে। দেশবাসী, স্বাধীন বাংলা কায়েমের জন্য দোয়া কর, মীরজাফরী করিও না। কারণ মুক্তিফৌজ তােমাদের ক্ষমা করিবে না এবং বাংলায় তােমাদের জায়গা দেবে না।
ছালাম, দেশবাসী ছালাম
ইতি
মােঃ সিরাজুল ইসলাম।
ক্যাপ্টেন মুসলিম তার ক্যাম্পে পুত্রহারা পিতার কাছ থেকে পত্রটি সংগ্রহের পর প্রায়ই তিনি পত্রটি মুক্তিযােদ্ধাদের পড়ে শােনাতেন। এর কিছুদিন পর ক্যাপ্টেন মুসলিম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে নিম্নে উদ্ধৃত পত্র লিখলেন :
Blue Shirts (Borsora) No. 9/Casualty 71-72-80-81 To: The Commander-in-Chief Bangladesh Forces
Enclosed is a copy of the letter written by one of the fallen Muktifouz to his father. This letter has recently been recovered by us from the father of the deceased. The Muktifouz died the death of martyr. On 8th August, 1971, this particular liberation fighter led the attack against extended enemy at Sachna Jamalganj p.s. Sylhet which led to capturing the place from the enemy hands. He died of enemy force.
This letter is often read over in the gathering of Muktifouz here. We have experienced that his letter has an electric effect in inspiring other fighters. Hence, it is requested that this letter may please be read occasionally over Swadhin Bangla Radio other Muktifouz in dedicating their lives for the cause.
Kindly Acknowledge. Sa/Major MM DIN Sub-sector Commander No. 5 (Borsora)
Copy with a copy of the above reffered letter is forwarded to HQ No. 5 Sector, BDF for information.
যাহােক, এই সাব-সেক্টরে ট্রুপস ক্যাপ্টেন মুসলিমের তত্ত্বাবধানে ২৪ অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুন আটগ্রাম পাকঘাঁটি আক্রমণ করে। ওই তারিখ রাতে
মুক্তিযােদ্ধা সিকান্দারের কম্যাণ্ডে আর একটি প্লাটুনও পাক অবস্থান আটগ্রাম আক্রমণ করে। এখানে পাকিস্তানিদের এক প্লাটুন সৈন্য ছিল। আটঘণ্টা স্থায়ী সংঘর্ষের পর ৮ জন রাজাকার এবং ২ জন পাকিস্তানি পুলিশ মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে । অন্যান্য সৈনিকরা আটগ্রাম ছেড়ে চলে যায়। মুক্তিবাহিনী এখান থেকে ২০টি রাইফেলসহ বেশ কিছু গােলাবারুদ উদ্ধার করে।
২৫ অক্টোবর তারিখে আর একটি সংঘর্ষ হয়। ওই তারিখে মুক্তিবাহিনীর একটি দল সুনামগঞ্জ মহকুমার গােচিহাটা পাক অবস্থানের ওপর অকস্মাৎ হামলা চালিয়ে ৭ জন রাজাকারকে হত্যা এবং ৭টি ৩০৩ রাইফেলসহ বেশকিছু গােলাবারুদ উদ্ধার করে।
ভােলাগঞ্জ সাব-সেক্টরটি দু’অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বে ছিল লেঃ স ম খালেদ, ছদ্মনাম ছিল ‘ব্ল্যাক বিয়ার্ড’। অপর দিকে পশ্চিমাঞ্চল সাব-সেক্টর কমান্ডার লেঃ তাহের উদ্দিন আখঞ্জি স্বয়ং তত্ত্বাবধান করতেন। লেঃ তাহের উদ্দিনের ছদ্মনাম ছিল ‘মবিডিক’, ক্যাপ্টেন, ‘পাইরেট’ ‘ব্লু প্যানথার’ ইত্যাদি।
সামরিক দিক থেকে গৌরীনগর গ্রামটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামটির তিনদিকেই জল এবং একটি মাত্র প্রবেশপথ ছিল। গৌরীনগর গ্রাম থেকে সালুটিকর বিমানবন্দরের দূরত্ব ছিল মাত্র তিন মাইল । সাব-সেক্টর কমান্ডার লেঃ তাহের আখঞ্জি গৌরীনগর গ্রামে অবস্থান নেওয়ার উদ্দেশে ১৮ অক্টোবর রাতে দুই কোম্পানি সৈন্য নিয়ে ২৫টি দেশী নৌকাযােগে গৌরীনগরের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন।
লে. আখঞ্জি আগের দিনই ওই গ্রাম ‘রেকি করে এসেছিলেন। তিনি রেকি করে আসার পরেই পাকসেনারা যে ওই গ্রামে অবস্থান নেয় লে, আখঞ্জি এ খবর পেলেন না।
১৮ অক্টোবর মুক্তিবাহিনী ২৫টি নৌকাযােগে গৌরীনগরের কাছাকাছি হতেই পাকসেনারা টের পেয়ে বেপরােয়াভাবে গৌরীনগর থেকে মুক্তিবাহিনীকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে। অকস্মাৎ এই আক্রমণের জন্যে মুক্তিবাহিনী আদৌ প্রস্তুত ছিল না। ২৫টি নৌকা ভর্তি মুক্তিবাহিনী নদীপথে রাতের অন্ধকারে দিক হারিয়ে ফেলল। ফলে নদীর মাঝে সে এক হট্টগােল ব্যাপার। লেঃ আখঞ্জি কমান্ড ও কন্ট্রোল হারিয়ে ফেললেন। অনেক চেষ্টার পর তিনি তার বাহিনী নিয়ে পেছনে সরে এসে বর্নি নামক স্থানে অবস্থান নিলেন। গৌরীনগর গ্রামে পাকিস্তানিদের প্রচণ্ড গােলার মুখে একজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ এবং ৬ জন গুরুতররূপে আহত হয় ।
বনি-তে সুবেদার মােশাররফ এবং এফ এফ মাহবুবের কম্যাণ্ডে মুক্তিবাহিনীর কোম্পানি দুটি রেখে লেঃ আখঞ্জি তাঁর হেড কোয়ার্টারে ফিরে গেলেন। বর্নিতে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ওপর পাকিস্তানিরা অক্টোবরের ২১/২২ তারিখে প্রচণ্ড হামলা চালায়। পাকসেনাদের এই প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে সুবেদার মােশাররফ এবং এফ এফ মাহবুব তাঁর বাহিনী নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী পিছু সরে ডাকাতের বাড়ি এবং দলিরগাঁও-এ পুনরায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলেন। বর্নিতে সংঘর্ষে ২ জন মুক্তিযােদ্ধা পাকসেনাদের হাতে বন্দী এবং বেশ কিছুসংখ্যক
যােদ্ধা আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর এই বিপর্যয়ের সংবাদ পেয়ে ২২/২৩ অক্টোবর ভােলাগঞ্জ সাব-সেক্টর কমান্ডার লেঃ আখঞ্জি সেক্টর কমান্ডার মেজর শওকতের নির্দেশে ২০০ জনের মতাে মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে ভাের সাড়ে পাঁচটায় পাক অবস্থান বনি আক্রমণ করলেন। বাঁ দিক থেকে লেঃ আখঞ্জি তার বাহিনী এবং ডান দিক থেকে সুবেদার মােশাররফ তার বাহিনী নিয়ে তীব্রভাবে আক্রমণ চালান। মুক্তিবাহিনীর কাছে উল্লেখযােগ্য অস্ত্র বলতে ৪টি এল এম জি, ১টি ২ ইঞ্চি মর্টার এবং ২টি জি এফ (গ্রেনেড ফায়ার) রাইফেল ছিল। মুক্তিবাহিনী বর্নিতে ঢুকে পড়ে। পাকসেনারা ফ্রন্ট লাইন ছেড়ে পেছনে সরে পাল্টা আক্রমণ করে। তাদের তীব্র আক্রমণের মুখে। মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে শুরু করে । এই সময় রণাঙ্গন কমান্ডার লে. আখঞ্জি সেক্টর কমান্ডারের কাছে ওয়ারলেস সেটযােগে বার বার সাহায্য প্রার্থনা করছিলেন। এই বার্তা পেয়ে সেক্টর কমান্ডার মেজর শওকত লেঃ আখঞ্জির সাহায্যে মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুনকে অস্ত্র, গােলাবারুদ দিয়ে পাঠালেন। এই প্লাটুন পৌছানাের ফলে মুক্তিবাহিনীর মনােবল বহুলাংশে বেড়ে যায় এবং পাকিস্তানিদের ওপর তীব্রভাবে আক্রমণ অব্যাহত রাখে। বেলা ৪টা পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে শেষ পর্যন্ত পাকসেনারা চরম ক্ষতি স্বীকার করে বর্নি ছেড়ে গৌরীনগর পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী বর্নিতে দৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলে।
এরপর মুক্তিবাহিনী বর্নি থেকে লেঃ আখঞ্জির কম্যাণ্ডে অগ্রসর হয়ে ৩০ অক্টোবর পাকঘাটি গৌরীনগর আক্রমণ করে, এফ এফ মাহবুবও তার বাহিনী নিয়ে এলেন। সংঘর্ষে ১৭৫ জন মুক্তিযােদ্ধা অংশ নিলাে। সেক্টর কমান্ডার মেজর মীর শওকত স্বয়ং ১২০ মিলিমিটার মর্টার দ্বারা সাহায্য করলেন। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকবাহিনীর প্লাটুনটি এবং রাজাকার বাহিনীর একটি কোম্পানি ৫০০ গজের মতাে পেছনে সরে যেতে বাধ্য হয়। মুক্তিবাহিনী গৌরীনগর পৌছে যায়। গােলাগুলির শব্দে সালুটিকর থেকে পাকিস্তানিদের একটি সাহায্যকারী শক্তিশালী দল চলে আসে এবং মুক্তিবাহিনীর ওপর প্রচণ্ডভাবে পাল্টা আঘাত হানে। এই পাল্টা আক্রমণে মুক্তিবাহিনীকে গৌরীনগর ছেড়ে দিতে হয়। এই ব্যাপক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ২ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ ও ২ জন আহত হয়। অপরদিকে পাকসেনাদের ১১ জন হতাহত হয় বলে জানা যায় ।
এদিকে ডাউকি সাব-সেক্টর কমান্ডার সুবেদার মেজর বি আর চৌধুরীও তাঁর এলাকাতে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিলেন ।
২৫ জুন সাব-সেক্টর কমান্ডার সুবেদার মেজর বি আর চৌধুরী ই পি আর বাহিনীর দুটি কোম্পানি নিয়ে ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে পাক অবস্থান তামাবিল ও জাফলং আক্রমণ করলেন। মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে পাকসেনারা পেছনে সরে যায়। তামাবিল ও জাফলং শত্রুমুক্ত হয়। এই সংঘর্ষে দু’জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ এবং বেশ কয়েকজন আহত হলেও মুক্তিবাহিনী তামাবিল ও জাফলং উদ্ধার করে। এই বিজয়ে সবার মনােবল বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। পাকসেনাদের হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা না
গেলেও তাদের সংখ্যা যে কম ছিল না, তা গ্রামবাসীর জবানবন্দীতেই পাওয়া যায় । এখান থেকে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে রেশন সামগ্রী এবং বেশ কিছু গােলাবারুদ উদ্ধার করে।
২৬ জুন, বয়সে প্রবীণ সুবেদার মেজর বি আর চৌধুরী পুনরায় তাঁর বাহিনী নিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহ ভরে পাকর্ঘাটি শ্রীপুর আক্রমণ করলেন। কিছুক্ষণের সংঘর্ষে পাকসেনারা ক্রমশ পিছু হটতে শুরু করে । এই অবস্থা দেখে মুক্তিবাহিনী তাদের আক্রমণের তীব্রতা এবং গতি আরও বাড়িয়ে দেয়। ফলে শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের প্রচণ্ডতার মুখে পাকসেনারা পেছনে সরতে বাধ্য হয়। উভয় পক্ষের গুরুতর কোনাে হতাহতের সংখ্যা জানা যায় না। জুন মাসেই সুবেদার মেজর বি আর চৌধুরী তামাবিল, জাফলং ও শ্রীপুর সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করেন। এরপর থেকে তিনি তার বাহিনী নিয়ে শত্রুদের ওপর চাপ অব্যাহত রাখেন।
পাঁচ নম্বর সেক্টরেও মুক্তিবাহিনী অত্যন্ত তৎপর ছিল । বড়ছড়া সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মুসলিম তার সাব-সেক্টরে ব্যাপকভাবে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে হামলা অব্যাহত রেখেছিলেন। ২ নভেম্বর আনন্দনগরে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর এক সংঘর্ষ হয়। পাকসেনাদের একটি সেকশন রসদপত্র নিয়ে সাচনা থেকে গােবিন্দপুর হয়ে তাহেরপুর যাচ্ছিল। মুক্তিবাহিনীর এফ এফ মুজাহিদ এবং এম এফ জিয়ার নেতৃত্বে একটি প্লাটুন আনন্দনগর নামক স্থানে অ্যামবুশে ফেলে পাকসেনাদের বেশ কয়েকজনকে হতাহত করে। কিছুসংখ্যক পাকসেনা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মুক্তিবাহিনী ২টি রাইফেল এবং প্রচুর পরিমাণে রেশনপত্র উদ্ধার করে।
৩ নভেম্বর ক্যাপ্টেন মুসলিম এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি পাকঘাটি তাহেরপুর আক্রমণ করে। পাকসেনারা সংখ্যায় এখানে এক কোম্পানির অধিক ছিল। উভয়পক্ষের সংঘর্ষ আধঘণ্টা স্থায়ী হয় । এই সংঘর্ষে পাকসেনাদের ৩৮ জন নিহত এবং বেশকিছু আহত হয়। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর কাশেম নামে একজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ এবং ৫ জন আহত হয়। ক্যাপ্টেন মুসলিম পাকিস্তানিদের ব্যাপক হামলার মুখে আধঘণ্টার বেশি টিকে থাকতে পারলেন । তাকে তার বাহিনী নিয়ে পেছনে সরে আসতে হলাে।
১৬ নভেম্বর পাকবাহিনীর সঙ্গে আজমিরীগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর এক ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। আজমিরীগঞ্জে কমান্ডার জগৎজ্যোতি দাস তাঁর ৪৫ জনের একটি দল নিয়ে অবস্থান করছিলেন। জগৎজ্যোতি দাসের সঙ্গে এক পুলিশ অফিসারের ১০/১২ বছরের ছেলে ‘ইনফরমার’ হিসেবে কাজ করছিল। সে যাবতীয় তথ্যাদি আনা-নেওয়া করত, আজমিরীগঞ্জে থাকাকালীন ছেলেটি বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে কথায় কথায় জগৎজ্যোতির অবস্থানের সঠিক স্থান বলে ফেলে । পুলিশ অফিসারটি সুযােগের সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ল না, ছেলেকে আটকিয়ে পাকসেনাদের খবর দিল। ওই তারিখে বেলা ১১টায় দু’শয়ের মতাে পাকসেনা মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এই এলাকার জগৎজ্যোতি দাস পাকিস্তানিদের কাছে টেরর’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। শােনা যায়, শ্রী জগৎজ্যোতি পাকসেনাদের চ্যালেঞ্জ করে যুদ্ধে নামতেন।
৬৮
ইতিপূর্বে ৯টি অপারেশনে তিনি তাঁর সফল রণকৌশলের পরিচয় দিয়েছেন। আরও শােনা যায়, জগৎজ্যোতিকে বারবার মায়ের সঙ্গে দেখা করার কথা বলা সত্ত্বেও তিনি নাকি দেশ শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত মায়ের মুখ দেখবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন । সেই দুঃসাহসী টেরর’ জগৎজ্যোতিকে নিশ্চিহ্ন করার এমন সুযােগ পাকসেনারা ছাড়ল।
জগৎজ্যোতি পাকসেনাদের এই আকস্মিক আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। কাজেই তিনি তার বাহিনী নিয়ে তড়িৎ বেগে প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিলেন। জগৎজ্যোতির তীব্র আক্রমণের মুখে ফাস্ট লাইনে অবস্থানরত পাকসেনারা পেছনে সরতে শুরু করে। এই সংঘর্ষ দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা স্থায়ী হলাে । ব্যাপকভাবে পাকিস্তানিরা ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করলেও শেষরক্ষা হলাে না। কমান্ডার নিভকি দেশপ্রেমিক জগৎজ্যোতি দাস, উপেন্দু প্রমুখরা পাকিস্তানি বুলেটের শিকার হলেন। আহত হলাে আইয়ুব, ইলিয়াস, দ্বিজেন্দ্রসহ আরও বেশ কয়েকজন। জগৎজ্যোতির মৃত্যুতে মুক্তিবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। পাকসেনাদের নিয়ন্ত্রণে চলে। গেল আজমিরীগঞ্জ।
ক্যাপ্টেন মুসলিম তার বাহিনী নিয়ে ১২দিন ধরে পাকঘাটি তাহেরপুর অবরােধ করে রেখেছিলেন। দীর্ঘদিনের অবরােধে পাকসেনারা মনােবল একেবারে হারিয়ে ফেলে। এমতাবস্থায় ২৮ নভেম্বর ক্যাপ্টেন মুসলিম একটি কোম্পানি নিয়ে ভাের ৫টায় তাহেরপুর আক্রমণ করলেন। সকাল ৬টার মধ্যে তাহেরপুর শত্রুমুক্ত হয়। পাকসেনারা চরম ক্ষতি স্বীকার করে এখান থেকে পালিয়ে যায় । ৩ জন নিহতের এবং ব্যাপক সংখ্যক আহত হওয়ার খবর জানা যায়। তাহেরপুর দখলের পর এই সাব-সেক্টরের মুক্তিবাহিনী বাজিতপুর পর্যন্ত সমগ্র সুরমা এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।
নভেম্বর মাসে ৩য় বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন কমান্ডার মেজর শাফায়াত জামিল তাঁর বাহিনী নিয়ে তামাবিল এলাকায় এলেন। ডাউকি সাব-সেক্টর টুপস, এবং ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট যৌথভাবে মেজর সাফায়াত জামিলের কম্যাণ্ডে ২৯ নভেম্বর রাধানগর। আক্রমণ করে। দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা সংঘর্ষ চলার পর ৩০ নভেম্বর রাধানগর মুক্ত হয় । সংঘর্ষে ৩ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ এবং বেশ কয়েকজন আহত হয় বলে জানা যায়। অপরদিকে পাকিস্তানিদের হতাহতের সংখ্যা ব্যাপক বলে জানা যায়। মুক্তিবাহিনী এখানে একজন সুবেদারকে জীবিত ধরে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়। একই তারিখে। সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী গােয়াইনঘাটের দিকে অগ্রসর হয় এবং গােয়াইনঘাট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।
শেলা সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হেলালও তাঁর সাব-সেক্টরে ব্যাপক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিলেন। নভেম্বরের মধ্যে পাকিস্তানিদের যােগাযােগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়ক বিচ্ছিন্ন করার জন্যে সেক্টর কমান্ডার মেজর শওকত লেঃ মাহবুবুর রহমান এবং লেঃ রউফকে নির্দেশ দেন। লেঃ মাহবুব অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে তার বাহিনী নিয়ে পাগলা সেতু ধ্বংস করলেন। এখানে প্রহরারত পাকসেনাদের বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। লেঃ রউফ তার বাহিনী নিয়ে অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়েও জাওয়া রেল ও সড়কসেতু ধ্বংস করতে সমর্থ হন।
টেংরাটিলাতে ছিল পাকিস্তানিদের একটা বড়াে ঘাঁটি। টেংরাটিলা আক্রমণের পূর্বে সেক্টর কমান্ডার মেজর শওকত তাঁর বাঁশতলা সেক্টর হেডকোয়ার্টারে ২০ নভেম্বর এক কনফারেন্স আহ্বান করলেন। সভাতে টেংরাটিলা আক্রমণের বিষয় নিয়ে মেজর শওকত বিস্তারিত আলােচনা করলেন। ওই সভায় অন্যান্যের মধ্যে যারা উপস্থিত ছিল তাঁরা হলেন ক্যাপ্টেন মহসীন, ক্যাপ্টেন আকবর, ক্যাপ্টেন হেলাল, লেঃ মাহবুবুর রহমান এবং কিছুসংখ্যক এফ এফ লিডার ।
সিদ্ধান্ত অনুসারে ২৭/২৮ নভেম্বর টেংরাটিলা ‘রেকি করা হলাে। ২৯ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর ৪টি কোম্পানি টেংরাটিলার উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে ৩০ নভেম্বর নির্দিষ্ট স্থানে পৌছে নিজ নিজ প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করে। পরিকল্পনা অনুসারে ৩য় বেঙ্গল ক্যাপ্টেন মহসীন তার কোম্পানি নিয়ে ডানদিক থেকে এবং ৩য় বেঙ্গলের কোম্পানি ক্যাপ্টেন আকবরের নেতৃত্বে বা দিক থেকে মূল আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত হলেন। লেঃ মাহবুব তার কোম্পানি নিয়ে বাঁ দিকে ‘ফ্লাঙ্কগার্ড’ হিসেবে রইলেন। লেঃ রউফ রইলেন ডানদিকের ফ্লাঙ্কগার্ডে। এই অপারেশন পরিচালনার ভার নিলেন সেক্টর কমান্ডার নিজে। ৩০ নভেম্বর সকাল ৭টায় মুক্তিবাহিনী প্রথম আক্রমণ করল। পাকিস্তানিরা পাল্টা গুলি চালায়। উভয়পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে । মুক্তিবাহিনীর ধারণা ছিল চারদিক থেকে ঘেরাও করে আক্রমণ অব্যাহত রাখলে নিশ্চয়ই পাকসেনারা আত্মসমর্পণে বাধ্য হবে। কিন্তু পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষাব্যুহ এমন দৃঢ় ছিল যে মুক্তিবাহিনী কিছুতেই সামনে অগ্রসর হতে পারছিল না। অবশ্য পাকসেনারা তাদের দুর্দশার কথা অনুমান করতে পেরেছিল। আর তাই কয়েকবার তারা পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু মুক্তিবাহিনী তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। অবশেষে প্রচণ্ড গােলাগুলির মধ্যে রাতের আঁধারে তারা একটি পায়ে চলার পথে জলের ভেতর দিয়ে তাদের যাবতীয় রেশন ও গােলাগুলি ফেলে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। ৫ ডিসেম্বর রাত পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী তাদেরকে ঘেরাও করে রেখেছিল। অবশেষে টেংরাটিলা শত্রুমুক্ত হলাে।
মুক্তারপুর সাব-সেক্টর ট্রুপসও ক্রমশ সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তারা জয়ন্তিয়াপুর, ডিবিহাওর, লামাখান ইত্যাদি এলাকাতে সাফল্যের সঙ্গে পাকিস্তানিদের মােকাবেলা করে। এখানে সাব-সেক্টর কমান্ডার সুবেদার নাজির হােসেন, এফ এফ ফারুক প্রমুখের তৎপরতা ছিল বিশেষ প্রশংসনীয়।
এই সাব-সেক্টর বাহিনী রাধানগরে ৫ নভেম্বর পাকিস্তানিদের সঙ্গে এক বড়াে রকমের সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এফ এফ ফারুক এবং নায়েক সুবেদার ওহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর দুটি কোম্পানি পাকঘাটি রাধানগরের ওপর আক্রমণ চালায়। এই সংঘর্ষে ডাউকি সাব-সেক্টর ট্রুপস ৩য় বেঙ্গল এবং মিত্রবাহিনীর ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্টের কিছুসংখ্যক সৈন্য অংশ নেয়। রাধানগরে পাকিস্তানিদের ছিল সুদৃঢ় ঘাঁটি। তুমুল সংঘর্ষে মিত্র ও মুক্তিবাহিনী চরম মার খায়। মিত্রবাহিনীর মেজর এস পি সিং এবং লেফটেন্যান্ট দেবপালসহ বেশ কিছুসংখ্যক সৈনিক প্রাণ হারায়। অপরদিকে পাকিস্তানিদের হতাহতের সংখ্যাও প্রচুর বলে জানা যায় ।
মুক্তাপুর সাব-সেক্টরে সরাসরি ৬টি কোম্পানি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। যারা কোম্পানি কমান্ড করেছেন তাঁরা হলেন : নায়েক সুবেদার শামসুজ্জামান, নায়েক সুবেদার সিরাজুল হক, নায়েক সুবেদার ওহিদুল ইসলাম, নায়েক সুবেদার শাহাবুদ্দিন, এফ এফ জয়ন্তকুমার এবং এফ এফ কমান্ডার ফারুক। যারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে শহীদ হন তাঁরা হলেন হাবিলদার ইসমাইল হােসেন, নায়েক নুরুল ইসলাম, সিপাই আবদুল হালিম, মুজাহিদ মুজিবুল হােসেন, এফ এফ তাহের নুরুল ইসলাম, ইসমাইল আলী, আবদুল মজিদ, আবুল হাসেম, আবুল হােসেন, রমিজউদ্দিন, জাহাঙ্গীর আলম এবং রফিকুল হক।
পাঁচ নম্বর সেক্টর এলাকাতে তখন জোর সংঘর্ষ চলছিল। ২ ও ৩ ডিসেম্বর গােয়াইনঘাটে পাকিস্তানিদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ হলাে। ২৯ নভেম্বর ভােলাগঞ্জ। সাব-সেক্টরে ইস্টার্ন জোনের কমান্ডার লেঃ এস এম খালেদের নেতৃত্বে একটি কোম্পানি গােয়াইনঘাটের দিকে অগ্রসর হয়। অপরদিকে জেড-ফোর্সের অন্তর্ভুক্ত ৩য় বেঙ্গল লেঃ নুরুন্নবী এবং লেঃ মঞ্জুর আহমদের নেতৃত্বে দুটি কোম্পানি সরাসরি পাকঘাঁটি গােয়াইনঘাটের ওপর আক্রমণ করে। লেঃ খালেদ তাঁর বাহিনী নিয়ে রইলেন ‘কাট অফ’ পার্টি হিসেবে। পাকিস্তানিরা এখানে সুদৃঢ় ঘাঁটি করে অবস্থান করছিল । মুক্তিবাহিনীও মরিয়া হয়ে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। পাকিস্তানিরা শেষ পর্যন্ত পরাজয় স্বীকার করে। ৩ ডিসেম্বর গােয়াইনঘাট মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে । মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন আহত হলেও কেউ নিহত হয়নি। লেঃ খালেদ অপারেশন শেষে তার হেডকোয়ার্টার আমবাড়িতে ফিরে যান।
এদিকে নভেম্বরের শেষের দিকে লামনিগাঁও-এ সংঘর্ষ চলছিল। লেঃ হােসেন ৩য় বেঙ্গলের একটি প্লাটুন নিয়ে বেশ বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন। পাকিস্তানিরা লামনিগাঁওএ লে. হােসেনকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। এই সংবাদ সাব-সেক্টর। কমান্ডার লে, আখুঞ্জির নিকট পৌছলে তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর বাহিনী নিয়ে লামনিগাঁও
৭১
এর দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে পাকিস্তানিরা তাঁকে এ্যামবুশ করে। কিছুক্ষণের সংঘর্ষে পাকিস্তানিদের পক্ষে ২জন রাজাকার বন্দী এবং কয়েকজন হতাহত হয় এবং অবশিষ্টরা পালিয়ে যায়। লেঃ আখুঞ্জি দ্রুত লামনিগাঁও পৌছে পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ করেন। এই আক্রমণে পাকিস্তানিরাও লামনিগাও ছাড়তে বাধ্য হয়। লেঃ হােসেন এবং লেঃ আখুঞ্জি পরবর্তীকালে এ এলাকায় তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখেন।
ভােলাগঞ্জ সাব-সেক্টর কমান্ডার লেঃ আখুঞ্জি তার বাহিনী নিয়ে গৌরীনগর দখল করে সালুটিকর বিমান বন্দরের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। শেলা সাব-সেক্টর ট্রুপস ছাতকের ওপর আক্রমণ শুরু করে। বালাট সাব-সেক্টর বাহিনী সুনামগঞ্জ শহরের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলে। বড়ছড়া সাব-সেক্টর বাহিনী ইতােমধ্যে সাচনা থেকে ধীরাই পর্যন্ত। মুক্ত করে ফেলে।
৪ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর এক ডিভিশন সৈন্য সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে করিমগঞ্জ থেকে মৌলভীবাজার হয়ে পূর্ব দিক থেকে সিলেটের পথে অগ্রসর হতে থাকে। অপরদিকে উত্তর ও পশ্চিম দিক থেকে পাঁচ নম্বর সেক্টর ট্রুপস সিলেটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বালাট সাব-সেক্টরের ট্রুপস ৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ শহর দখল করে নেয় । ওই দিন ছাতকের ওপরও তীব্রভাবে আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনী। সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল শওকত তৃতীয় বেঙ্গলের ২টি কোম্পানি এবং শেলা সাব-সেক্টর ট্রপস নিয়ে ছাতক আক্রমণ করেন। ৭ ডিসেম্বর রাত ৮টায় ছাতক শহর মুক্ত হয়। পাকসেনারা পালিয়ে গােবিন্দগঞ্জে আশ্রয় নেয়। এদিকে মেজর শাফায়াত জামিল ৩য় বেঙ্গলের ২টি কোম্পানি নিয়ে ডাউকি সাব-সেক্টর টুপসসহ রাধানগর নিয়ন্ত্রণে এনে গােয়াইনঘাট হয়ে। সালুটিকর বিমানবন্দরের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন।
৯ ডিসেম্বর সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল শওকত গােবিন্দগঞ্জ আক্রমণ করলেন। পাকসেনারা গােবিন্দগঞ্জ ছেড়ে নদী পেরিয়ে লামাকাজীতে প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তােলে। এমতাবস্থায় কর্নেল শওকত মিত্রবাহিনীর জেনারেল গিলের কাছে বিমান সাহায্য চাইলেন । ১২ ডিসেম্বর ভারতীয় ৩টি মিগ বিমান লামাকাজী পাক অবস্থানের ওপর বােমাবর্ষণ করে। এরপরই মুক্তিবাহিনী লামাকাজী দখলের জন্যে অগ্রসর হতে চাইলে মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে কর্নেল শওকতকে জানানাে হয় তুমি এখানেই থাকো। সামনে অগ্রসর হলে সেম-সাইড হতে পারে। সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল শওকত তার বাহিনী নিয়ে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওখানেই রইলেন। কর্নেল শওকত সামনে অগ্রসর হতে না পেরে তাঁর কিছু সৈনিককে বিশ্বনাথে পাঠিয়ে দিলেন। উক্ত বাহিনী বিশ্বনাথ দখল করে ১৫ ডিসেম্বর। সিলেটে পাকসেনারা যৌথ কম্যাণ্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করল।
তথ্য নির্দেশ
১. সাক্ষাৎকার : ব্রিগেডিয়ার (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত লেঃ জেনারেল মীর শওকত আলী, বীর
উত্তম।
২. পূর্বোক্ত।
৩. সাক্ষাৎকার : মেজর মুসলিমউদ্দিন (অব:)।
ছয় নম্বর সেক্টর
রংপুর ও দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও মহকুমা নিয়ে গঠিত হয় ছয় নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরের বৈশিষ্ট্য : সেক্টর ও সাব-সেক্টরের অবস্থানগুলাে বাংলাদেশের মাটিতেই গড়ে ওঠে। সেক্টরের বিস্তীর্ণ এলাকা প্রায় ৬০০ বর্গমাইল যা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কোনাে অবস্থাতেই ছিনিয়ে নিতে পারেনি। বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানী উইং কমান্ডার এম কে বাশারকে জুন মাসেই এই সেক্টরের দায়িত্ব অর্পণ করেন। উইং কমান্ডার বাশার তার সেক্টর এলাকাকে কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করেন :
১. ভজনপুর সাব-সেক্টর : কমান্ড করেছেন ক্যাপ্টেন নজরুল, স্কোয়াড্রন লিডার সদরউদ্দিন এবং সব শেষে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা অফিসার ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার।
২. পাটগ্রাম সাব-সেক্টর : প্রাথমিক পর্যায়ে ইপিআর-এর জুনিয়র কমিশন অফিসারগণই কমান্ড করেছেন। পরবর্তীকালে ক্যাপ্টেন মতিয়ুর রহমান এই সাব-সেক্টরের দায়িত্ব নেন। এই সাব-সেক্টর এলাকাতে পাকিস্তানিদের মজবুত ঘাঁটি ছিল বড়খাতাতে।
৩. সাহেবগঞ্জ সাব সেক্টর : কম্যাণ্ডিং অফিসার ছিল ক্যাপ্টেন নওয়াজেশউদ্দিন। এই সাব-সেক্টরের সম্মুখভাগে শত্ৰু-ঘাঁটি ছিল ভুরুঙ্গামারীতে।
৪. মােগলহাট সাব-সেক্টর : কমান্ড করেছেন ক্যাপ্টেন দেলওয়ার ।
৫. চিলহাটী সাব-সেক্টর : কমান্ড করেছেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ইকবাল।
জুন মাসে উইং কমান্ডার বাশার যখন সেক্টরের দায়িত্ব নেন তখন সেক্টরের সৈন্যসংখ্যা ছিল ৭০০-র মতাে এবং সৈন্য সংখ্যার প্রায় সবই ছিল ইপিআর বাহিনীর সদস্য। ডিসেম্বর পর্যন্ত সেক্টরের সৈন্যসংখ্যা দাঁড়ায় মােট ১১ হাজারের মতাে। মােট সৈন্যসংখ্যার ১০০০ ছিল ইপিআর বাহিনীর সদস্য। ৭০০-র মতাে আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ এবং অবশিষ্ট ছিল গণবাহিনী। সমগ্র সেক্টর এলাকাতে ৩৫টির মতাে গেরিলা বেইস গড়ে ওঠে। এ ছাড়া পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কিছুসংখ্যক স্থল, নৌ এবং বিমান বাহিনীর সদস্য যােগদান করেছিলেন। অবসরপ্রাপ্ত এবং ছুটি ভােগরত কিছু সৈনিকও ছিলেন।
সেক্টর হেড কোয়ার্টার ছিল পাটগ্রামের নিকট বুড়ীমারীতে । এই সেক্টরের অফিসারদের প্রশিক্ষণের জন্যে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খােলা হয়। প্রথম দলেই ৬৫ জন।
৭৩
অফিসার কমিশন লাভ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এই দলের পর ৬৫ জন অফিসার অর্তি হয়েছিল কিন্তু তারা স্বাধীনতার পর কমিশনপ্রাপ্ত হন।
ছয় নম্বর সেক্টরে ইপিআর বাহিনীর প্রাধান্য ছিল ব্যাপক। রংপুর, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর এবং সেক্টরের ই পি আর টুপস যথাক্রমে সাহেবগঞ্জ এবং ভজনপুরে মজবুত প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তােলে। পাকিস্তানিরা মে মাসের প্রথম দিকেই সীমান্ত এলাকার কিছু কিছু অংশ বাদ দিয়ে প্রায় সমগ্র এলাকাতেই তাদের আধিপত্য বিস্তার করেছিল। ইপিআর ট্রপস পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ, অ্যামবুশ করে তাদেরকে নাজুক অবস্থায় ফেলে দিল । মুক্তিবাহিনী প্রথমেই দু’টি সাব-সেক্টর গড়ে তুলল : এক, সাহেবগঞ্জ, দুই, ভজনপুর। রংপুর ১০নং ই পি আর উইং-এর সৈনিকরা অবস্থান নিলাে সাহেবগঞ্জে এবং এর কম্যাণ্ডে ছিল ওই উইং-এর সহকারী উইং কমান্ডার ক্যাপ্টেন নওয়াজেশউদ্দিন। ৯নং উইং-এর ইপিআর বাহিনী প্রথমে তেঁতুলিয়ায় এবং পরে ভজনপুরে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি প্রস্তুত করে। প্রাথমিক পর্যায়ে ইপিআর জেসিও-গণই কমান্ড করছিলেন। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে উইং কমান্ডার এম কে বাশার সেক্টরের দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি একে একে পুরাে সেক্টর এলাকা ঘুরলেন, অভাব-অভিযােগ শুনলেন, দেখলেন যুদ্ধের সুবিধা অসুবিধা । সেক্টর কমান্ডার বাশার বাহিনীকে সুশৃঙ্খল এবং সুসংগঠিত করে একটি কার্যকর সুদক্ষ বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হলেন।
প্রাথমিক পদক্ষেপেই ভজনপুর সাব-সেক্টরের প্রায় ৩ মাইল সামনে দুটি পােস্ট খােলা হলাে। একটি মাগুরমারী এবং অপরটি ময়নাগড়িতে। পাকসেনাদের ঘাঁটি ওমরখানা সামনে রেখে সুবেদার হাজী মুরাদ আলী একটি কোম্পানি নিয়ে ডিফেন্স নিলেন। সুবেদার মুরাদ তাঁর বাহিনী নিয়ে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখলেন। মাগুরমারীতে নায়েক সুবেদার বদি এবং নায়েক সুবেদার গােফরানও তাঁদের প্লাটুন নিয়ে ডিফেন্স নিলেন। ময়নাগড়িতে নায়েক সুবেদার মতি তাঁর প্লাটুন নিয়ে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখলেন।
জুলাই মাসের প্রথমে স্কোয়াড্রন লিডার সদরউদ্দিন এই সেক্টরে এলে তাকে ভজনপুর এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হলাে। ক্যাপ্টেন নজরুলকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হলাে। সাব-সেক্টরটিকে পুনরায় ঢেলে সাজানাে হলাে। সুবেদার হাফিজের নেতৃত্বে একটি কোম্পানিকে কাগমারা-ওমরখানা এলাকাতে, নায়েক সুবেদার খালেকের নেতৃত্বে একটি কোম্পানিকে সাহেবজুট, বেরাজুট এলাকায় এবং নায়েক সুবেদার মুরাদ আলীর নেতৃত্বে একটি কোম্পানিকে নছরাপাড়া এলাকাতে ডিফেন্স নিতে বলা হলাে। ওইসব ডিফেন্স থেকে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর সম্মুখ-সমর পরিহার করে গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ এবং অ্যামবুশ শুরু করে। ১৫ জুলাই সেক্টর কমান্ডার বাশার ক্যাপ্টেন সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খানকে সঙ্গে নিয়ে সাব-সেক্টরে হেড কোয়ার্টার দেবনগর আসেন। ১৮ জুলাই ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার এই সাব-সেক্টরটির দায়িত্ব নেন। ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে বাংলার মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। অকুতােভয়, নির্ভীক, সদালাপী ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার ট্রপস-এর নিকট অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। বর্তমান বাংলাদেশ রাইফেলস্-এর ৯ম শাখার সদস্যগণ এক পুস্তিকায় তাঁর সম্পর্কে বলেছেন,
৭৪
