আওয়ামী লীগ ছয়-দফা কর্মসূচি বাস্তবায়িত করার বিষয়টি নিশ্চিত করবে। অবশ্য, দলটির অগ্রাধিকার থাকবে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পন্থার প্রতি। তবে জনপ্রতিনিধিরা যদি পরিষদের ভেতরে কাজটি না করতে পারেন, জনসাধারণকেই পরিষদের বাইরে তা করতে হবে। বাহ্যত সমালােচকরা (আওয়ামী লীগ মিত্র ও বৈরী—উভয় তরফের সমালােচক) প্রথমত, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ের সম্ভাবনার উনমূল্যায়ন করেছিলেন আর, দ্বিতীয়ত, তাঁরা এ কথা ভুলে গিয়েছিলেন যে, যদি রাজপথে এ ইস্যু নিষ্পত্তি করতেই হয় তাহলে এমন এক বিশাল ব্যাপ্তির আন্দোলনের প্রয়ােজন হবে যা কোনাে বিশেষ একটি দলের সাংগঠনিক সামর্থ্যে কুলােবে না। এ আন্দোলন এক পূর্ণ ব্যাপ্তির জাতীয় আন্দোলনের আকার নেবে। আর তাই আওয়ামী লীগ জোট না বাঁধলেও তার তেমন কোনাে ক্ষতিই হবে না। অথচ নির্বাচনে জয়ের পর স্বায়ত্তশাসনের দাবি যে প্রক্রিয়াতেই পূরণ হােক না কেন, তা হবে আওয়ামী লীগের নামে। এ জন্যই আওয়ামী লীগ কোনরূপ মৈত্রী প্রস্তাবের প্রতি উদাসীন থাকে।
যারা মৈত্রী বা আঁতাঁত চেয়েছিল তাদেরও কথাটা জানা ছিল। আর সে কারণেই তারা সবচেয়ে আধিপত্যশীল দলের সঙ্গে থাকতে চাচ্ছিল। আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি এতই সুপরিসর ও সর্বাঙ্গীণ ব্যাপ্তির যে অন্যান্য স্বায়ত্তশাসনপন্থীর নতুন করে আর তাতে যােগ করার কিছুই ছিল না। নানা বৈরী পরিবেশ ও প্রতিকূলতার মধ্যে ছয়দফা কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের অটল, অবিচল থাকার বিষয়টি এত পরিপূর্ণ ছিল যে, এ সব দাবির স্তর খাদে নামানাের আর কোনাে অবকাশই ছিল না অন্যদের তরফে যদিও কোনাে কোনাে সমালােচক এর নাড়িই ধরতে পারেননি। কেউ তা করেননি ইচ্ছাকৃতভাবে, অনেকে করেননি অতীত ঘটনাবলির ঊনমূল্যায়নের কারণে। অনিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ইস্যু নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের তৈরি থাকার কথা এতই স্পষ্ট করে প্রকাশ করা হয় যে বিষয়টি সম্পর্কে আর কোনাে সংশয়ই থাকতে পারে না যদিও কোনাে কোনাে সমালােচক আবারও হয় ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা বুঝতে না পারার কারণে দেখেও দেখেননি, এমনকি উপেক্ষাও করেছেন। এগারাে-দফার প্রতি দলীয় সমর্থনের পাশাপাশি এ ধরনের ইতিবাচক প্রলক্ষণগুলি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে এক অজেয় অবস্থানে ন্যস্ত করেছে। আর এর একমাত্র বিকল্প যা তার ইঙ্গিত আওয়ামী লীগই দিয়েছে। আওয়ামী লীগ বলেছে, তার বিকল্প কার্যব্যবস্থা হবে সহিংস গণজোয়ারের মাধ্যমে গােটা সমাজের খােলস বদলে ফেলার ডাক। তবে বিরাজমান পরিস্থিতিতে গােটা। পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানীরা এ ধরনের আন্দোলনের সূচনা করবে—এটা অকল্পনীয়। আর। কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যেকার সম্পর্ক আগাগােড়া না বদলানাে হলে পূর্ব পাকিস্তানীদের কোনাে মাত্রার বিপ্লবী চেতনা তেমন সহিংস গণজোয়ার সৃষ্টি করতে পারতাে না যা পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে। এ জন্য স্বাধীন না হলেও পূর্ব পাকিস্তানে বৈপ্লবিক প্রকৃতির পরিবর্তনের বাস্তব অবস্থাগুলি সৃষ্টির জন্য প্রাথমিক আবশ্যকতা ছিল এ অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন। এ জন্য স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম শুধু অনিবার্যই নয় বরং অপরিহার্যও
২০১
ছিল। এ কারণে সমাজ পরিবর্তনের নিধিদের যুক্তিসঙ্গত মনােভাব হওয়া উচিত ছিল, এ প্রক্রিয়ায় গতি আরাে জোরদার করা। ‘৫০-এর দশকের গােড়ার দিক থেকে শুরু করে পরের বছরগুলিতে এ বিষয়টি নিয়ে বিতর্কে অবতীর্ণ হয়েছেন সমাজ পরিবর্তনের নানা গােষ্ঠী ও উপদল। এরা আবার এই প্রক্রিয়ার পরিক্রমায় অনেক খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়েছে। তবে মধ্যপন্থী শাখার প্রতিনিধিত্বকারী ওয়ালী ন্যাপ আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠাকিভাবে বলতে গেলে প্রায় সব সময়েই আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ থেকেছে।
১৯৭০-এ কোনাে কোনাে ভাসানী অনুসারী আওয়ামী লীগের মাধ্যমে কাজ করেন বলে মনে করা হয় যখন মওলানা ভাসানী তাদেরকে কাজের কোনাে দিগদর্শন দিতে ব্যর্থ হন।৪৪ অবশ্য তথাকথিত চরমপন্থীরা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের আদর্শিক বুনিয়াদের ওপর বিরাট পরিসরে তেমন কোনাে আশু প্রভাব ফেলতে পারেননি। তবে তারা সমাজের সর্বস্তরে মনােযােগ আকর্ষণে সমর্থ হয় যার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া হয় সুদূরপ্রসারী।
অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রে বামরাজনীতির প্রকৃতি ও বিকাশ সম্ভবত বলে দেয় যে, ১৯৭০-এ তখনকার নিম্ন সাক্ষরতার হার, নিম্ন শিল্প ও নগরায়নের হারের আলােকে এবং কোনাে ভালাে শেকড় গাড়া শ্রেণী চেতনার অনুপস্থিতিতে ন্যাপ (এমনকি মধ্যপন্থী ওয়ালী ন্যাপ)-এর মতাে বামপন্থী দলগুলির সঙ্গে আওয়ামী লীগের যুক্তফ্রন্ট গঠনও হিতে বিপরীত হতে পারতাে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ন্যাপ (ওয়ালী)-কে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির সম্মুখ সংগঠন বলে মনে করা হতাে। সে কারণে কড়াকড়ি আদর্শিক অর্থে এমন একটি সংগঠনে “ধর্মবিরােধী জনসমাজ গঠনের অঙ্গীকার থাকতেই হয়। এখন আওয়ামী লীগের সাথে এ ধরনের একটি দলের গাঁটছড়া বাঁধা সম্ভব হলে আওয়ামী লীগবিরােধী শক্তিগুলি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সফল আঘাত হানবে এমন ঝুঁকি ছিল। কারণ আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ প্রবণতার প্রবল বিরােধিতা ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানী সমাজের একাংশে যদিও পরের দিকের বছরগুলিতে সমাজে এই প্রবণতা গৃহীত হতে থাকে তরুণ রক্তের প্রভাব বৃদ্ধির আবেশিক কারণে। এই প্রবণতা গৃহীত হওয়ার আরাে একটি কারণ হলাে ইসলামের মৌলিক নীতিগুলির হেফাজতে আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য ও আনুষ্ঠানিক অঙ্গীকার (শেখ মুজিব নির্বাচনী প্রচারাভিযানকালে যে দেশজ সমাজতন্ত্রে তাঁর প্রত্যয়ের কথা বারংবার উল্লেখ করেন তা এ প্রসঙ্গেও তাৎপর্যপূর্ণ)। এ ক্ষেত্রে খুবই উল্লেখযােগ্য বিষয় হলাে, খন্দকার মােশতাক আহমদের মতাে আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান। মুসলিম। তিনি এসেছিলেন এক সুখ্যাত ধর্মপ্রচারক পরিবার থেকে। আওয়ামী লীগ সংগঠনের সূচনা থেকে দলে তিনি উচ্চ মর্যাদায় আসীন ছিলেন। স্থানীয় স্তরগুলিতেও এ রকম নজির ছিল অনেক। আর বস্তুত এগুলি ছিল আওয়ামী লীগ সংগঠনের নাস্তিক্য ও জ্ঞেয়বাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে নির্ভরযােগ্য রক্ষাকবচ। ন্যাপ (ওয়ালী) প্রচ্ছন্ন তাৎপর্যে কাজ করছিল আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের পক্ষে। তাই এই পর্যায়ে ওয়ালী ন্যাপের সাথে আওয়ামী লীগের আঁতাত হলে ইসলাম পসন্দ মহলগুলি প্রবল শাের তুলে এ আঁতাত ও আঁতাতের অঙ্গ সংগঠনগুলিকে আরাে জোরদারভাবে কলঙ্কিত করার প্রয়াসী হতাে।
২০২
আর সেটি বলাবাহুল্য, স্বায়ত্তশাসনই হােক কিংবা সমাজ পরিবর্তনই হােক কোনাে কিছুর জন্যই অনুকূল হতাে না।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার থেকে একান্তই পরিষ্কার, আওয়ামী লীগের ভালাে করেই জানা ছিল যে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ যতদূর অবধি দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকর্মে হস্তক্ষেপ না করবে ততদূর অবধি ঐ আদর্শ মেনে নেওয়া হবে—তার বেশি নয়। তাই নির্বাচনী ইশতেহারে খুবই সতর্ক অঙ্গীকার করা হয় এই মর্মে যে, ইসলামী নীতিমালাবিরােধী কোনাে আইন প্রণয়ন করা হবে না।৪৫ এ ঘােষণা ছিল দলীয় ম্যানিফেস্টোর বিবৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যে, কোরআন ও সুন্নাহর মৌলিক নীতিবিরােধী কোনাে আইন পাকিস্তানের জন্য গণতান্ত্রিক পন্থায় একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নকালে পাস করা হবে না।৪৬
ওয়ালী ন্যাপের নির্বাচনী ইশতেহারে অবশ্য ইসলাম, কোরআন, শরিয়ত ও সুন্নাহ কিংবা অন্য কোনাে ধর্মীয় বিষয়ের উল্লেখ নেই। এতে শুধু এ কথা বলা হয় যে, সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষাকে ঐচ্ছিক করা হবে। আর ধর্মীয় শিক্ষার জন্য পৃথক উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হবে।৪৭ নিহিত তাৎপর্যে এ বিষয়টির গ্যারান্টি রয়েছে যে ব্যক্তিগত বিশ্বাস হিসেবে ধর্মে হস্তক্ষেপ করা হবে না। তবে ওয়ালী ন্যাপ জমি ও কলকারখানার বেসরকারি মালিকানা বিলােপে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকায়৪৮ খোদ এই বিষয়টিই ইসলামবিরােধী এই অর্থে যে, ইসলাম ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর কোনাে বিধিনিষেধ আরােপ তাে করেইনি, কোনাে ব্যক্তির এ রকম সম্পত্তির পরিমাণের ওপরও কোনাে সীমা আরােপ করেনি যদিও ইসলাম জাকাত ইত্যাদি ব্যবস্থার মাধ্যমে ঐ ব্যক্তির সম্পত্তি ও সম্পদে অন্যের হিস্যার ব্যবস্থাপত্র দিয়েছে।
এ কারণে এ দল দুটির কোনাে তরফ তাদের ঘােষিত আদর্শ ও উদ্দেশ্য বিসর্জন দিয়ে নীতির প্রশ্নে আপােস না করা অবধি আওয়ামী লীগ ও ওয়ালী ন্যাপের মধ্যে কোনাে আঁতাত প্রস্তাব ফলপ্রসূ হতে পারতাে না। তাই এ সব থেকে দেখা যাবে যে, উভয় দল তাদের দৌড়ের সীমাচৌহদ্দি পুরােপুরি জানা সত্ত্বেও, আঁতাত ইস্যু নিয়ে পরস্পরের সমালােচনায় লিপ্ত ছিল কেবল রসনাযুদ্ধের ফাকে এ বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে যে, রাজনীতিতে ধর্মের মর্যাদা কী হবে সেই প্রশ্নে প্রকাশ্য আলােচনা শুরু করতে যাওয়ার মধ্যে ঝুঁকি রয়েছে। আওয়ামী লীগ ইসলামী নীতিমালা রক্ষায় অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকলেও এ নিয়ে যে কোনাে সময়ে প্রশ্ন তােলা যেতাে। এগারাে-দফার চূড়ান্ত অনিবার্যতা স্বীকার করে নিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেকে একটি অবস্থানে নিয়ে আসে। অথচ এই এগারােদফা কিন্তু সমাজে ধর্মের মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে একেবারেই নিশ্ৰুপ। ইসলামের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের অঙ্গীকারের বাস্তব প্রয়ােগ অংশটিরও নানা ভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও দেওয়া সম্ভব। যুক্তির দিক থেকে দেখলে ইসলামী নীতিমালার পরিপন্থী যদি কোনাে আইন না-ই হয়, তাহলে সেই আইনে ইসলামকে “সমুন্নত রাখার প্রয়ােজনই বা কোথায়? ইসলাম সম্পর্কে আওয়ামী লীগের অবস্থানকে শেখ মুজিব আরাে অস্পষ্ট করে তােলেন।
২০৩
তিনি তাঁর বেতার/টেলিভিশন ভাষণে উল্লেখ করেন যে, আওয়ামী লীগের ছয়-দফা ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উদ্দেশ্য সকলের প্রতি ন্যায়বিচার। কাজেই এ সব কখনাে ইসলামবিরােধী হতে পারে না। আওয়ামী লীগের ইসলাম পসন্দ বিরােধীরা হয় এ সব বিষয় ধরতেই পারেনি, নয় বলতে হয়, তাদের ইসলামবাদও আওয়ামী লীগের সমাজতন্ত্রের মতােই ধোঁয়াটে বা অন্তঃসারশূন্য।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দলের এই অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে যে, জনসাধারণকে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। এতে বলা হয়:
ন্যায়বিচারের বুনিয়াদে আমাদের জনসমাজ পুনর্নির্মাণের অভিন্ন প্রয়াসে জনগণ যাতে সক্রিয় ও সম্মিলিতভাবে নিজেদেরকে নিয়ােজিত করতে পারে সে জন্য আমাদের সমাজে বৈপ্লবিক প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামােগত পরিবর্তন সাধন করতে হবে। এ জন্যে দরকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এক সমাজ বিপ্লব সাধনের। এ ধরনের বিপ্লব সম্ভব করতে হলে আমাদের এক নতুন শাসনতন্ত্র, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক নির্মিতির প্রয়ােজন। তাই বিপ্লব আনতে হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ও সেভাবে এক নতুন শাসনতান্ত্রিক, আর্থ-রাজনৈতিক ও সমাজ-শৃঙ্খলা এনে বর্তমান অবিচারসুলভ ব্যবস্থার অচলায়তনকে সরিয়ে দিতে হবে। নতুন ব্যবস্থার আওতায় অঞ্চল ও অঞ্চলের মধ্যে, মানুষ ও মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার বিরাজ করবে। আর সেভাবেই দলীয় ইশতেহার প্রণীত হয়েছে। ইশতেহারের রূপরেখায় পাকিস্তানের প্রতিটি অঞ্চল দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য সুবিচারের নিশ্চয়তা বিধানের এক সর্বাঙ্গীণ কৌশলের উপস্থাপনা রয়েছে।৪৯
ইশতেহারে শাসনতন্ত্রের জন্য প্রদত্ত রূপরেখার মৌলিক বৈশিষ্ট্যবলিতে “এক সত্যিকারের প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের অঙ্গীকার রয়েছে—রয়েছে এই মর্মে গ্যারান্টি যে, “পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহয় সন্নিবেশিত ইসলামের অনুশাসনবিরােধী কোনাে আইন পাকিস্তানে প্রণয়ন বা বলবৎ করা যাবে না।” ছয়-দফা কর্মসূচির দাবিগুলি অন্তর্ভুক্ত করা ছাড়াও ইশতেহারে আর্থ-রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রবিষয়ক নানা ব্যবস্থার উল্লেখ রয়েছে যেগুলি আওয়ামী লীগ সংগঠন বাস্তবায়িত করার আশা রাখে। এগুলি হলাে: এক ব্যাপক সমবায়ভিত্তিক চাষাবাদ ব্যবস্থা, সর্বাঙ্গীণ বন্যা নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাদির বাস্তবায়ন, খাদ্যশস্যের উৎপাদকদের জন্য ন্যায়সঙ্গত ও স্থিতিশীল মূল্য; বাতাঈ ও ইজারা প্রথায় আইন ও শরিয়ত প্রয়ােগ; পশ্চিম পাকিস্তানে জায়গীরদারি, জমিদারি ও সর্দারি ব্যবস্থার বিলােপ, সরকারি খাস জমি ও বেসরকারি মালিকানার জন্য নির্ধারিত সিলিং বা সীমার অতিরিক্ত উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন চাষী ও ক্ষুদ্র চাষীদের মধ্যে বিলিবণ্টন, সমবায়ভিত্তিতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশসাধন; সকল মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ শিল্প এবং সকল ব্যাংক ও বীমা ব্যবসায়ের জাতীয়করণ, একচেটিয়া কারবারের ওপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা; ক্রমবর্ধমান পদ্ধতির আয়কর ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং মুলধনী লাভ, মুনাফা, সম্পদ, দানদেহাজ, উপহার ও উত্তরাধিকারের বেলায় মােটা কর আদায় কর অবকাশ, বিয়ােজন ও মওকুফের বেলায় সর্বাঙ্গীণ পুনর্বিবেচনা পদ্ধতির ব্যবস্থা, পাট ও তুলা ব্যবসায়ের জাতীয়করণ, ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের অধিকার,
২০৪
শ্রমিকদের ধর্মঘট, ন্যায্য মজুরি, তাদের ও তাদের পরিবারের যথা বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা-সুবিধা লাভের অধিকার; সেতু, সড়ক এবং সামুদ্রিক ও নদীবন্দর স্থাপনের মাধ্যমে উন্নততর যানবাহন ও যােগাযােগ সুবিধা প্রদান, নিরক্ষরতা উচ্ছেদ, সকল স্তরে ধর্মীয় শিক্ষা সম্প্রসারণের ব্যবস্থা, প্রাথমিক মান অবধি অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা, নতুন মেডিক্যাল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, মেধাবী ছাত্রদের জন্য উচ্চতর শিক্ষা লাভের সুযােগ-সুবিধা, উর্দু ও বাংলাভাষার উন্নয়নে উৎসাহ প্রদান, প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক ভাষাগুলির সংরক্ষণ, নারীর সমমর্যাদা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের নিয়ে সার্ভিস কোর গঠন; প্রতিটি ইউনিয়নে মেডিক্যাল সেন্টার ও প্রতিটি থানা সদরে হাসপাতালের ব্যবস্থা; পল্লী জনপদে মেডিক্যাল গ্র্যাজুয়েটদের জাতীয় সার্ভিস প্রবর্তন; পল্লী চিকিৎসাকেন্দ্রগুলিতে নিয়ােগের জন্য প্যারামেডিক্যাল কর্মী প্রশিক্ষণ; মােহাজিরদের জন্য সমান অধিকার ও সুযােগ; স্বল্প ব্যয়সাপেক্ষ নগর আবাসন প্রকল্পের বেলায় অগ্রাধিকার, স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি, ‘সিয়াটো’ ও ‘সেন্টো’ চুক্তি থেকে সরে আসা; সাম্রাজ্যবাদী ও নব্য উপনিবেশবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিপীড়িত মানুষের প্রতি সমর্থন, জাতিসংঘ প্রস্তাবানুসারে কাশ্মীর সমস্যার নিষ্পত্তি; ফারাক্কা বিরােধের মীমাংসা এবং সকল রাষ্ট্র, বিশেষ করে, প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।
ইশতেহারের উপসংহারে উল্লেখ করা হয় যে, ফেডারেশনের প্রতিটি ইউনিট সম্পর্কিত প্রস্তাব উল্লিখিত কাঠামাের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ফেডারেশন ইউনিটের আওয়ামী লীগ ইশতেহারে সাঙ্গীকৃত হবে।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের একুশ-দফার সাথে ১৯৭০ সালের আওয়ামী লীগের ইশতেহারের মিল রয়েছে। উভয় ইশতেহারেরই উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সকল স্তরের জনগণের মাঝে ব্যাপক আবেদন সৃষ্টি। এ ইশতেহার স্পষ্টত আওয়ামী লীগের বাস্তববাদী বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছে। অবশ্য, দলীয় এ ইশতেহারে অ্যাপস্যাকের দাবিকে ঠাই দেওয়া হয়নি। ইশতেহারের অঙ্গীকারগুলি আগাগােড়া বাস্তবায়িত হলে তা অবশ্য জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থায় একটা তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আনতে ও অর্থনীতির কাঠামােগত পরিবর্তনের এক বুনিয়াদ রচনা করতে পারতাে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারাভিযান ১৯৭০ সালের ৭ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। নির্বাচনী প্রচারাভিযানের বক্তৃতা-ভাষণগুলিতে প্রধানত স্থানীয় সমস্যাগুলির সাথে ছয়-দফা কর্মসূচি সম্পর্কিত ইস্যুগুলি আলােচিত হয়। এই প্রচারাভিযানের শেষ পর্যায়ে শেখ মুজিব হয় ব্যালটের মাধ্যমে নয় জনআন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের দাবি বাস্তবায়িত করার দৃঢ় সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচন শােষণ উচ্ছেদ করার সুযােগ নিয়ে এসেছে। তিনি আরাে বলেন, “আমরা যদি সময়ের ডাকে সাড়া দিতে ব্যর্থ হই তাহলে আগামী প্রজন্ম যুক্তিসঙ্গতভাবেই আমাদেরকে দায়ী করবে।” তিনি আশ্বাস দেন, “যারা জনস্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছে এবার তাদের ব্যর্থ করে দিতে হবে কেননা, জাতীয় বিষয়াবলিতে বাঙালির অংশ নিশ্চিত করেই দেশের শাসনতন্ত্র প্রণীত হবে।” পূর্ব পাকিস্তানীদের
২০৫
বারংবার মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে, পশ্চিম পাকিস্তানের শােষকেরা পূর্বাঞ্চলের অবক্ষয়ের জন্য দায়ী। আসন্ন ব্যালটের লড়াই’ তার জন্য হবে শান্তিপূর্ণ উপায়ের মাধ্যমে বাংলার অধিকার হাসিলের শেষ সংগ্রাম। তিনি তার কোনাে কোনাে বক্তৃতা/ভাষণে আরাে উল্লেখ করেন যে, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতার হস্তান্তর বিলম্বিত করার চক্রান্ত করা হচ্ছে। ১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর তার বেতার/টিভি ভাষণে দেশের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অবস্থার প্রেক্ষাপটে ছয়-দফা কর্মসূচির গুরুত্ব সম্পর্কে সবিশেষ জোর দিয়ে তিনি বলেন:
আওয়ামী লীগের ছয়-দফা কর্মসূচি, যা এগারাে-দফারও অন্তর্ভুক্ত, আঞ্চলিক অন্যায়-অবিচার। সমস্যার এক যৌক্তিক সমাধান। আমাদের ছয়-দফা ফর্মুলার ভিত্তিতে ফেডারেশনের ইউনিটগুলিকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার ব্যবস্থা করে শাসনতান্ত্রিক কাঠামাের পুনর্নির্মিতিই সমস্যার সম্ভব একমাত্র সমাধান। এ স্বায়ত্তশাসনকে কার্যকর করতে হলে এতে অবশ্য অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা থাকতে হবে। এ জন্যই আমরা চাই, ফেডারেশনের ইউনিটগুলির ক্ষমতা থাকতে হবে। এ জন্যই আমরা চাই, ফেডারেশনের ইউনিটগুলির হাতে মুদ্রা ও রাজস্বনীতি, অর্জিত বিদেশী মুদ্রার ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্য-সহায়তার বিষয়ে দরকষাকষির অন্যান্য ক্ষমতা থাকুক।৫০
স্পষ্টত বােঝা যায়, ছয়-দফা কর্মসূচি ছিল আওয়ামী লীগের প্রধান অবলম্বন। ১৯৬৬ সাল থেকে পরবর্তীকালে এ দল একটানা এ কর্মসূচি বাস্তবায়নকেই তার একমাত্র না। হলেও সর্বাগ্রগণ্য উদ্দেশ্য হিসেবে প্রচার করেছে। ১৯৭০ সাল নাগাদ এ কর্মসূচি পূর্ব পাকিস্তানী জনগণের ভবিষ্যৎ অস্তিত্বের প্রতীক হয়ে ওঠে। তাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের অন্য যে কোনাে রাজনৈতিক গােষ্ঠীর চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। সে কারণেই বলা চলে, তৃতীয় মত৫১-এর লেখকের মতাে ভাষ্যকারগণ আওয়ামী লীগের সদরদপ্তরে মনােনয়ন প্রার্থীদের বর্ধিষ্ণু ভিড় লক্ষ্য করে। যে বৈরী মন্তব্য করেছেন তা হয় বুঝবার ভুলে নয়তাে নিদারুণ অস্বস্তিতে।
আওয়ামী লীগের মনােনয়ন প্রার্থীর সংখ্যা ছিল বিপুল। ১৯৭০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তান থেকে আওয়ামী লীগ মনােনীত প্রার্থীদের তালিকা ঘােষণা করার সময় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও যুগপৎ আওয়ামী লীগ সংসদীয় বাের্ডের সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ উল্লেখ করেন যে, যথাক্রমে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের ১৬২ ও ৩০০ আসনের জন্য ৩৫৯ ও ১৫৫৬টি আবেদনপত্র পাওয়া গেছে। এতে এ দলের নির্বাচনে প্রত্যাশিত সম্ভাবনাটিই প্রতিফলিত হয়েছে। অন্য দলগুলির নির্বাচনে উন্নততর সম্ভাবনা থেকে থাকলে নিশ্চয়ই ‘খাটি নয় এমন প্রার্থীরা তাদের ওখানেই ভিড় জমাতাে (যদি না আবেদনকারীদের এমন কোনাে হীন মতলব থেকে না থাকে যে, আওয়ামী লীগ নেতাদের অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী, আত্মম্ভরী করে তুলতে হবে)। অন্য দলগুলির তুলনামূলক দুর্বলতা খুব পরিষ্কার লক্ষ্য করা যায় জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে তারা শতকরা কয়টি আসনে প্রতিযােগিতা করেছে
২০৬
তা থেকে। স্পষ্টত আওয়ামী লীগ নির্বাচনী দৌড়ের প্রথম ধাপেই অন্য দলগুলির তুলনায় অনেক এগিয়ে থাকে। আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সকল আসনে প্রার্থী দেয়। সে তুলনায় মাত্র একটি দল জাতীয় পরিষদের ও দুইটি দল প্রাদেশিক পরিষদে ৫০ শতাংশের বেশি আসনে প্রার্থী দিতে সক্ষম হয়।৫৩
আওয়ামী লীগ ও অন্য দলগুলির মধ্যে উপরােক্ত বিরাট ব্যবধানের জন্য তাৎপর্য এই যে, অন্য দলগুলির কোনােটিই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে নবাগত ছিল না। অনেক বেশি সংখ্যক আসন বা নির্বাচনী এলাকা থেকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার অক্ষমতায় এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, তাদের প্রভাব ছিল একান্তই স্থানীয় পর্যায়ে সীমিত।৫৪
এ কারণে অন্য দলগুলির পক্ষ থেকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রদেশের স্বাভাবিক জনজীবন। বিপর্যস্ত করেছে—এই অজুহাতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন-তারিখের তফসিল স্থগিত করার জন্য বলা খুবই স্বাভাবিক। তাদের এ অনুরােধ মঞ্জুর করে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ১৯৭০ সালের যথাক্রমে ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর পুনর্নির্ধারণ করা হয়। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর নির্বাচনের তারিখ আবার স্থগিত করার জন্য বলা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে আবেদন মঞ্জুর করা হয়নি। আর নিয়তির পরিহাস এই যে, ১৯৭০ সালের নভেম্বরে যে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় পূর্ব পাকিস্তানকে বিধ্বস্ত করে তা এ সব দলকে আরাে অজনপ্রিয় করে তােলে। আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসন মঞ্চের আবেদন বেড়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক জান্তা যে অবহেলা৫৫ দেখান তা তারা বিভিন্ন সরকারি বিভাগে, সশস্ত্র বাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানীদের সংখ্যা বাড়িয়ে ও কিছু পূর্ব পাকিস্তানী আমলার পদোন্নতি দিয়ে, কিংবা জাতীয় সম্পদের অপেক্ষাকৃত একটা বড় ভাগ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করে, এক দল শিল্পোদ্যোক্তা ও উদ্বৃত্ত চাষীকে পৃষ্ঠপােষকতা দিয়ে যা কিছু শুভেচ্ছা কোনাে কোনাে পূর্ব পাকিস্তানী মহলে সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন তার সবটুকুই বরবাদ করে দেয়। আর এই প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের ছয়-দফা কর্মসূচির রূপরেখা নির্ধারিত কেন্দ্রপ্রদেশ সম্পর্কের বিষয়টি যারা মেনে নিতে পারেননি তাঁরা তাঁদের যেটুকু বিশ্বাসযােগ্যতা ও আস্থা অবশিষ্ট ছিল, বিশেষ করে, ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকাগুলি সফর শেষে, ১৯৭০ সালের ২৬ নভেম্বর শেখ মুজিবের বিবৃতির পর, তার পুরােটাই হারান।
তিনি তাঁর এই বিবৃতির শেষাংশে যা বলেন, তা কার্যত এক রণ হুঙ্কারের শামিল যাকে স্বাধীনতার প্রচ্ছন্ন ঘােষণা হিসেবেও ধরা চলে। তিনি বলেন:
.. বাংলাদেশ এখন জেগে উঠেছে। সে এখন তার রায় দেবে ব্যালটে, অবশ্য সে ব্যালট যদি ভেস্তে দেওয়া না হয়। আর ব্যালট যদি ভেস্তেই দেওয়া হয় তাহলে বাংলাদেশের মানুষ—যে লাখাে মানুষ প্রাণ দিয়েছে তাদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে প্রয়ােজনে আরাে লাখাে প্রাণের চরম আত্মত্যাগ স্বীকার করতে—যাতে করে বাংলাদেশ হতে পারবে তার। নিয়তির বিধাতা।৫৬
১৯৬৫ সালের যুদ্ধ পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার উপনিবেশ ধরনের সম্পর্ককে যদি চূড়ান্তভাবে উন্মােচিত করে থাকে আর সে কারণে আওয়ামী লীগ মােকাবেলার
২০৭
অবস্থান গ্রহণ করে চলতি সম্পর্কের ধারাবাহিকতার বিরােধিতায় স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন শুরু করে থাকে, পূর্ব পাকিস্তানে ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত মানুষের প্রতি সরকারের নিদারুণ ঔদাসীন্য প্রমাণ করলাে যে চলতি সম্পর্কের কাঠামােয় কোনাে রেখাপাতই হয়নি এবং আওয়ামী লীগ নেতা আক্রমণাত্মক অবস্থানে যেতে বাধ্য হলাে। এ বিষয়ে জনঅনুভূতির যথার্থ অভিব্যক্তি দিয়েছে ‘ফোরাম’ এভাবে:
যদি জনগণের সরকারই হতাে তাহলে তার প্রধান নির্বাহী তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে বসতেন ভােলায় (ঘূর্ণিঝড়ে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা)—তিনি সরাসরি ত্রাণ তৎপরতা পরিচালনা করতেন। বস্তুত এ কারণে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের জন্য যে দাবি উঠেছে। তা উচ্চাভিলাষী রাজনীতিকদের কোনাে আকস্মিক খেয়াল বা মর্জিমাত্র নয়। সপ্তকোটি মানুষের অস্তিত্বের জন্য এ এক অপরিহার্য প্রয়ােজন। নির্বাচন আমাদের সমস্যার ধন্বন্তরী সমাধান—এমন কোনাে ভ্রান্তিবিলাস বা মােহ আমাদের নেই। নির্বাচন কেবল আমাদের জনসমক্ষে ও গােটা দুনিয়ার কাছে স্বশাসনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানী জনসাধারণের মৌলিক আকুতির স্বাক্ষর রাখবে। এ এমন এক দাবি যার জন্য আর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা যুক্তির প্রয়ােজন নেই। এখন দরকার কেবল এর সপক্ষে সােচ্চার ও পরিষ্কার রেকর্ড রাখার। এ দাবি জানানাের পর আমাদের শাসক শ্রেণী তা অবজ্ঞা করলে, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের পরবর্তী পর্যায় নিজেই প্রকটিত হবে। এখনাে সময় আছে রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকার যা এ দেশে শান্তি ও সম্প্রীতি অক্ষুন্ন রাখতে পারে। তবে এটির এক প্রদর্শনী সম্ভব যদি পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ পরিষ্কার গলায় বলতে পারে: আমাদের মৃতেরা জীবন দিয়ে এই ভােট দিয়ে গেছে, যারা আজও বেঁচে আছে তাদেরকে তাদের ভােট দিয়ে বলতে দাও।৫৭
এটি অত্যন্ত পরিষ্কার যে, এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ আর নতুন করে নির্বাচন স্থগিত করা চাইবে না। যে অঙ্গীকার রয়েছে পূর্ব পাকিস্তানকে হয় সংসদীয় পদ্ধতিতে নয় সংসদবহির্ভূত পদ্ধতিতে স্বনিয়ন্ত্রিত করার—সে অঙ্গীকার বাস্তবায়িত করতে আওয়ামী লীগকে লড়তে হবে একটা সুবিধাজনক অবস্থান থেকে। এ দলের শক্তি যেহেতু বন্দুকের নলে নিহিত নয় সেহেতু এ দলটিকে ঐ সব মানুষের মন জয় করতেই হবে সুনিশ্চিতভাবে, এ মানুষগুলিই হবে তার জন্য সমর্থনের বুনিয়াদ। আর এটিই ছিল এ ধরনের প্রয়াস চালানাের সবচেয়ে অনুকূল সময়। দ্বিতীয়ত, চূড়ান্ত মােকাবেলায় নামার আগে আওয়ামী লীগের নিজের জন্য যেমন নির্ধারণ করা দরকার তেমনি বিরােধীদের কাছে প্রমাণ করাও দরকার, তার সমর্থনের পরিসর ঠিক কতখানি। আর তার শক্তি কতখানি একটি আশু নির্বাচনই শুধু তা দেখাতে পারে। আর এই নির্বাচন যে, দলের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা বাস্তবিকপক্ষে অনেক আগেই শেখ মুজিব চট্টগ্রাম বার অ্যাসােসিয়েশনে প্রদত্ত ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত নিজেকে নেতা বলার কোনাে নৈতিক অধিকার আমার নেই”।৫৮ বাহ্যত ইয়াহিয়া খানের অভিমতও ছিল তাই। তিনি ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে, জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি কাউকে জনগণের প্রতিনিধি বলে মনে করেন না।৫৯
২০৮
কতিপয় রাজনীতিক নির্বাচন স্থগিত করার দাবিতে দলীয় ভূমিকার জন্য আওয়ামী লীগের সমালােচনা করে। ভাসানী ও অন্যরা ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর প্রতিবাদ দিবস পালন করেন। প্রতিবাদ দিবসে নির্বাচন তিন মাস বিলম্বিত করার দাবি করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক তাঁদেরকে “ঘূর্ণিঝড়ের এতিম” বলে আখ্যায়িত করে ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, “ঘূর্ণিঝড়-মহাপ্লাবনের যে ধ্বংসাবশেষের আবডালে আশ্রয় নিতে চেষ্টা করছেন সে ঝড়-দুর্যোগ নয় বরং যে রাজনৈতিক ঝড় গত এক বা দু’বছর ধরে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তার কারণেই মনে হয় ভদ্রলােকেরা হুঁশিয়ারি বিহনে নিজেদেরকে পুরাে অপ্রস্তুত দেখতে পান”।৬০ অথচ পূর্ব পাকিস্তানের মােটামুটি বেশিরভাগ মানুষ তাে মনে হয় আওয়ামী লীগের “এখনই কিংবা কখনাে নয়” এই অভিমতের অংশীদার। পূর্ব পাকিস্তান তাে বরাবরই তার অভাব-অভিযােগের কথা প্রকাশ করে এসেছে কেন্দ্রবিরােধী বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে। তবে এবার আর কোনাে বিক্ষোভের কথা খবরে জানানাে হয়নি। নির্বাচন এসে পড়ায় ওরা মনে হয় তাদের যা প্রকাশের তা প্রথমে ভােটাধিকারের মাধ্যমে ব্যক্ত করার ও প্রয়ােজনে পরে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয় বেছে নিয়েছে। এই সংযমী মনােভাব ছিল অংশত স্বতঃস্ফূর্ত, অংশত আওয়ামী লীগ কর্মীদের আর সেই সাথে ছাত্রলীগ কর্মীদের সজাগ প্রয়াসের ফল। কেননা, নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাঝে এর নিজ দায় ও স্বার্থ নিহিত ছিল। পাকিস্তানী রাজনীতির আচমকা নানা ডিগবাজির পূর্ব অভিজ্ঞতায় পরিপক্ক আওয়ামী লীগ নেতারা আশঙ্কা করেন যে, কোনাে ব্যাপক সহিংসতা দেখা দিলে (যে কোনাে সময় যে কোনাে কেন্দ্রবিরােধী বিক্ষোভের স্বাভাবিক পরিণতি) তা ১৯৬৮-৬৯ সালের বিক্ষোভ-নিপীড়ন ও সহিংসতার দুষ্টচক্রকে পুনরাবৃত্ত করবে আর তাতে নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যাবে। এতে কেবল স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের আরাে অগ্রগতিই বরবাদ হয়ে যাবে না, এ পর্যন্ত যে অগ্রগতি হয়েছে তা-ও বরবাদ হয়ে যাবে। তৃতীয়ত, ১৯৬৯ সাল থেকে দীর্ঘমেয়াদী প্রচারণা অভিযান আন্দোলন চালিয়ে আওয়ামী লীগ জনক্ষোভকে এক ফুটন্ত অবস্থায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এখন তাতে কোনাে রকম ঢিলে দিলে, কিংবা যতি-বিরতি ঘটালে দলীয় সংগঠনের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে, বিশেষ করে, ছাত্রলীগ কর্মীসহ ছাত্রদের মাঝে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা, অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে। ১৯৬৯ সালের প্রথম তিন মাসে যে তীব্রতায় ছাত্রবিক্ষোভ গড়ে উঠেছিল তার ধার অনেকটাই কমে আসে। এটি কতকটা হয় সামরিক আইন পুনঃআরােপের কারণে। তবে এর বড় কারণ। হলাে, ছাত্রসংগ্রাম কমিটির সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠনের স্বআরােপিত সংযমের কারণে। সংগঠনটি ছাত্রলীগ বৈ কেউ নয়। ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতৃত্ব সাময়িকভাবে আক্রমণাত্মক ও আদর্শে প্রগতিবাদী হলেও বাস্তববাদীও ছিল বটে। তারা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সমস্যা সমাধানে রাজনীতিকদেরকে সময় দিতে তৈরি ছিল তবে সেটি অনির্দিষ্টকালের জন্য নয়। তখন কোনাে কোনাে সময় এমনও দেখা যায় যে, ছাত্রলীগ কার্যত শেখ মুজিবের পরামর্শ অগ্রাহ্য করেছে। ছাত্র সংগ্রাম কমিটি যে গণআন্দোলন শুরু করে তা স্থগিত করা হলেও
২০৯
প্রত্যাহার করা হয়নি। অবশ্য এতে গঠনের দিক থেকে কমিটি দুর্বল হয়ে পড়ে। ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ অ্যাপস্যাক ছেড়ে যায় ও তাতে ঐ ছাত্রগ্রুপের মধ্যে বিভক্তিও দেখা দেয়। তবে আওয়ামী লীগের প্রতি ছাত্রলীগের প্রশ্নাতীত আনুগত্যের বিষয়টিও অনির্দিষ্টকালের জন্য অটুট থাকবে এমনও ধরা যায় না। এ সংগঠনটিও একই ধরনের সমস্যায় পড়ে। শেষ পর্যন্ত যদি নিয়মতান্ত্রিকতার বাইরে গিয়েই সঙ্কটের সমাধান করতে হয় তাহলে সে বিষয়টি যত শীঘ্র স্পষ্ট হয় ততােই মঙ্গল। কেননা, ছাত্র আন্দোলন তখন এমন একটা। গতি অর্জন করেছিল যাতে খুব বেশি দিন ফাক পড়ে গেলে ঐ আন্দোলন আবার শুরু করা ছাড়া উপায় থাকবে না।৬১
এ জন্য নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে আওয়ামী লীগের অনুকূল সিদ্ধান্ত প্রকাশ তার রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতারই পরিচয় দিয়েছে। এই ক্রান্তিকালে আওয়ামী লীগের নেওয়া অবস্থানের প্রতি জনসমর্থন থেকে আভাস পাওয়া যায় যে, আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচির বাস্তবায়নই সর্বাগ্রগণ্য হয়ে জনচিত্ত জুড়ে আছে। এটি বেশ বােঝা যায় যে, বিস্তারিত ব্যাখ্যায় “স্বায়ত্তশাসন” বিভিন্ন শ্রেণীর লােকের কাছে বিভিন্ন অর্থবাহক হতেও পারে। তবু সাধারণ মানুষের কাছে এর একটা অভিন্ন তাৎপর্য ছিল আর তাতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ অনুপ্রাণিত হয়। তাদের বিশ্বাস, আর্থ-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গােলামী না থাকলে স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমেই তাদের জীবনযাত্রার মান সন্তোষজনক হবে। অপেক্ষাকৃত বয়সী প্রজন্মের লােকেরা যখন পাকিস্তানের জন্ম হয় তখন এটিই চেয়েছিল কিন্তু তা পায়নি। আর তরুণতর প্রজন্মের কাছে এগুলি ছিল মৌলিক মানবাধিকার যা থেকে তারা বঞ্চিত রয়েছে। একজন রাজনৈতিক ভাষ্যকার এ সবের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে:
এ সব নির্বাচনে যে সব মৌলিক বিষয় বা কারণ ক্রিয়াশীল থাকবে তা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় খুব বেশি ভিন্ন হবে এমন সম্ভাবনা কম। সমগ্র প্রদেশের একমাত্র ইস্যু হলাে: পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বশাসন ও এ ক্ষেত্রে মুজিব ত্রাতা মসীহের ভূমিকায় অবতীর্ণ। তাঁর বার্তা স্থানীয় নেতা তথা পিতাদের প্রভাব অতিক্রম করে যেতে সক্ষম হবে কিনা কিংবা তাঁর সেই প্রভাবের সুবাদে তাঁর দলীয় প্রার্থীদের দোষত্রুটি ছাপিয়ে তাঁর জন্য সামগ্রিক জয় আসবে কিনা সেটি এখন দেখার বিষয়। তবে তিনি যে অন্য সব দল ও তাঁর ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বীদের পিছু ফেলে নির্বাচনে আধিপত্য লাভ করবেন সে বিষয়টি নিশ্চিত। এরপর সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্যায়। প্রথম পর্যায়ের ফল দেখে শাসকদের কী প্রতিক্রিয়া হয়। তার ওপর দ্বিতীয় পর্যায়ের এই সংগ্রামের গতিপ্রকৃতি নির্ভর করবে। যদি এ ফলাফলকে চ্যালেঞ্জও করা হয়, তাহলে প্রায় নিঃসংশয়ে বলা চলে আন্দোলনের রাজনীতির জন্য পূর্ব পাকিস্তানের মেজাজ এখন পুরাে তৈরি।৬২
স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে জনআগ্রহ এ-ও প্রমাণ করেছে যে, স্বায়ত্তশাসনের ইস্যুটিকে। মুলতবি রাখার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হাতে ছিল একনায়কের সর্বময় ক্ষমতা। তিনি সহজেই নির্বাচনের আগে স্বায়ত্তশাসনের পরিসর কী হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারতেন। বস্তুতপক্ষে, আইন
২১০
কাঠামাে আদেশের (এলএফও) আওতায় শাসনতন্ত্র বিলের অনুমােদনের বেলায় নিজ ভিটো ক্ষমতার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত রেখে এ বিষয়ে তিনি তাঁর স্বাধীন বিচার-বিবেচনার বিকল্পটি খােলা রেখেছিলেন। তবে তিনি এও জানতেন যে, স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে তাঁর রায় সংশ্লিষ্ট জনসমষ্টির কাছে গ্রহণযােগ্য হবে না। স্পষ্টতই নির্বাচনের আগে কোনাে অচলাবস্থা বাঞ্ছনীয় ছিল না, কেননা তেমন ঘটনা ঘটলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন শাসকগােষ্ঠীর নিজ অবস্থানকে একটা বৈধতা দেওয়ার প্রয়াসেও ছেদ পড়বে। তাই স্বায়ত্তশাসনের ইস্যুটি সম্পর্কে আগেভাগেই সিদ্ধান্ত দিয়ে আওয়ামী লীগের আবেদন কমানাের চেষ্টায় না গিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক শক্তিগুলির মধ্যে মতানৈক্যের অপেক্ষায় থাকেন। তাঁর আশা ছিল, এতে আওয়ামী লীগের ভােটের বাক্সে, ব্যালটের পরিমাণ কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, যেহেতু শাসকগােষ্ঠী আশা করেনি যে, আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল হবে (নির্বাচনে প্রার্থী প্রদানের ধারাবিন্যাসটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা হলে অবশ্য এ ক্ষেত্রে সতর্ক হয়ে যাওয়ার যথেষ্ট অবকাশ ছিল)। মনে করা হয়েছিল যে, স্থানীয় বিরােধ ও মতানৈক্য জাতীয় পরিষদ অবধি টেনে নিয়ে আসা যাবে ও তাতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে একটা অচলাবস্থা দেখা দেবে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে ব্যর্থ হলে প্রেসিডেন্ট আইনসম্মতভাবে” (এলএফও অনুসারে এ কাজটি নিখুঁত আইনসম্মত) তাঁর নিজ সমাধান জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়ে গােটা দোষ পূর্ব পাকিস্তানী রাজনীতিকদের, বিশেষ করে, আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারবেন এই সব কথা বলে যে, তাদের মধ্যে সহযােগিতার অভাব রয়েছে, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নেও তাদের মাথাব্যথা নেই। এভাবে গণতন্ত্রের একটা সাইনবাের্ডের আড়ালে শাসকচক্রের স্বার্থ পুরােপুরি প্রকাশ্যে না এনেও রাজনীতিকদের বিশেষ করে আওয়ামী লীগারদের দায়ী করে বর্তমান ব্যবস্থা কায়েমি রাখার সুযােগ মিলবে।
স্বায়ত্তশাসন ইস্যুর নিষ্পত্তির প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলির মনােভাব স্পষ্ট বােধগম্য। আওয়ামী লীগ ও মােজাফফর ন্যাপ ছাড়া সকল রাজনৈতিক দল নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট সুনির্দিষ্টভাবে স্বায়ত্তশাসন ইস্যুর নিষ্পত্তি দিন—এটিই চেয়েছিল। কারণ তারা মনে করেছিল, এটি করলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী আবেদন বহুলাংশেই জলাে হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ এ নিয়ে খুব ব্যগ্র ছিল না। কেননা, দলটি সুনির্দিষ্টভাবে স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নেই নির্বাচন লড়ছিল। অবশ্য সম্ভবত এ কথা ধরে নেওয়া ভুল হবে যে, সহজে নির্বাচন জয়ের জন্যই শুধু দলটি স্বায়ত্তশাসন ইস্যু জইয়ে রাখতে চেয়েছিল। স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের উদাতা ও পতাকাবাহী আওয়ামী লীগ নিশ্চিত ছিল যে, ছয়-দফা ফর্মুলার রূপরেখা অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসনের কথা পাকিস্তানের পশ্চিম পাকিস্তানীপ্রধান শাসকগােষ্ঠী কল্পনাও করতে পারে না। আর সে কারণে এ বিষয়ে প্রেসিডেন্টের কোনাে ব্যবস্থাপত্র কোনাে সমাধানও নিয়ে আসবে না। উল্লেখ করার বিষয় এই যে, ষাটের নয় বরং পঞ্চাশের দশকের গােড়ার দিকেই স্বায়ত্তশাসনের ধারণার জণ গঠিত হয়েছিল। জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের
২১১
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতাই এ ব্যাপারে একমাত্র আশা-ভরসা ছিল। বস্তুত আওয়ামী লীগ সেই লক্ষ্যে ব্যাপক ও নিবিড় প্রচার ও গণসংযােগ কর্মসূচির মাধ্যমে ১৯৬৯ সাল থেকেই কাজ করে আসছিল। তবে সংখ্যাগত গরিষ্ঠতাকে যে উদ্দেশ্যে কাজে লাগানাে হবে সে উদ্দেশ্যে এই সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে উৎকর্ষগত দিক থেকেও পর্যাপ্ত হতে হবে। এ কারণে, আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনােনয়নে, বিশেষ করে, জাতীয় পরিষদের প্রার্থী মনােনয়নের বেলায় প্রচুর আলাপ-আলােচনার প্রয়ােজন হয়। ফলত দেখা যায়, আওয়ামী লীগের মনােনয়নপ্রাপ্তরা গড়ে প্রায় সবাই লক্ষ্যাভিমুখী, সুসংবদ্ধ, শিক্ষিত ও রাজনীতি-সচেতন যাদের জন্ম গ্রামে, তুলনামূলকভাবে বয়সে তরুণ। আর তাঁদের প্রায় সকলেই স্বাধীন পেশার লােক।
জাতীয় পরিষদের সাধারণ আসনগুলির জন্য ১৬২ জন মনােনীত প্রার্থীর মধ্যে পেশার বিচারে সবচেয়ে বড় অংশটি (৪৭.৫৩%) গঠিত ছিল আইনজীবীদের নিয়ে; এর পরে যথাক্রমে ব্যবসায়ী (১৯.১৩%), কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক (৬.১৭%) ও জোতদার (৭%)-দের অবস্থান। শিক্ষার দিক থেকে মনােনীত প্রার্থীদের ৮১.৪৩% ছিল কমপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট (এঁদের মধ্যে বেশ কিছু লােক স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী)। বয়সের দিক থেকে মনােনীত প্রার্থীদের ৪৭.৫৩ শতাংশের বয়স ৪০-৫০ বছর। অবশিষ্টাংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ৩২ শতাংশের মনােনীত প্রার্থীদের বয়স ছিল ৪০-এর নিচে এবং মাত্র ২০ শতাংশ পঞ্চাশাের্ধ্ব।৬৩ মনােনীত প্রার্থীদের পেশা ও শিক্ষাগত পটভূমি উপনিবেশােত্তর উদীয়মান উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলির অনুরূপ। এ ছাড়া আইন প্রণয়নমূলক পরিষদীয় কার্যাবলিতে এই প্রার্থীদের ভূমিকার তাৎপর্যের বিবেচনায় উচ্চ শিক্ষা ও আইনগত প্রশিক্ষণের প্রাধান্য থাকাই স্বাভাবিক। তাছাড়া, তকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনসমষ্টিতে বিভিন্ন বয়ঃবর্গের বণ্টন বিন্যাসের তুলনায় মনােনীত প্রার্থীদের মাঝে অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সীদের আধিপত্যের বিষয়টিও বােধগম্য।৬৪ এ ছাড়া দলের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের বিষয়টি মনােনীত প্রার্থীদের দলের সাথে একটানা দীর্ঘ নিরবচ্ছিন্ন ও পরিষ্কার রেকর্ডের ভিত্তিতেই নিশ্চিত করা সম্ভব। আর এ জন্য প্রয়ােজনীয় পূর্বশর্ত হলাে দল যখন গােড়ার দিকে গড়ার পর্যায়ে ছিল তখন। যারা দলে যােগ দিয়েছেন সেই বর্ষীয়ানদের এবং অপেক্ষাকৃত বয়সে তরুণ যাদের রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ শুরু হয়েছে এই দলের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ সংসর্গে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা।
উল্লিখিত ১৬২ জন জাতীয় পরিষদের মনােনীত প্রার্থীর প্রায় ১০০ জন সম্পর্কে সংগৃহীত পটভূমি তথ্যে তারই প্রমাণ পাওয়া যায়।।
এই ১০০ জন আওয়ামী লীগ মনােনীত প্রার্থীর পটভূমি সমীক্ষায় দেখা যায় যে, এদের ৮৪ জনের জন্ম গ্রামে, ৬ জনের শহরে এবং যে সব জেলা থেকে তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সেই সব জেলাতেই এ সব গ্রাম ও শহর অবস্থিত। একজনের জন্ম নগরে (কলকাতায়)। অবশ্য এই মনােনীত প্রার্থীদের ৬১ জনের যেহেতু স্নাতকোত্তর শিক্ষাগত যােগ্যতা৬৫ ছিল তাদের পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পরের বছরগুলি পড়াশােনায় কেটেছে নগর। এলাকায়, ঢাকায়, কয়েকজনের রাজশাহী ও চট্টগ্রামে।৬৬
২১২
সমীক্ষাধীন এই ১০০ জনের মধ্যে ৩৫ জন তাদের ছাত্রজীবনে কিংবা আওয়ামী লীগে যােগদানের আগে কোনাে না কোনাে ছাত্র বা যুব সংগঠনের সদস্য ছিলেন।
বয়সভিত্তিতে উল্লিখিত ৩৫ জনের মধ্যে ১৮ জনের বয়স ছিল ৪০ বছরের নিচে। এদের ১২ জন ১৯৬০ সালের পর (বাস্তবিকপক্ষে ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের পর) এবং তিনজন ১৯৫০-এর দশকে আওয়ামী লীগে যােগ দেন। দু’জন সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়নি। ১৭ জন মনােনীত প্রার্থীর সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৩ জনের বয়স ছিল চল্লিশাের্ধ্ব (৫৫ বছরের কম)। এঁরা ১৯৫০-এর দশকে আওয়ামী লীগে যােগ দিয়েছিলেন এবং তিনজন ষাটের দশকে। একজনের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যায়নি।
পেশার দিকে থেকে ১৭ জন মনােনীত প্রার্থী ছিলেন আইনজীবী ও তাঁদের কর্মস্থল ছিল ঢাকা জেলার মধ্যে কিংবা ঢাকায়। দু’জন ছিলেন কৃষিজীবী-ব্যবসায়ী। দুইজন বিশ্ববিদ্যালয় ও দু’জন কলেজ শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত কিংবা সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগত পাঁচজন তখনাে কোনাে পেশার সাথে যুক্ত হননি। আর আটজন মনােনীত প্রার্থীর পেশা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়নি।৬৭
উল্লিখিত ৩৫ জন মনােনীত প্রার্থীর ২৪ জন ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ সদস্য (অর্থাৎ ছাত্রজীবনে তারা কেবল ছাত্রলীগেই ছিলেন)।৬৮ দু’জন ছিলেন মুসলিম ছাত্রলীগে (ছাত্রলীগের পূর্বসূরি)। আর এদের মধ্যে মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন, যুবলীগ ও নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন থেকেও একজন করে মােট তিনজন। একজন মুসলিম ছাত্রলীগ ও ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন। দু’জন মুসলিম ছাত্রলীগ ও যুবলীগের, একজন মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন ও যুবলীগের, একজন ছাত্র ইউনিয়ন ও যুবলীগের সদস্য ছিলেন। আর একজন আওয়ামী লীগে আসেন মুসলিম ছাত্রলীগ, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন হয়ে।
ছাত্রলীগের এই ২৪ জন ছাত্রলীগ সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে কর্মকর্তা ছিলেন। এদের ১৬ জন কমপক্ষে একটি নিম্নস্তর থেকে আরেকটি স্তরে গিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিস্তারিত তথ্যে দেখা যায়, এদের ১৫ জন প্রাদেশিক উচ্চস্তরের কর্মকর্তা। তাদের এই অবস্থান সর্বশীর্ষস্থানীয় কেননা ছাত্রলীগের জাতীয় (পাকিস্তান) পর্যায়ের কোনাে সংগঠন। তখন ছিল না। এই ১৫ জনের দুইজন জেলা পর্যায়ে কলেজ থেকে আসেন, তিনজন মহকুমা ও জেলা পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, আর সাতজন আসেন সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দু’জন মহকুমা থেকে জেলা হয়ে সরাসরি আসেন। এদের চারজন মহকুমা থেকে জেলা পর্যায়ে উন্নীত হন। একজন জেলা পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নীত হন। আর দু’জন, একজন ও একজন যথাক্রমে কেবল জেলা, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ স্তরে ছাত্রলীগ সংগঠনে কাজ করেন।
আওয়ামী লীগের সাবেক ২৪ জন ছাত্রলীগারের ১৩ জন দলীয় সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে কর্মকর্তার দায়িত্বও পালন করেন।৬৯ তাদের পেশা বা কর্মজীবন পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, এই ১৩ জনের চারজন জাতীয় পর্যায়ে পদাধিকারী ছিলেন। এঁদের একজন মহকুমা থেকে জেলা, জেলা থেকে প্রাদেশিক পর্যায়ে এবং তিনজন জেলা থেকে প্রাদেশিক
২১৩
পর্যায়ে উঠে আসেন। দু’জন থানা স্তর থেকে মহকুমা স্তরে এবং একজন মহকুমা স্তর থেকে জেলা স্তরে উন্নীত হন। এ ছাড়া একজন, চারজন ও একজন যারা যথাক্রমে নগর, জেলা ও প্রাদেশিক স্তরের পদে আসীন ছিলেন।
এগারােজন মনােনীত প্রার্থী যাদের প্রায় কেউই কেবল সাবেক ছাত্রলীগারই ছিলেন না তারা আওয়ামী লীগে বিভিন্ন পদে দায়িত্বও পালন করেন। এদের একজন করে নগর, জেলা ও প্রাদেশিক স্তরে ছিলেন। জেলা স্তরের একজন উঠে এসেছিলেন মহকুমা স্তর থেকে। এঁদের তিনজন ছিলেন জাতীয় স্তরে, তারা এ অবস্থানে উন্নীত হন জেলা থেকে প্রাদেশিক স্তর হয়ে। এঁদের প্রায় সকলেই তাঁদের নিজ নিজ ছাত্র/যুব সংগঠনে পদাধিকারী ছিলেন।
আওয়ামী লীগের সরাসরি সদস্য হিসেবে গৃহীত ৬৫ জন মনােনীত প্রার্থীর বেলায় দেখা যায়, এদের অনেকে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার আগে বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল মুসলিম লীগের ছাত্র শাখায় ছিলেন ও তারা পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনজন মনােনীত প্রার্থী ইতঃপূর্বে যথাক্রমে কেএসপি, ন্যাপ (ওয়ালী) ও ন্যাপ (ভাসানী)-তে ছিলেন। বয়সওয়ারি দেখা যায়, মনােনীত প্রার্থীদের ৫১ জনের বয়স ছিল চল্লিশাের্ধ্ব। এদের ২০ জন ১৯৫০ সালের আগে, ৮ জন ১৯৫০-এর দশকের গােড়ার দিকে, ১০ জন শেষের দিকে, ছয়জন ১৯৬০-এর দশকে ও একজন ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগে যােগ দেন। ছয়জন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ সম্ভব হয়নি। চল্লিশ অনূর্ধ্ব ১৪ জনের দু’জন ১৯৫০-এর দশকে, ৩ জন ১৯৬০-এর দশকে ও দু’জন ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগে আসেন। সাতজন সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়নি।
তাঁরা যে দলের নিষ্ক্রিয় সদস্য ছিলেন না তা দলীয় সংগঠনের ভেতরে তাঁদের সচলতার রেকর্ড থেকে বেশ পরিষ্কার। ১৯৭০ সালে এঁদের সাতজন ছিলেন জাতীয় পর্যায়ের কর্মকর্তা। এ সাতজনের চারজন আগে ছিলেন জেলা ও প্রাদেশিক স্তরে, দু’জন। প্রাদেশিক স্তরে ও একজন জেলা স্তরে। তিনজন ছিলেন প্রাদেশিক স্তরে যাদের দু’জন আগে ছিলেন জেলা ও একজন মহকুমা স্তরে। জেলা স্তরে ছিলেন নয়জন। তাদের আটজন আসেন মহকুমা স্তর থেকে আর একজন থানা স্তর থেকে মহকুমা স্তরে উন্নীত হয়ে। একজন তখনাে মহকুমা স্তরে। তিনি এর আগে থানা স্তরে ছিলেন। এই বিশজন। ছাড়া ছয়জন ছিলেন প্রাদেশিক, ছয়জন জেলা, চারজন মহকুমা ও পাঁচজন থানা পর্যায়ের কর্মকর্তা। এখানে আলােচিত মনােনীত শত প্রার্থীর ২৪ জনের (১৯৭০ বা আরাে আগে) দলীয় পদ ঠিক কী ছিল তা নির্ণয় করা যায়নি। তবে এই কয়েকজনের মধ্যে রয়েছে ১২ জনের মতাে মনােনীত প্রার্থী যাদের আওয়ামী লীগের সাথে দৃষ্টত দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল
আর সে কারণে সঙ্গতভাবেই সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকাগুলির অন্যান্য অভিলাষীরা। এ বিষয়ে প্রশ্ন তােলেন। এ সব “নবাগতদের তথ্যাদি পর্যবেক্ষণে তাদের মনােনয়নের। কারণ স্পষ্ট হয়ে যায়। একজন প্রথমে এক স্বতন্ত্র গ্রুপের নেতা ও পরে ১৯৬৫ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরােধীদলীয় নেতা ছিলেন। ছিলেন দু’জন
২১৪
বিশিষ্ট তরুণ ব্যারিস্টার যারা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামীপক্ষের কৌঁসুলি দলের বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন এবং এ দু’জনই গােলটেবিল সম্মেলনে বাংলাদেশ দলেরও অংশ ছিলেন। একজন ছিলেন প্রবীণ আইনজীবী যিনি ঢাকা হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্ট উভয়েরই বিশিষ্ট সদস্যও বটে। একজন তরুণ মনােনীত প্রার্থী ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাক-এর চীফ রিপাের্টার যিনি এই দলীয় মনােনয়ন পাওয়ার আগে ১৯৬৯ পর্যন্ত ইত্তেফাকে ঐ পদে ছিলেন। ট্রেড ইউনিয়নের দু’জন বিশিষ্ট নেতাও ছিলেন মনােনীত প্রার্থীদের মধ্যে। এঁদের একজন ছিলেন জাতীয় শ্রমিক লীগের সম্পাদক। কয়েকজন কলেজ অধ্যক্ষও আওয়ামী লীগের মনােনয়ন লাভ করেন। তাদের এলাকায় গঠনমূলক কাজের জন্য তারা সুনাম অর্জন করেন। আরাে দু’জন সাংবাদিক মনােনয়ন লাভ করেন। এরা হলেন: চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত এক প্রগতিশীল পত্রিকা দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এবং ভাসানী ন্যাপের সাবেক সদস্য ও একই দলের সাপ্তাহিক পত্রিকা জনতার সাবেক সম্পাদক।
কোনাে কোনাে মহল থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনােনয়ন খেয়ালখুশিমাফিক ও অযৌক্তিক বলে যে অভিযােগ করা হয় তা দৃষ্টত এই বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে যে, আওয়ামী লীগের কিছু মনােনীত প্রার্থী দৃষ্টত উল্লিখিত কোনাে শ্রেণীতেই পড়ে না। হামিদুল হক চৌধুরীর পত্রিকা দৈনিক পূর্বদেশ এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযােগের ভিত্তিতে এই মর্মে রিপাের্ট প্রকাশ করে যে, খন্দকার মােশতাক আহমদের কয়েকজন বাছাই করা ব্যক্তিকে মনােনয়ন দেওয়া হয়নি। অবশ্য ১৯৭৬ সালে খােদ খন্দকার মােশতাক আহমদ ১৯৭০ সালের দলীয় মনােনয়ন সম্পর্কিত কথাবার্তায় এর উল্লেখ করেননি। তিনি বরং বলেন যে, মনােনয়ন দানের। নীতিমালা যেমন দলীয় আনুগত্য, বলিষ্ঠতা, সততা, সেবা রেকর্ড, প্রার্থীর গুণাবলি সাধারণত মেনে চলা হয়েছিল তবে কতিপয় ক্ষেত্রে, যেমন, ড. কামাল হােসেনের মতাে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করা হয়।৭০
তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনােনয়নের আবেদন অনুমােদনের বেলায় সর্বাত্মক বস্তুনিষ্ঠতা অনুসৃত হয়ে থাক বা না থাক যারা মনােনীত হন তাদের বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নে দেখা যায় যে, মনােনীতদের সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিলেন দলের নির্ধারিত মানের নিরিখে বৈধ মনােনয়ন উপযুক্ত। আর তারা তীব্র বাধার মুখেও ছয়-দফার ভিত্তিতে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের এক সর্বাত্মক প্রয়াস তথা মিশন বাস্তবায়িত করার জন্য ছিলেন এক সুগঠিত ও সুসংবদ্ধ গ্রুপ। অন্ততপক্ষে তীব্র প্রচারাভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে জনমনে জাগ্রত প্রত্যাশাটি ছিল ঠিক তাই।
