You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

আমার জীবন কথা ও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম
এ. আর .মল্লিক

মুখবন্ধ
নিজের জীবনস্মৃতি লিখবাে এমন কোনাে পরিকল্পনা কোনদিন ছিল না। বহু বড়মাপের কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়েও কখনাে ভাবিনি এসব লিখবাে বা লিখবার সময় হবে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করার সময় একটা ডায়েরী লিখতাম। পরিকল্পনা ছিল পরে বিস্তারিত লিখবাে। দুর্ভাগ্য সেই ডায়েরীটি হারিয়ে যায়। তাই মুক্তিযুদ্ধের উপর কিছু লিখবার পরিকল্পনাও ভেস্তে গেল ।
বন্ধুবর সালাহউদ্দীন আহমদ যখন তাঁর Oral History Project-এর জন্য আমার সাক্ষাৎকার নিতেন, তখন প্রায়ই তিনি জীবনস্মৃতি লিখবার উৎসাহ দিতেন। তাঁরই উদ্যোগে মৌখিক সাক্ষাৎকার কাগজে লেখা হলাে প্রশ্ন-উত্তর আকারে। তার তাগাদা সত্ত্বেও কাজ এগােয়নি। আমার চোখের সমস্যাই তখন বড় বাধা হয়ে দেখা দিল। অনুজপ্রতিম সালাহউদ্দীন এবার নতুন করে সাহায্যের হাত বাড়ালেন। বাংলা একাডেমীর ডঃ সুকুমার বিশ্বাসকে দায়িত্ব দিলেন প্রশ্ন-উত্তর থেকে আমার স্মৃতিকথা সরলভাবে সময়ক্রম অনুসারে সাজিয়ে দিতে। সালাহউদ্দীন-এর উদ্যোগ ও আগ্রহ না থাকলে এ বইটি কোনদিনই লেখা হতাে না । কি ভাষায় তাকে ধন্যবাদ জানানাে যথাযথ হবে তা আমার জানা নেই। আমি আবেগে আপ্লুত হই এই ভেবে যে, দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব ও সহকর্মী হিসেবে কত গভীর আত্মিক সম্পর্ক স্থাপিত হলে মানুষ শত ব্যস্ততা ও অসুস্থতাকে অগ্রাহ্য করে একজন বন্ধুর ব্যাপারে এতটা উদ্যোগী হতে পারেন। সাক্ষাৎকারটিকে গুছিয়ে সময়ক্রম অনুসারে সাজাতে সুকুমার বিশ্বাসকে প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হয়েছে । আমার পক্ষে এ বয়সে এ কাজটি করা প্রায় অসম্ভব ছিল। বইটি আজ আলাের মুখ দেখছে তার প্রচেষ্টায়। অসংখ্য ধন্যবাদ তাঁকে।
আমার স্ত্রী দীর্ঘ বায়ান্ন বছর আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে আছেন। এ ‘স্মৃতিকথা’র সব ঘটনায় যেমন তিনি ছিলেন, লিখবার সময় অহরহ আমার ভুলে যাওয়া স্মৃতিগুলাে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তেমনি দিয়েছেন উৎসাহ। অথচ মুখে ধন্যবাদ বলা হয়নি কখনাে। আমার সব সাফল্যের পেছনে তাঁর সহযােগিতা কাজ করেছে, আজ সে কথা অকপটে স্বীকার করে আবারাে বলতে হয় স্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাবার ভাষা আমার জানা নেই।
আমার মেয়ে রানা সুকুমারকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত ঘটনাগুলাে সাক্ষাৎকারে ছিল না। এ সময়ের ঘটনাগুলাে আমার কাছ থেকে শুনে ও লিখেছে ।
আগামী প্রকাশনীর জনাব ওসমান গনি বইটি প্রকাশ করবার দায়িত্ব নিয়ে আমার কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন।
বইটিতে ছােটখাটো ভুল থাকতেই পারে। অনেক ক্ষেত্রে দিন-তারিখ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে পারিনি আমি, সেজন্য আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
আজিজুর রহমান মল্লিক
১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৫