“তাঁর উপস্থিতিতে আমাদের মুক্তিসংগ্রাম অভূতপূর্ব এক নতুন মােড় নিলাে। তাঁর যাদুস্পর্শে সঞ্জীবিত হয়ে উঠলাে আমাদের সুপ্ত সাব-সেক্টর। অকুতােভয় এবং অপরাজেয় মনােবলের অধিকারী, নিবেদিতপ্রাণ খাটি বাংলা মায়ের সন্তান তিনি। নিমেষে খাপ খাইয়ে নিলেন নিজেকে বাংলার কাদা-মাটির সঙ্গে। অনেকের মতাে নাক সিটকিয়ে ঐ কুচকিয়ে ভড়ং দেখাননি তিনি। এসেই সমস্ত ডিফেন্স এরিয়া ঘুরে প্রত্যেকটি সৈনিকের সঙ্গে দেখা করলেন। তাদেরকে বিভিন্নভাবে সান্ত্বনা ও উৎসাহ দান করলেন। সৈনিকরা তাঁর পরশে নতুন করে আশার আলাে দেখতে পেলাে।”
২৮ জুলাই পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধানপাড়া, ডাঙাপাড়া এবং নুনিয়াপাড়া গ্রামে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর হঠাৎ আক্রমণ করে। ওই এলাকায় সুবেদার হাফিজ তার কোম্পানি নিয়ে অবস্থান করছিলেন। পাকিস্তানিদের অকস্মাৎ আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। পাকসেনারা আক্রমণ চালিয়ে তাদের চাওই নদী তীরের মূল ঘাঁটিতে ফিরে আসে।
৭ সেপ্টেম্বর ভজনপুর সাব-সেক্টর ট্রুপস পাকঘাটি জগদলহাট আক্রমণ করে তা দখল করে। কিন্তু পাকিস্তানিদের পাল্টা আক্রমণে মুক্তিবাহিনীকে জগদলহাট ছেড়ে দিতে হয়। মুক্তিবাহিনী সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত তেমন কোনাে সাফল্য অর্জন করতে না পারলেও তারা চাওই নদীর তীর পর্যন্ত এলাকা তাঁদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়।
সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নওয়াজেশউদ্দিন তাঁর এলাকাতে তৎপরতা অব্যাহত রাখলেন। ৮ আগস্ট ফুলবাড়ি, ১৩ আগস্ট ভুরুঙ্গামারী, ও ১৫ আগস্ট আলীপুর থানা ইত্যাদি এলাকাতে মুক্তিবাহিনী ক্রমাগত আঘাত হানল।
সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নওয়াজেশউদ্দিন ন’মাসে যে তৎপরতা দেখিয়েছেন তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশউদ্দিন-এর নির্দেশে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানিদের ওপর ব্যাপকভাবে হামলা চালিয়ে তাদেরকে দারুণভাবে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল।
৪ সেপ্টেম্বর সুবেদার মেজর আলীর কম্যাণ্ডে মুক্তিবাহিনী নাগেশ্বরীতে পাকসেনাদের ওপর ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে ৫ জন পাকসেনাকে হত্যা করে। মুক্তিবাহিনী উল্লেখযােগ্য অস্ত্রের মধ্যে এই সংঘর্ষে ৩ ইঞ্চি মর্টার ব্যবহার করেছিল । মুক্তিবাহিনীর পক্ষে কোনাে ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ জানা যায়নি।
এই সেক্টরের পাঁচটি সাব-সেক্টরেই মুক্তিবাহিনী সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত পাকিস্তানিদের বিভিন্ন ঘাঁটির ওপর আক্রমণ, অ্যামবুশ, সড়ক ও সেতু ধ্বংসের কাজ অব্যাহত রাখলেও তারা তেমন বড়াে রকমের সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। অবশ্য কারণও ছিল প্রচুর। ব্যর্থতার কারণস্বরূপ অস্ত্রশস্ত্রের অভাব, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিকের অভাব, জেসিও এবং অফিসারদের অদূরদর্শিতা ইত্যাদির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
অক্টোবর মাসের গােড়া থেকেই এই সেক্টরের মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বড়াে রকমের আক্রমণ পরিচালনার জন্য প্রস্তুত হলে কৌশলগত পন্থাও কিছুটা পরিবর্তিত হলাে।
১৪ অক্টোবর কমান্ডার মেজর নওয়াজেশউদ্দিন-এর কম্যাণ্ডে একই সঙ্গে ভুরুঙ্গামারী এবং জয়মনিরহাটে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানিদের এক ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পরিকল্পনানুসারে সুবেদার আবদুল ওহাবকে তাঁর বাহিনী নিয়ে মিত্র বাহিনীর আর্টিলারি সাপাের্টে পাকঘাটির সম্মুখভাগে সরাসরি চার্জ করতে বলা হলাে । হাবিলদার সােনা মিয়াকে এক প্লাটুনের কিছু বেশি সৈন্য নিয়ে সম্মুখভাগে থাকতে বলা হলাে। ফাইটিং পেট্রোল পার্টি হিসেবে সুবেদার শামসুল হককে ৭০ জন মুক্তিযােদ্ধা দিয়ে সুবেদার ওহাবের পেছনে রাখা হলাে রিয়ার পার্টি হিসেবে। জয়মনিরহাট এবং রায়গঞ্জের মাঝে সিএণ্ডবি সড়কে ‘কাট-অফ পার্টি হিসেবে ২০ জনের একটি মুক্তিযােদ্ধার দলকে রাখা হলাে নায়েক আজহার আলীর নেতৃত্বে। মুজাহিদ অধিনায়ক আজিজের নেতৃত্বে একটি প্লাটুন সিএণ্ডবি সড়কে রামগঞ্জ এবং নাগেশ্বরীর মধ্যস্থলে কাট-অফ পার্টি হিসেবে ডিফেন্স নিল। প্রায় ২০০ মুক্তিবাহিনী সদস্য নিয়ে সুবেদার মাযহারুল হককে জয়মনিরহাট আক্রমণ করতে বলা হলাে। সুবেদার আরব আলীকে রাখা হলাে মাযহারুল হকের সাহায্যের জন্য। প্ল্যান মাফিক মুক্তিবাহিনী ১৩ অক্টোবর রাত ১২টার দিকে যথাযথ স্থানে পৌছে গেল। রাত একটার দিকে (১৪ অক্টোবর) মুক্তিবাহিনী ভুরুঙ্গামারী এবং জয়মনিরহাটে ব্যাপকভাবে হামলা চালাল পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর। মিত্রবাহিনীর আর্টিলারির ফায়ার শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ঝাপিয়ে পড়ে। উভয় পক্ষের তুমুল সংঘর্ষ ১৪ তারিখ সকাল ৭টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। উভয় স্থানেই চরম মার খায় পাকিস্তানিরা। ভুরাঙ্গামারী ও জয়মনিরহাট মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। পাকিস্তানিদের কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার ছাড়াও ২৫তম পাঞ্জাবের ৮ জন সৈন্যসহ একজন আর্টিলারির ক্যাপ্টেন মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দী হয় । মেজর নওয়াজেশের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও যােগ্য পরিচালনায় মুক্তিবাহিনীর এই সাফল্য ঘটে। এরপর পাকসেনারা পালিয়ে রায়গঞ্জে পুনরায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলে। মুক্তিবাহিনীর এই বিজয়ের পর এই সেক্টরের ৬০০ বর্গমাইল এলাকা মুক্ত বলে ঘােষণা করা হয়।
অপরদিকে ভজনপুর সাব-সেক্টরে ট্রুপস চাওই নদীর তীর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলল । ৯ অক্টোবর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার লেঃ আবদুল মতিন চৌধুরী এবং লেঃ মাসুদুর রহমান এই সাব-সেক্টরে যােগদান করলেন। এই এলাকায় পাকিস্তানিদের চলাচল অচিরেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তারা মুক্তিবাহিনীকে রীতিমতাে ভয় করতে থাকে। এই সাব-সেক্টর বাহিনী তেঁতুলিয়া, ঠাকুরগাঁও এবং সৈয়দপুর পাকা সড়ককে অক্ষরেখা ধরে ওমরখান পাকঘাটির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে পিছু হটে পঞ্চগড়ে ডিফেন্স নেয়।
ছয় নম্বর সেক্টরে নভেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনী বেশকিছু অপারেশন চালায়। মুক্তিবাহিনী আক্রমণ অব্যাহত রেখে ২৭ নভেম্বর পঞ্চগড় থেকে পাকসেনাদের বিতাড়িত করে পঞ্চগড় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।
৭৬
পাটগ্রাম সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন রহমানের নির্দেশ ১৯ নভেম্বর সাব-সেক্টর ট্রপস পাকিস্তানিদের সুদৃঢ় ঘাঁটি বড়খাতা আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে তারা ডিফেন্স ছেড়ে হাতীবান্ধা নামক স্থানে পুনরায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলে। নভেম্বর মাসের শেষের দিকে মুক্তিবাহিনীর তিনটি কোম্পানি তিন দিক থেকে একযােগে হাতীবান্ধা আক্রমণ করে। তিনটি কোম্পানির দু’টিতে দুজন ইপিআর জেসিও এবং অপরটিতে কমান্ডার ক্যাডেট ফারুক যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এই আক্রমণে পাকসেনারা বেশিক্ষণ টিকতে পারল না। তারা পেছনে সরে ভােটমারী হয়ে পাকাপাকিভাবে লালমনিরহাটে অবস্থান নেয়।
চিলাহাটি সাব-সেক্টর কমান্ডার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ইকবাল তার বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি নভেম্বর মাসেই ডিমলা নামক স্থান পর্যন্ত দখল করতে সমর্থ হন। পাকসেনারা ডিমলা ছেড়ে নীলফামারীতে এসে অবস্থান নেয়। তাদের এই ঘাঁটি থেকে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ছিল মাত্র ৪/৫ মাইল দূরে।
মােগলহাট সাব-সেক্টরে ট্রপস-এর ক্যাপ্টেন দেলওয়ারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল নভেম্বর মাসের শেষের দিকে পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি লালমনিরহাট থেকে মাত্র ৪ মাইল দূরে অবস্থান করতে থাকে।
সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টর বাহিনীর মেজর নওয়াজেশউদ্দিনের কম্যাণ্ডে ১৮ নভেম্বর পাক অবস্থান রায়গঞ্জ আক্রমণ করা হয় । প্রচণ্ড সংঘর্ষের মধ্যে রায়গঞ্জ মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে এলেও মুক্তিবাহিনীর তরুণ অফিসার লেঃ আব্দুস সামাদসহ বেশ কিছু সংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা প্রাণ হারায়। অপরদিকে পাকিস্তানিদের হতাহতের সংখ্যা সঠিক জানা না গেলেও তাদের নিহতের সংখ্যা ২০ জনের কম ছিল না। এই বাহিনী ৩০ নভেম্বরে মুক্তিবাহিনীর নাগেশ্বরীর ও পাটেশ্বরীর ধরলা নদীর ঘাট পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আনতে সমর্থ হয়। পাকসেনারা ধরলা নদীর অপর পাড়ে কুড়িগ্রামকে আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করে।
ছয় নম্বর সেক্টর ট্রুপস ডিসেম্বরের গােড়াতেই দ্রুতগতিতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিবাহিনী ৫ ডিসেম্বর ধরলা নদী অতিক্রম করে কুড়িগ্রাম পৌছে। পাকসেনারা কুড়িগ্রাম ছেড়ে লালমনিরহাট চলে যায়। সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর নওয়াজেশ ৬ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে বেসামরিক প্রশাসন চালু করার নির্দেশ দেন। ১০ ডিসেম্বর এই সাব-সেক্টর ট্রুপস আরও অগ্রসর হয়ে তিস্তা নদীর পাড়ে অবস্থান নেয়। পাটগ্রাম সাব-সেক্টর ট্রুপসও এই তারিখে তিস্তা নদীর পাড়ে অবস্থান নেয়। মুক্তিবাহিনী আরও অগ্রসর হয়ে বীরগঞ্জ, ভাতগাঁও ইত্যাদি এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী খানসামা নামক স্থান থেকে ডিসেম্বরের ৯/১০ তারিখে মুক্তিবাহিনীর ওপর মরিয়া হয়ে চড়াও হয়। মিত্রবাহিনীর ৩৩ নং কোরের সৈন্যবাহিনী ৬০ টি মাঝারি কামান, জঙ্গী বিমান, ট্যাঙ্ক বহর, হেলিকপ্টার ইত্যাদি সহযােগে। ব্যাপকভাবে আক্রমণ চালায়। যৌথবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে নিদারুণ ক্ষতি স্বীকার করে পেছনে সরতে বাধ্য হয় পাকিস্তানিরা। তারা পেছনে সরে নীলফামারীতে চলে যায়। এদিকে পাকিস্তানিরা ভাতগাঁও থেকেও পিছু হটে সৈয়দপুরে আশ্রয় নেয়।
૧૧
অপরদিকে তিস্তার পাড়ে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর সাহেবগঞ্জ এবং পাটগ্রাম সাবসেক্টর ট্রপস এবং মােগলহাট সাব-সেক্টর বাহিনী সম্মিলিতভাবে লালমনিরহাট আক্রমণ করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। চিলহাটি সাব-সেক্টর ট্রুপস ডােমার নীলফামারী হয়ে সৈয়দপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে ।
১২ ডিসেম্বরের মধ্যে একমাত্র রংপুর ও সৈয়দপুর সেনানিবাস ছাড়া সমগ্র সেক্টরটি মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কেবল আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানটি ১৭/১৮ ডিসেম্বরে সম্পন্ন হয়। দৈনিক বাংলায় এক সাক্ষাৎকারে সেক্টর কমান্ডার এম কে বাশার বলেছেন, “১৬ ডিসেম্বরেই আত্মসমপর্ণ হতে যাচ্ছে তা সেদিন আমরা আগে আগেই আন্দাজ করেছিলাম। আমাদের রেডিও ইকুপমেন্ট যা ছিল ১৬ তারিখ সকালে আমরা বেশিরভাগ অফিসারই তার পাশে বসে গিয়েছিলাম। পাকিস্তানিদের বেতার যােগাযােগকে আমরা ইন্টারসেপ্ট’ করতাম। সেদিন সকাল সাড়ে নটার দিকে এমনিভাবে শুনতে পেলাম মেসেজ দেয়া হচ্ছে। পাকিস্তানি হাই কমান্ড থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তােমরা সবাই ডিফেন্সিভ পজিশন ছেড়ে এক জায়গায় একত্রিত হয়ে যাও, সারেণ্ডার হতে যাচ্ছে। শুধু যেখানে একত্রিত হবে সেখানে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নাও।”
..তারা ভাবছিলাে ভারতীয় বাহিনী তেমন কিছু তাদের করবে না—কিন্তু মুক্তিবাহিনী পেলে তাদের একেবারে নাস্তানাবুদ কিংবা খতম করে দেবে। তাই মেসেজ বলা হচ্ছিলাে মুক্তিকো খেলাপ পজিশন লে লাে। সব একাটা ঠা হাে যাও। সারেণ্ডার হােনে বােলা হ্যায়।”
সেক্টর কমান্ডার এম কে বাশার ডিসেম্বর থেকে রণাঙ্গনে তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে বলেছেন, “৩রা ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় আমাদের সম্মিলিত কার্যক্রম। আমরা কয়েকটি পথে এগিয়ে যাই। যাকে বলে একসেস অব এডভান্স’। ঠাকুরগাঁও থেকে মূল সড়ক দিনাজপুর হয়ে রংপুরের ভেতর দিয়ে চলে এসেছে। মূল সড়কের ডান দিকে ছিল মুক্তিবাহিনী এবং বাম দিকে ছিল ভারতীয় বাহিনীর পজিশন। আমরা এভাবেই বরাবর অগ্রসর হয়ে দিনাজপুর ও রংপুর পর্যন্ত পৌঁছেছি।
আমরা পরিকল্পনা করতাম সম্মিলিতভাবে, মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর কমাণ্ডারদের কী কাজ তা ঠিক করে নেওয়া হতাে। পরিকল্পনা হতাে সম্মিলিতভাবে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী একযােগে অথবা পৃথকভাবে অপারেশন করতাম এবং কাজে সমন্বয় রাখা হতাে দুই বাহিনীর ভেতর। “টাক কমপ্লেশন’ রিপাের্ট পাওয়ার পরে আমরা সেখানে আবার ডিফেন্সিভ পজিশন নিয়ে নতুন পরিকল্পনা বানিয়ে আবার অগ্রসর হতাম । ছয় নম্বর সেক্টরে আমরা এবং মিত্রবাহিনী সম্মিলিত হয়ে এভাবেই যুদ্ধ করেছি। কাজেই একথা বলা ভুল হবে, শুধু মুক্তিবাহিনী বা ভারতীয় বাহিনী পৃথকভাবে অগ্রসর হয়ে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। সম্মিলিতভাবে পাশাপাশি আমরা এগিয়ে গেছি।’১
তথ্য নির্দেশ।
১. দৈনিক বাংলা, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭২-এ প্রকাশিত এয়ার কমােডর (পরে এয়ার ভাইস মার্শাল) এম কে বাশারের সাক্ষাৎকার ।
৭৮
সাত নম্বর সেক্টর
সাত নম্বর সেক্টর এলাকা ছিল রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া জেলা এবং দিনাজপুর জেলার দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে । ই পি আর বাহিনীর নওগাঁওতে অবস্থানরত সাত নম্বর উইং, চাঁপাই নবাবগঞ্জে অবস্থানরত ৬নং উইং, দিনাজপুরে অবস্থানরত ৮নং উইং এবং দিনাজপুর ও রাজশাহী সেক্টর হেড কোয়ার্টারের অধিকাংশ ট্রপস এই সেক্টরে যুদ্ধ করেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ৩য় বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন আনােয়ার সেক্টরটির পুনর্গঠনে প্রশংসীয় ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানীর নির্দেশে ই পি আর ৭নং উইং কমান্ডার মেজর নজমুল হক সেক্টরের দায়িত্ব নেন। প্রবীণ সুবেদার মেজর এ রবও কিছুদিন সেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন ।
দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মেজর নজমুল হক একটি কনফারেন্স শেষে ফেরার পথে রাতে এক মােটর দুর্ঘটনায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। মােটরগাড়িটি মেজর নজমুল হক নিজেই ড্রাইভ করছিলেন। মেজর নজমুল হকের আকস্মিক মৃত্যুর পর সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয় অবসরপ্রাপ্ত মেজর কিউ এন জামানকে। যুদ্ধকালীন অবস্থায় মেজর জামানকে লেঃ কর্নেল পদে উন্নীত করা হয়। এবং তিনিই ডিসেম্বর পর্যন্ত সাত নম্বর সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৪ জুন বাংলাদেশ উর্ধ্বতন সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মেজর শাফায়াত জামিল এই সেক্টরে এলেন সৈন্য সংগ্রহের জন্যে। শাফায়াত জামিল ইপিআর বাহিনীর ৫ শতাধিক সদস্যকে ৩য় বেঙ্গলের অন্তর্ভুক্ত করে পুরােপুরি এক ব্যাটালিয়নে রূপান্তরিত করলেন। এই তৃতীয় বেঙ্গলই ‘জেড’ ফোর্সের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
সাত নম্বর সেক্টরের বিস্তৃত এলাকাকে কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয় :
১. মালন সাব-সেক্টর : বস্তুত ইপিআর জেসিও-গণই সাব-সেক্টরটি কমান্ড করেন।
২. তপন সাব-সেক্টর : প্রাথমিক পর্যায়ে সেক্টর কমান্ডার মেজর নজমুল হক দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে ই পি আর, জেসিওদের কম্যাণ্ডে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে যুদ্ধ পরিচালিত হয়।
৩. মােহদীপুর সাব-সেক্টর : প্রাথমিক পর্যায়ে সুবেদার ইলিয়াস সাব-সেক্টরটি কমান্ড করেন। পরবর্তীকালে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (শহীদ)।
৪. ভােলাহাট সাব-সেক্টর : লে. রফিকুল ইসলাম এই সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন।
৫. হামজাপুর সাব-সেক্টর : কমান্ডার ছিল ক্যাপ্টেন ইদ্রিস। ক্যাপ্টেন ইদ্রিস পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দালালদের কাছে টেরর’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
৬, আংশিনাবাদ সা-সেক্টর : জনৈক গণবাহিনীর সদস্য মিত্রবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কমান্ড করেছেন।
৭. ঠোকরাবাড়ি সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিল সুবেদার মােয়াজ্জেম।
৮. লালগােলা সাব-সেক্টর : ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী সাব-সেক্টরটি কমান্ড করেন। এছাড়া ভােলাহাট-ছােবরা এবং হিলিতে মুক্তিবাহিনীর পকেট’ ছিল। সেক্টর হেড কোয়ার্টার ছিল তরঙ্গপুরে। প্রায় পনেরাে হাজার মুক্তিযােদ্ধা এই সেক্টরে যুদ্ধ করে। মােট বাহিনীর মধ্যে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় দুই হাজার পাঁচ শত এবং অবশিষ্ট সাড়ে বারাে হাজার ছিল গণ-বাহিনী। উল্লেখ্য যে, নিয়মিত বাহিনী বলতে ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ, সেনা ও বিমান বাহিনীর সম্মিলিত সদস্যকে ধরা হয়েছে। এই সেক্টরটি মিত্রবাহিনীর ব্রেভাে সেক্টরের তত্ত্বাবধানে ছিল। মিত্রবাহিনীর কমান্ডার ছিল ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিংহ এবং ব্রিগেডিয়ার মেজর ছিল শ্রী বি বি ব্যানার্জী।
সাত নম্বর সেক্টর বিপর্যস্ত অবস্থা কাটিয়ে ক্রমান্বয়ে একটি সুসংবদ্ধ সেক্টরে রূপলাভ করে। এই সেক্টরের অধীনে প্রতিটি সাব-সেক্টর ট্রুপস মে মাস থেকে পাক অবস্থান খঞ্জনপুর, সাপাহার, নিদপুর, পত্নীতলা, ধামরহাট, পার্শীপাড়া, ইসলামপুর, গােদাগাড়ি, শাহপুর, চারঘাট, মীরগঞ্জ, আলাইপুর, সারদা পুলিশ একাডেমী, কাটাখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পুটিয়া, দুর্গাপুর, লালপুর, তাহেরপুর ইত্যাদি এলাকার ওপর আক্রমণ, অ্যামবুশ অব্যাহত রেখে পাকিস্তানীদের মনে ভীতির সঞ্চার করে এবং সর্বদা ব্যতিব্যস্ত করে রাখে।
১৮ জুন মুক্তিবাহিনী দিনাজপুর জেলার ঠনঠনিয়াপাড়া নামক স্থানে পাক অবস্থানের ওপর এক বড়াে রকমের হামলা চালায়। এই অপারেশনে সেক্টর কমান্ডার মেজর নজমুল হক নিজে রণাঙ্গনে কমান্ড করেন। ভারতীয় সীমান্ত থেকে ৩০০ গজের মতাে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এই ঠনঠনিয়াপাড়াতে পাকবাহিনীর একটি কোম্পানি ছিল। ১৭ জুন রাতে মেজর নজমুল হক একটি কোম্পানি নিয়ে গন্তব্যস্থলের দিকে রওয়ানা হন। কোম্পানিটি দুটি কলামে বিভক্ত হয়ে একটি সম্মুখভাগ আক্রমণের জন্যে মেজর নজমুল হকের নেতৃত্বে এবং অপর কলামে সুবেদার মেজর রবের নেতৃত্বে বিরল। ঠনঠনিয়া সড়কের ১৫০ গজের মতাে বামে কাট অফ পার্টি হিসেবে ডিফেন্স নিল। সিদ্ধান্ত হলাে মিত্রবাহিনীর ১১তম গুর্খা রেজিমেন্ট পাক অবস্থানের ওপর কিছুক্ষণ মর্টার শেলিং করবে। শেলিং শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেজর নজমুল হক পাক ঘাঁটির ওপর
সরাসরি চার্জ করবেন। সুবেদার মেজর রব তাঁর কলাম নিয়ে দিনাজপুর থেকে পাকিস্তানি সাহায্যকারী সেনাদের বাধা দেবেন এবং প্রয়ােজনে ঠনঠনিয়াপাড়া থেকে পাকসেনারা পালাবার চেষ্টা করলে তাদেরকেও অ্যামবুশ করবেন। ১৭/১৮ জুন রাতে পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তিবাহিনী মেজর নজমুল হকের নেতৃত্বে স্ব স্ব অবস্থানে পৌছে গেল । রাত ১১টার দিকে মিত্রবাহিনীর ১১তম গুর্খা রেজিমেন্ট পাক অবস্থানের ওপর শেলিং শুরু করে। প্রায় দু’ঘণ্টা উভয়পক্ষে শেলিং অব্যাহত থাকে। শেলিং বন্ধ হবার। পর পরই মেজর নজমুল হক তার বাহিনী নিয়ে পাক ঘাঁটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন । ৩০ মিনিটের ভয়াবহ সম্মুখযুদ্ধে ১৫ জন পাকসেনা খতম হয় এবং আহত হয় ২০ জন। চরমভাবে মার খেয়ে অবস্থান ছেড়ে পেছনে সরে যেতে বাধ্য হয় পাকসেনারা। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ১জন নিহত এবং ২জন আহত হয়। ঠনঠনিয়াপাড়া মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে এলেও মুক্তিবাহিনী সেখানে অবস্থান না করে মূল ঘাঁটিতে ফিরে যায়। এই সংঘর্ষে পাকসেনাদের প্রত্যাঘাত এতােই ব্যাপক ছিল এবং মেজর নজমুল হক তার বাহিনী নিয়ে পাক-বিবরের এতাে অভ্যন্তরে ঢুকেছিলেন যে, অনেকেই মেজর নজমুল হক ও তাঁর বাহিনীর অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়েছিলেন। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, ওই চরম গুলিবৃষ্টির মধ্যেও সম্পূর্ণ অক্ষত দেহে মেজর নজমুল হক তাঁর টুপস নিয়ে নিজের ঘাঁটিতে ফিরে আসেন।
৪/৫ জুলাই মেজর হকের কম্যাণ্ডে মুক্তিবাহিনীর একটি দল কাঞ্চন সেতুর উপর পাকিস্তানিদের সঙ্গে আরেকটি বড় রকমের সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সুবেদার মেজর রব পাক অবস্থান কাঞ্চন সেতু এলাকা রেকি করে এলেন। কাঞ্চন সেতুর নিচে পাকসেনাদের অবস্থান চিলাে অত্যন্ত সুদৃঢ়। সেক্টর কমান্ডার মেজর নজমুল হক নিজেই একটি দল নিয়ে জুলাইয়ের ৪/৫ তারিখে রাত দেড়টায় পাক অবস্থানে আক্রমণ করেন। আড়াই ঘণ্টা ধরে উভয়পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ হল। মুক্তিবাহিনী ২ ইঞ্চি মর্টার, এল এম জি, এস এল আর ইত্যাদির ব্যবহার করল। কিন্তু পাকসেনাদের ঘাঁটি থেকে কিছুতেই সরানাে গেল না। উপরন্তু পাকসেনাদের আক্রমণ ক্রমান্বয়ে এত তীব্র হতে থাকে যে মুক্তিবাহিনীকে পেছনে সরে যেতে হয়। ওই দিনের সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। পাকসেনাদের ক্ষয়ক্ষতির সংবাদও পাওয়া গেল না।
সাত নম্বর সেক্টরে মােহদীপুর সাব-সেক্টরের অধীন চাঁপাই নবাবগঞ্জ মহকুমার শিবগঞ্জ থানার অন্তর্গত কলাবাড়ি নামক স্থানে ১০ আগস্ট মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাক বাহিনীর এক সংঘর্ষ হয়। ৯ আগস্ট তারিখে কলাবাড়িতে মুক্তিবাহিনীর দুটি প্লাটুনের সঙ্গে পাকসেনাদের এক সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীকে ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে কলাবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়। কলাবাড়ি পাকসেনাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবার সংবাদে মিত্রবাহিনীর অফিসার মেজর থাপা মুক্তিবাহিনীর সুবেদার মেজর এম এ মজিদকে ২টি প্লাটুন নিয়ে সত্বর কলাবাড়ি দখলের নির্দেশ দিলেন। সুবেদার মেজর মজিদ ৬৪ জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে ১০ আগস্ট রাতেই কলাবাড়ি পুনর্দখলের জন্যে রওয়ানা হলেন। রাত ৪টা ৩০ মিনিটে (১১ আগস্ট) তিনি তার বাহিনী নিয়ে কলাবাড়িতে পৌছলেন। পাকসেনাদের
মূল ঘাঁটি ছিল কানসাটে। পাকসেনারা নদী পেরিয়ে এসে কলাবাড়ি ডিফেন্স পজিশনে অবস্থান করছিল। সুবেদার মেজর মজিদ তাঁর বাহিনীকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে ভাের সাড়ে পাঁচটায় পাকসেনাদের ওপর হঠাৎ হামলা করলেন। পাকসেনারা এই অতর্কিত হামলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। উভয়পক্ষে দেড় ঘণ্টা গুলি বিনিময় হয়। অবশেষে পাকসেনারা কলাবাড়ি ছেড়ে নদী পেরিয়ে কানসাটে চলে যেতে বাধ্য হয়। কলাবাড়ি মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
ভােলাহাট সাব-সেক্টর রাজশাহী জেলার নবাবগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত রােহনপুরের পশ্চিমে মহানন্দা নদীর অপর তীরের এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল। দলদলিতে ভােলাহাট সাব-সেক্টরের সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। মহানন্দা নদীর দু’পাশে আলীনগর-মকরমপুর থেকে শাহপুর গড় পর্যন্ত প্রায় সাত মাইল বিস্তৃত এলাকায় মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল । নদীর এক তীরে আলীনগর-মকরমপুর, এপারে আলমপুর-কায়সাবাড়ি আম্রকানন, তারপরে শাহপুর গড়।
পশ্চাতে ভােলাহাট সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় ১০০ বর্গমাইল এলাকা সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত ছিল । প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে লেঃ রফিকুল ইসলাম এই সাব-সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
অপরপক্ষে মহানন্দা নদীর অপর তীরে শিবরামপুর থেকে রােহনপুর হয়ে বিষ্ণুপুর পর্যন্ত পাকসেনাদের কংক্রিট বাঙ্কারসহ সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল।
একাত্তরের বাইশে নভেম্বর। পাকবাহিনীর ২৫ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট মুক্তিবাহিনীর। এই প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর এই দিন ভাের রাতে আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল নিম্নরূপ :
মহানন্দা নদীর অপর তীরে আলীনগর-মকরমপুরে মুক্তিবাহিনীর দলটির অধিনায়ক ছিল মুক্তিযােদ্ধা রায়হান। আলমপুর-কায়সাবাড়ি প্রতিরক্ষা অবস্থানের অধিনায়ক ছিল মুক্তিযােদ্ধা নজরুল ইসলাম (বর্তমানে ঢাকা সেনানিবাসে মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসে স্টাফ অফিসার হিসেবে কর্মরত) ও আলতাফ হােসেন, আর শাহপুর গড়ের প্রতিরক্ষা অবস্থানের অধিনায়ক ছিল বিডিআর (প্রাক্তন ইপিআর)-এর নায়েক ওয়াশিল । রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এসসি শেষ বর্ষের ছানােয়ারও এখানে অবস্থান করছিলেন।
আকস্মিকভাবে পাকবাহিনী গােলন্দাজ কামানের গােলা নিক্ষেপ শুরু করে । মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের সর্ব ডানদিকে (Right flank) শাহপুর গড় এলাকা। পাকসেনারা আক্রমণ করে। অন্ধকার রাতে এই অতর্কিত আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা। ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। শাহপুর গড় থেকে মুক্তিযােদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করে দলদলিতে চলে আসে। বেশকিছু মুক্তিযােদ্ধা নদী অতিক্রম করে আলীনগর চলে যায়। পাকসেনারা অতি সহজেই শাহপুর গড় দখল করে নেয়। আলমপুর-কায়সাবাড়ি প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে পাকবাহিনীকে প্রতিহত করা হয়। মুক্তিবাহিনীর দুটি ৮১ মিলিমিটার মর্টার।
ছিল— একটি আলীনগর ও অন্যটি কায়সাবাড়িতে মােতায়েন করা হয়েছিল । মুক্তিবাহিনী সারাদিন মর্টারের গােলাবর্ষণ অব্যাহত রাখে। এছাড়া মুক্তিযােদ্ধাদের একটি অগ্রবর্তী দল আলমপুর আম্রকাননের পূর্বপ্রান্তে অবস্থান গ্রহণ করে পাকসেনাদের অগ্রাভিযান রােধ করে।
লেঃ রফিকের সঙ্গে সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান ওয়ারলেসে কথা বললেন। শাহপুর গড় থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের পশ্চাদপসরণ করার জন্যে তিনি অত্যন্ত রাগান্বিত ছিলেন। তিনি অবিলম্বে পাল্টা আক্রমণ করে শাহপুর গড় পুনর্দখলের আদেশ দিলেন । সেক্টর কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল জামানের পরিকল্পনা অনুযায়ী সেদিনই রাত ১: ৩০ মিনিটে পাল্টা আক্রমণ করা হয়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর মেহেদীপুর থেকে তাঁর বাহিনী নিয়ে এলেন। নৌকাযােগে খাল অতিক্রম করে শাহপুর গড়ের পূর্বকোণে অবস্থান নিলেন। ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণের আগে শিবরামপুর, রােহনপুর ও শাহপুর গড়ে একযােগে কামানের গােলা নিক্ষেপ শুরু করে। আলীনগর-মকরমপুর প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে মুক্তিবাহিনীর ৮১ মিলিমিটার মর্টার গর্জে ওঠে।
এখান থেকে শিবরামপুর ব্রিজের অপর প্রান্তে অবস্থিত পাক অবস্থান ও রােহানপুরে অবস্থিত পাকসেনাদের ওপর প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ অব্যাহত থাকে। মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল পাকবাহিনী যেন এই ধারণা করে যে, রােহানপুরে পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর মুক্তিবাহিনীর মূল আক্রমণ হয়েছে। অল্পক্ষণ পরে
ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের বাহিনী পূর্বকোণ থেকে শাহপুর গড় আক্রমণ করলেন। লেঃ রফিক, নজরুল, আলতাফ, ওয়াশিলকে সঙ্গে করে শাহপুরের সম্মুখ ও পশ্চিমদিক থেকে একসঙ্গে আক্রমণ করেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা প্রচণ্ড যুদ্ধ চলার পরে পাকসেনারা শাহপুর গড় ছেড়ে বিষ্ণুপুর ও কসবা এলাকায় পালিয়ে যায়। সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল জামান এই যুদ্ধের সার্বিক নেতৃত্ব দেন।
তখন ভাের হয়ে এসেছে। সফল পাল্টা আক্রমণ পরিচালনা করে মুক্তিযােদ্ধারা শাহপুর গড় পুনর্দখল করল। দখলের পরে প্রতিরক্ষা অবস্থানে ঢুকে দেখা গেল সাথী মুক্তিযােদ্ধাদের মৃতদেহ পড়ে আছে বাংলার মাটিতে। বাংলার দামাল ছেলেদের রক্তে ভেজা বাংলার মাটি, ঘাস, বন। পাকসেনারা ওদের হাতের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গেছে কিন্তু ওদের প্রাণহীন শরীরে তখনও অ্যামুনিশনের বান্দোলিয়ার বাধা আছে। ওদের চোখ, নাক, মুখ পােকায় কুরে খাচ্ছে। সাদা সাদা পােকা। যেখানেই মৃত অবস্থায় পড়ে ছিল সেখানেই তাদেরকে সমাধিস্থ করা হয়।
আলীনগর ব্রিজের সন্নিকটে পাক অবস্থানের ওপর অতর্কিত আক্রমণ উল্লেখযােগ্য। এই অতর্কিত আক্রমণে পাঁচজন পাকসেনা নিহত হয়।
এছাড়া আলমপুর আম্রকাননে পাকসেনাদের অবস্থানের ওপর লেঃ রফিকের নেতৃত্বে আক্রমণ পরিচালিত হয়। এই যুদ্ধে সুলতান শহীদ হন। মুক্তিযােদ্ধা রায়হান, আলতাফ, ওয়াশিল, জমির, শামসুদ্দিন, গফুর ও আহমদ রেজা অসীম বীরত্বের পরিচয় দেয়। একজন পাকিস্তানি গােয়েন্দা মেজর ধরা পড়ে ও বহু পাকসেনা হতাহত হয়।
এরপর সুবেদার মেজর মজিদ কানসাটে পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর ১৪ আগস্ট ২ ইঞ্চি এবং ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে ব্যাপকভাবে গােলাবর্ষণ করেন। এর ফলে, বেশ কিছুসংখ্যক পাকসেনা হতাহত হয়।
২৩ আগস্ট তারিখে সুবেদার মেজর মজিদ এবং ক্যাপ্টেন ইদ্রিস যৌথভাবে কানসাট আক্রমণ করলেন। হামজাপুর সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন ইদ্রিস একটি কোম্পানি নিয়ে সুবেদার মেজর মজিদের সাহায্যার্থে কলাবাগান এলেন। পরিকল্পনা অনুসারে ক্যাপ্টেন ইদ্রিস এবং সুবেদার মেজর মজিদ প্রায় দুটি কোম্পানি নিয়ে কানসাটে অবস্থানরত প্রায় এক কোম্পানি পাকসেনার ওপর আঘাত হানলেন । উভয়পক্ষের তুমুল সংঘর্ষে কানসাট মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে এলেও কিছুক্ষণের মধ্যে চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকে সাহায্যকারী পাকসেনা ঘটনাস্থলে এসে পড়ায় মুক্তিবাহিনীকে কানসাট ছেড়ে চলে আসতে হয়। চার ঘণ্টার স্থায়ী সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর মাত্র একজন আহত হয়। অপরদিকে পাকসেনাদের পক্ষে হতাহতের সংখ্যা প্রচুর বলে জানা যায়।
২৬ আগস্ট কানসাটে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর পুনরায় এক ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ক্যাপ্টেন ও সুবেদার মেজর মজিদ প্রায় দুই কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে নদী পেরিয়ে মরিয়া হয়ে কানসাটে পাকসেনাদের ওপর আঘাত হানলেন। মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণে পাকসেনারা কানসাট ছেড়ে চলে যায়। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের ধাওয়া করে প্রায় শিবগঞ্জ পর্যন্ত অগ্রসর হয়। কিন্তু স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পাকসেনারা পাল্টা
