This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
অভ্যত্থানের উনসত্তর
মাহফুজ উল্লাহ
শেষের পালা শুরু, অক্টোবর-নভেম্বর ১৯৬৮
আমাকে এক প্রজন্মের তারুণ্য দাও, আমি গােটা পৃথিবীটাকে বদলে দেব।
ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন (১৮৭০-১৯২৪)
সামরিক – আমলাতান্ত্রিক একনায়কত্বের বিরুদ্ধে ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে সমগ্র পাকিস্তানে যে গণ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে তার কারণগুলাে আকস্মিক নয়। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর আকস্মিকতা কাটিয়ে ওঠার কিছুদিনের মধ্যে জনমনে সামরিক শাসন বিরােধী অবস্থান বিকশিত হতে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে ১৯৫৯ সালের সাধারণ নির্বাচনকে ঠেকানাের জন্য সামরিক শাসন জারি করা হলেও এ হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল জনগণের আন্দোলনকে স্তব্ধ করা।১
আইয়ুবী শাসনের এক দশকে উন্নয়ন, প্রগতি এবং স্থিতিশীলতার নামে যে শাসন চালানাে হয়েছিল তা কখনােই জনগণের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটাতে পারে নি। সে সময়ে পাকিস্তানের উভয় অংশে একটি বিশেষ সুবিধাভােগী শ্রেণি ছাড়া আর সবাই সমানভাবে নির্যাতিত হয়েছেন এবং মুক্তির প্রহর গুণছিলেন। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে গণআন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করলেও ১৯৬৮ সালের অক্টোবর থেকেই রাজনৈতিক ঝড়ের পূর্বাভাস ছিল লক্ষ্যণীয়। ১৯৬৮ সালের নভেম্বর মাসে রাওয়ালপিন্ডির ৭০ জন ছাত্র চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত লাভিকোটাল থেকে কয়েক হাজার টাকার সামগ্রী কিনে ফেরার সময় পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে এবং পণ্যগুলাে বাজেয়াফত করে।২ ৬ নভেম্বর, বুধবার রাতে একদল ছাত্র একটি কলেজের ছাত্রাবাসে মিলিত হয়ে লাভিকোটাল ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছাত্রদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ও আইয়ুব বিরােধী বিক্ষোভের উদ্দেশ্যে
=================================================================
১ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দর মীর্জা তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খানের প্রত্যক্ষ মদদে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর, মঙ্গলবার সামরিক আইন জারি করেন। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন আইয়ুব খান। ১৯৫৮ সালের কয়েক বছর আগে থেকেই ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা প্রণয়নে তিনি প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মীর্জার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৫৭ সলে সেনা প্রধান হিসেবে আইয়ুব খানের অবসর গ্রহণের কথা থাকলেও প্রেসিডেন্ট মীর্জা আইয়ুব খানের চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে দেন। সামরিক শাসন জারির ২০ দিন পর ২৭ অক্টোবর, রবিবার, আইয়ুব নিজে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা দখল করে ইস্কান্দর মীর্জাকে লন্ডনে নির্বাসিত জীবন যাপনে বাধ্য করেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর আইয়ুব খান মন্তব্য করেছিলেন, “আমাদের বুঝতে হবে যে উষ্ণ আবহাওয়ায় গণতন্ত্র কার্যকর নয়। গণতন্ত্রের জন্য অবশ্যই প্রয়ােজন বৃটেনের মতাে ঠান্ডা আবহাওয়া।” প্রেসিডেন্ট মীর্জা ছিলেন ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম কিংস কমিশন পাওয়া অফিসার, যিনি স্যান্ডহার্স্টে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযােগ পেয়েছিলেন। তিনি জেনারেল পদেও উন্নীত হয়েছিলেন।
২ ডন, ৮ নভেম্বর, শুক্রবার, ১৯৬৮।
পেজ-২
জমায়েতের কর্মসূচি গ্রহণ করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় জুলফিকার আলী ভুট্টোর আইয়ুব বিরােধী রাজনীতি এবং রাওয়ালপিন্ডি পলিটেকনিকে বিরাজমান ছাত্র অসন্তোষ।৩ পলিটেকনিকের ছাত্ররা ৭ নভেম্বর ভূট্টোকে তাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ জানায়। ছাত্ররা ভেবেছিল ভূট্টো তাদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দানে সক্ষম এবং বাস্তবে তাই ঘটেছিল।৪
ভূট্টোকে পলিটেকনিকের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় নি। এ অবস্থায় ভূট্টো যখন তৎকালীন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলে ফিরে যাচ্ছিলেন তখনই পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ বাঁধে। ঘটনা আয়ত্তে আনার জন্য পুলিশ গুলি ছুড়লে ঘটনাস্থলেই পলিটেকনিকের সতের বছর বয়সের ছাত্র আবদুল হামিদ নিহত হয়। গুলির সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এক অবশ্যম্ভাবী শিহরণ রাওয়ালপিন্ডির মতাে কোলাহল মুখর শহরকে স্তব্ধ করে দেয়।৫ শহরের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুরু হয় ব্যাপক বিক্ষোভের প্রস্তুতি। বিক্ষোভের আশঙ্কায় সরকার প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। কিন্তু পরদিন রাওয়ালপিন্ডির গভর্ণমেন্ট কলেজ থেকেই শুরু হয় হাজার হাজার ছাত্রের মিছিল। ছাত্ররা পথের সর্বত্র এবং দোকানপাটে ঝােলানাে আইয়ুবের ছবি পুড়িয়ে দেয়। ৮ নভেম্বর, শুক্রবার সন্ধ্যার মধ্যে সর্বশ্রেণির জনগণ এসে যােগ দেন আইয়ুব বিরােধী মিছিলে। পরিস্থিতি মােকাবেলায় সরকার সেনাবাহিনী তলব এবং সান্ধ্য আইন জারি করে। আরও দুটি মৃত্যুর সংবাদ ৯ নভেম্বর, শনিবার ছাত্রদের উত্তেজিত করে তােলে। এ তারিখে বিনা কারণে পুলিশের গুলিতে দু’জন পথচারী মারা যান। ছাত্রদের পক্ষ থেকে অভিযােগ করা হয়, ৮ নভেম্বর বিক্ষোভ প্রদর্শনের কারণেই এদের গুলি করে মারা হয়েছে। সেদিন এক সভায় কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন বলেন, “পৃথিবীর যে কোনাে গণতান্ত্রিক দেশের মতাে পাকিস্তানের জনগণ পূর্ণ গণতন্ত্র ভােগ করছেন।“৬ এ পরিস্থিতিতে পশ্চিম
======================================================
৩ দৈনিক পাকিস্তান, ৮ নভেম্বর, শুক্রবার, ১৯৬৮।
৪ আইয়ুব খানের নির্দেশে স্বাস্থ্যগত কারণে ১৯৬৬ সালের ১৮ জুন, শনিবার, জুলফিকার আলী ভুট্টো
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এর আগে তাকে পাকিস্তান কনভেনশন মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ হতে অপসারণ করা হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত হওয়ার পর ১৯৬৭ সালে ভূট্টো পাকিস্তান পিপলস পার্টি নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৬৫ সালের পাক – ভারত যুদ্ধ শেষে তাসখন্দ চুক্তির সূত্র ধরে পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুব বিরােধী বিক্ষোভ শুরু হয় এবং এটাকেই ভূট্টো রাজনৈতিক মূলধন হিসেবে ব্যবহার করেন। পূর্ব পাকিস্তানে দলের শাখা গঠনের জন্য তিনি ঢাকা সফর করেন এবং ইঞ্জিনিয়ার্স ইনসটিটিউশন মিলনায়তনে এক সুধী সমাবেশে বক্তৃতা করেন। সে সভায় শেখ মুজিবের সঙ্গে ছয়দফা নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া প্রসংঙ্গে তিনি বলেন, “ that was not possible, because he was put behind the bar and I was kicked out of the Cabinet.” পূর্ব পাকিস্তানে নূরুজ্জামানের নেতৃত্বে ভূট্টোর দলের শাখা গঠিত হলেও তা বেশিদূর এগােয় নি। সামরিক শাসন জারির পর আইয়ুব খান যে মন্ত্রীসভা গঠন করেন তাতে ভূট্টো ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী। বলা হয়, তার ইরানী স্ত্রী নুসরাত ভূট্টোর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট মীর্জার ইরানী স্ত্রীর সখ্যতার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছিল। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভূট্টো আন্তর্জাতিক অঙ্গণে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।
৫ দৈনিক পাকিস্তান, ৮ নভেম্বর, শুক্রবার, ১৯৬৮।
৬ দৈনিক পাকিস্তান, ৯ নভেম্বর, শনিবার, ১৯৬৮।
পেজ-৩
পাকিস্তানের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে বিক্ষোভ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬০ সালে প্রণীত পশ্চিম পাকিস্তান পাবলিক অর্ডার অডিন্যান্স অনুযায়ী অসংখ্য ছাত্রকে গ্রেফতার করা হলেও, মুলতান, লাহাের, করাচী, হায়দ্রাবাদ, পেশােয়ার সর্বত্র শুরু হয় আন্দোলন। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সরকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয় ।
এ সময় এক সংক্ষিপ্ত সফরে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১০ নভেম্বর, রবিবার পেশােয়ার পৌছুলে ছাত্র বিক্ষোভকারীরা তাকে স্বাগত জানায়। সভাস্থলে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা সত্ত্বেও কিছু সংখ্যক ছাত্র প্যান্ডেলে ঢুকে পড়ে। আইয়ুব বক্তৃতা দিতে উঠলে হাসিম উমর জাই নামে একজন ছাত্র তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছােড়ে। সভা পন্ড হয়ে যায় এবং বক্তৃতা না দিয়েই আইয়ুবকে চলে যেতে হয়। হাসিম পরে তার স্বীকারোক্তিতে বলে, দীর্ঘদিন জনগণকে নির্যাতনকারী অত্যাচারীকে খুন করতে না পেরে সে দুঃখিত।৭
ছাত্রদের আন্দোলনকে দমনের জন্য সরকারি ব্যবস্থা ছিল নির্যাতন। সরকারের ধারণা ছিল, কিছু ‘গােলমাল সৃষ্টিকারীকে’ গ্রেফতার করতে পারলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এ কর্মসূচির অধীনে ১৩ নভেম্বর, বুধবার জুলফিকার আলী ভূট্টো ও ওয়ালী খানসহ তাদের বেশ কিছু সমর্থককে গ্রেফতার করা হয়। সন্ধ্যায় এক বেতার ভাষণে পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মুসা বলেন, “সব কিছুর একটা সীমা আছে। আজ সকালে এই উচ্ছৃঙ্খল আন্দোলনের কয়েকজন রিং লিডারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমি এটা পরিষ্কার করে দিতে চাই, এসব ব্যক্তির সমর্থক ও সাথীরা যদি আইন ভঙ্গের চেষ্টা করে তাহলে মারাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সরকার কোনাে বিশৃংখলা সহ্য করবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত একজন সাধারণ নাগরিক জড়িত, তার নিশ্চিত থাকা উচিৎ এ সব কিছু সরকার করছে তারই খাতিরে।”৮ পরবর্তীকালে পশ্চিম পাকিস্তানে এই গ্রেফতারের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল মারাত্মক। ‘জনগণকে বিশেষ করে ছাত্রদের, উত্তেজিত করা, আইন ভঙ্গ করা এবং হিংসাত্মক পথ গ্রহণ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যা নিরাপত্তা এবং পাকিস্তানের স্বার্থের পরিপন্থী’ প্রভৃতি অভিযােগে ভূট্টোকে দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পরপরই পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্টে দায়েরকৃত রীট আবেদনে ভূট্টো তাঁকে দমন করার জন্য ব্যবহৃত কৌশল সম্পর্কে কোর্টে যে সব বিষয় উত্থাপন করেন তার মধ্যে রয়েছেঃ
(ক) আমার শরীরে সশস্ত্র দৈহিক আক্রমণ
(খ) আমাকে এবং আমার পরিবারকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা
(গ) মিথ্যা মামলায় জড়ানাে এবং প্রশাসনের সহায়তায় ন্যায় বিচারে হস্তক্ষেপ করা
==================================================================
ঢাকার নবাব পরিবারের সন্তান, রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিবিদ খাজা শাহাবুদ্দীন ১৮৯৮ সালের ৩১ মে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি খাজা নাজিমুদ্দীনের মন্ত্রীসভায় বানিজ্য, শ্রম ও শিল্পমন্ত্রী ছিলেন (১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫)। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি বিভিন্ন দেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি আইয়ুব খান এর অধীনে তথ্য ও বেতার মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ৭৯ বছর বয়সে তিনি করাচিতে ইন্তেকাল করেন এবং এক সাধারণ কবরস্থানে সমাহিত হন।
৭ পাকিস্তান অবজারভার, ১১ নভেম্বর, সােমবার, ১৯৬৮।
৮ পাকিস্তান অবজারভার, ১৪ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার, ১৯৬৮।
পেজ-৪
(ঘ) অন্যান্য কৌশলে ব্যক্তিগতভাবে অপদস্থ করা
(ঙ) আমার রাজনৈতিক কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ এবং আমার রাজনৈতিক সমর্থকদের
দমন করা
(চ) আমার বন্ধুদের, পরিবারের সদস্যদের এবং কর্মচারীদের অপদস্থ করা
(ছ) জেলে এমন কি কোর্টের নিরাপত্তায় থাকাকালীন অবস্থায় দুর্ব্যবহার করা ৯
ভূট্টো এসব অভিযােগ বিস্তৃতভাবে উত্থাপন করেন এবং সেদিন জনমনে এ নিয়ে কোনাে সন্দেহ দেখা দেয় নি। ভূট্টোর গ্রেফতারের পর পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রাক্তন কমান্ডার ইন চীফ আসগর খান বিরােধী দলে যােগ দেন। আইয়ুব খানের সমর্থকরা দাবি করেন, ১৯৬৫ সালে অবসর গ্রহণের পর তাঁকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগ করা হয় নি বলে তিনি আইয়ুবের উপর অভিমান করেছেন। ১০
ভূট্টোর রীট আবেদনটি শুনানির জন্য ১৫ নভেম্বর, শুক্রবার, ১৯৬৮ পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্টের এক বিশেষ বেঞ্চে গৃহীত হয়। এই বিশেষ বেঞ্চের সদস্য ছিলেন বিচারপতি মুশতাক হােসেন ও বিচারপতি মােহাম্মদ গুল।১১ অন্যান্যদের রীট আবেদনটি গৃহীত হয় বিচারপতি ওয়াহিদউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চে। এ্যাডভােকেট জেনারেল ও আবেদনকারীর কৌশুলীদের বক্তব্য শােনার পর কোর্ট নির্দেশে বলা হয় ‘জনাব মাহমুদ আলী কাসুরী এবং মাননীয় এ্যাডভােকেট জেনারেল শুনানীর তারিখ এক পক্ষকাল পরে ধার্য করার আবেদন জানিয়েছেন। তাই শুনানির জন্য এই মামলা আগামী ২ ডিসেম্বর, সােমবার উত্থাপিত হবে।’ কোর্ট যখন এই রায় দিচ্ছে তখন শত শত আইনজীবী দলে দলে বিভক্ত হয়ে নীরব প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্ট থেকে আল্লামা ইকবালের মাজার পর্যন্ত যান। এই প্রতিবাদ মিছিলের নেতৃত্ব দেন পশ্চিম পাকিস্তান
=========================================================
৯ পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্টে (লাহাের) ভূট্টোর রীট পিটিশন থেকে (১৯৬৮ সালের ১৭৯৪ নম্বর
মামলা) উদ্ধৃত। পরবর্তীতে এ তথ্য পিপলস পার্টির পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
১০ এয়ার মার্শাল আসগর খান ১৯৫৭-৬৫ পর্যন্ত পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রথম পাকিস্তানী কমান্ডার ইন চীফ। ১৯৬৫-৬৮ সময়ে তিনি পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইনস (পিআইএ) এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এই দায়িত্ব শেষে ১৯৬৮ সালে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন এবং ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে সরকার প্রদত্ত হিলাল-ই-পাকিস্তান ও হিলাল-ই-কায়েদে আযম খেতাব প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭২ সালে তাঁর নিজ দল তেহরিক-ই-ইশতিকলাল গঠন করেন, ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৯৫ সালে দলীয় প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ান। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক সময় তাঁকে বিবেকের বন্দি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে।।
১১ পাকিস্তান অবজারভার, ১৬ নভেম্বর, শনিবার, ১৯৬৮। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে বিচারপতির সহায়তায়
জেনারেল জিয়াউল হক ভূট্টোকে ‘সাজানাে বিচারে’ ফাঁসিতে ঝােলাতে পেরেছিলেন তিনি হচ্ছেন বিচারপতি মুশতাক হােসেন।
পেজ-৫
হাইকোর্ট বার সমিতির প্রেসিডেন্ট ড. জাবেদ ইকবাল।১২ একই তারিখে সরকার ঘােষণা করে, পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউটের কাছে ৭ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার পুলিশের গুলিবর্ষণ সম্পর্কে ২২ নভেম্বর, শুক্রবার তদন্ত শুরু হবে।
আসগর খানের রাজনীতিতে যােগদানকে অনেকেই ভাল চোখে দেখেন নি। তাকে মনে করা হত মার্কিনপন্থী। কয়েকটি সরকারপন্থী সংবাদপত্রে সরকারের সমালােচনামূলক প্রবন্ধ প্রকাশের অনুমতি পেয়েছিলেন বলে মনে করা হয়েছিল ভূট্টোকে মােকাবেলা করার জন্যে তাকে রাজনীতিতে নামানাে হয়েছে। সক্রিয়ভাবে আইয়ুব সরকারের বিরােধিতা করার কথা ঘােষণা করে আসগর খান বলেন, “আজ পরিস্থিতি এত খারাপ যে, কোনাে আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি চুপ করে বসে থাকতে পারে না। দেশে আজ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি বিরাজমান- টেলিফোনে আড়িপাতা হয়, মতামতকে করা হয় শৃংখলিত।”১৩
ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বত্র বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সরকারিভাবে সর্বাত্মক চেষ্টা চলে রাওয়ালপিন্ডির বিক্ষোভ দমনের জন্য। কেননা, এখানে বিদেশী কূটনীতিবিদরা থাকেন। রাওয়ালপিন্ডিতে আন্দোলন দমনের কাজ দু’ভাবে চলে। প্রথমত, গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের পেশােয়ার ঘটনার সঙ্গে জড়ানাের চেষ্টা চলে। এতে ব্যর্থ হলে ছাত্রদের ছেড়ে দিয়ে আপােষ আলােচনা শুরু করা হয়। ছাত্ররা শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু দাবি পেশ করে এবং দাবি দাওয়া বিবেচনার জন্য কর্তৃপক্ষ সময় দাবি করে। শর্ত সাপেক্ষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খােলার ব্যাপারে ছাত্ররা রাজি হয়। ছাত্রদের ভয় ছিল দীর্ঘ দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে তারা ব্যাপক ছাত্র সমাজের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। সরকারের কাছে ছাত্রদের অঙ্গীকার ছিল আপােষ আলােচনা অব্যাহত থাকার সময়ে ছাত্ররা নতুন কোনাে আন্দোলনের ডাক দেবে না।
পশ্চিম পাকিস্তানে যখন এ অবস্থা বিরাজমান তখন ‘পশ্চিম পাকিস্তানে গণহত্যা, গ্রেফতার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্র জনতার দাবির সমর্থনে এবং ছাত্রসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে’ পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামী ছাত্র সমাজের উদযােগে ১৯ নভেম্বর, মঙ্গলবার, ১৯৬৮ বিকেলে বায়তুল মােকাররম প্রাঙ্গণে এক ছাত্র গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। এ জমায়েত সম্পর্কে দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত রিপাের্টে বলা হয়, তিনটি ছাত্র প্রতিষ্ঠানের আহবানে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে বায়তুল মােকাররম প্রাঙ্গণে একটি ক্ষুদ্র ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয় ও পরে এক শােভাযাত্রা বের করা হলে মিছিলে বেশ কিছু সংখ্যক লােক যােগ দেয়। পশ্চিম পাকিস্তানে গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তির দাবিতে এই সভা ও মিছিলের আয়ােজন করা হয়। মিছিলটি বায়তুল মােকাররম হতে বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত গিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ডাকসু সদস্য জনাব মফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত ছাত্রসভায় জগন্নাথ কলেজের নাজিমুল আলম (লাল), ডাকসু’র
=========================================================
১২ পাকিস্তান অবজারভার, ১৬ নভেম্বর, শনিবার, ১৯৬৮। ডঃ জাবেদ ইকবাল (১৯২৪) পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা কবি হিসেবে পরিচিত আল্লামা ইকবাল এর পুত্র। তিনি লাহাের হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এবং পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের অবসর প্রাপ্ত বিচারক।
১৩ দ্য টাইমস (লন্ডন), ২০ নভেম্বর, বুধবার, ১৯৬৮
পেজ-৬
প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক মােরশেদ আলী এবং ছাত্রলীগের আবদুর রব বক্তৃতা করেন।১৪ তারা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের প্রতিবাদ করেন। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে পশ্চিম পাকিস্তানে সাম্প্রতিক ছাত্র হত্যার প্রতিবাদ, গ্রেফতারকৃত সকল ছাত্র ও রাজবন্দির মুক্তির দাবি ও তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার, প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, প্রত্যক্ষ নির্বাচন এবং ভােটাধিকারের দাবি জানানাে হয়। এছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাস্তবপন্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েও সভায় প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ১৯ নভেম্বর, মঙ্গলবার বিকেলে আবদুল মালেকের সভাপতিত্বে ইসলামী ছাত্র সংঘ কার্যালয়েও এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পশ্চিম পাকিস্তানে ছাত্র অসন্তোষের কারণ দূর না করে সরকারি নির্যাতনের সমালােচনা করা হয়।১৫
প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভাইস এডমিরাল এ আর খান ১৯ নভেম্বর, মঙ্গলবার, ১৯৬৮ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি তাদের নিজেদের জন্য রাজনৈতিক মঞ্চ স্থাপনের চেষ্টা করছেন। রাজনীতিকদের নিজেদের সংগঠন ও কর্মসূচি থাকা খুবই ন্যায়সঙ্গত এবং স্বাভাবিক। কিন্তু যা দুঃখজনক তা হচ্ছে, তাদের কেউ কেউ প্রতিক্রিয়ার শক্তির পক্ষে কাজ করার চেষ্টা করছেন। আঞ্চলিকতা ও সকল রকম স্থানীয় দাবি দাওয়ার ব্যাপারে ভাবাবেগের সুযােগ নিয়ে তারা আসরে নেমেছেন। আমাদের মনে রাখা উচিত, পাকিস্তান একটি উন্নয়নশীল দেশ। পাকিস্তানী জনসাধারণ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। এজন্য তাদের দুস্তর বৈষম্য ও শােষণের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে যেতে হবে। আমাদের যা প্রয়ােজন তা হচ্ছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সকল জাতীয় প্রচেষ্টাকে সন্নিবেশিত করা। আঞ্চলিকতা ও
=======================================================
১৪ ২০ নভেম্বর, বুধবার, ১৯৬৮ দৈনিক পাকিস্তান। এই ছাত্র নেতাদের মধ্যে নাজিমুল আলম (লাল) এক সময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রজীবন শেষে তিনি আইন পেশা ও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ছাত্রজীবন শেষে মােরশেদ আলী কমিউনিস্ট পার্টিতে যােগ দেন। আবদুর রব ১৯৬৯-৭০ সময়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দয়িত্ব পালন করেন। তিনি আ স ম আবদুর রব হিসেবে অধিক পরিচিত এবং ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ, বুধবার, ডাকসুর ভিপি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা প্রথম উত্তোলন করেন। স্বাধীনতার পর তিনি অন্যান্যদের নিয়ে মুজিব সরকারের বিরােধিতা করার জন্য জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করেন। এরশাদ সরকারের শাসনামলে তিনি জাতীয় সংসদে বিরােধী দলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে মন্ত্রীসভার সদস্য নিযুক্ত হন।
১৫ ১৯৬৯ সালে নূর খানের শিক্ষানীতির প্রতিবাদ করার জন্য ১২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে আয়ােজিত ছাত্র সভায় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে সরকারের পক্ষ নিয়ে এই আবদুল মালেক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে আহত হন। পরবর্তী পর্যায়ে তার মৃত্যু ঘটে – তাঁর চিকিৎসার জন্য পাকিস্তান সরকার করাচী থেকে এক নেতৃস্থানীয় নিউরাে সার্জনকে ঢাকা এনেছিলেন। আবদুল মালেকের মৃত্যুর পর যাদের বিরুদ্ধে সামরিক আইনে মামলা হয় তাদের মধ্যে ছিলেন বর্তমানে ডেইলী স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, এ বইয়ের লেখক মাহফুজ উল্লাহ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সে সময়ে ছাত্রলীগ নেতা আফম মাহবুবুল হক ও বদিউল আলম (বর্তমানে সাংবাদিক), তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ প্রমুখ।
পেজ-৭
উশৃংখলাকে হাতিয়ার হিসেবে নির্বাচনে ব্যবহার করার প্রবণতা পরিত্যাগ করতে হবে।’১৬ এ. আর খান যখন সাক্ষাৎকারে এ কথা বলছিলেন, তখন জেল কর্তৃপক্ষের নিপীড়নের বিরুদ্ধে পেশােয়ার জেলে আটক পাঁচজন রাজনৈতিক বন্দি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। সরকারিভাবে বলা হয় রাজবন্দিরা অনশন করেন নি।
লাহােরে মুসলিম লীগ কর্মীদের উদ্দেশে ২০ নভেম্বর, বুধবার, ১৯৬৮ সন্ধ্যায় সৈয়দ আহমদ কিরমানী বলেন, বিরােধী দলগুলাের উস্কানিতে সমগ্র দেশব্যাপী যে গােলযােগের সৃষ্টি হয়েছে তা বুদবুদের ন্যায় শীঘ্রই উবে যাবে। বিরােধী দলীয় বিদ্বেষমূলক মনােভাব সম্পর্কে সতর্ক থাকার এবং সকল বিবাদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে বিরােধী দলীয় প্রচারণা মােকাবেলার জন্য তিনি মুসলিম লীগ কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।
পূর্ব পাকিস্তানের ১২ জন কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বিশিষ্ট নাগরিক ২২ নভেম্বর, শুক্রবার এক যুক্ত বিবৃতিতে পশ্চিম পাকিস্তানে ছাত্র জনতার উপর সাম্প্রতিক নির্যাতনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বিবৃতিতে তারা বলেন, সমাজের সচেতন নাগরিক হিসেবে তারা একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে জনসভা, বিক্ষোভ এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে মতামত ব্যক্ত করার অধিকার প্রত্যেকটি নাগরিকের অলংঘনীয় অধিকার। বিবৃতিতে সই করেন কবি জসীম উদ্দিন, কবি সুফিয়া কামাল, তােফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া), মালিক আবদুল বারী, কাজী মােহাম্মদ ইদ্রিস, শহীদুল্লাহ কায়সার, খন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস, সিরাজুদ্দীন হােসেন, আবদুল গাফফার চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান ও ফজল শাহাবুদ্দীন।১৭ একই তারিখে রাওয়ালপিন্ডি বার সমিতির সদস্যদের উদ্দেশ্যে এয়ার মার্শাল আসগর খান বলেন, রাজনীতিতে যােগ দিয়ে কোনাে ব্যক্তিগত আকাঙ্খ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্য তার নেই। সময়ে এ কথার যথার্থ প্রমাণ পাওয়া যাবে। তিনি অভিযােগ করেন, জনসাধারণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরানাের উদ্দেশ্যে সরকার আঞ্চলিক সমস্যাগুলাে উসকে দিচ্ছে।
১৬ ডন, ২০ নভেম্বর, বুধবার, ১৯৬৮।
১৭ দৈনিক পাকিস্তান, ২৩ নভেম্বর, শনিবার ১৯৬৮। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে কবি জসীম উদ্দিন, কবি
সুফিয়া কামাল ও মালিক আবদুল বারী ব্যতীত অন্যদের প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষভাবে সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এদের মধ্যে শহীদুল্লাহ কায়সার (১৯২৭-১৯৭১) ও সিরাজুদ্দীন। হােসেন (১৯২৯-১৯৭১) অন্যান্য বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে ১৪ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার, ১৯৭১ সালে নিহত হন। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী। স্বাধীনতার পর তিনি দৈনিক জনপদ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং স্ত্রীর চিকিৎসার প্রয়ােজনে সরকারি আনুকূল্যে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে লন্ডন চলে যান। হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-৮৩) শামসুর রাহমান (১৯২৯ – ২০০৬)ও ফজল শাহাবুদ্দীন কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত। স্বাধীনতার পর হাসান হাফিজুর রহমান দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদক হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বিরাগভাজন হওয়ার কারণে এ পদ থেকে অপসারিত হন। পরবর্তীতে তাকে মস্কোস্থ বাংলাদেশ মিশনে প্রেস মিনিস্টার নিযুক্ত করা হয়। কবি শামসুর রাহমান ১৯৭৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জিয়াউর রহমান সরকারের সময় দৈনিক বাংলা, বিচিত্রা ও কিশাের বাংলার সম্পাদক নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে এরশাদ সরকারের সময় তিনি দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
পেজ-৮
দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে ১৯৬৮ সালের ২৬ নভেম্বর, মঙ্গলবার আগমন ঘটে পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মােরশেদ এর। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, যারা জীবনের মৌলিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে তিনি তাদের সহায়তা করবেন। তিনি বলেন, এই সন্ধিক্ষণে কোনাে রাজনৈতিক দলে যােগদানের ইচ্ছে তার। নেই, এবং নিজে কোনাে দল গঠন করতে যাচ্ছেন না। তিনি বলেন, ‘কাল প্রবাহেই আমার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।’১৮
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খান আবদুল কাইয়ুম খান ২৭ নভেম্বর, বুধবার কাউন্সিল মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বলেন, এরপর থেকে তিনি আর কোনাে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন না। একই তারিখে পেশােয়ার বার সমিতির সভায় এয়ার মার্শাল আসগর খান বলেন, বিচারপতি মােরশেদ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবেন। ভাল লােকের রাজনীতিতে এগিয়ে আসায় দেশের অবস্থার উন্নতি হতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন। আসগর খান বলেন, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কার্যক্রমে রাজনীতিকে সব সময়েই তিনি ব্যক্তির উর্ধ্বে রাখবেন।
এ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের বিরােধী দলীয় রাজনীতিতে বন্দিমুক্তির প্রশ্নটি প্রাধান্য লাভ করে। বন্দিদের অনেককে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর পর অথবা পরবর্তী পর্যায়ে আইয়ুব বিরােধিতার কারণে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। কারারুদ্ধদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রনেতা মােঃ মনিরুজ্জামান (তারা) মছলাই, বদিউজ্জামান বড়লস্কর, মাহমুদ, শেখ কামরুজ্জামান, পীযুষ কান্তি ধর, রেজোয়ান আজিজ, নূরে আলম সিদ্দিকী, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, রাজনৈতিক নেতা লালা শরদিন্দু দে, অজয় ভট্টাচার্য, ননী চৌধুরী, মন্মথ নাথ দে, অমল সেন, আশু ভরদ্বাজ, সন্তোষ ব্যানার্জী, সুধাংশু বিমল দত্ত, মনি সিংহ, শেখ মুজিবুর রহমান, অমূল্য লাহিড়ী, তােফাজ্জল হােসেন, সত্যেন সেন, রণেন মৈত্র, জ্যোতিষ বােস, অজয় রায়, আবদুল হালিম, আবদুল হাই, নগেন সরকার, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, হীরালাল ভট্টাচার্য, শংকর বােস, আসদ্দর আলী, মােদাসসের আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, মােল্লা জালালউদ্দিন আহমদ, রনেশ দাশ গুপ্ত, হানিফ খান, আমজাদ হােসেন, রবি নিয়ােগী, বিষ্ণু চ্যাটার্জী, মনি কৃষ্ণ সেন, সত্যরঞ্জন মৈত্র, ফনীভূষণ চক্রবর্তী, চিত্তরঞ্জন সুতার, নুরুল ইসলাম, মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান আহমেদ, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন,
=========================================================
১৮ দৈনিক পাকিস্তান, ২৭ নভেম্বর, বুধবার, ১৯৬৮।
বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মােরশেদ (১৯১১-১৯৭৯) ১৯১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৯ সালে বিলাত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরে তিনি আইনজীবী হিসেবে কোলকাতা হাইকোর্টে যােগদান করেন। ১৯৫৫ সালে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন। ১৯৬২-৬৩ সময়ে পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন এবং ১৯৬৭ সালের ১৫ নভেম্বর চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন এবং ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বিচারপতি মােরশেদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি সব সময় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের কথা বলতেন এবং বিভিন্ন মামলায় সরকারের অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রায় দেন। ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল তিনি পরলােক গমন করেন।
পেজ-৯
শেখ ফজলুল হক (মনি), ওবায়দুর রহমান, হারুনুর রশিদ, প্রতাপ উদ্দিন, শফিকুর রহমান, রুহুল আমীন প্রমুখ। এ ছাড়া গ্রেফতারি পরওয়ানা ছিল সুখেন্দু দস্তিদার, সুখেন্দু রায়, নলিনী দাস, আব্দুস সাত্তার, চৌধুরী হারুনুর রশীদ, হেমন্ত সরকার, শচীন বােস, অনিল মুখার্জী, জ্ঞান চক্রবর্তী, আব্দুল বাকী প্রমুখের নামে। এদের অধিকাংশই উনসত্তরের অভ্যুত্থানের কারণে মুক্তি লাভ করেন। দু’একজন অবশ্য এর আগে কোর্টের রায়ে অথবা শারীরিক কারণে মুক্তি লাভ করেছিলেন।”১৯
রাওয়ালপিণ্ডির সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১৯৬৮ সালের ২৬ নভেম্বর, মঙ্গলবার খুলে দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্ররা সভা আহ্বান করে পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করে এবং রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। এ সময়ে ছাত্রদের দাবি দাওয়া ছিল শিক্ষা সমস্যা কেন্দ্রিক। দীর্ঘদিনের সরকারি প্রচারণার ফলে ছাত্রদের ধারণা হয়েছিল তাদের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা উচিত নয়। তথাপি ২৬ নভেম্বর, মঙ্গলবারের বিক্ষোভে যােগ দেওয়ার জন্য ছাত্ররা জনগণের প্রতি আহ্বান জানায়। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হলেও এদিন পুলিশের গুলিতে একজন পথচারী নিহত হন। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে ছাত্ররা ১৯ নভেম্বর, মঙ্গলবার রাওয়ালপিণ্ডিতে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে। এই আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিলেন রাজা আনােয়ার ও হাসানুল হক।২০
ধর্মঘটের দিন গােটা পশ্চিম পাকিস্তান জুড়ে চলে ছাত্র – পুলিশ খন্ডযুদ্ধ। ছাত্ররা পেশােয়ারে মার্কিন তথ্য কেন্দ্রের লাইব্রেরী তছনছ করে দেয়। প্রায় একশ মহিলা সারগােদা থেকে একশ’ মাইল পথ হেঁটে সরকারের বিরুদ্ধে আয়ােজিত প্রতিবাদ সভায় যােগদানের জন্য লাহাের আসেন। রাওয়ালপিণ্ডিতে শ্রমিকরা ছাত্রদের ডাকে সাড়া দেয় এবং শহরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতাে হরতাল পালিত হয়। একটানা ছয় ঘন্টা ছাত্র পুলিশ সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে, ছাত্র-শ্রমিকরা দুটি থানায় আগুন ধরিয়ে দেয়। রেলওয়ে স্টেশন ও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অফিস রক্ষার জন্য সেনাবাহিনী তলব করা হয়। ২৯ নভেম্বর, শুক্রবার পশ্চিম পাকিস্তানে ছাত্র ও শ্রমিকদের মিলিত কার্যক্রমের পর মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে প্রত্যক্ষ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে পূর্ব পাকিস্তানে।
==========================================================
১৯ এই ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতির জন্য পরিশিষ্ট – খ দেখুন।
২০ রাওয়ালপিন্ডি জেলার একটি গ্রামের রাজপুত বংশের সন্তান এই ছাত্র নেতা পিপলস পার্টি গঠিত হলে তাতে যােগদান করেন। ১৯৭১-১৯৭৭ সময়ে তিনি ভূট্টো সরকারের ছাত্র ও শ্রমিক বিষয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৭৭ সালে জিয়াউল হক ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি আফগানিস্তানে পালিয়ে যান এবং মুর্তাজা ভূট্টোর সঙ্গে যােগ দিয়ে সশস্ত্র সংগঠন আল জুলফিকার গড়ে তােলেন। আবার মুর্তাজা ভূট্টোর অনুরােধে আফগানিস্তানের সােভিয়েত সমর্থিত সরকার তাকে গ্রেফতার করে এবং ১৯৮৫ সালে মুর্তাজা ভূট্টো সিরিয়া চলে গেলে তিনি মুক্তি লাভ করেন। এরপর পাকিস্তানে ফিরতে না পেরে জার্মানীতে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১৯৮৮ সালে তার লেখা দ্য ট্রাজেডি অব আফগানিস্তান এ বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত গ্রন্থ। রাজা আনােয়ার বর্তমানে পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) এর সঙ্গে জড়িত এবং পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর মৌলিক শিক্ষা বিষয়ক টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান। তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ের ওপর উর্দু ও ইংরেজী ভাষায় ৭টি বই লিখেছেন।
পেজ-১০
আন্দোলনের প্রেক্ষিত
একটি বাঘের চেয়েও একটি অত্যাচারী সরকার ভয়ংকর।
কনফুসিয়াস (৫৫১-৪৭৯ খৃ: পূ:)
যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে তার ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানে আইয়ুবী শাসনের এক দশক পূর্ণ হলে যখন পাকিস্তানে উন্নয়ন ও সংস্কার দশকের উৎসব চলছিল তখন দেশের উভয় অংশে ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা শৃঙ্খলিত। পূর্ব পাকিস্তানে দমননীতি পৌছেছে চুড়ান্ত পর্যায়ে। রাজনৈতিকভাবে এ দমননীতিকে মােকাবেলা করার মতাে কোনাে শক্তিশালী সংগঠনও ছিল না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফলে সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগ ছিল বিপর্যস্ত। ভাসানী ন্যাপের অভ্যন্তরে ছিল মতাদর্শগত সংগ্রাম। মােজাফফর ন্যাপ এককভাবে আন্দোলনের পথে যেতে রাজি নয়। এমতাবস্থায় আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সবাই ভাবছিলেন আন্দোলনের কথা, ১৯৬৪ সালের মতাে বিরােধী দলীয় মাের্চা গঠনের কথা। কিন্তু কে প্রথম এগিয়ে আসবেন সেটাই ছিল বড় প্রশ্ন।২১ অবশেষে মওলানা ভাসানীই আন্দোলনের সূত্রপাত করেন।
===========================================================
২১ আইয়ুব খানের বিরােধিতা করার জন্য ১৯৬৪ সালের শুরু থেকেই বিরােধী দলগুলাে ঐক্যফ্রন্ট
জাতীয় কিছু একটা গঠন করার চেষ্টা করে। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৬৪ সালের অক্টোবর / নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভােটার মৌলিক গণতন্ত্রীদের নির্বাচনের আগেই কাউন্সিল মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং নেজামে ইসলামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে সংযুক্ত বিরােধী দল (কম্বাইন্ড অপােজিশন পার্টিজ – কপ) গঠন করে। জামায়াতে ইসলামী এই মাের্চার অংশীদার হতে পেরেছিল ১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসে তাদের ওপর আরােপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কারণে। এর আগে শিয়া বিরােধী লাহাের দাঙ্গার অভিযােগে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘােষণা এবং এর প্রধান মওলানা মওদুদীকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়। যখন কপ গঠিত হয় তখন বিভিন্ন দলীয় নেতৃবৃন্দ নিজেদের মধ্যেকার মতবিরােধ স্বীকার করার বদলে তা এড়িয়ে যান। উদাহরণ স্বরূপ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ঐক্যের খাতিরে পারিবারিক আইন সংশােধন করে ইসলামের আলােকে তা প্রণয়ন করার জন্য জামায়াতে ইসলামীর দাবির প্রতি সমর্থন জানায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পাকিস্তানে বিবাহ ও বিচ্ছেদ আইন সংশােধন করে নারীদের রক্ষা করার জন্য প্রণীত পারিবারিক আইন ছিল আইয়ুব সরকারে অন্যতম প্রগতিশীল উদ্যোগ। কপের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুবের প্রতিদ্বন্ধী হিসেবে ফাতেমা জিন্নাহকে প্রার্থী হতে রাজি করানাে। পাকিস্তানের জাতির পিতা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র বােন। ফাতেমা জিন্নাহ’র প্রতি জনগণের গভীর শ্রদ্ধা ছিল এবং নির্বাচনী প্রচার চালানাের জন্য তিনি যেখানেই গেছেন সেখানেই অভূতপূর্ব সমর্থন লাভ করেন। তিনি মাদারে মিল্লাত হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। কপ দাবি করে ৮০,০০০ মৌলিক গণতন্ত্রীর মধ্যে ৬৩,০০০ ফাতেমা জিন্নাহ’র পক্ষে ভােট দেবে। কিন্তু আমলাতন্ত্র এবং পুলিশের যৌথ প্রচেষ্টা আইয়ুবকে নির্বাচনে জিতিয়ে দেয়। এত কিছুর পরেও ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি, শনিবার অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৩৬ ভাগ মৌলিক গণতন্ত্রী ফাতেমা জিন্নাহ’কে ভােট দেয়।
পেজ-১১
সামরিক শাসন জারির পর থেকে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের হিংসাত্মক নির্যাতন, সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, মুৎসুদ্দী পুঁজি ও নির্মম জাতীয় নিপীড়নের ফলে জনগণ ও জনগণের শত্রু শিবিরের মধ্যে দ্বন্দ্ব অত্যন্ত প্রকট আকার ধারণ করে। দ্বন্দ্বের এই তীব্রতার সঙ্গে বাস্তব অবস্থার সঠিক সমন্বয় ঘটলে বৈপ্লবিক পন্থায় রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করে জনগণের রাষ্ট্র তথা জনগণের একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হত। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে একটি সাচ্চা বিপ্লবী পার্টি, গণ বাহিনী ও বিপ্লবী মুক্তিফ্রন্টের অনুপস্থিতির ফলে দ্বন্দ্বগুলির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে বিপ্লবী পদ্ধতিতে ক্ষমতা দখল সম্ভব হয় নি। ছাত্রসমাজ জনগণের সামনে ১১ দফা কর্মসূচি হাজির করেছিল, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ তৈরি করেছিল ৮ দফা কর্মসূচি। আওয়ামী লীগ, মস্কোপন্থী ন্যাপ, পিডিএম ও জামায়াতের সমন্বয়ে গঠিত ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি বা ড্যাক এর ৮ দফা কর্মসূচিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি স্থান পায় নি বলে পূর্ব বাংলার জনগণ ৮ দফার পতাকাতলে সমবেত হয় নি। এই কর্মসূচি শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্তসহ পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন নিপীড়িত শ্রেণির নূন্যতম আকাংখার প্রতিফলন ঘটাতে পারে নি। ন্যাপের ১৪ দফায় সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের রূপরেখা ও সাংগঠনিক তৎপরতার অনুপস্থিতির ফলে তা ব্যাপক জনগণের মধ্যে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়। এ সময় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও ঐক্যফ্রন্ট গঠনের প্রশ্নে ন্যাপের নীতি ছিল নিম্মরূপ ।
১। বর্তমান সরকারকে অপসারণ করিয়া দেশে গণতন্ত্র কায়েমের জন্য ন্যাপের স্বাধীন উদ্যোগে উহার কর্মসূচীর ভিত্তিতে দেশব্যাপী সচেতন, সংঘবদ্ধ আন্দোলন। গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা করা। সঙ্গে সঙ্গে অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলির সহিত আলাপ আলােচনা চালানাে, যাহাতে তাহারা একটি সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও বড় পুঁজি বিরােধী নিম্মতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হন এবং দেশব্যাপী গণ আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে অগ্রসর হন। বর্তমান সরকারকে পরিবর্তন করিয়া গণতান্ত্রিক সরকার কায়েমের জন্য যে ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠন করিতে হইবে উহাতে অবশ্যই জনগণ ও গণতন্ত্রের মূল তিনটি শত্রু – সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও বড় পুঁজির বিরুদ্ধে কর্মসূচী থাকিতে হইবে।
২। অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলি যখন বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ বিরােধী
==============================================================
মৌলিক গণতন্ত্র (বেসিক ডেমােক্রেসি) ছিল আইয়ুব খানের আবিষ্কার। ১৯৫৯ সালের ২৬ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র অধ্যাদেশ ঘােষণা করেন। এই আইন প্রণেতাদের ঘােষণা মতে এই আইনের অধীনে প্রবর্তিত ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল, “জনগণের ইচ্ছাকে সরকারের কাছাকাছি এবং সরকারি কর্মকর্তাদেরকে জনগণের কাছাকাছি এনে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ” সাধন করা। এই আইনে চারস্তর বিশিষ্ট একটি প্রশাসনিক কাঠামাে চালু করা হয়, যেখানে ইউনিয়ন পর্যায়ে গঠিত হয় ইউনিয়ন কাউন্সিল এবং থানা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে গঠন করা হয় যথাক্রমে থানা কাউন্সিল, জেলা কাউন্সিল এবং বিভাগীয় কাউন্সিল। একই সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদ ব্যতীত অন্যসব নির্বাচন পরােক্ষ পদ্ধতিতে একটি বিশেষ নির্বাচকমন্ডলী কর্তৃক সম্পন্নের ব্যবস্থা করা হয়। ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্বাচিত ব্যক্তিরা বিডি মেম্বার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গােটা পাকিস্তানে তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচিত ৮০,০০০ মৌলিক গণতন্ত্রী ছিলেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইলেকটোরাল কলেজের সদস্য।
পেজ-১২
কর্মসূচী গ্রহণে রাজি নয় তখন জনগণের আশু দাবি দাওয়া আদায়ের জন্য উহাদের। সহিত মিলিয়া ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে গড়িয়া তুলিবার প্রচেষ্টা নিতে হইবে।২২
এ ছাড়াও, ইসলামী সংগ্রাম পরিষদের ৮ দফা ছিল সামন্তবাদী, পশ্চাদমুখী আদর্শের একটি জ্বলন্ত স্বাক্ষর। তাই দেশের প্রগতিশীল শ্রেণিগুলাের কাছে এর আবেদন ছিল অত্যন্ত সীমিত। ১১ দফা আন্দোলনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইসলামী সগ্রামী পরিষদ বলেছে, “ঐ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ইসলামপন্থী দল ও জনগণ অত্যন্ত উৎসাহের সাথে যােগদান করেছিল। হঠাৎ ধর্ম নিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্রী মহল এক জোট হয়ে ঐ সময়ে জনগণকে ভুল পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করে। সমস্ত দেশবাসী যখন গণতন্ত্র বহালের আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছে তখন তারা ইসলাম বিরােধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে গণতন্ত্রের পথ রােধ করলাে। দেশে গণতন্ত্র বহাল হওয়ার পর ইসলাম বিরােধী তৎপরতা অসম্ভব হবে মনে করেই এরা ঐ আন্দোলনের সময় ইসলামের উপর হামলা করে বসলাে। এরই মােকাবেলায় আলেম সমাজ ও ইসলাম প্রিয় নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে ইসলামী সংগ্রামী পরিষদ গঠিত হয়।” পরবর্তী পর্যায়ে ৫ দফা কর্মসূচি উত্থাপন করে ইসলামী সংগ্রাম পরিষদঃ ।
১। প্রত্যেক মসজিদ, মহল্লায়, বাজার, গঞ্জে, ইসলামী সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে
হবে। দলমত নির্বিশেষে সকল স্থানীয় ওলামায়ে কেরাম, মসজিদের ইমাম, সকল ইসলামপন্থী শিক্ষিত লােক, ব্যবসায়ী ও যুবকদের সমন্বয়ে একটি পরামর্শ পরিষদ থাকবে। তন্মধ্যে একজন সভাপতি, একজন সেক্রেটারী ও একজন কোষাধ্যক্ষ থাকবেন।
২। বর্তমান পরিস্থিতি মােকাবেলার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে পুঁজিবাদ,সমাজতন্ত্র ও তথাকথিত বাঙালী জাতীয়তাবাদের নামে পাকিস্তান ধ্বংস ও হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি চালুর দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে এবং ইসলামী রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্বন্ধে যে সব পুস্তক পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে এবং ইসলামী জ্ঞান ও চরিত্রের উপযােগী বাংলা ভাষায় প্রকাশিত যত ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে ও হচ্ছে সেগুলাের দ্বারা প্রত্যেক মসজিদে একটি ছােট্ট পাঠাগার স্থাপন করতে হবে।
৩। প্রত্যেক শুক্রবার জুময়ার সময় ঐসব ভিত্তিতে কোনাে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে
অন্তত একজন বক্তৃতা করবেন এবং শ্রোতাদের প্রশ্নের জবাব দেবেন।
৪। উচ্চশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত, অশিক্ষিত সর্ব শ্রেণির ইসলাম প্রিয় যুবকদের নিয়ে প্রতি ইউনিটে ইউনিটে ‘মুজাহিদ সংঘ’ গঠন করতে হবে। পরিষদের এই বিভাগটি সামাজিক শান্তি, শৃংখলা ও নিরাপত্তা বিধান করবে এবং সমাজ বিরােধীদের অশুভ তৎপরতার ব্যাপারে সদা সচেতন থাকবে।
৫। ইসলামী সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে দীন ইসলামের ব্যাপক প্রচারের জন্য বিভিন্ন উপলক্ষ্যে সেমিনার, সীরাত মজলিশ ও ওয়াজ মাহফিলের আয়ােজন করতে হবে।২৩
==========================================================
২২ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ১৪ দফা, দলীয় পুস্তিকা, মােহাম্মদ সুলতান কর্তৃক প্রকাশিত, ১৯৬৮।
২৩ ইসলামী সংগ্রাম পরিষদের ডাক, কেন্দ্রীয় ইসলামী সংগ্রাম পরিষদ, ২১ বিসিসি রায় রােড, ঢাকা-১ এর পুস্তিকা। প্রকাশক জুলফিকার আহমদ কিসমতী, অক্টোবর ১৯৬৮। মূল্য : প্রতি কপি ১৫ পয়সা।
পেজ-১৩
ভিন্নমুখী রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রচারণা সত্ত্বেও ধীরে ধীরে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটে। জনগণ প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনমুখী হয়ে ওঠেন। এ সময় ভাষাবিতর্ক নতুন করে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী মহলে সাড়া জাগায়। বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন সময়ে সরকারি আনুগত্য লাভ করলেও, কয়েকটি প্রশ্নে সরকারের বিরােধিতা করা ছাড়া তাদের গত্যন্তর ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের বাংলা বানান এবং বর্ণমালার পরিবর্তন পদ্ধতির বিরুদ্ধে ১৯৬৮ সালের আগস্ট মাসে ৪১ জন বুদ্ধিজীবী একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন, ড. কাজী মােতাহার হােসেন, আবুল হাশিম (পরিচালক, ইসলামিক একাডেমী), অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন, সৈয়দ মুর্তজা আলী, কাজী মােহাম্মদ ইদ্রিস, সিকান্দার আবু জাফর (সম্পাদক, সমকাল), জহুর হােসেন চৌধুরী (সম্পাদক, সংবাদ), আবদুল গণি হাজারী, শহীদুল্লাহ কায়সার (সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক সমিতি), হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদক, পাকিস্তান লেখক সংঘ, পূর্বাঞ্চল শাখা), শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দিন, আহমেদ হুমায়ুন, সানাউল্লাহ নূরী, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, আফলাতুন, লায়লা সামাদ, শহীদ কাদরী, কালাম মাহমুদ, কে জি মুস্তাফা, আতাউস সামাদ (সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক সমিতি), আনােয়ার জাহিদ (সম্পাদক, আওয়াজ), আবদুল গাফফার চৌধুরী, জহির রায়হান, রােকনুজ্জামান খান (সম্পাদক, কচি ও কাঁচা), নূরজাহান বেগম (সম্পাদিকা, বেগম), এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, ওয়াহিদুল হক, কাজী মাসুম, ইসহাক চাখারী, শওকত আলী, মােহাম্মদ সালেহ উদ্দিন, আবদুল আউয়াল, জামাল উদ্দিন মােল্লা, গােলামুর রহমান ও শহীদুর রহমান।২৪ বিবৃতিতে তারা বলেন,
“আমরা সংবাদপত্র মারফত জানিয়া বিস্মিত হইলাম যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল বাংলা বর্ণমালা, লিখন নীতি এবং বানান পদ্ধতির পরিবর্তন সাধনে তৎপর হইয়াছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাংলা ভাষার এইরূপ পরিবর্তন সাধনে একতরফাভাবে কেন যে উদ্যোগী হইয়াছেন, তাহা আমরা জানি না। আমরা জানি না, কি উদ্দেশ্যে তাঁহারা ভাষার এরূপ ব্যাপক পরিবর্তন সাধনে উৎসাহী হইয়াছেন। তথাকথিত সরলীকরণের মাধ্যমে জনশিক্ষা প্রসারই যদি তাঁহাদের উদ্দেশ্য হয়, তাহা হইলে আমাদের বক্তব্য এই যে :
(ক) প্রচলিত বর্ণমালা এবং বানান পদ্ধতি যে জনশিক্ষা প্রসারের অনুপযােগী তাহা প্রমাণ হয় নাই।
(খ) প্রস্তাবিত লিখনরীতি যে জনশিক্ষা প্রসারে মন্ত্রসিদ্ধ উপায়ের মত কার্যকরী
হইবে, তাহারই বা নিশ্চয়তা কি?
(গ) যে সকল রাষ্ট্র ব্যাপকভাবে জনশিক্ষা বিস্তারে সফলকাম হইয়াছে তাহারা ভাষা
============================================================
২৪ এ তালিকায় উল্লেখিত ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতির জন্য পরিশিষ্ট গ দেখুন।
পেজ-১৪
কিম্বা লিপি সংস্কারের দ্বারা এই কার্য সম্পন্ন করেন নাই। জনশিক্ষা বিস্তারের প্রকৃত উপায় হইতেছে সর্বস্তরে অপরিহার্য রূপে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দান, শিক্ষা পদ্ধতির উন্নতি সাধন এবং সকলের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা। এই সকল উপায় অবলম্বন না করিয়া জনশিক্ষা প্রসারের অজুহাতে লিখন পদ্ধতির পরিবর্তন সাধন জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার কৌশল মাত্র।
(ঘ) প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক একতরফাভাবে গৃহীত
বর্ণমালা, বানান পদ্ধতি ও লিখনরীতি চালু হইলে বর্তমানে যাঁহারা শিক্ষিত, তাহাদের বেলায় এবং যতটুকু শিক্ষার প্রসার হইয়াছে, তাহার ক্ষেত্রে মারাত্মক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হইবে। অধিকন্তু ভাষা, সাহিত্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে চরম বিশৃংখলা ও অরাজকতা সৃষ্টি হইবে। শিক্ষিতদের নতুন করিয়া ভাষা লিখন ও পাঠ শিখাইবার ক্ষেত্রেও আরেকটি অতিরিক্ত সমস্যার সৃষ্টি হইবে যাহা দ্রুত অগ্রগতি সাধনতাে দূরের কথা, সাধিত অগ্রগতিকেই অনেকাংশে ব্যাহত করিবে। এর ফলে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে চালু করার প্রচেষ্টা সম্পূর্ণরূপে বানচাল হইয়া যাইবে। কৃত্রিম হস্তক্ষেপের দ্বারা ভাষা ও বর্ণমালা সংস্কার সম্ভব নয়। ভাষা ও লিখন প্রণালী আপন প্রবণতা অনুযায়ী নিজস্ব নিয়মে স্বাভাবিকভাবে বিবর্তিত হয়। ভাষা ও বর্ণমালার প্রকৃত মালিক দেশের . জনসাধারণ ; তাহাদের অগােচরে ইহার মৌলিক পরিবর্তন সাধনে কতিপয় ব্যক্তির অধিকার নাই। সুতরাং আমরা দেশবাসীর নিকট এই প্রকার সংস্কার প্রত্যাখ্যান করিতে আহ্বান জানাই।”২৫
আর একটি ভিন্ন বিবৃতিতে ৩০ আগস্ট, শুক্রবার, ১৯৬৮ কবি জসিম উদ্দিন বলেন, “সম্প্রতি বাংলা বানান লইয়া দেশে কথা কাটাকাটি হইতেছে। ঊ-কার ঔ-কার এবং দুই ন ও ণ, তিনটা শ, ষ ও স’র অত্যাচারে সারা জীবন আমাকে ভুগিতে হইয়াছে। সেই জন্য দুই বছর আগে আমার বালুচর গ্রন্থে আমি শুধুমাত্র উ-কার, ই-কার ব্যবহার করিয়াছি। যাহারা এইভাবে বানান সংস্কার করিতে চাহেন তাহাদের সহিত কতকটা আমি একমত। কিন্তু আমরা পূর্ব পাকিস্তানী জনসাধারণ যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক কাউন্সিল কর্তৃক গৃহীত হরফ ও বানান সংস্কার মানিয়া লই তবে আমাদের বংশধরদিগের এক চক্ষু বন্ধ করিয়া দেওয়া হইবে। যদি কোনাে বানান সংস্কার করিতেই হয়, বাংলা ভাষার সকল সাহিত্যসেবীরা যদি তাহা করেন, তাহা হইলেই পূর্বসূরীদের গ্রন্থাবলীসহ সকল সাহিত্য প্রয়াস নতুন বানান পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা রহিবে। কিন্তু এককভাবে পূর্ব পাকিস্তান যদি ধীরে ধীরে নিজেদের বানান পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা করিয়া ফেলেন তাহা হইলে আমাদের চক্ষু উৎপাটনেরই সামিল হইবে। আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এই বানান সংস্কার হইতে নিবৃত হইতে অনুরােধ করিতেছি। নতুবা জনগণের মধ্যে মারাত্মক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হইয়া দেশের শাসকবর্গের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ প্রদর্শিত হইবে।”২৬
=======================================================
২৫ দৈনিক পাকিস্তান, ২১ আগস্ট, বুধবার, ১৯৬৮।
২৬ দৈনিক পাকিস্তান, ৩১ আগস্ট, শনিবার, ১৯৬৮।
পেজ-১৫
ভাষা সংস্কারের বিতর্ক দীর্ঘদিন চললেও পরবর্তী পর্যায়ে রাজনৈতিক নির্যাতন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রশ্নটি গুরুত্ব লাভ করায় এই বিতর্কে ভাটা পড়ে। তথাপি, ১৯৬৮ সালের শেষ পর্যন্ত সরকার নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রে প্রায়শ বানান সংস্কারের প্রশ্নে প্রচুর চিঠিপত্র জনমত হিসেবে প্রকাশিত হয়। অবশ্য শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয় নি।
মৌলিক গণতন্ত্রের ভবিষ্যত সম্পর্কে ১৯৬৮ সালের অক্টোবরের প্রথম থেকেই সরকারি আশংকার কথা প্রকাশিত হতে থাকে। ৩ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার নাটোরের এক জনসভায় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর মােনায়েম খান ধিকৃত বিরােধী দলীয় রাজনীতিবিদদের সন্দেহজনক ভূমিকা ও কার্যকলাপের দিকে সর্বদা তীক্ষ দৃষ্টি রাখার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ক্ষমতা দখলের জন্য জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করাই এ সকল ধিকৃত রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্য। তিনি আরও বলেন, মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা ধ্বংস করাই বিরােধীদলীয় নেতৃবর্গের প্রধান লক্ষ্য। অথচ এই ব্যবস্থাই পল্লী অর্থনীতি ও দেশে স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েমে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।
এ সময় ভাসানী ন্যাপের অভ্যন্তরে সাংগঠনিক বিবাদ লক্ষ্যণীয় পর্যায়ে পৌঁছে। ৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিতব্য কার্যনির্বাহী পরিষদের বৈঠক সম্পর্কে ৪ অক্টোবর, শুক্রবার, ১৯৬৮ একটি দৈনিকে বলা হয় “ভাসানীপন্থী ন্যাপে এখন দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে কর্মসূচি সম্পর্কে দুটি মত জোরদার হয়েছে। এক দলের মতে আগামী নির্বাচনে ন্যাপের অংশগ্রহণ উচিত নয়। আর এক দলের মত হচ্ছে নির্বাচনের প্রাথমিক স্তর মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচনে ন্যাপ যদি অংশ নেয় তাতে অনেক দিক দিয়ে লাভবান হবে। প্রথমত, জনগণের মধ্যে যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে এই নির্বাচনী প্রচারের মধ্য দিয়ে তাদের মনােবল অনেকটা ফিরিয়ে আনা সম্ভবপর হবে। দ্বিতীয়ত, এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একটা পথ নির্দেশও পাওয়া যাবে। কর্মসূচির প্রশ্ন ছাড়াও এই বৈঠকে কিছু কিছু সদস্যের কার্যকলাপ সম্পর্কেও আলােচনা হতে পারে বলে জানা গেছে। অপর দিকে পশ্চিম পাকিস্তানে ভাসানীপন্থী ন্যাপের অবস্থা পর্যালােচনাকালেও প্রবল বিতণ্ডা হতে পারে। প্রকাশ, একদল পাঞ্জাবের সি আর আসলামকে ন্যাপ সংগঠনের দায়িত্ব দিতে চান। আবার অন্য পক্ষ মেজর ইসহাককে সমর্থন করতে চান। ফলে এ প্রশ্নের সুরাহা না হলে পশ্চিম পাকিস্তানে ভাসানী পন্থী ন্যাপের সংগঠন অনিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে। পরিশেষে আগামী নির্বাচনে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন কৃষক সমিতির অংশগ্রহণ সম্পর্কেও সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। মওলানা ভাসানী কৃষক সমিতির গঠনতন্ত্র সংশােধন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষপাতী।”২৭
===========================================================
২৭ দৈনিক পাকিস্তান, ৪ অক্টোবর, শুক্রবার, ১৯৬৮। মূলত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িত এবং বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত সি আর আসলাম বাহওয়ালপুর ন্যাপের সভাপতি ছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য মেজর ইসহাক মােহাম্মদ ছিলেন পূর্ব পাঞ্জাবের অধিবাসী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি সম্মানসূচক মিলিটারী ক্রস পদক পান। ১৯৫১ সালে উন্মােচিত রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলায় চাকরি থেকে বরখাস্ত এবং সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হন। ১৯৫৫ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পান এবং ন্যাপ গঠিত হলে তাতে যােগদান করেন।
পেজ-১৬
ন্যাপের এই বৈঠকে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার জন্য যে কোনাে ত্যাগের বিনিময়ে। সগ্রামের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে বন্যা পরিস্থিতি নিয়েও আলােচনা হয়, কিন্তু সরকারি দৈনিকের রিপাের্ট অনুযায়ী কোনাে সদস্যের কার্যকলাপ সম্পর্কে আলােচনা হয় নি। বৈঠকে ন্যাপের একুশ জন সদস্য অংশগ্রহণ করেন। বৈঠক শেষে, মওলানা ভাসানী সাংবাদিকদের বলেন, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে কোনাে রাজনৈতিক জোট গঠনে তিনি মােটেও রাজি নন। তিনি বলেন, জনাব ভুট্টোর রাজনৈতিক দল বলতে কিছু নেই এবং তার কোনাে জনসমর্থনও নেই। এমতাবস্থায় তার সঙ্গে রাজনৈতিক ফ্রন্ট বা জোট গঠন কোনাে মতেই সম্ভব হতে পারে না। বৈঠকে ১০ দফা দাবির ভিত্তিতে নভেম্বর থেকে দাবি সপ্তাহ পালনের সিদ্ধান্ত হয়। দাবিগুলাে ছিল:
১) বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা কার্যকর করা
২) বন্যাপীড়িত অঞ্চল সমূহকে দুর্গত এলাকা ঘােষণা।
৩) বন্যা দুর্গত জনগণের বকেয়া খাজনা ও ট্যাক্স মওকুফ করা
৪) প্রদেশব্যাপী পূর্ণ রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা
৫) সকল রাজবন্দীর মুক্তি
৬) দেশ হতে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার
৭) পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন
৮) প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান
৯)শিক্ষা সংকোচন নীতি বাতিল।
১০) ভিয়েতনাম ও প্যালেষ্টাইনী জনগণের প্রতি পাকিস্তান সরকারের প্রকাশ্য সমর্থন
ঘােষণা।
এই কর্মসূচির ভিত্তিতে ৩ নভেম্বর, রবিবার পল্টন ময়দানে প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫৪ সালের ন্যায় পুনর্বার জনগণকে উত্তেজিত করার মতাে বক্তৃতা করেন মওলানা ভাসানী। সভায় ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দানের দাবি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাবই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি। গণচীনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল বিশেষের অপপ্রচারের নিন্দা করে মওলানা ভাসানী বলেন, সেপ্টেম্বর যুদ্ধের (১৯৬৫) সময় গণচীন সাহায্য না করলে আমাদের ‘আজাদী’ বিপন্ন হত এবং এখানে আজ অশােকস্তম্ভ খচিত পতাকা উড়ত। এই সভায় বক্তব্য রাখেন, ন্যাপের সেক্রেটারী জেনারেল মােহাম্মদ তােয়াহা ও নূরুল হুদা। কাদের বক্স। ২৮
===========================================================
২৮ ন্যাপ সম্পাদক মােহাম্মদ তােয়াহা ছিলেন আত্মগােপনকারী পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। দীর্ঘ আত্মগােপনের পর ১৯৬৭ সালে এরা প্রকাশ্য রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় তাদেরকে গণসংগঠনের পতাকা তুলে ধরতে হয়। ভাষা আন্দোলনের সৈনিক ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা মােহাম্মদ তােয়াহা লক্ষীপুর জেলার হাজিরহাট গ্রামে জন্মগ্রহণ
পেজ-১৭
===========================================================
এর ছয়দিন পর, মওলানা ভাসানী ১১ অক্টোবর, শুক্রবার, ১৯৬৮ তার সন্তোষস্থ বাসভবনে। বিরােধী দলীয় নেতাদের এক বৈঠক আহ্বান করেন। আওয়ামী লীগ (উভয় গ্রুপ), কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও এনডিএফ নেতৃবৃন্দের কাছে বৈঠকের আমন্ত্রণপত্র পাঠানাে হয়। তবে মস্কোপন্থী ন্যাপ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামকে আমন্ত্রণ জানানাে হয় নি। আমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন নুরুল আমিন, আবদুস সালাম খান, আবু হােসেন সরকার, আতাউর রহমান খান, মিজানুর রহমান চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জহিরুদ্দিন। আহমদ, আবুল মনসুর আহমেদ, ইউসুফ আলী চৌধুরী, সৈয়দ আজিজুল হক, খাজা খয়ের। উদ্দিন ও মাহমুদ আলী।২৯ তবে সবাই এ সভায় যােগ দেন নি। এদের পক্ষ থেকে অলি আহাদ ও নুরুর রহমান মওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করেন। পরবর্তী পর্যায়ে মওলানা ভাসানী ঢাকায় এলে তার সঙ্গে আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, আবদুস সালাম খান, নূরুর রহমান, ও অলি আহাদ প্রমুখের বৈঠক হলেও কোনাে সিদ্ধান্ত হয় নি। মওলানা ভাসানী ন্যাপের অন্য অংশের সঙ্গে আলােচনা করতে রাজি ছিলেন না বলে ঐক্যের প্রশ্নটি অমীমাংসিত থেকে যায়।
পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক মুভমেন্টের (পিডিএম) প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ৬ অক্টোবর, রবিবার, ১৯৬৮ পল্টনের এক জনসভায় এনডিএফ নেতা নূরুল আমীন বলেন, তিনি ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের বিরােধিতা করেছেন এরূপ কোনাে দলিল বা কোনাে নথিপত্রে এর উল্লেখ নেই। মরহুম খাজা নাজিমুদ্দিনের দরুণ যে অশান্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তাতে আইন শৃংখলা রক্ষার জন্যই তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। পিডিএম এর সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন আবদুল সালাম খান, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও মওলভী ফরিদ আহমদ। সভাশেষে নূরুল আমীনের নেতৃত্বে একটি মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন, পার্লামেন্টারী পদ্ধতিতে পাকিস্তানে ফেডারেল সরকার গঠন, জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার, রাজবন্দীদের মুক্তি, সর্ব প্রকার অর্থনৈতিক দুরবস্থা দূরীকরণে বাস্তব ব্যবস্থার দাবি করা হয়।” । ৩০
========================================================
করেন। তিনি ১৯৩৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৪৮ সালে রাজনৈতিক বিজ্ঞানে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৫২ সালের শেষ দিকে তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মােহাম্মদ তােয়াহা ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাসনামলে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। জীবনের দীর্ঘ সময় তিনি আত্মগােপন অবস্থায় থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলন সংগঠিত করেন। তিনি একসময় চীনপন্থী পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার সম্পাদনায় পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র হিসেবে সাপ্তাহিক গণশক্তি প্রকাশিত হয়। তিনি ১৯৮৭ সালে ২৯ নভেম্বর নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন।
২৯ এই নেতৃবৃন্দের সংক্ষিপ্ত পরিচিতির জন্য পরিশিষ্ট – ঘ দেখুন।
৩০ আতাউর রহমান খানের বাসভবনে ১৯৬৭ সালের ৩০ এপ্রিল, রবিবার অনুষ্ঠিত সভায় নিম্মােক্ত রাজনীতিবিদদের সমন্বয়ে পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) গঠিত হয়: জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) এর পক্ষে নূরুল আমিন, হামিদুল হক চৌধুরী, আতাউর রহমান খান, পাকিস্তান মুসলিম লীগের পক্ষে মমতাজ দৌলতানা, তােফাজ্জল আলী ও খাজা খয়ের উদ্দিন, জামায়াতে ইসলামী, পাকিস্তান এর পক্ষে মওলানা তােফায়েল মােহাম্মদ, মওলানা আবদুর রহিম,
পেজ-১৮
========================================================
পল্টন ময়দানে নূরুল আমীনের জনসভার পরদিন, ৭ অক্টোবর, সােমবার, ১৯৬৮ সরকার নিয়ন্ত্রিত ন্যাশনাল প্রেস ট্রাস্টের মালিকানাধীন দৈনিক পাকিস্তানে ‘রাজনীতির নামে’ শিরােনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। সরকারি প্রচারণার চরিত্র উপলব্ধির জন্য সম্পাদকীয়টি হুবহু প্রকাশ করা হলোঃ
“গতকাল রবিবার পল্টনের মঞ্চ হইতে জনাব নূরুল আমীন এবং তার পিডিএম সহকর্মীগণ গণতন্ত্র ও গণ অধিকারের নামে বহু অভিনব আপ্তবাক্য উচ্চারণ করিয়াছেন। জনাব নূরুল আমীন যখন বাংলা ভাষার মর্যাদা ও বাক-স্বাধীনতার প্রশ্নে উচ্চকণ্ঠে নিজের সাফাই গাহিতেছিলেন, তখন বিগত দিনের প্রতিচ্ছবি বারবার তার চোখের সামনে ভাসিয়া উঠিয়াছিল কিনা অথবা অন্তরাল থেকে বিবেকের দংশনে তিনি জর্জরিত হইয়াছিলেন কিনা আমরা বলিতে পারি না। নৈতিক মূল্যবােধের প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধা থাকিলে জনসমক্ষে তিনি কিছুতেই এমন জোর গলায় সত্যকে বিকৃত করার চেষ্টা করিতেন না, আর এমন চটকদারী কায়দায় অতীতের ন্যাক্কারজনক ইতিহাসকেও বড় করিয়া তুলিয়া ধরিতে পারিতেন না। পুরাতন রাজনৈতিক অভিধানকে সম্বল করিয়াই বােধ হয় জনাব নুরুল আমীন এবং তাঁর দলের সহ-নায়কগণ নব পর্যায়ে রাজনীতির আসরে নামিয়াছেন। জনসাধারণের স্মৃতি ক্ষণস্থায়ী বলিয়া এই কীটদষ্ট অভিধানে যে কথাটি লিপিবদ্ধ আছে সম্ভবত উহাকেই ক্ষমতা লাভের মােক্ষম অস্ত্র হিসেবে তারা বাছিয়া লইয়াছেন। ম্যাকিয়াভেলি এবং হিটলারই ছিলেন এই দর্শনের শ্রেষ্ঠতম প্রবক্তা। তারা মনে করিতেন, একটা মিথ্যাকে বারবার জনসাধারণের সামনে সত্য বলিয়া প্রচার করিলে উহাকেই জনগণ অভ্রান্ত বলিয়া গ্রহণ করিবে। কিন্তু ক্ষমতা দখলের এসব জালিয়াতি, কায়দা কানুন বহু যুগ আগেই বাসি হইয়া গিয়াছে। জনগণের প্রতি যাদের আদৌ কোন শ্রদ্ধা ছিল না, যারা জনগণকে তাদের হীন উদ্দেশ্য সিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করিতে এবং যাদের রাজনীতি ছিল চোরাগলির রাজনীতি
====================================================
অধ্যাপক গােলাম আযম, পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পক্ষে নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, আবদুস সালাম খান ও গােলাম মােহাম্মদ খান লুন্দখোর, পাকিস্তান নেজামে ইসলামী পার্টির পক্ষে চৌধুরী মােহাম্মদ আলী, মওলভী ফরিদ আহমদ এবং এম আর খান। পিডিএম গঠন প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম (ভারপ্রাপ্ত সভাপতি) ও আমেনা বেগমের (ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক) নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী লীগ এবং মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ (সভাপতি) ও রাজশাহীর মজিবুর রহমান (সাধারণ সম্পাদক) পরিচালিত আওয়ামী লীগ যথাক্রমে ৬ দফা পন্থী আওয়ামী লীগ ও ৮ দফা পন্থী আওয়ামী লীগ নামে পরিচিতি লাভ করে। সিরাজগঞ্জ জেলার সলংগায় বৃটিশ বিরােধী আন্দোলনের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ (১৯০০-১৯৮৬)। ১৯২২ সালের ২৮ জানুয়ারি, শুক্রবার মওলানা তর্কবাগীশের নেতৃত্বে ফুলজোড় নদীর তীরে সংলা হাটে বিদেশী পণ্য বর্জনের আন্দোলন শুরু হলে পুলিশ তাতে হামলা চালায়। এতে বেশ কিছু লােক নিহত এবং অনেকে আহত হন। নিহতদের সঠিক হিসাব পাওয়া যায় কারণ সরকারি নির্যাতনের ভয়ে তারা নিহতদের সঙ্গে সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যে বলেন নি। সেই থেকে এলাকার লােকজন মওলানা তর্কবাগীশকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণােত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে।
পেজ-১৯
তারাই জনগণের স্মৃতি ক্ষণস্থায়ী বলিয়া প্রচার করিয়াছিল। সত্যের এত বড় অপলাপ বােধ হয় আর কিছুই হইতে পারে না। যুগে যুগে দেখা গিয়াছে জনসাধারণ কিছুই ভুলিয়া যায় না। হয়তাে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করিয়া, জনদরদীর বেশ ধারণ করিয়া কিছু সময়ের জন্য কিছু লােককে বােকা বানানাে যায়, কিন্তু সব সময়ের জন্য সব লােককে বােকা বানানাে যায় না। এবং শেষ পর্যন্ত দেখা গিয়াছে, নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য দেশের ভাগ্য লইয়া যারা ছিনিমিনি খেলিয়াছেন, আপামর জনগণ তাদের কিছুতেই ক্ষমা করে নাই। জনাব নুরুল আমীন হয়ত ভাবিয়াছেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ এতদিনে নিশ্চয়ই ১৯৫২ সালের রক্তাক্ত ভাষা সগ্রাম এবং তার পশ্চাতের রাজনৈতিক গ্লানির ইতিহাস বেমালুম ভুলিয়া গিয়াছে। সে জন্যই বােধ হয় তিনি নিজেকে সাধু বানাইবার চেষ্টা করিয়াছেন এবং বাংলা ভাষার জন্য এমন কুম্ভীরাশ্রুপাত করিয়াছেন। কিন্তু জনাব নূরুল আমীনের জানিয়া রাখা উচিত, পূর্ব পাকিস্তানের ৬ কোটি মানুষ কিছুতেই তাঁর সেই বিরাট অপকীর্তির কথা এত সহজে ভুলিয়া যাইতে পারে না। তিনি অন্যের কাঁধে দোষ চাপাইতে চেষ্টা করিয়াছেন। এ কথা বলার সময় তার সংকোচ বােধ করা উচিত ছিল। কেননা তখন তিনি ছিলেন পার্লামেন্টারী প্রশাসন ব্যবস্থার সর্বময় কর্মকর্তা। তাঁর নির্দেশ ছাড়া কিছুতেই ছাত্রদের উপর গুলী বর্ষণ করা সম্ভব ছিল না। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করিয়া দেওয়ার জন্যই তিনি এ ধরনের বেপরােয়া এবং বর্বরােচিত দমন নীতির আশ্রয় লইয়াছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের ঘরে ঘরে সেদিন তার নাম কিভাবে উচ্চারিত হইয়াছিল তা আমরা ভুলিয়া যাই নাই। বাংলা ভাষার জন্য তার দরদ কতখানি বন্দুকের মুখেই তিনি তার জবাব দিয়াছিলেন। একথা সকলেই জানে, বর্তমান সরকারই বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দিয়াছে এবং ইহার উন্নয়নের জন্য বাংলা উন্নয়ন বাের্ড, বাংলা একাডেমী এবং অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করিতেছেন। রাষ্ট্র ভাষা বাংলা শাসনতান্ত্রিক স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে। এ অবস্থায় কোনরূপ পরিবর্তন অসম্ভব। তবুও জনাব নুরুল আমীন এ প্রশ্নে একটি ছুতা ধরিয়া পানি ঘােলা করার চেষ্টা করিতেছেন। তিনি যে কেন হঠাৎ বাংলার দরদী সাজিয়াছেন তাহা কাহারও বােঝার বাকি নাই। ১৯৫২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি যে বিবৃতি দিয়াছিলেন, তিনি হয়ত এখন তাহা মনে করিতে চাহেন না। কিন্তু দেশবাসী উহা ভুলিয়া যায় নাই। সেই বিবৃতিতে তিনি ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ‘রাষ্ট্র বিরােধী’, ‘ভারতের চর’ এবং ‘কম্যুনিস্ট’ বিশেষণে ভূষিত করিয়াছিলেন। এর পরও জনাব নুরুল আমীন কোন মুখে এরূপ সাফাই গাহিতে পারিতেছেন ?
