This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
আওয়ামী লীগ ১৯৪৯–১৯৭১
শ্যামলী ঘোষ
মুখবন্ধ
এই গ্রন্থটি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়ের ইতিহাস সম্পর্কিত। জন্মলগ্নে এই দলটির নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, পরে এর নামকরণ করা হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপের পরিণতিতে এই দল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করে এবং দলটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নামে পুনর্গঠিত হয়। বলাবাহুল্য, কৌশলগতভাবে ১৯৫১ সাল থেকে পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের ভিন্নমতাবলম্বী মুসলিম লীগারদের দ্বারা গঠিত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক শাখা ছিল।
এই গবেষণাকর্মের মাধ্যমে আমি দক্ষিণ এশিয়ার এমন একটি রাজনৈতিক দলের কার্যপদ্ধতিকে বােঝার প্রয়াস পেয়েছি যে-দল নীতি ও কর্মসূচি এবং সাংগঠনিক কাঠামাে উভয় ক্ষেত্রেই উদারপন্থী গণতন্ত্রমনা হওয়া সত্ত্বেও এমন ধরনের দৃশ্যত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে এর কার্যক্রম পরিচালনা করেছে যে-রাষ্ট্রব্যবস্থায় অঞ্চলগুলাের মধ্যে সামঞ্জস্যহীন সম্পর্ক ও বড় রকমের বৈষম্য বিদ্যমান ছিল। এই গ্রন্থের আলােচনা থেকে এ কথা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হবে যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সেই গণতান্ত্রিক মূল্যবােধকে সর্বদা সমুন্নত রেখেছে যে-মূল্যবােধ সাম্রাজ্যবাদবিরােধী আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকেই দক্ষিণ এশীয় রাজনৈতিক সচেতনতাকে বদ্ধমূল তথা অন্তর্নিবিষ্ট করেছে। ঠিক এই কারণেই ব্রিটিশ রাজত্বকালে বাংলায় সামাজিক-রাজনৈতিক অগ্রগতির মূল জটিলতা দ্বারা ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রিত পূর্ব পাকিস্তানের দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনীতিতে ক্রিয়াশীল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দলীয় অভ্যন্তরীণ বিভেদ ও বিভিন্ন দলের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযােগিতা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কীভাবে এই জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয় এবং এই প্রক্রিয়ায় ছাত্রদের অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আমার এই গবেষণাকর্মের উল্লেখযােগ্য প্রতিপাদ্য বিষয়।
faggore fulgt anlage Gall “The East Pakistan Awami League, 1958-1971” শীর্ষক যে অভিসন্দর্ভটি আমি রচনা করি বর্তমান গ্রন্থটি তারই বিস্তৃতরূপ। ভারতের নয়াদিল্লিস্থ জওয়াহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে উক্ত ডিগ্রি প্রদান করে।
প্রফেসর মােহাম্মদ আইয়ুব আমার অভিসন্দর্ভ প্রণয়নের কাজে আমাকে যে পরামর্শ ও নির্দেশনা প্রদান করেছেন সে কথা আমি সকৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি এবং এ জন্য তাঁকে জানাই আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। বাংলাদেশে ছয় মাসব্যাপী সরেজমিনে নিবিড় ও আনুপুঙ্খিক গবেষণাকর্ম পরিচালনার জন্য জওয়াহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব সােস্যাল সায়েন্স রিসার্চ কর্তৃক প্রদত্ত অর্থ মঞ্জুরি আমার কাজে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে। এ জন্য আমি এই দুই প্রতিষ্ঠানকে ধন্যবাদ জানাই। বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট মহলসমূহের ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকার ও আলােচনা আমাকে বিষয়ের গভীরে যেতে অনুপ্রাণিত করেছে এবং এ জন্য আমি তাঁদের কাছে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। আমার অভিসন্দর্ভ এবং পরে এই গ্রন্থ প্রণয়নের সময় ভারত ও বাংলাদেশে বসবাসরত আমার বন্ধু, সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ী এবং সর্বোপরি আমার পরিবারের সদস্যদের উৎসাহ, সহযােগিতা ও সাহায্যের কারণে আমি অনেক বৈরী ও প্রতিকূল পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। আমি নিশ্চিত যে এঁরা সকলেই আমার আন্তরিক অনুভূতির কথা ব্যক্তিগতভাবেই জানেন এবং এ কারণে এখানে তাঁদের সকলের নাম উল্লেখ না করলেও তারা মনে কিছু নেবেন না। আমি অবশ্য প্রফেসর কলিন ক্লার্ক, প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক, প্রফেসর তালুকদার মনিরুজ্জামান, প্রফেসর আর. আই. চৌধুরী, প্রফেসর কে, এম. মহসীন, প্রফেসর বিমল প্রসাদ, প্রফেসর ইন্দ্রনাথ মুখার্জী এবং প্রয়াত প্রফেসর মফিজুল্লাহ কবীর ও প্রয়াত প্রফেসর শিশির গুপ্ত-এর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে এখানে উল্লেখ করতে চাই।
ঢাকা, রাজশাহী এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের গ্রন্থাগার ব্যবহার করতে দিয়ে ও অন্যান্য সুযােগ-সুবিধা প্রদান করে আমাকে সাহায্য করায় আমি এঁদের কাছে ঋণী। এ ছাড়া, আমার গবেষণাকাজে সাহায্য-সহযােগিতা প্রদানের জন্য ঢাকাস্থ বাংলা একাডেমী, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, বাংলাদেশ আর্কাইভস্, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, রাজশাহীর ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ এবং খুলনার পাবলিক লাইব্রেরির কাছেও আমি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। এ প্রসঙ্গে ভারতের ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড অ্যাফায়ার্স লাইব্রেরি ও জওয়াহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের কথা আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই।
গ্রন্থটি মুদ্রণকালে ধৈর্যসহকারে প্রুফ সংশােধনের গুরু দায়িত্ব পালন করার জন্য আমি প্রফেসর নুরুল মােমেনকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। টাইপকৃত ঝকঝকে পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দেয়ার জন্য আমি মি. চাঁদ নারায়ণ শর্মাকেও জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।
পরিশেষে, আমি বিনীতভাবে উল্লেখ করতে চাই যে রাজনৈতিক দল সম্পর্কিত কোন সাধারণ তত্ত্ব না থাকায় এবং লভ্য ধারণাগত/বিশ্লেষণধর্মী ব্যবস্থা বা কাঠামাে অসম্পূর্ণ, অতিসরলীকৃত বা অযৌক্তিক হওয়ায় আমি সেগুলাে কেবল বাহ্যিক কারণে ব্যবহার করিনি। রাজনৈতিক দলগুলাে সুনির্দিষ্ট সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা থেকে গড়ে ওঠে এবং আমি মনে করি এ জন্য উপনিবেশ-উত্তর তৃতীয় বিশ্ব সমাজে লব্ধ অভিজ্ঞতার ভিত্তিনির্ভর দেশজ কাঠামাের প্রয়ােজন রয়েছে। কারণ এরূপ সমাজে রাজনৈতিক দলগুলাে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দৃশ্যত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়ে থাকে। আমি আশা করি, আওয়ামী লীগ সম্পর্কিত আমার গবেষণাকর্ম এ সব দলকে বােঝার (যা যে কোন কাঠামাের ভিত্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়) ক্ষেত্রে প্রয়ােজনীয় সূচক হিসেবে কাজ করবে।
শ্যামলী ঘােষ
জওয়াহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়
নয়াদিল্লি, ভারত এপ্রিল ১৯৯০
বাংলা সংস্করণের ভূমিকা
আমি আনন্দিত যে আমার লেখা ও ১৯৯০ সালে ঢাকার একাডেমিক পাবলিশার্স প্রকাশিত “The Awami League 1949-1971” গ্রন্থটির বঙ্গানুবাদ দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড প্রকাশ করছে।
গ্রন্থটির বঙ্গানুবাদের জন্য বাংলাদেশের গবেষক ও পাঠকদের আগ্রহ আমার জানা ছিল। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে এ বিষয়ে আমি কোনাে পদক্ষেপ নেবার কথা ভাবিনি। কয়েক বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডালেমচন্দ্র বর্মণ আমাকে চিঠি লিখে জানান যে ঢাকাস্থ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চের মহাপরিচালক মােনায়েম সরকার মহাশয় বাংলা একাডেমীর সাবেক পরিচালক মি. হাবীব-উল-আলম দ্বারা গ্রন্থটির অনুবাদের উদ্যোগ নিয়ে আমার সম্মতির জন্য যােগাযােগ করার চেষ্টা করছেন। এর পরপরই বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতির আমন্ত্রণে আমি রাজশাহী যাই। ফেরার পথে মােনায়েম সরকার মহাশয়ের আমন্ত্রণে ঢাকায় কয়েকদিন থাকি। তখন সরকার মহাশয় এবং ফাউন্ডেশনের অন্যতম পরিচালক আশফাক-উল-আলম মহাশয়ের সঙ্গে এবং হাবীব-উল-আলম মহাশয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। এঁদের সঙ্গে ইংরেজি পাঠের প্রয়ােজনীয় সংশােধন, পরিমার্জন ইত্যাদি বিষয়ে আলােচনা হয়। বাংলা একাডেমীর তৎকালীন মহাপরিচালক প্রফেসর সৈয়দ আনােয়ার হােসেন এবং ঢাকাস্থ অন্যান্য বিদ্বজ্জন বন্ধুদের সঙ্গে আলােচনার পর আমি উক্ত অনুবাদ উদ্যোগের পক্ষে সম্মতি জানাই এই মৌখিক শর্তে যে অনুবাদটি কোনাে মর্যাদাসম্পন্ন প্রকাশক দ্বারাই প্রকাশিত হবে।
পরবর্তীতে প্রফেসর হােসেন মারফৎ অনুবাদকের সঙ্গে যােগাযােগ রাখি এবং অনূদিত পাণ্ডুলিপি প্রফেসর হােসেন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পড়ছেন জেনে অনুবাদের মান সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত। হই। তার এই অবদান অবশ্যই অকুণ্ঠ ধন্যবাদার্হ।
এক সময়ে বাংলা একাডেমী অনুবাদটি প্রকাশের জন্য আমার সম্মতি চেয়েছিল। পরে এ বিষয়ে আমাকে কিছু জানান হয়নি। হঠাৎই ইউপিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ মহাশয়ের চিঠিতে জানতে পারি যে ইউপিএল অনুবাদটি প্রকাশ করতে আগ্রহী। আমি এতে অবশ্যই আনন্দিত হই কারণ ইউপিএল-এর প্রকাশনাখ্যাতি সর্বজনবিদিত। তাই এই সিদ্ধান্তের জন্য আমি মহিউদ্দিন আহমেদ মহাশয়কে আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
পাঠককুলের প্রতি সবিনয় নিবেদন এই যে, মূল গ্রন্থটি প্রকাশের পরবর্তীকালে ওই বিষয়বস্তু সম্পর্কিত এমন কোনাে গবেষণাপ্রসূত রচনা আমি দেখিনি যাতে আমার মূল বক্তব্য পরিবর্তনের প্রয়ােজন হতে পারে।
পরিশেষে, আমি অনুবাদক, প্রকাশনা-প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চের মােনায়েম সরকার মহাশয় ও আশফাক-উল-আলম মহাশয়কে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই। কারণ, এঁদের আন্তরিক ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলেই এই প্রকাশনা সম্ভব হলাে।
শ্যামলী ঘােষ
গুরগাঁও, হরিয়ানা, ভারত ফেব্রুয়ারি ২০০৭
প্রথম অধ্যায়
সূচনা
বর্তমান শতকের শুরুতে যখন ভারতীয়দের অন্তরে জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ দানা বাঁধতে থাকে এবং এর পরিণামস্বরূপ যখন ব্রিটিশ কর্তৃক এক ধরনের প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রবর্তিত হয় তখন থেকেই ভারতীয় সমাজের বহুত্ববাদী চারিত্র্য বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তির মধ্য দিয়ে পরিস্ফুট হয়ে উঠতে থাকে। তিরিশ দশকের মাঝামাঝি নাগাদ একটি ধর্মভিত্তিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তথা ভারতীয় মুসলমানগণের অস্তিত্ব ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দরকষাকষির প্রশ্নে একটি প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং এই সব ভারতীয় মুসলমানের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্বপালন বহুলাংশে বর্তেছিল নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ওপর। চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি নাগাদ অধিকাংশ ভারতীয় মুসলমান তাদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তার দাবিটি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ রাজত্বের অবসান ঘটলে ভারত উপমহাদেশের বিভক্তি হয় এবং সংখ্যাগুরু মুসলিম এলাকা। নিয়ে গঠিত ভারতীয় মুসলমানদের আবাসভূমি পাকিস্তানের জন্ম হয়। তবে বিভেদ সৃষ্টিকারী শক্তিগুলি কিন্তু উবে যায়নি। ভারতীয় ইউনিয়নে পর্যায়ক্রমিক একত্রীকরণের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমুখী নীতিটি এ যাবৎ কেন্দ্রাতিগ শক্তিগুলিকে ধারণ করেছে। ওদিকে পাকিস্তানে সুসংহত সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অবর্তমানে আঞ্চলিক স্বার্থ ও ভাবাদর্শগত পার্থক্যের জন্য পাকিস্তানের পূর্বাংশে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি প্রকট হয় এবং পরিণামে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে যায়। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে, দক্ষিণ-এশীয় রাষ্ট্রীয় কাঠামােতে এই ঘটনা একটি নতুন মাত্রা যােগ করে এবং এই অঞ্চলের ক্ষমতার ভারসাম্য স্থাপন প্রক্রিয়া নবরূপ লাভ করে। এভাবেই একটি নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটে, যা বর্তমান শতকের গােড়াতে ১৯০৬ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সূচিত হয়েছিল। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র নেতৃত্বাধীন নিখিল ভারত মুসলিম লীগই ভারতীয় মুসলমানদের একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অবস্থান থেকে একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তার মর্যাদায় সংজ্ঞায়িত করে এবং অবশেষে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা করে।
১
পাকিস্তান সৃষ্টির পর নিখিল ভারত মুসলিম লীগ পাকিস্তান মুসলিম লীগ নাম ধারণ করে। কিন্তু যে নেতৃত্ব নিখিল ভারত মুসলিম লীগের মাধ্যমে সক্রিয় থেকে পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল সেই নেতৃত্ব একটি সুসংহত পাকিস্তানী সমাজ গড়ে তােলার ব্যাপারে পাকিস্তান মুসলিম লীগের কর্মশক্তিকে পরিচালিত করতে পারেনি, যদিও নিখিল ভারত মুসলিম লীগের আহ্বানে সাড়াদানকারী অনেকেই একটি সুসংহত সমাজব্যবস্থাই চেয়েছিলেন। এই ব্যর্থতার জন্য নানাবিধ ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে, তবে এ ব্যাপারে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী যে ব্যাখ্যা প্রদান করেন তা সর্বাধিক যুক্তিপূর্ণ ও বস্তুনিষ্ঠ বলেই প্রতীয়মান হয়। ১৯৫৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও ভূমিকা প্রসঙ্গে কতিপয় প্রশ্ন উত্থাপন করতে গিয়ে বলেন যে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কোনাে ইতিবাচক রাজনৈতিক দর্শন ছিল না এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অবসান ঘটলে জাতীয় পুনর্গঠনকল্পে যেসব আনুপুঙ্খিক বিষয়ের প্রতি নজর দেওয়া সমীচীন ছিল তার প্রতি মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ কখনই মনােনিবেশ করেনি। এবং এটিই হলাে পাকিস্তানে অদ্যাবধি সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার যথাযথ কারণ।১
নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কার্যকর ভূমিকা যখন একেবারে তুঙ্গে তখন তার একটিমাত্র লক্ষ্য ছিল, ভারতের মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমির সৃষ্টি। এই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের পতাকাবাহক হিসেবে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ তথাকথিত এক স্তম্ভমূলক (monolith) ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে সুপ্ত নৃতাত্ত্বিক, আঞ্চলিক, সাংস্কৃতিক ও ভাবাদর্শগত পার্থক্য কমিয়ে এনে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। কিন্তু এই একতা। কোনাে ঐকমত্যের ফসল নয়। জিন্নাহর ঐকান্তিক আহ্বানে সাড়া দিয়ে পাকিস্তান দাবির মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অভিন্নতার ভাবমূর্তি তুলে ধরার জন্য ভারতীয় মুসলমানদের বিভিন্ন গােষ্ঠী তাদের নিজস্ব মনােভাব সাময়িকভাবে চেপে রাখে। জিন্নাহ্ নিজেও জানতেন বিভিন্ন গােষ্ঠীর এই মতপার্থক্যের কথা। একবার তিনি মন্তব্য করেন: “আমাদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ করার সময় আমরা পাবাে তেমনি একটা সময় আসবে যখন আমাদের এই মতপার্থক্যের মীমাংসা করতে হবে, যখন অন্যায় ও অনিষ্টকর্মের প্রতিকার করতে হবে।” তাঁর মতে, ভারতীয় মুসলমানদের সর্বাগ্রে বিবেচনীয় বিষয় হওয়া উচিত একটি স্বতন্ত্র “আবাসভূমি ও সরকার”; “অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম ও রাজনীতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে পরবর্তী পর্যায়ে।২
পাকিস্তান সৃষ্টির মতাে একটি সীমিত উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ভারতীয় মুসলমানেরা জিন্নাহ্র পরামর্শ মানলেও অনেকেই, বিশেষ করে, বাঙালি মুসলমানদের একটি অংশ ভিন্ন মত পােষণ করতাে।৩ আর সেই কারণে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি পূরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরােপিত ঐক্যের অন্তঃসারশূন্যতা দৃশ্যমান হয়। সদ্যোজাত পাকিস্তান রাষ্ট্রে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরােপ করে নতুন নতুন দল গড়ে ওঠে এবং মুসলিম লীগের প্রাধান্য থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন দলছুট গােষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। এভাবে দেখা যায় যে,
২
১৯৪৯ সালের শেষ নাগাদ পাকিস্তানে প্রায় বিশটি বিরােধীদল সক্রিয় ছিল। শুধুমাত্র পাঞ্জাবেই তেরটি স্বীকৃত বিরােধীদল ছিল এবং এর মধ্যে আটটি দল দঠিত হয় মুসলিম লীগের ভিন্ন ভিন্নমতাবলম্বী সদস্যদের নিয়ে।৪
স্পষ্টত নবােজাত পাকিস্তানের জায়মান অবস্থা থেকেই পাকিস্তান মুসলিম লীগের এক ধরনের ভঙ্গুর সূচনা পরিলক্ষিত হয়। পূর্বাঞ্চলে এর অবস্থান সুদৃঢ়করণে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হওয়ার কারণ প্রমাণিত হয় পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের ফলাফল থেকে। বস্তুত এর অবক্ষয় অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানের জন্মের আগে থেকে না হলেও এর জন্মলগ্ন থেকেই। পূর্ব বাংলার কতিপয় বিশিষ্ট মুসলিম লীগ কর্মী ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় গণআজাদী লীগ (পরবর্তীকালে ১৯৫০ সালে সিভিল লিবারটিজ লীগ নাম ধারণ করে) গঠন করেন। এঁরা ছিলেন সােহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপের সদস্য, যা আহসান মঞ্জিল গ্রুপ (খাজা নাজিমুদ্দিন ও খাজা শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন) থেকে স্বতন্ত্র ছিল। মুসলিম লীগের কতিপয় প্রগতিশীল তরুণ সদস্য ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠন করে।৫ এসব দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যাবলি এবং মূল দল তথা মুসলিম লীগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যাবলির মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য ছিল। যদিও এসব দলের মধ্যেও আনুপুথিক বিষয়ে সূক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান ছিল তথাপি সামগ্রিকভাবে তাদের আক্রমণটি ছিল মুসলিম লীগ নেতৃত্বের সঙ্কীর্ণ, দলীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও কর্তৃত্ববাদী অভিমুখিতার বিরুদ্ধে। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে মুসলিম লীগের করাচি অধিবেশনে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী যে প্রস্তাব দেন। তাতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্টরূপে প্রতিফলিত হয়। এখানে তিনি অসাম্প্রদায়িক জাতীয় দলের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন।৬ মিয়া ইফতিখারউদ্দিন এবং সােহরাওয়ার্দীসহ মাত্র দশজন সদস্য এর পক্ষে রায় দান করলেও প্রস্তাবটি ছিল গণআজাদী লীগ ও গণতান্ত্রিক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতাবর্গ এবং ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ কর্মী শিবিরের উদ্যোক্তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এসবই ছিল পূর্বানুসৃত সাম্প্রদায়িক স্বৈরতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির স্থলে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি প্রবর্তনের প্রয়াস। এমনকি পাকিস্তান রাষ্ট্রের খােদ প্রতিষ্ঠাতার মতেও উক্ত সাম্প্রদায়িক স্বৈরতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির সঙ্গে এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জনের বাইরে কোনাে প্রকার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল না।
পরবর্তীকালে, ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে সােহরাওয়ার্দী একটি ব্যাপকভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় রাজনীতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেন এবং পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ গঠনের প্রস্তাব দেন, যা সকল পাকিস্তানী নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।৭ এদিকে ১৯৪৯ সালের গ্রীষ্মের গােড়ার দিকে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের আন্তঃদলীয় দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। দলের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের পক্ষপাতী সদস্যরা প্রাদেশিক পরিষদের টাঙ্গাইল আসনের উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের দলীয় প্রার্থী খুররম খান পন্নীর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ঢাকার বিশিষ্ট মুসলিম লীগ কর্মী শামসুল হককে মনােনয়ন দান করে। শামসুল হক
৩
উল্লেখযােগ্য ভােটের ব্যবধানে পন্নীকে পরাজিত করলে প্রদেশে পরিবর্তনের বিরােধিতাকারীদের নড়বড়ে অবস্থানের মুখােসটি উন্মােচিত হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির পরবর্তী ঘটনাগুলি এরই স্বাভাবিক পরিণতি বৈ আর কিছুই নয়।
১৯৪৯ সালের জুন মাসে কতিপয় মুসলিম লীগ এমএলএ ও কর্মী যারা দলীয় প্রভুদের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে তারা ঢাকায় দুদিনব্যাপী সম্মেলনের আয়ােজন করে। সম্মেলনে তারা তরুণ ভিন্নমতাবলম্বী শামসুল হক কর্তৃক লিখিত মূল দাবি নামক পুস্তিকায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাদের দাবি ও প্রত্যাশার কথা তুলে ধরে। সম্মেলনে তারা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে গণমানুষের মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী কর্তৃক ৪০-সদস্যবিশিষ্ট সাংগঠনিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব এই সম্মেলনে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তারিখে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। তাঁরই সভাপতিত্বে ১৯৪৯ সালের ২৪ জুন পূর্ব। পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়।৮
পাকিস্তানের তত্ত্বালীন রাজনৈতিক দৃশ্যপটে মুসলিম লীগের আরেকটি দলছুট গােষ্ঠী জন্মলাভের বিষয়টি অসাধারণ ছিল না। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত রাজনৈতিক গতিধারা এবং এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক বিকাশ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ এই ঘটনা একটি নতুন মাত্রা লাভ করে। এই ঘটনার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ মূল দলের প্রতি একটি বহুমুখী খােলাখুলি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে মারে। কিন্তু এটিও হঠাৎ করে ঘটেনি। ১৯৪০-এর দশকের গােড়ার দিকে প্রণীত বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল মুসলিম লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টো ব্যাপকভাবে অনুসরণ করেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম খসড়া ম্যানিফেস্টো তৈরি করা হয়;৯ বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল মুসলিম লীগের দলীয় ছাত্র শাখার প্রতিপক্ষ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রতিষ্ঠাতা সদস্যবর্গ ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করে; ভাষার প্রশ্নে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয় তাতে প্রতিষ্ঠাতা সদস্যবর্গ সক্রিয় অংশগ্রহণ করে এবং ১৯৪৭ সালে সূচিত এই বিতর্ক ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে প্রকট রূপ ধারণ করে এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সময় তাতে আরাে গতিবেগ সঞ্চারিত হচ্ছিল।
অর্থনৈতিক অবস্থার প্রসঙ্গে বলা যায় যে পূর্ব পাকিস্তান ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সালের মধ্যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষাবস্থার সম্মুখীন হয়। এমনকি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ ১৯৪৯ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ জুন তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এর দ্বিতীয় কাউন্সিল সভায় স্বীকার করে যে ক্রমাবনতিশীল বন্যা পরিস্থিতি মােকাবেলা করার ব্যাপারে মুসলিম লীগ সরকারের ঔদাসীন্য কেবল যে সরকারের জন্য অপবাদ বয়ে আনছে তা-ই নয় বরং তা মুসলিম লীগ সংগঠনেরও দুর্নামের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।১০
খাদ্য ঘাটতি ছাড়াও দেশত্যাগী হিন্দুদের মূলধন স্থানান্তর এবং পাকিস্তান কর্তৃক অনুসৃত অর্থনীতির কারণে এ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থব্যবস্থার ওপর দারুণ চাপ পড়ে।১১
৪
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম এমন এক সময় ঘটে যখন পাকিস্তান সরকার এরূপ কতিপয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে যা পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতে মুদ্রার মূল্যমান হ্রাসের পাশাপাশি পাকিস্তানে মুদ্রার মূল্যমান হ্রাসের প্রশ্নে পাকিস্তান সরকার অস্বীকৃতি জানানাের পরপরই ভারত পূর্ব পাকিস্তানের পাট প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যাপারে যেসব সুবিধা দিয়ে আসছিল তা প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে কাঁচা পাটের মূল্য হাস পায় এবং এতে করে পাটচাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।১২
প্রকৃতপক্ষে, ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ সর্বপ্রথম যে বৃহৎ জনসভার আয়ােজন করে তা এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পশ্চাৎপটেই অনুষ্ঠিত হয়। ভাসানীসহ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের অধিকাংশ নেতাকেই এই জনসভার পর গ্রেপ্তার করা হয়।১৩
বাঙালি ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এই ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লাে যে অবাঙালি পুঁজিপতিরা এই সুযােগ গ্রহণ করে সর্বোচ্চ সুবিধা ভােগ করবে। পূর্ব পাকিস্তান পাট সমিতি ১৯৪৯ সালের ২৪ অক্টোবর তাদের এক সিদ্ধান্তে অবাঙালি শিল্পোদ্যোক্তাগণ কর্তৃক পাট ব্যবসায় একচেটিয়াকরণ রােধ করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরােধ জানায়।১৪ কিন্তু বিষয়টি অগ্রাহ্য করে কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তায় ১৯৪৯ সালে আদমজী জুট মিলস্ স্থাপিত হয় যা পাটের সর্ববৃহৎ রপ্তানিকারক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।১৫ এছাড়া, তড়িঘড়ি করে গঠিত জুট বাের্ডেও কোনাে বাঙালি প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বললেই চলে।১৬ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাসদস্য সাখাওয়াৎ হােসেন তাঁর সভাপতির ভাষণে পূর্ব পাকিস্তান বণিক সমিতির নিকট বাঙালি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের আশঙ্কার কথাও ব্যক্ত করেন। বােম্বাইয়ের মুসলিম বণিক সম্প্রদায়ের দেশান্তরী হয়ে করাচিতে আগমন এবং পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন প্রবাহের আশঙ্কায় “পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুঃখ-দুর্দশার ভিত্তি রচিত হয়।”১৭ এভাবে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পঙ্গুদশা পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে এর রাজনৈতিক মতবিরােধ আরাে বাড়িয়ে দেয়।
পাট ব্যবসায়ের সম্ভাব্য সুবিধালাভে বঞ্চিত হয়ে বাঙালি ব্যবসায়ী সম্প্রদায় একে জাতীয়করণের দাবি জানান। এই দাবি অবশ্য ইতােমধ্যেই মূল দাবিতে১৮ ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টোতে১৯ স্থান পায় এবং এছাড়া পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের পরপরই প্রকাশিত ৪২-দফা ম্যানিফেস্টোতেও এই দাবি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই ম্যানিফেস্টোর অন্যান্য প্রধান দিক হলাে: ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলাকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান এবং কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র বিষয়াবলি ও মুদ্রাব্যবস্থা ন্যস্তকরণ; বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদান; বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারিপ্রথা উচ্ছেদকরণ এবং ভূমিহীনদের
৫
মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ; আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী সমবায় কৃষিব্যবস্থা ও শিল্পশ্রমিকদের সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠাকরণ; অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন।২০
যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকার উপরের দাবিগুলির প্রতি অনুকূল সাড়া দেয়নি সেহেতু পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবসায়ীমহল এবং কৃষক ও শ্রমিকেরা শাসকগােষ্ঠী মুসলিম লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানী সমাজের বিভিন্ন স্তরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তার কারণ হিসেবে এটিই প্রণিধানযােগ্য।
মুসলিম লীগের ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশােধননিমিত্ত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা করা হলেও এর প্রতিষ্ঠাতা-সদস্যদের একটি অংশের ঈপ্সিত কতিপয় আদর্শের সঙ্গে এটিকে আপােস করতে হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, এর নামকরণ “মুসলিম” শব্দটিকে বাদ দিয়ে করা সম্ভব হয়নি, যদিও কতিপয় প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে তাঁদের যােগসূত্র থাকায় এবং সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের কারণে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির প্রতি তাঁদের অনুরাগ প্রকাশ করেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকে অগ্রাধিকার প্রদান করায় সােহরাওয়ার্দীকে মুসলিম লীগের উপদলীয় শাসকগােষ্ঠী সন্দেহের চোখে দেখতেন। পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এর নিম্নরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন:
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বিরাজমান পরিস্থিতির প্রয়ােজনে যখন আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয় তখন আমাদের সংগঠনটিকে একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনের রূপ দিতে হয়েছিল। পাকিস্তানী জনগণের ধর্মবিশ্বাসের সুযােগ নিয়ে মুসলিম লীগ ইসলামকে তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে স্বীয় ভূমিকা পালন অব্যাহত রাখে। এছাড়া, মুসলিম লীগ যে বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করে তা থেকে জনগণ তখনাে সম্পূর্ণরূপে নিজেদের মুক্ত করতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে যদিও আমাদের সংগঠনটিকে ধর্মনিরপেক্ষতার রূপ দেওয়া সম্ভব ছিল তথাপি তা মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল প্রভাবকে মােকাবেলা করতে ব্যর্থ হতাে।২১ রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির খাতিরে আপােস করার প্রবণতা আওয়ামী লীগের কর্মপরিচালনার একটি স্থায়ী কৌশল হয়ে দাঁড়ায়। এতে করে অবশ্য সবসময় লাভ হয়েছে সে কথা বলা যায় না। তা সত্ত্বেও বলা যায় যে এতে করে প্রায়শ সীমিত উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়েছে এবং তা দলকে অধিকাংশ সময়ই সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।২১
মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলেও প্রকৃতপক্ষে বেঙ্গল মুসলিম লীগের আহসান মঞ্জিল গ্রুপের সদস্যদের থেকে আলাদা সেই সােহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপই প্রধানত উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং সােহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিগত উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়।২২ সােহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগকে একটি ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে পুনর্গঠিত করার আশা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি ১৯৪৯ সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি
৬
চৌধুরী খালিকুজ্জামানকে এই মর্মে একটি পত্র লিখেছিলেন যে আগ্রহী সব নবাগতের নাম যেন তালিকাভুক্ত করা হয় এবং এই মর্মে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন যে অন্যথায় তাঁরা তাঁদের নিজস্ব দল গড়ে তুলবেন। মুসলিম লীগের সংস্কারসাধনে স্বীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় সােহরাওয়ার্দী একটি জাতীয় বিরােধীদল গঠনের দিকে মনােনিবেশ করেন।২৩ তিনি আশা করেছিলেন যে এই ধরনের একটি দল যদি মুসলিম লীগকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরিয়ে দিতে পারে তাহলে পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটা ভারসাম্য সৃষ্টি হবে। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহােরে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক কর্মীদের এক সম্মেলনে সােহরাওয়ার্দীকে সভাপতি ও একমাত্র সংগঠক করে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের কথা ঘােষণা করা হয়।২৪ কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কোনাে অংশ হিসেবে গঠিত হয়নি কিংবা ১৯৫১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ্ আওয়ামী মুসলিম লীগেরও অংশে পরিণত হয়নি। ১৯৫১ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সংসদ নির্বাচনের পরই কেবল সােহরাওয়ার্দী এদের একত্রীকরণের সূচনা করেন।২৫ ইতােমধ্যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলা আইনসভায় বিরােধীদলের মর্যাদা লাভ করে এবং পূর্ব বাংলার জনগণের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে যে ক্ষোভ ছিল তা সমর্থন ও বেসিক প্রিন্সিপলস্ কমিটির অন্তর্বর্তীকালীন রিপাের্টের (১৯৫০) বিরুদ্ধে আনীত প্রতিবাদী পদক্ষেপে অংশগ্রহণ করে পূর্ব বাংলায় জনপ্রিয়তা অর্জন করে। অধিকন্তু, সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এর ভূমিকা সম্পর্কে কমিনফরম-এর স্বীকৃতি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির একটি অংশের আস্থা লাভেও সহায়তা করে।২৬
ওয়াকিবমহল সূত্রে জানা যায় যে ভাষা আন্দোলন বিষয়ক বিতর্কে অংশগ্রহণ ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ কর্মীরা ১৯৫১ সালের আদমশুমারি চলাকালে গণনাকারীদের নিকট জনগণ যাতে তাদের উর্দু ভাষার জ্ঞানের কথা স্বীকার না করে সে কথা বােঝানাের জন্য নীরব অভিযান চালায়। তারা যে এ ব্যাপারে কিছুটা সফলকাম হয়েছিল সেন্সস কমিশনারের মন্তব্য থেকে তা জানা যায়।২৭
বেসিক প্রিন্সিপলস্ কমিটি রিপাের্ট বিরােধী আন্দোলনের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জড়িয়ে পড়াটা ছিল একটি স্বাভাবিক ব্যাপার এবং দলের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একটি বিকাশমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ভিত্তি হিসেবে যে অগণতান্ত্রিক নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তাতে মুসলিম লীগের কতিপয় সদস্যসহ পূর্ব বাংলার জনগণ ব্যাপকভাবে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে। এমনকি, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শাহ আজিজুর রহমান এই রিপাের্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ প্রদেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন, যদিও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতির চাপে তাঁকে এই ধর্মঘট প্রত্যাহার করতে হয়।২৮ বিকল্প প্রস্তাবমালা বিবেচনার জন্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ একটি কমিটি গঠন করে। একই
৭
সময়ে আতাউর রহমান খান, তাজউদ্দিন আহমদ, অলি আহাদ, সাখাওয়াৎ হােসেনসহ আওয়ামী লীগের কতিপয় সদস্য যারা জেলের বাইরে ছিলেন তাঁরা ডেমােক্র্যাটিক ফেডারেশন বিষয়ক অ্যাকশন কমিটির আলােচনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বেসিক প্রিন্সিপলস্ কমিটি রিপাের্ট বাস্তবায়নের বিরােধিতা এবং বিকল্প প্রস্তাবমালা প্রণয়ন করার জন্য ১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে এই নির্দলীয় কমিটি গঠন করা হয় । চূড়ান্ত পর্যায়ে ঢাকায় ১৯৫০ সালের ৪ ও ৫ নভেম্বর মহাজাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।২৯ ডেমােক্র্যাটিক ফেডারেশন বিষয়ক অ্যাকশন কমিটির সঙ্গে সহযােগিতার সম্পর্ক থাকার। কারণে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের আতাউর রহমানকে সম্মেলনের সভাপতি করা হয়।”৩০
ডেমােক্র্যাটিক ফেডারেশন বিষয়ক অ্যাকশন কমিটির ‘জনাব লিয়াকত আলী খান কি নিম্নলিখিত প্রশ্নাবলির জবাব দেবেন?’—শীর্ষক প্রচারপুস্তিকার বিষয়বস্তু থেকে ডেমােক্র্যাটিক ফেডারেশন বিষয়ক অ্যাকশন কমিটি এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের মধ্যকার দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক সাদৃশ্য স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়। সম্মেলনের প্রাক্কালে এই প্রচারপুস্তিকা বিলি করা হয়।৩১ দুটি সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণাপুষ্ট লাহাের প্রস্তাব (১৯৪০), পাকিস্তান রাষ্ট্রগঠনের ভৌগােলিক অযৌক্তিকতা, পাটচাষীদের দুর্দশা লাঘবে জুট বাের্ডের ব্যর্থতা, উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার অপপ্রয়াস এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে রাখার ব্যাপারে পূর্ণ অনীহা প্রকাশ-এসব বিষয়ে উক্ত অ্যাকশন কমিটি এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ একই মত পােষণ করতাে।
সভাপতির ভাষণে আতাউর রহমান খান বেসিক প্রিন্সিপলস্ তথা বুনিয়াদী নীতিমালাকে ‘ক্ষমতাসীন কতিপয় ব্যক্তির স্বার্থসিদ্ধির জন্য জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবিদাওয়াকে দাবিয়ে রেখে একনায়কতন্ত্র কায়েম করার হীন ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করেন এবং বিরাজমান। পরিস্থিতির বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন যে পাকিস্তান সৃষ্টির আদর্শের সঙ্গে এর আদৌ কোনাে মিল নেই। তিনি আরাে বলেন যে অখণ্ডতার নামে একটি একনায়কতান্ত্রিক পদ্ধতি গড়ে। তােলার প্রয়াস চালানাে হচ্ছে এবং একে গণতন্ত্রবিরােধী অধ্যাদেশ দ্বারা উৎসাহিত করা হচ্ছে। রাষ্ট্র, সরকার ও ক্ষমতাসীন দলকে সমপর্যায়ভুক্ত করা হয়েছে। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন যে এহেন পরিস্থিতিতে ইসলামী কিংবা অন্য কোনাে প্রকার গণতান্ত্রিক পদ্ধতি স্পষ্টতই গড়ে উঠতে পারে না। পরিশেষে তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘােষণা করেন যে গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত মৌলিক নীতিমালা ও সুপারিশকৃত মৌলিক অধিকারসমূহ, এমনকি কোনাে প্রকার সংশােধনীসহ হলেও, সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযােগ্য এবং সে কারণেই তা পরিত্যাজ্য।৩২
যাহােক, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং ডেমােক্র্যাটিক ফেডারেশন বিষয়ক অ্যাকশন কমিটির প্রস্তাবের মধ্যে কতিপয় বিষয়ে পার্থক্য ছিল। প্রথমােক্ত দলটির প্রস্তাব ছিল জনগণের প্রত্যক্ষ ভােটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে মুদ্রাব্যবস্থা। রাখা এবং এক মানুষ এক ভােট পদ্ধতি। ডেমােক্র্যাটিক ফেডারেশন বিষয়ক অ্যাকশন কমিটি ভেবেছিল যে প্রত্যক্ষ ভােটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এই পদ্ধতিকে প্রথমে প্রেসিডেন্সিয়াল
৮
পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করবেন এবং পরে নিজেই একনায়কের রূপ পরিগ্রহ করবেন। তাছাড়া কমিটি এ চিন্তাও পােষণ করতাে যে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান দুটি পৃথক রাষ্ট্র (তাদের ধারণা মতাে) হওয়ায় জাতিসংঘ বা কমনওয়েলথে প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের মতাে এদেরও সমভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব থাকা বাঞ্ছনীয়; তা না হলে এ কথাই মনে করতে হবে যে পাকিস্তানের সমগ্র ভূখণ্ড’ যেন একটি রাষ্ট্রেরই পরিচায়ক।৩৩
এ কথা অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে উপযুক্ত পার্থক্যের ফলে, যা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ৪২-দফা ঘােষণায় প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি থেকে উদ্ভূত বলে প্রতীয়মান হয়, অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় এবং এতে করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিনিধিবর্গ সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশন থেকে বেরিয়ে যায়, যদিও বদরুদ্দীন উমর সাংগঠনিক বিষয়াবলি-সংক্রান্ত মতপার্থক্যকেই এর কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন বলে মনে হয়।৩৪
যাই হােক, সম্মেলনে ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে গঠনতন্ত্রের মূলনীতির একটি রূপরেখা গৃহীত হয় এবং এর গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলির সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ঘােষিত উদ্দেশ্যাবলির বড় একটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না।৩৫
পূর্ব বাংলার রাজনীতি থেকে সােহরাওয়ার্দীকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও যখন পূর্ব বাংলায় অসন্তোষ ঘনীভূত হচ্ছিল তখন ১৯৫২ সালের ডিসেম্বর মাসে লাহােরে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ্ আওয়ামী মুসলিম লীগকে অধিভুক্ত করা হয়। তবে এই অধিভুক্তি ছিল শর্তসাপেক্ষ। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ এর নামকরণ, ম্যানিফেস্টো ও কর্মসূচি থেকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে।৩৬ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৩ সালের ১১ এপ্রিল সাংগঠনিক কমিটির এক বৈঠকে এই অধিভুক্তি অনুমােদন করে। ঐ বছরের শেষের দিকে কাউন্সিল সভায় মওলানা ভাসানী বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে এই অধিভুক্তি, যা তাঁর কারাবন্দী থাকা অবস্থায় আলােচিত হয়, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কর্মসূচি ও ম্যানিফেস্টো আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হওয়ার পরই কেবল। চূড়ান্ত করা হবে এবং সে কারণে নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ্ আওয়ামী মুসলিম লীগের সঙ্গে কোনােরূপ বিরােধ দেখা দিলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ দলের কর্মসূচি ও। ম্যানিফেস্টোর প্রতি অবিচল থাকবে। এমনকি তিনি এ মর্মে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেন। যে, “যদি কেউ আমাদের কর্মসূচিতে নাক গলাতে আসে তাহলে কেন্দ্রীয় পার্টির সঙ্গে আমাদের অধিভুক্তির প্রশ্নটি পুনর্বিবেচনা করতে আমরা বাধ্য হবাে।” তিনি দাবি করেন যে পরিস্থিতির বাস্তবতার নিরিখেই তিনি এই গুরুত্ব আরােপ করছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, পাকিস্তানের দুটো অংশের সমস্যা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির এবং পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের অনড় অবস্থানের বিষয়টি
৯
সাংগঠনিক কাঠামােতে প্রতিফলিত হতে হবে।৩৭ তথাকথিত একটি জাতীয় পার্টির অধিভুক্ত পার্টি হিসেবে এই অতিমাত্রিক স্বতন্ত্র চারিত্র্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এক অনন্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরে রাখে। এমনকি ষাটের দশকে এই দল নতুন নেতৃত্বের অধীনে পুনর্জাগরিত হওয়ার পরও পার্টির দুটো শাখা একটি অভিন্ন ম্যানিফেস্টো দাঁড় করাতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পুনর্জাগরণ-উত্তর গঠনতন্ত্রেও সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ করা হয় যে, এর নিজস্ব গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচিকে স্বীকৃতিদানের ভিত্তিতেই কেবল এটি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের আঞ্চলিক শাখা হিসেবে গণ্য হবে।৩৮
যা হােক, মামদোতের নবাবকে প্রত্যাহারের পর খােদ নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ্ আওয়ামী মুসলিম লীগই বস্তুতপক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কে. কে. আজিজ মন্তব্য করেন:
এখানে (নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ্ আওয়ামী মুসলিম লীগ) এসে যারা ভিড় জমায় তারা হলেন মুসলিম লীগের প্রাক্তন সদস্য ও হতাশাগ্রস্ত সদস্য, ছােটখাট বিরােধীদলীয় নেতা, রাজনীতিক হিসেবে পরিচিতি লাভের আকাক্ষাতাড়িত তরুণ আইনজীবী, নবীন রাজনৈতিক দলগুলির পৃষ্ঠপােষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে আগ্রহী ব্যবসায়ী, মুরুব্বিয়ানা’ ভাব দেখাতে চায় এমন জমিদার, সােহরাওয়ার্দীর ভক্তবৃন্দ, গণতন্ত্রের সমর্থকগণ যারা দেশে একটি কার্যকর বিরােধীদলের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন এবং এমনকি স্বল্পসংখ্যক সুবিধাবাদী ফটকাবাজ।… এটা যেমন ঠিক নতুন কোনাে দল নয় তেমনি তা যথাযথ সংবদ্ধ কোনাে দলও নয়: এটা হলাে বিভিন্ন প্রাদেশিক শক্তির এক অদ্ভুত কনফেডারেশন বা মৈত্রীবন্ধন। কর্মসূচির মধ্যে সামঞ্জস্য এবং ব্যক্তিত্বের মধ্যে মিল না থাকায় এটা হলাে বিভিন্ন গােষ্ঠী বা অংশের মধ্যে এক ধরনের শিথিল বন্ধনবিশেষ, যার শুধুমাত্র একটি অভিন্ন লক্ষ্য হলাে মুসলিম লীগের বিরােধিতা করা। মুসলিম লীগের বিরােধিতা করার জন্য উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মানকী শরীফের পীর, পাঞ্জাবের মামদোতের খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকজন নেতা সংঘবদ্ধ হন, কিংবা বলা চলে সােহরাওয়ার্দী এঁদের সংঘবদ্ধ করেন।৩১
আপাতদৃষ্টিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ কিন্তু ভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কোনাে দল ছিল না। এটি ছিল মুসলিম লীগের বিভিন্ন মতের সাবেক সদস্যদের নিয়ে গঠিত মুসলিম লীগবিরােধী একটি প্ল্যাটফরম যার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষতাবিরুদ্ধবাদী, ডানপন্থী, বামপন্থী, কেন্দ্রবাদী, জাতীয়তাবাদী, আঞ্চলিকতাবাদী, মিশ্র মতাদর্শবাদী ইত্যাদির সমাবেশ হয়েছিল কিন্তু শুধুমাত্র নেতিবাচক প্রবণতাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের পেছনে প্রণােদনা শক্তি হিসেবে কাজ করেনি, যদিও তা মুসলিম লীগবিরােধী দলছুট গােষ্ঠীগুলির ক্ষেত্রে সত্যি ছিল। এই দলের নেতৃবর্গ ও অনুসারীদের একই ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক পটভূমি ও অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থাকায় এবং সর্বোপরি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের অভিন্ন ব্যাখ্যার (যা তাদের মতে পাকিস্তানকে সার্বভৌম আঞ্চলিক জোটবদ্ধ ইউনিট হিসেবে একটি ফেডারেল রাষ্ট্রের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে) কারণে এই দলের ছিল সমজাতীয় সাংগঠনিক
১০
ভিত্তি ও উদ্দেশ্য। পাকিস্তানের আঞ্চলিক বা জোটবদ্ধ ইউনিটের সার্বভৌমতু সম্পর্কিত ধারণা এবং আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার ধারণাটি, যা পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ নেতার চেতনায় দৃঢ়ভাবে গ্রথিত ছিল, পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সকল কর্মকাণ্ডে বিশেষ অবদান রাখে। অনুরূপভাবে, এই পর্যায়ে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠা কতিপয় সমাজতান্ত্রিক রীতির সঙ্গে অপরিহার্যরূপে বিকশিত উদারপন্থী গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা যুক্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক আন্দোলনের মূলধারার পেছনে চালিকাশক্তিরূপে কাজ করে।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টোতে, যা আবুল হাশিমের ম্যানিফেস্টোর সমধর্মীয়, দাবি করা হয় যে পূর্ব পাকিস্তানের আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য পাকিস্তানে কী ধরনের কার্যক্রম ও পদ্ধতি গ্রহণ করা হচ্ছে তা সুস্পষ্টরূপে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার সময় এসেছে। এতে বলা হয় যে জনগণই আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা হিসেবে রাষ্ট্রের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রয়ােগ করবে: পাকিস্তান হবে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসংঘ; এর দুটো আঞ্চলিক ইউনিট থাকবে, যথা পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল; পাকিস্তানের আঞ্চলিক ইউনিট দুটোকে পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রদান করতে হবে। এতে বলা হয় যে পূর্ব পাকিস্তানের নিজস্ব সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী থাকবে; ভূমিকে ক্রমান্বয়ে জাতীয়করণ করতে হবে; অর্থনৈতিক নিপীড়ন যা রাজনৈতিক দমন তথা নব্য-সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয় তা এড়ানাের জন্য বৈদেশিক পুঁজি সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে হবে। খনিজ, প্রতিরক্ষা, ব্যাংক, বীমা, যােগাযােগ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, রাসায়নিক দ্রব্য, বনজসম্পদ, পাট, চা, চিনি ইত্যাদির ন্যায় মৌলিক শিল্পকে জাতীয়করণ করতে হবে; প্রধান প্রধান সব শিল্প প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত শ্রমিক-প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিকল্পিত ও পরিচালিত হতে হবে; সকল অগণতান্ত্রিক এবং অনৈসলামিক নীতি ও মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করতে হবে; পাকিস্তান কেন্দ্রীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদগুলিকে অবিলম্বে ভেঙে দিতে হবে এবং শাসনতন্ত্র বা সংবিধানের ভিত্তি নিরূপণের জন্য প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে; কেন্দ্র এবং প্রদেশগুলির মধ্যে কর-রাজস্বের সমভিত্তিক বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে; আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে এবং পাকিস্তান যাতে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ও রক্ষায় নেতৃত্বদান করতে পারে সেজন্য শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পরিশেষে ঘােষণাপত্রে যে বিষয়টির ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরােপ করা হয় তা হলাে অর্থনৈতিক আগ্রাসন তথা অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানাের দৃঢ়সংকল্প। এই ঘােষণাপত্রের প্রথম ভাগে যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে সেটিই হলাে আবুল হাশিমের ঘােষণাপত্রের বিষয়বস্তু থেকে একমাত্র প্রধান পার্থক্য এবং তা হচ্ছে পাকিস্তান যদি আগামী পাঁচ বছরে ইসলামের আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবােধ বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয় তা হলে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণের পথ প্রশস্ত হবে।৪০
১১
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টোতে আবার এমন বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল যা এই দল ভবিষ্যতেও অব্যাহতভাবে অনুসরণ করে। সমাজের সর্বস্তরের জনগণের দাবিদাওয়া ও সকল রাজনৈতিক বিশ্বাস যাতে ধারণ করতে পারে এমন ব্যাপকভিত্তিক স্বার্থসমূহ এই ম্যানিফেস্টোতে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। এতে এমন এক মধ্যপন্থী নীতি অনুসরণের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় যাতে “ইসলামী আদর্শের পথ” অনুসরণ করে কমিউনিজম ও নব্য-ঔপনিবেশিকতাবাদ এই উভয় মতবাদ থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয়। প্রকৃত ধর্মবিশ্বাস থেকে উদ্ভূত কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যেই হােক না কেন ইসলামী আদর্শের ওপর গুরুত্ব আরােপের বিষয়টি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্মলগ্নে যযাগদান করার সময় থেকেই অনেকের কাছে নিরুৎসাহব্যঞ্জক ছিল। বদরুদ্দীন উমরের মতে কামরুদ্দিন আহমদ, তাজউদ্দিন আহমদ, অলি আহাদ, মােহাম্মদ তােয়াহা প্রমুখ প্রগতিবাদী নেতা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক নামকরণের জন্য গােড়াতে এই দলে যােগদান করতে অস্বীকৃতি জানান, যদিও এই দল গঠনের প্রাথমিক কাজের সঙ্গে এঁরা সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।৪১ দলের নামের মুসলিম’ শব্দটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহারের পর এঁদের মধ্যে কামরুদ্দিন আহমদ ১৯৫৫ সালের দিকে দলে যােগদান করেন।৪২ ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন চলাকালে সাবজেক্ট কমিটির বৈঠকে মুসলিম’ শব্দটি বর্জনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই অধিবেশনের উদ্দেশ্য ছিল দলের গঠনতন্ত্র ও ম্যানিফেস্টো চূড়ান্ত করা। এখানে লক্ষণীয় যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ইতােমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ্ আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রাদেশিক শাখায় পরিণত হয়। সর্বমােট ৫৫ জন সদস্যের মধ্যে খন্দকার মােশতাক আহমদের মতাে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বসহ মােট ২৭ জন সদস্য এই উদ্যোগের বিরােধিতা করেন।৪৩ অবশেষে, গণমানুষের অনুভূতি যাচাই এবং পরবর্তীকালে অনুষ্ঠিতব্য বিশেষ কাউন্সিল বৈঠকে তার ফলাফল উপস্থাপনের জন্য মওলানা ভাসানীকে প্রাধিকার প্রদান করা হয়।
উপরােক্ত জুলাই বৈঠকে ভাসানী ঘােষণা করেন যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ যে কোনাে মূল্যেই হােক প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রশ্নে অটল থাকবে। দলীয় কর্মসূচিতে কেন্দ্রের হাতে কেবল প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র বিষয় ও মুদ্রাব্যবস্থা ছেড়ে দিয়ে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের দাবির বিষয়েও অনুরূপ জোর দেওয়া হয়। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যের মধ্যে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল তা হলাে—নিরাপত্তা আইন বাতিল; বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারিপ্রথা বিলােপ; পাট ব্যবসায় ও প্রধান প্রধান শিল্প জাতীয়করণ; রাজবন্দীদের মুক্তিদান; নতুন করে নির্বাচন।৪৪
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সাংগঠনিক প্রতিবেদনে বলেন যে ১৯৪৯ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এই দল গঠনের বিষয়টি ছিল নির্যাতন-নিপীড়নের
১২
বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য জনগণ ও বুদ্ধিজীবীদের এক সমন্বিত প্রচেষ্টা। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে “আমরা এ মর্মে ঐকমত্য পােষণ করি যে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব হবে সরকারবিরােধী সকল শক্তির ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব গ্রহণ করা।” তিনি কাউন্সিলের প্রতি এই মর্মে আহ্বান জানান যে “আমরা যাতে ফ্রান্সের কনভেনশনপন্থীদের ন্যায় বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার মতাে কোনাে পরিস্থিতির শিকার না হয়ে পড়ি সেদিকে যেন সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখি।” পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরােধী অবস্থানের কথা উল্লেখ করা হয় এবং এছাড়া “সক্রিয় জোট-নিরপেক্ষ নীতি ও কমনওয়েলথ থেকে বিচ্ছিন্নতার বিষয়ে দলের প্রতিশ্রুতির কথাও উল্লেখ করা হয়। দলের অভ্যন্তরীণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য এসবের প্রয়ােজনীয়তার কথা তিনি ব্যাখ্যা করেন। প্রতিবেদনে বলা হয় যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ শিল্পায়নসহ ভূমি ব্যবস্থায় “বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে চায়, কিন্তু দেশ “সাম্রাজ্যবাদী আঁতাত” ও কমনওয়েলথের সঙ্গে যুক্ত থাকলে এসব বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। প্রতিবেদনে আরাে বলা হয় যে, উৎসাহী কৃষক, মধ্যবিত্ত শ্রেণী, ছাত্র ও যুবকদের জন্য সাংগঠনিক সুযােগসুবিধার কথা দল বিবেচনা করবে, কারণ বি. পি. সি.বিরােধী ও ভাষা আন্দোলন চলাকালে এ কথা প্রমাণিত হয়েছে যে এরা সকলেই তাদের বর্তমান অবস্থার অবসান ঘটাতে দৃঢ়সংকল্প।” তিনি বলেন, একেবারে ঢাকা শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের জনগণ পর্যন্ত উপলব্ধি করে যে “আদর্শগতভাবে সকলের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করলেও সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতার কারণে আওয়ামী মুসলিম লীগ তাদের সকলকে দলে নিয়ে আসতে পারবে না। সে কারণেই তিনি সর্বস্তরে আন্তঃদল যােগাযােগ এবং ব্যাপক গণযােগাযােগের মাধ্যমে দলীয় কর্মসূচিকে জনপ্রিয় করে তােলার ওপর গুরুত্ব আরােপ করেন।৪৫
উপরের প্রতিবেদনের আলােকে বিচার করলে এ কথা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে কাউন্সিল বৈঠকে যে গঠনতন্ত্র গৃহীত হয় তাতে আট শতাধিক সদস্যবিশিষ্ট কাউন্সিলের ব্যবস্থা রাখার বিষয়টি মােটেও বিস্ময়ের উদ্রেক করে না। যদিও তল্কালীন কতিপয় পর্যবেক্ষকের ন্যায় এম. রফিক আফজাল এটিকে “বিরাটাকারের হওয়ায় নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে অসুবিধাজনক”৪৬ বলে অভিহিত করেন তথাপি তা নিঃসন্দেহে সদস্য সংগ্রহের কাজ ত্বরান্বিত করে।
১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে কাউন্সিল বৈঠকে যে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে মূল লক্ষ্য এক হওয়া সত্ত্বেও শামসুল হক কর্তৃক প্রণীত খসড়া ম্যানিফেস্টোতে পাকিস্তানের জোটবদ্ধ ইউনিটগুলির সার্বভৌমত্ব” বলতে যে ধারণা প্রকাশ করা হয় তা পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন” শব্দনিচয়ের মাধ্যমে নবতররূপে ব্যাখ্যাত হয়। এটা ছিল কেবল রূপগত পরিবর্তন, বস্তুগত নয়। অবশ্য যে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায় তা হলাে খসড়া ম্যানিফেস্টোতে কমিউনিজমকে ক্ষতিকর বলে উল্লেখ করা হলেও এতে তা করা হয়নি৪৭ এবং সম্ভবত তা করা হয়নি এই কারণে যে ১৯৫১ সালের
১৩
পরে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও গােষ্ঠীর মাধ্যমে কাজ করার অভিপ্রায়ে যে সংশােধিত কৌশল গ্রহণ করে তার প্রতি অনুকূল সাড়া দেওয়া এবং এইভাবে আওয়ামী লীগ কর্তৃক আরাে সদস্য সংগ্রহের সুযােগ সৃষ্টি করা।
এই বৈঠকে কর্মসূচি, সাংগঠনিক কাঠামাে ও পরিচালনা পদ্ধতির যে রূপরেখা তৈরি করা হয় তা-ই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কমবেশি স্থায়ী বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। সােহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে পররাষ্ট্র নীতি ও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন-সংক্রান্ত নীতির বাস্তবায়ন বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত ছিল এবং বাহ্যত এই সব প্রশ্ন দেখা দেওয়ায় ১৯৫৭ সালে এই দল বিভক্ত হয়ে পড়ে। অবশ্য লক্ষণীয় দিক হলাে যে পূর্বের অবস্থান থেকে বিভক্তি-উত্তর ম্যানিফেস্টো ও কর্মসূচির ব্যত্যয় ঘটেনি। এ কথা দাবি করা হয় যে বিভক্তি-পূর্ব ম্যানিফেস্টোগুলিকে অগ্রাহ্য করে ১৯৬৪, ১৯৬৬ ও ১৯৬৭ সালের ম্যানিফেস্টোগুলির একীভূত একটি সংশােধিত ও সুসংহত রূপই হলাে ১৯৬৯ সালের ম্যানিফেস্টো;৪৮ তবে বিভক্তি-পূর্ব ও বিভক্তি-উত্তর এবং পুনর্জাগরণ-উত্তর দলের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অপরিবর্তিত থাকে এবং সর্বোচ্চ নেতৃত্ব পর্যায়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিত্ববর্গ নির্বিশেষে এই দল এর গঠন পর্যায়ে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ধারণ করেছিল তার জন্য জোর। প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে।
ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ ও গণসমাবেশের মাধ্যমে এককভাবে বিরােধীদলের নেতৃত্বদানের জন্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের প্রাক্কালে এই দল অন্যান্য দলের সঙ্গে হাত মিলায়, যদিও পরবর্তীকালে এই সিদ্ধান্তের জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হয়।
শাসক মুসলিম লীগ দলকে পরাভূত করার অভিপ্রায়ে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগকে কোয়ালিশনের প্রশ্নে অন্তর্দলীয় ও আন্তঃদলীয় বেশ কিছু মতপার্থক্য ধারণ করতে হয়েছিল। কিন্তু সােহরাওয়ার্দীর প্রাথমিক আপত্তি এবং মুজিবুর রহমানের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিরােধিতা সত্ত্বেও যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ যুক্তফ্রন্টের সর্ববৃহৎ অঙ্গে পরিণত হয়। যুক্তফ্রন্ট সৃষ্টির পেছনে বড় রকমের যে কারণটি ছিল তা হলাে গণদাবি এবং এই গণদাবির ব্যাপারে সােচ্চার ছিল ছাত্র সমাজ, যারা এই প্রদেশের সবচেয়ে বড় মুখর অংশ।৪৯
১৯৫৩ সালের গােড়ার দিক থেকেই বিরােধী দলগুলিকে নিয়ে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের অভিপ্রায়ের কথা আলােচিত হয়ে আসছিল। ঐ বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে কৃষক শ্রমিক পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, খেলাফত-ইরব্বানী পার্টি এবং পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের ব্যাপারে। তাদের সমর্থনের কথা পৃথক পৃথকভাবে ঘােষণা করে।৫০ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল বৈঠকে কল্পিত যুক্তফ্রন্টে অংশগ্রহণের ব্যাপারে চূড়ান্ত
১৪
সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পূর্বাভিমত স্মরণ করে বলেন যে প্রস্তাবিত যুক্তফ্রন্টের প্রকৃতি মূলত মুসলিম লীগবিরােধী এক জোট বৈ আর কিছুই নয় এ কথা মনে করেই তিনি ব্যক্তিগতভাবে এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিরােধিতা করেছিলেন; কিন্তু একইসঙ্গে তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ জনগণের দল হওয়ায় সেখানে গণমানসের প্রতিফলন হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং সে কারণেই তিনি উক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে তা সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করেন। তিনি সুস্পষ্টরূপে ব্যাখ্যা করেন যে প্রাথমিক পর্যায়ে যখন জনগণ হক-ভাসানী ঐক্যের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল তখন আভাস পাওয়া গিয়েছিল যে ফজলুল হক আওয়ামী লীগে যােগদান করবেন, যা তিনি নিজেই বলেছিলেন। কিন্তু অবশেষে ফজলুল হক যখন কৃষক শ্রমিক পার্টি গঠন করেন তখন আওয়ামী লীগ ও কৃষক শ্রমিক পার্টির যুক্তফ্রন্ট গঠন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে, মুসলিম লীগবিরােধী কয়েকটি নবজাত দলকেও যুক্তফ্রন্টের আওতায় আনা হয়। এইভাবে, “রাতারাতি গজিয়ে ওঠা দলগুলিকে দীর্ঘ সাত বছর ধরে সংগ্রামরত আওয়ামী লীগের ন্যায় একটি সংগঠনের সঙ্গে সমমর্যাদা দান করে আওয়ামী লীগ জনগণের স্বপ্ন তথা যুক্তফ্রন্টের বাস্তবায়ন ঘটায়।” কিন্তু তিনি এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে, “আজ আপনারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে যুক্তফ্রন্ট নামক এই জগাখিচুড়ি থেকে আমাদের জনগণ, কিছুই লাভ করেনি, বরং আমাদের সংগ্রাম প্রলম্বিত হয়েছে।”৫১
পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল৫২ থেকে দেখা যায় যে পরিষদে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগেরই প্রাধান্য ছিল। কিন্তু ফজলুল হককে যুক্তফ্রন্ট সংসদীয় দলের নেতা মনােনীত করা হলে তিনি কিন্তু প্রথমে তাঁর ক্ষুদ্রাকার মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের কোনাে সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করেননি।৫৩ আওয়ামী লীগের তরুণ সদস্যরা বিষয়টি আগেভাগেই অনুমান করতে পেরেছিল। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের “তরুণ অনভিজ্ঞ ও চরমপন্থী” সদস্য সম্পর্কে হক সাহেবের কথিত আপত্তিকর মনােভাব থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটি হক-মন্ত্রিসভার প্রতি সমর্থনদান অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের সদস্যের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে পরবর্তী যে কোনাে ধরনের অগ্রগতির ক্ষেত্রে আলাপ-আলােচনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মওলানা ভাসানীকে প্রাধিকার প্রদান করে।৫৪ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গণপরিষদ ভেঙে দেওয়ার কিংবা পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের পরাজয়ের কারণে ন্যূনতম সদিচ্ছাজ্ঞাপক পদক্ষেপ হিসেবে বাঙালি সদস্যদের পদত্যাগেরও দাবি জানায়।৫৫ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এই অজুহাত দেখিয়ে এই দাবি মানতে অস্বীকৃতি জানান যে এটা আর যা-ই হােক এটা একটি অংশের রায় মাত্র। ৫৬
কলকাতায় কথিত পাকিস্তানবিরােধী বিবৃতিদানের পরিপ্রেক্ষিতে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে যে সমালােচনার ঝড় তাঁর অবস্থানকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তােলে কেবল তারপরই
১৫
তিনি নমনীয় মনােভাব প্রদর্শন করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের পাঁচজন সদস্যকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি হন। কিন্তু তিনি দফতর বণ্টনের প্রক্রিয়া শুরু করার আগেই নারায়ণগঞ্জের আদমজী পাটকলে বাঙালি ও অবাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গা বেধে যায়। কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করে যে এটি ছিল যুক্তফ্রন্টের সমর্থনপুষ্ট কমিউনিস্ট পরিচালিত ষড়যন্ত্র । হক সাহেব ও মওলানা ভাসানী উভয়েই এই অভিযােগ অস্বীকার করেন এবং তারা আমলা ও মিল কর্তৃপক্ষের পরােক্ষ সমর্থনে এই দাঙ্গা ঘটানাের জন্য পরাজিত মুসলিম লীগকেই দায়ী করেন। হক সাহেবকে করাচিতে ডেকে পাঠানাে হয় এবং সেখানে তিনি কমিউনিস্টদের ব্যাপক ধর-পাকড়ের ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানান। এ কথাও জানা যায় যে ঐ সফরকালে হক সাহেব বারংবার উল্লেখ করেন যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘমেয়াদী চূড়ান্ত লক্ষ্যের তুলনায় যুক্তফ্রন্টের ২১দফা কর্মসূচি স্বল্পমেয়াদী প্রকৃতির।৫৭ ২১-দফা কর্মসূচি ছিল যুক্তফ্রন্টের ১৯৫৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহার। এতে লাহাের প্রস্তাবের আলােকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য যে দাবিদাওয়া উত্থাপন করা হয় তার মধ্যে ছিল প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র বিষয় ও মুদ্রাব্যবস্থা ব্যতিরেকে অন্যান্য সব বিষয়ের ওপর প্রাদেশিক অধিকার ও পূর্ব বাংলায় নৌবাহিনীর সদরদফতর স্থানান্তর, পূর্ব বাংলাকে প্রতিরক্ষার বিষয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য ‘আনসার’কে। পূর্ণ মিলিশিয়ায় রূপান্তরণ ও পূর্ব বাংলায় অস্ত্র কারখানা স্থাপন। এতে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের দাবিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এসব ছাড়াও এতে আওয়ামী লীগের পূর্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পূর্ব বাংলার বিভিন্ন সামাজিক স্তর যথা কৃষক, স্থানীয় নব্য শিল্পপতি ও বণিক শ্ৰেণী, শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থের কথা তুলে ধরা হয়।৫৮
আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, প্রশাসনের আস্থা আনয়নে ব্যর্থতা এবং প্রদেশে “শত্রুপক্ষের এজেন্টদের উপস্থিতি রােধে ব্যর্থতার কারণে হক সাহেবের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেওয়া হয়।৫৯ পূর্ব বাংলায় গভর্নরের শাসন জারি করা হয়। প্রাপ্ত বিবরণ থেকে জানা যায় যে ১২০০ জন আওয়ামী লীগ কর্মী ও নেতা এবং ৩০ জন এম. এল. এ.কে কারারুদ্ধ করা হয় এবং “একমাত্র” আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের নেতা আতাউর রহমান খান মুসলিম লীগের “জুলুমশাহীর বিরুদ্ধে আহ্বান জানান।৬০
এই সময়ের পাকিস্তানী রাজনীতির একজন বিশ্লেষক, এম. রফিক আফজাল মনে করেন:
কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক এই কঠোর ব্যবস্থা (যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল) গ্রহণের পেছনে যে দুটো মূল বিষয় কাজ করেছে তা হলাে: প্রথমত, কেন্দ্র এবং প্রদেশগুলির মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনসহ এর ফেডারেল কাঠামাে-সংক্রান্ত পরিকল্পনার বিষয়ে সম্মত হওয়ার জন্য যুক্তফ্রন্ট নেতৃত্বকে রাজি করানাের ক্ষেত্রে এর ব্যর্থতা; দ্বিতীয়ত, সম্পাদিত মার্কিন সামরিক সাহায্য ও চুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের দলগুলির সর্বসম্মতপ্রায় বিরােধিতা।৬১
এই সঙ্কটপূর্ণ সন্ধিক্ষণে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ দৃশ্যপট থেকে অনুপস্থিত থাকেন। সােহরাওয়ার্দী তাঁর চিকিৎসার
১৬
জন্য সুইজারল্যান্ড চলে যান এবং ভাসানী বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যােগদানের জন্য সুইডেনে যান। পূর্ব পাকিস্তানের অপর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ফজলুল হক বাহ্যত মৌনতা অবলম্বন করেন। ফলে নবনিযুক্ত গভর্নর ইস্কান্দার মীর্যার অধীনে দমনমূলক গভর্নরশাসন রূপ লাভ করতে থাকে এবং অন্যদিকে শাসনতন্ত্র রচনার ক্ষেত্রে অচলাবস্থা অব্যাহত থাকে।৬২ এই অচলাবস্থার পরিণামে গণপরিষদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে একটি বিল পাস করার পর জরুরি অবস্থা আরােপ করা হয়।৬৩ গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন যে আমলা, জমিদার ও খ্যাতিমান শিল্পপতিরা তাঁকে সমর্থন দেবে। কিন্তু স্থিতাবস্থা (status quo) বজায় রাখার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সমর্থনও তার প্রয়ােজন ছিল। সুতরাং বগুড়ার মােহাম্মদ আলী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যান। সােহরাওয়ার্দীর সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সমর্থন লাভের প্রচেষ্টা চালানাে হয়। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক উসমানী যখন আতাউর রহমানকে এই মর্মে অবহিত করেন যে গােলাম মােহাম্মদের বিরােধিতা করার অর্থই হবে সামরিক শাসনকে ডেকে আনা তখন তিনি নেতৃবৃন্দকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার জন্য ইউরােপ গমন করেন।৬৪
অনুমান করা যায় যে আতাউর রহমানের প্রত্যাবর্তনের পর গভর্নর জেনারেলের প্রতি তাঁর বাহ্যত কোমল মনােভাবের পেছনে সােহরাওয়ার্দীর সমর্থন ছিল, কেননা ফিরে আসার পর সােহরাওয়ার্দী নিজেই গােলাম মােহাম্মদের “বিজ্ঞ মন্ত্রিসভায়” (Cabinet of Talents) আইনমন্ত্রী হিসেবে যােগদান করেন। দলীয় লােকজনের প্রাথমিক বিরােধিতা সত্ত্বেও তিনি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, এমনকি তিনি যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে পরামর্শ করার প্রয়ােজনীয়তাও অনুভব করেননি। যুক্তফ্রন্টকে উপেক্ষা করার কারণ হিসেবে বলা যায় যে সম্ভবত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য তাঁকে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করেছিল। এরই সম্ভাব্য প্রতিশােধ হিসেবে লক্ষ্য করা যায় যে যখন ফজলুল হক করাচি গমনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং একজন সদস্যকে মনােনয়নদান করতে সম্মত হয়ে আবু হােসেন সরকারের নাম প্রস্তাব করেন তখন তিনিও সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে কোনাে পরামর্শ বা তাকে কিছু অবহিত করেননি।৬৫
এইভাবে দেখা যায় যে গভর্নর জেনারেল যুক্তফ্রন্টের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে তাঁর প্রতি বাধ্যতামূলকভাবে অনুরক্ত থাকার ব্যাপারে কৌশল অবলম্বন করায় ফ্রন্টের অভ্যন্তরীণ দলাদলি প্রবণতা আরাে বৃদ্ধি পায়। ১৯৫৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টারি পার্টির রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এই অন্তর্দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং যুক্তফ্রন্টের প্রধান অংশীদার হিসেবে তার ন্যায্য ও যথাযথ পাওনা লাভের জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে। এই কারণে আওয়ামী লীগ উক্ত বৈঠকে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনয়ন করে। ওদিকে কৃষক পার্টিও পাল্টা
১৭
অনাস্থা প্রস্তাব আনে। প্রচণ্ড হট্টগােলের মধ্যে যদিও এ বিষয়ে কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়নি তথাপি উভয় দল স্বীয় বিজয় অর্জিত হয়েছে বলে দাবি করে। বাস্তবিকপক্ষে অবশ্য আওয়ামী লীগ আবদুস সালাম খান, হাশিমুদ্দিন আহমদ ও আনােয়ারা খাতুনসহ কতিপয় সদস্যকে সাময়িকভাবে হারায়। এঁরা ফজলুল হক নেতৃত্বাধীন দলের সঙ্গে এই অজুহাতে যােগ দিয়েছিলেন যে প্রাথমিকভাবে এঁদের আনুগত্য ছিল যুক্তফ্রন্টের প্রতি।৬৬
‘বিজ্ঞ মন্ত্রিপরিষদে সােহরাওয়ার্দীর যােগদান করার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তিনি আশা করেছিলেন যে অচিরেই তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে এবং শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হবে এবং এভাবেই তিনি পাকিস্তানের রাজনীতিকে একটি সুস্পষ্ট গণতান্ত্রিক পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হবেন। জাতীয় তাৎক্ষণিক স্বার্থ না কি দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থ সােহরাওয়ার্দীকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছিল এ কথা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও তিনি ১৯৫৫ সালের ১৫ এপ্রিলের কনস্টিটিউশন কনভেনশন অর্ডার ও পরের সংশােধনীসমূহ মেনে নেন। কনভেনশনে পাকিস্তানের দুই অংশের সমপ্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা এই সংশােধনীতে রাখা হয়। অবশ্য যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টারি পার্টি এক জরুরি বৈঠকের পর তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করে।৬৭ আওয়ামী লীগ স্পষ্টতই বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। আবুল মনসুরের ভাষায়:
সমগ্র পূর্ব বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। কিন্তু শহীদ সাহেবের খাতিরে আওয়ামী লীগ এ ধরনের অন্যায়ের প্রতিবাদ করা থেকে বিরত থাকে। আমরা তথা আওয়ামী লীগ কর্মীরা লজ্জায় মরে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছিলাম। মওলানা ভাসানী কনভেনশনের বিরুদ্ধে কলকাতা থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের মুখ রক্ষা করেন।৬৮
আওয়ামী লীগ ও কৃষক শ্রমিক পার্টিকে কনভেনশন প্রস্তাবের ব্যাপারে রাজি করানাের জন্য সােহরাওয়ার্দী তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইস্কান্দার মীর্যার সঙ্গে ঢাকা সফরে আসেন। পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিকভাবে যারা সােচ্চার ছিল তাদের অধিকাংশই এই দুই দলের প্রতিনিধিত্ব করতাে। আওয়ামী লীগ সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে জানায় যে তারা কনভেনশন প্রস্তাব মেনে নিতে সম্মত, যদি প্রত্যাবর্তনের পর মওলানা ভাসানীও এটিকে সমর্থন দেন। অবশ্য কৃষক শ্রমিক পার্টি কনভেনশন ও সমতা-সূত্র উভয় বিষয়ের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ জানায়, এবং শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য সার্বভৌম গণপরিষদের দাবি জানায়। এই দল কনভেনশন বয়কট করার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করে। পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগও অনুরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আবুল মনসুর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন: “গণতন্ত্র ও পূর্ব বাংলার স্বার্থের জন্য সব দলই সংগ্রাম শুরু করে, কেবল আওয়ামী লীগই নীরব থাকে।”৬৯
ইতােমধ্যে, করাচিতে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন দলের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি উত্থাপন করে। সেগুলি হলাে: (১) সংসদীয় সরকারের পুনরুজ্জীবন; (২) পাকিস্তানে ভাসানীর প্রবেশের ওপর আরােপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার; (৩) রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিদান।৭০
১৮
অবশ্য ১৯৫৫ সালের ১০ এপ্রিল ফজলুল হকের অনুসারীরা পূর্ব পাকিস্তানে সর্বপ্রথম গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার দিবস পালন করে। এরপর আওয়ামী লীগ ১৯৫৫ সালের ১৫ এপ্রিল উক্ত দিবস পালন করে। ১৯৫৫ সালের ২২ এপ্রিল ভাসানীর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। এবং এদিকে আওয়ামী লীগকে পলায়নপর মনােবৃত্তির জন্য বড় রকমের মূল্য দিতে। হয়। আওয়ামী লীগকে যুক্তফ্রন্ট থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং আতাউর রহমান, আবুল মনসুর আহমদ ও শেখ মুজিবুর রহমানকে যুক্তফ্রন্ট নেতা ফজলুল হককে সরানাের অপচেষ্টা, কেন্দ্রের সঙ্গে মাখামাখি ও ১৯৫৫ সালের ১৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এক জনসভায় গালিগালাজপূর্ণ ও সংসদীয় আচরণ বহির্ভূত ভাষা ব্যবহার করাসহ সাতটি অভিযােগে অভিযুক্ত করা হয়।৭১
আওয়ামী লীগের বৈঠকে যােগদানের উদ্দেশ্যে ভাসানীসহ ঢাকায় ফিরে আসার পূর্বে সােহরাওয়ার্দী দুটি তাৎপর্যপূর্ণ বিবৃতি প্রদান করেন। প্রথম বিবৃতিতে তিনি বলেন যে শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কনভেনশনের সঙ্গে জনগণ যদি সহযােগিতা করে, তাহলে দেশে নিম্নলিখিত তিনটি বিকল্প পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে: ক. বিপ্লব যা নব্য বিপ্লবী দল কর্তৃক নতুনভাবে সূচিত হবে; খ. সামরিক সমর্থনপুষ্ট অসামরিক একনায়কতন্ত্র; এবং গ. সামরিক আইন।৭২
তিনি তাঁর দ্বিতীয় বিবৃতিতে সমতা-সূত্রের সমর্থনে বলেন যে এটি লিয়াকত আলীর আমল থেকেই সাধারণভাবে স্বীকৃত বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে এবং এমনকি যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা কর্মসূচিতেও এ বিষয়ে কোনাে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়নি।৭৩
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি সােহরাওয়ার্দীর এই অবস্থানকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমােদন করার আগে ভাসানী তাঁকে দিয়ে নিম্নলিখিত অঙ্গীকারনামা স্বাক্ষর করিয়ে নেন:
আমি এতদ্বারা ঘােষণা করছি যে যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা কর্মসূচি ও যুক্তনির্বাচনের প্রস্তাবসমূহ শাসনতন্ত্রকে যতটা প্রভাবিত করে ততটাই যেন শাসনতন্ত্র বিষয়ক কনভেনশন মেনে নেন তার জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবাে। এটি করতে ব্যর্থ হলে আমি মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেবাে। ৭৪
এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন যে এই ধরনের একটি অঙ্গীকারনামার ক্ষমতাবলে ভাসানী সােহরাওয়ার্দীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আশা করেছিলেন। তবে এ থেকে যে বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হচ্ছে যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্টের কর্মসূচির প্রতি তখন পর্যন্ত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। অন্য কথায় বলা যায় যে আওয়ামী লীগ স্বীকার করতাে যে ২১-দফা কর্মসূচি আওয়ামী লীগেরও কর্মসূচি। ভাসানী তাঁর দলের অবস্থানের কথা সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে বলেন যে পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হবে এই আশা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি শুভেচ্ছার নিদর্শন ও সমঝােতা হিসেবে সমতা-সূত্র গ্রহণ করা হয়েছে এবং ৯২-ক ধারা অপেক্ষা
১৯
অধিকতর খারাপ কিছু আরােপ করা হবে না এই আশা নিয়ে শাসনতান্ত্রিক কনভেনশন মেনে নেওয়া হয়েছে।
বিদ্যমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্যাখ্যা আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিসঙ্গত এবং গৃহীত অবস্থান প্রায় অনিবার্য মনে হলেও কৃষক শ্রমিক পার্টি, নিজাম-এ-ইসলাম, গণতন্ত্রী দল, খেলাফত-ই-রব্বানী, পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস ও পরে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কনভেনশন বয়কট করায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ তৎসময়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থের বিষয়ে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালানাের অভিযােগে ফজলুল হক ভাসানী ও সােহরাওয়ার্দী উভয়কে অভিযুক্ত করেন।৭৫ যা হােক, ফেডারেল আদালতের রুলিং কনভেনশনের কার্যকারিতা রহিত করে দেয় এবং দ্বিতীয় গণপরিষদ গঠন করা হয়। আশ্চর্য বিষয় হলাে প্রতিনিধিত্ব করার সমতাভিত্তিক নীতি অপরিবর্তিত থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলি যারা ইতঃপূর্বে কনভেনশন বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা আবার কোনাে রকম প্রতিবাদ ছাড়াই দ্বিতীয় গণপরিষদে নির্বাচনের জন্য তাদের প্রার্থীদের মনােনয়ন দান করে। পূর্ব পাকিস্তানের একত্রিশটি মুসলিম আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তেরটি, কৃষক শ্রমিক পার্টি ষােলটি এবং মুসলিম লীগ দুটি আসন লাভ করে।
এ কথা সহজেই অনুমেয় যে সামরিক শাসন জারির আশঙ্কায় সােহরাওয়ার্দী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার জন্য কতিপয় সমঝােতা করতে রাজি ছিলেন। পশ্চাদ্দৃষ্টি প্রয়ােগ করলে এ বিষয়টিও নিশ্চিতরূপে প্রতীয়মান হয় যে একটি আশু সংঘর্ষমূলক বিরুদ্ধতা নীতি অবলম্বন করলেও তা থেকে মূলত কোনাে পৃথক ফল পাওয়া যেত না। বরং তা কর্তৃত্বের অধিকতর কেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতাে, যা সম্ভবত অনিয়ন্ত্রণযােগ্য সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতাে। এ কারণেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অবস্থানটি ছিল আশু রাজনৈতিক সঙ্কট পরিহারের পন্থাবিশেষ। সােহরাওয়ার্দী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের অন্তর্নিহিত অভিপ্রায় বাস্তবায়নের জন্য সার্বিক সমতা-নীতি ও এক ইউনিট-নীতি এ দুটোই ছিল অপরিহার্য। তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেন যে উক্ত প্রস্তাবে বিধৃত দুটি আঞ্চলিক ইউনিটের সার্বভৌমত্ব (যা ১৯৪৬ সালে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনে শিথিল করা হয়) যা বিদ্যমান কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন ক্ষমতা কাঠামাে অস্বীকার করে চলেছে তা কেবল সার্বিক সমতা-নীতি ও দুটি ফেডারেল ইউনিট-নীতির মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
কিন্তু সােহরাওয়ার্দী ও তাঁর দলকে কূটকৌশলের মাধ্যমে পরাভূত করা হয়। মারী চুক্তির অন্তর্নিহিত ভাবাদর্শের প্রতি অশ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। এই চুক্তিতে সার্বিক আঞ্চলিক সমতা ও যুক্ত নির্বাচনের বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। সােহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রিত্বকেই যে কেবল অস্বীকার করা হয় তা-ই নয়, তাঁকে বিজ্ঞ মন্ত্রিসভা থেকেও বাদ দেওয়া হয় এবং এভাবে ৯২-ক ধারা প্রত্যাহারের পরেও পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখা হয়। হৃত বিশ্বাসযােগ্যতা পুনরুদ্ধারের জন্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ
২০
তার মূল দাবি অর্থাৎ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও যুক্তনির্বাচনের কথা ১৯৫৫ সালের অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে পুনরায় জোর দিয়ে উল্লেখ করে এবং এইভাবে জাতীয় আইনসভায় তাদের অভিযান অব্যাহত রাখার বিষয় ব্যক্ত করে।
কাউন্সিল বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়ে আশিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কথা বলা হয়।৭৬ এখানে লক্ষণীয় যে এই বৈঠকেই দলীয় সদস্যপদের ধর্মনিরপেক্ষতাকরণের বিষয়টি সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়।
উক্ত বৈঠকের (দু’বছরের মধ্যে প্রথম অনুষ্ঠিত) সভাপতির ভাষণে মওলানা ভাসানী বলেন যে বিগত দু’বছরে তিনি ইউরােপের বিভিন্ন দেশ সফরকালে সেখানকার রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পদ্ধতি সম্পর্কে যে ‘অন্তরঙ্গ জ্ঞান লাভ করেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি পাকিস্তানে বিরাজমান পরিস্থিতিকে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে অবলােকন করতে সক্ষম এবং তিনি বলেন, “আমি বিশ্বাস করি যে লব্ধ অভিজ্ঞতা আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি গ্রহণে সহায়তা করবে।” তাঁর বক্তব্যের সারসংক্ষেপ থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে কল্যাণরাষ্ট্র বিষয়ক ধারণা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং তিনি পাকিস্তানকে একটি কল্যাণরাষ্ট্রের রূপদানের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন।৭৭ তবে তা এমন এক পাকিস্তানে করতে হবে যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন থাকবে। তিনি বলেন:
পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি বহু দিনের। পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সমৃদ্ধি এর ওপর নির্ভরশীল। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রদেশ ও উপজাতীয় এলাকাসমূহ একত্রীকরণের পর এই দাবির যৌক্তিকতা আরাে জোরদার হয়েছে। প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি ও মুদ্রাব্যবস্থা—এই তিনটি বিষয় ছাড়া যাবতীয় ক্ষমতা আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক সরকারের হাতে অবশ্যই ন্যস্ত করতে হবে।… নৌবাহিনীর সদর দফতর থাকবে পূর্ব বাংলায় এবং বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালিত হবে প্রাদেশিক সরকারের অধীনে। আমি আইনসভার সদস্যদের অনুরােধ করবাে তারা যেন আগামী অধিবেশনে এই আলােকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।৭৮
এই উপমহাদেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য সূচিত যে কোনাে উদ্যোগকে আওয়ামী লীগের সক্রিয় সমর্থন করার কথা ঘােষণা করে তিনি তাঁর অঙ্গীকৃত সাম্রাজ্যবাদবিরােধী অভিপ্রায় পুনরায় জোর দিয়ে উল্লেখ করেন।৭৯
পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান বিজড়ন পূর্ব পাকিস্তানে যে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করে তার পরিপ্রেক্ষিতে ভাসানীর বিবৃতি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বিশেষ করে যখন সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিবেদনে বলা হয়:
পাকিস্তানের দ্বৈত নীতি আমাদের মাতৃভূমিকে দুরবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রদেশগুলির সামাজিক রীতিনীতি নির্বিশেষে তাদের সহ-অবস্থান নীতিই কেবল পাকিস্তানের অগ্রগতি ও উন্নতির ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। আজ আওয়ামী মুসলিম লীগ পাকিস্তানের শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে নির্দ্বিধায় বিশ্বশান্তির জন্য আহ্বান জানাবে।৮০