ঢাকা জেলার ধামরাইয়ের অন্তর্গত রাজাপুর গ্রামে আমার জন্ম। আমরা পাঁচ ভাই। আমি সবার বড়। দ্বিতীয় ভাই আমিনুর রহমান। পেশায় আইন ব্যবসায়ী ছিলেন (মৃত্যু ১৯৭৮)। আমার একমাত্র বােন জাহানারা। বিয়ে হয়েছিলাে সেনাবাহিনীর এক অফিসারের সঙ্গে। কিছুদিন পূর্বে মেজর খানসূর মৃত্যুবরণ করেছেন। আমার তৃতীয় ভাই মাহবুবুর রহমান। পেশা চিকিৎসা। চতুর্থ এবং পঞ্চম ভাই যমজআতাউর রহমান ও লুত্যর রহমান। দু’জনই ব্যাঙ্কার।
১৯১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা জেলার রাজাপুরে আমার জন্ম হয়। কিন্তু সে সময় ১৬ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবার বিধান না থাকায় বাবা কোর্টে গিয়ে এফিডেভিট করিয়ে আমার বয়স বাড়িয়ে দেন। ডিসেম্বরের স্থলে করা হলাে মার্চ মাস। অর্থাৎ আমার জন্ম সাল ও মাস গিয়ে দাঁড়ালাে ১৯১৮ সালের মার্চ।
আমার দাদা মুন্সি বাহরাম মল্লিক ছিলেন সে সময়ের একজন প্রভাবশালী ভূস্বামী। লাখেরাজ সম্পত্তি ও তালুকের মালিক ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন প্রজাবৎসল, সমাজ সচেতন। মানুষ হিসাবে তিনি বেশ জেদিও ছিলেন। সেকালে কয়েকজন জেলে প্রজার স্বার্থ রক্ষা এবং আত্মসম্মান রক্ষার্থে দীর্ঘ বারাে বছর যাবত দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলায় জড়িয়ে পড়েন। আর এ মামলা হয়েছিলাে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বােন গৌরীপুরের মহারানী স্বর্ণময়ী দেবীর সঙ্গে। মূলত এ মামলা চলেছিলাে ময়মনসিংহ ও ঢাকা কোর্টে। পরবর্তীতে ঢাকায় প্রথম স্থাপিত হাইকোর্ট পর্যন্ত এ মামলা গড়িয়েছিলাে। এ মামলাকে কেন্দ্র করে আমাদের এলাকায় কয়েকটি প্রকাশ্য ফৌজদারী ঘটনাও ঘটেছিলাে।
আমরা সবাই জানি ১৯০৫ সালে বাংলা ভাগ হয়ে পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গ নাম ধারণ করে। পূর্ব বঙ্গের রাজধানী ঢাকা। এ সময় ঢাকাতে একটি হাইকোর্ট স্থাপিত হয়। আর এই হাইকোর্টেই শেষ পর্যন্ত গৌরীপুরের মহারানীর সঙ্গে মামলার আপােস নিষ্পত্তি হয়।
দীর্ঘস্থায়ী এ মামলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার ফলে আমার দাদা বৃদ্ধ বয়সে বেশ আর্থিক সঙ্কটে দিন কাটান। পারিবারিক নানা সমস্যা, মামলার তদবির ইত্যাদি
কারণে দাদার নির্দেশে, তাঁর বড় ছেলে মােহাম্মদ সরফরাজ মল্লিক পাটনায় কর্মরত একটি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বাড়ি চলে আসেন। দাদার ছােট ছেলে মােহাম্মদ ইসমাইল মল্লিক এবং আমার বাবা ঢাকা মাদ্রাসায় তখন হােস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতেন। মাদ্রাসায় তখন এন্ট্রান্স পর্যন্ত পড়ানাে হতাে। আমার দাদা নানা কাজে ষাট, সত্তর মাইল ঘােড়ায় চড়ে কখনাে ঢাকা কখনাে ময়মনসিংহ যেতেন। আমার দাদা বাহরাম মল্লিক এক শীতকালের সন্ধ্যায় একটি ওভারকোটের দামদর ঠিক করেও শেষ পর্যন্ত কিনলেন না। আমার বাবা মােহাম্মদ ইসমাইল মল্লিক কোটটি কেনার জন্য তার বাবাকে বেশ পীড়াপীড়ি করলেন। কিন্তু তিনি কোটটি আর কিনলেন না। কারণ হিসাবে জানলেন যে তাঁকে পরদিন মামলার জন্য ব্যারিস্টার দাশকে বেশ কিছু টাকা দিতে হবে। এই ঘটনায় আমার বাবা অত্যন্ত মর্মাহত হন। বাবা ইতিমধ্যে পারিবারিক আর্থিক অনটনের কথাও জেনে গেছেন। তাই আমার বাবা একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে পড়াশােনায় ইস্তফা দিয়ে ভারতীয় কাস্টমস্-এ চাকরি নিয়ে রেঙ্গুন চলে যান। আমার বাবার এই হটকারিতা দাদাকে খুবই কষ্ট দিয়েছিলাে। শীতের সন্ধ্যায় কোট কিনতে না পারাটা আমার বাবা সারাজীবন মনে রেখেছিলেন। তিনি জীবনে ওভারকোট আর পরেননি।
আমার শৈশব কেটেছে রেঙ্গুনে। বাড়িতেই গৃহশিক্ষকের কাছে আরবী শিক্ষা, পবিত্র কোরান পাঠ শিখেছিলাম। এরপর রেঙ্গুনেই একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে স্ট্যাণ্ডার্ড ফোর-এ ভর্তি করা হলাে আমাকে। বেশ কয়েক বছর এই স্কুলে পড়েছিলাম। আমি যখন স্ট্যাণ্ডার্ড সেভেন-এর শেষ দিকে তখন হঠাৎ করে পারিবারিক প্রয়ােজনে (সরফরাজ মল্লিক সাহেবের মৃত্যু) আমাদের সবাইকে ঢাকা ফিরে আসতে হলাে। দেশের বাড়িতে কিছুদিন থাকার পর আমার বাবা আমাকে রেখে রেঙ্গুন ফিরে গেলেন।
তিনি আমাকে দেশের স্কুলের হােস্টেলে রেখে গেলেন। ১৯৩৪ সালে মানিকগঞ্জ মডেল হাই স্কুল থেকে আমি ম্যাটিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করি। ম্যাট্রিক পাশের আগে আমাকে দুবার স্কুল বদল করতে হয়েছিলাে। প্রথমে আমি পাকুটিয়া পি. টি. হাই স্কুলে ভর্তি হতে গিয়েছিলাম। স্কুলটি আমাদের বাড়ির কাছেই ছিলাে। ভর্তিও হলাম। হােস্টেলেই থাকতাম। লেখাপড়াও বেশ ভালাে করছিলাম। রেঙ্গুন থেকে ফিরে মাত্র এক মাস সময় পেয়েছিলাম পড়াশােনা করার। সপ্তম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণীতে যখন উঠলাম- তখন প্রথম স্থানটিই অধিকার করেছিলাম। ইংরেজিতে নম্বর পেয়েছিলাম পঁচাশি। ইংরেজিতে এই নম্বর দেখে সবাই মনে করতে লাগলেন আমি ইংরেজি খুব ভালাে জানি। আর এ জন্য ক্লাসে কোনােদিনই আমাকে ইংরেজি পড়া ধরতেন না। কিন্তু একদিন পড়া ধরলেন। সেদিনের কথা আজো মনে পড়ে। ইংরেজির শিক্ষক তারক বাবু পড়া ধরছেন একে একে। কেউই উত্তর দিতে পারছে না দেখে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই দাঁড়া। দাঁড়িয়ে সবাইকে শিখিয়ে দে। আমার সহপাঠীদের কেউ কেউ ‘পার্টস অফ স্পিচ’ কি তার উত্তর দিয়েছিলাে। কিন্তু আমি তাও পারলাম না। চুপ করে
১০
দাড়িয়ে রইলাম। আমার শিক্ষক চেয়ার ছেড়ে আমার কাছে আসলেন। বললেন, বল, আরম্ভ কর। আমি সাহায্য করছি। নাউন, প্রােনাউন, এডভার্ব, এডজেকটিভ কাকে কি বলে এ আমার জানা ছিলাে না। আমার শিক্ষক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর তিনি আমার কানের ওপরের চুল ধরলেন। চুল ধরে টান দিয়ে বললেন, ‘ক্লাসে ফার্স্ট হও, ইংরেজিতে শতকরা আশির ওপরে নম্বর পাও, আর গ্রামার জানাে না ? হতভাগা ছেলে’! এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি কান্না আরম্ভ করলাম। তিনি আমার চুল ছেড়ে দিয়ে ডায়াসের উপর গিয়ে চেয়ারে চুপ করে বসে থাকলেন। তারপর হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি ক্লাস নেবােনা’ বলেই হন হন করে চলে গেলেন। প্রথম বেঞ্চে বসে কাঁদছি। স্যার চলে যাওয়ার পর ছেলেরা সব ঘিরে ধরলাে। সবাই বললাে, তুই কাঁদছিস কেন ? স্যার বেত দিয়ে তাে মারেন নি, কেবল কানে হাত দিয়েছেন। ইতিমধ্যে স্কুলের ঘন্টা পড়লাে। ছেলেরা যার যার মতাে সিটে বসলাে। আমিও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ক্লাস থেকে বেরিয়ে সরাসরি হােস্টেলে গেলাম। হােস্টেলে পৌছে মাধবদাকে মিস্টি আনতে বললাম। মাধবদার মিষ্টির দোকান ছিল। আমার সঙ্গে তার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিলাে। এ সখ্যতা মিষ্টি খাওয়ার সূত্রে। দিনে-রাতে পাঁচ-ছ’বার মিষ্টি খেতাম আমি। মিষ্টি আমার খুবই প্রিয় ছিলাে। আমার চাচা আগেভাগেই মাধবদাকে বলে গিয়েছিলেন আমাকে মিষ্টি দেবার জন্য। মাধবদা জিজ্ঞাসা করলেন, এখন স্কুল চলছে, তুমি চলে আসলে কেন ? আমি সব ঘটনা বর্ণনা করলাম। মাধবদা একটু হেসে বললেন, আমি পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি। শিক্ষকের কতাে বেত যে খেয়েছি তার হিসাব নেই। তােমাকে তাে কানের ওপর চুল ধরেছেন মাত্র। আমি বললাম, আমাকে মিষ্টি দেন, আমি এ স্কুলে আর পড়বাে না। বিছানাপত্র, চৌকি সব থাকলাে-আপনি যা হয় করবেন। আমি জুতা খুলে কেট পরে আমার বাড়ি চার মাইল দূরত্ব প্রায় দৌড়ে বাড়ি পৌছে গেলাম। আমার মা-বাবা রেঙ্গুনে ছিলেন। বাড়িতে মেজো চাচা মােহাম্মদ আফতাব উদ্দিন মল্লিক ছিলেন আমার অভিভাবক। চাচা এ সময় ছুটিতে বাড়িতেই ছিলেন। চাচাকে স্কুলের ঘটনা জানালাম। পাকুটিয়া (টাঙ্গাইল) স্কুলে যে আর পড়বাে না—একথাও তাঁকে জানিয়েছিলাম। পাকুটিয়া স্কুলে পড়ার ইতি এখানেই ঘটে। আর ওমুখাে হইনি। পরে শুনেছিলাম স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমাকে ফিরে যাবার জন্য খবর পাঠিয়েছিলেন। ঘটনার জন্য অনুতপ্তও হয়েছিলেন তিনি। এরপর মেজো চাচা পাকুটিয়া স্কুল থেকে আমার টিসি নিয়ে এসে আমাদের রাজাপুর গ্রাম থেকে তিন মাইল দক্ষিণে বালিয়াটি হাই স্কুলে আমাকে ভর্তি করে দিলেন। কিন্তু এখানেও সেই ইংরেজি গ্রামার ভীতি আমাকে পেয়ে বসলাে। ইংরেজি গ্রামার না পারলে প্রধান শিক্ষক সরকার বাবুর নানা ধরনের শাস্তি দেবার খবর স্কুলে পা দেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পেলাম। ফলে এখানেও আমার পড়া হলাে না। এখান থেকেও টিসি নিতে হলাে। এবার গিয়ে ভর্তি হলাম মানিকগঞ্জ মডেল হাইস্কুলে। ইতিমধ্যে বাবার টেলিগ্রাম পেয়েছি। তাঁর নির্দেশ ছিল মানিকগঞ্জ অথবা টাঙ্গাইল স্কুলে ভর্তি
১১
হওয়ার। অথবা পড়াশােনা বন্ধ করে দেবার। কারণ তখন গ্রামের অনেক ছেলেই যারা বালিয়াটিতে পড়তাে, তারা স্কুলে যাবার নাম করে সকালে বের হয়ে সন্ধ্যায় ফিরতাে, কিন্তু স্কুলে যেতাে না। কুসঙ্গে পড়তে পারি এমন ভেবেই হয়তাে তিনি এ নির্দেশ দিয়েছিলেন।
১৯৩৪ সালে মানিকগঞ্জ মডেল হাইস্কুল থেকে আমি লেটারসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। এরপর ঢাকা সরকারী কলেজে ভর্তি হই। এখান থেকে ১৯৩৬ সালে আই. এ. পাশ করলাম প্রথম বিভাগে। আমরা যারা পরীক্ষায় বেশ ভালাে ফল করেছিলাম তারা প্রায় সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হলাম। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন ড: কালিকারঞ্জন কানুনগাে। আমি থাকতাম এস. এম. হলের দোতলায়। যতদূর মনে পড়ে আমার কামরা নম্বর ছিলাে ১২৬। এ সময় আমাদের হলের প্রভােস্ট ছিলেন ড: মাহমুদ হাসান। হলে খাওয়া বাবদ মাসে লাগতাে আট টাকা। সকালের খাওয়াতে সবজি, ডাল আবার ডিমও থাকতাে। আমি ডাল খেতাম না। সবজির পরিবর্তে ডিম নিতাম। রাতে থাকতাে খাসি অথবা গরুর গােত।
হলে থাকার সময় শরীর ছিল ক্ষীণকায়। মাঝে মাঝেই ভাবতাম শরীরটা কিভাবে ভাল করা যায়। শরীর ভাল করার জন্য আমার কয়েকজন বন্ধু এবং বড়রা নিয়মিত ব্যায়াম করার পরামর্শ দিল। ঠিক করলাম ব্যায়ামই করবাে। আমরা ক’বন্ধু মিলে নিয়মিত ব্যায়াম করা শুরু করলাম। ছােলা ভিজিয়ে রাখতাম। ছােলাগুলােতে যখন একটু একটু অঙ্কুর বেরুতাে তখনই আমরা আখের গুড় দিয়ে কয়েক বন্ধু মিলে বারান্দায় বসে খেতাম। ছােলা খাওয়া শেষ করে আমরা পরস্পর পরস্পরের গায়ে খাঁটি সরিষার তেল রীতিমতাে মালিশ করতাম। তারপর যেতাম গােসলে। গােসল সেরে নাস্তা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম ক্লাস করতে। পরীক্ষার সময় ছাড়া আমরা ক’বন্ধু কোনাে দিন সকালে পড়াশােনা করতাম না। ভােরেও কোনােদিন পড়িনি। শরীরের যত্ন নিতেই সারা সকাল চলে যেতাে। আমাদের এই ব্যায়াম করা আর ছােলা খাওয়া নিয়ে অন্যরা বেশ হাসিঠাট্টা করতাে। আবার বিকালে চারটা থেকে ছ’টা পর্যন্ত খেলাধুলা করতাম। আমাদের হলের পিছনে জঙ্গলঘেরা একটি স্থান ছিলাে, বর্তমানে যেখানে ব্রিটিশ কাউন্সিল—সেই স্থানটিতেই খেলতাম। আমার মনে আছে, আমাদের হলের বাবুর্চিখানার এক কর্মচারীর সাহায্যে লাঠিখেলা এবং সপ্তাহে একদিন ছােরাখেলা শিখতাম- বিপ্লবী দলের এক প্রাক্তন সদস্যের কাছে। সন্ধ্যার পর গােসল করে রাতের খাওয়া শেষ করে, রাত সাড়ে আটটার দিকে পড়াশােনার জন্য বই নিয়ে বসতাম।
আমি লাঠি ও ছােরা খেলা শিখতাম বটে কিন্তু ব্রিটিশবিরােধী বিপ্লবী সংগঠন ‘অনুশীলন সমিতি’ বা এ জাতীয় কোনাে গােপন সংগঠনের সঙ্গে আমার কোনাে যােগ ছিলাে না। তবে ব্রিটিশবিরােধী একটা চেতনা আমার মধ্যে কাজ করতাে। মনে মনে ভাবতাম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে হয়তাে আমাদের লড়তে হবে। এই প্রসঙ্গে
১২
আমার স্কুল জীবনের স্মৃতি মনে পড়ছে। আমি তখন মানিকঞ্জ মডেল হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র। সহপাঠী নিরঞ্জন সরকার এবং বলাই বসাকের সঙ্গে আমার খুবই হৃদ্যতা ছিলাে। ক্লাসে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় আমরাই হতাম। আমাদের তিনজনের মধ্যে নিরঞ্জন সরকার একটি গােপন সংগঠনের সদস্য ছিলাে। তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বেশ জমে উঠেছিলাে। নিরঞ্জন তার বাড়িতে মাঝে মাঝেই রাতের বেলায় এক আখড়ায় নিয়ে যেতাে এবং সেখানে আমাদের লাঠি খেলা, ছােরা খেলা, পিস্তল চালানাে শেখাতাে। বিষয়টি এক সময় আমার অঙ্কের শিক্ষক। আবদুর রশীদ সাহেবের কানে গেল। তিনি একদিন আমাকে ডেকে বললেন, ‘তােমার এটা করা ঠিক হচ্ছে না। মুসলমান পরিবারে শিক্ষিত লােকের সংখ্যা দু’একজনের বেশি থাকে না।’ তিনি আরও বললেন, আমি নিজে ভাল ছাত্র ছিলাম। ম্যাট্রিক এবং আই. এ. প্রথম বিভাগেই পাশ করেছিলাম। তারপর ভর্তি হয়েছিলাম প্রেসিডেন্সি কলেজে। কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়া আমার হলাে না। তখন চলছিলাে অসহযােগ আন্দোলন। যােগ দিলাম অসহযােগ আন্দোলনে। আর এই অপরাধে আমাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হলাে। পরে অন্য কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করে শিক্ষকতা পেশায় নিয়ােজিত হলাম। আমার পরিবারের আমিই প্রথম শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলাম। তাই আমার ধারণা মুসলিম পরিবারের মধ্যে যতদিন না শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি পায় ততদিন পর্যন্ত কোনাে গুপ্ত সমিতি বা কোনাে আন্দোলনে যােগদান করা ঠিক নয়। কারণ তাতে সম্প্রদায় হিসাবে আমরা আরাে পিছনে পড়ে যাবাে।’
আমার শিক্ষকের জীবনে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা শােনার পর আমি আর এ পথে এগুইনি। এ ঘটনা অবশ্য আমার বন্ধু নিরঞ্জন সরকারকে বলেছিলাম। নিরঞ্জন বলেছিলাে তিনি ঠিকই বলেছেন, তাের আর আসার দরকার নেই। তবে একথা আর কাউকে বলিস না। আমি কোনাে দিনই একথা বলিনি। নিরঞ্জন কর্মজীবনে কলকাতায় বিচারপতি হয়েছিলাে। ব্রিটিশবিরােধী একটা চেতনা আমার মধ্যে তখনাে কাজ করছিলাে।
আমাদের কালে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে তেমন মাতামাতি ছিলাে না। দলাদলিও তেমন ছিলাে না। এমন কি হল ইউনিয়নের যে নির্বাচন হতাে, সেটিও হতাে জেলাভিত্তিক মিলমিশের মাধ্যমে। হলগুলাে তাে বটেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় নির্বাচনগুলােতেও এই রীতি মেনে চলা হতাে। আমরা এসব নির্বাচনে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিতাম। আমাদের হলে সন্ধ্যার পর প্রায়ই বিতর্কের আসর বসতাে। কেবল আমাদের হল নয়, অন্যান্য হলেও বিতর্ক প্রতিযােগিতা হতাে। হলে ‘ইনডাের’ খেলাধুলারও আয়ােজন করা হতাে। রাত দশটার পর হল গেটে তালা লাগানাে হতাে। রাত দশটার পর হলে ঢুকতে হলে দারােয়ান দরজা খুলে দিত ঠিকই, তবে রেজিস্টার খাতায় রাত ক’টায় ফিরলাম তা অবশ্যই লিখতে হতাে। আমাদের সময় দারােয়ান ছিলাে বেশ মােটাসােটা আর বেশ শক্তিশালী। দারােয়ানকে পাশ কাটিয়ে সময় না লিখে কোনােমতেই হলে ঢােকার উপায় ছিলাে ।
১৩
রাত ৯টার পরে হাউস টিউটরের অনুমতি ছাড়া আমাদের হলের বাইরে যাবার। উপায় ছিলাে না। অনুমতি ছাড়া বাইরে গেলে পরদিন হাউস টিউটরের কাছে কৈফিয়ৎ দিতে হতাে।
ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন আমাদের হাউস টিউটর। তিনি ছেলেদের নামায- রােজার বিষয়টিও দেখাশােনা করতেন। তিনি নিয়ম করলেন সবাইকে এশার নামায পড়তেই হবে এবং নামাজের পর রােল কল করা হবে। ড: শহীদুল্লাহ এশার নামাযের পর রােজই রােল কল করতেন। আমরা যারা নিয়মিত নামায। পড়তাম না-তাদের হয়ে বন্ধুরা ‘প্রকসি’ দিতেন। এই নিয়ম চালু হওয়ার পর প্রথম দিকে আমার হয়ে কেউ ‘প্রসি’ দিতেন না। ফলে প্রতি মাসেই আমাকে জরিমানা গুণতে হতাে। কিন্তু একবার আমার জরিমানা নেওয়া হলাে না। বেশ অবাকই হলাম। কারণ আমি তাে নামায পড়িনি। স্বাভাবিকভাবেই আমার জরিমানা। দেওয়ার কথা। জরিমানা না নেওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলা হলাে আমি নাকি নামায পড়েছি। বেশ কৌতূহল হলাে আমার। হাউস টিউটর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-র সঙ্গে দেখা করলাম। তাকে বললাম, ‘স্যার, আমি নামায পড়িনি গত দু’মাস অথচ আমার জরিমানা নেওয়া হচ্ছে না।’ তৎক্ষণাৎ তিনি খাতা খুলে দেখলেন। তারপর বললেন, আমার খাতায় তােমার উপস্থিতির প্রমাণ রয়েছে অর্থাৎ তুমি নামায পড়েছে। সুতরাং জরিমানা আদায়ের কোনাে প্রশ্নই ওঠে না। আমি পুনরায় তাঁকে জানালাম, আমি নামায পড়িনি।’ তিনি বললেন, আমি তােমার সাথে তর্ক করতে চাই না। নামায যদি না পড়ে থাকো তাহলে তােমার হয়ে কেউ প্রসি’ দিয়েছে। তােমার পক্ষে কে প্রসি দিয়েছে তার নাম আমাকে বলতে হবে তা না হলে আমরা জরিমানা নিতে পারবাে না। আমি স্যারের কাছে সময় চেয়ে নিয়ে নিজের ঘরে না গিয়ে উপরে কমনরুমে গেলাম। বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করলাম আমার পক্ষে কে হাজিরা দেয়। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল আমার হলের অভিভাবক লাল মিয়া নিয়মিত আমার হয়ে হাজিরা দিয়েছে। লাল মিয়া আমাকে বললেন, ‘রাত নটায়। এশার নামাজের পরপরই এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে তােমাদের নামে প্রসি দিয়েছি। জরিমানার টাকাটা আমাকে দাও, মিষ্টি খাওয়া যাক। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে। থেকে বললাম, ‘লাল ভাই, আমরা দুভাবে পাপের ভাগী হচ্ছি। প্রথমত নামায না পড়ে, আর দ্বিতীয়ত মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আমার হয়ে যে প্রকসি দিচ্ছেন তা নীরবে সমর্থন করা । আমি লাল ভাইকে আর প্রকৃসি না দেবার জন্য অনুরােধ করলাম। এরপর থেকে লাল ভাই আর প্রকৃসি দিতেন না। পরদিন এসব কথা আমি আর ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে জানাইনি।
আমরা প্রভােস্টকে ভীষণ ভয় করতাম। কালেভদ্রে তাঁর সঙ্গে আমাদের দেখাসাক্ষাৎ হতাে। হাউস টিউটর সাহেবরাই সব দেখাশােনা করতেন। হাউস টিউটর আমাদের খুবই কড়া শাসনে রাখতেন। যা বলতেন সঙ্গে সঙ্গে তা পালন করতে হতাে। একটি ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছে ঃ আমার কুকুর পােষার খুব শখ ছিলাে। একটি কুকুরের বাচ্চা নিয়ে আমার রুমে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম সাত
১৪
আট দিন পর কুকুরের বাচ্চাটি মামার বাড়ি রেখে আসবাে। এ সময় দেশের বাড়িতে বাবা-মা কেউ থাকতেন না। তাই এ ব্যবস্থা। কুকুরের বাচ্চাটি ভােরবেলা বেশ বিরক্ত করতাে। এ সময় আমাদের হাউস টিউটর ছিলেন আবদুল হাদি তালুকদার, বরিশাল বাড়ি। তিনি আমার পাশের রুমেই থাকতেন। কুকুরের বাচ্চার শব্দ পেয়ে তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। জিজ্ঞেস করলেন আমি কুকুর পুষি কিনা। উত্তরে হ্যা বলাতে, তিনি বেশ রাগতস্বরে বললেন, ‘এক্ষুণি, এই মুহূর্তে কুকুরের বাচ্চা নিয়ে যেখানে পারাে ফেলে দিয়ে এসাে। আমি বিকাল পর্যন্ত সময় চাইলাম। তিনি রাজি হলেন না। বাধ্য হয়েই কুকুরের বাচ্চাটিকে একটি ব্যাগে ভরে সাইকেল নিয়ে রওনা হলাম ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশনের দিকে। এ সময় ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশনের কাছে একটি পশুপালন কেন্দ্র ছিলাে। কুকুর নিয়ে পৌছলাম পশুপালন কেন্দ্রে। কেন্দ্রের অফিসারকে আমার অবস্থার কথা সবিস্তারে জানিয়ে বাচ্চাটিকে রাখার অনুরােধ জানালাম। অনেক অনুরােধের পর শেষ পর্যন্ত প্রতিদিন কুকুরের জন্য খরচ বাবদ চার আনা দেবার অঙ্গীকার করে বাচ্চাটি রেখে হলে ফিরেছিলাম। পরে কুকুরটিকে গ্রামের বাড়িতে রেখে আসি।
আমাদের কালে রােজার সময় দিনের বেলায় ডাইনিং হল সম্পূর্ণ বন্ধ থাকতাে। আমরা যারা রােজা রাখতাম না তাদেরকে বাইরে খেতে হতাে। ভীষণ রাগ হতাে। কিন্তু কিছু করারও উপায় ছিলাে না। কিছুদিন এই অবস্থা চলার পর আমরা বেশ কয়েকজন ঠিক করলাম রাতে সেকেণ্ড শাে-তে সিনেমায় যাবাে। আমরা বিশ-পঁচিশ জন সেকেণ্ড শাে-তে সিনেমা দেখে রাত বারােটা-একটায় ফিরে সেহেরীর জন্য প্রস্তুত খাবার খেয়ে শুতে যেতাম। এমনিভাবে কিছুদিন চলার পর বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেল। আমাদের মতাে বেরােজদারীদের সংখ্যা এমন পর্যায়ে দাঁড়ালাে যে, সত্যিকারভাবে যারা রােজা রাখছিলাে তাদের খাবারে টান। পড়লাে। খাবার কেন কম পড়ছে তা দেখার জন্য তদন্ত কমিটি বসলাে। আমরা রাতে সেহেরী খাওয়া বন্ধ করলাম। এমন সব ঘটনা ঘটতাে আমাদের সময়।
১৯৩৭ সাল। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। এ সময় আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের এ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারী ছিলাম। আর সেক্রেটারী ছিলেন আমার সিনিয়র, অর্থনীতির ছাত্র সমর সেন। পরবর্তীকালে অর্থনীতিবিদ হিসাবে ড: সমর সেন জাতিসংঘে বেশ সুনামের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। সমর সেন আমাকে ছাত্র ইউনিয়নের ম্যাগাজিন দেখাশােনার দায়িত্বও দিয়েছিলেন।
১৯৩৭ সালেই শেরে-ই-বাংলা এ. কে. ফজলুল হক মন্ত্রিসভা গঠন করেন । বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এই মন্ত্রিসভাকে এক সংবর্ধনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সমর সেন এই সিদ্ধান্তে একমত হতে পারলেন না। তার যুক্তি ছিলাে যেহেতু এই মন্ত্রিসভায় সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব নেই তাই এই সংবর্ধনা দেওয়া সঙ্গত হবে না। তিনি এই অনুষ্ঠান আয়ােজনে বাধা দিলেন না। বটে—তবে ছাত্র ইউনিয়নের সেক্রেটারীর পদ থেকে সরে দাড়ালেন—পদত্যাগ
১৫
করেন। আর ঐ পদের দায়িত্ব আমার ওপর বর্তালাে। শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার সংবর্ধনার আয়ােজন করা হয়। ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে অভিভাষণ লেখা হলাে ইংরেজিতে। সেটি পড়ার ভার পড়লাে আমার ওপর। অভিভাষণটি সােনালী রংয়ের সিল্কের কাপড়ের ওপর ছাপানাে হলাে এবং শাঁখারী পট্টি থেকে সিল্কের কাপড়ের ওপর একটি শঙ্খও আঁকিয়ে আনা হলাে। অনুষ্ঠানের তিনদিন পূর্বে অভিভাষণ পড়ার মহড়াও অনুষ্ঠিত হলাে। আমাকে বলা হলাে অনুষ্ঠানের দিন শেরওয়ানী পরে অভিভাষণ পড়ার জন্য। আমি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলাম না। কারণ ইতিপূর্বে আমি কখনাে শেরওয়ানী পরিনি। নিয়মিত শার্ট-প্যান্ট এবং মাঝে-মধ্যে ধুতি-পাঞ্জাবি পরেছি। তাছাড়া আমার শেরওয়ানী ছিলাে না। সিনিয়র ছাত্ররা আমাকে বুঝালাে-প্রথম মন্ত্রিসভাকে সংর্ধনা দেওয়া হচ্ছে, মুসলমানের ছেলে, মুসলমানদের একটা প্রভাব থাকা চাই। শেষ পর্যন্ত আমাকে শেরওয়ানী পরতে হলাে। আমার সহপাঠী করিম তখন সদ্য বিয়ে করেছে-তার শেরওয়ানীটি এনে দর্জি দিয়ে। কাটছাঁট করে আমার উপযােগী করা হয়েছিলাে। শেরওয়ানী পরাটা আমি মােটেও পছন্দ করছিলাম না। ভিতরে ভিতরে রাগও হচ্ছিলাে। কিন্তু উপায় ছিলাে না। অধিকাংশ ছাত্রই শেরওয়ানী পরার পক্ষে ছিলাে। অনুষ্ঠানের দিন-তারিখ আজ আর মনে পড়ছে না। শেরওয়ানী পরে অভিভাষণ পড়েছিলাম। জাঁকজমকের সঙ্গেই ফজলুল হক মন্ত্রিসভার সংবর্ধনা দেওয়া হলাে। রাতে সলিমুল্লাহ হলে বিরাট আকারের ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছিলাে। রাতের এই অনুষ্ঠানেই আমি প্রথম এ. কে. ফজলুল হককে খুব কাছ থেকে দেখলাম। এ. কে. ফজলুল হক বক্তৃতা দিতে উঠে প্রথমে আমাদের অভিভাষণের জবাব দিলেন। তারপর বক্ততার এক পর্যায়ে। তিনি বলেছিলেন : মুসলিম লীগে না থেকেও পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের উপকার করা যায়। তিনি আরও বলেছিলেন : আমি বাংলার চ্যাটার্জী, মুখার্জী আর ব্যানার্জীদের চিনি। আমি শুধু তাকিয়ে দেখলাম যে এসব কথা বলে তিনি বুঝতে চাইলেন যে, হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা আছে তারা আমাদের দাবিয়ে রেখেছে। এসব কথার মধ্যে আমি সাম্প্রদায়িকতার চিহ্ন লক্ষ্য করলাম। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতাে ফজলুল হকের বক্তৃতা শুনেছিলাে। সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিকল্পিত হয়েছিলাে। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে। মুসলমানদের প্রভাব এবং ক্ষমতা প্রদর্শনই যেন অনুষ্ঠানের লক্ষ্য ছিলাে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ম নিয়ে সম্প্রদায় নিয়ে কথাবার্তা এ সময় থেকেই প্রথম শুনলাম।
আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ১৯৪০ সালের কথা। এম. এ. শেষ বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছি। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রথম ইংরেজি ম্যাগাজিন তখন সম্পাদনা করছিলাম। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নির্বাচন হচ্ছিলাে। এই সংসদে স্পীকারের একটি পদ ছিলাে। ইউনিয়নের নতুন সংবিধানে এই পদ সৃষ্টি করা হয়েছিলাে। এই স্পীকারের পদের জন্য প্রার্থী হলেন পরবর্তীকালের বিচারপতি বি. এ. সিদ্দিকী। তিনি তখন আইন পাশ করেছেন। নির্বাচন হতাে
১৬
জেলাভিত্তিক। আমাকে ঢাকা জেলা ইলেকশন কমিটির সভাপতি করা হয়েছিলাে। আমাদের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের রংপুর, দিনাজপুর এবং বগুড়া জেলা যােগ দিলাে। এই সমন্বিত জেলা কমিটির সভাপতি মনােনীত করা হলাে আমাকে। নির্বাচনের প্রচার বেশ জোরেশােরেই শুরু হয়েছিলাে। দেয়ালে দেয়ালে পােস্টারও লাগানাে হচ্ছিলাে। হঠাৎ একদিন সকালে দেখলাম চার-পাঁচ ফুট লম্বা বি. এ. সিদ্দিকীর ছবি। সংবলিত অসংখ্য পােস্টার দেয়ালে লাগানাে হয়েছে। ছবিতে বি. এ. সিদ্দিকীর। পরনে ছিলাে শেরওয়ানী এবং মাথায় টুপি। লেখা ছিলাে ‘ভােট ফর সিদ্দিকী। বি. এ. সিদ্দিকী আমাদের প্রার্থী। তাছাড়া ইলেকশন কমিটির সভাপতিও ছিলাম আমি। অথচ এই পােস্টার বিষয়ে আমি বা আমার অন্য সহপাঠীরা কিছুই জানতাম না। ইস্ট হাউস থেকে প্রতিবাদ উঠলাে—শ্লোগান দিলাে বি. এ. সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে। তারা বলছিলাে পােস্টারে ছবি ছাপানাে অনৈসলামিক কাজ। সুতরাং বি. এ. সিদ্দিকীকে আমরা ভােট দেবাে না । আমরা জানতে চেষ্টা করলাম কারা এ কাজ করেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম আমাদের বিরুদ্ধ দলই একাজ করেছে। কিন্তু পরে আমরা জানতে পারি বি. এ. সিদ্দিকী নিজেই পােস্টার ছেপে এনেছেন। ছাত্রদের মাঝে বি. এ. সিদ্দিকী সম্পর্কে এই মনােভাব দেখে দেয়ালের সকল পােস্টার উঠিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা হলাে। রাতে ইস্ট হাউসের ছেলেদের সঙ্গে বসে অনেক বুঝিয়ে তাদেরকে শান্ত করতে হয়। এই নির্বাচনে আমরা জিতেছিলাম। এই নির্বাচনে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করতে দেখেছিলাম—যা ইতিপূর্বে এমনভাবে প্রত্যক্ষ করিনি। ১৯৪০ সালের পর সাম্প্রদায়িকতা বেশ ভালভাবেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরে প্রবেশ করে।
আর একদিনের ঘটনা আমার বেশ মনে পড়ছে। আমি তখন ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক। সেদিন আমি সাইকেলে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছি। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতে যাবাে, এমন সময় কয়েকজন ছেলে আমার পথ রােধ করে দাঁড়ালাে। ওদের সবার হাতেই হকিস্টিক। জিজ্ঞেস করে জানলাম ওরা সবাই ঢাকা হলের ছাত্র। ওদেরই একজন আমাকে বলেছিলাে, স্যার, ভেতরে যাবেন না।’
কারণ জিজ্ঞেস করতেই ওরা বললাে, ‘স্যার, ভেতরে হিন্দু আর মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে মারামারি হচ্ছে। এরপর জিজ্ঞেস করলাম, “তােমরা হকিস্টিক নিয়ে ঘুরছাে কেন ? ওরা বললাে, “আসলে স্যার, আমরা মারামারি করতে আসিনি। এসেছি প্রােটেকশন দিতে যাতে আমাদের কেউ মারতে না পারে। আমরা কেউ ভেতরে যাচ্ছি না, আপনিও যাবেন না, স্যার। | বলে ফেললাম, পথ ছেড়ে দাও, আমি ভেতরে যাবাে। আমাকে কেউ মারবে । কিন্তু আপত্তি করলাে ওরা, বললাে- স্যার, আপনাকে তাে সবাই চেনে না। কি হতে কি হয়, এরকম বেশ তর্ক হচ্ছিল। ওরা আমাকে মরিয়া হয়ে বােঝাতে চাইলাে যে, ভেতরে গেলে আমার ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু আমি কিছুতেই তাদের
৩৩
কথা মানতে পারছিলাম না। শেষে বললাম, “ঠিক আছে, তােমরা যখন প্রােটেকশন দিতে চাইছাে আমি সাইকেলটা লক করে যাচ্ছি। তােমরা ওটা পাহারা দাও। আমি ভেতরে যাচ্ছি।
ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম। পথে দেখা হলাে ড: এস. সি. ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তাকে আমরা ‘গােল ভট্টাচার্য বলে ডাকতাম। দেখতে শুনতে বেশ গােল ছিলেন, তাই তাকে ও-নামে ডাকা হতাে। ড: ভট্টাচার্য ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। আমাদের শিক্ষক ছিলেন তিনি। পড়াতেন গ্রীক ইতিহাস, উপরে ওঠার সময় আমার কাঁধে হাত রাখলেন। তিনি বললেন, ‘অবস্থা খুব খারাপ মনে হচ্ছে, তাই না ? চলে এসাে।
আমি বললাম, স্যার আসছি।’ ড: ভট্টাচার্য আবার ফিরে এলেন, বললেন- তুমি কিছু মনে করােনি তাে ? ‘কেন ?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি। ‘এই যে, তােমাকে তুমি বলে সম্বােধন করলাম। ‘কি বলছেন স্যার, আমি হতচকিত হয়ে বললাম।
‘এই দেখ কি অবস্থা হয়েছে’, লক্ষ্য করলাম তিনি খুবই ভীতসন্ত্রস্ত। চারপাশে তাকিয়ে দেখি বেঞ্চ, চেয়ার-টেবিল সব ভাঙ্গা অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। অবশ্য কেউ মারা যায়নি। ছাত্ররা মারামারি করছে। কিন্তু দেখা গেল যে, শিক্ষক হয়েও তিনি ফিল করছেন যে, আমি তাঁর ছাত্র হয়ে কিছু মনে করলাম কিনা।
আমার মনটা বেশ দমে গেল। মনে মনে বেশ ছােট হয়ে গেলাম। দ্রুত গিয়ে স্টাফ রুমে বসলাম। ওখানে অনেকেই আছেন। কিন্তু কারাে মনই ভালাে নয়। কেউ কোনাে কথা বলছে না। আমার শুধু মনে হতে লাগলাে, উনিশশাে চল্লিশে যা শুরু হয়েছে তা বুঝি এখন চরমে উঠতে আরম্ভ করলাে। এভাবেই চললাে, তারপর উনিশশাে সাতচল্লিশে দেশটা তাে দু’ভাগই হয়ে গেল। ভারত ও পাকিস্তান। এই সাম্প্রদায়িক গণ্ডগােলের সময় বেশ কিছু ছাত্রও মারা পড়েছে এখানে সেখানে। এসব ঘটনায় আমার মনে পড়ে যায় আমার ছাত্রজীবনের অনেক স্মৃতি। তখন একসঙ্গে অনেক হিন্দু মুসলমান ছাত্র পড়াশুনা করতাে। কিন্তু আমাদের ছাত্রজীবনে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে তেমন কোনাে বৈরী সম্পর্ক ছিল না। বরং বলা যায় অত্যন্ত ভালাে এবং হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তখন তাে কোনাে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতে দেখিনি। শেষের দিকে সামান্য কিছু বৈরিতা লক্ষ্য করলেও তেমন মারাত্মক কিছু ছিল না। তবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তাে এখানে সেখানে অনেকবারই হয়েছে, কিন্তু কোনখানেই ছাত্ররা তেমন জড়িত ছিলাে না। ঢাকাতে তাে অনেকবারই হিন্দুমুসলমান দাঙ্গা হয়েছে। কিন্তু সেখানেও কোনাে ছাত্র জড়িত ছিল না। আর ছাত্ররা কেউ একজনকে মেরেছে এমনটা আমার চোখে পড়েনি। অবশ্য নাজির হত্যার ব্যাপারটা আলাদা। ছাত্ররা কেউ কাউকে যে মারতে পারে, তা আমরা জানতামও । এমনিতে আমাদের মধ্যে সম্পর্ক খুবই ভালাে ছিল। আর শিক্ষকদের মধ্যে
৩৪
হিন্দু শিক্ষকরা মুসলমান ছাত্রদের আর মুসলমান শিক্ষকরা হিন্দু ছাত্রদের খুবই আদর করতেন। এমনিতেই সব শিক্ষকের সাথেই আমাদের সম্পর্ক খুব ভালাে ছিল। ধর্মীয় কোনাে বিষয় আমাদেরকে আলােড়িত করতাে না। এসময় আমি এমন কিছু দেখিনি যাতে বলা যায় আমরা ‘কন্যুনাল’ বা সাম্প্রদায়িক হয়ে গেছি।
১৯৪০ সালে আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. পাশ করে বেরুলাম। না, ঠিক ১৯৪০ নয়-ফল বেরুতে ১৯৪১ সাল হয়ে গেল। পাশ করার পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসাবে চাকরি পেলাম। চাকরিতে যােগদান করার পর আমাকে সলিমুল্লাহ হলের ইস্ট হাউসের এ্যাসিসটেন্ট হাউস টিউটর করা হলাে। একটি কোয়ার্টার পেয়ে গেলাম। এ সময় ইস্ট হাউসের হাউস টিউটর ছিলেন আবদুল হাদি তালুকদার। আমি ছিলাম অবিবাহিত। আমার কোয়ার্টারে বেশ কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব এসে ঠাই নিলাে। বন্ধুদের মধ্যে মাহমুদ (পরে ড: মাহমুদ, অর্থনীতিবিদ), মির্জা নূরুল হুদা (পরে ডঃ এম:এন. হুদা অর্থনীতিবিদ), শামসুদ্দিন আহমেদ পরে ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন এদের নাম মনে পড়ছে। এরা তখন কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ব্যস্ত, আবার কেউ চাকরির জন্য প্রতিযােগিতা মূলক পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। একজন বাবুর্চি রেখেছিলাম। মাসিক বেতন ছিলাে ৬/৭ টাকা। আমি বেতন পেতাম ১২৫.০০ টাকা। এই বাবুর্চিই সবার রান্না-বান্না করতাে। বেশ আনন্দেই দিন কাটছিলাে।
১৯৪২ সালেই আমাকে বিয়ে করতে হলাে। বাবা ছিলেন হার্টের রােগী। বাবার ইচ্ছাতেই বিয়ে করতে হয়েছিলাে। বিয়ের পর এ্যাসিসটেন্ট হাউস। টিউটরের চাকরি ছেড়ে দিলাম। ফলে কোয়ার্টার ছাড়তে হলাে। বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টার ছেড়ে আগামসি লেনে একটি দোতলা বাড়ি ভাড়া করে সেখানে উঠে গেলাম। এ সময় আমরা স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা এবং আমার বােন ও বােনের স্বামী এস. এ. খান-সূর একত্রে থাকতাম। এস. এ. খানসূর চাকরি করতেন বিমান বাহিনীতে। কিন্তু এক দুর্ঘটনায় একটি বিমান ধ্বংস হওয়ার অপরাধে তার চাকরি। চলে যায়। বাবা একথা জানতেন না। কষ্ট পাবেন ভেবে একথা আমরা কেউ বাবাকে জানাইনি।
আমি একরকম অভিমান করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিলাম। এসময় উপাচার্য ছিলেন ড: মাহমুদ হাসান। ছাত্র থাকাকালে তিনি আমাদের প্রভােস্ট ছিলেন। তাঁর সময়ে আমাদের হল ইউনিয়ন থেকে ইংরেজি ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছিলাে। প্রভােস্ট হিসেবে তিনিই ইংরেজি ম্যাগাজিনের সম্পাদক নির্বাচন করেছিলেন আমাকে। এই সূত্রে তার সঙ্গে আমার বেশ ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলাে। শিক্ষক হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যােগদানের পরও তিনি আমার। খবরাখবর রাখতেন। একটি ঘটনার কথা আমার বেশ মনে আছে। তখন আমি সলিমুল্লাহ হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। একদিন সেকেণ্ড শাে-তে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু রাতে আর ফেরা হলাে না। এ সময় ঢাকাসহ সারা দেশে মাঝে মাঝেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হচ্ছিলাে।
৩৫
রাতে সিনেমা দেখে যখন হলে ফিরবাে-তখনই ঢাকা শহরের দাঙ্গা পরিস্থিতি এমন রূপ নেয় যে ঘরের বাইরে যাওয়া কোনমতেই নিরাপদ ছিলাে না। আমি সে রাতে মুকুল সিনেমার কাছে এক বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। খুব ভােরে, সেখান থেকে রওনা দিয়ে যখন হলে এসে পৌছলাম তখন দেখি আমার হলের আবাসিক শিক্ষক হাদি সাহেব গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। আমাকে দেখেই তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, ‘এক্ষুণি প্রভােস্ট সাহেবের সঙ্গে দেখা করাে—দ্যাট ইউ হ্যাভ এরাইভড। বাঁদর ছেলে-লেকচারার হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। রায়টের সময় কেন সেকেণ্ডে শাে-তে সিনেমায় গিয়েছিলে ?” আমি প্রভােস্ট হাসান সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আমাকে বললেন, ট্রাই টু বি রেসপনস্বল। ইউ আর নাে মাের এ স্টুডেন্ট।’ এ সময় আবদুর রাজ্জাক সাহেবও দেখা করতে গিয়েছিলেন। তিনিও দাঙ্গার কারণে রাতে ফিরতে পারেন নি। আবদুর রাজ্জাক সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘ইউ আর সিনিয়র নাও, হাউ কুড ইউ ডু দ্যাট ? লিখেও যাওনি কোথায় গেছ, খুঁজলেও কেউ পাবে না। সেদিনের মতাে কোনাে রকমে আমরা ছাড়া পেয়েছিলাম।
পরে ড: হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। আমি মাত্র ২ নম্বরের জন্য এম. এ.-তে প্রথম শ্রেণী পাইনি। আমি বুঝেছিলাম শিক্ষকতা করতে হলে উচ্চশিক্ষা প্রয়ােজন। তাই একদিন উপাচার্য ড: হাসানকে আমার উচ্চশিক্ষার বিষয়ে কথা পাড়লাম। তিনি বােধ হয় খুবই ব্যস্ত ছিলেন, আমাকে বললেন, “তুমি পরে এসাে’। এই পরে এসাে’ কথাতে আমি কষ্ট পেয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিলাে তিনি বােধ হয় আমাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছেন। তাই আমিও যাওয়ার সময় বললাম, স্যার আই মে রিজাইন ফ্রম দি ইউনিভার্সিটি।’ তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘ডন্ট বি ইমপেসেন্ট’। কি হয়েছে তােমার ? তুমি যুবক, নতুন যােগদান করেছে। উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে নানা দিক দেখতে হবে। হিন্দু-মুসলমানের প্রশ্নটিও রয়েছে। আমি আর কথা বাড়ালাম না। বললাম, স্যার ঠিক আছে, ইটস অল রাইট থ্যাংক ইউ’ এই বলে চলে এলাম। ফিরে এসেই আমি কাউকে কিছু না বলে পদত্যাগপত্র লিখে এক অবাঙালি বেয়ারার মারফত উপাচার্যকে দেবার জন্য ড: কানুনগাে’র (যিনি ইতিহাসের প্রধান ছিলেন) কাছে পাঠালাম। পদত্যাগপত্র দিয়ে বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরিনি। অভিমান করে জেদের বশেই চাকরি ছেড়েছিলাম। আমার বাবাও খুব জেদি ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি ছাড়ার পর অন্য কিছু করার জন্য তখন মরিয়া হয়ে ঘুরছি। রােজই চাকরির জন্য বের হতাম। একদিন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখলাম রাজশাহী সরকারী কলেজে ইতিহাসের প্রভাষক নেওয়া হবে। আবেদনপত্র পাঠাবার শেষ তারিখের আর মাত্র ছ’দিন বাকি ছিলাে। ছুটলাম রমনা পােস্ট অফিসের দিকে । পােস্ট অফিসের সামনে একটি ডেস্ক ছিলাে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লেখা যেতাে। দাঁড়িয়েই দরখাস্ত লেখা শুরু করলাম ঃ ‘টু চেয়ারম্যান, পাবলিক
৩৬
সার্ভিস কমিশন, কলকাতা। দরখাস্ত লিখলাম বটে, কিন্তু চরিত্র বিষয়ে কোনাে সার্টিফিকেট নেই। বিশ্ববিদ্যালয় অথবা সর্বশেষ কলেজ থেকে এ সার্টিফিকেট নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ফিরে যাবাে না তাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমার কলেজ থেকে সার্টিফিকেট নেওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম। এখন যেখানে হাইকোর্ট, সুপ্রীমকোর্ট ভবন সেখানটাতেই ছিলাে ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপালের বাসভবন। বস্তুত আগে ঢাকা কলেজ ছিলাে গভর্নর হাউসের অন্তর্ভুক্ত। এই ভবনে গভর্নরের সেক্রেটারী থাকতেন। ১৯৪৫-৪৬ সালের দিকে, কার্জন হলের উল্টোদিকে যে সাদা বিল্ডিংটা রয়েছে- সেটিই ছিলাে গভর্নর হাউস। গভর্নর সেখানেই থাকতেন।
সেদিন ছিলাে রবিবার। ঢাকা কলেজ অধ্যক্ষের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য সকালেই তাঁর কোয়ার্টারে গিয়ে হাজির হলাম। এ সময় কলেজ অধ্যক্ষ ছিলেন খান বাহাদুর ফখরুদ্দিন আহমদ। আমি কলেজ অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে বেয়ারা জানালাে, ‘আভি নেহি হােগা। সাব কিসিসে মােলাকাত নেহি কারেগা। আমিও দেখা করার জন্য জেদাজেদি শুরু করলাম। আমাদের এই কথাবার্তা হয়তাে অধ্যক্ষের কান পর্যন্ত পৌঁছেছিলাে। তিনি ঘর থেকেই বেয়ারাকে জিজ্ঞাসা করলেন কে এসেছে। বেয়ারা আমার কথা জানালে তিনি বললেন, ‘ভেজ দো’। আমার পরনে ছিলাে পাজামা-পাঞ্জাবি আর সঙ্গের বাহন সাইকেল। সাইকেলটি রেখে বারান্দায় ঢােকার জন্য সিঁড়িতে পা রাখলাম। সিঁড়িগুলাে ছিলাে বেশ উঁচু। আট-দশটি ধাপ পেরিয়ে বারান্দায় পৌছলাম । বারান্দাতেই ডেক চেয়ারে বসে তিনি খবরের কাগজ পড়ছিলেন। গায়ে ছিলাে গেঞ্জি, পাজামা পরা। পা’টা উঠিয়ে বসেছিলেন। আমাকে দেখে চমশাটা খুলে বললেন, ‘হােয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট ? আমি বললাম, ‘আই নীড এ ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট স্যার। আই ওয়াজ এ স্টুডেন্ট অফ দিস কলেজ।’ তিনি জোর দিয়ে বললেন, ‘স্টুডেন্ট অফ দিস কলেজ ? ডােন্ট ইউ নাে আই ডােন্ট সী এনিবডি অন সানডে ? আমি বললাম, ‘স্যার, আই ডােন্ট নাে। বাট ইটস ভেরি আর্জেন্ট। ‘হােয়াট ইজ দি আর্জেন্সি ইনভলভড়’-বলে তিনি সােজা হয়ে বসলেন। আমি বললাম, ‘স্যার, আই হ্যাভ টু অ্যাপ্লাই ফর এ জব এণ্ড আই নীড এ ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট ভেরী ব্যাডলি। আনলেস আই পােস্ট ইট টুডে বাই অর্ডিনারী মেইল, ইট উড নট রিচ ক্যালকাটা ইন টাইম।’ অধ্যক্ষ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হােয়েন ডিড ইউ পাস আউট ফ্রম দি ইউনিভার্সিটি ? হােয়াট ওয়্যার ইউ ড্রয়িং অল দিজ ডেজ?’ আমি বললাম, স্যার, আই ওয়াজ এ লেকচারার এট দি ডিপার্টমেন্ট অব। হিস্ট্রি। আই হ্যাভ রিজাইও ফ্রম দি জব এবাউট টু উইক এগাে।’ ‘রিজাইণ্ড ? হােয়াই ?” তিনি প্রশ্ন রাখলেন। আমি সমস্ত ঘটনা, তাকে জানালাম। ড: হাসানের সঙ্গে রাগ করে অভিমান করে পদত্যাগ করেছি—একথাও জানালাম। “ওহ, আই সি, হাসান ? ওয়েল, টেক ইয়াের সিট। বেয়ারা জলদি কুরসি লাও।’ কুরসি আনা হলাে। আমি বসলাম । তারপর তিনি নাতা আনার জন্য বললেন। আমি বললাম,
৩৭
– সরি স্যার, আই হ্যাভ টেকেন মাই ব্রেক ফাস্ট অলরেডি।’ ‘টেক এ কাপ অফ টি’-বলে তিনি আপন মনেই যেন বলে চললেন, হাসান তাে এ্যয়সা হােগাইইটস্ অলরাইট। আই অলসাে লেফট মাই জব ফ্রম দি ইউনিভার্সিটি। আই ওয়াজ দি লাইব্রেরীয়ান, ইউ নাে, আই রিজাইণ্ড। এনিওয়ে আই এ্যাম ভেরি হ্যাপী টু মিট এ ইয়াংম্যান লাইক ইউ। আই এ্যাম সিয়াের, ইউ উইল বি সামথিং সামডে । ইউ হ্যাভ দ্যাট কাইণ্ড অফ এইম। সিন্স ইউ আর সাে সেন্টিমেন্টাল, ইসকো কমা দিজিয়ে । বাট সিন্স ইউ হ্যাভ এ্যামবিশান্ এ্যাণ্ড ডিটারমিনেশন। হাে জায়েগা। টাইপ করানাের সময় ছিলাে না। অধ্যক্ষ নিজের হাতে আমার জন্য একটি সার্টিফিকেট লিখে দিলেন। আমি এই সার্টিফিকেটসহ রাজশাহী সরকারী কলেজের প্রভাষকের পদের জন্য আবেদন করলাম।
যথাসময়ে ইন্টারভিউ কার্ড পেয়ে কলকাতা গেলাম। ঐ পদের জন্য ৩০/৩৫ জন প্রার্থী ছিলেন। অনেক সিনিয়র প্রার্থীও ছিলেন। এঁদের মধ্যে আমার আত্মীয় সিদ্দিক সাহেব রেঙ্গুন থেকে এসেছিলেন। ইসহাক (বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন) সাহেবও ছিলেন। ইন্টারভিউ হলাে কলকাতার সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং-এ। বিশেষজ্ঞ হিসাবে কালিকারঞ্জন কানুনগাে (ড: কে. আর. কানুনগাে), ডি. পি. আই. এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানসহ ৪/৫ জন বাের্ডে ছিলেন। বাের্ডে প্রথমেই আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলাে ইতিহাসের ছাত্র হিসাবে ইতিহাসের কোন বিষয়টি আমার বেশি পছন্দ। আমি বলেছিলাম আধুনিক ইউরােপিয়ান ইতিহাস আমি বেশি পছন্দ করি। বাের্ডের অন্যতম সদস্য ড: স্নেহময় দত্ত জিজ্ঞাসা করলেন, কোন পিরিয়ড ? আমি বলেছিলাম, ফ্রেঞ্চ রেভলিউশন। তারপর আবার প্রশ্ন করা হলাে কেন ?’ এরপর দুনিয়ার সেরা জেনারেল কাকে বলা হবে ইত্যাদি বিষয়ে অনেক প্রশ্ন করা হয়েছিলাে। আমি যথাযথ উত্তর দিয়েছিলাম। প্রায় ৪৫ মিনিট যাবত আমাকে নানা প্রশ্ন করা হয়েছিলাে। আমি যখন সাক্ষাৎকার শেষ করে বেরিয়ে আসছি—তখন আমাকে জিজ্ঞাসা করা হলাে-তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়েছাে কেন ? আমি কানুনগাে স্যারকে দেখিয়ে বললাম, আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আছেন—হি উইল টেল ইউ হােয়াই আই লেফট দি জব। কানুনগাে স্যার সাহেবকে সব ঘটনা বলেছিলাম। আমি যখন চলে যাচ্ছি, তখন জেনকিন্স সাহেব ডেকে বললেন, ‘তুমি ভালাে করেছে। তােমাকে নেবাে। অন্যদের কিছু বলাে না। আমি সম্মতি। জানালাম। ফিরে আসার পর অপর প্রার্থীরা সবাই আমাকে ঘিরে ধরলাে। সবাই জিজ্ঞাসা করলাে এত সময় লাগলাে কেন ? আমি উত্তর দিলাম, ‘ব্রিটিশ পলিসি সম্পর্কে বলেছি। আমার চাকরি হলাে। পিএসসি চেয়ারম্যান জেনকিন্স-এর কথা ঠিক হলাে। কিন্তু যােগ দিতে হলাে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজে। চট্টগ্রামে ছিলাম এক মাস। তারপর আমাকে রাজশাহী সরকারী কলেজে বদলী করা হলাে। চট্টগ্রাম
৩৮
সরকারী কলেজ অধ্যক্ষ আবু হেনা আমার ফেয়ারওয়েল-এর আয়ােজন করলেন। বেশ জমজমাট করে অনুষ্ঠান হলো। এরপর ১৯৪৩ সালে আমি রাজশাহী সরকারী কলেজে প্রভাষক হিসাবে যােগদান করলাম।
রাজশাহী কলেজে যােগদানের প্রথম দিনটির কথা আজো আমার স্পষ্ট মনে আছে। ড: স্নেহময় দত্ত (রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ) আমাকে বললেন, তােমাকে আমি আনিয়েছি এখানে। তুমি ইন্টারভিউতে ভালাে করেছাে। তুমি এসেছাে। আমি খুশি হয়েছি। এরপর প্রথম ক্লাসে ঢুকলাম। ছাত্রদের রােলকল শুরু করলাম। ‘রােল ওয়ান,’ বলতেই পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, টু উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ‘জয় হিন্দু উচ্চারিত হলাে। আমি থ্রি পর্যন্ত না গিয়ে থেমে গেলাম। আমি বললাম, এটা কোনাে রাজনৈতিক মঞ্চ নয় । আই অ্যাম নট এ পলিটিশিয়ান। আই হ্যাভ মাই পলিটিক্যাল আইডিয়াস এণ্ড ভিউস অলসাে। আই উড নট লাইক মাই স্টুডেন্টস টু বি পলিটিক্যাল ইন দি ক্লাস। লীডার্স ইন দি ক্লাস রুম। আই গিভ লাস্ট ওয়ার্নিং টু অল অফ ইউ, অলদো আই হ্যাভ জয়েণ্ড দিস মর্নিং। আই উইল নট মার্ক ইউ প্রেজেন্ট, আনলেস ইয়াের এনসার ইজ প্রপার। একজন হাত তুলে বললাে, ‘হােয়াট ইজ দি প্রপার এ্যানসার, স্যার ?’ আই সে, ‘ইয়েস স্যার’। আর একজন সঙ্গে সঙ্গে বললাে, আই সে প্রেজেন্ট স্যার? আমি বললাম, “নাে, দি ফ্যাক্ট ইউ আর শাউটিং ইয়েস স্যার’ মিন্স ইউ আর ভেরি মাচ প্রেজেন্ট। অনলি ওয়ান রেসপন্স ইন মাই ক্লাস ইজ ইয়েস’ অর ইয়েস স্যার। নাে অলটারনেটিভ। ইফ ইউ সে ‘জয় হিন্দ’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ‘প্রেজেন্ট স্যার’ আই টলারেট ফর দি ফাস্ট ডে । বিফোর আই লিভ দি ক্লাস, আই উইল আস্ক ইউ নট টু জয়েন দি ক্লাস টুমরাে। বি কেয়ারফুল, আই মিন হােয়াট আই সে। আমি আবার রােল কল শুরু করলাম। সবাই ঠিকই ইয়েস স্যার’ বললাে। এই ঘটনা সারা কলেজে রীতিমতাে আলােচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ালাে।
কলেজে যােগদানের পরপরই আর একটি কাজ করেছিলাম। বলা যায়, দীর্ঘদিনের অভ্যাস ভেঙে দিয়েছিলাম। এ সময় রীতি ছিলাে কোনাে ক্লাসে ছাত্রীদের যােগ দিতে হলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক কমন রুম থেকে ছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে ক্লাসে ঢুকতেন, আবার ক্লাসশেষে কমন রুমে পৌছে দিতেন। এ বিষয়টি আমার মােটেও ভাল লাগলাে না। আমার বয়স কম, লজ্জাবােধও করতাম। তাই একদিন ক্লাস শেষে মেয়েদের বললাম, আজ থেকে আমি তােমাদের আর আনতে যাবাে। না। আমি দাঁড়ালাম। তােমরা তােমাদের কমনরুমে যাও। আসবার সময়ও আমি দাঁড়াবাে এই একই জায়গায়। এখানে এসে আমার সঙ্গে যােগ দেবে। আমি তােমাদেরকে এস্কর্ট করবাে না। এই ঘটনায়ও কলেজে একরকম সাড়া পড়ে গিয়েছিলাে। এ সময়ের আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস। নিচ্ছি। সাধারণ ইতিহাসের ক্লাস। বেশ লম্বা ক্লাস হতাে। ক্লাসের পরও ছাত্রদের নানা প্রশ্নের জবাব দিতে হতাে। এই ক্লাস শুরুর আগে আমি ছেলেমেয়েদের
৩৯
উদ্দেশে বললাম, ক্লাস চলাকালীন সময়ে কারাে বাইরে যাবার প্রয়ােজন হলে কিছু না বলে নীরবে বাইরে যাবে এবং শান্তভাবে ক্লাসে এসে বসবে। যারা প্রথম সারিতে আছে তারা ফিরে এসে প্রথম সারিতে না বসে, পিছনে এসে বসবে। ক্লাস শুরুর কিছুক্ষণ পর দেখি এক ছাত্র পরপর তিনবার বাইরে থুথু ফেলতে গেল। এটা দেখে অনেক ছাত্র মুচকি মুচকি হাসছিলাে। তৃতীয় বার সে যখন বসতে যাবে তখন তাকে বললাম, ‘দাঁড়াও। আই ডন্ট লাইক দ্যাট কাইণ্ড অফ স্টুডেন্ট। ফ্রম টু মরাে ইউ স্যাল নট কাম টু মাই ক্লাস। যদি আস, আই স্যাল সেণ্ড এ রিপাের্ট এগেনস্ট ইউ।’ ক্লাসশেষে ছেলেটি আমার পিছু পিছু আসলাে—মাপ চাইলাে। পরদিনও মাপ চাইলে—আমি ক্ষমা করে দিলাম। এই ঘটনাও ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে বেশ আলােড়ন তুলেছিলাে। এরপর আমাকে ছাত্র ইউনিয়ন এবং বিতর্কের দায়িত্বও দেওয়া হয়। তখনকার দিনে বয়সে নবীন একজন মুসলমান শিক্ষক হিসাবে এসব দায়িত্ব পাওয়া যেমন মুস্কিল ছিলাে, তেমনি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা-ভক্তি পাওয়াও বেশ কঠিন ছিলাে। কিন্তু আমি এই দুর্লভ সম্মান পেয়েছিলাম। সবার ভালােবাসা, ভক্তি-শ্রদ্ধা লাভ করেছিলাম। ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত আমি এই রাজশাহী কলেজেই ছিলাম। ‘ রাজশাহীতে প্রথম এসে উঠেছিলাম একটি মাটির তৈরী ঘরে। উপরে ছন আর বাকিটা মাটি। মােট চারটি ঘর ছিলাে। আমি এবং হুদা সাহেব থাকতাম এক ঘরে। অর্থনীতি বিভাগের সৈয়দ আহমদ, মাহতাবউদ্দিন সরকার—এঁরাও থাকতেন। কিছুদিন পর কলেজের কাছে মাস্টারপাড়াতে একটি একতলা ভবনে চলে আসি। এসময় আমার স্ত্রী আমার সঙ্গে থাকতেন। এরপর আমাকে হােস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট করা হলে আবাসিক শিক্ষকের জন্য বরাদ্দকৃত ভবনে চলে গিয়েছিলাম। রাজশাহী জীবনের বেশ ক’টা বছর এ বাসাতেই কেটেছে।
পাকিস্তান হবার পর পর সরকার ঠিক করেছিল বাইরে থেকে কিছু লােককে ফরেন সার্ভিসে নেয়া হবে (তখন কমপিটিটিভ পরীক্ষা নেবার সময় নেই)। আমি তার জন্য প্রার্থী হলাম। ইন্টারভিউ বাের্ডে ধর্ম, রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হতে পারে কিনা এসব নিয়ে নানা প্রশ্ন করা হলাে আমাকে। ধর্ম এবং রাষ্ট্র একসাথে চলে না এরকম মন্তব্য করার পর আমাকে প্রশ্ন করা হলাে, তাহলে পাকিস্তান করলে কেন তােমরা?” আমি উত্তর দিয়েছিলাম, ‘পাকিস্তান রাজনৈতিক কারণে হয়েছে। তাই বলে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার পক্ষপাতি আমি নই।’ ইন্টাভিউর পর আমার ধারণা ছিল আমার চাকরি হবে। কিন্তু হলাে না। পরে কলেজে নতুন প্রিন্সিপাল ড: জুবেরী আসলে তার কাছ থেকে শুনেছিলাম আমি। নির্বাচিত হলেও সেক্রেটারী জেনারেল মােহাম্মদ আলী আমার নাম বাদ দিয়ে দিয়েছেন এবং একজন পাঞ্জাবীকে নিয়েছেন। পি.এস.সি’র ব্যাপারে কেউ নাক গলাতে পারে তা আমার জানা ছিল না। এটা আমার একটি বড় আঘাত। পাকিস্তানে বাঙালিরা যে সমান সুযােগ পাবে না তা স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরে পাকিস্তান করা যে কতটা ভুল হয়েছে তা অনুধাবন করলাম।
৪০
১৯৫১ সালে ড: জুবেরী (প্রিন্সিপাল, রাজশাহী গভ: কলেজ) ডেকে বললেন, ‘তুমি ফরেন সার্ভিস মিস করেছাে, স্কলারশীপও মিস করেছে। পাকিস্তান আন্দোলন করার জন্যে তােমার ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়াও বন্ধ হলাে।
আমি তােমাকে একটা এডভাইস দেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি?’ তিনি বললেন, ‘তুমি দরখাস্ত করাে স্টাডি লিভ-এর জন্য। তােমার চাকরির যে লেন্থ হয়েছে তুমি স্টাডি লীভ পাবে এবং আমি স্ট্রংলি রিকমান্ড করবাে। ড: জুবেরীর কথামতাে আমি স্টাডি লিভ-এর জন্য দরখাস্ত করলাম এবং আমার সাথে ইংরেজির লেকচারার আবু রুশদ মতিনউদ্দিনও করলেন। আবু রুশ মতিনউদ্দিন আমার বাড়িতে মেহমান হিসাবে ছিলেন, ভাড়া বাড়ি না পাওয়া পর্যন্ত।
দু’জনেরই স্টাডি লিভ হয়ে গেল। সবকিছু ঠিক হয়ে যাওয়ার পর ঠিক হলাে যে ভর্তি হতে হবে। ভর্তির জন্য দরখাস্ত করলাম স্কুল অব অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (ইউনিভারসিটি অব লন্ডন)-এ। আর রুশ করলাে অক্সফোর্ডএ। রুশদ অবশ্য আমাকে অক্সফোর্ড-এ ভর্তি হবার জন্য পীড়াপীড়ি করলাে। কিন্তু আমি ওর কথায় কান দিলাম না। বললাম, না অক্সফোর্ড-এ আমি যাবাে না। আমি পিএইচ. ডি. ডিগ্রী করবাে। সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। যাওয়া ঠিক। টিকেট বুক করা হয়ে গেছে একটি পােলিশ জাহাজে। রাজশাহীতে আমাকে ফেয়ারওয়েল দেয়া হলাে। কিন্তু সে বছর আমার যাওয়া বন্ধ হওয়ার মতাে। পারিবারিক কারণ ছিলাে। আমার এক ভাই তখন মেডিক্যাল কলেজে পড়ে এবং অন্য আরাে দুই ভাইও পড়াশুনা করছে। আমি আবু রুন্দ মতিনউদ্দিনের বাসায় গেলাম। তাঁকে বললাম, মতিন, আমি এ বছর যাবাে না। তুমি চলে যাও—আমি পরের বছর যাবাে। মতিন আমার সাথে ভীষণ তর্ক শুরু করে দিলাে, তারপর রাগারাগি । তােমাকে যেতেই হবে। তােমার জন্য আমি দরখাস্ত করেছি। যেতে হবেই। ওর বাড়িতেই খেলাম। খাওয়া দাওয়ার পর আমাকে জোর করে ধরে রমনা পােস্ট অফিসে নিয়ে গেল। ওখানে নিয়ে গিয়ে মতিন বললাে, বুকিং কনফার্ম করতে হবে তােমাকে। রীতিমতাে জোর । আমি একটু চিন্তা করে বললাম, আচ্ছা, বুকিং কনফার্ম করবাে। কিন্তু আমাকে ছেড়ে দাও। আমি একটু বাসায় গিয়ে বলে আসি’। রাজশাহীতে ফিরে গিয়ে আমার স্ত্রীকে বললাম যে আমি তাে যাবাে না কিন্তু ও যেভাবে ধরেছে একদিক থেকে হি ইজ কারেক্ট; অন্যদিকে না গেলে এক বছর পিছিয়ে যেতে হবে। ভেবে দেখি আর্থিক প্রয়ােজনও তাে আছে। যে ভাই ডাক্তারী পড়ে তাকে টাকা দিয়ে যেতে হবে। এ সব কথা যখন ভাবছি, তখন আশরাফ চৌধুরী নামে এক ভদ্রলােক ছিলেন-নওগাঁর তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন, তাস খেলতাম একসঙ্গে তিনি এসে বললেন যে, ‘চল তাস খেলতে যাই’।
আমি বললাম, আশরাফ ভাই, আমার মনটা ভালাে না, আজকে তাস না-ই খেললাম। তিনি বললেন, তুমি তাে যাবে বেশ ক’দিন বাদে, এখন তাস খেলবে কেন ?
৪১
আমি বললাম, না, আমার যাওয়াটা স্থগিত করেছি। তিনি বসে পড়লেন। কেন স্থগিত করলে ?
বললাম, ফ্যামিলি প্রবলেম আছে ? তাই এবার আমি যাবাে না। তিনি বললেন, আসলে কি প্রবলেম, শুনতে পারি ?
বললাম, শুনতে পারেন। আমি বললাম যে আমার এতগুলি ভাই আছে। বাবামা মারা গেছেন। পরিবারে আমিই বড়াে। জমিজমা যা আছে, তা কয়েক বছরের জন্য লিজ দিয়েছিলাম। সেখান থেকে টাকা জোগাড় হবে না। অথচ টাকা জোগাড় করতে হবে।
তাই ভাবছি কি করি। আশরাফ ভাই বললেন, ‘শােন, তােমাকে যেতেই হবে। তােমার সম্বন্ধে রাজশাহীতে একটা রিউমার আছে যে তুমি একজন বুদ্ধিমান। ভালাে লােক। লেখাপড়ায় ভালাে করতে পারতে। তুমি বাইরে যাচ্ছাে না কেন ? আমার একটা ইনকাম আছে। তুমি যদি মনে কিছু না করাে প্রতি মাসের টাকা আমি সানুকে (আমার স্ত্রী) দেবাে। টেল মি দি এমাউন্ট। আমি একটু ভেবে বললাম, আশরাফ ভাই ঠিক আছে, আমরা পরে এ ব্যাপারে আলােচনা করবাে। তিনি বললেন, না, তুমি আমাকে বললে আমি টাকা দেবাে। এদিকে তাকানাের দরকার নেই। ইউ মাস্ট গাে। তােমার মত ছেলে বাইরে যাবে না তাে কে যাবে বাইরে ? আর ড: জুবেরী আমাদের বলেছেন তিনি তােমার পরিবারের খবরা-খবর রাখবেন।
আমি বললাম, আচ্ছা ভেবে দেখবাে। এরপর ক্লাশ নিতে গেলাম। এই কথা ছড়িয়ে পড়লাে বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে। আলিম নামে একজন উত্তর ভারত থেকে আগত কাপড়ের ব্যবসায়ী, সে একদিন বাসায় এলাে। বললাে, কিয়া বাত ভাই, রুপেয়া জারুরাত হ্যায়, হামলােগ তাে হায়।।
আমার মনটা নরম হয়ে গেলাে। আমি ঠিক করলাম যাবাে। আশরাফ ভাইকে বললাম-আপনি মাসে মাসে সানুকে ৫০ টাকা পাঠাবেন আর বাকিটার ব্যবস্থা আমি করে যাচ্ছি। ওর বাবার সাথেই থাকবে সে। এক শ’ টাকায় ওর হাতখরচ চলে যাবে। ঠিক হলাে জিনিসপত্র সব বিক্রি করে দেবাে। আলিমকে নিয়ে বাসায় গেলাম, ও আমার বন্ধু। তা ছাড়া এলাে জসিম চৌধুরী। খাট ইত্যাদির যা দাম বন্ধুরা তার চাইতে বেশি দাম দিল আমাকে। আমার আর কোনাে অভাব হলাে না। আমি ফিরে এলাম। এসেই টিকেট বুক করলাম। তারপর আমি আর আবু রুশ মতিনউদ্দিন জাহাজে উঠলাম। প্রথমে বােম্বে যেতে হবে। ব্যাটারী’ নামক জাহাজে আমাকে উঠিয়ে দিলাে। আবু রু আর , আমি চললাম লণ্ডনের পথে।
বিদেশ পাড়ি দেবার মুহূর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কথাই মনে পড়ছিলাে। আমি তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার পরিবেশ খুব ভাল ছিল। সাম্প্রদায়িকতা কোনাে বাধার সৃষ্টি করেনি। সেরকম কোনাে পরিবেশই ছিল না। এখানে এমন অনেক শিক্ষক ছিলেন, যারা দেশে এবং দেশের বাইরে অত্যন্ত সম্মানিত-এর মধ্যে বেশ
৪২
কয়েকজন ছিলেন যারা ব্যক্তিগত ধর্ম যাই থাক না কেন তাদের আচার, ব্যবহার এবং ছাত্রদের প্রতি তাদের মনােভাব সব সময় আমাদের আকর্ষণ করতাে। এরকম একজন শিক্ষক ছিলেন আমাদের সময়ের নাম অধ্যাপক হরিদাস ভট্টাচার্য। তিনি ফিলােসফির শিক্ষক ছিলেন। মাথায় একটি সুদৃশ্য টিকি ছিল। অনেকেই বলতেন তিনি হিন্দু মহাসভার পথ অবলম্বন করেছিল। কিন্তু আমরা দেখেছি যে কোনাে মিলাদ শরীফে, তা যে কোনাে হলের মিলাদ শরীফই হােক না কেন, প্রায় সব সময় প্রথম সারির লােকদের মধ্যে তিনি থাকতেন। তাঁর বক্তব্য আমরা মনােযােগ সহকারে শুনতাম, তিনি কোরান শরীফ থেকে উদ্ধৃতি দিতেন এবং হজরত মুহাম্মদ (সা:) এর জীবনী সম্বন্ধে এমনভাবে বক্তৃতা দিতেন যে আমরা আকৃষ্ট হয়ে যেতাম। এ কথা আমার এখনও মনে হয়। তিনি যে মুসলমান-বিদ্বেষী বা অন্য কিছু তার কোনাে কিছুই আমরা দেখিনি। তিনি আসলেও মুসলমান-বিদ্বেষী ছিলেন না। তিনি নিজের ধর্ম পালন করতেন। অন্য ধর্মের উপর আঘাত করার যে মানসিকতা তা তার মধ্যে ছিল না। আমাদের সময় আমরা আরাে শিক্ষক দেখেছি, প্রফেসর এইচ. এল. দে ছিলেন ইকনােমিক্স-এর, পরবর্তীকালে তিনি বিদেশে চলে যান। প্রফেসর এস. কে. দে ছিলেন বাংলার শিক্ষক। প্রফেসর কানুনগাে ছিলেন ইতিহাসের শিক্ষক। এঁরা সবাই ব্যক্তিত্বশীল এবং লেখাপড়া জানা ব্যক্তি এবং শিক্ষক হিসেবে তাঁদের সুনাম ছিল আকাশচুম্বী। সবচেয়ে বড় কথা এঁদের আচার-ব্যবহারের মধ্যেও অনেক লক্ষণীয় বিষয় ছিল। যেমন দেখেছি প্রফেসর কানুনগাের মধ্যে। তিনি খুব মিতব্যয়ী ছিলেন। সিগারেট খেতেন খুব ঘন ঘনই খেতেন। বাড়িতে। তিনি ফুলের বাগান করতেন, বাগানের সব কাজই নিজের হাতে করতেন। আমরা কেউ তাঁর বাসায় গেলে ফেরার পথে চা-টা খাওয়ার পর চলে আসবার সময় তিনি একটা ছুরি কিংবা একটা কাচি নিয়ে আসতেন। এসে বলতেন, কোনাে ফুল পছন্দ হয় ?’ পছন্দের ফুলটি কেটে হাতে দিতেন।
এরকম তিনি প্রত্যেক ছেলের ক্ষেত্রেই করতেন। তারপর আমরা ফাইনাল ইয়ারে পড়ার সময় প্রতি বছরেই পরীক্ষার পরে তাঁর বাসায় যেতে হতাে। রান্নাবান্না তার স্ত্রীই করতেন। পরিবেশনও তাঁর স্ত্রী করতেন। নিজের সন্তানের মতাে আমাদের সবাইকে বসিয়ে খাওয়াতেন। খাওয়ার সময় লাউঞ্জে সবাই হয়তাে দাঁড়িয়ে থাকতেন বা বসে থাকতেন। খাওয়ার পরে তিনি আবার বাগানে নিয়ে যেতেন, ফুল দিতে। তাঁর এই চরিত্র দেখেছি। তার মধ্যে কোনাে সাম্প্রদায়িকতার চিহ্ন দেখিনি। মুসলমান হওয়াতে কোনাে ছাত্রকে নম্বর কম দেবে কিংবা হিন্দু হওয়াতে কোনাে ছাত্রকে বেশি নম্বর দেয়া হবে- এ কথা আমরা চিন্তাই করতে পারিনি। এছাড়া অনেকের কাপড়-চোপড় সম্বন্ধেও যদি চিন্তা করা যায়—প্রফেসর এইচ. এল. দে, প্রফেসর এস. কে. দে, ওঁরা ভালাে কাপড় পরতেন। স্যুট পরতেন। তাঁদের পােশাক-আশাকের দিকে খেয়াল করে দেখতাম জুতাে থেকে শুরু করে টাই পর্যন্ত সবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এঁদের খাওয়া-দাওয়া, আচারব্যবহার আমাদের বেশ আকৃষ্ট করতাে।
৪৩
মােট কথা, এঁরা খুবই মার্জিত ছিলেন। রুচিবান মার্জিত এসব মানুষের বাড়িতে গেলে বেশ ভালাে লাগতাে। মুসলমান শিক্ষক তাে খুব কম ছিলেন । একজনের নাম ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অপরজনের নাম হাদি তালুকদার। মমতাজউদ্দিন আহম্মদ কিছুদিনের জন্য শিক্ষক ছিলেন। জসীমউদ্দীন সাহেব। ছিলেন বাংলাতে। রাজ্জাক সাহেব ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। মাজহারুল হক সাহেব ছিলেন অর্থনীতিতে। মােটামুটি এঁদের সাথে আমার সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল । কয়েকদিন আগে রাজ্জাক সাহেব আমার বাসায় এসেছিলেন। তিনি বলছিলেন। তিনি কিভাবে আপ্যায়িত হয়েছিলেন ড: কানুনগাে দ্বারা এবং তাঁকে কিভাবে স্নেহ। করতেন শিক্ষকরা। আমার মনে হয়, আগের সে পরিবেশ-আবহাওয়া পরবর্তীকালের বিশ্ববিদ্যালয়ে আর নেই। আমাদের সময় অভিযােগ করার মতাে কিছু ছিল না। পড়ার পরিবেশও ভালাে ছিলাে।
যাহােক, জাহাজে চেপে লন্ডনে পৌছানাের পরপরই ইউনিভার্সিটিতে যােগ দিলাম। সেটা ১৯৫১ সালের কথা। খুব অল্প সময়ের মধ্যে অর্থাৎ এক বছর ৯ মাসের মধ্যেই আমার পিএইচ. ডি. ডিগ্রী হয়ে গেল। দু’বছর শেষ হওয়ার আগেই আমি দেশে ফিরে এলাম। দেশে ফিরে রাজশাহী গভ: কলেজে যােগদান না করে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করলাম। আমার ভাগ্য ভালাে যে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি পেয়ে গেলাম। সেটা ছিলাে ১৯৫৪ সালের কথা। চাকরিতে যােগানের পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা কর্মকান্ডের সঙ্গে আমি জড়িয়ে পড়লাম। রাজশাহীতে সে সময় আমার যারা ছাত্র ছিল তারা সমাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। এ সমাজের সঙ্গে আমারও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। নানা কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার ব্যাপারে আমাকে যেসব দায়িত্ব দেওয়া হয় সে দায়িত্ব পালন করতে চেষ্টা করেছি। আমার মনে আছে এই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার দুরূহ কাজ দ্রুত সমাধা করার ব্যাপারে রাজশাহীর জনসাধারণের সমর্থন ও সহযােগিতা আমরা সবসময় পেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা কর্মচারী-কর্মকর্তা ছিলেন, তাদের কথাও মনে পড়ছে। তারা সবাই অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সমস্ত দালানকোঠা রাস্তা তৈরি হয়েছিল, মাঝে মাঝে যে সব বৃক্ষ রােপণ করা হয়েছে, সেগুলাে সে সময়ের শিক্ষক এবং ছাত্রদের সহযােগিতায় করা হয়েছে।
তখন আইয়ুবের শাসন আমল ছিলাে। সে সময় ছাত্ররা বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে পড়তাে। প্রায়ই তাদের বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে, লুকিয়ে রাখা, এদের উপদেশ দিয়ে ঠিকমতাে পরিচালনা করা—এসব দায়িত্ব আমরা কম-বেশি সবাই পালন করতাম। এজন্য আমাদের বেশ ঝুঁকিও নিতে হতাে। প্রিয় ছাত্রদের জন্য ঝুঁকি আমরা অনেকেই নিয়েছি। বিশেষ করে আমাকে এ দায়িত্ব বেশি করে নিতে হয়েছে, কারণ আমি বিভিন্ন পদে তখন জড়িত ছিলাম। আমি ইতিহাসের অধ্যাপক, জিন্নাহ হলের প্রভােস্ট, কলা অনুষদের ডীন ছিলাম । এছাড়া লাইব্রেরীয়ান না থাকায় ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরীর দায়িত্বও আমার উপর
৪৪
কিছুদিন ছিল। এসব কারণের জন্য আমি ছাত্রদের ক্রিয়াকর্মের সাথে বেশ ভালােভাবেই জড়িয়ে পড়েছিলাম। সে সময়কার বেশ কয়েকটি ঘটনা আমার মনে আছে। একবারের ঘটনা বলছি। সবে বাইরে থেকে ঘরে ফিরেছি। দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকে (শীতকাল ছিল) লম্বা কোট পরা কয়েকজন লােক দাঁড়িয়ে আছে গাছের নিচে। গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম তারা কারা। আমাকে তারা বললাে যে তারা সরকারের পক্ষ থেকে এসেছে। তাদের মধ্যে কিছু সামরিক বাহিনীর লােক আছে, পুলিশের লােকও আছে। ভেতরে গেলাম। বাসায় গিয়ে দেখি যে ওখানে একজন এস. পি. বসে আছেন। সাথে আরাে কয়েকজন সরকারী কর্মচারী। তারা বসে আছেন আমার জন্য। তারা কিছু ছাত্রকে গ্রেফতার করেছেন বিভিন্ন হল থেকে। তারা জিন্নাহ হলে ঢুকতে পারেননি, কারণ ছাত্ররা বাধা দিয়েছে এবং বলেছে যে ভেতরে ঢুকে তাদের গ্রেফতার করতে হলে তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হবে যা কপালে থাকে। আমি তাদেরকে বুঝিয়ে বললাম যে ছাত্রদের গ্রেফতার করতে আসার অনুমতি নিতে হবে কেন ? আমার অনুমতি নিয়ে তাে তাদের গ্রেফতার করতে আসা হয়নি। সুতরাং আমাকে কেন জড়ানাে হচ্ছে ? তাঁরা বললেন, ‘আপনার ছাত্ররা যদি বাধা দেয় তাহলে আমাদের গােলাগুলি করতে হতে পারে। ছাত্ররা মারা যাবে। এটা আমরা চাই না।’
ওরা আমার মানসিকতা জানতাে। আপনিও বাঙালি আমরাও বাঙালি, আপনাকে বলছি যে এদের গ্রেফতার করতে হবে-নাম যা আছে। আর যদি না দেন তাহলে আমাদের শেষ পর্যন্ত হয়তাে জোর করেই করতে হবে। রাত চারটা পর্যন্ত এদের সাথে তর্কবিতর্ক হলাে। আমি খবর নিয়ে জানলাম যে অন্যান্য হল থেকে গ্রেফতার করা হয়ে গেছে। আমি ভাইস চ্যান্সেলর ড: মমতাজউদ্দীন আহমেদ-কে ফোন করলাম। তার ফোন এনগেজড পেলাম। এরা বলল, তাঁর ফোন পাবেন না, তাঁর ফোন উঠিয়ে রেখেছে। তখন রাত চারটা। হাউজ টিউটর যারা ছিলেন তাদের কথা আজও মনে করি। যেমন আমার মনে আছে মুস্তাফা নূরউল ইসলামের কথা। তিনি বাংলার অধ্যাপক। এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন। আরাে বেশ কয়েকজনকে নিয়ে কথা বলছিলাম ওদের সাথে। একই সাথে ঠিক করলাম যে তাদের ডেকে পাঠাব—যাদের গ্রেফতার করতে চান।
সবকিছু ভেবে তাদের নাম করে ডেকে পাঠালাম। ওরা এলাে। ওদের আমি বললাম তােমাদের গ্রেফতার করতে চাচ্ছে, তােমরা পুলিশের সাথে চলে যাও। আমি তােমাদের ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করবাে। জামিন আমিই হবাে। তবে আজকে যদি জোর করে হলে ঢােকে তাহলে সংঘর্ষ হবে, তাতে হয়তাে কেউ আহত হতে পারে। ওরা গেল সব। কোনরকম আপত্তি করলাে না। ওরা পুলিশের গাড়িতে উঠে চলে গেল। তারপর আমি হলে গেলাম, রাত তখন সাড়ে চারটা। ছাত্রদের এড্রেস করলাম। ওদের কি অপরাধ আমি জানি না—তবে আমাকে দিয়ে যদি সম্ভব হয় আমি জামিনে ওদের ছাড়িয়ে নিয়ে আসবাে। আর যদি না পারি
৪৫
তাহলে আমার নিজের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাবাে। আমি ইমােশনালী আপসেট হয়ে চলে এলাম। পরের দিন ভােরবেলা। আমার মনে আছে ড: মাে. এনামুল হক প্রভােস্ট ছিলেন, ড: এম. টি. হক আর এক হলের প্রভােস্ট ছিলেন—তাঁদের খবর দিলাম যে, আমি যাচ্ছি কোর্টে, ভাইস চ্যান্সেলর-এর সাথে দেখা করে। আমাদের ছাত্রদের ধরে নিয়ে গিয়েছে। আপনাদের ছাত্রদেরও নিয়ে গেছে। ছাড়িয়ে নিয়ে আসি। লক্ষ্য করলাম তাদের এতে খুব উৎসাহ নেই। তবে ড: এনামুল হক উৎসাহিত হলেন। তাকে নিয়ে ভাইস চ্যান্সেলরের অফিসে গেলাম।
ড: মমতাজউদ্দিন আহমেদ আমাকে বললেন, এতে হাত লাগাবেন না—এতে জড়িয়ে পড়বেন না- জড়িয়ে পড়লে অসুবিধা হবে আপনারই।’ আমি তাকে বললাম, ইন দ্যাট কেইস, আপনি না জড়িয়ে পড়লেও আমার কিন্তু দায়িত্ব আছে প্রভােস্ট হিসেবে। আমি তাদের অভিভাবক। আমাকে যেতে হবে। আমি গেলাম। অন্তত দশবার ঢাকার সাথে টেলিফোনে কথা বলে শেষ পর্যন্ত বিকেল চারটা-সাড়ে চারটার সময় রাজি করলাম। বন্ড সই করলাম আমি সবার পক্ষ থেকে। তারপর সবাইকে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে হলে ফিরে এলাম। হলে এসে দেখি বহু ছেলে জমা হয়ে আছে। তাদের সামনে দিয়ে সবাইকে নিয়ে আসা হলাে এবং এর মধ্যে আমার যতদূর মনে পড়ে তাদের মধ্যে ছিল সরদার আমজাদ হােসেন, যিনি এরশাদের আমলে খাদ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। তখন অনেক কান্নাকাটি হলাে। আমি ওদের বললাম ‘তােমরা ফিরে এসেছাে ভাল, আমি রিস্ক নিয়েছি’ এর জন্য, সুতরাং যখন কেইস উঠবে তােমরা হারিয়ে যেও না-হারিয়ে গেলে আমার পক্ষে নিজেকে রক্ষা করা খুব ডিফিকাল্ট হবে। ওরা রইলাে। কেইস হলাে। শেষ পর্যন্ত ওরা নির্দোষ প্রমাণিত হলাে।
আর একটা ঘটনা আরাে বেশি করে মনে পড়ে। নানা জায়গায় বিভিন্ন সভা হচ্ছে, আইয়ুববিরােধী সভা। এটা ক্যাম্পাস-এর ভেতরে। আমার হলে হচ্ছে, বাইরেও হচ্ছে। কিছু ছাত্রকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলাে। তারপর এদের উদ্ধার করা, পুলিশ হেফাজত থেকে বের করে আনার জন্য আমি আবার গেলাম কোর্টে। জেলখানায় গেলাম। ওখানে গিয়েও সরকারী লােকের সাথে কথাবার্তা বলে, ঢাকাতে টেলিফোনে যােগাযােগ করে—ওদের আমি আবার জামিন হয়ে নিয়ে আসি। ওদের বিরুদ্ধে তখনাে কোনাে চার্জ ফ্রেম হয়নি—বিশেষ আইনে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। সরকারবিরােধী; দেশবিরােধী-ইত্যাদি চার্জ ছিলাে। আমার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব ছিল পুলিশে এবং সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে। তাঁদের আমি জিজ্ঞেস করলাম যে, কোন্ রিপাের্টের ভিত্তিতে তারা ছাত্রদের মাঝে মাঝে ধরে নিয়ে আসে ? অনেক পিড়াপীড়ি করার পর তাঁরা বললাে যে, আমরা রিপাের্ট সংগ্রহ করি ছাত্র, শিক্ষক এবং কর্মকর্তাদের মারফৎ। সেই রিপাের্ট মােতাবেক ওদের গ্রেফতার করি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে কি তাদের নাম বলতে পারেন ? ওরা জানালাে বলতে পারি কিন্তু এসব বাইরে বলতে পারবেন না।’ বললাম, ঠিক
৪৬
আছে। ওরা আমাকে কয়েকজন ছাত্রের নাম বললাে। একজন ছাত্রের নাম বললাে, যে আমার ডিপার্টমেন্টে পড়াশুনা করতাে, বােধ হয় অনার্স সেকেন্ড ইয়ার-এর ছাত্র ছিল। নাম মনে আছে। তবেএ মুহূর্তে নামটা আমি উল্লেখ করছি না। ঐ ছেলেটিকে বিভিন্ন মিটিং-এ সভাপতিত্ব করতেও দেখেছি। সেই ছেলেই এদের কাছে রিপাের্ট করতাে। আমার মনটা ভেঙে গেল। কারণ এই ছেলে সম্বন্ধে আমার ভাল ধারণা ছিল। সে বামপন্থী রাজনীতি করে এবং আমার বাসায় যাতায়াত করে, খাওয়া দাওয়া করে। তাকে প্রােগ্রেসিভ একজন ছাত্র ভাবতাম। সে যে মিটিং-এ সভাপতিত্ব করে, আবার যারা বক্তব্য রাখে তাদের বিরুদ্ধে রিপাের্ট করে এ আমি প্রথম শুনলাম। একজন কর্মকর্তার নামও শুনলাম।-বুদ্ধিজীবীরাও আছেন। কর্মকর্তাটির নামও বললাে। তাকেও অনেক সহায়তা করেছি। আমার মন ভেঙে গেল। একটা উত্তেজনা আমার মধ্যে ছিল—আমি বাসায় ফিরেই অফিসে গেলাম। প্রভােস্ট অফিসে এসে (সে হলে বাস করতাে) ঐ ছেলেটিকে ডাকালাম। এদিকে ছাত্ররা দেখেছে যে আমি অসময়ে উত্তেজিতভাবে অফিসে গেলাম। বহু ছেলে। এদিকে ওদিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলেটাকে ঘরে এনে-দরজা বন্ধ করে আমি তার সামনে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়ে আমি আগে তাকে একটা চড় মারলাম। আমি বললাম তুমি এত বড় বেঈমান! বামপন্থী রাজনীতি করাে। তুমি ছাত্রদের বিরুদ্ধে রিপাের্ট করাে, তার জন্য তুমি পয়সা পাও। আমার অনুমান যে তুমি পয়সা পাও। আমি কোথায় বলেছি, স্যার ?’ আমি আর এক চড় মারলাম। এখানে আর কেউ নেই। বেশি কথা বললে তােমাকে আমি মেরে ফেলবাে। তােমার চেয়ে গায়ে আমার শক্তি বেশি আছে। ছাত্রদের সঙ্গে বেঈমানী করাে কেন ? তুমি একটা বিষয়ে সরকারকে সাপাের্ট করাে আমার কোনাে আপত্তি নেই। যে কোনাে ধর্ম, যে কোনাে রাজনীতি তুমি করাে কিছু বলবাে না, কিন্ত তুমি উস্কিয়ে দিয়ে সভাপতিত্ব করে ধরা পড়বে না, আর যারা বক্তব্য দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে তুমি অনেক রকম খবরাখবর দিয়ে দাও। খবর পেয়ে তারা ওদের ধরে নিয়ে যায়। আজ ওদের ছাড়িয়ে নিয়ে আসলাম। এর জন্য তােমার অপরাধ অত্যন্ত বেশি। এত বড় নেমকহারামী কেন করাে ?
ছেলেটি চুপ করে রইল। আমার কাছে মাফ চাইলাে। আমার পায়ে ধরলাে। আমি বললাম, আমি তােমাকে ছেড়ে দিচ্ছি, কিন্তু জীবনে এরকম কাজ আর কখনও করবে না। আর একটা কথা বলি—তােমাকে আমি হলে রাখবাে না। হল ছাড়তে হবে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, স্যার তােমাকে পছন্দ করেননি। তুমি রুমে গিয়ে রেডি হয়ে নাও তােমাকে আধ ঘন্টার মধ্যে হল থেকে বের করে দেব। বাইরে থাক, বিভাগ থেকেও তােমাকে বের করতে পারতাম। তােমার এত ক্ষতি করতে চাই না। তুমি ঠিক হয়ে চলাে। তুমি অঙ্গীকার করলে আমার সাথে যে জীবনে এরকম বেঈমানী কাজ আর করবে না। আমি এটা ধরে নিলাম যে তুমি এই অঙ্গীকার রক্ষা করবে। আমি তাকে আধ ঘন্টা সময় দিলাম। রেডি হয়ে গেল । আমি জীপ আনালাম ইউনিভার্সিটি থেকে। সােজা রেল স্টেশনে পাঠিয়ে দিলাম ।
৪৭
বললাম, বাড়ি চলে যাও। বাড়ি থেকে তুমি এ বছর পরীক্ষা দেবে। বাইরে থাকবে, হলে থাকবে না। তােমার আচরণ আমি লক্ষ্য করবাে।’ ছেলেটি চলে। গেলাে। অন্যান্য ছেলেরা আমাকে ধরলাে। সবাই জানতে চাইলাে, ‘ওকে কেন বের করে দেয়া হলাে। আমি বললাম, “সেটা তােমাদের সাথে আমি আলােচনা করবাে না। আমি যা ভালাে মনে করেছি তাই করেছি। এটা ওর পক্ষে যেমন ভালাে সবার পক্ষে ভালাে। আমি জানতেই দিলাম না যে, আসল ঘটনা কি ঘটেছে। শুধু দু’একজন সহকর্মীকে বললাম যে কি কান্ড সে করেছে। পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালে দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে তখন সরকারী উদ্যোগে যে ইলেকশন হয়, সে সময় সেই ছেলেটি সরকারী দল থেকে দাড়িয়েছিল।
আর একটা ঘটনা মনে পড়ে। একবার জিন্নাহ হলে কোনাে এক গােয়েন্দা বিভাগের অফিসার ফকিরের ছদ্মবেশে হলে ঢুকেছিল এবং হলের প্রাঙ্গণে রাতের বেলায় থাকতাে। জানতে পারলাম ছাত্ররা তাকে মারধর করেছে। মারধর করার মধ্যে শাহজাহান কবীর বলে ফাস্ট ক্লাশ পাওয়া কেমিস্ট্রিতে একজন ছাত্র ছিল । পাগল বেশে যে ছিল তার কমপ্লেনে পুলিশ আসলাে, ছাত্রদের ধরে নিয়ে যেতে। তাদের আমি সরিয়ে দিলাম। ঐ ফকির ব্যক্তিটি যে ছদ্মবেশধারী আইবি-এর লােক। ছিল তা কনফার্ম হলাম, পুলিশ আসার পরপরই। সুতরাং এই ছেলেদের বাঁচাবার জন্য ওদেরকে সরিয়ে দেওয়া হলাে। ওদের কেইসটা উইথড্র করানাে হলাে। এই শাহজাহান কবীর পরবর্তীকালে রাজশাহী ইউনিভার্সিটির লেকচারার হয়ে ঢােকে।
কনভােকেশন হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসাবে প্রাদেশিক গবর্নর। মােনেম খান আসবেন। দেখা গেল যে ছাত্ররা কনভােকেশন করতে চায় না। ইউনিভার্সিটিতে এটা প্রথম কনভােকেশন। সুতরাং অনুষ্ঠানে বাধা দেওয়া ঠিক। নয়। তাছাড়া অনেকেই ডিগ্রীটা সম্মানের সাথে প্রকাশ্যে নিতে চায়। ছাত্রদের বােঝালাম ‘তােমরা যতই বিরােধিতা করাে, চ্যান্সেলর যখন গভর্নরই থাকবে স্বভাবতই তাঁকে অনুষ্ঠানে আসতেই হবে, এটা স্বাভাবিকভাবে নিলেই ভালাে হয়। তােমরা শ্লোগান দাও বা যা কিছু করাে, ইন্টারফেয়ার করাে না। তাই হলাে। ছেলেরা আমার কথা রাখলাে। মনে আছে অনুষ্ঠানের সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে। গেছে। সর্বশেষ সভায় বলা হলাে তারা অনুমান করছে যে কিছু ছেলে যারা রাজনীতি করতাে আগে-এখন তারা শিক্ষক; তাদের মধ্য থেকে কেউ হয়তাে দল পাকিয়ে কনভােকেশন প্যান্ডেলের মধ্যে একটা গন্ডগােল সৃষ্টি করতে পারে। আমরা দায়িত্ব নিলাম, বিশেষ করে আমি নিলাম । আমি বললাম, ওরা শ্লোগান দিতে পারে, আপনারা কেউ বাধা দেবেন না। কনভােকেশনটা হয়ে যাক। তারপর কনভােকেশন করার ব্যবস্থা হলাে। এদিকে আমার ভয় হলাে- যারা পুলিশের দৃষ্টিতে আগেই আছে—এখন কনভােকেশনের সময় তাদের ধরতে পারে। শাহজাহান কবীরকে ডেকে বললাম যে, তুমি কনভােকেশনের সময় তােমার দেশে চলে যাও। যশাের না কুষ্টিয়ায় তার বাড়ি ছিল। সে চলে গেল। আরাে দুজনকে বললাম যে তােমাদের নামে পুলিশের রিপাের্ট আছে- যদি কিছু নাও করাে
৪৮
তাহলেও আমাদের মধ্য থেকে কেউ পুলিশের কাছে রিপাের্ট করতে পারে। আমার কথামতাে তারাও চলে গেল। কনভােকেশন কার্ড ওদের দেওয়া হয়নি—বা ওরা নেয়নি। কনভােকেশনের সকল আয়ােজন সম্পন্ন। কিন্তু আগের দিন রাত্রে প্যান্ডেল পােড়াতে গিয়েছে ছেলেরা। আমাকে আবার যেতে হলাে। অনেক বুঝিয়ে তাদেরকে বললাম, ‘প্রথম কনভােকেশন, এটা হতে দাও।’ কনভােকেশন হওয়া ঠিক হলাে। ওরাও কথা দিলাে আর কিছু করবে না। কনভােকেশন যখন হচ্ছে। তখন ‘গাে ব্যাক মােনেম খান’ দু’বার আওয়াজ শুনলাম। আমরা প্যান্ডেলের ভেতরেই ছিলাম। আমি ঠিক খেয়াল করতে পারিনি—আমার ডানে মনে হয় আওয়াজটা হলাে। কনভােকেশন হয়ে গেল। এর পরে কথা উঠলাে যে, কারা করলাে এটা ? পুলিশ কমিশনার তখন আবার মিটিং ডাকলেন। আমরা গেলাম। যাওয়ার পরে পুলিশ কর্তৃপক্ষ আমাকে বললেন, আপনারা তাে বলেছিলেন কিছুই হবে না, কিন্তু কিছু তাে হলাে। আমি বললাম, “যে সব ছাত্র ডিগ্রী নিতে এসেছে। তাদের মধ্যে যদি কেউ বলে থাকে তাহলে আমাদের পক্ষে কিছু করা অসুবিধা । তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনাে শিক্ষক করেননি, এটা আমার ধারণা। কোনাে ছাত্র ডিগ্রী নিতে এসেছে, সে হয়তাে করেছে। তার উপর কোনাে কর্তৃত্ব আমাদের নেই। পুলিশ কমিশনার বললেন, না, আমাদের কাছে রিপাের্ট আছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এর মধ্যে আছে। আমি বললাম, নাম বলেন। নাম বললেন, ‘শাহজাহান কবীর—যাকে আপনি একবার পুলিশের হাত থেকে। বাঁচিয়েছেন—সে শিক্ষক। সে-ই শ্লোগান দিয়েছে। আমি বলে বসলাম, ইমপসিবল। সে থাকতে পারে না।’ তিনি বললেন, “আমাদের রিপাের্ট আছেপুলিশ রিপাের্ট এবং ইউনিভার্সিটিতে আমাদের যারা রিপাের্টার তাদের রিপাের্টেও আছে যে সে ছিল। সে-ই শ্লোগান দিয়েছে। আমি তখন বললাম, তার তাে প্রসেশনে থাকার কথা। শ্লোগান তাে হলাে প্যান্ডেলের ডান দিক থেকে। তিনি | বিশ্বাস করলেন যে আমাদের রিপাের্ট কোলাবােরেটেড হয়েছে। আমি তখন। বললাম, একথা যদি সত্যিই হয় যে শাহজাহান কবীর শ্লোগান দিয়েছে, তাহলে আপনাকে বলে যাচ্ছি, আই উইল রিজাইন ফ্রম মাই জবস্ ইন রাজশাহী এ্যান্ড লিভ । ফর গুড। আমি এই সন্দেহই করেছিলাম। এক সময় আমাকে বলা হয়েছিলাে যে, যারা রিপাের্ট করে তাদের মধ্যে ছাত্র ছিল, শিক্ষক ছিল, কর্মকর্তাও ছিল। এর পর থেকে আমরা সাবধান হয়ে গেছি। যে কোনাে ঘটনা ঘটলেই ওরা হয়তাে। আপনাদের কাছ থেকে অর্থ পেয়ে সত্য-মিথ্যা খবর দেয়। হয়তাে সন্দেহ করে নাম বলে। আমি শাহজাহান কবীরকে আগেই ক্যাম্পাসের বাইরে থাকতে বলেছিলাম। চ্যালেঞ্জ দিয়ে আমি চলে এলাম। ফিরে এসে প্রথম আমি গেলাম রেজিস্ট্রার অফিসে। জিজ্ঞেস করলাম, শাহজাহান কবীর গাউন নিয়েছে কিনা। ‘না’ সূচক জবাব পেয়ে গেলাম ড: কাজী আব্দুল লতিফ-এর কাছে (হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট অফ কেমিস্ট্রি)। তাঁকে বললাম, শাহজাহান কবীর কোথায় ? তিনি বললেন। শাহজাহান কবীরতাে বাড়ি চলে গেছে। আমি বললাম, এপ্লিকেশন আছে?
৪৯
বললেন, হ্যা। দরখাস্তটা নিলাম। তাড়াহুড়াে করে কনভােকেশনের দাওয়াতের কার্ডটি ডিপার্টমেন্টে দেওয়া হয়েছে। তিনি দাওয়াতের কার্ডটি বের করে দিলেন। আমি কার্ড এবং ছুটির দরখাস্তটি নিয়ে গেলাম। এদিকে আমি কমিশনারকে বলেছিলাম যে তিনি যেন যশােরের এস. পি-কে বলেন যে, শাহজাহান কবীর ঐ দিন তার বাড়িতে অথবা শহরে ছিল কিনা। খবর নিয়ে জানা গেল যে শাহজাহান কবীর ঐ দিন পুলিশ ক্লাবে এসে তাস খেলেছে। কমিশনার সাহেব আমার কাছে মাফ চাইলেন। সেদিন রাত্রে তাঁকে ছুটির দরখাস্তও দেখালাম। আমি অভিযােগকারীর নাম জানতে চাইলাম। তিনি অপরাগতা প্রকাশ করলেন। আমি পেছনে লেগে রইলাম। পরবর্তীকালে নাম জেনেছিলাম। এ হলাে একদিক। আর একদিক ছিলাে যারা আমার মতই ছাত্র ছাত্রীদের জন্য ঝুঁকি নিয়েছেন। ঝুঁকি নিয়েছেন এরকম ব্যক্তি ক্যাম্পাসে অনেকেই ছিলেন। যারা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব এবং তারা যে কোনাে ব্যাপারেই আমার সঙ্গে ঝুঁকি নিতেন। এদের মধ্যে ড: সালাহউদ্দীন আহমদ, ড: ফজলুল হালিম চৌধুরী, ড: মােশাররফ হােসেন, ড: রকিব, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম প্রমুখ ছিলেন। সব ছাত্র এবং আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ভাল ছিলাে। পরস্পরের প্রতি আস্থা ছিলাে। এই অবস্থার কারণেই অনেক ঝুঁকি নেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভবপর হয়েছিল।
১৯৬৫ সালের শেষের দিকে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বলা যায় প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিযুক্তি পেয়েছিলাম।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক উপাচার্য হিসাবে নয়—প্রথম আমি প্রােজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে যােগদান করেছিলাম। এই দায়িত্ব যিনি আমাকে প্রদান করেন। তিনি ছিলেন প্রাদেশিক সরকার প্রধান এবং বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সলর মরহুম আবদুল মােনায়েম খান। তার সাথে আমার কোনাে পরিচয়ই ছিল না। তিনিও আমাকে চিনতেন না। ভাইস চ্যান্সেলর হবার কোনাে আকাঙ্খও আমার ছিল না। আমি তখন বিদেশে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের পদে দু’বছরের চুক্তিতে যােগ দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। জনশূন্য পাহাড়ী অঞ্চলে প্রয়ােজনীয় দালানকোঠা নির্মাণ ও শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দায়িত্ব। গ্রহণ করার জন্য তিনি আমাকে প্রস্তাব করেন। তার প্রস্তাব আমি তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করি। আমাকে এই প্রস্তাব দেওয়ার আগে তিনি আমাকে ঢাকায় ডেকে পাঠান। আমি ঢাকায় এসে অনেককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। শিক্ষা সচিবও আমাকে কিছু বলতে পারলেন না কেন ডাকা হয়েছে। তখন শামীম আহসান ছিলেন গভর্নরের প্রাইভেট সেক্রেটারী । সি. এস. পি. এই অফিসারের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিলাে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম। সেও বলতে পারলাে না। তারপর যখন গভর্নরের সাথে আমার দেখা হলাে, গভর্নর আমাকে ধর্ম সম্বন্ধে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন। এক সময় আমাকে বললেন,
৫০
আপনার সাথে আমার গুরুতর আলােচনা আছে। আপনি আজকে বিকালে সাড়ে তিনটার সময় আসেন। আমার মন খারাপ হয়ে গেল। তিনি আমাকে রাজশাহী থেকে ডেকে এনে তারপর প্রথম সাক্ষাৎ হওয়ার পরে দু’এক কথা বলে, চা খাইয়ে। বিদায় করে দিয়ে বললেন সাড়ে তিনটার সময় যেতে হবে। আমি এসে এডুকেশন সেক্রেটারী সাহেবকে আবার ফোন করলাম। এ কোন ধরনের ভদ্রতা ? আমাকে কেন ডেকেছেন ?
তিনি বললেন, সাড়ে তিনটার সময় যখন যেতে বলেছেন আপনি যান। খুব নাকি জরুরী ব্যাপার। কিছু একটা আছে। সাড়ে তিনটায় আমি আবার গেলাম। এবার তিনি আমাকে লনে নিয়ে বসালেন, গাছের নিচে, ওখানে আর কেউ নেই। তিনি আমাকে অনেক কথার পরে বললেন, যে বিল্ডিংটা গভর্নর হাউজের এটাতে বেশ ইসলামিক আরকিটেকচার আছে। তিনি ঠিক যে কি মিন করলেন জানতে চাইলাম। আমাকে গম্বুজ দেখালেন; এই বিষয়ে অনেকক্ষণ আলাপ-আলােচনাও করলাম। আমার যা জ্ঞান আছে, আমি যা বুঝি তাই বললাম।
তারপরে হঠাৎ করেই তিনি বললেন, নামাজ পড়ে আসেন। বললাম, ‘স্যার আমি তাে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি না। সুতরাং আমি বসে থাকতে পারি। আমি বসে রইলাম। তিনি নামাজ পড়তে গেলেন। নামাজ পড়ে এসে আবার বসলেন। আবার চা খাওয়া হলাে। তারপর আমাকে বললেন, আপনাকে একটা দায়িত্ব আমি দিতে চাই। কি দায়িত্ব ? তিনি বললেন, আপনি একটা বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে সাহায্য করবেন।’ বললাম, কোথায় ? তিনি বললেন, চট্টগ্রাম।
আমি আগেই শুনেছিলাম বিদেশে থাকাকালীন সময়ে যে ওখানে একটা বিশ্ববিদ্যালয় হতে যাচ্ছে। কিন্তু কোথায় আমি জানতাম না। আমি বললাম, এটা কোথায় করা হচ্ছে ?” শহরের বাইরে। পাহাড়ী জায়গায়। হাটহাজারীর দিকে। আপনি আমাকে এ দায়িত্ব দিচ্ছেন কেন ?” তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন যে, আপনাকে আমি চিনতাম না, সুতরাং আমি আপনার প্রতি বায়াস হয়ে দায়িত্বটা দিচ্ছি তা ঠিক নয়। আপনার সম্বন্ধে সবাই বলছে, আপনার শত্রু-মিত্র সবাই, সাত-আট মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে গেলে আপনার মত লােকের প্রয়ােজন। আমি এ দেশের লােক। ইস্ট পাকিস্তানে একটা বিশ্ববিদ্যালয় আমি করবাে এবং সেটা করবাে ইসলামাবাদের ইউনিভার্সিটির মতাে। বড় আকারের বিশ্ববিদ্যালয়, সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের টাকায় হবে। সেখানে ভালাে একজন ভাইস চ্যান্সেলর প্রয়ােজন।’
আমি তাকে বললাম, “সে রকম লােক আপনি পাবেন। আমার এ ব্যাপারে খুব একটা ইচ্ছা নেই।’