পার্লামেন্টারী আমলে বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র পূর্ণমাত্রায় বজায় ছিল বলিয়া জনাব নুরুল আমীন পল্টন ময়দানে উচ্চ কণ্ঠে ঘােষণা করিয়াছেন। কিন্তু আমরা জিজ্ঞাসা করি, গণতন্ত্র বজায় থাকা সত্ত্বেও কেন তাঁর আমলে এক হাজার দুই শত চৌদ্দজন রাজবন্দী প্রদেশের বিভিন্ন কারাগারে বছরের পর বছর ধরিয়া বিনা বিচারে আটক ছিলেন। রাজনৈতিক প্রতিশােধ গ্রহণের জন্যই কি তিনি এই নির্যাতন মূলক নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেন? আমরা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা
পেজ-২০
করি, ইহাই কি তাঁর কথিত বাক স্বাধীনতার রূপ ? ইহাই কি তার প্রচারিত পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের আসল রূপ? তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য এখন দরদে গদগদ। কিন্তু তার আমলেই ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিক ও চট্টগ্রাম হইতে প্রকাশিত একটি বাংলা দৈনিকের প্রকাশনা বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল এবং একটি পত্রিকার সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারীকে আটক রাখা হইয়াছিল। একথা তিনি কি করিয়া এত তাড়াতাড়ি ভুলিয়া গেলেন? সংবাদপত্রগুলির দোষ ছিল, তারা তার সরকারের সমালােচনা করে। বর্তমানে তিনি এবং তাঁর রাজনৈতিক বন্ধুগণ সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দাবি তােলার সাথে সাথে প্রেস ট্রাস্ট পরিচালিত পত্রিকাগুলি বন্ধ করিয়া দেওয়ার দাবি তুলিয়াছেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি কি আশ্চর্য শ্রদ্ধাবােধ। কোন সুস্থ বুদ্ধি সম্পন্ন রাজনীতিক এ ধরণের একটা দাবি তুলিতে পারেন উহা ভাবিতেও অনেকে লজ্জাবােধ করিবেন। এঁদের রাজনীতি যে মূলত এবং মূখ্যত সুবিধাবাদী রাজনীতি, এ থেকেই তার প্রমাণ হয়। অথচ লক্ষ্য করিলে দেখা যাইবে, প্রেস ট্রাস্ট পরিচালিত পত্রিকাগুলি গুরুত্বের ভিত্তিতেই সরকারি ও বিরােধী দলীয় সংবাদ প্রকাশ করে থাকে, কোনাে সংবাদের প্রতিই উপেক্ষা প্রদর্শন করে না এবং নির্দ্বিধায় সরকারি কার্যক্রমের ত্রুটি বিচ্যুতিরও সমালােচনা করিয়া থাকে। পাঠক সমাজই এর সাক্ষী। পিডিএম সভার প্রস্তাব একথাই নির্দেশ করে যে ক্ষমতায় আসিলে নিজেদের খুশীমত সংবাদপত্রের কণ্ঠরােধ করিতে এক মুহূর্ত তারা বিলম্ব করিবেন না। বর্তমান আমলে বাক স্বাধীনতা নাই একথা যদি সত্যি হইত, তবে জনাব নুরুল আমীন এবং বিরােধী দলীয় নেতৃবৃন্দ কি করিয়া এমন উচ্চ নিনাদে সমালােচনা করিতেছেন ? এবং কি করিয়া তারা পল্টন ময়দানে দাঁড়াইয়া এত সাফাই গাহিয়াছেন? সত্যকে এভাবে বিকৃত করা আদৌ কোন সুস্থ রাজনীতির লক্ষণ নয়।
জনাব নুরুল আমীন এবং বিরােধী দলীয় সহকর্মীদের আমরা রাজনীতির নামে অহেতুক কাদা ছোঁড়াছােড়ি না করিয়া গঠন মূলক বিরােধিতার পথ বাছিয়া লওয়ার জন্য অনুরােধ জানাইতেছি। ফারাক্কা বাঁধ, কাশ্মীর প্রশ্ন, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, জনশিক্ষা এবং এমন আরও অনেক বহু ক্ষেত্র রহিয়াছে যেখানে তারা বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করিতে পারেন। গঠনমূলক কর্মসূচী লইয়া অগ্রসর হইলে তারা সকলেই শ্রদ্ধা লাভ করিবেন। বিভ্রান্তি সৃষ্টির দ্বারা তাদের কোন ফায়দা হইবে বলিয়া আমাদের মনে হয় না।”৩১
==================================================================
৩১ দৈনিক পাকিস্তান, ৭ অক্টোবর, সােমবার, ১৯৬৮। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর আইয়ুব খান সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনগণকে প্রভাবান্বিত করার জন্য ন্যাশনাল প্রেস ট্রাস্ট গঠন করেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর দৈনিক ও সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশের ব্যাপারে পূর্বতন সরকারের অবাধ নীতিমালার সমালােচনা করে তিনি মন্তব্য করেন ‘পত্রিকা প্রকাশের জন্য এদের প্রয়ােজনীয় অর্থ ছিল না, তাই ব্ল্যাকমেইলিং এর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে জীবনযাপন করতেন।’ ন্যাশনাল প্রেস ট্রাস্ট (এনপিটি) সরকার নিয়ন্ত্রিত ট্রাস্ট ছিল না, কিন্তু ট্রাস্টের উদ্যোগে প্রকাশিত প্রত্যেকটি পত্রিকা ছিল সরকার সমর্থক। ১৯৬৪ সালে গঠিত হওয়ার পর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ছয়টি প্রধান শহরে এনপিটি ১২টি ইংরেজী, উর্দু ও বাংলা সংবাদপত্রের মালিকানা লাভ করে। এনপিটি’র প্রতিষ্ঠাতা
পেজ-২১
মওলানা ভাসানী ১১ অক্টোবর, শুক্রবার, ১৯৬৮ যে বিরােধী দলীয় সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন সে বিষয়ে আলােচনার জন্য ৭ অক্টোবর, সােমবার, ১৯৬৮ অস্থায়ী সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২৪০ বড় মগবাজার, ঢাকায় অনুষ্ঠিত এই সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, সন্তোষ বৈঠকে ওয়ালী খানের নেতৃত্বে পরিচালিত ন্যাপের অনুপস্থিতির ফলে ঐক্যের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে। যার ফলে বিরােধী দলীয় সকল গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনও ব্যাহত হবে, তাই আওয়ামী লীগ এই বৈঠকে যােগদানের অক্ষমতা প্রকাশ করেছে। এই সভায় আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে আলােচনা অনুষ্ঠিত হলেও আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ সম্পর্কে কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয় নি। আওয়ামী লীগ মনে করে, দেশে বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন যার মাধ্যমে স্বাধীন জনমতের অভিব্যক্তি ঘটতে পারে তা সম্ভব নয়।৩২
এ সময়ে জামায়াতে ইসলামী ও ভাসানী ন্যাপ সমর্থক সংগঠনগুলাের মধ্যে বিরােধ দানা বেঁধে ওঠে। ৯ অক্টোবর, বুধবার, ১৯৬৮ সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) নেতৃবৃন্দ জামায়াতে ইসলামীর প্রচারণা সম্পর্কে দেশবাসীকে সচেতন করে দিয়ে বলেন, পাকিস্তানকে দ্বিতীয় ইন্দোনেশিয়া করার এক গভীর ষড়যন্ত্রে জামায়াতে ইসলামী লিপ্ত রয়েছে। বিবৃতিতে তারা বলেন, জামায়াতে ইসলামী সম্প্রতি চীন বিরােধী বহু প্রচার পুস্তিকা ও ইশতেহার প্রকাশ করে পাকিস্তানের জনগণকে বন্ধুহীন ও আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করা এবং কাশ্মীরের মুক্তি সংগ্রামকে দুর্বল করে সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদকে শক্তিশালী করার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলীর পক্ষে সভাপতি মােস্তফা জামাল হায়দার ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ এই বিবৃতির মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর হীন প্রচারণাকে প্রতিহত করার জন্য ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান এবং এ দেশের প্রগতিশীল মহলকে জনগণের স্বার্থে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কোনাে প্রকার মাের্চা গঠন না করার দাবি জানান।
=================================================================
চেয়ারম্যান ছিলেন এক সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্ণর আখতার হােসেন। এনপিটি’র উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত হয় দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ (ঢাকা সংস্করণ)। দৈনিক পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং মর্নিং নিউজের ঢাকা সংস্করণের সম্পাদক ছিলেন এস জি এম বদরুদ্দীন। এনপিটি নিয়ন্ত্রিত বার্তা সংস্থা ছিল এসােসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান (এপিপি)। স্বাধীনতার পর, এপিপি’র পূর্ব পাকিস্তান কার্যক্রম বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) নামে পরিচালিত হয়। দৈনিক পাকিস্তানের নাম বদলে করা হয় দৈনিক বাংলা । আওয়ামী লীগের শাসনামলে ৩১ অক্টোবর, শুক্রবার, ১৯৯৭ পত্রিকাটি এর সাপ্তাহিক প্রকাশনা বিচিত্রা সহ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
৩২ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে ভাঙণের পর এক অংশ মওলানা ভাসানী এবং অপর অংশ সীমান্ত গান্ধী হিসেবে পরিচিত আবদুল গাফফার খানের ছেলে আবদুল ওয়ালী খানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়। আত্মগােপনকারী কমিউনিস্ট পার্টির পিকিংপন্থীরা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্ব মেনে নেয় এবং মস্কোপন্থীরা ওয়ালী খানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়।
পেজ-২২
পূর্বে উল্লেখিত ভাষাবিতর্ক সম্পর্কে এ সময়ে নতুন করে বিবৃতি প্রকাশ করে পাকিস্তান তামুদ্দনিক আন্দোলন। ১১ অক্টোবর, শুক্রবার, ১৯৬৮ তমুদ্দনিক আন্দোলনের সহকারী সম্পাদক এক বিবৃতিতে বলেন, আবার ভাষাবিতর্ক নতুন করে তােলা দেশের আবহাওয়াকে ঘােলাটে করার এবং আঞ্চলিক মনােভাবকে জাগিয়ে তুলে দেশের সংহতিকে বিপন্ন করারই সামিল হবে।।
এ সময় ১৪ অক্টোবর, সােমবার, ১৯৬৮ দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে মওলানা ভাসানী বলেন, রাষ্ট্রের অহিত চিন্তাকে যারা প্রশ্রয় দেন এবং আমেরিকা ও ভারতের মদত চান তাদের সাথে তার কোনাে আপােষরফা নেই। তিনি বলেন, ‘আমি বর্তমান সরকারের বিরােধিতা করি কিন্তু রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও সংহতিকে সবার উপরে স্থান দিই।’ বিভিন্ন বিরােধী দলের ঐক্যজোট গঠন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটি ঐক্যজোট গঠনের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে আলাপ আলােচনার জন্য তিনি বৈঠক আহ্বান করেছিলেন। তিনি বলেন, ইতিপূর্বে বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ অভিযােগ করতেন যে তিনি তার মনােনীত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে অন্যান্য দলের সঙ্গে আলাপ আলােচনা চালালেও বয়ােবৃদ্ধ নেতা মওলানা ভাসানী স্বয়ং কখনও তাঁদের আলােচনার জন্য আমন্ত্রণ জানান নি, তিনি এবারে তাই বৈঠক ডেকেছেন এবং প্রধানত পূর্ব পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দকেই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
এনডিএফ নেতা দেলদার আহমদ, নূরুর রহমান এবং অলি আহাদ ১৩ অক্টোবর, রবিবার, ১৯৬৮ বিকেলে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ (পিডিএম পন্থী) সম্পাদক মুজিবর রহমান মওলানার সঙ্গে দেখা করেন। একই তারিখে খুলনার এক জনসভায় কেন্দ্রীয় যােগাযােগ মন্ত্রী খান এ সবুর আসন্ন মৌলিক গণতন্ত্র নির্বাচনে বিরােধী দলের প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য জনসাধারণকে সতর্ক করে দেন। সে দিন সন্ধ্যায় মুসলিম লীগ কাউন্সিলরদের সভায় খান এ সবুর বলেন, পাকিস্তানকে বন্ধুদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি বিশেষ শক্তির লেজুড়ে পরিণত করাই জামায়াতে ইসলামীর লক্ষ্য। তিনি বলেন, জামায়াত বর্তমানে রাষ্ট্র বিরােধী কার্যকলাপে নিযুক্ত রয়েছে। জনসাধারণের সরলতা ও ধর্মীয় অনুরাগের সুযােগ নিয়ে জামায়াতে ইসলামী এক বিপজ্জনক খেলায় লিপ্ত হয়েছে।
অক্টোবরের মাঝামাঝি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটি অভাবনীয় ঘটনা ঘটে। এ ঘটনা ঘটলে পরবর্তীতে ছাত্রদের পক্ষে ১৭ জানুয়ারি, শুক্রবার, ১৯৬৯ বটতলায় সভা করা সম্ভব হত কি না সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে। এই সভাই মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দেয়। ১৫ অক্টোবর, মঙ্গলবার, ১৯৬৮ রাত সাড়ে নয়টায় সলিমুলাহ মুসলিম হলে এমএ শেষ পর্ব পরীক্ষার্থীদের বিদায় উপলক্ষে আয়ােজিত মাসিক ভােজের পর ছুরিকাঘাতে আহত হন জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের (এনএসএফ) সাইদুর রহমান (পাঁচপার্তু হিসেবে পরিচিত) সহ নেসার উদ্দিন, আবদুল আলীম ও শেলী। সে সময় সবাই জানত কোন সংগঠনের নির্দেশে এ ঘটনা ঘটেছে। এ
পেজ-২৩
ঘটনায় সাধারণ ছাত্রসমাজ সন্তোষ প্রকাশ করলেও পরদিন থেকে এনএসএফ এর সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করে। এক বিবৃতিতে জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের প্রচার সম্পাদক ঘটনার সঙ্গে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অনতিবিলম্বে বহিঃষ্কার এবং দুস্কৃতিকারীদের গ্রেফতার ও তাদের বিরুদ্ধে যথাযােগ্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কর্তৃপক্ষের নিকট দাবি জানায়। অপর এক বিবৃতিতে এনএসএফ-এর প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক দোলন বলেন, যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জীবন এভাবে বহিরাগত ছাত্র নামধারী গুন্ডাদের করুণার উপর নির্ভরশীল হয় তাহলে ভবিষ্যতে দূরাঞ্চলের নিরীহ ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের আকাঙ্খকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সাইদুর রহমান বরিশাল থেকে এসে মাস্টার্স প্রথম পর্বে ভর্তি হয়েছিলেন।৩৩
উপরােক্ত ঘটনার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদযােগে পালিত হচ্ছিল আইয়ুবী উন্নয়ন দশকের উৎসব। ১৮ অক্টোবর, শুক্রবার, ১৯৬৮ ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের মিলনায়তনে এ উপলক্ষে আয়ােজিত সেমিনারে যখন উপাচার্য ড. ওসমান গনি বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন জমির আলীর নেতৃত্বে এনএসএফ এর কর্মীরা সেখানে প্রবেশ করে।৩৪ এর অব্যবহিত
=================================================
৩৩ ১৯৫৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন (এনএসএফ) জন্মলাভ করে। পাকিস্তান ছাত্র শক্তির নেতৃস্থানীয় অনেকে এনএসএফ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এটিএম তাহা এবং এ আর ইউসুফ (পরবর্তীতে ব্যরিস্টার ও এরশাদ সরকারের তথ্যমন্ত্রী ) যথাক্রমে এই ছাত্র সংগঠনের সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হন। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল ওমরাও খানকে স্বাগত জানানাের প্রশ্নে মতভেদ দেখা দেওয়ায় ছাত্র শক্তির অনেকে এনএসএফ গঠন করেন। পরে এই সংগঠনই ওমরাও খানের প্রভু আইয়ুব খানের নিজস্ব বাহিনীতে পরিণত হয়। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিকভাবে সরকারের আদর্শকে রক্ষা করা নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি নীতিমালার সকল বিরােধিতাকে দৈহিকভাবে মােকাবেলা করা। এনএসএফ এর সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক দোলন ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় আইয়ুব খানের পরিবর্তে বিরােধী দলীয় প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহ’কে সমর্থন করেন। তিনি ভূট্টোরও সমর্থক ছিলেন। ভূট্টোকে সংবর্ধনা দেওয়ার অপরাধে তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হলেও তা টেকে নি। পরে মাহবুবুল হক দোলনের সমর্থকরাই ১১ দফা আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ ও অংশগ্রহণ করে। এনএসএফের নেতারা ছিল গভর্ণর মােনায়েম খানের প্রিয় দুবৃত্ত। ১৯৬৮ সালের নভেম্বরের আগের মাসগুলােতে বামপন্থী সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের সঙ্গে এনএসএফের সংঘর্ষ লেগেই থাকত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. আবু মাহমুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযােগ এনে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। ১৯৬৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ড. মাহমুদ এই মামলায় জয়লাভ করেন। ঐ দিনই এনএসএফের গুন্ডারা হাইকোর্ট চত্বরে তাকে প্রহার করে আহত করে। এনএসএফ নেতা সাইদুর রহমানের কামরায় সাজানাে থাকত ছােরা, রিভলবার, রাইফেল ইত্যাদি। তার অন্যতম সহযােগী মাহবুবুর রহমান খােকা সাপ দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ভয় দেখাত। পরবর্তীতে খােকা নিহত হন এবং ১৯৭০ সালের ২০ ডিসেম্বর তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে তার লাশ পাওয়া যায়। তিনি এক সময় এনএসএস এর কেন্দ্রীয় কমিটির ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন। মৃত্যুর সময় তার বিরুদ্ধে রমনা থানায় মারামারি ও
হােটেলে নারী ধর্ষনের পাঁচটি মামলা ছিল।
৩৪ ড. ওসমান গনি (১৯১২ – ১৯৮৯) প্রথম ভারতীয় মুসলমান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন বিভাগ থেকে ১৯৩৫ সালে এমএসসি’তে প্রথম শ্রেণী অর্জন করেন। ১৯৩৮ সালে লন্ডন
পেজ-২৪
পরেই জমির আলী মঞ্চে উঠে উপাচার্যের হাত থেকে মাইক কেড়ে নেন এবং এ ঘটনার জন্য দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে মুসলিম লীগ সমর্থক উপাচার্য ঘােষণা করেন, ঘটনার তদন্ত হচ্ছে এবং এসএম হলের প্রভােষ্টকে তদন্ত করতে বলা হয়েছে। পূর্বাহ্নে এনএসএফ সদস্যরা সাইফুল্লাহ চৌধুরীর সভাপতিত্বে মধুর ক্যান্টিনে এক প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়। সভায় জমির আলী বলেন, বহিরাগত গুন্ডা ও তথাকথিত ছাত্র নামধারী দুস্কৃতিকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে একাধিকবার হামলা চালিয়েছে এবং নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় ছাত্রদের নিকট থেকে বলপূর্বক অর্থ, কাপড়চোপড়, জিনিষপত্র ছিনিয়ে নিয়েছে। সাইফুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা গােটা পূর্ব পাকিস্তানী ছাত্র সমাজ এর প্রতিবাদে আওয়াজ তুলবে।
ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এনএসএফের কর্মীরা মহসীন হল ও জিন্নাহ হলে (বর্তমানে সূর্যসেন হল) ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এই ঘটনার প্রতিবাদে ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সম্পাদক মন্ডলীর পক্ষে সহ-সভাপতি হায়দার আনােয়ার খান জুনাে ও দফতর সম্পাদক নুরুল হাসান এক বিবৃতিতে বলেন, “গত ১৪ অক্টোবর, সােমবার শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে বিশেষ একটি সংস্থার দুষ্কৃতিকারীরা তিনজন ছাত্রকে নির্দয়ভাবে প্রহার করেছে। তারাই গত ১৭ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার নিরীহ ছাত্রদের উপর বর্বর অত্যাচার করে। ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের মিলনায়তনে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে এবং এমন কি ছাত্রীদের উপরও হামলা চালায়। এই দৃস্কৃতিকারীরাই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নকে আক্রমণকারী অপবাদ দিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী, ছাত্র তথা সাধারণ ছাত্রদের উপর অমানুষিক অত্যাচার ও হলের অভ্যন্তরে গতানুগতিক পন্থায় আবাসিক ছাত্রদের বিছানা ও আসবাবপত্র লুট করে অরাজকতা অব্যাহত রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে মারামারি একটি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক ডজন গুণ্ডামী সংঘটিত হয়েছে কিন্তু এসব অবাঞ্চিত ঘটনার কোনােদিনই সুষ্ঠু তদন্ত অনুষ্ঠিত হয় নি। আমরা মনে করি, গত কয়েক দিনের ঘটনা কোনাে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আমরা আশা করি, শিক্ষার পবিত্র অঙ্গনকে কলুষিত করার ষড়যন্ত্রকে প্রতিরােধ করার জন্য ছাত্র সমাজ ও জনসাধারণ এগিয়ে আসবেন।”৩৫
================================================================
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি রসায়নে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। বিভিন্ন দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৬১ সালে কৃষি বিশ্বদ্যিালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে যােগ দেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষা ও মৃত্তিকা বিজ্ঞানে অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে ১৯৫৯ সালে সিতারা-এ-কায়েদে আজম এবং ১৯৬৪ সালে সিতারা-এপাকিস্তান খেতাবে ভূষিত করে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ সালের ২১ জুলাই তিনি ঢাকায় মারা যান। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ও বিএনপি নেতা
ড. ওসমান ফারুক তার সন্তানদের মধ্যে অন্যতম।
৩৫ দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ অক্টোবর, বুধবার, ১৯৬৮। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) এর
দপ্তর সম্পাদক নূরুল হাসান ছাত্র রাজনীতি শেষে কিছুদিন গােপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িত থাকেন। পরে প্রকাশ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন।
পেজ-২৫
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের (এসএমহল) ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ, এসএম হল ছাত্র সংসদের সহ সম্পাদক আহমদ রিয়াজুল করিম সহ কয়েকজনের নামে গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করলেও শেষ পর্যন্ত কাউকেই গ্রেফতার করতে পারে নি। পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে কর্তৃপক্ষ ২২ অক্টোবর, মঙ্গলবার, ১৯৬৮ অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘােষণা করে এবং ছাত্রছাত্রীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়। সাইদুর রহমানের আঘাত এত মারাত্মক হয়েছিল যে শেষ পর্যন্ত তিনি এই আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। সেদিনই এনএসএফ কেন্দ্রীয় সংসদের দফতর সম্পাদক, সুদর্শন সাইদুর রহমান (২৪) বেলা সাড়ে বারটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। সন্ধ্যায় বায়তুল মােকাররমে জানাজার পর দাফনের জন্য তার লাশ দেশের বাড়ি বরিশালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন এক বিবৃতিতে এনএসএফ নেতৃবৃন্দ ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের বিবৃতির প্রতিবাদ করেন। ২২ অক্টোবর, মঙ্গলবার, ১৯৬৮ রাতে সরকারি প্রেস নােটে বলা হয়, যে কোনাে মূল্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও শৃংখলা বজায় রাখা হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশকে বিনষ্ট করার জন্য দায়ী দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ২৩ অক্টোবর, বুধবার এক বিবৃতিতে ড. ওসমান গনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় এমন কিছু করা হলে কুচক্রীদের চক্রান্তই সফল হবে এবং দেশের অগ্রগতি হবে মারাত্মকভাবে ব্যাহত। একই দিনে সাইদুর রহমানের মৃত্যুতে শােক প্রকাশ করে বিবৃতি দেন এসএম হলের প্রভােস্ট ড. মফিজ উদ্দিন আহমদ, ডাকসু সম্পাদক নাজিম কামরান চৌধুরী, পাকিস্তান ছাত্র শক্তির সাধারণ সম্পাদক আখলাকুর রহমান প্রমুখ। এদিন ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত এনএসএফ কেন্দ্রীয় সংসদের সভায় ড. ওসমান গনির পদত্যাগ দাবি করা হয়। সাইফুল্লাহ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় বক্তৃতা করেন, মাহবুবুল হক দোলন, জাহাঙ্গীর ফয়েজ, আবু সুফিয়ান প্রমুখ।
সাংগঠনিকভাবে এ সময়ে আওয়ামী লীগ ছিল দ্বিধা বিভক্ত। এক অংশ পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি ঘােষণা করেছে, অপর অংশ নিজেদের শেখ মুজিবের অনুসারী ‘ছয় দফা পন্থী’ বলে দাবি করছে। ছয় দফা পন্থীরা একটি সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ থাকলেও আসন্ন নির্বাচন, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন প্রভৃতি প্রশ্নে তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ মতবিরােধ ছিল স্পষ্ট। ১৯ ও ২০ অক্টোবর, শনিবার-রবিবার, ১৯৬৮ ঢাকাস্থ হােটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত দু’দিন ব্যাপী দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে এই মতবিরােধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। অসুস্থতার কারণে ইত্তেফাক সম্পাদক তােফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া এই সম্মেলন উদ্বোধন করতে পারেন নি বলে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার উদ্বোধনী ভাষণ পড়ে শােনান। সাধারণ সম্পাদকের রিপাের্টে মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী তবে রাশিয়া বা চীনের নকল করে সমাজতন্ত্র কায়েম করবে না। আওয়ামী লীগ ব্যবস্থায় গণতন্ত্রও থাকতে হবে, সমাজতন্ত্রও কায়েম করতে হবে। সভাপতির ভাষণে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ৬ দফা সহ মূলনীতি বিসর্জন দিয়ে অথবা কাটছাট করে আওয়ামী লীগ কোনাে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে বিশ্বাস করে না। তিনি মন্তব্য করেন, ‘জনগণের দাবি আদায়ের জন্য অসহযােগ ও আইন অমান্য আন্দোলন সৃষ্টি করা যেতে পারে।’ কাউন্সিল অধিবেশনে চট্টগ্রামের মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী অভিযােগ করেন, বিভিন্ন ইস্যু নির্ণয়ের জন্য আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশন ডাকা হয় এবং
পেজ-২৬
মতদ্বৈধতার মুখে গোঁজামিল সিদ্ধান্তের দ্বারা প্রতিবার দলে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়েছে। এই সম্মেলনে নির্বাচনের প্রশ্নে মতবিরােধ দেখা দিলে মুখরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে একটি সম্প্রসারিত কমিটি গঠিত হয়। সরকারি নির্যাতনের কারণে অধিকাংশ কাউন্সিলর ও ডেলিগেট নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের দাবি জানান। এক সময় নির্বাচন সম্পর্কে তাড়াহুড়াে করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিরােধিতা করে বক্তৃতা করতে উঠলে কাউন্সিলররা মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরীর দিকে তেড়ে আসে। কাউন্সিলে সর্বশেষ মতবিরােধ দেখা দেয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদে নির্বাচনের প্রশ্নে। একদল প্রস্তাব করেন মিজানুর রহমান চৌধুরীর নাম, অন্যদল প্রস্তাব করেন মিসেস আমেনা বেগমের নাম। শেষ পর্যন্ত মিসেস আমেনা বেগমের নাম প্রত্যাহার করা হয়। নিম্মলিখিত ব্যক্তিদের নিয়ে সে সম্মেলনে আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়, সভাপতি – শেখ মুজিবুর রহমান, সহসভাপতি – সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলি, খন্দকার মােশতাক আহমাদ, সাধারণ সম্পাদক – তাজউদ্দীন আহমদ, সাংগঠনিক সম্পাদক – মিজানুর রহমান চৌধুরী, প্রচার সম্পাদক – আবদুল মান্নান, শ্রম সম্পাদক – জহুর আহমদ, কৃষি সম্পাদক – সােহরার হােসেন, অফিস সম্পাদক – মুহম্মদুল্লাহ, মহিলা সম্পাদিকা – মিসেস আমেনা বেগম, সমাজ সেবা সম্পাদক – ওবায়দুর রহমান, কোষাধ্যক্ষ – মুহিবুস সামাদ। কাউন্সিল অধিবেশন উপলক্ষে আওয়ামী লীগ ২০ অক্টোবর, রবিবার, ১৯৬৮ পল্টন ময়দানে একটি জনসভারও আয়ােজন করে। সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায়। বক্তৃতা করেন মিজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মালেক উকিল, নূরুল হক, রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া এবং সিন্ধুর (পশ্চিম পাকিস্তান) কাজী ফয়েজ। জনসভায় গৃহীত অন্যান্য প্রস্তাবের মধ্যে ১৯৬৯ সালে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের দাবিতে প্রস্তাব গৃহীত হয়।৩৬
নভেম্বরের প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তানে তেমন কোনাে উল্লেখযােগ্য ঘটনা ঘটে নি। তখন আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিবদমান গ্রুপগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা হলেও পিডিএমের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেয়ে মস্কোপন্থী ন্যাপের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারেই ছয় দফা পন্থীরা অনেক বেশি উৎসাহী ছিলেন। এ সময় মস্কোপন্থী ন্যাপ পরিচিত ছিল রিকুইজিশন পন্থী হিসেবে। অক্টোবরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে রিকুইজিশন ন্যাপের দুই নেতা – মহিউদ্দিন আহমদ ও পীর হাবিবুর রহমান বিশেষ আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। একক কর্মসূচী গ্রহণে অপারগ রিকুইজিশন ন্যাপ ১৭ নভেম্বর, রবিবার পল্টন ময়দানে এক জনসভার আয়ােজন করে। জনসভায় সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ এবং বক্তৃতা করেন মহিউদ্দিন আহমদ, দেওয়ান মাহবুব আলী, সৈয়দ আলতাফ হােসেন ও পীর হাবিবুর রহমান। এ সভায় পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরী বক্তৃতায় পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা নিয়ন্ত্রণে আশু ব্যবস্থার দাবি জানান। সভাপতির ভাষণে মােজাফফর আহমেদ গণদাবির ভিত্তিতে সকল বিরােধী দলের আশু ফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানান। তিনি বুদ্ধিজীবীদের রাজনৈতিক আন্দোলনে শরীক হওয়ার উপদেশ দেন।৩৭
==================================================================
৩৬ এই নেতৃবৃন্দের সংক্ষিপ্ত পরিচিতির জন্য পরিশিষ্ট – ঘ দেখুন।
৩৭ এদের মধ্যে অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ ব্যতীত আর প্রত্যেকে ইন্তেকাল করেছেন। মহিউদ্দিন
আহমদ আওয়ামী লীগে যােগদান করে ১৯৭৩ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর তিনি নতুন সরকারের পক্ষে ওকালতি করার জন্য মস্কো
পেজ-২৭
পরবর্তী পর্যায়ে রিকুইজিশন ন্যাপ ২৪ নভেম্বর, রবিবার, ১৯৬৮ প্রদেশব্যাপী প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। পার্টির পক্ষ থেকে বলা হয়, ওয়ালী খান, মাহমুদুল হক ওসমানী, জেড এ ভূট্টো সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার গ্রেফতার, ১৪৪ ধারা জারি ও গুলিবর্ষণের বিরুদ্ধে আহূত প্রতিবাদ দিবসে বায়তুল মােকাররমে গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হবে এবং জমায়েত শেষে মিছিল। এ গণজমায়েতে সভাপতিত্ব করেন রিকুইজিশন ন্যাপ ঢাকা শহর শাখার সভাপতি কাজী মােহাম্মদ ইদ্রিস। ন্যাপ সম্পাদক আলতাফ হােসেন তার বক্তৃতায় বলেন, গত দশ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের বহু রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করে জেলে আটক করা হয়েছে। তিনি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান। জমায়েতে বক্তৃতা করেন, অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ, মহিউদ্দিন আহমদ, নূরুর রহমান (প্রাক্তন মন্ত্রী), বেগম তাজউদ্দীন আহমদ, মােখলেসুজ্জামান এমএনএ ও পীর হাবিবুর রহমান। সভাশেষে একটি মিছিল পুরনাে ঢাকা পরিক্রম করে।
বন্যাদুর্গত এলাকা সফর শেষে ২৭ নভেম্বর, বুধবার, ১৯৬৮ মওলানা ভাসানী রংপুর থেকে ঢাকা এসে পৌছেন এবং পুনরায় ২৮ নভেম্বর সরিষাবাড়ি রওয়ানা হয়ে যান। ২৭ নভেম্বর, বুধবার, ১৯৬৮ সন্ধ্যায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সম্পর্কে আলােচনার জন্য মিজানুর রহমান চৌধুরী মওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করেন। আলােচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে ২৮ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার দৈনিক পাকিস্তানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে ভাসানীর যে আলাপ হয়েছে সে সম্পর্কে জানা গেছে যে, জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী জনসাধারণের দাবি দাওয়া আদায়ের প্রশ্নে গণ আন্দোলনের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি গ্রহণে তাঁর দল সম্মত আছে বলে জানিয়েছেন। নির্বাচনের ব্যাপারে কোনাে যুক্ত ফ্রন্ট গঠনে তাঁরা রাজি নন। আগামী পহেলা ডিসেম্বর ছয় দফা পন্থী আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলােচনা হবে। এই আলােচনার ফলাফল তারা মওলানা ভাসানীকে জানাবেন বলে জানিয়েছেন।”
পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ঢাকা হাইকোর্ট বার সমিতির সদস্যরা ২৯ নভেম্বর, শুক্রবার, ১৯৬৮ এক বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। পুরনাে হাইকোর্ট থেকে এই বিক্ষোভ মিছিল বের হয়ে সেগুন বাগিচা ও জিন্নাহ এভিনিউ (বর্তমানের বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) প্রদক্ষিণ করে বায়তুল মােকাররমে এসে শেষ হয়। মিছিল এগিয়ে চলার সময় পথের দু’পাশের লােকজন হাত তালি দিয়ে আইনজীবীদের অভিনন্দন জানান, পথচারীরাও শােভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। বিক্ষোভ মিছিলে অংশগ্রহণকারী আইনজীবীদের মধ্যে ছিলেন আতাউর রহমান খান, আবু হুসেন সরকার, ফজলুল কাদের চৌধুরী, চৌধুরী আজিজুল হক, আবদুস সালাম খান, তােফাজ্জল আলী, মওলভী ফরিদ আহমদ, আসাদুজ্জামান খান, আলীম আল রাজী, দেওয়ান মাহবুব আলী, এ কিউ এম শফিকুল ইসলাম, শওকত আলী খান ও মির্জা গােলাম হাফিজ।৩৮