প্রাদেশিক পরিষদের জন্য আওয়ামী লীগ মনােনীত প্রার্থীদের ওপর এক নজর বুলিয়ে নিলে কমবেশি একই ধারা লক্ষ্য করা যাবে। অবশ্য অনিবার্য কারণেই এই সমাবেশটিকে অনেকটা জৌলুসহীন মনে হয়। কিন্তু তারপরেও এই সমাবেশের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, মনসুর আলী, ডা. আসহাবুল হক, শামসুল হক, ময়েজুদ্দিন, ফণীভূষণ মজুমদার, মােহাম্মদ হাবিবুর। রহমান, কম্যান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী, নজরুল হক প্রমুখের মতাে সুপরিচিত প্রাদেশিক ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ; ছিলেন সরদার আমজাদ হােসেন, আব্দুর রউফ চৌধুরী, মােহাম্মদ শফিউল্লাহ,
২১৫
রাশেদ মােশাররফ, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, আব্দুর রাজ্জাকের মতাে ছাত্রলীগ নেতা এবং ছিলেন আইয়ুবী নিপীড়নের শিকার ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সার্জেন্ট ফজলুল হক যাকে “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে ঢাকা সেনানিবাসে। সার্জেন্ট জহুরুল হকের পাশাপাশি গুলিবিদ্ধ করা হয়।
এ কথা সকল মহলে স্বীকৃত যে ১৯৭০ সালের নির্বাচনী অভিযান ছিল মাত্র এক ব্যক্তির প্রদর্শনী বিশেষ। ১৯৪৫-৪৬ সালে ভারতের মুসলমানদেরকে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ এমনকি যদি ল্যাম্পপােস্টকেও মনােনয়ন দিয়ে থাকে তাকে ভােট দেওয়ার জন্য বলা হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানীদেরকে আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকায় ভােট দিতে বলা হয়। আগের বেলায় এ নির্দেশ আসে কায়েদ-ই-আযমের কাছ থেকে। পরের বেলায় এ নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু।৭১ শেখ মুজিবের নিজের একটা আবেদন তাে ছিলই, সবচেয়ে ফলদায়ক নির্বাচনী প্রচার মাধ্যম ছিল একটি পােস্টার যার শিরােনাম ছিল: “সােনার বাংলা শ্মশান হইল কেন?”৭২ অবশ্য কতিপয় মহল আওয়ামী লীগের কার্যকারিতাকে তেমন আমল দেয়নি। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, রাজশাহীর একজন “ধনী” ও “প্রভাবশালী” কনভেনশন মুসলিম লীগ প্রার্থীর বিশ্বাস ছিল যদি তিন মুসলিম লীগ ও জামায়াত-ই-ইসলামীর মতাে ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি তাঁকে সমর্থন দেয় তাহলে আওয়ামী লীগ, পিডিপি, ন্যাপ (ওয়ালী) ও ন্যাপ (ভাসানী)-র মধ্যে বিরােধীদলীয় ভােট ভাগাভাগির ফাকে তিনি সুনিশ্চিতভাবেই নির্বাচনে জয়ী হবেন। ঐ একই জেলায় নির্বাচনী প্রচারাভিযান চলাকালে এমনকি অনেকের এ ধারণাও জন্মে যে, শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তায় ভাটার টান পড়েছে কেননা তিনি সব গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে একত্রিত করার মতাে দূরদর্শিতা দেখাতে পারেননি। আরাে মনে করা হয় যে, জয় বাংলা শ্লোগান খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। ওয়ালী ন্যাপের অন্যতম জনপ্রিয় নেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী এ কথা বলেন বলে উল্লেখ করা হয় যে, জয় বাংলা শ্লোগানের মাধ্যমে লাখাে নির্যাতিত মানুষের অধিকার বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে না।৭৩ রাজশাহীকে ওয়ালী ন্যাপের তুলনামূলকভাবে শক্ত ঘাঁটি মনে করা হতাে। ওয়ালী ন্যাপ এই জেলা থেকে জেলার মােট নয়টি জাতীয় পরিষদ আসনের মধ্যে ছয়টিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এ জেলায় ওয়ালী ন্যাপের জেলাওয়ারি প্রতিদ্বন্দ্বিতার শতকরা হার (৬৬) গােটা প্রদেশে সর্বোচ্চ ছিল। কিন্তু কার্যত দেখা যায়। রাজশাহী জেলায় জেলার মােট নির্বাচন প্রার্থীর (৫০) ১৮ শতাংশ তথা নয়জন ছিলেন। আওয়ামী লীগের। কিন্তু তারা জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে এই জেলায় প্রদত্ত মােট বৈধ ভােটের শতকরা ৭৪.৫৯টি ভােট পেয়েছে। আর ৩৭ জন প্রার্থীর (৭৪ শতাংশ) জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।৭৪
অবশ্য সকল জল্পনা-কল্পনা, বিশেষ করে কিছু নির্বাচন জরিপভিত্তিক ধারণাগুলি ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়নি। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, রংপুর ও নােয়াখালীতে নির্বাচনের আগে একটি টিম জনমত জরিপ করে। এ জরিপ থেকে যে ধারণা দেওয়া হয় পরবর্তীকালে নির্বাচনী ফলাফলে তার সত্যতা প্রমাণিত হয়। এই টিমের ধারণা অনুযায়ী—যদিও প্রদেশের
২১৬
উত্তরাঞ্চলে রংপুর জেলাতেই ছিল সর্বাধিক সংখ্যক নির্বাচক ও এ জেলাতেই ছিল জমি মালিকানায় সর্বাধিক বিষম বণ্টন আর তদবধি তাদের বেশি আগ্রহ ছিল স্থানীয় ইস্যুতে যাতে আধিপত্য ছিল জোতদারের মতাে স্থানীয় প্রভাবশালীদের—এহেন জেলাও বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঢলমুক্ত থাকতে পারেনি আর শেখ মুজিবের চারপাশে আকর্ষিত হয় নজিরবিহীন, উন্মাতাল বিপুল জনতা।৭৫ রংপুরে ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনী ফল ছিল আওয়ামী লীগ কর্তৃক জেলার মােট বৈধ ভােটের ৭০.৩৭ শতাংশ লাভ।৭৬
নােয়াখালী জেলায় প্রাকনির্বাচন জরিপ দলের ধারণা ছিল, নােয়াখালী জেলা জামাতীদের। আখড়া” বলে জনশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও দৃষ্টত সমর্থনের জোয়ার-উচ্ছ্বাস আওয়ামী লীগের অনুকূলেই চলেছে। তাদের মনে হয়েছিল নােয়াখালী জামাতীদের চারণক্ষেত্র—এ ধারণাটি ঠিক নয় আর “চলতি সত্যতার আলােকে এর কোনাে ভিত্তি নেই।” তারা সঠিকভাবেই উল্লেখ করেছে: “নােয়াখালীবাসীদের সচলতার ঐতিহ্য রয়েছে। ফলে সেটি তাদেরকে চারধারের বিশ্ব সম্পর্কে অধিকতর সচেতন ও রাজনীতি সচেতন করেছে।” এও উল্লেখ করা হয় যে, হাতে গােনা যে ক’জন মৌলিক গণতন্ত্রী ১৯৬০-এ প্রেসিডেন্ট পদে অনুমােদনদানে আইয়ুবের বিরুদ্ধে ভােট দিয়েছিলেন তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠই নােয়াখালীর বিডি। আর নােয়াখালীর এই মৌলিক গণতন্ত্রীরাই ১৯৬৫ সালে প্রায় একাট্টা হয়েই মিস জিন্নাহকে ভােট দেয়। আর আইয়ুবশাহী আমলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বিরােধীদলীয় এমএনএ ও এমপিএ’ও আসেন এই জেলা থেকেই।৭৭ নােয়াখালী জেলায় আওয়ামী লীগ মােট ৮০.২৯ শতাংশ ভােট পায়। আওয়ামী লীগের ২৬ জন প্রতিপক্ষের ২০ জনই তাদের জামানত হারায়। জামায়াত-ই-ইসলামী জেলার আটটি আসনের পাঁচটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং ভােট পায় ৮.৫৩ শতাংশ।৭৮
উল্লিখিত দুটি জরিপের ফলাফল ধরে নেওয়া যেতে পারে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের জেলাভিত্তিক কেস সমীক্ষা। এই দুই জেলায় আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থনের বিষয়টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষকের চোখে ধরা পড়ে আর নির্বাচনের ফলে বিরাজমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সমীক্ষকদের মূল্যায়ন সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। এ কারণে মনে হয় আওয়ামী লীগে আত্মবিশ্বাসের ভালাে রকমের ভিত্তি ছিল। তারা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত জাতীয় পরিষদের ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০ আসনে জয়ী হয়। ৭৯
বহুদলীয় প্রতিযােগিতায় একটি দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােট নাও পেতে পারে। কিন্তু ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আসন জয়ে আওয়ামী লীগের অসাধারণ সাফল্য প্রাপ্ত ভােটের শতকরা হারে আরাে মজবুত হয়ে ওঠে। জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের ১৬২ জন প্রার্থী ছিল প্রদেশে ঐ সব আসনের মােট প্রার্থী সংখ্যার ২০.৭৪ শতাংশ। আর প্রদেশে জাতীয় পরিষদের আসনগুলিতে মােট যে বৈধ ভােট পড়ে তার ৭৫.১১ শতাংশ পায় এই দলের প্রার্থীরা।৮০ কোনাে রকমের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। অর্থাৎ প্রতিপক্ষের সাথে ভােটের ব্যবধান ছিল অনেক।
২১৭
আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য বিরােধী শিবিরের দলগুলিতে তীব্র মতানৈক্য ছিল। ফলত জাতীয় পরিষদের ৮২ শতাংশ আসনের প্রতিটিতে তিনের বেশি প্রার্থী এবং ৫৫ শতাংশ আসনে চারের বেশি প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।৮১ অবশ্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত সত্যও এই যে, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলেও তাতে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী সাফল্য খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতাে না।
আওয়ামী লীগের পক্ষে ভােট দিয়ে (বাতিলকৃত দুই শতাংশ ভােটের পছন্দ-অপছন্দ অজ্ঞাত থাকায় ভােটারদের তিন-চতুর্থাংশ ঘাের ধর্মবাদী ও ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদীদেরকে এবং সেই সাথে বামপন্থীদেরও প্রত্যাখ্যান করেছে। অবশ্য প্রদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে আওয়ামী লীগের নয় এমন ভােটগুলি বিলিবণ্টন বা ভাগবাটোয়ারা কেমন। তার একটা চিত্র কৌতূহলােদ্দীপক। বণ্টনের ধারাবিন্যাসে দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগের স্বকীয় আবেদন সম্ভবত সকল আঞ্চলিক ও লােকালয়গত প্রতিবন্ধকতা ছাড়িয়ে উত্তরিত হয় শুধু ব্যতিক্রম কিছু ক্ষেত্র ছাড়া। আর প্রদেশে আওয়ামী লীগ সমর্থক নয় এমন কোনাে তাৎপর্যময় এলাকাবিশেষও চিহ্নিত করা যায়নি।৮২ প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্তির পরিসর ও ব্যাপ্তি আওয়ামী লীগ সমর্থক নয় এমন শক্তিগুলির দুর্বলতা ও অন্তর্দ্বন্দ্বকে আরাে প্রকট ও নগ্ন করে তুলেছে। আনুমানিক ৬৬ শতাংশ প্রার্থী তাদের জামানত খুইয়েছেন। জামানত সবচেয়ে বেশি বাজেয়াপ্ত হয়েছে পিএমএল (কাইয়ুম)-এর, তারপরেই কাছাকাছি রয়েছে পিএমএল (কনভেনশন) ও প্রগ্রেসিভ ন্যাশনাল লীগ (পিএনএল)। যে সব দল জামানত হারিয়েছেন তাদের মধ্যে সবেচেয় কম ক্ষতিগ্রস্ত দল হলাে জামায়াতই-ইসলামী।৮৩ বিষয়টি অধিকতর তাৎপর্যের দাবিদার কেননা, দলীয় জামানত হারানাের হার পশ্চিম পাকিস্তানে—এ দলটির একান্ত ভুবন পাঞ্জাবে অনেক বেশি। পাঞ্জাবে জামায়তই-ইসলামী ৭৯.৪৫ শতাংশ আসনে জামানত হারায়। সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে জামানত হারানাের এই শতকরা হার যথাক্রমে ছিল ৫২.৬৩, ১০০ ও ৮০ শতাংশ।৮৪ তবে পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াত-ই-ইসলামীর প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভােটের শতাংশ হারের বণ্টন থেকে পরিষ্কার বােঝা যায় যে, কোনাে কোনাে পকেট এলাকায় জামায়াতই-ইসলামীর কিছু কট্টর সমর্থক সমাবেশ ছিল। সেখানে তারা অন্যান্য ডানপন্থী কিংবা রক্ষণশীল দলের অনিশ্চিত সমর্থক ঘাঁটি বা বুনিয়াদের তুলনায় আওয়ামী লীগের প্রবল চাপের মােকাবেলায় সমর্থ হলেও প্রদেশে তাদের সামগ্রিক নির্বাচনী মদদের শক্তি খুবই সীমিত। তারা মােট ভােটের যে শতাংশ (৬.০৭%) পেতে সক্ষম হয়েছে বলে দেখা গেছে। তাতেই তা প্রমাণিত হয়েছে।৮৫
জামানত হারানাের আলােকে পূর্ব পাকিস্তানে অন্যান্য আওয়ামী লীগ বিরােধী দলের তুলনায় জামায়াত-ই-ইসলামীর ভালাে অবস্থার বিবেচনায় পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলায়। এই দলের প্রার্থী বণ্টনের ধারাবিন্যাস লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, পশ্চিমের জেলাগুলিতে উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলির তুলনায় জামায়াতের তুলনামূলক বেশি সমর্থকের সমাবেশ রয়েছে।৮৬ যে সব জেলা থেকে জামায়াত ৭০ শতাংশেরও
২১৮
বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম ছিল সে জেলাগুলি হলাে: দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা ও কুষ্টিয়া।”৮৭ যে জেলাগুলিতে জামায়াতের ২০ জন প্রার্থী ২০ শতাংশেরও বেশি ভােট পায়। সেই জেলাগুলি হলাে: রংপুর, বগুড়া, পাবনা, রাজশাহী, যশাের ও খুলনা।৮৮
পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনী ফল পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনী ফলেও পরিষ্কার প্রতিফলিত হয়। আর সেই সুবাদে আওয়ামী লীগের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সমর্থনের বিষয়টিও পুনঃপ্রমাণিত হয়। যদিও আওয়ামী লীগ বহির্ভূত দলগুলি প্রাদেশিক পরিষদের জন্য অপেক্ষাকৃত অধিক হারে প্রার্থী মনােনয়ন করে তথাপি তাদের নির্বাচনী ফলাফল ছিল হতাশাব্যঞ্জক।৮৯
জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে আওয়ামী লীগ স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রে সরকার গঠনের অধিকার অর্জন করে। অবশ্য, জাতীয় পরিষদে এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন ছিল একান্তই আঞ্চলিক কেননা, এ দল পশ্চিম পাকিস্তানে এমনকি একটি আসনও পায়নি যদিও আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে নামেমাত্র হলেও আটটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। এটি আবারও আওয়ামী লীগের একান্তই আঞ্চলিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে প্রকাশ করেছে। এ ছাড়াও, পূর্বাঞ্চলের কোনাে বিশিষ্ট আওয়ামী লীগারই, এমনকি, প্রতীকী অভিব্যক্তি হিসেবেও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। এতে কেবল পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের আদৌ আস্থাযােগ্যতা নেই— কেবল এ কথাই প্রমাণিত হয়নি বরং এ ধরনের প্রয়াস নিষ্ফল হবে বলে আওয়ামী লীগের যে পূর্বাহেই জানা ছিল সে কথাও প্রকাশ পেয়েছে। এদিকে, পূর্ব পাকিস্তানে পিপিপির পরিপূর্ণ অনুপস্থিতি এ সবের সাথে যােগ হওয়ায় এ বিষয়টিই প্রতিফলিত হয়েছে যে, পাকিস্তানী জনসমাজে সংহতি বিধায়ক রাজনৈতিক শক্তির অস্তিত্ব ছিল না। ফলে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যবস্থা তার স্বকীয় স্ববিরােধিতারই শিকার হয়েছে।
ইতঃপূর্বে বলা হয়েছে, জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ সর্বাত্মক ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে—এটি শাসকগােষ্ঠী কল্পনা করতে পারেননি। আর তার ফলে একটা অচলাবস্থা দেখা দেয়। আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে তার ছয়-দফা কর্মসূচির জন্য গণভােট রায় হিসেবে কাজে লাগায়। এ দল বারংবার ঘােষণা করেছে যে, এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের পক্ষে জনগণের অনুকূল রায় পাওয়ার পরেও যদি নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় তা বাস্তবায়নের পথ রুদ্ধ হয়, তাহলে জনগণ নিয়মবহির্ভূত পন্থায় এই সংঘাতের বা বিরােধের নিরসন করবে। নির্বাচনের পর পেছনে ফেরার পথও ছিল না। বাস্তবিকপক্ষেও, “আওয়ামী লীগ জনগণের পক্ষ থেকে যে বিপুল ম্যান্ডেট পায় সেই সমর্থনই দলের ছয়-দফা কর্মসূচিকে পূর্ব বাংলার ন্যূনতম দাবি করে তােলে যা নিয়ে কোনাে আপােসরফার বা দরকষাকষির অবকাশ নেই।”৯০
আওয়ামী লীগের এই অবস্থান ছিল মি. জিন্নাহর সেই বিখ্যাত ঘােষণার অনুরূপ যে ঘােষণায় তিনি বলেছিলেন, (অবিভক্ত) ভারতের মুসলমানরা যদি নিজেদেরকে জাতি’ ভাবে ও সংখ্যালঘু মনে না করে তাহলে তাদের উচিত হবে তাদের নিজেদের জন্য এক
২১৯
স্বদেশভূমি হাসিলে যে কোনাে আত্মত্যাগের জন্য তৈরি থাকা। পরবর্তীকালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ পাকিস্তান ইস্যুকে ভিত্তি করে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে লড়ে।৯১ আর এই নির্বাচনে মুসলিম লীগ জেতার ফলে শুধু সকল বিরােধিতাই স্তব্ধ হয়নি বরং মুসলিম লীগ “প্রত্যক্ষ সংগ্রামের প্রস্তাব গ্রহণ করে (অবিভক্ত ভারতের) মুসলমান জনসাধারণের মেজাজের শরিক হয়। একইভাবে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিজস্ব শৈলীতে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগকেও পূর্ব পাকিস্তানীদের রায় মেনে চলতে হয়। এ থেকে তার কোনাে বিচ্যুতিতে প্রদেশের জনগণ তাদের আস্থা প্রত্যাহার করতে পারতাে। উল্লেখযােগ্য যে, ঐ সময় পূর্ব পাকিস্তানকে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ বলেই উল্লেখ করতাে।
২২০
দশম অধ্যায়
পরােক্ষ প্রতিরােধ
শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর যদি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করা হতাে যে পাকিস্তানের জন্য একটা অর্থবহ যুগের সূচনা হয়েছে তাহলে অবস্থা খুবই আশাব্যঞ্জক হতে পারতাে। কিন্তু অনেকেই এ ধরনের আশাবাদে অংশীদার হতে পারেনি। নির্বাচনের ফল কোনাে বড় রকমের স্বস্তি নিয়ে আসেনি। বরং এটি বিভিন্ন গােষ্ঠীর মাঝে বিভিন্ন কারণে, বিভিন্ন মাত্রায় অস্বস্তিকর প্রভাব ফেলে। অবশ্য এর সাধারণ কারণটি ছিল নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাফল্য।
পাকিস্তানের তৎকালীন ক্ষমতার কাঠামােটি—যা সামরিক বাহিনী, আমলাতন্ত্র এবং ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও সামন্ত অভিজাতদের সমন্বয়ে গঠিত, যাকে যথার্থই “ত্রিশূল”১ তথা ত্রয়ী শক্তি বলে অভিহিত করা হয়েছে—সেই শাসকগােষ্ঠী একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল জাতীয় পরিষদে আসায় প্রথমবারের মতাে সত্যিকারের সমস্যায় পড়ে, কেননা পাকিস্তানী সমাজের ঐ অংশগুলির সাথে এই রাজনৈতিক দলের কোনাে তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না। এ রকম সঙ্কট আগেও হতে পারতাে তবে পাকিস্তানী শাসকরা বিগত দু’দশক ধরে ঐ সম্ভাব্য সঙ্কট নিপুণ কৌশলে এড়িয়ে এসেছে। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিতে ক্ষমতার ঐ ত্রয়ী শক্তি” (প্রায়) রীতিমতাে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।
সাবেকী ধরনের প্রবীণ রাজনীতিকরা হতাশাব্যঞ্জকভাবে রাজনীতির রণক্ষেত্রে পরাজয় বরণ করেন। তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টো ও পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবের অভ্যুদয়ে নিজেদের অস্তিত্ব হারান।
ভুট্টো দৃষ্টত পশ্চিমাঞ্চলের পক্ষে কথা বলার অধিকার জয় করেছিলেন। অন্তত গােড়ার দিকে হলেও তার আশঙ্কা ছিল যদি শাসকচক্র আওয়ামী লীগের সাথে কোনাে রকম রফা করে তাহলে তাতে তার স্বার্থ ক্ষুন্ন হতে পারে। আর যদি তা হয়ই তাহলে তার দলের তাে বটেই, আরাে শঙ্কার কথা, তাঁর নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও বিপন্ন হবে। নির্বাচনে শিকার হওয়া পক্ষগুলির মধ্যে এক ধরনের সমঝােতা তাই অনিবার্য ছিল। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানে এ ধরনের সম্ভাবনাটি অদৃষ্টপূর্ব ছিল না।২
২২১
আওয়ামী লীগ ও দলের ছাত্র অনুসারীরা নির্বাচনােত্তর ঘটনার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে কখনই খুব আশাবাদী ছিলেন না। নির্বাচনের পরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মতাে বিপুল সাফল্য সত্ত্বেও দলনেতারা সন্দিহান ছিলেন। আর তারা জনসাধারণের কাছে এ কথা গােপন রাখেননি। এই জনগণ ছিল, বলাবাহুল্য, তাদের নব প্রতিষ্ঠিত আনুষ্ঠানিক বৈধতার উৎস যার বলে তারা প্রদেশের (যদিও তা টেকনিক্যাল দিক থেকে পাকিস্তানের বৃহত্তর অংশকেই বােঝায়) পক্ষে কথা বলতে সক্ষম হলেন। পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণকে এই বলে সতর্ক করে দেওয়া হয়। যে, যদিও নির্বাচনের ফল “বাংলাদেশ”-এর নির্যাতিত মানুষের জয় সূচিত করেছে, লক্ষ্য এখনাে অর্জিত হয়নি। এ কারণে ছয়-দফা বাস্তবায়নের আন্দোলন চলতে থাকবে।৩
আগামীতে কী হবে না হবে—এ নিয়ে সন্দেহ-সংশয়ের বীজ পাকিস্তানের রাজনৈতিক অতীতেই নিহিত ছিল। প্রথমত, এ সন্দেহ-সংশয় জোরদার হয় এলএফও’তে সন্নিবেশিত কতিপয় বিধানের কারণে; দ্বিতীয়ত, পরে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বারংবার অঙ্গীকার ব্যক্ত করার সময় তার কিছু মন্তব্যের কারণে। এ রকম একটি মন্তব্য ছিল, যে কোনাে দল এলএফও মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানালে ধরে নেওয়া হবে সেই দল কখনাে নির্বাচনে৪ অংশগ্রহণ করেনি। এ মন্তব্যে জল্পনা-কল্পনার ঢেউ বয়ে যায়। অনেক পর্যবেক্ষক, প্রেসিডেন্ট আগে যা বলেছিলেন আর। এখন যা বলছেন তার মধ্যে তারতম্য লক্ষ্য করেন। তার আগের প্রস্তাবাবলি ও এলএফও’তে বলা ছিল যে, এলএফও কাঠামাের মধ্যে ও নির্ধারিত সময়ে শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নে। ব্যর্থ হলে জাতীয় পরিষদ আপনাআপনি বাতিল হয়ে যাবে ও সামরিক শাসন চলতে থাকবে। কিন্তু তার পরের মন্তব্য সম্পর্কে (পূর্ব পাকিস্তানে) সাধারণ ব্যাখ্যা এভাবে করা হয় যে, তিনি এক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন যা অশুভ ইঙ্গিতবাহক। কেননা, তার এ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এলএফওপন্থী পরিষদ সদস্যদের নিয়ে জাতীয় পরিষদ চলতে থাকবে আর সম্ভবত এই ব্যবস্থার আওতায় উপনির্বাচনের মাধ্যমে এলএফও বিরােধীদের বাদ দেওয়া হবে। তারপর খয়ের খা এমএনএদের সাহায্যে তাঁর পছন্দমাফিক একটি শাসনতন্ত্র তৈরি করে এ সব সদস্যের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য সামরিক আইন তুলে নেওয়া হবে। পূর্ব পাকিস্তানীদের এই আশঙ্কার কথা গােপন ছিল না।৫ এই অস্বস্তিতে আরাে যুক্ত হয়, সরকারি আমলা মহলে ও পূর্ব পাকিস্তানের কোনাে কোনাে সরকারপন্থী। ব্যক্তিদের মাঝে বিরাজমান কিছু অভিমত। তাঁদের অভিমত ছিল এই যে, পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ সংসদীয় ব্যবস্থা কিংবা পূর্ণ প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার—কোনােটিই উপযােগী নয়। সে জন্য একটা মিশ্র পদ্ধতি বের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তুরস্কের শাসনতন্ত্রের প্রায়ই উল্লেখ চলতে থাকে।৬ তুর্কী শাসনতন্ত্রে আইন পরিষদের সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের কথা থাকলেও ইসলামাবাদের সরকার হয়তাে তুর্কী শাসনতন্ত্রের ১১১ অনুচ্ছেদের বিধানাবলি সন্নিবেশের বিষয় বিবেচনা করছিলেন। এ সব বিধানে প্রেসিডেন্ট জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির মাধ্যমে তাঁকে প্রদত্ত ক্ষমতা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীকে সরিয়ে দিতে পারেন।
২২২
পূর্ব পাকিস্তানীরা সবচেয়ে বেশি বিমূঢ় হয় এ কারণে যে, তদবধি পূর্ব পাকিস্তানের, বিশেষ করে, আওয়ামী লীগের এলএফও অগ্রাহ্য করার মনােভাব দেখেও দেখা হয়নি। আর আওয়ামী লীগ যে এলএফও’কে ধর্তব্য কোনাে বিষয় নয় বলেছে, সে কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল। এ পরিবর্তন কোন সুবাদে? সম্ভবত প্রেসিডেন্ট (যথার্থই) তাঁর আগেকার পরিকল্পনার কার্যকারিতা সম্পর্কে সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন। এলএফওনির্ধারিত একটি শাসনতন্ত্র মেনে নেওয়া অথবা সামরিক শাসন আইন চলতে থাকা—এ দুয়ের মধ্যে যে কোনাে একটি পথ বেছে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়ার মধ্যে এ অনুমান।
স্পষ্টতই ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তান কম খারাপ জিনিসটিই বেছে নেবে যেমনটি সে করেছিল ‘৫০-এর দশকের মাঝামাঝি। সে সময় আওয়ামী লীগ (প্রতিবাদসহকারে) সমতানীতি ও বহুলাংশেই অগ্রহণযােগ্য শাসনতন্ত্র মেনে নিয়েছিল এই আশায় যে, এতে সামরিক আইন জারি করা সম্ভব হবে না, একনায়কের শাসনও থাকবে না। একজন পশ্চিম পাকিস্তানী। ভাষ্যকার মনে করিয়ে দেন যে, “আমাদের পরিস্থিতি একই ধরনের, আর এ পরিস্থিতিতে একই পুরস্কার ও হুমকি রয়েছে। আর তারপর ঐ ভাষ্যকার খুবই কঠিন ও তীক্ষ্ণ প্রশ্ন। উত্থাপন করেছেন: “তারা (পূর্ব পাকিস্তানীরা) কি মূলত সেই একই রেয়াত দেবে?”৭ স্পষ্টত পূর্ব পাকিস্তানের সাথে এ ধরনের সরল দরকষাকষি আর সম্ভব ছিল না। তাই প্রেসিডেন্ট স্বায়ত্তশাসনবাদীদের জন্য পরিস্থিতি আরাে কঠিন করে তােলার প্রয়াসে তাদেরকে বললেন, হয় এলএফও মেনে নিতে (অন্যভাষ্যে, তাঁর নির্দেশ) কিংবা জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের বৈধতার বাজেয়াপ্তির জন্য তৈরি থাকতে। এ সব অনুমান করে শেখ মুজিব আগেই ঘােষণা করেছিলেন যে, দাবি না মেনে নেওয়া হলে, বাঙালিরা নিজেরাই স্বায়ত্তশাসনের বিকল্প স্থির করবে। তিনি আরাে হুঁশিয়ার করে দেন যে, ২২ বছরের পুরানাে ক্ষমতাসীনচক্রের জানা উচিত “এখন তারা আগুন নিয়ে খেলছেন।”৮ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসকও প্রেসিডেন্টকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মােকাবেলার মনােভাব সম্পর্কে অবহিত করছিলেন।”৯ মােকাবেলার মনােভাব, অবশ্য, আওয়ামী লীগ প্রধানত মনে মনেই পােষণ করছিল। প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ যা করছিল তাকে ব্যাপক ও তীব্র পরােক্ষ প্রতিরােধ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।
নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রেসিডেন্ট তাঁর বেতার/টিভি ভাষণে প্রস্তাব করেছিলেন যে, নির্বাচন অনুষ্ঠান ও জাতীয় পরিষদের প্রথম সভার মধ্যবর্তী সময়টুকু রাজনীতিকদের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার কাজে লাগানাে উচিত।১০ এ নিয়ে আরেক দফা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে যায়। ঐকমত্যের অভাব পাকিস্তানী রাজনীতির অন্যতম মৌলিক বিষয়। এই আলােকে প্রেসিডেন্ট হয় জটিলতার অবমূল্যায়ন করেছিলেন এই প্রত্যাশায় যে, স্বল্প সময়ের মেয়াদেই এগুলির নিষ্পত্তি হয়ে যাবে, নয় একটা কিছু ঘটবে। আর এ রকমটি হওয়ার সম্ভাবনাই ছিল বেশি। তিনি নির্বাচন অনুষ্ঠান ও জাতীয় পরিষদের প্রথম সভা অনুষ্ঠানের মাঝে একটা লম্বা সময়ের বিরতি বা ব্যবধানের কথা ধরে নিয়েছিলেন কিংবা কল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তিনি কেমন করে ও কেন এত আগেই এই বিলম্বের আশঙ্কা বা আশা করেছিলেন বিশেষ
২২৩
করে যখন নির্বাচন তখনাে অনুষ্ঠিত হয়নি? জাতীয় পরিষদে কোনাে একক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হবে না বলে সরকারি গােয়েন্দা বিভাগের যে সব স্বস্তিদায়ক রিপাের্ট ছিল সেগুলির বিশ্বাসযােগ্যতা সম্পর্কে কি তার সন্দেহ ছিল? তিনি কি বুঝতে পেরেছিলেন। যে, পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোনাে কোনাে কনভেনশন লীগার ও কিছু লােককে১১ টাকা ধরিয়ে দিলেও তাতে কোনাে কাজ হবে না? নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের পর পূর্ব পাকিস্তানীদের মনােভাব কঠোর হয়ে ওঠার ঘটনা তার কৌশল পরিবর্তনের জন্য আরেকটি সঙ্কেত হওয়া উচিত ছিল। কোনাে কোনাে পর্যবেক্ষকের অবশ্য সুনিশ্চিত ধারণা যে, ইয়াহিয়া গােড়ার দিকে (১৯৭০ সালের এপ্রিল-নভেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ে) মুজিবকে লম্বা ছাড় দিয়েছিলেন (মুজিবের এলএফও অগ্রাহ্য করার বিষয়টি দেখেও না দেখার আকারে)। এটি ঘটেছিল ইরানের শাহের পরামর্শে। ইরানের শাহ ১৯৭০ সালের এপ্রিলে পাকিস্তান (পূর্ব পাকিস্তানসহ) সফর করেছিলেন। এ সব সূত্রের মতে শাহ তাঁর ঐ সফরকালে দৃঢ়বিশ্বাস ব্যক্ত করেছিলেন যে, আওয়ামী লীগ পাকিস্তানকে কমিউনিজমের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। এ কথা তিনি ইয়াহিয়াকে জানিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খানও তাঁর সে পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন শাহের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে। মুজিবের ব্যাপারে পরবর্তীকালে ইয়াহিয়ার মনােভাব কঠোর হওয়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে উল্লিখিত একই পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছেন, চীন-মার্কিন সম্পর্কের বরফ ভাঙার নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রয়াসে বার্তাবাহকের ভূমিকার কারণে চীনা নেতাদের সাথে ইয়াহিয়ার নতুন ব্যক্তিগত সম্পর্কের ফল হিসেবেই তাঁর মনােভাবে এ কাঠিন্য দেখা দেয়। চীনাদের পরামর্শ ছিল এ রকম বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে যে, নির্বাচনের ফল যদি তেমনই নির্দেশ করে। তাহলে আওয়ামী লীগকে যেন কোনােক্রমেই ক্ষমতা হস্তান্তর না করা হয়।১২ আওয়ামী লীগ আধিপত্যাধীন পাকিস্তানের ব্যাপারে চীনের অপছন্দ-সংশয়, বিশেষ করে, উল্লিখিত পর্যবেক্ষণ সঠিক হয়ে থাকলে বােধগম্য বটে। তথাকথিত বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের (মস্কোপন্থী পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির সম্মুখ সংগঠন সমর্থিত) প্রতি চীনা বিতৃষ্ণা স্বাভাবিক ব্যাপারই হতে পারতাে। “সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে ক্রম উত্তরণের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের বারংবার অঙ্গীকারে চীনারা হয়তাে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী” সােভিয়েত ইউনিয়নের কোনাে ক্রীড়নককে সন্দর্শন করে থাকবে আওয়ামী লীগ শাসিত পাকিস্তানে। অনুরূপভাবে, বেশি কিছু না হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের আওতায় অন্তত পাকিস্তান ও ভারতের সম্পর্ক অধিকতর বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা তাে ছিল। আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি করতে। পারার অধিকার। এর অর্থ যথার্থই ছিল মূল্যবান বিদেশী মুদ্রা বাঁচানাের জন্য ভারতের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নত করা। পাকিস্তানের বিদেশী মুদ্রার একটা মােটা অংশ তখন দূরদেশ থেকে পণ্য আমদানি খাতে অপচয় হচ্ছিল (আর সবচেয়ে ঘন ঘন উল্লিখিত আমদানি পণ্যটি ছিল কয়লা)। তাই স্পষ্টত ভারতের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতর বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ার অভিপ্রায়ে দুই পক্ষের মধ্যে আরাে বন্ধুসুলভ সম্পর্কের
২২৪
পূর্বাভাস ছিল আর সেই সাথে তাতে ভারত ভীতির কোনাে অন্তলীন জুজুর অনুপস্থিতিরও ইঙ্গিত ছিল। ১৯৭০ সালে চীন গণপ্রজাতন্ত্র আর যা-ই হােক কোনাে ভারত-সােভিয়েতপন্থী পাকিস্তানকে সমর্থন জানাতে পারতাে না।
কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, চীন থেকে ফেরার পথে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। খান ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তানে বেশি দিন থাকতে পারেননি (তিনি চীনে যান, চীন-মার্কিন যােগাযােগে বার্তাবাহকের ভূমিকা পালনের জন্য), কেননা ঐ সময়ে সেনাবাহিনীতে আসন্ন এক সঙ্কট ঠেকানাের জন্য রাওয়ালপিণ্ডিতে তার উপস্থিতির প্রয়ােজন ছিল। বাহ্যত কিছু শীর্ষস্থানীয় পদস্থ সেনা কর্মকর্তার পদোন্নতির দাবি নিয়েই ঐ সমস্যা দেখা দেয়। তবে তাঁর নিজের আরাে ভেতরের “চক্রে”১৩ ফেরার তাড়াটি এ জন্যেও হতে পারে যে, চীনের পরিকল্পনামাফিক একটি পরিকল্পনা ছকে ফেলাও হয়তাে জরুরি হয়ে উঠেছিল। আর সংশােধিত সিদ্ধান্তের জন্য তাঁর পরিতাপের কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। কেননা এই সিদ্ধান্তে হয়তাে সশস্ত্র বাহিনী ও অসামরিক আমলা কট্টরপন্থীদের সাথে তাঁর আগের সম্পর্কটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখানে বলা দরকার, সরকারিভাবে ক্ষমতাবান হােক বা না হােক, এই কট্টর কর্মকর্তারা স্বায়ত্তশাসন মঞ্জুর দূরের কথা বরাবরই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার গণতন্ত্রায়নের বিরােধী ছিলেন। এই কট্টরপন্থী সামরিক ও অসামরিক কর্মকর্তারাই গােলটেবিল সম্মেলন থেকে কোনাে রকমের ন্যূনতম কার্যকর ফল যাতে না পাওয়া যায়। সে জন্য এ প্রয়াসে কূটাঘাত করেন এবং আইয়ুব খানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন। কারণ, তাঁদের আশঙ্কা ছিল, আইয়ুব হয়তাে তাঁদের স্বার্থ বিকিয়ে একটা আপােসরফা’ করে কোনাে রকমে তাঁর গদিটির হেফাজত করবেন।
কারণ যা-ই হােক, ইয়াহিয়া খানের মনােভাব দৃষ্টিগােচরভাবেই বদলে যায়। আর তাতে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে তাঁর সত্যিকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানে যথেষ্ট সন্দেহ দেখা দেয়। পূর্ব পাকিস্তানে (ও পশ্চিম পাকিস্তানেও) এমন ধারণার সৃষ্টি হয় যে, যবনিকার আড়ালে একটা কিছু ঘটছে যার প্রকৃতি সম্পর্কে যদিও ব্যাপক পর্যায়ে জানা ছিল না তবু যাঁরা বাস্তবিকপক্ষে কী ঘটতে পারে তা জানতে যত্নবান ছিলেন তাঁদের বােধের অগম্য ছিল না। যারা পাকিস্তানের তৎকালীন অভ্যন্তরীণ ও বহিঃসামাজিক শক্তিগুলির ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন তাঁদের পক্ষে কী অনিবার্য সত্য তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। এ জন্য আসন্ন বিপদের প্রথম প্রকাশ্য আভাস পেতেই আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবেই শাণিত তীক্ষ্ণতা ও তীব্রতায় নিজ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। এ সময় ভুট্টো দাবি করেছিলেন যে, তাঁর দলের সহযােগিতা ও অংশীদারি ছাড়া কোনাে শাসনতন্ত্র প্রণীত হতে পারে না, কোনাে সরকারও কাজ করতে পারবে না, কেননা তাঁর দল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আইন পরিষদগুলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া ছাড়াও “ক্ষমতার কেন্দ্রীয় ঘাঁটি” পাঞ্জাব ও সিন্ধুর প্রতিনিধিত্ব করে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ উল্লেখ করেন যে, জাতীয় আইন পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগই কেবল শাসনতন্ত্র প্রণয়নে ক্ষমতাবান আর তা করতে গিয়ে অন্য দলগুলির সহযােগিতা
২২৫
নেওয়া হবে কিনা সেটি বিচার-বিবেচনা করে স্থির করার পুরাে এখতিয়ার আওয়ামী লীগের। তাজউদ্দিন আহমদ আরাে উল্লেখ করেন যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এক প্রদেশের ওপর আরেক প্রদেশের শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্ন একান্তই অবান্তর ও অনভিপ্রেত আর “ক্ষমতার দুর্গ”-এর মতাে ধারণাগুলির বাতিলকরণই ছিল বাস্তবিকপক্ষে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের যথার্থ লক্ষ্য। এ কথার পুনরুক্তি করে এ বিবৃতির ছেদ টানা হয় যে, আওয়ামী লীগ তার নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে পুরােপুরি সজাগ, দলটি তার এ দায়িত্ব পালনে প্রয়াসের ত্রুটি করবে না।১৪ এ রকম এক অর্থপূর্ণ বিবৃতি দেওয়ার সময় তাজউদ্দিন আহমদ হয়তােবা মনে রেখেছিলেন যে ভুট্টো তার ক্ষমতা সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করছেন। যে পাঞ্জাব ও সিন্ধুকে তিনি তার ক্ষমতার দুর্গ বলছেন আসলে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে তার দল ঐ প্রদেশগুলিতে যথাক্রমে ৪১.৬৬ ও ৪৪.৯৫ শতাংশ ভােট এবং গােটা পাকিস্তানে মাত্র ৩৮.৩৯ শতাংশ ভােট পেয়েছে।১৫
তাৎপর্যের বিষয়, ভুট্টো তাঁর উল্লিখিত অবস্থানের কথা ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর সেনাবাহিনী সদরদপ্তরে ইয়াহিয়া খান ও কিছু শীর্ষস্থানীয় জেনারেলদের সাথে প্রায় এক দিনব্যাপী বৈঠকের পর প্রথম প্রকাশ্যে ঘােষণা করেন। উল্লেখ্য, ১৭ ডিসেম্বর ছিল পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদগুলিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন। উৎসুক পর্যবেক্ষকরা লক্ষ্য করেন, প্রেসিডেন্ট কিংবা সেনাবাহিনীর উক্ত জেনারেলরা কেউ ঐ দিন তাদের ভােট প্রদান করতে ভােটকেন্দ্রে আসেননি। পরের অনুসন্ধানের আলােকে উল্লিখিত পর্যবেক্ষকদের এই বিশ্বাস জন্মায় যে, জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করতে একটি পরিকল্পনা তৈরিই ছিল ঐ বৈঠকের উদ্দেশ্য।১৬
পিপিপির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো লাগাতার এই দাবি করতে থাকেন। যে, পাকিস্তানের রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে তাঁর দল অপরিহার্য। তিনি সম্ভবত নিশ্চিত হয়েছিলেন যে আওয়ামী লীগের পক্ষে তার তিনটি মৌলিক অঙ্গীকার যথা: ইসলাম, সমাজতন্ত্র ও ভারতের সাথে হাজার বছরের যুদ্ধের বিষয় স্বীকার করে নেওয়া কার্যত সম্ভব হবে না। আর তাই তিনি এই অজুহাতে আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির। মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাব দেন, কেননা, অন্যথায় তিনি তাঁর সমর্থকদের যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেগুলি রক্ষা করা সম্ভব হবে না। তিনি জাতীয় সংহতি বিপর্যস্ত হবে না সেইভাবে আগে থেকে স্বায়ত্তশাসনের সীমাচৌহদ্দি চিহ্নিত করার দাবি জানান।১৭ তাঁর এ দাবির প্রচ্ছন্ন তাৎপর্য ছিল এই যে, স্বায়ত্তশাসনের সীমারেখা নির্ধারণের একমাত্র লক্ষ্য ও মাপকাঠি ছয়-দফা (যেহেতু এ ক্ষেত্রে এ যাবৎ অন্য কোনাে বিকল্প দেওয়া হয়নি) জাতীয় সংহতি বিপন্ন করবে। অবশ্য তিনি যুগপৎ এ কথাও স্বীকার করেন যে, আওয়ামী লীগ নেতারা বিচ্ছিন্নতাবাদী নন, আর শেখ মুজিব জনগণের কাছ থেকে যে অবস্থানের ম্যান্ডেট পেয়েছেন সেই অবস্থান থেকে তিনি বিচ্যুত হতে পারেন না। দৃষ্টত তিনি অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছিলেন। কিন্তু তাঁর সে সব কথাবার্তার একটা মনােনিবেশকেন্দ্র বা সারবিষয় ছিল। তাঁর এ সব ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলা কথাবার্তায় এই বাস্তবতার স্বীকৃতির
২২৬
ইঙ্গিত পাওয়া যায়, গােড়ায় দরকষাকষির জন্যই ছয়-দফা দেওয়া হলেও জনগণের দেওয়া আনুষ্ঠানিক ম্যান্ডেটের পর আওয়ামী লীগ নেতারা পছন্দ করুন বা না-ই করুন ছয়-দফা আর দরকষাকষির বস্তু নয়। তবে বাস্তবতা কবুল করা হলেও সেই পথ ধরে শােভনীয়তার সাথে সত্যতাকে গ্রহণ করা হয়নি। অপ্রশম্য ভুট্টো বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামাের শীর্ষের উৎকণ্ঠিত ত্রয়ী কর্তৃপক্ষের উত্তেজনা আরাে বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। সহজেই বােধগম্য যে, এ সব হৈ চৈমূলক কথার খৈ ফোটানাের ব্যাপারগুলি আসলে তাদের স্বার্থের (অর্থাৎ ত্রয়ী কর্তৃপক্ষ ও ভুট্টোর) অভিন্ন প্রকৃতির আভাস। এ সব নিশ্চয়ই ক্ষমতাসীনচক্রের দৃষ্টি এড়ায়নি। আর সেই সাথে তারা এও উপলব্ধি করেছিলেন যে, নির্বাচনকালে পাঞ্জাবে যে ধারায় ভােট পড়েছে তাতে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর সর্বস্তরের পরিষ্কার সমর্থনের সাক্ষ্য রয়েছে ভুট্টোর পক্ষে। এভাবে স্বার্থের এই একত্র সমাবেশ ভুট্টোর দৃঢ় অবস্থানকে আরাে জোরদার করে এবং দেশের গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়া বন্ধ করতে ইয়াহিয়া খানকে প্রয়ােজনীয় মদদ যােগায়। ক্ষমতার কায়েমি গােষ্ঠীর সাথে ভুট্টোর যােগাযােগের বিষয়টি গােপন ছিল না। বাস্তবিকপক্ষে, ১৯৬৯ সালের অক্টোবরে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার মার্শাল নূর খান এক প্রকাশ্য বিবৃতিতে বলেন যে, ভুট্টো “পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা কজা করার জন্য কোনাে কোনাে আমলার সঙ্গে চক্রান্ত করছেন।১৮
ভুট্টো এমনি করেই একদিকে যেমন ক্ষমতার ত্রয়ী কর্তৃপক্ষের তথা তখনকার ক্ষমতাসীনচক্রের কাছাকাছি দ্রুত আসতে থাকেন, আওয়ামী লীগ তেমনি তার চেয়েও সম্ভবত দ্রুত ঠিক তার বিপরীত দিক অর্থাৎ জনগণের দিকে তথা তাদের ভবিষ্যৎ (প্রতিশ্রুত)। ক্ষমতা কাঠামাের বুনিয়াদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ভুট্টোর বিরুদ্ধে আরাে বাদ-প্রতিবাদে না গিয়ে আওয়ামী লীগ (পূর্ব পাকিস্তানের) জনগণের সাথে তার সংহতি প্রকাশের এক অভিনব উপায় বেছে নেয়। তারা জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদে নির্বাচিত সকল। সদস্যের এক প্রকাশ্য শপথ অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আহূত এক জনসভায় এই শপথ অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। এ অনুষ্ঠানে নির্বাচিত সদস্যরা সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে শপথ গ্রহণ করেন যে, ছয়-দফা ও এগারাে-দফা সনদ অনুযায়ী একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নে তারা চেষ্টার কোনাে ত্রুটি করবেন না। এ ছাড়া তাঁদের বিরােধিতার কোনাে চেষ্টা হলে তাঁরা সে রকম যে কোনাে শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তােলারও অঙ্গীকার করেন। শেখ মুজিব শ্রোতাদের উদ্দেশে বলেন, তিনি নিজেসহ কোনাে আওয়ামী লীগার যদি তাঁদের শপথের সাথে বেঈমানি করে তাহলে তাদের যেন জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। তিনি শ্রোতাসাধারণকে আশ্বাস দেন, ঘােষিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হাসিলের কাজটি বিপজ্জনক হলেও প্রক্রিয়াটির সাফল্য সুনিশ্চিত। তিনি নির্বাচনের ফল নিয়ে আত্মতুষ্টির বিরুদ্ধে তাদেরকে হুঁশিয়ার করে দেন। কেননা, তাঁর মতে, “আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের কাছে দেনা হয়তাে আবারও রক্তেই পরিশােধ করতে হবে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়কে নাকচ করে দেওয়ার জন্য
২২৭
যে “চক্রান্ত করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে “আসন্ন এক সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিতে (তিনি। আগেও এই সম্ভাবনাটির কথাই বলেছিলেন) আওয়ামী লীগ কর্মীদেরকে প্রদেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে সাংগঠনিক তৎপরতা শক্তিশালী করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তিনি আরাে পরিষ্কার জানিয়ে দেন যে, “নীতি সম্পর্কিত মৌলিক বিষয়গুলি বিকিয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে কোনাে সহযােগিতার সম্ভাবনা নাকচ করা হয়েছে।”১৯
তাঁর এ ভাষণে বিষয়বস্তুর বিচারে সম্পূর্ণ নতুন বলতে কিছু ছিল না। তবে একজন ভাষ্যকার যেমন বলেছেন, “এখন জনসাধারণ তাঁর কথাবার্তা আরাে ঘনিষ্ঠ অভিনিবেশসহকারে শুনতে থাকে, কেননা তখন আর এগুলি কেবল নির্বাচনী প্রচার মনে করে উড়িয়ে দেওয়া যেত না বরং এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও ইশারাগুলি পরিশ্রুত করে বােঝার দরকার ছিল। ৭ ডিসেম্বর থেকে বক্তৃতা-ভাষণ আর হাল্কাভাবে দেওয়াও হচ্ছে না এবং সেভাবে গ্রহণ করাও যাচ্ছে না।”২০
নির্বাচিত পরিষদ সদস্যদের জনসমক্ষে শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান অনেক উদ্দেশ্যই সাধন করে। এতে সর্বাত্মক সংহতির প্রদর্শনী হয়। এতে প্রতিটি সদস্যকে জনগণের কাছে সরাসরি জবাবদিহির দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাছাড়া এতে এই জল্পনা-কল্পনারও অবসান ঘটে যে, মুজিব তার মরহুম নেতার (সােহরাওয়ার্দীর) মতাে মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ফাঁদে পা দিয়ে শেষ পর্যন্ত সেই সােহরাওয়ার্দী স্টাইলের আপােসরফাই করবেন। তাই বােধ করি এ সিদ্ধান্তে আসাটা খুব অযথার্থ হবে না যে, জনসমক্ষে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাস্তবিকপক্ষে নেতার পাঁয়তারা করার কৌশলের সীমাবদ্ধতাকেই তুলে ধরা হয়। কেননা, “এ ছিল ঐ সব শক্তি সম্পর্কে তাঁর নিজ সচেতনতারই জবানবন্দি যে সব শক্তি তাঁর নেতৃত্বকে কিংবদন্তীতুল্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। ছয়-দফাকে এখন আলােচনা বহির্ভূত ইস্যু বলে ঘােষণা করা হয়।”২১ অন্য উদ্দেশ্যটি ছিল এই যে, শাসকচক্র এবং সেই সাথে বৈরী ভুট্টো ও অন্যদেরকে এই মর্মে বুঝিয়ে দেওয়া যে কৌশল তৈরি ও তা কাজে লাগাতে গিয়ে ঐ পরিস্থিতিকে হিসেবে নেওয়া দরকার। তাদেরকে এই মর্মে আগে থেকে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানীরা এখন স্বায়ত্তশাসনের জন্য রক্ত ঢালতে তৈরি। যথার্থই অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, “টিভি ক্যামেরার সামনে যে লাখাে লােক এ প্রত্যয় ঘােষণা করছে তারা হয়তাে প্রতিরােধ সংগ্রামের নায়ক নয় তবু তারা এখন জানে, এ সংগ্রাম কিসের জন্য।” আর তাই তারা এখন সজাগ ও সঙ্কল্পে অটুট হয়েই আন্দোলনের রাজনীতির দিকে এগিয়ে যাবে আর “এটি এক গভীর চিন্তার বিষয় হতে পারে সেই সব সম্ভাব্য প্রতিবিপ্লবীদের জন্য যারা বরাবরই এ সমস্যাকে দেখে এসেছে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকে পূর্ব পাকিস্তানের কিছু শহর-নগরে আগলে রাখার ব্যাপার হিসেবে যে, যারা রেসকোর্স ময়দানে শপথ নিয়েছে ওদের অনেকেই এসেছে দেহাতি কোনাে গ্রাম বা জনপদ থেকে যা শহর থেকে বহুদূর।”২২
নির্বাচনী রায়ের ভিত্তিতে অনুমিত হুমকি থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ছয়-দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সঙ্কল্প নেয়। ছাত্রলীগের উদ্দেশে এক ভাষণে শেখ মুজিব বলেন, এমনকি
২২৮
এমএনএদেরও ফর্মুলা বদলানাের কোনাে অধিকার নেই। তিনি যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানী এমএনএদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন, অনিবার্যভাবেই তার ঐ মন্তব্যের উদ্দিষ্ট ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের এমএনএরা। এটি পরিষ্কার হয়ে ওঠে তাঁর এ কথায় যে, পশ্চিম পাকিস্তানের কেউ ফর্মুলার বিরােধিতা করলে তার ফলাফলের জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে দায়ী হবেন। একই উপলক্ষে তিনি বাঙালি সংস্কৃতির সংরক্ষণ সম্পর্কেও উল্লেখ করেন। তিনি প্রত্যয়ের সাথে বলেন, বাঙালিরা বরাবর বাঙালি হয়েই বাঁচবে। তিনি প্রসঙ্গত বিদেশী আধিপত্যের বিরুদ্ধে মুক্তি আন্দোলনের সঠিক ইতিহাসের প্রয়ােজন সম্পর্কে সবিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেন। তাঁর মতে, মুক্তি আন্দোলনের সঠিক ইতিহাসে ব্যারাকপুরের সেনানিবাসে সৈনিকরা যে আত্মত্যাগ করেছে, তিতুমীর যে সব বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন, আর চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন সে সব অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত।২৩ সহিংস রাজনৈতিক কার্যকলাপের ঘটনাগুলির এ ধরনের শ্রদ্ধামিশ্রিত উল্লেখ নিয়মতান্ত্রিক অহিংস আন্দোলনের ঘােষিত বিশ্বাসীর কাছ থেকে আসার বিষয়টির মাঝে তাঁর ঐ সব অনুসারীর জন্য কিছু তাৎপর্যময় সঙ্কেত ছিল যাদের অহিংসায় খুব একটা ভক্তি না থাকলেও তারা ঠিকই অনুগত ছিল তাঁর প্রতি। তাদের কাছে ঐ সঙ্কেতের অর্থ ছিল পরিস্থিতি যদি তেমন দাবিই করে তাহলে লক্ষ্যে পৌঁছানাের শেষ উপায় হিসেবে শেখ মুজিব সহিংসতাকেও বেছে নেবেন। বাস্তবিকপক্ষেও যেহেতু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ের সমসাময়িক সেহেতু তার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়তাে অহিংসতাকে পদ্ধতি হিসেবে বেছে নিয়েছে, বিশ্বাস হিসেবে নয়।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মতাে ওয়ালী ন্যাপ ও ভাসানী ন্যাপ উভয়ে একই আশঙ্কা করতাে। মওলানা ভাসানীর কোনাে রাখ-ঢাক ছিল না—অনভিপ্রেত আশঙ্কা নিয়ে। তিনি বলতেন, তিনি (লাহাের প্রস্তাব অনুসারে) তার রক্তের বিনিময়ে হলেও স্বায়ত্তশাসন ছিনিয়ে আনবেন। তিনি অবশ্য ব্যাখ্যায় বলেন, সশস্ত্র বিপ্লব অপরিহার্য কিছু নয় এবং বৈপ্লবিক পরিবর্তন বলিষ্ঠ জনমতের মাধ্যমেও অর্জন করা সম্ভব। আতাউর রহমানও স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।২৪
একটা ধারণার সৃষ্টিই হয়েছিল এই বলে যে, ভাসানী দায়িত্বহীন লাগামছাড়া কথাবার্তা বলে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরকে কেবল বিলম্বিতই করছেন না বরং তা বিপন্নও করছেন। তবে এর চেয়েও কিছুটা নরমপন্থী মত পরের দিকে এই বলে প্রচারিত হয় যে, তিনি আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এ বাস্তবতাকে যদি বিবেচনায় নেওয়া হয় যে, ছয়-দফা বাস্তবায়িত হলে পূর্ব পাকিস্তান নিখিল পাকিস্তান ফেডারেশনের কার্যত একটি স্বাধীন ইউনিটে পরিণত হবে আর স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে ভাসানীর ইতঃপূর্বেকার (১৯৫৭ সালের আগের দলীয় বিভক্তির সময়) অবস্থান জানা থাকলে তিনি এখন যে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের ডাক দিচ্ছেন তার মধ্যে কোনাে হীন মতলব আছে এমনটি ধরে নেওয়া কঠিন। আসলেও তাঁর এই আহ্বান খারাপ কোনাে
২২৯
কিছু তাে নয়ই বরং এর সুবাদে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হওয়ার পরিবর্তে আওয়ামী লীগারদের “স্বায়ত্তশাসনপন্থী হওয়ার দাবিই তাে জোরদার হওয়ার কথা। সশস্ত্র বিপ্লবের ধারণা বিসর্জন দিয়ে ও এক গণআন্দোলনে সর্বান্তঃকরণে শরিক হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে নিঃসন্দেহেই তিনি আওয়ামী লীগের এই ঘােষণার প্রতি নিজ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন যে, যদি রক্তপাতও ঘটে তবুও এক গণআন্দোলন শুরু করা হবে। এতে ইশারা ছিল তাঁর অনুসারীদের জন্যেও যাদের মাঝে কেবল সনিষ্ঠ-বামপন্থী ছাড়াও পল্লীজনপদের অরাজনৈতিক কৃষক সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ ছিল তারা যাতে আগামী দিনগুলিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সহযােগিতা করে। রাজনৈতিক আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে মওলানা ভাসানীর যতাে কিছু ব্যর্থতা বা ত্রুটিই থাক না কেন, পাকিস্তানী রাজনীতির তপ্ত কড়াইয়ের তেলে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যােগ করতে তিনি কখনাে ব্যর্থ হননি। এ রকম সর্বশেষ ভূমিকাটি তিনি পালন করেছিলেন, ১৯৬৮-৬৯ সালের আন্দোলনের প্রাথমিক পর্বে। এই পর্যায়ে তার ভূমিকায় পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ও ভুট্টোর মনােভাব যদি আরাে কঠোর হয়ে থাকে তাতে সম্ভবত করার কিছু ছিল না। অবশ্য এ কথা অনস্বীকার্য যে, আওয়ামী লীগ যখন গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহের প্রতি জোর দিচ্ছিল সেই সময় মওলানা ভাসানী বাঙালি আঞ্চলিকতা/জাতীয়তাবাদের কথাই বেশি করে উল্লেখ করেছিলেন। আর এটা করে সম্ভবত তিনি সােজাসুজি স্পষ্ট কথাই বলছিলেন।
এভাবে কামানের বারুদে আগুন দেওয়ার কাঠিতে যখন আগুন ধরানাে হয়েছে ঠিক সে সময়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন। শেখ মুজিবের সাথে তাঁর দীর্ঘ আলােচনা হয়। তিনি তাঁকে দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী বলে উল্লেখ করেন। তিনি এ কথাও বলেছিলেন বলে জানা যায়: “আমি ওয়ারিশ সূত্রে এক মন্দ অর্থনীতি পেয়েছি আর এখন সেটি আমি শেখ সাহেবের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছি।” ইয়াহিয়া-মুজিব আলােচনাকে উভয় তরফই সন্তোষজনক’ বলে উল্লেখ করেন। তবে সেটা ঐ পর্যন্তই। তার বেশি কিছু জানা যায়নি। শাসনতন্ত্র খসড়া দশ দিনের মধ্যেই তৈরি করা যেতে পারে বলে তাঁর মন্তব্যের পাশাপাশি এই সতর্কীকরণ এবং আওয়ামী লীগ প্রণীত শাসনতন্ত্রের খসড়া যদি পশ্চিম পাকিস্তান প্রত্যাখ্যান করে তাহলে তিনি কী করবেন—এ রকম জল্পনাকল্পনামূলক প্রশ্নের জবাব দানে অস্বীকৃতি ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্য-অভিসন্ধি সম্পর্কে অনিশ্চয়তা ও সন্দেহের কুয়াশা কাটাতে প্রকৃতপক্ষেই সহায়ক হয়নি। আর কেউ এ কথা বিশ্বাস করেনি, ভুট্টোর সাথে তার যে দেখা করার কথা তাতে তার কোনাে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই, তিনি প্রস্তাবিত লারকানা সফরে চলেছেন শুধু পাখি শিকারে।২৫
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মন্তব্যের দ্ব্যর্থকতা হয়তােবা তাঁর দ্বিধাজড়িত ধারণা কিংবা সিদ্ধান্তহীনতার প্রতিফলন তবে তা নির্মম বাস্তবতা সম্পর্কে পরিকল্পিত রাখঢাকও হতে পারে। রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ইয়াহিয়া হয়তােবা শেখ মুজিবকে এমন এক শাসনতন্ত্রে তাঁর সম্মতি দিতে প্রলুব্ধ করেছিলেন যাতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর কট্টরপন্থীদের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থরক্ষা হলেও ইয়াহিয়ার নিজের অবস্থানটি আপাতত সুরক্ষিত হয়। এর নেপথ্যে আরাে কিছু
২৩০
থাকলেও থাকতে পারে। তবে সেগুলির মধ্যে হয়তাে অন্যতম মতলব ছিল ভুট্টোর প্রভাব যাতে আরাে বেড়ে না যায় তা ঠেকানাে। পশ্চিম পাকিস্তানে এ ধরনের একটি প্রয়াসের সম্ভাবনাকে নাকচ করা যায় না।২৬ ভুট্টো কি ব্যাপারটা ইতােমধ্যেই কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন? ১৯৭১ সালের ১৩ জানুয়ারি রাওয়ালপিণ্ডিতে তার বিবৃতির উদ্দিষ্ট আর কেউ নয় বরং ইয়াহিয়াই ছিলেন বলেই মনে হয়। তিনি গূঢ় তাৎপর্যে যা বলতে চেয়েছিলেন তা হলাে দেশ সুনিশ্চিতভাবেই ভাঙতে চলেছে। তবে তিনি যেহেতু একজন “কড়া জাতীয়তাবাদী”, তিনি এতে কোনাে পক্ষ হতে পারেন না। কথাটা এভাবেও বলা যায় যে, ইয়াহিয়া খান মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী করুন, ছয়-দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্রের পথ করে দিন তাতে বাধা নেই। কিন্তু তার কথা রাখতে হবে, তার সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে—এমন বাধ্যবাধকতা ভুট্টোর তাে নেই। ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী সম্বােধন করায় নিজ বিরক্তিকর কথা ভুট্টো নিজেই স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন: “পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ঢাকায় গিয়ে ঘােষণা করেছেন যে, শেখ মুজিব হবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। তারা উভয়ে জানিয়েছেন, তাঁদের আলােচনা সন্তোষজনক হয়েছে আর এও ধরে নেওয়া হয়েছে যে, শাসনতন্ত্র কার্যত তৈরি হয়ে গেছে। তবে লাখাে যে জনসমষ্টি আমাদের নির্বাচিত করেছে তাদের প্রতি আমাদেরও কর্তব্য রয়েছে।”২৭ এই ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যালঘিষ্ঠ ভােট পান। তাহলে সেই অবস্থায় দেশের সিদ্ধান্ত প্রণেতাদের মধ্যে তাঁর কোনাে অদৃশ্য অথচ শক্তিশালী সমর্থনের বুনিয়াদ না থাকলে তিনি এ রকম একটা দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন কী করে?