‘কেন ?
‘দুই কারণে।’ বলে ফেললাম, ‘প্রথমত আমার দুর্নাম আছে যে আমি সরকারকে পছন্দ করি না। আমার সম্বন্ধে এনকোয়ারী দু’একবার হয়েছে। এবং দ্বিতীয়ত আমি মুসলিম লীগ পছন্দ করি না—এ দুর্নামও আমার আছে। আপনি
৫১
মুসলিম লীগ করেন। সরকার সমর্থক আপনি। আপনি গভর্নর। আপনার সাথে একটা বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে যাবাে-আপনার সাথে তাে প্রায়ই লেগে যাবে নানা ব্যাপারে। ভুল বুঝাবুঝি হবে। পূর্ব পাকিস্তানে একটা বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া দরকার সেটা আপনি করুন আমি খুব খুশি হবাে। সমর্থন যতটুকু পারি দেব। কিন্তু আমি দায়িত্ব গ্রহণ করবাে না। কারণ এটা করলেই আমাদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি হবে। এবং আমি কাজে বাধা পেলে একদিনও ওখানে থাকবাে না। সুতরাং আপনি স্যার দয়া করে আমাকে মাফ করে দেন। আর কাউকে দেন। তাঁর সামনে টেবিলের উপর একটা ফাইল ছিল। ওটা দেখিয়ে গভর্নর বললেন, আপনি আপনার ইচ্ছেমত বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার জন্য যা করা প্রয়ােজন আমার বুদ্ধি-বিবেচনায় মনে হয় আমি তাই করবাে। ওখানে আপনি চ্যান্সেলর হিসাবে আমাকে যদি বাধা দেন , তাহলে আমার আপত্তি আছে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক কারণে কাউকে চাকরি দেওয়া বা চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়া এগুলাে আমি করবাে না।’ তিনি রাজি হয়ে গেলেন। আর তৃতীয়ত, আমি বললাম, “যে মুহূর্তে আমার ভালাে লাগবে না বা মনে হবে পরিবেশ আর ভালাে লাগছে না ‘সেই মুহূর্তে যদি আমি চাকরি ছাড়তে চাই ছেড়ে দেবাে।’ তিনি আমার সব শর্তেই রাজি হলেন ।আমাকে বললেন যে, আপনাকে কিন্তু অডিন্যান্স ড্রাফট করতে হবে। সে পর্যন্ত আপনি প্রজেক্ট ডাইরেক্টর হিসাবে আমার অধীনে কাজ করবেন। যত তাড়াতাড়ি করতে পারেন অর্ডিন্যান্স করে নিয়ে আসলে আপনাকে ভাইস চ্যান্সেলর করা হবে। অর্ডিন্যান্স ছাড়া তাে ভাইস চ্যান্সেলর করতে পারছি না। আমি তখন বললাম, “ঠিক আছে অর্ডিন্যান্স করবাে। তাঁকে বললাম ইউনিভার্সিটি গড়তে আমাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। এগুলি ছাড়াও সিলেবাস কমিটি করে সিলেবাস ঠিক করতে হবে, লাইব্রেরী ঠিক করতে হবে, বিল্ডিং তৈরী করতে হবে। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আমি আবার বলছি, আমার কোনাে ধরনের কাজে আপনি কোনাে বাধা সৃষ্টি করতে পারবেন না। আমার যাকে প্রয়ােজন যেখানে আমি রিকমেন্ড করবাে তাকে সেখানেই এপয়েন্টমেন্ট দিতে হবে।’ তিনি রাজি হয়ে গেলেন। গভর্নর বললেন, আপনাকে আমি সেন্টার গভর্নমেন্টের কাছ থেকে টাকা যােগাড় করে দেবাে, সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট থেকে।
ঢাকাতে আসলে আমি সবসময়ই আমার প্রায় সমবয়সী মামা আবদুল মান্নান খান (বিরুমামা)-এর বাসায় উঠতাম। তার সাথে পরামর্শ করে গভর্নরের প্রস্তাবে রাজি হবাে বলে মনস্থির করলাম।
এখন বলছি, মূলত এজন্যই এ কাজে আমি অনেকটা আকৃষ্ট হয়েছি যে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট পূর্ব পাকিস্তানকে ঠকাচ্ছে এবং আমরা পাকিস্তান সৃষ্টি করে মনে হয় তেমন কোনাে উপকার পাইনি। আমরা ঠকেছি, ঠকছি এবং আরাে ঠকবাে। একথা ভেবে বললাম, সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের কাছ থেকে যদি আপনি কোনাে টাকাপয়সা আনতে পারেন আমি খুশি হবাে এবং একথা বলাতেই আমি কিছুটা রাজি হয়েছি। আচ্ছা দেখি পারি কিনা।’ তিনি আমাকে বলে বসলেন, আপনাকে কিন্তু
৫২
আট-নয় মাসের মধ্যে সব কাজ শেষ করতে হবে।’ আমি তখন বললাম, পাহাড়ে। কাজ করতে গেলে বেশ অসুবিধা হবে। টেম্পােরারী বিল্ডিং-এর ব্যবস্থা করতে হবে।’ তিনি বললেন, আপনি যা ভালাে বােঝেন তাই করবেন। আমি কোনাে বাধা দেব না। কিন্তু আমি আমার প্রেসিডেন্টকে কথা দিয়েছি যে, আমি আট-নয় মাসের মধ্যে ইউনিভারসিটি শুরু করে দেবাে। প্রেসিডেন্ট ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে এসেছেন। কিন্তু এক-দেড় বছর হয়ে গেল, কোনাে খবর নেই। যেখানে তিনি ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে এসেছেন সেখানেই ইউনিভার্সিটি হবে। জায়গাটা আপনি দেখে আসবেন।” “ঠিক আছে, যাবাে।’ এমন কথাবার্তার পর আমি চলে এলাম। ফিরে এসে রাতে এডুকেশন সেক্রেটারীকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, আগামীকাল এগারােটার সময় যেতে বলেছেন। এই আমি প্রথম জানলাম। আমি অনুমান করেছিলাম। আমি জানলাম ওখানে প্রজেক্ট ডাইরেক্টর করে পাঠানাে হচ্ছে। সেক্রেটারী জানালে । আপনার সাথে কথাবার্তা বলে গভর্নর সাহেব বলেছেন যে, ‘আমি ফ্র্যাংক লােক পছন্দ করি। ঠিক আছে আগামীকাল ১১টায় আসবেন। ঠিক এগারটার সময় গেলাম। তারপর আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলাে। আমাকে বলা হলাে, আপনাকে আগামীকালই চট্টগ্রাম যেতে হবে। জায়গাটা দেখে আসেন। আমি বললাম, ঠিক আছে। এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার থাক, আমি এখনই জয়েন। করছি না। আমি আগে দেখে আসি জায়াগটা কেমন, আমি পারবাে কিনা।’ তিনি বললেন, আমি আর উল্টোবাে না। আপনি এপয়েন্টমেন্ট লেটার নেন। জয়েন করেন, না করেন পরে রিপাের্ট দেবেন। আপনি আগামীকাল যান।’
পরের দিন ভােরবেলা আমি প্লেনে করে চট্টগ্রাম গেলাম। চট্টগ্রামে তখন ডি. সি., এ. ডি. সি. সব আমার পরিচিত। সিডিএ চেয়ারম্যান ছিলেন আমার ঘনিষ্ঠ। আমি পৌছেই ক্যাম্পাসে চলে গেলাম। শামসুর রহমান খান সাহেবের বাড়িতে উঠলাম। ড: ফজলুল হালিম চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হলাে। স্থানটি শহর থেকে দূরে, মেইন রােড থেকে ভেতরে তিন-চার মাইল গ্রাম ভেদ করে মাঠের মধ্যে যেতে হয়। পানি-কাদা আর পাহাড়ী অঞ্চল। জনগােষ্ঠী কিছু নেই। আমার মনে আছে। ফজলুল হালিম চৌধুরী সাহেব বলে বসলেন যে, ‘স্যার, আপনি দায়িত্ব নেবেন না। এ দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব। রাস্তা-ঘাট কিছু নেই। ইট-কাঠ কোথা দিয়ে আসবে? কোথায় বিল্ডিং করবেন ? কিছুই নেই। আপনি সােজা না করে দেন। আপনার বদনাম হবে। পারবেন না। কিন্তু শামসুর রহমান খান বললেন, তিনি কিন্তু আমাদের মতের লােক। আমরা চাই আমাদের মতাবলম্বী লােক, যারা একই মত পােষণ করেন সেরকম একজন ব্যক্তি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে থাকুক। আমি চাই তিনি দায়িত্ব নিন। আমরা সাহায্য করবাে। এরকম আদর্শবান একজন মানুষ যদি ভাইস-চ্যান্সেলর হন তাহলে আমাদের খুব ভালাে হবে। একটা বিশ্ববিদ্যালয় আমরা গড়ি না কেন ? আমি সর্বাত্মক সমর্থন দেবাে সিডিএ’র পক্ষ থেকে। যা তিনি চাইবেন দেওয়া হবে।’ নূরুল কাদের খান (এ. ডি. সি এবং আমার শ্যালক) বললেন, ‘আমরা সরকারী তরফ থেকে সবরকম সাহায্য করবাে।
৫৩
আপনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এসব মিলে আমি দায়িত্ব নেওয়ার ব্যাপারে রাতে অনেক চিন্তা-ভাবনা করলাম। আবু রুশদ মতিনউদ্দিন তখন ছিলেন গভর্নমেন্ট কলেজের প্রিন্সিপাল। তার ওখানে রাতে রইলাম। তিনিও দায়িত্ব নেবার কথা বললেন। একটা ইউনিভার্সিটি আমাদের পছন্দমত হােক।
শেষ পর্যন্ত আমি দায়িত্ব নিলাম। প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার কাজে হাত দিলাম। প্রচন্ড পরিশ্রমের কাজ ছিল। আমি ভাবছিলাম রাস্তা তৈরি করা, সার্ভে করানাে, মাটির নিচে কি আছে তার খবর নেওয়া, মাটি লুজ কিনা সে সম্বন্ধে ধারণা রাখা, তারপর কোথায় কি করবাে ? এসব ভেবে আমি শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম যে প্রথমে স্কুল বিল্ডিং করি। বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার কাজ দ্রুতগতিতে চলল। আর একটা কথা এখানে বলা ভালাে যে, গভর্নর মােনায়েম খানের যত দোষই থাক একটি গুণ ছিল। গুণটি হলাে তিনি আমার সাথে যে অঙ্গীকার করেছিলেন তা তিনি ভঙ্গ করেননি। দু’একটি ঘটনা আমার মনে আছে। দু’ একটি ঘটনার কথাই বলি। আমি সিলেবাস কমিটি করেছি। আমি সিলেবাস কমিটিতে প্রবীণ শিক্ষকদের রেখেছি কমিটির চেয়ারম্যান করে। এর মধ্যে একজন ছিলেন প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক, পলিটিক্যাল সায়েন্সের লােক। আর একজন আমি সাজেস্ট করলাম। তিনি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রফেসর হাবিবুল্লাহ। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগের চেয়ারম্যান। এঁরা ছিলেন সিলেবাস প্রণয়নের জন্য। দু’জনকে নিয়ে আমার সঙ্গে গভর্নরের কথা হলাে। কিন্তু তারপরও এ সংক্রান্ত কোনাে সিদ্ধান্ত পেলাম না। এরপর গভর্নর চট্টগ্রাম আসলেন। আমাকে খবর দেয়া হলাে যেন আমি সার্কিট হাউজে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। আমি সার্কিট হাউজে গভর্নরের সঙ্গে দেখা করলাম। অনেক লােক ছিল। অধিকাংশই সরকারী কর্মচারী, কর্মকর্তা। আর ছিলেন সে সময়ের মুসলিম লীগ নেতৃবর্গ। তার সঙ্গে ছিলেন অর্থমন্ত্রী ড: এম. এন. হুদা। একপাশে ড: হুদা আর একপাশে গভর্নর। মাঝখানে আমি। সামনে প্রচুর লােক। তিনি আমার সঙ্গেই প্রথম কথা বললেন। তিনি বললেন, ‘ড: সাহেব আপনার সঙ্গেই কাজটা আগে সেরে ফেলি। আপনার দুটো ফাইলই আমি নিয়ে এসেছি। আমি আপনার প্রস্তাব অনুমােদন করবাে না। আপনার মত বদলাতে হবে। যে ব্যক্তি হাইকোর্টে আমার। প্রেসিডেন্ট ও সরকারের বিরুদ্ধে মকদ্দমা করেছেন তাঁকে আপনি রেখেছেন সভাপতি করে। আমি বললাম, কে ? বললেন, আবদুর রাজ্জাক। বললাম, রাজ্জাক সাহেব অপরাধ করলাে কোথায় ? তিনি বললেন, অপরাধ হলাে-আমার সরকারের বিরুদ্ধে তিনি মকদ্দমা করেছেন। আমি বললাম, আপনার সরকার তাে বলে যে এটা গণতান্ত্রিক সরকার। যদি গণতান্ত্রিক সরকার হয়ে থাকে তাহলে প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার আছে নিজের অধিকার রক্ষা করার। তিনি নিজের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে মনে করেই রীট করেছেন—আমি জানি। যে কোনাে দেশের নাগরিক সরকারের বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা করতে পারেন। এটা কোনাে অপরাধ নয় স্যার।’ ‘অপরাধ না ? শােনেন হুদা সাহেব, আপনার বন্ধুর কথা শােনেন ।
৫৪
দ্বিতীয় জন ড: হাবিবুল্লাহ-ইসলাম বিরােধী লােক।’ আমি বললাম, আপনাকে কে বলেছে, তিনি ইসলাম বিরােধী লােক।’ গভর্নর জানালেন, আমি এ খবর রাখি। আমি বললাম, “স্যার, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ না পড়লে কি ইসলাম বিরােধী হয় ? আমি তাে পড়ি না। তাই বলে কি আমি ইসলাম বিরােধী ? তিনি ইসলাম বিরােধী কি কাজ করেছেন ? ড: হাবিবুল্লাহ ইসলামের ইতিহাস এবং সংস্কৃতি বিষয়ের প্রফেসর। আর আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। আমি তাহলে ইসলামের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির জন্য এ কমিটিতে কাকে রাখতে পারি ? একটা কথা বলি স্যার, আপনার সঙ্গে কথা হয়েছিল আপনি আমার কোনাে কাজে বাধা দেবেন না। আপনি বাধা দিচ্ছেন। সুতরাং আপনার এ কাজে যদি আমি থাকি, তাহলে আমার মনােনীত ব্যক্তিকে রাখতে হবে। আর যদি না রাখতে চান তাহলে আমিও থাকবাে না। এভাবে আমি যদি বাধাপ্রাপ্ত হই তাহলে আমি কাজ করবাে না। আপনার যুক্তি আমি গ্রহণ করতে পারছি না।’ একথা বলার পর গভর্নর বললেন, ঠিক আছে। হুদা সাহেব শুনলেন ? আপনার বন্ধু আমাকে উল্টো চার্জ করছে। আনেন, ফাইলটা দেন। আমি সাইন করে দিচ্ছি।’ তিনি নথিতে স্বাক্ষর দিলেন। বাংলা বিভাগে। রিডার পদের জন্য আমি ড: কাজী আবদুল মান্নানকে নির্বাচন করেছিলাম। কিন্তু নিয়ােগপত্র তখনও দেইনি। এর মধ্যে জানতে পারলাম সৈয়দ আলী আহসান বাংলা একাডেমীর পরিচালকের পদ থেকে অপসারিত হয়েছেন। তাঁর চাকরি নেই। তখন ঠিক করলাম বাংলা বিভাগের জন্য কাজী আবদুল মান্নানের পরিবর্তে সৈয়দ আলী আহসান ভালাে হবেন। তখন প্রফেসরের পদ সৃষ্টি করা হয়নি। তবে এমন ছিল যে আমি এদের জন্য সুপারিশ করতে পারি । চ্যান্সেলর যদি সেই সুপারিশে সম্মতি দেন তাহলে নিয়ােগ দেয়া যেতে পারে। যথাযথ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই নিয়ােগ দেয়া যেতে পারে। আমি প্রফেসর পদের জন্য সৈয়দ আলী আহসান-এর নাম প্রস্তাব করে পাঠিয়েছিলাম। ঐ দিনই কিনা আমার ঠিক মনে নেই। গভর্নর বলেছিলেন, যাকে আমি পদচ্যুত করেছি তাকে আপনি প্রফেসরশীপ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন। আপনার সিন্ডিকেট নেই। আমাকেই সবকিছু করতে হয়। আমি এটা করবাে না। আমি উত্তরে বললাম, আলী আহসান সাহেবকে বাংলা একাডেমীর পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ করেছেন তার মানে এই নয় যে, তিনি বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হতে পারবেন না। শিক্ষক হিসাবে কি তাঁকে আপনি ডিসমিস করেছেন ? তা তাে করেননি স্যার। করেছেন পরিচালক হিসাবে। পরিচালক হিসাবে তার কাজ হয়তাে আপনার পছন্দ হয়নি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, শিক্ষকতার যােগ্যতা তার নেই। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘হুদা। সাহেব শােনেন। তারপর তিনি বললেন, ফাইলগুলাে দেন। দেন ফাইলগুলাে। তারপর বললেন, আমি আপনার প্রস্তাব মেনে নিলাম কিন্তু পরে আপনি এজন্য অনুতাপ করবেন। আপনি মানুষ চেনেন না।’
হঁ্যা, লিখে, ফাইল তিনটা আমার হাতে দিলেন। আমি উঠে চলে আসলাম। দেখলাম মােনায়েম খান সাহেব তার ওয়াদা ভঙ্গ করেন নি। আর এক দিনের
৫৫
ঘটনার কথা মনে পড়ছে। আমরা এসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার নেবাে। বিজ্ঞাপন দিয়েছি। দরখাস্ত পড়েছে অনেক। ইন্টারভিউ নিচ্ছি। একটি আবেদনপত্রে গভর্নর লিখেছিলেন, ভাইস চ্যান্সেলর সাহেব, এর কেইসটা আপনি বিবেচনা করতে পারেন। দরখাস্তের কপিটা ছিল রেজিস্ট্রার খলিলুর রহমানের কাছে। যখন ইন্টারভিউ নিচ্ছি তখন খলিলুর রহমান সাহেব আমাকে ইংগিত করে কাগজটা দিলেন। তাৎক্ষণিকভাবেই আমি মনস্থির করে ফেললাম এ প্রার্থীকে আমি নেব না। আমি বুঝেছিলাম গভর্নরের প্রভাবে যদি আমি একজনকে নেই তাহলে এরকম আরাে অনেককে নিতে হবে। গভর্নর অর্ডার দিয়ে করাতে পারতেন। অর্ডার দিয়ে করালে তা সমস্ত আইনের উর্ধ্বে করতে হতাে। আমি প্রার্থীকে অনেক প্রশ্ন। করলাম। প্রশ্নের জবাব তিনি দিতে পারলেন না। আমাকে খলিলুর রহমান পরে বললেন, স্যার, চিন্তা করে দেখেন, গভর্নর রেগে যাবেন। আমি বললাম, কি আর হবে, চাকরি ছেড়ে দেব আর কি ? কিন্তু গভর্নর আর আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেননি।
আর একটি ঘটনার কথা মনে আছে। আইয়ুব খান বিদেশ থেকে দেশে আসার পরে চীনের ‘সেয়িংস অফ মাও’-এর মতাে ‘সেয়িংস অফ আইয়ুব’ বলে একটি বই প্রকাশ করা হলাে। ছােট বই। চীনাটা ছিল লাল, আর এটি সবুজ। একদিন গভর্নর সব ভাইস চ্যান্সেলরকে ডাকলেন। তখন আমি ভাইস চ্যান্সেলর হয়ে গেছি। আমরা গেলাম। তিনি আলােচনা শেষে বললেন, আপনারা যাওয়ার। সময় প্রত্যেকে একটি বইয়ের বান্ডিল নিয়ে যাবেন। আমার প্রেসিডেন্ট-এর সেয়িংস আছে। এগুলি আপনারা শিক্ষক এবং ছাত্রদের মধ্যে বিলি করবেন। এতে প্রেসিডেন্ট অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। ‘ সবাই চুপ। যার যারটা তার কছে। এনে দিল। সবাই উঠে আসছেন, তখন আমি বললাম যে, স্যার, আমি এ বান্ডিল নেবাে না।’ তিনি বললেন, ‘কেন নেবেন না ?” বললাম, আপনাকে আমি পূর্বেই বলেছি যে আমি রাজনীতি করবাে না। আমার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মত যা-ই থাক, সরকার পছন্দ করি বা না করি ভিন্ন কথা, কিন্তু আমি রাজনীতি করবাে না। আমাকে দিয়ে এমন কোনাে কাজ করাবেন না যা আমার মতের বিপরীতে। আমার ক্যাম্পাসে আমি এটা করতে পারি না। তিনি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, হ্যা, আপনার সে অধিকার আছে। আপনি ঐ বান্ডিল নাও নিতে পারেন। আমি আরও বলেছিলাম, ক্যাম্পাসে বিরােধী লােক আছে, ছাত্র সমাজ আছে। অনেকে বর্তমান সরকারকে পছন্দ করে না। এগুলাে যদি আমি দিতে যাই তাহলে আমি সরকারের একটা পার্ট হয়ে যাবাে। এটা ঠিক হবে না।’ তিনি চুপ করে থাকলেন। আমি বেরিয়ে আসছিলাম, তখন আমার হাতে প্যাকেট না দেখে দু’জন জিজ্ঞেস করলেন, আপনার প্যাকেট কোথায় ?’ বললাম, “রেখে এসেছি।’ প্রশ্ন করলেন, ‘কেন ?’ বললাম, “বিলি করতে পারবাে না। তারা বললেন, “বেশ চালাক লােক। তাে আপনি।’ মােনায়েম খান আমার ওপর কোনাে কিছু চাপিয়ে দেননি। আমার মনে হয় যে তিনি আমার বিশ্ববিদ্যালয়টি হােক-এটা চেয়েছিলেন। কারণ
৫৬
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। গভর্নর হয়তাে প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে সুনাম আশা করেছিলেন। আমি বােধ হয় এই ঘটনাগুলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘চেলেঞ্জ অফ বিইং-এ ভাইস চ্যান্সেলর’ বক্তৃতায় বলেছি।
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলছি তখন আমার সংগে আমার সহকর্মী সে শিক্ষকই হােক অথবা কর্মকর্তা-কর্মচারী হােন সবার সমর্থন পেয়েছি। আর এজন্যই আমার কাজটি সহজ হয়েছিলাে। ছাত্ররা আমার সংগে সহযােগিতা করেছে। যদি আমি জনসাধারণের সহযােগিতা না পেতাম তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার কাজটি খুব সহজ হতাে না। এ সহযােগিতার দু’একটি উদাহরণ আমি দিতে পারি। আমার মনে আছে যে, আমি একদিন ক্যাম্পাসের মধ্য সীমানা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ করেই ভবনের দেয়ালের গায়ে কয়েকটি পােস্টার চোখে পড়লাে। গাড়ি থামালাম। আমি চিন্তা করলাম যে যদি এখনই এটা বন্ধ না করা যায় তাহলে ভবিষ্যতে হয়তাে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতাে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলাে ভবনের দেয়ালই শ্লোগানে-পােস্টারে ভরে যাবে। এতে ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য নষ্ট হবে। আমার মনে হলাে যার যার মতবাদ প্রকাশ করার জন্য যদি বিকল্প স্থান করে দেওয়া যায় তাহলে সৌন্দর্য রক্ষা সম্ভব হতে পারে। আমি সেদিন অফিসে গিয়েই বিকেল পাঁচটায় ছাত্র-শিক্ষকদের এক সভা আহবান করলাম। সভার আয়ােজন করা হলাে যে ভবনটিতে. পােস্টার লাগানাে হয়েছিলাে সে ভবনটির সামনের মাঠে। সবাই জড়াে হলাে। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললাম, “দেয়ালের এসব পােস্টার বা লিখন কে বা কারা করেছেন তা জানতে চাচ্ছি না। পােস্টারিং করা কোনাে অপরাধ নয়। তবে তােমরা আমাকে যদি তােমাদের অভিভাবক মনে করাে, পিতৃস্থানীয় ব্যক্তি মনে করাে, তাহলে বলবাে এ ভবন সুন্দর রাখতে হবে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ তােমাদেরও। এটা পড়াশুনার জায়গা এবং এটা রক্ষা করার দায়িত্ব যদি তােমাদের হয়ে থাকে তাহলে আমি এটা আশা করতে পারি কিনা যে সমস্ত নতুন দালান-কোঠা এখানে করা হচ্ছে সেগুলাে তােমরা ক্ষত-বিক্ষত করবে না। যেমন, বাড়িতে তােমার বাবা যদি কোনাে নতুন ঘর তৈরি করান তাহলে কি তিনি তােমাকে সে ঘরে পােস্টারিং করতে দেবেন ? সেই ঘরে কি তিনি কালাে কালি দিয়ে লিখতে দেবেন ? আমি আশা করি কোনাে ভবন তােমরা স্পর্শ করবে না। তােমাদের যে রাজনৈতিক মতবাদ আছে তা প্রকাশের ব্যবস্থা আমি করে দেবাে। প্রত্যেক রাস্তার মােড়ে যদি ব্ল্যাক ওয়াল করে দিই তাহলে সে দেয়ালে পােস্টারিং করতে পারাে। আর যদি জায়গায় জায়গায় আমি থাম্ব গেড়ে তার টাঙিয়ে দিই তাতে তােমরা বিভিন্ন ধরনের পােস্টার কিংবা বিভিন্ন ধরনের শ্লোগান লিখে টাঙিয়ে দিতে পারাে। এক সপ্তাহ বা দু’সপ্তাহ পর আমি তা পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করবাে। আমি আজ ভাইস চ্যান্সেলর, কাল থাকবাে না। তুমি আজ ছাত্র, কাল থাকবে না। বিশ্ববিদ্যালয় তােমাদের। আমি মনে করি যদি তােমরা সহযােগিতা করাে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ পরিষ্কার,
৫৭
সুন্দর রাখা সম্ভব। বিদেশে আমি চাকরি করেছি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি থেকেছি। সেখানে ছাত্ররা এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ভবন পােস্টারে শ্লোগানে ক্ষতবিক্ষত করে না। আমি এ অনুরােধ তােমাদের করছি-যতদিন আমি ভাইস চ্যান্সেলর থাকবাে ততদিন তােমরা ভবনে কোনাে পােস্টার লাগাবে না। কালকেই আমি তােমাদের পােস্টার লাগাবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তােমরা রাজি কিনা বলাে। সবাই হাত তুলে রাজি আছে জানালাে। পরের দিন থেকে ঐ ব্যবস্থা হলাে—ব্যাক। ওয়াল’ এবং থাম্বা পুঁতে তার দেওয়া। এরপর থেকে আমি যে ছয়-সাত বছর ছিলাম একটা পােস্টার আর ভবনগুলােতে লাগানাে হয়নি।
আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। আমি একদিন দশটার সময় খবর পেলাম এম. এ. শেষ বর্ষের ছাত্ররা প্রত্যেক হলে নীল এবং লাল রং তৈরি করে জমা করেছে। পরদিন ‘র্যাগ ডে’ পালন করবে। আমি হলে গেলাম। দুই হলের ছাত্রদের ডেকে এক সভার মতাে করলাম। আমি বললাম, রং ছড়ালে ভবনের সৌন্দর্য নষ্ট হবে। র্যাগ ডে’ মানে যদি এই হয়-যা ইচ্ছা তাই করা—তাহলে। তােমাদের সংগে অশিক্ষিত মানুষের কোনাে পার্থক্য থাকে না। র্যাগ ডে’ করতে গিয়ে কোনাে মেয়ের গায়ে যদি রং দাও—সে মেয়ে যদি আপত্তি করে, তাহলে কলহ। বাধবে। অনেকে হয়তাে রং দেওয়া পছন্দ করে না। অনেকে হয়তাে মনে করে এগুলাে ধর্মবিরুদ্ধ কাজ। এগুলাে তােমরা করতে যাচ্ছাে কেন ? তােমরা তার চাইতে উৎসব করাে—আমি সমর্থন দেব। তােমরা চলে যাচ্ছাে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আমাদের খারাপ লাগবে। তােমরা যাওয়ার আগে এমন কিছু স্মৃতি রেখে যাও যে স্মৃতি আমরা সব সময় স্মরণ করবাে। র্যাগ ডে’ করে তা হয় না। আমি বলার পর ছেলেরাও বক্তৃতা দিল এবং শেষ পর্যন্ত তারা রাজি হলাে। আমি বলেছিলাম কাল র্যাগ ডে নয়—কালকে সমাপনী উৎসব হবে। সারাদিনব্যাপী উৎসব চলবে । ছেলেরা রাজি হলাে। সমাপনী উৎসব হলাে বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে।
বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে গিয়ে ছাত্র-শিক্ষক-জনসাধারণ, সবার সহযােগিতা পেয়েছি। ক্যাম্পাসের ভিতর কেউ মাযার’ দেখিয়ে আস্তানা গড়ে তুলতে চেয়েছে। আবার হিন্দু সম্প্রদায়ের একদল মানুষ শ্মশান ঘাটের কথা বলে কাজে বাধার সৃষ্টি করতে চেয়েছে। কিন্তু আমি যখন তাদের বুঝিয়েছি তারা বুঝেছে, আমার কাজে সমর্থন দিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার কাজে ছাত্র, শিক্ষক, জনসাধারণের কাছ থেকে যে সহযােগিতা পেয়েছি সে কথা আমি আজো ভুলিনি। পরস্পর পরস্পরের প্রতি আস্থা ছিলাে-বিশ্বাস ছিলাে। এখন যেন তেমনটি আর দেখি না। বড় কষ্ট হয়।
একবার ইসলামাবাদ গেছি আমরা-হঠাৎ গভর্নরের কাছ থেকে টেলিগ্রাম গেল। সকল উপাচার্যদের ফিরে যেতে বলা হয়েছে। কারণস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘটের উল্লেখ ছিলাে। আমরা সব তড়িঘড়ি করে চলে এলাম। ছাত্রদের দাবি ছিলাে-বন্যার জন্যে পরীক্ষা পিছাতে হবে। গভর্নর বললেন যে, আমাকে স্মারকলিপির কপি দিয়েছে। সব বিশ্ববিদালয়ে পরীক্ষা পিছাতে হবে বন্যার
৫৮
কারণে। আপনারা যার যার ক্যাম্পাসে ফিরে যান, ছেলেদের বােঝান। পরের দিন দেখি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ধর্মঘট শুরু করে দিয়েছে। ময়মনসিংহেও আরম্ভ হয়ে গেছে। আমি চট্টগ্রাম ফিরে এলাম। এসে শুনি আগামীকাল থেকে অবস্থান ধর্মঘট করবে ছাত্ররা। এক দল ছেলে এসে স্মারকলিপি দিয়ে গেল। রাজশাহীতেও স্ট্রাইক শুরু হয়ে গেছে-চট্টগ্রামেও হতে যাচ্ছে। আমি খোজ-খবর নিয়ে দেখলাম বন্যাতে চট্টগ্রাম অঞ্চলের কোনাে ক্ষতিসাধন হয়নি। আর ক্ষতি হলেও তা ছিলাে নগণ্য। এজন্য পরীক্ষা পেছানাে যায় না। সত্যি কথা বলতে কি, বন্যার জন্য পরীক্ষা পেছানােটা আমি যুক্তিসঙ্গত মনে করলাম না। চট্টগ্রামের বন্যা বড় ধরনের ছিলাে না। পরদিন ভােরে আমি যখন বেরুবাে-ঠিক তখনই রেজিস্ট্রার খলিলুর রহমান এসে হাজির হলেন। তিনি বললেন, স্যার, যাবেন না, রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছে, বাধাপ্রাপ্ত হবেন। তাদের দাবি মানতে হবে। আমি রেজিস্ট্রারকে বললাম, তুমি না গেলেও আমি যাচ্ছি। আমি বাসা থেকে গাড়ি বের। করে রওনা দেওয়ার মুহূর্তে খলিলুর রহমান বললাে, স্যার আমাকে নিয়ে যান। খলিলুর রহমান পিছনের সিটে বসলেন। আমি গাড়ি চালাচ্ছি। কিছুদূর যাওয়ার পরই একটি ব্যারিকেডের সম্মুখীন হলাম। ছাত্ররা সেখানে দাঁড়িয়েছিলাে। বললাম, ‘কি জন্য ব্যারিকেড দিয়েছাে ?’ বললাে, স্যার আমাদের পরীক্ষা পেছানাের দাবি। যদি না মানেন তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় যাতে চলতে না পারে সেজন্য ব্যারিকেড দিয়েছি। আমি বললাম যে, এ বিষয়ে কোনাে সিদ্ধান্ত কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিতে হবে ? অফিসে এসে কথা বলাে। ছাত্র-শিক্ষকদের বাধা দিও না। যা বক্তব্য বলাে—যুক্তি থাকলে শুনবাে। ওরা ব্যারিকেড তুলে নিল। পরের ব্যারিকেড পার হয়ে শেষে আর একটি ব্যারিকেডের সম্মুখীন হলাম। ছাত্রদের বললাম, আমার অফিসে এসাে।’ ছেলেরা অফিসে জমা হলাে। তাদের সঙ্গে এ নিয়ে আলােচনা করলাম। আমি বললাম, কারা কারা বন্যাকবলিত বা ক্ষতিগ্রস্ত বলাে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত তারা দরখাস্ত করুক তাদের পরীক্ষা আমি পরে নেবাে। কয়েকজন ছেলের জন্য এতগুলি ছেলের পরীক্ষা আমি বন্ধ করতে পারি না। তােমাদের এবং তােমাদের অভিভাবকদের ওপর আর্থিক চাপ পড়বে। কয়েকমাস পিছিয়ে যাবে। ডিগ্রী পরীক্ষা। আমার কথা শােন, বন্যায় যদি কারাে ক্ষতি হয়ে থাকে তাহলে আমি তাদের পরীক্ষা পরে নেবাে। কিন্তু বাকি সবারই পরীক্ষা দিতে হবে। ছেলেরা আমার কথায় রাজি হলাে না। আমাকে বলে গেলাে যে আজ থেকে তারা অবস্থান ধর্মঘট করবে। সত্যি সত্যিই ছেলেরা অবস্থান ধর্মঘটে গেল। আমি তাদেরকে বললাম, “ধর্মঘট করাে আর যাই করাে আমি পরীক্ষা পিছাবাে না। কোনাে যুক্তি নেই। যে কাজ করলে তােমার বাবা-মা’র ক্ষতি হবে তােমাদের ক্ষতি হবে, সে কাজ আমি করবাে না। ওরা বললাে, “স্যার, ঢাকা পিছিয়ে দিয়েছে, রাজশাহী পিছিয়ে দিয়েছে। আমি তার উত্তরে বললাম ‘ঢাকা-রাজশাহী পিছালে আমাদেরও পিছাতে হবে এমন কোনাে কথা নেই। সব জায়গার পরিস্থিতি এক রকম নয়। চট্টগ্রামে এ বন্যায় তেমন ক্ষতি হয়নি।’ ঠিক আছে তােমরা তাে
৫৯
পর্যায়ক্রমে আসবে যাবে খাওয়া-দাওয়া করবে। আমার সঙ্গে যারা দেখা করতে আসবে তারাও যাতায়াত করবে, বাধা দিও না। থাকো অবস্থান ধর্মঘটে । আমি থাকবাে। আমিও বাসায় যাবাে না। আই উইল স্টে হেয়ার।
রাত তখন দশটা, ছেলেরা প্রথমে টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিল। এ সময় একজন সাদা পােশাকধারী পুলিশ এসে আমাকে জানালাে যে, সে ডিসি এবং ডিআই জি’র নির্দেশে এখানে এসেছে পুলিশের সাহায্য লাগবে কিনা তা জানার। জন্য। আমি বললাম, না, পুলিশ আমার লাগবে না। টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছে যাতে আমি পুলিশ ডাকতে না পারি। আপনি চলে যান। যদি ছাত্ররা বুঝতে পারে যে, আপনি পুলিশের লােক তাহলে আমার সম্মান নষ্ট হবে। তারপর আমি ঘর থেকে বেরিয়ে ছাত্রদের উদ্দেশে বললাম, আমি পুলিশ ডাকবাে বলে তােমরা আমার লাইন কেটে দিয়েছাে, তােমরা আমাকে ভয় দেখাচ্ছাে ? আমি ভয় পাই না। আমি কোনাে অন্যায় কাজ করছি না। আমার সঙ্গে প্রফেসর মােহাম্মদ আলী, ডক্টর আনিসুজ্জামান, আর. আই. চৌধুরী ও অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দ রেজিস্ট্রার এবং যারা কর্মকর্তা আছেন—তাঁদেরকে তােমরা ভয় দেখাতে পারবে না। আমরা কোনাে অন্যায় কাজ করছি না। পরীক্ষা পিছানাে যাবে না। কিছুক্ষণ পর বিদ্যুৎ চলে যেতে পারে সে ধারণা আমার আগেই ছিল। আগেই আমি কয়েকটি হ্যাজাক, মােমবাতি এবং টর্চ এনে রেখেছিলাম। আমি একটি নিয়ে বেরুলাম। আমার সঙ্গে ড: করিম, প্রফেসর মােহাম্মদ আলী, ড: আনিসুজ্জামান, ড: আর. আই. চৌধুরী এঁরা ছিলেন। অন্যদের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। রেজিস্ট্রার, ডেপুটি রেজিস্ট্রারও আমার সঙ্গে ছিলেন। আমি ধর্মঘটীদের বললাম, তােমরা আমাদের ভয় দেখাচ্ছাে। বাতি নিভিয়ে দিয়েছ। আমি তােমাদের আগেই বলেছি—আবার আমি রিপিট করছি—আমি পরীক্ষা পিছাবাে না। আমার যারা সহকর্মী আছেন তারা সবাই আমার সঙ্গে একমত। সুতরাং তােমরা এমন করাে না। একটি গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে তােমরা আমাদের আক্রমণ করবে। তাহলে একটা কথা বলে রাখি, আক্রমণ করলে তােমরা পাঁচ-ছ’জন ছেলে মারা যাবে। আমি যদি তােমাদের বাবা হয়ে থাকি, আমি বাবা হিসাবে কথা বলছি। বেয়াদপ ছেলে যারা আঘাত করতে আসবে তাদেরকে আমি হত্যা করবাে। আমার কাছে দুটি লােডেড রিভলভার আছে। আমার সহকর্মীদের ওপর আক্রমণ করলেও আমি গুলি চালাব। বারটি গুলি আছে আমার রিভলভারে। শুনেছি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসরকে ছেলেরা মেরেছে। আর এখানে মারতে হলে মারবে প্রফেসর মল্লিককে। তােমরা এ কাজ করাে না। আমরা অন্যায় কিছু করছি না। পরীক্ষা নিতে চাই। এরপর আমি চলে এলাম। কতক্ষণ পরে শ্লোগান শুনলাম। ঘর থেকে বেরিয়ে বললাম, “শ্লোগান। দিচ্ছাে কেন ?’ ছেলেরা বললাে, স্যার, কালকে আসবাে। বুঝলাম শীত করছে। ডিসেম্বর মাস ছিলাে। আমি বললাম, “ঠিক আছে। শীত করছে বােধ হয়। বাড়ি গিয়ে শুয়ে থাকো। তবে যাবার আগে একটি সিদ্ধান্ত তােমরা শুনে যাও। আগামীকাল দশটায় তােমাদের ভাইস চ্যান্সেলর ড: মল্লিক আর থাকছে না। কাল।
৬০
দশটায় সে রিজাইন দেবে।’ ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার ইউ এন সিদ্দিকীকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে উপাচার্য ক্যাম্পাস ত্যাগ করবে। এটা তােমাদের জানিয়ে দিলাম। সরকারী অনুমতির জন্য আমি অপেক্ষা করবাে না। উপাচার্য হয়ে এসেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার জন্য। তােমরা পরীক্ষা দিচ্ছাে, পড়াশুনা করছে। সুতরাং আমার কাজ শেষ হয়েছে। আমার দায়িত্ব আমি পালন। করেছি। আমি চলে যাবাে। তােমরা চলে যাও। অনেক ছেলেমেয়ে রাতে চলে গেল।
সে রাতেই ক্যাম্পাসে অবস্থানরত শিক্ষকদের নিয়ে এক সভা করলাম। সভায় আমি বললাম, কাল আমি আমার পদ থেকে পদত্যাগ করছি। বিশ্ববিদ্যালয় চলতে থাকবে। নতুন উপাচার্যের সঙ্গে আপনারা সার্বিক সহযােগিতা করবেন।’ দু’একজন বললেন, “আমরাও রিজাইন দেবাে। আমি আপত্তি করলাম। আমি বলেছিলাম, ‘তাহলে প্রমাণিত হবে যে আমরা ছাত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষে যাচ্ছি। ওরা যেমন অবস্থান। ধর্মঘট করছে আমরা তেমনি পদত্যাগ করছি। ছাত্ররা বুঝুক যে উপাচার্যের পদ এমন লােভনীয় নয় যে, আমাকে থাকতে হবে। বরাবরই বলি এখনও বলছি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের পদ অপেক্ষা উপাচার্যের পদটি খুব বড় না।
পরদিন সকাল সাড়ে ন’টার সময় আমি পদত্যাগপত্র লিখে ট্রেজারারকে খবর দিলাম উপাচার্যের দায়িত্ব বুঝে নেয়ার জন্য। এদিকে আমার পদত্যাগের খবর রাত্রেই ছড়িয়ে পড়েছিল। ক্যাম্পাস এবং শহরের বিভিন্ন স্থানে এ ঘটনা নিয়ে সভা চলছিলাে। সকালের দিকেই সৈয়দ আলী আহসান আমাকে জানালেন, ছেলেরা সিদ্ধান্ত জানাবার জন্য দু’ঘন্টা সময় চাচ্ছে। আমি বললাম, তাদের বলেন আমি একটা পর্যন্ত সময় দিলাম। কিছুক্ষণ পর তিনি আবার ফিরে এসে বললেন, ছেলেরা দেখা করতে চায়। আমি অনুমতি দিলে সবাই এসে বললাে, আমাদের মাফ করবেন। আপনি পদত্যাগ করবেন না। আমি তাৎক্ষণিকভাবে এক সভা ডেকে। বললাম, আমি খুশি হয়েছি তােমরা বাপের মর্যাদা রেখেছে। আমরা সবাই তােমাদের বাবা কিংবা চাচা কিংবা বড় ভাইয়ের সমান। তােমরা যে আমাদের সম্মান রক্ষা করেছে এজন্য আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। আমি আনন্দিত। তবে দুতিন দিন ধরে তােমরা পড়াশুনা কর নাই। ধর্মঘট করতে গিয়ে বইপত্রের সঙ্গে সম্পর্ক তুলে দিয়েছে। এই তিনদিন আমি পরীক্ষা পিছিয়ে দেব। তাছাড়া কোনাে ছেলে যদি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়—তবে তাকে আবেদন করার জন্য বারাে ঘন্টা সময় দিলাম। তাদের পরীক্ষা আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মে পরে নেবাে।’ এই বলে সভা শেষ করলাম। এসব সংবাদ ‘ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলাে। তারিখটি আজ আর মনে নেই।
দেখতে দেখতে মার্চ মাস এসে পড়লাে। মার্চ মাস, ১৯৭১ সাল। আমি মুক্তিযুদ্ধে জড়িত হলাম। এটা স্বাভাবিকও ছিলাে। কারণ, আমি পাকিস্তান হওয়ার পর, কয়েক বছরের মধ্যে আমার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছিলাম যে
৬১
পাকিস্তান হওয়ার ফলে বাঙালিদের সবদিক থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তাদের যে অধিকার সে অধিকার তারা আদায় করতে পারছে না। সরকারী সমর্থন পাচ্ছে না। এসব ব্যাপারে আমাদের মধ্যে আলােচনা হতাে এবং আমরা এ বিষয়ে সচেতনও ছিলাম। সুতরাং নির্বাচন হওয়ার পর যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকার গঠন করতে দেওয়া হলাে না, তখন থেকেই আমার ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেল যে, পাকিস্তানী শাসনে আমাদের দ্বারা সরকার গঠন করা সম্ভব হবে না। কারণ, গণতান্ত্রিক উপায়ে আমরা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ হই, তাহলেও কোনাে রাজনৈতিক নেতাকে সরকার গঠন করতে দেওয়া হবে না। এ সম্বন্ধে আমরা মােটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেলাম। সুতরাং মার্চ মাসে রাজনৈতিক উত্তেজনা ক্রমশ বাড়তে থাকলাে। আমি মনে করলাম যে দেশে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আসন্ন। এ সংগ্রামে হয়তাে আমাকে জড়িত হতে হবে। সংগ্রামে জড়িত হওয়ার ব্যাপারে আমার মনে কোনাে দ্বিধাও ছিল না।
আমার মনে হয় ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বাঙালির ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। ঐ দিন, আমরা জানি, ঢাকাতে বঙ্গবন্ধু এক বিরাট জনসভায় দেশবাসীকে আহবান জানান সংগ্রামের মাধ্যমে মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। ৭ই মার্চের ভাষণ বেতার মারফত চট্টগ্রামে থেকেই আমাদের শােনার সুযােগ হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি সংগ্রামে যােগ দেবার সিদ্ধান্ত নেই ঐ দিনই। সঙ্গে সঙ্গে। আমার পরামর্শে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও শিক্ষকদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় আমি ছাড়াও অন্যান্যের মধ্যে বাংলাদেশের উপরে বক্তব্য রাখেনঅধ্যাপক আবদুল করিম, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান ও ড: আনিসুজ্জামান। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ নামে এক কেন্দ্র ছিলাে। সেখানে ড: আবদুল হাই নামে এক ব্যক্তি তার সহযােগিদের নিয়ে সংগ্রামে যােগ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলে আমরা জানতে পারি। তাঁর সঙ্গে আমাদের যােগাযােগ স্থাপিত হয়। আমাদের ল্যাবরেটরীতে হাতবােমা, গ্রেনেড ইত্যাদি তৈরি করা যায় কিনা সে ব্যাপারে খবর নিতে এবং সম্ভব হলে অবিলম্বে এসব প্রস্তুত করার জন্য প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নিতে আমি অধ্যাপক শামসুল হককে এক গােপনীয় মৌখিক নির্দেশ দিই। কিছু সংখ্যক ছাত্রকে অধ্যাপক আবদুল হাই-এর কাছে পাঠানাে হয় অস্ত্র ব্যবহারের ট্রেনিং নেবার জন্য। সেই সঙ্গে ইউওটিসি’র ভারপ্রাপ্ত অফিসার ড: আতাহারকে নির্দেশ দেওয়া হয় আমাদের ইউওটিসি’র ডামী রাইফেলগুলিকে সক্রিয় করা যায় কিনা তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য। এর কয়েকদিন আগেই ভবিষ্যতে আমাদের কাজে লাগতে পারে ভেবে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার জনাব ইউ এন সিদ্দিকীর মারফতে আমাদের দুজনের বন্দুকের লাইসেন্সকে ভিত্তি করে বেশ উচ্চ ধ্বংসক্ষমতাসম্পন্ন কার্তুজ বাজার থেকে কিনে রেখেছিলাম। এর মধ্যে চট্টগ্রাম। শহরে বাঙালি-অবাঙালি সংঘর্ষ হয়। অনেক লােক এই সংঘর্ষে হতাহত হয় । আহতদের জন্য আমার নেতৃত্বে ছাত্র-শিক্ষকরা রক্ত দান করে। শহরে পাকিস্তান
৬২
বিরােধী অনেক মিছিলও বের হয়। ছাত্র-শিক্ষকরা এ মিছিলে যােগ দিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে আমার সঙ্গে সংযােগ রক্ষা করছিলেন বাংলা বিভাগের ড: আনিসুজ্জামান। ২৩শে মার্চ সকালে আমার সঙ্গে পরামর্শ না করেই কে বা কারা চট্টগ্রাম বেতার থেকে বারবার ঘােষণা করেন যে সংঘবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়ােজনে ঐ দিন চট্টগ্রাম। শহরে সব স্তরের ছাত্র-শিক্ষক-জনতার এক বিরাট মিছিল হবে আমার নেতৃত্বে। মিছিল শেষে আমার সভাপতিত্বে প্যারেড গ্রাউন্ডে এক সভা অনুষ্ঠিত হবে। ঘােষণাকারীদের কয়েকজন আমার সঙ্গে ক্যাম্পাসে দেখাও করে। আমি মিছিলে যােগ দেওয়া এবং সভায় সভাপতিত্ব করার সিদ্ধান্ত নিলাম। নির্ধারিত মিছিলে যােগ দিলাম এবং মিছিল শেষে এক বিরাট জনসভায় সভাপতিত্ব করি। সভার মাঝে, বাড়ির ছাদে, বারান্দায়, গাছের উপরে হাজার হাজার মানুষ। জীবনে এত বড় সভায় যােগ দেওয়ার সুযােগ এর আগে আমার হয়নি। এ সভায় বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে আমার সঙ্গে অনেকেই একাত্মতা ঘােষণা করেন। এদিন ঐ সভাতেই আমি ঘােষণা করলাম, আজ থেকে আমি আর উপাচার্য নই। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত একজন মুক্তিসংগ্রামী হিসাবে আমি নিজেকে মনে করবাে। জনতার ইচ্ছায় ঐ সভাতেই স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি। সভায় বক্তব্য রাখেন স্থানীয় রাজনীতিক মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক আর আই চৌধুরী, অধ্যাপক আবদুল করিম এবং আরাে অনেকে। সভার আয়ােজন ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন অন্যান্যের মধ্যে আমার প্রাক্তন ছাত্র ও তৎকালীন সরকারী কলেজের অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন আহমদ। সভা চলাকালে এক পর্যায়ে এক উত্তেজনামূলক সংবাদ আসে এই মর্মে যে, ‘সােয়াত’ নামক জাহাজ থেকে সামরিক বাহিনীর জন্য আনীত অস্ত্রশস্ত্র নামাতে বাধা দেওয়ার জন্য কয়েক হাজার জনতা বন্দরে এক বেষ্টনী সৃষ্টি করেছে। ব্যারিকেড সৃষ্টি করেছে। এ কাজে সহায়তার জন্য আমি অবিলম্বে জনতাকে শহরের বড় বড় রাস্তায়, বিশেষ করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হওয়ার রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করতে পরামর্শ দিয়ে সভা মুলতবি ঘােষণা করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার পথে আমরা জায়গায় জায়গায় ব্যারিকেডের সম্মুখীন হই। বিভিন্ন রাস্তায় ট্রাক উল্টিয়ে আরাে ব্যারিকেড তৈরি হচ্ছে এও দেখতে পাই। বড় বড় রাস্তায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছাত্র-জনতার সংগ্রামী শ্লোগানও শােনা যায়। আমরা অন্য কোনাে পথ না পেয়ে রাঙুনিয়া হয়ে অনেক ঘুরে মধ্যরাতে ক্যাম্পাসে ফিরি। পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে বাঙালির মুখােমুখি সংগ্রাম যে আসন্ন সে বিষয়ে আমার মনে কোনাে সন্দেহ থাকলাে না। আমার দায়িত্ব সম্বন্ধে আমার মনে আর কোনাে দ্বিধা রইলাে না। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রস্তুতি আরাে জোরদার করার প্রয়ােজন বােধ করলাম।
২৪শে মার্চ সকালে শহরে যারা আমাদের মতাে জনসংগ্রামে যােগ দিয়েছেন – তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সংগে টেলিফোনে আমরা যােগাযােগ করি। তাদের মধ্যে দুজনের কথা আমার এ মুহূর্তে মনে পড়ছে—একজন হলেন ব্যাংকের এক অফিসার আবদুল কাদের। যার সঙ্গে আমার অনেক আগে থেকেই পরিচয় ছিল
৬৩
এবং আর একজন হলেন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট শামসুল হক। উভয়েই কয়েকদিনের মধ্যে শাহাদাৎ বরণ করেছিলেন। শহরে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে শত্রুসৈন্য পথে বের হলে যাতে স্থানীয় লােকজনের সাহায্যে তাদের বাধা দেওয়া হয় সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে আমরা বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত নিই। এর মধ্যে রাওজান এবং হাটহাজারী থানার সঙ্গে আমি টেলিফোনে যােগাযােগ স্থাপন করি এবং স্থানীয় নেতাদের সহায়তায় প্রতিরােধ গড়ার জন্য আমি প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপও নিই। এ সময় টেলিফোন ডিপার্টমেন্টের বহু মেকানিক ও কর্মচারী আমাদের সংগে সংগ্রামে যােগ দিয়েছিলেন। প্রয়ােজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার ব্যবস্থাও করা হলাে। শহরের বাইরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রামের এক শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হলাে।
২৫শে মার্চ খুব উত্তেজনায় কাটে। শহরের বিভিন্ন স্থানের প্রতিরােধে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তাদের সংগে সরাসরি সারাদিন আমার টেলিফোন যােগাযােগ ছিলাে। আমার সাংকেতিক নাম ছিল ‘দানিয়েল। মনে পড়ে, ঐ দিন আমাদের ট্রেজারার সিদ্দিকী উত্তেজিত হয়ে টেলিফোনে আমাকে জানান যে, তাঁর বন্দুক এবং তাঁর কাছে যে কার্তুজ আছে তা জনগণের পক্ষ থেকে স্থানীয় নেতারা চাচ্ছেন। আমি তাকে বলি যে, দেশে সশস্ত্র সংগ্রাম আরম্ভ হয়ে গেছে। তাঁর বন্দুক তিনি এই বৃদ্ধ বয়সে ব্যবহার করতে পারবেন না। কাজেই সেগুলাে যেন তিনি দিয়ে দেন। তাঁর কাছে যে সমস্ত কার্তুজ আছে তাও দিতে বললাম। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকার বিভিন্ন বন্ধু-বান্ধবদের নিকট থেকে টেলিফোনে খবর পাই যে, সেনাবাহিনীর ট্যাংক ঢাকার বিভিন্ন বড় বড় রাস্তায় বিশেষ করে সংযােগ স্থলে পজিশন নিয়েছে। শেখ সাহেবকেও নাকি গ্রেফতার করা হয়েছে এবং সান্ধ্য আইন জারি হতে যাচ্ছে। খবর পেয়ে রাতেই পরিস্থিতি পর্যালােচনার জন্য আমি আমার অফিসে অধ্যাপক করিম, অধ্যাপক আলী আহসান, অধ্যাপক আর. আই. চৌধুরী, অধ্যাপক মােহাম্মদ আলী, ড: আনিসুজ্জামান সহ আরাে কয়েকজনকে ডেকে পাঠালাম। চট্টগ্রামের সাংবাদিকদের সঙ্গে যােগাযােগ করা হয়। কিন্তু টেলিফোনে এদের কাছ থেকে কোনাে খবর পাওয়া গেল না। অনেক চেষ্টার পর ঢাকার পূর্বদেশ’ ও ‘ইত্তেফাক অফিসের সংগে এবং আমার দু’তিনজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপনে সক্ষম হলাম। তারা জানালেন উত্তেজনা বিরাজ করছে। ঢাকায় একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তবে মারাত্মক কোনাে ঘটনার খবর তারা তখনাে জানেন না। কার্য্য ঘােষণা করাতে তারা বাইরে যেতে পারছেন না এবং কোনাে খবরও নিতে পারছেন। না। ট্যাংকে করে সৈন্যারা শহরে টহল দিচ্ছে। ঢাকা এবং অন্যান্য স্থানে কথাবার্তার সময়ে বাইরের সংগে আমাদের যে টেলিফোন লাইন ছিল তা বিচ্ছিন্ন। হয়ে গেল। তখন রাত এগারােটা হবে। শেষ টেলিফোনে আমি কথা বলি আমার এক খালাতাে ভাই, কুমিল্লার ডিসি শামসুল হক খানের সঙ্গে। তাঁকে অবস্থার গুরুত্ব বুঝিয়ে দিই। অবিলম্বে শহরের বাইরে নিরাপদ স্থানে অবস্থান নিতে পরামর্শ
৬৪
দিলাম। কারণ তার অবস্থান ক্যান্টনমেন্টের কাছে এবং আমার জানামতে ক্যান্টনমেন্টের গাড়িগুলােকে পেট্রোল পাম্পগুলাে তেল দিচ্ছে না। এতে নাকি তার নির্দেশ আছে, এ খবর আমি শুনেছি। সে বললাে এসপি’র সাথে পরামর্শ করে ঐ রাত্রেই সিদ্ধান্ত নেবে। সিদ্ধান্ত সে নিতে পারেনি বলে আমার ধারণা। কারণ সেই রাতেই তাকে ও এসপিকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সম্ভবত গুলি করে হত্যা করা হয়। তাদের লাশের খবরও আমরা আর পাইনি।
ঢাকাতে যে মারাত্মক কিছু ঘটনা ঘটে যাচ্ছে সে সম্বন্ধে আমরা নিশ্চিত হই। বাইরের সঙ্গে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রাত চারটা পর্যন্ত আমরা অফিসে থাকি। আমার অফিস তখন ঐ এলাকার প্রতিরােধ সংগ্রামের সদর দফতর ছিলাে। সদর দফতর রাত-দিন খােলা থাকতাে। ভাের সাড়ে আটটায় বাসায় ফিরে গােসল করতে যাওয়ার মুহূর্তে শহর থেকে ট্রেজারার সিদ্দিকী সাহেবের কাছ থেকে টেলিফোন পেলাম। তিনি জানান, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কয়েকজন ই. পি. আর. সদস্য এবং কিছু সংখ্যক যুবক তার বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে। ক্যান্টনমেন্টের ওপর নজর রাখার জন্য সিদ্দিকী সাহেবের বাড়ি তাদের দখলে থাকা প্রয়ােজন বলে তারা বলছে। আমি তাদের সংগে সরাসরি কথা বললাম। সিদ্দিকী সাহেবকে ওদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নিতে বলি। টেলিফোনে যুবকদের কাছ থেকে আমি যখন বিস্তারিত খবরাখবর নিচ্ছি তখন হঠাৎ করে ওরা জানালাে যে রাস্তার উল্টোদিক থেকে কে বা কারা যেন ওদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে। সম্ভবত পাক বাহিনীর কিছু সৈন্য ঐসব আবাঙালি বাড়িতে আগেই অবস্থান নিয়ে থাকবে। কথা শেষ হবার আগেই ওরা আবার জানালাে রাস্তায় বিদ্যুতের তার গুলিতে ছিড়ে গেল। ওদের এখনই প্রতি-আক্রমণ করার দরকার বলে আমরা মনে করছি না। ওদের উৎসাহিত করে ফোন ছাড়ার আগে বললাম, তােমরা বেরুবে না, যে পর্যন্ত নিশ্চিত না হতে পারাে যে তােমাদের নিরাপত্তা পর্যাপ্ত আছে। এরপর ওদের সংগে আমার যােগাযােগ ছিন্ন হয়ে গেল। সম্ভবত টেলিফোন লাইন অচল হয়ে পড়েছিলাে। শহরের সর্বত্র জনতার সংগে পাক বাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রাম তখন শুরু হয়ে গেছে।
২৬শে মার্চ পরিস্থিতি সম্পর্কে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ. হান্নান ও এম. আর. সিদ্দিকীর সংগে আমার টেলিফোনে কথা হয়। ইপিআর বাহিনীতে কর্মরত ক্যাপ্টেন রফিক নামের এক বাঙালি সামরিক অফিসার একটি টিলায় অবস্থান নিয়েছে-এ সংবাদও জেনেছি। চট্টগ্রাম ডাকবাংলাে, রেলওয়ে রেস্ট হাউজ তখন সংগ্রাম পরিষদের হাতে। ওখান থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করে আমাদের শােনানাে হয়। এরপর চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রকে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ ঘােষণা করা হয়। দুপুর দেড়টার দিকে ঐ কেন্দ্র থেকে হান্নান বঙ্গবন্ধুর ঘােষণা পাঠ করেন। এ কেন্দ্র থেকে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া নামের একজন সামরিক অফিসার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সকলকে লালদীঘিতে একত্র হতে আহবান জানান। সংগে সংগে আমি এতে আপত্তি করি। তার সংগে টেলিফোনে কথা
৬৫
বার্তার মধ্যে জানাই যে ওখানে এই খবরের পর একত্রিত হলে সমূহ বিপদ আছে, বিমান হামলার সম্ভাবনা আছে। সুতরাং আমি ঐ ধরনের সমাবেশ স্থগিত রাখতে পরামর্শ দেই। আমার পরামর্শে সমাবেশ বন্ধ করা হয়। পরে ওখানে বিমান হামলা। হয়। আমার আশংকা সত্য প্রমাণিত হয়।
কালুরঘাটেও বােমাবর্ষণ হয়। ওখানে মেজর জিয়াউর রহমান অবস্থান নিয়েছিলেন। ২৬শে মার্চ সন্ধ্যায় তৌফিক ইমাম আমাকে ফোনে এ কথা জানালেন।
তৌফিক ইমাম তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। তিনি জানান যে, আমার পরামর্শে এবং তার নির্দেশে চট্টগ্রাম ও উত্তর চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ২৫০ জন ইপিআর জমা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। আমরা তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করি। গাড়ির পেট্রোল আনানাে হলাে। সরবরাহ ব্যবস্থা যাতে ঠিক থাকে সেজন্য একটি কমিটি করা হয়। জনগণের সহায়তায় সব কাজ দ্রুত সম্পন্ন হচ্ছিলাে। আমার নির্দেশে সুবেদার আবদুল গনি নামে একজন ইপিআর জেসিও পাক-বাহিনীর সংগে যুদ্ধ করার আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করেন। সবদিক বিবেচনা করে প্রথমে ক্যান্টনমেন্টের উত্তরে ট্রেঞ্চ করে জওয়ানদের পােস্ট করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রতিদিন তাদের প্যাকেট খাবার পাঠানাে হতাে। সন্ধ্যায় তাদের বদলে আর এক গ্রুপকে পাঠানাে হতাে। ক্যান্টনমেন্টের পূর্ব দিকে আরাে কয়েকটি ট্রেঞ্চ কেটে আমাদের ছেলেরা অবস্থান নেয়। রােজ রাতে সুবেদার গনির সংগে আমিও বেরুতাম বিভিন্ন পােস্ট দেখার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইল খানেক দূরে-পূর্ব দিকে এক গ্রামে আমি এক ওয়্যারলেস যােগাযােগ কেন্দ্র স্থাপন করি।
২৭শে মার্চ জিয়াউর রহমান নিজ নামে স্বাধীনতার ঘােষণা দিলেন। আমার মনে আছে তিনি বলেছিলেন, ‘আই, মেজর জিয়া ডু হেয়ারবাই ডিক্লার’ ইত্যাদি। সঙ্গে সঙ্গে আমি আপত্তি জানাই। হান্নানকে বলি যে কালুরঘাটে খবর পাঠাবার জন্য যাতে এ ধরনের ঘােষণা না দিয়ে ঘােষণার কথাগুলাে বদলানাে হয়। আমি পরামর্শ দিই দেশের স্বার্থে ঘােষণার পুনর্বিন্যাস করতে হবে অবিলম্বে। বঙ্গবন্ধু মুজিবের পক্ষ থেকে জিয়া ঘােষণা করতে পারেন, তাতে আন্তর্জাতিক সমর্থন আমরা পাবাে। জিয়াকে বাইরের লােক কেউ চেনে না। মেজর জিয়া ঘােষণা করেছেন, তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন—একথা শুনলে দেশের বাইরের সমর্থন খুব পাওয়া যাবে না। সেভাবে আবার সেই ঘােষণা মেজর জিয়া পুনর্বিন্যাস করেন। আমার মনে হয় আমার পরামর্শে এম. আর. সিদ্দিকী, হান্নান এরা হয়ত মেজর জিয়ার সঙ্গে যােগাযােগ করে ঘােষণা বদলে ছিলেন।
২৮শে মার্চ পর্যন্ত ক্যান্টনমেন্ট থেকে কিছু সংখ্যক বাঙালি সৈনিক আত্মরক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে আমাদের সঙ্গে যােগ দেয়। এ সময় ক্যাম্পাসে সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা চারশ’র ঊর্ধ্বে। এই বিপুল সেনা সদস্যদের ঐ মুহূর্তে কাজে লাগানাে আমার পক্ষে সম্ভব ছিলাে না। তাদের যে অস্ত্রশস্ত্র আছে, সে খবরও আমরা পেলাম। এসব যােদ্ধাদের জন্য খাবার তৈরি, প্যাকেট করা, চাল
৬৬
ডাল সংগ্রহ এক সমস্যা হয়ে দাঁড়ালাে। তখন আমি আমার সহকর্মীদের বললাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক দিয়ে সর্বত্র ঘােষণা করা হােক যে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা চার শ’ থেকে ছয় শ’র মতাে। তাদের খাওয়াদাওয়া প্রয়ােজন। সেজন্য আমরা জনসাধারণের কাছে আহবান জানাচ্ছি চাল, ডাল, তরিতরকারি, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল যা পারেন দান করতে। আরাে আহবান জানালাম প্যাকেটে আটার রুটি, গােত, সিদ্ধ তরকারি এমনভাবে দিতে যাতে এই প্যাকেট একজন লােকের পক্ষে একবেলা খাওয়া চলে। খাবারের প্যাকেট তৈরি করে প্যাকেটগুলাে ক্যাম্পাসে পাঠাবার জন্যও অনুরােধ জানানাে হলাে। আমাদের এই আহবান জানাবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সাড়া পেলাম। চট্টগ্রামের ঐ অঞ্চলে যত গ্রামবাসী ছিলাে তারা অতিদ্রুত আমাদের ঐ সমস্ত জিনিসপত্র পাঠাতে শুরু করলেন। আমার মনে আছে, অবস্থা এমন হলাে যে, হলের দুটি কামরা চাল-ডাল আর আটার বস্তায় ভরে গেল। অসংখ্য মুরগি, হাঁস,গরু-ছাগল ইত্যাদি ক্যাম্পাসের মধ্যে জমা করা হলাে এবং এর পর নিয়মিত প্রতিদিন প্রায় দু’তিন শ’ প্যাকেট প্রায় প্রত্যেক বাড়ি থেকেই খাবার পাঠানাে হতাে। অর্থ আমরা চাইনি, কারণ অর্থ দিয়ে তাে এগুলিই আমরা কিনবাে। তাছাড়া টাকার হিসাব রাখাও বেশ সমস্যা ছিলাে। আর একটি কমিটি করা হলাে খাবারদাবার ঠিকমত যত্নে রাখা এবং চাল, ডাল, হাঁস, মুরগি যাতে নষ্ট না হয় তার ব্যবস্থা করার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যারা ক্লাশ ফোর্থ এমপ্লয়ি ছিলেন তাদের বলা হলাে দায়িত্ব নিতে। তারা আগ্রহভরে সে দয়িত্ব নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আরও এক আহবান জানিয়েছিলাম। আমার মনে আছে আমরা গাড়ি ও পেট্রোল দেওয়ার অনুরােধ করেছিলাম। অনেক গাড়ি আমরা পেয়েছিলাম। অনেকে গাড়ি আমাদের দিয়ে গিয়েছিলাে। অনেকে আবার ট্রাক, জীপ এনে রেখে গিয়েছিলাে। গাড়িগুলাে কাদের তাও আমরা জানতাম না। ওগুলাে চালাবার জন্য আমরা ড্রাইভারও পেলাম। পেট্রোল নেওয়ার সময় আমরা স্লিপ দিতাম এবং সেই স্লিপে অধ্যাপক আবদুল করিম আমাদের পক্ষ থেকে স্বাক্ষর করতেন। স্লিপ অনুযায়ী পেট্রোলের যা দাম হয় সে দাম আমরা পরিশােধ করার অংগীকার করেছিলাম। এ আহবানে আমরা ব্যাপক সাড়া পেয়েছিলাম। অধ্যাপক করিম এখনাে জীবিত আছেন। তিনি আমার নির্দেশমতাে হাটহাজারী যান। পেট্রোল পাম্প মালিকের সংগে দেখা করে পেট্রোলের ব্যবস্থা করেছিলেন। আমরা বিনা পয়সায় স্লিপ দিয়ে পেট্রোল নেওয়া আরম্ভ করি। সামরিক বাহিনী, ই বি আর এবং ই পি আর, পুলিশের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিলাে। বাকি আমরা যারা ছিলাম আমাদের বাড়িতে তখনাে খাবার ছিল। আমরা অনেকেই আগেই কিনে রেখেছিলাম। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা তখনও কিচেন থেকেই খাওয়া-দাওয়া করতাে। রান্না করার বাবুর্চী ছিল।
আর একটা কথা বােধ হয় এখানে বলা প্রয়ােজন। সেই সমস্যাসংকুল সময়ে আমরা চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের সার্বিক সহায়তা পেয়েছি। গরু-ছাগল পালা,
৬৭
তাদের ঘাস খাওয়ানাে, হাঁস-মুরগি দেখাশােনা এ সবই তারা করেছে। আমার আর একটি কথা মনে আছে। আমরা ব্যাংক লুট করতে মানা করেছিলাম। একটি ব্যাংক আমাদের ক্যাম্পাসে ছিল। অসহযােগ আন্দোলনের জন্য ব্যাংক বন্ধ থাকতাে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারী তহবিলে কোনাে টাকা ছিল না। আমরা টাকা যােগাড় করি নিজেদের মধ্য থেকে, চাদা তুলে। আমার একটা গাড়ি ছিল, সেটা বিক্রি করে আমি ছ’ হাজার টাকা আমাদের সাধারণ তহবিলে দিয়েছিলাম। আর. আই. চৌধুরী সাহেব কিছু টাকা দিয়েছিলেন। এইভাবে টাকা যােগাড় করে আমাদের কাজ চলছিলাে। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বলা ছিল যে, তারা যেন ব্যাংক লুট করার চিন্তা না করেন। কর্মচারীরা আমাদের কথা শুনেছিলেন।
এদিকে মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে আমি হিমশিম খাচ্ছিলাম, তাদের কি করে কাজে লাগাবাে ভাবছি, আবার ট্রেঞ্চেও পাঠাচ্ছি। ক্যান্টনমেন্টের উত্তর-পূর্ব দিকে যে রাস্তাটা-তার পূর্বে কয়েকটি ট্রেঞ্চ কাটা হয়েছিল—সেখানে পাঠাচ্ছি। কোন অস্ত্র কিভাবে চলে আমাদের জানা নেই। অফিসার বলতে ঐ একজন-জেসিও গনি। আর আমরা সবাই তাে অস্ত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলাম না। আমি কালুরঘাটে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন ভূঁইয়াকে ফোন করলাম। ফোনে আমার ক্যাম্পাসে যে সমস্ত সৈনিক আছে, পুলিশ আছে, আনসার আছে তাদের নেতৃত্ব দেবার জন্য একজন। দক্ষ অফিসার অবিলম্বে পাঠাবার জন্য বললাম। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া আমাকে বললেন, মেজর জিয়ার সঙ্গে পরামর্শ না করে কিছু করা যাবে না। তিনি আপাতত এখানে নেই। তাঁকে বললাম, মেজর জিয়ার সঙ্গে পরামর্শ করে অবিলম্বে একজন অফিসার পাঠিয়ে দিতে। তিনি একজন অফিসার পাঠালেন। সে অফিসারের নাম বােধ হয় আমি দু’এক জায়গায় বলেছি। এখন আমি বলছি না। সে অফিসার এলেন ক্যাম্পাসে। আমি অফিসে বসে আছি। শুনলাম একজন অফিসার আর দু’জন ছাত্র এসেছে। তারা এসে আমার ক্যাম্পাসে যারা সামরিক সদস্য আছে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে এবং অস্ত্রশস্ত্র কি আছে তাও পরীক্ষা করেছেন। হাবিলদার গনি এই খবর আমাকে গােপনে পাঠিয়ে দিল একজন সৈনিক মারফত। আরাে খবর পাওয়া গেল যে, ঐ অফিসার বলছে যে, সে এখন চলে যাচ্ছে—সংগে গাড়ি আছে। গাড়ি নিয়ে সীমান্তে যাচ্ছে—আরাে অস্ত্র আনতে। একজন শিক্ষক তাকে জানান যে, এখানে ভাইস চ্যান্সেলর সাহেব বসে আছেন তার অফিসে যা কিছু করার তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করেই করবেন। এর জবাবে ঐ সামরিক অফিসার বলেন, তাঁকে আমি। চিনি। তাঁর বড় ছেলে আমার বন্ধু। এসব কথা শােনার পর অফিসারের গতিবিধি আমার ভাল বলে মনে হলাে না। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার সেক্রেটারী মকবুল ইসলামকে (বর্তমানে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার) ডেকে বললাম যে, তুমি মাহমুদ সাহেবকে খবর দাও। তিনি যেন এখনই চলে আসেন। আর একজন লােককে পাঠাও হাবিলদার গনির কাছে সে যেন একজন অস্ত্রধারী সৈনিক এখানে পাঠায়। সে আমার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করবে—একথাও বলে পাঠাও। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি জীপে তিনজন এসে পৌছালাে। আমার সাথে দেখা
৬৮
করলাে তারা। আমি অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম তােমাকে কে পাঠিয়েছে ? সে উত্তর দিলাে, ক্যাপ্টেন ভূইয়া আমাকে পাঠিয়েছেন। আমি বললাম, ভুইয়া সাহেব পাঠিয়েছেন ভাল কথা। কিন্তু তুমি আমার সাথে দেখা না করেই সরাসরি সৈন্যদের ওখানে কেন গেলে ? ‘স্যার, আমি মনে করলাম আমাদের সৈন্যসংখ্যা কত তা আগে দেখা উচিত সে উত্তর দিলাে। আমি বললাম, কিন্তু তুমি গাড়ি নিয়ে সীমান্তে যাবে এ কথা কেন বলছাে ? সীমান্তে তােমাকে অস্ত্র দেবে কে ? কত মাইল দূরে ? তুমি এ গাড়ি নিয়ে যেতে পারবে একথা তােমাকে কে বললাে ? রাস্তাঘাট সব কেটে রাখা হয়েছে, বহু পুল উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যেতে হলেও এ গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না। তুমি কোনাে খবর না জেনেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছাে। বললাে, না স্যার, আমি ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার সঙ্গে আলাপ করে কাজ করতাম। আমি এখানে রয়েছি, তুমি আমার সঙ্গে কথা বলবে না ? সে বললাে, স্যার আপনার বাসায় আমি গিয়েছিলাম। আপনার বড় ছেলে ফারুক আমার বন্ধু। তার আর কোনাে কথা বলার আগেই আমি বললাম, তুমি কবে স্বাধীনতা সংগ্রামে যােগ দিয়েছাে ? সে বললাে, স্যার আমি আজকেই এসেছি। আমাকে ওরা কনফাইন্ড রেখেছিলাে ক্যান্টনমেন্টে। আমাকে ওরা মারধর করেছে। জামা-কাপড় খুলে সে মারের দাগ দেখালাে। আমাকে মারধর করে আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছে যে আমি আর কোনাে রকম বেঈমানী করবাে না পাকিস্তানের সঙ্গে। আমি কোরআন স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করেছি। তারপর তারা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। আমার পরিবার পরিজনদের সঙ্গেই দেখা করবার জন্য তাদের কাছে আবেদন করেছিলাম আমি। স্যার, আমি আজকেই ছাড়া পেয়ে সােজা কালুরঘাট গিয়েছি সংগ্রামে যােগ দেব বলে ওখান থেকেই আমাকে পাঠানাে হয়েছে। ক্যাপ্টেন ভুইয়াকে তুমি জিজ্ঞেস করনি কার সঙ্গে দেখা করতে হবে ?” আমি বললাম। তখন সে চুপ রইলাে। আমি বললাম, আমি যা বলছি এজন্যে কিছু মনে করাে না। আমি তােমাকে সব দায়িত্ব দেব। আমি একজন অফিসার চেয়েছিলাম ভূঁইয়ার কাছে। আমি ভূঁইয়ার সঙ্গে কথা বলে নিই। তুমি ওয়েটিং রুমে বস। চা খাও। আমি কথাবার্তা বলার পর তােমাকে খবর দেবাে। তােমাকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্পাসে যাবাে। আমার ক্যাম্পাসে যেসব সৈনিক অবস্থান করছে তাদের দায়িত্ব তােমার উপর অর্পণ করবাে। আমার সেক্রেটারীকে সঙ্গে দিয়ে তাকে পাশের ঘরে পাঠিয়ে দিলাম। সে পাশের ঘরে গিয়ে বসলাে। আমি প্রফেসার মােহাম্মদ আলীকে বললাম যে, পাশের ঘরে তিনজন লােক আছে-তাদের সঙ্গে অস্ত্র আছে। মনে হলাে তিনজনের কাছেই ছয়টি রিভলবার আছে। ওদের আমি এ্যারেস্ট করবাে। মােহাম্মদ আলী সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে? আমি বললাম, আমার সন্দেহ হচ্ছে ওরা শত্রুপক্ষের লােক। সন্দেহ আরাে করছি এজন্য যে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া আমাকে জানালাে না কেন। সে শত্রুর এজেন্ট হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়—কারণ তাকে মারধর করার পর ছেড়ে দিল। কেন—যেখানে আমাদের লােকজনকে পাকিস্তানীরা হত্যা করছে ? নিশ্চয়ই সে খবরাখবর দেবার প্রতিজ্ঞা করে এসেছে। আমার ভয়—হি মে বি এ স্পাই। এ
৬৯
সন্দেহ নিরসন না হওয়া পর্যন্ত আমি ওদের আটকিয়ে রাখবাে। প্রফেসর মােহাম্মদ আলীকে বললাম, “যে সােফাতে ওরা বসেছে সেই সােফার উল্টো দিকে তুমি বসবে। সােফার দিকে নজর রাখবে। কারণ যদি গুলির নির্দেশ আমাকে দিতে হয়। তাহলে গুলি করলে তােমার গায়ে গুলি লাগতে পারে। একটু ডিস্টেন্স মেইনটেন। করাে টিল সাচ টাইম আই এন্টার দি রুম-আইদার ফর এ গুড অর ফর গিভিং এ ডাইরেকশন অর অর্ডার। আমি এই মুহূর্তে কাউকে পাচ্ছি না। তােমাকে পাওয়া গেছে—তুমি ঐ কামরায় গিয়ে চা খেতে থাকো। এ্যান্ড ডন্ট বি নার্ভাস। তারপর আমি ওয়েট করছি যে জীপের আওয়াজ কখন হয়, আমি বেরিয়ে আসবাে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা জীপের আওয়াজ হলাে, বেরিয়ে এলাম। আমার পেছনে আসল আমার প্রাইভেট সেক্রেটারী মকবুল আর জহুরুল বলে একজন পার্সোনাল এ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল সে। তারা এখনাে জীবিত সবাই। আমি বেরিয়ে এসে দেখলাম একজন ইউনিফর্ম পরা লােক। তার সঙ্গে অটোমেটিক রাইফেল। তাকে আমি বললাম, আমার সঙ্গে সঙ্গে যাবে। আমি ঐ ঘরের দরজা খুলে দেব। দরজা খােলার সঙ্গে সঙ্গেই ওদের বলবাে, হ্যান্ডস আপ। হ্যান্ডস আপ যদি না করে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ওদের তিনজনেরই পায়ে গুলি করবে। কোনাে মায়া মমতা কর না। যদি হ্যান্ডস আপ করে তাহলে আমি অস্ত্র খুলে নিতে বলব। ছাত্র দু’জনকে আমি চিনি না। আমি গিয়ে দরজাটা খুললাম। ওরা তখন বসে চা খাচ্ছিল। আমি বললাম, ক্যাপ্টেন, হ্যান্ডস আপ। হাত তােল। সঙ্গে সঙ্গে ওরা হাত তুললাে। আমি সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র খুলে নিলাম। আমি বললাম, তােমরা পাশের কামরায় এসাে। এই ঘটনা হয়তাে তােমাদের হতভম্ব করেছে। তােমরা আমার মতাে ব্যক্তির কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ আশা করােনি। এটা স্বাভাবিক। আমি একজন শিক্ষক মানুষ। তবে জাতীয় প্রয়ােজনে অনেককে অনেক কিছু করতে হয়। কেন করলাম। তােমাদের বুঝিয়ে বলবাে। পাশের ঘরে তােমাদের ডেকে পাঠালে এসাে। আর যে পর্যন্ত না আমি তােমাদের ক্যাম্পাস থেকে গাড়ি করে বাইরে পাঠাই ততক্ষণ বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করাে না। বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করলে নির্দেশ আছে গুলি করা। হবে। দুজন অস্ত্রধারী লােককে আনানাে হয়েছিল। তারা পাহারায় থাকবে। ‘ডন্ট মেইক এনি এটেম্পট টু লিভ দি বিল্ডিং অর লিভ দিস রুম। যা বলা হবে তাই করতে হবে। বুঝেছ ?’ বললাে, হ্যা। আমি মােহাম্মদ আলীকে সঙ্গে নিয়ে চলে এলাম। ওদের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হলাে। কিছুক্ষণ পর ওদের ডাকা হলাে। আমি বললাম, উই আর পাসিং প্রু এ ক্রাইসিস, ক্রাইসিসটা কোনাে পারিবারিক না। ন্যাশনাল। তােমরা মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেবে বলে এসেছে। অত্যন্ত আনন্দের কথা। কিন্তু কতকগুলি কারণের জন্য আমার মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে। তুমি একজন ক্যাপ্টেন। অথচ আমার সঙ্গে দেখা কর নাই। তুমি যদি আমাদের অস্ত্রের হিসাব নিয়েও থাকো অথবা তােমাকে যদি সীমান্তে যেতে হয়— তাহলে তােমার প্রয়ােজন ছিল আমার সঙ্গে কথা বলে যাওয়া। কিন্তু তুমি তা করনি। দ্বিতীয়ত ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া বা মেজর জিয়া আমাকে এখনাে পর্যন্ত তােমাদের
৭০
সম্পর্কে কিছুই জানায়নি। তুমি তাদের দ্বারা প্রেরিত তা আমার বুঝবার কোনাে উপায় নেই। তােমাকে প্রাণে না মেরে, আটকিয়ে না রেখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তােমাকে ছেড়ে দিল কেন মুক্তিযােদ্ধাদের সম্পর্কে খবরাখবর দেবার জন্যই কি ? এ সন্দেহ কিন্তু অমূলক না। তুমি নির্দোষ হলেও এ মুহূর্তে আমি বিশ্বাস করবাে না । আর একটি বিষয়, তুমি যদি পাক্কা মুসলমান হও এবং তুমি যদি কোরান স্পর্শ করে বলে থাকো তুমি পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে বেঈমানী করবে না, তাহলে তুমি বেঈমানী করছাে। মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করে তাদের সঙ্গে বেঈমানী হচ্ছে। কোরান স্পর্শ করে ওয়াদা ভঙ্গ করছাে। আর যদি বলাে ‘কোরান শরীফ স্পর্শ করলেও স্যার জাতীয় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি, তাহলে তুমি সঙ্গে সঙ্গে এখানে চলে এলে কেন? আর সীমান্তে যাবে এ কথাটা বা কেন বললে ? কে তােমাকে অস্ত্র দেবে ? তােমার কি কোনাে যােগাযােগ আছে ? যাকগে বাবা, বসাে-খাওয়া-দাওয়া করাে। বইপত্র দিচ্ছি পড়াশােনা করাে। ডন্ট মেইক এনি এটেম্পট টু মুভ। ক্যাপ্টেনকে বিদায় করলাম। ঐ দুই ছেলেকে বললাম, “তােমরা কারা ? ঐ দুই ছেলে বললাে, ‘স্যার, আমরা ছাত্র। সিটি কলেজের না কমার্স কলেজের বললাে। আমি বললাম, “ওই অফিসারের সঙ্গে তােমাদের সঙ্গে দেখা হলাে কোথায়? বললাে, স্যার, এটাও একসিডেন্ট। আমরা গেছি মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেবার জন্য। আমরা দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় ঐ অফিসার আসলেন। তারপর ভূঁইয়া সাহেব অর্ডার দিলেন, ইউ টু গাে উইথ হিম। আমরা সার কিছুই জানি না। আমাদের গাড়ি আছে। গাড়িতে তাঁকে উঠালাম। ঐ গাড়িটা স্যার আমাদের। ঐ গাড়িতে তাকে উঠিয়ে নিয়ে আসি ক্যাম্পাসে। আপনার কথা বললেন যে, আপনার কাছে অনেক সৈন্য আছে, এটা তিনি দেখতে যাচ্ছেন। দায়িত্ব তিনি নেবেন। আমাদের পৌছে দেওয়ার জন্য বলা হলাে। আমরা কোনাে খবর রাখিনি, তাকে আমরা চিনিও না। আমি প্রশ্ন করলাম, এই আর্মস পেয়েছাে কোথায় ? ওরা বললাে, স্যার লুট করেছি আমরা। বন্দুকের দোকান লুট করা হয়েছে। সে অস্ত্রের একটা ভাগ আমরা পেয়েছি। আমরা সব মুক্তিযুদ্ধে যাবাে। আমি বললাম,’ একজন লােকের নাম বলাে যিনি তােমাদের চিনবেন। তারা তখন তরুণ এম. পি. আখতারুজ্জামানের কথা বললাে। আত্মীয় বলে পরিচয় দিলাে। ওদের কাছ থেকে টেলিফোন নম্বর নিয়ে আখতারকে আমি ফোন করলাম। আখতার বললাে, “হ্যা স্যার, ঠিক। ওদের একজন আমার আত্মীয়। ওরা মুক্তিযুদ্ধ করতেই গিয়েছে। ওরা স্যার যা বলেছে। মনে হয় সবই সত্য। আপনি বিশ্বাস করতে পারেন। ওদের ছেড়ে দিতে পারেন। আমি বললাম, ঠিক আছে। ওদের হার্মলেস বলেই মনে হলাে। একটা অস্ত্র রেখে ওদের চলে যেতে বললাম। ওরা চলে গেল। এরপর দুপুর গেল। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়াকে পাওয়ার চেষ্টা করলাম। মেজর জিয়াকেও পাওয়ার চেষ্টা করা হলাে। কিন্ত কাউকেই পাওয়া গেল না। দুপুর বেলা আমি খেতে গেলাম। পাহারার ব্যবস্থা যথারীতি করে গেলাম। তাড়াতাড়ি খেয়ে আমি অফিসে ফিরলাম। ফেরার পরপরই ফোন পেলাম আখতারুজ্জামানের। সে বললাে আপনি যাদের ছেড়ে দিয়েছেন।
৭১
তারা দুইজনই শহীদ হয়েছে। কিভাবে হলাে ? আমি ফোনে প্রায় চিৎকার করে উঠলাম। ওদের গাড়িতে ডাইরেক্ট হিট হয়েছে। দুটা ছেলেই স্যার মারা গেছে, সে জানালাে। আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি ফোনে কালুরঘাট কথা বললাম। কার সাথে যেন কথা বললাম ঠিক মনে নেই। ভুইয়া কিংবা রফিক। আমি বললাম যে, তােমরা কোনাে বুদ্ধিতে কাজ কর ? তােমরা দেশ স্বাধীন করবে এই মাথা নিয়ে ? একটি লােক সে ক্যাপ্টেনের পদমর্যাদায় আছে তাকে পাকিস্তান আর্মি আটকিয়ে রাখলাে, কয়েকদিন না খাইয়ে নির্যাতন করলাে, তার পায়ে দাগও আছে। সে তােমাদের সঙ্গে যােগ দিতে এলাে আর তােমরা কোনাে সন্দেহ ছাড়াই লােকটিকে পাঠালে পাঁচ-ছয় শ’ মুক্তিযােদ্ধাকে কভার করার জন্য। এই যদি তােমাদের বুদ্ধি হয়ে থাকে তবে আই এ্যাম ভেরী সরি টু সে দ্যাট দিস ইজ নট দি ওয়ে ইউ ক্যান মেইক ইউর কান্ট্রি ফ্রি। ন্যাশনাল ক্রাইসিসে একটু সাবধানে কাজ করতে হয়। আমি বললাম, আমি অফিসারটিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। কারণ তার কাছে আমি আর দায়িত্ব দেবাে না। তােমরা দেখ, ওয়াচ করাে এবং আমার যদি কোনাে পরামর্শ নাও, তার আচরণে সন্তুষ্ট হও তাহলে তাকে চার্জ দেবে। মে বি আই এ্যাম রং। তবুও একটু দেখে নাও। তারপর চার্জ দিও। অন্য কোনাে অফিসারকে পাঠাও যে তােমাদের সঙ্গে অনেক আগে থেকেই আছে। তাকে আমি চার্জ দিয়ে একটু স্বস্তি পাবাে।
এই নাটকীয় ঘটনা আমার মনে হয় ২৮ বা ২৯ মার্চ তারিখে ঘটেছিলাে। ৩০ তারিখও হতে পারে। আমি ফোনে বললাম, দেখ দুটো ছেলে মারা গেল। এই জন্য আমি নিজেকে অপরাধী মনে করছি। ঐ দুই ছেলেকে যদি আমি সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিতাম, তাহলে তােমাদের কাছেই ফিরে যেত। ফিরে গেলে তােমরা রিক্রুট করতে। তারা হয়তাে শহরে-বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাে। কিন্তু বােমার আঘাতে গাড়িসুদ্ধ উড়ে গেল দুটো ছেলে। শহীদ হয়ে গেল দুটো প্রাণ। পাকিস্তানীর বিরুদ্ধে লড়াই করবার পূর্বেই তাদেরকে প্রাণ দিতে হলাে। বহুদিন পর্যন্ত আমি ছেলে দুটির জন্য মানসিক কষ্ট পেয়েছি। রাতে আমার ঘুম কম হতাে। আমার মনে হতাে, ওদের আমি যদি আগেই ছেড়ে দিতাম তাহলে ছেলে দুটো হয়তাে মারা যেতাে না।
ঐ অফিসারকে আমি একটি ট্রাকে গার্ডসহ ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। পরবর্তীকালে যখন আমি আগরতলা গেলাম এবং মাঝে বােধ হয়। ইন্ডিয়ান একটা আর্মী ট্রেনিং সেন্টার ছিলাে-সেখানে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলাে। একটা বড় প্রাঙ্গণের মধ্যে কতকগুলি বিল্ডিং আছে ওখানে ওসমানী সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হলাে। তাঁকে আমি ঐ ক্যাপ্টেনের কথা তাকে বললাম। তিনি বললেন, আপনি ঠিকই তাে সন্দেহ করেছেন। আইদার হি ইজ এ কাওয়ার্ড অর সে কাওয়ার্ড না হলেও অত্যাচারিত হওয়ার পর বােধ হয় তার মধ্যে মনােবল বলতে কিছু ছিল না। হয়তাে আপনি যা সন্দেহ করেছেন তাও হতে পারে। আমি বললাম, কেন ? বললেন, তাকে আমি এর মধ্যে নােয়াখালী শহরে
৭২
পাঠিয়েছিলাম যেখানে আমাদের মুক্তিযােদ্ধা ছিল। তার বাড়ি তাে ওদিকেই তাই তাঁকেই পাঠালাম। বলা হয়েছিলাে নােয়াখালি শহরকে প্রটেকশন তােমরা দেবে যাতে পাকিস্তান আর্মী ঢুকতে না পারে। আমাদের মুক্তিযােদ্ধা আছে এবং আরাে লােক আছে, এ্যান্ড হি ওয়াজ সেন্ট দেয়ার। সেখানে গিয়ে যেখান দিয়ে শত্রু আসবে না এই জায়গায় অবস্থান নিয়েছিলাে—সেটা ছিল নদীর পাড়ে। পেছন দিক থেকে পাকিস্তান আমী এসে নােয়াখালি শহর দখল করে ফেলল। তারপর থেকে তাকে আমি সন্দেহের চোখে দেখি বলেই তাকে আমি ওরকম অভিযানে পাঠাইনি। মে বি যে আমি রং। পরবর্তীকালে তার সঙ্গে বােধ হয় আমার দেখা একবার কি দুবার হয়েছে। কোথায় আছেন তা আমি জানি না। নামটা আমি বলছি না তার। আমারই ভুল হয়েছিলাে তাও হতে পারে বা ওসমানী সাহেবের ভুল তাও হতে পারে।
এর কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ছাড়তে হলাে। কারণ তখন যুদ্ধ বেশ ভালােভাবে আরম্ভ হয়ে গেছে। বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ হচ্ছিল। আমাদের দুই ছাত্র আদুর রব (ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক) এবং ফরহাদ ২৯শে মার্চ কাপ্তাই রােডের উপর সম্মুখ সমরে শাহাদাত বরণ করে। ২৯শে মার্চ রাজনৈতিক নেতাদের সাথে ও কালুরঘাটে অবস্থানরত সামরিক অফিসারদের সাথে আমাদের যােগাযােগ ছিন্ন হয়ে গেল। চট্টগ্রাম শহরেরও পতন হয়ে গেল। আমরাও স্থান পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলাম। পরে শুনেছি, কালুরঘাটের সামরিক অফিসারেরাও স্থান পরিবর্তন করেছিল। ক্যাম্পাসের যে কয়জন যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধা ছিল তাদের দায়িত্ব দিয়ে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তার বাশার ও ডাক্তার আখতারউজ্জামানের উপর। আমরা নাজিরহাটের দিকে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। সৈনিকরা নাজিরহাটে ক্যাম্প করে থাকবে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবার আগ পর্যন্ত, ইউওটিসি’র ছেলেদের বলল যে ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে এবং যে যেখানে পারে যে কোনাে সংস্থার সাথে যুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করতে। আমার পক্ষে পরবর্তীতে তাদের দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয় এবং আমাদের পক্ষে যে ক্যান্টনমেন্ট আর অবরােধ করে রাখা সম্ভব নয় তাও তাদের বুঝিয়ে বললাম। ক্যাম্পাসে যেসব শিক্ষক পরিবার ছিল তাদের পাঠিয়ে দিলাম কুন্ডেশ্বরী গার্লস হাই স্কুলে। ওখানে সব পরিবার জমা হলেন। নূতন সিংহ সবার থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।
আমিও ঐ সময় আমার এক প্রাক্তন ছাত্র যার বাড়ি রাউজানে ছিল—ওখানে সপরিবারে উঠলাম। ক্যাম্পাস ছেড়ে আসার সময় আমি নাইট গার্ড, ডে গার্ড সবাইকে বলে এলাম যে তােমরা যার যার সুবিধামতাে যেখানে সুবিধা হয় চলে যাও। রাউজানে সপ্তাহখানেক ছিলাম আমি। এর মধ্যে আমি জানতে পারলাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সেনাবাহিনী ঢুকে পড়েছে। আমাদের একজন গার্ড বােকার মত সেখানে ছিল। সে কিছু বুঝতে পারেনি—এমন হতে পারে। পাক সেনারা তাকে হত্যা করে। তারা আমার বাড়ি-ঘর লুটপাট করেছে এমন খবরও পেলাম। যাই হােক, কুন্ডেশ্বরী গার্লস স্কুলে যারা আশ্রয় নিয়েছিলাে তাদেরকে আমি আরাে
৭৩
উত্তরে চলে যেতে বললাম। অবশেষে ৮ই এপ্রিল রাউজান থেকে আমি নাজিরহাট চলে গেলাম। সেখানে আমাদের সৈন্যরা আগেই অবস্থান নিয়েছিলাে। নাজিরহাটে জওয়ানদের সঙ্গে আমি এক রাত কাটালাম। রাতে তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম রামগড়ে আমাদের আর একটি ঘাঁটি রয়েছে সেখানে জিয়াউর রহমান। অবস্থান করছেন। তাঁর সঙ্গে আরাে বেশ কিছু সংখ্যক সামরিক অফিসার রয়েছেন। আরাে জানতে পারলাম যে, রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক তৌফিক ইমাম যিনি প্রথম দিকে আমাকে সামরিক বাহিনীর কিছু সংখ্যক সৈন্য পাঠিয়েছিলেন—তিনিও রামগড় চলে গেছেন। এই অবস্থায় আমরা ঠিক করলাম যে প্রথমে আমি রামগড় চলে যাব এবং তার পরপরই এই বাহিনীর সদস্য যারা আছেন তারা রামগড় গিয়ে আমাদের সঙ্গে যােগ দেবেন। ড: আনিসুজ্জামানের পরিবার এবং আরাে কয়েকজন। যুবক আমার সঙ্গে গেলেন। রামগড়ে এসে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমাদের দেখা হলাে। তৌফিক ইমাম, মেজর শামসুদ্দিন, ক্যাপ্টেন রফিক, ক্যাপ্টেন ভুইয়া, ক্যাপ্টেন আফতাব, এস কে বজলুর রহমান প্রমুখ আগেই সেখানে পৌঁছে গেছেন। রামগড়ে গিয়ে আমরা কয়েকদিন রইলাম। ওখানে মুক্তিযুদ্ধের যে সমস্ত প্রস্তুতি নেওয়া দরকার সেগুলাে নেওয়া হলাে। এখান থেকে আমরা প্রতিদিনই কিছু কিছু ছেলেকে পাঠাতাম বিভিন্ন অপারেশনে। এক পর্যায়ে রামগড়ে থাকাও আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালাে। কারণ চারদিক থেকে শত্রু ক্রমশ এদিকে আসছে। আমার মনে আছে আমরা যখন রামগড়ে ছিলাম তখন আমাদের সব রকমের সহায়তা দিয়েছেন ওখানকার একটি চা বাগানের ম্যানেজার। তাঁর নাম আবদুল কাইউম। আমার সঙ্গে সৈয়দ আলী আহসান সাহেবের পরিবার, আনিসুজ্জামান সাহেবের পরিবার, ড: রশিদুল হকের পরিবার—সবাই ছিলাে। আমাদের কারাে বিছানাপত্র ছিল না। চা বাগান থেকে কতগুলাে সােফা সেটের গদি দেওয়া হয়, চাদরও দুই-একটা পাওয়া গিয়েছিলাে। সব বিছিয়ে রাত কাটিয়েছিলাম। ম্যানেজার ভদ্রলােক প্রচুর সহায়তা করেছেন। এর মধ্যে আর একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল। আমরা বুঝতে পারছিলাম এখানে আর থাকা যাবে না। জিয়া ও অন্যান্য অফিসাররা মনে করলেন যে প্রথমত আমার চলে যাওয়া উচিত। আমার পরিবারবর্গের দায়িত্ব তারা নেবেন। তারা আমার পরিবার পরে পাঠিয়ে দেবেন। বিভিন্ন মহল থেকে আমাকে খোজাখুঁজি করা হচ্ছে এ সংবাদ পাওয়া গেল। যেদিন আমি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি সেদিন ক্যাপ্টেন কাদের নামের এক তরুণ অফিসার আমার সংগে দেখা করলাে। সে জিয়ার নির্দেশে পাবর্ত্য চট্টগাম এলাকায় অপারেশনে যাচ্ছে। আমি তাঁকে দোয়া করলাম। পরবর্তীতে আমি জানতে পারলাম যে, অপারেশনে ক্যাপ্টেন কাদের শাহাদৎ বরণ করেছে।
এপ্রিলের মাঝামাঝি আমি রামগড় ত্যাগ করলাম। একটা জীপে করে আমি আগরতলা পৌছলাম। তার কিছু পরেই আমার পরিবারবর্গ, আলী আহসান সাহেবের পরিবারবর্গ আগরতলা পৌছে গেলেন। আমাকে একজন ক্যাপ্টেনের পরিত্যক্ত বাড়িতে থাকতে দেওয়া হলাে এবং অন্যদের রাখা হলাে টিচার ট্রেনিং
৭৪
কলেজের হােস্টেলে। ওখানে তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হলাে। আমার ব্যবস্থা আমি নিজেই করলাম। আমার স্ত্রী, ছেলে, বড় মেয়ে, জামাই সঙ্গে ছিলাে। তাদের নিয়ে আমি ঐ ক্যাপ্টেনের বাড়িতে রইলাম। সামরিক বাহিনীর দু’চারটা কম্বল দেওয়া হয়েছিলাে আমাদের। বালিশ নেই। ঐ অবস্থায় রইলাম। আমাদের পৌছবার অনেক আগেই এম. আর. সিদ্দিকী, জহুর আহমদ চৌধুরী প্রমুখ আগরতলা পৌছেছিলেন। তাদের সঙ্গে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে আমার আলােচনা হয়। অবিলম্বে স্বাধীন বাংলার সরকার গঠন এবং তা ঘােষণা দেওয়ার উপর আমি জোর দেই। আমি আলােচনাকালে বলি, তাজউদ্দিন সাহেবকে কলকাতায় খবর পাঠানাে হােক। তিনি যেন অবিলম্বে সরকার গঠন করে ঘােষণা দেন।
আগরতলায় আছি। একদিন রাত আটটার দিকে হবে—এক ভদ্রলােক তিনি নিজেকে আবদুল মালেক উকিল পরিচয় দিয়ে আমাকে জানালেন যে, তাঁকে তাজউদ্দিন সাহেব পাঠিয়েছেন কলকাতা থেকে। আমাকে নাকি অবিলম্বে কলকাতা যেতে হবে। মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাদের একটি সাক্ষাৎকার হবে তাতে আমাকে উপস্থিত থাকতে হবে। আমি তাঁকে জানালাম আমার পক্ষে পরের দিনই যাওয়া সম্ভব নয়—কারণ আমার পরিবারের একটা ব্যবস্থা না করে যেতে পারি না। এজন্য আমার দু’একদিন দেরী হতে পারে। আবদুল মালেক উকিল রয়ে গেলেন। তার পরের দিন আমি পরিবারের একটা ব্যবস্থা করে কলকাতা রওয়ানা দিলাম । আমার পরিবারবর্গকে কলকাতায় যেতে বললাম।
আমরা প্লেনে গেলাম। আমার জন্য টিকেট পাঠিয়েছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ। ঐ টিকিট আমি গ্রহণ করিনি। আমি বলেছিলাম, যে পর্যন্ত দেশ স্বাধীন না হয়, দেশের অবস্থা ভালাে না হয় সে পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে এরকম আর্থিক সাহায্য নেওয়া আমার ঠিক হবে না। আমার টাকা-পয়সা ফুরিয়ে গেলে তখন বিবেচনা করবাে। মালেক উকিল আমার পরিবারের জন্য টিকিট পাঠাবার কথা বলেছিলেন। সে প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলাম। আমি কোলকাতা পৌছলাম। এখানে খরচ বাবদ আমাকে মাসে মাসে পাঁচ শ’ টাকা করে সম্মানী দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। যা নাকি মন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তিরা পাচ্ছেন। আমি সে অর্থও গ্রহণ করিনি।
যাই হােক, কলকাতা পৌছানাের পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হলাে পার্ক সার্কাস এলাকায়—যেখানে ডেপুটি হাই কমিশনার-এর অফিস ছিল। হাই কমিশনে হােসেন আলী সাহেব ছিলেন। তিনি তখন পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারে যােগ দিয়েছেন। হাই কমিশনে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বলা হলাে যে আমি যেন আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি। কারণ জিজ্ঞেস করলাম । বলা হলাে আবু সাঈদ চৌধুরী সাহেব নাকি এখনাে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেন। নি।
তখন তিনি লন্ডনে ছিলেন। তিনি এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। তবে তিনি যুদ্ধ পরিস্থিতি বিষয়ে যােগাযােগ রাখছিলেন।
৭৫
টেলিফোন বুক করা হলাে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম কিন্তু লাইন পাওয়া গেল না । তখন আমাকে বলা হলাে আপনি একটি মেসেজ দেন। আমি জনাব চৌধুরীকে জানাতে বললাম যে, আমি ডিফেক্ট করেছি—আমি মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত হয়েছি আমি খুশি হবাে যদি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে আমাদের সঙ্গে যােগ দেন। ঐ মেসেজ রেখেছিলাম হােসেন আলী সাহেবের কাছে। এ সময় সেখানে মওদুদ আহমদ, মাহবুব আলম প্রমুখরা ছিলেন।
এর কয়েকদিন পরেই তিনি ডিফেক্ট করে আমাদের সঙ্গে যােগ দেন। লন্ডনে অস্থায়ীভাবে হাই কমিশন স্থাপন করেন তিনি। কলকাতায় পৌছে আমি দেখতে পেলাম অসংখ্য বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক এসেছেন। কিন্তু তাদের দিয়ে কাজ করাতে হলে যে সংস্থা বা সংগঠন দরকার তার। অভাব রয়েছে। এই অভাব পূরণে আমি ‘লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্টসিয়া নামের একটি সংস্থা গড়ে তুললাম। এই সংগঠনের সম্পাদক। হলাে জহির রায়হান—যিনি পরবর্তীকালে, স্বাধীনতার পরপরই মিরপুরে সহােদর শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে পাকিস্তানীদের হাতে প্রাণ হারান। আমাকে করা হয় সভাপতি। আমার সঙ্গে আর যারা এই কমিটিতে ছিলেন তারা হলেন—সৈয়দ আলী আহসান, খান সারওয়ার মােরশেদ, ফয়েজ আহমদ, ব্রজেন দাস, কামরুল হাসান প্রমুখ। প্রথম দিকে আমাদের সভা করার কোনাে স্থান ছিল না। আমরা সভা করতাম আমার ছাত্রী ড: পি. সি. ঘােষ-এর বাড়িতে। বাড়িটি পার্ক সার্কাস এলাকায়। ঐ মহিলা সভার ব্যয়ভার বহন করতেন। পরে আমি যখন বাসা নিলাম তখন থেকে আমার বাসাতেই সকল সভা বসতাে। আমার ছাত্রীই পার্ক সার্কাসের কাছে আমার বাসা ঠিক করে দিলেন। বাসা ভাড়াও ঠিক করে দিলেন ড: পি সি ঘােষ এবং তাঁর স্বামী কমল ঘােষ। বাড়ি ভাড়ার অগ্রিমও তাঁরাই দিলেন। আমার কাছে টাকা ছিল না। আমার বাসার কাছাকাছি থাকতেন ড: মােশাররফ হােসেন, পুলিশ বিভাগের আবদুল খালেক প্রমুখ। পরে আমাদের অফিসের জন্য আমরা আরাে জায়গা পেয়েছি। নেতাজী রিসার্চ ইন্সটিটিউট-এ কিছুদিন আমরা অফিস করি। পরবর্তীকালে কলকাতার অরূপ চৌধুরী নামের অপর এক বাঙালি ভদ্রলােক যিনি একসময় আমাদের পূর্ব বাংলায় ছিলেন, তাঁর বাবাও পূর্ব বাংলায় ছিলেন, আমাদের কাজের জন্য সেই অরূপ চৌধুরী তার অফিস ছেড়ে দিয়েছিলেন। ফলে আমাদের লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্সিয়া’র মিটিং বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত হয়। আমরা এই সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত শিল্পীদের দিয়ে বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সংগীত পরিবেশন করিয়েছি। এ বিষয়ে সহায়তা করেন মৈত্রেয়ী দেবী, গৌরী আয়ুব, বিচারপতি মাসুদ, অধ্যাপক আবদুল ওয়াহেদ, মাহমুদ প্রমুখ । একই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড: সত্যেন সেনকে সভাপতি এবং দিলীপ চক্রবর্তীকে সম্পাদক করে গঠিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি’। এঁরা মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে আমাদের সহায়তা করেছেন। এই
৭৬