৮৪
আঘাত শুরু করে। চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকেও পাকসেনারা আর্টিলারির সাহায্যে অগ্রসর হতে থাকে। ব্যাপক গােলাবর্ষণের মুখে মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। পাকসেনারা কানসাট নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এই সংঘর্ষে সুবেদার মেজর মজিদসহ ১৪জন মুক্তিযােদ্ধা গুরুতরভাবে আহত হয় এবং অস্ত্রশস্ত্র ও হারাতে হয় প্রচুর। পাকসেনাদের হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও বেশকিছু হতাহত হয়েছিল বলে গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন।
সাত নম্বর সেক্টরের শেখপাড়া সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন আব্দুর রশীদের নির্দেশে ৩ আগস্ট ই পি আর হাবিলদার শফিকুর রহমান তাহেরপুরে পাকসেনাদের ওপর হামলা চালান। ওই তারিখে হাবিলদার শফিকুর রহমান মুক্তিবাহিনীর একটি দল নিয়ে বাংলাদেশের ২৫ মাইল অভ্যন্তরে পাকিস্তানিদের অগ্রবর্তী ঘাঁটির ওপর আক্রমণের উদ্দেশে অগ্রসর হলে রাজশাহীর পুটিয়া থানার অন্তর্গত ঝলমলিয়া সেতুর নিচে অবস্থানরত পাকসেনাদের সঙ্গে এক অকস্মাৎ সংঘর্ষ হয়। পাক সান্ত্রী মুক্তিবাহিনীর হাবিলদার শফিকুর রহমানকে চ্যালেঞ্জ করলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে পজিশন নিয়ে সান্ত্রীর ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। হাবিলদার শফিক কৌশলে সাহসের ওপর ভর করে দুটি গ্রেনেড পাকসেনাদের গানের ওপর নিক্ষেপ করে গান দুটিকে অকেজো করে দেন এবং তিনি ক্রমশ পিছু হটে তাহেরপুরস্থ নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসেন।২
৪ আগস্ট হাবিলদার শফিক যখন তাঁর তাহেরপুরের আস্তানায় বিশ্রাম করছিলেন ঠিক তখনই সংবাদ পাওয়া গেল পাকিস্তানিদের একটি টহলদার দল তাহেরপুর দিয়ে প্রবাহিত নদীপথে অগ্রসর হচ্ছে। রাত তখন সাড়ে দশটা। হাবিলদার শফিকুর রহমান তার দল নিয়ে নদীর পাড়ে খুব কাছ থেকে পাকসেনাদের নৌকা লক্ষ করে পর পর ১৪টি গ্রেনেড নিক্ষেপ এবং ক্রমাগত রাইফেল ও এলএমজির গােলাবর্ষণ করতে থাকেন। এই অ্যামবুশে ১৮ জন পাকসেনাসহ ৩ জন মাঝি নিহত হয়।
২৬ আগস্ট তারিখেও রাজশাহী জেলার দূর্গাপুরে পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাবিলদার শফিকুর রহমানের এক সংঘর্ষ হয়। ওই তারিখ সকালে হাবিলদার শফিকুর যখন মাত্র একটি সেকশন নিয়ে দুর্গাপুরে অবস্থান করছিলেন সেই সময় পাকসেনাদের একটি বড়াে রকমের দল এবং ৫০ জনের মতাে একটি রাজাকারের দল দুর্গাপুরে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ঘিরে ফেলে। পাকসেনাদের এই আকস্মিক আক্রমণে হাবিলদার শফিকুর রহমান কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে তাঁর সেকশনে মাত্র ২টি এলএমজি, ১টি ২ ইঞ্চি মর্টার এবং অবশিষ্ট রাইফেল যথাস্থানে বসিয়ে একযােগে পাকিস্তানিদের হামলার জবাব দিতে শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত হাবিলদার শফিকুর পাকিস্তানিদের অবাক করে দিয়ে তার পুরাে সেকশন নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে আসতে সক্ষম হন।
১৭ আগস্ট থেকে মুক্তিযােদ্ধা শিবলী সারদাতে বেশ কয়েকটি দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেন। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শ্রেণীর ছাত্র মুক্তিযােদ্ধা শিবলী মাত্র ৬ জন গেরিলা নিয়ে ওই তারিখে সারদাতে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ চালান। এই সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি
৮৫
কোম্পানি সারদা পুলিশ একাডেমীতে অবস্থান করছিল। মুক্তিযােদ্ধা শিবলী পাকসেনাদের মূলঘাঁটিতে আঘাত হানার উদ্দেশে ক্রলিং করে শত্রুঘাঁটির দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। মুক্তিযােদ্ধা ৪ জন শক্রবাঙ্কারের নিকটবর্তী হয়ে পাক অবস্থানে গ্রেনেড নিক্ষেপ শুরু করে। পাকসেনারা হতচকিত হলেও তারা মুক্তিযােদ্ধাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে অনবরত গুলি চালাতে থাকে। পাকসেনাদের গুলিতে দুইজন মুক্তিযােদ্ধা ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। লিডার শিবলী গুরুতর আহত অবস্থায় পাকসেনাদের হাতে বন্দী হন। ১ জন মুক্তিযােদ্ধা পেছনে অবস্থানরত অপর একজন মুক্তিযােদ্ধার ফায়ার সাপাের্টে কোনােমতে নিরাপদ স্থানে চলে আসতে সমর্থ হন। শােনা গেছে, পাকসেনারা শিবলীর কাছ থেকে মুক্তিবাহিনীর সম্পর্কে নানামুখী তথ্য সংগ্রহের জন্যে দিনের পর দিন তাঁর ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েও কেবল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ছাড়া আর কিছুই বের করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত পাকসেনারা হতাশ হয়ে প্রথমে চোখ তুলে, তারপর হাত কেটে বাংলা মায়ের বাঙালি সন্তান মুক্তিযােদ্ধা শিবলীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। শিবলী ও তাঁর দল ওই দিন ১০ জন পাকসেনাকে খতম করেছিল।৩
২২ আগস্ট মীরগঞ্জে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর এক সংঘর্ষ হলাে। সাবসেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন আবদুর রশীদের নির্দেশে সুবেদার মুবাসসারুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্লাটুন ২২ আগস্ট রাজশাহী জেলার চারঘাট থানার অন্তর্গত পাকঘাঁটি মীরগঞ্জ বিওপি আক্রমণ করে । সুবেদার ইসলাম তার প্লাটুন নিয়ে ভয়ঙ্করী পদ্মা দেশী নৌকায় পার হয়ে মীরগঞ্জের দিকে অগ্রসর হলেন। এই সময় মীরগঞ্জে অবস্থানরত এক প্লাটুন পাকসেনা সুখে দ্রিা যাচ্ছিল। তারা ভাবতেও পারেনি এই ভয়ঙ্করী পদ্মা পেরিয়ে রাতের আঁধারে তাদেরকে আঘাত হানবে । দু’জন পাকসান্ত্রীকে দণ্ডায়মান দেখা গেল । সুবেদার ইসলাম তৃরিত পজিশন নিয়ে একযােগে পাকসেনাদের ওপর আঘাত হানলেন। এই অকস্মাৎ আক্রমণে পাকসেনারা হতচকিত হয়ে দ্রিা জড়ানাে চোখে পজিশন নেয়ার চেষ্টা করলে তারা অধিকাংশই বুলেটবিদ্ধ হয়। সুবেদার মােবাসসারুল ইসলাম ঘাঁটিতে ফিরবেন ভাবছেন, এমন সময় পাকসেনাদের টহলদানরত একটি ছােটো দল মুক্তিবাহিনীকে পাল্টা আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী এর জন্যে প্রস্তুত না। থাকলেও অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পাকসেনাদের গুলির জবাব দিয়ে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে একমাইল পিছু হটে দেশী নৌকায় পদ্মা পেরিয়ে মুক্তঘাটিতে ফিরে আসে। সেপ্টেম্বর মাসে সাত নম্বর সেক্টরের প্রতিটি সাব-সেক্টরেই পাকিস্তানিদের ওপর মুক্তিবাহিনীর আঘাত অব্যাহত ছিল। শেখপাড়া সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন রশীদের নির্দেশে নায়েক সুবেদার নুরুন্নবী মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে বাংলাদেশের পনের মাইল অভ্যন্তরে অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছিল। ১৪ অক্টোবর নায়েক সুবেদার নুরুন্নবী রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর থানার গলহরিয়া নামক স্থানে তাঁর প্লাটুন নিয়ে যখন বিশ্রাম করছিল ঠিক তখনই পাকবাহিনীর একটি কোম্পানি এবং ২০০-এর মতাে রাজাকার নায়েক সুবেদার নুরুন্নবীর ওপর হামলা করে। নায়েক সুবেদার নুরুন্নবীর অবস্থান ছিল চমৎকার স্থানে। চারদিকে জল । কেবল একটিই পথ, তাও আবার বাঁশের সেতু অতিক্রম করে আসতে হবে । রাজাকারের দল ত্বরিত বাঁশের সেতুটি অতিক্রম করে মূলঘাটি আক্রমণের চেষ্টা
৮৬
করে। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের আক্রমণ টের পেয়ে সত্বর পজিশন নিয়ে চুপচাপ বসে ছিল। রাজাকারের দল যখনই বাঁশের সেতুটির উপর দিয়ে অগ্রসর হতে যাবে ঠিক তখনই মুক্তিবাহিনীর গানগুলাে একসঙ্গে গর্জে ওঠে। প্রথম চোটেই নিহত হল ৩০ জন পাকিস্তানি। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের অগ্রাভিযান রােধকল্পে ৭৩ এম এ এন্টিট্যাঙ্ক গান দিয়ে সেতুটি সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস করে। পাকসেনারা প্রথম চোটেই হকচকিয়ে গেলেও পুনরায় একত্র হয়ে বিপরীত দিক থেকে ফিল্ড গানের সাহায্যে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়।
সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় সকাল ৬টায়। সুতরাং দিনের আলােয় পরিষ্কার সব দেখা যাচ্ছিল। নায়েক সুবেদার নুরুন্নবী দেখলেন একজন পাক মেজর সৈন্যদের কী সব নির্দেশ দিচ্ছেন। নুরুন্নবী সঙ্গে সঙ্গে একটি এলএমজি নিয়ে পাক মেজরকে লক্ষ করে ট্রিগারে হাত দিলেন। লক্ষ্য ছিল অব্যর্থ। পাক মেজর ধরাশায়ী হল । অন্যদিকে খাল পার হয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে পাকসেনারা। মুক্তিবাহিনী ছিল দৃঢ় পজিশনে। ফলে, প্রত্যেকটি বুলেটে একজন করে খানসেনা খতম হতে থাকে। এই চরম বিপর্যয়ের মুখেও মুক্তিবাহিনী গােলাবর্ষণ অব্যাহত রাখল ধীরস্থিরভাবে । কিন্তু এক সময় দেখা গেল মুক্তিবাহিনীর গােলা প্রায় নিঃশেষ। অপরদিকে পাকসেনারা পাল্টা গােলা বর্ষণের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর করতে থাকে। কমান্ডার নুরুন্নবী এখানে বেশিক্ষণ থাকা সমীচীন মনে করলেন না। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তার প্লাটুন নিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে গেলেন। এখানকার সংঘর্ষের ফলাফল সম্পর্কে এই স্থানের একজন ওয়াপদা প্রকৌশলী পাকিস্তানিদের ২ জন অফিসার এবং ৭৩ জন সৈন্য নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন, অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর দু’জন গুলিবিদ্ধ হন।
‘লালগােলা সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে অপারেশন অব্যাহত ছিল। ক্যাপ্টেন গিয়াস পাকিস্তানিদের নিকট টেরর’ ছিলেন। ক্যাপ্টেন গিয়াসের নির্দেশেই মুক্তিবাহিনীর একটি দল নবাবগঞ্জ থানার অন্তর্গত পাকঘাঁটি রাধাকান্তপুর হাট আক্রমণ করে। সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর নায়েক আরশাদ শহীদ এবং বেশ কয়েকজন আহত হলেও রাধাকান্তপুর হাট শত্রুমুক্ত হয়। ৭ জন পাকসেনা এবং ১১ জন রাজাকার নিহত হয় এখানে। একই তারিখে বেশ কয়েকজন রাজাকার অস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে।
“সাত নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টেন গিয়াস, ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর প্রমুখ অফিসার তাঁদের বাহিনী নিয়ে প্রচণ্ডভাবে পাকিস্তানিদের ওপর হামলা চালিয়ে একের পর এক সাফল্য অর্জন করে চলেছিলেন। সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন গিয়াসের তত্ত্বাবধানে মুক্তিবাহিনীর একটি দল ইসলামপুরে পাকিস্তানিদের অবস্থানের ওপর হামলা চালায়। ওইদিন সুবেদার আবুল হাশেম একটি কোম্পানি নিয়ে গন্তব্যস্থানের দিকে অগ্রসর হয়ে পুরাে কোম্পানিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে রাত সাড়ে চারটার মধ্যে স্ব স্ব অবস্থানে পৌছে যায়। ইসলামপুরে পাকিস্তানীদের মূলঘাঁটির ডানদিকে একটি কলাম হাবিলদার সাজ্জাদ, বাঁ দিকের কলামটি হাবিলদার কাওসার এবং মাঝের কলামটি নায়েক আবুল পরিচালনার ভার নেন। মুক্তিবাহিনির সাপাের্ট সেকশন ৬টি ৩ ইঞ্চি মর্টার দ্বারা পাক অবস্থানের ওপর বেশ কিছুক্ষণ শেলিং করে। শেলিং-এর ফলে পাকিস্তানিরা বিপর্যস্ত
৮৭
হয়ে পলায়নের চেষ্টা করলে তাদের ওপর মুক্তিবাহিনী একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে । এই সংঘর্ষে শতাধিক পাকিস্তানি হতাহত হয় বলে গ্রামবাসী সূত্রে জানা যায়। ৩০ জন রাজাকার বন্দী এবং পরে আরও ৫০ জন রাজাকার স্বেচ্ছায় মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর ১০ জন শহীদ এবং কয়েকজন আহত হয়। পাকসেনারা চরম মার খেয়ে ইসলামপুর লক্ষ্মীনারায়ণপুর ছেড়ে চাঁপাই নবাবগঞ্জের মূলঘাটিতে একত্র হয়। ৫
এদিকে হামজাপুর সাব-সেক্টর বাহিনীর ১০ জন মুক্তিযােদ্ধা নভেম্বরের ১৩/১৪ তারিখে দিনাজপুর জেলার খানপুর বিওপি আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে পাকসেনারা খানপুর বিওপি ছাড়তে বাধ্য হয়। সংঘর্ষে ৩০ জন পাকসেনা নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর হাবিলদার ইমান আলীসহ। বেশ কয়েকজন গুরুতররূপে আহত হলেও খানপুর বিওপি মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
২৭ নভেম্বর ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন চৌধুরীর নির্দেশে মুক্তিবাহিনীর ৫টি কোম্পানি পাকিস্তানিদের সুদৃঢ় ঘাঁটি পােড়াগ্রাম আক্রমণ করে। দীর্ঘস্থায়ী চরম সংঘর্ষে পাকিস্তানিরা শেষ পর্যন্ত সরে আশ্রয় নেয় একেবারে চাপাই নবাবগঞ্জে। সংঘর্ষে ৩০ জন পাকসেনা এবং ৫০ জন রাজাকার নিহত হয়। এই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর মর্টারচালক সিপাই মুরতাজ আলীর অপূর্ব বীরত্ব ও সাহসিকতা মনে করে আজও সবাই গর্ববােধ করে।
সাত নম্বর সেক্টর ট্রুপস দ্রুতগতিতে নবাবগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১০ ডিসেম্বরে মুক্তিবাহিনী নবাবগঞ্জের ওপর ব্যাপকভাবে হামলা চালায়। এই সেক্টরের তপন এবং হামজা সাব-সেক্টর ট্রুপস হিলি থেকে বগুড়া হয়ে দিনাজপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মেহেদীপুর লালগােলা সাব-সেক্টর ট্রুপসও রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হয়। পাকিস্তানিদের সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে বাংলার মুক্তিযুদ্ধে যােগদানকারী নির্ভীক দেশপ্রেমিক ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর শহীদ হন। এই ত্যাগী অফিসারের মৃত্যুতে মুক্তিযােদ্ধারা সাময়িকভাবে শােকাভিভূত হয়ে পড়লেও পুনরায় সামনে অগ্রসর হতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বরেই সাত নম্বর সেক্টর। এলাকা মুক্ত হয়ে যায় ।
তথ্য নির্দেশ
১. মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত কাহিনী, নবম উইং বি ডি আর, ঠাকুরগাঁও থেকে প্রকাশিত।
২. সাক্ষাৎকার : কর্নেল আব্দুর রশীদ, বীর প্রতীক, পি এস সি।
৩. দৈনিক বাংলা, ২৭ অগ্রহায়ণ, ১৩৭৯।
৪. সাক্ষাৎকার : ব্রিগেডিয়ার গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী, বীর বিক্রম, পি এস সি, (অবঃ)।
৫. পূর্বোক্ত।
আট নম্বর সেক্টর
বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে আট নম্বর সেক্টর গঠিত হয়। এপ্রিল মাসে অপারেশনাল এলাকা ছিল কুষ্টিয়া, যশাের, ফরিদপুর ও খুলনা জেলার দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়ক পর্যন্ত। শেষে অপারেশন এলাকা সঙ্কুচিত করে কুষ্টিয়া ও যশাের জেলা, খুলনা জেলা সদর, সাতক্ষীরা মহকুমা ও ফরিদপুরের উত্তরাংশ পর্যন্ত অপারেশন এলাকা নির্ধারণ করা হয়।
যশাের ই পি আর সেক্টর অর্থাৎ চুয়াডাঙা ৪ নং এবং খুলনার ৫নং উইং, ১৫নং উইং-এর একটি কোম্পানি এবং সেক্টর হেড কোয়ার্টার ট্রুপস এই সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেছে। বলা প্রয়ােজন যে, ‘জেড’ ফোর্সের প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিকাংশ সৈনিককেই লেঃ হাফিজের নেতৃত্বে এই সেক্টরের ই পি আর ট্রুপস থেকে বাছাই করে নেয়া হয়েছিল।
আগস্ট মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত সেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন মেজর এম এ ওসমান চৌধুরী। জুলাই মাসে ১৪তম প্যারা ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর— মেজর মঞ্জুর পাকিস্তানের শিয়ালকোট সেনানিবাস থেকে স্ত্রী-পরিজন নিয়ে পালিয়ে ভারত হয়ে বাংলাদেশে এলে বাহিনীপ্রধান কর্নেল ওসমানী তাঁকে আট নম্বর সেক্টরের ভার অর্পণ করলেন। মেজর মঞ্জুর ১৮ আগস্ট মেজর ওসমানের কাছ থেকে সেক্টরের দায়িত্ব বুঝে নেন। পাকিস্তানে বাঙালি অফিসারের মধ্যে যাদের নাম শােনা যেত মেজর মঞ্জুর ছিল তাঁদের অন্যতম। দীর্ঘ কয়েক মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুরের সুযােগ্য পরিচালনার ভেতর দিয়েই তাঁর প্রতিভার প্রমাণ রেখেছেন।
সেক্টর সৈন্যসংখ্যার মধ্যে ২ হাজারের মতাে ছিল নিয়মিত বাহিনী এবং ৮ হাজার ছিল গণবাহিনী। সেক্টর হেড কোয়ার্টার বেনাপােলে থাকলেও কার্যত হেড কোয়ার্টারের একটা বিরাট অংশ ভারতের কল্যাণী শহরে অবস্থিত ছিল।
সেক্টর এলাকাকে কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। সাব-সেক্টরগুলাে গড়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গের লালগােলা সীমান্ত থেকে খুলনার অপর প্রান্ত পর্যন্ত ।
১. বয়রা সাব-সেক্টর : কমান্ডার ছিল ক্যাপ্টেন খােন্দকার নজমুল হুদা।
২. হাকিমপুর সাব-সেক্টর : কমান্ড করেছেন ক্যাপ্টেন শফিকউল্লাহ।
৩. ভােমরা সাব-সেক্টর : প্রথমে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন এবং পরে ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিনকে এখানকার পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
৪. লালবাজার সাব-সেক্টর : কমান্ডার ছিল ক্যাপ্টেন এ আর আযম চৌধুরী।
৫. বানপুর সাব-সেক্টর : কমান্ডার ছিল ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান।
৬. বেনাপোেল সাব-সেক্টর : কমান্ডার ছিল যথাক্রমে ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম এবং
ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী।
৭. শিকারপুর সাব-সেক্টর : কমান্ডার ছিল যথাক্রমে ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী এবং লে. জাহাঙ্গীর ।
মে মাসের প্রথম সপ্তাহেই ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জামালউদ্দিন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন আবদুল ওহাব, লে. এনামুল হক, মেজর শামসুদ্দিন, মেজর মুজিব এই সাব-সেক্টরে যােগদান করেন। সেক্টরের দায়িত্ব পালনে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জামালউদ্দিন, বর্তমান বি ডি আর-এর উপ-সহকারী পরিচালক মােজাফফর আহমদ প্রমুখ প্রশংসার দাবি রাখেন । প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে মেজর শামসুদ্দিনের নিরলস ভূমিকা উল্লেখযােগ্য।
আট নম্বর সেক্টরের প্রতিটি সাব-সেক্টরেই মুক্তিবাহিনী তাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিল। ২৭ মে পাকসেনাদের দুটি কোম্পানি মুক্তিবাহিনীর বয়রা অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে। বয়রা সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ছিল বয়রা সীমান্তবর্তী একটি বাঁধের উপর ও তার পেছনে। এই অবস্থান থেকে মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের ওপর বার বার আঘাত হানায় তারা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন প্রায় এক কোম্পানি ইপিআর বাহিনী নিয়ে ঘাঁটিতে অবস্থান করছিলেন। পাকসেনারা ২৭/২৮ মে ভাের চারটার দিকে দুটি কোম্পানি নিয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। উভয়পক্ষে ব্যাপকভাবে সংঘর্ষ হয়। পাকসেনারা তেমন সুবিধা করতে না পেরে পেছনে সরে যায়। কিন্তু সকাল ৬টার দিকে পুনরায় পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ করে। থেমে থেমে এই সংঘর্ষ দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। পাকসেনারা একটি ব্যাটালিয়নের বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন সময়ে এই সংঘর্ষে অংশ নেয়। এই সংঘর্ষে পাকিস্তানিদের পক্ষে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার আহত হয় এবং একজন ক্যাপ্টেনসহ ১৩০ জনের মতাে পাকসেনা খতম হয়। মুক্তিবাহিনীর ২ জন শহীদ এবং ৮ জন আহত হন। এই সংঘর্ষে নায়েক সুবেদার জব্বার, হাবিলদার বেলায়েত হােসেন, হাবিলদার তরিকউল্লাহ অপূর্ব বীরত্বের পরিচয় দেন। শেষ পর্যন্ত পাকসেনাদের ব্যাপক আক্রমণের মুখে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন তার বাহিনী নিয়ে পেছনে সরে যান।
এদিকে ক্যাপ্টেন নজমুল হুদা বয়রার অপর এলাকাতে অ্যামবুশ করে বেশকিছু সংখ্যক পাকসেনাকে খতম করলেন। ১০ মে ক্যাপ্টেন নজমুল হুদা তার বাহিনী নিয়ে চৌগাছা ও মাসালিয়া সড়কের মধ্যবর্তী স্থানে ওত পেতে রইলেন। তিনি যা ভেবেছিলেন ঠিক তাই হলাে, পাকসেনাদের একটি টহলদার দল ওই পথে নির্দ্বিধায় অগ্রসর হতে থাকে। ক্যাপ্টেন হুদা গুলি চালালেন, উভয়পক্ষে গােলাগুলি শুরু হলাে। সংঘর্ষে ৮ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং তারা বেশকিছু গােলাবারুদ ফেলে রেখে বাধ্য হয় পালিয়ে যেতে। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর ২ জন শহীদ হন।
১৫ মে ক্যাপ্টেন নজমুল হুদা কাশীপুর বিওপি এলাকাতে পাকসেনাদের টহলদার দলের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ৬ জন পাকসেনাকে হত্যা করে ১টি এলএমজি, ৮টি রাইফেল, একটি মানচিত্র এবং বেশকিছু গােলাবারুদ উদ্ধার করেন। এখানে পাকসেনাদের একটি জীপ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়।
হঠাৎ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, পুলিশ ও তার সহযােগী দালাল অবাঙালিরা ছুটিপুর গ্রামে ঢুকে আগুন জ্বালিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে গ্রামবাসীদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালাতে থাকে। ক্যাপ্টেন হুদা এই সংবাদ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ইপিআর বাহিনীর দুটি প্লাটুন নিয়ে ২৭ মে ছুটিপুর গ্রাম ঘিরে ফেলেন। ক্যাপ্টেন হুদা পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ করতে বললেন । কিন্তু তারা সে কথা গ্রাহ্য না করে গুলি চালায়। ক্যাপ্টেন হুদা তাঁর বাহিনীকে পাল্টা গুলি চালাবার নির্দেশ দিলেন। বেশ কিছুক্ষণ সংঘর্ষ স্থায়ী হয়। সংঘর্ষে ৪ জন পাকসেনা মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং ১১ জন নিহত হয়। এই নিহতদের মধ্যে ঝিকরগাছা থানার বাঙালি পুলিশ অফিসারও ছিল। মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের একটি জিপসহ বেশকিছু গােলাবারুদ উদ্ধার করে। পাকিস্তানিদের অবশিষ্টরা পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। ক্যাপ্টেন হুদা ২৭ মে তারিখের মধ্যে প্রায় ১৫০ বর্গমাইল এলাকা নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন।
২৭ মে তারিখে কাশীপুর বি ও পি-তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৪ তম এফএফ এর দুটি কোম্পানির সঙ্গে ক্যাপ্টেন হুদার বাহিনীর পুনরায় এক বড়াে রকমের সংঘর্ষ হয়। পাকসেনারা ওই তারিখে দুটি কোম্পানি নিয়ে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনীর ডিলেয়িং পার্টির সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। ক্যাপ্টেন হুদা অবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করে সুবেদার মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি প্লাটুন দিয়ে অগ্রসরমান পাকসেনাদের বাধা দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। কিছুক্ষণ পর পাকসেনাদের আক্রমণের তীব্রতা বুঝে ক্যাপ্টেন হুদা নিজে কিছুসংখ্যক সৈন্য এবং ক্যাপ্টেন তােফিক-ই-এলাহীর কম্যাণ্ডে কিছু সৈন্য দিয়ে কাশীপুর বিওপি-র ডানদিক থেকে শত্রুদের ওপর তীব্রভাবে আক্রমণ চালালেন । পাকসেনারা এই সংঘর্ষে সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করল, কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলাে তাদের । পাকসেনাদের হতাহতের সংখ্যা ছিল ভয়াবহ। রণাঙ্গন থেকেই ৬০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ৩ জন। ১টি রকেট লাঞ্চারসহ ৩০টি চায়নিজ রাইফেল পাকসেনাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। পাকবাহিনীর ৪টি ট্রাক ওইদিন মুক্তিবাহিনীর হাতে ধ্বংস হয়। মুক্তিবাহিনীর সুবেদার মনিরুজ্জামান শহীদ হন এবং বেশ কয়েকজন গুরুতরভাবে আহত হন। ২৭ মে তারিখের এই সংঘর্ষে অংশগ্রহণকারী হাবিলদার আব্দুল কুদ্স খাঁ সাপ্তাহিক দেশ বার্তায় এ সম্পর্কে লিখেছেন :
“মনিরুজ্জামান সাহেবের নির্ভীক ও সুষ্ঠু পরিচালনায় মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণে শত্রুর আক্রমণ শুধু প্রতিহতই হয়নি, পক্ষান্তরে শত্রুকে প্রায় চার মাইল পর্যন্ত ‘অ্যাডভান্স টু কনট্যাক্ট’ পদ্ধতি অবলম্বনে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন হুদা সাহেব শত্রুর পিছু ধাওয়া করে মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে একত্র হন।
৯১
“এদিকে শত্রুর সঙ্গে হাতাহাতি যুদ্ধের সুযােগ উপস্থিত হওয়ায় সুবেদার মনিরুজ্জামান সাহেব বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রুর ওপর। ঠিক পুকুরের পাড়ে, জঙ্গলের ভেতর, বটগাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শত্রু চায়নিজ রাইফেল দিয়ে মাত্র চারগজ দূর থেকে সুবেদার সাহেবকে লক্ষ করে গুলি ছােড়ে। আর আমার অবস্থান ছিল অনুমান ৬ গজ দূরে। আহ! একটি আওয়াজই তার কণ্ঠ হতে উচ্চারিত হতে শুনেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের ভেতর ধরাশায়ী হলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য ধরাও পড়েছিল সেই হত্যাকারী।
“সেদিন শত্রুও অনেক যানমালের ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়েছিলাে। আমাদের পক্ষে সুবেদার সাহেব (শহীদ) ছাড়া ৪৬ বছর বয়স্ক হাবিলদার বর্তমান নায়েক আরব আলী (বীর বিক্রম) শত্রুর এক তরুণ লেফটেন্যান্টের সঙ্গে হাতাহাতি যুদ্ধে সামান্য আহত হয়েছিলেন। উক্ত লেফটেন্যান্ট আরব আলীর হাতেই নিহত হন।১
লালবাজার সাব-সেক্টর এলাকা থেকে ক্যাপ্টেন এ আর আযম চৌধুরী তার বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রেখেছিলেন। ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরীর নির্দেশে নায়েক সুবেদার আব্দুল মতিন পাটোয়ারী একটি প্লাটুন নিয়ে মুজিবনগরে অবস্থান করছিলেন। নায়েক সুবেদার পাটোয়ারী ২০ মে তারিখে বাগুয়ান নামক স্থানে এক অ্যামবুশে বেশ কিছু সংখ্যক পাকিস্তানিকে হত্যা করেন। ওই তারিখে পাকসেনাদের একটি প্লাটুন বলুভপুর মিশনারী চার্চে এসেছিল লুটতরাজ করতে । নায়েক সুবেদার পাটোয়ারী এই সংবাদ পেয়ে তাঁর প্লাটুনসহ অগ্রসর হন এবং দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে তার নিজের নেতৃত্বে একটি কলাম বাগুয়ান নামক স্থানে এবং অপর কলাম বল্লভপুর সড়ক জংশনে ডিফেন্স নেয়। পাকসেনারা চার্চে লুটতরাজ চালিয়ে ওই তারিখে বেলা দেড়টার দিকে মূল ঘাঁটিতে ফিরছিল। ফিরতি পথে তারা মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশে পড়ে। নায়েক সুবেদার পাটোয়ারী গুলিবর্ষণের হুকুম দিলে একসঙ্গে সব কটি গান গর্জে উঠে। পাকসেনারা হতচকিত হয়ে পজিশন নিয়ে পাল্টা আঘাত হানে। উভয়পক্ষে গুলি বিনিময় একঘণ্টা স্থায়ী হয়। সংঘর্ষে পাকসেনাদের ১৭ জন খতম এবং ৫ জন আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে কোনাে হতাহতের সংবাদ পাওয়া যায়নি। এইদিন মুক্তিবাহিনী ১টি জিপ, ৪টি রাইফেল, ১টি এলএমজি, ১টি বড়াে বাইনােকুলার এবং বেশকিছু গােলাবারুদ উদ্ধার করে। নায়েক সুবেদার পাটোয়ারী তাঁর প্লাটুন নিয়ে মুজিবনগরেই অবস্থান করতে থাকেন।
ইংল্যাণ্ড থেকে এম পি মি. স্টোনহাউজ এবং পশ্চিম জার্মানির বিচার বিভাগীয় মন্ত্রী মি. চেস্টওয়ার্থ বাংলাদেশের মুক্ত এলাকা পরিদর্শনের উদ্দেশে মে মাসের শেষের দিকে এই সেক্টর পরিদর্শনে আসেন। অতিথিবৃন্দ বয়রা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তাঙ্গনে প্রবেশ করেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কমান্ডার মেজর এম এ ওসমান চৌধুরী তাদেরকে স্বাগত জানান।
৩ জুন তারিখে মুজিবনগরে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর পুনরায় এক বড়াে রকমের সংঘর্ষ হয়। নায়েক সুবেদার পাটোয়ারী মাত্র ৪৫ জন ইপিআর ট্রুপস নিয়ে
প্রতিরক্ষায় ছিলেন। পাকসেনাদের প্রধান ঘাঁটি ছিল মেহেরপুরে। ওই তারিখ বিকাল ৪টার দিকে পাকসেনারা প্রায় এক ব্যাটালিয়ন শক্তি নিয়ে কিছুসংখ্যক বাগুয়ানে মূল ডিফেন্সে রেখে মুজিবনগর আম্রকুঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে থাকে । নায়েক সুবেদার পাটোয়ারী পাকসেনাদের আগমন টের পেয়ে তার ৪৪ জন সৈন্যকে দুটি ভাগে ভাগ করে একটিতে নিজে এবং অপরটি নায়েক সুবেদার তােফাজ্জল হােসেনের নেতৃত্বে ডিফেন্স নিলেন। পাকসেনারা ঐতিহাসিক আমবাগানের নিকটবর্তী হলে মুক্তিবাহিনীর গানগুলাে একসঙ্গে গর্জে ওঠে। পাকসেনারা ছিল মাঠে। ফলে মুক্তিবাহিনী নির্দিষ্ট লক্ষ্যে গুলিবর্ষণ করতে লাগল। মুজিবনগর সম্পর্কে পাকসেনাদের মনে নানা অজানা রহস্য বাসা বাঁধায় মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করে তারা তীব্র গতিতে অগ্রসর হতে থাকে। পাকসেনাদের তীব্র আক্রমণের মুখে মুক্তিবাহিনীর টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে, তারা পিছু হটতে থাকে। পাকসেনারা শেষ পর্যন্ত মুজিবনগরে মুক্তিবাহিনীর মূলঘাটি দখল করে নিয়ে ঘর-দুয়ার জ্বালিয়ে ধ্বংস করে বিরাট বিজয়ে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে নৃত্য করতে থাকে। মুক্তিবাহিনী নীরবে পিছু হটে পুনরায় সবাই একত্র হয়। নায়েক সুবেদার পাটোয়ারী এই দুর্যোগময় মুহূর্তেও মনােবল হারালেন না। ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিলেন। আমবাগানের পেছনে ছিল আখক্ষেত। মুক্তিবাহিনীর ওই স্বল্পসংখ্যক যােদ্ধাকেই বিস্তীর্ণ এলাকাতে ছড়িতে দিয়ে পাকিস্তানি সামরিক কায়দায় বজ্রকণ্ঠে নায়েক সুবেদার পাটোয়ারী হাঁকলেন, “আলফা ব্রেভাে রাইট, চার্লি ডেল্টা লেফট, ইকো ইহাসে অ্যাডভান্সড আওর সালে লােককে জিন্দা পাকড়ে লে আও।” এরপরই মুক্তিবাহিনী বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে গুলি ছােড়া শুরু করে। একই সঙ্গে বিভিন্ন দিক থেকে গুলি আসায় এবং কম্যাণ্ডে এমন দৃঢ়তা শুনে বিচলিত হয়ে পড়ল পাকসেনারা। তারা ভাবল, ব্যাপকভাবে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনী যৌথভাবে তাদেরকে আক্রমণ করেছে। মুক্তিবাহিনী তাদেরকে দেখতে পাচ্ছিল আখক্ষেত থেকে আর তাই বুলেট যথাযথই পাকিস্তানিদের ধরাশায়ী করল। পাকসেনারা হতচকিত হয়ে শেষ পর্যন্ত ভয়ে পেছনে সরে যায়। সংঘর্ষে ২৮ জন পাকসেনা নিহত এবং ২০ জন আহত হয়। মুক্তিবাহিনী পুনরায় তাদের মুজিবনগর ঘাঁটি পুনরুদ্ধার করে। মুক্তিবাহিনীর এই গ্রুপটি মুজিবনগরে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে বহুসংখ্যক অপারেশনে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে। ১৪ জুন মানিকনগর, ২০ জুন এবং ২১ জুন মুজিবনগর বিওপি ইত্যাদি স্থানের সংঘর্ষের কথা বিশেষ উল্লেখযােগ্য।
মে মাসের শেষ পর্যায়ে পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর কাছ থেকে ভােমরা এলাকা দখল করে নিলেও জুলাই মাসে ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে পাকিস্তানিদের ওপর হামলা চালিয়ে ভােমরা পুনরুদ্ধার করা হয়। কৈখালীতেও পাকসেনাদের একটি বড়াে রকমের শক্ত ঘাঁটি ছিল; বস্তুত জুলাই মাসেই ক্যাপ্টেন মাহবুব তার বাহিনী নিয়ে পাকসেনাদের ওপর হামলা চালিয়ে কৈখালী দখল করেন।
৫ আগস্ট ক্যাপ্টেন নজমুল হুদা তাঁর বাহিনী নিয়ে পাকসেনাদের মজবুত ঘাঁটি বনী বিওপি আক্রমণ করেন। পাকসেনারা সংখ্যায় প্রায় ৭৫ জনের মতাে ছিল। ক্যাপ্টেন
হুদা প্রায় দু’কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে ব্যাপকভাবে পাকসেনাদের ওপর হামলা চালালেন। মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে পাকসেনারা তাদের ২৫ জনের লাশ ফেলে পালিয়ে যায় । এই ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে এফ এফ বাহিনীর একটি কোম্পানি সংঘর্ষে অংশ নেয়। ক্যাপ্টেন নজমুল হুদা তাড়াতাড়ি বনী বিওপি থেকে অস্ত্র গােলাবারুদ নিজেদের মূল ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া শুরু করেন। এমনি অবস্থায় পাকসেনারা ‘রিয়ার’ থেকে অগ্রসর হয়ে মুক্তিবাহিনীর ওপর প্রবলভাবে আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী এই আক্রমণের জন্যে মােটেও প্রস্তুত ছিল না। ব্যাপক সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর ৪ জন শহীদ হলেন। কমান্ডার ক্যাপ্টেন নজমুল হুদা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বলা যায় অলৌকিকভাবে রক্ষা পান। এই সংঘর্ষ সম্পর্কে হাবিলদার কুদুস খাঁ সাপ্তাহিক ‘দেশবার্তায় লিখেছেন :