যা-ই হােক, পরিস্থিতি দাঁড়ায় এই যে, মুজিব বা ইয়াহিয়া কেউই তাঁদের নিজ নিজ সমর্থনের বুনিয়াদ বা কাঠামাের প্রকাশ্য এবং/অথবা প্রচ্ছন্ন অভিমতের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনাে রফায় পৌঁছুতে পারলেন না। এ সুযােগ নিলেন ভুট্টো। নানা রকম কলকাঠি নাড়ার পর্যাপ্ত উপকরণ হাতে মিলে গেল তার। অবশ্য শাসকচক্রের পরিবর্তনবিরােধী কট্টরদের সাথে ভুট্টোর স্বার্থের সঙ্গমের বিষয়টি নেহাত কোনাে কাকতালীয় আকস্মিকতা নয়। হাজার হােক, তিনি ছিলেন তাঁদেরই একজন যাঁদের বিরােধিতায় তিনি সাম্প্রতিককালে অবতীর্ণ হয়ে থাকলেও তাঁদের সাথে তার চেয়েও অনেক বেশিকাল কাটিয়েছেন। আর তিনি ছিলেন ঐ ব্যবস্থার সহস্থপতি যে ব্যবস্থার সেবা করেছেন অনুগত সেবক হিসেবে দীর্ঘকাল। যেমন ধরা যাক, এই ভুট্টো ছিলেন আইয়ুব খানের বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনিই প্রবর্তন করেছিলেন রপ্তানির ক্ষেত্রে বােনাস ভাউচার পদ্ধতি যাতে উপকৃত হয়েছে এক শ্ৰেণীর পশ্চিম পাকিস্তানী। ইনি হলেন সেই ভুট্টো যার ভারত-আতঙ্ক পাকিস্তানে সশস্ত্র বাহিনীগুলির চির বর্ধমান প্রভাবকে যৌক্তিকতা দিয়েছে। তিনি বস্তুত পাকিস্তানের এই ব্যবস্থাটির এতখানি অঙ্গ ছিলেন যে, এমনকি এই ব্যবস্থাটির বিরােধিতাকালেও, তাঁর সকল সমাজবাদী জোশ ও শ্রেণীহীন সমাজের একরারের বড়ম্বর সত্ত্বেও ক্ষীণ গলায় এ রকম ওয়াদা করা এড়াতে পারেননি, “যে সব শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিযােগিতামূলকভাবে চলছে ও যে সব শিল্প প্রতিষ্ঠানের বেসরকারি হাতে নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর
২৩১
নয় আমরা সেগুলির জাতীয়করণ করার কথা বলি না।”২৮ এহেন ভুট্টোই ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময়ে ক্ষমতাসীনদের একজন ও তাদের মুখপাত্র হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত সরকারের নীতির পক্ষে প্রকাশ্য ওকালতি করেন ও যুক্তি দেখান। আর তার ফলেই পাকিস্তানের দুটি শাখার মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক বিভেদ পাকাপােক্ত হয়ে যায়।
তাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে কথা বলার পর শেখ মুজিবের সাথে দেখা করতে ভুট্টো যখন পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন তখন তিনি ক্ষমতার লীলাখেলায় কোনাে অচেনা খেলােয়াড় ছিলেন না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন যে, মতভেদ, মিটিয়ে ফেলার জন্য মুজিব-ভুট্টো বৈঠক হওয়া দরকার। কোনাে কোনাে পূর্ব পাকিস্তানীরও এ রকম ধারণা ছিল। আবুল মনসুরের মতে, তাঁদের ধারণা ছিল এই, “ভুট্টো যাতে তাঁর নির্বাচকমণ্ডলী-পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছে এই ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব পালন করতে পারেন যে, ছয়-দফা মেনে না নিলে তার বিকল্প হবে হয়তােবা এক-দফা, সে জন্য ঐ বৈঠক হবে প্রয়ােজনীয় গৌরচন্দ্রিকাবিশেষ। ছয়-দফা গৃহীত না হলে অনিবার্য কারণে এক-দফা ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না।”২৯ আবুল মনসুরের মতাে ব্যক্তিবর্গ যাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে আর আওয়ামী লীগের কিংবা ছয়-দফার প্রচার-প্রচারণার সাথে সম্পর্কিত ছিলেন না অথচ এ ধারাপ্রবণতার স্থপতি, যাদের এর বুনিয়াদ ও লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি ছিল তারা কিন্তু যে পরিস্থিতি সামনে আসছে তার দাবি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে কোনাে ভুল করেননি।
স্পষ্টত ভুট্টোর কাছে ছয়-দফার পুরােটা গ্রহণযােগ্য হওয়ার কথা নয়। এটির কল্পনাও কষ্টসাধ্য যে, তিনি বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ফেডারেশনের ইউনিটগুলির স্বাধীনতার শাসনতান্ত্রিক গ্যারান্টিতে সম্মত হবেন। কেননা, তার পুরােপুরি ভালাে করেই জানা যে, প্রস্তাবিত ফেডারেশনের অন্তত একটি ইউনিট এমন এক দেশের সঙ্গে স্বাধীন বাণিজ্যিক যােগাযােগ প্রতিষ্ঠা করবে যে দেশের বিরুদ্ধে তিনি হাজার বছরের যুদ্ধ ঘােষণা করেছিলেন। বলাবাহুল্য, তার এ অবস্থান ছিল, বিশেষ করে, পাঞ্জাবে ব্যালট জয়ের অন্যতম স্তম্ভ। এ এমন এক অবস্থান যা তাঁকে এমনকি নির্বাচনের পরেও বজায় রাখতে হয়েছে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হকি বিশ্বকাপে ভারতীয় হকি দলের বিরুদ্ধে তার হুমকি, কাশ্মীর ও ফারাক্কা ইস্যুর বারংবার উল্লেখ ও পরিশেষে, বিমান ছিনতাই ঘটনায় তাঁর অবস্থান—এ রকম নানা ভারতবিরােধী কার্যকলাপের মাধ্যমে। এ সব কারণে তিনি আর্থিকভাবে দুর্বল কোনাে কেন্দ্রের ধারণায় সম্মত হতে পারেন না যে কেন্দ্র “প্রয়ােজনের” নিক্তির চুলচেরা মাপে ইউনিটসমূহ কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণ চাঁদানির্ভর হবে। আর জাতীয় আইন পরিষদের “নিরঙ্কুশ, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ” তেমন মনে করলে প্রতিরক্ষা বাজেট কেন্দ্রীয় বিষয় হলেও সেটিকে নিচু পর্যায়ে রাখতে পারবে। আর তাতে তাঁর অবস্থানের মূল্য আরাে কমে যাবে। এ সব ও আরাে অনেক বিচার-বিবেচনা বরাবরই পাকিস্তান ও গণতন্ত্রের মাঝে স্থায়ী অন্তরায় হয়েছিল। আর এমন বিশ্বাসের কোনাে কারণ ছিল না যে, ঐ পরিবেশের জাতক ভুট্টো ইয়াহিয়া খানের মতাে পাকিস্তানের কায়েমি শাসক মহলেরই অন্যতম হিসেবে
২৩২
কোনাে ভিন্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেরণায় সঞ্জীবিত হয়েছিলেন। ভুট্টো ইয়াহিয়া খানের মতােই একই শাসকগােষ্ঠীস্বার্থের শরিক ছিলেন। তাঁরা উভয়েই একই ধ্যানধারণারই লােক। তাদের মধ্যেকার তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য হলাে: ইয়াহিয়া তখনাে ক্ষমতায় ছিলেন, অন্তত আরাে কিছুকাল থাকবেন। আর ভুট্টোর অবস্থা ছিল: তিনি তখন ক্ষমতা লাভের চেষ্টায় লিপ্ত। পাঞ্জাব ও সিন্ধু—দুই প্রাদেশিক পরিষদের ‘চাবি’ দুই পকেটে রেখে, পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের আয়ােজন রেখে গােড়ার দিকে ভুট্টো ভেবেছিলেন, তাঁর খুশিমতাে কেন্দ্রীয় সরকারকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘােরানাের মতাে কলকাঠি তিনি হাতে পেয়ে যাবেন।৩০ তখন তিনি যা ভুল করেছিলেন এবং পরে বুঝতে পেরেছিলেন (কিংবা উপলব্ধি করতে বাধ্য হয়েছিলেন) যে, ছয়-দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্রের আওতায় সে ধরনের কোনাে কলকাঠি কোনাে কাজে দেবে না। তাই একমাত্র উপায় ছিল ছয়-দফার পরিবর্তনপরিমার্জনা। এ কারণেই, এ পরিবর্তন সম্ভব করার জন্য তিনি পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। স্পষ্টত তাই দেখা যায়, আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি পরস্পরের বিরুদ্ধেই মূলত ক্রিয়াশীল ছিল। তাই সম্ভবত কারও পক্ষে রফায় আসা সম্ভব ছিল না। অন্তত পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতিকদের একটা তাৎপর্যপূর্ণ অংশের জন্য এ অবস্থাটি ছিল সংশয়াতীতভাবেই আগে থেকে জানা বিষয়। এরা ছিল ছাত্র ও যুবতরুণ সমাজ যাদের মাঝে মধ্য ও চরমপন্থী দুই-ই ছিল। তবু মতবিনিময়ের সুযােগ ছেড়ে দেওয়া আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ ধরনের বৈঠকের আবশ্যকতা বাস্তবিকই ছিল প্রতিপক্ষের তা প্রেসিডেন্ট বা ভুট্টো যিনিই হন না কেন তার বিরােধিতা কিংবা সংশয় সন্দেহের চূড়ান্ত প্রমাণ পাওয়ার জন্য। কেননা তাদের কেউই আওয়ামী লীগের শাসনতন্ত্র প্রস্তাবের পাশাপাশি তাদের পছন্দসই কোনাে শাসনতান্ত্রিক ফর্মুলা দেননি। আর ভুট্টোর কাছে আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত ছয়-দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্রের কোনাে কোনাে বিষয় একেবারেই অগ্রহণযােগ্য—সে বিষয়ে প্রকাশ্য ঘােষণা খােদ ভুট্টোর কাছ থেকেই আসার প্রয়ােজন ছিল। ভুট্টোর এ সব অগ্রহণযােগ্যতার নেপথ্য মতলব জানা ছিল আর এই আগে থেকে জানা থাকার কারণেই ছয়-দফাকে পুরােপুরি গ্রহণ করতে হবে—এ দাবিতে আওয়ামী লীগ অটল ও অপরিবর্তনীয় থাকে। তাই এটি এ ক্ষেত্রে মুখ্য কারণ বলতেই হয়। আর এ কারণে অনিবার্যভাবে এই সিদ্ধান্তে আসতেও হয় যে, আওয়ামী লীগ ও ভুট্টোর মধ্যেকার মতপার্থক্য নিরসন হওয়ার নয়। এই মতভেদ এতই মৌলিক যে, অন্য যে সব বিষয়ে যেমন, কমবেশি একই ধরনের অর্থনৈতিক কর্মসূচির ক্ষেত্রে উভয় তরফের মতৈক্যে পৌঁছানাের যে সম্ভাবনাটি ছিল তা-ও তাদের দু’তরফকে কাছাকাছি আনতে ব্যর্থ হয়। বলাবাহুল্য, এ মতৈক্যের বুনিয়াদ হতে পারতাে সাধারণ মানুষের কল্যাণের অভিন্ন। লক্ষ্যটি। বিশেষ করে, ভুট্টোর দলের ঘােষিত মূল উদ্দেশ্যই ছিল এটি আর এ নিয়ে প্রচুর বাগাড়ম্বরও ঘটে। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে ভুট্টো-মুজিব আলােচনা স্বভাবতই নিষ্ফল হয়। এ সময়ে তাঁদের আলােচনার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়নি, কেবল ফলটি জানা যায় মাত্র। ১৯৭১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভায়
২৩৩
কমিটিকে ভুট্টো ও পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য নেতাদের সঙ্গে শেখ মুজিবের আলােচনার বিস্তারিত বিবরণ জানানাে হয়। পরে জানা যায়, ওয়ার্কিং কমিটি, যেভাবে এ আলােচনা হয়েছে তা অনুমােদন করে। আর ঐ আলােচনায় সারকথা ছিল: শেখ মুজিব ছয়-দফার প্রশ্নে অটল থাকেন, আর ভুট্টোর কাছে ছয়-দফার কোনাে কোনাে অংশমাত্র গ্রহণযােগ্য হয়। স্পষ্টত তার কাছ থেকে ঐ প্রতিক্রিয়াই প্রত্যাশা করা হয়েছিল, কেননা শেখ মুজিব পরে মন্তব্য করেছিলেন: তিনি ভুট্টোকে নিয়ে তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট কোনােটাই নন।৩১ ভুট্টো আলােচনাকে এভাবে তুলে ধরেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে ছয়-দফা ব্যাখ্যা করার জন্য তার সময়ের দরকার। এটি করার পর এর ওপর তিনি তাঁদের রায় চাইবেন। আর সে কারণে, ১৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সভা আহ্বানের জন্য শেখ মুজিবের অনুরােধ প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে মঞ্জুর করা যাবে না। ছয়-দফা ছাড়াও, আরাে যে অস্বস্তিকর কারণটি ছিল ভুট্টোর জন্য তা হলাে: জাতীয় পরিষদে ভােটদান পদ্ধতি যা তখনাে অমীমাংসিত ছিল।
তাৎপর্যপূর্ণ এই যে, ঢাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলােচনাকালে ভুট্টো কেবল ছয় ও এগারাে-দফার কোনাে কোনাে বিষয়ে মন্তব্য করেন। বৈদেশিক বাণিজ্য, বিদেশী মুদ্রা, হিসাব ও কারেন্সি ইত্যাদির বিলিবণ্টন সম্পর্কিত বিষয়ে মন্তব্য এড়িয়ে যান। ছয়-দফা। মেনে নেওয়ার পথে “সত্যিকারের অসুবিধাগুলি” বলতে তিনি কী বােঝাতে চান—এ ধরনের প্রশ্নের জবাব ভুট্টো এড়িয়ে যান।৩২ পাকিস্তানের আত্মপরিচয়ের মৌল বিষয় হিসেবে ধর্মের স্থলে এক ধরনের সমাজতান্ত্রিক ঐক্যের প্রত্যাশা যারা করেছিলেন, তাঁদের কাছে এ দুই নেতার আলােচনার ফলাফল ছিল হতাশাব্যঞ্জক। তবে এক ভাষ্যকারের মন্তব্য অনুযায়ী, ঐ ঐক্য বস্তুত সম্ভব ছিল না। কেননা, পূর্ব পাকিস্তান এখন স্থানীয় পর্যায়ের জাতীয়তাবাদ বাতিল করে “শােষণমুক্ত” সুসংহত পাকিস্তান গড়তে পারে এবং পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের অঙ্গীকার বিসর্জন দিয়ে সমাজতান্ত্রিক ঐক্যের শক্তিশালী কেন্দ্র ব্যবস্থার মাধ্যমে বৈষম্য দূর করার প্রয়াস চালাতে পারে—এ ধরনের প্রস্তাবনাকে তাই “সম্ভাব্যতা”র নিরিখেই দেখা যায়। বলা হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। প্রথমটি হলাে, দুই অঞ্চলের সামাজিক গঠন বা নির্মিতির মধ্যে বৈষম্য; আর দ্বিতীয়টি, পাকিস্তানের অঞ্চলগুলির সহজাত স্ববিরােধিতা বা স্বার্থের সংঘাত অথচ সে অবস্থায়ই তাদেরকে সম্পদের অভিন্ন সঞ্চয়” নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করতে হবে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা হয়, “ভূমি সংস্কার সিন্ধুর অপেক্ষাকৃত বেশি সামন্ত প্রতিনিধিদের তুলনায় পাঞ্জাবের অধিকতর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পিপিপি পার্লামেন্টারিয়ানদেরকেই বরং একগুচ্ছ সমস্যার মুখােমুখি করবে।” আরাে উল্লেখ করা হয় যে, “কোনাে সংসদীয় কাঠামাের মধ্যে এ দুই প্রদেশে অভিন্ন ভূমি সংস্কার বাস্তবায়িত করা শক্ত হবে।” আর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের জনপ্রতিনিধির শ্ৰেণীচরিত্র বিবেচনায় সেখানে আদৌ সংস্কার ঘটবে—এমনটি প্রত্যাশা করা যায় না। সে জন্য, কর্মসূচির বৈপ্লবীকরণের মাত্রা অনিবার্য কারণেই ভিন্ন হবে। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বেপরােয়া শ্রেণী শক্তিগুলির কারণেই নয়
২৩৪
বরং খােদ পিপিপির অভ্যন্তরেও শ্রেণী বিভিন্নতার কারণেও অবস্থা সে রকমই দাঁড়াবে। আর “যদি কোনাে কর্মসূচিকে এগিয়ে নিতে গেলেই দেশের পশ্চিমাঞ্চলে এত সব সমস্যা দেখা দেয় তাহলে সে ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা কী? জীবনধারণ-নির্ভর প্রান্তিক চাষী ও পল্লীবাংলার দ্বান্দ্বিক সমস্যা বিরাট জোতমালিকপ্রধান পশ্চিম পাকিস্তানী সামন্ত সমাজের সমস্যার চেয়ে একেবারে সহজাতভাবেই ভিন্ন প্রকৃতির।” তাই প্রতিটি ইউনিট বা প্রদেশের একান্ত স্বকীয় সামাজিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে—এমন পাঁচটি প্রদেশের এক ফেডারেশন বা কেন্দ্রীয় সরকারকে বাংলাদেশে সম্পত্তি ব্যবস্থার সম্পর্কগুলি কী হবে তা নির্ধারণ করতে দেওয়া কেবল অযথার্থ, অদক্ষই হবে না বরং তা হবে বিপজ্জনকও।” শহর-নগরের বড় বড় ব্যবসায়ের বেলায় বলায় যায়, কোনাে একটি সংহত সমন্বিতঅর্থনীতির জনসমাজে এই ব্যবসায় সংগঠনগুলি নিশ্চিতভাবেই যেমন পূর্ব তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রগতিশীলদের জীবন কঠিন করে তুলবে। কেননা, বহুকাল ধরেই এ সব পশ্চিম পাকিস্তানী প্রতিষ্ঠানের পূর্বাঞ্চলের সাথে ব্যবসায় যােগসূত্র রয়েছে। অন্যদিকে, অসমন্বিত অর্থনীতির জনসমাজ হিসেবে চিহ্নিত বাংলার ঋণজর্জর ও সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীন নব্যবুর্জোয়া সমাজ কিন্তু সে তুলনায় প্রগতিবাদীদের কর্মসূচিকে সেভাবে কূটাঘাত করতে পারবে না। এ ছাড়াও বলা হয়েছে যে, দুটি সমাজতান্ত্রিক সরকারের কোনাে সরকারই জাতীয় সম্পদে অধিকতর বড় ভাগ পাওয়ার ব্যাপারে কম অঙ্গীকৃত হবে—এমন মনে হয় না। তাই বিষয়টির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “পাকিস্তানের সকল অঞ্চলেই জাতীয় চেতনার উত্তাপ বাড়াতে দেশটির ইতিহাস ও ভূগােলের মণিকাঞ্চন সংযােগই ঘটেছে। এখন আমরা যদি সমাজতান্ত্রিক সংহতির আবেদনের পুরানাে কথাতেই নাচার হয়ে ফিরে যাই তাহলে তাতেও দেখা যাবে পাকিস্তানের তখনকার পরিস্থিতিতে এই সমাজতন্ত্রের আবেদনও পুরাননাপন্থীদের “ইসলাম পসন্দ” জোশের মতােই এক অলীক কল্পনাবিশেষ।” তখনকার পাকিস্তানী রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতায় কিছুটা সত্য এই মর্মে ছিল যে, “সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ তাত্ত্বিক দিক থেকে আলােচনার জন্য ভালাে। বিষয় হলেও এ বাস্তবতাও ভােলার নয় যে, আমরা এক জাতীয়তাবাদী দুনিয়ার অধিবাসী। তা যদি না-ই হয় তাহলে ভুট্টো তথা পিপিপির উচিত ছিল আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসনের। দাবিকে তাদের নিজ গণমানুষের স্বার্থের পােষকতার আলােকে দেখা।” অত্যন্ত অকাট্য প্রশ্ন তাই উঠেছিল: “পশ্চিম পাকিস্তানের শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থ কি ছয়-দফার কারণে এতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে যাতে কায়েমি স্বার্থও প্রভাবিত হবে? যদি তা না হয় তাহলে এই মৌলিক ও সর্বজনীন দাবির বিরােধিতাই বা কেন?”৩৩
পাকিস্তানের সংহতির প্রতি হুমকির ব্যাপারে ভুট্টো যে সব যুক্তি প্রদর্শন করেছেন সেগুলি এর বাস্তব অর্থে বুঝতে হবে। এই হুমকির উৎপত্তি যে শুধু পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতায় নিহিত তা নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের একজন সাংবাদিকের জবানিতে:
অধিকাংশ পশ্চিম পাকিস্তানী এ কথা ভেবে আশঙ্কিত যে, ছয়-দফায় যা আছে সে অবস্থায় তা মেনে নেওয়া হলে তার নিহিত তাৎপর্য হবে এই যে, বেলুচিস্তান, সিন্ধু ও সীমান্ত প্রদেশকেও
২৩৫
অভিন্ন সুযােগ-সুবিধা দিতে হবে। … যুক্তি দেখিয়ে বলা হয়েছে, একবার পাঁচটি স্বতন্ত্র অর্থনীতির স্বীকৃতি দেওয়া হলে ঐ পাঁচটি ইউনিট নিজ নিজ স্বতন্ত্র পথে এগিয়ে যাবে আর তাতে পাকিস্তান বলে কিছু থাকবে না।”৩৪
যারা এ সব এত নিশ্চিত হয়ে ভেবেছিলেন তাঁদের সে ভাবনার যুক্তিও ছিল। তবে এ কথাও ঠিক যাঁরা এর বিপরীত ধারণায় বিশ্বাসী তাঁদেরও ভাবনা ঐ একই ভাষ্যকারের ভাবনার সাথে আবশ্যিকভাবেই মিলে যায়। তা হলাে:
যদি পাকিস্তানের আদর্শ ও পাকিস্তানের অধিবাসীদের একত্র ধরে রাখার উপাদানগুলি যথেষ্ট শক্তিশালী না হয় আর একই কারণে তাদের অর্থনীতিকে একক, সমন্বিত করতে না পেরে থাকে তাহলে বরাতজোর খুব মন্দই বলতে হবে। (তবে) কোনাে দেশকে যদি কপটাচার, প্রতারণা কিংবা কলকৌশলে এক জায়গায় ধরে রাখতেই হয় তাহলে তেমন ধরে রাখায় সার্থকতা নেই।৩৫
অবশ্য সন্দেহ আছে আদৌ কতজন পাকিস্তানী (পূর্বাঞ্চলের পাকিস্তানীরাসহ) এই ভাষ্যকারের সাথে একমত হতে পারবেন যে, “দেশের বৃহদাংশের বেরিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা থাকলেও অস্তিত্ব সংরক্ষণে জনঅভিপ্রায়ের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অগ্নিপরীক্ষার মুখােমুখি হওয়ার মনােবল পাকিস্তানের থাকা উচিত। দুর্বলচিত্ততার কোনাে অবকাশই নেই এতে এই কারণে যে, যদি তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কোনাে আশা আদৌ থেকে থাকে তবে সেটি হলাে এ অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাওয়া, অন্য কোনােভাবে নয়।”৩৬ পরবর্তীকালের ঘটনাবলিতে দেখা যায়, পাকিস্তানীরা সেই “অগ্নিপরীক্ষা যাচাইয়ের পথে আগুয়ান হয়েছে যদিও অনেকেই তার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এমনকি, যাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানের অনিবার্য কী তা বুঝতে পেরেছিলেন তাঁদেরও বেশিরভাগ সেই অনিবার্য পরিণতি মেনে নিতে তখন তৈরি ছিলেন না। ওদিকে পূর্ব পাকিস্তানকে সেই অনিবার্যতার জন্যই মানসিকভাবে তৈরি করার কাজ চলছিল, সেই অনিবার্যতা যতই অরুচিকর হয়ে। থাক না কেন তাদের জাতীয়তাবাদী পাকিস্তানী মনস্তত্ত্বের জন্য। পূর্ব পাকিস্তানীদের এই মনন অভিমুখিনতা সম্ভব হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানী জনসমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিত্বশীল সমর্থকদের মাঝে প্রধানত আওয়ামী লীগের থেকে থেকে তীব্র, নিবিড় প্রচারাভিযানের সুবাদে।
অবশ্য, বিস্ফোরণমুখী নাটকীয়তার চূড়ান্ত জমে ওঠা ভাবটা তখনাে আসেনি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের প্রথম সভার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত তারিখটি ঘােষণা করলেন (এ ঘােষণা দেওয়া হয় ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সালে) যদিও মুজিব-ভুট্টো সংলাপের ফল হিসেবে উভয় তরফের মনােভাব আরাে অনমনীয় ও কঠোর হওয়ায় বিরাজমান পরিস্থিতিতে কোনােই পরিবর্তন আসেনি। এভাবে মেরুকরণের নিখুঁত পরিপূর্ণতায় পৌঁছে যায় দুই পক্ষ। আর দুই তরফের দুই নেতা ১৯৭১ সালের ৩০ জানুয়ারি লাহােরে একটি ভারতীয় বিমান ছিনতাই ও পরে সেটিকে বিধ্বস্ত করার ঘটনায় যেভাবে নিজ নিজ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তার মাঝেই সম্ভবত তার অত্যন্ত ভাবব্যঞ্জনাময় প্রতিফলন ঘটে। শেখ মুজিব এ
২৩৬
কাজের নিন্দা জ্ঞাপন করেন ও ঘটনার তদন্তের দাবি জানান। আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ১৯৭১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ইস্যুটি নিয়ে আলােচনায় বসে। কেননা দলের মতে, “এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা আমাদেরকে ভারতের সাথে এক সংঘাতময় অবস্থায় নিয়ে গেছে।”৩৭ এর বিপরীত দৃশ্যে, ভুট্টো এতে হরষিত হন এবং তাঁর ভারতবিরােধিতাকে এ সুযােগে আরাে তীক্ষ্ণ, শাণিত করে তােলেন। ভুট্টোর অনুসারীরাও মুজিবকে ভারতপন্থী বলে অভিহিত করে আর পূর্ব পাকিস্তানীরা ভুট্টোর প্রতিক্রিয়াকে গণবিরােধী চক্রান্তের একটি অংশ বলে সাধারণভাবে মনে করতে থাকে। এ একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে যে জনগােলযােগ ও হাঙ্গামা দেখা দেয় পূর্ব পাকিস্তানীরা সে সবকে ঐ চক্রান্তেরই অংশ বলে মনে করে।৩৮
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ১৯৭১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় জাতীয় পরিষদ উদ্বোধন করার ব্যাপারে প্রত্যাশিতভাবেই প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। সভায় কোনাে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব না নেওয়া হলেও শাসনতন্ত্র প্রণয়ন সম্পর্কিত দলীয় সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করা হয়। এ ছাড়াও, পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে, পশ্চিম পাকিস্তানের সুনির্দিষ্ট আঞ্চলিক সমস্যাসমূহের ব্যাপারে শাসনতন্ত্রে প্রয়ােজনীয় বিধান সন্নিবেশিত করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপূরক এমন যে কোনাে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এই সভা শেখ মুজিবকে প্রদান করে। তবে এও প্রত্যাশা করা হয় যে, শেখ মুজিব পরের দিন শাসনতান্ত্রিক ইস্যুতে আওয়ামী লীগের অবস্থান ব্যাখ্যা করে এক “বড় রকমের নীতিনির্ধারক বিবৃতি দেবেন। ধারণা করা হয়েছিল যে, “তিনি ঘােষিত দলীয় অবস্থানের কথাই পুনর্ব্যক্ত করবেন। আর সে ঘােষণা হবে আরাে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে।” পরের দিন আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএদের এক যৌথ সভায় শেখ মুজিব দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথেই দলীয় সংকল্প সম্পর্কে বক্তব্য পেশ করেন। তিনি গণবিরােধী চক্রান্ত সম্পর্কেও উল্লেখ করেন। অন্যান্য দিক থেকেও তাঁর এ বক্তৃতা নানাভাবে বিভিন্ন বিষয়ে আলােকপাত করে ও এ থেকে নানা বিষয় জানা যায়। ভুট্টোর সাথে তাঁর আলােচনাকে তিনি সন্তোষজনক বা অসন্তোষজনক কিছু নয় বলে উল্লেখ করলেও বােঝা যায় এ ছিল তার রসবােধক এক লঘু উক্তিমাত্র। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় এই যে, তিনি মন্তব্য করেন, ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন পাঞ্জাব ও সিন্ধুর প্রতিনিধি হিসেবে। এ কথা বলার মধ্য দিয়ে তিনি প্রচ্ছন্ন তাৎপর্যে বুঝিয়ে দেন যে, পাকিস্তানের গােটা পশ্চিমাঞ্চলের মুখপাত্র হিসেবে কোনাে বৈধতা ভুট্টোর নেই। পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টির জন্য কতিপয় আমলা চক্রান্তে নিয়ােজিত বলে যে অভিযােগ তখন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান তাদের প্রচণ্ড ধিক্কার জানিয়ে বলেন, যারা কেবল বন্দুকই বােঝেন, রাজনীতি বােঝেন না, তাদের কোথাও জায়গা নেই। তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল দলছুট বা বিরােধীদেরকে তার এই মর্মে সতর্কবাণী যে, ১৯৫২ বা ১৯৫৪ সালের পরিস্থিতি আর ১৯৭১ সালের পরিস্থিতি এক নয়। তিনি জনগণের ক্ষমতায় প্রাধান্য আরােপ করে আগামীর গর্ভে কী শঙ্কা, কী প্রত্যাশা নিহিত
২৩৭
রয়েছে সে বিষয়ে প্রদত্ত বক্তব্যে কোনাে রকম সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশমাত্র রাখলেন। না। তিনি বলেন, ১৯৬৮-৬৯ সালের আন্দোলনে জনগণই আইয়ুব খানকে পদচ্যুত করেছে। যদিও নেতারা তখন কারাপ্রাচীরের অন্তরালে ছিলেন। তিনি হুঁশিয়ার করে দেন, এখন যেহেতু জনগণের মাঝে নেতারা উপস্থিত রয়েছেন সেহেতু সেই প্রকার অথবা আরাে গুরুতর পরিস্থিতি দেখা দিতেই পারে।৩৯ স্পষ্টত আওয়ামী লীগ অনভিপ্রেত কিছু ঘটার আশঙ্কা করছিল। আর তাই এ দল সঙ্কট মােকাবেলার জন্য জরুরি পরিকল্পনা ছকে রাখার প্রয়ােজনীয়তাও অনুভব করে। না হলে, কেন ঐ সভায় জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও দলের লক্ষ্য অর্জনে যে কোনাে কর্মপন্থা গ্রহণের ব্যাপারে শেখ মুজিবকে সর্বাত্মক ক্ষমতা দেওয়া হবে? জাতীয় পরিষদের প্রস্তাবিত উদ্বোধনের প্রাক্কালে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অবিসংবাদিত নেতাকে এ ধরনের বাড়তি ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়টি আর যা-ই হােক সাদামাটা, গুরুত্ব-তাৎপর্যহীন কিছু হতে পারে না। তখনকার ঐ মহাক্রান্তিকালে জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্যরা যে নিয়মতন্ত্র-বহির্ভূত, অসাধারণ ক্ষমতা তার ওপর ন্যস্ত করলেন তার প্রয়ােজন ছিল না যদি তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনে নিয়মতন্ত্র-বহির্ভূত উপায় অবলম্বনের সম্ভাবনা এতখানি অবশ্যম্ভাবী ও স্পষ্ট না হয়ে উঠতাে।
এখানে মনে রাখা দরকার, প্রেসিডেন্টের ঘােষণার আগেই দলীয় ওয়ার্কিং কমিটির সভার বিষয়টি স্থির হয়েছিল। ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার একটি তারিখ নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। এখন যদি ঐ অধিবেশন এ তারিখের পরে পিছিয়ে যায় তাহলে সে ক্ষেত্রে সভা রাজনৈতিক কৌশল কী হবে তা স্থির করবে এবং সুনির্দিষ্ট প্রত্যক্ষ কাৰ্যব্যবস্থার পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে। সন্দেহ-সংশয়ের ঘনঘটায় রাজনৈতিক আকাশ আচ্ছন্ন না থাকলে প্রেসিডেন্টের উল্লিখিত ভাষণের পর দলের সর্বস্তরের লােকজনের মধ্যে উত্তেজনা ও তজ্জনিত অস্থিরতা, চাঞ্চল্য প্রশমিত হওয়ারই কথা।৪০ কিন্তু ভবিষ্যৎ ঘটনাপ্রবাহের আশঙ্কার প্রেক্ষাপটে বিরাজমান পরিস্থিতিতে তারপরেও আওয়ামী লীগকে তার অবস্থান আবারও স্পষ্ট করেই ব্যক্ত করতে হয়। যারা প্রায় বছর দুই ধরে আওয়ামী লীগের ন্যূনতম প্রতিরােধের নীতির ধারাবাহিকতাকে সাময়িকভাবে জায়গা করে দেওয়ার জন্য প্রত্যক্ষ কর্মপন্থামূলক সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাগুলি মুলতবি রেখেছিলেন তাদের কারণেই আওয়ামী লীগকে তার অবস্থান এভাবে স্পষ্টাকারে বলতে হয়। সে কারণে, শেখ মুজিবের বক্তৃতার উদ্দিষ্ট ছিল যেমন ছাত্র ও তরুণেরা তেমনিই উদ্দিষ্ট ছিল যারা জনগণের কাছে ক্ষমতার হস্তান্তরকে বিলম্বিত করার জন্য দায়ী তারা ।
ছাত্রফ্রন্টের দিক থেকে দেখতে গেলে বলা যায়, এ সময় নাগাদ অ্যাপস্যাক কার্যত বিলুপ্ত হয়। এটি ঘটে এ কারণে যে, ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্রসমাজের এক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অন্যান্য মধ্যমপন্থীদের আংশিক সমর্থনে আওয়ামী লীগের, বিশেষ করে, শেখ মুজিবের নির্দেশে এক ধরনের সন্ধির বিষয় মেনে নেয়। ১৯৬৯-এ যখন সহিংস ছাত্রবিক্ষোভ দাবাগ্নির মতাে ছড়িয়ে পড়ছিল আর তাতে অংশ নিচ্ছিল কলকারখানার শ্রমিক ও দেহাতি মানুষের মতাে জনসমষ্টির নানা অংশ এবং বিক্ষোভের দাবাগ্নি গােলটেবিল সম্মেলনের
২৩৮
আলােচনার ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে অদম্য ব্যাপ্তি লাভ করছিল তা শুধুমাত্র সামরিক আইন পুনঃআরােপ করলেই নিভে যাবে—এমনটি সম্ভব ছিল না। তবু এতে সংযমের যতির ডাক দেওয়া হয় অপেক্ষাকৃত কম বাস্তব মূল্য দিয়ে নির্বাচনে অভীষ্ট লাভ ঘটে কি না—এটা দেখতে। এটা ছিল একটি পরীক্ষামূলক অবস্থান। এবং অন্য তরফের বৈরিতার আভাসের মুখে এ ধরনের সন্ধির মেয়াদ দ্রুত ফুরিয়ে যেতে বাধ্য। যখন সন্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তখন অ্যাপস্যাকের দাবির ভিত্তিতে (অর্থাৎ ছয়-দফা ও এগারাে-দফার সম্মিলিত ভিত্তিতে) শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর ও শাসনতন্ত্র প্রণয়নের যে সম্ভাবনা ছিল এখন সে সম্ভাবনা যে সুদূরপরাহত হয়ে ওঠে তা খুবই স্পষ্ট হয়ে যায়। স্পষ্টত আওয়ামী লীগেরও সেই ধারণাই হয়েছিল। স্বভাবত ছাত্রনেতারা তাদের নিজস্ব বিকল্প কৌশল ও প্রত্যক্ষ কর্মপন্থার পরিকল্পনা করছিল হাতের কাছে যা কিছু উপায়-অবলম্বন পাওয়া যায় তাই নিয়ে, গােড়ার দিকে। তাদের আন্তঃসাংগঠনিক সংহতি ও সমন্বয়ের অভাব থাকলেও। প্রতিটি সংগঠন নিজ প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ছাত্রলীগ (ঢাকা সদরদপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল) গেরিলাযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ও স্থূল ধরনের বিস্ফোরক তৈরির (খুবই সীমিত মাত্রায়) অস্থায়ী প্রকৃতির ব্যবস্থায় নিয়ােজিত থাকে। মতিয়াপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন (সদরদপ্তর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরজগন্নাথ হল) অল্প পরিমাণে অস্ত্র সংগ্রহেই মূলত ব্যস্ত থাকে। তুলনামূলকভাবে বেশি জঙ্গি (ন্যূনপক্ষে বাচনিক অর্থে) মেননপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন আত্মগােপন করে। তখনকার ধারণা ছিল এই যে, এই সংগঠনটি দেশের পল্লী জনপদে বামপন্থী আদর্শ প্রচারের সাথে সাথে এক ধরনের প্রতিরােধ দল গড়ে তুলছে। আর ছিল কিছু দলছুট চরমপন্থী যারা কাজ করছিল একই ধারায়। তবে এদের ব্যাপারে এ ধারণাও করা হতাে যে, এরা বিক্ষিপ্ত সহিংসতায় নিয়ােজিত ছিল। এ ছাড়াও সামরিক, আধাসামরিক ও সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা। যারা তাদের হয় নিজ নিজ কর্মস্থলে নিয়ােজিত ছিল কিংবা পূর্ব পাকিস্তানে নিজ বাড়িতে ছুটিতে ছিল তারাও ঘটনাপ্রবাহের তাৎপর্য সম্পর্কে সজাগ ছিল। এরা ছাত্রনেতাদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করছিল। এদের উভয় পক্ষেরই আবার যুগপৎ প্রদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যােগাযােগ ছিল। এভাবে যে যােগসূত্র বা নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে তা শুধু রাজনৈতিক উদ্যোগ বা তৎপরতা সম্পর্কে একটা কাজের যােগাযােগ চ্যানেলই হয়ে ওঠেনি বরং সশস্ত্র বাহিনীর প্রস্তুতির অবস্থা কেমন পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অস্ত্রের চলাচল, এমনকি, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আরাে সশস্ত্র সেনা আমদানির ব্যাপারে তথ্য প্রাপ্তির মাধ্যমও হয়ে ওঠে।
এ পরিস্থিতিতে ভুট্টোর প্রতিক্রিয়া৪১ যদিও অপ্রত্যাশিত ছিল না তবু সেটি আওয়ামী । লীগের জন্য বাহ্যত অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখন থেকে অপেক্ষাকৃত মারমুখী তরুণ সম্প্রদায় পরিবৃত হয়ে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আওয়ামী লীগকে কাজ করতে হয়। এ কারণেই ভুট্টোর বিবৃতির ওপর শেখ মুজিবের মন্তব্য ছিল এক পাল্টা প্রশ্ন বিশেষ: “ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে আজ সকালে আমি যে সব কথা বলেছি (এ বক্তৃতা সম্পর্কে আগেও উল্লেখ । রয়েছে। সেগুলিকে কি আপনারা যথেষ্ট মনে করেন না?”৪২
২৩৯
ভুট্টো যখন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে তার যােগদানের অক্ষমতার কথা বারংবার বলছিলেন প্রতিবারই তিনি নতুন আপত্তির কথা তুলছিলেন। অন্যদিকে, ঐ একই সময়ে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। আওয়ামী লীগ তার সংসদীয় দলের জন্য শেখ মুজিব, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে যথাক্রমে নেতা, উপনেতা ও সচিব নির্বাচিত করে। দিনাজপুরের ইউসুফ আলী, টাঙ্গাইলের আব্দুল মান্নান ও কুষ্টিয়ার আমিরুল ইসলাম যথাক্রমে চীফ হুইপ ও অপর দুইজন হুইপ নির্বাচিত হন। স্পিকার পদে খন্দকার মােশতাক আহমদ ও ডেপুটি স্পিকার পদে আব্দুল মালেক উকিলকে মনােনয়ন দেওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে শােনা যায়। শেখ মুজিব আবার প্রস্তাব দেন, পশ্চিম পাকিস্তানী এমএনএরা যদি প্রয়ােজন মনে করেন তবে অধিবেশনের আগে তিনি তাদের কাছে ছয়-দফা বিষয় ব্যাখ্যা করবেন।৪৩ ১৯৭১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক দীর্ঘ ও তাৎপর্যপূর্ণ বিবৃতিতে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার করে ব্যক্ত করেন। তিনি পটভূমি বিস্তারিত তুলে ধরে, যে সব ঘটনা পরিস্থিতিকে জটিল করছে সেগুলি নিয়ে আলােচনা করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বীকৃত একমাত্র প্রতিনিধি আওয়ামী লীগের ধারণা অনুযায়ী এ সবের বিকল্প কী হতে পারে তার আভাস দেন।
নির্বাচন-পরবর্তীকালের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে তাঁর ক্ষোভ প্রকাশক এক প্রচ্ছন্ন মন্তব্য দিয়ে শুরু করে, শেখ মুজিব ব্যাখ্যা দেন যে, আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের আশু অধিবেশন আহ্বানের জন্য বলেছিল এ কারণে যে এই দল মনে করে, জাতীয় পরিষদেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শাসনতান্ত্রিক ইস্যুগুলির নিষ্পত্তি করা যায়, তা হওয়াও উচিত। কিন্তু তারপরেও আওয়ামী লীগ যে কোনাে দল বা ব্যক্তির কাছে ফেডারেল পাকিস্তান রাষ্ট্রের পশ্চিম পাকিস্তানী ইউনিটগুলির ন্যায়সঙ্গত স্বার্থের জন্য” ছয়-দফা ফর্মুলা কোনাে রকম ক্ষতিকর হবে না তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগের এই দাবির পুনরুক্তি করে বলেন যে, ছয়-দফা ফর্মুলা কেন্দ্রীয় সরকারকে রাষ্ট্রীয় ইউনিটগুলির আর্থিক করুণানির্ভর করে তুলবে বলে যে বিকৃত ধারণা রয়েছে তা ঠিক নয়। কারণ “রাজস্ব ও বৈদেশিক মুদ্রা সম্পদ থেকে ফেডারেল সরকার পর্যাপ্ত উপযােজন বা ব্যয়বরাদ্দ নিতে পারবে আর শাসনতন্ত্রের এ সব বিধান বলে ফেডারেল আইন পরিষদ-ফেডারেশনের ইউনিটগুলির ওপর ফেডারেল লেভি ধার্য করতে পারবে।” তিনি যথেষ্ট জোর দিয়ে বলেন, “এই লেভি প্রতিটি ইউনিটের সম্পদের ওপর সবার আগে প্রথম চার্জ হিসেবে। বসবে।” পশ্চাদ্দৃষ্টি দিলেই দেখা যাবে, শেখ মুজিব হয়তাে আন্তরিকতাবশে খেয়াল করেননি যে, এখানেই তাে আসল সমস্যা। জাতীয় পরিষদে “বিপুল/নিরঙ্কুশ” গরিষ্ঠতা নিয়েই তাে আদত প্রশ্ন যে প্রশ্ন ঐ ফেডারেল লেভির মতাে ইস্যুর সিদ্ধান্তকে সরাসরি প্রভাবিত করতে পারে। যদি কেন্দ্রের প্রয়ােজন বা চাহিদামাফিক কেন্দ্রকে দিতে হয় আর আওয়ামী লীগ-সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতীয় পরিষদকে “এ সব চাহিদার” প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাহলে কি এমন হবে না যে, ঐ জাতীয় পরিষদ কেন্দ্রের চাহিদাকে একান্ত ন্যূনতম
২৪০
পর্যায়ে নির্ধারণ করবে, যাতে প্রতিরক্ষার মতাে বিষয়টিও থাকবে? তাহলে সে অবস্থায় স্থিতাবস্থার পরিবর্তনবিরােধীদের পক্ষে কি এ ধরনের পরিকল্পনা মেনে নেওয়া সম্ভব হবে? অনুরূপভাবে, মুজিবের আশ্বাস ছিল এই যে, বৈদেশিক সাহায্য ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইউনিটগুলি তাদের ক্ষমতার অনুশীলন করবে “দেশের পররাষ্ট্রনীতি কাঠামাের মধ্যে।” সে আশ্বাসও খুব একটা নির্ভরযােগ্য নয়। আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্র তাে এমনি করে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করতেই পারে যা কেবল নিজ দলীয় বৈদেশিক বাণিজ্যসংক্রান্ত স্বার্থের পরিপূরক হবে!