সংগঠন শরণার্থীদের বিশেষ করে শিক্ষকদের দেখাশুনা করেছেন। এদের কাজের সুবিধার জন্য আমার সভাপতিত্বে কলকাতা দারভাঙ্গা ভবনে সকল পর্যায়ের কয়েক হাজার শিক্ষকের এক বিরাট সভা অনুষ্ঠিত হয়। এখানেই গঠিত হয় শিক্ষক সমিতি অর্থাৎ বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি। এই সংগঠনেরও সভাপতি করা হলাে আমাকে। সম্পাদক করা হয় ড: আনিসুজ্জামানকে। সহ-সভাপতি করা হয় তদানীন্তন এমপি কামরুজ্জামানকে। সৈয়দ আলী আহসান, খান সারওয়ার মােরশেদ প্রমুখ এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ঐ সভায় সভাপতি হিসেবে যে বক্তব্য আমি রেখেছিলাম কলকাতা বেতারে তা প্রচারিত হয়। সে বক্তব্য বাংলাদেশের অনেকেই সেদিন শুনেছিলেন। বক্তব্যে আমি আমার পরিস্থিতিটা তুলে ধরেছিলাম। পরবর্তীতে আনিসুজ্জামানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা সেলে নিয়ােগ করা হলে শিক্ষক সমিতির সম্পাদক করা হয় ড: অজয় রায়কে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি মুক্তিযুদ্ধে প্রচুর অবদান রেখেছে। শরণার্থী শিবিরে এই সংগঠনের সাহায্যে ছােট ছােট ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা হয়। প্রত্যেক শিবিরেই প্রাথমিক পর্যায়ে ছােট ছােট ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা হয়। কারণ তখনাে পর্যন্ত আমরা ঠিক করতে পারিনি কতদিন পর্যন্ত আমাদেরকে এভাবে থাকতে হবে। পুস্তিকা, প্রচারপত্র গ্রন্থ প্রণয়ন ও বিতরণ করা হয় এই সংগঠনের মাধ্যমে। বিভিন্ন দেশের শিক্ষকদের সঙ্গেও যােগাযােগ স্থাপন করা হয়। বিভিন্ন দেশে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সাহায্যের আবেদন জানানাে হয়। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার অভিযান চালানাে হয়। আবার অনেককে পারিবারিকভাবেও আর্থিক সাহায্য প্রদান করা হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি এ ব্যাপারে আমাদের সহায়তা করেছে। ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকেই আমাদের অর্থ সাহায্য করতেন। আমরা বিভিন্ন জায়গায় যখন সভা করতাম ঐ সভাতেই অনেকে টাকা দেয়ার জন্য এগিয়ে আসতেন। টাকা আমরা গ্রহণ করতাম না। আমরা তাদেরকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির কাছে জমা দিতে বলতাম। তাদের মারফৎ আমরা টাকা নিতাম। বেশ কয়েক লক্ষ টাকা বিভিন্ন সভাতে আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে। বহু সংস্থাও এগিয়ে এসেছে। আমার মনে আছে বােম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর একটি সভায় সভাপতি হিসেবে ছিলেন। আমি সেই সভায় বক্তৃতা দিয়েছিলাম ওখানে সর্বমােট ৬০ লক্ষ টাকা দেওয়ার জন্য এগিয়ে এলাে বিভিন্ন ব্যক্তি, সংস্থা। আমরা নিজেরা টাকা গ্রহণ করিনি। ড: আনিসুজ্জামান আমার সঙ্গে ছিলাে। সেই টাকাগুলাে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। এ সময় আমি নিজে শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং লিবারেশন কাউন্সিল। অফ ইন্টেলিজেন্সিয়ার সভাপতি হিসেবে বিদেশে আমার পরিচিত বহু বন্ধুবান্ধবকে চিঠি লিখেছিলাম। অস্ট্রেলিয়া ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে সাউথ এশিয়ান হিস্ট্রির প্রফেসর ছিলেন এ. এল. ব্যাশাম, যিনি আমার পূর্বপরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু ।
৭৭
তাকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে চিঠি লিখেছিলাম। তিনি আমার চিঠিটা কপি করে তাঁর প্রধানমন্ত্রীকে এবং বিভিন্ন সংস্থাকে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি একবার কলকাতায় আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন-তাঁর সহযােগিতা, সাহায্যের কথা আমি ভুলবাে না। তিনি কিছুদিন আগে মৃত্যুবরণ করেছেন। অস্ট্রেলিয়া প্রধানমন্ত্রী ম্যালকোম ক্লার্ককে লেখা চিঠির একটি কপি আজো আমি বহন করছি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে ভারতের বিভিন্ন শহরেনগরে যখনই আমি সভা করতে চেয়েছি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি তাৎক্ষণিকভাবে আমাদেরকে নানাভাবে সহায়তা প্রদান করেছে। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে সভার আয়ােজনও তারা করতেন। সহায়ক সমিতির প্রতিনিধি আমাদের সঙ্গে থাকতেন। প্রতিনিধি দলের মধ্যে সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ চক্রবর্তী, সৌরেন ভট্টাচার্য, আনিল সরকার, ড: অনিরুদ্ধ রায়, জ্ঞানেশ পত্ৰনবীশ প্রমুখের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। আমাদের পক্ষ থেকে ড: আনিসুজ্জামান মাঝে মাঝে যেতেন। বিশ্বকান্তি শাস্ত্রী, সংস্কৃতের অধ্যাপক ছিলেন। তিনিও আমার সঙ্গে থাকতেন। আমার ইংরেজী বক্তব্যকে হিন্দি করে সঙ্গে সঙ্গেই জনসাধারণকে শােনাতেন। অনেক সভাতেই তাঁকে নিয়ে গিয়েছি। বিভিন্ন স্থানের মধ্যে এলাহাবাদ, আলীগড়, লক্ষ্ণৌ, দিল্লী, বােম্বে, মাদ্রাজ, কেরালা, পুনা, জয়পুর, পাটনা, অমৃতসর, বর্ধমান প্রভৃতি স্থানের কথা মনে পড়ছে। ছােট-বড় প্রায় ত্রিশটি শহরে আয়ােজিত জনসভাতে আমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বক্তৃতা দিই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে জনমত গড়ে তােলাই ছিলাে এসব জনসভার মূল লক্ষ্য। জনসভা, আলােচনার মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌছানাের বিষয়টি ছিলাে পরিকল্পিত।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী প্রমুখের অনেক আগেই কথা হয়েছিলাে। কথা অনুযায়ী ইন্দিরা গান্ধীও চাচ্ছিলেন যে, আমরা জনসাধারণের কাছে আবেদন করি, জনমত গড়ে তুলি-যাতে তাঁর পক্ষে আমাদের সহায়তা করার সুবিধা হয়। আগেই বলেছি আমাদের সঙ্গে যারা যেতেন তারা আমার বক্তৃতা ইংরেজী থেকে হিন্দি করতেন। এ কাজটি বিশ্বকান্ত শাস্ত্রী বেশ নিষ্ঠার সঙ্গেই করতেন। আবার কোথাও কোথাও উর্দু তরজমা করতেন আমাদের বাংলাদেশের এক যুবক। সভা-সমিতির যেসব স্থানে আমরা যেতাম সেখানকার পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা সচেতন ছিলাম। আলীগড়, লক্ষৌর পরিবেশ পরিস্থিতি বিশেষত আলীগড়ের পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে ছিলাে না। যখন আমরা আলীগড় পৌছলাম তখন ঠিক হলাে যে কেবল আমি একাই বক্তব্য রাখবাে। স্থানীয় নেতা যারা আমাদের সমর্থক ছিলেন তাঁরা আমাকে বললেন যে, আপনি একাই বক্তৃতা দেবেন আর কাউকে বক্তৃতা দিতে দেওয়া হবে না। কারণ আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশই পাকিস্তানের সমর্থক। সুতরাং যিনি বক্তৃতা দেবেন তিনি এবং তার বক্তব্য এমন হওয়া প্রয়ােজন
৭৮
যেন তিনি যে কোন পরিস্থিতি মােকাবেলা করতে সক্ষম হন। তাই ঠিক হলাে। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে গেলাম। আমার মনে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলটি পুরুষ-মহিলায় ভরা ছিলাে। আমি এখানে বসে চিন্তা করলাম যে সভাতে এমন বক্তব্য রাখা দরকার যা সবাইকে স্পর্শ করবে। এ সভাতে আমি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমির ওপর দীর্ঘ বক্তব্য রাখলাম। বলেছিলাম যে, পাকিস্তান আন্দোলনে আমি ছিলাম । ছাত্র হিসাবে পাকিস্তান সৃষ্টিতে আমি সহায়তাও করেছি। তখন পাকিস্তানে বিশ্বাস করতাম। কিন্তু সে বিশ্বাস টিকে থাকেনি। আমরা হলাম বঞ্চনার শিকার। অনেক উদাহরণ দিলাম। বিভিন্ন হেডকোয়াটার্স, আর্মী, নেভী, এয়ারফোর্স থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকারে—সর্বত্রই আমাদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছে-ন্যায্য হিস্যা দেওয়া হয়নি। আমরা সবদিক দিয়ে বঞ্চিত হয়েছি। আমাদের মন ভেঙ্গে পড়েছিলাে। এরপর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে সরকার গঠন করতে দেওয়া হলাে না। আমরা বুঝে ফেললাম পাকিস্তান রাষ্ট্র আমাদের কোনাে সুবিধা বা কোনাে কল্যাণ বয়ে আনবে না। আমরা এ সময় অনুধাবন করলাম যে, পাকিস্তান করতে যাওয়াটাই বােধ হয় ভুল হয়েছে। আজকে। আপনারা যারা এদেশে আছেন তাদের তাে আমরা পাকিস্তানে নিতে পারিনি। এসব কথা বেশ জোরালােভাবে আবেগময় ভাষায় বলেছিলাম। পটভূমির পর আমি বলেছিলাম পাক সেনাদের নির্যাতনের কথা। বিশেষ করে নারী নির্যাতনের কথা। আমি কিছু ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেছিলাম যে, মেয়েদেরকে কিভাবে ধর্ষণ করে, অত্যাচার করে উলঙ্গ অবস্থায় সীমান্ত দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে-যে দৃশ্য আমি। নিজে প্রত্যক্ষ করেছি। কিভাবে একটি বাচ্চাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে- মরা বাচ্চা কোলে নিয়ে মহিলারা শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছে, কিভাবে একজন মহিলার একটি স্তন কেটে ধর্ষণ করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘটনাগুলাে বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম যে মহিলারা আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদছেন। আর সমস্ত সভার মানুষ মানে পুরাে হলঘরটি স্তব্ধ হয়ে রইলাে। এরপর আমি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে বললাম। দু’একটি প্রশ্ন যারা করলেন তারা ছিলেন পুরুষ। কেবল একজন মহিলা দাঁড়িয়ে শুধু বললেন যে, “আমরা যা শুনলাম এর পরে আমাদের আর শােনার কিছু রইলাে না। আমরা আপনাদের সঙ্গে সহযােগিতা করবাে’ এছাড়াও ঘরােয়াভাবে আলােচনা করতাম। বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, গভর্নর, সরকারী কর্মকর্তাসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। দিল্লীতেও এ রকম গুরুত্বপূর্ণ আলােচনা আমরা করতাম। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, ইন্দিরা গান্ধী প্রমুখের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছি।
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারের সময় আমার সঙ্গে বােধ হয় ড: আনিসুজ্জামান ছিলেন। সম্ভবত সৈয়দ আলী আহসানও ছিলেন। আরাে দু’একজন ছিলেন, যাদের নাম মনে পড়ছে না। শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎকার। অনেকক্ষণ হয়েছিলাে। তিনি ধৈর্য সহকারে আমাদের কথা শুনেছিলেন। কিন্তু তিনি
৭৯
কোনাে কমিটমেন্ট করেন নি। তিনি জানতে চাচ্ছিলেন আমরা জাতি হিসাবে কতটা ঐক্যবদ্ধ এবং সংগ্রামী চেতনা আমাদের কোন্ স্তর পর্যন্ত পৌঁছেছে। এ আন্দোলন কি কেবল শিক্ষিত সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ, না কি তার বাইরেও বিস্তার লাভ করেছে। আমি মিসেস গান্ধীকে ভারতে আশ্রয় নেবার পূর্বের চট্টগ্রাম এলাকার সার্বিক চিত্র তুলে ধরলাম। গ্রামের অশিক্ষিত হাজার হাজার মানুষ যে আমাদের সাহায্য করেছে তার কথা আমি উল্লেখ করলাম। আমি চার-পাঁচ শ সামরিক সদস্য নিয়ে ক্যাম্পাসে ছিলাম, তাদের খাবার-দাবার গ্রাম থেকে প্যাকেট হিসাবে আসতাে। গ্রামের কৃষকের ঘরের মহিলা সদস্যরা রুটি বানিয়ে প্যাকেট করে আমাদের পাঠাতাে, সে কথাও বেশ স্পষ্ট করেই জানিয়েছিলাম। আমার বক্তব্য শােনার পর সংগ্রামী চেতনা যে সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে এ বিষয়ে মিসেস গান্ধীর মনে আর কোনাে সন্দেহ রইলাে না বলে মনে হলাে। মিসেস গান্ধীকে আমি এ কথাও বলি যে, আমি রাজনীতিবিদ নই। আমি একজন শিক্ষক। জীবনে কোনদিন রাজনীতি করিনি। আমি বেরিয়ে আসলাম কেন ? আমাকে তাে মারতে আসেনি। কেউ, আমাকে ধরতেও আসেনি কেউ। আমি অনুভব করেছি সমগ্র দেশের মানুষ মুক্তি চায়। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের আর তাঁদের প্রয়ােজন নেই।
সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের সঙ্গেও কথা বলেছিলাম। তিনি মিসেস গান্ধীর খুব কাছের লােক ছিলেন। মিসেস গান্ধীর ব্যক্তিগত উপদেষ্টা ছিলেন ডি.পি. ধর, তার সঙ্গেও আলােচনা করেছিলাম। দুইজন ডি.পি. ধর ছিলেন। একজন ছিলেন শিক্ষক, অপরজন উপদেষ্টা ছিলেন। এদের আমি চিনতাম, কথাও হয়েছে।
নূরুল হাসান ছিলেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। তিনি আমাকে আলীগড়ে গিয়ে বক্তৃতা দেবার কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন খেয়াল রাখবেন যেন আপনার বক্তৃতা আলীগড়ের মানুষকে স্পর্শ করতে পারে। তিনি আলীগড় সম্পর্কে ভালাে জানতেন তাই একথা বলেছিলেন। ড: নূরুল হাসানের সঙ্গে বহুদিন আগে থেকেই আমার পরিচয় ছিলাে। তিনি সে সময় নানাভাবে সহায়তা করেছেন। অশােক মিত্র নামের একজন আইসিএস ছিলেন-তিনিও প্রচুর সাহায্য করেছেন নানাভাবে।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলােচনা হতাে। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলােচনা করবার সময় আমাকে আরাে প্রস্তুতি নিতে হতাে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য। সুতরাং, সারাদিন পরিশ্রম করেও রাতের বেলায় কোথাও কি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারি তার সম্ভাব্য উত্তর কি হতে পারে—সেগুলাে আমাকে ঠিক করতে হতাে।
মন্ত্রী, সরকারী কর্মকর্তা, পুরনাে বন্ধু-বান্ধবসহ সবার সঙ্গে আলােচনা করে আমার ধারণা বদ্ধমূল হলাে যে, ভারতবর্ষের জনসাধারণ এবং সরকার সবাই চায় যে আমরা স্বাধীন হই। তারা বােধ হয় এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে দেশটি স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তারা যে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর বােঝা বহন করছেন তা থেকে তারা নিস্তার পাবেন না। ভারত সরকার আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে আরাে বেশি সাহায্য করুক সাধারণ মানুষও তাই চাচ্ছিলাে। সরকারকে চাপ দেওয়ার জন্য
৮০
তারা সব সময় প্রস্তুতও ছিলাে। ভারতের জনগণ বুঝেছিলেন যে আমরা যেভাবে সংগ্রামী মনােভাব নিয়ে কাজ করছি তাতে দেশ স্বাধীন হবেই। তাড়াতাড়ি স্বাধীন হলে তাদের দেশ ভারতও নানা সমস্যা থেকে মুক্ত হয়। আর আমরাও মুক্ত হই। এজন্য সরকারকে যত ধরনের সমর্থন দেওয়ার তাতাে তারা দিচ্ছিলেনই সেই সঙ্গে চাপ সৃষ্টি করছিলেন যাতে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার আরাে বেশিভাবে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। এখানে উল্লেখ করা বােধ হয় প্রয়ােজন যে সমস্ত সভাসমিতিতে আমি যেতাম সেখানেই দেখতে পেতাম সরকারী পক্ষের লােক উপস্থিত আছেন। দু’একটি ঘটনার কথা বললে বিষয়টি আরাে পরিষ্কার হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রশ্নে সরকার এবং বিরােধী দলেরও কোনাে দ্বিমত ছিলাে না।
পাটনাতে যে সভা করা হয় তাতে হাজার হাজার লােক হয়েছিলাে। পাটনা শহরে আমার বন্ধু-বান্ধব কিছু ছিলেন। ভারতীয় বন্ধু-বান্ধব এঁরা। যারা আমার সাথে লেখাপড়া বিদেশেই করেছেন এঁদের সঙ্গে যােগাযােগ ছিলাে। বিরাট এ সভাতে মঞ্চ করা হয় প্রায় বিশ ফুট উঁচু করে। এ সভাতে সভাপতিত্ব করেন জয়প্রকাশ নারায়ণ। প্রধান বক্তা ছিলাম আমি আর বিশেষ বক্তা ছিলেন গভর্নর ড: বড়ুয়া, পাটনার গভর্নর। সুতরাং দেখা যাচ্ছে সরকার বিরােধী এবং সরকার পক্ষের লােক সবাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছিলাে। রাতে গভর্নরের বাড়িতে আমার খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছিলাে। আবার গভর্নরের বাসভবনে আমাদের আলােচনা হয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে। তৎকালীন সরকারবিরােধী নেতা কপুরী ঠাকুরও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর সঙ্গেও কথা হয়। ইন্দিরা গান্ধীর কট্টর সমালােচক-পরবর্তীকালে যিনি ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনী এলাকা থেকে গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রতিযােগিতা করেন এবং নির্বাচিত হন সেই বিরােধী নেতা রাজনারায়ণও আমাদের সমর্থন করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন সভাতে যােগদান করতেন, বক্তব্যও রাখতেন। এলাহাবাদে তিনিই এক বিরাট জনসভার আয়ােজন করেন। এ সভাতে। আমাকে প্রধান অতিথি করা হয়েছিলাে। আমি দীর্ঘ বক্তব্য রেখেছিলাম। সেই সভা অঙ্গনে দেখেছিলাম একটি তােরণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক বিরাট প্রতিকৃতি টাঙানাে হয়েছে। আমার বক্তৃতার পর অনেকেই ভারত সরকারকে আরাে বেশি করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করার আহ্বান জানালেন। এবং তাঁরা বলতে লাগলেন যে দেরি করে ভারতেরই ক্ষতি হচ্ছে। অপরদিকে বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা চাইলেন ইন্দিরা গান্ধী আরাে এগিয়ে আসুন। প্রকাশ্যভাবে আমাদের সঙ্গে তিনি দেখা করুন। বিরােধী এবং সরকার উভয় পক্ষেরই এই মত ছিল।
বােম্বের জনসভায় উপস্থিত হয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের নবাব ইয়ারজং খান। ঐ সভাতেও সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিলাে। নবাব ইয়ারজং খান-এর অবদানের কথা আজো মনে পড়ে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমি তখন ভারতে হাই কমিশনার। একদিন নবাব ইয়ারজং খান দিল্লীতে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তিনি আমাকে জানালেন বাংলাদেশের সাহায্যের জন্য তিনি যে আহ্বান
৯৭
জানিয়েছিলেন, তহবিল গড়ে তুলেছিলেন, সেই তহবিলে এখনাে টাকা আসছে মনি অর্ডার যােগে। তাঁর কাছে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা জমে আছে। ঐ টাকাটা তিনি আমাকে দিতে চান—দেশ স্বাধীন হলেও টাকা যেহেতু সংগ্রহ করা হয়েছিলাে বাংলাদেশের নামে এবং এখনাে লােকে সেই নামে টাকা দিচ্ছে। তিনি বললেন, গ্রামে হয়তাে অনেকেই জানে না যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। তাই এখনাে টাকা আসছে। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন কোনাে আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই। সরাসরি তিনি আমার বাসভবনে চলে এসেছিলেন সেদিন। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিলাে। আমি তাঁকে জানালাম টাকাটা নেবার আগে আমার একটু সময়ের প্রয়ােজন। তিনি আমাকে সময় দিলেন। আমি টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বললাম। বঙ্গবন্ধুকে বললাম, টাকা আমরা নিতে পারি। নবাব সাহেব বলেছেন যে। টাকা তিনি কি করবেন? এ টাকা ভারত সরকারেরও না, আবার এ টাকা ফেরতও দেওয়া যাবে না। সুতরাং টাকা আমরা নিতে পারি। তবে আমরাদেরও একটা দায়িত্ব আছে। বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের দায়িত্ব কি? বললাম, মহারাষ্ট্রে দুর্ভিক্ষ চলছে, এই দুর্ভিক্ষের সাহায্য হিসেবে দেয় টাকার সমপরিমাণ অথবা কাছাকাছি টাকার আলাদা একটা চেক আপনি পাঠিয়ে দিন-মহারাষ্ট্রের গভর্নরের নামে। তাহলেই আমাদের মনে আর কোনাে দ্বিধা থাকবে না। বঙ্গবন্ধু রাজি হলেন। নিচে নেমে গভর্নরকে বললাম, আমি চেক নেব। সঙ্গে সঙ্গেই চেক পেয়ে গেলাম। এই ঘটনার কিছু দিন পর বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রেরিত চেকটি মহারাষ্ট্রের দুর্ভিক্ষে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য পাঠানাে হয়। নবাব ইয়ারজং খান স্বাধীনতার পরও তার তহবিলে আমাদের জন্য সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন এবং তা দিয়েও গিয়েছিলেন। এ ঘটনা সত্যিই মনে রাখার মতাে।
লাক্ষ্মৌ যে সভা হয়েছিলাে সে সভার কথা আজো স্মৃতি হয়ে আছে। আমাদের পরিবেশ খুব সহযােগিতাপূর্ণ ছিল। আমাকে বলা হয়েছিলাে লাক্ষ্ণৌতে দুই-তিনটি সভাতে যােগ দিতে হবে। রােটারী ক্লাবে একটি, জনসাধারণের জন্য একটি, এবং অন্য এক সংস্থা আয়ােজিত সভা একটি। আমার সঙ্গে বেশ বড়াে আকারের দল গেল। লাক্ষ্ণৌতে যখন সভামণ্ডপে ঢুকতে যাচ্ছি তখন দেখতে পেলাম যে একজন অতি বৃদ্ধ মাথায় একটা ছােট টুপি, হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে মৃদু মৃদু হাসছেন। কাছে গিয়ে দেখলাম ড: কালিকারঞ্জন কানুনগাে-আমার প্রাক্তন শিক্ষক। ড: কানুনগাে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং চেয়ারম্যান ছিলেন ইতিহাস বিভাগের। আমাকে খুবই স্নেহ করতেন তিনি। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। দোয়া চাইলাম স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য। এক ফাঁকে তিনি বললেন, আমি এসেছি তােমাকে নিতে। তােমার কাকীমা বলে পাঠিয়েছেন রাতে তােমাকে আমার বাসায় খেতে হবে সবাইকে | নিয়ে। তিনি নিজে রান্না করে তােমাদের খাওয়াবেন। একথা শুনে আমি অভিভূত হয়ে পড়লাম। এই বয়সের একজন মহিলা যিনি আমাদের ছাত্রজীবনেও খাইয়েছেন তিনি আবার আমাদের খাওয়াবেন। আমার মনটা খুব নরম হয়ে
৯৮
গেলাে। কিন্তু আমার উপায় ছিলাে না। আমি স্যারকে বললাম যে, স্যার আমাকে মাফ করতে হবে। কারণ আমাকে রাতের বেলা রােটারী ক্লাবে বক্তৃতা দিতে হবে, খেতে হবে সেখানেই। এখনাে মিটিং রয়েছে। বিকেলেও মিটিং। আমার আবার আগামীকাল ভাের ৬টায় চলে যেতে হবে। বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমি আপনার সাথে দেখা করবাে আরাে কিছুদিন পরে। আবার আসবাে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাে আমি আসবােই। দেশ তাে স্বাধীন হবেই। তিনি বললেন, ঠিক আছে। তােমার কাকীমাকে আমি বুঝিয়ে বলবাে। এখন আমি তােমার সভা শুনে যাবাে। তিনি বসে রইলেন। সভায় আমি বক্তব্য রাখলাম। আমার শিক্ষক খুব খুশি হলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের সমর্থনে কয়েকটি কথা বলে আমার কাছ থেকে বিদায় নিলেন। দেশ স্বাধীন হলাে। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে স্বাধীনতার পরও আমি আমার শিক্ষক ড: কানুনগাে’র সঙ্গে দেখা করার পূর্বেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার সাথে আমার আর কোনদিন দেখা হবে না। এ দুঃখ আমার মনে রয়ে গেছে। এ ব্যথা আমি আজও ভুলিনি।
আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। আইন বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন ড: পাল। যতদূর মনে পড়ে ড: এন. পাল নাম ছিল। বােম্বেতে দেখা হলাে। বােম্বেতে আমি এক জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছি। সামনের সারিতে দেখতে পেলাম একজন ফর্সা মতাে ভদ্রলােক বসে আছেন। বয়স্ক, কিন্তু লম্বা বেশ, চুল সাদা- আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। যেই আমার দৃষ্টি তার দিকে যায় অমনি তিনি একটু হাসেন। তাঁর চেহারা আমার খুব পরিচিত মনে হলাে। সভাশেষে তিনি আমার কাছে এসে বললেন, আমাকে চিনতে পারলেন? আমার তখন হঠাৎ করে মনে হলাে যে তিনি ড: পাল। আমি বললাম, হ্যা স্যার চিনতে পেরেছি। বললেন, তুমি ইউনিয়নের চার্জে ছিলে। আমি এক সময় তােমাদের ইউনিয়নের দেখাশুনা করতাম। বললাম, হ্যা স্যার, মনে আছে। তিনি বললেন, আমার তাে শরীর ভালাে না তবুও আমি তােমাকে দেখতে, তােমার কথা শুনতে এলাম। বাংলাদেশের জন্য আমার যেটুকু করার আমি অলরেডি তা করা আরম্ভ করে দিয়েছি। সেদিন স্যারের সঙ্গে অনেক কথা হয়েছিলাে। অনেক পুরনাে দিনের স্মৃতিও আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম। এ রকম ঘটনা অনেক জায়গায় ঘটেছে। প্রাক্তন শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা হয়েছে-তাদের সমর্থন পেয়েছি। আর. সি. মজুমদার যিনি তখন কলকাতায় ছিলেন-তিনি আমাদের সহায়তা করেছেন।
আর একটি খুব উল্লেখযােগ্য ঘটনার কথা মনে পড়ে। ১৯৭১ সালে ১৮ থেকে ২০ শে সেপ্টেম্বর দিল্লীতে বাংলাদেশের উপর এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়ােজন করেন জয়প্রকাশ নারায়ণ । আমি তখন মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছি। আমার কাছে খবর গেল যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এবং তাঁর মন্ত্রিসভা চাচ্ছেন যে এই সম্মেলনে বাংলাদেশ পক্ষের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব যেন আমি দিই। তাজউদ্দিন-এর পক্ষে আসা সম্ভবপর নয়। আমি রাজি হলাম। আমি দিল্লী চলে এলাম। এই সম্মেলনটি ওয়ার্ল্ড মিট অন বাংলাদেশ’
৯৯
নামে পরিচিত। ওয়ার্ল্ড মিট অন বাংলাদেশ’ আয়ােজন করতে জয়প্রকাশ নারায়ণকে প্রচুর সহযােগিতা করেছিলাে ‘গান্ধী পিস ফাউণ্ডেশন’।
পৃথিবীর চব্বিশটি দেশ থেকে সম্মেলনে যােগদানের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিনিধি আসেন। একশত ষাট জনের মতাে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সভাতে ছিলেন। এ সভার জন্য আমি তেমন প্রস্তুত ছিলাম না। হঠাৎ করেই আমাকে বলতে হয়। সে সময় সে বক্তৃতা টেপ করে রাখা হয়। টেপ রেকর্ড ধারণকৃত সভার বিররণী পরবর্তীতে মুদ্রিত হয়। আমার মনে আছে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমার বক্তব্য রাখার। সময় বহুবার করতালি পড়ে। আমাদের সহায়তার জন্য যখন আহ্বান জানানাে হলাে তখনাে বেশ হাত ওঠে বিভিন্ন দিক থেকে। গান্ধী ফাউণ্ডেশনের কথা আমি আগেই বলেছি। অমরেশ সেন নামের এক ভদ্রলােক ছিলেন গান্ধী পিস ফাউণ্ডেশনে। তিনিও সব সময় আমার সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করতেন। ঐ সভার পরে তাঁর বাড়িতে রাতে যখন আমি খেতে গেলাম তখন তিনি আমাকেই কেবল সঙ্গে নিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, আর কাউকে নেওয়া যাবে না। আমি তখন বুঝতে পারিনি কেন আমাকে একা সঙ্গে নিচ্ছেন। বুঝলাম পরে। খেতে বসার আগে পাশের ঘর থেকে এক ভদ্রলােক আসলেন—বি পি টকরালা, নেপালের এক সময়কার প্রধানমন্ত্রী। তিনি তখন ভারতবর্ষে অবস্থান করতেন। নিজের দেশে থাকতে পারতেন না। তিনি এসে দেখা করলেন। তিনি এসে আমাকে অফার দিলেন যে তার অধীনে অনেক গুর্খা আছে যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিতে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা রাজি হলেই তিনি তাদের পাঠাতে পারেন । তাদেরকে দেশ থেকে আনতে পারেন। আমি এর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমি তাকে বললাম, এটা সম্ভব হবে না। আপাতত হবে না এজন্য যে আপনি দেশের বাইরে আছেন। আপনার দেশের সরকার এবং আপনার সঙ্গে সম্পর্ক ভালাে না। আপনার মহানুভবতায় আমরা অভিভূত বােধ করছি কিন্তু এই গুর্খা নাগরিক যদি আমাদের সঙ্গে যােগ দেয় তাহলে আন্তর্জাতিকভাবে অসুবিধা হতে পারে। ভারতীয় সরকারও পড়বে অসুবিধায়। আপনার সরকার এটা করবে না। আমার মনে হয় আপনি অন্যভাবে আমাদের সহায়তা করুন। আমাদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন, আবেদন করেন বিভিন্ন দেশের কাছে। কিন্তু গুর্খা সৈন্য দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখসমরে নামাটা বােধ হয় ঠিক হবে না। তবু আপনাকে আমি এ বিষয়ে পরে জানাবাে। আমিতাে সরকারের কেউ না। আলাপ-আলােচনা করে দেখি। এরপর কলকাতা ফিরে তাজউদ্দিন আহমদকে কথাটা বললাম। তিনি আমাকে সমর্থন। করলেন। তিনি বললেন, এটা বােধ হয় হটকারিতা হবে। গুর্খা সৈন্যের দরকার নেই। আমি পরে অমরেশ সেনের মারফৎ নেপালী নেতাকে জানিয়ে দিলাম।
এখানে আর একটা ঘটনা ঘটেছিলাে। আমার মতাে অনেকেই জানেন যে, আমাদের দেশে চরমপন্থী কিছু লােক ছিলাে। নকশালপন্থী ধরনের। তাদের মধ্যে দুই-একজন নেতা আমার কাছে খবর পাঠিয়েছিলেন যে তাদের ক্যাডার সদস্যরাও।
১০০
সম্মুখসমরে যােগ দিতে চান। তাদের রিক্রুট করা হবে কিনা। আমি এ বিষয়েও উত্তর দিয়েছিলাম যে আমি রাজনৈতিক নেতা নই। সুতরাং এ বিষয়ে আমার পক্ষে কথা বলা সম্ভবপর নয়। আপনারা আমাদের অন্যভাবে সহায়তা দিন। পাকিস্তান সরকার যেন স্বস্তিতে থাকতে না পারে এমন অসুবিধার সৃষ্টি করুন না কেন? সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করুন। সরাসরি একত্র হতে অসুবিধা আছে। এখানে বােধ হয় আর একটা কথা বলা দরকার। আমরা ভারতবর্ষে থাকাকালীন সময়ে মুজিব বাহিনী নামে একটি বাহিনীও গঠিত হয়েছিলাে। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামে মুজিব বাহিনী নামে তাদেরকে যােগ দিতে দেয়নি সরকার। সেটার কারণও বােধ হয় একই যে, এক একজনের নামে এক একটি বাহিনী গড়ে তুললে অসুবিধা হবে। যদিও অনেকেরই সমর্থন ছিলাে।
আর একটি ছােট ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় এ সময় দিল্লীতে। আমি তার সঙ্গে দেখা করি। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় তখন কেন্দ্রীয় সরকারের একজন মন্ত্রী ছিলেন। তিনি অনেকক্ষণ আমাকে নানা প্রশ্ন করলেন। আমি অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম। তিনি ধৈর্য সহকারে সব শুনলেন। আমরা কোথায় কোথায় অপারেশন করছি তিনি তা জানতেন কিছু কিছু। আমরা কারা কারা জড়িত, সবার নামও তিনি জানেন দেখলাম। আমার পরে মনে হলাে যে তাকে বােধ হয় মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন আমার সঙ্গে বিস্তারিতভাবে কথা বলার জন্য। বাংলাদেশ সরকারের বাইরের একজন ব্যক্তি হিসেবে বােধ হয় আমার কাছ থেকে নানা কথা শুনতে চেয়েছিলেন। কথা শেষ করে আমি তখন বেরিয়ে আসছি, তিনি আমার সঙ্গে নীচতলা পর্যন্ত আসলেন। আমি গাড়িতে উঠবার সময় তিনি আমাকে বললেন, ‘হােয়েন ডু উই মিট নেক্সট ? আমি বললাম, আমার তাে বাইরে যাওয়ার কথা হচ্ছে। এখন বােধ হয় ইমিডিয়েটলি দেখা হবে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই আপনি আমার দেশে গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করবেন-আমার অতিথি হবেন। সেটা হবে কবে?’ হাসতে হাসতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, বিফোর দি ইয়ার ইজ আউট, আই হােপ উই উইল বি ফ্রি এণ্ড ইউ উইল বি মাই গেস্ট ফ্রম দিস কান্ট্রি। আপনাকে আমি রিসিভ করবাে। আমার বাড়িতে থাকবেন। আমি হাসতে হাসতে হ্যান্ডশেক করলাম। তারপর তিনি আমাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
দেশ স্বাধীন হলাে। আমি হাই কমিশনার হয়ে ভারতে যাচ্ছি। কলকাতা এয়ারপাের্টে নেমেছি। আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম। আমাকে হাই কমিশনার করা হলাে। কোনাে নােটিশ ছাড়াই। আমাকে ডেকে নিয়ে বলা হলাে তার পরদিন যেতে হবে। আমি বেশ ক্লান্ত ছিলাম। তখন আমি শিক্ষা সচিবের কাজ করছিলাম। সারা রাত। ঘুম হয়নি। বিমানবন্দরে নেমে দেখি বিরাট সমাবেশ। পতাকা হাতে অনেক লােক। প্লেনের কাছে হেঁটে আসছে অনেকে। দেখি অন্যদের সঙ্গে রয়েছেন সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। আরাে অনেক পরিচিত লােক সেখানে ছিলেন। সরকারী বেসরকারী অনেক। আর বাইরে অপেক্ষা করছে বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির লােকজন—সব
১০১
মিলে বিরাট সমাবেশ। আমাকে বলা হলাে যে ঐ জনতার উদ্দেশে আমাকে কিছু বলতে হবে। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় আমার সামনে এসে হাজির হলেন। আমাকে। জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আই শুড নট টক উইথ ইউ। ইউ ডিড নট কীপ ইউর ওয়ার্ড এণ্ড ইউ ডিড ভায়ােলেট ইউর প্রমিস। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। প্লেনে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ঘুম অবস্থায় প্লেন থেকে নেমেছি কেবল। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের কথা শুনে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলাে। তিনি এ কথা বলে একটু হাসলেন এবং হাত টেনে বললেন, আসুন। আমি এয়ারপাের্ট থেকে বিশ্রামাগারে যাওয়ার আগ পর্যন্ত খুব আপসেট ছিলাম। কেবলই ভাবছিলাম ভুলটা আমি কোথায় করলাম? শ্রী রায় কথা বলে হাসলেন বটে কিন্তু কথা সিরিয়াসলি বললেন। আমি তার হাত ধরলাম-ধরে বললাম যে, এদিক আসেন। তিনি বললেন, না, আমি জনতার উদ্দেশে বলবাে, কিন্তু তার আগে আমার মানসিক দ্বন্দ্ব মুছে ফেলতে চাই। আমার অপরাধ কি আপনি বলেন। তখন হেসে তিনি বললেন, চা খাওয়ার সময় বলবাে। চা দিয়েছে। তিনি বললেন, আপনারা সবাই শুনুন ড: মল্লিক একজন শিক্ষক। সম্মানিত ব্যক্তি হাই কমিশনার হয়ে এসেছেন। তিনি একজন মুক্তিযােদ্ধা। তিনি কি কথা রাখেননি তা জানতে চাচ্ছেন। কথাটা হলাে এই, আপনি দিল্লীতে আমার অফিস থেকে নেমে গিয়ে গাড়িতে ওঠার আগে আমাকে কি বলেছিলেন? আমার সব কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বললেন, আমি বলছি এদের। আপনি বলেছিলেন, আই উইল বি ইউর ফাস্ট গেস্ট আফটার ইনডিপেন্ডেন্স এবং দেশ স্বাধীন হবে বিফোর দি ইয়ার ইজ আউট। দেশ স্বাধীন ঠিকই হয়েছে, অনেকে গিয়েছেন। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের যাওয়া হয়ে ওঠেনি। সবাই হাসতে আরম্ভ করলাে। আমি বললাম, আপনাকে আমি আবার দাওয়াত করছি। আপনি যাবেন। যখনই যাবেন আমি দিল্লী থেকে ওখানে আপনাকে রিসিভ করবাে। সেদিন আবার সবার উদ্দেশে বক্তব্য রেখেছিলাম। ঘটনা খুবই ছােট। আমি ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু শ্রী রায়ের ঠিকই মনে ছিলাে।
যাক, আমি আবার পুরনাে কথায় ফিরে যাই। হঠাৎ করেই বাংলাদেশ সরকার চাইলেন যে আমি একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে জাতিসংঘে যাই। ওখানে গিয়ে আমাদের প্রচারণার কাজ চালাই।
দিল্লীর ঐ যে ওয়ার্ল্ড অন বাংলাদেশের কথা বলেছি— হ্যা তার আগে একটি ঘটনার কথা মনে পড়েছে। ঠিক দিল্লীর ছাড়ার আগে, নিউইয়র্ক-এর পথে আমাকে দাওয়াত করেন ড: নূরুল হাসান। তিনি মিসেস গান্ধীর খুব ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন।
তিনি তখন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। আমি দাওয়াত রক্ষা করতে গেলাম। আমি একা খাওয়া-দাওয়ার পরে তিনি আমাকে নিয়ে একটি ঘরে ঢুকলেন। সে ঘরে ভারতের একটি ম্যাপ ছিলাে। বাংলাদেশের ম্যাপও ছিলাে। এই ম্যাপগুলাের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, এই যে ম্যাপ দেখছেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল সম্বন্ধে আমি কিছু প্রশ্ন করবাে তার জবাব যদি পারেন দেবেন। তিনি আমাকে
১০২
জিওগ্রাফিক্যাল লােকেশন, যাতায়াত ব্যবস্থা কোথায় কি, বিভিন্ন জায়গা সম্বন্ধে জানতে চাইলেন। যতদূর আমার জানা ছিল আমি সেগুলি বললাম। তারপর জানতে চাইলেন, বাংলাদেশের সমস্ত শহরে বিশেষ করে ঢাকার আশেপাশে যে। সমস্ত শহর আছে সেখানে মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতা তাে আছেই কিন্তু ঐসব। অঞ্চলের জনসাধারণের মনােভাব কি? তারা তাে নিশ্চয় চায় যে দেশ স্বাধীন হােক—আমি বললাম। আরাে জানতে চাইলেন যে ঢাকার পথে যেখান দিয়ে এখন | লােকে ঢাকার পথে যাতায়াত করে সেখানে কি খুব বেশি বাধার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা আছে পাকিস্তানীদের পক্ষ থেকে? আমি বললাম, আমার যতটুকু জানা আছে যে ঢাকার আশেপাশে যে সমস্ত ছােট ছােট শহর আছে সেসব এলাকায় আমাদের বাঙালি যুবকরা, স্বেচ্ছাসেবকরা এবং মুক্তিযােদ্ধারা তৎপর আছে এবং তাদের সহায়তায় ঢাকায় মাঝে মাঝে আমাদের ছেলেরা বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালিয়ে তাদের অবস্থান জানান দিচ্ছে। আমার মনে হয় যে এ পথে তেমন কোনাে বাধার সম্মুখীন কেউ হবে না। তিনি জানতে চাইলেন বাংলাদেশের কোন কোন্ জায়গায় পেট্রোল পাম্প-বড়াে বড়াে পেট্রোল ডিপাে আছে যেখানে ফুয়েলিং—হয় বিমান কিংবা অন্য যানবাহনের জন্য। আমি বললাম, এ বিষয়ে আমার ছেলে ফারুক, আমার সঙ্গেই কলকাতায় আছে-তাকে আমি খবর দিয়ে যাবাে। সে-ই বিস্তারিত তথ্য দিতে পারবে।
আমার বড় ছেলে ফারুক বার্মা ইস্টার্নে একজিকিউটিভ ছিলাে। সে সব জানে। তাকে একবার ওরা কন্ট্যাক্টও করেছিলাে। ম্যাপ দেখিয়ে অনেক বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিলাে। রাত যখন প্রায় ১২টা হলাে তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস। করলাম, আপনি কি আমাকে দাওয়াত করে খাইয়ে এগুলির জন্য ডেকেছেন? এসব তথ্য আপনার কি প্রয়ােজন? তখন তিনি বললেন, ‘আমাদের প্রয়ােজন আছে। প্রয়ােজন আছে বলেই এসব কথা জিজ্ঞেস করছি। আমার ধারণা হলাে যে ভারতবর্ষের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্মুখযুদ্ধ প্রায় আসন্ন। তার প্রশ্নের ধরন দেখে মনে হলাে যে ভারতীয় সামরিক বাহিনী সবদিক থেকে কিভাবে সহায়তা পেতে পারে, তা জানার চেষ্টা করছেন। ঢাকার দিকে যদি অগ্রসর হতে হয় তাহলে জনসাধারণ তাদের বাধা দেবে কি না এটাও জানতে চাচ্ছেন মনে হলাে। পেট্রোল পাম্প বা ডিপাে সম্বন্ধে জিঞ্চেস করায় আমার মােটামুটি ধারণা হলাে যে এখন থেকে যেখানে যেখানে তেল মজুদ আছে সব অবস্থানে হয়তাে যুদ্ধকালীন অবস্থাতে ভারতীয় বিমান বাহিনী হামলা করতে পারে। আমার ধারণা বদ্ধমূল হলাে যে, যুদ্ধ প্রায় আসন্ন এবং এটা বােধ হয় ওরা বুঝতে পেরেছে। যুদ্ধ ভারতীয়রা চান বা না চান পাকিস্তান একটা যুদ্ধ বাধিয়ে ছাড়বে। পাক-ভারত যুদ্ধ অনিবার্য প্রায়। রাত তখন ১২ টা। ড: হাসান আমাকে বললেন, রাত ১২টা বেজে গেলাে, কি করবেন আপনি? তারপরেই জানালেন, আপনার জন্য দু’জন ক্লাসিক্যাল মিউজিশিয়ান। ডাকানাে হয়েছে। পাশের ঘরে আছে। দু’তিনটি গান শুনে যান। রাত তিনটার সময় তিনি আমাকে বিদায় জানালেন।
১০৩
এরপর আমি চলে গেলাম নিউইয়র্ক-এ। নিউইয়র্ক-এ আমাকে পাঠানাে। হয়েছিলাে জাতিসংঘে একটি প্রতিনিধি দলে। এই দলে আমি এবং আবু সাঈদ চৌধুরীসহ সংসদ সদস্য আবদুস সুলতান, এম. আর. সিদ্দিকী, সিরাজুল হক, ডাঃ আসহাবুল হক এবং ফকির শাহাবুদ্দিনের মত কয়েকজন সদস্য। এছাড়া ছিলেন এস. এ. করিম, আবুল ফাতাহ, এ. এম. এ. মুহিত এরা পাকিস্তান সার্ভিস থেকে ডিফেক্ট করে আমাদের সঙ্গে যােগ দিয়েছিলেন। আমাদের সেখানে পাঠানাে হলাে এজন্য যে জাতিসংঘে গিয়ে আমরা বাংলাদেশের উপর প্রচার কার্য চালাবাে, বিভিন্ন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করবাে, তাদের সমর্থন নেওয়ার চেষ্টা করবাে এবং সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের সমর্থন আদায় করবাে জনসমাবেশের মাধ্যমে।
এখানে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। একদিন আমি জাতিসংঘ ভবনে। আমার উপর অর্পিত দায়িত্বের অংশ হিসেবে পর্তুগালের এ্যাম্বাসাডার-এর সঙ্গে কথা বলছিলাম। আগেই এ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিলাে। আমি বাংলাদেশের। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তাকে বললাম এবং অবস্থা কি তাও জানালাম। আমরা কি আশা করি তাও তাঁকে জানালাম। পর্তুগালের ইতিহাস সম্বন্ধে আমার কিছু ধারণা ছিল, সে সম্বন্ধে আলােচনা হলাে। বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে পর্তুগালের কি সম্পর্ক ছিলাে, মধ্যযুগে কেমন ছিলাে—তা নিয়ে আমরা আলােচনা করলাম । মােটামুটি আমাকে ধারণা দিলেন যে তিনি তাঁর সরকারকে জানাবেন এবং তাঁদের সমর্থনের জন্য চেষ্টা করবেন ব্যক্তিগতভাবে। তারপর হঠাৎ তিনি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন দরজার দিকে। আমি তাকিয়ে দেখি শাহ আজিজুর রহমান, মাহমুদ আলী, রাজিয়া ফয়েজ দাঁড়িয়ে আছেন সারিবদ্ধভাবে। দলটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আমাকে পর্তুগালের এ্যামবাসাডার বললেন, ঐ তাে আপনাদের বাঙালি যারা পাকিস্তান থেকে জাতিসংঘে এসেছেন তারা দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ওদের দিকে তাকালাম। ওরাও আমার দিকে তাকালাে। নিজেদের মধ্যে কি যে আলােচনা করলাে জানি না। ওরা বেগম রাজিয়া ফয়েজকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি ঐ দলবিচ্ছিন্ন হয়ে আমার কাছে এসে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। সময় চাইলেন এবং সেই সঙ্গে কথা বলার সময় আর কেউ যেন সেখানে না থাকেন সে বিষয়টি নিশ্চিত করার অনুরাধ জানালেন। আমি সম্মতি জানালাম। রাত দশটায় আমার হােটেল কক্ষে আসতে বললাম। সে হােটেলে আমাদের অপর প্রতিনিধিরাও অবস্থান করছিলেন।
বিভিন্ন কামরায় অপর প্রতিনিধিরা ছিলেন। আবু সাঈদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, ফনীভূষণ মজুমদার, সৈয়দ সুলতান, খান পন্নী প্রমুখ। আমার জন্য একক রুম দেওয়া হয়েছিলাে। অনেকে আবার ডাবল রুমে ছিলাে। নির্দিষ্ট সময় রাত দশটায় রাজিয়া ফয়েজ আসলেন আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য। তিনিই প্রথমে কথা বললেন। তিনি বললেন, ‘আমরা একটু আশ্চর্য হয়েছি যে সরকারের প্রধান হলাে তাজউদ্দিন আহমদ সেই সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে আপনি কাজ করছেন—আপনার মতাে একজন বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী, দেশে-বিদেশে যার সম্মান
১০৪
রয়েছে। এই সরকারের মধ্যে তেমন কোনাে লােক নেই যারা সরকার চালাবার ক্ষমতা রাখে, যারা জনসাধারণের সমর্থন পেতে পারে। এসব কথার উত্তরে আমি হেসে বললাম যে, আপনার মতাে শিক্ষিত মহিলার কাছ থেকে এ ধরনের কথা আমি আশা করিনি। যারা জনপ্রতিনিধি, যারা সংসদে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন তাঁদের সম্মান দেশ এবং বিদেশে সর্বত্রই রয়েছে। আমি যত বড় বুদ্ধিজীবীই হই না কেন, যত বড় ধনী ব্যক্তি অথবা ব্যবসায়ী হই না কেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ আমাদের চাইতে অগ্রগণ্য বলে সবাই ধরে নেন। এবং এটাই স্বাভাবিক। সাধারণ জ্ঞান যাদের আছে তারাও এ কথাটা বুঝবেন। একজন দেশের প্রধানমন্ত্রী, যদি তাঁকে জনপ্রতিনিধি ধরে নেওয়া হয় এবং তাকে যদি সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত করেন তাহলে তিনিই সর্বজনগ্রাহ্য হবেন। সর্বত্র ডেমােক্রেসি মানেই তাে এই। পাকিস্তান যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে এবং আপনিও যদি তা বিশ্বাস করেন তাহলে তাজউদ্দিন আহমদ সম্পর্কে আপনার এ ধারণা কেন হলাে? আমার মনে হয় আপনার ধারণা ভুল। আমার এ কথার পর তিনি চুপ করে থাকলেন। আমি বললাম, আমরা স্বাধীনতার জন্য লড়ছি, এখন-কে বড় কে কোন্ দিক থেকে ছােট সেটা বড় কথা নয়। আমি রাজনীতি করিনি। রাজনীতিবিদ নই। দেশকে ভালােবাসি। ভাইস চ্যান্সেলর ছিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম যে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবাে। এখন যুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছি। আমি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদএর আনুগত্য মেনে নিয়েই কাজ করছি। বাংলাদেশ কদিন পরই স্বাধীন হতে যাচ্ছে। এটা অবধারিত সত্য। পাকিস্তানী সৈন্যদের যে মনােবল নষ্ট হয়েছে এ খবর কি আপনি রাখেন না?’ তিনি খুব ইতস্ততঃ করে বললেন, ‘হ্যা, ইদানীং মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধ যারা করছে, তারা জায়গায় জায়গায় হামলা করছে-তাতে বেশ লােকজন মারা যাচ্ছে বলে আমার ধারণা। কারণ ট্রাকে লােড হয়ে ডেড বডি খুলনা অঞ্চলের দিকে নিয়ে যেতে আমি দেখেছি। ট্রাক থেকে রক্ত ঝরতেও দেখেছি। এমন কয়েকটি ট্রাক ঢাকার দিকেও যেতে দেখেছি। আমি বললাম, সুতরাং বুঝতেই পারছেন আমাদের ছেলেরা ভালােভাবেই কাজ করছে। আজ না হােক কাল দেশ স্বাধীন হবেই। আমি ভেবে আশ্চর্য হচ্ছি যে আপনি কি করে আপনার বর্তমান এ শারীরিক অবস্থায় এখানে এলেন?
আমি লক্ষ্য করলাম তিনি অন্তঃসত্ত্বা। তিনি চুপ করে থেকে বললেন, হ্যা, আমি সাত মাসের প্রেগনেন্ট। আমি মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম যে আমার পক্ষে বাইরে আসা সম্ভব নয়। কিন্তু সার্টিফিকেট দিলেও তারা যুক্তি দেখালাে যে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা প্লেনে চড়লে কোনাে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা নেই। শেষ পর্যন্ত আমাকে পাঠানাে হলাে। আমাকে আসতে হয়েছে এবং এসে এদের পক্ষে কাজ করছি। আমি তাকে বললাম যে, আপনি ভুল করেছেন। আপনাকে জোর করে পাঠাবে কেন? যদি বলতেন যে আপনি যাবেন না! আমার পরামর্শ হবে আপনি দেশে ফিরে যান। কারণ দেশে ফিরে যাওয়াটাই আপনাদের পক্ষে ভালাে। অল্পদিনের মধ্যেই আমার মনে হয় একটা সুরাহা হয়ে
১০৫
যাবে। এই বছর শেষ হওয়ার আগেই দেশ স্বাধীন হবে বলে আমার ধারণা। আপনি আমার পূর্বপরিচিত। আমি মনে করি যে আপনি যা বলতে এসেছিলেন তার। উত্তর পেয়ে গেছেন। এখন মনে হয় দেশে ফিরে যাওয়াটাই ভালাে।
পাকিস্তানী দলের সদস্যদের দেখেও আমি আশ্চর্য হয়েছি। শাহ আজিজুর রহমানকে আমি ভাল বক্তা হিসেবে জানি। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে যখন পড়তেন তখন থেকে তাকে জানি। তার পার্লামেন্টের বক্তব্য আমি শুনেছি। ভালই বলেন। এদের মতাে লােক যে কি করে পাকিস্তানী দালাল হয়ে গেলাে-এটা আমাদের মনঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাে। রাজিয়া ফয়েজ সম্পর্কে আরাে কিছু কথা আমার আজো মনে আছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমি দিল্লীতে বাংলাদেশের প্রথম হাই কমিশনার। হঠাৎ একদিন দেখি যে বেগম রাজিয়া ফয়েজের স্বামী এবং রাজিয়া ফয়েজের বােন আমার কাছে হাজির। রাজিয়া ফয়েজের বােন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল। ভর্তি আমিই করিয়েছিলাম। প্রায়ই মেয়েটি আমাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতাে। তার অভিভাবক হিসেবে তার দেখাশুনা আমি করতাম। সেই রাজিয়া ফয়েজের ছােট বােন এবং রাজিয়া ফয়েজের স্বামী ফয়েজ সাহেব দিল্লীতে আমার বাসভবনে গিয়ে হাজির হলাে। শুনলাম রাজিয়া ফয়েজকে জেলে রাখা হয়েছে। তার বাচ্চা হওয়ার সময়ও এসে গেছে। এই অবস্থাতে তাকে জেলা রাখা হয়েছে। তখন অবশ্য অনেককেই জেলে রাখা হয়েছিলাে। যারা দালালী করেছে, রাজাকার ছিলাে তাদেরকে আটক রাখা হয়। আমি একটু চিন্তা করলাম। তারপরই আমি শেখ সাহেবকে টেলিফোন করলাম। ডাইরেক্ট লাইনে তাঁকে পেয়ে গেলাম। আমি টেলিফোনে বললাম যে, রাজিয়া ফয়েজকে কি জেলে রেখেছেন? বঙ্গবন্ধু বললেন, হ্যা। আমি বললাম, দালালী তাে অনেকেই করেছে। রাজিয়া ফয়েজ একটি কৈফিয়ৎ আমাকে দিয়েছিলাে সেটা আপনার জানা দরকার। তিনি আমাকে নিউইয়র্কে বলেছিলেন যে, তিনি সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা হওয়া সত্ত্বেও মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দেওয়ার পরেও তাকে আসতে হয়েছে। তাতে আমার মনে হয়েছিলাে অনেকটা অনিচ্ছুক বােধ হয় তিনি ছিলেন। আর তাছাড়া কতকগুলাে ইনফর্মেশান তখন তিনি আমাকে দিয়েছিলেন, বিশেষ করে পাকিস্তানীদের হতাহতের খবর। কদিন পর দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে একথাও বলেছিলাম। আমার মনে হয় তিনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন এবং ফিরে এলেন। এইসব চিন্তা করে দেখেন তাকে যদি মাফ করতে পারেন। তার বাচ্চা হবে, এ অবস্থায় হাজতের মধ্যে থাকা ঠিক না বােধ হয়। শেখ সাহেব রাজিয়া ফয়েজকে মুক্তি দিলেন। মুক্তি তিনি পেলেন। আরাে অনেকে মুক্ত হলাে বিভিন্ন কারণে। শাহ আজিজুর রহমানের মতাে লােকও মাফ পেয়ে গেলাে।
জাতিসংঘে প্রচারকাজ চালানাে, জাতিসংঘের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় বাংলাদেশের উপর বক্তব্য রেখে জনসাধারণের সমর্থন জোগাড় করা আমার দায়িত্বের মধ্যে ছিলাে। জাতিসংঘে যে দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছিল সে বিষয়ে
১০৬
একটি কর্মসূচী তৈরি করে ফেললাম। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বক্তব্য রাখার জন্য আমন্ত্রণ আসাও শুরু হলাে। বিভিন্ন সংগঠন থেকেও আমন্ত্রণ পেলাম। আমাকে যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রণ জানানাে হচ্ছিলাে তার কারণ একটা ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর দশ-পনেরাে বছর পূর্ব থেকে আমি নানা কারণে আমন্ত্রিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছি। গবেষণামূলক সংস্থা থেকে আমন্ত্রিত হয়েছি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও আমন্ত্রণ পেয়েছি। তার ফলে দশ-পনেরাে বছরের মধ্যে আমার আমেরিকা যাওয়া হয়েছে বহুবার এবং বহু বিশ্ববিদ্যালয় আমি দেখেছি। অনেক সেমিনার-কনফারেন্সে আমি বক্তব্য রেখেছি। ফলে যারা সাউথ এশিয়া হিস্ট্রির উপর কাজ করতেন তারা আমার নামটা মােটামুটি জানতেন। ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে গিয়েছি। আমাকে ইউনির্ভাসিটি অব পেনসিলভেনিয়াতে ভিজিটিং প্রফেসর করা হয়েছিলাে এবং ফুল’ প্রফেসর। প্রফেসর এবং ডাইনে ‘ফুল’ লেখা ছিলাে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম এই ফুল’টা কেন লেখা হয়েছে? তারা বললাে, এটা কালে ভদ্রে দেওয়া হয়। প্রফেসর হিসাবে এটি বিশিষ্ট পদ। তুমি এজন্য একটি রুম পাবে, একজন সেক্রেটারী পাবে, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি পাবে, বই পত্র যা আছে আমাদের এগুলাে পাবে। সুতরাং ইউনির্ভাসিটি অব পেনসিলভেনিয়াতে সাউথ এশিয়া হিস্ট্রিতে প্রফেসর হিসাবে কাজ করতে গিয়ে আমার সুযােগ হয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেওয়ার, বক্তব্য রাখার–দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের উপর বিভিন্ন কলেজে এবং সেমিনারে। সুতরাং দক্ষিণ এশিয়া ইতিহাসের ওপর যারা কাজ করেছেন আমি মােটামুটিভাবে তাদের কাছে পরিচিত। তখন যারা ছাত্র ছিলাে তাদের অনেকেই এখন শিক্ষক হয়েছে। শিক্ষকদেরও অনেকে ছিলেন। এইসব কারণের জন্য বােধ হয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমার দাওয়াত আসতে আরম্ভ করলাে। বাংলাদেশের উপর বক্তব্য রাখার অনুরােধ জানালাে তারা। যারা আমার বন্ধু-বান্ধব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন-তারাও বিভিন্ন সংস্থাকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসলেন।
এসব কারণে যুক্তরাষ্টে আমার কার্যক্রম বেশ বড় আকারের হয়ে গেল। আমি দেখলাম যে, ছত্রিশ দিনের মধ্যে আমাকে বহু জায়গায় যেতে হবে। আমার প্রােগ্রাম করার জন্য আমাকে একজন সচিব দেওয়া হলাে। আমার খরচ সরকারকে বহন করতে হয়নি। আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে যারা বক্তব্য রাখতে যেতেন যেমন ডাঃ আসহাবুল হক, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং সৈয়দ সুলতান—এঁদের খরচও বাংলাদেশ সরকারকে বহন করতে হয়নি। আমার জন্য ব্যয় বহন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন সংস্থা এবং সহকারী হিসাবে কাজ করেছে বিভিন্ন শহরে যারা বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতাে। তা ছাড়া ‘আই আর সি’ বলে একটি সংগঠন আর্থিক সহায়তাসহ সব রকমের সহায়তা করেছে। সুতরাং আমার জন্য কোনাে পয়সা ব্যয় করতে হতাে না। আমি অসংখ্য জায়গায় গিয়েছি, বক্তব্য রেখেছি। বিস্তারিত না বলে শুধু এতটুকুই বলবাে যে আমি ৩৬ দিনে নিউইয়র্ক, কলম্বিয়া, পেনসিলভেনিয়া, স্ট্যানফোর্ড, বার্কালি, লংবীচ, চিকাগাে, বাফেলাে, নর্থ
১০৭
ক্যারােলিনা, হার্ভার্ড, বােস্টোন, ইয়াল, টেক্সাসসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়েছি। প্রায় প্রতিটি জায়গায় বক্তৃতার ধরনটা ছিলাে এ রকম ঃ প্রথমে ফ্যাকালটি মেম্বারদের উদ্দেশে, তারপর বিকালে ছাত্র-জনসাধারণের উদ্দেশে, আর রাতে টেলিভিশন প্রােগ্রাম কিংবা সাংবাদিক সম্মেলন। বিভিন্ন স্থানের অনুষ্ঠানসূচী এমনই ছিলাে যে বিশ্রাম নেওয়ার কোনাে সুযােগ ছিলাে না। হয়তাে একটা শহরে দুপুরে পৌছেই প্রথমে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথাবার্তা বললাম, তারপরই ফ্যাকালটিতে বক্তব্য রাখা, বিকেলে জনসাধারণ ও ছাত্রদের উদ্দেশে এবং সন্ধ্যায় সে স্থান ত্যাগ করতে হয়েছে। কোনাে সময় এক রাত্রি থেকেছি, কোনাে সময় এক রাত্রি থাকারও সুযােগ হয়নি। অনেক সময় এমন হয়েছে যে আমাকে হেলিকপ্টারে যেতে হয়েছে। আবার কখনাে প্রাইভেট প্লেন ভাড়া করে তারা আমাকে নিয়ে গিয়েছে। আমি জানি। এজন্য বহু খরচও হয়েছে। অনুষ্ঠানসূচী, কাগজ-নথিপত্র আমার দেখা শােনা এ সবের জন্য সচিব রাখলাম আমি আমার পছন্দমতাে। জমশেদ রেজা খান আমার প্রাক্তন ছাত্র। রাজশাহীতে সে আমার ছাত্র ছিলাে। তাঁর আত্মীয় স্বজনের অনেকেই আমার ছাত্র ছিল। তারা এখন প্রতিষ্ঠিত। ঐ পরিবারের সঙ্গে আমার পরিবারের ঘনিষ্ঠতা ছিলাে। জমশেদ রেজা খান তখন ওখানে পড়াশুনা করছিলাে। বােধ হয় এম.বি.এ. পড়তাে আর পার্ট টাইম চাকরি করতাে। জমশেদ চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে আমার সচিব হয়ে গেল। আমার কাপড়-চোপড় ইস্ত্রি করা থেকে সব কাজই সে করতাে। এ সময় মাত্র দুটো স্যুট আমার ছিলাে। ফলে, সভা-সমিতিতে যাওয়ার জন্য ঘন ঘন ইস্ত্রি করতে হতাে। বস্তুত জমশেদ স্বেচ্ছায় আমার সকল দায়িত্ব। নিয়েছিলাে। আমি আগেই বলেছি দুই-একটি শহরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রস্তাব অনুযায়ী বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন আবু সাঈদ চৌধুরী, সৈয়দ সুলতান এবং সিরাজুল হক। আসহাবুল হক আমার সঙ্গে প্রায়ই থাকতেন। এসব কর্মসূচী পালন করার সময় একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। আমি হঠাৎ একবার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। দৌড়াদৌড়ি ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল। আমি টেক্সাস শহরে এমপি সিরাজুল হককে পাঠিয়ে দিলাম। সিরাজুল হকের বােন টেক্সাসের কাছাকাছি কোথায় যেন থাকতেন আজ আর মনে নেই। এক আমেরিকানকে বিয়ে করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই আমি ধরে নিয়েছিলাম ভগ্নিপতি যখন আমেরিকান তখন সিরাজুল হক গেলে মন্দ হয় না। টেক্সাসে আমি জানিয়ে দিলাম যে, এমপি সিরাজুল হককে পাঠাচ্ছি। প্লেনে পাঠানাে হলাে তাঁকে। টেক্সাসে তিনি তার বক্তব্য রাখলেন। তিনি তাঁর বক্তব্য রেখে আমার এখানে আসার পরপরই টেক্সাসে যারা পাকিস্তানী ছিলেন, বিশেষ করে পাকিস্তানী ছাত্ররা যারা আমাদের বিপক্ষে, তারা ড: ফাতেমা সাদেক নামের এক বাঙালি মহিলাকে হাজির করলাে সেখানে। ড: ফাতেমা সাদেক ভুল তথ্য দিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে বক্তব্য রেখেছেন। ভয়ানক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। আমি অল্পক্ষণের মধ্যে টেক্সাস থেকে কয়েকটা ফোন পেলাম পর পর। এদের মধ্যে কয়েকজন বাঙালি আবার দু’চারজন আমেরিকানও ছিলাে। আমাকে বলা হলাে যে পরিস্থিতি অন্যদিকে মােড় নিয়েছে। সিরাজুল হক যা বলে
১০৮
গেলেন আবার ড: ফাতেমা যা বলে গেলেন উভয় বক্তৃতায় মানুষ দোটানায় পড়ে যেতে বসেছে। অবিলম্বে আমাকে যেতে হবে। যে কোনভাবেই হােক যেতে হবে। আমি তাদের বললাম যে, আমার তাে আরাে প্রােগ্রাম আছে। প্রােগ্রাম তাে ক্ল্যাশ’ করে যাচ্ছে। আমাকে বলা হলাে, আপনি ফোর সীটের প্লেনে যাবেন, আবার প্রাইভেট প্লেনে ফিরে আসবেন, তাহলে আর আপনার কর্মসূচী নষ্ট হবে না। এ বাবদ যে অতিরিক্ত খরচ হবে তা আমরা বহন করবাে। আমি টেক্সাসে গেলাম। সেখানে যাওয়ার আগেই ভালােভাবে আমার ছবিসহ পােস্টারিং হয়েছে এবং আমি যে বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাইস চ্যান্সেলার ছিলাম সেসবও পােস্টারে লেখা হয়েছে। খুব লাে ফ্লায়িং রেঞ্জে চার সিটের প্লেন উড়ে চললাে। নিচে গরুর বাছুর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। আমি আর আমার সচিব, জমশেদ রেজা খান আর পাইলট টেক্সাসে নামলাম। শহরে ঢােকার মুখেই দেখি বিভিন্ন দেয়ালে বড় বড় পােস্টার। রাস্তার মােড়ে মােড়ে আমার ছবিসহ পােস্টার। বুঝলাম বেশ পয়সা খরচ করেছে আমাদের সমর্থকেরা। গিয়ে দেখি বড় ভিড়। বিরাট এক সমাবেশ সেখানে। সভায় পাকিস্তানী, বাঙালি, আমেরিকানসহ বিভিন্ন দেশের লােক আছে এবং হলটি পূর্ণ। অনেকে বাইরেও দাঁড়িয়ে আছে। এর কারণ বােধ হয় এটাই যে আমাদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রেখেছেন একজন এমপি আর পাকিস্তানকে সমর্থন করে বক্তব্য রেখেছন ড: ফাতেমা সাদেক যিনি একজন বাঙালি মহিলা। সেজন্যই অনেকে উৎসুক ছিল যে আমি কি বলি তা জানার জন্য। সেখানে অনেক শিক্ষিত পাকিস্তানী ছিল। শিক্ষিত এ সব মানুষের সবাইকে আমি খারাপ বলবাে না। তাদের মধ্যে অনেকেই পাকিস্তান থেকে যেসব তথ্য পাঠাতাে ঐ তথ্যের উপর নির্ভর করেই একটি সিদ্ধান্তে পৌছতাে। আমার মনে হলাে তারা সঠিক খবর জানেন না। সভায় আমি সব প্রশ্নের জবাব তাৎক্ষণিকভাবে দিতে আরম্ভ করলাম। এর মধ্যে দু-একজন বক্তৃতা দিল পাকিস্তানের পক্ষ থেকে। তাদের বক্তব্য আমি আবার খণ্ডন করলাম। এক পর্যায়ে কোনাে কোনাে ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেক গভীরে যেতে হলাে। পাকিস্তানীদের অত্যাচারের বেশ কিছু বিবরণ দিলাম। আমি কতকগুলাে ছবিও দেখালাম। সে সব ছবি ছিলাে নারী নির্যাতন, বুদ্ধিজীবী, জনসাধারণ এবং ছাত্রহত্যার। আমার এক ছাত্র ছিলাে জব্বার। তার ঘটনা আমি বললাম। সে উকিল ছিলাে এবং মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে পরােক্ষভাবে জড়িত ছিলাে, অর্থ সাহায্য করতাে তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে তার পায়ে দড়ি বেঁধে একটি ট্রাকের পিছনে বেঁধে দশ মাইল পর্যন্ত রাস্তার উপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ছেচড়িয়ে, বাই দি টাইম দি ট্রাক রিচড ইট’স ডেস্টিনেশন। তখন তার কেবল পা’টাই ছিল আর কিছুই ছিল না। তারপর নারী নির্যাতনের কয়েকটি ঘটনার কথা। বললাম। এসব শুনে সবাই নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আর কোনাে প্রশ্ন এলাে না। অনেকেই মাথা নিচু করে আছে। আর যে সমস্ত পাকিস্তানী এতক্ষণ সরাসরি প্রশ্ন করছিলাে তারাও মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। সভা যখন নিস্তব্ধ হয়ে গেল আমি তখন ধরে নিলাম আমার আর বক্তব্য কিছু নেই। সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে সভা
১০৯
শেষ করলাম। এখানে একটা কথা বলি। একজন আমেরিকান এবং একজন ফরাসী ভদ্রলােকও এ সভায় আমাদের পক্ষে বক্তব্য রেখেছিলেন এবং তারা তাদের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন যে, কেন তাদের সরকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে খােলাখুলিভাবে সমর্থন করে না?
আর একটি ঘটনার কথা বলি ঃ ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভেনিয়ার কথা। এখানকার পিলেডেলফিয়া শহরে আমি যাই। এটা ঐতিহাসিক শহর। আমি এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম। ওখানে আমার ডাক পড়লাে। আগেই ঠিক ছিল। তারিখও ঠিক হয়েছে। আমি যাবাে। আমাকে বলা হলাে যে ওখানকার আমাদের লবি খুবই স্ট্রং। কারণ প্রাক্তন ছাত্র আছে অনেক যারা এখন শিক্ষক হয়ে। গেছেন কিংবা বিভিন্ন সংস্থাতে কাজ করেন। ঐ শহরে থাকেন। আর কিছু ছাত্রছাত্রী যারা বাইরে থেকে খবর পেয়ে আসবে বলে জানিয়েছে এবং তারা লােকজন সঙ্গে নিয়ে আসবে। সুতরাং আমি যেন পেনসিলভেনিয়াতে ভালােভাবে প্রস্তুত হয়ে যাই। সভা খুবই বড় হবে এবং আমাকে হয়তাে বেশিদিন থাকতেও হতে পারে। আমি পেনসিলভেনিয়াতে গেলাম। যাওয়ার পর অনেক উদ্যোক্তাকে পেলাম। যারা এই সভার আয়ােজন করেছেন, এদের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রী ছাড়াও প্রফেসর ব্রাউন, রিচার্ড ল্যামবার্ট এর মতােন প্রবীণ শিক্ষাবিদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও ছিলেন। ঐ বিরাট সমাবেশে আমি বক্তব্য রাখলাম। এখানেও নানা প্রশ্ন তােলা হলাে। এখানেও অনেক পাকিস্তানী ছাত্র ছিলাে। তারা প্রশ্ন করলাে। উত্তরও দেওয়া হলাে।
আর একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা এখানে ঘটে গেল। ঠিক ঐ সময়ে একটি জাহাজ অস্ত্র বােঝাই করে পাকিস্তানে রওনা হবে এমন অবস্থায় ছিল। জাহাজটিকে স্পীড বােটের সাহায্যে ঘেরাও করে রেখেছিল আমার প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীরা এবং তাদের আমেরিকান সহযােগীরা। জনসাধারণও ওদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলো। আমি যখন পৌছলাম তখন অস্ত্রশস্ত্র বােঝাই জাহাজটি বন্দরে আটকা পড়ে আছে। বেরুতে পারছে না। উত্তেজনা আরাে বেড়ে গেছে। জাহাজটা আটকা পড়ে যাওয়ায় জনসাধারণের মনে প্রশ্ন জাগলাে যে কেন জাহাজটি আটকিয়েছে। এজন্য অনেকেই আমাদের সভাতে এসেছিলাে। তারা জানতে চায় যে আমরা কারা। আর কেনই বা এমনটি করছে। আমেরিকান ছাত্র-ছাত্রীরা কেন এটা ঘেরাও করে রেখেছে।
আর একটা ঘটনা মনে পড়ছে। সভা শেষ হওয়ার পর নরম্যান ব্রাউন প্রমুখদের সঙ্গে আমি কথাবার্তা বললাম, ওদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করলাম। বিকেলে আর একটি সভা ছিল, সেখানে গেলাম। একটি প্রাইভেট সংস্থা এ সভার আয়ােজন করেছিলাে। ঐ সভাতে কয়েকজন লােককে হাজির করলাে কয়েকজন যুবক। তারা আমাদের মেরিন একাডেমীর ছাত্র ছিল। এরা বাঙালি। আমেরিকাতে এদের পাঠানাে হয়েছিলাে ট্রেনিং-এর জন্যে। ট্রেনিংরত অবস্থায় যখন জাহাজ নিয়ে ঘুরছে তখন ওরা দেখতে পেল যে মুক্তিযুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে বেশ আন্দোলন
১১০
হচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষে লােকজন বেশ তৎপর। এই মেরিন ছাত্রদের মধ্যে কয়েকজন জাহাজ থেকে লাফ দিয়ে সমুদ্রে পড়ে। সমুদ্রে সাঁতাররত অবস্থায় আমেরিকানরা তাদের উদ্ধার করে। এদের মধ্যে তিনজনকে আমার সামনে হাজির করলাে। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানী জাহাজ ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে চলে আসে।
আজকে তারা বেশ প্রতিষ্ঠিত। তাদের একজনের নাম হলাে আবদুল আউয়াল। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের সঙ্গে কাজ করার পর সে আমেরিকায় থেকে যায়। আমেরিকাতেই এম.বি.এ. কোর্স সমাপ্ত করে ডিগ্রী লাভ করে। বর্তমানে সে ন্যাশনাল ব্যাংক-এর একজন সুপরিচিত পরিচালক। ব্যবসা ক্ষেত্রে তিনি দেশে ও বিদেশে সুনাম অর্জন করেছেন। আমি বলছিলাম নরম্যান ব্রাউনের কথা। পঁচাশি বছরের এই বৃদ্ধও এ সভায় যােগ দিয়েছিলেন। তাঁকে সহায়তা করেছিলেন একজন মহিলা। নরম্যানকে ধরে ধরে উঠানাে-নামানাে ইত্যাদি ঐ মহিলাই করেছিলেন। আমি এসব দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। এরা এই বয়সেও এত কষ্ট করে সব জায়গায় সব সভায় এসেছেন বাংলাদেশের জন্য। তারা বলেছেন যে তাঁরাও বিবৃতি দিচ্ছেন, সমর্থন করছেন এবং আমরা যেন না ঘাবড়াই একথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তারা আরাে বলেছিলেন, আজ হােক, কাল হােক তাদের সরকার আমাদের সমর্থন করতে বাধ্য হবে।
ওখান থেকে চলে এলাম হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানকার ঘটনার কথাও মনে পড়ে। ফ্যাকালটির পক্ষ থেকে মধ্যাহ্ন ভােজের দাওয়াত ছিলাে। খাওয়া দাওয়ার পর আমাকে ফ্যাকালটি মেম্বারদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতে হলাে। ঐ সভায় ড: কিসিঞ্জারের একজন সহকারী ছিলেন। তার নামটি আজ আর আমার মনে নেই। তিনিও বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষক। আমার বক্তব্যের পর অনুমতি নিয়ে তিনি কয়েক মিনিট কথা বললেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বেশ কিছু প্রশ্নও উত্থাপন করলেন। আমি প্রশ্নের জবাব দিলাম। সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন তাদেরকে হেনরি কিসিঞ্জারের সহকারীর বক্তব্য খুব আকৃষ্ট করেনি বলে আমার ধারণা হলাে। কারণ আমি যখন বক্তব্য রাখছিলাম তখন মাঝে মাঝে হাততালি পড়ছিলাে। তাতে মনে হলাে ফ্যাকালটির সমর্থন মােটামুটিভাবে আমাদের দিকে আছে। ঐ দিন বিকেলে আবার একটি জনসভায় গেলাম। এ জনসভায় সভাপতিত্ব করলাে আমাদের একজন প্রাক্তন সি এস পি-খােরশেদ আলম। সেখানে ড: আলমগীর ছিলেন বলে আমার মনে পড়ে। আলমগীরের ওখানে আমি আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলাম। ড: আলমগীর একজন অর্থনীতিবিদ। তিনিও প্রচুর কাজ করেছেন। আমাদের আন্দোলনের পক্ষে। তাঁর সঙ্গে অনেক আলােচনা করলাম। যখন আমরা বক্তব্য রাখতাম তখন সেই অনুষ্ঠান টেলিভাইসড হয়েছে, রেডিওতে বিশেষ বিশেষ বক্তব্যের অংশগুলােকে শােনানাে হয়েছে।
নিউইয়র্ক থাকাকালীন সময়ে আর একটি ঘটনা ঘটেছিলাে। একদিন হঠাৎ একজন আইনজীবী আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। ভদ্রলােক আমেরিকান।
১১১
সঙ্গে একজন ব্যবসায়ী থাকবেন, এ কথাও বলা হয়েছিলাে। আমি সময় দিলাম। ওরা রাতে দেখা করতে এলাে। আমার শােবার ঘরেই বসা হলাে। তারা জানালেন গােপনীয় কিছু বলার আছে। গােপনীয় কথার সারমর্ম হলাে যে, তারা অস্ত্রের ব্যবসা করে। আমাদের যদি মুক্তিযুদ্ধের জন্য অস্ত্রশস্ত্র লাগে তবে তারা তা দিতে প্রস্তুত আছে এবং সেগুলাে কোথায় পৌঁছাতে হবে, কি ধরনের অস্ত্র লাগবে, তার তালিকা যদি দেওয়া হয় তবে তা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছে দেবে। স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা পাঠিয়েই যাবে। মূল্যটা নেবে পরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। আমরা তার মূল্য শােধ করে দিলেই হবে। দাম হয়তাে কিছু বেশি। পড়বে যেহেতু এটা বিভিন্ন উপায়ে দেওয়া হবে। আর একটি প্রস্তাব তারা রাখলাে যে, তারা কমাণ্ডোর সাহায্যে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের জেল থেকে নিয়ে আসবে, যদি আমরা তাতে রাজি হই। আমি বললাম, কিভাবে আনবে? তারা উত্তর দিল, এ বিষয়ে বিস্তারিত আপনি ঠিক বুঝবেন না—এইগুলি তাে আমরা করে থাকি। আমাদের বিভিন্ন সংস্থা আছে, প্লেন আছে, মানুষজন আছে। পাকিস্তানে আমাদের লােক আছে, যারা আমাদের পক্ষে কাজ করবে। তারা পাকিস্তানী। সবই আছে। যদি আপনার সরকার রাজি হয়—আপনারা রাজি হন তাহলে ঐ এ্যাটেমপ্ট আমরা নিতে পারি। কারণ আপনাদের দেশতাে স্বাধীন হবেই। দেশ যদি স্বাধীন হয়। আমরা অস্ত্রের দামও পেয়ে যাবাে। আপনাদের একটা উপকারও করলাম। আমাদের ব্যবসায়িক লাভও হলাে। এসব দিক চিন্তা করেই এ প্রস্তাব এনেছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম আমাকে এপ্রােচ করার কারণটা কি? উত্তর দিল, আমরা গােপন সূত্রে খবর নিয়েছি যে আপনি একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি, সম্মানিত ব্যক্তি। দেশে-বিদেশে আর বর্তমান সরকার আপনাকে সম্মান করে। আপনি পরামর্শ দিলে সে পরামর্শ তারা গ্রহণ করবেন। আমরা ঠিক করলাম যে, সরকারীভাবে না গিয়ে আপনার মাধ্যমে যদি যাই তাহলে কাজটি সহজ হবে এবং গােপনীয়তাও রক্ষা হবে। এই প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে সন্দেহ ও নানা প্রশ্ন দেখা দিলাে। আমার মনে হলাে এটা যদি ষড়যন্ত্র হয়ে থাকে—আর এর পেছনে যদি পাকিস্তান থেকে থাকে তাহলে যে অস্ত্র পাঠানাে হবে মুক্তিযােদ্ধারা যখন সেই অস্ত্র আনতে যাবে কোনাে পােস্টে বা সমুদ্রতীরে তখন তারা হয়তাে প্রস্তুত হয়ে থাকবে—অস্ত্রও হাতছাড়া হবে এবং তাদের জীবনও বিপন্ন হবে। আর একটা হতে পারে যে সে পাকিস্তানের সঙ্গে পরামর্শ করেই হয়তাে বলতে এসেছে। আমরা রাজি হলে হয়তাে অস্ত্র পাঠাবার আগেই অস্ত্র কোথায় নামবে, খবরটা দিয়ে দিতে পারে। তারপর আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা যখন সংগ্রহ করতে যাবে তখন এলাকার লােকদের সমূহ বিপদ হতে পারে। আর কমাণ্ডে দিয়ে মুজিবকে উদ্ধার করার প্রস্তাবটি নিয়েও নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিলাে। এটা যদি ষড়যন্ত্র হয়ে থাকে তাহলে এমন হতে পারে যে শেখ মুজিবকে উদ্ধার করতে কমাণ্ডোরা গেলাে এবং উদ্ধারও করলাে। তারপর হয়তাে তাঁকে হত্যা করা হলাে। তখন বলা হলাে দুর্ঘটনা ঘটে। গেছে। আবার এমন হতে পারে যে, মেরে ফেলে বলতে পারে কমাণ্ডোরা উদ্ধার
১১২
করতে গিয়েছিলাে—ইন দি মিডস্ট অফ দি ক্ল্যাশ গােলাগুলির মধ্যে শেখ সাহেবও মারা গেছেন। এমন নানা চিন্তা তাৎক্ষণিকভাবে মাথায় এলাে। যাই হােক, তাদের আমি আপ্যায়ন করলাম। কফি খেলাে। এরই মধ্যে আরাে চিন্তা করলাম যে, যদি এদের মধ্যে আন্তরিকতা থেকেও থাকে, ধরলাম যে ব্যবসায়ী বুদ্ধি আছে, সিনসিয়ারিটিও আছে তাহলেও বড় ঝুঁকি। এ ঝুঁকি কে নেবে? আমি ওদের বললাম যে, আমার তাে এভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনাে এখতিয়ার নেই। তােমরা যা বললে আমি দেশে ফিরে আমাদের সরকারকে বলবাে। সরকার যদি সম্মতি দেয় তাহলে আমি তােমাদের সঙ্গে যােগাযােগ করবাে, তােমাদের ঠিকানাটা আমাকে | দাও। ওরা ঠিকানা দিলাে। আমি ঠিকানা নিয়ে দেশে ফেরার পর দেখা গেল যে। তখন যুদ্ধ রীতিমতাে আরম্ভ হয়ে গেছে। দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। আমাদের আর ঐ। পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়ােজন হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রে যখন আমি সভা করে বেড়াচ্ছি তখন কয়েকজন সিনেটরের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিলাে, তাদের সঙ্গে আলােচনাও হয়েছিলাে। তাদের দাওয়াতও আমি রক্ষা করেছিলাম। এসব সিনেটরের মধ্যে সিনেটর কেনেডি, সিনেটর সাক্সবি, সিনেটর চার্চ এই তিনজনের সঙ্গেই খুব ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিলাে। দুএকটি সভাতে তারা আমার সঙ্গে থেকেছেনও। শিকাগাের একটি ঘটনার কথা আমার বেশ মনে পড়ে। ওখানেই দেখা হয় খুব নাম করা ইঞ্জিনিয়ার আমাদের দেশের কৃতী প্রতিভাধর নাগরিক ফজলুর রহমানের সঙ্গে। তিনি ইঞ্জিনিয়ার এবং আর্কিটেক্ট। ড: ফজলুর রহমান খানের অনেক কীর্তি ঐ দেশে আছে। শিকাগােতে পৌছানাের পর তাঁর মেহমান হতে হলাে আমাকে। তাঁর স্ত্রী বােধ হয় বিদেশী। আমার থাকার ব্যবস্থা ড: খানের ওখানেই করা হয়েছিলাে। তিনি একটি সংগঠনও করেছেন—যারা এসব কাজ করে থাকেন। ফজলুর রহমানের ফার্মে এক ভদ্রলােক ছিলেন তাঁর নাম ছিলাে স্টেনলি টাইগার। ফার্মটিও দেখলাম। তারপর সভায় গেলাম। শিকাগাে বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিলাম। সভা বেশ ভালােই হয়েছিলাে। এখানে ফজলুর রহমান সম্পর্কে দু-একটি কথা না বললে অন্যায় হবে। ফজলুর রহমান দেশকে অন্তর দিয়ে ভালবাসতেন। নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য বাদ দিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে সংগঠন গড়ে তুলে আর্থিক সাহায্য দিয়ে কাজ করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি যে কতখানি খুশি হয়েছিলেন তার প্রমাণ আমি পেয়েছি ব্যক্তিগতভাবে। আজ তিনি আমাদের মধ্যে নেই কিন্তু তার কথা প্রায়ই আমার মনে হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি অল্পদিনের মধ্যে দিল্লী চলে গেলাম। মার্চের দিকে বােধ হয় দিল্লী গেছি। হঠাৎ একদিন দেখি যে ফজলুর রহমান খান দিল্লীতে আমার বাসায় এসে হাজির। এয়ারপাের্ট থেকে সরাসরি চলে গেছেন। তাড়াতাড়ি বের হলাম। অফিসে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে তখন। অফিসে গেলাম না। তিনি গাড়ি থেকে নেমে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ভাই আমি ঢাকা থেকে এখানে। এসেছি আপনার সঙ্গে দেখা করতে, ঢাকা থেকে আমি ফুল নিয়ে এসেছি। আমি মালাও নিয়ে এসেছি আপনাকে দেওয়ার জন্য। আপনি শিকাগাে শহরে যে বক্তৃতা
১১৩
দিয়েছিলেন তাতে কাজ হয়েছিলাে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমার ধারণা যে, আপনাকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া দরকার, দেখা করা উচিত আর এজন্যই আমি এসেছি। আমি আবার জড়িয়ে ধরলাম তাকে। অনেকক্ষণ এভাবে ছিলাম। আমি তাকে বললাম, আপনি তাে আমার চাইতে বেশি কাজ করেছেন। বললেন, না, আমি কাজ করেছি একটা ক্ষুদ্র জায়গায় বসে, আপনি দুনিয়াময় ঘুরে বেড়িয়েছেন। আপনি প্রথম হাই কমিশনার হয়েছেন আমি খুবই খুশি হয়েছি। আমি আজকেই ফিরে যাবাে। তিনি দুপুর বেলা আমার ওখানে খেলেন। আবার ঐদিনই ফিরে আসলেন বাংলাদেশে। এ স্মৃতি আমার কাছে এক অমূল্য সম্পদ। আমি তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। যা হােক, আবার ফিরে যাই আমেরিকায়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেওয়ার পর বােস্টনে যে জনসমাবেশ হয় সেখানে খুরশীদ আলম সভাপতিত্ব করেন। আর ফ্যাকালটিতে করেছেন ডীন অফ দি ফ্যাকালটি যিনি। বােস্টনে অনেক বাঙালি ছাত্র-ছাত্রী, সমর্থক অনেকের সাথে দেখা হয়। পাবলিক মিটিং-এ খুরশীদ আলম সভাপতিত্ব করেন।
এখানে একটি ছােট্ট ঘটনার কথা বলি। ড: আকরাম হােসেনের স্ত্রী আমার ভাগ্নী হয়। ওদের বাড়িতে খেতে গেলাম। তারা জানে আমি কি খাই না-খাই। ভাগ্নী রান্না করেছে। অন্য বেশ কিছু লােককে দাওয়াত করেছিলাে। আসবার সময় আমাকে একটা প্যাকেট দিলাে। তাতে গরম কাপড়-চোপড় ছিলাে। প্যাকেটটি নিয়ে আসলাম।
প্যাকেটের ভেতরে ছিলাে সােয়েটার, সে সব সােয়েটার যার যার গায়ে লাগে দিয়ে দিলাম। একটা আমি রাখলাম টোকেন হিসেবে। এ সময় আমেরিকা বসেই আমাদের গেরিলাদের হাতে যে বহু পাক সেনা মারা যাচ্ছে তা আমরা বিভিন্ন ইস্যুরেন্স কোম্পানীর মাধ্যমে জানতে পারি। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম দেশ স্বাধীন হতে আর বেশ দেরি নেই। এই অবস্থায় আমি, আবু সাঈদ চৌধুরী, লুফুল মতিন প্রমুখের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিলাম—এমন অবস্থায় দেশে ফিরে যাওয়াই ভালাে। কারণ এখন তাে সম্মুখযুদ্ধ হবে। তাছাড়া আমার শরীরও ভালাে যাচ্ছিল না। সমস্ত কর্মসূচী বাতিল করা হলাে। আমি সরাসরি দিল্লী চলে আসি। আমাদের পাসপাের্ট ছিল ভারতীয়। ভারত সরকারই ব্যবস্থা করেছিলাে।
দিল্লীতে এসে মাত্র একরাত্রি থেকে কলকাতায় ফিরে গেলাম। কলকাতা ফিরে আমি দিন গুনছি কখন পাক-ভারত যুদ্ধ আরম্ভ হবে। আমার কথাই ঠিক হলাে। ভুট্টো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বক্তৃতা দিলাে। ফাইট টু দি লাস্ট। তারপর ভারতবর্ষকে গালাগালি করলাে। এর ক’দিন পরই পাকিস্তানী বিমান ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে আক্রমণ করলাে। এ সময় মিসেস গান্ধী ছিলেন কলকাতাতে। তিনি তখন ময়দানে স্মরণকালের এক বৃহত্তম জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন। ইন্দিরা। গান্ধীর সঙ্গে আমার দেখা করার কথা ছিলাে। কিন্তু দেখা করা গেল না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে দিল্লী ফিরে আসেন। যুদ্ধ শুরু হলাে সর্বাত্মকভাবে। পরিস্থিতি যে এরকম হবে সেটা আমি আগেই ধারণা করেছিলাম। আমি দিন গুণতে আরম্ভ করলাম যুদ্ধ কবে
১১৪
শেষ হবে। সত্যিই যুদ্ধ খুব তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেল। পাকিস্তান সেনা আত্মসমর্পণ করলাে। আমাদের দেশে ফেরার সময় হলাে।
কিন্তু এই মুহুর্তে আমার আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। তাজউদ্দিন আহমদ-এর সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিলাে। তাজউদ্দিন আহমদ আমাকে বললেন, দেখুনতাে, পাকিস্তান আর্মী সারেণ্ডার করবে, প্লেন যাবে অথচ ওসমানী সাহেবকে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি মনে হয় খুব রিলাকটেন্ট। এর কারণ কি তা বুঝা গেল না। তিনি আমাকে বললেন, একটু খুঁজে দেখতে হবে। খোঁজাখুঁজি আমিও করলাম। কিন্তু পেলাম না। পরে শুনলাম যে তিনি এয়াপাের্টে গিয়ে একটি হেলিকপ্টার নিয়ে সিলেট চলে গেছেন কাউকে না জানিয়ে।
সারেণ্ডার করছে পাকিস্তান আর্মী, কম্বাইণ্ড আর্মড ফোর্সের সঙ্গে জড়িত ছিলেন আমাদের ওসমানী। তাঁর থাকাটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আমাদের এমনই দুর্ভাগ্য যে তিনি কেন, কি কারণে কাউকে না বলে হি লেফট ফর সিলেট ইন এ হেলিকপ্টার তা বুঝা গেল না বললেন তাজউদ্দিন আহমদ। আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ওসমানী সাহেবের থাকাটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তিনি কেন রইলেন না? এ বিষয়ে আর কোনাে আলােচনা হয়নি। তবে ওসমানী সাহেব যে সিলেট চলে গিয়েছিলেন এ খবর আমি জানতাম।
জেনারেল ওসমানী আমার অত্যন্ত সম্মানিত বন্ধু ছিলেন। আমাদের কাছাকাছি বয়স ছিল। তাঁর সম্বন্ধে আমি কি বলবাে? তবে এটুকু আমি জানি যে, জেনারেল ওসমানী যুদ্ধক্ষেত্রে বা অপারেশন ক্ষেত্রে খুব কম যেতেন। আর গেলেও জেনারেল ওসমানী সাধারণ পােশাক পরে যেতেন। ঠিক সামরিক পােশাক পরে যেভাবে জেনারেলরা যায় সেভাবে আমি তাঁকে দেখিনি। তিনি নাকি ভাবতেন যে তিনি যেহেতু টার্গেট সুতরাং তাকে এভাবেই থাকতে হবে। যারা লক্ষ্য করেছেন—তাঁরা নিশ্চয়ই দেখেছেন যে জেনারেল ওসমানীকে মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে সামরিক পােশাকে খুব কমই পাবেন। বরং তাজউদ্দিনকে পাবেন খাকি ইউনিফর্ম পরে আছেন। তিনি যেখানে থাকতেন সেখানে একটি অফিস ছিলাে। সেখানে তার ব্যক্তিগত রক্ষী ছিলাে। অনেক রক্ষী বলতাে যে, রাত্রে তিনি খুব অস্থির থাকতেন। একটু আওয়াজ হলেই অস্থির হয়ে পড়তেন। তিনি মানুষ হিসাবে অত্যন্ত ভাল মানুষ ছিলেন। তিনি যখন গোঁফ কামিয়ে গেছেন আমি তাকে দেখেই বলেছিলাম যে, ভাই আপনাকে তাে আমি গোঁফ দিয়েই সহজে চিনি। গোঁফটা কামিয়ে কেন গেছেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমাকে তাে পালিয়ে আসতে হয়েছে ভাই। গোফটা হলাে চিহ্ন যে আমি ওসমানী। পথে কোনাে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে ভেবেই গোঁফটা আমি ঢাকাতেই কামিয়ে ফেলে দিয়েছি।
দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তাজউদ্দিন আহমদ আমাকে বললেন, দেশে তাে চলে যাবেন, দেশে যাওয়ার আগে রেডিওতে একটি বক্তৃতা দেওয়া খুবই জরুরী। দেশে এখন খুনাখুনি আরম্ভ হয়ে যাবে। রাজাকার দালাল যারা আছে তাদের লােকে ধরে ধরে মারবে। তাদের বিচার না করে মারাটা যেমন খারাপ দেখাবে তেমন
১১৫
রক্তক্ষয়ও বাড়বে। বিশৃঙ্খলা বাড়বে। আপনাকে সবাই চেনে, আপনি কলকাতা রেডিও থেকে একটি বক্তব্য রাখেন দেশবাসীর উদ্দেশে। আমি কলকাতা ত্যাগের পূর্বে রেডিও মারফত একটি বক্তব্য রেখেছিলাম। আমার যতটুকু মনে আছে আমার বক্তব্য ছিলাে এরকম—দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে—যারা আমাদের সাথে বেঈমানী করেছে, তাদের বিচার হবে। বিচারের আগে আমরা তাদের বিরুদ্ধে নিজেদের হাতে আইন তুলে যেন না নেই। কাউকে যেন মারধাের না করি ইত্যাদি। এরপরই আমি প্রথমে যশােরে গেলাম। যশাের তখন আমাদের অধীনেই ছিলাে। যশাের থেকে আবার পরদিন ফিরে এসে পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশে ফিরে গ্রামের বাড়িতে গেলাম।
আমি যখন আগরতলা ছিলাম খালেদ মােশাররফ সে সময় আগরতলাতে ছিল। খালেদ মােশাররফ সম্পর্কে আমার শ্যালক হয়। আমার স্ত্রীর দূর সম্পর্কের ভাই। আমি যখন আগরতলা পৌছলাম তখন খালেদ মােশাররফই এসেছিলাে। রাতে যখন আমি শুতে যাচ্ছি তখন খালেদ মােশাররফ এসে হাজির। খালেদ মােশাররফ বললাে, ‘দুলাভাই একটা রিভলবার রাখেন আপনি। এটা দিয়ে গেলাম আপনার পার্সোনাল ব্যবহারের জন্য। আমি বললাম, এখন তাে বিদেশে আছি। হাউ ক্যান আই…… আমার রিভলবার, বন্দুক তাে রেখে এসেছি চট্টগ্রামে, জিয়াউর রহমানকে দিয়ে এসেছি সবগুলাে। সে বললাে, না, ইণ্ডিয়া কোনাে কিছু বলবে না। এটা লাইসেন্স করা আছে। ইউ কীপ ইট। রিভলবারটি আমাকে দিয়ে আসলাে আর বললাে, আপনাকে মাঝে মাঝে আমি নিয়ে যাবাে প্রকৃত অর্থেই যেখানে আমাদের ছেলেরা অপারেশন করছে। তিন রাত্রি খালেদ মােশাররফের সঙ্গে গিয়েছিলাম। রাত দশটা-এগারােটায় বেরিয়েছি, ফিরেছি রাত চারটা, পাঁচটায়। সে আমাকে নিয়ে যেতাে বিভিন্ন জায়গায় যেখান থেকে আমাদের ছেলেরা অপারেশন করতাে। খালেদ মােশাররফ লং রেঞ্জের শব্দ শুনেই অপারেশনের ধরন ধারণ বলে দিতাে। এমন কি আমাদের পক্ষের গােলাগুলি কেমনতর হবে, কি পরিমাণ হবে তাও বলতাে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম গুলি যে করছে এর সংখ্যা তুমি কিভাবে বলাে? সে বলেছিলাে, ইণ্ডিয়ান গভর্নমেন্ট আমাদের যে অস্ত্র দিচ্ছে, যে গােলাবারুদ দিচ্ছে তা সীমিত আকারে দিচ্ছে। আমি কারণ জিজ্ঞেস করতেই সে বলেছিলাে ভারত সরকার চাইছে অকারণে ক্ষয়-ক্ষতি হঠকারিতা যেন না করি। আর আমাদের সবার সম্পর্কে ধারণাও তেমন ছিলাে না। এজন্য খুব সীমিত সাহায্য করতাে। আমাদের ছেলেরা এজন্য খুব আপত্তি করতাে। গােলাগুলি ঠিকমতাে করতে না করতেই গােলাবারুদ ফুরিয়ে যেতাে। একদিন মনে আছে আমাকে খালেদ মােশাররফ বললাে, আজকে একান্নটা ফায়ার হবে। আমরা বসে বসে ঠিক একান্নটি ফায়ারই গুণলাম। আর একদিন রাত্রের কথা মনে আছে। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল, তুমুল বৃষ্টির মধ্যে জীপ নিয়ে এসে আমাকে নিয়ে গেল। তখন বাজে নটা সাড়ে নটা। খালেদ মােশাররফ আমার স্ত্রীকে বললাে, আপা আমরা এসে খাবাে। কি রান্না করবেন? রান্না করার মতাে তেমন কিছু থাকতাে না। আলু আর ডাল
১১৬
মজুত থাকতাে। ডিম রান্না করে রাখতে বলে আমরা রওয়ানা দিলাম। আমরা এমন বৃষ্টির মধ্যে পড়লাম যে বৃষ্টির পানি জায়গায় জায়গায় জমে গাড়ি চলে না। জায়গায় জায়গায় ট্রেঞ্চ করা ছিলাে। খালেদ বললাে, দুলাভাই, এখন আর আপনার ওখানে যাওয়া যাবে না। কোথায় যাবাে? আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম। লেটস্ গাে টু এ ডক্টর’স হাউজ—বললাে খালেদ। ডাঃ বণিক নামে এক ডাক্তার ছিল, সেখানে গেলাম। গিয়ে দেখি আমাদের ছেলেরা অনেকগুলাে মশারি খাটিয়ে শুয়ে আছে। এরা সবাই মুক্তিযােদ্ধা। এদের মধ্যে এয়ারফোর্সের একটা ছেলে ছিল যে পরবর্তীকালে বিয়ে করলাে আমাদের এক মন্ত্রী শামস্-উল-হকের মেয়েকে। ছেলেটি তখন পাইলট ছিলাে। রাত সাড়ে বারটা-একটার দিকে আমরা ডাঃ বণিকের বাড়িতে পৌছলাম। তাঁর স্ত্রী তাড়াতাড়ি আমাদের জন্য খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ালেন। রাত তিনটার দিকে খাওয়া শেষ হলাে। বাঙালি ডাঃ বণিক আর তার স্ত্রী যে আন্তরিকতা আর মমতায় আমাদের খাওয়ালেন তা আজো মনে আছে। ডাঃ বণিক আগরতলা থাকতেন। তিনি আমাদের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। ডাঃ বণিকের বাড়িতে ওপেন ডাের যত মুক্তিযােদ্ধা ছিলাে, তারা থাকতাে বিভিন্ন কামরায়। ডাঃ বণিক আমাকে দেখালাে যে বিভিন্ন কামরার মধ্যে মশারি টাঙ্গিয়ে আমাদের ছেলেরা শুয়ে আছে। এদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা বণিক পরিবারই করছিলাে। ডাঃ জানালেন, আমার স্ত্রীই রান্না করে। সে রাতে আমাদের খাওয়াটা বেশ মজার হয়েছিলে। মহিলা আমাকে খাওয়ালেন। মহিলা বােধ হয় ফ্রিজে রান্নার জিনিসপত্র রাখেন। ভুনা খিচুড়ি করলেন। মহিলা জিজ্ঞেস করলেন কি ধরনের খিচুড়ি আমি পছন্দ করি। আমি বললাম, খালি খালি কষ্ট করবেন না। বললেন, না, কোনাে কষ্ট হবে না। ঘরে সব আছে। খাসির গােশত ছিলাে। গােত বােধ হয় রান্না করেছিলেন। আমরা রাত তিনটায় খেলাম। এদিকে । ছেলেরাও সব ঘুম থেকে উঠে পড়লাে। সবাই গল্প করলাে আমাদের সঙ্গে। ঐ রাতের স্মৃতি আজো আমার মনে জ্বলজ্বল করছে। খালেদ মােশাররফ অপারেশন থেকে ফেরার পথে প্রায়ই আসতেন। যুদ্ধের ময়দানে সে গুলিবিদ্ধও হয়েছিলাে। এজন্য বেশ বড় রকমের অপারেশন করতে হয়েছিলাে। আমার মনে আছে। লাক্ষ্ণৌতে অপারেশন করার পর একটি বুলেট বের করা গেল না। ডাক্তাররাও বলেছিলাে এতে তার মৃত্যু হবে না। কিন্তু কোনাে সময়ই সে বেশিক্ষণ ঠিকভাবে চিন্তা করতে পারবে না। চিন্তায় ধারাবাহিকতা থাকবে না। পরবর্তীকালে তাঁর কার্যক্রমে এটা প্রমাণিতও হয়েছে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি সপরিবারে ঢাকা ফিরে আসি। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লণ্ডন থেকে ঢাকা পৌছলেন। তাঁকে। আমরা বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে গেলাম। আপনারা সবাই জানেন যে সেদিন। ঢাকা এয়ারপাের্ট মানুষের ঢলে প্রায় ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছিলাে। রাস্তায়। রাস্তায় মানুষের ঢল নামে। ঐ জনস্রোতের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে এয়ারপাের্ট থেকে আমরা নিয়ে এলাম। তার কয়েকদিন পরই তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন।
১১৭