================================================================
সফর করেন। ১৯৭২ সালে জুলফিকার আলী ভূট্টো পাকিস্তানে সরকার গঠন করলে মিয়া মাহমুদ
আলী কাসুরী মন্ত্রীসভায় যােগদান করেন। অবশ্য এর আগেই তিনি পিপলস পার্টিতে যােগ দেন।
৩৮ এদের কেউই এখন জীবিত নেই।
পেজ-২৮
এ পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানের সাংবাদিকরাও নিশ্চুপ ছিলেন না। ১ ডিসেম্বর, রবিবার, ১৯৬৮ ঢাকার সাংবাদিকরা রাজপথে নেমে আসেন। তারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার ও সাংবাদিক সহ রাজবন্দীদের মুক্তির জন্য শ্লোগান দেন। এর আগে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের (ইপিইউজে) সভাপতি শহীদুল্লাহ কায়সারের সভাপতিত্বে প্রেসক্লাবে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন, সংবাদপত্র প্রেস কর্মচারী এবং হকারদের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তৃতা করেন ইত্তেফাক সম্পাদক তােফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া), পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (পিএফইউজে) জেনারেল সেক্রেটারী মিনহাজ বার্ণা, প্রেস ক্লাব সভাপতি এ বি এম মুসা, ইপিইউজে’র জেনারেল সেক্রেটারী আতাউস সামাদ ও আলী আশরাফ। প্রতিবাদ সভায় মানিক মিয়া সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আদায়ে অবিরাম সংগ্রাম চালানাের জন্য সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, জনগণের সঙ্গে মৌলিক অধিকার আদায় ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ন্যায় তাদের সাধারণ স্বার্থ হাসিলে সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তিনি বলেন, এই দাবি আদায়ে সংবাদপত্রের সম্পাদকবৃন্দ ও মালিকগণ যদি এগিয়ে না আসেন তবুও সাংবাদিকদের এই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। পিএফইউজে’র জেনারেল সেক্রেটারী মিনহাজ বার্ণা বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করে সংবাদপত্র একান্তই অসহায়। প্রকৃত ঘটনা পরিবেশিত না হওয়ায় জাতীয় সংবাদপত্রগুলাে সেখানে জনগণের প্রকাশ্য সমালােচনার সম্মুখীন হয়েছে। সভায় গৃহীত বিভিন্ন প্রস্তাবে সংবাদপত্রের উপর সকল বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে নাগরিক অধিকার পুনঃ প্রতিষ্ঠা, দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক সাংবাদিকসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি এবং নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্তকরণের নির্দেশ প্রত্যাহারের দাবি জানানাে হয় এবং পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নিন্দা করা হয়। সভা পিএফইউজে’র প্রতি সমগ্র পাকিস্তানব্যাপী সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিবস পালনের আহ্বান জানায়।৩৯
============================================================
৩৯ সে সময় পাকিস্তানের বিভিন্ন ইউনিটে গঠিত সাংবাদিক ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত হত পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (পিএফইউজে)। এ বি এম মুসা ১৯৩১ সালে ফেনী জেলার কুতুবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৫৭-৭১ সময়ে পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ছিলেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনের ম্যানেজিং ডিরেকটর ও দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকার প্রশাসক-সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদক ও বাংলাদেশ প্রেস ইনসটিটিউটের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেটে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের দু’বার সভাপতি ও দু’বার সম্পাদক নির্বাচিত হন। জাতীয় প্রেসক্লাবের তিনবার সম্পাদক ও চারবার সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত। আতাউস সামাদ ১৯৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। ১৯৬৫-৬৯ সময়ে পাকিস্তান অবজারভার এ রিপাের্টার, ১৯৭২-৭৬ সময়ে নয়াদিল্লীতে বাসস এর বিশেষ সংবাদদাতা এবং ১৯৮২-৯৪ সময়ে বিবিসি’র বাংলাদেশ সংবাদদাতা ছিলেন। সাংবাদিকতার কারণে তিনি এরশাদ আমলে জেল খাটেন। বর্তমানে সাপ্তাহিক এখন এর সম্পাদক এবং বিভিন্ন পত্রিকার নিয়মিত কলাম লেখক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে আলী আশরাফ দৈনিক পাকিস্তানের চীফ রিপাের্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। স্বাধীনতার পর কিছুদিন সরকার নিয়ন্ত্রিত দৈনিক বাংলার প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে এই দায়িত্ব ছেড়ে ১৯৭৩ সালে প্রগতিশীল সাপ্তাহিক অভিমত প্রকাশ করেন।
পেজ-২৯
একই দিনে ঢাকায় আওয়ামী লীগ (৬ দফা পন্থী), পিডিএম পন্থী আওয়ামী লীগ ও পূর্ব পাকিস্তান পিডিএম কমিটির পৃথক পৃথক বৈঠক বসে। ৬ দফা পন্থী আওয়ামী লীগ বিরােধী দলের ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য নিম্নোক্ত ১৪ দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেঃ
• সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার
• সকল দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মুক্তি
• পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের ছাত্র ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দের মুক্তি
• সংবাদপত্র ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স বাতিল
• নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্তকরণের নির্দেশ প্রত্যাহার ও ইত্তেফাক প্রকাশের ব্যবস্থা
• বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্সসহ সকল কালাকানুন বাতিল
• সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অবিলম্বে খােলার ব্যবস্থা
• জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার
• পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন
• এক ইউনিট বাতিল ও পশ্চিম পাকিস্তানের সাবেক প্রদেশগুলাের পুনঃ প্রবর্তন
• মৌলিক অধিকার পুনঃ প্রবর্তন
• প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সকল পর্যায়ে প্রত্যক্ষ নির্বাচন
• জাতীয় ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ
• খাদ্য ও অন্যান্য নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যের মূল্যের উর্ধ্বগতি রােধ।৪০
ঐক্য আলােচনার জন্য আওয়ামী লীগ ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি সাব-কমিটি গঠন করে। এই কমিটির সদস্য হিসেবে মনােনীত হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মিজানুর রহমান চৌধুরী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, মােল্লা জালালউদ্দিন আহমদ ও আবদুল মান্নান। তাজউদ্দীন আহমদ এর ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকেই তাজউদ্দীন আহমদের স্থলে
=============================================================
নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস থেকে দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা টাইমস এবং সাপ্তাহিক পূর্বানী ছাপা হত। ছয় দফা আন্দোলনের সূত্রপাতের পরপরই সরকার এই প্রেস বাজেয়াফত করে এবং পত্রিকাগুলাের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। ১৯৬৬ সালের ১৭ জুন থেকে ১১ জুলাই এবং ১৯৬৬ সালের ২৭ জুলাই, বুধবার থেকে ১৯৬৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, সােমবার পর্যন্ত ইত্তেফাকের প্রকাশনা বন্ধ থাকে। দৈনিক ইত্তেফাক আওয়ামী লীগের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত ছিল। সরকার দেশরক্ষা আইনে ইত্তেফাক সম্পাদক তােফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া) কে ১৯৬৬ সালের ১৬ জুন, বৃহস্পতিবার, গ্রেফতার করে। তাঁর মূল অপরাধ ছিল ৭ জুন, মঙ্গলবারের হরতালের প্রতি সমর্থন। ১৯৪৯ সালের ১৫ আগস্ট, সােমবার মওলানা ভাসানী সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের প্রকাশনা শুরু করেন। ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার সম্পাদক, মুদ্রাকর এবং প্রকাশক হিসেবে তােফাজ্জল হােসেনের নাম
নিয়ে ইত্তেফাক দৈনিক হিসেবে প্রকাশিত হয়।
৪০ দৈনিক পাকিস্তান, ২ ডিসেম্বর, সােমবার, ১৯৬৮।
পেজ-৩০
মিজানুর রহমান চৌধুরী দলের অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বৈঠকে ১৩ ডিসেম্বর, শুক্রবার, ১৯৬৮ প্রদেশব্যাপী নির্যাতন প্রতিরােধ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
পিডিএম কার্যালয়ের ছাদে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সালাম খান সভাপতিত্ব করেন। পিডিএম ৫ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর ১৯৬৮ পর্যন্ত কাল পতাকা প্রদর্শন, পােস্টার, পথসভা, শান্তি পূর্ণ শােভাযাত্রা ও জনসভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ৬ ডিসেম্বর, শুক্রবার, ১৯৬৮ নির্যাতন থেকে দেশকে রক্ষার জন্য আল্লাহর কাছে মােনাজাত করারও কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়।
প্রায় আট মাস দেশরক্ষা আইনে আটক থাকার পর ২ ডিসেম্বর, সােমবার, ১৯৬৮ সন্ধ্যায় মুক্তি লাভ করেন আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি খন্দকার মােশতাক আহমাদ। এই সময় লাহােরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান মুসলিম লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির এক বিশেষ সভায় দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালােচনা করে নয়া চ্যালেঞ্জ মােকবেলায় কতিপয় কার্যক্রম গৃহীত হয়। সেদিন এক সাংবাদিক সম্মেলনে ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীগণ বর্তমান সরকারের গৃহভৃত্যে পরিণত হয়েছে।’৪১ দেশকে রক্ষা করার জন্য তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে নিম্নোক্ত ৯ দফা দাবি মেনে নেয়ার আবেদন জানানঃ
• জনগণের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া
• রাজনৈতিক নির্যাতনে যাতে নির্যাতিত না হতে হয় তার নিশ্চয়তা বিধান
• অবিলম্বে সকল রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি দান
• সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য সরকারি বিধিনিষেধ প্রত্যাহার
• অবিলম্বে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার
• দেশের অধিকাংশ লোক যাতে উপকৃত হয় এমন অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ
• দেশের সংহতি রক্ষার জন্য দেশরক্ষাসহ সশস্ত্র বিভাগের চাকুরীতে বিভিন্ন অঞ্চলের সংখ্যানুপাতিক সমান প্রতিনিধিত্ব
• বিশেষ ভৌগােলিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে স্বায়ত্বশাসনের অধিকার দান।
==================================================
৪১মুসলিম লীগ নেতা, চট্টগ্রামের সন্তান ফজলুল কাদের চৌধুরী (১৯১৯-১৯৭৩) ১৯৪১ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে মুসলিম লীগের টিকেটে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হন এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৩ সালে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন এবং সে বছরই পুনঃনির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদের স্পীকার নির্বাচিত হন। পুনরায় ১৯৬৫ সালে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হন কিন্তু দল বিরােধী কর্মকান্ডের অভিযােগে ১৯৬৬ সালে দল থেকে বহিষ্কার হন। আইয়ুব খানের বিদেশ সফরের সময় তিনি অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাক বাহিনীর সঙ্গে সহযােগিতার অভিযােগে তাকে বন্দী করা হয় এবং ১৯৭৩ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা কারাগারে তাঁর মৃত্যু ঘটে। তার জ্যেষ্ঠ সন্তান সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রাক্তন মন্ত্রী এবং বর্তমানে এমপি ও বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য।
পেজ-৩১
এ সব দাবি দাওয়া পেশ করতে গিয়ে ফজলুল কাদের চৌধুরী মন্তব্য করেন, ‘প্রেসিডেন্ট আইয়ুব দেশকে বর্তমান সংকট থেকে মুক্তি দিতে পারেন।’
এদিকে ১ ডিসেম্বর, রবিবার, ১৯৬৮ বিকেলে ৬ ডিসেম্বর, শুক্রবার অনুষ্ঠিতব্য জনসভার প্রচার চালানাের জন্য মওলানা ভাসানী গুলিস্থান বাস স্ট্যান্ড, জিন্নাহ এভিনিউর (বর্তমানের বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) ন্যাশনাল ব্যাংক (বর্তমানের সােনালী ব্যাংক) কর্ণার ও বায়তুল মােকররমের পথসভায় ভাষণ দেন। পথসভার জন্য একটি মিছিল বের হয় কাপ্তানবাজারস্থ ন্যাপ অফিস থেকে। মিছিলে অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন মশিউর রহমান, কৃষক সমিতির আবদুল হক এবং শ্রমিক ফেডারেশনের সিরাজুল হােসেন খান। পথসভায় মওলানা ভাসানী ৬ ডিসেম্বরের কর্মসূচী পালনে সহযােগিতার জন্য সকল বিরােধী দলের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও জনগণের সার্বভৌম অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। পথসভায় বের হওয়ার আগে মওলানা ভাসানী ন্যাপ কার্যালয়ে এক কর্মীসভায় ভাষণ দেন। সে তারিখে ঢাকার অটোরিক্সা চালকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। লাইসেন্স ও ভাড়ার প্রশ্নে বিরােধে পুলিশ অটোরিক্সা চালকদের মারধাের করে। বিক্ষুব্ধ অটোরিক্সা চালকরা পুলিশী নির্যাতনের প্রতিবাদে ২ ডিসেম্বর, সােমবার, ১৯৬৮ ধর্মঘট আহ্বান করে এবং ১ ডিসেম্বর, রবিবার বিকেলে মওলানা ভাসানীর বায়তুল মােকাররমের সভায় যােগদান করে। ভাসানী ন্যাপ ২ ডিসেম্বরের ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানায়। ভাসানী ন্যাপ, পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতি ও পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন ৬ ডিসেম্বর, শুক্রবার, ১৯৬৮ জুলুম বিরােধী দিবস পালনের জন্য যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করে। এ উপলক্ষে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হক বলেন, “কিছুদিন পূর্বে মিরপুর ও নরসিংদীতে এক মারামারিকে কেন্দ্র করে অসংখ্য ছাত্র ও কৃষক কর্মীর উপর গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করা হয়েছে। এই গ্রেফতারি পরওয়ানার সুযােগ নিয়ে সেখানকার সরকার সমর্থক কিছু সংখ্যক লােক পুলিশের সহযােগিতায় বাড়ি বাড়ি ঢুকে তল্লাশির নামে নানা রকম অত্যাচার করছে। থানা কর্তৃপক্ষ এই কর্মীদের অভিভাবকদের থানায় ডেকে এনে সমভাবে অপমান করছে। আমরা এই পুলিশী নির্যাতনের নিন্দা করছি এবং সাথে সাথে কর্মীদের গ্রেফতারি পরওয়ানা প্রত্যাহার করে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের শাস্তিদানের দাবি জানাচ্ছি।”
পিণ্ডি থেকে ৪ ডিসেম্বর, বুধবার, ১৯৬৮ ঢাকা পৌঁছে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলােচনাকালে কেন্দ্রীয় কৃষি ও পূর্তমন্ত্রী এ এইচ এম এস দোহা মন্তব্য করেন, বিরােধী দলীয় নেতৃবৃন্দ তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ছাত্র সমাজ ও জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। বিরােধী দলীয় নেতৃবৃন্দের ভূমিকার সমালােচনা করে তিনি বলেন, তাদের কার্যকলাপ আদৌ গঠনমূলক নয়। তাদের ভূমিকা সুস্থ ও গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য গড়ে তােলার পক্ষে সহায়ক নয়। ৫ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ সভাপতি নওয়াব খাজা হাসান আসকারী বলেন, যে কোনাে রাজনৈতিক পরিস্থিতি মােকাবেলা করার মতাে করে মুসলিম লীগকে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করা হচ্ছে। প্রতিটি রাজনৈতিক সমস্যাকে মুসলিম লীগ কর্মীগণ যাতে
পেজ-৩২
রাজনৈতিকভাবে মােকাবেলা করতে পারেন সেজন্য মুসলিম লীগ কর্মীদের বিশেষভাবে রাজনৈতিক শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।৪২ একই তারিখে প্রকাশিত আর একটি সাক্ষাৎকারে জাতীয় পরিষদে বিরােধী দলের নেতা ও এনডিএফ প্রধান নূরুল আমীন বলেন, তিনি গভীরভাবে বিরােধী দলগুলাের ঐক্য কামনা করেন। তবে বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে নিজে ঐক্য গঠনের উদ্যোগ নেবেন না। তিনি বলেন, অপরকেই উদ্যোগ নিতে হবে তবে তিনি সাধ্যমত সাহায্য করতে প্রস্তুত আছেন। তিনি বলেন, যে সকল দলের ঐক্য গঠন ও এক প্ল্যাটফরম তৈরির জন্য ইতিপূর্বে যথেষ্ট চেষ্টা চালিয়েছেন তা সম্পূর্ণ সফল হয় নি। তাই এখন আর তিনি কোনাে উদ্যোগ নেবেন না। তবে অন্যদের প্রচেষ্টায় সহযােগিতা করতে প্রস্তুত থাকবেন। এই সাক্ষাৎকারে নূরুল আমীন নির্বাচন সম্পর্কে কোনাে মন্তব্য করতে বিরত থাকেন।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন ৫ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার, ১৯৬৮। বিমানবন্দরে তিনি বলেন, “সাধারণ লােকের অবস্থার উন্নতিই তার দিন-রাতের চিন্তা। সাধারণ লােকের অবস্থা ভাল না হলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাই হবে মূল্যহীন। তাই সরকার পাকিস্তানকে একটি শক্তিশালী ও সম্মানজনক রাষ্ট্রে পরিণত করার কাজে সচেষ্ট রয়েছে।”৪৩ এর আগে, ১ ডিসেম্বর, রবিবার, ১৯৬৮ জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত নিয়মিত মাস পহেলা বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বলেন, ছাত্রদের অসুবিধা দূর করার জন্য তিনি নিম্নলিখিত নির্দেশগুলাে দিয়েছেনঃ
• ছাত্র ও শিক্ষকদের সত্যিকার অসুবিধা সমূহ দূর ও তাদের মনের সন্দেহ নিরসনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স সংশােধন করা
• ছাত্রদের ডিগ্রী বাতিলের ধারা বিলােপ করা
• তৃতীয় বিভাগে পাশ ছাত্রদের উচ্চতর ক্লাসে ভর্তির ব্যাপারে কোনাে বিধি নিষেধ না থাকা সম্ভব হলে অন্যান্য ছাত্রদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না করে তাদের অধিকতর সুযােগ দেওয়া, সাপ্লিমেন্টারী পরীক্ষা পুনঃপ্রবর্তন করা
• দ্বিতীয় বিভাগে পাশের নম্বর সারা দেশে এক হওয়া এবং তা হবে শতকরা ৪৫ ভাগ
• পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউটের বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতির বদলে সেমিস্টার পদ্ধতি
পুনরায় চালু করা।
প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, এসব ব্যবস্থা কার্যকর করার আগে একাডেমিক কাউন্সিলের
============================================================
৪২ দৈনিক পাকিস্তান, ২ ডিসেম্বর, সােমবার, ১৯৬৮।
ঢাকার নবাব পরিবারের সন্তান খাজা হাসান আসকারী (১৯২১ – ১৯৮৪) আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শেষে দীর্ঘদিন সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৮ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন কনভেনশন মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানে আস্তানা গাড়েন এবং এর পর নিজের বাসভূমে আর ফিরে আসেন নি। ১৯৮৪ সালের ৯ আগস্ট তিনি করাচীতে মারা যান।
৪৩দৈনিক পাকিস্তান, ৬ ডিসেম্বর, শুক্রবার, ১৯৬৮।
পেজ-৩৩
অনুমােদন নেওয়ার জন্য সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
আইয়ুবের ঢাকা অবস্থানের সময় ৬ ডিসেম্বর, শুক্রবার, ১৯৬৮ ভাসানী ন্যাপের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন মওলানা ভাসানী। বক্তৃতা করেন ন্যাপ সম্পাদক মােহাম্মদ তােয়াহা, শ্রমিক ফেডারেশনের সেক্রেটারী জেনারেল সিরাজুল হােসেন খান ও কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হক।৪৪ বক্তৃতায় মওলানা ভাসানী বলেন, জনগণের দাবিগুলি মেনে না নেওয়া হলে দেশব্যাপী তীব্র গণবিক্ষোভ দেখা দেবে। অত্যাচার, উৎপীড়নের মাধ্যমে জনগণকে কাবু করা যায় না। ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মারফতই জনগণের মন জয় করা যায়। পশ্চিম পাকিস্তানের ঘটনাবলীর উল্লেখ করে তিনি বলেন, অত্যন্ত পরিতাপের কথা এই যে, ভূট্টোকে সংবর্ধনা জানানাের অপরাধে ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণ করা হয়েছে। জনসভা শেষে এক বিরাট মিছিল গভর্ণর হাউজ (বর্তমানের বঙ্গভবন) ঘেরাও করে। এখানে পুলিশের সঙ্গে জনতার ইট পাটকেল বিনিময় হয়। পরে ইফতার বিরতির জন্য মিছিল বায়তুল মােকাররমের সামনে আসে। এ সময়ে ধর্মঘটী অটোরিক্সা ড্রাইভাররা ৭ ডিসেম্বর, শনিবার, ১৯৬৮ হরতাল ঘােষনার জন্য দাবি তােলে। জনসভায় মওলানা ভাসানী ঘােষণা করেছিলেন ১২ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার হরতালের কর্মসূচি। ইফতার শেষে বায়তুল মােকাররম থেকে বেরিয়ে এসে তিনি ঘােষণা করেন ৭ ডিসেম্বর, শনিবার পুলিশী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গােটা ঢাকা শহরে হরতাল পালিত হবে। এর পরই কয়েক হাজার লােক
=============================================================
৪৪ কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হক ১৯২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর যশাের জেলার খড়কী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স সহ বিএ ডিগ্রী এবং ছাত্রাবস্থায়ই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। তিনি ১৯৪৩-৪৪ সময়ে তেভাগা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে অনশনরত বন্দীদের ওপর গুলী চালালে তিনি মারাত্মক ভাবে আহত হন। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি সব সময় কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তার দল আত্মগােপন অবস্থায় দীর্ঘদিন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি নামে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনযুদ্ধ পরিচালনা করে। ১৯৭৮ সালে পার্টির নাম বদলে রাখা হয় বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। ১৯৯৫ সালের ২২ ডিসেম্বর আত্মগােপন অবস্থায় মৃত্যু পর্যন্ত তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
সিরাজুল হােসেন খান (১৯২৬-২০০৭) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৯ সালে ছাত্রাবস্থায় তিনি পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। পরে ১৯৫১ সালে পূর্ববঙ্গ সরকারের প্রচার বিভাগে যােগদান করেন এবং ১৯৬১ সালে এই পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকে নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের পর ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন গঠন করেন। তিনি ছিলেন এই দলের (জাগমুই) সাধারণ সম্পাদক। জীবনের দীর্ঘ সময় বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকলেও ১৯৮৫ সালের ৩ জুলাই, বুধবার এরশাদ সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
পেজ-৩৪
মিছিল নিয়ে বেরিয়ে যায় হরতালের কর্মসূচি ঘােষণার জন্য। ৭ ডিসেম্বর, শনিবার, ঢাকায় স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। হরতাল সফল করার জন্য অটোরিক্সা ড্রাইভাররা সর্বাত্মক সহযােগিতা করে। সরকারিভাবে হরতাল বিরােধী বিভিন্ন কর্মসূচীর অংশ হিসেবে পূর্বাহ্নে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। হরতালের দিন ভােরবেলা থেকেই শহরের পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। ভােরবেলা থেকেই বাস ও রিক্সা চলাচল বন্ধ থাকে। সকালে দু’একটি ‘ষ্টেটবাস’ চললেও, শেষ পর্যন্ত তা বন্ধ হয়ে যায়।৪৫ সকাল থেকেই জনগণ মারমুখী হয়ে ওঠেন। দশটার দিকে নিউ মার্কেট, পুরানা পল্টন, শান্তিনগর প্রভৃতি এলাকায় উত্তেজনা চরমে পৌঁছে। নীলক্ষেত এলাকায় অবস্থা আয়ত্বে আনার জন্য টহলদার পুলিশ গুলিবর্ষণে করলে পাকিস্তান ইলেকট্রনিক্স নামে একটি দোকানের বন্ধ দরজার ভেতরে কর্মরত কর্মচারী ইসহাক (২৮) ও ওয়াপদার কর্মচারী মজিদ (৩০) গুলিবিদ্ধ হন। দোকানের কপাট ভেদ করে গুলি ভেতরে ঢােকে। দুপুরে মজিদ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সন্ধ্যা পর্যন্ত সারা শহরে তুমুল উত্তেজনা বিরাজ করে, যত্রতত্র চলে জনতা-পুলিশ খন্ডযুদ্ধ। কিন্তু তখনও বােঝা যায় নি এ বিক্ষোভ পরবর্তীতে বিস্ফোরণের রূপ নেবে। সারা দিনের এই ঘটনার পর রাতে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির নৈশভােজে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বিরােধী দলের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের আশ্রয় গ্রহণে উসকানি দানের অভিযােগ উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে আশ্রয় গ্রহণের উসকানি জঘন্যতম অপরাধ। সে দিন সকালে রমনা গ্রীনে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক মুসলিম লীগের এক সাধারণ সভায় গৃহীত প্রস্তাবে জাতীয় স্বার্থে পরবর্তী কার্যকালে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের প্রতি অনুরােধ জানানাে হয়। এ অনুষ্ঠানে গভর্ণর মােনায়েম খান বলেন, “যদি রাজনীতিকদের একটি অংশ ধ্বংসাত্মক পথ গ্রহণ করেন, জাতীয় সম্পদ নষ্ট করেন, শান্তি ভঙ্গ করেন, শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের জীবনে বিশৃংখলার সৃষ্টি করেন, তা হলে কোনাে সরকারই নীরব দর্শক হিসেবে বসে থাকতে পারে না। সরকারকে এই আইন ও শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের চ্যালেঞ্জ মােকাবেলা করতে হবেই।”৪৬ হরতালের সময় গুলি বর্ষণের প্রতিবাদ করে বিবৃতি দেন বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব
==========================================================
৪৫ সে সময়ে পূর্ব পাকিস্তান সড়ক পরিবহন সংস্থা (ইপিআরটিসি) পরিচালিত যাত্রীবাহী বাস স্টেটবাস হিসেবে পরিচিত ছিল। এখন এসব বাস বিআরটিসি বাস হিসেবে রাস্তায় চলাচল করছে।
৪৬ দৈনিক পাকিস্তান, ৮ ডিসেম্বর, রবিবার, ১৯৬৮। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রী, ময়মনসিংহের সন্তান
মােনায়েম খান (১৮৯৯-১৯৭১) ১৯৬২ সালের ২৬ অক্টোবর, শুক্রবার পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর নিযুক্ত হন। এর আগে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাকিস্তান জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি পূর্ব পাকিস্তানে সাতটি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এলএমএফ ডাক্তারদের জন্য সংক্ষিপ্ত এমবিবিএস কোর্স চালু করেন। তার আমলেই পিজি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৯ সালে দ্বিতীয়বার সামরিক শাসন জারির আগে তাকে গভর্ণরের পদ থেকে সরিয়ে অর্থনীতিবিদ ডঃ এম এন হুদাকে (১৯১৯-১৯৯১) সে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ঘােষণা করা হয় মােনায়েম খানকে সউদী আরবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত করা হবে। বিরােধীদের দমন করতে সিদ্ধহস্ত মােনায়েম খান আইয়ুব খানের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৩ অক্টোবর মুক্তিযােদ্ধারা তাঁকে ঢাকার বনানীর বাসভবনে গুলি করে এবং হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।
পেজ-৩৫
মােরশেদ এবং সি আর আসলামের নেতৃত্বে ঢাকায় আগত পশ্চিম পাকিস্তানি ন্যাপ নেতৃবৃন্দ। ন্যাপের পক্ষ থেকে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন সি আর আসলাম, আহমদ হােসেন মান্টো, সরদার শওকত আলী ও বশির জাফর।
এ দিন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন চলাকালে ন্যাপ (ভাসানী) দলীয় সদস্য মশিউর রহমান পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা জানালে সরকার ও বিরােধী দলীয় সদস্যদের মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ বিতর্ক শুরু হয়। পরে বিরােধী দলীয় ও স্বতন্ত্র সদস্যরা পরিষদ অধিবেশন থেকে ওয়াক আউট করেন এবং মিছিল সহকারে নিহত মজিদকে দেখার জন্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। পরিষদের ঘটনা সম্পর্কে ৮ ডিসেম্বর, রবিবার, ১৯৬৮ দৈনিক পাকিস্তানে নিম্নোক্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়, “জনাব মশিউর রহমান অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ কষ্ঠে গুলীবর্ষণের কথা জানিয়ে পরিষদ নেতার নিকট হতে ঘটনা সম্পর্কে বিবৃতি দাবি করেন এবং অধিবেশন স্থগিত রাখার দাবি জানান। পরিষদের নেতা খান এ সবুর বলেন, সদস্যদের প্রাথমিক কর্তব্য হচ্ছে তাদের আইন পরিষদ সংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করা। গােলযােগের বিষয়টি আলােচনার উদ্দেশ্যে পরিষদের নিয়মিত কর্মসূচী মূলতবী রাখার জন্য বিরােধী দল যে প্রস্তাব দেন তার সাথে তিনি একমত নন বলে জানান। তিনি বলেন, পরিষদের বাইরে যদি কিছু ঘটে থাকে তাতে বিরােধী দলের নেতারা নিজেদেরকে তার থেকে দায়িত্ব মুক্ত বলতে পারেন না।”৪৭ এ মন্তব্যের জবাবে বিরােধী দলের নেতা নূরুল আমীন বলেন, “পরিষদের সদস্যদের যেমন আইন প্রনয়ণ সংক্রান্ত দায়িত্ব আছে, তেমনি আমরা বাইরে যা ঘটেছে তার প্রতি চক্ষু বন্ধ করে থাকতে পারি না। আমরা যারা পরিষদের সদস্য তারা ১১ কোটি জনগণের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র।” পরিষদ থেকে ওয়াকআউট করে নেতৃবৃন্দ হাসপাতালে যেতে চাইলে পিডিএম সেক্রেটারী জেনারেল এর বিরােধিতা করেন। তার যুক্তি ছিল, এর ফলে অবস্থার আরও অবনতি ঘটতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঐ বিরােধিতা কার্যকর হয় নি।
দৈনিক আজাদ, ৭ ডিসেম্বর, শনিবারের ঘটনা সম্পর্কে ৯ ডিসেম্বর, সােমবার, ১৯৬৮ আন্দোলন ও গণ-ঐক্য শীর্ষক এক সম্পাদকীয় কলামে মন্তব্য করেঃ
ঢাকার রাজপথ আবার রক্তস্নাত হইয়াছে। ১৯৬৬ সালের ৭ই জুনের পর ১৯৬৮ সালের ৭ই ডিসেম্বর আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে এই দুইটি তারিখ
=====================================================================
৪৭ খুলনার সন্তান, চিরকুমার, খান আবদুস সবুর (১৯০৮-১৯৮২) ১৯৩৩ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের পর ১৯৩৭ সালে কৃষক প্রজা পার্টিতে যােগদান করে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। দল বদলের পর ১৯৩৮ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থায় পাকিস্তান জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হন এবং কেন্দ্রীয় যােগযােগ মন্ত্রী নিযুক্ত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দালাল আইনে তাকে ১৯৭২ সালে গ্রেফতার করা হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষিত সাধারণ ক্ষমায় তিনি মুক্তি লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে মুসলিম লীগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার দান করা জায়গায় ঢাকায় ধানমন্ডীতে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ। তিনি ১৯৮২ সালের ২৫ জানুয়ারি পরলােক গমন করেন।
পেজ-৩৬
অভিন্ন সূত্রে গাঁথা হইয়া গেল। তবে এবারের এই আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য একটু আলাদা। এতদিন পূর্ব পাকিস্তানে যত আন্দোলন হইয়াছে, পশ্চিম পাকিস্তানে তার কোন ছায়াপাত ঘটে নাই। আবার পশ্চিমের আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান সাড়া দিয়াছে। শুধু সাড়া দেয় নাই, পশ্চিম পাকিস্তানের কিশাের আবদুল হামিদের রক্তের সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে পূর্ব পাকিস্তানের কিশাের যুবক আবদুল মজিদের রক্ত। এই রক্ত ঋণের রাখীবন্ধনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের গণমানুষের মধ্যে যে অটুট ঐক্য ও অভিন্ন ভ্রাতৃবােধ গড়িয়া উঠিতে চলিয়াছে, উহার সম্ভাবনায় আমরা গর্বিত। আজিকার অপরিসীম শোকের মধ্যে এখানেই আমাদের একমাত্র সান্ত্বনা। শাসক সম্প্রদায়ের সৃষ্ট সকল বিভেদের প্রাচীর ভাঙ্গিয়া, সকল অপপ্রচার ব্যর্থ করিয়া দিয়া এই বিশ, একুশ বৎসরের মধ্যে এই প্রথমবারের মতাে পাকিস্তানের উভয় অংশের গণমানুষ যে একই আন্দোলনের কাতারে সামিল হইতে পারিয়াছে, নির্ভয় প্রাণের পতাকা উড়াইতে পারিয়াছে, এখানেই এবারের আন্দোলনের সার্থকতা, এখানেই এবারের সংগ্রামের বিজয়।
আমরা বিশ্বাস করি, পাকিস্তানের উভয় অংশের গণমানুষ নিজেদের হৃত অধিকার আদায়ের জন্য যদি আজিকার মতাে ঐক্যবদ্ধ থাকিতে পারে, তাহা হইলে নিয়মতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্যে নিজেদের সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ ও জাগ্রত রাখার জন্য আমরা দেশবাসীকে অনুরােধ জানাই। উত্তেজনা সৃষ্টি বা হিংসাত্মক পথে পা বাড়াইয়া তারা যেন এই গণআন্দোলন দমনে শাসকদের জন্য অজুহাত সৃষ্টির সুযােগ তৈরী না করেন কিম্বা তাহাদের সৃষ্ট ফাঁদে পা না দেন। উত্তেজনা সৃষ্টি বা হিংসাত্মক পন্থা গ্রহণের জন্য প্ররােচনা দানের লােকের অভাব হইবে না। কিন্তু গত বিশ বছরের রাজনৈতিক আন্দোলন হইতে আমরা যদি কোন শিক্ষা গ্রহণ করিয়া থাকি, তাহা হইলে অবশ্যই আমাদিগকে সতর্ক ও সংযত হইতে হইবে। গণ ঐক্যের দুর্ব্বার তরঙ্গে প্রতিক্রিয়ার সকল বালির বাঁধ ধুইয়া মুছিয়া সাফ হইয়া যাইবে। কিন্তু এই তরঙ্গকে ক্ষ্যাপা বন্যা হইলে চলিবে না, তাহাকে সৃষ্টির পলিমাটি বহন করিয়া পাকিস্তানে একটি সুখী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নূতন ভিত্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অবিচল থাকিতে হইবে।