শেখ মুজিব তাঁর এই বক্তব্যে পিপিপির আসল চেহারা উন্মােচনের চেষ্টা করেন যে, এর আগে পিপিপি স্বীকার করেছে, বাস্তবিকপক্ষেই পূর্ব পাকিস্তান উপনিবেশ ছিল। অথচ এখন সেই পিপিপিই ছয়-দফার কোনাে কোনাে ব্যবস্থার বিরােধিতা করে আসলে কি স্ববিরােধিতা করছে না? তাঁর মতে, ছয়-দফার এ সব ব্যবস্থার সরল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলাে বৈদেশিক বাণিজ্য, বৈদেশিক সহায়তা ও বৈদেশিক মুদ্রার মতাে বিষয়কে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উপনিবেশবাদী শােষণের যে ব্যবস্থা আরােপ করা হয়েছে সেই ব্যবস্থাকে নাকচ করে দেওয়া। তিনি পিপিপির এই অভিযােগ অস্বীকার করেন যে, আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর এই বলে ছয়-দফা চাপিয়ে দিতে চেয়েছে যে কোনাে ইউনিট মনে করলে তার কিছু ক্ষমতা কেন্দ্রকে ছেড়ে দিতে পারে। শেখ মুজিব তাঁর এই যে অবস্থানের কথা বললেন তা যদিও আরাে বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সাপেক্ষ ও কিছুটা এক তরফাও শােনায় তবুও এটি যতােটা মনে করা হয় আসলে ততােটা উদ্ভট নয়। একই বিষয় ঘুরিয়ে বললে দাড়ায়, পশ্চিম পাকিস্তানের ফেডারেশন ইউনিটগুলিও ইচ্ছা করলে সাধারণ পর্যায়ে গ্রহণযােগ্য স্বায়ত্তশাসন ভােগ করতে পারে আর তার পাশাপাশি কোনাে কোনাে অনিবার্য কারণে পূর্ব পাকিস্তান বিশেষ মর্যাদা ভােগ করবে।
ভুট্টো ও তার দল পিপিপির অবস্থানের মতলবটি উন্মােচনে শেখ মুজিবের বক্তব্যে তাঁর এই বিশ্বাস প্রচ্ছন্ন যে, ভুট্টো ও তাঁর দলের অবস্থান মূলত সে সব ষড়যন্ত্রকারীদেরই চক্রান্ত যারা বরাবর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। তার ধারণা “এভাবেই জনগণের হাতে ক্ষমতার হস্তান্তরকে কূটাঘাত করতে চাওয়া হয়েছে।” ঝড়ের আগে তুলনামূলক থমথমে অবস্থার মতাে বাহ্যত পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত মনে হলেও ভেতরে যে আগ্নেয় সক্রিয়তার ধারাপ্রবাহ চলেছে ও আওয়ামী লীগও যে সে বিষয়ে সজাগ ছিল শেখ মুজিব এই সচেতনতাকেই পরিষ্কার করে তুললেন। একইসঙ্গে তিনি এও জানিয়ে দিলেন যে, ঘটনার একের পর এক উন্মােচনের মিছিলের নীরব দর্শক হয়ে থাকবে না আওয়ামী লীগ। তিনি বলেন:
পাকিস্তানের সচেতন জনসাধারণের মনে কোনাে সন্দেহ থাকার অবকাশমাত্র নেই যে, কুচক্রী, কায়েমি স্বার্থবাদী মহল ও তাদের দোসররা জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা একটি শাসনতন্ত্র অনুমােদন ও তাদের হাতে ক্ষমতার হস্তান্তর বানচাল করার জন্য বেপরােয়া শেষ চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। তাদের এই বেপরােয়াভাব এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, তারা
২৪১
পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি নিয়ে উদ্বিগ্নতার ভান করলেও আসলে তারা সেই পাকিস্তানের অস্তিত্ব নিয়েই জুয়া খেলার বাজি ধরতেও তৈরি। ওরা হলাে সেই মহল যারা পাকিস্তানের নংহতিতে মারণাঘাত করতে চলেছে। আর এভাবে নস্যাৎ করতে চলেছে এক গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এক সাথে থাকার এক ভিত্তি বের করার জন্য পাকিস্তানী জনসাধারণের শেষ সুযােগকে।
ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের জন্য একটা টেকসই শাসনতন্ত্র দেওয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রতিটি অংশের প্রত্যেক এমএনএ’র প্রতি সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত বা নস্যাৎ করার চক্রান্ত প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে নিজেদের প্রস্তুত করার জন্য “পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়িত মানুষ” এবং “বাংলাদেশের জাগ্রত মানুষ” তথা চাষী, শ্রমিক ও ছাত্রদের প্রতি নিজেদেরকে প্রস্তুত করার ডাক দেন। তিনি সকল পাকিস্তানীর প্রতি এই বলে উদাত্ত আবেদন জানান; “বাংলাদেশ, পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের জাগ্রত জনসাধারণের পবিত্র দায়িত্ব হবে চক্রান্তকারীদের প্রতিরােধ করা।” তিনি বিশেষ করে বাংলাদেশের জাগ্রত জনসাধারণকে সম্ভব সকল উপায়ে গণবিরােধী শক্তিগুলিকে প্রতিরােধ করতে তৈরি হতে বলেন যাতে ঐ সব “গণবিরােধী শক্তিকে আমাদের মাটি থেকে উৎখাত করা যায়।” তিনি আরাে বলেন, “আমরা প্রয়ােজনে আমাদের জীবনদান করবাে—এই মর্মে আজকে আমরা নতুন করে শপথ নিচ্ছি যাতে করে আমাদের আগামী বংশধরেরা কোনাে উপনিবেশের অধিবাসী হয়ে এক ‘মুক্ত দেশের মুক্ত মানুষ হিসেবে স্বাধীনভাবে মর্যাদার সাথে বসবাস করতে পারে। তাঁর এই মুক্তদেশ’ কথাটির অর্থ ঐ বিশেষ পরিস্থিতির পটভূমিকায় স্পষ্টত দ্ব্যর্থক ছিল। এই “আগামী বংশধর’ [বাংলাদেশের] হয় এক ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানে বাস করবে যেখানে তারাও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রদত্ত স্বাধীনতাগুলি প্রয়ােগ করতে পারবে, আর যদি তা সম্ভব না হয়, তারা বাস করবে সম্পূর্ণত “মুক্ত বাংলাদেশে।৪৪
একই সংকল্পের কথা নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নির্বাচিত এমএনএ এএইচএম কামারুজ্জামান ব্যক্ত করেছিলেন এক মাসেরও বেশি আগে রাজশাহী স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সদর মহকুমার ১৫০০ কর্মীর এক সম্মেলনে। তিনি বলেছিলেন: “পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা যদি ছয়-দফা ও এগারাে-দফা দাবিকে পাশ কাটাতে চেষ্টা করেন, তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘােষণা দেওয়া হবে।” কামারুজ্জামান হয়তাে এ কথা বলেছিলেন মওলানা ভাসানীকে সামাল দেওয়ার জন্য। মাত্র দু’দিন আগে মওলানা ভাসানী ঐ একই শহরের মাদ্রাসা ময়দানের জনসভার উদ্দেশে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন যে, লাহাের প্রস্তাবের ধারণায় এক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে স্বাধীন ও সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাগ্রত বাঙালির উচিত হবে ২৩ বছরের শােষণের অবসান ঘটানাে।৪৫ তবে নিরেট বাস্তবতা হলাে এই যে, আওয়ামী লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা কামারুজ্জামান এই বিবৃতি দেন, যার সাথে কিছু পশ্চিম পাকিস্তানী
২৪২
নেতার ব্যক্তিগত যােগাযােগও ছিল। এ থেকে পরিষ্কার বােঝা যায়, আওয়ামী লীগের হাতে বিকল্প তেমন কিছু ছিল না। ছয়-দফায় যে সব অধিকারের অঙ্গীকার রয়েছে পূর্ব পাকিস্তানকে সে সব দেওয়ার জন্য দলটি যে কোনাে পর্যায়ে যেতে, এমনকি তাতে পাকিস্তানের অবশিষ্টাংশ থেকে বিচ্ছিন্নতা বােঝালেও তার জন্য তৈরি ছিল। তবে এ ধরনের চূড়ান্ত পরিণতি তারা নিশ্চয়ই এড়াতে চাচ্ছিলেন।
পাকিস্তানের বাদবাকি অংশ সম্পর্কে বলা যায়, তাদের জন্য প্রশ্ন জটিল হলেও সরলও বটে। আওয়ামী লীগকে যদি জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়া হয় তাহলে পূর্ব পাকিস্তানকে উপনিবেশ করে রাখার হাতিয়ারটি হারিয়ে যাবে চিরতরে আর দেশের অন্যান্য অঞ্চল আওয়ামী লীগের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কার্যত কেন্দ্রাধীন থাকবে না আর তাতে কেন্দ্র একেবারে অচল না হলেও দুর্বল হয়ে পড়বে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের দাবি না মেনে নিলে তাতে বড়জোর পূর্ব পাকিস্তানই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং সম্ভবত পাকিস্তানের বাদবাকি অঞ্চলগুলি আগের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ হবে। কাজেই শেষােক্ত বিকল্পটি স্পষ্টত কম ভয়াবহ ও সেটির নিরীক্ষা অর্থবহ। বস্তুত পূর্ব পাকিস্তানের এ বিষয়টি জানা ছিল। পূর্ব পাকিস্তান জানতাে যে, সাধারণ গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসারে, পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠের। শাসন কখনাে অর্জন করা সম্ভব হবে না। আর এই সত্য উপলব্ধির বিষয়টি খুবই তীক্ষ, শাণিত ভাষায় ব্যক্ত করেছেন আবুল মনসুর আহমদ। যারা মনে করেন, পাকিস্তানে “সংখ্যালঘিষ্ঠের একনায়কত্ব” চিরকালের নির্ধারিত নিয়তি তাঁদের যুক্তিকে তিনি শ্লেষাত্মকভাবে উপস্থাপন করেছেন। সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ও তৎকালে পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ। সভাপতি আতাউর রহমান খান সংবাদপত্রে দেওয়া এক বিবৃতিতে ভুট্টোকে পুঁজিপতিআমলা আঁতাতের “ক্রীড়নক” বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।৪৬
এভাবে সংঘাত আসন্ন হয়ে ওঠে। তবে ইয়াহিয়া খান তখনাে শাসনতন্ত্র প্রশ্নে নিজ অবস্থান স্পষ্ট করেননি যাতে করে পাকিস্তানের জনসাধারণ গণতন্ত্রের প্রতি চূড়ান্ত হুমকির মােকাবেলায় নিজেদের তৈরি করতে পারে। আর এ রকমও মনে করা হচ্ছিল, এটি সম্ভব। নয় যে এহেন অগ্রসর অবস্থায় মুজিব মুখােমুখি সংঘাতকে পাশ কাটিয়ে যাবেন, কারণ দেশে আগুন তখন প্রকট রূপ ধারণ করেছিল।৪৭
ইয়াহিয়া খান সত্যিই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে চেয়েছিলেন— এ কথা ধরে নিলেও প্রশ্ন থেকে যায়, কোনাে স্বাধীন অবস্থান নেওয়ার মতাে অবস্থা তাঁর ছিল কি? পরিস্থিতিগত আভাস পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এর সুনির্দিষ্টপ্রায় জবাব: সে রকম অবস্থা তার ছিল না। ঐ সময়ে রাওয়ালপিণ্ডিতে কর্তব্যে নিয়ােজিত একজন বাঙালি সাংবাদিকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় জেনারেল ও আমলা রাওয়ালপিণ্ডির প্রেসিডেন্ট হাউসে এক জরুরি সভায় মিলিত হন। উল্লিখিত আমলাদের মধ্যে প্রেসিডেন্টের বক্তৃতা-ভাষণ, বিবৃতি ইত্যাদির একজন “ছায়া লেখকও ছিলেন। দিনটি ছিল ছুটির দিন। আর প্রেসিডেন্ট রওনা দিয়েছিলেন করাচির উদ্দেশে। ঢাকার পথে, ঢাকায় ১৯৭১ সালের ৩ মার্চে প্রস্তাবিত জাতীয় সংসদের উদ্বোধনী অধিবেশনে
২৪৩
যােগ দিতে। উল্লিখিত জেনারেলদের তিনজন ঐ একই সন্ধ্যায় বিমানে করাচি পৌঁছান।৪৮ আর এরপর ১৯৭১ সালের ১ মার্চের এক অস্বাভাবিক সময়ে জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় প্রেসিডেন্টের এক ঘােষণায় । আইয়ুব খানের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলি সাধারণত সন্ধ্যার দিকে ব্যক্তিগতভাবে টিভি/বেতার সম্প্রচারে জানিয়ে দিতেন। কিন্তু তার জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন স্থগিত করার এ অতীব নাজুক ও গুরুত্বপূর্ণ ঘােষণাটি এক অজ্ঞাতনামা ঘােষক দুপুরে পাঠ করে সম্প্রচারিত করায় তাতে জনসাধারণ হতবাক ও আশঙ্কিত হন। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ৪৯ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধন করা হলে খাইবার থেকে করাচি হরতাল ডাকবেন বলে ভুট্টো তাঁর যে সুবিখ্যাত ঘােষণাটি দিয়েছিলেন তার অল্পসময় পরেই প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে এ ঘােষণা দেওয়া হয়। ফলে প্রেসিডেন্টের ঘােষণা আরাে তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে।
এও যদি ধরে নেওয়া যায়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নিজেই তাঁর এ সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন তাহলেও বাহ্যত মনে হয় তিনি ভুট্টোর চরমপত্রের অপেক্ষায় ছিলেন। ভুট্টোর আবেগময়, অলঙ্কারবহুল বক্তৃতার পরিষ্কার সারবস্তুটি ছিল এই যে, এমন শাসনতন্ত্র কখনাে তাঁর কাছে গ্রহণযােগ্য হবে না যার আওতায় বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্যের ব্যবস্থাপনা প্রদেশের হাতে যাবে। এ ছাড়া তিনি জাতীয় পরিষদের মিলিত হওয়ার আগে এই ইস্যুর নিষ্পত্তি না হলে দুটি বিকল্পের ধারণা দেন। এক, পরিষদ বিলােপ ও সামরিক আইন বহাল রাখা। আর দুই, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন উদ্বোধন বাতিল এবং শাসনতন্ত্র প্রণয়নে ১২০ দিনের যে সময়সীমা রয়েছে তা তুলে দেওয়া।৫০ তাঁর এই দুই বিকল্প প্রস্তাবেই ক্ষমতা হস্তান্তর স্থগিত রাখার ইঙ্গিত নিহিত ছিল।
প্রেসিডেন্টের নামে পড়া ঐ বিবৃতিতে ব্যাখ্যা দেওয়া হয় যে, প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্রের বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটা ঐকমত্য গড়ে তােলার ব্যর্থতার কারণে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক মােকাবেলা-সংঘাতের মতাে একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আর পিপিপি ও অন্য কয়েকটি দল জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনে যােগ দিতে অস্বীকৃতি জানানাের ফলে তাঁর হাতে কোনাে বিকল্প নেই। তিনি নিরুপায় হয়ে পড়েছেন। এখানে তাৎপর্যের বিষয় এই যে, জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী স্থগিত রাখার জন্য আংশিকভাবে ভারতকেও দায়ী করা হয়। কেননা, অভিযােগ করা হয় যে, ভারত পাকিস্তানবিরােধী প্রচারণার মাধ্যমে বর্তমান উত্তেজনায় ইন্ধন যােগাচ্ছে।৫১
ভুট্টো যখন তাঁর চরমপত্রের কথা ঘােষণা করার পরিকল্পনা করছিলেন আর পাকিস্তানের সিদ্ধান্ত প্রণেতারা ওটা তামিল করার অপেক্ষা করছিলেন তখন আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের ৩০ সদস্যের এক কমিটি দলের পক্ষ থেকে জাতীয় পরিষদে যে খসড়া শাসনতন্ত্র বিল পেশ করা হবে তার প্রতিটি দফা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যস্ত ছিলেন। বিলের বিস্তারিত প্রকাশ না করা হলেও, জানা যায়, এ বিলে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলির জন্য ছয়দফার বিকল্প সন্নিবেশিত করা হয়। খসড়া বিলে ১৮৮টি অনুচ্ছেদ, দশটি তফসিল এবং
২৪৪
ফেডারেশনের ইউনিটগুলির মধ্যে যােগাযােগ রক্ষার জন্য এক ফেডারেল সমন্বয় সংস্থার ব্যবস্থা রাখা হয়। এ ছাড়া এই মর্মে একটি ফেডারেল ফাইন্যান্স কমিশনেরও প্রস্তাব ছিল যে, কমিশনের কাজ হবে প্রতি পাঁচ বছর পর বিভিন্ন ইউনিটের জন্য ফেডারেল লেভি বা করের হার পর্যালােচনা ও পুনর্বিবেচনা করা। ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগ যে সব শাসনতান্ত্রিক সংশােধনীর প্রস্তাব করে মূলত সে সবের ভিত্তিতেই শাসনতন্ত্রের খসড়া তৈরি করা হয় বলেই মনে করা হয়।
রেডিও পাকিস্তানের সম্প্রচারে যখন জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘােষণা দেওয়া হয় তখনাে ঢাকার একটি হােটেলে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। বাস্তবিকপক্ষে গােটা ঢাকা নগর ঐ ঘােষণার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া প্রকাশের (সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যা সরকারি প্রেসনােটসহ সকল মহল স্বীকার করে) পরই কেবল তাঁরা এ ঘটনার কথা অবহিত হন। সরকারি অফিস, আদালত, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিল্প স্থাপনা ইত্যাদি থেকে লােকজন শােভাযাত্রা করে হয় পূর্বাণী হােটেলে (যেখানে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দল বৈঠকরত ছিল) কিংবা পল্টন ময়দানে (বড় সভাসমিতির জন্য সাধারণভাবে নির্ধারিত মাঠ) পৌঁছায়। “ইয়াহিয়ার ঘােষণা, বাঙালিরা মানে না”—শ্লোগানে আকাশবাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। নগরের বাস সার্ভিসের চলাচল থেমে যায়, দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা স্টেডিয়ামে এ সময় একটি আন্তর্জাতিক খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, প্রতিবাদ মিছিলে যােগ দিতে দর্শকরা মিছিল করে বেরিয়ে এলে ঐ খেলার অনুষ্ঠান পরিত্যক্ত হয়।৫২ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃবৃন্দ এবং শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাবিষ্ট জনতার উদ্দেশে বক্তৃতা দেন। এ জনতা জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে তাদের আস্থা পুনর্ব্যক্ত করে। ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী জানান যে পল্টন ময়দানে বক্তৃতা দেওয়ার আগে তিনি নিজে, ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদুস মাখন এবং (সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এবং ১৯৬৮-৬৯ সালের আন্দোলনের অন্যতম নেতা) তােফায়েল আহমদ এমএনএ পূর্বাণী হােটেলে শেখ মুজিবের সাথে মিলিত হন। তার পরামর্শ অনুযায়ী শেখ ফজলুল হক মণি ও তারা তিনজন কোনাে কোনাে ছাত্র ইউনিয়ন নেতার সাথে আলােচনা করেন। কিন্তু সর্বসম্মত ঐকমত্যে পৌঁছানাে সম্ভব হয়নি। তাই ঐ নেতারা অনতিবিলম্বে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়ে শেখ মুজিবের পরামর্শ অনুযায়ী পল্টন ময়দানে যান। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে নূরে আলম সিদ্দিকী স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তথা এসবিসিএসপি গঠনের কথা ঘােষণা করেন। তিনি আরাে ঘােষণা করেন যে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে তাঁরা তাঁদের কৌশল বদলেছেন। এখন থেকে প্রতিটি আঘাতের বিরুদ্ধে পাল্টা আঘাত হেনে জবাব দেওয়া হবে।” তাঁদের সবাই “স্বাধীন বাংলা” প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, এত তাড়াতাড়ি “স্বাধীন বাংলার শ্লোগান তােলার জন্য কোনাে কোনাে মহল থেকে তাদের তীব্র সমালােচনা করা হয়।
২৪৫
আর তাতে করে শেখ মুজিবের ওপর চাপ বাড়ে।৫৩ তবে এটি বুঝতে অসুবিধা হয় না, শেখ মুজিবের প্রচ্ছন্ন অনুমােদন ছাড়া ছাত্ররা এটা করতে পারতাে না।
প্রেসিডেন্টের ঘােষণাকে আওয়ামী লীগ চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়। শেখ মুজিব সাংবাদিকদের জানান যে, একটি সংখ্যালঘিষ্ঠ দলকে তােষামােদ করার নীতিকে বিনাপ্রতিবাদে মেনে নেওয়া যায় না। তবে এ ধরনের অসন্তোষের চূড়ান্ত অভিব্যক্তি প্রকাশের পূর্বে প্রাথমিক প্রতিবাদের পর সরকারের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা সময়ের দরকার ছিল। তাই শেখ মুজিব ইতােমধ্যে পরিস্থিতিতে যথেষ্ট পরিবর্তন না ঘটলে আগামী কর্মসূচি কী হবে সে বিষয়ে তিনি ৭ মার্চ এক জনসভায় ঘােষণা দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। ইতােমধ্যে ঢাকা ও গােটা প্রদেশে যথাক্রমে ২ ও ৩ মার্চ হরতাল পালনের কথা বলা হয়। তিনি ঘােষণা করেন, অতঃপর যা কিছু ঘটবে তার পরিণতির জন্য তিনি জবাবদিহি হবেন না। পরের দিন কেবল ঢাকার জন্য হরতাল ডাকা হলেও তা গােটা পূর্ব পাকিস্তানে পালিত হয়।৫৪ এতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, জনসমষ্টির অংশবিশেষ কিংবা আওয়ামী লীগের গােষ্ঠীবিশেষই শুধু নয় বরং পূর্ব পাকিস্তানের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সাথে একাত্ম রয়েছে।
১ ও ২ মার্চ কোনাে কোনাে স্থানে বিক্ষিপ্ত সহিংসতা ঘটে। তবে আরাে বেশি সহিংসতা হবে বলেই আশঙ্কা করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর অ্যাডমিরাল আহসানকে ঐ দিনই তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক সাহেবজাদা ইয়াকুবকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হয়। তিনি অনতিবিলম্বে সংবাদপত্রের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরােপ করেন যদিও তা আদৌ তেমন প্রতিপালিত হয়নি। মনে করা হয়ে থাকে যে, অ্যাডমিরাল আহসান মুজিবের সাথে সংঘাতে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন ইয়াহিয়াকে, কেননা তা পাকিস্তানের জন্য বিপর্যয়কর হবে।
আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে পরােক্ষ প্রতিরােধের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেও মাঝে মাঝেই সরকার সহিংস ব্যবস্থা গ্রহণ করায় তা থেকে আরাে সহিংসতা ঘটে। তবে সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের জন্য অধিকতর তাৎপর্যময় ও উস্কানি হয়ে দেখা দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে এক অহিংস ঘটনায়। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ আহূত এক বিরাট জনসভায় পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে ফেলে বাংলাদেশের নামে এক পতাকা উত্তোলন করা হয়। সভার সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী স্বীকার করেছেন, এ ধরনের আদৌ কিছুর পরিকল্পনা ছিল না । যা হােক, পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা যখন পােড়ানাে হচ্ছিল, সভার জনতা তখন ঐ পতাকার একটি বিকল্প দাবি করে। হাতের কাছে তখন ছাত্রলীগের ‘জঙ্গি-বাহিনী’র। (এই বাহিনী ১৯৭০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হকের স্মরণে গঠন করা হয়েছিল) কাছে একটা পতাকা পাওয়া যায়, যে পতাকায় ছিল লালবৃত্তের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্রের সােনালি রঙের রূপরেখা যার পটভূমি হিসেবে সবুজের জমিনে দেখানাে হয়েছে পূর্ণ উদিত সূর্য।৫৫ এই পতাকা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতীক হয়ে ওঠে।৫৬ এই সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম নিরবচ্ছিন্ন
২৪৬
রাখার শপথ এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েমের অঙ্গীকার করা হয়।৫৭ আওয়ামী লীগ অহিংস থাকার জন্য জনগণের কাছে আবেদন জানিয়ে যেতে থাকে। ২ মার্চে সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে শেখ মুজিব ৩ মার্চের পূর্ণ হরতালের পর ৭ মার্চ অবধি প্রতিদিন দেশব্যাপী আংশিক ধর্মঘটের কর্মসূচি ঘােষণা করেন। তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত করার জন্য শােক হিসেবে এ ধর্মঘট পালিত হবে। সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ ঢাকায় ২ মার্চ থেকে সান্ধ্য আইন জারি করলেও তা সংবাদপত্রের ওপর আরােপিত কড়াকড়ির মতােই কার্যকর হয়নি।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে এক বিরাট ও অভূতপূর্ব জনসমাবেশ ঘটে। এই জনসভায় লােকজন হাতে করে বাঁশের লাঠি উঁচিয়ে আসে ক্ষুব্ধ প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে। সে দিনের সভাটির আহ্বায়ক ছিল ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। ইতােমধ্যে পরিষদ ১নং ইশতেহার নামে তাদের পয়লা বুলেটিন তৈরি করেছিল স্বাধিকার আন্দোলনে পরিষদের প্রথম নির্দেশিকা দলিল হিসেবে।৫৮
তিনটি মৌলিক উদ্দেশ্যে ইশতেহারে এক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘােষণা দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য তিনটি হলাে:
১. বিশ্বসভায় এক উন্নত বলিষ্ঠ বাঙালি জাতি সৃষ্টির মাধ্যমে বাঙালির ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশ;
২. আঞ্চলিক ও শ্রেণীগত পার্থক্যের পরিপূর্ণ উচ্ছেদ, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও কৃষক শ্রমিকের শাসন প্রতিষ্ঠা; এবং
৩. বিশেষ করে, বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং পূর্ণ ব্যক্তিগত স্বাধীন মতামতসহ নিখাদ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।
ইশতেহারে দফাক্রমে আসন্ন সংগ্রামের কার্যপদ্ধতিগুলি নির্দেশ করা হয়। এগুলির অন্তর্ভুক্ত ছিল: গ্রাম, মহল্লা, থানা, মহকুমা, নগর ও জেলা পর্যায়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং শিল্প এলাকা ও পল্লী জনপদে যথাক্রমে শ্রমিক ও কৃষকদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী’ গঠন।
ইশতেহার অনুযায়ী বর্তমান সরকারকে বিদেশী, ঔপনিবেশিক, শােষক শাসকগােষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে ও এই সরকার কর্তৃক জারিকৃত সকল আইনকে সে কারণে অবৈধ গণ্য করতে হবে। তথাকথিত পাকিস্তানী বাহিনীর অবাঙালি সামরিক লােকজনকে ‘অবৈধ ক্ষমতাদখলকারী’ বলে বিবেচনা করতে হবে আর তাদের মধ্যে হামলাকারীদের ‘খতম করতে হবে। ইশতেহারে সশস্ত্র প্রতিরক্ষার জন্য প্রস্তুতির আহ্বান জানানাে হয় যাতে মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর যে কোনাে আঘাত হানার প্রয়াস কার্যকরভাবে প্রতিহত করা যায়। এ ছাড়া, ‘ঔপনিবেশিক সরকারকে কর ও খাজনা প্রদান বন্ধ রাখার, পশ্চিম পাকিস্তানী পণ্য বর্জন করার, পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে ফেলার ও পরিবর্তে বাংলাদেশের পতাকা ব্যবহারের ডাক দেওয়া হয়। কবি রবীন্দ্রনাথের একটি সঙ্গীতকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত
২৪৭
হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ইশতেহারে মুক্তিযােদ্ধাদেরকে সম্ভব সব রকম সহযােগিতা দেওয়ার জন্য জনসাধারণের প্রতি আবেদন জানানাে হয়। পরিশেষে ইশতেহারে “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক’ ঘােষণা করা হয়। ইশতেহারে মুক্তিসংগ্রামকালে ব্যবহার্য শ্লোগানের একটি তালিকাও দেওয়া হয়। ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে উল্লিখিত সভায় শেখ মুজিবুর রহমান ও আরাে অনেকে ভাষণ দেন।
ছাত্র নেতারা ইশতেহার পাঠ করা ছাড়াও উল্লেখ করেন যে, শুধুমাত্র ভৌগােলিক সীমারেখা বা অঞ্চলের স্বাধীনতাই তাঁদের সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। জনগণের সত্যিকারের মুক্তির বাস্তবায়নও চূড়ান্ত উদ্দেশ্য। তাঁরা মতপ্রকাশ করেন যে, একটি গণতান্ত্রিক ও শােষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আদর্শাভিসারী সংগ্রামের প্রয়ােজন। তারা শপথ নেন যে, তাঁরা তাঁদের রক্তের মূল্যে উল্লিখিত উদ্দেশ্য অর্জনে প্রস্তুত।
ইশতেহারে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে দীর্ঘায়িত, বৈপ্লবিক সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য পরিষ্কার আহ্বান জানিয়ে বলা হয় যে জাতীয় মুক্তি অর্জনের পর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সমাজবাদী ধারায় জাতীয় পুনর্গঠন বাস্তবায়িত করা হবে। এ সবের আলােকে দেখা যায়, মুজিব প্রদেশের দুটি পরস্পরবিরােধী রাজনৈতিক শক্তির প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। এর একটি শক্তি ছিল আওয়ামী লীগের নিয়মতান্ত্রিক সংস্কারবাদের প্রতিনিধি, অন্যটি সশস্ত্র সংগ্রামের প্রবক্তা। কিন্তু তিনি কার্যপরিচালনার দিক থেকে অহিংস পন্থার পক্ষপাতী ছিলেন, আর তাই তিনি শর্তযুক্ত হলেও “অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীদেরকে সময় দিয়েছিলেন। তিনি বারংবার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, পরিস্থিতি না বদলালে পরিণতির জন্য তিনি দায়ী হবেন না। তদবধি তিনি প্রতিদিন সকাল ছয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন হরতালের ডাক দেন। সরকারি, আধাসরকারি ও বেসরকারি সকল সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানে এ হরতাল পালিত হবে। হাইকোর্ট ও অন্যান্য আদালত এর আওতায় থাকবে। এ সময় তিনি এক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “পশ্চিম পাকিস্তান যদি এক শাসনতন্ত্র না চায় তাহলে দুটি শাসনতন্ত্রই হােক আর তারপর দেখা যাক আমরা পরস্পরের ভাই হিসেবে একত্রে বাস করতে পারি কি না।” স্পষ্টত এ উক্তির একাধিক ব্যাখ্যা হতে পারে।
একদিক থেকে এই সভাটি পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত ৭ মার্চের সভা ও অন্যান্য সভার মতাে স্মরণীয় না হলেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই সভাস্থলেই শেখ মুজিব তাঁর হেঁয়ালিময় ভূমিকাসমূহের রহস্যের পর্দা সরিয়ে দেন। তাঁর দেওয়া বিকল্প প্রস্তাবগুলির ভাবার্থ ছিল এ রকম:
১. জাতীয় পরিষদের সভা ডাকুন—শাসনতন্ত্র রচনা নিয়ে সেখানে আলােচনা। হােক। আর তার ফলাফল যা-ই হােক শােভনভাবে মেনে নিন। সবচেয়ে খারাপ কিছু হলে পাকিস্তান কনফেডারেশন হতে পারে—একটা উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক কাঠামাের মধ্যে আর সেই সাথে একটু ঝোঁক থাকবে সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার
২৪৮
প্রতি (আর সেটা ছয়-দফার সঙ্গে সঙ্গে এগারাে-দফার বাস্তবায়নে অর্জিত হতে পারে যা পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অঞ্চলের ফলপ্রসূ নেতৃত্বের মাধ্যমে সম্ভব);
২. শান্তিপূর্ণভাবে দেশের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান শাসনতন্ত্রসহ আলাদা হয়ে যাক। আর তারপর বহু আর্থ-সামাজিক পারস্পরিক সম্পূরকতাসহ দুটি ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ হিসেবে বসবাসের চেষ্টা করুক;
৩. উল্লিখিত দুটি প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করে সহিংস পন্থায় প্রয়ােজনে এক দীর্ঘায়িত সগ্রামের মাধ্যমে সমাজ পুনর্নির্মাণের ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ প্রত্যয়ী নেতৃত্বে পূর্বাঞ্চলে দীর্ঘায়িত বৈরিতার পরিণতির মােকাবেলা করুন।
এ বিকল্পের প্রস্তাব স্বভাবতই শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের কট্টর” ও কপটাচারী মহলকে দেওয়া হয়নি, প্রস্তাবটি দেওয়া হয় একই শ্রেণীর পূর্ব পাকিস্তানী মহলের কাছেও যাতে এদের কারও কারও পক্ষে তাদের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থ এ বিকল্পগুলি কীভাবে প্রভাবিত করবে তার ভালমন্দ খতিয়ে দেখার সুবিধা হয়। এদের কারও না কারও নিশ্চয়ই উল্লিখিত প্রথম দুই প্রস্তাবের কোনাে না কোনাে বিকল্পে কায়েমি স্বার্থ থেকে থাকবে এবং নিশ্চয় পশ্চিমে তাদের অনুরূপ পক্ষদের (অবশ্য মাত্রাগত তারতম্যসহ) সাথে কিছু যােগাযােগ থাকবে যারা সিদ্ধান্ত প্রণেতাদেরকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে যতটা দেখা যায়, পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত ছিল।
এ যাবৎ শেখ মুজিব কেবল কোনাে রকম শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তিতে উপনীত হতে না পারার “ফলাফল” বা পরিণতির কথা বলে এসেছেন। কিন্তু পরিণতির সম্ভাবনা কী কী তা বিস্তারিত বলেননি। ছাত্রসভায় তাঁর উপস্থিতি তীক্ষ সুনির্দিষ্টতায় না হলেও তির্যক অস্পষ্টতায় তিনি ও তার সহযােগীরা একে কীভাবে দেখছেন তার আলােকে ভবিষ্যৎ প্রবণতার আভাস দিয়েছে। এতে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে যদি অধিক শক্তিশালী সামাজিক শক্তি নাও হয় সমান শক্তির আবির্ভাবের পাশাপাশি তার নিজের শক্তি ও সীমাবদ্ধতা প্রতিভাত হয়েছে।
ছাত্রসভায় তাঁর এই বক্তৃতা এবং সেই সাথে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আহূত নেতাদের সম্মেলনে যােগ দিতে তার অস্বীকৃতি বাস্তবিকপক্ষেই পরিস্থিতিকে একেবারে মুখােমুখি সংঘাত” অবস্থায় নিয়ে যায়। তিনি এই প্রস্তাবকে এক নিষ্ঠুর তামাশা’ বলে অভিহিত করেন। কেননা, এ প্রস্তাব আসছে সরকারের সহিংস দমনমূলক কার্যব্যবস্থা গ্রহণের পর। তিনি উল্লেখ করেন, “বিষয়টি বেশি করেই তা-ই, কেননা, আমাদেরকে এমন সব লােকের সাথে বসতে বলা হচ্ছে যাদের সন্দেহজনক কলকাঠি নাড়াই নিরপরাধ ও নিরস্ত্র কৃষক, মজুর, ছাত্রের প্রাণহানির জন্য দায়ী।” তিনি বলেন, এ দাওয়াত হলাে “বন্দুকের নলের মুখে” দাওয়াত, যা কবুল করার প্রশ্নই ওঠে না।৫৯
ইতােমধ্যে ওয়ালী ন্যাপ ১৯৭১ সালের ২ মার্চে জাতীয় সংসদের উদ্বোধনী অধিবেশন বাতিলের প্রতিবাদ জানাতে পল্টন ময়দানে এক সভার আয়ােজন করে। এই সভায় দলটি
২৪৯
পরিষ্কার দাবি করে যে, “মার্কিন সাম্রাজ্যবাদও” এ চক্রান্তের শামিল।৬০ ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ মতিয়াপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন শহীদ মিনারে এক জনসভা করে এবং ব্যারাকে ফেরার জন্য সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানায়। সভায় বিশেষ গুরুত্বসহকারে বলা হয়, এটি কোনাে অনুরােধ নয় বরং ছাত্র সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে নির্দেশ। এভাবে সূচনার পর মতিয়া ছাত্র ইউনিয়ন কার্যত প্রতিদিনই শহীদ মিনারে সভা করতে থাকে যার অর্থ ছিল এই যে, তারা তখনাে স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখছিল। ফলে এসবিসিএসপির পুরােটাই ছাত্রলীগের করায়ত্ত থেকে যায়। এটি একদিক থেকে রীতিমতাে লক্ষ্য করার মতাে বিষয়, কেননা, এই প্রথমবারের মতাে এক সঙ্কট সন্ধিক্ষণে ছাত্র সংগঠনগুলি তাদের মতপার্থক্য তাকে তুলে রেখে একটি অভিন্ন কর্মসূচিতে কাজ করার জন্য মিলেমিশে গেল না। মতিয়া ছাত্র ইউনিয়ন হয়তােবা সিদ্ধান্তহীনতার শিকার, কেননা, এসবিসিএসপি প্রকাশ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের ডাক দিয়েছিল যার নিহিত তাৎপর্য ছিল পাকিস্তানের অনিবার্য ভাঙন অথচ নিখিল পাকিস্তান ওয়ালী ন্যাপপ্রধান ওয়ালী খান পাকিস্তান ভাঙার যে কোনাে আভাসের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সুস্পষ্ট মতপ্রকাশ করেছিলেন। কাজেই ওয়ালী ন্যাপের সাথে সংসর্গ ছেদ না করে মতিয়াপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে প্রকাশ্যে এসবিসিএসপিতে যােগ দেওয়া সম্ভব ছিল না।৬১
আওয়ামী লীগ তখনাে তার পরােক্ষ প্রতিরােধের নীতি আনুষ্ঠানিকভাবে আঁকড়ে থাকলেও সক্রিয় প্রতিরােধের জন্য প্রস্তুতির বিষয়টি কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলের ছাত্রদের মধ্যে সীমিত থাকেনি আর সেটি নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে অজানা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষকরাও তাদের সাথে যােগ দেয়।৬২ এ ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানে কর্মস্থলে নিয়ােজিত ও ছুটিতে পূর্ব পাকিস্তানে আগত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও তাদের নিজস্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলেন। এঁরা সকলেই সর্বাত্মক এক সশস্ত্র সংগ্রামের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তারা আশা করছিলেন, তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ৬৩ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করবেন। তবে সে জিনিসটি তাদের বাঞ্ছিত আকারে আসেনি। আঙ্গিকের দিক থেকে শেখ মুজিবের ভাষণ কোনাে স্বাধীনতার ঘােষণা না হলেও বিষয়বস্তু বিবেচনায় এটি পরিপূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে সংগ্রামের ডাক ছিল সুনিশ্চয়।৬৪
সেই সময়ে স্বাধীনতা ঘােষণা না করার ব্যাপারে মুজিবের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা ছিল কিনা তা নিয়ে ঢের বিতর্ক হয়েছে, এখনাে সম্ভবত চলছে, কেউ এ বিষয়টিকে “তার ব্যর্থতা” হিসেবে অভিহিতও করেছে, তবু কম রক্তপাত, কিংবা রেসকোর্স ময়দানে গােটা নেতৃত্ব নিশ্চিহ্ন হওয়া কিংবা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর গদি পাওয়ার সম্ভাবনা ইত্যাদির আলােকে পূর্ববর্তী ঘটনাবলির নিরাসক্ত, বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণে তাঁর উল্লিখিত সিদ্ধান্তের যুক্তি ছিল বলেই দেখা যাবে। এ কথা সত্যি যে, তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রক্তপাত এড়াতে চেয়েছিলেন। তিনি এও চাননি যে, সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালিরা আন্দোলনে জড়িত হােক (কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশ নিতে সামরিক বাহিনীর
২৫০
পদস্থ ব্যক্তিদের আহ্বান জানানাের ফলে সামরিক অভিজাতগােষ্ঠীর সংহতির কারণে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির সামরিকীকরণ দ্রুততর হয়েছে)।৬৫ তাই আগেভাগে তিনি রক্তপাতের দায়দায়িত্ব নেওয়া থেকেও সরে থাকবেন সেটিই তার জন্যে স্বাভাবিক। এমনকি যদি তিনি বুঝতেও পারতেন যে, রক্তপাত অনিবার্য তাহলেও কি তিনি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে (যাঁরা তাঁকে তাঁদের পক্ষে কথা বলার বৈধতা দিয়েছেন) সঙ্গতভাবেই স্বাধীনতার ঘােষণা দিতে পারতেন যেহেতু তিনি নিজে এই মর্মে জনসমক্ষে অঙ্গীকার করেছিলেন যে তিনি পরিস্থিতি বদলানাের জন্য ৭ মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন? পরিস্থিতি বদলেছিল যদিও তা তাত্ত্বিক অর্থে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ তার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেছিলেন যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা হবে। অবশ্য তিনি ঘােষণাটি দিয়েছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে এই হুমকিসহকারে যে তিনি পাকিস্তানের পরিপূর্ণ ও সর্বাত্মক সংহতির” নিশ্চয়তা বিধান করবেন।৬৬
অবশ্য, শেখ মুজিব এত বিলম্বিতভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার নিষ্ফলতার বিষয়টি অত্যন্ত তীক্ষ, শাণিত ভাষায় উল্লেখ করে এই অধিবেশনে আওয়ামী লীগের যােগদানের পক্ষে কতকগুলি পূর্বশর্ত দেন। সেগুলি হলাে:
১. অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার;
২. জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর;
৩. সামরিক বাহিনীর সকল সদস্যকে অবিলম্বে ব্যারাকে প্রত্যাহার;
৪. পূর্ববর্তী সপ্তাহে যে সব ঘটনায় লােক নিহত হয়েছে সে সব ঘটনা সম্পর্কে তদন্তানুষ্ঠান।
এ সবের অতিরিক্ত তাঁর অন্যান্য দাবি ছিল:
১. সামরিক প্রস্তুতি ও পশ্চিমাঞ্চল থেকে বিপুল সেনার আগমন রহিতকরণ;
২. বেসামরিক ব্যক্তিদের ওপর গুলিবর্ষণের আশু অবসান যাতে আর একটি বুলেটও
নিক্ষিপ্ত হয়;
৩. বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি শাখার কাজে সামরিক কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা এবং সরকারি অফিসার ও কর্মচারীদের অযথা বিপন্ন করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দান;
৪. আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব শুধুমাত্র পুলিশ ও পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের বাঙালি সদস্যদের হাতে ছেড়ে দিয়ে যেখানে প্রয়ােজন আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তা গ্রহণ।৬৭
ইয়াহিয়া খান যদি ভেবে থাকেন যে, এলএফও প্রয়ােগ করে তিনি আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্রে ভিটো প্রয়ােগ করে আওয়ামী লীগকে চিরকালের জন্য অযােগ্য
২৫১
ঘােষণা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে সামরিক আইন বহাল রাখবেন তাহলে তিনি ভুল করেছিলেন। কেননা এটি রুখতেই সামরিক আইন প্রত্যাহারের বিষয়টিকে অন্যতম পূর্বশর্ত করা হয়। সাধারণ আইনগত মানদণ্ড অনুযায়ী নির্বাচন বাতিল না করে এটি করা অসম্ভব ছিল। তবে সুনিশ্চিতভাবেই বলতে হয়, প্রেসিডেন্ট মনে করলে কিছুই তাঁকে রুখতে পারে না (তিনি নিজেও ক্ষমতায় এসেছিলেন একেবারেই অনিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ও অবৈধভাবে, কেননা তখনাে ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রটি নাকচ হয়নি)।
একটি প্রস্তাবে বলা হয়, শেখ মুজিবের উচিত ছিল নিঃশর্তভাবে পরিষদের অধিবেশনে যােগ দেওয়া। যােগ দিয়ে আওয়ামী লীগ দলীয় একজন স্পিকারের নির্বাচন নিশ্চিত করা এবং তারপর পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা ও এভাবে সামরিক আইন থেকে অব্যাহতি পাওয়ার ব্যবস্থা করা।৬৮ ১৯৭১ সালের মার্চের পরিস্থিতির আলােকে সম্ভবত এ ধারণাটি অতি আশাবাদী ও অতি সরল। কয়েকটি ব্যবস্থা আগে না নেওয়ার আলােকে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগদানে অস্বীকৃতি ছিল বাস্তবিকপক্ষে ইয়াহিয়া খানের এই প্রত্যয়ের প্রতি চ্যালেঞ্জ যে, প্রেসিডেন্ট তথা সামরিক আইন প্রশাসকের নির্দেশ প্রতিপালিত হতেই হবে।৬৯ প্রেসিডেন্টের কর্তৃত্বকে আরাে চ্যালেঞ্জ করা হয় অহিংস অসহযােগ কর্মসূচির মাধ্যমে। শেখ মুজিব ৭ মার্চ দশ-দফা কর্মসূচি ঘােষণা করলে ৮ মার্চ থেকে শুরু হয় এই অহিংস অসহযােগ আন্দোলন।৭০ আওয়ামী লীগ সরকারি ও বেসরকারি সহযােগিতায় পূর্ব পাকিস্তানে কার্যত একটি সমান্তরাল সরকার চালু করে। তাজউদ্দিন আহমদ পরে বলেন, “… এই পরিস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত। সরকার না হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ অসহযােগ আন্দোলন চলাকালে অর্থব্যবস্থা ও প্রশাসন অব্যাহত রাখার দায়িত্ব গ্রহণে বাধ্য হয়। এই দায়িত্ব পালনকালে তারা কেবল জনগণেরই নয় প্রশাসন ও ব্যবসায় সম্প্রদায়েরও অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করে।… পুলিশের সহযােগিতায় আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির একটা উপযুক্ত অবস্থা বজায় রাখে।… আওয়ামী লীগ এবং এই ঐতিহাসিক অসহযােগ আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ জনসমর্থনের মােকাবেলায় জেনারেল ইয়াহিয়া তার কৌশল সংশােধন করেছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়।”৭১
টিক্কা খানের নিয়ােগে আগামীতে কী ঘটতে যাচ্ছে তা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। কেননা, তার পরিচিতি অন্যতম কট্টর হিসেবে যার নিষ্ঠুরতার রীতিমতাে লক্ষণীয় রেকর্ড রয়েছে।
এ কারণে ২৫-২৬ মার্চ মাঝরাতে ও তারপর যা ঘটে তা অপ্রত্যাশিত ছিল না। কার্যত এটি এর পূর্ববর্তী ২৫ দিনে বিক্ষিপ্তভাবে যা ঘটেছে তারই ব্যাপক ব্যাপ্তির ধারাবাহিকতা ও নিরবচ্ছিন্নতা। তবে পার্থক্য ছিল শুধু এই যে, ঐ ২৫ দিনে পূর্ব পাকিস্তান কার্যত এক বেসরকারি সরকারের আওতায় বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয় আর যুগপৎ মুখােমুখি হয় ঐ সরকারের বিবেচনায় এক দখলদার সেনাবাহিনীর। ফলত, ১৯৭১ সালের ১৫ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যবর্তী সময়ে ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও মুজিব এবং তাঁর সহযােগীদের আলােচনায় কী ঘটেছিল সে বিষয় অবান্তর। উভয় তরফের জানা উচিত ছিল, যে মােকাবেলা
২৫২
তারা এড়াতে চাচ্ছিল কিংবা যার মুখােমুখি হতে তারা ভয় পাচ্ছিল তাদের নিজ নিজ কারণে সেই মােকাবেলাই অবধারিত, অনিবার্য হয়ে পড়েছে। এই অনিবার্যতা যদি বেশি কিছু নাও হয়ে থাকে, তা ছিল ১৯৪৭ সালে এ উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার অনুরূপ অনিবার্য।
তবু “আলাপ-আলােচনার একটা লােক দেখানাে নামাবলি গায়ে চড়ানাে হয়। তবে তাৎপর্যের বিষয় এই যে, এ সব আলােচনা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন, এমনকি, ইয়াহিয়ার ইচ্ছানুসারে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত ছিল না। বরং এই আলােচনা ছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ আওয়ামী লীগের দেওয়া শর্তের কারণে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সৃষ্ট সঙ্কট নিরসনের জন্য। অবশ্য, আওয়ামী লীগের এই যে সব শর্তের কথা বলা হচ্ছে সেগুলি পূরণ করা হলেও আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের প্রস্তাবিত অধিবেশনে যােগ দেবে এমন নিশ্চয়তা ছিল না। শেখ মুজিব শুধু এ কথাই বলেছিলেন যে, আশু দাবিগুলি মেটানাে হলে আওয়ামী লীগ এ অধিবেশনে যােগ দেবে কিনা সে বিষয়টি বিবেচনা করে দেখবে। যদি কেউ এমন কল্পনাবিলাসী থেকেও থাকেন অন্তত শেখ মুজিব ও তাঁর সহযােগীরা অবশ্যই সেই সব কল্পনাবিলাসীদের কেউ ছিলেন না। ঢাকায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. নুরুল্লাহর কথা অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের পরেই কিছু ছাত্রলীগার তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে লভ্য যন্ত্রপাতি দিয়ে একটি বেতারকেন্দ্র তৈরি করে দেওয়ার অনুরােধ জানায় ও পরে তাঁকে শেখ মুজিবের বাসভবনে নিয়ে যায়। সেখানে শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁকে একই অনুরােধ জানান। শেখ মুজিব তাঁকে বলেন, তিনি দেশবাসীর কাছে তাঁর ভাষণ পৌঁছে দেওয়ার জন্যই ওটা কাজে লাগাবেন। ড. নুরুল্লাহ জানান, শেখ মুজিব বলেন, “আমি আমার শেষ ভাষণ দিতে চাই।”৭২
আলােচনা চলাকালে শেখ মুজিবের শান্ত ও সংযত মেজাজ বহিরাগতদের কাছে অসাধারণ স্থিতিশীল মনে হলেও তাঁর সহযােগীরা জানতেন, তিনি তখন লড়ে চলেছেন এক হেরে যাওয়া খেলায়। হেরে যাওয়ার কারণ এই আলােচনায় আর কোনাে ফল হবে না , বহু চেষ্টা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত আর রক্তপাত এড়ানাে যাবে না। উভয়পক্ষ কেবল সময় কাটাচ্ছিল। ইয়াহিয়ার জন্য সময় দরকার ছিল আঘাত হানা চূড়ান্ত করার জন্য। মুজিবের সময়ের দরকার ছিল যারা আওয়ামী লীগের পতাকাতলে লড়াইয়ের নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখবেন তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থাসহ আরাে কিছু কাজ সারার। কেননা এ ছিল আওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন থেকেই সূচিত সংগ্রামের নিরবচ্ছিন্নতা—যার ধারাবাহিকতা চলে এসেছে। পাকিস্তানী রাজনীতির সংসদীয় ও সামরিক শাসনের পর্যায়গুলিতে পরিষদে ভাষণ থেকে শুরু করে বিবৃতি দান, আলােচনা ও পরিশেষে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে যা শেষাবধি পাকিস্তানী রাজনীতির গতিধর্মের প্রবণতায় রূপান্তরিত হয়েছে স্বশাসনের আন্দোলনে।।
তবু অন্তর্বর্তীকালীন বিভিন্ন আলাপ-আলােচনায় যা উঘাটিত হয়েছে তা-ও তাৎপর্যবিহীন নয় । এ সব থেকে অনিবার্যতা এড়ানাের এ ধরনের শেষ মুহূর্তের আধা-গেঁচড়া প্রয়াসের
২৫৩
নিষ্ফলতাই প্রমাণিত হয়েছে। বস্তুত, অস্তিত্বশীল বাস্তবতাসমূহের নিয়মের ফসল হিসেবে অনিবার্য পরিণতি রুখে দেওয়া সম্ভব নয় যদি না পরিস্থিতির সহজাত কতিপয় বিষয়ে ক্রমবিকাশের গােটা প্রক্রিয়াকেই উল্টে না দেওয়া যায়। ইতিহাসের বিচারে, এ রকম কিছু একটা অত্যন্ত কল্পনাসুলভ ও অবাস্তব প্রাকধারণা।
এ কারণেই ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে কোনাে নেতার বাহ্যত সহানুভূতির অভিব্যক্তিতে আওয়ামী লীগের অভিভূত না হওয়ায় আশ্চর্যের কিছু নেই। ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ ভুট্টোর সুদীর্ঘ তারবার্তাতেও আওয়ামী লীগের সামান্য ভাবান্তরও ঘটেনি। আরাে তাৎপর্যের বিষয়, ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তান সফরের প্রস্তাব দিলে আওয়ামী লীগ তাঁকে “বাংলাদেশের মেহমান হিসেবে স্বাগত জানাবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। এ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়া ও সেই সুবাদে ইসলামাবাদ কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার আরাে আভাস। আর এ কর্তৃত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা যদি বা হয় তাহলেও জনগণের চোখে উপমহাদেশ পুনর্দখলের জন্য ব্রিটিশ প্রয়াসের মতাে অনুরূপ কিছুর বেশি বলে প্রতিভাত হবে না বললে সেই সময়ের বিচারে তা আদৌ কোনাে অত্যুক্তি হবে না।৭৩
সাবেক পূর্ব পাকিস্তানীদের মনে এমন ধারণা জন্মেছিল যে, “ইসলামাবাদের শাসকগােষ্ঠীর একমাত্র ক্ষমতা ছিল এই যে, তারা শুধু পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণকে হত্যা করতে আর তাদের অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলারই ঘনঘটা বাড়িয়ে দিতে পারে। এরই পরিষ্কার দৃষ্টান্ত রয়েছে খাদ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম থেকে করাচির দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার ঘটনায়।”৭৪
আলােচনার জন্য ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এলে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের চিন্তাশীল মানুষের নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল, “শেখ মুজিবের দাবির প্রশ্নে রফায় আসার জন্য ইসলামাবাদের কাছে একটা পথই খােলা আর তা হলাে গণহত্যা চালানাে।” তারা এ কথাও জানতেন যে, ইতঃপূর্বে পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের মানুষ যদি এখন অনুভব করে যে, একটি জাতি হিসেবে থাকার মূল্য বড় বেশি হয়ে যাচ্ছে তবে পশ্চিমে তাদের ভাইদেরকে বিদায়ী সালাম জানানাের সার্বভৌমত্ব তাদের রয়েছে যে সার্বভৌমত্বের অধিকার বলে তারা একদিন মূল ভারত ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল।”৭৫
আওয়ামী লীগের দেওয়া যে চারটি শর্ত সন্তোষজনকভাবে পূরণ হলে সৃষ্ট পরিবেশে দলটি জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগ দেবে কিনা বিবেচনা করতে পারতাে সেই শর্তগুলি দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত: মুখ্য ও গৌণ কিংবা প্রধান ও পরিপ্রান্তিক (অতীব গুরুত্বপূর্ণ বা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়)। এ রকম বিভক্তি এই অর্থে যে দুটি শর্ত যেমন, ব্যারাকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি এবং যারা নিহত হয়েছে তাদের ব্যাপারে তদন্ত অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা হলেই তথাকথিত কোনাে আইনগত জটিলতা ছাড়াই সমস্যাটির নিষ্পত্তি হতে পারতাে। বাস্তবিকপক্ষে, কর্তৃপক্ষের জবানি অনুযায়ী, এ দুটি বিষয়েই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেনাদের ব্যারাকে ফেরত পাঠানাে হয়েছে যদিও আওয়ামী লীগ দাবি করে যে, আসলে তা করা হয়নি। সামরিক আইন আদেশে এক তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের সদস্য চারজন। এঁদের একজন করে সিএসপি, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও ইপিআর-এর প্রতিনিধি।
২৫৪
কমিশনের সভাপতি পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের একজন বিচারক। আওয়ামী লীগ অবশ্য এ কমিশন মেনে নেয়নি এর গঠন বিন্যাসের ও সামরিক আইন আদেশের আওতায় গঠিত হওয়ার কারণে।
অন্য দুটি দাবি যেমন, সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং শাসনতন্ত্র চূড়ান্ত না হওয়া অবধি অন্তর্বর্তীকালীন মেয়াদের জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ছিল আলােচনার কেন্দ্রীয় বিষয়।
আওয়ামী লীগের ভাষ্য অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট ও আওয়ামী লীগের মধ্যে অন্তর্বর্তী মেয়াদের। জন্য কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। এগুলি হলাে:
১. সামরিক আইন প্রত্যাহার করে প্রেসিডেন্টের এক ইশতেহার জারি এবং একটি বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর;
২. প্রতিটি প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর;
৩. জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবেন;
৪. শাসনতন্ত্র চূড়ান্ত করার জন্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের প্রাকপ্রস্তুতি হিসেবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যদের জন্য জাতীয় পরিষদের স্বতন্ত্র অধিবেশন।৭৬
আওয়ামী লীগ যেহেতু ইতােমধ্যে যে সব বিষয় আলােচনার জন্য প্রস্তাব করেছে। তাতে আর কিছু যােগ করার বা সেগুলি থেকে কিছু বাদ দেওয়ার কোনাে আবশ্যকতা। ছিল না, সে কারণে অতিরিক্ত আর কোনাে বৈঠকে তার বসার দরকারও ছিল না। কেবল প্রেসিডেন্ট বা তাঁর উপদেষ্টা এমএম আহমদের কাছ থেকে কোনাে বার্তা যখন এলাে না। তখনই তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা এমএম আহমদ ২৫ মার্চ সকালে করাচি রওনা হয়ে গেছেন। আর ঠিক ঐ দিন সন্ধ্যাতেই ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ নেতাদের না জানিয়ে চলে গেছেন বলে গুজব রটে। অথচ ইয়াহিয়া খানের সাথে তাদের দরকষাকষিমূলক আলােচনা চলছিল। ভুট্টোকে ঢাকায় ডেকেছিলেন ইয়াহিয়া খান। তিনি আশ্চর্যজনকভাবে শেখ মুজিবের সাথে দেখা করেননি। শুধু শেখ মুজিবের সাথে প্রেসিডেন্টের যে আলােচনা হয়েছে সে ভাষ্য ইয়াহিয়ার কাছ থেকে পেয়েই শেষ মুহূর্ত অবধি তুষ্ট থাকার পর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ও পিপিপির মধ্যে সরাসরি দরকষাকষির আলােচনা। হওয়া অত্যাবশ্যক।৭৭
পাকিস্তান সরকারের তৈরি শ্বেতপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী সংশােধন করার পর আওয়ামী লীগ যে খসড়া ইশতেহারটি (দুটি প্রধান দাবি পূরণের জন্য) পেশ করেছে তা “ফেডারেশনের পরিবর্তে কনফেডারেশনের জন্ম দেবে, তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব বিলুপ্ত হবে, ১ মার্চ থেকে তিনি (শেখ মুজিব) পূর্ব পাকিস্তানে যে সমান্তরাল সরকার কার্যত চালাচ্ছেন। তাকে আইনানুগ কর্তৃপক্ষের মর্যাদা দেবে এবং আইনের বৈধতাবিহীন এক ইশতেহার জারির মাধ্যমে শাসনতান্ত্রিক শূন্যতার সৃষ্টি করবে।”৭৮
