This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব
অস্ট্রিক আর্যু
১৯৪৭ সালের আগস্টের মাঝামাঝি দেশবিভাগের পর স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানের শাসনভার মুসলিম লীগের উপর ন্যস্ত হয়। মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দের সবাই উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রবাহ থেকে আগত; যাদের অধিকাংশই ছিলেন নওয়াব, জোতদার এবং বােম্বাই-লক্ষী গুজরাটের পুঁজিপতি। দৈনিন্দন শাসনকার্য সম্পর্কে মুসলিম লীগ মন্ত্রীদের কোনােপ্রকার জ্ঞানই ছিল না। ফলে সমস্ত ক্ষমতা গিয়ে পড়ে আমলাদের হাতে। এই মুসলিম আমলারাও পাকিস্তান সৃষ্টিতে সমর্থন জানিয়েছিলেন। দেশবিভাগের পর রাজনৈতিক ক্ষমতা আমলাতন্ত্র কর্তৃক প্রভাবিত হওয়ায় পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিবর্তনও তাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। পাকিস্তানের ভূস্বামী এবং পুঁজিপতিদের সাথে তাদের এমন একটা সখ্য ও আঁতাত গড়ে ওঠে যা পূর্ববাংলার পক্ষে চরম সর্বনাশের সূচনা করে। দেশবিভাগের পর বেশ কিছুদিন শেখ মুজিব ভারতে ছিলেন। তিনি পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করে যুবনেতৃত্ব দান করেছিলেন সত্য, কিন্তু মুসলিম লীগের বুর্জোয়া চরিত্রকে বিশেষভাবে তিনি অনুধাবন করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, পাকিস্তানের স্বাধীনতা বাঙালির ওপর নতুন ধরনের শাসন ও শােষণব্যবস্থা চাপিয়ে দেবে, যদি না মুসলিম লীগের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে জনগণের হাতে দেয়া হয়। তাই ১৯৪৭-এর ৩ জুন ব্রিটিশ সরকার ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতা দানের কথা। ঘােষণা করার পর পরই তিনি ইসলামিয়া কলেজের ‘সিরাজুদ্দৌলা হলে ছাত্র ও যুব নেতাদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার কক্ষে মিলিত হয়েছিলেন এবং পূর্ববাংলার মুসলিম লীগ। বিরােধী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্র, যুবক ও রাজনৈতিক কর্মীদের সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এই সভায়ই তিনি বিশ্লেষণ করেছিলেন যে, মুসলিম লীগ ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করলেও জনগণ চায় অর্থনৈতিক মুক্তি। সেই মুক্তি অবশ্যই আনতে হবে। তার এই বিশ্লেষণ তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার এক অমর সাক্ষী।১
এ-প্রসঙ্গে যতীন্দ্র ভাটনগর-এর কথা স্মরণ করা যায় : “As Pakistan emerged on the horizon on August 14. 1947. There was Jubilation in Muslim regions but not so much in Bengal and politically conscious Bengali Muslim homes. It became evident right from the first days that political and administrative power. That is the real power, was surely gravitating towards West Pakistan. East Pakistan was looked down upon more or less as a colony and Bengalis as second class citizens. This was a terrible shock for the intellectuals of Bengal who had harboured great visions of a democratic set up and decisive role of East Bengal.” যতীন্দ্র ভাটনগর যা বলেছেন তার মধ্যে সত্যতা কিছুটা আছে। এদেশের মুসলিম বুদ্ধিজীবীর একটি বিরাট অংশ মুসলিম লীগের শ্রেণীচরিত্র সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। এই বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠান যে ধর্মের নামে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানকে পশ্চিমপাকিস্তানের কলােনিতে রূপান্তরিত করবে এ সম্পর্কে তারা প্রথম থেকেই আশঙ্কাগ্রস্ত ছিলেন। কিন্তু একথা ঠিক নয় যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় এদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ আনন্দিত হননি।। হােক পাকিস্তান, তবু একথা অনেকে স্বীকার করে যে, সাম্রাজ্যবাদ শক্তির হাত থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছিলাম। এই মুক্তি শুধু ধর্মীয় নয়—আর্থিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক । কিন্তু আনন্দিত হলেও অনেকের মনেই যে আশঙ্কা ও সন্দেহের উদ্রেক হয়েছিল, একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। শেখ মুজিব ছিলেন এঁদেরই একজন। ইতিহাসের ঘটনাচক্রে প্রমাণিত হয়েছে যে, পাকিস্তান ছিল বাংলাদেশ অর্জনের প্রথম সিড়ি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর ঢাকায় এসে শেখ মুজিব অল্পদিনের মধ্যেই কতিপয় স্বাধীনচেতা ও উন্নতমনা যুবকদের নিয়ে গঠন করেন পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক লীগ’। টাঙ্গাইলের জনাব শামসুল হকও ডেমােক্রেটিক লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এসময় শেখ মুজিব মুসলিম ছাত্রলীগের গােড়াপত্তন করেন। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলন সক্রিয়ভাবে দানা বেঁধে উঠেছিল ১৯৪৮ সালের গােড়ার দিকে, তথাপি দেশবিভাগের পূর্বেই বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা এ-বিষয়ে সচেতন মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। লাহাের প্রস্তাবের পর পাকিস্তান সৃষ্টিই এই উপমহাদেশের মুসলিম সমাজের আন্দোলনের একমাত্র বিষয় ছিল। ১৯৪৭-এর ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা ঘােষণার পর ভাবী পাকিস্তানের নানাবিধ সমস্যার সাথে সাথে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নও আলােচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পেছনে গ্রহণযােগ্য কোনাে যুক্তিই ছিল না। সাহিত্য সংস্কৃতিতে সে-ভাষার স্থান আঞ্চলিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাছাড়া উর্দুভাষী। লােকের সংখ্যাও ছিল অতি নগণ্য। পক্ষান্তরে বাংলাভাষা আন্তর্জাতিক মর্যাদা অর্জনের অধিকারী। তাছাড়া বাংলা ভাষাভাষী, লােকের সংখ্যা পাকিস্তানের সমগ্র লােক সংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার উপলব্ধির মধ্য দিয়ে বাঙালিরা ভাষায় প্রশ্নে যে স্বাতন্ত্রবােধের পরিচয় দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে সেটাই। বাঙালি জাতীয়তাবাদে রূপ পরিগ্রহ করে। ১৯৪৭-এর ৩ জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেনের রােয়েদাদ ঘােষণার পর মুসলিম লীগের বামপন্থী কর্মীদের উদ্যোগ ঢাকায় জুলাই মাসে ‘গণ-আজাদী লীগ’ নামে একটি ক্ষুদ্র সংগঠন করা হয়। গণআজাদী লীগের সাথে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন এবং পরবর্তীকালে শেখ মুজিব কলকাতা থেকে এসে প্রত্যক্ষভাবে। এই জাতীয় আন্দোলনে সমর্থন জানাতে থাকেন। গণআজাদী লীগ’ একটি দল। হিসেবে মূলত নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত বিষয়েই কাজকর্ম সীমাবদ্ধ রেখেছিল। ১৯৫০ সালে এর নাম পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায় “সিভিল লিবার্টিজ লীগ’। নানা কারণে এই দল একটি শক্তিশালী দল হিসেবে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক স্তরে উগ্র ইসলামপন্থীদের অনেকেই নানাবিধ কারণে বাংলাভাষার সপক্ষে জোরালাে ভাবে কাজ করেছেন। এঁদের মধ্যে তমদুন মজলিশএর কর্মকর্তা ও কর্মীদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। শেখ মুজিব এই মজলিশকে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বহু কাজে সাহায্য ও সমর্থন দান করেন। পরবর্তীকালে এই তমদুন মজলিশ যদিও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে দূরে সরে গিয়েছিল তবু ভাষা-আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে এর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। এদিকে প্রগতিবাদী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী যুবকগণ কিন্তু ধীরে ধীরে নিজেদের সংঘবদ্ধ করতে থাকেন। সেদিন গণতান্ত্রিক যুবলীগ এবং মুসলিম ছাত্রলীগ এই দুই যুবপ্রতিষ্ঠান গঠন ও যুবসমাজে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির মাধ্যমে পূর্ববাংলার অধিকার অর্জনের প্রয়াসে অন্যান্যদের মধ্যে শেখ মুজিব ও তাজউদ্দিন আহমদের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। শেখ মুজিব ছিলেন মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা। দেশে একটি সুষ্ঠু যুব-আন্দোলন গড়ে তুলতে, বাংলাভাষাকে তার যথাযযাগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে শেখ মুজিবের অক্লান্ত নেতৃত্ব বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। শেখ মুজিবসহ সকল প্রগতিবাদী ছাত্রনেতাই বাংলা ভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তােলার প্রয়ােজনীয়তা গভীরভাবে অনুভব করেন। ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ ভাষা-আন্দোলন-বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নব অধ্যায়ের সূচনা করে। ১১ মার্চের ধর্মঘটের জন্য পিকেটিং-এর সময় যেসব ছাত্রনেতা বন্দি হন, শেখ মুজিব ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
পাকিস্তান অর্জনের মাত্র দুই বছরের মধ্যেই ন্যায়ের পথে সংগ্রাম করে বিপ্লবী। যুবনেতা শেখ মুজিব কয়েকবার কারাবরণ করেন। কিন্তু কোনাে নির্যাতনের মাধ্যমেই ন্যায়ের ও সত্যের পথ থেকে তাকে বিচ্যুত করা যায়নি। এ সময়ের যুব-আন্দোলন এবং মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী শাসন ইত্যাদি কারণে নতুন রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি আসন্ন হয়ে পড়েছিল। এমনি পরিস্থিতি ১৯৪৯-এর ৩ জুন ঢাকার রােজ গার্ডেনে আওয়ামীলীগের জন্ম হয়। তখন এই দলের নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগের বিরােধীদল মওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে যে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করে, শেখ মুজিব তার সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫০-এর ১১ মার্চ গণআন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ১১ মার্চের সংগ্রাম দিবসের কর্মসূচির প্রধান উদ্যোক্তা শেখ মুজিবকে কারারুদ্ধ করা হয়। বাংলাভাষাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রতিটি শহরে, মহকুমায়, গ্রামে চলছিল আন্দোলন, সভা ও মিছিল। এই আন্দোলনের মধ্যে বাঙালি মানসের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা প্রমাণ করে যে, সামগ্রিক মুক্তিই তাদের একমাত্র কাম্য। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য শুধু বাংলাভাষাকেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত করা ছিল না; সমগ্র আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল নায্য অধিকারে বাধা সৃষ্টি থেকে। এই অধিকার যেমন ভাষার ক্ষেত্রে; তেমনি রাজনীতির ক্ষেত্রে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে এবং সমগ্র সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। এর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বাঙালি দিনের-পর-দিন ছিল বঞ্চিত, অবহেলিত এবং শােষিত। সুতরাং ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙালি তার সামগ্রিক মুক্তির সন্ধান করছিল। আর এ-কারণেই একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তস্নাত দিন থেকে আমাদের নতুন দিগন্তের পানে যাত্রা শুরু হল—যে দিগন্ত স্বাধীনতার প্রান্তসীমা পর্যন্ত প্রসারিত। দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে ও ভাষা-আন্দোলনে শেখ মুজিব একটি অত্যন্ত উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। সরকার তার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। এ কারণেই ২১ ফেব্রুয়ারির পূর্বে অনেকবার তিনি কারাবরণ করেন।
পাকিস্তান সৃষ্টির সাথে সাথে এখানকার রাজনীতির গতিধারা বড় বিচিত্র আকার ধারণ করে। একদিকে পূর্ববাংলায় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আগুন জ্বলছে, অপরদিকে পশ্চিমপাকিস্তানে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্রমাগত ক্ষমতার হাতবদল করছে। ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনের পটভূমিকায় ১৯৫৪ সালে যখন সমগ্র পূর্ববাংলাব্যাপী সাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছিল, শেরেবাংলা আওয়ামী লীগের প্রতি। তখন নির্বাচনী ঐক্যের আহ্বান জানান। এই বৃদ্ধ জননেতার বিপুল জনপ্রিয়তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আওয়ামী লীগ তাতে সমর্থন জানায়। এই নির্বাচনে শেখ মুজিব যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে মুসলীম লীগের প্রভাবশালী কোটিপতি ওয়াহিদুজ্জামানকে গােপালগঞ্জ নির্বাচনী এলাকায় তেরাে হাজার ভােটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। ২৩৭টি আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ পেয়েছিল মাত্র ৯টি আসন। যুক্তফ্রন্টের এই ঐতিহাসিক বিজয়ের পেছনে ছিল তাদের একুশ দফা কর্মসূচি। কিন্তু ১৯৫৪-এর ৩১ মে রােববার গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ পূর্ব পাকিস্তানে ৯২ (ক) ধারা প্রবর্তন করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দিলেন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। এই নির্বাচনেও শেখ মুজিব সদস্য নির্বাচিত হন। যুক্তফ্রন্টে আওয়ামী লীগের সদস্যসংখ্যা ছিল সর্বাধিক; তথাপি তাদেরকে বাদ দিয়েই যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করায় ফ্রন্টের মধ্যে ভাঙনের সৃষ্টি হল। বাধ্য হয়ে আওয়ামী লীগকে বিরােধীদলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। পরিশেষে যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনী ওয়াদা পালনের জন্য শেখ সাহেব একটা পূর্ণ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জনসমর্থন লাভের মূলে ছিল বাংলাভাষা ও সাংস্কৃতিক মর্যাদা। রক্ষার ও পূর্ববাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি। পূর্ববঙ্গের ওপরে জাতীয় ঐক্যের নামে পশ্চিমপাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন ও শােষণের অবসান—এই ধ্বনি মূর্ত হয়েছিল নির্বাচনী রায়ের মাধ্যমে। পশ্চিমপাকিস্তানের এই উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যেই শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের মাধ্যমে শুরু করলেন ব্যাপক গণআন্দোলন। ১৯৬৯-এর ২৬ মার্চে জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রদত্ত ভাষণের মূল কথা ছিল : “… শাসনতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার উপযােগী পরিবেশ সৃষ্টি করা ও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা।” সেই উদ্দেশ্যে ১৯৭০-এর ২৬ মার্চে নির্বাচনী সমাবেশে বক্তৃতা করতে বঙ্গবন্ধু মফস্বলে যাচ্ছিলেন। তাঁর সাথে একই গাড়ির পেছনের সিটে সহযাত্রী ছিলেন করাচির একটি পত্রিকার ঢাকাস্থ নির্বাচনী রিপাের্টার। চলতি কিছু ঘটনার কথা উত্থাপন করে জনৈক রিপাের্টার শেখ মুজিবকে উস্কে দিয়েছিলেন এবং সংগােপনে নিজের ক্যাসেট রেকর্ডারের বােম টিপে দিয়েছিলেন। ঐ টেপকৃত বাণীর মধ্যে মূল কথা ছিল : “ এখানে আমি যা চাইব তাতে কেউ না বলতে পারবে না। এমনকি ইয়াহিয়া খানও আমার দাবিকে উপেক্ষা করতে পারবেন না।”
১৯৭০-এর ৩০ মার্চ ইয়াহিয়া খান আইনগত কাঠামাে আদেশ (এল.এফ.ও.) ঘােষণা করেন। এল,এফ.ও.- এর মূলকথা ছিল : পাকিস্তানে তেইশ বছর ধরে চলে। আসা অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রাখার অর্থাৎ পশ্চিমপাকিস্তানের বৃহৎ পুঁজি, সামরিকবেসামরিক আমলাচক্র তাদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার অস্ত্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তীব্র ভাষায় এর প্রতিবাদ জানিয়ে বাঙালিকে এসব চক্রান্তের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। এ সম্পর্কে সিদ্দিক সালিক বলেন : শেখ মুজিবের দাবীগুলি কী ছিল? ইয়াহিয়া খানের গােয়েন্দা বাহিনীর সংগৃহীত আরেকটি টেপ থেকে সূত্রটি পাওয়া যায়। বিষয়টি লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক’ সম্পর্কিত। এটা ছিল শাসনতন্ত্রের বহিরঙ্গ চিত্র। এই আদেশ বিখ্যাত ছয় দফা বাস্তবায়নের ব্যাপারে মুজিবের হাত বেঁধে ফেলল। এল,এফ,ও-র উপর তিনি তার মতামত একান্ত নির্ভরতার সাথে বলেছিলেন তার সিনিয়র সহকর্মীদের কাছে। তিনি আঁচ করতে পারেননি যে, তার কথাগুলি ইয়াহিয়া খানের জন্য টেপ হয়ে যাচ্ছে। রেকর্ডকৃত টেপে মুজিব বলেন-আমার লক্ষ্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি ঐ এল, এফ, ও, টুকরাে টুকরাে করে ছিড়ে ফেলব। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর আমাকে চ্যালেঞ্জ করবে কে? যখন এই টেপ ইয়াহিয়া খানকে শােনানাে হল, তিনি বললেন : যদি মুজিব বিশ্বাসঘাতকতা করে তা হলে আমিও তাকে দেখে নেব। ৭০-এর নির্বাচনে বিভিন্ন চক্রান্তের মধ্যে বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, সামরিক সরকার পূর্ববাংলায় শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানীকে কাজে লাগানাের ব্যবস্থা করতে সমর্থ হয়েছিল।
‘৭০-এর নির্বাচনে বিপক্ষদের সকল জল্পনা-কল্পনাকে উড়িয়ে দিয়ে, সামরিক জান্তার সর্বপ্রকার গণনা ও ধারণা এবং প্রদত্ত রিপাের্ট ভুল প্রমাণিত করে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সর্বমােট ৩১৩ সদস্যসংখ্যা বিশিষ্ট আসনে আওয়ামীলীগ এককভাবে। ১৬৭টি আসন লাভে সমর্থ হয়। আওয়ামীলীগের এই বিজয় ছিল ঐতিহাসিক। প্রদত্ত ভােটের ৭২.৫৭ ভাগ আওয়ামীলীগ লাভ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে বাঙালির এই ঐতিহাসিক বিজয়কে নসাৎ করার লক্ষ্যে পাক শাসকচক্র নানান অপচেষ্টার আশ্রয় নেয়। শুধু তাই নয়, ছয়-দফা বাংলার জনগণের। এই ম্যান্ডেট-এর সঙ্গে আপােষ নয়-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এই দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য ও মনােভাব সম্পর্কে তখন ঢাকায় অবস্থানরত জেনারেল ইয়াহিয়া খানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন- আমাদের উপর এসব ‘ব্ল্যাক বাস্টার্ডদের’ শাসন করতে দেয়া হবে না। উনসত্তরে গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার গণমানসের অবিসংবাদিত নেতারূপে আত্মপ্রকাশ করেন। জনগণের নিরন্তর দাবি আর চাপের মুখে পাকিস্তানের সমরনায়ক প্রেসিডেন্ট আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান উত্তাল গণআন্দোলনের জোয়ারকে সাময়িক সামাল দেওয়ার জন্য নির্বাচনের পথকে বেছে নেন। ১৯৭০-এর ৫ অক্টোবর জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ঘােষণা করা হলেও পরবর্তীতে তা পিছিয়ে ৭ ডিসেম্বর পুনর্নির্ধারণ করা হয়। নির্বাচন সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের মনে ছিল শঙ্কা অনিশ্চয়তা। ১৯৭০ -এর ১৭ অক্টোবর দিনটি ছিল শেখ মুজিবের নির্বাচনী প্রচার-অভিযানের প্রথম দিন। পুরােনাে ঢাকার ধােলাইখালে লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে তিনি ঘােষণা THC 19-‘Ballet battle my last fight to secure rights of East Bengal’. পরদিন “দি পিপল’ পত্রিকায় লেখা হল :১০ Sheikh Mujibur Rahman, the Awami League Chief while addressing a compact gathering of over a lakh of cheering people at Dolaikhal area yesterday declared
that the ensuing ballot battle” would be his last fight to achieve the rights of Bengal through peaceful means. Launching his first election campaign in the old city from where he is contesting for a National Assembly seat, Sheikh Mujib reaffirmed his determination to nationalise banks and insurance companies, which have been serving the interest of the monopoly capital of West Pakistan and which have done a positive harm to the small traders of Bengal by refusing them due facilities. Sheikh Mujib said that Bonus Voucher system had destroyed the small traders of Bengal and he assured that he would safeguard the interest of the small business from the devouring grip of the big business and monopoly capital of West Pakistan. Turning to election he said that although he was seeking votes like all other parties, power was not the motto of his politics like those seasonal politicians who instead of suffering the pains of imprisonment had slaughtered the people of Bengal by joining hands with the vested interests. He said that if he had any greed for power, he could become the Prime Minister of the country immediately after his release from the prison and if he wanted to be the Governor of Bengal he could occupy that chair even without suffering the long days of imprisonmemt. But no amount of allurement could ever deviate him from his devotion to the cause of the people of Bengal. In a voice resonant with emotion, he asked the people to pray to Almighty to allow him an endurace to serve the cause of Bengal even at the cost of his life. He said that he had nothing left with him except his humble life to offer to the people in exchange of their immense love and affection and unprecedented sacrifices that saved him from being hanged. Amidst thunderous ovation Sheikh Mujib declared that if the six-point demands were not fulfilled through election, he would again call the heroic people of Dacca to join him in the struggle and give blood once again. While explaining the reason for contesting from the city constituency, he said that it was the people of Dacca who contributed the maximum blood for his release and it was in the Dacca Central Jail where he had spent 10 years of his youthful days. He claimed to be more “Daccaiya” than Khawaja Khairuddin, who incidentally happens to be of Kashmiri origin. The Sheikh claimed that he had established blood-relation with the local people with whom he had spent the best part of his life. He promised to give due consideration to them as for the local problems, particularly the provision of an alternative drainage against the sealed Dolaikhal and home for the uprooted destitutes. Sheikh Mujib said that crores of rupees were being drained in Bengal to defeat the Awami League in the next election and conspiracies were still being hatched by the vested interests to defer the transfer to the elected representatives of the pepole in the same old style that was adopted in 1954 after the historic victory of the United front. ১৯৭০-এর ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের পক্ষে বাংলাদেশের মানুষ রায় দিল। বাংলার জনগণের এই রায় ছিল তুলনাবিহীন। ১০টি মহিলা আসনসহ মােট ৩১০টি আসনের মধ্যে আওয়ামীলীগ ২৯৮টি আসনে জয়লাভ করে। ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের শপথ গ্রহণ করালেন। এদিকে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১১ জানুয়ারি ঢাকা আসেন। তিনি ৩ দিন ঢাকায় অবস্থান করেন। ঢাকায় অবস্থানকালে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের ১২ ও ১৩ জানুয়ারি আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমদিনের দীর্ঘ আলােচনা কোনাে সঙ্গী ছাড়াই শেখ মুজিব এবং প্রেসিডেন্টের মধ্যে। অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ১৩ জানুয়ারি শেখ মুজিবের সঙ্গে আলােচনাসভায় উপস্থিত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মােশতাক আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ এবং নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব এ.এইচ.এম, কামরুজ্জামান। প্রেসিডেন্টের সাথে আলােচনা শেষে ধানমণ্ডির বাসভবনে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন-জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বানের সম্ভাব্য তারিখ সম্পর্কে আলােচনা হয়েছে। ২৭ জানুয়ারি পিপিপি প্রধান ভুট্টো তার কয়েকজন সহকর্মী সঙ্গে নিয়ে ঢাকা আসলেন। শেখ মুজিব এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি কয়েকদফা আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে পাকিস্তান সরকার নানান ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান না-করার জন্য শেখ মুজিব সরকারের তীব্র সমালােচনা করেন। ৯ ফেব্রুয়ারি তার দেওয়া বিবৃতি উদ্ধৃত করে ‘দি ডন পত্রিকায় লেখা হল : Sheikh Mujibur Rahman, the Awami League Chief, regretted today the unnecessary dealy in convening the National Assembly and said it seemed another conspiracy to deprive the people of their own Government. Sheikh Mujibur Rahman reiterated that his party was detemined to frame a constitution on the basis of its sixpoint programme. He said. “We want to frame a constitution and we shall frame it on the basis of six-point programme. Those who would accept it, let them accept and those who won’t (accept) let them not accept it.” The Awami League Chief said his party was in majority in Pakistan, and it could frame a constitution. But still it sought the co-operation of others. He said: “if anyone refuses to co-operate, it will be his responsibility.” Sheikh Mujibur Rahman said that people had reposed confidence in his party and “only the representatives of the people are competent to frame a constitution for the country.” “No one else has that right to frame the constitution” he said. Sheikh Mujibur Rahman referred to his party’s victory in last December elections and their expectation to frame a constitution to help the induction of a people’s Government to solve their problems and said “conspiracy is still going on.” He said, “Pakistan’s politics is the politics of conspiracy and intrigue. Conspiracy has not yet stopped, it is still going on. But since the Bangalees have learnt to shed blood none can stop them any more. We must frame the constitution on the basis of six-points. Sheikh Mujibur Rahman said, “The Awami Leaguers are true to their promise and they don’t go back on their promise.” “If necessary, we will again suffer jail term, but we can’t deviate from the principle.” He said that he and his partymen were not afraid of anyone except God. adding that if the ruling clique had thought they could frighten them, they were mistaken. In this connection he referred to “jail-zoolum” of Ayub regime on him and other Awami Leaguers. He told the Awami Leaguers that the struggle had not ended. It had only started and asked them to remain prepared for sacrifice for the sake of posterity. Sheikh Mujbur Rahman restating his party’s stand on framing the constitution referred to the oath taken by his party MNAs at Raman Race Course for framing it on the basis of six-point and 11-point programmes. He said that in the joint meeting of the Awami League Parliamentarians in the National and Provincial Assemblies and in the Party Working Committee Meeting during the middle of february “decisions would be taken on our future coarse action.” The Awami League Chief referred to the acute food shortage, price spiral in the province and recent cyclone devastation, and said “we can’t allow our people to die and to be exploited.” He listed various problems being faced by the people and said that his party wanted to take away the resources from the exploiters and distribute those among the people. He said that after elections they had hoped to frame a constitution, and to take over the responsibility of administration and “to go all-out to solve the problems of the people.” Shekjh Mujibur Rahman said that the rulling clique and the exploiters had created such multifarious problems in different sphers of life that even if his party came to power it would be terribly difficult to solve those problems immediately. He said that Bengal had been turned into a market and colony, and its food problem had been made so acute that the province was now having in annual deficit of 2,000,000 tons of foodgrains. The Awami League Chief asked his party-men to remain prepared, adding: “If time come I will give a call to you. Power has to come to us and none can stop it. When power comes to us, we will go all out to solve the problems of our people.” He said he was hopeful of a bright and prosperous future of the Benglaless.” We will succeed because we are fighting for truth.” জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার প্রশ্নে শেখ মুজিবুর একা ছিলেন না। বাংলার মানুষের সঙ্গে পত্রপত্রিকাও এগিয়ে এসেছিল। পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে ৩ মার্চ বুধবার সকাল নটায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে বলে ঘােষণা দিলেন। সমগ্র দেশ যখন ৩ মার্চের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তখন আকস্মিকভাবেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ১ মার্চ বেলা ১ টা ৫ মিনিটে এক বেতারবক্তৃতায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করেন। প্রেসিডেন্টের ভাষণের পরপরই সারা বাংলাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকা শহর মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দও জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বঙ্গবন্ধু।
শেখ মুজিব তাৎক্ষণিকভাবে আহূত জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন—লক্ষ্য অর্জিত না-হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ, ২২ ফাল্গুন ১৩৭৭ রবিবার বাঙালির জীবনে এক ঐতিহাসিক দিন। এদিন রমনার রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ জনতার মুহুর্মুহু স্লোগানের মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা সগ্রামের আহ্বান জানালেন। এদিন এক সপ্তাহের নতুন কর্মসূচি ঘােষণা করা হল। সামরিক জান্তার এই প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনেও চক্রান্ত চলতে থাকে। চক্রান্ত ও ঘটনাসমূহ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায়। ইয়াহিয়া খান ও সামরিক চক্র চেয়েছিলেন শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে উৎখাত করতে ও এই লক্ষ্যে ভুট্টোকে দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ লাগিয়ে অধিবেশন স্থগিত ও সামরিক শাসন অব্যাহত রাখতে। আর ভুট্টো চেয়েছিলেন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যােগসাজশে তার ক্ষমতাপ্রাপ্তির পথকে প্রশস্ত করতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতির দৃঢ়তার মুখে ১৩ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খান ঘােষণা করেন যে, ৩ মার্চ তারিখে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। এদিকে বাঙালির ছয়দফা বিষয়ে আপােষের ফমূলা নিয়ে ভুট্টো নানান কথাবার্তা বলতে থাকেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি বললেন : পাকিস্তানে তিনটি শক্তিকেন্দ্র রয়েছে—আওয়ামী লীগ, পিপিপি ও সামরিক বাহিনী। এখন আওয়ামীলীগকে১২ সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কি একা যাবে না অন্যদের সঙ্গে সমঝােতায় আসবে।১৪ অন্যদিকে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২১ ফেব্রুয়ারি বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির অজুহাতে তার বেসামরিক মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন। প্রদেশসমূহের সামরিক গভর্নর ও জেনারেলদের সঙ্গে সভা করেন। এরপর হতেই সমগ্র প্রদেশকে সেনাবাহিনীর পুনঃনিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।১৫ এদিকে লাহােরের এক জনসভায় ভুট্টো ঘােষণা করেন : তার দলের কোনাে সদস্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে উপস্থিত থাকলে তাকে হত্যা করা হবে।১৬ ভুট্টোর এই হুমকি সত্ত্বেও কাইয়ুম মুসলীম লীগের ও পিপিপির সদস্যগণ দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ঢাকায় আসার জন্য প্রস্তুতি নেয়।
পাকিস্তানের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মেজর জেনারেল ওমর ব্যক্তিগতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্যের অধিবেশনে যােগদান না-করার জন্যে চাপ প্রদান করতে থাকে।১৭ এদিকে ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার লে.জে.এস.জি.এম. পীরজাদা পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আহসানকে টেলিফোনে বললেন ৩ মার্চের আহূত পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করা হয়েছে। পীরজাদার ইচ্ছানুসারে সন্ধে সাতটায় গভর্নর হাউসে ভাইস অ্যাডমিরাল এস, এম, আহসান শেখ মুজিবকে প্রেসিডেন্টের ইচ্ছার কথা অবহিত করালেন। আশ্চর্যের বিষয়, মুজিব কোনাে উদ্বেগই প্রকাশ। করলেন না বরং যুক্তিসহকারে বলেন—মার্চ-এ অধিবেশন পুনঃ আহ্বান করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব। এপ্রিল হলে বড় অসুবিধা হবে এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিষদ স্থগিত হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এদিন সন্ধ্যায় শেখ মুজিবের প্রতিক্রিয়া রাওয়াল পিণ্ডিকে জানানাে হয়, এবং বলা হয় এই ঘােষণায় যেন পার্লামেন্ট বসবার নতুন তারিখ থাকে। এর জবাবে রাওয়ালপিণ্ডি ঠাণ্ডাভাবে শুধু বলে পাঠায় : ‘Your massage fully understood’। এক গভীর ষড়যন্ত্রের আবর্তে সেদিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবর্তিত হয়েছিল, তারই প্রমাণ ১ মার্চের প্রেসিডেন্টের ভাষণ।১৮। সিদ্দিক সালিক লিখেছেন—পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘােষণার সম্পর্কে শেখ মুজিব পূর্বেই অবগত ছিলেন বলে তিনি তাঁর প্রতিক্রিয়া প্রকাশের জন্য বেশ সময় পেয়েছিলেন। ঘােষণার আধঘণ্টার মধ্যে ক্রুদ্ধ জনতা বাঁশের লাঠি, লােহার রড এবং আপত্তিকর স্লোগানে রাস্তায় নেমে আসে। স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলার প্যান্ডেলে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়।১৯