ঢাকায় গত ৭ই ডিসেম্বর তারিখে পুলিশের গুলীবর্ষণে আমরা মর্মাহত। আরাে মর্মাহত একাধিক অমূল্য প্রাণের অকাল বিয়ােগে। সরকারী প্রেসনােটে অবশ্য দাবী করা হইয়াছে, পুলিশ গুলীবর্ষণে বাধ্য হইয়াছিল। গুলীবর্ষণ করিবার মতাে পরিস্থিতি সৃষ্টি করিবার কাজ আসলে কাহারা করিয়াছেন তাহা আমরা জানি না। একমাত্র নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত দ্বারাই এই প্রশ্নের মীমাংসা হইতে পারে। কর্তৃপক্ষ এই ব্যাপারে অবিলম্বে বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা করুন ইহাই আমাদের দাবী এবং সেই সঙ্গে নিহতদের পরিবার পরিজনদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দানের প্রশ্নটিও বিবেচনা করার জন্য আমরা কর্তৃপক্ষকে অনুরােধ জানাইতেছি। সরকার দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের তৎপরতা আবিষ্কারের চাইতে বাস্তব সত্যকে স্বীকারের সৎসাহস প্রদর্শন করুন। অধিকার বর্জিত দেশে আজ অসন্তোষ জমাট বাধিয়া
পেজ-৩৭
উঠিয়াছে। সামান্য ঘর্ষণেই সৰ্ব্বত্র স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হইতেছে। এই স্ফুলিঙ্গ হইতে দাবানল সৃষ্টির আগেই সরকার দেশের মানুষের ইচ্ছা ও আকাঙ্খ উপলব্ধি করিতে তৎপর হউন। দমন নীতি দ্বারা সাময়িক সাফল্য অর্জিত হইতে পারে। কিন্তু সমস্যা সমাধানের উহা স্থায়ী ব্যবস্থা নয়।
সাত ডিসেম্বরের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী ১০ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের আহ্বান জানান। এছাড়া, ৮ ডিসেম্বর, রবিবারও ন্যাপের পক্ষ থেকে হরতাল পালনের আহ্বান জানানাে হয়। ৭ ডিসেম্বর, শনিবার সালাম খানের বাসভবনে দীর্ঘ সাড়ে ছয় ঘন্টা অধিবেশনের পর রাত সাড়ে বারােটায় অন্যান্য বিরােধী দলীয় নেতৃবৃন্দ ঐক্যবদ্ধভাবে ৮ ডিসেম্বর, রবিবার, হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হন। এ সম্পর্কে মতভেদের মূল কারণ ছিল নেতৃত্ব। এদের অভিমত ছিল, হরতালের আহবান জানালে তা ভাসানী ন্যাপের রাজনীতিরই সহায়তা করবে। এ সভায় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী, মস্কোপন্থী ন্যাপ ও ‘ড্যাক’ নেতৃবৃন্দ। আট ডিসেম্বরের হরতালের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ। বিবৃতিতে তারা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
ডিসেম্বরের পরবর্তী দিনগুলােতে পূর্ব পাকিস্তানের নিস্তরঙ্গ রাজনৈতিক জীবন প্রবাহে উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে। একদিকে বিভিন্ন স্থানে মাওলানা ভাসানীর ঘেরাও আন্দোলন, জাতীয় পরিষদে বিরােধী দলীয় সদস্যদের বিতর্ক, অন্যদিকে বিরােধী দলীয় রাজনীতিবিদদের ঐক্যমতে পৌছার চেষ্টা – সব মিলিয়ে এক বিস্ফোরােনুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ৯ ডিসেম্বর, সােমবার, ১৯৬৮ দিনাজপুরে এক জনসভায় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বলেন, ‘বিরােধী দলের বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ বন্ধ করতেই হবে। কেননা সরকার দেশকে বিভক্ত হতে দিতে পারে না।’
রাওয়ালপিণ্ডিতে একজন সাংবাদিকের উপর হামলার প্রতিবাদে ঢাকার সাংবাদিকরা ১১ ডিসেম্বর, বুধবার, ১৯৬৮ ধর্মঘট পালন করেন। ধর্মঘট উপলক্ষে শহীদুল্লাহ কায়সারের সভাপতিত্বে প্রেসক্লাবে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। একই তারিখের নাগরিক সম্বর্ধনায় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব পুনর্বার বলেন, ‘বিরােধী দল দেশে রক্তপাত ঘটাতে বদ্ধ পরিকর।’
প্রদেশব্যাপী ১২ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার, ১৯৬৮ হরতাল পালনের আহ্বান জানিয়ে ১১ ডিসেম্বর, বুধবার বিবৃতি দেন বিচারপতি মােরশেদ ও সে সময় ঢাকায় অবস্থানরত এয়ার মার্শাল আসগর খান। আরেকটি বিবৃতিতে ১৩ ডিসেম্বর, শুক্রবারের কর্মসূচি সফল করার আহ্বান জানান, ‘সংযুক্ত বিরােধী দলীয় সমন্বয় কমিটির পক্ষে মিজানুর রহমান চৌধুরী, সৈয়দ আলতাফ হােসেন ও এম এ সামাদ। অপরদিকে নুরুল আমীনের নেতৃত্বে ২০ জন পরিষদ সদস্য ১২ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার, হরতাল পালনের আহবান জানান। এ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন শাহ আজিজুর রহমান, ডক্টর আলীম আল রাজী, ইউসুফ আলী, মােহাম্মদ
পেজ-৩৮
কামরুজ্জামান, মশিউর রহমান, মুখলেসুজ্জামান খান, মিজানুর রহমান চৌধুরী, খান ফজলে রব চৌধুরী, এ এস এম সােলায়মান, হাসান এ শেখ, মাহমুদ আলী, আবুল কাশেম, আরিফ ইফতেখার, মুজিবর রহমান চৌধুরী, ফরিদ আহমদ, আমিনুল ইসলাম চৌধুরী, খাজা খয়ের উদ্দিন ও পীর মােহসেন উদ্দিন।৪৮ অপরদিকে ১৩ ডিসেম্বর, শুক্রবারের কর্মসূচীর প্রতি সমর্থন ঘােষণা করেন ১৭ জন মহিলা। এক যুক্ত বিবৃতিতে এঁরা ‘গণতন্ত্রের সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে অগ্রসর হওয়ার জন্য সকল বিরােধী দলের প্রতি আহ্বান জানান।’ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেনঃ খােদেজা চৌধুরী, সুফিয়া কামাল, জোহরা চৌধুরী, আমেনা বেগম, হুরমুতুন্নেসা, রেবেকা মহিউদ্দিন, আজিজা ইদ্রিস, বেগম জসীম উদ্দিন, খালেদা খানম, মিসেস শামসুন্নাহার, হােসনে আরা চৌধুরী, মমতাজ আকসাদ, সুলতানা চৌধুরী, মিসেস নবী, মিসেস মাহমুদ ও নিসাকত নাহার।৪৯
১২ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার, ১৯৬৮ হরতাল চলাকালীন সময়ে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। জুমার নামাজ শেষে বায়তুল মােকাররমে গায়েবানা জানাজা পড়তে গেলে ইপিআর মওলানা ভাসানীকে বাধা দেয়। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন আরিফ ইফতেখার সহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ। এয়ার মার্শাল আসগর খান নামাজ শেষে জনতার উদ্দেশ্যে বক্তৃতা শুরু করলে রায়ট কার এসে লাল পানি ছিটিয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে তােপখানা রােডে প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে পুলিশ আসগর খানের সেক্রেটারী কর্ণেল মােখতার হােসেনকে গ্রেফতার করে। এ দিন চট্টগ্রামে পুলিশ দু’জায়গায় গুলি বর্ষণ করলে ১২ জন আহত হয়। ঘটনা সম্পর্কে প্রেসনােটে বলা হয়, “চট্টগ্রামের কাছে ফৌজদারহাট রেলস্টেশনে সকাল সাড়ে ছ’টায় ক্ষিপ্ত জনতা খাদ্যশস্যবাহী একখানি মালগাড়ি আক্রমণ করে। স্টেশনে উপস্থিত রেল পুলিশ ট্রেনটিকে রক্ষা করার চেষ্টা করলে জনতা পুলিশকেও আক্রমণ করে। পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করায় আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি বর্ষণ করে। এখানে তিন ব্যক্তি আহত হয়। পাহাড়তলীতেও আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলী বর্ষণ করলে ৯ ব্যক্তি আহত হয়।”
=================================================================
৪৮ এই নেতৃবৃন্দের সংক্ষিপ্ত পরিচিতির জন্য পরিশিষ্ট – চ দেখুন।
৪৯এই মহিলাদের সবাই রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না, কিন্তু সামাজিকভাবে তাদের
অবস্থান ছিল প্রথম কাতারে। কবি সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯) পাকিস্তান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থক ছিলেন এবং বিভিন্ন সময়ে গণআন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন। মুত্যুর পর তাকে জননী সাহসিকা সম্বােধনে আখ্যায়িত করা হয়। আমেনা বেগম ছিলেন সে সময় আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। রেবেকা মহিউদ্দীন ছিলেন ন্যাপনেতা ও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন আহমদের স্ত্রী। আজিজা ইদ্রিস ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক কাজী মােহাম্মদ ইদ্রিসের স্ত্রী। বেগম জসিম উদ্দিন ছিলেন কবি জসিম উদ্দিনের সহধর্মিনী। মিসেস শামসুন নাহার ছিলেন রেবেকা মহিউদ্দিনের বােন। হােসনে আরা চৌধুরী (মাককি আপা হিসেবেও পরিচিত) মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের ট্রাস্টি আককু চৌধুরীর মা এবং রাজনৈতিক নেতা হায়দার আকবর খান রনাের শাশুড়ি। মমতাজ আকসাদ ছিলেন শান্তি কমিটির নেতা আলী আকসাদের স্ত্রী। মিসেস নবী বা বেলা নবী মহিলা আন্দোলনের নেত্রী ছিলেন। সমসাময়িক সময়ের অনেক মহিলা নেত্রী জীবিত নেই বলে এদের সম্পর্কে বিস্তৃত তথ্য সংগ্রহ করা যায় নি।
পেজ-৩৯
ভাসানী ন্যাপের পক্ষ থেকে মশিউর রহমান ১৪ ডিসেম্বর, শনিবার, ১৯৬৮ ঘােষণা করেন, ২৯ ডিসেম্বর, রবিবার, ১৯৬৮ থেকে মওলানা ভাসানী ঘেরাও আন্দোলন শুরু করবেন। তিনি বলেন, ন্যাপ কর্মীরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে থানা, মহকুমা এবং ডিসিদের অফিস ঘেরাও করে তাদের দাবি দাওয়া পেশ করবে। এই আন্দোলনে থাকবে শ্রমিক, কৃষক এবং সাধারণ মানুষ। ঘেরাও আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে ২৯ ডিসেম্বর রবিবার মওলানা ভাসানী পাবনা টাউন হল ময়দানে আয়ােজিত জনসভায় বলেন, তাঁর দল আগামী সাধারণ নির্বাচন বর্জন করবে এবং ভূট্টো, এয়ার মার্শাল আসগর খান, এস এম মােরশেদ অথবা বিরােধী দলের অন্য যে কোনাে নেতার নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিরােধিতা করবে। মওলানা বলেন, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য নয়, বরং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এক বিরাট গণ আন্দোলন গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে তিনি সকল বিরােধী দলের ঐক্য কামনা করেন। মওলানা ভাসানী দাবি করেন, নৌ বাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করতে হবে। এ জনসভায় সভাপতিত্ব করেন পাবনা জেলা ন্যাপের সভাপতি মীর্জা আবদুল আউয়াল। বক্তৃতা করেন পাবনা জেলা ন্যাপের সেক্রেটারী আবদুল মতিন ও কৃষক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক আলাউদ্দিন আহমদ।৫০ সভা শেষে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এক বিরাট জঙ্গী মিছিল পাবনার ডেপুটি কমিশনারের বাড়ি ঘেরাও করে। এর মাধ্যমেই সূত্রপাত ঘটে ঘেরাও আন্দোলনের। ২৯ তারিখে মওলানা ভাসানী যখন পাবনায় ঘেরাও আন্দোলনের সূত্রপাত করেন তখন সে আন্দোলন শুধু পাবনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। একই তারিখে ঢাকা জেলার নরসিংদী থানার হাতিরদিয়ায় ঘেরাও আন্দোলনের সূত্রপাত করেন ১১ দফা আন্দোলনের শহীদ আসাদুজ্জামান। ছাত্রজীবন শেষে আসাদুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগে ভর্তি হলেও তৎকালীন রাজনীতির গতিধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে কৃষক সংগঠন গড়ে তােলার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। স্বল্প সময়ে হাতিরদিয়ায় শক্তিশালী কৃষক ঘাঁটি গড়ে তােলেন আসাদ। ঘেরাও’র দিনে আসাদের নেতৃত্বে কৃষকরা সার্কেল অফিসারের অফিস ঘেরাও করলে পুলিশ গুলি বর্ষণ করে।৫১ ঘটনা সম্পর্কে সরকারি
==========================================================
৫০ মীর্জা আবদুল আউয়াল ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত
হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বিএনপিতে যােগ দেন এবং ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর পাবনায় এক জনসভার মঞ্চে হৃদরােগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আবদুল মতিন (বর্তমানে ভাষা সৈনিক হিসেবে সমধিক পরিচিত) এবং আলাউদ্দিন আহমদ যৌথভাবে কৃষির চরিত্র ধনতান্ত্রিক তত্ব উপস্থাপন করে প্রচুর বিতর্কের অবতারণা করেন। পিকিংপন্থীদের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাসে, শ্রীমঙ্গলের এক চা বাগানে। এই কংগ্রেসে তিনটি রাজনৈতিক ধারা সামনে আসে। এক অংশের নেতৃত্ব দেন হক-তােয়াহা, অন্য অংশের নেতৃত্ব দেন মতিন-আলাউদ্দিন এবং শেষােক্তটির নেতৃত্ব দেন দেবেন শিকদার (নানা নামে অধিক পরিচিত) এবং শ্রমিক নেতা আবুল বাশার। ১৯৬৮ সালে হক-তােয়াহা’র নেতৃত্বাধীন কমরেডরা অন্যদের পার্টি থেকে বহিষ্কার করেন। মতিন-আলাউদ্দিন অংশ
১৯৬৯ সালে তাদের তত্ত্ব সংশােধন করে জাতীয় চরিত্র নির্ধারণ করেন আধা-ঔপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক।
৫১ ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানে প্রবর্তিত ‘মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার অধীনে ১৯৬১ সালে গ্রামীণ অঞ্চলে সার্কেল ব্যবস্থা প্রবর্তনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। থানা পর্যায়ে থানা পরিষদ নামে একটি স্থানীয়
পেজ-৪০
প্রেসনােটে বলা হয়ঃ
“২৯ ডিসেম্বর ঢাকা জেলার মনােহরদী থানাতে হাতিরদিয়া বাজারে বিকেল বেলা স্বাভাবিক বেচাকেনা চলতে থাকাকালে ছাত্রসহ কিছু লােক বাজারে আসে এবং বলপূর্বক দোকান পাট বন্ধ করে দিতে চেষ্টা করে। তারা বাজারে পাট ও অন্যান্য মালামাল বয়ে আনা গরুর গাড়িগুলােও আক্রমণ করে। সেখানে উপস্থিত একদল পুলিশ এতে বাধা দেয় এবং দোকান ও ব্যবসার কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করার জন্য তাদের অনুরােধ করে। তারা পুলিশের অনুরােধে কর্ণপাত না করলে গােলমাল থামানাের জন্য পুলিশ ৪ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের রমিজউদ্দিন ব্যাপারীর দোকান কাম গুদামে নিয়ে আটক করা হয়। অচিরেই ছাত্রসহ দু’শ লােকের এক জনতা উক্ত দোকান আক্রমণ করে এবং দোকানের প্রভূত ক্ষতি সাধন করে। এমনকি তারা দোকানে অগ্নি সংযােগের চেষ্টা করে এবং দোকানের মধ্যে অবস্থানকারী পুলিশের উপর ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে তিন জন পুলিশ আহত হয়। এরপর তারা দোকান ভেঙ্গে ঢুকে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের পুলিশের হেফাজত থেকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। নিজেদের সম্পূর্ণ পরাভূত দেখতে পেয়ে আত্মরক্ষার্থে এবং গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের নিজেদের হেফাজতে রাখার জন্য পুলিশ গুলী বর্ষণ করে। গুলী বর্ষণের ফলে ৩ ব্যক্তি নিহত হয় এবং অপর একজন আহত হয়।”
এ ঘটনার প্রতিবাদে এক বিবৃতিতে ভাসানী ন্যাপের সাতজন নেতা মওলানা ভাসানীর আহ্বানে দমননীতি ও খাজনা ট্যাক্সের অত্যাচারের প্রতিবাদে এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের দাবিতে কৃষক-জনতার সমাবেশে পুলিশের গুলি বর্ষণের নিন্দা করেন। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন, হাজী মােহাম্মদ দানেশ (সহ-সভাপতি), সাঈদুল হাসান (কোষাধ্যক্ষ) ও কার্য নির্বাহী সংসদের সদস্য আবদুল জলিল, মােহাম্মদ সুলতান, কামরুল ইসলাম, আবদুল করিম এবং ঢাকা জেলা ন্যাপ সভাপতি আবদুর রশীদ।৫২
=======================================================
পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা রাখা হয়। একটি সরকারি আদেশ বলে পূর্ব পাকিস্তানে ৪১৩টি সার্কেল সৃষ্টি করা হয়। সে সময়ে একজন সার্কেল অফিসার নিয়ােগ দেওয়া হয়। তাকে থানা পরিষদের ভাইস চেয়াম্যান করা হয়। ১৯৬১ সালের পর প্রতিটি থানায় রাজস্ব সার্কেল অফিসার নামে একটি আলাদা পদ সৃষ্টি করা হয়। তারা সাধারণত সি.ও (রাজস্ব) হিসেবে পরিচিত ছিলেন। শুধু রাজস্ব বিষয়ে তাদের কার্যক্রম সীমিত ছিল। এ ক্ষমতাবলে তারা তহশিলদারদের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের অধিকারী ছিলেন। ১৯৭৭ সাল বা এর কাছাকাছি সময়ে সার্কেল অফিসারদের পদমর্যাদা উন্নীত করে নতুনভাবে তাদের সহকারি কমিশনার নামকরণ করা হয়। ১৯৮৪ সালে উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর একজন নির্বাচিত চেয়ারম্যানের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসার’ পদ চালু করার সঙ্গে সঙ্গে সার্কেল ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটে।
৫২ কৃষক নেতা ও বাম রাজনীতিবিদ হাজী মােহাম্মদ দানেশ দিনাজপুর জেলার সুলতানপুর গ্রামে ১৯০০
সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩১ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ এবং ১৯৩২ সালে বিএল ডিগ্রী লাভের পর দিনাজপুরে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৩৮ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্গ সংগঠন কৃষক সমিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯৪৫ সালে মুসলিম লীগে যােগ দেন কিন্তু তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন। হাজী দানেশ ১৯৫২ সালে গণতন্ত্রী দল নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তিনি ১৯৫৪
পেজ-৪১
অপরদিকে ২৯ ডিসেম্বর, রবিবার, ১৯৬৮ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউটে অনুষ্ঠিত সভায় কাউন্সিল মুসলিম লীগ নির্বাচন সম্পর্কে কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হয়। নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এ সভায় বিশেষভাবে যােগদান করেন মিয়া মমতাজ দৌলতানা। কিন্তু সদস্যদের মনােভাব দেখে এবং দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে তিনি ঘােষণা করতে বাধ্য হন – নির্বাচনে অংশগ্রহণের ন্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সম্পর্কে এ মুহূর্তে এককভাবে কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কাউন্সিল মুসলিম লীগের পক্ষে উচিত হবে না। অন্যান্য গণতান্ত্রিক সংগঠন বিশেষ করে পিডিএমের অন্য দলগুলাের সঙ্গে আলােচনার পর কোনাে ঐক্যমতে উপস্থিত হয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। এ বৈঠকে মুসলিম লীগের কর্মীরা অভিযােগ করেন, পার্টির কর্মকর্তারা কর্মীদের সঙ্গে যথাযথ যােগাযােগ রক্ষা করতে পারছেন না।
=======================================================
সালে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে দিনাজপুর থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দেওয়ার পর তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৫৬ সালে মুক্তি লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে
মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যােগ দেন এবং সহ সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের পর তাকে আবার জেলে যেতে হয়। ১৯৬৪ সালে ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে ন্যাপ থেকে পদত্যাগ করে তিনি
মুজিবনগরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি বাকশালে যােগ দেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন। বাকশাল এর পতনের পর ১৯৭৬ সালে ১৯৭৩ সালে গঠিত জাগমুই পুনরুজ্জীবিত করেন। ১৯৮০ সালে এই দল বিলােপ করে গণতান্ত্রিক পার্টি নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। ১৯৮৬ সালে তার এই দল এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গে একীভূত হয় এবং তিনি জাতীয় কৃষক পার্টির প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। ১৯৮৬ সালের ২৮ জুন তিনি ইন্তেকাল করেন।
পেজ-৪২
পূর্ব পাকিস্তান, জানুয়ারি-মার্চ ১৯৬৯
আমি মুক্তিদাতা নই, মুক্তিদাতা বলে কিছু নেই। জনগণ নিজেরাই নিজেদের মুক্ত করে।
চে গুয়েভারা (১৯২৮-৬৭)
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ), এই তিনিটি ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি, শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ডাকসু কার্যালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলন আহ্বান করেন।৫৩ সেদিন ছাত্রদের সাংবাদিক সম্মেলনেকে কেউ গুরুত্ব দেন নি। অনেকে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ছাত্রদের আবার সাংবাদিক সম্মেলন।’
সাংবাদিক সম্মেলন ছাত্র নেতৃবৃন্দ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা কল্পে নিম্নোক্ত কর্মসূচি পেশ করেনঃ
স্বৈরাচারী সরকারের দীর্ঘদিনের অনুসৃত জনস্বার্থ বিরােধী নীতির ফলেই ছাত্র সমাজ
ও দেশবাসীর জীবনে সংকট ক্রমশ বৃদ্ধি পাইয়া চলিয়াছে। শাসনে, শােষণে অতিষ্ঠ হইয়া ছাত্র জনতা ছাত্র গণ আন্দোলনের পথে আগাইয়া আসিয়াছেন। কিন্তু এই অবস্থায় সরকার বিরােধী রাজনৈতিক সংগঠন সমূহ ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের দিকে আগাইয়া আসিতেছে না। সম্প্রতি দুই একটি দিবস ঐক্যবদ্ধভাবে পালন করা হইলেও কর্মসূচী ভিত্তিক কোন ঐক্যফ্রন্ট গড়িয়া উঠিতেছে না। আমরা ছাত্রসমাজ ও দেশবাসীর স্বার্থে নিম্নোক্ত দাবী সমূহের ভিত্তিতে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করিয়া ব্যাপক গণ আন্দোলনের পথে আগাইয়া আসিবার জন্য সকল সরকার বিরােধী রাজনৈতিক দল সমূহের প্রতি আহ্বান জানাইতেছি।
১। (ক) স্বচ্ছল কলেজগুলিকে প্রাদেশিকীকরণের নীতি পরিত্যাগ করিতে হইবে
এবং ইতিমধ্যে যে সব কলেজ প্রাদেশিকীকরণ করা হইয়াছে সেগুলিকে পূর্বাবস্থায় ফিরাইয়া আনিতে হইবে। তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ ছাত্রদের উচ্চ ক্লাসে
====================================================================
৫৩দৈনিক আজাদ, ৫ জানুয়ারি, রবিবার, ১৯৬৯। এই সাংবাদিক সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদদাতা হিসেবে বর্তমান লেখক এবং দৈনিক আজাদের স্টাফ রিপাের্টার, পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সেক্রেটারী, আমিনুল হক বাদশা উপস্থিত ছিলেন। তিনি বর্তমানে লন্ডনে প্রবাসী । প্রবীণ রাজনীতিবিদ অলি আহাদ তাঁর জাতীয় রাজনীতি, ১৯৪৫ থেকে ৭৫ বইতে লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক এনএসএফের নেতা নাজিম কামরান চৌধুরী এগার দফা কর্মসূচীর অন্যতম প্রণেতা ছিলেন। বিষয়টি তথ্যগতভাবে সঠিক নয় বলে তৎকালীন ছাত্র নেতাদের প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন।
পেজ-৪৩
ভর্তি বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল করিতে হইবে। কারিগরি, প্রকৌশল, চিকিৎসা ও কৃষি ছাত্রদের দাবী মানিতে হইবে, ছাত্র বেতন কমাইতে হইবে, নারী শিক্ষার প্রসার করিতে হইবে এবং শিক্ষা সংকোচন নীতি পরিহার করিয়া শিক্ষার ব্যাপক প্রসার করিতে হইবে।
(খ) কুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় কালাকানুন সম্পূর্ণ বাতিল করিতে হইবে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন প্রদান করিতে হইবে।
(গ) শাসক গােষ্ঠীর শিক্ষা সংকোচন নীতির প্রামান্য দলিল ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপাের্ট’ ও ‘হামুদুর রহমান কমিশন রিপাের্ট’ বাতিল করিতে হইবে এবং ছাত্রসমাজের ও দেশবাসীর স্বার্থে গণমুখী ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করিতে হইবে।৫৪
২। প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিতে হইবে। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করিতে হইবে।
৩। নিম্নলিখিত দাবী সমূহ মানিয়া লইবার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ
স্বায়ত্বশাসন দিতে হইবেঃ
(ক) দেশে শাসনতান্ত্রিক কাঠামাে হইবে ফেডারেল শাসন ভিত্তিক রাষ্ট্র সংঘ এবং আইন পরিষদের ক্ষমতা হইবে সার্বভৌম।
(খ) ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা এই কয়টি বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকিবে। অপরাপর সকল বিষয়ে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা হইবে নিরঙ্কুশ।
(গ) দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকিবে। এই ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে
থাকিবে। কিন্তু এই অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যাহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতে না পারে। এই বিধানে পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে, দুই অঞ্চলে দুইটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক অর্থনীতি প্রবর্তন করিতে হইবে।
(ঘ) সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, কর ধার্য ও আদায়ের সকল ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের কোন কর ধার্য করিবার
==================================================================
৫৪অনেকেই ১৯৬২ সালের শরীফ কমিশন বিরােধী আন্দোলনকে ১৯৬৪ সালের হামুদুর রহমান কমিশন বিরােধী আন্দোলনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। ১৯৬২ সালে আন্দোলনের মুখে শরীফ কমিশনের রিপাের্টের বাস্তবায়ন স্থগিত ঘােষণা করা হয় এবং এ পটভূমিতে ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি, এক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর (নভেম্বর ১৯৫৮-ডিসেম্বর ১৯৬০), হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে কমিশন অন স্টুডেন্টস প্রবলেমস এন্ড ওয়েলফেয়ার গঠিত হয়।
পেজ-৪৪
ক্ষমতা থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভেনিউর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সাথে সাথে ফেডারেল তহবিলে জমা হইবে। এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাংক সমূহের উপর পরীক্ষামূলক বিধান শাসনতন্ত্রে থাকিবে।
(ঙ) ফেডারেশনের প্রতিটি রাষ্ট্রের বহির্বাণিজ্যের পৃথক হিসাব রক্ষা করিতে হইবে এবং বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত মুদ্রা অঙ্গরাষ্ট্রগুলির এখতিয়ারধীন থাকিবে। ফেডারেল সরকারের প্রয়ােজনীয় বিদেশী মুদ্রা অঙ্গরাষ্ট্রগুলি সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রের নির্ধারিত হার অনুযায়ী প্রদান করিবে। দেশজাত দ্রব্যাদির বিনা শুল্কে অঙ্গরাষ্ট্রগুলির মধ্যে আমদানী রফতানি চলিবে এবং ব্যবসা বণিজ্য সম্পর্কে বিদেশী রাষ্ট্রগুলির সাথে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানী রফতানী করিবার অধিকার অঙ্গরাষ্ট্রগুলির হাতে ন্যস্ত করিয়া শাসনতন্ত্রে বিধান করিতে হইবে।
(চ) পূর্ব পাকিস্তানকে মিলিশিয়া বা প্যারা-মিলিটারী রক্ষীবাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা নির্মাণ ও নৌ বাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপন করিতে হইবে।
৪। পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধুসহ সকল প্রদেশের স্বায়ত্বশাসন প্রদান করতঃ সাব ফেডারেশন গঠন করিতে হইবে।
৫। ব্যাংক, বীমা, ইনসুরেন্স ও বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ করিতে হইবে।
৬। কৃষকের উপর হইতে খাজনা ও ট্যাক্সের হার হ্রাস করিতে হইবে এবং বকেয়া খাজনা ও ঋণ মওকুফ করিতে হইবে। সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল ও তহসিলদারদের অত্যাচার বন্ধ করিতে হইবে। পাটের সর্বনিম্ন মূল্য মন প্রতি চল্লিশ (৪০) টাকা নির্ধারণ এবং আখের ন্যায্য মূল্য দিতে হইবে।
৭। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরী ও বােনাস দিতে হইবে এবং শিক্ষা বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদির ব্যবস্থা করিতে হইবে। শ্রমিক স্বার্থ বিরােধী কালাকানুন প্রত্যাহার করিতে হইবে এবং ধর্মঘটের অধিকার ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রদান করিতে হইবে।
৮। পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জল সম্পদের সার্বিক ব্যবহারের ব্যবস্থা
করিতে হইবে।
৯। জরুরী আইন প্রত্যাহার, নিরাপত্তা আইন ও অন্যান্য আইন প্রত্যাহার করিতে
হইবে।
১০। সিয়েটো, সেন্টো, পাক মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল করিয়া জোট বহির্ভূত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি কায়েম করিতে হইবে।
১১। দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক সকল ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, রাজনৈতিক কর্মী
ও নেতৃবৃন্দের অবিলম্বে মুক্তি, প্রেফতারী পরােয়ানা ও হুলিয়া প্রত্যাহার এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সহ সকল রাজনৈতিক কারণে জারীকৃত মামলা প্রত্যাহার করিতে হইবে।”৫৫
========================================================= ৫৫ সিয়েটো, সেন্টো, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ছয় দফা সম্পর্কে বিস্তৃত তথ্যের জন্য পরিশিষ্ট – ছ দেখুন।
পেজ-৪৫
সাংবাদিক সম্মেলনের এই বিবৃতিতে সই করেন, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) এর পক্ষে নূর মােহাম্মদ খান, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এর পক্ষে আবদুর রউফ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) এর পক্ষে সামসুদ্দোহা।৫৬ সাংবাদিক সম্মেলনে প্রচারিত বিজ্ঞপ্তিতে বিভিন্ন কারণে সকল ছাত্রনেতার স্বাক্ষর না থাকলেও তখন ছাত্র সংগঠনগুলাের নেতৃত্বে ছিলেন, আবদুর রউফ, সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, খালেদ মােহাম্মদ আলী, সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, মােস্তফা জামাল হায়দার, সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ), মাহবুব উল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ), সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক, সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ), মাে: শামসুদ্দোহা, সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ)। মামলার কারণে আত্মগােপন অবস্থায় ছিলেন সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক ও মাহবুব উল্লাহ। এছাড়া, ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ সভাপতি, ছাত্রলীগের তােফায়েল আহমেদ এবং ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের নাজিম কামরান চৌধুরী।৫৭
এর আগে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর বিশ্ববিদ্যালয় খােলার তারিখ ১ জানুয়ারি, বুধবার, ১৯৬৯ ছাত্র নেতৃবৃন্দ বটতলায় এক সভা আহ্বান করেন। সভা আহবানের বিবৃতিতে সই করেন ডাকসু সহ সভাপতি তােফায়েল আহমদ, সাধারণ সম্পাদক নাজিম কামরান চৌধুরী, পুর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) এর সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক ও সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দোহা, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুর রউফ ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ মােহাম্মদ আলী এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) এর সভাপতি মােস্তফা জামাল হায়দার। বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘সম্প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলনের পথে অগ্রসর হয়েছে। সরকারের শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানেও ছাত্রসমাজ দীর্ঘ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সরকার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্রসমাজের ন্যায়সংগত দাবি দাওয়াকে নস্যাৎ করার জন্য আমানুষিক দমননীতির আশ্রয় গ্রহণ করেছে। এমন কি ছাত্র গণহত্যা, নির্বিচারে গ্রেফতার, রাজনৈতিক মামলা দায়ের, লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার, গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে চলেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, লাহাের, করাচী, পিন্ডি সর্বত্র আজ ১৪৪ ধারা কবলিত। এই অবস্থার প্রতিবাদে ১ জানুয়ারি বটতলায় ছাত্র সভা আহ্বান করা হয়েছে।’ এই সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করার পক্ষে বিপক্ষে বিতর্ক হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হয় নি বরং ছাত্ররা বটতলা থেকেই পুলিশের উদ্দেশ্যে ইট পাটকেল নিক্ষেপ এবং কলাভবনে মিছিল করে।
===========================================================
৫৬ প্রতিলিপি দ্রষ্টব্য। সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত থাকার কারণে লেখকের কাছে একটি কপি সংরক্ষিত
আছে।
৫৭ ছাত্রনেতাদের জীবন বৃত্তান্তের জন্য পরিশিষ্ট – জ দেখুন। তখন ডাকসুতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা ছিল না। প্রত্যেকটি হল থেকে ডাকসুর জন্য প্রতিনিধি নির্বাচিত হতেন এবং তাদের মধ্য থেকে পর্যায়ক্রমে সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হতেন।
পেজ-৪৬