“গভীর রাতে যশােরের বনী বিওপি শত্রু প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে সাফল্যজনক আক্রমণ চালিয়ে প্রত্যাবর্তনের সময় নিজেদের বাহিনী ভেবে ভুল করে শত্রুর একটি ফাইটিং প্লাটুনের সঙ্গে ক্যাপ্টেন হুদা মুখােমুখি হন। সেদিন অনিবার্য কারণবশত তিনি ছিল বড়ােই শ্রান্ত ক্লান্ত। তাই সেদিন প্রথম তাকে আমরা বিচলিত হতে দেখেছি। আমাদের পক্ষে ভীষণ প্রতিকূলতা। গুলি বিনিময় সমানভাবে হচ্ছে। ক্যাপ্টেন সাহেব খাল পার হতে অক্ষম। সিগন্যালম্যান ফায়ার সাপাের্ট চাচ্ছেন। নিজেদের জীবন বিপন্ন জেনেও ছুটে এলেন ল্যান্স নায়েক নূর মােহাম্মদ (শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ) ও হাবিলদার আবুল হােসেন (বর্তমানে ল্যান্স নায়েক)। দুজনে মিলে ক্যাপ্টেন সাহেবকে কাঁধে করে খাল পার করলেন। খালের ভেতর কোনাে জায়গায় বুকপানি আবার কোনাে জায়গায় গলা পানি। আমনধানের পাকা নাড়ার ভেতর খাল অতিক্রম করা ছিল দুরূহ। তার ওপর ঝক ঝাক গুলি । সেদিনই নিজের বিপদে তাকে প্রথম অশ্রু বর্ষণ করতে দেখেছি। সবচেয়ে বেশি মুষড়ে পড়তে দেখেছি তাঁকে সেদিন, যেদিন ল্যান্স নায়েক নূর মােহাম্মদ ও নায়েক সুবেদার মনিরুজ্জামান শহীদ হন।২
১৪ তম প্যারা ব্রিগেডের মেজর মঞ্জুর শিয়ালকোট সেনানিবাস থেকে জুলাই মাসে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালি অফিসারদের মধ্যে যাদের নাম বেশি শােনা যেতাে মেজর মঞ্জুর ছিল তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমান্ড অনুসারে মেজর মঞ্জুর ১৫ আগস্ট আট নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব নিতে আসেন। ১৮ আগস্ট তিনি সেক্টরের সম্পূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। মেজর মঞ্জুর শুধু আট নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব পেলেন না- নয় নম্বর সেক্টরেরও বৃহত্তম অপারেশনের ক্ষেত্রে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। তিনি সেক্টরের দায়িত্ব নেওয়ার পর সেক্টরকে সম্পূর্ণভাবে ঢেলে সাজালেন। এফএফ বাহিনীকেও নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেন। তারপর শুরু করলেন নতুন করে অপারেশন। মেজর মঞ্জুর মুক্তিযােদ্ধাদের আশু করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে একটি পুস্তিকা লিখে সমগ্র সেক্টরে প্রচার করলেন। বাঙালি রাজাকার ও দালালদের হত্যার পরিবর্তে তাদেরকে ‘মটিভেট করে নিজেদের দলে নিয়ে আসার বিষয়ে তিনি বেশি জোর দিলেন।
৯৪
এদিকে ১৭ জুলাই মুজিবনগরের নিকটে বাগুয়ান ও রতনপুর ঘাটের মাঝামাঝি জায়গায় পাকবাহিনীর সঙ্গে নায়েক সুবেদার পাটোয়ারীর দলের এক সংঘর্ষ হয়। তাঁর। ভাষায় ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ :
“১৭ জুলাই তারিখের ঘটনা। আমাদের ইনফরমার’ ছিল ভাদুমণ্ডল (গােপালনগরে বাড়ি)। সে পাকসেনাদের সঙ্গে থাকত এবং খবরাখবর সংগ্রহ করে আমাদের দিত। ভাদুমণ্ডল আমাকে খবর দিল যে, ১৭ জুলাই তারিখে তারা গরুর গাড়ি করে নাটোর থেকে রেশন নিয়ে মানিকনগর যাবে। সঙ্গে ১৫ জনের মতাে পাকসেনা থাকবে। ভাদুমণ্ডল হুশিয়ার করে দিল। আমার গাড়ােয়ান যেন না মরে।’ আমি ১৫ জনের একটি দল নিয়ে একজন সিভিল গাইডের সহায়তায় বাগুয়ান ও রতনপুর ঘাটের নিকটে ওত পেতে বসে থাকি। গাইডও আমাদের সঙ্গে রইলাে। ভাের ৬ টায় যখন পাকসেনাদের দলটি রেশন নিয়ে চলছিল ঠিক তখনই আমরা পাকসেনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। এক ঘণ্টা সংঘর্ষ চলল। গােলাগুলির শব্দে মানিকনগর ও নাটোদা হাই স্কুলে অবস্থানরত পাকসেনারা ঘটনাস্থলে দ্রুত চলে আসে এবং আমাদের দু’দিক থেকে ঘিরে ফেলে। পাকসেনারা আমাদের আত্মসমর্পণ করতে বলল। আমি বললাম, ক্ষমতা থাকে তাে এসে ধরাে। সামনা-সামনি গালাগালি চলছে— গুলি চালাচ্ছি আর পিছু হটছি। আমাদের গাইড পিছু পড়ে গেল এবং সে পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ল। আমরা শেষ পর্যন্ত নিরাপদে মূলঘাঁটিতে ফিরে আসি। ওইদিন বিকেলে পাকসেনারা আমাদের গাইডের দু’হাত-পা বেঁধে নাটোদা স্কুলে উপস্থিত জনতার সামনে বেয়ােনেট দিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করল। এই হত্যাযজ্ঞ নিরীহ গ্রামবাসীকে দেখতে বাধ্য করা হলাে, বলা হলাে ‘মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করলে এমনি শাস্তি পেতে হবে।৩
এই এলাকাতে ২০, ২৬ এবং ৩০ জুলাই তারিখে গেরিলা মােঃ সারী, রবীন মণ্ডল, মফিজউদ্দিন, রওশন আলী, বরকত আলী, জার্মান আলী, জামাত আলী, নায়েক আলী প্রমুখ পাকসেনাদের বিভিন্ন অবস্থানের ওপর, এমন কি প্রকাশ্য দিবালােকে নদী পেরিয়ে মেহেরপুরের বিভিন্ন পাক অবস্থানের ওপর হামলা চালিয়ে পাকসেনাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে দেয়। ক্যাপ্টেন এ আর আযম চৌধুরীর সুযােগ্য নেতৃত্বের ফলেই ৩রা আগস্ট পাকসেনারা মানিকগঞ্জ ছেড়ে মােনাখালী ঘাটে চলে যায়। মুক্তিবাহিনী অগ্রসর হয়ে মানিকগঞ্জে এসে মজবুতভাবে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তােলে।
২৪ আগস্ট এক কোম্পানি পাকসেনা নাটোদা থেকে মুজিবনগরের দিকে অগ্রসর হয়। ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরী সংবাদ পেলেন মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি বাগুয়ান এবং মানিকনগরে এসে ডিফেন্স নিল। ওই তারিখে সকাল ১০টার সময় পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর রাইফেলের আওতায় এলেই সবাই গুলি ছুড়তে থাকে। উভয় পক্ষে আড়াই ঘণ্টা কাল সংঘর্ষ স্থায়ী হয়। ৯জন পাকসেনা নিহত এবং বেশকিছু আহত হন। মুক্তিবাহিনীর একজন এলএমজি ধারী গুরুতররূপে আহত হয়। চরমভাবে মার খেয়ে পেছনে সরে যায় পাকসেনারা।
অন্যদিকে ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান, ক্যাপ্টেন তােফিক-ই-এলাহি চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মাহবুব, লেঃ জাহাঙ্গীর প্রমুখ অফিসার তাদের স্ব স্ব সাব-সেক্টর এলাকাতে পাকিস্তানিদের ওপর হামলা অব্যাহত রাখেন।
১৭ আগস্ট গয়েসপুরে পাকসেনাদের একটি টহলদার দলের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর এক সংঘর্ষ হয়। ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমানের নির্দেশে হাবিলদার মফিজুল হক তার প্লাটুন নিয়ে গয়েসপুর এলাকাতে অবস্থান করছিলেন। ১৭ আগস্ট হাবিলদার মফিজুল হক পাক সেনাদের একটি টহলদার দলকে আসতে দেখে সঙ্গে সঙ্গে তার দল নিয়ে দুটি কলামে ভাগ হয়ে চুপচাপ বসে রইলেন। গয়েসপুর গ্রাম পেরিয়ে যাবার শেষ পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর রাইফেল গর্জে উঠল। এই আক্রমণে পাকসেনারা এতােই ভীত হয়ে পড়ে যে পাল্টা কিছু করার পরিবর্তে তারা জিপ গাড়িটি ফেলে পালিয়ে যায়। হাবিলদার হক তার বাহিনী নিয়ে জিপ গাড়িটি এবং বেশকিছু গােলাবারুদ সাব-সেক্টরে, হেড কোয়ার্টার বানপুরে, পৌছে দেন।
আট নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুর প্রতিটি সাব-সেক্টর ঝটিকা সফর করে মুক্তিবাহিনীকে সুসংহত ও সুসংগঠিত করে পাকিস্তানিদের ওপর আঘাতের পর আঘাত হানতে লাগলেন। সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নজমুল হককে ৫ সেপ্টেম্বর সেক্টর। কমান্ডার মেজর মঞ্জুর আর একটি অতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিলেন । বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে আগত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলাদের ফরিদপুর জেলা ও ঝিনাইদহ মহকুমার। দুটি থানা ভিন্ন সমগ্র যশাের জেলার অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে গেরিলা অবস্থান প্রস্তুত করে সেখান থেকে গেরিলাদের দেশের প্রত্যন্ত এলাকাতে পাঠাতে বললেন। ক্যাপ্টেন। নজমুল হক তার সাব-সেক্টরের দায়িত্ব ছাড়াও এই অতিরিক্ত দায়িত্বটি সুষ্ঠুভাবে পালন করেন।
সেপ্টেম্বর মাসে ১৬/১৭ তারিখে সাতক্ষীরা মহকুমার কলারােয়া থানার বালিয়াডাংগা নামক স্থানে পাকিস্তানীদের সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। ক্যাপ্টেন শফিকউল্লাহ তাঁর ‘ই’ কোম্পানি নিয়ে ঐ এলাকায় পূর্ব থেকেই যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। ক্যাপ্টেন এ আর আযম চৌধুরী একটি কোম্পানি নিয়ে বালিয়াডাংগাতে এলেন। হটাৎগঞ্জে ৯নং বেলুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি অবস্থান করছিল। পাকিস্তানিরা আর্টিলারির সহায়তায় ওই তারিখে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান বালিয়াডাংগা আক্রমণ করে। ক্যাপ্টেন আযম ও শফিকউল্লাহ তাদের বাহিনী নিয়ে প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করে পাল্টা আঘাত হানতে থাকেন। পাকিস্তানি আক্রমণের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। বৃষ্টির মতাে তাদের আর্টিলারি গােলার আঘাতে মুক্তিবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। এই প্রচণ্ড আক্রমণের মুখেও মুক্তিবাহিনী টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে। সংঘর্ষ অব্যাহত রইলাে। ১৮/১৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি গােলার আঘাতে ক্যাপ্টেন শফিকউল্লাহ গুরুতররূপে আহত হলেন। এই সংবাদে সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুর ক্যাপ্টেন মাহবুবকে পাঠালেন। ২০ সেপ্টেম্বর পাকসেনাদের তীব্র আক্রমণের মুখে মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে থাকে। গােলার আঘাতে ক্যাপ্টেন মাহবুবও আহত হলেন। ক্যাপ্টেন আযম
৯৬
চৌধুরী পেছনে সরে এলেন। বালিয়াডাংগা পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় । পাকিস্তানিদের নিহতের সংখ্যা অধিক হলেও মুক্তিবাহিনীর ৮জন নিহত এবং দু’জন অফিসারসহ বহুসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা গুরুতররূপে আহত হয়। সুবেদার মেজর তবারকউল্লাহ পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী হন। তার ওপর দিনের পর দিন অত্যাচার। চালিয়ে নানা তথ্য জানার চেষ্টা করা হয়। তাকে মুমূর্ষ অবস্থায় ১৬ ডিসেম্বর জেলখানা থেকে মুক্ত করা হয়।
বালিয়াডাংগার সংঘর্ষ এতাে ভয়াবহ, লােমহর্ষক ও মারাত্মক ছিল যে, আজ সেকথা মনে করলে অনেকেই শিউরে ওঠে। সেক্টর কমান্ডার মঞ্জুর বলেছেন, বালিয়াডাংগার যুদ্ধ ছিল যুদ্ধ-জগতের এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী সংঘর্ষ ।
১৫ অক্টোবর ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান তার বাহিনী নিয়ে ধােপাখালীতে অবস্থানরত পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করলেন। তুমুল সংঘর্ষে ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর। রহমান গুরুতরভাবে আহত হলেন, শহীদ হলেন হাবিলদার আবদুল গফুর, নায়েক রশীদ আলী প্রমুখ। পাকসেনাদের পক্ষে হতাহতের সংখ্যা সঠিক জানা না গেলেও গ্রামবাসীর সূত্রে ৭ জনের মৃত্যুর সংবাদ জানা যায়।
অন্যদিকে ক্যাপ্টেন হুদার বাহিনী ১৫ অক্টোবর তারিখে ঝিকরগাছার নিকটবর্তী দোশাতিনাল নামক স্থানে পাকিস্তানি টহলদার দলকে ‘অ্যামবুশ করে ৩০ জন পাকসেনাকে হত্যা করে এবং বেশকিছু অস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার করে।
আট নম্বর সেক্টরের আওতাভুক্ত নাভারনের নিকটবর্তী গৌরপুর নামক স্থানে পাকিস্তানিরা দিনের বেলাতেই বাঙ্কার করে ডিফেন্স নিচ্ছে বলে জানতে পেরে ক্যাপ্টেন হুদা তাঁর নিজস্ব একটি কোম্পানি এবং এক কোম্পানি এফ এফ নিয়ে ১লা নভেম্বর রাতে পাকিস্তানিদের আক্রমণ করেন। তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা ডিফেন্স ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরপর পাকসেনারা আর কোনাে সময়ই এমুখাে হয়নি।
৩রা নভেম্বর ক্যাপ্টেন হুদার নির্দেশে লেঃ অলীক গুপ্ত একটি ই পি আর প্লাটুন নিয়ে মাসলিয়ার নিকটবর্তী হিজলী বি ও পিতে পাকসেনাদের অ্যামবুশ করলেন। তীব্র গােলাগুলির মুখে পাকসেনারা ক্ষতি স্বীকার করে পেছনে সরে যায়। কিন্তু পাকিস্তানিরা কিছুক্ষণের মধ্যে বিপর্যস্ত অবস্থা কাটিয়ে রিয়ার সাপাের্টে লেঃ গুপ্তের ওপর ব্যাপকভাবে প্রতিআক্রমণ চালায়। তারা লেঃ গুপ্ত ও তাঁর বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। বাংলাদেশ কমিশও তরুণ অফিসার লেঃ অলীক গুপ্ত অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে পাকিস্তানীদের মােকাবেলা করে। মুক্তিবাহিনীর চরম অবস্থার খবর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নজমুল হুদার নিকট পৌছলে ক্যাপ্টেন হুদা সঙ্গে সঙ্গে দুটি প্লাটুন নিয়ে পাকিস্তানিদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালান। মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি সাপাের্টও পাওয়া গেল। একদিকে মুক্তিবাহিনীর তীব্র সম্মুখ আক্রমণ, অপরদিকে আর্টিলারির আঘাতে পাকিস্তানিরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। প্রচুর অস্ত্র, গােলাবারুদ এবং ১২ জনের মৃতদেহ ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়ে অবশিষ্ট কোনাে রকমে জীবন বাঁচায়।৪
১০ নভেম্বর লেঃ কামাল সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি যশােরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। লে. সিদ্দিকী ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে লােহাগড়া থানা, কালিয়া থানা এবং নড়াইল মহকুমা নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সমর্থ হন।
১২ নভেম্বর রাতে ক্যাপ্টেন হুদা ২টি কোম্পানি নিয়ে চৌগাছা ও মাসলিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত পাকঘাঁটি আক্রমণ করেন। এই আক্রমণে মিত্রবাহিনীর ১নং জম্মু-কাশ্মীর রাইফেলস ব্যাটালিয়নও অংশ নেয়। যৌথ আক্রমণের মুখে পাকসেনারা ডিফেন্স ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।৫
১৩ নভেম্বর ক্যাপ্টেন হুদা তাঁর বাহিনী নিয়ে আরও ১ মাইল অগ্রসর হয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুললেন।
২৪ নভেম্বর গরীবপুরে পাকিস্তানিদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর এক ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে পাকিস্তানি ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সাহায্যে ভারতীয় ট্যাঙ্কও রণাঙ্গনে উপস্থিত হয়। উভয়পক্ষের তুমুল সংঘর্ষে পাকসেনাদের ৭টি ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়। এই সময় পাক জঙ্গী বিমান সাহায্য করতে এলে দুটি জঙ্গী বিমানকেই গুলি করে ভূপাতিত করা হয়, বন্দী করা হয় দু’জন পাইলটকে। এই সংঘর্ষ সম্পর্কে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা নামে দেশ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে :
‘বাংলাদেশের চৌগাছা থানার অখ্যাত গ্রাম গরীবপুর। ২১ নভেম্বর ভারতীয় ট্যাঙ্কের কু-দের ত্বরিত লড়াইয়ে পাকিস্তানিদের তিনটি শাফে ট্যাঙ্ক সেখানে বন্দী হলাে। ৭৬ জন খানসেনা খতম। বাকিরা চম্পট। যাবার সময় ফেলে গেছে আরও ৮টি জখম ট্যাঙ্ক, বাক্সভরা মার্কিন আর চীনা অস্ত্র খােলারও সময় পায়নি।৬
বাংলা নামে দেশ” গ্রন্থে তারিখের প্রশ্নে ২১ নভেম্বরের উল্লেখ থাকলেও সম্ভবত তারিখটি ২৪ নভেম্বরই ছিল।
এদিকে ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান ২৬ নভেম্বর কুষ্টিয়ার জীবননগর থানা দখল করে ক্রমশ খালিশপুর, কোটচাদপুর, কালিগঞ্জ এবং ঝিনাইদহের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। ক্যাপ্টেন এ আর আযম চৌধুরী তার বাহিনী নিয়ে মানিকনগর, মােনাখালী, রশিপুর ও রাজাপুর হয়ে মেহেরপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন।
এই সময় এ এলাকায় পাকিস্তানি ৯ম ডিভিশন চরমভাবে মার খাচ্ছিল। ৯ম ডিভিশন হেডকোয়ার্টার যশাের সেনানিবাস থেকে সরিয়ে মাগুরা নিয়ে যাওয়া হল । পাকসেনারা চৌগাছায় চরমভাবে মার খাবার পর তারা তিন ভাগে ভাগ হয়ে একটি অংশ ঝিনাইদহ-মেহেরপুর এলাকাতে, একটি অংশ ঝিকরগাছার উত্তর-পশ্চিমে এবং একটি অংশ সাতক্ষীরা-খুলনা এলাকাতে অবস্থান নেয়।
আট নম্বর সেক্টরে পুরােদমে যুদ্ধ চলছিল। ৩ ডিসেম্বর থেকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় নবম ডিভিশনও অগ্রসর হতে থাকে। ভারতীয় ডিভিশন দুটি কলাম দু’দিক থেকে যশাের-ঢাকা হাইওয়ের উপর এসে দাঁড়াল। ৬ ডিসেম্বর থেকে পাকিস্তানি নবম ডিভিশনও পালাবার পথ খুঁজছিল। লেঃ জেনারেল নিয়াজী ৫ ডিসেম্বর রাতেই সব ক’টি ডিফেন্সে খবর পাঠিয়েছিল ‘পুলব্যাক। এই সংবাদে ৯ম ডিভিশনের পুরাে অংশটাই
৯৮
পালাবার ইচ্ছা করলেও পালাবার পথ তারা পেল না। কারণ ততক্ষণে ভারতীয় চতুর্থ ও নবম ডিভিশন যশাের-ঢাকা হাইওয়েতে ঘাঁটি করে ফেলেছে। পাকিস্তানি নবম ডিভিশনের একটি কলাম মাগুরা হয়ে মধুমতী পেরিয়ে ঢাকার দিকে, অপর কলাম খুলনার দিকে এবং কিছু অংশ কুষ্টিয়ার দিকে যায়। বস্তুত ৬ ডিসেম্বরেই যশাের শহর মুক্ত হয়। ৭ ডিসেম্বর বেলা এগারটার দিকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী উভয়দিক দিয়ে যশাের পৌছে। মিত্রবাহিনীর ডিভিশন প্রধান মেজর জেনারেল দলবীর সিং বয়রাঝিকরগাছার পথ ধরে ৯ম ডিভিশনের অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে যশাের পৌছেন।
এদিকে ১২ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলার ভাটিয়াপাড়া থানার মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানিদের সংঘর্ষ চলছিলাে। লেঃ সিদ্দিকী তাঁর বাহিনী নিয়ে বেশ বিব্রত বােধ করছিলেন। এই সংবাদ ক্যাপ্টেন নজমুল হুদার কাছে পৌছলে তিনি তৎক্ষণাৎ তার বাহিনী নিয়ে ভাটিয়াপাড়া পৌছেন। ১৪ ডিসেম্বর যৌথবাহিনী পাকিস্তানিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখানে অসংখ্য এফ এফ বাহিনীও সংঘর্ষে অংশ নেয়। মুক্তিবাহিনীর এই প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে অফিসারসহ ১৫০ জন পাকসেনা ক্যাপ্টেন হুদার কাছে ১৮ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে। যশাের, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও খুলনা হানাদারমুক্ত হয়।
তথ্য নির্দেশ
১. সাপ্তাহিক দেশ বার্তা, সিলেট থেকে প্রকাশিত, ২৫ জুলাই ১৯৭৩, প্রথমবর্ষ, ৪৬ সংখ্যা।
২. পূর্বোক্ত।
৩. সাক্ষাৎকার : সুবেদার আব্দুল মতিন পাটোয়ারী।
৪. সাক্ষাত্তার : মেজর মােহাম্মদ মােস্তফা (অব.)।
৫. সাক্ষাৎকার : মেজর মােহাম্মাদ আলী (অব.)।
৬. অভীক সরকার সম্পাদিত ‘বাংলা নামে দেশ’, কলিকাতা, এপ্রিল ১৯৭২, পৃষ্ঠা-১১৭।
নয় নম্বর সেক্টর
বরিশাল-পটুয়াখালী, দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়ক থেকে খুলনা জেলার দক্ষিণাঞ্চল ও ফরিদপুর জেলার অংশবিশেষ নিয়ে নয় নম্বর সেক্টর এলাকা নির্ধারিত হয়। সেক্টর কমান্ডার ছিল মেজর এম এ জলিল । সেক্টরকে তিনটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়।
সাব-সেক্টরগুলাের অবস্থান ছিল :
(১) টাকি, (২) হিঙ্গলগঞ্জ এবং (৩) শমসেরনগর।
এ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরে বেশ কিছু গেরিলা বেইস গড়ে উঠেছিল । সেক্টর মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা ছিল প্রায় ৮ হাজার। কিন্তু কমান্ডার মেজর জলিল ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার মুক্তিযােদ্ধা কাজ করেছেন বলে দাবি করেছেন।
নয় নম্বর সেক্টরে বেশকিছু মুক্তিযােদ্ধা বেইস এবং সাব-সেক্টর গড়ে ওঠে। বরিশালের অভ্যন্তরে ক্যাপ্টেন শাজাহানের নেতৃত্বে একটি বড়াে রকমের মুক্তিবাহিনীর দল গড়ে ওঠে। ক্যাপ্টেন শাজাহান বরিশালের বিভিন্ন স্থানে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ ও অ্যামবুশ করে তাদেরকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুল গফুর, আরব আলী, কুদুস মােল্লা, মধু প্রমুখের কম্যাণ্ডে বেশকিছুসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রেখেছে। বরিশালে গড়ে ওঠা ছােটো ছােটো মুক্তিযােদ্ধার দলগুলাে ক্যাপ্টেন শাজাহানের কমান্ড মেনে নিয়ে কাজ করতে থাকে।
পটুয়াখালী জেলার অভ্যন্তরেও মুক্তিযােদ্ধারা তাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিলাে। জেলার অভ্যন্তরেই ক্যাম্প করে ক্যাপ্টেন মেহেদী পাকিস্তানিদের ওপর হামলা চালিয়েছেন।
ফরিদপুর জেলার অভ্যন্তরে স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান এবং স্টুয়ার্ড নূর মােহাম্মদ মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে অপারেশন চালিয়েছেন।
ক্যাপ্টেন জিয়া সুন্দরবন এলাকাতে একক প্রচেষ্টায় এক বিরাট বাহিনী গড়ে তােলেন। তিনি তার বাহিনীকে গড়ে তুলেছিলেন দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের জন্যে। সুন্দরবন এলাকাতে তিনি একটি গ্যারিসন তৈরি করে ফেলেছিলেন। এই এলাকায় লেঃ বেগও কিছুদিন কাজ করেন। দেশের অভ্যন্তরে ক্যাপ্টেন শাজাহান, ক্যাপ্টেন মেহেদী, ক্যাপ্টেন জিয়া, স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান, স্টুয়ার্ড নূর মােহাম্মদ প্রমুখের সঙ্গে সেক্টর
১০০
কমান্ডার মেজর জলিলের নিয়মিত যােগাযােগ ছিল এবং তিনি সামরিক সাহায্যও পাঠিয়েছেন। যদিও সে সাহায্য প্রয়ােজনের তুলনায় অপ্রতুল ছিল।
ফরিদপুর জেলাতে হাবিলদার হেমায়েতের এক বিরাট বাহিনী গড়ে ওঠে। হাবিলদার বিশেষ করে ফরিদপুর জেলাতে ব্যাপকভাবে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে হামলা চালিয়ে জেলাতে নিজ কর্তৃত্ব বজায় রাখেন। পরবর্তীকালে এই বাহিনী ‘হেমায়েত বাহিনী হিসেবে পরিচিত হয়।
এই সেক্টর মিত্রবাহিনী ‘চার্লি’-সেক্টরের তত্ত্বাবধানে ছিল। সেক্টর কমান্ডার ছিল ব্রিগেডিয়ার এন এ সালেক।
নয় নম্বর সেক্টরেও মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা অব্যাহত ছিল। মেজর জলিল সেক্টরের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রাথমিক পর্যায়ে পাকঘাটি শ্রীপুর, বসন্তপুর ও কৈখালী দখলের জন্যে বিপরীতে টাকি, হিঙ্গলগঞ্জ ও শমসেরনগরে মুক্তিবাহিনীর সুদৃঢ় ঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনা নিলেন। প্রথমে টাকিতে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে হিঙ্গলগঞ্জে ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে প্রথম বেইস ক্যাম্প স্থাপন করলেন। “হিঙ্গলগঞ্জে ভারতের ৭২নং সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর একটা স্থায়ী ফাঁড়ি ছিল- ক্যাপ্টেন পান্ডে ছিল এর অধিনায়ক। তিনি তাঁর ফাঁড়ির এক মাইল দক্ষিণে একটি ঘাঁটি বানাতে ক্যাপ্টেন হুদাকে সব রকম সাহায্য করলেন। এ ঘাঁটিটি ইছামতি নদীর তীর থেকে আধ মাইল ভেতরে। এর ঠিক উল্টো পাড়ে পাক হানাদারদের সুদৃঢ় পর্যবেক্ষণ ফাঁড়ি।১
আগস্ট মাসের প্রথমদিকে মেজর জলিল তার পরিকল্পনানুযায়ী শমসেরনগরে সাবসেক্টর স্থাপন করলেন। কমান্ডার নিযুক্ত হলেন ফ্লাইট সার্জেন্ট সলিমুল্লাহ। অবশ্য পরবর্তীকালে ক্যাপ্টেন বেগ এই সাব-সেক্টরটির দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
“শমসেরনগরে ভারতীয় সীমান্তবর্তী ফাঁড়ির আধ মাইল দক্ষিণে নদীর তীরে বাঁশ দিয়ে একটা ঘাঁটির মতাে তৈরি করা হল। এর চতুর্দিকে কাদা পানি।”
গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধির জন্যে মেজর জলিল একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা আর্মি হাইকমান্ড থেকে অনুমােদন করিয়ে নিলেন। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী- “ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা ও পটুয়াখালী এই চারটি জেলাকে ১৯টি অঞ্চলে বিভক্ত করা হলাে। আগের কার্যক্রম অনুযায়ী এক একটি অঞ্চলে দু’ থেকে তিনটি থানা রইলাে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আগে থেকেই গেরিলা ঘাঁটি ছিল সর্বমােট ৮৩টি। প্রতিটি জেলা, প্রতিটি অঞ্চল, প্রতিটি থানার দায়িত্ব যথাক্রমে একজন সামরিক অফিসার, অথবা অভিজ্ঞ নন-কমিশণ্ড অফিসার এবং বাছাই করা একজন ছাত্রের ওপর ন্যস্ত করা হলাে। সকল পর্যায়ে এদের সঙ্গে ছিল একজন করে সহ-অধিনায়ক।২
এই সেক্টরে পাঁচটি লঞ্চলে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে গানবােট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই গানবােটগুলাে খুলনা, চালনা ও সুন্দরবন এলাকাতে নদীপথে পাকিস্তানিদের ওপর হামলা চালিয়ে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছিল । উল্লেখ্য যে, এই লঞ্চগুলাে প্রায় সবই ছিল ইপিআর বাহিনীর। শুধু এই সেক্টরেই নয়, অন্যান্য সেক্টরেও ইপিআর বাহিনীর লঞ্চগুলােকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানাে হয়েছে।
১০১
পাকসেনাদের শক্ত ঘাঁটি ছিল শংকরা, শ্রীপুর, দেবহাটা, খানজী, বসন্তপুর, উকসা ও কৈখালী। ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা বসন্তপুর পাকঘাটি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন। একই সময়ে টাকি বেইস থেকে শ্রীপুর পাকঘাঁটি আক্রমণেরও সিদ্ধান্ত হল। ইছামতী পেরিয়ে ‘রেকি করে সকল তথ্য সংগ্রহ করলেন হাবিলদার সােবহান।
১২/১৩ জুন রাতে ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুন নিয়ে বসন্তপুর পাকঘাটির দিকে অগ্রসর হলেন। অপর দিকে ইছামতি পেরিয়ে মুক্তিবাহিনীর লে. মুখার্জী, হাবিলদার সােবহান এবং শিক্ষক শাজাহানের নেতৃত্বে একটি করে প্লাটুন শ্রীপুর পাকঘাটির দিকে অগ্রসর হল। মুক্তিবাহিনীর এই দুটো দলই রাত ১২টার পর অকস্মাৎ পাকর্ঘাটি আক্রমণ করে বসল। পাকসেনারা এই আক্রমণের জন্য মােটেই প্রস্তুত ছিল না। তারা ভাবতেও পারেনি এই দুর্যোগময় রাতে প্রমত্তা ইছামতি পেরিয়ে মুক্তিবাহিনী তাদেরকে আক্রমণ করতে পারে । ক্যাপ্টেন নুরুল হুদার তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা চরমভাবে মার খেল । সংঘর্ষে ২০ জন পাকসেনা নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হলাে। মুক্তিবাহিনী ৫০টি রাইফেল, দুটি এলএমজি এবং বেশকিছু গােলাবারুদ উদ্ধার করে।
অপরদিকে জনাব শাজাহানের নেতৃত্বে শ্রীপুরেও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ সফল হয়। পাকসেনাদের হতাহতের সংখ্যা জানা না গেলেও মুক্তিবাহিনী ৩৫টি রাইফেল এবং বেশ কিছু গােলাবারুদ উদ্ধার করে। দুটি অপারেশনেই মুক্তিবাহিনী কোনাে ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই ভােরবেলা মূল ঘাটিতে ফিরে আসে।
জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা মুক্তিবাহিনীর ১৬০ জন লােক নিয়ে পাকঘাটি খানজী বি ও পি আক্রমণ করলেন। রাত ১০ টায় ক্যাপ্টেন হুদা তাঁর বাহিনী নিয়ে ঈপ্সিত লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হলেন। তিনি তাঁর বাহিনীকে বিভক্ত করলেন তিনটি কলামে। ডান দিকে একটি কলাম নিয়ে ক্যাপ্টেন হুদা নিজে রইলেন। বাম দিকের কলামটিতে লেঃ বেগ এবং হাবিলদার সােবহান রইলেন ‘কাট অফ পার্টি হিসেবে। বি ও পি তে পাকসেনাদের শক্তি ছিল দুই প্লাটুন।
তিনটি কলামই যথাযথ স্থানে পৌছে গেলে প্রথমে নায়েক সুবেদার গফুর ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে গােলা নিক্ষেপ করলেন পাকিস্তানি অবস্থানে। উভয়পক্ষের ব্যাপক সংঘর্ষ ৩০ মিনিট স্থায়ী হয়। মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে পাকসেনারা পালিয়ে সাতক্ষীরা ও দেবহাটার মধ্যস্থলে পারুলিয়া নামক স্থানে অবস্থান নেয়। আহত অবস্থায় ৪ জন পাকসেনা বন্দী হয়। নিহতের সংখ্যা সঠিক জানা যায়নি। ক্যাপ্টেন হুদা পাকসেনাদের কাছ থেকে ২ ইঞ্চি মর্টার, এসএমজি ৭৬২ টি, চায়নিজ রাইফেল এবং বেশকিছু গােলাবারুদ ও রেশন সামগ্রী উদ্ধার করেন। এই বিজয়ে মুক্তিবাহিনী সদস্যদের মনােবল বহুগুণে বেড়ে যায়।
ক্যাপ্টেন হুদা হিঙ্গলগঞ্জে ঘাঁটি স্থাপনের কিছুদিনের মধ্যেই উকসা পর্যন্ত তাঁর ঘাঁটি বিস্তৃত করলেন। আগস্ট মাসের শেষের দিকে পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর উকসা ঘাঁটি আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীও ছিল প্রস্তুত। ফলে, শেষ পর্যন্ত পাকসেনারা দারুণ ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই অপারেশন সম্পর্কে বাংলা মুক্ত
১০২
এলাকা থেকে প্রকাশিত ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ এ ‘উকসা-গােবিন্দপুরে নয় ঘণ্টা যুদ্ধ গােবিন্দপুর মুক্ত’ এই শিরােনামে লিখেছে :
খুলনা, ৩০ আগস্ট উকসা-গােবিন্দপুরে মুক্তিবাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটির ওপর প্রায় ৪০০ পাকসেনা আক্রমণ চালালে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। বাংলাদেশের বীর বিপ্লবী মুক্তিযােদ্ধারা দীর্ঘ নয় ঘণ্টা যুদ্ধের পর শত্রুসেনাদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। এখানে যুদ্ধে ৮ জন খানসেনা নিহত এবং বেশকিছু সৈন্য আহত হয়। জানা গেছে, পাক মেজর গুরুতর আহত হলে সৈন্যরা পালিয়ে যায়। উকসা-গােবিন্দপুর এখন মুক্তিবাহিনীর দখলে।৪
২০ আগস্টে শ্যামনগরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকসেনাদের এক বড়াে রকমের সংঘর্ষ হয়। ক্যাপ্টেন নুরুল হুদার নেতৃত্বে ১৫০ জন মুক্তিযােদ্ধা অগ্রসর হয় শ্যামনগর আক্রমণের জন্যে। ক্যাপ্টেন হুদার সঙ্গে লে. বেগ, সুবেদার ইলিয়াস, নায়েক গফুর, হাবিলদার সােবহান, হাবিলদার আবদুল হক প্রমুখ সুযােগ্য যােদ্ধাগণও ছিলেন। মুক্তিবাহিনীর দলটি উকসা হেডকোয়ার্টার থেকে রওয়ানা হয়ে রাত দুটোয় শ্যামনগর শত্রুবহের কাছাকাছি পৌছে যায়। শ্যামনগর ওয়াপদা কলােনীতে অবস্থানরত পাকসেনাদের এক প্লাটুন শক্তি ছিল। পাকসেনাদের প্রতিরক্ষা ছিল অত্যন্ত সূদৃঢ় । ক্যাপ্টেন হুদা তাঁর বাহিনীকে তিন কলামে বিভক্ত করলেন এবং একটি কলামে তিনি নিজে রইলেন। সড়কের অপর পাড়ে একটি কলামের সঙ্গে রইলে লেঃ বেগ। নায়েক সুবেদার আবদুল গফুর, হাবিলদার সােবহান রইলেন অপর কলামে। মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র ছিল এল এম জি ১২টি, ২ ইঞ্চি মর্টার ২টি এবং অবশিষ্ট এস এল আর ও রাইফেল। মুক্তিবাহিনী যথাযথ অবস্থানে পৌঁছে গেলে রাত ২ টার পর পরই নায়েক সুবেদার গফুর ২ ইঞ্চি মর্টার নিয়ে প্রথম পাক অবস্থানে আঘাত হানতে শুরু করলেন। এদিকে পাকসেনাদের প্রচণ্ড বাধা অতিক্রম করে ক্যাপ্টেন হুদা এবং লে. বেগ কিছুতেই অগ্রসর হতে পারছিলেন না। রাত ৪ টার দিকে কালিগঞ্জ থেকে পাকসেনাদের আর একটি প্লটুন নির্বিবাদে শ্যামনগর চলে আসে। উভয়পক্ষে প্রচণ্ড সংঘর্ষ চলতে থাকে । উভয়পক্ষের মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গুলিবৃষ্টির মধ্যে সুবেদার ইলিয়াস ক্রলিং করে ওয়াপদা কলােনীর ভেতর প্রবেশ করে পজিশন নিলেন। সুবেদার ইলিয়াসকে লক্ষ করে আরাে কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা ক্রলিং করে কলােনীর ভেতরে প্রবেশ করে, ইত্যবসরে ক্যাপ্টেন হুদা বেশ অগ্রসর হয়ে যান। মুক্তিবাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণের মুখে পাকসেনারা চরমভাবে মার খেয়ে পালিয়ে যায়। সকাল ৯টায় শ্যামনগর মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। সংঘর্ষে ৪ জন পাকসেনার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় । ৪ জন। পাকিস্তানি আহত অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দী হয়। এই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী শ্যামনগর থানা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেও বিজয়ের চরম দণ্ড দিতে হয়। সুবেদার ইলিয়াসসহ ৮জন এখানে শহীদ হন এবং ৬জন মুক্তিযােদ্ধাকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায়। ওইদিন সকালে ২৫জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। ক্যাপ্টেন হুদা শ্যামনগর থানায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। এই সংবাদ পরিবেশন করে স্বাধীন বাংলা থেকে প্রকাশিত ‘জয়বাংলা পত্রিকায় লেখা হয় :