তবে তিনি স্বীকার করেন যে এত বড় দায়িত্ব পালনের জন্য আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে ততটা শক্তিশালী নয়। তিনি বলেন যে এই সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণেই কেবল
২১
প্রতিক্রিয়াশীলচক্র বারংবার আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে কর্মীদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ও দলীয় শৃঙ্খলার প্রতি অধিকতর আনুগত্য দলকে তখনাে সম্পূর্ণ সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।৮১
সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতার কথা স্বীকার করায় তাঁর এ বিষয় সম্পর্কে অবহিত থাকার কথা প্রকাশ পায় যে জনগণ কর্তৃক দলের মতবাদ ও বিশ্বাসযােগ্যতাকে গ্রহণ করা অপেক্ষা নেতিবাচক ভােটই (মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ভােটদানের জন্য একটিমাত্র বিকল্প থাকায়) ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে দলের সাফল্য (যুক্তফ্রন্টের অঙ্গ হিসেবে) বয়ে আনে এবং এ কারণে তৃণমূলে পৌঁছানাের লক্ষ্যে একটি ক্যাডারভিত্তিক সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক জরুরি হয়ে পড়েছে। দল যখন ১৯৫৬-৫৭ সালে ক্ষমতায় আসে তখন একটি শক্তিশালী সংগঠনের ব্যাপারে এই অব্যাহত উদ্বেগ ধীরে ধীরে এক গম্ভীর অন্তর্দলীয় স্নায়ুযুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
১৯৫৫ সালের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে “মুসলিম” শব্দটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করা হলে ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সকলের জন্য দলের সদস্যপদ লাভের পথ উন্মুক্ত হয়। ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে কাউন্সিল অধিবেশনে সর্বপ্রথম বিষয়টি উত্থাপিত হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ভাসানী কর্তৃক জনমত যাচাই না হওয়া পর্যন্ত প্রশ্নটি অমীমাংসিত থাকে। ১৯৫৩ সালের অক্টোবর মাসে সভাপতির ভাষণে ভাসানী বলেন:
আওয়ামী লীগকে একটি অসাম্প্রদায়িক দলে পরিণত করার প্রশ্নটি দু’বছর আগেই উত্থাপন করা হয় এবং গত কাউন্সিল বৈঠকে যখন দলের গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত করা হচ্ছিল তখন নামকরণ সম্পর্কিত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব আমাকে অর্পণ করা হয় এবং জনমত যাচাই করে একটি বৈঠক আহ্বানের কথা আমাকে বলা হয়। বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা পর্যায়ের দলীয় কর্মীদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার পর আমি লক্ষ্য করি যে এই ভূখণ্ডের (তিনি অবশ্যই পূর্ব পাকিস্তানের কথা বলেছেন) অধিকাংশ জনগণ, বিশেষ করে, দলীয় কর্মীদের বৃহৎ অংশই দলের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের অনুকূলেই কেবল মত প্রকাশ করেনি, বরং তারা এটিকে তাদের জোর দাবি হিসেবে উপস্থাপন করে।৮২
যুক্ত নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের যে দাবি ছিল তারই অনুসরণে দলের ধর্মনিরপেক্ষতাকরণের বিষয়টি ছিল একটি পদক্ষেপ। এটি ছিল সময়ােচিত দাবি, কারণ অমুসলমান সম্প্রদায়, বিশেষ করে, হিন্দু সম্প্রদায় যারা নিজেরাই যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে ছিল তারা এবং ঐসব অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল সদস্য যারা অন্যথায় দল ত্যাগ করতাে তারাও এটি সমর্থন করে। এটা এমন একটা সময় ছিল যখন দলকে সুসংহত করার প্রশ্নটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এ সময়ে যদি রাজনৈতিকভাবে সচেতন অংশের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা দেখা দিতাে তাহলে তা হতাে দলের জন্য চরম আঘাতস্বরূপ।
এই কাউন্সিল বৈঠকে গঠনতন্ত্র প্রণয়ন বিষয়ক সাবকমিটির আহ্বায়ক আবদুল হামিদ চৌধুরী, এম. পি. এ. (১৯৫৪ সালের ৫ এপ্রিল নিয়ােগদান করা হয়) দলের গঠনতন্ত্র উপস্থাপন করেন এবং সাবজেক্ট কমিটির বৈঠকে এই গঠনতন্ত্রের ওপর দীর্ঘ এগারাে
২২
ঘণ্টা আলােচনার পর চূড়ান্তরূপে তা গৃহীত হয়।৮৩ এই গঠনতন্ত্রে বলা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এর গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচির অনুমােদনের ভিত্তিতে নিখিল। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তান আঞ্চলিক শাখা হিসেবে গণ্য হবে।” এতদ্বারা দলের প্রথম সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর পূর্বোক্ত দৃঢ় অবস্থানটিকেই বহাল রেখে এই প্রাদেশিক দলটির অনন্য নিজস্বতা নিশ্চয়ভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়। অপরপক্ষে, এইভাবেই পাকিস্তান সমাজের সার্বিক প্রতিষ্ঠানমাত্রিকতার প্রয়াসের এক ফলপ্রসূ অংশীদারিত্ব। থেকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই একরূপ স্বারােপিত সীমাবদ্ধতা আরােপ করে।
এছাড়া, প্রাদেশিক দলের মধ্যে সংবদ্ধ থাকার প্রবণতা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও দুই ধরনের বিবাদ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছিল। পরস্পরবিরােধী স্বার্থসম্বন্ধিত এই বিবাদ ছিল কিছুটা আদর্শগত ও কিছুটা ব্যক্তিগত। দলীয় রাজনীতিতে এই ধরনের অন্তর্দ্বন্দ্ব স্বাভাবিক। এবং এর পরিণতিতে মেরুকরণও হতে পারে। কিন্তু পরবর্তী আলােচনাসমূহ থেকে আমরা লক্ষ্য করবাে যে আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে অবশ্য এই সব অন্তর্দলীয় ঝগড়া-বিবাদ রাজনীতির সারবস্তুস্বরূপ ফলপ্রসূ মেরুকরণে ব্যর্থ হয়েছিল।
উপসংহারে বলা যায় যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ভেতরে বিভক্তি ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকা সত্ত্বেও এই দল পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিকভাবে সচেতন জনমানসের মৌলিক আকাক্ষা অর্থাৎ পাকিস্তানের জাতীয় পুনর্গঠনে অর্থপূর্ণ ভূমিকা পালনে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিল এবং সেই কারণেই এই দল প্রদেশে প্রভাব বিস্তারে সমর্থ হয়েছিল।
২৩
দ্বিতীয় অধ্যায়
বিপর্যয়
আগের অধ্যায়ের রূপরেখা থেকে পরিষ্কার যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের হাতেখড়ি হয়েছিল এক প্রাদেশিক বিরােধীদলীয় রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে। পরে এ সংগঠন এক জাতীয় বিরােধীদলের “নামধেয়” শাখা হয়ে ওঠে। এ দল পাকিস্তানে এক ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামাের ভেতরে এমন এক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয় যেব্যবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার ন্যায্য ভূমিকা পালন করতে এবং যথাযথ অংশীদার হতে সক্ষম হবে। এ লক্ষ্য অর্জনে দলটি কতকগুলি কৌশলগত আপােস করতে তৈরি ছিল।
দলীয় ফর্মুলা, দলের লােকায়তকরণের মততা সংঘাতসঙ্কুল ইস্যুগুলির নিষ্পত্তি হওয়ার আলােকে মনে হতে থাকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তার কর্মসূচি নিয়ে। এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। তবে বাহ্যত সাধারণ ঐকমত্যের গভীরে সংগঠনের নানা স্তরে মতানৈক্য ও অবিশ্বাসের অন্তঃস্রোতধারা প্রবাহিত ছিল। ১৯৫৬ সালে এ দল পূর্ব পাকিস্তানে ও কেন্দ্রে ক্ষমতায় অংশীদার হওয়ার পর প্রধানত দুটি ধারার সংঘাত দানা বেধে ওঠে।
প্রদেশ পর্যায়ে সংগঠন ও সংসদীয় শাখার নেতৃত্বে ছিলেন যথাক্রমে শেখ মুজিবুর রহমান ও আতাউর রহমান খান। তাঁদের দু’জনের মধ্যে আমলাতন্ত্র/প্রশাসনের মােকাবেলায় দলীয় সংগঠনের সঙ্গত ভূমিকার প্রশ্নে গুরুতর বিরােধ ছিল। প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও সে কারণে প্রশাসন বা সরকারপ্রধান হিসেবে আতাউর রহমান এক অরাজনৈতিক আমলা ব্যবস্থার সনাতন ধারণায় দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতে এ আমলা ব্যবস্থা কাজ করবে রাজনৈতিক চাপমুক্ত অবস্থায় সরকারের ঘােষিত নীতিমালা বাস্তবায়নে। আর সে জন্য শাসক দলের কর্মকর্তাদের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে না। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান জোরালাে এক ক্যাডারভিত্তিক দলীয় সংগঠন। নির্মাণের অভিলাষী ছিলেন। তিনি জানতেন, তাঁর দলীয় পরিকল্পনা ও কর্মসূচির প্রতি
২৫
আমলাদের বৈরীপ্রায় মনােভাবের কথা। আর সে জন্যই তিনি বিভিন্ন স্তরের প্রশাসক ও প্রশাসনের বিভিন্ন এখতিয়ারের ওপর দলীয় কর্মীদের নিরবচ্ছিন্ন তীক্ষ নজরদারির পক্ষপাতী ছিলেন। এ ব্যবস্থায় এমনও হতে পারে যে, দলীয় কর্মীদের পুরস্কার দিয়ে সংগঠনের প্রতি তাদের আনুগত্য নিশ্চিত করা গেলাে। এটা, ব্রিটিশ যে সনাতন ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা কায়েম করেছিল সেটিকে ছাপিয়ে বা কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টাও হতে পারে। একে সংসদীয় গণতন্ত্রের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসেবেও দেখা যায়। সংসদীয় গণতন্ত্রে দলের সংসদীয় শাখার ওপর দলীয় সংগঠনের শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি একটি নিরবচ্ছিন্নভাবে বিতর্কিত প্রশ্ন এবং এই দ্বন্দ্বে জড়িত ব্যক্তিত্বদের ভিত্তিতেই পরিস্থিতি তার নিজ খাতে এগিয়ে যায়। তবে সে যাই হােক দলীয় সংগঠনের শ্রেষ্ঠত্বে তাঁর বিশ্বাস ও সরকারের নীতি বাস্তবায়নে সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতা মনে করে আমলাদের প্রতি তাঁর অবিশ্বাস ছিল অনেকটা তাঁর বদ্ধ ধারণার মতাে।১
সম্ভাবনার দিক থেকে গুরুতর এই স্থানীয় প্রকৃতির সংঘাতকে ছাপিয়ে ওঠে তার চেয়েও আরাে বেশি জরুরি ও জটিল প্রকৃতির এমন কিছু সংঘাত যার ফলাফল বা পরিণতি ছিল দেশের জন্য অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। এগুলি ছিল পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি এবং দেশের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনমূলক অভ্যন্তরীণ নীতির সাথে সম্পর্কিত। এ দুটি বিষয়ই কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি সিদ্ধান্তের এখতিয়ার। এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান শুরু থেকেই অত্যন্ত পরিষ্কার ছিল। আওয়ামী লীগ জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি ও একটি ফেডারেল কাঠামাের আওতায় কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য সীমিত ক্ষমতাসহ পরিপূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষপাতী। কিন্তু হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী এই ঘঘাষিত নীতি থেকে সরে গিয়ে সিয়াটো (SEATO), সেন্টো (CENTO) এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সামরিক চুক্তিতে অংশীদার হওয়ার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের সাথে পাকিস্তানের জোটভুক্তি নীতির প্রবক্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। আপাতদৃষ্টিতে তিনি স্বায়ত্তশাসন। ইস্যুর অগ্রাধিকারমূলক গুরুত্বের মাত্রাও লঘু করে বাহ্যত পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গত ও ন্যায্য স্বার্থের প্রশ্নে আপােস করেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানীই প্রধানত এই সব বিচ্যুতির বিষয় আলােকপাত করে নেতা হিসেবে সােহরাওয়ার্দীর বৈধতার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন। ১৯৫৫ সালের শেষের দিক থেকে জনাব সােহরাওয়ার্দী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য ছিলেন, প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন। বিশেষ করে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী পদে তখনই এসব ইস্যুকে ঘিরে সঙ্কট ঘােরতর হয়ে উঠছিলাে। সােহরাওয়ার্দীর মােকাবেলায় ভাসানীর একটি বাড়তি সুবিধে ছিল। আওয়ামী লীগ সংগঠনের মূল্যায়নে দলের সংসদীয় শাখার জাতীয় পর্যায়ের কাজ সন্তোষজনক ছিল না। এক অর্থে এটি দুই নেতার মধ্যে এক লড়াইও বটে—এক নেতা প্রাদেশিক স্তরের হলেও তাঁর ছিল গণভিত্তি, অন্যজন জাতীয় পর্যায়ের নেতা যার তৎপরতা প্রধানত নগরভিত্তিক ও সমাজের শিক্ষিত শ্রেণীর মাঝে। এই বিবাদে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দু’জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা তাদের জাতীয় নেতার পক্ষাবলম্বন করেন। এতে নামধেয় প্রাদেশিক দলপ্রধান
২৬
তাদের সমর্থন হারান। চূড়ান্ত বােঝাপড়ায় সােহরাওয়ার্দী প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ও সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থনে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ী হলে দলে ভাঙন দেখা দেয় এবং আরেকটি জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক দলের অভ্যুদয়ের পথ অবারিত হয়। এই দলের নাম ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। এ দলের কর্মসূচি অধিকতর ব্যাপক পরিসরের বলেই ধরে নেওয়া হয়।
পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে ভাসানী-সােহরাওয়ার্দী বিরােধের বিষয়টি সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই বােধগম্য হয়ে ওঠে আর সেটি দিবালােকের মতােই স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৯৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারি কাগমারীতে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে। সভাপতির ভাষণে মওলানা ভাসানী মুসলিম লীগের পরিপূর্ণ ধ্বংসের কারণগুলি সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে হুঁশিয়ারি জ্ঞাপন করেন। প্রসঙ্গত তাঁর জিজ্ঞাস্য ছিল: “রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদের আদর্শ কী হবে?” আর এর জবাবও তিনি দেন ফরাসী বিপ্লবের “নতুন দর্শন ও মূল্যবােধের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে যাতে রয়েছে ভাবপ্রকাশ, সংগঠন, জীবিকার্জন ও বাকস্বাধীনতার ধারণাগুলি। তিনি ঘােষণা করেন:
আমাদের আজকের লক্ষ্য হলাে, পাকিস্তানের জনসাধারণের জন্য এসব মৌলিক অধিকার আদায় … এদেশের মানুষ অবশ্যই এক গণতান্ত্রিক জীবনধারা ও উৎপাদন ব্যবস্থা কায়েম করবে … এতে কোনােরকম আপােসরফা করা হবে না। জনগণ যেমন হিটলারি ফ্যাসিবাদ সহ্য করবে না বা কোটারি শাসন মেনে নেবে না, তেমনি কমিউনিজমকে বরণ করবে না।২
তিনি প্রস্তাব করেন, পাকিস্তানের কমবেশি লক্ষ্য হওয়া উচিত “ব্রিটেনের প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করা। কেন্দ্রে ক্ষমতা আংশিক করায়ত্ত করার পর থেকে আওয়ামী লীগের অর্জিত সাফল্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৭৫ শতাংশ অর্জিত হলেও ২৫ শতাংশ অনর্জিত রয়ে গেছে এখনাে। আর সে জন্য প্রচুর কাজ করার রয়ে গেছে। ২১দফা ও আওয়ামী লীগ ম্যানিফেস্টোর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল একমাত্র পররাষ্ট্র বিষয়, দেশরক্ষা ও মুদ্রা ব্যবস্থা ছাড়া সকল বিষয় প্রদেশের আওতায় নিয়ে আসা। কেননা মনে করা হয়েছিল যে, পূর্ব পাকিস্তান যে বিদেশী বিনিময় মুদ্রা আয় করে তা যদি সে নিজের কাজে লাগাতে না পারে, শিল্প ও বাণিজ্য, রেল ও ডাকবিভাগকে যদি প্রদেশের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে না নিয়ে আসা যায়, পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম—দুই অংশের অর্থনীতি আলাদা—এর স্বীকৃতি যদি না আসে তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তিনি তাঁর শ্রোতাদের মনে করিয়ে দেন, “আমরা সংখ্যার সমতা মেনে নিয়েছি দেশের সকল বিষয়ে আমরা সমান আচরণ পাবাে বলে, দেশের মােট ব্যয়ের ৭৫ শতাংশ থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্য নয়।” তিনি এ কথাও উল্লেখ করেন, অত্যন্ত বেশি ঘনবসতির কারণে পূর্ব পাকিস্তানে কৃষি খাতে বিরাট আকারের উন্নয়ন সম্ভব নয় যা পশ্চিম পাকিস্তানে সম্ভব। আর সে কারণে এর বৈজ্ঞানিক প্রতিকার হতে পারে পূর্ব পাকিস্তানকে শিল্পায়িত আর
২৭
পশ্চিম পাকিস্তানে আধুনিক যান্ত্রিক কৃষির প্রবর্তন করে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রয়ােজনের ওপরে জোর দেন। এ ব্যাংক থাকবে প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ভাসানীর এসব কথা আসলে কলিন ক্লার্ক ও এ. সাদেকের মতাে কিছু অর্থনীতিবিদের সুপারিশের প্রতিধ্বনি ছিল। জনাব সাদেকের মতাে অর্থনীতিবিদ এবং এম. এ. চৌধুরী ও আব্দুর রাজ্জাকের মতাে বিদগ্ধ ব্যক্তিবর্গের সহায়তায় আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারিয়ানরা গণপরিষদ ও অন্যত্র ব্যাপক আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা সংবলিত এক ফেডারেল শাসনতন্ত্রের পক্ষে বলতে গিয়ে ইতঃপূর্বে এসব বক্তব্য দিয়েছিলেন। এগুলিকেই পরে ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের (ভাঙন পরবর্তী ও পুনরুজ্জীবন পরবর্তী) ৬-দফায় রূপান্তরিত করা হয়।৩
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নে ভাসানী তার আগের অবস্থানের পুনরাবৃত্তি করে এশিয়া ও আফ্রিকার বিশাল অঞ্চলকে সকল সাম্রাজ্যবাদী প্রভাবমুক্ত করার জন্য এশীয় ও আফ্রিকীয় জনগণের মাঝে বন্ধুত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে এক বলিষ্ঠ ও স্বাধীন নীতি গ্রহণের সুপারিশ করেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, “সাম্রাজ্যবাদীদের উস্কে দেওয়া বিরােধে নিজেরা জড়িত হলে তা হবে আত্মহত্যার শামিল।” ডলার, রুবল কোনাে কিছুই কোনাে দেশে উন্নয়ন নিয়ে আসবে না—এ সাবধানবাণী উচ্চারণ করে তিনি এ ধরনের নীতির ব্যর্থতার উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে চিয়াং কাইসেকের কথা উল্লেখ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, কাশ্মীর হলাে পাক-ভারত মৈত্রীর ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। আর তাই তিনি তাঁর ভাষণে কাশ্মীরে অবাধ ও নিরপেক্ষ গণভােট অনুষ্ঠানে সম্মত হয়ে এ সমস্যা নিরসন করার জন্য ভারতের জনসাধারণ ও ভারতের “শান্তিপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী নেহরুর কাছে আবেদন জানান।
দলের কাজ সম্পর্কে ভাসানীর এই অভিমতে দলের ভেতরে সাংগঠনিক ও আদর্শিক উভয় ক্ষেত্রে কতকগুলি ঘটনাপ্রবাহের বিষয়ে তাঁর আপত্তির প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রয়েছে। এতে তিনি কী চান তা পরিষ্কার। যেমন দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, তিনি বলেন, দলের কর্মীরা হলাে “দেশের জীবনদায়িনী রক্তপ্রবাহ” আর সে কারণে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা সরকারের উচিত তাদের মতামতকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া। আর সেই পথে দলের অপেক্ষাকৃত নবীন ও প্রবীণ সদস্যদের মধ্যে আদর্শিক উপলব্ধি গড়ে তােলার জন্য নিরলস প্রয়াসী। হওয়া। আর শুধুমাত্র কর্মীদের বেলায় শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নিলেই চলবে না, প্রতিষ্ঠিত ও উদীয়মান নেতাদেরকেও দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে। যাদের দলত্যাগ অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে তাদেরকে দলে পুনরায় নেওয়ার বিরুদ্ধেও তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
তিনি আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও পার্লামেন্ট সদস্যদের মনে করিয়ে দেন যে, দলের সংসদীয় শাখা মূল দলেরই অংশবিশেষ। সে কারণে তাদেরকে দলের নীতি, আদর্শ ও গঠনতন্ত্র মেনে চলতেই হবে। বস্তুত তিনি এসব বক্তব্যে দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের রেষারেষিতে শেখ মুজিবুর রহমানকেই সমর্থন করেছিলেন। কথাটা এভাবেও বলা যায় যে, সাধারণ সম্পাদক সভাপতির মতাে
২৮
একই অভিমত পােষণ করতেন। কিন্তু তবু এই অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিও দলের এ দুই কর্মকর্তাকে একত্রে রাখতে পারেনি। পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক নানা প্রশ্নে তারা আলাদা হয়ে যান। পরের কয়েক বছরে শেখ মুজিবের কার্যপরিচালনা কৌশল থেকে আভাস পাওয়া যায়, ভাসানীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কোনাে মৌলিক মতপার্থক্যের কারণে বদলায়নি। বরং তা বদলায় স্বল্পমেয়াদী বিষয়ের কারণে। এর অন্যতম কারণ ছিল প্রতীক্ষিত ও প্রত্যাশিত নির্বাচন। পাকিস্তানের শাসকচক্রের সঙ্গে দরকষাকষিতে একটানা মার খেয়েও সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একাংশ তখনাে স্পষ্টত বিশ্বাস পােষণ করতাে যে, এমনকি ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের আওতার মধ্যে হলেও জাতীয় পর্যায়ে নবনির্বাচিত আইনসভার সদস্যদের সুবাদে আওয়ামী লীগ স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তার দাবি আদায়। করতে সক্ষম হবে। আর তাই কেন্দ্রীয় ক্ষমতা কাঠামাের মােকাবেলায় একটা নতজানু। ভূমিকা অবলম্বন করা হয় প্রত্যাশিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া অবধি। এবং এটিকে সর্বোত্তম কৌশল বলেই ধরে নেওয়া হয়। ভাসানী অনতিবিলম্বে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের প্রস্তাব করেছিলেন। ফলে ধরে নেওয়া যায় যে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা তিনিও নাকচ করে দেননি। অবশ্য সব সত্ত্বেও তিনি তাঁর প্রত্যয়ের পুনরুক্তি করে বলেন, পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে সমঝােতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি পাকিস্তানের উভয় অংশের পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসন লাভের ওপর নির্ভরশীল।
আওয়ামী লীগের পরের কয়েক বছরের রাজনীতির মূল্যায়ন করলে পরিষ্কার লক্ষ্য করা যাবে ভাসানী কাগমারী সম্মেলনে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা এই দলের কৌশল ও কর্মসূচির প্রকৃতি স্থির করে দিয়েছে, যদিও পরবর্তীকালে মওলানা কেবল অন্য একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বই দেননি বরং বেশিরভাগ সময়ই তিনি আওয়ামী লীগকে তাঁর সমর্থন জানাননি। উদাহরণস্বরূপ, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে জনগণের বেঁচে থাকার অধিকার বলে তিনি যে উল্লেখ করেন তা ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে এই দল কর্তৃক জনগণকে সংগঠিত করার উপায় হয়ে উঠলেও মওলানা আওয়ামী লীগের সমালােচনায় মুখর ছিলেন।
রাজনৈতিক দাবিদাওয়ার প্রশ্নে দলীয় বিচ্যুতির প্রবণতাগুলিকে সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরার সাথে সাথে, স্বীয় রাজনৈতিক বিচক্ষণতার সুবাদে ভাসানী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা শােষণের উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহারের বিরুদ্ধে দলকে সতর্ক করে দেন। মওলানা ভাসানীর কাছে ধর্ম কেবল আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জন্যই প্রয়ােজন। ভাসানী কাগমারী সম্মেলনে। তার বক্তৃতার শেষে তাঁকে দলের সভাপতির পদ থেকে অবসরদানের ও দলের একজন। সাধারণ কর্মী হিসেবে কাজ করতে দেওয়ার আবেদন জানান। কারণ হিসেবে তিনি তাঁর দৈহিক অসুস্থতা ও বার্ধক্যের কথা উল্লেখ করেন। নিঃসন্দেহে বলা যায়, দল যে তাঁকে দলীয় নেতৃত্ব থেকে অবাধে বাদ দিতে পারে এটি তারই ইঙ্গিত। আসলেও অল্পকালের মধ্যেই দল তার নেতৃত্ব ছাড়াই চলার সিদ্ধান্ত নেয় যদিও ঐ পর্যায়ে তিনি যে সব নীতিকে সমুন্নত রাখতে লড়াই করেছেন দল সেগুলি বাতিল করেনি।
২৯
তাঁর এ ভাষণের সাথে প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষাপট বিচার-বিবেচনা করলে সংঘাত-বিরােধের একটা পরিষ্কার আভাস পাওয়া যায়। কিছু পর্যবেক্ষক ও অন্যান্যের লিখিত বিবরণ থেকে নিশ্চিত জানা যায় যে দুটি বিবদমান উপদলের মধ্যে তখন তীব্র বিরােধ-সংঘাত চলছিল। কাগমারী অধিবেশনে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ভাসানী এ কথা স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন (সাবজেক্ট কমিটি/ওয়ার্কিং কমিটি বৈঠকে) যে, পশ্চিম পাকিস্তান যদি পূর্ব পাকিস্তানের দাবিগুলি স্বীকার করে না নিতে পারে তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের উচিত হবে পশ্চিম পাকিস্তানকে বিদায় জানানাে।৪ ভাসানী এ রকম সরাসরি হুমকি দিয়ে থাকলে তা ছিল একজন বিক্ষোভপ্রবণ রাজনীতিকের স্পষ্ট অভিব্যক্তি যার আভাস আওয়ামী লীগের রাজনীতিকরা জাতীয় আইনসভায় ইতােমধ্যে দিয়েছিলেন।৫
কাগমারী সম্মেলনে পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চরম পর্যায়ে চলে যায়। এমনকি, সােহরাওয়ার্দীও ইস্তফা দেওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু তাঁর অনুসারী আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিবাদে এগিয়ে এসে ভাসানীর তখনকার প্রধান অবলম্বন যুব আওয়ামী লীগ সদস্যদের পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করে ভাসানীকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার চেষ্টা করেন।৬
অবশ্য, সম্মেলনের প্রস্তাব অনুসারে ভাসানীকে প্রতিরক্ষা ও সামরিক চুক্তির ব্যাপারে আওয়ামী লীগের ঘােষিত নীতি লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়। কিন্তু সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন সংসদীয় দলকেও আবার কেন্দ্রে কোয়ালিশনে থেকে কাজ চালিয়ে যাওয়ারও অনুমতি দেওয়া হয়। এর আগে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ১৯৫৫ সালের অক্টোবর ও ১৯৫৬ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত দলীয় কাউন্সিল অধিবেশনগুলিতে সামরিক জোট আঁতাত প্রশ্নে নিজ অবস্থান ব্যক্ত করে। অক্টোবর ১৯৫৫ অধিবেশনে আওয়ামী লীগ সামরিক চুক্তিগুলিকে পার্লামেন্টে উপস্থাপন করার দাবি জানায় ও বলে যে, এভাবে যে চুক্তিগুলি অনুমােদন পেতে ব্যর্থ হবে সেগুলি বাতিল হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে পার্লামেন্টের পূর্বানুমােদন ছাড়াই এ ধরনের কোনাে চুক্তি সম্পাদন করা হলে চুক্তিগুলি সম্পাদনের তিন মাসের মধ্যে অনুমােদনের জন্য পার্লামেন্ট সমীপে পেশ করতে হবে। পরের বছরের কাউন্সিল অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এক স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের আবেদন জানায় এবং পাকিস্তান যে জন্য মুসলিম বিশ্বের সহানুভূতি হারিয়েছে সেই সামরিক আঁতাত বা জোটের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করে।৭ অবশ্য, সােহরাওয়ার্দী সামরিক জোটের প্রতি সমর্থন জানান। তিনি বলেন, শূন্যের সাথে শূন্য যােগ করলে যােগফল শূন্যই হয়।
নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পশ্চিম পাকিস্তানী শাখাগুলি সাধারণত স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে মত প্রকাশ করে। তবে দলের কেন্দ্রীয় সংগঠন সােহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী পদের দায়িত্বভার গ্রহণ না করা অবধি এ বিষয়ে কোনাে দৃঢ় মত ব্যক্ত করেনি। পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সরকারের অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতি অনুমােদন করে বলে যে দাবি। ওঠে সে বিষয়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু, করাচি ও লাহােরের দলীয় সদস্যরা
৩০
প্রশ্ন তােলে ও বিষয়টি আলােচনার জন্য ওয়ার্কিং কমিটির পূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠানের দাবি জানায়। ১৯৫৭ সালের ৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক উল্লিখিত মর্মে প্রদত্ত বিবৃতি সঠিক বলে জানায়। এই বৈঠক কেন্দ্রীয় দলের (নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের) সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক উসমানীর দল থেকে বহিষ্কারের বিষয়ও অনুমােদন করে। এই বহিষ্কারের কথা পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে তাঁর সাথে মতপার্থক্যের দরুন শহীদ সােহরাওয়ার্দী আগেই ঘােষণা করেছিলেন। এরও আগে ১৯৫৭ সালের ২৫-২৬ জানুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নির্ধারিত কনভেনশন ১৯৫৭ সালের মে অবধি মুলতবি করা হয়।৮ পশ্চিম পাকিস্তানে প্রচ্ছন্ন ও ধূমায়িত অসন্তোষ ও বিরােধিতার বহিঃপ্রকাশ অচিরেই ঘটে। ১৯৫৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের কাগমারীতে যখন ভাসানীসােহরাওয়ার্দী সংঘাত মােকাবেলা চলেছে তখন পশ্চিম পাকিস্তানের লাহােরে পশ্চিম পাকিস্তানের আনুমানিক একশ’ আওয়ামী লীগ সদস্য এক কনভেনশনে পশ্চিম পাকিস্তান। আওয়ামী লীগের প্রতি সােহরাওয়ার্দীর অগণতান্ত্রিক মনােভাবের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে তার নিন্দা করে। আরাে তাৎপর্যের বিষয় হলাে এই যে, কনভেনশন মওলানা ভাসানীর প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করে।”৯
১৯৫৭ সালের মার্চে পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাত সদস্যের এক কমিটি (বিরুদ্ধ মতাবলম্বী গ্রুপ) ও পাকিস্তান ন্যাশনাল পার্টি গঠন করা হয়। গফফার খান, ইফতেখার উদ্দিন, উসমানী, মানকি শরীফের পীর, আবদুল মজিদ সিন্ধি, আবদুল গফফার ও মাহমুদ আলী কাসুরিকে নিয়ে নিখিল পাকিস্তানভিত্তিক একটি দল গঠন করাই ছিল এর উদ্দেশ্য।১০
পূর্ব পাকিস্তানে কাগমারী সম্মেলনে পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে সােহরাওয়ার্দীর ভূমিকাকে কেন্দ্র করে শেষ পর্যন্ত দলের আনুষ্ঠানিক ভাঙন এড়ানাে সম্ভব হলেও তা স্পষ্টত আওয়ামী লীগের অবস্থান বিরুদ্ধ হওয়ায় দলীয় কাঠামাের বুনিয়াদ পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অংশেই গুরুতর রকমে দুর্বল হয়ে পড়ে। স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে মওলানা ভাসানী ঘােষণা করেন: “এই একটি ইস্যুর প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ এতই ঐক্যবদ্ধ যে ছােট-বড়, নতুন-পুরানাে যে রাজনৈতিক দলই হােক না কেন স্বায়ত্তশাসনের দাবির বিরােধিতা করে পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে টিকে থাকার আশা করতে পারে না।” মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমানের অনুপস্থিতিতে ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দানের পুনরুক্তি করে এক প্রস্তাব গৃহীত হলে সুনিশ্চিত বােঝা যায় যে মওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানের জননেতাদের মনােভাব সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।১১ ঐ সময় পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গােলাম আলী খান তালপুর এক বিরূপ মন্তব্য করাতে প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। আওয়ামী লীগের অন্যতম পূর্ব পাকিস্তানী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এম. এ. খালেক এর জবাবে বলেন, এ ধরনের প্রতিনিধিত্বমূলক সিদ্ধান্ত যদি কারও কাছে এমন মনে হয় যে, সেটি পাকিস্তানের দুশমনদের তুষ্ট করেছে তাহলে তাে যুক্তির খাতিরে বলতেই হয় সকল পূর্ব
৩১
পাকিস্তানই পাকিস্তানের দুশমন। কিন্তু খােদ সােহরাওয়ার্দী বিষয়টিকে এক রাজনৈতিক ভেলকি বলে অভিহিত করেন।১২ তিনি এমন মন্তব্যও করেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায় যে, স্বায়ত্তশাসনের দাবি জনসাধারণের দাবি নয় বরং নেতারা যারা এ বিষয়ে সােচ্চার তারাও এর সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে পারবেন কিনা সে বিষয়ে তিনি সংশয় প্রকাশ করেন। ভাসানী এর পাল্টা জবাব দেন ১৯৫৭ সালের ৫ এপ্রিল। ঐ দিন তিনি সােহরাওয়ার্দী স্বাক্ষরিত ২১-দফা বাস্তবায়নের অঙ্গীকারপত্র সংবাদপত্রে প্রকাশ করেন।১৩
দৃষ্টত আওয়ামী লীগের দলীয় সংগঠন রীতিমতাে অবিন্যস্ত, বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। যারা দলীয় ম্যান্ডেট লঙ্ন করে কেন্দ্রীয় আইনসভায় পররাষ্ট্রনীতির প্রতি সমর্থন জানায় তাদের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগের ১৩ জন এমপির মধ্যে কেবল নূরুর রহমান দলীয় ম্যান্ডেটের প্রতি অবিচল থাকেন। আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমান আইনসভার ভােট গ্রহণের সময় ঢাকায় ছিলেন। তাঁরা পরে জনাব সােহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্রনীতি অবস্থানের প্রতি তাদের সমর্থন ঘােষণা করে এক বিবৃতি দেন।১৪ অবশ্য যদি দলীয় ম্যান্ডেটের প্রতি ঐ ১৩ জন এমপি একযােগে বিশ্বস্ত থাকতেন তাহলেও সংখ্যাগত দিক থেকে তার কোনাে প্রভাব থাকতাে না। যা হতাে, তা হলাে এ সংহতি দলকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করতাে। এই ভাঙনই পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষিতে পূর্ব পাকিস্তানের সামর্থ্যকে দুর্বল করে দেয়।
১৯৫৭ সালের ৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি বৈঠকে কথিত সােহরাওয়ার্দীপন্থীরা কথিত ভাসানীপন্থীদের পরাজিত করে। ভাসানীপন্থী যুবলীগার ও দলীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অলি আহাদকে শৃঙ্খলাজনিত কারণে বহিষ্কার করা হলে তার প্রতিবাদে অন্য নয়জনও পদত্যাগ করেন। ১৩ ও ১৪ জুন ঢাকায় এক কাউন্সিল বৈঠক ডাকা হয়। এই বৈঠকের আলােচ্যসূচির অংশ ছিল ওয়ার্কিং কমিটিতে ২৫ জন সদস্যের মনােনয়নদানের বেলায় সভাপতির ক্ষমতা খর্ব করার জন্য এক সংশােধনীর ব্যবস্থা। এ কথাও ঘােষণা করা হয় যে, ভাসানীর ইস্তফাদানের বিষয়টিও (১৯৫৭ সালের মার্চে সাধারণ সম্পাদকের কাছে এক পত্রে তিনি ঐ ইস্তফা দেওয়ার কথা বলেন বলে জানা যায়) বিবেচনা করা হবে। কয়েকজন পর্যবেক্ষকের বিবরণ অনুযায়ী জুনের ঐ কাউন্সিল বৈঠকে কী হবে না হবে তার সব কিছুই ম্যানেজ করে রেখেছিলেন কথিত সােহরাওয়ার্দীপন্থী গ্রুপ যার নেতৃত্বে ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। এর মধ্যে মওলানা ভাসানী উত্তরবঙ্গে এক কৃষক সম্মেলন ডেকেছিলেন। তিনি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। আত্মশুদ্ধির জন্য এক সপ্তাহব্যাপী অনশনও শুরু করেছিলেন। জুনের দলীয় কাউন্সিল বৈঠকে যােগ দেওয়ার আগ্রহ তাঁর ছিল না বরং একটি নতুন দল গঠনের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল তাঁর কাছ থেকে।১৫
বিভিন্ন খবরাখবর অনুযায়ী ঐ কাউন্সিল বৈঠকে তুমুল হট্টগােল, সহিংসতা ও অগঠনতান্ত্রিক চাতুরির মধ্য দিয়ে সরকারের অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে এক প্রস্তাব অনুমােদিত হয়। এসব ঘটনার নেপথ্যে হাত ছিল সােহরাওয়ার্দীপন্থী গ্রুপের। এছাড়া, যুবলীগারদেরকেও
৩২
দলছাড়া করার ব্যাপারে আরাে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত প্রস্তাবে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন বাস্তবায়িত করার জন্য ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র সংশােধনের আহ্বান জানানাে হয়। অবশ্য, সাধারণ সম্পাদকের রিপাের্টে উল্লেখ করা হয় যে, আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ এই ইস্যু নিয়ে মাঠে নামবে। ভাসানীর ইস্তফা গৃহীত হলাে না । তিনি এ বিষয়ে সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দিয়ে কাউন্সিলরদের বললেন, ঐ কাউন্সিল বৈঠকের অধিবেশনে যে সব ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে সেগুলি সৎ কিনা তা নিজেদের বিবেকের কাছে জিজ্ঞেস করে দেখতে। তিনি এ কথাও বলেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়, ‘মুজিব এ কথা বুঝতে পারছে না যে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন হাসিল করতে হলে তাকে অবশ্যই পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে অর্থাৎ সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হবে। কেননা, সামরিক চুক্তির আওতায় পাওয়া অস্ত্র যে কেবল পূর্ব পাকিস্তানীদের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করার জন্য ব্যবহৃত হবে—এ কেবল অন্ধ মানুষই দেখতে অক্ষম।”১৬ ভাসানী ১৯৫৭ সালের ২৫-২৬ জুলাই ঢাকায় এক গণতান্ত্রিক কনভেনশন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাথে তার সম্পর্কচ্ছেদের বিষয়টি পাকাপােক্ত করেন। এ কনভেনশনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হয়। দলের সভাপতি হন মওলানা ভাসানী।১৭ পরের বেশ কয়েকটি বছর এই দল পাকিস্তানের বামপন্থীদের জন্য ছত্রচ্ছায়া হিসেবে কাজ করে।
সােহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার অন্যতম মন্ত্রী (কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদের সন্দেহ ছিল এই যে, আওয়ামী লীগের ভাঙন ও ন্যাপ গঠনের নেপথ্যে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্যা জড়িত থাকতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযােগী হিসেবে কাগমারী অধিবেশনের আগে থেকেই তিনি জানতেন যে, প্রেসিডেন্ট মীর্যা ভাসানীকে গ্রেপ্তার করার জন্য সােহরাওয়ার্দীকে চাপ দিচ্ছিলেন। আর সেটি না করতে পেরে সেই তিনিই হয়তাে ভাসানীকে রাজি করিয়েছেন আওয়ামী লীগ ছেড়ে এক নতুন দল গঠন করতে।১৮ এ সময় প্রায় সবাই জানতাে যে জাঁকজমকপূর্ণ কাগমারী সম্মেলনের সংগঠক ভাসানীকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল ইস্পাহানীরা যাদের ব্যবসার স্বার্থ নিহিত ছিল পূর্ব পাকিস্তানে আর একই সাথে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন চক্রেরও ঘনিষ্ঠ ছিল। তারা হয়তােবা মীর্যার কথিত চক্রান্তে সহযােগিতা করেছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে যে রাজনৈতিক সংহতি ও ঐক্য গড়ে উঠছে সেটিকে ধ্বংস করতে। এও অসম্ভব নয় যে, দলীয় কর্মসূচি অনুসরণের ব্যাপারে সােহরাওয়ার্দীর আন্তরিকতা বা নিষ্ঠায় আস্থাবান হতে না পেরে (কিংবা সােহরাওয়ার্দীর উদ্যোগ সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে) ও একই সময়ে জাতীয় রাজনীতির কৌশলগত অবস্থানে থাকার কারণে সােহরাওয়ার্দীকে রুখতে না পেরে তিনি চাইছিলেন, নিখিল পাকিস্তানভিত্তিক একটি সভাপতির পদ হাসিলের মাধ্যমে নিজের প্রাদেশিক নেতার মর্যাদাকে জাতীয় নেতার মর্যাদায় উন্নীত করে সােহরাওয়ার্দীর সাথে লড়তে, যাতে করে প্রয়ােজনে তিনি সমান শক্তিতেই তাঁর সাথে যুঝতে পারেন। এও খুবই সম্ভব ইস্কান্দার মীর্যা ভাসানীর নিজের নেওয়া কৌশলের সুযােগটি সদ্ব্যবহার করেছিলেন।
৩৩
নাটের গুরু যে বা যারাই হয়ে থাকুক না কেন ভাসানীর আপােসহীন মনােভাব এমন সময় আওয়ামী লীগের ভাঙন ত্বরান্বিত করে যখন দলটি বহু প্রতিকূলতার মুখে সবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামােতে ঠাই করে নিতে কোনােমতে সমর্থ হয়েছে আর একই কারণে স্বীয় সহজাত সীমাবদ্ধতার চৌহদ্দির মধ্য থেকেই তার উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই ক্রান্তিকালে ভাসানী নিজেই অবশ্য উল্লেখ করেছিলেন যে, আইনসভার বাইরে ও ভেতরে দলের যুগপৎ সংগ্রাম পরিচালনার আবশ্যকতা রয়েছে।১৯ দলের ভাঙন প্রদেশকেন্দ্র উভয় পর্যায়েই সংগঠনের শক্তিকে দুর্বল করে দেয়। অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, খােদ ন্যাপ স্বকীয় অসঙ্গতি ও নড়বড়ে নীতির পরিচয় দেয়। ফলে তাতে না সাহায্য হয় দল গঠনে, না উপকার হয় পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থের যা নাকি ছিল ভাসানীর সমসাময়িক রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক।
ভাসানীপন্থীদের মনােভাব আরাে কঠোর হয়ে ওঠার জন্য সােহরাওয়ার্দীপন্থী গােষ্ঠীও। কম দায়ী ছিল না। তারা যদি এই বিশ্বাস করতাে যে, সােহরাওয়ার্দীর বাহ্যত অসঙ্গতি সত্ত্বেও তিনি আসলে পূর্ব পাকিস্তান যাতে তার ন্যায্য-পাওনার যতটা বেশি সম্ভব আদায়ের লক্ষ্যে সঠিক পথে এগিয়ে চলেছেন তাহলে, তারা কথিত প্রগতিবাদীদের বহিষ্কার করে ভাসানীকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টার পরিবর্তে এ বিষয়ে দলের ভেতরে একটা ঐকমত্যের জন্য প্রয়াসী হতে পারতাে। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে কাজটি আদৌ সম্ভব ছিল কি? দলের ভেতরে প্রগতিবাদীদের থাকতে দিলে আওয়ামী লীগের শেষ পর্যন্ত পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে সােহরাওয়ার্দীর নীতি অবস্থান অস্বীকার করা ছাড়া গত্যন্তর থাকতাে না। আর সে ক্ষেত্রে হয় দলের সাথে সােহরাওয়ার্দীর সম্পর্ক ছিন্ন হতাে নইলে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা থেকে বেরিয়ে আসতে হতাে। আর এ দুইয়ের যেটিই হােক আওয়ামী লীগ ক্ষমতার কাঠামাের সাথে যে সামান্য যােগসূত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল সে যােগসূত্র হারিয়ে যেতাে। বলাবাহুল্য ক্ষমতার এই কাঠামােটি সামগ্রিক সমতার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের দাবির প্রতি প্রচ্ছন্ন-প্রকাশ্য উভয়ত বৈরী ছিল।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠার দাবি মেটানাের লক্ষ্যে সােহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার কিছু নীতি সিদ্ধান্তের প্রবল সমালােচক ছিল কিছু স্বার্থান্বেষী। গােষ্ঠী আর বিষয়টি নিয়ে রাখঢাক ছিল না মােটেও। এই জমিদার ও শিল্পপতিরা কার্যত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানস্থিত ক্ষমতার কাঠামাের বুনিয়াদ। এই সব ব্যবসায়ী গােষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানী রাজনীতিকদের ক্রমাগত দাবির মুখে ব্রিত হয়ে প্রেসিডেন্ট মীর্যার কাছে কেন্দ্রের যে হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন তালুকদার মনিরুজ্জামান তার এক সংক্ষিপ্ত ও তীক্ষ্ণ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিয়েছেন।২০ দৃষ্টান্তস্বরূপ, এক বার্ষিক ভােজ সভায় শিল্পবণিক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি মি. রেঙ্গুনওয়ালা প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্যার উদ্দেশে এক ভাষণে বলেন:
আমাদের রাজনীতিকেরা পরিস্থিতি ঘোঁট পাকিয়ে তুলেছেন। তাঁদের দলীয় রাজনীতির কারণে কেবল যে দেশের রাজনৈতিক মর্যাদাই ক্ষুন্ন হয়েছে তাই নয় বরং জাতির
৩৪
অর্থনৈতিক জীবনেও এর অভিঘাত গুরুতর। … রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সমতা হয়তােবা কার্যত সম্ভব কিন্তু অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নের বেলায় অন্যান্য অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে এর প্রয়ােগ ঘটলে তা হয়তাে আমাদের এক কানাগলিতে নিয়ে পৌঁছে। দেবে যেখান থেকে বেরিয়ে আসার আর কোনাে উপায় থাকবে না।২১
এ ধরনের অভিযােগে সােহরাওয়ার্দীর প্রতিক্রিয়া ছিল:
… যাদের স্বার্থ কায়েমি তাদের কাছে যদিও এরকমটাই মনে হতে পারে যে, এই নীতিগুলি অসামঞ্জস্যময়, কিন্তু আসলে ঘটনা তা নয়। দেশকে সামগ্রিকভাবে বিবেচনায় নিতে হবে। আমরা দেশের একটা অংশবিশেষের স্বার্থ বিকিয়ে অন্য অংশের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে পারি না। কেননা, প্রশ্নটি সার্বিক উন্নয়নের।২২
আবুল মনসুর আহমদ আরাে কিছু ঘটনার কথা বলেছেন। এসবের বেলায় দেখা যায়, দেশের দুই অংশের মধ্যে বিরাজমান অর্থনৈতিক অসমতা দূর করার লক্ষ্যে কেন্দ্রের বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী হিসেবে তিনি কিছু কিছু সিদ্ধান্ত নিলে পশ্চিম পাকিস্তানী আমলা ও ব্যবসায়ী স্বার্থগােষ্ঠী সে সবের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।২৩ এমনি করে কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ দেখতে পায় যে, পূর্ব পাকিস্তানের অনুকূলে সিদ্ধান্তগুলি বাস্তবায়িত করা বেশ কঠিন কাজ। তবু সে প্রয়াস থেমে থাকেনি। পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ ও চাহিদার প্রতি ইচ্ছাকৃত অবহেলার অভিযােগ সােহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে উঠলেও, এমনকি তাঁর কট্টর সমালােচকও এ ধরনের কোনাে সুনির্দিষ্ট অবহেলার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেননি। এ ছাড়াও তিনি উল্লিখিত বিবৃতিটি দিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগের ভাঙনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন। হওয়ার পর। তাতে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, তিনি তখনাে ভাঙন-পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগের মৌলিক নীতিগুলি আদায়ের জন্য লড়ছিলেন। বাস্তবিকপক্ষেও, কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকারের ক্ষমতার অংশীদার কোনাে রাজনৈতিক দলের পক্ষে একইসঙ্গে প্রদেশের স্বার্থে কাজ করে প্রদেশটির জন্য বিশেষ “ফল” লাভ করা এবং কেন্দ্র ও প্রদেশের ক্ষমতার অভিজাতবর্গকে তুষ্ট রাখা খুবই কঠিন ছিল। তবুও এ কথা স্বীকার্য যে, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানী রাজনীতির অত্যন্ত নাজুক মুহূর্তে এক অনিবার্য ও অপরিহার্য বহুমাত্রিক ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছিলেন আর সেই জন্যই পশ্চিম পাকিস্তানী অভিজাত ক্ষমতাধরদের হাতে খেলার পুতুল হওয়ার দুর্বলতার জন্য অভিযুক্ত হন। এভাবে যে শিক্ষালাভ ঘটে বলে মনে হয় তার যথেষ্ট প্রভাব পড়ে পরের বছরগুলিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যপরিচালনায় যখন ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে দরকষাকষির প্রক্রিয়াটির পরিবর্তে জায়গা নেয় শান্তিপূর্ণ গণসংগঠনের প্রয়াস। অবশ্য এটি তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়নি।
পাকিস্তানের একেবারে গােড়ার দিনগুলি থেকে সােহরাওয়ার্দী ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় রাজনৈতিক দল, যুক্তনির্বাচন, এক ইউনিট ও সার্বিক সমতার পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁর এক ইউনিট মেনে নেওয়ার পক্ষে যুক্তি এই ছিল যে সে ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানে। পাঁচ প্রদেশের একটি প্রদেশ না হয়ে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের একটি অঞ্চল হতে পারবে। তিনি যে কোনাে মূল্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে একান্ত আগ্রহী ছিলেন। এ থেকে
৩৫
গণতান্ত্রিক পন্থায় সকল রকমের অনিয়মতান্ত্রিকতা ও গলদ দূর করার পূর্বশর্ত হিসেবে সংহতিনির্ধারক নানা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় তাঁর জরুরি বিবেচনাবােধের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর এই ধরনের আগ্রহের আতিশয্যে, এমনকি, তিনি তাঁর দলের জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতিকেও বিসর্জন দেন। এর কারণে তাঁর যে সমালােচনা হয় তাতে অবশ্য প্রতীয়মান হয় ঐ সমালােচনায় বাস্তব পরিস্থিতির সহজাত কোনাে কোনাে বাধ্যবাধকতাকে আমলে নেওয়া হয়নি। যেমন, সােহরাওয়ার্দী যে ধরনের কোয়ালিশন গড়ে তােলার প্রয়াসী ছিলেন তার কারণেই তাঁর নিজের “জাতীয় নেতা হওয়া প্রয়ােজন হয়ে পড়ে। কিন্তু তখনাে পাকিস্তানী মানসে (বরং বলা যায় পশ্চিম পাকিস্তানী মননে) তার জাতীয় আত্মপরিচয়কে বৈধতার বুনিয়াদে দাঁড় করানাে বাকি ছিল। আর সে কারণেই বােধ করি বলা যায়, পাকিস্তানের সামরিক আঁতাত অনুমােদন অপেক্ষা আর কী তাঁর সেই কাজে ভালাে করে সহায়ক হতে পারতাে? কারণ, আর যাই হােক, পাকিস্তানী দৃষ্টিকোণ থেকে এসব আঁতাতের অর্থ তার পশ্চিমী সহায়কদের লক্ষ্য অনুযায়ী কেবল কমিউনিস্ট ঠেকানাে নয় বরং পাকিস্তানের চির দুশমন ভারতকে ঠেকিয়ে রাখাও বটে। আরাে বলতে হয় তিনি জাতিসংঘে কাশ্মীর ইস্যুকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা একাধিকবার করেছিলেন। এর চেয়ে আর কী-ই বা তার পশ্চিম পাকিস্তানবাদী মনােভাবের আরাে ভালাে পরিচয় তুলে ধরতে পারে? তবে সে যাই হােক তার সে কৌশল মার খায়। একদিকে, যারা তাঁর সমর্থনের ভিত তাদের একটা বড় অংশ থেকে বিরােধিতা আসে আর অন্যদিকে, কেন্দ্রের সন্দিহান ক্ষমতাধারী অভিজাতকুল তাকে বর্জন করে। যারা ইতােমধ্যে আমলা, সামরিক বাহিনী ও উঠতি ব্যবসায়িক স্বার্থবাদী মহলের আঁতাতের ভিত্তিতে ক্ষমতার কায়েমি কাঠামাে চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিল তারা রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতন্ত্রায়নের সম্ভাবনায় আঁতকে ওঠে। তারা টের পায় পূর্ব পাকিস্তানীদের রাজনৈতিক মনােভাব যদি একবার শেকড় গেড়ে বসতে পারে তা পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় স্থিতাবস্থার জন্য এক গুরুতর হুমকি হয়ে উঠবে। এ কারণে রাজনৈতিক চক্রান্তের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানী রাজনীতিকদের নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়। দুর্বলতর আওয়ামী লীগ এ কাজটিকে আরাে সহজ করে দেয়।
দেশের উভয় অংশে দলের ভাঙন, বিশেষ করে এক ইউনিট নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে বিরােধিতা যখন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে ঠিক সেই সময়ে কেন্দ্রে সুযােগভিত্তিক মাের্চা গড়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ অনেকটা ক্ষমতাও হারায়। এই পরিস্থিতির সুযােগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সােহরাওয়ার্দীকে পদচ্যুত করা হয়। তবে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে সােহরাওয়ার্দী তারপরেও এমন একটা শক্তি হিসেবে থেকে যান যা উপেক্ষণীয় নয়। পৃথক নির্বাচনপ্রথা পুনঃপ্রচলনের জন্য মুসলিম লীগ রিপাবলিকান কোয়ালিশনের সর্বাত্মক প্রয়াসের বিরুদ্ধে সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে তীব্র বিরােধিতার মুখে ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দ্রীগড় প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন। তাঁর উত্তরসূরি ফিরােজ খান নূন কেবল সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সহযােগিতা ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একাংশের সমর্থনে কাজ করে যেতে সমর্থ হন। বিষয়টি আরাে পরিষ্কার
৩৬
করতে বলা দরকার, ১৯৫৮ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এ. কে. ফজলুল হক পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে কৃষক শ্রমিক পার্টির আবু হােসেন সরকারকে মুখ্যমন্ত্রী নিয়ােগ করলে সােহরাওয়ার্দী এই নতুন মন্ত্রিসভাকে ও সেই সাথে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরকেও বরখাস্ত করতে বাধ্য করেন। এরপর আবারও ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে ছয়জন আওয়ামী লীগ সদস্যকে আসনচ্যুত করাতে নির্বাচন কমিশনের রায়কে অগ্রাহ্য করানাের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের এক অধ্যাদেশ জারি করাতে সক্ষম হন। আবার ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে সােহরাওয়ার্দীর ইঙ্গিতে নূন তাঁর মন্ত্রিসভা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলির সদস্যদের বাদ দিতে বাধ্য হন। এমনি করে সােহরাওয়ার্দী তখনাে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে একজন বিবেচ্য ব্যক্তি হিসেবে রয়ে যান। তবে তাঁর দল পূর্ব পাকিস্তানে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার নেতৃত্বে থাকলেও সেখানে দলটি অত্যন্ত গুরুতর গােলযােগে পড়ে যায়।
আওয়ামী লীগে ভাঙনের পর এই দল পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে প্রায় ত্রিশজন সদস্যের সমর্থন হারায়। তাঁরা ন্যাপে যােগ দেন। প্রাদেশিক পরিষদের বাইরেও কিছু লােক দল থেকে বেরিয়ে যায়। এ কারণে আওয়ামী লীগের জন্য মিত্রের প্রয়ােজন দেখা দেয়। কৃষক শ্রমিক পার্টির একটি অংশের সাথে এ বিষয়ে দরকষাকষি সােহরাওয়ার্দীর অনীহার কারণে শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হতে পারেনি।২৪ মুসলিম লীগ ও অন্যান্য দল এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও সােহরাওয়ার্দীর ওপর দোষারােপ করে সুযােগ নেওয়ার চেষ্টা করে। তারা প্রধানত যুক্তনির্বাচন-সংক্রান্ত বিষয়ে সােহরাওয়ার্দী ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে সমালােচনা চালায়। এই সমালােচনার প্রচারণা অভিযান যখন চলছে তখন আওয়ামী লীগ বিরােধী ভূমিকায় অবতীর্ণ থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা যাতে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠান অবধি টিকে থাকে সেই বাস্তব কারণে ন্যাপ পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের মতাে ন্যাপেরও আশঙ্কা ছিল এই যে, কোনাে না কোনাে অজুহাতে হয়তাে ৯২-ক বা ৯৩ ধারা জারি করে নির্বাচন স্থগিত করা হবে। মুসলিম লীগ ও অন্যান্য দল তাদের আওয়ামী লীগবিরােধী (ও সােহরাওয়ার্দীবিরােধী) প্রচারণা প্রদেশব্যাপী চালায়। দৈনিক আজাদে (মুসলিম লীগের ঐতিহ্যবাহী মুখপত্র) প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনের নিম্নবর্ণিত সারাংশ থেকে এ প্রচারণা অভিযানের ধরন ও প্রবণতাটি বােঝা যাবে।
১৯৫৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, পাবনা, টাঙ্গাইল, সৈয়দপুর, রংপুর, কিশােরগঞ্জ ইত্যাদি স্থানে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের ১৫টি জনসভার মধ্যে ছয়টিতে নুরুল আমিন, তিনটিতে আই. আই. চুন্দ্রীগড়, তিনটিতে ফজলুর রহমান ভাষণ দেন। এ ছাড়া এসব জনসভায় শাহ আজিজুর রহমান ও অন্য স্থানীয় নেতারাও বক্তৃতা দেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাদের আক্রমণের মূল
৩৭
লক্ষ্য ছিল যুক্তনির্বাচন পদ্ধতি এবং এর প্রবক্তা আওয়ামী লীগ ও সােহরাওয়ার্দী। তাঁদের এসব প্রচারণার বক্তব্য ছিল সােহরাওয়ার্দী ও আওয়ামী লীগের যুক্তনির্বাচন প্রস্তাবের নেপথ্যে রয়েছে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি, হিন্দু তােষণ ও ভারত-পাকিস্তান কনফেডারেশন (এক আন্তর্জাতিক চক্রান্ত) গঠনের দুরভিসন্ধি। আর এর পরিণতি হিসেবে বলা হয়, এতে পাকিস্তানের বুনিয়াদ দুর্বল হয়ে পড়বে। পাকিস্তান আন্দোলন যে আদর্শকে ভিত্তি করে হয়েছিল তা অস্বীকৃত হবে, দ্বিজাতিতত্ত্ব অস্বীকৃত হবে এবং সকল নির্বাচনী এলাকায় সমতার ভারসাম্য চলে যাবে সংখ্যালঘু জনসম্প্রদায়ের (অর্থাৎ হিন্দুর) হাতে, পূর্ব পাকিস্তানে আবার হিন্দুর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, চোরাচালান স্থায়ীরূপ লাভ করবে এবং পাকিস্তানী অর্থনীতির ভিত্তি ও কাঠামাে ধ্বংস হয়ে যাবে। এই নেতারা এমনকি, হিন্দুদের একাংশকে আওয়ামী লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করে এই বলে যে, যুক্তনির্বাচন পদ্ধতির আওতায় তফসিলী হিন্দু ও তফসিলী উপজাতীয় লােকেরা বর্ণ হিন্দুদের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে। এদের অনেকে একদিকে আওয়ামী লীগ ও সােহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে হিন্দু তােষণের অভিযােগ করলেও, তাদেরই কেউ কেউ আবার এই দাবিও করেন যে, হিন্দুরা নিজেরাই পৃথক নির্বাচন পদ্ধতির পক্ষপাতী। অভিযােগ ওঠে যে, পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা মনােরঞ্জন ধর (একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী নেতা, তকালে পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস সদস্য) কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এ ছাড়া আরাে উল্লেখ করা হয় যে, যুক্তফ্রন্টের ২১-দফায় যুক্তনির্বাচনের দফাটি নেই আর সে কারণেই আওয়ামী লীগের এই নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তনের কোনাে অধিকার নেই। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে দুর্নীতি আনুকূল্য করার অভিযােগও তােলা হয় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। বন্যা সমস্যার প্রতিকার, চোরাচালান রােধ ও বন্যার পুনরাবৃত্তি নিবারণে এই সরকারের ব্যর্থতার বিষয়ও উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়াও সর্বসাধারণকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে, এই সেই আওয়ামী লীগ যে দল পাকিস্তানকে “ইসলামী” অভিধায় অভিহিত করা, শাসনতন্ত্রে চিরন্তন ইসলামী বিধিবিধানের অন্তর্ভুক্তি করা এবং ইসলামভিত্তিক শিক্ষার বিরােধিতা করে, এমনকি, একজন অমুসলিমও পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রধান হতে পারবেন এই মর্মে শাসনতন্ত্রের বিধান রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করে। এ ছাড়া, এই দল দেশের শাসনতন্ত্রে স্বাক্ষর পর্যন্ত করেনি। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি অধ্যাদেশ বলে দেশ শাসনের বিষয় সমর্থন করে। গণপরিষদ ভেঙে দেওয়ায় সােহরাওয়ার্দী গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদকে অভিনন্দন জানান এবং দেশের ওপর প্রস্তাবিত গণতন্ত্রবিরােধী শাসনতান্ত্রিক কনভেনশন চাপিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করেন। আরাে অভিযােগ ওঠে যে, প্রথমত যুক্তফ্রন্ট ও পরে আওয়ামী লীগের কুশাসনে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে। আর পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগ চোরাচালান রােধে সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা খর্ব করার চেষ্টা করছে। তারা ধর্মশিক্ষা একেবারেই বন্ধ করে দেবে আর সর্বোপরি সােহরাওয়ার্দী চাচ্ছিলেন এমন এক একনায়কসুলভ ব্যবস্থা যার কর্তৃত্বে থাকবেন খােদ তিনি। জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে সােহরাওয়ার্দীর ধারণা পাশ্চাত্যের
৩৮
জড়বাদী সংস্কৃতি ও লােকায়ত রাজনৈতিক তত্ত্বাবলির বুনিয়াদে প্রতিষ্ঠিত। আর সে কারণে, পাকিস্তান সােহরাওয়ার্দীর হাতে নিরাপদ নয়। ১৯৫৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় সরকার এক ঘােষণায় যুক্তনির্বাচনের ভিত্তিতে ভােটার তালিকা প্রণয়নের নির্দেশ দেওয়ার পরেও সােহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে নিন্দাবাদ চলতেই থাকে। জামায়াত-ইইসলামীর মওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী ৪৩ দিনব্যাপী পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন। তিনি ঢাকার পল্টন ময়দানে প্রদত্ত ভাষণে যুক্তনির্বাচনের নানা কুফলের বিশদ ব্যাখ্যা দেন। অবশ্য তার এসব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তাঁর মুসলিম লীগের সহযােগীরা এর আগে যা বলেছিলেন সে সবের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। একই সুরে কথা বলেন, নিজামএ-ইসলামের মওলানা আতাহার আলী ১৯৫৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কিশােরগঞ্জের এক জনসভায়।২৫
প্রায় একই সময়ে মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তান সফর করেন। করাচিতে তিনি এক স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তিতে এক আওয়ামী লীগবিরােধী ফ্রন্টের প্রস্তাব দেন। এর আগে ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক এমএইচ উসমানী ঢাকার এক সংবাদ সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানীদের উস্কে দেওয়া ও প্রাদেশিকতাবাদের বীজ রােপণের জন্য সােহরাওয়ার্দীকে দোষারােপ করেন। উসমানী অবশ্য এর আগে উল্লেখ করেছিলেন যে, সময়মতাে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ন্যাপ কোয়ালিশন সরকারকে সমর্থন জানাবে, তবে এক ইউনিট বিরােধিতায় স্বীয় অবস্থানে অবিচল থাকবে। ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগ নীতি পরিবর্তন না করলে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হবে না।২৬
একটি গােষ্ঠী যখন যুক্তনির্বাচন সম্পর্কিত নীতির কারণে আওয়ামী লীগের বিরােধিতা করছিল ও দলটিকে জাতীয়তাবিরােধী বলে অভিহিত করছিল এবং অপর একটি গােষ্ঠী যখন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি প্রশমনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে অপারগতার কারণে আওয়ামী লীগকে দোষারােপ করছিল তখন ১৯৫৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে শহীদ দিবস পালন উপলক্ষে আয়ােজিত জনসভায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করেন যে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন হলাে পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দাবি। তিনি দাবি করেন যে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন পাওয়া গেলে পূর্ব পাকিস্তানের বহু সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যেমন দেশের দুই অংশের বার্ষিক রাজস্ব খাতে যে বৈষম্য রয়েছে তা আর থাকবে না, কেননা রাজস্ব খাতের উৎসগুলির বণ্টন সে ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে অনেকখানি সুষম হয়ে উঠবে দেশের দুই অঞ্চলের মধ্যে। শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র বিষয় ও মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে রাখার দাবির পুনরাবৃত্তি করে তিনি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে রাজস্ব আয়ের উৎসগুলি প্রদেশের হাতে ছেড়ে দেওয়ার আবেদন জানান। সমাপনী ভাষণে তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা কেবল ভাষাবিশেষের জন্য জীবনদান করেননি বরং জাতীয় জীবনের গণতান্ত্রিক দাবিগুলির জন্যও জীবন উৎসর্গ করেছেন। ভাষা আন্দোলন তাই ভাব প্রকাশেরই এক আঙ্গিক।২৭
৩৯
এভাবেই আতাউর রহমান দৃষ্টত সাংস্কৃতিক ইস্যুকে আর্থ-রাজনৈতিক ইস্যুর সাথে সম্পর্কিত করেন।
অনেকটা এই সময় নাগাদ দলীয় সংগঠনের ভূমিকার প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ও দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘদিনের মতবিরােধ নিয়ে একটা সঙ্কটজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
সােহরাওয়ার্দী এ বিরােধ নিষ্পত্তির দায়িত্ব দিয়েছিলেন আবুল মনসুর আহমদকে। তিনি দেখলেন দলের সংসদীয় ও সাংগঠনিক শাখা দুটির মধ্যে বিশেষ ধরনের মতবিরােধের এই সংঘাতটি তুঙ্গে উঠেছে দলের সম্পাদকের এ বিষয়ে নিজস্ব কিছু দৃঢ় বিশ্বাসের কারণে। আবুল মনসুরের মতে সমস্যাটি এরকম: দলের সম্পাদকের ধারণা জেলা আওয়ামী লীগের স্থান অপেক্ষাকৃত উর্ধ্বে, অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের স্থান অপেক্ষাকৃত উর্ধ্বে।২৮ অবশ্য আতাউর রহমানের নিজস্ব ধারণা ছিল এই যে, শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই মুখ্যমন্ত্রী হতে চান আর ঐ মতভেদ ছিল তাঁকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে উৎখাত করার একটা অজুহাত মাত্র। তিনি এমন বহু দৃষ্টান্ত দিয়েছেন যেসব ক্ষেত্রে দলের কর্মীরা এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত প্রণয়নের এখতিয়ারেও হস্তক্ষেপ করেছে, আর জেলা কর্মকর্তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে হস্তক্ষেপ তাে করেছেই।২৯ আতাউর রহমান নিশ্চিত ছিলেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান দলের অভ্যন্তরে একটি চক্র গড়ে তুলেছেন তাঁর ওপর কলঙ্কারােপের উদ্দেশ্যে, আর এতে মুজিব অন্তত এই অবধি সফল হয়েছেন যে, এমনকি, সােহরাওয়ার্দীও আতাউর রহমানের বিশ্বাসযােগ্যতায় সন্দিহান হয়ে ওঠেন ও তাঁকে সরাতে চান। আবুল মনসুর আহমদ এই সাক্ষ্যও দিচ্ছেন যে, সােহরাওয়ার্দী আতাউর রহমানকে সরিয়ে দিয়ে তাকেই সেখানে বসানাের চিন্তা করছিলেন, কিন্তু আসন্ন নির্বাচনের মুখে তেমন কাজ কৌশলগত দিক থেকে ঠিক হবে না বুঝতে পেরে সে উদ্যোগে ক্ষান্ত দেন।৩০
খুব সম্ভবত আতাউর রহমান দলের কাছে সম্পদ গণ্য হওয়ার চেয়ে দায় হয়ে উঠেছিলেন “অপারেশন ক্লোজড ডাের” (OCD)-এর নানা প্রতিক্রিয়ার কারণে। এ অভিযান চলে হিন্দুদের ওপর। আওয়ামী লীগের একাংশের কাছে এ ব্যবস্থা জনপ্রিয় ছিল না। ওসিডি অভিযান শুরু হয় ১৯৫৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর। এ সময় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আতাউর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত বরাবর এলাকায় চোরাচালান বন্ধ করার কাজে সশস্ত্র বাহিনীকে আমন্ত্রণ জানান। এর আগে আওয়ামী লীগ পরিষ্কার অবস্থান নিয়েছিল যে, বেসামরিক প্রশাসনে সশস্ত্র বাহিনীর কোনাে হস্তক্ষেপ হতে পারবে না। মুখ্যমন্ত্রীর উল্লিখিত কার্যব্যবস্থা ছিল দলের অবস্থানের একান্ত পরিপন্থী। ইতঃপূর্বে যুক্তফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার খাদ্যপণ্যের চলাচল ও বিতরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনাবাহিনী তলব করার জন্য তীব্রভাবে সমালােচিত হন। যুক্তি দেখিয়ে বলা হয় যে, চোরাচালানের নেপথ্যে নানারকমের সুগভীর অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। সে কারণগুলি দু’ভাবে দূর করা যায়। একটি ব্যবস্থা হলাে আইনসম্মত সীমান্ত বাণিজ্য; অন্যটি পূর্ব পাকিস্তানের দ্রুত
৪০
অর্থনৈতিক উন্নয়ন। কিন্তু শেষােক্ত দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের লক্ষ্যে কাজ না করে মুখ্যমন্ত্রী এক অনিশ্চিত নিরাময় ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন। দৃষ্টত মনে হয়, জনাব আবু হােসেন। সরকারের সেনাবাহিনী নিয়ােগের সিদ্ধান্তটি কেন্দ্রের প্রভাবমুক্ত ছিল না। যদিও তিনি এ কথা অস্বীকার করে সিদ্ধান্তের সকল দায়দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নেন তবু তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদ দেওয়ার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্যার৩১ প্রস্তাবের সত্যতা তিনি স্বীকার করায় এ আভাসই মেলে যে ওসিডি-এর বেলায় সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে আতাউর রহমান খানের খােলা মনের পরিচয় পেয়ে প্রেসিডেন্ট সম্ভবত নিজের প্রয়ােজনে তার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে একটি যােগসূত্র গড়ার চেষ্টা করেছিলেন। আর প্রস্তাবিত ওসিডি ছিল এ ক্ষেত্রে এক যাচাই নিরীক্ষামূলক ব্যবস্থা।
তবে নেপথ্যে যেসব কারণই ক্রিয়াশীল থাক না কেন, অন্তর্দলীয় কোন্দল ছিল এক বহুল আলােচিত বিষয়। এতে আওয়ামী লীগের গঠন কাঠামাের দুরবস্থাই প্রতিফলিত। অনেকের দল ছেড়ে ন্যাপে যােগ দেওয়া এবং ওসিডি চলাকালে হিন্দুদের ওপর নিগ্রহ নির্যাতনের খবরে আওয়ামী লীগ থেকে হিন্দুদের সমর্থন তুলে নেওয়ার ফলে পূর্ব পাকিস্তান পরিষদেও আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়ে পড়ে।
আওয়ামী লীগের দুর্বলতা মুসলিম লীগে উদ্যম সঞ্চার করে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ভরাডুবির পর প্রথমবারের মতাে মুসলিম লীগ পূর্ব পাকিস্তানে বেশ কয়েকটি জনসভা করতে সক্ষম হয়। এমনকি, নুরুল আমিন আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ দেন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকালে হত্যাকাণ্ডের হােতা তিনি ছিলেন বলে যে দাবি করা হয় তার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য (কেননা, এখন তাে তাদের হাতে সব রেকর্ডপত্র রয়েছে)। আওয়ামী লীগ তাকে “খুনি” বলেছিল। আবদুস সাত্তার অভিযােগ করেন, কংগ্রেসের যােগসাজশে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ মসজিদের চেয়ে মন্দির মেরামতে বেশি ব্যয় করছে। এর কয়েকদিন পরে মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক আবুল কাসেম প্রকাশ্যে বলেন, আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পোন্নয়ন বিঘ্নিত করছে।৩২
মুসলিম লীগ প্রচারণার যে প্রবণতা গড়ে তােলে তাতে স্পষ্টত ন্যাপ উদ্বিগ্ন হয়। কিন্তু নিজ থেকে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার ক্ষমতা তার ছিল না। এ কারণে, ন্যাপের একাংশ ১০-দফার ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের সাথে একটা কাজের আঁতাতে আসার পক্ষপাতী ছিল। এ ছিল ভাসানী ও ন্যাপের পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের প্রকাশ্য অভিপ্রায় বিরােধী। তবে ন্যাপের উল্লিখিত ভিন্ন মতাবলম্বীরা আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা উৎখাতে বিরােধীদলের প্রয়াসে কোনাে রকম সহযােগিতা না দিতে দৃঢ়সংকল্প ছিল। ফলে, ১৯৫৮ সালের ২২ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদে প্রথম তিন মাসের জন্য বাজেট হিসাব-সংক্রান্ত সরকারের আনীত এক প্রস্তাবের ওপর গৃহীত ভােটের সময় ন্যাপ পরিষদে অনুপস্থিত থেকে মন্ত্রিসভাকে তার নিশ্চিত পরাজয় থেকে রক্ষা করে।৩৩ ১৯৫৮ সালের ২৪ মার্চ ন্যাপ (পার্লামেন্টারি দল) সিদ্ধান্ত নেয়, যদিও দল মন্ত্রিসভার গণবিরােধী কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত তবুও দেশের বৃহত্তর
৪১
স্বার্থে ঐ মন্ত্রিসভাকে উৎখাত করার চেষ্টা করবে না। কেননা, সে রকম পদক্ষেপ ১৯৩ ধারা জারির সুযােগ করে দেবে আর তাতে আসন্ন নির্বাচন বিলম্বিত হবে। ঐ সভায় মন্ত্রিসভাকে উৎখাতের জন্য প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির যে কোনাে প্রয়াসের বিরােধিতা করার এবং ১০-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের সাথে দরকষাকষিমূলক আলােচনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।”৩৪
ন্যাপের হাজী মােহাম্মদ দানেশ তাঁর দলের এ ভূমিকার সপক্ষে এই বলে যুক্তি দেখান যে, পরিষদে এই দলের ভূমিকা হলাে সরকারকে সঠিক দিকনির্দেশনায় পরিচালনা করা, নিছক (নেতিবাচক অর্থে) মন্ত্রিসভার পতন ঘটানাে নয়। এতে তুষ্ট আতাউর রহমান সমর্থনদানের জন্য ন্যাপকে অভিনন্দন জানান।৩৫ এই পর্যায়ে মওলানা ভাসানী তাঁর ইতঃপূর্বেকার ভূমিকার কতকটা ব্যত্যয় ঘটিয়ে এক বিবৃতি দেন। এ বিবৃতিতে তিনি আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভাকে উৎখাতের চক্রান্ত প্রতিরােধের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।৩৬ ১৯৫৮ সালের ৩০ মার্চ ঢাকায় ন্যাপ তার সংসদীয় দলের এক সভায় দলের এ সিদ্ধান্তের কথা পুনর্ব্যক্ত করে এবং পৃথক নির্বাচন পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তনের জন্য প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির চক্রান্ত সম্পর্কে সজাগ ও ঐক্যবদ্ধ থাকার ও চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য জনগণকে সতর্ক করে দেয়। এই সভায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কলকাঠি নাড়াচাড়ায় দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির প্রয়াসে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ন্যাপের পূর্ব পাকিস্তান শাখা এ বিষয়ে পরিপূর্ণ একমত হতে পারেনি। একদা ঢাকা আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা ও পরবর্তীকালে ন্যাপের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ইয়ার মােহাম্মদ খান দলত্যাগ করেন। তিনি এক বিবৃতিতে ন্যাপ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযােগ করেন, তারা সুবিধাবাদী ও একইসঙ্গে কমিউনিস্ট। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, দলের অপেক্ষাকৃত অনুগত সদস্যরা সক্রিয় নন আর যারা সক্রিয় তারা ভাসানীকে তাদের নিজ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার কাজে লাগাবেন। কাজ ফুরিয়ে গেলেই। তাঁকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে।৩৭
সাংগঠনিক দিক থেকে দেখলে ধারণা হয়, ন্যাপ, দল হিসেবে এতই দুর্বল ছিল যে, শুধুমাত্র কৌশলের কারণে হলেও আওয়ামী লীগের সাথে একটা যােগসূত্র রাখতে বাধ্য হয়েছিল। সে যাই হােক, এই দল তারপরেও নিজেকে আওয়ামী লীগের ত্রাণকর্তা হিসেবে দেখানাের চেষ্টা করে। আওয়ামী লীগের সমস্যাও ছিল অনেক। আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে তার অবস্থান ও নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেছিল। দলের অন্তর্কলহ ও কোন্দল নানা মাত্রায় বাড়ছিল। মুসলিম লীগ তার স্বকীয় পন্থায় নিজের ভিত প্রশস্ত করার চেষ্টা করছিল। সর্বোপরি, দলের একমাত্র জাতীয় পর্যায়ের নেতা সােহরাওয়ার্দীও তীব্র সমালােচনার মুখে পড়েছিলেন। এসবের কোনাে কোনােটির দৃষ্টত সঙ্গত কারণও ছিল। তবু বহু পূর্ব পাকিস্তানী অন্যান্য দল ছেড়ে আওয়ামী লীগে যােগ দেয়। কৌতুহলােদ্দীপক বিষয় এ ক্ষেত্রে এই যে, তাদের প্রায় সকলেই আওয়ামী লীগে যােগ দেয় এ কারণে যে, তাদের ধারণা আওয়ামী লীগ সােহরাওয়ার্দীর দল এবং তাদের বিশ্বাস এ দল অগ্রগতি
৪২
ও প্রগতি নিশ্চিত করবে। এ দলের নেতৃবৃন্দ নিবেদিতপ্রাণ, সহিষ্ণু ও নিঃস্বার্থপরায়ণ বলে মনে করা হতাে। সংবাদপত্রের নানা প্রতিবেদন দেখে বােঝা যায়, ১৯৫৮ সালের প্রথম সিকিভাগে কমপক্ষে ৪০০০ পূর্ব পাকিস্তানী ঠিক এসব গুণগত কারণেই আওয়ামী লীগে যােগ দেন।
এ সময়ে যারা আওয়ামী লীগে যােগ দেন তারা তাদের এ সিদ্ধান্তের পক্ষে বিশটির মতাে কারণ দেখান। এ ক্ষেত্রে সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্ব সর্বাধিক বিবেচনা লাভ করে। এর পরের গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনাটি ছিল এই মর্মে বিশ্বাস যে, একমাত্র আওয়ামী লীগই বাঞ্ছিত পথে দেশের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারে। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের ত্যাগতিতিক্ষায় নির্ভর করা যায়।৩৮
সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মী থেকে শুরু করে চিকিৎসক, আইনজীবী, শিক্ষক ও ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকে আওয়ামী লীগে নবাগতদের বেশিরভাগই ছিল কেএসপির। এর পরের স্থান যথাক্রমে রক্ষণশীল মুসলিম লীগ ও প্রগতিবাদী ন্যাপের। এতে আওয়ামী লীগের মঞ্চসূলভ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আরাে জোরদার হয়। এই নবাগতদের চট্টগ্রাম, নােয়াখালী, বরিশাল, খুলনা, যশাের, ফরিদপুর, ঢাকা, বগুড়া, ময়মনসিংহ ও সিলেটে প্রায় দেশজোড়া অবস্থান বিন্যাসের সুবাদে দলের দেশব্যাপী পরিসর বাড়তে থাকে। একই সময়ে এই মর্মে খবর পাওয়া যায় যে আওয়ামী লীগ স্থানীয় স্তরে তথা ওয়ার্ড, থানা, ইউনিয়ন ও মহকুমা পর্যায়ে শাখা কার্যালয় স্থাপন করছে, কর্মী সম্মেলনের আয়ােজন করছে, কর্মকর্তা বাছাই করছে ও আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করছে।৩৯ এ ছাড়াও সােহরাওয়ার্দী নিজে প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক সফরে গিয়ে জনসভায় ভাষণ দেন। ফলে মার্চ ১৯৫৭ ও ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ৬টি উপনির্বাচনের পাঁচটিতে জয়লাভ করে।৪০
উল্লেখ করা যায়, ঐ একই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করছে এমন অন্যসব দলের পক্ষ থেকে এ ধরনের দল গঠন তৎপরতার খবর পাওয়া যায়নি। এমনকি সরকারি বা বেসরকারি মুখপত্রেও অন্য কোনাে সংগঠনেরও এরকম তৎপরতার খবর পাওয়া যায়নি। বাহ্যত দেখা যায়, ঐ সব দল গােটা পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় সভাসমিতি অনুষ্ঠানে ব্যস্ত এবং এমন একটা ধারণার সৃষ্টি করে যেন তারা আওয়ামী লীগকে পরাভূত করার কৌশল আঁটছে।
আওয়ামী লীগের সমস্যাবলির একটি তৃতীয় মাত্রাও ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের দলীয় রাজনীতিতে নাক না গলাবার কথা থাকলেও তিনি কেএসপির মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে কাজ করার জন্য খুবই চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তাই আওয়ামী লীগের মুখ্যমন্ত্রী ১৯৫৮ সালের ৩০ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন। স্থগিত করার পরামর্শ দিলে গভর্নর এই অজুহাত দেখিয়ে দ্রুত মুখ্যমন্ত্রীকে পদচ্যুত করলেন। যে, তিনি আর আইনসভার আস্থার অধিকারী নন। আর একইসঙ্গে কেএসপির আবু হােসেন সরকারকে ১৯৫৮ সালের ৩১ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী নিয়ােগ করা হয়। কিন্তু কেন্দ্রে নূন
৪৩
মন্ত্রিসভার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সােহরাওয়ার্দী অপরিহার্য হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানে আতাউরমন্ত্রিসভাকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়ােজন ছিল। তাই ফজলুল হককে পদচ্যুত করা হয়। তৎকালে পূর্ব পাকিস্তানের অস্থায়ী গভর্নর ও পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্য সচিব, একজন সিএসপি অফিসার আবু হােসেন সরকারকে ১৯৫৮ সালের ১ এপ্রিল পদচ্যুত করে আতাউর রহমানের পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভাকে পুনর্বহাল করেন। ঐ একই দিনে আতাউর মন্ত্রিসভার পক্ষে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক আনীত ও ন্যাপের মাহমুদ আলী কর্তৃক সমর্থিত আস্থা প্রস্তাব পাস করা হয়। প্রস্তাবটির পক্ষে ১৮২, বিপক্ষে ১১৭ ভােট পড়ে এবং ১০ জন সদস্য ভােটদান থেকে বিরত থাকেন। বােঝা যায়, ন্যাপের সঙ্গে এক সমঝােতায় আসার জন্য সময় কেনার ও নিজেদের অবস্থান শক্ত করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ যে চেষ্টা করে যাচ্ছিল। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে হতাশ করার জন্য ফজলুল হক উদ্যোগী হয়েছিলেন। সােহরাওয়ার্দী-নূন আঁতাত তার সে উদ্যোগে বাধা হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ-ন্যাপ সমঝােতাও ফলপ্রসূ হয়নি। আর সে কারণে ন্যাপ মন্ত্রিসভা থেকে স্বীয় সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে ১৯৫৮ সালের ১৯ জুন এক ছাঁটাই প্রস্তাবে আতাউর রহমান মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। এরপর কেএসপি মন্ত্রিসভার দায়িত্বভার নিলেও ১৯৫৮ সালের ২২ জুন এক অনাস্থা ভােটে পরাজিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান অনাস্থা প্রস্তাবটি উত্থাপন করলে প্রস্তাবের। পক্ষে ১৫৬ ও বিপক্ষে ১৪২ ভােট পড়ে। এতে প্রথমে ১৯৩ ধারা বলবৎ করার পর সকল। মহলের প্রবল দাবি ও চাপের মুখে ১৯৫৮ সালের ২৫ আগস্ট আতাউর রহমানকে মুখ্যমন্ত্রী পদে পুনর্বহাল করা হয়। তবে আতাউর রহমান খান ও আবুল মনসুর আহমদ উভয়েই বলেছেন যে সােহরাওয়ার্দী ততদিনে আতাউর রহমানকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরানাের ব্যাপারে উপদলীয় চাপের কাছে কার্যত নতিস্বীকার করেছিলেন। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত তাকে সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে স্বপদে বহাল রাখা হয়। পরবর্তী মন্ত্রিসভার সদস্য কে কে হচ্ছেন এমনকি তার তালিকা নিয়ে তাঁর সাথে কোনাে রকম আলােচনাও করা হয়নি।৪১
এক বছর মেয়াদে তৃতীয়বারের মতাে ক্ষমতায় ফিরে আতাউর রহমান লক্ষ্য করেন, পাটের দাম পড়ে যাওয়া ও নিত্যপ্রয়ােজনীয় জরুরি দ্রব্যাদির দাম চড়ে যাওয়ায় প্রদেশে বিক্ষোভ বিরাজ করছে। দ্রব্যমূল্য কমাতে না পারলে গদি ছাড়ার দাবিতে ঢাকায় বিক্ষোভ হয়। বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা বর্ধিত মহার্ঘ ভাতা ইত্যাদির দাবিতে অনশন ধর্মঘট করেন।৪২
অর্থনৈতিক দুরবস্থা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে বিক্ষোভ, অসন্তোষ কোনাে নতুন বিষয় ছিল না। তবে সাধারণ নির্বাচন ঘাড়ের ওপর এসে পড়ায় এ ধরনের পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় ফিরতে চাওয়া যে কোনাে রাজনৈতিক দলের জন্য বেশ উদ্বেগজনক বটে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া অবধিও ক্ষমতায় টিকে থাকা রীতিমতাে অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। কারণ কোয়ালিশনের মিত্ররা মােটেও নির্ভরযােগ্য ছিল না। এভাবে যে উত্তেজনার। সৃষ্টি হয় সেই উত্তেজনার আগুনে ঘৃতাহুতি দেন প্রাদেশিক পরিষদের তৎকালীন বৈরী
৪৪
স্পিকার। জানা যায়, এই স্পিকার মহােদয় সর্বদাই সরকারের জন্য সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতেন। তাই পরিষদে সরকারি ও বিরােধী উভয় দলের সদস্যরা তার বিরুদ্ধে অনাস্থা আনতে চেয়েছিলেন। স্পিকার তার সচিবালয়ের জন্য বর্ধিত ব্যয় বরাদ্দের অনুমােদন চেয়েছিলেন ও তাঁর নিজেকে আরাে ক্ষমতাবান করার আইন পাস করতে চেয়েছিলেন, তাঁর সে প্রস্তাব অবশ্য সফল হয়নি। ১৯৫৮ সালের জুনে সােহরাওয়ার্দী তার এ প্রয়াসে বাধা দেন। তবে আগস্টে এ উদ্যোগ আবার নেওয়া হয় বিরােধীদলের সহযােগিতা ছাড়াই।৪৩
২০ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভাকে অপদস্থ, হেয় করার এক পরিকল্পিত প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রাদেশিক আইনসভা থেকে আওয়ামী লীগের ছয়জন সদস্যকে বহিষ্কার করার দাবি ওঠে, কেননা তারা সরকারি পদে থাকায় নির্বাচন কমিশন তাদেরকে পরিষদ সদস্য থাকার অযােগ্য ঘােষণা করেন। তবে প্রকৃত পরিস্থিতি কী তা স্পষ্ট ছিল না, কারণ কেন্দ্রীয় সরকার এক বিশেষ অধ্যাদেশ বলে নির্বাচন কমিশনের ঐ রায় নাকচ করেছিলেন। এদিকে স্পিকার তাঁর রুলিং ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংরক্ষিত রাখেন ও ন্যাপ সদস্য দেওয়ান মাহবুব আলী কর্তৃক স্পিকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করার অনুমতি দেননি। দৈহিক সহিংসতা সৃষ্ট হট্টগােলের মধ্যে স্পিকার পরিষদকক্ষ ত্যাগ করলে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী পরিষদে স্পিকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মাহবুব আলীর প্রস্তাব ও পিএনসির পিটার পল গােমেজ আনীত অপর এক প্রস্তাবে স্পিকারকে মানসিকভাবে অসুস্থ ঘােষণা করা হয় ও হৈ হট্টগােলের মধ্যে ঐ প্রস্তাব পাস হয়।৪৪
নির্বাচন কমিশন কী রায় দিয়েছে তার জন্য বিরােধীদলের দাবি যতটা নয় তার চেয়েও বরং পরিষদে আওয়ামী লীগের শক্তি হ্রাস করার জন্যই পরিস্থিতিকে কাজে লাগানাে হয়। আর আওয়ামী লীগও কেন্দ্রে তার শক্তির কলকাঠি কাজে লাগিয়ে উল্লিখিত অধ্যাদেশ স্বীয় উদ্দেশ্যসাধনে ব্যবহার করে নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্ব খাটো করে। অথচ নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও এখতিয়ার হলাে গণতান্ত্রিক কর্মপরিক্রমায় এক অপরিহার্য অঙ্গ। এতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পদ্ধতি ও সরকার কাঠামাের শূন্যভিতই উন্মােচিত হয়েছে।
২৩ সেপ্টেম্বর নাগাদ আওয়ামী লীগ কেএসপির কয়েকজন সদস্যকে সপক্ষে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। সংখ্যা শক্তির দিক থেকে দুর্বল হয়ে বিরােধীপক্ষ দৈহিক শক্তি প্রয়ােগে ভারপ্রাপ্ত স্পিকার শাহেদ আলীকে (আওয়ামী লীগের সদস্য) তার কাজে বাধা দেয়। চেয়ার ও হাতের কাছে পাওয়া জিনিসপত্র তাকে লক্ষ্য করে ছোড়া হলে তিনি আহত হন। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সভাপতি প্যানেলের অন্যতম সদস্য জিয়াউল। হাসান পরিষদের কাজ চালানাের দায়িত্ব নিয়ে পরিষদের অধিবেশন পরের দিন পর্যন্ত স্থগিত ঘােষণা করেন। ২৬ তারিখে জনাব শাহেদ অনেকগুলি আঘাতজনিত কারণে মারা যান। বিরােধীদলের যে সব সদস্যকে হাঙ্গামা, হট্টগােলের অভিযােগে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদেরকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়।৪৫ আবুল মনসুর আহমদ এ বিষয়ে পরিতাপের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন যে, “আওয়ামী লীগকে রক্ষা করতে গিয়ে শাহেদ আলী বিরােধীদলের
৪৫
নিক্ষিপ্ত ইটপাটকেলের আঘাতে মৃত্যুবরণ করেন। এ সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গের দুশমনরা এখনাে বলে থাকে আওয়ামী লীগই শাহেদ আলীকে হত্যা করেছে। তিনি এ অভিযােগ মিথ্যা” বলে অভিহিত করেন।৪৬
অবশ্য, বিগত কয়েক মাস ধরে পরিস্থিতি যেভাবে গড়াচ্ছিল তাতে আওয়ামী লীগও কোনাে কোনাে দায়িত্ব থেকে রেহাই পেতে পারে না। ন্যাপের মাঝে মাঝে ভ্রান্তিজনিত কার্যকলাপের কারণেও পরিস্থিতি আরাে অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। সে যাই হােক, বলা হয়ে থাকে যে, প্রধানত এই মর্মান্তিক ঘটনাকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়। এর মধ্যবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্যার কথিত প্ররােচনায় ফিরােজ খান নূন আওয়ামী লীগকে তােষামােদ করে কেন্দ্রীয় সরকারে মন্ত্রীর পদ গ্রহণে রাজি করান। আওয়ামী লীগ এ প্রস্তাব গ্রহণ করে পুনরায় তার পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তের পরিপন্থী কাজ করে। শাসকচক্রের চক্রান্তের শিকার হওয়ার মতাে দুর্বলতা আওয়ামী লীগের ছিল—এ থেকে অন্তত সে রকম ব্যাখ্যাই করা যায়। কিন্তু আঞ্চলিক ইস্যুগুলির জন্য এক জাতীয় ঐকমত্য গড়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের তথা সােহরাওয়ার্দীর আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বিবেচনায় এনে এরকম ব্যাখ্যায় যাওয়া চলে যে, আঞ্চলিক ইস্যুগুলি সম্বন্ধে জাতীয় স্তরে মতপার্থক্য দূর করার জন্য এ অভিপ্রায় এক প্রয়ােজনীয় নমনীয়তারই বহিঃপ্রকাশ। পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলির বেলায় একটি বাস্তবতা লক্ষণীয়। সেটি হলাে এই রাজনৈতিক দলগুলি তাদের সীমিত উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ঘন ঘন তাদের অবস্থান বদলায়। যেমন পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি কখনাে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভাকে সমর্থন করেছে, কখনাে বা তার বিরােধিতা করেছে, আর সেটা কখনাে সরাসরি, কখনাে পরােক্ষভাবে। মুসলিম লীগ হঠাৎ করেই পাকিস্তানের পাশ্চাত্যপন্থী পররাষ্ট্রনীতির সমালােচনায় অবতীর্ণ হয়। তাই সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যদি বিভিন্ন ইস্যুর ভ্রান্ত মােকাবেলা করে একটা অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে এবং পরবর্তীকালে রাজনৈতিক ব্যবস্থার সামরিকীকরণ দ্রুততর ও সেই পথ প্রশস্ত করে থাকে তাহলে খান আবদুল কাইয়ুম খানের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগকেও মাত্রাতিরিক্ত বিদ্রোহী হঠকারিতার ভূমিকার জন্য সমানভাবেই দায়ী করা যায়। পরিস্থিতি আরাে বেশি করে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, কেননা, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধু প্রদেশে গফফার খান, জিএম সৈয়দ, মােহাম্মদ আইয়ুব খুরাে, মীর গােলাম আলী তালপুর, পীর পাগারাে ও মানকি শরীফের পীরের মতাে বিভিন্ন ও বিচিত্র মতবাদের নেতাদের এক ইউনিটবিরােধী জোট বা জমায়েত আরাে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বেলুচিস্তানের কালাত রাজ্যের খান প্রকাশ্যে বিদ্রোহীর মনােভাব প্রদর্শন করেন। এসব মিলে অবস্থা যা দাঁড়ায় তা রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে, কারণ, না ছিল তার কোনাে রাজনৈতিক সমর্থন লাভের বুনিয়াদ, না ছিল বৈধতা যদিও তা সত্ত্বেও তিনি স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আকাঙ্ক্ষা করছিলেন। অরাজক পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে তিনি সামরিক আইন আরােপ করেন, শাসনতন্ত্র বাতিল করেন, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদগুলি ভেঙে দেন, সকল মন্ত্রীকে
৪৬
বরখাস্ত করেন এবং রাজনৈতিক দলগুলিকে নিষিদ্ধ করেন। এমনকি তাদের সম্পদ আটকে দেন আর তারপর তিনি তাঁর আগ বাড়ানাে কাজের কৈফিয়ত উদ্ধত ভঙ্গিতে এই বলে দেন যে, “আমার এসব কাজের পেছনে আইনের কিংবা শাসনতন্ত্রের অনুমােদন নেই। আমি যা করেছি তা কেবল নিজ বিবেকের অনুশাসনে।”৪৭ তালুকদার মনিরুজ্জামানের মতে এর কারণ হলাে “প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্যার চারপাশে যে ছােট একদল ক্ষমতার অভিজাতদের সমাবেশ ঘটে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তাদের অঙ্গীকারের অভাব ছিল।” তালুকদার উপসংহার টেনেছেন এই বলে: “রাজনৈতিক পতনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে ১৯৫৭ কিংবা ১৯৫৮ সালের গােড়ার দিকেও যদি অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতাে। তাহলে পাকিস্তানের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের (আওয়ামী লীগ ও মুসলিম লীগ) প্রতিফলন ঘটতাে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আর তাতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ এড়ানাে যেতাে।”৪৮ কিন্তু পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, প্রেসিডেন্ট মীর্যা ও তার অনুসারীরা ঐ অনিবার্য সমাধানকে সহজে ও পরিকল্পিতভাবেই পাশ কাটাতে পেরেছিলেন, কেননা সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের শীর্ষস্তরগুলির ব্যক্তি ও সাংগঠনিক উচ্চাভিলাষগুলি একাট্টা হয়েছিল। এই সমাবেশ বা জোটকে সমর্থন জানিয়েছিল ব্যবসায় মহলের অভিজাতবর্গ, এতে আরাে ইন্ধন যুগিয়েছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আগ্রহী বিদেশী স্বার্থান্বেষী মহল। যুগপৎ তারা আওয়ামী লীগসহ সেইসব, পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতাকে হটিয়ে দেয় যারা পাকিস্তানের মতাে সদ্যোজাত দুর্বল দেশে রাষ্ট্র ও জাতিগঠনমূলক কাজগুলি করছিল। তখন পাকিস্তানের জনসমাজে সংহতির অভাবের কারণ ছিল: খােদ পাকিস্তান আন্দোলনের নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যাবলি, পাকিস্তানের ভৌগােলিকভাবে খণ্ডিত অবস্থান, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সমাজ-রাজনৈতিক চেতন স্তর এবং শাসকবর্গের পটভূমি ও বিন্যাস। পরবর্তীকালের ঘটনাপ্রবাহের স্রোত পাকিস্তানকে ফেডারেল-গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান প্রণয়নের থেকে বহুদূরে নিয়ে যায়। যদিও আওয়ামী লীগ তার দরকষাকষি ও আপােসের রাজনীতির মাধ্যমে প্রয়াস করছিল পাকিস্তানে ফেডারেল-গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য।