এগার দফা কর্মসূচি প্রণয়নে ছাত্র সংগঠনগুলিকে বেশ বেগ পেতে হয়। ১৯৬৮ সালে মওলানা ভাসানীর ঘেরাও আন্দোলনের পর গােটা দেশে আন্দোলনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমুখী অবস্থানের কারণে ছাত্র সংগঠনগুলাে ঐক্যমতে পৌঁছতে পারছিল না। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে আন্দোলনের ব্যাপারে আলােচনা শুরু হয়। নিয়মিত আলােচনা চলে ইকবাল হল (বর্তমান জহুরুল হক হল) ক্যান্টিনের নিচ তলার সিঁড়ির কামরায়। তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক অবস্থা ছিল দুর্বল। ডাকসুর পক্ষেও আন্দোলনের আহ্বান জানানাে সম্ভব ছিল না। কেননা, ডাকসু’র নেতৃত্ব ছিল দু’টি বিবদমান ছাত্র সংগঠনের মধ্যে বিভক্ত। অপর দিকে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) এর উপর নেমে এসেছে নির্যাতন – সাইদুর রহমান হত্যাকে কেন্দ্র করে দায়ের করা মামলায় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ পলাতক, রাশেদ খান মেনন কারাগারে বন্দি। অবশ্য এর আগে, ২৮ ডিসেম্বর, শনিবার, ১৯৬৮ সাতজন ছাত্রনেতা এক যুক্ত বিবৃতিতে শিক্ষাগত দাবি দাওয়া আদায়ে আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য ছাত্র সমাজ এবং সুস্পষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য সকল গণতান্ত্রিক বিরােধীদলের প্রতি আহ্বান জানান। তারা অভিযােগ করেন, সরকার, ছাত্র নির্যাতন, গুন্ডামি, শিক্ষায়তনে পুলিশ মােতায়েন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘােষণা করে ছাত্র সামজের গণতান্ত্রিক অধিকারকে ধ্বংস করতে চাচ্ছে। তারা বলেন ‘সংগ্রামী ছাত্র সামজ নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর কোনাে প্রকার হস্তক্ষেপ সহ্য করবে না।’ বিবৃতিতে সই করেন ডাকসুর সহ সভাপতি তােফায়েল আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক নাজিম কামরান চৌধুরী, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) এর পক্ষে সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক ও সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দোহা, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) এর পক্ষে সভাপতি মােস্তফা জামাল হায়দার এবং ছাত্রলীগের পক্ষে সভাপতি আবদুর রউফ ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ মােহাম্মদ আলী।৫৮
=================================================================
৫৮ দৈনিক আজাদ, ২৯শে ডিসেম্বর, রবিবার, ১৯৬৮।
১৯৩৬ সালের ৩১ অক্টোবর মওলানা আকরাম খাঁ এদেশের প্রাচীনতম সংবাদপত্র অধুনা বিলুপ্ত দৈনিক আজাদ কলকাতা থেকে প্রকাশ করেন এবং সেখানে এর প্রকাশনা অব্যাহত থাকে ১৯৪৮ সালের ১২ অক্টোবর পর্যন্ত। পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর পূর্ব পাকিস্তান সরকার দৈনিক আজাদ অফিস প্রতিষ্ঠার জন্য ঢাকায় ঢাকেশ্বরী রােডে একটি প্লট লিজ দেয়। দৈনিক আজাদ যতদিন চালু ছিল ততদিন ওখান থেকেই তা প্রকাশিত হত। ঢাকা থেকে পত্রিকা প্রকাশকালে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় আজাদ অতীতের অনেক আন্দোলনের মতাে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আজাদ-এ তখন প্রতিদিন একটি আলাদা অংশ থাকত শুধু আন্দোলনের খবর আর ছবি নিয়ে। ২২ জানুয়ারি আজাদ এর এই আলাদা অংশটির প্রথম পৃষ্ঠায় পাঁচ কলামব্যাপী সংবাদের শিরােনাম ছিল ‘মৃত্যুর জানাজা মােরা কিছুতেই করিব না পাঠ, কবরের ঘুম ভাঙ্গে জীবনের দাবি আজ এই বিরাট।’ উনসত্তরের আন্দোলনের তথ্য নির্ভর ও সঠিক ইতিহাসের জন্য আজাদ এক মূল্যবান উৎস। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দৈনিক আজাদের সব পুরনাে কপি এখন পাওয়া যায় না। ১৯৬৯ সালে মওলানা আকরম খাঁর মৃত্যুর পর পত্রিকার বিশেষ করে সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে বিরােধ দেখা দেয় এবং ১৯৯০ সালে এর প্রকাশনা পুরােপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
পেজ-৪৭
এই প্রেক্ষাপটে আলােচনার সূত্রপাত ঘটে। আলােচনা চলার সময় ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) এর বক্তব্যকে সমর্থন করে ছাত্রলীগ। এর একটা কারণ ছিল। ১৯৬৫ সালে ছাত্র ইউনিয়নের দ্বিধা বিভক্তির পর মতিয়া গ্রুপ রাজনৈতিক সমর্থন লাভের আশায় ছাত্রলীগের বিভিন্ন অবস্থানকে সমর্থন করে। ১৯৬৬ সালে ছাত্রলীগের সঙ্গে মতিয়া গ্রুপের একটি ঐক্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ভিত্তিতে মতিয়া গ্রুপ ও ছাত্রলীগ ১৯৬৭ সালের ৭ জুন, বুধবার ঐক্যবদ্ধভাবে ছয় দফার সমর্থনে হরতাল পালন করে। কিন্তু গ্রেফতার ও দমননীতির ফলে আন্দোলনের সম্ভাবনা বানচাল হয়ে যায়। অপরদিকে, দ্বিধা বিভক্তির কারণে, মতিয়া ও মেনন গ্রুপ উভয় সংগঠনই নিজেদের একমাত্র ছাত্র ইউনিয়ন বলে দাবি করে। এই জটিলতা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে দীর্ঘ তিন বছর। ১১ দফা কর্মসূচী প্রণয়নের সময় ছাত্রলীগের বক্তব্য ছিল, ৬ দফা কর্মসূচীকে এর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করতে হবে। এ বিষয়ে দীর্ঘ বিতর্কের পর উপরােক্ত কর্মসূচি প্রণীত হয়।
ইতােমধ্যে, ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে ৮টি রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক ঐক্যফ্রন্ট নামে একটি কাঠামাে দাঁড় করায়। এই ৮টি দল হচ্ছে , পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মােজাফফর), পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (পিডি এম), পূর্ব পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান জমিয়াতুল উলেমা-ই-ইসলাম, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পার্টি, গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ও পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী। এদের ঐক্যমতের পেছনে মূল লক্ষ্য ছিল আসন্ন নির্বাচন। ভাসানী ন্যাপ এতে অংশগ্রহণ করে নি। কেননা তখন ভাসানী ন্যাপ এককভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের বক্তব্য ছিল নির্বাচন বর্জন। এ সময় ভাসানী ন্যাপের অঙ্গ সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির পক্ষে ‘কৃষক সমিতির ডাক’ এই শিরােনামে প্রকাশিত একটি প্রচারপত্রে মওলানা ভাসানীর রাজনীতি তুলে ধরা হয়। কৃষক সমিতির পক্ষে যুগ্ম সম্পাদক আবদুল মতিন কর্তৃক ১ জানুয়ারি, বুধবার, ১৯৬৯ প্রকাশিত প্রচারপত্রটিতে বলা হয়,
“৮ জানুয়ারি হইতে ১৫ই জানুয়ারি গ্রামে গ্রামে হাতিরদিয়া ও নড়াইলে গণহত্যা, ধরপাকড় ইত্যাদি জুলুমের বিরুদ্ধে জনসভা ও ঘেরাও মিছিল করুন। শুধু শহরের আন্দোলনে স্বৈরাচারী সরকারের জুলুম বন্ধ হইবে না। সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের দুর্নীতি, দৌরাত্ম ও ঘুষ বন্ধ হইবে না – সার্টিফিকেট প্রথা, মালক্রোক, বডি ওয়ারেন্ট বন্ধ হইবে না। আখ ও পাটের ন্যায্য মূল্য কৃষকেরা পাইবে না – নদী সিকস্তি জমির খাজনা মওকুফ হইবে না – নিত্য প্রয়ােজনীয় জিনিষের দাম কমান যাইবে না। তাই আজ দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দলের ছাত্র, শ্রমিক ও অন্যান্য সংগঠনের নেতৃবর্গ ও কর্মীদের নিকট আমার আকুল আবেদন কৃষক সমিতির সহিত কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া, হাতে হাত মিলাইয়া এই জুলুম বিরােধী দিবস সাফল্যমন্ডিত করিয়া তুলিতে আন্তরিকভাবে সহযােগিতা করুন।”
প্রচারপত্রে মওলানা ভাসানী আন্দোলনের আহ্বান জানান, এবং ঘােষণা করেন, “একমাত্র নির্বাচনের (ইলেকশনের) জন্য কোন যুক্তফ্রন্টে যােগদান করিব না।” প্রায় একই সময়ে
পেজ-৪৮
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ভাসানী) পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয় ‘নির্বাচন বর্জন করিয়া সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী, স্বৈরতন্ত্র বিরােধী গণতান্ত্রিক সরকারের পতাকা উর্দ্ধে তুলিয়া ধরুন।’ শিরােনামের আরেকটি পুস্তিকা। ন্যাপের পক্ষে এই পুস্তিকাটি প্রকাশ করেন হাজী মােহাম্মদ দানেশ। তৎকালীন পরিস্থিতিতে ন্যাপের এই বক্তব্য লক্ষ্যনীয়। কেননা তখন নির্বাচন প্রশ্নে ন্যাপের মধ্যে চলছে রাজনৈতিক বিতর্ক। একই সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) এ চলছে মতাদর্শগত লড়াই। আবদুল মতিন, আলাউদ্দিন আহমেদ, দেবেন শিকদার, আবুল বাসার প্রমুখ সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন মােহাম্মদ তােয়াহা, আবদুল হক এদের সঙ্গে। নকশালবাড়ি আন্দোলনের বিতর্কে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা কারও উপরেই আস্থা স্থাপন করতে পারছিল না। ছাত্র ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ মতাদর্শগত লড়াই পরবর্তী পর্যায়ে ভিন্ন রূপ নেয়।
মওলানা ভাসানী ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে যেভাবে আইয়ুব বিরােধী আন্দোলনের সূত্রপাত করেন তা লক্ষ্যণীয়। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে আইয়ুব খানকে সমর্থন দানের পর থেকে ভাসানী ন্যাপ আইয়ুব বিরােধী কোনাে ব্যাপক আন্দোলনের সূত্রপাত করে নি। ৬ দফার পাশাপশি ন্যাপ ১৪ দফা কর্মসূচি উত্থাপন করলেও আন্দোলন নিয়ে খুব বেশি দূর এগােয় নি। যা হােক, শেষ পর্যায়ে ন্যাপ আইয়ুব বিরােধী আন্দোলনের সূত্রপাত করে।৫৯
ছাত্রদের ১১ দফা কর্মসূচি ঘােষিত হওয়ার পর পরই ৮ জানুয়ারি, বুধবার, ১৯৬৯ ঘােষিত হয় গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদের (ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি বা ড্যাক) কর্মসূচি। ঐদিন সন্ধ্যায় আটটি দলের নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবের বাসভবনে আহুত এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘােষণা করেনঃ
“আমরা নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, জমিয়াতুল উলেমা-ই-ইসলাম, পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও পিডিএমের অঙ্গদল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ, পাকিস্তান জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ও জামাতে ইসলামের প্রতিনিধিগণ দৃঢ়ভাবে মনে করি যে, দেশে বর্তমান স্বৈরাচারী নিপীড়নমূলক এক ব্যক্তির শাসন আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে অবক্ষয় ও ধ্বংস ডাকিয়া আনিয়াছে। বিশেষ করিয়া এই ব্যক্তির শাসন সচেতন ও নিরবচ্ছিন্নভাবে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার প্রতি অবহেলা প্রদর্শন, গণতন্ত্র, জনগণের সার্বভৌমত্ব, সকল মৌলিক স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার কাড়িয়া লইয়াছে। সর্বস্তরের মানুষ বিশেষ করিয়া ছাত্র, শ্রমিক,
=================================================================
৫৯ পূর্ণ বিবরণের জন্য পরিশিষ্ট-ঝ দেখুন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন মওলানা ভাসানী একটি রাজনৈতিক সমঝােতার ভিত্তিতে আইয়ুব খানকে সমর্থন করেছিলেন। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, সে সময় হুলিয়ার কারণে আত্মগােপনকারী কমিউনিস্ট নেতাদের হুলিয়া প্রত্যাহার। মওলানা ভাসানীর মধ্যস্থতায় কমিউনিস্ট নেতা মােহাম্মদ তােয়াহা, আবদুল হক, প্রফেসর আসহাব উদ্দিন আহমেদ এবং অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদের হুলিয়া প্রত্যাহার করা হয়। বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর মােনায়েম খানের কারণে মনি সিংহ এর হুলিয়া প্রত্যাহার করা হয় নি। এ ছাড়াও, মওলানা ভাসানীর দর কষাকষিতে তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধু সীমান্ত গান্ধী হিসেবে পরিচিত আবদুল গাফফার খান মুক্তি পেলেও কয়েকমাস পরে তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়।
পেজ-৪৯
কৃষক ও অন্যান্য মেহনতী শ্রেণীর উপর বর্তমান সরকার নির্যাতন চালাইবার অপরাধে অপরাধী।
বর্তমান অগণতান্ত্রিক সরকার দেশের সম্পদরাজি কতিপয় পরিবারের হাতে কুক্ষিগত করার জন্য সুপরিকল্পিত নীতি অনুসরণ করিয়াছে। অন্য দিকে ক্ষমতাসীন চক্র আমলাতন্ত্র ও প্রশাসন ব্যবস্থার সহিত জড়িত বিভিন্ন পর্যায়ের লােকের মধ্যে দুর্নীতি উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পাইতেছে। দুর্নীতি সরকারি ব্যবস্থার অচ্ছেদ্য অঙ্গের বিষয় হইয়া পড়িয়াছে। ব্যাপক ভিত্তিতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার, সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে জরুরী অবস্থা বলবৎ রাখা, মৌলিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমানভাবে স্বেচ্ছাচারী সরকার নির্যাতন মূলক শাসন চালাইয়া যাইতেছে।
বর্তমান দুর্যোগপূর্ণ জাতীয় পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে উপরােল্লিখিত দুর্নীতির প্রতিকার ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অন্যান্য উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য উল্লেখিত দল সমূহের প্রতিনিধিগণ পাকিস্তানে পূর্ণ গণতন্ত্র কায়েম ও জনগণকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্বাধীনতা পুনঃপ্রদানের লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্ব স্ব দলের দ্ব্যর্থহীন সংকল্পের কথা ঘােষণা করিতেছেঃ
(ক) ফেডারেল পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার
(খ) প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন
(গ) অবিলম্বে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার
(ঘ) নাগরিক স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার ও সকল কালাে আইন, বিশেষ করিয়া বিনা
বিচারে আটক ও বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স বাতিল।
(ঙ) শেখ মুজিবুর রহমান, খান আবদুল ওয়ালী খান ও জুলফিকার আলী ভূট্টোসহ
সকল রাজবন্দী, আটক ছাত্র, শ্রমিত ও সাংবাদিককে মুক্তি দান ও আদালতে এবং ট্রাইবুনালে বিচারাধীন সকল মামলা প্রত্যাহার, রাজনৈতিক মামলা, জারীকৃত গ্রেফতারী পরােয়ানা প্রত্যাহার
(চ) ১৪৪ ধারা মতে জারীকৃত সকল নির্দেশ প্রত্যাহার
(ছ) সংবাদপত্রের উপর হইতে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার, নতুন ডিক্লারেশন প্রদান এবং ‘ইত্তেফাক’ ও ‘চাত্তান’ সহ যে ক্ষেত্রে ডিক্লারেশন বাতিল করা হইয়াছে সে ক্ষেত্রে উহা পুনঃপ্রদান, প্রগ্রেসিভ পেপারস লিমিটেডকে উহার সাবেক মালিকদের পুনঃপ্রদানের জন্যও সংকল্প গ্রহণ করা হইতেছে।৬০
=================================================================
৬০ আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পর সংবাদপত্র দলনের নীতি গ্রহণ করেন। সে সময় পাকিস্তানে একটি প্রভাবশালী দৈনিক সংবাদপত্র ছিল প্রগ্রেসিভ পেপারস লিমিটেড পরিচালিত এবং পাকিস্তানের জনক মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রতিষ্ঠিত দ্য পাকিস্তান টাইমস। ১৯৪৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার পত্রিকাটি আত্মপ্রকাশ করে। প্রগ্রেসিভ পেপারস লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মিয়া ইফতেখার উদ্দিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় মুসলিম লীগের সঙ্গে জড়িত থাকলেও পরবর্তী পর্যায়ে তিনি মুসলিম লীগ ত্যাগ করে আজাদ পাকিস্তান পার্টি গঠন করেন। মওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন
পেজ-৫০
আমরা স্ব স্ব দলের পক্ষে এই মর্মে সংকল্প ঘােষণা করিতেছি যে, আমরা এবং আমাদের দলসমূহ এই বিরাট ঐতিহাসিক ও দেশপ্রেমিক দায়িত্ব পালন ও উল্লেখিত লক্ষ্যসমূহের দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য নিরবচ্ছিন্ন, অহিংস, সুসংগঠিত ও সৃশৃংখল গণআন্দোলন জোরদার করার যে কোনাে আত্মত্যাগে কুষ্ঠিত হইব না। ঘােষণায় সই করেন আমীর হােসেন শাহ, মােহাম্মদ আলী, মুফতী মাহমুদ, মমতাজ মােহাম্মদ খান দৌলতানা, নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, নূরুল আমীন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তােফায়েল মিয়া।
পরবর্তী পর্যায়ে ১২ জানুয়ারি, রবিবার, ১৯৬৯ আয়ােজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে মওলানা ভাসানী বলেন, দেশের সর্বত্র এমন ব্যাপক ও সর্বাত্মক কার্যকর গণআন্দোলন গড়িয়া তুলিতে হইবে যাহাতে বর্তমান শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে কোনাে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হয়। ১৪ জানুয়ারি, মঙ্গলবার, হাতিরদিয়ায় এক জনসভায় মওলানা ভাসানী ঘােষণা করেন, ‘জনসাধারণের ভােটাধিকার, লাহাের প্রস্তাবে উল্লিখিত পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়ােজন হইলে খাজনা-ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করিব।’
যেদিন ড্যাক গঠিত হয়, সেদিন আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি (৬ দফা পন্থী) নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং দলীয় সদস্যদের প্রতি জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগের আহ্বান জানায়। ১২ জানুয়ারি, রবিবার, ১৯৬৯ ড্যাক প্রাদেশিক সমন্বয় কমিটির এক সভায় গৃহীত প্রস্তাবে নিম্মলিখিত দাবির ভিত্তিতে ১৭ জানুয়ারি দাবি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, পল্টনে জনসভা অনুষ্ঠান, শােভাযাত্রা সহকারে ঢাকার প্রধান রাস্তা প্রদক্ষিণ এবং যদি ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা না হয় তাহলে তিনজন করে শােভাযাত্রা বের করা। শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত দিনে ড্যাকের জমায়েত অনুষ্ঠিত হয় বায়তুল মােকাররমে।
এগার দফা প্রণীত হওয়ার পরও এ কর্মসূচির বাস্তবায়ন সম্পর্কে বিরােধের অবসান হয় নি। কোন তারিখে ছাত্রসভা হবে সে নিয়েও বিতর্ক চলে। মতিয়া গ্রুপের বক্তব্য ছিল, ড্যাক এর কর্মসূচির সঙ্গে ছাত্রদের কর্মসূচি যুক্ত করে দেওয়া। কিন্তু তত্ত্বগতভাবে তারা মনে করত,
============================================================
করলে তিনি আজাদ পাকিস্তান পার্টি সহ ঐ দলে অঙ্গীভূত হয়ে যান। আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করলে একমাত্র পাকিস্তান টাইমস ব্যতীত অন্যান্য সংবাদপত্র তাকে স্বাগত জানায়। পাকিস্তান টাইমস সম্পর্কে পাকিস্তান সরকারের প্রধান আপত্তির বিষয় ছিল এ পত্রিকায় প্রগতিশীল ও বামপন্থী সাংবাদিকদের কর্মসংস্থান। এ কারণেই ১৯৫২ সালের নিরাপত্তা আইন সংশােধন করে ১৯৫৯ সালের ১৬ এপ্রিল, বুধবার জারি করা স্পেশাল অর্ডিন্যান্সের অধীনে সরকার পত্রিকার মালিকানা গ্রহণ করে। এর প্রতিবাদে ছাত্রনেতা তারিক আলীর পিতা মাজহার আলী খান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। সরকার ঝাণু আমলা কুদরতউল্লা শাহাবকে পত্রিকার প্রশাসক নিয়ােগ করেন। পাকিস্তান টাইমস অধিগ্রহণের সময় প্রগ্রেসিভ পেপারস লিমিটেড পরিচালিত আরও দুটি পত্রিকার, ইমরােজ ও লাইনুন নাহার, মালিকানাও সরকার দখল করে। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে বৈধ মালিকদের কাছে প্রগ্রেসিভ পেপারস লিমিটেড ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিটি জোরে শােরে উত্থাপিত হতে শুরু করে এবং ১৯৭২ সালে এ কোম্পানীর মালিকানা মূল মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। মিয়া ইফতেখার উদ্দীনের মৃত্যুর পর তার ছেলে আরিফ ইফতেখার ভাসানী ন্যাপে যােগ দান করেন এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
পেজ-৫১
“এই ঐক্যজোটে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রাধান্য থাকায় ইহারা একটি পূর্ণ গণতান্ত্রিক কর্মসূচি গ্রহণে স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া আগাইয়া আসিবে না ইহা ছিল সুনিশ্চিত।”
ছাত্ররা যখন ড্যাক নেতৃবৃন্দের কাছে ১১ দফা কর্মসূচির প্রতি সমর্থন দাবি করে তখন তারা এ কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানাতে অস্বীকার করেন এবং ১৭ জানুয়ারি, শুক্রবার, ১৯৬৯ সারা পাকিস্তানে দাবি দিবস পালনের আহ্বান জানান। এমতাবস্থায় ছাত্ররাও ১৭ জানুয়ারি, শুক্রবার, বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় সভা আহ্বান করে। আন্দোলনের সম্ভাবনা আঁচ করে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সরকার। এ পরিস্থিতিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ব্যাপারে ছাত্রদের মধ্যে বিতর্ক দেখা দেয়। স্থির হয়, সভাস্থলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ড্যাকের কর্মসূচি ঘােষিত হওয়ার পর অন্যদের সঙ্গে আলােচনা না করে মতিয়া গ্রুপ ১১ দফা কর্মসূচিতে কিছু সংশােধন করে। কেননা কর্মসূচি মুদ্রণের দায়িত্ব ছিল মতিয়া গ্রুপের হাতে। মুদ্রিত কর্মসূচি থেকে, সাংবাদিক সম্মেলনে পঠিত কর্মসূচির নিম্নোক্ত লাইন ক’টি বাদ দেওয়া হয় – “কিন্তু এই অবস্থায় সরকার বিরােধী রাজনৈতিক সংগঠনসমূহ ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের দিকে আগাইয়া আসিতেছেন না। সম্প্রতি দুই একটি দিবস ঐক্যবদ্ধভাবে পালন করা হইলেও কর্মসূচি ভিত্তিক কোনাে ঐক্যফ্রন্ট গড়িয়া উঠিতেছে না।” এই ঘটনায় ঐক্য ক্ষতিগ্রস্থ হলেও মেনন গ্রুপ নেতৃবৃন্দ বৃহত্তর আন্দোলনের খাতিরে শেষ পর্যন্ত তা মেনে নেয় এবং ১৭ জানুয়ারি, শুক্রবার, বটতলায় অনুষ্ঠিত হয় সেই ঐতিহাসিক ছাত্র সভা। ঢাকা শহরে ১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারি, শুক্রবার দু’টি জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। একটি ড্যাকের আহ্বানে গণজমায়েত, অপরটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবনের বটতলায় ছাত্র জমায়েত। এসব জমায়েত যাতে মিছিলে রূপ নিতে না পারে সেজন্য পূর্বাহ্নেই ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। সভার পূর্বে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ৭ জানুয়ারি, মঙ্গলবার সভা ও শােভাযাত্রা হবার কথা ছিল। লিখিত চুক্তি হয়েছিল, ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে শােভাযাত্রা হবে। কিন্তু অনুষ্ঠিতব্য বার্ষিক সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) কোনাে ঝুঁকি নিতে রাজি না হওয়ায় ছাত্রলীগও পিছু টান দেয়। মতিয়া গ্রুপের সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল ২২ জানুয়ারি, বুধবার থেকে। অবশেষে, আপােষরফা হিসেবে ১৭ জানুয়ারি, শুক্রবার সভার দিন ধার্য হয়। মতিয়া গ্রুপ পরবর্তী পর্যায়ে এ ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়েছে নিম্নোক্তভাবেঃ
“ড্যাক সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা কর্মসূচী গ্রহণ করে নাই। কিন্তু ১৭ জানুয়ারি সারা পাকিস্তানব্যাপী দাবী দিবস পালনের আহ্বান দেয়। আমরা এই দিবস হইতেই প্রত্যক্ষ আন্দোলনের সূচনা করিবার জন্য প্রচেষ্টা করিয়া আসিতেছিলাম। কারণ আয়ুব শাহীর অবসানের জন্য সারা পাকিস্তানব্যাপী একই দিনে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু করার তাৎপর্য ও গুরুত্ব ছিল খুবই বেশি। কিন্তু কেহ কেহ বিভেদমূলক চিন্তা ও সংকীর্ণতা বােধ হইতে (এ ক্ষেত্রে মেনন গ্রুপকে বােঝানাে হয়েছে- লেখক) ১৭ জানুয়ারি প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু না করিয়া তারিখটি আগে পিছে করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। অবশেষে ছাত্র কর্মীদের সমর্থনে আমাদের প্রস্তাব পাশ হয় ও ফলে ১৭ জানুয়ারি হইতে ১১ দফার দাবীতে সারা পূর্ব বাংলা ব্যাপী ছাত্র সমাজের প্রত্যক্ষ জঙ্গী সংগ্রাম শুরু হয়।”৬১
================================================================
৬১ ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচী ও এগার দফা প্রতিষ্ঠার পথ, কেন্দ্রীয় সংসদ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র
ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় কার্যালয়, ৩১/১ হােসেনী দালান রােড থেকে সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম
পেজ-৫২
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের বটতলায় ১৭ জানুয়ারি, শুক্রবার অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় সভাপতিত্ব করেন ডাকসু’র সহ সভাপতি তােফায়েল আহমেদ। প্রথম সভায় ডাকসু’র সভাপতিত্বের আর একটি কারণ ছিল। আন্দোলনের সূচনায় ছাত্ররা এনএসএফের গুন্ডাদের হামলার ভয় করেছিলেন। ভয় থাকলেও, মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জন্য এ সম্ভাবনা ছিল সীমিত। যা হােক, অবশেষে হাজার খানেক ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতিতে সভার কাজ শুরু হয়। কলাভবনের সামনের রাস্তা অবরােধ করে রাখে পুলিশ ও আইয়ুবী দশকের বিখ্যাত ‘পানি ছিটানাে’ লাল গাড়ী – রায়ট কার। সভা শুরু হবার পর ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ব্যাপারে মতদ্বৈধতা দেখা দেয়। এ সময় ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের নেতৃস্থানীয় কর্মী শফিকুল ইসলাম প্রথম শ্লোগান দেন ১৪৪ ধারার বিরুদ্ধে।৬২ সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত ছাত্ররা সক্রিয় হয়ে ওঠে। নির্দেশ অমান্য করে একদল ছাত্র ছুটে বেরিয়ে যায় রাস্তার দিকে। শুরু হয় পুলিশের লাঠি চার্জ, কাঁদুনে গ্যাস প্রয়ােগ ও রঙ্গীন পানি ছিটানাে। এ তারিখে ২৫ জন আহত ছাত্রকে পুলিশ গ্রেফতার করে। বায়তুল মােকাররমে ‘ড্যাকের’ জনসভায়ও পুলিশী হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশ বায়তুল মােকাররম মসজিদে ঢুকে কিছু লােককে পেটালে ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে সারাদিন চলে ছাত্র-পুলিশ লড়াই। এই দিন এনএসএফের ব্যাপক সদস্য ছাত্র বিক্ষোভে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ছাত্ররা পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে ইপিআরটিসির একটি বাসে অগ্নি সংযােগ করে। এ ঘটনার পর, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) সদস্যদের তলব করা হয়।৬৩ দুপুরের দিকে পুরনাে ঢাকা থেকে আসা একটি মিছিলের উপর গুলিস্থানের কাছে পুলিশ হামলা চালায়। সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে, ‘দুষ্কৃতিকারী’ দমনে নিযুক্ত হয় ইপিআর।
এ সময় ঢাকা থেকে সান্ধ্য দৈনিক হিসেবে প্রকাশিত হত আওয়াজ। ১৯৬৮ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত আওয়াজের মালিক ও সম্পাদক ছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। পরবর্তী পর্যায়ে ভাসানী ন্যাপের জন্য এ কাগজের মালিকানা ক্রয় করেন মশিউর রহমান (যাদু মিয়া)। ১৯৬৮ সালের জুন মাসে আনােয়ার জাহিদের সম্পাদনায় ভাসানী ন্যাপের মুখপত্র
==================================================================
কর্তৃক প্রকাশিত, জানুয়ারী ১৯৭০। (এই নুরুল ইসলাম হচ্ছেন ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের
নেতৃত্বে গঠিত জোট সরকারের শিক্ষা মন্ত্রী।)
৬২ মরহুম শফিকুল ইসলাম জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে কর্মজীবনের সমাপ্তি টানেন।
৬৩ এই বাহিনী রামগড় লােকাল ব্যাটালিয়ন নামে ১৭৯৫ সালে যাত্রা শুরু করে এবং ১৮৬১ পর্যন্ত এই নামেই পরিচিত ছিল। ১৮৬১-১৮৯১ পর্যন্ত এই বাহিনীর নাম ছিল ফ্রন্টিয়ার গার্ডস। ১৮৯১-১৯১৯ সময়ে এই বাহিনীর নাম ছিল বেঙ্গল মিলিটারী পুলিশ। ১৯২০ সালে এর নাম বদল করে করা হয় ইস্টার্ণ ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) নামে এই বাহিনী যাত্রা শুরু করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বাহিনীর সদস্যরা সাহসিকতার সঙ্গে পাক বাহিনীকে মােকাবেলা করে। এই সাহসিকতার জন্য ইপিআর এর দুজন সদস্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব বীর শ্রেষ্ঠ পদকে ভূষিত হন। ১৯৭২ সালের ৩রা মার্চ, শুক্রবার, এই বহিনীর নাম বদলে রাখা হয় বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর)। ২০১০ সালের ২৩শে ডিসেম্বর থেকে এ বাহিনীর নামকরণ করা হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ।
পেজ-৫৩
হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আওয়াজ। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের এক সময়ের সাধারণ সম্পাদক গিয়াস কামাল চৌধুরী, ন্যাপ নেতা নুরুল হুদা কাদের বখশ, (ছটি ভাই হিসেবে পরিচিত), এ বইয়ের লেখক প্রমুখ কাজ করতেন এই সান্ধ্য দৈনিকে, প্রকাশিত হত টিপু সুলতান রােড থেকে। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর মাসে আওয়াজের ভূমিকা ছিল উল্লেখযােগ্য। আন্দোলনের সংবাদের জন্য পাঠক নির্ভর করত এ পত্রিকার ওপর। কিন্তু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিরােধের কারণে ভাসানী ন্যাপের মুখপত্র হিসেবে এর অস্তি ত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় নি। ১৮ জানুয়ারি, শনিবার, ১৯৬৯, শনিবার থেকে আপাতদৃষ্টিতে ‘অর্থনৈতিক কারণে’ বন্ধ হয়ে যায় সান্ধ্য দৈনিক আওয়াজের প্রকাশনা।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন ১৯ জানুয়ারি, রবিবার কেন্দ্রীয়ভাবে ছাত্র জমায়েতের কোনাে কর্মসূচি ছিল না। কিন্তু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পুলিশী হামলার বিরুদ্ধে শােভাযাত্রা বের করলে পুলিশ লাঠি চার্জ, কাঁদানে গ্যাস প্রয়ােগ করে। এতে বেশ কিছু ছাত্র আহত এবং ৮ জন গ্রেফতার হয়। এ সময়ে সবাই অনুভব করছিলেন আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছে। আন্দোলনের গতি প্রকৃতি দেখে এনএসএফের কর্মীদের মনেও দোদুল্যমনতা দেখা দেয়। প্রাক্তন এনএসএফ নেতা মাহবুবুল হক দোলন এ সময় জমীর আলী গ্রুপের সঙ্গে বিরােধের কারণে একটি উপদলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। বলা হয়ে থাকে, সেদিন দোলনকে সাহায্য ও সমর্থন যুগিয়েছিলেন খান এ সবুর। ডাকসু’র তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক নাজিম কামরান চৌধুরী ছিলেন দোলনের সমর্থক। তাই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে আলােচনা চলে সংগ্রাম পরিষদে এনএসএফের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে। অতীতের তিক্ততার কারণে এ ব্যাপারে কেউই বিশেষ উৎসাহ দেখান নি। কিন্তু ১৭ থেকে ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত এনএসএফের একদল ছাত্রের ভূমিকা সাধারণ ছাত্রদের উৎসাহ যােগায়। এমতাবস্থায় অন্যান্য ছাত্র নেতৃবৃন্দ অপেক্ষা করেছিলেন এনএসএফের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বহিঃপ্রকাশের জন্য। এ ছাড়া এ চিন্তাও ছিল যে, এনএসএফ-এ প্রকাশ্য ভাঙ্গন ধরলে তা আন্দোলনের পক্ষে সহায়ক হবে। অবশেষে ২০ জানুয়ারি, সােমবার কোন্দলের বহিঃপ্রকাশ ঘঠে। জমির আলীর নেতৃত্বাধীন সংগঠনের সঙ্গে বিরােধিতা করে এনএসএফের একাংশ ঐ তারিখে একটি প্রচারপত্র বিলি করে। প্রচারপত্রে তারা সরকারের অবিচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানাের আহ্বান জানায় এবং ‘সংগ্রামী ২২ দফা’ কর্মসূচি ঘােষণা করে। এসব দফার মধ্যে শিক্ষা সমস্যা সংক্রান্ত এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দাবি দাওয়াও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।৬৪ পরবর্তী পর্যায়ে এই প্রচারপত্র কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যপদ লাভে জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের ‘সার্টিফিকেট’ হিসেবে কাজ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ২০ জানুয়ারি, সােমবার, ১৯৬৯ সকালে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। হাজার হাজার জঙ্গী ছাত্র লাঠি সােটা সহকারে সভায় উপস্থিত হয়। বক্তৃতার পালা শেষ হলে ফুলার রােড ধরে মিছিল বেরিয়ে পড়ে। শুরুতে মিছিলে কোনাে পুলিশী হামলা হয় নি। শহীদ মিনারের সামনে দিয়ে গিয়ে মিছিল যখন চানখাঁর পুল এলাকায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ সংলগ্ন রশীদ বিল্ডিং অতিক্রম করছিল তখন পুলিশ বাধা দিলে মিছিল দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। প্রথম অংশ পুরনাে ঢাকার রাস্তা
==============================================================
৬৪পূর্ণ বিবরণের জন্য পরিশিষ্ট- ঞ দেখুন।
পেজ-৫৪
অতিক্রম করে শেষ হয় বাহাদুর শাহ পার্কে। ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) এর অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনের অজুহাতে বাহাদুর শাহ পার্কে মেনন গ্রুপ সভাপতি মােস্তফা জামাল হায়দার ঘােষণা করেন ‘আন্দোলনের কর্মসূচি পরবর্তী পর্যায়ে ঘােষণা করা হবে।’৬৫ অথচ এরা তখনও জানেন না, মিছিলের শেষাংশের ভাগ্যে কি ঘটেছে ?