বঙ্গবন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাব, না অন্য কোথায় যেতে চাই। আমি তাকে বললাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অনেক দিন হয়ে গেছে। আমি আর ওখানে থাকতে চাই না। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় অস্ট্রেলীয় অধ্যাপক এ.এল. বাশামের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। চিঠিপত্র আদান প্রদান হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তিনি আমাদের অনেক সহায়তা করেছেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরে যদি আমি ইচ্ছা করি তাহলে আমি অস্ট্রেলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতে পারি। আমি শেখ সাহেবকে বললাম, আমি অস্ট্রেলিয়া কিংবা বিলেতে যাবাে। আমি আর উপাচার্য থাকতে চাই না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকদিন হয়ে গেছে। তাছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও লেখা দরকার। ঐ কাজটা আমি করতে পারবাে যদি আমি দেশের বাইরে থাকি। তিনি আমাকে বলে বসলেন যে, বিদেশে একটু পরে যান, আপাতত আপনি শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একটি শিক্ষা কমিশন বসাতে হবে। শিক্ষা কমিশন বসিয়ে দিয়ে আপনি যেতে পারেন। সুতরাং আমাকে শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হলাে। এরই মাঝে একবার চট্টগ্রাম গেলাম। আমার সঙ্গে ড: আনিসুজ্জামান ছিলেন। আমাদের মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে সংবর্ধনা দেওয়া হলাে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি সবার সাথে দেখা করে এলাম। ওখানে বড় একটা জনসভা হলাে। ফিরে এসে আমি শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। কুদরত-ই-খুদা কমিশন বসানাে হলাে। আমি পরিশ্রম করতাম প্রচুর। ভাের সাড়ে সাতটার সময় অফিসে যেতাম আর রাত নটা-দশটায় ফিরতাম। বিশ্রাম বলে কিছু ছিলাে না।
একদিন বােধ হয় মার্চ মাস হবে, আমার কাজ যখন শেষ হয়ে এসেছে তখন হঠাৎ একটা টেলিফোন পেলাম রাত সাড়ে ৭টার দিকে। আমি তখন অফিসে। টেলিফোন তুলতেই বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, আপনি এখনাে পর্যন্ত অফিসে আছেন? বললাম, হ্যা। তিনি বললেন, আপনি অনুগ্রহ করে আমার সাথে দেখা করে যাবেন। খুব জরুরি। রাত আটটার দিকে গণভবনে পৌছলাম। প্রচুর ভিড় দেখলাম। আমি যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু অনেক লােকের মধ্য থেকে উঠে এসে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন পাশের ঘরে। ঘরটিতে যে চেয়ার পাতা ছিল তার একটিতে তিনি বসলেন আমি একটি চেয়ারে বসলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, আপনি অনেক পরিশ্রম করছেন, কিন্তু শরীরটা তাে ঠিক রাখতে হবে। তারপরই বললেন, ভারতবর্ষে আমাদের একজন হাই কমিশনার পাঠাতে হবে। এ ব্যাপারে কথা বলতে ডেকেছি। আমি কিছু না বুঝেই তাঁকে বললাম, ঠিক আছে আপনি কি ধরনের লােক চান বলুন। আমি চিন্তা-ভাবনা করে আপনাকে কালকে জানাবাে। তিনি বলে বসলেন, ‘পরামর্শ আমি আপনার কাছে চাইনি। আপনাকে ভারতে যেতে হবে হাই কমিশনার হয়ে। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে বললাম, দেখুন আমি সরকারী চাকরি চাইনি। আপনি আমাকে জোর করে একটি চাকুরি দিয়েছেন, শিক্ষা সচিব করেছেন। দায়িত্ব পালন করেছি। আপনি আমাকে বলেছিলেন যে,
১১৮
কয়েক মাস পর আমি সরকারী দায়িতু থেকে অব্যাহতি পাবাে, চলে যেতে পারবাে। আমার মনটা টানছে বাইরে যাওয়ার জন্যে। আপনি আমাকে অনুগ্রহ করে এ দায়িত্ব দেবেন না। আমি এ পদ নিতে চাচ্ছি না। তিনি তার উত্তরে বললেন, ক্যাবিনেটে আমরা আলােচনা করেছি। আমাদের নতুন রাষ্ট্র। অনেক সমস্যা আছে আমাদের। অর্থের সমস্যা, রিকগনিশনের সমস্যা। অনেক দেশ এখনাে পর্যন্ত আমাদের রিকগনাইজ করে নাই। সেজন্য দিল্লীতে এমন একজন হাই কমিশনার পাঠাতে হবে যিনি এ কাজগুলি ভালােভাবে করতে পারবেন। সব রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা হবে। ইচ্ছা করলে যে কোনাে জায়গায় যেতে পারবেন, আমার স্পেশাল এনভয় হিসেবে। এ বিষয়ে ক্যাবিনেটে আলােচনাও হয়েছে। সবাইকে পর পর নাম দিতে বলা হয়েছিলাে। ক্যাবিনেটের সব লােকজন প্রথমে আপনার নামটা দিয়েছে। সুতরাং আপনাকে যেতে হবে। আপনি দায়িত্বটা কিছুদিন পালন করুন। দেশ রিকগনাইজড হােক। বিদেশী রাষ্ট্রগুলাে আমাদের রিকগনাইজ করুক। আমাদের বর্তমান যে সমস্যাগুলাে সেসব কিছুটা সমাধান হয়ে যাক, তারপর আপনি নিশ্চিন্ত মনে বাইরে গিয়ে চাকরি করবেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস লিখবেন। এটা আমারও ইচ্ছা।’ আমি মুজিবকে বললাম, আপনি আমাকে যে প্রস্তাব দিচ্ছেন সে বিষয়ে আমাকে একটু ভাবতে দিন। আপনি আমাকে একটু সময় দিন। আগামীকাল ভােরে আপনাকে আমি জানাবাে। তিনি আমার হাত ধরে বললেন, সময় দেওয়া যাবে না। আপনি দায়িত্বটি পালন করুন। আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি প্রায় সারা ভারতবর্ষ চেনেন। আপনাকে সবাই সম্মানও করে। বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও আপনার নাম জানেন। একই সঙ্গে নেপাল এবং ভুটানের দায়িত্বও থাকবে। এই দুই রাষ্ট্রের দায়িত্বও আপনাকে পালন করতে হবে। মাঝে মাঝে আপনাকে বাইরে যেতে হবে। রিফিউজি যারা পাকিস্তান থেকে আসবে তাদের দেখাশুনা করার দায়িত্ব তাে একজনকে নিতে হবে। সে দায়িত্ব আপনি ছাড়া কেউ নিতে পারবে না। ভারতবর্ষের সঙ্গে আপনার যে লিংক আছে এই লিংকটা আমরা ব্যবহার করতে চাই। মিসেস গান্ধী আপনাকে খুব পছন্দ করেন সেটা আমরা জানি। সুতরাং আপনি গেলে অনেক কাজ সহজ হবে। আমি শেষমেষ বললাম, ঠিক আছে, আগামীকাল ভােরে আপনাকে আমি চূড়ান্ত কথা জানাবাে। তিনি তখন উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে সামাদ সাহেবকে ডাকলেন। আবদুস সামাদ আজাদ তখন বিদেশ মন্ত্রী। সামাদ সাহেব ঘরে ঢুকে একটি চেয়ারে বসলেন। আমার মনে হলাে বঙ্গবন্ধু আগেই সব ঠিক করে রেখেছিলেন। কারণ, বঙ্গবন্ধু বললেন, সামাদ সব ঠিক হয়ে গেছে। রাজি হয়েছেন। আমি বললাম যে, আমি তাে রাজি হইনি। রাজি আমি আগামীকাল হতে যাচ্ছিলাম। আমার কিছু শর্ত তাে থাকতে পারে। বললেন, কি শর্ত বলুন। আমি বললাম, আমার বাড়িঘর লুট হয়েছে। আপনারা আমাকে থাকতে দিয়েছেন মন্ত্রীর বাসায়। আমার পরিবার ঢাকাতে থাকবে। মেয়েরা লেখাপড়া করে। আমাকে মাঝে মাঝে ঢাকা আসতে হবে। সুতরাং আমি যদি হাই কমিশনার হই এবং তখন যদি আনুষ্ঠানিকভাবে
১১৯
দরখাস্ত করে ছুটি নিতে হয় তাহলে আমার পক্ষে অসুবিধা হবে। আমার পারিবারিক অসুবিধা হবে। বঙ্গবন্ধু বললেন, আপনাকে কোনাে ছুটি নিতে হবে না। আপনি শুধু জানিয়ে দেবেন যে আপনি কবে আসতে চাচ্ছেন ঢাকাতে, কবে ফিরতে চাচ্ছেন। ছুটি পরে হবে। তারপর আমি বললাম, আপনার কোনাে হুকুম বা কোনাে সরকারী নির্দেশ যদি আমি না মানতে পারি তাহলে জোর করে তা মানতে বাধ্য করা যাবে না। আমাকে ইস্তফা দেওয়ার সুযােগ দিতে হবে। শেখ সাহেব বললেন, আমরা রাজি। সামাদ সাহেবও বললেন, রাজি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কতদিন থাকতে হবে? তিনি আমাকে বললেন, যে কাজগুলি, যেমন বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় করা, আর্থিক সমস্যা সমাধান করা বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে যােগাযােগ করে শরণার্থীদের নিয়ে আসা, বাঙালি যারা পাকিস্তান থেকে বিভিন্ন পথে দিল্লী হয়ে আসবে, তাদের দেখাশােনা ইত্যাদি দায়িত্ব শেষ হওয়ার পর আপনি যেতে পারবেন। আরাে বললেন, অনুমান মাস ছয়েক লাগতে পারে। আমি বললাম, ঠিক আছে আমি ভেবে দেখি। তিনি বললেন, ভেবে দেখবার আর কিছু নেই। কালকে আপনি আমাকে জানাবেন। আপনাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে, বেশি দিন সময় দেওয়া যাবে না। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বেরিয়ে এলাম। আমার শরীরও তেমন ভালাে না। বাসায় এসে যখন সিঁড়ির কাছে পা রেখেছি ঠিক তখনই উপর থেকে আমার মেয়ে রানা এসে বললাে যে, আব্বা আপনার নাম রেডিওতে ঘােষণা করা হলাে। আপনি প্রথম হাই কমিশনার হয়ে ভারত যাচ্ছেন এবং একই সঙ্গে নেপাল ও ভুটানের দায়িত্ব নিচ্ছেন আপনি।
পরদিন অফিসে গেলাম। ইউসুফ আলী তখন শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। আমার পাশের রুমে বসতেন। তিনি ঘরে ঢুকে বললেন, স্যার, আপনাকে বঙ্গবন্ধু রিলিজ করতে বলেছেন। দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। আপনাকে এখনই রিলিজ করে দিচ্ছি। আমি তাকে বললাম, তােমার সঙ্গে কি বঙ্গবন্ধুর কথা হয়েছে? বললাে, হ্যা স্যার, কথা হয়েছে। ইউসুফ আলীকে আমি তুমি বলতাম। ইউসুফ আলী জানালাে আপনি ইণ্ডিয়াতে হাই কমিশনার হয়ে যাওয়াতে আমরা খুব খুশী হয়েছি। আপনি স্যার এ মুহূর্ত থেকে ফ্রি হয়ে গেলেন। আপনি বাসায় গিয়ে ঠিকঠাক হন। আমি বললাম, এটা শেখ সাহেবের অন্যায়। আমাকে সময় পর্যন্ত তিনি দিলেন না, ঘােষণা করে দিলেন। আবার তােমাকে পাঠিয়েছেন আমাকে দায়িত্ব থেকে রিলিজ করে দেওয়ার জন্য। ইটস্ অল রাইট। তুমি যাও। পরে ঢুকলাে নূরুল কাদের খান, আমার শ্যালক। সে সিভিল সার্ভিসে ছিল। তখন সে ক্যাবিনেট সেক্রেটারী। সে ঘরে ঢুকেই বললাে, দুলাভাই, খলিফা নিয়ে এসেছি, আপনার কাপড়-চোপড়ের মাপ নিতে হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন? বললাে, আপনি হাই কমিশনার হয়ে যাবেন, আমাকে বলা হয়েছে কয়েক ঘন্টার মধ্যে কাপড়-চোপড় তৈরি করে দিতে। কি কাপড়? হাই কমিশনারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাপড়-চোপড় আপনার দরকার। কাপড়ের জন্য হাই কমিশনারদের এলাউয়েন্স আছে। আপনার এলাউয়েন্সের সঙ্গে এটা এডজাস্টেড হবে। আমি একটু রাগ করেই বললাম,
১২০
তােমরা এসব কি শুরু করেছ? আমাকে কি ঘরেও যেতে দেবে না? এতই তাড়াহুড়া? নূরুল কাদের বললাে, জানেন না মিসেস ইন্দিরা গান্ধী আসবেন। তাঁর আসার আগেই আপনাকে হাই কমিশনারের দায়িত্ব নিতে হবে। আপনি তাকে নিয়ে আসবেন। আপনি অনুমতি দেন, আমি মাপ নিয়ে যাচ্ছি। কি করবাে শেষ পর্যন্ত মাপ নিয়ে গেল। কাপড়ের মাপ নেওয়ার পরপরই শেখ সাহেব আমাকে ফোন করলেন। বললেন, ড: সাহেব, আপনি হয়তাে অসন্তুষ্ট হয়েছেন, আমি শুনেছি, ইউসুফও বলেছে। আপনার পক্ষে এমন হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের প্রয়ােজনে আপনি তাে অনেক কিছুই করেছেন—এটুকুও করে দিয়ে যান। আপনি আমাদের উপর কোনাে রাগ রাখবেন না। আমি উত্তরে বললাম, ঠিক আছে, রাগ রাখবাে না, কিন্তু আপনি তাে আমাকে বলতে পারতেন খলিফা পাঠাচ্ছি। বঙ্গবন্ধু বললেন, আপনি না করে বসতে পারেন সেজন্য আমি সােজাসুজি আপনার সম্মুখে পাঠিয়ে দিয়েছি যাতে কিছু বলার সুযােগ না পান। আগামীকালই যেতে হবে।
এই ঘটনার পরদিন বা তার পরের দিন ঠিক মনে নাই, দিল্লীতে রওয়ানা হলাম। দিল্লীর পথে কলকাতা হয়ে গেলাম। কলকাতা এয়ারপাের্টে যখন নামলাম তখন অনেক বিশিষ্ট লােকজন আমাকে রিসিভ করলেন। এঁদের মধ্যে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় ছিলেন। আমাকে মালা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলাে। হাঁটতে হাঁটতে মুখ্যমন্ত্রী বললেন যে, মল্লিক সাহেব, আপনি আপনার প্রমিজ রক্ষা করেননি। এতে আমি মনঃক্ষুন্ন হয়েছি। আমি সরকারের পক্ষ থেকে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আপনাকে রিসিভ করতে এসেছি। খুব গম্ভীর হয়ে। তিনি কথাগুলাে বললেন। আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আমি কোথায় কোন্ ভুলটা করলাম যার জন্য সিদ্ধার্থ বাবু এ কথাটা বলে বসলেন! ভারতবর্ষে নেমেই হাই কমিশনার হিসেবে প্রথম আমি এ কথাটা শুনলাম। আমি বললাম, বলুন কি করেছি?’ বললেন, ‘পরে বলবাে। তারপরে আমরা লাউঞ্জে বসলাম। লাউঞ্জে বসে তিনি বললেন, বাইরে তাে অনেক লােক অপেক্ষা করছে, দুজন বিদেশী রাষ্ট্রের লােকও এখানে আছেন। একজন ইস্ট জার্মানীর পক্ষ থেকে আছেন। আর অপরজন রাশিয়ান প্রতিনিধি। তারপর বললেন, বাইরে অনেক লােক আছে। আপনাকে কিছু বলতে হবে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে আপনি কাজ করেছেন তারাও এসেছে। বিমানবন্দরের বাইরে লােকে লােকারণ্য হয়ে গেছে। শ্রী রায়কে বললাম, আমি বােধ হয় বলেছিলাম, কয়েক মাসের মধ্যে আমরা স্বাধীন হবাে। আপনি বলেছিলেন তখন আমার কথা যেন মনে থাকে? আমি বলেছিলাম, স্বাধীন হওয়ার পরেই আপনাকে আমি দাওয়াত করবাে, ঢাকা নিয়ে যাবাে। ধরে রাখুন নাইনটিন সেভেনটি টু’র জানুয়ারির দিকে আমরা দেশে পৌছে যাবাে এবং আপনাকে আমি দেশে নিয়ে যাবাে। তখন তিনি বললেন, সে কথা তাে আপনি ভুলে গেছেন—আমি বললাম যে, একটু ভুল হয়েছে আপনার। দেশ স্বাধীন পনেরাে দিন আগেই হয়েছে। ষােলই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলাে। ঠিক আমার হিসাব অনুযায়ী হয়নি। সুতরাং আমি ভুলে গেছি। যাই হােক, যে
১২১
কোনাে সময় আপনাকে আমি নিয়ে যাবাে। তারপর আমি বাইরে গিয়ে জনসাধারণ। যারা অপেক্ষা করছিলেন তাদের উদ্দেশে কিছু কথা বললাম। তারপর দিল্লী রওনা হলাম। হাই কমিশনার হিসাবে শপথ নিলাম।
১৯৭২ সালের ১৭ই মার্চ ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ঢাকা আসলেন। ঐদিনই সােহরাওয়ার্দী ময়দানে নির্মিত মঞ্চে ইন্দিরা গান্ধী এক বিশাল জনসমাবেশে ভাষণ দিলেন। বঙ্গবন্ধুও বক্তব্য রাখলেন। সে এক জনসমুদ্র। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর ভাষণে বললেন ঃ
কোন ফায়দা ওঠানাের জন্য আমরা বাংলাদেশকে সাহায্য করিনি। বাংলাদেশকে সাহায্য করেছি মানবতার স্বার্থে। আমরা চাই বাংলাদেশ শক্তিশালী হােক। শক্তিশালী বাংলাদেশ আমাদের কাম্য। কেননা, তাহলে মানবতার জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা বাংলাদেশকে সমানভাবে পাবাে। আমরা চাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরা একসাথে লড়বাে।
গতকাল (শুক্রবার) ঐতিহাসিক সােহরাওয়ার্দী ময়দানে লক্ষ লক্ষ নর-নারীর সমাবেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী উপরােক্ত ঘােষণা করেন। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে ঘােষণা করেন, ভারত ও বাংলাদেশের জনগণ নিপীড়িত মানবতার দুর্গতি মােচনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাবে এবং ভাবী বংশধরদের জন্য এক নতুন এশিয়া রচনা করবে।
স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় দাঁড়িয়ে ভারতের মহীয়সী নেত্রী বলেন, ভারত তার একান্ত নিজস্ব স্বার্থেই চায় বাংলাদেশ একটি দৃঢ় ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠুক। ভারত অত্যন্ত আগ্রহের সাথে দেখতে চায় তার প্রতিবেশীরা নিজস্ব শক্তিতে তাদের লক্ষ্যে পৌছুতে সক্ষম। কিন্তু এ শক্তি যেন কারাে নির্যাতনের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, এবং তা হতেও দেয়া যায় না।
এ প্রসঙ্গে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের সকল দেশকে তাঁদের স্বীয় ঐতিহ্য ও আদর্শের পথ অনুসরণ করে সুখী ও সমৃদ্ধ মানবতা গড়ে তােলার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যায় ভারত ও বাংলাদেশ ঐক্যমত পােষণ করলেও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে তারা অবশ্যই আপন আপন নীতি ও পথ অনুসরণ করবে।
তিনি দৃঢ়তার সাথে আস্থা প্রকাশ করেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানের মহান নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণ নব্য স্বাধীনতালব্ধ দেশকে নিজস্ব পথে পরিচালিত করতে সমর্থ হবে। তিনি বলেন, অনেক বাধা বন্ধুর পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু যে দেশের জনগণ দাসত্বের শৃঙ্খল হতে নিজেদের বাহুবলে মুক্ত করতে পেরেছে, তারা নিশ্চিতভাবে সকল বাধা অতিক্রম করবে।
১২২
স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ অত্যাচার ও নিপীড়নের এক ভয়াবহ অধ্যায় পেছনে ফেলে এসেছে। একমাত্র তরুণদের অতুলনীয় সাহসিকতা ও বীরত্বে দেশ আজ মুক্ত।
তিনি জনতাকে স্মরণ করিয়ে দেন, জনগণ যাকে ভালবেসে বন্ধু বলে বরণ করে নিয়েছে সে মহান নেতার আজ জন্মদিন। এ স্মরণীয় দিনে ভারত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে অব্যাহতভাবে সাহায্য দিয়ে যাবে বলে আশ্বাস দিচ্ছে।
তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান একজন সুমহান নেতা, যিনি জনগণের কল্যাণ কামনায় নিজের গােটা জীবন উৎসর্গ করেন। শ্রীমতী গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রলীগ ও মুক্তিবাহিনীর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে বলেন যে, জীবন দিয়ে ওরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে।
শ্রীমতী গান্ধী দৃঢ়তার সাথে বলেন যে ভারত ও বাংলাদেশের মৈত্রী পারস্পরিক সম্মান ও বােঝাপড়ার সুদৃঢ় ভিত্তির উপর রচিত। দুটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের মধ্যে এ মৈত্রী বন্ধন। বাংলাদেশকে সহায়তা দানের ব্যাপারে ভারত তার স্বীয় আদর্শেই পরিচালিত।
ভারত ও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন যে এ নবলব্ধ স্বাধীন দেশকেও বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অনেক আগ্রহী দেশ বাংলাদেশকে একটি নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করার জন্য প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ একান্তভাবে নিজেরাই নিজেদের পথ বেছে নেবে।
ভারতের জাতীয় ঐক্যের কথা উল্লেখ করে তিনি মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ বসু, চিত্তরঞ্জন দাস, খান আবদুল গাফফার খান এবং মৌলানা আজাদের ন্যায় মহান নেতাদের অবদানের কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন যে, জাতীয় চেতনায় বর্তমান যুব সম্প্রদায়ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছে।
শ্রীমতী গান্ধী বলেন যে, বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের মতাে এক নেতা রয়েছেন যিনি আজ রূপকথার নায়কে রূপান্তরিত হয়েছেন। বাংলাদেশের জনগণের উচিত তার হাতকে আরও শক্তিশালী করা।
শ্ৰীমতী গান্ধী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে অনেক দেশই পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেনি। অনেক ধনী দেশই উদাসীন থাকার মনােভাব দেখিয়েছে। এই সঙ্কটময় মুহূর্তে ভারতের মতাে এক দরিদ্র দেশের জনগণই বাংলাদেশের নিপীড়িত জনসাধারণের দুঃখদুর্দশার বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের জনগণের কথা বলতে গিয়ে ভারতকে অনেক সমস্যার মােকাবেলা করতে হয়েছে। কিন্তু
১২৩
সে তার ন্যায়নীতির পথ থেকে কোনাে সময়ই বিচ্যুত হয়নি।
শ্ৰীমতী গান্ধী ঢাকায় তাঁর প্রতি যে বিপুল সম্বর্ধনা ও স্বাগত জানানাে হয়েছে, কৃতজ্ঞতার সাথে তা স্মরণ করে বলেন যে, এ অভ্যর্থনা কোনাে ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়। এ সংবর্ধনা বিশ্বের কাছে পরিচিত এক আদর্শনিষ্ঠ দেশের প্রতিনিধির প্রতি প্রদত্ত হয়েছে। তিনি বলেন, ভারতীয় সৈন্যদের রক্ত মুক্তিসেনাদের রক্তের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। দু দেশের জনগণ তাদের গৌরব রক্ষার জন্যই একসাথে কাজ করে যাবে।
মানুষের জীবনে ধর্মের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারত ও অন্যান্য দেশে অনেক ধর্মের অস্তিত্ব রয়েছে। ধর্ম জনগণের জীবনে শক্তি যােগায়। কিন্তু প্রত্যেক দেশের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের মৌলিক দায়িত্ব মেটানাে।*
সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বক্তব্য রাখেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্পর্কে সংবাপত্রে বলা হয় :
সাম্রাজ্যবাদীরা আমাদের স্বাধীনতাকে, বাংলাদেশ, ভারত মৈত্রীকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। আপনারা ওয়াদা করুন, আবার। যদি অস্ত্র ধারণ করতে হয় সেই ষড়যন্ত্রকে রুখতে, তাহলে আপনারা প্রস্তুত আছেন ? প্রয়ােজন হলে জীবন দিতে রাজী আছেন?
গতকাল ঐতিহাসিক সােহরাওয়ার্দী ময়দানে মহান অতিথি শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপরােক্ত আহ্বান জানালে, জনতা বজ্রমুষ্টি তুলে সমস্বরে জানিয়ে দেয়—“হ্যা, আমরা রাজী আছি। আমরা প্রস্তুত আছি।”
বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় ঘােষণা করেন যে, বাংলাদেশ দুনিয়ার সকল দেশের সঙ্গে শান্তিতে বাস করতে চায় এবং একই সঙ্গে যে কোনাে অন্যায় বা তার স্বাধীনতার উপরে যে কোনাে ধরনের হস্তক্ষেপের। বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত আছে। | ঐতিহাসিক সােহরাওয়ার্দী ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে স্বাগত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে যে কোনাে চক্রান্ত প্রতিহত করার জন্য এবং যে কোনাে মূল্যে বহু ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে আহ্বান জানান।
শেখ মুজিবুর রহমান জনগণকে হুঁশিয়ার করে দেন যে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধ শক্তিগুলাে এখনও চক্রান্তের জাল বুনে চলেছে। তারা এখনও বাংলাদেশের ভেতরে তাদের দালাল তৈরি করে চলেছে। এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বিনষ্ট করার জন্য অস্ত্র চালান দিচ্ছে।
…..
*সংবাদ, ১৮ মার্চ ১৯৭২
১২৪
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সচরাচর ভঙ্গিতে উচ্চকণ্ঠে বিশাল জনতাকে প্রশ্ন করেন, তারা কি আবারও অস্ত্র তুলে নেয়ার এবং প্রয়ােজনে চরম ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রস্তুত আছে ? শেখ মুজিব ঘােষণা করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যদি ৩০ লাখ প্রাণ দিয়ে থাকে, তবে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য দরকার হলে আরও এক কোটি প্রাণ দেবে।
শেখ মুজিব বলেন, কোনাে দেশের প্রতি বাংলাদেশের প্রতিহিংসার মনােভাব নাই। এমনকি পাকিস্তান, যার সেনাবাহিনী ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা চালিয়েছে, তার বিরুদ্ধেও প্রতিহিংসার মনােভাব নাই। পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের উপর নিপীড়ন নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা সত্যই নির্মম ও দুঃখজনক ব্যাপার যে বাঙালিরা এক বন্দী শিবিরে আটক রয়েছে এবং পরিবার-পরিজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে। তিনি হুঁশিয়ার করে দেন যে, বাংলাদেশ কিছুতেই এ ধরনের অবিচার সহ্য করবে না।
প্রধানমন্ত্রী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে বাঙালিদের পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তার প্রভাব খাটানাের অনুরােধ জানান। শেখ মুজিব বলেন, তাঁর সরকারও এ ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের বলিষ্ঠ ভূমিকার জন্য, শ্রীমতী গান্ধী, তাঁর সরকার ও ভারতের জনগণের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ইয়াহিয়ার বর্বরতার হাত থেকে পালিয়ে যাওয়া এক কোটি মানুষকে ভারত আশ্রয় দিয়েছে। খাদ্য দিয়ে, বস্ত্র দিয়ে, সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ত্রিশ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছে, তিন কোটি মানুষ গৃহহারা হয়েছে, খাদ্যশস্যের গুদাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। পাকিস্তানী বাহিনী ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা পুল, রাস্তাঘাট, বন্দর সব বিনষ্ট করে দিয়েছে। এক কথায় দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়েছে।
শেখ মুজিব বিশ্বাস করেন, “আমাদের দুঃসময়ে ভারত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, ভবিষ্যতেও সে আমাদের পাশে দাড়াবে।” তিনি বলেন, নির্ধারিত সময়ের দশ দিন আগেই ভারত বাংলাদেশ থেকে তার সৈন্য ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতের বিরুদ্ধে আর উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রচারণা চালাতে পারবে না। কোনাে চক্রান্তই ভারতবাংলাদেশের বন্ধুত্বকে নষ্ট করতে পারবে না।।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনর্গঠিত করার কাজে ভারতের সাহায্যের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করে বলেন যে, ভারত বর্তমানে পাঁচ লক্ষ টন খাদ্যশস্য দিচ্ছে এবং তাদের
১২৫
সৈন্যরা কয়েকটি পুল নির্মাণ করে দিয়েছে। তিনি আশা করেন যে, বাংলাদেশের পুনর্গঠনের কাজে ভারত সম্ভাব্য সব সাহায্য দিয়ে যাবে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী প্রয়ােজনীয় সহযােগিতা দানের জন্য সােভিয়েত ইউনিয়নকেও ধন্যবাদ জানান।
শেখ মুজিব বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাঁচাবার জন্য মায়ের মত’ এগিয়ে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, নিজ পায়ে দাঁড়ানাের জন্য বাংলাদেশের এখন প্রয়ােজন খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় সামগ্রীর। তাদের খাদ্য উৎপাদনে সময় নেবে। কিন্তু জনগণের দুশমনেরা অপপ্রচার চালাচ্ছে এবং অভাব ও দারিদ্র্যজনিত পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে চাইছে। তিনি ঘােষণা করেন যে, এরা রাজাকার, আলবদর ও সাম্রাজ্যবাদীদের চর। জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী কাজে নিয়ােজিত এদের শায়েস্তা করার জন্য তিনি জনগণকে আহ্বান জানান। তিনি দৃঢ়ভাবে ঘােষণা করেন, যেসব। দালাল এবং সামরিক পােশাক পরে যারা জনগণকে হত্যা করেছে, এই বাংলাদেশেই তাদের বিচার হবে।
শ্রীমতী গান্ধীর উদ্দেশে তিনি বলেন, আমরা আজ গরীব, আপনাকে এবং ভারতের জনগণকে প্রীতি আর ভালবাসা ছাড়া আমাদের দেয়ার কিছুই নাই। তিনি বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে শ্রীমতী গান্ধীকে কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, স্বাধীন দেশের স্বাধীন জনতা আজ আপনাকে পেয়ে আনন্দিত ও গর্বিত।”*
ইন্দিরা গান্ধীর থাকাকালীন সময়েই ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি খসড়া হলাে। এ সময় বিদেশ সচিব ছিলেন বােধ হয় করিম সাহেব। চুক্তির মধ্যে এমন কিছু ছিলাে না যাতে নাকি আমাদের কোনাে সম্মান নষ্ট হয়। পরবর্তীকালে এই চুক্তি নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। এটা নাকি সিক্রেট ডকুমেন্ট। এটা সিক্রেট ডকুমেন্ট ছিল না। প্রকাশ্য ডকুমেন্ট ছিল, সবাই এটা জানে। এই চুক্তির মধ্যে এমন কিছুই ছিল না। পারস্পরিক বােঝাপড়ার মাধ্যমেই সব হয়েছে। আণ্ডারস্ট্যান্ডিং এবং কোঅপারেশন ছিল-এই চুক্তির মূল কথা। আমরা সাহায্য চাইলে সাহায্য করবে—এই তাে ছিল ব্যবস্থা। আজকালকার দিনে এ রকম চুক্তি প্রায়ই হচ্ছে। এরপর আমি আমার দিল্লীতে ফিরে গেলাম।
আমার তখন প্রধান কাজ ছিলাে ভারতবর্ষের বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে দেখাশােনা করা। সেই সঙ্গে শরণার্থী যারা আসবে তাদের দেখাশােনা করা, বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি যাতে পাওয়া যায় সে ব্যবস্থা নেওয়া এবং অর্থ সাহায্য যাতে পাওয়া যায় সেদিকেও নজর দেওয়া। আমি সবগুলি কাজই একত্রে আরম্ভ করি। আমার মনে আছে, মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যখন আর্থিক
……
*সংবাদ, ১৮ মার্চ ১৯৭২
১২৬
বিষয়ে কথাবার্তা হয় তখন আমাদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। বৈদেশিক মুদ্রা কিছুই ছিলাে না। মিসেস গান্ধী আমাকে বললেন, ফরেন একচেঞ্জ দিয়ে সাহায্য করা আমার পক্ষে অসুবিধা, তবে ভারতীয় মুদ্রাতে ঋণ দিতে কোনাে অসুবিধা নেই। মিসেস গান্ধী সাহায্য দেওয়া অব্যাহত রেখেছিলেন। আমি একই সঙ্গে বিভিন্ন পশ্চিমা রাষ্ট্র যাদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলাে তাদের সঙ্গে যােগাযােগ করলাম। বন্ধুরাষ্ট্রের মধ্যে কানাডা এগিয়ে এলাে।
আফগানিস্তানে গেলাম। এ সময় পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালিরা আফগানিস্তান হয়ে ভারতবর্ষ হয়ে বাংলাদেশে ফিরছিলেন। আফগানিস্তানে পৌছানাের পর সেখানকার সরকার এ বিষয়ে সাহায্য করছিলাে। বােধ হয় আফগানিস্তানকে ভারতবর্ষ সরকারের পক্ষ থেকে অনুরােধ জানানাে হয়েছিলাে। আমি কাবুল বাদশাহ জহির শাহর সাথে দেখা করলাম। আফগানিস্তান সরকার সহায়তা প্রদানের অঙ্গীকার করলেন। জহির শাহ অত্যন্ত ভদ্র মানুষ। কম কথা বলতেন। আমি ইংরেজীতে কথা বলতাম আর দোভাষী ভাষান্তর করে বাদশাহকে শােনাতেন। হাই কমিশনার হিসাবে গিয়েছি। জহির শাহ অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে আমার কথাবার্তা শুনেছিলেন। তিনি বললেন, তাঁর সরকার সম্ভাব্য সব রকমের সহায়তা প্রদান করবে। এক পর্যায়ে আমি প্রশ্ন তুললাম শরণার্থী যারা আফগানিস্তান এয়ারওয়েজের বিমানে যাচ্ছে তাদের টাকা তাে দিতে পারছি না। এগুলাে আমরা পরে দেব। বাদশাহ জহির শাহ বললেন, এ দায়িত্ব মিসেস ইন্দিরা গান্ধী নিয়েছেন। সুতরাং এ নিয়ে আপনার না ভাবলে চলবে। মিসেস গান্ধীর সঙ্গে আমরা বন্দোবস্ত করে নেব। তখন প্রায় প্রতিদিনই বিমানের অধিকাংশ আসনই নিতে হতাে আমাদের বাঙালি রিফিউজিদের জন্য। এখানেই দেখা হলাে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শফিউল্লাহর সঙ্গে। তিনি তাঁর পরিবারবর্গ নিয়ে আছেন এক বাড়িতে। আফগানিস্তান সরকার কতগুলাে আশ্রয় কেন্দ্র করেছিলেন। আমি সমস্ত আশ্রয়কেন্দ্রগুলাে ঘুরে দেখলাম। এসব বিষয়ে আফগান সরকারের যা খরচ হবে পরে আমরা তা পরিশােধ করে দেবাে এমন একটি চুক্তি সই করলাম।
এর ক’দিন পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে আমাকে আলজিরিয়া যেতে হলাে। বুমেদীন এসময় আলজিরিয়ার প্রেসিডেন্ট। আলজিরিয়া সরকার আমাকে ভালভাবেই গ্রহণ করলেন। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, তােমরা স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে গিয়ে সব সাহায্য নিয়েছ ভারতবর্ষ থেকে। তােমরা ইণ্ডিয়া ঘেঁষা হয়ে গেছে। অনেকে এ কথা বলে যে তােমরা ইণ্ডিয়া। ঘেঁষা হওয়ার ফলে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের অসুবিধা হচ্ছে। উত্তরে আমি বললাম, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমাদের সহায়তা করার মতাে রাষ্ট্র কোথায় ছিলাে? আমি প্রেসিডেন্ট বুমেদীনকে আরও বললাম যে, আমরা ভারতবর্ষ ছাড়া কি অন্য কোনাে রাষ্ট্রের সহায়তা পেতাম? ঐ পরিস্থিতিতে একমাত্র পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত
১২৭
সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। আমাদের যারা নির্যাতিত হচ্ছিল তারা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতবর্ষে ঢুকে পড়লাে। আর যারা মুক্তিযুদ্ধ করছিলাে তাদেরও ঐ সীমান্ত পেরিয়ে আসা-যাওয়া করতে হতাে। আলজিরিয়ার মতাে এত দূরের রাষ্ট্রের কাছ থেকে আমরা এত তাড়াতাড়ি সাহায্য পেতাম না। বার্মার সাহায্য আমরা আশা করতে পারি না। বার্মাতে রাজনৈতিক সমস্যা রয়ে গেছে। এমতাবস্থায় আমরা কোন্ রাষ্ট্র থেকে সহায়তা নিতে পারতাম ? এমতাবস্থায় কোনাে দেশের মানুষ স্বাধীনতা চাইলে তাদের কোনাে না কোনাে রাষ্ট্রের সাহায্য সহযােগিতার প্রয়ােজন। হয়, এ কথা সব রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই প্রযােজ্য। যদি আমরা যূরােপের ইতিহাস খুঁজি এমন কি আপনার দেশেও খুঁজি তাহলে দেখা যাবে আপনাদেরও সহায়তা নিতে হয়েছে বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা ভারতবর্ষের সাহায্য নিয়েছি। আর সহায়তা নিয়েছি বলেই আমরা ভারতবর্ষের গােলাম হয়ে গেলাম এ চিন্তা যদি কেউ করেন তাহলে সেটা ভুল করা হবে। তাছাড়া ভারতবর্ষ এমন কিছু করেনি। যাতে প্রমাণিত হয় যে তারা আমাদের সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন করেছে। সুতরাং এ রকম ধারণা থাকা ঠিক নয়। অনেক কথাবার্তার পর তিনি কনভিন্স হলেন। তিনি আমাদের দেশকে খুব তাড়াতাড়ি স্বীকৃতি দিচ্ছেন বলে জানালেন। আর যে ভুল বুঝাবুঝি ছিল সেটাও আর রইল না। প্রেসিডেন্ট বললেন তুমি আমাকে বললে যে, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হলে বাইরের সাহায্যের প্রয়ােজন হয়—অর্থ দিয়ে হােক, অস্ত্র দিয়ে হােক কিংবা সহযােগিতামূলক মনােভাব দেখিয়ে হােক। তােমরা সেভাবেই নিয়েছাে ঠিকই আছে।’
এখানে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। আমি যখন ঢুকলাম আমার উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজিতে কথাবার্তা বলবাে তারপর দোভাষী ভাষান্তর করে দেবে। দেখলাম যে তিনি আরম্ভ করলেন আরবী দিয়ে। আর এক ভদ্রলােক আরবী অনুবাদ করলেন ফার্সিতে। আমার সঙ্গে ছিল সৈয়দ আমিরুল ইসলাম। আমার সেকেণ্ড সেক্রেটারী, সে ফরাসী জানতাে। তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলাম। সে ফরাসী থেকে আমাকে বাংলা তরজমা করে বােঝাচ্ছে। আমিও বাংলায় আরম্ভ করলাম। আমার বাংলা ফরাসী ভাষায় তরজমা করছিলাে সৈয়দ আমিরুল ইসলাম। এরপর ফরাসী থেকে আরবী। এতে অনেক সময় গেল। বুমেদীন আমার সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করলেন। বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীকে ডাকলেন তিনি। তার দায়িত্বে আমাকে রাখলেন। আমি রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসাবে রইলাম। আমার মনে আছে কথায় কথায় বুমেদীন বলেছিলাে, আমার দেশ কি তােমার পছন্দ হলাে? আমি বলেছিলাম, পছন্দ তাে হয়েছেই, তাছাড়া তােমরাও স্বাধীনতা অর্জন করেছাে আমাদের মতাে সংগ্রাম করে-আমার তাে তােমাদের প্রতি সম্মানবােধ আছেই। তিনি খাওয়া-দাওয়ায়, কোনাে অসুবিধা হচ্ছে কিনা তাও জিজ্ঞাসা করলেন। খাওয়া-দাওয়া খুব ভালাে বলতেই বললেন, কোন্টা ভালাে লাগে? আমি বললাম, তােমাদের খেজুরগুলাের রং কাঁচা সােনালী রং-এর মতাে, খেতে বেশ মজা। প্রেসিডেন্ট বেশ আগ্রহভাবে কথাগুলাে শুনছিলেন।
১২৮
আমরা আলজিরিয়া বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছি। দুই সরকারের পক্ষ থেকে যুক্ত বিবৃতি প্রস্তুত করা হলাে। বিবৃতি ইংরেজিতে আমি ড্রাফট করে দিয়েছি। ঐ বিবৃতি আবার ফরাসী ভাষায় রূপান্তর করা হয়েছে। তারপর আরবীতে করা হলাে। যুক্ত বৃিবতিটি আমাদের সমর্থন করে দেওয়া হয়। আমাদের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতার পরও দেখি বিমান ছাড়ছে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, বিমান কত দেরিতে ছাড়বে? উত্তর দিলাে, দেরি বেশি হবে না। তােমার সঙ্গে যে জিনিসগুলাে যাবে সে জিনিসগুলাে উঠতে দেরি হচ্ছে। আমি বললাম, আমার তাে কোনাে জিনিসপত্র নেই কেবল সুটকেস। তারা জবাব দিলাে, না, প্রেসিডেন্ট বুমেদীন তােমাকে অনেকগুলি কাঠের বাক্স দিয়েছেন—তাতে কি জিনিস জানি না। কিছুক্ষণের মধ্যে প্লেন ছাড়লাে। নামলাম লণ্ডনে। মালগুলি নামালে দেখা গেল ক্রেট বােঝাই খেজুর। মনে হলাে গাছ থেকে পাকা খেজুর পাড়া হয়েছে এবং ক্রেটকে ক্রেট দিয়েছে। লণ্ডনে। আমাদের ডেপুটি হাই কমিশনার ছিলাে ফারুক। আরাে কয়েকজন সেখানে ছিলাে। আমি বললাম, তােমরা কয়েকটা ক্রেট রেখে দাও। কয়েকটা ক্রেট লণ্ডনে রেখে দিল। কয়েকটি ক্রেট ভারতে রেখে কিছু নিয়ে এলাম বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধুকে এক ক্রেট দিলাম। আমি ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যেই আলজিরিয়া আমাদের স্বীকৃতি দিলাে।
আমি তখন দিল্লীতে। একদিন রাত দশটা সাড়ে দশটায় দাওয়াত খেয়ে বাসায় ফিরতেই আমার ছােট ছেলে বললাে যে, বঙ্গবন্ধু ফোন করেছিলেন, আপনাকে রাত্রে টেলিফোন করতে বলেছেন। আমার একটু সন্দেহ হলাে, কারণ এর আগে আমি শুনেছিলাম যে তাজউদ্দিন আহমদকে মন্ত্রিত্ব থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সেখানে তিনি একজন মন্ত্রী নেওয়ার কথা চিন্তা করে আমার কথা ভাবছেন—এমন কথাও শুনেছিলাম ! কেন ফোন করলেন? কি সংবাদ নানা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলাে। আমার আরাে সন্দেহ হলাে এত রাতে কেন তিনি টেলিফোন করলেন। একবার ভাবলাম যে আজ আর ফোন করবাে না। কালকে ভােরবেলা চিন্তা-ভাবনা করে বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলবাে। এসব ভাবতে ভাবতে শুয়ে পড়েছিলাম। রাত তখন প্রায় একটা। আবার টেলিফোন বেজে উঠলাে। টেলিফোন ধরেই বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বর টের পেলাম। তিনি আমাকে বললেন যে, আপনাকে ফোন করেছিলাম। আমি অপেক্ষা করেছিলাম আপনার ফোনের জন্য। আপনি তাে ফোন করলেন না। আমি বললাম যে, রাত অনেক হয়ে গিয়েছিলাে তাই আপনাকে ডিস্টার্ব করিনি। তিনি বললেন, যা হােক, আপনি আগামীকালই থাই এয়ারওয়েজে চলে আসবেন। খুব জরুরী কথা আছে। আমি শেখ মুজিবকে বললাম যে, আগামীকাল একটু অসুবিধা আছে, কয়েক দিন ঢাকাতে গিয়ে থাকতে হবে। তাছাড়া ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দিবস আসছে। মিসেস গান্ধী স্বাভাবিকভাবেই আশা করবেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত থাকুক। তিনি
১৪৫
কোনাে কথা শুনতে চাইলেন না, তিনি বললেন, না আগামীকালই আসতে হবে, খুব জরুরী। আপনি মিসেস গান্ধীর সাথে দেখা করে বলে আসেন। আর আপনার যে ডেপুটি হাই কমিশনার তিনি দায়িত্ব পালন করবেন।
এ সময় আমার সঙ্গে ডেপুটি হাই কমিশনার হিসেবে আতাউল করিম কাজ করছিলেন। আমি পরের দিন ভােরবেলা মিসেস গান্ধীর সঙ্গে দেখা করলাম, দেখা করে বললাম যে আমাকে ঢাকা চলে যেতে হচ্ছে বলে ভারতের স্বাধীনতা দিবসে আমি থাকতে পারছি না। ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে দেখলাম কামরুজ্জামান অপেক্ষা করছেন। তিনি আমাকে নিতে এসেছেন। তিনি আমাকে বললেন, আপনাকে জবাই করা হচ্ছে, আপনি যা চান না তাই আপনাকে হতে হবে। আমি বললাম, কি? তিনি বললেন, আপনাকে মন্ত্রী বানিয়ে ছাড়বেন শেখ সাহেব। তিনি আমাকে বিমানবন্দর থেকে আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন। আমার মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। তাঁকে জানালাম, এ অবস্থায় আমি যাবাে না। কামরুজ্জামানের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল অনেকদিনের। কামরুজ্জামানকে বললাম, বঙ্গবন্ধুকে বলাে আমি পরে তাঁর সঙ্গে দেখা করবাে। আমি আমার বড় ছেলে ফারুকের ধানমণ্ডিস্থ বাড়িতে যাচ্ছি। ঐ দিন বিকেলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলাম না। পরের দিন সকাল আটার দিকে শেখ মুজিব ফোন করলেন। তিনি আমাকে তাড়াতাড়ি চলে আসতে বললেন। আমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে রওয়ানা হলাম। বঙ্গবন্ধু এ সময় সেকেণ্ড ক্যাপিটালের একটি ভবনে বসতেন। আমি যেতেই তিনি বললেন, ‘কি জন্য আপনাকে এনেছি সে আভাস কামরুজ্জামান নিশ্চয়ই আপনাকে দিয়েছে? আমি বললাম, হ্যা দিয়েছে। আমার মতামত চাইলেন তিনি। তাৎক্ষণিকভাবে জানালাম মন্ত্রী হবাে না। আপনার সঙ্গে আমার কথা ছিলাে যে আপনি আমাকে ছেড়ে দেবেন জরুরি কাজগুলাে হবার পর । হাই কমিশনার হিসেবে আমার দায়িত্ব কিছুটা পালন করেছি—এখন আমাকে ছেড়ে দিলে ভালাে হয়।’ তিনি বললেন আপনাকে আমার দরকার। স্বাধীনতার পরপরই আপনার ক্যাবিনেটে আসা উচিত ছিলাে। আপনাকে আমি ইঙ্গিতও দিয়েছিলাম কিন্তু আপনি রাজি হননি। এখন ক্যাবিনেটে আসতে হবে। কিছুদিন আমাদের সঙ্গে থাকতে হবে। তারপর আপনি যেখানে যেতে চান ব্যবস্থা করে দেবাে। আমি বললাম, ‘স্বাধীনতার পর থেকে জরুরি কাজ সারতে সারতে ১৯৭৫ সালে চলে এলাে। আর কতদিন আমি এভাবে থাকবাে? তিনি বললেন, আর কিছুদিন আপনি থাকেন। তারপর আপনি যাবেন। এখন মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব নিয়ে ক্যাবিনেটে আপনাকে আসতে হবে। তখন আমি বললাম যে, ক্যাবিনেটে যদি আমাকে আসতেই হয়, তাহলে কি বলতে পারি আমি কোন্ পাের্টফলিউ নেবাে? তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই। আমি তাঁকে জানালাম যে, আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয় নেবাে না। যেহেতু আমি বহুদিন
১৪৬
শিক্ষা ক্ষেত্রে আছি। আমার ছাত্ররা এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে, বন্ধু-বান্ধবরা ছড়িয়ে আছে। এ দায়িত্ব নিলে আমি বােধ হয় কোনাে ভুল-ভ্রান্তি করে বসবাে। হয়তাে অনেক সময় অন্যায় করে বসবাে। পরিচয়ের সুযােগে হয়তাে অনেকে নানা সুবিধা নিতে পারে।’ তিনি বললেন, ঠিক আছে। আমি আরাে জানালাম ব্যবসাবাণিজ্য সংক্রান্ত কোনাে মন্ত্রণালয়ও আমি নিতে চাই না। যেহেতু আমি ওগুলাে বুঝি না। আমি বলেছিলাম, আপনার দলের লােকজন যেন আমার কাছে সুযােগ সুবিধার জন্য না আসে। তিনি বললেন, ঠিক আছে। আমি শেষে বললাম, ‘আপনি আমাকে মন্ত্রিত্ব দিলে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে দিতে পারেন। ঐ দায়িত্ব আমি খুব ভালােভাবে পালন করার চেষ্টা করবাে—যাতে পরিবার পরিকল্পনা সমস্যার কিছুটা সুরাহা করতে পারি। আমার একথা শুনে বঙ্গবন্ধু উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। তিনি বললেন, ‘ঐ কাজটি আপনাকে করতে হবে না। আমি বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশে জনসংখ্যা একটি বড় সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করে আমার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে সচেষ্ট হলাম। আপনাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিতে হবে। আমি সঙ্গে সঙ্গেই বললাম, আমি এ দায়িত্ব নেবাে না মূলত দুটো কারণে। আমি অর্থনীতি কম বুঝি। আর দ্বিতীয়ত সামাজিক কারণ। আপনি তাজউদ্দিন আহমদকে বাদ দিয়েছেন। তিনি আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন ব্যক্তি এবং তাঁর স্থলে আমি মন্ত্রিত্ব নেবাে এটা আমার দ্বারা হবে না। আমাকে মাফ করুন আপনি। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘বিশেষ কারণে আপনাকে এ অনুরােধ করা হচ্ছে। এখানে বলা প্রয়ােজন যে, তাজউদ্দিনের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্বে তাঁর সঙ্গে আমার কোনাে পরিচয়ই ছিল না। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে কলকাতায়। বাংলাদেশ সরকার প্রকাশ্যভাবে শপথ নেওয়ার আগেই তিনি আমাকে ত্রিপুরা থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবদুল মালেক উকিলকে পাঠিয়েছিলেন। এর পর থেকেই তাজউদ্দিন আহমদ-এর সঙ্গে আমার সখ্যতা গড়ে ওঠে। তিনি প্রায় সব ব্যাপারেই আমার সঙ্গে আলােচনা করতেন। যদিও আমি ক্যাবিনেটে ছিলাম না বা কোনাে সরকারী দায়িত্ব আমি গ্রহণ করিনি। আমি তাঁকে বলেছিলাম, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত কোনাে সরকারী দায়িত্ব আমি নেবাে না। ক্যাবিনেটে আলােচিত অনেক কথাই তিনি আমাকে বলতেন। আমার মনে আছে, আমাদের দেশের নােটে যখন ছবি ছাপা হয় তখনাে তিনি এ বিষয় নিয়ে বার কয়েক আলােচনা করেছেন। নিরলস পরিশ্রমী। নিষ্ঠাবান এই মানুষটি যুদ্ধকালীন সময়ে অফিসেই দিন-রাত থাকতেন, অফিসেই খেতেন, অফিসেই ঘুমাতেন বলা যায়।
একই ভবনে তাজউদ্দিনের স্ত্রী, সৈয়দ নজরুল ইসলামের পরিবার, বাস করতেন। কিন্তু তাজউদ্দিন সেখানে থাকতেন না। আমাকে বলেছিলেন, ভাই দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমার পরিবারের সঙ্গে এক বাসাতে থাকতে চাই না।
১৪৭
কাজেরও সুবিধা হয়, সাংসারিক ঝামেলা আমি নিতে চাই না। তার গায়ে একটি শার্টই প্রায় দেখতাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম যে, শার্ট বদলান না কেন? বললেন, ওটাও হাঙ্গামা হবে। এই শার্টটি ময়লা কম হয়, গােছল করার সময় মাঝে মাঝে ধুয়ে নিই।’ দ্যাট ওয়াজ তাজউদ্দিন। সুতরাং তাঁর প্রতি আমার অত্যন্ত স্নেহ বর্তমান। আমার চেয়ে বয়স তার কম ছিল। তিনি কোনাে সিদ্ধান্ত নিতে আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, ক্যাবিনেটের বাইরে এসেও কথা বলতেন। ক্যাবিনেট মিটিং-এ আমাকে মাসে পাঁচ শ টাকা দেবার কথাও তিনি বলেছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামও টাকা দেবার কথা বলেছিলেন। আমি বিনয়ের সঙ্গেই সে প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, আমার টাকা লাগবে না। দেশেবিদেশে আমার অনেক ছাত্র আছে। আত্মীয় স্বজনও দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে আছে। কর্জ হিসাবে আমি টাকা পাচ্ছি। পরে আমি শােধ করে দেব। সরকারী কোনাে অর্থ সাহায্য আমি নেব না। এতে বােধ হয় আমার সম্পর্কে তার ধারণা আরাে ভালাে হয়েছিলাে। আমার হাই কমিশনার থাকাকালীন সময়ে তাজউদ্দিন আহমদ যখন দিল্লী যেতেন তখন অধিকাংশ সময়ই তিনি আমার বাসায় থাকতেন। এমন কি বিদেশে যাওয়ার পথে দিল্লী হয়ে ফেরার পথে কি যাওয়ার পথে আমার বাসায় দুএক রাত্রি তিনি কাটিয়ে যেতেন। তাঁর সঙ্গে অনেক বিষয় নিয়েই আলাপ হতাে। যতদূর মনে পড়ছে ১৯৭৪ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে একবার আমাকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে তিনি বােধ হয় আর ক্যাবিনেটে থাকতে পারছেন না। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দিনের সম্পর্ক খুবই ভাল ছিলাে। পরস্পরের বাড়িতে আসাযাওয়া ছিলাে। তাজউদ্দিন আমাকে বলেছিলেন, আমার মনে হচ্ছে একটা চক্র আছে যারা বঙ্গবন্ধুর চারপাশে থাকে এবং তারাই আমার সম্বন্ধে অনেক কিছু বলে, যাতে তিনি বিরূপ হন। আমি বঙ্গবন্ধুকে খুব বেশি পছন্দ করি না কিংবা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমার ভূমিকা বড় ছিলাে এবং সেটি পুঁজি করে বঙ্গবন্ধুকে ব্যবহার করতে চাই—এমন একটি ধারণা বােধ হয় দিতাে। আমি বলেছিলাম, আপনি খােলাখুলিভাবে শেখ সাহেবের সঙ্গে আলাপ করলেই তাে পারেন। বললেন, ‘তাতে লাভ কি? তিনি যখন জিজ্ঞেস করেন না, আমি কি করে বলি?’ আমি একবার বলেছিলাম, আমি কি কথাটা তুলবাে?’ বল্লেন, না। প্রয়ােজন হলে পরে আমি বলবাে।’ এসব কথা আমি জানতাম। তাই তাজউদ্দিনকে বাদ দেওয়ায় আমার মন খুব খারাপ হয়েছিলাে। যাই হােক, আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, তাজউদ্দিন সাহেবের পাের্টওলিফটা আমি ভাই নিতে পারবাে না।’ তিনি বসেছিলেন, উঠে দাঁড়ালেন। আমিও দাঁড়ালাম। তিনি আমার হাত ধরে বসলেন। ‘আপনি আমাকে সাহায্য করুন। আমি বেশ ঝামেলায় আছি। আমার চারপাশে পাের্টফোলিও নিয়ে পলিটিক্যাল লােকজন ঘােরাফেরা করে। অনেক সময় সিদ্ধান্ত
১৪৮
ঠিকমতাে নিতেও পারি না। আপনার মতাে লােক যদি প্রথম থেকে থাকতাে, যে কোনাে রাজনীতি করে না তাহলে হয়তাে আমার উপকার হতাে, দেশের উপকার হতাে। বঙ্গবন্ধু প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলাে বলে ফেললেন। তারপর বললেন, ‘এবার আপনাকে এ দায়িত্ব নিতে হবে। তাজউদ্দিন সম্পর্কে আপনার কথা পরে শুনবাে। আর তাজউদ্দিন সাহেবকে যদি মন্ত্রিত্বে আনতে হয়, সেটাও আনা যাবে কিন্তু আপাতত অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে।’ তিনি বললেন, ‘অর্থমন্ত্রী হতে অর্থনীতি জানতে হয় না। আপনি এমন একজন মন্ত্রীর কথা বলতে পারবেন না যিনি অর্থনীতিতে লেখাপড়া করেছেন এবং ভালাে অর্থমন্ত্রী হয়েছেন। আমি আপনাকে উদাহরণ দিতে পারি যে অর্থনীতি না পড়েও ভালাে অর্থমন্ত্রী হয়েছেন। ইমপার্সিয়ালিটির প্রয়ােজন হয়। নিজের বিচারের প্রতি বিশ্বাস থাকতে হয়। আর দেশকে ভালােবাসতে হয়। এ সবই আপনার মধ্যে আছে। আপনি পদ। নিলে আমার উপকার হয়। অর্থনীতির অবস্থা তাে আপনি দেখেছেন। আমি । আবারও অর্থমন্ত্রীর পদ আর কাউকে দেবার জন্য বললাম। তিনি বললেন, আর কাউকে না। এক ব্যক্তি এ পদ নেওয়ার জন্য আগ্রহভরে দাঁড়িয়ে আছেন—যদি আপনি এ পদ গ্রহণ না করেন তাহলে হয়তাে আমাকে এমন অবস্থায় পড়তে হতে পারে যে ঐ পদটি তাকেই দিতে হবে।’ তিনি বলেই বসলেন, সাহেব আপনি যদি না হন, তাহলে অর্থমন্ত্রী কিন্তু হয়ে যাবে খন্দকার মােশতাক আহমদ। দেশ স্বাধীন। হওয়ার পর খন্দকার মােশতাককে বিদেশ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে সেখানে আবদুস সামাদ আজাদকে বসানাে হয়। তার ধারণা এ কাজ তাজউদ্দিন করিয়েছে। তিনি এখন অর্থমন্ত্রিত্ব নেওয়ার চেষ্টা করছেন এজন্য যে তাজউদ্দিন যেমন তাঁকে সরিয়ে দিয়েছিলাে তিনিও তাজউদ্দিনকে সরিয়ে ঐ পদে বসবেন। আমি বললাম, “কেন, আপনি খন্দকার মােশতাককে না বলে দিলেই তাে পারেন? তিনি বললেন, হ্যা, । তা বলতে পারি। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার মতাে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোনাে লােক আমার আর নেই। অন্য কেউ মন্ত্রী হলে, যেহেতু আমি শেখ মুজিবুর রহমান, তাই আমি কোনাে কথা বললে সে তাৎক্ষণিকভাবেই শুনবে। তাজউদ্দিনও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। আমি বললাম, হ্যা মনে আছে, তাজউদ্দিন আহমদ আমাকে দিল্লীতে বসে বিমান কেনার একটি ঘটনা বলেছিলেন। আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই বিমানটি কেনা হয়েছিলাে। ওসমানী সাহেব প্লেন নিয়ে আসেন, আপনার কথা মতাে অর্থমন্ত্রীকে টাকা দিতে হয়েছিলাে। তাজউদ্দিন আহমদ দিল্লীতে আমাকে বলেছিলেন, ভাই, মন্ত্রিত্ব কি করবাে, শেখ সাহেব যা বলেন তাই শুনতে হয়। তিনি অনেক সময় অনেক কাজই করেন যেগুলাে পরবর্তীকালে আমাদের সমালােচনার মুখে পড়তে হবে, কৈফিয়ৎ দিতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, দেশে একটি বড় ধরনের দুর্ভিক্ষ হয়ে গেল । ১৯৭৪ সালে মানুষ না খেয়ে মরেছে।
১৪১
অনেককে কাফন দেওয়ার কাপড় পর্যন্ত দিতে পারিনি। এই পরিস্থিতির জন্য আমার সরকার দায়ী। যদিও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র একটা ছিল। আমি চাচ্ছি না যে আমার দেশের মানুষকে আর যেন না খেয়ে মরতে হয়, কাপড়ের অভাবে দাফনকাফনের অসুবিধা যেন না হয়। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হবে, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে যে সমস্ত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়ােজন তা আপনি নেবেন। আপনি রাজনীতিক নন, আপনাকে কোনাে কাজে আমরা বাধা দেব না। আপনি ইচ্ছামতাে কাজ করবেন। এই শর্তেই আপনি এ দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। আপনি দায়িত্ব গ্রহণ না করলে আপনাকে আমি ছাড়বাে না। আপনাকে আমি দিল্লী ফিরে যেতে দেব ।’ এসব কথা বলে তিনি আমাকে বসিয়ে দিলেন। আমি তখন বললাম যে, যদি এ দায়িত্ব নিতেই হয় তাহলেও কি আপনার ভাবীর সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার না? তিনি বললেন, ‘সেটা আমি করবাে। আমি ভাবীকে ফোন-এ বলবাে যে। আপনি যাচ্ছেন না। আপনার শপথ নেওয়া হােক। আপনি মন্ত্রী হন, তারপর অন্য । কথা। কারণ আপনাকে যদি আমি ছেড়ে দিই তবে আপনি দিল্লী গিয়ে হয়তাে আর। আসতে চাইবেন না। আপনাকে শপথ নিয়ে তারপর দিল্লী যেতে হবে।’ এই বলে তিনি আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই বেল টিপলেন। কে একজন এলাে। বললেন, তৌফিককে খবর দাও। তৌফিক এসে দাঁড়ালাে। তৌফিক ইমাম তখন ক্যাবিনেট সেক্রেটারী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, “তৌফিক, আগামীকাল ড: মল্লিকের অর্থমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়ার ব্যবস্থা করাে। কোরবান আলীর নামসহ আরাে দু’একজনের নাম তিনি বললেন। বঙ্গবন্ধু এমনভাবে কথা বললেন, যেখানে আমার রাজি হওয়া না-হওয়ার কোনাে সুযােগই রইলাে না। আমি তখন বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বেরিয়ে এলাম। পরে আমি শুনলাম যে, বঙ্গবন্ধু আমার স্ত্রীর সঙ্গে। ফোনে কথা বলেছেন। তিনি আমার স্ত্রীকে নাকি বলেছেন, ভাবী, কিছু মনে করবেন না। আমি জোর করেই ডক্টর সাহেবকে মন্ত্রী করেছি। যদি কোনাে অপরাধ হয় তাহলে আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনার সঙ্গে তার কথা বলার সুযােগ আমি দিলাম না। আমি যখন বেরােচ্ছি তখন দেখি তাজউদ্দিন আহমদ, শেখ মুজিবসহ বেশ কয়েকজন একটি লম্বা টেবিলে চা খাচ্ছেন। আমি যেতেই শেখ মুজিব মন্তব্য করলেন – দেখ, আমি তাঁকে ফাঁসির আসামী করেছি। তার মন্ত্রী হবার ইচ্ছা নেই। আমি জোর করে তাঁকে মন্ত্রী করলাম। চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখ – কি রকম চেহারাটা হয়েছে। আমি তাকে বুঝিয়েছি, তােমরাও তাঁকে বুঝিয়ে বলাে যে তার দরকার আছে। আমি কথার জবাব না দিয়ে তাজউদ্দিন আহমদের ঘাড়ে হাত দিয়ে বললাম যে, চা কি খাবেন? বললেন, কেন? বললাম, আপনি আমার সঙ্গে চলেন। তারপর আমি শেখ সাহেবকে বললাম, আমাকে মাফ করবেন – আমি এখন চা খাবাে না। আমি তাজউদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে চা খাবাে। তিনি বললেন, ঠিক আছে যান । শেখ মুজিব আমাকে দরজা পর্যন্ত দিয়ে গেলেন। আমি তাজউদ্দিনকে নিয়ে সােজা তাঁর বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। পথে তাকে বললাম, তাজউদ্দিন সাহেব, আপনি হয়তাে আশ্চর্য হয়েছেন যে আমার মতাে লােক যেখানে
১৫০
আপনাকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে সেই মন্ত্রিত্ব আমি কি করে গ্রহণ করলাম। তিনি বললেন, আমি সব জানি। বললাম, কি রকম জানেন? বললেন, আপনি এ পদ গ্রহণ করতে চাননি তা আমি শুনেছি। কোথায় শুনেছেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম । তাজউদ্দিন সাহেব বললেন, আমি শুনেছি, অনেক সাের্স আছে। তাছাড়া শেখ সাহেবও তাে আমাদের সামনেই বললেন। আমাকে কেনাে সরানাে হয়েছে, কি হয়েছিলাে তা যদি কখনাে জানতে চান তাহলে জানতে পারবেন, তবে আমি খুব খুশি যে আমার দায়িত্ব আপনি নিয়েছেন। আর কারাে হাতে পড়েনি। ইতিমধ্যে আমরা বাসায় পৌছে গেলাম। তাজউদ্দিন আহমদ তাঁর স্ত্রীকে ডাকলেন। আমরা চা খেলাম। চা খেতে খেতে তাজউদ্দিন তাঁর স্ত্রীকে বললেন যে, আমি খুশি হয়েছি যে, আমার দায়িত্ব ভাই সাহেব নিয়েছেন। তিনি আরও বললেন, আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যার কথা শেখ সাহেব ফেলতে পারবেন না। আপনি আওয়ামীলীগ বা অন্য কোনাে রাজনীতি করেন না। আওয়ামীলীগের কেউ আসলেই নানা তদবীর নিয়ে নানা লােক আসতাে। এখন শেখ মুজিব যে কিছু বলবেন সে সুযােগ আর রইলাে না। আপনি আপনার কাজ চালিয়ে যান। আমরা আছি। আপনি আমাকে নিয়ে ভাববেন না। এরপর আমি বাড়িতে ফিরে এলাম।
পরদিন সকালে আমি অফিসে যাওয়ার আগে শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি তাঁর চেয়ার থেকে উঠে এসে আমকে জড়িয়ে ধরলেন। জড়িয়ে ধরে (আমি কোলকুলি পছন্দ করি না) তিনি আমার সঙ্গে কোলাকুলি করলেন। তারপর বললেন, ভাই আমার রাতে ভালাে ঘুম হয়েছে। আপনি দায়িত্ব নিয়েছেন। আপনি যখন হাই কমিশনার হয়েছিলেন তখন অনেক শর্ত দিয়েছিলেন। এবার আর শর্তের প্রয়ােজন হবে না। যে পর্যন্ত আপনি অর্থমন্ত্রী আছেন সে পর্যন্ত আপনাকে জিজ্ঞেস করা ছাড়া অর্থ সংক্রান্ত কোনাে ব্যাপারে আমি কিছু বলবাে না। আর আপনি দেশের স্বার্থে যা চাইবেন সেটা আমাকে বুঝিয়ে বললে আমি ক্যাবিনেটে যাতে কোনাে সমস্যা না হয় সেদিকটি দেখবাে। আপনি আপনার কাজ করে যান। অর্থনীতি চাঙ্গা হবে এ বােধ আমার আছে। যদিও আপনি বলেছেন আপনি অর্থনীতি জানেন না। আমি বিশ্বাস করি আপনি পারবেন। একটি কথার আমি পুনরুক্তি করছি, ডক্টর সাহেব, আমার দেশের লােক যেন আর না খেয়ে মারা না যায়। দাফন-কাফনের কাপড় নেই – এ কথা যেন আর শুনতে না হয়। এ সময় তিনি বেশ আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। দেখলাম তার চোখ ছলছল করছে । আমি শেখ মুজিবকে বললাম, প্রতিজ্ঞা করছি, আমি এ কাজে আমার সর্বশক্তি নিয়ােগ করবাে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবাে। তবে আপনি বলেছেন কোনাে ইন্টারফেয়ার করবেন না – কেবল এটুকু মনে রাখবেন। আমি রাজনীতিবিদ নই। আমার পক্ষে বাইরের চাপ সহ্য করা কঠিন। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর শেখ মুজিব তাঁর কথা রেখেছিলেন। আমার কোনাে কাজে তিনি হস্তক্ষেপ করেননি। তিনি যে তার ওয়াদা রেখেছিলেন সে বিষয়ে বেশ কিছু ঘটনার কথা আমার মনে আছে।
১৫১
সেদিন বঙ্গবন্ধুর বােধ হয় জন্মদিন ছিলাে। আমি জানি না। সবাই আমাকে ফোন করে বলছে, আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, আমরা যাচ্ছি, আপনি যাবেন নাকি? আমি বললাম, আমার হাতে অনেক কাজ রয়েছে, এ সময়ে আমি যেতে পারবাে না । আমি সেক্রেটারিয়েটে আমার অফিসে রয়ে গেলাম। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালন করে কয়েকজন গায়ে রং নিয়েই আমার ঘরে ঢুকলেন। এঁদের মধ্যে ফনীভূষণ মজুমদারও ছিলেন। আমাকে তিনি বললেন, আপনি এখনাে পর্যন্ত যাননি? আমি বললাম, কোথায়? বললেন, বঙ্গবন্ধুর আজ জন্মদিন, আপনি এখনাে এখানে বসে আছেন? ফনীদার কথার উত্তরে আমি বললাম, বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে জন্মদিন পালন করছেন না। আপনারা বন্ধু বান্ধবরা মিলে আনন্দ করছেন। জন্মদিন আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করলে মন্ত্রী হিসাবে আমি যেতাম। আমার যাওয়ার কোনাে প্রয়ােজন আছে বলে মনে হয় না। তাছাড়া আমার কাজ রয়েছে, যাওয়া সম্ভব নয়। তিনি চুপ করে গেলেন। এরই মধ্যে আরাে কিছু লােক আমার ঘরে ঢুকলেন। তারা। সবাই মন্ত্রী। তারা আমার সব কথা শুনেছিলেন। তারা বললেন, কি সাংঘাতিক কথা বলেছেন। আমি প্রায় বিরক্ত হয়েই ওদের সামনেই শেখ সাহেবকে ফোন করলাম। আমি বললাম, বঙ্গবন্ধু আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি, আপনার জন্মদিনে আজ আমি আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করছি। আমি ভাই আসতে পারিনি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, আমি খুব খুশি হয়েছি যে আপনি দায়িত্ব ফেলে আসেননি। আমি প্রায় চিৎকার করে বললাম, ফনীদা শােনেন বঙ্গবন্ধু কি বলছেন।
আর একদিনের ঘটনা। শেখ সাহেব ঢাকায় নেই। তিনি গেছেন কক্সবাজার। হঠাৎ করে আমাকে বলা হলাে বঙ্গবন্ধুর অফিস থেকে টেলিফোন এসেছে, একটি ফাইল পাঠাতে হবে। ফাইলটিতে আমার স্বাক্ষর লাগবে। ফাইলটি ড্রেজার ক্রয় সংক্রান্ত ছিলাে। ড্রেজার ক্রয়ের জন্য নাকি ইতিমধ্যে কয়েকজন ইউরােপ গেছেন। তারা নাকি ড্রেজারের দাম-দর ঠিক করে ফেলেছেন। এখন টাকা পাঠাতে হবে। আমি সব শুনে বললাম, এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমি না জেনে কোনাে স্বাক্ষর দিতে পারবাে না। ফাইল পাঠাও, আমি দেখছি। নথি পরীক্ষা করে দেখলাম যে, ড্রেজার কিনতে (আমার যতদূর মনে পড়ে) আসাফউদ্দৌলাসহ আরাে কয়েকজন ব্রাসেল্স-এ গেছেন। মনে হয় সানাউল হক এ সময় ব্রাসেলস-এ আমাদের অ্যামবাসাডর ছিলেন। সেখান থেকেই টেলিগ্রাম এসেছে ড্রেজার কেনার জন্য অবিলম্বে টাকা পাঠাবার জন্য। দামদরও ঠিক করা হয়েছে। এমন কি ড্রেজার বুক করা পর্যন্ত হয়ে গেছে। অথচ এ বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। তাছাড়া এ মুহূর্তে টাকা দেওয়াটাও বেশ কষ্টকর ছিলাে। প্রচণ্ড অর্থ সংকট ছিলাে এ সময় । ড্রেজার ক্রয় করতে টেণ্ডারও ডাকা হয়নি। এই অবস্থায় আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের। গভর্নরকে আমার অনুমতি ছাড়া কোনাে টাকা না দেবার নির্দেশ দিলাম। শেখ মুজিব এ সময় ঢাকার বাইরে। কিছুক্ষণ পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম (উপরাষ্ট্রপতি) আমাকে ফোন করলেন। তিনি বললেন, ভাই সাহেব, আপনি কি ফ্রি আছেন? আমি উত্তরে বললাম, কেন বলুন তাে ? তিনি জানালেন, জরুরি কথা
১৫২
আছে। একটি বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য সাঈদুজ্জামান এবং বঙ্গবন্ধুর প্রাইভেট সেক্রেটারী এসেছে। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের লােকও ডেকে পাঠিয়েছি, জরুরি আলােচনা আছে। তিনি জানালেন, আমরা আসবাে না আপনি আসবেন? আমি বললাম, আপনারা এতাে লােক যখন আছেন তখন আমিই আসছি। কি বিষয় জিজ্ঞেস করতেই বললেন, আসুন তারপর বলছি। আমি ঘরে ঢুকতেই দেখলাম সাঈদুজ্জামানসহ অনেকেই বসে রয়েছেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম জানালেন, ড্রেজার কেনার টাকা দিতে আপনি আপত্তি জানিয়েছেন। কিন্তু এখন টাকা না দিলে আমাদের বড় রকমের ক্ষতি হয়ে যাবে। জাহাজ ভাড়া করা হয়েছে। তাছাড়া ব্রাসেলস-এ যে টিমটি গেছে তারা মন্ত্রী সেরনিয়াবতসহ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলােচনা করেই গেছে। সুতরাং এভরিথিং ইজ অল রাইট। আমি বললাম, আপনারা ড্রেজার কেনার টাকা পাবেন কোথায়? সৈয়দ নজরুল ইসলাম জানালেন, ড্রেজারের টাকা সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আসবে। টাকা আসতে সময় লাগছে। ইন দি মিন টাইম আপনি দিয়ে দেন, টাকা আসলে রিপ্লেস করবেন। আমি বললাম, এটা সম্ভব নয়। কারণ একবার টাকা নিয়ে গেলে সে টাকা আর পাবাে না। টাকা আসুক তারপর ড্রেজার কেনা হবে। আমি অর্থমন্ত্রী অথচ টাকা আছে কি নেই সে বিষয়ে আলােচনা করা হলাে না। ড্রেজার কেনার জন্য কোনাে টেন্ডারও ডাকা হলাে না। এ টাকা আমি দিতে পারবাে না। আর শেখ মুজিব যদি বলে থাকেন তাহলে তিনি করতে পারেন। তিনি অর্ডার দিলে আমি টাকা দেবাে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী হিসাবে আমি এতে সই করতে পারবাে না। হােয়াট ইজ মাের, যদি এটা আপনারা না শুনতে চান, ইউ হ্যাভ এ মিনিস্টার। আমার কোনাে আপত্তি নেই। মন্ত্রিত্বের প্রতি আমার কোনাে লােভ নেই। কোনাে সময় ছিলও না। সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমার কথায় থ’ হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, আমি টেলিফোন লাগিয়ে দিচ্ছি, আপনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলুন। তিনি কক্সবাজারে লাইন মিলিয়ে দিলেন। আমি টেলিফোন ধরে বঙ্গবন্ধুকে সালাম দিয়ে বললাম, ভাই, আপনি কয়েকটি কথার জবাব দিলে আমি খুশি হই। তিনি বললেন, বললেন, কি হয়েছে ? আমি তখন বললাম, ব্রাসেলস-এ যে দলটি ড্রেজারের জন্য গেছে, সেই দল এবং মন্ত্রী সেরনিয়াবত নাকি আপনার সঙ্গে দেখা করে ড্রেজার কেনার অনুমতি নিয়েছেন ? এটা কি সত্য ? তিনি বললেন, তারা আমার সঙ্গে দেখা করেছে সত্য, তবে আমি তাদেরকে ড্রেজার কেনার কোনাে কথা বলিনি। আমি আবারাে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি ড্রেজারের দাম পরিশােধের জন্য কাগজপত্র পেয়েছেন ? সানাউল হক টেলেক্স পাঠিয়েছেন। বললেন, হ্যা কাগজপত্র এসেছে। আপনার ডিসিশন আপনি নেবেন। আমি বললাম, ড্রেজার কেনার জন্য টেন্ডারও ডাকা হয়নি। বঙ্গবন্ধু বললেন, হ্যা, প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে আপনাকে বলছি ইউ টেক ইউর ওন ডিসিশন। ড্রেজার কিনতে আমি তাদের বলিনি। টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুকে আমি আরাে বললাম, সংযুক্ত আরব আমিরাতে আমাদের রাষ্ট্রদূত শামসুল আলমের সঙ্গে ড্রেজার ক্রয় বিষয়ে যােগাযােগ করা
১৫৩
হয়েছে। শামসুল আলম জানিয়েছেন, ড্রেজার ক্রয়ের সময় আমিরাতের প্রতিনিধিকে সঙ্গে রাখতে হবে। টাকা আমিরাত দেবে তবে দিন নির্দিষ্ট করেনি এবং নির্ধারিত অর্থের অতিরিক্ত কোনাে টাকাও তারা দেবে না বলে জানিয়েছে। বঙ্গবন্ধু, আপনি আমাকে বলেছেন যে দেশের লােক যেন আর না খেয়ে না মরে। আমি সে চেষ্টাই করছি। আর্থিক সংকটের কথা বিবেচনা করে এখন ড্রেজার ক্রয় বাবদ টাকা দিতে পারছি না। বঙ্গবন্ধু ওপাশ থেকে বললেন, না, না, টাকা দেবেন না । ইটস ক্লিয়ার ফ্রম মাই সাইড যে আমি কাউকে ড্রেজার কিনতে বলিনি, বুঝলেন ? দু’একদিনের মধ্যে আমি আসছি, তখন কথা হবে। আমি ফোন ছেড়ে দিয়ে বললাম, শুনলেন, শুনলেন তাে পয়সা কড়ি দিতে ‘না’ করে দিলেন ! সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাে। আমি উঠতে গেছি এমন সময় আবার ফোনটা বেজে উঠলাে। ফোন ধরে সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, আপনার ফোন, বঙ্গবন্ধু কথা বলবেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ড: সাহেব একটা নির্দেশ আছে। যারা ব্রাসেলসে গেছে তাদের সবাইকে এ্যারেস্ট করতে হবে এ্যজ সুন এ্যজ। দে গেট ডাউন এট দি এয়ারপাের্ট। আমি বললাম, কেন ? বললেন, তারা এরকম অন্যায় কাজ কেমন করে করলাে ? আর আমার নাম দিয়ে দিল যে আমি কিনতে বলেছি ? তাদের এ্যারেস্ট করা হবে এবং তাদের কাছে কৈফিয়ৎ চাওয়া হবে। আমি বললাম, “ঠিক কাজ হবে না। বললেন, কেন ? বললাম, আপনি এ্যারেস্ট করে পরের দিনই ছেড়ে দেবেন। আপনি অনেক বিশ্বাসঘাতক লােককেই ছেড়ে দিয়েছেন। এরা তাে ছেলে মানুষ, ইয়্যাং অফিসার – ওরা হয়তাে কিনবে বলেছে। আপনি হয়তাে তাদের কথা বুঝতে পারেননি। দাম ঠিক করেছে, কিনেছে তাতে ওদের আবার বিচার করতে হবে কেন ? আপনি কৈফিয়ৎ চাইতে পারেন। কৈফিয়ৎ আপনি চান বা সেরনিয়াবতকে বলেন, কিংবা আমাকে বলেন আমি কৈফিয়ৎ চাই।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, না, ঠিক আছে। তারপর বললেন, ‘ইউ সেন্ড সাইদুজ্জামান ইমিডিয়েটলি টু ব্রাসেলস টু এনকোয়ার। আমি বললাম, আপনি কি সন্দেহ করছেন যে ওরা টাকা-পয়সা মেরেছে ? আমি মনে করি যে এ সন্দেহটা হয়তাে অমূলক। বাচ্চা মানুষ গেছে কিনেছে, হয়তাে সেরনিয়াবাত সাহেব কিনতে বলেছেন– টাকা পাবে আমিরাতের কাছ থেকে। গিভ ইট আপ। আর সাইদুজ্জামানকে পাঠিয়ে আমি আবার পয়সা খরচা করবাে ? হােয়াই শুড আই স্পেন্ড মানি ? ফরেন কারেন্সির কি দাম নেই স্যার ?’ বললেন, ‘হা-হা, ইউ আর রাইট। ঠিক আছে ইউ টেক ইউর ডিসিশন।’ এরপর ফোন ছেড়ে দিলেন তিনি। ফোন ছাড়তেই সবাই জিজ্ঞাসা করলাে বঙ্গবন্ধু কি বললেন, আমি তাদেরকে সব কথা বললাম। আমি আর সৈয়দ নজরুল ইসলাম মনে করলাম যে, বঙ্গবন্ধু যদি হােম মিনিস্টারকে বলে দেয়। একথা ভেবে তখনি আমি হােম মিনিস্টারকে ফোন করলাম। তাকে বললাম, “শেখ সাহেব যদি এয়ারপাের্টে কাউকে এ্যারেস্ট করার নির্দেশ দেন তাহলে ডন্ট ডু ইট। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বললেন, ‘কেন ? আমি সমস্ত ঘটনা তাঁকে জানালাম। এই ঘটনার পরপরই ব্রাসেলস-এ একটি লম্বা টেলেক্স পাঠালাম।
১৫৪
টেলেক্স-এ লিখলাম, তােমরা চলে এসাে। আর তােমাদের কমপেনসেশন হিসাবে যে অর্থ দিতে হবে ফর হৃয়ারিং দি স্পেস এ্যান্ড আনলােড দি শীপ এ ফাইন মাের দেন মেইড আপ–বিকজ ঐ টাকা আমি দিচ্ছি না। দ্বিতীয়ত সানাউল হককে নির্দেশ দিলাম, ট্রাই টু ফাইন্ড আউট এ কাস্টোমার ফর দি স্পেইস ইউ আর গােয়িং টু ভ্যাকেট। কাস্টোমার পাওয়া গেল। আমাদের আর টাকা-পয়সা দিতে হলাে না।
আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। বঙ্গবন্ধু ক্যাবিনেট সিদ্ধান্তও নাকচ করেছিলেন। সে এক লম্বা ঘটনা। আমি দিল্লীতে তখন হাই কমিশনার। একদিন এম. আর. সিদ্দিকী আমাকে টেলিফোন করলেন, জানালেন যে, ইন্ডিয়া থেকে। ছােলা কিনতে হবে। রােজার সময় ছােলা লাগবে এবং লােক চলে গেছে। আমার হাই কমিশন অফিসে সত্যিই একজন অফিসার আসলাে। দেখলাম, সে আমার ছাত্র। ঐ তরুণ অফিসার এসে বললাে, “স্যার ছােলা কিনতে গিয়েছিলাম। দাম ঠিক হয়ে গেছে, এখন নিতে হবে। ছােলার দাম শুনেই বললাম, ‘এ দামে তাে ছােলা বিক্রি হয় না। এর চাইতে কম দাম আমি ঢাকাতে দেখে এসেছি।’
চার-পাঁচটি মাত্র রােজা হয়েছে, এরই মধ্যে কি হলাে? ইতিমধ্যে অফিসারটি আমার কাছ থেকে সহায়তা চাইলাে ছােলা পাঠাবার। আমি বললাম, ‘পাঠাবাে না। আই উইল নট সেন্ড এনি ছােলা ফ্রম হিয়ার। তুমি নিতে চাও নাও গিয়ে যেভাবে পার। আমার কোনাে সহায়তা তুমি পাবে না। আই এ্যাম এগেইনস্ট ইট। ছােলা খেয়ে বাংলাদেশের লােককে রােজা ভাঙতে হবে না। দেশ স্বাধীন হয়েছে – খেসারির ডাল খেয়ে এরা পারবে রােজা খুলতে। ছােলাটা হলাে বড়লােকের খাদ্য। সে জানালাে খেজুর নাকি ইরাক থেকে আসবে ভারত হয়ে। এ সময় পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। তিনি ফোন করলেন, মল্লিক সাহেব, আপনার দেশ তাে ছােলা চেয়ে পাঠিয়েছে, আমাকে এম. আর. সিদ্দিকী সাহেবও টেলিফোন করেছেন। ছােলা পাঠাতে একটু অসুবিধা আছে। আমার এখানে ছােলা কম। আমি বললাম, ভাই ডন্ট সেণ্ড এনিথিং দেয়ার। সিদ্ধার্থ শঙ্কর জবাব দিলেন, ‘কেন ? আমি বললাম, আমি হাই কমিশনার হিসেবে না’ করছি আপনাকে। এত দাম দিয়ে আমরা ছােলা কেন কিনব ? আর খেজুর খায় বড়লােকে। খেজুর তাে ইরাকের ব্যাপার, আপনার ব্যাপার না। তাও ইন্ডিয়ার থু দিয়ে পাঠাতে হবে। ওটাও বন্ধ করে দিলাম। এই বলে ফোন রেখে দিলাম। কিছুক্ষণ পরই এম. আর. সিদ্দিকী আমাকে ফোন করে জানালেন, এটি ক্যাবিনেট ডিসিশন। শেখ মুজিব এ সময় লণ্ডনে ছিলেন, আমি বললাম, ক্যাবিনেট ডিসিশন হােক আর যা-ই হােক, আপনি ক্যাবিনেট ডিসিশন ফলাে করুন। কিন্তু আমার সাহায্য পাবেন না। এ্যজ এ হাই কমিশনার অফ ইউর কান্ট্রি আই উইল নট ডু ইট। কারণ ছােলাও লাগে না, খেজুরও লাগে না। রােজা ইতিমধ্যে বেশ কয়েকদিন পার হয়ে গেছে। ইট’স নট দ্যাট বিগ থিং। তিনি তখন শেখ মুজিবকে টেলিগ্রাম করলেন। শেখ মুজিব টেলিগ্রামের জবাবে লিখলেন, মল্লিক সাহেব যেটা বলেছেন সেটাই শােন। দরকার নেই ওসব জিনিসে। বঙ্গবন্ধু যুক্তি মানতেন, ন্যায্য অনেক যুক্তি মেনে নিয়েই তিনি
১৫৫
কাজ করতেন। আমার মনে হয় আমরা যদি সবাই ইমপার্সিয়েলি চিন্তা করে কাজ করতাম তাহলে বােধ হয় অনেক ভাল থাকতে পারতাম।
বঙ্গবন্ধুকে অনেকের অনুরােধই রাখতে হতাে। কখনাে রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রী পর্যায়ে, আবার কখনাে সাধারণ কর্মী পর্যায়ে অনুরােধ আসতাে। সাধারণ কর্মী পর্যায়ের লােক যখন তাঁকে ধরতাে তখন তিনি অনেক অনুরােধই শুনতেন। সে। সময় তিনি হয়তাে সবদিক চিন্তা করতেন না। ঐ যে ছােলার ব্যাপারটা বললাম। বিষয়টির সঙ্গে কিছু লােক জড়িত ছিলাে যারা এই লেনদেন করতাে। ছােলাটা নিয়ে আসবে এ দেশে, তারপর বেচবে। কাপড় নিয়েও অনেক কথা হয়েছিলাে। ভারত কাপড় সাহায্য করেছিলাে। ভারত সরকার কাপড় কিনে পাঠাতে চেয়েছিলাে। আমি তখন হাই কমিশনার। আমি শেখ মুজিবকে বললাম, কাপড় সাহায্য তারা করবে। দে ওয়ান্ট টু বাই এন্ড সেন্ড ইট। ভারত সরকার চেয়েছিলাে কাপড় পছন্দ এবং ক্রয় করা হবে তাদের টেক্সটাইল বিষয়ক একটি কমিটির মাধ্যমে। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শেষ পর্যন্ত এমন ব্যবস্থা হলাে যে কাপড় তারা সরাসরি নেবে। সরাসরি নেবার কারণ ছিল। কিছু লােকের স্বার্থ সেখানে। জড়িত ছিলাে, যারা নাকি বাংলাদেশে বিক্রি করবে। তার ফল হলাে, একদম। জালের মতাে কাপড় নিয়ে গেল, এমন কাপড় যে দেহের সব অংশ দেখা যায়। বদনাম হলাে ভারতের। অথচ ভারত কাপড় দান করলাে। দান করেও বদনাম কিনলাে যে, ভারত সব বাজে কাপড় পাঠিয়েছে। কিন্তু প্রধান কারণ ছিলাে— আমাদের দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় যারা রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল, সেই সঙ্গে ভারতীয় ব্যবসায়ী সম্প্রদায় যুক্ত হয়ে এসব করেছিলাে। মাঝখান থেকে ভারতবর্ষের বদনাম হলাে। জড়িতদের মধ্যে শেখ মুজিবের আশপাশের লােকজনই ছিলাে। পরে এই ঘটনার তদন্ত হয়েছিলাে। তদন্তে দেখা গেছে যে তাঁর ঘনিষ্ঠ জনেরাই এর মধ্যে জড়িত। তারা সরাসরি কেনার যুক্তি হিসাবে বলেছিলাে যে, সময় নেই। লােকজন কাপড়ের অভাবে রয়েছে। শেখ মুজিব যে সবসময় সব কথা শুনতেন তা নয়। তবে অনেক সময় তিনি অনুরােধের চাপে পড়ে কাজ করেছেন, যেগুলি হয়তাে কর্মী পর্যায়ের বন্ধুবান্ধব কিংবা আমার মত ব্যক্তির অনুরােধ ছিলাে। বঙ্গবন্ধুর আত্মা খুব বড় ছিল, মনটাও ছিলাে খুব বড়। তিনি ঘটনার বা কাজের। ফলাফল কি হবে তা বিচার করে দেখার সময় পাননি। আর কাজের চাপও ছিল প্রচুর। কয়েক বছর তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। সদ্য স্বাধীন দেশটি ছিলাে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। রাস্তাঘাট সেতু কালভার্ট নির্মাণ সমস্যা, খাদ্য সমস্যা, কাপড়ের সমস্যা, । অর্থ সমস্যা- পুনর্বাসন সমস্যা – চারিদিকে কেবল সমস্যা আর সমস্যা। তাই স্বাভাবিকভাবেই তার পক্ষে সব জিনিস খুব গভীরভাবে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া সব সময় সম্ভবপর হয়নি। কিন্তু তারপরও বন্ধবন্ধুকে যখন হত্যা করা হলাে- তখন। আমরা আমাদের অর্থনৈতিক সংকট অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছিলাম। অবস্থার বেশ খানিকটা উন্নতি হয়।
১৫৬
অর্থমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নেবার পর বাকিতে খাদ্য আর আমি ক্রয় করিনি। বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচিয়ে নগদ অর্থেই চাল কিংবা গম কিনেছি। এ সময় যিনি খাদ্য সচিব ছিলেন তিনিও বাকীতে খাদ্যদ্রব্য কেনার পক্ষপাতী ছিলেন না। বাকীতে আমি কিনতে চাইনি তার প্রধান কারণ ছিলাে দামের পার্থক্য। নগদে কিনতে পারলে প্রচুর অর্থ সাশ্রয় হতাে।
এ সময় আমি একশ’ টাকার নােট অচল করেছিলাম। ঐ নােট স্মাগলিং হতাে। প্রত্যেক মন্ত্রণালয়কে ব্যয় সংকোচন নীতি অনুসরণের কড়া নির্দেশ দিয়েছিলাম। আগে খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে মন্ত্রীদের অনেক ক্ষমতা ছিল। আমি নির্দেশ করলাম যে, কেবল বিস্কুট এবং চা ছাড়া আর কিছু দেওয়া হবে না। মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করতে যেই আসুক না কেন আনলেস ইট ইজ এ ফরমাল ওকেশন। অর্ডার দেয়া হলাে। নির্দেশ মানতে শুরু করলেন। আগে বিদেশে যাওয়ার সময় একজন মন্ত্রীর সঙ্গে অনেকে যেতেন। আমি তা বন্ধ করলাম। বিদেশে আমরা যে রাষ্ট্রদূত পাঠাতাম খরচের কথা ভেবে তাও কমানাে হলাে। মােটামুটি আর্থিক অবস্থা ভালাের দিকে চলছিলাে। বঙ্গবন্ধুকে যদি হত্যা করা না হতাে – যদি দ্বিতীয় বাজেট করা যেতাে, তাহলে হয়তাে ফলাফল ভালােই হতাে।
এ সময় একশ’ টাকার নােট অচল করা একটি বড় ধরনের ঘটনা ছিলাে। আর এ কাজে বঙ্গবন্ধুর সার্বিক সহযােগিতা আমি পেয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে বললাম, একশ’ টাকার নােট ব্যাপকভাবে চোরাচালান হচ্ছে, ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে টাকা জমা করছে। আমি একশ’ টাকার নােট অচল করতে চাই, যারা ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছে। তাদের ধরতে চাই। তিনি বললেন, বিষয়টি ক্যাবিনেটে উপস্থাপন করতে হবে। আমি বললাম, “বিষয়টি ক্যাবিনেটে উপস্থাপন করা যাবে না। উপস্থাপন করলে সব জানাজানি হয়ে যাবে এবং সংশ্লিষ্টরা সাবধান হয়ে যাবে। তাজউদ্দিন আহমদএর সময় আপনি এ কাজ করেছিলেন। কিন্তু তার ফল ভাল হয়নি। কারণ বিষয়টি জানাজানি হয়ে গিয়েছিলাে। এ কাজ করতে হলে অর্থমন্ত্রী (আমি) আর আপনি ছাড়া আর কেউ জানবে না। আপনি যদি এতে রাজি হন তাহলে আমি উদ্যোগ নিতে পারি। আমার মনে আছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। মুস্তাফিজুর রহমানকে নিয়েই আমি প্রথম কাজ আরম্ভ করি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নাজিরও যােগ দিল। আমরা তিনজন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কয়েক দফায় বসলাম। তিনি আমাদের প্রস্তাবে রাজি হলেন। তারপর বললেন, ‘অচল করেন ঠিক আছে – কিন্তু ভাই, আমাকে তাে পরে অসুবিধায় পড়তে হবে না ? আমি তাে পলিটিসিয়ান ?’ আমি তখন গ্রেট ব্রিটেনের উদাহরণ দিলাম। আমি বললাম, সেখানে অর্থনৈতিক কোনাে আবশ্যকীয় পদক্ষেপ ক্যাবিনেটকে জানানাে হয় না। তিনি বললেন, ‘উদাহরণ আপনি দেন কিন্তু কেউ-ই জানবে না- তা কি করে হয়? আমি বললাম, ঠিক আছে যেদিন ঘােষণা দেওয়া হবে ঐ দিনই আপনি বলবেন। তাদের আমি ঐ জায়গাতেই আটকিয়ে রাখবাে। তিনি হেসে দিয়ে বললেন, ঠিক আছে তা করবেন। সব ঠিকঠাক করা হলাে। পরিকল্পনা করা হলাে, কাগজপত্রও
১৫৭
তৈরি করা হলাে। ঐ কয়েকজন, আমার সেক্রেটারী কফিলউদ্দিন মাহমুদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নাজির এবং মুস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে এসব কাজ। করা হলাে। আর কেউ জানলাে না, কাগজপত্র সব ঠিকঠাক। ঘােষণা দেওয়া হবে। এমন সময় হঠাৎ করেই শেখ মুজিবের বাবা মারা গেলেন। আমার মনে আছে সে। ঘটনা। আমরা এয়ারপাের্টে গেলাম। তিনি দেশের বাড়িতে হেলিকপ্টারে যাচ্ছেন। সেখান অনেক নেতা-মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমার হাত ধরে এক কোণায় নিয়ে গেলেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘ডক্টর সাহেব, রাষ্ট্রের স্বার্থে আমি কোনাে বাধা সৃষ্টি করতে চাই না। আপনাদের পক্ষে স্বাভাবিক যে আমাকে সি-অফ করতে এসেছেন। আমার এই দুঃখজনক ঘটনা সত্ত্বেও আপনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আপনি আগামীকাল ঘােষণা দেবেন। একশ’ টাকার নােট অচল করে দেন। আমি তাঁর হাত ধরে বললাম যে, বঙ্গবন্ধু আপনি সেন্টিমেন্টাল হবেন না। বিষয়টি তাে আর কেউ জানে না। আমরা কেবল চারজন জানি। দশ-বারােদিন পরেও কাজটি করা যাবে। আপনি ফিরে আসুন। উই উইল ডিসাইড।’ তিনি বললেন, না, পরে আপনি বা আপনার মতাে আর কেউ যদি ভাবেন যে, আমার বাবার মৃত্যুর কারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাজ হলাে না। রাষ্ট্রের কোনাে ক্ষতি হােক এটা আমি চাই । না। আমার বাবা মারা গেছেন, তাকে আর পাবাে না। কিন্তু কাজ তাে আর বন্ধ রাখা যাবে না। আপনি আপনার কাজ করে ফেলুন। আমি আবারাে বললাম, না, আপনি ঘুরে আসুন।’ বঙ্গবন্ধু চলে গেলেন। অনেকে জিজ্ঞাসা করলেন, শেখ সাহেব কি বললেন? আমি বললাম, পার্সোনাল কথাবার্তা।
বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার পর একশ’ টাকার নােট অচল ঘােষণার তারিক নির্দিষ্ট করা হলাে। তিনি বললেন, ‘ঘােষণার আগে অন্তত দু’জনকে জানাতে হবে। প্রথম জন উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, দ্বিতীয়জন প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী।’ আমি বললাম, “ঠিক আছে, তাদের আপনি সকাল সাড়ে আটটার দিকে ডাকেন। আমার লােকজন আটটার মধ্যে চলে আসবে। কিন্তু ভাই, আপনি কিছু মনে করবেন না – আই উইল কীপ দেম। সন্ধ্যার আগে বেরুতে দেব না।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ঠিক আছে, আপনি যা পারেন, করেন তারপরই তিনি বললেন, তাহলে এক কাজ করেন বিছানাপত্র আনিয়ে নিই।’ তিনি তিনটা বিছানা আনালেন, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা এখানে হবে সে খবরও বাসাতে পাঠালেন। ‘আপনি থাকবেন নাকি?” বললাম, আপনার ইচ্ছা। আমার মনে আছে ঘােষণার দিন সকাল সােয়া আটটার দিকে সেরনিয়াবাত একটি ফাইল নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি আমাদের ঘরের দিকে আসছিলেন। আমরা এ সময় সেকেণ্ড ক্যাপিটালে অফিস করছিলাম। বঙ্গবন্ধু সেরনিয়াবতকে উদ্দেশ করে বললেন, এই এখন না, এখন না, এখন কিচ্ছু হবে না। এখন চলে যাও।’ বিষয়টি অন্যদিকে যেতে পারে, তাছাড়া আমার খারাপও লাগছিলাে। আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বললাম, ভাই, কি ব্যাপার? বললেন, একটা জরুরি ব্যাপার ছিল।’ বললাম, “ফাইলটা দেন, সাইন করতে হবে?’ বললেন, হ্যা। আমি বললাম, সাইন করিয়ে দেব। সেরনিয়াবত
১৫৮
আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার? আমি বললাম, আছে কিছু জরুরি ব্যাপার। আমাকে এখনাে পর্যন্ত বলেননি। দেখি কি বলতে চান তিনি। এই বলে তাকে বিদায় করলাম। এরপরই বঙ্গবন্ধু নির্দেশ করলেন যে তাঁর কাছে যেন কেউ না আসে। কেবল ভাইস প্রেসিডেন্ট আর ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আসবেন। তারা দু’জনেই কিছুক্ষণের মধ্যে চলে এলেন। তারা পৌছাবার পরই আমি গেটে ফোন করে উপরাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি বাইরে পাঠিয়ে দিতে বললাম। এ নির্দেশ যে শেখ মুজিবের তাও জানালাম। এঁদের দুজনের কাছে যেন কোনাে লােক না আসে – সে নির্দেশও দিলাম। কথা শেষ করে বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে বসলাম। শেখ সাহেব তখন উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে বললেন, ‘ডক্টর সাহেব একশ’ টাকার নােট অচল করতে যাচ্ছেন। অর্থনীতির প্রয়ােজনে নাকি এটা করতে হবে। আমি কনভিন্সড হয়ে গেছি। এটা আজকে করা হচ্ছে।’ তখন দু’জনেই বললেন, ঠিক আছে – ক্যাবিনেটে প্রেস করা হােক। এ সময় আমি বললাম, এসব ব্যাপার কোনাে দেশে ক্যাবিনেটে উত্থাপন করা হয় না। ক্যাবিনেটে উত্থাপন করলে আমার কাজ হবে না। সব জানাজানি হয়ে যাবে। তখন সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব লাফ দিয়ে উঠে বললেন, আমি তাে গতকালই একশ’ টাকার নােট দিয়ে আমার সমস্ত এরিয়ার সেলারী ড্র করেছি। মনসুর আলী সাহেব বললেন, আমার এলাকা থেকে লােক এসেছিলাে। তারা বেশ কিছু একশ’ টাকার নােট আমার কাছে জমা রেখে গেছে। ব্যবসার প্রয়ােজনে আবার নেবে। আমি তার উত্তরে বললাম, আমার বাসার পজিশন আমি জানি না, শেখ সাহেবের বাসার পজিশন তিনি জানেন না। আপনারা রাজি হয়ে যান। কোনাে দেশেই ক্যাবিনেটে এরকম ডিসিশন নেয়া হয় না। বিষয়টি আপনাদের কাছে বলারও প্রয়ােজন ছিলাে না। এটা অর্থমন্ত্রী আর রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব। যাই হােক, রাষ্ট্রপতি বিষয়টি আপনাদের জানাতে চেয়েছেন। ভাই, আর একটি অনুরােধ আছে। আপনারা আজকে আর বেরুতে পারবেন না। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে। আপনারা বেরুলে বিষয়টি যদি হঠাৎ জানাজানি হয়ে যায় তাহলে দুর্নামটা আপনাদেরই হবে। তাঁরা বললেন, ঠিক আছে। খাবাে কোথায়? বললাম, খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তাদেরকে পাশের ঘরে নেওয়া হলাে এবং খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হলাে। সব কাগজপত্র তৈরি আরম্ভ হলাে। আবার লােকজন ডাকা হলাে। তিন বাহিনীর প্রধানদেরও ডাকা হলাে। পােস্টাল ডিপার্টমেন্ট, রেডিও, টেলিভিশন সবাইকে ডাকা হলাে। একটি কামরায় এদের ব্রীফ করা হলাে। বলা হলাে, সন্ধ্যার সময় একশ’ টাকার নােট অচল ঘােষণা দেওয়া হবে। আর ছ’টি হেলিকপ্টার প্রয়ােজন হবে আগামীকাল সকালে সর্বত্র কাগজপত্র পাঠানাের জন্য। প্রত্যেক ব্যাংক, পপাস্ট অফিসে এসব কাগজপত্র যাবে। পােস্ট অফিস কর্তৃপক্ষকে বলা হলাে সন্ধ্যা ছ’টার পর নির্দেশ পাঠানাের জন্য। টেলিভিশন, রেডিওকে এ খবর দেওয়া হলাে। সাড়ে চারটা-পাঁচটার দিকে কাজ শেষ হলাে। কাজ শেষে শেখ সাহেব হাত-মুখ ধুয়ে নিলেন। এসময় আমি শেখ
১৫৯
মুজিবকে উদ্দেশ করে বললাম, শামসুল হক সাহেবের মেয়ের বিয়েতে আমার দাওয়াত আছে। আমাকে যেতে হবে। তাছাড়া আমি পরিস্থিতিটি দেখেও আসি । এদের রেখে আমি রওয়ানা হতে যাচ্ছি, তখন শেখ সাহেব বললেন, এরপর আর দায়িত্ব আমাদের রইল না। যদি জানাজানি হয় তবে আপনি দায়ী হবেন-যেহেতু আপনি বেরিয়ে যাচ্ছেন। আমি বললাম, ঠিক আছে। বলে চলে গেলাম। প্রথমে আমি নিউ মার্কেটে গেলাম। সেখান থেকে বায়তুল মােকাররমে সােনার দোকান প্রত্যক্ষ করলাম, কেউ সােনা কিনছে কিনা। দেখলাম মার্কেট খুব নর্মাল। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে অফিসে ফিরে গেলাম। অফিসে পৌছাতেই শেখ সাহেব বলে বসলেন, এখন আমাদের ছুটি দেন। আমরা যাবাে। আমি বললাম, আর একটু সময় থাকতে হবে। এদের গাড়ি আমি সব ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি। শেখ সাহেব বললেন, কেন? বললাম, আমার গাড়িতে যাবেন সবাই। শেখ মুজিব আর কিছু বললেন না। সন্ধ্যা সাতটায় ঘােষণা করার কথা ছিল। মিনিট বিশেক আগে আমরা বেরুলাম। বেরিয়ে প্রথমে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে নামালাম। তারপর ক্যাপ্টেন মনসুরকে নামিয়ে আমি আমার বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। আমার শ্যালক নূরুজ্জামান দৌড়িয়ে বেরিয়ে আসছে – পকেটে হাতে দিয়ে। বললাম, কি ব্যাপার? বললাে, আপনি সর্বনাশ করেছেন। বললাম, কি? নূরুজ্জামান বলে চললাে, এই মাত্র আমি সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তিনি সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় বললেন, ‘আপনার মল্লিক সাহেব একশ’ টাকার নােট অচল করে দিয়েছেন। এখনই ঘােষণা দেওয়া হবে। আমি হা-সূচক জবাব দিলাম। নূরুজ্জামান বললাে, আমার কিছু টাকা আছে, কাছে রেখেছিলাম, সব একশ’ টাকার নােট। আমি বাজারে জিনিসপত্র কিনতে বেরুচ্ছি। আমি হাসলাম। সেখানে নূরুল কাদের, ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমদসহ অনেক লােক বসে ছিলেন। তারা ইতিমধ্যেই শুনেছেন সমস্ত দিন আমি বাড়িতে নেই। তারা বললেন, ‘কি ডিসিশন হয়েছে আওয়ামী লীগের? আমরা তাে জানি আপনি বাকশাল’ বিষয়ে আগ্রহী নন। তাহলে আপনি কি জন্য সারাদিন কাটালেন? আমরা খুব উদ্বিগ্নের সঙ্গে বসে আছি। আমি বললাম, একটু অপেক্ষা করুন, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘােষণা হচ্ছে। তারা বললেন, আমরা শুনেছি। আপনি নাকি একশ’ টাকার নােট অচল করে দিয়েছেন? আমি বললাম, হ্যা, এ বিষয়েই এখন ঘােষণা হবে। তখন নূরুল কাদের লাফ দিয়ে উঠে বললেন, আমার ফরটি থাউজেন্ড টাকার সব একশ’ টাকার নােট। আমি স্টাফ পেমেন্ট করবাে কালকে। এঁদের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য লক্ষ্য করলাম। আমি বললাম, ঘাবড়াবার দরকার নেই, টাকা-পয়সা জমা দেওয়ার ব্যবস্থা আমি করে দেব তবে, কৈফিয়ৎ দিয়ে হয়তাে টাকা ফেরৎ নিতে হবে। একথা বলার পরপরই একশ’ টাকার নােট বাতিলের ঘােষণা হলাে।