“গত ২০ আগস্ট মুক্তিবাহিনী শ্যামনগর থানা দখল করে। অন্যদিকে পাইকগাছায় একটি লঞ্চে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে গেরিলা যােদ্ধারা ২৬ জন দখলদার সৈন্যকে হত্যা করেন। ৪
শ্যামনগর অপারেশন সম্পর্কে হানাদার নিয়ন্ত্রিত দৈনিক আজাদ’-এ লেখা হয় : সুন্দরবনে গােপন আড্ডায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ— ৫১ জন ভারতীয় চর নিহত; ৯ জন বন্দী—বহু হিন্দুস্তানি অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার: ঢাকা ২১ আগস্ট।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী গত শুক্রবার প্রত্যুষে সুন্দরবনে ভারতীয় চরদের গােপন আড়ার ওপর আক্রমণ করিয়া ৫১ জনকে নিহত ও ৯ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা ছাড়াও বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র আটক করিয়াছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সীমান্ত হইতে প্রায় ৫ মাইল দূরে শ্যামনগরে সুন্দরবনের গভীর অরণ্যে ভারতীয় দালালদের অবস্থানের সন্ধান লাভ করিয়া উভয় দিক হইতে উক্ত আড়ার ওপর আক্রমণ করে। গােপন আড্ডায় অবস্থানরত ভারতীয় চরগণ ভীত-সন্ত্রস্ত হইয়া প্রাণভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় সীমান্তের দিকে পলায়ন করে। ভারতীয় চরগণ ৫১টি লাশ ফেলিয়া যায় এবং তাহাদের ৯ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। আটককৃত ব্যক্তিগণ জানায় যে, পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বাহিনীর দলত্যাগী ক্যাপ্টেন হুদা তাহাদের ক্যাম্প পরিচালনা করিত। এতদ্ব্যতীত লেফটেন্যান্ট বেগ ও সুবেদার লস্করও তাহাদের সাথে অবস্থান করিত।
আটককৃত ব্যক্তিগণ আরও জানান যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাহাদের ওপর আক্রমণ করার পর অধীনস্থ দলীয় লােকজনকে কোনােরূপ নির্দেশ দান না করিয়াই ক্যাপ্টেন হুদা, লেফটেন্যান্ট বেগ ও সুবেদার লস্কর সর্বপ্রথম ছুটিয়া পালাইতে থাকে । লেঃ বেগ ও সুবেদার লস্কর পলায়নকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং সম্ভবত নিহত হয়। ক্যাপ্টেন হুদা কোনােক্রমে পালাইতে সক্ষম হয়। দলীয় নেতৃবৃন্দের পশ্চাদপসরণের পর প্রাণরক্ষার জন্য বিদ্রোহীদের ছুটিয়া পলায়ন করা ছাড়া অন্য কোনাে গত্যন্তর ছিল না।
আটককৃত অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ৩টি ভারি মেশিনগানসহ ৬টি ২ ইঞ্চি মর্টার, ৪৯টি রাইফেল, ৩২টি গ্রেনেড, ৩৫টি মাইন, বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও কয়েক হাজার রাউন্ড রহিয়াছে। আটককৃত অস্ত্রশস্ত্রের অধিকাংশেই ভারতের চিহ্ন রহিয়াছে।৫
ইতােমধ্যে ক্যাপ্টেন জিয়া, ক্যাপ্টেন শাজাহান, ক্যাপ্টেন মেহেদী, স্টুয়ার্ড মুজিবরও তাঁদের আক্রমণাত্মক অভিযান অব্যাহত রেখেছিলেন। ফ্লাইট সার্জেন্ট সলিমুল্লাহও শমসেরনগর থেকে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে বুড়িগােয়ালিনী, হরিনগর ও মুন্সীগঞ্জ দখল করেন। সামরিক স্ট্রাটেজির দিক থেকে বুড়িগােয়ালিনী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। কারণ এখান থেকে বিভিন্ন ‘পাক পকেটে সরবরাহ এবং সবার গতিবিধির ওপর অতি সহজে নজর রাখার সুবিধে ছিল। বুড়িগােয়ালিনী মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসায় মুক্তিবাহিনীর চলাচলের পথ বিশেষ করে নদীপথে যাতায়াত অনেক সহজ হয়।
অক্টোবর মাসে নয় নম্বর সেক্টরে বেশ কয়েকজন তরুণ অফিসার যােগদান করেন। লে. মােহাম্মদ আলী, লেঃ আহসানউল্লাহ এবং লেঃ শচীনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এই তিনজন অফিসার ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে কালিগঞ্জ, পারুলিয়া
১০৪
ইত্যাদি অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অক্টোবর মাসে সেক্টর ট্রুপস গঠনের জন্যে মেজর জলিল নির্দেশ দেন।
নয় নম্বর সেক্টরেও মুক্তিবাহিনী বিশেষভাবে তৎপর ছিল। নভেম্বরের ২০ তারিখে কালিগঞ্জে পাকিস্তানিদের সঙ্গে একটি সংঘর্ষ হল । কালিগঞ্জের ওয়াপদা কলােনিতে পাকসেনাদের একটি কোম্পানি অবস্থান করছিল। এ ছাড়া ছিল পশ্চিমা রেঞ্জার এবং বেশকিছু রাজাকার। ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা তাঁর বাহিনী নিয়ে হেড কোয়ার্টার উকসা থেকে রওয়ানা হয়ে টারগেটের নিকট এসে পৌঁছলেন। এই সময়ে একটি কলাম নিয়ে লে, আহসানউল্লাহ এবং সুবেদার সােবহান শত্রুঘাটির কাছাকাছি এসে পড়লেন। সঙ্গে ছিল মাত্র দুটি প্লটুন। কমান্ডার ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা নিজে একটি কলাম নিয়ে বসন্তপুর। হয়ে কালিগঞ্জ পৌছলেন। নায়েক সুবেদার গফুরও একটি প্লাটুন নিয়ে অপরদিকে অবস্থান নিলেন। নভেম্বরের ২০/২১ তারিখ ভাের ৫টায় মুক্তিবাহিনী প্রথম পাকিস্তানিদের ওপর হামলা চালাল। মিত্রবাহিনীর ৩য় রাজপুত হিঙ্গলগঞ্জ থেকে মুক্তিবাহিনীকে আর্টিলারি সাপাের্ট দেয়। ভাের ৫টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলে। এই দু’ঘণ্টা স্থায়ী সংঘর্ষে কোনাে পক্ষেরই কোনাে হতাহতের সংবাদ পাওয়া যায়নি। তবে প্রায় ৪০ জন পাকসেনা মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। লেঃ আহসানউল্লাহ নিজেই ২২ জন পাকসেনাকে বন্দী করেন। নায়েক সুবেদার গফুরও ৬ জন খান-সেনাকে বন্দী করেন। কালিগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয় । পাকিস্তানিরা পালিয়ে আলীপুর নামক স্থানে অবস্থান নেয়। তারা আলীপুরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলার পূর্বেই পারুলিয়া কাঠের এবং আলীপুর লােহার সেতু ধ্বংস করে । মুক্তিবাহিনীও পিছু ধাওয়া করে, কিন্তু পাকিস্তানিদের ব্যাপক আর্টিলারি ফায়ারের মুখে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি তারা।
নভেম্বর মাসে দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা বাহিনী তাদের উপস্থিতি সর্বত্র ঘােষণা করে চলছিলাে। ২০ নভেম্বর কমান্ডার আনােয়ার হােসেন (মজনু) ৬০ জনের একটি দল নিয়ে পটুয়াখালী জেলার বামনা থানা আক্রমণের জন্য রওয়ানা হন। কিন্তু পরে সংবাদ পাওয়া যায় তিনটি পাকিস্তানি গানবােট সেদিকেই আসছে। কমান্ডার আনােয়ার হােসেন তার বাহিনী নিয়ে খােলপটুয়ার নিকট বিশখালী নদীর চরে অবস্থান নেন। ভাের সাড়ে পাঁচটায় গানবােটগুলাে রাইফেল রেঞ্জের আওতায় এলে একসঙ্গে রাইফেলগুলাে গর্জে ওঠে। গেরিলাদের অন্যান্য অস্ত্রের মধ্যে ৩০টি রকেট লাঞ্চারও ছিল। পাকসেনারা দেশের অভ্যন্তরে এই জাতীয় ব্যাপক আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত ছিল না। ফলে বেশ বােঝা গেল তারা খানিকটা ভীত হয়ে পড়েছে। গােলাগুলি দু’ঘণ্টা স্থায়ী হয়। একটি গানবােট সম্পূর্ণ ডুবে যায়। আনােয়ার হােসেন মজনু তার বাহিনী নিয়ে ওই দিনই বামনা থানা ঘেরাও করলে পুলিশ এবং রাজাকারদের দল অস্ত্রসমেত গেরিলাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিবাহিনীর এই দলটির মধ্যে যারা দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন রণাঙ্গনে বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছিল তাঁরা হলেন সুবেদার মেজর মজিদ, নায়েক আব্দুল মান্নান, আব্দুল মালেক ও মমিনউদ্দিন। | এদিকে নভেম্বর মাসের প্রথমদিকে মিত্রবাহিনীর চার্লি সেক্টর হেড কোয়ার্টার কৃষ্ণনগরে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হলাে। সভায় জরুরি অবস্থা বিরাজ করলে
১০৫
অথবা ভারত যুদ্ধ ঘােষণা করলে মুক্তিবাহিনীর কর্তব্য ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ আলােচনা হয়। এই সভা সম্পর্কে মেজর এম এ জলিল তার সীমাহীন সমর’ গ্রন্থে লিখেছেন :
“সাতক্ষীরার বাঁদিক থেকে একটা সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে সাতক্ষীরা-দৌলতপুর বরাবর শত্রুঘাঁটিগুলাে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যশােরে, উত্তর দিক থেকে প্রধান আক্রমণ পরিচালনা করা হবে। তাছাড়া, আমার মুক্তিযােদ্ধারা পাকবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর গােলাবর্ষণের মাঝখানে পড়ে যাতে বিপর্যস্ত না হয়, সে জন্য মিত্রবাহিনীর আগে আমার সৈন্যবাহিনী পাঠাতে বারণ করা হলাে। আমাকে জানানাে হলাে যে, মিত্রবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্য হবে এইরূপ- প্রথমত, সময়মতাে মিত্রবাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য প্রয়ােজনীয় লােকজন দেয়া। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর মিত্রবাহিনী কোনাে প্রশাসনিক অসুবিধার সম্মুখীন হলে তা দূর করার জন্য তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা। তৃতীয়ত, ঘনিষ্ঠভাবে মিত্রবাহিনীকে অনুসরণ করা এবং তাদের সংস্পর্শে থাকা। আমাকে বলা হলাে যে, যেহেতু বাংলা অঞ্চল (বেঙ্গল এরিয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঘাঁটি) আমার নিকটবতী, সেইজন্য আমার সেক্টরকে এখন থেকে বাংলা অঞ্চলের প্রশাসনিক আওতাধীনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাছাড়া দক্ষিণ দিকের সুন্দরবন এলাকায় সম্পূর্ণ জলপথ বাংলা অঞ্চলের অধীনে এনে এর দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয় মেজর জেনারেল পি কে রায় চৌধুরীর ওপর।৬
চার্লি সেক্টরের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে মেজর জলিল ১৫ নভেম্বর সাব-সেক্টর কমান্ডারদের নিয়ে একটি কনফারেন্স করলেন। কনফারেন্সে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হলাে। এ সম্পর্কে মেজর জলিল লিখেছেন :
“খুলনা শহরের নিকট রূপসা নদীর পশ্চিম তীরে আক্রমণ ব্যুহ তৈরি করার জন্য লেঃ জিয়াকে সুন্দরবন অঞ্চল থেকে ঘাঁটি গুটিয়ে ফেলার জন্য প্রয়ােজনীয় আদেশ দিলাম। বাগেরহাটে সুবেদার তাজুল ইসলামের অধীনে যে সমস্ত সৈন্য ছিল তাদের লেঃ জিয়ার নিয়ন্ত্রণে কাজ করার জন্য নির্দেশ দিলাম। শত্রুপক্ষ যাতে নৌপথ ব্যবহার করতে না পারে, সেজন্য মি. নােমানউল্লাহকে তেরখাদা ও মােল্লারহাটে যে সমস্ত মুক্তিযােদ্ধা ছিল তাঁদের সঙ্গে সমন্বয় স্থাপন করে খুলনার উত্তর-পূর্ব দিক থেকে এসে এক জায়গায় জড়াে হয়ে পরিস্থিতি মােকাবেলা করার জন্য সতর্ক থাকতে বললাম। আরও বললাম যে, তারা যেন পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় সর্বদা প্রস্তুত থাকেন। খুলনার দক্ষিণে পাইকগাছা, তালা ও আশাশুনী অঞ্চলে সেকেণ্ড লেঃ আরেফিন গেরিলা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাকে বললাম, তিনি যেন গেরিলাদের সঙ্গে নিয়ে সামনের দিকে খুলনা শহরের কাছাকাছি কোথাও প্রস্তুত হয়ে থাকেন। ক্যাপ্টেন হুদার দু’ব্যাটালিয়নের বেশি মুক্তিযােদ্ধা ছিল— তাঁকেও সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলাম। আমি দুটো দলকে প্রস্তুত করে লেঃ বেগের নেতৃত্বাধীন বরিশালের দিকে নৌকায় পাঠিয়ে দিলাম। প্রথম দলটি ক্যাপ্টেন ওমরের (শাজাহান) সঙ্গে সংযােগ স্থাপন করে বরিশালের উদ্ভূত পরিস্থিতির মােকাবেলা করবে। আর দ্বিতীয় দলটি সেকেণ্ড লেঃ মঈনের নেতৃত্বে পটুয়াখালী পাঠানাে হলাে। ৭
উপরােক্ত পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্যে সেক্টর অ্যাডজুটেন্ট জনাব মােস্তফা যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে সবাইকে স্ব স্ব স্থানে পাঠিয়ে দিলেন।
১০৬
এদিকে ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা সামনে অগ্রসর হতে লাগলেন।
“হানাদাররা তখনও পালাচ্ছিল। প্রশংসনীয় উদ্যম ও মনােবল নিয়ে ক্যাপ্টেন হুদা দীর্ঘ বারাে মাইল হেঁটে তাঁর বাহিনীসহ মি. শাজাহানের লােকজনের কাছে পৌছে হানাদারদের সম্মুখ থেকে আঘাত হানলেন। তখন ওরা দিশেহারা হয়ে পারুলিয়ার দিকে পালাতে শুরু করে। ওদিকে মি. শাহজাহানের নেতৃত্বে টাকি থেকে যে সৈন্যদলটি এসেছিল তারা পলায়নপর হানাদার বাহিনীর একটি দলকে মাঝপথে অবরােধ করে বসল। এদিকে হুদা জানতে পারলেন যে, হানাদাররা পারুলিয়া সেতু উড়িয়ে দিয়ে ওপারে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। সেতুর চার মাইল দূরে অবস্থান নিয়ে ক্যাপ্টেন হুদা দ্রুত মি. চৌধুরী ও শাজাহানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীকে তাঁর লােকজনদের সঙ্গে একত্র করে পুনর্বিন্যাস করলেন।৮
২৭ নভেম্বর কর্নেল এম এ ওসমানী মুক্তিবাহিনীর অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলাে পরিদর্শন করলেন। উভয়পক্ষে তখনও গুলি বিনিময় চলছিল। এই অবস্থানের ঠিক বাঁ দিকে ৮নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহবুব তাঁর ট্রপস নিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে হামলা চালাচ্ছিলেন।
নয় নম্বর সেক্টর ট্রপস তখন দ্রুত সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১ ডিসেম্বর আলীপুর ছেড়ে আরও পেছনে সরে গেল। ইতােমধ্যে হাবিলদার আফজলের নেতৃত্বে ২০০ মুক্তিযােদ্ধাকে সাতক্ষীরা পাঠানাে হয় । ৩ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা হানাদারমুক্ত হয়। ২৯ নভেম্বর ঠুকরা নামক স্থানে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর এক বড়াে রকমের সংঘর্ষ হয়। পাকবাহিনী মার খেয়ে পেছনে সরতে থাকে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান মুক্তাঙ্গন পরিদর্শন করেন ।
১০ ডিসেম্বর মিত্র এবং মুক্তিবাহিনী খুলনা পৌঁছে যায়। ওদিকে বরিশাল মুক্ত হয় ৭ ডিসেম্বর। ক্যাপ্টেন বেগ এবং নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের নিকট পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ১৬ ডিসেম্বর মেজর জলিল আত্মসমর্পণের চিত্রটি সুন্দর করে তাঁর গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন :
জেনারেল দলবীর সিং-এর সাথে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। কেননা প্রধান স্টাফ অফিসার আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি কমান্ডারদের নিয়ে ইতিমধ্যেই রওয়ানা হয়েছেন, এখনাে এসে পৌঁছাননি। সময় অতি মন্থরগতিতে চলতে লাগল। এক একটি মুহূর্ত যেন এক একটি ঘণ্টা। মিত্রবাহিনীর ১নং ডিভিশনের স্টাফ অফিসার কর্নেল দেশপাণ্ডে জেনারেল দলবীর সিংকে বললেন, ‘ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান ও তাঁর সঙ্গে সাতজন লেঃ কর্নেল এসে পৌছে গেছেন।’
উত্তেজনার চরম মুহূর্ত। জেনারেল দলবীর সিং গম্ভীর স্বরে হুকুম দিলেন, ওদের এখানে নিয়ে আসুন।’ আমরা হেড কোয়ার্টার বিল্ডিং-এর উপরতলায় বসা ছিলাম । নিচের দিকে চাইতেই দেখলাম সাংঘাতিক অবস্থা। সামরিক বাহিনীর ফটোগ্রাফাররা এতােদিন ধরে পাগলের মতাে অধীন আগ্রহে অপেক্ষা করছিল।
‘যাহােক, পাকিস্তানি কমান্ডারদের নিয়ে আসা হলাে। আমি চারদিকে তাকাচ্ছিলামওদের ভেতর আমার চেনা কেউ আছে কি না। হ্যা, ওদের ভেতর আমার চেনা দুজন
১০৭
ছিল । একজনের নাম লেঃ কর্নেল ইমতিয়াজ ভয়ায়েচ। পাকিস্তানি মিলিটারি একাডেমিতে যখন আমি ক্যাডেট ছিলাম তখন ওখানে তিনি ক্যাপ্টেন ছিলেন। অপরজন লেঃ কর্নেল শামস। তার সঙ্গে আমার জানাশােনা ছিল। ব্রিগেডিয়ার হায়াতকেও একবার কি দু’বার পশ্চিম পাকিস্তানে দেখেছি। তখন আমাদের মনে হতাে খুব ভদ্র, বিনয়ী। কিন্তু বাংলাদেশে তারাই অভদ্র, অযােগ্য প্রমাণিত হয়েছে। বসতে তাঁদের চেয়ার দেয়া হল। জেনারেল দলবীর সিং অত্যন্ত সৌজন্যমূলক ব্যবহার করলেন ওদের সঙ্গে। বিজয়ী ও বিজিতের মধ্যে কোনাে অসামঞ্জস্য রাখলেন না। তিনি ওদের চা-পানে আপ্যায়িত করলেন। জেনারেল দলবীর সিং-এর মার্জিত রুচিবােধ ও ব্যবহার দেখে সত্যিই আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। তিনি ব্রিগেডিয়ার হায়াতের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই যে ইনি হচ্ছেন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার, আগে আপনাদেরই একজন ছিলেন। | আত্মসমর্পণের খুঁটিনাটি বিষয় সমাপ্ত হল। ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান তাঁর ব্রিগেড মেজরকে ডেকে বললেন, ‘মেজর ফিরােজ…তুমি এখনই চলে যাও। এবং সৈন্যদের। হুকুম শুনিয়ে দাও, যে যেখানে আছে সেখানেই অস্ত্র সংবরণ করতে। ওদের বলে দিও আমরা আত্মসমর্পণ করেছি।’
‘দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আত্মসমর্পণকারী ইতালির সৈন্যের মতাে হানাদাররা দীর্ঘ লাইন দিয়ে চলতে লাগল। ধীরে ধীরে আমরা খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের ভেতরে ঢুকলাম। এখানে ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের হেড কোয়ার্টার। চারদিক শান্ত, নীরব। মিত্রবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ারের তত্ত্বাবধানে আত্মসমর্পণকারী সৈন্যদল মার্চ করে এগিয়ে চলে। চেয়ারে বসে ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ভদ্র মহােদয়গণ, পূর্ব পাকিস্তানে বসে শেষবারের মতাে এক কাপ চা দিয়ে আপ্যায়ন করা ছাড়া দেয়ার মতাে আমার আর কিছুই নেই।’
‘মৃত পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলাদেশ বলবেন কি?’ আমি এ কথা বলতেই ব্রিগেডিয়ার হায়াত অসহায়ের মতাে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। উপায়ান্তর না দেখে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি তাঁর ভুল সংশােধন করে নিলেন। চা খেয়ে আমরা সবাই সার্কিট হাউসে যাবার জন্যে প্রস্তুত হলাম। এই যাত্রাটা খুবই আনন্দকর। আমরা খুলনা শহরের কাছাকাছি আসতেই রাস্তার দু’পাশের লােকজন গগনবিদারী চিৎকারে আমাদের স্বাগত জানাল, ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত। আজ মনে হলাে, জয় বাংলা বাস্তব সত্য। প্রত্যেক বাড়ির চূড়ায়, দোকানে বাংলাদেশের পতাকা। প্রতিটি নারীপুরুষ ও শিশুর হাতেই বাংলাদেশের পতাকা। হাত নেড়ে জনতার অভিনন্দনের জবাব দিলাম। সবার মুখেই হাসি। শিগগিরই আমরা সার্কিট হাউসে পৌছলাম। আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা দলে দলে এদিকে আসতে লাগল। সার্কিট হাউসের উপরে বাংলাদেশের পতাকা শােভা পাচ্ছে। বুকটা গর্বে ফুলে উঠল । সমুন্নত পতাকার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। হাজার হাজার উৎসুক মানুষ সার্কিট হাউস ঘিরে রয়েছে। এবং সবাই। সামনে আসার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে।
“যে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীরা নিরীহ বাঙালীদের ওপর এতােদিন অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে, তাদের এক নজর দেখার জন্যে জনতা বাঁধভাঙা স্রোতের মতাে ছুটতে চাইলাে। জনতার অসম্ভব ভিড় নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ােগ করা হয়েছে। কিন্তু জনতার চাপ এতাে বেশি যে, মুক্তিযােদ্ধারা কিছুতেই ওদের সামলাতে পারছে না। সার্কিট
১০৮
হাউসের দরজায় নামতেই এতাে ভিড়ের মধ্যেও পিষ্ট হতে হতে জনতা আমাদের দেখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল। কেউ আনন্দে হাততালি দেয়, কেউ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে, কেউবা পাগলের মতাে ছুটে এসে চুমাে খায়। কী অপূর্ব দৃশ্য, মানবতার কী মহান বহিঃপ্রকাশ! সব হারাবার দুর্বিষহ জ্বালা ভুলে গিয়ে নতুন দিনের নতুন সম্পর্কে কত আপন করে কাছে নিতে চায়! মহামানবের তীর্থ সলিলে অবগাহন করে অবহেলিত জনতা আজ যেন নতুন প্রাণের সন্ধানে পেয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ওরা আজ মুক্ত, ওরা আজ স্বাধীন। প্রতিটি জিনিস আজ ওদের নিজস্ব। ইতিমধ্যেই একটা হেলিকপ্টার জেনারেল দলবীর সিংকে নিয়ে সার্কিট হাউসে অবতরণ করলাে । লম্বা, উন্নত চেহারার অধিকারী জেনারেল দলবীর সিং সার্কিট হাউস পর্যন্ত হেঁটে আসলেন এবং আত্মসমর্পণ পর্বের খুঁটিনাটি বিষয় ঠিক না করা পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করলেন। সবুজ ঘাসের উপর লাল কার্পেট বিছানাে। তার উপর একটি টেবিল ও একটি চেয়ার।
“ঐতিহাসিক মুহূর্তটি সমাগত। সুশিক্ষিত আট হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের কমান্ডারদের আত্মসমর্পণ। যে দাম্ভিক পাকিস্তানি সৈন্যরা হিংস্র কুকুরের মতাে ঘেউ ঘেউ করত তারা আজ নিরীহ মেষশাবকের মতাে আত্মসমর্পণ করল। জেনারেল দলবীর সিং চেয়ারে উপবিষ্ট। ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান তাঁর সঙ্গের আটজন কর্নেলকে নিয়ে মার্চ করে তাঁর সামনে এসে থামলেন। পাকিস্তানি কমান্ডার যখন সার্কিট হাউস থেকে বেরিয়ে মার্চ করে আসছিল, তখন বাইরে অপেক্ষমান হাজার হাজার লােক আনন্দে ফেটে পড়ল। কেউ হাততালি দেয়। কেউ বা শিস দেয়। গ্লানিকর পরাজয়। কতাে বড়াে শাস্তিমূলক অনুষ্ঠান। জেনারেল দলবীর সিং-এর পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম, পাকিস্তানি অপরাধীগুলাে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনুষ্ঠান খুবই সাদাসিধে। জেনারেল দলবীর সিং আত্মসমর্পণের দলিল পাঠ করলেন এবং পাকবাহিনীর পরাজিত কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান মাথা নুইয়ে কম্পিত হাতে দলিলে স্বাক্ষর দিলেন। সােজা ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান ও তাঁর সঙ্গের অন্যান্য অফিসার কোমরের বেল্ট খুলে মিত্রবাহিনীর কাছে অর্পণ করলেন। এই সময় সমস্ত ফটোগ্রাফার ফটো নেয়ার জন্যে উঠেপড়ে লেগে গেলেন। দেখে মনে হল যেন একটা বিয়ের পর্ব। উধ্বর্তন সামরিক অফিসারদের পক্ষে এই রকম গ্লানিকর আত্মসমর্পণ আমি আর কখনও দেখিনি। অত্যন্ত অপমানজনক পরাজয়। ৯
তথ্য নির্দেশ
১. মেজর এম এ জলিল সীমাহীন সমর’, ৯ প্রথম প্রকাশ, ১৯৭৪, পৃষ্ঠা-৯৯।
২. পূর্বোক্ত।
৩. বিপ্লবী বাংলাদেশ, ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১, প্রথম বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা।
৪. জয়বাংলা, ২১ আগস্ট, ১৯৭১।
৫. দৈনিক আজাদ, ২২ আগস্ট, ১৯৭১।
৬. মেজর এম এ জলিল, সীমাহীন সমর’ ।
৭. পূর্বোক্ত।
৮. পূর্বোক্ত।
৯. পূর্বোক্ত।
১০৯
দশ নম্বর সেক্টর
দশ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল নৌ-কমান্ড, সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল ও অভ্যন্তরীণ নৌপথ। এই সেক্টরের কোনাে অধিনায়ক ছিল না। নিজ নিজ সেক্টর এলাকায় অধিনায়কগণ অপারেশন পরিচালনা করেছেন।
দশ নম্বর সেক্টর গঠিত হয় নেভাল কমান্ডারদের নিয়ে। সমগ্র দেশের নদীপথ ও বন্দরসমূহে গেরিলা তৎপরতা চালানাের জন্য এই সেক্টর গঠিত হয়। বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তর থেকে সরাসরি এইসব অপারেশনের নির্দেশ দেওয়া হতাে। অনেক সময় সেক্টর কমান্ডারদের অবগতি ও তত্ত্বাবধানে নিজ নিজ এলাকায় অপারেশন চালানাে হতাে।
‘আগস্ট মাসের শেষের দিকে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে পাকিস্তানি জল জাহাজ ধ্বংস করার জন্য গেরিলা ফ্রগম্যানদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এইসব নৌ-কম্যাণ্ডোরা। ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরে এম ভি হুরমুজ ও এম ভি আল আব্বাস ডুবিয়ে দেয়।১
“সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে ২১ টি পাকিস্তানি জাহাজ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। খুলনা, চালনা, মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরে নৌ-কমার্তোদের তৎপরতা ব্যাপক হয়ে ওঠে এবং পাকিস্তানিরা ভীত হয়ে পড়ে।
‘বাংলাদেশ’ নামক পত্রিকায় প্রকাশিত নিচের সংবাদটি থেকে এই কম্যাণ্ডোদের সাফল্য বােঝা যায়
নৌ-কম্যান্ডোদের অভূতপূর্ব সাফল্য
সম্প্রতি বাংলাদেশের নদীপথে নেভাল কম্যাণ্ডোদের গেরিলা তৎপরতা উল্লেখযােগ্যভাবে বেড়েছে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ এতােই তীব্রতর হয়েছে যে এরই মধ্যে ৬টি সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজ ধ্বংস হয়েছে। এর মধ্যে ২টি আমেরিকান, ২টি চাইনিজ, ১টি জাপানি ও ১টি পাকিস্তানি জাহাজ ছিল। এ জাহাজগুলাে অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ বহন। করছিল।
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরের একজন মুখপাত্র জানান যে, তাঁরা ২৩টি স্টিমার, লঞ্চ ও বার্জ দখল করে নিয়েছেন। সিলেট, ঢাকা, চাঁদপুর এলাকায় ৮টি নৌযান ডুবিয়ে দিয়েছে।
১১০
২৩ আগস্ট সাতক্ষীরাতে ১টি গানবােট অতর্কিত আক্রমণ করে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকা থেকে সিলেট গমনরত রসদ বহনকারী একটি জাহাজ চাঁদপুরে মুক্তিবাহিনী দখল করে নেয়। এই সময়ে চাঁদপুরে অপর একটি অভিযানে ১টি বিরাটকায় বার্জ ও ২টি স্টিমার ধ্বংস করে। | সুনামগঞ্জের শাচনা এলাকায় গেরিলারা একটি মালবাহী লঞ্চ, ৪টি বার্জ ও ১৬টি বিভিন্ন আকারের জাহাজ দখল করে।
নদীপথে গেরিলা তৎপরতা এতাে বৃদ্ধি পায় যে, চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ ঢােকার পথ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ সূত্রে জানা যায়, লেঃ জেনারেল টিক্কা খান স্বয়ং বন্দর ও জাহাজগুলাের ক্ষয়ক্ষতি স্বচক্ষে দেখার জন্য নৌ-বাহিনীর সিনিয়র অফিসার সমভিব্যাহারে চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শন করেন।৩
নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ’ পত্রিকা নিম্নলিখিত সংবাদ পরিবেশন করে—
নৌ-কম্যাণ্ডোর প্রচণ্ড আঘাত!
নেভাল কম্যাণ্ডোর প্রচণ্ড আঘাত অপ্রতিহত রয়েছে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে জল জাহাজগুলাে ধ্বংস হওয়ার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী বন্দর রক্ষার জন্য অতিমাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করে। পাকবাহিনীর সতকর্তা সত্ত্বেও গেরিলারা সাফল্যের সঙ্গে গ্রিক জাহাজ বার্মা জাদে’ ডুবিয়ে দিয়েছে। ঢাকা থেকে তৈলবাহী জাহাজ মাহতাব জাভেদ ধ্বংস হয় ও ডুবে যায়।৪
গেরিলাদের বারবার আক্রমণ ও বিস্ফোরণের ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিগুলাে প্রায় অকেজো হয়ে পড়ে। পাকিস্তানিদের মনােবল ভেঙে দেওয়ার জন্য এই আঘাত। সুদূরপ্রসারী ফলাফল বয়ে আনে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নৌবাহিনীর ফ্রগম্যান ও অন্যান্য কর্মীদের অবদানও বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তাঁরা সারাদেশে নদীবন্দরগুলােতে ব্যাপকভাবে তৎপরতা চালিয়ে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। নৌবাহিনী সম্পর্কে বাংলার বাণীতে লেখা হয়:
“নৌ বাহিনীর লােকদের নিয়ে একাত্তরের নভেম্বর মাসে নিয়মিত বাহিনীর অধীন নৌবাহিনী গঠন করা হয়। ৯ই নভেম্বর পাকবাহিনীর নিকট থেকে দখল করা ছােট আকারের ৬টি নৌযান নিয়ে প্রথম বঙ্গবন্ধু’ নৌবহরের উদ্বোধন করা হয়। এই বাহিনী দখলকৃত অঞ্চলের জলপথে কম্যাণ্ডে তৎপরতা চালাতে থাকে।৫
‘বাংলার বাণী’র অপর এক নিবন্ধে অবসরপ্রাপ্ত মেজর রফিকুল ইসলাম লিখেছেন : “আগস্ট মাসের দিকে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর এলাকায় সমুদ্রগামী জাহাজগুলাে ধ্বংস করার জন্য মুক্তিবাহিনীর মধ্য থেকে একদল গেরিলা ফ্রগম্যান তৈরি করা হয়। ১৬ আগস্ট এই মুক্তিসেনারা চট্টগ্রাম বন্দরে নােঙর করা এম ভি আরমাদ ও এম ভি আল আব্বাস নামক করাচি থেকে আগত অস্ত্রবাহী দুটো জাহাজ লিমপিট মাইনের সাহায্যে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দেয়।
১১১
“মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ফ্রগম্যানদের এটাই ছিল প্রথম তৎপরতা। এর পর থেকে সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিক পর্যন্ত সময়ে এরা প্রায় ২১টি পাকিস্তানি ও বিদেশি জাহাজ বিনষ্ট করে ও ডুবিয়ে দেয়।৬
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ফ্রগম্যানদের খুলনা, চালনা ও মংলা বন্দর, চট্টগ্রাম বন্দর এককথায় সারা দেশে নদী বন্দরগুলােতে আক্রমণের তীব্রতা ছিল যেমন ব্যাপক তেমনি ফলপ্রসূ। নৌ-কম্যাণ্ডোদের এই তৎপরতার কথা পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষও স্বীকার করতে বাধ্য হন। হানাদার কবলিত এলাকা থেকে দৈনিক পূর্বদেশে লেখা হলাে…এ পি পি’র এক খবরে প্রকাশ, সরকারি মুখপাত্র জানিয়েছেন যে, ইউ এস এস লাইটনিং নামের একটি খাদ্যশস্যবাহী মার্কিন জাহাজ সম্প্রতি চালনা বন্দরে ‘লিমপিড’ মাইন বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।৭
নৌপথে বাংলার ফ্রগম্যানদের আক্রমণের তীব্রতা যে কতাে ব্যাপক এবং বিস্তৃত ছিল তা নিম্নোক্ত সংবাদেই সুস্পষ্ট হবে। ‘Bangladesh’ নামক পত্রিকায় নৌবাহিনীর কম্যাণ্ডোদের সাফল্যের কথা উল্লেখ করে সংবাদ লেখা হয় :
ON THE WATER FRONTS
SPECTACULAR ACHIEVEMENTS The recent successful guerilla action in the Bangladesh waters is being viewed by the observers as a new dimension to the gradually intensifying
ities of the freedomfighters. Their most significant achievement has a the sinking of nine ocean-going ships in the waters of Bangladesh.
On the hight of August 16, the Liberation Forces sank six cargo ships onsisting of two American, two Chinese, one Japanese and one Pak-flags at Mongla port (Khulna). All of them were of medium size. These ships were carrying arms and ammunitions and other supplies for the Pakistan Army.
On August 16, the brave comandos carried out a daring operation inside the Chittagong port and blew up the ships “Al-Abbas” and “Formosa with the capacities of 15,000 tons and 12,500 tons respectively. The ship “Al-Abbas” was launched by Ayub Khan in 1968. A Barge leaded with Jute products was sank by the guerillas the same day.
A report from the Liberation Force’s Headquarters says that special groups of guerillas in a week of wide spread operations captured 23 Steamers, Launches and Barges and sank or damaged eight River crafts in Sylhet, Dhaka, Chandpur and Chittagong.
August 23, 1971 a Gunboat was sank in the Satkhira area.
On August 21, the Liberation Forces captured one Launch carrying food-stuff and other goods from Dhaka to Sylhet in the Chandpur area. In Chandpur the Comandos carried out another successful operation and destroyed steamers and one big Barge with cargo board.
১১২
On August 15, the Guerillas captured one cargo Launch, four Barges and 16 Launches from the Sachna area of Sunamgong.
Guerilla activities have completely blocked at approach of the Chittagong port at present. It is reported that Lt. General Thikka Khan came to Chittagong personally next day to assess the damage. Some senior Naval officers in charge of the Chittagong port and all the sentries on duty at the port had been arrested following the success of the guerilla fighters.
নভেম্বর মাসেও ‘Bangladesh’ পত্রিকায় সংবাদ বেরুল :
‘MARINE COMANDOS’ VITAL BLOW The Marine Comandos of Bangladesh have again struck a vital blow at the sagging moral of the occupation Army. Following the sinking of a number of ships by the Bangladesh Navy-men in August and September, the Pakistan Army took extreme precautionary measures to keep the port areas immuse from Guerilla one laughts. Unhindered by this Marine Comandos have successfully crippled the Greek eil tanker ‘Burmah Jade An A.P. report from Dacca (quoting official sources) says that, a series of explosions in a Chittagong port jetty has caused Pakistan oil-tanker “Mahtab Javed” to capsize and sink on November 3. The report further says that the post officials charged the Bangladesh guerillas with being responsible for the explosions, we accept this charge gladly.