এ পরিস্থিতিতে হােটেল পূর্বাণীতে আয়ােজিত জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ মুজিব ঘােষণা করেন : ‘We can not late it go unchallened’। তিনি ২ মার্চ ঢাকায় পূর্ণ হরতাল এবং ৩ মার্চ সারা বাংলাদেশে হরতাল আহ্বান করেন এবং সরকারকে চিন্তা করার জন্য তিন দিনের সময় প্রদান করে বঙ্গবন্ধু বলেন : আগামী ৭ মার্চ জনসভায় তিনি তার পরবর্তী কর্মসূচি ঘােষণা করবেন। এ প্রসঙ্গে সিদ্দিক। সালিক লিখেছেন : জনগণের সামনে কঠিন মনােভাব দেখানাের পর শেখ মুজিব গভর্মেন্ট হাউসে এসে বললেন : এখনাে সময় আছে যদি অধিবেশন বসার নতুন তারিখ প্রদান করা হয় তবে জনগণের ক্রোধ প্রশমিত করা যাবে। তার পরে হলে ইট উইল বি টুলেট’। ঢাকায় মুখ্য সামরিক কর্মকর্তাগণ এ লক্ষ্যে চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রত্যুত্তরে শেষরাতে জেনারেল পীরজাদা জেনারেল ইয়াকুবকে অ্যাডমিরাল আহসানের নিকট থেকে ক্ষমতা অধিগ্রহণের কথা ফোনে জানালেন।২০ শেখ মুজিবের ইঙ্গিতে ও নির্দেশে সমগ্র বাঙালি জাতি উদ্বেলিত ও একতাবদ্ধ হয়ে সামরিক সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে শুরু হল অভূতপূর্ব অসহযােগ আন্দোলন। এ সময়ে ২ মার্চের রাতে কাফ্ট চলাকালে সেনাবাহিনী ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষে নিহত ছয় ব্যক্তির লাশকে সামনে রেখে ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু অনলবর্ষী বক্তৃতা করেন এবং এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সকল স্তরের জনগণকে এবং সরকারি কর্মচারীদের ‘অবৈধ সরকার’-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হবার এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একমাত্র বৈধ ক্ষমতার উৎস হিসেবে স্বীকৃতির আহ্বান জানান। ঐদিন এরকম বিবৃতি মার্শাল ল হেডকোয়াটারে পৌছলে জেনারেল ইয়াকুব রাত সাড়ে এগারাে হতে চল্লিশ মিনিট ধরে শেখ সাহেবকে উক্ত বিবৃতি তুলে নেয়া বা সুর নরম করার জন্য বহুভাবে অনুরােধ করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাদের অনুরােধ অগ্রাহ্য করেন। এ প্রেক্ষিতে জেনারেল ইয়াকুব মিনি ওয়ার কাউন্সিল ডাকলেন এবং প্রদেশের সর্বত্র সেনাবাহিনীকে সতর্ক রাখার নির্দেশ দিলেন।২২
এ-সময় দেশের অবস্থা দ্রুত পরিবর্তনের দিকে এগুতে থাকে। অবস্থা পরিদৃষ্টে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১০ মার্চ তারিখে গােল টেবিল বৈঠক ডাকার কথা ঘােষণা করলে মুজিব তা প্রত্যাখান করে বলেন : এটি একটি নিষ্ঠুর তামাশা। এ-সময়ে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটলে শেখ মুজিবের প্রস্তাবে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া হয়, তখন আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী রাজধানীর সর্বত্র চেকপােস্ট বসায় এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তুলে নেয়; এর ফলে প্রকৃত প্রস্তাবে শেখ মুজিব দেশের কর্তৃত্ব গ্রহণ করলেন। এদিকে মুজিব আন্দোলনের কর্মসূচি ঘােষণা করার জন্য ঐতিহাসিক ৭ মার্চ দিনটিকে নির্ধারিত করেন। সমগ্র বাঙালি তখন ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে উৎকণ্ঠিত। শেখ মুজিব চিন্তামগ্ন—এসময় ৬ মার্চ রাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া টেলিফোনে শেখ মুজিবকে অনুরােধ করে বলেন : আপনার (শেখ মুজিব) আশা-আকাঙ্ক্ষা আর জনগণের প্রতি প্রদত্ত অঙ্গীকারকে পুরােপুরি সম্মান করা হবে—যা ছয়-দফার চেয়ে বেশি।২৩ ৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ২৫ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘােষণা দেন। ৭ মার্চ সকালে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ফারল্যান্ড। মুজিবের সাক্ষাৎকার সম্পর্কে জি, ডব্লিউ চৌধুরী বলেন—ফারল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের পলিসি তুলে ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী (স্বাধীনতা) এই খেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে শেখ মুজিবকে কোনােপ্রকার সাহায্য না-পাবার কথা পরিষ্কার করে বলেন ।২৪ শেখ মুজিব এদের কারাে কথা শুনলেন না। ৭ মার্চের ঐ জনসভায় তিনি সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের রূপরেখা ঘােষণা করলেন। অসহযােগ আন্দোলনের এ অবস্থায় ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘােষণা করেন তিনি। বাংলাদেশের বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব নিচ্ছেন এবং বেসামরিক জনজীবন পরিচালনার জন্য একত্রিশটি নির্দেশ জারি করেন। সেনাবাহিনীর চলাচল প্রতিহত করার জন্য সংগ্রামী জনগণের প্রতিও মুজিব উদাত্ত আহ্বান জানান।
একই দিনে অর্থাৎ ১৫ মার্চে ইয়াহিয়া খান ঢাকা আসেন। ১৬ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া একান্ত আলােচনা এবং ১৭ মার্চ আনুষ্ঠানিক পূর্ণাঙ্গ আলােচনা শুরু হয়। ঐদিন সন্ধ্যায় জেনারেল টিক্কা খানকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বললেন : মুজিব সঠিক আচরণ করছে না। তুমি তৈরি হও।২৫ শুরু হয়ে যায় সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি। ২৪ মার্চ ভুট্টো ইয়াহিয়া বৈঠকে পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষায় আর্মি এ্যাকশনের বিষয়ে একমত হলেন। ঐদিন সন্ধে সাতটায় রহস্যজনক ও প্রচণ্ড গােপনীয়তায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন—কিন্তু পাক-সরকার শত ব্যবস্থা নেয়া সত্ত্বেও উইং কমান্ডার এ. কে. খন্দকার সাথে সাথে খবরটি বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দেন। ঐদিন সন্ধে সাতটায় ইয়াহিয়া খান পূর্বনির্ধারিত ভাষণ না দিয়ে চলে যাবার ফলে শেখ মুজিব আসন্ন ভয়াবহ অবস্থার কথা ভেবে নেতাদের আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে বলেন। দিনের আলাে নিভে গিয়ে শুরু হল বিভীষিকাময় রাত। যখন প্রথম গুলির শব্দ হল, তখন পাকিস্তান রেডিওর ওয়েভ লেংথের পাশে শেখ মুজিবের ক্ষীণ কণ্ঠ ভেসে। এল—মনে হল এটি পূর্ব-রেকর্ডকৃত। শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশরূপে ঘােষণা করেন।২৬ পরের দিন ২৬ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভাষণ দিলেন। বললেন : শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযােগ আন্দোলন ছিল দেশদ্রোহিতামূলক। সে আর তাঁর দল তিন সপ্তাহব্যাপী আইনানুগ কর্তৃপক্ষকে অস্বীকার করেছে। তারা। পাকিস্তানি পতাকা ও জাতির পিতার ছবির অবমাননা করে এবং সমান্তরাল (বিকল্প) সরকার পরিচালনা করেছে। তারা গণ্ডগােল, সন্ত্রাস ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে। সে যে-ঘােষণাসমূহের প্রস্তাব করেছিল তা ছিল শুধুমাত্র ফাঁদ। তার জানা ছিল সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হলে এগুলাে শুধুমাত্র কাগুজে ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে, প্রকৃতপক্ষে তখন সে পূর্ণভাবে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করত। তার ঔদ্ধত্য, একগুয়েমিতা এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন উপলব্ধির আচরণ একটি শর্তই। পূরণ করে, আর তা হল ঐ ব্যক্তি (মুজিব) ও তার দল পাকিস্তানের শত্রু। এবং
তারা পূর্ব পাকিস্তানকে সার্বিকভাবে পাকিস্তান হতে পৃথক করতে চায়। এই অপরাধ ‘উইল নট গাে আনপানিশড়।২৭ ২৫ মার্চের রাতেই লে, ক, জেড, এ খান এবং কোম্পানি কমান্ডার মেজর বেলাল পঞ্চাশ জন কমান্ডাে সৈন্যকে নিয়ে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে সেকেন্ড ক্যাপিটাল (শেরেবাংলা নগর)-এ নিয়ে যায়। পরদিন মুজিবকে ফ্লাগ স্টাফ হাউসে রাখা হল এবং তিনদিন পর ওখান থেকে সরাসরি তাকে করাচি পাঠিয়ে দেয়া হল।২৮ বাংলাদেশের সবুজ প্রান্তর ছাড়িয়ে দু’হাজার কিলােমিটার দূরে লায়ালপুরের এক নির্জন নিঃসঙ্গ সেলে শেখ মুজিব বন্দিজীবন কাটাতে থাকেন। এদিকে এক সরকারী প্রেসনােটে বলা হল শেখ মুজিবকে বিশেষ সামরিক আদালতে বিচার করা হবে। কেননা সে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেছে। … এই বিচার ১১ আগস্ট শুরু হবে, বিচারকার্য ক্যামেরায় ধারণ করা হবে এবং কার্যধারা গােপন থাকবে।২৯ এ-সময় (৩০ আগস্ট) বন থেকে প্রকাশিত এক সংবাদপত্রে বলা হয় অবশ্যই শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেয়া হবে। বিশেষ সামরিক আদালতেরপাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি শফি ইতিমধ্যে জ্ঞাত হয়েছেন যে, শেখ মুজিবকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হবে। প্যারিসের লা ফিগারাে পত্রিকায় প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন—মুজিব পাকিস্তানের শক্র।৩১ এসময় আরেকটি প্রেসনােটে বলা হয় : পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার জন্য বিশেষ সামরিক আদালতে আগস্ট ১১ তারিখ থেকে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হয়েছে। আসামী শেখ মুজিবের পক্ষে। রাষ্ট্র এ, কে, ব্রোহীকে আইনজীবী হিসাবে নিযুক্ত করেছেন। এ-পর্যন্ত বিশ জনের সাক্ষ্য গৃহীত হয়েছে। বিচারকার্য চলছে। যথাসময়ে জনসাধারণকে মামলার অগ্রগতি অবগত করানাে হবে।৩২
এদিকে ফ্রান্সের ল মান্ডে পত্রিকার সঙ্গে ২০ অক্টোবর এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন : যেখানে রাষ্ট্রের সংহতি বিপন্ন হবার হুমকির প্রশ্ন জড়িত সেখানে বিচার কার্য এভাবে পরিচালনা অস্বাভাবিক নয়। তিনি বলেন : আমি একজন (মুজিব) বিদ্রোহীর সঙ্গে কথা বলতে পারি না। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ পেরিয়ে আর একটি নতুন দিনের অভ্যুদয় ঘটল। ৮ মার্চে বিচিত্রমুখী ঘটনায় পূর্ণ এ দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ সংবাদপত্রের এক বিবৃতিতে শেখ মুজিব ঘােষিত কর্মসূচির ব্যাখ্যা ও অব্যাহতি ঘােষণা করেন। এদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সংস্থা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শর্ত মেনে নিয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় রােধে যত্নবান হওয়ার জন্য প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানান। ১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান একটি বিশেষ বিমানে করাচি থেকে ঢাকা এসে পৌছান। একই দিনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ইতিমধ্যে ঘােষিত পঁয়ত্রিশটি নির্দেশাবলির কতিপয় ব্যাখ্যা প্রদান করেন। এদিকে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আহূত অসহযােগ আন্দোলন ও দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন দান অব্যাহত থাকে। ১৬ মার্চ মঙ্গলবার, অসহযােগ আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায়ের দ্বিতীয় দিন। এদিন প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান আড়াই ঘণ্টাব্যাপী রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করেন। আলােচনা-শেষে শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট ভবন ত্যাগ করলে বহিদ্বারে অপেক্ষমাণ দেশী-বিদেশী সাংবাদিকবৃন্দকে জানান যে, রাজনৈতিক ও অন্যান্য পরিস্থিতি নিয়ে তারা উভয়ে আলােচনা করেছেন। তবে আলােচনা চলছে এবং আরাে চলবে। এর বেশি তাঁর (শেখ মুজিব) কিছু বলার নেই। ১৭ মার্চ বুধবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠক সম্পন্ন করেন। শেখ মুজিব লক্ষ্য অর্জিত না-হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত রাখার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
১৮ মার্চ ১৯৭১ বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনে অপেক্ষমাণ বিপুল সংখ্যক দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন : জনগণ ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ় সংকল্প। আজ আর কোনাে শক্তিই বুলেট বা মেশিনগানের জোরে বাংলাদেশের মানুষকে দমাইতে পারিবে না। আপনারা কি মনে করেন যে, জনগণের কণ্ঠকে বুলেট ও মেশিনগানের জোরে স্তব্ধ করা যাইবে। জনগণ যখন ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ় সংকল্প হইয়াছে তখন তাহারা নিশ্চয়ই তাহাদের লক্ষ্য হাসিল করিবেই। ৪। একদিন বিরতির পর ১৯ মার্চ শুক্রবার পুনরায় মুজিব-ইয়াহিয়া তৃতীয় দফা বৈঠক শুরু হয়। ঢাকাস্থ প্রেসিডেন্ট ভবনে সকাল এগারােটা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আলােচনা করেন। ২০ মার্চ ১৯৭১ শনিবার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু চতুর্থ দফা আলােচনায় মিলিত হন। আলােচনাকালে শেখ মুজিবের সঙ্গে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মােশতাক আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান, তাজউদ্দিন আহম্মদ এবং ড. কামাল হােসেন। অপর পক্ষে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ছিলেন বিচারপতি কর্নেলিয়াস, লে. জেনারেল। পীরজাদা ও কর্নেল হাসান। উভয়পক্ষের আলােচনার স্থায়িত্বকাল ছিল সােয়া দু’ঘণ্টা। আলােচনা শেষে শেখ মুজিব বলেন : “আলােচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে।” ২১ মার্চ ১৯৭১ রবিবার অসহযােগ আন্দোলনের বিংশতম দিবস। এদিন আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ও ইয়াহিয়া খান এক অনির্ধারিত বৈঠকে মিলিত হন। ৭০ মিনিট স্থায়ী এ আলােচনাকালে শেখ মুজিবের সঙ্গে ছিলেন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ। ২২ মার্চ ১০টা ৫৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে পুনরায় বৈঠকে মিলিত হন। ষষ্ঠ দফার এই আলােচনায় পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোও যােগদান করেন। সােয়া ঘণ্টা স্থায়ী এই যুক্ত বৈঠক শেষে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আলােচনায় অগ্রগতি না হইলে আমি কেন আলােচনা চালিয়ে যাবাে? প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদিন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন যে, সংকট অতিক্রম সম্ভব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে পশ্চিমপাকিস্তানি সকল নেতা এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বারবার আলােচনার পরও ২২ মার্চ গভীর রাত পর্যন্ত কোনাে সমাধান মেলেনি।
স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে সারাদেশে ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হল। জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কালাে পতাকার পাশাপাশি প্রতি ঘরের শীর্ষে স্বাধীন বাংলার সবুজ জমিনে লাল সূর্যের মাঝে সােনালি রঙের বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা নতুন পতাকাটিও ওড়াল। এদিকে পল্টন ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। জয়বাংলা বাহিনী পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করেন। এদিন মঙ্গলবার শেখ মুজিবের সঙ্গে পশ্চিমপাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের এক যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জাতীয় পরিষদের পশ্চিমপাকিস্তানের পার্লামেন্টারি দলসমূহের চারজন নেতা শেখ মুজিবের বাসভবনে ৯০ মিনিট স্থায়ী এক যৌথসভায় মিলিত হন। সভায় ছিলেন পশ্চিমপাকিস্তানের ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খান, কাউন্সিললীগ প্রধান মিয়া মমতাজ দৌলতানা, জমিয়তুল ওলামায়ে পাকিস্তানের সাধারণ সম্পাদক মুফতি মাহমুদ ও জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সভাপতি মওলানা আহমদ নুরানী। আলােচনা বৈঠকে বেলুচিস্তান ন্যাপের সভাপতি জনাব গাউস বক্স বেজেঞ্জো ও পাঞ্জাব কাউন্সিললীগের সভাপতি সরদার শওকত হায়াত খানও উপস্থিত ছিলেন। আলােচনায় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খােন্দকার মােশতাক আহমদ, তাজউদ্দিন আহমদ এবং ড. কামাল হােসেন উপস্থিত ছিলেন। এদিন সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামীলীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ এবং ড. কামাল হােসেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টাদের সঙ্গে পুনরায় বৈঠকে মিলিত হন। এদিকে প্রখ্যাত আইনবিদ এ. কে. ব্রোহী সম্প্রতি ঢাকা সফরকালে অবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি আইনগত ফর্মুলার কথা উল্লেখ করে বলেন যে, ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রকৃতপক্ষে আইনগত কোনাে বাধা নেই। উদাহরণ হিসাবে তিনি Indian Independence Act- এর কথা উল্লেখ করেন।৩৫ ২৩ মার্চ দেশের বিভিন্ন অংশে বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গা সংঘটিত হয়। ২৪ মার্চ বুধবার পশ্চিমপাকিস্তানি নেতৃবর্গ একে একে ঢাকা ত্যাগ শুরু করেন। অন্যদিকে ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ ও ড. কামাল হােসেন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টার সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাগণ ছিলেন বিচারপতি কর্নেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা ও লে. কর্নেল হাসান। উভয় পক্ষের বৈঠক ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট স্থায়ী হয়। আলােচনা শেষে আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, “অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করা চলে না। বিলম্বে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে।”
২৪ মার্চ বুধবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার বাসভবনের সম্মুখে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণদানকালে বলেন
“লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে।” তিনি আরও বলেন—“বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি এবং তাদের অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠিত নাহওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। যে-কোনাে পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকিয়া আন্দোলন চালাইয়া যাওয়ার জন্য তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। শেখ মুজিব আরও বলেন—আরও প্রচণ্ড সংগ্রামের আদেশ দেওয়ার জন্য আমি বাঁচিয়া থাকিব কি-না জানি না, কিন্তু আপনারা নিজেদের অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অবশ্যই সংগ্রাম অব্যাহত রাখিবেন।” ২৫ মার্চ ১৯৭১, চৈত্র ১৩৭৭ বৃহস্পতিবার। এদিন সকালেও পিপিপি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে ৪৫ মিনিট ব্যাপী এক বৈঠকে মিলিত হন। ঢাকা নগরীতে প্রতিদিনের মতাে এদিনও মিছিলের ঢল নামে। ২৪ ও ২৫ মার্চ-এ সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে শেখ মুজিব ২৭ মার্চ সারাদেশে হরতাল আহ্বান করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ২৫ মার্চের এই আহ্বানপত্র পত্রিকায় প্রকাশ হল। পাকিস্তান টাইমস লিখল :
“Sheikh Mujibur Rahman today gave a call for a general strike throught “Bangladesh” on March 27th as a mark of protest against “heavy firing upon the civilian population in Saidpur, Rangpur & Joydevpur”. In a statement he declared that such “atrocities and killing of unarmed people would not go unchallenged.” He said, “I am shocked to hear of the military action in Saidpur, Rangpur and Joydevpur. There are reports of heavy firing upon the civilian population and of atrocities being committed on them. The police are being totally by-passed while a reign of terror is being unleashed. From Chittagong reports are pouring in of heavy firing.” He said all this happend while the Presidents is at Dacca for the declared purpose of resolving politically the grave crisis facing the country. I urge him to order immediate cessation of such military operations,” he said. It should be known that such atrocities and killing of unarmed people shall not go unchallenged. I am confident that the brave sons of “Bangladesh” are ready to face all eventualities in order to attain their goal, that is, the emancipation of the people of the “Bangladesh” he addied.
The following exemption shall be allowed during the strike: Hospitals, ambulances, doctors’ cars, medicine shops, press and press cars, water, gas and electric supply. According to another message, Sheikh Mujib today called upon the people to remain prepared for supreme sacrifices “to realise your rights.” Addressing a huge procession from Royerbazar area, the Sheikh said: “If some of us have to die again for our rights, this will be the last time.” He said there mst not be any relaxation in the movement in which the people of East Pakistan had demonstrated their unity. The Sheikh said that the Bangaless were dying every year in floods and cyclones. “it seems they are born to die in this calamities,” he added. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২৫ মার্চ পুনরায় জনগণের দাবি মেনে নেওয়ার জন্য সামরিক 67105 10 ORIGATA 739 91 “ONLY WAY OUT IS TO ACCEPT AWAMI LEAGUE DEMANDS IN TOTO” fata 671 : “The Awami League Chief, Sheikh Mujibur Rahman, reierated here today that on power on earth could now frustrate the just and legitimate demands to the 75 million people of East Pakistan. The Awami League Chief addressed a number of processions which marched upto his Dhanmondi residence today. He said, “Our demands are just and clear and there is no other way out than to accede to the demnands in toto.” Sounding a stern note of warning against the conspirators whole, he said, were active again to sabotage the united movement of the East Pakistanis, Sheikh Mujib asked them not to play with fire. This might lead to dire consquences for the counntry. He asserted that the uprecedented unity of 75 million people of East Pakistan was bound to realise their legitimate demands. These could not be suppressed by force now whatever its strength. If anyone showed his eyes to suppress the poeple’s rights we would not tolerate and would crush it, he added. The Sheikh asserted that Bengalees would either live as free citizens of the country or would perish but would never bow down to the unholy clique.
He called upon the people to continue the movement until their legitimate demands were fully accepted and they were emancipated. The staff and employees of the Hotel Intercontinental today ceremoniously hoisted a regular sized ‘Joy Bangla flag’ replacing the smaller one at the main mast. The new flag measuring 100 x 60 inches was unfurled in the presence of a large number of people including foreign journalists. Sheikh Mujibur Rahman had a series of dicussions today with his front ranking party aids on the latest political development and the situation at Chittagong Saidpur and Rangpur. Curfew was re-imposed in Rangpur for 14 hours beginning from 5 p.m, today according to the reports reaching here tonight. The 24 hour curfew, which was imposed there last night, was relaxed for five hours earlier in the day today. “4 বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বর্তমান ঘটনার রাজনৈতিক সমাধানে অসহনীয় বিলম্বে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি আর কালবিলম্ব না করে উদ্ভূত সমস্যার দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান চাইলেন। শেখ মুজিবের ২৫ মার্চ দেওয়া বিবৃতির উল্লেখ করে পত্রিকায় লেখা হল : MUJIB REGRETS DELAY IN POLITICAL SOLUTION ATTEMTS TO DIVIDE BENGALEES AND MOHAJIRS CONDEMNED Sheikh Mujibur Rahman, Awami League Chief, today expressed concern over the “regrettable delay in resolving the crisis politically” and termed it as ” unfortunate.” He said that if a “political solution is desired” by President Yahya Khan and his advisers they should ” realise that it was for them to take matters immediately. to a conclusion, and that to delay this would expose the country and its people to grave hazards.” In a statement to the press here tonight, the Awami League Chief said: “We have done our duty and contributed our utmost efforts towards the attainment of the political solution.” He apprehended that certain elements have been deployed by the anti-people forces to foment tension between locals and non locals and said: “let those evil forces of destruction know that their conspiracles cannot succeed when 75 million people are united in
their determination to make every sacrifice and to resist those who seek to impose upon them by force.” The Awami League Chief said: “The arrival of the President in Dacca and his subsquent talks had led the people to expect that there was a realisation that the grave crisis engulifing the country could noly be resolved politically. It was for this reason that I met the President. The President affirmed that there could only be a political solution of the crisis. Upon that promise, certain fundamental principles on which such a solution would be based were accepted by the President. Subsequently, my colleagues sat with the Presidents advisers to work our those principles. We have thus done our duty and contributed our utmost efforts towards the attainments of a political solution. There is no reason or justification for any delay. If a political soultion is desired by those concerned they should realise that it is for them to take matters immediately to a conclusion, and that to delay this would expose the country and its people to grave hazards. It is therefore, unfortunate that here is regrettble delay in resolving the crisis politically. Indeed the critical situation already pervailing is being aggravated by renewed military activities, the pace of which, according to reports from different parts of Bangla Desh, is being stepped up. This is all the more regrettable at a time when the President is in Dacca for the declared purpose of resolving the crisis politically. After last week’s firing at Joydevpur, reports of atrocities are pouring in from Rangpur, Saidpur, where curfew has been imposed. From Chittagong, there are reports of heavy firing on the civilian population. Issue of Non-Locals “What is more reprehensible is that certain elements have been deployed by the anti-people forces to foment tension between locals and non-locals’. I have repeatedly re-affimed that all those who live in Bangla Desh, regardless of their place of origin or the language they speak, are our people, and they should consider themselves as such and take full part in the struggle for emancipation of Bangla Desh. Their life, property and honour are our sacred trust. It is, therefore, clear that those who are fomenting tension are doing so for the malicious purpose of sabotaging a political solution and creating a pretext for use of force against unarmed people. Let the people of the world take notice that while we have been exerting our utmost towards the attainment of a political solution, there are certain evil elements still bent upon making a last desperate bid to impose a solution by force. Let those evil foreces of destruction know that their conspiracies cannot succeed, when seventy-five million people are united in their determination to make every sacrifice and to resist those who seek to impose upon them by force. I condemn the firing that has taken place and the atrocities that have been committed in different parts of Bangla Desh. A general strike shall be observed on the 27th March 1971, throughout Bangla Desh to protest against such firing. I urge those concerned to desist from creating situation of confrontation between the military and the unarmed civilian population. If they fail to take heed and continue to resort to military confrontion, they will bear full responsibility for aborting a political solution and for all the grave consequences that would follow. I urge our heroic people to continue with their strugggle. Our economy, however, must function normally and indeed every person must consider it his sacred duty to ensure that the economy functions with maximum efficiency. Our workers in the mills and factories bear a heavy responsibility in this matter. They must take all steps to maintain normal conditions in which maximum production can be attained. Our movement shall go forward. The directives issued on the 14th March 1971, shall continue in force, subject to the clarification issued from time to time.” ২৫ মার্চ দুপুরের পর থেকেই একটা থমথমে ভাব বিরাজ করতে থাকে। ঢাকাসহ সারাদেশে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ল। এমন খবরও পাওয়া গেল যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সকল দাবি মেনে নিয়েছেন। এদিন সকাল থেকেই সেনাবাহিনীকে বেশ তৎপর হতে দেখা গেল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চলাইট’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সকল পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে এদিন সন্ধ্যার কিছু পূর্বেই গােপনে করাচীর উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করলেন।
নিউইয়র্ক টাইমস সংবাদদাতা সিডনি শনবার্গ ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থান করছিলেন। ঐদিনের এক রিপাের্টে তিনি উল্লেখ করেন : ৭৫ মিলিয়ন মানুষের পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ধ্বংস করার জন্য নিরস্ত্র সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে পাকবাহিনী কামান ও ভারী মেশিনগান ব্যবহার করছে কোনাে সতর্কীকরণ ছাড়াই বৃহস্পতিবার রাতে আক্রমণ শুরু হয় । প্রথমদিকে গােলাগুলি চলছিল বিক্ষিপ্ত, তবে রাত একটার দিকে তা জোরদার ও বিরামহীন হয়ে ওঠে.। বিদেশী সাংবাদিকরা সকলেই অবস্থান করছিলেন হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। হােটেলের আশেপাশে গােলাগুলি। বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং রাত একটার দিকে গােটা শহরেই গুলিবর্ষণের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনও আক্রান্ত হল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ত্বরিত আক্রমণ চালিয়ে সে রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং তারপর পাকিস্তান। শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করে সারাদেশে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর বর্বর হামলার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য বাঙালিদের প্রতি আহ্বান জানালেন। সংবাদপত্রে লেখা হল : BANGLADESH DECLARES FREEDOM-RAHMANS STEP FOLLOWS ARMY CRACDOWN-CIVIL WAR ERUPTS IN EAST PAKISTAN-AWAMI LEAGUE LEADERS GO UNDERGROUND “Pakistan’s Eastern Wing, rechristened the independent State of Bangla Desh by Sheikh Mujibur Rahman in a clandestine Radio Broadcast, was in the throes of a civil war on Friday with west wing troops resorting to force to regain control and the people aided by the East Pakistan rifles and the police, resisting the attermpt, reports UNI. Heavy fighting was going on in Dacca, Chittagong. Sylhet, Comilla and other towns, according to reports from across the border gathered by UNI Bureaus in Shillong and Calcutta and correspondents close to the border in the eastern sector. Casualties were believed to be heavy. Mr. Rahman and other Awani League leaders had gone underground, according to highly reliable reports received in Gauhati by PTI and UNI. A later reports said Pakistan troops went hunting for them but could not find them.