পরদিন টাকা জমা দেওয়া আরম্ভ হলাে। টাকা জমা দেওয়ার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিলাে। দেখা গেল যে আমাদের বাসার চাকর এবং অন্যান্য চতুর্থ। শ্রেণীর কর্মচারীদের বেশ কয়েক হাজার টাকা আছে। যার সবই একশ’ টাকার
১৬০
নােট। আমার নিজের বেতনের টাকার মধ্যে দু’তিন হাজার টাকা একশ’ টাকার নােট ছিল। শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা হলাে – তিনি বললেন, আমি দেশে ফোন করেছিলাম আপনার ভাবীর কাছে। তিনি বললেন, আলমারী খুলে দেখ শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে কিছু একশ’ টাকার নােট আছে সব মিলিয়ে ৬/৭ হাজার টাকা মত হয়েছে। পরে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করলাম। তাকে বললাম, ‘টাকা তাে আপনার ঘরে খুব বেশি নেই। আমার ঘরেও ৭/৮ হাজার টাকা আছে। পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত কৈফিয়ৎ ছাড়াই ফেরৎ দেওয়া যাবে। বাকীটা কৈফিয়ৎ দেখিয়ে ফেরৎ নিতে হবে।’
ইতিমধ্যে টাকা জমা দেওয়ার সময় পার হয়ে গেল। অনেক টাকা পুড়িয়ে ফেলা হলাে। কলকাতায় আমাদের ডেপুটি হাই কমিশনারের অফিসের সামনে পার্ক সার্কাসে যারা টাকা নিয়ে আসতে পারলাে না তারা ঐ টাকা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিল প্রকাশ্যে। খবরটা খবরের কাগজে বেরুলাে আমরা দেখলাম। সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হলাে। এয়ারপাের্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলাে – যাতে টাকা নিয়ে কেউ না আসতে পারে। এর ফলে অনেক একশ’ টাকার নােট জমা হতে পারলাে না। আর যা জমা হলাে – তার আবার হিসাব দিতে হবে। হিসেব দিয়ে টাকা নিতে হবে। এমন হলাে সকলে নানা প্রতিষ্ঠানের নামে টাকা জমা দিতে লাগলাে। মাদ্রাসার নামে, স্কুলের নামে অনেক টাকা জমা পড়লাে। চিন্তা করা যায় না এসব স্কুলের এত টাকা থাকতে পারে, এসব মাদ্রাসার এত টাকা থাকতে পারে। দাউদকান্দির যে মাদ্রাসা—যেটি খােন্দকার মােশতাক সাহেবের গ্রামে-সেই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বত্রিশ হাজার টাকা জমা হলাে। খােন্দকার মােশতাক পরে চাইলেন। আমি ‘না’ করে দিলাম। তিনি খুব রাগারাগি করলেন।
একশ’ টাকার নােট সংক্রান্ত বিষয়ে একটি কমিটি করে দেওয়া হলাে। কমিটি ভবিষ্যতে সকল দিক দেখে টাকা ফেরৎ দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। পাচ। হাজার টাকা পর্যন্ত হিসাব ছাড়াই দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। আমার একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। হঠাৎ শেখ সাহেব ফোন করলেন, বললেন, আপনি কি ফ্রী আছেন?’ বললাম, “কেন?’ বললেন, তাড়াতাড়ি আসেন- দশ মিনিট রাখবাে আপনাকে। আমি বললাম, এমন কি জরুরী হলাে?’ বললেন, আপনি আসলে এনজয় করতে পারবেন জিনিসটা। আমার প্রতি আপনার বিশ্বাস বাড়বে। বললাম , “কেন? বিশ্বাস কি কম আছে ?’ বললেন, না। তবু আপনি আসেন। আমি, শেখ মুজিবের গণভবনের অফিসে গেলাম। দেখলাম তিনি বসে রয়েছেন। আমাকে দেখেই কতক্ষণ হা-হা করে হাসলেন। তারপর বললেন, এখন প্রমাণিত হবে ডক্টর সাহেব, আমরা রাজনীতি করলেও বিশ্বাসঘাতকতা করি না। না রাষ্ট্রের সঙ্গে, না সরকারের সঙ্গে। আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, আমি কি তা বলেছি?’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তা বলেননি, কিন্তু আপনি ক্যাবিনেটে ডিসিশন নিতে। দেন নাই। আপনি রাইট, সবাই তাে সমান হয় না। তবে আমি যে সন্দেহের উর্ধ্বে
১৬১
তা এক্ষুণি প্রমাণিত হবে’। কি রকম?’ বললাম আমি। তিনি বললেন, আপনার ভাবী যখন বললেন যে শাড়ির ভাঁজের মধ্যে টাকা আছে, তখন আপনি নিজেই সামনে ছিলেন। তিনি এখন টংগীবাড়ি থেকে ফিরে এসে বলছেন যে সিক্সটি ফাইভ থাউজেন্ড টাকা তাঁর কাছে আছে। এসব একশ’ টাকার নােট। এই নােটগুলি তাকে বদলিয়ে দিতে হবে। আমি বলেছি, তােমার টাকা গেছে সত্য, তবে যে মানুষ অর্থমন্ত্রী যিনি ঘােষণা দিয়েছেন – এখন কারাে সাধ্য নেই টাকা ভাংগানাে। কিন্তু এ টাকা পেলে কোথায়? তার উত্তরে তিনি জানালেন, তুমি তাে ছেলেমেয়ের বিয়ে দিতে কোনাে টাকা-পয়সা দিতে পারবে না, যা হাতে থাকে তা লােককে দিয়ে দাও তােমার ওয়ার্কারদের দাও, আর নিজে খরচা করাে। তাই বিয়ের জন্য আত্মীয়-স্বজনরা যে সাহায্য করেছে তাই আছে। ইলিয়াস চৌধুরী, শেখ নাসেরসহ আরাে কয়েকজন আত্মীয়-আপনজন কিছু টাকা-পয়সা আমাকে। দিয়েছে। শেখ মুজিব বললেন, আমার ওয়াইফ বলেছে আমি মল্লিক সাহেবকে বলবাে। আমি বলেছি যে, কথা যতই বলাে কাজ হবে না। এখন ভাই, আপনি কথা বলেন আপনার ভাবীর সাথে। আপনি না করে দেন। আমি ফোন করলাম। “তিনি (বেগম মুজিব) বললেন, সর্বনাশ করেছেন ভাই আপনি। আমি বললাম, ‘কি রকম?’ বেগম মুজিব বললেন, আমার টাকা না দিলে আমি ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেব কেমন করে?’ আমি বললাম, “বিয়ের টাকা যােগাড় হবে। যােগাড় যদি না হয় তাহলে বিনা পয়সাতেই হবে। আপনার ঐ টাকা গেছে। টাকা আর পাবেন না । বললেন, এক পয়সাও পাবাে না?” বললাম, না, এক পয়সাও পাবেন না। আপনার কেবল একার এমন হয়নি। তাছাড়া আপনার তাে কেবল পঁয়ষট্টি হাজার -তাও আবার লােকের সাহায্য করা টাকা। অনেকের কিন্তু লক্ষ লক্ষ টাকা আছে। যারা ভয়ে জমা দিতে পারেনি। আরাে বললাম, আপনি রাষ্ট্রপতির স্ত্রী। এটা উদাহরণ হিসাবে থাকুক যে আপনার টাকাও আমি ফেরৎ দেই নি। আর আপনি শেখ সাহেবকে প্রথমে কেন বিশ্বাস করলেন না?’ বললেন, ‘কি করে বিশ্বাস করবাে, টাকা পাঠিয়ে দিলে তিনি খরচ করে বসে থাকতেন। তাছাড়া আমি ভেবেছিলাম যে, আমি রাষ্ট্রপতির স্ত্রী, হয়তাে একটা স্পেশাল কেইস করতে পারবাে। আমি বললাম, তাহলে পারলেন না তাে? রাষ্ট্রপতির স্ত্রীর কোনাে বিশেষ অধিকার থাকে না। তিনি তখন বললেন, তাহলে কি করবাে? বললাম, টাকাটা বেঁধে রেখে দেন। পরবর্তী বাজেটের সময় টাকাটা আমাকে দেবেন। আমি যদি মন্ত্রী থাকি তাহলে ঐ টাকা আমি টেবিলের উপর রেখে দেবাে। সকলকে দেখাবাে যে রাষ্ট্রপতির স্ত্রীর টাকাও জমা দিতে পারেননি। রাষ্ট্রপতিকে তিনি বিশ্বাস করতে পারেন নাই-স্বামীকে টাকা দেন নাই খরচ করে ফেলবেন বলে। তার ফলে তিনি এত টাকা গচ্চা দিয়েছেন’ বললাম আমি। শেখ সাহেব হাঁফ ছেড়ে বললেন, ‘বেঁচে গেলাম ভাই। আপনার ভাবী তাে টাকা রেখেছিল ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেবার জন্য। যাক একটা উদারহণ রইলাে। আমি কি তা পারতাম? পারতাম না ? জিজ্ঞেস করলেন তিনি। আমি বললাম, আপনি পারতেন কিন্তু নিজে ছােট
১৬২
হয়ে যেতেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, আমার পাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। আমার প্রতি আপনার বিশ্বাস এবার বাড়বে এটা আমি দৃঢ়ভাবেই বলতে পারি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হবার পর ঐ পঁয়ষট্টি হাজার টাকা তাঁর। বাসভবনে পাওয়া গিয়েছিলাে। যতদূর মনে পড়ছে একটা কাগজেও বেরিয়েছিল।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যার পেছনে এক গভীর ষড়যন্ত্র ছিল। এই ষড়ষন্ত্রে দেশী-বিদেশী লােক জড়িত ছিল বলেও আমার ধারণা। বঙ্গবন্ধুকে দেশে এবং বিদেশে হেয় প্রমাণ করার জন্য একটি চেষ্টা চলছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এবং সেটাই পরে পরিকল্পিত আকার ধারণ করে বলে আমার বিশ্বাস। ১৯৭৪ সালে দেশে যে দুর্ভিক্ষ হয় – এই দুর্ভিক্ষের পেছনেও বৈদেশিক ষড়ষন্ত্র কিছুটা ছিল বলে আমি বিশ্বাস করি। কারণ প্রতিশ্রুত খাদ্য যা আমাদের পাওয়ার কথা ছিল বিদেশ থেকে তা আমরা পাইনি। শেষ মুহূর্তে সে সাহায্য আমাদেরকে আর পাঠানাে হয়নি। এমন কি সাহায্য পাঠানাে হয়েছে বলে যে খবর দেওয়া হয়েছিল সেই খাদ্যভর্তি জাহাজগুলােও আমাদের দিকে না পাঠিয়ে অন্যদিকে পাঠানাে হয়। আমি দৃঢ়ভাবেই বলবাে এই দুর্ভিক্ষের পেছন দেশী বিদেশী ষড়ষন্ত্র ছিল। ১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে এটা আরাে বেড়ে যায়। তাছাড়া আওয়ামী লীগের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলও কিছু ছিল। কিছু কিছু লােক ছিল যারা বঙ্গবন্ধুর কাছে অনেকের সম্বন্ধে অনেক কথা বলতেন, যেগুলাের সব সত্য ছিলাে না। বঙ্গবন্ধুর কান ভারি করাই এর উদ্দেশ্য ছিলাে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তান কারাগারে। নয় মাস যুদ্ধকালীন অবস্থায় আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী লীগের বাইরের লােকদের কি ভূমিকা ছিলাে তিনি তা সঠিক জানতেন বলে আমার মনে হয় না। তিনি সবই শুনেছেন বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে এবং সে শােনার মধ্যে হয়তাে অনেক সময়ই সঠিক খবর ছিলাে না। পূর্বে যারা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে বড় আকারের অবদান ছিলাে-তাদেরকে সুকৌশলে ছােট করার চেষ্টা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কাছে। আমার মনে হয় ঐসব ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্যই এমন আয়ােজন করেছিলাে। এই হত্যাকাণ্ডে অনেকেরই ভূমিকা ছিলাে। দলীয় এবং সরকারী কাজে খুব ব্যস্ত থাকার দরুন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এসব ঘটনা যাচাই করা সম্ভব ছিল না। যারা নিরপেক্ষ ছিলেন। – রাজনীতি করতেন না, স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িত ছিলেন – তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করে সব জেনে নেবার সুযােগ তিনি পাননি, সে সময়ও পাননি তিনি। কারণ স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরই যে গুরুদায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পিত হয় – তা পালন করতেই তাঁকে দিন-রাত ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের মধ্যেও কিছু লােক ছিলেন যারা বঙ্গবন্ধুকে অনেক কিছুই বলতেন- যেগুলি সব হয়তাে সত্য নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলাে তিনি নিজে বিশ্বাস করতেন না যে তাঁর বিরুদ্ধে
১৬৩
কোনাে ষড়যন্ত্র হতে পারে। বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে এটা তিনি চিন্তাও করতে পারেননি। কারণ তিনি ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির যে বাড়িতে থাকতেন তা ছিলাে। অরক্ষিত বাড়ি।
আমার একটি ঘটনার কথা মনে আছে। তিনি যে কতখানি বাঙালি জাতিকে বিশ্বাস করতেন তার একটা উদাহরণ দিচ্ছি। আমার বড় ছেলের যখন বিয়ে হয় তখন আমি দিল্লীতে হাই কমিশনার ছিলাম। আমি ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুকে দাওয়াত দিতে আমার স্ত্রীকে নিয়ে গেলাম। বিনা বাধায় তাঁর কমপাউণ্ডে ঢুকলাম। অবশ্য অনেকেই আমাকে চিনতাে। হয়তাে তাই গেটে আমাকে কেউ বাধা দিল না । তারপর আমি বৈঠক খানায় ঢুকলাম। নিচে কোনাে লােক দেখলাম না। আমি ও আমার স্ত্রী বারান্দাতে গেলাম। বারান্দা থেকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। এ পর্যন্ত কারাে সাথে দেখা হলাে না। সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার পরে একটি ছেলের । সাথে দেখা হলাে- তাকে জিজ্ঞেস করলাম, বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন? সে কামরা দেখিয়ে দিল। সরাসরি আমরা ঐ কামরাতে গেলাম। বঙ্গবন্ধু কামরাতে ছিলেন। ওখানে বসেই কথাবার্তা হলাে। আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, আপনি রাষ্ট্রপতি, আমার স্ত্রীকে নিয়ে আপনার বাড়িতে আমি ঢুকলাম অথচ কোথাও কেউ বাধা দিল না। যদি আমার ইচ্ছা থাকে যে আপনাকে হত্যা করবাে – আই ক্যান ডু ইট। তার মানে আপনি অরক্ষিত অবস্থায় আছেন। এটা ঠিক না। আমি আরাে বললাম যে, ভারববর্ষে আমি যখন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রথম দেখা করতে যাই তখন আমাকে অনেক জায়গা ঘুরে যেতে হয়েছে এবং এখনাে যে যাই গাড়ি নিয়ে তাও অন্তত দুই-তিন জায়গায় থামানাে হয়। তারপর এসকর্ট করে নেওয়া হয় আমাকে। যে কোনাে দেশেই রাষ্ট্রপতিকে নিরাপদ এবং সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব সরকারের এবং আপনি সরকারপ্রধান। আপনি নিজেকে শেখ মুজিব না ভেবে যদি রাষ্ট্রপ্রধান ভাবেন তাহলে অনেক কিছুই সহজতর হবে। তাছাড়া আপনার সিকিউরিটি’র। ব্যাপারটা আপনার নিজেরও দেখা উচিত- যাতে রাষ্ট্র কোনাে অসুবিধায় না পড়ে। আপনাকে যে কোনাে সময় যে কেউ এসে হত্যা করতে পারে। হত্যার কথা শুনে। বঙ্গবন্ধু হা-হা করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, আমাকে হত্যা করবে কে? আমি কি করেছি? আমি বললাম, বাঙালি যে বাঙালিকে হত্যা করতে পারে সে নজির তাে ইতিহাসে আছে। আমি ইতিহাসের ছাত্র। আপনি যদি চান আমি অনেক নজির দেখাতে পারি। বাঙালি বাঙালিকে হত্যা করবে না এটা যেমন ঠিক না, তেমনি আপনি সৎ বাঙালি হয়েও অসৎ বাঙালির হাতে মুত্যুবরণ করবেন না এমন কথাও বলা যাবে না। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আপনার সুরক্ষিতভাবেই থাকতে হবে। আমি আজ যেভাবে আসলাম – এভাবে যে কোন লােক আসতে পারে। পকেট থেকে রিভলবার বের করে আপনাকে মেরে ফেলতে পারে। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি কি করবাে ভাই, আপনার ভাবীকে জিজ্ঞেস করে দেখেন।’ বেগম মুজিবের
১৬৪
সঙ্গে দেখা হলাে। চায়ের ব্যবস্থা হলাে। আমি বেগম মুজিবকে উদ্দেশ করে বললাম, বঙ্গবন্ধু এখানে থাকতে পারেন না। তাঁর জায়গা হওয়া উচিত – বঙ্গভবনে। এখানে থাকা চলবে না।’ বেগম মুজিব বললেন, এতে আমার কোনাে আপত্তি নেই। তবে আমি যাবাে না’ আমি বললাম, কেন? তিনি বললেন, তিনি যখন জেলে থাকতেন, আমাকে এ বাড়িতে ও বাড়িতে থাকতে হতাে। আমার থাকার জায়গা ছিল না। আমি ভাই অনেক কষ্টে এ বাড়িটা করেছি। এখান থেকে আমি সরবাে না। ওনাকে আপনারা নিয়ে রাখুন বঙ্গভবনে। সুরক্ষিত অবস্থায় উনি থাকুন। আমাকে যেতে বলবেন না। উনি মাঝে মাঝে আসলেই চলবে। কিংবা মাঝে মাঝে আমি যাবাে। আমি তখন বললাম, ভেবে দেখি কি করা যায়। আমি তাে এখন দিল্লীতে আছি। এই বলে আমরা বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে চলে আসি।
তখন ভাের পাঁচটা-ছয়টা হবে। গুলির আওয়াজে আমি প্রথম বুঝতে পারলাম যে একটা ঘটনা ঘটেছে। এমন সময় আমার সিকিউরিটি গার্ডরা এসে বলল যে তারা খবর পেয়েছে যে শেখ সাহেবকে হত্যা করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বিচলিত হয়ে পড়লাম। কোনাে খবর পাচ্ছিলাম না। মান্নান সাহেব তখন মন্ত্রী, তাকে ফোন করলাম। মান্নান সাহেব খুব ডিপ্রেস্ল্ড মুডে বললেন, আমিও খবর পেয়েছি। আমাদের বােধ হয় বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত? কি ঘটনা ঘটেছে। বুঝা মুশকিল। যদি এটা বড় রকম ষড়যন্ত্র হয়ে থাকে তাহলে আরাে অনেককে হয়তাে হত্যা করা হবে। আমার অনুরােধ হলাে আপনিও বাসা ছাড়েন। সবাই বাসা ছেড়ে চলে যাই। আমি তার উত্তরে বললাম, বঙ্গবন্ধুকে যদি হত্যা করেই থাকে তাহলে আমার মতাে লােকের জীবনের মূল্য এ দেশে নেই। আমাকে যদি হত্যা করে তাহলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আমি কোথাও যাবাে না। আপরাধ কিছু করিনি। আমি বাড়িতেই থাকবাে। এই বলে ফোন ছেড়ে দিলাম। মনে আছে যে, কয়েকটি ট্যাঙ্ক আমার বাড়ির সামনে দিয়ে উল্লাস করতে করতে চলে গেল। তারও কিছুক্ষণ পর রেডিওতে ঘােষণা দেওয়া হলাে যে খন্দকার মােশতাক রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। আমার যতদূর মনে পড়ে মেজর ডালিম রেডিওতে ঘােষণাটি দিয়েছিলাে। আমার তাে মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ। আমার বাড়ির সব সদস্যও বেশ উদ্বিগ্ন আর দুশ্চিন্তার মধ্যে এঘর ওঘর করছিলাে। ফ্ল্যাগ নামিয়ে দিলাম। এমন সময় একজন এডিশনাল এসপি আসলেন। তিনি ছিলেন ইনচার্জ অফ দি সিকিউরিটি অফ দি মিনিস্টার। তিনি উপরে এসে আমাকে বললেন, রাষ্ট্রপতির নির্দেশ স্যার, আপনারা কেউ বাড়ি ছাড়বেন না বা বাইরের কোনাে লােকও
১৬৫
আপনাদের সাথে দেখা করতে পারবে না। আমি রাগ করে বললাম, আমি রাষ্ট্রপতির গােলাম না বা আমি কোনাে সরকারী চাকুরে নই। আমি মন্ত্রী ছিলাম। ফ্ল্যাগ নামিয়ে দিয়েছি, দেখতে পাচ্ছেন? আমি কারাে নির্দেশ মানতে বাধ্য নই। আমি কি করবাে না করবাে সে নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা আমি কাউকে দিইনি। তিনি চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমাকে আবার বললেন, স্যার, আমার তাে কিছু করার নেই। আমাকে বলা হয়েছে নির্দেশটা ক্যুনিকেট করতে । আমি সবাইকে কমুনিকেট করছি ব্যক্তিগতভাবে। আমি বললাম, “ঠিক আছে, আপনার কাজ আপনি করেছেন, তবে যদি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা হয় তাহলে আমি যে কথাগুলি বললাম হুবহু সেগুলি রাষ্ট্রপতিকে জানাবেন। এরপর তিনি চলে গেলেন। তার বেশ কিছুক্ষণ পরে বঙ্গভবন থেকে একটা গাড়ি এলাে। দেখলাম চীফ প্রটোকল অফিসার এবং তার সঙ্গে সৈনিকের পােশাক পরা এক ভদ্রলােক। তিনি এসে আমাকে বললেন, আমাকে বঙ্গভবনে যেতে হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন? উত্তরে বলা হলাে যে, আপনাকে মন্ত্রীর শপথ নিতে হবে। আমি তার উত্তরে বললাম, আমি একবারই হয়েছি – বঙ্গবন্ধুর অনুরােধে আমার দায়িত্ব শেষ হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর এখন আর আমার দায়িত্ব কিছু নেই। আমি ফ্ল্যাগ নামিয়ে দিয়েছি, আমি কারাে মন্ত্রী হবাে না। সুতরাং আমি কোথাও যাবাে না। ওরা দু’জনই দাঁড়িয়ে রইলেন। আবার বললেন, আমরা স্যার আপনাকে নিতে এসেছি – আরাে কয়েকজনকে নিতে হবে। আমরা বরং আরাে কয়েকজনকে নিয়ে আসি, আপনি মনস্থির করেন। আপনাকে মন্ত্রিত্বের শপথ নিতে হবে বলে আমাদের বলা হয়েছে। আমাদের দায়িত্ব আপনাকে পৌছিয়ে দেওয়া। আমি তখন বললাম, আমাকে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কানেকশন করিয়ে দিন-আমি কথা বলবাে। প্রটোকলে যিনি ছিলেন তিনি ফোন ঘুরিয়ে আমাকে কানেকশন দিলেন। বঙ্গভবন থেকে কথা বললেন আসাফউদ্দৌলা। তাঁর সঙ্গে আমার একটু আত্মীয়তার সম্পর্কও আছে। আমি তাকে বললাম, আমি তাে তােমার সাথে কথা বলতে চাই না। আমি কথা বলতে চাচ্ছি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে – খন্দকার মােশতাক আহমদের সঙ্গে। আসাফউদ্দৌলা জানালাে, তার সঙ্গে তাে কথা বলতে পারবেন না। কোনাে জায়গায় কোনাে লাইন নেই। একটি মাত্র লাইন তাও আমি ধরে বসে আছি। বললাম, তুমি এখানে কেমন করে আসলে?’ সে জানালাে, আমাকে সকালে খবর পাঠিয়ে আনানাে হয়েছে। আমি আদিষ্ট হয়ে দায়িত্ব পালন করছি। আমি বললাম, তাহলে এক কাজ করাে খন্দকার সাহেবকে বলাে যে আমি মন্ত্রী হতে সম্মত নই। তারপর তার মতামত আমাকে জানাও। কিছুক্ষণ পর আসাফউদ্দৌলার ফোন পেলাম। সে ফোনে জানালাে, স্যার, তিনি বলেছেন, আপনি যাই সিদ্ধান্ত নিন বঙ্গভবনে এসে তাঁর সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিতে। তিনি আপনাকে সালাম দিয়েছেন এবং আসতে বলেছেন। আচ্ছা আমি দেখি – এই বলে ফোন ছেড়ে দিলাম। যারা আমাকে নিতে এসেছিলাে তারা জানালাে, স্যার আমরা একটু ঘুরে আসি – এই বলে চলে গেল। এই ঘটনার কিছুক্ষণ পর মুজাফফর
১৬৬
সাহেব – যিনি শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি দৌড় দিয়ে উপরে উঠে আসলেন । হাঁফাতে হাঁফাতে আমাকে বললেন, ‘স্যার, আপনি নাকি ‘না’ করেছেন? কিন্তু ওরা আমাকে অনুরােধ করলাে আপনাকে বলার জন্য। আপনি ওখানে যান, আমরা দেখে আসি ঘটনাটা কি হয়েছে। আমার বাড়ির সবাই চুপচাপ ছিল। সিকিউরিটি গার্ড আমার স্ত্রীকে বারবার বলছিলাে, স্যারকে বলেন যেতে। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি ঘটনা ঘটছে।
শেষ পর্যন্ত আমি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যাওয়ার পথে মনে আছে তােপখানা রােডের কাছে এসে গাড়িটা বাঁ দিকে টার্ন নিলাে, আমি তখন মুজাফফরকে বললাম যে, মুজাফফর, আমার মনে হচ্ছে আমরা বঙ্গভবনে যাচ্ছি না । আমাদের বােধ হয় কোথাও বন্দী করে রাখা হবে। কারণ এদিকে তাে বঙ্গভবন না। আমার কথায় মুজাফফর চুপ রইলাে, সামনে ড্রেস টুপি পরা পূর্বের লােকটা আছে। গাড়ি ঘুরে বাঁ দিকে একটা কম্পাউণ্ডওয়ালা বাড়ি, যেখানে সিকিউরিটি দাঁড়িয়ে আছে দেখলাম – সেখানে গিয়ে থামলাে। আমি মনে করলাম বােধ হয় এখানেই আমাদের আটকিয়ে রাখা হবে। গাড়ি থেকে নামলাম। নামার পর সঙ্গে সঙ্গেই সেলুট দিল আমাকে। তখন আমার মনে হলাে বােধ হয় ভুল করলাম। ভিতরে গিয়ে দেখি এটা খন্দকার আসাদুজ্জামানের বাড়ি। তিনি আগে মন্ত্রী ছিলেন। এ বাড়িতে ইতিপূর্বে কখনাে আসিনি। দেখলাম তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, সঙ্গে তাঁর স্ত্রী। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, ভাই, আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। শুনলাম আপনি আসছেন। লেটস গাে এ্যাণ্ড সি হােয়াট হেজ একচুয়ালি হ্যাপেণ্ড। কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাদের বঙ্গভবনে নিয়ে যাওয়া হলাে। দেখলাম সেখানে বেশ ভিড়। অনেকে সেখানে উপস্থিত ছিলাে। আমি পৌছানাের পরপরই খন্দকার মােশতাক সাহেব আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন ভেতরের একটি ঘরে। সম্ভবত ড্রেসিং রুম। সেখান থেকে অন্য আর একটি ঘরে। আমাকে ঐ ঘরে নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। তারপর আমাকে বললেন যে, আপনার আপত্তি আমি শুনেছি। কিন্তু আমার অনুরােধ রাখুন। আপনাকে মন্ত্রী হতেই হবে। আমি তাকে বললাম, ভাই আমি রাজনীতি করি না, আর শেখ সাহেবকে কে হত্যা করেছে আমি জানতে পারিনি। আমি এটা না জানা পর্যন্ত কোন ব্যাপারে জড়িত হবাে না। তাছাড়া মন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। একবারই হয়েছি, আর হবাে না। আমি না’ করেছি ঠিকই।’ তিনি আমাকে বললেন, তাহলে আপনি কি আর্মী গভর্নমেন্ট চান? আমি বললাম, কেন? বললেন, ‘শেখ সাহেবকে কে হত্যা করেছে সেটা তাে পরে জানতে পারবাে তদন্ত কমিটি বসলে। কিন্তু এখন যদি আপনারা আমার সঙ্গে একটা সিভিল গভর্নমেন্ট ফরম না করেন তাহলে কিন্তু দেশের সমূহ বিপদ। দেশে কিন্তু আর্মী গভর্নমেন্ট হয়ে যাবে। আমাকেও তারা নিয়ে এসেছে’ আমি বললাম, আপনি তাে রাষ্ট্রপতি হয়ে গিয়েছেন। আমাকে মন্ত্রী হতে হবে কেন?’ খন্দকার মােশতাক জানালেন, আপনাকে হতে হবে এজন্য যে আপনি রাজনীতি করেন না। আপনার মতাে লােক মন্ত্রিত্বে যদি থাকে তাহলে
১৬৭
দেশের পক্ষে সুবিধা। বিদেশে মুখ রক্ষা হয় যে সিভিল গর্ভনমেন্ট হয়েছে। আগের কিছু মন্ত্রী আছেন যারা রাজনীতিক নন – আপনার মতাে লােক । আপনাকে অনেকে চেনেও। আপনি ক্যাবিনেটে থাকলে ক্যাবিনেট একটু জোরদার হয়। আমি নিজেকে শক্তিশালী মনে করবাে। আর তাছাড়া গভর্নমেন্টটা স্টেবল হবে বলে আমার ধারণা। আমি তখন তাকে বললাম, আমাকে ভাবতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, ‘ভাববার ভাই সময় নেই-আপনি এখনি মত দেন। যদি না হন, আপনারা যদি কোঅপারেট না করেন তাহলে আপনাকে বলছি আমী গভর্নমেন্ট হবে। আমী গভর্নমেন্ট হলে বুঝতেই পারছেন দেশের অবস্থা কি হবে।’ তখন বিব্রত অবস্থায় জিজ্ঞেস করলাম, আর কে কে হচ্ছে? তিনি কয়েকজনের নাম জানালেন। এঁদের মধ্যে ফনীভূষণ মজুমদার, আবদুল মান্নান এবং আসাদুজ্জামানের কথা মনে আছে। আসাদুজ্জামানের কথা আমি জানতামই না। তিনি আমার সঙ্গেই এসেছেন। মন্ত্রীর শপথ নেওয়ার সিদ্ধান্ত আমাকে নিতেই হলাে। আমি খন্দকার মােশতাককে জানালাম, ঠিক আছে আমি নিচ্ছি – কিন্তু কতদিন থাকতে হবে?’ তিনি জানালেন, ‘বেশি দিন না, তিন-চার মাস থাকলেই হবে। গভর্নমেন্ট স্টেবল হয়ে যাক-আমি পার্লামেন্ট ডাকি। আমি মনে মনে ভাবলাম দু’তিন মাসের জন্য যদি থাকতে হয় আর ইতিমধ্যে যদি পার্লামেন্ট ডাকেনই তাহলে শেখ সাহেবকে কে হত্যা করলাে সে সম্বন্ধে জানতে পারব। তাছাড়া যখন আমার পূর্ববর্তী কিছু কিছু সহকর্মী যােগ দিচ্ছে – যারা আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে পরিচিত। এমনি সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই আমাদেরকে শপথ গ্রহণ করাতে নিয়ে যাওয়া হলাে। সেখানে পৌছে আমার কেমন যেন ভয় ভয় লাগছিলাে। ওখানকার পরিবেশ খুব সুবিধার বলে মনে হলাে না। আশেপাশে সব আমীর লােক। যে ঘরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলাে সেখানে কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশীদকে দেখলাম। চারদিকে গাদা গাদা সেনাবাহিনীর লােক দেখে চিন্তা করলাম যে আগেও মন্ত্রীর শপথ নিয়েছি কিন্তু আমীর লােক তাে দেখিনি। সিভিল গভর্নমেন্ট যদি হয়ে থাকে আর আমী যদি হত্যা করে থাকে তাহলে এতাে লােক কেন এখানে? এমন নানা প্রশ্ন মনে ভিড় করছিলাে। এমন সময় খন্দকার মােশতাক ঢুকলেন। ঢােকার পরই আমাদের জাতীয় সঙ্গীত আরম্ভ হলাে। খন্দকার মােশতাকের মুখে হাসি ছিল। তাঁর পরিধানে ছিল নতুন কাপড়, গলাবন্ধ, সিল্কের কোট। এ কাপড় তার গায়ে দেখেছি বলে মনে হলাে না। কিছুক্ষণ আগে আমি তাকে অন্য পােশাকে দেখেছি। পােশাক বদলিয়ে তিনি এসেছেন। হয়তাে স্বাভাবিক তিনি শপথ নেবেন। কিন্তু পােশাকের ধরন এবং তার চেহারার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলাে যে তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যার ব্যাপারে কিছু জানেন। তা না হলে তিনি এতাে নিশ্চিন্ত কেন? আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। যে অবস্থায় ছিলাম সেই অবস্থায় আমাদের শপথ নেওয়া হলাে। শপথ গ্রহণের পর। বাসায় ফিরে এলাম। বাসায় এসে আমি চিন্তা করলাম বঙ্গবন্ধুর হত্যার পেছনে কে। বা কারা আছে তখনাে পর্যন্ত জানিনা কিন্তু বর্তমান রাষ্ট্রপতি যদি জেনে থাকেন
১৬৮
তাহলে কেন তিনি একথা বললেন যে, তদন্ত কমিটি বসাবেন তারপর জানা যাবে? কয়েক দিন পরই একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে ষড়যন্ত্রের আভাস পেলাম। কিছুদিন পর ক্যাবিনেট মিটিং ডাকা হলাে। ক্যাবিনেট মিটিংয়ে কোনাে এজেন্ডা ছিলাে না। বঙ্গভবনে মিটিং হচ্ছে – মিটিংয়ে গেলাম। খন্দকার মােশতাক রাষ্ট্রপতি হিসাবে। সভাপতিত্ব করছিলেন। আমার মনে আছে তার বাঁ পাশে মােহাম্মদউল্লাহ বসেছিলেন যিনি এর আগে রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এমন সময় আবু সাঈদ চৌধুরী সাহেব ঢুকলেন। আর একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। তিনি এসে প্রথম রাগ করলেন তৌফিকের উপরে। আমার ঘটনাটা মনে আছে। তৌফিককে বললেন, তৌফিক ইউ ডিড নট ইনফরম মি ইন টাইম। আমার লেইট হয়ে গেছে। তিনি এসে মােশতাকের ডান পাশে বসলেন।
আবু সাঈদ চৌধুরী বসার পর মােশতাক সাহেব এজেণ্ডা দিলেন। তিনি। বললেন, আমাদের জাতীয় পােশাক আছে তবে পােশাকটা কমপ্লিট না। আমাদের মাথায় কোনাে টুপি নাই। আপনারা যদি কিছু মনে না করেন (মাথার টুপিটা খুলে টেবিলে রাখলেন), এই টুপিটা যদি আপনারা এপ্রুভ করেন তাহলে এই টুপি ন্যাশনাল ড্রেস -এর একটা পার্ট হয়ে যায়। এটা বলার পর দেখলাম অনেকে রাজি হয়ে গেলেন। কেউ মুখে রাজি হলেন, কেউ চুপ করে রইলেন। এভাবে বিষয়টি পাস হলাে বলে মনে হলাে। এমন সময় হঠাৎ করে মােহাম্মদউল্লাহ সাহেব বলে বসলেন – রাষ্ট্রীয় পােশাক সম্বন্ধে মল্লিক সাহেবের একটা মতামত আছে। ভুটানে সেটা আমার শােনার সৌভাগ্য হয়েছিলাে। কিন্তু তিনি তাে কিছু বললেন না।’ এ সময় আবু সাঈদ চৌধুরী সাহেবও বলে বসলেন, আমারও মনে আছে। ‘আমার সঙ্গে তিনি দিল্লীতে ন্যাশন্যাল ড্রেস নিয়ে আলােচনা করেছিলেন। এ সম্বন্ধে মল্লিক সাহেবের নিজস্ব মতামত আছে। আমরা যখন ন্যাশনাল ড্রেস ফাইনালি করতে যাচ্ছি মাথায় টুপি দিয়ে তখন তার মতামত জানতে পারলে ভালাে হতাে। প্রথম দিক থেকেই লক্ষ্য করছিলাম যে, খন্দকার মােশতাক আমার দিকে একবারও না তাকিয়ে কথা বলছিলেন। তিনি হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, বলুন স্যার, বলুন স্যার, আপনার কি বক্তব্য আছে। আমি তখন বললাম, আমার বড় বক্তব্য কিছু নেই। বক্তব্য সামান্যই। ন্যাশনাল ড্রেস যখন করা হয় তখন অত্যন্ত তাড়াহুড়া করে করা হয়েছিলাে। দেশ স্বাধীন হলাে। বঙ্গবন্ধু একটা কোট পরতেন, সেই কোটেরই হাতা বাড়িয়ে দেওয়া হলাে- বাড়িয়ে ওটাকে পুরা করা হলাে – এটাই হলাে ন্যাশনাল ড্রেস। ঐ ন্যাশনাল ড্রেসে আমি খুব খুশী হইনি এজন্য যে এটা কোনাে আলােচনা বা কোনাে কমিটি না করেই অত্যন্ত তাড়াহুড়া করে করা হয়েছিল। কে করেছে আমি জানি না কাউকে দোষ দিতে পারছি না। ঐ ড্রেস পরেই আমি হাই কমিশনার হিসাবে দিল্লীতে গেলাম এবং ঐ পােশাক পরেই আমি আমার দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।
আমি একই সঙ্গে নেপালেরও এ্যামবাসাডর ছিলাম। নেপালের একটি ঘটনার কথা বলবাে। নেপালের রানীর জন্মদিনে গিয়েছি। আমি জাতীয় পােশাক পরেই
১৬৯
গিয়েছি। আমি দাঁড়িয়ে আছি। পেছন থেকে এক ভদ্রলােক এসে বললেন, গুড মর্নিং, ইউর একসেলেন্সি। আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। হ্যাণ্ড শেক করলাে। আমাকে বললাে, আর ইউ দি নিউ এ্যামবাসাডর ফ্রম ইণ্ডিয়া?” আমি বললাম, আই এ্যাম ভেরী সরি, আই এ্যাম ফ্রম বাংলাদেশ। বললেন, ‘ফরগিভ মি প্লিজ। আই এ্যপােলােজাইস।’ আমি বললাম, ‘হাউ ডিড ইউ সে দ্যাট আই এ্যাম ফ্রম ইণ্ডিয়া?’ বললাে, ‘ওয়েল স্যার ইউর ড্রেস ইণ্ডিকেটস দ্যাট। দিস ড্রেস ইউ হ্যাভ পুট অন ইজ এ ড্রেস হুইচ ইজ নর্মালি ওর্ন বাই দি অফিসার্স অফ দি গভর্নমেন্ট অফ ইণ্ডিয়া এণ্ড সামটাইমস বাই দি মিনিস্টার্স ইনফরমাল এণ্ড ফরমাল মিটিংস। গলাবন্ধ কোট। প্রিন্স কোট যাকে বলা হয়।
ওটাকে প্রিন্স কোট বলা হতাে। অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসেও বিষয়টি ভুলতে পারলাম না, মনে হলাে, এই ভুলতাে অনেকেই করবে। আমি তখন বঙ্গবন্ধুকে ফোন করলাম। তাকে বললাম যে, আমাদের জাতীয় পােশাকটার একটু পরিবর্তন করতে হবে। আমি পুরােপুরি পরিবর্তন করতে বলছি না। মনে হয় যে, গলাতে কিংবা হাতে কিছু কারুকার্জ থাকা উচিত আর না হলে লম্বায় একটু বাড়ানাে দরকার। একটা কিছু করতে হয় যাতে একটু ডিসটিংশন হয়, বর্তমান পােশাকে অসুবিধা হচ্ছে। গলাবন্ধ কোট পরেন এখানকার আই.সি.এস-রা। আই.সি. এস ছাড়া আমরাও পরছি। মানুষ কনফিউজ হচ্ছে। হয় হাতে অথবা কোমরের কাছে কিংবা ঘাড় বা গলায় কোন রকম কাজ থাকরে ভাল হয়। কিংবা টুপি দেওয়া হােক। তখন আবু সাঈদ সাহেব বলেছিলেন, ঠিক আছে আমি গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বলবাে-তাগাদা দেবাে।
মােহাম্মদউল্লাহ সাহেবের কথা মনে আছে। তিনি কাঠমুণ্ড যাচ্ছেন। স্যুট পরে বসে আছেন। যাবেন রাজার করােনেশনে। অনুষ্ঠানে যােগ দেবার জন্য ভারতের রাষ্ট্রপতি গেছেন। আরাে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বিভিন্ন স্থান থেকে গেছেন। আমাকে আমাদের প্রেসিডেন্ট মােহাম্মদউল্লাহর মিলিটারী সেক্রেটারী ফোন করলেন, বললেন, স্যার তাড়াতাড়ি আসেন। প্রেসিডেন্ট সাহেব তাে স্যুট পরে বসে আছেন ন্যাশনাল ড্রেসে নাকি ভালাে লাগে না, গায়ে ফিট করে না, পরতে চাচ্ছেন না। আমি ছুটে গেলাম। রাষ্ট্রপতিকে বললাম, ভাই, তাড়াতাড়ি ন্যাশনাল ড্রেস পরেন। দেখুন না, আমি পরে এসেছি? তিনি বললেন ভাই গলাটা আমার ঠিকমত লাগে না-আমি বললাম, ওসব শুনতে চাই না-ইউ আর দি হেড অফ দি স্টেট। ইউ আর গােয়িং টু এ্যান অফিসিয়াল ফাংশান। আপনাকে এপ্রােভড ন্যাশনাল ড্রেস পরতে হবে। পুট ইট অন প্লিজ। তিনি তাড়াতাড়ি ন্যাশনাল ড্রেস পরলেন।” তখন আমি বললাম, “এই ন্যাশনাল ড্রেসটা আমি বদলাবার কথা বলেছি। আমি আবু সাঈদ চৌধুরীকে কথাগুলাে বঙ্গবন্ধুকে বলার জন্য বলেছিলাম, রাষ্ট্রপতিকেও তাই বললাম। তারপর আমি বললাম, খেয়াল করে দেখবেন ভি.ভি. গিরি যা পরে এসেছেন আর আমি যা পরেছি তা কাছাকাছি প্রায়। ভি.ভি. গিরি এখন পরেছেন শেরওয়ানী। বিকালে দেখবেন যে চায়ের সময় এ রকম কোট
১৭০
পরেই এসেছেন।” “ঐ কথাগুলাে তখন বলেছিলাম বটে তবে আমার এ বক্তব্য এখন আর কোনাে কাজে লাগবে না। কারণ ইতিমধ্যে বিষয়টি পাশ হয়ে গেছে। ইটস অল রাইট। আমার কিছু বলবার নেই এখানে।” মােস্তাক সাহেব হঠাৎ করে বললেন, তাহলে পরে এটা বিবেচনা করা যাবে-আপনি যা বললেন। এখন এটা পাশ হয়ে গেল। বলেই তিনি মিটিং শেষ করে দিলেন।
আমার স্ট্রাইক করলাে যে “টুপি বিকেইম ওনলি এজেণ্ডা এণ্ড দি মিটিং ইজ ওভার। অন্য কোনাে এজেণ্ডা নেই। হঠাৎ আমার মনে হলাে একটি ঘটনার কথা। ঘটনাটা এ রকম ঃ শেখ মুজিব নিহত হবার কিছু আগে (আমি মন্ত্রী হলাম ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে) তিনি দিল্লী গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন খােন্দকার মােশতাক আহমদ। তাঁরা রাষ্ট্রপতি ভবনে উঠলেন। আমি যেহেতু হাই কমিশনার সেহেতু তাঁদের ওখানে নিয়মিত যাতায়াত করতাম। যদিও এই যাতায়াত আনুষ্ঠানিক ছিল না। খােন্দকার মােশতাক সব সময় শেখ মুজিবের সঙ্গে সঙ্গে থাকেন। তাদেরকে বাংলাদেশ হাই কমিশনে আনা হলাে। আমি খন্দকার মােশতাককে বললাম যে, আমার গাড়িতে প্রেসিডেন্ট থাকবেন। আপনি আলাদা গাড়িতে উঠবেন। কারণ নিয়ম হলাে ভ্রমণরত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমাদের এ্যামবাসাডার বা হাই কমিশনার থাকবেন। এই বলে আমি আর একটা গাড়ি এনে তাকে আমার গাড়ি থেকে নামিয়ে অপর গাড়িতে উঠতে বললাম। তারপর হাই কমিশনে গেলাম আমরা। ওখানে চা খাবার পর শেখ মুজিব আমাকে বললেন যে, ফরমাল কোন ফাংশন করবেন না যেহেতু আমি ইনফরমালি এসেছি অন মাই ওয়ে। তিনি বললেন আপনি ইনফরমালি হাই কমিশনার অফিস স্টাফদের দাওয়াত করতে পারেন। ওদের সাথে আমি পরিচিত হই আর কিছু কথাবার্তা বলি। আমি বাসাতে একটা ইনফরমাল ডিনারের ব্যবস্থা করলাম যেখানে সমস্ত হাই কমিশন-এর স্টাফ ও অফিসারদের দাওয়াত করা হলাে। বাইরের কাউকে বলা। হলাে না। ভবনের যেখানেই বসি আমরা তিনজন-আমি, খােন্দকার মােশতাক আর বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু একটু বাসাটা দেখি বলে দুবার আমাকে নিয়ে উঠলেন। আমরা যখনই উঠি সঙ্গে সঙ্গে মােশতাক সাহেবও ওঠেন। তিনিও ঘুরতে আরম্ভ। করলেন। আবার এসে বসলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, আচ্ছা, আপনার লনটা দেখি, বাইরে তাে অনেকে বসেছে। আবার লনে নিয়ে গেলাম। লনে একবার কথাবার্তা হয়েছে। তাও তিনি পুনরায় গেলেন। বঙ্গবন্ধু আবার আমাকে বলে বসলেন, চলেন ভেতরে যাই। আবার ভিতরে গেলাম। ভিতরে যাওয়ার সময় বললেন, আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল কিন্তু মােশতাক তাে সঙ্গে সঙ্গে লেগে থাকছে। বললাম, বললেই তাে হয় যে আপনি আমার সংগে জরুরি কথা বলতে চান। বললেন, না, ইট ডাজ নট লুক নাইস। ঠিক আছে। এরই মধ্যে মােশতাক সাহেব এসে। আমাদের সঙ্গে যােগ দিলেন। আবার তিনজনে বসলাম। বসার পর শেখ সাহেব। হঠাৎ করে মােশতাক সাহের মাথা থেকে টুপিটা খুলে নিলেন। তারপর বললেন, ‘ড: সাহেব, আপনি খুব জ্ঞানী, বিদ্বান ব্যক্তি। এই টুপি সম্বন্ধে আপনার মন্তব্য
১৭১
চাই। কেমন লাগে আপনার?’ হাসতে হাসতেই কথাগুলাে বললেন। আমি বললাম, আপনারা বন্ধু মানুষ-ঘনিষ্ট বন্ধু । আপনাদের কারাে সাথে আমার এতখানি ঘনিষ্ঠতা বন্ধুত্ব নেই যাতে আমি জোক করতে পারি।’ শেখ সাহেব বললেন, না, না, আপনি বলেন । কি মােশতাক-বলুক কিছু?’ মােশতাক সাহেব চুপ চাপ বসে আছেন। আমি তখন বললাম, “ঠিক আছে, আপনি যখন মন্তব্য চাচ্ছেন-একটা ছােট্ট মন্তব্য করি। এই টুপিটা মােশতাক ভাইকে মানায়। তার শরীরের গঠন, আকার, উচ্চতা সবটা মিলিয়ে এ টুপি মােশতাক ভাইকে মানাবে। কিন্তু এই টুপি বঙ্গবন্ধু আপনাকে মানাবে না- আপনি অত্যন্ত লম্বা, বড় সড় মানুষ আপনার টুপিটা একটু উঁচু হতে হবে এবং বড় হতে হবে। একইভাবে এই টুপি আমাকে মানাবে না- আমার ঘাড়টা মােটা, মাথা খুব বড়। আর শরীরটা মােটাও। মােশতাক ভাইয়ের শরীর যেমন, মানিয়েছেও ভালাে। অনেকটা মাড়ােয়ারী টাইপের টুপি।” বঙ্গবন্ধু তখন টুপিটা হাতে নিয়ে মােশতাক সাহেবের মাথায় দিলেন। তারপর বললেন, ‘শুনলেন তাে বিদ্বান ব্যক্তির কথা। আমি বললাম, না, বিদ্বান ব্যক্তির কথা এটা না-একটা উদাহরণ দিই: প্রেসিডেন্ট আইয়ুব কিন্তু জিন্না ক্যাপ বাদ দিয়েছিলেন। কারণ জিন্নাহর মাথা ছিল ছােট-তাঁকে যে ক্যাপটা মানাতাে আইয়ুবকে তা মানাতাে না। তার মাথা বড়-অনেক উঁচু লম্বা স্বাস্থ্যবান মানুষ। আপনার মনে আছে কি না জানিনা-তবে আমার মনে আছে। জিন্নাহ ক্যাপ আর আইয়ুব ক্যাপটা এক ছিলােনা। শেখ মুজিব বললেন, ‘প্রখর দৃষ্টি তাে আপনার? আমার তাে এটা স্ট্রাইক করেনি। আমি বললাম, আমার স্ট্রাইক করেছে। এ জন্য যে পাকিস্তান হওয়ার সময় জিন্নাহ ক্যাপ আমরা পরেছি। আবার আইয়ুব ক্যাপ হলাে। পার্থক্যটা কি আমার দেখতে হয়েছে।’
১৯৭৫ সালে খােন্দকার মােশতাক আহমদ মন্ত্রিসভায় একমাত্র আলােচ্যসূচী টুপি থাকায় আমার পুরনাে কথা মনে পড়লাে। তাঁর ঐ টুপিটিকেই ন্যাশনাল ড্রেস। করতে চেয়েছিলেন যাতে স্থায়ী হয়ে যায়। এ টুপির ছবি দু তিনটি খবরের কাগজে প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিলাে। মন্ত্রী পরিষদ সভায় টুপিটি রাখা হয়েছিলাে। সভায় ফনীদা, মান্নান, মােমেন-এঁরা ছিলাে। আমি বললাম যে, ভাই-আমি এ টুপি পরবাে না। এই ঘটনায় আমি সাংঘাতিক আঘাত পেলাম। আই অ্যাম ফিলিং ভেরী আনইজ। আই ওয়ান্ট টু আনবার্ডেন মাইসেলফ। বললাম, আপনারা আসেনতাে আমার সাথে। পাশের ঘরে গিয়ে বসলাম। আমি চায়ের অর্ডার দিলাম। আমি বললাম, টুপি সম্পর্কে আমার বক্তব্য শােনেন। তারপর দিল্লীর ঘটনার কথা জানালাম। এ টুপি আমি মাথায় দেব না। আমার একটা সুবিধা হলাে যে, “অন দ্যাট ইস্যু আই ক্যান রিজাইন ফ্রম মাই জব।” এই টুপি ন্যাশনাল ড্রেসের একটা অংশ যদি করতেও চায়, আমি কিন্তু রাজী হতে পারবাে না। পাশ হয়ে গেছে যাক। অন্যরা বললাে, আমরাও তাহলে পরবাে না। সেদিনের মন্ত্রী সভার অনেকেই। আজো জীবিত আছেন।
১৭২
আমি ভেবে অবাক হলাম যে, মৌখিক আদেশে এই টুপি নিয়ে কতদূর অগ্রসর হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কাপড়ও এয়ারলিফটে আনা হয়েছে।
আর একটি ঘটনা বলি। একদিন হঠাৎ আমাকে ডেকে পাঠানাে হলাে। আমাকে বলা হলাে যে, প্রেসিডেন্ট খবর দিয়েছেন-সেক্রেটারী কফিলউদ্দিন মাহমুদ (এখন অবসরপ্রাপ্ত) কে সঙ্গে নিয়ে যেতে। ঠিক তারিখগুলাে আমার মনে নেই। আমি কফিলদ্দিন মাহমুদকে নিয়ে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নাজির আহমেদ উপস্থিত। আমরা গিয়ে বসার পরই প্রেসিডেন্ট এসে বসলেন। বসার পরপরই বললেন, মাহমুদ, ইউ হ্যাভ নট ক্যারিড আউট মাই অর্ডার। মাহমুদ আমার দিকে তাকালেন। আমি বললাম, “কোন অর্ডার কেরি করেনি?” বললেন, আমি বলেছিলাম যে, দাউদকান্দি স্কুলের দান বাক্সে যে সব একশত টাকার নােট আটক করা হয়েছে তা ছেড়ে দিতে। আমি বললাম, ছাড়তে আমিই ওঁকে না করেছি। টাকা আটকে রাখা হয়েছে অনেক স্কুল কলেজেরই; এক সঙ্গে ডিসিশন নেওয়া হবে। আমিই তাঁকে না করেছি। সূতরাং তাঁর কোনাে অপরাধ নেই।’ পরবর্তীতে তার স্কুলের জন্য এক তরফা অর্ডার-এর সঙ্গে আমিও অর্ডার দিলাম সমস্ত স্কুল কলেজের টাকা ছেড়ে দিতে। একশ’ টাকার নােট মােট পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিলাে। পাঁচ হাজারের উর্ধে হলেই টাকা আটক করার সিদ্ধান্ত ছিলাে। হিসাব পরীক্ষার পরই এবং তা যথাযথ হলেই টাকা ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিলাে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট খােন্দকার মােশতাক তা মানলেন না। এরপর তিনি বললেন, ভাই, দশ টাকার নােটে শেখ সাহেবের ছবি। আছে। তাঁর ছবি বাদ দিয়ে নতুন রাষ্ট্রপতির ছবি দেওয়ার দরকার বলে সবাই বলছে-এজন্য আপনাকে ডেকেছি। এ ধরনের কথায় আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমি বললাম যে, দশ টাকার নােটে আপনার ছবি দিতে হবে? তখন খেয়াল করলাম যে, ঘরের বাইরে ফটোগ্রাফাররা অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ আগে তিনি মন্তব্য করেছেন যে তাঁকে ভাল কাপড়-চোপড় পরতে হয়েছে। ছবি তুলতে হবে বলে। আমি প্রশ্ন করলাম, দশ টাকার নােটে ছবি বদলাতে হবে কেন? ক্যান আই নাে দি রিজন?” তখন তিনি বললেন যে, ‘রিজন কি? কেউ চাচ্ছে না যে শেখ সাহেবেরু ছবি নােটে থাকুক।’ আমি বললাম, “কে চাচ্ছে না? তিনি জানালেন, ‘আপনি খবর রাখবেন কেমন করে? আপনিতাে রাজনীতি করেন না। দেশের গ্রামে আপনি যান না অথবা খুব কম যান, জানেন না, নােবডি ওয়ান্টস হিম।” আমি বললাম, আমি গ্রামেও যাই, গ্রামের সাথে সম্পর্কও রাখি। নােবডি লাইকস হিম। বললে আমি তা গ্রহণ করবাে না। আমি তাে অর্থমন্ত্রী। আমাকে লােকে বলতে পারতাে যে আমরা শেখ মুজিবের ছবি চাই না। আমি নােটে বর্তমান ছবির পক্ষে। কথা বলছি না, আমি বলছি যে নাে বডি লাইকস্ হিম যে কথাটা বলেছেন ভাই, সেটা আমি জানিনা। আচ্ছা ঠিক আছে যে, নােবডি লাইকস্ হিম প্রমাণিত হলে আমি বদলাব। কিন্তু এ ব্যাপারে বৈদেশিক এবং স্থানীয় মুদ্রা কত লাগবে? নাজির, ইউ টেল মি দি এমাউন্ট ইনভলভড। নাজির বললাে, ‘হিসাব করতে হবে।’
১৭৪
বললাম, “হিসাব করাে। আই ওয়ান্ট টু নাে হােয়াট ইজ দি ভল্ম অফ ক্যাশ টেন টাকা নােট ইন সার্কলেশন ইন দি মার্কেট টু ডে। নাম্বার ওয়ান এবং নম্বর টু হােয়াট ইজ দি ভলুম ইন আওয়ার স্টক? কত কোয়ানটিটি স্টকে আছে? কত কোয়ানটিটি ছেড়েছে বাজারে? টোটাল নাম্বারটা বলাে এবং এগুলি যদি আমি সব উঠিয়ে নিই এবং বর্তমান টাকার পরিবর্তে যদি নতুন নােট চালু করতে যাই তাহলে কত খরচ হবে-আই ওয়ান্ট টু নাে দি ফাইনানসিয়াল ইনভলমেন্ট এ্যাজ দি ফাইনান্স মিনিস্টার অফ দি কান্ট্রি।” তখন নাজির বললাে, “স্যার, এটা বলতে আমার সময় লাগবে। আই হ্যাভ টু ওয়ার্ক ইট আউট।’ আমি বললাম, “প্লিজ ওয়ার্ক ইট আউট।’ প্রেসিডেন্ট সাহেব কিছু মনে করবেন না, অর্থমন্ত্রী হিসাবে আমি একথাগুলাে বলছি। আমার মন্ত্রী থাকার কোন সখ নেই। অর্থমন্ত্রী আমাকে করা হয়েছিলাে জোর করে। আপনি কিছুটা জানেন শেখ সাহেব আমাকে মন্ত্রী করেছিলেন। আমি আবার যে মন্ত্রী হয়েছি তার পটভূমি আপনি জানেন। আপনার সাথে কথা হয়েছে। আমার কয়েকমাস থাকার কথা ছিল। সুতরাং অর্থমন্ত্রী হিসাবে আমার দায়িত্ব যদি ঠিক মতাে পালন করতে হয় তাহলে দায়িত্বের এটা একটা অংশ। বৈদেশিক মুদ্রার অবস্থা খারাপ থাকাকালীন সময়ে আমি মন্ত্রী হয়ে এসেছিলাম। দেশের আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়াতেই আমাকে জোর করে আনা হয়েছিলাে। আই টুক এ ফিউ স্টেপ। বিফোর আই কুড কমপ্লিট মাই স্টেপস, শেখ সাহেবকে হত্যা করা হয়েছে। এখন আমার কাজের পদ্ধতি এটাই হবে যে আমি এমন কোন ইনভলভমেন্টে যাবাে না, যেখানে আমাদের বহু টাকার দরকার। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি রয়েছে এখনাে। স্বাভাবিকভাবেই ফরেন একচেঞ্জ বাঁচানাের জন্য আমি বাকিতে খাদ্য না কিনে নগদে কেনার ব্যবস্থা করেছি। আই হ্যাভ টু পে ইন ক্যাশ। সুতরাং প্রতিটি স্টার্লিং ডলার আমার জন্য খুবই গুরুত্ববহ। তাছাড়া এটা বােধ হয় ক্যাবিনেটের জানা দরকার। কত টাকার প্রয়ােজন হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট তখন বলে বসলেন, আচ্ছা করবাে ওটা। আমি আর একটি কথা বললাম, দশ টাকার নােটে শেখ মুজিবের ছবি আপনারাই ছাপিয়েছিলেন। শেখ মুজিবের গভর্নমেন্ট এটা করেনি। এটা আপনারা যখন মুজিবনগরে সরকার গঠন করেন, তখন ঠিক করলেন আপনাদের একটা আলাদা কারেন্সি লাগবে। পাকিস্তান কারেন্সি ইজ অলরেডি ইন সার্কলেশন-ওটাকে এভয়েড করার জন্য-দেশ স্বাধীন হলে টাকা লাগবে, যে জন্য আপনারা প্রস্তুতি হিসাবে নােট ছাপতে দিলেন। আমার মনে আছে তাজউদ্দীনের সাথে আমার কথা হয়েছিলাে-তাজউদ্দীন তখন প্রাইম মিনিস্টার ছিলেন। আমি বলেছিলাম যে নর্মাল কোর্সে সাধারণ: প্রাইম মিনিস্টার অথবা প্রেসিডেন্ট-এর ছবি নােটে থাকে না প্রায় দেশেই। কিন্তু যেহেতু শেখ সাহেব আমাদের সঙ্গে নেই তার মতামত লাগছে না তাই পাকিস্তান নােটের পরিবর্তে নতুন নােট শেখ মুজিবের ছবিসহ করতে পারেন। এটাতাে আপনারাই করেছেন। দেশ স্বাধীন হলাে এবং নােট-ই চালু রইলাে। এগুলাে আবার ছাপা হলাে যেহেতু ওটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামালাে না যে ছবি থাকবে কি থাকবে না। কিন্তু মাথা আমি ঘুমিয়েছি একশত টাকার নােট যখন অচল করলাম। যে নােট আপনার দাউদকান্দিতে জমা হয়েছিল-যার জন্য আপনি (মাহমুদকে) ধমকালেন।
১৭৫
ঐ টাকাতে শেখ মুজিবের ছবি ছিল। নতুন নােট যখন আমি ছাপাতে দিলাম তখন শেখ সাহেবকে আমি বলেছিলাম যে, আমার একটা ব্যক্তিগত মতামত আছে-সেটা হলাে টাকাতে রাজা বাদশাহদের ছবি থাকে, ডাইনেস্টিক রুল যেখানে আছে। প্রেসিডেন্ট মারা গেলে তার সম্মানে টিকেটও বের হয়-তাঁর ছবি অনেক সময় নােটেও ছাপা হয়। সুতরাং আপনার মৃত্যুর আগে নােটে ছবি যাওয়া উচিৎ নয়। শেখ মুজিব রাজি হয়ে গেলেন। একশ’ টাকার নতুন নােটে আমরা অন্য কিছুর ছবি দেব ঠিক করেছিলাম। তারা মসজিদ’ কার্জন হল’ (আমার যতদূর মনে আছে) এবং আরাে দু’একটা বিল্ডিং এর ছবি তােলা হয়েছিল বলা হয়েছিলাে এসব থেকে একটি যাবে। সুতরাং শেষ মুজিবের মতাে ব্যক্তিও নােটে ছবি দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। যদিও তাঁর ছবি বিদ্যমান ছিল পুরাতন নােটের উপর। সুন্দরবনের টাইগারও দেওয়ার কথা হচ্ছিল। খন্দকার মােশতাক বললেন, ঠিক আছে, ‘একশ’ টাকার নােটে রাষ্ট্রপতির ছবি দিন। তাহলে পয়সা খরচ কম হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নাজিরকে বললাম, তুমি একটু খবর নাও নােট কি পর্যায়ে আছে। ঐ বিল্ডিং-এর ছবির পরিবর্তে নতুন রাষ্ট্রপতির ছবি দিতে পারি কি না এবং তাতে কি পরিমাণ খরচ হবে সেটা আমাকে একটা ওয়ার্ক আউট করে বল যে নােট কি পর্যায়ে আছে। আর নােটগুলি যদি বাদ দিয়ে নতুন করে করতে হয় তাহলেও খরচ কত হবে। আমি আরাে বললাম যে, দশ টাকার নােট সম্বন্ধে খোঁজ নাও। প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ্য করে বললাম, প্রেসিডেন্ট সাহেব, আমি যদি দশ টাকার। নােট এখন উইথড্র করতে যাই তাহলে ইকনােমিক ট্রানজেকশনের একটা ব্যাপার আছে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট অস্থিরতা দেখা দেবে। কারণ এ নােট উইথড্র করতে যে সময় লাগবে এবং নতুন নােট দিতে যে সময় লাগবে, মাঝে দেওয়ানেওয়ার যে সময় বা শূন্যতার সৃষ্টি হবে তাতে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেকটা স্থবির হয়ে পড়বে। এটা একটা বড় বিষয় বা দেশের স্বার্থে আমাকে চিন্তা করতে হবে। নােট তাে আর অল্প নয়। এ সমস্ত নােট সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। এ কথা বলে আমরা উঠে পড়লাম। বাইরে ফটোগ্রাফাররা তখনাে বসে আছে দেখলাম। ফিরে এসে বললাম, মাহমুদ, আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ঐ যে তিন মাস চার মাস থাকবাে বলেছিলাম, আমার মনে হয় আমাকে অতদিন থাকতে হবে না। কারণ আজকে যে ঘটনা ঘটলাে তারতাে তুমি নিজেই সাক্ষী। আমাকে সমস্ত টাকা ছাপাতে হচ্ছে, অচল একশ’ টাকার নােট যা জমা দেওয়া হয়েছিলাে-প্রেসিডেন্ট নির্দেশ দিয়ে কেবল তারটা ছাড় করালেন। আমি তাে এখন অর্ডার দিয়ে সব ছেড়ে এখন যদি নােটে ছবি পরিবর্তন করতে হয় তাহলে দুটি কারণে আমার আপত্তি আছে এক. সাইকোলজিক্যাল যে মানুষটি দেশ স্বাধীন করলেন-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-যার নামে আমরা শ্লোগান দিলাম-বিভিন্ন। পার্টি একত্র হলাে- তার যত দোষই থাক তাকে আমরা হত্যা করেছি। আর আমরাই হত্যার পর তাঁর চিহ্নটা পর্যন্ত উঠিয়ে দেব? এর পক্ষপাতি আমি নই। আর খন্দকার মােশতাক যে তাঁর ছবি দিতে বললেন তা লেনদেনের দিক দিয়ে অসুবিধা আছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাবে। একশ’ টাকার নােটে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু দশ টাকার নােটে দিতে পারবাে না। একশ’ টাকার নােটের
১৭৬
উপর যদি দেওয়া যায়- যদি খরচ কম লাগে তাহলে ক্যাবিনেটে বিবেচনা করে দেখতে পারে। এসব কথার পর কফিলউদ্দিন সাহেব চলে গেলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই একটা ঘটনা মনে পড়লাে। আমি কফিলদ্দিন মাহমুদকে আবার ডাকলাম। তাকে বললাম, টেলিফোন লাগাও। আমি টেলিফোনে প্রেসিডেন্টকে বললাম,আপনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন? বললেন, ‘হ্যা পড়ি। বললাম, ‘আপনি ধার্মিক লােক মনের দিক দিয়ে এবং বাইরের দিকে দিয়েও? তাই তাে মনে করি। আমি ভাই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি না। টুপিও মাথায় দিই না। তবে আমি ইসলামের কতগুলাে নীতিগত জিনিস মানি। আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি? নােটের মধ্যে ছবি দেওয়া নিয়ে এদেশেই একটা প্রতিক্রিয়া হয়েছিলাে। আপনার মনে আছে কি না জানিনা। তবে মনে থাকাটা স্বাভাবিক। এক টাকার নােটে একটি মেয়ে চাল কুটছে এমন ছবি ছাপা হয়েছিলাে, এ নিয়ে বিভিন্ন কাগজে অনৈসলামিক কাজ বলে লেখালেখি হয়েছিলাে। তিনি বললেন, শেখ সাহেবের ছবি তাে ছিল সেটি নিয়ে তাে কেউ প্রশ্ন তােলে নি। আমি বললাম, এখন যদি আপনার ছবি ছাপা হয় আপনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন তাহলে কি আপনি একটুখানি বেকায়দায় পড়বেন না? চিন্তা করে দেখেন। তিনি বললেন, ‘ঠিক বলেছেন। আমি একটু ভেবে নিই। কতক্ষণ পর জানালেন, ভাই, নােটে আর ছবি দেওয়ার দরকার নেই।’ এই কথাবার্তার কিছুক্ষণ পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নাজির আমাকে ফোন করলেন। বললেন, স্যার, আমাকে প্রেসিডেন্ট হাউজ থেকে বলা হয়েছে যে, প্রেসিডেন্টের ছবি দিয়ে নােট ছাপাতে তিনি রাজী নন। তারিখটা আমার ঠিক মনে নেই। আমি বললাম, নাজির, তুমি কি প্রস্তাব দিয়েছিলে যে ছবি বদলাতে হবে? বললাে, না-স্যার। আমি বললাম, তাহলে তােমার কথা কেন লিখলাে। তিনি যে তােমার প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন। তুমি এর জবাব দিয়ে দাও। তুমিতাে এ প্রস্তাব করনি। তখন নাজির বললাে, “স্যার, আমরা চাকরি করে খাই-আমাকে এই হাঙ্গামায় ফেলবেন? আবার লেখালেখি করলে অসুবিধা হবে। আমি বললাম, তুমি যদি ঐ প্রস্তাব না দিয়ে থাকো তাহলে প্রেসিডেন্ট হাউসের ঐ চিঠির ফটোস্ট্যাট কপি আমাকে একটা পাঠিয়ে দাও। নাজির বললাে, কেন স্যার? আমি বললাম, পাঠাবে এজন্য যে আমি যেন তাকে জিজ্ঞেস করতে পারি যে আপনি এ চিঠি কেন লিখেছেন? প্রস্তাব সে দেয়নি। সে জানালাে, স্যার ওটা করতে যাবেন না। আমার অসুবিধা হবে।
স্বাধীনতার পর তাজউদ্দিন আহমদ-এর সঙ্গে খন্দকার মােশতাক-এর সম্পর্কের অবনতি লক্ষ্য করেছি। কলকাতার কথা। আমার মনে আছে একদিন হঠাৎ তাজউদ্দিন সাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। তাজউদ্দিন আহমদ আমাকে বললেন, ‘ভাই সাহেব, একটা ঘটনা ঘটেছে। কিছু কাগজপত্র ধরা পড়েছে তাতে মনে হচ্ছে আমাদের মধ্যে কোনাে মন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তির সঙ্গে পাকিস্তানের নেগােসিয়েশন চলছে। আমি বললাম, “কে?’ তখন তিনি বললেন, ‘মােশতাক ভাই।’ মােশতাক তখন বিদেশ মন্ত্রী। গভর্নমেন্ট অফ ইণ্ডিয়া এটা ইন্টারসেপ্ট করেছে এবং পেয়েছে। আমাদের বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পাকিস্তান গভর্নমেন্ট কমপ্রােমাইজ করতে চায়। কমপ্রােমাইজ করে একটা সেটলমেন্টে আসবে। এ
১৭৭
বিষয়ে বেশ কিছু কাগজপত্র ধরা পড়েছে। আমার খারাপ লাগছিলাে। মাহবুব আলম চাষীর জড়িত থাকার কথাও বললেন। তবে এটা থামানাে হয়েছে; এখন। সম্পূর্ণভাবে এদের সবাইকে বিশ্বাস করা যাবে না বলেও জানালেন। আমি বললাম যে, এটাতাে আমি ভাবতেও পারি না। তারপর যখন দেশে ফিরে এলাম বিদেশ মন্ত্রীর পদ থেকে মােশতাক আহমদকে বাদ দেওয়া হলাে। তাকে বােধ হয় কমার্স মিনিস্টার করা হলাে। আবদুস সামাদ আজাদকে করা হলাে ফরেন মিনিস্টার। খােন্দকার মােশতাক এই রদবদলে খুবই মনঃক্ষুন্ন হয়েছিলেন। তাজউদ্দিন আহমদকে মন্ত্রী পরিষদ থেকে বাদ দেওয়ার ব্যাপারে খন্দকার মােশতাকদের ভূমিকা ছিলাে। তাজউদ্দিনের পরিবর্তে খন্দকার মােশতাককে অর্থমন্ত্রী করা হবে এমন ধারণা ছিলাে অনেকের। সবগুলি ঘটনা একটার পর একটা মিলালে খন্দকার মােশতাকের ভূমিকা স্পষ্ট হবে। অনেকেই জানেন, ত্রিপুরাতে প্রথম ক্যাবিনেট গঠন করার কথা হয়েছিলাে। তখনই মােশতাক গ্রুপ এবং তাজউদ্দিন গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছিলাে। তার জের স্বাধীনতার পরও লক্ষ্য করা গেছে। মােশতাক সাহেব ফরেন মিনিস্ট্রি থেকে বাদ পড়লেন। তাজউদ্দিনের মন্ত্রিত্ব চলে গেল। আমাকে তাজউদ্দিন আহমদ মােশতাক সম্পর্কে অনেক কথাই বলেছিলেন।
আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের কথা। আমি তখন বােম্বেতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গড়ে তােলার জন্য বিভিন্ন স্থানে সভা-সমিতিতে বক্তব্য রাখছি। হঠাৎ আমার কাছে খবর এলাে যে আমাকে তাড়াতাড়ি কলকাতা ফিরতে হবে। আমাকে নাকি আমেরিকা যেতে হবে। আমি এজন্য মােটেও প্রস্তুত ছিলাম না, তবু তাজউদ্দিনের আহ্বানে কলকাতা ছুটলাম। কলকাতা পৌছতেই তাজউদ্দিন আহমদ বললেন, আপনাকে ইউনাইটেড ন্যাশনস-এ যেতে হবে। তাড়াতাড়ি আপনার কাপড়-চোপড় তৈরি করে নিন। কাপড়ের জন্য টাকা দেওয়া আছে। আমার মনে আছে এই দলে তাহরেউদ্দীন ঠাকুরেরও যাওয়ার কথা ছিল। আমি যখন তাজউদ্দিন-এর দফতর থেকে বেরুচ্ছি। তখন তাহেরউদ্দীন ঠাকুর, এয়ার ভাইস মার্শাল এ. কে. খন্দকার প্রমুখের সঙ্গে দেখা হলাে। তাহের আমাকে বললাে, স্যার, আপনি তাে যাচ্ছেন। রাজি হয়েছেন। নাকি?’ বললাম, হ্যা, রাজি হয়েছি। তাহের জানালাে, আপনার কাপড়-চোপড় তৈরি করতে হবে না?’ হা- সূচক জবাব দিলাম। কাপড় তৈরি করতে সময় লাগবে। আমার জন্য এক সেট কাপড় তৈরি করেছিলাম। আপনার গায়ে যদি লাগে তাহলে এটাও নিতে পারেন। কাজে দেবে।’ বললাে তাহেরউদ্দীন ঠাকুর। আমি বললাম, ভাই তুমি বলছাে ঠিকই। কিন্তু বাইরে যাচ্ছি তােমারটা ঠিকমত ফিট না করলে ওটা নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। আমার তাে বেশি কাপড়-চোপড় নেই। একটা মাত্র সূট তাও পুরানাে। আমি তাহেরকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি বাদ পড়লে কেন?’ সে জানালাে, এখানে কাজকর্ম আছে। পরবর্তীতে আমার মনে। হয়েছে তাকে ইচ্ছা করেই আমেরিকায় পাঠানাে হয়নি। বােধ হয় তাজউদ্দিন এবং সৈয়দ নজরুল বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং খন্দকার
১৭৮
মােশতাক পরস্পর ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রাখছিলেন। আর এ জন্যই শেষ মুহূর্তে তাহেরকে বাদ দেওয়া হয়।
শেখ মুজিবের হত্যার পর ঐ সব ঘটনা বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি আরাে স্পষ্ট করেই আমাদের কাছে ধরা দেয়। মাহবুব আলম চাষী ছিলেন ফরেন সেক্রেটারী । তারও যাওয়া হলাে না। তাকে যেতে দেওয়া হলাে না। কারণ নিশ্চয়ই ছিলাে। শেখ মুজিব হত্যার বীজ কি তখনই রােপিত হয়েছিলাে? মুজিব হত্যার পরপরই তাহেরকে কিছুদিন বেশ তৎপর দেখলেও এখন তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। না রাজনীতিতে, না সমাজ-সংস্কৃতি অঙ্গনে। অথচ তিনি এখনাে জীবিত। এগুলাে থেকে মনে হচ্ছে যে পুরাে ব্যাপারটা একটা ষড়যন্ত্র ছিলাে। মুজিব হত্যার ব্যাপারটায় কে বা কারা জড়িত ছিল তা আমি জানি না, তবে এদের একটা দল ছিল। যে দলটাকে মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে আর বিশ্বাস করা হতাে না।
আমরা যখন জেলহত্যা সম্পর্কে আভাস পেলাম তার পরই মােশতাক সাহেব। ক্যাবিনেট মিটিং ডাকলেন। আমি, মান্নান সাহেব, আবদুল মােমেন ও আরাে। কয়েকজন ঠিক করলাম ক্যাবিনেট আমরা আর থাকবাে না। যতদূর মনে পড়ে, । আমরা মােহাম্মদউল্লাহ সাহেবের বাড়ি গেলাম।
আমরা বেশ কয়েকজন মন্ত্রী মােহাম্মদউল্লাহকে জানালাম, জেলে যে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে এরপর আর আমরা এ ক্যাবিনেটে থাকতে পারি না। তিনি বললেন, আমি প্রেসিডেন্টের কাছে এখনি যাচ্ছি। তিনি তখনি রওয়ানা হলেন। আমরা সারাদিন উদ্বেগের মধ্যে রইলাম। নাওয়া-খাওয়া কিছুই হলাে না। কেবলই ভাবছি কি হলাে। কারা ক্ষমতায় গেল। কেনই বা হত্যাকাণ্ড। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এসব নানা ভাবনার মধ্যে আসলাে জরুরী নােটিশ। খন্দকার মােশতাক মন্ত্রী পরিষদের সভা আহ্বান করেছেন। আমরা যে মন্ত্রী পরিষদে থাকবাে না— একথা জানাবার জন্য মন্ত্রী পরিষদ সভায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা ক্যাবিনেট মিটিং-এ গেলাম। খন্দকার মােশতাক সভাপতিত্ব করছিলেন। আমরা জেলহত্যা সম্পর্কে জানতে চাইলাম। খন্দকার মােশতাক এ কথা এড়িয়ে অন্যান্য প্রসঙ্গ তুলতে আরম্ভ করলেন। আমার মনে আছে হঠাৎ কে একজন ঢুকলাে। আমরা ইতিমধ্যে বাইরে নানারকম আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। মােশতাক সাহেবের কানের কাছে গিয়ে ঐ আগন্তুক কি যেন বললাে। তিনি তাড়াতাড়ি সভা থেকে উঠে গেলেন। বাইরে তর্কবিতর্ক শুনতে পেলাম। কিছুক্ষণ পর মােশতাক সাহেব দরজা ঠাস করে বন্ধ করে দিয়ে বসে পড়লেন। বসে মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন। তার পর পরই দরজা খুলে গেল। ঘরে অস্ত্রধারী কিছু লােক ঢুকলাে। তারা সবাই সেনাবাহিনীর লােক। ঘরে ঢুকেই বললাে, আপনারা যে যেখানে আছেন সেখানেই থাকবেন। নড়াচড়া করবেন না, ঘর থেকে কেউ বেরুবেন না। এ কথা বলার পর চারজন লােকঘরের চার কোনায়, অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে গেল। জেনারেল ওসমানী এবং মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান অস্ত্রধারীদের থামাবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুজনকে ধাক্কা দিয়ে ওরা ঘরের
১৭৯
মধ্যে ঢুকে পড়লাে। অস্ত্রধারীরা ওসমানী সাহেবকে বসিয়ে দিল। তিনি বসে পড়লেন। মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, আমার ডান দিকে বােধ হয় আমার ঠিক মনে নেই, দুটো সীট পরে এসে বসলাে। হঠাৎ আমার পেছনে এক আর্মী, অফিসার নামটা মনে নেই— সে দাড়িয়ে এক বক্তৃতা দিলাে। সে বলল, আপনারা যে যেখানে আছেন সেখানেই থাকবেন। খন্দকার মােশতাককে দেখিয়ে বললাে, এই যে বসে আছেন ইনিই হলেন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী। এই হত্যাকারীর বিচার হবে। জেলহত্যার সঙ্গেও এই ব্যক্তি জড়িত। তারও বিচার হবে। মােশতাক সাহেব কথা বলতে চাচ্ছিলেন। তাঁকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেওয়া হলাে। তারপর ঐ অফিসারএকটা ছােট খাটো, বক্তৃতা দিল— খুব তাড়াতাড়ি কথা বলছিলাে— আমি পেছন দিকে তাকিয়ে তার বুকের মধ্যে একটা হাত দিলাম। আমার পেছনে দাড়িয়ে সে। আমি বললাম আস্তে কথা বলাে তােমার কথা বুঝতে হবে তাে। তখন সে ‘সরি স্যার’ বলে আমার সাথে হ্যাণ্ডশেক করে আবার আস্তে আস্তে বলতে আরম্ভ করলাে। সব কথা আমার এখন আর মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে যে খন্দকার মােশতাককে যখন খুনী হিসাবে চিহ্নিত করলাে—তখন মােশতাক ছিলেন নীরব।
১৯৭৫-এর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহটি ছিল ঘটনাবহুল। খালেদ মােশাররফএর অভুত্থান প্রচেষ্টা, জেলা হত্যা, সিপাহী বিদ্রোহ, মােশতাক সরকারের পতন, জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ ইত্যাদি নানা ঘটনা এই অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ঘটে যায়। এ সময়ে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে আমি আমার ছেলের বাসায় থাকতে আরম্ভ করি।
আমি যখন আবসর জীবন কাটাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তখন আমার অনেক বন্ধু বান্ধব আমাকে নতুন করে কর্মজীবনে (শিক্ষকতায়) ফিরে যেতে অনুরােধ জানালেন। বিদেশের বন্ধু-বান্ধব, যেমন প্রফেসর বাশাম (যার কথা আগেও উল্লেখ করেছি) আমাকে অস্ট্রেলিয়াতে শিক্ষকতার অনুরােধ জানান। কিন্তু তখন আমার মন নানা কারণে বিক্ষিপ্ত ছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড আমাকে অত্যন্ত মর্মাহত করে। খন্দকার মােশতাকের আচরণ আমাকে বিচলিত করে। এ প্রসঙ্গ আমি আগেও বলেছি। আমার ধারণা ছিল খন্দকার মােশতাক শেখ মুজিবের হত্যার সথে জড়িত নন। তাঁর মন্ত্রিসভায় মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করার অন্যতম শর্ত ছিল যে প্রথম ক্যাবিনেট মিটিং-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বাস্তবে তা হলাে না। যখন বঙ্গবন্ধুর হত্যার সাথে মােশতাককে জড়িয়ে নানা কথা শােনা যেতে লাগলাে, তখন এই লােকটির সরকারের সাথে আমি জড়িত ছিলাম ভাবতেই আমার কষ্ট হতাে। মন্ত্রিত্বের লােভে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করলে আমার কোনাে খেদ থাকতাে না। আর সে ক্ষেত্রে পরেও নানা সময়ে আমার মন্ত্রিত্ব গ্রহণের সুযােগও ছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে যাওয়া, এবং অজ্ঞাতসারে মােশতাকের মতাে মানুষকে বিশ্বাস করা সম্ভবত আমার জীবনের একটা বড় রকমের ভুল। এ সময়ের ঘটে যাওয়া আরাে অনেক ঘটনাও আমাকে ব্যথিত করে। সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা। জেল হত্যাকাণ্ড আমাকে স্তম্ভিত করেছিল। তাজউদ্দিন সাহেব
১৮০
আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। কামরুজ্জামানের সাথে রাজশাহী থেকেই ঘনিষ্ঠতা। সৈয়দ নজরুলের সাথে ছিল আত্মীয়তার বন্ধন। মনসুর আলী সাহেবের সাথেও ছিল সুসম্পর্ক। এসব তাে ব্যক্তিগত পর্যায়ের কথা। জাতির চরম দুর্দিনে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে এরা যেভাবে জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তার প্রতিদান কি তাঁরা। এভাবে পেলেন? এঁরা বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের ইতিহাস হয়তাে অন্যরকম হয়ে যেতাে। নভেম্বরের সে দিনগুলাে ছিল চরম হতাশা, মানুষের প্রতি বিশ্বাসহীনতা আর দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠায় ভরা। তখন দেশ ছেড়ে বাইরে যাবার মত মানসিকতা আমার ছিল না। নিজের মাতৃভূমিতে জীবনের বাকি দিনগুলাে কাটাবাে এ সিদ্ধান্তে অটল থেকে প্রফেসর বাশামের প্রস্তাবটি নাকচ করে দিলাম।
এ সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড: মুহম্মদ এনামুল হক এবং অন্যান্যদের অনুরােধে আমি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে যােগদানের সিদ্ধান্তে আসি। ১ জানুয়ারি ১৯৭৬-এ আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যােগ দিলাম। আমার বয়স এবং স্বাস্থ্যগত কারণে আমি সপ্তাহে ২/৩ দিন ক্লাস নেবাে বলে ঠিক করি। কয়েক বছর পর ১৫ এপ্রিল ১৯৮৩ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে প্রফেসর এমেরিটাস করার সিদ্ধান্ত নেন। এটি একজন শিক্ষকের জন্য বিরল সম্মান। আমি সানন্দে ও সকৃতজ্ঞচিত্তে তা স্মরণ করি। দীর্ঘদিন পর ছাত্রদের সাথে শ্রেণীকক্ষে মিলিত হতে পেরে, নানাবিধ একাডেমিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতে থাকতে আমি ধীরে ধীরে আমার উদ্যম ফিরে পেতে শুরু করি। তরুণ ছাত্রদের সাহচর্য আমার জন্য যেন টনিকের মতাে কাজ করে।
আমি যখন আবার আগের মত উদ্যমী হয়ে উঠছি, তখন বাংলাদেশে বেসরকারী ব্যাংক স্থাপনের তৎপরতা শুরু হয়েছে। আমি প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ছিলাম এ কারণে সিটি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আমাকে তাদের সাথে কাজ করবার অনুরােধ জানান। কেবল বঙ্গবন্ধুর অনুরােধে এবং অর্থ মন্ত্রণালয়কে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিতে পারবাে এ বিশ্বাসে আমি অর্থমন্ত্রী হয়েছিলাম। কিন্তু অর্থনীতি বা ব্যাংক পরিচালনা সম্পর্কে তেমন কোনাে তত্ত্বীয় জ্ঞান আমার ছিল না। আমি কোনদিনই অর্থনীতির ছাত্র ছিলাম না, এসব যুক্তি দেখিয়ে তাদের আমি ফিরিয়ে দেই। এদের ফেরাতে পারলেও ন্যাশনাল ব্যাংকের উদ্যোক্তারা যখন আমাকে তাদের ব্যাংকের দায়িত্ব নিতে অনুরােধ জানালেন তখন আমি ভাববার জন্য কিছু সময় নিলাম। এরা আমার হৃদয়ের দুর্বলতম স্থানটিতে টোকা দিয়েছিল। তারা বারবার বুঝাতে চাচ্ছিল এটা প্রথম বাঙালিদের দ্বারা এবং সম্পূর্ণভাবে বাঙালি মূলধনের গড়ে উঠা ব্যাংক। দেশের স্বার্থেই কাজ করবে। আমি ২/১ দিন বেশ গভীরভাবে এ ব্যাপারটি নিয়ে ভাবলাম। ব্যাংক একটা দেশের অর্থনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ দেশের স্বাধীনতার জন্য অন্য অনেকের মতাে আমিও যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করেছি এবং দেশের মঙ্গলামঙ্গল নিয়ে আমি আমৃত্যু চিন্তা করবাে-এমন অঙ্গীকারও করেলািম। এসব চিন্তা করে আমি দেশের প্রথম বেসরকারী বাঙালি ব্যাংকের সাথে জড়িত থাকতে অস্বীকার করতে পারলাম না। ১৯৮৩-র মার্চ মাসে
১৮১
অর্থাৎ এ ব্যাংকের সূচনালগ্ন থেকে আমি এ ব্যাংকের চেয়ারম্যান হই এবং ১৯৯৩ পর্যন্ত এ পদে ছিলাম। এর মাঝে বহুবার ব্যাংক ছাড়তে চাইলেও ব্যাংকের কর্মকর্তাগণ আমাকে ছাড়তে দেন নি। ব্যাংকের কারণে বাংলাদেশের নানা। জায়গায় আমাকে যেতে হতাে। আমার সরাসরি উপস্থিতি অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের জন্য সাফল্য ডেকে আনে। যেমন, চট্টগ্রামে ব্যাংকের প্রথম শাখা উদ্বোধন করার। পর আমার উপস্থিতিতেই ৬০ লক্ষ টাকা এককভাবে জমা পড়ে। ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রমে আমার কোনাে ভূমিকা ছিল না, তবে ব্যাংকের মূলনীতির ব্যাপারে আমি পরামর্শ দিতাম। আমার পরামর্শে মধ্যপ্রাচ্য এক্সচেঞ্জ অফিস খােলা। হয়। কাতার, কুয়েত, ওমান, আবুধাবি ইত্যাদি জায়গায় অবস্থিত এসব এক্সচেঞ্জ অফিস সব অঞ্চলে কর্মরত বাঙালিদের দেশে তাদের টাকা পাঠাতে সহায়তা করেছে। অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মতাে এ ব্যাংকও বছরের প্রথমে গ্রাহকদের মাঝে শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে ক্যালেণ্ডার ইত্যাদি উপহার দিয়ে থাকতাে। আমার প্রস্তাবে এ ব্যাংকে নিয়ম করা হলাে ১লা বৈশাখ আমরা শুভাকাঙ্খীদের দেশী বই উপহার দেবাে। এতে আমাদের কাজও হবে, দেশী লেখক ও প্রকাশনা শিল্পকে সহায়তা করা হবে। আবার মানুষকে পুস্তকমুখী করে তােলা যাবে। ন্যাশনাল ব্যাংক একটি স্কুলও স্থাপন করেছে। আমি বিশ্বাস করি, যে কোন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের তাদের লভ্যাংশের একটা অংশ জনকল্যাণমূলক । কাজে ব্যয় করা উচিত। জাতির প্রতি, দেশের প্রতি সবার দায়িত্ব আছে। স্বল্পাংশে হলেও সে দায়িত্ব পালন করলে জাতি তার দুর্দশা ও দুর্গতি থেকে মুক্তি পাবে। আমার এসব উপদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সব সময় গ্রহণ করেছেন।
১৯৭৫-সালে আর একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে আমি বেশ জড়িয়ে পড়ি।এটি হলাে এশিয়াটিক সােসাইটি। এশিয়াটিক সােসাইটি একটি ঐতিহ্যবাহী একাডেমিক প্রতিষ্ঠান। পাকিস্তান আমলে এটিকে পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরকরণের প্রচেষ্টা চালানাে হলে অন্যান্যদের সাথে আমিও তাতে বাধা দেই। কর্মজীবনে ঢাকায় ছিলাম না বলে এ প্রতিষ্ঠানের সাথে তেমন যােগাযােগ ছিল না। অবশ্য আমার “British Policy and the Muslims in Bengal, 17571856” এ প্রতিষ্ঠানই প্রথম প্রকাশ করে ১৯৬১ সালে। মাঝে মাঝে এদের পত্রিকাগুলােতেও আমার প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। ১৯৭৫’র পর ঢাকায় থাকার কারণে এশিয়াটিক সােসাইটির সাথে আমার যােগাযােগ গভীরতর হয়। ১৯৮৩-৮৪ এবং ১৯৮৪-৮৫ এ দু’ বছর আমি এ প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট ছিলাম। এশিয়াটিক সােসাইটির মর্যাদার তুলনায় বাহ্যিক রূপটি ছিল দৈন্যে ভরা। আমার সময় মর্যাদা অনুযায়ী এর একটা সুন্দর বাহ্যিক রূপ দেবার চেষ্টা আমি করেছি। ভবন, অডিটোরিয়াম ইত্যাদি আমার সময়েই করা হয়। ১৯৮৬-তে এশিয়াটিক সােসাইটি আমাকে তাদের ফেলাে (Fellow) হিসেবে গ্রহণ করে আমাকে সম্মান প্রদান। করেছে। এটিও একজন শিক্ষিত ও শিক্ষানুরাগীর জন্য পাওয়া বিরল সম্মান। এশিয়াটিক সােসাইটি যখন তিন খণ্ডে বাংলার ইতিহাস (১৭০৪-১৯৭১) লিখবার
১৮২
উদ্যোগ গ্রহণ করে তখন আমাকে সেই এডিটোরিয়াল বাের্ড-এর চেয়ারম্যান হবার অনুরােধ জানানাে হয়। আমি সে অনুরােধ ফেলতে পারিনি। ১৭০৪ থেকে ১৯৭১-এ দীর্ঘ সময়ের বাংলাদেশের একটি ইতিহাস লিখবার এটি প্রথম প্রচেষ্টা, বহু জ্ঞানী-গুণী, প্রবীণ ও নবীন লেখকদের লেখায় বইটি সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক নিয়ে এত বড় পরিসরের বইটির রচনা-কর্মকাণ্ডে আমি জড়িত ছিলাম- সে স্মৃতি আমাকে আনন্দ দেয়। এতবড় মাপের একটি কাজে, ছােট-খাটো ত্রুটিবিচ্যুতি থাকতেই পারে। পরের কাজগুলাে ত্রুটিমুক্ত হােক এ আমার ঐকান্তিক কামনা। সম্পূর্ণভাবে সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে স্বাধীন গবেষণা অনেক সময় করা যায় না। এশিয়াটিক সােসাইটি যদি বড় রকমের স্বাধীন গবেষণা কাজে অর্থসংকুলান করতে না পারে তাহলে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আনুকূল্য নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির একাডেমিক কর্মকাণ্ড সচল রাখবে- এ আমার প্রত্যাশা।
১৯৭৫-এর পর থেকে বাংলা একাডেমীর সাথেও আমি কিছুটা ঘনিষ্ঠ হই। aans Britist Pollicy and the Muslims in Bangall 1757-1856 বইটির বাংলা অনুবাদ বাংলা একাডেমী প্রকাশ করেছে। এদের নানা অনুষ্ঠানে, প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে, বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের অনুষ্ঠানে আমি বহুবার প্রধান অতিথি হয়েছি। ৪ জানুয়ারি ১৯৭৬-এ বাংলা একাডেমী আমাকে তাদের ফেলাে হিসেবে সম্মান প্রদান করে। একজন শিক্ষিত ব্যক্তির জন্য এ সম্মানটুকু খুবই কাঙ্খিত। ‘
এমনিভাবে জীবনে নানা সময়ে নানা জায়গায় মানুষের ভালবাসা, সম্মান এবং শুভেচ্ছা কুড়িয়ে জীবনের সঞ্চয় খুব একটা কম হয়নি। সুদীর্ঘ ৭৫ বছর পর যখন জীবনের ফেলে আসা দিনগুলাের দিকে তাকাই তখন নিজেই বিস্মিত হই। স্রষ্টার শক্তি অসীম, তা থেকে সামান্য শক্তি আর ক্ষমতা দিয়ে মানুষকে স্বল্প সময়ের জন্য পৃথিবীতে পাঠানাে হয়। কিছু কিছু মানুষ এ স্বল্প সময়ে সীমিত শক্তি নিয়ে অসাধ্য সাধন করে। আমি তাদের দলে পড়ি না। কিন্তু এই এক জীবনে কত ঘটনা, কত কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়েছি, মুখােমুখি হয়েছি কত চ্যালেঞ্জের। কত রৌদ্রউজ্জ্বল দিন পেয়েছি। কখনাে আকাশ মেঘে মেঘে ছেয়ে গেছে, আবার সূর্য উঠবে সে বিশ্বাস নিয়ে অপেক্ষা করেছি। কখনাে হতাশ হইনি, উদ্যম হারাইনি, নিজের উপর বিশ্বাসও হারাইনি। কি পাইনি তার হিসেব আমি মেলাতে যাইনি, যা পেয়েছি তা অনেক সময় আমার চাওয়াকে ছাড়িয়ে গেছে। আজ তাই বােধ হয়। অকপটে বলা যায়, নানা ছােটখাটো বেদনার মাঝেও আনন্দময়, সাফল্যময় ও সন্তুষ্টিময় এক জীবন যাপন করেছি আমি। ব্যক্তিগত জীবন এবং কর্মজীবনে কত অসংখ্য চ্যালেঞ্জ আমাকে গ্রহণ করতে হয়েছে, কখনাে সেসব চ্যালেঞ্জকে ভয় পাইনি বলেই জীবনের এতটা পথ অনায়াসে পার হয়েছি।
রেঙ্গুনে পড়ার পাট চুকিয়ে যখন বাংলাদেশের গ্রামের এক সাদামাটা স্কুলে ভর্তি হয়েছি তখন জীবন এমন বর্ণাঢ্য হবে একথা ভাববার যুক্তি ছিল না। কিন্তু
১৮৩
হতাশা আমাকে স্পর্শ করেনি, নিজের ভেতরের এক সাহসী সত্তা আমাকে সামনে নিয়ে গেছে, নিজের অজান্তে।
মাত্র তেইশ বছর বয়সে যখন কর্ম ও সংসার জীবনের শুরু তখন বাবা পরপারে চলে গেলেন। অসহায় চারটি ভাই, বড়টি কলেজে পড়ে, সবচেয়ে ছােটদের বয়স নয় বছর, স্ত্রী-পুত্র, বিধবা মা, এত বড় সংসারের দায়িত্ব মাথায় নিয়ে শােকাতুর হবার সময় পাইনি। নানা মামলায় জড়িয়ে পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভাল ছিল না। শিক্ষক হিসেবে বেতন অল্প, আবার আত্মসম্মান এবং বংশমর্যাদার কথা ভেবে কোথাও কোনাে আপােসের কথাও ভাবিনি। এটি সম্ভবত আমার জীবনের প্রথম চ্যালেঞ্জ। মা সাহস দিয়েছেন। স্ত্রী সাহস দিয়েছেন, বন্ধুবান্ধবের সহানুভূতি ছিল। সবচেয়ে বড় কথা সবার অলক্ষ্যে যিনি থাকেন, সেই তিনি শক্তি যুগিয়েছেন। আজ যখন দেখি আমার সব ভাই-ই সুপ্রতিষ্ঠিত তখন বড় আনন্দ হয়।
সংসারের অবস্থা যখন কিছুটা গােছানাে, তখন বিদেশে যাবার সুযােগ এলাে। উৎফুল্ল বােধ করলেও ভয় ছিল। বিলেতে যাবার জাহাজ যখন ডাঙ্গা ছাড়লাে। মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছে অথৈ জলে ঝাঁপ দিলাম না তাে? দুই মেয়ে ও এক ছেলেসহ সন্তান সম্ভবা স্ত্রীকে রেখে গেলাম দেশে, মা ইহলােকে নেই, একটি ভাই মাত্র ওকালতিতে ঢুকেছে। অন্যরা ছাত্র। আবারাে সেই পরমশক্তিধর আমাকে শক্তিমান করেছেন। মাত্র এক বছর দশ মাসে গবেষণা শেষ করে পিএইচডি নিয়ে যখন দেশে ফিরলাম মনে হয়েছে অনেক তাে হলাে, এখনও জানি না আরাে কত ‘অনেক’ আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে জীবন শুরু করে, সেখানেই জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া মিটালেও নিজেকে কম ভাগ্যবান ভাবতাম না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রস্তাব যখন পেলাম তখন আবার এক চ্যালেঞ্জের মুখােমুখি হলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ করা, পাহাড় ঘেরা গ্রামটিতে দাঁড়িয়ে ক্ষণিকের জন্য থমকে গেছি। মাত্র এক বছরে এ পাহাড় কেটে পারবাে কি বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে? পারতেই হবে’ -এ প্রত্যয় নিয়ে কাজে নেমেছি। পেয়েছি পরিশ্রমী সহকর্মী, এবং মানুষের আশীর্বাদ। সফল হয়েছি অঙ্গীকার রক্ষায়।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভিসির বাড়িতে গুছিয়ে বসবার আগেই আবার নতুন চ্যালেঞ্জ। এবার আর চ্যালেঞ্জটি ব্যক্তিগত পর্যায়ের নয়। সমস্ত বাঙালীর জন্য এ ছিল এক চরম পরীক্ষা। নিজ পরিচয়ে নিজ দেশে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকবার চেষ্টা করবাে, নাকি পাকিস্তানীদের আজ্ঞাবহ হয়ে থাকবাে —এ প্রশ্নের উত্তর দিতে আমাকে মুহূর্তের জন্য দ্বিধান্বিত হতে হয়নি। ভীত হতে হয়নি। ২৪ মার্চের জনসভায় আমার ভাষণ যখন চলছিল তখন পাকিস্তানীরা বন্দরে জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে যেয়ে জনতার বাধার মুখােমুখি। নানা পথ ঘুরে যখন বাড়িতে ফিরছিলাম তখনই সিদ্ধান্ত নেই, পারিবারিক বা নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে পালাবাে না বরং ক্যাম্পাসে থেকে ক্যান্টনমেন্টের পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রতিহত
১৮৪
করবাে। যথাসাধ্য সে চেষ্টা করেছিও, যার বিবরণ কিছু দিয়েছি। এপ্রিলের মাঝামাঝি দেশ ছেড়ে যেদিন ভারতের মাটিতে পা রাখলাম সেদিন নিজেই নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছি যে বছর শেষ হবার আগে দেশে ফিরবােই। না, কোন যুক্তি বা তথ্যনির্ভর ছিল না সে ধারণা, হয়তাে প্রচণ্ড আবেগে এ ধারণার জন্ম, সম্ভবত সমস্ত বাঙালির এই আবেগ ও মনের জোর সত্যি সত্যি ডিসেম্বরের মধ্যে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে সবার সাথে কাজ করে সুন্দর করে গড়বাে –এ প্রত্যয় নিয়ে দেশে ফিরলাম। কিন্তু মাস দুয়েকের মধ্যে যতটুকু গুরুভার আমাকে বইতে হবে ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক বড় দায়িত্ব নিতে হলাে আমাকে। ভারতের মতাে একটি রাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব নিতে হলাে আমাকে। ভারত মুক্তিযুদ্ধে আমাদের যেভাবে সাহায্য করেছে তাতে ভারত সে সময় আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু। আবার ২৪ বছরের পাকিস্তানী শাসনকালে দুই অঞ্চলের সংহতি’ এই অযুহাতে ভারত সম্পর্কে চালানাে হয়েছে নানা অপপ্রচার। যে কোন সমস্যার সময় ভারতীয় জুজুর ভয় দেখানাে হতাে পাকিস্তানে। তাতে সাধারণ লােকের মনে ভারত সম্পর্কে নানা ধরনের ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে সব ধারণা সুপ্ত ছিল। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছিলাম অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল ইস্যু নিয়ে আমাকে কাজ করতে হবে। ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাবর্তন ঘটেনি তখনাে। বাংলাদেশের রাস্তা-ঘাট মেরামত হয়নি, কল-কারখানা ভাঙ্গা। অতি প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদি, অতি দ্রুত আনতে হলে আনতে হবে ভারত থেকে, পৃথিবীর অনেক দেশ তখনাে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। ভারতে বসে সে চেষ্টা-তদ্বির করতে হবে, আবার পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের প্রত্যাবর্তনের দায়িত্বটিও আসবে আমার উপরই। যে ক’ বছর ভারতে ছিলাম আমার পাশে পেয়েছি বেশ কিছু দক্ষ, প্রথম শ্রেণীর পেশাদার কূটনীতিক। রাষ্ট্রদূত হিসেবে অভিজ্ঞতা না থাকলেও নানা আন্তর্জাতিক ফোরামে নিজের দেশের কথা বলার ও দেশের স্বার্থ উদ্ধারের অভিজ্ঞতা ছিল। সেসব অভিজ্ঞতা ও সহকর্মীদের দক্ষতা মিলিয়ে আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব আমি যথাযথ পালন করবার চেষ্টা করেছি।
এরপর যে দায়িত্ব নিতে হলাে তাও ছিল খুবই সমস্যাসংকুল। যার জায়গায় আমাকে অর্থমন্ত্রী হতে হলাে তিনি একজন জনপ্রিয় ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। যে দেশটির অর্থনীতি নিয়ে আমাকে কাজ করতে হবে সে দেশটি যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন একটি দেশ। অর্থনীতির উপর আমার নিজের তেমন তত্ত্বীয় জ্ঞান নেই। তা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর অনুরােধ আমি ফেলতে পারিনি। অবশ্য সে সময় আমার সুহৃদ তাজউদ্দিন সাহেব (যার জায়গায় আমি অর্থমন্ত্রী হলাম) আমাকে বলেছিলেন, শেখ সাহেব আপনাকে যে ধরনের স্বাধীনতা দেবেন দলীয় কোন ব্যক্তি মন্ত্রী হলে তা পাবেন না। তিনি এ কথাও বলেছিলেন, কেবল আমিই পারবাে এ গুরুভার নিতে, এবং তিনি খুশী হবেন যদি এ দায়িত্ব আমি নেই। যে কয়েকমাস এ দায়িত্বে ছিলাম
১৮৫
নিজের সব রকমের অভিজ্ঞতার আলােকে নানা সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেছি, কালাে টাকা ধরবার জন্য ১০০ টাকার নােট বাতিল করেছি, একটি বাজেট প্রদান করেছি। এ সবই করেছি একটি বিপর্যস্ত অর্থনীতির উপর দাঁড়িয়ে।
১৯৭৫’র পর ভেবেছিলাম কমব্যস্ত জীবনের অবসান ঘটলাে; এবার বিশ্রাম আর স্মৃতি রােমন্থনের পালা। কিন্তু আবার জড়িয়ে পড়লাম শিক্ষকতা ও ব্যাংক। গড়ার কাজে। অবসরটুকু ব্যয় করেছি এশিয়াটিক সােসাইটির সাথে অথবা বিভিন্ন জায়গায় সভা ইত্যাদিতে উপস্থিত থেকে, বক্তৃতা দিয়ে।
এখন শরীর আর সহযােগিতা করে না, অখণ্ড অবসরে তাই এ স্মৃতিচারণ । খরস্রোতের ধারায় যে নৌকার পথচলা সে হয়তাে আপনি ভেসে যায়, কিন্তু তার। হালটি ধরতে হয় শক্ত হাতে। বিধাতা আমার নৌকাটি ভাসিয়েছেন খরস্রোতে। আমি কেবল হাল ধরেছি তাকে দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করতে। জীবনে যা করবার ইচ্ছে ছিল তার অনেকটা করেছি। যা কোনদিন করতে হবে ভাবিনি তাও করেছি। যখন যে গুরুভার আমার উপর পড়েছে আমি সাধ্যমত তা বহন করেছি, যিনি আমাকে সে শক্তি ও সাহস যুগিয়েছেন সকল প্রশংসা তাঁর, আর যেটুকু ত্রুটিবিচ্যুতি তার দায় আমার ।
শিক্ষকতা পেশা ও নেশা ছিল। বিদেশে শিক্ষকতার ডাক পেয়েছি বহুবার, তাতে হয়তাে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ থাকতাে কিন্তু মন সাড়া দেয়নি। নিজের ক্ষুদ্র। সামর্থ্য দিয়ে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছি। সবার সাথে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতে চেয়েছি। কত মানুষকে হাত ধরে উপরে টেনে তুলেছি। কোনাে ব্যক্তিগত প্রত্যাশা আমার ছিল না। তাঁদের অনেকেই দায়িত্বশীল পদে গেছে, সমাজ ও দেশের প্রতি তারা দায়িত্ব পালন করেছে। তাদের সাফল্য আমাকে আনন্দ দেয়। আবার কেউ কেউ হয়েছে আদর্শচ্যুত। অর্থের জন্য, ব্যক্তিস্বার্থের জন্য নীতিবােধকে জলাঞ্জলি দিয়েছে তাঁরা, তাঁদের কাছে সমাজের যে প্রত্যাশা ছিল তা পূরণ না করে কেবল নিজের ব্যক্তিস্বার্থের জালে আটকে গেল আমারই নিজের হাতে গড়া কিছু মানুষ। তাদের আমি ক্ষমা করতে পারি না। যিনি সবাইকে ক্ষমা করেন, সেই তিনি আমার ওই ক্ষমাহীনতাকে ক্ষমা করুন।
যখন দেখি যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলাম তা পূরণ করতে পারলাম , এমনকি যখন দেখি যে আদর্শের জন্য যুদ্ধ করা, এত প্রাণদান তাও ধুলােয় পড়ে আছে— বড় কষ্ট হয়। আমার এখন আর সাধ্য নেই কিছু করার, তাই নিরব থাকি। জনসংখ্যার ভারে দেশ আজ বিপর্যস্ত, অশিক্ষিত আর দরিদ্র জনগােষ্ঠীর । মাঝে জনসংখ্যার আধিক্য ঘটেছে। এই শিশুদের শিক্ষা ও খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে, নইলে সামনে ভয়াবহ দিন। ভুখা, অশিক্ষিত মানুষকে অসহায় মনে করে যারা সম্পদের পাহাড় গড়ছে তারা হৃদয়হীন তাে বটেই, মূঢ়ও। প্রত্যেকটি মানুষের অধিকার আছে খাদ্য ও শিক্ষার। তাদের অধিকার হরণ না করে বরং সম্পদের সুষম বন্টন করতে হবে। বড় রকমের দুর্যোগ ঘটবার আগে তা না করলে পস্তাতে হবে সবাইকে।
১৮৬
তরুণ সমাজের হতাশা ও সেই কারণে হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতা আমাকে ব্যথিত করে। শিক্ষার যে degradation ঘটেছে আজকাল আমাকে তা ভাবিয়ে তােলে। স্কুল-কলেজের ছাত্রদের হাবভাবে মনে হয় বিদ্যা অর্জন যেন তেমন কোনাে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। আবার এর মাঝেই অত্যন্ত ধী-সম্পন্ন উজ্জ্বল তরুণদেরও। চোখে পড়ে। তাই মনে হয় কোথাও একটা গলদ আছে। মেধাসম্পন্ন নতুন প্রজন্মকে আমরা সঠিক পথে, সঠিকভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছি। সময় থাকতে তরুণ ও যুব সমাজের মাঝে সুনীতি ও আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মানুষের জন্য মানুষের ভালবাসাই দেশ ও পৃথিবীকে বাঁচাতে পারবে। হৃদয়বৃত্তিকে না জাগিয়ে যদি কেবল নানা বিষয়ে জ্ঞানদান করা হয় তা মানুষকে স্বার্থপর করে তুলতে পারে। স্বার্থপরতা মানুষের ধ্বংস ডেকে আনে। হৃদয়হীন মানুষ সমাজকে কলুষিত করে তােলে।
সারা জীবন অসংখ্য মানুষের ভালবাসা পেয়েছি, মানুষকে ভালবেসেছি। আমার কাছাকাছি যারা এসেছে—কি আত্মীয়, কি ছাত্র, কি সহকর্মী—সবাইকে বড় আপনজন ভেবে তৃপ্তি পেয়েছি। অবলীলায় তাদের শাসন করেছি। তাদের অনেকের কাছেই হয়তাে রাগী’ লােক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছি। অনেকে আবার আমার কঠোর আবরণের ভেতরের মানুষটিকেও চিনেছে ঠিক। আমি মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসার শক্তিতে বিশ্বাস করি। আমার জন্ম যে দেশটিতে সেটি হয়তাে ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’ নয়, কিন্তু এটুকু যেন সত্য হয় ভাইয়ের মায়ের এত স্নেহ …..’ তাহলেই সত্যি এ দেশটি ভরে উঠবে ‘ধন্য ধান্যে ও পুষ্পে’। তা দেখবার। সুযােগ আমার নাইবা হলাে। আমার স্বপ্নটি যেন সত্য হয়। স্বপ্নটি সত্য হবে এমন বিশ্বাস নিয়েই যেন চলে যেতে পারি ।
১৮৭