৪৭
তৃতীয় অধ্যায়
সামরিক আইনের আমল
আওয়ামী লীগ জানতাে যে, দরকষাকষি ও আপােসরফার মাধ্যমে আঞ্চলিক ও আদর্শিক ব্যবধান ন্যূনতম পর্যায়ে কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে এর প্রয়াস ইতিবাচক ফল দেয়নি, কেননা আন্তঃজনসমাজ ব্যবধানসে ঐকমত্যের জন্য যে যে সর্বজনীন ঐকমত্যের পরিবেশ দরকার তা তখনাে পাকিস্তানে অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়াকে যে শিকেয় তােলা হবে তা স্পষ্টতই এ দল কল্পনা করতে পারেনি। তাই বিপর্যয় নেমে আসার আগে সােহরাওয়ার্দী তার সকল আন্তরিকতায় তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযােগীদের সাথে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারাভিযানের নীতি-কৌশল কী হবে সে বিষয়ে আলােচনায় নিয়ােজিত ছিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, দলের ‘হৃত মর্যাদার’ পুনরুদ্ধার যাতে সংগঠনটি নির্বাচনের পর ফলদায়কভাবে কাজ করতে পারে। তাদের কাছে প্রতিশ্রুত নির্বাচন ছিল ক্ষমতার আরাে কেন্দ্রায়নের বিরুদ্ধে গ্যারান্টিবিশেষ। সে জন্য, সামরিক আইন জারির বিষয়টিকে তাৎক্ষণিকভাবে গােটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বানচালের পরিকল্পিত চেষ্টা বলেই ধরে নেওয়া হয়। দলের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সদস্য আতাউর রহমান খান এ জন্য শাসকগােষ্ঠীকে দোষারােপ করেন এবং এ অচলাবস্থার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকেও আংশিকভাবে দায়ী করেন।১ যুক্তরাষ্ট্রের সুপরিকল্পিত কৌশলগত নানা বিচার-বিবেচনা যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলিকে প্রভাবিত করেছে তার প্রমাণ পরবর্তীকালে পাওয়া যায়।২ অবশ্য, এই বহিঃহস্তক্ষেপের জন্য চূড়ান্ত দায়িত্ব বর্তায় পাকিস্তানের জাতীয় স্তরের কর্মকর্তাদের ওপর।
নির্বাচন স্থগিত ও রাজনৈতিক দলগুলিকে নিষিদ্ধ করায় কারও কারও আশু স্বার্থসিদ্ধি হয়তাে হয়ে থাকবে। কিন্তু জাতীয় পুনর্গঠনের কাজে বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানীকে অংশীদার হওয়া থেকে এভাবে বঞ্চিত করায় পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থ মােটেও লাভবান হয়নি। ১৯৬০-এর দশকে দলীয় পুনরুজ্জীবনের পর আওয়ামী লীগ এই পদ্ধতিগত দুর্বলতা খুবই দক্ষতার সাথে উঘাটিত করে। সামরিক আইন আমলের রাজনৈতিক আন্দোলনগুলি আওয়ামী লীগকে এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য তৈরি করে। পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক
৪৯
শাসকগােষ্ঠী রাজনৈতিক দলগুলিকে প্রকাশ্যে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। তাতে কার্যত ঐ দলগুলি শহর-নগরবাসী শিক্ষিত সমাজের অসন্তোষ-বিক্ষোভের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের একটা অবকাশ পায়। রাজনৈতিক দলগুলিকে আসলে এদের মাধ্যমেই সংগঠিত হয়ে উঠতে হয়। কোনাে সন্দেহ নেই যারা সঠিকভাবে সে সময় দেওয়ালের লিখন পড়তে পেরেছিলেন তাঁরা সহজেই জনসমর্থন লাভ করেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এই পরবর্তীকালীন সাফল্যে বিপুল অবদান রয়েছে এ দলের কয়েকজন দূরদর্শী নেতার।
প্রদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানীদের সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত অভিপ্রায়ের প্রতিক্রিয়া হিসেবে কার্যরহিত আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে আদর্শিক ধ্যানধারণার একটা সুনির্দিষ্ট মেরুকরণ ঘটে। ১৯৬৪ সালে এ দল পুনরুজ্জীবনের সিদ্ধান্ত এবং পরবর্তীকালে এর আচরণও প্রধানত এই রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে পূর্ব পাকিস্তানীদের একটা বিপুল অংশের প্রায় ঐকমত্যের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হয়। সেই কারণেই সামরিক আইনের শাসনামলে ও তারপরে পূর্ব পাকিস্তানের জনঅসন্তোষ সম্পর্কে একটি ধারণা নেওয়া ১৯৬৪ সালের পুনরুজ্জীবনের পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অগ্রাধিকার ও কার্যধারা বুঝে ওঠার জন্য অপরিহার্য।
সামরিক শাসন—যাকে তার উদাতারা “বিপ্লব” বলে অভিহিত করেছিল—প্রথমাবস্থায় অনেকটাই ঘটনা ও সংঘাতহীন ছিল কারণ, পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনী ইতােমধ্যেই শিকড় গেড়েছিল। রওনক জাহানের সুস্পষ্ট অভিমতে কু ঘটবার বহুপূর্ব থেকেই তারা দেশের সিদ্ধান্ত প্রণয়নের কলকাঠিস্বরূপ বেসামরিক-সামরিক-আমলাতন্ত্র আঁতাতের এক নীরব অংশীদার হয়ে গিয়েছিল।৩ সামরিক আইনের মেয়াদকালে (১৯৫৮-৬২) বিভিন্ন সামরিক আইনবিধি ও বুনিয়াদী গণতন্ত্র পদ্ধতির মাধ্যমে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয় শাসনতন্ত্র কমিশন নামে এক বিশদ ব্যবস্থার পর্দার আড়ালে। এই কমিশন দৃশ্যত ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের বিষয়ে ঐকমত্য অন্বেষণ করছিল।৪
প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে শাসকচক্রকে বিভিন্ন সামাজিক শক্তির সঙ্গে আঁতাত করতে হয়। এটি করতে ব্যর্থ হলে ঐ শাসকগােষ্ঠী প্রাতিষ্ঠানিক কার্যব্যবস্থার অভাবে তাদের ঠাইছাড়া সামাজিক শক্তিগুলি দ্বারাই বৈপ্লবিক পন্থায় উৎখাত হতে পারে। বিশেষ করে, সামরিক শাসকগােষ্ঠীর বিপদ আরাে বেশি কেননা “নিয়মবিধি ও নির্মিতির দিক থেকে তারা অবশিষ্ট জনসমাজ থেকে ভিন্ন।”৫ পাকিস্তানে সামরিক কর্তারা অসামরিক আমলা, উদীয়মান উচ্চশ্রেণীর শিল্পপতি মহল ও গ্রামের অভিজাতবর্গের সাথে জোট বাঁধে। হান্টিংটনের মতে বন্দুক+সংখ্যা বনাম মস্তিষ্ক এই সমীকরণ প্রসূতব্যবস্থা স্থায়িত্বশীল সরকার স্থাপন করতে পারে। তাহলে গ্রামীণ অভিজাতদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পল্লীসমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠদের কার্যত সমর্থন লাভ করে স্থিতাবস্থার সম্ভাবনা ছিল। তবে অন্যান্য সমীকরণও এই পরিস্থিতিতে কল্পনা করা যায়। যেমন, মস্তিষ্ক+বন্দুক বনাম সংখ্যা, অথবা মস্তিষ্ক+সংখ্যা বনাম বন্দুক। অবশ্য হান্টিংটনের মতে, এই সব সমীকরণ যথাক্রমে ভঙ্গুর স্থিতিশীলতা ও বিপ্লবের জন্ম দেয়।৬
৫০
সামরিক শাসন টিকে থাকতে হলে যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার দরকার তা। নির্ভর করবে জনসাধারণ সামরিক শাসনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছেন কিনা কিংবা ঐ শাসকগােষ্ঠীর নিয়মনীতি ও প্রতীকগুলি মেনে নিচ্ছেন কিনা তার ওপর। এটি হলে তবেই নেতৃত্বের এই নয়া ধাচ ও তার বৈধতা সিদ্ধ হবে। য়ানােভিজ (Janowitz) অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, “বস্তুনিষ্ঠ জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব করার লক্ষ্যে সামরিক বাহিনী গণরাজনৈতিক ভিত্তির আবশ্যকতা স্বীকার করে।”৭ পাকিস্তানে অবশ্য আইয়ুব খানের রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলি, যাকে লাতিন আমেরিকার প্রেক্ষাপটে “Continuismo” বা ‘নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখা’ বলা হয়েছে, সেগুলি ক্ষমতায় সেঁটে থাকারই কৌশলের ওপর বরং একটা আচ্ছাদন বা ঢাকনি বিশেষ। আইয়ুবের আমলের পাকিস্তানী ক্ষমতার কাঠামােতে সামরিক বাহিনীর সুগভীর শেকড় থেকে সেটি খুবই স্পষ্ট।৮ উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ১৯৬২ সালের পাকিস্তানী শাসনতন্ত্রে এই মর্মে লিপিবদ্ধ আছে (অনুচ্ছেদ ২৩৮) যে, এই শাসনতন্ত্রের সূচনা থেকে প্রথম ২০ বছরের মধ্যে পাকিস্তানে এমন কোনাে প্রতিরক্ষামন্ত্রী থাকবেন না যার পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে পদমর্যাদা লে. জেনারেল কিংবা সমতুল্য অন্যান্য বাহিনীর পদমর্যাদার নিচে।
সামরিক আইন শাসনামলে পাকিস্তানের সামরিক শাসকগােষ্ঠী মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে, প্রেসিডেন্টের জন্য আস্থা ভােট সংগ্রহ করে, “জনগণের জন্য শাসনতন্ত্র গড়ে তােলার চেষ্টা করে আর নিরন্তর জাতীয় ঐক্যের কথা বলে সামরিক শাসনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ও বৈধতাদানের চেষ্টা করে। পরে, শুরুতে রাজনৈতিক দলগুলিকে আইনসিদ্ধ ও তারপরে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা হয় (কনভেনশন মুসলিম লীগ) এ দলের মাধ্যমে কাজ করার জন্য। তবে স্বাধীনতার উষালগ্ন থেকেই যে সব বড় সমস্যা পাকিস্তানীদের বিচলিত করে রেখে ছিল সেগুলি অমীমাংসিত থেকে যায়। পাকিস্তানের সামরিক শাসকগােষ্ঠী পছন্দ করুক বা নাই করুক একটি বহুজাতিগােষ্ঠী, বহুভাষী, “বহুঅর্থনীতি” সমন্বিত জনসমাজের প্রেক্ষাপটে যা করতে চেষ্টা করে তা হলাে উল্লিখিত সমস্যাগুলিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক জনমত সংগঠন স্তিমিত করা এবং অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরে অসন্তোষ থামিয়ে রাখা। ক্ষোভ অবদমিত হওয়ার কারণেই বিরােধী জনসংগঠনকে উপযুক্ত গতিবেগ ও মুহূর্ত তৈরি না হওয়া পর্যন্ত শাসকগােষ্ঠীর মােকাবেলায় অনেকটাই নিষ্ক্রিয় থাকতে হয়। ১৯৬৮-৬৯ সালে যে বিস্ফোরণ এ শাসকগােষ্ঠীর সযত্নে গড়ে তােলা ব্যবস্থাকে কাঁপিয়ে তােলে সেটি কোনাে আকস্মিক অগ্ন্যুগার ছিল না। কারণ শাসকচক্রের হাতের মুঠোয় ক্ষমতা আরাে বেশি কেন্দ্রীভূত হওয়ার পাশাপাশি একটি সমান্তরাল বিরােধী পক্ষও গড়ে ওঠে। এমনকি, সামরিক আইনের শাসনামলেও বেশ কয়েকবার তার উপস্থিতি প্রকাশ পায়, এবং অবশেষে এর আঘাতেই শাসনব্যবস্থায় পাকাপাকি ফাটল ধরে যায়।
পূর্ব পাকিস্তানে জনসাধারণের জন্য সামরিক আইনের স্বল্পমেয়াদী পীড়ন তেমন ধর্তব্য ছিল না, বরং তাদের জন্য অনেকখানি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ঐ শাসনের ভবিষ্যৎ বিন্যাস
৫১
বা রূপরেখার বিষয়টি। এটির অবয়ব তৈরি হচ্ছিল এমন এক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের মধ্য দিয়ে যে শাসনতন্ত্র ব্যক্তিবিশেষের “রাজনৈতিক দর্শন”-এর ধারক হয়ে উঠবে। ১৯৬২ সালের ৮ জুন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বলেন, “আজ থেকে যে শাসনতন্ত্র বলবৎ হচ্ছে সেটি পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থায় প্রযােজ্য আমার রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন এবং সেটি সুষম প্রয়ােগের দাবীদার।”৯ বলাবাহুল্য, পূর্ব পাকিস্তান তাই সামরিক আইনের শাসনামল বা তারপরে যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেষ্টা করছিল তা হলাে এই দর্শন’, কেবল সামরিক আইনবিধিসমূহ নয়। তৎকালীন নিষ্ক্রিয় আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রথম সারির নেতা আবুল মনসুর আহমদ প্রসঙ্গত লিখেছেন যে, সামরিক আইনের দীর্ঘ প্রায় চার বছরের মেয়াদকালে পূর্ব পাকিস্তানে কোনাে সামরিক আইনবিরােধী অভ্যুত্থানের বিষয় সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন না।১০ তিনি অবশ্য পরবর্তীকালে দেওয়া এক ব্যাখ্যায় বলেছেন, নিষ্ক্রিয় রাজনীতিকদের এ যাবৎ নীরবতা ছিল ইচ্ছাকৃত। কিন্তু অনেকেই অবাক হন এই ভেবে যে, তিনি ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চের ছাত্রবিক্ষোভ সম্পর্কে কিছুই বলেননি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিক্ষুব্ধ রাজনীতির লালনক্ষেত্র হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের ভাবমূর্তির পরিপ্রেক্ষিতে এই নীরবতা সম্পর্কে ফেল্ডম্যান মন্তব্য করেছেন। যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সামরিক আইন সম্বন্ধে যাই চিন্তা করে থাকুক না কেন, পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় অধিকতর প্রতিরােধ এখানে দেখা যায়নি এবং সামরিক আইনের ভীরু বশংবদতা এখানেও কিছু কম দৃষ্ট হয়নি।১১
শাসনতন্ত্র রচনার কাজ যখন চলছে সেই সময়ে সামরিক আইন শাসকগােষ্ঠী তাঁদের উদ্যম ও শক্তি দুটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে জনমত দানা বাঁধানাের কাজে নিয়ােজিত করেন। এক, দেশ যেসব সমস্যায় পীড়িত তার মূল কারণ হলাে রাজনীতিকরা, আর তাই তাদেরকে সমস্ত কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখতে হবে। দুই, পাকিস্তানের জন্য পাশ্চাত্যধারার গণতন্ত্র উপযােগী নয়, আর সে জন্য একটা দেশজ ব্যবস্থা দরকার (যা শাসকগােষ্ঠী দেবেন)। এ দুটি বিষয়ই পূর্ব পাকিস্তানকে সুগভীরভাবে প্রভাবিত করে। এ প্রদেশের রাজনৈতিকীকরণের স্তর ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাদির সপক্ষে প্রদেশের জনসাধারণের অত্যন্ত সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সেটিই স্বাভাবিক। প্রকৃতপক্ষে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানমূলক ব্যবস্থার সপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের চাপ ক্রমবর্ধিত হওয়ার কারণ ছিল ঐ প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও সারা দেশের ব্যবস্থাপনায় এর ক্ষীয়মাণ ভূমিকা। অবিভক্ত উপমহাদেশে মুসলিম রাজনীতির প্রকৃতি ও পাকিস্তানের গােড়ার দিকে সে দেশের শাসকবর্গের মনােভাব ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে পূর্বাঞ্চলের স্থান কী হবে সে বিষয়টি পূর্বাঞ্চলের রাজনীতিকদের আশঙ্কিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। সময় গড়াতে থাকার সাথে সাথে বৈষম্যের সুনির্দিষ্ট প্রমাণগুলি স্থূপীকৃত হতে থাকে আর দেশের দুই অংশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য (বিশেষ করে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে) পূর্ব পাকিস্তানকে ক্রমেই বেশি করে শঙ্কিত করতে থাকে। সামরিক আইন আমলে এ বিষয়ে প্রচুর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু শিক্ষিত ও চিন্তায় সুচর্চিত পূর্ব পাকিস্তানীরা আসন্ন ব্যবস্থায় কোনাে স্থায়ী প্রতিকার বেরিয়ে আসবে—সে
৫২
রকম কিছুতে আদৌ আস্থাবান হতে পারেনি। ফলে, সামান্য মাত্র সুযােগ পেলেও তারা শাসকগােষ্ঠীর ধারাপদ্ধতির বিরুদ্ধে অসন্তোষ ব্যক্ত করার চেষ্টা করেছে। তাদের সুস্পষ্ট মতামত প্রকাশের স্বাভাবিক পথগুলি রুদ্ধ থাকায় অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটতাে কখনাে কখনাে, ও বাহ্যত অসংগঠিতভাবে। তবে শহর-নগরবাসীদের নানা শাখা থেকে আসা পূর্ব পাকিস্তানীদের এই সব মতামত প্রকৃত প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি সচেতন, সক্রিয় ও উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মতামতকেই বিপুলভাবে প্রতিনিধিত্ব করে এবং আবেগের দিক থেকে এরা একান্তভাবে গণমানুষের সাথে অর্থাৎ কৃষকশ্রেণীর সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত, কারণ, পল্লীনিবাসী কৃষককুলের মধ্য থেকেই এরা সাম্প্রতিককালে আবির্ভূত হয়েছিল।
বিরুদ্ধ মতের অভিব্যক্তি লাগাতার না ঘটলেও একটি মূলভাবগত ঐক্য গড়ে ওঠে: পূর্ব পাকিস্তান এই অভিমত স্বীকার করে নিতে পারেনি যে, কোনাে আধুনিক সমাজব্যবস্থা গণতান্ত্রিক রাজনীতি ব্যতিরেকে টিকে থাকতে পারে। দেশের একটি অংশ যখন অন্য অংশের স্বার্থ বিকিয়ে নিজের শ্রীবৃদ্ধি সাধন করে তখন কেমন করে জাতীয় পর্যায়ে সংহতি সম্ভব এটা তাদের ধারণাতীত ছিল! এই অভিমত আসে নানা ধরনের সূত্র ও উৎস থেকে। এদের মধ্যে ছিল পেশাজীবী, বিদগ্ধ ব্যক্তিবর্গ, অর্থনীতিবিদ, আমলা ও নিষ্ক্রিয় রাজনীতিকবৃন্দ। পরিশেষে পূর্ব পাকিস্তানী ছাত্ররা প্রকাশ্যে বিদ্রোহে নামে। তাতে যে আবহ ও পরিবেশ তৈরি হয় তার অবকাশে রাজনীতিকরা প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হন। এ সময়ে যেসব অভিমত প্রকাশিত হয় তা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতেইবা বলি কেন বরং পাকিস্তানের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তারই পর্যালােচনা রয়েছে বক্ষ্যমাণ গ্রন্থের পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলিতে।
আওয়ামী লীগের রাজনীতিকসহ পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ রাজনীতিককে ‘এবডাে’র আওতায়, ও ঘন ঘন কারারুদ্ধ করার মাধ্যমে দৃশ্যপটের বাইরে রাখা হয়। আবুল মনসুর আহমদ, মনােরঞ্জন ধর, খয়রাত হােসেন, কোরবান আলী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। আবুল মনসুর আহমদের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপে নিয়ােজিত এক গুপ্ত সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকার অভিযােগ করা হয়। এ মামলায় তাঁর কৌঁসুলি এইচ. এস. সােহরাওয়ার্দী অত্যন্ত সঠিকভাবেই উল্লেখ করেন, যে সময়টিতে তাঁর মক্কেল নাশকতামূলক কার্যকলাপের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে অভিযােগ করা হয়েছে সে সময় কখনাে তিনি একজন প্রাদেশিক মন্ত্রী, কখনাে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবার—সময় বিশেষে কয়েকবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার অস্থায়ীভাবে পরিচালনা করেন। তাহলে সেই সময়ে ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ কী করছিল?—এ প্রশ্ন তুলেছিলেন সােহরাওয়ার্দী। তিনি আরাে প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন এ কথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তখন অবহিত করা হয়নি? আর সেই গুপ্ত সংগঠনই বা কেমন? আওয়ামী লীগের আরেকজন বিশিষ্ট নেতা তাজউদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধে অভিযােগ ওঠে, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলায় সফর করে নাশকতামূলক কাজ করেছেন। আর এ কথিত কার্যকলাপ যে সময়ের
৫৩
বলে অভিযােগে উল্লেখ করা হয় জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বরাবরই সে সময়ে ঢাকায় থেকে আইন পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন।১২ অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতি ও অন্যান্য বিষয়ের অভিযােগের অধিকাংশই আদালতে প্রমাণিত হয়নি।
অনেক নিষ্ক্রিয় রাজনীতিক নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ সত্ত্বেও শাসনতন্ত্র কমিশন প্রণীত প্রশ্নমালার জবাব দেওয়ার সময় তাঁদের নিজ মতামত প্রকাশের অবাধ সুযােগ গ্রহণ করেন।১৩ তাঁরা এ সুযােগ পুরােপুরি কাজে লাগান এবং সংবাদ মাধ্যমের ওপর নিবর্তনমূলক বিধিবিধানের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও তাঁদের দেওয়া জবাবগুলি খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়। এ বিষয়ে অত্যন্ত পরিষ্কার অভিমত আসে আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রবীণ নেতা ও পূর্ব পাকিস্তানের সর্বশেষ মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের কাছ থেকে।
আতাউর রহমান স্পষ্টত বলেন যে, অভিযােগ করা হয় সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঐ গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়নি কেননা আসলে তাে এর কোনাে প্রয়ােগ-যাচাই আদৌ হয়নি। পাকিস্তানে গণতন্ত্রের দুর্ভাগ্য সম্পর্কে তাঁর অবস্থানের সপক্ষে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বলেন, কতিপয় ব্যক্তি “গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যে অভিমত দিয়েছেন তা একান্তই ভাসাভাসা। আর তাতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কোনাে ত্রুটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়নি। পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করার আগে কোনাে সময়ে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে তাদের স্বকীয় কঠোর প্যাটার্নের শাসনব্যবস্থা সে জায়গায় বহাল করার আগে কখনাে তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কোনাে গলদ দেখাননি।” তিনি উল্লেখ করেন, স্বাধীনতার সময় জনগণের হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত না। করে তড়িঘড়ি করে জোড়াতালি দিয়ে তৈরি আইনসভার কাছে সে ক্ষমতা দেওয়া হয়। আর তারপর ক্ষমতা গ্রাসের জন্য হুড়ােহুড়ি পড়ে যায়। প্রাসাদ চক্রান্ত চলতে থাকে ও অন্যান্য নােংরা খেলা শুরু হয়। মুসলিম লীগ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হওয়ার দু’মাসের মধ্যেই “সরকার ও আইন পরিষদকে বরখাস্ত করতে এবং বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক কর্মীকে জেলে পাঠাতে সক্ষম হয়।” আতাউর রহমান আমলাদেরকে “ব্রিটিশ রাজের রেখে যাওয়া ভারবােঝা” বলে নিন্দা জানান ও বলেন, ওরা কখনাে গণতান্ত্রিক নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধা জানায়নি।১৪ আতাউর রহমান গণবিরােধী চক্রান্তে লিপ্ত হওয়ার অভিযােগ করেন আমলাদের বিরুদ্ধে। তাঁর মতে, এ কারণে “অনবরত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সন্দেহ-অবিশ্বাস চলতে থাকে… তাতে ধারাবাহিক নানা বিপর্যয়কর ঘটনা ঘটতে থাকে।” তিনি নিশ্চিত, বহু পাকিস্তানীর ধারণা যে, আমলাতন্ত্রের মাঝে এক শক্তিশালীচক্র অস্তিত্বশীল ছিল যারা চায়নি গণতন্ত্র কাজ করুক। এ বিষয়ে তিনি লিয়াকত আলী খানের কথা উল্লেখ করে বলেন যে, একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার পরপরই তাঁকে হত্যা করা হয়। খাজা নাজিমুদ্দিন যখন একটি শাসনতন্ত্র বিল তৈরি করেছিলেন সেই সময় তাকে অবমাননাকরভাবে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। বগুড়ার মােহাম্মদ আলী সরকার যাকে পুতুল সরকার বলে মনে করা হতাে সেই তিনিও একটি খসড়া
৫৪
শাসনতন্ত্র তৈরি করলে তাকেও সরানাে হয়। আমলাতন্ত্রের ধ্বজাধারী হিসেবে পরিচিত চৌধুরী মােহাম্মদ আলী একটি শাসনতন্ত্র প্রকাশ করলে তাকেও অচিরে পদচ্যুত করা হয়। এইচ. এস. সােহরাওয়ার্দী এর আগে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের কতিপয় বিধান চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তিনি যখন তার অঙ্গীকার অনুযায়ী নির্বাচনের জন্য তারিখ নির্ধারণ করে ভােটার লিস্ট তৈরির নির্দেশ দিলেন তখনই তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আই. আই. চুন্দ্রীগড় দীর্ঘসূত্রতার কৌশল নিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে তিনি আইনসভার আস্থা হারান। তাঁকে আমলাতন্ত্র চাইলেও সরে যেতে হয়। সপ্তম ও শেষ প্রধানমন্ত্রী ফিরােজ খান নূন এ ধরনের খেলায় মাতেননি। তিনিও নির্বাচনের জন্য একটি তারিখ নির্ধারণ করেছিলেন। এ অনুসারে ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। আর ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের অধীনে প্রথম ও শেষ প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্যা প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থাকার কোনাে আশা নেই জেনে বেপরােয়া হয়ে। সামরিক আইন জারি করেন এবং ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র বাতিল করেন।
ভবিষ্যতের জন্য আতাউর রহমান খানের প্রস্তাবনা ছিল: পার্লামেন্টারি ধাচের সরকার হতে হবে। সরকারে থাকবে কেবিনেট পদ্ধতি, রাষ্ট্রকাঠামাে হবে ফেডারেল পদ্ধতির। এ কাঠামােতে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশ হবে ঐ ফেডারেশনের একেকটি ইউনিট। তিনি এককক্ষ ব্যবস্থাপক পরিষদের পক্ষপাতী। এ পরিষদের সদস্যরা নির্বাচিত হবেন সর্বজনীন ভােটাধিকার ও যুক্তনির্বাচন পদ্ধতিতে। তাঁর মতে, প্রেসিডেন্ট হবেন খেতাবী পদধারী আর তিনি নির্বাচিত হবেন ফেডারেল ইউনিটসমূহ ও কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্যদের পরােক্ষ ভােটে।
শাসনতন্ত্র কমিশনের প্রশ্নমালায় ৪০নং প্রশ্নটি ছিল এরকম: নিরাপত্তা, শান্তি ও সম্প্রীতি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কমিশনের জন্য নির্ধারিত কর্তব্যমূলক শর্তাবলির সাথে১৫ সম্পর্কিত আর কোনাে প্রস্তাব আপনার করার আছে কিনা? এর জবাবে আতাউর রহমান নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলি উল্লেখ করেন:
১. অনতিবিলম্বে সামরিক আইন তুলে নিতে হবে ও জননির্বাচিত একটি গণপরিষদ গঠন করতে হবে। এ গণপরিষদের কাজ হবে তিন মাসের মধ্যে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও ছয় মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান;
২. এটি সম্ভব না হলে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা;
৩. বর্তমান কমিশনের উচিত হবে জনমতের ভিত্তিতে এবং দেশের ভৌগােলিক, ভাষাগত ও অর্থনৈতিক পটভূমির বিবেচনায় একটি শাসনতন্ত্র সুপারিশ করা;
৪. অবাধে রাজনৈতিক দল গঠন করতে এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কর্মসূচি অনুযায়ী ঐ দলগুলিকে কাজ করতে দিতে হবে।
৫. পাকিস্তানের দুই শাখার মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য অবিলম্বে দূর করতে হবে;
৫৫
৬. সরকারি চাকরিতে সকল গ্রেডে অবিলম্বে সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে ও এ জন্য প্রয়ােজনে অ্যাড-হক নিয়ােগ দিতে হবে;
৭. পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পায়ন উৎসাহিত করতে হবে;
৮. পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে উচ্চতর মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে যথাক্রমে বাংলা ও উর্দু শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে;
৯. পূর্ব পাকিস্তানে একটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক একাডেমী প্রতিষ্ঠা করতে হবে;
১০. দেশের বিভিন্ন অংশের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা, সন্দেহ-সংশয়, অবিশ্বাস ও অবিচারবােধ দূর করার জন্য প্রয়াস চালাতে হবে।১৬
দেখা যায়, আতাউর রহমান খানের সুচিন্তিত অভিমত ছিল এই যে, পাকিস্তানে নিরাপত্তা, শান্তি ও শুভেচ্ছা নিশ্চিত করতে পূর্ব পাকিস্তানের দাবিগুলি মেটাতে হবে। এখানে আতাউর রহমান যা বলেছেন সেগুলি নিষ্ক্রিয় আওয়ামী লীগেরই অভিমত ধরতে হবে, কেননা প্রশ্নমালার জবাবগুলি তৈরি করার সময় তিনি তাঁর দলীয় সহযােগীদের সাথে আলােচনা করে তাদের সম্মতি নিয়েছেন।১৭ যেহেতু এ অভিমত আওয়ামী লীগ দলের এবং যেহেতু পাকিস্তানে রাজনৈতিক দলগুলির পুনরুজ্জীবনের পর পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগই সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয় সেহেতু এ অভিমত যে কোনাে রাজনীতিকের ব্যক্তিগত অভিমতের তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
আর যেসব উল্লেখযােগ্য রাজনীতিক শাসনতন্ত্র কমিশনের ঐ প্রশ্নমালার জবাবদাতা ছিলেন তাঁদের অন্যতম হলেন নুরুল আমিন। তিনি প্রায় আতাউর রহমানের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেন।১৮
ঢাকার পাকিস্তান অবজার্ভারে প্রকাশিত একাধিক রিপাের্ট অনুযায়ী ১৩টি সংগঠন প্রশ্নমালার জবাব দেয়। এগুলির মধ্যে ১২টিই ছিল বার অ্যাসােসিয়েশন। ত্রয়ােদশ সংগঠনটি ছিল মেডিক্যাল অ্যাসােসিয়েশন। সমিতিগুলির চারটি ছিল প্রাদেশিক স্তরের। অন্যগুলি জেলাস্তরের—যেমন, ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রংপুর ও কুষ্টিয়ার। এদের সকলেই সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের অনুকূলে মত প্রকাশ করে। দশটি সংগঠন ইউনিটারি থেকে ফেডারেল পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার পক্ষপাতী। সাতটি সংগঠন ভােটদান ব্যবস্থার প্রশ্নে মত প্রকাশ করে। তারা সকলেই সর্বজনীন বয়স্ক ভােটাধিকারের পক্ষে। এদের চারটি সংগঠন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের যৌথ নির্বাচকমণ্ডলী ব্যবস্থার অনুকূলে মত প্রকাশ করে। সাতটি সংগঠন সুনিশ্চয় করে জানায়, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র ব্যর্থতা বরণ করেনি কেননা সাধারণ নির্বাচন না হওয়ায় এর ভালােমন্দের যাচাইও হয়নি। শাসনতন্ত্র রক্ষা করা কর্তব্যের অংশ হওয়া সত্ত্বেও যারা শাসনতন্ত্রের বিধিবিধান লঙ্ঘন করেছেন, এই সাতটি সংগঠনের পাঁচটি তাঁদের নিন্দাজ্ঞাপন করে। তারা রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে ন্যস্ত অতিরিক্ত ক্ষমতার সমালােচনা করে। তাদের বরাত দিয়ে আরাে বলা হয়, তারা গােলাম মােহাম্মদের
৫৬
নাম করে তাঁকে স্বৈরাচারী অভিহিত করে বলে, তিনি সংসদীয় গণতন্ত্র চুরমার করেছেন। তারা আরাে বলে, ইস্কান্দার মীর্যা গােলাম মােহাম্মদের চেয়েও একনায়কসুলভ। অভিযােগ করা হয়, এঁরা উভয়েই তাদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য হীন মতলবে দলীয় রাজনীতিতে নাক গলিয়েছেন। এসব জবাবদাতাদের মাত্র দুটি সংগঠনের মতে, রাজনৈতিক দলগুলির সপক্ষ ত্যাগ ও ক্ষমতার লড়াই সংসদীয় পদ্ধতি ভেঙে পড়ার জন্য দায়ী।১৯
ইস্ট পাকিস্তান লইয়ার্স অ্যাসােসিয়েশনের ৫ম বার্ষিক অধিবেশনে খান বাহাদুর নাজিরুদ্দিন আহমদ সভাপতির ভাষণে, সংসদীয় ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে—শাসনতন্ত্র কমিশনের এ ধারণার সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করলে সামরিক শাসকগােষ্ঠীর তথাকথিত বৈধতার মুখােশ উন্মােচিত হয়।২০
ইস্ট পাকিস্তান প্রভিন্সিয়াল ডেভলপমেন্ট অ্যাডভাইজরি কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য ও আরেকজন আইনজীবী এস. এম. এ. মজিদ একই সুর ও মননে প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বাড়তি উল্লেখে বলেন যে, গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য আদর্শ নির্বাচকমণ্ডলীর অবর্তমানে দেশকে অবশ্যই যা আছে তা নিয়েই এগুতে হবে।২১
শাসনতন্ত্র কমিশন পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকজন সাংবাদিকেরও সাক্ষাৎকার নেয় একই প্রশ্নে। তাঁরা হলেন: পাকিস্তান অবজার্ভার, ইত্তেফাক, আজাদ, সংবাদ ও পাসবান (উর্দু)-এর সম্পাদক। তাঁদের পাঁচ জনই বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়নি। বরং এ ব্যবস্থা কার্যকর হওয়ার সুযােগই পায়নি। তারা উল্লেখ করেন, শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও নির্বাচন অনুষ্ঠানে বারংবার সরকারের ব্যর্থতার কারণে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। এঁদের মধ্যে একজন সম্পাদকের মতে, কেন্দ্রের প্রভাব এ জন্য দায়ী। আরেকজন গণপরিষদ (১৯৪৭) সদস্যদের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার ষড়যন্ত্র, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য ও রাজনীতিকদের সপক্ষ ত্যাগের বিষয়গুলিকে দোষারােপ করেন। অন্যরা বলেন, আমলাতন্ত্রের একটি ক্ষমতাশালী অংশের সকল ক্ষমতার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের ফলে অগণতান্ত্রিক পন্থায় বিভিন্ন মন্ত্রিসভা বাতিল হয় ও শাসনতন্ত্র প্রণয়নে বিলম্ব ঘটে, এবং অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। এসব সম্পাদক ঘন ঘন অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান, সুস্পষ্ট কর্মসূচি আছে এরকম বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক দলগুলিতে সপক্ষ ত্যাগের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরােপ, শাসনতন্ত্রের অপব্যাখ্যা ও অপপ্রয়ােগের বিরুদ্ধে বিধিবিধান সন্নিবেশিত করে শাসনতন্ত্র রচনার প্রস্তাব করেন। তাঁদের সবাই সংসদীয় সরকার পদ্ধতির অনুকূলে মত প্রকাশ করেন। এ ধরনের সরকার ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামাের আওতায় থাকবে। আর প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র বিষয় ও মুদ্রা ব্যতিরেকে অন্য সকল বিষয় প্রদেশগুলির হাতে থাকবে। আর এভাবে কেন্দ্র ও প্রদেশগুলির মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের ক্ষেত্রে সীমারেখাও স্থির করে দিতে হবে।২২ এ বিষয়গুলি নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে আরাে অনেকে আরাে বিশদ ও সুবিস্তৃতভাবে আলােচনা করেছেন।
৫৭
১৯৬১ সালের গ্রীষ্মে প্রেসিডেন্টের পূর্ব পাকিস্তান সফরের অল্পদিন পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রেহমান সােবহান “হাউ টু বিল্ড পাকিস্তান ইনটু এ ওয়েলনিট নেশন” শীর্ষক নিবন্ধে উল্লেখ করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানী জনগণের মাথাপিছু আয় ক্রমাগত কমে যাচ্ছে, পশ্চিম পাকিস্তানীদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। এই বাস্তবতার নিরিখে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলেরই নিজ নিজ সম্পদের ওপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত।২৩ অধ্যাপক সােবহান নিবন্ধটি ইসলামী একাডেমি আয়ােজিত এক সেমিনারে পাঠ করেন। আসলে অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি বেশ কিছুদিন ধরেই আলােচিত হচ্ছিল।২৪ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব এ বিষয় সম্পর্কে ইতােমধ্যে উল্লেখ করে একে “বল্গাহীন ও দায়িত্ববর্জিত কথাবার্তা” বলে বাতিল করেছিলেন। তবু দুই অর্থনীতি নিয়ে আলােচনা চলতেই থাকে। ঢাকার জার্নাল “নিউ ভ্যালুজ”-এর ১৯৬১ সালের গােড়ার দিকের কোনাে এক সংখ্যায় অধ্যাপক রেহমান সােবহানের “দ্য মিনিং অব দ্য টু ইকনমিজ থিসিস” শীর্ষক একটি লেখা ছাপা হয়। ঐ একই নিবন্ধের বাংলা অনুবাদ ১৯৬২ সালে ঢাকায় সম্পাদিত এক সঙ্কলনে প্রকাশিত হয়।২৫ দুই অর্থনীতিতত্ত্বকেন্দ্রিক আলােচনার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে ১৯৬২ সালের জুলাইয়ে “এশিয়ান সার্ভে”-তে মুদ্রিত অধ্যাপক রেহমান সােবহানের নিবন্ধে। তিনি এই নিবন্ধে পাকিস্তানী অর্থনীতির দ্বৈত বৈশিষ্ট্যের মূল কারণগুলির বিশ্লেষণ করে রায় দেন:
একাডেমিক দিক থেকে দেখলে পাকিস্তানী অর্থব্যবস্থা একটি কৌতূহলােদ্দীপক বিষয়সমীক্ষার উপাদান হতে পারে কারণ, দুই অঞ্চলের মধ্যেকার উন্নয়নের ভিন্ন ভিন্ন হার অর্থনৈতিক সমতার ক্ষেত্রে সমস্যা রূপে বিরাজ করছিল। এ কথা অবশ্যই বলতে হয় যে মুক্তবাজারে ক্রিয়াশীল শক্তিগুলির এই অসমতাকে বাড়িয়ে তুলবার প্রবণতা আছে এবং আঞ্চলিক আয়ের ক্ষেত্রে কোন রকম সমতা আনবার জন্য সরকারি ব্যবস্থাগ্রহণ প্রয়ােজন। এটি অবশ্যই সমস্যাটিকে যতটা অর্থনৈতিক ততটাই রাজনৈতিক পর্যায়েও উন্নীত করে বিভিন্ন জটিল সমস্যার প্রশ্ন তােলে যা বিশেষভাবে অনুধাবন করার প্রয়ােজন আছে।২৬
সামরিক আইনের শাসনামলে আতাউর রহমান খান পাকিস্তানের রাজনৈতিক দুর্দশা ও সমস্যার সবচেয়ে বিশদ বিবরণ দেন। আর অধ্যাপক রেহমান সােবহান সবচেয়ে প্রাঞ্জল ও স্পষ্ট বর্ণনায় অর্থনৈতিক সমস্যাগুলি তুলে ধরেন। আর্থ-রাজনৈতিক সমস্যার এই দ্বৈত সঙ্কট চলতে থাকার মধ্যেই আভাস পাওয়া যেতে থাকে রাজনৈতিক দলগুলির ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানী রাজনীতি কোন দিকে ধাবিত হবে।
অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টি অনেক পূর্ব পাকিস্তানী আমলারও মনােযােগ আকর্ষণ করে। ১৯৬১ সালের ফিন্যান্স কমিশনে পাঁচজন পূর্ব পাকিস্তানী সদস্য তাঁদের পাঁচ পশ্চিম পাকিস্তানী সহযােগীর সাথে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার পন্থা ও উপায়ের বিষয়ে একমত হতে পারেননি। পূর্ব পাকিস্তানী পাঁচ সদস্যের তিনজন ছিলেন সিএসপি, একজন শিল্পোন্নয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পঞ্চম জন অর্থনীতির অধ্যাপক। পূর্ব পাকিস্তানী সদস্যরা এক পৃথক রিপাের্ট তৈরি করে তাতে সুপারিশ করেন যে, যে শাসনতন্ত্র তৈরির কাজ চলছে।
৫৮
তাতে কেবল দেশের দুই প্রদেশের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য ন্যূনতম ২৫ বছর মেয়াদে দূর করার লক্ষ্য সন্নিবেশিত থাকলেই চলবে না বরং উন্নয়নের বিভিন্ন সহায়সম্পদ বিলিবণ্টনের জন্য যে ফর্মুলা তাঁরা রিপাের্টে প্রস্তাব করেছেন সেটাও থাকতে হবে।২৭
পাকিস্তানের জাজ্বল্যমান আন্তঃআঞ্চলিক বৈষম্যের কারণ ও প্রতিকারের বিষয়গুলি অর্থনৈতিক পারিভাষ্যে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে আমলা-অর্থনীতিবিদদের উদ্যোগ নিয়ে মতপার্থক্য তথা মতভেদ থাকতেই পারে। একে “বাস্তবতামূলক মতানৈক্য” বলা যায়।২৮ কিংবা একটা স্থিতি-ভারসাম্য অবস্থায় আমলাতান্ত্রিক আধিপত্য বজায় রাখাও এর উদ্দেশ্য হতে পারে।২৯ কিন্তু তবু নিরেট বাস্তবতা এই যে, বিরাজমান পরিস্থিতিতে নিহিত বিপদের সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে তাঁরা তাঁদের উদ্বেগ ব্যক্ত করেন। শাসকগােষ্ঠী এ নিয়ে কার্যত আদৌ মাথা না ঘামালেও পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কর্মসূচির একটা মজবুত বুনিয়াদ হিসেবে এই দ্বিঅর্থনীতিতত্ত্বের সবচেয়ে কুশলী প্রয়ােগ করেছেন।
ইস্ট পাকিস্তান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ও আরাে কিছু ব্যবসায়ী সমিতির তৈরি এক রিপাের্টে দেশের দুই অংশের জনসাধারণের জীবনযাত্রার মানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের প্রতি অঙুলি নির্দেশ করে বলা হয়, সরকারের মর্জিমাফিক’ নীতির ফল এটি। ঐ রিপাের্টে পূর্ব পাকিস্তানের চাহিদা পূরণের জন্য দ্বিতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনার আওতায় জোরদার কর্মসূচি নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। তাঁদের এ প্রস্তাবের কারণ, ঐ পাঁচসালা পরিকল্পনায় যােগাযােগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সরবরাহ, শিক্ষা ও কারিগরি সুযােগ-সুবিধা খাতে প্রয়ােজনীয় গুরুত্ব আরােপ করা হয়নি।৩০
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, সামরিক আইন শাসকগােষ্ঠী সবকিছুর ঊর্ধ্বে জাতীয় ঐক্যের অগ্রাধিকারের কথা এক নাগাড়ে জনসাধারণকে বলে যাচ্ছিল। এ বিষয়ে নানা সেমিনার ও সিম্পােজিয়ামও অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। অভিযােগ রয়েছে, এসব আয়ােজনের নেপথ্যে ছিল সামরিক শাসকগােষ্ঠীর পােষকতা ও প্রেরণা। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে ঢাকায় “বৃহত্তর জাতীয় সংহতি” শীর্ষক এক সেমিনারের আয়ােজন করা হয় (এ সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয় এর আগে সেপ্টেম্বরে লাহােরে অনুরূপ এক সেমিনারের পর)। এই সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম. এন. হুদা তার ধারণা ব্যক্ত করে বলেন, এসব আলােচনা “দুটি ভিন্ন সমান্তরাল রেখায় এগিয়ে চলেছে আর তাই এ দুই রেখার কখনাে এক বিন্দুতে মিলিত হওয়ার কোনাে সুযােগ নেই।” এর একটি হচ্ছে, ইসলাম—যা ঐক্যবিধায়ক শক্তি বলে অভিহিত আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য যা কার্যত বিভেদ সৃষ্টিকারী শক্তি। তিনি তার কথার উপসংহারে বলেন, কেবল বিভেদাত্মক বৈষম্য দূর করেই জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বিধান করা যেতে পারে। ঐ একই সেমিনারে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হােসায়েন বলেন, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগােষ্ঠীর মিশ্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সাংস্কৃতিক সামঞ্জস্য অর্জনের ক্ষেত্রে বিরাট প্রতিবন্ধকতা। তার ধারণায় এ ধরনের সংহতি অর্জন
৫৯
‘একান্তই অবাস্তব’। তিনি প্রস্তাব করেন, পাকিস্তানকে তার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিয়েই বাস করতে শিখতে হবে। তাঁর মতে, ঐক্য বিধায়ক উপাদানের বরং সন্ধান করতে হবে এক অভিন্ন জাতীয় উদ্দেশ্য ও সার্থকতার মাঝে অর্থাৎ এমন এক জাতি গড়তে হবে যে জনসমাজে মানুষ মর্যাদাসহকারে বাস করতে সক্ষম হবে। প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, বৈষম্যমূলক উন্নয়ন একটি জাতির ঐক্যবদ্ধ ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করে।”৩১
উপরােক্ত বিবরণ থেকে স্পষ্ট বােঝা যায় যে সামরিক আইনের কঠোরতা সত্ত্বেও সে সময় উপরােক্ত ধারণার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ অথবা এ ব্যাপারে ঘনিষ্ঠভাবে আলাপআলােচনা কিংবা উভয় প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান ছিল। তবে রেখাপাতযােগ্য ও আরাে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলাে: দৃশ্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকা আওয়ামী লীগ যে অভিমতের ধারক (যা ব্যক্ত করেছেন আতাউর রহমান) তার সঙ্গে নুরুল আমিনের মতাে বিশিষ্ট মুসলিম লীগারসহ বাকি প্রায় সকলের মতের একটা মিল রয়েছে। স্পষ্টত দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্য গড়ে উঠতে লক্ষ্য করা যায়। সে দুটি হলাে: এক, রাষ্ট্র ও সরকারের পদ্ধতি ও নির্মিতি (কাঠামাে) আর দুই, কেন্দ্র ও ফেডারেশনের ইউনিটগুলির মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন। এসব নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে বিদগ্ধ জ্ঞানবেত্তা মহলে ক্রমবর্ধমান একটা বঞ্চনাবােধ লক্ষ্য করা যায়। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি দল পুনরুজ্জীবিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব কেমন করে পুরানাে ইস্যুগুলির মােকাবেলা করেন এবং এ দলের পুনরুজ্জীবনের। বাধ্যবাধকতাগুলি কী, এর আশু প্রভাব-প্রতিক্রিয়া কী—নানা বাধা সত্ত্বেও জনমত গড়ে তােলার ক্ষেত্রে তুলনামূলক সহজ সাফল্যের নেপথ্যে এসবের আংশিক ভূমিকার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
তবে রাজনৈতিক দলগুলি তখনাে বেআইনী থাকায় ব্যাপক পর্যায়ে রাজনৈতিক শক্তিসমাবেশ অসম্ভব ছিল। এ জন্য আওয়ামী লীগের বিজ্ঞ পরামর্শদাতা সােহরাওয়ার্দী এক রাজনৈতিক দলবিহীন গণআন্দোলনের কৌশল বের করেন যা রাজনৈতিক চেতনাকে আরাে জোরদার না করতে পারলেও অন্তত সে চেতনাকে সঞ্জীবিত রাখার একমাত্র বাস্তবসম্মত পন্থা নিঃসন্দেহে।
সােহরাওয়ার্দী সব সময় জাতীয় স্তরের রাজনীতিরই পক্ষপাতী ছিলেন। তাই তাঁর সে ধারণার সাথে সুসঙ্গতিক্রমে আঞ্চলিকতাবাদী রাজনীতির বদলে তিনি রাজনীতিবিদদের আগের দলীয় পরিচয় নির্বিশেষে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান—উভয় অঞ্চলের রাজনীতিকদের সমর্থন আদায়ের ও অভিন্ন কর্মসূচির ভিত্তিতে এক আন্দোলন শুরুর পরিকল্পনা করেছিলেন। প্রথমে পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিকদের সাথে আলােচনার পর ১৯৬২ সালের ২৪ জানুয়ারি৩২ পূর্ব পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক দলের নিষ্ক্রিয় রাজনীতিকদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে তিনি বলেন, প্রকাশ্য রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের। অবর্তমানে সৃষ্ট “শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে হলে অতীতের সকল ঝগড়া ও বিদ্বেষ ভুলে একযােগে, এক অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করতে হবে। সে লক্ষ্য হলাে, গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। তিনি বুনিয়াদী গণতন্ত্রীদের নির্বাচনে অংশীদার হওয়ার
৬০
প্রস্তাব করেন। তবে তা এই শর্তে যে, এমনসব প্রার্থীকে সতর্কতার সাথে মনােনয়ন দিতে হবে যারা তাদের আদর্শে ও উদ্দেশ্যে অবিচল থাকবেন। তিনি তাঁর এ বার্তা গােপনে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বলেন। কাজটি সময়সাপেক্ষ বলে সেটি অবিলম্বে শুরু করতে বলেন। তিনি জোর দিয়ে জানান যে, এ আন্দোলন অবশ্যই নির্দলীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হতে হবে।৩৩
সােহরাওয়ার্দী শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলনের কথা ভাবলেও বাস্তবে তা হয়নি। বরং দুর্ভাগ্যক্রমে ঐ বৈঠকের কয়েকদিনের মধ্যেই সােহরাওয়ার্দী গ্রেপ্তার হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানী ছাত্রদের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে প্রথমবারের মতাে সামরিক আইনবিরােধী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। আর আন্দোলনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই, ছাত্ররা প্রত্যক্ষভাবে দায়ী হােক না হােক, বিক্ষোভ সহিংস রূপ নেয়।
১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি করাচিতে ১৯৫২ সালের পাকিস্তানের নিরাপত্তা আইনের ৩নং ধারায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। স্পষ্টত এর উদ্দেশ্য ছিল, কোনাে সম্মিলিত আন্দোলনের সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনাশ করা। সরকার সােহরাওয়ার্দী ও তার সহযােগীদের ১৯৫৮ সালের শেষার্ধে পাকিস্তানী সঙ্কটের জন্য দোষারােপ করেন। এই মর্মে দাবি করা হয় যে, “বিপ্লব” আরাে “পতন” রােধ করেছে ও “আরাে সুবিধাজনক অবস্থায় উত্তরণ সম্ভব করেছে। এ কথাও প্রকাশ করা হয় যে, সােহরাওয়ার্দী ও আরাে কয়েকজনের “অপরাধমূলক অপকীর্তির কথা সুপরিজ্ঞাত হলেও সেগুলি “ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে উপেক্ষা করা হয়েছিল।” কিন্তু পাকিস্তানের ভেতরে ও বাইরে পাকিস্তানবিরােধী মহলের সাথে সােহরাওয়ার্দীর প্রকাশ্য সংলাপ পাকিস্তানের “সংহতি ও নিরাপত্তার জন্য এতই ক্ষতিকর যে, তাঁর কার্যকলাপকে যে কেউ রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কাজ বলে অভিহিত করতে পারে। সে জন্য সরকার সপক্ষে সাফাই দিতে গিয়ে উল্লেখ করেন যে, “তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে আটক রাখার আদেশ দিতে বাধ্য হয়েছেন।৩৪
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেই “রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কাজগুলি কী তা কখনাে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি। আর এ ধরনের অস্পষ্ট অভিযােগের আসলে কোনাে বৈধতা আছে কি নেই তা নির্ধারণের জন্য পূর্ব পাকিস্তানী ছাত্ররা কালক্ষেপণ করেনি (যেমন ১৯৬৮-৬৯ সালে ভিন্ন। বর্গের ছাত্র নেতারাও আগরতলা মামলার সত্য-মিথ্যা যাচাই নিয়ে আদৌ মাথা ঘামায়নি) বরং তারা সােহরাওয়ারি মুক্তির জন্য বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে।
সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ এই অভিযােগের সারবত্তার প্রমাণ দেওয়ার মতাে অবস্থায় সামরিক আইন প্রশাসন থাকুক বা না থাকুক, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সােহরাওয়ার্দীর শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলনের পরিকল্পনা যে সামরিক শাসকগােষ্ঠীর জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে তা তারা বুঝে গিয়েছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেদিন যা লক্ষ্য করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তা হলাে এ ধরনের যৌথ আন্দোলন শুরু করে সােহরাওয়ার্দী বিভেদ সৃষ্টিকারক প্রবণতার আরাে দানাবাঁধা রুখতে প্রয়াস পেয়েছিলেন। আর সে প্রবণতার অস্তিত্ব ছিল বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানীদের মাঝে। তবে তিনি যে পূর্ব ও পশ্চিম
৬১
পাকিস্তানে এককালে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত রাজনৈতিক দলগুলিকে একটি অভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে একত্রিত ও সংগঠিত করতে পেরেছিলেন কেবল সেটিই ক্ষমতা আত্মসাৎকারীদের জন্য ভীতির কারণ হয়ে ওঠে। তাই বেশ স্পষ্টতই পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য কোনাে সত্যিকারের হুমকি নয়, কায়েমী স্বার্থগােষ্ঠীর প্রতি হুমকির অনুমান কল্পনাই বরং সােহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তারের নেপথ্য প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। পূর্ব পাকিস্তানী ছাত্ররা অচিরেই তাঁর গ্রেপ্তারের জন্য প্রদত্ত কারণকে স্রেফ ধাপ্পা বলে অভিহিত করে। এরপর খােদ প্রেসিডেন্ট পূর্ব পাকিস্তান সফরকালে যখন গ্রেপ্তারের সাফাই দিতে চেষ্টা করেন ছাত্ররা তখন তাদের একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করে।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব সাংবাদিকদের বলেন, রাজনৈতিক দলগুলির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে না। তিনি জানান, দেশ যদি কোনাে রাজনৈতিক দল ছাড়াই চলতে পারে, তিনি খুশি হবেন আর জনগণ ভাগ্যবান হবে। তবু যদি রাজনৈতিক দল অপরিহার্য হয়ে ওঠে, ভবিষ্যৎ পার্লামেন্ট কর্তৃক অনুমােদিত আইনে তারা আত্মপ্রকাশ করবে। এমনকি তারপরেও পার্লামেন্টকে তাদের কতকগুলি “মৌল উপাদানের বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। তিনি সােহরাওয়ার্দীর গ্রেপ্তারের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তাঁকে এমন একজন অদেশপ্রেমিক রাজনীতিক বলে অভিহিত করেন যিনি পূর্ব পাকিস্তানকে নিজের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে পাকিস্তানের দুশমনের আর্থিক সহায়তায় বিভেদমূলক কার্যকলাপ বাড়ানাের জন্য “দুর্বল নেতৃত্বকে কাজে লাগিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট উল্লেখ করেন (তবে ব্যাখ্যা করেননি) সােহরাওয়ার্দীর দুষ্কর্ম আরাে বড় ইস্যুর অংশমাত্র।৩৫ স্পষ্টতই তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় চক্রান্তের কথাই বলেছিলেন।
এক বেতার ভাষণে পূর্ব পাকিস্তানের অগ্রগতির পর্যালােচনাকালে আইয়ুব খান স্বীকার করেন যে, “পাকিস্তানের দুটি অংশের প্রতিটির আরাে বেশি শক্তিবৃদ্ধির মাঝেই নিহিত রয়েছে পাকিস্তানের শক্তি আর এই দুই অংশের সুস্থ বিকাশ না হলে কোনাে অংশই তথা সামগ্রিকভাবে পাকিস্তান আর্থ-রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকতে পারবে না।” তিনি এও স্বীকার করেন যে, শ্রমিক বিনিময়, পণ্য চলাচল, দূরত্ব ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতাই বটে। তবে তিনি বলেন, “যেহেতু একজাতি হওয়ার প্রত্যয় আমাদের আছে, তাই ভৌগােলিক বিচ্ছিন্নতার বিষয়টিই বরং আমাদের আরাে বেশি উদ্যোগী হতে প্রেরণা যােগাবে আর তাতে করে আমরা আরাে প্রবৃদ্ধি ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাবাে।৩৬
১৯৬২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিমানবন্দরে বিদায় ভাষণে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে অবশ্য এতটা নরমভাষী বলে মনে হয়নি। তিনি পূর্ব পাকিস্তানীদেরকে কষ্ট ভােগ না করতে ও এতাে অসুবিধার মধ্য দিয়ে উন্নয়নের যে সুষ্ঠু ভিত্তি গড়ে তােলা হয়েছে উত্তম ও সুষ্ঠু প্রশাসন গড়ে তােলার মাধ্যমে তা হারাতে না চাইলে “দায়িত্বহীন কার্যকলাপ ও বল্গাহীন উক্তি” বন্ধ করতে বলেন।৩৭ স্পষ্টতই এ ছিল ঐ সব রাজনীতিকদের প্রতি হুঁশিয়ারি যাঁদেরকে তিনি মনে করেছিলেন যে তাঁরাই নিশ্চয় ছাত্রদের উস্কানি দিচ্ছেন। ছাত্রনেতৃবৃন্দ যাঁরা ভবিষ্যতে দেশের নেতা হবেন তাঁদেরও বিচারবুদ্ধি রয়েছে এবং তারা যখন তাঁদের
৬২
ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলে মনে করবে তখন তারা বিক্ষুব্ধ হবেন ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করবেনআতাউর রহমানের এহেন বক্তব্যের সঙ্গে আইয়ুব একমত হতে পারেননি। একই আলাপে। আতাউর রহমান প্রেসিডেন্টকে বলেন, পাকিস্তানের ভৌগােলিক প্রেক্ষাপটে যদি কোনাে অপ্রতিনিধিত্বশীল কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা পূর্ব পাকিস্তানীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় সে অবস্থায় অনিবার্যভাবেই পূর্ব পাকিস্তান উপনিবেশে পর্যবসিত হবে। পূর্ব পাকিস্তানী রাজনীতিকদের সুনির্দিষ্ট দাবিগুলির বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে আতাউর রহমান ঐ রাজনীতিকদের দেওয়া যে আর্থ-রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা৩৮ প্রেসিডেন্টকে দেন তা পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ৬-দফা ফর্মুলা থেকে আলাদা কিছু ছিল না।
ছাত্র বিক্ষোভের খবর সংবাদপত্রে ছাপতে দেওয়া হয়নি। তবে মজার ব্যাপার এই যে, যে সরকারি প্রেসনােটগুলি সম্ভবত ছাত্রদের ওপর কালিমা লেপন করার জন্য ঐ সময় বের করা হয় তাতে ছাত্র বিক্ষোভগুলির বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ায় ছাত্র আন্দোলনের ব্যাপ্তি প্রকাশ হয়ে পড়ে। এসব প্রেসনােট থেকে জানা যায়, ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে গােটা প্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুলের অসংখ্য ছাত্র তাদের ক্লাসে যােগ না দিয়ে মিছিল বের করে, শ্লোগান দেয়, পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ছোঁড়ে বা তাদের নাজেহাল করে, পুলিশবাহিনীর গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, দোকানপাট বন্ধ করতে বাধ্য করে, ঢাকাতে দৈনিক আজাদ পত্রিকা কার্যালয়ে ইটপাটকেল ছোঁড়া হয় ও ট্রেনেও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। পিরােজপুরে মহকুমা আনসার অ্যাডজুট্যান্ট কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে কিছু রেকর্ডপত্র ধ্বংস করা হয়। এসব প্রেসনােটে আরাে বিবরণ দেওয়া হয় যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করা হয়। আর গ্রেপ্তার করে ছাত্রদের বিচার করা হয় বিশেষ সামরিক আদালতে। প্রেসনােটের উল্লেখ অনুসারে, বিভিন্ন স্থানে ছাত্রদের সাথে অন্য লােকজনও যােগ দেয়। এ তথ্যও ফাস হয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বক্তৃতা দেওয়ার চেষ্টা করলে সেখানে গােলযােগ ঘটে।৩৯
এমনি করে, দমন-পীড়ন সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র অসন্তোষের খবর ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। এমনকি, লাহাের ও মুলতানের ছাত্ররাও এ ব্যাপারে তাদের সহানুভূতি জানায়। এছাড়া ইংল্যান্ডেও পাকিস্তানী ছাত্রদের বিক্ষোভের খবর জানা যায়।৪০
১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে শহীদ দিবস পালনকালেও আবার গণঅসন্তোষ দেখা দেয়। ঢাকার এক গ্রন্থাগার সিম্পােজিয়ামে গৃহীত এক প্রস্তাবে সরকারের প্রতি গণতান্ত্রিক ও সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পরিপূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের আহ্বান জানানাে হয়।৪১
এসব ছাত্র বিক্ষোভে শাসক মহলের প্রতিক্রিয়াটি ছিল ঐ শাসকগােষ্ঠীরই বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সাংবাদিকদের জানান, পূর্ব পাকিস্তানের গােলযােগ দুঃখজনক’ ঘটনা আর দেশের উভয় অংশেই ছাত্রদেরকে অপব্যবহার করছে রাষ্ট্রবিরােধী বিক্ষোভে পেশাদার উস্কানিদাতারা।৪২ সরকারের ক্রমাগত প্রচারণায় ছাত্রনেতারা প্রতিবাদমুখর হয়ে
৬৩
ওঠেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন ‘ডাকসু’র সাধারণ সম্পাদক এনায়েতুর রহমান ১৯৬২ সালের ২৩ এপ্রিল এক বিবৃতিতে ছাত্রদেরকে রাজনীতিকদের ক্রীড়নক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পুরােধা বলে সরকারের কুখ্যাতি রটানাের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।৪৩
ছাত্র বিক্ষোভ একান্তই স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ হয়তােবা থাকতে পারে। তবে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, পূর্ব পাকিস্তানী ছাত্ররা। সবসময়েই পূর্ব পাকিস্তানের সকল আন্দোলনের সম্মুখভাবে ছিলেন। আর একবার এ ধরনের ছাত্র জাগরণ দেখা দিলে তার শক্তিকে অস্বীকার করার উপায় ছিল না। কালপরিক্রমার উল্লিখিত ক্রান্তিকালে শাসক মহল ও নিষ্ক্রিয় রাজনীতিবিদ—উভয় তরফই ছাত্রদের খুব বেশি ঘটানাের ব্যাপারে সতর্ক থাকতেন। গ্রেপ্তার করা ছাত্রদেরকে শেষাবধি সাধারণ ক্ষমার অধীনে মুক্তি দেওয়া হয়। আর রাজনীতিকেরা, বিশেষ করে, যারা আওয়ামী লীগ করতেন তারা ছাত্রদের অভিপ্রায় অনুযায়ী মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচনে শরিক হওয়া থেকে বিরত থাকেন। অন্যদের সাথে নিষ্ক্রিয় আওয়ামী লীগ গােড়ায় অবশ্য এই নির্বাচনে অংশীদার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কারণ তাঁরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সাঁড়াশি আন্দোলনের কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা স্থির করেছিলেন, আইনসভার বাইরে ও ভেতরে উভয় ক্ষেত্রে তৎপর হলে তাদের উদ্দেশ্য সাধনে তা আরাে বেশি ফলদায়ক। হবে। কিন্তু ছাত্ররা যুক্তি দেয় যে, তাঁরা যে শাসনতন্ত্র গ্রহণ করেননি সে শাসনতন্ত্রেরই বিধিবিধানে নির্ধারিত নির্বাচনে অংশীদার হওয়ার প্রশ্নই উঠতে পারে না। এ অবস্থায় যেহেতু একমাত্র ছাত্ররাই সক্রিয় ভূমিকায় ছিল সেহেতু নিষ্ক্রিয় আওয়ামী লীগ তাদের সিদ্ধান্তই মেনে নেয়। অবশ্য হাতেগােনা কিছু লােক যারা এই সংশােধিত সিদ্ধান্তের বিরােধিতা করে তারা নির্বাচনে অংশ নেয় ও তাদের অনেকে নির্বাচিতও হয়। শাসকগােষ্ঠী নির্বাচন বয়কটের ব্যাপারে বিরােধী তরফের সিদ্ধান্তে বিচলিত হয়, কেননা তাদের কাছে। এ কাজটি ছিল শাসনতন্ত্র না মেনে নেওয়ার এক সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি। তাই তারা যাতে তাদের সিদ্ধান্ত বদলায় সে জন্য রাজি করাতে দৌত্যগিরির আশ্রয় নেওয়া হয়।৪৪ খন্দকার মােশতাক আহমদও বলেছেন যে, সামরিক আইনের শাসনামলে ছাত্ররাই পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।৪৫
নির্বাচনের আগে হতাশা আর চেপে রাখতে না পেরে সাতজন নিষ্ক্রিয় রাজনীতিক এক যুক্তবিবৃতি তৈরি করে সেটি ১৯৬২ সালের ১৪ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশ করতে সক্ষম হন। এই বিবৃতিতে স্বাক্ষরদাতারা হলেন: নুরুল আমিন, আতাউর রহমান খান, আবু হােসেন সরকার, হামিদুল হক চৌধুরী, সৈয়দ আজিজুল হক, মাহমুদ আলী ও পীর মােহসেন উদ্দিন। তাঁরা উল্লেখ করেন, আসন্ন নির্বাচনে একটি নির্বাচনী এলাকায় ৫০০-র সামান্য কিছু বেশি ভােটার থাকবেন আর তারা বড় জোর পূর্ব পাকিস্তানে ৬,৫০,০০০ ও পশ্চিম পাকিস্তানে ৫,০০,০০০ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করবেন। তাতে জনসাধারণের অভিমত কার্যত আদৌ প্রতিফলিত হবে না। সর্বোপরি, অনেক
৬৪
নেতৃস্থানীয় ও বিশিষ্ট জননেতা এবং ছাত্রকে এই সময়ে বন্দী রেখে এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারটি হবে এক নিষ্ঠুর, অযৌক্তিক ও অন্যায় পদক্ষেপ। তারা সকল রাজবন্দীকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার জন্য সরকারকে অনুরােধ জানান এ কারণে যে, তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, তা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।৪৬
অবশ্য নির্বাচন যথারীতি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মার্চের ঘােষণা অনুসারেই অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা নির্বাচিত হন। এই নির্বাচকমণ্ডলী বলতে ১৯৫৯-৬০ সালে নির্বাচিত মৌলিক গণতন্ত্রীদেরকে বােঝায়, যারা একজন পাকিস্তানী সমীক্ষকের মতে নির্বাচিত হয়েছিলেন “কঠোরভাবে বলবৎ অনেকগুলি বিধিবিধানের আওতায়।” ফলে তাঁদের সে নির্বাচন রাজনৈতিক অংশীদারিত্ব ও রাজনৈতিক বিতর্কালােচনার বিচারে তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ে। নির্বাচনের মাস খানেক আগে অবশ্য প্রার্থীরা যাতে মােটামুটি ধরনের মিছিল-শােভাযাত্রা ও তাদের সপক্ষে কিছুটা নিচু লয়ে ও মাত্রায় সভাসমিতি করতে পারে সে বিষয় নিশ্চিত করার জন্য সামরিক আইনবিধির (সামরিক আইনবিধি নং ৫৩) সংশােধনের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। তবে এই প্রার্থীদেরকে খােদ মৌলিক গণতন্ত্র পদ্ধতি নিয়ে কোনাে বিতর্ক তােলার অনুমতি দেওয়া হয়নি, কিংবা তাদের রাজনৈতিক আলােচনায় কোনাে আঞ্চলিক, ধর্মীয় বিশ্বাস, পররাষ্ট্রনীতি কিংবা পুরানাে রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্যের বিষয় তােলারও অনুমােদন দেওয়া হয়নি। সংসদীয় সরকারের সাথে সম্পর্কিত রাজনীতিকদের এসবে অংশীদার হওয়াকে (১৯৫৯৬০-এর মৌলিক গণতন্ত্র নির্বাচন) নিরুৎসাহিত করার প্রয়াসে প্রার্থীদেরকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে যাচাই-পরীক্ষা করে নেওয়া হয়েছিল। আর সেই সাথে প্রয়ােজনে এবডাে (Elected Bodies Disqualification Orders) প্রয়ােগ করে “ব্যক্তিবিশেষকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থাও ছিল।… তবে এসব প্রয়াস সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচিত প্রায় ২৮০০ ও পশ্চিম পাকিস্তানে নির্বাচিত প্রায় ৫০০০ মৌলিক গণতন্ত্রী রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত ছিলেন।”৪৭
১৯৬২ সালের নির্বাচনের নির্বাচনী এলাকাগুলির চূড়ান্ত তালিকা ১৯৬২ সালের ২৪ মার্চ প্রকাশিত হয়। আর ঐ তারিখ পর্যন্ত নির্বাচিত প্রাথমিক মৌলিক গণতন্ত্রের সকল সদস্যকে নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের জন্য নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য সংখ্যা ছিল সর্বাধিক ৫৭৬ ও ন্যূনতম ২৩৪ এবং প্রাদেশিক পরিষদের জন্য যথাক্রমে ২৯৮ ও ২৬৬।৪৮ ১৯৬২ সালের ২৮ এপ্রিল ও ৬ মে যথাক্রমে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদগুলির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।৪৯ এই নির্বাচন বলা চলে অনেকটা “গুমােট পরিবেশেই” অনুষ্ঠিত হয়।৫০ “স্বল্পমেয়াদী নােটিশে ভােট গ্রহণের। আয়ােজন করতে হবে”—এই বিবেচনায় “কোথাও কোনাে বিরতি ছাড়াই ভােট গ্রহণের কাজ সম্পন্ন করা হয়।”৫১
স্পষ্টতই নির্বাচনী এলাকাগুলি সংখ্যার দিক থেকে ছিল ছােট আর যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলি ছিল তখনাে নিষিদ্ধ সেহেতু রাজনৈতিক ইস্যুগুলি নিয়ে কোনাে প্রচারণা অভিযান
৬৫
চলেনি। নির্বাচনের প্রার্থীরা কেবল মৌলিক গণতন্ত্রীদের জন্য সরকারি উদ্যোগে আয়ােজিত সভায় মৌলিক গণতন্ত্রীদের সাথে মিলিত হয়ে তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পারতেন। স্পষ্ট কারণেই এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনী অভিযান কোনাে রকম উৎসাহ-উদ্দীপনা কিংবা আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি।”৫২ পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচনী সভাগুলিতে শাসনতন্ত্র ও সর্বজনীন ভােটাধিকার বাতিলের দাবির পাশাপাশি কিছু লােক আবার সংসদীয় ব্যবস্থা ও জাতীয় রাজনৈতিক দলসমূহ থাকার প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করেন। পূর্ব পাকিস্তানের এ ধরনের সভাগুলিতে অবশ্য “প্রায় ক্ষেত্রেই নিষ্ক্রিয় করে রাখা রাজনৈতিক দলগুলির সাথে সম্পর্কের কথা আলােচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হতাে। আলােচনা হতাে রাজনৈতিক বিষয়াবলি যেমন, সর্বজনীন ভােটাধিকার নিয়ে। এগুলি প্রার্থী ও নির্বাচকদের মধ্যে আলােচনার নিয়মিত বিষয় হয়ে ওঠে। এ ছাড়া অর্থ কিংবা ভবিষ্যতের আনুকূল্যের অঙ্গীকারের বিনিময়ে ভােটের জন্য আনুষ্ঠানিক দরকষাকষিও হয়। পরিশেষে, পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় রাজনৈতিক আলােচনা কিছুটা কমমাত্রা ও পরিসরে হলেও তা সর্বদাই। চলতাে এবং বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।”৫৩
১৯৬২ সালের নির্বাচন অল্প সময়ের নােটিশে অনুষ্ঠিত হলেও এই নির্বাচন হয় কঠোর বিধিনিষেধের আওতায়। ফলে নির্বাচনী অভিযানের প্রচার-প্রচারণা ছিল নিম্ন লয় ও মাত্রায়। এ নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য ছিল অত্যন্ত প্রতিযােগিতামূলক (যা সাধারণত ভােট ভাগ হয়ে যাওয়ার ও তাতে ক্ষমতাসীন শাসক দলের অনুকূল অবস্থারই সূচক)। আর এ প্রতিযােগিতামূলক অবস্থাটি আরােপিত অথবা স্বাভাবিক পরিস্থিতি—উভয়ই হতে পারে। পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের যথাক্রমে ৭৫ ও ১৫০টি আসনের জন্য ২৯৩ ও ১০০৫ জন প্রার্থী ছিল। এতে আসনপ্রতি গড় প্রার্থীর হার দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩.৮৯ ও ৬.৭ জন। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের উভয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেই বিজয়ী প্রার্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সংখ্যালঘিষ্ঠ ভােটে পাস করে। ৪৭ জন এমএনএ (জাতীয় পরিষদ সদস্য) ও ১২৬ জন এমপিএ (প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য) ৫০ শতাংশেরও কম ভােট পায়। পশ্চিম পাকিস্তানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আসনের জন্য যথাক্রমে ৩১৬ ও ৮৯০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ফলে সেখানে উল্লিখিত দুই পরিষদের আসনপ্রতি গড় প্রতিযােগীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৪.২ ও ৫.৯ জন। এ ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ এমএনএ (৪৩) ও এমপিএ (৭৭) ৫০ শতাংশেরও বেশি ভােটে জয়ী হয়। কাজেই প্রকৃত অবস্থার বিচারে তৎকালীন শাসকগােষ্ঠীর প্রতি সমর্থনের কাঠামােটি পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে দুর্বল ছিল।
দলওয়ারি হিসেবে মুসলিম লীগের লােকজন দৃষ্টত বেশি সংখ্যায় নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত ৪৩ জন এমএনএ’র সঙ্গে “মুসলিম লীগের সম্পর্ক ছিল।”৫৪ আওয়ামী লীগ যাঁরা করতেন তাঁদের কোনাে কোনাে বিশিষ্ট ব্যক্তি (এরা নিষ্ক্রিয় আওয়ামী লীগের ম্যান্ডেটের বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে) নির্বাচিত হন। এঁরা হলেন: এমএনএ হিসেবে এএইচএম কামারুজ্জামান, মােহাম্মদ সােহরাব হােসেন,
৬৬
বেগম রােকেয়া আনােয়ার ও মিজানুর রহমান চৌধুরী। আর আব্দুল মালেক উকিল ও অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমপিএ হিসেবে নির্বাচিত হন। দুই পরিষদের নির্বাচিত এই আওয়ামী লীগ নেতাদের কারও বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয় দলের ম্যান্ডেট লঙ্ঘনের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বরং এঁদের প্রায় সকলেই পরের দিকের বছরগুলিতে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব পালন করেন এবং বিরােধীদলীয় বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
আইয়ুব খানের শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্বাক্ষর হিসেবে ১৯৬২ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত ইতঃপূর্বে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ যে পরােক্ষ প্রতিরােধের মনােভাব প্রদর্শন করে তার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আর কিছু না হলেও অন্তত পরিষদে আলােচিত হয়েছিল। সেই শাসনতন্ত্র যদি আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযােগ্য না হয়ে থাকে তাহলে ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রও তাদের কাছে উপাদেয় হওয়ার কোনাে কারণই ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের কাছে যা যা অগ্রাধিকারমূলক বিবেচনার বিষয় সেই আলােকে ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের চেয়ে মূলত উন্নততর কিছুই ছিল না।৫৫ নিষ্ক্রিয় আওয়ামী লীগ এ ক্ষেত্রে যে হতাশা ও বিস্ময় প্রকাশ করেছে তার সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটেছে আতাউর রহমান খানের পর্যবেক্ষণে। তিনি বলেন, “ব্যক্তিবিশেষ এ শাসনতন্ত্র দিয়েছেন যাতে জনসাধারণের কাছ থেকে কোনাে ম্যান্ডেট নেই।” এই শাসনতন্ত্রের আওতায় (১) সকল ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে কেন্দ্রীভূত; (২) এতে জনসাধারণকে ভােট প্রদান থেকে বঞ্চিত করে তাদের প্রতি পরিপূর্ণ অনাস্থা জ্ঞাপন করা হয়েছে; (৩) এতে এক ক্লীব ব্যবস্থাপক সভার ব্যবস্থাই করা হয়েছে। আতাউর রহমান এর কারণ নির্দেশ প্রসঙ্গে বলেছেন, “এ কথা দাবি করা যাবে যে শাসনতন্ত্রটি অত্যন্ত সাদাসিধে, সহজ-সরল। যদি বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ক্ষমতার বিলিবণ্টন করে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা এতে থাকতাে কেবল তাহলে মােকাবেলা, সংঘাত শুরু হতাে, জটিলতা বেড়ে যেতাে বহুগুণে। শাসনতন্ত্রে এ সবই সযত্নে এড়িয়ে গিয়ে শঠতার আশ্রয় নিয়ে তা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযােগ্য করে তােলার প্রয়াস চালানাে হয়েছে।”৫৬
“সাধারণ মানুষ” সম্ভবত এর নিহিত তাৎপর্যটি বুঝতে পারেনি আর যদি বুঝেও থাকে, তা নিয়ে আশু প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তবে পূর্ব পাকিস্তানে নিষ্ক্রিয় থাকা রাজনীতিকরা, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সদস্যরা, প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। তাঁরা আইয়ুব খানের শাসনামলে গণতন্ত্রের বদ্ধদশার প্রতি জনসাধারণের মনােযােগ আকর্ষণ করেছিলেন ও রাষ্ট্র কাঠামােতে আইয়ুব খানের ক্ষমতা আরাে সংহত করার পথে বাধা হয়ে দাড়িয়েছিলেন। ক্ষমতাসীন শাসকগােষ্ঠীর সাততাড়াতাড়ির নিরাময় ব্যবস্থাপত্রটি ঐ গােষ্ঠীর জন্য আশু উপশম দিলেও রাজনৈতিক উত্তেজনা বেড়ে যায় এবং আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনের পথে এগিয়ে চলে।
৬৭
চতুর্থ অধ্যায়
পুনরুজ্জীবনের পথে
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর আরােপিত সামরিক আইন তুলে নেওয়া হয় ১৯৬২ সালের ৮ জুন। আর এই সাথে দুটি ঘটনা যুগপৎ ঘটে। এক, নতুন শাসনতন্ত্রের শুরু ও দুই, ঐ একই দিনে নতুন জাতীয় পরিষদ উদ্বোধন। অবাধ কার্যপরিচালনার পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য এর এক মাস আগে রাজনৈতিক সংগঠন (অনিয়মতান্ত্রিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ জারি করা হয়। প্রেসিডেন্ট তার পরিকল্পনা বানচাল করার জন্য রাজনৈতিক তৎপরতার আশঙ্কা করেছিলেন। তাই স্পষ্টত এ ধরনের কোনাে তৎপরতা নিবারণের অন্যতম ব্যবস্থা হিসেবেই এ অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এর আওতায় জাতীয় পরিষদ কর্তৃক রাজনৈতিক দলগুলির কার্যকলাপ ও তৎপরতা সম্পর্কে কোনাে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবধি সকল রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা হয়। আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, জামায়াত-ই-ইসলামী, নিজাম-এ-ইসলাম, রিপাবলিকান পার্টি, কৃষক শ্রমিক পার্টি—এসব দলের নাম উল্লেখ করে এ অধ্যাদেশে বলা হয়: এসব দল স্বনামে কিংবা ছদ্মনামে রাজনীতিতে লিপ্ত হতে পারবে না। এভাবে যে কঠোর প্রাকসতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তা যে পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া হচ্ছে তার সহজাত দুর্বলতা কতটুকু ও এ পদ্ধতির বাস্তবায়নে কী পরিমাণ বিরােধিতার মােকাবেলা করতে হবে সে বিষয়ে আইয়ুব খান যে সচেতন ছিলেন কেবল সেটাকেই স্পষ্ট করেছে। তাঁর এসব বিধিনিষেধমূলক ব্যবস্থা কিন্তু সকল নিষ্ক্রিয় রাজনীতিককে দমিয়ে রাখতে পারেনি। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অসন্তোষের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৬২ সালের ২৪ জুন পূর্ব পাকিস্তানের নয় নেতা স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে। নুরুল আমিন, আতাউর রহমান, হামিদুল হক চৌধুরী, আবু হােসেন সরকার, মাহমুদ আলী, ইউসুফ আলী চৌধুরী, পীর মােহসেন উদ্দিন, শেখ মুজিবুর রহমান (সদ্য কারামুক্ত) ও সৈয়দ আজিজুল হক এ বিবৃতিতে সই করেন। ব্যাপক মতপার্থক্যসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা হওয়া সত্ত্বেও তারা এই যুক্ত বিবৃতিতে এক বাক্যে একটি গণভিত্তিক শাসনতন্ত্র, ফেডারেল সংসদীয় ব্যবস্থা,
৬৯
পাকিস্তানের উভয়াঞ্চলের বৈষম্যের প্রতিবিধান ও ইতােমধ্যে সরকারের কাজ পরিচালনার জন্য শাসনতন্ত্রে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের কতিপয় বিধান অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান।১ এগুলি নতুন কোনাে দাবি না হলেও সম্মিলিতভাবে উত্থাপিত হওয়ায় বিবৃতিটি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ঐ সব দাবির সর্বজনীন আবেদনকে স্পষ্ট করে তােলে।
রাজনৈতিক নেতাদের ঐক্যের বিষয়টি অবশ্য তাঁদের জন্য কোনাে শুভলক্ষণ ছিল না যারা রাজনৈতিক নেতাদের অনৈক্যের কারণেই ফায়দা লুটছিলেন। আর সে কারণেও অনৈক্যের মাঝেই তাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল। ১৯৬২ সালের ১৫ জুলাই এক আইন পাস হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলিকে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সুযােগ করে দেওয়াই ছিল শাসকচক্রের লক্ষ্য। স্পষ্টত এ আইন পাসের প্রয়াসও তাতেই নিহিত। কর্তৃত্ববাদী শাসকগােষ্ঠী যা তখনাে তার অবস্থান তেমন মজবুত করে তুলতে পারেনি, এনডিএফ-এর মতাে ‘একমেরু’ ফ্রন্টকে বহুমেরু’ বৈশিষ্ট্যের কয়েকটি দলের তুলনায় অধিকতর হুমকি বলে মনে করতাে। রাজনৈতিক দলগুলিকে দুটি ফ্রন্টে লড়তে হতাে। এক, সরকারি কায়েমি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, দুই, তাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে। আইয়ুব খানও উপলব্ধি করেন (বা তাঁকে সেই ধারণা দেওয়া হয়) যে, একটি রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে কাজ করাতেই নিহিত রয়েছে তার নিজের শাসনতান্ত্রিক অবস্থানকে বৈধতা দেওয়ার সংক্ষিপ্ত পথ। সেই জন্য পাকিস্তানে কিছু রাজনৈতিক দলের আবশ্যকতা রয়েছে। তাই একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রয়ােজন পুরােপুরি উপেক্ষা করা যাবে না।
পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইতে লিপ্ত থাকলে বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলি তাদের আসল ভূমিকা পালনে দুর্বল হয়ে পড়বে—এই ধারণাটি একটি বাস্তবতাকে ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি। পূর্ব পাকিস্তানে যে কোনাে বিরােধীদলীয় আন্দোলন তা দলবিহীন যুক্তফ্রন্টের নৃেতত্বে হােক কিংবা কোনাে বিশেষ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হােক উভয় তরফকেই পূর্ব পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ পল্লীময় জনপদ থেকে উঠে আসা রাজনীতি সচেতন উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণীমানসে অগ্রগণ্য ইস্যুগুলিকে অবশ্যই আমলে নিতে হচ্ছিল। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা ও পল্লীপূর্ত কার্যক্রমের মাধ্যমে তাঁর ক্ষমতায় অবস্থানের এই অন্যতম বুনিয়াদকেই কজা করতে চেয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের এই গুরুত্বপূর্ণ জনশ্রেণীর মনােভাব, কি ছিল সামরিক আইনের শাসনামলেও পরিষ্কার বােঝা যায়, সে কথা আগেই বলা হয়েছে। সামরিক আইন তুলে নেওয়ার সময় নাগাদ পরিস্থিতিতে কোনাে মৌলিক বা বড় রকমের পরিবর্তন না হওয়ায় উক্ত মনােভাব বা অভিমত আগের তুলনায় আরাে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযােগ্য হয়ে ওঠে। মােদ্দা কথা, ৬২ সালের শাসনতন্ত্র তাদের পছন্দনীয় ছিল না, এই আমলে নেওয়া ব্যবস্থাদির কারণে দেশের দুই অংশের মধ্যেকার বৈষম্য কমেনি (বরং অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সংক্রান্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচকে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যেকার বৈষম্য বেড়েছে বলে লক্ষ্য করা যায়)। স্বভাবতই অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে পূর্ব পাকিস্তানকে দীর্ঘদিন যাবৎ যে পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছিল সেটিই চালু রাখতে হয়। বলাবাহুল্য, সেই পন্থা বা পদ্ধতির
তাত্ত্বিক উপস্থাপনার নাম
৭০
হলাে: এক কার্যোপযােগী কাঠামাের মধ্যে “দুই অর্থনীতি” তত্ত্বের প্রয়ােগ যার অর্থ এক স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তান, যার থাকবে আইনত বৈধ এক স্বতন্ত্র অর্থনীতি। এভাবে এ প্রদেশটি অভিন্ন প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতির আওতায় পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামাের ভেতরে থাকবে। পূর্ব পাকিস্তানে বরাবরই এ ধরনের ব্যবস্থার অনুকূল অভিপ্রায়ের অস্তিত্ব স্পষ্টত লক্ষ্য করা যায়। সামরিক আইন শাসকগােষ্ঠী গণতন্ত্রের সহজাত আত্মচর্চার প্রক্রিয়াকে বানচাল করে। তবু পূর্ব পাকিস্তানীদের উল্লিখিত অভিপ্রায় প্রশমিত হয়নি। এমনকি আরােপিত নিষ্ক্রিয়তার আমলে এবং তারপরেও এ বিষয়টি নিষ্ক্রিয় রাজনীতিকদের দৃষ্টি এড়ায়নি। বরং বলা যায়, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নিষ্ক্রিয় নেতারা এ বাস্তবতা সম্পর্কে ঢের বেশি সচেতন ছিলেন। কিন্তু তখনকার দলীয় নেতৃত্ব আশাবাদী ছিলেন ও সঙ্কীর্ণতর “প্রাদেশিক” বা “আঞ্চলিক” ভূমিকার পরিবর্তে এক বিস্তৃততর জাতীয় ভূমিকা পালনেই মনােযােগী ছিলেন। আর তাই প্রকাশ্য ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক “জাতীয় সমস্যা”র (এবং সম্ভবত ভারতঙ্ক ছাড়া) প্রতি নিরবচ্ছিন্ন গুরুত্বারােপ করেছিলেন। এই জাতীয় সমস্যাটি ছিল “পরিপূর্ণ সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি”র পুনঃপ্রতিষ্ঠা। এ কারণেই “জাতীয়তাবাদী” সােহরাওয়ার্দী “ন্যাশনাল ডেমােক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ)-এর কল্পনা করেছিলেন। তাঁর এ কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেন দুটি বর্গ বা গােষ্ঠীর রাজনীতিক। এর একটি গােষ্ঠীতে ছিলেন, তার একান্ত অনুসারীর দল আর অন্যটিতে ছিলেন, কিছুকাল আগেও যারা ছিলেন তাঁর প্রবল সমালােচক। এখানে বলা দরকার, এবডাে’ বিধির আওতায় স্বয়ং সােহরাওয়ার্দীসহ বেশ কিছু রাজনীতিকের বেলায় সক্রিয় রাজনীতি ১৯৬৬ সালের শেষ অবধি নিষিদ্ধ ছিল। তাই সােহরাওয়ার্দী কথিত নির্দলীয় আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংগঠনের বিকল্প পথ অনুসরণের পরামর্শ কেন দিয়েছিলেন তার কারণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে খুব বেশিদূর এগিয়ে যাওয়ার দরকার পড়ে না। ক্ষমতার কায়েমি গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে একটি কার্যকর সংহতি গড়তে সকল রাজনীতিককে একত্রিত করার আর কোনাে বিকল্প ছিল না। তার সাথে যারা যােগ দেন তারাও উপলব্ধি করেছিলেন যে, রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতি আরাে অনুকূল না। হয়ে ওঠা অবধি অস্তিত্ব রক্ষার এই একটি মাত্র উপায়ই হাতে আছে। অবশ্য এরপরেও রাজনৈতিক দলগুলিতে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগে, পুনরুজ্জীবনের অনুকূল অন্তঃস্রোত বইতে থাকে। দলের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠাতা সদস্য খন্দকার মােশতাক আহমদ স্বীকার করেন যে, “সােহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিত্ব ও তাঁর রাজনৈতিক মর্যাদার কারণেই কেবল “স্বৈরাচারী ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট হিসেবে” এনডিএফ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযােগ্য হয়ে ওঠে। তবে তিনি আরাে ব্যাখ্যায় বলেন যে, আওয়ামী লীগের একাংশ এনডিএফকে আপাতত শূন্যস্থান পূরণ ব্যবস্থা হিসেবেই মাত্র গ্রহণ করেছিল। বস্তুত, তাদের অনেকেই ছিল দলীয় পুনরুজ্জীবনে প্রবল আগ্রহী।২
তুলনামূলকভাবে মুক্তরাজনীতি পুনরুজ্জীবনের পর তাই দুটি ধারা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এক, নিজ নিজ দলীয় কর্মসূচির পক্ষে কাজ করার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক দলগুলির পুনরুজ্জীবনের জন্য একেকটি দলের ভেতরের আলাপ-আলােচনা; ও দুই, সম্মিলিতভাবে
৭১
একটি অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির পক্ষে কাজ করার জন্য এনডিএফ ফর্মুলাকে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলােচনা। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও ঐ সময় এই দুই ধারাই যুগপৎ কাজ করতে থাকে। এনডিএফ-এর সাথে আওয়ামী লীগের যােগসূত্র। থাকলেও বিভিন্ন স্তরের বহু আওয়ামী লীগার স্বীয় দলের নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে দীর্ঘ আলােচনায় নিয়ােজিত হন। এই অংশেরই অভিমত প্রতিফলিত হয় ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনে এবং পুনরুজ্জীবিত দলের নীতি ও কর্মসূচিতে।
সােহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগারদের নেতা হলেও বাহ্যত তিনি আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের বিরােধী ছিলেন। তাঁর এ অবস্থানের কারণে পুনরুজ্জীবনবাদী আওয়ামী লীগাররা তেমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারছিলেন না। ১৯৬২ সালের ৪ অক্টোবর এনডিএফ আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করলে আওয়ামী লীগ ফ্রন্টের অন্যতম শরিক হয়ে যায়। এ ঘটনা ঘটে করাচিতে কিছু সাবেক মুসলিম লীগারের এক কনভেনশনে চৌধুরী। খালিকুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে মুসলিম লীগ (কনভেনশন) গঠনের এক মাস পরে। বাদবাকি মুসলিম লীগার অক্টোবরের শেষের দিকে ঢাকায় খাজা নাজিমুদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) গঠন করেন। এরই মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে নিজাম-এ-ইসলাম ও জামায়াত-ই-ইসলামী পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল।৩
এভাবে এনডিএফ একটি পূর্ব পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠন হয়ে ওঠে। এ সংগঠনের প্রতি মওলানা মওদুদী, মিয়া মমতাজ দৌলতানা, সরদার বাহাদুর খান, মােহাম্মদ আইয়ুব খুরাে প্রমুখ পশ্চিম পাকিস্তানী নেতার সমর্থন ছিল। এই ফ্রন্ট একটি বলিষ্ঠ গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারতাে। কিন্তু এনডিএফ যে যে রাজনৈতিক দলের সমবায়ে গঠিত এক মাের্চা ছিল সেই সব দলের আদর্শ ও অগ্রাধিকারগুলির মধ্যে মিল ছিল না আর সেই সাথে ছিল স্বতন্ত্রভাবে দলীয় পুনরুজ্জীবনের হাতছানি। পরের ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে গড়ায় তাতে প্রমাণিত হয় যে, যেমন জোরদার গণআন্দোলন সম্ভব নয় তেমনি দলীয় পুনরুজ্জীবনের প্রলােভন কাটিয়ে ওঠাও সম্ভব নয়। ফলে সর্বাত্মক ঐক্যভিত্তিক প্রবল গণআন্দোলন সে সময়ে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবুও এরপরেও পূর্ব পাকিস্তানের এনডিএফ-এর কিছু জনপ্রিয়তা থেকে যায় প্রধানত সােহরাওয়ার্দীর প্রদেশব্যাপী বিভিন্ন সভা-সমিতিতে ভাষণ ও বক্তব্য প্রদানের কারণে। তিনি এসব সভায়-সংসদীয় রাজনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠার ডাক দেন। ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র এভাবে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ফলে ১৯৬২ সালের রাজনৈতিক দল আইন সংশােধন করে “রাজনৈতিক দল”-এর পুনঃসংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়;৪ এবডাে অধ্যাদেশকে আরাে কঠোর করে তােলা হয় একটি বিধান সংযােজনার মাধ্যমে। এই বিধান বলে এবডাের আওতাধীন রাজনীতিকদের এমনকি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার জন্য আরাে দণ্ডের ব্যবস্থা করা হয়। আবার একই সাথে প্রেসিডেন্টের জারি করা ইশতেহার অনুযায়ী, অযােগ্যতার মেয়াদ মওকুফ বা হ্রাসের জন্য প্রেসিডেন্ট সমীপে আবেদন করার অধিকারও দেওয়া হয় এবডাের আওতায় পড়া রাজনীতিকদেরকে। এভাবে এই যে টোপ দেওয়া হলাে তা স্পষ্টতই “আনুগত্যের বিনিময়ে “ক্ষমা” বা “ইনাম”
৭২
দানের শামিল। সরকার ও রাজনীতিকদের মধ্যে এ ধরনের পােষক-মক্কেল সম্পর্কের বিষয়টি ব্যাপক পর্যায়ে সমালােচিত হয়।৫
পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র নেতারাও এক যুক্তবিবৃতিতে এই অধ্যাদেশের সমালােচনা করেন। তারা সরকারকে এই বলে হুঁশিয়ার করে দেন যে, দমন-নিপীড়ন চলতে থাকলে ছাত্রদের জন্য সে অবস্থায় একটি মাত্র পথই খােলা থাকবে আর তা হলাে এক “চূড়ান্ত ও জোরদার আন্দোলন শুরু করা, কেননা ইতিহাস তার নিজ-নির্ধারিত পথ ধরেই এগিয়ে যাবে।”৬ বাস্তবিকপক্ষেও ১৯৬২ সালের গােড়ার দিকে সােহরাওয়ার্দীর গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানী ছাত্ররা সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। জনসমাজের অপরাপর রাজনীতি সচেতন অংশের মতােই ছাত্ররাও নতুন শাসনতন্ত্র মেনে নিতে অস্বীকার করে ও ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের যতগুলি কপি তারা হাতের কাছে পায় সেগুলি পুড়িয়ে তাদের বিরােধিতা প্রকাশ করে। এর পরের পর্যায়ে শিক্ষা কমিশনের রিপাের্ট প্রকাশিত হলে তাদের অসন্তোষ আরাে ঘােরতর হয়ে ওঠে। কেননা তাদের মনে হয় যে, ঐ শিক্ষা কমিশন রিপাের্টের লক্ষ্য আরাে বিধিনিষেধ আরােপ করে শিক্ষার সুযােগ সঙ্কুচিত করা। ছাত্রদের আহূত প্রতিবাদ আন্দোলন সাধারণ ধর্মঘট অবধি গড়ায়—এ সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয় ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে। শিক্ষা কমিশনের ঐ রিপাের্টের সংশােধন করে। ছাত্রদের দাবিদাওয়া আংশিক পূরণ করা হলেও সরকারের প্রতি সাধারণ অনাস্থার বিষয়টি নানা প্রতীকী ঘটনায় প্রকাশ পায়। আর বলাবাহুল্য, এ ধরনের অধিকাংশ ঘটনাই সহিংসতায় পর্যবসিত হয়। ছাত্র নেতারা গ্রেপ্তার হন। রাজনীতিকদের ওপর আরাে বেশি করে কড়াকড়ি আরােপ করা হতে থাকে।
এনডিএফ-এর প্রতি সরকারের বিরূপ মনােভাব ছিল বেশ স্পষ্ট। সরকার সােহরাওয়ার্দীর মনােভাব ও উদ্দেশ্যের ইচ্ছাকৃত ভুল ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিতে থাকেন। এছাড়া, পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের সম্ভাবনার একটা ভ্রান্ত কল্পভীতিও ছিল। শাসনব্যবস্থায় কেবল গণতন্ত্রায়ন অভিলাষী এনডিএফ-এর তুলনায় স্বায়ত্তশাসন ইস্যুর প্রশ্নে দৃঢ় ভূমিকায় অবতীর্ণ আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে অধিকতর ‘খােশ আমদেদ’ হবে—এ কথা ভাবাও অতিমাত্রিক কল্পনাবিলাসীরই সাজে।৭ যদি এ ধরনের বেঠিক মূল্যায়ন প্রেসিডেন্টের নানা সিদ্ধান্তের বুনিয়াদ হয়ে থাকে আর তা যদি তাকে নিজ অগ্রাধিকার জাতীয় সংহতি থেকে দূরে ঠেলে নিয়ে যায় তাহলে বলতেই হয় তিনি নিজেই স্বীয় সৃষ্ট অপ্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থার শিকার কিংবা কয়েদি; তা না হলে এই বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় থাকে না, যা কিছু করা হয়েছে এসবই সংহতিনাশক শক্তিতে মদদ দেওয়ার সুপরিকল্পিত প্রয়াসের ফল।
সােহরাওয়ার্দী প্রায় অসম্ভব একটি কাজ করার চেষ্টা করছিলেন। কঠিন কাজটি ছিল দেশের বিভিন্ন ধারার সমাজ-রাজনৈতিক শক্তিগুলির মাঝে একটি সংহতি বিধান। আরব্ধ এ মিশনটি তিনি সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন এক অভিন্ন মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের নামে (যেমনটি জিন্নাহ্ করতে চেয়েছিলেন, ভারতীয় মুসলমানদের জাতীয়তাবাদের নামে)
৭৩
যাকে বিরােধী নানা শক্তির নানা পাল্টা কৌশলের মােকাবেলা করতে হয়। এতে গােড়ার দিকে কিছুটা এগিয়েও ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে সােহরাওয়ার্দীর প্রবল সমালােচক ও বৈরী মওলানা ভাসানী ও নুরুল আমিন তাঁর এ ধারণাকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। সােহরাওয়ার্দী পশ্চিম পাকিস্তানেও বেশ উল্লেখযােগ্য সমর্থন পেয়েছিলেন। ১৯৬২ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে পরিস্থিতি পর্যালােচনার আলােকে কর্মপন্থা ও কৌশল নির্ধারণের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের এক বৈঠক আহ্বানেও সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। মুসলিম লীগের চৌধুরী মােহাম্মদ হােসেন সাজ্জা ও জেডএইচ লারি, জামায়াত-ই-ইসলামীর মিয়া তােফায়েল মােহাম্মদ ও চৌধুরী গােলাম মােহাম্মদ, নিষ্ক্রিয় আওয়ামী লীগের নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, রিপাবলিকান পার্টির মেজর সৈয়দ মােবারক আলী শাহ ও সর্দার আবদুর রশিদ, নিষ্ক্রিয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির খান আবদুল ওয়ালী খান ও মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরিকে সদস্য করে ঐ সময় পরিপূর্ণ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য এক সর্বদলীয় সমন্বয়কারী সাবকমিটি গঠন করা হয়।৮