Speaking over “Swadhin Banla” (Free Bengal) Betar Kendra. Mr. Rahman later proclaimed the birth of an independent Bangla Desh. The declaration was made shorly before General Yahya Khan went on the air in the West wing to announce that the army had been instructed to reassert the Government’s authority in the East wing. He Called Mr. Rahman and his followers traitors. Mr. Rahman in his broadcast derlared definitely: “We shall not die like cats and dogs, but shall die as worthy children of Bangla Ma (Mother Bengal)” adding “The flage of Bangla Desh is flying in all villages of Bangla Desh”. The broadcast said presonnel of the East Bengla regiment the East Pakistan Rifles and the entire police force had surrounded West Pakistani troops in Chittagong, Comilla, Sylhet, Jessore, Barisal and Khulna. Heavy fighting was continuing, it said. An announcer on the clandestime radio station evidently located in the northern region of East Bengal, said, “The Sheikh has declared the 75 million people of East Pakistan as citizens of the sovereign independent Bangla Desh”. The broadcast called upon the people of free Bangla Desh to continue the current movement til the last enemy soldier was vanquished. It said Mr. Rahman was the only leader of the people of independent Bangla Desh and his commands should be obeyed by all sections of people to save the country from the ruthless dictatorship of West Pakistanis. Mr. Rahman in his broadcast asked the people to resist the enemy forces at any cost in every corner of Bangla Desh. May Allah bless you and help in your struggle for freedom from the enemy he said. Freedom at all costs Mr. Rahman said: “Pakistan armed forces suddenly attacked the East Pakistan Rifle base at Peelkhana and Rajabag police station in Dacca at zero hours on March 26, killing a number of unarmed people. Fierce fighting is going on with East Pakistan Rifles at Dacca. “People are fighting gallantly with the enemy for the cause of freedom of Bangla Desh. Every section of the people of Bangla Desh are asked to resist the enemy forces at any cost in every corner of Bangla Desh. May
Allah bless you and help in your struggle for freedom from the enemy. Jai Bangla.” The first victim of the military crackdown in the province was Dacca Betar Kendra, the worlds’ only source of news from East Pakistan. Troops seized the radio station early on Friday and announced a 24 hour curfew in Dacca and its surrounding areas. When the radio came back on the air it announced itself as “Radio Pakistan Dacca” and broadcast 16 martial law orders. All flights between Karachi and Dacca have been suspened and teleprinter links between the two cities cut. At least 10,000 West Pakistani troops have landed at Chittagong and Chalna (Khulna district) during the last 24 hours. They arrived in the five ships and have since been dispersed to the three cantonments in Dacca, Comilla and Jessore. This brings the total number of trops in Pakistan to 70.000.80 ভারত উপমহাদেশে অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের জন্মদান করেন মহাত্মা গান্ধী। ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ আরম্ভ হবার পর গান্ধীজি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে আসেন এবং যে সত্যাগ্রহ আন্দোলন তিনি আফ্রিকার অধিকারবিহীন ভারতীয়দের জন্য শুরু করেছিলেন, ভারতে তিনি তার সূত্রপাত করেন। কিন্তু গান্ধীজির জীবনে যা বহুলাংশে সম্ভব হয়নি, শেখ মুজিব বাংলাদেশের মাটিতে তা সম্ভব করে তুলেছিলেন। ৩ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত তার অহিংস অসহযােগ আন্দোলন যে সাফল্য অর্জন করে, সত্যাগ্রহের ইতিহাসে তা একান্তভাবেই দুর্লভ। এ-বিষয়ে বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস বলেছেন : “On 3 March Mujibur Rahman called a provincewide strike and launched a non-violent non-co-operation movement … Every where the people responded to Sheikh Mujib’s appeal and the movement became more orderly and effective; … Restoration of order in Dacca was assisted by the withdrawal of troops after it was found they could not enforce the curfew. The troops also began to sell the Pinch of hunger as supplies, including foodstuffs, were denied on the orders of the Awami
league.”৪১
অন্যত্র ম্যাসকারেনহাস বলেছেন : “অসহযােগ আন্দোলন বিস্তার লাভের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের মনােভাবও কঠোর হতে লাগল এবং উপর্যুপরি কয়েকবার হরতালের ফলে প্রদেশের কর্মপ্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল। …”৪২। বঙ্গবন্ধুর এই অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের সাফল্য সম্পর্কে শুধু পূর্ববাংলার কাগজগুলাে নয়, পশ্চিমপাকিস্তানের পত্রপত্রিকাতেও৪৩ বিস্ময় প্রকাশ করা হল। এই সাফল্য সম্পর্কে একজন পণ্ডিত আইনজীবী বলেছেন : The response of the entire people in East Bengal to the call of their leader was spontaneaus, complete and overwhelming. Since in contemporary international law the effectiveness of an authority is to be measured by the popular support it commands, the authority of Mujib and his Awami league in East Bengal was conclusively proved by the success of the movement between 1 and 25 of March.88 সুতরাং এই অচিন্তনীয় সাফল্যই প্রমাণ করে যে, শেখ মুজিব শুধু নির্বাচনে বিপুল ভােটাধিক্যে জয়লাভ করেছিলেন তা নয়, পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ তার নির্দেশেই পথ চলতে উদগ্রীব; ইয়াহিয়া বা অন্য কোনাে কায়েমী স্বার্থবাদী ব্যক্তির আদেশে নয়। ব্যারিস্টার সুব্রত রায় চৌধুরীর একটি মূল্যবান উক্তি এখানে স্মরণ করা যায়। তিনি লিখেছেন : “By admitting the total suceess of the non-co-operation movement. Yahya had admitted the forfeiture of his lawful authority to administer the country. It was the writ of Mujib alone which ran throghout East Bengal during the three weeks of peaceful non-co-operation movement, there was no one to carry out the orders of the military janta. It Mujib could run a parallel Government in East Bengal, it was only because he had the unstinted loyalty of seventyfive million people. If Yahya’s authority was ignored during the three weeks of March 1971, it only proved the truth of the immortal Lincoln concept that bullets can never successfully replace ballots. The
minimum right of the people in East Bengal to launch a peaceful non-co-operation movement for achieving self determination can never be in dispute. This is an acknowledged right of the people.”8€ মুজিব অহিংস অসহযােগ আন্দোলনে একান্ত বিশ্বাসী। গান্ধীবাদে নিশ্চয়ই তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু শান্তি যে শুধু অহিংস ও অসহযােগ কার্যক্রমের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব একথা তিনি বিশ্বাস করেন না। মার্চ মাসের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান একটি বিশেষ তাৎপর্যময়। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ‘জয়বাংলা’ স্লোগানটি প্রথম উদ্ভাবিত হলেও বঙ্গবন্ধু যখন এই স্লোগানকে একটি স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করলেন মাত্র তখন। থেকেই তা সমগ্র দেশে, এমনকি ভারতবর্ষে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। ১৯৭০-এর ১১ জানুয়ারি তারিখ পল্টনের জনসভায় শেখ মুজিব এই স্লোগানটিকে নিজের স্লোগান। এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের অন্তরের স্লোগান হিসেবে গ্রহণ করেন। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর এক জীবনীকার কহন লিখেছেন : “১৯৭০ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নির্মিত মঞ্চের দেবদারু পাতার পশ্চাৎপটের ওপর ফুল দিয়ে প্রথম ‘জয় বাংলা’ শব্দ দুটি লেখা হয়। তারপর ‘জয় বাংলা’ লেখাটি নিয়ে ছাত্রলীগের ছেলেদের মিছিলও বের হয়। কিন্তু সাধারণের মধ্যে ধ্বনিটির প্রচার ঘটে ১৯৭০ সালের ১১ই জানুয়ারি থেকে। ১৯৭০ সালের জানুয়ারির গােড়ায় রাজনেতিক দলগুলাের ওপর থেকে ইয়াহিয়া আরােপিত বাধা-নিষেধ তুলে নেয়া হল। রাজনৈতিক সভা অনুষ্ঠানের উপর থেকে বাধা নিষেধ তুলে নেয়ার পর ১১ই জানুয়ারি শেখ সাহেব পল্টন ময়দানে প্রথম জনসভা করলেন। ওই দিনই প্রথম প্রকাশ্যে সভামঞ্চের সামনে হার্ডবাের্ডে বড় বড় হরফে ছাত্ররা লিখেছিলেন ‘জয় বাংলা’ শব্দ দুটি। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি আজ এপার বাংলা ওপার বাংলার হাজার হাজার মানুষের কণ্ঠে রণিত হচ্ছে। বাংলাদেশের রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের বীজমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ‘জয় বাংলা’। গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব জয়ের পিছনে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি একটি ফ্যাক্টর’। শেখ মুজিবের অসহযােগ আন্দোলনের সময়ে ঢাকায় দেখা গেছে, একজন রিকশাওয়ালা আর একজন রিকশাওয়ালাকে দেখলেই ‘জয় বাংলা’ বলে কুশল বিনিময় করছে। ক্রমশ সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এটা একটা রেওয়াজে দাঁড়িয়ে যায়।”৪৬ ১৯৭১-এর ১ মার্চ দুপুরের পর পূর্ববঙ্গের রাজনীতিতে, গণআন্দোলনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল।
কলহন বলেছেন : “৩রা মার্চ পল্টনে ছাত্রলীগ আয়ােজিত জনসভায় মুজিবের সামনেই ‘আমার সােনার বাংলা সঙ্গীতসহ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তােলা হল। স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের কথা ঘােষণা করে ইস্তাহার বিলি করা হল। যে ইশতেহারটি হাতে নিয়ে বিশাল জনসমুদ্রে শেখ মুজিব ঘােষণা করলেন যে, এই ইশতেহারে যেসব কথা লেখা আছে সেসবই আমার নিজেরও কথা। শেখ মুজিব ওই জনসভায় অহিংস অসহযােগ আন্দোলন চালিয়ে যাবার আহ্বান জানালেন। শেখ মুজিব বললেন : হিংস্রতা আন্দোলনের পক্ষে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।”৪৭ অসহযােগের সময়, দেশে যে একটি ব্যাপক গণহত্যার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর একাধিক ভাষণে আর পরিচয় বিধৃত হয়েছে। এই সময়ের সামগ্রিক পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে এবং সমগ্র ঘটনাপঞ্জি এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়ায়। এই সময়ের পরিস্থিতি কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিকের চোখে বিশেষভাবে ধরা পড়েছে। বিশিষ্ট সাংবাদিক এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস বলেছেন : লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান প্রেসিডেন্ট কর্তৃক আকস্মিকভাবে বরখাস্তকৃত গভর্ণর আহসানের কাছ থেকে প্রদেশের দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য ঢাকায় আগমন করে। গােলযোেগ দমনের কাজে টিক্কা খানের পাকা হাত ছিল। টিক্কা খানের উপস্থিতির ফলে সরকারের অনুকূলে পরিস্থিতির কোনাে উন্নতিই লক্ষিত হল না। বরং অবস্থার আরাে অবনতি ঘটল। বাঙালিদের আইন অমান্য আন্দোলন আরাে জোরদার হয়ে উঠল। … সরকারি পরােয়ানা প্রদেশের প্রায় সর্বত্র, বিশেষ করে সগ্রামের কেন্দ্রস্থল ঢাকায় কার্যকর হয়নি। আন্দোলনের গভীরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা দাবির ব্যাপকতাও বেড়ে চলল। শীঘ্রই সকলের দৃষ্টি ঢাকা ঘােড়দৌড় ময়দানের দিকে নিবদ্ধ হল, যেখানে ৭ই মার্চ তারিখে শেখ মুজিব স্বাধীনতার কথা ঘােষণা করবেন বলে সবাই আশা করেছিল। নিঃসন্দেহে এমন একটা সঙ্কটকাল এগিয়ে এল, যা ছিল সমস্ত প্রত্যাশার অতীত। প্রেসিডেন্ট দ্রুত কঠোর কর্মব্যবস্থা গ্রহণ এবং পরিকল্পনায় আমূল পরিবর্তনের সিদ্ধান্তে পৌছলেন।… ইয়াহিয়া খান কী করবেন তা ৫ই মার্চের অপরাহে তাঁর মনে স্পষ্ট হয়েছিল। তার উদ্দেশ্য সাধনের কৌশল হবে প্রয়ােজনীয় সামরিক শক্তিকে যােগান দেয়া, প্রস্তুতির জন্য সময় নেয় এবং যথোপযুক্ত মুহূর্তে মরণ আঘাত হানা।… স্পষ্টত ইয়াহিয়া খান কেবল ঘােড়দৌড় ময়দানে সভার প্রাক্কালে শেখ মুজিবের অন্ত্রকে ভোতা করে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন, যেখানে শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘােষণা করবেন বলে সবাই আশা করেছিল। এটা ছিল সুপরিকল্পিত জুয়াখেলা। অন্তত এই সময়ে তিনি হিসাবে ভুল করেননি।
মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ ও ওয়ার্কিং কমিটি এবং এই দলের নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যগণ ফাঁদে আটকা পড়লেন। ঘােড়দৌড় ময়দানের সভায় সম্মিলিত জনগণের অনেককে হতাশ করে বহু আকাক্ষিত স্বাধীনতা স্পষ্টত ঘােষিত হয়নি। তার পরিবর্তে শেখ মুজিব স্বাধিকার অর্জন’এর জন্য আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন যে, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ এবং ‘এবারের সংগ্রাম-স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই আন্দোলন ইয়াহিয়া খানের শাসনব্যবস্থার কাছে যতই ধ্বংসাত্মক ও অপ্রীতিকর মনে হােক না কেন, এটা পূর্ববাংলায় সামরিক প্রস্তুতির জন্য আকাক্সিক্ষত সময় দিয়েছিল। জনগণের একজন বিপ্লবী নেতা হিসাবে আওয়ামী লীগ প্রধান যে সুনাম অর্জন করেছিলেন, তার প্রতি তার আস্থা থাকলে তিনি টিক্কা খানের আত্মসমর্পণের দাবি করে তাঁকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার জন্য দৃঢ় মনােভাবাপন্ন লাখ লাখ বাঙালীকে চার মাইল দূরে অবস্থিত পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান সেনা নিবাসে পাঠাতেন। বাঙালিরা তা করার জন্য প্রস্তুত ছিল এবং সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করার জন্য সানন্দে কয়েকশাে লােক জীবন বিসর্জন দিত। তখন ন্যূনতম রক্তপাতে বাংলাদেশ বাস্তবে রূপ লাভ করত। পরবর্তীকালে কিছুতেই লাখ লাখ লােক নিহত হত না। এবং সেনাবাহিনীর বর্বরতায় শিকার হয়ে অগণিত লােক দেশত্যাগ করত ।”৪৮ ম্যাসকারেনহাস আরাে বলেছেন : “৩রা ও ২৫শে মার্চের মধ্যে সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত বাঙালি সদস্যগণ পৃথকভাবে তিনবার শেখ মুজিবের নির্দেশ লাভের জন্য তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, কেননা যা ঘটতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে তাদের কোনাে সংশয় ছিল না। প্রতিবারই শেখ মুজিব তাদের সঙ্গে সময়ােচিত ব্যবহার করেছেন কিংবা মামুলি কথা শুনিয়ে বিদায় করে দিয়েছেন। আমার তাে মনে হয় না, এই সাহসী ও আত্মত্যাগকারী লােকগুলাে, যারা এখন মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম পরিচালনা করছেন, কখনও এই অভিজ্ঞতার কথা ভুলে যাবেন। রাজনীতিবিদগণ যতই তাদের পেছনের দিকে চলুন না কেন, এই লােকগুলাে এবং তাদের মতাে সাহসী যেসব ছাত্র তাদের পাশে থেকে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রকৃত বীর হিসাবে পরিচিত হবেন এবং পরিশেষে তারাই নতুন প্রজাতন্ত্রের তত্ত্বাবধায়ক হবেন।”৪৯ ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সম্পর্কে ম্যাসকারেনহাস বলেছেন : সেদিনকার ময়দানের সভায় বাঙালিদের সংগ্রামের একটি নাটকীয় মােড় লক্ষিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জনগণ যা আশা করেছিল তা হয়নি। শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসন অর্জনের পথে ব্যবস্থা গ্রহণের একটি কর্মসূচি
দেওয়ার ওয়াদা করেন। কিন্তু সভায় সমবেত দশ লক্ষাধিক লোেক শুনতে চেয়েছিল আর কিছু স্বাধীনতার ঘােষণা। … ছাত্রনেতাগণ, যারা ছিলেন বাস্তব পরিস্থিতির প্রতি স্পন্দনশীল, প্রকাশ্যভাবে স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারকার্য চালালেন। তারা প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত এবং অবশিষ্ট সকলের সঙ্গে শামিল হওয়ার জন্য চরমপত্র দিলেন। ময়দানে সমবেত জনসমুদ্রের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল সভামঞ্চের উপর, যেখানে যেকোনাে মুহূর্তে শেখ মুজিবের উপস্থিতি আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু ‘বঙ্গবন্ধু’, যাকে সবাই আদরের সাথে এ নামে ডেকে থাকে, সভায় উপস্থিত হতে বিলম্ব করছিলেন। সভায় দাঁড়িয়ে তিনি দৃপ্তকণ্ঠে ঘােষণা করলেন যে, তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে ৪ দফা দাবি পেশ করবেন এবং প্রদেশব্যাপী ‘অহিংস আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করবেন, যা নিশ্চিতভাবে বাঙালিদের দৃঢ়সংকল্পের কথা প্রকাশ করবে। দাবিগুলাে ছিল আপােস জাতীয় । এগুলাের লক্ষ্য অপরিবর্তনীয় থাকবে যেন জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ও সেনাবাহিনী প্রত্যাহার কিন্তু এর পদ্ধতি হবে অহিংস। অসহযােগ আন্দোলনের সাফল্য সম্পর্কে শেখ মুজিবের বিশ্বাসের কারণ, তিনি পূর্ণ সচেতন ছিলেন যে, তাঁর হাতে জনগণের ক্ষমতারূপ শক্তিশালী অস্ত্র রয়েছে। তার ভুল ছিল এই যে, তিনি প্রেসিডেন্টের অভিপ্রায়কে সঠিকভাবে বুঝতে পারেননি এবং সেইজন্য তিনি সেই অস্ত্রের সবচেয়ে বাস্তব ব্যবহার করতে সাময়িকভাবে সফল হননি। আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি শেখ মুজিবের পরিকল্পনাকে অনুমােদন করতে দ্বিধা করেননি। স্পষ্টত এই ব্যবস্থা আরেকটি মধ্যপন্থা খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু বাইরে অপেক্ষমাণ ছাত্রনেতাগণ এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে স্পষ্টত নিরুৎসাহ হয়ে পড়লেন। ঘােড়দৌড় ময়দানে যাওয়ার আগে শেখ মুজিব তাদের শান্তি করতে চেষ্টা করেন, কিন্তু তাতে কোনাে ফল হয়নি। শেখ মুজিব একজন শক্তিশালী বক্তা। সেদিন ঘােড়দৌড় ময়দানে বক্তৃতা দেয়ার সময় তিনি সবকিছুই ব্যবহার করেছেন- যথার্থ শব্দ, প্রজ্ঞা এবং বজ্রধ্বনি। কিন্তু তিনি যা বলেছেন, তার সঙ্গে জনগণের প্রত্যাশার মিল ছিল না। বক্তৃতার সময় যদিও তারা মাঝে মাঝে করতালি দিচ্ছিল এবং যথার্থ স্থানে প্রশংসাধ্বনি উচ্চারণ করছিল, তথাপি স্পষ্ট যে, তিনি জনগণের কাছ থেকে দূরেই রয়ে গেলেন। জনগণের যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল, তা নিশ্চয়ই ঘটনার উপযােগী হয়নি। পূর্ব থেকে সুচিন্তিত বক্তৃতা শেষ করার পর তিনি কিছুক্ষণের জন্য নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন এবং বিরাট জনসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে এর হতাশার ভাব উপলব্ধি করলেন। তখন তিনি আবার বঙ্গবন্ধু হয়ে গেলেন । তিনি তার দৃষ্টি উত্তোলন করে সর্বোচ্চ কণ্ঠে বললেন : “আমাদের এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। আমাদের এবারের সগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।”
জনতা উত্তেজিত হয়ে উঠল। তারা যেজন্য এসেছিল, তা তারা পায়নি; কিন্তু শেখ মুজিব তাে মুক্তি এবং স্বাধীনতার কথা বলেছেন। এই মনােভাব নিয়েই তারা ময়দান থেকে চলে গেল এবং আওয়ামী লীগের আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মসূচিতে পূর্ণ সমর্থন দেয়ার সঙ্কল্প গ্রহণ করল। পরদিন সেনাবাহিনীর ছাউনিগুলাে ছাড়া পূর্ববাংলার সর্বত্র কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব শেষ হয়ে গেল, জনগণের শাসন প্রবর্তিত হল। … তখন সরকারি কাজের। প্রতিটি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের প্রতি অবাধ্যতা লক্ষণীয়ভাবে বিস্তার লাভ করল। এই ব্যাপারে বাঙালিরা ছিল পুরাে মাত্রায় শৃঙ্খলাবদ্ধ ও উৎসর্গীকৃত; প্রতিটি পুরুষ, নারী ও শিশু কেন্দ্রীয় সরকারকে অগ্রাহ্য করাকে ব্যক্তিগত সম্মানের প্রশ্ন হিসেবে ধরে নিয়েছিল এবং অত্যন্ত যত্নের সাথে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশাবলি পালন করছিল। এ জাতীয় শান্তিপূর্ণ আইন অমান্যের দৃশ্য আর কখনও দেখা যায়নি। এ কারণেই অহিংস আন্দোলনের আজীবন ভক্ত খান ওয়ালী খান বলেছেন, ‘এমনকি গান্ধীও অভিভূত হতেন’।”৫০ ম্যাসকারেনহাসের অনেক অভিমতের সাথেই অনেকের দ্বিমত রয়েছে, যদিও বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে প্রথম ব্যাপক বর্ণনা তুলে ধরে তিনি বিশ্বে একটা আলােড়ন দৃষ্টি করেছিলেন এবং তার প্রথম প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ ও পরবর্তীকালে “The Rape of Bangladesh’ গ্রন্থটি বিশ্বের জনমত গঠনে ব্যাপক সাহায্য করেছিল। ছাত্রনেতৃবৃন্দ এবং জনগণ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ মােতাবেক অবিলম্বে ৪ দফা মেনে নেবার জন্য প্রেসিডেন্টের প্রতি দাবি জানাতে থাকেন। অসহযােগ আন্দোলনও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে চলে। প্রশাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণই সামরিক সরকারের নিয়ন্ত্রণের। বাইরে চলে যায়। শেখ মুজিবের নির্দেশেই বাংলাদেশের যাবতীয় রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাজ সুষ্ঠুভাবে চলতে থাকে। এ-সময় অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান ঢাকায় ছিলেন। তিনি সব প্রত্যক্ষ করলেন। দূরদর্শী নেতা এ-সত্যও অনুধাবন করতে পারলেন যে, পাকিস্তানের আয়ু শেষে হয়ে এসেছে। শেখ মুজিবের সাথে আলােচনা শেষ করে ১১ মার্চ করাচিতে ফিরে গিয়ে তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে তার সে আশঙ্কার কথা প্রকাশ করে পারলেন না। তিনি বললেন : ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দ্রুত ক্ষীয়মাণ সম্পর্কের শেষ সংযােগ হচ্ছেন শেখ মুজিব। জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা ঘােষণা করতে পারে।”৫১
মুজিবের মূল লক্ষ্য ছিল যদিও স্বাধীনতা, কিন্তু যারা মনে করেন যে পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে ছয়দফার বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না, তাদের সঙ্গে কেউ কেউ একমত নাও হতে পারেন। একজন বৃটিশ প্রাজ্ঞ লেখক, যিনি নির্বাচনের পরেই পূর্ববাংলায় এসেছিলেন, অত্যন্ত প্রণিধানযােগ্য একটি মন্তব্য করেছেন : “If the proposals of Sheikh Mujib form the part of the new Pakistan constitution and are transmuted into law, they will constitute the denial of the concept of total national solidarity. But this will be realistic, and will prove the basis on which a viable country would rise from the ruins of Jinnah’s original ideal. It is despair, ironically, which has driven Pakistan to face reality.” ১৫ মার্চ ১৯৭১। এ-দিন বাংলার জনগণ ও প্রগতিশীল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের দাবিতে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন। দেশের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করার পর জনসাধারণ ও সরকারি কর্মচারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বঙ্গবন্ধুকে সাহায্য করতে লাগলেন। অসহযােগ চলাকালীন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে সাংবাদিক ম্যাসকারেনহাস লিখেছেন :পূর্ব বাংলায় পশ্চিমপাকিস্তান থেকে আগত সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলাে চরম দুঃখ-কষ্ট ও অবমাননার শিকারে পরিণত হল। স্থানীয় বাজার থেকে সেনাদলকে খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যকার প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র দিতে অস্বীকার করা হল। তারা বাজারে জিনিসপত্র কিনতে গেলে তাদের ব্যঙ্গ করা হত ও তাদের উপর থুতু ফেলা হত। কোনাে দোকানদারই তাদের কাছে কোনাে কিছু বিক্রি করত না। শীঘ্রই তাদের খাদ্যের মান অতি সস্তার জল-রুটির পর্যায়ে নেমে এল এবং কোনাে কোনাে সময় তাও আসত করাচি থেকে মাংস ও শাক-সজির সরবরাহের সঙ্গে বিমানবাহিনীর মালবাহী বিমানে করে। ঐসব কষ্টের দিনগুলাের কথা স্মরণ করে কুমিল্লাস্থ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনীতে কর্মরত জনৈক পাঠান আমাকে বলেছে তাদের একটি দলকে কীভাবে একদল বিক্ষোভকারী ছাত্র রাস্তায় পাকড়াও করেছিল আমাদের প্যান্ট খুলে উলঙ্গ করে তারা আমাদেরকে ক্যান্টনমেন্টের দিকে ফিরে যেতে বাধ্য করেছিল।’ সে আরাে বলল, “সৌভাগ্যক্রমে আমাদের অনেকেরই পরনে জাঙ্গিয়া ছিল। নতুবা আমাদের লজ্জাকর অবস্থা হতাে আরাে ভয়ানক।’
আসলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশাবলি’ বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে ছিল বাইবেলের বাণীর মতােই পবিত্র। কারণ জনগণের কাছে এ বিষয়ে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না যে, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন সম্ভব নয়, এর জন্য প্রয়ােজন সশস্ত্র সগ্রামেরই প্রস্তুতিপর্ব।”৫৪ ১৯ মার্চ। ঢাকা শহর থেকে বাইশ মাইল দূরে অবস্থিত জয়দেবপুরে চীন নির্মিত অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেল বাহিনীর একটি দলকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র করতে চেষ্টা করলে মারাত্মক সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। স্থানীয়। জনগণও এই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পাকসৈন্যরা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। ফলে কমপক্ষে ২০ জন নিহত ও ১৬ জন আহত হয়। সরকারি হিসেব মতে ২ জন নিহত ও ৫ জন আহত হয়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করা হয়। এই সংবাদে শেখ মুজিব ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। ২১ মার্চ। ১৩ জনের প্রতিনিধিদলসহ ভুট্টো ঢাকায় এলেন। ঢাকায় পৌছানাের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে তুমুল বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। ঢাকায় পৌছেই প্রথমে ভুট্টো ইয়াহিয়া খানের সাথে দেখা করে উভয়ে এক গােপন বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকশেষে তিনি বলেন যে, সব কিছুই ঠিক হয়ে যাবে’। ২২ মার্চ। ভুট্টো-ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের ৭৫ মিনিটব্যাপী এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের পর এই প্রথম ত্রিপক্ষীয় আলােচনা-বৈঠক বসে। একই দিনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শাসনতন্ত্রের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মতৈক্যে উপনীত হবার সুযােগদানের জন্য পুনরায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করেন। ২৫ মার্চ এই অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল। এই অধিবেশন আবার যে কবে বসবে তা জানানাে হয়নি। প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে একটি সংক্ষিপ্ত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় : In consultation with leaders of both the wings of Pakistan and with a view to facilitating the process of enlarging areas of agreement among the political parties, the President had decided to pastpone the meeting of the National Assembly called on March 25. মুজিব ইয়াহিয়া ভুট্টোর মধ্যে বৈঠকের পর সকলেই এর সফলতা সম্পর্কে আশা পােষণ করতে লাগলেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্র এদিন বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যে পূর্ববাংলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, একথা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না।
এমনকি ২২ মার্চ তারিখেও তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন : “That the stage is now set for our elected representatives to work together for the common goal which would accommodate both East and West wings in a smoothly working harmonius system … I have no doubt that we shall succeed in dissolving the current political crisis. প্রেসিডেন্টের সাথে ভুট্টোর যে একটি গভীর সংযােগ ছিল, সেকথাও আজ বিশ্বাসীর নিকট সুস্পষ্ট হয়ে পড়েছে। ২২ মার্চে ভুট্টো বললেন যে, তিনি শেখ মুজিব ও প্রেসিডেন্টের মধ্যে যে সমঝােতা হয়েছে তা পরীক্ষা করে দেখেছেন এবং তিনি। অত্যন্ত আশাবাদী। তিনি বলেন : “I had a fruitful and satisfactory meeting with Sheikh Mujibur Rahman this morning. I would welcome another meeting.”৫৭ ২৪ মার্চ ভুট্টো ইয়াহিয়ার সাথে সুদীর্ঘ আলাপ করেন এবং বলেন : “We are making some progress.” ২৫ মার্চে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভুট্টো বললেন : “While I supported in principle the four point preconditions of Sheikh Mujibur Rahman, My party is
trying to come close to six points.” শুধু ভুট্টোই নন, পশ্চিমা স্বার্থবাদী মহলের আর এক নায়ক মিয়া মমতাজ দৌলতানাও এক উজ্জ্বল আশার কথা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন : । “I am hopeful about the talk”৬০ মুজিব এবং ইয়াহিয়ার আলােচনা যে একটি আপােস হতে যাচ্ছে, এ-সম্পর্কে পাকিস্তান টাইমস্ লিখেছে : “To Mujib he (President) indicated that there were no serious objections to the four point proposals and that an interim constitution could be worked out by the respective advisers accordingly. The basic points on which an agreement was reached were : (i) lifting of martial law and transfer of power to a civilian government by a presidential proclamation. (ii) transfer