PAKISTANI SCHOLARS GIVE SPEECHES
BY JIM WASCHER

The two members of the Bangladesh delegation to the United Nations yesterday pleaded for the help and support of the Stanford community. Speaking at a noon rally in White Plaza, Dr. Azizur Rahman Mallick said that U. S. military assistance to West Pakistan was having a serious effect upon the “continuous battle between the democratic forces of Bangladesh and the despotic forces of West Pakistan.” Present with Mallick at the rally was fellow delegate Dr. Ashabul Haque.
According to Haque, “one million Bengalis have already been slain by an uncivilized and barbaric enemy that does not believe in any human values”. He added that another nine million had been driven into refugee camps where they “are huddled together just waiting to go home” to a free country.
At a press conference immediately preceding the rally, Mallick said, “If the price of freedom has to be paid in blood and life and suffering, I think our people have paid enough. I don’t know of any country that has suffered more.”
Mallick is the Vice Chancellor of Chittagong University, which is the second largest university in Bangladesh and was a member of the Pakistani delegation to Red China in 1969. He now serves as President of the Bangladesh Teachers’ Associaton.
Haque is a member of the Bengali Provincial Assembly and was a founding member of the Awami League. Both have merely lobbied at the United Nations since Bangladesh has not been granted member status.
They hope that their efforts will produce sufficient public pressure to force the Nixon Administration to end all military and economic aid to West Pakistan.
In describing the Bengalis’ struggle with the West Pakistanis, Mallick stated that “the doors were closed on us” and that “we chose to fight for complete independence rather than to suffer in abject slavery.” Mallick said that the
পৃষ্ঠা: ২১৭

Bengalis now face an enemy which “has all the characteristics of a primitive and barbaric horde” which he claims will rape “wives in the view of their husbands, and girls in the view of their parents.”
The rally served as a prelude to today’s noon vigil in White Plaza on behalf of the “Fast Save a People.” Students will be asked to donate a day’s meal money to relief efforts for the nine million Bengali refugees now in India.
The Standard daily
November 3. 1971.
পৃষ্ঠা: ২১৮

PAKISTAN RELIEF CAMPAIGN REACHES CAMPUS
BY JOE SEGURA

Dr. Azizur Rahman Mallick and Dr. Ashabul Haq, in their efforts to garner American financial support for the International Rescue Committee to assist East Pakistan refugees in India, brought their international campaign for funds and understanding of the Pakistan civil war to the campus Thursday afternoon.
Both Mallick and Haq were sharply critical in their remarks about President Richard Nixon Administration’s handling of the military foreign aid to West Paksitan which they viewed as helping a dictator. They stated that it would be difficult for their fellow countrymen approximately 75 million, to understand the official U. S. rule during this period.
But in referring to the general financial support by citizens for the nutritional and medical relief and pressures by politicians in Washington for a change of policy, Mallick stated, “The United States government does not reflect the wishes of its people.”
Both visitors were on the other hand pleased with the defeat of the foreign aid bill in the Senate last Friday for it marked an end of the military aid going to West Pakistan. Some of the senators who voted against the foreign aid measure were reportedly particularly displeased with funds being spent on arms.
Skinned skeletons, bloated stomachs, stares of despair. These are the scenes of East Pakistan refugees who have poured into India which is ill-equipped to handle the crisis in dealing with this now overflowing and suffering population.
The first flood of refugees poured into India following the outburst of civil war in late March, when West Pakistan decided to crush East Pakistan’s drive for Bangladesh, an independent Bengali State. Between one and two million refugees have poured into Indira Gandhi’s India which may soon spell economic and political disaster for her country.
পৃষ্ঠা: ২১৯

From the outset, Paksitan’s history’ beginning in 1947, tensions arose between West and East which is separated by over 1200 miles of Indian territory. Dr. Alexander Lipski, CSLB history professor, explains, “All political, military and economic power was concentrated in the West. While East Pakistan was responsible for 70 percent of all foreign exchange earnings 60 percent of the earnings went to West Pakistan.
“When Sheikh Mujibur Rahman (now imprisoned) made it clear that he would insist on autonomy for East Pakistan, the West Pakistani leaders realized that this would mean the end of the exploitation of East Pakistan. This they were unwilling to tolerate. They consequently decided to annul the results of the (December, 1970) election by brutal force.”
Both Mallick and Haq voiced their government’s determination to compromise only when independence is guaranteed. Lipski commenting on their stand stated, “How long can you hold down 75 million people ?”
Prior to the Pakishtan civil war, Mallick was ViceChancellor of Chittagong University and he has participated actively in developing the educational system of his country and has also been a delegate to UNESCO conferences. Haq is a practicing physician and is presently Chairman of the Bangladesh Red Cross.
Both during their remarks continued to stress the importance of sending the funds to the International Rescue Committee to avoid having any funds channeled into other Pakistan agencies. This would assure, they noted, that the funds would assist the refugees.
The Forty-Niner
Volume 23 Number 23
California College, Long Beach
Friday, November 5, 1971
পৃষ্ঠা: ২২০

PROMINENT REFUGEES WILL DISCUSS PROSPECT OF
INDIAN-PAKISTAN WAR

The prospect of war between India and Pakistan and the refugee problem in India today, will be the subject of a special program presented by the India Association and the A. S. Lectures and Forums Commission.
Dr. Azizur Rahman Mallick and Dr. Ashabul Haq, East Pakistan refugees, will speak at noon in front of the bookstore and at 2.30 p.m. in the multi-media room 200.
Mallick was vice-chancellor of Chittagong University. He has specialized in the field of modern Indian history, serving as a lecturer and then professor of history at several Bengali universities since 1941.
As a member of several commissions and eventually chairman of the Inter-University of Pakistan and the standing committee of vice-chancellors, he has participated actively in developing the educational system of East Pakistan. He has also been a delegate to UNESCO conferences and was a member of the Pakistan delegation for the People’s Republic of China 1969. He is now president of the Bangladesh Teachers’ Association.
Haq has been a practicing physician since 1944, while also being active in Bengali politics. He joined the Awami League as founding member in 1949 and was president of the Kushtia District of the Awami League from 1961-66.
In 1970, he was elected to the Provincial Assembly of East Pakistan. He is presently chairman of the Bangladesh Red Cross.
On March 25, 1971 the armed forces of West Pakistan descended upon the University of Dhaka campus and opened fire on student dormitories. Approximately 500 students were killed.
All eminent professors, journalists, lawyers, and political leaders in the area were executed according to Haq and Mallick.
পৃষ্ঠা: ২২১

It is estimated that at least 40,000 people were killed that first night. By now it is estimated that up to one million people have been killed and nine million have fled to neighboring India.
Mallick and Haq will relate the refugee situation, history of the division of Pakistan as well as a plan for action on the part of the people of the United States.
The appearance of both men was arranged through the International Rescue Committee and the Student Committee for Bengal Refugee Day.
The Froty Niner
November 5. 1971.
পৃষ্ঠা: ২২২

PAKISTANIS WANT END TO AID
By NANCY WARE
Mercury Staff Writer

Two Pakistani leaders visiting K-State today called for a half to U. S. economic aid to Pakistan.
At a time when all U. S. foreign aid is in question, the two leaders said, aid to Pakistan should cease because it is “going to the wrong people.”
Azizur Mallick and Dr. Ashabul Haq, both forced to leave their country last April, claimed U. S. aid is not reaching the needy people in Pakistan because there is no elected government and the “army decides who gets the food.”
The two Pakistanis charged that U. S. aid is so badly administered that they have “seen AID. transports being used by the army in Dacca for their own use.
“Help to India is good”, they said, referring to indications that Indian Prime Minister Indira Gandhi left Washington over the weekend with assurances U. S. aid for Pakistani refugees in India would top $500 million. Aid to India gets to those in need of it, they said.
Mallick and Dr. Haq were forced to leave Pakistan after the West-dominated central government declared newlyelected Eastern representatives traitors and fighting between the two areas broke out.
Dr. Haq is a practicing physician and last year was elected as a member of the Awami League to the East Pakistan Provincial Assembly. Mallick has been active in developing the educational system in Pakistan and is president of the Bangladesh Teachers’ Association.
The men are representatives of the International Rescue Committee sent to the United States to oppose direct aid to Pakistan. They will appear on a public lecture panel at 7:30 tonight in Union Little Theater.
Mallick commented in an interview that “after the recent cyclone in Pakistan, when the countries of the world were
পৃষ্ঠা: ২২৩

giving aid to our country, the Pakistan government did not make an attempt to use the help properly. This is our fear and it is based on past experience.”
“Volunteers should be gathered from all over to distribute the food. This is the only way it will be given to the right people,” Mallick said.
“A package deal will not help the situation,” siad Haq, who explained the problem as twofold. “The first problem is with India and the refugees and the second is the political problem in East and West Pakistan.
“We want liberty and freedom in East Pakistan and West Pakistan is determined to put that part of the globe under military rule denying the seating of elected officials,” Haq, who is one of those elected officials, said.
Mallick said that “what we wanted was a parliamentary form of government, and autonomous form of government for East and West and what we got in return was killing.
The Manllattan Mercury
November 8. 1971.
পৃষ্ঠা: ২২৪

PAKISTAN GETS NO BACKING
HONG KONG—Pakistan apparently has failed in a desperate bid to play off Red China against the Soviet Union in its quarrel with India.
A high level Pakistani politiamilitary delegation headed by former Foreign Minister Zulfikar Ali Bhutto left Peking over the weekend after a three-day surprise visit- apparently without getting the additional military aid it had sought.
Significantly, no communique was issued at the end of the visit, indicating there had been no agreement between the two parties. The Pakistani delegation included three generals, one of them the air force commander.
Instead of more arms, including jet aircraft, the Pakistanis got soothing words. While condemning India for having “crudely interferred” in Pakistan’s internal affairs, China’s Foreign Minister Chi Peng-Fei urged both sides to reduce tensions and withdraw troops from their borders.
The dispute between India and Pakistan should be settled “through consultations and not by resorting to force,” Chi said.
Thus China took roughly the same position as other major powers including the United States and Russia in urging moderation on both countries.
Although Peking has supported Pakistan just as Moscow has backed India, there were several reasons why the Chinese were playing it cool.
To overcommit themselves to Pakistan might provoke the Russians to make hostile moves along the 4,000-mile long SinoSoviet border where both sides have massed troops.
Another reason for Chinese prudence is that warlike talk or behavior would be at odds with China’s newly acquired respectability as a member of the United Nations.
There have been recent hints of a New Delhi and Peking, whose relations have been frozen since the 1962 Himalayan war.
পৃষ্ঠা: ২২৫

Some observers here feel that if war does break out between India and Pakistan it will be because India cannot resist the temptation to invade East Pakistan in support of the secessionist “Bangladesh Republic,” which is demanding independence from West Pakistan.
Much more than foreign aid for an estimated 9 million East Pakistan refugees is involved in the current tours of Western capitals by Indian Prime Minister Indira Gandhi.
What her speeches add up to is support for an independent East Pakistan, or, as the West Pakistanis see it, the dismemberment of their country. Even though there is a strong case to be made for an independent East Pakistan, few countries have shown themselves ready to help India achieve this objective.
Chicago Daily News
পৃষ্ঠা: ২২৬

BANGLADESH UN DELEGATES SPEAK TONIGHT
Two members of the Bangladesh delegation to the United Nations will explain the Pakistan separatist movement tonight
The speakers are Dr. A. R. Mallick, former chairman of the Council of University Presidents in Pakistan, and Dr. Ashabul Haque, chairman of the Bangladesh Red Cross Society.
Phi Alpha Theta, international history honor society, is sponsoring the 7:30 p.m. program in Chemistry Room 100.
Society president Capt. Charles Brisce said both men have been leader in the educational development of Pakistan.
The Bangladesh movement is an attempt by East Pakistan to become a separate country from West Pakistan.
Dr. Mallick has the Ph.D. in moden history from the University of London. He has been a history professor at Dhaka University, visiting professor at the University of Pennsylvania and president of Chittagong University until March 25, 1971.
He is the Author of many publications in Southeast Asia history.
Dr. Haque is a medical doctor and founding member of the Awami League, the provincial assembly. .
Both men will arrive at 2:30 p.m. Tuesday. A questionanswer session follows the lecture.
UNITED STATES
Nov. 9, 1971
পৃষ্ঠা: ২২৭

PAKISTANIS DIVIDED BY BATTLES, POLITICS
Pakistan is a country plagued by political division, exploitation and war, Azizur Mallick, member of the Pakistani delegation to the People’s Republic of China and President of the Bengladesh (East Pakistan) Teachers’ Association said Monday night
Mallick spoke at a meeting sponsored by the Union News and Views cornmittee and a Southeast Asia Civilization class in the Union Little Theatre.
Mallick and his colleague Ashabul Haq (founding member of Awami League, the major political party of East Pakistan and a member to the Provincial Assembly of East Pakistan in the 1970 elections) said, East Pakistan is the victim of increasing discrimination by West Pakistan.
EAST PAKISTAN, which has changed its name to Bangladesh, has tried to sustain democracy, Mallick said.
From 1962-1969, Pakistan had a constitutional government called the Basic Democracy System. By 1969, enough opposition had developed to this system that martial law was established and General Yahya Khan was proclaimed president, Mallick said.
Yahya promised the people general elections which were held in December of 1970. However, the people elected to the assembly to write a new constitution for Pakistan never were called, Mallick said.
On March 25, the Pakistan National Army, composed primarily of West Pakistanis, and apparently under the orders of General Yahya, attacked the East Pakistanis, Mallick said.
Artillery, rifles and tanks were a position as slaves to the West Pakistanis or striving for freedom,” Mallick said.
A controversial and sometimes heated question and answer period followed the speech by Mallick with Haq answering most of the questions.
“The United States is always charging around like the Great White Knight to rescue the poor defenseless countries for
পৃষ্ঠা: ২২৮

the sake of democracy but look what has happened in Korea and Vietnam,” one American student said, “I think it would be better for us to stay out of this one,” he added.
Haq quietly shook his head and answered, “I agree.”
When asked about Sheikh Mujibur Rahman-major Bengali leader undergoing secret military trial in West Pakistan for treason— Haq said as he knew, Mujib was still alive in West Pakistan.
পৃষ্ঠা: ২২৯

বাজেট বক্তৃতা
২৩ জুন ১৯৭৫

জনাব স্পীকার,
আমি জাতীয় সংসদের সামনে ১৯৭৫-৭৬ সালের বাজেট পেশ করিতেছি। ইহার সহিত আমি জাতীয় সংসদের অবগতি ও অনুমােদনের জন্য ১৯৭৪-৭৫ সালের সম্পূরক আর্থিক বিবৃতি বা সংশােধিত বাজেটও পেশ করিতেছি। বঙ্গবন্ধু বিঘােষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের শুভলগ্নে এই কর্তব্য পালন করিতে পারিয়া আমি অত্যন্ত আনন্দ ও গৌরব অনুভব করিতেছি। আমি আশা করি যে, আগামী বৎসরের বাজেটে নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হইবে।
২। বাজেট সম্পর্কে আলােচনার পূর্বে আমি জাতীয় অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি এবং বিগত এক বৎসরে জাতি যে সকল জটিল অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হইয়াছে এবং তাহা সমাধানার্থে যে সকল গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হইয়াছে সেই সম্পর্কে সংসদকে সংক্ষেপে অবহিত করিতে চাই।
৩। চলতি বৎসর ছিল আমাদের জাতীয় জীবনের একটি কঠিন পরীক্ষার সময়। বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য আমদানী পণ্যের উচ্চমূল্য এবং আমাদের কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানী বাণিজ্যের প্রতিকূল শর্ত ইত্যাদি কারণে গত অর্থ বৎসরের শেষদিকে, দেশ এক সংকটজনক বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। রপ্তানী বাণিজ্যের প্রতিকূল পরিবেশ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে, চলতি বৎসরের গােড়ার দিকে এই পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে এবং অত্যাবশ্যক কাঁচামাল, যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় পণ্যদ্রব্যের আমদানী অত্যন্ত সীমিত করিতে হয়। ফলে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যাহত হয়।
৪। জাতীয় জীবনের এই বিপর্যয়ের মুহূর্তে দেশ এক ধ্বংসাত্মক বন্যার কবলে পতিত হয়। এই বন্যায় দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জলমগ্ন হয়, তিন কোটি লােক প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রায় ২.৯৭ কোটি মণ খাদ্যশস্য ও প্রায় ৩ লক্ষ বেল পাট বিনষ্ট হয়। এই বন্যার ফলে খাদ্যশস্যের ঘাটতি বৃদ্ধি পায় এবং দেশে। এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের ছায়াপাত হয়। সরকার এই পরিস্থিতির মােকাবেলা করিবার। জন্য খয়রাতি নগদ অর্থ সাহায্য, গৃহনির্মাণ মঞ্জুরী ও অন্যান্য খাতে প্রায় ৬.৪৭ কোটি টাকা বিতরণ করেন। ইহা ছাড়াও বিপুল পরিমাণ খাদ্য ও বস্ত্র সামগ্রী। বিতরণ করা হয়। দুর্ভিক্ষের হাত হইতে দেশবাসীকে রক্ষা করিবার জন্য সরকার জরুরী ভিত্তিতে প্রতিটি ইউনিয়নে এক বা একাধিক লংগরখানা খুলিয়া মােট ৫,৮৬২টি লংগরখানার মাধ্যমে দৈনিক গড়ে প্রায় ৪৫ লক্ষ লােকের আহারের বন্দোবস্ত করেন। জনগণ ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহও এই সময় দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের সাহায্যে সর্বতােভাবে সাড়া দেয়। সরকারের সর্বাত্মক তৎপরতা ও
পৃষ্ঠা: ২৪০

জনগণের সহায়তায় দেশ যদিও ব্যাপক দুর্ভিক্ষের হাত হইতে রক্ষা পায়, তবুও কয়েক সহস্র লােককে মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা করা সম্ভব হয় নাই। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও বন্ধু রাষ্ট্র, যাহারা এই দুর্দিনে আমাদের সাহায্যের জন্য আগাইয়া আসিয়াছিলেন, আমি সরকারের পক্ষ হইতে তাহাদিগকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। বন্যার পানি নামিয়া যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণের দুর্দশা লাঘব করিবার জন্য জরুরী কৃষিভিত্তিক পরীক্ষামূলক সাহায্য প্রকল্পের অধীনে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সরকার ব্যাপক সাহায্য প্রদান করেন। ইহা ছাড়া “কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্পের অধীনে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর অধীনস্থ সাহায্যসহ ১১.২২ লক্ষ মণ গম বরাদ্দ করা হয়।
৫। দেশ যখন এইরূপ বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন তখন দেশের বৃহত্তম। ঘােড়াশাল সার কারখানায় এক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটে, যাহার ফলে ইহার উৎপাদন বিঘ্নিত হয় এবং সার বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হয়। ঘােড়াশাল সার কারখানার প্রয়ােজনীয় মেরামত ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হইয়াছে এবং উৎপাদন পুনরায় শুরু হইয়াছে।| ৬। বন্যার ভয়াবহতা ও তাহার ফলে কৃষিক্ষেত্রে যে ক্ষতি হয় সেই সম্পর্কে আমি আগেই বলিয়াছি। এই ক্ষতি পূরণের জন্য সরকার বিভিন্ন জরুরী কার্যক্রম গ্রহণ করেন। ইহা অতীব আনন্দের বিষয় যে আমাদের এই কার্যক্রম কৃষক ভাইদের সহযােগিতা ও তৎপরতায় সাফল্য লাভ করে। এই সর্বাত্মক সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে দেশে যে মারাত্মক উৎপাদন ঘাটতির আশংকা করা গিয়াছিল তাহা এড়ানাে সম্ভব হয়। আমদানীর স্বল্পতাহেতু প্রয়ােজনীয় পরিমাণ কৃষি উপকরণ সরবরাহ করা সম্ভব হয় নাই; তবুও খাদ্যশস্য উৎপাদনের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী উৎপাদন গত বৎসরের তুলনায় বিশেষ কম হইবে না।
৭। কৃষির অন্যান্য ক্ষেত্রে, যেমন চা, ইক্ষু, আলু, তামাক ও শাকসবৃজি ইত্যাদির উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। এই বৎসরে চায়ের উৎপাদন দাঁড়ায় ৭১০ লক্ষ পাউন্ডে, ১৯৭২-৭৩ ও ১৯৭৩-৭৪ সালে এই উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ৫৩২ লক্ষ পাউন্ড ও ৬০৭ লক্ষ পাউন্ড। ইক্ষুর উৎপাদন ১৯৭২-৭৩ ও ১৯৭৩-৭৪ সালে ছিল যথাক্রমে ১৪.৩১ কোটি মণ ও ১৭.০১ কোটি মণ। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী এই বৎসর ইহার উৎপাদন প্রায় ১৭.৮২ কোটি মণ। ইহা হইতে প্রতীয়মান হয় যে সরকারের বিশেষ প্রচেষ্টা ও কৃষক সমাজের সহযােগিতার ফলে বিভিন্ন বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও কৃষি উৎপাদন বিশেষ হ্রাস পায় নাই। এই জন্য জনসাধারণ, বিশেষ করিয়া কৃষক সমাজকে আমি ধন্যবাদ জানাই।
৮। খাদ্যশস্যের তুলনায় পাটে মুনাফা কমিয়া যাওয়াতে পাট উৎপাদন এই বৎসর অপেক্ষাকৃত হ্রাস পায়। গত বৎসর পাটের নিম্নতম মূল্য ৬০ টাকায় ধার্য করা হইয়াছিল। পরবর্তী পর্যায়ে ইহার বাজার দর অনেক বৃদ্ধি পায়। কিন্তু কিছু সংখ্যক আড়তদার ও ফড়িয়া প্রভৃতি মধ্যস্বত্বভােগী অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃষকের। নিকট হইতে নিম্নতম মূল্যে খরিদ করিয়া বাজারে চড়া মূল্যে বিক্রয় করিয়া অধিক
পৃষ্ঠা: ২৪১