এনডিএফ তার ন্যূনতম কর্মসূচিকে যখন পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় করে তােলার জন্য দেশের পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য ইস্যুকে স্থগিত রেখে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে তখন পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ঢাকায় দেওয়া কথিত এক বিবৃতি দেশের উভয় অঞ্চলের রাজনৈতিক মহলে বেশ বড় রকমের আলােড়ন সৃষ্টি করে। ঐ মার্কিন রাষ্ট্রদূত নাকি এ কথা বলেন যে, তিনি তাঁর দেশ ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বৃহত্তর সহযােগিতার চেষ্টা করবেন আর আমেরিকানদের সাথে পূর্ব পাকিস্তানীদের বৃহত্তর সমঝােতাও থাকা উচিত। তিনি বিশেষ করে বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানীদের আরাে বেশি সংখ্যায় যুক্তরাষ্ট্র সফর করা। উচিত। তিনি এ কথাও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ দেখবে এবং এ অঞ্চলে উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণের উদ্যোগকে উৎসাহিত করবে। পিপিএ ও এপিপির খবরে বলা হয়, পাকিস্তান সরকার বিষয়টি গুরুতর বলে গণ্য করছেন ও একই খবরে কেন্দ্রীয় সরকারের যােগাযােগ মন্ত্রীর বরাতে বলা হয় যে, প্রেসিডেন্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলােচনা অনুষ্ঠিত হতে পারে। ঐ সময়ে পাকিস্তানের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বিবৃতিকে “গােলমেলে, দুরভিসন্ধিমূলক”৯ বলে অভিহিত করে বিরক্তি প্রকাশ করেন।
সামান্য ব্যতিক্রম বাদে বিষয়টি নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিক্রিয়া ছিল লক্ষণীয়ভাবেই ভিন্ন। পশ্চিম পাকিস্তানে এমন মনােভাব লক্ষ্য করা যায় যার বক্তব্য: যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবির নেপথ্যে রয়েছে (পশ্চিমাঞ্চলে একে বিচ্ছিন্নতাবাদী উদ্যোগ’ বলে অভিহিত করা হয়)। লাহােরের জেলা বার অ্যাসােসিয়েশন ও করাচি মুসলিম লীগের (কনভেনশন) মতাে কিছু সংগঠন ঐ বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি অর্থনৈতিক সহযােগিতার কথিত প্রস্তাব দেওয়ার জন্য এ বিবৃতির নিন্দা জ্ঞাপন করে ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহারের আহ্বান জানায়। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা হাইকোর্ট বার অ্যাসােসিয়েশন ও ঢাকা জেলা বার অ্যাসােসিয়েশনের
৭৪
মতাে সমিতি-সংগঠনগুলির কাছে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ঐ বিবৃতি তেমন আপত্তিকর বিবেচিত হয়নি। বরং এসব সংগঠনের বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানের বিশেষ প্রয়ােজনের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের খেয়ালের বিষয়টির প্রশংসা করা হয়।১০
পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিকদের মধ্যে তক্কালে নিষ্ক্রিয় পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ আলী পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানাের জন্য মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সমালােচনা করেন। অবশ্য, আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্ন। নিষ্ক্রিয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জহিরুদ্দিন বলেছিলেন, মার্কিন সরকার সকল ক্ষেত্রে এ যাবৎ অবহেলিত পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নে সাহায্য-সহায়তা করার ব্যাপারে যে আগ্রহ ও উদ্বেগ ব্যক্ত করেছেন, তা প্রশংসনীয়।’ তিনি আরাে উল্লেখ করেন যে, যেখানে মার্কিন ও অন্যান্য সাহায্য-সহায়তার ৭০ শতাংশ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করার বিষয় অবিসংবাদিত “সেখানে মার্কিন সরকার পাকিস্তানে পার্লামেন্টের ভেতরে-বাইরে। সমালােচনার আলােকে যদি পূর্ব পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ সহযােগিতায় সাহায্য-সহায়তা বিলিবণ্টন সমস্যার সমীক্ষার চেষ্টা করে থাকে তাতে দোষের কিছু নেই। তিনি আরাে উল্লেখ করেন, পূর্ব পাকিস্তানের কথা কোনাে বিবেচনায় না রেখেই পশ্চিম পাকিস্তানের বিশেষ বিশেষ প্রকল্পের জন্য সাহায্য চাওয়া হয়েছে। তার মতে, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বিবৃতির ব্যাপারে যে আপত্তি তা “রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত যা অনভিপ্রেত মনে করা যায়।”১১
গােটা বিষয়কে চায়ের পেয়ালায় তুফান’ হিসেবে বর্ণনা করে পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বিবৃতিকে যৌক্তিকতা দেওয়ার প্রয়াস পায়। পত্রিকায় বলা হয়, সাহায্য-সহায়তা দাতাসংস্থা পাকিস্তান সরকার প্রণীত প্রকল্পের সম্ভাব্যতা ও বাঞ্ছনীয়তার বিষয়ে খোঁজ-খবর নেবে সেটা নতুন কিছুই নয়। এ কাজ আগেও করা হয়েছে, তখন কোনাে কথা ওঠেনি। পত্রিকায় ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়, যে কৃত্রিম উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়েছে তার মতলব মিশ্র, একটি মতলবের জন্ম সেই কট্টর মহল থেকে যাদের “মার্কিন বিরােধিতা সাধারণভাবে তাদের পূর্ব পাকিস্তানের জন্য দরদের চেয়ে বেশি আর দ্বিতীয়টি তাদের যারা “যে সব পূর্ব পাকিস্তানী তাদের প্রদেশের জন্য বরাবরই অর্থনৈতিক সুবিচারের দাবি জানিয়ে আসছে তাদের দাবিয়ে রাখতে চায়।”১২
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যের যে উদ্দেশ্যই থেকে থাক, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কোনাে কোনাে নেতা সেটিকে পূর্ব পাকিস্তানের অভাব-অভিযােগ তুলে ধরার কাজে লাগিয়েছিলেন। তাছাড়া, জহিরুদ্দিনও বলেছিলেন, পাকিস্তানের একজন সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কর্তৃপক্ষকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, ১ম পাঁচসালা পরিকল্পনার উন্নয়ন কার্যকলাপ। কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য হওয়ায় তা দেশের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে আর সৃষ্টি হচ্ছে দুই অঞ্চলের মধ্যে বিশাল ব্যবধান। তিনি এ দাবিও করেন যে, ২য় পাঁচসালা পরিকল্পনায় অর্থনৈতিক ভারসাম্য পূর্ব পাকিস্তানের অনুকূলে আনতে চাওয়ায় সােহরাওয়ার্দীকে তার প্রধানমন্ত্রিত্ব খােয়াতে হয়েছে। এ ছাড়া বৈষম্যও
৭৫
চলেছে। কাজেই স্পষ্টত যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ও অন্যান্য সহায়তা যা পাওয়া যায় তার সিংহভাগ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে সমৃদ্ধতর করা হয়েছে, ঐ অঞ্চলকে উন্নত করে তােলা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ এ ধরনের বিদেশী সাহায্য-সহায়তায় উপকার না পাওয়ায় স্বভাবত বিদেশী সাহায্য-সহযােগিতার সার্থকতা ও উপযােগিতা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ঐ সব সাহায্যদাতা দেশের প্রতি বৈরিতা পােষণ করতে থাকে। এ রকম পরিস্থিতিতে এ ধরনের যে কোনাে দেশের প্রতিনিধি খুব স্বাভাবিক কারণেই দেখতে চাইবে যে, তার দেশ অকারণে যেন যে দেশ তাদের সাহায্য পাচ্ছে সেই দেশের একটা অংশ বা অঞ্চলের চক্ষুশূল না হয়ে পড়ে। সাবেক মন্ত্রী আবদুল খালেক এর সুযােগ নিয়ে দাবি তােলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির উন্নতি সাধনের জন্য দ্বিঅর্থনীতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ৩য় পাঁচসালা পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।১৩
উল্লেখনীয় এই যে যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই যদি পূর্ব পাকিস্তানে নিজের জন্য অনুকূল জনমত সৃষ্টির প্রয়াস পেয়ে থাকে—যা নাকি লক্ষ্যগােচরভাবেই ৫০-এর দশকের গােড়া থেকে অনুপস্থিত ছিল—সেই কাজটি করা হলাে যখন সদ্য সদ্য পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এসেছে জুলফিকার আলী ভুট্টোর হাতে যিনি তখন তেমন পাশ্চাত্যপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন না। কাকতালীয়ভাবে তখন ভারত-চীন বৈরিতার সময়কালে মার্কিন তরফ থেকে সহযােগিতার অনুরােধে আইয়ুবের তৃষ্ণীভাব প্রকাশ পায়। বিষয়টি এমন সময়ে ঘটে যখন তৃতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার কাজ চলছিল।১৪ আন্তঃআঞ্চলিক বৈষম্য নিয়েও উত্তপ্ত আলােচনা চলছিল জাতীয় পরিষদে। আর তাতে যে সব প্রতিক্রিয়া হয় তাও এই ইস্যুতে আরেকটি নতুন মাত্রা যােগ করে। অবশ্য তা আইয়ুব খানের আত্মবিশ্বাসের অবয়বে মৃদু চিমটির তাৎপর্য বহন করলেও (পূর্ব পাকিস্তানে) বিভিন্ন রাজনৈতিক মতের ধারক এনডিএফ-এর ন্যূনতম কর্মসূচি থেকে তাঁর আগ্রহ আঞ্চলিক ইস্যুতে নিবদ্ধ করানাের কাজটি করে। এর কোনাে আশু লক্ষণীয় প্রভাব-প্রতিক্রিয়া না থাকলেও এই মার্কিন উদ্যোগে দুইজন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতার সাগ্রহ সমর্থন ও এর অনুকূল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকে মনে হয় এটি ঐ সব আওয়ামী লীগারদের উদ্দীপনাউৎসাহ যুগিয়েছে যাদের এনডিএফ ভাবধারা খুব বেশি আকৃষ্ট করতে পারেনি। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের প্রতি এনডিএফ-এর কোনাে কোনাে অঙ্গ সংগঠনের মতপার্থক্যের কারণে এনডিএফ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযােগ্য বিবেচিত হয়নি।১৫
এনডিএফ-এর মতাে অবয়বহীন একটি সংগঠনের মধ্যে দ্বিধা-সংশয় স্বাভাবিক। তবে এই “ন্যাশনাল” ফ্রন্টের ওপর পূর্ব পাকিস্তানের প্রভাব ছিল বেশ স্পষ্ট। ১৯৬৩ সালের গােড়ার দিকে ঢাকায় ফ্রন্টের সভায় অন্য বিষয়াবলিসহ পরিষ্কার উল্লেখ করা হয় যে, কোনাে শাসনতন্ত্র গ্রহণযােগ্য হতে হলে তাতে (ক) ফেডারেশনের ইউনিটগুলির জন্য সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন; (খ) আন্তঃআঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার জন্য সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিগত ব্যবস্থা; এবং (গ) স্থানীয় জনশক্তি ও অন্যান্য আবশ্যকতার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য
৭৬
স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকতে হবে।১৬ তবে এ ফ্রন্টের কার্যপরিচালনা ও সম্পাদনে প্রয়ােজনীয় আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল। এ অভাব বিশেষভাবে অনুভূত হয়েছিল আওয়ামী লীগ দলীয় পুনরুজ্জীবনের পক্ষপাতী গােষ্ঠীতে। নিষ্ক্রিয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবের এক বক্তব্যে এই মনােভাব ব্যক্ত হয়। তিনি বলেন:
দশ মাস আগে, একই পল্টন ময়দানে নয় নেতার বৈঠকের পর আমরা বাংলাদেশের ১৭টি জেলায় জনসভার আয়ােজন করি। এসব জনসভায় আমরা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আবেদন জানাই। আমরা সেই মতাে প্রস্তাবও গ্রহণ করি, কিন্তু হুজুররা আমাদের কথায় কান দেননি—আমাদের সকল আবেদন ও দাবিদাওয়া উপেক্ষা করা হয়েছে। তাই শুধু বক্তৃতা-ভাষণ শুনে ঘরে ফিরে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকলে কাজ হবে না। এ জন্য দরকার নিরবচ্ছিন্ন লড়াই—এ বিশ্ব বহু নিপীড়ককে দেখেছে, কিন্তু তাদের কেউই টিকতে পারেনি। আপনারা যদি গণদাবি উপেক্ষা করেন তাহলে নিজেরাই খতম হয়ে যাবেন। জাগ্রত জনতাকে দুনিয়ার কোনাে শক্তিই রুখতে পারবে না।১৭
পরবর্তীকালে কর্মী ও সাবেক দলীয় কর্মকর্তাদের বৈঠকে এনডিএফকে তার ন্যূনতম কর্মসূচি কৌশলভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেওয়ার কথা স্থির করা হয়। আর তা করা হয় সভায় গৃহীত কয়েকটি প্রস্তাবের ভিত্তিতে। ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, আইন পরিষদসমূহের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি, ফেডারেল সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার বিধিবিধান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের চূড়ান্ত রায় সাপেক্ষে এক ইউনিট ব্যবস্থার বিলুপ্তি—প্রস্তাবগুলির অন্তর্ভুক্ত ছিল।১৮ স্পষ্টত এনডিএফ এ যাবৎকাল যে ন্যূনতম কর্মসূচির পক্ষে কাজ করেছে এগুলি তা থেকে সরে যাওয়ার সূচনা। আর তা সােহরাওয়ার্দীর সমর্থন সত্ত্বেও এনডিএফপন্থীদের জন্য এক বিপর্যয়েরও ইঙ্গিত বহন করে।
এনডিএফ-এ ন্যাপের অব্যাহতভাবে থাকার বিষয়টিও সংশয়াপন্ন হয়ে পড়ে। নাজিমউদ্দিনও নিখিল পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠন হিসেবে এনডিএফ-এর ভবিষ্যৎ প্রশ্নে তাঁর নিজ সন্দেহ প্রকাশ করেন। এর কিছুকালের মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের কথাবার্তা শােনা যেতে থাকে।১৯
নিজ নিজ দলীয় পুনরুজ্জীবন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের সিদ্ধান্তহীনতায় তাদের নিজ নিজ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের প্রশ্নে দ্বিধা-সংশয়ের অস্তিত্ব প্রতিফলিত হয়। তাই শাসনতন্ত্র গণতন্ত্রায়নের এক-স্তর না গণতন্ত্রায়ন ও স্বায়ত্তশাসনের দ্বি-স্তর আন্দোলন—এ দুয়ের কোনটিকে বেছে নেওয়া হবে সে প্রশ্ন দেখা দেয়। এ নিয়ে দ্বিধা-সংশয় যখন চলেছে। তখন আইন পরিষদের বিভিন্ন বিতর্কে আন্তঃআঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রশ্নটি (এটি স্বায়ত্তশাসন অভিপ্রায়ের বুনিয়াদ) ঘন ঘন উত্থাপিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন ছাত্র ফোরামেও এই ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ আলােচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। ঢাকার এক ছাত্র সিম্পােজিয়ামে অধ্যাপক রেহমান সােবহান বলেন যে, উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইতােমধ্যে যে অসমতার অস্তিত্ব। রয়েছে তা শােধরানাে না হলে এ বৈষম্য দূর করা যাবে না। তাঁর মতে, এ জন্যে প্রথম শর্ত হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে গুরুত্বপূর্ণ ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে। তিনি
৭৭
উল্লেখ করেন, সরকারের আমদানি নীতি আগাগােড়া সংশােধন করা না হলে এমনকি দুই বা তিনটি পাঁচসালা পরিকল্পনাও দুই অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক অসমতা দূর করার জন্য পর্যাপ্ত হবে না। এই সিম্পােজিয়ামের সভাপতি ড. আবু মাহমুদ বলেন, মূলধন বিনিয়ােগের ওপর অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ভরশীল। পূর্ব পাকিস্তানের মূলধন নেই তা নয় তবে সে মূলধন পশ্চিম অঞ্চলে স্থানান্তর করা হচ্ছে। বাইরের যারা পুঁজিবিনিয়ােগ করছেন। তাঁদের মুনাফাও চলে যাচ্ছে এখান থেকে। তিনি এ অবস্থায় প্রশ্ন তােলেন: “তাহলে ব্রিটিশ আমলে যে অবস্থা ছিল তার সাথে এর তফাৎ কোথায়?”২০ তাঁর এ কথায় পূর্বপশ্চিমাঞ্চলের সম্পর্কের ঔপনিবেশিক বৈশিষ্ট্যের ইঙ্গিত পরিষ্কার।
বিভিন্ন ছাত্র ফোরামে এ ধরনের আলােচনার তাৎপর্য নিহিত ছিল এই বাস্তবতায় যে, এটি পূর্ব পাকিস্তানের জনসমষ্টির একাংশের চেতনায় গােটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার গণতন্ত্রায়নের মতাে সরল দাবি ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য দাবি জাগরূক রাখতে সাহায্য করে। আসলেও এই ছাত্রসমাজই অতীতে এই প্রদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে বরাবরই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পূর্ব পাকিস্তানী ছাত্রসমাজ আইয়ুব খানের নেতৃত্বে সামরিক আমলাতান্ত্রিক বৃহৎ শিল্পপতি আঁতাতের শাসনের বিরুদ্ধে জঙ্গি বিরােধিতায় অবতীর্ণ হয়। এই বিশেষ সিম্পােজিয়ামটি যখন অনুষ্ঠিত হয় সেই সময়েই আওয়ামী লীগের অনানুষ্ঠানিক ছাত্র শাখা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নিজকে তার প্রস্তাবিত কাউন্সিল অধিবেশনের আগে বিরাট আকারে পুনর্গঠনে নিয়ােজিত ছিল।২১
সিরাজুল আলম খান (পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ), কাজী জাফর আহমদ (পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন), রেজাউল হক সরকার (পাকিস্তান ছাত্রশক্তি) ও আবদুল হালিম (জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন)—জাতীয় পরিষদের উপনির্বাচন প্রশ্নে এক স্বাক্ষরিত যুক্তবিবৃতি দেন। এই বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ রাজনীতিতে কত গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট তার পরিষ্কার পরিচয় পাওয়া যায়। বিবৃতিতে “গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট প্রার্থীদের ভােট প্রদানের ও মনােনীত “ছদ্ম” সরকারি প্রার্থীদের বিরােধিতা করার জন্য মৌলিক গণতন্ত্রীদের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। তারা বলেন, “আসুন, আমরা ছাত্র ও জনগণের সম্মিলিত প্রয়াসে মুক্তি ও গণতন্ত্রের বিরােধী সকল চক্রান্ত খতম করি।” এই বিবৃতিতে স্মৃতিচারণ করে বলা হয়, ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারির পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানী ছাত্রসমাজ আইয়ুব খানের সরকারের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণিত দাবি নিয়ে সংগ্রাম করে আসছে:
১. পূর্ণ গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন ও গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন;
২. মৌলিক অধিকারসমূহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বিনা বিচারে আটক সকল রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তিদান এবং রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে সকল হুলিয়া প্রত্যাহার;
৩. পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বিরাজমান “গগনচুম্বী” অর্থনৈতিক বৈষম্যের
অবসান;
৪. সমাজের সকল স্তর থেকে শিক্ষা সঙ্কোচন নীতির অবসান; এবং
৭৮
পুনরুজ্জীবনের পথে
৫. কোনাে রকম প্রতিরক্ষা আঁতাতের বাইরে অবস্থান এবং সাম্রাজ্যবাদী কিংবা কমিউনিস্ট কোনাে শিবিরে যােগদান না করে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ।
এই বিবৃতিতে ছাত্র ও জনগণের ঐ সব দাবি পূরণের লক্ষ্যে সম্মিলিত আন্দোলনের ওপর “স্টিমরােলার চালিয়ে গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য “স্বৈরাচারী, একনায়ক আইয়ুব সরকারকে অভিযুক্ত করা হয়। তবে তারা একই সাথে ঘােষণা করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের চির জাগ্রত ও সজাগ ছাত্রসমাজের “আপােসহীন ও অপ্রতিরােধ্য সংগ্রাম” এখনাে চলছে ও স্বৈরাচারী শাসনের অবসান না হওয়া পর্যন্ত তা চলতেই থাকবে।২২
ছাত্রদের ব্যাপারে তখন প্রায়ই উল্লেখ করা হতাে যে তারা ভবিষ্যতের নেতা। এই ছাত্ররা বলিষ্ঠ যুক্তফ্রন্ট গড়ে তুললেও প্রবীণ রাজনীতিক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে, এমনকি একেকটি রাজনৈতিক দলের ভেতরেও ঐক্যের অভাব ছিল। আর এনডিএফ তার নামমাত্র অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। এর অঙ্গ রাজনৈতিক দলগুলি তাদের নিজ নিজ দলীয় পুনরুজ্জীবনের বিষয় বিবেচনা করে দেখছিল বলে প্রায়ই খবর পাওয়া যেতে থাকে। সােহরাওয়ার্দীর নীতিনিষ্ঠ ভূমিকা আপাতদৃষ্টিতে বজায় থাকলেও, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে এই ইস্যুতে বিভক্তি দেখা দেয়। আর মওলানা ভাসানীর ভূমিকা এ ব্যাপারে মােটেও স্পষ্ট না থাকায় সর্বত্র, বিশেষ করে, নিষ্ক্রিয় আওয়ামী লীগে জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। ন্যাপের সহযােগিতা ছাড়া কোনাে অর্থবহ সম্মিলিত আন্দোলন সম্ভব নয় বলে মনে হওয়ায়, এই দলের পুনরুজ্জীবনের পরপরই আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পুনরুজ্জীবনের দরকার পড়ে। এ বিষয়ে এমনকি সােহরাওয়ার্দীরও কোনাে সংশয় ছিল না। বাস্তবিকপক্ষেও তিনি নিষ্ক্রিয় আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাদেরকে এই মর্মে নির্দেশ দেন যে, ন্যাপ তার নিজ দলের পুনরুজ্জীবনের সিদ্ধান্ত নিলে আওয়ামী লীগকেও অনতিবিলম্বে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।২৩
এখন ন্যাপ নিজে পুনরুজ্জীবিত হবে, না প্রস্তাবিত জাতীয় দলে সম্মিলিত হয়ে যাবে—সে বিষয়টি মওলানা ভাসানীর দাবি অনুযায়ী আওয়ামী লীগ তার পাঁচ-দফা। শর্তের বিষয়গুলি স্বীকার করে কিনা তার ওপর নির্ভর করবে:
১. সকল রাজবন্দীর মুক্তি;
২. নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি;
৩. সিয়াটো ও সেন্টো থেকে সরে আসা;
৪. পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন;
৫. বয়স্ক ভােটাধিকার, মৌলিক অধিকার ও পার্লামেন্টের স্বাধীনতা।২৪
এমনি করে ন্যাপ পুনরুজ্জীবিত হবে কি হবে না তার দায় বর্তায় আওয়ামী লীগের ওপর। তবে একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠনের প্রশ্নে মওলানা ভাসানীর আগ্রহ তেমন। আন্তরিক বলে মনে হয়নি। কেননা মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগকে তাঁর এ শর্তগুলি
৭৯
দেওয়ার সময় এ মন্তব্যও করেন যে, তাঁর এসব দাবি বা শর্ত যদি সরকারি দল মেনে নেয় তাহলে তিনি ঐ সরকারি দলের সাথেও সহযােগিতা করবেন। আবার, পশ্চিম পাকিস্তান সফরে গিয়ে তিনি সেখানে সকল রাজনৈতিক দলের কাছে একটি ইউনাইটেড ডেমােক্র্যাটিক পার্টি বা সম্মিলিত গণতন্ত্রী দল গঠনের জন্য আবেদন জানান এবং একইসঙ্গে এ কথাও উল্লেখ করেন যে, “এসব রাজনৈতিক দলের আদর্শ, মৌলিক নীতি ও আচরণ ভিন্ন।” তিনি আরাে বলেন, তিনি সকল রাজনৈতিক দলের ঐক্যের প্রয়ােজনীয়তার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন এ কারণে যে, একা ন্যাপের পক্ষে লড়াই করা সম্ভব নয়।২৫
আসলে মূল সমস্যাও সেখানে। সাংগঠনিক দুর্বলতা রাজনৈতিক দলগুলিকে একটি একত্রীভূত আকার গঠনের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। ন্যাপকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে, না একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠন করা হবে—এ নিয়ে ভাসানীর দোদুল্যমান ভূমিকার নেপথ্যে ভিন্ন প্রকৃতির কিছু কারণও থেকে থাকতে পারে। এবডাে বিধির কারণে সােহরাওয়ার্দী রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ায় সে পটভূমিতে কোনাে জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠিত হলে এ ধরনের দলের অবিসংবাদিত নেতা হতেন মওলানা ভাসানী। আওয়ামী লীগ ও তাঁর কৃষক সমর্থকদের সহযােগিতায় পাকিস্তানী রাজনীতিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণ সফল হওয়ার আশাও তিনি সঙ্গতভাবেই করতে পারতেন। আওয়ামী লীগ পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে তাঁর অবস্থানের বিষয় স্বীকার করে নেবে—এ রকম আশাবাদী তিনি ছিলেন। তাঁর এ আশাবাদে একটা আপােসরফার হিসেবী মনােভাবও ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ফেরার পর তিনি এ রকম দাবিও করেন যে, পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে ন্যাপ ও আওয়ামী লীগের মতপার্থক্যের বিষয় ইতােমধ্যেই নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। তিনি আরাে জানান, সােহরাওয়ার্দীর সাথে কথা বলার পরে শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তরাজ্য থেকে ফিরলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিষ্কার হয়ে উঠবে।২৬ তিনি কি তাহলে আশা করেছিলেন যে, মুজিব হয় সােহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে সবুজ সঙ্কেত নিয়ে ফিরবেন নইলে সােহরাওয়ার্দীকে অগ্রাহ্য করে তার সাথে যােগ দেবেন? আসলে এ দুইয়ের কোনােটিই ঘটেনি। মুজিবের দেশে ফেরার পরেও ধোয়াটে পরিস্থিতি পরিষ্কার হয়নি। তিনি সম্মিলিত এক জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠন সম্পর্কে শুধু উল্লেখ করেন যে, এ ধরনের কোনাে প্রয়াস হাতে নেওয়ার আগে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সতর্কতার সঙ্গে বিচার-বিবেচনা করে একটি পূর্ব পরিকল্পিত কার্যক্রম স্থির করা দরকার। তিনি আশ্বাস দেন, আওয়ামী লীগ প্রস্তাবটি সযত্নে বিচার-বিবেচনা করবে। অবশ্য তিনি এই মর্মে মনােযােগ আকর্ষণ করেন যে, বিভিন্ন দলের সমবায়ে গঠিত একটি যুক্তফ্রন্টের (অর্থাৎ এনডিএফ) অস্তিত্ব তাে রয়েছেই। আর এই ফ্রন্ট শাসনতন্ত্রের গণতন্ত্রায়ন ও দেশে গণতন্ত্রের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। তার এ বক্তব্যে পরিষ্কার ইঙ্গিত রয়েছে যে, কোনাে অভিন্ন ভিত্তিতে স্বীকৃত এনডিএফ অপেক্ষা ব্যাপকতর কর্মসূচি ছাড়া কোনাে সংগঠন গড়ায় কোনাে তারতম্য ঘটবে না। এ ধরনের অবস্থানের যৌক্তিকতা না বুঝতে পারারও কোনাে কারণ নেই। কেননা, এ ধরনের প্রস্তাবিত নিখিল পাকিস্তানভিত্তিক একটি
৮০
রাজনৈতিক দলকে তার সম্ভাব্য সংগঠনের পরস্পরবিরােধী অবস্থা বা ভূমিকাকে জায়গা করে দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে আর তাতে সুনিশ্চিতভাবেই ঐ জাতীয় রাজনৈতিক দলের চালিকাশক্তি ও কেন্দ্রীয় লক্ষ্য ব্যাহত হবে।
পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে আওয়ামী লীগের অবস্থানের বিষয়ে শেখ মুজিবুর রহমানও কোনাে অঙ্গীকার করেননি। তবে একটি বিষয় ছিল পরিষ্কার, সােহরাওয়ার্দী তখনাে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে ন্যূনতম প্রতিরােধের ধারায় অবিচল ছিলেন। তিনি জানান, যারা গণতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য এখনাে লড়ছেন তাঁদের জন্য দেশের পররাষ্ট্রনীতি অস্বস্তির প্রধান কারণ হতে পারে না, তাছাড়া আওয়ামী লীগের জন্য দেশের ভেতরের সমস্যা পররাষ্ট্রনীতির চেয়ে ঢের জরুরি। তাছাড়া পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে আওয়ামী লীগের অবস্থান পরিষ্কার: “সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়।” তিনি বলেন, সােহরাওয়ার্দী পররাষ্ট্রনীতির যে কাঠামাে গড়েছিলেন তা অপরিবর্তিতই রয়েছে। তবে সে পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন কীভাবে হচ্ছে তা বাইরে থেকে বলা সম্ভব নয়। আর দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোনাে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ ঘটছে কিনা সে বিষয়েও নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়। এখানে বলা দরকার, এর মাত্র একদিন আগে মওলানা ভাসানী দেশের গণতন্ত্রের ব্যর্থতার ও বিরাজমান বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য অত্যন্ত স্পষ্টভাষায় বিদেশী হস্তক্ষেপকে দোষারােপ করেন। শেখ মুজিব আরাে স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেন, ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ যে নীতিমালা ও কর্মসূচি নির্ধারণ করেছে তার পুনঃসংস্কার বা সংশােধনের কোনাে প্রয়ােজন নেই। ভাসানীর উল্লিখিত সব শর্ত মেনে নিয়ে একটা সমন্বিত জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ ও প্রয়াসে আওয়ামী লীগের শীতলবারি নিক্ষেপের কোনাে ইঙ্গিত যদি এসবেও পর্যাপ্ত না হয়ে থাকে তাহলে ভাসানীর দাবি বা শর্তের জবাবে আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক আহ্বানের কোনাে সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে নেই’—এই প্রত্যয়ী বিবৃতিই বলতে হয় উল্লিখিত উদ্দেশ্যে কোনােরকম আলাপ-আলােচনার সম্ভাবনায় নেতিবাচক চূড়ান্ত সীলমােহর এঁটে দিয়েছে।২৭
অবশ্য নিষ্ক্রিয় ন্যাপের ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং সুদীর্ঘ আলােচনার পর মওলানা ভাসানী কর্তৃক ইতঃপূর্বে উত্থাপিত ৫-দফাসহ ১৪-দফা প্রস্তাব গৃহীত হয়। পল্টন ময়দানে এক জনসভায় মওলানা ভাসানী ঘােষণা করেন যে, ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার তার দাবি মেনে নিতে ব্যর্থ হলে তিনি আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করবেন। ন্যাপ সংগঠনের একাংশ এনডিএফ-এর কার্যকলাপে অসন্তুষ্ট ছিল। তারা ছিল একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক দল গঠনের পক্ষপাতী। কিন্তু তা সম্ভব না হলে তারা ন্যাপকেই পুনরুজ্জীবিত করার পক্ষে ছিল। আওয়ামী লীগ সােহরাওয়ার্দীর দেশে না ফেরা পর্যন্ত কোনাে অঙ্গীকারে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।২৮
আওয়ামী লীগ ন্যাপের মতাে তার নিষ্ক্রিয় ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক না করলেও দলটি নিজ ভবিষ্যৎ নিয়ে একেবারেই পা গুটিয়ে বসে ছিল না, আবার এনডিএফ-এর গােটা
৮১
কার্যক্রমেও তৎপর ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় পর্যায়ে নিষ্ক্রিয় আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক/কর্মিসভা অনুষ্ঠিত হয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ (নিষ্ক্রিয়) ১৯৬৩ সালের ২৫ আগস্ট এক সম্মেলনের আয়ােজন করে। ছয় ঘণ্টাব্যাপী এ সভায় প্রায় দেড়শ’ দলীয় কর্মী যােগ দেন। সভায় ডজনখানেক প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেগুলির মধ্যে ছিল:
১. নাগরিক ভােটাধিকার কমিশন রিপাের্টের সংশােধন ও বয়স্ক ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠান;
২. জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি ও সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব;
৩. পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তাকে বিবেচনায় রেখে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিরক্ষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিমানবাহিনী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন;
৪. লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে কেন্দ্রের হাতে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় (বৈদেশিক বাণিজ্য বাদে) রেখে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ ঘােষণা;
৫. ভৌগােলিক অবস্থান ও পরিবেশগত কারণে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের অর্থনীতিকে পৃথক করা;
৬. এক দীর্ঘ সামরিক শাসনে জনমনে সৃষ্ট অসন্তোষ ও হতাশার অবসানে মতাদর্শ নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দলের এক যুক্তফ্রন্ট প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণকনভেনশন ডাকার জন্য জাতীয় নেতৃবর্গের প্রতি আহ্বান জ্ঞাপন।২৯
এ সব প্রস্তাবে বৈদেশিক বিষয় থেকে বৈদেশিক বাণিজ্য বাদ দেওয়া ছাড়া এমন নতুন। কিছুই ছিল না। তবে এতে গণকনভেনশন ও যুক্তফ্রন্টের (যদি তা এনডিএফ থেকে স্বতন্ত্র কিছু হয়ে থাকে) যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তার সাথে (নিষ্ক্রিয়) দলের সাধারণ সম্পাদক কর্তৃক প্রায় একই সময়ে প্রদত্ত বক্তব্যের (যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে) পুরােপুরি মিল নেই। এ কথাও স্পষ্ট যে এই সভা, কেবল জাতীয়’ দাবিসমূহের ন্যূনতম কর্মসূচিতেই” সন্তুষ্ট ছিল না। এই সভা পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক দাবিসমূহের বিষয়েও উদ্বিগ্ন ছিল, যে সব দাবির কথা এনডিএফ তুলে ধরতে পারেনি। ওদিকে, এ সব দাবি বহুকাল ধরেই আওয়ামী লীগ ম্যানিফেস্টোর একান্ত অঙ্গীভূত ছিল। অন্যভাবে বলা যায়, বস্তুত এ বৈঠকে যেগুলি পূর্ব পাকিস্তানের জরুরি দাবি বলে বিবেচিত হয় সে সব দাবির পক্ষে লড়াই-সংগ্রামের দায়িত্ব তথা কাজের দায়িত্ব নিতে পারে–পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বা পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি কিংবা এ ধরনের সমমনা দলগুলির এক মাের্চা। বাস্তবিকপক্ষে, দলীয় পুনরুজ্জীবনের পর এগুলিই ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দাবি। এ সব বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টিপাত করে উল্লিখিত বৈঠক দলীয় পুনরুজ্জীবনের বিষয়টির প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব আরােপ করে। পরে পূর্ব পাকিস্তানের আরাে কয়েকটি জেলায় এ ধরনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, স্পষ্টতই এ সব বৈঠকের
৮২
উদ্দেশ্য ছিল, আওয়ামী লীগের দলীয় পুনরুজ্জীবনের প্রয়ােজনীয়তা ও এ দলের কর্মসূচি ও দাবিদাওয়ার প্রতি দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবর্গের সবিশেষ মনােযােগ আকর্ষণ।৩০
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মূর্ত প্রতীক ছিলেন অবিসংবাদিতভাবে সােহরাওয়ার্দী জাতীয় স্তরে সকল রাজনৈতিক দল ও গােষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তাঁর ধারণায় তখনাে একমাত্র পথ ছিল শাসনতন্ত্র গণতন্ত্রায়নে ন্যূনতম কার্যক্রমভিত্তিক ঐক্য। লন্ডনে সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর এক সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ মুজিব এই বার্তাই জ্ঞাপন করেছিলেন। দলীয় পুনরুজ্জীবন সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত মতামত যাই থাক তিনি তার প্রকাশ্য বক্তৃতাবিবৃতিতে তার প্রতিফলন এড়িয়ে যান। অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ইস্যুর ব্যাপারে তাঁর উদ্বেগ ও চিন্তাভাবনার কোনাে রাখঢাক ছিল না। ফরিদপুরে তার নিজ জেলার জাতীয় পরিষদ উপনির্বাচনের নির্বাচনী এলাকায় সফর থেকে ফিরে ১৯৬৩ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান যা বলেন তাতে। অনেক নিগূঢ় তথ্য উন্মােচিত হয়। তিনি বলেন, পরিস্থিতির চাপে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানীরা বিশ্বাস করে যে, তারা এখন এক উপনিবেশে পর্যবসিত হয়েছে। আর তাই তিনি মনে করেন এই উপনিবেশের নাগপাশ থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে হলে তাদেরকে নিরন্তর সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে। তিনি বলেন, সরকারযন্ত্রের (তার মতে) পাঁচ স্তম্ভ: আমলাতন্ত্র, ফেডারেল রাজধানীর অবস্থান, পুঁজি গঠন, সশস্ত্র বাহিনী ও রাজনৈতিক সমতার কোনােটিতে পূর্ব পাকিস্তানের অংশীদারি নেই। তিনি বলেন, সরকার আন্তঃপ্রাদেশিক সমতার বিষয়টিকে যেভাবে দেখছেন তাতে আর সংখ্যার সমতা মেনে নেওয়া যায় না। তিনি তার বক্তব্যের ব্যাখ্যায় সরকারকে মনে করিয়ে দেন যে, সমতা বলতে কেবল জাতীয় পরিষদের সংখ্যায় সমান প্রতিনিধিত্বকেই বােঝায় না বরং জাতি ও রাষ্ট্রের সকল বিষয়ে সমতাকে বুঝিয়ে থাকে। তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৫৫ সালে সংখ্যাসাম্য মেনে নেওয়া হয় এই পরিষ্কার বােঝাপড়ার ভিত্তিতে যে, পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য পর্যাপ্ত বৈদেশিক সাহায্য বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু তার বদলে সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ একচেটিয়া ভােগের সুবিধা দেওয়া হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানকে। করাচি থেকে ফেডারেল রাজধানী সরিয়ে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের পিঠে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। কেননা, এর আগে করাচিসহ গােটা পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন সাধন করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের খাত থেকে নেওয়া যথেষ্ট পরিমাণ অর্থে। তিনি করনীতিরও সমালােচনা করেন। তিনি অভিযােগ করেন যে, এই করনীতি পূর্ব পাকিস্তানের শক্তি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থ বিনষ্ট করার মতলব নিয়ে প্রণীত হয়েছে।”৩১
এর সপ্তাহ দুয়েক আগে লন্ডন থেকে ফিরে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, উল্লিখিত সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া তার বক্তৃতার মেজাজ তা থেকে একেবারেই অন্যরকম। বরং তার এ সব কথাবার্তার সুর ভাঙনপূর্ববর্তীকালের মওলানা ভাসানীর অবস্থান ও দাবিদাওয়ার সঙ্গে বেশি সঙ্গতিপূর্ণ। সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিব এনডিএফ কিংবা ন্যূনতম কর্মসূচির কথা মুখেই আনেননি যদিও মাত্র পক্ষকাল আগেও করাচির “আউটলুক” পত্রিকায় প্রকাশিত
৮৩
এক সাক্ষাৎকারে সােহরাওয়ার্দী “ন্যূনতম কার্যক্রম”, “শাসনতন্ত্রের গণতন্ত্রায়ন”, “সকল দল ও গােষ্ঠীর জন্য অভিন্ন প্ল্যাটফরম”, “১৯৬৫ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ” এবং “শাসনতন্ত্র সংশােধনের জন্য পার্লামেন্টের ভেতরে-বাইরে জনমত গঠন”—ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর অগ্রাধিকার বিবেচনার পুনরুক্তি করেছিলেন।৩২
যশাের আওয়ামী লীগের (নিষ্ক্রিয়) এক কর্মিসভায় শেখ মুজিবুর রহমান একই সুরে কথা বলেন। তিনি সেখানে আরাে উল্লেখ করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ। পাকিস্তানের দুই অংশের ঐক্যের প্রশ্নে অঙ্গীকারাবদ্ধ। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, উন্নয়ন। ব্যয়ের সিংহভাগই পশ্চিম পাকিস্তানে কাজে লাগানাে যাবে। বয়স্ক ভােটাধিকার, মৌলিক অধিকার, বাক-স্বাধীনতা, শাসনতন্ত্রের গণতন্ত্রায়ন এবং আন্তঃআঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে তিনি গােটা পাকিস্তানভিত্তিক সম্মিলিত গণআন্দোলনের ডাক দিলেও এনডিএফ-এর মধ্য দিয়েই যে ঐ আন্দোলনকে অনিবার্যভাবেই পরিচালিত করতে হবে সে বিষয়ে বিশেষ করে কিছু যেমন উল্লেখ করেননি তেমনি এর ন্যূনতম কর্মসূচির সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের কথাও বলেননি। তিনি অন্যান্য উপায়ের ওপর গুরুত্বারােপ করেছিলেন বলেই নয় বরং তাঁর পূর্ব পাকিস্তানের জরুরি সমস্যাগুলির বারংবার উল্লেখে তাঁর নিজের অগ্রাধিকারগুলি খুবই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।৩৩
কেউ কেউ আওয়ামী লীগের দলীয় পুনরুজ্জীবনের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে থাকলেও সে কথা প্রকাশ্যে বলেননি। অনেকে সােচ্চারও ছিলেন অবশ্য। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, ১৯৬৩ সালের মধ্য নভেম্বরে ঢাকা নগর আওয়ামী লীগ কর্মীদের চার ঘণ্টা স্থায়ী এক সম্মেলনে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক দলগুলির পুনরুজ্জীবনের অনুকূলে মত প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় অংশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থার জন্যও দাবি করা হয়। ঐ সম্মেলনে ফেডারেল রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরেরও দাবি করা হয়।৩৪
এ সবের অর্থ যদি হয় দলীয় পুনরুজ্জীবনের প্রয়ােজনীয়তার প্রতি কেন্দ্রীয় নেতাদের বিশেষ মনােযােগ আকর্ষণ তাহলে দেখা যায়, সে বার্তা শেষাবধি সােহরাওয়ার্দীর কাছে পৌঁছায়। সােহরাওয়ার্দী তখনাে আওয়ামী লীগের পুরােধা ব্যক্তি। বৈরুতে জং পত্রিকাকে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে সােহরাওয়ার্দী এ কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন বলে জানা যায় যে, “কেন আমাকে পাকিস্তানে ফিরতেই হবে? কেন লােকজন আমাকে ফেরার অনুরােধ করছে? কেন তারা নিজেরা নিজেদের জন্য কিছু করতে পারে না? কেন ওরা আমার অপেক্ষায় আছে? কেন ওরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখে না?” তিনি আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ বা প্রস্তাবিত ন্যাশনাল ডেমােক্র্যাটিক পার্টি সম্পর্কে তার পরিকল্পনা নিয়ে কোনাে কিছু বলতে অস্বীকার করেন।৩৫ তিনি কি তাহলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে তার অপরিহার্যতার কথাটিই এভাবে তুলে ধরতে চাচ্ছিলেন, না তিনি তাঁর দলের পুনরুজ্জীবনপন্থীদের কাছে নিজের পরাজয়ের ব্যাপারটি মেনে নিচ্ছিলেন?
এই মর্মে কিছু কিছু আভাস পাওয়া যাচ্ছিল যে, সােহরাওয়ার্দীর নরমপন্থী লাইনের লােকেরা রাজনীতির অঙ্গনে নতুন অভিলাষী প্রজন্ম ছাত্রদের রাজনৈতিক চেতনাকে পথ ছেড়ে
৮৪
দিচ্ছিলেন। যেমন ধরা যাক, ১৯৬৩ সালের নভেম্বরের গােড়ার দিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রাদেশিক সম্মেলনকালে সংগঠনের সভাপতি শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন পুনরুক্তি করেন, গণতান্ত্রিক, লােকায়ত ও সমাজবাদী ব্যবস্থার জন্যই তাঁর সংগঠন কাজ করবে। তিনি বলেন, ছাত্রলীগ বিশ্বাস করে, পরিপূর্ণ সমাজতন্ত্র বিরাজ করে এমন শােষণমুক্ত সমাজেই কেবল আর্থ-রাজনৈতিক মুক্তি সম্ভব। রাজনীতিতে ছাত্রদের অংশগ্রহণের পক্ষে মত প্রকাশ করে তিনি বলেন:
আমরা নিশ্চিত জানি, ছাত্ররা কেবল রাজনীতির জন্য রাজনীতির কথা বলে না। অধিকার, শিক্ষা, অন্ন-বস্ত্র যখন রাজনীতির বিষয় হয় তখন ছাত্ররা নিশ্চয়ই এ সব নিয়ে কথা বলবে। কেননা, তাদের বাবা-মায়েরা এ সব সমস্যার ঊর্ধ্বে নয়। যখন কোনাে বাবা পাটের দাম পড়ে যাওয়ার জন্য ছেলের কলেজের পড়াশােনা বন্ধ করে দেন তখন ঐ ছেলের নিশ্চয় জিজ্ঞাসার অধিকার রয়েছে: কেন পাটের দাম পড়ে গেল, কে এর জন্য দায়ী? আর এই-ই যদি হয় রাজনীতি তাহলে ছাত্রদের রাজনীতিতে না থেকে গত্যন্তর নেই।
পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ যে সব সমস্যার মুখােমুখি সেগুলির মূল কারণ দেশের পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমে সম্পদ স্থানান্তরকে দায়ী করে শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে বলেন, এ রকম অবস্থায় নিজ অধিকারের জন্য লড়াই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাঁর দাবি, সেখানেই নিহিত রয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের সকল ছাত্র আন্দোলনের মূল কারণ।
পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ বিকিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সমৃদ্ধির বিষয়ে আলােকপাত করে গােটা বিষয়টির যে তীক্ষ সারসংক্ষেপ তিনি নিম্নবর্ণিত বক্তব্যে প্রকাশ করেন তা সম্ভবত পাকিস্তানী পরিস্থিতির বাস্তবতা সম্পর্কে ছাত্রসমাজের চেতনা ও ধারণারই সর্বাগ্রগণ্য বিষয়। তিনি বলেন:
যদি দেশ এ ধরনের শােষণ থেকে মুক্ত হয়েই থাকে, যদি এ সব পাকিস্তানে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যকে প্রতিফলিত করে থাকে, আর এ সব কিছুই যদি ঘটে থাকে ইসলাম ও ইনসাফ অনুযায়ী, তাহলে আমায় স্বীকার করতেই হচ্ছে, আমরা এ সবের ফলাফল ও তাৎপর্য বুঝে ওঠার সামর্থ্যই হারিয়েছি।৩৬
পূর্ব পাকিস্তানী জনসমষ্টির এক অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন ও সােচ্চার অংশের উদ্দেশে এ ধরনের স্পষ্ট বক্তব্যের প্রভাব প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তার কল্পনা আদৌ কষ্টসাধ্য নয়। বাস্তবিকপক্ষেও পূর্ব পাকিস্তানী ছাত্ররা সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলির মােকাবেলায় কেবল প্রেসার গ্রুপের মর্যাদাই অর্জন করেনি বরং অন্যান্য সংগঠিত খাতের কার্যত অবর্তমানে তারা সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী প্রেসার গ্রুপও হয়ে ওঠে। বিশেষ করে, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের বেলায় যােগসূত্রগত ধাচ থেকে এটা কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, যে কোনাে সঙ্কটজনক পরিস্থিতির মােকাবেলায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ যথেষ্ট ক্ষমতা রাখতাে। এটি অত্যন্ত রেখাপাতযােগ্য বিষয় কারণ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। যদিও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অনানুষ্ঠানিক অঙ্গসংগঠন তবু শেষােক্ত সংগঠন ছাত্র সংগঠনটিকে কখনাে তাদের কী করণীয়, কী নয় তা নির্ধারণ করে দিতে পারেননি।
৮৫
আর ঠিক এই বিশেষ ক্রান্তিকালে রাজনীতিতে ছাত্রদের অংশীদার হওয়ার অধিকারের বিষয়টির প্রতি সবিশেষ জোর দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ আসলে পরােক্ষ পূর্ণ রাজনৈতিক কার্যকলাপ পুনরুজ্জীবনের পক্ষে নিজ সমর্থন ব্যক্ত করেছিল। এটি ছাত্রদের নিজ প্রত্যয় না তারা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দলীয় পুনরুজ্জীবনপন্থী লবির সঙ্কেত-ইশারায় তাদেরই দাবি নিয়ে সরব হয়েছিল সে প্রশ্ন থাকলেও এতে যােগসূত্র যে রীতিমতাে শক্তিশালী ও দ্বিমুখী ছিল তাতে কোনাে সন্দেহ নেই।
ফলে খুব পরিষ্কার বােঝা যায় যে, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের একটি অংশ সংগঠিত রাজনৈতিক কার্যকলাপ পুনরুজ্জীবন ও সরকারের তরফ থেকে ন্যায় আচরণ পাওয়ার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানের আশা-আকাঙ্ক্ষার পক্ষে জনমত সৃষ্টির পক্ষপাতী ছিল। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মূর্তপ্রতীক সােহরাওয়ার্দী এবং আতাউর রহমান ও আবুল মনসুর আহমদের মতাে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কোনাে কোনাে বলিষ্ঠ নেতা তখনাে দলীয় পুনরুজ্জীবনের পক্ষপাতী ছিলেন না। আতাউর রহমান খান ১৯৬৩ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকায় এক বিবৃতিতে এ বিষয়ে তার মতামত খুবই পরিষ্কার করে তুলে ধরেন। তিনি বলেন:
এনডিএফ প্রতিষ্ঠার মূলনীতি ছিল এই যে, দেশে পরিপূর্ণ গণতন্ত্র কায়েম না হওয়া অবধি রাজনৈতিক দলগুলিকে পুনরুজ্জীবিত না করা। আমাদের এ লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলি পুনরুজ্জীবিত না করার ব্যাপারে আমরা জনসাধারণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ রকম এক পরিস্থিতিতে কোনাে অজুহাতে আমাদের সে অঙ্গীকার ভঙ্গ করার কাজটি দেশের রাজনীতিতে এক গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করবে। কাজেই এ কাজ সম্ভব নয়।”৩৭
আওয়ামী লীগের এই পুনরুজ্জীবনবাদী বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনবাদীদেরকে তাদের সামনে আপাতত খােলা একমাত্র বিকল্প—এনডিএফ ও এর ন্যূনতম কর্মসূচি নিয়ে তুষ্ট থাকতে হয়। ১৯৬৩ সালের উপনির্বাচনে বিরােধীদলীয় প্রার্থীদের ভরাডুবি ঘটে। কেননা, আওয়ামী লীগাররা এ বিষয়ে উৎসাহ দেখায়নি। আর ন্যাপ নেতা ভাসানীও দোদুল্যমান ছিলেন। ফলে এনডিএফ-এর ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে বলেই মনে হয়। অবশ্য এ সবের পরেও সংগঠনটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যেও টিকে থাকে। আর সম্ভবত এ রকম নিষ্ফল, অক্ষম অবস্থায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতাে এনডিএফ আরাে বহুদিন, কিন্তু ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর বৈরুতে সােহরাওয়ার্দীর আকস্মিক মৃত্যুর সাথে সাথে এনডিএফ-এর ওপর যবনিকা নেমে আসে। বস্তুত এনডিএফ-এর ঘরােয়া কোন্দল ও সংঘাতের নিষ্পত্তি কোনােদিনই এ সংগঠনের অস্তিত্বকালে সম্ভব হয়নি। পাকিস্তানের রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে সােহরাওয়ার্দীর বিদায়ের পর কথিত জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন এক অপূরণীয় বিপর্যয়ে পড়ে। কোনাে জাতীয় যুক্তফ্রন্ট গঠনের সম্ভাবনা সম্পর্কে আস্থার অভাব প্রকট হয়ে ওঠে আর সেই প্রেক্ষাপটে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্রভাবে এবং ন্যাপ পুনরুজ্জীবিত
৮৬
হয়। আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্মিলিত বিরােধীদলের (COP) পক্ষে আঞ্চলিক পর্যায়ে তারতম্যমূলক ভােট প্রদানের বৈশিষ্ট্যের মাঝে জাতীয় পর্যায়ে বিরােধী কোনাে দলীয় যুক্তফ্রন্টের অবস্থা কী হতে পারে তা আরাে একবার প্রমাণিত হয়।
“জাতীয় গঠন কাঠামাের মধ্যে কোনাে সম্মিলিত বিরােধীদলীয় আন্দোলন যে সম্ভব নয় সে বিষয় পূর্ব পাকিস্তান এনডিএফ ও পশ্চিম পাকিস্তান এনডিএফ-এর পৃথক পৃথকভাবে স্বীকৃত লক্ষ্য ও কর্মসূচির মধ্যে তীক্ষ ও শাণিত হয়ে ফুটে ওঠে। বৈশিষ্ট্যমূলকভাবেই। পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে সাথে নিয়ে গঠিত পশ্চিম পাকিস্তান এনডিএফ পূর্ব পাকিস্তানের দাবিদাওয়া সংবলিত পূর্ব পাকিস্তান এনডিএফ-এর কোনাে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের বিষয় তাদের আলােচনায় উত্থাপন করেনি।৩৮
এই সময় নাগাদ ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে মহানবীর পবিত্র কেশ চুরির কথিত অভিযােগের প্রতিক্রিয়া হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটে। পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা এতে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয় সে সম্পর্কে ব্যাপক পর্যায়ে মনে করা হয়, জনগণের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক চেতনা ও সংশ্লিষ্টতাকে ক্ষুন্ন করার জন্য সরকার এ সব সাম্প্রদায়িক ঘটনার নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ায়। পরে পুনরুজ্জীবনবাদী ও পুনরুজ্জীবনবাদী নয়—উভয় অংশই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিস্তাররােধ প্রয়াসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিষ্ক্রিয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব এক বিবৃতিতে জনসাধারণ, বিশেষ করে, ছাত্রদের প্রতি তাদের সকল শক্তি দিয়ে মানবতার দুশমনদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানান। তিনি মনে করিয়ে দেন, মৌলিক মানবিক মূল্যবােধ ছাড়াও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বুনিয়াদ ধ্বংস হবে। পূর্ব পাকিস্তানের দেউলে অর্থনীতি আরাে খান খান হয়ে ভেঙে পড়বে যদি সাম্প্রদায়িক প্রতিশােধ ও প্রতিহিংসার ধারণা আরাে বেশি করে প্রশ্রয় পায়। কেননা, তার ফলে এদেশ অভিমুখে সীমান্তের ওপার থেকে মােহাজের আগমনের ঢল নামবে। তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, “যারা সাম্প্রদায়িকতায় উস্কানি দিচ্ছেন তারা পূর্ব পাকিস্তানের দুশমন।”৩৯ তাকে পরে “পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও” শীর্ষক বাংলায় ছাপা প্রচারপত্র বিলির এক মামলায় জড়ানাে হয়। প্রচারপত্রটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিরােধ কমিটি কর্তৃক এ সময় প্রকাশিত হয়েছিল।
ইতােমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তাদের ওয়ার্কিং কমিটিতে দু’দিনব্যাপী ছয় ঘণ্টার অধিবেশনে আলােচনার পর দলকে পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। বলা হয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি, কোনাে কোনাে রাজনৈতিক দলের পুনরুজ্জীবন ও আওয়ামী লীগ দলকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ঐ সব দলের ক্রমাগত অনুরােধ এবং ন্যাপের পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনা—ইত্যাদি বিষয়ের সতর্ক ও নিরাসক্ত বিচার-বিবেচনার আলােকে ওয়ার্কিং কমিটি উল্লিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ বিষয়ে কমিটির বক্তব্য ছিল: “কমিটি এ বিষয়ে সতর্কতা ও সাবধানতার প্রয়ােজন সম্পর্কে সচেতন রয়েছেন। তাঁরা দেখবেন, এনডিএফ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু করেছে তা যেন পশ্চিম
৮৭
পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের ফলে কোনাে রকম বিপর্যস্ত না হয়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ও হােসেন মনসুর এমএনএ পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যায়।৪০
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের বিষয়টি এখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। নিষ্ক্রিয় দলের সাধারণ সম্পাদক ইতােমধ্যেই ১৯৬৪ সালের ৯ জানুয়ারি এক নােটিশ দিয়েছিলেন যে, সােহরাওয়ার্দীর প্রত্যাশিত পূর্ব পাকিস্তান প্রত্যাবর্তন সাপেক্ষে গেল। ডিসেম্বরে ওয়ার্কিং কমিটির যে বৈঠক আতাউর রহমান খানের বাসগৃহে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল তা সােহরাওয়ার্দীর ইন্তেকালের কারণে স্থগিত হয়ে যায়। এখন এই সভা একই স্থানে ২৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। সভায় নিষ্ক্রিয় দলের ওয়ার্কিং কমিটির সকল সদস্য, জেলা আওয়ামী লীগ শাখাগুলির সভাপতি ও সম্পাদক, এবং আওয়ামী লীগের সকল জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যকে ঐ সভায় উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানানাে হয়।৪১ তবে ওয়ার্কিং কমিটিতে কারা থাকবেন সে বিষয়ে কিছু সংশয় দেখা দেয়। কেননা ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন প্রশাসন কর্তৃপক্ষ দলের নথিপত্র ও দলিলাদি আটক করার ফলে দলের হাতে রেকর্ডপত্র ছিল না। এ কারণে অনেকে আশঙ্কা করেন যে, শেখ মুজিব হয়তাে তার পছন্দমাফিক কমিটি সদস্য বাছাই করবেন। দলীয় পুনরুজ্জীবন বিরােধীদের এই আশঙ্কা আরাে ঘনীভূত হয় এ কারণে যে, আতাউর রহমান খান ও আবুল মনসুর আহমদের সঙ্গে শেখ মুজিবের আগে যে সমঝােতা ছিল তার পাশ কাটিয়ে আতাউর রহমান ও আবুর মনসুর আহমদের সঙ্গে আগে কোনাে পরামর্শ না করেই কমিটির এ সভা ডাকা হয়।৪২
যাই হােক পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা পূর্বঘােষিত সময় অনুযায়ী ১৯৬৪ সালের ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। সভার প্রথম দিনে তাজউদ্দিন আহমদ নিষ্ক্রিয় প্রাদেশিক আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত ও পুনর্গঠিত করার প্রস্তাব দেন। তাঁর সে প্রস্তাব সমর্থন করেন যশােরের মশিউর রহমান। সভায় ওয়ার্কিং কমিটির মােট ৩১ জন সদস্যের মধ্যে উপস্থিত ২৩ জন সদস্যের সকলে সর্বসম্মতভাবে এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন। প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, রাজনৈতিক কর্মীদের সক্রিয় করা, চরম হতাশা থেকে দেশকে রক্ষা করা, মৌলিক অধিকারসমূহ রক্ষা এবং জনসাধারণের সার্বভৌমত্বের বুনিয়াদে পূর্ণ গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জনগণকে শিক্ষিত ও সংগঠিত করার জন্য আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা প্রয়ােজন। অন্য এক প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ অঙ্গীকার করে যে, এনডিএফ-এর অন্যতম অঙ্গসংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ এনডিএফকে পূর্ণ সমর্থন ও সহযােগিতা দেবে।৪৩
১৯৬৪ সালের ২৬ জানুয়ারির মুলতবি সভায় আগামী ছয় সপ্তাহের মধ্যে দলের কাউন্সিল সভা ও প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দলের ম্যানিফেস্টো প্রণয়নের জন্য নিম্নবর্ণিত সদস্যদের নিয়ে ঐ একই সভায় একটি উপকমিটিও গঠন করা হয়: প্রফেসর হাফেজ হাবিবুর রহমান (আহ্বায়ক), ড. আলীম আল রাজী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম,
৮৮
বেগম রােকেয়া আনােয়ার, আবদুর রহমান খান ও তাজউদ্দিন আহমদ। সভা জেলা, নগরশহর, মহকুমা ও অন্যান্য নিম্নতর স্তরের আওয়ামী লীগ কমিটিগুলিকে তাদের নিজ নিজ এলাকায় সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করার নির্দেশ দেয়। সভায় গৃহীত অন্যান্য প্রস্তাবের অন্তর্ভুক্ত ছিল:
ক. গণতান্ত্রিক সংসদীয় শাসনতন্ত্র;
খ. সর্বজনীন বয়স্ক ভােটাধিকার;
গ. প্রত্যক্ষ নির্বাচন;
ঘ. পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের জন্য স্বায়ত্তশাসন;
ঙ. পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যেকার দূরত্বের পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিঅর্থনীতি ব্যবস্থা গ্রহণ;
চ. পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে জোরদার করা;
ছ, চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর সদরদপ্তর স্থাপন;
জ. এবড়াে, রাজনৈতিক দল আইন ও নিরাপত্তা আইন বাতিল;
ঝ. রাজবন্দীদের মুক্তি ও হুলিয়া প্রত্যাহার;
ঞ. পাটের ন্যূনতম বাজারদর নির্ধারণ;
ট. মূল্যস্ফীতি রােধ;
ঠ. জামায়াত-ই-ইসলামীর নেতা ও কর্মীদের মুক্তিদান ।
সভায় জামায়াত-ই-ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘােষণারও প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা হয়।৪৪
সভায় অনুপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন: আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, আব্দুল জব্বার খদ্দর, নূরুর রহমান, খয়রাত হােসেন ও জহুর আহমদ চৌধুরী।৪৫ কোনাে কোনাে সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, সভায় উপস্থিত ২৩ জন সদস্যদের মধ্যে মাত্র ৬ জন ছিলেন মূল নিষ্ক্রিয় ৩৫ সদস্যবিশিষ্ট ওয়ার্কিং কমিটির “খাটি সদস্য”।৪৬
আতাউর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন:
আমি জানতে পেরেছি যে, আওয়ামী লীগে আমার কয়েকজন বন্ধু সংবাদপত্রের কাছে এ কথা ঘােষণা উপযুক্ত মনে করেছেন যে, তারা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। আমরা যখন এনডিএফ-এর মাধ্যমে জনগণের, বিশেষ করে, পূর্ব পাকিস্তানী জনগণের ঐক্য রক্ষার ঐকান্তিক আশা পােষণ করছি ঠিক তখন এই ঘােষণা দুর্ভাগ্যজনক বিষয়। এনডিএফ হলাে সেই বুনিয়াদ তথা ভিত্তি যার ওপর আমাদের মহান নেতা মরহুম হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী বিপুল সাফল্যের সৌধ গড়ে তুলেছিলেন তাঁর নিজ মূল্যবান প্রাণের বিনিময়ে। তাই কোনাে রাজনৈতিক দলকে পুনরুজ্জীবিত করার মাধ্যমে আমাদেরই কেউ সে ঐক্য ভাঙবেন তা নিশ্চয়ই কারও প্রত্যাশিত হতে পারে না। এনডিএফ-এর সেই
৮৯
সূচনালগ্ন থেকেই স্বার্থান্বেষী মহল লাগাতার এ ঐক্যে ফাটল ধরানাের চেষ্টা করে আসছে। আর এ জন্যই তারা রাজনৈতিক দলগুলির পুনরুজ্জীবনকে উৎসাহিত করছে। দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি অবশ্য এ ধরনের অশুভ প্রয়াসকে প্রতিরােধ করে চলেছে। আমি এ কথা ভেবে রীতিমতাে মর্মাহত যে, ঘটনাক্রমে কিছু আওয়ামী লীগারই এই চক্রান্তের কলকাঠি নাড়ছে। তবু এনডিএফ জনগণের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে নিজ কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাবে আমাদের কয়েক বন্ধুর বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও।”৪৭
তিনি “স্বার্থান্বেষী মহল” বলতে কনভেনশন মুসলিম লীগ ও তার হােতা আইয়ুব খানকে বােঝাতে চেয়েছেন, কেননা, পরবর্তীকালে তিনি লেখেন, রাজনৈতিক দলগুলির পুনরুজ্জীবনে আইয়ুব খানের খুশি হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক এবং সেটিই ছিল তাঁর “অন্তরের বাসনা”; এতে ঐ দলগুলির নিজেদের মধ্যে কোন্দলের সুযােগ তৈরি করা গেলে তিনি “স্বস্তির হাঁফ” ছাড়তে পারবেন। আর সে অবকাশে তাঁর বিরুদ্ধে সম্মিলিত চ্যালেঞ্জ গড়ার সম্ভাবনাও উবে যাবে।৪৮
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের পর তকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদপত্রে অভিমতের তিনটি ধারা দৃশ্যমান ছিল। তফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া নামে বহুল পরিচিত) সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেফাক ছিল সােহরাওয়ার্দীর অনুগত বিশ্বস্ত। গােড়ার দিকে এ পত্রিকা বিষয়টি অনেকটা এড়িয়ে যায়। মানিক মিয়াকে দল পুনরুজ্জীবনবিরােধী মনে করা হতাে।৪৯ তবে দেখা যায়, তিনি এ বিষয়ে সম্পাদকীয় ভাষ্যে বা অন্য কোনােভাবে কোনাে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন।
পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকা কেএসপির হামিদুল হক চৌধুরীর প্রতি অনুগত ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে নেতৃত্বের শূন্যতায় এনডিএফ-এর মাধ্যমে আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টা করছিলেন জনাব চৌধুরী। তিনি ছিলেন সােচ্চার দলীয় পুনরুজ্জীবনবিরােধী। তাই পূর্ব। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের খবর পরিবেশন প্রসঙ্গে পাকিস্তান অবজার্ভার এমন একটি ধারণা দেয় যে, দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি ক্ষুদ্র গােষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমত অগ্রাহ্য করে এনডিএফ-এর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে কুঠারাঘাত করতে চাচ্ছে।৫০ মর্নিং নিউজ (ঢাকা) পত্রিকা পূর্ব পাকিস্তান কনভেনশন মুসলিম লীগের পক্ষ নিয়ে ঠিক এর উল্টো অভিমত প্রকাশ করে। মর্নিং নিউজের মতে আতাউর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের খুবই একটি ছােট অংশই মাত্র দলীয় পুনরুজ্জীবনের বিরােধিতা করছে। পত্রিকায় আরাে খবর দেওয়া হয় যে, কাউন্সিল মুসলিম লীগ সভাপতি খাজা নাজিমুদ্দিন ও ন্যাপ হাইকম্যান্ডের ঘনিষ্ঠ সূত্রের মতে, দেশ যে রাজনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন তার সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলির পুরুজ্জীবনই একমাত্র সমাধান। তাই যারা জনগণের মুখােমুখি হতে ভয় পায় তাদের কাছেই শুধু দলীয় পুনরুজ্জীবনের নীতি অগ্রহণযােগ্য হতে পারে। রিপাের্টে আরাে জানানাে হয়, কাউন্সিল মুসলিম লীগের মতে পুনরুজ্জীবিত রাজনৈতিক দলগুলির একটি জোটই কেবল পরিবর্তনের কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে। পূর্ব পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগের
৯০
সাধারণ সম্পাদক ‘একমাত্র সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলগুলিই পারে দেশের জনসাধারণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে’–এই বাস্তবােচিত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিনন্দন জানান। পত্রিকায় পূর্ব পাকিস্তান কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি আব্দুল জব্বারের মন্তব্য প্রকাশ করা হয়। ঐ মন্তব্যে তিনি বলেন, “ব্যক্তিগত খেয়ালখুশি বশে কিছু ব্যক্তির বিক্ষিপ্ত সমাবেশের চেয়ে সাংগঠনিক নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা সাপেক্ষ একটি বিরােধী পক্ষ দেশের গণতান্ত্রিক বিকাশের জন্য অনেক বেশি উপকারী হবে। সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি আছে এ ধরনের রাজনৈতিক দলগুলি দেশের জন্য সম্পদ হয়ে উঠতে পারে।” পূর্ব পাকিস্তান কনভেনশন মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হাশিম উদ্দিন আহমদ অপেক্ষাকৃত এক দীর্ঘ বিবৃতি দেন রাজনৈতিক দলগুলির পুনরুজ্জীবনের পক্ষে। তিনি আওয়ামী লীগারদের মধ্যে এ ধরনের মতপার্থক্যে বিস্ময় প্রকাশ করেন কেননা তাঁরাই তাদের দলের ‘প্যারিটি ফর্মুলা’, শাসনতন্ত্র-সংক্রান্ত নীতি পদ্ধতি, ১৯৫৪-৫৫ সালে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের বিরােধিতা এবং ইঙ্গ-মার্কিন চাপের কাছে সােহরাওয়ার্দীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ও সুয়েজ সঙ্কটে মুসলিম বিশ্বের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার মতাে প্রশ্নে দলের নীতিবিগহিত সিদ্ধান্তে” সায় জানানাের ক্ষেত্রে বরাবরই এক ছিলেন। তিনি আরাে। একটি বাস্তবতার প্রতি মনােযােগ আকর্ষণ করে উল্লেখ করেন যে, দলের পুনরুজ্জীবনবিরােধী। গ্রুপের নেতারা সকলেই “রাজনৈতিক দল আইনের আওতায় রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার অযােগ্য ছিলেন। কনভেনশন মুসলিম লীগ নেতা উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের দিক থেকে সুশৃঙ্খল, সুস্থ, বাস্তববাদী, গঠনাত্মক ও জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গির এক বিরােধীদলকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “এ ধরনের গুণাবলিসম্পন্ন বিরােধীদল বাস্তবিকপক্ষে গণতন্ত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। কিন্তু যতই আমার এই অশুভ আঁতাত নজরে পড়ছে যে আঁতাতে শরিক রয়েছে পরস্পরবিরােধী ও সংঘাতে লিপ্ত কিছু গােষ্ঠী ও ব্যক্তি আমি ততই এদের উদ্দেশ্য ও আন্তরিকতায় বিশ্বাস হারাচ্ছি। ওয়াশিংটন, মস্কো, নয়াদিল্লি, পিপিং-এর দিকে তাকিয়ে থাকা এসব লােককে যুগপৎ একমঞ্চে রাখার এই জোটকে সত্যিই আমার কাছে এক অসম্ভব রাজনৈতিক নিরীক্ষা বলেই মনে হয়। অবশ্য তিনি এই সুযােগটিকে “সকল সুস্থ ও সঠিক বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন। মানুষ, বিশেষ করে, তরুণ প্রজন্মের কাছে আবেদন পৌঁছে দেওয়ার কাজে ব্যবহার করেছিলেন।” সে আবেদন ছিল, তার দলে যােগ দেওয়ার। তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন, তাঁর দল হবে: “গতিময় ও বলিষ্ঠ” আর “জনগণের বিচারবুদ্ধি ও মানসিকতা/মেজাজের উপযােগী।”৫১
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দলীয় পুনরুজ্জীবনে কনভেনশন মুসলিম লীগের। অতি উৎসাহের কারণ বােধগম্য। বক্ষ্যমাণ অধ্যায়ের গােড়ার দিকে উল্লেখ করা হয়েছে। আর আওয়ামী লীগের দলীয় পুনরুজ্জীবনের বিরােধীরাও দাবি করেছেন, আইয়ুব খান রাজনৈতিক দলগুলির পুনরুজ্জীবনকে উৎসাহিত করেছেন, কারণ রাজনৈতিক দলগুলিকে পুনরুজ্জীবনে মদদ দিয়ে তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে নিজ শাসন কায়েম রাখার আদর্শ পরিস্থিতি “বিভেদ ও শাসন” (Divide and Rule) তৈরি করা যাবে। অবস্থা সে
৯১
রকমটা হলে যা দাঁড়াবে তা হলাে আবুল মনসুর আহমদ ও আতাউর রহমানবিহীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ!—তার চেয়ে সুসংবাদ আর কী হতে পারে! তেমন আওয়ামী লীগ তাে খােশ আমদেদ! কেননা আবুল মনসুর আহমদ ও আতাউর রহমান কেন্দ্রের ক্ষমতাচক্রের কাছে ১৯৫০-এর দশকে কেন্দ্রীয় আইনসভা ও অন্যত্র তাদের কার্যকলাপের কারণে গােলযােগ সৃষ্টিকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আইয়ুব খান ও তার সহযােগীরা হয়তাে আশা করেছিলেন যে, দলের দীক্ষাগুরু সােহরাওয়ার্দীসহ এবডােকৃত ঝানু নেতাদের। অবর্তমানে দুর্বল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে সামাল দেওয়া তুলনামূলকভাবে সহজতর হবে। ধরে নেওয়া চলে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের আশু পুনরুজ্জীবনের বিষয়টিই ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষের কথিত চাল বা উদ্যোগের মূল মনােনিবেশকেন্দ্র, এনডিএফ-এর ব্যবচ্ছেদ নয়। কারণ, আর যা-ই হােক এনডিএফ তার প্রাথমিক পর্যায়ের পর, বিশেষ করে, সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আর বড় রকমের হুমকি ছিল না, কিন্তু পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কেবল দলের প্রতিষ্ঠাতাদের উদ্দেশ্য ও কর্মসূচিকে বহাল রাখার কথাই পুনর্ব্যক্ত করেনি, বরং এবডােকৃত রাজনীতিকরা ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের আকাঙ্ক্ষা পূরণের যে সব দাবির সূচনা করে গিয়েছিলেন সে প্রক্রিয়াকে আরাে জোরদার, আরাে শাণিত করার পথই অনুসরণ করতে থাকেন। আর শাসক কোটারির সঙ্গে এ নিয়ে দরকষাকষির নিষ্ফলতা সম্পর্কে নিশ্চিত পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এ সব ইস্যু জনগণের কাছে তুলে ধরার কাজে মনােনিবেশ করে। ফলে এই প্রক্রিয়ায় ইচ্ছার বিষয়টি অপরিবর্তনীয় ‘দাবি’তে রূপান্তরিত হয়।৫২
তবে পুনরুজ্জীবিত দলের চেহারা ও ভূমিকা কী হবে তা তখনাে অজ্ঞাত থেকে যায় । তাই এ নিয়ে একটি অংশে যখন উদ্বেগ-আশঙ্কা চলেছে তখন অন্য অংশে তা নিয়ে এসেছে স্বস্তিবােধ। উভয়েরই অবশ্য একাধিক কারণও ছিল। কিন্তু এ দুটিকে নিয়েই বাড়াবাড়ি করা হয়েছে।
দল পুনরুজ্জীবনের বিরােধী শিবিরের নেতারা, বিশেষ করে, আতাউর রহমান ঠাওর করে উঠতে পারেননি যে জাতীয় নেতা ছাড়া ন্যাশনাল ডেমােক্র্যাটিক ফ্রন্ট কখনাে বাস্তবে রূপ নিতে পারবে না। আর এও খুবই বিস্ময়ের বিষয় এই যে, এনডিএফ-এর যারা সােহরাওয়ার্দীর প্রতি ও তাঁর ন্যূনতম কর্মসূচির প্রতি আনুগত্য প্রকাশে নিরন্তর কথার খৈ ফোটাতাে তারা কেমন করেই বা এনডিএফ-এর পূর্ব পাকিস্তান কমিটির উদ্দেশ্যাবলির প্রতি সমর্থন জানাতে পারে। ১৯৬৪ সালের জানুয়ারির গােড়ার দিকে এই উদ্দেশ্যগুলি ঘােষণা করা হয়। এনডিএফ-এর নিখিল পাকিস্তান কমিটি এ সব উদ্দেশ্য নিজেদের সম্মতিক্রমে স্থির করে থাকলে ব্যাপারটি হতাে আলাদা। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের। এনডিএফ কর্মসূচিতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সে রকমটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এমনকি গঠন-কাঠামাের দিক থেকেও পশ্চিম পাকিস্তান এনডিএফ ও পূর্ব পাকিস্তান এনডিএফ তাৎপর্যপূর্ণভাবে ভিন্ন। পশ্চিম পাকিস্তান এনডিএফ গঠিত ছিল দলীয় পুনরুজ্জীবনবাদী ও পুনরুজ্জীবনবিরােধী উভয় গ্রুপকে নিয়ে কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান এনডিএফ-এ ছিল কেবল
৯২
পুনরুজ্জীবনবিরােধীরা।৫৩ পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে কেবল যে একটি জায়গায় মিল ছিল। তা হলাে সােহরাওয়ার্দীর ন্যূনতম কার্যক্রম যা বিশেষত সােহরাওয়ার্দীর অবর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানকে সক্রিয় করে তােলার জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। এ পর্যায়ে দল পুনরুজ্জীবিত হলে রাজনৈতিকভাবে তারা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবেন—এমন আশঙ্কা যদি না করতেন তাহলে এবডাের নিষেধাজ্ঞাধীন দলীয় পুনরুজ্জীবনবিরােধীরা এ বিষয়টিকে উপেক্ষা করতে পারতেন না। অনুরূপভাবে, নরমপন্থী সিনিয়র নেতাদের হস্তক্ষেপবিহীন একটা বলিষ্ঠ সংগঠন গড়ে তােলার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য এ ছিল এক সুযােগও বটে।
পূর্ব পাকিস্তান এনডিএফ অবশ্য পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের একাংশ”৫৪ বলে অভিহিত করতে থাকে। আর নিষ্ক্রিয় দলের ৩৭ জন পুনরুজ্জীবনবিরােধী এই দলের পুনরুজ্জীবন সম্পর্কে এই বলে মন্তব্য করেন যে, “কাজটি কেবল রাজনৈতিক বিচক্ষণতা, কৌশলগত সুবিধাবাদ (ও) গঠনতান্ত্রিক উপযুক্ততার নিরিখেই নয় বরং নৈতিকতার দিক থেকেও ঠিক নয়।”৫৫
তবে পুনরুজ্জীবনবিরােধী হাতেগােনা কিছু কট্টর দলের কথা বাদ দিলে, দল পুনরুজ্জীবনের যুক্তিগুলি বাহ্যত বলিষ্ঠতর হয়ে উঠতে থাকে।৫৬
যাই হােক সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনবিরােধীরা ও পূর্ব পাকিস্তান এনডিএফ নিখিল পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হলে আরাে দুর্বল হয়ে পড়ে।৫৭ এভাবে অস্থিকঙ্কালসার এনডিএফ দলবিহীন এক গণআন্দোলনের ধারণা ব্যক্ত করে চলতে থাকে যা আবুল মনসুর আহমদের ভাষায় এক দুর্বল কণ্ঠস্বর’।৫৮
আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ সকল দলের পক্ষ থেকে সম্মিলিত কার্যব্যবস্থা গ্রহণের বাঞ্ছনীয়তা নিয়ে আলােচনা চালাতেই থাকে। কিন্তু তাদের নিজ নিজ দল পুনরুজ্জীবনের সিদ্ধান্তের বাস্তবতাই বরং প্রতিযােগিতামূলক রাজনীতির প্রতি তাদের অগ্রাধিকার প্রকাশ করে।
সামরিক আইন জারির প্রাক্কালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অনুমিত ক্ষয়িষ্ণু জনপ্রিয়তা এবং কনভেনশন মুসলিম লীগের আনুকূল্যপ্রাপ্ত অবস্থানের পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনে দলটি আরাে দুর্বল হয়ে পড়বে-কনভেনশন মুসলিম লীগ এই প্রত্যাশাই করেছিল। কিন্তু ভুলে যাওয়া হয়েছিল যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যাবলি নিহিত ছিল পূর্ব পাকিস্তানীদের রাজনৈতিক চেতনতার সর্বাগ্রগণ্য বিষয়গুলি—এবং তারা তাদের নিজ প্রজ্ঞা ও মেজাজমত কার্যক্রম চালাবার যােগ্যতার অধিকারী ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এ কথা ভালভাবেই জানতাে এবং এই ধারণার ভিত্তিতেই পুনরুজ্জীবন পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও কর্মপদ্ধতির সঠিক ধারা নির্ধারিত হয়।
৯৩
পঞ্চম অধ্যায়
পুরানাে ইস্যু, নয়া নেতৃত্ব
নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ঢাকায় ওয়ার্কিং কমিটির সভায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের বিষয়টি অনুমােদন করে। এ ছাড়া তিন দিনব্যাপী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিলর ও ডেলিগেট সম্মেলনের প্রাক্কালে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তার নিজ পুনরুজ্জীবনেরও সিদ্ধান্ত নেয়।১ যে ধারা বিন্যাসে পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন ঘটে তাতে পাকিস্তানের অন্যতম জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় সংগঠনের নির্মিতি ও কাঠামােগত দুর্বলতারই আভাস পাওয়া যায়। এতে খােদ পাকিস্তানী জনসমাজের অভ্যন্তরে মৌলিক ও অমীমাংসিত স্ববিরােধিতাই প্রকাশ পেয়েছে। এ ছাড়া পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযােগ্য একটি ম্যানিফেস্টো প্রণয়নে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ব্যর্থতায় এ দুর্বলতা আরাে বেশি করে প্রতিফলিত হয়েছে। এ জন্য কাগজপত্রে পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অন্যতম অঙ্গ থাকলেও সকল ব্যবহারিক পর্যায়েই পূর্ব পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বকীয় স্বাধীন সত্তা বজায় রাখে।
নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের বিষয়টি অনুমােদন করে এ কথা আগেই বলা হয়েছে। এ পুনরুজ্জীবন আসলে আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। কেননা, পুনরুজ্জীবনের বহু আগে থেকেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ আসলে কাজ করতে শুরু করেছিল। ফেব্রুয়ারির গােড়ার দিকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ভােটাধিকারের বিষয়টি নিয়ে আলােচনায় মিলিত হয়। এ বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ জনসাধারণের ঘােষিত অভিপ্রায় ও ভােটাধিকার কমিশনের সুপারিশের বিরুদ্ধে তৎকালীন সরকারের চলতি নির্বাচন পদ্ধতি আঁকড়ে থাকার জেদের নিন্দা জানায়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি জনগণের দাবি পূরণের লক্ষ্যে
৯৫
শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে হাত মিলানাের জন্যে অন্যান্য দলের প্রতি আহ্বান জানায় ও সেই সাথে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ইউনিটগুলিকে তাদের নিজ নিজ এলাকায় সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে একত্রিত ও সংঘবদ্ধ করার নির্দেশ দেয়। এ সব নির্দেশনার অনুসরণে দল গড়ার কাজ অনতিবিলম্বে হাতে নেওয়া হয়। এ কাজের সূচনা হয় জেলা ও মহকুমা পর্যায়ের কর্মী সম্মেলন দিয়ে যেখানে শীর্ষস্থানীয় দলীয় নেতারা জনগণের দাবি আদায়ের জন্য রাজনৈতিক দলসমূহের গুরুত্ব ও আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের প্রয়ােজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। এই সব সম্মেলন অনুষ্ঠানের পরপরই অতি আবশ্যিকভাবেই বিভিন্ন জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সব জনসভায় স্থানীয় নেতাদের পাশাপাশি সফরে আসা দলীয় নেতারা পাকিস্তানের আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয় আলােচনা করেন। আলােচনায় পূর্ব পাকিস্তানের দুর্গতি সম্পর্কে সবিশেষ গুরুত্ব আরােপ করা হয়। তাঁরা তাঁদের এ সব ভাষণে স্থানীয় নানা সমস্যার কথাও আলােচনা করতেন যেগুলির আশু সমাধানের প্রয়ােজন ছিল।২ আসলে এ সব সভাসমিতির অনুষ্ঠান ছিল অচিরেই অনুষ্ঠেয় কাউন্সিলর ও ডেলিগেট সম্মেলনের প্রাকপ্রস্তুতি। পূর্ব পাকিস্তানের গণমানুষ স্তরে পৌঁছানাে ও তাঁদের সাথে যােগাযােগ করার এই ধারা পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের একটা স্থায়ী রীতিতে পরিণত হয়।
কাউন্সিলর ও ডেলিগেট সম্মেলনের অধিবেশনকালেও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যগুলি বেশ পরিষ্কার ও বােধগম্য হয়ে ওঠে। উদ্বোধনী ভাষণে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান গণবিরােধী নানা কার্যকলাপের জন্য গণতন্ত্রবিরােধী সরকারের সমালােচনা করেন ও জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামে পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সমর্থন দেওয়া উচিত বলে উল্লেখ করেন। তবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সক্রিয়তার প্রধান বিষয় পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাগুলি কী কী তার কোনাে সুনির্দিষ্ট উল্লেখ তিনি করেননি। অবশ্য তিনি যে সভামঞ্চে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন সেখানকার আশপাশের দেওয়ালে পূর্ব পাকিস্তানের নানা দাবিদাওয়াভিত্তিক পােস্টার শােভা পাচ্ছিল। এ সব পােস্টারে। লেখা ছিল: নৌবাহিনীর প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামে চাই; জনসংখ্যারভিত্তিতে সৈন্যবাহিনীতে লােক নিয়ােগ করতে হবে, পাটের ন্যায্যমূল্য দিতে হবে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিতে হবে ইত্যাদি।৩
দলীয় পুনরুজ্জীবনের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে এই সভায় সম্মিলিত প্রয়াসের প্রয়ােজনের কথাও স্বীকার করা হয় এবং সাধারণ সম্পাদককে ওয়ার্কিং কমিটির সাথে পরামর্শক্রমে অন্যান্য পুনরুজ্জীবিত রাজনৈতিক দলের সাথে সহযােগিতার লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় কর্মসূচি নেওয়ার ব্যাপারে ক্ষমতা প্রদান করা হয়।
সভায় ২৬টি প্রস্তাব গৃহীত হয়।৪ এ সব প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু থেকে এ সংগঠনের যে সব দাবিদাওয়ার কথা মাঝেমাঝেই উচ্চারিত হয়েছে সেগুলি আগের যে কোনাে সময়ের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা হয়।
৯৬
পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র সম্পর্কিত প্রস্তাবে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের শাসনতান্ত্রিক নিশ্চয়তার বিষয়ও সন্নিবেশিত ছিল। অন্য এক প্রস্তাবে দেশের প্রতিটি অঞ্চলের পৃথক পৃথক অর্থনীতির জন্য শাসনতান্ত্রিক গ্যারান্টি ও পৃথক অর্থনীতির ভিত্তিতে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরির দাবিও করা হয়।
নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলির জন্য শাসনতান্ত্রিক গ্যারান্টি চাওয়া হয়:
ক. সর্বজনীন ভােটাধিকারভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন;
খ. মৌলিক অধিকারের ন্যায্যতা;
গ. বেআইনী গ্রেপ্তার ও বিচার ছাড়া আটকাদেশের বিরুদ্ধে প্রতিবিধান;
ঘ. নির্বাহী বিভাগকে বিচার বিভাগ থেকে পৃথকীকরণ;
ঙ. আইন পরিষদসমূহের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব;
চ. রাজনৈতিক দল গঠন এবং সংবাদ মাধ্যম ও সংগঠনের মাধ্যমে জনমত প্রকাশের অবাধ অধিকার।
এ ছাড়া নিম্নবর্ণিত দাবিগুলিও উল্লিখিত গৃহীত প্রস্তাবাবলির অন্তর্ভুক্ত ছিল:
ক. বন্যা নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ব্যবস্থাগুলির বাস্তবায়ন;
খ. উত্তরবঙ্গের দ্রুততর অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বাহাদুরাবাদের কাছে যমুনা নদীর ওপর দিয়ে সেতু নির্মাণ;
গ. যমুনার পশ্চিম তীর বরাবর রংপুর থেকে সিরাজগঞ্জ অবধি বাঁধ নির্মাণ;
ঘ, সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাগুলির পান ও নারকেল চাষীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী সুদমুক্ত ঋণ;
ঙ. প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতনস্কেল বৃদ্ধি এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের জন্য মহার্ঘ ভাতা বৃদ্ধি;
চ. মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার এবং মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্রদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযােগ অবারিত করা;
ছ, শ্রমিক/কর্মীদের ধর্মঘটের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ বাতিল;
জ, গরিবদের কষ্ট লাঘবে জমির মালিকানা নিরূপণ-সংক্রান্ত আইনকানুনের সংশােধন;
ঝ. বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য স্বায়ত্তশাসন এবং পশ্চিম পাকিস্তানী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ওপর থেকে বিধিনিষেধমূলক অধ্যাদেশগুলি প্রত্যাহার; এবং
ঞ. রাজবন্দীদের মুক্তিদান।
ভারতে পশ্চিমা শক্তিগুলির ব্যাপক অস্ত্র সাহায্যের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট কথিত জরুরি পরিস্থিতির আলােকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এক পূর্ব পাকিস্তানী মিলিশিয়া বাহিনী বা আধা সামরিক বাহিনীর প্রয়ােজনের কথাও পুনরায় উল্লেখ করা হয়।
৯৭
করাচি থেকে ইসলামাবাদে ফেডারেল রাজধানী স্থানান্তরের প্রতিবাদ করে বলা হয়, করাচি যদি ফেডারেল রাজধানীর অনুপযুক্ত হয়ে থাকে তাহলে ঢাকা তার বিকল্প হওয়া উচিত।
সভায় গৃহীত অন্যান্য প্রস্তাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সমালােচনা করা হয়, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় এবং কাশ্মীরীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়।
বিশ্বশান্তি ও দেশে স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে মতপ্রকাশ করা হয়।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় এই যে, সভার অন্যতম প্রস্তাবে ঘােষণা করা হয় যে, কেবল। সমাজতান্ত্রিক ধরনের অর্থনীতিই জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে আর সে কারণেই সমাজবাদী ধরনের অর্থনীতির ক্রম বাস্তবায়ন প্রয়ােজন।
স্পষ্টত এ সব গৃহীত প্রস্তাব ইতােমধ্যে নিয়ােজিত ম্যানিফেস্টো উপকমিটির জন্য নির্দেশনামূলক রূপরেখা প্রদান করে। শাসনতন্ত্রের গণতন্ত্রায়ন দাবির বাইরে যে দুটি দাবি ১৯৪৯ থেকে প্রণীত ইতঃপূর্বেকার ম্যানিফেস্টোগুলিতে তেমন করে মনােযােগে আসেনি। উল্লিখিত প্রস্তাবগুলিতে সে দুটির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করা হয়। প্রস্তাবগুলি। হলাে: (১) চূড়ান্ত পর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির অপরিহার্যতা; (২) দ্বিঅর্থনীতির জন্য শাসনতান্ত্রিক গ্যারান্টি। পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ১১-দফা খসড়া ম্যানিফেস্টো কয়েকমাস আগে প্রকাশিত হয়।৫ প্রস্তাবগুলি তাই মূলত ভাঙন পূর্ববর্তী মূল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোর মতােই কমবেশি একই থাকে। এতে যা কিছু ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায় তা হলাে দেশের অন্যতম মৌলিক আইন হিসেবে দ্বিঅর্থনীতি প্রবর্তন এবং চূড়ান্ত অনিবার্য লক্ষ্য হিসেবে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির দাবি।
আগের ম্যানিফেস্টোগুলিতে “দ্বিঅর্থনীতি” এই পরিভাষা ব্যবহৃত না হলেও আওয়ামী লীগাররা এ শব্দ ব্যবহার করেছেন। আর মওলানা ভাসানীও কাগমারীতে দল ভাঙার আগে অনুষ্ঠিত দলের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে তাঁর সভাপতির ভাষণে এর উল্লেখ করেন।
সমাজবাদী অর্থনীতির ব্যাপারে গুরুত্ব আরােপের বিষয়টি এক উল্লেখযােগ্য সংযােজন। ১৯৪৯ সালের পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টোতে বিধৃত ধারণা অনুযায়ী পাকিস্তান হবে “রাষ্ট্রসমূহের এক স্বাধীন সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ইউনিয়ন, এদেশের শিল্প হবে জাতীয়কৃত আর এ সব শিল্পের ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে।” তবে “সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি” এই পারিভাষিক শব্দটি তাতে ব্যবহৃত হয়নি।৬ সমাজের অগ্রগতি বিধানের জন্য অতঃপর একমাত্র বাস্তব প্রয়ােগযােগ্য উপায় হিসেবে “সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গ্রহণ করা সংক্রান্ত প্রস্তাব দলীয় নেতাদের আর্থ-রাজনৈতিক ধারণায় এক তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত করেছিল। এতে আরাে যে জিনিসটি বােঝা যায়। তা হলাে দলের সিদ্ধান্ত প্রণয়ন পরিমণ্ডলে কথিত প্রগতিবাদীদের আরাে কার্যকর ও ফলদায়ক
৯৮
অংশগ্রহণ। ন্যাপের দিক থেকে কোনাে সম্ভাব্য হুমকির বিরুদ্ধে ভারসাম্যরক্ষাকারী কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, নাকি তা ছিল ঐ দলের সত্যিকারের রূপান্তর বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকতে পারে। তবে বিতর্ক যে দিকেই হােক, এতে প্রধান রাজনৈতিক গতি প্রবণতায় পরিবর্তন প্রতিফলিত হয়।
আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কথা ছেড়ে দিলেও ভবিষ্যতে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কী হবে সে বিষয়ে গৃহীত অবস্থান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এবং নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের মধ্যে মতপার্থক্য আরাে বাড়িয়ে তােলে এবং এর ফলে দলের জাতীয় বৈশিষ্ট্য দুর্বল হয়ে পড়ে। একটি শাখা অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের স্বাতন্ত্রের বিষয়টি পরিষ্কার ফুটে ওঠে। এ বিষয়টি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতারা প্রায়ই উল্লেখ করেছেন। আর নয়া নেতৃত্বেও আদৌ এর কোনাে পরিবর্তন ঘটায়নি।
সভায় দলের সাধারণ সম্পাদকের রিপাের্টে উল্লেখ করা হয় যে, (পূর্ব পাকিস্তান) আওয়ামী লীগই প্রথমবারের মতাে দেশের দুই অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বৈষম্যের দিকে মনােযােগ আকর্ষণ করেছে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগই প্রথমবারের মতাে তথ্য ফাঁস করেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানী গরিব চাষীর কঠোর শ্রমলব্ধ বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের মুষ্টিমেয় শিল্পপতি ও ধনবান ব্যক্তির স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে আর তাতে দেশের দুই অংশের মধ্যে ব্যবধান আরাে বেড়ে যাচ্ছে। সাধারণ সম্পাদক এ কথাও মনে করিয়ে দেন যে, এ ধরনের কথাবার্তা বলার জন্য এক সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের দণ্ডিত করা হয়েছে কিন্তু তাঁরা যে সব নিরেট সত্য প্রকাশ করেছিলেন তার যথার্থতা। পরবর্তীকালে ব্যাপক পর্যায়ে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে এবং তা হয়ে উঠেছে ক্রমবর্ধমান গণঅসন্তোষের কারণ। আর তারই ফলে সামরিক আইন সরকার ও পরবর্তী সরকার এ সব অভিযােগের সারবত্তা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন।
সাধারণ সম্পাদক জোর দিয়ে উল্লেখ করেন যে, বলিষ্ঠভাবে সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলগুলির সমর্থনবিহীন কোনাে “ফ্রন্ট”-এর পক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করা অসম্ভব কাজ। কেননা শুধু বিবৃতি আর প্রচারণাই জনগণের দাবি মেনে নিতে এমন চরম প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্রকে সম্মত করার জন্য পর্যাপ্ত নয়। এ জন্য একটা কার্যকর, ফলপ্রসূ ব্যবস্থা নিতে হবে। কেবল নেতাদের ঐক্য দিয়ে তা আদৌ সম্ভব ও বাস্তববাচিত নয়। জনগণের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি এ জন্য অত্যন্ত জরুরি ও মৌলিক পূর্বশর্ত। আর জনঐক্য কেবল সংগঠিত রাজনৈতিক দলগুলির দ্বারাই সম্ভব। এমনকি কোনাে ন্যূনতম কর্মসূচিভিত্তিক আন্দোলন পরিচালনা করতে হলে এবং কোনাে রকমের চাক্ষুষ ও বাস্তব ফল পেতে হলে সংগঠিত রাজনৈতিক দলসমূহের সমর্থনও আবশ্যক।৭
কাউন্সিলর ও ডেলিগেট সম্মেলনে ৯৪৪ জন কাউন্সিলর ও ডেলিগেট পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলা থেকে যােগ দেন। তারা প্রতিটি গ্রামে গণআন্দোলন গড়ে তােলার শপথ নিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন। এ ছাড়াও বলা যায় যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এ সম্মেলন
৯৯
নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। দলীয় কর্মীদের প্রকাশ্য ও রুদ্ধদ্বার—উভয় অধিবেশনেই খােলাখুলি আলােচনায় দেখা যায়, কর্মীরা উপলব্ধি করেন যে, সামরিক আইন পূর্ব ও পরবর্তী আমলের রাজনৈতিক আন্দোলনগুলির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। একজন একক ব্যক্তিকেন্দ্রিক কোটারি শাসনের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে কেবল অঙ্গীকারের ভিত্তিতে বিভিন্ন দল ও তাদের নেতাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকতামূলক ঐক্যই জনগণের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট নয়। যা দরকার ছিল তা হলাে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্য এবং গ্রাম অবধি নিম্নতম স্তরে জনমত সংগঠিত করা যা কেবল একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের পক্ষেই সম্ভব। আওয়ামী লীগের সংগঠন অসংহত হয়ে পড়েছে বলে যে জল্পনা-কল্পনা ছিল তাও এ সম্মেলনে বিপুল উপস্থিতি, খােলাখুলি আলােচনা, উত্থাপিত প্রস্তাবগুলি সম্পর্কে ঐকমত্য এবং ব্যাপক গণপর্যায়ে জনমত সংগঠনের কর্মসূচি বাস্তবায়নের দৃঢ় প্রত্যয়ের কারণে ঠিক নয় বলেই প্রমাণিত হয়। এ ছাড়া, দল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সবচেয়ে কার্যকর অবস্থানের বিষয়টির আর একটি প্রমাণ: একদা কট্টর মুসলিম লীগার ও প্রাকসামরিক আইন আমলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ আজিজুর রহমান পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে যােগদান করেন। কারণ তাঁর এই মর্মে উপলব্ধি ঘটে যে, আওয়ামী লীগ কেবল বিরােধীদলকে নেতৃত্ব দিতেই সক্ষম নয় বরং ভবিষ্যতে দায়িত্ব নেওয়ার সামর্থ্যও রাখে।৮