রশীদ বিল্ডিং-এর কাছে হামলা চালানাের পর কোন সতর্কবাণী না দিয়ে পুলিশ গুলি ছোঁড়ে। ঘটনাস্থলে মেনন গ্রুপের অন্যতম নেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের এম এ শেষ বর্ষের ছাত্র, আসাদুজ্জামান গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হন। গুলিতে আরও আহত হয়েছিলেন, পাকিস্তান অবজারভারের স্টাফ ফটোগ্রাফার মােজাম্মেল হক (মরহুম), সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আবু, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র আবদুল মজিদ। ছাত্ররা ধরাধরি করে আসাদকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জরুরী বিভাগে নেয়ার আগেই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মুহূর্তের মধ্যে গােটা আন্দোলনের চেহারা পাল্টে যায়। ঘটনার প্রতিবাদে দুপুরের পর পর এক ঐতিহাসিক শােক মিছিল বের হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সারাদেশে তিনদিন ব্যাপী শােক ঘােষণা করে। কর্মসূচিতে ছিল, ২১ জানুয়ারি, মঙ্গলবার হরতাল, ২২ জানুয়ারি, বুধবার শােক মিছিল এবং ২৩ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মশাল মিছিল। ২০ জানুয়ারি, সােমবার, কোনাে প্রস্তুতি ছাড়াই যে শােক মিছিল বের হয় তাতে মেয়েরা নেতৃত্ব দেয়। সংবাদপত্র মন্তব্য করে, “গৃহসমূহের ছাদ ও জানালা হইতে মিছিলকারীদের উপর পুষ্পবৃষ্টি নিক্ষেপ করা হয়।” ঐদিনও পুলিশ ও ইপিআর কয়েক রাউন্ড গুলি বর্ষণ এবং বেয়নেট ও ব্যাটন চার্জ করে। ছাত্রীদের অধিকাংশই ছিল ইডেন কলেজের ছাত্রী। তারা যাতে হরতালে অংশগ্রহণ করতে না পারে সেজন্যে পূর্বাহ্নেই কর্তৃপক্ষ ছাত্রী নিবাসের গেট বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ছাত্রীরা সে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাস্তায় বেরিয়ে আসে ও পুলিশী নির্যাতনের শিকার হয়। তাদের অনেককেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়। এদের কেউ কেউ পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন রাজনৈতিক স্রোতধারার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ যােগাযােগ রেখেছিলেন।
ন্যূনতম প্রস্তুতি ছাড়াই, ২১ জানুয়ারি, মঙ্গলবার স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয় ঢাকায়। সকাল থেকেই সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসতে শুরু করেন। ২০ জানুয়ারি, সােমবার রাতে আসাদের লাশ নিয়েও এক নাটকীয় ঘটনা ঘটে। ছাত্র নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন আসাদের লাশ তার গ্রামের বাড়ি হাতিরদিয়ায় পাঠানাে হবে। হাতিরদিয়া শুধু আসাদের বাড়ি নয়, ১১ দফা আন্দোলনের সময় হাতিরদিয়া ছিল কৃষক জনতার সংগ্রামের প্রতীক। অপরদিকে কর্তৃপক্ষীয় সিদ্ধান্ত ছিল লাশ নিতে না দেওয়া। এ সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ছিলেন অগ্রগামীর প্যানেল থেকে নির্বাচিত আশিকুল আলম (মরহুম)। তার উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত ২১ জানুয়ারি, মঙ্গলবার, ১৯৬৯ ভাের চারটায় ট্রাকে করে আসাদের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় হাতিরদিয়ায়। ২১ জানুয়ারি, মঙ্গলবার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় শহীদ আসাদুজ্জামানের গায়েবানা জানাজা। জানাজা শেষে
=================================================================
৬৫ দৈনিক আজাদ, ২১ জানুয়ারি, মঙ্গলবার, ১৯৬৯।
পেজ-৫৫
১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে লক্ষ লােকের মিছিল বের হয়। মিছিলের অগ্রভাগে ছিল শহীদ আসাদের রক্তমাখা শার্ট।৬৬ এ মিছিল সম্পর্কে ২২ জানুয়ারি, বুধবার, ১৯৬৯ দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়ঃ
“মিছিলে অসংখ্য কালাে পতাকা ও রক্ত আঁকা ফেষ্টুনও বহন করা হয়। মিছিলে ছাত্রছাত্রী, কিশাের, মহিলা, শ্রমিক, কর্মচারী, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, দোকানদার, রাজনীতিক, পরিষদ সদস্য, শিল্পী, সাহিত্যিক সহ সকল নাগরিক যােগদান করেন। স্মরণকালের মধ্যে এতবড় মিছিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় নি। এই বিশাল গণমিছিলের দৃপ্ত পদভারে ও বজ্র নির্ঘোষ আওয়াজে ঢাকার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠে। মিছিল যতই অগ্রসর হতে থাকে, ইহার কলেবরও ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলা থেকে ২২ জানুয়ারি, বুধবার দুপুর একটায় এক ঐতিহাসিক শােক মিছিল বেরিয়ে ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে। ২৩ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মশাল মিছিলের জন্য বিকেল থেকেই দলে দলে ছাত্রছাত্রীরা জমায়েত হতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায়। সন্ধ্যা হতে না হতেই উপস্থিতির সংখ্যা দাঁড়ায় লক্ষাধিক। সর্বস্তরের মানুষ যােগ দেয় এই জমায়েতে। মশাল মিছিলের শুরুতে হঠাৎ প্রচারিত একটি প্রচারপত্রের বক্তব্য নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক।৬৭ ছাত্রলীগ প্রশ্ন তােলে, সংগ্রামী ছাত্র সমাজের নামে কে এই প্রচারপত্র বিলি করেছে? মিছিল বেরুনাের আগে এর বিরুদ্ধে নিন্দাপ্রস্তাব গ্রহণের চেষ্টা হলেও ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) এর কারণে তা সম্ভব হয় নি। প্রচারপত্রটি প্রকাশের দায়িত্বে ছিলেন মেনন গ্রুপ এর নূর মােহাম্মদ খান ও মাহফুজ উল্লাহ। ২৩ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার যে মশাল মিছিল বের হয় তা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে তখন পর্যন্ত বৃহত্তম মশাল মিছিল। বিশ্ববিদ্যালয় বটতলা থেকে বের হয়ে ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে মিছিল শেষ হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। কর্মসূচি ঘােষণা করা হয়, ২৪ জানুয়ারি, শুক্রবার, ১৯৬৯ হরতাল।
ঐ সময় মেনন গ্রুপের আত্মগােপনকারী সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ ঢাকায় ফিরে আসেন। এ নিয়ে সংগঠনে দীর্ঘ আলােচনা শেষে ২৩ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার রাতে সিদ্ধান্ত হয় ২৪ জানুয়ারি, শুক্রবার তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন। কেননা গ্রেফতার হলেও মুক্তি অনিবার্য। একই তারিখে মতিয়া গ্রুপের সভাপতি সাইফউদ্দিন আহমদ (মানিক)ও আত্মগােপন অবস্থা থেকে জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করেন। এদের দুজনের নামেই ১৯৬৮ সালে গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি হয়েছিল। এই অবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক স্মারকগ্রন্থে তাকে উদ্ধৃত করে মােহাম্মদ হাননান লিখেছেন, “আমি আর মাহবুব উল্লাহ ২৪ জানুয়ারি আত্মগােপন অবস্থা থেকে প্রকাশ্যে বের হয়ে আসি। এদিন পূর্ব ঘােষিত হরতালে ঢাকা শহর মানুষে মানুষে প্লাবন ডেকে আনে। সেনাবাহিনীও তলব করা
=================================================================
৬৬ মিছিলের অগ্রভাগে আসাদের এই রক্তরঞ্জিত শার্টটিই কবি শামসুর রাহমানকে আসাদের শার্ট
কবিতাটি লিখতে উদ্বুদ্ধ করে।
৬৭ পূর্ণ বিবরণের জন্য পরিশিষ্ট- ট দেখুন।
পেজ-৫৬
হয়েছিল সেদিন। সমগ্র শহর এক অভূতপূর্ব শিহরণে জেগে উঠে। ছাত্র-জনতার মধ্যে এমন একটা লড়াকু মনােভাব জাগ্রত হয়ে উঠে যে, তা যে কোনাে সময় উশৃংখল হয়ে উঠতে পারতাে। ছাত্র নেতারাও জনতার এই অগ্নিমূর্তি দেখে ভয়াবহ কিছুর আশংকায় ভাবিত হয়ে পড়েছিলেন। এই অবস্থায় ছাত্র নেতৃবৃন্দ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। অবশেষে শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় দরুদ পাঠ করার জন্য মাইকে ঘােষণা দেওয়া হয়। দরুদ পড়ার ঘােষণা সেদিন লক্ষ প্রাণ রক্ষার সহায়ক হয়ে উঠেছিল। শহীদদের জানাজা শেষে দরুদ পড়তে পড়তে মিছিল পল্টন ময়দান থেকে এগিয়ে যায় ইকবাল হলের দিকে। জনতার মিছিলের জঙ্গিভাব অপেক্ষাকৃত শান্ত হয়ে আসে। ইকবাল হলে এ সময় এক বিশাল ছাত্র-জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে আমি, তােফায়েল আহমদ ও মাহবুব উল্লাহ বক্তৃতা করি। ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সিরাজুল আলম খানও সেদিন বক্তৃতা করেছিলেন।”
আসাদের মৃত্যু সম্পর্কে ২৬ জানুয়ারি, রবিবার, ১৯৬৯ সাপ্তাহিক ‘জনতায়’ নিম্নোক্ত সম্পাদকীয়টি প্রকাশিত হয়। এই সম্পাদকীয় মন্তব্যের শিরােনাম ছিল “নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান…”। তখন জনতার সম্পাদক ছিলেন আনিসুজ্জামান।৬৮ এ সম্পাদকীয় কলামে মন্তব্য করা হয়ঃ
“গণতন্ত্রের সংগ্রাম ক্রমশঃ ব্যাপকতর ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দুর্বার গতিতে সামনে এগােচ্ছে। ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, জনতার ব্যাপকতম অংশ এ সংগ্রামে শরীক হয়ে স্বৈরতন্ত্রের জুলুম-জবরদস্তি মােকাবেলায় এগিয়ে এসেছে। ক্ষমতাদর্পী শাসকের দ্রুকুটি এবং নির্যাতন নিপীড়নের বীভৎস আয়ােজন দেখে জনগণ আর ভীত হচ্ছে। না। দেশের আপামর জনসাধারণ আজ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনপণ করে এগিয়ে আসছে। কেননা দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর তারা আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি
================================================================
৬৮ এ দেশের বামপন্থী ও মার্কসবাদী মহলের মুখপত্র হিসেবে ১৯৬৩ সনের ৪ সেপ্টেম্বর সাপ্তাহিক জনতা প্রথম প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির মালিক ও সম্পাদক ছিলেন দানবীর রনদা প্রসাদ সাহার (যিনি আর পি সাহা হিসেবে অধিক পরিচিত) জামাতা, আইনজীবী ব্যারিস্টার শওকত আলী খান (মরহুম)। ১৬/২০ নব রায় লেনের আরফান প্রেস থেকে মুদ্রিত পত্রিকাটির প্রকাশক ছিলেন বেগম বিজয়া খান। এই পত্রিকা প্রকাশের পেছনে এককভাবে দায়িত্ব পালন করেন মওলানা ভাসানী। জনতার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন আনােয়ার জাহিদ, বার্তা সম্পাদক ছিলেন মােহাম্মদ সুলতান। প্রকাশের স্বল্প সময়ের মধ্যে পত্রিকাটি ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা অর্জন ও ঈর্ষণীয় প্রচার সংখ্যা অর্জন করে। ছাত্র আন্দোলনের প্রতি কঠিন সমর্থন জ্ঞাপনের অপরাধে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আনােয়ার জাহিদ ১৯৬৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হন। বিদেশ থেকে ফেরার পর ১৯৬৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর শওকত আলী খান গ্রেফতার হন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে ভাঙন দেখা দিলে শওকত আলী খান মওলানা ভাসানী বিরােধী ক্যাম্পে যােগ দেন এবং ১৯৬৪ সালের ৯ অক্টোবর আনােয়ার জাহিদ ও অন্য দুজন তাদের চাকরি হারান। সম্পাদক হিসেবে যােগ দেন এম. আনিসুজ্জামান (মরহুম) এবং পত্রিকাটি বন্ধ হওয়া পর্যন্ত তিনি সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আনিসুজ্জামান বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিযুক্ত হন। শওকত আলী খান আওয়ামী লীগের টিকেটে ১৯৭০ সালে পাকিস্তনি জাতীয় সংসদ ও ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।
পেজ-৫৭
করেছে যে, গণ অধিকার কায়েমের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, সংগ্রামের কন্টকে আকীর্ণ। সে পথ দিয়ে সামনে এগােতে হলে পদে পদে ক্ষত বিক্ষত হতে হবে, দুর্যোগের ভয়াল অমানিশা অতিক্রম করেই তবে ভােরের নবারুণকে আহ্বান জানাতে হবে। জনসাধারণ তাই ভয় মুক্ত হয়ে ক্রান্তিকালের ডাকে সাড়া দেবার জন্য দলে দলে পথে বেরিয়ে আসছে।
সংগ্রামী ছাত্র নেতা আসাদুজ্জামান এই ক্রান্তি যজ্ঞে আত্মাহুতি দিয়ে শহীদ হয়েছে। এদেশের অধিকার হারা নিপীড়িত জনতার মুমূর্ষ মুখে জীবনের হাসি ফুটিয়ে তােলার অমর সাধনায় আসাদ নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে। আসাদ নিজের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে সংগ্রামের শুকনাে ময়দান উর্বর করে গেছে। আসাদের মৃত্যু তাই সহস্র সহস্র মানুষের প্রতিদিনের স্বাভাবিক মৃত্যুর মত সাধারণ ঘটনা নয়। যে দেশে ক্ষুধা, পিপাসায় কাতর অসহায় মানুষ বাঁচার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে ‘শুধু দু’টি অন্ন খুঁটি কোন মতে ক্লিষ্ট প্রাণ’ বাঁচিয়ে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে, সে দেশের জনতার সকল অধিকার নিয়ে ‘স্ফীতকায় অপমান অক্ষমের বক্ষ হতে রক্ত শুষি করিতেছে পান লক্ষ মুখ দিয়া,’ যে দেশে ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে,’ সে দেশের নির্যাতিত জনতার ‘প্রাণ শুষ্ক ভগ্ন বুকে’ আশার প্রত্যয় জাগিয়ে তােলার জন্য আসাদ শাহাদাৎ বরণ করেছে।
আসাদের আত্মদান তাই অসাধারণ, এমন অসাধারণ যা ইতিহাসের পাতায়ই শুধু স্থান পায় না, ইতিহাসের মােড় ঘুরিয়ে দেয়। আসাদের জানাজায় তাই দুই লাখ লােক শরীক হয়েছে, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা দলে দলে নগ্ন পায়ে তার শােক মিছিলে যােগ দিয়ে জালেমশাহীর বিরুদ্ধে গগণ বিদারী সংগ্রামী ধ্বনি তুলেছে। আসাদের হত্যার প্রতিবাদে সারা পূর্ব পাকিস্তানের ছয় কোটি মানুষ ধর্মঘট করে জুলুমের মূলােৎপাটনের বজ্ৰ শপথ নিয়েছে। আসাদ জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছে – ‘যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তােমার চেয়ে, যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পালাইবে ধেয়ে।’ আসাদের মৃত্যু গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নতুন শক্তি সঞ্চার করেছে, ভীত সংকুচিত ক্রীতদাসদের দূরে হটিয়ে দিয়ে সংগ্রামী জনতার হাতে আন্দোলনের নেতৃত্ব তুলে দিয়েছে।
আসাদের জন্য আমরা তাই কাঁদবাে না। আমাদের চক্ষু যদি প্লাবিত হয় হােক, কিন্তু সে অশ্রুর বন্যায় যেন জালেমের মৃত্যুর গর্জন ধ্বনিত হয়। আসাদের জন্য আমরা শােক করবাে না। আমাদের হৃদপিণ্ড যদি বেদনার অগ্নি দহনে ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে তবে সে দহন যেন জালেমের সমাধি রচনার হােম হুতাশনে পর্যবসিত হয়। আসাদের জীবনাহুতির মধ্য দিয়ে অধিকার হারা জনতার মুমূর্ষ অন্তর যেন মৃত্যুঞ্জীয় শক্তির বিজলী স্পর্শে জেগে ওঠে। কোটি জনতার মুক্তির সংগ্রামে আসাদ শহীদ হয়েছে। শহীদ আসাদের রক্তদান বৃথা যাবে না। মানুষের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে আর একটা অমর নাম – আসাদ।”
২৪ জানুয়ারি, শুক্রবার, ১৯৬৯ গণ জাগরণের জোয়ার প্লাবিত করে দেয় ঢাকা শহরকে। দুপুরের দিকে ১ ডিআইটি এভিনিউতে (বর্তমানে রাজউক এভিনিউ) অবস্থিত দৈনিক
পেজ-৫৮
পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ অফিস, এবং বিভিন্ন স্থানে মুসলিম লীগের অফিস ও নেতাদের মালিকানাধীন পেট্রোলপাম্পে জনতা আগুন লাগিয়ে দেয়।৬৯
এ জন্যেই পরবর্তী সময়ে এ তারিখকে গণঅভ্যুত্থান দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এদিন সেনাবাহিনীর গুলিতে সেক্রেটারিয়েটের সামনে প্রথম মৃত্যুবরণ করে রুস্তম। রুস্তমের লাশ কাঁধে করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন ন্যাপ নেতা আনােয়ার জাহিদসহ কয়েক জন। পরবর্তী পর্যায়ে গুলিতে নিহত হয় স্কুল ছাত্র মতিউর। সমগ্র নগরী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। দুপুরে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জানাজা শেষে লক্ষাধিক লােকের মিছিল পুরনাে ঢাকার পথ অতিক্রম করে এসে পৌঁছে ইকবাল হলের মাঠে। এখানে অনুষ্ঠিত জমায়েতে বক্তৃতা করেন শহীদ মতিউরের পিতা। তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে ঘােষণা করেন ‘এক মতিউরকে হারিয়ে আজ আমি হাজার মতিউরকে পেয়েছি।’ সেদিন টহলদানকারী সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে ঢাকায়, আদমজীনগরে পুলিশের গুলিবর্ষণে এবং নারায়নগঞ্জে ছাত্র-জনতার উপর পুলিশের কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও ব্যাটন চার্জে ২ জন নিহত এবং তােলারাম কলেজের কয়েকজন অধ্যাপকসহ কমপক্ষে ৩০ জন ছাত্র আহত হয়। খুলনার দৌলতপুর ও খালিশপুরে পুলিশের গুলিবর্ষণে ৩ জন নিহত ও বহু আহত হয়।
সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকা শহরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সরকার সেনাবাহিনী তলব করে। সন্ধ্যায় যুগপৎ এক বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে গভর্নর মােনায়েম খান ঘােষণা করেন, বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করার জন্য সেনাবাহিনী তলব করা হয়েছে এবং শহরের নিয়ন্ত্রণভার সেনাবাহিনীর হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও ঘােষণা করেন, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সান্ধ্য আইন বলবৎ থাকবে। সান্ধ্য আইন জারির পর থেকে এক থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করতে থাকে।৭০ ২৪ জানুয়ারি, শুক্রবার, ১৯৬৯ রাতে তেমন উল্লেখযােগ্য কোনাে ঘটনা ঘটে নি। কিন্তু ২৫ জানুয়ারি, শনিবার, সেনাবাহিনী ও ইপিআর ঢাকা শহরে এক নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। বেপরােয়াভাবে গুলি চলে নিরীহ জনসাধারণের উপর। বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানাের সময় নাখালপাড়ায় গুলিতে নিহত হন আনােয়ারা বেগম। দু’এক জায়গায় জনগণ সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করার চেষ্টা করলেও কোনাে সংঘর্ষ বাঁধে নি।
এ দিন গুলিবর্ষণে ৬ জন নিহত ও ১৪ জন আহত হন। সরকারি প্রেসনােটে বলা হয়, সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করায় গুলিতে ৩ জন নিহত ও ১০ জন আহত হয়েছে। ময়মনসিংহে শােক মিছিলের উপর পুলিশী হামলায় বহু লােক আহত হয় এবং ৮৪ জন কারাবরণ করেন। সরকার ২৫ জানুয়ারি, শনিবার সন্ধ্যায় সান্ধ্য আইনের মেয়াদ আরও ২৪ ঘন্টা বাড়ায় এবং ২৬ তারিখ বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত তিন ঘন্টা বিরতি প্রদান করে। অন্যদিকে নারায়নগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ, ডেমরা এবং খুলনায় সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। ২৬ জানুয়ারি
==============================================================
৬৯ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় বাংলা ভাষা বিরােধী অবস্থানের কারণে মর্নিং নিউজ পত্রিকায়
অগ্নিসংযােগ করা হয়েছিল।
৭০ দৈনিক পাকিস্তান, ২৫ জানুয়ারি, শনিবার, ১৯৬৯।
পেজ-৫৯
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক, শামসুদ্দোহা, আবদুর রউফ, খালেদ মােহাম্মদ আলী, মােস্তফা জামাল হায়দার, মাহবুব উল্লাহ, তােফায়েল আহমেদ, নাজিম কামরান চৌধুরী, মাহবুবুল হক (দোলন) ও ইব্রাহিম খলিল এক বিবৃতিতে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহারের দাবি জানান। কিন্তু এই বিবৃতির অন্য দুটি উল্লেখযােগ্য বিষয় ছিল, গুলি বর্ষণ, বেয়নেট চার্জ ও লাঠির আঘাতে আহতদের জন্য রক্ত দান করার এবং আন্দোলনের সময়ে গুলিবর্ষণে শহীদ ও আহতদের পরিবার-পরিজনদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসার আহ্বান। বিবৃতিতে তােফায়েল আহমেদ, ডাকসু সহ সভাপতি, ৩১৩ ইকবাল হল, ঢাকা এই ঠিকানায় নিহত ও আহতদের সাহায্যার্থে অর্থ পাঠানাের অনুরােধ করা হয়।৭১
নিরীহ মানুষের উপর সান্ধ্য আইনের হামলায় সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রতিবাদে পশ্চিম পাকিস্তানেও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। অবস্থা চরমে পৌছুলে ২৭ জানুয়ারি, সােমবার, ১৯৬৯ করাচী ও লাহােরে সেনাবাহিনী তলব করা হয় । ঐ তারিখে গুলিতে করাচীতে একজন নিহত এবং অনেকে আহত হয়। লাহাের ও করাচীতে জারি হয় সান্ধ্য আইন। ২৭ জানুয়ারি, সােমবার পেশােয়ারে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তলব করা হয় সেনাবাহিনী। জনগণ আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলে বহু লােক আহত হয়। ২৯ জানুয়ারি, বুধবার সেনাবাহিনীর গুলিতে গুজরানওয়ালায় ৩ জন নিহত হয়।
২৪ জানুয়ারি, শুক্রবারের গণবিক্ষোভ সম্পর্কে ২৬ জানুয়ারি, রবিবার, ১৯৬৯ দৈনিক আজাদে ‘শুক্রবারের সর্বাত্মক হরতালে সাধারণ মানুষকে যেমন দেখেছি – নয়া ইতিহাস লিখেছে ধর্মঘট, রক্তে রক্তে আঁকা প্রচ্ছদপট’ শিরােনামে নিম্নলিখিত প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়ঃ
“শুক্রবার ঢাকা শহর ছিল মিছিলের শহর। ভােরে কাক ডাকার আগেই প্রতিটি মহল্লায় তরুণ, কিশাের, যুবকবৃন্দ মােড়ে মােড়ে জমায়েত হয়, আর খন্ড খন্ড মিছিলে শরিক হয় – নিজ নিজ এলাকা পরিক্রমণ করে। সবার চোখে আগুনের হুক্কা, মুখে নির্ভীক ভ্রুকুটি, আর কষ্ঠে বুলন্দ আওয়াজ। মহল্লার এ সব খন্ড মিছিলে আমি দেখেছি পানওয়ালা, মজুর, রিক্সাওয়ালা আর সাধারণ মেহনতী মানুষ। কিন্তু তাদের মহল্লা ঘােরার বুঝি দরকার ছিল না। কারণ কোন দোকানপাট, যানবাহন চালু ছিল না, এমন কি কাঁচাবাজারগুলােও জনশূণ্য অবস্থায় খা খা করছিল। অভিজাত আবাসিক এলাকার অফিসার আর উর্ধ্বতন কর্মচারী, বিভিন্ন অফিস আদালতের কিছু সংখ্যক সাধারণ কর্মচারী কাক ডাকা ভােরে চোখে পানি দিয়ে মুখে কিছু গুজে অফিসের দিকে পায়ে হেঁটে রওনা দেয়, এমন কিছু অফিসারের সাথে
================================================================
৭১এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কি পরিমাণ অর্থ এসেছিল সে কথা কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারেন নি। অবশ্য এ নিয়ে কিছু ভুল বােঝাবুঝিও হয়। ছাত্রনেতা শামসুদ্দোহা তার ইতিহাসের অল্প কথা বইতে মন্তব্য করেছেন, “পরবর্তীকালে সংগৃহীত সাহায্য বিষয়ে কোনাে দিন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কোনাে সভায় জমা অর্থ ও সাহায্য প্রদান সম্পর্কে আলােচনা হয় নাই।”
এ আবেদনের পূর্ন বিবরণের জন্য পরিশিষ্ট-ঠ দেখুন। সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র: দ্বিতীয় খন্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, নভেম্বর ১৯৮২, পৃষ্ঠা- ৪১৮-৪১৯।
পেজ-৬০
আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। তাদের একজন বলেন – কি করব ভাই, ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার করি, চাকরিটাতাে রাখতে হবে। হেঁটে এই সকালে রওনা হয়েছি। তবে আমার কোন দুঃখ নেই, আজকে হেঁটে কষ্ট করছি এই ভরসায় সুদিন আমাদের আসবেই। একজন নিম্ন বেতনভুক কর্মচারী বললেন – বিশ্বাস করুন, এই মিছিলে শরিক না হতে পেরে ক্ষোভে নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে নিজের চুল দুহাতে ছিড়তে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, যাক শালার চাকুরী। আবার পরক্ষণে সংসারের দায়ের কথা মনে পড়ছে, আপনি খবরের কাগজের লােক। বুকে হাত দিয়ে বলছি ভাই ছাত্র ভাইদের সাথে ঝাপিয়ে পড়তে আমাদেরও মন চাইছে – কি করব আমাদের উপায় নেই। তবে ওদের জানাবেন আমাদের বুকেও আগুন জ্বলছে। তুষের আগুনের মত ধিকি ধিকি জ্বলছে। এক বুড়াে বললেন – জানি আমাদের অফিসে যেতে দেখে আপনারা ধিক্কার দিচ্ছেন। কি করব আমরা নিরুপায়। সরকারি চাকুরী করি, নিয়মের দাস আমরা, তবে আমি দোওয়া করছি যারা মানুষের জন্য প্রাণ দিচ্ছে তারা যেন জয়ী হয়। আমার বয়স ৬০ বছর। আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। খােদা আমার দোওয়া শুনবে। ওদের ভাল হবে, সবার ভাল হবে। বলতে বলতে বুড়াে কেঁদে ফেললেন।
সকাল দশটার মধ্যেই সারা শহর অগণিত খন্ড মিছিলের শহরে পরিণত হয়। সব পথে মিছিল, কোথাও শ্রমিকের মিছিল, কোথাও মেহনতী মানুষের মিছিল। মিছিল আর শ্লোগান। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই মানুষের মিছিল আর যেদিকেই কান যায় সেদিকেই বিক্ষুব্ধ মানুষের শ্লোগান। সূর্যের তাপ যত প্রখর হয়, রাজধানীর পরিবেশ তত প্রতিবাদমুখর হয়। এরই মধ্যে পাঁচ-ছয় হাজার মানুষের একটি মিছিল মতিঝিলের বাণিজ্যিক এলাকায় যেতে থাকে। তারপর তারা শুরু করে এক অভিনব আবেদন। বিভিন্ন আবেদন। বিভিন্ন অফিসের চার দিক ঘিরে হাতজোড় করে আবেদন করতে থাকে তারা – ভাইসব বেরিয়ে আসুন, ছাত্র হত্যার প্রতিবাদ করুন, আমাদের মিছিলে শরীক হােন। যারা চাকরি রক্ষার দায়ে সকল আবেগ আর অনুভূতিকে চোখ-মুখ, কান ঝুঁজে রােধ করে অফিসে এসেছিল মিছিলের কান্নাভেজা শ্লোগান তাদের বুকে গিয়ে বাজে। আর নয়, আর নয় বিবেকের সাথে ছলনা (একজন কর্মচারী এ উক্তি করেছেন) এবার তারা দলে দলে ছােটেন অফিসের বাইরে। সব কর্মচারী, পিওন-চাপরাশী, বড় সাহেব, ছােট সাহেব সবাই মিছিলে নামে। এমনকি ওয়াপদার চেয়ারম্যান জনাব মাদানী, ডিআইটির চেয়ারম্যান জনাব খায়ের, এডিসির চেয়ারম্যান জনাব আহসানও বেরিয়ে আসেন, কর্মচারীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মিছিলে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে ঘােষণা করে শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।
জনাব খায়ের তাে মিছিলের সাথে বেশ কিছুক্ষণ এগিয়ে যান। জনাব আহসানের চোখে আমি পানি দেখেছি। এভাবে পাঁচ হাজারের মিছিল পনের হাজারে পরিণত হয়। গােটা শহর বিক্ষোভের নগরীতে পরিণত হয়। যেদিকেই যাই, দেখি শুধু হাজারাে মানুষের বলদৃপ্ত পদভারে থর থর কম্পমান রাজধানীর রাজপথ। তখন আমি ছিলাম এস এম হলের সামনে একটা পাঁচ হাজারী মিছিলের পার্শ্বে। হাজারীবাগের শ্রমিক, লালবাগের শ-কয়েক মেহনতী মানুষ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের
পেজ-৬১
ছাত্ররা। এমন সময় দেখি, পাঁচ-সাত জন ছাত্র খালি পায়ে পাগলের মত ছুটে আসছে। ওরা এসে কাঁদতে কাঁদতে ঘােষণা করল-ওরা আবার গুলী করেছে, আবার মানুষ মেরেছে। কী? সমগ্র মিছিল স্তম্ভিত। বিক্ষুব্ধ মানুষগুলি যেন মৃতপ্রায়, নীরব নিথর হয়ে গেল। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল খবর আবার মরেছে, মানুষ মরেছে। দশ মিনিট হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে থাকল মিছিল। হু হু করে কেঁদে ফেলল অনেক ছাত্র। শুরু হল কান্নার শ্লোগান – মরেছে, মরেছে, ভাই মরেছে। কান্না মাখা শ্লোগান কত মর্মস্পর্শী হতে পারে, তা বুকের কত গভীরে যেয়ে বাজতে পারে তা এখানে যারা ছিলেন না তাদের বােঝানাে যাবে না। এমন সময় রােকেয়া হলের ছাত্রী মিছিলটা এল। আবার মৃত্যুর খবর শুনে মেয়েরা শব্দ করে কেঁদে উঠল। সে কি কান্না! সে কি দৃশ্য! অকস্মাৎ মিছিলের রূপ পাল্টে গেল। যে মিছিল ছিল প্রতিবাদ, শােক প্রকাশ আর বিক্ষোভের মিছিল, মুহূর্তে তা পরিণত হল জঙ্গী মিছিলে। মুহূর্তে কান্না ভুলে গেল তারা, চোখের জল দুহাতে মুছে বজ্রমুষ্টি আকাশে ছুড়ে তারা ঘােষণা করল “জ্বালাে জ্বালাে – আগুন জ্বালাে। দিকে দিকে আগুন জ্বালাে, শহীদের রক্ত বৃথা যাবে না, আসাদ ভাইয়ের রক্ত বৃথা যাবে না।” কিছু মেয়েরা তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। হঠাৎ দেখলাম একজন ছাত্র মিছিলের পুরােভাগে এসে শাণিত কণ্ঠে ঘােষণা করলাে – “বােনেরা আমার, আমরা কাঁদব না। কেঁদে কেঁদে তাদের দেখানাে চলার পথ আমরা পিচ্ছিল করে দেব না, ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান, আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা দেবে কোন বলিদান?” বােনেরা আজ আসাদ ভাই এসে দাঁড়িয়েছে, আসুন কে দেবেন বলিদান? বুলেটকে আমরা পরােয়া করি না। আমরা জানি বুলেট শুধু রক্ত ঝরাতে পারে – প্রাণ অথবা অন্য কিছু নয়। ছেলেটির বক্তৃতার পর পরই দেখলাম মিছিলটা দৌড়াতে শুরু করল। আমায় ছেড়ে মিছিলটা চলে গেল। শুনলাম, তারা ভাইয়ের লাশ আনতে গেল। তখন মহল্লায় মহল্লায় যেয়ে দেখলাম সেখানকার রূপ পাল্টে গেছে। প্রতিবাদের স্থলে দেখলাম একটা থম থমে ভাব। মুখে মুখে ফিরছে, শুনেছ শহরে আবার গুলী হয়েছে। বাড়ির দরজায় দরজায় বুড়াে, গিন্নীদের শুকনাে মুখ। তরুণ ও যুবকরা তখন মিছিলে গেছে।
গেন্ডারিয়া, কমলাপুর আর নওয়াবগঞ্জের আবাসিক এলাকায় আমি দেখেছি এক মর্মান্তিক দৃশ্য। এইসব এলাকার বাড়িতে বাড়িতে মরা কান্নার বিলাপ শুনেছি। ছােট খােকনকে বুকে চেপে ধরে মাকে বলতে শুনেছি না, কিছুতেই আর সহ্য করব না। আমার যাদুদের খুন আর নিতে দেব না। নওয়াবগঞ্জের এক প্রৌঢ় বলেছেন – নয় বছরের রুস্তমকে কেন মারল ওরা? ওরা আমাদের দেখতে পায় না। আমাদের গুলী করুক। বুড়ােদের গুলী করুক, নয় বছরের নিস্পাপ শিশু কি দোষ করেছে? গেন্ডারিয়ার সেই ইমামের ফরিয়াদ, আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না। মসজিদের সেই ইমাম হত্যার খবর শুনে মােড়ের পানের দোকানের সামনে দুই হাত আকাশের দিকে তুলে ফরিয়াদ করল, হে খােদা তুমি দেখ না, জালেমের এই অত্যাচার তুমি কি দেখ না। এই মাসুম বাচ্চাদের খুন করলে তুমি? কি দেখ না? হে রহমানের রহিম, তুমি গজব নাজেল কর খােদা, তুমি গজব নাজেল কর। এ আর সহ্য হয় না।
পেজ-৬২
সে সময় ইমামের সাথে আর যারা ছিল সবাই মুনাজাতের মত হাত তুলে ফঁপে ফুপে কাঁদছিল। সেখান থেকে প্রেস ক্লাবে আসার পথে একটা কবিতা আমার কানে বাজল: “যাহারা তােমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলাে, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালাে?