মুনাফা লাভ করে। ফলে কৃষক তাহার ন্যায্য পাওনা হইতে বঞ্চিত হয়। কৃষক যাহাতে বাজারে দাম পায়, সেইজন্য সরকার আগামী মৌসুমের জন্য পাটের কোন নিম্নতম মূল্য ধার্য করেন নাই। তাহা ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় ও সীমান্ত এলাকায় পাট ক্রয়-বিক্রয়ের সুবিধার জন্য সরকার প্রয়ােজনীয় সংখ্যক ক্রয়-কেন্দ্র খুলিয়াছেন। পাটের চোরাচালান রােধ করিবার জন্য সীমান্ত প্রহরাও জোরদার করা হইয়াছে।
৯। বিশ্ববাজারে মন্দাভাব ও কৃত্রিম আঁশের প্রতিযােগিতার ফলে পাট রপ্তানী এই বৎসর হ্রাস পায়। অভ্যন্তরীণ বাজারদর ও রপ্তানী মূল্যের বিশেষ পার্থক্যের। ফলে পাট শিল্প সংস্থা ও পাট সংস্থাসমূহ বিরাট লােকসানের সম্মুখীন হয় এবং এই ক্ষতিপূরণ মিটাইবার জন্য সরকারকে ভর্তুকি ও সহজ শর্তে মােটা অংকের ঋণ প্রদান করিতে হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, স্বাধীনতার পূর্বে পাট শিল্পকে বােনাস-ভাউচারের মাধ্যমে পরােক্ষভাবে এই ভর্তুকি প্রদান করা হইত।
১০। টাকার বৈদেশিক মান পুনঃনির্ধারণ, এই বৎসরের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ প্রচেষ্টা। আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের প্রতিযােগিতা শক্তিবৃদ্ধি, পাট রপ্তানীর প্রসার, অভ্যন্তরীণ বাজারে পাটের যুক্তিসঙ্গত মূল্য নিশ্চিতকরণ ও টাকার বাস্তব মূল্য নির্ধারণকল্পে সরকার এই বৎসরের ১৭ই । মে টাকার বৈদেশিক মান পুনঃনির্ধারণ করেন। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি বৃটিশ পাউন্ডের মূল্য ১৮.৯৭ টাকার স্থলে ৩০ টাকায় নির্ধারণ করা হয়। আমার ঐকান্তিক বিশ্বাস যে, এই ব্যবস্থা রপ্তানী বাণিজ্যের প্রসার ও পাট চাষ ও পাট শিল্পের পুনর্বাসনের পথে একটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ। টাকার এই নতুন বিনিময় হার হেতু পাট শিল্প উদ্ভূত এবং কাঁটা পাট ব্যবসাজনিত যে অতিরিক্ত আয় সঞ্জাত হইবে তাহার উপর যথাযথ কর আরােপ করা হইবে। এই আদায়কৃত অর্থকে পাট বিষয়ক ব্যাপারে নিয়ােজিত করিবার উদ্দেশ্যে“পাট তহবিল” নামক এক নূতন তহবিলের সৃষ্টি করা হইবে।
১১। মুদ্রার মান পুনঃনির্ধারণের ফলে বহিরাগত আয় বৃদ্ধি পাবে বলিয়া আশা করা যাইতেছে। ফলে অধিকতর কাঁচামাল, খুচরা যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য দ্রব্যের আমদানী স্বভাবতই বৃদ্ধি পাইবে। ইহা ছাড়াও সরকার এই বৎসর, কল-কারখানার পূর্ণ উৎপাদনক্ষমতা সদ্ব্যবহারের জন্য পূর্ণমাত্রায় কাঁচামাল, ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ ইত্যাদি আমদানী করিবার জন্য প্রয়ােজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করিতে পারিবেন বলিয়া আশা করা যাইতেছে। ফলশ্রুতি হিসাবে একদিকে যেমন আমাদের শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি পাইবে অন্যদিকে তেমনি আমদানী-রপ্তানী শুল্ক, আবগারী শুল্ক প্রভৃতি খাতে রাজস্ব আয়ের পরিমাণও বাড়িয়া যাইবে এবং ঘাটতি অর্থসংস্থানের প্রয়ােজন হইবে না। প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধি এবং বন্টন ব্যবস্থার উন্নতির ফলে এই মুদ্রামানের পুনঃনির্ধারণ, জনসাধারণের অত্যাবশ্যক ভােগ্যপণ্যের মূল্যের উপর বিশেষ কোন প্রভাব বিস্তার করিবে না।
পৃষ্ঠা: ২৪২

১২। আমি আগেই বলিয়াছি যে, এই বৎসর বৈদেশিক মুদ্রার অপ্রতুলতার জন্য প্রয়ােজনানুসারে শিল্পের কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানী করা সম্ভব হয় নাই। ইহা সত্ত্বেও সুতা ও বস্ত্র, চিনি, নিউজপ্রিন্ট, সিমেন্ট প্রভৃতির উৎপাদন গত বৎসরের তুলনায় উল্লেখযােগ্যভাবে বৃদ্ধি পাইয়াছে। লবণ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এই উৎপাদন মৌসুমের একটি উল্লেখযােগ্য সাফল্য। গত বৎসর লবণের মােট উৎপাদন ছিল ৪৫ লক্ষ মণ, এই বৎসর সেই স্থলে ইহার উৎপাদন দাঁড়ায় ২০৪ লক্ষ মণ। এই বৎসর, প্রথম নয় মাসে বস্ত্রশিল্প সংস্থার অধীনে ৬.৩৩ কোটি গজ কাপড় এবং ৭.৩৩ কোটি পাউণ্ড সুতা তৈয়ারী হয়, গত বৎসর একই সময়ে উপরিউক্ত উৎপাদনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫.৫৯ কোটি গজ এবং ৭.১০ কোটি পাউন্ড; অর্থাৎ কাপড়ের উৎপাদন শতকরা ১৩ ভাগ ও সুতার উৎপাদন শতকরা ৩ ভাগ বৃদ্ধি পায়। গত বৎসর চিনি উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৪ লক্ষ মণ, এই বৎসর এই উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ২৬.৫ লক্ষ মণে উন্নীত হয়; বৃদ্ধির হার শতকরা ১২ ভাগ। এই বৎসর প্রথম ৯ মাসে নিউজপ্রিন্ট ও যান্ত্রিক মুদ্রণ কাগজের (মেকানিক্যাল প্রিন্টিং পেপার) উৎপাদন ২৩,০৩৯ টন, গত বৎসর একই সময়ে ইহার উৎপাদন ছিল ১৯,১১০ টন; উৎপাদন বৃদ্ধির হার শতকরা ২০ ভাগ। ইহা ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ক্ষেত্রে কিছু সংখ্যক দ্রব্যের উৎপাদন উল্লেখযােগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়— যেমন মেশিন টুল, চট তৈয়ারীর তাঁত, ডিজেল ইঞ্জিন, সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প, ফাইব্রিফেক্স সামগ্রী, সােডিয়াম সিলিকেট, টিউব লাইট, কাষ্ঠ আহরণ ইত্যাদি। সিমেন্ট এবং পেট্রোলজাত পদার্থ গত বৎসরের চাইতে প্রায় দেড়গুণ বৃদ্ধি পায়। বাইসাইকেল ও ইলেকট্রিক কেবলস্ যথাক্রমে শতকরা ৪৬ ভাগ ও ২৬ ভাগ। বৃদ্ধি পায়। প্রয়ােজনীয় কাঁচামালের অভাবে ভােজ্যতৈল, ঔষধ-পত্র, সিগারেট, চামড়া, জুতা, বৈদ্যুতিক পাখা, কস্টিক সােডা ও স্টীল ইনগটস প্রভৃতি উৎপাদন সামগ্রিক হিসাবে হ্রাস পায়। পাট রপ্তানীর শ্লথগতির পরিপ্রেক্ষিতে সাময়িকভাবে ব্রডলুম বন্ধ করিলেও তুলনামূলকভাবে এই বৎসর পাট শিল্পের উৎপাদন বিশেষ হ্রাস পায় নাই। গত বৎসরের তুলনায় প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী ক্ষুদ্র শিল্পের উৎপাদন হ্রাস পায় নাই।
১৩। এই অর্থ বৎসরের দ্বিতীয়ার্ধে শাসনতন্ত্রের পরিবর্তন ও বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের নবলব্ধ চেতনার ফলে, আইন-শৃঙ্খলা, প্রশাসন ও উৎপাদন নৈপূণ্যে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। শ্রমিক ও উৎপাদন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যাহাদের সহযােগিতা ও সমবেত প্রচেষ্টার ফলে নানাবিধ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এই বৎসর শিল্পোৎপাদনের আশংকাজনক ঘাটতি নিরােধ করা সম্ভব হইয়াছে, তাহারা প্রশংসার যােগ্য।
১৪। পুঁজি বিনিয়ােগে বেসরকারী উদ্যোক্তাদিগকে যথাযথ ভূমিকা পালনে। উদ্বুদ্ধ করিবার জন্য এবং বৈদেশিক পুঁজি বিনিয়ােগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিকল্পে, সরকার চলতি অর্থ বৎসরের শুরুতে বেসরকারী পুঁজি বিনিয়ােগের উধ্বসীমা ২৫ লক্ষ হইতে ৩ কোটি টাকায় উন্নীত করতে এবং বেসরকারী খাতেও বৈদেশিক
পৃষ্ঠা: ২৪৩

পুঁজি বিনিয়ােগের সুযােগ প্রদান করেন। নতুন নীতির অধীনে বেসরকারী খাতে, কয়েকটি নতুন শিল্প গড়িয়া তােলার অনুমতি দেওয়া হইয়াছে। আশা করা যাইতেছে যে, দেশের সংহতি ও শৃঙ্খলার উত্তরােত্তর উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারী পুঁজি বিনিয়ােগ আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌছাইবে। তাহা ছাড়া সরকারী নীতি অনুযায়ী ৭১৫টি পরিত্যক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এই পর্যন্ত ১৩৩টি মালিকদের ফিরাইয়া দেওয়া হয়, ৮২টি ব্যক্তি মালিকানায় ও ৫১টি কর্মচারী সমবায়ের নিকট বিক্রয় করা হয় এবং ২১০টি বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে হস্তান্তর করা হয়।
১৫। আমি আগেই বলিয়াছি যে, ১৯৭৩-৭৪ সালের শেষদিকে, বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতিতে সংকট দেখা দেয়। চলতি বৎসরের প্রথমার্ধে বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দাভাব ও রপ্তানী বাণিজ্যের প্রতিকূল পরিস্থিতির দরুন এই সংকট আরও বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৩-৭৪ সালে রপ্তানী আয় ছিল ২৭৬.৯১ কোটি টাকা। বর্তমান বৎসরে এই রপ্তানী আয়ের পরিমাণ ধরা হইয়াছিল ৩৪৮ কোটি টাকা। গত বৎসরের তুলনায় এই বৎসরের রপ্তানী আয় বৃদ্ধি পাইলেও প্রধানত পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানীর শ্লথগতির ফলে, এই বৎসরের নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় পৌছান সম্ভব হইবে না। কিন্তু আমাদের আমদানী চাহিদা বাড়িয়া গিয়াছে। বৈদেশিক সাহায্য ও প্রবাসী বাঙ্গালীদের উপার্জন স্কীমের অধীনে আমদানী আমাদের এই সংকটময় বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতির মােকাবেলা করিতে সাহায্য করিয়াছে।
১৬। গত কয়েক বৎসরের মত এই বৎসরও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রধান কারণ ছিল আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে ঘাটতি, মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবসা ও বিতরণ ব্যবস্থায়। অনিয়ম। এই কারণগুলির সঙ্গে এই বৎসরে বন্যাজনিত খাদ্যাভাবও যুক্ত হইয়াছে। ইহা অবশ্য আশাপ্রদ যে এই বৎসরের দ্বিতীয়ার্ধে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার প্রথমার্ধের তুলনায় হ্রাস পায়। এই বৎসরে মুদ্রা সরবরাহ কিছুটা কমিয়াছে, জুন মাসের প্রথমদিকে ইহার পরিমাণ দাঁড়াইয়াছে ৮০২.৭১ কোটি টাকায়। গত বৎসর জুন। মাসে ইহার পরিমাণ ছিল ৮১৬.৭৮ কোটি টাকা। আশা করা যায় যে, সরকার কর্তৃক সম্প্রতি গৃহীত কয়েকটি জোরালাে পদক্ষেপ যাহার মধ্যে ১০০ টাকার নােট বাতিল, বস্ত্র ও সুতার অবাধ বন্টন, নির্মাণ সামগ্রীর সুষ্ঠু বিতরণ ব্যবস্থা, দ্রব্যমূল্য। স্থিতিকরণের প্রতি সরকারের সজাগ দৃষ্টি ও আগামী বৎসরে উৎপাদন মাত্রা বৃদ্ধির সম্ভাবনা, ইত্যাদি আগামী বৎসর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে রােধ করিতে সমর্থ হইবে।
১৭। মুদ্রাস্ফীতির চাপ প্রশমিত করা ও অর্থনীতিতে কালাে ও বাড়তি টাকার অশুভ প্রভাব দূর করিবার জন্য সরকার বিগত ৬ই এপ্রিল ১০০ টাকার নােট অচল বলিয়া ঘােষণা করেন। জনগণ তাঁহাদের সাময়িক অসুবিধা সত্ত্বেও, সরকারের এই প্রচেষ্টার সাফল্যের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে সাড়া দিয়াছেন, তাহার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। জনগণের এই সহযােগিতার ফলে চোরাকারবারী ও কালােবাজারী বহু লােকের অসদুপায়ে অর্জিত টাকা আটকা পড়িয়াছে। সরকার অবগত আছেন যে,
পৃষ্ঠা: ২৪৪

এই টাকা বাতিল ঘােষণার ফলে কিছু কিছু সৎ ও নিরীহ জনসাধারণ অসুবিধার। সম্মুখীন হইয়াছেন। কিন্তু জাতির বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে সরকারের এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। জনসাধারণের সুবিধার জন্য সরকার ৮০০ টাকা পর্যন্ত জমাদানকারীকে আংশিক নগদ ও অবশিষ্ট পাঁচ হইতে সাত বৎসর মেয়াদী শতকরা বার্ষিক ৮ ভাগ সুদসহ ঋণপত্রের মাধ্যমে পরিশােধ করিবার কার্যক্রম ঘােষণা করিয়াছেন। অবশ্য পরবর্তী পর্যায়ে অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এই ঋণের মেয়াদ উত্তীর্ণ হইবার পূর্বেও পরিশােধ করিবার বিষয় পুনর্বিবেচনা করিতে পারেন। সরকারের এই সুচিন্তিত ব্যবস্থার ফলে মুদ্রা সরবরাহ হ্রাস পাইয়াছে ও জিনিসপত্রের মূল্যের উপর ইহার কিছুটা শুভ প্রভাব পরিলক্ষিত হইতেছে।
১৮। সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করিয়া তােলার জন্য ও উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ১৯৭৩-৭৪ সাল পর্যন্ত কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে উদার ঋণনীতি অনুসরণ করিয়া আসিয়াছেন। কিন্তু শিল্প ও কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন আশানুরূপ বৃদ্ধি পায় নাই। অপরপক্ষে দুর্ভাগ্যবশত কোন কোন ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজ, মধ্যস্বত্বভােগী মজুতদার, কালােবাজারী এই সুযােগের অপব্যবহার করিয়াছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ঋণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরও জোরদার করিয়াছেন। অবশ্য এই ঋণ-সংকোচ যাহাতে উৎপাদন ব্যাহত না করে তাহার প্রতি যথারীতি লক্ষ্য রাখা হইয়াছে।
১৯। ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারী জাতীয় জীবনের একটি অবিস্মরণীয়। দিন। এই দিনে রাষ্ট্রীয় সংবিধানের ৪র্থ সংশােধনীর মাধ্যমে জাতির রাষ্ট্রীয় জীবনে। এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়। এই পরিবর্তনের প্রধান উদ্দেশ্য সমাজের দুর্নীতি অপসারণ, ক্ষেতে-খামারে, কল-কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও জাতীয় সংহতি দৃঢ়বদ্ধ করা এবং সেই জন্য প্রয়ােজনীয় প্রশাসনিক পরিবর্তন সাধন। সর্বক্ষেত্রে, সর্বস্তরের জনসাধারণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তি ও সুশৃঙ্খল শােষণমুক্ত সমাজ গড়িয়া তুলিবার প্রয়াসেই এই সংবিধানের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন অপরিহার্য হইয়া উঠিয়াছিল।
২০। কৃষক-শ্রমিকসহ সকল মেহনতী মানুষের সমন্বয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা আমাদের জাতীয় জীবনের আর একটি তাৎপর্যময় ঘটনা। এই বৎসর ঐতিহাসিক ৭ই জুনে রাষ্ট্রপতি এই জাতীয় দলের গঠনতন্ত্র ঘােষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই দ্বিতীয় বিপ্লবের আহ্বানে দেশ গড়ার ডাকে, জাতীয় জীবনে যে অভূতপূর্ব চাঞ্চল্যের সাড়া পড়িয়াছে, তাহাতে আমি বিশ্বাস করি যে, জাতীয় জীবনে যে জড়তা, যে পঙ্কিলতা দেখা দিয়াছিল তাহা আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মশুদ্ধির চেতনাঘাতে অদূর ভবিষ্যতে দূরীভূত হইবে এবং জাতি এক উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের লক্ষ্যে দ্রুত অগ্রসর হইতে সক্ষম হইবে, যেমন করিয়া। তাহারা স্বাধীনতার সংগ্রামে অগ্রসর হইয়াছিল।
পৃষ্ঠা: ২৪৫

২১। অর্থনৈতিক উন্নয়নের যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি ও প্রশাসনিক নৈপূণ্য বৃদ্ধির জন্য প্রয়ােজনমত পুনর্গঠনেও সরকার এ বছর বেশ কয়েকটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়াছেন। শাসন পদ্ধতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সরকার জেলা প্রশাসনের পুনর্বিন্যাস ও প্রশাসনের মৌল সংগঠনের পরিবর্তন করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিটি মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হবে ও নতুন জেলাসমূহের প্রশাসনভার উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রশাসনিক কাউন্সিলের উপর ন্যস্ত করা হইবে। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম অধিবেশনে এই নূতন প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিশদ রূপরেখা প্রদান করিয়াছেন।
২২। ১৯৭৫-৭৬ অর্থ বৎসরের বাজেট আলােচনা করিবার পূর্বে সংসদকে আমি ১৯৭৪-৭৫ সালের সংশােধিত বাজেট সম্পর্কে অবহিত করিতে চাই। ১৯৭৪-৭৫ সালের মূল রাজস্ব বাজেটে অভ্যন্তরীণ প্রাপ্তি ধরা হইয়াছিল ৫৫৯.৩৭ কোটি টাকা। অনুন্নয়নমূলক রাজস্ব খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৪৭০.২৩ কোটি টাকা। ইহার ফলে অনুন্নয়নমূলক রাজস্ব বাজেটে উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়াইয়াছিল ৮৯.১৪ কোটি টাকা। চলতি বৎসরের সংশােধিত রাজস্ব বাজেটে আয় ধরা হইয়াছে ৫৯৫.৫০ কোটি টাকা, ব্যয় ধরা হইয়াছে ৫৩১.১৩ কোটি টাকা, যাহার। ফলে অনুন্নয়নমূলক রাজস্ব বাজেটে উদ্বৃত্ত দাঁড়ায় ৬৪.৩৭ কোটি টাকা।
২৩। এইক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় যে, সংশােধিত বাজেটে বিক্রয় কর, আয় কর, কর্পোরেশন কর, এবং স্ট্যাম্প, বন, রেজিস্ট্রিকরণ খাতে প্রাপ্তি উল্লেখযােগ্যভাবে বৃদ্ধি পাইয়াছে। রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধির প্রধান প্রধান কারণ হইতেছে খাদ্যে ভর্তুকি পাট শিল্প সংস্থা ও চা বাের্ডকে ভর্তুকি প্রদান বন্যাকবলিত এলাকায় খয়রাতি সাহায্য ও টেস্ট রিলিফ খাতে অধিকতর বরাদ্দ ও রেলওয়ের ব্যয় বৃদ্ধি।
২৪। ১৯৭৪-৭৫ সালের মূল বাজেটে অনুন্নয়নমূলক রাজস্ব খাতের বাহিরে বৈদেশিক ঋণ ও মঞ্জুরীসহ নীট প্রাপ্তি ছিল ৪৫৭.৯৭ কোটি টাকা। ইহার তুলনায় সংশােধিত বাজেটে এই নীট প্রাপ্তি দাঁড়াইয়াছে ৪৪২.০১ কোটি টাকা। নীট প্রাপ্তি হ্রাসের বিবিধ কারণের মধ্যে পাট বাণিজ্য সংস্থাসমূহ এবং পাট শিল্প সংস্থাকে মােটা অংকের ঋণদান এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্থ প্রতিষ্ঠানে মূলধন বিনিয়ােগ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। সংশােধিত বাজেটে অনুন্নয়নমূলক রাজস্ব খাতের উদ্বৃত্ত ৬৪.৩৭ কোটি টাকা এবং অনুন্নয়নমূলক রাজস্ব খাতের বাহিরে নীট প্রাপ্তি ৪৪২.০১ কোটি টাকা মিলাইয়া, উন্নয়নমূলক কর্মসূচীর খরচের জন্য মােট অংক দাঁড়ায় ৫০৬.৩৮ কোটি টাকা। মূল বাজেটে বার্ষিক উন্নয়নমূলক কর্মসূচীর মােট বরাদ্দ ছিল ৫২৫ কোটি টাকা, সংশােধিত বাজেটেও মােট বরাদ্দের পরিমাণ একই। ৫০৬.৩৮ কোটি টাকার মােট অংকের তুলনায় উন্নয়ন কর্মসূচীর প্রয়ােজনীয় ব্যয় ১৮.৬২ কোটি টাকা বেশি। এই ১৮.৬২ কোটি টাকা ১৯৭৪-৭৫ সালের সংশােধিত বাজেটের সামগ্রিক ঘাটতি। ঘাটতি অর্থ সংস্থান মারফত এই ব্যবধান পূরণ করা হইবে।
২৫। ১৯৭৪-৭৫ সালের সংশােধিত উন্নয়ন কার্যক্রমে কৃষি ও গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান খাতে মােট ৯২.৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হইয়াছে। সমগ্র উন্নয়ন
পৃষ্ঠা: ২৪৬

বাজেটের ইহা ১৭.৬ ভাগ। বন্যা ও ঘােড়াশাল সার কারখানায় দুর্ঘটনার ফলে ঈপ্সিত পরিমাণ সার সংগ্রহ ও বিতরণ করা সম্ভব হয় নাই। সংশােধিত পর্যায়ে ৮৭ লক্ষ ৭৫ হাজার মণের স্থলে ১৯৭৫ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত বিতরণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৭ লক্ষ ৭৮ হাজার মণ। সেচ কাজের জন্য প্রয়ােজনীয় পাম্প ও নলকূপ খননের ক্ষেত্রে মার্চ মাস পর্যন্ত ৪০,০০০টি সেচ পাম্পের স্থলে ৩৪,৬৫৮টি, গভীর নলকূপ ২,৭০০টির স্থলে ১,৮২২টি ও অগভীর নলকূপ ২,০০০টির স্থলে ৩০০টি বসান হয়। সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচীর অধীনে এই বৎসর ১০টি থানাসহ বর্তমানে দেশের ১৬২টি থানা এই কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছে।
২৬। চলতি বৎসরে শিল্প খাতে মূল উন্নয়ন বাজেটে ৭১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হইয়াছিল, সংশােধিত বাজেটে ইহার বরাদ্দের পরিমাণ ৬৫ কোটি টাকায় নামিয়া আসে। এই বৎসরে চট্টগ্রামের টি. এস. পি. কারখানা এবং যশােহরের রাজ টেক্সটাইল মিলের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হইয়াছে। সিলেট মন্ড কারখানা এবং সাভার ও গােয়ালন্দে দুইটি সূতী কলের নির্মাণ কাজ এই বৎসরে সম্পন্ন ও চালু হইবে। রাজশাহী, দিনাজপুর, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও বরিশালে সূতী কলের নির্মাণ কাজের প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হইয়াছে। বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং অন্যান্য ৫টি দেশের আর্থিক সহায়তায় এদেশের বৃহত্তম কারখানা, আশুগঞ্জ সার ও রসায়ন কারখানার জমি উন্নয়নের কাজ দ্রুত অগ্রসর হইতেছে। বাংলাদেশ সার, রসায়ন ও ভেষজ শিল্প সংস্থা ও সুইজারল্যান্ডের সিবা গেইগীর সহযােগিতায় চট্টগ্রামে একটি কীটনাশক ঔষধ তৈয়ারীর কারখানা স্থাপনের কাজও চলিতেছে।
২৭। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এই বৎসর উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি সাধিত হইয়াছে। গত ১৮ই এপ্রিল আমাদের প্রতিবেশি ও বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সংগে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে গঙ্গার পানি বন্টন সমস্যার সমাধানের সূচনা হয়। এই বৎসর সংশােধিত উন্নয়ন কার্যক্রমে বন্যানিয়ন্ত্রণ ও পানি উন্নয়ন খাতে মূল বাজেটে বরাদ্দকৃত ৮০ কোটি টাকার স্থলে ইহার পরিমাণ বাড়াইয়া ৮৬ কোটি টাকা করা হয়। এই বৎসরের সমগ্র উন্নয়ন কার্যক্রমের ইহা হইতেছে শতকরা ১৬.৩ ভাগ। এই বৎসরের কার্যক্রমের অধীনে গৃহীত প্রকল্পসমূহের মধ্যে উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্প– ১ম পর্যায়, গঙ্গা কপােতাক্ষ, ২য় পর্যায়, চাঁদপুর সেচ প্রকল্প— পাবনা প্রকল্প, কুড়িগ্রাম বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প, কর্ণফুলি সেচ প্রকল্প, নােয়াখালী জেলার সদর মহকুমায় বহুমুখী জল নিষ্কাশন প্রকল্প বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এতদ্ব্যতীত চাঁদপুর, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ ও ঢাকা শহরসহ মােট ২৩টি শহর রক্ষা প্রকল্পের জন্যও বর্তমান বৎসরে কার্যক্রম গ্রহণ করা হইয়াছে।“কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর অধীনে কুড়িগ্রাম ব্রহ্মপুত্র নদীর পশ্চিম পাড়ে ৫ মাইল এবং মহেশখালী দ্বীপে ৩ মাইল বন্যা নিরােধ বাঁধের কাজ সম্পন্ন হইয়াছে। ইহা ছাড়া বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর অধীনে বর্তমান বৎসরে প্রায় ১০০ মাইল বাঁধ নির্মাণ এবং খাল খনন কার্য সম্পন্ন করা হইবে।
২৮। বিদ্যুৎ খাতে সংশােধিত উন্নয়ন কার্যক্রমের আকার অপরিবর্তিত রহিয়াছে। এই বৎসর ৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতা বৃদ্ধি পাইয়া বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা
পৃষ্ঠা: ২৪৭

মােট ৭২০ মেগাওয়াটে উন্নীত হইবে। ৪০ মেগাওয়াট ভেড়ামারা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হইয়াছে। বিদ্যুৎ সঞ্চালন ক্ষেত্রে বিদ্যমান মােট ৬৫৪ মাইল ১৩২ কে. ভি. সঞ্চালন লাইনের সংগে শীঘ্রই আরও ১৫০ মাইল সঞ্চালন লাইন যুক্ত হইতেছে। শীঘ্রই ১৪টি মহকুমা সদরকে গ্রীডের সংগে সংযুক্তকরণ এবং ৬০টি থানা সদরকে বিদ্যুতায়ন করার কাজ সম্পন্ন হইবে ।
২৯। বেতবুনিয়া ভূ উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন বাংলাদেশের যােগাযােগের ক্ষেত্রে এক উল্লেখযােগ্য ঘটনা। এই কেন্দ্র স্থাপনের ফলে উপগ্রহের মাধ্যমে বহির্বিশ্বের সহিত বাংলাদেশের যােগাযােগের সূচনা হয়। ইহা আমাদের আন্তর্জাতিক টেলিযােগাযােগ ব্যবস্থায় বিশেষ অবদান রাখিবে। সংশােধিত উন্নয়ন কার্যক্রমে যােগাযােগ খাতের বরাদ্দ ১৭ কোটি টাকা হইতে বাড়াইয়া ১৮.৫৯ কোটি টাকা। করা হইয়াছে। বেতার ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করিবার জন্য শীঘ্রই নয়ারহাটে একটি ১০০০ কিলােওয়াট শক্তিবিশিষ্ট মধ্যম তরঙ্গ উচ্চ শক্তিসম্পন্ন ট্রান্সমিটার চালু করা হইবে। উচ্চমানের যান্ত্রিক সুবিধাদি সম্পন্ন রামপুরাস্থ টেলিভিশন ভবন নির্মাণ এই বৎসরে সমাপ্ত হইয়াছে এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন কেন্দ্র উক্ত স্থানে স্থানান্তরিত করা হইয়াছে। পরিবহন খাতে সংশােধিত বাজেটে বরাদ্দ ৮০ কোটি টাকা হইতে বৃদ্ধি করিয়া ৮১.২৫ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। এই ক্ষেত্রে ঢাকা-আরিচা। জনপথে মিরপুর, কালীগঙ্গা ও বংশী সেতু এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে তুরাগ ও বাইমাইল সেতুর নির্মাণ এই বৎসরের উল্লেখযােগ্য সাফল্য।
৩০। শিক্ষা খাতে এই বৎসরের সংশােধিত কার্যক্রমে ২৮.৭৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হইয়াছে। কারিগরি ও প্রকৌশলী শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের অধিকতর গুরুত্ব প্রদান অব্যাহত থাকে। স্বাস্থ্য খাতে সংশােধিত উন্নয়ন বাজেটে ২১ কোটি টাকার স্থলে ২১.৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। এই বৎসর সমন্বিত স্বাস্থ্য প্রকল্পের অধীনে ৯০টি সমন্বিত স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতাল স্থাপনের কাজ সম্পন্ন। হইয়াছে। খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানের কাজে এই বৎসর উল্লেখযােগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ। করা হইয়াছে। তৈল ও গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য ৬টি বিদেশী কোম্পানীর সংগে চুক্তি সম্পাদিত হইয়াছে। ইহা ছাড়া মুলাদি ও বেগমগঞ্জে অনুসন্ধানমূলক কূপ খননের কার্য বিভিন্ন পর্যায়ে রহিয়াছে।
জনাব স্পীকার,
৩১। আমি এখন ১৯৭৫-৭৬ সালের বাজেট আলােচনা করিতে চাই। ১৯৭৫-৭৬ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যমান করের ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব প্রাপ্তির পরিমাণ ৭৫৫.৩৮ কোটি টাকা ও অনুন্নয়নমূলক রাজস্ব খাতে ব্যয়ের বরাদ্দ ৫৯৯.১৯ কোটি টাকা অনুমান করা হইয়াছে। অর্থাৎ উদ্বৃত্ত থাকিবে ১৫৬.১৯ কোটি টাকা।
৩২। আগামী বৎসর রাজস্ব আয় খাতে কর বাবদ ধরা হইয়াছে ৫৮৪.৬২ কোটি টাকা, এই বৎসর সংশােধিত বাজেটে ইহার পরিমাণ ছিল ১৪২.২১ কোটি টাকা। অর্থাৎ কর বাবদ আগামী বৎসর ১৪২.৪১ কোটি টাকা বেশি পাওয়া যাইবে বলিয়া আশা করা যাইতেছে। সংশােধিত বাজেটের চাইতে আগামী বৎসরের
পৃষ্ঠা: ২৪৮

বাজেটে আমদানী ও রপ্তানী শুল্ক বাবদ ১০০ কোটি, আবগারী শুল্ক বাবদ ১১ কোটি, বিক্রয় কর বাবদ ৪৭ কোটি ও আয় কর, কর্পোরেশন কর ইত্যাদি বাবদ ২০ কোটি টাকা বেশি পাওয়া যাইবে বলিয়া অনুমান করা হইয়াছে। অন্যান্য কর খাতে অবশ্য আয় ৩৫.৫৯ কোটি টাকা কম পাওয়া যাইবে। আগামী বৎসর করবহির্ভুত রাজস্ব খাত হইতে পাওয়া যাইবে এই বৎসরের ১৫৩.২৯ কোটি টাকার স্থলে ১৭০.৭৬ কোটি টাকা।
৩৩। ১৯৭৫-৭৬ সালের অনুন্নয়নমূলক রাজস্ব ব্যয় বর্তমান বৎসরের সংশােধিত বাজেটের চাইতে ৬৮.০৬ কোটি টাকা বেশি। এই বৃদ্ধির হেতুর মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রতিরক্ষা, রেলওয়ে, আইন-শৃঙ্খলা ও সুদ প্রদান খাতে অধিকতর বরাদ্দ উল্লেখযােগ্য। আগামী বৎসর অপ্রত্যাশিত খাতে ৩০ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ রাখা হইয়াছে।
৩৪। ১৯৭৫-৭৬ সালের রাজস্ব ব্যয় বরাদ্দের বিশ্লেষণ করিলে দেখা যাইবে যে, গণমুখী শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রসারকল্পে সরকারের ঘােষিত প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকিবে। দেশে আইন শৃঙ্খলার উত্তরােত্তর উন্নতির প্রতিও বাজেটে দৃষ্টি দেওয়া হইয়াছে। আগামী বৎসরে আয়ের পরিমাণ ১৯৭৪-৭৫ সালের তুলনায় বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও ব্যয়ের পরিমাণ যথাসম্ভব সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করা হইয়াছে, যাহাতে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ সম্পদের হার যথাসম্ভব বৃদ্ধি পায়।
৩৫। আগামী বৎসরের বাজেটে অনুন্নয়নমূলক রাজস্ব খাতের বাহিরে বৈদেশিক ঋণ ও মঞ্জুরীসহ নীট প্রাপ্তি ধরা হইয়াছে ৭৯৪.১০ কোটি টাকা। ইহার সহিত রাজস্ব খাতের উদ্বৃত্ত ১৫৬.১৯ কোটি টাকা মিলাইয়া উন্নয়নমূলক কর্মসূচীর জন্য পাওয়া যায় ৯৫০.২৯ কোটি টাকা। আগামী বৎসরের উন্নয়ন কর্মসূচীর জন্য বরাদ্দের পরিমাণ ৯৫০ কোটি টাকা। ৯৫০.২৯ কোটি টাকার মােট সম্পদের চাইতে উন্নয়ন কর্মসূচীর ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব ২৯ লক্ষ টাকা কম। এই ২৯ লক্ষ টাকা ১৯৭৫-৭৬ সালের বিদ্যমান কর ভিত্তিক সামগ্রিক বাজেটের সামান্য উদ্বৃত্ত মাত্র।
৩৬। আগামী বৎসরের উন্নয়ন বাজেটের বিভিন্ন খাতওয়ারী বন্টন বিশ্লেষণ করিলে দেখা যাইবে যে, এই বৎসরের তুলনায় ১৯৭৫-৭৬ সালে টাকার অংক। সর্বক্ষেত্রে বৃদ্ধি পাইয়াছে। আগামী বৎসর কৃষি ও গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান, জনসংখ্যা পরিকল্পনা, শিল্প, বিদ্যুৎ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি সম্পদ খাতে বরাদ্দ উল্লেখযােগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাইয়াছে।
৩৭। ১৯৭৫-৭৬ সালে কৃষি ও গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান এই দুই খাতে মােট ১৬৩ কোটি টাকা রাখা হইয়াছে। ১৯৭৪-৭৫ সালে এই দুই খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ৯২.৩৭ কোটি টাকা। আগামী বৎসর কৃষিক্ষেত্রে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য কতিপয় বলিষ্ঠ কর্মসূচী নেওয়া হইয়াছে। ১৯৭৫-৭৬ সালে চাউল ও গম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হইতেছে ৩৪ কোটি ৭৪ লক্ষ মণ। আগামী মৌসুমে নিবিড় চাষ (ইনটেনসিভ কালটিভেশন) সহ ৪০ লক্ষ বেল পাট উৎপাদন করা হইবে
পৃষ্ঠা: ২৪৯

বলিয়া ধরা হইয়াছে। ইক্ষু উৎপাদনের লক্ষ্য হইতেছে ১৮ কোটি ২৫ লক্ষ মণ । সার বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা মােট ১ কোটি ৬২ লক্ষ মণ। সেচ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে আগামী বৎসরের লক্ষ্যমাত্রা হইতেছে ৪২,০০০ সেচ পাম্প, ৩,৭৫১টি গভীর নলকূপ ও ৪,৫০০টি অগভীর নলকূপ।
৩৮। গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান ও সমবায় ক্ষেত্রে স্পেশাল গ্রামীণ সমবায় প্রবর্তনের পরিকল্পনা ১৯৭৫-৭৬ সালের উন্নয়ন কার্যক্রমের এক উল্লেখযােগ্য সংযােজন। এই পরিকল্পনার অধীনে জাতীয় উৎপদন বৃদ্ধির জন্য বাংলার প্রতিটি গ্রামে বাধ্যতামূলক ভিত্তিতে এই সমবায় গঠন করা হইবে। জমির মালিক, কর্মক্ষম সকল ভূমিহীন কৃষক ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট জনগণকে এই সমবায় গঠিত ও পরিচালিত হইবে। আধুনিক উপকরণ প্রয়ােগের মাধ্যমে সম্ভাব্য সর্বাধিক উৎপাদনই এই সমবায়ের লক্ষ্য। আগামী বৎসর ন্যূন পক্ষে ৬০ হইতে ১০০ গ্রামকে এই কর্মসূচীর অধীনে আনয়ন করা হইবে এবং পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের সকল গ্রাম এই স্পেশাল সমবায় কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত করা হইবে। এই ক্ষেত্রে আমি সরকারের পক্ষ হইতে জনসাধারণকে স্পষ্ট করিয়া জানাইয়া দিতে চাই যে, এই ব্যবস্থায় জমির মালিকানা জমির মালিকেরই থাকিবে, উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হইয়াছে। এইজন্য ১৯৭৫-৭৬ সালে বার্ষিক উন্নয়ন কার্যক্রমে আলাদাভাবে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হইয়াছে। এই স্পেশাল গ্রামীণ সমবায় কর্মসূচী সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সাধারণ কর্মসূচীর অতিরিক্ত। এই ব্যবস্থায় শুধু উৎপাদন বৃদ্ধি পাইবে তাহাই নহে, বাংলার গ্রামে গ্রামে যে অসংখ্য ভূমিহীন কৃষক রহিয়াছে। তাহাদের কর্মসংস্থান হইবে এবং দেশের বেকার সমস্যার স্থায়ী ও ফলপ্রসূ সমাধান ঘটিবে। জাতীয় কল্যাণ বৃদ্ধির জন্য, শােষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য একদিকে যেমন উৎপাদনের আকার বাড়াইতে হইবে, অন্যদিকে তেমনি সকলের ন্যায্য চাহিদার প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া সুষম বন্টন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। উৎপাদনের এই সুষম বন্টন নিশ্চিত করিবার জন্য সমবায়ের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলাদি, মালিক, মজুর, সরকার ও সমবায়সহ সমবায়ের সহিত সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তিদের মধ্যে, শুধু তাহাদের উৎপাদন ক্ষমতার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়াই নহে উপরন্তু তাহাদের চাহিদার প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া সমবেতভাবে সৃষ্ট এই সম্পদের বন্টন করিতে হইবে। বঙ্গবন্ধু পরিকল্পিত স্পেশাল গ্রামীণ সমবায় প্রতিষ্ঠা এই গ্রামভিত্তিক অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ও পুনর্বিন্যাসের পথে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে এক বিরাট পদক্ষেপ। ইহা ছাড়া আগামী বৎসর সমন্বিত পল্লী কর্মসূচীর অধীনে আরও ৮৮টি থানা আনয়ন করিবার প্রাথমিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হইয়াছে। ইহাসহ এই কর্মসূচীর অধীনে মােট থানার সংখ্যা দাঁড়াইবে ২৫০টি। পল্লীপূর্ত কর্মসূচী খাতে এই বৎসরে ১৮ কোটি ৬২ লক্ষ টাকার স্থলে আগামী বৎসর ২১ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হইয়াছে।
৩৯। ১৯৭৫-৭৬ সালে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি সম্পদ খাতে ১৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হইয়াছে, বরাদ্দের পরিমাণ এই বৎসরের তুলনায় ৫০ কোটি টাকা
পৃষ্ঠা: ২৫০

বেশী । আশা করা যাইতেছে যে, আগামী বৎসর বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি সম্পদ কার্যক্রমের অধীনে গৃহীত প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়নের পর দেশে প্রায় তিন লক্ষ একর জমিতে বন্যা নিরােধ এবং প্রায় দেড় লক্ষ একরে ও অধিক জমিতে সেচ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হইবে।
৪০। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করিবার জন্য বিভিন্ন মৌলিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য চলতি বৎসরে কতিপয় বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়াছে। জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপক প্রচেষ্টার মাধ্যমে সীমিত উৎপাদন ও অন্যান্য সুযােগ সুবিধার উপর জনসংখ্যা বিস্ফোরণের প্রবল চাপ যথাযথ প্রশমিত করাই বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচীর অন্যতম লক্ষ্য। জনসংখ্যা সম্পর্কিত নীতি প্রণয়নের জন্য সরকার উপরাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীমণ্ডলীসহ একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় জনসংখ্যা কাউন্সিল গঠন করিয়াছেন। জনসংখ্যা পরিকল্পনা খাতে সরকার আগামী বৎসরের বরাদ্দ, বর্তমান ৭.৭৪ কোটি টাকা হইতে বাড়াইয়া ২৫ কোটি টাকায় উন্নীত করিয়াছেন।
৪১। শিল্পক্ষেত্রে ১৯৭৪-৭৫ সালে সংশােধিত বাজেটে বরাদ্দ করা হইয়াছে। ৬৫ কোটি টাকা। আগামী বৎসর এই খাতে বরাদ্দ বাড়াইয়া ১৩৬ কোটি টাকা করা হইয়াছে। বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি পাইয়াছে ৭১ কোটি টাকা। আগামী বৎসরে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পক্ষেত্রে বিদ্যমান ক্ষমতার সদ্ব্যবহারের জন্য বেশ কয়েকটি বি.এম.আর. (ব্যালেন্সিং, মডারনাইজেশন এণ্ড রিপ্লেসমেন্ট) প্রকল্প হাতে লওয়া হইবে। আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার কারখানা নির্মাণে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হইবে বলিয়া আশা করা যাইতেছে। তাহা ছাড়া বস্ত্র শিল্প সংস্থার অধীনে সূতীকল প্রকল্পসমূহের যথেষ্ট অগ্রগতি ও চট্টগ্রামে কীটনাশক ঔষধ তৈয়ারী কারখানার প্রথম পর্যায়ে শেষ হইবে বলিয়া আশা করা যাইতেছে। বেসরকারী বিনিয়ােগ ক্ষেত্রে এবং কুটিরশিল্প সংস্থার অধীনে আগামী বৎসর উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি সাধিত হইবে বলিয়া আশা করা যায়।
৪২। বিদ্যুৎ খাতে আগামী বৎসর ১৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হইয়াছে। আগামী বৎসর ১০৬ মাইল প্রাথমিক সঞ্চালন লাইন ও ১৭০০ মাইল বিতরণ লাইন স্থাপন করিবার প্রস্তাব রহিয়াছে। তাহা ছাড়া ১০৯টি থানার বিদ্যুতায়ন ও ২,৬৪৬টি গভীর নলকূপ ও পাম্পে বিদ্যুৎশক্তি সরবরাহ করা হইবে বলিয়া আশা করা যাইতেছে। পল্লী অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহকরণ যথাসম্ভব ত্বরান্বিত করিবার জন্য গ্রামাঞ্চলে শক্তিচালিত পাম্প, গভীর ও অগভীর নলকূপে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও পল্লী অঞ্চলে বৈদ্যুতিক আলাে প্রদানের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হইবে।
৪৩। স্বাস্থ্য খাতে এই বৎসরে সংশােধিত বাজেটে বরাদ্দ ২১.৭৬ কোটি টাকার স্থলে আগামী বৎসরে ৩৩ কোটি টাকা ধরা হইয়াছে। আগামী অর্থ বৎসরে ১৫৩টি সমন্বিত স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতাল চালু করা সম্ভব হইবে বলিয়া আশা করা যায়। ১৯৭৫-৭৬ সালে শিক্ষাক্ষেত্রে মােট বরাদ্দ ধরা হইয়াছে ৪৫ কোটি টাকা। সংশােধিত বাজেট এই বরাদ্দের পরিমাণ ২৮.৭৮ কোটি টাকা। সর্বস্তরে শিক্ষার
পৃষ্ঠা: ২৫১

প্রসার ও কারিগরি ও প্রকৌশলী শিক্ষার উপর অধিকতর গুরুত্ব প্রদান অব্যাহত থাকিবে। অর্থনৈতিক উন্নতির প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে জাতির বিশেষ করিয়া তরুণ সমজের, দৈহিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধনের প্রতিও এই বাজেটে প্রয়ােজনীয় দৃষ্টি দেওয়া হইয়াছে। ১৯৭৫-৭৬ সালে সরকার ক্রীড়া খাতে ৩০ লক্ষ টাকা বিশেষ। বরাদ্দসহ ৮০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করিয়াছেন। ইহা ছাড়া লােক শিল্প ও চারুকলা উন্নয়নের জন্যও সরকার আগামী বৎসর বিশেষ বরাদ্দ করিয়াছেন। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন কার্যে সরকারের বিশেষ বিবেচনা অব্যাহত থাকিবে।
৪৪। পরিবহণ ক্ষেত্রে আগামী বৎসরের প্রকল্পের মধ্যে কুর্মিটোলা আধুনিক বিমান বন্দর চালু করার প্রচেষ্টা, হার্ডিঞ্জ ব্রীজের মেরামত ও পুনঃনির্মাণ সম্পন্ন করা ও রেলওয়ে কর্তৃক ৫০টি যাত্রীবাহী গাড়ী ও ৫০০ মালবাহী গাড়ীর আমদানী উল্লেখযােগ্য। পরিবহণ ও যােগাযােগ খাতে ১৯৭৫-৭৬ সালের বরাদ্দ যথাক্রমে ১২৫ কোটি ও ৩৪.৫০ কোটি টাকা।
৪৫। শ্রমিকদের বর্ধিত সুযােগ-সুবিধা প্রদান করিবার জন্য সরকার এই খাতে আগামী বৎসরের বরাদ্দ শতকরা ১৩৪ ভাগ বৃদ্ধি করিয়াছেন। অনুরূপভাবে সমাজ কল্যাণ খাতেও বরাদ্দের হার শতকরা ১০০ ভাগ বাড়ান হইয়াছে। সাইক্লোন রিকস্ট্রাকশন খাতে বাড়ান হইয়াছে ১৩.৫০ কোটি টাকা। জনসাধারণের আবাসিক সমস্যা দূরীকরণার্থে সরকার গৃহনির্মাণ ও ভূমি উন্নয়ন খাতে বর্তমান বরাদ্দ হইতে আগামী বৎসরে ৩২ কোটি টাকা বাড়াইয়াছেন।

জনাব স্পীকার,
৪৬। সরকারের রাজস্ব বাজেট ও উন্নয়ন বাজেট প্রকৃতপক্ষে সরকারের পূর্ণ কর্মসূচীর পরিচায়ক নহে, দেশে যে সকল স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহ রহিয়াছে তাহাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মসূচীর একটি বৃহৎ অংশ প্রতিফলিত হয়। অতএব সামগ্রিক জাতীয় অর্থ ব্যবস্থায় এই সকল স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহের গুরুত্ব অপরিসীম। ইহাদের মধ্যে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান উন্নয়নমূলক কাজ করিতেছে। অন্যান্য সংস্থা দেশের অধিকাংশ শিল্প, বাণিজ্য, পরিবহন ও অন্যান্য কৃত্যকাদি পরিচালনা করিয়া থাকেন। অতএব জাতীয় অর্থনীতি সম্পর্কে পূর্ণতর ধারণা পাইতে হইলে এই সকল প্রতিষ্ঠানের আয়, ব্যয় ও অন্যান্য আর্থিক বিবরণী সম্পর্কে অবহিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। এইজন্য ৬৪টি এই জাতীয় বিভিন্ন শ্রেণীর প্রতিষ্ঠানের একটি নিবদ্ধ সংসদের সম্মুখে পৃথকভাবে সরবরাহ করা হইল। আশা করি জাতীয় সংসদের সদস্যবৃন্দ ও অন্যান্য জনসাধারণ ইহার মাধ্যমে এই সকল প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কে অবগত হইতে পারিবেন। এই ব্যবস্থার ফলে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহের আর্থিক নিয়মানুবর্তিতা ও অর্থ ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটিবে। এই সকল প্রতিষ্ঠানসমূহের আর্থিক বিবরণী হইতে দেখা যাইবে যে উপরিউক্ত ৬৪টি প্রতিষ্ঠানের ১৯৭৫-৭৬ সালের মােট আয়ের পরিমাণ ১৭৭১.৭৫ কোটি টাকা এবং ব্যয়ের বরাদ্দ
পৃষ্ঠা: ২৫২

১৭০০.০২ কোটি টাকা। এই প্রসঙ্গে আমি উল্লেখ করিতে চাই যে, এই প্রথমবারের মত এই সকল প্রতিষ্ঠানসমূহের বাজেট সংসদের সম্মুখে সামগ্রিকভাবে পেশ করা হইতেছে। সময়ের স্বল্পতাহেতু এই নিবন্ধে অপূর্ণতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকিতে পারে, কিন্তু প্রথম প্রয়াস হিসাবে ইহা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে।

কর প্রস্তাবসমূহ জনাব

স্পীকার,
৪৭। একটু আগে আমি সার্বিক রাজস্ব আয়ের একটি চিত্র আপনার সম্মুখে উপস্থাপিত করিয়াছি। কর রাজস্ব সম্পর্কে বলা প্রয়ােজন যে, ইতিমধ্যে রহিত আমদানী লাইসেন্স কর এবং বিনিময় মুদ্রা করের হিসাব বাদে বর্তমান আর্থিক বৎসরের সংশােধিত বাজেটের তুলনায় আগামী আর্থিক বৎসরে কর খাতে প্রায়। ১৭৮ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব পাওয়া যাইবে। এই অতিরিক্ত অর্থ প্রধানত তিনিটি কারণে আদায় হইবে বলিয়া আশা করা যায়। প্রথমত বর্তমান বৎসরের তুলনায় আগামী বৎসর শুল্ক ও কর আরােপনীয় আমদানী পণ্যের মােট পরিমাণ ন্যূনপক্ষে শতকরা প্রায় ৩৫ ভাগ বৃদ্ধি পাইবে বলিয়া ধরা হইয়াছে। এই পূর্বভাস তথ্য ও বস্তুভিত্তিক। দ্বিতীয়ত আমাদের টাকার বিনিময় হার পুনর্নির্ধারণের ফলে বেশ কয়েকটি নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের উপর আমদানী শুল্ক হ্রাস করা সত্ত্বেও, বাকী যে সমস্ত দ্রব্যের মূল্যভিত্তিক শুল্কহার আরােপিত রহিয়াছে, তাহা হইতে বােধগম্যভাবেই শুল্ক আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাইবে। উপরােক্ত দুইটি কারণে আমাদের তিনটি প্রধান পরােক্ষ করের মধ্যে আমদানী শুল্ক ও বিক্রয় কর এই দুইটি খাতে রাজস্ব সরাসরিভাবেই উল্লেখযােগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি পাইবে। অপরটি অর্থাৎ আবগারী শুল্ক খাতেও অধিকতর কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানীর ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে কিছু রাজস্ব বৃদ্ধি আশা করা যায়। তৃতীয়ত আমি আনন্দের সহিত উল্লেখ করিতে পারি যে, নানাবিধ সমস্যা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও রাজস্ব প্রশাসনে প্রভূত উন্নতি সাধিত হইয়াছে। ফলে, পূর্ববর্তী আর্থিক বৎসরের তুলনায় রাজস্ব আদায়ে বর্তমান বৎসরে প্রশাসনিক উৎকর্ষের মাধ্যমে উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি অর্জিত হইয়াছে। আমরা আশা করি আগামী বৎসরেও ইহার গতিধারা অব্যাহত রাখিয়া অধিকতর রাজস্ব আদায় সম্ভব হইবে। বিভিন্ন খাতে বিগত বৎসরের তুলনায় বর্তমান বৎসরের সংশােধিত বাজেটে এবং আগামী বৎসরের বাজেটের অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের অংকগুলি হইতে এই সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাইবে।
৪৮। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং জনসাধারণের অর্থনৈতিক কল্যাণের লক্ষ্য সম্মুখে রাখিয়া আমি আগামী অর্থ বৎসরের জন্য কোন উল্লেখযােগ্য নতুন কর প্রস্তাব সংসদের সম্মুখে পেশ করিব না। বরং আয় কর ও সম্পদ করের ক্ষেত্রে কিছু কিছু করভার লাঘব করার প্রস্তাব করিব। এতদ্ব্যতীত ইতিমধ্যেই আমদানী
পৃষ্ঠা: ২৫৩

লাইসেন্স কর, বৈদেশিক মুদ্রা কর এবং পাট কর রহিত করা হইয়াছে। বর্তমান অর্থ বিলে আরাে কয়েকটি কর, যথা ঃ বাড়ী ভাড়া কর, উৎকর্ষ কর, জলযানের উপর আরােপিত কর, মাল পরিবাহী মােটরযানের উপর আরােপিত কর এবং যাত্রী ও মালের ভাড়া উপর আরােপিত ‘টোল’ রহিত করার প্রস্তাব করা হইয়াছে। তদুপরি ব্যক্তিগত কৃষি আয়কে করারােপ হইতে দুই বৎসরের জন্য মওকুফ করার যে সিদ্ধান্ত সরকার পূর্বে গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহার মেয়াদ আরও এক বৎসর। অর্থাৎ আগামী বৎসর পর্যন্ত বাড়াইয়া দেওয়ার প্রস্তাব করা হইতেছে। আবার কতকগুলাে ক্ষেত্রে বর্তমান কর হারের এবং করারােপ বিধানাবলীর যৌক্তিকীকরণ, বিভিন্ন অর্থনৈতিক বাস্তবতার এবং সরকারের অর্থনৈতিক নীতির সঙ্গে সংগতি বিধান এবং কর হারসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের উদ্দেশ্যে কিছু কিছু প্রস্তাব অর্থ বিলে সন্নিবেশিত করা হইয়াছে। এইবার আমি অর্থ বিলের বিধানবলীতে অন্তর্ভুক্ত মুখ্য প্রস্তাবসমূহের একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করিতেছি।

বহিঃশুল্ক
৪৯। বর্তমানে সিগারেট শিল্পে ব্যবহৃত বেশীর ভাগ কাগজের উপর শতকরা। ১০০ ভাগ হারে মূল্যভিত্তিক (Ad valorem) বহিঃশুল্ক আরােপিত আছে। কিন্তু একটি ক্ষেত্রে উক্ত কাগজের উপর আকার এবং প্রকার ভেদে শতকরা ৪০ এবং ৫৫ ভাগ হারে শুল্ক ধার্য রহিয়াছে। একই জাতীয় কাগজের উপর শুল্ক হারের এই অসমতা উপরােক্ত হারদ্বয়ের অসদ্ব্যবহারের সুযােগ সৃষ্টি করে। সুতরাং উক্ত কাগজের উপরেও শতকরা ১০০ ভাগ হারে শুল্ক ধার্য করিয়া শুল্কহারগুলির মধ্যে। ভারসাম্য বিধান করার প্রস্তাব করা হইয়াছে। এই বাবদ ৫ লক্ষ টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় হইবে।
৫০। মৎস্যজীবী কর্তৃক আমদানীকৃত ৩ প্লাই নাইলন সূতার উপর শুল্কের হার মূল্যভিত্তিক শতকরা ৫০ ভাগ। ইহা ছাড়া অন্য সকল প্রকার কৃত্রিম আঁশের সূতার উপরে শুল্কের হার পরিমাণভিত্তিক (Specific)। অপর পক্ষে কার্পাস এবং পশমী সূতার উপর শুল্কের হার অন্যান্য সামগ্রীর মতই মূল্যভিত্তিক। আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্যের উঠা-নামার সঙ্গে পরিমাণভিত্তিক এই শুল্কহার সব সময়ই পিছনে পড়িয়া থাকে। তাই পরিমাণভিত্তিক এই শুল্ক হারের অবসান করিয়া সকল প্রকার কৃত্রিম সূতার উপরে শতকরা ৫০ ভাগ হারে মূল্যভিত্তিক শুল্ক ধার্য করার প্রস্তাব করা হইয়াছে। একই কারণে জরী সূতার মূল্যের উপর শতকরা ৭৫ ভাগ হারে শুল্ক ধার্য করার প্রস্তাব করা হইয়াছে। এই বাবদ ১ (এক) কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব। আদায় হইবে।
৫১। বর্তমানে আমদানীকৃত লুব্রিকেটিং তৈলের উপরে শুল্কহার দুই প্রকার, যথা অনধিক ১ গ্যালনের খুচরা প্যাকিং-এ প্রতি গ্যালন ৩.২৫ টাকা, বাল্ক। প্যাকিং-এ প্রতি গ্যালন ২.৫ টাকা। পরিমাণভিত্তিক এই শুল্কহার আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলজাত দ্রব্যের মূল্যের উঠা-নামার সাথে তাল মিলাইতে অক্ষম। তাহা ছাড়া দেশে উৎপাদিত লুব্রিকেটিং তৈলের উপরে আবগারী শুল্কের হারও
পৃষ্ঠা: ২৫৪

মূল্যভিত্তিক। এই বিবেচনায় পরিমাণভিত্তিক এই আমদানী শুল্ক হারের অবসান করিয়া লুব্রিকেটিং তৈলের খুচরা এবং বাল্ক প্যাকিং-এর উপরে যথাক্রমে শতকরা ৩৫ এবং ৩০ ভাগ মূল্যভিত্তিক শুল্ক ধার্য করার প্রস্তাব করা হইয়াছে। এই বাবদ রাজস্ব আদায়ের পরিমাণে বিশেষ কোন তারতম্য হইবে না।
৫২। বর্তমানে আমদানীকৃত সিগারেটের উপর শতকরা ৩০০ ভাগ আমদানী শুল্ক ছাড়াও শতকরা ১০০ ভাগ রেগুলেটরী শুল্ক ধার্য রহিয়াছে। আমদানীকৃত মার্বেল চিপসের উপরেও শতকরা ৭৫ ভাগ হারে কেবলমাত্র রেগুলেটরী শুল্ক ধার্য রহিয়াছে। বর্তমান আর্থিক বৎসর শেষ হওয়ার সাথে সাথে এইসব রেগুলেটরী শুল্কের মেয়াদ শেষ হইয়া যাইবে। উল্লিখিত দ্রব্য সামগ্রীর উপর এই অতিরিক্ত শুল্ক বহাল রাখার উদ্দেশ্যে সিগারেট এবং মার্বেল চিপসের উপর ধার্য রেগুলেটরী শুল্ক সাধারণ শুল্কের সাথে একত্রীকরণের প্রস্তাব করা হইয়াছে।

আবগারী শুল্ক
৫৩। সুরাবিহীন পানীয় দ্রব্যের উপর বর্তমানে খুচরা মূল্যের শতকরা ৩০ ভাগ হারে আবগারী শুল্ক ধার্য রহিয়াছে। এই পদ্ধতিতে শুল্কারােপের প্রধানতম শর্ত হইতেছে দ্রব্যটির উপর পরিষ্কার, সহজদৃষ্ট এবং অনপনীয়ভাবে খুচরা বিক্রয় মূল্য মুদ্রণ করা। কিন্তু বােতলের ক্রাউন কর্কের উপর মূল্য মুদ্রণের কোন যন্ত্র বর্তমানে বাংলাদেশে না থাকার দরুন উপরােক্ত আইনগত বিধান যথাযথভাবে কার্যকর করা সম্ভব হইতেছে না। কাজেই এই পদ্ধতি পরিবর্তন করিয়া পরিমাণভিত্তিক হারে বিজ্ঞাপিত ধার্যকরণ পদ্ধতিতে শুল্কারােপের প্রস্তাব করা হইয়াছে। ইহার ফলে আপাতত কোন অতিরিক্ত রাজস্ব আশা করা যায় না।
৫৪। প্রায় এক দশক পূর্বে কাচা তামাকের বাজার দর যখন বর্তমান মূল্যের তুলনায় অনেক কম ছিল তখন পরিমাণভিত্তিক হারে (প্রতি পাউণ্ড ৬০ পয়সা) শুল্ক ধার্য করা হয়। এই শুল্কহার তামাকের বর্তমান মূল্যের এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশে পরিণত হইয়াছে। তাই নিয়ত পরিবর্তনশীল মূল্যমানের সঙ্গে সংগতি বিধানের উদ্দেশ্যে বর্তমান পরিমাণভিত্তিক নির্দিষ্টাংক শুল্কহারের স্থলে বিজ্ঞাপিত ধার্যকরণ পদ্ধতি। প্রবর্তন করার প্রস্তাব করা হইয়াছে। ইহাতে শুল্ক ব্যবস্থায় প্রয়ােজনীয় নমনীয়তা নিশ্চিত হইবে।
৫৫। তামাকজাত দ্রব্যের উপর শুল্ক ব্যবস্থা ক্রমে ক্রমে জটিলতায় আচ্ছন্ন। হইয়া পড়িয়াছে। ইহাতে কিছু কিছু অসামঞ্জস্য এবং প্রয়ােজনীয় নমনীয়তার অভাবও পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং তামাকজাত দ্রব্যগুলির সংজ্ঞা ও শুল্ক হারের পুনর্বিন্যাস করিয়া দ্রব্যটিকে বিজ্ঞাপিত নির্ধারণ পদ্ধতির আওতায় আনয়ন করিবার প্রস্তাব করা হইয়াছে। এই বাবদ রাজস্ব আদায়ের পরিমাণে আপাতত কোন তারতম্য হইবে না।
৫৬। কাগজ ও কাগজ বাের্ডের উপর বর্তমানে প্রতি হন্দরে যথাক্রমে ১৫.০০ টাকা এবং ১০.০০ টাকা হারে শুল্ক ধার্য রহিয়াছে। এই পরিমাণভিত্তিক
পৃষ্ঠা: ২৫৫

নির্দিষ্টাংকের শুল্কহার প্রাক-স্বাধীনতাকালীন সময়ে ধার্য করা হইয়াছিল। ইতিমধ্যে কয়েকগুণ মূল্য বৃদ্ধি সত্ত্বেও রাজস্ব একই হারে স্থির রহিয়াছে। কাজেই এই শুল্কহারের যৌক্তিকীকরণ প্রয়ােজন হইয়া পড়িয়াছে। তফসীলে বলবৎ নির্দিষ্টাংক শুল্কহারের পরিবর্তে বিজ্ঞাপিত নির্ধারণ পদ্ধতিতে শুল্ক হার প্রবর্তন করা হইলে পরিবর্তনশীল অবস্থার সাথে তাল রাখিয়া সময়ে সময়ে প্রয়ােজনানুসারে শুল্কহারের। পরিবর্তন সাধন সহজতর হইবে। শুল্ক পদ্ধতির এই যৌক্তিকীকরণের ফলে বর্তমানে কোন অতিরিক্ত রাজস্ব আশা করা যায় না।
৫৭। বৈদ্যুতিক বাল্বের বেলায় বিজ্ঞাপিত নির্ধারণ পদ্ধতি বলবৎ থাকার ফলে পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে শুল্কহারের সঙ্গতি বিধান সহজতর হইয়াছে। অথচ বৈদ্যুতিক টিউবের ক্ষেত্রে তফসীলে নির্দিষ্ট হার ধার্য থাকার দরুন মূল্য পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার সাথে শুল্কহারের সঙ্গতি বিধান এবং যৌক্তিকীকরণ কঠিন হইয়া পড়ে। কাজেই বৈদ্যুতিক বাল্বের মত টিউবের ব্যাপারেও একই বিজ্ঞাপিত নির্ধারণ পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হইয়াছে। এর ফলে কোন অতিরিক্ত রাজস্ব আয়ের সম্ভাবনা নাই।
৫৮। রেডিও সেটের উপর বর্তমানে প্রতি সেট ২৫.০০ টাকা অথবা মূল্যের শতকরা ১৫ ভাগ—যাহা অধিকতর—হারে শুল্ক ধার্য রহিয়াছে। সেট সংযােজনের উদ্দেশ্যে আমদানীকৃত সম্পূর্ণ বিযুক্ত ক্ষুদ্রাংশের ১৫০% হারে আমদানী শুল্ক আরােপিত রহিয়াছে। কিন্তু সম্প্রতি সরকার এক ব্যাণ্ড রেডিও সেটকে সম্ভাব্য নিম্নতম মূল্যে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার আওতায় আনয়নের নীতি গ্রহণ করিয়াছে। এই নীতি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে আমদানী পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যাণ্ডের। রেডিওর বিযুক্ত ক্ষুদ্রাংশের শুল্ক হ্রাস করিয়া সংযােজনােত্তর পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যাণ্ডের উপর বিভিন্ন হারে শুল্কারােপ করা প্রয়ােজন। এই উদ্দেশ্যে আবগারী শুল্ক হারের বর্তমান পদ্ধতি পরিবর্তন করিয়া বিজ্ঞাপিত নির্ধারণ পদ্ধতির মাধ্যমে শুল্কহার ধার্যকরণের প্রস্তাব করা হইয়াছে।

আয়কর
৫৯। দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করিয়া এবং স্বল্প আয়ের মানুষের করভার কিছু পরিমাণ লাঘব করিবার উদ্দেশ্যে কর আরােপনীয় আয়ের নিম্নসীমা ৬,০০০ টাকা হইতে বাড়াইয়া ৮,৪০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হইয়াছে। ইহার ফলে প্রায় ২০ লক্ষ টাকা রাজস্ব হ্রাস পাইবে।।
৬০। একই উদ্দেশ্যে কর রেয়াতের জন্য ছেলেমেয়েদের শিক্ষা খরচের। পরিমাণ ৯০০ টাকা হইতে বাড়াইয়া ১,৫০০ টাকা ধার্য করিবার প্রস্তাব করা হইয়াছে। ইহার ফলে ২ লক্ষ টাকা রাজস্ব কমিবে।
৬১। কর রেয়াতের জন্য বর্তমানে ব্যক্তিগত এলাউন্সের ক্ষেত্রে বিবাহিত এবং অবিবাহিত করদাতার মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। এই এলাউন্সের পরিমাণ বিবাহিত
পৃষ্ঠা: ২৫৬

করদাতার ক্ষেত্রে অবিবাহিতদের অপেক্ষা অতিরিক্ত ১,০০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হইয়াছে। ফলে ৩ লক্ষ টাকা রাজস্ব হ্রাস পাইবে।
৬২। তিন হাজার টাকা পর্যন্ত আপ্যায়ন ভাতা আয়করমুক্ত করার প্রস্তাব করা। হইয়াছে। ফলে ২ লক্ষ টাকা রাজস্ব কমিবে।
৬৩। নতুন গৃহাদি নির্মাণে উৎসাহ প্রদানের জন্য ১৯৭৫ সনের ১লা জুলাই হইতে ১৯৮০ সনের ৩০শে জুন পর্যন্ত যেসব গৃহাদি নির্মিত হইবে, বাসস্থান হিসাবে সেইগুলি ব্যবহৃত হইলে তদ্দরুন ৮,৪০০ টাকা পর্যন্ত বাৎসরিক আয় করমুক্ত করার প্রস্তাব করা হইয়াছে।
৬৪। বাধ্যতামূলকভাবে কোম্পানীর মুনাফা বন্টনে যে আইন আছে তাহার প্রয়ােগ ৩ (তিন) বৎসরের জন্য স্থগিত আছে। এই বৎসর সেই সময়সীমা উত্তীর্ণ হইবে। দেশের অর্থনৈতিক ও সার্বিক কল্যাণ মানসে এবং শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করিবার উদ্দেশ্যে এই বিধানের প্রয়ােগ আরও ২ (দুই) বৎসরের জন্য স্থগিত রাখার প্রস্তাব করা হইয়াছে।
৬৫। বর্তমানে যদি কোন নিয়ােগকর্তা চাকুরীর শর্ত হিসাবে কোন কর্মচারীকে বাসস্থানের জন্য বিনা ভাড়ায় বাড়ী দেন তবে সেই কর্মচারীর বেতনের সঙ্গে বেতনের শতকরা ১০% ভাগ, এবং আসবাবসহ হইলে শতকরা ১৫% আয় হিসাবে ধরা হয়। এইভাবে নিরূপিত আয়ের সঙ্গে প্রকৃত ভাড়ার কোন সম্পর্ক নাই। কিন্তু যদি কোন কর্মচারী তাহার নিয়ােগকর্তার নিকট হইতে নগদ ভাড়া পান। তবে সম্পূর্ণ ভাড়াই তাহার আয়ের সঙ্গে যােগ হয়। এই বৈষম্য লাঘব করিবার জন্য নগদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা পর্যন্ত করারােপ হইতে অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তাব করা হইয়াছে। ইহার ফলে ২ লক্ষ টাকা রাজস্ব হ্রাস পাইবে।
৬৬। পুঁজিসম্পদ (Capital asscts) বিক্রয়ের ব্যাপারে দেখা যায় যে মূলধন মুনার(Capital gains) উপর আরােপযােগ্য কর ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে বাজারদর হইতে অনেক ক্ষেত্রে কম মূল্য দলিলে লেখা হইয়া থাকে। প্রচলিত আইনানুযায়ী প্রকৃত মূল্যের ভিত্তিতে কর নির্ধারণ ও আদায় করা প্রায়ই সম্ভব হয় না। কারণ তাহা করিবার জন্য আয়কর অফিসারকে ক্রেতা এবং বিক্রেতার মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ সম্পর্ক প্রমাণ করিতে হয়। ইহা সহজসাধ্য নয় হেতু বহুক্ষেত্রে রাষ্ট্র তার ন্যায্য রাজস্ব হইতে বঞ্চিত হয়। তাই এই ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতাকে রােধ করিবার জন্য দলিলে লেখা মূল্য অগ্রাহ্য করিয়া বাজার দরে সঠিক মূল্যায়নের প্রয়ােজনীয় ক্ষমতা আয়কর বিভাগকে দিবার প্রস্তাব করা হইতেছে। ইহাতে প্রায় ২০ লক্ষ টাকা রাজস্ব বৃদ্ধি পাইবে।
৬৭। এই সঙ্গে আরাে প্রস্তাব করা যাইতেছে যে যদি কোন ব্যক্তি বসতবাড়ী বিক্রয়লব্ধ অর্থে নতুন কোন বসতবাড়ী ক্রয় বা নির্মাণ করেন এবং বিনিয়ােজিত মূলধনের মুনাফা যদি শেষােক্ত বসতবাড়ীর ক্রয়মূল্য বা নির্মাণমূল্য অপেক্ষা কম হয় তবে এই মুনাফার উপর কোন আয়কর দিতে হইবে না। প্রচলিত আইনানুযায়ী সম্পত্তি ক্রয়ের ১ (এক) বৎসর পরে যদি তাহা হস্তান্তর করা হয় তবে মুনাফার
পৃষ্ঠা: ২৫৭

৫০% ভাগকে আয়কর হইতে অব্যাহতি দেওয়া হয়। যৌক্তিকতার দিক দিয়া, বিশেষ করিয়া মুদ্রাস্ফীতির কারণে এই ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসের প্রয়ােজনীয়তা রহিয়াছে। সেই হেতু এইরূপ মুনাফার অব্যাহতির হার নিম্নলিখিতভাবে পুনর্বিন্যাস করার প্রস্তাব করা হইতেছে:
সময় – অব্যাহতির হার
(ক) যে সমস্ত সম্পত্তি এক বৎসরের মধ্যে হস্তান্তর করা হইবে -শূন্য (খ) যে সমস্ত সম্পত্তি এক বৎসরের পর কিন্তু তিন বৎসরের মধ্যে হস্তান্তর করা হইবে। -মুনাফার ৩০% ভাগ।
(গ) যে সমস্ত সম্পত্তি তিন বৎসরের পর কিন্তু পনের বৎসরের মধ্যে হস্তান্তর করা হইবে। -মুনাফার ৫০% ভাগ।
(ঘ) যে সমস্ত সম্পত্তি পনের বৎসরের পর হস্তান্তর করা হইবে- মুনাফার ৭০% ভাগ।
৬৮। সরকার কর্তৃক ঘােষিত “নতুন পুঁজি বিনিয়ােগ নীতির” ফলে নতুন শিল্প-কারখানার কর অবকাশের (Tax holiday) শর্তের ক্ষেত্রে কিছু সংশােধনী অপরিহার্য হইয়া পড়ায় প্রয়ােজনীয় সংশােধনী অর্থ বিলে সন্নিবেশিত হইয়াছে।
৬৯। বর্তমানে সকল আয়করদাতাকে সর্বনিম্ন ৫০ টাকা এবং কতকগুলি পেশার ক্ষেত্রে অধিক হারে প্রাক্তন প্রাদেশিক আইনের আওতায় ফাইন্যান্স ট্যাক্স দিতে হয়। স্বাধীনতা-উত্তর জাতীয় সরকারের কর প্রশাসনের পুনর্বিন্যাস এবং দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে উপরােক্ত কর রহিত করিয়া ইহার ৫০ টাকা আয়করের সঙ্গে একত্রীকরণের প্রস্তাব করা হইতেছে। এই উদ্দেশ্যে অর্থ বিলের আয়কর হার কাঠামাের পুনর্বিন্যাস সংযােজিত হইয়াছে। ইহার ফলে উক্ত কর খাতে হ্রাস-বৃদ্ধি হিসাব করিয়া নীট ১৫ লক্ষ টাকা রাজস্ব হ্রাস পাইবে।

সম্পদ কর
৭০। ১৯৭৩ সনের অর্থ আইনে করমুক্ত নীট সম্পদের নিম্নসীমা ২ (দুই) লক্ষ টাকাতে ধার্য করা হইয়াছিল। মুদ্রাস্ফীতির ফলে করমুক্ত নীট সম্পদের বর্তমান নিম্নসীমার যৌক্তিকীকরণের প্রয়ােজন হইয়া পড়িয়াছে। সেই কারণে এই সীমা দুই লক্ষ টাকা হইতে চারি লক্ষ টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব করা হইতেছে। উপরন্তু এই করের বর্তমান সর্বোচ্চ হার (৬%) অত্যাধিক বলিয়া বিবেচিত হইয়াছে। কাজেই সর্বোচ্চ হার ৩% ধার্য করিয়া হার কাঠামােটিকে পুনর্বিন্যাস করার প্রস্তাব করা হইতেছে। ইহার ফলে ২ লক্ষ টাকা রাজস্ব হ্রাস পাইবে।

বিক্রয় কর
৭১। প্রচলিত আইনানুযায়ী লাইসেন্সধারী প্রস্তুতকারক বা উৎপাদনকারীকে আমদানীকৃত কাঁচামাল বা আংশিকভাবে উৎপাদিত মালের উপর আমদানী পর্যায়ে কোন বিক্রয় কর দিতে হয় না। স্থানীয় খরিদের ব্যাপারেও লাইসেন্সধারী উৎপাদনকারী ক্রয় পর্যায়ে অনুরূপ সুবিধা ভােগ করেন। বাস্তবক্ষেত্রে এই সুবিধার
পৃষ্ঠা: ২৫৮

অপপ্রয়ােগ হওয়ায় এখন হইতে প্রত্যেক লাইসেন্সধারী প্রস্তুতকারককেও কর শােধ করিয়া কাঁচামাল খরিদ ও ছাড় করাইতে হইবে বলিয়া প্রস্তাব করা হইতেছে। পরে। কর নির্ধারণী আদেশের পর আদায়কৃত করের জন্য ক্রেডিট দেওয়া হইবে। একই কারণে লাইসেন্সধারী পাইকারী বিক্রেতার ক্ষেত্রেও অনুরূপ ব্যবস্থা উঠাইয়া দেওয়া। হইতেছে। ইহার ফলে প্রায় দুই কোটি টাকা রাজস্ব বৃদ্ধি পাইবে বলিয়া আশা করা যাইতেছে।

বাড়ী ভাড়া কর
৭২। উন্নয়নের জন্য অর্থ সংস্থান মানসে গত বৎসরে অর্থ বিলে বাড়ী ভাড়ার উপর এই কর আরােপিত হয়। রাজস্ব আয়ের উন্নতির পরিপ্রেক্ষিতে এখন অতি প্রয়ােজনীয় গৃহনির্মাণকে উৎসাহিত করিবার উদ্দেশ্যে এই কর উঠাইয়া দেওয়ার প্রস্তাব করা হইতেছে। ইহাতে প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা রাজস্ব হ্রাস পাইবে।

উৎকর্ষ কর
৭৩। অনুরূপ কারণে ১৯৭৪ সালের অর্থ বিলে উৎকর্ষ কর(Betterment tax) আরােপের বিধান করা হয়। বিতরণমূলক ব্যবসার ক্ষেত্রে আরােপনীয় করসমূহের জটিলতা বৃদ্ধি এবং তাহার বােঝা ক্রেতাসাধারণের উপর চাপাইয়া দেওয়ার প্রবণতা রােধ করিবার উদ্দেশ্যে এই করটিও রহিত করিবার প্রস্তাব করা হইতেছে। ইহার ফলে প্রায় ৯০ লক্ষ টাকা রাজস্ব হ্রাস পাইবে।

বিবিধ কর
৭৪। জনসাধারণের করভার এবং হয়রানী লাঘব করিবার উদ্দেশ্যে এবং কর প্রশাসনের পুনর্বিন্যাস ও উৎকর্ষ বিধানের স্বার্থে আরাে চারটি সামান্য রাজস্ববিশিষ্ট। কর যথা ঃ (১) জলযানের উপর আরােপিত কর, (২) মাল পরিবাহী মটরযানের উপর আরােপিত কর এবং (৩) যাত্রী ও মালের ভাড়ার উপর আরােপিত ‘টোল’ রহিত করিবার প্রস্তাব করা হইতেছে। ইহার ফলে মােট প্রায় ২৭ লক্ষ টাকা রাজস্ব হ্রাস পাইবে।
৭৫। আমি এইমাত্র যে সকল প্রস্তাব আলােচনা করিলাম তাহা হইতে অতিরিক্ত নীট ১ কোটি ২২ লক্ষ টাকা পাওয়া যাইবে। ইহার সহিত পূর্বে উল্লখিত সামান্য উদ্বৃত্ত ২৯ লক্ষ টাকা যােগ করিলে মোেট আগামী বৎসরের বাজেটের সামগ্রিক উদ্বৃত্ত ১ কোটি ৫১ লক্ষ টাকায় দাঁড়াইবে।

জনাব স্পীকার
৭৬। চলতি বৎসরে যদিও আমরা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে আশানুরূপ সফলতা অর্জন করিতে পারি নাই তবুও আমাদের এই বৎসরের সবচাইতে বড় কৃতিত্ব হইতেছে এই যে, আমরা উন্নয়ন কার্যক্রমের সাফল্যের জন্য উৎপাদন বৃদ্ধির পথ সুগম করিবার জন্য, প্রয়ােজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি ও প্রশাসন
পৃষ্ঠা: ২৫৯

যন্ত্রকে কার্যকরী ও শক্তিশালী করিবার ক্ষেত্রে কতিপয় উল্লেখযােগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করিবার প্রচেষ্টা পাইয়াছি। আমরা মুদ্রানীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কতিপয় মৌলিক পরিবর্তন আনয়ন করিতে সক্ষম হইয়াছি। সর্বোপরি জাতীয় সার্বিক প্রবৃদ্ধির প্রয়াসে আমরা দল-মত-শ্রেণী নির্বিশেষে সকলকে একক দলের নেতৃত্বে সুসংবদ্ধ করিতে সক্ষম হইয়াছি। আমার বিশ্বাস, বর্তমান বৎসরে এই দৃঢ় পদক্ষেপসমূহ আমাদের জাতীয় উন্নতির পথ প্রশস্ত করিতে বিশেষ ফলপ্রসূ অবদান রাখিবে।
৭৭। পরিশেষে আমি বলিতে চাই যে, এই বাজেট সর্বপ্রকার জাতীয় সমস্যার সমাধান করিবে এই প্রতিশ্রুতি আমি দিতেছি না, তবে এই কথা আমি দৃঢ়প্রত্যয়ের সহিত বলিতে পারি যে, আমরা উন্নয়ন কার্যক্রমের সর্বাঙ্গীণ সফলতার জন্য যে পদক্ষেপ গ্রহণে সচেষ্ট হইয়াছি তাহা জাতিকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছাইতে সাহায্য করিবে। ১৯৭৫-৭৬ সনের বাজেটের উদ্দেশ্য হইতেছে এমন একটি বাৎসরিক কর্মসূচী প্রণয়ন যাহা জনগণকে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে উদ্বুদ্ধ করিবে, দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি রােধ করিবে, জাতীয় নীট সঞ্চয় বাড়াইবার জন্য প্রয়ােজনীয় কৃচ্ছু সাধনায় উৎসাহিত করিবে এবং বিভিন্ন উন্নয়ন খাতে সম্পদের এইরূপ বন্টন নিশ্চিত করিবে যাহাতে সীমিত সম্পদের সর্বাধিক সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত জাতীয় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়।
৭৮। তবে এই সবই হইতেছে আমাদের যাত্রা শুরুর শুভ আয়ােজন মাত্র। বহু বাধা-বিপত্তির দুর্গম পথ অতিক্রম করিয়া পৌছাইতে হইবে আমাদের সম্ভাব্য সমৃদ্ধির লক্ষ্যে। তাই আমাদের সকলকে সব রকম সংকীর্ণতা ও ব্যক্তিগত স্বার্থ বিসর্জন দিয়া ত্যাগ ও সহনশীলতার মাধ্যমে দেশ গড়ার কাজে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাইতে আগাইয়া আসিতে হইবে দ্বিধাহীন চিত্তে। আমরা যদি এই প্রচেষ্টার উদ্‌যােজনে অসমর্থ হই তাহা হইলে আমাদের বহু আকাংখিত বহু রক্তের বিনিময়ে লব্ধ স্বাধীনতা নিরর্থক হইয়া যাইবে; আগামী দিনের সােনালী স্বপ্ন হইবে সুদূরপরাহত।
৭৯। অতএব আসুন আমরা বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের নীতিকে অনুসরণ করিয়া অর্থনৈতিক মুক্তি ও শােষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা গড়িয়া তুলিয়া বন্দিত জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হইবার ঐক্যবদ্ধ প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করি।

খােদা হাফেজ। জয় বাংলা।
সংক্ষিপ্ত বাজেট বক্তৃতা
২৩, জুন ১৯৭৫