বাস্তবিকপক্ষে, পল্লী জনগণের দলীয় কর্মীদের চাপেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দলীয় পুনরুজ্জীবন দ্রুততর হয়। কর্মসূচিভিত্তিক সাংগঠনিক কাজের অভাবে এই দলীয় কর্মীরা অস্থির হয়ে উঠছিল। তাদের মনে হতে থাকে তারা জনসাধারণের আস্থা দ্রুত হারাচ্ছে।”৯
এই “জনসাধারণ” আসলে কারা? ওরা ছিল বিপুল সংখ্যক দারিদ্রপীড়িত গ্রামবাংলার চাষীকুল ও প্রদেশের কিছু শিল্প শ্রমিক। জীবনের অপরিহার্য প্রয়ােজনগুলি হাতের নাগালে পাওয়াই ছিল তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্থাৎ মুসলমানরা ১৯৪৫-৪৬ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগকে ভােট দিয়েছিল এই আশায় যে, পাকিস্তানে তাদের এ সব জিনিসের অভাবে ভুগতে হবে না। তবে এ সংগঠনটি সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় তারা ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগকে প্রত্যাখ্যান করে। ‘৬০দশকের মধ্যভাগ নাগাদ তারা টের পেয়ে যায় যে, বুনিয়াদি গণতন্ত্র ব্যবস্থা ও সেই সঙ্গে পল্লী পূর্ত কার্যক্রম যা আইয়ুব খান প্রবর্তন করেছিলেন সেগুলি আসলে পল্লী জনপদের অধঃপতিত গরিবদের কপাল ফেরানাের চেয়ে বরং অর্থনৈতিক দিক থেকে আধিপত্যশীল যে শ্রেণী ইতােমধ্যে বিরাজমান ছিল সেই “উদ্বৃত্ত” জোতদারদেরই পৃষ্ঠপােষকতা ও তাদের। ক্ষমতাকে বৈধতা দেওয়ারই হাতিয়ার মাত্র।১০ প্রশাসনিক অনিয়ম ও গলদের কারণে পিএল-৪৮০ তহবিলের অর্থে পরিচালিত পল্লী পূর্ত কার্যক্রম গরিব ও ঋণজর্জরিতদের স্বস্তি আনার বদলে “উদ্বৃত্ত” জোতমালিক তথা সুদের মহাজনদের সমন্বয়ে গঠিত গ্রামের বিশিষ্ট প্রভাবশালীদের হাতে আরাে বিত্ত পুঞ্জীভূত হতে দেওয়ার মাধ্যমে নিগ্রহমূলক
১০০
শক্তিকে আরাে কেন্দ্রীভূত করায় সাহায্য করে। উল্লেখ্য, এই জোতদার-মহাজনরাই প্রধানত ছিলেন মৌলিক গণতন্ত্রী। ১৯৬৩ সালের উপনির্বাচনে এরাই সরকারকে বিপুলভাবে যে সমর্থন জানায় তা আসলে ছিল ক্ষমতাসীন শাসকগােষ্ঠীর “মহানুভবতায় তাঁদের কপাল খুলে যাওয়ার জন্য তাঁদের কৃতজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কিন্তু নিঃস্ব, গরিব চাষীর হতাশার চশমার কাঁচে এ মৌলিক গণতন্ত্রীরা অলস ও দুনীতিপরায়ণ লােক হিসেবে ফুটে ওঠে যারা তাদের ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে অত্যন্ত নির্লজ্জের মতাে এ তহবিলের টাকা ব্যবহার করে।১১ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পল্লী পূর্ত কার্যক্রমকে এক প্রতারণা বলে অভিহিত করতে থাকে। এদিকে, এমনকি ইউনিয়ন স্তরে সাংগঠনিক কাঠামাে রয়েছে এ রকম একমাত্র বিরােধীদল হওয়ায়, আওয়ামী লীগ গরিব পল্লীবাসীর জন্য একমাত্র চাক্ষুষ ও নির্ভরযােগ্য বিকল্প হয়ে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কর্মীরাও ছিল ওদেরই লােক। একই কথা ইউনিয়ন ও থানা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাদের সম্পর্কেও। তখন নগরায়নের হার অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ে থাকায়১২ মহকুমা ও জেলা পর্যায়ের নেতারা যদি বা তথাকথিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কেউ হয়েও থাকেন তাহলে তারা একই ‘গণ’-এর অন্তর্ভুক্ত। দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও খুব একটা ভিন্ন কিছু ছিলেন না। তবে তাঁদের বেলায় পার্থক্য শুধু এটুকুই যে, শহরের গণ্যমান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ ছিল। এ প্রদেশের রাজনীতির ব্যবস্থাপনায় এই শেষােক্ত নাগরিকদের একটা কায়েমি স্বার্থ থাকারই কথা। তাদের আকাঙ্ক্ষা-অভিলাষ সরকারের সিদ্ধান্ত প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া—উভয় ক্ষেত্রেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রবল আধিপত্যের কারণে ক্ষুন্ন হচ্ছিল। এ ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রায়নের ব্যবস্থাসহ পাকিস্তানে একটি ফেডারেল কাঠামাের আওতায় পরিপূর্ণ অংশীদারিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম থাকলে অবশ্য এ অবস্থার প্রতিকার হতে পারতাে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এ সবকিছুর জন্য সব সময় লড়েছে। এ জন্য সাধারণ মানুষের স্পর্শ অর্থাৎ গ্রামের মানুষের ও অপেক্ষাকৃত ভালাে অবস্থার শহরের লােকদের স্বার্থের একত্র সমাবেশ ঘটার ফলে সেটি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জন্য সমর্থনের এক ব্যাপকতর বুনিয়াদ ও যুগপৎ অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হাতিয়ারও হয়ে ওঠে। ১৯৬৪ সালের মাঝামাঝি প্রকাশিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টো বাস্তবিকপক্ষে একাধারে দ্বিঅর্থনীতির দাবি অন্তর্ভুক্ত করে শহরবাসী জনগােষ্ঠীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে এবং এক সমাজবাদী অর্থনীতির সপক্ষে বিঘােষিত অগ্রাধিকারের মাধ্যমে গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন করে দ্বৈত উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি’—এই পারিভাষিক শব্দ নিয়ে কী কী কল্পনা করা হয়েছে তা স্পষ্ট করা হয়নি তবে শিল্প কারখানাগুলির জাতীয়করণ ও বড় ধরনের ভূমি সংস্কার পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কর্মসূচির অঙ্গ বলে তখন জানা ছিল। ১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ-গণতন্ত্রী দল (জিডি)-কংগ্রেস কোয়ালিশন এক ভূমি সংস্কার সম্মেলনের আয়ােজন করে। সম্মেলন আয়ােজনের উদ্দেশ্য ছিল, পূর্ব পাকিস্তানে জমিদারি উচ্ছেদ পরবর্তীকালে কৃষি জমির রাজস্ব বা খাজনা সম্পর্কিত সমস্যাবলি দূর করার সুনির্দিষ্ট উপায় ও পন্থা
১০১
সুপারিশ করা। এ সম্মেলনে এ বিষয়ে যে সব সুপারিশ করা হয় সেগুলি বিরাজমান পরিস্থিতির বিচারে বেশ “প্রগতিধর্মী” বলে বিবেচিত হয়।১৩ এ কারণে কৌশলগতভাবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানের মতাে সামন্ত জমিদারের নেতৃত্বাধীন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অঙ্গ হলেও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বিভিন্ন স্তরের পূর্ব পাকিস্তানী জনসাধারণের হৃদয়ের অত্যন্ত নিবিড় চাহিদা ও সমস্যাগুলির পক্ষে কাজ করেছে। আর এই একই কারণে পশ্চিম পাকিস্তানী মনমানসে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ব্যাপারে নানা রকমের সংশয় ছিল। আর সরকার সেটির সুযােগ নিয়ে সংশ্লিষ্ট দুই তরফের মধ্যে বিভেদ আরাে বাড়িয়ে তােলার প্রয়াস পায়। ঢাকায় যখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেই সময়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। নীলফামারীতে বিশেষ কিছু রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে জনগণকে হুঁশিয়ার করে দেন। তার বক্তব্য ছিল যে, যদি এই দলগুলি সিঁড়ি বেয়ে ক্ষমতায় উঠে আসতে সক্ষম হয় তাহলে তা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দেশের অস্তিত্ব লুপ্ত হওয়ার শামিল হবে। তিনি এ সব দলের রাজনীতিকদেরকে “কেরায়া কা টাটু” বা “ভাড়ার খচ্চর” বলে অভিহিত করেন। তিনি এই একই সুর ও ভাষায় পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনেও বক্তৃতা দেন।১৪ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ অবশ্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলে যে, পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের দাবির অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানের অগ্রগতি রােধ করা নয়। আর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ যে সংগ্রাম পরিচালনা করছে তা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে নয় বরং এ রাজনৈতিক দল দেশের উভয় অঞ্চলের সুসমঞ্জস বিকাশ ও উন্নতির পক্ষে।১৫ এতে বাহ্যত আশ্বস্ত হয়ে, নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ১৯৬৪ সালের ৯ মার্চ অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে দেশের দুই অঞ্চলের মধ্যে সকল প্রকার বৈষম্য দূর করতে সম্ভাব্য সকল প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, দেশের সংহতি ও ঐক্যের স্বার্থে পাকিস্তানের উভয় অংশেরই উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক সতর্ক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ যদিও অভিমত প্রকাশ করে যে, তাদের দাবিদাওয়া পশ্চিম পাকিস্তানীদের তরফ থেকে মেনে নেওয়ার ব্যাপারে এক তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ তবু পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয় যে, নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সমস্যার সত্যতা স্বীকার করে নিলেও সে কারণে পূর্ব পাকিস্তানের দাবিদাওয়া মেনে নেওয়ার অনুকূলে পশ্চিম পাকিস্তানী সমর্থনের পরিসর কোনাে রকম সম্প্রসারিত হয়নি। কেননা, যদি তাই হয়ে থাকবে তাহলে প্রথমে যে কাজটি হওয়া উচিত ছিল তা হলাে, দলের জন্য একটি অভিন্ন ম্যানিফেস্টো প্রণীত হওয়া। তা হয়নি।
১৯৬৪ সালের যে সময় নাগাদ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হয় সেই সময়কালে পাকিস্তানী রাজনীতির স্ববিরােধিতাগুলি এই দলের নেতৃত্বের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় বলেই মনে হয়। দেশবিভাগপূর্ব ভারতে মুসলিম লীগের রাজনীতির সক্রিয় অংশীদার হিসেবে তাদের এ বিষয়টির প্রতি নজর ও মনােযােগ এড়ায়নি যে, দুই অঞ্চলের মধ্যকার বৈষম্যের কারণ মূলত খােদ নিখিল ভারত মুসলিম লীগের রাজনীতিতেই নিহিত ছিল।
১০২
অবিভক্ত বাংলা সবচেয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ হলেও তৎকালে এই প্রদেশ নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সিদ্ধান্ত প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় কখনাে সমানুপাতিক ভিত্তিতে অংশীদার হতে পারেনি। বাংলার মুসলিম লীগার বাদ দিলে বাংলার মুসলমানরা বলতে গেলে কার্যত পুরােপুরিই নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিলের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত-সংক্রান্ত সংস্থার প্রতিনিধিত্ব পায়নি। এ অবস্থার প্রতিকার কেবল মূল পর্যায়েই হওয়া সম্ভব ছিল। এ কারণে পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তার স্বল্পমেয়াদী অগ্রাধিকারগুলি বদলায়। জাতীয় স্তরে এক বিরােধীদলের একটি প্রধান শাখা হওয়ার পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বরং একনিষ্ঠভাবে একটি প্রাদেশিক রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেকে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেয়—যার প্রাথমিক উদ্দেশ্য: পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামাের খােলনলচে বদলে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ন্যায্য অধিকার ও অবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ন্যায়বিচার প্রত্যাশী পূর্ব পাকিস্তানীদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ। অবশ্য এই পরিবর্তন যতাে না তার অগ্রাধিকারগুলির বিষয়বস্তু ও গুরুত্ব আরােপের ক্ষেত্রে ছিল, তার কাঠামাের ক্ষেত্রে দৃশ্যত ততােখানি ছিল না। বস্তুতপক্ষে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে এ দল নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার আগে অবধি একটি জাতীয় পার্টির শাখা হিসেবেই নিজের অবস্থান বজায় রাখে, কিন্তু এর আগে পর্যন্ত একটা নিখিল পাকিস্তানভিত্তিক দলের ধ্বজা ধরে রাখলেও দলটি বিভিন্ন কার্যক্রম ও পদক্ষেপের মধ্যদিয়ে পূর্ব পাকিস্তানীদের অভিপ্রায়’কে দাবি’তে পরিণত করে।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের গঠন পর্যায়ে যে দলীয় উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয় সেগুলি বদলায়নি। তবে তখনাে পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়নি দলের উদ্দেশ্যগুলি অর্জন বা বাস্তবায়নে কী কী পন্থা বা পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে দু’টি বিকল্প ছিল এক, নির্বাচনগুলির মাধ্যমে সুবিধাজনক অবস্থানে যাওয়া। দুই, ব্যাপকভিত্তিতে গণচেতনা, জাগরণ ও আকাক্ষার সৃষ্টি করা। যে উপায়ই অবলম্বন করা হােক না কেন ব্যাপক পর্যায়ে জনমত সংগঠনের আবশ্যকতা ছিল। আর তাই এর আশু পরবর্তী পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে সচেষ্ট হয়। ১৯৬৪ সালের ১১ মার্চ বয়স্ক ভােটাধিকার ও প্রত্যক্ষ নির্বাচন দেওয়ার জন্য সর্বদলীয় সগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সেই আন্দোলনে শরিক হওয়া হােক কিংবা প্রেসিডেন্ট বা পরিষদীয় নির্বাচন লড়াইয়ের জন্য ১৯৬৪ সালের জুলাইয়ে গঠিত সম্মিলিত বিরােধীদল কপ (COP)-এ অংশীদার হওয়া হােক—লক্ষ্য ছিল এ সব কার্যক্রমের সীমিত লক্ষ্যগুলি ছাড়িয়েও পরিণতিগুলির জন্য জনসাধারণকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতির মেজাজ থেকে এ বিষয়টি একান্তই স্পষ্ট। বয়স্ক ভােটাধিকার ও প্রত্যক্ষ নির্বাচনকে ইস্যু করে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি আহূত দু’দিনব্যাপী দাবি দিবসের প্রথম দিনেই এ সংগঠনের বিদ্রোহাত্মক মনােভাবের বিষয় পরিলক্ষিত হয়। দাবি দিবস উপলক্ষে আয়ােজিত বিক্ষোভ মিছিলে ছাত্র জনতার ওপর কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়। মিছিলে লাঠি চার্জ করা হয়। তাজউদ্দিন আহমদ ও কোরবান আলীর মতাে নেতারা গ্রেপ্তার হন। পরের দিন হরতাল
১০৩
চলাকালে পল্টন ময়দানে আয়ােজিত এক বিশাল জনসভা মওলানা ভাসানী ও মুজিবের নেতৃত্বে এক সুবিশাল মিছিলের রূপ নেয়। এ জনসভায়, সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক মুজিব ঘােষণা করেন যে, এমন একদিন নিশ্চয়ই আসবে যে দিন মানুষ এক অপ্রতিরােধ্য গণজোয়ারের মাধ্যমে তার মৌলিক মানবাধিকারগুলি ছিনিয়ে নেবে। এ সময় যে সব ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান—যাঁরা সীমিত ও পরােক্ষ ভােটাধিকার সমর্থন করে খবরের কাগজে তারবার্তা পাঠাতেন—তাঁদেরকে কড়া হুঁশিয়ারি জ্ঞাপন করে তিনি বলেন, তাঁর দল ক্রীড়নক সার্কেল অফিসার, এমনকি উচ্চতর পর্যায়ের আমলাদের একটি তালিকা তৈরি করছে। তিনি বলেন, আমরা এ সব টাউটদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি ইউনিয়নে যাবাে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের আদি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও পরবর্তীকালে নিখিল পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মওলানা ভাসানীও এ বিষয়ে অনুরূপ বক্তব্য প্রদান করেন।১৭
একটি চরমপত্রের আভাসের কারণেই উল্লিখিত বক্তৃতা পূর্ববর্তী বক্তব্যের চেয়ে ভিন্ন হলেও গত এক বছর বা অনুরূপ সময়ে ছাত্রসমাজ যে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেয় তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। আর এতে রাজনৈতিক দলগুলির সিদ্ধান্ত প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় ছাত্রসমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি আবারও একবার উজ্জ্বলরূপে প্রতিভাত হয়। ঘটনাটি অধিকতর তাৎপর্যবহ এ কারণে যে, এ সব বক্তৃতায় দুই নেতার চিন্তাধারার মধ্যে একটা মাত্রায় ঐক্য ফুটে ওঠে যদিও এই দুই নেতার একজন স্বীকৃত দলীয় নীতি থেকে দলের বিচ্যুত হওয়ার কথিত কারণে দল ছেড়েছিলেন।
যদিও সেই সময়কার পরিস্থিতির মেজাজ স্পষ্টতই বিদ্রোহাত্মক, মুজিব বা ভাসানীর কেউই এ পর্যায়ে কোনাে সক্রিয় মােকাবেলামূলক কার্যক্রম দেননি। মুজিব তাঁর “বাঙালি ভাইদেরকে” কারাবরণ করে জেলখানা ভর্তি করে ফেলার আহ্বান জানান, কিন্তু জেল ভাঙতে নিষেধ করেন। ভাসানীও সম্মিলিত এক নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ডাক দেন এবং জনগণের প্রতি সহিংসতার আশ্রয় না নেওয়ার আবেদন জানান। তবু অচিরেই সহিংসতা শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গভর্নরের সভাপতিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে। তারা যুক্তি প্রদর্শন করে, মােনায়েম খান কোনাে একাডেমিক ব্যক্তিত্ব নন, একজন রাজনৈতিকভাবে নিয়ােগপ্রাপ্ত ব্যক্তি মাত্র। এমনকি চ্যান্সেলর পদেরও যােগ্য নন। সে কারণে তারা তাদের ডিগ্রি ঐ গভর্নরের কাছ থেকে নিতে ইচ্ছুক নন। এ নিয়ে হাঙ্গামা ঘটে। প্যান্ডেল ভেঙে তছনছ করা হয়। এ ঘটনায় অনেকে জখম হয়। ছাত্রদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হয়। দু’জন ছাত্রের এমএ ডিগ্রি ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এদের অপরাধ এই বলে নির্দেশ করা হয় যে, ১৯৬৪ সালের ২২ মার্চ কনভােকেশন দিবসে তারা হাঙ্গামা সৃষ্টির কাজে যােগ দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তাই তাদেরকে গুরুতর অসদাচরণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এদের অন্যতম ছিলেন ছাত্রলীগার শেখ ফজলুল হক মণি। চারজন ছাত্রকে ৫ বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। এদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট ছাত্র ইউনিয়ন নেতা এএসএম রাশেদ খান মেনন ও
১০৪
বিশিষ্ট ছাত্রলীগ নেতা কেএম ওবায়দুর রহমান। ছয়জন ছাত্রকে তিন বছরের জন্য ও ১৪ জনকে দু’বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। এদের মধ্যে ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক (ছাত্রলীগ) ও সিরাজুল আলম খান (ছাত্রলীগ)। অন্য ২০ জন ছাত্রের কাছে নির্ধারিত ফরমে সদাচরণের জন্য ব্যক্তিগত গ্যারান্টি চাওয়া হয় যে গ্যারান্টিতে তাদের নিজ নিজ অভিভাবকের সই থাকতে হবে।১৮ শেখ মুজিব সংবাদপত্রে তথ্য চেপে দেওয়ার বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দেন। ঐ বিবৃতিতে প্রতীয়মান হয় তিনি ছাত্রদের মারমুখী মেজাজের কারণটি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তিনি বলেন:
এ ব্যাপারে আমি ক্ষমতাসীনচক্রকে এই মর্মে হুঁশিয়ার করে দিতে চাই যে, যে সব দেশে গণতন্ত্রের কণ্ঠরােধ করা হয়েছে সে সব দেশের ইতিহাস যেন তারা মনে রাখেন। যারা গণতান্ত্রিক আদর্শ ও ব্যবস্থায় বিশ্বাসী কেবল সাময়িকভাবেই তাদের কণ্ঠরােধ করা যায়। অত্যাচার-নিপীড়ন যদি বন্ধ না হয়, গণতন্ত্র যদি পুনরুজ্জীবিত না করা হয়, যদি কর্তৃপক্ষ গণতান্ত্রিক আন্দোলন চলতে না দেন তাহলে তাঁদের জেনে রাখা উচিত তেমন পরিস্থিতিতে জনসাধারণ অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই বেছে নিতে পারে। আর যদি তেমনটিই ঘটে তাহলে সেটা হবে এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়।১৯
কাগজপত্রে ভাসানী একটি পাকিস্তানভিত্তিক দলের (ন্যাপ) প্রতিনিধি হলেও স্পষ্টতই পশ্চিম পাকিস্তানের বিস্তৃততর অংশের প্রতিনিধি তিনি ছিলেন না। এ জন্য আন্দোলন জোরদার করার জন্য বিরােধীদলগুলির নিখিল পাকিস্তানভিত্তিক একটি সংগঠনের চিন্তাভাবনা করতে হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু নেতার সঙ্গে আলােচনার পর এ ধরনের একটি সংগঠন গড়ার সম্ভাবনার কথা ঘােষণা করেন।২০ আর এ পরিকল্পনার একটা মহড়া দেওয়া হয় ১৯৬৪-৬৫ সালের নির্বাচনের সময় সম্মিলিত বিরােধীদল (COP) গঠনের মাধ্যমে। কিন্তু এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তার নিজ কর্মসূচি স্থির করে ফেলে আর সে সব কর্মসূচির পক্ষে মতপ্রকাশও করে। জাতীয় পরিষদে ভােটাধিকার বিল আনয়নের প্রতিবাদে ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভার আয়ােজন হয়। ঐ জনসভায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষণা করেন যে, জনগণকে ভােটাধিকার না দেওয়া হলে, এক নাগরিক অসহযােগ। আন্দোলন শুরু করতে ও জনসাধারণকে কর ইত্যাদি প্রদানে অস্বীকৃতি জানাতে হতে পারে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ জনসাধারণের প্রতি লাগাতার আন্দোলন পরিচালনার আহ্বান জানান। ১৯৬৪ সালের ৫ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় সাংগঠনিক কার্যকলাপ দ্রুততর করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা হয়। কমিটি দলের সকল ইউনিটের প্রতি অবিলম্বে সদস্যভুক্তির কাজ শুরুর এবং যথাক্রমে ৩০ জুন, ৩১ জুলাই ও ৩১ আগস্টের মধ্যে ইউনিয়ন, মহকুমা ও জেলা কমিটিসমূহ গঠনের নির্দেশ দেয়—যাতে করে নতুন প্রাদেশিক কাউন্সিল ৩০ সেপ্টেম্বর সম্মেলনে মিলিত হতে পারে।২১ মনে হতে থাকে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী
১০৫
লীগ নতুন করে কিছুটা এগিয়েছে, কেননা খবর পাওয়া যায়, জনজীবনের বিভিন্ন স্তরের লােকজন দলে তাদের নাম লেখাচ্ছে।২২
প্রদেশজুড়ে সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক আরাে জোরদার করার জন্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতারা জেলাগুলিতে ব্যাপক সফর করেন। তাঁরা প্রতিটি জায়গাতেই জনসভায় ভাষণ দেন এবং দলের স্থানীয় কর্মীদের সঙ্গে বেঠকে মিলিত হন। এই সব বৈঠকে শ্রোতাসাধারণের মৌলিক আনুগত্যের প্রতি আবেদন জানানাের প্রয়াস চলে। যেমন, চট্টগ্রামে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “এ দেশ আমাদের, এ মাটি আমাদের, এই সব নদনদী আমাদের। আওয়ামী লীগ এই দেশের সত্যিকারের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে যাবে।” বরিশালে তিনি বলেন, সামরিক আইনের একমাত্র উদ্দেশ্য হলাে সম্ভব সকল উপায়ে পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করা। পূর্ব পাকিস্তান যখন প্রাকৃতিক দুর্বিপাকে বিধ্বস্ত তখন ইসলামাবাদের বিলাসবহুল রাজধানীর জন্য অকাতরে ব্যয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। তিনি ঘােষণা করেন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সত্যিকার সংগ্রামে অঙ্গীকৃত যে কোনাে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সহযােগিতা করতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তৈরি রয়েছে। তবে তাঁর দল কোনাে দল বা গােষ্ঠীর সঙ্গে কোনাে আঁতাত করবে না। তাঁর এই সব বক্তৃতায় এবং পরবর্তীকালেও প্রায়ই শেখ মুজিব স্বাধীনতা’ শব্দটির ব্যবহার করেছেন যা অবশ্য সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই শব্দ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বাধীনতাকেই সুনিশ্চিতভাবে বুঝিয়েছে।২৩
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ যখন পুর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় চাপ সৃষ্টির জন্য জনমতকে সংগঠিত করার অভিযানে নিয়ােজিত সেই সময়ে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান অনেকটা সীমিত রেয়াত বা ছাড় দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আবেদন জানাচ্ছিলেন। এক বিবৃতিতে তিনি-
সরকারের প্রতি দেশে এমন পরিবেশ তৈরির আহ্বান জানান যে পরিবেশে জনগণ অবাধে তাদের মতপ্রকাশ করতে ও অধিকার অনুশীলন করতে পারে তাতে যতই সীমিত ও অসন্তোষজনকভাবেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হােক না কেন। তিনি অবশ্য আশা ব্যক্ত করেন যে, জাতি তার জনগণের মৌলিক অধিকার অর্জনের জন্য সংগ্রাম বজায় রাখবে এবং সরকারের অদ্ভুত নির্বাচন পদ্ধতি সত্ত্বেও তারা একটি রায় দেবে।২৪
এতে পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে রাজনৈতিকীকরণের স্তরগত ব্যবধানটি সুস্পষ্টরূপে পরিস্ফুট হয়। সরকারের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানী বিরােধীদলের এই রফার মনােভাব কেবল চলতেই থাকেনি বরং শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তানের বিরােধীদলীয় চাপকে লঘুতর করার একটা একটানা প্রয়াসও চলতে থাকে।
তবে সে যাই হােক, কেন ও কেমন করে অত্যন্ত অল্প সময়ে পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ব্যাপক জনমত সংগঠিত করার আন্দোলনে গােটা প্রদেশে বিপুল জনসমর্থন পেতে সক্ষম হয় তার কিছু ব্যাখ্যা নিচের বিবরণ থেকে পাওয়া যাবে।
পূর্ব নির্ধারিত তফসিল অনুযায়ী দলীয় নেতারা গােটা প্রদেশ সফর করেন। স্থানীয় পর্যায়ের দল কর্মীদের সাথে বৈঠকের পরে বা আগে তখন একটি করে জনসভার আয়ােজন
১০৬
করা হয় এবং সাধারণত প্রাদেশিক পর্যায়ের কমপক্ষে তিনজন ও অন্যান্য স্থানীয় নেতা এ সব জনসভায় ভাষণ দেন। সাধারণত একজন নেতা তার গােটা বক্তৃতায় একটি বিশেষ ইস্যু বা বিষয়েই বলতেন। যেমন, খন্দকার মােশতাক আহমদ সব সময়ই তাঁর ভাষণে উল্লেখ করতেন যে, বর্তমান শাসকগােষ্ঠীর আমলে যে অবস্থা চলছে সে জন্য পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়নি (“আমরা কি এই অবস্থার জন্য পাকিস্তান হাসিল করেছিলাম?”)। তিনি আরাে বলতেন যে, জনমত অস্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী। শেখ মুজিবুর রহমান সব সময় বলতেন, পাকিস্তান সাধারণ মানুষের দেওয়া ভােটে সৃষ্টি হয়েছে, আর সে কারণেই জনগণের ভােটাধিকারের অস্বীকৃতি অযৌক্তিক ও উদ্ভট ব্যাপার। আর যে তথাকথিত ‘বিপ্লব’ (১৯৫৮ সালের)-এর কথা বলা হয় সেটি প্রকৃত প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে খাটো করার জন্য সামরিক ও কায়েমি স্বার্থগােষ্ঠীর আঁতাত কর্তৃক একটা লােক দেখানাে ব্যাপার মাত্র। আসলে ঐ সরকার ছিল জনবিরােধী। ফেডারেল রাজধানী স্থানান্তরিত করার বিষয়টি কেবল অযৌক্তিকই নয় নিছক পাগলামি। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সােহরাওয়ার্দীর নির্দেশিত পথেই চলছে। জহিরুদ্দিন সব সময়েই বলতেন যে, বর্তমান সরকার দেশকে শুধু অর্থনৈতিক ও নৈতিক দেউলিয়াত্বের দিকেই ঠেলে দেননি বরং মৌলিক জাতীয় ঐক্য ক্ষুন্ন করেছেন। বরং সে দিক থেকে আওয়ামী লীগই হচ্ছে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির রক্ষক। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের যে দু’জন নেতা ঘন ঘন বক্তৃতা করতেন তারা হলেন শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মােশতাক আহমদ। এঁদের মধ্যে শেষােক্ত ব্যক্তি প্রায় সর্বত্র সাধারণত গুটিকয়েক নির্দিষ্ট বিষয়ে আলােচনা করতেন। তাঁর বক্তৃতার ধরনই এভাবে সীমিত প্রকৃতির ছিল। তাঁর বক্তৃতার বিবরণ থেকে মনে হয় অনেকটাই আগে থেকে তৈরি ভাষণের মতাে। শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণত পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা খর্ব করার ব্যাপারে সামরিক কায়েমি স্বার্থ আঁতাতের ভূমিকা দিয়ে শুরু করতেন এবং তারপর ঢালাওভাবে নানা বিষয়ের উল্লেখ করতেন। ১৯৬৪ সালের মে-জুন এই দুই মাসে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতারা গােটা প্রদেশ সফর করেন। তাতে তাদের আবার সচলতা ও উদ্যমেরই পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁরা এ সময় প্রায় ৫০টি সভায় (জনসভা ও কর্মিসভা) ভাষণ দেন। এ সব সভায় প্রায় ৬০টি বিষয় তারা আলােচনা করেন। এ বিষয়গুলিকে মােটামুটি চার শ্রেণীতে ফেলা যায়। যেমন,
১. পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ: দলীয় পুনরুজ্জীবনের আবশ্যকতা, লক্ষ্য, আদর্শ ও উদ্দেশ্যসমূহ এবং অতীত কার্যকলাপ;
২. সরকার: এর প্রকৃতি, এর সন্দেহজনক সৃষ্টি, পরিচালনায় ত্রুটি ও এর অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যৎ;
৩. গণতন্ত্র: জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জরুরি আবশ্যকতা;
৪. পূর্ব পাকিস্তানের অভাব-অভিযােগ: অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অধীনতা,
সাংস্কৃতিক দলন ও দমন।২৫
১০৭
অধিকার ও সে অধিকারের জন্য সংগ্রামের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করে তােলায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রয়াস বাহ্যত পদ্ধতিসম্মত ও সংগঠিত বলেই মনে হয়। সভা-সমিতিতে জনসমাগম এবং ছাত্রসমাজের সাথে সমঝােতা স্থাপনের দিক থেকে যে সাড়া পাওয়া যায় তা ইতিবাচক ছিল। তবে এ দল কতখানি পরিসরে ফলদায়ক সমর্থনের কাঠামাে গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিল তার যাচাই তখনাে হয়নি। বাস্তবিকপক্ষে, তখনকার প্রচলিত ব্যবস্থায় এ রকম কিছু করার সুযােগ একেবারে ছিলই না বলা চলে। স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিভিন্ন মেয়াদে নির্বাচনে লড়লে সেটাই হতাে যথেষ্ট। কিন্তু এ ধরনের শক্তি যাচাইয়ের মহড়ার জন্য ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের আওতায় পাকিস্তান পদ্ধতিতে যা কিছু বিধিব্যবস্থা ছিল তা পর্যাপ্ত ছিল না। যদিও বিভিন্ন নির্বাচন তখন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং একটি বিরােধীদলীয় ফ্রন্ট এ সব নির্বাচনে প্রতিযােগিতায় অংশগ্রহণ করেছিল, কিন্তু এ সব সত্ত্বেও জনমনােভাবের মেজাজটি প্রচ্ছন্নই থেকে যায়। জুলাইয়ে জুলুম প্রতিরােধ দিবস, কলকারখানা, রেলওয়ে, ডাকবিভাগ ইত্যাদিতে ধর্মঘটের মতাে বিভিন্ন সরকারবিরােধী মনােভাবের বহিঃপ্রকাশমূলক ঘটনাবলির পর্যালােচনা করলে সেই মনমেজাজ ও মনােভাব নির্ণয় করতে অসুবিধা হয় না। তবে এ সব কার্যকলাপের মূলে জড়িত মানুষেরা কিন্তু নির্বাচনগুলির সরাসরি অংশীদার ছিল না। নির্বাচিত ব্যক্তিদের প্রায় সকলেই ছিল মৌলিক গণতন্ত্রী, তারা ছিল একটি সুবিধাভােগী শ্ৰেণী। তাদের নিজ স্বার্থ রক্ষার জন্য স্বভাবতই তারা চলতি ব্যবস্থাকেই কায়েম রাখতে চেয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব সীমিত ভােটাধিকার ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান অবান্তর—এ বিষয়ে সজাগ ছিলেন না তা হতে পারে না। কেননা, তারাই গােড়াতে মতপ্রকাশ করেছিলেন আসন্ন নির্বাচনে দলীয় কর্মীদের অংশগ্রহণ হবে সময় ও শক্তির অপচয়।২৬ কিন্তু এর পরেও বরাবরের রীতি অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সুনিশ্চিতভাবেই ভিন্ন পথে চলছিল। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কয়েকদিন পরে লাহােরে ঘােষণা করেন যে, তাঁর দল শাসনতন্ত্রের গণতন্ত্রায়নের জন্য একটি অভিন্ন ফ্রন্ট গঠন করতে পারে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের হুমকির সাথে তাঁর এ বক্তব্যের সুরের ঠিক মিল ছিল না। কেননা, আওয়ামী লীগের হুমকির ব্যাপ্তি ছিল শাসনতান্ত্রিক গণতন্ত্রায়ন ছাড়িয়েও অনেকদূরব্যাপী বিস্তৃত। আসলেও শাসনতন্ত্রের গণতন্ত্রায়নের বিষয়টির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য খুবই সীমিত। বিশেষ করে, পূর্ব পাকিস্তান এ বিষয়ে যদুর সংশ্লিষ্ট তার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলতেই হয়। পরের ঘটনাবলিও সে কথাই বলে। কেননা, খােদ জহিরুদ্দিন এই সীমিত উদ্দেশ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁর সাথে পূর্ব পাকিস্তান থেকে হাতে গােনা আরাে কয়েকজন। পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের লাইনই বেছে নেন। আর এ কারণে জহিরুদ্দিন বলেছিলেন যে, এ ধরনের একটি অভিন্ন ফ্রন্ট গঠন বিলম্বিত হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতপার্থক্য নিরসনের কাজটিই শুধু জটিলতর হবে—কথাটি তাৎপর্যবিহীন ছিল না।২৭
১০৮
নিখিল পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিও বিরােধীদলগুলির মধ্যে ঐক্যের পক্ষে বক্তব্য দেন। “গণবিরােধী শাসকচক্রের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হানার লক্ষ্যে এক কর্মসূচির ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের মধ্যে কিছুটা সমঝােতা হয় বলেই তখন মনে করা হয়। জানা যায়, আওয়ামী লীগের অনুভূতি ছিল এই যে, প্রয়ােজনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি এ ধরনের কর্মসূচিও চলতে পারে। বলা হয়ে থাকে, মওলানা ভাসানী দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যের জন্য বিরােধীদলগুলির কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। খাজা নাজিমউদ্দিন, চৌধুরী মােহাম্মদ আলীর মতাে অন্যান্য বিরােধীদলীয় নেতাও সম্মিলিত বিরােধী রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষে বক্তব্য দেন যদিও তারা এ ঐক্য কেবল গণতন্ত্রায়নের দাবিতে সীমিত রাখতে চেয়েছিলেন।২৮ এই ধারা প্রবণতা ও পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের স্পষ্ট অগ্রাধিকারের সাথে সঙ্গতি রেখে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ও একই দলের আবদুস সালাম খানকে সকল বিরােধীদলের তরফ থেকে একজন একক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী দাঁড় করানোের সিদ্ধান্তকল্পে আলাপ-আলােচনায় বসার কর্তৃত্ব প্রদান করে এই শর্তে যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত ন্যূনতম উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য যেন বজায় থাকে। সেগুলি হচ্ছে:
ক. পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ ফেডারেল পদ্ধতির সরকার;
খ. সর্বজনীন বয়স্ক ভােটাধিকার ও প্রত্যক্ষ নির্বাচন।
গ. দেশের দুই অঞ্চলের মধ্যে বিভিন্ন বৈষম্য দূরীকরণ এবং পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের জন্য দুই পৃথক অর্থনীতির ভিত্তিতে ভবিষ্যতে নানা উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ;
ঘ. সীমান্ত অপরাধ’সহ সকল প্রকার নিপীড়নমূলক আইন বাতিলকরণ;
ঙ. বিনা বিচারে বন্দী সকল রাজবন্দীর মুক্তিদান; এবং
চ. কর কাঠামাের সংস্কার—যাতে করে মুষ্টিমেয় কয়েক ব্যক্তির হাতে সম্পদ। পুঞ্জীভূত না হতে পারে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীসহ সমাজের গরিব লােকজনের ওপর করভার ক্রমবর্ধিত হারে হ্রাস পায়।২৯
এভাবে লক্ষ্য করা যাবে যে, দলের আঞ্চলিক দাবিদাওয়াগুলিকে জাতীয় স্তর ও মর্যাদায় নিয়ে এসে আঞ্চলিক আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রয়াস (কিংবা জাতীয় স্তরে পূর্ব পাকিস্তানের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বৈধতাদানের প্রয়াস)। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এ ক্ষেত্রে কিছু সাফল্য লাভ করেছিল বলেও মনে হয়। সম্মিলিত বিরােধীদল কপ’৩০-এর ৯-দফা কর্মসূচিতে শাব্দিক মিল না থাকলেও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির উল্লিখিত দফাগুলির সারবস্তু অন্তর্ভুক্ত ছিল। বস্তুতপক্ষে যা ছিল না তা হলাে “দুই অর্থনীতি”—এই শব্দযুগল। এ শব্দগুলি কপ’ ৯-দফা কর্মসূচিতে ব্যবহৃত হয়নি। এ ছাড়াও, এই আঁতাত বা জোটে ন্যাপকে ছাড়িয়ে
১০৯
আওয়ামী লীগের আধিপত্যের বিষয়টি এক ইউনিট বাতিল ও সামরিক জোট থেকে পাকিস্তানের অবিলম্বে প্রত্যাহার-সংক্রান্ত দাবি অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার মাধ্যমে সুনিশ্চিত হয়।৩১
তবে খুব স্পষ্টতই কপ-এর নিজ প্রয়াসে তার শেষাবধি সাফল্য আসবে এ বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তেমন বিশ্বাস ছিল না। আর তাই “সর্বাত্মক ও চূড়ান্ত সংগ্রাম”, “করাে অথবা মরাে” মিশন আর এই প্রক্রিয়ায় অনেককে প্রাণ দিতে হতে পারে, ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হতে পারে বলে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়।৩২ তবু কপ-এর কার্যকারিতায় আস্থার অভাব সত্ত্বেও এ আন্দোলনে আওয়ামী লীগের অংশীদারি কেবল আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়নি। আওয়ামী লীগের, বিশেষ করে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতারা এ আন্দোলনের বাড়তি সুযােগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ নির্বাচনী প্রচার অভিযানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আরাে কাছাকাছি পৌঁছানাের প্রয়াস পেয়েছেন। এ ছাড়াও মিস জিন্নাহ্ প্রকাশ্যে ঘােষণা করেন যে, আইয়ুব খান দেশের দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য জিইয়ে রাখার প্রধান হােতা। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আইয়ুবের উদ্বেগকে “ডাহা মিথ্যা”৩৩ বলে অভিহিত করায় বিষয়টি পূর্ব পাকিস্তানের দাবিদাওয়াগুলি আরাে জোরদার করে তােলায় সহায়ক হয়। কেননা, এখন এ সমস্যাগুলির ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক নেতাদের প্রকাশ্য স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব হয়। মিস ফাতেমা জিন্নাহ ‘কপ’-এর প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন আর পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এই সম্মিলিত বিরােধীদলের শরিক ছিল। এ বিষয়টিও পশ্চিম পাকিস্তানের বিস্তৃত জনশ্রেণীর মাঝে পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নিজ ভাবমূর্তি তুলে ধরতে এক সুযােগ হিসেবে কাজ করে।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতারা পূর্ব পাকিস্তানে মিস জিন্নাহর নির্বাচনী সফরের সঙ্গী ছিলেন। তাঁরা এ সফরে বিভিন্ন জনসভায় আগের মতাে একইভাবে তাঁদের বক্তব্য প্রকাশ করেন। এ সব বক্তৃতা-ভাষণে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেকার বৈষম্যের বিষয় তুলে ধরা হয়। আর সরকার এ বৈষম্য লাঘবে কিছুটা সফলতার যে দাবি করেছেন সেই দাবির তাঁরা চ্যালেঞ্জ করেন। সরকারের এই দাবির বুনিয়াদ হলাে এই যে, তৎকালীন শাসকগােষ্ঠী পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কিছু নীতি গ্রহণ করে পূর্ব পাকিস্তানের উল্লিখিত অভাব-অভিযােগে আনুষ্ঠানিক সাড়া দিয়েছিলেন। আর সরকার সেই ভিত্তিতেই উল্লিখিত দাবি করে। আন্তঃআঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার বিষয়টিকে শাসনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা ও একে ২০ বছরমেয়াদী ভাবী পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য বলে ঘােষণা করা হয়। তৃতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনায় পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানকে বেশি অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করার জন্যেও পূর্বাঞ্চলে পল্লীপূর্ত কার্যক্রম চালু করা হয় বলে দাবি করা হয়। ১৯৬৪ সালে জাতীয় অর্থ কমিশন তাদের রিপাের্টে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিতে। তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি পরিলক্ষিত হয়েছে বলে জানায়। এর পাঁচসালা পরিকল্পনার রূপরেখায় আরাে বলা হয় যে, আন্তঃআঞ্চলিক বৈষম্য কমে যাচ্ছে। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নের
১১০
সূচকে উল্টো ছবি লক্ষ্য করা যায়। তাতে আন্তঃআঞ্চলিক বৈষম্য কেবল থেকে যায়নি তার মাত্রাও বেড়ে যায়।৩৪ সে কারণে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সরকারের কড়া সমালােচনা করে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ একনাগাড়ে বৈষম্যের ব্যাপকতা সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করতে চেষ্টা করে আর কিসের জন্য এ সব ঘটছে সে সম্পর্কেও তথ্য প্রদান করে। আইয়ুব খানের নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতারা এ রকম কিছু বিষয় জনগণের গােচরে আনেন। তাঁরা রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, বন উন্নয়ন কর্পোরেশনের কাঠ আহরণ প্রকল্প, সিলেটে কাগজ কল প্রকল্প, পূর্ব পাকিস্তানের গ্যাস সম্পদের পূর্ণ সদ্ব্যবহার, ঘােড়াশাল সার কারখানা—ইত্যাদি প্রকল্পের বিষয় নজির হিসেবে উল্লেখ করেন। তাঁদের মতে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনােযােগ আকর্ষণ করার জন্যই এ সব নিছক কাগজী প্রকল্প নিয়ে প্রচারণার বাড়াবাড়ি করা হয়। এ অভিযােগও করা হয় যে, সরকার কার্যত পূর্ব পাকিস্তানকে বন্ধক রেখে বিদেশী ঋণ। গ্রহণ করছে। এ ধরনের ঋণের শতকরা ৮০ ভাগ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হলেও এ ঋণের দায়ভার প্রধানত পূর্ব পাকিস্তানকে বহন করতে হচ্ছে কেননা মােট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের শতকরা ৭০ ভাগের বেশি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের উপার্জন। দাবি করা হয় যে, এভাবে পূর্ব পাকিস্তানের উন্নতি বা বিকাশকে সংশ্লিষ্ট স্বার্থান্বেষী পক্ষগুলির স্বার্থে ব্যবহৃত করার ত্রিমুখী পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এই ত্রিমুখী চক্রীদের একটি পক্ষ হলাে, আইয়ুব খানের সরকার, দ্বিতীয়টি পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিদের একটি ক্ষুদ্র গােষ্ঠী এবং তৃতীয়টি বিদেশী ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানসমূহ ও তাদের বিশেষজ্ঞগণ।৩৫
নিঃসন্দেহে উল্লিখিত তথ্যাদি ফাঁসের কারণে পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে আইয়ুব খানের অঙ্গীকারের ব্যর্থতা ধরা পড়ে। এতে তাঁর জনপ্রিয়তা কেবল শহর-নগরবাসীদের মধ্যেই শুধু কমেছে এমন নয়, বরং প্রকৃত পরিস্থিতির কারণে যে অসন্তোষ দেখা দেয় তা কেবল নগরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যেই সীমিত ছিল না। সাধারণ পল্লীবাসী পরিসংখ্যানগত বিস্তারিত তথ্য সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে অবগত না থাকলেও তাদের মনেও এতে বঞ্চনাবােধ গড়ে ওঠে। এ ধরনের একটা বৈশিষ্ট্যময় ভাবানুভূতির প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে কিছু পল্লী কবির কবিতায়। এ ধরনের কোনাে কোনাে কবিতায় শুধু পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অভাব-অভিযােগই তুলে ধরা হয়নি বরং সাধারণ মানুষ যেভাবে বােঝে সেভাবে পাকিস্তানী অর্থনীতির আঞ্চলিক নানা বৈষম্যের এক সজীব চিত্রময় আখ্যানও তুলে ধরা হয়। এই সব সহজ, সরল, স্থূল দেহাতি ভাষায় অবস্থার বর্ণনা আসলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতাই প্রতিফলিত করে। আর সম্ভবত এ সবের কারণেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতারা কিছুটা আশায় থেকেছেন যে, শেষ পর্যন্ত দীর্ঘায়িত এক জনসংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের আন্দোলনে সাফল্য আসবে। এক অগ্রহণযােগ্য নির্বাচন পদ্ধতির আওতায় নির্বাচনগুলিতে অংশগ্রহণের বিষয়টি ছিল সামগ্রিক সংগ্রামের অংশ। তারা তা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর এ সবের মাঝে এ ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়, কেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে
১১১
কপ’ প্রার্থীর পরাজয় ও তাতে মৌলিক গণতন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন চক্রের সম্পর্কের সমীকরণটি উন্মােচিত হওয়ার পরও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনগুলিতে পূর্ণ উদ্যমে প্রচারাভিযান চালায়। শুধু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগই এ কৌশল গ্রহণ করেনি, পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের (পুনরুজ্জীবনের পর) প্রথম কাউন্সিল অধিবেশনে হাজী মােহাম্মদ দানেশ প্রায় একই সুরে কথা বলেন। তিনি বলেন, “আমাদের দলের বক্তব্য হলাে নির্বাচনও একটি আন্দোলন। আর কেবল আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই সংগঠন গড়ে তােলা যায়, সংগঠনকে শক্তিশালী করা যায়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কপ’ পরাজিত হওয়ার পর তিনি স্বীকার করেন যে, ন্যাপ কর্মীরা হতাশ, নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যই ভুলে গেছে। তবে ন্যাপ কর্মীরা এভাবে হতাশ ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লেও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রতিরােধ গড়ে তােলার লক্ষ্যে জনগণের সঙ্গে যােগাযােগের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনগুলিতে পাকিস্তান মুসলিম লীগের স্থান কিছুটা নেমে যাওয়ার নেপথ্যে তাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভূমিকা রয়েছে বলা যেতে পারে। কেননা হাজী দানেশের কথা অনুযায়ী, গণপর্যায়ে যােগাযােগের অভাবে ন্যাপ পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে তেমন লক্ষ্যগােচর ছিল না।৩৭ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে৩৮ পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান মুসলিম লীগের ভােট প্রাপ্তির যে ধারা পরিলক্ষিত হয় তা থেকে এ ব্যাখ্যা অনুমান করা চলে যে, কোনাে কোনাে মৌলিক গণতন্ত্রীকে (সম্ভবত প্রান্তিক সংখ্যায় হলেও) বিরােধীদল সপক্ষে নিতে সক্ষম হচ্ছিল। আর তা না হলে এর অর্থ এও হতে পারে যে, যে ব্যবস্থাটি মৌলিক গণতন্ত্রীদের স্বার্থবাদী সেই ব্যবস্থার রক্ষাব্যুহ মজবুত করে নেওয়ার পর হয়তাে তারা মনে করে থাকবে যে, কিছু স্থানীয় বিদ্রোহীকে একটা ক্লীব আইনসভার অংশ হতে সাহায্য করে বরং তাদের মেজাজ ঠাণ্ডা রাখার একটা ব্যবস্থা হতে পারে।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগাররা এই পরিস্থিতির বেশ বস্তুনিষ্ঠ বিচার-বিশ্লেষণে সক্ষম হয়। এ বিষয়টি খুবই পরিষ্কার হয়ে ওঠে ১৯৬৫ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে। বৈঠকে ঘােষণা করা হয় যে, ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের কাঠামাের মধ্যে গণতন্ত্রায়নের সংগ্রাম চলতে থাকবে।৩৯
জনসাধারণের বিরুদ্ধে সরকার ক্রমাগত নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ১৯৬৫ সালের ৭ জুন তার ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভায় গৃহীত পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করে। ঐ প্রস্তাবে দলের সাধারণ সম্পাদক ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে এক গণআন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন।৪০ নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনার কিছু প্রয়াস লক্ষ্য করা গেলেও তাতে স্পষ্টতই কোনাে ফল হয়নি এবং এমনকি, কোনাে অভিন্ন দলীয় ম্যানিফেস্টো প্রণয়নও সম্ভব হয়নি। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সভাপতিত্বে করাচিতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতাদের
১১২
এক বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের উল্লিখিত সিদ্ধান্তের পুনরুক্তি করেন। এ ছাড়াও, জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এমএনএ কামারুজ্জামান, মিজানুর রহমান চৌধুরী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী প্রমুখ ইতােমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে সরকারের ভূমিকায় অত্যন্ত আক্রমণাত্মকভাবে সােচ্চার হয়ে ওঠেন।৪১ আর এমনি করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ক্রমেই নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরে যায়।
প্রতিশােধমূলক নিপীড়ক ব্যবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগার ও ছাত্রনেতাদের বারংবার গ্রেপ্তার চলতে থাকায় সম্ভবত সেই বিষয়টিই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সংকল্পকে আরাে সুদৃঢ় করে তােলে। তবে সে যাই হােক, কচ্ছের রান এলাকা নিয়ে বিরােধকে কেন্দ্র করে পাক-ভারত বৈরিতা শুরু হলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক নাটকীয় মােড় নেয়। আর তার পরিণতি গড়ায় কাশ্মীরে পাকিস্তানী অনুপ্রবেশকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত পাক-ভারত যুদ্ধে।৪২
এই যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে পাকিস্তানের শাসকচক্রের মনােভাব খুবই স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। ঐ সময় পূর্ব পাকিস্তানীরা উপলব্ধি করে যে, তাদের অঞ্চলটিকে সামরিক দিক থেকে অরক্ষিত রেখে ভারতের করুণার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানীরা এটি বিশ্বাসঘাতকতার শামিল ধরে নেয় আর তা উটের কুঁজে সেই কিংবদন্তীর নলখাগড়া ফুটিয়ে দেওয়ার মতাে কাজ করে। এতে এক পাকিস্তানী জাতীয়তার অতিকথার বেলুন আর দেশের দুই অংশের মধ্যেকার নিকৃষ্ট ঔপনিবেশিক সম্পর্কের চেহারা নগ্নরূপে ধরা পড়ে। যদি অনুমান করা হয় যে অবস্থা এ রকম ছিল না তাহলে বলতে হয়, ভারতের সাথে যে কোনাে সশস্ত্র সংঘাতে গােটা দেশকে রক্ষা করতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী অসামর্থ্য ছিল যদিও পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সামর্থ্য নিয়ে বিস্তর বাগাড়ম্বর হতাে। তাই নিরেট বাস্তবতাটি হলাে, ইচ্ছাকৃত হােক বা পাকিস্তান সরকারের নিদারুণ অসামর্থ্যের কারণেই হােক পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের বসবাস হলেও অঞ্চলটি ছিল প্রতিরক্ষাহীন। আর সরকারের খয়ের খা ব্যক্তিরা যদি দাবি করে থাকেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া রয়েছে বিদেশী শক্তির হাতে তাহলে তার পছন্দ অপছন্দের ভার খােদ পূর্ব পাকিস্তানের হাতে কেন তুলে দেওয়া হয় না যদি না দেশের দুই অংশের মধ্যে বিরাজমান ঔপনিবেশিক সম্পর্ক কায়েমি না করার উদ্দেশ্য থেকে থাকে? যদি পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রচলিত থাকতাে এবং এ ধরনের ইস্যুগুলি নিয়ে কার্যকর আলােচনার জন্য মুক্ত ফোরামের ব্যবস্থা শাসনতান্ত্রিক পন্থায় নিশ্চিত থাকতাে তাহলে রাজনীতি সচেতন পূর্ব পাকিস্তানীরা সুনিশ্চিত ও ন্যায়সঙ্গতভাবে এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারতাে ও করতােও, কিন্তু পাকিস্তানে এ সবের কোনােটাই ছিল না। কাজেই এর একমাত্র বিকল্প ছিল কার্যকর গণআন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে প্রবল জনমত গড়ে তােলা। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এ কাজটিই করতে প্রয়াসী হয়। কাজটা করা হয় ঠিক লােহা গনগনে থাকতে থাকতে আঘাত হেনে ৬-দফা ফর্মুলার মাধ্যমে আবেগের বারুদযুক্ত “স্বায়ত্তশাসন”-এর প্রতীকী লড়াইয়ের অস্ত্র পূর্ব পাকিস্তানের হাতে তুলে দিয়ে।
১১৩
৬-দফার কথা ঘােষণা করা হয় এমন সময় যখন পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেকার সম্পর্ক, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের রূঢ় বাস্তবতার অভিজ্ঞতায় পােড় খেয়ে নবতম নিম্নতম স্তর ছুঁয়েছে। ৬-দফা ফর্মুলা বাস্তবিকপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের লালিত অধিকতর ন্যায্য আচরণ প্রাপ্তির “অভিলাষকে” আর্থ-রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের সুনির্দিষ্ট “দাবিতে” রূপান্তরের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। এই রূপান্তরই পুরাতন ইস্যু নিয়ে নয়া নেতৃত্বের অবদান।
১১৪
ষষ্ঠ অধ্যায়
নয়া কৌশল: ছয়-দফা ফর্মুলা
দেশের দুটি অঞ্চলের মধ্যে একনাগাড়ে অর্থনৈতিক বৈষম্য, সেই সাথে রাষ্ট্রীয় বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগত গরিষ্ঠতার প্রতি পরিপূর্ণ অবহেলা এবং এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐক্য ও সামঞ্জস্য ক্ষুন্ন করার বারংবার অপপ্রয়াসে পূর্ব পাকিস্তানীদের মন গভীর হতাশায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তানের এই অসন্তোষ কেবল শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মাঝেই সীমিত ছিল না—এ কথা আগেই বলা হয়েছে। পল্লীর জনসাধারণের মাঝেও এ প্রতিক্রিয়া ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। তবে অসন্তোষের এই অনুভূতিকে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট দাবিদাওয়ায় রূপান্তরিত করার প্রয়ােজন ছিল। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব পরিষ্কার আভাস দেন যে, তাঁদের দল এ ক্ষেত্রে সর্বাত্মক প্রয়াসী হবে। কিন্তু এই প্রয়াসের কেন্দ্রবিন্দু তখনাে স্পষ্ট হয়নি। সেটা স্পষ্টরূপ ধারণ করল যখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর যে সব তথ্য প্রকাশ পায় তারই আলােকে ছয়-দফা ফর্মুলার আকারে এক প্রস্তাব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তরফ থেকে দেওয়া হলাে। ছয়-দফায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রসত্তার পরিপূর্ণ পুনর্নির্মিতির কথা বলা হয়।
ছয়-দফা ফর্মুলার কথা জনসমক্ষে প্রথমবারের মতাে বলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহােরে পাকিস্তানের বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলির এক কনভেনশনে। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত তাসখন্দ চুক্তির বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানে অসন্তোষের আলােকে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিরােধীদল গঠন ছিল এই সম্মেলনের লক্ষ্য। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গােড়ার দিকে ততটা আগ্রহী না হলেও শেষ পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে দশ সদস্যের এক প্রতিনিধি দল পাঠায়।
শেখ মুজিবুর রহমানের বর্ণনা অনুযায়ী, সম্মেলনের বিষয়-নির্বাচনী কমিটির বৈঠকে তিনি তাঁর কথা অনুযায়ী দেশের দুই অঞ্চলের মধ্যে পারস্পরিক সমঝােতা জোরদার করার উদ্দেশ্য সামনে রেখেই ছয়-দফা প্রস্তাব পাঠ করেন। তাঁর মতে, ছয়-দফা বাস্তবায়িত
১১৫
হলে দেশের ঐক্য ও সংহতি নিশ্চিত হবে। দেশে ফিরে তিনি সাংবাদিকদের কাছে ব্যাখ্যা করে বলেন, ১৭ দিনের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে লব্ধ অভিজ্ঞতার আলােকে বােঝা যায় যে, দেশের জনগণের প্রতি আরাে সুবিচারের স্বার্থে দেশের প্রশাসন কাঠামাে নতুন করে ঢেলে সাজানাে সম্পর্কে নতুন করে চিন্তাভাবনার দরকার। তিনি আরাে উল্লেখ করেন যে, যুদ্ধের ঐ বিভীষিকাময় দিনগুলিতে পূর্ব পাকিস্তানীদের ঐক্যবােধের উপলব্ধির কারণেই দেশের পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মধ্যে যােগসূত্র ও সম্পর্ক রক্ষিত হয়েছে। তিনি যে সব প্রস্তাব করেছেন সেগুলির উদ্দেশ্য হলাে ঐ একই মনােভাবের সংরক্ষণ যাতে করে দেশের একক রাজনৈতিক সত্তারক্ষা নিশ্চিত করা যায়। তাঁর প্রস্তাবগুলির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল:
১. শাসনতান্ত্রিক গ্যারান্টির আওতায় পাকিস্তানে ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামাের প্রতিষ্ঠা যার ভিত্তি হবে ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাব; সরকার হবে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির, থাকবে সর্বজনীন বয়স্ক ভােটাধিকার ও সার্বভৌম আইন পরিষদ।
২. ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়; অবশিষ্ট বিষয়গুলি ফেডারেশনের ইউনিটগুলির হাতে থাকবে;
৩. দুটি পরস্পর বিনিময়যােগ্য মুদ্রা বা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং ব্যবস্থাসহ | একটি মুদ্রা ব্যবস্থা থাকবে। আর থাকবে পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধনপ্রবাহ রােধের শাসনতান্ত্রিক বিধান। ফেডারেশনের ইউনিটগুলির জন্য পৃথক রাজস্ব ও অর্থনীতি থাকবে;
৪. করারােপ ও লেভি বলবৎ করার বিষয় ফেডারেশনের ইউনিটগুলির হাতে থাকবে, কেন্দ্রের হাতে নয়। কেন্দ্র যাতে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় নির্বাহে প্রয়ােজনীয় তহবিলের জন্য প্রদেশগুলির কাছ থেকে সকল কর রাজস্বের একটা অংশ পায় তার শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকবে;
৫. প্রতিটি প্রদেশের জন্য বৈদেশিক বণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি করে পৃথক হিসাব খােলা হবে এবং তারা প্রত্যেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবে তার ওপর তাদের নিজ নিজ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। আর এর একাংশের বরাদ্দ থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের চাহিদা মেটানাের জন্য। দেশে উৎপাদিত পণ্যাদির আন্তঃপ্রদেশ চলাচল বা পরিবহনের বেলায় অভিশুল্কমুক্ত সুযােগ-সুবিধা থাকতে হবে। প্রদেশগুলির বিদেশে বাণিজ্য প্রতিনিধি পাঠানাের এবং সংশ্লিষ্ট প্রদেশের স্বার্থে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা থাকতে হবে;
৬. প্রদেশগুলির জন্য আধা-সামরিক বাহিনী বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী থাকতে হবে।
শেখ মুজিব জানান যে, সম্মেলনের আয়ােজকদের একটি প্রভাবশালী মহল এমনকি তার বক্তব্য শুনতেও অস্বীকৃতি জানায়, ওসব নিয়ে আলােচনা তাে দূরের কথা! আর সে কারণে তিনি ও তাঁর প্রতিনিধি দল ঐ সম্মেলনের সঙ্গে সকল প্রকার যােগসূত্র ছিন্ন করতে বাধ্য হয়েছেন।১
১১৬
পরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশনের প্রাক্কালে তিনি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকালে অর্জিত অভিজ্ঞতার আলােকে তার প্রস্তাবগুলির সিদ্ধতার মূল্যায়নের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ছয়-দফা নিয়ে রাজনৈতিক দরকষাকষির কোনাে অবকাশ নেই। ছয়-দফা কোনাে রাজনৈতিক ভােজবাজি নয়। ছয়-দফা পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষের অস্তিত্বের প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কিত। তিনি যুক্তি দেখান যে, ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের এখনাে বৈধতা রয়েছে। কেননা, ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের ব্যবস্থাপকদের কনভেনশনে ঐ প্রস্তাবে পরিবর্তন আনা হলেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল মূল প্রস্তাবের ভিত্তিতে। ২
১৯৬৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ছয়-দফা ফর্মুলা দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুস সালাম খান, জহিরুদ্দিন, তাজউদ্দিন, হাফেজ হাবিবুর রহমান ও এ. কে. মুজিবুর রহমানকে নিয়ে পুস্তিকার আকারে এই ছয়-দফা ফর্মুলা প্রকাশের জন্য একটি উপকমিটি গঠিত হয়। পরে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ব্যাখ্যামূলক টীকাভাষ্যসহ এটি প্রকাশিত হয়। পুস্তিকার প্রণেতা হিসেবে ছাপা হয় শেখ মুজিবুর রহমান-এর নাম।৩ ১৮ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় পুস্তিকাটি বিতরণ করা হয়। এ পুস্তিকা দলীয় কর্মীদের মধ্যে রীতিমতাে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এ ফর্মুলা ঘােষিত হওয়ার পর কোনাে কোনাে মহল থেকে সমালােচনার একটা ঝড় বইলেও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল। সভায় আগত ১৪৪৩ জন কাউন্সিলর শেখ মুজিবুর রহমানকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তাজউদ্দিন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে। কাউন্সিল সভা ছয়-দফার ভিত্তিতে সংশােধিত দলীয় গঠনতন্ত্রের একটি খসড়া অনুমােদন করে। কাউন্সিল সভার সমাপ্তিসূচক জনসভায় শেখ মুজিব এক শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই ছয়দফা আদায়ের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। ১৯৬৬ সালের ১৯ মার্চ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ উল্লিখিত কর্মসূচিকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে জোরদার করার এবং এ প্রদেশের আর্থ-রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক ও সুপারিশযােগ্য কর্মসূচি বলে বর্ণনা করে এবং এই দাবিও করে যে, এ কর্মসূচি সত্যিকারের আন্তরিকতায় বাস্তবায়িত করা হলে পাকিস্তানের সংহতি অনেক বেশি জোরদার হবে এবং পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের বিকাশে বিপুল অবদান যােগাবে।৪
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ অনুমােদিত ছয়-দফা ফর্মুলাটি নিম্নরূপ:
১. দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রে লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে সত্যিকার ধারণার ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামাের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিশেষ করে, সরকার হবে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির, আর সর্বজনীন বয়স্ক ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সরাসরি ভােটে নির্বাচিত
আইন পরিষদ হবে সার্বভৌমত্বের অধিকারী;
২. ফেডারেল সরকার মাত্র দুটি বিষয় পরিচালনা করবেন। এ দুটি বিষয় হলাে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়। আর অন্য সকল বিষয় ফেডারেশনের ইউনিটগুলির হাতে ন্যস্ত থাকবে;
১১৭
৩. ক) দুটি পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যােগ্য মুদ্রা দুই অঞ্চলে প্রবর্তন করা যেতে পারে; অথবা
খ) গােটা দেশের জন্য একটি মাত্র মুদ্রা রাখা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার বন্ধে শাসনতান্ত্রিক বিধান থাকতে হবে। পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভ রাখতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক রাজস্ব ও মুদ্রানীতি গ্রহণ করতে হবে;
৪. ফেডারেশনের ইউনিটগুলির হাতে করারােপ ও রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে। ফেডারেল কেন্দ্রের হাতে এ রকম কোনাে ক্ষমতা থাকবে না। তবে কেন্দ্র তার নিজ ব্যয় চাহিদা মেটানাের জন্য প্রদেশগুলির করের একটা অংশ পাবে। প্রদেশের সকল করের ওপর একটা নির্ধারিত হারে লেভি থেকে একটা সর্বমােট সুসংহত তহবিল গড়ে উঠবে;
৫. ক) দেশের দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের জন্য দুইটি পৃথক বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রার হিসাব থাকবে;
খ) পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তান
সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে; গ) ফেডারেল সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়ােজন দুই অঞ্চল কর্তৃক সমান হারে অথবা নির্ধারণযােগ্য অনুপাতে দুই অঞ্চল কর্তৃক মেটানাে হবে;
ঘ) দেশজ পণ্য দেশের দুই অঞ্চলের মধ্যে শুল্কমুক্তভাবে অবাধে চলাচল করবে;
ঙ) শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতাবলে ফেডারেশনের ইউনিট সরকারগুলি বিদেশে | বণিজ্য মিশন খুলতে ও বিভিন্ন দেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে;
৬. পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি সামরিক বা আধাসামরিক বাহিনী গঠন করতে হবে।৫
ফর্মুলার মূল বিষয়বস্তু ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। এই দাবিটি বাস্তবিকপক্ষে রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের জন্ম নেওয়ারও আগের। আর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তার প্রথম থেকেই বরাবরই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়ে আসছিল। স্বায়ত্তশাসন পুস্তিকার লেখক শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ছয়-দফা ফর্মুলা জনগণের বিপুল স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া লাভ করেছে কারণ বিষয়গুলি কোনাে নতুন আবিষ্কার” নয় বরং “প্রকৃতপক্ষে জনগণেরই দীর্ঘকালের দাবি, আর তাদের নেতাদের অঙ্গীকারও বটে যা কয়েক দশক ধরে পূরণের অপেক্ষায় রয়েছে।”৬
বিভাগ-পূর্ব ভারতে মুসলিম রাজনীতির প্রকৃতি ও প্রবণতা এবং গােড়ার দিকে থেকেই পাকিস্তানের শাসকচক্রের মনােভাবে ভবিষ্যতে দেশের রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে পূর্বাঞ্চলের অবস্থান
১১৮
কী হবে তা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানী রাজনীতিকদের সন্দেহ ছিল। এমনকি ‘৫০-এর দশকের পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতাদেরও এ সবের প্রতিকার কী হতে পারে সে বিষয়েও কোনাে সন্দেহ ছিল না। তারাও বেশ বাস্তববাদী পথেই ব্যবস্থা গ্রহণের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। এই অর্থে ছয়-দফা ফর্মুলার আকারে যে সব সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেওয়া হয় তার বিশেষ কোনাে নতুন বৈশিষ্ট্য ছিল না।
‘৫০-এর দশকের মধ্যভাগে যখন পাকিস্তানী সমাজের দুটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের বিষয়ে যুগপৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছিল তখন এই প্রবণতাটি বেশ লক্ষ্যগােচরভাবেই কায়েমি হয়। এর একটি ছিল, গণপরিষদ কর্তৃক শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়ন ও অন্যটি হার্ভার্ড উপদেষ্টা গ্রুপের৭ নির্দেশনায় ১ম পাঁচসালা পরিকল্পনা প্রণয়ন। শাসনতন্ত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়া চলাকালে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানী রাজনীতিকেরা, বিশেষ করে, আওয়ামী লীগের রাজনীতিকেরা, যখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অধিকারগুলিকে আইনের বৈধতা দেওয়ার উদ্দেশ্যে শাসনতন্ত্রে যতখানি বেশি সম্ভব গণতান্ত্রিক উপাদান সন্নিবেশের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিলেন সেই সময়েই ১ম পাঁচসালা পরিকল্পনা প্রণয়নকালে পূর্ব পাকিস্তানী অর্থনীতিবিদ ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তি পূর্ব পাকিস্তানের অবনতিশীল অর্থনৈতিক দুর্দশা ও এর প্রতিকারের প্রতি মনােযােগ আকর্ষণে নিয়ােজিত ছিলেন। এই দুই অংশের মধ্যে যােগসূত্র অর্থাৎ একদিকে রাজনীতিকবৃন্দ এবং অন্যদিকে অর্থনীতিবিদ ও বিদ্বজ্জন তথা চিন্তাশীল পূর্ব পাকিস্তানীদের পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তাদের মধ্যে ভাব ও তথ্যবিনিময় ঘটে। এ সবের পরিস্রাবণ প্রক্রিয়ার পথ ধরে সমস্যা সমাধানের এক ধরনের ফর্মুলা ক্রমান্বয়ে গড়ে ওঠে। পাকিস্তানের দ্বিতীয় গণপরিষদে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আওয়ামী লীগের নেতা আবুল মনসুর আহমদ দু’দিনে (১৬ ও ১৭ জানুয়ারি ১৯৫৬) সাত ঘণ্টাব্যাপী বক্তব্য প্রদান করেন। তাঁর আলােচনার বিষয় ছিল: পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরাট ব্যবধানে অবস্থিত দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের আলােকে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের আবশ্যকতা, দুই অঞ্চলের মধ্যেকার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত তারতম্য, এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় আয়ের সিংহভাগ কেবল পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের অপরাধতুল্য অবহেলা এবং বিভিন্ন সরকারি চাকরি/সার্ভিসে পূর্ব। পাকিস্তানী বাঙালিদের ঊনপ্রতিনিধিত্ব। তার গােটা বক্তৃতায় অসংখ্য তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে বক্তব্যকে প্রামাণ্য করা হয় ও তিনি কয়েকটি যুক্তি ও বাস্তবতার কারণে কেবল তিনটি বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রেখে একটি বিকেন্দ্রায়িত সরকার বা শাসনব্যবস্থা কেন প্রয়ােজন সে বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরেন।৮
স্পষ্টত আবুল মনসুর আহমদের বক্তৃতার মূল বিষয় ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য ও এর কারণগুলি। তিনি যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও সরকার কাঠামাের প্রস্তাব দেন সেগুলি ঐ সব সমস্যার সমাধান বলে ধারণা করা হয়। বাস্তবিকপক্ষে, আবুল মনসুর আহমদের ঐ চাঞ্চল্যকর বক্তৃতা ছিল রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের প্রয়াসের যৌথ ফসল। ঐ দলে ছিলেন, পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিসংখ্যান
১১৯
বাের্ডের ড. এ. সাদেক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক ও ড. এএফএ হুসেন। তারা সকলেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে করাচিতে যান এবং সম্মিলিতভাবে ভাষণের প্রধান বিষয়বস্তুগুলি তৈরি করেন। ড. এ. সাদেকই প্রথমবারের মতাে পাকিস্তানের গােড়ার দিকে আন্তঃআঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্য ও এ বৈষম্য একটানা চলতে থাকার কারণগুলি এবং সেগুলির প্রতিবিধান নির্দেশ করেন।৯ এখানে উল্লেখ আবশ্যক, এই দলের দুই সদস্য: রাজ্জাক ও হুসেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিকল্পনা বাের্ডের সদস্যও ছিলেন। তারা পাকিস্তানে পাঁচসালা পরিকল্পনার খসড়ার ওপর অনুষ্ঠিত আলােচনা বিতর্কে অংশগ্রহণও করেন। ড. এএফএ হুসেন ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সরকার নিয়ােজিত অর্থনৈতিক মূল্যায়ন কমিটিরও অন্যতম সদস্য ছিলেন। ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদদের এক বিশেষ সম্মেলনে প্রণীত খসড়া পরিকল্পনার ওপর ইস্ট পাকিস্তান ইকনমিস্টস রিপাের্ট প্রণয়নেও রাজ্জাক ও হুসেন সংশ্লিষ্ট ছিলেন।১০খসড়া পরিকল্পনার অসংলগ্ন পদ্ধতি সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে ঐ রিপাের্টে বলা হয়:
উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য বিশেষ করে কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টির জন্য পাকিস্তান দুটি অর্থনৈতিক ইউনিট মিলে গঠিত—এভাবে ধরতে হবে। তবে বিশেষ কোনাে কোনাে উদ্দেশ্যে, দৃষ্টান্ত দিয়ে যেমন বলা যায়, দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বৈদেশিক সম্পদ সমাবেশ ও নিয়ােজনের জন্য দেশকে একক অর্থনীতির বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।১১
এতে আরাে বলা হয়:
পূর্ব পাকিস্তান সম্পদের ঘাটতি আমাদের অতীতের কারণে তৈরি হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে যে সম্পদ তৈরি হচ্ছিল কিংবা এ অঞ্চলের প্রয়ােজন কী ছিল তার সাথে পাকিস্তানের প্রথম আট বছরের উন্নয়ন এবং বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রার বরাদ্দ ইত্যাদির সম্পর্ক তেমন ছিল না। তাই যা আজকে সবচেয়ে যথার্থ ও উপযুক্ত তা হলাে, ভবিষ্যতের জন্য আমাদের নীতি গ্রহণের বেলায় অতীত অবহেলাকে হিসেবে ধরে সে ঘাটতি পূরণের লক্ষ্য স্থির করা। এ ক্ষেত্রে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য অতীতের নিহিত তাৎপর্য বিস্মৃত হওয়ার কাজটি হবে অদূরদর্শী ও অবাঞ্ছনীয়।১২
১৯৫৬ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান অর্থনীতি সমিতির (PEA) সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তান। আওয়ামী লীগের দুর্ভাবনা ও উদ্বেগের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে আবুল মনসুর আহমদের কথার প্রায় পুনরুক্তি করে বলেন:
পাকিস্তান আজ যে সব অর্থনৈতিক সমস্যার মােকাবেলা করছে তা কেবল খুব জটিল প্রকৃতিরই নয়, বরং কোনাে না কোনােভাবে বলা যায়, এ সমস্যা পৃথিবীর অর্থনৈতিক ইতিহাসে ব্যতিক্রমধর্মী। পাকিস্তান বস্তুতপক্ষে দ্বিঅর্থনীতির দেশ। এ দেশের দুটি ইউনিটের স্বকীয় সুনির্দিষ্ট সমস্যাদি রয়েছে যেগুলির মােকাবেলা আলাদাভাবে ইউনিট বা অঞ্চলভিত্তিতেই করতে হবে।১৩
১২০
পাকিস্তান ইকনমিক অ্যাসােসিয়েশনের সভাপতি জাহিদ হুসেন খসড়া পরিকল্পনা সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের সংশয়ের কথা উল্লেখ করেন। তিনি অবশ্য পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সম্পদ বরাদ্দের বিষয় উল্লেখ করে বলেন এ সমস্যার প্রতিকার সহজেই করা যায়। কেননা:
আজকে মনে হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তান উন্নয়নের পথে এক দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার মতাে অনুকূল অবস্থায় রয়েছে। আপনাদের রাজনৈতিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল। আপনাদের এমন একটি রাজনৈতিক দল (তিনি নিশ্চয়ই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কথাই বলেছেন যে দলটি পূর্ব পাকিস্তানের কোয়ালিশন সরকারে তখন প্রধান অংশীদার ছিল) ক্ষমতায় রয়েছে যা দৃষ্টত সাফল্যের দিক থেকে রেকর্ডের অধিকারী। কেন্দ্রে আপনাদের শক্তিশালী প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত প্রায় সকল দপ্তর আপনাদের নিয়ন্ত্রণে। দেশ বিভাগের আগের শােষণ থেকে আমরা সকলে যে ভীতি ও আতঙ্ক ওয়ারিশ হিসেবে পেয়েছি সেই দুঃস্বপ্ন আর কতকাল পূর্ব পাকিস্তানকে তাড়া করে ফিরবে! আপনাদের নিয়তি রয়েছে আপনাদের হাতে। আমি আপনাদেরকে এ বাস্তবতা উপলব্ধি ও মূল্যায়ন করার জন্য একান্ত বিনীত অনুরােধ জানাই। আমরা একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়ে আমাদের সকল শক্তি ক্ষয় করে পাকিস্তানকে সবল করতে পারবাে না। এ অবস্থার অবসান যদি না ঘটে, তাহলে দিনের পর রাত যেমন আসে তেমনি বিপর্যয়ও আসবে সুনিশ্চিতভাবেই।১৪
জাহিদ হুসেন যা বলতে চেয়েছেন তাত্ত্বিক দিক থেকে তাতে কোনাে খুঁত নেই। কিন্তু যখন পূর্ব পাকিস্তানীরা পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত প্রণেতা সংস্থাগুলিতে থেকে তাদের বিবেচনা প্রয়ােগ করতে গেলেন তখনই পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমি স্বার্থবাদী মহলগুলিতে তার বিরুদ্ধে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। যেমনটা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ওরা তারপর এও সুনিশ্চিত করলাে যাতে ভবিষ্যতে কখনাে আর এমনটি না ঘটে।
পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের তথা বিকাশের নিরিখে খসড়া পরিকল্পনার ফাক ও গলদগুলি তাঁদের কাছে স্পষ্ট ধরা পড়ে যারা খসড়া পরিকল্পনার ব্যাপারে বিরুদ্ধ মতপ্রকাশ করেছিলেন। এই মত প্রধানত অস্ট্রেলীয় অর্থনীতিবিদ কলিন ক্লার্ক (Colin Clark)-এর একটি রিপাের্টের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল। তিনি ‘৫০-এর দশকের গােড়ার দিকে তাঁর এ প্রতিবেদন তৈরি করে পাকিস্তান সরকারের কাছে জমা দিয়েছিলেন। কলিন ক্লার্ক ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চল সফর করার পর তাঁর এই প্রতিবেদন তৈরি করেন। তাঁর এ প্রতিবেদন ছিল এক কূটনৈতিক দলিলবিশেষ যা অস্ট্রেলিয়া সরকারের পররাষ্ট্র বিষয় বিভাগ সরকারিভাবে পাকিস্তান সরকারে কাছে পেশ করে। এ দলিল ছিল “গােপনীয়”।১৫ প্রতিবেদনে১৬ কলিন ক্লার্ক দেশের আধুনিক শিল্পায়নের ক্ষেত্রে পূর্ব । পাকিস্তানকে একটা ভাগ দেওয়ার জন্য অত্যন্ত জোরালাে সুপারিশ করেন ও সেভাবেই বক্তব্য দেন। তার নানা সুপারিশে জোর দিয়ে বলা হয় যে, পাকিস্তানের সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে আধুনিক শিল্প বিকাশ একটা পূর্বশর্ত। তবে সরকার দৃষ্টত এ পরামর্শে কান দেননি। পরে ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এক আইন
১২১
পরিষদ সদস্য জহিরুদ্দিন এ রিপাের্টের বিষয়বস্তু চেপে যাওয়ার ব্যাপারে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তােলেন।১৭ অবশ্য কলিন ক্লার্কের সুপারিশগুলি ১৯৫২ সালের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন কমিটির রিপাের্টে নীতিগতভাবে মেনে নেওয়া হয়। কমিটির রিপাের্টে বলা হয়: “আমাদের অভিমত এই যে, আমাদের সমস্যাগুলির সমাধান খুঁজতে হবে সুষম কৃষিশিল্প উন্নয়ন ও বিকাশের মাঝে।”১৮ তবে অন্তত পূর্ব পাকিস্তান যেখানে সংশ্লিষ্ট সেখানে বা সেই বিষয়ে স্পষ্টতই নীতি নির্ধারকদের ওপর এর কোনাে প্রভাব পড়েনি।
কলিন ক্লার্ক তাঁর সুপারিশগুলি১৯ স্থির করেছিলেন, প্রত্যাশিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি-সংক্রান্ত এক সংখ্যাতাত্ত্বিক অভিক্ষেপ বা হিসাবের ভিত্তিতে। এতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনুযায়ী, শ্রমশক্তিতে কত সংখ্যা বৃদ্ধি প্রত্যাশিত তা নিরূপণ করা হয়। অন্য কথায়, কর্মসংস্থান প্রার্থীর সংখ্যা কত বৃদ্ধি পাবে সেটি বের করা হয়। কলিন ক্লার্কের হিসেব অনুযায়ী, পাকিস্তানে তখন বার্ষিক মােট কর্মসংস্থান প্রার্থী বা অতিরিক্ত শ্রমজীবীর সংখ্যা ৩,০০,০০০ করে। বাড়ার কথা। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে বাড়বে ২,০০,০০০। তিনি আরাে বলেন যে, শ্রমশক্তির ৭০ শতাংশ কৃষিকর্মে নিয়ােজিত। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে কৃষি জমির ঘাটতি ও পশ্চিম পাকিস্তানে পানিসম্পদের ঘাটতির কারণে অনিবার্যভাবেই পল্লীজনপদের বহু শ্রমজীবী মানুষ বেকার থেকে যায়। সেচ ব্যবস্থার যত রকমে উন্নতি সম্ভব সে সব। ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করার পরেও পশ্চিম পাকিস্তান তখনকার। তুলনায় সামান্য কিছু বেশি লােকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবে। আর পূর্ব পাকিস্তানে এখনকার চেয়ে বেশি কোনাে লােকের কর্মসংস্থান সম্ভব হবে না। তিনি আরাে বলেন, “পাকিস্তানের সম্পদের অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবহারের জন্য পূর্ব। পাকিস্তানে ধান, পাট, চা ও নারকেল এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ধান, গম ও ভুট্টা আবাদেই সবচেয়ে বেশি মনোেযােগ দেওয়া উচিত এবং জাতীয় বা প্রাদেশিক পর্যায়ে স্বনির্ভরতা অর্জনের প্রয়াস পরিত্যাগ করা উচিত।” তাঁর মতে:
অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতার নিরিখে কৃষি বহির্ভূত খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে সম্ভাব্য কঠোর প্রয়াস যদি চালানাের কথাই বলা হয় তাহলে পশ্চিম পাকিস্তান শুধু কোনােক্রমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তাল রক্ষা করে চলতে সক্ষম হবে আর পূর্ব পাকিস্তানে কয়েক বছর ধরে কৃষি থেকে জীবিকানির্বাহে প্রয়াসী মানুষের সংখ্যা কেবল বাড়তেই থাকবে। শিল্পোন্নয়নের সকল প্রস্তাবে পশ্চিম পাকিস্তান অপেক্ষা পূর্ববাংলাকে সর্বদা অগ্রাধিকার দিতে হবে আর পূর্ব পাকিস্তানে ফি বছর যে অতিরিক্ত ২,০০,০০০ কর্মসংস্থানকামী মানুষ শ্রমশক্তিতে যুক্ত হবে তাদের জন্য কৃষিবহির্ভূত কর্মসংস্থানের জন্য পরিকল্পনা নিতে হবে।
তিনি আরাে বলেন:
১৯৫১ সালে পাকিস্তানে অকৃষি খাতে কর্মে নিয়ােজিত মানুষের সংখ্যা ছিল ৬.৫ মিলিয়ন অথবা মােট শ্রমশক্তির ৩০%। এ অনুপাত পূর্ব পাকিস্তানের বেলায় ছিল মাত্র ২২% এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বেলায় ৪৬%। অন্যান্য দেশের এবংবিধ রেকর্ডের সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে দেখা যায়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মসূচি যতই বলিষ্ঠ হােক না কেন, শিল্পে নিয়ােজিত ব্যক্তির মােট সংখ্যা বার্ষিক ৩% হারের বেশি বাড়ানাে যাবে না…. ৩% হারে এই বার্ষিক
১২২
প্রবৃদ্ধিতে বছর প্রতি সর্বাধিক যত মানুষের কর্মসংস্থান আমরা বর্তমান অকৃষি খাতে আশা করতে পারি তা হতে পারে পূর্ব পাকিস্তানের বেলায় বার্ষিক ৮০,০০০ ও পশ্চিম পাকিস্তানে বার্ষিক ১,২০,০০০। এটা স্পষ্ট যে, অকৃষি খাতে কর্মসংস্থানের ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তান তার প্রাপ্যের চেয়ে বেশি অংশ পেয়েছে। সে জন্য পূর্ব পাকিস্তানকে সকল শিল্পোন্নয়ন প্রকল্পের বেলায় আনুকূল্য প্রদানে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। যদি আমরা সেটা করিও তারপরেও অবস্থা দাঁড়াবে সম্ভবত এ রকম:
পশ্চিম পাকিস্তান : বার্ষিক শ্রমশক্তির বৃদ্ধি – ১,০০,০০০, অকৃষি কর্মসংস্থান বৃদ্ধি – ১,০০,০০০, কৃষি খাতে জীবন ধারণ প্রয়াসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি – ০.
পূর্ব পাকিস্তান : বার্ষিক শ্রমশক্তির বৃদ্ধি – ২,০০,০০০, অকৃষি কর্মসংস্থান বৃদ্ধি – ১,০০,০০০, কৃষি খাতে জীবন ধারণ প্রয়াসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি – ১,০০,০০০
ঘুরিয়ে কথাটি এভাবেও বলা যায় যে, অন্তত কয়েক বছর ধরে হলেও পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় সমৃদ্ধতর হয়ে উঠবে যখন পূর্ব পাকিস্তান আরাে দরিদ্র হতে থাকবে যতদিন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে আরাে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে না তােলা হয়; অথবা জনসমষ্টির কিছু লােক অন্যত্র না চলে যায়।২০
পরে প্রকাশ পায়, ক্লার্ক পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য যে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন তার প্রতি কর্তাব্যক্তিরা আমল দেননি (যদিও পশ্চিম পাকিস্তান সম্পর্কিত তার কোনাে কোনাে সুপারিশ যেমন, মৃত্তিকার লবণাক্ততা মুক্তকরণ। ও লভ্য পানিসম্পদের সর্বাধিক ব্যবহারের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়)। বরং পাকিস্তানে
স্পষ্টত হার্ভার্ড অ্যাডভাইজরি গ্রুপের পরামর্শে এমন এক প্রবৃদ্ধিমূলক উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করা হয় যার জন্যে (পূর্ব পাকিস্তানের) কৃষি খাতের সম্পদ (পশ্চিম পাকিস্তানের) শিল্প খাতে স্থানান্তর করতে হয়। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানী অর্থনীতির ক্রমাবনতি ঘটতে থাকে। অর্থনৈতিক সম্পদের অসঙ্গত বিলিবণ্টনের কারণে ‘৬০-এর দশকের মধ্যভাগে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক ক্ষোভ ও অভাব অভিযােগ দেখা দেয়। তবে এরও আগে প্রবৃদ্ধি উন্নয়ন নীতি-কৌশলের২১ কুফল খুব বেশি দ্রুত পরিদৃশ্যমান না হয়ে উঠলেও একটি ভারসাম্যহীন জাতীয় অর্থনীতির ফলাফল ‘৫০-এর দশকেই অনেকের নজরে আসে। ড. সাদেক পাকিস্তানের খসড়া প্রথম পরিকল্পনার ঘাটতিগুলি নির্দেশ করে এ বিষয়ে “পুনরায় চিন্তাভাবনা করে দেখার প্রয়ােজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। তিনি অত্যন্ত বিশদ ব্যাখ্যায় বলেন: ভৌগােলিক কারণে দেশের দুই অঞ্চলের মধ্যে শ্রম ও মূলধনের। গতিবিধি প্রায় অসম্ভব থাকায় পাকিস্তানে দুই অর্থনীতির ভিত্তিতে এক অর্থনৈতিক আদর্শের রাষ্ট্র পরিচালনা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আর এটি করতে হলে, তাঁর মতে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একদিকে কেন্দ্রীয় রাজস্ব আয়-ব্যয় ও অন্যদিকে আমদানি-রপ্তানি খাতে অঞ্চল ভিত্তিতে দ্বৈত ভারসাম্য রক্ষার সচেতন প্রয়াস চালাতে হবে। এ ধরনের কোনাে ব্যবস্থা বের করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই যুক্তরাজ্যের সঙ্গে তার তৎকালীন উপনিবেশ যুক্তরাষ্ট্রের যােগসূত্র রক্ষাকারী আর্থ-বাণিজ্যিক কার্যব্যবস্থাটি ছিন্ন হয়ে যায়। কেননা, যুক্তরাজ্য
১২৩
ও তার আমেরিকান উপনিবেশগুলির মাঝে ছিল কার্যত দুই অর্থনীতির ব্যবস্থা। তিনি লেখেন যে:
রাজস্ব ব্যয়ের উপকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে যুক্তরাজ্যে স্থানান্তরিত হয়ে যাচ্ছে এই উপলব্ধিই এক অশান্ত রূপ নেয়, প্রতিনিধিত্ব ছাড়া করারােপ নয়’—এই শ্লোগানে। আর এই শ্লোগান তুলেই আমেরিকানরা একটা দ্বিঅর্থনীতির বাস্তবতায় যুক্তরাজ্যের সঙ্গে তার এক আর্থবাণিজ্যিক ব্যবস্থার বন্ধন ছিন্ন করে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ব্রিটিশ দক্ষিণ আফ্রিকা—অন্য সকল ব্রিটিশ ডােমিনিয়নকে এ ঘটনার পর একাদিক্রমে দ্রুত আর্থ-বাণিজ্যিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। আর সেই পথ ধরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বহুঅর্থনীতি সংবলিত দেশ বহু একক অর্থনীতির দেশ হিসেবে আলাদা হয়ে যায়।২২
ড. সাদেক যা বলতে চেয়েছিলেন তা হলাে, একান্তভাবে ঔপনিবেশিক সম্পর্কের বেলায় যদি এ ধরনের উদার ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় তাহলে অবশ্যই তা পাকিস্তানেও সম্ভব, অন্তত গােটা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে। দেশটির একাংশের স্বার্থ বিকিয়ে অন্য অংশের উন্নয়ন বা সমৃদ্ধির জৌলুসের ব্যবস্থা করা যাবে না। আর ঠিক এ বিষয়টিই ‘৫০-এর দশকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মুখপাত্রদেরকে দেশের দুই অঞ্চলের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্যগুলিকে মনোেযাগের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে এবং পরিস্থিতির দাবির সাথে খাপ খাওয়ানাের জন্য উঁচু মাত্রায় বিকেন্দ্রায়নের ব্যবস্থাসহ পাকিস্তান ফেডারেল রাষ্ট্রের একাধিক ইউনিট আকারে ঐ সমস্যার স্থায়ী সমাধান নির্দেশে অনুপ্রাণিত করে। আবুল মনসুর আহমদ নির্দেশিত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাগুলির (৫০-এর দশকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে যতগুলি বক্তব্য দিয়েছে সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে সর্বাঙ্গীণ ও নিটোল) অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট ও পরিষ্কার বিশ্লেষণ দিয়েছেন ড. এ. সাদেক। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, পাকিস্তানের এক ব্যতিক্রমধর্মী ভৌগােলিক অবস্থানজনিত প্রেক্ষাপটে দেশটির ফেডারেল রাজধানীর অবস্থান, প্রতিরক্ষা ব্যয়, যুক্ত ফেডারেল অর্থব্যবস্থা, এক মুদ্রানীতি, এক বাণিজ্যনীতি, এক মুদ্রা বিনিময় হার, এক শিল্পনীতি—এসব কেমন করে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর প্রতিকূল প্রভাব ফেলছে। যদি এ সবের বদলে পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক দিক থেকে কমবেশি স্বশাসিত করা যেতাে তাহলে “পাকিস্তানের মতাে দ্বিঅর্থনীতিভিত্তিক রাষ্ট্র বিশ্বের যে কোনাে। এক অর্থনীতিভিত্তিক রাষ্ট্রের মতাে সুদৃঢ় ও সুষ্ঠু বুনিয়াদের ওপর দাঁড়াতে পারতাে।”২৩
ড. সাদেক তাঁর লেখায় এই বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন যে, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে ভৌগােলিক বা ভূখণ্ডগত নিরবচ্ছিন্নতা নেই বলেই এ দেশে একক অর্থনীতির কথা বলা হলেও আসলে সেখানে দুই অর্থনীতিই বাস্তবতা। জোর করে তত্ত্বকথার এক অর্থনীতি চাপানাের ফলে দেশের দুই অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য গুরুতর আকার ধারণ করছিল। অথচ বিচক্ষণতার সাথে এ পরিস্থিতির মােকাবেলা করা। হলে দেশের দুই অঞ্চল পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠে পাকিস্তানের সামগ্রিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারতাে। এ কারণে “আওয়ার রাইট টু লিভ” (আমাদের বাঁচার অধিকার) শীর্ষক লেখায় একই সুরে যুক্তি দেখিয়ে উল্লেখ করা হয় যে, পাকিস্তানকে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ
১২৪
করতে হলে দেশটির জন্য এমন নেতৃত্ব দরকার যাদের দূরদৃষ্টি “অসাধারণ রকমে সুদূরপ্রসারী।২৪ এই লেখায় লেখক এ সব কথারই পুনরাবৃত্তি করেছেন যা আগেই বলা হয়েছে, বিস্তৃত কলেবরে সে সবের বিশদ ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে।
বাস্তবিকপক্ষে, ড. সাদেক যা লিখেছেন, ১৯৫৬ সালের গণপরিষদে আবুল মনসুর আহমদ যা বলেছেন, ঐ একই বছর পাকিস্তান অর্থনীতি সমিতির সম্মেলনে আতাউর রহমান খান যা বলেছেন এবং ১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভাঙনপূর্ববর্তী কাগমারী কাউন্সিল অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে মওলানা ভাসানী যা উল্লেখ করেছিলেন এবং অধ্যাপক রেহমান সােবহান ও আতাউর রহমান ‘৬০-এর দশকের গােড়ার দিকে যা বলেছিলেন এগুলিকে ক্রমান্বয়ে দেখলে বােঝা যায় “আওয়ার রাইট টু লিভ” পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রদত্ত ছয়-দফা ফর্মুলাটি এসেছে ড. সাদেক কর্তৃক রচিত “ইকনমিক ইমার্জেন্স অব পাকিস্তান” (Economic Emergence of Pakistan, vol. II)২৫ গ্রন্থে প্রদত্ত পরামর্শসমূহের সরল অনুসরণে।
ছয়-দফা ফর্মুলা এই সত্যকে পরিষ্কার লক্ষ্যগােচর করে তােলে যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের অঙ্গ হিসেবে দু’দশককাল অতিবাহিত হওয়ার পর দেশের পূর্বাঞ্চল আদৌ উপকৃত হয়নি বলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতারা বুঝতে পারেন। তাদের এ উপলব্ধিও ঘটে, তাঁরা যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনের শরিক হয়েছিলেন সেগুলি পূরণ করতে হলে দেশের শাসনতন্ত্রের গ্যারান্টির আওতায় আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষমতা করায়ত্ত করার মাধ্যমে এ বিষয়ের একটা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করতে হবে। এর অর্থ হবে পাকিস্তানী রাষ্ট্রসত্তার পরিপূর্ণ পুনর্নির্মাণ।
ছয়-দফা ফর্মুলার প্রবক্তাদের নিশ্চিত ধারণা ছিল যে, পাকিস্তানী জাতির সংহতি ও প্রগতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলাে পাকিস্তানের প্রধান আর্থ-রাজনৈতিক স্রোতধারা থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। আর এ বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়েছে পাকিস্তানী শাসকচক্রের বিষম আচরণ ও ব্যবস্থা থেকে। পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনচক্রে সর্বদাই আধিপত্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের, বিশেষ করে পাঞ্জাবীদের। এই ফর্মুলাটি প্রধানত দেশের আন্তঃআঞ্চলিক আর্থ-রাজনৈতিক সমস্যাবলির টেকসই সমাধানের মৌলিক নীতি হলেও এতে ৫ কোটি ৫০ লাখ পূর্ব পাকিস্তানীর মনােভাবের ও তাদের বেঁচে থাকার অধিকারের দাবির সত্যিকারের প্রতিফলন ঘটেছে।২৬ এ ছাড়া ছয়-দফা ফর্মুলাতে জাতি গঠনের। সমস্যার মতাে অধিকতর মৌলিক প্রকৃতির সমস্যা সমাধানের রূপরেখাও ছিল!
পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই দেশটির শাসক অভিজাতবর্গ একটি গঠন নির্মিতি বা কাঠামােকে স্থিতিশীলতার নামে শক্তিশালী করে তুলতে চেয়েছে যাতে কেন্দ্রের কর্তৃত্ব ও সে কর্তৃত্বের অলঙ্নীয়তা নিশ্চিত করা যায়। কেন্দ্রের চূড়ান্ত ও সর্বোচ্চ ক্ষমতার বিষয়ে অতিরিক্ত গুরুত্ব আরােপ করার কারণে শাসকগােষ্ঠীতে কার্যকরভাবে প্রতিনিধিত্ব নেই। এমন বিভিন্ন অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক লােকের আর্থ-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আশা-আকাঙ্ক্ষা ক্ষুন্ন হয়। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে সর্বাধিক দূরে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তানই দুর্ভোগ
১২৫
মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে সবচেয়ে বেশি। তবে এ সবের প্রতিকার কী হতে পারে এ নিয়ে আঞ্চলিক দাবিদাওয়া প্রশ্নে, বিশেষ করে, কোনাে কোনাে নীতিগত সাড়ার কারণে বিভ্রান্তি বিরাজ করে (এ বিষয়ে ইতঃপূর্বে অন্যত্র আলােচনা করা হয়েছে)।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এ ধরনের বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ গ্রহণের নিষ্ফলতা বুঝতে পারে, পূর্ব পাকিস্তানের অন্য যে কোনাে রাজনৈতিক গােষ্ঠীর চেয়ে অনেক আগে বিষয়টি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে। তাই এই দলটিই ছয়-দফা ফর্মুলায় অত্যন্ত পরিষ্কার ও প্রাঞ্জল বর্ণনায় প্রথমবারের মতাে সমস্যাবলির একটা বাস্তবায়নযােগ্য সমাধান তুলে ধরে। ছয়-দফা পাকিস্তানী রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যােগ করে আর সেই সাথে পাকিস্তানের রাজনীতিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এক নবপর্যায়ও সূচিত হয়। জাতীয় রাজনৈতিক দলের তথা মুসলিম লীগের একটি বিকল্প সংগঠনের ভূমিকা পালন ও পাকিস্তানে এক রাজনৈতিক জনসমাজ গড়ে তােলা থেকে এ দল এখন প্রত্যয়বলিষ্ঠ এক আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠে যার লক্ষ্য পাকিস্তানের অভ্যন্তরে পূর্ব পাকিস্তানকে এক রাজনৈতিক জনসম্প্রদায় হিসেবে গড়ে তােলা। নিঃসন্দেহে গােটা বিষয়টি ছিল এক ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। তবে এ কথাও সত্যি, পাকিস্তান রাষ্ট্র ও তার রাজনৈতিক ব্যবস্থাও ছিল ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। পাকিস্তানী পরিস্থিতির এই ব্যতিক্রমধর্মিতার বাস্তবতা তথা পাকিস্তানের ইতিহাস ও ভূগােলসঞ্জাত বৈশিষ্ট্য পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন অভিজাতবর্গ কখনাে স্বীকার করেনি। আর সেই কারণেও দেশের আর্থ-রাজনৈতিক সমস্যাবলির ব্যতিক্রমী সমাধানও শাসকচক্রের কাছে কোনাে সুবিবেচনা লাভ করেনি। বরং এ রকম পরিস্থিতিতে যে ধরনের গতানুগতিক বাঁধাধরা প্রতিক্রিয়া দেখানাে হয়েছে তার নমুনা হিসেবে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের এই জবানিরই বরাত দেওয়া যায়: “অস্ত্রের ভাষায় এর জবাব দেওয়া হবে।”২৭
যে রূঢ় বাস্তব পরিস্থিতি পূর্ব পাকিস্তানকে কনফেডারেশনের একটি ইউনিটের মর্যাদা দেওয়ার মতাে এক প্রস্থ দাবিদাওয়া তুলে ধরার পথ দেখায় আসলে তার সৃষ্টি হয় উদ্ভূত কতকগুলি সমাজ-সাংস্কৃতিক, আর্থ-রাজনৈতিক সমস্যা থেকে। তবে এ সব সমাজ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান কেবল কিছু প্রতিবাদী কর্মসূচিতেই নিহিত ছিল না। বরং দেশের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যেকার রাজনৈতিক সম্পর্কের সমীকরণেও একটা পরিবর্তন একান্ত অপরিহার্য ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অভাব অভিযােগের প্রতিকারের জন্য দ্বিবিধ পরিবর্তনের প্রয়ােজন ছিল। এক, রাজনৈতিক ব্যবস্থার আগাগােড়া পরিবর্তন; দুই, কেন্দ্র-প্রদেশ সম্পর্ক পরিবর্তন। প্রথম দফায় বর্ণিত পরিবর্তনের বাস্তবায়ন হলেও তাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দ্বিতীয় দফা পরিবর্তন সাধিত হবে এমন সম্ভাবনা ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসনের যে দাবি ছয়-দফায় রয়েছে তার মাঝেই উল্লিখিত উভয় পরিবর্তনের ভিত্তি নিহিত। সাদেক ও অন্যদের প্রস্তাবিত একটি যুক্তিসঙ্গত আর্থ-রাজস্বনীতি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত বিকেন্দ্রায়িত শাসন পদ্ধতিসহ ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামাের আওতায় ‘৫০-এর দশকে অনুসৃত হলে। তেমন অবস্থায় স্বার্থের সংঘাত সৃষ্ট সমস্যাবলির প্রতিকারসমূহের একটা দাবি-ফর্মুলার
১২৬
আনুষ্ঠানিকীকরণের প্রেরণা খুব সম্ভবত নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতাে কিংবা নিদেনপক্ষে অনেকটা প্রশমিত বা ন্যূনতম পর্যায়ে স্তিমিত হয়ে যেতাে। কেননা, এভাবেই কোনাে একটা চলনক্ষম ব্যবস্থা কাজ করে ও যে কাঠামাের মধ্যে তা কাজ করে সে কাঠামাে বা নির্মিতিও সেটিই টিকিয়ে রাখে। তবে এই ব্যর্থতা, ইচ্ছাকৃত, পরিকল্পিত কিংবা অনিচ্ছাকৃত যা-ই হােক, পরিস্থিতির বাস্তবতা শুধুমাত্র কবুল করলেই পরিস্থিতি বদলায় না। এতে কেবল ঐ পরিস্থিতি সম্পর্কে সমাজের বিভিন্ন অংশের চেতনার ব্যাপ্তি বাড়ে, চেতনা প্রখরই হয়ে ওঠে। ছয়-দফা ফর্মুলার অভ্যুদয় তারই নজির। ‘৫০-এর দশকে এ ছিল অর্থনীতিবিদ, রাজনীতি-সচেতন শিক্ষাবিদ ও ছয়-দফা ফর্মুলার সূচনার জন্য সমবেতভাবে প্রয়াসী কিছু রাজনীতিকের সমন্বয়কর্ম। সামরিক শাসনামলে কমবেশি এরাই একত্রে ধারণাটি আরাে চাঁছাছােলা করে শাণিত, তীক্ষ্ণ, নিটোল করে তােলে। ‘৬০-দশকের মাঝামাঝি নাগাদ ছাত্র ও কোনাে কোনাে বাঙালি আমলা এতে নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট হন। এভাবে সমাজের ব্যাপকতর অংশ এতে সংশ্লিষ্ট না হওয়া অবধি প্রতিকারমূলক প্রস্তাবগুলি বহুলাংশেই কল্পনাবিলাসের পর্যায়ে থেকে যায় কিংবা আরাে সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, ঐ সব ধারণা বাস্তব রাজনৈতিক দাবি হিসেবে অভিব্যক্ত না হয়ে কেবল বাসনা’র চৌহদ্দিতেই আটকে থাকে। বস্তুতপক্ষে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন-পরবর্তী নয়া নেতৃত্বের আশাবাদী বাস্তববােধই ঐ বাসনা’কে পূর্ব পাকিস্তানের দাবি’র ফর্মুলায় রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়।
ছয়-দফা ফর্মুলার বিবর্তন প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায় সম্বন্ধে নানা ধরনের ভাষ্য রয়েছে। এদের একটিতে এই ফর্মুলার খসড়া রচনার কৃতিত্ব দেওয়া হয় আলতাফ গওহরকে আর তিনি নাকি সেটি করেন লাহােরে বিরােধীদলীয় কনভেনশনকে কূটাঘাত করার জন্য। কিন্তু ছয়-দফা ফর্মুলার ক্রমগঠন প্রক্রিয়াটির হদিস বের করার পর মনে হয়, উল্লিখিত সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। যদিও এটি অবশ্য খুবই সম্ভব যে, আইয়ুব খানের একজন একনিষ্ঠ নিশানবরদার হিসেবে গওহর হয়তাে বা শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎসাহ দিয়েছিলেন তার ঐ ফর্মুলাটি আইয়ুববিরােধী লাহাের কনভেনশনে পেশ করতে। আর তার নেপথ্য মতলব ছিল আইয়ুবের সমালােচকদের ভঙ্গুর ঐক্য ভেঙে দিয়ে তাদের দৃষ্টি তাসখন্দ চুক্তির “ভ্রান্তি থেকে সরিয়ে ছয়-দফার “ফলাফলে” আকৃষ্ট করা। আবুল মনসুর আহমদই ছয়-দফার প্রণেতা বলে যে দাবি করা হয়ে থাকে সেটি বরং বেশি বােধগম্য। কিন্তু খােদ আবুল মনসুর আহমদ তা অস্বীকার করেছেন যদিও তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের নামে প্রকাশিত পুস্তিকার লেখক বলে দাবি করেছেন।২৮
আবুল মনসুর আহমদ ও কামরুদ্দিন আহমদ ছাড়াও এ ব্যাপারে কয়েকজন আমলার নামও উল্লেখ করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে রয়েছেন: শামসুর রহমান সিএসপি, ফজলুর রহমান সিএসপি, রুহুল কুদুস সিএসপি, সানাউল হক সিএসপি, একেএম আহসান সিএসপি প্রমুখ। এঁদের মধ্যে তিনজন পরবর্তীকালে তথাকথিত “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়” দোষী সাব্যস্ত হন। ওয়াকেফহাল সূত্রের তথ্য অনুযায়ী লাহাের বিরােধীদলীয় কনভেনশনে
১২৭
যে আকারে ফর্মুলাটি পেশ করা হয় প্রকৃতপক্ষে রুহুল কুদুস সে আকারেই ছয়-দফা ফর্মুলার খসড়া তৈরি করেন আর অন্য আমলারা বিষয়টি জানতেন। তবে তাঁদের কেউ শেখ মুজিবের সাথে রাজনৈতিকভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির কোনাে কোনাে সদস্য এবং মকসুমুল হাকিম, এ. কে. মুসা, সাংবাদিক আবদুল গফফার চৌধুরী ও একজন পূর্ব পাকিস্তানী ব্যাঙ্কার খায়রুল কবির বিষয়টি সম্পর্কে জানতেন। শেষােক্ত ব্যক্তির অফিসে ফর্মুলার খসড়াটি টাইপ করা হয়।২৯
নিঃসংশয়ে বলা যায়, যে সব আমলা শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন তারা সেটি করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের প্রতি তারা নিজেরা ঝুঁকে পড়েছিলেন বলে। তবে তাঁদের জড়িত হওয়ার বিষয়টি সােহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবের নেতৃত্বের মধ্যে পার্থক্য উপলব্ধির কারণে দ্রুততর হয়। তাঁদের ধারণায় পূর্ববঙ্গের সাথে সােহরাওয়ার্দীর কোনাে সামাজিক একাত্মতা না থাকার ফলে তিনি কখনাে তাঁদের সাথে এতাে ঘনিষ্ঠ বিবেচিত হননি যাতে তিনি তাদের নেতা হতে পারেন। এ ছাড়াও সােহরাওয়ার্দীর সাথে এই আমলাদের কখনাে সরাসরি যােগসূত্র না থাকায় শেষােক্তদের আরাে ধারণা হয় যে, সােহরাওয়ার্দী কখনাে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ধারণা গ্রহণের কাছাকাছিও আসেননি কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার মনােভাব কখনাে প্রকাশ করেননি, চেপে রেখেছিলেন।৩০
তবে অনেকে এ ধারণার ব্যাপারে ভিন্নমত পােষণ করতে পারেন কেননা, স্বায়ত্তশাসন ইস্যু প্রশ্নে সােহরাওয়ার্দী সম্পর্কে মূল্যায়ন করে তারা অত্যন্ত স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য অংশ বুঝে পাওয়ার ব্যাপারে তিনি বরাবরই একান্ত আগ্রহী ছিলেন আর বস্তুত সেটিই ছিল স্বায়ত্তশাসনের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু এ সবের পরেও ঐ আমলাদের কল্পিত ধারণার বাস্তবতা ছিল। আর সেটি ছিল নেতা সােহরাওয়ার্দী এবং এই সব আমলা ও অনুরূপ ধারণার অধিকারী অন্যদের মধ্যে যােগাযােগের অভাবের সুনির্দিষ্ট আভাস। এ কারণে যদি এ ধরনের ফর্মুলা এর আগেও প্রণীত হয়ে থাকে কিংবা এ রকম কিছু ভাবা হয়ে থাকে তা সম্ভবত সােহরাওয়ার্দী যতদিন আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন ততদিন যােগাযােগের অভাবে যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে তার প্রচার করা যায়নি। তাই তাদেরকে এমন নেতার অভ্যুদয়ের অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে যার স্থানীয় পর্যায়ে জোরালাে সম্পর্ক রয়েছে, অপেক্ষা করতে হয়েছে তদ্দিন যদ্দিন না পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক ধাচের সম্পর্কটি নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হচ্ছে এবং নয়া নেতৃত্বের এ কথার যথেষ্ট পরিষ্কার উপলব্ধি না ঘটছে যে, সােহরাওয়ার্দীর কৌশল তার বাঞ্ছিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে আর পরিস্থিতির দাবিই হলাে ভিন্ন পন্থা নেওয়ার।
স্বায়ত্তশাসন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গই ছিল। তবু দলের নতুন নেতা সে স্বায়ত্তশাসনের পরিসর সম্পর্কে বিস্তারিত বলার আবশ্যকতা উপলব্ধি করেন। বিশেষ করে এটি এই কারণে যে, তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মােনেম খান দাবি করেছিলেন, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র যদি সােহরাওয়ার্দীর দাবি অনুযায়ী পূর্ব
১২৮
পাকিস্তানকে ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন দিয়ে থাকে তাহলে ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র পূর্ব পাকিস্তানকে শতাংশ স্বায়ত্তশাসনই দিয়েছে। এই কাজটি করা যেতাে দলের জাতীয় বা প্রাদেশিক স্তরে প্রকাশ্য আলােচনার মাধ্যমে। এর অন্য বিকল্প ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ে রুদ্ধদ্বার আলাপ-আলােচনা। বলা হয়েছে, শেখ মুজিব শেষােক্ত পথই বেছে নেন। আর এ প্রক্রিয়ায় রুহুল কুদ্স স্বকীয় উদ্যোগে একটি ফর্মুলা প্রণয়ন করেন। তাতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের একটি রূপরেখাও দেন। তিনি তাসখন্দ চুক্তির পর খসড়াটি শেখ মুজিবকে দেন। পরবর্তীকালে ছয়-দফা ফর্মুলা যে আকার নেয় তাতে সকল দফা তাে ছিলই বরং তাতে নির্বাচিত প্রাদেশিক গভর্নরের জন্য আরেকটি বাড়তি দফাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। স্থির হয়েছিল যে, পাকিস্তানের প্রস্তাবিত ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামােতে এই ফর্মুলা হবে কেন্দ্রপ্রদেশ সম্পর্কের আদর্শ ভিত্তি আর তাই এ ফর্মুলায় কোনাে বিচ্ছিন্নতা বা স্বাধীনতার জন্য কোনাে পরিকল্পিত প্রয়াস নেওয়া হয়নি। এমনকি, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আঞ্চলিক মিলিশিয়া বা সেনাবাহিনীর জন্য যে দফাটি ফর্মুলায় রয়েছে সেটি ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরই ছয়-দফাভুক্ত করা হয়। কেননা ‘৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় এ ধরনের কোনাে ব্যবস্থা না থাকায় পূর্ব পাকিস্তানীরা নিজেদের একান্তই অসহায় ও প্রতিরক্ষাহীন বলে মনে করে।৩১
তাই যখন লাহােরে বিরােধীদলীয় কনভেনশন ডাকা হয় তখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্পাদক শেখ মুজিবের কাছে পাকিস্তানের রাষ্ট্রসত্তার এক বৈপ্লবিক পুনর্নির্মাণের প্রস্তাব ছিল। তিনি এ নিয়ে দলে তার কয়েকজন সহযােগী এবং দলের বাইরে কয়েকজন বন্ধুর সাথে আলােচনাও করেছিলেন। তিনি এ ক্ষেত্রে তখনাে দলের ওয়ার্কিং কমিটিকে আস্থায় নেননি। ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এক বৈঠক নির্ধারিত ছিল। সম্পাদক চাইলে এ বৈঠক পূর্বেই হতে পারতাে। তবে এর বদলে ঐ বৈঠক স্থগিত করা হয় লাহাের কনভেনশনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের যােগদানের সুবিধার জন্য।৩২
বিষয়টি সুনিশ্চিত আভাস দেয় যে, তাঁর ফর্মুলার ব্যাপারে বিরােধিতার কোনাে ঝুঁকিই তিনি নিতে চাচ্ছিলেন না সেটি লাহাের কনভেনশনে উত্থাপনের আগে। কেননা, অন্যথায় ফর্মুলার প্রাকঅনুমােদনের জন্য দলের স্বাভাবিক কার্যকলাপের আওতায় একটি জরুরি বৈঠক ডাকা যেতাে। ওয়ার্কিং কমিটির সকল সদস্য৩৩ তাঁর ফর্মুলার ব্যাপারে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবেন সে বিষয়ে সম্ভবত তিনি নিশ্চিত ছিলেন না যদিও তিনি জনগণের অনুকূল প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সুনিশ্চিতভাবেই আস্থাবান ছিলেন। আর তাই তিনি এমন কুশলী উপায় অবলম্বন করলেন যাতে করে ওয়ার্কিং কমিটির মধ্যে বিদ্যমান সম্ভাব্য বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের পক্ষে ওটা ঠেকানাের কোনাে পথ রইলাে না।৩৪ কৌশলটি ভালােই কাজে দিল। কেননা গােড়ার দিকে অনেকে যারা ফর্মুলার ব্যাপারে অনেকটাই শীতল মনােভাব দেখিয়েছিলেন তাঁরা আর এই পর্যায়ে তেমন বিরােধিতা করতে পারলেন না। এভাবে ওয়ার্কিং কমিটিকে পাশ কাটানাের কাজটি বস্তুত অগণতান্ত্রিক হলেও এ নিয়ে
১২৯
কোনাে প্রশ্ন ওঠেনি, কেননা সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পারস্পরিক সমঝােতা ও সমন্বয়ক্রমে। আর এটির একটি প্রয়ােজনীয় কৌশলগত তাৎপর্যও” ছিল।৩৫
এভাবে লাহাের কনভেনশনে ছয়-দফা প্রস্তাব উত্থাপনের কর্মপদ্ধতিগুলি থেকে আভাস পাওয়া যায়, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট নয় বরং দলের সম্পাদকই কার্যপরিচালনাগত দিক থেকে দলের শীর্ষ অবস্থানে রয়েছেন। আবার কনভেনশনে যখন নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানের সভাপতিত্বে তাসখন্দ চুক্তিবিরােধী প্রস্তাব গৃহীত হয় সেই অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি এ কথাই নিঃসংশয়ে প্রমাণ করে যে, নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নিতান্তই সামগ্রিকভাবে পাকিস্তানী চরিত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হওয়ার দাবিটি অতিকথা, যদিও নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নিজে ব্যক্তিগতভাবে ঢাকায় এসে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে কনভেনশনে যােগ দিয়ে একে সাফল্যমণ্ডিত করার আবেদন জানিয়েছিলেন।৩৬
বাস্তবিকই, শেখ মুজিব ও যারা তাঁর আস্থাভাজন ছিলেন তাঁরা এ ধরনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে, বিশেষ করে, তাদের নিজেদের পায়ের তলার মাটি যথেষ্ট শক্ত কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে অনানুষ্ঠানিক ও অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিতে পারেন না । শেখ মুজিব সম্পর্কে বলা যায়, ফর্মুলার যৌক্তিকতা কিংবা প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তিনি ব্যক্তিগতভাবে নিঃসংশয় ছিলেন। ছয়-দফা ফর্মুলার বিবর্তনশীল উন্মেষের গােড়ার দিনগুলি থেকেই তিনি পাকিস্তানী রাজনীতির বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে এর অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে আবুল মনসুর আহমদ যখন গণপরিষদে ভাষণ দেন তখন তিনিও গণপরিষদের একজন সদস্য ছিলেন। তিনিও তখন মাঝেমাঝেই পূর্ব পাকিস্তানের অনুকূলে কিছু তিক্ত সত্য মন্তব্যও করেন। সাদেক ও অন্যান্য ব্যক্তির পূর্বে উল্লিখিত পটভূমির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং তার সুষ্ঠু নির্ভুলতা ও প্রামাণিকতা সম্পর্কেও তিনি ভালােভাবে অবহিত ছিলেন। তিনি বলেন, সামরিক আইন যদিও দেশে সূচিত প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত ফলকে নস্যাৎ করে দিয়েছে তবু সামরিক আইন, মূল বিষয়গুলির আরাে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, প্রাঞ্জলিকরণ ও পরিশীলন এবং প্রস্তাবিত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাগুলিকে কেন্দ্র করে ধ্যানধারণার বুনট আরাে জোরদার হওয়াকে ঠেকাতে পারবে না। বরং সামরিক আইনের শাসনামলেই আতাউর রহমান ও অধ্যাপক রেহমান সােবহান প্রকাশ্যে সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন’ ও ‘দ্বিঅর্থনীতি’ ব্যবস্থার পক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন। দলের অপেক্ষাকৃত তরুণ কর্মী ফজলুল হক মণি, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, আব্দুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম। খানের মতাে ছাত্রলীগ নেতাদের সাথে শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ তাে ছিলই, তিনি পূর্ব পাকিস্তানী জনসমাজের ঐ স্তরের নাড়িও বুঝতেন যে স্তরটি একাধারে শহরের বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতি সচেতন গ্রামবাংলার মানুষেরও প্রতিনিধিত্বশীল। বস্তুত লাহােরে ছয়-দফা উপস্থাপনের ঠিক আগে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি তার এক বর্ধিত সভায়। একই ধরনের দাবিদাওয়া সংবলিত এক প্রস্তাব পাস করে। বিষয়টি বেশ তাৎপর্যের দাবিদার, কেননা ঐ সভায় “পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য” শীর্ষক একটি নিবন্ধ পাঠ করা
১৩০
হয় ও ঐ নিবন্ধের ওপর আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। সভার আলােচনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, আঞ্চলিক বৈষম্যগুলি মৃদু দরকষাকষি দিয়ে দূর করা যাবে না, এ জন্য পূর্ব পাকিস্তানীদের দৃঢ় প্রতিরােধ গড়ে তুলতে হবে।৩৭ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এ নিবন্ধটি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা দপ্তর থেকে বই আকারে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই পুস্তকের মুখবন্ধটি লেখেন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে মাযহারুল হক বাকী ও আব্দুর রাজ্জাক। এই মুখবন্ধে বলা হয়, বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে ঔপনিবেশিক সম্পর্কের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য গ্রহণযােগ্য নয়।৩৮ সে জন্যই বলতে হয়, ছয়-দফা ফর্মুলা কতখানি ব্যাপ্তিতে আশু সমর্থন লাভ করবে শেখ মুজিব সে সম্পর্কে অবশ্যই অবহিত ছিলেন। সর্বোপরি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান আন্দোলনের একজন সক্রিয় মুসলিম লীগার হিসেবে দেখেছিলেন কীভাবে বাঙালি মুসলমানরা তাদের উন্নততর জীবনযাপনের জন্য নিজস্ব স্বদেশভূমি লাভের সুযােগ গ্রহণের আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন—কেমন করে তা অর্জিত হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত চিন্তাভাবনা না করেই। তাই তিনি জানতেন যে মঞ্চ এখন প্রস্তুত; পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে সিদ্ধান্ত প্রণেতা সংস্থার অভ্যন্তরে যদি কিছু ভিন্নমতের লােক থেকেও থাকে তাহলে তাতে কিছু এসে যাবে না শুধু একবার এ ধারণাগুলি যদি শহর-নগরের রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যায় ও তাদের মাধ্যমে সে ধারণা গ্রামবাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। ফর্মুলার প্রতি জনসমর্থনের বিষয়টি সুনিশ্চিত বলেই ধরে নেওয়া হয়। পরবর্তীকালের ঘটনাবলিতে—যা স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন নামে পরিচিত—এর সত্যতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শােষণ করাটাই অভীষ্টমূলক হতে পারতাে অর্থাৎ এটি উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে পরিকল্পিত পূর্ব পাকিস্তানের শােষণ হতে পারতাে কিংবা এটি কেবল ভ্রান্তিপ্রসূত অভীষ্টের উপায়ও হতে পারতাে অর্থাৎ কিনা বণ্টন সুবিচারের স্বার্থ বিকিয়ে দ্রুততর অর্থনৈতিক শিল্প ও শ্রীবৃদ্ধিকেই উন্নয়নের প্রধান বিষয় বলে গণ্য করা হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তার বাস্তবতা এই যে, ফলস্বরূপ পূর্ব পাকিস্তানকে জাতীয় সম্পদ ও সমৃদ্ধিতে তার ন্যায্য অংশ ও প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হয়। এমনকি, পূর্ব পাকিস্তানের মৌলিক চাহিদাগুলিও পূরণ করা হয়নি। সন্তোষজনক জীবনযাত্রার পরিস্থিতি অনুপস্থিত থাকায় তা পাকিস্তানী জাতিসত্তার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের একাত্মতাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। ১৯৬৬ সাল নাগাদ এ ধরনের বিচ্ছিন্নতা বােধ এতই বিস্তৃতি লাভ করেছিল যে, মুজিব এ দাবি করতে সক্ষম হন: “এখন যেহেতু ছয়-দফা কর্মসূচি আওয়ামী লীগ কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবেই গৃহীত হয়েছে সেহেতু তা জনগণের, বিশেষ করে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে।”৩৯
সত্যিকার অর্থেও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ছয়-দফা ফর্মুলাকে ও এ ছয়-দফা দলীয় কর্মসূচি হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কর্তৃক গৃহীত হওয়াকে স্বাগত জানায়। পূর্ব পাকিস্তানী নেতাদের একাংশ ও পশ্চিম পাকিস্তানী আওয়ামী লীগাররা অবশ্য এ কর্মসূচি সম্পর্কে তাদের নানা সংশয় ব্যক্ত করেন। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে পরবর্তীকালের
১৩১
পটপরিবর্তন থেকে এই প্রবণতাটি পরিষ্কার বােঝা যায়। ছয়-দফা ফর্মুলাকে শেখ মুজিবের “জাতীয় দাবি” বলে উল্লেখকে কার্যত বৈধ বলা যেতে পারে। কেননা পাকিস্তানী জনসমষ্টির ৫৬ শতাংশের তথা সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব করে পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু লাহােরে বিরােধীদলীয় মহাসম্মেলনের পক্ষ থেকে এই ফর্মুলা প্রত্যাখান পশ্চিম পাকিস্তানের সাড়ার বিপরীতে ভাবী ইঙ্গিতবহ ছিল।৪০
ফর্মুলাটি ঘােষণার পরপরই সমালােচনার ঢেউ বয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগের সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম এই ছয়-দফায় পাকিস্তান ভাঙার পরিকল্পনা দেখতে পান। ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক এমএইচ উসমানীর মতে, “ছয়-দফা নিশ্চিতভাবেই দেশের সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করবে।” আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির অন্যতম সদস্য আরশাদ চৌধুরী একে “দেশ ও দল ভাঙার এক অশুভ কর্মসূচি” বলে অভিহিত করেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব কোনাে কোনাে রাজনৈতিক নেতা যারা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের শ্লোগান তুলছে তাঁর বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা সম্পর্কে জাতিকে হুঁশিয়ার করে দেন। পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লুখাের বলেন, তিনি ফেডারেশনের ইউনিটগুলিকে অধিকতর ক্ষমতা দেওয়ার বিরােধী, কেননা সেটি করা হলে কেন্দ্রীয় সরকার পররাষ্ট্রনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়বে। তাঁর বিবেচনায় পাকিস্তানকে একটি কনফেডারেশনে পরিণত করার যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তাতে জাতীয় সংহতি ক্ষুন্ন হবে। তিনি দাবি করেন যে, পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মালিক সরফরাজ ও বেগম আহমদের অভিমতও তাঁর অনুরূপ ছিল। তিনি অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার আয়ােজন-সংক্রান্ত দাবি সমর্থন করেন।৪১
১৯৬৬ সালের মার্চে পূর্ব পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব তাঁর পক্ষকালের সফর শেষে মন্তব্য করেন যে, পূর্ব পাকিস্তান ‘খুব চমৎকার অবস্থায় রয়েছে। সবুর খানের মতাে সরকারি মুখপাত্র এ রকম ধারণা দেওয়ার প্রয়াস পান যে, ছয়-দফা ফর্মুলা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাথাব্যথা নেই। এ সব তারা বলেন ঠিকই কিন্তু এরই মাঝে তাঁদের উদ্বেগও স্পষ্ট ধরা পড়ে। যেহেতু ক্ষমতাসীন শাসকগােষ্ঠীর মুখপাত্ররা ভালাে করেই জানতেন যে, পূর্ব পাকিস্তানী জনসাধারণের মাঝে তাদের বিশ্বাসযােগ্যতা একেবারে নেই বললেই চলে সেহেতু তারা কায়েদ-ই-আযম, সােহরাওয়ার্দী, ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ইত্যাদির ভাবমূর্তির নামাবলি গায়ে চড়ান।৪২ পূর্ব পাকিস্তানীদের কাছে ক্ষমতাসীন গােষ্ঠীর বিশ্বাসযােগ্যতা কার্যত উবে যায় যখন তৎকালীন পাকিস্তানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো মুখরক্ষার চেষ্টা করেন এই বলে যে, সেপ্টেম্বরের যুদ্ধ থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থার আওতায় নিরাপদ রাখা হয়েছে। তিনি পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বলেন:
… এ সব বিবৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সব বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে পূর্ব পাকিস্তানকে দেশরক্ষার দিক থেকে অসহায় করে রাখা হয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। হয়েছে… বস্তুনিষ্ঠভাবে বলতে হয়, আগ্রাসনের শিকার হওয়ার চেয়ে বরং বিচ্ছিন্ন বা
১৩২
আলাদা থাকাই ভালাে… পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার ব্যাপারে আমি কোনাে গােপন কিছু ফাঁস করবাে না। আমি এখন যা বলবাে, তা কোনাে গােপনীয় তথ্য উন্মােচন নয়। বৃহৎ শক্তিবর্গ জানে, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন জানে, সম্ভবত সােভিয়েত ইউনিয়নও জানে, কেন সংঘাত থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে সরিয়ে রাখা হয়েছিল ।… ভারত কেন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর হামলা চালায়নি, সেটি নিজেদেরকেই জিজ্ঞাসা করে দেখুন। কী সেই কারণ? এগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ যা বিবেচনার দাবিদার। দেশের ভবিষ্যতের জন্যও এ সব বিচার-বিবেচনার প্রাথমিক গুরুত্ব রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পূর্ব পাকিস্তানের ওপর আক্রমণ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সাথে চীন গণপ্রজাতন্ত্রের প্রতিনিধিদের ওয়ারশতে আলােচনা ও বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। এ নিয়ে বিচার-বিবেচনাও চলে। ঐ সময়ে পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এই প্রস্তাব নিয়ে আসেন যে, পূর্ব পাকিস্তানকে যুদ্ধের আওতামুক্ত রাখতে হবে। কেন?… আমার এখতিয়ারে সকল দায়িত্বসহকারেই আমি বলতে চাই যে, ভারত তখন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর তর্জনী তুলতেও সাহস করেনি…।
… তবে একদিন গােটা দেশ, জাতি, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ জানবে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়েও পূর্ব পাকিস্তানের কথাই বেশি ভেবেছে।৪৩
এমনি করে পাকিস্তান সরকারের অন্যতম মুখপাত্র হিসেবে জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানীদের কাছে এই তথ্য প্রকাশ করেন যে, পাকিস্তানের শাসকচক্র পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার ভার অধিকতর উত্তম বিদেশীদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছে; কাজেই তাদের চিন্তার কোনাে কারণ নেই।
আবেগ-উত্তেজনা যখন তুঙ্গে তখন এহেন বক্তব্য বরং ছয়-দফা ফর্মুলাকে সকলের কাছে গ্রহণযােগ্য হওয়ার পথকেই প্রশস্ত করে এবং এমনকি যেসব সমালােচক একাধিক কারণে এই ফর্মুলার নিন্দামুখর ছিলেন তারা এর যে নিহিত তাৎপর্য তুলে ধরেন তা-ও উপেক্ষিত হয়।
‘আমাদের বাঁচার অধিকার’ শীর্ষক লেখার উপসংহার অংশে শেখ মুজিব বলেন: আমি যখন বলি, পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হয়ে সেখানেই পুঞ্জীভূত হচ্ছে, আমি তখন আঞ্চলিক কেন্দ্রায়নের কথাই শুধু বলি। আমি তাতে এ কথা বােঝাই না যে, ঐ সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে গণমানুষের হাতে পৌঁছেছে।… আমি এও জানি যে, দেশের মােট সম্পদ গুটিকয়েক পরিবারের হাতে পুঞ্জীভূত হচ্ছে। আমাদের সমাজের পুঁজিবাদী ধাচ না বদলানাে পর্যন্ত এই ধারা চলতেই থাকবে। কিন্তু সমাজ বদলানাের আগে এই আঞ্চলিক শােষণ অবশ্যই বন্ধ হতে হবে। আমি অবশ্য আঞ্চলিক শােষণের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানীদের দোষ দিই না … বরং আমার কথা হলাে ভৌগােলিক অবস্থা ও বর্তমানে অনুসৃত অস্বাভাবিক ব্যবস্থাই এই অবিচারের জন্য দায়ী।৪৪
এতে পরিষ্কার, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করতাে যে যদিও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় অঞ্চলের সাধারণ মানুষ চলতি পাকিস্তানী সমাজের পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কারণে শােষিত হচ্ছে, তবু সে কারণে পূর্ব পাকিস্তানের দুর্দশা আঞ্চলিক অবিচারের কারণে
১৩৩
আরাে বেশি। ছয়-দফা কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল প্রাগুক্ত সমস্যা দূর করার শর্ত হিসেবে শেষােক্ত সমস্যার নিরসন। পাকিস্তানে উল্লিখিত পুঁজিবাদী ধাঁচের সমাজ পুনর্নির্মাণের লক্ষ্য স্পষ্টতই এই ছয়-দফা কর্মসূচির ছিল না। বরং এর লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রসত্তার শাসনতান্ত্রিক পুনর্নির্মাণ । তাই স্বাভাবিক কারণেই পাকিস্তানের বৈপ্লবিক সামাজিক পরিবর্তনের প্রবক্তাদের তা মনঃপূত হয়নি। তবু এতে অস্তিত্বশীল পুঁজিবাদী ধারার অভিশাপ ও মন্দ দিকের উল্লেখ ও নতুন সমাজ ব্যবস্থাকে এর স্থলবর্তী করার প্রয়ােজনীয়তার প্রতি আভাসইঙ্গিত, বিশেষ করে, কিছু পশ্চিম পাকিস্তানীর তরফ থেকে এই কর্মসূচির প্রতি অনুকূল সাড়ার কারণে—সে সাড়া যতই সীমিত হােক না কেন—সেখানকারই কিছু রক্ষণশীল নেতা আঁতকে ওঠেন। পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের করাচি শাখা তার ১৯৬৬ সালের ১৫ই মার্চের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয়-দফা ফর্মুলার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। বৈঠকে বলা হয়, বিষয়টি নতুন কিছুই নয়। করাচি আওয়ামী লীগের সভাপতি মঞ্জুরুল হক ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে অংশগ্রহণকালে সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন, গােড়ার দিকে পশ্চিম পাকিস্তানে ছয়-দফা নিয়ে ভুল বােঝাবুঝি হলেও, নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জহিরুদ্দিন বিষয়টি ব্যাখ্যা করার পর ছয়-দফাকে এখন এখানে তার যথার্থ পারম্পর্যেই দেখা হচ্ছে। তিনি আরাে বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানীরা অপেক্ষাকৃত কম রাজনীতি সচেতন হলেও, গণতন্ত্রের ডাক ঠিকই তাদের কাছে পৌঁছেছে। কাজেই আমি আমার পূর্ব পাকিস্তানী ভাইদের এই আশ্বাস দিতে পারি যে, ছয়-দফা আদায়ের জন্য একবার পূর্ণাঙ্গ আন্দোলন শুরু হলে আপনারা দেখবেন, পশ্চিম পাকিস্তানীরা আপনাদের পাশে রয়েছেন। করাচি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তিরমিযী একই মনােভাব ব্যক্ত করে এই প্রশ্নটি ছুঁড়ে দেন: পাকিস্তানের দুইটি অংশে কি সােনার দর ভিন্ন নয়? সেটি কি দুই আলাদা অর্থনীতির অস্তিত্বের কথা বলে না? আরেক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তিরমিযী বলেন, পূর্ব পাকিস্তানী নেতারা গােটা দেশের আর্থ-রাজনৈতিক, ভৌগােলিক ও প্রতিরক্ষা চাহিদা বিবেচনায় রেখে ছয়-দফা প্রস্তাব রচনা করেছেন। আশা করা যায়, অচিরেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা এই ফর্মুলার কার্যকারিতা উপলব্ধি করবেন এবং ছয়-দফার প্রতি তাদের পরিপূর্ণ সমর্থন জানাবেন। তিনি এও মন্তব্য করেন যে, ছয়-দফা যেহেতু অসংখ্য নিপীড়িত মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যাভিসারী সেহেতু এক শ্রেণীর কায়েমি স্বার্থবাদী, বিশেষ করে, কোনাে কোনাে পুঁজিপতি এর বিরােধিতায় নেমেছেন। ওরা চিরকালই জনগণের যে কোনাে কল্যাণ প্রয়াসকে সর্বদাই চক্রান্ত বলে অভিহিত করেছে, তাই ছয়-দফার বেলায় তার ব্যতিক্রম হতে পারে না।৪৫ এ থেকে সুনিশ্চিত বােঝা যায় যে, অন্তত কোনাে কোনাে পশ্চিম পাকিস্তানী বুঝতে পেরেছিলেন ছয়-দফা বহুল প্রত্যাশিত সমাজ পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। অবশ্য এই ছয়-দফায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এ ধরনের পরিবর্তন আনার কর্মপন্থা কী হবে তার নির্দেশ ছিল না। শেখ মুজিব কেবল বলেছিলেন, শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের জন্য দেশে অসাধারণ ব্যাপ্তির দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃবৃন্দের প্রয়ােজন রয়েছে।৪৬
১৩৪
বাস্তবিকপক্ষে পাকিস্তানের একেবারে গােড়া থেকেই প্রয়ােজন থাকলেও এই অসাধারণ ব্যাপ্তির দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব দেশটির ছিল না। কেননা, পাকিস্তানে রাষ্ট্র ও জাতি গঠনের জটিল কাজটি পাকিস্তান আন্দোলনের নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য, পাকিস্তানের ভূগােল, ভৌগােলিকভাবে বিরাট ব্যবধানে অবস্থিত দেশের দুই ইউনিটের স্ব স্ব জনসমষ্টির রাজনৈতিক চেতনাস্তরের পার্থক্য এবং পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনচক্রের পটভূমি ও গঠনবিন্যাস ইত্যাদির কারণে জটিলতর হয়ে ওঠে। পাকিস্তানে জাতি গঠনে সমস্যাবহুলতার কারণে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী নেতৃত্বের উচিত ছিল দেশের কল্যাণে নতুন করে সব কিছু চিন্তাভাবনা করে দেখার এবং অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ার। কিন্তু সেটি না করে তারা এমন পথ বেছে নেন যা সীমিত মেয়াদে তাদের ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করে মাত্র। তারা অন্যান্য বহু নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের মতাে বাহ্যত এমন এক উন্নয়নের মডেল বেছে নেন যার পূর্বশর্ত ছিল রাজনৈতিক গণতন্ত্র ও জনগণ অবধি অংশীদারির সম্প্রসারণের আগেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। তাঁরা বাহ্যিক টেকসই অবস্থার প্রয়ােজনীয় পূর্বশর্ত হিসেবে স্থিতিশীলতাকেই অগ্রাধিকার দেন। সংক্ষেপে এর অর্থ ছিল জাতি গঠনকে পিছে রেখে আগে রাষ্ট্র গঠন। আর এই ব্যবস্থা বা পদ্ধতির সাথে ছিল বৈদেশিক সাহায্য, ঋণ সহায়তা গ্রহণ ও তাদের সাথে আঁতাত তত্ত্ব। বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্যগ্রহীতা দেশগুলির সাহায্যদাতা দেশগুলির ওপর বড় রকমের নির্ভরশীলতার সম্পর্কের নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতার প্রয়ােজনে চলতি কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার কাঠামােটিকেও বহাল রাখা ও সংহত করার প্রয়ােজন হয়। তাই এ ক্ষেত্রে কোনাে প্রকারের নিরীক্ষা আর সেই অবকাশে কোনাে নতুন ও অজ্ঞাত পরিচয় উপাদানের উল্লিখিত ব্যবস্থায় ঢুকে পড়ার আশঙ্কাকে সুনজরে দেখা হয়নি। আর এই প্রক্রিয়ায় তাই পদ্ধতির সামরিকীকরণই প্রায় স্বাভাবিক অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে।
‘৬০ দশকের পাকিস্তানে ঐ দেশের ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক অভিজাতকুল গঠিত ছিল আমলাসামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে। তারা তাদের ক্ষমতা কায়েমি রাখতে অন্য যে কোনাে ক্ষমতাসীনচক্রের মতােই কাজ করে। এটি করা হয় স্থিতিশীলতা রক্ষা, ভারতের হাত থেকে রক্ষা ও দ্রুততর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অজুহাতে। পাকিস্তানের বিভিন্ন মিত্রদেশ বিভিন্ন কারণে পাকিস্তানের এই কৌশলের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন জানায় আর এ প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানী পরিস্থিতির একান্ত স্বকীয়ত্ব সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়। আত্তীকৃত জাতীয় সংহতির নিশ্চয়তা বিধানের পদ্ধতির অপ্রযােজ্যতা উপেক্ষা করা হয়। এর ফলে ১৯৬৮-৬৯ সালে দেশের উভয় অংশেই বিশৃঙ্খল অবস্থা চরম শিখরে পৌঁছে।
এই ব্যবস্থার সম্ভবত অন্যতম শিকার পূর্বাঞ্চলে এ সবের প্রতিক্রিয়া বরাবরই খুবই লক্ষণীয়। তবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তার ছয়-দফা ফর্মুলার সুবাদে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবিকে একটা সুনির্দিষ্ট কেন্দ্রবিরােধী ভূমিকায় রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়। এর ফলে পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রাও যুক্ত হয়। এ পর্যায়ে কোনাে এক ধরনের প্রত্যক্ষ আন্দোলন পদ্ধতি অনিবার্য হয়ে ওঠে। আর তারই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় ছাত্রলীগের পূর্বোক্ত প্রকাশনায়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বিদ্রোহাত্মক
১৩৫
এই মনােভাব লক্ষ্য করে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের সূচনা করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দল ও মুখপাত্র হিসেবে নিজ অবস্থান মজবুত করতে সক্ষম হয়।
১৩৬
সপ্তম অধ্যায়
স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন
১৯৬৬ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন শুরু হয়। তবে বাস্তবিকপক্ষে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এর সূচনা করেছিল ১৯৬৪ সালে। এ দলের পুনরুজ্জীবনের পর থেকে আন্তঃআঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার জন্য শান্তিপূর্ণ পন্থায় চূড়ান্ত প্রয়াস চালানাের লক্ষ্যে প্রদেশে এক ব্যাপকতর সমর্থনের বুনিয়াদ ব্যাপকতর করার জন্য। অবশ্য ছয়-দফা ফর্মুলাই সংশ্লিষ্ট দাবিগুলিকে সুনির্দিষ্টভাবে মনােযােগের পাদপ্রদীপের সামনে নিয়ে আসে ও জনমত সংগঠনকে দ্রুততর করে তােলে।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ যখন ছয়-দফা কর্মসূচির১ পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে নিজের উদ্যম ও শক্তিকে সংহত ও কেন্দ্রীভূত করছিল তখন সরকারও অতি উদ্বিগ্ন হয়ে পরিস্থিতি নিয়ে যৌক্তিক চিন্তাভাবনা না করেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। সাঁড়াশী আক্রমণ শুরু করে। একদিকে, সরকার ছয়-দফার প্রবক্তাদেরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী” বলে পূর্ব পাকিস্তানীদেরকে এর পরিণতির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার করে দেয়—অন্যদিকে জনমত আরাে সংগঠিত করা ঠেকাতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীদের ধরপাকড় শুরু করে এবং স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের জনপ্রিয়তা সম্পর্কিত খবরাখবর প্রকাশ বন্ধ করার জন্য খবরের কাগজের ওপর বিধিনিষেধ আরােপ করে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট যিনি কনভেনশন মুসলিম লীগেরও প্রধান ছিলেন তিনি তাঁর পূর্ব পাকিস্তান সফরকালে ধারাবাহিকভাবে প্রদত্ত বিভিন্ন ভাষণে পূর্ব পাকিস্তানীদের এ রকম ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেন যে, ছয়-দফা সমর্থকরা বিচ্ছিন্নতাবাদী। তাদেরকে সমর্থন দিলে পূর্ব পাকিস্তানীরা শেষ পর্যন্ত ভারতের ফাঁদে পড়বে। তিনি ছয়-দফাওয়ালাদের ধ্বংস করার জন্য প্রয়ােজনে “অস্ত্রের ভাষা প্রয়ােগের হুমকি দেন।২ কিন্তু এ সব সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সূচিত স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ আন্দোলনের প্রকৃতি দেখে বােঝা যায় যে, এর আগে যে সব কেন্দ্রবিরােধী আন্দোলন হয়েছে সেগুলি থেকে এটি লক্ষণীয়ভাবেই ভিন্ন চরিত্রের। এ আন্দোলন আর মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে সীমিত থাকলাে না।
১৩৭
জীবনের সকল স্তরের মানুষ, রিক্সাওয়ালা, কলকারখানার শ্রমিক, ক্ষুদে দোকানদার, বাস-ট্যাক্সি-বেবিট্যাক্সি চালক, দিনমজুর সকলে এ আন্দোলনের বিক্ষোভে শরিক হয়। শান্তি বজায় রাখার জন্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের বারংবার আবেদন সত্ত্বেও বিক্ষোভে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ এ স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে এক আক্রমণাত্মক, বেপরােয়া উপাদান যােগ করে। থানা, ব্যাংক, সরকারের প্রশাসনিক দপ্তরের ভবনাদি এবং সরকারপন্থী সংবাদপত্রগুলি মাঝে মাঝেই আক্রান্ত হতে থাকে কোনাে সংগঠিত সহিংস আন্দোলনজনিত কারণে নয় বরং এ সব ঘটে প্রধানত সরকারের নিষ্ঠুর পুলিশী নির্যাতন-নিপীড়ন ও দমনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া হিসেবে। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে অভিযােগ রয়েছে যে, খােদ সরকার পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে কলঙ্কিত করার জন্য এ সব ঘটনা পরিকল্পিতভাবে ঘটায়।৩
আন্দোলনে জনসাধারণের অংশগ্রহণকে ঠেকাতে না পেরে সরকার মাত্র একটি অভিযানেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির ৩৭ সদস্যের প্রায় সকল সদস্য, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অন্যান্য বিশিষ্ট নেতা, ছাত্রলীগ ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতাকে পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৩২ বিধির আওতায় গ্রেপ্তার করে।৪ ১৯৬৬ সালের ১৩ মে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ এই সব ধরপাকড়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে প্রতিবাদ দিবস পালন করে। ঐ একই দিনে অনুষ্ঠিত এক জনসভা ছয়-দফা কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। যারা সরকার গৃহীত ব্যবস্থাদির বিরুদ্ধে বলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন এনডিএফ-এর চেয়ারম্যান নুরুল আমিন ও ঢাকার মৌলিক গণতন্ত্রীরা।৫
১৯৬৬ সালের ৩০ মে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এক বৈঠকের পর দলীয় সংগঠন বেশ পরিকল্পনামাফিক অগ্রসর হয়। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন প্রদেশব্যাপী হরতাল ডাকা হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী, এমএনএ (ও মূলত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক) সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে সকলের প্রতি এ হরতালকে সফল করার আহ্বান জানান। পুলিশ একটি ছাপাখানা থেকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কিছু পােস্টার বাজেয়াপ্ত করায় এবং আওয়ামী লীগ কর্মীদের বেআইনি আটক রাখায় সরকারের সমালােচনা করে তিনি সরকারকে মনে করিয়ে দেন যে, পাকিস্তান যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত৬ হয়েছিল জনসাধারণ সেগুলির ব্যত্যয় হতে দেবে না। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মােনেম খানও পাল্টা বিবৃতি দেন। তবে শিল্পশহর নারায়ণগঞ্জে এক জনসভায় মােনেম খানের ভাষণ দেওয়ার সময় এ বিষয়ে জনগণের মনােভাব কী তার বড়রকমের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ঐ সভায় জনতা স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের অনুকূলে শ্লোগান দেয় এবং এই আন্দোলনের সমালােচনার প্রতিবাদে তারা সভাস্থল ছেড়ে চলে যায়। এই জনসভায় আরাে অনেকের মধ্যে ঢাকা নগর মুসলিম লীগের (কনভেনশন) সভাপতি শামসুল হুদাও বক্তৃতা করেন। উভয় বক্তাই হরতাল পালন না করার আহ্বান জানান।৭ এমনিভাবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ আহুত হরতাল কায়েমি কর্তৃপক্ষের প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়।
১৩৮
ঢাকায় ও অন্যত্র সভাসমিতি, পথসভা, ঘরােয়াসভা ও মিছিলের মাধ্যমে উক্ত হরতালকে সফল করে তােলার প্রস্তুতির জন্য যখন ছাত্র, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লােকজন ও কর্মীরা সমবেতভাবে কাজ করছিল তখন মিজানুর রহমান চৌধুরী সংবাদপত্রে আরাে এক বিবৃতিতে শান্তিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেন। আর প্রাদেশিক পরিষদের পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নয়-সদস্য এক যৌথ বিবৃতিতে দমন-নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া কতদূর গড়াতে পারে সে ব্যাপারে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন।৮
পরিকল্পিত হরতালের পূর্বাহে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান। চৌধুরী রাজনৈতিক দলমত ও সামাজিক মর্যাদা নির্বিশেষে পূর্ব পাকিস্তানের সকল শ্রেণীর মানুষের প্রতি আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় বলেন, “যা-ই ঘটুক না কেন, আমরা আমাদের লড়াই চালিয়ে যাবাে।” পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামও ছয়-দফার জন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সকল গণতান্ত্রিক সংগঠনের সহযােগিতা কামনা করেন।”৯
দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া) এ আন্দোলনে জনসাধারণের সাড়াকে উল্লিখিত উদ্দেশ্য অভিমুখে এক সম্মুখ পদক্ষেপের সুনিশ্চিত আভাস বলে বর্ণনা করেন। তিনি উল্লেখ করেন, “যদিও প্রতিক্রিয়াশীলরা অতীতের মতােই বিধিনিষেধ আরােপক ব্যবস্থাদির পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে এবং মাত্র একটিবারের জন্য হলেও ইতিহাসের পুরানাে পাতায় দৃকপাত মাত্র না করেই ন্যায়সম্মত গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে তবু এবার জনগণ তাদের পূর্ণ অধিকার আদায়ে সংকল্পবদ্ধ।”১০
১৯৬৬ সালের ৭ জুনের হরতাল সম্পর্কে খবরের কাগজে একমাত্র সরকারি ভাষ্য ছাড়া কোনাে কিছু ছাপার অনুমতি না দেওয়া হলেও, সবাই জানতাে যে হরতাল সর্বাত্মক সফল হয়। কিন্তু সরকার পরিকল্পিত গুণ্ডামির আশ্রয় নেয় এবং কোনাে কোনাে জায়গায় গুলি চালানাে হয়। এতে বেশ কিছু লােকের প্রাণহানি ঘটে। এ সব উস্কানির মুখে জনসাধারণের আক্রমণাত্মক মনােভাব বেপরােয়া পর্যায়ে চলে যায়। তারা পুলিশের গাড়ি পােড়ানাে, পুলিশ ফাঁড়ি ও সরকারি অফিস ইত্যাদিতে ইটপাটকেল নিক্ষেপের মতাে কিছুটা মাত্রায় সহিংসতার আশ্রয় নেয়।১১ অবশ্য সুদীর্ঘ সরকারি প্রেসনােটে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে সহিংস ঘটনার সূত্রপাত করার জন্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের লেলিয়ে দেওয়া সমাজবিরােধীদের দায়ী করে নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনাকে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা বলে বর্ণনা করা হয়।১২ তবে সরকারের এই প্রেসনােট জনচিত্তে তেমন কোনাে রেখাপাত করতে সমর্থ হয়নি বলেই মনে হয়। পূর্ব পাকিস্তানে বিরােধীদলীয় সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া খুবই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন বাজেট অধিবেশনের তৃতীয় দিনে বিরােধীদলগুলির সকল সদস্য ও নির্দলীয় গ্রুপ প্রাদেশিক পরিষদ বর্জন করে। পাকিস্তানের সংসদীয় ইতিহাসে এ ধরনের পরিস্থিতি নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করা হয়।১৩
১৩৯
বিধিনিষেধমূলক আদেশ-নির্দেশ সত্ত্বেও এ সব ঘটনা সম্পর্কে ঢাকায় কোনাে কোনাে খবরের কাগজে উল্লেখ করা হয়। তফাজ্জল হােসেন লেখেন, “ছয়-দফা আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গৃহীত নিষ্ঠুর ব্যবস্থাদির কারণে মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে একমাত্র সান্ত্বনার বিষয় হলাে এই যে, জনসাধারণ ছয়-দফা আন্দোলন তথা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে তাদের নিজেদের আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করেছে।” একদা রক্তপাত যেমন ভাষা আন্দোলনের সাফল্যের পথ রচনা করেছে, রক্তপাতে সূচিত স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনেও, তাঁর মতে, সাফল্য এখন সুনিশ্চিত।১৪ তফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া) যিনি ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউটের পাকিস্তান শাখার চেয়ারম্যান ছিলেন তাঁকে এ সব কথার জন্য মূল্য দিতে হয়। তাঁকে ১৯৬৬ সালের ১৬ জুন পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৩২(১) ধারার আওতায় গ্রেপ্তার করা হয় এবং ‘দ্য নিউনেশন প্রিন্টিং প্রেস’ নামে ছাপাখানা যেখান থেকে দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা টাইমস ও পূর্বাণী প্রকাশিত হতাে বাজেয়াপ্ত করা হয়।১৫
দ্য টাইমস (লন্ডন) পত্রিকা সঠিকভাবেই অনুমান করে যে, ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের হরতাল সরকারের সঙ্কটকে ঘনীভূত করবে, সরকারের হরতাল ভাঙার প্রয়াসে সহিংসতা অনিবার্য হয়ে উঠবে আর তাতে যাদের প্রাণহানি ঘটবে হরতালকারী পক্ষ তাদেরকে তাঁদের “শহীদ” বলে গণ্য করতে কিংবা নিজ সাফাই দেওয়ার উপায় হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।১৬ পাকিস্তান সরকার তার স্বকীয় চরিত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ঐ হরতালের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানাবার ঝুঁকি গায়ে না মেখে পারেনি। তবে নিপীড়ন, হয়রানি সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এগিয়ে যেতেই থাকে। ১৯৬৬ সালের ১০ ও ১১ জুন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দলের ওয়ার্কিং কমিটির এক জরুরি বৈঠকে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের প্রথম পর্যায় চলাকালে জনসাধারণের অনুকূল সাড়া লক্ষ্য করে সন্তোষ প্রকাশ করা হয় ও ১৬ আগস্ট ১৯৬৬ সালের মধ্যে ১৪৪ ধারার জরুরি অবস্থার মতাে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার, নাগরিক অধিকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার এবং বিনাবিচারে আটক রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া না হলে ঐ তারিখ থেকেই আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ওয়ার্কিং কমিটির সভার আরাে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল এই যে, ১৭, ১৮ ও ১৯ জুন—এই দিনগুলি নিপীড়ন প্রতিরােধ দিবস হিসেবে পালিত হবে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রতিটি ইউনিটকে বাড়ি বাড়ি কালাে পতাকা উত্তোলন ও কালাে ব্যাজ ধারণের কর্মসূচি সংগঠিত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। তাদের সভাসমিতি ও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ আয়ােজনের জন্যেও বলা হয়। ওয়ার্কিং কমিটি ছয়-দফা ফর্মুলার সপক্ষে প্রদেশব্যাপী স্বাক্ষর গ্রহণ অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় এবং আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের সাফল্যের জন্য সমাজের বিভিন্ন স্তরের জনসাধারণ যে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিয়েছেন সে জন্য তাদেরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে। কমিটি এই আন্দোলনে সাফল্যের জন্য যারা জীবন দিয়েছেন তাদের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করে। যারা আন্দোলন চলাকালে নিহত হয়েছেন তাঁদের পরিবারগুলিকে সহায়তা দেওয়ার জন্য একটি তহবিল প্রবর্তনেরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
১৪০
আন্দোলনের প্রথম পর্যায় চলাকালে যারা বিভিন্ন আইনগত মামলায় পড়েছেন তাদের জন্য আইনগত সাহায্য-কমিটি গঠনের বিষয়টিকে ওয়ার্কিং কমিটি অভিনন্দিত করে। কমিটির সভায় গৃহীত ১৫টি প্রস্তাবের মধ্যে ছিল, তীব্র খাদ্য সঙ্কট প্রশমনের জন্য প্রদেশব্যাপী রেশনিং ব্যবস্থা প্রবর্তন, লেভি ব্যবস্থা বিলােপ, সকল সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার, সিলেট ও রংপুর জেলার বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকাগুলির জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদির দাবি।১৭ আর কিছু প্রস্তাব প্রকাশ করা হয়নি। এগুলিতে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মসূচির কিছু বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি বিষয় ছিল। এগুলির মধ্যে ছিল, সাধারণ ধর্মঘট, কলকারখানা ও অফিস-আদালতে বিভিন্ন সময়ে কর্মবিরতি, ভুখা মিছিল, জনসভা, জনপ্রতিনিধি দল প্রেরণ এবং অবস্থান ধর্মঘট বা ধরনা ইত্যাদি।১৮
হরতালের সাফল্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের গৃহীত নীতি ও কর্মকৌশলের সাফল্যের স্পষ্ট প্রমাণ। ছয়-দফা ফর্মুলাকে স্পষ্টত একান্ত জনমনোেযােগের কেন্দ্রে নিয়ে আসা না হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পক্ষে এত বিপুল অনুসারী পাওয়া হতাে খুবই কঠিন কাজ। বিষয়টি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ‘৪০-এর দশকে গৃহীত কৌশলেরই অনুরূপ। ঐ সময় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাটি প্রচার করা হলে ভারতের বিভিন্ন পথ ও মতের মুসলমান মুসলিম লীগের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়।
পূর্ব পাকিস্তান ১৯৬৬ সালের ১৭ জুন থেকে পরপর তিনদিন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের আহ্বানে প্রতিবাদ দিবস পালন করে। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে পার্লামেন্টারি সচিব এমএ জহির ৭ জুনের পুলিশের গুলিবর্ষণের পদক্ষেপের সমর্থন করে হরতালকারীদের নিন্দা জ্ঞাপন করেন। তাঁর ভাষায় ওরা ছিল গুণ্ডা-হাঙ্গামাকারী। তিনি দেশে নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য বিরােধীদলগুলি, বিশেষ করে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে দোষারােপ করেন এবং ৭ জুন ১৯৬৬ সালে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে নৈরাজ্যের জন্য তাদেরকে দায়ী করেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক যিনি একজন এমএনএ-ও বটে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত অন্যতম এনডিএফ সদস্য মাহমুদ আলী বিষয়টি জাতীয় পরিষদে উত্থাপনের চেষ্টা করেন কিন্তু তাঁকে বিষয়টি উত্থাপন করতে দেওয়া হয়নি। আর সেই সাথে আওয়ামী লীগবিরােধী প্রচারণা চলতে থাকে।১৯
জুন বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি গৃহীত আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরুর সিদ্ধান্তটি ২৩ ও ২৪ জুলাই ১৯৬৬ সালে অনুষ্ঠিত কমিটির পরবর্তী বৈঠকে অনুমােদন করা হয়। কমিটির স্থির প্রত্যয় জন্মায় যে, জনগণ ছয়-দফাকে তাদের গণতান্ত্রিক। দাবিদাওয়া পূরণ ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার এবং সেই সুবাদে পাকিস্তানের ঐক্য সংহতি অক্ষুন্ন রাখার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জেলা শাখাগুলিকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের বার্তা প্রতিটি গ্রামে পৌঁছে দিয়ে ছয়-দফা কর্মসূচি আদায়ে জনমত সৃষ্টির নির্দেশ দেওয়া হয়।২০
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যাপক ধরপাকড়ের পর কেবল জেলা পর্যায়ে কিছু দলীয় কর্মকর্তাই ছিলেন প্রাদেশিক সদরদপ্তরে সাংগঠনিক কাজ করার জন্য। ঐ
১৪১
সময় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ মহিলা শাখার সম্পাদিকা ছিলেন আমেনা বেগম। তাঁকেই নিরীক্ষামূলকভাবে দলের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক করা হয়।২১
আমেনা বেগম ১৯৫৩ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে ছিলেন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি সমাজকর্মের জন্যই মূলত রাজনীতিতে যােগ দেন।২২ ১৯৬০ সালের মার্চে কাউন্সিল সভায় তাকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মহিলা শাখার সম্পাদক করা হয় আর সেই সুবাদে পদাধিকারবলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যও ছিলেন। দলে একজন মহিলা সম্পাদক নেওয়ার মূলে স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে নারীর অংশগ্রহণকে আরাে জোরদার করে তােলা। ঘটনাচক্রে তাকে এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দলের দায়িত্বভার নিতে হয়। বাস্তবিকপক্ষে তাকেই স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় পরিচালনা করতে হয়। তার অনভিজ্ঞতা সত্ত্বেও এই স্তরে জনগণকে সুসংগঠিত করার অভিযান ক্ষুন্ন হয়নি। বরং এ আন্দোলন অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলে আর সেই সাথে পূর্ব পাকিস্তানীদেরকে আরাে আগামী ঘটনাবলি যেমন, ১৯৬৮-৬৯ সালের আইয়ুববিরােধী বিক্ষোভের জন্য তৈরি করে। ইতােমধ্যে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে আরাে এক গুরুতর সাংগঠনিক সমস্যার মােকাবেলা করতে হয় যা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের মর্যাদার প্রশ্নটিকে রীতিমতাে হুমকির মুখে ফেলে। আমেনা বেগমও সঙ্কটসঙ্কুল পরিস্থিতি মােকাবেলা করতে যথেষ্ট যােগ্যতার পরিচয় দেন।
অবশ্য স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থনকে সুসংগঠিত পথে এগিয়ে নিয়ে সে সমর্থনকে সাংগঠনিক কার্যক্রমের মধ্যে অভিব্যক্ত করার প্রয়ােজন ছিল। বিভিন্ন সংগঠিত মহলের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে ভালাে যােগাযােগ রয়েছে এ রকম সিনিয়র নেতার অভাব, জনপ্রিয়তার অধিকারী ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ও ছাত্রনেতাদের কারাগারে প্রেরণ এবং পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নিষ্ক্রিয়তা সুনিশ্চিতভাবেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কর্মসূচির এ অংশটিকে অনেকটাই মন্থর করে দেয়।
স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের সূচনা করার কথা ছিল ঢাকার আউটার স্টেডিয়ামে এক জনসভার মাধ্যমে। তবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে সেখানে সভা অনুষ্ঠানের অনুমতি না দিয়ে এই অনুমতি দেওয়া হয় কনভেনশন মুসলিম লীগকে। এ কারণে আমেনা বেগম শান্তিপূর্ণ ও শাসনতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় চালিয়ে যাওয়ার জন্য সকল জেলা, মহকুমা, শহর, থানা ও ইউনিয়ন স্তরের পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কমিটিগুলিকে নির্দেশ দেন। ১৯৬৬ সালের ১৭ আগস্ট চট্টগ্রামে দলের এক জনসভার আয়ােজন সম্ভব হয়। ঐ জনসভায় আমেনা বেগম স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক সূচনার কথা ঘােষণা করতে সক্ষম হন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান ও দলের অন্যান্য কর্মীর মুক্তি দাবি করেন। তিনি ছয়-দফাকে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্যের বুনিয়াদ হিসেবে বর্ণনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন পাকিস্তান অর্জনে পূর্ব
১৪২
পাকিস্তানীদের অবদান অনেক বেশি। আর তাই তিনি পূর্ব পাকিস্তানীদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায়িত করার নিন্দা জানান। তিনি শান্তিপূর্ণ ও শাসনতান্ত্রিক উপায়ে এই আন্দোলন পরিচালনার জন্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সংকল্পের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, যে কোনাে আত্মত্যাগের বিনিময়ে তার দল এ আন্দোলনকে সফল করবেই।২৩
উল্লিখিত জনসভার পর দলের যে সব নেতাকে পাওয়া সম্ভব হয় তাঁদের সঙ্গে নিয়ে আমেনা বেগম বিভিন্ন জেলা সফর করেন। এ সফরে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার সাথে ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁদের বক্তৃতায় ছয়-দফা দাবির যৌক্তিকতা, বৈধতা ও ন্যায্যতার বিষয়গুলি (যা ব্যাপক জনসমর্থনের বুনিয়াদে ইতােমধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত) ব্যাখ্যা করেন। তাঁরা বলেন, সরকারের কারণে জনগণের ভীত হওয়ার প্রয়ােজন নেই, কেননা আওয়ামী লীগের প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। তাঁরা ছয়-দফা প্রশ্নে গণভােটের মাধ্যমে এ বিষয়ে জনমত যাচাইয়ের দাবি করেন।২৪
তাঁদের এ সফরে অনুষ্ঠিত জনসভাগুলিতে গৃহীত বিভিন্ন প্রস্তাবের মধ্যে ছিল: ছয়-দফার জন্য একটানা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ, রাজবন্দীদের মুক্তি দাবি, সংবাদপত্রের ওপর আরােপিত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার, জরুরি অবস্থা বাতিল, ১৯৬৬ সালের ৭ জুন আন্দোলনে নিহতদের পরিবারদের জন্য পেনশন প্রদানের দাবি, নিউনেশন প্রিন্টিং প্রেসের আটকাদেশ প্রত্যাহার, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্রুগ কমিশনের সুপারিশগুলির বাস্তবায়ন, পূর্ণ রেশনিং ব্যবস্থা। প্রবর্তন, মূল্যবৃদ্ধি নিবারণমূলক ব্যবস্থা, জমি মালিকানার সিলিং ২৫ বিঘা পর্যন্ত নির্ধারণ, তাঁতীদের কাঁচামাল, সূতা ও রঙের মূল্য হ্রাস, বেকার বিড়ি শ্রমিকদের পুনর্বাসন, ছাত্র বেতন হ্রাস, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি পুনরায় খােলা এবং ভিয়েতনামে মার্কিননীতির প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন।২৫
উল্লিখিত বক্তৃতা-ভাষণগুলির বক্তব্য ও বিষয়বস্তু মােটামুটি এক থাকলেও সময় গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে মেজাজ ও সুর চড়তে থাকে। গােড়ার দিকে ছয়-দফার পক্ষে যুক্তি প্রদান করতে বলা হতাে সেগুলি পাকিস্তানের ঐক্য বিধায়ক বিষয়, আর ক্ষমতা গ্রাস কিংবা ক্ষমতার ভাগীদার হওয়ার কোনাে উচ্চাভিলাষ ব্যতিরেকেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এ সগ্রাম পরিচালনায় দৃঢ় সংকল্প। পরবর্তীকালে দাবি করা হয়, ছয়-দফা হলাে সমাজতান্ত্রিক-অর্থনৈতিক কাঠামাে নির্মাণ নিশ্চিত করার উপায় আর এর মধ্য দিয়েই শুধু পাকিস্তান উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারে।২৬ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সংকল্প জোরদার হয়ে ওঠার বিষয়টি আমেনা বেগমের এ বক্তব্যে প্রতিফলিত:
“আমি শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের মুক্তি আজ চাইব না, কেননা আজকে কেবল লাখাে আওয়ামী লীগ কর্মীই নয় বরং গােটা জাতি ছয়-দফা আদায়ের লক্ষ্যে সর্বাধিক আত্মত্যাগের জন্য তৈরি। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এ দেশের (পূর্ব পাকিস্তানের) গােটা অঞ্চল সফর করে জনমত যাচাই করেছি…. সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ ছয়-দফা আদায় না হওয়া পর্যন্ত সম্মিলিতভাবে (পূর্ব পাকিস্তান) আওয়ামী লীগের সাথে
থাকবে।২৭
১৪৩
নিঃসংশয়ে বলা যায় শীর্ষস্থানীয় নেতৃপর্যায়ে শক্তি কমে যাওয়া সত্ত্বেও এ সময় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তার পতাকা সমুন্নত রাখে এবং দলটির প্রতি জনসমর্থন ক্রমেই বাড়তে থাকে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় এই যে, অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে তেমন সাড়া মেলেইনি (যদিও এদের কয়েকটি সংগঠন নীতিগতভাবে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল) বরং নুরুল আমিন, আতাউর রহমান খান ও আবু হােসেন সরকার প্রমুখের মতাে পূর্ব পাকিস্তানী নেতারা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে কোনাে সুনির্দিষ্ট ও শাণিত উল্লেখ না করেই পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবনের সংগ্রামে সম্মিলিত বিরােধী সংগঠন গড়ে তােলার ওপর জোর দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেন। আর পূর্ব পাকিস্তানে বামপন্থীদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি মওলানা ভাসানী স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন। থেকে দূরে থাকেন। অথচ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের গােড়াপত্তনের প্রথম দিন থেকেই (মওলানা ভাসানী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি) তাঁর স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে অঙ্গীকার ছিল। এখন তিনি তাঁর এ থেকে দূরে থাকার অজুহাত দিলেন এই বলে যে, স্বায়ত্তশাসনের এ আন্দোলনের নেপথ্যে বাইরের মদদ রয়েছে, পরিকল্পনাও তাদের।২৮ মওলানা ভাসানীর দল ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক এমএইচ উসমানীর মাথায় এমনকি এমন ভাবনারও উদয় হয় যে,’ছয়-দফা পরিকল্পনার আওতায় যে সব প্রশাসনিক পরিবর্তন আনতে চাওয়া হচ্ছে তা “দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করতে পারে।২৯ তবে সে যা-ই হােক, ভাসানী স্বায়ত্তশাসনের কথা মাঝে মাঝে বলতে থাকলেও নিশ্রুপ রইলেন ছয়-দফার প্রশ্নে।”৩০ একইভাবে ১৯৬৬ সালের ৫ জুন ঢাকায় ন্যাপের এক জনসভায় ৭ জুনের হরতাল সম্পর্কে কিছুই বলা হলাে না যদিও আইয়ুব খানের “অস্ত্রের ভাষায় কথা বলার হুমকির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হলাে।৩১ অবশ্য এই দ্বিধান্বিত মনােভাব ছিলাে ন্যাপের ভেতরে পরস্পরবিরােধী অভিমতেরই ফল।৩২ ভাসানী এ বিষয়ে তাঁর আনুষ্ঠানিক অবস্থান। সম্পর্কে উল্লেখ করে বলেন, ন্যাপ ছয়-দফা সমর্থন করছে না তবে তাঁর দল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, ভাষাভিত্তিক প্রদেশ ও এক ইউনিট বিলােপের জন্য লড়ে যাবে। তিনি দীর্ঘসূত্রতার কৌশল অবলম্বনের বিপজ্জনক পরিণতির বিষয়ে সরকারকে হুঁশিয়ার করে দেন।৩৩ তিনি অঞ্চল বহির্ভূত নানা ইস্যুকে কেন প্রাধান্য দিচ্ছিলেন তা বােধগম্য। কিন্তু সরকার কিছুটা পরিসরে আমাদের দাবি মেনে নিয়েছে বলে তিনি যে বিবৃতি দেন তা কিংবা “যদ্দিন সরকার সমাজতন্ত্রী দেশগুলির সাথে বন্ধুত্ব গড়ার অনুকূল পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করবেন, আমরা সরকারকে তদ্দিন আমাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে যাবাে”৩৪—এ ধরনের কথাবার্তা তাঁর ভাবমূর্তিকে আর যাই হােক উজ্জ্বলতর করেনি। কেবল তাই নয়, তাঁর এ প্রতিক্রিয়া। সরকারের মােকাবেলায় সুনির্দিষ্ট কার্যব্যবস্থা কী হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বেলায়। তাঁর রাজনৈতিক অনুসারীদের জন্যও সহায়ক হয়নি। আওয়ামী লীগ ও ছয়-দফা প্রশ্নে। তাঁর ভূমিকা বা অবস্থানটিও রীতিমতাে হেঁয়ালিময়। ছয়-দফা তাঁর কাছে গ্রহণযােগ্য নয়—এটি ঘােষণা করতে গিয়ে তিনি এ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন যে, একদিন যারা
১৪৪
তাঁর ‘আসসালামু আলায়কুম’ বলার জন্য তাঁর সমালােচনা করেছিলেন আজ তারাই স্বায়ত্তশাসনের এক তেজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে।৩৫ ন্যাপ রাজনৈতিক দল হিসেবে বন্যাত্ৰাণ, খাদ্য ঘাটতি, চড়া দ্রব্যমূল্য৩৬ ইত্যাদি বিষয়ক কার্যক্রমে মনােযােগী থাকলেও কোনাে কোনাে ন্যাপ নেতা ছয়-দফার সমর্থনেও মতপ্রকাশ করেন। ন্যাপ সহসভাপতি ও জনপ্রিয় কৃষক নেতা হাজী মােহাম্মদ দানেশ এমনকি ছয়-দফাকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাণের দাবি” বলেও উল্লেখ করেন।৩৭
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসনবাদীরা তাঁদের সংকল্পে অটল থাকলেও তখনকার অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তেমন দাগ কাটতে পারছিলেন না। একই ধরনের পরিস্থিতিতে ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়াে আন্দোলনও একই ধরনের পরিণতি বরণ করে। অবশ্য স্বায়ত্তশাসনবাদীদের এই বন্ধ্যাদশা খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে তথা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে জড়িত করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুববিরােধী আন্দোলনের ঢেউ পূর্ব পাকিস্তানে এসে লাগার সাথে সাথে স্বায়ত্তশাসনবাদীরা এক দ্বিস্তরের আন্দোলন শুরু করে দেয়। এর এক স্তরে ছিল, প্রচলিত শাসন ব্যবস্থা তথা আইয়ুবের নেতৃত্বাধীন শাসকগােষ্ঠীর পরিবর্তন, অন্যস্তরে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত দাবিদাওয়া। তবে ইতােমধ্যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্পর্কে স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে ফাটল দেখা দেয়। আওয়ামী লীগের একটি উপদল ছয়-দফা বিসর্জন দিয়ে পাকিস্তান ডেমােক্র্যাটিক মুভমেন্ট বা পিডিএম-এ যােগ দেয়।
এই মেয়াদে পূর্ব পাকিস্তানের বিরােধীদলীয় রাজনৈতিক সংগঠনগুলি তিনটি শিবিরে বিভক্ত ছিল:
১. কট্টর স্বায়ত্তশাসনবাদী: এদের বেশিরভাগ অংশ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের । আরেকটি অংশ, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির একাংশ। এদের সকলের কাছে এ অঞ্চলের পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের যে রূপরেখা ছয়-দফা কর্মসূচিতে দেওয়া হয়েছে তা গােটা দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মতােই ছিল সমান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
২. মধ্যপন্থী: এনডিএফ, পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াত-ই-ইসলামী, নিজাম-এ-ইসলাম এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের হাতেগােনা কিছু নেতাসহ নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের একাংশ। এরা সকলে মিলে নুরুল আমিনের নেতৃত্বে পাকিস্তান ডেমােক্র্যাটিক মুভমেন্ট নামে একটি মাের্চা গঠন করে। এই রাজনৈতিক দলগুলি সংসদীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে অধিকতর গুরুত্ব আরােপ করে। কেননা, তাঁদের বিশ্বাস ছিল, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় স্বায়ত্তশাসন দাবির নেপথ্য ইস্যুগুলির যথা সুব্যবস্থা ও প্রতিকার রয়েছে।
৩. বিভিন্ন বামপন্থী গ্রুপ: মওলানা ভাসানীর ছত্রচ্ছায়ায় এরা সমাজের সামগ্রিক পুনর্নির্মাণ ও পুনর্গঠনে বিশ্বাসী ছিল বলেই মনে হয় যা তাঁদের মতে, ছয়-দফা
১৪৫
ফর্মুলার বাস্তবায়ন বা পিডিএম-এর উদ্দেশ্য রূপায়ণের মাধ্যমে সম্ভব নয়। তারা সন্দেহ করতেন স্বায়ত্তশাসনপন্থীরা সাম্রাজ্যবাদীদের ক্রীড়নক আর বড়জোর পূর্ববঙ্গের উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধি।৩৮
ন্যাপের অভ্যন্তরে উপদলীয় সংঘাত মূলত স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে দলের অবস্থান নিয়ে দেখা দেয় ও পরে তা থেকে আরাে মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে ন্যাপ-আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্ট৩৯ সম্পর্কে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। এ জল্পনা-কল্পনা আরাে জোরদার হয় ন্যাপের এক সভার পর থেকে। এই সভায় দলের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় সদস্য এই মর্মে অভিমত প্রকাশ করেন যে, সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যসমূহ, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও সাম্রাজ্যবাদী বিরােধমূলক যে আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের প্রয়ােজন তার দায়িত্ব কেবল ন্যাপ ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগই নিতে পারে, কেননা এই দুই রাজনৈতিক দলের প্রতিই কেবল জনসাধারণের রয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন।৪০
১৯৬৭ সালের অক্টোবরে পূর্ব পাকিস্তানের ৮ জন ন্যাপ নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। ব্যাপারটি “আন্তর্জাতিকতাবাদী” ও “জাতীয়তাবাদীদের অন্তর্দলীয় সংঘাতের পরিণতি বলে বর্ণনা করা হয়।৪১ দলের আনুষ্ঠানিক ভাঙন ঘটে ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বরে। ইতােমধ্যে, নিখিল পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক এমএইচ উসমানী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন যে, ন্যাপের অন্তর্কলহে কোনাে আদর্শিক প্রশ্নই সংশ্লিষ্ট ছিল না। তবে সমস্যা ছিল সরকারের প্রতি ন্যাপের নীতি কী হবে সেটাই। তিনি আরাে বলেন যে, ন্যাপ কোনাে বিশেষ “শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে না, এ দল বিশ্বাস করে যে, শুধুমাত্র সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমেই সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদকে প্রতিরােধ ও নির্মূল করা যেতে পারে।৪২
এবডাে বিধির কার্যকারিতার মেয়াদ শেষে পাকিস্তান স্টাডি সার্কেল আয়ােজিত এক প্রাণবন্ত আলােচনায় পিডিএম-এর সূত্রপাত ঘটে। নুরুল আমিনের সভাপতিত্বে এ সেমিনারে বিরােধী শিবিরে ঐক্যের সমস্যাগুলি নিয়ে আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলােচনায় বক্তাদের প্রধান উদ্বেগের বিষয় ছিল দৃষ্টত সকল বিরােধী রাজনৈতিক দলের সমবেত প্রয়াসের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা। তাৎপর্যের বিষয় এই যে, আলােচনায় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ইস্যুটি আদৌ ওঠেনি। অবশ্য, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শাহ আজিজুর রহমানের অভিমত ছিল এই যে, শেখ মুজিব ও অন্যান্য কারাবন্দী নেতাকে মুক্তি না দেওয়া। হলে এ ধরনের ঐক্যের বিষয়ে ফলদায়কভাবে আলােচনা সম্ভব নয়। এ ছাড়া পিকিংপন্থী পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট (ইপিসিপিএমএল)-এর অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক হিসেবে পরিচিত ন্যাপ নেতা আব্দুল হক বলেন যে, প্রস্তাবিত ন্যূনতম কর্মসূচিতে বিরােধীদলগুলির সাম্রাজ্যবাদবিরােধী ভূমিকার পরিচয় এবং তাতে কৃষক ও শ্রমিকদের দাবিদাওয়া অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে।৪৩
পিডিএম-এর কর্মসূচিতে৪৪ কিছুটা পরিমাণে ক্ষমতার বিকেন্দ্রায়নের কথা অন্তর্ভুক্ত। থাকলেও পিডিএম নেতাদের সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতিতে যে বক্তব্য
১৪৬
পাওয়া যায় তা একান্তই শূন্যগর্ভ ও অস্পষ্ট। বরং তাদেরকে একটা ধরি মাছ না ছুঁই পানি গােছের মধ্যপন্থী কর্মসূচির মাধ্যমে ক্ষমতা দখলেই একান্ত আগ্রহী বলে লক্ষ্য করা যায় যা কায়েমি কর্তৃপক্ষ ও তাদের ভবিষ্যৎ সমর্থক গােষ্ঠীগুলি—উভয়ের কাছে গ্রহণযােগ্য হবে। এই পর্যায়ে তারা যদি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে তাদের কর্মসূচি পরিত্যাগ কিংবা কর্মসূচির মেজাজ কিছুটা হাল্কা করে তাদের কাতারে যােগ দিতে সম্মত করানাের কাজে সফল হতাে তাহলে তাদের মূল উদ্দেশ্যসাধন অনেকখানি সহজ হয়ে যেতাে। আর তাহলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের, বিশেষ করে, পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে যে মূল ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিল সেটিও যুগপৎ হরণ করা হতাে। এ জন্যে আওয়ামী লীগারদেরকে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন থেকে দূরে সরানাের জন্য নানা প্রলােভনের টোপ ফেলা হয়।
মধ্যপন্থী ও ক্ষমতাসীনচক্র উভয়েই আওয়ামী লীগে ফাটল ধরিয়ে দেওয়া ও স্বায়ত্তশাসনবাদীদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলার অপপ্রয়াস চালায়। স্পষ্টত এটা করা হয় স্বীয় স্বার্থ রক্ষার সুযােগ আরাে উজ্জ্বল করার তাগিদে। তবে ঐ সময়কার ব্যবস্থায় গােটা সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার তৃণমূল ও শীর্ষ স্তরের মধ্যে সরাসরি যােগাযােগের অবকাশ না থাকায় ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষ বিভ্রান্ত হন ও তাদের এই ধারণা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অপেক্ষাকৃত অনভিজ্ঞ নেতারা আবছা প্রলােভনের টোপ গিলবেন ও তাঁদের আনুগত্য বদলাবেন। আর তার পরেই স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন খতম হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সােহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত আফতাব আহমদ নামে একজন অবসরপ্রাপ্ত পশ্চিম পাকিস্তানী আমলা ঢাকায় এসে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কয়েকজন জেলা পর্যায়ে উঠতি ও সম্ভাবনাময় নেতার সাথে যােগাযােগ করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন টাঙ্গাইলের মান্নান ও খুলনার মােমেন। কিন্তু ঐ আমলা তাদেরকে তাঁর টোপ গেলাতে পারেননি। এই আমলা তাঁদেরকে অঙ্গীকার করেছিলেন যে, তাঁরা যদি ছয়-দফা ছাড়েন তাহলে ছয় মাসের মধ্যে সব কিছু বিলকুল ঠিক হয়ে যাবে।” কিন্তু এ সবে আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে আদৌ টলানাে যায়নি। আফতাব আহমদ সব কিছু “ঠিকঠাক করে দেওয়ার উদ্দেশ্য ও পদ্ধতির ব্যাপারে তাঁদেরকে আস্থায় আনতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।৪৫ এ ধরনের আলােচনার ফলাফল শেষ পর্যন্ত গােপন থাকেনি। কেননা, এই মর্মে জানা যায়:
এ উদ্দেশ্যে পিণ্ডি থেকে বিশেষ কিছু দূত সম্প্রতি এলেও তাঁরা এতে আদৌ দাঁত বসাতেই পারেননি। কারণ আওয়ামী লীগাররা তাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, জনসাধারণের দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য তাঁরা যে কোনাে গােষ্ঠীর সঙ্গে সহযােগিতায় রাজি থাকলেও দলীয় পর্যায়ে তাঁদের ছয়-দফার আন্দোলন চলতেই থাকবে।৪৬
তবে এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত তখনাে আসেনি। ১৯৬৭ সালের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসে। এই বৈঠকে প্রাদেশিক সংগঠন কেন্দ্রীয় সংগঠনকে একটি সম্মিলিত বিরােধী ফ্রন্ট
১৪৭
গঠন সম্পর্কে আলােচনা করতে দিতে সম্মত হয় যদিও পূর্ব পাকিস্তানী আওয়ামী লীগারদের একটি বড় অংশ প্রকাশ্যেই প্রস্তাবিত ফ্রন্টে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের বিরােধিতা করে। এ সব আওয়ামী লীগারদের কাছে বিষয়টি নীতির প্রশ্ন তাে ছিলই, সেই সাথে কৌশলগত প্রশ্নও ছিল বটে। এ ধরনের কোয়ালিশনের ব্যাপারে মুজিবের অনীহা ছিল সর্বদাই অত্যন্ত প্রবল। তাছাড়া, জনসাধারণ ছয়-দফা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে—এই বিবেচনার আলােকে তিনি ইতােমধ্যে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, কোনাে নতুন ও অপেক্ষাকৃত নিচু লয়ের কর্মসূচি নতুন করে শুরু করা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জন্য লাভজনক হবে না।৪৭
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ছয়-দফা কর্মসূচিতে অটল প্রত্যয় ও বিশ্বাসের বিষয়টি ১৯৬৭ সালের মে মাসে পাকিস্তান ডেমােক্র্যাটিক মুভমেন্ট নামে এক মাের্চা গঠনের সময় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। গুটিকয়েক সপক্ষত্যাগী ছাড়া, পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ পিডিএম থেকে দূরে থাকে। এতে শেষাবধি পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের পাকিস্তান আওয়ামী লীগে বিভক্তি ঘটে। আর তাতে শুধু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভেতরেই নয় বরং পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভেতরেও অন্তর্দলীয় সংঘাতের অস্তিত্ব প্রকাশ পায়। পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে এ নিয়ে যে মেরুকরণ ঘটে তাতে তাৎপর্যপূর্ণভাবে অঞ্চলভিত্তিক গ্রুপিংয়ের বৈশিষ্ট্যই প্রকাশ পায়।
পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে সব কিছু যে সত্যি ঠিকঠাক চলছিল না ছয়-দফা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগ আয়ােজিত আলােচনায় যােগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে মিজানুর রহমান চৌধুরীর সফরের কিছুকালের মধ্যেই তার আভাস পাওয়া যায়। করাচি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে ভাঙন সম্পর্কে এক শ্রেণীর খবরের কাগজে বিভিন্ন খবরাখবর প্রকাশিত হলে করাচি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মঞ্জুরুল হক সে খবরের সত্যতা অস্বীকার করেন।৪৮ করাচি আওয়ামী লীগের মঞ্জুরুল হক ও তিরমিযী এর আগে ছয়-দফার প্রতি তাদের অনুকূল সাড়া ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মােহাম্মদ লুন্দভাের ছয়-দফা প্রশ্নে প্রতিকূল সাড়া ব্যক্ত করেন। এই পরিস্থিতির আলােকে দেখা যায়, পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মুখপাত্রস্থানীয় লুখাের ও নসরুল্লাহ খান করাচি আওয়ামী লীগে ছয়-দফাসংক্রান্ত অবস্থানের বিরােধিতা করছেন। এভাবে পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে মতভেদ ও এর পরিণতি হিসেবে পাকিস্তান আওয়ামী লীগে ছয়-দফা ও স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে মতপার্থক্যের বিষয়টি একান্তই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের একাংশ স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে পিডিএম-এ যােগ দেওয়ার জন্য তৈরি হন। তবে পরবর্তীকালের ঘটনাবলির আলােকে দেখা যায়, এদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। যা হােক, দলের কর্মকর্তাদের মধ্যে দীর্ঘ আলােচনায় এ সম্পর্কিত ইস্যুর নিষ্পত্তি হয়।
১৪৮
১৯৬৭ সালের ১৯ ও ২০ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে জেলা ও মহকুমা পর্যায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা পিডিএম-এর দলীয় উপকমিটির পক্ষ থেকে আবদুস সালাম খানের পেশ করা একটি রিপাের্ট প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁরা পিডিএম-এর তিন-দফা কার্যক্রমের বদলে ছয়-দফা কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন। অবশ্য এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিলকে ছেড়ে দেওয়া হয়, ইত্যবসরে ওয়ার্কিং কমিটি ছয়-দফার কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি পিডিএম-এর সাথে সহযােগিতার সিদ্ধান্ত নেয়।৪৯
এই সঙ্কট সন্ধিক্ষণে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ যখন একদিকে সরকার ও দলের ভেতরে ছয়-দফা ফর্মুলা ও স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে মধ্যপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়ছে তখন ছাত্ররা, বিশেষ করে, ছাত্রলীগ কর্মীরাই বহুলাংশে আন্দোলনের প্রাণপ্রবাহ সঞ্জীবিত রাখে।৫০
এর পরে যা ঘটে তাকে নিছক উপদলীয় কোন্দলই বলা যায়। দলের ওয়ার্কিং কমিটির ১৩ জন পিডিএমপন্থী সদস্য পিডিএম-এর জন্য প্রতিনিধি মনােনয়নের উদ্দেশ্যে ওয়ার্কিং কমিটির এক রিকুইজিশন সভা ডাকেন। এটি করা হয় এ বিষয়ে আগের আলােচনার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। কেননা, কথা ছিল প্রয়ােজনে বিষয়টি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে উত্থাপন করা হবে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে তারা তা করলেন না। কাউন্সিলকে মােকাবেলায় তাঁদের এই অনীহায় বরং দলের বৃহত্তর সংস্থায় তাঁদের নিজ দুর্বলতাই উন্মােচিত হলাে; ছয়দফাপন্থীদের অধিকতর গণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বনে, ওয়ার্কিং কমিটিতে পিডিএমপন্থীদের সংখ্যালঘিষ্ঠ অবস্থানটি ধরা পড়লাে।৫১
১৯৬৭ সালের ১৯ আগস্ট দলের কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় দলের মােট ৯৫০ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ৮৮৬ জন যােগ দেন। তারা সর্বসম্মতিক্রমে এই মর্মে প্রস্তাব পাস করেন যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পিডিএম-এ যােগ দেবে না। এতে দলের পিডিএমপন্থী গােষ্ঠীর দুর্বলতা আরাে প্রকট হয়ে ওঠে। তবে এ সভায় অধিকতর বিতর্কিত ইস্যুটি ছিল রিকুইজিশনপন্থীদের দল থেকে বহিষ্কারের বিষয়টি। সংখ্যাগরিষ্ঠ কাউন্সিলরগণ তাঁদের অনতিবিলম্বে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি জানান এবং “বিশ্বাসঘাতকদের বহিষ্কার করাে” “নওয়াবজাদা বাংলা ছাড়াে”—ইত্যাকার শ্লোগান দেন। পরিশেষে বর্ণিত ব্যক্তিদের প্রতি কারণ দর্শাও নােটিশ জারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এঁরা হলেন: আবদুস সালাম খান, জহিরুদ্দিন, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, মুজিবুর রহমান (রাজশাহী), আবদুর রহমান খান, এমএ রশিদ, রওশন আলী, মমিনউদ্দিন আহমদ, লিয়াকত উল্লাহ, সা’দ আহমদ, রহিমুদ্দিন আহমদ ও জালালুদ্দিন খান।৫২
এই কাউন্সিল সভায় করাচি আওয়ামী লীগের একাধিক প্রতিনিধি ভাষণ দেন। তাঁরা ছয়-দফা সমর্থন করেন এবং পিডিএম-এ যােগদানের বিরােধিতা করেন। এক বিবৃতিতে তারা বলেন, করাচি আওয়ামী লীগ ছয়-দফা ফর্মুলা সমর্থন করে। তারা এর প্রতি বৃহত্তর জনসমর্থন সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।৫৩
১৪৯
কাউন্সিল সভার উদ্বোধনী ভাষণে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্তর্দলীয় সংঘাতের পরিস্থিতি ও পটভূমি বর্ণনা প্রসঙ্গে এক তাৎপর্যময় বাস্তব সত্য প্রকাশ করে বলেন যে, নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অদ্যাবধি কোনাে গঠনতন্ত্র নেই। দলের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আমেনা বেগম এ মত পুনর্ব্যক্ত করে বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নীতি অত্যন্ত নিখুঁত ও ত্রুটিহীন। অতি সাম্প্রতিককালের তিক্ত অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে। যে, এ ধরনের ফ্রন্ট খুব বেশি দিন টেকে না। আর কোনাে উদ্দেশ্যও হাসিল করতে পারে না । সে কারণে, “আমরা ছয়-দফা ছাড়া অন্য কোনাে কিছুর ভিত্তিতে কোনাে আন্দোলনে যেতে তৈরি নই।” সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আমেনা বেগম উভয়েই দলের ভেতরে বিভেদের জন্য কতিপয় পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগারকে দোষারােপ করেন।৫৪
ছয়-দফার সমালােচনা করে পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগ নেতা লুখাের দাবি করেন যে, আমেনা বেগম দলের মুখপাত্র নন; তাঁর গ্রুপটি “নীরব গ্রুপ”। আর পূর্ব পাকিস্তানে ১৭ দিন থাকার পর নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান সাংবাদিকদের বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তে পিডিএম-এর কার্যকলাপ প্রভাবিত হবে না। ১৯৬৭ সালের ১৯ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সভা ছিল অবৈধ আর এ সভায় যারা অংশগ্রহণ করে তারা সত্যিকারের আওয়ামী লীগ কর্মী নয়। আর তাঁর মতে, এ সব লােক বরং সরকারকেই মদদ যােগাচ্ছে। এ ছাড়াও, ১৯৬৭ সালের ২৩ আগস্ট ঢাকায় নসরুল্লাহর সভাপতিত্বে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির এক সভা ঐ দিন থেকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ভেঙে দেওয়ার কথা ঘােষণা করে। এর পরিবর্তে ২৪ সদস্যের এক অ্যাড-হক কমিটি গঠন করা হয়। যার বৈধতার মেয়াদ সীমিত থাকবে ১৯৬৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এ ছাড়াও এ সভা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদককে কেন তাঁদের দলের প্রাদেশিক সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার করা হবে না—এই মর্মে শােকজ নােটিশ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ঐ সময় নাগাদ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের (ছয়-দফাপন্থী) কাউন্সিল সভার সিদ্ধান্ত ইতােমধ্যে বাস্তবায়িত হয়ে যায় ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ১৩ জন সদস্যের প্রত্যেকের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে কারণ দর্শাও নােটিশ জারি সম্পন্ন হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এক যৌথ বিবৃতিতে পরিষ্কার ও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ২নং অনুচ্ছেদে প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়টি পরিষ্কার নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে ও ঐ অনুচ্ছেদ অনুসারে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি বিলুপ্ত করার কোনাে অধিকার কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেই।” এর পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জন্য ৪৮ সদস্যের (উভয় অঞ্চল থেকে ২৪ জন করে সদস্য নিয়ে) এক সাংগঠনিক কমিটি গঠনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই কমিটিকে ছয়-দফা ফর্মুলা সন্নিবেশিত করে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জন্য একটি গঠনতন্ত্র ও ম্যানিফেস্টো প্রণয়নের দায়িত্ব এবং একই সঙ্গে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের
১৫০
কাউন্সিল সভা আহ্বানের ক্ষমতাও দেওয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সকল ইউনিটের সঙ্গে যােগাযােগ করা এবং উক্ত সাংগঠনিক কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠানের পূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করা হয় জাতীয় পরিষদ সদস্য ও পদাধিকারবলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির অন্যতম সদস্য এএইচএম কামারুজ্জামানকে। সভায় তথ্য প্রকাশ। করে জানানাে হয় যে, ১৯৬৪ তে নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানের সভাপতিত্বে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের একটি অ্যাড-হক কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু সেই কমিটি সাংগঠনিক নির্বাচনগুলির আয়ােজন অনুষ্ঠান এবং দলের গঠনতন্ত্র ও ম্যানিফেস্টো রচনায় ব্যর্থ হয়। এক প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি বিলােপ করার কোনাে ক্ষমতা নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেই। আর এই যে সিদ্ধান্ত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নিয়েছে তা উদ্দেশ্যপ্রণােদিত ও অবৈধ।৫৫
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এই সিদ্ধান্তের পর কামারুজ্জামান পশ্চিম পাকিস্তান সফর করেন। করাচিতে তিনি সাংবাদিকদের জানান যে, করাচি ও সিন্ধু আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে তাঁর কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে অত্যন্ত ফলদায়ক আলােচনা হয়েছে। অচিরেই নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে ছয়-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে পুনর্গঠিত করা হবে। এর পর দলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। হায়দরাবাদ, করাচি ইত্যাদি স্থানে কামারুজ্জামান আরাে এ কথা বলেন বলে জানা যায় যে, পিডিএম-এর প্রতি জনসাধারণের কোনাে আস্থা নেই, তবে ছয়-দফা কর্মসূচিতে তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে এ কারণে যে, তাদের বিশ্বাস, সত্যিকারের গণতন্ত্র কেবল এর মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে। নসরুল্লাহ খান দলীয় নির্বাচন না করে দলের সাথে বিশ্বাস ভঙ্গের কাজ করায় তিনি তাঁর বিশ্বাসযােগ্যতা হারিয়েছেন। পরে কামারুজ্জামান ঘােষণা করেন যে, নসরুল্লাহ আর নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নন।৫৬
নসরুল্লাহ খান তার কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়েছেন—এ কথা বারংবার সবিশেষ জোর দিয়ে উল্লেখ করার তাৎপর্য স্পষ্টতই এ যুক্তি দিতে চাওয়া যে, ছয়-দফা নিয়ে নানা রকম মতভেদজনিত বিভেদের কারণে নয় বরং দলের ভাঙনটি ঘটেছে প্রধানত টেকনিক্যাল কারণে। কারণ, হাজার হলেও ছয়-দফার গ্রহণযােগ্যতা গােটা পাকিস্তানে সর্বজনীন পর্যায়ে পৌঁছায়নি—এ নিরেট বাস্তবতার প্রচার থেকে ছয়-দফাপন্থীদের কোনাে লাভই হতাে না। এই আলােকেই কামারুজ্জামান তার এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা আমাদের নেতার অতীত ভুল শােধরাতে সংকল্পবদ্ধ। তিনি দলের কার্যাবলি যথাযথভাবে না করলেও আমরা তা করতে চাই।”৫৭
১৯৬৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আয়ােজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কামারুজ্জামান নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ৪৮ সদস্যের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি গঠনের কথা ঘােষণা করেন। তিনি বলেন, করাচি, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান আওয়ামী লীগ এই নতুন সাংগঠনিক কমিটি গঠনকে সমর্থন জানিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সাথে তারাও নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে কোনাে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী
১৫১
লীগের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। পাঞ্জাবে নতুন সাংগঠনিক কমিটির পক্ষে বেশ ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। তবে পাঞ্জাব আওয়ামী লীগ অদ্যাবধি তার কোনাে আনুষ্ঠানিক অভিমতের কথা জানায়নি। তিনি জানান যে, পশ্চিম পাকিস্তানে, বিশেষ করে, পাঞ্জাবে নসরুল্লাহ খান ও গােলাম জিলানী ছয়-দফাবিরােধী প্রচারণা চালাচ্ছেন। সাংগঠনিক কমিটির ২৪ জন পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন: মালিক হামিদ সরফরাজ, চৌধুরী নাজিরুদ্দিন, সৈয়দ আবু আছিম, সৈয়দ খালিদ আহমদ তিরমিযী, সৈয়দ শাহ বােখারি ও মােহাম্মদ মুরতাজা প্রমুখ।৫৮
পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে কোনাে এলাকায় মানুষের অনুভূতি সম্পর্কে কামারুজ্জামানের মূল্যায়ন ছিল বাস্তবতাভিত্তিক। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, ১৯৬৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর জ্যাকোবাবাদে অনুষ্ঠিত সিন্ধু আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গ্রহণ করে যে, তখনকার নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কমিটি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের আস্থা হারানাের পর আর বৈধ থাকতে পারে না। সভা ছয়-দফার ভিত্তিতে অনতিবিলম্বে দলীয় পুনর্গঠনের দাবি জানায় এবং মতপ্রকাশ করে যে, পিডিএম-এ যােগ দিয়ে তখনকার নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সিন্ধু আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো অগ্রাহ্য করেছে।৫৯
নবগঠিত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগওয়ার্কিং কমিটির প্রথম সভা ১৯৬৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। সভা ওয়ার্কিং কমিটির বর্তমান কাঠামাে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। কামারুজ্জামান এই কমিটির স্থায়ী আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। পুনর্গঠিত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ও ম্যানিফেস্টো প্রণয়নের জন্য এক ১০ সদস্যের উপকমিটি গঠিত হয়। উপকমিটিকে ছয়-দফা, পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বিলােপ ও সমাজবাদী অর্থনীতির ভিত্তিতে গঠনতন্ত্র ও ম্যানিফেস্টো প্রণয়নের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পূর্বে এক ইউনিট বলবৎ হওয়ার আগে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলি যে স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদার অধিকারী ছিল প্রদেশগুলিকে সে মর্যাদায় পুনর্বহাল করার পক্ষে এক সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়।৬০
একই দিনে পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগের অ্যাড-হক কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় । বৈঠকে নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান দলের নতুন সাংগঠনিক কমিটি গঠনের সমালােচনা করেন। তবে ১৯৬৭ সালের ১৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত এই দলের কাউন্সিল সভায় পূর্ব পাকিস্তানে পিডিএম-এর মূল দুর্বলতা আর গােপন থাকেনি। পিডিএম-এর পূর্ব পাকিস্তানী সহযােগীদের গলায় অনেকটা আত্মরক্ষামূলক (পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মােকাবেলায়) কৈফিয়তের সুর ধ্বনিত হয়। তাঁদের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা আসে এই বলে যে, পিডিএম-এর ধারণাটি তােলা হয়েছে দেশব্যাপী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অসামর্থ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠার পর। তাছাড়া, পিডিএম গঠনের উদ্দেশ্যটি আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয় কেবল পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা ছয়-দফার মৌল বিষয়বস্তুগুলি স্বীকার করে নেওয়ার পরেই। এ ছাড়াও যদিও এ দাবি করা হয় যে, পিডিএম-এর আট-দফা কর্মসূচির যথা
১৫২
বাস্তবায়ন হলে তাতে পূর্ব পাকিস্তানের দাবিদাওয়াগুলি রক্ষিত হবে, তবু এ কথাও জানিয়ে দেওয়া হয় যে, অদূর ভবিষ্যতে পিডিএম কোনাে বাস্তবধর্মী কর্মসূচি শুরু করতে ব্যর্থ হলে তাঁরা তাঁদের নিজ কর্মসূচি নির্ধারণ করতে বাধ্য হবেন কারণ পিডিএম-এর কোনাে অঙ্গসংগঠন পিডিএম-এ যােগ দিয়ে তাদের নিজ নিজ দলীয় কর্মসূচি চিরকালের জন্য বিসর্জন দেয়নি। অতএব, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে তারা বিকিয়ে দেয়নি। স্পষ্টতই লক্ষণীয় যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সপক্ষত্যাগীদের ছয়-দফা সম্পূর্ণত বিসর্জন দেওয়ার সাধ্য ছিল না। আর সে জন্য তারা দাবি করেন যে, আট-দফা ফলত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নৈতিক বিজয়কেই সূচিত করে।৬১
পাকিস্তানী রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতায় পিডিএম-এর অভ্যুদয় অপ্রত্যাশিত ছিল না, বিশেষ করে এই কারণে যে, ছয়-দফার সূচনায় এর কার্যকারিতা নিয়ে আবদুস সালাম খান ও মওলানা তর্কবাগীশের মতাে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতারাও সন্দিহান ছিলেন। বস্তুত আবদুস সালাম খান ১৯৬৬ সালের কাউন্সিল অধিবেশনে উদ্বোধনী ভাষণে বলেছিলেন, “(জাতীয়) রাজনীতিতে ছয়-দফাই শেষ কথা নয়”—আর “কোনাে মহল বা গােষ্ঠী যদি পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে বৈষম্যের হিমালয় অপসারণে এগিয়ে আসে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তাকে স্বাগত জানাবে।”৬২ পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের সাথে তাঁর দরকষাকষির আলােচনায় হয়তােবা তাঁর এ রকম উপলব্ধি ও আস্থা জন্মাতে পারে যে, আট-দফা ছয়-দফার একটা সক্ষম বিকল্প হতেও পারে। আর বাস্তবিকপক্ষেও আট-দফা নিশ্চিতভাবেই ৫৬ সালের শাসনতন্ত্র থেকে উন্নততর ব্যবস্থা ছিল। এতে এমন সব দাবির বিষয় সন্নিবেশিত ছিল যেগুলি পূরণ হলে খুব জরুরি চাহিদাগুলি পূরণ হতে পারতাে। কিন্তু নিজ অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় পূর্ব পাকিস্তানের নিজ অধিকারের জন্য সুনির্দিষ্ট ও পূর্ব নির্ধারিত শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়াই যে দাবিগুলি পূরণ হবে তার গ্যারান্টি কি? পিডিএমপন্থী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতারা সম্ভবত সােহরাওয়ার্দীর একদাকৃত ভুলের পুনরাবৃত্তিই করতে যাচ্ছিলেন। সােহরাওয়ার্দী, বলাবাহুল্য, কোনাে কোনাে মৌলিক বিষয়ে রফা করে ভুল করেছিলেন। আর ছয়-দফা ছিল কোনাে এক বিশেষ কৌশলের প্রমাণিত ব্যর্থতাপ্রসূত পরিণামের ফল। এখন এ সব রাজনীতিক সেই একই জিনিসের ওকালতি করছিলেন। আট-দফা যা-ই ছিল পাকিস্তানে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ভালাে করে শেকড় গেড়ে থাকলে সেগুলিই পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পর্যাপ্ত হতে পারতাে। দেশ গঠনের বছরগুলিতে পাকিস্তান দেশে গণতান্ত্রিক আদর্শ ও রীতি গড়ে তুলতে পারেনি। মধ্যবর্তী বছরগুলিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিচালনায় বিরােধী প্রেসার গ্রুপগুলির প্রভাবপ্রতিপত্তি মােটেও কমেনি বরং পাকিস্তানী সমাজে আরাে মজবুত করে তাদের শেকড় গেড়ে বসার অনুকূলে আরাে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। আর তাই গােড়ার দিকে যে সব প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা ব্যাধির নিরাময় করতে পারেনি এ সব উপসর্গ আরাে ঘােরতর হওয়ায় এ সব চিকিৎসায় স্বাভাবিক কারণেই কোনাে ফলােদয় হয়নি। এ জন্য ছয়-দফাপন্থী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পিডিএম-এর কর্ম ও নীতিকৌশল প্রত্যাখ্যান করে।
১৫৩
পূর্ব পাকিস্তানে ছয়-দফার জনপ্রিয়তা ও আট-দফার প্রতি ঔদাসীন্য পিডিএম-এর কর্মসূচি গ্রহণে যে সব ঝুঁকি নিহিত সেগুলির কোনাে উপলব্ধির কারণেই ঘটে—এমনটি নাও হয়ে থাকতে পারে। তবে পিডিএমবিরােধী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতারা নিশ্চয়ই বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন ও পূর্ব পাকিস্তানের জনসমষ্টির এক বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ছয়-দফার প্রশ্নে স্পষ্ট অগ্রাধিকারের আদি ও প্রাথমিক (primordial) ভাবাবেগের আবেদন সৃষ্টি করে পিডিএম-এর আট-দফা যাতে প্রাধান্য না পায় তার নিবারণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। পিডিএম যদি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি-সচেতন জনসমষ্টির কোনাে একটা তাৎপর্যপূর্ণ অংশের জনমত তাদের অনুকূলে সংগঠিত করতে পারতাে তাহলে সফল হলেও হতে পারতাে। কেননা, হাজার হলেও এক শ্রেণীর পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিকের তরফ থেকে পিডিএম-এর প্রতি যথেষ্ট সমর্থন ছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে পিডিএম-এর জনসমর্থনের বুনিয়াদ প্রধানত এবডােমুক্ত রাজনীতিকদের ব্যক্তিগত অনুসারীদের মধ্যে নিহিত থাকায় পিডিএম-এর কর্মসূচি ছয়-দফা থেকে জনগণের মনােযােগ সরিয়ে সপক্ষে, আট-দফা কর্মসূচিতে নিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়।
পশ্চিম পাকিস্তানেও পিডিএম-এর একটা পাল্টা শক্তি গড়ে উঠছিল। যখন আদি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পিডিএম গঠনের পর ভেঙে পড়ছিল ও পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে কোনাে অঞ্চলে ছয়-দফা, সমাজবাদী অর্থনীতি ও এক ইউনিট বাতিলকে গুরুত্ব প্রদান করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের লাইনে আদি পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত করার পক্ষে স্পষ্টত সমর্থন পরিলক্ষিত হচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো এক নতুন রাজনৈতিক দল গড়ছিলেন।৬৩ পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রতিষ্ঠার সময়টি কাকতালীয় কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানে, বিশেষ করে, সিন্ধু ও বেলুচিস্তানে জোরালাে বুনিয়াদসহ পুনর্গঠিত পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অভ্যুদয় রােধ করার জন্য এক পরিকল্পিত উদ্যোগ—যা-ই হােক নেপথ্য ঘটনা আসলে কী ছিল তা নিরূপণ করা কঠিন। এমনও অসম্ভব নয় যে, পূর্ব পাকিস্তানে যেমন করে স্বায়ত্তশাসনবাদীদের অভ্যুদয় ঘটেছে তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানেও পিপিপির আবির্ভাব ঘটেছে স্বাভাবিকভাবেই। পক্ষান্তরে মনে হয়, পিডিএম-এর পরিকল্পনা করা হয়েছে। পাকিস্তানকে আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসনবাদী ও প্রগতিবাদী পিপিপির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। বলাবাহুল্য, ঘটনা যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে পিডিএম নিদারুণ ব্যর্থতাই বরণ। করেছে বলতেই হয়।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ক্রমেই তার মতাদর্শ প্রকাশে সােচ্চার ও অদম্য হয়ে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন:
ছয়-দফার মাধ্যমে আমরা চাই পূর্ব পাকিস্তানের অর্থ পূর্ব পাকিস্তানেই থাকুক। পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থও সেখানে থাকুক। এতে জাতিবিরােধী কী থাকতে পারে? যদি ছয়-দফা প্রশ্নে গণভােট দেওয়া হয় আর তাতে ছয়-দফার বিপক্ষে এমনকি ৩০ শতাংশও ভােট পড়ে আমরা ছয়-দফা কর্মসূচি ছেড়ে দেব।… (আমাদের বলুন) কেন আপনারা আমাদের
১৫৪
শত শত নেতাকর্মীকে বিনাবিচারে অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠে রেখেছেন?… গণদাবি মেনে নিন। কোনাে আন্দোলনের প্রয়ােজন আর থাকবে না। আমরা ক্ষমতা চাই না। আওয়াম লীগের অর্থনৈতিক কর্মসূচি সমাজতান্ত্রিক। আমরা এক সমাজবাদী অর্থনীতির মাধ্যমে শােষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই। স্বাধীনতা এই জন্য হাসিল করা হয়নি যে একটি বিশেষ অঞ্চলের দুইশটি পরিবার জনসাধারণের রক্ত শােষণ করবে এবং সারা দেশের (জাতীয়) সম্পদ গ্রাস করবে।৬৪
সমাজতন্ত্রী অর্থনীতির প্রতি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পক্ষপাতিত্বের বিষয়টি দৃষ্টত মনে হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অন্তত একাংশের মনে ধরে। কামারুজ্জামান করাচিতে সাংবাদিকদের তথ্য প্রদানের সময় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের চলতি পুনর্গঠন সম্পর্কিত বিস্তারিত উল্লেখ করে এই মর্মে ঘােষণা দেন যে, আওয়ামী লীগ পাকিস্তানে “শ্রেণীহীন সমাজ” ও “সংসদীয় গণতন্ত্র” চায়।৬৫ অবশ্য এ দুটি দাবি পশ্চিম পাকিস্তানের একই গােষ্ঠী না ভিন্ন ভিন্ন গােষ্ঠীর তরফ থেকে এসেছে তা স্পষ্ট নয়।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনপন্থী আওয়ামী লীগারদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কমাতে পারতেন। তিনি পারতেন খুব সহজেই চাষীসমাজ ও শহরের বামপন্থীদের সুসংগঠিত করতে। কেননা কৃষকনেতা হিসেবে তাঁর প্রতিষ্ঠা ও জনপ্রিয়তা বহুদিনের। তাঁর দল ছিল নিষিদ্ধ ঘােষিত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও কর্মীদের আশ্রয়। তিনি ‘৬০-এর দশকের মধ্যভাগে তাঁর চীনপন্থী অবস্থানের কথা ঘােষণা করেছিলেন। ঐ সময়টিতেই পূর্ব পাকিস্তানে চীনপন্থী বাম রাজনীতিকদের আবির্ভাব ঘটছিল। কিন্তু মওলানা ভাসানী রাজনৈতিক কার্যকলাপের কোনাে বােধগম্য ধারা দিতে পারেননি। এ কাজে সক্ষম হলে আওয়ামী লীগের প্রাধান্য ও আধিপত্যের একটা সম্ভাব্য বিকল্প তিনি দিতে পারতেন। আর তা পারেননি বলেই তার অবস্থান অপুনরুদ্ধারযােগ্যভাবে দুর্বল হয়ে যায়, ফলে তার দল প্রথমে মাঝামাঝি বরাবর দু’ভাগ হয়ে যায়। পরে যে উপদলটি তখনাে তার সাথে ছিল সেটিতেও ভাঙন দেখা দেয়। তবে সে যাই হােক, ন্যাপ ও আওয়ামী লীগের মধ্যেকার আঁতাত তখনাে সম্ভব ছিল।৬৬ কারণ, ভাসানী উল্লেখ করেছিলেন যে, এক ইউনিট, পররাষ্ট্রনীতি ও অর্থনীতির বিষয়ে আওয়ামী লীগ তার অবস্থান বা ভূমিকা বদলানাের পর আওয়ামী লীগের সাথে ন্যাপের মতপার্থক্য বহুলাংশেই দূর হয়েছে। পেছনের দিকে নজর দিলে মনে হবে যে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক মঞ্চেও পাকিস্তান পিপলস পার্টির আবির্ভাবের সাথে সাথে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বিশেষ করে, পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাপ নিজ পক্ষে সমর্থনের ভিত্তি সেখানে বাড়াতে না পারলেও যা ছিল তা বজায় রাখার জন্য খুব স্বাভাকিভাবেই মিত্রের সন্ধান করবে। তাই পুনর্গঠিত আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে কোনাে এলাকায় যার সমর্থন ছিল সেই দলটিকেই হয়তােবা তাই ন্যাপের কাছে তার সম্ভাব্য ত্রাতা মনে হয়ে থাকবে।
পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের কিছু নেতা (যারা মস্কোপন্থী বলে অভিহিত) তাদের দলের ভেতরের মতভেদ ও বিভক্তিকে সরকারের প্রতি দলীয় নীতি, একটি বিরােধীদলীয় যুক্তফ্রন্ট
১৫৫
গঠন, স্বায়ত্তশাসন ও আন্দোলনের প্রকৃতি নিয়ে মতপার্থক্যেরই ফল হিসেবে চিহ্নিত করেন। ন্যাপের আরেকটি উপদল (পিকিংপন্থী বলে পরিচিত) আলােচিত সরকারবিরােধী আন্দোলনের বিরােধী ছিল বলেই উল্লেখ করা হয়ে থাকে। তারা উল্লিখিত চারটি ইস্যু নিয়ে পুরােপুরি সরকারবিরােধী সম্মিলিত বিরােধীদলীয় মাের্চার আন্দোলনের জন্য তৈরি ছিল না। অধ্যাপক মােজাফফর আহমদও সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন, ন্যাপের (তথাকথিত) জাতীয়তাবাদী উপদলটি এখন আর (তথাকথিত) আন্তর্জাতিকতাবাদী উপদলটির সঙ্গে উল্লিখিত কারণগুলির জন্য কাজ করতে পারছে না।৬৭
উল্লিখিত বিভেদের কারণে ন্যাপই শুধু ভাগ হয়ে গেল না, মওলানা ভাসানীর ভাবমূর্তিও যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হলাে। ১৯৬৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় ন্যাপ রিকুইজিশনপন্থীদের সভায় শ্লোগান দেওয়া হয়: “ভাসানী আইয়ুব খানের দালাল”। মহিউদ্দিন আহমদ এক লিখিত বক্তৃতায় বলেন, দলের অন্য উপদলটি আইয়ুব সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে এই অজুহাতে যে, সরকার সাম্রাজ্যবাদবিরােধী আর সাম্রাজ্যবাদই দেশের প্রধান দুশমন। তারা অবশ্য জনসমক্ষে প্রকাশ্যে ব্যাখ্যা করছিলেন না, সরকার কেমন করে সাম্রাজ্যবাদবিরােধী ভূমিকা পালন করছেন। আবার সেই তারাই সরকারকে সরাসরি সমর্থনও দিচ্ছিলেন না অথচ সরকারকে ব্ৰিত না করার নীতি অনুসরণ করছিলেন ঠিকই। ৭ জুনের পরবর্তী আন্দোলনে শরিক না হওয়ার জন্য মহিউদ্দিন তার কথিত ন্যাপের অন্য উপদলটিকে। ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যায়িত করেন। এর জবাবে মাহমুদুল হক উসমানী বলেন, তাঁরা সাম্রাজ্যবাদবিরােধী। তবে তাই বলে তিনি একে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে গুরুতর জাতীয় সমস্যাগুলিকে খাটো করতে চাননি। তিনি আরাে উল্লেখ করেন যে, যখন, সংসদীয় গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, কিংবা মৌলিক অধিকার বলতে কিছুই দেশে নেই তখন সেখানে জনগণতন্ত্রের আলােচনা নিরর্থক। তিনি এই সাথে যােগ করে বলেন, জনগণের ক্ষমতা ছাড়া জনগণতন্ত্রও তাে অর্জিত হতে পারে না। তবে সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমেও সমাজবাদী সমাজ গড়া বেশ সম্ভব। তাঁর এ সব যুক্তি যদিও একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির আলােকে বলা তবু তিনি ন্যাপের বিভিন্ন গােষ্ঠী বা উপদলকে মস্কোপন্থী বা পিকিংপন্থী এভাবে আখ্যায়িত করার বিরােধিতা করেন। এ ফাটল বা বিভেদ দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলির সাথে সম্পর্কিত হলেও তিনি বলেন, এ সবই সত্যিকার অর্থে আসল ইস্যুগুলিকে ধামাচাপা দেওয়ার সমান।৬৮
তাই স্পষ্টত ন্যাপের বিভেদ দেশে সমাজতন্ত্র কায়েমের উপায় ও পন্থার মতাে আদর্শিক ইস্যুতে ঘটলেও বাস্তব তাৎপর্য ছিল এই যে, ভাসানীর নেতৃত্বে পরিচালিত বলে কথিত পিকিংপন্থীরা সরকারের প্রতি দলীয় নীতি কী হবে সে বিষয়ে ছিল দ্বিধান্বিত, পক্ষান্তরে কথিত মস্কোপন্থীরা সরকারবিরােধী ছিল সুনিশ্চয়।
ন্যাপের একাংশ কর্তৃক সরকারকে সমর্থনের কথা বলা হলেও স্পষ্টত দলটি সরকারের সমালােচনার উর্ধ্বে ছিল না, আর পূর্ব পাকিস্তানীদের সম্পর্কে আইয়ুব খানের অবমাননাকর। মন্তব্যে ভাসানী তখনাে ক্রুদ্ধ ছিলেন। তিনি তাঁর এই ক্ষুব্ধ মনােভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে
১৫৬
বলেছিলেন “প্রেসিডেন্ট হয়তাে ভুলে গেছেন যে পাকিস্তানীদের শতকরা ৫৬ জনের বাস এই পূর্ব পাকিস্তানেই।”৬৯
ন্যাপসহ অন্যান্য বিরােধীদলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সমর্থন না থাকায় ছয়-দফা আন্দোলনের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া কিছুটা কম হলেও পূর্ব পাকিস্তানে এটি মনােযােগের কেন্দ্র হয়েই থাকে, এর প্রেরণাও এ অঞ্চলের মানুষের মনে গভীর শেকড় গাড়ে। এটি অত্যন্ত রেখাপাতযােগ্য বিষয় যে, বিভ্রান্তি ও বিভেদের সেই আমলেও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তুলনামূলকভাবে নবীন নেতা যারা তখন জেলের বাইরে ছিলেন তাঁরা দলীয় কর্মসূচির প্রতি দৃঢ়চিত্তে অটল ও অবিচল থাকেন যদিও বিরােধী পক্ষের বাকিদের অনেকে ও কোনাে কোনাে খােদ দলীয় সদস্য তাদেরকে দাবির স্বরগ্রাম খাদে নামিয়ে আপােসমনা নেতাদের সঙ্গে হাত মেলানাের জন্য রাজি করাতে চেষ্টা চালায়। এমনকি, আওয়ামী লীগের কথিত সাংগঠনিক দুর্বলতাও৭০ ঐ সময়ে (পূর্ব পাকিস্তানে) দলের দায়িত্বে আসীন আওয়ামী লীগারদের বিশ্বাস ও প্রত্যয়ে ফাটল ধরাতে পারেনি। এ থেকে দেখা যায়, তাঁরা যথাপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁদের হেতু প্রয়ােগের ধারাটি ছিল এই যে, একবার এই জনপ্রিয় আন্দোলন পরিত্যাগ করার পর দরকষাকষির আলােচনা শুরু হলে সে আলােচনা যদি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে বিকল্প পথ খােলা থাকবে না।৭১ তাই তাঁদের এ ভূমিকায় তাঁদের একটা বড় মাপের রাজনৈতিক পরিপকৃতার প্রতিফলন ঘটেছে, অত্যন্ত স্পষ্ট হয়েছে, কোনাে ব্যক্তিত্বের মহিমায় নয় কিংবা কেন্দ্রবিরােধীর নেতিবাচক মনােভঙ্গির কারণেও নয় বরং তারা ছয়-দফা কর্মসূচির ইতিবাচক উদ্দেশ্যে বিশ্বাসী ছিলেন বলেই দলীয় কর্মসূচিতে অটল ছিলেন। এই বিশ্বাসই তাঁদেরকে ও এ আন্দোলনকে সঠিক পথে রেখেছে। অন্য সব বিরােধীদল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কোনাে বাস্তব বিকল্প হয়ে উঠতে না পারায় সরকারের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়, কেননা ক্ষমতাসীন শাসকচক্রের স্বার্থে একান্ত জরুরি আওয়ামী লীগকে নিবীর্য করার কাজটি সম্ভব হয়নি। সরকারের সামনে একটি মাত্র পথই খােলা ছিল। তা হলাে, বিভিন্ন আঞ্চলিক আন্দোলন ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের স্বার্থে দীর্ঘ সাহচর্যে দলটির যে বৈধতার ভিত গড়ে উঠেছে তাতে আঘাত হানা। এ কাজটি করাও হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ছয়-দফা কর্মসূচির প্রধান প্রবক্তা শেখ মুজিব যিনি ১৯৬৬ সালের মাঝামাঝি থেকেই কারাগারে ছিলেন তাঁকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে।৭২ এ ধরনের ব্যবস্থার নেপথ্যে উদ্দেশ্য ছিল শেখ মুজিবকে খলনায়ক হিসেবে দেখানাে ও সেভাবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে জনমত গড়ে তুলে “হিন্দু” ভারতের বিরুদ্ধে মুসলিম ভাই-বেরাদরির পক্ষে সরকারের পেছনে লােকজন। জড়াে করা। প্রত্যাশিত ছিল যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে “ভারতের দালাল” হিসেবে কলঙ্কিত করা গেলে অপবাদদুষ্ট আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের কাছে তার বৈধতা হারাবে। যারা এ কৌশলের প্রণেতা তাঁরা সম্ভবত ১৯৬৬ সালে নুরুল আমিন যে সব কথাবার্তা বলেছিলেন সে ধরনের কথাবার্তায় উৎসাহিত হয়েছিলেন। নুরুল
১৫৭
আমিন বলেছিলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদের কথা এমনকি কারও ভাবনায় এলেও সে দোষে প্রকাশ্য আদালতে তার বিচার ও যথাযােগ্য শাস্তি হওয়া উচিত।৭৩ তবে ষড়যন্ত্র মামলার কাজ চলাকালে ক্ষমতাসীনচক্র এ ধরনের বিবৃতি বা কথাবার্তায় যে জনপ্রতিক্রিয়া হতে পারে সে সম্পর্কে ধারণা নিতে স্পষ্টত ব্যর্থ হয়। বরং শাসকগােষ্ঠীর এ প্রয়াসে উল্টো ফল দর্শায়। পূর্ব পাকিস্তানে জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া বিলম্বিত হলেও প্রমাণিত হয় যে, আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রদ্রোহে লিপ্ত—এ অতিকথায় তারা বিশ্বাস করে না। বস্তুত সরকারিভাবে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ নামে আখ্যায়িত মামলাটি বরং শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা এবং আস্থাযােগ্যতা বাড়িয়ে আওয়ামী লীগকে নবজীবন দান করে ও পূর্ব পাকিস্তানে এ দলের বৈধতা অনেকখানি বেড়ে যায়।
গােড়ার দিকে, ষড়যন্ত্রের কথা ঘােষণা এবং এ ষড়যন্ত্রে শেখ মুজিবের জড়িত থাকার বিষয়টি পূর্ব পাকিস্তানী রাজনীতিক ও আওয়ামী লীগারদের স্তম্ভিত করে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের প্রায় সকলেই কারাগারে ছিলেন। কোনাে কোনাে নেতা দলত্যাগ করে পিডিএম-এ যােগ দেন। বহু গুরুত্বপূর্ণ দলকর্মী আত্মগােপন করেন এবং দলের প্রতি সহানুভূতিশীল গােষ্ঠী ভীতিতে পড়েন। অনেকের মতে, দলের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আমেনা বেগম নিশ্চিত জানতেন যে, শেখ মুজিব ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আঘাত হানতে কোনাে উপায়ই বাদ রাখা হবে না। তবে তারপরেও তাঁর বিশ্বাস ছিল যে দেশব্যাপী জনআন্দোলন ঘটলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে।৭৪ তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রকাশ্য বিচার এবং প্রচলিত আইনের আওতায় ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়ে এক বিবৃতি দেওয়া।৭৫ সরকার নিজ পদক্ষেপের নির্ভুলতা প্রমাণ করার আশায় সম্ভবত এই মামলার প্রকাশ্য শুনানির সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৬৮ সালের এপ্রিলে এক অধ্যাদেশবলে প্রেসিডেন্ট সাবেক প্রধান বিচারপতি এসএ রহমান, বিচারপতি মুজিবুর রহমান ও বিচারপতি মকসুমুল হাকিমকে নিয়ে রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য মামলার বিচার পরিচালনার জন্য এক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন।৭৬ ঢাকার কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন মামলা শুরু হয়। এখানেই মামলার সকল অভিযুক্তকে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী আইনে ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি থেকে আটক রাখা হয়েছিল।
এ রকম এক পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগাররা শঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা বুঝতে পারে এ মামলায় শেখ মুজিব দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি কেবল দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকেই অপসারিত হবেন না বরং এ ঘটনা দলের কার্যত অবসান ঘটাবে ও দলের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অর্জনে যে সব বুনিয়াদ রচনামূলক কাজ ইতােমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে সেগুলিও নিশ্চিহ্ন হবে। এ জন্য সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে অত্যন্ত সীমিত লক্ষ্য স্থির করা হয় আর সেটি হলাে, যে কোনাে উপায়ে শেখ মুজিবের মুক্তি হাসিল করা।৭৭ মামলার আইনগত প্রক্রিয়াটি পরিচালনার জন্য
১৫৮
আওয়ামী লীগাররা কৌঁসুলি নিয়ােগ করে এবং ব্যয় নির্বাহের জন্য চাঁদা তুলে তহবিল গঠন করে।৭৮ দ্বিতীয়ত, জনসভা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অনেকটা প্রচ্ছন্নভাবে হলেও স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের লক্ষ্যে গণমত সংগঠনের কর্মসূচি বজায় রেখে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতারা দলের স্থানীয় ইউনিটগুলিকে বিপদ ও ঝামেলার বিষয়গুলি বিশদ অবহিত করেন। এবং শেখ মুজিবের মুক্তি দাবির লক্ষ্যে বিক্ষোভের জন্য তাদেরকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে তৈরি করেন। তৃতীয়ত ও সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন যে কাজটি করা হবে বলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতারা স্থির করেন তা হলাে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের সঙ্গে একটা বােঝাপড়ায় আসা যাতে করে তারাও শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য পূর্ব পাকিস্তানের দাবির। প্রতি সমর্থন জানান।৭৯
যখন মামলার বিচার অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছিল তখন গােটা রাজনৈতিক তৎপরতা চলছিল অনেকটাই নিচু লয়ে। একজন ভাষ্যকার এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, এই মামলার। কারণে মনে অপরাধ থাকলে যা হয় সে রকমভাবেই বিরােধীদলের নেতারা শামুকের মতাে খােলসের মধ্যে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়েছেন—যেন তারা চাচ্ছেন সব কিছু বিলকুল সাফ—এ রকম সবুজ সঙ্কেত না পাওয়া অবধি ওরকম চুপটি মেরেই থাকবেন।৮০ তবু ন্যাপের উভয় উপদলের সভাসমিতির তুলনায় আওয়ামী লীগের জনসভাগুলিতে ভালাে। জনসমাগম হতে থাকে।৮১
আগরতলা মামলার বিচার শুরুর সময় নাগাদ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ: ‘এক পা এগুনাে ও দু’পা পেছানাের কৌশল বের করে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবির পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন গড়ে তােলার জন্য। সেই অনুযায়ী ১৯৬৮ সালের ৪ জুলাই ওয়ার্কিং কমিটির অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে জনগণের কাছে এক সম্মিলিত আন্দোলন পরিচালনার আহ্বান জানানাে হয়।৮২
অবশ্য, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এ পদক্ষেপকে অনেকে রক্ষণশীল পিডিএম-এর বিরুদ্ধে এক পাল্টা শক্তি গড়ে তােলার উদ্যোগ বলে ব্যাখ্যা করেন। আর এ সবের ফল হিসেবে বেশ কিছু জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। এগুলির অন্তর্ভুক্ত ছিল, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (ভাসানী) ও পিপিপির এক জোট গঠনের সম্ভাবনা। এ ধরনের কোনাে সম্মিলিত আন্দোলনের স্বার্থে কোনাে ব্যাপকতর আদর্শের (ও আবশ্যিকভাবে প্রগতিশীল ধ্যানধারণা) জন্য ছয়-দফা কর্মসূচির অপরিবর্তনযােগ্যতা বিসর্জন দেওয়ার আবশ্যকতা দেখা দেয়। এ জন্য মনে করা হয় যে, এ লক্ষ্যে কোনাে উদ্যোগের সাফল্য কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সক্রিয় কামারুজ্জামান এবং প্রাদেশিক পর্যায়ে সক্রিয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আমেনা বেগমের মতাে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতারা নিজেদের সংগঠনের “কিছু পুরানাে বটবৃক্ষ” উৎপাটনে নিজেদেরকে কতখানি ভালাে করে তৈরি করেন তার ওপর নির্ভর করবে।৮৩
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতারা সুনিশ্চিতভাবে নিজেদেরকে তৈরি করেছিলেন। তবে তা আগাগােড়া ভিন্ন এক উদ্দেশ্যে। সেটি হলাে, আগের মতাে ছয়-দফা কর্মসূচিকে দরকষাকষির বাইরে রেখে আশু প্রয়ােজনে সাহায্য-সহায়তাও যুগপৎ সংগ্রহ করা। শেষােক্ত
১৫৯
কাজটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের সমর্থন নিয়ে গণআন্দোলনে শেখ মুজিবের মুক্তি আদায় করা। এই অনুসারে ১৯৬৮ সালের অক্টোবরে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভা কতিপয় জরুরি দাবি আদায়ের জন্য জনগণের কাছে অনতিবিলম্বে এক সম্মিলিত আন্দোলন শুরুর আহ্বান জানান। এ জন্য চার পর্যায়ের কার্যসূচি ঘােষণা করা হয়। এগুলি হলাে: (১) সভা ও মিছিল; (২) ধর্মঘট; (৩) অসহযােগ; ও (৪) প্রয়ােজনে, শান্তিপূর্ণ আইন অমান্য কার্যক্রম। পরের এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করে এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় গৃহীত অন্যান্য প্রস্তাবের অন্তর্ভুক্ত ছিল: সকল রাজবন্দীর মুক্তি এবং ছয়-দফা বাস্তবায়নের জন্য জনগণকে সংগঠিত করে তােলার আহ্বান।৮৪
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্মিলিত আন্দোলনের আহ্বানে আশু সাড়া পরিলক্ষিত না হলেও পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক প্রবণতায় একটা বােধগম্য পরিবর্তন সে সময় ঘটে। মওলানা ভাসানী সরকারকে এতদিন যে (পরােক্ষ) সমর্থন দিয়ে আসছিলেন তা প্রত্যাহার করেন। তিনি আইয়ুব খানের অনতিবিলম্বে পদত্যাগ দাবি করেন, কেননা সরকার গরিবদের অবস্থার উন্নতি বিধানে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি স্বীকার করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি “প্রদেশের সর্বসম্মত দাবি”।৮৫ স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের বৈধতার প্রশ্নে তাঁর এই স্বীকৃতি পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুববিরােধী আন্দোলনে তাঁর সংশ্লিষ্টতার সূচনা করে। তিনি শেখ মুজিবের মুক্তির জন্যও এ আন্দোলনকালে জোর দাবি জানান। আর শেষে এই আন্দোলনই প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের পতনে বিরাট ভূমিকা পালন করে। পরিস্থিতির এ সব পটপরিবর্তন সুনিশ্চিতভাবেই পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের আধিপত্যশীল ভূমিকার ইঙ্গিতবাহী। দলটি স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন সূচনা করার পর বহু বাধার মুখে একে এগিয়ে নেওয়ার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক আন্দোলনের পুরােধায় চলে আসে।
১৬০
অষ্টম অধ্যায়
আইয়ুববিরােধী আন্দোলন
পাকিস্তানে ১৯৬৮-৬৯ সালের গণআন্দোলনের জোয়ার সরকারের সযত্নে গড়ে তােলা ভঙ্গুর বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে। জনসাধারণের সাধারণ আশা-আকাঙ্ক্ষা যথাবিবেচনায় নিয়ে সেগুলি মেটাতে প্রশাসন ব্যবস্থার ব্যর্থতার কারণেই এটি ঘটে। কথাটা এভাবেও বলা যায়। যে, এতে পাকিস্তানের আধা-গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার অক্ষমতাই প্রমাণিত হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদই (APSAC) প্রধানত আইয়ুববিরােধী বিক্ষোভের সূচনা ও পরিচালনা করে। আর এ আন্দোলনের মধ্যে অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের দীর্ঘকালের অসন্তোষের সর্বসম্মত বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আরাে একটি সমান তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলাে, প্রদেশের সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলের অবস্থানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের উত্তরণ এই অ্যাপস্যাকের অবদান। এগারাে-দফা দাবির সনদে১ ছয়-দফা ফর্মুলাকে অন্তর্ভুক্ত করে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছয়-দফা ফর্মুলা, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে নবশক্তি দান করে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এভাবে নব প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত না হলে পাকিস্তানী রাজনীতির পরবর্তী গতিপ্রকৃতি ভিন্ন ধারার হতে পারতাে।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এগারাে-দফাকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরের গােড়ার দিকে অ্যাপস্যাক গঠিত হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সংগঠনটিকে সাধুবাদ জানায়। তবে ছয়-দফার আশু প্রয়ােজনীয়তা ও এগারাে-দফার চূড়ান্ত অনিবার্যতার মধ্যে একটা কৌশলগত পার্থক্য সব সময় বজায় রাখা হয়।
এগারাে-দফার প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের গােড়ার দিকের সন্দেহ-সংশয়কে এভাবে যুক্তির বুনিয়াদ দেওয়া যায় যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কৌশলগত কারণেই ছাত্রদেরকে স্বতন্ত্র শ্রেণী হিসেবে রাখতে চেয়েছিল যাতে ছাত্রসমাজের সচলতা আরাে অনেক ফলদায়ক হয়। প্রস্তাবিত বিরােধী ফ্রন্টের অনিশ্চিত প্রকৃতি ও অ্যাপস্যাকের গঠনবিন্যাস—এই উভয় কারণেও হয়তােবা এই কৌশল গ্রহণ করা হয়ে থাকবে।
১৬১
অ্যাপস্যাকের তিন অঙ্গ সংগঠন: ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) ও ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) মধ্যে ছাত্রলীগ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যাবলির২ সাথে একাত্ম ছিল। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) ছয়-দফাকে ছাত্রলীগের মতাে “মুক্তি সনদ” হিসেবে গ্রহণ করেনি। কেননা, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া) (বা পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি)৩ ধারণা অনুয়ায়ী ছয়-দফা দেশে সমাজতন্ত্র কায়েমের পর্যাপ্ত সাধনী নয়। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) ছয়-দফা ফর্মুলা বা স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের কোনােটিকেই প্রকাশ্যে সমর্থন জানায়নি। তারা তাদের বিক্ষোভ স্বতন্ত্রভাবে পরিচালনা করে। পুলিশের নিষ্ঠুরতা ও অন্যান্য নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাদিই মনে হয় দুর্ভোগ-দুর্দশার মধ্যে এদের সবাইকে একে অন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসে। ১৯৬৮ সালের গােটা বছর জুড়ে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সংগঠনগুলি সম্মিলিত কিংবা স্বতন্ত্র থেকে বিভিন্ন বিক্ষোভ খণ্ড খণ্ডভাবে পরিচালনা করে। ফলে প্রদেশব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ও ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক হলগুলি বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাপক ধরপাকড় চলে, পুলিশ গুলি চালায়। মাঝে মাঝে এদের কোনাে কোনাে সংগঠন, বিশেষ করে, মতিয়াপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন অগণতান্ত্রিক শাসকগােষ্ঠীকে ক্ষমতাচ্যুত করতে অভিন্ন দুশমনের বিরুদ্ধে প্রত্যয়ী এক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে সকল বিরােধীদলের মধ্যে ঐক্যের প্রয়ােজনের দিকে মনােযােগ আকর্ষণ করে।৪
পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্ররা যখন এক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তােলার চেষ্টা করছিল ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এক প্রগতিবাদী বিরােধী ফ্রন্ট গঠন নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছিল ঠিক সেই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানেও গােলযােগের খবর পাওয়া যায়। লান্ডিকোটালের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক হাঙ্গামা ঘটে। ১৯৬৮ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের এই গােলযােগে পুলিশের গুলিবর্ষণে কয়েকজন ছাত্রের প্রাণহানি ঘটে। প্রধান ন্যাপ নেতা ওয়ালী খান ও উদীয়মান পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে গ্রেপ্তার করা হলে সরকারবিরােধী ছাত্রবিক্ষোভ আরাে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৮ সালের ১৯ নভেম্বর গােটা পশ্চিম পাকিস্তানে হরতাল পালিত হয়।৫ পূর্ব পাকিস্তানী ছাত্ররা প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করে। তারা বিরােধীদলগুলির মধ্যে নতুন করে ঐক্যের আহ্বান জানায়। ঐ সময় তারা নিজেরাই সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন ও এগারাে-দফা প্রণয়ন চূড়ান্ত করে।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কোনাে কোনাে নেতা ছাত্রদের সাথে নিজেদের ঐক্যের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তবে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচ্ছন্ন অনুমােদন সত্ত্বেও তারা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে এগারােদফাকে অনুমােদন করিয়ে নিতে পারেননি। এই সময়ে শেখ মুজিব ছিলেন কারাগারে।৬ এগারাে-দফার আনুষ্ঠানিক অনুমােদন হয়তাে খন্দকার মােশতাক আহমদের মত অনুযায়ী কিছু সদস্য বিরােধিতা করতে পারতেন কারণ খন্দকার মােশতাক মনে করতেন এগারাে-দফা ছয়-দফাকে নিষ্প্রভ করার জন্যেই প্রণীত হয়েছে।৭
১৬২
রাজনীতিকদের স্তরে সবচেয়ে প্রবল ও কার্যকর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন মওলানা ভাসানী। ন্যাপ (ভাসানী) ও এই দলের অঙ্গ সংগঠন যেমন, কৃষক সমিতি ও শ্রমিক ফেডারেশন কর্তৃক ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকায় এক সভায় মওলানা ভাসানী প্রেসিডেন্টকে “ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে অবসর জীবনযাপন করার জন্য বলেন। পাকিস্তান আন্দোলনের সময় যে সব অঙ্গীকার করা হয়েছিল সেগুলি মেনে চলার ও পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার জন্য তিনি ক্ষমতাসীন শাসকচক্রের প্রতি আহ্বান জানান। অন্যথায় তিনি এই মর্মে হুমকি দেন যে, এভাবে এই দাবি উপেক্ষিত হতে থাকলে পূর্ব পাকিস্তানীরা এক “স্বাধীন পূর্ব বাংলা”র জন্ম দেবে।
ভাসানী ৭ ডিসেম্বর হরতালের ডাক দেন। ঐ দিন পুলিশী অত্যাচার-নিপীড়ন সরকারের মুখােশ পুরাে উন্মােচন করে এবং অগণতান্ত্রিক শাসকগােষ্ঠীর অবসানের লক্ষ্যে জনগণের লাগাতার সংগ্রামের সূচনা হয়। ঐ একই দিন সন্ধ্যায় মওলানা ভাসানী যখন গভর্নর হাউস অভিমুখে এক বিশাল মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন গভর্নরের কাছে এক স্মারকলিপি পেশ করার জন্য সেই সময়ে আওয়ামী লীগ, পিডিএম, পিপিপি, নিজাম-এ-ইসলাম ও ন্যাপ (মােজাফফর) সাড়ে ছয় ঘণ্টার এক দীর্ঘ আলােচনার পর পরের দিন হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেন।৮ আইয়ুব খান ডিসেম্বরের পয়লা সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি মন্তব্য করেন, বিরােধীদল সংকল্প এঁটেছে রক্তপাত তারা ঘটাবেই।”৯ বাস্ত বিকপক্ষেই এ রকম পরিণতির জন্য এ সব উস্কানি যেন পরিকল্পিতই ছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ৭ ডিসেম্বর হরতালের সময় নিহতদের জন্য গায়েবানা জানাযা নামাজে পুলিশের কুৎসিত, নগ্ন হস্তক্ষেপ ঘটে। তারা ধর্মীয় নামাজের অনুষ্ঠান থেকেও লােকজনকে টানাহেঁচড়া করে।১০
১৯৬৮ সালের ৭ ডিসেম্বরের ঘটনা দিয়ে শুরুর পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক আবহাওয়ায় যথেষ্ট পরিবর্তন দেখা দেয়। ভাসানীর প্রতিক্রিয়া খােদ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়ার তুলনায় বিস্ফোরক পরিস্থিতির সাথে বেশি সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। পাকিস্তান আওয়ামী লীগ যখন সম্মিলিত বিরােধী পক্ষের এক সমন্বিত কর্মসূচি নিয়ে আলােচনায় অবতীর্ণ তখন মওলানা ভাসানী এই উল্লেখমাত্র করেন যে, প্রস্তাবিত বিরােধী পক্ষের উদ্দেশ্য নির্বাচনে লড়া নয় বরং এর কাজ হবে সমাজবাদী কাঠামাের এক নতুন শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা যার আওতায় থাকবে সর্বজনীন বয়স্ক ভােটাধিকার এবং সকল অঙ্গ ইউনিটের জন্য (অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের চার প্রদেশের জন্য) পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। এখানে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়টি হলাে এই, ১৯৫৭ সালে তিনি যে ধ্যানধারণা ব্যক্ত করেছিলেন স্বায়ত্তশাসনের সংজ্ঞায়নে তিনি সে কথাগুলিই পুনর্ব্যক্ত করেন।১১
রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে সমঝােতার কিছু কিছু আভাস দেখা যাচ্ছে বলে মনে হলেও প্রতিটি দলকেই যেন অন্যের সাফল্যের স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত বলে মনে হয়। মূল ইস্যু নিয়ে তখনাে তারা ঐকমত্যে আসতে পারেনি। আদতে মূল ইস্যু ছিল: গঠনের বা আকারের দিক থেকে আংশিক গণতান্ত্রিক অথচ সারবস্তুর দিক থেকে অগণতান্ত্রিক এক
১৬৩
ব্যবস্থার আওতায় আয়ােজিত নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সরকারের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করাই যথেষ্ট হবে? না, একটা গণআন্দোলন অনিবার্য? যদি গণআন্দোলনই করতে হয় তা কি কেবল আইয়ুব খানকেই গদিচ্যুত করার লক্ষ্যে পরিচালিত হলেই হবে? না আন্দোলনের কিছু অর্থনৈতিক দাবিদাওয়াও থাকা দরকার? ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে কিছু সংশােধনী হলেই চলবে? না ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন চাওয়া হবে? চরম বাম ও চরম ডানপন্থীদের যেমন বহু রাজনৈতিক দল, উপদল/গােষ্ঠী ছিল তেমনি তাদের মতামতও ছিল অনেক ধরনের। ন্যাপ (ভাসানী) নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিরােধী ছিল। এ দল সাধারণভাবে এক সাম্রাজ্যবাদবিরােধী গণআন্দোলনে বিশ্বাস করতাে। তবে দলের কিছু লোেক গণউত্থানের পক্ষপাতী ছিল। তাদের মতে, এ গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হবে ‘ঘেরাও কর্মসূচি দিয়ে। তবে তাদের সমালােচকরা এ ধরনের কর্মসূচিতে কতকগুলি মৌলিক বিষয়ের অনুপস্থিতির প্রতি মনােযােগ আকর্ষণ করেন। গণঅভ্যুত্থান হতে হলে কর্মী ও চাষীদের মাঝে অত্যন্ত শক্তিশালী সাংগঠনিক বুনিয়াদ থাকতে হবে, থাকতে হবে সুপ্রশিক্ষিত ক্যাডার শ্রেণী ইত্যাদি। তাদের সুনিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে, দুর্দশাপীড়িত অপ্রস্তুত গণমানুষ এ আন্দোলনে হিতে বিপরীত ঘটাতে বাধ্য। ন্যাপের অন্য অংশ তথা ন্যাপ (ওয়ালী) যা পূর্ব পাকিস্তানে ন্যাপ (মােজাফফর) বা ন্যাপ (মস্কো) নামে অভিহিত এই দলটি ছিল সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় সামাজিক পরিবর্তনে বিশ্বাসী। দলটি বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় যা কিছু সুযােগ-সুবিধা পাওয়া যায় তা কাজে লাগাতে তৈরি ছিল। এই দলের মতে, কোনাে সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণীর অস্তিত্ব না থাকায় একমাত্র বিকল্প হলাে বহু শ্রেণীভিত্তিক আন্দোলন। প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তি ও সাম্রাজ্যবাদীদের ক্রীড়নকরা যাতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দখল না করতে পারে সে জন্য ন্যাপ (মােজাফফর) ছয়-দফাপন্থী আওয়ামী লীগের সাথে, এমনকি, পিডিএম-এর উদারপন্থী অংশের সাথে হাত মিলিয়ে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনে নামতেও তৈরি ছিল। পিডিএম—যাকে কার্যত মৃতবৎবিরােধী ফ্রন্ট বলা যায়—ছিল কার্যত বিভক্ত। এনডিএফ-এর প্রতিনিধি মাহমুদ আলী নির্বাচনের সকল স্তরে অংশগ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগার সালাম খান কেবল নির্বাচনের নিম্নতম স্তরে অর্থাৎ মৌলিক গণতন্ত্র স্তরে অংশগ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। পিডিএম-এর অন্য কিছু সদস্যের মতে, ছয়-দফাপন্থী আওয়ামী লীগ এবং দুই ন্যাপ তাদের সাথে যােগ না দিলে কোনাে সিদ্ধান্তই কার্যকর হবে না। নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান ও মিয়া মমতাজ দৌলতানা পশ্চিম পাকিস্তানে জনবিক্ষোভের অবস্থা দৃষ্টে বিরােধীদলের প্রাথমিক নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও নিজাম-এ-ইসলাম প্রয়ােজনে মৃদু নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনসহ নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুকূলে মত ব্যক্ত করে। জামায়াত-ই-ইসলামী সরকারের অপসারণ চাইলেও তারা শান্তিপূর্ণ আইন অমান্যভিত্তিক কোনাে আন্দোলনের জন্য তৈরি ছিল না, কেননা তাতে বিত্তবানদের স্বার্থে বিরূপ আঘাত পড়তে পারে। তাছাড়া, স্পষ্ট আদর্শিক কারণেও জামায়াত-ই-ইসলামী ন্যাপের সাথে কোনাে
১৬৪
যৌথ কর্মসূচিতে হাত মিলাতে তৈরি ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ উভয় ন্যাপের সঙ্গে যৌথ আন্দোলনের জন্য তৈরি ছিল, কিন্তু ন্যাপ (মােজাফফর) ন্যাপ (ভাসানী)-এর সঙ্গে কাজ করতে রাজি ছিল না। দৃষ্টত তখনকার পূর্ব পাকিস্তানী রাজনীতি (পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিও) ছিল জটিল এক হেঁয়ালি ভরা ধাধা বিশেষ।১২ অথচ সে তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ সর্বদাই যে কোনাে বিরােধীদলীয় আন্দোলনের পুরােভাগে থেকে দ্বিধান্বিত কুণ্ঠিত রাজনীতিকদের পিছে ফেলে স্বকীয় রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন তাদের আদর্শগত মতপার্থক্য পেছনে ফেলেঅ্যাপস্যাক বা সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনে এগিয়ে আসে। তারা ১৯৬৯ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনের ঐতিহাসিক বটতলায় এক সভায় মিলিত হয়। এই সভায় তারা তাদের সর্বাত্মক রাজনৈতিকীকরণের আভাস দিয়ে ঘােষণা করে যে, ছাত্র সম্প্রদায়ের কিছু সুনির্দিষ্ট দাবিদাওয়ার জন্য লড়লেও তারা যুগপৎ অন্যান্য আর্থরাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলিতেও অংশগ্রহণ করবে কেননা সমাজেরই একটি অংশ হিসেবে জনগণের দুঃখ-দুর্দশায় তারা উদাসীন থাকতে পারে না। ধর্মঘটের ডাক অবশ্য স্থগিত করা হয়১৩ দৃষ্টত রাজনীতিক যারা তখনাে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন তাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ঘন ঘন সলাপরামর্শ করছিলেন মওলানা ভাসানীর সঙ্গে আর সেটি স্পষ্টত সঠিক কৌশল সম্পর্কিত পরামর্শ লাভের জন্য—তাঁকে বিরাট আকারে সরকারবিরােধী বিক্ষোভ আন্দোলনে খুবই প্রয়ােজনীয় নেতৃত্ব দিতে বলার জন্য না হলেও। আর এও নিশ্চিত ছিল যে, সেই সময় নাগাদ সরকারের সঙ্গে মওলানা ভাসানীর মধুচন্দ্রিমা শেষ হয়ে যায়। তিনি আর তখন এই ভ্রান্তিবিলাসী যুক্তির নিগড়ে বন্দী ছিলেন না যে, সমাজতান্ত্রিক দেশের সাথে কোনাে সরকার বন্ধুভাবাপন্ন হলে তা দেশে সমাজতন্ত্র প্রবর্তনের সম্ভাব্য সাধনী হিসেবে কাজ করতে পারে। এখন তাঁর এই বাস্তবতার উপলব্ধি ঘটে যে, সমাজের যে পুনর্নির্মাণে তিনি বরাবরই প্রয়াসী তা নিয়ন্ত্রকদের দ্বারা আরােপিত হবে এমন আশা করা যায় না, কারণ সে ক্ষেত্রে তাদের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হতে বাধ্য। তিনি আরাে জানতেন, এ ধরনের সমাজ-পরিবর্তন রাতারাতি সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়ােজন সুদীর্ঘ সংগ্রামের। তবে এ কথা ঠিক যে, সূচনা তাে একটা করতেই হয় আর সে জন্য প্রথমে সাধারণ মানুষকে তাদের স্থবির, জড়, অলস অবস্থা থেকে অবশ্যই জাগিয়ে তুলতে হবে।১৪ আর এই কারণেই কোনাে সুযােগ এলে তা কাজে লাগাতেও হবে। এর ফল হিসেবে আমরা যা দেখি তা হলাে মওলানা ভাসানীই সেই ব্যক্তি যিনি প্রয়ােজনে জেলের দেওয়াল ভেঙে শেখ মুজিবকে মুক্ত করার জন্য প্রত্যয়-দৃঢ় আহ্বান জানিয়ে পূর্ব পাকিস্তানী যুবক-তরুণদের মনে বিপ্লবী চেতনার আগুন জ্বালিয়েছিলেন।
কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতারা এগুচ্ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক পদবিক্ষেপে, বিকল্প উপায়গুলি হাতে রেখে। তাঁরা মওলানা ভাসানীর সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করছিলেন, ছাত্রদের কর্মসূচির প্রতি সমর্থনও জানাচ্ছিলেন। আবার, যারা যৌথ ফ্রন্ট গড়ায় আগ্রহী
১৬৫
তাদের সাথেও কথা বলছিলেন। পরিশেষে তাঁরা যােগ দেন আটদলীয় গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদে (Democratic Action Committee)। আনুমানিক তিন মাসের আলােচনার পর ১৯৬৯ সালের জানুয়ারির গােড়ার দিকে ড্যাক (DAC) গঠিত হয়। এই ড্যাক প্রকৃতপক্ষে গঠিত হয় পিডিএম (Pakistan Democratic Movement), নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (ছয়-দফাপন্থী), জমিয়তুল উলেমা-ই-ইসলাম ও ন্যাপ (ওয়ালী)-কে নিয়ে। ন্যাপ (ভাসানী) বা পিপিপি কেউই ড্যাকে যােগ দেয়নি।১৫ ড্যাক নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আর আট-দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। তবে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি তাতে ছিল না। এ কারণে, ড্যাকে যােগদানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত রীতিমতাে হেঁয়ালি মনে হতাে কিন্তু এ-ও দেখার মতাে বিষয় যে, ড্যাকের কর্মসূচির ৫নং দফায় শেখ মুজিবুর রহমান, খান আবদুল ওয়ালী খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ সকল রাজবন্দী, ছাত্র, শ্রমিক ও সাংবাদিকের মুক্তির দাবিটি ছিল। এই দফায় রাজনীতিবিদ সম্পর্কিত এমন সকল ঝুলে থাকা আদালতের মামলা প্রত্যাহারই কেবল নয় ট্রাইব্যুনালগুলির আওতাধীন মামলাগুলির প্রত্যাহারও অন্তর্ভুক্ত ছিল।১৬ আগেই ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ব্যাপকতর সমর্থনের প্রয়ােজন ছিল। তাছাড়া, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতাদের জন্য ছাত্রদের রাজনীতির অতিমাত্রায় বামপন্থীকরণ ঠেকানাের এটিই ছিল একমাত্র পথ। এটি তাদের নিজ অবস্থান বজায় রাখা নিশ্চিত করতেও দরকার ছিল। তৃতীয়ত, এই পন্থা ছাত্র উদ্যোগ ও উদ্যমের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা থেকে তাদের রক্ষাও করে। অবশ্য, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ড্যাকে যােগদানের জন্য তার নিজ কর্মসূচিকে বিসর্জন দিতে হয়নি। ড্যাক যখন গঠন পর্যায়ে ছিল তখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক সভা কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। এ সব প্রস্তাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, ছয়-দফা আদায় ও সকল স্তরে নির্বাচন বয়কটের লক্ষ্যে ব্যাপকভিত্তিতে গণআন্দোলন সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল।১৭ ছয়-দফার প্রতি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অঙ্গীকারের কথা আরাে একবার প্রমাণিত হয় ১৯৬৯ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত গােলটেবিল বৈঠকে। ঐ বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমান ছয়-দফা কর্মসূচিতে অটল থাকেন ও পরে, ড্যাক পরিত্যাগ করেন। তবে ড্যাকের সাথে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের একটি সম্পর্ক না থাকলে এ দলের হয়তাে কখনাে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সাথে সরাসরি সংলাপের অবকাশ ঘটতাে না—এ কথা বােধগম্য। এই পদক্ষেপের সুবাদে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পাকিস্তানে কথিত অন্য জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলির সমান মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়। তবু নিরেট বাস্তবতাও থেকে যায়। সেটি হলাে সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলােকে ড্যাক যে কর্মসূচি দিতে পারে তার চেয়ে ভিন্ন কর্মসূচি দেওয়া প্রয়ােজনীয় হয়ে পড়ে। তাই অ্যাপস্যাক ১৯৬৭ সালে মূলত যা স্থির হয়েছিল সেই কর্মসূচি শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্ত তখনই বস্তুত নেওয়া হয় যখন ছাত্ররা নিশ্চিত হয় যে, ড্যাকে ডানপন্থীদের আধিপত্যের কারণে কোনাে পূর্ণ গণতান্ত্রিক কর্মসূচি
১৬৬
নিতে গেলে তারা তাতে বাধা দেবে। তাই তারা বরং অনুরূপভিত্তিতে আন্দোলনের ডাক দেওয়ার জন্য ড্যাককে চাপ দেয়।১৮
ড্যাক এ চাপে সাড়া দেয়নি। তবে অ্যাপস্যাক পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুববিরােধী আন্দোলনে এক তৃতীয় মাত্রা যােগ করে। আইয়ুবী শাসনের অবসানের জন্য পূর্ব পাকিস্তানী দাবির সাথে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিটিও যােগ করা হয়। এর সাথে উন্নততর সামাজিক ন্যায়বিচার-সংক্রান্ত বিষয়ে আরাে কিছু দাবি যােগ করে গােটা দাবিদাওয়াকে আরাে মজবুত করে তােলা হয়। ছাত্রদের এগারাে-দফায়১৯ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত ফর্মুলা অঙ্গীভূত করে নেওয়া ছাড়াও শিল্প ব্যবস্থায় পরিবর্তন, ব্যাংক, বীমা ও বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলির জাতীয়করণ ও চাষীদের ওপর করভার কমানাে, শ্রমিকদের উন্নততর মজুরি প্রদানের দাবিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ সব দাবি অবশ্য পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ/পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে নিয়মিত বৈশিষ্ট্য হিসেবেই অস্তিত্বশীল ছিল। তবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য মধ্যপন্থীদের থেকে ব্যতিক্রম হিসেবে অ্যাপস্যাক এক ধরনের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম বা কার্যব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প বেছে নেয়। এটি বিশেষ করে ঘটে ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণে একজন আইনের ছাত্রের মৃত্যুর পর।২০ ২৫ জানুয়ারি অ্যাপস্যাক সেনাবাহিনী ও ইপিআর-এর সদস্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানায় এবং ঘােষণা করে যে, তাদের দাবিদাওয়া পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ছাত্ররা তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। তারা। জানায়, অ্যাপস্যাক বৃহত্তর কর্মসূচির বিস্তারিত ঘােষণা করবে। আপাতত জনগণ যাতে আরাে তীব্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে সে জন্য জনগণের প্রতি-
১. জেলা, মহকুমা, থানা, গ্রাম পর্যায়ে এবং সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানে অ্যাপস্যাকের স্থানীয় ইউনিটের সহযােগিতায় কমিটি গঠন;
২. অ্যাপস্যাকের কর্মসূচি প্রচারের জন্য পুস্তিকা, প্রচারপত্র ও পােস্টার বিতরণ এবং মাইক্রোফোন সহযােগে পথিপার্শ্বে সভার আয়ােজন, জনগণকে সংগঠিতকরণ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন; এবং
৩. শৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আবেদন জানানাে হয়।
এ ছাড়াও ছাত্র ও শ্রমিকদের প্রতি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনে এগিয়ে আসার অনুরােধ জানানাে হয়।২১
পূর্ব পাকিস্তানে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর নিপীড়ন, নিষ্পেষণ ছাড়াও মাঠে কর্মরত চাষী, শিশুকে স্তন্যদানরত মাতা এবং রুটি কিনতে আসা শ্রমিকের ওপর পুলিশের নির্বিচার। গুলিবর্ষণে পশ্চিম পাকিস্তানেও ক্রোধের সঞ্চার হয়। ফলে লাহাের, করাচি, পেশােয়ার, ও গুজরানওয়ালায় সেনা তলব করা হয়।২২
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অস্থায়ী সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে ছাত্রদের সাথে একস্বরে বলেন যে, পরিস্থিতি এমন সীমায় পৌঁছেছে
১৬৭
যখন পশুর মতাে মানুষ হত্যাকে নীরব দর্শকের মতাে দেখা আর সম্ভব নয়। তিনি সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, এ সব অত্যাচার-নিপীড়ন সরকারের নিজ অবস্থান বজায় রাখতে যেমন সহায়ক হবে না তেমনি তা ১২ কোটি মানুষের উত্থানকেও দমিয়ে রাখতে পারবে না । এ কারণে, এখন সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে সরিয়ে নেওয়ারই উত্তম সময়। অন্যথায়, তিনি জানান, খুব দেরি হয়ে যাবে।২৩
বিক্ষোভ-নিপীড়ন-সহিংসতার ঘন ঘন পুনরাবৃত্তি যত ঘটছিল নিপীড়নের সব হাতিয়ার, প্রধানত পুলিশ ও ইপিআর প্রয়ােগের কার্যকারিতাও কমে যাচ্ছিল। বিভিন্ন সময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছিল এমনকি তারা তাদেরকে দেওয়া কাজ করতেও আগ্রহী নয়।২৪ আর এ জন্য সেনাবাহিনী তলবের দরকার পড়ে। স্পষ্টতই আইয়ুব সরকারের এ ছিল শেষ অবলম্বন। কেননা, এর অল্পকালের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট “দায়িত্বশীল” রাজনৈতিক দলগুলির সাথে আলােচনায় বসতে তার ইচ্ছার কথা ঘােষণা করেন।২৫
অ্যাপস্যাক এ প্রস্তাবের জোর বিরােধিতা করে। কেননা, তাদের বিবেচনায় এ প্রস্তাব এগারাে-দফার অনুকূলে গণআন্দোলন থেকে মনােযােগ বিভ্রান্ত করার এক ধোকা মাত্র।২৬ অ্যাপস্যাকের শীর্ষ দশ নেতার সাথে এক সাক্ষাৎকারে দৈনিক আজাদের একজন স্টাফ রিপাের্টার বলেন, তিনি যতদূর ছাত্রদের দেখেছেন তাতে এগারাে-দফা কোনােক্রমেই দরকষাকষিযােগ্য নয়। আজাদ-এর এই প্রতিবেদক ছাত্রদের এই দশ শীর্ষ নেতাকে “জানুয়ারি আন্দোলনের মস্তিষ্ক ও এগারাে-দফার প্রধান হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এই ছাত্রনেতারা কোনাে ব্যক্তি, গােষ্ঠী বা কোনাে দলের সঙ্গে সহযােগিতার প্রশ্নে তাদের দৃঢ় ভূমিকার কথা খুব পরিষ্কার করে বলেন যে, এই সহযােগিতা এগারাে-দফার প্রশ্নে তাদের অবস্থান কী সেই শর্তসাপেক্ষ হবে। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তাঁরা বলেন:
আমরা প্রশাসনিক ব্যবস্থার কাঠামােগত পরিবর্তন চাই, স্রেফ সরকার পরিবর্তন নয়…. আমরা এগারাে-দফাবিরােধী যে কোনাে সরকারের বিরােধিতা করবাে…. সরকারকে উৎখাত করে একটি পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করার পর পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, অবশিষ্ট একচেটিয়া পুঁজির সম্পূর্ণ বিলুপ্তি, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, চাকরিজীবী ও ছােট ও মাঝারি শিল্পমালিকদের নানা সমস্যার সমাধান না হওয়া অবধি আমাদের আন্দোলন থামবে না।২৭
ওপরে বর্ণিত লক্ষ্য, ও উদ্দেশ্যগুলিতে ছাত্রসমাজের বিভিন্ন স্তরের মতের প্রতিফলন রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনসমাজের প্রেক্ষাপটে এই অভিমতে কেবল শহুরে শিক্ষিতদের অনুভূতিই নয় বরং নিরক্ষর, অর্ধশিক্ষিত, রাজনীতিক না হলেও দারিদ্র্য-সচেতন পূর্ব পাকিস্তানী সমাজের স্তরগুলির অনুভূতিও নিহিত রয়েছে। তবে এ সব কিছুর পরেও কিছু কিছু দ্বিধা-সংশয় ছিল—এও সত্যি। যেমন, “গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রকৃতি ঠিক কী হবে? অর্থনীতির গঠন কাঠামাে কী হবে যা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ এবং ছােট ও মাঝারি আকারের শিল্পপতিদের স্বার্থ যুগপৎ রক্ষা করবে? এ সব ও আরাে অন্যান্য খুঁটিনাটি বিষয়ের রূপরেখা চিহ্নিত করে দেওয়া হয়নি। আর সম্ভবত এগারাে-দফার এ রকম
১৬৮
প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের কারণেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাছে এগুলি তুলনামূলকভাবে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণযােগ্য হয়ে ওঠে কেননা এ দলটিও কমবেশি অনুরূপ লক্ষ্য অর্জনের কথাই বলে আসছিল লক্ষ্যগুলি অর্জনের পদ্ধতিগুলি কী হবে তার উল্লেখ না করেই। অ্যাপস্যাকের অস্পষ্টতার কারণ তার নিজ গঠনবিন্যাসে নিহিত। প্রথমত, এই কমিটিতে প্রতিনিধিত্বকারী ছাত্র সংগঠনগুলির ছিল বিভিন্ন ধরনের আদর্শিক ঝোঁক বা প্রবণতা। দ্বিতীয়ত, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন দুই ন্যাপের সাথে শিথিলভাবে সম্পর্কিত যদিও। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের দ্বিধাবিভক্তি ঘটে ন্যাপের বিভক্তিরও আগে। আর এ বিভক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভক্তির। বস্তুত আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভক্তির পরপরই ছাত্র ইউনিয়ন বিভক্ত হয়। জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন বা এনএসএফ ছিল মূলত ক্ষমতার কায়েমি গােষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার। তবে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এর অবস্থান ও নেতৃত্ব বদলায় যদিও। সুনিশ্চিতভাবেই এ সংগঠন দুই ছাত্র ইউনিয়নের কোনােটিরই আদর্শের অংশীদার ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ তার অনানুষ্ঠানিক পিতৃ রাজনৈতিক সংগঠনের মতােই ছিল মূলত মধ্যপন্থীদের এক কোয়ালিশন বিশেষ যেখানে মধ্যবাম ও মধ্যডান উভয় তরফের লােক ছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাথে এর নিবিড় সম্পর্ক, ছাত্রলীগ থেকে নিয়মিতভাবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে নিয়মিত সদস্যভুক্তি একদিকে ও অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে প্রত্যক্ষ ও নিবিড় সম্পর্কের কারণে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নিঃসন্দেহে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠন হয়ে ওঠে। তাই ছাত্রলীগ অ্যাপস্যাকের অবশিষ্টদের প্রতি তর্জনী নির্দেশের মতাে অবস্থানে থাকায় শেষােক্ত সংগঠনের “বিপ্লবী” কর্মসূচি লঘু ও জলাে হয়ে যায়।
অ্যাপস্যাকের অভ্যন্তরে সুসংবদ্ধতার অভাব সদস্যদের যে কোনাে আলােচনার ভিত্তি সম্পর্কে তাদের নিজ নিজ অবস্থান ও ভূমিকায় প্রতিফলিত। একটি অত্যন্ত অস্পষ্ট অভিমতে বলা হয় যে, আলােচকের আন্তরিকতা সম্পর্কে ছাত্ররা নিশ্চিত হলেই কেবল দরকষাকষি হওয়াটা সম্ভব ছিল। আরেকটি অপেক্ষাকৃত স্পষ্ট মত হলাে এই যে, এগারাে-দফার বিরােধিতা করা হবে না—এই মর্মে প্রতিশ্রুতিই কোনাে দরকষাকষির জন্য যথেষ্ট ছিল। তৃতীয় অভিমত ছিল এই যে, ছাত্রদের নিজেদের সম্পর্কিত সকল দাবিদাওয়া গৃহীত হলে, সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দেওয়া হলে, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করা হলে, সর্বজনীন বয়স্ক ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের ঘােষণা দেওয়া হলে, এবং সর্বোপরি এগারাে-দফারভিত্তিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের সুনিশ্চিত আশ্বাস দেওয়া হলেই কেবল আলােচনা ও দরকষাকষি সম্ভব ছিল। অবশ্য অ্যাপস্যাকের চূড়ান্ত ও সংখ্যাগরিষ্ঠ বা চতুর্থ মতটি হলাে এই যে, “আমরা জানি, এগারাে-দফা তথা জনসাধারণের দাবি মেনে নেওয়ার অর্থ হবে খােদ। সরকারের নিজের অস্তিত্বহীন হয়ে পড়া—এ কথা সরকারেরও জানা। তাই তারা যদি কোনাে প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে একান্ত স্ব-স্বার্থে তারা তা ভাঙতে বাধ্য আর সে কারণেই। এগারাে-দফা নিয়ে দরকষাকষির কোনাে প্রশ্ন উঠতে পারে না।”২৮
১৬৯
আজাদ ঐতিহ্যগতভাবে এক রক্ষণবাদী সংবাদপত্র। এহেন খবরের কাগজও কিছুটা উদারনৈতিক হয়ে ওঠে। পত্রিকাটি ইতােমধ্যে আইয়ুব সরকারের রােষানলেও পড়েছিল। যে দিন প্রেসিডেন্ট প্রাদেশিক রাজধানীতে আসছিলেন ঠিক সেই দিনটিকেই বেছে নিয়ে আজাদ এগারাে-দফার ওপর এক বিশেষ ফিচার প্রকাশ করে। এই বাস্তবতাটি ছিল এই মর্মে পরিষ্কার আভাস যে, পূর্ব পাকিস্তানে সরকারের কর্তৃত্ব নিতান্তই নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।
আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানে পৌঁছে সংবাদপত্রগুলিকে জানান যে, তিনি জরুরি অবস্থা, পাকিস্তান দেশরক্ষা আইন ও অধ্যাদেশ ব্যবহার প্রত্যাহারের বিষয় বিবেচনা করছেন। এ ছাড়া সরকারের আপােসরফার মনােভাবের অন্যান্য আভাসও পাওয়া যায়। পূর্ব পাকিস্তানে তার অবস্থানকালে নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসের বাজেয়াপ্তি প্রত্যাহার করা হয়। ন্যাপ (মাে)-এর মােজাফফর আহমদ ও আলতাফ হােসেনের মতাে কিছু রাজবন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে তাঁর এই পরীক্ষামূলক কৌশল অবলম্বনের ঘটনায় খুব একটা কাজ হয়নি। অ্যাপস্যাকের মেজাজ নরম করার কোনাে আভাসই ছিল না। বরং এ ধরনের রেয়াত বা ছাড়ে ছাত্ররা এগারাে-দফা নিয়ে কোনাে রকম দরকষাকষির বিরুদ্ধে তথা এগারাে-দফাকে কোনাে রকম ক্ষুন্ন করার বিরুদ্ধে আরাে অটল হয়ে দাঁড়াতে উৎসাহিত হয়। সাম্প্রতিক কয়েক বছরের মধ্যে বৃহত্তম বলে বর্ণিত পল্টন ময়দানে অ্যাপস্যাকের জনসভায় তােফায়েল আহমদ, আবদুর রউফ, মােস্তফা জামাল হায়দার, সাইফুদ্দিন মানিক, ফখরুল ইসলাম, মাহবুবুল্লাহ, ইবরাহিম খলিল, খালেদ মােহাম্মদ আলী ও শামসুদ্দোহা তাঁদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, এগারাে-দফার চেয়ে কোনাে কিছু কম হলে তাতে কাজ হবে না। উল্লেখ করে বলা হয় যে, বহু দোষারােপিত রাজনীতিকদের সাথে আলােচনায় বসার জন্য প্রেসিডেন্টের প্রস্তাব, ইত্তেফাক-এর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, জরুরি অবস্থা ও পাকিস্তান দেশরক্ষা আইন প্রত্যাহার—এ সবই এই ইঙ্গিত বহন করে যে, গণআন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী শাসনের বুনিয়াদ ধসে পড়ছে। ছাত্ররা দাবি করে বিজয় তাদের প্রায় করায়ত্ত। প্রয়ােজনে বিক্ষুব্ধ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিবের নিঃশর্ত মুক্তিসহ অন্যান্য দাবি মেনে নিতে বাধ্য করার বিষয়টি তারা দেখবে। প্রস্তাবিত গােলটেবিল বৈঠক আন্দোলনের বিজয়ের পথে এক ধাপ অগ্রগতি ধরে নেওয়া হলেও একে সংগ্রামের পথ থেকে জনগণকে বিভ্রান্ত করার ধূম্রজাল হিসেবেও বর্ণনা করা হয়। এ কথা বলা হয় যে, প্রথমে দাবিদাওয়াগুলি পূরণ না করা হলে ছাত্ররা আলােচনার ধারণাকে সমর্থন করবে না। ঐ সভায় এই পূর্বশর্তগুলি প্রস্তাবাকারে পাস করা হয়। প্রস্তাবগুলির অন্তর্ভুক্ত ছিল: শেখ মুজিব, ওয়ালী খান, ভুট্টো, মণি সিং ও আব্দুল জব্বারের মুক্তি, আগরতলা মামলাসহ সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার, পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনবলে আটক ছাত্রসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি, প্রাদেশিক গভর্নর মােনেম খানের পদত্যাগ, আন্দোলন চলাকালে যে সব সরকারি কর্মকর্তা বাড়াবাড়ির সাথে জড়িত তাদেরকে জরিমানা, আন্দোলনে যে সব ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন তাদের পরিবারের জন্য পেনশন, পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনাগুলি সম্পর্কে বিচার বিভাগীয় তদন্তানুষ্ঠান, মােহাম্মদ তােয়াহা, জ্ঞান চক্রবর্তী, সুখেন্দু দস্তিদার,
১৭০
কাজী জাফর আহমদ, মােহাম্মদ ফরহাদের মতাে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে হুলিয়া প্রত্যাহার, সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সংখ্যালঘু অধ্যাদেশসহ সকল কালাকানুন বাতিল, কৃষক, শ্রমিক ও বেতনধারীদের দাবি পূরণ ইত্যাদি। এমনিভাবে, অ্যাপস্যাকের ব্যাপক ব্যাপ্তি এবং মূলধারার রাজনীতিতে সর্বাত্মক ছাত্রসংগ্রামের বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার।২৯
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আনুমানিক ২৫০ জন সাক্ষীর শুনানি এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জবানবন্দীর কাজ ১৯৬৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়। এই মামলায় সরকারের প্রধান কৌঁসুলি মঞ্জুর কাদির ১৯৬৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বাদীপক্ষের যুক্তি প্রদর্শন শুরু করেছিলেন তবে আদালতের প্রসিডিংস ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মুলতবি করা হয় ও পরে এই মুলতবি আদেশ ১০ মার্চ, ১৯৬৯ পর্যন্ত বাড়ানাে হয়। ইতােমধ্যে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে দেশ থেকে জরুরি অবস্থা ও পাকিস্তান দেশরক্ষা আইন প্রত্যাহার করা হয়। আর পরিশেষে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সকল আসামিকে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি দেওয়া হয়। পাকিস্তান সরকারের এক প্রেসনােটে ব্যাখ্যা দেওয়া হয় যে, জরুরি আইন প্রত্যাহারের সাথে কোনাে রকম ভুল বােঝাবুঝি এড়ানাের জন্য মৌলিক অধিকার পুনর্বহাল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করা হয়েছে আর সেই পটভূমিতেই শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে।”৩০
সরকার আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের যে টেকনিক্যাল আইনগত কারণই দেখিয়ে থাকুন না কেন, বাস্তবিকপক্ষে গণউত্থানের কারণেই সরকার ঐ সিদ্ধান্ত দিতে বাধ্য হন। পরিশেষে মােনেম খানও ২২ মার্চ ১৯৬৯ পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে রাওয়ালপিণ্ডি রওনা হন। তিনি আর তাঁর পদে ফিরে আসেননি। আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট পদে ইস্তফা দিয়ে ক্ষমতা ছাড়েন। কিন্তু ইতােমধ্যে, “দরকষাকষির আলােচনার নামে আরাে অনেক রক্তপাত ঘটে। অ্যাপস্যাক ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে পরিবর্তনের দ্বার উন্মােচনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয় সে পরিবর্তন পরবর্তীকালে যতই সামান্য প্রতিভাত হােক না কেন।
এগারাে-দফা বিকিয়ে কোনাে আপােস হবে না—এই মর্মে অ্যাপস্যাকের ঘােষণার প্রতি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছাড়াও তাতে সমর্থন ঘােষণা করে কলকারখানার শ্রমিকরা। জোরালাে সমর্থন জানিয়েছিলেন, উপমহাদেশে বিক্ষোভ রাজনীতির অন্যতম পুরােধা মওলানা ভাসানী। ভাসানী পরপর কয়েক দফা জনসভায় পরিষ্কার উল্লেখ করেন যে, এগারাে-দফা দাবির অস্বীকৃতি পূর্ব পাকিস্তান মেনে নেবে না। শুধু তাই নয়, ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ন্যাপ (ভাসানী)-র এক সভায় তিনি ঘােষণা করেন যে, অহিংস নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের দিন অতিক্রান্ত হয়েছে, এবার আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায় হবে সহিংস ও অনিয়মতান্ত্রিক। তিনি আরাে ঘােষণা করেন, তার এক সময়ের সহপথযাত্রী শেখ মুজিব ও অন্যদের যদি অবিলম্বে মুক্তি না দেওয়া হয় তাহলে ফরাসী বিপ্লবের সময়কার মতাে জনসাধারণ জেলের তালা ভেঙে তাদের মুক্ত করবে।
১৭১
তিনি আরাে বলেন, এগারাে-দফা দাবি পূরণ না করা হলে জনগণ খাজনা ও কর পরিশােধ বন্ধ করে দেবে। পরিস্থিতি সম্পর্কে ভাসানীর মূল্যায়ন জনগণের ঐ সময়ের ক্রোধানুভূতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। আগরতলা মামলার অন্যতম প্রধান আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যার পর জনগণের মাঝে এ ক্রুদ্ধ অনুভূতির সৃষ্টি হয়। ক্যান্টনমেন্ট কারাগারের একজন প্রহরী সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা করে। তাঁর লাশ যখন মিছিল করে দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন ঢাকার অধিবাসীরা পথিমধ্যে কয়েকটি ভবনে আগুন লাগিয়ে দেয়। এর মধ্যে চার কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রীর সরকারি ও বেসরকারি বাসভবন, রাষ্ট্রীয় অতিথিভবন, আগরতলা মামলার জন্য গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানের সরকারি বাসভবন, পূর্ব পাকিস্তান কনভেনশন মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তানের আহ্বায়কের বাসভবন, কনভেনশন মুসলিম লীগের তৎকালীন কার্যালয় ভবন ও একই দলের নির্মীয়মাণ কার্যালয় ভবন, ঢাকা জিমখানা ক্লাবের কোনাে কোনাে অংশ ও একটি ছাপাখানা রয়েছে।৩১
শেখ মুজিবের মুক্তি সম্পর্কে মওলানা ভাসানীর উল্লেখ এক নতুন শ্লোগানের জন্ম দেয়: “জেলের তালা ভাঙবাে, শেখ মুজিবকে আনবাে” আর তা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটিকে এই মর্মে প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করে প্রস্তাব নিতে শক্তি যােগায়: প্রেসিডেন্ট ও রাজনীতিকদের মধ্যে প্রস্তাবিত গােলটেবিল বৈঠকে ড্যাকের যােগদানের জন্য আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবি। ইতঃপূর্বেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৬৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি গােটা পূর্ব পাকিস্তানে ‘শেখ মুজিব দিবস’ ও ‘ছয়-দফা দিবস পালিত হয়। করাচি আওয়ামী লীগও শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করে। বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা আব্দুল মান্নান নারায়ণগঞ্জের আদমজিনগরে এক শ্রমিক সমাবেশে ঘােষণা করেন যে, শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া না হলে কলকারখানার শ্রমিকরা এক বিরাট আন্দোলন শুরু করবে। রুহুল আমিন ও মওলানা সাইদুর রহমানের মতাে অন্যান্য শ্রমিক নেতা একই ধরনের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।৩২ তাৎপর্যপূর্ণভাবে সৈয়দ নজরুল ইসলামও বলেন, “আজকে আমাদের সগ্রামের বিভিন্ন স্তর বা পর্যায়কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে।”৩৩ স্পষ্টত এ কথা বলার মধ্য দিয়ে তিনি আভাস দিয়েছিলেন যে কেবল ড্যাক বৈঠকে, এমনকি গােলটেবিল আলােচনাতে অংশগ্রহণই সব নয়, বরং ধরে নিতে হবে এ সব হলাে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানাের উপায়।” এই পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ছিল দলের অস্তিত্ব রক্ষা আর সেটি অনেকখানিই নির্ভর করছিল দলনেতার বেঁচে থাকার ওপর। তাই নানা সমস্যার জট একাদিক্রমে ও অগ্রাধিকারের ধারাবিন্যাসে সমাধানের দরকার ছিল, যেমন, প্রথমে নেতার অস্তিত্বরক্ষা, পরে দলের অস্তিত্বরক্ষা ও শেষে স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্বরক্ষা। আর তাই যে কৌশল তথা সীমিত লক্ষ্যে ড্যাকে যােগদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে কড়াকড়ি নৈতিক ধারণায় একটা সুবিধাবাদের গন্ধ পাওয়া গেলেও সে সিদ্ধান্ত ছিল বাস্তবসম্মত। এই বাস্তববাদ যে কোনাে সঙ্কটে বরাবরই আওয়ামী লীগের জন্য তুরুপের তাসের কাজ করেছে। শেখ মুজিবের মুক্তি এখন আর কেবল পূর্ব পাকিস্তানের দাবি নয়—এ কথার
১৭২
শাণিত উল্লেখ করেছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর বক্তৃতায়। তাতে ড্যাকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের যােগদানের প্রকৃতি কী তার একটা পরিষ্কার ইশারা রয়েছে। যদিও ড্যাকের কর্মসূচি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কর্মসূচি থেকে অনেক সীমিত। ড্যাক স্টাইলে গণতন্ত্রায়নের প্রয়ােজনীয় সূচনামাত্র হবে বলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের যুক্তি বাহ্যত বােধগম্য হলেও তাতে পিডিএম-এ যােগদানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের রূঢ় স্কুল প্রত্যাখ্যানের ব্যাখ্যা মেলেনি, কারণ, পিডিএম-এরও লক্ষ্য ছিল অন্তত কিছু না হলেও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতন্ত্রায়ন। অবশ্য ধরে নেওয়া চলে, পিডিএম যদি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজানাের পর গঠিত হতাে তাহলে সম্ভবত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য পিডিএমকে কাজে লাগাতাে।
শেখ মুজিবের মুক্তির প্রশ্নে মওলানা ভাসানীর ভূমিকা ও অবদান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জন্য শক্তির উৎস হলেও তাতে হুমকিও যুগপৎ প্রচ্ছন্ন ছিল। আন্দোলন খুব বেশি মারমুখী হয়ে গেলে পরিস্থিতি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ঘােষিত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সীমার বাইরে চলে যেতে পারতাে আর তাতে বিপন্ন হতে পারতাে দলের নেতা, দল এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কল্পনার পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ। এ ছাড়াও ড্যাকের আট-দফার মধ্যে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবির অন্তর্ভুক্তি পশ্চিম পাকিস্তানী সংশ্লিষ্ট নেতাদের অনুমােদনকেও সূচিত করেছে। তাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কোনাে কোনাে নেতা যদি এই মর্মে আশাবাদী হয়ে থাকেন যে, শেষাবধি ছয়-দফাও পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের কাছে গ্রহণযােগ্য হয়ে উঠতে পারে তাতে তেমন বিস্ময়ের কিছু নেই। ১৯৬৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তিলাভের অব্যবহিত পর তাজউদ্দিন আহমদ এক বিবৃতিতে চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে চলতি আন্দোলনে দেশের উভয় অঞ্চলের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন। তাঁর এই বক্তব্য দেওয়ার নেপথ্য নিয়ন্ত্রক কারণটি নিশ্চয়ই ছিল আন্দোলনের পরিস্থিতির সহিংসতায় পর্যবসিত হওয়ার আশঙ্কা এবং যুগপৎ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রত্যাশা। অল্পকাল পরেই তাঁকে আন্দোলনের পূর্ববর্তী ঘটনাপ্রবাহের পূর্ণ বিশদ বিবরণ অভিহিত করা হলে তিনি বলেন, গণআন্দোলন ও রাজনীতিকদের আলাপ-আলােচনা একইসঙ্গে চলতে থাকবে। বস্তুত এতে স্বীয় বিকল্পগুলি ভােলা রাখতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কৌশলই প্রতিফলিত হয়। তবে তিনি আন্দোলনের প্রকৃতি কী হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি।৩৪
কাজেই এখন আন্দোলনের মনােযােগের মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের নিঃশর্ত মুক্তি। কেননা দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একমাত্র তিনিই গােলটেবিল বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। তবে সাম্প্রতিককালে যে সব নেতাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয় ও যারা কঠিন সঙ্কটময় বছরগুলিতে দলকে পরিচালনা করছিলেন তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই যােগাযােগের অভাব ঘটে থাকবে। ড্যাকের লাহাের বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অবস্থান সম্পর্কে কিছু প্রারম্ভিক
১৭৩
বিভ্রান্তি দেখা দেয় বলেই মনে হয়। কেননা, সাধারণ সম্পাদক ও ভারপ্রাপ্ত সভাপতির মধ্যে মতভেদের একটা আভাস পাওয়া যায়। অবশ্য এই মতপার্থক্যের দ্রুত নিষ্পত্তি হয়ে যায় এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অন্যতম ডেলিগেট (প্রতিনিধি) ময়েজুদ্দিনকে ঢাকায় পাঠানাে হয় শেখ মুজিবের স্ত্রীর মাধ্যমে তাঁকে অবহিত করানাের জন্য যে, তিনি যেন প্যারােলে মুক্তি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। তখন এই মর্মে এক গুজব রটেছিল যে, শেখ মুজিব হয়তাে প্যারােলে গােলটেবিল আলােচনায় যােগ দিতে পারেন। আর এ প্রস্তাব তাজউদ্দিনের সবুজ সঙ্কেতে তিনি নাকি মেনে নিয়েছেন। মুজিব এ পরামর্শ শুনতেন কিনা তা নিশ্চিত ছিল না তবে এও ঠিক এ সম্ভাবনার বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছিল।৩৫ মওলানা ভাসানীও শেখ মুজিবকে প্যারােলে মুক্তি না নেওয়ার জন্যেই পরামর্শ দিয়েছিলেন বলেই বিশ্বাস করা হয়। অবশ্য গােলটেবিল বৈঠকে মওলানার কোনাে কিছুই করার ছিল না। কারণ, তিনি এই গােলটেবিল বৈঠককে দেশকে কজা করে রাখার জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত হিসেবে নিন্দা করেন।৩৬
কোনাে কোনাে রাজনীতিবিদ গােলটেবিল বৈঠকে যােগদানের ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পূর্বশর্ত প্রেসিডেন্টকে মেনে নিতে সম্মত করানাের ব্যাপারে ড্যাকের সাফল্য নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা করেন। তারা আশা করেন যে, গােলটেবিল সম্মেলনে দেশের গণতন্ত্রায়নের লক্ষ্যে কিছু ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে। আর তার ফলে স্বাভাবিক রাজনৈতিক তৎপরতার দ্বার উন্মােচিত হবে। অন্য কিছু রাজনীতিক এ বিষয়ে তাঁদের সংশয় প্রকাশ করলেও উভয় তরফের রাজনীতিবিদরা পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদের ভূমিকার প্রশংসা করেন। কেননা, ছাত্ররা পূর্ণ উদ্যম ও বিপুল অধ্যবসায়সহকারে তাদের বিক্ষোভ প্রদর্শন অব্যাহত রাখে। পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণও তাঁদের আহ্বানে বিপুলভাবে সাড়া দেন। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হত্যার খবর এলে ঢাকাবাসীরা “সামুদ্রিক জলােচ্ছাসের মতাে ঢাকার রাস্তায় মানুষের ঢল নামায়।”৩৭
আন্দোলনের প্রথম প্রয়াসেই সাফল্য তথা বিজয় প্রায় হাতের মুঠোয় এসে যায়। ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত এক ভাষণে বলেন, তিনি পরবর্তী নির্বাচনে দাঁড়াবেন না। ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয় এবং শেখ মুজিবসহ অন্যান্য বামপন্থী নেতা যেমন, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির মণি সিং প্রমুখকে মুক্তি দেওয়া হয়। শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের তথ্য ও বেতারমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন কর্তৃক গােলটেবিল সম্মেলনে আমন্ত্রিত হন।
কারামুক্তির অব্যবহিত পরই শেখ মুজিব মওলানা ভাসানীর সাথে বৈঠকে মিলিত হন ও এগারাে-দফার প্রতি তাঁর সমর্থন ঘােষণা করেন।৩৮ অ্যাপস্যাক শেখ মুজিবের জন্য গণসংবর্ধনার আয়ােজন করে। আর তার মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব ও অ্যাপস্যাক। নেতৃত্বের মধ্যে পরিপূর্ণ সমঝােতার বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যময় ও বিশিষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। শেখ মুজিব তাঁর ভাষণে বলেন, তাঁর মুক্তিতে ছাত্রদের বিজয়ই সূচিত হয়েছে।
১৭৪
তিনি এগারাে-দফার প্রতি তাঁর সক্রিয় সমর্থনের আশ্বাস দেন। এই মর্মে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে, (গােলটেবিল আলােচনায়) সম্পৃক্ত সকল দাবিই উত্থাপন করবেন ও সেগুলি মেনে না নেওয়া হলে গণআন্দোলন তীব্রতর করবেন। প্রয়ােজনে তিনি কারাগারে ফিরে যাবেন। ছাত্ররাই তাঁকে আবার মুক্ত করবে।৩৯ এতে আবারও প্রমাণিত হলাে যে, ড্যাকের সাথে তাঁর দলের সংশ্লিষ্টতা ছিল এক কুশলী চাল যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল দলের জন্য কিছু আশু সুবিধা নাগালে আনা। এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও ড্যাকের মধ্যেকার মতভেদজনিত পার্থক্য বেশ দৃষ্টিগােচর হয়ে ওঠে যদিও আঁতাতের একটা মুখােশ ১৯৬৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি গােলটেবিল আলােচনার সূচনা পর্যন্ত ধরে রাখা হয়। যা হােক, গােলটেবিল সম্মেলন আয়ােজনের পথে সবচেয়ে কঠিন বাধাটি অপসারিত হওয়ার পর ড্যাক তার নিজ সাংগঠনিক কাঠামাের ভেতরে অন্যান্য জটিলতা দূর করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তবু ড্যাকের সহজাত অনৈক্য চেপে রাখা গেল না। গােলটেবিল সম্মেলনের কার্যঅধিবেশনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ সম্পর্কে পূর্বশর্তগুলি কী হবে সে সম্পর্কে স্বীয় অবস্থানের বিষয়ে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির বৈঠকে ড্যাক মিলিত হলে উল্লিখিত অনৈক্য পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