Some berths of the Chittagong port are now completely out of the commission. These Naval actions have produced a far reaching effect in so far as these to the inhancement of insurance rates in the London insurance Market for cargoes sailing to and from Bangladesh.”৮
সারা বাংলাদেশে সেক্টরগুলাে গঠিত হওয়ার পর মুক্তিযােদ্ধারা সক্রিয় হলােএকের পর এক আঘাত হেনে চলল পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে।
৯নং সেক্টরে ফ্রগম্যানরা নদীপথে তৎপরতা চালিয়ে বেশ সাফল্য অর্জন করতে থাকে। এই সব দক্ষ ফ্রগম্যানকে ভারতীয় তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
মেজর জলিল তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,
“জুনের শেষ সপ্তাহে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ওদের জোগাড় করা হয়। এবং নবাব সিরাজুদ্দৌলার ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদের পলাশী নগরে ভারতীয় নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এইসব ছেলেদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
ভারতীয় নৌবাহিনীর লেঃ কমান্ডার মার্টিস ও লেঃ দাসের সহযােগিতায় প্রশংসনীয়ভাবে মাত্র দু’মাসের ভেতর এ সমস্ত তরুণ গ্রাম্য ছেলেরা দক্ষ ফ্রগম্যানশিপ ট্রেনিং নিয়ে বেরিয়ে আসে।৯
দক্ষ ফ্রগম্যানদের ৩০ জনের একটি দলকে আসাদুল্লাহর নেতৃত্বে শমসেরনগর পাঠানাে হয়। উক্ত দলটি মংলা ও চালনা বন্দরে পাকিস্তানি বাণিজ্যিক ও নৌবাহিনীর
১১৩
ওপর হামলা চালানাের জন্যে প্রস্তুতি নিতে থাকে। অপর দলটি ক্যাপ্টেন জিয়ার নেতৃত্বে ত্রিকোণ দ্বীপ, যেখানে পাকিস্তানিদের গােপন ঘাঁটি আছে বলে মনে করা হচ্ছিল— সেখানে পাঠানাের সিদ্ধান্ত হয়। প্রতিকূল আবহাওয়া এবং অন্যান্য বাস্তব অসুবিধার জন্যে ত্রিকোণ দ্বীপে হামলা চালানাে সম্ভব না হলেও প্রথম দল চালনা ও মংলাতে পরিকল্পনা অনুসারে আক্রমণ সাফল্যজনকভাবে সমাপ্ত করে। এরপর সিদ্ধান্ত হলাে ১৬ সেপ্টেম্বর হামলা চালানাে হবে। চালনা বন্দরে তখন ৮টি জাহাজ। এলােমেলােভাবে নােঙর করা ছিল। একটি জাহাজের জন্যে নির্দিষ্ট করা হলাে দু’জন করে ফ্রগম্যান। এবং চারটি করে মােট আটটি লিম্পেট মাইন’ প্রতি দলে দেয়া হলাে।
সেপ্টেম্বরের ১৫/১৬ তারিখ ২ টা ৩০ মিনিটে ১৬ জন ফ্রগম্যান ভয়াবহ পশুর নদীতে নেমে পড়ল। আরাে ১৪ জন ফ্রগম্যানকে রিজার্ভ রাখা হলাে প্রয়ােজনে তাদেরকেও কাজে লাগানাে হবে বলে । রাত তখন ৪টা ৩০মিনিট। তড়িৎ গতিতে ১৬ জন ফ্রগম্যান ৮টি জাহাজে লিম্পেট মাইন লাগিয়ে চলে আসে। ভাের ৫টা ৩০ মিনিটে চালনা বন্দর থেকে গগণবিদারী আওয়াজ শােনা গেল। অত্যন্ত সফল অভিযান। ৮টি জাহাজের মধ্যে সেদিন ভােরে ৭টি জাহাজই ধ্বংস হয়েছিল। ফ্রগম্যানদের এই সাফল্যে পাকিস্তানি শাসকচক্র দিশেহারা হয়ে পড়ে। নৌ-পথে তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়।
১৬ অক্টোবর নৌবাহিনীর আলমের নেতৃত্বে চালনা বন্দরে আর একটি বড়াে রকমের অভিযান চালানাে হয়। এই অভিযানে ফ্রগম্যানরা চারটি জাহাজ ধ্বংস করেছিলাে। জাহাজ চারটির মধ্যে বিশেষ করে ‘লাইটনিং’ এবং ‘আল-মুরতজার। ধ্বংসের কথা উল্লেখযােগ্য। এই অপারেশনে ফ্রগম্যান আনােয়ারের সাহসিকতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় ।
নৌবাহিনীর রহমতুল্লাহর নেতৃত্বে ফ্রগম্যানদের অপর দল নভেম্বর মাসেও অত্যন্ত। সফল অভিযান চালান। রহমতুল্লাহ নৌবাহিনীর একজন দক্ষ অফিসার। তাঁর আত্মত্যাগ, সাহসিকতা, নিরলস নিষ্ঠা এদেশের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
তথ্য নির্দেশ
১. দৈনিক বাংলা, ২৭ অগ্রহায়ণ, ১৩৭৯। ২. দৈনিক ইত্তেফাক, ২৯ অগ্রহায়ণ, ১৩৮২। ৩. বাংলাদেশ, ২৫ আগস্ট, ১৯৭১। ৪. বাংলাদেশ, নভেম্বর, ১৯৭১। ৫. বাংলার বাণী, ১৯৭১। ৬. পূর্বোক্ত। ৭. দৈনিক পূর্বদেশ, ১৯৭১। ৮. Bangladesh, ১৯৭১। ৯. মেজর জলিল, সীমাহীন সমর।
১১৪
এগারাে নম্বর সেক্টর
এগারাে নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক ছিল মেজর আবু তাহের। কিশােরগঞ্জ মহকুমা ছাড়া ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইল জেলাকে এই সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৫ নভেম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর তাহের কামালপুর সংঘর্ষে গুরুতররূপে আহত হলে স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহকে সেক্টর অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য, এই এলাকায় ময়মনসিংহের ২ নং উইং-এর প্রায় সমস্ত ই পি আর সৈন্য এবং অন্যান্য স্থান থেকে আসা কিছু ই পি আর সৈন্য ও জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে তৎপরতা অব্যাহত রাখে। সেক্টর কমান্ডার মেজর তাহের তার সেক্টর এলাকাকে কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করেন :
১. মানকারচর সাব-সেক্টর : কমান্ড করেছেন স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ এবং সহযােগী ছিল আসাদুজ্জামান।
২. মহেন্দ্রগঞ্জ সাব-সেক্টর : লে, মান্নান এই সাব-সেক্টরের অপারেশনাল দায়িত্বে ছিলেন।
৩. পুরাখাসিয়া সাব-সেক্টর : সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিল লে, হাশেম।
৪. ঢালু সাব-সেক্টর কমান্ড করেছেন যথাক্রমে লে. তাহের এবং লে. কামাল। এই সাব-সেক্টরে ডা. আবদুল্লাহ-আল-মাহমুদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
৫. রংরা সাব-সেক্টর : কমান্ডার ছিল ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান এই এলাকাতে ক্যাপ্টেন হামিদ নামে পরিচিত ছিলেন।
৬. শিববাড়ি সাব-সেক্টর এবং
৭. বাগমারা-সাব-সেক্টর : এই সাব-সেক্টর দুটি ই পি আর, জে সি ও এবং গণ মিত্র
বাহিনীর তত্ত্বাবধানে অপারেশন অব্যাহত রেখেছিলেন।
৮. মহেশখােলা সাব-সেক্টর : জনৈক ই পি আর কমান্ডার ছিলেন ।
মহেন্দ্রগঞ্জকেই সেক্টর হেড কোয়ার্টার করা হয়। অধ্যাপক আবদুল হান্নানকে সেক্টরের আই ও হিসেবে নিয়ােগ করা হয়। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে লে. মিজান, লে. শামসুল হক, ক্যাপ্টেন আজিজ প্রমুখ অফিসার এই সেক্টরে যােগদান করেন। সেক্টরের অফিসারগণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাব-সেক্টরে কাজ করেছেন। অপারেশনের ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন আজিজের দৃঢ় পদক্ষেপ এবং সাহসিকতা বিশেষভাবে স্মরণযােগ্য। এই সেক্টরে প্রায় পঁচিশ হাজারের মতাে মুক্তিযােদ্ধা যুদ্ধ করেছে। মিত্র বাহিনীর ৯২তম
১১৫
মাউন্টেন ব্রিগেড এই এলাকায় মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করে। কমান্ডার ছিল ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার।
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম ব্রিগেড ‘জেড’ ফোর্স গঠিত হয় ৭ জুলাই। মেজর জিয়াউর রহমানের নামানুসারে এই ব্রিগেডের নামকরণ করা হয় ‘জেড ফোর্স’ (জিয়া ফোর্স)। বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে জেড-ফোর্স এক বিশেষ অবদান রেখেছে। এই ফোর্সে তিনটি নিয়মিত পদাতিক বাহিনী ছিল। যথাক্রমে, ১ম ইস্ট বেঙ্গল, ৩য় ইস্ট বেঙ্গল এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন। ব্রিগেড কমান্ড করেন মেজর জিয়াউর রহমান (বর্তমানে মেজর জেনারেল), ব্রিগেডিয়ার ব্রিগেড মেজরের দায়িত্ব পালন করেন ক্যাপ্টেন অলি আহমদ (বর্তমান অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল)।
প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যেসব অফিসার কর্তব্য পালন করেছিলেন তাঁরা হলেন:
কম্যাণ্ডিং অফিসার : মেজর মইনুল হােসেন চৌধুরী। আগস্ট মাস থেকে মেজর জিয়াউদ্দিন এই ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব নেন। মেজর জিয়াউদ্দিন পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে বাংলার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড : ক্যাপ্টেন বজলুল গনি পাটোয়ারী এ্যাডজুটেন্ট এবং কোয়ার্টার মাস্টারের দায়িত্ব পালন করেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত আলী খান ।
ব্যাটালিয়নে ৪টি কোম্পানি যাঁরা কমান্ড করেছেন, তাঁরা হলেন১ :
‘এ’ কোম্পানি কমান্ডার : ক্যাপ্টেন মাহবুব ।
‘বি’ কোম্পানি কমান্ডার : ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন।
‘সি’ কোম্পানি কমান্ডার : ক্যাপ্টেন আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী।
‘ডি’ কোম্পানি কমান্ডার : ক্যাপ্টেন বজলুল গনি পাটোয়ারী।
লেঃ আনিসুর রহমান এবং লেঃ এম ওয়াকার হাসানও এই ব্যাটালিয়নে যােগ দেন।
তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁরা হলেন : কম্যাণ্ডিং অফিসার : মেজর শাফায়াত জামিল। সেকেণ্ড-ইন-কমান্ড : ক্যাপ্টেন মহসীন।
‘এ’ কোম্পানি কমান্ডার : ক্যাপ্টেন আনােয়ার হােসেন।
‘বি’ কোম্পানি কমান্ডার : ক্যাপ্টেন আকবর হােসেন।
‘সি’ কোম্পানি কমান্ডার : ক্যাপ্টেন মহসীন। ‘ডি’ কোম্পানি কমান্ডার : লে. নুরুন্নবী চৌধুরী।
এছাড়া লে. মঞ্জুর, লে, ফজলে হােসেন, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আশরাফুল আলম প্রমুখ অফিসার এই ব্যাটালিয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এই ব্যাটালিয়নে নায়েক সুবেদার আজিজের নেতৃত্বে একটি সাপাের্ট প্লাটুনও ছিল।
অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যেসব অফিসার কমান্ড করেছেন, তারা হলেন : কম্যাণ্ডিং অফিসার : মেজর এ টি এম আমিনুল হক।
১১৬
সেকেণ্ড-ইন-কমান্ড : ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী।
‘এ’ কোম্পানি কমান্ডার : ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী।
‘বি’ কোম্পানি কমান্ডার : ক্যাপ্টেন সাদেক হােসেন।
‘সি কোম্পানি কমান্ডার : লে. মােদাসসের হােসেন।
‘ডি’ কোম্পানি কমান্ডার : লে, মাহবুবুর রহমান।
এছাড়া লেঃ এমদাদুল হক, লে, কাজী মনিবুর রহমান, লে. ওয়ালিউল ইসলাম, লে, বাকের প্রমুখ তরুণ অফিসার এই ব্যাটালিয়নে কাজ করেন।
জেড ফোর্স কামালপুর, বাহাদুরাবাদঘাট, দেওয়ানগঞ্জ থানা, চিলমারী, হাজীপাড়া, ছােটখাল, গােয়াইনঘাট, টেংরাটিলা, গােবিন্দগঞ্জ, সালুটিকর বিমানবন্দর, ধলাই চাবাগান, ধামাই চা-বাগান, জাকিগঞ্জ, আলিময়দান, এম সি কলেজ, ভানুগাছা, কানাইঘাট, বয়মপুর, ফুলতলা চা-বাগান, বড়লেখা, লাতু, সাগরনালা চা-বাগান ইত্যাদি স্থানে পাক সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, এই ব্রিগেডের ব্যাটালিয়নের শতকরা ৫০ জন সৈনিকই ছিল প্রাক্তন ই পি আর বাহিনীর সদস্য। ব্যাটালিয়ন গঠনে, বিশেষ করে প্রথম বেঙ্গল এবং তৃতীয় বেঙ্গল গঠনে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফুটবল খেলােয়াড় ক্যাপ্টেন হাফিজ এবং মেজর শাফায়াত জামিলের বলিষ্ঠ সাংগঠনিক ক্ষমতা, নেতৃত্ব, আত্মত্যাগ ও অধ্যবসায় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয় ।
এগারাে নম্বর সেক্টর অফিসিয়ালি আগস্ট মাসে গঠন করা হলেও এই সেক্টর এলাকাতে মূলত ই পি আর বাহিনীর সদস্যরা সীমান্ত বরাবর পাকসেনাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ অব্যাহত রেখেছিল। মেজর তাহের সেক্টরের দায়িত্ব নেবার পর সেক্টরটিকে সম্পূর্ণভাবে পুনর্গঠিত করেন। বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিলেন : এক. গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে, দুই, দালাল পাকিস্তানি সমর্থকদের হত্যা না করে বন্দী করে এনে মটিভেট’ করে নিজেদের দলে কাজ করার সুযােগ দিতে হবে, তিন. দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের জন্যে যথােপযুক্ত ট্রেনিং দিতে এবং সেই সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের রাজনীতি-সচেতন করে তুলতে হবে। এরপর মেজর তাহের তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যে যথােপযুক্ত ব্যবস্থা নিলেন।
এই সেক্টর পুরােপুরি গঠনের পূর্বেই ঢালু সাব-সেক্টরের অধীনে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ক্যাপ্টেন বালজিৎ সিং ত্যাগীর তত্ত্বাবধানে বেশকিছু অপারেশন করা হয়। ক্যাপ্টেন ত্যাগী তাঁর কর্তব্যে নিষ্ঠা, সাহসিকতা ও আন্তরিকতার জন্যে ওই এলাকায় সকলের আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। শােনা যায়, মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের তিনি এতােই স্নেহ করতেন যে, কোনাে ছেলে মৃত্যুবরণ করলে তার শেষক্রিয়ায়। দাঁড়িয়ে বলতেন, ‘আমার বাচ্চার জন্যে আমি প্রেয়ার করব।’ ক্যাপ্টেন ত্যাগীর আন্তরিকতা দেশের যােদ্ধারা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
মুক্তাগাছা থানাতে পাকিস্তানীদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। নায়েক মুজাফফর হােসেন ১৪ জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে মুক্তাগাছা থানা আক্রমণ করেন। থানা
১১৭
প্রহরায় ছিল রাজাকার, আল-বদরের দল। সামান্য কিছুক্ষণের গুলি বিনিময়ে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। অবশিষ্টরা থানা ছেড়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী থানা থেকে বেশকিছু রাইফেল ও গােলাবারুদ হস্তগত করে ফুলবাড়িয়া থানার দিকে অগ্রসর হয়। ওই তারিখেই সকাল ৯টায় মুক্তিবাহিনীর ‘হাইড আউট’ থেকে পাক অবস্থান বান্দকাটা বি ও পি-র দিকে অগ্রসররত ৫ জনের একটি পাকসেনা দলকে অ্যামবুশ করে সকলকে হত্যা করে সব ক’টি রাইফেল ছিনিয়ে আনতে সমর্থ হন। গােলাগুলির শব্দে বান্দরকাটা বিওপি থেকে পাকসেনারা আক্রমণ শুরু করলে মুক্তিবাহিনীর দলটি নিরাপদ স্থানে সরে যায়। বান্দরকাটা বিওপি-তে ৩১তম বেলুচ রেজিমেন্টের একটি এবং মিলিশিয়া বাহিনীর একটি প্লাটুন অবস্থান করছিল।
২৫ জুন নায়েক ফরহাদ এবং অপর দু’জন মুক্তিযােদ্ধার নেতৃত্বে তিনটি প্লাটুনকে জামালপুর পিয়ারপুর রেলওয়ে স্টেশন ও রেল লাইন ধ্বংস করতে পাঠানাে হয়। লিডারত্ৰয় অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। স্টেশনটি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং রেল লাইনের ফিসপ্লেট তুলে ফেলার ফলে একটি বড়াে। রকমের ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে।
২৬ জুন হাবিলদার রেফাজউদ্দিন একটি প্লাটুন নিয়ে পুনরায় মুক্তাগাছা থানা আক্রমণ করে বসলেন। থানায় প্রহরারত পুলিশ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে মুক্তিবাহিনী আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। সংঘর্ষে ৪ জন পুলিশ নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। হাবিলদার রেফাজ থানা নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেন এবং উদ্ধার করলেন ৭৫টি রাইফেল, গুলি ও টেলিফোনের তার।
২রা জুলাই এফ এফ কমান্ডার গােলাম রব্বানীর নেতৃত্বে একটি প্লাটুন মুক্তাগাছ ও জামালপুরের মধ্যবর্তী সড়কে অবস্থিত সেতুটি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে ধ্বংস করে।
৪/৫ জুলাইতে একটি বড়াে রকমের সংঘর্ষ ঘটল । ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুক্তিযােদ্ধা নজমুল হকের নেতৃত্বে একটি কোম্পানিকে নালিতাবাড়ি ও শেরপুরের মধ্যবর্তী সড়কে দুটি সেতু ধ্বংস করার জন্যে নির্দেশ দেওয়া হলাে। নজমুল হক ওই তারিখেই সেতু দুটি ধ্বংস করে যখন পার্শ্ববর্তী গ্রামে বিশ্রাম গ্রহণ করছিলেন ঠিক তখনই সংবাদ পেয়ে উক্ত গ্রাম ঘিরে ফেলে অকস্মাৎ তীব্রভাবে আক্রমণ শুরু করল পাকসেনারা। মুক্তিবাহিনী এই আক্রমণের জন্যে মােটেও প্রস্তুত ছিল না। মুক্তিযােদ্ধা নজমুল হক তাড়াতাড়ি পজিশন নিয়ে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করলেন। বেশ কিছুক্ষণ সংঘর্ষ চলল । কিন্তু শেষ রক্ষা হলাে না। কমান্ডার নজমুল হক এবং আরও বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা এখানে প্রাণ হারালেন । অবশিষ্টরা কোনােমতে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে সমর্থ হয়।
জুলাই মাসে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ‘জেড ফোর্স গঠনের পর পরই এই বাহিনীর ওপর ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলার অপারেশনাল দায়িত্ব দেওয়া হয়। মেজর জিয়া (বর্তমানে মেজর জেনারেল) তাঁর বাহিনী নিয়ে আগরতলা থেকে তেলঢালা এলে তার বাহিনী জুলাই ও আগস্ট মাসে তিনটি বড়াে রকমের অপারেশনে
১১৮
অংশ নেয়। এক. কামালপুর সংঘর্ষ, দুই. বাহাদুরাবাদ ঘাট সংঘর্ষ; তিন, নকসী সংঘর্ষ। বিশেষ করে কামালপুরের সংঘর্ষের কথা মনে পড়লে আজও ভীতির সঞ্চার হয়। ধানুয়া কামালপুর বি ও পি-তে পাকসেনাদের ছিল অত্যন্ত শক্ত ঘাঁটি। শেলফ বাঙ্কারের চারদিকে তারকাঁটা দিয়ে ঘিরে মাইন বসিয়ে আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানিরা এখানে সদা সতর্ক থাকতাে । ৩০-৩১ জুলাই কামালপুরে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে পাকিস্তানিদের বড়াে রকমের সংঘর্ষ হলাে। ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ এবং লেঃ মান্নান কামালপুর শত্রু এলাকা রেকি করে এলেন। রেকি করতে গিয়ে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ পাকসেনাদের টহলরত সৈনিকদের খপ্পরে পড়েন। অন্ধকারের মধ্যে উভয়পক্ষে হাতাহাতি ধস্তাধস্তি গােলাগুলির মধ্যে সুবেদার হাই এবং নায়েক শফিকের ত্বরিত হস্তক্ষেপের ফলে অফিসারদ্বয় শেষ পর্যন্ত নিজ ঘাঁটিতে ফিরে এলেন। রেকি করার সময়েই পাকিস্তানিদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষের ফলে পাকসেনারা বেশ সতর্ক হয়ে গেলাে। তারা বুঝতে পারল মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে বড়াে রকমের আক্রমণ অত্যাসন্ন। পাকসেনাদের ৩১তম বেলুচ রেজিমেন্টের ২টি কোম্পানি এবং বেশকিছু সংখ্যক রাজাকার কামালপুরে অবস্থান করছিল। সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’র এই নিবন্ধে মেজর আমীন আহমদ চৌধুরী কামালপুর সংঘর্ষের চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন।
“৩০-৩১ জুলাই প্রথম ইস্ট বেঙ্গল (সিনিয়র টাইগার) রাতের আঁধারে রওয়ানা হলাে। প্রথমে সালাহউদ্দিনের ডেল্টা কোম্পানি, ফলাে আপ কোম্পানি হলাে ক্যাপ্টেন হাফিজের ব্রেভাে, এর পিছে রইলাে ব্যাটালিয়ন আর’ গ্রুপ। এই আর গ্রুপে ছিল মেজর (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) মঈন এবং তাঁর সঙ্গে ছিল কর্নেল জিয়াউর রহমান। সম্ভবত ব্রিগেডের প্রথম অ্যাটাকিং সরেজমিনে তদারক করার জন্য কর্নেল জিয়া নিজেও অ্যাটাকিং টুপসের সঙ্গে রওয়ানা হন। আক্রমণের ‘এইচ আওয়ার ছিল ৩০৩১ জুলাই-এর রাত ৩-৩০ মিনিট। কিন্তু গাইডের অভাবে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল এফ ইউ পি-তে সময়মতাে পৌছতে পারেনি। ফলে ৩-৩০ মিনিট টাইম প্রােগ্রাম মােতাবেক আমাদের নিজস্ব আর্টিলারি ফায়ার যখন শুরু হয় (ফায়ারের সঙ্কেত ধ্বনি ছিল হিস করে অয়্যারলেসের ওপর শব্দ করা) তখন আমাদের ছেলেরা এফ ইউ পি-তে পৌছবার জন্য প্রাণপণ দৌড়াচ্ছে। কাদামাটিতে এতােগুলাে লােকের এমন দৌড়াদৌড়ির ফলে যথেষ্ট শব্দ হয়, তাতে করে দুশমনের পক্ষে আক্রমণের ডাইরেকশন নির্ধারণ করা একেবারে সহজ হয়। এবং নিমেষের মধ্যে তাদের আর্টিলারি ফায়ার এসে পড়তে থাকে। এদিকে প্লাটুন পর্যায়ে ডেপথ (টু-আপ) হওয়ার ফলে লােক আগে-পিছে হয়ে যায়। ফলে কমান্ড ও কন্ট্রোল কায়েম করা ভয়ানক মুশকিল হয়ে পড়ে, অন্যদিকে অ্যাসেমব্লি এরিয়া থেকে পূর্ব নির্ধারিত এফ ইউ পি-তে আসার মাঝপথে ইস্ট বেঙ্গল তৎক্ষণাৎ সে অবস্থাতেই কোনােক্রমে ফলাে আপ হতে থাকে। ফলে সে কি চিৎকার আর হট্টগােল। আবার ডাইরেকশনের অভাবে অ্যাডভান্স করাকালীন একে অন্যের ওপর চড়ে বসে। আর অপেক্ষাকৃত নিচু
১১৯
কর্দমাক্ত জমির উপর আসার সঙ্গে সঙ্গে এবং পাকিস্তানি ও আমাদের যুগ্ম আর্টিলারির ক্রস ফায়ারিং-এর নিচে আসার ফলে আমাদের বেশকিছু ছেলে হতাহত হয়। অন্যদিকে অয়্যালেস সেট জ্যাম হওয়াতে সংযােগ সম্পূর্ণরূপে বিভিন্ন হয় এবং তাতে বিশৃঙ্খলা চরমে পৌছায়। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল হাট-বাজার বসেছে। আর ইস্ট বেঙ্গলের পক্ষে আক্রমণের ব্যুহ রচনা করা আদৌ সম্ভব ছিল না। বরং সৈন্যদলের পক্ষে পালিয়ে আসাটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। কারণ অ্যাটাকিং ট্রুপস যদি ঠিকমতাে ফর্ম-আপ না হতে পারে তবে তাদের পক্ষে আক্রমণ করার প্রশ্নই ওঠে না। ‘৬৫ সনের যুদ্ধে কী সেক্টরে বিআরবি-র ওপরে ভারতের এক ডিভিশন সৈন্য যখন ফর্ম-আপ হচ্ছিলাে তখন তদানীন্তন পাকিস্তানি মাত্র তিনটি ট্যাঙ্ক আচম্বিতে এসে সৈন্যদলের ওপর হামলা চালায়। ফলে, ভারতীয় সৈন্যদল পালিয়ে যায়। যুদ্ধের ময়দানে এ ঘটনা অহরহ ঘটেছে এবং ঘটবে। এদিকে কর্নেল জিয়াউর রহমান বাঘের মতাে গর্জে উঠলেন; কাম অন অ্যাট এনি কস্ট, উই উইল লাঞ্চ দি অ্যাটাক। মেজর মঈন অয়্যারলেস ছেড়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিলেন। আর ক্যাপ্টেন হাফিজ একপ্রান্ত থকে অপর প্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছেন। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। একদিকে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল প্রসিডিউরের চামড়া পর্যন্ত তুলে ফেলেছে, অন্যদিকে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মেগাফোনে বাংলা-ইংরেজি-উর্দু মিশিয়ে অকথ্য ভাষায় গালি দিচ্ছিলেন তাঁর সৈন্যদলকে। কারাে বা কলার ধরে লাইন সােজা করে আগের দিকে
১২০
(টাইগারমুখী) মুখ করে দিচ্ছেন। আর কাউকে ক্যাপ্টেন হাফিজ স্টেনের বাট দিয়ে মারছেন। মােগল রাজপুতের প্রথম যুদ্ধে আশিটি যুদ্ধ বিজয়ী রানা সংগ্রাম সিংহের বিপুল রণাভিজ্ঞ সৈন্যবাহিনীকে দেখে আকারে ছােটো মােগল বাহিনী ভড়কে গিয়েছিল যুদ্ধের প্রারম্ভেই। কিন্তু ভেলকিবাজির মতাে বাবর সে সৈন্যবাহিনীকে বাগে এনে বিপুল বিক্রমে আক্রমণ করে শেষ পর্যন্ত জয়ী হন। তাই সামরিক নেতা হিসেবে ইতিহাসে বাবরের স্থান অতি উঁচুতে। ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ ও ক্যাপ্টেন হাফিজের কৃতিত্ব বুঝি সেখানেই চরম বিশৃংখলার মাঝে শুধুমাত্র মনের জোর ও অদম্য সাহসে বলীয়ান হয়ে সালাহউদ্দিন ও হাফিজ সর্বপ্রকার প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নিজ নিজ কোম্পানিকে অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত করতে সক্ষম হন এবং নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ আক্রমণ সুচারুরূপে সম্পন্ন করেন। যুদ্ধের ময়দানে ফলাফলটা সকল সময় সবকিছুর পরিমাপ নয় বরং ঘাঁটিটি কীভাবে গঠিত হলাে সেটাই সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়।
দ্বিতীয় মহাসমরে মন্টগােমারির কাছে রােমেল চরমভাবে মার খেয়েছিলেন। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, মাসের পর মাস, মাইলের পর মাইল পশ্চাদপসরণ অভিযান অব্যাহত রাখতে হয়েছে রােমেলকে সাহারার দুস্তর মরুপথে পথে। অথচ মন্টগােমারির বিজয়াভিযানের চেয়ে রােমেলের সেই পশ্চাদভিযানই সকলের মনে অনুপ্রেরণা যােগায়— তাই বুঝি রােমেল শুধুমাত্র রােমেলই। এফ ইউ পি-র বিশৃঙ্খলা থেকে সামান্য রেহাই পেয়ে ১ম বেঙ্গল সবেমাত্র অগ্রসর হয়েছে, অমনি পাকিস্তানি আর্টিলারির সেলভাে ফায়ার এসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে শুয়ে পড়ল আমাদের হতােদ্যম সৈন্যরা। শেষ মুহূর্তে বুঝি আর আক্রমণ করা সম্ভব হল না দেখে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়লেন। একদিকে সমগ্র বাঙালি জাতির মান ইজ্জতের প্রশ্ন, অন্যদিকে দু’শ ছেলের জীবন।
সালাহউদ্দীন তখন ক্ষ্যাপা দুর্বাশা, জাহান্নামের আগুনে বসে হাসছে পুষ্পের হাসি। মারছেন লাথির পর লাথি। কারাে বা কলার চেপে ধরে অকথ্য ভাষায় গালি দিচ্ছিলেন—’বেশরম, বেগারত, শালা, নিমকহারামির দল আগে বাড়াে’। আবার সৈন্যদের মন চাঙ্গা করার জন্য নিজের অবস্থান জাহির হয়ে যাবে জেনেও পাকবাহিনীকে লক্ষ করে মেগাফোনে উর্দুতে বলছিলেন ‘অভিতক ওয়াত্ হ্যায়, সালে লােক সারেণ্ডার করাে, নেহিতাে জিন্দা নেহি ছােড়েংগা। তারপরের ইতিহাস প্রতিটি বাঙালির গৌরবের ইতিহাস। এ যেন শুধুমাত্র ইতিহাস নয়, মুক্তিকামী মানুষের প্রাণবন্যার ইতিহাস। বাঙালি সৈন্যরা তখন ছুটছে ঝড়ের মতন। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল মুহূর্তের মধ্যে ভাসিয়ে দিল পাক বাহিনীর ডিফেন্সের প্রথম সারির বাঙ্কারগুলাে। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতাে গুরুগর্জন করে সিনিয়র টাইগার’ (প্রথম ইস্ট বেঙ্গল) ‘জয় বাংলা-আল্লাহ আকবর ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে তুলল যুদ্ধের ময়দানকে । বাঙ্কার অতিক্রম করে বিশ-পঁচিশটা ছেলে কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকে পড়লাে। যাদের ভেতর মাত্র দু’একজন আহত অবস্থায় ফেরত আসতে পেরেছিল।
১২১
আর বাকি সবাই হাতাহাতি যুদ্ধে শাহাদাৎ বরণ করেন। প্রচণ্ডভাবে তখন হাতাহাতি যুদ্ধ চলছে। বাঘের থাবাতে যত্রতত্র ভূপাতিত পাকসৈন্যরা। পেছনে তখন আমাদের পক্ষের লাশ আসা শুরু হয়ে গেছে। কর্নেল জিয়া তখন বলছেন, আই উইল অ্যাকসেপ্ট নাইনটি ফাইভ পারসেন্টস ক্যাজুয়ালটি বাট…সর্ট দেম আউট মইন। আহত ক্ষতবিক্ষত জোয়ানরা বলছে, স্যার, নিয়ে এলেন কেন? আর সামান্য বাকি, কী হতাে— আমি না হয় মরে যেতাম। গর্বে বুক ফুলে উঠেছিল। পেছনের উঁচু পাহাড়ে দাঁড়িয়ে দর্শকরাও বুঝতে পারছিলেন বাঙালিরা শুধু বসে বসে (এমন কি না খেয়ে) কবিতা লিখে কিংবা গালগল্প করে আর স্লোগান দিয়ে ভাবালুতার মাঝে দিন কাটায় না, যুদ্ধ করতে জানে বৈকি! আজকে শুধু আফসােস হচ্ছে যে, আজকের প্রপার টাইগাররা যদি সেদিন যুদ্ধের ময়দানে থাকতেন তবে সম্ভবত আজ তারা আমাদেরকে ‘খােদার খাসী’ বলার দুঃসাহস প্রকাশ করতেন না। ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিনের গায়ে তখন সেই রিলিফের সাদা শার্টটা ছিল। মহানগরীর নিউ মার্কেটে গিয়ে মার্কেটিং করার অবসর তাঁর ছিল না, ছিল না সঙ্গতি কিংবা তেমন নিচু মনােবৃত্তি। তবে হ্যা, বন্যপশুদের মতাে আমরা জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরেছি। তাই বুঝি লুঙ্গি মালকোঁচা বেঁধে সিভিল সার্ভিস তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী যশাের রণাঙ্গনকে কাঁপিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছিল কথার ফুলকি দিয়ে নয়, জীবন-টোটার রহস্য জানতে গিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে। তাই বলছি, হে মহাত্মন, রক্তের ওজন নাও, শরীরের ওজন নাও, খােদার খাসী কে ওজন মাপার যন্ত্র নির্ভুল বলে দেবে।’
এদিকে মাইন ফিল্ডে ফেঁসে যাওয়া সুবেদার হাই-এর প্লাটুনের ডানে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন বুঝতে পারলেন যে শত্রুরা মাইন ফিল্ডের পেছনের বাঙ্কারগুলাে ছেড়ে দিয়ে আরও পেছনে সরে গিয়ে সেকেণ্ড লাইনে কাউন্টার অ্যাটাকের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মেগাফোনে হাইকে বললেন : ‘হাই, প্লাটুন নিয়ে ডানে যাও’। প্রথম আক্রমণ শুরুকালে সুবেদার হাই-এর লােকসংখ্যা ছিল ৪০ জন, কিন্তু লক্ষ্যে পৌছানাে পর্যন্ত দাঁড়ায় ১৫ হতে ২০ জনে। এদিকে মাইনের আঘাতে নায়েক সফিকের হাত উড়ে গেল। আর ধাবমান সৈন্যদের পিছু নেওয়াকালে জোয়ানরা বারবার সালাহউদ্দিনকে অনুরােধ করল, “স্যার, পজিশনে যান’ (মাটিতে শুয়ে পড়া)। সালাহউদ্দিন ধমকে উঠল: ‘ব্যাটা, স্যার স্যার করে চিঙ্কার করিস না। শত্রুরা আমার অবস্থান টের পেয়ে যাবে। চিন্তা করিস না, তুই বেটা আমার কাছে এসে দাঁড়া, গুলি লাগবে না। ইয়াহিয়া খান আজও আমার জন্য গুলি বানাতে পারেনি। তার দু’দিক থেকে বৃষ্টির মতাে গুলির মাঝে দাঁড়িয়ে একথা বলা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। তাই বুঝি আজও ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কেঁদে কেঁদে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের প্রাণপ্রিয় সালাহউদ্দিনকে। দ্বিতীয়বার মেগাফোনে ‘হাই’ বলার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিনের সামনে ২/৩টি বােমা এসে পড়লাে। মুহূর্তের মধ্যে সালাহউদ্দিন ধরাশায়ী হলেন। তাঁর দেহটা প্রথমে বামে পড়ে আধা ডানে ও শেষে দড়াম করে পেছনের দিকে পড়ে গেল। আশেপাশের জোয়ানরা ছুটে এসে বলে, ‘স্যার, কলেমা
১২২
পড়ুন’। কিন্তু একান্ত গৌরব সালাহউদ্দিন উত্তর দিল ‘আমার কলেমা পড়ার দরকার নেই। খােদার কসম, যে পেছনে হটবি তাকে গুলি করব।’ তারপর বিড়বিড় করে বলে উঠলেন : ‘মরতে হয় এদের মেরে মরাে বাংলাদেশের মাটিতে মরাে। এমন মরণ দুনিয়ার ইতিহাসে যে বিরল তা নয়, তবে এ মৃত্যুতে আনন্দ আছে, গর্ব আছে। যা সহজে করা যায় না। উঁচু মাটির ঢিবিতে পড়ে থাকা সালাহউদ্দিনের লাশটাকে ২/৩ জন জোয়ান শত্রুর এলাকা থেকে টেনে আনতে চেষ্টা করল, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে সকলেই মৃত্যুবরণ করে। পরিশেষে একটি বিহারী ছেলে আটটি গুলি খেয়ে নিজে গুরুতরভাবে আহত হয়েও লাশটি আনতে শেষবারের মতাে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সালাহউদ্দিনের গায়ে তখনও সেই সাদা শার্টটা ছিল, যা তাঁর খুলে ফেলার কথা ছিল-কারণ সাদা শার্ট রাত্রিবেলায় বেশি দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিনের ঘড়ি, স্টেন ও অন্যান্য কাগজ নিয়ে আসা হয়।
ওদিকে ক্যাপ্টেন হাফিজ বেঁচে গেল অলৌকিকভাবে। হাতের স্টেন তােপের মুখে উড়ে গেলেও সামান্য আহত হয়ে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার বেঁচে গেলেন। কিন্তু ৬০০ গজ পেছনে এফ ইউ পি’র তত্ত্বাবধানে কর্মরত লেঃ মান্নান উরুতে গুলি খেয়ে গুরুতরভাবে আহত হলেন। অন্যদিকে আহত ক্যাপ্টেন হাফিজের অয়্যারলেস সেট নিরাপদ জায়গায় রেখে পুনরায় হাফিজকে উদ্ধারকল্পে ল্যান্স নায়েক রবিউল ছুটল শত্রু অভিমুখে। কয়েক কদম যেতেই দু’হাতে গুলি এসে লাগল। তথাপি তার প্রাণপ্রিয় সখা বাংলাদেশের অমূল্য রত্ন ক্যাপ্টেন হাফিজকে উদ্ধার করার সঙ্কল্প থেকে তাকে এতােটুকু টলাতে পারেনি। যথাস্থানে পৌছে দেখে হাফিজকে অন্য কেউ নিয়ে গেছে। পড়ে থাকা অয়্যারলেস ও রকেট লাঞ্চার ওঠাবার সময় ল্যান্স নায়েক রবিউলের বুকে গুলি লাগল । রবিউল মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। মুখ থেকে পড়তে লাগল রক্ত। পাশের জোয়ান পাশ কেটে চলে গেল সাহায্যের ভয়ে। রাগে-দুঃখে রবিউল গ্রেনেডটা হাতে নিয়ে (উদ্দেশ্য বন্দী হবে না) জীবনের আশা ত্যাগ করে নিকটবর্তী ইক্ষুক্ষেতের দিকে দিল ভোঁ দৌড়। বৃষ্টির মতাে শত্রুর গুলি আসছিলাে কিন্তু আশ্চর্য রবিউলের গায়ে লাগল না। কোনােমতে টেনে-হেঁচড়ে ইক্ষুক্ষেতে গিয়ে পৌঁছতেই রবিউলের প্রতীতি জন্মাল সে সহজে মরছে না। অন্যের সাহায্য ব্যতীত সে বাঁচতে পারবে। বাঁ হাত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। ডান হাতের হাড়টি বের হয়ে গেছে, নাকে-মুখে রক্তের ছােপ। এ অবস্থায় পালিয়ে যেতে দেখে এগিয়ে এসেছিল গ্রামের গৃহবধূরা- যদিও গৃহস্বামীরা দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিল। নিজের সাথী যখন মুখ ফিরিয়ে চলে গেল তখন আর কারাে সাহায্যও প্রত্যাশিত নয়। তাই গৃহবধূদের হাত ছাড়িয়ে সে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করল। কিন্তু পরের ইতিহাস আজও তাঁর কাছে ঝাপসা হয়ে আছে। তার বিশ্বাস, দুই রমণীর কাঁধে ভর দিয়ে সে এফ ইউ পি’র এরিয়া পর্যন্ত পৌছায়। এদিকে সালাহউদ্দিনের মৃত্যুর পর আমাদের সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও সেই ছত্রভঙ্গ অবস্থায় ছােটো ছােটো গ্রুপে ওরা শত্রুর বাঙ্কারের ওপর আঘাতের পর আঘাত হানতে থাকে । বেলা তখন ৭টা বাজে। অযথা লােকক্ষয় না করে উইথড্র করা শ্রেয় জেনেও (বর্তমানে