২৫৫
এভাবে ইসলামাবাদ কর্তৃপক্ষ জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে সরকারিভাবে স্বীকার করে নেন যে, কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডের একটি অংশের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে যে অংশটি তার শাসনে থাকার কথা। ইয়াহিয়া খান ও তাঁর উপদেষ্টারা এখনাে শান্তিপূর্ণভাবে আলাপ-আলােচনা চালাতে পারেন বলে কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে নেওয়ায় প্রমাণিত হয় যে, “সমান্তরাল সরকার বা প্রশাসন” ঐ অংশে কমবেশি দক্ষতার সাথে নিজ নিয়ন্ত্রণ পরিচালনা করছে। ঘটনা বাস্তবিকপক্ষে যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে “আওয়ামী লীগ ২৬ মার্চের সকালে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরুর পরিকল্পনা করছিল” বলে শ্বেতপত্রে যে দাবি করা হয়েছে। তা শূন্যগর্ভ মনে হয়, বােধগম্যও নয়।
শ্বেতপত্রে গৃহীত সামরিক কার্যব্যবস্থার সপক্ষে যুক্তি দিয়ে বলা হয়, “ভারতের যােগসাজশে আওয়ামী লীগের জঙ্গি মনােভাবের বিরুদ্ধে অনিবার্য ব্যবস্থা ছিল এটি। দেশের সংহতি রক্ষায় প্রেসিডেন্টের পক্ষে এ বেদনাদায়ক সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। ৭৯ “ভারতের সাথে যােগসাজশ” প্রশ্নে বলা যায়, বাংলাদেশ ও ভারতের ওয়াকেফহাল। মহলের তথ্যানুযায়ী ঐ সময়ে আওয়ামী লীগকে শুধু এই প্রতিশ্রুতিই দেওয়া হয় যে, আশ্রয় চাওয়া হলে দলীয় নেতাদের আশ্রয় দেওয়া হবে। ঐ একই সূত্রে জানা যায়, পরবর্তীকালে ভারতের সাহায্যের প্রকৃতি ও উপকরণ নির্ভরশীল ছিল পরিস্থিতির গুরুত্বের ওপর, ঘটনার পরিক্রমায় অন্যান্য ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে।
অবশ্য, আওয়ামী লীগের ক্রমবর্ধমান লড়াকুভাবও ছিল এক নিরেট বাস্তবতা। তবে তাদের এ জঙ্গি মেজাজটি ছিল প্রকৃতপক্ষেই মনমানসিকতার, উপকরণগত প্রস্তুতির নয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঘােষণা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ অসহযােগ আন্দোলনের আকারে সঙ্কট উত্তরণের যে কৌশল গ্রহণ করে তা ছিল বিশেষভাবে গান্ধীর পরােক্ষ প্রতিরােধের অনুকরণ। আদর্শিকভাবে আওয়ামী লীগ সংগ্রামপ্রবণ বা সহিংস অভিমুখী ছিল না। যদি তা হতাে তাহলে ১৯৬৮-৬৯ সালের সম্ভাবনার দিক থেকে সহিংস আন্দোলনটি ঐ সময়েই তাকে উঠতাে না যখন ইয়াহিয়া খান তখনাে তাঁর অবস্থান মজবুত করে উঠতে পারেননি, যখন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট যে জখমি আঘাত হেনেছিলেন, সে জখমের ক্ষত তখনাে কাঁচা রয়ে গিয়েছিল। তখনকার মােকাবেলার মনােভাবটি রুখে যায় প্রধানত এ কারণে যে, আওয়ামী লীগ তখনাে পূর্ব পাকিস্তানের দাবিগুলি আদায়ের অহিংস নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালনায় অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিল। অথচ ইয়াহিয়া খান নিজে হয় তাঁর সহজাত প্রেরণায়। নয় তাঁর উপদেষ্টাদের তাগিদে একটা সর্বাত্মক মােকাবেলা পরিস্থিতিতে নিহিত বৈরিতার আগুনে ঘৃতাহুতি দেওয়ার পথ বেছে নেন। তিনি বুঝতে পারেননি যে মােকাবেলার বিষয়টি কোনাে ব্যক্তি বা দলের সাথে নয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী মােকাবেলা করছিল সংস্কৃতিগতভাবে সুসমঞ্জস, অর্থনৈতিক দিক থেকে অবদলিত এবং রাজনৈতিক দিক থেকে অধিকারবঞ্চিত ঐক্যবদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানী গণমানুষের সাথে, যে গণমানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে চরিত্রগতভাবে এক মঞ্চপ্রতিম দল—আওয়ামী লীগের পতাকাতলে এক অভিন্ন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। ১৯৬৯ সালের ব্যাপক মারমুখী আন্দোলনকালে যে বৈরিতার
২৫৬
প্রকাশ ঘটে তাতে পাকিস্তানের চলতি রাষ্ট্রীয় কাঠামাের জন্য কী কঠিন ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে তার আভাস পাওয়া যায়। ইয়াহিয়া খান তখন জনতার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতির সন্ধি সাপেক্ষে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের চেহারাটি বজায় রাখার একটা ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ১৯৭১ সালে তার জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতকরণ সিদ্ধান্তের ফলে সেই ‘সন্ধি স্থগিত হয়ে যায়। ফলে পরিস্থিতি আবার সেই অবস্থায় ফিরে যায় যখন ব্যাপক মারমুখী তৎপরতার অবসানের জন্য ওই অঙ্গীকার করা হয়েছিল। সন্ধি ভেঙে যাওয়ার পর নিপীড়ক ও নিপীড়িতদের মধ্যে সর্বাত্মক সংঘাতের কোনাে বিকল্প রইল না । শেষােক্তবর্গ এখন তাদের বৈধ প্রতিনিধি অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অসহযােগিতামূলক পরােক্ষ প্রতিরােধ কর্মসূচিই ব্যাপকভাবে অব্যাহত রাখে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এই কর্মসূচিকে “দেশদ্রোহিতামূলক কর্মকাণ্ড” মনে করেন, শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দলকে “পাকিস্তানের শত্রু” হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন।৮০ কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চের রাতে বর্বর সামরিক নিষ্ঠুরতা শুরু হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এই ঘােষণা অর্থহীন হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব নিশ্চিতরূপে উপলব্ধি করে যে এ যাবৎ যে পাকিস্তান বিদ্যমান ছিল তা এখন “মৃত এবং শবের পাহাড়ের নিচে তার দাফন হয়ে গেছে।”৮১
পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সদস্যগণ জাতীয় পরিষদ গঠন করেন এবং স্বাধীনতা ঘােষণার মাধ্যমে বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘােষণা করেন।৮২
স্বাধীনতা ঘােষণার ভিত্তিতে বাংলাদেশকে শাসন করার জন্য গঠিত অস্থায়ী সরকার নয় মাস স্থায়ী মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ প্রসঙ্গে মওদুদ আহমদ বলেন, “নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় এবং স্বাধীনতার সংগ্রামে তাদের আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণ ছাড়া বাংলাদেশ এত শিগগির স্বাধীন রাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহ করতে পারতাে না।”৮৩
ইতােমধ্যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নামধারণ করে। আগেই বলা হয়েছে যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কৌশলগতভাবে কিংবা নামমাত্রভাবে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক শাখা ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় এএইচএম কামারুজ্জামান ছিলেন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি এবং তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে এক বৈঠকে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে বিলুপ্ত ঘােষণা করা হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।৮৪ এখানে উল্লেখনীয় যে, ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রতীক বরাদ্দের সময় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নাম পরিবর্তন
২৫৭
করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাখার বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ। সুপ্রিমকোর্ট এই মর্মে রায় প্রদান করেন যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রকৃতপক্ষে এমন। একটি দল যা পূর্বে ছিল এবং নামেমাত্র ভিন্ন নামে ১৯৭০ সালের পাকিস্তান সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।৮৫ এইভাবে, পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাদেশ হিসেবে অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগও বৈধভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে পরিণত হয়।
২৫৮
একাদশ অধ্যায়
উপসংহার
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের স্বাধীনতা ঘােষণা ও একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিষয়টি দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য ও প্রভাবসম্পন্ন দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা। একটি হলাে এক নতুন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয় আর অন্যটি পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামাের পুনর্গঠন। তা দক্ষিণ এশিয়ার এক অত্যন্ত জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ সমাজ-রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা পর্বের অবসান যুগপৎভাবে চিহ্নিত করেছে। | এভাবে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্র ব্যবস্থার নির্মাণগত পরিবর্তন আনয়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং এই পরিবর্তনের সার্বিক প্রক্রিয়ায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বােধগম্যভাবেই কয়েকটি কারণে অন্যতম ছিল। এ সংগঠনটি এই পরিবর্তন সম্ভব করে পাকিস্তানের জাতীয় পুনর্গঠনে যথা অংশ বা পাওনা লাভের “ইচ্ছা”কে স্বশাসনতুল্য স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে রূপান্তরিত করে। এই প্রক্রিয়ায় খােদ আওয়ামী লীগেও ধারাবাহিক পরিবর্তন ঘটে তার নিজ অগ্রাধিকার ও কার্যধারার প্রয়ােজনে। মূলত বলা চলে অগ্রাধিকার রূপান্তরিত হয় “জাতীয়” থেকে “আঞ্চলিক” অগ্রাধিকারে আর কার্যধারা রূপান্তরিত হয়, “আপােসরফা” থেকে “মােকাবেলায়”।
পূর্ব পাকিস্তানী জনসমাজের রাজনীতি সচেতন স্তরগুলিতে “স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের একটা বলবতী ইচ্ছা সন্দেহাতীতভাবেই ছিল। কিন্তু সেই “ইচ্ছা”কে “দাবিতে রূপান্তরিত করার কাজটি এক বড় ধরনের সাফল্য বলতেই হয়। এ দুই পর্যায়ের মধ্যবর্তী সময় ও সেই সাথে অনুভূতির তীব্রতা বেড়ে ওঠার বিষয়টি কার্যকর নেতৃত্বের অভ্যুদয়ের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল যে নেতৃত্ব জনসমষ্টির একটা বেশ বড় অংশকে সংগঠিত করে তাদের সক্রিয়তাকে বাঞ্ছিত লক্ষ্যাভিমুখে পরিচালিত করতে সক্ষম। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এই জনসংগঠনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজটি আশু সামাজিক উত্তেজনা সৃষ্টি না করে খুব সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করে। এ ছাড়াও, এই দলটি যে পাকিস্তানী রাষ্ট্রসত্তা পুনর্গঠনের
বড় দায়িত্ব পালন করেছে সে বিষয়টিও আওয়ামী লীগের ভূমিকাকে আরাে তাৎপর্যময় করে তুলেছে।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে তার সূচনা (পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ) থেকে সার্বিক পর্যালােচনায় দেখা যায় যে, প্রাদেশিক স্তরের অন্যতম নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর আনুষ্ঠানিক নেতৃত্বে পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রাদেশিক দলছুট অংশ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও অচিরেই এ দলটি জাতীয় বিরােধীদল নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক শাখার মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়।১ এটি সম্ভব হয় হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর প্রচেষ্টায়। সম্ভবত তিনিই একমাত্র পূর্ববাংলার রাজনৈতিক নেতা পাকিস্তানে যার গুরুত্ব ও প্রভাব ছিল জাতীয় পর্যায়ে।২ পূর্ব পাকিস্তান যতদিন পাকিস্তানী রাষ্ট্র কাঠামাের অংশ ছিল ততদিন দলের এই মর্যাদা বজায় থাকে। তবে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাথে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ছিল বহিরঙ্গগত। আর সে সম্পর্কের মাঝেও ছিল অনেক শর্তের দেওয়াল তােলা। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মধ্যে এমনকি সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্কেরও অভাব ছিল যা পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে অবয়বগত ঐক্যের পরিপূর্ণ অনুপস্থিতির মাঝে অত্যন্ত মর্মস্পর্শীভাবেই স্পষ্ট।৩
জাতীয় পুনর্গঠনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে রাষ্ট্রের মৌল প্রকৃতি, এর অর্থনৈতিক অবকাঠামাে এবং বাংলা ভাষার ভূমিকাসহ সকল ক্ষেত্রেই পাকিস্তানের দুই অংশের দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট তারতম্য পরিলক্ষিত হয় পাকিস্তানী রাষ্ট্রব্যবস্থার ঐতিহাসিক ও ভৌগােলিক কারণে। পাকিস্তান আন্দোলনকালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সিদ্ধান্ত নির্ধারক সংস্থাগুলিতে পর্যাপ্ত বাঙালি প্রতিনিধিত্বের অনুপস্থিতি, ফজলুল হক-জিন্নাহ্ সম্পর্কে বৈরিতা, আবুল হাশিমের ম্যানিফেস্টো প্রত্যাখ্যান এবং দেশবিভাগের (১৯৪৭) প্রশ্নে তাঁর নেওয়া অবস্থান এ সবই অবশিষ্ট ভারতীয় মুসলমানদের (পরে পশ্চিম পাকিস্তানী মুসলমানদের) তুলনায় এ সব বাঙালি মুসলমানদের (পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমানদের) ভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কয়েকটিমাত্র বহিঃপ্রকাশ। শামসুল হকের মূল দাবি ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ম্যানিফেস্টোতে পাকিস্তানী রাষ্ট্রব্যবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ ভূমিকা সম্পর্কে কিছু মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। এটি করা হয়েছে স্ববিরােধী আদর্শিক, সমাজ-সাংস্কৃতিক, এবং আর্থ-রাজনৈতিক ইস্যুগুলির নিষ্পত্তির প্রয়াসে। বলাবাহুল্য, এ সব ইস্যু মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র নেতৃত্বে গড়ে তােলা এক সাধারণ সর্বজনীন ঐকমত্যের আড়ালে পাকিস্তান আন্দোলন চলাকালে সুপ্ত অবস্থায় ছিল।
কিন্তু, একটা জনসমাজের ভেতরের বিভেদ মর্জিমাফিক দূর করা যায় না। এ কারণেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের গােড়ার দিকের নেতৃত্ব—যারা পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন এবং যার প্রতীক ছিলেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী-রাজনৈতিক বাস্তবতা হিসেবে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে মজবুত, সংহত করার জন্য কাজ করেছেন। যদিও তারা পাকিস্তানী রাষ্ট্রব্যবস্থায় কেন্দ্রাতিগ নানা প্রবণতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন তবুও
২৬০
তাঁরা ঐ সব শক্তিকে যদূর সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করার ও অখণ্ড পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন। একটি নিখিল পাকিস্তানী রাজনৈতিক দল—নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ থেকে বিরাট সমর্থন বলে বলীয়ান হয়ে শহীদ সােহরাওয়ার্দী সমস্যার সমাধান চেয়েছিলেন দরকষাকষি ও রফার স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক পন্থায়। তাঁর এই আপােসরফার পদ্ধতি পুরােপুরি ব্যর্থ হয়নি। তিনি যুক্ত নির্বাচন প্রথাকে আইনসিদ্ধ করেন এবং কিছু সরকারি উদ্যোগ ও প্রতিষ্ঠানের প্রাদেশিকীকরণে সক্ষম হন। তিনি আশা করেছিলেন, সাধারণ নির্বাচনের পর ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের আওতায় স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানের নানা রকমের গলদ ও বৈষম্য দূর করবে এবং এক পর্যায়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা আর থাকবে না। তবে একজন “আঞ্চলিকতাবাদী” বা “প্রাদেশিকতাবাদী” পূর্ব পাকিস্তানী হিসেবে নিজেকে দাঁড় করানাের বদলে নিজেকে “অনুগত” অথবা “জাতীয়তাবাদী” পাকিস্তানী হিসেবে দেখানাের প্রয়াসে পাশ্চাত্যের সাথে (বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে) আঁতাতের সমর্থন জানিয়ে সুনিশ্চিতভাবেই তিনি পাকিস্তানের ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
স্বায়ত্তশাসনের দাবির নেপথ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক দিক থেকে বিরাট রকমের বঞ্চনার বিষয়টির বেশ অনেকখানিই সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রশ্নে গৃহীত নীতির অন্যতম পরিণাম হিসেবে। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক নীতিমালা ও উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলিতে ঐ নীতির প্রতিফলন ঘটে। এ সব অর্থনৈতিক নীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রধানত তৈরি করেছিল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল মার্কিন বিশারদ। তারা প্রথমে পাকিস্তানে আসেন পাকিস্তানের প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই।৪ সম্ভবত পাকিস্তানের জন্য এর চেয়ে ভালাে বিকল্প ছিল এর আগে অস্ট্রেলীয় অর্থনীতিবিদ কলিন ক্লার্কের৫ সুপারিশ বাস্তবায়িত করা। তবে পাকিস্তান ইচ্ছা করেই অর্থনীতির জন্য এমন এক প্রবৃদ্ধি মডেল বাছাই করে যার আওতায় সম্পদের স্থানান্তর ঘটবে কৃষি থেকে আধুনিক উৎপাদন শিল্পে। আর এরই ফল হিসেবে সম্পদ পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়।৬ এ ধরনের প্রবৃদ্ধি কৌশল গ্রহণের নেপথ্য উদ্দেশ্য ছিল গােড়ার দিকে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অর্থনৈতিক অভিলাষ পূরণ। শিল্প ও বাণিজ্য পরিমণ্ডলের এই প্রভাবশালী বিত্তবানদের বেশিরভাগই ছিলেন ভারত থেকে দেশত্যাগ করে আসা মুসলিম ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি।’৭ গােড়ার দিকের স্তরে, তাঁদের এই অর্থনৈতিক অভিলাষ লালনের জায়গা করে দেন পাকিস্তানী রাজনীতির কুলীন মহল। আর সেখানেও ছিল ভারত থেকে আগত ব্যক্তিদের প্রাধান্য। তারা নিরাপত্তার অভাববােধে তাড়িত হয়ে ভারত থেকে আগত ব্যবসায়ী শ্রেণীর সাথে সহযােগিতা করে আর ঐ ব্যবসায়ী শ্ৰেণীটিই পরে কুলীন শিল্পপতিকুলের অবস্থানে উন্নীত হয়। তুলনামূলকভাবে নিরাপত্তাহীন এই দুই গােষ্ঠী এক অধিকতর সুরক্ষিত গােষ্ঠীর
২৬১
যেমন, পাঞ্জাবীপ্রধান সশস্ত্র বাহিনী ও আমলাদের সাথে আঁতাতে আসে। স্পষ্ট কারণেই সম্পর্কের এই ধারাবিন্যাস চলতে থাকে যদিও পরবর্তীকালে জিন্নাহ্ ও লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর “মৃত্তিকার সন্তানেরা রাজনৈতিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ মুজাহিদদের হাত থেকে তাদের নিজেদের হাতে তুলে নেয়।
বেতালা অর্থনৈতিক উন্নয়ন, এর বিপদ ও এর সম্ভাব্য প্রতিকার—এ সব কিছুই আলােচিত হয় সজাগ, সচেতন শিক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানীদের বিভিন্ন মহলে আর কেন্দ্রীয় এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আইন পরিষদে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সদস্যরা এ সব আলােচনা-সমালােচনাকে আরাে সুতীক্ষ, সুচর্চিত করে তােলেন। পাকিস্তানী সিদ্ধান্ত প্রণেতাদেরকে একই নীতি আঁকড়ে থাকলে তার কী কুফল দেখা দিতে পারে সে কথা অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে ঘন ঘন মনে করিয়ে দেওয়া হয়।৮ সােহরাওয়ার্দী, আগেই বলা হয়েছে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপের মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে অন্তর্সমাজ বিভেদগুলির নিষ্পত্তির জন্য যে রফামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছিলেন তারই অংশ। হিসেবে দরকষাকষির জন্য ঐ সব কুফল-সংক্রান্ত হুঁশিয়ারিকে হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগান।
কিন্তু পূর্ব বাংলা ও পাঞ্জাবের (পাঞ্জাব বলতে কার্যত পশ্চিম পাকিস্তান) মধ্যেকার বিরােধ-সংঘাতের আপােস-নিষ্পত্তি ছিল মূলত অসম্ভব।৯ কৌশলগত কারণে, পাঞ্জাব একটা কর্তৃত্নসর্বস্ব স্বৈরাচারী শক্তি কাঠামাের আনুকূল্য করেছিল যাতে আধিপত্য থাকবে আমলা-সামরিক কর্মকর্তা আঁতাতের। অন্যদিকে, পূর্ব বাংলা এক প্রতিযােগিতামূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চেয়েছিল। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুসলিম লীগকে পুরােপুরি সরানাের পর পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রের শাসক কুলীনদের রাজনৈতিক কলকাঠি নাড়ার একমাত্র অবলম্বনটিও লুপ্ত হয়। আগামীর জন্য সাবধানতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্থলবর্তী করা হয় কায়েমি স্বার্থগােষ্ঠীগুলির স্বৈরাচারী শাসনের পর সামরিকরাজকে। আর এমনি করে, পূর্ব বাংলা প্রথম-দফাতেই হেরে যায়।
কিছুটা পরিমাণে রাজনীতি সচেতনকৃত কোনাে জনসমাজে প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ করলেও ঐ সমাজে পুরােপুরি রাজনৈতিক তৎপরতা লুপ্ত হয় না। এমনিভাবেই বলা যায়, জনসমাজের মানব উপকরণের ওপর নির্মিত কোনাে স্বৈরশাসন পরিকাঠামাে সমাজের ঐ মানুষগুলির আর্থ-রাজনৈতিক ও সমাজ-সাংস্কৃতিক আশা-আকাঙ্ক্ষাকে দাবিয়ে দিতে পারে না । এ কারণে সােহরাওয়ার্দী জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট বা এনডিএফ-এর মাধ্যমে এক সম্মিলিত গণআন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন আর একটা অস্থায়ী মেয়াদের জন্য অন্যান্য ইস্যু স্থগিত রেখেছিলেন এই আশায় যে, গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত হলে সেই ব্যবস্থাদি পরে ঐ সব সমস্যার সমাধান দেবে। জিন্নাহ্ ভেবেছিলেন, পাকিস্তান অর্জিত হওয়ার পর তৎকালীন ভারতীয় মুসলমানদের যে সব অন্তঃসাম্প্রদায়িক সমস্যা রয়েছে সেগুলির সমাধান করা যাবে। সােহরাওয়ার্দীও সেভাবেই মনে করেছিলেন যে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে খাড়া করা গেলে পাকিস্তানের আন্তঃআঞ্চলিক সমস্যাগুলির ঐ-সব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই
২৬২
নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। কিন্তু সােহরাওয়ার্দীর সে মিশন সফল হয়নি। কেননা, আইয়ুব খানের রাজনৈতিক দর্শনে” এমন কোনাে ব্যবস্থার স্থান ছিল না। এ ছাড়া, মিলমিশের এই দৃষ্টিভঙ্গির নিষ্ফলতা এনডিএফ-এর সদস্য সংগঠনগুলির একাংশের কাছে, বিশেষ করে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। আর এনডিএফ-এর প্রয়ােজনও তাই ফুরিয়ে যায়।
১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সময় নাগাদ পাকিস্তানী রাজনীতির উভয় সঙ্কট পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নয়া নেতৃত্বের কাছে স্ফটিক স্বচ্ছ হয়ে ওঠে।১০ এ কারণে পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তার অগ্রাধিকারগুলি বদলায়। এর আগে এ সংগঠনটি ছিল জাতীয় স্তরে অন্যতম প্রধান বিরােধীদলের প্রাদেশিক শাখা। এখন সেটি নিজেকে সম্পূর্ণ প্রাদেশিক দলে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেয় যে দলের কাজ হবে পূর্ব পাকিস্তানের অভাব-অভিযােগ প্রতিবিধানের ব্যবস্থা করা।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুরােপুরি অংশীদারিভিত্তিক যদি হতাে, যদি সরকার ও শাসিতদের মধ্যে সরাসরি যােগাযােগের একটি ব্যবস্থা থাকতাে, পূর্ব পাকিস্তানীদের “আকাঙ্ক্ষা-অভিলাষকে হিসেবে নেওয়ার জন্য উপকরণ-উৎপাদন-ফলাবর্তনের একটা ব্যবস্থা থাকতাে তাহলে সুতীব্র বঞ্চনাবােধ প্রশমিত হতে পারতাে। আর জনগণের মাঝে ঐ সব অভাব-অভিযােগ চেতনাকে আরাে তীক্ষ্ণ, শাণিত করে তােলায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাফল্যও কমে যেতাে। কিন্তু সে ব্যবস্থার পরিবর্তে মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা ও পিএল-৪৮০ তহবিলপুষ্ট পূর্ত কার্যক্রম বরং ঐ সব অভাব-অভিযােগকে আরাে ঘনীভূত করে তােলে।১১ স্বাভাবিক কারণেই অন্যেরা ছাড়াও এমনকি মূর্খ, গ্রামের গরিব মানুষ যাদের প্রায় সবাই চাষী, যারা পরিবর্তনে আগ্রহী তারাও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মধ্যে তাদের পক্ষের সােচ্চার এক প্রবক্তার সন্ধান পায়। আইয়ুব খান, মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা ও পূর্ত কার্যক্রমের মাধ্যমে তাঁর যে সমর্থক বুনিয়াদটি গড়তে চেয়েছিলেন সেটি কেবল কিছু অকেজো বশংবদ তৈরির মতাে অতি সীমিত উদ্দেশ্য সাধনে সক্ষম হয়। মৌলিক গণতন্ত্রী তথা উদ্বৃত্ত চাষীরা তার ও গণমানুষের মধ্যে কোনাে ফলদায়ক যােগসূত্র স্থাপনে ব্যর্থ হয় যদিও তিনি হয়তাে তাদেরকে সে ভূমিকায়ই ভেবেছিলেন। তারা ও তাদের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় পপাষকতাপ্রাপ্ত পূর্ব পাকিস্তানী উদ্যোক্তা শ্রেণী সরকারপন্থী। শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয় আর প্রান্তিক চাষী (ও বহুউদ্বৃত্ত প্রান্তিক চাষী) পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে, কেননা এই দল স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের অঙ্গীকারে আবদ্ধ।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যকার উপনিবেশসুলভ সম্পর্কটি উন্মােচিত হওয়ার পর আপােস-নিষ্পত্তির শেষ সম্ভাবনাটুকু উবে যায়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব অনমনীয় হয়ে ওঠে। এই দল পূর্ব-পশ্চিম সম্পর্কে পরিপূর্ণ কাঠামােগত পরিবর্তন দাবি করে। ছয়-দফা ফর্মুলা ঘােষণা করা হয় ও স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের সূচনা ঘটে। বস্তুত ছয়-দফা ফর্মুলার বিষয়বস্তুগুলি ১৯৫০
২৬৩
দশকের গােড়া থেকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করে আসছিলেন পূর্ব পাকিস্তানী জনজীবনের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিরা।
এমনকি এই পর্যায়েও আপােসরফার প্রত্যাবর্তন সম্ভব হতে পারতাে যদি পরিস্থিতির সঙ্কটজনক নাজুক অবস্থা উপলব্ধির মতাে চেতনা থাকতাে শাসকচক্রের। কিন্তু ভ্রান্ত নীতি গ্রহণ করা হয়। তাই সে সবে উল্টো ফল ছাড়া আর কিছুই হয়নি। “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা” স্বায়ত্তশাসনবাদীদের সংহতি দুর্বল করার পরিবর্তে বরং খােদ শাসকগােষ্ঠীর জন্য এক প্রচণ্ড বুমেরাং হয়ে ওঠে। গােলটেবিল আলােচনায় নামাবলি দেখে পূর্ব পাকিস্তানের লড়াকু ছাত্রদের এবং তাদের শহর, নগর এমনকি গ্রামীণ সহযােগীদেরও অবদমিত করতে পারেনি।
১৯৬৯ সালের গােড়ার দিকে পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের দৃষ্টতই দুর্বল অবস্থা ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের নিয়তির পরিষ্কার আভাস দিয়েছিল বলে মনে হয়। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের পক্ষে তাদের কুণ্ঠাহীন আস্থা শেখ মুজিবুর রহমানের মতাে একজন বিশ্বাসঘাতক’ লােকের নেতৃত্বে ন্যস্ত করার কারণ আর কী হতে পারে? শেখ মুজিব এভাবে জনসমর্থন পাওয়ার ফলে তার পেছনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ জনগণের প্রচ্ছন্ন স্বীকৃতি পেয়ে যায়।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব নাটকীয়ভাবে গদি না ছেড়ে দিলে ও পরে সর্বজনীন বয়স্ক ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচনের ঘােষণা দেওয়া না হলে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারবিরােধী আন্দোলন আরাে বিরাট ব্যাপ্তিতে ছড়িয়ে যেতে পারতাে। আইয়ুব খানের ক্ষমতা থেকে সহজে সরে যাওয়া ও জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের অঙ্গীকারের বিষয় এক সাথে বিবেচনায় নিলে নিরাপদ নিশ্চিন্তে এ কথাও ধরে নেওয়া যায় যে, এগুলি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের “সন্ধির প্রস্তাব।
শাসকচক্র এমনটি ধরে নিয়েছিল বলেই মনে হয় যে, শেখ মুজিবের সাথে দরকষাকষির আলােচনায় বসলে সঙ্কট সামাল দেওয়া যাবে কিংবা বৈরিতা কমানাে যাবে। আসলে তারা এ ক্ষেত্রে খুব বেশি অতিকথা বা কিংবদন্তীনির্ভর হয়ে পড়েছিল। সে অতিকথা এই যে, শেখ মুজিব সােহরাওয়ার্দীর “রাজনৈতিক ওয়ারিশ” হিসেবে হয়তাে পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও ঐক্যের খাতিরে আপােসরফাকে অগ্রাধিকার দেবেন আর সে জন্য তিনি ছয় ও এগারােদফা প্রশ্নে একটা রফায় আসতে সাহায্য করবেন। যেভাবেই হােক, পাকিস্তানের শাসকচক্র এ বিষয়টি বিবেচনায় নিতে ভুল করেছিল যে, শেখ মুজিব শুধুমাত্র সােহরাওয়ার্দীর অনুসারী নন, বাঙালি মুসলিমের ভাগ্য উন্নয়নে একনিষ্ঠ ফজলুল হকের আবেগ এবং বাঙালি মুসলিমের স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে অবাঙালি মুসলিমদের ওপর হক সাহেবের আস্থাহীনতার ঐতিহ্যও তিনি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার হিসেবে।১২
শেখ মুজিব বিক্ষোভপ্রবণ ছাত্রদের ওপর সংযম আরােপে গােড়ায় সফল হয়েছিলেন। তাই পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ একটু বিভ্রান্ত হওয়ার কারণে ছাত্রদের সহিংসতাকে তেমন প্রাসঙ্গিক মনে করেননি, আমলও দেননি। তবে শেখ মুজিব একটা বহুমুখী কৌশল গ্রহণ করে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জন্য বিভিন্ন বিকল্প হাতে রেখেছিলেন। এর অন্যতম
২৬৪
ছিল, কর্তৃপক্ষকে তাদের হাতের তুরুপের তাসগুলি খেলতে দেওয়া ও সেই অবকাশে তাদের মতলবগুলি উন্মােচিত করা। আর এভাবে তাদের জন্য পিছু হঠার কোনাে জায়গা না রাখা। আরেকটি কৌশল ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে মােকাবেলা অবস্থার জন্য সতর্ক ও মানসিকভাবে তৈরি রাখা—যা বাস্তবিকপক্ষে অনিশ্চিত বস্তুগত প্রস্তুতির প্রয়াসের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ছয়-দফা ফর্মুলাকে কেন্দ্র করে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের সময় থেকেই এ প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল। সরকারের সর্বাত্মক বিরােধিতা ও কিছু বেসরকারি বিরােধিতার বিরুদ্ধে ছয়-দফার অনুকূলে জনমত গড়ে তােলার কাজটি ক্রমেই ছয়-দফাকে একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতীকে রূপান্তরিত করে। স্বায়ত্তশাসনের নামে (যাতে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবি প্রচ্ছন্ন) ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নির্বাচনী লড়াইয়ের ফলাফলই জনমত সংগঠিত করায় ঐ দলের সাফল্যের অকাট্য প্রমাণ। এর বেশি কিছু প্রমাণের দরকার যদি পড়েই তা রয়েছে ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযােগ আন্দোলনের সময় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাথে পূর্ব পাকিস্তানীদের সংহতি ও একাত্মতায়।
এই অনন্য পরােক্ষ প্রতিরােধ এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যার ফলে কেন্দ্রীয় বেসামরিক কর্তৃত্ব পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মকভাবে অচল হয়ে পড়ে। মােকাবেলা পরিস্থিতিতে স্বাধীনতার গন্তব্যে এটিও ছিল এক ইতিবাচক পদক্ষেপ যদিও তা আনুষ্ঠানিক ঘােষণাবর্জিত। ঔপনিবেশিক শােষণের বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রধানত জাতীয়তাবাদী পূর্ব পাকিস্তানী জনগণের আবেগতাড়িত সংশ্লিষ্টতার প্রকাশ ঘটে অসহযােগ আন্দোলনে যার অনিবার্য পরিণতি ছিল পাকিস্তানের অবশিষ্টাংশ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটি মূল সমস্যা তথা অন্তঃসামাজিক উত্তেজনা বিবর্জিতভাবে জনগণকে সংগঠিত করার কাজ অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করে। কোনাে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সাফল্য আনতে হলে সংশ্লিষ্ট জনসমাজে যথেষ্ট মাত্রায় ঐক্য থাকতে হবে। তবে জনমত গড়ে তােলা বা সংগঠিত করার কাজে সাধারণত অভ্যন্তরীণ শ্রেণী, সম্প্রদায় ও জাতিগােষ্ঠীগত সংঘাত দেখা দিয়ে থাকে আর তাতে জাতীয়তাবাদী স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়। ‘২০ ও ৩০-এর দশকে অবিভক্ত ভারতে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব কর্তৃক এ ধরনের জনমত সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ঐ ধরনের সমস্যা সুস্পষ্ট ছিল। পাকিস্তানের ভেতরে পূর্ব পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের বিকাশের অন্য বাধাটি ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ধর্মের বন্ধন। পূর্ব পাকিস্তানে স্বকীয় সংস্কৃতি ছিল ও জনসমাজ খুব বেশি উল্লম্ব শ্রেণী বিন্যস্ত ছিল না। ধর্ম বস্তুতপক্ষে এই সুবিধাজনক অবস্থার প্রতিসাম্যবিধায়ক হতে পারতাে। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকচক্র দেশের ধর্মীয় মহলের কাতারে শামিল হয়ে ধর্মকে কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে গেলে ব্যাপারটা হতে পারতাে শাঁখের করাতের মতাে। তাতে হয়তাে শাসকগােষ্ঠীকে আরেক গুচ্ছ সমস্যায় পড়তে হতাে। এ ছাড়া, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ধর্মের ভূমিকার
২৬৫
ব্যাপারে নিম্নলয়ের ভূমিকা গ্রহণ করায় পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে ধর্ম কার্যত আর কোনাে ইস্যু থাকেনি।
কোনাে লাগাতার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্য জনগণকে সংগঠিত করতে প্রতীক ব্যবহারের দরকার হয়। পূর্ব পাকিস্তানীরা এ ধরনের এক চমৎকার প্রতীকের সন্ধান পায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ছয়-দফা কর্মসূচিতে। পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে শােষণের বিষয়টিকে জনসাধারণ ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মধ্যে যােগসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটি ছিল এক সুনির্বাচিত প্রতীক। কারণ, পূর্ব পাকিস্তানী জনসমষ্টির সকল স্তরে এর প্রভাব ও এ থেকে অনুকূল সাড়া সমান ছিল। এ প্রতীক শ্ৰেণীবৈরিতাকে সীমিত রাখায় সক্ষম ছিল। দারিদ্রপীড়িত জনসাধারণের ক্রোধকে পশ্চিম পাকিস্তানী শােষকদের দিকে সহজে চালিয়ে নেওয়া যেতাে বলে পূর্ব পাকিস্তানে শ্ৰেণীবৈরিতাকে সহনীয় মাত্রায় সীমিত রাখা সম্ভব ছিল এবং পূর্ব পাকিস্তানীদের সহজাত আনুগত্যের সুযােগ নেওয়া সম্ভব ছিল।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের বিরােধীরা ধর্মপন্থী হােক কিংবা অন্য মধ্যপন্থী হােক তাদের তাৎপর্যপূর্ণ সমর্থনের বুনিয়াদ তেমন ছিল না। বামপন্থীরাও ছিল বেশ উপান্তিক পর্যায়ে সীমিত। তাদের আদর্শও ছিল তাদের জন্য অন্তরায় আর ঐ পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানী জনসমাজের জন্য ঐ আদর্শ খুব একটা প্রাসঙ্গিক ছিল না—কেননা, তৎকালীন জনসমাজে খুব একটা সুস্পষ্ট সংজ্ঞায়িত শ্রেণী সংঘাত ছিল না, ধর্মবিরােধী কোনাে সুগঠিত বিশ্বাসের অস্তিত্বও ছিল না।
শ্ৰেণীবৈরিতা ও ধর্মান্ধতা কার্যত না থাকায় পূর্ব পাকিস্তানের বস্তুনিষ্ঠ পরিবেশ পরিস্থিতি আওয়ামী লীগের মতাে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক লক্ষ্য এবং সমাজ পরিবর্তনে মধ্যনীতিসম্পন্ন। একটি মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দলের১৩ অভ্যুদয়ের জন্য অত্যন্ত অনুকূল ছিল। তাই “উপনিবেশ” থেকে পূর্ব পাকিস্তানের একটি স্বাধীন সত্তার উত্তরণে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। তবে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের প্রাসঙ্গিকতায় ইচ্ছা’কে দাবি’তে রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় এই দলটি বিচ্ছিন্নতার প্রক্রিয়াটিকে আরাে দ্রুততর করে তােলে যদিও রাজনৈতিক দল (যা মূলত এক সংহতিবিধায়ক উপব্যবস্থা বিশেষ) হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ যাত্রা শুরু করেছিল এক সংহতিবিধায়ক ভূমিকায়।
নিঃসন্দেহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ১৯৬৬ সালে ছয়-দফা প্রণয়ন করে পূর্ব পাকিস্তানীদের অসন্তোষ তীব্রতর করে তােলার অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। তবে পাকিস্তানী রাষ্ট্রসংস্থার অবস্থা বৈগুণ্যেই আওয়ামী লীগ এই পথে যেতে বাধ্য হয়। যথার্থ বলতে গেলে পর্যাপ্ত রকমে অংশীদারিমূলক একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা উদ্ভাবন এবং দেশের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পদের অধিকতর ন্যায্য বিলিবণ্টনের নিশ্চয়তা বিধানে শাসকগােষ্ঠীর ব্যর্থতার জন্যই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ একান্তভাবে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের অনুকূলে তার পাকিস্তানী ভাবমূর্তি বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়।
আধুনিক রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে অবশ্যই একটি দক্ষ অবকাঠামাে গড়ায় সক্ষম হতে হবে (হয় বহুত্ববাদী প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ নয় সমাজতান্ত্রিক
২৬৬
রাষ্ট্রগুলির মতাে পরিসঞ্চালন বলয়ের মাধ্যমে) যাতে জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলিকে তীক্ষ্ণ, শাণিত, পরিচৰ্চিত করে তােলার প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করা যায় এবং এক সংবেদনশীল, সক্ষম ও দায়িত্বশীল ফলপ্রদায়ক কার্যপ্রণালীতে গােটা ব্যবস্থার দাবি মেটানাে যায়। অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন পাকিস্তানী শাসককুলীনেরা কোটারি আধিপত্যময় এক স্বৈর পরিকাঠামাে গড়ে তােলার অনুকূলে জাতি গঠনের এই গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলিকে অবহেলা করে। ভ্রান্ত অগ্রাধিকারগুলিতে সবিশেষ গুরুত্ব আরােপ করা হয়। অংশীদারি ভিত্তিতে জাতি গঠনের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি পুরােপুরি অবহেলিত হয়। পাকিস্তানী ক্ষমতার শীর্ষস্থানীয়দের এই ভূমিকার সাথে তাদের “ভারত-আতঙ্ক” নিবিড় সম্পর্কিত ছিল আন্তর্জাতিক ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে, আগে কমিউনিজম রােধের১৪ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বারােপের সঙ্গে ও পরে দক্ষিণ এশিয়ায় সােভিয়েত প্রভাব ঠেকাতে চীনের সাথে আঁতাতে উপনীত হওয়ার ব্যগ্রতায় আর এরই নীট ফল হিসেবে পাকিস্তান হয়ে ওঠে এক জাতিসন্ধানী সেনাবাহিনী!
পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় ঐ দেশের একেবারেই ভিন্ন দুটি শাখার জনসমষ্টির রাজনৈতিক চেতনার স্তরও ভিন্ন। নগর ও শিল্পায়নের নিম্নস্তর সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের রাজনৈতিকীকরণের স্তর পশ্চিম পাকিস্তানীদের তুলনায় অনেক বেশি উঁচু।১৫ পাকিস্তানের রাষ্ট্র প্রকৃতির প্রশ্নে পাকিস্তানের দুটি শাখার নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গির পরিপূর্ণ মেরুকরণের বিষয়টিকে’অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রকাশ করেছেন চার্লস বার্টন মার্শাল। তিনি ১৯৫৯ সালে লিখেছিলেন: “পূর্ব পাকিস্তান রাজনীতিভাবাপন্ন, আর পশ্চিম পাকিস্তান সরকারগত প্রাণ।”১৬ তাই পাকিস্তানী রাজনীতির স্ববিরােধিতা ‘৬০-এর দশকের মধ্যভাগ অবধি পশ্চিম পাকিস্তানী জনসমষ্টির রাজনীতি সংশ্লিষ্ট অংশগুলির তুলনামূলক নিষ্ক্রিয়তায় প্রলম্বিত হয়েছে ও তাতে করে পরিবর্তনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে অনুপ্রেরণাও দিয়েছে। দলটি তাতে সফল হয়েছে। ঠিকই কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের কার্যত স্বাধীনতা ঘােষণার আগে অবধি নয় কিংবা একটা সম্পূর্ণ নতুন ব্যবস্থাকে সার্বিকভাবে জায়গা ছেড়ে দিয়ে পাকিস্তানের তৎকালীন বিরাজমান ব্যবস্থা। পুরােপুরি ভেঙে পড়া অবধি নয়। তাই যুক্তিসঙ্গতভাবেই বলা যায় যে, পূর্ব পাকিস্তান। আওয়ামী লীগ ইতিহাস-নির্ধারিত ভূমিকা সাফল্যের সঙ্গে পালন করেছে। এর অন্যথা করার খুব সামান্য বিকল্পই তার সামনে খােলা ছিল।
আধুনিক রাজনৈতিক দলগুলিকে জনসমাজের জন্য প্রাসঙ্গিক বা প্রয়ােজনীয় হতে হলে এ সব দলকে মানব বিষয়াবলির একটা যৌক্তিক ও উদ্দেশ্যসাধক গন্তব্যে সামাজিক অগ্রগতির বাহন হতে হবে। নিখিল ভারত মুসলিম লীগের উত্তরসূরি এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ/পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পিতৃ সংগঠন পাকিস্তান মুসলিম লীগ কার্যত খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায় এ কারণে যে, এই দলটির কোনাে ব্যাপক ও সুসংজ্ঞায়িত সামাজিক লক্ষ্য ছিল না। আর সে কারণেই দলটি কর্তৃপক্ষ ও জনসমাজের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যােগসূত্র হতে পারেনি। আশু রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলি ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সে তুলনায় সুপরিসরভাবে সংজ্ঞায়িত সামাজিক উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও অঙ্গীকার ছিল।
২৬৭
তবে এ দলের কার্যপরিচালনাগত নীতির গঠনপ্রক্রিয়া ছিল অনেকটাই খণ্ড খণ্ডভাবে যাতে কোনাে বাধ্যবাধকতা আরােপক ব্যবস্থাপত্রের বিধান ছিল না। এর অবশ্য এক ব্যাখ্যাও দেওয়া চলে এভাবে যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাছে রাজনৈতিক সমস্যাই, কিংবা জাতীয়তাবাদের তাল-লয় বিহীন বিকাশ বা ইত্যাকার বিষয় ছিল সর্বাগ্রগণ্য। কিন্তু আসলে সেগুলিই কি সব? কিংবা এটিকে অন্যভাবে বলা যায়: ঘটনা এ রকমই বা ছিল কেন?
পূর্ব পাকিস্তানে শাসকগােষ্ঠীবিরােধী শক্তিগুলির রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া এবং এ শক্তিগুলির সাথে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্পর্কের সমীকরণের একটা মােটামুটি পর্যালােচনায় দেখা যাবে, পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ বৈশিষ্ট্যগতভাবে একটি উপনিবেশবিরােধী প্ল্যাটফরম দল যা আবশ্যিকভাবেই অনিয়তাকার প্রকৃতির। এ দলটির অস্তিত্ব রক্ষার রসদ আসে সবচেয়ে সক্রিয় ও গােলযােগময় দিনগুলিতে অভাব-অনটন প্রপীড়িত কৃষককুল, প্রান্তিক উদ্বৃত্ত চাষী, শিল্প শ্রমিক, শহরে শিক্ষিত অথচ প্রধানত পল্লী জনপদভিত্তিক ছাত্রদের কাছ থেকে।
পূর্ব পাকিস্তান বলতে যে অঞ্চলকে বােঝাতে সে অঞ্চলের গ্রামীণ জনসাধারণের রাজনৈতিকীকরণ শুরু হয় ‘৩০-এর দশকে ফজলুল হকের ডাল-ভাত রাজনীতি থেকে আর তা তীব্রতর হয়ে ওঠে ‘৪০-এর দশকে কৃষক সভাগুলির প্রয়াসের বদৌলতে। তাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ যে সময় নাগাদ প্রধানত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জনগণকে সংগঠিত করার কাজে নামে সেই সময় নাগাদ চরম দারিদ্র্য ও শােষণজনিত সামাজিক আঁতাত ও উত্তেজনায় ঐ সব লােকের মনে ভােটের অধিকারের আশা-আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি অন্ততপক্ষে ন্যায়বিচার লাভের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানজনিত ধারণা উজ্জীবিত হয়। ‘৬০-এর দশকের শেষ ভাগে শাসকগােষ্ঠীবিরােধী গণজোয়ারের মেজাজে সে ধরনের সমাজ রাজনৈতিক আঁতাতের যৌথ প্রভাব পড়তে লক্ষ্য করা যায় যখন তারা জোতদার, গ্রাম্য টাউট, উদ্বৃত্ত চাষী তথা মৌলিক গণতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে জেগে ওঠে, এমনকি গণআদালতে তাদের “বিচারানুষ্ঠানও” করে।
পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের কৃষককুলের সংখ্যাশক্তির বিচারে তার শ্রমিক শক্তি নগণ্য (‘৬০-এর দশকের শেষভাগে ৯৭৬,০০০)। এর মধ্যে অর্ধেকেরও কম আধুনিক শিল্প খাতের শ্রমিক। এ সব শ্রমিকদের মধ্যে যারা সংগঠিত ছিল তারা ‘৬০-এর দশকের শেষভাগ অবধি বামপন্থী রাজনৈতিক গ্রুপগুলির সাথে সম্পর্কিত। এ সময় নাগাদ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তার শ্রমিক ফ্রন্ট শ্রমিক লীগের মাধ্যমে অধিকতর আধিপত্যশীল হয়ে ওঠে। শিল্প উৎপাদিত পণ্যের বর্ধিত মূল্যের পাশাপাশি ‘৬০-এর দশকে শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি সূচক পড়ে গেলে শ্রমিক অসন্তোষ ধূমায়িত হয় ও তারা রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের একেবারে গােড়া থেকেই এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শ্রমিকদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও অসন্তোষ কার্যত নারায়ণগঞ্জ শিল্প শহর থেকে ১৯৬৯ সালে শুরু হয়। এখানকার শিল্প শ্রমিকরা যথেষ্ট জঙ্গি মনােভাব প্রকাশ করে নিজ দাবি-দাওয়া আদায়ে
২৬৮
মালিকদের বিরুদ্ধে নিগ্রহমূলক পদ্ধতি প্রয়ােগ করে। আর কৌতূহলােদ্দীপকভাবে পরবর্তীকালে সরকারি ছাড়, রেয়াত ইত্যাদি পাওয়ার ফলে তাদের শক্তি বৃদ্ধি পায়। তাদের জঙ্গি কার্যকলাপ অসহযােগ আন্দোলন চলাকালে শিখরে পৌঁছায়। এ অসহযােগ আন্দোলনের উদাতা ও সংগঠক ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। এ আন্দোলনটি হয় ১৯৭১ সালের মার্চে।
স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ও আইয়ুববিরােধী গণজাগরণের সংগঠক ছাত্ররা বরাবরই পূর্ব পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের পুরােভাগে ছিল। তারা ছিল পূর্ব পাকিস্তান। আওয়ামী লীগ এবং কৃষক শ্রমিকদের এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ যােগসূত্র। এই ছাত্র সমাজের মধ্যে ছিল সক্রিয়তাবাদী ছাত্রদের একটি অংশ যাদের মার্কসবাদী বা মার্কস-লেনিনবাদ প্রবণতাসম্পন্ন বলে উল্লেখ করা হয়। এ বাস্তবতার কারণে বােঝা যায় যে, আন্দোলনে গণমানুষের অংশীদার হওয়ার প্রেরণা কেবল রাষ্ট্রীয় অধিকার পাওয়ার জন্যই ছিল না বরং ন্যায়বণ্টনের প্রশ্নটিও গুরুত্ব লাভ করেছিল।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নয়া নেতৃত্ব ব্যাপক জনসংগঠনের মাধ্যমে একটা মােকাবেলামূলক মনােভঙ্গির ভূমিকা গ্রহণ করে পূর্ব পাকিস্তানী রাজনীতিকে এক নতুন অভিমুখিতাসম্পন্ন বৈশিষ্ট্য দেয়। ঐ সময়কার দাবির প্রয়ােজনে দলটি আদর্শিক মতাদর্শ নির্বিশেষে গ্রামের কৃষক, শিল্প শ্রমিক ও ছাত্র সমাজের আরাে কাছাকাছি যায়। আর সে কারণেই ১৯৬৪ সালের পর থেকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে উত্তরণের কথা ক্রমবর্ধমান হারে উচ্চারণ করতে থাকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। স্পষ্টত এটি করা হয় কিছুটা বিশ্বাস, কিছুটা বাগাড়ম্বর সর্বস্ব আবেগ হিসেবে। বােধগম্যভাবেই যারা সমাজতান্ত্রিক বুলি সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে, আর যারা সমাজতান্ত্রিক বুলির জন্যই দলটিকে সমর্থন জানায় তারা তা করে তাদের নিজ নিজ নেপথ্য কারণ ও স্বার্থে। বলা যায়, সামাজিক সমস্যাবলির প্রশ্নে যারা স্থিতাবস্থাবাদী ও যারা কাঠামােগত সংস্কারপন্থী তাদের উভয় তরফই আশু-রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে যেতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করে। সমস্যার অহিংস নিষ্পত্তির সম্ভাবনা প্রথমে কিছু মরীচিকাবৎ হয়ে দেখা দিলেও গােলটেবিল আলােচনার ব্যর্থতায় তার দফারফা ঘটে। পরিশেষে নির্বাচন পরবর্তী ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে বিরােধ তীব্র হয়ে ওঠে। ক্রমান্বয়ে গােড়ার দিকে বিক্ষিপ্ত সশস্ত্র প্রতিরােধের ঘটনা ঘটে ও পরে পূর্ণাঙ্গ মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। আওয়ামী লীগ অস্থায়ী সরকারের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুক্তিযােদ্ধাদের সার্বিক আনুগত্য সত্ত্বেও তাদের মাঝে মেরুকরণ ঘটে। এই অস্থায়ী সরকার সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায়সম্মত সার্বভৌমত্ব লাভ করে।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সংগ্রামের প্রকৃতিকে সামগ্রিক বিবেচনায় নিলে দেখা যায় যে, উল্লিখিত ধরনের মেরুকরণ ছিল অনিবার্য, যেমন অনিবার্য ছিল একটা গতানুগতিক উপনিবেশবিরােধী দৃশ্যপটে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কোয়ালিশন ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং ফলত অনিবার্য ছিল বাংলাদেশের জাতীয় পুনর্নির্মাণের জন্য সুস্পষ্ট কর্মধারার ব্যাপারে বিভ্রান্তির উদ্ভব।
২৬৯
টীকা ও তথ্যনির্দেশ
প্রথম অধ্যায়
১. পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন, কাগমারী, ৭-৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অভিভাষণ; ৭.২.৫৭ (বাংলা) (ঢাকা, ১৯৫৭), পৃ. ১১।
২. এ বিষয়ে আলােচনার জন্য দ্র. Khalid Bin Sayeed, Pakistan: The Formative Phase (লন্ডন, ১৯৬৮), ২য় সং, জিন্নাহর ঐক্যের আহ্বানের জন্য দ্র. Jamil-ud-din Ahmed, সম্পা., Some Recent Speeches and Writings of Mr Jinnah (লাহাের, ১৯৪৭)।
৩. কিছুটা বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র. Abul Hashim, In Retrospection (ঢাকা, ১৯৭৫); কামরুদ্দিন আহমদ, বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ (ঢাকা, ১৯৭৬), বালাম ২, পৃ. ১-৮৮; ও Shyamali Ghosh, ‘Fazlul Haq and Muslim Politics in Pre-Partition Bengal’, International Studies (নয়াদিল্লি), বালাম ১৩, নং ৩, জুলাই ১৯৭৪, পৃ. ৪৪১-৬৪।
8. কিছুটা বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র. M. Rafiq Afzal, Political Parties in Pakistan 1947-1958 (ইসলামাবাদ, ১৯৭৬), এবং K. K. Aziz, Party Politics in Pakistan, 1947-1958 (ইসলামাবাদ, ১৯৭৬)।
৫. কিছুটা বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র. বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (কলকাতা, ১৯৭১), ১ম খণ্ড, ১ম ভারতীয় সং, পৃ. ২। আরাে দ্র. কামরুদ্দিন, এন. ৩, পৃ. ৯৭-১০১।
৬. আফজাল, এন, ৪।
৭. Constituent Assembly of Pakistan (Legislative) Debates, বালাম ১, নং ৮, ৬ মার্চ
১৯৪৮, পৃ. ২৬১-৬২।
৮. এই পুস্তিকাটি তৈরি করেছিলেন তরুণ প্রতিবাদী শামসুল হক। এই মূল দাবিতে পাকিস্তান ফেডারেশন ইউনিটগুলির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, ইসলামের গণতান্ত্রিক নীতিমালা সমন্বিত প্রজাতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র চাওয়া হয়। এতেও আবুল হাশিম প্রস্তাবিত ম্যানিফেস্টোর মতাে একই কৃষি সংস্কার, শিল্পোন্নয়ন কামনা করা হয় ও তেভাগা ব্যবস্থা, ব্যবসায়-বাণিজ্য জাতীয়করণ, শিল্প মুনাফার ওপর সিলিং ও বিদেশী পুঁজির ওপর বিধিনিষেধ আরােপের সুপারিশ করা হয় । আবুল হাশিমের ম্যানিফেস্টোর বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে এতে উপসংহারে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘােষণা করা হয়। দ্র. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬২-৬৪।
৯. এই ম্যানিফেস্টো তৈরি করেছিলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সম্পাদক আবুল হাশিম যা অবশ্য নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিল অনুমােদন করেনি। ঐ সময় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নেতারা জনাব হাশিমকে কমিউনিস্ট বলে আখ্যায়িত করেন। দেশভাগ পরিকল্পনাকে জনাব হাশিম সমালােচনা করায় তাঁকে ‘ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সাপ’ বলে সমালােচনা করা হয়।
১০. আজাদ (ঢাকা), ২৩ জুন ১৯৪৯।
১১. A Sadeque, Economic Emergence of Pakistan with Special Emphasis on East Pakistan (ঢাকা, ১৯৫৪), ১ম খণ্ড।
১২. আফজাল, এন. ৪, পৃ. ১১৮-১৯।
১৩. উমর, এন, ২য় খণ্ড, পৃ. ১২২-২৫।
১৪. Richard Lambert, “Factors in Bengali Regionalism in Pakistan”, Far Eastern Economic Review (Hong Kong), বালাম ২৮, নং ৪, এপ্রিল ১৯৫৯, পৃ. ৪৯-৫৮।
১৫. প্রাগুক্ত।
১৬. এমএএইচ ইস্পাহানি, একমাত্র পূর্ব পাকিস্তানী সদস্য যদিও তিনি প্রকৃত অর্থে ছিলেন অবাঙালি।
১৭. আফজাল, এন. ৪, পৃ. ১১৮-১৯।
১৮. মূল দাবি, পৃ. ২৪-২৫, বরাতের জন্য দ্র. উমর, এন. ৫, পৃ. ২৬৩।
১৯. শামসুল হক, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ খসড়া ম্যানিফেস্টো (ঢাকা, তা. বি.), পৃ.