of power in the provinces to the majority parties. (11) Yahya to remain The President and in control of the Entral Government and (iv) sepOrate sitting of the National Assembly members from East and West Pakistan preparatory to a joint sesson of the house to finalise the constitution. The last suggestion in fact came from Yaha to accommodate Bhutto.” সুতরাং একথা স্পষ্ট যে, চারটি স্বীকৃতির ভিত্তিতে মুজিব ও ইয়াহিয়া আলােচনা রাজনেতিক অচলাবস্থা অবসানের পথে এগােতে থাকে : (১) সাময়িক শাসন তুলে নিয়ে প্রেসিডেন্টের ঘােষণার মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে, (২) প্রদেশগুলােতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা দেয়া হবে, (৩) কেন্দ্রীয় সরকার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হাতেই আপাতত থাকবে, (৪) প্রদেশ দুটোতে পৃথকপৃথকভাবে গণপরিষদের সদস্যগণ বসবেন এবং পরবর্তীকালে যাতে দুই প্রদেশ থেকে সমগ্র সদস্যগণ একত্রে বসে অনুমােদন করতে পারেন এমন একটি সংবিধানের খসড়া প্রস্তুত করবেন। দেশের বৃহত্তর স্বার্থের দিকে দৃষ্টি রেখে বঙ্গবন্ধু এই শর্তগুলােতে সম্মত হয়েছিলেন। তাছাড়া তার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল যে, এভাবে শান্তিপূর্ণ পথে এবং নিয়মতান্ত্রিক উপায়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা একদিন-না-একদিন বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করবেই। শেখ মুজিব শেষাবধি নিয়মাতন্ত্রিক উপায়ের পথে বিশ্বস্ত ছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ও শেখ মুজিবের মধ্যে চারটি সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে যে সমঝােতা হয়েছিল তার বাস্তবায়নে অস্বাভাবিক বিলম্ব দেখে বঙ্গবন্ধুর মনে সন্দেহের উদ্রেক হলেও তিনি বিশ্বাস হারাননি। সামরিক বাহিনীর বর্বরগুলাে এ দেশবাসীর ওপর ঝাপিয়ে পড়বার পূর্ব পর্যন্ত প্রদত্ত তার সর্বশেষ বিবৃতিতে তিনি দুঃখ করে একথার উল্লেখ করেছেন। এ-প্রসঙ্গে ‘ডন’ পত্রিকার উদ্ধৃতি : The arrival of the President in Dacca and his subsequent talks led the people to expect that there was a realisation that this grace crisis engulfing the country could only be resolved politically. It was for this reason that I met the President. The President affirmed that there could only be a political soution of the crisis. Upon that promise, certain fundamental principles on which such a solution would be based were accepted by the President. Subsequently my colleagues sat with the sers to work out those principles. We
have thus done our duty and contributed our utmost efforts towards the attainment of a political solution. There is no reason or justification for any delay. If a political solution is desired by those concerned, they should realise that it is for them to talk matters immediately to a conclusion, and that to delay this would expose the country and its people to grave hazards. It is. threfore, unfortunate that there is a regrettable delay in resolving the crisis politically. Indeed, the critical situation already prevailing is being aggravated by renewed military activities, the pace of which, according to reports from different parts of Bangladesh, is being stepped up. This is all the more regrettable at a time when the President is in Dacca for the declared purpose of resolving the crisis politically. After last weeks firing at Joydevpur, reports of atrocities are pouring in from Rangpur, Saidpur, Where curfew has been imposed. From Chittagong, there are reports of heavy firing on the civilian population (emphasis added) এ সম্পর্কে প্রখ্যাত লেখক সুব্রত রায় লিখেছেন :
While Awami League leaders were anxiously awaiting a call form General Peerzada for the final session, which never materialized it was learnt that Ahmed had suddenly left for Karachi on the morning of 25 March without any warning to the Awami League. No one knew what transpired in the private meetings between Yahya and Bhutto at Dacca, but a consensus between the two must have been reached. 60 ROTO 48 10 consensus between the two @ W UT বিশ্ববাসীর কাছে অবিদিত নেই। গণহতা, রক্তপাত, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, ধ্বংস—এসবই সেই মতৈক্যের ফসল। এক কোটি মানুষের স্বদেশত্যাগ, ত্রিশ লক্ষ মানুষের জীবনাবসান, অসংখ্য নির্যাতন সবই সেই ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতি। বিখ্যাত সাংবাদিক Peter Hazelhurst C e nta PCCER : “Yahya and Mujib had agreed to an interim settlement providing (i) immediate withdrawal of martial law by a presidential proclamation, (ii) immediate restoration of power at the provincial level, and (111) the interim Central Government to be administered by the President until the constitution was framed. Bhutto opposed the
scheme stating that if martial law was withdrawn and power transferred to the provinces. Pakistan would be broken up into five sovereign states, It was Bhutto who finally brought the President to talk the decision which set East Bengal on fire… Talking events to their logical conclusion thers is no doubt that the present holocaust was precipitated by President Yahya Khan when he postponed the Assembly without consulting the Bengalies, but even more so by Mr. Bhutto’s deliberate decision to boycott the Assembly on 3 March.58
সুতরাং ঘটনার ঐকান্তিক বিশ্লেষণে একথা সুস্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয় যে, ভুট্টো এবং ইয়াহিয়ার যৌথ ষড়যন্ত্রে ও সম্মাতিতে পূর্ববাংলার ওপর গণহত্যা, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ আরােপিত হয় এবং পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রকে বাংলার মাটিতে হত্যা করা হয়।
২৩ মার্চ। এ-দিনটি বরাবর পাকিস্তানের জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হয়ে এসেছে। কিন্তু ‘৭১-এর ২৩ মার্চ নতুন হিসেবে পালিত হয়ে এসেছে। এই দিন বাংলাদেশের সর্বত্র সরকারি ও বেসরকারি অফিস-ভবনসমূহে, বাড়িঘরে ও যানবাহনে কালাে পতাকার পাশাপাশি স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীন করা হয়। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১-এর ২৩ মার্চেই আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের সমাধি রচিত হয়। পাকিস্তান দিবস-এর নাম ইতিহাসের পাতা থেকে চিরদিনের জন্য মুছে যায়। বাংলার জনগণ নিজেদের অস্তিত্বের স্পন্দন অনুভব করে উপলব্ধি করে, এ আরেক দেশ-পাকিস্তানের কবরের ওপর নতুন দেশের উত্থান ঘটেছে, এ দেশের নাম বাংলাদেশ। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের রাত্রিতে শেখ মুজিবের ধানমণ্ডিস্থ বাসভবন আক্রান্ত হবার পূর্বে রাত্রি বারােটার পরই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। তিনি ২৫ মার্চের মধ্যরাত্রিতে সহকামী ও দেশবাসীর নিকট ঘােষণা করেন: “আজ থেকে (অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম লগ্ন) বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র। একে যেমন করেই হােক শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করতেই হবে।” বঙ্গবন্ধু এই ঘােষণা বাংলার বীর জনগণের নিকট পৌছিয়ে দেবার চেষ্টা করলেন। প্রথমে ঢাকা বেতারের সঙ্গে যােগাযােগ করলেন। কিন্তু বেতার কেন্দ্র পাক হানাদাররা অবরুদ্ধ করে রাখায় তা সম্ভব হয়নি। অতঃপর তিনি চট্টগ্রাম বেতারের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। শেষ পর্যন্ত ওয়ারলেসে তিনি খবরটি পৌছে দিতে সমর্থ হন। বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘােষণা জারি করেছিলেন তা চট্টগ্রামের বেতারের নিকট এবং জনগণের কাছে পৌছে দেবার জন্য তারই বিশিষ্ট সহকর্মী
scheme stating that if martial law was withdrawn and power transferred to the provinces. Pakistan would be broken up into five sovereign states. It was Bhutto who finally brought the President to talk the decision which set East Bengal on fire… Talking events to their logical conclusion thers is no doubt that the present holocaust was precipitated by President Yahya Khan when he postponed the Assembly without consulting the Bengalies, but even more so by Mr. Bhutto’s deliberate decision to boycott the Assembly on 3 March.”48
সুতরাং ঘটনার ঐকান্তিক বিশ্লেষণে একথা সুস্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয় যে, ভুট্টো এবং ইয়াহিয়ার যৌথ ষড়যন্ত্রে ও সম্মাতিতে পূর্ববাংলার ওপর গণহত্যা, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ আরােপিত হয় এবং পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রকে বাংলার মাটিতে হত্যা করা হয়।
২৩ মার্চ। এ-দিনটি বরাবর পাকিস্তানের জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হয়ে এসেছে কিন্তু ‘৭১-এর ২৩ মার্চ নতুন হিসেবে পালিত হয়ে এসেছে। এই দিন বাংলাদেশের সর্বত্র সরকারি ও বেসরকারি অফিস-ভবনসমূহে, বাড়িঘরে ও যানবাহনে কালাে পতাকার পাশাপাশি স্বাধীন বাংলার পতাকা উডীন করা হয়। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১-এর ২৩ মার্চেই আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের সমাধি রচিত হয়। পাকিস্তান দিবস-এর নাম ইতিহাসের পাতা থেকে চিরদিনের জন্য মুছে যায়। বাংলার জনগণ। নিজেদের অস্তিত্বের স্পন্দন অনুভব করে উপলব্ধি করে, এ আরেক দেশ-পাকিস্তানের কবরের ওপর নতুন দেশের উত্থান ঘটেছে, এ দেশের নাম বাংলাদেশ। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের রাত্রিতে শেখ মুজিবের ধানমণ্ডিস্থ বাসভবন আক্রান্ত হবার পূর্বে রাত্রি বারােটার পরই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। তিনি ২৫ মার্চের মধ্যরাত্রিতে সহকামী ও দেশবাসীর নিকট ঘােষণা করেন: “আজ থেকে (অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম লগ্ন) বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র। একে যেমন করেই হােক শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করতেই হবে।” বঙ্গবন্ধু এই ঘােষণা বাংলার বীর জনগণের নিকট পৌছিয়ে দেবার চেষ্টা করলেন। প্রথমে ঢাকা বেতারের সঙ্গে যােগাযােগ করলেন। কিন্তু বেতার কেন্দ্র পাক হানাদাররা অবরুদ্ধ করে রাখায় তা সম্ভব হয়নি। অতঃপর তিনি চট্টগ্রাম বেতারের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। শেষ পর্যন্ত ওয়ারলেসে তিনি খবরটি পৌছে দিতে সমর্থ হন। বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘােষণা জারি করেছিলেন তা চট্টগ্রামের বেতারের নিকট এবং জনগণের কাছে পৌছে দেবার জন্য তাঁরই বিশিষ্ট সহকর্মী
জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী ও জনাব এম, আর খানের সাথেও তিনি টেলিফোনে যােগাযােগ করেন। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জারিকৃত তার এই স্বাধীনতা ঘােষণা বার্তার অনুলিপি তল্কালীন গণভবনে রক্ষিত দলিল থেকে নিম্নে উকলিত হল : Declaration of war of Independence Pak Army suddenly attacked E.P.R. Base at Pilkhana, Rajarbag Police line and Killing citizens. Street battle are going on in every street of Dacca-Chittagong. I appeal to the Nations of the World for for help. Our freedom fighters are gallantly fighting with the enemies to free the motherland. I appeal and order you all in the name of Almighty Allah to fight to the last drop of blood to liberate the country. Ask Police, E.P.R. Bengal Regiment and Ansar to stand by you and to fight. No compromise. Victory is ours. Drive out the last enemy from the holy soil of motherland. Convey this message to all Awami league leaders, workers and other patriots and lovers of freedom. May Allah bless you. Joy Bangla. Sk. MUJIBUR RAHMAN বঙ্গবন্ধু যে রাত্রি বারােটার পরেই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘােষণা করেন তার বহু প্রমাণ রয়েছে। তবে সেটি ভিন্ন স্বতন্ত্র একটি বিষয়ের দাবি রাখে। একটি প্রমাণ এমন : “Before he was arrested, Sheikh Mujib made a formal declaration of Independence of Bangladesh sometime between 12.00 a.In. and 1-30 a, In. on March 26, 1971, It was broadcast over the clandestive Swadhin Bangladesh Betar controlled by the Mukti Fauj at noon of March 26, 1971″৬৭ এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস তাঁর গ্রন্থে মুজিবের গ্রেফতারের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : The army had gone into action moments after the Eastern Command headquarters had received the signal of the President’s safe arrival in karachi. That was about
11-30 P.M. By midnight the troops were well into their terrible task. সৈন্যরা ট্যাঙ্ক, বাজুকা ও অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে প্রথমে পূর্বপাকিস্তান। রাইফেলস-এর হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করে। প্রথমেই পাকিস্তান আর্মি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ করেনি। যখন দেখেছে যে সৈন্যশক্তি প্রয়ােগ করে ঢাকাকে কাবু করা যাবে এবং অংশত তা সম্ভবও হয়েছে, কেবল তখনই বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়েছে এবং তাকে গ্রেফতার করেছে। এ-প্রসঙ্গে ম্যাসকারেনহাস লিখেছেন : “Some of his (Sheik’s) followers kept telephoning his residence every half hour to inquire about his safety. His servant gave an answering peply. At 1-30 A.M. about two and a half hours after the air had been filled with the sound of guns and the night sky was bright with the glare of flames. Sheikh Mujib’s telephone went dead. In mounting panic the word was passed that the army had go Bangabndhu … At about 1-30 A.M. two army jeeps followed by a few trucks halted outside No 32. Moments cater the garden was swarming with soldiers. Some shots were fired at the roof and through a window on the top floor. The soldiers were not attacking, just threatening. Then in the commotion Sheikh Mujib was heard colling from an upstair’s bedroom-“Why are you being so barbarous? It you had called me I would have come down to you.” Mujib, with a maroon dressing gown thrown over pyjamas, walked down the stairs to where a young Captain was standing. The officer was polite and courteous. “You will come with me sir.” he said in a firm,flat voice. Then they all drove away.”90 একজন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক বলেন : “The 25th of March was spent by Sheikh Mujibur Rahman and his party leaders in awaiting a call from General Pirzada for a final meeting with Yahia Khan and also for final drafting session for working out the details of interim transfer of power. No such call came. At zero hours on the 26th March, the army swang into action against the unarmed people of East Pakistan, launching
operation on a war scale. Meanwhile sheikh Mujibur Rahman proclaimed the birth of sovereign Independent
state of Bangladesh.’৭১ মুজিবের গৃহে গমন ও তাঁকে গ্রেফতারের বিবরণ সিদ্দিক সালিক তাঁর গ্রন্থে বেশ ভালােভাবেই উল্লেখ করেছেন। মুজিবের কণ্ঠে স্বাধীনতা ঘােষণা যে সামরিক বাহিনীর নিকট ধরা পড়েছে, সেই ঘােষণা শােনা গিয়েছিল যখন ঢাকায় গােলাগুলি। বর্ষিত হয় তখনই, একথাও তিনি বলেছেন। সালিক লিখেছেন : “When the first shot had been fired, the voice of Sheikh Mujibur Rahman came faintly through an wavelength close to that of the official Pakistan Radio. In what must have been, and sounded like, a prerecorded message, the Sheikh proclaimed East Pakistan to be the People’s Republic of Bangladesh.”92 এখানে অফিসিয়াল পাকিস্তান রেডিও বলতে সালিক সম্ভবত ঢাকা বেতার কেন্দ্রের কথাই বুঝিয়েছেন, কেননা গ্রন্থের ৭৩ পৃষ্ঠায় তিনি উল্লেখ করেছেন যে, রাত্রি সাড়ে এগারােটার দিকেই official Pakistan Radio at Dacca-তে পাকবাহিনী অবস্থান গ্রহণ করেছিল। লে, কর্নেল জেড, এ. খান ও মেজর বেলালের নেতৃত্বে শেখ মুজিবকে একদল কমান্ডাে বাহিনী গ্রেফতার করে। এ সম্পর্কে সিদ্দিক সালিকের গ্রন্থ আমাদের জানায় : “Lieutenant Colonel Z.A. Khan, the commanding officer, and Major Bilal the company Commander, themselves have accompanied the raided platoon. As the commandos approached Mujib’s house, they drew fire from the armed guard pasted at his gate. The guards were quickly neutralized. Then up raced the fifty tough soldiers to climb the four feet high compound wall. They announced their arrival in the courtyard by firing a stengun burst and shouted for Mujib to came out. But there was no response. Scrambling across the verandah and up the stairs. They finally discovered the door of Mujib’s bedroom. It was locked from outside. A bullet pierced the hanging metal and it dangled down. Whereupon Mujib readily emerged offering himself for arrest. he seemed to be waiting for it. The raiding party rounded up everybody in the house and brought them to
the second capital in army jeeps. Minutes later Majior Safar, Brigade Major of 57 Brigade, was on the wireless. I could hear his crisp voice saying BIG BIRD IN THE CAGE … OTHERS NOT IN THE NESTS …OVER.”40 বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২৫ মার্চের দিবাগত রাত্রে ২৬ মার্চের জিরাে আওয়ারে যে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন তার অনেক সত্যনির্ভর দলিল ও সমর্থন রয়েছে। তার একটি হচ্ছে পাকবাহিনীর উচ্চপদস্থ এবং উচ্চশিক্ষিত কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক, যার হাতে তখন ছিল পাকিস্তান অফিসিয়াল বেতার কেন্দ্র; অপরটি যন্ত্র, যা মিথ্যাকথা বলা জানে না- যন্ত্রটি অফিসিয়াল পাকিস্তান রেডিও। সিদ্দিক সালিক লিখেছেন : “When the first shot had been fired, the voice of Sheikh Mujibur Rahman carne fintly through an wavlength close to that of official Pakistan Radio. In what must have been and sounded like a prerecorded message. The Sheikh proclaimed East Pakistan to be the People’s Republic of Bangladesh.”48 এই প্রমাণটি খুবই নির্ভরযােগ্য, কেননা জনাব সালিক শত্রুপক্ষের লােক, যিনি শেখ মুজিবকে অকারণ গৌরবদানের জন্যে ইতিহাস বিকৃত করেননি এবং ঘােষণাটি ধরা পড়েছে যন্ত্রে, যার কোনাে পক্ষ-বিপক্ষ নেই। এই বেতারকেন্দ্রটি যে ঢাকা বেতার কেন্দ্র (সম্ভবত) তা বুঝা যায় একই গ্রন্থে বর্ণিত সিদ্দিক সালিকের আরেকটি ভাষ্যে :
“The troops were to be in target areas before 1 a.m. but some of them, anticipating delay on the way, had started moving from the cantonment at about 11.30 p.m. Those who were already in the city to guard the official Pakistan Radio at Dacca and Television stations telephone exchange, power house and state Bank had also taken their posts much before the hour (private code).”90 ২৭ মার্চ তারিখে তৎকালীন মেজর জিয়া চট্টগ্রাম বেতার থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা প্রচার করেন। এই বেতারকেন্দ্র থেকে ৩০ মার্চ তিনি পুনরায় ঘােষণা করেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বয়ং এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিরােধের এমন সম্ভাবনাময় মুহূর্তে এই ঘােষণা সমস্ত স্বাধীনতা সংগ্রামকে একই লক্ষ্যে এগিয়ে যাবার অনুপ্রেরণায় সংহত ও সুদৃঢ় করে। ৭৬
মুক্তিবাহিনী সরকারি পর্যায়ে দুই ভাগে বিভক্ত ছিল :
১. নিয়মিত সেনাবাহিনী
২. গণবাহিনী
১. বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই.পি. আর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ বাহিনীর লােকদের নিয়ে এই বাহিনী গঠিত হয়েছিল। সরকারি পর্যায়ে এদের নামকরণ করা হয়েছিল এম. এফ. (মুক্তি ফেীজ)। এই সৈন্যের পরিমাণ ছিল প্রায় দশ হাজার।৭৭। ১৭ জুন ওয়ামিংটন প্রেস ক্লাবে এক ভাষণে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং বলেন যে, বাংলাদেশের দুঃখজনক ঘটনা এই অঞ্চলের শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতি এক বিরাট হুমকিস্বরূপ। শেখ মুজিবের জীবনের নিরাপত্তা সম্বন্ধে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সর্দার শরণ সিংহ বলেন যে, তিনি শুধু একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাজনীতিবিদই নন, অধিকন্তু তিনি জনগণের অফুরন্ত ভালােবাসা লাভ করে ছিলেন। তার মুক্তির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত। পাকিস্তানের সামরিক সরকারের কার্যকলাপে উদ্ভূত পরিস্থিতি ভারতের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তাই ভারত আশা করে যে, সমস্যার এমন একটি রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে যেটা পূর্ববাংলার জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য হবে।৭৮ ১৯৭১-এর ২ এপ্রিল রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি পাকস্তিানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে প্রেরিত এক চিঠিতে বলেন যে, ঢাকাতে রাজনৈতিক আলােচনা ভেঙে গেছে এবং সামরিক বাহিনী পূর্বপাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এই ঘটনাবালীতে সােভিয়েট ইউনিয়ন খুবই উদ্বিগ্ন। সাধারণ নির্বাচনে জনগণের ভােটে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য রাজনীতিবিদের গ্রেফতারের খবরে। সােভিয়েট ইউনিয়নের জনগণ খুবই মর্মাহত। সােভিয়েট ইউনিয়ন সব সময় পাকিস্তানের সুখ ও সমৃদ্ধি চায়। পাকিস্তান আজ যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, তা কেবল রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা যায়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা ও রক্তপাত সমস্যাকে আরাে জটিল করে তুলবে, যা পাকিস্তানের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষতি করবে। সােভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন জানাচ্ছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে দমননীতি ও রক্তপাত বন্ধ করে সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের জন্য যেন জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
সার্বজনীন মানবাধিকার ঘােষণার মানবিক নীতিসমূহে উদ্বুদ্ধ হয়ে সােডিয়েট ইউনিয়ন এই আবেদন জানাচ্ছে। ৭৯ সােভিয়েত কম্যুনিস্ট পার্টির পত্রিকা প্রাভদা’-তে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে সােভিয়েট প্রধানমন্ত্রী মি. কসিগিন বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলীতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে উত্তেজনা বিরাজ করছে, তাতে সােভিয়েট ইউনিয়ন খুবই উদ্বিগ্ন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ লােক তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। তারা। সেখানে নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিন যাপন করছে। যারা মানবিকি রীতিনীতিসমূহে বিশ্বাস করেন, তারা অবশ্যই আশা করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক অনকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা হােক যেখানে শরণার্থীরা তাদের জীবনের নিরাপত্তা ও মান-সম্মানের নিশ্চয়তা পাবে। আমরা পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে এ ব্যাপারে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরােধ জানাচ্ছি। ভারত ও পাকিস্তানের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে এবং এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সমস্ত সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হওয়া উচিত বলে সােভিয়েট ইউনিয়ন মনে করে। ১৯৭১ এর ২০ অক্টোবর। যুগােস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর ভারত সফর শেষে প্রকাশিত এক যুক্ত ইশতেহারে ঘােষণা করা হয় যে, দু-দেশই মতৈক্যে পৌছেছে যে, জনগণের ভােটে নির্বাচিত বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযােগ্য একটা রাজনৈতিক সমাধানই এ এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থা প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে। দু-দেশ এ ব্যাপারে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানায়। জনগণের ইচ্ছাকে পদদলিত করা হলে পরিস্থিতি আরাে মারাত্মক আকার ধারণ করবে বলে দু-দেশ বিশ্বাস করে। প্রেসিডেন্ট টিটো উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ মুজিবের মুক্তির ওপর গুরুত্ব আরােপ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের শর্তহীন মুক্তির কথা পুনরায় উল্লেখ করেন।
‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিবৃতিতে মি, চেষ্টার বাউনূস বলেন। যে, আমেরিকার অস্ত্রশস্ত্রে সমর্থনপুষ্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্বপাকিস্তানের নিরীহনিরস্ত্র জনগণের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালাচ্ছে। আন্তর্জাতিক রেডক্রসের লােকজনকেও পূর্বপাকিস্তানে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না এবং বিদেশী সাংবাদিকদের সেখান থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। আমেরিকার কনস্যুলেট জেনারেল পূর্বপাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর কার্যকলাপের কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু এখনও আমেরিকান সরকার বলছেন যে, পূর্ববাংলার
পরিস্থিতি সম্বন্ধে তারা কিছু জানেন না। এই সংঘর্ষ বন্ধ করতে বিশ্বজনমত গঠন করার ব্যাপারে আমেরিকার নেতৃত্ব গ্রহণ করা উচিত। আমেরিকা কর্তৃক সরবরাহকৃত অস্ত্রশস্ত্রের অপব্যবহার সম্বন্ধেও পাকিস্তানকে অবিলম্বে সতর্ক করে দেয়া। আমেরিকার কর্তব্য।৮২ ‘দি সানডে টাইমস’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি। প্রতিনিধিদলের সদস্য মি. রােগন্যাড প্রেনটিস বলেন যে, শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযােগ্য একটা রাজনৈতিক সমাধান পূর্ববাংলার বর্তমান সংকট নিরসনের একমাত্র উপায় । ইয়াহিয়া খানকে একথা অবশ্যই মেনে নিতে হবে।৮৩ কলকাতার ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিবৃতিতে আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক এবং এককালীন ভারতবর্ষে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত জে. কে. গলব্রেথ বলেন যে, পূর্ববাংলার জনগণের অধিকারকে স্বীকার করে নিয়ে একটা শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের মধ্যেই রয়েছে সকল উত্তেজনার নিরসন এবং বিবাদের মীমাংসা। জনগণের অধিকার বলতে বুঝায়, তারা নিজেরা নিজেদেরকে শাসন করবে এবং নিজেদের সরকার গঠন করবে। বাংলাদেশের জনগণ তাদের ভাগ্য, জীবনব্যবস্থা ও রাজনীতির সম্পূর্ণ নিয়ন্তা হবে। এই সহজ সত্যকে আজ বিশ্ববাসীর এবং বিশেষ করে আমেরিকাবাসীর স্বীকার করতে হবে। ৮৪ ২৭ মে। হেলসিংকিতে অনুষ্ঠিত সােশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সম্মেলনে গৃহীত। এক প্রস্তাবে পাকিস্তানের দুঃখজনক ঘটনাবলিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। প্রস্তাবে শেখ মুজিবসহ অন্যান্য রাজবন্দিদের জীবনের জন্য আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য সােশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল তার সদস্যরাষ্ট্রদের কাছে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে আবেদন জানায়। পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর, সুইডেন, নরওয়ে ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীরা, পশ্চিম ইউরােপ, আমেরিকা, কানাডা, আফ্রিকা এবং এশিয়ার খ্যাতনামা সমাজতন্ত্রীরা এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ।৮৫ ১৪ এপ্রিল। আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশন জেনেভা থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেন যে, জুরিস্ট কমিশন রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের বিরােধিতা করে। যদি শেখ মুজিবুর রহমান অথবা অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতা পাকিস্তানের আইনের আওতায় কোনাে অপরাধ করে থাকেন, তাহলে তাদেরকে বেসামরিক আদালতের সামনে হাজির করা উচিত।