লেঃ কর্নেল) মইন তাঁর সৈন্যদলকে কিছুতেই পশ্চাদপসরণ করাতে পারছিলেন না। আমাদের আর শত্রুর লাশে কমিউনিটি সেন্টার ভরে গেল। শেষ পর্যন্ত বেলা ৭টা ৩০ মিনিটের দিকে আমাদের সৈন্যদল পশ্চাদপসরণ করে। এ যুদ্ধে আমাদের একজন অফিসারসহ ৩০ জন নিহত কিংবা নিখোঁজ আর দুইজন অফিসারসহ ৬৬ জন আহত হন। গ্রামের লােকেরা শত্রুদের তিন ট্রাক বােঝাই লাশ নিয়ে যেতে দেখেছে। পরদিন হেলিকপ্টারে পাকবাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসাররা, সম্ভবত জিওসি আসেন কামালপুর পরিদর্শন করতে।”
ফলাফল।
বাঙ্কারে বসে থাকা খানসেনাদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করাই এ যুদ্ধের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য সাফল্য। এ যুদ্ধে প্রমাণিত হলাে বাঙালিরা দূর থেকে ফায়ার করে শত্রুকে শুধুমাত্র হেস্তনেস্ত করে দূর থেকেই আর পালিয়ে যাবে না, বরং বাঙ্কার থেকে খানসেনা তাড়ানােই তার উদ্দেশ্য। তাই বুঝি এ আক্রমণের পর থেকে খানসেনারা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তথা কামালপুরের নাম শুনলেই আঁতকে উঠত। তখনকার দিনে পাক শিবিরে বন্দী মেজর আজিজের ভাষায় বলতে হয়-
পাকিস্তানিদের নিজেদের মতে কামালপুর হলাে পাকসৈন্যের মরণ ঘাঁটি। ইন্টারােগেশনের সময় মেজর আজিজকে জিজ্ঞাসা করা হতাে ‘হেয়্যার ইজ ধানিয়া কামালপুর কিংবা ‘হােয়্যার ইজ ইওর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।’ কথা প্রসঙ্গে সেই জুলাই- আগস্টে (১৯৭১) পাক অফিসাররা কখনাে বা হঠাৎ করে বলে ফেলত ইওর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইজ ফাইটিং লাইক রিয়েল টাইগারস।’ আক্রমণটি ব্যর্থ হলেও এর চরম সাফল্য এই উক্তির মাঝেই নিহিত আছে।২
‘জেড ফোর্সের ৩য় বেঙ্গল ৩১ জুলাই বাহাদুরাবাদ ঘাটে পাকসেনাদের সঙ্গে এক বড়াে রকমের সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ৩য় বেঙ্গলের সুযােগ্য কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে এই যুদ্ধ পরিচালিত হয়। লেঃ কর্নেল আমীন আহমদ চৌধুরী সাপ্তাহিক বিচিত্রার একটি নিবন্ধে এই সংঘর্ষ সম্বন্ধে লিখেছেন :
‘৩১ জুলাই, ১৯৭১ সনে প্রায় ৩৫০ জন লােক নিয়ে দেওয়ানগঞ্জ-বাহাদুরাবাদ ঘাট আক্রমণের জন্য ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট রওয়ানা হয়। ওই অঞ্চলের একটি আই এ পাস ছেলে, বলরামপুর গ্রামের নাসের ছিল এই আক্রমণের পথপ্রদর্শক। তার দূরদর্শিতার ফলে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তিনটি বড়াে বড়াে নদী ক্ষিপ্রগতিতে সকলের অগােচরে ১১টি নৌকাসহ অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। এবং গানবােটে পাহারারত পাক সৈন্যদের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে পাশ কাটিয়ে ১৫/২০ মাইল পথ নিরাপদে অতিক্রম করে রাত তিনটার সময় পূর্ব এফ ইউ পি-তে পৌছাতে সক্ষম হয়। ক্যাপেন আনােয়ারের অধীনে আলফা কোম্পানি নৌকাঘাটে (হাইড আউট) পাহারারত থাকে। আর ১২নং প্লাটুন ই পি আর-এর নায়েক সুবেদার আলী আকবরের অধীনে ‘কাট অফ
১২৪
পার্টির কাজ করে? ‘ডি’ কোম্পানি লেঃ নুরুন্নবীর অধীনে বাহাদুরাবাদ ঘাট আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়। নায়েক সুবেদার ভুলু মিয়া ১১ নং প্লাটুন নিয়ে যায় যাত্রীবাহী ট্রেনের দিকে। আর সুবেদার করম আলী ১০ নং প্লাটুন নিয়ে যায় রেলওয়ে ট্রেনের জেটির দিকে। তখন ভাের হয় হয় প্রায়। রেললাইনের ওপাশে দুশমনরা তখন স্ট্যান টু’র জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। এদিকে একটি যাত্রাবাহী ট্রেন তখন রেললাইনের উপর শানটিং করছিল। গাড়ি গানটিং করে পিছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুবেদার করম আলী প্লাটুনের রকেট লাঞ্চারটি নিজে কাঁধে করে এগিয়ে গিয়ে প্রথমে মালগাড়িতে অবস্থানরত জেনারেটর এবং পর মুহূর্তে অগ্রসরমান শান্টিং গাড়ির ইঞ্জিনকে ফায়ার করে অকেজো করে দেন আর সঙ্গে সঙ্গে ডাইনে অবস্থানরত নায়েক সুবেদার ভুলু মিয়ার প্লাটুন ফায়ার শুরু করে এবং গ্রেনেড পার্টি রেলের প্রত্যেক কামরায় গ্রেনেড ছুড়তে শুরু করে। প্রায় প্রত্যেক কামরাতেই ৩/৪ জন খাকি পােশাক পরিহিত লােক শুয়ে ছিল। এদিকে অ্যাকশন পার্টি (২টি প্লটুন) উইথড্রলের সঙ্গে সঙ্গে ৩ ইঞ্চি মর্টার গর্জে ওঠে। ফলে, স্থায়ীভাবে যে দুটি ফার্স্টক্লাস কামরা আর্মি গার্ডের জন্য রাখা হয়েছিল তা ধ্বংস হয়। এছাড়া রেলওয়ে স্টেশনে বহু রেলওয়ে বগি এবং ঘাটে অবস্থানরত মালগাড়ি বহনকারী স্টিমার এবং জেটির ছাদের উপর দুশমনের মেশিনগানের বাঙ্কার ভীষণভাবে বিধ্বস্ত হয়। স্টেশন এরিয়া হতে উইথড্র করাকালীন দুশমনের একটি গুলি নায়েক ভুলু মিয়ার বাম বাহুতে লেগে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়। এই আক্রমণকালে নায়েক সুবেদার ভুলু মিয়া ছাড়া আমাদের পক্ষের আর কেউ হতাহত হয় নি। পরদিন সুবেদার করম আলী
গেল পার্শ্ববর্তী ব্রিজ ওড়াতে। ব্রিজ ওড়ানাের আওয়াজ শুনে দেওয়ানগঞ্জে অবস্থানরত পাকসৈন্যরা বাহাদুরাবাদ ঘাটের দিকে ধাবমান হলাে। সঙ্গে সঙ্গে আলফা ও ডেন্টা কোম্পানি ক্ষিপ্রগতিতে দেওয়ানগঞ্জ বাজার, সুগার মিল ও রাজাকার হেড কোয়ার্টারে পর্যায়ক্রমে আক্রমণ করে সেই এলাকা সম্পূর্ণভাবে তছনছ করে। তিনদিন বিজয়ীর বেশে অবস্থান করার পর ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিজ ক্যাম্পে ফেরত আসে। এই আক্রমণটিকে একটি পরিপূর্ণ সার্থক আক্রমণ বলা চলে। এই সফলতার প্রধান কারণ হচ্ছে চৌকশ গাইড, ধীর-স্থির ও সিংহ-হৃদয়ের অধিকারী কর্নেল শাফায়াত জামিলের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও দক্ষ পরিচালনা এবং ৩য় ইস্ট বেঙ্গল, ই পি আর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের লােক অধিক সংখ্যায় থাকার জন্য ব্যাটাল প্রসিডিউর মােতাবেক কার্যক্রম বাস্তবায়িত করতে পেরেছিলেন বলেই ।৩
৩ আগস্ট নকশী বি ও পি-তে মুবািহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানিদের আর একটি বড়াে রকমের সংঘর্ষ হয়। জেড ফোর্সের ৮ম বেঙ্গল এই যুদ্ধে অংশ নেয়। যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন মেজর আমীন আহমদ চৌধুরী। নকশী সংঘর্ষের কমান্ডার বর্তমান লেঃ কর্নেল আমীন আহমদ চৌধুরী এই সংঘর্ষ সম্পর্কে বিচিত্রা’য় লিখেছেন :
“৩ আগস্ট আমি ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্রেভাে ও ডেল্টা এই দুই কোম্পানি যােদ্ধা নিয়ে আক্রমণ করলাম নকশী বিওপি। এর আগে আমি তিনদিন পুরাে বিওপি রেকি করেছি। নকশী বিওপি-র পূর্বর্তন সুবেদার হাকিম ও তার সাথীরা আমায় এ বিষয়ে সক্রিয় সাহায্য করেছেন। তার কারণ এই বিওপি তাদের নখদর্পণে ছিলাে। প্রথমদিন
১২৬
নিজে সুবেদার হাকিমসহ নকশী বিওপি-র আশেপাশে রেকি করি একটি উঁচু টিলা থেকে। বাইনােকুলারে সুবেদার হাকিম আমায় বলেছিল কোথায় শত্রুদের বাঙ্কার, বার্বড় অয়্যার, বাঁশের কঞ্চি, মাইন ফিল্ড ককহাউস, মসজিদ ও বিওপি-র প্রবেশ পথ, কোথায় কত সান্ত্রী থাকতে পারে ইত্যাদি। তারপর গারাে পাহাড়ে গিয়ে চুপি চুপি দেখা করলাম শত্রু শিবিরে আমাদের প্রেরিত বাবুর্চির সঙ্গে। বাবুর্চি বলল সে ৪৫ জন আর্মির খাবার পাকিয়েছে এবং আরও ৬৫ জন আর্মির লােক আসছে এবং গােটা ৫০/৬০ জন রাজাকারও বিভিন্ন ডিউটিতে আছে । দ্বিতীয় দিন প্লাটুন কমান্ডারকে নিয়ে আমি আবার স্বচক্ষে হালছটি গ্রাম, শালবন ও নালাপথ রেকি’ করে কোথায় কোন হাতিয়ার হবে এবং কোথায় এফ ইউ পি Form up place হবে সকলকে প্রায় দেখিয়ে দিলাম। ১ আগস্ট আমি পুরাে সেকশন কমান্ডারদের নিয়ে পূর্ব নির্দিষ্ট জায়গা আবার দেখিয়ে দিলাম যাতে করে রাতের আঁধারে ভুল না করে। এদিকে সাপাের্টিং হাতিয়ার মেশিনগান ১০৬ মি. মি ও ৭৫ মি মি আর/ আর এর জন্য বাঙ্কার তৈরির উদ্দেশে ২৫টি আড়াই মণি চটের বস্তা নিয়ে এলাম। এতাে প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয়েছিল শালবনের ঘন আড়ালের জন্যই। অবশ্য পাকিস্তানিরা উত্তরদিকে পরিষ্কার করে ফিলিং জোনের ফিল্ড অব ফায়ার একেবারে সাফ রেখেছিল। তৃতীয় দিন ‘রেকি’ করাকালে হালছটি গ্রামের নালার পাশে আমরা একটি আমগাছের মাথায় লাল ফুলকে মানুষ মনে করে থমকে দাঁড়ালাম। নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে একগাল হাসি হাসতে যাব এমন সময় ঝুপ করে একটি শব্দ হলাে, মনে হলাে একটি লােক নালার ভেতর দিয়ে পালাচ্ছে। আমার সেকশন কমান্ডাররা জড়সড় হয়ে একে অপরের মুখােমুখি হয়ে পজিশনে গেল দেখে পিত্তি জ্বলে গেলাে। আসলে তাদেরকে আরও ছড়িয়ে একে অপরের বিপরীত দিকে মুখ করে (ডায়মন্ড ফর্মেশন) অলরাউণ্ড ডিফেন্স নেওয়া উচিত ছিল। বুঝলাম আরও অনেক ট্রেনিং-এর দরকার। ভাগ্যিস এই ঝপ আওয়াজ হয়েছিল নালাতে পাড় ভেঙে ধ্বসে পড়া মাটি থেকে, তা না হলে গােলগাল হয়ে বসে থাকা আমার দলটিকে নিমেষের মধ্যে শেষ করে দেওয়া একজন মাত্র শত্রু সৈন্যের পক্ষেই যথেষ্ট ছিল। ফেরত আসার সময় একটি গারাে মেয়ে আমাকে দেখে ঝুপ করে পাহাড়ের গাছের সঙ্গে মিশে রইলাে। আমি ধারণাই করতে পারিনি যে অমন ফাঁকা জায়গায় কোনাে মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে। আমি মেয়েটিকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবার পর যখন সুবেদার হাকি ইশারায় আমায় দেখাল আমি তাে থ।
২ আগস্ট বিকেলে কর্নেল জিয়াউর রহমান স্বচক্ষে আমার প্ল্যান মােতাবেক হাতিয়ারের অবস্থানগুলাে দেখলেন। রাতে রাস্তা থেকে গাড়ি পড়ে যাওয়াতে যখন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় তখন ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে ১ম ইস্ট বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন মাহবুব (যিনি পরে ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ সনে সিলেট রণাঙ্গনে শহীদ হন) আমাকে বললেন, “স্যার, মনে কনফিউশন থাকলে অ্যাটাক করতে যাবেন না। আমি হেসে বললাম, ‘বেওকুফের মতাে মরতে আমি রাজি নই।’ ৩ আগস্ট রাত ১২ টার দিকে এসেমব্লি এরিয়া হতে রওয়ানা হবাে, দেখি বাহাদুরাবাদ ঘাট বিজয়ী বীর কর্নেল শাফায়াত
১২৭
জামিল জিপ নিয়ে হাজির। বললেন, ‘আমীন রিমেম্বার, ডােন্ট গাে ফর ইমপসিবল টাস্ক অল বাই ইওরসেলফ, অল দি বেস্ট। বলা বাহুল্য আর্মিতে ইংরেজিতে কথােপকথনটা একটু বেশি বৈকি, যদিও মরার আগে আমরা সকলেই বরাবরই বাংলাতে চিঙ্কার দিয়ে থাকি। এসেমব্লি হতে অত্যন্ত সাবলীল গতিতে আমার সৈন্যরা এফইউপি-তে পৌছায়। এমন কি মাঝপথে নালা ক্রস করার সময়ও কোনাে শব্দ করেনি। কারণ পূর্ববর্তী দু’রাত বিনা শব্দে পানির উপর চলার প্র্যাকটিসও করেছিলাম। অন্যদিকে একই সময় দুই প্লাটুন রাঙামাটিয়াতে যায় কাট-অফ পার্টি হিসেবে। যদিও ইপিআর-এর গার্ড ছিল, তথাপি মনে হয় এফ ইউ পি করলে যে সামান্য বিশৃঙখলাটুকু হয়েছিল তাও হতাে না। সৈন্যরা যখন এফইউপি-তে যাচ্ছে, আমি তখন ৮/১০ জন এফ এফ (ছাত্র) নিয়ে এমজিও আর/আর-এর অমুনিশন বাঙ্কারে পৌছিয়ে দিই। উদ্দেশ্য– ওদের মনে সাহস জোগানাে। কারণ, যুদ্ধের ফলাফল এদের ওপর অনেকটা নির্ভর করছিল। বাঙ্কারের পিছে অবস্থানরত সুবেদার হাকিম তখন তাে রীতিমতাে ক্ষেপে গেছেন। কারণ, ইনি নিজে তাে খাবার পাননি, নিজের ছেলেরা যারা সারারাত ওই আড়াই মণি বস্তায় বালি ভরে বাঙ্কার বানিয়েছে ওরাও পায়নি। দেমাক ঠাণ্ডা রেখে বললাম, সব ভুলি নাই তবে আপনাদের রুটি পেছনে এসেমব্লি এরিয়াতে রয়ে গেছে। কাউকে পাঠিয়ে দিয়ে আনুন। এফইউপি-তে আমার কম্যাণ্ডিং অফিসার মেজর আমীন আমাকে একাকী শত্রু অভিমুখে ঠেলে না দিয়ে আমার সঙ্গে উনি নিজেও যেতে চাইলেন। আমি সেই দুঃসাহসিক বীরযােদ্ধাকে ইকনমির কথাটা বােঝাতে চাইলাম। নিছক ভাবালুতায় কাজ হবে না- একসঙ্গে দু’জন অফিসার হারানাে মুক্তিবাহিনীর জন্য তখন নিছক বােকামি। রাত ৩টা ৩৫ মিনিটে এফইউপি-তে পজিশন নিলাম। আমার ডানে ১২নং প্লাটুন আর বামে ৫নং প্লাটুন। আর সেই ১২নং প্লাটুনে আমার এক ভাগ্নে আই এ ক্লাসের ছাত্র জহিরুল আনােয়ার ওরফে সানু সাধারণ সৈনিক হিসেবে আমার পাশেই ছিল। আশ্চর্য, আজ আত্মীয়তার প্রশ্নটাই যদিও বা বড়াে হয়ে দেখা দিয়েছে (যেহেতু স্বজনপ্রীতি আমাদের মজ্জাগত), সেদিন কিন্তু এ প্রশ্নটা তেমন করে দেখা দেয়নি। সেদিন প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঝঙ্কৃত হয়েছিল- ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? তাই বুঝি ঘুণাক্ষরেও যুদ্ধের ময়দানে আমার ভাগ্নের উপস্থিতি আমি টের পাইনি। স্বাধীনতার পর জার্মান থেকে চিকিৎসা সেরে ফেরত আসার পর পরিচয় ঘটে ৮ম বেঙ্গলের সেই সৈনিকের সঙ্গে চৌমুহনী পােস্টঅফিসে— যে পােস্টঅফিসের পােস্টমাস্টার ওর পিতা জনাব এ কে এম শফিকুর রহমান।
এফইউপি-তে পজিশনে গিয়ে ৩টা ৪৫ মিনিটে অয়্যারলেসে বললাম ‘জোরে মারাে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আর্টিলারি গর্জে উঠল। বুঝতে পারলাম আর্টিলারির আওয়াজের ধমকে আমার স্বল্প ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈনিকরা এফইউপি-তে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চাইছে। মাটি কামড়ে পড়ে থাকাটা আরও প্রকট হয়ে উঠল, যখন নিজেদেরই পিএইচ আওয়ারের আর্টিলারি গােলাবর্ষণকালে দু’তিনটি রাউণ্ড ভুলবশত ঠিক আমাদের এফইউপি-তে এসে পড়ে। যদিও-বা টারগেট থেকে এফইউপি ছিল প্রায় এক হাজার
১২৮
গজ দূরে। মনে হয় এফ ইউ পি শত্রুশিবির ও আমাদের আর্টিলারি পজিশন এক লাইনে ছিল বলে সহজে আর্টিলারির গােলা এসে এফইউপি-তে পড়েছিল। অবশ্য পূর্বাহ্নে আর্টিলারির কর্মদক্ষতা সম্বন্ধে সন্ধিহান হলে কিংবা এতাে নিম্নমানের হতে পারে এ ধারণা থাকলে আমি হয়তাে ডাইনে হালছটি গ্রামের শালবনকে এফইউ পি বানাতম। হালছটি গ্রামের শালবনটি শক্রশিবির হতে মাত্র তিনশ’ গজ দুরে ছিল। কিন্তু যেহেতু আমাদের আক্রমণের বেশ কিছুদিন আগে ওই শালবনকে এফইউপি বানিয়ে এফএফ কোম্পানি বিওপি-র ওপর আক্রমণ করেছিল, তাই আমি ওই শালবনটিকে এফইউপি বানাইনি। অন্যদিকে পূর্বদিন (২ আগস্ট) আমার পরিকল্পনা ছিল সামনের শালবনকে এফইউপি বানিয়ে আর্টিলারির ফায়ার অন কলু রেখে আক্রমণ করা। তাতে করে রাতের আঁধারে শত্রুর অজান্তে আমরা শুক্রশিবিরের শত গজ ভেতরে পৌঁছে যেতাম এবং নিজস্ব আর/ আর ও মেশিনগান দিয়ে শত্রুকে আচম্বিতে ঘায়েল করে শত্রুর ব্যুহাভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারতাম বলে আমার বিশ্বাস। আর বিশেষ দরকার মতাে আর্টিলারি সাপাের্ট তাে ছিলােই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অবস্থার চাপে পূর্ব পরিকল্পনা বদল করে পিএইচ আওয়ার (আক্রমণের পূর্বাহ্নে) গােলাবর্ষণের কার্যক্রম নিতে বাধ্য হলাম। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস যুদ্ধের আগেই এফইউপি-তে নিজেদেরই আর্টিলারির এই দুতিনটি রাউণ্ড এসে পড়াতে আমার ছয়টি ছেলে ঘটনাস্থলে গুরুতররূপে আহত হয়, ফলে পুরাে প্লটুন আহতদের শুশ্রুষার নামে এফ ইউপি-তেই থেকে যায়। এতে যথেষ্ট শােরগােলও হয়। অপরদিকে প্রচণ্ড গােলাগুলির মাঝে আমাদের আর্টিলারি গর্জে ওঠার মিনিটখানেকের মধ্যেই পাকিস্তানি আর্টিলারি গর্জে ওঠে। একবার মাটিতে শুয়ে পড়ে তারপর আবার দাঁড়িয়ে অগ্রসর হওয়া যথেষ্ট সাহসের কাজ বৈকি, বিশেষ করে আমার দুই কোম্পানির জন্য। কারণ আমার দুই কোম্পানিতে (৮ম বেঙ্গল) ২০০ জনের মধ্যে তখন মাত্র ১০ জন সামরিক বাহিনীর লােক, গােটা আটেক ইপিআর এবং দুই তিনজন পুলিশের লােক ছাড়া বাকি সবাই সাতদিনের ট্রেনিংপ্রাপ্ত গ্রাম-বাংলার একান্ত সাধারণ মানুষ। পিএইচ আওয়ারে গােলাবর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে আমার ডাইনে অবস্থিত মেশিনগান ও আর/আর প্রচণ্ডভাবে গর্জে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে হালছটি গ্রাম থেকে ই পি আর-এর প্লাটুনটি ভাঁওতা দেয়ার জন্য আক্রমণের ব্যুহ রচনা করে শত্রুদের ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দিল। এই কার্যক্রম অত্যন্ত সুষ্ঠু ও সাবলীল গতিতে হতে থাকে। ইপিআর-এর আক্রমণ চলাকালেই আমরা চুপি চুপি এক্সটেণ্ডেস লাইন (বিলম্বিত রেখার মতাে) ফরমেশন করে পায়ে পায়ে এগুতে থাকি। এ অবস্থায় সুবেদার জালাল যথেষ্ট দৌড়াদৌড়ি করলেও পরবর্তীকালে আর তার সাক্ষাৎ পাইনি। এফইউপি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি ছেলে পাশ থেকে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠল, ‘স্যার, বাঁদিক থেকে গুলি আসছে যে, ‘—ভাবখানা এই, গুলি তার পিছু ধাওয়া করছে। হাসি পেলেও চিঙ্কার করে উঠলাম “বেটা, গুলি আসবে নাতাে বৃষ্টির ধারা আসবে?’ ৫০০ গজ আগে নালার কাছে পৌছে শুধু ২ ইঞ্চি মর্টারওয়ালাদের নালার পাড়কে আড়াল করে ৩৩০ গজ আগে শত্রু শিবিরের ওপর ফায়ার করার নির্দেশ দিলাম। এই নির্দেশ না দিলেই যেন ভালাে
১২৯
হতাে। কারণ আমার এই নির্দেশের সুযােগে আমার স্বল্প ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈনিকরা নালাতে আড়াল নিয়ে নেয়। তাতে কমান্ড ও কন্ট্রোল একেবারে শিথিল হয়ে পড়ে। নায়েক সুবেদার কাদের ও বাচ্চুর অধীনে ৫ ও ৬ নং প্লাটুন বিওপি-র গেটের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করার কথা ছিল কিন্তু তারা নালার ভেতরে আড়ালে মাথা নিচু করে আন্দাজে ফায়ার করতে শুরু করে। সম্ভবত এই জন্যই এফইউপি ত্যাগ করার পর ‘ফায়ার অ্যাণ্ড মুভ’ পদ্ধতিতে আক্রমণ করা মিলিটারি একাডেমীতে (পাকিস্তানি) বিতর্কের বস্তু ছিল এবং প্রায়ই বলা হতাে এফ ইউ পি ছাড়ার পর ডােন্ট গাে টু দ্যা গ্রাউণ্ড অ্যাগেইন। নালাতে আমার সৈন্যদের এমন কাণ্ড দেখে শত্রু শিবিরের নিকটবর্তী এসেও আমি চিঙ্কার না করে পারিনি। এমন কি কাউকে কাউকে লাথি পর্যন্ত মেরেছিলাম। শেষ পর্যন্ত উপায়ান্তর না দেখে কলার চেপে ধরে আমি জোর করে আগে পাঠাতে শুরু করি। আমার বামে হাবিলদার নাসির তার সেকশন নিয়ে অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে ক্ষিপ্রগতিতে এগুতে থাকে এবং আমি নিজে নায়েক সিরাজকে সঙ্গে করে ডাইনে বাঙ্কারের দিকে এগুতে থাকি। আমাদের এই মনােবল দেখে শত্রুরা তখন পলায়নরত। ইতােমধ্যে আমরা ফর্ম তৈরি করি এবং সঙ্গে সঙ্গে ‘চার্জ’ বলে হুঙ্কার দিই এবং পর মুহূর্তে ‘ইয়া আলী’ বলে আমার সৈন্যরা সঙ্গীন উঁচু করে বেয়নেট চার্জের জন্য রীতিমতাে দৌড়াতে শুরু করে। এদের উত্তেজনাকে বাড়াবার জন্যে নায়েক সুবেদার মুসলিম নারায়ে। তাকবীর’ ধ্বনি করলে সৈন্যরা ঘন ঘন ‘আল্লাহু আকরব’ ধ্বনি করে যুদ্ধের ময়দানকে প্রকম্পিত করে তােলে। আনন্দের আতিশয্যে আমার সিগনালম্যান অয়্যারলেস সেট আমার সামনে এনে ধরলে আমি ধমকে উঠলাম, তুমি নিজেই যা পারাে বলে পাঠাও’। পিছু পিছু সে অয়্যারলেসে জোশের সঙ্গে বলে বেড়াচ্ছিল হয়ে গেছে, আর একটু বাকি…বাঙ্কারে যুদ্ধ হচ্ছে…ইত্যাদি। ঠিক এমন সময় শত্রুদের আর্টিলারি শেলভাে। ফায়ার (এয়ার বারস্ট) এসে পড়ল আমাদের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকজন ঢলে পড়ল, যার ভেতরে সম্ভবত হাবিলদার নাসিরও ছিল। আমাদের সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। আমার ডান পায়ে এসে একটা শেল লাগল । আঘাতটার গুরুত্ব উপলব্ধি করার বদলে আগের জোশের সঙ্গে এগিয়ে গেলাম আরও ৫০ গজ। শত্রু বাঙ্কার মাত্র ৫ গজ বাকি। আমাদের গুটিকতক ছেলে তখন পলায়নরত শত্রুদের মারছে, কেউ কেউ মাইন। ফিল্ডে ফেসে গিয়ে শত্রুর মাইনে উড়ে যাচ্ছে, কেউবা শত্রুর গুলি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় অনার্স ছাত্র শামসুল আলম মাইন কিংবা তােপের মুখে উড়ে গেল। ওই বিশ-পঁচিশটা ছেলের মন চাঙ্গা রাখার জন্য জোরে জোরে চিৎকার করে উঠলাম-বিওপি একেবারে তছনছ হয়ে গেছে, আগে বাড়াে’। যদিওবা বিওপি-র মাটির দেয়াল আগের মতােই ঠিক খাড়া ছিল। এমন সময় বাঁ পায়ে বাঁশের কঞ্চি বিধল, আমি পড়ে গেলাম। বাচ্চা ছেলে সালাম আগেই খতম করেছিল খানসেনাকে। এদিকে যার যার মাথা নিচু করে পেছনের নালা থেকে আন্দাজে ফায়ার করছিল। তাদের ফায়ারে আমাদের দুটি ছেলে জখম হলাে। করার কিছুই নেই তখন। এর আগে এফইউপি থেকে অ্যাডভান্স করাকালীন নালাতে অবস্থানকালে অমন মাথা নিচু করে আন্দাজে
১৩০
ফায়ার করার জন্য আমি একটি ছেলের কাছ থেকে রাইফেল কেড়ে নিয়ে পেছনে পাঠিয়ে দিই। মাটিতে পড়ে গিয়ে আমি দু’টি ধাবমান শত্রুকে গুলি করে ডানদিকের বাঙ্কারে অবস্থানরত শত্রুসেনাকে গুলি করার জন্যে বিহারী ছেলে হানিফকে ঘন-ঘন নির্দেশ দিচ্ছিলাম। অবশ্য হানিফ তখন ভীষণভাবে অনুরােধ করছে, ‘স্যার, আপ পিছে। চলা যাইয়ে, মায় কভারিংয়ে রাঁহা হু।’ বলা বাহুল্য, বিহারী ছেলে হানিফ ছিল আমার ব্যক্তিগত প্রহরী। বরিশালের এক বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করেছিল হানিফ। বেশ কয়েকটা অপারেশন করার পরও সন্দেহভাজন হয়ে মুক্তিবাহিনী তাকে বন্দী করে। বন্দীশিবিরে স্পষ্ট বাংলায় সে আমাকে বলল, ‘স্যার, আপনি আমাকে একটা চান্স দিন, জান দিয়ে প্রমাণ করব।’ পিঠ চাপড়িয়ে বললাম ‘হানিফ, তুমি আজ থেকে আমার পার্সোনাল গার্ড।’ ‘পারব স্যার, আমার জান থাকতে আপনার গায়ে গুলি লাগবে না। প্রত্যয় ভরা মুখে উত্তর দিল হানিফ। সত্যিই সে জীবিত থাকাকালীন আমার গায়ে গুলি লাগে নি (যদিও শেল লেগেছে)। হানিফকে নির্দেশ দেবার আগেই হিস শব্দ হলাে, হানিফ ঢলে পড়ল, মনে হয় ওর গুলি লেগেছিল। তার মাথায় স্টিল হেলমেট ছিল না। প্রাণটা কেদে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে শত্রুর গুলিতে পাশের মাটি উড়ে গেল। বুঝতে পারলাম শত্রু আমায় দেখে ফেলেছে। সাইড রােল করে সরে যাওয়ার চেষ্টা করাকালীন বাঁ দিক থেকে একটা গুলি এসে আমার ডান হাতের কনুইতে লাগল। ঝাঁ করে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলাে সারা শরীরে। হাতের স্টেনটা ছিটকে পড়ল। বাঁ হাত দিয়ে তা কুড়িয়ে নিলাম। কজিটা বেঁকে নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ল। ফিল্ড ড্রেসিংটা বের করবাে, এক ঝাঁক গুলি এসে পাশের জমির আইলটা উড়িয়ে দিল। বুঝলাম শত্রুর পাঁচগজের ভেতরে থাকা আর সম্ভব না। আমার দু’ধারে শুধু লাশ আর লাশ-কারণ এর আগের মুহূর্তে শত্রুর এস ও এস এয়ার আর্টিলারি ফায়ারে যে আট-দশ জন লােক শত্রু বাঙ্কারে ঢুকে পড়েছিল তারা ধরাশায়ী হলাে- তার মধ্যে নায়েক সিরাজ এবং পুলিশের ল্যান্স নায়েক সুজা মিয়াও ছিল।
শত্রু তখন ৫০ গজ দূরে আমায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। ক্রমেই আমি যেন তলিয়ে এবং নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি। শেষবারের মতাে টেনে-হিচড়ে নিজের বিক্ষত দেহটাকে আর্টিলারি শেলে সৃষ্ট একটি মাটির গর্তে নিয়ে গেলাম শত্রু যাতে সহজে দেখতে না পায়। গলা পর্যন্ত ধীরে ধীরে বাঁ হাতের কর্দমাক্ত কালাে মাটি দিয়ে লেপে দিয়ে স্টীল হেলমেট মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে রইলাম- অপেক্ষা চরম মুহুর্তের। চোখটা আপনা থেকেই বুজে আসছে। ভেসে উঠল মায়ের মুখচ্ছবি। যুদ্ধে যােগ দেয়ার আগে মাকে দেখে আসা একান্ত উচিত ছিল। আজ মা-বাপ, ভাই-বােন কে কোথায় আছে জানি না। তারাও জানলাে না। আমি কেমন করে মরতে যাচ্ছি। ভাবনার কূপমণ্ডুকতা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে জোর করে চোখ খুলে চাইলাম। স্টেনটা বাঁ হাতে ধরা। বন্দী হবাে না কোনােক্রমেই। বরং মেরে মরব। তবুও মনেপ্রাণে মরার কথাটা চিন্তা করতে পারিনি। কেন যেন মনে হচ্ছিল নিশ্চয়ই বেঁচে যাব। আশ্চর্য, এত বিহ্বলতার মাঝেও একটা কথা
১৩১
বারবার মনে পড়ছিল, আহা! কেউ যদি আমার হারিয়ে যাওয়া ডায়রিটা পেতাে! কিংবা এখানে-ওখানে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত আমার লেখাগুলাে! ঠিক এমন সময় আমার কম্যাণ্ডিং অফিসার মেজর আমীনের কণ্ঠস্বর ভেসে এল শালবন থেকে আস্তে আস্তে আসার চেষ্টা করাে। আহত হওয়ার তিন ঘণ্টা পর এই প্রথমবারের মতাে সক্রিয় সাহায্য পেলাম । বস্তুত আমার নিহত বা নিখোঁজ হওয়ার সংবাদে কর্নেল জিয়াউর রহমানের নির্দেশে মেজর আমীন তখন কম্যাণ্ডে প্লাটুন নিয়ে আমার মৃতদেহ খুঁজতে বের হয়েছিলেন। আমার কাছে ক্রল করে আসতে ইতস্তত করছিল দেখে মেজর আমীন নিজেই খালি হাতে ক্রল করতে শুরু করলেন। সঙ্গে সঙ্গে হাবিলদার তাহের (বর্তমানে নায়েক সুবেদার) মেজর আমীনের পিছু নিলেন। আমার কাছে এসে উভয়েই পর্যায়ক্রমে মৃতদেহের মতাে আমার পা ধরে টানতে শুরু করল । পিঠের চামড়া উঠে যাচ্ছেবিক্ষত ডান পায়ের ব্যথায় ডুকরে উঠলেও দাঁত কামড়ে রইলাম। সম্ভবত আনন্দের আতিশয্যে ব্যথা ভুলে গেলাম। লেঃ মােদাসসের তখন চিঙ্কার করছে শালবন থেকে, ‘তাড়াতাড়ি করেন স্যার। তার দুই এল এম জিওয়ালা তখন দুই গাছের উপর উঠছে। শত্রুরা তখন আমাদের ২০/২৫ গজ পেছনে। একজন আহত জোয়ানকে হত্যা করে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। আমাদের দুই এল এম জিওয়ালা কেদে কেদে বলছে, ‘আপনাদের ধরে ফেলল যে স্যার’। দাঁত খিচিয়ে আমরা বললাম, ব্যাটা ফায়ার কর। আমাদের ওপর দিয়ে ফায়ার করতে হবে তাই জোয়ানদ্বয় ইতস্তত করছিল। শত্রু তখন আমাদের ওপর চার্জ করে আর কি! সঙ্গে সঙ্গে এলএমজি গর্জে উঠল। ৬/৭ টি খানসেনা তৎক্ষণাৎ লুটিয়ে পড়ল। মকবুল আর তার সাথী দালালকে আমরা হাতেনাতে ধরে ফেললাম। দুটি খানসেনা পালিয়ে বাঁচল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শত্রুর আর্টিলারির ফায়ার এসে পড়তে লাগল। বৃষ্টির মতাে আর্টিলারি ফায়ারের তীব্রতায় মেজর আমীন আমাকে কাঁধে নিতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু পরিশ্রান্ত মেজর আমীন নিজেই আমাকে নিয়ে নালায় পড়ে গেলেন। স্যার, প্লিজ, আপনি চলে যান, তাহের আমাকে নিয়ে আসবে’- আমি বলে উঠলাম । শেষ পর্যন্ত জোর করে আমি তাহেরের দিকে হাত বাড়ালাম স্যার প্লিজ চলে যান’- আবার বলে উঠলাম মেজর আমীনকে। বৃষ্টির মতাে আর্টিলারি ফায়ারের মধ্যে হাবিলদার তাহের আমাকে কাঁধে নিয়ে দিল এক ভোঁ দৌড়। ভীষণভাবে হাঁপাচ্ছিল তাহের। হাঁপাতে হাঁপাতে বলছে, স্যার, চিন্তা করবেন না, মরলে দু’জন একসঙ্গেই মরব’।
নকশী সংঘর্ষে ক্যাপ্টেন আমীন আহমদ চৌধুরী শেষ পর্যন্ত বেঁচে গেলেও বহু মুক্তিযােদ্ধাকেই সেদিন বাংলা মায়ের জন্য চরম মূল্য দিতে হলাে। এখানকার সংঘর্ষে যারা শহীদ বা নিখোঁজ হয়েছিল, তারা হলেন :
১. হাবিলদার নাসিরউদ্দিন, ২. ল্যান্স নায়েক আবুল কালাম, ৩. ল্যান্স নায়েক মােঃ ইউসুফ মিয়া, ৪, সিপাই মােহাম্মদ আলী, ৫. সিপাই সিরাজুল হক, ৬. সিপাই হুমায়ুন কবীর, ৭. সিপাই মােঃ সুজা মিয়া, ৮. সিপাই শামসুজ্জামান, ৯. সিপাই আব্দুস সাত্তার, ১০, সিপাই ফয়েজ আহমদ, ১১. সিপাই আব্দুস সালাম এবং ১২. সিপাই মােঃ হানিফ।
এগারাে নম্বর সেক্টরের সামনে বড়াে রকমের কাজ ছিল- কোদালকাঠি, চিলমারী, হালুয়াঘাট এবং কামালপুর থেকে শত্রুসেনাদের বিতাড়িত করা। সুবেদার আফতাবকে কোদালকাঠি দখল করতে বলা হলাে। সুবেদার আফতাব অক্টোবর মাসেই তিস্তা নদীর মুখে শত্রুসেনাদের মাত্র কয়েক শ’ গজ দূরে দুটি কোম্পানি নিয়ে কোদালকাঠিতে পজিশন নিলেন। কোদালকাঠির মুক্তিবাহিনীর অবস্থান থেকে পাকসেনাদের অবস্থান পর্যন্ত মাঝখানের অনেকখানি এলাকা সম্পূর্ণ খােলামেলা ছিল। সুবেদার আফতাব বাঙ্কারে নির্দিষ্ট স্থানে তার বাহিনী নিয়ে বসে পড়লেন। পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর অবস্থান টের পেয়ে তাদেরকে শায়েস্তা করতে অগ্রসর হল । সুবেদার আফতাব তার। বাহিনীকে সজাগ করে দিলেন। পাকসেনারা রাইফেল রেঞ্জের মধ্যে এলেই ‘ফায়ার’ বলে বজ্রকণ্ঠে তিনি হুকুম দিলেন। একই সঙ্গে দুটি কোম্পানির রাইফেলগুলাে গর্জে উঠল । শত্রুসেনারা ছিল খােলা মাঠে, আর তা ছাড়া মুক্তিবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে সঠিক কোনাে ধারণাও পাকিস্তানিদের ছিল না। ফলে মাঠে মুক্তিবাহিনী সহজেই খানসেনাদের বুলেটবিদ্ধ করতে লাগলাে। এই অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর তীব্র গুলিবর্ষণের মুখে খুব নগণ্য সংখ্যক পাকসেনাই সেদিন পালাতে পেরেছিলাে। ফলে কোদালকাঠি পুরােপুরি হানাদারমুক্ত হয়।
এগারাে নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর তাহের রৌমারীকে মুক্ত, নিরাপদ এবং স্বাধীন রাখার মানসে অক্টোবরের ১১ তারিখে পাকঘাঁটি চিলমারী আক্রমণ করলেন। চিলমারী প্রখ্যাত বন্দর। এই বন্দর এলাকার সঙ্গে সড়ক এবং রেলপথের মাধ্যমে অন্যান্য স্থানের ছিল পূর্ণ যােগাযােগ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দু’টি কোম্পানি, দুটি মিলিশিয়া কোম্পানি এবং বেশ কিছুসংখ্যক রাজাকার প্রচুর অস্ত্রসস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে চিলমারীতে অবস্থান করছিল। মুক্তিবাহিনীর সংখ্যানুপাতে অস্ত্র ছিল নগণ্য। তাই অস্ত্র সংগ্রহের জন্যেও চিলমারী আক্রমণ ছিল অবশ্যম্ভাবী । পাকসেনারা ওয়াপদা কলােনি, রেলওয়ে এলাকা, থানা, হাট এবং বলবাড়িতে পাকা বাঙ্কার করে দৃঢ়ভাবে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলে অবস্থান করছিল। তারা চিলমারীর রাজভারটা থেকে জোড়গাছা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় বাঙ্কার নির্মাণ করেছিল। চর সামাদের পেছনে চিলমারী ঘাটে শত্রুদের কয়েকটি গানবােটও ছিল। মুক্তিবাহিনীর জন্যে চর-জমিতে ভরা প্রায় তিন মাইল দীর্ঘ এই নদীটি অতিক্রম করে পাকিস্তানিদের আক্রমণ করাটা কষ্টকর ছিল বৈকি। কম্যাণ্ডে অফিসার সেক্টর কমান্ডার মেজর তাহের সব জেনেশুনেই সেই বিপজ্জনক অপারেশনের ঝুঁকি নিলেন। ঈপ্সিত লক্ষে পৌছানাের জন্যে প্রাথমিক প্রয়ােজন ছিল নৌকা, ফায়ার সাপাের্ট এবং গােপনীয়তা। পরিকল্পনা হলাে মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের রিয়ার হেড কোয়ার্টার এবং অন্যান্য ডিফেন্স পজিশনগুলাের মধ্যে পরস্পরের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করবে। এবং এই লক্ষে পৌছুতে শত্রুসেনাদের যানবাহনাদি ধ্বংস এবং সঙ্গে সঙ্গে ক্রমান্বয়ে যতদূর পারা যায় একই সঙ্গে শত্রুঘাঁটি ধ্বংস করতে হবে। সিদ্ধান্ত অনুসারে মেজর তাহের চারটি ফিল্ডগানই শত্ৰুৰূহের কাছাকাছি নিয়ে এলেন। ৯ অক্টোবরের মধ্যে কাট অফ পার্টি গন্তব্যস্থানে পৌছে গেল । মুক্তিবাহিনী ৬০টি দেশি নৌকাযােগে পাকসেনাদের মূলঘাঁটি আক্রমণের জন্যে নদী পেরিয়ে তীরে পৌছাল। ফিল্ডগান চারটি বসানাে