২৩। ২০. T. Maniruzzaman, Radical Politics and the Emergence of Bangladesh (ঢাকা,
১৯৭৯), পৃ. ৩২-৩৩।
২১. পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন, সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের বার্ষিক রিপোের্ট (ঢাকা, ১৯৫৫), পৃ. ২৬-২৭।
২২. কিছুটা বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র. উমর, নােট ৫, কামরুদ্দিন আহমদ, নােট ৩, ও মুস্তাফা সরওয়ার, “পঁচিশ বছরের সগ্রামে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু”, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশন, ১৯৭৪, স্মরণিকা (ঢাকা, ১৯৭৪)।
২৩. আফজাল, এন. ৪, পৃ. ৮৬, Cites Dawn, ৩০ ডিসেম্বর ১৯৪৯।
২৪. আফজাল, এন, ৪, পৃ. ৮৬, Cites Dawn, ২৬ জানুয়ারি ১৯৫১।
২৫. আফজাল, এন. ৪, পৃ. ৪৯।
৬. মনিরুজ্জামান, এন. ১৭, পৃ. ৬।
২৭. E. H. Slade, Census Commissioner, Pakistan, Census of Pakistan 1951 (করাচি, ১৯৫৫), বালাম ১, পৃ. ৬৬-৯৭।
২৮. উমর, এন. ৫, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৮৯।
২৯. জাতীয় মহাসম্মেলনের (জিএনসি) বিবরণের জন্য দ্র. উমর, এন, ৫, পৃ. ৩৯৯-৪০৪, এবং Kamruddin Ahmad, A Socio-Political History of Bengal and the Birth of Bangladesh (ঢাকা, ১৯৭৫), Appendix B, পৃ. ৩৯২-৯৬। উমর ও কামরুদ্দিন গ্র্যান্ড ন্যাশনাল কনভেনশনের একাধিক তারিখ দিয়েছেন তাতে গরমিল রয়েছে। কামরুদ্দিন আহমদ
২৭২
গণতান্ত্রিক ফেডারেশন সংগ্রাম কমিটির (সিএডিএফ) অন্যতম সবচেয়ে সক্রিয় অংশীদার হলেও তিনি কালপঞ্জি সম্পর্কে নির্ভুলতার দাবি করেননি। আন্দোলন সম্পর্কে বদরুদ্দীন উমরের সুগবেষণাপ্রসূত অধ্যায়টি লেখা হয়েছে প্রধানত তাজউদ্দিন আহমদের ডায়েরি ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন রিপাের্ট থেকে, আর সে কারণেই তাঁর দেওয়া কালপঞ্জি অধিকতর প্রামাণ্য বলেই মনে হয়।
৩০. কামরুদ্দিন, এন, ৩, পৃ. ১৩৪-৩৫।
৩১. উমর, এন. ৫, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৯২-৯৫।
৩২. উমর, এন. ৫, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৯৪-৩৯৯।
৩৩. কামরুদ্দিন, এন. ৩, পৃ. ১৩৩-৩৪।
৩৪. উমর, এন. ৫, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৯৯।
৩৫. প্রস্তাবাবলি দ্র., এন. ২৯।
৩৬. আফজাল, এন. ৪, পৃ. ১০০।
৩৭. প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৩, বরাত সূত্র: Dawn, ১০ জুলাই ১৯৫৩।
৩৮, তাজউদ্দিন আহমদ, সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ: নীতি ও কর্মসূচির ঘােষণা (ম্যানিফেস্টো), (ঢাকা, ১৯৬৯), পৃ. ১।
৩৯. আজিজ, এন. ৪, পৃ. ৯৫-৯৬।
৪০. আবুল হাশিমের ম্যানিফেস্টো পাকিস্তান কেমন দেশ হবে তার সংজ্ঞায়নে প্রয়াসী হয়েছে। তাতে এমন ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে, পাকিস্তান আর্থ-রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক দিক থেকে হবে আদর্শস্থানীয় যা “পূর্বাঞ্চলের” জীবনযাত্রা ও পরিবেশের জন্য অনুকূল হবে। সেই সময় এই “পূর্বাঞ্চল” বলতে পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্র মনে করা হয়েছিল। এতে বলা হয়: “পূর্ব পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব কার্যকর করবে সংশ্লিষ্ট জনসাধারণ এবং সর্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত একটি ব্যবস্থাপক পরিষদ একটি গণতান্ত্রিক অধিকার, নারী শিক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রীয় ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, বিশেষ করে পাটসহ সকল একচেটিয়া কারবার ও খাজনা প্রাপক স্বত্বাদির বিলােপ, মূল শিল্পসমূহের জাতীয়করণ, উপযুক্ত ন্যূনতম মজুরি, সকলের জন্য বেকারত্ব ও বার্ধক্য ভাতা, শ্রমিক-কর্মীদের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, সমবায় কৃষি ও বিপণন ব্যবস্থা, বৃহদাকার জাতীয়কৃত সেচ প্রকল্প ও রাষ্ট্র কর্তৃক বড় ও ছােট আকারের কুটির শিল্পের যুগপৎ উন্নয়নের কথা বলা হয়। এতে প্রস্তাবিত পাকিস্তানকে কোন ইসলামী রাষ্ট্র বলে উল্লেখ করা হয়নি তবে এ প্রত্যাশা ম্যানিফেস্টোতে ছিল যে, মুসলীম লীগ শরিয়ত আইনের প্রয়ােগ ও মুসলমানদের মধ্যে তাঁর প্রতিফলন ও ইসলামী নৈতিক মূল্যবােধের পুনরুজ্জীবনের বিষয় নিশ্চিত করবে। এতে সাম্রাজ্যবাদবিরােধী শক্তিগুলির মধ্যে ঐক্যের আহ্বানও জানানাে হয়। দ্র. উমর, এন. ৫, ১ম খণ্ড, পৃ. ২২২-২৫।
৪১. উমর, এন, ৫, পৃ. ২৬৪।
৪২. কামরুদ্দিন, এন. ৩, পৃ. ১৪৬।
৪৩. বাংলাদেশে গৃহীত বিভিন্ন সাক্ষাৎকার।
৪৪. আফজাল, এন. ৪, পৃ. ১০৩।
২৭৩
৪৫. ১৯৫৩ সালের ৩ জুলাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল সভায় দলের কার্যরত সম্পাদক উপস্থাপিত সাংগঠনিক রিপাের্ট।
৪৬. আফজাল, এন. 8, পৃ. ১০২।
৪৭. দ্র. শামসুল হক, এন. ১৬।
৪৮. তাজউদ্দিন, এন. ৩৮, মুখবন্ধ ।
৪৯. আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (ঢাকা, ১৯৭৫), ৩য় পরিবর্ধিত সংস্করণ, পৃ. ৩২২; কামরুদ্দিন, এন, ৩, পৃ. ১৮৩-৮৬, ও Dawn, ৮ ও ১৭ সেপ্টেম্বর, ২৮ নভেম্বর ও ৪ ডিসেম্বর ১৯৫৩। যুক্তফ্রন্ট সম্পর্কে আরাে বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র. Najma Chowdhury, The Legislative Process in Bangladesh Politics and Functioning of the East Bengal Legislature 1947-58, ঢাকা ১৯৮০, পৃ. ১৫৭-৬৪।
৫০. দ্র. চৌধুরী, এন. পৃ. ৪৯।
৫১. দ্র. এন. ২১, পৃ. ৪-৫।
৫২. দ্র. Dawn, ৫ এপ্রিল ১৯৫৪ এবং আবুল মনসুর, এন. ৪৯, পৃ. ৩৩৩।
৫৩. দ্র. চৌধুরী, এন. ৪৯, পৃ. ১৭৫-৬।
৫৪. আবুল মনসুর, এন, ৪৯, পৃ. ৩৩৭।
৫৫. আফজাল, এন. ৪, পৃ. ১২৯। ৫৬. Dawn, ৩০ এপ্রিল ১৯৫৪।
৫৭. প্রাগুক্ত, ২৯ জুন ১৯৫৪।
৫৮. ২১-দফা ম্যানিফেস্টো দ্র., পরিশিষ্ট ১।
৫৯. Dawn, ৩১ মে ১৯৫৪।
৬০. দ্র. এন. ২১, পৃ. ১৬।
৬১. আফজাল, এন. ৪, পৃ. ১৩৪, বাড়তি গুরুত্বসহকারে। ১৯৫৪ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পাদিত সামরিক সাহায্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য একদল মার্কিন অর্থনীতিবিদ পাকিস্তানে আসেন।
৬২. শাসনতন্ত্র রচনার বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র.। G. W. Choudhury, Constitutional Development in Pakistan (লন্ডন, ১৯৬৯); আরাে দ্র. Choudhury’s Document and Speeches on the Constitution of Pakistan (ঢাকা, ১৯৬৭)।
৬৩. চৌধুরী, এন, ৪৯, পৃ. ১৭৮।
৬৪. আবুল মনসুর, এন. ৪৭, পৃ. ৩৪৬-৬০, কামরুদ্দিন, এন, ২৯, আতাউর, এন. ৬৬ এবং কামরুদ্দিন,
এন. ২৯, পৃ. ১৮৮; আফজাল, এন. ৪, পৃ. ১৬২; আতাউর রহমান খান, ওজারতির দুই বছর
(ঢাকা, ১৯৭২), ৩য় পুনর্মুদ্রণ, পৃ. ৯০।
৬৫. Dawn, ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর ১৯৫৪।
৬৬. Pakistan Observer (ঢাকা), ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫। আরাে দ্র. Jyoti Sengupta, Eclipse
of East Pakistan: Chronicle of Events since Birth of East Pakistan till October | 1963 (কলকাতা, ১৯৬৩), পৃ. ২৩০।
২৭৪
৬৭. Dawn, ১৮ এপ্রিল ১৯৫৫।
৬৮. আবুল মনসুর, এন, ৪৭, পৃ. ৩৫৪।
৬৯. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫৫।
৭০. Dawn, ৭ এপ্রিল ১৯৫৫।
৭১. প্রাগুক্ত, ২৫ এপ্রিল ১৯৫৫।
৭২. প্রাগুক্ত, ২৪ এপ্রিল ১৯৫৫।
৭৩. প্রাগুক্ত, ২৬ এপ্রিল ১৯৫৫।
৭৪. বরাত দ্র. আফজাল, এন. ৪, পৃ. ১৭৬। আফজাল সূত্রের বরাত না দিয়েই বলছেন যে, ঐ মুচলেকার পাঠটি মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালের ৬ এপ্রিল সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য পাঠান।
৭৫. প্রাগুক্ত, ৩০ এপ্রিল ১৯৫৫।
৭৬. Dawn, ২৩ ও ২৪ অক্টোবর ১৯৫৫।
৭৭. পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন, কাগমারী, ৭-৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭, সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অভিভাষণ (বাংলা), (ঢাকা, ১৯৫৭), পৃ. ১। পরবর্তীকালে মওলানা ভাসানী চীনা পদ্ধতিতেও সমান আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এ থেকে দেখা যাবে যে, দরিদ্র, নিগৃহীত, নিপতিত মানুষের স্বার্থরক্ষায় চির সােচ্চার ভাসানী যে পদ্ধতিতেই অভাবী মানুষের জন্য কল্যাণের প্রতিশ্রুতি থাকতাে তাতেই আকৃষ্ট হতেন। এমনকি তিনি এভাবে আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রী ব্যবস্থায়ও আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাই একান্ত আদর্শিক পরিমিতি দিয়ে তার অবস্থানগত পরিবর্তনগুলি বিচার করা নিরর্থক।
৭৮. প্রাগুক্ত, পৃ. ১০।
৭৯. প্রাগুক্ত, পৃ. ২২।
৮০. এন. ১৮, পৃ. ৩১।
৮১. প্রাগুক্ত।
৮২. এন. ৭৭, পৃ. ২১।
৮৩. শেখ মুজিবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ও নিয়মাবলি (ঢাকা, তা. বি.), মুখবন্ধ।
দ্বিতীয় অধ্যায়
১. বাস্তবিকপক্ষে বাংলাদেশের প্রতিটি মহকুমার জন্য “গভর্নর” মনােনয়নের বাকশাল পরিকল্পনার (১৯৭৪-৭৫) মাঝেও একই মনােভাব প্রকাশ পায়, যার উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসকদের কাজের ওপর নিরন্তর নজর রাখা। অবশ্য স্বাধীনতা পরবর্তী দেশে এ ধরনের প্রহরা বা নজরদারির ব্যবস্থা। ছিল দেশের সমাজবাদী অর্থনীতিতে সফল উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের অন্যতম প্রস্তাব। দ্র. Planning Commission, Government of the People’s Republic of Bangladesh, The First Five Year Plan, 1973-78 (ঢাকা, নভেম্বর ১৯৭৩), পৃ. ১-৮।
২৭৫
২. বক্তৃতার পূর্ণ পাঠের জন্য দ্র. পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন, কাগমারী, ৭-৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭, সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অভিভাষণ; ৭.২.১৯৫৭, (বাংলা), (ঢাকা, ১৯৫৭)।
৩. বিস্তারিত দ্র. ৬ অধ্যায়।
8. বিস্তারিত দ্র. Jyoti Sengupta, Eclipse of East Pakistan: Chronicle of Events since Birth of East Pakistan till October 1963 (কলকাতা, ১৯৬৩), Amitava Gupta, Bangladesh (কলকাতা, ১৯৭৩), নতুন সং ও Rashiduzzaman, “The Awami League in the Political Development of Pakistan”, Asian Survey (9196), বালাম ১০, নং ৭, পৃ. ৫৭৪-৮৭।
৫. আবুল মনসুর আহমদ তাঁর সাত ঘণ্টাব্যাপী দীর্ঘ বক্তৃতা (১৬, ১৭ জানুয়ারি ১৯৫৬) এই বলে শেষ করেন যে, “আপনারা ভূগােলকে অগ্রাহ্য করিবেন না। মনে রাখিবেন ভূগােল ও ইতিহাস যমজ সহােদর। যদি ভূগােলকে আপনারা অস্বীকার করেন, তবে ইতিহাস আপনাদের ক্ষমা করিবে না। মনে রাখিবেন ইতিহাসের পুনরাবর্তন অবশ্যম্ভাবী।” (দ্র. বক্তৃতা, CAP Debates, বালাম ১, নং ৫১, ১৬ জানুয়ারি ১৯৫৬, ও বালাম ১, নং ৫২, ১৭ জানুয়ারি ১৯৫৬)। কয়েক সপ্তাহ পর বাজেট বক্তৃতার সমাপনী ভাষণে তিনি যা বলেছিলেন তা আরাে তথ্যবহুল। তিনি বলেন:
আমি আমার ভ্রাতাদেরকে এই হুঁশিয়ারি দিয়ে আমার বক্তৃতা শেষ করবাে যে, অতীতে ওরা কোনাে শাসনতন্ত্র ছাড়াই পূর্ব পাকিস্তানকে শােষণ করেছে। আর আজকে তারা আবার নতুন এক শাসনতন্ত্রের নামে সেই শােষণ, সেই অবিচারকে কায়েমি করতে চলেছে। তারা যদি সেটা করেই আমি আমার বন্ধুদের ইংল্যান্ডের কৃতী সন্তান এডমান্ড বার্কের কথা স্মরণ করিয়ে দেব। স্যার এডমান্ড বার্ক আমেরিকা নিয়ে প্রচুর তর্জন করেছিলেন কিন্তু, মহােদয়, তাতে তিনি তদানীন্তন ব্রিটিশ রাজনীতিকদের তাঁর পরামর্শে আকৃষ্ট করতে পারেননি। এডমান্ড ব্যর্থ হয়েছিলেন, তাঁর বাগ্মিতা সে দিন ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু মহােদয়, আমেরিকান জনগণ ব্যর্থ হয়নি। যে বিশাল মহাসাগর ইংল্যান্ড ও আমেরিকাকে আলাদা করে রেখেছিল তা আর যা-ই হােক শুকিয়ে ফেলা যায়নি। তাই রাজনীতিবিদরা যখন পারেনি ভূগােল তখন তার ভূমিকা পালন করেছে, সৃষ্টি করেছে নবতর ইতিহাস। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের বেলায়ও আমি আপনাদের ঠিক সেই হুঁশিয়ারিই জ্ঞাপন করছি। আমি আমার ভ্রাতাদের সতর্ক করছি, আপনারা যদি ভূগােলকে অবহেলা করেন, ইতিহাস আপনাদের ক্ষমা করবে না। ভূগােলকে যদি আপনারা উপেক্ষা করেন, ইতিহাস আপনাদের উপেক্ষা করবে, সে বলিষ্ঠ হস্তক্ষেপ করবে, আর মহােদয়, আপনি জানেন যে, যখন ইতিহাস হস্তক্ষেপ করে তখন ইতিহাস কেবলই পুনরাবৃত্ত হয়।
Constituent Assembly (Legislature) of Pakistan Debates, বালাম ১, নং ৭, ২২ মার্চ ১৯৫৭, পৃ. ৩৪৪-৬২।
৬. Jyoti Sengupta, History of Freedom Movement in Bangladesh, 1947-1971: Some Involvement (কলকাতা, ১৯৭৪), পৃ. ৯৮-১০৫; Amitava, এন. ১৪, পৃ. ৮৬-৮৭, ও Rashiduzzaman, এন. ৪।
২৭৬
৭. Dawn, ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭ ও Rashiduzzaman, এন. ৪।
৮. প্রাগুক্ত, ২ নভেম্বর ১৯৫৬, ৩ ডিসেম্বর ১৯৫৬ ও ৯ জানুয়ারি ১৯৫৭।
৯. Sengupta, এন, ৬, পৃ. ৩১৬।
১০. M. Rafiq Afzal, Political Parties in Pakistan, 1947-1958 (ইসলামাবাদ, ১৯৭৬), পৃ. ২১১, এন. ৫২।
১১. Dawn, ৩, ৬, ২১ ও ২৭ মার্চ ১৯৫৭ এবং Sengupta, এন. ৬, পৃ. ৩১৮-১৯।
১২. Dawn, ৩, ৪, ৫ ও ৭ এপ্রিল ১৯৫৭ এবং Sengupta, এন. ৬, পৃ. ৩১৮-১৯।
১৩. Sengupta, এন. ৬, পৃ. ৩১৮-২২। ১ অধ্যায়ে প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকারের পাঠ দ্র.।
১৪. Sengupta, এন. ৮, পৃ. ১০৭।
১৫. প্রাগুক্ত, পৃ. ১১২। ১৯৫৭ সালের ৮ জুন সেনগুপ্ত ভাসানীর সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
১৬. প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৬-১৮।
১৭. Dawn, ২৬ ও ২৭ জুলাই ১৯৫৭।
১৮. আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (ঢাকা, ১৯৭৫), ৩য় পরিবর্ধিত | সং, পৃ. ৪৮৮-৯২।
১৯. কাগমারী ভাষণ, এন. ২।
২০. Talukder Maniruzzaman, The Politics of Development: The Case Study of Pakistan, 1947-1958 (ঢাকা, ১৯৭১), পৃ. ৮৬-১০০।
২১. উদ্ধৃত প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৭, গুরুত্ব আরােপিত।
২২. Dawn, ২২ আগস্ট ১৯৫৭, বরাত প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৭-৯৮, গুরুত্ব আরােপিত।
২৩. Abul Mansur, এন. ১৮, পৃ. ৪০৯-৮৯।
২৪. কিছুটা বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র. আতাউর রহমান খান, ওজারতির দুই বছর (ঢাকা, ১৯৭২), ৩য় পুনর্মুদ্রণ, পৃ. ২৩১-৭; সেনগুপ্ত, এন, ৬, পৃ. ৩৫১-৪; আবুল মনসুর, এন, ২৬, পৃ. ৫২০-২৫।
২৫. বক্তৃতার বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র. দৈনিক আজাদ, ১ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮।
২৬. প্রাগুক্ত, ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮, ও ১৭ জানুয়ারি ১৯৫৮, ও ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮।
২৭. প্রাগুক্ত, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮।
২৮. আবুল মনসুর, এন. ১৮, পৃ. ৫৫০।
২৯. আতাউর, এন. ২৪, পৃ. ১১৩-২২৫।
৩০. আবুল মনসুর, এন. ১৮, পৃ. ৫৫১-৪।
৩১. আতাউর, এন, ২৪, পৃ. ২৪, পৃ. ২৬৫-৭৪, ২৯৬-৯৮।
৩২. আজাদ, ১৬ ও ২০ মার্চ ১৯৫৮।
৩৩. আতাউর, এন, ২৪, পৃ. ২৮।
৩৪. আজাদ, ২৬ মার্চ ১৯৫৮।
২৭৭
৩৫. ইত্তেফাক, ২৭ মার্চ ১৯৫৮।
৩৬. মওলানা ভাসানীর বক্তৃতা সম্পর্কিত “চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়ান” শীর্ষক প্রতিবেদন দ্র. ইত্তেফাক, ২৭ মার্চ ১৯৫৮।
৩৭. ইত্তেফাক, ২৯ মার্চ ১৯৫৮, আজাদ, ৩১ মার্চ ১৯৫৮।
৩৮. দৈনিক ইত্তেফাক (ঢাকা), ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ মার্চ ১৯৫৮ প্রকাশিত রিপাের্ট থেকে সঙ্কলিত ।
৩৯. বিস্তারিত দ্র. ইত্তেফাক, ১ জানুয়ারি ১৯৫৮ থেকে ২৮ মার্চ ১৯৫৮।
৪০. Dawn, ৩১ মার্চ ও ৪, ৫, ২৩ ডিসেম্বর ১৯৫৭ ও ৬ ফেব্রুয়ারি ও ৩১ মার্চ ১৯৫৮।
৪১. আবুল মনসুর, এন. ১৮, পৃ. ৫৫১-৬, ও আতাউর, এন. ৩৩, পৃ. ৩০২-৬।
৪২. আতাউর, এন. ২৪, পৃ. ৩০৬-৮।
৪৩. বিস্তারিত দ্র., প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০৭-৯।
৪৪. বিস্তারিত দ্র. ইত্তেফাক, ও Pakistan Observer (ঢাকা), ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৮।
৪৫. ইত্তেফাক, ২৪-২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫৮ ও Sengupta, এন, ৬, পৃ. ৪১১-১৩।
৪৬. আবুল মনসুর, এন, ১৮, পৃ. ৫৬০-৬১।
৪৭. Time (লন্ডন), ২০ অক্টোবর ১৯৫৮ থেকে উদ্ধৃত। Saleem M. M. Qureshi, “Party Politics in the Second Republic of Pakistan”, নিবন্ধে Time (লন্ডন), থেকে উদ্ধৃত, | Middle East Journal (ওয়াশিংটন), বালাম ২০, নং ৪, শরৎ ১৯৬৬, পৃ. ৪৫৬-৭২।
৪৮. Maniruzzaman, এন. ২০, পৃ. ১৩৮।
তৃতীয় অধ্যায়
১. আতাউর রহমান খান, স্বৈরাচারের দশ বছর, পরিবর্ধিত ২য় সং (ঢাকা, ১৯৭৪), পৃ. ১৬, ও পৃ. ১০৩।
২. অত্যন্ত বিশদ প্রামাণ্য দলিলভিত্তিক সমীক্ষার জন্য দ্র. Venkataramani, M. S., The American Role in Pakistan 1947-1958 (নয়াদিল্লি, ১৯৮২)।
৩. Rounaq Jahan, Pakistan: Failure in National Integration (কলাম্বিয়া, ১৯৭২), পুনর্মুদ্রণ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস (ঢাকা, ১৯৭৩), পৃ. ৫২।
৪. পাকিস্তানের দ্বিতীয় শাসনতন্ত্র প্রণয়ন-সংক্রান্ত কিছুটা বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র. Government of Pakistan, Report of the Constitution Commission, Pakistan 1961 (করাচি, ১৯৬২)
Edgar A. Schuler 3 Kathryn R. Schuler, Public Opinion and Constitution Making in Pakistan 1958-1962 (মিশিগান, ১৯৬৭)।
৫. M. D. Feld, “Professionalism, Nationalism and the Alienation of the Military”
প্রকাশনা সূত্র: J. Vand Doorn, সম্পা., Armed Forces in Society (দ্য হেগ, ১৯৬৮),
পৃ. ৫৫-৭০।
৬. S. P. Huntington, Political Order in Changing Societies (ইয়েল, ১৯৬৮), পৃ. ২৪০-৪১।
২৭৮
৭. Morris Janowitz, “Armed Forces and Society: A World Perspective” gotat সূত্র: Van Doorn, এন. ৫, পৃ. ১৫-৩৮। বিশেষ গুরুত্বসহকারে।
৮. বিস্তারিত দ্র. Khalid Bin Sayeed, “The Role of Military in Pakistan”, Van Doorn, এন. ৫, পৃ. ২৭৪-৯৭।
৯. National Assembly of Pakistan Debates, বালাম ১, নং ১, ৮ জুন ১৯৬২; (করাচি, ১৯৬২), পৃ. ৩। গুরুত্বসহকারে।
১০. আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (ঢাকা, ১৯৭৫), ৩য় পরিবর্ধিত
সংস্করণ, পৃ. ৫৭৬।
১১. Herbert Feldman, Revolution in Pakistan (লন্ডন, ১৯৬৭), পৃ. ১৫৬।
১২. বিস্তারিত দ্র. আতাউর, এন, ১, পৃ. ৫৪-৮১।
১৩. Report of the Constitution Commission-এ প্রদত্ত প্রশ্নমালার পাঠ, এন. ৪, পৃ. ৪৩-৪৬।
১৪. যদি তাঁদের কোনাে শ্রদ্ধাবােধও এ জন্য থাকতাে, তাহলেও তাদের ধারণাগত বােধে সুনিশ্চিতভাবেই গণতন্ত্র এ উপমহাদেশের জন্য উপযােগী ছিল না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, অবিভক্ত পাঞ্জাবের মুখ্য সচিব আখতার হুসেন তাঁর কোনাে এক পাক্ষিক রিপাের্টে অবমাননাকরভাবে লেখেন: “এ দেশে গণতন্ত্র সম্পর্কে সত্যিকার উপলব্ধি নেই বললেই চলে।” দ্র. নথি নং ১৮.১২.৪৬, Home Political (Internal), National Archives of India, নয়াদিল্লি।
১৫. Report of the Constitution Commission, 47. 8, Annexure ‘A’, 4. 1891
১৬, আতাউর রহমানের জবাব তার নিজের টাইপ করা পাঠ থেকে সংক্ষিপ্ত করা। তিনি তাঁর টাইপ করা পাঠের কপিটি আমাকে ঢাকায় ১৯৭৬ গ্রীষ্মে ধার দিয়েছিলেন। তাঁর জবাব Pakistan Observer (ঢাকা), ৩০ জুন ১৯৬০-এও প্রকাশিত হয়েছিল।
১৭. ১৯৭৬-এ ঢাকায় আতাউর রহমানের সাথে সাক্ষাৎকার।
১৮. নূরুল আমিনের জবাবের জন্য দ্র. Pakistan Observer, ২৭ জুন ১৯৬০। অন্য সব রাজনীতিকদের জবাবের জন্য দ্র. প্রাগুক্ত, ১২-২০ জুন ১৯৬০।
১৯. সংকলন সূত্র: ২৬ জুন ১৯৬০।
২০. প্রাগুক্ত, ২৬ জুন ১৯৬০।
২১. প্রাগুক্ত, ২৫ জুন ১৯৬০।
২২. প্রাগুক্ত, ১০, ১২ জুন ১৯৬০।
২৩. প্রাগুক্ত, ২৯ মে ১৯৬১।
২৪. অধ্যায় ১ ও অধ্যায় ২ দ্র. অধ্যায় ৬-এ বিষয়টি নিয়ে আরাে আলােচনা হয়েছে।
২৫. রেহমান সােবহান, “আমাদের অর্থনীতি” প্রকাশনা সূত্র: আজাদ সুলতান সম্পাদিত, দেশ আজ
কোন পথে? (ঢাকা, ১৯৬৩), ২য় সং, পৃ. ২৩-৪১।
২৬. Rehman Sobhan, “Problem of Regional Imbalance in the Economic Development in Pakistan”, Asian Survey (বার্কলে), বালাম ২, নং ৫, জুলাই ১৯৬২, পৃ. ৩১-৩৭।
২৭. Khalid Bin Sayeed, The Political System of Pakistan (বােস্টন, ১৯৬৭), পৃ. ২০১২।
২৭৯
২৮. দ্র. Leonard Shapiro, Political Opposition in One Party State (লন্ডন, ১৯৭২)।
২৯. Sayeed, এন. ২৭।
৩০. Pakistan Observer, ২২ জুন ১৯৬১।
৩১. Schuler ও Schuler, এন. ৪, পৃ. ১৩২।
৩২. উপস্থিত অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন আতাউর রহমান খান, আবু হােসেন সরকার, হামিদুল হক চৌধুরী, তফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া), শেখ মুজিবুর রহমান ও নুরুল আমিনের প্রতিনিধি ইউসুফ আলী চৌধুরী (মােহন মিয়া)।
৩৩. আতাউর, এন. ১, পৃ. ১৬১-৩।
৩৪. Government of Pakistan, capucaia, Pakistan Observer, ৩১ জানুয়ারি ১৯৬২।
৩৫. প্রাগুক্ত, ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২।
৩৬. প্রাগুক্ত, ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২।
৩৭. Morning News (ঢাকা), ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২।
৩৮. আতাউর রহমান খান ও প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মধ্যে আলােচনার বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র. আতাউর, এন. ১, পৃ. ১৬৫-৯৪।
৩৯. Pakistan Observer, ৭-২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২।
৪০. বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র. Dawn (করাচি), ১৮ ও ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২; Hind (মাদ্রাজ), ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২, ও Pakistan Times (লাহাের), ২৫ এপ্রিল ১৯৬২।
৪১. Schuler ও Schuler, এন. ৪, পৃ. ১৬১-এ পিটিআই রিপাের্ট থেকে বরাত। এন. ৪, পৃ. ১৬১।
৪২. Pakistan Observer, ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২।
৪৩. J. K. Ray, Democracy and Nationalism on Trial: A Study of East Pakistan (সিমলা, ১৯৬৮), পৃ. ২৩৫-৩৬।
৪৪. বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র. আতাউর, এন. ১, পৃ. ২০২-৬।
৪৫. ঢাকায় ১৯৭৬ গ্রীষ্মে খন্দকার মােশতাক আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার।
৪৬. Pakistan Observer, ১৪ এপ্রিল ১৯৬২।
৪৭. Iftikhar Ahmad, Pakistan General Election; ১৯৭০ (লাহাের, ১৯৭৬), পৃ. ১৯।
৪৮. Secretariat of the Chief Election Commissioner, Pakistan General Elections,
১৯৬২ (করাচি, ১৯৬৩), পৃ. ২৮-২৯।
৪৯. প্রাগুক্ত, পৃ. ৫১।
৫০. Iftikhar, এন. ৪৭, পৃ. ২২।
৫১. Pakistan General Elections, এন, ৫০, পৃ. ৬০।
৫২. Iftikhar, এন. ৪৭, পৃ. ২১।
৫৩. Karl Von Vorys, Political Development in Pakistan (প্রিন্সটন, ১৯৬৫), পৃ. ২৩৪-৬।
২৮০
৫৪. Iftikhar, এন, ৪৯, পৃ. ২২।
৫৫. বিস্তারিত তুলনার জন্য দ্র. Schuler ও Schuler, এন. ৪, পৃ. ১৯৮-২০৯।
৫৬. আতাউর, এন. ১, পৃ. ১৯৮-২০১।
চতুর্থ অধ্যায়
১. বিবৃতির পাঠ দ্র. Pakistan Observer (ঢাকা), ২০ জুন ১৯৬২।
২. ১৯৭৬ গ্রীষ্মে খন্দকার মােশতাক আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার।
৩. কিছুটা বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র. Karl Von Vorys, Political Development in Pakistan (fepba, ssee) Herbert Feldman, From Crisis to Crisis: Pakistan 1962-1969 (লন্ডন, ১৯৪৭), পৃ. ১৪-২২।
৪. রাজনৈতিক দলগুলিকে এখন কোনাে রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার কিংবা কোনাে রাজনৈতিক কার্যকলাপে লিপ্ত হবার উদ্দেশ্যে কার্যপরিচালনাকারী একটি গােষ্ঠী বা ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়” এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র. Pakistan Observer ৮ জানুয়ারি ১৯৬৩।
৫. ইতঃপূর্বে তাদের কোনাে রাজনৈতিক দলের সদস্যভুক্তি কিংবা রাজনৈতিক দলে পদ ধারণের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। সংশােধিত অধ্যাদেশ অনুযায়ী তাদের এমনকি কোনাে রাজনৈতিক প্রকৃতির বিবৃতি প্রদান কিংবা কোনাে সংবাদ সম্মেলন বা কোনাে জনসভায় বক্তৃতা দান নিষিদ্ধ করা হয়। প্রাগুক্ত, ও ইত্তেফাক (ঢাকা), ৯, ১৩, ১৭ ও ২৭ জানুয়ারি ১৯৬৩।
৬. ইত্তেফাক, ১৩ জানুয়ারি ১৯৬৩।
৭. এ ধরনের অভিমতের একটি পরিষ্কার ও ব্যাখ্যামূলক ধারণা লাভের জন্য লাহােরের সরকার নিয়ন্ত্রিত Pakistan Times পত্রিকায় “Dangerous Approach” শীর্ষক সম্পাদকীয় (২০ সেপ্টেম্বর ১৯৬২) দ্রষ্টব্য।
৮. ইত্তেফাক, ৩০ জানুয়ারি ১৯৬৩। এক ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে অধিকতর ব্যাপক ও বাস্তব ঐক্যের জন্য বিভিন্ন নিষ্ক্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতা ও অন্যান্য নেতার সঙ্গে যােগাযােগের জন্য (জাতীয় পরিষদের) Pak People’s Group নামক আরাে একটি সমন্বয় উপকমিটি গঠিত হয়। দ্র. ইত্তেফাক, ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩, ও Pakistan Observer, ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩।
৯. Morning News (ঢাকা), ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩, ও Pakistan Observer, ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩।
১০. Pakistan Observer, ১৮ ও ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩।
১১. Morning News, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩, Pakistan Observer ও ইত্তেফাক, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩। গুরুত্বসহকারে।
১২. Pakistan Observer, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩। পাকিস্তানে মার্কিন অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি থেকে বিভিন্ন এলাকার লােকজন কতােখানি উপকৃত হয়েছে তা নিরূপণের জন্য ঐ সব এলাকা সফরের নির্ধারিত কর্মসূচির আওতায়ই মার্কিন রাষ্ট্রদূত পূর্ব পাকিস্তান সফরে যান। প্রাগুক্ত সূত্রে লাহাের বিমানবন্দরে McConaughy-র বিবৃতি দ্র.।
২৮১
১৩. ইত্তেফাক, ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩।
১৪. পাকিস্তানের প্রথম দুই পাঁচসালা পরিকল্পনার বেশিরভাগ মার্কিন উপদেষ্টাদের দ্বারা প্রণীত হয়।
১৫. খন্দকার মােশতাক আহমদের সাথে সাক্ষাৎকার।
১৬. ইত্তেফাক, ১৮ মার্চ ১৯৬৩।
১৭. প্রাগুক্ত।
১৮. Pakistan Observer ও আজাদ (ঢাকা) ৮ এপ্রিল ১৯৬৩।
১৯. আজাদ, ১৩ ও ২০ এপ্রিল ১৯৬৩ ও ইত্তেফাক, ২২ মে ১৯৬৩।
২০. প্রাগুক্ত, ২১ মে ১৯৬৩।
২১. পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাংগঠনিক তৎপরতার বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র. ইত্তেফাক, জানুয়ারি জুন ১৯৬৩।
২২. ইত্তেফাক, ১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৩।
২৩. ১৯৭৬-এর গ্রীষ্মে আবুল মনসুর আহমদ ও আতাউর রহমানের সঙ্গে আমার আলােচনার সময় তারা আমাকে এ কথা বলেন।
২৪. ইত্তেফাক, ১৩ আগস্ট ১৯৬৩।
২৫. Morning News, ২৭ আগস্ট ১৯৬৩।
২৬. বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র. ইত্তেফাক, ২৯ আগস্ট ১৯৬৩।
২৭. বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র. প্রাগুক্ত, ৩০ আগস্ট ১৯৬৩।
২৮. প্রাগুক্ত, ২ ও ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬৩ ও Morning News, ১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৩।
২৯. অন্যান্য প্রস্তাবের জন্য দ্র. ইত্তেফাক, ২৮ আগস্ট ১৯৬৩।
৩০. খন্দকার মােশতাক আহমদের সাথে সাক্ষাৎকার।
৩১. ইত্তেফাক, ২১ আগস্ট ১৯৬৩।
৩২. বাংলা বরাতের জন্য দ্র. প্রাগুক্ত, ৮ অক্টোবর ১৯৬৩।
৩৩. প্রাগুক্ত, ১৮ নভেম্বর ১৯৬৩।
৩৪. প্রাগুক্ত, ১৮ নভেম্বর ১৯৬৩।
৩৫. বাংলা বরাতের জন্য দ্র. প্রাগুক্ত। সােহরাওয়ার্দী তাঁর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযােগী ও দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক, তফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া)-র কাছে লেখা পত্রে একই মনােভাব ব্যক্ত করেছিলেন। ইত্তেফাক-এর সােহরাওয়ার্দী সংখ্যা, ১৯৬৪-তে এ সব চিঠির অবিকল প্রতিলিপি দ্র.।
৩৬. ভাষণের ওপর পুরাে প্রতিবেদন দ্র. ইত্তেফাক, ৭ নভেম্বর ১৯৬৩।
৩৭. প্রাগুক্ত, ২১ নভেম্বর ১৯৬৩।
৩৮, এনডিএফ-এর পূর্ব পাকিস্তান কমিটির প্রস্তাবগুলি পূর্ণ পাঠের জন্য দ্র. Pakistan Observer ৬ জানুয়ারি ১৯৬৪ এবং সংবাদ সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তান এনডিএফ-এর ঘােষণার জন্য দ্র. প্রাগুক্ত, ২২ জানুয়ারি ১৯৬৪।
২৮২
৩৯. ইত্তেফাক, ১৪ জানুয়ারি ১৯৬৪।
৪০. প্রাগুক্ত, ও Morning News, ১২ জানুয়ারি ১৯৬৪।
৪১. ইত্তেফাক, ১০ জানুয়ারি ১৯৬৪।
৪২. দ্র. Pakistan Observer; ২৫ জানুয়ারি ১৯৬৪, ও আতাউর রহমান খান, স্বৈরাচারের দশ বছর (ঢাকা, ১৯৭৪), ২য় পরিবর্ধিত সংস্করণ, পৃ. ২৯৪-৭।
৪৩. ইত্তেফাক, ২৬ জানুয়ারি ১৯৬৪। ৪৪. প্রাগুক্ত, ২৬ জানুয়ারি ১৯৬৪।
৪৫. প্রাগুক্ত, Pakistan Observer ও Morning News, ২৬ জানুয়ারি ১৯৬৪।
৪৬. দ্র., “They call it Revival, Pakistan Observer, ২৬ জানুয়ারি ১৯৬৪।
৪৭. Morning News, ২৬ জানুয়ারি ১৯৬৪। আতাউর, এন, ৪২, পৃ. ২৯৭।
৪৮. আতাউর, এন. ৪২, পৃ. ২৯৪-৭।
৪৯. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭৬-৭।
৫০. Pakistan Observer, ২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি ১৯৬৪।
৫১. Morning News, ২৬, ২৮ ও ৩০ জানুয়ারি ও ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪।
৫২. পরে সরকার এক রাষ্ট্রবিরােধী ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত বলে শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিযুক্ত করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে অচল করে দেওয়ার বৃথাই প্রয়াস চালান।
৫৩. মাহমুদুল হক উসমানীর বিবৃতি দ্র., Morning News, ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪।
৫৪. এনডিএফ-এর পূর্ব পাকিস্তান কমিটির বিবৃতি দ্র. প্রাগুক্ত, ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪।
৫৫. যৌথ বিবৃতি দ্র. প্রাগুক্ত, ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪।
৫৬. দ্র., “Two Sides” (সম্পাদকীয়), Pakistan Observer, ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪।
৫৭. সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে নিখিল পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক উসমানী তাঁর দলের পুনরুজ্জীবনের কথা ঘােষণা করেন। দ্র. ইত্তেফাক, ১ মার্চ ১৯৬৪।
৫৮. আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (ঢাকা, ১৯৭৫), ৩য় পরিবর্ধিত সংস্করণ, পৃ. ৫৮৬।
পঞ্চম অধ্যায়
১. ইত্তেফাক (ঢাকা), ৬ মার্চ ১৯৬৪।
২. দ্র., Moming News (ঢাকা), ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪ এবং ইত্তেফাক ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ মার্চ | ১৯৬৪।
৩. ইত্তেফাক, ৭ মার্চ ১৯৬৪।
৪. প্রাগুক্ত, ৯ মার্চ ১৯৬৪।
২৮৩
৫. খসড়া ইশতেহারের বাংলা ভাষ্যের জন্য দ্র. ইত্তেফাক, ৬ জুন ১৯৬৪।
৬. পাঠের জন্য দ্র. শামসুল হক, পূর্ব পাকিস্তানী আওয়ামী মুসলিম লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টো (ঢাকা, তা. বি.), পৃ. ৩-৪।
৭. ভাষণের আরাে বিস্তারিত দ্র. ইত্তেফাক, ৭ মার্চ ১৯৬৪।
৮. ১৯৭৬ সালে কয়েকজন আওয়ামী লীগার ও আরাে কিছু ব্যক্তির সাথে বাংলাদেশে গৃহীত সাক্ষাৎকার। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্মেলনে শাহ আজিজুর রহমানের ভাষণের জন্য দ্র. প্রাগুক্ত, ৭ মার্চ ১৯৬৪।
৯. দ্র. মােসাফির, রাজনৈতিক মঞ্চ, প্রাগুক্ত, ১০ মার্চ ১৯৬৪। খন্দকার মােশতাক আহমদ, আব্দুল মান্নান, আমেনা বেগমসহ প্রায় সকল আওয়ামী লীগার যাদের সাথে আমি ১৯৭৬ সালে দেখা করি তারাও এর সত্যতা স্বীকার করেন।
১০. Rehman Sobhan, Basic Democracies, Works Programme and Rural Development in East Pakistan (করাচি, ঢাকা, লন্ডন, ১৯৬৩), আরাে দ্র. বদরুদ্দীন উমর, “আইয়ুব খানের আমলে বাংলাদেশের কৃষক”, বিচিত্রা (ঢাকা, সাপ্তাহিক), (ঢাকা, Weekly), ১ নভেম্বর ১৯৭৮, পৃ. ২৭-৩৪, ২৭৫-৯৬ এবং Sobhan, “The Rural Poor of East Pakistan”, Asian Review, বালাম ২, নং ২, জানুয়ারি ১৯৬৯, পৃ. ১৩৬-৫২।
১১. Sobhan, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৩-৪৪।
১২. পাকিস্তানে ১৯৬১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, পূর্ব পাকিস্তানীদের মাত্র ৫.২ শতাংশ ৪টি নগর ও ৭৭টি শহর এলাকায় বসবাস করতাে। (করাচি, তা. বি.) ২য় অংশ।
১৩. কিছুটা বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র., উমর, এন. ১০।
১৪. Morning News (ঢাকা) ও Pakistan Observer (ঢাকা), ৭ মার্চ এবং ১৬ মার্চ ১৯৬৪।
১৫. পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদকের সমাপনী ভাষণ দ্র., ইত্তেফাক, Pakistan Observer ও Morning News, ৯ মার্চ ১৯৬৪।
১৬. ইত্তেফাক, ১০ মার্চ ১৯৬৪।
১৭. প্রাগুক্ত, ১৯ এবং ২০ মার্চ ১৯৬৪, এবং Pakistan Observer; ২০ মার্চ ১৯৬৪।
১৮. রেজিস্ট্রারের বিজ্ঞপ্তি দ্র., Morning News, ৪ এপ্রিল ১৯৬৪।
১৯. ইত্তেফাক, ৪ এপ্রিল ১৯৬৪।
২০. “Sheikh Mujibur Rahman at Karachi”, প্রাগুক্ত, ২৭ মার্চ ১৯৬৪।
২১. Morning News, ৩০ মার্চ ও ৫ এপ্রিল ১৯৬৪, Pakistan Observer, ৩০ মার্চ ১৯৬৪,
এবং ইত্তেফাক, ৭ এপ্রিল ১৯৬৪।
২২. দ্র., ইত্তেফাক, ১-৩০ এপ্রিল ১৯৬৪।
২৩. প্রাগুক্ত, ১০, ১৯ এবং ২১ এপ্রিল ১৯৬৪। ২৪. Morning News, ১৭ এপ্রিল ১৯৬৪।
২৫. ইত্তেফাক প্রতিবেদনসমূহ থেকে সঙ্কলিত, ইত্তেফাক, মে-জুন ১৯৬৪।
২৮৪
২৬. পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের বিবৃতি দ্র., ইত্তেফাক, ২৫ মে ১৯৬৪।
২৭. জহিরুদ্দিনের সংবাদ সম্মেলনের রিপাের্ট দেখুন, প্রাগুক্ত, ৪ জুলাই ১৯৬৪।
২৮. প্রাগুক্ত, ৩ জুলাই ১৯৬৪ এবং Pakistan Times (লাহাের), ৩০ জুন ও ৬ জুলাই ১৯৬৪।
২৯. ইত্তেফাক, ৬ জুলাই ১৯৬৪।
৩০. জুলাই মাসে ঢাকায় বিরােধীদলগুলির এক সভায় কপ (সিওপি) বা সম্মিলিত বিরােধীদল গঠিত হয়। কাউন্সিল মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, আওয়ামী লীগ, নিজাম-এ-ইসলাম ও জামায়াত-ই-ইসলামীকে নিয়ে কপ গঠিত হয়। এ দলটি সকল পর্যায়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়। তারা নির্বাচকমণ্ডলী, জাতীয়, প্রাদেশিক ও প্রেসিডেন্ট পর্যায় সকল স্তরের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নেয়। কপ প্রেসিডেন্ট পদে একক প্রার্থী দেওয়ার ব্যাপারেও একমত হয়। কিছুটা বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র., K. P. Misra, আরাে অনেকে সম্পা., Pakistan’s Search for Constitutional Consensus (নয়াদিল্লি, ১৯৬৭), পৃ. ৪৭-৫১।
৩১. কপ-এর নয়-দফা কর্মসূচির পূর্ণ বিবরণের জন্য দ্র. Pakistan Observer, ২৫ জুলাই ১৯৬৪, ও এই জোট সম্পর্কে কিছু আলােচনার জন্য দ্র. Misra, প্রাগুক্ত; Karl Von Vorys, Political Development in Pakistan (প্রিন্সটন, ১৯৬৫), পৃ. ২৬৯-৭৪; Sharif AlMujahid, “Pakistan’s First Presidential Elections”, Asian Survey, a (,১৯৬৫, পৃ. ২৮০-৯৪।
৩২. পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ঢাকায় পল্টন ময়দানে আয়ােজিত জনসভায় শেখ মুজিবের ভাষণ সম্পর্কে দ্র., ইত্তেফাক, ১৩ জুলাই ১৯৬৪।
৩৩. Dawn, ৯ নভেম্বর ১৯৬৪।
৩৪. বিস্তারিত বিবরণের জন্য সারণিসমূহ ও চার্ট (সারণি) ৬ দ্র.।
৩৫. বাস্তব সাক্ষ্যপ্রমাণমূলক তথ্যসহ শেখ মুজিবের দীর্ঘ বিবৃতি দ্র. ইত্তেফাক, ৭ নভেম্বর ১৯৬৪।
৩৬. উদাহরণস্বরূপ: রয়হান বয়াতী; “ভােটের গান”—“বাক্স ভইরা ট্যাক্স দিব, ভােটের বেলা নাই”, অমিতাভ গুপ্ত, কলিকাতা, ১৯৭১, পৃ. ২৯৪-৯৯। সম্পূর্ণ উদ্ধৃতির জন্য দেখুন পরিশিষ্ট ৪।
৩৭. পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রথম কাউন্সিল অধিবেশনে প্রাদেশিক সাংগঠনিক কমিটির সম্পাদক হাজী মােহাম্মদ দানেশের রিপাের্ট, ২৪ জুলাই ১৯৬৫, পৃ. ১৪, ১৮।
৩৮. মােট কততা ভােট প্রদত্ত হয় সে সম্পর্কে দ্র. Sharif, এন, ৪৬।
৩৯. ইত্তেফাক, ৪ এপ্রিল ১৯৬৫।
৪০. প্রাগুক্ত, ৮ জুলাই ১৯৬৫।
৪১. দ্র. Debates, Pakistan National Assembly, ১৯৬৫-৬৬।
৪২. কাশ্মীর ইস্যু সম্পর্কিত বিস্তারিত দ্র. Sisir Gupta, Kashmir: A Study in India-Pakistan Relations (বােম্বাই, ১৯৬৬), এবং ১৯৬৫-এর যুদ্ধের জন্য দ্র., Russel Brines, The IndoPakistani Conflict (লন্ডন)।
২৮৫
ষষ্ঠ অধ্যায়
১. বিস্তারিত দ্র. পূর্বদেশ (ঢাকা, সাপ্তাহিক), ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬।
২. ইত্তেফাক (ঢাকা), ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬।
৩. শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের বাঁচার দাবি ৬-দফা কর্মসূচি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পক্ষে তাজউদ্দিন আহমদ কর্তৃক প্রকাশিত, ঢাকা, ৪ চৈত্র ১৩৭২ (বঙ্গাব্দ); Sheikh Mujibur Rahman, Six-point Formula; Our Right to Live, ঢাকা, ২৩ মার্চ ১৯৬৬। ৪. মুস্তাফা সরােয়ার, সাতই জুনের শিক্ষা, ইত্তেফাক, ৭ জুন ১৯৭৪; ইত্তেফাক, ১৯, ২০ ও ২১ মার্চ ১৯৬৬; Dawn (করাচি), ২০ ও ২১ মার্চ ১৯৬৬।
৫. দ্র. শেখ মুজিবুর রহমান, Our Right to Live, এন. ৩।
৬. প্রাগুক্ত।
৭. ১৯৫৪ সাল থেকেই ১ম পাঁচসালা পরিকল্পনাটি হার্ভার্ড অ্যাডভাইজরি গ্রুপ নামে পরিচিত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল অর্থনীতিবিদের নির্দেশনায় তৈরি হচ্ছিল। এই হার্ভার্ড অ্যাডভাইজরি গ্রুপ (HAG) ঐ পরিকল্পনা প্রণয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার অধিকারী ছিল। ২য় পরিকল্পনায়ও তারা সে ভূমিকায়ই ছিলেন। অবশ্য তৃতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনাটি বলা যায়, হার্ভার্ড অ্যাডভাইজরি গ্রুপ নয় বরং পাকিস্তানীরাই তৈরি করে। দ্র. A. Waterson, Planning in Pakistan: Organisation and Implementation (Baltimore, S540); W. Tims, Analytical Techniques for Development Planning: A Case Study of Pakistan’s Third Five-Year Plan, (PSIC, SSub), N. Islam, “Foreign Assistance and Economic Development. The Case of Pakistan”, The Economic Journal, vol. 82, 1977 i
৮. বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণের জন্য দ্র. Constituent Assembly of Pakistan Debates, বালাম ১, নং ৫১, ১৬ জানুয়ারি ১৯৫৬, পৃ. ১৮১৯-২১, ও বালাম ১, নং ৫২, ১৭ জানুয়ারি ১৯৫৬। সংক্ষিপ্ত বাংলা ভাষ্যের জন্য দ্র. আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর (ঢাকা, ১৯৭৫), ৩য় পরিবর্ধিত সং, পৃ. ৩৮৬-৯২।
৯. ১৯৭৬ সালে ঢাকায় চৌধুরী, রাজ্জাক ও আবুল মনসুরের সঙ্গে আমার আলাপের সময় তারা এ কথা বলেন।
১০. কোনাে কোনাে অর্থনীতিবিদের খসড়া পরিকল্পনা নিয়ে সমীক্ষা ও তা আলােচনার ইচ্ছা প্রকাশের আলােকে পাকিস্তান প্ল্যানিং বাের্ড পাকিস্তান ইকনমিক অ্যাসােসিয়েশনকে (PEA) একাধিক বিশেষ আলােচনা অধিবেশন আয়ােজনের অনুরােধ জানায়। সেই অনুসারে PEA যথাক্রমে আগস্ট ও নভেম্বরে ১৯৬৫-তে ঢাকা ও লাহােরে অর্থনীতিবিদ ও অন্যদের দুটি বিশেষ অর্থনৈতিক সম্মেলন আহ্বান করে। ঢাকা সম্মেলনের বিস্তারিত দ্র. Pakistan Economic Journal, বালাম ৬, নং ৩, সেপ্টেম্বর ১৯৫৬।
১১. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪৩-৮।
১২. প্রাগুক্ত।
১৩. পাকিস্তান অর্থনৈতিক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমানের উদ্বোধনী ভাষণ, ডিসেম্বর ১৯৫৬, রাজশাহী, Pakistan Economic Journal, বালাম ৭, নং ৭১, মার্চ ১৯৫৭, পৃ. ৬-১০।
২৮৬
১৪. প্রাগুক্ত, পৃ. ১১-১৩।
১৫. আমার কাছে লেখা Prof. Colin Clark-এর ৭ এপ্রিল ১৯৭৭ তারিখের চিঠিতে বর্ণিত।
১৬. Prof. Colin Clark ১৯৭৮ সালের অক্টোবর মাসে রিপাের্টের একটি কপি আমার হস্তগত করার ব্যবস্থা করেন।
১৭. Constituent Assembly of Pakistan (Legislative) Debates, বালাম ১, নং ৬, ২১ মার্চ ১৯৫৬, পৃ. ৩০৭।
১৮. Government of Pakistan, Report of the Economic Appraisal Committee (করাচি, ১৯৫২), পৃ. ৭৮।
১৯. Prof. Colin Clark-এর রিপাের্ট, এন, ১৬।
২০. প্রাগুক্ত।
২১. পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি কৌশল ও পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির ওপর তার প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার জন্য 5. Keith Griffin Azizur Rahman, syaft., Growth and Inequality in Pakistan (লন্ডন, ১৯৭২)।
২২. A. Sadeque, Pakistan’s First Five-Year Plan in Theory and Operation (ঢাকা, ১৯৫৭), পৃ. ২৮-৪৮।
২৩. দ্র. A. Sadeque, The Economic Emergence of Pakistan (ঢাকা, অক্টোবর ১৯৫৬), ২য় অংশ, পৃ. ১-৪৯।
২৪. Our Right to Live, এন. ৩।
২৫. রচনার প্রথম বালামে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য প্রধানত পূর্ব পাকিস্তান থেকে দেশত্যাগীদের পুঁজিপাচারকে দায়ী করা হয়। বিস্তারিত দ্র. A. Sadeque, The Economic Emergence of Pakistan: With Special Emphasis on East Pakistan (GPI, ১৯৫৪), ১ম অংশ। লেখক স্বীকার করেছেন, রচনার দ্বিতীয় খণ্ড প্রকৃতপক্ষে প্রথমটির যােজনা মাত্র, কেননা ইতােমধ্যে কতিপয় নির্ভুল তথ্য হাতে এসে পৌঁছানাের কারণে গােটা লেখার পর্যালােচনা ও পরিবর্তনের আবশ্যকতা দেখা দেয়। তিনি দ্বিতীয় বালামের মুখবন্ধে লেখেন: “প্রথম খণ্ডের প্রকাশ ও প্রচার ঘটে জুলাই ১৯৫৪ সালে। ইতােমধ্যে বেশ কিছু অর্থনৈতিক ও পরিসংখ্যানগত উপাত্ত পাওয়া যায় এবং পাকিস্তানের নতুন অর্থনীতির অভ্যুদয়ের আরাে পরিষ্কার চিত্র সামনে আসে। তাই ঐ অর্থনীতির সর্বশেষ পরিস্থিতির একটি বিবরণ ছাড়া আমার এই শ্ৰেণীমালামূলক লেখার কাজের যে মূল পরিকল্পনা ছিল তাতেই নিজেকে সীমিত রাখা আর সম্ভব ছিল না। আর তাই বক্ষ্যমাণ প্রকাশনাকে আমার এই সিরিজের রচনায় দ্বিতীয় অংশ করা হয়েছে।”
২৬. Our Right to Live, এন. ৩।
২৭. Pakistan Times (লাহাের), ২১ মার্চ ১৯৬৬।
২৮. আবুল মনসুরের সাথে সাক্ষাৎকার। আরাে দ্র. Ahmad, এন. ১০, পৃ. ৬৮২। আবুল মনসুর
আহমদের দাবি শেখ মুজিব কখনাে প্রকাশ্যে কিংবা ঘরােয়া পর্যায়ে অস্বীকার করেননি।
২৯. বাংলাদেশ, ভারত ও যুক্তরাজ্যে ১৯৭৬ থেকে ১৯৯০ সালে গৃহীত সাক্ষাৎকার।
২৮৭
৩০. প্রাগুক্ত।
৩১. কামরুদ্দিন আহমদ, প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক, প্রফেসর মােজাফফর আহমদ চৌধুরী, আমেনা বেগম, শামসুর রহমান ও অন্যান্যের সঙ্গে আলােচনা থেকে।
৩২. ইত্তেফাক, ১৯ এবং ২১ জানুয়ারি ১৯৬৬।
৩৩. শামসুর রহমানের কথা অনুযায়ী, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা তর্কবাগীশ ও আবদুস সালাম খান এ বিষয়ে তেমন উৎসাহী ছিলেন না; খন্দকার মােশতাক আহমদ বলেন যে, তিনি ও আবদুস সালাম খান গােড়ার দিকে বিষয়টির প্রতি তেমন গুরুত্ব আরােপ করেননি।
৩৪. জানুয়ারি ১৯৭১ সালেও সকল এমএনএ ও এমপিএ’র এক প্রকাশ্য শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছয়-দফার অপরিবর্তনীয়তা নিয়ে অনুরূপ কৌশল গ্রহণ করা হয়।
৩৫. খন্দকার মােশতাক আহমদের সাথে সাক্ষাত্তার। ৩৬. ইত্তেফাক, ২৯ এবং ৩০ জানুয়ারি ১৯৬৬।
৩৭. বিস্তারিত দ্র. ইত্তেফাক প্রতিবেদন, ১৬ জানুয়ারি ১৯৬৬।
৩৮. দ্র. আবুল কালাম আজাদ-এর লেখা “দুটি কথা”, পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য (ঢাকা, ১৯৬৬)।
৩৯. দ্র. Our Right to Live, এন, ৩।
৪০. লক্ষণীয় যে ৮০০ আমন্ত্রিত ব্যক্তির মধ্যে কনভেনশন বা মহাসম্মেলনে যােগদানকারী ৭৫০ জনের মধ্যে মাত্র ২১ জন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানী । বিস্তারিত দ্র. ইত্তেফাক, ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬।
৪১. দ্র. Dawn, ১৬ ফেব্রুয়ারি এবং ২, ৩ এবং ১৬ মার্চ ১৯৬৬, এবং ইত্তেফাক ৫ মার্চ ১৯৬৬।
৪২. দ্র. Dawn, ২, ১২, ২২ এবং ২৩ মার্চ ১৯৬৬।
৪৩. Government of Pakistan, National Assembly Debates, বালাম ১, ৭-২৭ মার্চ ১৯৬৬, পৃ. ৪৯০-৫০০।
৪৪. দ্র. Our Right to Live, এন, ৩, বাড়তি গুরুত্বসহকারে।
৪৫. ইত্তেফাক, ১৬, ১৯ এবং ২৬ মার্চ ১৯৬৬।
৪৬. Our Right to Live, এন, ৩।
সপ্তম অধ্যায়
১. পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতাদের পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক সফর ও জনসভায় বক্তৃতা সম্পর্কে বিভিন্ন রিপাের্ট দ্র. ইত্তেফাক, মার্চ-এপ্রিল ১৯৬৬।
২. বিস্তারিত দ্র. Pakistan Times (লাহাের), Dawn (করাচি), এবং ইত্তেফাক, মার্চ-এপ্রিল ১৯৬৬।
৩. আমেনা বেগম, আব্দুল মান্নান ও অন্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় সংগৃহীত তথ্য। আরাে দ্র. ইত্তেফাক, মার্চ-এপ্রিল ১৯৬৬, এবং Rounaq Jahan, Pakistan: Failure in National Integration (ঢাকা, ১৯৭৩), পেপারব্যাক সং, পৃ. ১৬৮-৯।
২৮৮
৪. গ্রেপ্তারের বিস্তারিত দ্র. ইত্তেফাক, ১৮ এপ্রিল থেকে ৯ মে ১৯৬৬।
৫. ইত্তেফাক, ১৪ মে এবং ৬ জুন ১৯৬৬ এবং পূর্বদেশ (ঢাকা, সাপ্তাহিক)।
৬. মুস্তাফা সারােয়ার, সাতই জুনের শিক্ষা, ইত্তেফাক, ১, ২, ৭ জুন ১৯৬৬।
৭. ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে গৃহীত বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে সংগৃহীত তথ্য।
৮. ইত্তেফাক, ৫, ৬ এবং ৭ জুন ১৯৬৬।
৯. প্রাগুক্ত, ৭ জুন ১৯৬৬।
১০. মােসাফির, “রাজনৈতিক মঞ্চ”, ইত্তেফাক, ৭ জুন ১৯৬৬।
১১. ১৯৭৬ সালের প্রথমার্ধে বাংলাদেশে বিভিন্ন স্তরের লােকজনের সঙ্গে আলাপ থেকে নির্বিশেষ পদ্ধতিতে সংগৃহীত তথ্য।
১২. সরকারি প্রেসনােট, ইত্তেফাক, Pakistan Observer, ৮ জুন ১৯৬৬।
১৩. Government of East Pakistan, East Pakistan Assembly Proceedings, বালাম ৩০, নং ১, পৃ. ৫৫-৫৬ ও পূর্বদেশ (ঢাকা, সাপ্তাহিকী), ১২ জুন ১৯৬৬।
১৪. মােসাফির, “রাজনৈতিক মঞ্চ”, ইত্তেফাক, ৯ জুন ১৯৬৬। তফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া)১৯৬৬ সালের গােড়া থেকেই ছয়-দফা নিয়ে মন্তব্য করতে শুরু করেন। তিনি ছয়-দফা ফর্মুলার যৌক্তিকতা সম্পর্কে অত্যন্ত খােলাখুলি কথা বলেন আর এ ফর্মুলার বিরােধীদের নির্মম, কঠোর সমালােচনায় প্রবৃত্ত হন। এ জন্য বিশেষভাবে দ্র. “বাস্তবতার আলােকে ৬-দফা কর্মসূচি” ও “সার্বভৌম বাংলা হইতে গৃহযুদ্ধ” ইত্তেফাক, ৪ মার্চ এবং ২৫ মার্চ ১৯৬৬ এবং মােসাফির, “রাজনৈতিক মঞ্চ”, ইত্তেফাক, ৩০ মার্চ এবং ২, ৫, ৭, ৯, ১৫ এবং ১৬ জুন ১৯৬৬।
১৫. পূর্বদেশ, ১৯ জুন ১৯৬৬ এবং ইত্তেফাক, ১১ জুন ১৯৬৬। ১৭ জুন এবং ১০ জুলাই ১৯৬৬ সালের মধ্যে ইত্তেফাকের প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে হয়। ১১ জুলাই পত্রিকাটি পুনঃপ্রকাশিত হওয়ার পর আবার ২৭ জুলাই বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকাটি ১৯৬৯ সালের গােড়ার দিক অবধি বন্ধ থাকে।
১৬. “Drive for self-rule grows in East Pakistan, Tactical Dilemma for President Ayub”, The Times (লন্ডন), ১৭ মে ১৯৬৬।
১৭. ইত্তেফাক, ১২ জুন ১৯৬৬। ইত্তেফাক রিপাের্টে উল্লেখ করা হয় যে গৃহীত ১৫টি প্রস্তাবের মধ্যে যেগুলি প্রচার করা সম্ভব হয়েছিল সেইগুলিই মাত্র প্রকাশ করা হলাে। এতে অবশিষ্ট প্রস্তাবগুলির তাৎপর্যও স্পষ্ট।
১৮. আব্দুল মান্নান ও আমেনা বেগম প্রমুখের সঙ্গে সাক্ষাৎকার।
১৯. Morning News, ২৩, ২৮, ২৯ এবং ৩০ জুন ১৯৬৬।
২০. আজাদ এবং ইত্তেফাক, ২৫ জুলাই ১৯৬৬।
২১. পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, আজাদ, ২৮ জুলাই ১৯৬৬ এবং আমেনা বেগমের সঙ্গে সাক্ষাৎকার।
২২. আমেনা বেগমের সঙ্গে সাক্ষাৎকার।
২৩. আজাদ, ১০, ১৭ এবং ১৮ আগস্ট ১৯৬৬।
২৪. আজাদ (ঢাকা), আগস্ট-ডিসেম্বর ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত বিভিন্ন রিপাের্ট থেকে সংকলন।
২৮৯
২৫. প্রাগুক্ত।
২৬. দৃষ্টান্ত হিসেবে চট্টগ্রামের সৈয়দ নজরুল ইসলামের বক্তৃতা দ্র. আজাদ, ২৬ নভেম্বর ১৯৬৬।
২৭. আজাদ, ২৪ নভেম্বর ১৯৬৬।
২৮. আমি ১৯৭৬ সালের গ্রীষ্মে মওলানা ভাসানীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, তিনি খােলামেলা আলােচনা করলেও এ বিষয়ে কোনাে বােধগম্য ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।
২৯. Dawn, ২ মার্চ ১৯৬৬।
৩০. তাঁর বক্তৃতার ওপর রিপাের্ট দ্র. ইত্তেফাক, ২৬ মার্চ ১৯৬৬, এবং Dawn, ২৭ মার্চ ১৯৬৬।
৩১. ইত্তেফাক, ৬ জুন ১৯৬৬।
৩২. এ সংঘাত এবং গােপন প্রচারপত্র সম্পর্কে বিস্তারিত দ্র. জ্ঞান চক্রবর্তী, “সাতই জুনে প্রগতিশীলদের ভূমিকা”, দৈনিক বাংলা, ৭ জুন ১৯৭২।
৩৩. ইত্তেফাক, ২১ জুলাই ১৯৬৬।
৩৪. Dawn, ১৯ জুলাই ১৯৬৬, গুরুত্ব আরােপিত।
৩৫. আজাদ, ১৯ জুলাই ১৯৬৬।
৩৬. ন্যাপের ৮ ও ১৪-দফা কর্মসূচির কিছুটা বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র. আজাদ, জুলাই-আগস্ট ১৯৬৬।
৩৭. আজাদ, ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৬।
৩৮. বামপন্থীদের ভূমিকা ও তাদের উভয় সঙ্কট সম্পর্কিত বিবরণের জন্য দ্র. Talukder Maniruzzaman, Radical Politics and the Emergence of Bangladesh (ঢাকা, ১৯৭৫), পৃ. ১০-১৯।
৩৯. আজাদ এবং পূর্বদেশ, জানুয়ারি-মে ১৯৬৭।
৪০. আজাদ, ১৩ মে ১৯৬৭।