১১ সেপ্টেম্বর ব্যুরাে অব সােশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল লন্ডন থেকে এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক নির্যাতন বন্ধের আবেদন জানান। সােশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল অবিলম্বে শেখ মুজিবসহ অন্যান্য নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের শর্তহীন মুক্তি দাবি করেন। যে পর্যন্ত না সমস্যার একটা সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমাধান হচ্ছে, সে পর্যন্ত সাহায্যদানকারী কনসর্টিয়াম-এর নিকট পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধের আবেদন জানানাে হয়।৮৬ ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিশ্ব সম্মেলনের এক প্রস্তাবে বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। প্রস্তাবে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য একটি রাজনৈতিক মীমাংসার ওপর জোর দেয়া হয়। আর এক প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে আবেদন জানানাে হয় ।৮৭। বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদপত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে। বস্তুত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পশ্চাতে বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের ভূমিকার চেয়ে সংবাদপত্রের ভূমিকা অনেক মানবতামুখী, আর তাই সাংবাদিকদের নিকট আমরা সত্যি নানাভাবে ঋণী। বাংলাদেশের বর্বর সেনাবাহিনীর অমানুষিক হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসলীলাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য পাকিস্তান সামরিক জান্তা সমস্ত বিদেশি সাংবাদিককে পূর্ববাংলা থেকে বহিষ্কার করে দিয়েছিল। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। সমস্ত বিশ্বের মানুষ সামরিক বাহিনীর জঘন্য কার্যকলাপের কথা জানতে পারে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ কম্যান্ডের প্রকাশ্য যুদ্ধ শুরু হলে সারা বিশ্বে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা এ খবর ফলাও করে প্রকাশ করতে থাকে। ‘দি সান বাল্টিমাের’ পত্রিকায় এক বিবৃতিতে আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্টের জনৈক উচ্চপদস্থ সরকারি মুখপাত্র ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হবার প্রথম থেকেই ভারতীয় নীতির ফলেই সংকট আরাে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে বলে মন্তব্য করেন। তার মতে সীমান্তে সংঘর্ষ শুরু করার জন্য ভারতই অধিকাংশ দায়ী।৮৮ ঐ দিনই অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. নিগেল এইচ, বােয়েন ‘দি ক্যানবেরা টাইমস’-এ প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে অস্ট্রেলিয়ার নিরপেক্ষ ভূমিকার কথা ঘােষণা করেন। তিনি বলেন যে, পূর্বপাকিস্তান সংকটের গােড়া
থেকেই অস্ট্রেলিয়া উত্তেজনা প্রশমন ও রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টার সাথে যােগাযােগ রক্ষা করে আসছে। অস্ট্রেলিয়া যুদ্ধরত কোনাে দেশকেই অস্ত্র সরবরাহ করবে না বলে তিনি ঘােষণা করেন। এদিকে ৭ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্তো এক বিবৃতিতে বলেন যে, যদি ভারত ও পাকিস্তান দুই যুদ্ধরত দেশ অনুরাধ করে, তাহলে ইন্দোনেশিয়া এই সংঘর্ষে মধ্যস্থতা করতে রাজি আছে ৯০ ঐদিন ওয়ারশ’তে পােল্যান্ডের কম্যুনিস্ট পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসে ভারত বাংলাদেশপাকিস্তানের উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে এক ভাষণে মি. লিউনিদ ব্রেজনেভ আশা প্রকাশ করে বলেন যে, বাইরের কোনাে হস্তক্ষেপ ছাড়াই ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে বলে সােভিয়েট ইউনিয়ন বিশ্বাস করে। তিনি বলেন যে, পূর্বপাকিস্তানের জনগণকে মৌলিক অধিকারসমূহ থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টাতেই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছে। ১০ ডিসেম্বর। সােভিয়েটের ‘ইজভেস্তিয়া”৯২ -তে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয় যে, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ পূর্বপাকিস্তানের জনগণকে মৌলিক অধিকারসমূহ থেকে বঞ্চিত করার জন্যে চরম দমননীতি গ্রহণ করেছে। তারা সার্বজনীন মানবাধিকার ঘােষণার প্রতি চরম উপেক্ষা প্রদর্শন করেছে। এই সমস্ত ঘটনা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষের জন্য দায়ী। ১২ ডিসেম্বর। লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট কর্নেল গাদাফি বলেন যে, জোটনিরপেক্ষ দেশসমূহ পাক-ভারত যুদ্ধ বন্ধ করতে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। এটা উপমহাদেশে বৃহৎ শক্তিবর্গের ঔপনিবেশিক স্বার্থকে চরিতার্থ করার সুযােগ এনে দিয়েছে।৯৩
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সারাবিশ্বে তার বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলে জাতিসংঘ তৎপর হয়ে ওঠে। ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ। রাওয়ালপিন্ডি থেকে এক বেতার-ভাষণে ইয়াহিয়া খান ঘােষণা করলেন যে, শেখ মুজিব একজন দেশদ্রোহী; তিনি দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হেনেছেন। তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী । ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করলেন এই যুক্তিতে যে, দলটি অহিংস-অসহযােগ আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল।
১৯৭১-এর ৩ আগস্ট। এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান অধুনা বিলুপ্ত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবের বিচারের কথা ঘােষণা করলেন। তিনি বললেন, শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহিতার অপরাধে আটক করা হয়েছে এবং দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে তার বিচার করা হবে।৯৪ ১৯৭১-এর ৯ আগস্ট। এক সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহিতার অভিযােগের সঙ্গে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘােষণা’র এক নতুন অভিযােগ আনয়ন করা হয়। এতে বলা হয় : “অধুনা বিলুপ্ত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা এবং অন্যান্য অপরাধের জন্যে বিশেষ সামরিক আদালতে বিচার করা হবে। আগস্ট মাসের ১১ তারিখ থেকে গােপনে এ বিচার অনুষ্ঠিত হবে এবং বিচার সম্পর্কিত সবকিছু গােপন রাখা হবে।”৯৫ শেখ মুজিবের বিচারের কথা প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সারাবিশ্বে প্রবল আলােড়নের সৃষ্টি হয়। প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে বিশ্বজনমত। ১৯৭১-এর ৮ আগস্টে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানের নিকট শেখ মুজিবের বিচার-প্রহসন বন্ধ করবার জন্য এক আবেদনপত্র প্রেরণ করেন। তিনি বলেন : “ভারত সরকার এবং ভারতীয় জনগণ, সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় পার্লামেন্ট ও ইয়াহিয়া খান কর্তৃক শেখ মুজিবের বিচার-সম্পর্কিত বিবৃতিতে বিচলিত হয়ে পড়েছেন। ইয়াহিয়া খান এক গােপন সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার শুরু করতে যাচ্ছেন এবং (এই বিচার শেখ মুজিবকে) কোনাে বৈদেশিক আইনজ্ঞের সহায়তা থেকে বঞ্চিত করেছেন। আমরা ধারণা করছি যে, তথাকথিত এই বিচার শেখ মুজিবকে হত্যা করবার একটা আবরণ হিসেবে ব্যবহার করা হবে।৯৬। ১৯৭১-এর ১৪ আগষ্টে জার্মান ডেমােক্রাটিক রিপাবলিকের বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র শেখ মুজিবের বিচার সম্পর্কে এক বিবৃতি দিয়ে বলেন : “শেখ মুজিবের গোপন সামরিক বিচারালয়ে বিচার-অনুষ্ঠানের উদ্ধৃতি দিয়ে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল যে (এখানকার) বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিত্ব পূর্ব পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতার জীবন সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠেছেন। কাজেই জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের জনগণ পাকিস্তান সরকারের কাছে মানবিক সহানুভূতি প্রদর্শন করতে এবং শেখ মুজিবকে তার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরূপে সম্মান প্রদর্শন করতে আবেদন জানাচ্ছে।৯৭
শেখ মুজিবের বিচার বন্ধ করবার অনুরােধ জানিয়ে আগস্ট মাসের ১৭ তারিখে জেনেভায় অবস্থারত আন্তর্জাতিক জুরি-কমিশনের সদস্যরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে এক তারবার্তায় বলেছেন : “বিশ্বজনমত ধরে নিয়েছে যে, সামরিক আদালত শেখ মুজিবকে মৃত্যুদণ্ড দণ্ডিত করবে। এ ধারণা যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে আন্তর্জাতিক জুরি-কমিশন আপনার কাছে। অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে নিবেদন করছে, এ দণ্ডাদেশকে বাতিল করে দিয়ে আপনার মহানুভবতা ও বিজ্ঞতা প্রদর্শনের মাধ্যমে জিঘাংসা, সন্ত্রাস আর দুঃখ-কষ্টকে ব্যাপকতর আকার ধারণ করতে না দেয়া।”৯৮। ২০ আগস্টে হেলসিংকি থেকে বিশ্ব শান্তি সংস্থা পাকিস্তানের সরকারের কাছে শেখ মুজিবের গােপন বিচার বন্ধ করে মুক্তি দেবার আবেদন জানান। ১৩ সেপ্টেম্বরে, যুক্তরাজ্যের প্রাক্তন সেক্রেটারি অব স্টেট মি, আর্থার বটমলি কুয়ালালামপুরে কমনওয়েলথ দেশভুক্ত রাষ্ট্রসমূহকে শেখ মুজিবের মুক্তির জন্যে। পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির উপদেশ দেন। এখানে তিনি শেখ মুজিবকে সমর্থন করে বলেছিলেন, “পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের পক্ষে একমাত্র শেখ মুজিবই কথা বলবার অধিকারী।”৯৯ শেখ মুজিবের বিচার সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চাপ এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও মুজিবের অন্যায় বিচারের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া শেষ পন্ত ইয়াহিয়া খানের দাম্ভিক মনােভাবকেও অবনমিত করেছিল। “নিউজউইক’ ম্যাগাজিনে এক সাক্ষাঙ্কারের ইয়াহিয়া বলেন : “আমাকে অনেকেই বিশ্বাস নাও করতে পারে, কিন্তু আমার মনে হয় যদি তিনি। (শেখ মুজিব) পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যান, তবে তার নিজের জনগণই তাকে হত্যা করবে। (কেননা) তারা তাকেই (মুজিব) তাদের দুঃখ-দুর্দশার জন্যে দায়ী করেছে।… আমি খামখেয়ালিপনার আশ্রয় নিয়ে তাকে মুক্তি দিতে পারি না।। এটা একটা বিরাট দায়িত্ব। কিন্তু জাতি যদি তার মুক্তি চায়, আমি তাহলে তাকে মুক্তি দিতে পারি।”১০০ সুব্রত রায় চৌধুরী শেখ মুজিবের বিচার যে অবৈধ তার সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপিত করবার জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের কার্যবিবরণী ও জেনেভা কনভেনশনের বিভিন্ন ধারার উপধারার পুখানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, কোনাে ন্যায়নীতির দ্বারাই শেখ মুজিবের বিচার বৈধ হতে পারে না।১০১
শেখ মুজিবের গােপন বিচার প্রসঙ্গে ট্রাইবুন দি জেনেভা১০২ -তে লেখা হয় : “শেখ মুজিবুর রহমান নামে এমন একজনের গােপন বিচারানুষ্ঠান হতে যাচ্ছে, যাকে পাকিস্তান ফেডারেশনের অধিকাংশ জনসাধারণ পরােক্ষভাবে দেশের। প্রধানমন্ত্রিত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। এই ঘটনায় উভয়পক্ষীয় পারস্পরিক সমঝােতার যে ক্ষীণতম আশাটুকু ছিল, তাও নিঃশেষিত হল।” UNDER SECRET SUMMARY PROCEEDING “জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল মি. উ থান্ট এই বলে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন যে, গত নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে এবং তার অব্যবহিত পরবর্তীকালের কলেরা মহামারীতে পূর্ববাংলায় যে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছিল, তার চেয়েও বহুগুণ ভয়াবহ পরিণতি নেমে আসতে পারে, যদি দেশদ্রোহিতার অপবাদে পূর্ব পাকিস্তানের অবসিংবাদিত নেতা মুজিবুর রহমানের এমন ধরনের গােপন বিচারের প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকগণও উ থান্ট-এর সঙ্গে একমত হলেন। …।”১০৩ জাম্বিয়ার ‘দি সানডে টাইমস’ পত্রিকা মুজিবের ‘দেশদ্রোহিতার প্রকৃতি তুলে ধরে। পত্রিকাটি লেখে : “আগস্ট মাসের ১১ তারিখে শেখ মুজিবের গােপন বিচার শুরু হল, তাঁর। বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ ছিল দেশদ্রোহিতা’ । ১৯৬৬ সালে মুজিবুর রহমান যখন স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে তাঁর ৬ দফা। কর্মসূচির কথা ঘােষণা করলেন (যা আগের নির্বাচনে তাঁর অভূতপূর্ব সাফল্যের প্রধান কারণও ছিল), তখন থেকেই তিনি বিশ্বাসঘাতক বলে চিহ্নিত হলেন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে পড়লেন। সরকারপক্ষীয় লােকেরাই এ-ব্যাপারে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করল এবং সাজানাে মিথ্যা অভিযােগগুলাে স্থগিত রাখা হল। স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি নতুন কিছুই ছিল না। পাকিস্তান সৃষ্টির মূল সেই লাহােরপ্রস্তাব— যার খসড়া জিন্নাহ স্বয়ং করেছিলেন সেখানেই বলা হয়েছিল যে, ভারতবর্ষের মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলাে এমনভাবে পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম অংশে বিভক্ত হবে, যেগুলাের প্রত্যেক অঞ্চলই হবে স্বায়ত্তশাসিত এবং এর সবগুলাে স্টেট মিলেই অখণ্ড পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পূর্বাঞ্চল কখনােই তেমন স্বায়ত্তশাসিত ‘স্টেট’ বলে পরিগণিত হল না। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকবর্গ পূর্বাঞ্চলকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে শাসন ও শােষণ করে আসছে
স্বাধীনতা রাভের পর ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ববাংলার জনগণ এই। প্রথম শেখ মুজিব ও তার দলকে পাকিস্তান সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য এনে দিল শেখ মুজিব আবার বিশ্বাসঘাতকরূপে চিহ্নিত হলেন এবং শুরু হল গণহত্যা মজার কথা এই যে, লাহাের প্রস্তাবে বর্ণিত সেই পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতিটুকুও শেখ মুজিব তাঁর ৬-দফাতে দাবি করেননি। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্র দফতর রাখার ব্যাপারে তার মত ছিল …।”১০৪ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ বা নির্বাচিত ১৬৭ জন সদস্যের মধ্যে, বলা হয়, মাত্র ৮৮ জন পশ্চিমের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধাবার পক্ষে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। অন্য যারা শেখ মুজিব ও তাঁর দলের প্রতি বিশ্বস্ত রইলেন এবং স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে অনমনীয় থাকলেন তাদেরকে নিজ নিজ জেলার সামরিক প্রশাসকের কাছে ২৬ আগস্ট ৮ টার মধ্যে হাজির হবার নির্দেশ দেয়া হল। নিজেদের কৌসুলি মনােনয়নের। সুবিধা না দিয়েই সামরিক বিশেষ বিচারালয় তাঁদের বিচার করার জন্য অপেক্ষা করছে। যদি প্রকৃতই এইসব এম, পি, সামরিক বিচারকদের কাছে গিয়ে হাজির হত, তাহলে কী হত – সে সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানি মেজর ইফতেখার স্পিগেল-এর প্রতিনিধিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন : “একজনের মাধ্যমে এমন ত্রাসের সঞ্চার করতে হবে যেন পর পর তিনপুরুষও এর (মুজিবের) কথা সভয়ে চিন্তা করতে বাধ্য হয়।”১০৫ মুজিবের মুক্তি প্রসঙ্গে আরেকটি বিদেশী পত্রিকা বলে : “পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সবকিছু মিটমাট করার ভান করলেন। যদি বাঙালির প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান শীঘ্র মুক্তি না পান, তা হলে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের পুনর্মিলন বা মিটমাট করে ফেলার সদিচ্ছাজনিত এই ভানেরও কোনাে মানে হয় না।”১০৬ মুজিবের মুক্তির বিষয়ে পাকিস্তানি আইনসম্মত মতবাদ লক্ষ্য করা যায়। “দি। ডেইলি নিউজ’ পত্রিকা জানায় : “পূর্বাঞ্চলের গােলযােগে জড়িত ব্যক্তিদের প্রতি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সার্বিক ক্ষমা প্রদর্শনের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানও কি ক্ষমা পেতে পারেন? এই প্রশ্ন এখানকার (করাচি)। লিগ্যাল এক্সপার্ট ও স্থানীয় রাজনৈতিক চক্রকে উত্তেজিত করেছে।
সযত্ন বিশ্লেষণে দেখা গেল যে, সাধারণ ক্ষমার ব্যাপারে যে রাজনৈতিক ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছে, তাকে সাধারণ ক্ষমা ছাড়া আর কিছুই বলা হয়নি। এই ঘােষণার প্রচলিত আইনসিদ্ধ ব্যাখ্যায় সম্ভবত শেখ মুজিবুর রহমানও মুক্তি পেয়ে যান। অন্তত পশ্চিম পাকিস্তানে শেখ মুজিব-সমর্থক মহল থেকে এরকমই বলাবলি হচ্ছে। অন্যপক্ষের মতে, এই সাধারণ ক্ষমার আওতায় কোনােক্রমেই শেখ মুজিবুর রহমান এবং তথাকথিত জাতীয় সংসদ ও আইন সংসদের সদস্যরা, যাদের অপরাধী সাব্যস্ত করে বিচার চলছে, তারা পড়েন না। করাচির রাজনৈতিক এবং আইনজ্ঞ মহল অতঃপর অত্যন্ত অধীর চিত্তে শেখ মুজিব ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের ব্যাপারে সকল জল্পনা-কল্পনার অবসানমূলক একটা সরকারি বিজ্ঞপ্তি আশা করছে।”১০৭ ক্রনিদাদ গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয় : . গণতন্ত্র রক্ষার খাতিরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একনায়কের ভূমিকা ত্যাগ করতে পারতেন। … প্রায় নয়মাস হতে চলল, শেখ মুজিবুর রহমান রাজদ্রোহিতার অপরাধে বিচারাধীন (বন্দি অবস্থায়) রয়েছেন এবং যদি দোষী প্রমাণিত হন, তাহলে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন, অথচ তিনি তার নীতির জন্য পূর্ব পাকিস্তানী নাগরিকের সমর্থন পেয়ে নির্বাচনে বিপুল ভােটে জিতেছিলেন। এটা শেখ মুজিবেরই যুক্তি ছিল, প্রজাতন্ত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল পূর্বপাকিস্তানকে কতকগুলাে পশ্চিমপাকিস্তানি মিল-মালিকদের স্বার্থে উপনিবেশ করে রাখার অবিরত চেষ্টা শােষণেরই নামান্তর।… প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সার্বিক ক্ষমা ঘােষণার মধ্যে তিনি এই বিশ্বাস পােষণ করতে পারেন যে, সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছে। কিন্তু এটা ঠিকও নয় এবং শান্তি রক্ষার আগ্রহও এতে নেই। কারণ, শেখ মুজিব সম্পূর্ণরূপেই তাঁর দয়ার বাইরে রয়ে গেলেন।”১০৮ ট্রিবিউন এ্যাফ্রিকাইনি পত্রিকা তাদের মতামত দেয় : “আমাদের মতে, শেখ মুজিবকে যদি যথাসময়ে মুক্তি দেয়া হয়, তবে তা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে একটা চূড়ান্ত পদক্ষেপেরই সূচনা করবে। আর এখান থেকেই ইয়াহিয়া খান এবং তাঁর পারিষদবর্গ তাঁদের সযত্ন-লালিত এই সংকটের (যা অনেকদিন ধরে চলছে) সমাধানের প্রচেষ্টা শুরু করতে পারেন।”১০৯ ‘দি ক্যানবেরা টাইমস’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয় : “উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে আনবার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য পাকিস্তানের ওপর অবশ্যই চাপ সৃষ্টি করতে হবে…..পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এখনাে অখণ্ড
পাকিস্তানের আদর্শে দৃঢ়বিশ্বাসী এবং তাঁকে তাঁর কার্যকলাপের পরিণাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ বলে মনে হয়। কথিত বিচারালয়, যা পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতা। শেখ মুজিবের বিচার করছে, তা যদি তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে, তবে শান্তিপূর্ণ সমাধানের সম্ভাবনা তিরােহিত হয়ে যাবে।”১১০ ‘দি ইভনিং স্টার পত্রিকা লেখে : “এই জটিল ও ভয়ানক পরিস্থিতিতে মনে হয়, মাত্র একজনই সমঝােতার সূত্রপাত ঘটিয়ে সংশ্লিষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সাহায্যে দেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। তিনি হলেন বর্তমানে বেআইনি ঘােষিত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, যাঁর দল গত ডিসেম্বরে দেশের জাতীয় নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করেছিল। ২৫শে মার্চে সেনাবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের পর থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিমপাকিস্তানে অন্তরীণ অবস্থায় রয়েছেন। দেশদ্রোহিতার অপরাধে তাকে। গােপন সামরিক আদালতে বিচার করা হয়েছে। প্রাণদণ্ডের হুমকিস্বরূপ সেই রায় এখন পর্যন্ত ঘােষণা করা হয়নি। সম্ভবত শেখ মুজিবই একমাত্র বাঙালি নেতা যিনি তাঁর নিজস্ব ক্ষমতা দিয়ে এবং অনুগামীদের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানের ধ্বংসাত্মক গােলযােগের ধারাকে বদলিয়ে দিতে সক্ষম। ১১১ রােম-এর ল” উনিটা পত্রিকায় লেখা হয় : “ দেশের পূর্বাঞ্চলের পৈশাচিক নিপীড়নের মহানতম বলি সন্ত্রস্ত জনগণের ভারত অভিমুখে পলায়ন, বাইবেলে বর্ণিত সেই মহাপ্রস্থানে যাত্রার সমতুল্য। রাজনৈতিক সমাধানের ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত হবে আওয়ামী লীগ নেতাকে মুক্তি দেয়া ।… প্রকৃতপক্ষে মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতার প্রতি পুরাে সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনভিত্তিক নির্বাচনী কর্মসূচিকে আশ্রয় করে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। কর্মসূচিটি ছয় দফা কর্মসূচি’ নামে পরিচিত। কিন্তু সত্য করে একথাকে বলতে পারবে যে, বিরাট জাতীয় প্রশ্ন (রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক), স্বায়ত্তশাসন ও যুক্তরাজ্য গঠনের সমস্যা যা এতদিন পর্যন্ত সমাধান করা হয়নি, সেই প্রশ্নকে বাদ দিয়ে পাকিস্তানে শান্তি রক্ষা এবং গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা সম্ভব। বিশ বছর মেয়াদী ভারত-সােভিয়েট মৈত্রী ও সহযােগিতার চুক্তি সম্পাদনের পর যুক্তবিবৃতিতে যে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা হয়েছিল, তা বাস্তবের চেয়েও অধিক সত্য, প্রয়ােজনীয় এবং জরুরি। এর জন্য সময়ােচিত প্রথম অপরিহার্য পদক্ষেপ হল, ভালােবাসার মাধ্যমে শান্তিকামী জনগণ ও সরকারের মধ্যে সৌহার্দ্য।
স্থাপন, অঞ্চলগুলাের মধ্যে বন্ধন সৃষ্টি এবং ফ্যাসিবাদ বিরােধী বীর নায়ক আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের অবিলম্বে মুক্তি প্রদান। তাঁর মুক্তির সেই দাবি উথিত হওয়া এবং দাবি আদায়ের ব্যবস্থা হওয়া উচিত।১১২ ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। পাকিস্তান কারাগার থেকে ফিরে এলেন বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব। পাকিস্তানি কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি পর। পর বিশ্বের পত্র-পত্রিকায় তাঁর কারামুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে সম্পাদকীয় ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এখানে তিনটি সম্পাদকীয় মন্তব্যের নির্বাচিত অংশের ভাষান্তর পত্রস্থ। হল। সম্পাদকীয় তিনটি সংগ্রহ ও ভাষান্তর করেছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক, কলাম লেখক সমালােচক হাসান ফেরদৌস।১১৩
জিন্দাবাদ শেখ মুজিব। শেখ মুজিবুর রহমান সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব অধিকার যার রয়েছে। (কারাগার থেকে) তার প্রত্যাবর্তন প্রমাণ করে যে পাক-ভারত যুদ্ধ এই অঞ্চলে যে ট্রাজেডি ঘটে চলেছে সে-সময়ে প্রকৃত সত্যকে ঢেকে রাখতে পারে। এখানে ৭৪ মিলিয়ন বাঙালি তাদের অস্তিত্ব ও স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়ের জন্যে সংগ্রামরত। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের পতনের পর থেকেই তাদের এই সংগ্রাম। চলছে। অসংখ্য মানুষ এখানে গুলিতে নিহত হয়েছে, জীবন দিয়েছে ক্ষুধা ও রােগভােগে। শেখ, যাকে বাংলার মানুষ মুজিব’ নামে ডেকে থাকে, তার কারামুক্তির ভিতর দিয়ে ৭৫ মিলিয়ন বাঙালির আশা পূর্ণ হয়েছে। যদি বাঙালি জাতি পাকিস্তানের সাথে সংহতি চায়, সেটি তাদের ব্যাপারে। যদি তাঁরা অন্য কিছু চায়, তাও তাদেরই ব্যাপার। উভয় ক্ষেত্রেই তাদের সিদ্ধান্তকে আমাদের শ্রদ্ধাসহকারে মেনে নেয়া উচিত। তাদের সাহায্য করাও আমাদের দায়িত্বের অন্তর্গত। প্রেসিডেন্ট ভুট্টো সম্ভবত এসব প্রশ্ন বিবেচনা করেই তাকে মুক্তি দেবার সিদ্ধান্ত। নিয়েছেন। জিন্দাবাদ শেখ মুজিব। তার দেশ গৌরবান্বিত হােক।১১৪
মুজিবের প্রত্যাবর্তন প্রবল আবেগ উচ্ছাস ও উল্লাসে বিহ্বল এক জনতার সম্ভাষণের ভিতর দিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান। বৃটেনের কাছ থেকে ভারত
স্বাধীনতা পাওয়ার ঘটনার পর এই আবেগবিহ্বল ঘটনা উপমহাদেশে ঘটেনি। দেশে ফেরার সাথে সাথে সম্ভাষণের পাশাপাশি তাকে তার নবলব্ধ স্বাধীন দেশে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সমস্যাসমূহেরও মুখােমুখি হতে হবে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন থেকেই উপেক্ষার শিকার। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা এই দেশটির অর্থনীতিকে সবল করার জন্যে যে উন্নয়ন কার্যক্রম প্রয়ােজন কার্যত তার। কিছুই করেনি। বাংলাদেশে যে গণবিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে তার একটা প্রধান কারণই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের নিজের প্রয়ােজনে সম্পদ তুলে রাখা ও পূর্ব পাকিস্তানের রক্ত শুষে খাবার অব্যাহত নীতি। স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। কিন্তু এখন সমস্যা হচ্ছে সে স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখা। মুজিবের দায়িত্ব হবে পরিপূর্ণভাবে একটি স্বাধীন ও সংহত একটি দেশ হয়ে উঠার আগ পর্যন্ত তার দেশের—শক্তিসমূহকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে উদ্যোগী হওয়া। বর্তমানের উল্লাস যখন থেকে যাবে এবং দেশ গড়ার কঠিন দায়িত্ব সামনে বসে, তখনি বাংলাদেশ সে পরীক্ষার মুখােমুখি হবে। নতুন আত্মঘােষিত দেশটির স্বাধীন অস্তিত্বের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। কার্যকর বেদেশিক সাহায্য। সরকারি স্বীকৃতির প্রশ্নটিও এর সাথে জড়িত। শেখ মুজিব বৃটেনের সাথে সে প্রশ্ন ইতিমধ্যে তুলেছেন। অস্ট্রেলিয়াকেও অতিস্বত্ত্বর সে প্রশ্নের বিবেচনা করতে হবে। দেশের বৃহত্তম অংশের সমর্থন অর্জনের পাশাপাশি মুজিব ও তাঁর সরকারকে প্রমাণ করতে হবে যে দেশটি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এসব প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া গেলে পরাশক্তি সমূহের সিদ্ধান্তের জন্যে আপােষ না করেই অস্ট্রেলিয়ার উচিত হবে স্বীকৃতির পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া। অস্ট্রেলিয়া এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। সে এই অঞ্চলের অবিচ্ছেদ্য অংশ কিনা তা প্রমাণের জন্যে তাকে এখনি মনস্থির করতে হবে।১১৫
বাংলাদেশের উদাহরণ
গতকাল পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর লন্ডনে অবতরণের পরপরই শেখ মুজিবুর রহমান তার নবগঠিত বাংলাদেশের জন্যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আবেদন জানান। যে দেশের মাটিতে ভারতীয় সৈন্যের অবস্থান স্বীকৃতি বিলম্ব হওয়ার অন্যতম কারণ। আশা করা হচ্ছে এটি একটি ক্ষণস্থায়ী এবং যুক্তিপূর্ণ পরিস্থিতি। কিন্তু যেভাবে কোনাে কোনাে দেশ শীতলতার সাথে দেশটির স্বীকৃতির প্রশ্নটি বিবেচনা করেছে তা যুক্তিপূর্ণ মনে হয় না। এই শীতলতার একটি অন্যতম কারণ, অনেক দেশ এই ভেবে উৎকণ্ঠিত যে বাংলাদেশের উদাহরণ আরাে অনেক দেশের ভেতর অবস্থানরত জাতিসমূহ অনগ্রসর করতে পারে। যদিও তেমন উৎকণ্ঠা এককথায় বাতিল করা যায় না,
কিন্তু উদ্বেগ যে ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে এই দেশটির বিভক্তি অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে সে সমন্ধে সম্যক ধারণার অভাব। সবচাইতে দৃশ্যমান কারণটি ছিল ভৌগােলিক। পাকিস্তানের দুই প্রদেশের মধ্যে ব্যবধান এক হাজার মাইলেরও অধিক। এই ব্যবধান হয়তাে দূর করা সম্ভব হতাে যদি দুই অংশের নাগরিকদের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ মিল থাকত। কিন্তু একে অপরের চাইতে অধিক ভিন্ন এমন উদাহরণ পাকিস্তানের দুই অংশের বাইরে অন্যত্র পাওয়া দুষ্কর। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের মানুষ জাতিগত, দৈহিক, ভাষাগত ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তুলনায় ইসলামধর্ম তাদের মধ্যে একমাত্র ঐক্যের সূত্র স্থাপন করে। কিন্তু সেখানেও দুই অঞ্চলের মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবধান রয়েছে। বাংলাদেশের। মুসলমানেরা যারা অনতিদীর্ঘ সময় পূর্বে এই ধর্মগ্রহণ করে, তারা পশ্চিম পাকিস্তানের ধর্মোন্মত্ত মুসলমানদের প্রতিবেশী হিন্দুদের প্রতি অনেক সহনশীল। এই প্রভেদের পাশাপাশি আরাে যে-কারণটি বিভক্তিতে সহায়ক হয়ে উঠে তা হলাে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের উদ্ধত আচরণ। পশ্চিম পাকিস্তানিরা প্রথাগতভাবে দেশটির সরকার ও সামরিক বাহিনীতে একচেটিয়াভাবে কৃতিত্ব চালিয়ে এসেছে। উন্নয়ন প্রচেষ্টার অধিকাংশই পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত ছিল। পূর্ব অংশ কার্যত পশ্চিমের কলােনীতে রূপান্তরিত হয়। পূর্বাঞ্চলের মানুষদের উদ্যোগের ফলেই যে চূড়ান্ত বিভক্তি সম্পন্ন হয় তা নয়, বরং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। খান যে সামরিক কায়দায় পূর্বাঞ্চলের নাগরিকদের স্বাধিকারের জনপ্রিয় দাবীকে দমনের চেষ্টা করে তার ফলেই এই বিভক্তি অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে। হাজার হাজার বাঙালি এই যুদ্ধে নিহত হয়, লক্ষ লক্ষ মানুষ হয় গৃহহারা। অসংখ্য গৃহ হয়। ভস্মীভূত । এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের বিভক্তি ছিল অনিবার্য। বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উদাহরণ থেকে তাই ভয়ের কিছু নেই, বা তা নিন্দনীয় নয় মােটেই। যা নিন্দনীয় এবং যা প্রত্যাখ্যান করা উচিত তা হলাে দৃষ্টিসম্পন্ন। পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের ভূমিকা। কীভাবে জনপ্রিয় ও ন্যায়সঙ্গত দাবীর প্রতি
প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা উচিত নয় পাকিস্তানীরা তারই উদাহরণ স্থাপন করেছে।১১৬ ফিরে এসে দায়িত্ব নিলেন দেশ পরিচালনার। এদিকে ২১ জানুয়ারি স্বদেশ ফিরতি পথে আসামের ফকিরগঞ্জে এক জনসভায় মৌলানা ভাসানী বললেন :
মিসেস গান্ধীর মতাে দয়ালু মহিলা হয় না। ভারতের জনগণের সহানুভূতির কথা ভুলব না। বললেন, স্বাধীন বাংলাদেশ ধর্ম-নিরপেক্ষ, গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।১১৭
চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই ১৯৭১ এর-১৭ ডিসেম্বর পিকিং-এ বললেন : ভারতীয়রাই পাকিস্তানের ঘাড়ে তথাকথিত বাংলাদেশের ক্রীড়নক সরকারকে চাপিয়ে দিয়েছে। চৌ-এন-লাই-র এ-ধরনের অনেক কথাবার্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশে অনেকটা মৌলানা ভাসানীর নেতৃত্বে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা’ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলতে থাকে। এ-আন্দোলনকে জোরদার করার জন্যে ভুট্টো যােগ দিলেন। লন্ডন হয়ে বিশেষ দূত মারফত ভুট্টো মৌলানা ভাসানীর নিকট পত্র প্রেরণ করেনসেখানে ভুট্টো মুসলিম বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য মৌলানার সাহায্য কামনা করেন।১১৮ এদিকে জাসদ গঠিত হবার পর স্বাধীনতার পরাজিত শক্ররা বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে জাসদকে ব্যবহার করে। গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহের সুযােগ নিয়ে জাসদ প্রকাশ্যত অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালাতে থাকে। বাকশাল গঠিত হওয়ার পর জাসদ জনগণের প্রতি সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতির আহ্বান জানায়। একদিকে ১৯৭৪এর ১৪ এপ্রিল ন্যাপ ভাসানী, জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ গণমুক্তি ইউনিয়ন, বাংলাদেশ কমুনিষ্ট পাটি (লেনিনবাদী) শ্রমিক-কৃষক সাম্যবাদী দল সম্মিলিতভাবে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। অন্যদিকে পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি, পূর্ববাংলার সাম্যবাদী দল (এম. এল.) পূর্ব বাংলার কমুনিস্ট পার্টি (এম. এল.), পূর্ব পাকিস্তান। কমুনিস্ট পাটি প্রকাশ্য ও গােপন তৎপরতা চালায়। তারা আইন-শৃঙ্খলা ও জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তােলে। এইসব অতি উগ্রপন্থী দল ১৯৮৪-এর জুননভেম্বর মাসে কমপক্ষে একশােবার পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় ।১১৯ স্বাধীনতার পরপরই এই অতি উগ্র চীনপন্থী দলগুলাে কখনাে স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ কখনাে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’ কখনাে মুসলিম বাংলার শ্লোগান দিয়ে চীনপাকিস্তান প্রদত্ত অস্ত্র নিয়ে শেখ মুজিবের সরকারকে উৎখাতের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।১২০ প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানি দালাল নেতাদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর মনােভাব কোনাে সময়ই কঠোর ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানি দালালগণ বঙ্গবন্ধুর এ মহানুভবতাকে দুর্বলতা ভেবেছে। ফলে স্বভাবতই সাম্প্রদায়িক শক্তি এ দুর্বলতার আড়ালে নিজেদের
সংগঠিত করেছে। এমন অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে আওয়ামীলীগও উপদলীয় কোন্দলের এক সর্বনাশা খেলায় তৎপর হয়ে ওঠে। ১৯৭২ সনে গৃহীত শাসনতন্ত্রের উল্লিখিত মৌলিক অধিকারসমূহের অবাধ সুযােগ নিয়ে অতিউগ্র বামপন্থী দল ও চক্র বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুর সরকার সম্পর্কে অজস্র বানােয়াট মিথ্যাচারসমূহ বিভিন্নভাবে প্রচার করে জনগণকে সার্বিকভাবে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়। ঐ সকল মিথ্যাচার বঙ্গবন্ধু-হত্যার পেছনেও বিশেষ ভূমিকা। রেখেছে। এ সমস্ত দলগুলাে সকল ন্যায়বােধ, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বিসর্জিত হয়ে শুধু গুজব আর মিথ্যাচার দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার কৌশল গ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশ মুক্ত হবার পরপরই মৌলানা ভাসানী, জাসদ, অতিবাম, চৈনিকপন্থী দল ও তার সহযােগীরা বলতে লাগলেন :
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ভারতীয় নেতাদের হাতে পুতুল ছাড়া আর কিছু নয়, ভারতের অঙ্গুলি হেলনেই তারা চলে।১২১
মিথ্যা প্রচারে জনগণ বিশ্বাস না করলেও তারা বিভ্রান্ত হয়েছিল। এবং এসব মিথ্যা প্রচারের কিছু ভিত্তিও তৈরি হয়েছিল। এর মধ্যে সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং রক্ষীবাহিনী গঠন বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তির ফলে সেদিনের সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশ কতখানি উপকৃত হয়েছিল সেই বিবেচনায় না গিয়ে ভারতবিদ্বেষী মনােভাব নিয়ে এই চুক্তির বিরােধিতা এবং বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছিল। রক্ষীবাহিনী নিয়েও নানা কথা প্রচার হচ্ছিল। ১৯৭২-এর ২১ ফেব্রুয়ারিতে রক্ষীবাহিনী গঠনের সময় হতে ১৯৭৫ সালের মধ্যে রক্ষীবাহিনী সদস্যসংখ্যা দাঁড়ায় বিশ হাজার। ফলে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বিক্ষোভ, ঈর্ষা এবং বিভ্রান্তি দানা বাঁধতে থাকে। কিন্তু তদানীন্তন রাজনৈতিক, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এবং দেশকে সেই বিশৃঙ্খল প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা ঠেকাতে রক্ষীবাহিনীর গঠন অনস্বীকার্য। ছিল। সেনাবাহিনীকে দলমতের ঊর্ধ্বে সম্মানে রাখার জন্যই; দৈনন্দিন আভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলার প্রয়ােজনে সেনাবাহিনীর ব্যবহার কখনও যুক্তিযুক্ত নয়।১২২
চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই ১৯৭১ এর-১৭ ডিসেম্বর পিকিং-এ বললেন : ভারতীয়রাই পাকিস্তানের ঘাড়ে তথাকথিত বাংলাদেশের ক্রীড়নক সরকারকে চাপিয়ে দিয়েছে। চৌ-এন-লাই-র এ-ধরনের অনেক কথাবার্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশে অনেকটা মৌলানা ভাসানীর নেতৃত্বে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা’ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলতে থাকে। এ-আন্দোলনকে জোরদার করার জন্যে ভুট্টো যােগ দিলেন। লন্ডন হয়ে বিশেষ দূত মারফত ভুট্টো মৌলানা ভাসানীর নিকট পত্র প্রেরণ করেনসেখানে ভুট্টো মুসলিম বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য মৌলানার সাহায্য কামনা করেন।১১৮ এদিকে জাসদ গঠিত হবার পর স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে জাসদকে ব্যবহার করে। গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহের সুযােগ নিয়ে জাসদ প্রকাশ্যত অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালাতে থাকে। বাকশাল গঠিত হওয়ার পর জাসদ জনগণের প্রতি সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতির আহ্বান জানায়। একদিকে ১৯৭৪এর ১৪ এপ্রিল ন্যাপ ভাসানী, জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ গণমুক্তি ইউনিয়ন, বাংলাদেশ কমুনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী) শ্রমিক-কৃষক সাম্যবাদী দল। সম্মিলিতভাবে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। অন্যদিকে পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি, পূর্ববাংলার সাম্যবাদী দল (এম. এল.) পূর্ব বাংলার কমুনিস্ট পার্টি (এম, এল.), পূর্ব পাকিস্তান কমুনিস্ট পাটি প্রকাশ্য ও গােপন তৎপরতা চালায়। তারা আইন-শৃঙ্খলা ও জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তােলে। এইসব অতি উগ্রপন্থী দল ১৯৮৪-এর জুননভেম্বর মাসে কমপক্ষে একশােবার পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।১১৯ স্বাধীনতার পরপরই এই অতি উগ্র চীনপন্থী দলগুলাে কখনাে স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ’ কখনাে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’ কখনাে মুসলিম বাংলার শ্লোগান দিয়ে চীনপাকিস্তান প্রদত্ত অস্ত্র নিয়ে শেখ মুজিবের সরকারকে উৎখাতের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।১২০ প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানি দালাল নেতাদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর মনােভাব কোনাে সময়ই কঠোর ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানি দালালগণ বঙ্গবন্ধুর এ মহানুভবতাকে দুর্বলতা ভেবেছে। ফলে স্বভাবতই সাম্প্রদায়িক শক্তি এ দুর্বলতার আড়ালে নিজেদের
সংগঠিত করেছে। এমন অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে আওয়ামীলীগও উপদলীয় কোন্দলের এক সর্বনাশা খেলায় তৎপর হয়ে ওঠে। ১৯৭২ সনে গৃহীত শাসনতন্ত্রের উল্লিখিত মৌলিক অধিকারসমূহের অবাধ। সুযোগ নিয়ে অতিউগ্র বামপন্থী দল ও চক্র বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুর সরকার সম্পর্কে অজস্র বানােয়াট মিথ্যাচারসমূহ বিভিন্নভাবে প্রচার করে জনগণকে সার্বিকভাবে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়। ঐ সকল মিথ্যাচার বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এ সমস্ত দলগুলাে সকল ন্যায়বােধ, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বিসর্জিত হয়ে শুধু গুজব আর মিথ্যাচার দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার কৌশল গ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশ মুক্ত হবার পরপরই মৌলানা ভাসানী, জাসদ, অতিবাম, চৈনিকপন্থী দল ও তার সহযােগীরা বলতে লাগলেন :
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ভারতীয় নেতাদের হাতে পুতুল ছাড়া আর কিছু নয়, ভারতের অঙ্গুলি হেলনেই তারা চলে।১২১ মিথ্যা প্রচারে জনগণ বিশ্বাস না করলেও তারা বিভ্রান্ত হয়েছিল। এবং এসব মিথ্যা প্রচারের কিছু ভিত্তিও তৈরি হয়েছিল। এর মধ্যে সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং রক্ষীবাহিনী গঠন বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তির ফলে সেদিনের সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশ কতখানি উপকৃত হয়েছিল সেই বিবেচনায় না গিয়ে ভারতবিদ্বেষী মনােভাব নিয়ে এই চুক্তির বিরােধিতা এবং বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছিল। রক্ষীবাহিনী নিয়েও নানা কথা প্রচার হচ্ছিল। ১৯৭২-এর ২১ ফেব্রুয়ারিতে রক্ষীবাহিনী গঠনের সময় হতে ১৯৭৫ সালের মধ্যে রক্ষীবাহিনী সদস্যসংখ্যা দাঁড়ায় বিশ হাজার। ফলে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বিক্ষোভ, ঈর্ষা এবং বিভ্রান্তি দানা। বাঁধতে থাকে। কিন্তু তদানীন্তন রাজনৈতিক, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এবং দেশকে সেই বিশৃঙ্খল প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা ঠেকাতে রক্ষীবাহিনীর গঠন অনস্বীকার্য ছিল। সেনাবাহিনীকে দলমতের ঊর্ধ্বে সম্মানে রাখার জন্যই; দৈনন্দিন আভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলার প্রয়ােজনে সেনাবাহিনীর ব্যবহার কখনও যুক্তিযুক্ত নয়।১২২
পরপর দু’বছর প্রচণ্ড বন্যা, অনাবৃষ্টি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির ফলে ১৯৭৪ সনে বাংলাদেশে খাদ্যসংকট তীব্র আকার ধারণ করে। বিশ্ব মুদ্রাস্ফীতির ধাক্কায় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা নিঃশেষিত। এমনি অবস্থায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। বঙ্গবন্ধু হাজারাে প্রয়াস নিয়েও খাদ্যসংকট ঠেকাতে ব্যর্থ হলেন। অনেক গবেষকই অভিযােগ করেছেন দেশে যে খাদ্য ছিল তার সুষ্ঠু বিলিবণ্টন হলে বহুলােকের প্রাণ বাঁচানাে যেত এমন কি দুর্ভিক্ষ ঠেকানাে যেত—অভিযােগটির সত্যতা বিশ্লেষণ সাপেক্ষ-বিতর্কিত। তৎকালীন খাদ্যবিভাগের ব্যর্থতা ও ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষক্লিষ্ট মানুষদের নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড পলিটিক্স’ সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরপরই বিভিন্ন সময়ে স্বাধীনতার বৈরী শক্তি ‘হলিডে চক্র’ মৌলানা ভাসানীকে সামনে রেখে ও জাসদ-নেতৃত্ব মুক্তিযােদ্ধার ভাবমূর্তি নিয়ে মিথ্যাচার প্রচার করছিল। এই হলিডে চক্র প্রথমদিকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সরাসরি না লিখলেও সংবাদ-বিশ্লেষণ, সম্পাদকীয় মন্তব্য এবং চিঠিপত্র কলামে সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তসমূহ সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর সমালােচনা করার উদ্যোগী হয়। পত্রিকাটি প্রকাশ্যত চীনের পক্ষে ওকালতি ও পাক-মার্কিনীদের সাফাই গাইতে শুরু করে এবং চরমভাবে ভারত ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিষােদ্গার করতে থাকে।
১৯৭৩-এর ২৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মালেক উকিলকে উদ্দেশ্য করে সংসদসদস্য আব্দুল কুদুস মাখন একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টি আকর্ষণ প্রশ্ন। উত্থাপন করলে, সেই প্রশ্নের সূত্রে পরবর্তীতে অনুসন্ধানে দেখা গেল-জুলফিকার আলী ভুট্টো তার পিপলস্ পার্টি গঠন করার সময় আসলাম নামের জনৈকি উর্দুভাষী সাংবাদিকের আবির্ভাব ঘটে। যুদ্ধকালে সে বাংলাদেশেই ছিল। গােয়েন্দা রিপাের্টে দেখা গেছে সে ছিল পাকিস্তান তথা ভুট্টোর এজেন্ট। পাকিস্তানের সাথে সকল যােগাযােগ ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় সে ঢাকায় গােপনে কাজ করছিল। তার কাছ ছিল বিচ্ছিন্ন পাকিস্তানি এজেন্টদের সঙ্গে পাকিস্তানি গুপ্তচর বাহিনীর পুনঃযােগাযােগ ঘটিয়ে দেয়া। সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে সে এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। বলাবাহুল্য এই পাকিস্তানি এজেন্টটি ছিল হলিডের নির্বাহী সম্পাদক। এখানে উল্লেখ্য,
আসলাম যে একজন পাকিস্তানি ও তার পত্রিকায় কর্মরত ছিল এনায়েতউল্লাহ খান তা অস্বীকার করেননি।১২৩
ইনটেলিজেন্স রিপাের্টে জানা যায়, এনায়েতউল্লাহ খান বাংলাদেশবিরােধী একটি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিল এবং তার গতিবিধি সন্দেহজনক। মােশতাকের আমলে হলিডে চক্রের নির্লজ্জ দালালী, স্বাধীনতাবৈরী তৎপরতা এবং স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির উপর অন্তহীন আক্রমণ শুরু হয়। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু-হত্যার পূর্ব পর্যন্ত একবছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ঘটনার মধ্যে কয়েকটি বিশেষ ঘটনা উল্লেখযােগ্য। এর মধ্যে দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিপ্লবী সরকারকে স্বীকৃতি দান ও তার রাষ্ট্রপ্রধানকে বাংলাদেশে লাল গালিচা সম্বধর্না, ১৯৭৪ সনের প্রচণ্ড বন্যা ও বন্যা উদ্ধৃত দুর্ভিক্ষ, খােন্দকার মােশতাকের ইরান সফর এবং মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জারের ঢাকা আগমন উল্লেখ্য।
১৯৭৪-এর ৩০ অক্টোবর মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট ড. হেনরি কিসিঞ্জার উনিশ ঘন্টার সফরে বাংলাদেশে আসেন। তিনি গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দুইঘণ্টা ব্যাপী আলাপ-আলােচনা করেন। আলােচনা-শেষে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন : A man of ‘vast conception’, Kissinger said, ‘he had rarely met a man who was the father of his nation and this was a particularly unique experience for him, for those who listed to Kissingers dead-pan delivery that then, there was a slight trace of Sarcasm in his voice. সংবাদিক লিফসুলৎজ মনে করেন শেখ মুজিব সম্পর্কে বিশেষিত শব্দগুলাে এ ম্যান অব ভাস্ট কনসেপশন’ ছিল একধরনের কথার কথা, ব্যঙ্গোক্তি! লিফসুলৎজ লিখেছেন : Within a month after kissinger visit to Dhaka, according to a high level U.S. source then stationed at the American Embasy in Dhaka the first regular contacts with the coup planning cell began.১২৫ কিসিঞ্জারের ঢাকা সফরের পর পরই বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যে ‘কু প্লানিং সেল’-এর সঙ্গে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের কন্টাক্ট হয়। বঙ্গবন্ধু-হত্যার ব্যাপারে
১৯৮২ সালে মার্কিন সাপ্তাহিক ‘টাইম’ পত্রিকায় বলা হয় : স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দশবছরের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের আমল ছিল সর্বপ্রথম এবং দীর্ঘতম গণতান্ত্রিক আমল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক ও প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে হত্যার পর হঠাৎ গণতান্ত্রিক আমলের অবসান ঘটে।১৩৪ খােন্দকার মােশতাক, আবু সাদাত সায়েম, জিয়া ও আব্দুস সাত্তারের আমলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি বহুলপ্রচারিত ও প্রভাবশালী পত্রিকাটির দৃষ্টি এড়ায়নি। টাইম ও অন্যান্য মার্কিন সংবাদপত্র বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় তাঁর সরকারের অযৌক্তিক সমালােচনা করে। ভারত ও তৎকালীন সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক অব্যাহত রাখার জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার তাদের কোপানলে পড়ে। বঙ্গবন্ধু-হত্যার সাত বছর পর, সামরিক শাসকদের বন্ধ্যা প্রশাসনের সঙ্গে তুলনা করে, বঙ্গবন্ধুর সরকারকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে পত্রিকাটি সাংবাদিক-সততা প্রদর্শন করে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার অব্যবহিতপর আমেরিকার অপর একটি প্রভাবশালী সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নিউজউইক’-এর প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় : “গত সপ্তাহে (মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে) শেখ মুজিব যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন, তখন তার কোনাে কোনাে সমালােচক বলেছিলেন, তিনি শুধু উগ্রপন্থী সমর্থকদের চাপের মুখে নতি স্বীকার করেছেন । ঢেউয়ের চূড়ায় উঠে তিনি তলিয়ে যাওয়া থেকে শুধু আত্মরক্ষার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এক অর্থে বলা চলে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের সপক্ষে লড়াইয়ের স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে মুজিব এক নতুন বাঙালি জাতির সংগ্রামী নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ। হয়েছেন। মুজিব ঢেউয়ের চূড়ায় অবস্থান করছেন বটে, কিন্তু তা অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়।” নিউজউইককর্তৃক পরিবেশিত সংবাদে আরও বলা হয় : “মুজিব মৌলিক চিন্তার অধিকারী বলে ভান করেন না। তিনি একজন রাজনীতির কবি, প্রকৌশলী নন। শিল্প কৌশলের প্রতি উৎসাহের পরিবর্তে শিল্পকলার প্রতি ঝোক বাঙালিদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। কাজেই সকল শ্রেণী ও আদর্শের অনুসারীদের একতাবদ্ধ করার জন্য সম্ভবত তাঁর ‘স্টাইল’ (পদ্ধতি) সবচেয়ে বেশি উপযােগী ছিল।”১৩৫ বাংলাদেশে স্বাধীন হওয়ার মাত্র দু সপ্তাহ পর ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয় :
শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় একটি চালু সরকার প্রতিষ্ঠা করেছেন, এ-সম্বন্ধে কোনাে সন্দেহ নেই। সারাদেশে গেরিলাদের অস্ত্রসমর্পণ, লক্ষ লক্ষ বাস্তুহারাদের ভারত থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন এবং ধাপে ধাপে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার—এসব
নতুন বাঙালি প্রশাসনের জনপ্রিয়তা ও কার্যকারিতা প্রমাণ করে।”১৩৬ ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে আমেরিকার বিখ্যাত দৈনিক ‘ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটার’-এ প্রকাশিত এক সংবাদ সমীক্ষায় বলা হয় : “বিজয় দিবসের আসন্ন প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে বলা চলে, যারা বাংলাদেশ পৃথক রাষ্ট্র হিসাবে টিকে থাকবে না বলে ভবিষ্যৎবাণী করেছিল, তারা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হবে।”১৩৭ ডিসেম্বর মাসে জার্মানির প্রভাবশালী দৈনিক দি ওয়েল্ট’-এ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় : “ঢাকা, চট্টগ্রাম অথবা কুমিল্লায়, এমনকি রাতের বেলাও পথচারীরা কোনাে রকমের বাধাগ্রস্থ না হয়ে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারে। এসব শহরের রাস্তাঘাট জার্মানীর ফ্রাংফুট কিংবা আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের রাস্তাঘাটের। তুলনায় অধিকতর বিপজ্জনক নয়। এই আশ্চর্য ব্যাপারের সঠিক ব্যাখ্যা মুজিব। তিনিই রাষ্ট্রের সমন্বয়কারী শক্তি।”১৩৮ সাংবাদিক এ. এল, খতিব তাঁর ‘হু কিল্ড মুজিব’ গ্রন্থে মুজিব-হত্যার বিবরণ দিয়েছেন এভাবে : Soldiers were by then swarming all over Mujib’s house. They bound a room closed on all sides- it was Rehana’s bedroom. They forced a door open, sending a cupboard full of things crashing to the floor. “Let me see what they want.” Mujib said and came out of the room as he had done on the night of 26 March, 1971. He had faced the Pakistani soldiers. These were his own men. Mujib was wearing a checked lungi and a white kurta. Mujib met Huda on the stair case. “It is you. What do you want? “Mujib ask. “We have come to take you.” Huda said, “Do you think it is fun?” Mujib thundered. “I will not allow the country to be ruined.” Huda was unnerved. A servant cried : “Kamal Bhai is dead.” Havilder Moslemuddin, who was coming down from the terrace, swore and opened fire from behind with an automatic weapon, riddling Mujib’s body with bullets.
Sodiers were picking up whatever they could. “Take whatever you want but dont kill us.” Begam Mujib pleaded. But hearing the burst of firing. She come out. “You have killed him, kill me.” She wailed. She was silenced for ever. Jamal, his wife Rosy and Sultana, Kamal’s wife were still in the dressing room. A burst from a sten gun and the three were dead. The gunmen found Naser in a bathroom and shot him. Russel was cowering in a corner. “Take me to my mother,” he whimpered. “We will take you to your mother.” One of the homicidal maniacs said. A police officer pleaded for Russel’s life “He is only a child.” The officer was killed. One arm of Russell had been shot off, yet he begged : “Don’t kill me, don’t kill me.” The answer was a bullet. Russell lay dead by his mother’s side. Farook and Rashid were late in reaching Mujib’s house, Farook went up to satisfy himself that all had been killed.১৩৯ মি, খতিব প্রাগুক্ত গ্রন্থে শহীদ শেখ মুজিবের কাফন ও দাফনের বর্ণনা দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর কবর কোথায় হবে এ নিয়ে কু-এর পক্ষের লােকদের মধ্যে সিন্ধান্তহীনতা ছিল। একদিন পেরিয়ে যাবার পর সিদ্ধান্ত হল বঙ্গবন্ধুর লাশ টুঙ্গিপাড়াতে কবরস্থ করা হবে। এদিন দুপুর আড়াইটার দিকে হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধুর লাশ টুঙ্গিপাড়ায় আনা হলাে। ততক্ষণে গােপালগঞ্জের এস,ডি,ও, একদল পুলিশ নিয়ে টুঙ্গিপাড়াতে উপস্থিত হয়েছেন। কফিনে আবদ্ধ লাশ নামানাে হল। সামরিক অফিসাররা চাইলেন কফিনসুদ্ধ লাশ কবরে নামিয়ে মাটি দেয়া হােক। গ্রামের লােকেরা ও পেশ ইমাম আপত্তি জানালেন তা হতে পারে না, কেননা তা ইসলামসম্মত নয়। “তাহলে লাশ নামিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কবর দিতে হবে।” গ্রামের লােকেরা বল্লেন, তারা লাশ দেখবেন। “না দেখে মাটি দেয়া যায় না?” সামরিক অফিসারগণ দাবী করলেন। “হ্যা, দেয়া যায়, তবে ঘােষণা করতে হবে যে, মুজিব একজন শহীদ”- পেশ ইমাম উত্তর করলেন। গ্রামের মসজিদের পেশ ইমাম মৌলভী শেখ আব্দুল হালিমের সাহস আছে বলতে হবে, কেননা ততক্ষণে বঙ্গবন্ধুর অনেক সহকর্মী বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ করে মন্ত্রী হয়েছেন।
মুজিবের লাশ তার গ্রামের বাড়ির বারান্দায় নিয়ে যাওয়া হল। তার শরীরে উনত্রিশটি গুলিবিদ্ধের চিহ্ন। স্বয়ংক্রিয় রিভলভারের একটি গুলি সামনে থেকে পেছনে বেরিয়ে গেছে। তাঁর পাঞ্জাবীর পকেটে পাওয়া গেল তার পাইপ ও চশমা—চশমাটি ভেঙে গেছে। মুজিবের গ্রামের সকল দোকান বন্ধ। একজন বহুকষ্টে একটি কাপড়কাচা সাবান নিয়ে এল। তাকে সর্বশেষ গােছল দেবার জন্যে পানি গরম করবার সময়ও পাওয়া গেল না। ঠান্ডা পানিতেই গােসলের কাজ শুরু করা হল। কিন্তু রক্ত পরিষ্কার না হতেই কুকুরের মতাে মেজরটি চীৎকার করে উঠল- “আর কত। সময়, এবার শেষ করাে।” মুজিবের মাতা সায়রা খাতুনের নামে নির্মিত গ্রামের হাসপাতাল থেকে চারটি শাড়ি নিয়ে আসা হল। তার লাল পাড়গুলাে ছাড়িয়ে মুজিবের লাশকে কাপড়ে জড়ানাে হল। কিন্তু অফিসাররা সেলাইয়ের সময় দিতে প্রস্তুত নয়। অতএব ঐ অবস্থাতেই লাশ কবরের কাছে নিয়ে আসা হল। সামরিক অফিসাররা বলল, “জানাজার আর কী দরকার?” মৌলানা সাহেব ঘােরতর আপত্তি করলেন। অবশেষে জানাজা করা হল। উপস্থিত পুলিশরা অজু করবার সময় চাইলেন। তারাও জানাজায় শরিক হতে চান। কিন্তু তাদেরকে সেই সময় দেয়া হলাে না। মুজিবকে তাঁর পিতার পাশে সমাধিস্থ করা হল। পশ্চিমাকাশের সূর্য তার উজ্জ্বল রশ্মি ছড়িয়ে বিষন্ন নয়নে মুজিবকে চির অন্ধকারের জগতে বিদায় জানাল। অথবা তিনি তখন আরাে সমুজ্জ্বল জগতের যাত্রী।১৪০ মুজিবকে নিজ হাতে যে গুলি করেছে তার নাম মােসলেমুদ্দিন। ওকে পৃথিবীর জঘন্যতম হন্তাদের সাথে তুলনা করা হয়। ১৯৭৭-এর ২ অক্টোবরের এক অভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে ব্যর্থ হলে বিশেষ সামরিক আদালতে ওর বিচার হয়। সেখানে। ও স্বীকার করে যে, “ডালিম তাকে মুজিব-হত্যায় উদ্বুদ্ধ করে এবং ফারুক প্রত্যক্ষভাবে মুজিবকে নিহত করতে উপদেশ দেয়। মুজিবকে যখন সে হত্যা করে তখন সে মদ্যপানজনিত নেশায় ছিল এবং সেই অবস্থায় সে মুজিব ও তার পরিবারের চারজনকে নিজের হাতে গুলি করে হত্যা করে। কোর্টে দাড়িয়ে একথাও সে বলে যে, যে পাপ সে করেছে তার সীমা নেই, তার মৃত্যু হওয়াই উচিত- জাতি তাকে সারাজীবন ঘৃণার চোখে দেখবে।১৪১ সামরিক আদালতের বিচারে মােসলেমুদ্দিনকে ফাঁসিতে ঝুলানাে হয়।
পিটার হেজেলহ আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থান সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন : আমরা কি এই ঘটনাকে সামরিক অভ্যুত্থান বলতে পারি? আমি অন্তত বলব সাধারণত অভ্যুত্থানে একটি প্রাতিষ্ঠানিক অনুমােদন থাকে, যা এক্ষেত্রে নেই। সমগ্র সেনাবাহিনী এ ঘটনায় জড়িত ছিল না—এমনকি এ নিয়ে তাদের মধ্যে রীতিমতাে বচসা হয়। যখন এদের মধ্যে কেউ কেউ ১৫ই আগস্ট অতিপ্রত্যুষে রাস্তায় ট্যাঙ্ক চলতে দেখে তখন কোনাে একটা গােলমাল হয়েছে কিনা তা জানবার জন্যে একে অপরকে ফোন করে বিশেষ করে সিনিয়রগণ অবাক; তারা জানেন না, অথচ ট্যাঙ্ক রাস্তায়! কিন্তু তখন বিলম্ব হয়ে গেছে।১৪২ আরেকজন সাংবাদিক টমাস মুর আগস্ট অভ্যুত্থান সম্পর্কে এক জায়গায় বলেছেন : “সামরিক অভুথানের পশ্চাতে একটি আদর্শগত অনুপ্রেরণা কাজ করে। এ ঘটনায় তার বিন্দুমাত্র স্পর্শ ছিল না। কেননা মুজিবকে হত্যার পর যাদেরকে ক্ষমতায় বসানাে হল তারা সবাই কেবল মুজিব-মন্ত্রিসভার সদস্যই ছিলেন না– আদর্শগতভাবেও তারা সবাই ছিলেন তার আদর্শের অনুসারী। মুজিবকে হত্যার পর এ-সরকার কোনাে গুণগত ও আদর্শগত পরিবর্তন আনতে পারে না। ঘটনার মাত্র তিনদিন পরেই মােস্তাক ঘােষণা করল যে, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা হবে তার সরকারের মূলনীতি, যদিও প্রথমদিন সে বলেছিল ইসলামের আদর্শের কথা, যা মুজিবেরও কথা ছিল- মুজিব তাে আর ইসলামবিরােধী কোনাে নীতি গ্রহণ করেননি, সে প্রশ্নই ওঠে না।”১৪৩ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসে মুজিব এক মহানায়ক। একদিনে হঠাৎ মঞ্চে এসে দাঁড়িয়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেননি। তাঁর আবির্ভাব ধমূকেতুর মতাে নয়। মুজিব ইতিহাসের এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। একজন পণ্ডিত। মুজিবের তিরােধানের প্রশ্নে দুঃখ করে বলেছেন : “A great life in modern history thus came to a most ignoble end.588 শৈশবেই মুজিব ছিলেন দুরন্ত, দুর্বার। তার হৃদয়ে সবসময় একটা বিক্ষোভ দানা। বেঁধে থাকত। স্কুলজীবনেই এক দুঃসাহসিক ঘটনার মধ্যদিয়ে তার সে বিক্ষুব্ধ। হৃদয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯৩৯ এর মুজিব ছিলেন গােপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র; অবশ্য অসুস্থতার কারণে তিনবছর তাঁর ছাত্রজীবনের বিরতি
ঘটে। সে সময় শেরেবাংলা ফজলুল হক সাহেব স্কুল পরিদর্শনের জন্য সেখানে গিয়েছিলেন। নেতাকে যথাযােগ্য সংবর্ধনা জানাতে প্রথমদিকে কংগ্রেস-সমর্থকগণ সম্মত হন কিন্তু পরে তাঁরা বেঁকে বসলেন এবং ঐ সংবর্ধনা প্রদান থেকে তারা বিরত থাকেন ও বাধার সৃষ্টি করেন। যাহােক, নেতাকে যথারীতি সংবর্ধনা জানানাে হলাে। হক সাহেব চলে যাবার পর এই ব্যাপারে মন-কষাকষি, বচসা ও কথা কাটাকাটি চলতে থাকে এবং একটি ছােটখাটো গােলমাল বেধে যায়। শেখ মুজিবুর রহমান। ছিলেন সংবর্ধনা প্রদানের সপক্ষে। তিনি তাঁর প্রচেষ্টা ও যত্নদ্বারা কংগ্রেস ও ফজলুল হক সমর্থকদের মধ্যে একটা সমঝোতার চেষ্টা করেন। কেননা তিনি শৈশব থেকেই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক মনােভাবাপন্ন আদর্শবাদী যুবক। মুজিবের চেষ্টা সফল হয়, কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি নিজেই এক চক্রান্তের ফাঁদে। পড়ে পুলিশ কর্তৃক সাতদিনের জন্য কারাগারে আবদ্ধ হন। স্থানীয় পুলিশের মনােভাবও তার প্রতি প্রসন্ন ছিল না। তিনি অতীতেও তাদের জ্বালাতন করেছেন। এ-প্রসঙ্গে যতীন্দ্র ভাাগার-এর বক্তব্য : Mujib is a great organiser. He demonstrated it amply since the day he led a small group of around 12 year olds in Faridpur to stone the police station because policemen did not allow a political meeting be held in the area. That was the beginning of a series of events which went to prove his great organisation skill and his success in moulding ‘Bheetu Bengalis’ into indomitable freedom fighters.১৪৫ যাহােক, এই প্রথম তিনি সাম্রাজ্যবাদ শক্তির শিকারে পতিত হন। এই হল তাঁর কারাজীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা। তার সারা অন্তর হল স্পন্দিত। শুরু হল সংগ্রামী জীবনের প্রথম অধ্যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবরে শুয়ে থেকেও তিনিই যেন পরবর্তী সরকারগুলােকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালিত করেছেন, তাকে অস্বীকার করাবার এক হাস্যকর নেতিবাচকতার মধ্যে তিনি বারবার ফিরে এসেছেন, তার পুণ্যস্মৃতির প্রতি ভীতির মধ্যেই তিনি যেন সােচ্চার হয়েছেন। অনেক বিদেশি তথ্যনিষ্ঠ লেখক তাই। বলেছেন : Mujib rules from the grave.