ড. কামাল হােসেন যথার্থই মন্তব্য করেন যে, “ড্যাক ছিল সহজাতভাবে সংঘাতময় নানা স্বার্থের বাহক মহলগুলির সমাবেশ। যখনই পরিষ্কার বােঝা গেল আইয়ুব আর ক্ষমতা হাতে রাখতে পারবেন না এবং নতুন একটা শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থাপত্রও সত্যিকার অর্থে সম্ভবপর হয়ে উঠেছে তখনই ঐ সব সংঘাতময় স্বার্থগুলি স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে।”৪০
চৌধুরী মােহাম্মদ আলী, নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান ও মওলানা মওদুদীর নেতৃত্বে। স্বায়ত্তশাসনবিরােধী ও এক ইউনিটপন্থী ড্যাক উপগােষ্ঠীটি ফেব্রুয়ারির এক প্রস্তুতিমূলক বৈঠকে ইতােমধ্যেই রায় দিয়েছিলেন যে, যেহেতু ড্যাকের আট-দফায় স্বায়ত্তশাসন ও এক ইউনিট ইস্যু নেই—এগুলি গােলটেবিল বৈঠকে আলােচনা করা যাবে না। এদিকে, স্বায়ত্তশাসনপন্থী ও এক ইউনিটবিরােধী উপগােষ্ঠী তথা ছয়-দফাপন্থী আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ (ওয়ালী) তাদেরকে বােঝাতে অক্ষম হন যে, যেহেতু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। গণআন্দোলনের এক অসাধারণ পরিস্থিতিতে যে আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ছিল পূর্ব পাকিস্তানে আর এ আন্দোলনে মূল প্রেরণা ছিল এগারাে-দফা তাই এই এগারাে-দফার অন্তর্ভুক্ত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও এক ইউনিট বাতিলের দাবির মতাে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে গােলটেবিল সম্মেলনে যদি আলােচনা না-ই করা যায় তাহলে তেমন গােলটেবিল আলােচনার সার্থকতা কোথায়? একটি অভিন্ন অবস্থান রচনায় ড্যাক উপকমিটি পূর্ব পাকিস্তানী ডেলিগেটদের সর্বসম্মত পাঁচ-দফার প্রশ্নে ঐকমত্য অর্জন করতে পারেনি। পূর্ব পাকিস্তান ডেলিগেটদের এ পাঁচ-দফায় অন্তর্ভুক্ত ছিল: সর্বজনীন বয়স্ক ভােটাধিকার, ফেডারেল সংসদীয় সরকার, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, জনসংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব এবং এক ইউনিট বাতিল। সবচেয়ে বেশি বিরােধিতা করা হয় স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে। ফলে, পূর্ব
১৭৫
পাকিস্তানী প্রতিনিধি দল এগারাে-দফায় ঘােষিত অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার কারণে গােলটেবিল সম্মেলনে যােগ না দেওয়ার সিদ্ধান্তও নেয়। উল্লেখ করা দরকার, এগারাে-দফায় ছয়-দফা অন্তর্ভুক্ত ছিল। পূর্ব পাকিস্তানী প্রতিনিধি দল ৯ তারিখে যখন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরতি যাত্রার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল সেই সময় এয়ার মার্শাল আসগর খান সকলের কাছে গ্রহণযােগ্য একটি আপােস ফর্মুলা বের করতে সক্ষম হন। এর ফলে নসরুল্লাহ খান সর্বসম্মত দাবিগুলির উত্থাপনের ক্ষমতা লাভ করেন আর ঠিক হয় গােলটেবিলে যােগদানকারী অন্য সব দল তাদের নিজ নিজ প্রস্তাব গােলটেবিল আলােচনায় উত্থাপন করতে পারবে। এরই প্রেক্ষাপটে ড্যাকের আহ্বায়ক, নসরুল্লাহ খান
১. ফেডারেল সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা; ও
২. সর্বদলীয় বয়স্ক ভােটাধিকারেরভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা—প্রবর্তনের দাবি জানান।
নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের (ছয়-দফাপন্থী) সভাপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের দাবি ছিল:
১. ফেডারেল আইনসভায় জনসংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন;
২. ছয়-দফা ফর্মুলায় প্রদত্ত রূপরেখা অনুযায়ী পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন;
৩. দেশের পশ্চিমাঞ্চলে এক ইউনিট বাতিল।
শেখ মুজিবের বক্তৃতা অন্যান্য অংশগ্রহণকারীর ওপর কোনাে প্রভাব-প্রতিক্রিয়া ফেলে থাকুক না থাকুক, তিনি আওয়ামী লীগের অবস্থানটি রেকর্ডে দেওয়ার এই সুযােগটি হারাননি। তিনি দেশ যে সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলেছে সেই সঙ্কটের সমাধান এগারাে-দফা ও ছয়-দফা ফর্মুলার বাস্তবায়নে নিহিত রয়েছে বলে জোর উল্লেখ করে তার পার্টিকে কিছুটা বিপ্লবাত্মক রূপে প্রতিবিম্বিত করার জন্যও এই মঞ্চটিকে কাজে লাগান। তিনি স্বীকার করেন, জনসমাজের পুনর্নির্মাণ আবশ্যক। আর এও স্বীকার করেন যে, এগারাে-দফা কার্যক্রম সঠিকভাবেই দেশের শিল্প ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠনের প্রয়ােজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছে। তবে তিনি ঐ সভাকে মনে করিয়ে দেন, ছয়-দফা কর্মসূচি অর্থনীতির বৈপ্লবিক পুনর্গঠনের প্রয়ােজনের কথা স্বীকার করে আর মনে করে যে, কর্মসূচিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের যে রূপরেখা দেওয়া হয়েছে তা ফলদায়ক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাদি বাস্তবায়নের এক জরুরি পূর্বশর্ত। এমনি করে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের যুবসম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করে বলেন, ছয়-দফা কর্মসূচির বাস্তবায়নই একমাত্র অভীষ্ট বলে ধরা হয়নি বরং এ সব দফায় যে সব বৃহত্তর পরিবর্তন দাবি করা হয়েছে সেগুলির অবকাঠামাে বা বুনিয়াদ হিসেবে এর কাজ করার কথা। তবে তিনি উল্লেখ করেন আপাতত তিনি চান শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনগুলির রূপরেখা তৈরিতে নিজেকে সীমিত রাখতে যা মানুষ ও মানুষের মাঝে, অঞ্চল ও অঞ্চলের মাঝে অর্থনৈতিক সুবিচার অর্জন করার পূর্বশর্ত।৪১
১৭৬
৬৬-৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বিরােধীদলগুলির রক্ষণবাদী গােষ্ঠীগুলির দলে না ভিড়ে নিজের অবস্থান আরাে মজবুত করে। ভাসানীর নেতৃত্বে উগ্রপন্থী বিরােধীদল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অভিমত গ্রহণ না করায় অনেকখানি আস্থা হারায়। ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগ অ্যাপস্যাক তথা ছাত্রদের সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠনের সঙ্গে মৈত্রীতে উপনীত হয়ে নিজ অবস্থানকে শক্ত করে তােলে। কেননা, এই ছাত্ররা পূর্বাঞ্চলে। সবচেয়ে সােচ্চার ও সঙ্কল্পে অটল অংশ। তাই এই মৈত্রী আওয়ামী লীগের পরবর্তী পর্যায়ের সংগ্রামে বিরাট সুবিধা করে দেয়।
আওয়ামী লীগের এই মনােভঙ্গি ভারতের জাতীয় কংগ্রেস গৃহীত কৌশলের কথা মনে করিয়ে দেয়। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে প্রগতিবাদীরা ছিল। তারা যে কর্মসূচির বিষয় স্থির করেছিল তার বেশির ভাগ উজ্জ্বলতা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির কর্মসূচিতে প্রগতিবাদী দাবির কথা বলে তা সন্নিবেশিত করেছিল তকালীন কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। আর এভাবে, প্রকাশ্য সংঘাতের ঝুঁকি ন্যূনতম পর্যায়ে কমিয়ে এনেছিল।
বাস্তবিকপক্ষেও ঐ সময়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পক্ষে ছাত্রদের নাখােশ করা সম্ভব ছিল না। দলটি উদাসীন মনােভাব দেখালে তারা হয়তাে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে পুরােপুরি অগ্রাহ্য করে ভাসানীর দিকে ঝুঁকে পড়তে পারতাে। ড্যাকের অন্যান্য পক্ষের মনােভাব ও ক্ষমতাসীনচক্রের মনােভাব খুবই পরিষ্কার থাকার আলােকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই সচেতন ছিল, তাদের এ সংগ্রামকে গােলটেবিল আলােচনাকেও ছাড়িয়ে উত্তরিত করতে হবে। আর তাই ছাত্রদেরকে তাদের সপক্ষে রাখাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেকার সংঘাত সম্পর্কিত ব্যাপক শাসনতান্ত্রিক ইস্যুগুলির আশু সমাধান না হলে কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে বিষয়ে খুব বিশদ আভাস দিয়েছিলেন শেখ মুজিব। গােলটেবিল সম্মেলনে বক্তৃতার সূচনায় তিনি বলেন, “আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্নই আমাদের কাছে বড়।” পরে তিনি বলেন, “আমি যে সব প্রস্তাব এ সম্মেলনে পেশ করছি তা এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে যে, পাকিস্তানের হেফাজত, এমনকি পাকিস্তানকে শক্তিশালী করে তােলার জন্য তা একান্ত জরুরি।”৪২ কিন্তু পাকিস্তানের “অস্তিতুরক্ষা” ও “হেফাজত করার উল্লেখের নেপথ্যে যে হুঁশিয়ারি সঙ্কেতটি প্রচ্ছন্ন ছিল প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ও ড্যাকের সংখ্যাগরিষ্ঠ পক্ষগুলি তা উপেক্ষা করেন। গােলটেবিল সম্মেলনে সমাপনী ভাষণে আইয়ুব বক্তব্য পেশ করেন যে, যেহেতু মাত্র দুইটি ইস্যুতে যেমন, ফেডারেল সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সর্বদলীয় বয়স্ক ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেহেতু তার পক্ষে আপাতত মাত্র এ দুটিই মঞ্জুর করা সম্ভব আর অবশিষ্টগুলি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবে আইন পরিষদ। এমনি করে, ক্ষমতাসীন শাসকগােষ্ঠী, পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিক এবং সেই সাথে পূর্ব পাকিস্তানের রক্ষণশীল রাজনীতিকদের স্বার্থ এই স্তরে এসে একত্রে মিলেমিশে যায়।
১৭৭
কামাল হােসেনের সাথে একমত হতেই হবে সংশয়াতীতভাবেই যে, পরিস্থিতি এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যেখানটায় এসে আর কোনাে কিছুই টেবিলের আলােচনায় নিষ্পত্তি করা যায় না। কেননা, ঐ টেবিলের চার ধারে যারা বসে আছেন তারা হলেন, নিন্দিত অপ্রতিনিধিত্বশীল নেতা যাদের প্রবণতা টেবিলের তলে কিংবা পর্দার আড়ালে লেনদেন করা।৪৩ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষও এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছিল বলেই মনে হয়। তারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং বহু ক্ষেত্রে সহিংসতার আশ্রয় নিয়ে আইয়ুব খানের রায়ের প্রতি তাদের অনাস্থা প্রকাশ করে। অ্যাপস্যাক গােলটেবিল বৈঠকের রায়ের প্রতিবাদে এবং পূর্ব পাকিস্তানী নেতাদের ঐ বৈঠকে ভূমিকার প্রতিবাদে এবং এগারাে-দফা বাস্তবায়নে নতুন করে শপথ নেওয়ার জন্য ১৯৬৯ সালের ১৭ মার্চ প্রদেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয়।
শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে গােলটেবিল আলােচনায় এনডিএফ-এর হামিদুল হক চৌধুরী, পিডিএম-এর মাহমুদ আলী, নিজাম-এ-ইসলাম-এর ফরিদ আহমদের ভূমিকার প্রকাশ্য সমালােচনা করেন এবং নুরুল আমিন, জাস্টিস মুর্শেদ ও ওয়ালী ন্যাপের মােজাফফর আহমদের বলিষ্ঠতার প্রশংসা করেন। তিনি এর আগেই ড্যাকের সাথে তাঁর দলের সম্পর্কচ্ছেদের কথা ঘােষণা করেন। তিনি গােলটেবিল আলােচনায় মওলানা ভাসানীর অনুপস্থিতি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি মন্তব্যও করেন যে, তারা দু’জন যদি একত্রে গােলটেবিল আলােচনা থেকে ফিরতে পারতেন৪৪ তাহলে বােধহয় খুবই ভালাে হতাে। স্পষ্টতই এর অর্থ তার প্রতিক্রিয়া হতাে আরাে অনেক বেশি আর আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায় হতাে আরাে বেশি শক্তিশালী। এ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের এবং একই সঙ্গে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ভাসানীর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ও মর্যাদার খােলা স্বীকৃতি। তবে শেখ মুজিব ভাসানীর গুরুত্বের কথা স্বীকার করলেও, ভাসানীর এই পরিচয় নিয়ে অন্যেরা প্রশ্ন তােলে। ছাত্রলীগ ও অ্যাপস্যাক নেতা তােফায়েল আহমদ এর আগে এ বিষয়ে একটি মৌলিক প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভাসানী যদি এগারাে-দফার এতই সপক্ষে থাকেন তিনি কেন তাহলে এ সব দফা উত্থাপনের জন্য গােলটেবিল সম্মেলনে গেলেন না?৪৫
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সীমিত উদ্দেশ্যে ড্যাকে যােগ দিয়ে থাকলে অন্য দল বা উপদলগুলিও তা-ই করেছিলেন। তাদের সীমিত উদ্দেশ্য হাসিল হওয়ার পর যখন তারা দ্বিতীয়-দফার কলকাঠি নাড়ার রাজনীতির প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছে তখনই ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। বস্তুত এই কলকাঠি নাড়ার চালের রাজনীতি পাকিস্তানের একটা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। নসরুল্লাহ খান গােলটেবিল সম্মেলনের সমাপনী দিবস ১৯৬৯ সালের ১৩ মার্চ ড্যাকের বিলুপ্তি ঘােষণা করেন ও প্রেসিডেন্টের সম্মানে এক সংবর্ধনার আয়ােজন করেন। ঐ দিন সন্ধ্যায় এয়ারমার্শাল আসগর খান জাস্টিস পার্টি গঠনের কথা ঘােষণা করেন।৪৬ নসরুল্লাহ খান পরে পাকিস্তান ডেমােক্র্যাটিক পার্টি গঠন করেন সাবেক পিডিএমভুক্ত প্রায় সকলকে নিয়ে।
১৭৮
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্ব পাকিস্তান চটকল ফেডারেশনের সভাপতি মওলানা সাইদুর রহমানের সভাপতিত্বে নারায়ণগঞ্জের আদমজিনগরে আয়ােজিত প্রায় তিন লাখ লােকের এক জনসভায়৪৭ ভাষণ দেওয়ার সময় তাঁর দলের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা কী হবে তার রূপরেখার আভাস দেন। তিনি বলেন, এখন থেকে সংগ্রাম হবে দ্বিমুখী: একদিকে, গণআন্দোলন, অন্যদিকে জনসাধারণের ভােটাধিকার। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, এ কৌশলে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন আদায়, পশ্চিমে এক ইউনিট বাতিল এবং সেখানকার স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশগুলির মধ্যে উপফেডারেশন গড়া সম্ভব হবে। তিনি বলেন, “আমি এক কথার মানুষ: আমি আমার দেশবাসীদেরকে এই মর্মে আশ্বাস দিতে চাই যে, ছাত্র/শ্রমিক/কৃষকের সঙ্গত দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য আমি তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে যাবাে।”
প্রতিপক্ষ শক্তিসমূহের অস্তিত্বে আওয়ামী লীগ যে সজাগ ছিল সে বিষয়টি স্পষ্ট করেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ। তিনি উল্লেখ করেন যে, গণআন্দোলন নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি তৎপর হয়ে উঠেছে। তবে তিনি এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, জনগণ আর তাদের ফাঁদে পড়বে না । পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের আবদুর রউফ ও তােফায়েল আহমদ সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অবস্থানের সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করে কোনাে আশু রাজনৈতিক মুনাফার জন্য নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে সহিংস আন্দোলনে পর্যবসিত করার সম্ভবাবনার বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। আর সম্ভবত এটি অ্যাপস্যাকে ভাঙনের সূচনার প্রতিও অঙুলি নির্দেশ করে।
মওলানা সাইদুর রহমান আশা প্রকাশ করেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান শ্রমিকদের পক্ষেই থাকবেন। সুপরিচিত শ্রমিক নেতা এবং চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের সম্পাদক আব্দুল মান্নান শ্রমিকদের বহুমুখী সমস্যার সমাধানে শেখ মুজিবের সহযােগিতা কামনা করেন। সভায় অন্য বক্তাদের মধ্যে ছিলেন, সুতাকল শ্রমিক ইউনিয়নের সম্পাদক আব্দুল মােতালিব, নারায়ণগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগ সভাপতি ফজলুর রহমান এবং এমপিএ ও নােয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক নুরুল হক। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতা সিরাজুল আলম খান প্রস্তাব পাঠ করেন ও সভার শ্রোতারা হাত উঠিয়ে বেশ কতকগুলি প্রস্তাব পাস করেন। যা হােক, সভার জন্য নির্বাচিত স্থান, বাছাই করা বক্তা এবং সেখানে প্রখ্যাত ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের উপস্থিতি কলকারখানায় বিভিন্ন ইউনিয়নগুলির মাঝে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ক্রমবর্ধমান মর্যাদা বৃদ্ধির পরিচায়ক কেননা, এ সব ইউনিয়ন ঐতিহ্যগত ধারা অনুযায়ী বামপন্থী দলগুলির সঙ্গেই অনেক বেশি সম্পর্কিত ছিল।
শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের প্রশ্নে ঘােষিত অগ্রাধিকারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আওয়ামী লীগ ১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ জাতীয় পরিষদের সচিবের কাছে শাসনতান্ত্রিক সংশােধনী-সংক্রান্ত এক বিল দাখিল করে।৪৮ এতে একশতটি সংশােধনীর প্রস্তাব করা হয়। এ সব সংশােধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ছয়-দফা ও এগারাে-দফা অনুসারে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ
১৭৯
ফেডারেল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং এক ইউনিট বাতিল করে পশ্চিম পাকিস্তানে এক উপফেডারেশনের প্রতিষ্ঠা দেখতে চেয়েছিল। এই সর্বশেষ উদ্যোগটি সফল হলে তাতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যাগুলি সমাধান হতে পারতাে। জাতীয় পরিষদে এ সংশােধনী প্রস্তাবগুলির ওপর খােলা ও অবাধ আলােচনা অনুষ্ঠিত হলে তাতে ছয়-দফা ফর্মুলার কথিত দুর্বল কেন্দ্র সম্পর্কিত কল্পিত হুমকি কমতে পারতাে ও ফলত গােটা ব্যবস্থাকে পশ্চিম পাকিস্তানী জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য করা যেতাে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা বরাবরের মতােই তখনাে বিষয়টি এভাবে ভাবতে পারেননি। বরং অনুমান করা যায়, সিন্ধি, পাঠান, বালুচ ও বাঙালি সদস্যদের সমর্থনে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের সংশােধনী প্রস্তাব পাস হয়ে যেতে পারে—এ আশঙ্কা ও অন্যদিকে এক বিরাজমান বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হয়ে প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ এক বেতার ভাষণে আইয়ুব খান দেশবাসীকে জানান যে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রায়ন করা হলে তা শেষ পর্যন্ত দেশকে ধ্বংস করবে। আর তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে তা নীরবে প্রত্যক্ষ করতে পারেন না। যেহেতু জাতি চায়, সেনাবাহিনীপ্রধান তার শাসনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা পালন করুন সে জন্য তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়ে দিচ্ছেন।৪৯ এর আগে ১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ আইয়ুব খান এক পত্রে সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে তাঁর এই প্রস্তাবিত পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত করেন।৫০
আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক ও নিয়মতন্ত্রবহির্ভূত—উভয় বিকল্প পথ খােলা রাখলেও মওলানা ভাসানী অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের উপায় প্রত্যাখ্যান করেন। তখন মনে হয়েছিল মওলানা ভাসানীর আদর্শিক প্রবণতায় একটা বােধগম্য পরিবর্তন ঘটেছে। কেননা, তিনি গরিব, শােষিত মানুষের মুক্তির পথ হিসেবে “ইসলামী সমাজতন্ত্রের কথা বলতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাতে তার ঘােলাটে ভূমিকা আরাে বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠে।৫১
সে যা-ই হােক, তকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে ভাসানীই কেবল অজ্ঞাত ও অনিশ্চিত ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠলেন না, অ্যাপস্যাকের ভবিষ্যৎ ভূমিকাও অনিশ্চিত হয়ে উঠলাে। অ্যাপস্যাক পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন সেই “অবিসংবাদিত নেতা”র কাছ থেকে আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে তাদের দাবিগুলির প্রতি স্বীকৃতি আদায়ে সক্ষম হয়েছিল যাকে অংশত তারাই এই স্থানের অধিকারী বলে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এগারাে-দফা তখনাে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে ছিল আধিপত্যশীল মূলভাব যদিও রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রাথমিক উদ্যোগের ব্যাপারটি চলে যায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের হাতে কিংবা আরাে সঠিকভাবে বলতে গেলে শেখ মুজিবের হাতে। কিন্তু এ রকম এক ধরনের মহিমারােপের পর সেই অ্যাপস্যাকের পক্ষে তাকে কার্যকরভাবে অস্বীকার করাও সম্ভব ছিল না। ফলে তখনকার বিরাজমান পরিস্থিতিতে অ্যাপস্যাক যে তুলনামূলকভাবে কম সংহত ইউনিট হয়ে উঠবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেননা, হাজার হলেও
১৮০
উভয় ছাত্র ইউনিয়নের তাদের নিজ নিজ গুপ্ত বা প্রকাশ্য মূল দলের প্রতি আনুগত্য যেমন ছিল তেমনি তাদের পরিষ্কার আদর্শিক অঙ্গীকারও ছিল। যেমন দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর প্রতিনিধি ছিলেন মাহবুবুল্লাহ; এ সংগঠনের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাথে কিংবা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)-এর সঙ্গেও মৈত্রীতে আসা সম্ভব ছিল না। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে তাদের একত্র সমাবেশ সম্ভব হয়েছিল কৌশলগত কারণে ও সীমিত উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য। অনুরূপভাবে, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)-র প্রতিনিধি সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক তাঁর মূল সংগঠন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির দীর্ঘদিনের নীতি-কৌশল অনুসারে হয়তােবা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের ঘনিষ্ঠ থাকতে পেরেছিলেন, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর সঙ্গে আশু উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য যতটুকু সময় প্রয়ােজন নিশ্চয়ই তার বেশিদিন থাকা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ ছাড়াও, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রদেশে নিজের পায়ের তলায় মাটি মজবুত করে নিতে পারার পর স্পষ্টতই অ্যাপস্যাকের ছত্রচ্ছায়ার আর কোনাে প্রয়ােজনীয়তা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের জন্য ছিল না। তাই সময় এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ন্যাপ মােজাফফরের ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মনােভাব শীতল হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। (মতিয়া)-এর সঙ্গেও ছাত্রলীগের সম্পর্কের উষ্ণতা অনুরূপভাবেই কমে যায়। অবশ্য, পরবর্তীকালের রাজনৈতিক আন্দোলনগুলি নিয়ে কোনাে কিছু আরাে দানা বেধে ওঠার আগেই একান্ত পাকিস্তানী বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পরিস্থিতি নাটকীয় মােড় নেয় যা আইয়ুব খানের ক্ষমতা ত্যাগের পটভূমিকায় অপ্রত্যাশিতও ছিল না।
আইয়ুব খান ক্ষমতা ছাড়লেও পাকিস্তানী ক্ষমতার কাঠামােটি বদলায়নি। তবে যে পরিস্থিতিতে তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন তাতে বােঝা যায়, পাকিস্তান তখন একটা এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে প্রেসিডেন্টের, প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ও প্রেসিডেন্টের জন্য সরকার”৫২ গােটা জনসমষ্টির রাজনীতি সম্পর্কিত সাধারণ মানুষের কাছে আর মােটেও গ্রহণযােগ্য ছিল না। রাজনৈতিক দল হিসেবে অবস্থার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি খাপ খাওয়ানাের প্রবণতাসম্পন্ন ও চালিকাশক্তিসম্পন্ন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগই, বিশেষ করে, পূর্ব পাকিস্তানে এই পরিস্থিতি গড়ে তােলায় সবচেয়ে বেশি কৃতিত্বের দাবিদার হতে পেরেছিল।
১৮১
নবম অধ্যায়
সাধারণ নির্বাচন
পাকিস্তানে ক্ষমতার হাতবদল ও সামরিক আইন পুনঃআরােপের পর কোনাে কোনাে অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষকের মতে পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি এমন এক চরম অবস্থায় পৌছায় যখন সামাজিক অভ্যুত্থান ঘটতে পারতাে।১
অবশ্য শাসকগােষ্ঠীবিরােধী উত্তাল জোয়ার শেষ পর্যন্ত সামাজিক বিপ্লবে গড়ায়নি। কেননা, সামাজিক বাস্তব পরিস্থিতি সেভাবে পরিণত হয়ে ওঠেনি। ঐ সময়ে পাকিস্তানী জনসমাজে অত্যন্ত সুস্পষ্ট শ্রেণী-সংঘাতের অস্তিত্ব ছিল না।২ আর শ্রেণী বিরূপতা সে কারণেই তীব্র, শাণিত হতে পারেনি। বিপ্লবী নেতৃত্বও সে সময়ে ছিল অনুপস্থিত। ফলে তা বিপ্লবী প্রক্রিয়ার সম্ভাবনাকে কার্যত তাৎপর্যহীন করে তােলে। এ দিকে, ব্যাপক বিস্তৃত এক সাংগঠনিক নেটওয়ার্কের অধিকারী আওয়ামী লীগের সাথে আবার ছাত্রদের মাধ্যমে যুবসম্প্রদায়ের ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ থাকায় দলটি জনসাধারণকে সক্রিয় করে তুলতে সক্ষম ছিল। কিন্তু সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে পরিবর্তন আনার ব্যাপারে দলটির কোনাে অঙ্গীকার ছিল না। শেখ মুজিব পরিষ্কার বলেন, আওয়ামী লীগের প্রথম ও সর্বাগ্রের লক্ষ্য হলাে, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন অর্জন করা। পরে অন্যান্য পরিবর্তন আসবে। আর সেগুলি এর আগে যেমন ঘটবে না, যুগপৎ স্বায়ত্তশাসনের সাথেও তা আসবে না। তিনি আরাে স্পষ্ট করে বলেন, দ্বিতীয়-দফার পরিবর্তনগুলিকে ক্রমান্বয়ে ও খাপ খাইয়ে নিয়ে প্রবর্তন করা হবে।
প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ নেতারা আদর্শিকভাবে কখনাে সহিংসতার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের তত্ত্বে আস্থা স্থাপন করেননি। ঐ স্তরে এমনকি কৌশল হিসেবে এ ধরনের নীতি গৃহীত হলেও তাতে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় অবস্থান বজায় থাকতাে না। আওয়ামী লীগের নীতি ছিল যে জনপ্রিয়তা সে ইতােমধ্যে অর্জন করেছে তা ধরে রাখা ও আরাে বিস্তৃত করা। আওয়ামী লীগ বরাবরই উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সমর্থক। সেই হিসেবে পাকিস্তানের জাতীয় রাজনৈতিক দলের মর্যাদা ফিরে পেতে হলে তার সামনে মাত্র।
১৮৩
একটি পথ খােলা ছিল আর তা হলাে নির্বাচনে প্রথম সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল হওয়া। সে জন্য তার যে কোনাে কিছুর চেয়ে সবচেয়ে দরকার ছিল আগামীতে এক উল্লেখযােগ্য জয়ের গৌরব অর্জন করা।
দলের স্বকীয় স্বার্থ ছাড়াও অন্য বিবেচনাটি ছিল এই যে, কোনাে সহিংস আন্দোলন হলে তা এমন প্রবল দমন ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা ডেকে নিয়ে আসতে পারে যার ফলে সকল বিরােধিতার অস্তিত্ব চূর্ণ হয়ে যেতে পারে। আর তাতে স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে ভবিষ্যৎ, এমনকি, শাসনব্যবস্থার গণতন্ত্রায়নের সম্ভাবনাটুকুর ভবিষ্যৎ লুপ্ত হবে। এ কারণে আওয়ামী লীগ সামাজিক বিপ্লবের সূচনা না করে নির্বাচন অনুষ্ঠান ও তাতে অংশগ্রহণের রাজনীতির ওপরই বেশি নির্ভর করেছে।
ক্ষমতায় আসার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আইন পরিষদ ও ১৯৬২ সালে শাসনতন্ত্রের বিলুপ্তি এবং অনতিবিলম্বে সামরিক আইন বলবৎ করার ঘােষণা দেন। তিনি সর্বজনীন বয়স্ক ভােটাধিকারেরভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দেন।৩ অবশ্য অল্পদিন পরেই তিনি বলেন, পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের রূপরেখা ও কাঠামাে এবং রাজনৈতিক কাঠামাে কী হবে সে বিষয়ে রাজনীতিকরা সর্বসম্মতভাবে একমত হওয়া পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় থাকবেন।৪ নতুন শাসকগােষ্ঠীর উদ্দেশ্য ছিল খুবই পরিষ্কার। পাকিস্তানের অতীত ইতিহাস, ১৯৬৮-৬৯ সালের জনবিক্ষোভের প্রকৃতি এবং গােলটেবিল সম্মেলনের ঘটনাবলি পরিষ্কার দেখিয়ে দেয় যে, পাকিস্তানী সমাজে এক সহজাত বৈপরীত্য রয়েছে আর তা এতই ব্যাপক যে, সে দেশটিতে কোনাে বিষয়ে ঐকমত্য সর্বদাই এক দুর্লভ বস্তু। বাস্তবিকপক্ষে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সময় পাকিস্তানীদের যে প্রধান ইস্যুগুলি রীতিমতাে বিমূঢ় সংশয়ে রেখেছিল সে ইস্যুগুলি অমীমাংসিতই রয়ে যায়। যেমন, পাকিস্তান রাষ্ট্রে ইসলামের ভূমিকা কী হবে ও ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থা কী প্রকৃতির হবে—এগুলিও অমীমাংসিত থেকে যায়। আইয়ুব খান যখন ক্ষমতা ছেড়ে যান এবং ইয়াহিয়া খান যখন ক্ষমতায় আসেন তখন তাঁরা দু’জন এই সামগ্রিক বিভ্রান্তি সম্পর্কে জানতেন না—এমন হতে পারে না।
কাজেই ক্ষমতার গঠন কাঠামােয় কোনাে পরিবর্তনের বেলায় সর্বসম্মতি বা ঐকমত্যকে পূর্বশর্ত হিসেবে ধরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কেবল এই নিরেট বাস্তবতাকে বেআব্রু করেছেন যে, ক্ষমতাসীনচক্রের নীতি-নৈতিকতায় কোনাে পরিবর্তন ঘটেনি; তাঁর এ পূর্বশর্ত দেখিয়ে দিয়েছে এটাও যে, তারা কিছু অঙ্গরাগমূলক তথা ভাসাভাসা রদবদল করে প্রচলিত ধারার নিরবচ্ছিন্নতাকেই বজায় রাখতে চান। অবশ্য তাঁরা মর্মে ঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন যে, নিদেনপক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈধতাদানকারী বিধির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আর কোনাে জনপ্রিয় প্রতিনিধিকে সেই অবস্থানে দেওয়া না গেলে শাসকগােষ্ঠীর যা কিছু সমর্থনের ভিত এখনাে আছে তা-ও হারাতে হবে। অবশ্য শাঁসালাে কিছু পরিবর্তন ঘটাতে গেলে তাতে আবার বহাল ক্ষমতার কাঠামােই বিপন্ন হবে। সে জন্য ইয়াহিয়া খান এমন এক পদ্ধতিতে আনুষ্ঠানিকতার ছোঁয়াচ দিতে চেয়েছিলেন যার আওতায় জনপ্রিয়তার
১৮৪
অধিকারী প্রতিনিধি শাসকগােষ্ঠীর প্রতিনিধি হয়ে উঠবেন আর একইসঙ্গে নিজেদের কলহে ঐ প্রতিনিধিরা ক্রমেই তাদের বিশ্বাসযােগ্যতা হারাবেন। জাতীয় স্তরে রাজনৈতিক ঐকমত্যের অনুপস্থিতির খােদ বিষয়টিই রাজনীতিকদের কলহে ব্যস্ত রাখবে আর সেই অবকাশে জোরদার হয়ে উঠবে আমলা-মিলিটারি আঁতাত। বাস্তবিকপক্ষেও ইয়াহিয়া খান শাসকচক্রের তরফে পাকিস্তানী রাজনীতির দুর্বলতার সুযােগ নিতে কিংবা সেটিকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করছিলেন। কোনাে সত্যিকারের জাতীয় দলের অভাবে জাতীয় দলপদ্ধতির কার্যপ্রক্রিয়া। সর্বদাই সঙ্কট তৈরি করবে আর তা আমন্ত্রণ করে আনবে আমলা-সামরিক হস্তক্ষেপ। তবে সে যা-ই হােক, ইয়াহিয়া খান ১৯৬৯ সালের ২৮ জুলাই জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে তার অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। কিন্তু ১৯৬৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আবার ইঙ্গিত দেন যে, দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর নিজের কিছু “ভাবনাচিন্তা আছে। আর সে কথা যথাসময়ে জানানাে হবে।৫ নিশ্চয়ই ইয়াহিয়ার এ উক্তি পূর্বসুরীর (আইয়ুব খানের) এই প্রত্যয়ী বক্তব্যের অশুভ স্মারক যে, ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রও তাঁর নিজ রাজনৈতিক দর্শনেরই প্রতিফলন।
১৯৬৮-৬৯ সালের সরকারবিরােধী আন্দোলনে পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু প্রবীণ রাজনীতিক ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন শুধু ক্ষমতায় জনগণের ব্যাপকতর অংশীদারি নেই বলেই, কিন্তু সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র, বড় ভূস্বামী ও ব্যবসায়ীরা যে ক্ষমতার আধার সেই ক্ষমতার ভারসাম্যের কোনাে মৌলিক পুনর্গঠনের জন্য তাঁরা কোনাে আন্দোলন করেননি। ডেমােক্র্যাটিক অ্যাকশন কমিটি বা ড্যাকে প্রতিনিধিত্বকারী পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিকরা ক্ষমতা থেকে আইয়ুব খানের প্রস্থানে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনীতির মেজাজ বা উত্তাপ পরে কমে যাওয়ায় শাসকচক্র আশ্বস্ত হয় যে, একটি সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশীদারির আনুষ্ঠানিকতায় পশ্চিম পাকিস্তানের এ সব রক্ষণশীল রাজনীতিক তুষ্ট হবেন। আর এক ইউনিট বাতিল করে ওয়ালী খান বা জিএম সৈয়দের মতাে একটু বেশি নটখটে ব্যক্তিদেরকে ঠাণ্ডা করা যাবে।
অবশ্য, পশ্চিম পাকিস্তানের নতুন সামাজিক শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপিলস পার্টির মাধ্যমে। জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তার দল পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে সপক্ষে যে সমর্থনের ভিত গড়ে তুলেছিলেন শাসকগােষ্ঠী তা মােটেও মূল্যায়ন করতে না পারারই প্রবণতা দেখান। বস্তুত ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন অবধি এ ধরনের উনমূল্যায়ন চলতেই থাকে। পিপিপি ড্যাক কিংবা গােলটেবিল আলােচনা কোনােটিতেই যােগ দেয়নি। আর এভাবে দলটি শাসক মহলের প্রতি তাদের বিরােধিতার মহড়া প্রদর্শন করে। কিন্তু তাই বলে এতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের আওতায়। নবায়িত আমলা-সামরিক শাসকচক্রের মধ্যে কোনাে সমঝােতার সম্ভাবনা সম্পূর্ণ নাকচ হয়ে যায়নি। তাই সামরিক বাহিনীর কায়েমি স্বার্থ ও ভুট্টোর স্বার্থের একটা মিল অনুমান করে দৃষ্টত শাসক জান্তা ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুট্টোর নেতৃত্বে পিপিপির অভ্যুদয়কে দেখেও
১৮৫
দেখার ভান করে। এ ছাড়াও, পিপিপির আবির্ভাব ঘটেছিল প্রগতিবাদের দর্শনধারী হিসেবে, তাতে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রের প্রতি পক্ষপাতিত্ব। তাই এ বিষয়টি দেশের পশ্চিমাঞ্চলে পুনর্গঠিত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে এক অন্তর্বিষ্ট রক্ষাকবচের নিশ্চয়তা দেয়। ভুট্টো ও পিপিপি যে প্রবল শক্তি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে তা যদি আগেই না ঘটতাে তাহলে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ হয়তাে পশ্চিম পাকিস্তানে কিছু কিছু সমর্থনের বুনিয়াদ গড়ে তুলতে পারতাে। বিশেষ করে, সিন্ধুর জিএম সৈয়দ ও সীমান্ত প্রদেশের ওয়ালী ন্যাপ আওয়ামী লীগের সাথে যােগ দিলে অবস্থা অন্য রকম হতেও পারতাে। সিন্ধুতে সিন্ধি মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও ছাত্র ইত্যাদির মুখপাত্র হিসেবে ভুট্টোর আবির্ভাব সুনিশ্চিতভাবেই আওয়ামী লীগের উদ্যোগকে পূর্বাহে নস্যাৎ করে এবং জিএম সৈয়দের ‘জিয়ে সিন্ধ’ আন্দোলনকে পুরােপুরি অকেজো করে দেয়। তাই ভুট্টো ও পিপিপি আবির্ভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি জাতীয় দলের অভ্যুদয়ের ক্ষীণ সম্ভাবনাটুকুও শেষ হয়ে যায় আর এই প্রক্রিয়ার সংহতিবিধায়ক প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় সুফল লাভের আরেক সুযােগ থেকে বঞ্চিত হয় পাকিস্তান।
পূর্ব পাকিস্তান ক্ষমতার সম্পর্ক পরম্পরায় পরিপূর্ণ পরিবর্তন দাবি করেছিল। তবে যেহেতু এ দাবি অভিব্যক্ত হয়েছিল স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সেহেতু পাকিস্তানের সংহতির হেফাজতের অজুহাত দেখিয়ে এবং গণতন্ত্রের সারবস্তুর চেয়ে আঙ্গিকের বেশি ভক্ত রক্ষণশীলদের পক্ষে যাদেরকে হাতের কাছে পাওয়া যায় ও যারা কেবল ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের পুনরুজ্জীবনে তুষ্ট থাকবে তাদের পিঠ চাপড়ে সবসময়েই এ দাবিকে গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল। উল্লেখ্য, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ যে ব্যাপক আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন চায় তার ব্যবস্থা ছিল না।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এ অবস্থান গােলটেবিল আলােচনায় অত্যন্ত স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ইতঃপূর্বে এক বিবৃতিতে এক বিদেশী সংবাদদাতাকে বলেছিলেন, “আমি সমস্যার একটা এসপার-ওসপার চাই আর তা চিরকালের মতাে। অন্য নেতারা যদি একমত হতে পারেন খুব ভালাে কথা। কিন্তু তা যদি না হয় আমার লােকেরা সেটা করায়ত্ত করবে।”৬ এ থেকে তিনি আভাস দেন, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দাবি জনগণেরই ইচ্ছার অভিব্যক্তি ও প্রতীক এবং তিনি কেবল এক সত্যতার চর্চাই করছিলেন যা পাকিস্তানের চূড়ান্ত ভবিষ্যৎ নির্ধারক হয়ে উঠবে। এ ছাড়া, দেশের রাজনীতিতে, বিশেষ করে, দেশের পূর্বাঞ্চলে আওয়ামী লীগের রাজনীতির ভবিষ্যৎও এই বাস্তব সত্যতায় দলটি কতখানি সাড়া দিতে পারবে তার ওপরও নির্ভর করছিল। আওয়ামী লীগ স্বীয় বৈশিষ্ট্যময় উদার গণতান্ত্রিক ভঙ্গিতে জনগণের দাবির চূড়ান্ত পরিপূরণের সূচনা হিসেবে আশু প্রত্যক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে ক্রমাগত গুরুত্ব আরােপ করে যেতেই থাকে। ইয়াহিয়া খানের সামরিক আইন বিধির আওতায় প্রকাশ্য সকল রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। তবে আলােচনা, জল্পনা-কল্পনা ও প্রস্তুতি চলতে থাকে।
১৮৬
পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল যখন আলােচনা, জল্পনায় ব্যস্ত তখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রস্তুতিতে নিজ মনােযােগ কেন্দ্রীভূত করে। এ জন্য শেখ মুজিব অন্য নেতাদের সঙ্গে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জেলাগুলি সফর করেন। তিনি জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে ভাষণ দেন (সামরিক আইনে তখনাে জনসভা অনুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল)। তাঁর সে সব ভাষণের মূল বক্তব্য ছিল: ছয়-দফায় নিহিত দলীয় দাবিগুলি পূরণ, সর্বজনীন বয়স্ক ভােটাধিকারেরভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের বিধান সন্নিবিষ্ট এক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য জনসমষ্টিভিত্তিক প্রতিনিধিত্বসম্পন্ন জাতীয় পরিষদ গঠনই একান্ত আশু ও প্রাথমিক প্রয়ােজন। পরিষ্কার উল্লেখ করা হয় যে, কোনাে কোনাে রাজনৈতিক দল ১৯৫৬ কিংবা ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন দাবি করলেও তাতে কোনাে ফলােদয় হবে না। যারা ইসলামের স্বার্থরক্ষার কথিত দাবিদার তাদের সম্পর্কে আওয়ামী লীগ কর্মীদের সজাগ থাকার জন্য হুশিয়ার। করে দেওয়া হয়। বলা হয়, এ সব শক্তি সেই একইভাবে তাদের কোনাে কোনাে কায়েমি স্বার্থ রক্ষা করার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করছে। তারা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময়েও তাই করেছিল। গণতন্ত্রের জন্য পরিচালিত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে নস্যাতের অপপ্রয়াসে লিপ্ত চরম বামপন্থীদের বিরুদ্ধেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়।৭
পশ্চিম পাকিস্তানেও জনমত গড়ে তােলার কিছু চেষ্টা চলে। করাচি সফরকালে শেখ মুজিবুর রহমান উল্লেখ করেন যে, তাঁর দল সমাজবাদে বিশ্বাস করলেও বিদেশ থেকে ধ্যানধারণা ধার বা আমদানি করে না। বরং তিনি সুনিশ্চিত করে বলেন, আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্র বলতে যা বােঝায় তা হলাে, তা দেশজ হতে হবে, তা উৎসারিত হবে মাটি থেকে তথা একান্ত ঘনিষ্ঠ পরিবেশজাত কোনাে কিছু হিসেবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগের ধারণার সমাজবাদে একদলীয় শাসন বা কোনাে নাস্তিক রাষ্ট্রের অবকাশ নেই। ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে তার পরবর্তী সফরকালে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানীদের এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের জনসাধারণের উন্নতিই আওয়ামী লীগ কার্যক্রমের লক্ষ্য।৮
পরে এমন এক সাধারণ ধারণা গড়ে ওঠে যে, মুজিব যদি আরাে আগে পশ্চিম পাকিস্তানের অবশিষ্টাঞ্চল সফর করতেন এবং আওয়ামী লীগের অবস্থান ও ভূমিকা ব্যাখ্যা করতেন। তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানে যথেষ্ট সমর্থন নিশ্চিত করা সম্ভব হতাে। অবশ্য আওয়ামী লীগের কর্মসূচির ব্যাপারে বলতেই হয় এতে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান সমর্থন ছিল এক ইউনিট বিলােপকেন্দ্রিক। আর স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে কিছু সমর্থন থাকলেও তা কোনাে কোনাে পকেট এলাকায় মাত্র। আওয়ামী লীগের সমাজবাদী অর্থনীতির চূড়ান্ত অপরিহার্যতা সম্পর্কিত অবস্থানের প্রচার কিছুটা বিলম্বিত না হলে সে কারণেও কিছু সমর্থন পাওয়া যেতাে। কিন্তু পিপিপির অভ্যুদয়ে আওয়ামী লীগের সেই সম্ভাবনা মাটি হয়ে যায়। তাই পশ্চিম পাকিস্তানে প্রান্তিক প্রভাব-প্রতিক্রিয়া দৃষ্টে পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে সুনিশ্চিত সাফল্যের প্রতি আওয়ামী লীগের মনােযােগ বেশি করে পড়াটাই স্বাভাবিক।
১৮৭
জনসভা অনুষ্ঠানের ওপর লাগাতার নিষেধাজ্ঞা থাকায় আওয়ামী লীগের মতাদর্শ প্রচারের জন্য দলীয় কর্মীদের বিভিন্ন স্তরে ব্যাপক কাজ করার আবশ্যকতা দেখা দেয়। এ জন্য ১৯৬৯ সালের আগস্ট ও অক্টোবরের মধ্যবর্তী সময়টি শেখ মুজিবুর রহমান কর্মিসভায় ভাষণ দিতে থাকেন। ঐ সব কর্মিসভায় তিনি কেবল আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ব্যাখ্যাই দেননি বরং বিভিন্ন মহল থেকে আওয়ামী লীগের নানা সমালােচনার জবাব দেন। এমনিভাবেই তিনি স্থানীয় স্তরেই এ ধরনের সমালােচনার মােকাবেলায় স্থানীয় ইউনিটগুলিকে তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তিনি তাঁর এই কর্মসূচি নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ততার কারণে জাতীয় শ্রমিক লীগের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও উপস্থিত থাকতে পারেননি। আওয়ামী লীগের শ্রমিক ফ্রন্ট জাতীয় শ্রমিক লীগের উদ্বোধন নির্ধারিত ছিল ঢাকায় ১৯৬৯ সালের ১১ অক্টোবর। অবশ্য অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে প্রেরিত এক বার্তায় তিনি বলেন, বাইশ বছর ধরে বাইশ পরিবার জাতীয় সংহতি ও ধর্মের নামে জাতীয় সম্পদের ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। তিনি এক সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামােকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “এ ধরনের সমাজতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক কাঠামাে হবে আমাদের রীতি-প্রথা, ঐতিহ্য ও ইচ্ছানুগ যা জাতীয়তাবাদী উপলব্ধির বুনিয়াদে এক নতুন শােষণমুক্ত জনসমাজ পত্তন করবে।” তিনি দাবি করেন যে, দেশের কলকারখানার মালিকানা বেশিরভাগ জনগণকে দিতে হবে। খরা, বন্যা ও অতিবর্ষণের দুর্ভোগ ও দুর্দশা কাটিয়ে ওঠার জন্য তিনি নিম্নোক্ত প্রস্তাব দেন:
১. পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিক চাষীদের খাজনা ও কর মওকুফ;
২. উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন চাষীদের মধ্যে বণ্টন;
৩. বন্যা নিয়ন্ত্রণ;
৪. সমবায় চাষাবাদের প্রবর্তন;
৫. দীর্ঘমেয়াদী ঋণ মঞ্জুরের জন্য গ্রামে গ্রামে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা;
৬. পাটের ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ ও পাটশিল্পের জাতীয়করণ।৯
এভাবে ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে রাজনৈতিক কার্যকলাপের ওপর আরােপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনেক আগেই আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু করে দেয়। আর নির্বাচনী এলাকাগুলির বৃহত্তম অংশের স্বার্থের দিকে খেয়াল রাখার জন্য প্রয়ােজনীয় যত্নও নেওয়া হয়। ১৯৬৯ সালের নভেম্বরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির গৃহীত প্রস্তাবে এই দৃষ্টিভঙ্গির আনুষ্ঠানিক অনুমােদন দেওয়া হয়। ঐ সব প্রস্তাবে রেশনিং ব্যবস্থাকে এমনভাবে সুষ্ঠু করে তােলার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানাে। হয় যাতে গ্রামের মানুষ ও শিল্প শ্রমিকরা উপকৃত হতে পারে। এ ছাড়া সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ন্যায্যমূল্যের দোকান খােলার, বেকারদের জন্য আর্থিক সাহায্য ও কাজের ব্যবস্থা, লকআপ তুলে নিয়ে ও ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের কাজে পুনর্বহাল করে শিল্প শ্রমিকদের মধ্যে শ্রম অসন্তোষ দূর করা, পাট ও আখ চাষীদের ফসলের অনুকূল ন্যূনতম দর নির্ধারণ, সকল
১৮৮
চা-বাগানকর্মীর জন্য যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে ন্যূনতম মজুরি প্রবর্তন এবং (স্বামী ও স্ত্রীকে এক ইউনিট হিসাব করার পদ্ধতির পরিবর্তে) মাথাপিছু এক ইউনিট গণনার ব্যবস্থা প্রচলনের জন্যও সরকারের প্রতি আবেদন জানানাে হয়।১০
আওয়ামী লীগ যখন জনসাধারণের বৈষয়িক অভিযােগের প্রতিকারের জন্য সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাদির আভাস দিচ্ছিল তখন জামায়াত-ই-ইসলামী ও পিডিপির মতাে অন্য রাজনৈতিক দলগুলি অস্পষ্টভাবে ইসলাম ও পাকিস্তানের সংহতি বিপন্ন হওয়ার ধুয়াে তুলে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি জানাচ্ছিলেন। জামায়াত-ই-ইসলামীর আমীর মাওলানা মওদুদী অভিযােগ করেন, পূর্ব পাকিস্তানের বিক্ষোভ আন্দোলনের নেপথ্যে পড়শী ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে কলকাঠি নাড়া হচ্ছে। জামায়াত-এর আরাে একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব মিয়া তােফায়েল মােহাম্মদ অভিযােগ করেন, শেখ মুজিব একজন কমিউনিস্ট। পরে অবশ্য পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের মজলিশ-ই-শুরা এক প্রস্তাবে আইন পাসের মাধ্যমে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার জন্য সরকারের প্রতি আবেদন জানান এবং দাবি করেন, “এ ব্যাপারে গৃহীত বাস্তব পদক্ষেপগুলি বছরকালের মধ্যে অবশ্যই গােটা জাতির দৃষ্টিগােচর হতে হবে।” কৌতূহলােদ্দীপক বিষয় এই যে, জামায়াতের প্রস্তাবে আওয়ামী লীগের ছয়-দফা ও পিডিএম-এর আট-দফার একটা সমন্বিত উপস্থাপনা ছিল।১১
পূর্ব পাকিস্তান পিডিপির আহ্বায়ক, আবদুস সালাম খান হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, আওয়ামী লীগের ছয়-দফার প্রায় সবই পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে অগ্রহণযােগ্য বলে এগুলি বাস্তবায়নের প্রয়াসে সশস্ত্র সংঘাত বাধবে। তিনি সে জন্য বলেন, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, এক ইউনিট বাতিল এবং জনসংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মতাে ইস্যুগুলির নিষ্পত্তি সাধারণ নির্বাচনের আগে হতে হবে। পরে অবশ্য তিনি নিজেকে দৃষ্টত অনেকখানি যৌক্তিক করে তুলতে চেষ্টা করেন এই প্রস্তাব তুলে যে, স্বায়ত্তশাসনের ইস্যুটি এক বিশারদ কমিটিকে দিয়ে ছয়, আট ও এগারাে-দফাসমূহের মূল্যায়ন করানাের মাধ্যমে নির্বাচনের আগেই এগুলির নিষ্পত্তি করা যায়।১২ পিডিএম ও ড্যাক প্রসূত পিডিপি ১৯৬৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তার নিজ গঠনতন্ত্র ও ম্যানিফেস্টো গ্রহণ করে।১৩ তবে এ সব ইস্যু নিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এ রকম সব বিলম্বিত পাল্টা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক প্রচারাভিযানে। আদৌ সুবিধা করা যায়নি (আর পরবর্তীকালে লক্ষ্য করা যায়, নিষ্ফলও বটে)। তাই পিডিপি বা জামায়াতের মত দলগুলি এ ধরনের জটিল সমস্যাবলির জন্য অতিসরলীকৃত সমাধানের পরামর্শ দিচ্ছিল।
১৯৬৯ সালের জুলাইয়ে আতাউর রহমান আহূত ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ লীগ (এনপিএল) ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে দলীয় গঠনতন্ত্র ও ম্যানিফেস্টো প্রণয়ন করে। ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সম্মেলনে দলের আহ্বায়ক অংশত সঠিক অভিমত দিয়ে বলেন, ছয়-দফা কর্মসূচি কোনাে বিরাট কিছু আবিষ্কার নয় আর সেই সাথে তিনি তাঁর রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা দেখিয়ে ফেলেন এ কথা যােগ করতে গিয়ে যে, সমতা নীতি বিলুপ্ত হওয়ায় ছয়-দফা অপ্রয়ােজনীয় হয়ে পড়েছে, কেননা পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে
১৮৯
ও কেন্দ্রীয় সরকারে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তার কথায় যা গড়িয়ে ও এড়িয়েও যায় তা হলাে: ইতঃপূর্বে ছয়-দফার বিষয়গুলি দরকষাকষির রাজনীতি ও রফার অংশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে যখন পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থার উন্নতির প্রয়াসকে কতিপয় কায়েমি স্বার্থবাদী মহল নস্যাৎ করে দিচ্ছিল; আর বস্তুতপক্ষেও এ ধরনের শক্তি তখন আগেকার যে কোনাে সময়ের চেয়েও অনেক বেশি ভালােভাবে শেকড় গেড়ে বসেছিল; ছয়-দফা ফর্মুলা এ ধরনের ঘটনাবলির পুনরাবৃত্তির বিরুদ্ধে শাসনতান্ত্রিক গ্যারান্টি চাচ্ছিল।১৪
আওয়ামী লীগ যখন তার বুনিয়াদের ব্যাপ্তি বাড়িয়ে চলেছিল এবং নির্বাচনের লক্ষ্যে তার দলীয় কর্মীদের নির্দেশনা দিচ্ছিল তখন রক্ষণশীল রাজনৈতিক শক্তিগুলি আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ সমালােচনাকে মূলধন করে টিকে থাকার চেষ্টা করছিল। বামপন্থীদের প্রতিনিধিত্ব করছিল ন্যাপের দুটি উপদল। মওলানা ভাসানী কী করবেন সেটা বােঝা যাচ্ছিল না। তিনি দুৰ্জেয় হয়েই রইলেন। ১৯৬৯ সালের জুনে তিনি ঘােষণা করেন যে, তাঁর দল নির্বাচনে অংশ নেবে না। কিন্তু অক্টোবরে তিনি প্রস্তাব দেন, প্রেসিডেন্টের একটা গােলটেবিল বৈঠকের আয়ােজন করা এবং দেশের আগামী খসড়া শাসনতন্ত্রের একটি কাঠামাে বা রূপরেখা তৈরি করে সেটির ওপর গণভােটের ব্যবস্থা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমষ্টির অভিমত গ্রহণ করা উচিত। অবশ্য, সে বছর ডিসেম্বরেই আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইস্যুতে তার দল বিভক্ত হয়ে যায়। ১৯৭০ সালের গােড়ার দিকে ভাসানী গদি দখল নয়, বরং পরিষদে জনসাধারণের অভাব-অভিযােগ উত্থাপন করার জন্যই নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুকূলে মত ব্যক্ত করেন। তার কয়েকজন সমর্থক তখনাে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিরােধিতা করছিলেন। তবে বছর গড়ানাের মুখে তিনি সহিংস সমাজ বিপ্লব ছেড়ে অহিংস ইসলামী বিপ্লবের পক্ষপাতী হয়ে ওঠেন। এতে তাঁর দলের ভেতরের বিভেদ আরাে বেড়ে যায়। মওলানা ভাসানীর এ দ্বিধা ও সিদ্ধান্তসংশয় পূর্ব পাকিস্তানের বিপ্লবী বামশক্তিকে অত্যন্ত দুর্বল করে দেয়। মধ্যবামের প্রতিনিধি ওয়ালী ন্যাপ যা পূর্ব পাকিস্তানে মােজাফফর ন্যাপ নামে বেশি পরিচিত কৌশলগত কারণে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছিল। এক্ষণে এই দলটি স্বতন্ত্রভাবে নিজ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আওয়ামী লীগের সাথে এক আনুষ্ঠানিক জোট বাঁধার চেষ্টা করতে থাকে।১৫
ইয়াহিয়া খানের শাসনামলের প্রথম কয়েক মাসে ছাত্ররা নিচু লয়ে চললেও তারা ১৯৬৯ সালের আগস্টে প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করে। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)-এর মতাে দুটি ছাত্র সংগঠন বিভিন্ন বিরােধীদলগুলির মধ্যে ঐক্যের কথা বলতে থাকে যদিও ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এ ধরনের বক্তব্য বন্ধ করে দিয়ে নিজের সংগঠনকে প্রদেশের আরাে ভেতরে ছড়িয়ে দিয়ে। আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রচারে মনােনিবেশ করে। ছাত্রলীগ ১৯৭০ সালের মার্চে ঢাকায়। বার্ষিক সম্মেলনে খুব পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে, ছয়-দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন বাস্তবায়িত
১৯০
হলে এগারাে-দফার অন্যান্য দাবির বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়বে। ছাত্রলীগের আগামী কর্মপদক্ষেপ কী হবে তা ছকে দেন শেখ মুজিব যখন তিনি এ বার্ষিক সম্মেলনে বলেন যে, ‘জনগণকে এবার শহীদ নয়; গাজী হওয়ার জন্য তৈরি হতে হবে।১৬
১৯৬৬-৬৭ সালের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের সময় ও তার পরের বছরগুলিতে যেমন তেমনি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক শক্তিগুলি এখন থেকে প্রধানত তিনটি ভিন্ন দিকনির্দেশনায় কাজ করে যেতে থাকে। অবশ্য দেখা যায় যে আওয়ামী লীগই জনসাধারণের বাস্তব আশা-আকাঙ্ক্ষার সবচেয়ে কাছাকাছি ছিল। কাছাকাছি ছিল ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্রসমাজের বৃহত্তর অংশেরও। ১৯৬৯ সালের ২৮ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যখন চূড়ান্তভাবে জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের রূপরেখার ঘােষণা করেন এ রকমই পরিস্থিতি ছিল তখনকার। তিনি উল্লেখ করেন, রাজনীতিকদের মাঝে ঐকমত্য নেই আর সেই সঙ্গে তিনি তাঁর এই উক্তির পুনরুক্তি করে বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানীদের অভাব-অভিযােগ ন্যায়সঙ্গত আর এ সবের সমাধান নিহিত রয়েছে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামাে প্রতিষ্ঠায় যার আওতায় প্রদেশগুলি আইনগত ও আর্থিক উভয় ক্ষমতাই লাভ করবে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বাতিল এবং জনপ্রতি এক ভােট নীতির ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ঘােষণা করেন। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পরিসর কী হবে সে সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট পরিষ্কার কোনাে কিছু বলেননি। স্বায়ত্তশাসনের এ বিষয়কে সংজ্ঞায়িত করার প্রকৃত কাজটি ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র প্রণেতা সংস্থার জন্য রেখে দেওয়া হয়। তার দেওয়া নির্দেশিকায় বলা হয়, ফেডারেশনের অংশীদার কোনাে ইউনিটের স্বায়ত্তশাসন জাতীয় অখণ্ডতা ও দেশের সংহতি ক্ষুন্ন করবে না। তিনি বলেন, কেন্দ্রে জাতীয় সরকারের কার্যপরিচালনায় বিরূপ প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করার শর্তে পাকিস্তানের দুই অঞ্চল তদবধি তাদের অর্থনৈতিক সম্পদ ও উন্নয়নের ওপর নিয়ন্ত্রণের অধিকারী হবে। প্রেসিডেন্ট উল্লেখ করেন যে, যেহেতু সংসদীয় পদ্ধতির সরকারে প্রত্যক্ষ বয়স্ক ভােট, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও সেগুলির ন্যায্যতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও শাসনতন্ত্রের ইসলামী বৈশিষ্ট্য নিয়ে কোনাে মতানৈক্য নেই সেহেতু আগামীতে যে শাসনতন্ত্র প্রণীত হতে যাচ্ছে (সে জন্য নির্বাচনের ক্ষেত্রেও) তার জন্য এগুলিকে নিষ্পত্তিকৃত বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা উচিত হবে। ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়সূচি ছিল এ রকম: রাজনৈতিক কার্যকলাপের পুনরুজ্জীবন ১ জানুয়ারি, ১৯৭০; নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অস্থায়ী আইন কাঠামাে আদেশ প্রণয়ন ১৯৭০ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে; ভােটার তালিকা প্রণয়ন জুন, ১৯৭০ নাগাদ; জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান ৫ অক্টোবর, ১৯৭০; এর পরে প্রাদেশিক পরিষদগুলির নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং জাতীয় পরিষদের প্রথম সভা অনুষ্ঠানের ১২০ দিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন। প্রেসিডেন্ট “সকল সঙ্কীর্ণ স্বার্থ এবং ব্যক্তিগত ও স্থানীয় পর্যায়ের বিষয় বড় করে দেখা পরিহারের”১৭ জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
প্রেসিডেন্টের এই ঘােষণাকে পূর্ব পাকিস্তানী রাজনৈতিক মহল কিছু সমালােচনা করলেও মৃদু থেকে উষ্ণ মাত্রায় স্বাগত জানায়।
১৯১
আশু যে সব সাড়া বা প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় সেগুলির মধ্যে প্রথম বিশদ ও সমালােচনামূলক প্রতিক্রিয়া ছিল সাবেক আওয়ামী লীগার, পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও সম্প্রতি গঠিত ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ লীগের আহ্বায়ক আতাউর রহমান খানের। তিনি উল্লেখ করেন যে, “প্রেসিডেন্টের ঘােষণায় আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে ইতিবাচক কিছুই নেই যদিও স্বায়ত্তশাসনের দাবি এক ইউনিট ভাঙার মতাে ক্ষমতাধর ছিল।” তিনি আরাে বলেন, জাতীয় সংহতি ক্ষুন্ন হয় না—এমন পরিসর অবধি সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাবটি অস্পষ্ট ও অসংজ্ঞায়িত এ কারণে যে, পূর্ব পাকিস্তানের দাবি ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার। কেননা ঐ দাবিতে বলা রয়েছে, কেন্দ্রের হাতে থাকবে কেবল তিনটি বিষয়। তিনি এ কথাও বলেছিলেন বলে জানা যায় যে, “প্রেসিডেন্টের ঘােষণায় একটি নিয়ন্ত্রিত পরিষদকেই পাওয়া যায় যদিও আমাদের দাবি ছিল একটি সার্বভৌম শাসনতান্ত্রিক পরিষদ।”১৮
আশু সুখ্যাতিমূলক অভিব্যক্তি পাওয়া যায় কাউন্সিল মুসলিম লীগ পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি খাজা খয়েরউদ্দিনের কাছ থেকে। তিনি এই “বলিষ্ঠ” ও “সাহসী” ঘােষণাকে স্বাগত জানান। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক একিউএম শফিকুল ইসলাম আরাে এক ধাপ আগ বাড়িয়ে বলেন যে, “প্রেসিডেন্ট জনসাধারণের ঠিক মনের কথাটিই বলেছেন” আর “তিনি তাঁর পক্ষে সর্বোত্তম যা করতে পারার তা করেছেন।”১৯
পাকিস্তান পিপলস পার্টির পূর্ব পাকিস্তান শাখার চেয়ারম্যান মওলানা নুরুজ্জামান। “সর্বান্তকরণে এই শাসনতান্ত্রিক ফর্মুলার প্রতি সমর্থন জানান এবং এর মূল্যায়ন করেন, “একমাত্র সমাধান” বলে অভিহিত করে।২০ এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, শফিকুল ইসলাম ও মওলানা নুরুজ্জামান উভয়ে প্রেসিডেন্টের ঘােষণাকে সুস্বাগত জানালেও শফিকুল ইসলামের মতে, “বল” এখন “রাজনীতিকদের” কোর্টে পক্ষান্তরে মওলানা নুরুজ্জামানের ভাষ্য অনুযায়ী “বল” রয়েছে “জনগণের” কোর্টে।
পূর্ব পাকিস্তান জামায়াত-ই-ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গােলাম আযম এই মর্মে সন্তোষ প্রকাশ করেন যে, প্রেসিডেন্ট কতকগুলি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি তাঁর উপলব্ধির কথা প্রকাশ করে বলেন, স্বায়ত্তশাসনের পরিসর কতদূর পর্যন্ত হবে সেই অমীমাংসিত প্রশ্নটি এই মুহূর্তে সমাধানের বাইরে কেননা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে এখনাে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি।২১
মওলানা ভাসানীর আশু প্রতিক্রিয়ায় তাঁর মিশ্র অনুভূতি প্রকাশ পায়। তিনি এক ইউনিট বিলােপের মতাে কোনাে কোনাে বিষয়কে স্বাগত জানান। আবার স্বায়ত্তশাসনের মতাে অন্য কিছু বিষয়-সংক্রান্ত ঘােষণাকে অস্পষ্ট বলে মতপ্রকাশ করেন। তাঁর মতে, ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের আলােকে কেন্দ্র ও প্রদেশের সম্পর্কের পরিষ্কার ব্যাখ্যা থাকা উচিত ছিল। তিনি প্রেসিডেন্টের কথিত ইসলামী বৈশিষ্ট্যের শাসনতন্ত্র কী সে ব্যাখ্যা চান। কেননা তাঁর মতে, “ইসলামী শাসনতন্ত্রের প্রকৃতি নিয়ে প্রচুর বিভ্রান্তি রয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপাের্ট দৃষ্টে মনে হয়, মওলানা প্রেসিডেন্টের সাথে তাঁর সর্বশেষ আলােচনার পর ধারণা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ইসলামী সমাজতন্ত্রে সম্মত হয়েছেন আর তিনি মর্মাহত হন এই
১৯২
ভেবে যে কথাটি তার ঘােষণায় তিনি উল্লেখ করেননি। তিনি ঘােষণার বিভিন্ন ভুলচুকের প্রতি অঙুলি নির্দেশ করার সাথে সাথে কতকগুলি প্রস্তাবও দেন। তাঁর মতে, “সাধারণ নির্বাচন বা এ ধরনের অন্য বিষয়ের জন্য কোনাে আইনগত কাঠামাে প্রণয়ন করতে হলে তা করা দরকার “রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক ও কৃষক প্রতিনিধিদের সম্মেলনে।” এভাবে যে কাঠামাে পাওয়া যাবে সেটিকে এরপর গণভােটে দিতে হবে। আর এটি করতে হবে বিশেষ করে এই কারণে যে, কিছু রাজনৈতিক নেতা যেমন জনমতের প্রতিনিধি নন। তেমনি প্রেসিডেন্টের সাথে তারা কী আলােচনা করেছেন তা প্রকাশ করাও হয়নি। তাছাড়া, প্রেসিডেন্ট নিজেও জনসমক্ষে এ নিয়ে কথা বলেননি।”২২
অস্থায়ী আইনগত কাঠামাে সম্পর্কে মওলানা ভাসানীর মূল অসন্তোষের বক্তব্য ছিল এই যে, “আগের দুটি শাসনতন্ত্রের মতাে এটিকেও জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।” বিষয়টি আরাে তীক্ষ্ণ, শাণিত করে প্রকাশ করেন তাঁর দলীয় সাধারণ সম্পাদক মােহাম্মদ তােয়াহা। তিনি বলেন, “প্রস্তাবিত জাতীয় পরিষদের মাধ্যমে একটি শাসনতন্ত্র প্রাপ্তির ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের ঘােষণা আমাদের সময়ের চাহিদা পূরণ করতে পারেনি।” তিনি এ কথা বলেছিলেন বলে জানা যায় যে:
তিনি বুঝতে পারেন না, শাসনতন্ত্র প্রণয়নের মতাে এমন প্রয়াস দেশের শ্রমজীবী শ্রেণী ও কৃষককুলকে হিসেবে না নিয়ে কেমন করে সম্ভব হতে পারে… কার্যকর একটি শাসনতন্ত্র লাভের যে কোনাে প্রয়াসে শ্রমজীবী শ্রেণী, কৃষককুল, ছাত্রসমাজ, রাজনৈতিক দল, দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী এবং জাতীয় বুর্জোয়ার দেশপ্রেমিক অংশের অবশ্যই অংশীদারি থাকতে হবে… দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রে অবশ্যই গণমানুষের শাসনতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে।২৩
এখানে বিষয়টি কৌতুহলপূর্ণভাবেই লক্ষণীয় যে, ভাসানী ও তােয়াহা উভয়েই রাজনৈতিক দলগুলির যে কোনাে জনপ্রতিনিধিত্বশীলতা থাকতে পারে তা স্বীকার করেননি। কেননা, রাজনৈতিক দলগুলি ছাড়াও তারা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় কর্মজীবীদের প্রতিনিধিত্ব চাচ্ছিলেন। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, তাদের নিজ সংগঠন ন্যাপ-ভাসানীসহ রাজনৈতিক দলগুলি আসলে প্রতিনিধিত্ব করছিল কাদের? যদি তারা কারও স্বার্থের প্রতিনিধি না হয়ে থাকে তাহলে কিসের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তারা অংশগ্রহণের অধিকারী হবে?—এ ক্ষেত্রে ভাসানীর ও তােয়াহার মতাে নেতার স্পষ্ট ধারণার অভাব রয়েছে বলেই মনে হয়। আর যদি তা না হয়ে থাকে তাহলে বুঝতে হবে তাঁরা তাঁদের ধ্যানধারণা বােঝাতে বা জ্ঞাপন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তবে ঘটনা এ দুয়ের যা-ই হােক দুটিই দল গঠনের পথে গুরুতর প্রতিবন্ধক, আর পূর্ব পাকিস্তানের বামপন্থীরা খুব সম্ভবত নেতৃত্বের নানা গলদ-ত্রুটির জন্য প্রচুর ভুগেছে। তার ফলে বাম আন্দোলনের বিকাশ হয়েছে প্রতিবন্ধী প্রাণীর মতাে।
কনভেনশন মুসলিম লীগের সিনিয়র সহসভাপতি খান এ সবুরকে অনেকটাই দ্বিধান্বিত মনে হয়েছে। তিনি গােড়ার দিকে কোনাে মন্তব্য করতে চাননি ও পরে করলেও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তাঁর অভিমত দিয়েছেন। তিনি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাওয়ায় আন্তরিকতা প্রমাণের জন্য প্রেসিডেন্টকে প্রশংসা করেন। তবে তিনি বলেন যে,
১৯৩
ভােটদানের পদ্ধতি, কেন্দ্র ও প্রদেশগুলির মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন, নির্বাচনী প্রচার অভিযানের জন্য মৌলিক বিধিবিধান—এসবের আরাে বিশদ ও সরল ব্যাখ্যার প্রয়ােজন রয়েছে আর ততােদিন পর্যন্ত তিনি এ বিষয়ে তার চূড়ান্ত মন্তব্য দেবেন না। তবু তাঁর এই সতর্ক বিবৃতি থেকেও টের পাওয়া যায়, তিনি মনে করতেন না যে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়াটি এত মসৃণ, সাবলীল হবে কেননা, চার মাস এ জন্য খুবই অল্প সময়।২৪
পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপ (মােজাফফর)-এর প্রতিক্রিয়া ছিল একান্তই নিরুত্তাপ। দলীয় ওয়ার্কিং কমিটিতে প্রেসিডেন্ট কিছু জনদাবি গ্রহণ করেছেন—এ কথার উল্লেখ করে এ দল দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যাখ্যা দাবি করে। এক, যে অথেনটিকেশন/অনুমােদনের কথা বলা হয়েছে তা শুধুই আনুষ্ঠানিকতা কিনা, আর দুই, প্রেসিডেন্ট ও প্রস্তাবিত জাতীয় পরিষদের মধ্যে সম্পর্ক কী হবে। মােজাফফর ন্যাপের এ ধরনের প্রতিক্রিয়া অন্যদের তুলনায় ভিন্ন ধরনের ছিল এই বিবেচনায় যে, তারা স্বায়ত্তশাসনের পরিসর নিয়ে প্রশ্ন তােলেনি যদিও এ প্রশ্নে তারা নিজ অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বলেছে কেবল পররাষ্ট্র বিষয় (রাজনৈতিক), প্রতিরক্ষা ও মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকবে।২৫
আওয়ামী লীগ কোনাে ত্বরিৎ প্রক্রিয়া ব্যক্ত করা থেকে বিরত থাকে।২৬ অবশ্য দলের ভেতরে আলােচনার পর একটা দীর্ঘ অথচ নিরুত্তাপ বিবৃতি দেয়। তাতে পরিষ্কার বলা হয় যে, ইয়াহিয়া খান যে প্রকৃতির আইন কাঠামােই আরােপ করুন না কেন তাতে আওয়ামী লীগে কোনাে পরিবর্তন ঘটবে না। দলটি তার নিজ কর্মসূচি অনুসরণ করবে। অন্য বেশিরভাগ প্রতিক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আওয়ামী লীগ। দলটি কোনাে ইস্যুর ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে ব্যাখ্যা চায়নি। তবে উল্লেখ করে যে, কোনাে কোনাে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অমীমাংসিত রেখে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ ধরে নেয় যে, এ সব ইস্যু (আরাে অন্যান্য ইস্যু যে সব বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছেন) নির্বাচনে জনগণের ম্যাণ্ডেটে প্রতিফলিত তাদেরই অভিপ্রায় অনুযায়ী মীমাংসিত হবে। সে যা-ই হােক, প্রেসিডেন্ট গণতান্ত্রিক পন্থায় জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরণের মনােভাব ব্যক্ত করায় আওয়ামী লীগ সেই মনােভাবের প্রশংসা করে এবং এই আশা ব্যক্ত করে যে, কোনাে “স্পর্শকাতর বিষয়ে” ও “বিতর্কিত বিষয়ে” “অতি উৎসাহী ব্যবস্থা গ্রহণে প্রশাসনকে সংযত রাখার অনুকূল পরিবেশ প্রেসিডেন্ট নিশ্চিত করবেন। প্রেসিডেন্টের ঘােষণায় আওয়ামী লীগের কোনাে কোনাে বিষয়ে বিজয়ী হওয়ার আভাস প্রতিফলিত। ঐ বিবৃতিতে বলা হয়:
আমরা সুনিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি, জনগণ ছয়-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে দ্ব্যর্থহীনভাবে তাদের স্বায়ত্তশাসন দাবির সপক্ষে রায় দেবে। কেননা, স্বায়ত্তশাসনের বুনিয়াদেই কেবল পাকিস্তানে সংহতি ও অখণ্ডতা গড়ে উঠতে পারে। কারণ, আজকে ক্ষমতার ভারসাম্যের যে অভাব, অর্থনৈতিক বৈষম্য, প্রতিরক্ষা খাতে চাকরি-বাকরিসহ সকল সরকারি পদে নিয়ােগের বেলায় যে বৈষম্য কেন্দ্র ও ফেডারেশনের ইউনিটগুলি, বিশেষ করে, পূর্ববঙ্গের বেলায় রয়েছে স্বায়ত্তশাসনই কেবল তার চির অবসান ঘটাবে।২৭
১৯৪
সামগ্রিকভাবে আওয়ামী লীগকে দৃষ্টত শান্ত মনে হয়। এ কথা ধরে নেওয়া ঠিক হবে না যে, যে আশঙ্কামূলক অনুভূতি প্রকাশ করা হয়েছে, যেমন আতাউর রহমান যে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন তা ভিত্তিহীন কিংবা বিপরীতক্রমে আওয়ামী লীগ নিহিত তাৎপর্য দেখেও দেখেনি, অন্ধ ছিল। বাস্তবিকপক্ষেও আওয়ামী লীগের এ বিষয়ে ঢের বেশি জ্ঞাত ও সজাগ থাকা উচিত ছিল। তবে এ পর্যায়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার বিষয়টি কেবল তার নিজের দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে দিত আর নিশ্চয়ই তা হতাে মন্দ কৌশল। তাই আওয়ামী লীগ, প্রেসিডেন্ট কী বলেছেন ও সেই সাথে কী-ই বা তাঁর বলা উচিত ছিল অথচ বলেননি সে বিষয়ে একটা নিরুদ্বিগ্ন ঔদাসীন্যের মনােভাব দেখানাের সিদ্ধান্ত নেয় বলেই মনে হয়। আর এ মনােভাব যেন প্রেসিডেন্ট কী বললেন তাতে কিছু যায় আসে না—এমনি করে গায়ে না মাখা ভাব গােটা নির্বাচনী অভিযানের আগাগােড়াই চলতে থাকে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে এই নির্বিকার ভাব এমন এক প্রত্যয় জোরদার করে তােলে বলে মনে হয় যেন তারা উদ্দিষ্ট পথেই চলেছে। নানা উপলক্ষে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ছাত্রলীগের এক আলােচনা সভায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, তার দলের সকল দাবি খুব ভালাে করে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখার পর দৃঢ় প্রত্যয়ে স্থির করা হয়েছে। কাজেই এ সব দাবি নিয়ে দরকষাকষির কোনাে অবকাশ নেই। ২৮
ছাত্রসমাজ প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের বক্তব্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন (এনএসএফ)-এর সভাপতি ও সম্পাদকদের সই করা এক প্রচার পুস্তিকায় কতকগুলি বিষয়ে ব্যাখ্যা, প্রস্তাবিত নির্মিতিগত কাঠামাে সম্পর্কে দ্রুততর ঘােষণা, সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং রাজবন্দীদের মুক্তি দাবি করা হয়। তাদের কাছে কাক্ষিত ছিল ঐ নির্মিতিগত কাঠামাের চৌহদ্দিতে সরল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে শাসনতন্ত্র গৃহীত হওয়া, আনুষ্ঠানিকতা মাত্র হিসেবে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক শাসনতন্ত্র অনুমােদন এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনসহ সকল সিদ্ধান্ত প্রণয়নে জাতীয় পরিষদের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হওয়া। এখানে লক্ষ্য করার মতাে বিষয় এই যে, ছাত্ররাও স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে প্রেসিডেন্টের কোনাে ফরমান চায়নি। তারাও দৃষ্টত এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিল যে, এ রকম কোনাে ফরমান দেওয়া হলেও তা নিষ্ফল হতাে। তারা বরং অনেক বেশি উদ্বিগ্ন ছিল তাদের ভাষায় “ডান প্রতিক্রিয়াশীল ও বাম রােমাঞ্চবিলাসীদের নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে। আর তাই তারা জনগণকে তাদের আত্মতুষ্টি ছেড়ে এ সব শক্তি সম্পর্কে সজাগ হওয়ার জন্য হুঁশিয়ার করে দেয়। ছাত্ররা অবশ্য এই প্রত্যয় ব্যক্ত করে যে, তারা যে মুক্তির কথা ভাবে তা কেবল নির্বাচন ও সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়িত করা যাবে না। সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ এবং একচেটিয়া পুঁজি উৎখাত না করা, বাঙালিসহ (পাকিস্তানের) সকল নরগােষ্ঠীর স্বশাসন পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া এবং সাধারণ মানুষের সকল সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলতে থাকবে। তাদের মতে, নির্বাচন ও সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠার যে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়ে থাকে তা কেবল অভীষ্টের
১৯৫
উপায় মাত্র, খােদ অভীষ্ট নয়।২৯ তবে মৌলিক কাঠামােগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে সংসদীয় গণতন্ত্রকে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করে এই অভিযানের দলিলে স্বাক্ষরদাতারা প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের সংগ্রামের কৌশলের প্রতি সমর্থন জানান। এখানে লক্ষণীয় যে, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) ঐ স্বাক্ষরদাতাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ফলত তা থেকে আভাস পাওয়া যায় যে, আওয়ামী লীগকে সমর্থনের সিদ্ধান্তে ছাত্রসমাজের মাঝে আর ঐকমত্য ছিল না।
সময় গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে খুব ভালাে করেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আওয়ামী লীগ অন্য দলগুলির সাথে কোনাে রকম আঁতাত না করেই কিংবা জোট না বেধেই নিজ ছয়-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে স্থিরসংকল্প। আর নির্বাচনসংক্রান্ত বিধিবিধানের ব্যাপারে কোনাে রকম আলােচনা বা দরকষাকষি নিয়েও দলটি মাথা ঘামায়নি। বস্তুত এ ছিল আওয়ামী লীগের নিজ কর্মসূচির ওপর জনগণের আনুষ্ঠানিক রায় লাভের প্রথম সুযােগ। এ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ায় দলটি অন্য কোনাে রাজনৈতিক গােষ্ঠীকে তাই এ রাজনৈতিক গৌরবে অংশীদার করতে চায়নি। শেখ মুজিব ছাত্রলীগকে বলেন, “যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে জনগণের কোনাে সত্যিকারের কল্যাণ নিশ্চিত করা যাবে না ।” তিনি জোর দিয়েই বলেন, “আমরা দল বা নেতাদের ঐক্য চাই না, আমরা জনগণের ঐক্য চাই।” তিনি আরাে বলেন, যদি অন্যান্য দলের সদস্যরা আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাস করে তাহলে তাদের নিজ নিজ সাইনবাের্ড বদলে আওয়ামী লীগে যােগ দেওয়া উচিত। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট রাজনীতির উল্লেখ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনি আবার সেই একই অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে প্রস্তুত নন। তাঁর উল্লিখিত সমমনা দল বলতে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপ (মােজাফফর)-ই ছিল স্পষ্টতই সেই দল। এ দলটি নির্বাচনের জন্য। বারংবার যুক্তফ্রন্ট গঠনের তাগাদা দিয়ে আসছিল। আর বলাবাহুল্য, পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপ (মােজাফফর)-ই ছিল একমাত্র রাজনৈতিক দল যা প্রায় সকল মৌলিক সমস্যার সমাধানের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মতবাদের সবচেয়ে কাছাকাছি। স্পষ্টত পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপ (মােজাফফর) তখনাে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটা নির্বাচনী গাঁটছড়া বাঁধার আশায় হাল ছাড়েনি কেননা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) তখনাে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সঙ্গে এক কাতারে শামিল ছিল।৩১
কোনাে আঁতাত প্রশ্নে আওয়ামী লীগের অনাগ্রহ দৃষ্টত মনে হয় এক সুচিন্তিত নীতিই বটে। ১৯৭০ সালের জুন মাসে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদকের রিপাের্টে৩১ পরিষ্কার বলা হয় যে, অন্যান্য দলের সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাত হলে তাতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। তাই এখন জনসাধারণকে তাদের নিজ প্রতিনিধি ও দল” বেছে নিতে হবে। অবশ্য (আওয়ামী লীগ) দলের নিজ বিকল্পগুলি বেছে নেওয়ার পথ। খােলা রাখার জন্য এই মর্মে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে:
এর অর্থ অবশ্য এই নয় যে, আমরা দেশের অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তির সাথে কোনােই যােগাযােগ রাখবাে না, ইতঃপূর্বে বলা হয়েছে যে, যদি আগামীতে রাজনীতি গণতন্ত্রের
১৯৬
পথে না এগিয়ে যায় এবং আমরা গণআন্দোলন গড়ে তুলতে ও সংগ্রাম শুরু করতে বাধ্য। হই সে ক্ষেত্রে আমরা দেশের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলের সহযােগিতাকে স্বাগত জানাবাে।
অন্যান্য দলকে আরাে আশ্বাস দেওয়া হয় যে, আওয়ামী লীগ “শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তাদের সহযােগিতা ও পরামর্শ চাইবে।” তাজউদ্দিন তাদের এ কথা মনে করিয়ে দেন যে, “নির্বাচনে প্রতিযােগিতা হতেই পারে, তবে অসহযােগিতা তার পূর্বশর্ত নয়।”
উল্লিখিত রিপাের্টে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়ের আভাস রয়েছে: (ক) বিরােধী শক্তির অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানে নিজ প্রাধান্য ও আধিপত্য সম্পর্কে আওয়ামী লীগ প্রত্যয়শীল; (খ) পূর্ব পাকিস্তানে একাধিপত্য সত্ত্বেও এ দলটি পাকিস্তানী ক্ষমতাসীন শাসকচক্রের মােকাবেলায় নিজের দরকষাকষির সীমিত সামর্থ্য সম্পর্কে খুব ভালােভাবেই অবহিত। প্রথম বিষয়টি এমনকি নির্বাচনে প্রার্থী মনােনয়নদান পর্যায়েই পরিষ্কার ধরা পড়ে। কেননা, তখন কনভেনশন মুসলিম লীগও পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের মােট আসনের অর্ধেকের জন্য প্রার্থী দিতে পারেনি। আর দ্বিতীয় বিষয়টি নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরে স্পষ্ট হয়।
আশু লক্ষ্য হিসেবে ছয়-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী প্রচারাভিযান চালায়। এ দল আগাগােড়া এ কথাই বলে যে, তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে, পাকিস্তানে শােষণমুক্ত এক জনসমাজের অভ্যুদয় ঘটানাে। নির্বাচনী অভিযানের আগাগােড়া, বিশেষ করে, প্রচারণা অভিযানের প্রধান ভাষণগুলিতে কোনাে ঐতিহ্যগত বা চিরায়ত শ্রেণীহীন সমাজ কিংবা কোনাে নাস্তিক সমাজ সম্পর্কে কোনাে কোনাে মহলে যাতে কোনাে প্রকার আশঙ্কার উদ্রেক না হয় সে জন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।৩২ এটি করা হয় এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি নিবারণ করার জন্য যে পরিস্থিতিকে আওয়ামী লীগবিরােধী ধর্মীয় ও রক্ষণশীল দলগুলি তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার কাজে লাগাতে পারে। ‘৫০-এর দশকের মাঝামাঝি মুসলিম লীগ আওয়ামী লীগের ঘন ঘন সমালােচনায় নিয়ােজিত হয়। সােহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে ঘন ঘন অভিযােগ তােলা হয়, তিনি পশ্চিমা লােকায়ত দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ আর ঠিক সে কারণেই তাঁকে ইসলামী পাকিস্তানের স্বার্থরক্ষায় অক্ষম বলে অভিহিত করা হয়। আর এভাবেই মুসলিম লীগ পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। এ সব কারণে দেশজ “সমাজতন্ত্রে” শেখ মুজিবের গুরুত্বারােপের বিষয়টিকে একটা সুপরিকল্পিত আত্মরক্ষামূলক অবস্থান বলেই মনে হয়।
এ ছাড়াও প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে কিছু হুমকির আভাসও ছিল। যেমন, তিনি তাঁর বিবৃতিতে বলেছিলেন যে, শাসনতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর নিজেরও কিছু ভাবনাচিন্তা আছে আর স্বায়ত্তশাসন ইস্যুর সাথে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনাে সম্পর্ক নেই। শাসনতন্ত্র তৎকর্তৃক অনুমােদন প্রশ্নে প্রেসিডেন্টের ঘােষিত অবস্থানটিও শাসনতন্ত্রের বৈধতাদানের প্রক্রিয়াকে সহজ করবে—এমন আভাস মােটেও নয় কেননা, প্রেসিডেন্ট বলেন যে তিনি কেবলই সই করার এক যন্ত্রমাত্র নন, বরং একজন অরাজনৈতিক ও নিরপেক্ষ ব্যক্তি
১৯৭
হিসেবে রাষ্ট্রপ্রধানের দেশ ও জনসমষ্টির স্বার্থের হেফাজতেও দায়িত্ব রয়েছে।৩৩ এ ধরনের কথাবার্তা ও মন্তব্যে নানা সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি হয়। আর এগুলি আরাে ঘনীভূত হয় এলএফও বা আইন কাঠামাে আদেশের কোনাে কোনাে বিধানের কারণে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বিদ্যমান কাঠামাের কোনাে পরিবর্তন প্রবর্তনে প্রয়াসী হলে এ সব বিধান। বলে প্রেসিডেন্ট তা নাকচ করার ক্ষমতা রাখেন। এলএফও’র, বিশেষ করে, দুটি-দফার সমালােচনা করেন পূর্ব পাকিস্তানী রাজনীতিকরা। এর প্রথমটি হলাে ২৫নং দফা। এতে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে: জাতীয় পরিষদ কর্তৃক অনুমােদিত শাসনতন্ত্র বিলটি অনুমােদনের জন্য প্রেসিডেন্ট সমীপে পেশ করা হবে। এই অনুমােদন প্রত্যাখ্যাত হলে জাতীয় পরিষদ বিলুপ্ত বলে গণ্য হবে।” দ্বিতীয়টি ২৭নং দফা। এতে বলা হয়েছে:
১. এই আদেশের কোনাে বিধানের ব্যাখ্যাদির বিষয়ে কোনাে প্রশ্ন বা সন্দেহ দেখা দিলে তা প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তে নিষ্পত্তি হবে; এবং এ সিদ্ধান্ত হবে চূড়ান্ত এবং এ নিয়ে কোনাে আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।
২. জাতীয় পরিষদ নয়, প্রেসিডেন্ট এই আদেশের যে কোনাে সংশােধন করার ক্ষমতার অধিকারী হবেন।৩৪
এলএফও ঘােষণার অব্যবহিত পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি দু’দিনব্যাপী এক সভায় মিলিত হয়। এ সভা গণতান্ত্রিক নীতিমালা অনুযায়ী এলএফও’র সংশােধন চেয়ে এক প্রস্তাব পাস করে। প্রকাশ্যেও আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে এলএফও’র সংশােধন করার জন্য বলে।৩৫ তবে এটিকে তারা তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের পূর্বশর্ত করেনি। ছাত্রলীগও একই পথ অনুসরণ করে। তবে আওয়ামী লীগের মতাে নীরব না থেকে তারা এলএফও’র সমালােচনায় সােচ্চার হয়। ছাত্রলীগের বক্তব্যে প্রেসিডেন্টকে তাঁর অর্পিত কার্যদায়িত্ব অপপ্রয়ােগের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। ছাত্রলীগ নেতারা বলেন যে, জাতি প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে কোনাে শাসনতান্ত্রিক কাঠামাে চায়নি। প্রেসিডেন্টের কেবল কাজ ছিল নির্বাচনের জন্য একটা আইন কাঠামাে দেওয়া। নির্বাচনের পরে যা কিছুই ঘটুক সেগুলি পুরােপুরিই জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়। শাসনতন্ত্র অনুমােদন বা অননুমােদনের ভিটো ক্ষমতা, এমনকি, প্রেসিডেন্টের ইচ্ছায় জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতাটি তাঁর হাতে রেখে দেওয়ায় তাতে গণতান্ত্রিক নীতিমালা ও পাকিস্তানের জনসাধারণের প্রতি প্রেেিডন্টের অনাস্থাই প্রকাশ পেয়েছে। তারা ঘােষণা করেন যে, বাঙালিরা কোনাে ব্যক্তির দেওয়া শাসনতন্ত্র গ্রহণ করবে না। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নূর এ আলম সিদ্দিকী জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের ভাবী সদস্যদের পূর্বাহে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন:
ছয় ও এগারাে-দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য আপনাদেরকে সর্বাত্মক প্রয়াসী হতে হবে। আপনারা যদি এতে ব্যর্থ হন, তার পরেও আমরা আপনাদেরকে সম্মান দেব। কিন্তু কেউ যদি ছয়-দফা ও এগারাে-দফা প্রশ্নে রফা করে মন্ত্রিত্ব কিংবা পারমিট বাগাতে
১৯৮
বাংলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন এবং কোনাে অগণতান্ত্রিক পকেট শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সাহায্য করেন, তাকে ক্ষমা করা হবে না।৩৬
এই বার্তা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে ও এক আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নিতে ছাত্রলীগ কর্মীদের বলা হয়। ১৯৭০ সালের ৭ এপ্রিল ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের মিছিলে এক নতুন শ্লোগান: “জাগাে, জাগাে, বাঙালি জাগাে” ধ্বনিত হতে শােনা যায়। এ সময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ছিল প্রদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন, তখন ১২৪টি কলেজ ইউনিয়নের মধ্যে ১১৪টি ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রণ করতাে ছাত্রলীগ। পরে বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও আবাসিক হলে ১৪২টি নির্বাচনের মধ্যে ১৩২টি নির্বাচনে ছাত্রলীগ জয়ী হয়ে ছাত্র সংগঠনসমূহের নির্বাচনে এক রেকর্ড সৃষ্টি করে।৩৭
১৯৭০ সালের জুনে আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সভা দলীয় ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করে বলে যে, আওয়ামী লীগ এলএফও’র ২৫ ও ২৭নং দফা বাতিল দেখতে চায়। তবে প্রেসিডেন্ট দফাগুলি যদি বাতিল করতে রাজি নাও হন তবু আওয়ামী লীগ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। আওয়ামী লীগ মনে করে, জনগণই কর্তৃত্বাধিকারের একমাত্র উৎস, আর এ-ও বিশ্বাস করে, জনপ্রতিনিধিদের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করার মতাে কোনাে উচ্চতর কর্তৃপক্ষ দেশে নেই; জনগণ যদি ছয়-দফার প্রতি অনুকূল রায় দেয়, এলএফও’তে যা-ই লেখা থাক আওয়ামী লীগ উক্ত রায় বাস্তবায়িত করবে।৩৮ এর আগে শেখ মুজিব বলেন, (নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্টকে স্বায়ত্তশাসনের ইস্যুটির নিষ্পত্তি করতে হবে—এই মর্মে মওলানা ভাসানীর নাছােড়বান্দা দাবির উল্লেখ প্রসঙ্গে): “আমরা ভিখারি নই, আমরা জানি অধিকার কী করে প্রতিষ্ঠা করতে হয়।”৩৯ এমনি করে বলা চলে, কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের প্রতি আওয়ামী লীগের মনােভাব ছিল প্রায় অবজ্ঞার। তবু এর বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
আওয়ামী লীগের জোট না বাঁধার নীতি এবং এলএফও’র তাৎপর্য সম্পর্কে তার নির্বিকার মনােভাব অনেকের কাছেই হেঁয়ালিময় মনে হয়। মুসলিম লীগের কোনাে উপদলের সঙ্গে কোনাে গােপন সমঝােতা বা পিপিপির সঙ্গে প্রায় সমঝােতা হয়েছে কিনা এ রকম নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে যায়। শেখ মুজিবের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ ব্যক্ত করা হয়। পরে এলএফও সংশােধিত না হওয়া, চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দাবি গৃহীত না হওয়া এবং নির্বাচন ডিসেম্বর অবধি স্থগিত রাখার দাবি গৃহীত না হওয়াকে শেখ মুজিবের পরাজয় বলে বর্ণনা করা হয়।৪০ কোনাে কোনাে সমালােচকের ধারণা, আওয়ামী লীগ যুক্তিবর্জিতভাবে অতি আত্মবিশ্বাসী। যুক্তি দেখিয়ে বলা হয় যে, শাসনতন্ত্রে ছয়-দফা কর্মসূচি সন্নিবেশিত করার জন্য আওয়ামী লীগের দরকার হবে পরিষদে অন্যান্য স্বায়ত্তশাসনপন্থী শক্তিগুলির মৈত্রীর। আর যদি বিষয়টির ফয়সলা পরিষদের বাইরে গণআন্দোলনের মধ্য দিয়েও করতে হয় তাহলেও অন্য সব স্বায়ত্তশাসনপন্থী শক্তির সহযােগিতা প্রয়ােজন হবে আওয়ামী লীগের। আর সে জন্যই আওয়ামী লীগের আঁতাঁতবিরােধী মনােভাব যুক্তিযুক্ত নয়।৪১ অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, মুজিব
১৯৯
তাঁর “আগ্রহাতিশয্যে” হয়তােবা তাঁর দাবির বিষয়বস্তুগুলির প্রশ্নে কোনাে রকম রফা। না করেই তার যৌক্তিক উপসংহারে নিয়ে যাওয়ার এক বিশাল দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নিলেন,” কেননা তাদের প্রায় সুনিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে, “মাত্র একটি প্রদেশে তাঁর নিজ শক্তিকে ভর করে আর যা-ই হােক তিনি নিজ পছন্দমাফিক শাসনতন্ত্র পেতে পারেন না” কারণ, “গােলটেবিল সম্মেলনের অভিজ্ঞতায় অত্যন্ত পরিষ্কার যে, ছয়-দফার অত্যন্ত প্রবল বিরােধিতা কেবল প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলির মধ্যে নয় বরং তার অস্তিত্ব রয়েছে ক্ষমতাসীন প্রতিযােগী স্তরগুলির মধ্যেও।” তাঁদের আশঙ্কা ছিল: প্রেসিডেন্ট শাসনতন্ত্র অনুমােদনের আগেই এ ধরনের বৈরিতা প্রকাশ্যে এসে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে কেননা, প্রেসিডেন্ট তার নানা বিকল্প খােলা রেখেছেন এ ঘােষণা দিয়ে যে, তিনি সই করার যন্ত্র হবেন না।৪২
এলএফও ঘােষিত হওয়ার আগেই যদি এত গভীর আশঙ্কা অনুভব করা ও তা এত স্পষ্ট প্রকাশ করা হয়ে থাকে তাহলে এটি ধরে নেওয়া ভুল হবে (যেমন করেছেন কোনাে কোনাে সমালােচক) যে, শেখ মুজিব বা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এলএফও ঘােষিত হলে তাতে কী বিপদ নিহিত থাকতে পারে তা জানতেন না।
ক্ষমতাসীন শাসকচক্রের মনােভাবটির এক সংক্ষিপ্ত ধারণা পাওয়া যায় ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে লন্ডনে পাকিস্তান সােসাইটিতে প্রদত্ত পাকিস্তানের তৎকালীন যােগাযােগমন্ত্রী প্রফেসর জিডব্লিউ চৌধুরীর (যিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের শাসনতন্ত্র সম্পর্কিত বেসরকারি উপদেষ্টা) বক্তব্যে। পশ্চিম পাকিস্তানীরা কোনাে অবস্থায় জনসংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের অনিবার্য ফল মেনে নেবে না ও শাসক জান্তা এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিল যে পূর্ব পাকিস্তানে কোনাে রাজনৈতিক দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না… এ সব মেনে নেওয়ারই শামিল ছিল এ বক্তব্যটি।৪৩ এমনিভাবে দেখা যায়, ‘৫০-এর দশকে যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বানচাল করা হয় পাকিস্তান ঠিক তখনকার মতাে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতার রজ্জ্ব যাদের হাতে তাদের পক্ষ থেকে ঘটনা পুনরাবৃত্তির বিপদ অগ্রাহ্য করার চিহ্নাভাস অত্যন্ত উজ্জ্বল, তীক্ষ হয়ে দেখা দেয়। তবে এমন চিহ্নও সুস্পষ্ট ছিল যে, এ ধরনের কোনাে তৎপরতা বিনা চ্যালেঞ্জে যাবে না। পূর্ব পাকিস্তান আপােস-নিষ্পত্তির নীতির পথ ছেড়ে দিয়েছিল। সুনিশ্চিতভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির এই বিরাট, বিশাল পরিবর্তন সাধনের স্থপতি ছিল আওয়ামী লীগ।
এলএফও ঘােষণার আগেও শেখ মুজিব ছয় হাজার ছাত্রলীগ কর্মীর এক বিরাট সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার সময়, আর শহীদ নয়, গাজী হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলেন, যার এ পরিবেশে একমাত্র অর্থ ও তাৎপর্য এই হতে পারে যে, বিজয় দ্বারে সমাগত। আর তাই তাদের উচিত হবে শহীদ নয়, গাজীর ভূমিকা পালনের জন্য তৈরি হওয়া। এলএফও জারির পর সাবলীল স্বচ্ছন্দে শাসনতন্ত্র পাস হওয়ার আশা ছিল একান্তই ক্ষীণ। তাজউদ্দিন আহমদের রিপাের্ট ও শেখ মুজিবের বিভিন্ন বিবৃতির যে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলি আওয়ামী লীগের চিন্তাধারারই পরিচায়ক। বাস্তবিকপক্ষেও, শেখ মুজিব ১৯৬৯ সাল থেকে যা বলে আসছিলেন তা এ কথা ঘােষণার সমান যে, যেভাবেই, যে পন্থায়ই হােক,