হলাে চর চালাই পাড়াতে। এখানে সেক্টর কমান্ড পােস্ট স্থাপন করা হলাে। আক্রমণের তারিখ স্থির হলাে ১১ অক্টোবর ভাের ৪টা। নায়েক সুবেদার মান্নাকে ওয়াপদা কলােনি (যেখানে পাকিস্তানি অফিসার থাকত) আক্রমণের নির্দেশ দেয়া হলাে। নায়েক সুবেদার মান্নানের সঙ্গে দুটি ৩.৫ ইঞ্চি রকেট লাঞ্চার ছিল। কমান্ডার চাদকে জোড়াগাছা, রাজভারটা, থানাহাট পুলিশ স্টেশন এবং পেছনে সেতু এলাকা পর্যন্ত আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হলাে। মূল বাহিনীকে ভাগ করে রাখা হলাে ৬টি গ্রুপে- যথাক্রমে খালেদ, দুদু, সুলায়মান, নূর আহম্মদ, আলাে এবং নজরুলের কম্যাণ্ডে। রাত একটার মধ্যে মুক্তিবাহিনী তাদের পজিশনে চলে গেল। ভাের চারটায় প্রথম ওয়াপদা কলােনির ওপর নায়েক সুবেদার মান্নান তাঁর রকেট লাঞ্চার নিক্ষেপ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র চিলমারী যেন গােলাগুলির আঘাতে ফেটে পড়ল । একই সঙ্গে শত্রুর গানবােটের ওপর আক্রমণ চালানাে হলাে। মেজর তাহের নিজে তার পােস্ট থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন। সকাল ৬টার মধ্যে জোড়াগাছা, রাজভারটা, পুলিশ স্টেশন এবং সেতু এলাকা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ওয়াপদা কলােনি থেকে তখনাে শত্রুদের প্রতিরােধ আসছিল। মাত্র দুটি রকেট লাঞ্চার দিয়ে শত্রুদের কাবু করা যাচ্ছিল না। ওদিকে কমান্ডার চাদ পুলিশ স্টেশন দখল করে ৭৬টি ছােটো-বড়াে হাতিয়ারের সাহায্যে শত্রর প্রতিরােধ করছিলেন। এখানে পাকসেনাদের আক্রমণের তীব্রতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। কমান্ডার চাদ সেক্টর। কমান্ডারের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। শত্রুসেনারা বলবাড়ি এবং রেলওয়ে ট্রাকে পজিশন নিয়ে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। মেজর তাহের এই অবস্থায় তার ছােট্ট গানবােটের কমান্ড পােস্ট ছেড়ে কয়েকজন এল এম জি ম্যান নিয়ে চাঁদের সাহায্যে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু তার আগেই চাঁদকে পুলিশ স্টেশন ত্যাগ করতে হলাে। মেজর তাহের তাঁর এল এম জি স্কোয়াডকে সঙ্গে সঙ্গে পজিশন নিয়ে শত্রুসেনাদের ওপর আঘাত হানার নির্দেশ দিলেন। এই সাহায্যে চাঁদের অনেকখানি সুবিধে হলাে। সে এল এম জি সাপাের্টে তাঁর বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানিদের ওপর তীব্রভাবে আক্রমণ চালায়। আক্রমণের মুখে শত্রুসেনারা পেছনে সরতে বাধ্য হয়। মেজর তাহের বলবাড়ি পর্যন্ত শত্রুদের পিছু ধাওয়া করে গেলেন। বলবাড়িতে পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীকে বাধা দেয়ার প্রস্তুতি নেয়। এই সুযােগে মেজর তাহের তার ট্রুপস নিয়ে পুলিশ স্টেশনে ফিরে এসে অস্ত্রশস্ত্র-গােলাবারুদ গাজীর চরে নিয়ে যাওয়া শুরু করেন । ওয়াপদা কলােনিতে মান্নান তখনও পাকিস্তানিদের ব্যস্ত রেখেছিল। স্কোয়াড্রন লিডার হামিদউল্লাহ গাজীর চরে বহুসংখ্যক বন্দী পাকিস্তানিকে তখনই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। সন্ধ্যায় মেজর তাহের তাঁর দলবল নিয়ে গাজীর চরে ফিরলেন। এই যুদ্ধে পাকিস্তানিরা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে। চিলমারী আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল অস্ত্রশস্ত্র-গােলাবারুদ উদ্ধার করা এবং মুক্তিবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে পাকিস্তানিদের অবহিত করা। মুক্তিবাহিনীর এই আক্রমণে পাকিস্তানিরা বেশ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এরপর ১৩ অক্টোবর মেজর তাহের তার বাহিনী নিয়ে রৌমারী পৌছলেন । অক্টোবর। মাসের শেষের দিকে নেত্রকোণা এবং কিশােরগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওর এলাকা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
১৩৪
এগারাে নম্বর সেক্টরে সেক্টর কমান্ডার মেজর তাহের বিদ্যুৎগতিতে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রেখেছিলেন। ঢালু সাব-সেক্টর ট্রুপস ৬ নভেম্বর পাকঘাটি অন্তরগ্রাম আক্রমণ করে। অন্তরগ্রামে ৫০ জন পাকসেনা অবস্থান করছিল। ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং সুবেদার মেজর জিয়াউল হকের একটি প্লাটুন ওই তারিখে রাত ৮টায় হাতিপাথার নদী পেরিয়ে অন্তরগ্রামে অবস্থানরত পাকিস্তানীদের ওপর অকস্মাৎ আক্রমণ করল । উভয়পক্ষের ব্যাপক সংঘর্ষে ৭ জন পাকসেনা নিহত এবং বহুসংখ্যক আহত হয়। পাকিস্তানিরা মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে অন্তরগ্রামে পানিহাতা অবস্থান ছাড়তে বাধ্য হয়। এই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর অপূরণীয় ক্ষতি হয়। নিউকি দেশপ্রেমিক এম এফ এফ আব্দুল লতিফ শহীদ হন। ল্যান্স নায়েক মেসবাহউদ্দিন এবং সিপাই আবুল কাশেম গুরুতররূপে আহত হন। এই সংঘর্ষে হাবিলদার আতিকউল্লাহ, নায়েক কফিল উদ্দিন এবং নায়েক ইদ্রিসের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
১২ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী পাক অবস্থান বান্দরকাটা আক্রমণ করে। এই অপারেশনের পরিকল্পনা করলেন মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিং নিজে। পরিকল্পনানুসারে তিন কোম্পানি এফএফ এবং এক কোম্পানি এমএফ যথাক্রমে ডা. মাহমুদ, জনাব আবুল হাশেম, অধ্যাপক আব্দুল হান্নান এবং সুবেদার মেজর জিয়াউল। হকের নেতৃত্বে ওই তারিখে ভাের চারটায় পাক অবস্থান বান্দরকাঁটা আক্রমণ করে । পাকসেনারা ওইখানে সংখ্যায় ছিল প্রায় ২০০ জন । মিত্রবাহিনী আর্টিলারি সাপাের্ট দিলে পাকঘাটি চার্জ করা হয়। রণাঙ্গনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিল ক্যাপ্টেন বি এস ত্যাগী। পাকসেনারা দৃঢ় ঘাঁটি করে অবস্থান করলেও মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে প্রায় ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। বান্দরকাটা মুক্ত হয়। ১৯ জন পাকসেনার মৃতদেহ পাওয়া যায়। আহত ও নিহতের সংখ্যা আরও অধিক বলে সবাই জানান। মুক্তিবাহিনীর এম এ ক্লাসের ছাত্র শওকত প্রমুখ শহীদ হন। আহত হন বেশ কয়েকজন।
১৫ নভেম্বর পুনরায় কামালপুরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানিদের এক ভয়াবহ সংঘর্ষ হলাে। কামালপুরে পাকিস্তানিদের ২টি কোম্পানি সুদৃঢ়ভাবে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলে অবস্থান করছিল। মুক্তিবাহিনীর তিনটি কোম্পানি এবং মিত্রবাহিনীর দুটি কোম্পানি সংঘর্ষে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। পরিকল্পনাসারে মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন মান্নান, লে. মিজান এবং এম এফ সাইদের পরিচালনায় তিনটি কোম্পানি রাত ১২ টার দিকে ডিফেন্স পজিশনে পৌঁছে যায়। সেক্টর কমাণ্ডার মেজর তাহেরের সঙ্গে ১০ জন মুক্তিযােদ্ধা রইলাে । এই ১০ জনের সঙ্গে ৮টি এসএলআর, ২টি স্টেন এবং ১টি অয়্যারলেস সেট ছিল। ওই তারিখে ভাের ৪টা ৩০ মিনিটে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। ফ্রন্ট লাইনে অবস্থানরত প্রায় একটি পাকিস্তানি কোম্পানি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সকাল প্রায় ৭টার দিকে মেজর তাহের মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি নিয়ে নয়াপাড়ার শেষপ্রান্তে পৌছলেন। সংঘর্ষ তখনও চলছিল। কামালপুর প্রায় নিয়ন্ত্রণে। এমন সময় অকস্মাৎ একটি শেল এসে মেজর তাহেরের বা পায়ে পড়ে। মেজর তাহের চিৎকার করে পড়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে এফ এফ মিজানুর রহমান তাকে ধরলেন। ছুটে
এলেন লে. মিজান, এফ এফ সাইদ। সেক্টর কমান্ডারের আহতের সংবাদ তুরিত ছড়িয়ে পড়ল । মুক্তিবাহিনী ভেঙে পড়ল— পাকিস্তানিরা তাদের আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি করল । শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীকে পেছনে সরে আসতে বাধ্য হতে হলাে। গুরুতর আহত অবস্থায়ও মেজর জ্ঞান হারালেন না বরং নির্দেশ দিলেন, আগে বাড়াে। কিন্তু আগে যাওয়া আর সম্ভব হলাে না। মেজর তাহেরকে পেছনে সরিয়ে নিয়ে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হলাে। এই সংঘর্ষ সম্পর্কে মেজর তাহেরের সুইসাইড স্কোয়াডের অন্যতম সদস্য বি এ ক্লাবের ছাত্র এফ এফ মিজানুর রহমান তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন,
‘রাত বারােটার দিকে আমরা ডিফেন্স পজিশনে চলে গেলাম। কামালপুর আক্রমণ করা হলাে রাত ৪ টা ৩০ মিনিটে। আমরা ১০ জন মুক্তিযােদ্ধা মেজর তাহেরের সঙ্গে ছিলাম। আমাদের সঙ্গে ছিল ৮টি এস এল আর এবং ২টি স্টেন। আমাদের সঙ্গে অস্ত্র ছাড়াও ১টি অয়্যারলেস ছিল। আমাদের ওপর নির্দেশ ছিল কামালপুর দখলের পরই অস্ত্রশস্ত্র দখল করে পেছনে সরিয়ে আনতে হবে। মেজর তাহেরের সঙ্গে ছিল একটি অয়্যারলেস সেট। এছাড়া সার্বক্ষণিক সঙ্গী প্রিয় ছড়িটিও তাঁর সঙ্গে ছিল। রাস্তার পাশে আমরা পজিশন নিলাম। উভয়পক্ষে ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে। সকাল ৮টার দিকে একটি শেল মেজর তাহেরের বাঁ পায়ে এসে পড়ে। মেজর তাহের চিৎকার করে উঠলেন। আমি ছুটে গেলাম। তাঁর কাছ থেকে অয়্যারলেস সেট এবং ছড়িটি নিয়ে তাঁকে ধরলাম। মুক্তিযােদ্ধা শফিও ছুটে এল। আমরা দু’জনে তাঁকে নিয়ে পেছনে সরলাম। লে, মিজানও ছুটে এলেন। আমরা তখন কাঁদছিলাম। মেজর তাহের চুপ করতে বলে সবাইকে আক্রমণ অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিলেন। সেদিন কামালপুর বিজয়ের পূর্বমুহর্তে এই দুর্ঘটনা সকলের মন ভেঙে দেয় ব্যর্থ হয় কামালপুর বিজয়।৫
নভেম্বরের ২০/২১ তারিখে মুক্তিবাহিনী নালিতাবাড়ি থানা হেড কোয়ার্টার আক্রমণ করে দখল করে নেয়। এখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সৈনিক না থাকলেও পশ্চিমা পুলিশ, রাজাকার এবং আলবদরের দল জাকজমকের সঙ্গেই অবস্থান করছিল। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে তারা পাল্টা জবাব দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সংঘর্ষে বেশ কিছুসংখ্যক পুলিশ, রাজাকার এবং আলবদর নিহত হয়। অবশিষ্টরা আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিবাহিনী প্রচুর গােলাবারুদ উদ্ধার করে। এই বিজয়ের পরে একমাত্র হালুয়াঘাট ছাড়া শেরপুর থেকে দুর্গাপুর পর্যন্ত সমগ্র সীমান্ত এলাকা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানি জঙ্গী বিমানগুলাে ৫টা ৪০ মিনিটে অমৃতসর, ৫টা ৪৭ মিনিটে শ্রীনগর এবং ৬টা ৮ মিনিটে কাশ্মীর উপত্যকার অবন্তীপুরে হামলার পর পরই ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘােষণা করলাে এবং পাকিস্তানি জঙ্গী বিমানগুলাে যখন হামলা চালাচ্ছিল, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তখন কলকাতায়। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার সময় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ বিমান দমদম বিমানবন্দর থেকে দিল্লির পথে ডানা মেলল। প্রধানমন্ত্রীর বিমান পাহারা দিয়ে চলল ভারতীয় বিমান বাহিনীর জঙ্গী বিমান। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লি পৌঁছেই তিন বাহিনী প্রধান সেনাবাহিনীর জেনারেল এস এইচ এফ জে মানেকশ, নৌবাহিনীর এডমিরাল এস এম নন্দ এবং
বিমান বাহিনীর এয়ার চীফ মার্শাল পি সি লালের সঙ্গে এক জরুরি বৈঠকে বসলেন, আলােচনা করলেন, নির্দেশ দিলেন। বাহিনী প্রধান তাঁদের সবগুলাে সদর দফতরে নির্দেশ পাঠালেন : ‘ওয়ার ইজ অন । হিট ব্যাক। হিট ব্যাক উইথ অল ইওর মাইট।’
ভারতকে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হতে পারে এ আশঙ্কা তারা পূর্ব থেকেই করেছিলেন এবং এর জন্যে এপ্রিল মাস থেকেই ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নিম্নবর্ণিত বিভিন্ন দিক ভারতীয় সমর নায়কদের সামনে তুলে ধরেছিলেন।
“এক, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম চালাবে মূলত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী। ভারতীয় সেনাবাহিনী ট্রেনিং এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করবে।
দুই. মুক্তিবাহিনীকে ভারত সরকার সাহায্য দিচ্ছে বলে পাকবাহিনী যদি ভারতের ওপর হামলা করে তাহলে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সেই আক্রমণের জবাব দিতে হবে।
তিন, বাংলাদেশ সমস্যার যদি কোনাে রাজনৈতিক সমাধান না হয় তাহলে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীকেও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত লড়াইয়ে নামতে হতে পারে।
চার, যদি চূড়ান্ত লড়াইয়ে ভারতীয় বাহিনীকে নামতে হয়ই তাহলে তার লক্ষ্য হবে রাজধানী ঢাকাসহ গােটা বাংলাদেশকে দখলদার পাকবাহিনীর কবল হতে মুক্ত করা।
পাচ, মুক্তিসংগ্রামে যদি প্রত্যক্ষভাবে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী অংশ নেয় তাহলে রাজধানীসহ গােটা বাংলাদেশকে খুব দ্রুতগতিতে মুক্ত করতে হবে।
ছয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর অংশ নেয়ার অর্থই হবে
পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ। এবং
সাত, পাক-ভারতের লড়াই হলে উত্তর সীমান্তে চীনের কথাও মনে রাখতে হবে। এই লক্ষ সামনে রেখে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী দু’ভাগে তাঁদের পরিকল্পনা রচনা
করল এবং প্রস্তুতি গড়ে তুলল : (১) মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিং দেয়া এবং তাঁদের অস্ত্র সরবরাহ করা। (২) বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ের লড়াইয়ের জন্য পরিকল্পনা করা
এবং তার প্রস্তুতি গড়ে তােলা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত পর্যায়ের পরিকল্পনা রচনা করতে গিয়ে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে প্রথমেই কতকগুলাে অসুবিধার কথা বিবেচনা করতে হয়। প্রথমত, বাংলাদেশের প্রকৃতি। | বাংলাদেশে অসংখ্য নদী-নালা। কতকগুলাে নদী বিশাল। আর, বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র জলাভূমি এবং এইসব জলাভূমিতে শীতকালেও কিছু কিছু জল জমে থাকে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের নদী-নালাগুলাে অধিকাংশই উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত। তাই পশ্চিম থেকে পূর্বে অগ্রসর হওয়া অত্যন্ত কঠিন ছিল। অথচ ভারত থেকে বাংলাদেশে কোনও বড়াে সেনাবাহিনীকে পাঠাতে হলে নানা কারণে পশ্চিম দিক থেকে পাঠানােই সুবিধাজনক। তৃতীয়ত, বাংলাদেশে রাস্তাঘাট অত্যন্ত কম। কয়েকটি মাত্র পাকা রাস্তা আছে। সেগুলােও অসংখ্য নদী-নালার ওপর দিয়ে গিয়েছে। চতুর্থত, প্রয়ােজনীয়
১৩৭
সংখ্যায় সৈন্য, বিমান এবং জাহাজবােট পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশে পাক দখলদার বাহিনীতে মােট সৈন্য এবং আধা সৈন্য প্রায় চার ডিভিশন। সামরিক বিশেষজ্ঞদের হিসাব মতে ঘাঁটি থেকে কোনাে সেনাবাহিনীকে উচ্ছেদ করতে হলে আক্রমণকারীর অন্তত তিনগুণ শক্তি চাই।
অর্থাৎ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের জন্য অন্তত বারাে ডিভিশন ভারতীয় সৈন্য প্রয়ােজন। অথচ তা পাওয়া যাবে না। উত্তরের জন্যও কিছু সৈন্য এবং বিমান মজুত রাখতে হবে। এইসব অসুবিধা সত্ত্বেও খুব দ্রুত ঢাকাসহ বাংলাদেশকে মুক্ত করতে হবে কিন্তু বাংলাদেশে এমন সতর্কভাবে লড়াই চালাতে হবে যাতে সাধারণ নাগরিকের কোনাে ক্ষতি না হয়, দেশের কোনাে সম্পদ ধ্বংস না হয় এবং লড়াই চলবে শুধু পাকবাহিনীর সঙ্গে অর্থাৎ তাড়াতাড়ি লড়াই শেষ করতে হবে। কিন্তু আর পাঁচটা লড়াইয়ের মতাে সর্বাত্মক লড়াই করা যাবে না। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী বাংলাদেশের চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য একটা বিস্তারিত পরিকল্পনা রচনা করলেন। সেই পরিকল্পনার লক্ষ ছিল পাঁচটি। প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য ক্ষিপ্রতা। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী স্থির করলাে যদি যুদ্ধে নামতেই হয় তাহলে দু সপ্তাহের মধ্যে যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকাতে পৌছুতে হবে। অন্যান্য শহর বা ঘাঁটি দখলের জন্য সময় বা শক্তি নষ্ট করা হবে না। সেগুলােকে এড়িয়ে যেতে হবে।
দ্বিতীয় লক্ষ্য, শত্রুপক্ষকে ধোকা দেয়া। তাকে বােঝাতে হবে যে তার চেয়ে অন্তত চারগুণ শক্তি নিয়ে ভারতীয় বাহিনী আক্রমণ করছে। আর তাকে দেখাতে হবে যে ভারতীয় বাহিনী সবদিক থেকেই আক্রমণ করতে যাচ্ছে- যাতে শত্রুপক্ষ তার সৈন্যবাহিনী কোনাে একটা এলাকায় জড়াে করতে না পারে এবং বাংলাদেশের চতুর্দিকে ছড়িয়ে রাখতে বাধ্য হয়। | তৃতীয় লক্ষ্য, সেই ছড়িয়ে ছড়া পাকবাহিনীকে আবার একত্র হতে না দেয়া। যাতে পাকবাহিনী পুনরায় সংঘবদ্ধ হয়ে কোনাে দ্বিতীয় পর্যায়ের লড়াইয়ে নামতে না পারে এবং যাতে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সৈন্য সরিয়ে এনে তারা ঢাকা রক্ষার জন্য পদ্মা ও মেঘনার মাঝামাঝি অঞ্চলে কোনাে শক্তিব্যুহ রচনা না করতে পারে।
চতুর্থ লক্ষ্য, ভারতীয় বাহিনী যাতে পাকবাহিনীর সঙ্গে কোথাও কোনাে বড়াে এবং দীর্ঘ যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে পড়ে এবং যেন ভারতীয় বাহিনীর ক্ষতি যথাসম্ভব কম হয়। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর পরিচালকগণ এটাও জানতেন যে, কোথাও বড়াে এবং দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ হলে তাতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ক্ষতি হবে এবং জাতীয় সম্পদ ধ্বংস হতে বাধ্য। এজন্য ভারতীয় বাহিনী প্রথম থেকেই ঠিক করল বাংলাদেশে ঢুকতে হলে বড়াে সড়কগুলাে এড়িয়ে যাবে এবং এগােবে কাঁচা পথ দিয়ে যেখানে পাকবাহিনী তাকে আশা করবে না, যেখানে পাকবাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যুহ বা মাইন থাকবে না- যেখানে শত্রুপক্ষ ভারী অস্ত্রশস্ত্র আনতে পারবে না এবং যেখানে জনবসতি খুবই কম থাকবে।
পঞ্চম লক্ষ, গােড়া থেকেই এমনভাবে আক্রমণটা চালানাে এবং পরিকল্পনা করা যাতে বাংলাদেশের দখলদার পাকবাহিনীর মন লড়াইয়ের প্রায় শুরুতেই ভেঙে দেয়া যায় এবং যাতে তারা শেষ পর্যন্ত লড়াই না করে আগেই আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
১৩৮
এই পাঁচটি লক্ষ সামনে রেখে ভারত বাংলাদেশের প্রায় চতুর্দিকে তার সেনাবাহিনীর সমাবেশ ঘটাল এভাবে :
২নং কোর। সদর দফতর কৃষ্ণনগর। প্রধান লেঃ জেনারেল টি এন রায়না। দুটো পার্বত্য ডিভিশন। ৯ম ও ৪র্থ। তৎসহ টি-৫৫ এস রুশ ট্যাঙ্কে সজ্জিত একটি মাঝারি আমর্ড রেজিমেন্ট, পি টি-৭৬ সাঁতারু রুশ ট্যাঙ্ক সজ্জিত আর একটি হালকা ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট, একটি মাঝারি আর্টিলারি রেজিমেন্ট, ১৩০ মিলিমিটার দূরপাল্লার রুশ কামানসহ ব্রিজ তৈরি করতে পারে এমন একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিট। ৯ম ডিভিশন তার প্রধান ঘাঁটি করলাে ২৪ পরগণার বয়রার কাছাকাছি। ৪র্থ ডিভিশনের মূল ঘাঁটি হলাে কৃষ্ণনগর ছেদের মাঝামাঝি।
৩৩ নং কোর। সদর দফতর শিলিগুড়ি। প্রধান লেঃ জেনারেল এম এল থাপান। ৬ এবং ২০ নং পাবর্ত্য ডিভিশন। তৎসহ রুশ পিটি-৭৬ এস ট্যাঙ্কে সজ্জিত একটি হালকা আর্মড রেজিমেন্ট, ব্রিটিশ ৫.৫ ইঞ্চি কামানে সজ্জিত একটা মাঝারি রেজিমেন্ট এবং ব্রিজ তৈরি করার একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিট। ২০ নং পার্বত্য ডিভিশনের প্রধান ঘাঁটি করা হলাে বালুরঘাটের কাছে। ৬ নং ডিভিশন কোচবিহার জেলায়। এই ৩৩ নং কোরের আর একটা অংশের ঘাঁটি হলাে গৌহাটিতে। পরিচিতি ১০১ কমিউনিকেশন জোন। প্রধান : মেজর জেনারেল জি এস গিল । শক্তি : দুই ব্রিগেড পদাতিক সৈন্য। জামালপুরের কাছে প্রচণ্ড এক লড়াইয়ে জেনারেল গিল আহত হওয়ার পর এই বাহিনীর প্রধান হলেন মেজর জেনারেল জি নাগরা।
৪নং কোর। সদর দফতর আগরতলা। প্রধান লেঃ জেনারেল সগত সিং। ৮, ৫৭ এবং ২৩ নং পার্বত্য ডিভিশন। তৎসহ দু’স্কোয়াড্রন পি টি-৭৬ এস রুশ সাঁতারু ট্যাঙ্ক, বৃটিশ ৫.৫ ইঞ্চি কামান সজ্জিত একটি মাঝারি রেজিমেন্ট এবং ব্রিজ তৈরির ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিট। ওই তিনটি পার্বত্য ডিভিশনকে ভাগ করে বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলাে। যুদ্ধ যখন পুরােদমে শুরু হয়ে গেল এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষভাবে লড়াইয়ে অংশ নিলাে তখন বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নিয়ে গঠিত হলাে একটি কমান্ড। এই কমাণ্ডের প্রধান হলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং আরােরা” /৬
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পাক সামরিক চক্র তিন কিস্তিতে তাদের পরিকল্পনাকে কার্যকরী করে বাংলাদেশে বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা প্রথম চোটেই যাদেরকে সামনে পেয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামী মনে করেছে— খতম করে দিয়েছে। এতে করে ফল ফললাে উল্টো, টিক্কা খানের সদম্ভ উক্তি টিকলাে না। বাঙালিরা আরাে ক্ষিপ্ত হলাে, এগিয়ে এল হাতে হাতিয়ার নিয়ে। মুক্তিযােদ্ধারা একত্র হতে লাগল— প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নিল শুরু হলাে প্রশিক্ষণও। এই পর্যায়ে পাকিস্তানীরা একাই নামল না। তৈরি করলাে রাজাকারআলবদর আর আল-শামস। এবং তারা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের খুঁজে বের করে নিশ্চিহ্ন করে সীমান্তের দিকে অগ্রসর হতে থাকল। কারণ, পাকিস্তানিরা ভেবেছিল সীমান্তে ভারতীয় সাহায্যে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা একত্র হওয়ার চেষ্টা করছে, কোনাে কোনাে এলাকা।
১৩৯
মুক্ত করে সেখানে স্বাধীনবাংলা সরকার প্রতিষ্ঠিত করে বিশ্বের কাছে একটি কূটনৈতিক চাল চালবার চেষ্টা করছে। আর তাই সীমান্ত বন্ধ করে দিতে হবে। তৃতীয় পর্যায় পাকচক্র পরিষ্কার বুঝতে পারছিল তাদের দিন ঘনিয়ে আসছে। মুক্তিবাহিনী সারা বাংলাদেশে সমগ্র সীমান্ত এলাকা দিয়েই ক্রমশ এগিয়ে আসছে। আর তাছাড়া ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাংলাদেশে পাকবাহিনী প্রধান লেঃ জেনারেল এ এ কে নিয়াজী সাত-পাঁচ ভেবে খোঁজখবর নিয়ে একটা মাস্টার প্ল্যান’ করলেন। তার পরিকল্পনা হলাে : “সীমান্তের সবগুলাে পাকা রাস্তার ওপর সুদৃঢ় প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরি করতে হবে। ভারতীয় বাহিনী যেখানে যেখানে জড়াে হয়েছে তার ঠিক উল্টো দিকে সুদৃঢ় বাঙ্কার তৈরি করে তাতে ভারি কামানসহ পাকসেনাদের বসিয়ে দেয়া হবে। যে রাস্তা দিয়েই ভারতীয় বাহিনী অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করুক সেই রাস্তায়ই তাকে বাধা দিতে হবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মােকাবিলা করবে পাকসেনাবাহিনী। আর অন্যান্য আধা-সৈনিক লড়বে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে।
পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিয়াজী তার সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিল । সীমান্ত থেকে দেশের ভেতরে দশ-পনেরাে মাইল, কোথাও কোথাও ত্রিশ-চল্লিশ মাইল পর্যন্ত বড়াে বড়াে সড়কের ওপর অসংখ্য বাঙ্কার তৈরি করল । প্রধান প্রধান ঘাঁটির মুখােমুখি ভারি কামান ও ট্যাঙ্কসহ পাক সেনাবাহিনীকে প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত করা হলাে।
নিয়াজীর ৯ম ডিভিশন তখন যশােরের ঘাঁটিতে। ৯ম ডিভিশনের সৈন্যরা সাতক্ষীরা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে দাঁড়াল। ষােড়শ ডিভিশনের হেড কোয়ার্টার প্রথমে ছিল নাটোরে ! সরিয়ে সেটাকে নিয়ে আসা হলাে বগুড়ায়। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মধ্যবর্তী অঞ্চলের সমগ্র সীমান্তে ষােড়শ পাক ডিভিশনের সৈন্যরা বাঙ্কার করে শক্ত হয়ে বসল।
১৪ এবং ৩৯ নং ডিভিশনকে মােতায়েন করা হলাে পূর্ব সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে । উভয় সীমান্তে জামালপুর থেকে দক্ষিণে কক্সবাজার পর্যন্ত এই ডিভিশন দুটোর সৈন্যরা ছড়িয়ে রইলাে। বাংলাদেশে পাকবাহিনীর হাতে ছিল ৮৪টা মার্কিন সাফি ট্যাঙ্ক, শ’আড়াই মাঝারি বা ভারি কামান। নিয়াজী সেগুলােও সীমান্তের কাছাকাছি নিয়ে এল। এবং দৃশ্যমান প্রধান প্রধান ভারতীয় ঘাঁটিগুলাের মুখােমুখি দাঁড়াবার জন্যে এর প্রায় সবকিছু নিয়ে জড়াে করল পাঁচটা কেন্দ্রে—চৌগাছা, হিলি, জামালপুর, সিলেট এবং আখাউড়ায়।৭
৩ ডিসেম্বর ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘােষণা করে বাংলাদেশের চতুর্দিকে সৈন্য সমাবেশ করে সত্য, কিন্তু মুক্তিবাহিনী তখন অনেক দূর এগিয়েছে। সমগ্র দেশেই মুক্তিবাহিনীর আধিপত্য স্পষ্ট । বিস্তীর্ণ এলাকা তখন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। পাকিস্তানিরা মার খাচ্ছে আর পিছু হটছে। মিত্রবাহিনী একে একে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যােগ দিল । যৌথভাবে এগিয়ে চলল চূড়ান্ত সাফল্যের জন্যে।
এগারাে নম্বর সেক্টরে যৌথবাহিনী হালুয়াঘাট ও নালিতাবাড়ি হয়ে ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এদিকে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ তাদের বাহিনী সরিয়ে জামালপুরে সর্বাত্মক প্রতিরােধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ৬ ডিসেম্বর যৌথবাহিনী ময়মনসিংহ জেলা মুক্ত করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডটি ময়মনসিংহ থেকে পিছু
১৪০
সরে সিলেট এবং ভৈরববাজারে অবস্থান নেয়। মিত্রবাহিনীর ১০১ কমিউনিকেশন জোনের একটি ব্রিগেড এবং মুক্তিবাহিনী জামালপুর-টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। জামালপুরে মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানিদের এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হলাে। এই সংঘর্ষ ৯ ডিসেম্বরে শুরু হলেও ১১ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা পুরােপুরি পরাজয়। স্বীকার করে। এখানকার সংঘর্ষেই ভারতীয় জেনারেল গিল গুরুতররূপে আহত হলেন। পাকিস্তানীদের ৫৮১ জন এখানে যৌথ কম্যাণ্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পাকসেনাদের অপর কলাম তখন পেছনে সরে টাঙ্গাইল পৌছে গেছে। ময়মনসিংহ থেকেও মিত্রবাহিনীর ১০১ কমিউনিকেশন জোনের ব্রিগেডটি টাঙ্গাইলের পথে রওয়ানা হয়।
১২ ডিসেম্বর ভােরবেলা টাঙ্গাইলে নদীর উত্তর দিকে ভারতীয় ছত্রীসেনার একটি ব্যাটালিয়ন নামিয়ে দেয়া হয়। এদিকে জামালপুর থেকে পাকিস্তানিরা মার খেয়ে কিছু অংশ পালিয়ে টাঙ্গাইলের দিকে আসতে থাকে। ভারতীয় ছত্রীসেনা এ খবর পেল না। পাকসেনারা কাঁচা সড়ক ধরে এগােচ্ছিল। এক পর্যায়ে উভয় বাহিনী মুখােমুখি হয়। পাকিস্তানিরা ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতি দেখে অবাক হয় ক্ষণিকের জন্যে। তার পর পরই ভারতীয় ছত্রীসেনাদের লক্ষ্য করে চালাল গুলি। উভয়পক্ষের গুলি বিনিময় শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানিরা ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছিল। তারা পালাবার পথ খুঁজল। প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে পুনরায় রি-গ্রুপ হয়ে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু দক্ষিণেও পাকিস্তানীদের পালাবার পথ ছিল রুদ্ধ। ভারতীয় ১০১ কমিউনিকেশন জোনের ব্রিগেড এবং মুক্তিবাহিনী ততােক্ষণে টাঙ্গাইল পৌছে গেছে। আর উপায় ছিল না, পাকিস্তানিরা টাঙ্গাইলে আত্মসমর্পণ করল । টাঙ্গাইলের ছােটো বিমান বন্দরটি যৌথবাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে এবং তারপরই ভারতীয় ক্যারিবু বিমানের সাহায্যে বহুসংখ্যক সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ টাঙ্গাইলে পৌছে যায়। যৌথবাহিনী টাঙ্গাইল থেকে ঢাকার পথে মির্জাপুরের দিকে অগ্রসর হয়। ১৩ ডিসেম্বর এই বাহিনী জেনারেল গন্ধর্ব নাগরাসহ ঢাকার ১৫ মাইলের মধ্যে পৌছে যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জামালপুরে জেনারেল গিল আহত হবার পর জেনারেল গান্ধর্ব নাগরা এই সেক্টরের দায়িত্ব নেন। যা হােক, ১৪ ডিসেম্বর জেনারেল নাগরা যৌথবাহিনী নিয়ে টঙ্গীর কাছে এসে গেলেন। এই বাহিনী আরও অগ্রসর হয়ে ১৬ ডিসেম্বর ভােরবেলা নয়ারহাট ফরেস্ট সড়ক দিয়ে সাভারের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। এরপর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মিরপুর পৌছে গেল তারা। পাকিস্তানি জেনারেল জামসেদ জেনারেল নাগরার কাছে তাঁর বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। বস্তুত এই সেক্টর ট্রপস ও মিত্রবাহিনী ১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০ টা ৪০ মিনিটে ঢাকা পৌঁছে। ইতােমধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ’র আহ্বানের প্রতি সাড়া দিয়ে বাংলাদেশস্থ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রধান লেঃ জেনারেল নিয়াজী তাঁর বাহিনীর আত্মসমর্পণের বার্তা ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে জানান। পাকসেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের বার্তা পৌঁছানাের পর পরই বেলা ১২টার দিকে ভারতীয় বাহিনীর চীফ-অব স্টাফ জেনারেল জ্যাকব আত্মসমর্পণের দলিল প্রণয়ন করতে ঢাকায় আসেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন (বর্তমানে
১৪২
অবসরপ্রাপ্ত) এয়ার মার্শাল এ কে খােন্দকার। লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ, মেজর হায়দার এবং কাদের সিদ্দিকীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
শীতের দিন গড়িয়ে আসে বিকেল । বিকেল ৫টা ১ মিনিট । যে ঐতিহাসিক রেসকোর্স (বর্তমানে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে ৭ মার্চ উজ্জ্বল আলােঝরা বিকেলে । বাংলার আকাশে বাতাসে অনুরণিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ—’এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,’ সেই রেসকোর্স ময়দানেই শীতের পড়ন্ত বিকেলে জন্ম নিল ইতিহাসের এক অনন্য মুহূর্ত। দীর্ঘ ন’মাস ব্যাপী বাংলার মাটিতে ইতিহাসের জঘন্যতম যে ধ্বংসলীলা অব্যাহত ছিল—তার অবসান ঘটল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে লে. জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী, মুক্তি ও মিত্রবাহিনী সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর অধিনায়ক লে. জে: জগজিৎ সিং অরােরার কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করলেন। কোমর থেকে বেল্ট খুলে এবং অস্ত্র সমর্পণ করে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করল যৌথবাহিনীর কাছে। কিছুক্ষণ পরেই পশ্চিম আকাশে শীতের সূর্যটা অস্ত গেল। সেই সঙ্গে যেন অস্তমিত হলাে ঔপনিবেশিক শােষণ-বঞ্চনার তমসাময় একটি অধ্যায়। পরদিন পূর্বদিগন্তে সমগ্র বাংলাদেশকে আলােকিত করে যে সূর্য আবার উদিত হলাে- সে সূর্য স্বাধীনতার সূর্য, আর সেই সঙ্গে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নিল বিজয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত বাঙালি জাতির বহু শতাব্দীর আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের আবাসভূমি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
তথ্য নির্দেশ
১. সাক্ষাৎকার : কর্নেল বজলুল গনি পাটোয়ারী (অব.)।
২. মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) আমিন আহমদ চৌধুরী, বীর বিক্রম, পিএসসি। সম্মুখ সমরে বাঙালি, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, প্রথম বর্ষ, বিজয় দিবস সংখ্যা, ডিসেম্বর, ১৯৭২।
৩. পূর্বোক্ত।
৪. পূর্বোক্ত।
৫. সাক্ষাৎকার : মিজানুর রহমান, বীর প্রতীক।
৬. অভীক সরকার সম্পাদিত বাংলা নামে দেশ, কলিকাতা, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ২৯-১০১।
৭. পূর্বোক্ত ।