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পরদিন ‘দি টাইমস্’ পত্রিকায় প্রকাশিত তার সংক্ষিপ্ত জীবনীতে বলা হয় :
“সবকিছু সত্ত্বেও শেখ মুজিব স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এজন্য যে, তাকে ছাড়া বাংলাদেশ কখনও বাস্তবে পরিণত হতাে না।১৪৬ ফাইনান্সিয়াল টাইমস’ -এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয় : “শেখ মুজিবকে হত্যার ফলে বাংলাদেশ এমন একজন আকর্ষণীয় ব্যক্তিকে হারিয়েছে, যিনি তার ব্যক্তিত্বের প্রভাব খাটিয়ে দেশকে অখণ্ড রাখার মতাে প্রয়ােজনীয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।” এই নিবন্ধে আরও বলা হয় : “দারিদ্র্য, উৎপীড়ন, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত দ্বিতীয় বিপ্লবের মাঝামাঝি সময় শেখ মুজিব নিহত হন। তাঁর কর্মসূচির প্রায় প্রত্যেকটি বিরােধীদলের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে।”১৪৭ ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় : “শেখ মুজিবের ভয়াবহ মৃত্যুকে বাংলাদেশের কোটি কোটি লােক অপূরণীয় ক্ষতি বলে গণ্য করবে। শেখ মুজিব এখনও জনগণের শ্রদ্ধা ও ভালােবাসার পাত্র। রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী জনগণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার কোনাে পরিবর্তন হবে বলে ওয়াকেবহাল মহল আশা করেন না।” পত্রিকাটির করাচিতে নিয়ােজিত সংবাদদাতা বলেন “বাংলাদেশের সামরিক কু অনুষ্ঠানের ফলে কূটনীতি ক্ষেত্রে পাকিস্তানের জন্য অযাচিতভাবে দ্বার উন্মুক্ত হল।”১৪৮ “দি গার্ডিয়ান’-এ বলা হয় : “রক্ষীবাহিনীর প্রতি বাংলাদেশের সামরিকবাহিনীর বিরূপ মনােভাব কু অনুষ্ঠানের জন্য মূলত দায়ী।” ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর কর্তৃক প্রচারিত এক বিবৃতিতে বলা হয় : শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারবর্গের মৃত্যুসংবাদ যদি সমর্থিত হয় তাহলে এদেশে তা ব্যাপকভাবে দুঃখজনক বলে বিবেচিত হবে। মুজিব
বহুলপরিচিত এবং শ্রদ্ধেয় স্টেটসম্যান (রাজনীতিজ্ঞ ব্যক্তি) ছিলেন। তিনি । বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন।১৪৯ বঙ্গবন্ধু-হত্যা সম্পর্কে এক বিশেষ নিবন্ধে ‘দি অবজার্ভার’ পত্রিকার প্রখ্যাত কলামিস্ট’ গেভিন ইয়াং বলেন :
পাকিস্তান সামরিকবাহিনীকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশে ভারতের প্রতি যে শ্রদ্ধাবােধ ছিল, তা এখন হাওয়ায় উবে গিয়েছে। বাংলাদেশের অনেকেই এখন মনে করে, মুক্তিযােদ্ধারা যখন জয়লাভ নিশ্চিত করে, তখন সুযােগ বুঝে ভারতীয়রা এসে যােগ দেয়। এটা একটা অবমাননাজনক অলীক কাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়। বাঙালিরা এখন নিজেদের মধ্যে ফিসৃফিস করে ভারতীয় নয়া উপনিবেশবাদ’-এর কথা বলে।” গেভিন ইয়াং আরও বলেন : “ভারত-বিদ্বেষ মুজিব উদ্দেশ্যমূলকভাবে সৃষ্টি করেননি। এটা বাংলাদেশে রয়েছে।”১৫০ নয়াদিল্লি থেকে টি. ডি. অলম্যান কর্তৃক প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয় :
“মার্কিন কূটনীতিবিদ ও গােয়ান্দাদের সঙ্গে সংযােগ-রক্ষাকারী হিসাবে পরিচিত এবং ভারতের প্রতি সন্দেহপরায়ণ খােন্দকার মােশতাক আহমদের সরকার সামরিক বাহিনী-নিয়ন্ত্রিত বিধায়, আমেরিকা ও চীন কর্তৃক দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের প্রভাব পুনরুদ্ধার করার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে হয়। উল্লিখিত সংবাদে দুটো বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। প্রথমত পাকিস্তান সর্বপ্রথম ঢাকার সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। দ্বিতীয়ত কু-সম্পর্কিত সংবাদ প্রথমে ওয়াশিংটন থেকে প্রচারিত হয়। এই তথ্যের ভিত্তিতে ভারতীয় অফিসাররা। ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, সিআইএ কু’র সঙ্গে জড়িত ছিল।”১৫১ অল-ইন্ডিয়া রেডিও থেকে জনৈক সরকারি মুখপাত্র বলেন : বাংলাদেশের ঘটনাবলি সম্পর্কিত সংবাদ ভারত-সরকার মনােযােগ দিয়ে পরীক্ষা করছে এবং বিকাশশীল পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে। একটি প্রতিবেশীসুলভ দেশে এ ধরনের রাজনৈতিক বিবর্তনের প্রভাব থেকে আমরা মুক্ত থাকতে পারি কিন্তু এসব বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং তাদের পরিবার পরিজনদের হত্যা সংবাদ আকস্মিক আঘাত হিসাবে এসেছে। স্থিরসংকল্প নিয়ে সাহসের সঙ্গে জাতীয় মুক্তির
নেতৃত্বদানকারী শেখ মুজিবুর-এর শােকাবহ মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে মর্মাহত।” “আমাদের কালের একজন সুবিদিত রাজনেতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে আমরা ভারতে তাকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলাম।”১৫২ ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বলেন : “গত সপ্তাহে সংঘটিত বাংলাদেশের ঘটনাবলি তার সরকার আকস্মিক আঘাত বলে গণ্য করে।” শেখ মুজিবের মৃত্যুতে শােক প্রকাশের জন্য আয়ােজিত এক জনসভায় মিসেস গান্ধী তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন : সারা বিশ্বে শেখ মুজিব একজন মহান জাতীয় নেতা এবং স্টেটসম্যান হিসাবে স্বীকৃত। তিনি অসাধারণ সাহস ও দৃঢ় প্রত্যয় সহকারে তার জাতির স্বাধীনতা। সংগ্রামে নেতৃত্বদান করেন। ভারতের জনগণ তাকে এদেশের বন্ধু ও প্রীতির
দৃষ্টিতে দেখেন।”১৫৩ বিবিসি টেলিভিশনের দূরপ্রাচ্য সংবাদদাতা ব্রায়ান ব্যরন বঙ্গবন্ধু-হত্যার কয়েকদিন পর বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে ঢাকা পৌছান। তৎকালীন হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তিনদিন আটক থাকার পর তাদের সবাইকে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ১৯৭৫-এর আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে লিখিত তার সংবাদ বিবরণীতে বলা হয় :
“শেখ মুজিব সরকারিভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং জনসাধরণের হৃদয়ে উচ্চতম আসনে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হবেন। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। এটা যখন ঘটবে, তখন নিঃসন্দেহে তার বুলেট-বিক্ষত বাসগৃহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মারকচিহ্ন এবং তাঁর কবরস্থান পুণ্যতীর্থে পরিণত হবে।”১৫৪। “দি গার্ডিয়ান’-এর সংবাদদাতা টমাস মুর কর্তৃক ঢাকা থেকে প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয় : “খােন্দকার মােশতাকের অধীনে যারা বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন হয়েছে, তারা এখন নিহত শেখ মুজিবের রক্তের দাগ মুছতে গিয়ে লেডি ম্যাকবেথের। (শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের চরিত্র) দুঃস্বপ্নের দৃশ্য পুনরাভিনয় করছে বলে মনে হয়।” “নতুন সরকার বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশ্বস্ত বিষয় হিসাবে বিবেচিত ধর্মকে ব্যবহার করছে বলে সর্বপ্রথম মনে হয়। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার স্বাধীনতার
পর নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ইসলামপন্থী গোঁড়া খন্দকার মােশতাকের ক্ষমতা দখল, পাকিস্তান কর্তৃক ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান এবং রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের ফলে পুরােনাে আমলের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি অনতিবিলম্বে ফিরে আসে।” “কু অনুষ্ঠানের প্রথমদিন মসজিদে মুসল্লিদের ভিড় আগের তুলনায় বেশি হয়। রিকশাচালকরা যে-কোনাে মান্যগণ্য চেহারার পথচারীকে সালাম জানায় এবং পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা উর্দু শহরের সর্বত্র ব্যবহৃত হয়।” “হাল-চাল দেখে মনে হয়, বাংলাদেশের জনসাধারণ আইয়ুবের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ধর্মীয় প্রচারণা ও সামরিক শাসনের যুগে ফিরে গিয়েছে।”১৫৫ ১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর লন্ডন অবস্থানকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দরা গান্ধী এক অভিনন্দনবাণী পাঠান। এ বাণীতে তিনি বলেন : “আপনি বন্দি ছিলেন, কিন্তু আপনার চিন্তাশক্তি ও চেতনাকে কারারুদ্ধ করা সম্ভব নয়। আপনি নিপীড়িত জনগণের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।”১৫৬ ১৯৭৯-এর আগস্ট মাসে পশ্চিমে জার্মানির শেখ মুজিব স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়ােজিত এক সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে যােগদানের জন্য মিসেস গান্ধীকে স্মৃতি সংসদের পক্ষ থেকে অনিল দাসগুপ্ত আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রণ পত্রের প্রাপ্তিস্বীকার করে ইন্দিরা গান্ধী জানান : “শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়ােজিত সভায় যােগদান করতে সক্ষম হলে আমি আনন্দিত হতাম। আপনারা সম্ভবত জানেন, আমার পাসপাের্ট নেই এবং বর্তমান ভারত-সরকার আমার বিদেশ সফর, বিশেষ করে এ-ধরনের একটি অনুষ্ঠানে যােগদান ভালাে চোখে দেখবে না।” “শেখ মুজিব একজন মহান নেতা ও অত্যন্ত হৃদয়বান মানুষ ছিলেন। তাঁর। বন্ধুত্বলাভ বিশেষ অনুগ্রহ বলে আমি মনে করি। আপনারা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান তার স্মৃতি প্রজ্বলিত রাখার কাজে নিয়ােজিত রয়েছেন জেনে আমি আনন্দিত। যে-ধরনের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তিনি সংগ্রাম করেছেন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন, তা বজায় রাখার কাজে আত্মনিয়ােগ করার জন্য তাঁর স্মৃতি বাংলাদেশের জনগণকে চিরকাল অনুপ্রাণিত করবে বলে আমি স্থির নিশ্চিত।”১৫৭ কর্মব্যস্ততার জন্য ২৪ জুলাই তারিখে লিখিত চিঠির উত্তর তিনি (ইন্দিরা গান্ধী) ১ সেপ্টেম্বরের আগে পাঠাতে পারেননি।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আন্তর্জাতিকভাবে প্রচার করা হয়েছে যে, ব্যক্তিগত আক্রোশে শেখ মুজিব নিহত হয়েছেন। এসব আন্তর্জাতিক রিপাের্ট থেকে সমগ্র বিশ্বে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের কাছেও একথা বিশ্বাসযােগ্য করার প্রয়াস চলেছিল যে, মুজিব-হত্যা ব্যক্তিগত আক্রোশের নির্মম ফলশ্রুতি। যেমন বিখ্যাত। সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাস কিসে ভুল হল’ শিরােনামে লন্ডনের সানডে টাইমস এক বিরাট রিপাের্ট প্রকাশ করেন। রিপাের্টটি১৫৮ নিম্নরূপ : “১৯৭২ সালে নবপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে ফিরে এসে শেখ মুজিবুর রহমান বীরের সম্বর্ধনা পেয়েছিলেন। তিনি তখন সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। গত সপ্তাহে এক সামরিক অভুথানে নিহত হয়েছেন। দুটি ঘটনার মাঝখানের ক’বছর তার সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণের মােহ কেটে গেছে এবং সােনার বাংলার স্বপ্ন মিলিয়ে গেছে। কিসে ভুল হল? মুজিবের ট্র্যাজেডি এই যে, চার বছরের কম সময়ে তিনি বঙ্গবন্ধু উচ্চতর মর্যাদা হারিয়ে বঙ্গদুশমনে পর্যবসিত হলেন। তার বিপর্যয়ের রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় প্রধানত তিনটি উপকরণ মিশে আছে। প্রথমত ; সামরিক বাহিনীর প্রধান হওয়া সত্ত্বেও মুজিব সেনাবাহিনীকে অবিশ্বাস করতেন। সেনাবাহিনীর এবং বাংলাদেশ আন্দোলনে প্রশংসনীয় ভূমিকা রয়েছে এমন অনেক সামরিক অফিসারের মর্যাদা ক্ষুন্ন করার কোনাে সুযোেগ তিনি ছাড়তেন না।১৫৯ মুজিবের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে অনুগত উচ্চট্রেনিংপ্রাপ্ত সুসজ্জিত ইউনিফরমধারী রক্ষীবাহিনীকে অস্ত্রেশস্ত্রে বেতন ভাতায় ব্যয় বরাদ্দে সামরিক বাহিনীর চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হত। উভয়ের মধ্যে স্বার্থের অনেক সংঘাতেই মুজিব অন্ধভাবে রক্ষীবাহিনীকে সমর্থন করতেন।১৬ বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর সানডে টেলিগ্রাফ-এ এক বিশেষ রিপাের্ট প্রকাশিত হয়। সে। রিপাের্টে বলা হয় : সমস্যার মােকাবেলা না করে মুজিব গুণ্ডা-বদমাইশ নিয়ে পঁচিশ হাজার লােকের রক্ষীবাহিনী খাড়া করেছিলেন যাতে সেনাবাহিনী তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সাহস না পায়। উক্ত রিপাের্টে আরও বলা হয় : মুজিবের এসব ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের একজন হল গাজী গােলাম মােস্তফা, যিনি বাংলাদেশে বড় চোর বলে কুখ্যাত। মুজিবের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে তিনি আইনের ঊর্ধ্বে ছিলেন। প্রকাশিত রিপাের্টে আরাে বলা হয় : বিগত চার বছরে শেখ মুজিবের আপন ভাই শেখ আবু নাসের যতবার ঢাকা থেকে স্বীয় আদি ব্যবসাকেন্দ্র খুলনায় গিয়েছেন তার চেয়ে বেশিবার লন্ডনে
এসেছেন। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সম্পাদক জিলুর রহমান লন্ডনে বেড়াতে আসেন। ফেরার সময় তিনি ২৩টি বড় বড় বাক্স বােঝাই করে সওদা নিয়ে গেছেন।১৬১ বিজ্ঞ আন্তর্জাতিক রিপাের্টারগণ ব্যক্তিগত পর্যায়ে শেখ মুজিবের পাশে কে কী করেছেন তার বিশদ বিবরণ ছাপিয়ে মুজিব-হত্যাকে জাস্টিফাই করতে চেয়েছেন। ব্যক্তিগত আক্রোশরূপে। এ প্রসঙ্গে এ, এল, খতিব-এর লেখা ‘হু কিল্ড মুজিব বইতে বিস্তারিত আলােকপাত করা হয়েছে।১৬২ দুর্নীতির জন্য শেখ মুজিবকে নিহত হতে হয়েছে এমন কথাও অনেকে বলেন। পৃথিবীর বিশেষ বিশেষ সংবাদপত্রগুলােতে দুনীতি, স্বজনপ্রীতি, লুটপাট ও কালােবাজারের কাহিনী ফলাও করে ছাপানাে হতে থাকে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই সমস্ত সংবাদপত্রগুলি পুঁজিবাদী দেশ থেকে প্রকাশিত। জুরিখের ‘টাজেস আর্জগার’ পত্রিকায় বলা হয়েছে : এ ব্যাপারে কারাের সন্দেহ নেই যে দুর্ভিক্ষ সামলাবার জন্য বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ সাহায্যের প্রয়ােজন। কিন্তু সাহায্যকারী দেশগুলাের ধারণা এই যে বন্যার অজুহাতে বাংলাদেশ সরকার অধিকতর খয়রাত আদায় করে নিজেদের দুর্নীতির খােরাক যােগাতে চাচ্ছে। নিজের সাহায্যের জন্য নিজেও সাহায্য করাে’- একথা বাংলাদেশে অর্থহীন। কেননা যত সাহায্য এসেছে তা আওয়ামীলীগ নেতাদের ব্যক্তিগত পকেটে গিয়েছে। মি. টনি হেগেনে- যিনি বাংলাদেশের জাতিসংঘের দেয়া সাহায্যের কাজে ছিলেন- প্রকাশ করেছিলেন যে যাবতীয় খয়রাতি শিশুখাদ্য ও কম্বলের অতি অল্পই ঠিক জায়গায় পৌঁছেছে। বাদবাকি কালােবাজারে বিক্রি হয়েছে অথবা পাচার হয়ে ভারত চলে গেছে। সে অবস্থার আজও পরিবর্তন হয়নি। যে সরকার শিয়ালকে হাঁস পাহারা দিতে দিয়েছেন, অর্থাৎ যে সরকার কুখ্যাত জোচ্চোর (দেশে ও বিদেশে) গাজী গােলাম মােস্তফাকে জাতীয় রেডক্রসের সভাপতি নিযুক্ত করেছেন, সে সরকার সম্পর্কে কোনােকিছুতেই বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। মােস্তফা পদ পেয়েছেন যেহেতু তিনি ঢাকা আওয়ামীলীগের নেতা ছিলেন। এই গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকায় তার অনেক বেশি মওকা মিলেছে। তিনি শুধু খুঁড়ােদুধই কালােবাজারে বিক্রি করেননি, অনেক ওষুধপত্রও আত্মসাৎ করেছেন। বাংলাদেশের রেডক্রস সভাপতি এখন ৩৭টি ওষুধের দোকানের মালিক।১৬৩ ডেইলি নিউজ পত্রিকায় বলা হয়েছে : “দেশের সম্পদ বিদেশে চলে যাচ্ছে। তা সম্ভব হচ্ছে সরকারের অভ্যন্তরে ব্যাপক দুর্নীতির জন্য। বাংলাদেশের জর্জওয়াশিংটন’ প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর
রহমান নিজে হয়তাে কোনােদিনই ঘুষ গ্রহণ করেননি। কিন্তু সর্বত্র গুজব ছড়িয়ে রয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী ঘুষ খান। সরকারি কর্মকর্তারা যে ঘুষ খান, তাতে কোনাে সন্দেহ নাই। তবে তারা যদি ঘুষ না খেতেন তাহলে হয়তাে চোরাচালান সম্ভব হত না।১৬৪ মুজিব-হত্যা সম্পর্কে ওয়াশিংটন পােস্ট লিখেছে : “The young officers were motivated more personal grivences with Mujib than by ideological and political differences,”১৬৫ মুজিব-হত্যার পর পরই করাচি হতে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আল ফাত্তাহ পত্রিকার সম্পাদক লিখলেন : “বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিবর্তন সি. আই. পরিকল্পিত এবং যা ১৯৬৯ সন থেকেই বাস্তবায়নের জন্য চলে আসছিল।”১৬৬ মুজিব-হত্যার এক সপ্তাহের মধ্যেই ওয়াশিংটন পােস্ট লিখল : ঢাকা কু প্রাে- ওয়েস্ট ১৬৭। দি নিউইয়র্ক টাইমস রিপাের্ট করল : “বাংলাদেশের সংঘটিত কু সম্পর্কে ক্রেমলিন মনে করছে শেখ মুজিবের উৎখাতের ফলে সেখানে পশ্চিমা শক্তির প্রভাব বাড়বে।”১৬৮ বঙ্গবন্ধু-হত্যার সঙ্গে যে-সমস্ত আন্তর্জাতিক চক্র জড়িত ছিল তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ধ্বংস করার সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত যােশেফ ফারল্যান্ড এবং বিশেষ করে সিআইএ পরিষ্কারভাবে বুঝেছিলেন যে, শেখ মুজিবের নিকট স্বাধীনতার বিকল্প কোনােকিছুই গ্রহণযােগ্য নয়। একথা বুঝতে পেরেই শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী গণহত্যার যে ব্লুপ্রিন্ট হাতে নিয়ে কাজ করেছিল। সে ব্লুপ্রিন্ট রচনায় সামরিক-চক্রকে সাহায্য করেছিল রবার্ট জ্যাকসন। ২৫ মার্চের আগে থেকেই জ্যাকসন ঢাকাতে ছিলেন এবং সামরিক চক্রের সঙ্গে সর্বদা। যােগাযােগ রক্ষা করে চলতেন। জ্যাকসনের ছিল গণহত্যা-পরিকল্পনার অতীত। অভিজ্ঞতা-যে অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেছিলেন দক্ষিণ ভিয়েতনাম ও ব্রাজিলে হত্যা ও ধ্বংসের পরিকল্পনা সরবরাহের মাধ্যমে।
১৯৭১-এর মধ্যমার্চে সি.আই.এ. পেন্টাগন ইলেকট্রোনিক গােয়েন্দা সূত্র থেকে ওয়াশিংটন পাকবাহিনীর ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতির খবর জানলেও তা ঢাকাকে জানতে দেয়া হয়নি।১৬৯ অবশ্য ড, কিসিঞ্জার বারবার বলে এসেছেন যে, পূর্বপাকিস্তানের সমস্যার ব্যাপারে এ-ধরনের সামরিক সমাধানের তিনি কোনাে সময়েই পক্ষপাতী ছিলেন। ১৭০ কিন্তু কলামিষ্ট জ্যাক এন্ডারসনের ফাস করে দেয়া কাগজপত্রে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সর্বতােভাবে সাহায্য দিয়েছে এবং দেবার জন্য প্রস্তুত ছিল।১৭১ প্রখ্যাত লেখক রবার্ট পাইন প্রাসঙ্গিক বিষয়ে লিখেছেন : পূর্বপাকিস্তানের অসহায় জনগণের জন্য ড, কিসিঞ্জার কোনােপ্রকার সহানুভূতি উচ্চারণ করেনি। পূর্বপাকিস্তানের এই সমস্ত ম্যাসাকার ছিল তার চোখে একটি সহজ দুঃখজনক রাজনৈতিক ঘটনা যা শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে।১৭২ কিন্তু যা কোনােক্রমেই এই রাষ্ট্রের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবােধ বিনষ্ট করতে পারবে না। তারা একত্রে সমতা রেখে কাজ করে যাবে—যতই ম্যাসাকার ঘটুক না কেন।১৭৩ এই মধুর সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য নিক্সন প্রশাসন মিথ্যাচার। করতে কুণ্ঠিত হয়নি। তাছাড়া জ্যাক এন্ডারসন কর্তৃক প্রকাশিত ঐ দলিলপত্র থেকে জানা যাচ্ছে যে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি গােপন চুক্তির অস্তিত্ব রয়েছে।১৭৪ বাংলাদেশের গণহত্যা দেখে ঢাকাস্থ মার্কিন কনস্যুলেট অনেক গােপন এবং উল্লেখযােগ্য ডিসপাচ ওয়াশিংটনে প্রেরণ করে। ১৯৭১-এর ২৮ মার্চ একটি টেলিগ্রাম করে পূর্বপাকিস্তানে সংঘটিত গণহত্যা বন্ধের জন্য ওয়াশিংটনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।১৭৫
এছাড়া কূটনৈতিক রীতিনীতি ভঙ্গ করে ১৯৭১-এর ৬ এপ্রিল ঢাকাস্থ মার্কিন কনস্যুলেটের উনিশজন অফিসার, ঢাকাস্থ কনস্যুলেট জেনারেল মি, আর্চার ব্লাড কর্তৃক অনুমােদন করিয়ে AID মিশন USIA একটি রেজিস্টার টেলিগ্রাম ওয়াশিংটনে প্রেরণ করে। এ সম্পর্কে কিসিঞ্জার বলেছেন—“সেক্রেটারি রজার্স তাকে বলেছেন যে তার ডিপ্লোম্যাটগণ রিপাের্ট না পাঠিয়ে দরখাস্ত লিখেছে।” অন্যদিকে দিল্লিস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিনেথ কিটিং অনুরূপ রিপাের্টে এই হত্যাযজ্ঞ ও নৃশংসতায় সামরিক সাহায্য অবিলম্বে বন্ধের জন্য লিখে পাঠায়।১৭৬ বলাবাহুল্য এই দুটি রিপাের্ট ও আবেদনই প্রত্যাখ্যাত হয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ঠেকানাের সর্বশেষ প্রকাশ্য প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহর বা টাস্কফোর্স-৭৪ পাঠানাের মাধ্যমে। ওয়াশিংটন স্পেশাল এ্যাকশন গ্রুপের (wSAG) পরামর্শ মনঃপূত না-হওয়ায় নিক্সন। চাইলেন, সােভিয়েতকে বুঝতে হবে সােভিয়েত-অস্ত্র ব্যবহার করে পাকিস্তানকে বিভক্ত করা যাবে না।১৭৭ শুধু তাই নয়, আমেরিকা আশা করেছিল চীন পাকিস্তানের সহযােগিতায় এগিয়ে আসবে। যুদ্ধে চীন এগিয়ে এলে সােভিয়েত ইউনিয়ন নিশ্ৰুপ থাকবে না এবং তার ফলে আমেরিকার জড়িত হয়ে পড়াও অনিবার্য হয়ে উঠবে। নিক্সন ব্যক্তিগতভাবে এই ঝুঁকি (পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধের) নিতে প্রস্তুত ছিলেন।১৭৮ এছাড়া রাশিয়ামার্কিন হটলাইনের মাধ্যমে কিসিঞ্জার মস্কোকে অনুরােধ করেন যে, সে যেন পশ্চিমপাকিস্তান ধ্বংস করা থেকে ভারতকে নিবৃত্ত করে।১৭৯ এদিকে পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন দেখে বঙ্গোপসাগরে টাস্ক ফোর্স বা সপ্তম নৌবহর পাঠানাের জন্য এডমিরাল মুরারকে নির্দেশ দেয়া হয়।১৮০ স্বাধীনতাযুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ শুধুমাত্র অস্ত্রশস্ত্র, অর্থসম্পদ ও নৌবহর দিয়ে পাকিস্তানকে সাহায্য করেই ক্ষান্ত হয়নি, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ যেন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় তার অশুভ প্রয়াস চালিয়েছিল। এ-বিষয়ে মার্কিন অনেক চক্রান্তের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ চক্রান্তে জড়িত ছিলেন মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার। মােশতাক। মােশতাকের সাথে সিআইএ-র যােগাযােগ ছিল। মােশতাক-চক্রের সঙ্গে সিআইএ-র যােগাযােগের উদ্দেশ্যে ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে আটকে দেয়া-পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যেই বাংলাদেশের জন্য অধিকতর স্বায়ত্তশাসন গ্যারান্টি করা। ১৯৭১-এর অক্টোবর মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের বৈঠক। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী খােন্দকার
মােশতাকের নেতৃত্বে একটি দল জাতিসংঘের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। প্রায় সব ঠিকঠাক, এমনকি টিকিট পর্যন্ত কাটা শেষ হয়েছে। এমন সময় ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে পড়ল। ষড়যন্ত্রের মূলকথা ছিল : পররাষ্ট্রমন্ত্রী খােন্দকার মােশতাক নিউইয়র্কে যাবেন এবং অকস্মাৎ মার্কিন নীতির কাছাকাছি একটি ঘােষণা দেবেন পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার বিকল্প হিসেবে। পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের কলকাতাস্থ থিয়েটার রােডের বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন এবং পাল্টা সরকার গঠন করবেন।১৮১ বাঙালির পরম সৌভাগ্য যে, সি.আই.এ. ও মােশতাকের ষড়যন্ত্র সেদিন সফল হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের অজান্তে মােশতাক-চক্র পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামাের কনফেডারেশন স্বীকার করে নিয়ে পাকিস্তান কারাগার থেকে শেখ মুজিবকে ফিরিয়ে আনার নাম করে মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই বিপন্ন করে তুলছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য চেষ্টা চালিয়েছে, একথা মিথ্যা ও বানােয়াট। কেননা কিসিঞ্জারের সঙ্গে তদানীন্তন ওয়াশিংটনস্থ ভারতীয় রাষ্ট্রদূত টি. এন, কাউলের আলােচনায় কাউলের মনে এই প্রতীতিই জন্মলাভ করেছে যে, কিসিঞ্জারের ধারণা মুজিবকে বন্দি করে রাখা না হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকানাে যাবে না।১৮২
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ বানচাল করার জন্য তার প্রয়াসের অন্ত ছিল না।১৮৩ মার্কিন প্রশাসন বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও কিসিঞ্জার স্বাধীনতাযুদ্ধের পূর্ব হতেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্পর্কে বৈরী মনােভাব গ্রহণ করে স্বাধীনতাকে বানচাল করার যাবতীয় প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। জুলাই মাসে হেনরি কিসিঞ্জার দিল্লি সফরের পর টি, এন, কাউল লিখেছেন : ” remember meeting him when he landed in Delhi, I found him entirely pro-Pakistan, anti-India, anti Bangladesh when I first met him.”558 এদিকে চৌ-এন-লাই পাকিস্তানের জাতীয় স্বাধীনতা’ ও ‘রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায় চীনের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের কথা জানান।১৮৫ শুধু তাই নয়, ১৯৭১-এর জুন থেকেই পশ্চিমপাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে চীন প্রতিদিন একশতটি লরিভর্তি সমর-উপকরণ পাঠায়। এছাড়া অত্যন্ত অভিজ্ঞ সামরিক বিশেষজ্ঞ পাঠিয়েছিল।১৮৬ এছাড়া শুধুমাত্র ১৯৭১ সালেই চীন পাকিস্তানে সরবরাহ করেছিল ৪৫ মিলিয়ন ডলারের সমর-উপকরণ।১৮৭ বিশিষ্ট সাংবাদিক, বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য আবদুল গাফফার চৌধুরী’র একটি স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থে মুজিব সম্পর্কে একজন বিদেশী সাহিত্যিকের অভিমত রয়েছে। গ্রন্থটির তেইশ অনুচ্ছেদে লেখক গাফফার চৌধুরী স্মৃতিচারণ করেছেন : উনিশশাে চুয়াত্তর সালের তেরােই জুন বৃহস্পতিবার।… তবু সকালে বিছানা ছাড়তে হল যথারীতি।… টেবিলের উপর সেদিন সকালের একগাদা খবরের কাগজ পড়ে রয়েছে। … চোখে পড়ল একটা খবর-ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচন : লােহানী-রিয়াজ প্যানেলের জয়লাভ। বুঝলাম, ধীরে ধীরে সকল ফ্রন্টেই জাতীয়তাবাদীদের ‘রিট্রিট’ শুরু হয়েছে আর। সাফল্যের সঙ্গে অনুপ্রবেশ ঘটছে ছদ্মবেশী রাজনৈতিক সাবােটিয়ারদের। তারা। তাদের কভার’ হিসেবে সঙ্গে পেয়েছে ‘নিরপেক্ষদের’। ফলে তাদের আঘাত করাও কঠিন। … খবরের কাগজ হাতে ভাবতে বসলাম শেখ মুজিবের অবস্থা। এমন জনপ্রিয়। অথচ এমন নিঃসঙ্গ নেতা আজ সম্ভবত পৃথিবীতে আর দুটি নেই। জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশ গড়ার কাজে মুজিব আজ সম্পূর্ণ একা এবং অসহায়। যে প্রশাসন দিয়ে। তিনি কাজ চালাচ্ছেন তা তার নয়; ঔপনিবেশিক মনােভাবাপন্ন এবং প্রভুত্বপরায়ণ। একটি প্রশাসন। সঙ্গে অতি উচ্চাভিলাষী অথচ অদক্ষ একটি সামরিক বাহিনী।
শেখ মুজিবের নিজের সংগঠনের ডানপন্থীরা সংগঠিত এবং শক্তিশালী। ছাত্র ও যুব ফ্রন্ট দ্বিধাবিভক্ত। কেবল নিজের ব্যক্তিত্ব ও জনপ্রিয়তাকে মূলধন করে একটি সর্বাধিক গরিব, অনুন্নত সমাজ ও আর্থিক ব্যবস্থার দেশে তিনি রাজনৈতিক বিপ্লবের পরপরই তাকে সংহত করার আগে সমাজবিপ্লবের যাত্রা শুরু করতে চান। আমলা, সেনাবাহিনী শহুরে মধ্যবিত্তের দল এটা শান্ত মনে মেনে নিবে আমার তা মনে হল না। শুরু হয়েছে এই মধ্যবিত্ত ছাত্র-যুবা এবং বুদ্ধিজীবী মহলেও ভাঙন। জাতীয়তাবাদী বিপ্লবের স্রোতের যারা মুজিবের চারপাশে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তারা ধীরে ধীরে আবার বিড়াল-থাবার নিচে নখর শানাতে। শুরু করেছেন। জানি না, কখন তারা চরম আঘাত হানবে। মনে পড়ল ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে মুল্করাজ আনন্দের একটি সতর্কবাণী। ‘৭২ সালের অক্টোবর বােম্বাইয়ে বেড়াতে যেতেই সাক্ষাতের ব্যবস্থা হল মুল্করাজ আনন্দ এবং খাজা আহমদ আব্বাসের সঙ্গে। দুজনেই বিখ্যাত সাহিত্যিক। মুলক্রাজ এর মধ্যে আবার বাংলাদেশ ঘুরে এসেছেন। বাংলাদেশ তখন সবে মুক্ত হয়েছে। আমরা উল্লাসে আনন্দে গর্বে গৌরবে অধীর। ভাবখানা এই, এ যুগের সবচাইতে বড় বিপ্লব আমরাই করেছি। প্রথম সাক্ষাতের দিনেই মুলাজ আমার উল্লাস দেখে হাসলেন। বললেন : তােমাদের বিপদ মাত্র শুরু হল। জিজ্ঞাসা করলাম : এমন কথা কেন বলছেন? মুলক্রাজ বললেন : তােমাদের বাংলাদেশ আমি কয়েকদিনের জন্য ঘুরে এসেছি। তােমাদের শহর ও গ্রামের সামাজিক ও আর্থিক জীবনের ব্যবধান ও পার্থক্য দেখে আমি ভয় পেয়েছি। এটা কী করে সম্ভব হল? শহর ও গ্রামের এমন বৈষম্য তাে আমি ত্রিশ বছর আগের বাংলাদেশে দেখিনি। তখন অবশ্য দেশভাগ। হয়নি। : বৈষম্যটা কী ধরনের? : তােমাদের নতুন ঢাকা দেখলে বা এই ঢাকার অভিজাতপাড়ার বাসিন্দাদের দেখলে মনে হয়, কোনাে উন্নত পাশ্চাত্য দেশে রয়েছি। কিন্তু এই সামান্য শহুরে পরিধির বাইরে গেলেই গ্রাম আর গ্রামের মানুষের অবস্থা দেখলে শিউরে উঠতে হয়। সামাজিক অবস্থান ভেঙে পড়ছে। আর্থিক কাঠামাে চুরমার। সাধারণ মানুষের জীবনে সামান্য পরিবর্তন আসেনি। যােগাযােগব্যবস্থার উন্নতি হয়নি। দেখলে মনে হয়, দুশাে বছর আগের জীবনেই সারাদেশটা পিছিয়ে রয়েছে। বললাম ; গ্রামে ট্রানজিসটার হাতে অথবা বাইসিকেলে দু-একজন ধনী কৃষক আপনার চোখে পড়েনি? মুলরাজ বললেন : ওদের সংখ্যা হাতে গােনা যায়। এরাও শহুরে শাসকদের সৃষ্টি। রিলিফের টাকা, রেশনের মাল এবং ওয়ার্কস প্রােগ্রামের টাকা মেরে এদের বড়লােক হতে দেওয়া হয়েছে। এরা এখন ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বার চেয়ারম্যান। সাধারণ মানুষ এদের ঘৃণা করে। সুযােগ পেলেই এদের হত্যা করে। চুপ করে রইলাম।