৪১. পূর্বদেশ, ১৫ অক্টোবর ১৯৬৭।
৪২. আজাদ, ১৬ অক্টোবর ১৯৬৭।
৪৩. সভায় অন্যান্য বক্তাদের মধ্যে ছিলেন: আতাউর রহমান খান, ফরিদ আহমদ (নিজাম-এ-ইসলাম), | গােলাম আজম (জামায়াত-ই-ইসলামী) ও মাহমুদ আলী (এনডিএফ)। বক্তৃতাসমূহের বিস্তারিত দ্র. পূর্বদেশ (সাপ্তাহিক), ১৫ জানুয়ারি ১৯৬৭।
৪৪. দ্র. গােলাম আজম, সম্পা., পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলন, আট-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ | গণআন্দোলন (তা. বি.)।
৪৫. আবদুল মান্নানের সঙ্গে সাক্ষাৎকার।
৪৬. পূর্বদেশ, ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭।
৪৭. প্রাগুক্ত, ২৩ জুন এবং ৩০ এপ্রিল ১৯৬৭।
৪৮. দ্র. ইত্তেফাক, ১০ জুন এবং ২০ জুলাই ১৯৬৬।
৪৯. বিস্তারিত দ্র. আজাদ, ১৯, ২০, ২১ এবং ২২ মে ১৯৬৭।
২৯০
৫০. ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে গৃহীত সাক্ষাৎকার। পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ৭ জুনকে মুক্তি দিবস হিসেবে পালন করতে থাকে। দ্র. ঘােষণাপত্র, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ (ঢাকা, ১৩৭৭ | বাংলা সন), পৃ. ৭।
৫১. দ্র. আজাদ, ১৮ ও ২৫ জুলাই এবং ১৬ ও ১৭ আগস্ট ১৯৬৭।
৫২. প্রাগুক্ত, ১৯ এবং ২০ আগস্ট ১৯৬৭।
৫৩. আজাদ, ২০ ও ২১ আগস্ট ১৯৬৭ এবং পূর্বদেশ ২০ মার্চ ও ১০ এপ্রিল ১৯৬৬।
৫৪. আজাদ, ২২ আগস্ট ১৯৬৭।
৫৫. বিস্তারিত দ্র. প্রাগুক্ত, ২৩-২৮ আগস্ট ১৯৬৭।
৫৬. প্রাগুক্ত, ১৪ ও ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬৭।
৫৭. প্রাগুক্ত, ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬৭।
৫৮. প্রাগুক্ত, ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৬৭।
৫৯, প্রাগুক্ত, ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬৭।
৬০. প্রাগুক্ত, ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬৭।
৬১. প্রাগুক্ত, ১৭, ২৫ ও ৩০ সেপ্টেম্বর এবং ১৬ অক্টোবর ১৯৬৭।
৬২. ইত্তেফাক, ১৯ মার্চ ১৯৬৬।
৬৩. পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত প্রকাশিত প্রতিবেদন দ্র. প্রাগুক্ত, ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬৭।
৬৪. প্রাগুক্ত, ২৫ নভেম্বর ১৯৬৭।
৬৫. প্রাগুক্ত, ১৩ ডিসেম্বর ১৯৬৭।
৬৬. দ্র. আজাদ ও পূর্বদেশ, জানুয়ারি-মার্চ ১৯৬৭।
৬৭. পূর্বদেশ, ২৩ ও ২৬ নভেম্বর ১৯৬৭।
৬৮. আজাদ, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৬৭।
৬৯. প্রাগুক্ত, ১৮ ডিসেম্বর ১৯৬৭।
৭০. M. Rashiduzzaman, “The Awami League in the Political Development in Pakistan”, Asian Survey, বালাম ১০, নং ৭, পৃ. ৫৭৪-৮৭।
৭১. আবদুল মান্নানের সাথে সাক্ষাত্তার। তিনি আবদুস সালাম খানের সাথে পিডিএম-এ যােগদান সম্পর্কে আলােচনা চলাকালে আরাে অনেকের সাথে মিলে বিতর্কে নিয়ােজিত হয়েছিলেন।
৭২. ৬ জানুয়ারি ১৯৬৮ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রেসনােটে ঘােষণা করা হয় যে, ঢাকায় ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনের কিছু কর্মকর্তা ও ভারতের সীমান্ত শহর আগরতলায় দায়িত্বে মােতায়েন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার চক্রান্তে জড়িত থাকার জন্য দু’জন বাঙালি সিএসপিসহ মােট ২৮ ব্যক্তিকে ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দাবি করা হয় যে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কার্যত সবাই তাদের দোষ স্বীকার করেছে। ১৮ জানুয়ারি ১৯৬৮ সালে পরের এক প্রেসনােটে শেখ মুজিবকে এ চক্রান্তের প্রধান স্থপতি বলে উল্লেখ করা হয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত দ্র. দৈনিক পাকিস্তান, ৭ ও ১৯ জানুয়ারি ১৯৬৮।
২৯১
৭৩. Morning News (ঢাকা), ১৬ জুলাই ১৯৬৬।
৭৪. আমেনা বেগমের সাথে সাক্ষাৎকার ।
৭৫. দৈনিক পাকিস্তান, ২২ জানুয়ারি ১৯৬৮। আমেনা বেগমের উক্তি অনুযায়ী এই বিবৃতির খসড়া লিখেছিলেন সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী। তিনি নিজেও তাঁর লেখা নিজস্ব কলাম: তৃতীয় মত’-এ এর উল্লেখ করেছেন। এ জন্য দ্র. পূর্বদেশ, ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০।
৭৬. মােট ৩৫ জন অভিযুক্তের মধ্যে ১১ জন রাজসাক্ষী হওয়ায় তাদেরকে ক্ষমা করা হয়। উল্লিখিত ৩৫ জনের ২৮ জন ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর লােক আর এদের প্রায় সবাই নৌ ও বিমান বাহিনীর লােক। আর এদের মধ্যে সবচেয়ে পদস্থ অফিসার ছিলেন লে. কর্নেল মােয়াজ্জেম হােসেন (১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে নিহত), আর বাদবাকি সবাই তুলনামূলকভাবে সশস্ত্র বাহিনীসমূহের নিম্ন পদে নিয়ােজিত ছিলেন। ৩৫ জনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ৬ জন সদস্য ছিলেন। একজন দলের সভাপতি আর অন্যরা বিভিন্ন জেলার স্থানীয় নেতা। মােট অভিযুক্তদের ৩ জন ছিলেন বাঙালি সিএসপি যারা সচিব পদের যােগ্যতাসম্পন্ন। গুজব ছিল এই ৩ জন সিএসপি ছয়-দফা ফর্মুলার খসড়া তৈরিতে জড়িত ছিলেন।
৭৭. আব্দুল মান্নান, আমেনা বেগম ও অন্য কয়েকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎকার।
৭৮. স্থানীয় খ্যাতনামা আইনজীবীগণ ছাড়াও লন্ডনে বসবাসকারী আওয়ামী লীগপন্থীদের সহায়তায় | প্রখ্যাত ব্রিটিশ আইনজীবী W. T. Williams-কেও নিযুক্ত করা হয়।
৭৯. আব্দুল মান্নান, আমেনা বেগম ও অন্য কয়েকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎকার।
৮০. “Lull on Political Front is Biting”, The Wave (সাপ্তাহিক), ১৮ জুন ১৯৬৮।
৮১. পূর্বদেশ, ১৬ মে ১৯৬৮।
৮২. ওয়ার্কিং কমিটি সভার রিপাের্ট দ্র. সংবাদ, ৫ জুলাই ১৯৬৮। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে আলােলাচনার সময় আব্দুল মান্নান ও আমেনা বেগম আমাকে কৌশলটির ধারণা দিয়েছিলেন। আরাে দ্র. মুস্তাফা সারােয়ার, “পঁচিশ বছরের সংগ্রামে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু”, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশন, ১৯৭৪ স্মরণিকা (ঢাকা, ১৯৭৪)।
৮৩. এই অভিমতের ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা লাভের জন্য দ্র. The Wave (ঢাকা, সাপ্তাহিক), ১৫ জুন ১৯৬৮, ১৪ জুলাই ১৯৬৮। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে সংগৃহীত তথ্যানুযায়ী এ বিষয়ে বেশ আগ্রহের সৃষ্টি হয়।
৮৪. সংবাদ (ঢাকা), অক্টোবর ১৯৬৮। ৮৫. প্রাগুক্ত, ৪ নভেম্বর ১৯৬৮।
অষ্টম অধ্যায়
১, এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানেও ইপস্যাকের (পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ) ১১-দফা পাকিস্তানী। ছাত্রদের জন্য সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বশীল বিবেচিত হয়েছিল। দ্র. Iffat S. Dhar, “Students Problems”, পাকিস্তান কাউন্সিল সেমিনারে উপস্থাপিত নিবন্ধ, ইসলামাবাদ, অক্টোবর ৩০, ১৯৭০।
২. ছয়-দফার প্রতি ছাত্রলীগের অনুমােদন দ্র. ইত্তেফাক (ঢাকা), ৯ মার্চ ১৯৬৬।
২৯২
৩. বিস্তারিত দ্র. ঐতিহাসিক এগারাে-দফা কর্মসূচি ও এগারাে-দফা প্রতিষ্ঠার পথ, প্রকাশক: কেন্দ্রীয় কমিটি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (ঢাকা, তা. বি.), পৃ. ৭।
৪. বিস্তারিত দ্র. আজাদ (ঢাকা), জুন-সেপ্টেম্বর ১৯৬৭, বিশেষ করে ২১-২৩ জুলাই, ২৩-২৫ আগস্ট ও সেপ্টেম্বর ১৯৬৭, এবং আজাদ ও সংবাদ (ঢাকা), জানুয়ারি-নভেম্বর ১৯৬৮।
৫. বিস্তারিত দ্র. Tariq Ali, Military Rule or People’s Power (লন্ডন, ১৯৭০)।
৬. দ্র. মুস্তাফা সারােয়ার, “পঁচিশ বছরের সংগ্রামে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু”, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশন, ১৯৭৪ স্মরণিকা (ঢাকা, ১৯৭৪)।
৭. ১৯৭৬ সালে খন্দকার মােশতাক আহমদের সাথে সাক্ষাৎকার।
৮. বিস্তারিত দ্র. সংবাদ, আজাদ ও দৈনিক পাকিস্তান (ঢাকা), ৮ ডিসেম্বর ১৯৬৮।
৯. দৈনিক পাকিস্তান, ১২ ডিসেম্বর ১৯৬৮।
১০. বিস্তারিত দ্র. প্রাগুক্ত, ৯ ডিসেম্বর ১৯৬৮।
১১. আজাদ, ১৫ ডিসেম্বর ১৯৬৮ ও দৈনিক পাকিস্তান, ৩০ ডিসেম্বর ১৯৬৮।
১২. ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে নেওয়া সাক্ষাৎকার।
১৩. দৈনিক পাকিস্তান, ২ জানুয়ারি এবং সংবাদ, ২ এবং ৭ জানুয়ারি ১৯৬৯।
১৪. ১৯৭৬ সালের গ্রীষ্মে মওলানা ভাসানীর আলােচনায় আমি লক্ষ্য করেছি তিনি তখনাে তার সেই মতেই বিশ্বাস করেন। সে কারণে যাঁরা মনে করেন, “শেখ মুজিবের মুক্তির আন্দোলন শুরু করার ব্যাপারে মওলানা ভাসানী মস্তিষ্ক নয়, হৃদয়াবেগ দিয়ে পরিচালিত হয়েছিলেন” আমি তাঁদের সাথে একমত নই।
১৫. ড্যাক কর্মসূচিতে স্বাক্ষরদাতারা বলেন: আমির হােসেন শাহ, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, নিখিল পাকিস্তান ন্যাপ (ওয়ালী), চৌধুরী মােহাম্মদ আলী, সভাপতি, নিজাম-এ-ইসলাম, মুফতি মাহমুদ, মহাসচিব, জমিয়তুল উলেমা-ই-ইসলাম, মিয়া মমতাজ দৌলতানা, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), নসরুল্লাহ খান, সভাপতি, নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (পিডিএমপন্থী), নূরুল আমিন, সভাপতি, এনডিএফ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও মিয়া তােফায়েল মােহাম্মদ, ভারপ্রাপ্ত আমীর, জামায়াত-ই-ইসলামী, সংবাদ, ৯ জানুয়ারি ১৯৬৯।
১৬. ড্যাক কর্মসূচির বিস্তারিত দ্র. সংবাদ, ৯ জানুয়ারি ১৯৬৯।
১৭. প্রাগুক্ত।
১৮. ঐতিহাসিক ১১-দফা, এন. ৩, পৃ. ৯-১০।
১৯. পাঠ অংশের জন্য দ্র. পরিশিষ্ট।
২০. বিস্তারিত দ্র. আজাদ ও সংবাদ, ২৫-৩০ জানুয়ারি ১৯৬৯।
২১. সংবাদ, ২৬ জানুয়ারি ১৯৬৯।
২২. বিস্তারিত দ্র. আজাদ ও সংবাদ, ২৫-৩০ জানুয়ারি ১৯৬৯।
২৩. নির্যাতনের পথ পরিহার করুন—সংবাদপত্রে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের বিবৃতি, সংবাদ, ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৯।
২৯৩
২৪. বহু সক্রিয়তাবাদী ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে আলাপ থেকে।
২৫. প্রেসিডেন্টের মাস পয়লা ভাষণ দ্র. Pakistan Observer, ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯।
২৬. আজাদ, ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯।
২৭. প্রাগুক্ত সূত্রে পূর্ণ পৃষ্ঠা জুড়ে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারসমূহ ইপস্যাকের বিবরণ।
২৮. প্রাগুক্ত।
২৯. বক্তৃতা ও প্রস্তাবসমূহের আরাে বিস্তারিত দ্র. সংবাদ ও আজাদ, ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ এবং ইত্তেফাক, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯।
৩০. দ্র. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা (সঙ্কলন), (ঢাকা, ১৯৭০), পৃ. ১০৩।
৩১. বিস্তারিত দ্র. আজাদ, সংবাদ এবং দৈনিক পাকিস্তান, ১০-১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ এবং সংবাদ ও ইত্তেফাক, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯।
৩২. ইত্তেফাক, ১২ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি, সংবাদ, ১২ এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি এবং আজাদ, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯।
৩৩. সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাষণের বিস্তারিত দ্র. ইত্তেফাক, ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯। ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মােশতাক আহমদ ও মােল্লা জালালুদ্দিনের সঙ্গে শেখ মুজিবের বৈঠকের খবরের জন্য দ্র. সংবাদ, ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯।
৩৪. পল্টন ময়দানে তাজউদ্দিন আহমদের বিবৃতি ও বক্তৃতার জন্য দ্র. ইত্তেফাক, ১৩ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯।
৩৫. ব্যাপক পর্যায়ে বিশ্বাস করা হয় যে, বেগম মুজিবকে বার্তাটি দেওয়ার পর তিনি বলেছিলেন কারাগারে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার একজনও থাকতে মুজিব গােলটেবিল বৈঠকে যাওয়ার চেয়ে বরং তিনি বৈধব্য বরণ করবেন (আমেনা বেগম, আব্দুল মান্নান, কামরুদ্দিন আহমদের সাথে সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত থেকে)। গােলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিবের প্যারােলে যােগদানের সম্ভাবনার বিষয়টি তাজউদ্দিন আহমদ কিছুটা তাড়াতাড়ি মেনে নেন। এ ঘটনাটি ব্যাপক পর্যায়ে জ্ঞাত থাকলেও কখনাে এর প্রচার হয়নি।
৩৬. ভাসানী ন্যাপের মশিউর রহমানের (যাদু মিয়া) আমাকে দেওয়া বিবরণ অনুযায়ী, পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত গােলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আইয়ুব খানকে রাজি করাতে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন আর সেই সাথে প্রস্তাবিত সম্মেলনে প্রতি মুহূর্তে কি ঘটছে না ঘটছে সে সম্পর্কে মার্কিন দূতাবাসকে অবহিত রাখার জন্যও ব্যাপক আয়ােজন রাখা হয়।
৩৭. ইত্তেফাক ও সংবাদ, ১৮, ১৯ ও ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯। আরাে দ্র. Talukder Maniruzzaman, Radical Politics and the Emergence of Bangladesh,
৩৮. প্রাগুক্ত, ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯।
৩৯. প্রাগুক্ত, ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯।
৪০. কামাল হােসেন, “Post-mortem on RTC, Forum (ঢাকা, সাপ্তাহিক), বালাম ১, নং ১৭, ১৪ মার্চ ১৯৭০, পৃ. ৮-৯। Forum নামের পত্রিকাটি দেড় বছরের মতাে তথা ১৯৬৯ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ অবধি তার স্বল্প জীবন মেয়াদে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন। করে। ঐ সময়ে পত্রিকাটি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক সমীক্ষক ও সাংবাদিকদের পাকিস্তানে,
২৯৪
বিশেষ করে, পূর্ব পাকিস্তানে ঐ কয় মাসে যে কঠিন সঙ্কটজনক অবস্থা চলছিল তার ওপর তাঁদের চমৎকার বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণমূলক লেখা প্রকাশ করে।
৪১. ভাষণের জন্য দ্র. গােলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ (ঢাকা, তা. বি.)। আরাে দ্র. কামাল হােসেন, প্রাগুক্ত; কামাল হােসেন আরাে লিখেছেন যে, যদি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে নীতিগত ঐকমত্য হয় তাহলে তার বিস্তারিত খুঁটিনাটি অনতিবিলম্বে পরীক্ষা করে দেখার জন্য মুজিব একটি বিশারদ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন ও সে কমিটিতে (যদি গঠিত হয়) কাজ করার জন্য কয়েকজন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদকেও ইতােমধ্যে বলে রাখা হয়েছিল।
৪২. গােলটেবিল, প্রাগুক্ত।
৪৩. কামাল হােসেন, এন, ৪০।
৪৪. ইত্তেফাক, ১৪ ও ১৫ মার্চ ১৯৬৯।
৪৫. ইত্তেফাক, ৯ মার্চ ১৯৬৯।
৪৬. প্রাগুক্ত, ১৪ মার্চ ১৯৬৯।
৪৭. বক্তৃতার বিস্তারিত ও বৈঠকের অন্যান্য খুঁটিনাটির জন্য দ্র. প্রাগুক্ত, ২২ ও ২৩ মার্চ ১৯৬৯।
৪৮. ইত্তেফাক, ২৫ মার্চ ১৯৬৯। খসড়া শাসনতন্ত্রের অনুলিপির জন্য দ্র. Moudud Ahmed, Bangladesh: Constitutional Quest for Autonomy 1950-1971 (ঢাকা, ১৯৭১), পরিশিষ্ট ১, পৃ. ২৭৯-৩২০।
৪৯. পূর্ণ পাঠ দ্র. Dawn, ২৬ মার্চ ১৯৬৯।
৫০. দ্র. দৈনিক পাকিস্তান, ২৭ মার্চ ১৯৬৯।
৫১. ভাসানীর কথাবার্তার বিস্তারিত দ্র. ইত্তেফাক, ২৫ মার্চ ১৯৬৯। বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, “শােষণের কার্যব্যবস্থা সম্পর্কে মওলানা ভাসানীর অজ্ঞতা আর তাঁকে জামায়াত-ই-ইসলামী কাফির বলায় “তিনি মওলানা মওদুদীর চেয়েও যে বড়াে মুসলমান তা প্রমাণ করায় তার প্রয়াস I” 5. Badruddin Umar, “The Political Cycle of Maulana Bhasani”, Holiday (ঢাকা, সাপ্তাহিক), মওলানা ভাসানী বিশেষ ক্রোড়পত্র, ১৮ জানুয়ারি ১৯৭০।
৫২. আইয়ুব সরকার সম্বন্ধে চৌধুরী মােহাম্মদ আলী ব্যবহৃত অভিব্যক্তিবিশেষ দ্র. Dawn, ২ এপ্রিল ১৯৬৯।
নবম অধ্যায়
১. দৃষ্টান্ত দ্র., রেহমান সােবহান, “East Pakistan’s Revolt Against Ayub”, Round Table (লন্ডন), বালাম ৫৯, পৃ. ৩০২-৭।
২. ব্যাখ্যার জন্য দ্র., Anisur Rahman, “East Pakistan: The Roots of Estrangement, South Asian Review (লন্ডন), বালাম ৩, নং ৩, এপ্রিল ১৯৭০, পৃ. ২৩৫-৩৯।
৩. পাঠ দ্র. Dawn (করাচি), ২৭ মার্চ ১৯৬৯।
৪. দ্র. প্রাগুক্ত, ১১ এপ্রিল ১৯৬৯।
২৯৫
৫. প্রাগুক্ত, ২৯ জুলাই ১৯৬৯ ও ইত্তেফাক (ঢাকা), ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯।
৬. Observer (লন্ডন), ৯ মার্চ ১৯৬৯ (অতিরিক্ত গুরুত্ব আরােপিত)।
৭. এ বক্তৃতার বিস্তারিত দ্র. Dawn, ৩১ আগস্ট, ১, ২, ৩, ১১, ১৩, ১৯, ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৬০; ইত্তেফাক, ৩১ আগস্ট, ১, ৩, ১১, ১৫, ২৩, ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯, আজাদ, ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯, দৈনিক পূর্বদেশ, ২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯।
৮. ইত্তেফাক, ২৯-৩০ জুন, ১-৭ জুলাই ও ২১ আগস্ট ১৯৭০।
৯. Dawn, ১৪ অক্টোবর ১৯৬৯।
১০. বিস্তারিত দ্র. Morning News, ১৭ নভেম্বর ১৯৬৯।
১১. আরাে বিস্তারিত দ্র. Dawn, ১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯; Morning News (ঢাকা), ২৮ নভেম্বর ১৯৬৯।
১২. Dawn, ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯; Morming News, ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯; ও ইত্তেফাক, ১০ মার্চ ১৯৭০।
১৩. দ্র. পাকিস্তান ডেমােক্র্যাটিক পার্টি ঘােষণাপত্র (ঢাকা, তা. বি.), পৃ. ৪; আরাে দ্র. Morning News, ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯।
১৪. দ্র. এপ্রিল সাংগঠনিক উপকমিটির আহ্বায়ক, অলি আহাদ প্রকাশিত ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টো (ঢাকা, তা. বি.) ও ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ লীগ প্রথম জাতীয় সম্মেলন ১৯৭০ (১ ও ২ আগস্ট) আহ্বায়কের ভাষণ, আতাউর রহমান খান, প্রকাশক: কে. এম. আবদুল কাদের, আহ্বায়ক প্রচার উপকমিটি (ঢাকা, তা, বি.)।
১৫. Pakistan Observer (ঢাকা), ২২ জুন ১৯৬৯; ইত্তেফাক, ৭ অক্টোবর ১৯৬৯; Morning News, ৭ নভেম্বর ১৯৬৯।
১৬. ইত্তেফাক, ১৩ আগস্ট ১৯৬৯ এবং ২১ ও ২২ মার্চ ১৯৭০।
১৭. Dawn, ২৯ নভেম্বর ১৯৬৯।
১৮. Morning News, ৩০ নভেম্বর ১৯৬৯।
১৯. প্রাগুক্ত।
২০. প্রাগুক্ত, নুরুজ্জামান পরে পিপিপি থেকে সরে গিয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট পিপলস পার্টি গঠন করলেও বলা যায় তা ছিল জন্মেই মৃতবৎস।
২১. Morning News, ৩০ নভেম্বর ১৯৬৯।
২২. প্রাগুক্ত, ২৯ নভেম্বর ১৯৬৯।
২৩. প্রাগুক্ত, ১ ডিসেম্বর ১৯৬৯।
২৪. প্রাগুক্ত, ৩০ নভেম্বর ১৯৬৯; ও এপিপিতে প্রদত্ত বিবৃতি, প্রাগুক্ত, ১ ডিসেম্বর ১৯৬৯।
২৫. প্রাগুক্ত।
২৬. প্রাগুক্ত, ৩০ নভেম্বর ১৯৬৯।
২৭. প্রাগুক্ত, ১ ডিসেম্বর ১৯৬৯।
২৮. প্রাগুক্ত, ১ ডিসেম্বর ১৯৬৯।
২৯৬
২৯. এগারাে-দফার সংগ্রাম চলবেই-ইয়াহিয়া খানের ভাষণ সম্পর্কে ছাত্র সমাজের অভিমত (বাংলা পুস্তিকা)।
৩০. ইত্তেফাক, ৫ ও ১২ জানুয়ারি ১৯৭০; Morning News, ১৪, ১৮ ও ২৮ ডিসেম্বর ১৯৬৯।
৩১. ইত্তেফাক, ৫ জুন ১৯৭০।
৩২. দ্র. সংবাদ, জানুয়ারি-এপ্রিল ১৯৭০।
৩৩. Morning News, সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর ১৯৬৯।
৩৪. Pakistan Observer; ৩০ মার্চ ১৯৬৯।
৩৫. ইত্তেফাক, ২ এপ্রিল ১৯৭০; ও Pakistan Observer, ৪ এপ্রিল ১৯৭০।
৩৬. বিস্তারিত দ্র. ইত্তেফাক, ৮ এপ্রিল ১৯৭০।
৩৭. প্রাগুক্ত, ৯ এপ্রিল ও ১৮ মে ১৯৭০।
৩৮. দ্র. দৈনিক পূর্বদেশ (ঢাকা), ও ইত্তেফাক, ৭ ও ৮ জুন ১৯৭০-এর রিপাের্ট।
৩৯. ইত্তেফাক, ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০।
৪০. দৈনিক পূর্বদেশ, জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ১৯৭০, বিশেষ করে, আবদুল গাফফার চৌধুরীর নিয়মিত কলাম: তৃতীয় মত, দ্র.।
৪১. দৃষ্টান্ত হিসেবে দ্র. Muyeedul Hasan, “The Strategy for Autonomy”, Forum (ঢাকা), ৩১ জানুয়ারি ১৯৭০, পৃ. ৪।
৪২. প্রাগুক্ত, আরাে দ্র. Talukder Maniruzzaman, Radical Politics and the Emergence of Bangladesh, (ঢাকা, ১৯৭৫), পৃ. ৩৮-৩৯।
৪৩. বিস্তারিত দ্র. A Mascarenhas, The Rape of Bangladesh (নয়াদিল্লি, ১৯৭১), পৃ. ৫৬
৫৭।
৪৪. বাংলাদেশে ১৯৭৬ সালে গৃহীত সাক্ষাৎকার। আরাে দ্র. Kalim Siddiqui, Conflict, Crisis and War in Pakistan (লন্ডন ও বেসিংস্টোক, ১৯৭২) পৃ. ১৪৫ এবং Financial Times (লন্ডন), ১ ডিসেম্বর ১৯৭০।
৪৫. দ্র. এএইচএম কামারুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক, নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো (ঢাকা, ১৯৭০)। কামারুজ্জামান মুখবন্ধে লেখেন: “১৯৬৯ সালের ৯ আগস্ট করাচিতে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক কমিটির এক বৈঠকে, এক ম্যানিফেস্টো উপকমিটি গঠিত হয়। ঐ উপকমিটি দলের বিভিন্ন ইউনিট থেকে বিভিন্ন প্রস্তাব আহ্বান করে তারপর এক খসড়া ম্যানিফেস্টো তৈরি করে তা ১৯৭০ সালের ৩ জুন সাংগঠনিক কমিটিতে পেশ করা হয়। ৫ জুন সাংগঠনিক কমিটি ঐ খসড়াটির চূড়ান্ত আকার দিয়ে তা নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে পেশ করে। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন ১৯৭০ সালের ৬ জুন সর্বসম্মতিক্রমে ম্যানিফেস্টোটি গ্রহণ করে।
৪৬. দ্র. তাজউদ্দিন আহমদ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নীতি ও কর্মসূচির ঘােষণা (ঢাকা, ১৯৬৯), পৃ. ৩। বাড়তি গুরুত্বসহ। এই ম্যানিফেস্টোতে মার্চ ১৯৬৪, মার্চ ১৯৬৬ ও আগস্ট ১৯৬৭ সালের কাউন্সিল অধিবেশনগুলিতে অনুমােদিত সকল সংশােধনী অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
২৯৭
৪৭. ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পূর্ব পাকিস্তান শাখার নির্বাচনী ইশতেহার অক্টোবর ১৯৭০, পৃ. ২৪। এ ম্যানিফেস্টোটি কেন্দ্রীয় দলের ম্যানিফেস্টোভিত্তিক আর এতে পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কিত বিষয়গুলির বিশেষ উল্লেখ রয়েছে।
৪৮. প্রাগুক্ত, পৃ. ১২।
৪৯. ম্যানিফেস্টো, এন. ৪৫।
৫০. Dawn, ৮ ও ১৫ জুন ১৯৭০, The People (ঢাকা), ও দৈনিক পাকিস্তান, ৮-৩০ অক্টোবর ১৯৭০।
৫১. দ্র. দৈনিক পূর্বদেশ, ২০ আগস্ট ১৯৭০।
৫২. প্রাগুক্ত, ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭০।
৫৩. সারণি ও চার্ট ৯.১-এ প্রার্থী হওয়ার দলওয়ারি শতকরা হার দ্র.।
৫৪. সারণি ও চার্ট ৯.২ এবং ৯.৩ দ্র.।
৫৫. আসলে এ বিষয়টি ঔদাসীন্যের চেয়েও বেশি অন্য কিছু। এমনকি, “তথ্য মাধ্যমগুলিকেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধ্বংসলীলার বিস্তারিত খবর নিচু লয়ে পরিবেশনার পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া হয়”। দ্র. Forum, বালাম ২, নং ২, ২৮ নভেম্বর ১৯৭০, পৃ. ৩।
৫৬. Morning News, ২৭ নভেম্বর ১৯৭০।
৫৭. “Burying the Dead Centre” (সম্পাদকীয়), Forum, বালাম ২, নং ২, ২৮ নভেম্বর ১৯৭০, পৃ. ৩।
৫৮. Dawn, ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯।
৫৯. দ্র. Morning News, ২৪ ডিসেম্বর ১৯৬৯।
৬০. Mazhar Ali Khan, “Between the Lines: Orphans of the Storm”, Forum, arata ২, নং ৩, ৫ ডিসেম্বর ১৯৭০, পৃ. ১৩-১৪।
৬১. কতিপয় ছাত্র সক্রিয়তাবাদীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার।
৬২. Rashed Akhter, “Election Prospects: East Pakistan, The Final Round”, Forum, বালাম ২, নং ৩, ৫ ডিসেম্বর ১৯৭০।
৬৩. বিস্তারিত দ্র. তালুকদার মনিরুজ্জামান, এন. ৪২, পৃ. ৩৯-৪১।
৬৪. ১৯৬১ সালের পাকিস্তানের আদমশুমারির উপাত্ত অনুযায়ী ১৯৭০-৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানীদের শতকরা ৪০-৫০ জন ১৫-৩৫ বয়ঃবর্গের ছিল বলে অনুমান করা হয়।
৬৫. সব সময়েই যে মাস্টার্স ডিগ্রি তা নয়। এ সমীক্ষার উদ্দেশ্যের জন্য আইনের স্নাতক ডিগ্রিকেও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে কেননা এই কোর্সটি কেবল বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পড়ানাে হতাে।
৬৬. এখানে এ বিষয়টি পরিষ্কার করা দরকার যে, ঢাকা ছাড়া আর কোনাে জায়গাকে সম্ভবত কথাটির পাশ্চাত্য ধারণায় “নগরীয়” বলা যায় না। তাঁরা ছিলেন নামে নগরবাসী। এমনকি, ১৯৭৬ সালেও বাংলাদেশের তৎকালীন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান একবার এমন মন্তব্য করেছিলেন যে, হাজার হােক ঢাকা তাে একটি জেলা শহরই বটে যা হঠাৎ করেই জাতীয় রাজধানীর মর্যাদা অর্জন করেছে।
২৯৮
৬৭. তাঁরা হয় রাজনীতিতে পুরাে সময় নিয়ােজিত ছিলেন চাষাবাদের আয়ের ওপর নির্ভর করে নয় তারা পুরােদস্তুর কৃষকই ছিলেন। এখানে লক্ষ্য করা দরকার যে, পূর্ব পাকিস্তানের শহরবাসী শিক্ষিতদের পেশা যা-ই হােক না কেন বরাবরই তাদের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন ছিল কৃষি (বিষয়টি বাংলাদেশে আজও তাই) আর সেটিই বস্তুত ছিল প্রধানত শহর ও গ্রামের মধ্যে নিবিড় যােগাযােগের কারণ।
৬৮. পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের উত্তরসূরি। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক না থাকলেও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অনানুষ্ঠানিক ছাত্র শাখা এবং এর প্রধান সদস্য সংগ্রহ শাখা ছিল। তাছাড়া, এ ছাত্র সংগঠনটি অনেক ক্ষেত্রেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অগ্রবর্তীর ভূমিকা পালন করে।
৬৯. পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের গঠন কাঠামাের জন্য দ্র. সারণি ও তালিকা ৯.৪।
৭০. ড. কামাল হােসেন ১৯৭০ সালের মে মাসে আওয়ামী লীগে যােগ দেন। ঢাকায় শেখ মুজিব দুটি আসনে বিজয়ী হওয়ার পর একটি থেকে ইস্তফা দিলে ড. কামাল ঐ আসনের উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
৭১. ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ শেখ মুজিবুর রহমানের কারামুক্তির পর ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসংবর্ধনায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাঁকে এই উপাধিতে ভূষিত করে।
৭২. মূল পােস্টারের অনুলিপি, পরিশিষ্ট ৬ দ্র.।
৭৩. বিস্তারিত দ্র. রাজশাহী বার্তা (সাপ্তাহিক), ১০ জুলাই, ২১ আগস্ট ও ১৩ নভেম্বর ১৯৭০।
৭৪. কামারুজ্জামান তাঁর নিজ জেলা রাজশাহীতে ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে এক জনসভায় ঘােষণা করেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা ছয়-দফা ও এগারাে-দফা প্রত্যাখ্যান করলে স্বাধীন বাংলাদেশ ঘােষণা করা হবে। দ্র. প্রাগুক্ত, ২২ জানুয়ারি ১৯৭১।
৭৫. Forum, Research Unit, “Electoral Prospects”, Forum, বালাম ২, নং ১, ২১ নভেম্বর ১৯৭০, পৃ. ৫-৭।
৭৬. দ্র. সারণি ও তালিকা ৯.২।
৭৭. ১৯৬৫ সালে মিস জিন্নাহ্ নােয়াখালীতে ৬৩ শতাংশ ভােট পেয়েছিলেন। দ্র. Report on General Election in Pakistan 1964-65, বালাম ১, মানচিত্র নং ১, ১১৮ ও ১১৯ পৃষ্ঠার মাঝে।
৭৮. দ্র. সারণি ও তালিকা ৯.২।
৭৯. দ্র. সারণি ও তালিকা ৯.৫।
৮০. শতাংশ হিসাবে প্রাপ্ত ভােটের দলওয়ারি বিস্তারিত সারণি ও তালিকা ৯.৪ দ্র.।
৮১. পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত বিস্তারিত তথ্য থেকে গণনাকৃত Report on General Election_1970-71 (ইসলামাবাদ, ১৯৭২), বালাম ১।
৮২. দ্র. সারণি ও তালিকা ৯.২।
৮৩. দলওয়ারি জামানত বাজেয়াপ্তির শতকরা হারের জন্য দ্র. সারণি ও তালিকা ৯.৭।
৮৪. রিপাের্ট থেকে হিসাব করা, এন, ৮১, পৃ. ১৭১।
২৯৯
৮৫. দ্র. সারণি ও তালিকা ৯.৮।
৮৬. এই সব জেলার অবস্থান নির্দেশ সংবলিত রূপরেখামূলক মানচিত্রের জন্য দ্র. সারণি ও তালিকা।
৮৭. এন. ৫৪-তে উল্লিখিত তালিকা দ্র.। আরাে দ্র. এন. ৮৬-তে প্রদত্ত মানচিত্র।
৮৮. মিমিওগ্রাফ করা বিশদ তথ্য থেকে হিসাব করা, এন. ৭৮। ঘটনাক্রমে বরিশাল ও চট্টগ্রাম জেলার সাথে এই জেলাগুলি থেকে মিস জিন্নাহ্ শতকরা ৪৫টিরও কম ভােট পান। তবে অন্যান্য জেলায় তাঁর ভােট প্রাপ্তির হার ছিল শতকরা ৪৫ থেকে ৬০টি।
৮৯. দ্র. সারণি ও তালিকা ৯.৩, ৯.৫ ও ৯.১০।
৯০. Mohammed Ayoob, “From Martial Law to Bangladesh”, প্রকাশনা সূত্র: Pran Chopra, সম্পা., Bangladesh: A Special Debate (বােম্বাই, ১৯৭১), পৃ. ৪০-৫৯।
৯১. অবিভক্ত বাংলায় ১৯৪৫-৪৬ সালে মুসলিম লীগের নির্বাচনী অভিযানের নির্দেশনামূলক রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল হাশিম তাঁর লেখা ‘Let Us Go to the War’ শীর্ষক পুস্তিকায়। দ্র. Abul Hashim, In Retrospection (ঢাকা, তা, বি.)। পুস্তিকাটির পাঠ সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতির আকারে দেওয়া রয়েছে এই গ্রন্থের পরিশিষ্টে, পৃ. ১৭০-৭৮।
দশম অধ্যায়
১. ত্রয়ী” শক্তির অভ্যুদয় ও তাদের ভূমিকার এক আখ্যানমূলক বর্ণনার জন্য দ্র. Kalim Siddiqui, Conflict, Crisis and War in Pakistan (লন্ডন ও বেসিংস্টোক, ১৯৭২) পৃ. ৭২-৯৮।
২. M. B. Naqvi, “View from the West: Headlong into the Great Divide”, Forum, বালাম ২, এন, ১, ২১ নভেম্বর ১৯৭০, পৃ. ২৪-২৭।
৩. শেখ মুজিবের ভাষণ, দৈনিক পাকিস্তান (ঢাকা), ১০ ডিসেম্বর ১৯৭০।
৪. Morning News (ঢাকা), ২৮ নভেম্বর ১৯৭০।
৫. দ্র. আবুল মনসুর আহমদ, “প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কি মত বদলাইয়াছেন?” ইত্তেফাক (ঢাকা), ৬ ডিসেম্বর ১৯৭০।
৬. বাংলাদেশে গৃহীত কয়েকটি সাক্ষাৎকারে উল্লিখিত। আরাে দ্র. আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (ঢাকা, আগস্ট ১৯৭৫), তৃতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণ, পৃ. ৬৩০ ৩১।
৭. Naqvi, এন. ২।
৮. Morning News ও দৈনিক পাকিস্তান, ২৭ নভেম্বর ১৯৭০।
৯. Rao Farman Ali, ভুট্টো, শেখ মুজিব, বাংলাদেশ (বাংলা অনু. মােস্তফা হারুন) (ঢাকা, ১৯৭৮); G. W. Choudhury, The Last Days of United Pakistan (ব্লুমিংটন, ১৯৭৪)।
১০. পাঠের জন্য দ্র. Dawn (করাচি), ৪ ডিসেম্বর ১৯৭০।
৩০০
১১. Rao Farman Ali, এন, ৯।
১২. ঐ সময়ের শাসকমহল ও চীনাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যারা নিজ পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক তাঁদের সাথে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে গৃহীত সাক্ষাৎকার ।
১৩. এই “ভেতরের চক্র” সম্পর্কে কিছু আলােচনার জন্য দ্র. H. Feldman, The End of the Beginning, Pakistan, 1969-1971 (লন্ডন, ১৯৭৫)।
১৪. Dawn, ২১ ডিসেম্বর ১৯৭০; দৈনিক পাকিস্তান, ২২ ডিসেম্বর ১৯৭০।
১৫. Iftikhar Ahmad, Pakistan General Elections; ১৯৭০ (লাহাের, ১৯৭৬), পৃ. যথাক্রমে ৮৮, ১০০ ও ৮০।
১৬. বাংলাদেশের কতিপয় নাগরিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকার যারা ঐ সময়ে সরকারি কর্তব্য কাজে পশ্চিম পাকিস্তানে বাস করছিলেন।
১৭. ভুট্টোর ভাষণের জন্য দ্র. Dawn ও দৈনিক পাকিস্তান, ২২, ২৫ ও ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭০।
১৮. Dawn, ৬ অক্টোবর ১৯৭০।
১৯. বক্তৃতা ও সভার বিস্তারিত দ্র. দৈনিক পাকিস্তান, Pakistan Observer ও ইত্তেফাক, ৪ জানুয়ারি ১৯৭১।
২০. Dacca Correspondent, “Renewing a Pledge”, Forum, বালাম ২, নং ৮, ৯ জানুয়ারি ১৯৭১, পৃ. ৪।
২১. প্রাগুক্ত।
২২. প্রাগুক্ত।
২৩, ৪ জানুয়ারি ১৯৭১ ছাত্রলীগের ২৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী সভায় প্রদত্ত ভাষণের বিস্তারিত দ্র. Dawn, দৈনিক পাকিস্তান ও ইত্তেফাক, ৫ জানুয়ারি ১৯৭১।
২৪. দৈনিক পাকিস্তান, ৩০ ডিসেম্বর ১৯৭০ এবং ১০ ও ১১ জানুয়ারি ১৯৭১।
২৫. ঢাকায় সাংবাদিকদের কাছে ইয়াহিয়া খানের বিভিন্ন মন্তব্য ও তাদের বিভিন্ন প্রশ্নে তার জবাব দ্র. Dawn, Pakistan Observer; দৈনিক পাকিস্তান ও ইত্তেফাক, ১২, ১৩, ১৪, ১৫ জানুয়ারি ১৯৭১।
২৬. দ্র. Mazhar Ali Khan, “Conspiracy Against Freedom”, Forum, বালাম ২, নং ৯, ১৬ জানুয়ারি ১৯৭১, পৃ. ১৩-১৪।
২৭. দ্র. ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত বক্তৃতা; Hamid Jalal ও Khalid Hasan, systt., Marching Towards Democracy: A Collection of Articles, Statements and Speeches by Zulfikar Ali Bhutto (রাওয়ালপিণ্ডি, ১৯৭২), বালাম ৩, ১৯৭০-৭১, পৃ. ১৬৬-৭০।
২৮. দ্র. ১৮ নভেম্বর ১৯৭০ সালে জাতির উদ্দেশে বেতার ও টিভি ভাষণ; প্রকাশনা সূত্র: Jalal ও Hasan, এন. ২৭, পৃ. ১৫২-৬০। বাড়তি গুরুত্বসহকারে।
২৯. আবুল মনসুর আহমদ, “জনমতের ম্যাজেস্টির দরবারে মাথা নত করুন”, ইত্তেফাক, ১৩ ডিসেম্বর
১৯৭০, ও “পশ্চিমা ভাইরা এবার দেশপ্রেমের পরীক্ষায় পাস করুন”, প্রাগুক্ত, ২০ ডিসেম্বর ১৯৭০।
৩০১
৩০. দ্র. ১২ ডিসেম্বর ১৯৭০ পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদের বাইরে প্রদত্ত ভুট্টোর ভাষণ, প্রকাশনা সূত্র: Jalal ও Hasan, এন. ২৭, পৃ. ১৬১-৬৫।
৩১. Dawn, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১।
৩২. ২৮-৩১ জানুয়ারি, ১৯৭১, Dawn, Pakistan Times, দৈনিক পাকিস্তান ও ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত রিপাের্ট দ্র.।
৩৩. দ্র. সম্পাদকীয়, “Different Roads to Socialism, Forum, বালাম ২, নং ১১, ৩০ জানুয়ারি ১৯৭১, পৃ. ৩।
৩৪. M. B. Naqvi, “In the Aftermath of Mujib-Bhutto Failure”, Forum, a ২, নং ১৩, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১, পৃ. ৪-৫।
৩৫. প্রাগুক্ত।
৩৬. প্রাগুক্ত।
৩৭. তাজউদ্দিন আহমদ কর্তৃক সাংবাদিকদেরকে ব্রিফিং, Dawn, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১।
৩৮. দ্র. “No Time for Adventure” (সম্পাদকীয়), Forum, বালাম ২, নং ১২, ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১, পৃ. ৩।
৩৯. Dawn, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১, Pakistan Observer ও দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১।
৪০. দ্র. Rashed Akhter, “The Costs of Delay”, Forum, বালাম ২, নং ১৩, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১, পৃ. ১৬।
৪১. Dawn, ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১।
৪২. Pakistan Observer, ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১।
৪৩. প্রাগুক্ত, ১৭ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১।
৪৪. দৈনিক পাকিস্তান, ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ও Pakistan Times (লাহাের), ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১।
৪৫. রাজশাহী বার্তা, ২২ জানুয়ারি ১৯৭১।
৪৬. দ্র. আবুল মনসুর আহমদ, “মেজরিটির ডিক্টেটরশিপ বনাম মাইনরিটির ডিক্টেটরশিপ”, ইত্তেফাক, ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ও দৈনিক পাকিস্তান, ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১।
৪৭. Rashed Akhter, “Bhutto’s Brinkmanship”, Forum, বালাম ২, নং ১৪, ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১, পৃ. ৮-১০। বাড়তি গুরুত্বসহকারে।
৪৮. হাতেগােনা কিছু লােক এই বৈঠক সম্পর্কে ও জেনারেলের করাচি সফর সম্পর্কে জানতেন এদেরই একজন (একজন বাঙালি) পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার সময় ১৯৭১ সালে নয়াদিল্লিতে এ কথা বলেন।
৪৯. Jalal ও Hasan, এন. ২৭, পৃ. ১৭১-৬। আরাে দ্র. Pakistan Times, ১ মার্চ ১৯৭১।
৫০. প্রাগুক্ত, বাড়তি গুরুত্বসহ।
৫১. পাঠ দ্র. Dawn, ২ মার্চ ১৯৭১।
৩০২
৫২. ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক পাকিস্তান ও দৈনিক পূর্বদেশ, ২ মার্চ ১৯৭১।
৫৩. নূর-ই-আলম সিদ্দিকী, “পহেলা থেকে পঁচিশে মার্চ”, বাংলার বাণী, বিশেষ সংখ্যা (বাংলাদেশে গণহত্যা), ঢাকা, ১৯৭২, পৃ. ১৬।
৫৪. দ্র. ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক পাকিস্তান ও দৈনিক পূর্বদেশ, ২ ও ৩ মার্চ ১৯৭১।
৫৫. নূর-ই-আলম, এন. ৫৩।
৫৬. এটি ১৯৭২ অবধি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ছিল। তারপর পতাকায় বাংলাদেশের মানচিত্রের রূপরেখাটি অপসারণ করা হয় এবং পতাকার আকার ও অন্যান্য খুঁটিনাটি বিষয় চূড়ান্ত করা হয়।
৫৭. ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক পাকিস্তান, ৩ মার্চ ১৯৭১।
৫৮. বাংলায় ইশতেহারের একটি অনুলিপি পরিশিষ্টে দ্র.।
৫৯. শেখ মুজিবের ভাষণের বিস্তারিত দ্র., দৈনিক পাকিস্তান, ৪ মার্চ ১৯৭১ ও ইংরেজি ভাষ্য দ্র. _Dawn, ৪ মার্চ ১৯৭১, Bangladesh Documents-এ পুনঃপ্রকাশিত (নয়াদিল্লি, ১৯৭১),
বালাম ১, পৃ. ১৯৫-৭।
৬০. দৈনিক পাকিস্তান, ৩ মার্চ ১৯৭১।
৬১. এই ব্যাখ্যাটি দিয়েছেন একজন সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন সদস্য যিনি পরবর্তীকালে জাসদ সদস্য হন।
৬২. দ্র. ঢাকায় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. নুরুল্লাহর সঙ্গে বাংলার বাণী পত্রিকার রশীদুল হাসানের
সাক্ষাৎকার, বাংলার বাণী, বিশেষ সংখ্যা, বাংলাদেশে গণহত্যা (ঢাকা, ১৯৭২), পৃ. ১৯।
৬৩. দ্র. মেজর এমএ জলিল, সীমাহীন সমর (ঢাকা, ১৯৭৪), পৃ. ২০-২৮; আরাে দ্র. মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফের দেওয়া বিবরণ, প্রকাশনা সূত্র: বিচিত্রা (সাপ্তাহিকী), স্বাধীনতা দিবস বিশেষ সংখ্যা (ঢাকা, ১৯৭৪)।
৬৪. মুক্তি সংগ্রাম প্রথম পর্ব (ঢাকা, ১৯৭২), পৃ. ২৮৭-৯০-এ বাংলা পাঠ এবং ইংরেজিতে নানা উদ্ধৃতি দ্র. Dawn, ৮ মার্চ ১৯৭১।
৬৫. ১৯৭৬ সালে কামরুদ্দিন আহমদের সাথে সাক্ষাৎকার।
৬৬. পাঠ দ্র. Dawn, ৭ মার্চ ১৯৭১।
৬৭. ৮ মার্চ ১৯৭১ সালে দৈনিক পাকিস্তানে শেখ মুজিবের দীর্ঘ বিবৃতি ও একই তারিখে Dawn-এ | প্রকাশিত তাঁর ঐ বিবৃতি থেকে নানা উদ্ধৃতি দ্র.।
৬৮, আবুল মনসুর আহমদ, এন, ৬।
৬৯. ইয়াহিয়া খানের বিবৃতির পাঠ, এন, ৬৬।
৭০. ১০-দফা কর্মসূচি এবং তাজউদ্দিন আহমদ কর্তৃক কতিপয় ব্যাখ্যার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, ঢাকা ১৯৮২, পৃ. ৭০৩-৪, ৭২৫ ২৬ এবং ৭৩০-৩২ দ্র.।
৭১. বিস্তারিত বিবরণের জন্য ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ কর্তৃক সংবাদপত্রে প্রদত্ত বিবৃতি, Bangladesh Documents, vol. I, New Delhi 1971, পৃ. ২৯১-৯৯ দ্র.।
৩০৩
৭২. ট্রান্সমিটারটি আনুমানিক ৯ দিনে তৈরি করা হয় তবে তা ব্যবহার করা হয়নি। তবে এ থেকে ড. নুরুল্লাহর একটা ধারণা হয় যে, কোনাে সহিংসতা ঘটলে যদি সম্ভব হয় তার আলােকচিত্রে রেকর্ড রেখে দিতে হবে। আর সেই ধারণা বশেই তিনি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগনাথ হলে যে নশংসতা ঘটে তা একটি ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করে। রাখেন। এ কাজটি তিনি করেন জগন্নাথ হলের আঙিনামুখী তাঁর ফ্ল্যাটের একটি জানালা থেকে। রাশেদুল হাসানের সাথে সাক্ষাৎকার, বাংলার বাণী, বিশেষ সংখ্যা, “বাংলাদেশে গণহত্যা” (ঢাকা, ১৯৭২), পৃ. ১৯।
৭৩. দ্র. Rashed Akhter, “Negotiating from Strength, Forum, বালাম ২, নং ১৮, ২০ মার্চ ১৯৭১, পৃ. ১৪-১৫।
৭৪. প্রাগুক্ত।
৭৫. “Option for a Sane Man” (সম্পাদকীয়), Forum, বালাম ২, নং ১৮, ২০ মার্চ ১৯৭১, পৃ. ৩। বিশেষ গুরুত্বসহকারে।
৭৬. দ্র. সংবাদপত্রে প্রদত্ত বিবৃতি, এন. ৭১।
৭৭. প্রাগুক্ত, ও Pakistan Times, ২৬ মার্চ ১৯৭১।
৭৮. পাকিস্তান সরকার, White Paper on the Crisis of East Pakistan (ইসলামাবাদ, ১৯৭১),
পৃ. ২৭।
৭৯. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫।
৮০. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, সপ্তম খণ্ড, ঢাকা ১৯৮৪, পৃ. ১-৩ দ্র.।
৮১. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, ঢাকা ১৯৮২, পৃ. ২৫-৩২-এ ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ কর্তৃক সংবাদপত্রে প্রদত্ত বিবৃতি, To the People of the World দেখুন।
৮২. দলিলপত্র, এন, ৮১, পৃ. ৪-৬। পটভূমি বিশ্লেষণের জন্য দ্র. Moudud Ahmed, Bangladesh: Constitutional Quest for Autonomy, Dhaka, 1979, পৃ. ২৬৪-৬৯; এবং Bangladesh: Era of Sheikh Mujibur Rahman, Dhaka, 1983, পৃ. ৪-৬; এবং মঈদুল হাসান, মূলধারা ‘৭১, ঢাকা, ১৯৮৬, পৃ. ৪-১৮।
৮৩. Ahmed, Constitutional Quest, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭৪।
৮৪. মঈদুল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫২ এবং মুস্তাফা সারােয়ার, “পঁচিশ বছরের সংগ্রামে আওয়ামী লীগ ও | বঙ্গবন্ধু”, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশন, ১৯৭৪, স্মরণিকা (ঢাকা, তা. বি.)।
৮৫. বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে রীট পিটিশন এবং রায়ের বিস্তারিত বিবরণের জন্য Bangladesh Election Commission, Report on the First General Election to Parliament in Bangladesh 1973, Dhaka, 1974, পৃ. ১৯-৩০ দ্র.।
৩০৪
একাদশ অধ্যায়
১. অল্প কিছু দিনের জন্য নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগও ক্ষমতাসীন কোয়ালিশনের অন্যতম
অংশীদার ছিল।
২. অন্য দুইজন বিশিষ্ট বাঙালির মধ্যে ফজলুল হক কোনাে কালেই একজন জাতীয় নেতা হতে।
আগ্রহী ছিলেন না। আর খাজা নাজিমুদ্দিন বাংলায় জিন্নাহ্র বিশ্বস্ত দক্ষিণ হস্ত ছিলেন। ভারতের কোনাে কোনাে ব্রিটিশ আমলার কাছেও জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। আর সে কারণেই তিনি একটা
বিশেষ অবস্থানগত মর্যাদা ভােগ করতেন, তবু তিনি পূর্ববঙ্গের বাঙালি নেতা ছিলেন না।
৩. এমনকি ১৯৫০-এর দশকের গােড়ার দিকেও মওলানা ভাসানী এই মর্মে সবিশেষ গুরুত্ব আরােপ করে বলতেন যে পাকিস্তানের দুই অঞ্চল যে সব সমস্যার শিকার সেগুলি একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির।
৪. তাৎপর্যের বিষয় এই যে, এই বিশেষজ্ঞ বা বিশারদ ব্যক্তিদের খুব বেশি লােক এমনকি পরিকল্পনা প্রণয়নেও প্রশিক্ষিত ছিলেন না। দ্র. A. Waterson, Planning in Pakistan: Organisation and Implementation (বাল্টিমাের, ১৯৬৩), পৃ. ৩৪-৩৫।
৫. ১৯৫২ সালের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন কমিটির অভিমতও তাই ছিল এবং খসড়া পরিকল্পনা সম্পর্কে ১৯৫৬ সালের The East Pakistani Economists’ Report একই চিন্তাধারায় বক্তব্য দিয়েছে।
৬. পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি নীতিকৌশল ও পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির ওপর তার প্রভাব প্রতিক্রিয়া
সম্পর্কিত বিবরণের জন্য দ্র. Keith Griffin ও Azizur Rahman, সম্পা., Growth and Inequality in Pakistan (লন্ডন, ১৯৭২)।
৭. Gustav Papanek, Pakistan’s Development Social Goals and Private Incentives (কেজি, ম্যাসাচুসেটস, ১৯৬৭)। Papanek এই বেনিয়া শিল্পপতি শ্রেণীর লােকদেরকে “Robber Barons” বলে উল্লেখ করেছেন, পৃ. ৬৬।
৮. কতাে ঘন ঘন তাঁরা (পূর্ব পাকিস্তানীরা) জানতে চেয়েছে: “আমরা কি একটা না দুটি দেশ?” আর কতাে ঘন ঘন তারা আমেরিকার কলােনীদশা মুক্তির পথে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের কথা উল্লেখ করেছেন—এগুলি বিশেষরূপে প্রণিধানযােগ্য।
৯. এই বিরােধ-সংঘাতের উৎপত্তির জন্য দ্র. Sisir Gupta, “The Problem”, Seminar, নং। ১৪২, জুন ১৯৭১,পৃ. ১০-১৪।
১০. এক মারমুখী ভূমিকার জন্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কর্মীদের মানসিকভাবে তৈরি করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে গল্পকাহিনীকে কিভাবে ব্যবহার করে আসছিলেন তার কৌতূহলােদ্দীপক বিবরণের জন্য দেখুন: শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, নিত্য কারাগারে (ঢাকা, ১৯৭৫), পৃ. ৬৯-৭১।
১১. Rehman Sobhan, “Social Forces in the Basic Democracies”, Asian Review,
বালাম ১, নং ৩, এপ্রিল ১৯৬৮, পৃ. ১৬৬-৭৬।
১২. ফজলুল হকের মতামতের জন্য দ্র. Shyamali Ghosh, “Fazlul Haq and Muslim Politics in Pre-partition Bengal, International Studies, বালাম ১৩, নং ৩, জুলাই। ১৯৭৪, পৃ. ৪৪১-৬৪।
৩০৫
১৩. শেখ মুজিবের মন্তব্যের জন্য দ্র. Morning News (ঢাকা), ১২ ডিসেম্বর ১৯৬৯।
১৪. যােগসূত্র পাওয়ার জন্য দ্র. Ayoob and Subrahmanyam, The Liberation War (নয়াদিল্লি, ১৯৭২)।
১৫. খালিদ বিন সাঈদ এ জন্যে বহুলাংশে ব্রিটিশ প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন যেগুলির
আওতায় সেই আমলে পাকিস্তানের এই দুইটি অঞ্চল শাসিত হয়েছে। বিস্তারিত বিবরণের জন্য
দ্র. Khaleed Bin Sayeed, Pakistan: The Formative Phase (লন্ডন, ১৯৬৮), ২য় সং।
১৬. Charles Burton Marshal, “Reflections on a Revolution”, Foreign Affairs, (নিউইয়র্ক), বালাম ৩৭, নং ২, জানুয়ারি ১৯৫৯, পৃ. ২৪৭-৫৬।
৩০৬
পরিশিষ্ট
পরিশিষ্ট ১: ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা
১. বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হইবে।
২. বিনাক্ষতিপূরণে জমিদারী ও সমস্ত খাজনা আদায়কারী স্বত্ব উচ্ছেদ ও রহিত করিয়া ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে জমি বিতরণ করা হইবে এবং উচ্চহারের খাজনা হ্রাস করা হইবে। সার্টিফিকেটপ্রথা রহিত করা হইবে।
৩. পাট ব্যবসার জাতীয়করণ। পাটের ন্যায্য মূল্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হইবে এবং লীগ মন্ত্রিসভার
আমলের পাট কেলেঙ্কারির তদন্ত করিয়া সংশ্লিষ্ট সকলের শাস্তির ব্যবস্থা ও তাহাদের অসদুপায়ে অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হইবে।
৪. সমবায় কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন। সকল প্রকার কুটির ও হস্তশিল্পের উন্নতিসাধন।
৫. পূর্ববঙ্গকে লবণ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিবার জন্য লবণ তৈয়ারির কারখানা স্থাপন। লবণ কেলেঙ্কারি সম্পর্কে তদন্ত।
৬. শিল্পী ও কারিগর শ্রেণীর গরীব মােহাজেরদের কাজের আশু ব্যবস্থা ও তাহাদের পুনর্বসতির ব্যবস্থা।
৭. খালখনন ও সেচের ব্যবস্থা করিয়া দেশকে বন্যা ও দুর্ভিক্ষের কবল হইতে রক্ষার ব্যবস্থা।
৮. পূর্ববঙ্গকে শিল্পায়িতকরণ। শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক এবং সকল প্রকার অধিকার প্রতিষ্ঠিতকরণ।
৯. প্রাথমিক অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন। শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা।
১০. শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কারসাধন। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা।
১১. ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিক্রিয়াশীল কানুন বাতিল ও রহিতপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে | স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা।
১২. শাসন ব্যয় সর্বাত্মকভাবে হ্রাস করা। উচ্চ বেতনভােগী সরকারী কর্মচারীদের বেতন হ্রাস ও নিম্ন বেতনভােগীদের বেতন বৃদ্ধির ব্যবস্থা।
১৩. দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ঘুষ, রিশওয়াত বন্ধ করা। এতদুদ্দেশ্যে সরকারী ও বেসরকারী পদাধিকারীর ও ব্যবসায়ীর ১৯৪০ সাল হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত মুদ্দতের আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ।
১৪. জননিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স প্রভৃতি কালাকানুন রদ ও রহিতকরত বিনাবিচারে আটক সমস্ত
বন্দীকে মুক্তিদান। সংবাদপত্র ও সভাসমিতি করিবার অধিকার অবাধ ও নিরঙ্কুশকরণ।
১৫. বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগকে পৃথককরণ।
১৬. বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাত্রাবাস ও পরে বাংলাভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা।
১৭. বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবীতে শহীদানের পবিত্র স্মৃতির চিহ্নস্বরূপ ঘটনাস্থলে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ এবং তাহাদের পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দান।
১৮. ২১শে ফেব্রুয়ারীকে শহীদ দিবস ঘােষণা করা ও উহাকে সরকারী ছুটির দিন ঘােষণা করা ।
১৯. লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে, পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌমকরণ এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত অন্যান্য সমস্ত বিষয় (অবশিষ্টাত্মক ক্ষমতাসহ) পূর্ববঙ্গের হাতে আনয়ন। দেশরক্ষা বিভাগের স্থল বাহিনীর হেডকোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তানে ও নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন এবং পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্রকারখানা স্থাপন। বর্তমানের আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হইবে।
২০. যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা কোনাে অজুহাতেই আইন পরিষদের আয়ু বাড়াইবে না। আইন পরিষদের আয়ু শেষ হওয়ার ছয় মাস পূর্বে মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করিয়া নির্বাচন কমিশনের মারফত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থাকরণ।
২১. যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভার আমলে যখন যে আসন শূন্য হইবে, তিন মাসের মধ্যে তাহা পূরণের জন্য উপনির্বাচনের ব্যবস্থাকরণ এবং পর পর তিনটি উপনির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনােনীত প্রার্থী পরাজিত হইলে মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করিবেন।
সূত্র: Joyoti Sengupta, Eclipse of East Pakistan (Calcutta, 1963), pp. 165-7/
৩১৮