মুক্রাজ বললেন : শহরের শতকরা পাঁচজন মানুষের জীবনে সবরকম বিলাসবিভব এবং দেশের বাকি শতকরা পচানব্বই ভাগ মানুষের জীবনে ভয়াবহ দারিদ্র্য, এই অবস্থা কোনাে জাতীয় বিপ্লব বা জাতীয় স্বাধীনতার জন্যই অনুকূল হতে পারে না। বাংলাদেশের জাতীয় বিপ্লবকে সংহত ও রক্ষা করতে হলে। মুজিবকে এই বৈষম্য পাল্টাতে হবে। শহরের জৌলুশ কমিয়ে গ্রামের মানুষের। জীবনে স্বস্তি ও আশা জাগাতে হবে। কিন্তু তা কি তিনি পারবেন? বললাম : আপনার কী মনে হয়? মুলাজ বললেন : কঠিন কাজ। এটা রাজনেতিক বিপ্লবীর কাজ নয়, সমাজবিপ্লবীর কাজ। মুজিব কি সমাজ-বিপ্লবী নেতা? তাঁর রাজনৈতিক সংগঠনের কি রাজনৈতিক বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে সমাজবিপ্লব সম্পন্ন করার প্রস্তুতি ও শক্তি রয়েছে? থাকলে ভালাে। নইলে পায়ে পায়ে প্রতিবিপ্লব এগিয়ে আসবে। আর যে গরিব দেশে মুষ্টিমেয় সুবিধাভােগী মানুষের এত প্রাচুর্য, সে দেশে প্রতিবিপ্লব রীতিমত প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। কেবল ছােবল মারার অপেক্ষা। আমার ভয়ও এখানে। তােমাদের দেশে পাকিস্তানী শাসকেরা শহরভিত্তিক একটা ‘হােয়াইট কলার শ্রেণী তৈরি করে গেছে। এদের হাতেই সমাজের সব বিত্ত এবং প্রতিপত্তি। আরাে পাওয়ার লােভে মুজিবের সঙ্গে এদের একটা অংশ সহযােগিতা করেছে। কিন্তু এরা যখনই দেখবে, মুজিবের কমিটমেন্ট’ তাদের কাছে নয়, বরং গরিব চাষা-ভুষা মানুষের কাছে, তখনই তারা আঘাত হানার প্রস্তুতি নেবে। আর আঘাত হানার অস্ত্র এবং অবস্থান দুইই তাদের হাতে। সেনাবাহিনী, আমলা, ব্যবসায়ী—এমনকি তােমাদের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরাও এই ‘হােয়াইট কলার’ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধে মুজিব এদের সীমিত এবং সাময়িক সমর্থন পেয়েছেন; কিন্তু দেশ গঠনে নিঃশর্ত এবং স্থায়ী সমর্থন পাবেন না। প্রশ্ন কললাম ; তাহলে মুজিব কি ব্যর্থ হবেন? মুরাজ বললেন : এটা নির্ভর করে মুজিবের দূরদর্শিতা ও সংগঠনী শক্তির উপর। তিনি যদি কেবল জনপ্রিয়তা ও ব্যক্তিগত চমকের উপর নির্ভর না করে সংগঠনের চরিত্র বদল করেন এবং শক্তি বাড়ান এবং প্রশাসন সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থেকে সুবিধাভােগীশ্রেণীর প্রতিনিধিদের কঠোর চিত্তে হটাতে পারেন, তাহলে হয়তাে তিনি সফল হবেন। নইলে জাতীয় ও আন্তর্জাতীয় চক্রান্তের মুখে তিনি টিকতে পারবেন না।… … বৃটিশের তৈরি আমলা নিয়ে স্বাধীন ভারতে নেহেরু হিমসিম খেয়েছেন, এখন তার মেয়ে খাচ্ছেন। আর বৃটিশ ও পাকিস্তানী উপনিবেশিক মানসিকতা। দিয়ে তৈরি আমলা, সৈন্য ও প্রশাসন নিয়ে মুজিব গঠন করবেন বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক বাংলা? আমার ভয় হচ্ছে, হিসেবটা যেন গরমিল হয়ে যাচ্ছে। বােম্বাই থেকে ঢাকায় ফিরে প্রথম সুযােগেই বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম মুলাজ আনন্দের হুঁশিয়ারির কথা। তিনি কথাটা শুনে গম্ভীর হয়ে রইলেন। জবাব দিলেন ।১৮৮
এ্যানি লােপাটো-আমেরিকান সাংবাদিক। সাংবাদিকের বাইরেও তার আরাে দুটি পরিচয়-সাহিত্যিক ও আইনজীবী। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। সাংবাদিকতা থেকে অবসর নিয়ে নিউইয়র্ক শহরে আইনব্যবসায় নিয়ােজিত। একসময় ছিলেন আমেরিকার বহুলপ্রচারিত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর পত্রিকার দিল্লি ব্যুরাের সহকারী চিফ। প্রায় চারবছর ছিলেন ভারতে। সাংবাদিকতার পেশায় উপমহাদেশের সবকটি দেশ তিনি ভ্রমণ করেছেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর দুবার ঢাকা আসেন। প্রথমে পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর একটি সাক্ষাৎকার নিতে। দ্বিতীয়বার আসেন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে নতুন দেশের প্রথম সংবিধান অনুমােদন অনুষ্ঠানে যােগ দিতে। এক সাক্ষাৎকারে১৮৯ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এ্যানি লােপাটো বলেন : “ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি, পাঞ্জাবির উপর কালাে কোট পরিহিত দীর্ঘ মানুষটি ছিল অত্যন্ত সাদামাটা। প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শেখ মুজিব অসম্ভব সহজ সরল প্রকৃতির এটা ভাবতে অবাক লাগে। নিজের আত্মবিশ্বাস দৃঢ় মনােবল ও অসীম সাহসী এই সুদর্শন পুরুষ বাঙালি জাতির মধ্যে খুব কম নজরে পড়ে।১৯০
দিল্লিতে থাকাকালীন এ্যানি বাংলাদেশের খবর দিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন ওয়াশিংটনে। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী রতন তালুকদার যখন এ্যানির কাছে বাংলাদেশের সফরের অভিজ্ঞতা ও বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাতের বিষয় জানতে চান তখন এ্যানি অনর্গল বাংলাদেশ সম্পর্কে বলে যাচ্ছিলেন। সাক্ষাৎকারে এ্যানির স্মৃতিচারণটা ধন্য সেই পুরুষ’ গ্রন্থ থেকে নিচে উদ্ধৃত হল। এ্যানি লােপাটো প্রথমবার বাংলাদেশে যান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ঢাকা আসার পূর্বে অর্থাৎ ৯ জানুয়ারি । ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর পত্রিকার প্রতিনিধি হিসাবে দিল্লি থেকে ঢাকা আসেন। এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিশেষ ফ্লাইটে সেদিন দিল্লি থেকে প্রায় শতাধিক পশ্চিমা সাংবাদিক, কূটনৈতিক, পদস্থ কর্মকর্তা নিয়ে কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে অল্পকালীন যাত্রাবিরতির পর অপরাহে ঢাকায় পৌঁছে। ঢাকা বিমানবন্দরের কর্মকর্তাদের ব্যবহারে তিনি কিছুটা বিরক্ত হন। তার ধারণা, সম্ভবত আমেরিকান সাংবাদিক বলেই কর্তৃপক্ষ তাকে বাঁকা চোখে দেখেছে। কারণ তখন এই নব্য স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক কারণে একটি এ্যান্টিআমেরিকান সেন্টিমেন্ট বড় জোরালাে ছিলাে। এ্যানি বলেন, এই বাস্তবতাকে মেনেই খুব খারাপ অনুভব করিনি। তাছাড়া সাংবাদিকদেরতাে।
লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করতে হয়। বিমানবন্দরের ইমেগ্রেশন প্রটোকল শেষ হলে, বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রতিনিধি পশ্চিমা সব সাংবাদিকদের সরকারি গাড়িতে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমানে ঢাকা শেরাটন) নিয়ে আসে। এখানেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। হােটেলে এবং বাইরে আমেরিকান সাংবাদিকদের জন্য নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল অন্যদের চেয়ে কড়াকড়ি। এদিন রাতে এ্যানি একটি হােটেল রুম থেকে কাচের জানালায় চোখ রেখে দেখেছে ঢাকা শহর। ঢাকার রাস্তায় তখন খণ্ড খণ্ড বিজয়মিছিল। পরের দিন বঙ্গবন্ধু আসবে স্বদেশে। জনগণ রাস্তায় স্লোগান দিচ্ছে, নৃত্য করছে। আপামর মানুষের এই বিজয়উল্লাস এ্যানির মন কেড়েছে। পরেরদিন দুপুরে এ্যানি যান এয়ারপাের্টে। সরকারি গাড়িই নিয়ে গিয়েছিলেন। রাস্তায় ট্রাফিক নয়, মানুষের উপচেপড়া ঢাকার রাস্তা। দেড় ঘণ্টায় তারা পৌছে এয়ারপাের্টে। এদিন দুপুরেই বঙ্গবন্ধু দিল্লি থেকে ঢাকা আসেন। ঢাকা শহর লােকে লােকারণ্য, রাজপথে মানুষের ঢল। শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত আকাশবাতাস। সকলের মুখেই বিজয়ের হাসি। এ্যানি বলেন, এয়ারপাের্ট রাস্তাঘাট মাঠ। ময়দান এক মহাজনসমুদ্রে পরিণত হল। এমনকি বড় বড় গাছের ডালে পাখির মতাে মানুষ ঝুলছে, দালানের ছাদে মানুষের ভিড়। এত মানুষ জীবনে কোনােদিন দেখেনি। ভারতেও এত মানুষ একসঙ্গে কখনাে নজরে পড়েনি। কী আশ্চর্য! একটি যুদ্ধ বিশ্বস্ত দেশ, চারদিকে স্বজনহারা মানুষ, মা-বােনের আর্তনাদ, তখনাে বাতাসে লাশের গন্ধ ভেসে আসছে—তবু দেখেছি সর্বত্রই মানুষের আনন্দউজ্জ্বাস, রাঙ্গাহাসি ও জাতিরপিতাকে বরণ করার অকৃত্রিম অলােবাসা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। হঠাৎ মুজিবকে বহনকারী ভারতীয় রাজকীয় প্লেনটি দেখে। মানুষ গগনবিদারী শ্লোগানে লাফিয়ে উঠল। জয় বাংলা শ্লোগানে বিমানবন্দর কেঁপে উঠছে। প্রচণ্ড নিরাপত্তা বিমানবন্দরে। মানুষের ভিড় ঠেলেও নিরাপত্তাকর্মীরা চতুর শিয়ালের মতাে সতর্ক। বিমান অবতরণ করল । যথাসময়ে বিমান থেকে বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে এলেন। বিমানের সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে বিশাল দুটি হাত নেড়ে জনগণকে অভিনন্দন জানান তিনি। সিড়িমুখে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবকে স্বাগত জানান। তিনি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আন্তরিক কোলাকুলি করেন। পরিবার-পরিজন ছিল পাশেই। কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। ছােট ছেলে রাসেলকে টেনে নিলেন বুকে। সবার সাথে কুশল বিনিময় হল।
পরিচিত হলেন অপেক্ষমাণ বিদেশী কূটনৈতিক মিশনের প্রধানদের সাথে, দেশী-বিদেশী সাংবাদিকরা ঝাপিয়ে পড়ল শেখ মুজিবের উপর সবার প্রশ্ন । তিনি বিদেশী সাংবাদিকদের বেশি সময় দিলেন না। সম্ভবত খুব ক্লান্ত ছিলেন বলে। তাছাড়া লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের প্রিয় নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখতে চায়। সংক্ষেপে বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে দলীয় নেতৃবৃন্দ তাঁকে নিয়ে শােভাযাত্রাসহ শহরের দিকে যাত্রা করেন। দুদিন পর এ্যানির সাথে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ ঘটে প্রাতরাশের মধ্যদিয়ে। সময় সকাল ৮টা। মাত্র ৪০ মিনিট সময় পেয়েছিলেন তিনি। এদিনের রােদ্রোজ্জ্বল সকালে একটি সরকারি গাড়ি তাকে হােটেল থেকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে নিয়ে যায়। তথ্য মন্ত্রণালয়ের একজন তরুণ কর্মকর্তা এ্যানিকে নিতে এসেছিল। ছেলেটির নাম মনে পড়ছে না তার। শুধু বললেন, ছিপছিপে সুন্দর যুবক, চমৎকার পরিষ্কার ইংরেজিতে কথা বলে। গাড়িতে যেতে যেতে ছেলেটি এ্যানিকে ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি দেখাল। ৩২ নম্বর বাড়িতে পৌছলে ঢাকার ক’জন সাংবাদিক এ্যানিকে স্বাগত জানান। সরাসরি এ্যানিকে নিয়ে বসানাে হল বঙ্গবন্ধুর ড্রয়িংরুমে। সােফার এককোণে বসে তিনি চারদিক তাকান। অনুমান পাঁচ মিনিট পর ধবধবে সাদা পায়জামা, পাঞ্জাবির উপর কালাে কোট পরিহিত লম্বা মানুষটি ঢুকতেই এ্যানি উঠে দাঁড়ান। বঙ্গবন্ধু হাত বাড়িয়ে দিলেন। এবং অনুগ্রহ করে বসতে অনুরােধ করেন। বঙ্গবন্ধু বসলেন এ্যানির মুখােমুখি। এ্যানির মুখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টিহাসি হেসে তিনি কুশল বিনিময় করলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন বেগম মুজিবের সাথে। পাশে দাঁড়ানাে ছিল ছােটছেলে শেখ রাসেল, এ্যানি তাকে টেনে নিয়ে পাশে বসালেন। এ্যানি বলেন : বিশাল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শেখ মুজিবের মুখােমুখি বসে আমার ভয় ভয় লাগছিল। এ্যানির তখন ছাব্বিশ বছর বয়স। এ্যানি বঙ্গবন্ধুকে অবাধে নানা প্রশ্ন করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুও সরল ভাষায় উত্তর দিলেন। স্থানীয় সাংবাদিকরা ফটো তুললেন। নিজের ক্যামেরা দিয়ে এ্যানি নিজেও বঙ্গবন্ধুর অনেকগুলি ছবি তুললেন। এ্যানি বলেন ; সম্ভবত আমার বােঝার জন্য শেখ মুজিব খুব ধীরে ধীরে পরিষ্কার ইংরেজিতে কথা বললেন। খুব ভেবেচিন্তে নয়, তবে কথায় কথায় খুব আবেগপ্রবণ হয়ে উঠছিলেন তিনি। ক্ষোভে দুঃখে ভারী গলায় বললেন তিনি । পাকিস্তান আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে শ্মশান বানিয়ে গেছে। চারদিকে সন্তানহারা মা’র ক্রন্দন, মা-বাবা হারা এতিম সন্তানের মুমূর্ষ আর্তনাদ, স্বজনহারা মানুষের মর্মবেদনা। আসলে আমরা একটি ধ্বংসস্তু পে দাঁড়িয়ে আছি। এ্যানি নির্বাক হয়ে শুনেছে কেবল বঙ্গবন্ধুর কথা। দেশ ও জাতির প্রতি এই সরল সােজা মানুষটির কী দরদ কী ভালােবাসা। তার ধারণা শেখ মুজিব একজন আবেগপ্রবণ মানুষ। স্বদেশের মানুষের প্রতি ছিল তার হৃদয়ের গভীর আন্তরিকতা। প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এ-মানুষটি যে এত সাদামাটা ছিলেন তা ভাবতে অবাক লাগে। অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ় মনােবল ও অসীম সাহসী ছিলেন তিনি। এমন সুদর্শন পুরুষ বাঙালি জাতির মধ্যে খুব কম নজরে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এ্যানি বিরামহীন বলে যাচ্ছিলেন। মুজিবের প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধাবােধ বােঝা গেল। বঙ্গবন্ধুর আতিথেয়তার মুগ্ধ এ্যানি বলেন : শেখ মুজিবের মতাে একজন অসাধারণ রাষ্ট্রনায়কের সাথে আমার সাক্ষাৎকার ছিল অত্যন্ত ঘরােয়া পরিবেশে।
একবারও মনে এই অনুভূতি আসেনি। যে একজন এতবড় নেতার সামনে বসে আছি। ভীষণ আন্তরিক ও বন্ধুসুলভ শেখ মুজিব নিজের হাতে চা-এর কাপ তুলে দিলেন আমার হাতে। এটা দেখে আমি অভিভূত হয়েছি। এ্যানি বলেন, আমার সাংবাদিকতার জীবনে পৃথিবীর নানাদেশ ঘুরেছি, বহু নেতা-নেত্রীর সাক্ষাৎ পেয়েছি। কিন্তু বাংলাদেশের শেখ মুজিবের মতাে এমন সহজ-সরল মানুষ চোখে পড়েনি। এ্যানি বললেন, শেখ মুজিবের মৃত্যুসংবাদ যখন পাই সে-সময় আমি সবে ভারত থেকে বদলি হয়ে আফ্রিকার কেনিয়ায় এসেছি। নাইরােবি টিভিতে খবর শুনে আমি কিছুক্ষণ কেবল চুপ ছিলাম। বিশ্বাস হতে খুব কষ্ট হয়েছিল। সাথে সাথে আমেরিকান দূতাবাসের সাথে যােগাযােগ করি এবং ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টেও খোঁজখবর নেই। আমার স্মৃতিতে ভেসে উঠল শেখ মুজিবের সাত বছরের ছেলে রাসেলের কথা। পরিষ্কার মনে আছে, আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়েছি। এই শিশুটি রাজনীতির শিকার হল। ভাবলে এখনাে ভীষণ কষ্ট পাই। বেগম মুজিবের কথা বলতে গিয়ে এ্যানি বললেন, তিনি ছিলেন একজন হাউস ওয়াইফ এবং অমায়িক। কথা প্রসঙ্গে এনি বললেন, এত জনপ্রিয় হওয়ার পরও শেখ মুজিবের এমন একটি মর্মান্তিক পরিণতি হবে তা অবিশ্বাস্য। শেখ মুজিব ছিলেন একজন জননন্দিত নেতা। কিন্তু তিনি অনেকাংশ বাস্তবতা এড়িয়ে চলতেন। সদ্য স্বাধীন দেশে রাষ্ট্র পরিচালনার যেসব গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি প্রয়ােজন ছিল তিনি তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে আমি মনে করি।১৯১ পঁচাত্তরে সপরিবারে শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত লেখক ও বুদ্ধিজীবী অন্নদাশঙ্কর রায় কাদো প্রিয় দেশ” নামে একটি বই লেখেন। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার উপর পরপর তিনটি বই তিনি লিখেছেন; কাদো প্রিয় দেশ’ এর মধ্যে দ্বিতীয় বই। কাঁদো প্রিয় দেশ’ বইটিতে অন্নদাশঙ্কর রায় মুজিব সম্পর্কে লিখেছেন : “জয়াহরলালের মতাে অসাধারণ তার ক্যারিজমা। জয়াহরলালের পর ওই দুর্লভ মােহনীয়তা মুজিবের মধ্যেই আমি দর্শন করেছি।”১৯২ একই বইতে তিনি অন্যত্র লিখেছেন : প্রথমাবধি আমি বলে আসছি যে, জাতীয়তাবাদ যত না কঠিন তার চেয়ে আরাে কঠিন ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা যত না কঠিন তার চেয়ে বেশি কঠিন সমাজতন্ত্র বা সামাজিক ন্যায়। একই সঙ্গে চার চারটে কঠিন, কঠিনতর, কঠিনতম ও মহাকঠিন কর্মে হাত দিলে সিদ্ধি সুদূরপরাহত। বিশেষত বাংলাদেশের মতাে অতি ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে, যার জনসংখ্যা অতি বৃহৎ। শেখ মুজিবুর রহমান যা পারলেন না, আর কেউ যে পাঁচ-দশ বছরের মধ্যে তা পারবেন এটা একটা অলীক ধারণা। এটা একটা অবাস্তব মােহ। আবার মােহভঙ্গ হবেই । তখন যেন আরাে কয়েকজনের জন্য শােক করতে না হয়। বাঁচতে যদি তাদের ইচ্ছা। থাকে তবে দেশের লােককে বুঝিয়ে বলুন যে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের বিশ্বাস করতে হবে। দেশকে মস্তকশূন্য করলে যে ক্ষতি হয় তা অপূরণীয় … ১৯৩
আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন : “দুনীতি, স্বজাতিপােষণ ইত্যাদি কলঙ্ক তার গায়ে লাগবে না। লাগবে যেটাকে গ্রিকরা বলত hubrs অর্থাৎ অতিদর্প। একা একাই তিনি একটা দেশকে স্বাধীন করেছিলেন এই অহংকার “আমিই রাষ্ট্র” -এই অহমিকা।”১৯৪ একই বইতে বঙ্গবন্ধুর হত্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন : …“এ দুঃখ, এ শােক, এ লজ্জা এ গ্লানি, এ কলঙ্ক কোনােকালেই মুছবে না।
শেখ মুজিবর রহমান নেতাজি সুভাষের পরে বাঙালিদের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর”…১৯৫ মুজিব-হত্যার আকস্মিকতায় ও নৃশংসতায় কীভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন তিনি তার স্বাক্ষর ছড়িয়ে আছে বইটিতে। আদর্শ ও সাংস্কৃতিক পরিচয়হীন একটি দেশের সঙ্গে আত্মাহীন মানুষের তুলনা করে বিশ্ববিখ্যাত আইনজীবী এবং নােবেল ও লেনিন শান্তি পুরস্কার বিজয়ী সন ম্যাকব্রাইড বলেন, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান তার দেশের আত্মার প্রতীক। সর্ব-ইউরােপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর ৬২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৮২ সালের ২০শে মার্চ লন্ডনে আয়ােজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে ভাষণদানকালে পরিষদের চেয়ারম্যান মি. ম্যাড্রাইড উল্লিখিত মন্তব্য করেন। তিনি বলেন : “আমরা সম্ভবত মানব ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে রয়েছি যখন। সারা বিশ্বে আদর্শ ও নীতিবােধ প্রায় নেই বললেই চলে এবং হৃদয়হীনতা ও পাশবশক্তি আধিপত্য স্থাপন করেছে। আমাদের ইতিহাসে তার অনেক প্রমাণ রয়েছে। শেখ মুজিবের হৃদয়বিদারক হত্যা তার মধ্যে অন্যতম। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বে আদর্শবাদ, নীতিবােধ ও মানবতাবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা বাঞ্ছনীয় ও অবশ্যকর্তব্য। অতএব, আপনাদের মহান নেতা শেখ মুজিবের স্মৃতি অর্পণের জন্য সমবেত হয়ে আপনারা একটি জরুরি কর্তব্য পালন করেছেন।” মি. ম্যাক্ৰাইড আরও বলেন, শেখ মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন, স্বাধীনতা শুধু পতাকা পরিবর্তন অথবা দেশের নতুন নাম বােঝায় না। তার দৃষ্টিতে স্বাধীনতার অর্থ হল সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্র ও আদর্শবাদ। যে চারটি আদর্শ (গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র) বঙ্গবন্ধুর নীতি ও কার্যাবলিকে প্রভাবিত করেছিল তার উল্লেখ করে মি. ম্যাব্রাইড বলেন, বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, স্বাধীনতা অর্থহীন হবে যদি জনগণ প্রাণধারণের স্বাধীনতা, অভুক্ত না-থাকার ও রুজিরােজগারের স্বাধীনতা এবং অন্যদের সঙ্গে সম্পদের অংশীদার হওয়ার স্বাধীনতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। কাজেই তিনি ছিলেন মূলত একজন সমাজতান্ত্রিক এবং একই সঙ্গে উৎসাহী জাতীয়তাবাদী, কারণ তিনি বাংলার কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার এবং নিরাপত্তা বিধানের গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। তাঁরই সৃষ্ট রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হবে, এ-সম্বন্ধে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। এটা জানা
কথা, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা অথবা স্বৈরচারী প্রশাসন বাংলাদেশের নাগরিকদের নায্য অধিকার ও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত রাখবে। সুতরাং তিনি তাঁর চার মূলনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। ( পরিশেষে মি. ম্যাকব্রাইড বলেন : “যদি আপনারা আপনাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য-ভাষা ও কৃষ্টিগত দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখেন, তা হলে আপনারা জাতি হিসাবে পুনরায় মাথা উচু করে দাঁড়াবেন এবং বঙ্গবন্ধুর চার-আদর্শ বাস্তবে পরিণত করতে পারবেন।” পরাধীনতার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামকারী লর্ড (ফেনার) ব্রকওয়ে ১৯৭৯ সালে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রদত্ত এক বাণীতে বলেন : বাংলাদেশের প্রত্যেক পুরুষ, মহিলা ও শিশুসহ সব নাগরিকদের জন্য বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন তার মধ্যেই তিনি সযত্নে রক্ষিত থাকবেন। বাংলাদেশের জনগণের জন্য শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, তাদের দৈনন্দিন জীবনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্যও তিনি সংগ্রাম করে গেছেন। তার হত্যা ব্যক্তিবিশেষকে হত্যার চেয়েও বড় অপরাধ; এটা সমগ্র জাতির বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ। সাম্রাজ্যবাদবিরােধী সংগ্রামের ইতিহাসে তার নাম লেনিন, রােজা লুক্সেমবার্গ, গান্ধি, এন্মা, লুমুম্বা, ক্যাস্ট্রো ও আয়েন্দের নামের সঙ্গে নিশ্চয় বেঁচে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও তাদের উত্তরাধিকারীদের ষড়যন্ত্রের ফলে বাংলাদেশ সম্পর্কে তার প্রত্যাশা বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশের আগত দিনের মানুষের কর্তব্য হবে, তার উদ্দেশ্য সফল করে এমন একটি জাতি গঠন করা যে-জাতি শুধু রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন নয়, বরং সেই স্বাধীনতার মাধ্যমে প্রত্যেক নাগরিককে পরিপূর্ণ জীবন উপভােগ করার
সুযােগ দান করবে।”১৯৬ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু ও রক্তাক্ত বাংলা” শীর্ষক এক নিবন্ধে পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা লেখক নিরঞ্জন মজুমদার বলেন : “দেশে দেশে নেতা অনেকেই জন্মান। কেউ ইতিহাসের একটি পঙক্তি, কেউ একটি পাতা, কেউ বা এক অধ্যায়। কিন্তু কেউ আবার সমগ্র ইতিহাস। শেখ মুজিব এই সমগ্র ইতিহাস। সারা বাংলার ইতিহাস। বাংলার ইতিহাসের পলিমাটিতে তার জন্ম। ধ্বংস, বিভীষিকা, বিরাট বিপর্যয়ের মধ্যদিয়ে সেই পলিমাটিকে সাড়ে-সাত কোটি মানুষের চেতনায় শক্ত ও জমাট করে একটি ভূখণ্ডকে শুধু তাদের মানসে নয়, অস্তিত্বের বাস্তবতায় সত্য করে তােলা এক মহাঐতিহাসিক দায়িত্ব। মুজিব মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয় নেতার মতাে এই ঐতিহাসিক ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন। ইতিহাসের সন্তান ইতিহাসকে পুনর্নির্মাণ করেছেন। এইখানেই তাঁর নেতৃত্বের ঐতিহাসিকতা।”
তিনি আরও বলেন :
“কোনাে নেতার জীবনকালে তার নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বগুণের প্রকৃত মূল্যায়ন সম্ভব নয়। বলেছেন অনেক খ্যাতনামা জীবনীকার। তবু নিজের জীবনকালেই কেউ কেউ অত্যাশ্চর্যভাবে কোনাে দেশ বা তার ইতিহাসের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছেন, ভবিষ্যতের সমালােচনা ও মূল্যায়নের পরােয়া না করেই, যেমন ভারতের গান্ধী, মিশরের নাসের ভিয়েতনামের হাে চি মিন, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ন, কেনিয়ার জোমাে কেনিয়াত্তা, চীনের মাও সে-তুং, রাশিয়ার লেনিন এবং আরাে কেউ কেউ। আজ বাংলাদেশের মুজিবও তাই, ভবিষ্যতে তার নেতৃত্বের যে-মূল্যায়নই হােক না কেন। “আগেই বলেছি, ব্যক্তি কখনাে ইতিহাসের একটি বা একাধিক পঙক্তি, পৃষ্ঠা বা। অধ্যায় হয়ে ওঠেন, কখনাে গােটা ইতিহাস হয়ে ওঠেন। যিনি শুধু জাতির উত্থানে নেতৃত্বে দেন বা পতনে জড়িত থাকেন বা এই উত্থান-পতন পর্বেই নিজের ব্যক্তিত্বের সম্প্রসারণ সীমাবদ্ধ রাখেন, তিনি ইতিহাসের এক বা একাধিক অধ্যায় । কিন্তু যিনি জাতির উত্থান-পতনের সুখে-দুখে মিশে গিয়ে নিজের সুখদুঃখ, উত্থান-পতন, জীবন ও মৃত্যুকে এই ইতিহাসের ধারায় সমাপিত করেন, ইতিহাসের অতীত ও বর্তমানের ঐতিহ্যে স্থিত হন, আবহমান ইতিহাসের স্রোতকে সংগ্রাম ও সাধনায় অধঃপাত থেকে উর্ধ্বমুখী করার চেষ্টা করেন, তিনিই ইতিহাসের মানসপুত্র, গােটা ইতিহাসের প্রভৃতি, জাতির স্রষ্টা, নব নায়ক। জগলুল-নাহাশ মিশর ইতিহাসের এক একটি অধ্যায়। নাসের গােটা ইতিহাস। নওরােজি, গােখলে, মালব্য, মােহাম্মদ আলী ভারতের ইতিহাসের এক একটি অতি উজ্জ্বল অধ্যায়। গান্ধী সমগ্র ইতিহাস। ফজলুল হক, সােহরাওয়ার্দী
বাংলাদেশের ইতিহাসের খণ্ড খণ্ড অধ্যায়! মুজিব সমগ্র ইতিহাস।”১৯৭ একাত্তরের পঁচিশ মার্চ বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে গণহত্যা শুরু করেছিল তা বিশ্ববাসী প্রথম জানতে পারে লন্ডনে ৩০ মার্চ প্রকাশিত দি ডেইলি টেলিগ্রাফ-এ সাইমন ড্রিং-এর সচিত্র প্রতিবেদন পড়ে। ১৯৯৬-এর ২২ সেপ্টেম্বর। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর সাইমনকে দেয়া এক সংবর্ধনার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় দৈনিক বাংলা পত্রিকায়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ৭টা। পাকিস্তানি আর্মি চারদিক থেকে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (শেরাটন) ঘেরাও করে ফেলে। আর্মির পক্ষ থেকে আমাদের বলা হয় হােটেলের বাইরে যাওয়া যাবে না। আমরা জনা ১২ সাংবাদিক, যারা মাত্র কয়েকদিন হল উত্তেজনাকর পূর্ব পাকিস্তানে এসেছি, হােটেলেই আটকা পড়ে যাই। হােটেল থেকে রাস্তায় তাকাই। একটা
অস্বাভাবিক ব্যস্ততা লক্ষ্য করি । রিকশাও দ্রুত ধাবমান। একটা কিছু ঘটছে। রাত আনুমানিক ৯টা। হােটলে পার্ক করা গাড়ির একজন চালক জানালেন, তিনি একটু আগে ৩টি ট্যাংক ঢাকা সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছেন। এমন সময় পাকিস্তানী আর্মি হােটেলের ভেতর অবস্থান নেয়। আমাদের জানানাে হয়, শহরে সান্ধ্য আইন জারী করা হয়েছে। আমি তখন স্পষ্ট বুঝতে পারি। ভয়ানক কিছু ঘটবে। রাত সাড়ে ৯টা। শেখ মুজিবুর রহমানের বাসায় টেলিফোন করি। পরিস্থিতি সম্পর্কে তাকে অবহিত করি। জিজ্ঞেস করি- আপনি এখনও। বাসায় কেন? উত্তরে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “আমি গা-ঢাকা দিলে পাকিস্তানী আর্মি আমার খোঁজে সমগ্র ঢাকা শহর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে।” অবিস্মরণীয় এই বর্ণনা দেন “ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার রিপাের্টার সাইমন ড্রিং। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঢাকায় যে গণহত্যা শুরু করেছিল, বিশ্ববাসী তা প্রথম জানতে পারে তাঁর পাঠানাে প্রতিবেদন ও সংবাদচিত্র থেকে। এই সচিত্র প্রতিবেদন তিনি ব্যাংকক থেকে পাঠান এবং তা ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফে ফলাও করে ছাপা হয়। গতকাল (২২ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬) রােববার বিকালে মুক্তিযুদ্ধে যাদুঘরে দেয়া সংবর্ধনায় তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ লন্ডনে “দি ডেইলি টেলিগ্রাফ” সংখ্যায় প্রকাশিত সাইমন ড্রিং-এর প্রতিবেদনের শিরােনাম ছিল “ট্যাংকস ক্রাশ রিভােল্ট ইন পাকিস্তান”। প্রতিবেদনের শিরােনাম ছিল এরকম : “গত সপ্তাহে শেখ মুজিবুর রহমানের ২৫ দিনের পুরােনাে স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করার জন্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লে পূর্ব পাকিস্তানের সকল বৈদেশিক সংবাদদাতাকে বন্দুকের মুখে, যুদ্ধের শুরু থেকেই, ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলে আটক করা হয় এবং তাদেরকে একত্র করে করাচী পাঠিয়ে দেয়া হয়। তবে আমি হােটেলের ছাদে লুকিয়ে থেকে এই ধরপাকড় এড়াতে পেরেছিলাম। পরে আমাকে এবং অপর দলছুট সংবাদদাতা এপির ফটোগ্রাফার মাইকেল লরেন্টকে খুঁজে বের করার জন্য সেনাদের তৎপরতা সত্ত্বেও আমরা ব্যাপকভাবে ঘুরে। বেড়াতে সক্ষম হই এবং পাকিস্তান সরকার যে গণনিধনকে চাপা দেয়ার চেষ্টা করেছিল তার ব্যাপকতা লক্ষ্য করি। গতকাল আমি পশ্চিম পাকিস্তানগামী একটি বিমানে উঠতে সক্ষম হই। অল্পের জন্য তল্লাশি থেকে বেঁচে যাই এবং আমার মালপত্র ও সারা শরীর যদিও দুবার ব্যাপকভাবে হাতড়ানাে হয়েছে, তবুও আমার টুকে রাখা কাগজপত্র অক্ষতভাবে ব্যাংকক নিয়ে এসে এই রিপাের্ট পাঠাতে পারি।” সাইমন ড্রিং একাত্তরের ভয়াল পঁচিশে মার্চের কথা উল্লেখ করে বললেন, “মধ্যরাতে হােটেল থেকে প্রচণ্ড গােলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। ধারণা করেছিলাম দু-পক্ষের সংঘর্ষ। আসলে তা ছিল পাকিস্তান আর্মির একতরফা গণহত্যা। পরদিন ২৬ মার্চ সকালে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলের কাছেই কাউকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। সকাল ৯টায় হােটেলের ১১ তলায় স্যুটে অবস্থানরত মি, জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তার বসার কক্ষে টেবিলের ওপর একটি বড় এ্যাসট্রেতে দেখলাম পােড়া সিগারেটের রূপ। মি. ভুঠোকে বেশ বিচলিত মনে হল। আমার ধারণা ঢাকায় কী ঘটছে তা তিনি ঠিক অনুধাবন করতে পারেননি। এদিনই তাকে পশ্চিমপাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া সাইমন ড্রিং-এর ভাষায় ২৬ মার্চ ঢাকা শহরকে মনে হয়েছে নীরব নিস্তব্ধ। বেলা ১১ টায় পুরাতন ঢাকায় পাকিস্তানী আর্মি দ্বিতীয় দফা আক্রমণ চালায়। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে জ্বালিয়ে মাটির সঙ্গে মিলিয়ে দেয়া হচ্ছিল। আমরা হােটেলের ছাদ থেকে এই দৃশ্য দেখতে পাই। এদিনই পাকিস্তান আর্মির মেজর সিদ্দিক সালেক হােটেলে বিদেশী সাংবাদিকদের বলেন, “নিজের স্বার্থেই তােমাদের পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করা উচিত। আর যদি না যাও তাহলে তােমাদের জন্য বিশেষ পার্টির প্রস্তুতি নিচ্ছি।” সাইমন ড্রিং বলেন, “আর্মির চোখ এড়ানাের জন্য আমি আমার ব্যাগে জিনিসপত্র গােছাই, ঢাকা ত্যাগের ভান করে। হােটেলের বাঙালি কর্মদের সাহায্যে রান্নাঘরে লুকিয়ে থাকি। হােটেলের রান্নাঘরে সে কী অসহ্য গরম। তবু তা ছিল পাকিস্তান আর্মির হাতে ধরা পড়ার চেয়ে অনেক স্বস্তিকর। ২৭ মার্চ দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে বাঙালি কর্মীদের সাহায্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে ইকবাল হলের ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করি। তখন বেলা ১১ টা। ইকবাল হলের সড়ক ছিল আর্মির নিয়ন্ত্রণে। আমার পরনে তখন প্যান্ট-শার্ট-কোট ছিল না। ছিল বাঙালি পােশাক।” একাত্তরের অসহযােগ আন্দোলনের সময় তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন সরাসরি ভিয়েতনামের রণাঙ্গন থেকে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ও পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ দেখতে তিনি ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন। সাইমন ড্রিং স্বদেশের মুক্ত মাটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাকারও নেন।১৯৮ সবিশেষ বলতে হয়, বঙ্গবন্ধুর বিরূপ সমালােচনার ব্যাপক অবকাশ আছে। তার সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জীবনের ব্যর্থতাও স্মর্তব্য। বঙ্গবন্ধুর মধ্যে ভ্রান্তি ও দুর্বলতা প্রচুর ছিল-কিন্তু সেগুলাের কঠোর সমালােচনার পূর্বে ইতিহাসে তার যা প্রাপ্য তার সঠিক মূল্য যেন আমরা আবেগবর্জিত ভাষায় নিরূপণ করতে ব্যর্থ না হই। ভ্রান্তি ও দুর্বলতা, লােভ ও মােহ এগুলােকে তার ক্ষেত্রে বড় করে দেখানাের সময় তার অন্যান্যগুণাবলিকে যেন আমরা হেয় প্রতিপন্ন ও উপেক্ষা না করি।