পরিশিষ্ট ২: নিজের জবানিতে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে প্রদত্ত
জনাব আবুল মনসুর আহমদ-এর ভাষণ
শাসনতন্ত্র রচনা
অতঃপর ১৯৫৬ সালের ৯ই জানুয়ারী হইতে শাসনতন্ত্র রচনায় হাত দেওয়া হইল। সর্বসম্মত শাসনতন্ত্র রচনার জন্য আমরা সকল প্রকার চেষ্টা করিলাম। পাকিস্তানের বয়স আট বছর হইয়া যাওয়ার পরেও শাসনতন্ত্র রচিত না হওয়া একটা পরম লজ্জার ও দুর্ভাগ্যের বিষয় ছিল। এ সম্বন্ধে পজিশন দল ও অপজিশন দলের সবাই একমত হইলাম। সে জন্য শাসনতন্ত্র রচনার কাজে সহযােগিতা করিতে আমরা সর্বদাই প্রস্তুত ও আগ্রহশীল ছিলাম। অপজিশন বলিতে তখন কার্যত এক আওয়ামী লীগ। গােড়াতে কিছুদিন অপজিশনে বসিয়া অবশেষে হামিদুল হক চৌধুরী সাহেবও মন্ত্রিসভায় যােগ দেওয়ায় আওয়ামী লীগ ব্যতীত আর যারা অপজিশনে রহিলেন, তাঁদের মধ্যে জনাব ফিরােজ খাঁ নূন ও নবাব মােজাফফর আলী কিজিলবাস ও আজাদ পাকিস্তান পার্টির একমাত্র প্রতিনিধি মিয়া ইফতিখারুদ্দিন এবং স্বাধীন মুসলিম লীগ মেম্বার জনাব ফজলুর রহমানের নাম উল্লেখযােগ্য। পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে এঁরা কেউ আওয়ামী লীগের সমর্থন না করায় শাসনতন্ত্রকে গণমুখী করিবার ব্যাপারে এঁরা কোনও কাজে লাগিলেন না। ফলে পাঁচ-দফা মারিচুক্তি কার্যকরী করিবার ব্যাপারে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইলাম। যুক্তনির্বাচনপ্রথাও গ্রহণ করা হইল না। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন তাে দূরেই থাকিল। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনকে অধিকতর সঙ্কুচিত করা হইল। আমাদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় আমরা জীবনমরণ সংগ্রামের পথ’ বাছিয়া লইলাম।
এবারও আমি অপজিশনের ‘ওপেনিং ব্যাটসম্যান’ হইলাম। এর আগেই আমি ১৬৭টি সংশােধনী দাখিল করিয়া রাখিয়াছিলাম। সাধারণ আলােচনার বিতর্কে প্রথম বক্তা হিসাবে আমি এক নাগাড়ে দুই দিনে সাত ঘণ্টা সময় লইয়াছিলাম। অবশ্য এই সাত ঘণ্টার মধ্যে ডেপুটি-স্পিকারের বাধাদানে অনেক সময় নষ্ট হইয়াছিল। তবু আমার বক্তৃতায় (১) পূর্ববাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের আবশ্যকতা; (২) ভৌগােলিক অবস্থানহেতু অর্থনৈতিক বিভিন্নতা; (৩) ঐতিহ্যিক ও কৃষ্টিক পার্থক্য (৪) পূর্ববাংলার প্রতি ক্রিমিন্যাল ঔদাসীন্য; (৫) রাষ্ট্রের আয়ের প্রায় সবটুকু পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয়ের ভয়াবহ পরিণাম; (৬) অর্থনৈতিক অসাম্য; (৭) চাকুরীতে পূর্ববাঙালির শােচনীয় অবস্থা; (৮) তিন সাবজেক্টের কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের যৌক্তিকতা ও সম্ভাব্যতা ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলােচনা করিতে পারিয়াছিলাম। ১৯৫৬ সালের ১৬ ও ১৭ই জানুয়ারির গণপরিষদের ডিবেট’ বা প্রসিডিংয়ের সরকার-প্রকাশিত বিবরণী হইতে দেখা যাইবে যে বিনাবাধায় আমি অগ্রসর হইতে পারি নাই। কিন্তু অত বাধা দিয়াও ডেপুটি-স্পিকার মিঃ গিবন আমাকে কান্ত, বিরক্ত ও রাগান্বিত করিতে পারেন নাই। আমি হাসিমুখে তার বাধা ঠেলিয়া অগ্রসর হইতেছিলাম। আমার ধৈৰ্য্য দেখিয়া আমার নেতা অপজিশন লিডার মি. সােহরাওয়ার্দী পর্যন্ত তাজ্জব হইয়াছিলেন। মি. গিবনের পুনঃপুন বাধাদানে আপত্তি করিয়া তিনি বলিয়াছিলেন: ‘মিঃ ডেপুটি-স্পিকার, বক্তাই অপজিশন দলের প্রথম বক্তা; তাঁকে বিনাবাধায় বক্তৃতা করিতে দিন। আপনি তার বক্তৃতার ধারা পছন্দ নাও করিতে পারেন কিন্তু এটা তাঁর নিজস্ব ধারা।
৩১৯
ডেপুটি-স্পিকার মিঃ গিবন মিঃ সােহরাওয়ার্দীকে বাধা দিয়া বলেন: ‘কে বলিয়াছে আমি তাঁর বক্তৃতার ধারা পছন্দ করি না? আমি তাঁর ধারা খুবই পছন্দ করি। আপনি এঁর বক্তৃতার গােড়ার দিকে এখানে ছিলেন না বলিয়াই আপনি শুনেন নাই, আমি এঁর সম্পর্কে কি বলিয়াছি। আমি বলিয়াছি: মিঃ আবুল মনসুর একজন ‘লাভে লইয়ার (প্রিয়ভাষী উকিল)।’
জনাব সােহরাওয়ার্দী: ‘সে কথা সত্য। কিন্তু তবু আমি বলিতেছি যে আপনি যখন এঁর বক্তৃতায় ঘনঘন বাধা দিতেছিলেন তখন আমি তার পাশে বসিয়া এই কথাটাই ভাবিতেছিলাম: আমি নিজে অত বাধা পাইলে একবিন্দু অগ্রসর হইতে পারিতাম না এবং বক্তৃতার খেই হারাইয়া ফেলিতাম।
শাসনতন্ত্রের বাঞ্ছিত মূলনীতি
আমি নামকরা বাগ্মী নই। কিন্তু দেওয়ানী উকিল। এতক্ষণ ধরিয়া বক্তৃতা করিতে পারিয়াছিলাম। আমার কাছে বিষয়বস্তু তথ্য-পরিসংখ্যান প্রচুর ছিল বলিয়া। আমি অনেক বই-পুস্তক পড়িয়া ঐ। বক্তৃতার জন্য তৈয়ার হইয়াছিলাম। আমি জানিতাম, আমি মাঠে-ময়দানে জনসভায় বক্তৃতা করিতে যাইতেছি না, গণপরিষদে শাসনতন্ত্রের কাঠামাের উপরে বক্তৃতা করিতে যাইতেছি। আমার বক্তৃতায় শাসনতন্ত্র সম্পর্ক এই কয়টি মূলনীতির অপরিহার্যতা উল্লেখ করিয়াছিলাম: (১) পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে রচিত হইতে হইবে। কারণ (ক) লাহাের প্রস্তাব একটি নির্বাচনী ওয়াদা। উহারই ভিত্তিতে ভারতের মুসলমান ভােটাররা ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানের পক্ষে ভােট দিয়াছিল; (খ) লাহাের প্রস্তাব তদানীন্তন ভারতের স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশসমূহের মধ্যে একটা পবিত্র চুক্তি। এই চুক্তির পক্ষগণের সকলের সম্মতি ব্যতীত কোনও এক পক্ষের ইচ্ছায় এই চুক্তির রদবদল হইতে পারে না; (গ) লাহাের প্রস্তাব একটি দূরদর্শী, বাস্তবধর্মী, সুচিন্তিত পরিকল্পনা। পাকিস্তানের ভৌগােলিক অবস্থান, দুই অঞ্চলের ভাষিক, কৃষ্টিক ও ঐতিহ্যিক পার্থক্যের ওপর ভিত্তি করিয়াই উহা রচিত হইয়াছে; (ঘ) মুসলিম লীগের পরবর্তী অধিবেশনের কোনও প্রস্তাবে লাহাের প্রস্তাব সংশােধিত বা পরিবর্তিত হয় নাই; হইবার কোনও কারণ ও অধিকার ছিল না; (ঙ) পূর্ব পাকিস্তানের ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা নির্বাচনী ওয়াদা লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে রচিত। পূর্ব পাকিস্তানের উহা জাতীয় দাবি এবং পূর্ব পাকিস্তানী প্রতিনিধিদের উহা পবিত্র ওয়াদা; (চ) উক্ত ২১-দফা ওয়াদার ১৯-দফায় যে তিন বিষয়ের কেন্দ্রীয় সরকারের কথা বলা হইয়াছে, উহা অবাস্তব-অসাধ্য দাবি নয়। স্বাধীনতার প্রাক্কালে ব্রিটিশ সরকারের কেবিনেট মিশন যে গ্রুপিং সিস্টেম ও ফেডারেল কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়াছিল তাতেও তিন-বিষয়ের কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যবস্থা ছিল; (ছ) লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচিত না হইলে তা পরিণামে যে টিকিবেও না, দেশবাসী তা গ্রহণও করিবে না, সে কথা লাহাের প্রস্তাবের মধ্যেই সুস্পষ্ট হুঁশিয়ারিস্বরূপ উচ্চারিত হইয়াছে।
লাহাের প্রস্তাব ব্যতীত অন্য কোনও বুনিয়াদে যে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচিত হইতে পারে না, তা দেখাইতে গিয়া আমি বলিয়াছিলাম: (২) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান আসলে দুইটি দেশ; (৩) উহাদের বাসিন্দারা আসলে দুইটি জাতি; (৪) দুই পাকিস্তানের আসল সমস্যা রাজনৈতিকের চেয়ে বেশি অর্থনৈতিক; কারণ অর্থনৈতিক স্বার্থ দুইয়ের এক ও অভিন্ন নয়; (৫) সরকারি আয় জনগণের ব্যয়, সরকারি ব্যয় জনগণের আয়, এই নীতিতে সরকারি ব্যয় হইতে পূর্ব বাংলার কোনও লাভ হয় নাই; (৬) পূর্ব বাংলা হইতে যে টাকা পশ্চিমে আসে, তা আর ফিরিয়া যায় না। এটা কার্যত একরােখা অর্থনীতি; (৭) এই একরােখা অর্থনীতির বিষময় পরিণাম কিভাবে দেশের অনিষ্ট সাধন করিতেছে তা
৩২০
দেখাইতে গিয়া আমি সরকার িস্টেটিসটিক্স হইতে বিস্তারিতভাবে ‘ফ্যাক্টস এন্ড ফিগার্স কোট’ করিয়া দেখাইয়াছিলাম:
ক. দেশের রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত হওয়ায় এবং দুই অঞ্চলের মধ্যে মবিলিটি অব লেবার ও ক্যাপিটেল না থাকায় সরকারি সমস্ত ব্যয়ের, সরকারি গৃহনির্মাণাদি সাকুল্য খরচের, সবটুকু সুবিধা পশ্চিম পাকিস্তান পাইতেছে। পূর্ব পাকিস্তান এর একবিন্দু সুবিধা পাইতেছে না।
খ. শিল্প ও বৈদেশিক বাণিজ্যের সব প্রতিষ্ঠান পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপিত ও এখান হইতে পরিচালিত হওয়ায় এই সবের সকল সুবিধাই আঞ্চলিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নতি সাধন করিতেছে।
গ. দেশের রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে হওয়ায় ব্যাংকিং ইনশিওরেন্স ইত্যাদি সমস্ত কেন্দ্রীয়
প্রতিষ্ঠানের হেড অফিস এবং বিদেশী মিশনসমূহের অফিস ও ক্রিয়াকলাপ পশ্চিম পাকিস্তানে সীমাবদ্ধ থাকিতেছে। এ সবের আর্থিক সুবিধা শুধু পশ্চিম পাকিস্তান পাইতেছে।
ঘ. সরকারী চাকুরীতে দেশের মােট রাজস্বের শতকরা পঁচিশ টাকার বেশি (তত্ত্বালে একশ পঞ্চাশ কোটির মধ্যে সাড়ে বত্রিশ কোটি) ব্যয় হইতেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের উপরের চাকুরীর শতকরা একশটি এবং মধ্য ও নিম্নমধ্য চাকুরীর শতকরা আশি-নব্বইটি পশ্চিম পাকিস্তানীরা অধিকার করিয়া থাকায় এই হইতে যে বিপুল আয় হয় তার সবটুকু পশ্চিম পাকিস্তানীরাই পায়। ব্যয়ও হয় পশ্চিম পাকিস্তানেই। প্রতি বছর পশ্চিম পাকিস্তান এই হারে ধনী ও পূর্ব পাকিস্তান এই হারে গরিব হইতেছে।
ঙ. দেশরক্ষা বাহিনীর পিছনে দেশের মােট রাজস্বের শতকরা ৬২ ভাগ (তৎকালে একশ পঞ্চাশ কোটির মধ্যে একশ দশ কোটি) ব্যয় হয়। দেশরক্ষা বাহিনীর কোনও বিভাগে পূর্ব পাকিস্তানী অফিসার একরূপ না থাকায় এই বিপুল আয় হইতে তারা সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত। চাকুরী-বাকুরী ছাড়াও সরবরাহ বা নির্মাণকার্যের কন্ট্রাক্টরি হইতে তারা বঞ্চিত। ইহার ফলস্বরূপ প্রতি বছর এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানকে ধনী ও তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানকে গরিব করিতেছে।
এই ব্যাপারটাই পরিষ্কার হইয়াছিল নবাব গুরমানীর সাথে আমার কথা কাটাকাটিতে। আমি আমার বক্তৃতায় যখন উভয় পাকিস্তানের সমান অধিকার দাবি করিতেছিলাম, তখন আমার বক্তৃতায় বাধা দিয়া নবাব গুরমানী বলিলেন: বন্ধুবর ভুলিয়া যাইতেছেন যে পাকিস্তান সরকারের রাজস্বে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে আসে শতকরা চৌরাশি টাকা; পূর্ব পাকিস্তান দেয় মাত্র শতকরা ষােল টাকা।
জবাবে সরকারী হিসাবের খাতা দেখাইয়া আমি বলিয়াছিলাম: নবাব সাহেব একটু ভুল করিয়াছেন। পূর্ব পাকিস্তানের দান শতকরা ষােল নয়। আরও কম। মাত্র চৌদ্দ টাকা।
নিজের বিরুদ্ধে যুক্তি দিতেছি দেখিয়া নবাব গুরমানীসহ পশ্চিমা নেতারা কৌতূহলে আমার দিকে চাহিয়াছিলেন। আমি তাঁদের আরও বিস্মিত করিয়া বলিয়াছিলাম: বর্তমান পূর্ব পাকিস্তান দেয় শতকরা চৌদ্দ। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার বছর দিয়াছিল শতকরা ত্রিশ। আট বছরে শতকরা ষােল কমিয়া হইয়াছে চৌদ্দ। বছরে দুই কমিয়াছে। বাকি চৌদ্দ কমিয়া শূন্যে আসিতে লাগিবে আর মাত্র সাত বছর। ১৯৬৩ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জমার খাতায় যখন শূন্য হইবে, তখন আপনারা ন্যায়তই বলিতে পারিবেন: পূর্ব পাকিস্তান লােকসানের কারবার। ওটা লিকুইডেট করা যাইতে পারে।’
৩২১
প্রকৃত ব্যাপার এই যে ব্যাংকিং ইনশিওরেন্সসহ সমস্ত শিল্প-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের হেড অফিস করাচিতে হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানে অর্জিত সকল আয় পশ্চিম পাকিস্তানের হিসাবে জমা করার সুবিধা ছিল।
আমি বক্তৃতার উপসংহারে বলিয়াছিলাম: আপনারা ভূগােলকে অগ্রাহ্য করিবেন না। মনে রাখিবেন ভূগােল ও ইতিহাস যমজ সহােদর। যদি ভূগােলকে আপনারা অস্বীকার করেন, তবে ইতিহাস আপনাদের ক্ষমা করিবে না। মনে রাখিবেন ইতিহাসের পুনরাবর্তন অবশ্যম্ভাবী।
সূত্র: আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (ঢাকা, ১৯৭৫), ৩য় পরিবর্ধিত সংস্করণ, পৃ. ৩৮৬-৯২।
৩২২
পরিশিষ্ট ৩: পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টো ১৯৬৪
(আওয়ামী লীগের ১১-দফা খসড়া ম্যানিফেস্টোর পূর্ণ বিবরণ)
১. রাজনৈতিক আদর্শ
আওয়ামী লীগ গণ প্রতিষ্ঠান। ইহা বিশ্বাস করে যে, রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা জনগণের হাতে এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি কর্তৃক রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা ও কতৃত্ব পরিচালিত হইবে। লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রচিত না হইলে কোন শাসনতন্ত্র জনগণের নিকট গ্রহণযােগ্য হইবে না। এই শাসনতন্ত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, শাসনকার্যে এবং দেশরক্ষা ব্যাপারে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করিবে। পাকিস্তানের সংহতি, স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তা এইরূপ শাসনতন্ত্রের মাধ্যমেই সম্ভব বলিয়া আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে।
রাষ্ট্রের সকল প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের সার্বজনীন ও প্রত্যক্ষ ভােটের মাধ্যমে নির্বাচিত হইবে। ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণী নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিক ১৮ বৎসর বয়সে ভােটাধিকার লাভ করিবে এবং ২১ বৎসর বা তদূর্ধ্ব বয়সের যে কোন ভােটার নির্বাচনপ্রার্থী হইবার অধিকারী হইবে। নির্বাচন স্বাধীনভাবে এবং গােপন ব্যালটভভাটে হইবে।
শাসনতন্ত্রে আইনসভার প্রাধান্য স্বীকৃত হইতে হইবে; এবং বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকিতে হইবে।
২. মৌলিক অধিকার
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পাকিস্তানের প্রতিটি নাগরিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বীকৃত প্রতিটি মৌলিক অধিকার ভােগের অধিকারী। যথা, নাগরিকদের ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু জীবনযাপনের অধিকার ও সুযােগ প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। সকল নাগরিকের মৌলিক প্রয়ােজনীয় খাদ্য, বাসস্থান, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ন্যায়সঙ্গত উপায়ে উপার্জনের ব্যবস্থা থাকিতে হইবে।
আইনের চক্ষে সকলে সমান বলিয়া পরিগণিত হইবে।
৩. ব্যক্তি স্বাধীনতা
পাকিস্তানের প্রতিটি নাগরিককে তাহার জীবনের সর্বক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হইবে—যাহাতে সে স্বীয় প্রতিভা বিকাশের পূর্ণ সুযােগ লাভ করিয়া জাতীয় উন্নতিতে স্বীয় সামর্থ্য অনুসারে অংশগ্রহণ করিতে পারে। মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা, বই-পুস্তক, সংবাদপত্র ও প্রচারপত্র প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা, সমবেত হইবার ও সংগঠন করিবার স্বাধীনতা থাকিতে হইবে। বিনা বিচারে কাহাকেও আটক রাখা চলিবে না।
একমাত্র যুদ্ধকালীন সময় ব্যতীত অন্য কোন সময়ে এই সকল অধিকার খর্ব করা হইবে না।
সর্বোপরি, আওয়ামী লীগ হিন্দু-মুসলিম, বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক ও শ্রেণীগত বিদ্বেষের সম্পূর্ণ বিরােধী এবং ধর্ম, শ্ৰেণী, বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকারে বিশ্বাসী।
৩২৩
৪. অর্থনৈতিক আদর্শ (শিল্প)
আওয়ামী লীগের আদর্শ শােষণহীন সমাজ-ব্যবস্থা কায়েম করা। সমাজতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার মাধ্যমেই বর্তমানের শােষণ, বৈষম্য ও দুর্দশার হাত হইতে মুক্তিলাভ করা সম্ভব বলিয়া আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে।
মূল শিল্পগুলিকে, যথা—খনিজ শিল্প, যুদ্ধের অস্ত্র-সরঞ্জাম শিল্প, বিদ্যুৎ ও রাসায়নিক শিল্পকে জাতীয়করণ করিতে হইবে এবং ইহাদের পরিচালনার ভার রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে গঠিত ও পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপর ন্যস্ত করা হইবে।
ব্যাঙ্ক, বীমা, গুরুত্বপূর্ণ যানবাহন প্রভৃতি প্রত্যক্ষ জনস্বার্থমূলক প্রতিষ্ঠানগুলিকে আবশ্যকবােধে জাতীয়করণ করা হইবে।
শিল্পে ও ব্যবসায়ে কোন প্রকারের একচেটিয়া অধিকার স্বীকার করা হইবে না।
পাকিস্তানে এ যাবৎ কোন সুষ্ঠু শিল্পনীতি কার্যকরী করা হয় নাই। কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদসমূহে পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রায় একচেটিয়া অধিকার ও প্রাধান্য বর্তমান। সরকার ব্যক্তিগত শিল্প ও শিল্পপতিকে সাহায্যের নীতি গ্রহণ করায় উক্ত উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সহানুভূতিতে ও পক্ষপাতিত্বে পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যক্তিগত শিল্প ব্যাপকভাবে গড়িয়া উঠিয়াছে। তদুপরি, পাবলিক সেক্টরেও সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ােজিত হইয়াছে। ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে পর্বতপ্রমাণ বৈষম্য সৃষ্টি হইয়াছে। এই অবস্থার প্রতিরােধ ও প্রতিকারকল্পে এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা করিবার উদ্দেশ্যে শিল্প ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট (Earmarked) অর্থ পাবলিক সেক্টরে নিয়ােজিত করিবার নীতি গ্রহণ করিতে হইবে। এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের উদ্দেশ্যে দুই অর্থনীতির ভিত্তিতে একটা দীর্ঘকালীন ও কার্যকরী পরিকল্পনা গ্রহণ করিতে হইবে।
শিল্প প্রতিষ্ঠায় বিকেন্দ্রীকরণ নীতি গ্রহণ করিতে হইবে।
দেশের বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রয়ােজনীয় সংখ্যক কারিগরি শিক্ষা-কেন্দ্র ও ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান স্থাপন করিয়া ব্যাপক শিল্প প্রসারের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
পাকিস্তানের, বিশেষ করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের মত কৃষিপ্রধান দেশে কুটিরশিল্প প্রসারের প্রয়ােজনীয়তা, উপযােগিতা ও সাফল্য অনস্বীকার্য। সুতরাং কুটিরশিল্পকে সর্বপ্রকার সাহায্য ও উৎসাহ প্রদান করিতে হইবে। দেশের কেন্দ্রে কেন্দ্রে উহা প্রসারের ব্যবস্থা করিতে হইবে। বর্তমানের কুটিরশিল্পগুলিকে এই উদ্দেশ্যে প্রয়ােজনীয় সকল প্রকার সাহায্য করিতে হইবে।
৫. কৃষি ব্যবস্থা
কৃষি উন্নয়নের জন্য যে সব স্বভাবজাত উপাদানের প্রয়ােজন, পাকিস্তান-বিশেষ করিয়া পূর্ব পাকিস্তান সেই সকল উপাদানে ঐশ্বর্যমণ্ডিত। কিন্তু স্বভাবজাত প্রাচুর্যের মধ্যেও এদেশের কৃষকেরা দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে জর্জরিত। এই অবস্থার প্রতিকারের এবং আমাদের কৃষকদের জীবনের মান সুষ্ঠু পর্যায়ে আনয়নের উদ্দেশ্যে এক ব্যাপক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কার্যকরী করিতে হইবে।
সমবায় পদ্ধতিতে আমাদের দেশে চাষাবাদের (Co-operative Cultivation) প্রচলন করিতে হইবে।
পূর্ব পাকিস্তানে প্রতি কৃষকের জমি গড়ে এত ক্ষুদ্র এবং তাহাও এরূপ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে দুভাগ যে, সমবায় পদ্ধতির চাষাবাদ ব্যতীত এখানে কৃষি উন্নয়নের অন্য কোন উপায় নাই। কৃষি ব্যাঙ্কের, কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের এবং অন্যান্য কৃষি ঋণের টাকা কৃষকদিগকে ব্যক্তিগতভাবে বিতরণ না করিয়া সমবায় পদ্ধতির
৩২৪
কৃষির জন্য উহা ব্যয় করা উচিত। ইহার ফলে কৃষকদের প্রধান সমস্যা-মূলধন সমস্যার সমাধান সম্ভব হইবে। সমবায় পদ্ধতিতে কৃষি ব্যবস্থার ফলে আধুনিক কৃষি-যন্ত্রপাতি ক্রয়, উন্নত বীজ ক্রয় এবং উৎপাদিত ফসলের সংরক্ষণ ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা সহজ হইবে।
আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার সর্বপ্রকার যন্ত্রপাতি পূর্ব পাকিস্তানে প্রস্তুত করিবার জন্য কারখানা স্থাপন করিতে হইবে। উন্নত ধরনের বীজ সরবরাহের, জমিতে সার প্রদানের ও সেচ ব্যবস্থার সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করিতে হইবে।
সরকার কর্তৃক পর্যাপ্ত সংখ্যায় আদর্শ ফার্ম (Model Firm) পরিচালিত করিয়া কৃষকদিগকে কৃষি উন্নয়নের আধুনিক পন্থা প্রদর্শন করিতে হইবে। পাট ব্যবসা: পাট ব্যবসা জাতীয়করণ করিতে হইবে। সরকারী তত্ত্বাবধানে গঠিত ও পরিচালিত একটা পাট ক্রয়, পাট রফতানীকারী ও প্রতিষ্ঠানের পর্যাপ্ত সংখ্যক শাখার মাধ্যমে কৃষকদের পাট সরাসরিভাবে খরিদ ব্যবস্থা করিতে হইবে। এই প্রতিষ্ঠানের মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য (Profit Making Motive) থাকিবে না। তবে পাট বিক্রয় ও রফতানীর মাধ্যমে যে মুনাফা দাঁড়াইবে, উহা পাট চাষীদের কল্যাণে এবং পাটজাতদ্রব্য উৎপাদনের গবেষণায় ও শিল্প প্রতিষ্ঠায় ব্যয় করা হইবে। পাট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের যে ব্যবস্থা এতদিন আংশিকভাবে করা হইয়াছিল, তাহা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়াছে। পাট ব্যবসা জাতীয়করণের জন্য একটা সুষ্ঠু ও সামগ্রিক পরিকল্পনার আবশ্যক। উপরােক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রয়ােজনীয় মূলধন থাকিতে হইবে—যাহাতে উহা দেশের সমস্ত পাট ক্রয় করিতে সক্ষম হয়। খাজনা ও কর: সর্বোপরি, কৃষকদের উপর হইতে বিভিন্ন করের বােঝা কমাইতে হইবে। যেসব কৃষকের জমি ২৫ বিঘা বা তন্নিম্নে, তাহাদের জমির উপর অন্তত ২৫ বৎসর কাল কোন কর ধার্য করা হইবে না।।
৬. বন্যানিয়ন্ত্রণ
সাম্প্রতিককালে পাকিস্তানে বন্যা একটা জাতীয় সংকটরূপে দেখা দিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানে বর্ষার শুরুতে উত্তরের নদীপথে বন্যা আসিয়া এক ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি করে; আবার সামদ্রিক বন্যা ও লবণাক্ত পানি চট্টগ্রাম, বরিশাল, নােয়াখালী ও খুলনায় ফসল ধ্বংস করে। বন্যা রােধ করিবার জন্য ক্রুগ মিশনের ও পরবর্তীকালীন উপদেষ্টাদের মতামতের আলােকে একটা সুষ্ঠু ও কার্যকরী পরিকল্পনা মতে সত্বর কাজে হাত দিতে হইবে।
পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু উপত্যকার জলসেচ সমস্যা যেভাবে জাতীয় বিশেষ সমস্যারূপে গৃহীত হইয়াছে, পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা সমস্যাও সেইভাবে জাতীয় বিশেষ সমস্যারূপে গ্রহণ করিয়া এই সমস্যার সমাধান করিতে হইবে।
৭. শ্রমিকদের অধিকার
আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থার (ILO) গৃহীত সুপারিশ ও কনভেনশনের ভিত্তিতে শ্রমিকদের সকল প্রকার। অধিকার ও সুযযাগ-সুবিধামূলক আইন প্রণয়ন করিয়া প্রত্যেক শ্রমিকের সুষ্ঠু জীবন-যাপনের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
প্রত্যেক শ্রমিকের উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করিতে হইবে। তাহাদের চাকুরীর নিরাপত্তা প্রদান করিতে হইবে। শ্রমিকদের ও শ্রমিক পরিবারের জন্য বিনা ভাড়ায় বাসযােগ্য গৃহের বন্দোবস্ত করিতে হইবে। বিনা ব্যয়ে তাহাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে হইবে; পীড়িতকালে শ্রমিকদের পূর্ণ বেতনে ছুটির ব্যবস্থা থাকিবে। পূর্ণ বেতনে বৎসরে অন্তত এক মাস প্রত্যেক শ্রমিকের ছুটির ব্যবস্থা করিতে হইবে।
৩২৫
শ্রমিকদিগকে উন্নত ধরনের কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে। তাহাদের ছেলেমেয়েদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা (মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত) করিতে হইবে।
শ্ৰমিকসংঘ গঠনের ও ধর্মঘট করিবার অধিকার স্বীকার করিতে হইবে। ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য একটা সুষ্ঠু ও ব্যাপক পরিকল্পনা কার্যকরী করিতে হইবে।
৮. শিক্ষা
পাকিস্তানের প্রত্যেক নাগরিকের শিক্ষার অধিকারকে বাস্তব রূপ দানের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করিতে হইবে; মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এরূপ ব্যাপকভাবে প্রসারিত ও এরূপ সহজলভ্য ও সুলভ করিতে হইবে যাহাতে প্রতিটি দরিদ্র নাগরিকের ছেলেমেয়েও এই শিক্ষা লাভের সুযােগ গ্রহণ করিতে পারে।
যুগের ও দেশের চাহিদানুসারে কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক প্রসার করিতে হইবে, এই জন্য দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের এবং বিদেশে ট্রেনিং প্রাপ্তির ব্যবস্থা করিতে হইবে।
বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানরূপে বাস্তব স্বীকৃতি প্রদান করিতে হইবে। একজন সুপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষাবিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর থাকিবেন। সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ হস্তক্ষেপের ফলে বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেসব দমনমূলক আইন প্রবর্তন করা হইয়াছে, সেইসব বাতিল করিতে হইবে।
৯. বাংলা ভাষা
শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করিতে হইবে এবং পাকিস্তানের সরকারী ও বেসরকারী সকল প্রতিষ্ঠানে ও কার্যে বাংলা ভাষা চালু করিতে হইবে।
১০. মােহাজের
বাস্তহারা মােহাজেরদের স্থায়ী পুনর্বাসনের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক উপ-শহর (Satellite Towns) স্থাপন করিতে হইবে এবং মােহাজেরদের কর্মসংস্থানের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ছােট-বড় শিল্প সত্বর গড়িয়া তুলিতে হইবে। এই উদ্দেশ্য কার্যকরী করিবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে একটা ব্যাপক পরিকল্পনা সত্বর কার্যকরী করিতে হইবে।
১১. বৈদেশিক সম্পর্ক
সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব, হিংসা কারাে বিরুদ্ধে নহে (Friendship to all, Malic to non) আওয়ামী লীগ বৈদেশিক সম্পর্কে এই নীতিতে বিশ্বাস করে।
বিশ্ব শান্তির প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগ সহযােগিতা প্রদান করিবে। বৈদেশিক সম্পর্ক অনড় (Static) থাকিতে পারে না, উহা সচল ও পরিবর্তন সাপেক্ষ (Dynamic) এই সত্য উপলব্ধি করিয়া আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাস্তববাদে বিশ্বাসী। তবে বৈদেশিক সম্পর্কের ব্যাপারে পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও মর্যাদার দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাধীননীতি গ্রহণে আওয়ামী লীগ বিশ্বাসী।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক (ঢাকা), জুন ৬, ১৯৬৪।
৩২৬
পরিশিষ্ট ৪: স্বভাবকবি রয়হান বয়াতী রচিত: “ভােটের গান”
বাক্স ভইরা ট্যাক্সো দিব, ভােটের বেলা নাই
জোট কইরাছি ভােট দেব ভাই নয়-দফায়
ভােট দেব না তাদের যারা
সাত টাকাতে তেল খাওয়ায়।
দুঃখের কথা বলব কত
আমার দুঃখ শত শত
দিবানিশি খাটি তবু
তেল আনিতে নুন ফুরায়।।
ডাল পিঁয়াজের পাঁচসিকা সের
গিন্নি করে গােসা
মাছ কিনিতে পাইছি ভাইরে
চিঙ্গইর মাছের খােসা।
বলুম কত এদের নামে
সকল কিনি ডবল দামে
তবু, আছি যেন স্বর্গ ধামে
দালালেরা তাই শােনায়।।
চাউলের কথা বলব কি ভাই
পাটের কথাই কই।
এই পাটের রশি গলায় দিয়া
গাছে ঝুইলা রই।
তাঁতীরা সব মরছে ভাতে
কি আসে যায় বল তাতে
মিল মালিকের ট্যাক্স হলিডে
হইছে খােদার খাসি প্রায়।।
আমার দেশের গরিব চাষীর
খাজনা না হয় মাফ।
উঠতে বসতে ছােবল মারে
ট্যাক্সের জাতি সাপ।
৩২৭
সার্টিফিকেট করেন জারি
নিলাম করে ঘর
ও বাড়ি ওরে ট্যাক্স দিতে রসিদ নিতে
ঘুষ লাগে ভাই সব জাগায় ।।
কর্তা অইছে দালালেরা
গিয়া বাড়ি বাড়ি।
হুকুম দখল করেন সবার
যত ঘােড়া-গাড়ি।
আনব মানুষ তাতেই চড়ে
ইসৃপিশাল টেরেন ঠিক যে করে
তবু খালি ময়দান থাকে পড়ে
লক্ষ লােকের ঢাক পিটায়।।
এরা মিলের মজুর কইরা ভাড়া
আইনা করে জড়।
গাঁয়ের মানুষ ধইরা নিয়া
সভা করে বড়।
বলব কি সেই সভার পরে
কর্তারা সব পড়েন সরে
শেষে ভাড়ার মানুষ পায় না ভাড়া
ভাত খাবে কি বাড়ি যায়।।
আমার ক্ষ্যাতে ভাইরে যখন
নােনাপানি আসে,
সােনার ফসল যখন আমার
বানের জলে ভাসে,
দেশদরদী লীগের নেতা
তখন তিনি কন না কথা
আর মরুভূমির নুন সরাইতে
সবার আগে সে যে ধায়।।
এই মরুভূমি করতে আবাদ
বানছে নতুন বাঁধ।
পিণ্ডিতে দেয় টাকার পাহাড়
নাম ইসলামাবাদ।
বলব কি আর নগরবাসী
মমাদের কান্না ছাড়া নাইরে হাসি
৩২৮
ওরে আমরা যখন বানে ভাসি
হয় না টাকা তার বেলায়।
যেই ভাষাতে বােল বলি
করি কাঁদা হাসা।
মােরা বুকের লহু দিয়া রাখছি
সেই না মুখের ভাষা।
এখন তারা নানান ছলে
আরবী উর্দুর কথা বলে
দোষ নাহি ইংরেজি বােলে
যত জ্বালা এ বাংলায়।।
তােমার আমার ভােট নাহি ভাই
কেমন কুটিল মন্ত্র।
কর্তা ইচ্ছা কীর্তন হবে
আজব গণতন্ত্র।
কইতে না পাই মনের কথা
নাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
সবখানে অরাজকতা
ইচ্ছামত আইন বানায়।
আমি বাক্সো ভইরা ট্যাক্সো দিব
ভােটের বেলা নাই।
এমন আজব কথা কেহ কোথা
শুনছনিরে ভাই।
ভােটাধিকার পাইব যেদিন
ট্যাক্সো মােরা দেব সেদিন
ঢালী ঢুলী কিষান কুলি
এই কথা আজ কইয়া যাই।।
ইস্কুলে, মিলে মাস্টার শ্রমিক
করতেছে হরতাল
শুধু দুই বেলা চায় পেট ভরিয়া
খাইতে ভাত ও ডাল।।
গুণ্ডা পুলিশ আইনা পরে
শিক্ষক শ্রমিক দমন করে
আরাে সমন জারি করে।
ভইর্যা রাখে জেলখানায় ।।
৩২৯
ফাতেমাকে ভােট না দিলে
বইলা দিলাম ভাই
জন্মের মত আশার মুখে
পড়বে তােদের ছাই।
তাই সবারে করি মানা
ওদের স্বরূপ আছে জানা
ওরাই তারা ভাইরে যারা
মানুষেগােরে গরু ঠাওরায়।।
সূত্র: অমিতাভ গুপ্ত, বাংলাদেশ, নতুন সংস্করণ, কলিকাতা, জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭৮, পৃ. ২৯৪-৯৯।
৩৩০
পরিশিষ্ট ৫: ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে ছাত্রদের এগারাে দফা
সংগ্রামী ছাত্র সমাজের ডাক এগার দফার দাবীতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়িয়া তুলুন
স্বৈরাচারী সরকারের দীর্ঘ দিনের অনুসৃত জনস্বার্থবিরােধী নীতির ফলেই ছাত্র সমাজ ও দেশবাসীর জীবনে সংকট ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাইয়া চলিয়াছে। শাসনে-শােষণে অতিষ্ঠ হইয়া ছাত্র-জনতা ছাত্র-গণআন্দোলনের পথে আগাইয়া আসিয়াছেন।
আমরা ছাত্র সমাজ ও দেশবাসীর স্বার্থে নিম্নোক্ত ১১-দফার দাবীতে ব্যাপক ছাত্র-গণআন্দোলনের আহ্বান জানাইতেছি:
১. ক) সচ্ছল কলেজসমূহকে প্রাদেশিকীকরণের নীতি পরিত্যাগ করিতে হইবে এবং জগন্নাথ কলেজসহ প্রাদেশিকীকরণকৃত কলেজসমূহকে পূর্বাবস্থায় ফিরাইয়া দিতে হইবে।
খ) শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্য প্রদেশের সর্বত্র বিশেষ করিয়া গ্রামঞ্চলে স্কুল-কলেজ স্থাপন করিতে হইবে এবং বেসরকারী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল-কলেজসমূহকে সত্বর অনুমােদন দিতে হইবে। কারিগরী শিক্ষা প্রসারের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, পলিটেকনিক, টেকনিক্যাল ও কমার্সিয়েল ইনষ্টিটিউট স্থাপন করিতে হইবে।
গ) প্রদেশের কলেজসমূহে দ্বিতীয় শিফটে নৈশ আই, এ; আই, এসসি; আই, কম, ও বি, এ; বি, এসসি; বি, কম, এবং প্রতিষ্ঠিত কলেজসমূহে নৈশ এম, এ, ও এম, কম, ক্লাস চালু করিতে হইবে।
ঘ) ছাত্র বেতন শতকরা ৫০ ভাগ হাস করিতে হইবে। স্কলারশীপ ও ষ্টাইপেণ্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি করিতে হইবে এবং ছাত্র আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করার অপরাধে স্কলারশীপ ও ষ্টাইপেণ্ড কাড়িয়া লওয়া চলিবে না।
ঙ) হল, হােস্টেলের ডাইনিং হল ও কেন্টিন খরচের শতকরা ৫০ ভাগ সরকার কর্তৃক ‘সাবসিডি’ হিসাবে প্রদান করিতে হইবে।
চ) হল ও হােস্টেল সমস্যার সমাধান করিতে হইবে।
ছ) মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে। অফিস আদালতে বাংলা ভাষা চালু করিতে হইবে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত সংখ্যক অভিজ্ঞ শিক্ষকের ব্যবস্থা করিতে হইবে। শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধি করিতে হইবে এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার দিতে হইবে।
জ) অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করিতে হইবে। নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার করিতে হইবে।
ঝ) মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিতে হইবে এবং অটোমেশন প্রথা বিলােপ, নমিনেশনে ভর্তি প্রথা বন্ধ, মেডিকেল কাউন্সিল অর্ডিনেন্স বাতিল, ডেন্টাল কলেজকে পূর্ণাঙ্গ কলেজে
৩৩১
পরিণত করা প্রভৃতি মেডিকেল ছাত্রদের দাবী মানিয়া লইতে হইবে। নার্স ছাত্রীদের সকল দাবী মানিয়া লইতে হইবে।
ঞ) প্রকৌশল শিক্ষার অটোমেশন প্রথা বিলােপ, ১০% ও ৭৫% রুল বাতিল, সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর সুব্যবস্থা, প্রকৌশল ছাত্রদের শেষবর্ষেও ক্লাস দেওয়ার ব্যবস্থাসহ সকল দাবী মানিয়া লইতে হইবে।
ট) পলিটেকনিক ছাত্রদের কনডেন্স কোর্সের সুযােগ দিতে হইবে এবং বাের্ড ফাইনালে পরীক্ষা বাতিল করিয়া একমাত্র সেমিষ্টার পরীক্ষার ভিত্তিতেই ডিপ্লোমা দিতে হইবে।
ঠ) টেক্সটাইল, সিরামিক, লেদার টেকনােলজি এবং আর্ট কলেজ ছাত্রদের সকল দাবী অবিলম্বে মানিয়া লইতে হইবে। আই, ই, আর, ছাত্রদের দশ-দফা; সমাজ কল্যাণ কলেজ ছাত্রদের, এম, বি, এ, ছাত্রদের ও আইনের ছাত্রদের সমস্ত দাবী মানিয়া লইতে হইবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগকে আলাদা “ফ্যাকাল্টি করিতে হইবে।
ড) কৃষি বিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রদের ন্যায্য দাবী মানিয়া লইতে হইবে। কৃষি ডিপ্লোমা ছাত্রদের কনডেন্স কোর্সের দাবীসহ কৃষি ছাত্রদের সকল দাবী মানিয়া লইতে হইবে।
ঢ) ট্রেনে, ষ্টিমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের আইডেন্টিটি কার্ড’ দেখাইয়া শতকরা পঞ্চাশ ভাগ কন্সেসনে টিকেট দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে। মাসিক টিকিটেও এই কন্সেসনে’ টিকেট দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে। মাসিক টিকিটেও এই কন্সেসন’ দিতে হইবে। পশ্চিম পাকিস্তানের মত বাসে ১০ পয়সা ভাড়ায় শহরের যে কোন স্থানে যাতায়াতের ব্যবস্থা করিতে হইবে। দূরবর্তী অঞ্চলে বাস যাতায়াতেও শতকরা ৫০ ভাগ কন্সেসন’ দিতে হইবে। ছাত্রীদের স্কুলকলেজে যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা করিতে হইবে। সরকারী ও আধা-সরকারী উদ্যোগে আয়ােজিত খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছাত্রদের শতকরা ৫০ ভাগ কন্সেসন’ দিতে হইবে।
ণ) চাকুরীর নিশ্চয়তা বিধান করিতে হইবে।
ত) কুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স সম্পূর্ণ বাতিল করিতে হইবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হইবে।
থ) শাসকগােষ্ঠীর শিক্ষা সংকোচন নীতির প্রামাণ্য দলিল জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপাের্ট ও হামুদুর রহমান কমিশন রিপোের্ট সম্পূর্ণ বাতিল করিতে এবং ছাত্রসমাজ ও দেশবাসীর স্বার্থে গণমুখী ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করিতে হইবে।
২. প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। বাক-স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিতে হইবে। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করিতে হইবে।
৩. নিম্নলিখিত দাবীসমূহ মানিয়া লইবার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হইবে: ক) দেশের অশাসনতান্ত্রিক কাঠামাে হইবে ফেডারেশন শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্রসংঘ এবং আইন পরিষদের ক্ষমতা হইবে সার্বভৌম।
৩৩২
খ) ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা এই কয়টি বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকিবে। অপরাপর সকল বিষয়ে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা হইবে নিরঙ্কুশ।
গ) দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকিবে। এই ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে। কিন্তু এই অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যে, যাহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতে না পারে। এই বিধানে পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকিবে। দুই অঞ্চলে দুইটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকিবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক অর্থনীতি প্রবর্তন করিতে হইবে।
ঘ) সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, কর ধার্য ও আদায়ের সকল ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের কোন কর ধার্য করিবার ক্ষমতা থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভিনিউর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে জমা হইবে। এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাঙ্কসমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রে থাকিবে।
ঙ) ফেডারেশনের প্রতিটি রাষ্ট্র বহিঃবাণিজ্যের পৃথক হিসাব রক্ষা করিবে এবং বহিঃবাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত মুদ্রা অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির এক্তিয়ারাধীন থাকিবে। ফেডারেল সরকারের প্রয়ােজনীয় বিদেশী মুদ্রা অঙ্গ রাষ্ট্রগুলি সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রের নির্ধারিত ধারা অনুযায়ী প্রদান করিবে। দেশজাত দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির মধ্যে আমদানী-রপ্তানী চলিবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে বিদেশী রাষ্ট্রগুলির সাথে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানী-রপ্তানী করিবার অধিকার অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির হাতে ন্যস্ত করিয়া শাসনতন্ত্রে বিধান করিতে হইবে।
চ) পূর্ব পাকিস্তানকে মিলিশিয়া বা প্যারা মিলিটারী রক্ষী বাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা নির্মাণ ও নৌবাহিনীর সদর দফতর হইবে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা নির্মাণ ও নৌবাহিনীর সদর দফতর স্থাপন করিতে হইবে।
৪. পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধুসহ সকল প্রদেশের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতঃ সাব-ফেডারেশন গঠন।
৫. ব্যাঙ্ক-বীমা, পাট ব্যবসা ও বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ করিতে হইবে।
৬. কৃষকের উপর হইতে খাজনা ও ট্যাক্সের হার হ্রাস করিতে হইবে এবং বকেয়া খাজনা ও ঋণ মওকুফ করিতে হইবে। সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল ও তহশিলদারদের অত্যাচার বন্ধ করিতে হইবে। পাটের সর্বনিম্ন মূল্য মণ প্রতি ৪০ টাকা নির্ধারণ এবং আখের ন্যায্য মূল্য দিতে হইবে।
৭. শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরী বােনাস দিতে হইবে এবং শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদির ব্যবস্থা করিতে হইবে। শ্রমিক স্বার্থ বিরােধী কালাকানুন প্রত্যাহার করিতে হইবে এবং ধর্মঘটের অধিকার ও ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার প্রদান করিতে হইবে।
৮. পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জল সম্পদের সার্বিক ব্যবহারের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
৯. জরুরী আইন প্রত্যাহার, নিরাপত্তা আইন ও অন্যান্য নিবর্তনমূলক আইন প্রত্যাহার করিতে হইবে।
১০. সিয়াটো, সেন্টো, পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল করিয়া জোটবহির্ভূত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি কায়েম করিতে হইবে।
৩৩৩
১১. দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক সকল ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, রাজনৈতিক কর্মী ও নেতৃবৃন্দের অবিলম্বে মুক্তি, গ্রেফতারী পরােয়ানা ও হুলিয়া প্রত্যাহার এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ সকল রাজনৈতিক কারণে জারিকৃত মামলা প্রত্যাহার করিতে হইবে ।
সংগ্রামী ছাত্র সমাজের পক্ষে:
আবদুর রউফ
সভাপতি
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ
খালেদ মােহাম্মদ আলী
সাধারণ সম্পাদক
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ
সাইফুদ্দিন আহমেদ
সভাপতি
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন
সামসুদ্দোহা
সাধারণ সম্পাদক
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন
মােস্তফা জামাল হায়দার
সভাপতি
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন
দীপা দত্ত
সহ-সম্পাদিকা
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন
তােফায়েল আহমেদ
সহ-সভাপতি ডাকসু
নাজিম কামরান চৌধুরী
সাধারণ সম্পাদক
ডাকসু
সূত্র: ছাত্র সমাজের প্রচার পত্র, তারিখ: জানুয়ারী, ১৯৬৯।
৩৩৪
পরিশিষ্ট ৬: সােনার বাঙলা শ্মশান কেন?
১৯৭০-এ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের একটি প্রচারপত্র*
বৈষম্য বিষয় বাঙলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তান
রাজস্ব খাতে ব্যয়
উন্নয়ন খাতে ব্যয়
বৈদেশিক সাহায্য
বৈদেশিক দ্রব্য আমদানী
কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরী
সামরিক বিভাগে চাকুরী
চাউল মণ প্রতি
আটা মণ প্রতি
সরিষার তৈল সের প্রতি
স্বর্ণ প্রতি ভরি
১৫০০ কোটি টাকা
৩০০০ কোটি টাকা
শতকরা ২০ ভাগ
শতকরা ২৫ ভাগ
শতকরা ১৫ জন
শতকরা ১০ জন
৫০ টাকা
৩০ টাকা
৫ টাকা
১৭০ টাকা
৫০০০ কোটি টাকা
৬০০০ কোটি টাকা
শতকরা ৮০ ভাগ
শতকরা ৭৫ ভাগ
শতকরা ৮৫ জন
শতকরা ৯০ জন
২৫ টাকা
১৫ টাকা
২.৫০ পয়সা
১৩৫ টাকা
* পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নির্বাচনী প্রচার দপ্তর থেকে আবদুল মমিন কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত।
পরিশিষ্ট ৭: আওয়ামী লীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ কর্তৃক ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত জনসভায় গৃহীত শপথের পাঠ
আমরা—জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় নবনির্বাচিত সদস্যবৃন্দ—শপথ গ্রহণ করছি পরম করুণাময় ও সর্বশক্তিমান আল্লাহতালার নামে; আমরা শপথ গ্রহণ করছি সেই সব বীর শহীদের ও সংগ্রামী মানুষের নামে যারা আত্মাহুতি দিয়ে ও চরম নির্যাতন-নিপীড়ন ভােগ করে আজ আমাদের প্রাথমিক বিজয়ের সূচনা করেছেন; আমরা শপথ গ্রহণ করছি এই দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মেহনতী মানুষ তথা সর্ব শ্রেণীর জনসাধারণের নামে: জাতীয় সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে এই দেশের আপামর জনসাধারণ আওয়ামী লীগের কর্মসূচী ও নেতৃত্বের প্রতি যে বিপুল সমর্থন ও অকুণ্ঠ আস্থা জ্ঞাপন করেছেন তার মর্যাদা রক্ষাকল্পে আমরা সর্বশকতি নিয়ােগ করবাে।
ছয় দফা ও এগার দফা কর্মসূচীর উপর প্রদত্ত গণরায়ের প্রতি আমরা একনিষ্ঠরূপে বিশ্বস্ত থাকবাে এবং শাসনতন্ত্রে ও বাস্তব প্রয়ােগে ছয় দফা কর্মসূচী ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন ও এগার দফা কর্মসূচীর প্রতিফলন ঘটাতে সর্বশকতি প্রয়ােগ করবাে।
আওয়ামী লীগের নীতি, আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচীর প্রতি অবিচল আনুগত্য জ্ঞাপনপূর্বক আমরা অঙ্গীকার করছি যে অঞ্চলে অঞ্চলে ও মানুষে মানুষে বিরাজমান চরম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের চির অবসান ঘটিয়ে শােষণমুকত এক সুধী সমাজের বুনিয়াদ গড়ার এবং অন্যান্য অবিচার বিদূরিত করে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবাে।
জনগণ অনুমােদিত আমাদের কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির প্রয়াসী যে কোন মহল অশুভ শকতির বিরুদ্ধে আমরা প্রবল প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তুলবাে এবং সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে যে কোনরূপে ত্যাগ স্বীকার করতঃ আপােষহীন সংগ্রামের জন্যে আমরা সর্বদা প্রস্তুত থাকবাে।
আল্লা আমাদের সহায় হােন।
জয় বাংলা।
জয় পাকিস্তান।
সূত্র: দৈনিক পাকিস্তান (ঢাকা, ৪ জানুয়ারী, ১৯৭১)।
৩৩৬
পরিশিষ্ট ৮: ঢাকায় ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় পঠিত স্বাধীন বাঙলা
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ইস্যুকৃত ইশতেহারের পাঠ
ইশতেহার নং/এক
জয় বাংলা
(স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলাদেশের ঘােষণা ও কর্মসূচী)
স্বাধীন ও সার্বভৌম বাঙলাদেশ ঘােষণা করা হয়েছে। গত তেইশ বছরের শােষণ, কুশাসন ও নির্যাতন একথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত করেছে যে, সাত কোটি বাঙালীকে গােলামে পরিণত করার জন্যে বিদেশী পশ্চিমা উপনিবেশবাদীদের যে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র তা। থেকে বাঙালীর মুক্তির একমাত্র পথ স্বাধীন জাতি হিসেবে স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিক হয়ে বেঁচে থাকা। গত নির্বাচনের গণরায়কে বানচাল করে শেষবারের মতাে বিদেশী পশ্চিমা শােষকরা সে কথার প্রয়ােজনীয়তা হাড়ে হাড়ে প্রমাণ করেছে।
৫৪ হাজার ৫ শত ৭৩ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগলিক এলাকার ৭ কোটি মানুষের জন্যে আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম ‘বাঙলাদেশ। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাঙলাদেশ’ গঠনের মাধ্যমে নিম্নলিখিত তিনটি লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।
(১) স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ’ গঠন করে পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙালী জাতি সৃষ্টি ও বাঙালীর ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
(২) স্বাধীন ও সার্বভৌম বাঙলাদেশ’ গঠন করে অঞ্চলে-অঞ্চলে ও ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে বৈষম্য নিরসন করে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করে কৃষক শ্রমিক রাজ কায়েম করতে হবে।
(৩) স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলাদেশ’ গঠন করে ব্যক্তি, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সহ নির্ভেজাল গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে।
বাঙলার স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্যে নিম্নলিখিত কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে।
(ক) বাঙলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, মহল্লা, থানা, মহকুমা, শহর ও জেলায় স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটি গঠন করতে হবে।
(খ) সকল শ্রেণীর জনসাধারণের সহযােগিতা কামনা ও তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
(গ) শ্রমিক এলাকায় শ্রমিক ও গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের সুসংগঠিত করে গ্রামে-গ্রামে, এলাকায়-এলাকায় মুক্তিবাহিনী গঠন করতে হবে।
(ঘ) হিন্দু-মুসলমান ও বাঙালী-অবাঙালী সাম্প্রদায়িক মনােভাব পরিহার করতে হবে এবং সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে।
(ঙ) স্বাধীনতা সংগ্রামকে সুশৃঙ্খলতার সাথে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে পারস্পরিক যােগাযােগ রক্ষা করতে হবে এবং লুটতরাজ সহ সকল প্রকার সমাজবিরােধী ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে।
৩৩৭
স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারা নিম্নরূপ হবে ।
(অ) বর্তমান সরকারকে বিদেশী উপনিবেশবাদী শােষক সরকার গণ্য করে এ বিদেশী সরকারের ঘােষিত সকল আইনকে বেআইনী বিবেচনা করতে হবে।
(আ) তথাকথিত পাকিস্তানের স্বার্থের তল্পীবাহী পশ্চিমা অবাঙালী মিলিটারীদেরকে বিদেশী ও হামলাকারী শত্রু সৈন্য হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং এ হামলাকারী শত্রু সৈন্যকে খতম করতে হবে।
(ই) বর্তমান বিদেশী উপনিবেশবাদী শােষক সরকারকে সকল প্রকার ট্যাক্স-খাজনা দেয়া বন্ধ করতে হবে।
(ঈ) স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের উপর আক্রমণরত যে কোনও শক্তিকে প্রতিরােধ, প্রতিহত, পাল্টা আক্রমণ ও খতম করার জন্যে সকল প্রকার সশস্ত্র প্রস্তুতি নিতে হবে।
(উ) বৈজ্ঞানিক ও গণমূখী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে সকল প্রকার সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।
(উ) স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে আমার সােনার বাঙলা আমি তােমায় ভালবাসি …’ সংগীতটি ব্যবহৃত হবে।
(ঋ) শােষক রাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানী দ্রব্য বর্জন করতে হবে এবং সর্বাত্মক অসহযােগ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
(এ) উপনিবেশবাদী পাকিস্তানী পতাকা পুড়ে বাঙলাদেশের জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে হবে।
(ঐ) স্বাধীনতা সগ্রামের বীর সেনানীদের সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযােগীতা প্রদান করে বাঙলার স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ুন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাঙলাদেশের সর্বাধিনায়ক।
স্বাধীনতা ও সার্বভৌম বাংলাদেশ’ গঠন আন্দোলনের এ পর্যায়ে নিম্নলিখিত জয়ধ্বনি ব্যবহৃত হবে—
• স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলাদেশ’ দীর্ঘজীবী হউক।
• স্বাধীন কর স্বাধীন করবাঙলাদেশ স্বাধীন কর।
• স্বাধীন বাঙলার মহান নেতা-বংগবন্ধু শেখ মুজিব।
• গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়—মুক্তিবাহিনী গঠন কর।
• বীর বাঙালী অস্ত্র ধর—বাঙলাদেশ স্বাধীন কর।
• মুক্তি যদি পেতে চাও—বাঙালীরা এক হও।
বাঙলা ও বাঙালীর জয় হােক
জয় বাঙলা।
স্বাধীন বাঙলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।।