প্রেসক্লাবে এসে খবর পেলাম বিক্ষোভ আর মিছিলের। খবর পেলাম বিক্ষুব্ধ জনতা আগুন লাগিয়েছে প্রেস ট্রাস্ট কাগজের অফিসে আর সেক্রেটারিয়েট ভবনের দেওয়ালে। খবর পেলাম সংঘর্ষের। তখন ৪টা হবে। দেখলাম লাশ নিয়ে মিছিল আসছে একটা, দুইটা, তিনটা লাশ। লক্ষ লক্ষ জনতা সে মিছিলে। কারখানার শ্রমিক দেখলাম। তার হাতে ব্যানার ‘ছাত্র আসাদ আমাদের ভাই, শ্রমিক ফেডারেশন।’ লাঙ্গল আর কোদালবাহী কৃষক দেখলাম, তাদের হাতে ব্যানার, ‘ছাত্র হত্যার বিচার চাই, কৃষক সমিতি।’ অগণিত জনতা সে মিছিলে। শুধু মানুষ আর মানুষ। আমি হারিয়ে গেলাম সেই মানুষের ভিড়ে, মিছিলের পথে পুলিশ আর ইপিআর ছিল। কিন্তু তারা ছিল একবােরে নীরব। মিছিল এসে থামলাে অনেক সংগ্রামের সূতিকাগার ইকবাল হলে। ইকবাল হল ময়দান কালাে কালাে মাথায় ভরে গেল। শুরু হােল ছাত্রদের সভা।
শুরুতেই লাশ ঘাড়ে করে সভার প্রত্যেক প্রান্তেই ঘুরিয়ে নেওয়া হল। সে সময় সৃষ্টি হল আরেক মর্মভেদী দৃশ্য। শহীদের মুখ এক নজর দেখার জন্য সবার সে কি আকুতি। ছাত্ররা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, ভাইসব বসুন। কিন্তু কে শােনে কার কথা। শহীদের লাশ দেখে সবার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। কেউ আবার হু হু করে কেঁদেও উঠলেন। ছাত্ররা বলল তাদের বক্তব্য। ঘােষিত হলাে তাদের মুক্তি সনদ মহান ১১ দফা। এরপর মতিউর রহমানের শােকাতুর পিতা আজহার মল্লিক এক হাতে কাঁধে ভর দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘােষণা করলেন – আমার দুঃখ নাই, আমার মতিউর মরেছে, আমি হাজার মতিউর পেয়েছি। আমার দুঃখ নাই। সে সময় মনে পড়লাে আরও দুটি ঘটনা। একটি ১৩ বছরের শিশু রুস্তমের নানার। আমার রুস্তম অমর, আপনাদের মধ্যে বেঁচে আছে। আর অপরটি শিবপুর থেকে পাঠানাে শহীদ আসাদের মায়ের বাণী। সে বাণীতে বলা হয়েছে – আমার আসাদের মৃত্যু হয় নি। আমার আসাদ বলত ‘মা আগামী দশ বছরের মধ্যে এই মাতৃভূমি নতুন জীবন পাবে। আমার আসাদের এই স্বপ্ন তােমরা সার্থক কর।’ শহীদ আসাদের পথ ধরে প্রাণ দিল ১৩ বছরের কিশাের রুস্তম, ১৭ বছরের ছাত্র মতিউর, ১৫ বছরের মকবুল আরও নাম না জানা কতজন কে জানে? আমি ভাবছি পৃথিবী কি উল্টো ঘুরছে? কোথায় কখন কবে কোন তারা ঝরে যায় আকাশ কি তার হিসাব রাখে না? পরক্ষণই শুনলাম, আবার শ্লোগান। ভাবলাম, “পৃথিবী আজ উল্টো ঘােরে নি, এগিয়ে গেছে।”
চব্বিশে জানুয়ারির ঘটনা সম্পর্কে ১৯৬৯ সালের ২৫ জানুয়ারি, শনিবার সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকা মন্তব্য করে:
“ছাত্রসমাজ চিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্রে জনবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক দলগুলাের চেয়ে অনেক বেশি প্রাগ্রসর ছিল। তারা নিজেরাই রাজনৈতিক আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেওয়ার
পেজ-৬৩
চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। চিন্তা ও কর্মের দৃঢ়তার মধ্য দিয়ে ছাত্রসমাজ জনগণের মনে অভূতপূর্ব সাহসের জন্ম দেয়। যখন রাজনৈতিক দলগুলাে দাবি-দাওয়া সংশােধনে ব্যস্ত, তখন ১১ দফা কর্মসূচির ব্যানারে জনগণকে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে উৎসাহিত করেছে ছাত্র সমাজ। গুছানাে রাজনৈতিক দলগুলাে ছাত্রদের দাবি দাওয়ার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে নি। ছাত্ররা যার ভিত্তিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে তা সহজেই সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করতে পারে। দেশ এবং জনগণ ব্যাপকভাবে তাদের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে।”
এগার দফা আন্দোলন যখন উত্তাল তরঙ্গে পরিণত হয়েছে তখন আত্মগােপনকারী কমিউনিস্ট পার্টি (পিকিংপন্থী) দ্বিধা বিভক্ত। মনি সিংহের নেতৃত্বাধীন এক অংশ আনুগত্য প্রকাশ করেছে মস্কোর অনুসৃত রাজনীতির প্রতি। অন্য অংশ, যাঁরা পিকিংপন্থী বলে পরিচিত তাদের মধ্যেও মতাদর্শগত সগ্রাম ছিল তীব্রতর। পিকিংপন্থীদের মূল পার্টির নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি। এ সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সুখেন্দু দস্তিদার, মােহাম্মদ তােয়াহা, আবদুল হক প্রমুখ। এদের সঙ্গে জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে পূর্বাহ্নেই সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন আবদুল মতিন, আলাউদ্দিন আহম্মদ, দেবেন শিকদার (নানা) প্রমুখ। শেষােক্ত দু’জনকে মূল পার্টি থেকে বিনা কারণে বহিষ্কার করা হয়। এরা ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি গঠন করেন এবং এর ভিত্তিতেই পরবর্তী পর্যায়ে গঠিত হয় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি।
কমিউনিস্ট পার্টির মতদ্বৈধতা ছাত্র ইউনিয়নেও (মেনন গ্রুপ) অন্তঃদলীয় বিতর্কের সূচনা করে এবং সিরাজ শিকদার, মাহবুব উল্লাহ, আবুল কাশেম ফজলুল হক প্রমুখের নেতৃত্বে তৃতীয় মত বিকশিত হয়। ১৯৬৬ সালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য হিসেবে সিরাজ শিকদার ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এবং সলিমুল্লাহ হল থেকে আবুল কাশেম ফজলুল হক দপ্তর সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।৭২ আবদুল মতিনদের
=================================================================
৭২ সিরাজ শিকদার ১৯৪৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর শরিয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন।১৯৬৭ সালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী লাভ করেন। এ সময় তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) এর কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ছিলেন। ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ব উদ্যোগে বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য তিনি টেকনাফ গিয়ে বিপ্লবী ঘাঁটি গড়ে তােলার চেষ্টা করেন, ১৯৬৮ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন মাও সে তুং চিন্তাধারা গবেষণা কেন্দ্র। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী গঠন করে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ৩ জুন পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি গঠন করেন যা সর্বহারা পার্টি নামে অধিক পরিচিত ছিল। এই পার্টি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করে। ক্ষমতাসীনদের চোখে তিনি হয়ে পড়েন দেশদ্রোহী। ১৯৭৪ সালে জরুরী অবস্থা জারি হওয়ার পর তাকে ধরার জন্য ব্যাপক তৎপরতা চালানাে হয়। এর পরিণতিতে তিনি ১৯৭৫ সালের ১লা জানুয়ারি চট্টগ্রামের হালিশহরে গ্রেফতার হন। সর্বহারা পার্টির নেতা ও মুজিব শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের নায়ক সিরাজ শিকদার ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি বন্দী অবস্থায় গুলিতে নিহত হন। অনেকেই এটাকে বাংলাদেশে এনকাউন্টারে প্রথম মৃত্যু হিসেবে অভিহিত করেন। সিরাজ শিকদারের মৃত্যুর পর শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, ‘কোথায় সিরাজ শিকদার?’
পেজ-৬৪
নেতৃত্বাধীন পার্টি কাজ চালাত মেঘনা সংঘ নামে। ২১ জানুয়ারি, মঙ্গলবার পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি এবং ৩১ জানুয়ারি, শুক্রবার মেঘনা সংঘ পরিস্থিতি সম্পর্কে দুটি সাইক্লোস্টাইল করা প্রচারপত্র অত্যন্ত গােপনে প্রচার করে।৭৩ পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির প্রচারপত্রটি বিলি হয় ২২ জানুয়ারি, বুধবার বটতলার জমায়েতে। ছাত্রলীগ কর্মীদের মনে এতে ক্ষোভ দেখা দেয়। ছাত্রলীগ তখনও সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করতে পারে নি। তারা এজন্য সরাসরি দায়ী করে মেনন গ্রুপের ছাত্রদের। কিন্তু মেনন গ্রুপের সবাই এজন্য দায়ী ছিলেন না। মেনন গ্রুপের অভ্যন্তরে তখন চলছে ত্রিমুখী রাজনৈতিক সংগ্রাম। এক অংশ কাজী জাফর আহমদ, অপর অংশ আবদুল মতিন, এবং তৃতীয় অংশ মূল পার্টির নেতৃত্বে আস্থাশীল। অবশ্য প্রথমােক্ত দু’অংশের সমর্থক ও কর্মী সংখ্যাই ছিল বেশি। এই মতদ্বৈধতা কোনােভাবেই আন্দোলনের ক্ষতি করে নি।
পহেলা ফেব্রুয়ারি, শনিবার, মধুর ক্যান্টিনে আয়ােজিত সভায় ছাত্র নেতৃবৃন্দ ঘােষণা করেন, এগার দফা কর্মসূচির বাস্তবায়ন ব্যতিত কোনাে প্রকার আপােষ মীমাংসার অবকাশ নেই। তারা আরও বলেন, এগার দফা সমর্থন করে না এমন কোনাে দল বা নেতার পেছনে ছাত্রসমাজ থাকবে না। পক্ষান্তরে যে কোনাে রাজনৈতিক দল, নেতা, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রদের তথা শােষিত জনগনের প্রাণের দাবি এগার দফার সমর্থনে এগিয়ে আসবেন, ছাত্রসমাজ তাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শরীক হবে। এ ধরনের বক্তব্যের কারণ ছিল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সরকারের একটি আশু গােলটেবিল বৈঠকের সম্ভাবনা সম্পর্কে কানাঘুষা। ডাকসু সহ-সভাপতি তােফায়েল আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় বক্তৃতা করেন শামসুদ্দোহা, মাহবুব উল্লাহ, খালেদ মােহাম্মদ আলী ও ফখরুল ইসলাম।
ছাত্ররা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের ব্যাপক গ্রেফতারের প্রতিবাদে প্রতীক সাধারণ ধর্মঘট পালন সহ উক্ত ছাত্রসভায় যােগদান করে। সর্বদলীয় ছাত্র সগ্রাম পরিষদ এই ধর্মঘট পালন ও সভানুষ্ঠানের ডাক দিয়েছিল। ছাত্রসভা শুরু হওয়ার বহু আগে থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনের রাস্তায় ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বিভিন্ন মােড়ে মিলিটারী ভ্যান ও ট্রাক মােতায়েন করা হয়। পূর্ব কর্মসূচি অনুযায়ী বেলা বারােটার দিকে ছাত্ররা কলাভবন অঙ্গনে বটতলায় সভানুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ করলে রাস্তায় প্রহরারত মিলিটারী ভ্যান হতে মাইকযােগে ছাত্রদের সভা না করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে মধুর ক্যান্টিন প্রাঙ্গনে সভা অনুষ্ঠিত হয়।
শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি ঢাকায় জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে পরিষদ নেতা খান এ সবুর এগার দফার একটি দাবি ব্যতীত বাকি দশটি দাবিই ছাত্রদের নয় বলে যে মন্তব্য করেন ছাত্র নেতৃবৃন্দ তার জবাবে ঘােষণা করেন, ছাত্ররা এদেশের সমাজেরই সচেতন অংশ। সে হিসাবে দেশের শােষিত জনগনের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক তথা সার্বিক মুক্তির জন্য ছাত্র সমাজ অবশ্যই কর্মসূচি গ্রহণ করবে। দেশের সন্তান হিসাবে এ তাদের পবিত্র কর্তব্য। এর বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত এগার দফার আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। নেতৃবৃন্দ
=============================================================
আবুল কাসেম ফজলুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক।
৭৩পূর্ণ বিবরণের জন্য পরিশিষ্ট- ড ও ঢ দেখুন।
পেজ-৬৫
সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, ১৯৫৮ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করার পরিণতি কখনই শুভ হতে পারে না। তারা বলেন, দেশরক্ষার পবিত্র কাজেই সেনাবাহিনীকে নিয়ােজিত রাখা উচিত। তারা অভিযােগ করেন, গত ১৭ই জানুয়ারি হতে এই পর্যন্ত পুলিশ, ইপিআর ও মিলিটারীর গুলিবর্ষণে কেবলমাত্র ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে শতাধিক ছাত্র ও নাগরিক নিহত হয়েছেন। এমনকি সান্ধ্য আইন বলবৎ থাকার সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনী মা-বােনদের মর্যাদা পর্যন্ত ক্ষুন্ন করতে কুণ্ঠাবােধ করে নি।
শত নির্যাতন, বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও ছাত্র জনতার আন্দোলন এগিয়ে যেতে থাকে। ১ ফেব্রুয়ারি, শনিবার, ১৯৬৯ এক বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বলেন, “শীঘ্রই আলাপ আলােচনার জন্য আমি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলগুলাের প্রতিনিধিবর্গকে আমন্ত্রণ জানাবাে।”৭৪ প্রেসিডেন্টের এই ঘােষণার পর পর, একটি সম্ভাব্য গােলটেবিল বৈঠক সম্পর্কে রাজনৈতিক মহলে আলােচনার সূত্রপাত ঘটে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে নিয়ে। তাদের অনেকেই তখনও কারাগারে বন্দী। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয়, নেতৃবৃন্দকে জেলে রেখে কোনাে আলাপ আলােচনা হতে পারে না। আইয়ুব খান প্রস্তাব করেন, ১৭ ফেব্রুয়ারি, সােমবার, ১৯৬৯ তিনি পিণ্ডিতে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। কিন্তু ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির অনুরােধে আইয়ুব খান ১৯ ফেব্রুয়ারি, বুধবার, বৈঠকের তারিখ পুনঃনির্ধারণের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন এবং যাদের আমন্ত্রণ জানানাে হয় তাদের মধ্যে ছিলেন: মওলানা ভাসানী (ন্যাপ), জুলফিকার আলী ভূট্টো (পিপলস পার্টি), এয়ার মার্শাল আসগর খান (অবসর প্রাপ্ত), লে: জে: আযম খান (অবসর প্রাপ্ত), সৈয়দ মাহবুব মােরশেদ (প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি, ঢাকা হাইকোর্ট)। এ ছাড়াও পাকিস্তান মুসলিম লীগের পক্ষে মমতাজ মােহাম্মদ খান দৌলতানা, খাজা খয়ের উদ্দিন, পাকিস্তান জমিয়াতুল উলেমা-ই-ইসলামের পক্ষে মুফতি মাহমুদ, পীর মােহসেন উদ্দিন দুদু মিয়া, পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (৮ দফা) এর পক্ষে নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান ও আবদুস সালাম খান, পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টির পক্ষে চৌধুরী মােহাম্মদ আলী ও মওলভী ফরিদ আহমদ, পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পক্ষে আব্দুল ওয়ালী খান ও মােজাফফর আহমদ, পাকিস্তান ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক ফ্রন্টের পক্ষে নূরুল আমিন ও হামিদুল হক চৌধুরী, পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (৬ দফা) এর পক্ষে শেখ মুজিবুর রহমান ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং জামায়াতে ইসলামী, পাকিস্তান এর পক্ষে মওলানা আবুল আলা মওদুদী ও অধ্যাপক গােলাম আযমকে আমন্ত্রণ জানানাে হয় । মজার ব্যাপার হচ্ছে, তখন পর্যন্ত রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাবন্দী এবং তাঁর ও অন্যান্য অভিযুক্তের বিচার চলছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতর স্থাপিত বিশেষ আদালতে।
ইতিমধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, শেখ মুজিব প্যারলে পিণ্ডি যাবেন। মওলানা ভাসানী তীব্রভাবে এর বিরােধিতা করেন। গােলটেবিল বৈঠকে যােগদানের প্রশ্ন নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম
=================================================================
৭৪দৈনিক পাকিস্তান, ২ ফেব্রুয়ারি, রবিবার, ১৯৬৯।
পেজ-৬৬
পরিষদেও মতভেদ দেখা দেয়। ৪ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার, ১৯৬৯ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের এক সভায় মধুর ক্যান্টিনে এ নিয়ে বিরােধ বাঁধে। ছাত্রদের অভিমত ছিল গােলটেবিল বৈঠকে যােগদান না করা। এই মনােভাবের পরিচয় পেয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) কর্মী, বরিশালের সন্তান, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, জগন্নাথ কলেজের স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র এনায়েত হােসেন প্রথম শ্লোগান তােলেন, ‘গােলটেবিল না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ।’ সঙ্গে সঙ্গে এর সমর্থনে শ্লোগান ওঠে। গােলটেবিল বৈঠক বিরােধী মিছিল বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। এ সুযােগে তােফায়েল আহমেদ নিজে উদ্যোগী হয়ে ভাসানী বিরােধী প্রচারণা শুরু করেন। বিভিন্ন সভায় তিনি মওলানার বিরুদ্ধে কটুক্তি করতেও দ্বিধা করেন নি। এরই প্রতিবাদে সংগ্রামী ছাত্র সমাজের নামে একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয় ৬ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার, ১৯৬৯।৭৫ এই প্রচারপত্রে মূলত মওলানা ভাসানীর সংগ্রামী ভূমিকার প্রশংসা করা হলেও এ নিয়ে বিরােধ বাধে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে। কিন্তু আন্দোলনের গতি এমনই ছিল যে, এ নিয়ে সংগ্রাম পরিষদ ভেঙ্গে দেওয়ার মতাে সাহস কারও ছিল না।
এ সময়ে আর একটি ঘটনা ঘটে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সাক্ষী হিসেবে জড়িয়ে পড়েন সংবাদ সম্পাদক জহুর হােসেন চৌধুরী। এ সুযােগে তাঁকে ঘায়েল করার জন্য ছাত্রলীগ গােপনে একটি প্রচারপত্র বিলি করে।৭৬ প্রচারপত্রের শিরােনাম ছিল ‘দৈনিক সংবাদ সম্পাদক জনাব জহুর হােসেন চৌধুরী সাহেব বনাম আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা।’ প্রচারপত্রটির মূল উদ্দেশ্য ছিল জহুর হােসেন চৌধুরীর চরিত্র হনন। অবশ্য বিভিন্ন সময়ে তার বিভিন্ন ভূমিকা সম্পর্কেও এতে প্রশ্ন তােলা হয়।।
পরিস্থিতির মূল্যায়ণের জন্য ৬ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার, ১৯৬৯ শেষবারের মতাে পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। বিমানবন্দরে তিনি সংবাদিকদের বলেন, জরুরী অবস্থা প্রত্যাহারের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। পরদিন এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি দেশরক্ষা আইন ও অর্ডিন্যান্সের প্রয়ােগ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন।৭৭ সে মােতাবেক নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস এর উপর থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি, শনিবার, ১৯৬৯ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ৯ ফেব্রুয়ারি, রবিবার শপথ দিবস উপলক্ষে পল্টন ময়দানে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় দুই লক্ষাধিক ছাত্র জনতার এই সভায় ছাত্র
=========================================================
৭৫ পূর্ণ বিবরণের জন্য পরিষ্টি – ণ দেখুন।
৭৬ পূর্ণ বিবরণের জন্য পরিশিষ্ট —ত দেখুন।
জহুর হােসেন চৌধুরী (১৯২২-১৯৮০) ১৯২২ সালের ২৭ জুন জন্মগ্রহণ করেন। এম এন রায়ের অনুসারী জহুর হােসেন চৌধুরী ১৯৩৮ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হয়ে বিএ ডিগ্রী নেন, কিন্তু এমএ শেষ করেন নি। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর তিনি কিছুদিন সরকারি চাকরি করেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত পাকিস্তান অবজারভারে কাজ করেন। এরপর তিনি দৈনিক সংবাদে যােগ দেন এবং ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সেখানে কাজ করেন। জীবনের শেষ দিকে এসে লেখার কারণে কারারুদ্ধ অবস্থায় ১৯৮০ সালের ১১ ডিসেম্বর তিনি পিজি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।
৭৭ দৈনিক পাকিস্তান, ৮ ফেব্রুয়ারি, শনিবার, ১৯৬৯। ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, সােমবার, পাকভারত যুদ্ধ শুরু হলে যে জরুরী অবস্থা জারি করা হয় তখন পর্যন্ত তা বলবৎ ছিল।
পেজ-৬৭
সংগ্রাম পরিষদ ঘােষণা করে, আশু গণদাবি আদায় ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বিরােধী দলীয় নেতৃবর্গকে প্রস্তাবিত গােল টেবিল বৈঠকে উপস্থিত হতে দেওয়া হবে না। জনতা হাত তুলে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের প্রতিও সমর্থন জানায়।
সভায় সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই বাঁচার দাবি এগার দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের অগ্রগতি সাধিত হবে। তাই আজ সংগ্রামী ছাত্র-জনতা জনগণের সরকার কায়েমের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তিনি বলেন, গত দশ বছর একচেটিয়া নির্যাতন ও শােষণের ফলেই আজ গণমানসে অসন্তোষের আগুন জ্বলে উঠেছে। তাহারই বহিঃপ্রকাশ হিসাবে দেশব্যাপী গণ-অভ্যুত্থান দেখা দিয়েছে। গােলটেবিল বৈঠকের কতিপয় সুযােগ সুবিধার মধ্য দিয়ে নয় – একমাত্র এগার দফা দাবী বাস্তবায়নের পরই ছাত্র জনতার বিজয় সূচিত হবে এবং তারই প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা বাঞ্ছনীয়।
শামসুদ্দোহা বলেন, বিগত দশ বছরের শােষণ ও শাসনে জর্জরিত এদেশের মানুষ বর্তমান সরকারের প্রতি সম্পূর্ণভাবে অনাস্থা প্রকাশ করেছে। শােষিত জনগণ বর্তমান একনায়কত্ববাদী সরকারের পরিবর্তন চায়। এই কথা বলার পর, শামসুদ্দোহা জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা কি বর্তমান সরকারের পরিবর্তন করে গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম করতে চান। যদি তা’ই চান, তবে হাত তুলে রায় জানান। সঙ্গে সঙ্গেই সমবেত জনতা হাত তুলে সরকারের অবসান এবং জনগণের সরকার কায়েমের পক্ষে রায় দান করেন।
সভায় মাহবুব উল্লাহ বলেন, এগার দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য এদেশের সর্বশ্রেণির মানুষ ত্যাগ স্বীকারে দ্বিধাবােধ করে নি। ঘরে ঘরে এগার দফা কর্মসূচির পরবর্তী ব্যাপক আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে। তিনি বলেন, এদেশের কৃষক-শ্রমিক তথা সকল মেহনতি মানুষের আশা-আকাংখার কথা ছাত্রদের ঘােষিত এই কর্মসূচিতে স্থান পেয়েছে। একটি শােষনমুক্ত সুখী সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের জন্যই আমাদের আপােষহীন সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। তিনি আরও বলেন, শপথ দিবসে আমাদের সুস্পষ্ট ঘােষণা – কোনাে চাতুরির আশ্রয়ে জনগণের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করা যাবে না বরং আন্দোলনকে নস্যাৎ করার কিংবা জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথকে রুদ্ধ করার ষড়যন্ত্রকে জনগণের দুর্জয়শক্তি, দীর্ঘস্থায়ী, ঐক্যবদ্ধ, নিরবিচ্ছিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিরােধ করব।
তােফায়েল আহমেদ বলেন, এগার দফা কর্মসূচি কোনাে বিশেষ রাজনৈতিক দলের দাবি নয়, এটা দেশের আপামর জনসাধারনের বাঁচার দাবি এবং সংগ্রামী ছাত্র সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে এই কর্মসূচি প্রণয়ন করেছে এবং দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবেই। তিনি বলেন, ছাত্ররা ক্ষমতায় আসীন বা উজির হতে চায় না, তারা কেবল জনগনের মুক্তিসনদ এগার দফার বাস্তবায়ন দেখতে চায়। সভার শুরুতে সাম্প্রতিক আন্দোলনে নিহত শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এক মিনিট নীরবতা পালন এবং শােক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। মঞ্চে পােড়ানাে হয় ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র ও ‘প্রভু নয় বন্ধু’ বইয়ের কপি। জনসভা শেষে এক বিরাট গণমিছিল রাজপথ প্রদক্ষিণ করে।৭৮
=============================================================
৭৮ আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসেই ১৯৫৬ সালে জাতীয় সংসদে গৃহীত সংবিধান বাতিল করে দেন এবং
পেজ-৬৮
সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী জনসভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, “এই সমাবেশ আরও ঘােষণা করিতেছে যে, আরও দাবি আদায় ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বিরােধী দলীয় নেতৃবর্গকে গােলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত হইতে দেওয়া হইবে
=============================================================
তার শাসনের বৈধতার জন্য একটি সংবিধান রচনা ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। ১৯৬০ সালে নির্বাচনের পর ১৭ ফেব্রুয়ারি তার ভাষ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার পর পরই আইয়ুব খান সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি শাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে একটি সংবিধান কমিশন গঠন করেন। এই কমিশনে উভয় প্রদেশ থেকে পাঁচজন করে প্রতিনিধি নেওয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে কমিশনে অন্তর্ভুক্ত সদস্যরা ছিলেন, পরবর্তী পর্যায়ে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং সে সময় এডভােকেট জেনারেল আবু সাইদ চৌধুরী, আইনজীবী আফতাব উদ্দিন আহমদ, আইনজীবী দ্বারকানাথ বারুরী বা ডিকে বারুরী, রাজনীতিবিদ আজিজ উদ্দিন আহমদ এবং চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিল্পপতি ও আর নিজাম। এই কমিশনের দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানে পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকারের ক্রমব্যর্থতা এবং পরিণতিতে ১৯৫৬ সালের সংবিধান বিলােপের কারণ অনুসন্ধান করা, জনগণের মেধা, শিক্ষার মান এবং রাজনৈতিক বিচক্ষণতা বিবেচনায় নিয়ে একটি সংবিধানের জন্য প্রস্তাব পেশ করা, এবং এই প্রস্তাবাবলীর মধ্যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রের গ্রহণযােগ্যতা, ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে ন্যায় বিচার, সমতা এবং সহনশীলতার নীতির প্রতিফলন ঘটানাে, জাতীয় ঐক্য সংহত করার ব্যবস্থা এবং একটি স্থায়ী সরকারের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা। এই কমিশন ১৯৬১ সালের ৬ মে তার রিপাের্ট পেশ করে। কমিশন দু কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট, প্রত্যক্ষ ভােটে একজন উপ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং আলাদা নির্বাচনের প্রস্তাব করে। আইয়ুব খান এসব সুপারিশ গ্রহণ করেন নি, তার কাছে গ্রহণযােগ্য হয়েছিল প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা। কমিশনের প্রস্তাব ছিল প্রেসিডেন্ট এক প্রদেশ থেকে নির্বাচিত হলে ভাইস প্রেসিডেন্ট অন্য প্রদেশ থেকে নির্বাচিত হবেন এবং তার হাতে কিছু নির্বাহী ক্ষমতা থাকবে। ১৯৬১ সালের ২৪-৩১ অক্টোবর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত গভর্নরদের সভা সংবিধান কমিশনের সুপারিশ পর্যালােচনা করে এবং ১৯৬২ সালের ১ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বেতার ভাষণে আইয়ুব খান তার পছন্দের সংবিধান ঘােষণা করেন। এই সংবিধানের মূল ব্যবস্থা ছিল: প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার, প্রাদেশিক সরকারের হাতে সর্বোচ্চ মাত্রার ক্ষমতা প্রদান, প্রেসিডেন্ট কর্তৃক প্রদেশের গভর্ণর নিয়ােগের ক্ষমতা, মৌলিক গণতন্ত্রীদের নির্বাচকমন্ডলী হিসেবে গ্রহণ করা, এবং আইন প্রণয়নে ইসলামী ভাবধারা অক্ষুন্ন রাখার জন্য একটি পদেষ্টা পরিষদ গঠন করা। সংবিধান সম্পর্কে আইয়ুব খান বলেন, এতে গণতন্ত্র ও শৃংখলার সম্মিলন ঘটেছে। নতুন সংবিধানের অধীনে ১৯৬২ সালের ১৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদের ও ৬ মে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
আইয়ুব খানের আত্মজীবনী ‘প্রভু নয় বন্ধু’ পাকিস্তানের উভয় অংশে ১৯৬৭ সালে এক সঙ্গে প্রকাশিত হয় এবং এর প্রকাশক ছিল অক্সফোর্ড ইউনির্ভাসিটি প্রেস। বইটি মূল গ্রন্থ ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স এর অনুবাদ। বইটি সম্পর্কে আইয়ুব খানের মন্তব্য ছিল, উন্নয়নশীল দেশগুলাের জনগণ সহায়তা প্রত্যাশা করে, কিন্তু সেটা করে পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে, তারা প্রভু নয়, বন্ধু প্রত্যাশা করে। বলা হয়, আইয়ুব খানের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে বইটি লিখেছিলেন তারই অত্যন্ত বিশ্বস্ত আমলা আলতাফ গওহর। আইয়ুব খানের শাসনামলে বইটি ইন্টারমিডিয়েট থেকে পােস্ট গ্রাজুয়েট পর্যায় পর্যন্ত পাঠ্য করা হয়েছিল। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখলের পর ১৯৬৯ সালের আগস্ট মাসে কেন্দ্রীয় সরকার সকল বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাবাের্ডকে পাঠ্যসূচী থেকে প্রভু নয় বন্ধু প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়। একই সঙ্গে বলা হয়, গ্রন্থটি পােস্ট গ্রাজুয়েট ও আন্ডার গ্রাজুয়েট স্তরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক বিষয় অধ্যয়নে সহায়ক হতে পারে, কিন্তু অন্যান্য স্তরে সমাজবিজ্ঞান বিষয় হিসেবে একে পাঠ্য তালিকাভুক্ত করার পেছনে কোনাে যুক্তি নেই।
পেজ-৬৯
না । এই জন্য অবিলম্বে ক) জরুরী আইনে আটক সকল রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি ত্বরান্বিত করিতে হইবে। খ) শেখ মুজিব, ওয়ালী খান, ভূট্টো, মনি সিংহ, তাজউদ্দীন, আব্দুল জব্বার সহ সকল নেতাকে মুক্তি দিতে হইবে, কেননা তাঁহারাই জনগণের দাবি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কারারুদ্ধ হইয়াছেন গ) নিরাপত্তা আইনে আটক সকল রাজবন্দীকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হইবে। নিরাপত্তা বন্দীদের পক্ষে বাবু মন্মথ দে, সন্তোষ ব্যানার্জি গত ১০ বৎসর যাবত একটানা (সামরিক শাসনের সময় হইতে) নিরাপত্তা আইনে বন্দী রহিয়াছেন। ঘ) দেশরক্ষা আইনে আটক ও রাজনৈতিক কারণে সাজাপ্রাপ্ত বেগম মতিয়া চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, রাশেদ খান মেনন ও মাহবুবুল হক দোলন সহ সকল ছাত্রবন্দীকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হইবে। ঙ) আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সহ সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করিতে হইবে। চ) খােকা রায়, সুখেন্দু দস্তিদার, অনিল মুখার্জী, মাে: তােয়াহা, আবদুল হক, জ্ঞান চক্রবর্তী, চৌধুরী হারুনুর রশীদ, মােহাম্মদ ফরহাদ, কাজী জাফর আহমদ, নাসিম আলী, ফয়েজ উদ্দীন, আবদুস সাত্তার, সুনেন্দু কানুনগাে, বরুণ রায় প্রমুখ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপর হইতে হুলিয়া ও গ্রেফতারী পরােয়ানা অবিলম্বে প্রত্যাহার করিতে হইবে ছ) সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতা, পূর্ণ বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিতে হইবে। দেশ হইতে সকল দলনমূলক ব্যবস্থা ও সংখ্যালঘু অর্ডিন্যান্স সহ সকল কালাকানুন অবিলম্বে বাতিলের ব্যবস্থা করিতে হইবে জ) সাম্প্রতিক আন্দোলনে নিহত শহীদ ও আহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে এবং গুলিবর্ষণের বিচার বিভাগীয় তদন্ত ঘােষণা করিতে হইবে। ঝ) ছাত্র সমাজের শিক্ষা দাবি তথা ১১-দফার ১ নং দাবি অবিলম্বে পূরণের ব্যবস্থা করিতে হইবে ঞ) শ্রমিক, কৃষক, চাকরীজীবীদের বেতন বৃদ্ধি সহ সকল জরুরী দাবি সমূহ অবিলম্বে পূরণ করিতে হইবে। এই সমাবেশ এই সকল আশু দাবি পূরণের জন্য নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালাইয়া যাইবার ঘােষণা প্রদান করিতেছে।”৭৯
এদিন সরকারি নীতির প্রতিবাদে জাতীয় পরিষদের সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন ভাসানী ন্যাপের মশিউর রহমান ও আরিফ ইফতেখার। ততদিনে গােলটেবিল বৈঠক বিতর্ক চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। আওয়ামী লীগ ‘প্যারলেই’ শেখ মুজিবের গােলটেবিল বৈঠকে যােগদানের ইচ্ছা পােষণ করলেও প্রকাশ্যে ঘােষণা করে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার না করা হলে তারা সে বৈঠকে যােগদান করবে না। ১২ ফেব্রুয়ারি, বুধবার ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ঘােষণা করেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের সঙ্গে দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নটি জড়িত। ইতিমধ্যে ড্যাক ১৪ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার সারা দেশে হরতাল আহ্বান করে এবং হরতালের কারণ ব্যাখ্যা করে একটি প্রচারপত্র বিলি করে।৮০
আওয়ামী লীগের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত দৈনিক ইত্তেফাক এ সময়ে ভাসানী বিরােধী প্রচারণায় সােচ্চার হয়ে ওঠে। ১৪ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার, ১৯৬৯ দৈনিক ইত্তেফাকে গােলটেবিল বৈঠক সম্পর্কে ‘মঞ্চে নেপথ্যে’ কলামে মন্তব্য করেন মােসাফির (সম্পাদক তােফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া)। এই উপ সম্পাদকীয় নিবন্ধটি থেকে তৎকালীন
=================================================================
৭৯ দৈনিক ইত্তেফাক, ১০ ফেব্রুয়ারি, সােমবার, ১৯৬৯।
৮০ পূর্ণ বিবরণের জন্য পরিশিষ্ট – থ দেখুন।
পেজ-৭০
আওয়ামী লীগের প্রচারণা উপলব্ধি করা যাবে। পরবর্তী পর্যায়ে এই বক্তব্য প্রচারপত্র আকারে ছাপিয়ে বিলি করা হয়। প্রচারপত্রটি প্রকাশিত হয়েছিল সংগ্রামী ছাত্র-শ্রমিক সমাজের নামে। ১২ ফেব্রুয়ারি, বুধবার, ১৯৬৯ কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন আওয়ামী লীগ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। ঐ তারিখে সরকারি নীতির প্রতিবাদে বিরােধী দলের সাতজন সদস্য জাতীয় পরিষদের সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন। এর পরেই ঢাকায় অধিবেশনরত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মূলতবী ঘােষণা করা হয়।
নির্যাতনের বিরুদ্ধে ১৩ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার মিছিলের আয়ােজন করেন মহিলারা। শহীদ মিনারে জমায়েত শেষে মিছিল বাহাদুর শাহ্ পার্ক পর্যন্ত যায়। পরদিন কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রী ঘােষণা করেন, ১৭ ফেব্রুয়ারি, সােমবার থেকে জরুরী আইন প্রত্যাহার করা হবে। এই তারিখে পল্টনের ময়দানে অনুষ্ঠিত ড্যাকের জনসভায় নূরুল আমীন বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালে জনতার পক্ষ থেকে তাকে অপমান করে নামিয়ে দেওয়া হয়। নূরুল আমীনের পক্ষে এগিয়ে আসেন অধ্যাপক মােজাফফর আহম্মদ। তিনি এজন্য ভাসানী ন্যাপকে দোষারােপ করেন। জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরাও উগ্রমূর্তি হয়ে বিক্ষোভকারীদের তেড়ে আসে। সন্ধ্যায় ভাসানী ন্যাপের কর্মীরা ১৬ তারিখের জনসভার প্রস্তুতিকল্পে মাইক প্রচারে বেরুলে ছাত্রলীগ কর্মীরা এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তাদের উপর হামলা চালায়। হামলায় সেক্রেটারিয়েটের সামনে ন্যাপের যুগ্ন-সম্পাদক আনােয়ার জাহিদ আহত হন। ফলে জনসভার সম্ভাব্যতা সম্পর্কে ন্যাপ মহলে সন্দেহ দেখা দিলেও শেষ পর্যন্ত কিছুই হয় নি।
এগার জন ছাত্রনেতা ও ৩ জন শ্রমিকনেতাসহ ৬৫ জন ১৩ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার, ১৯৬৯ বিভিন্ন জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। এদের মধ্যে ছিলেন, আলী হায়দার খান (ছাত্র ইউনিয়ন) রাশেদ খান মেনন (ছাত্র ইউনিয়ন), আবদুর রাজ্জাক (ছাত্রলীগ), শফি আহমেদ (ছাত্র ইউনিয়ন), মাহবুবুল হক দোলন (এনএসএফ) জি. এম ইয়াকুব (ছাত্র ইউনিয়ন) কাজী ফিরােজ রশীদ (ছাত্রলীগ) শেখ ফজলুল হক মনি (ছাত্রলীগের প্রাক্তন নেতা), মনিরুল ইসলাম (ছাত্রলীগ), মােহাম্মদ হােসেন (শ্রমিক নেতা), রুহুল আমিন ভূঁইয়া (শ্রমিক নেতা), আবুদল মান্নান (সাধারণ সম্পাদক, পাটকল শ্রমিক ফেডারেশন) প্রমুখ। দেশরক্ষা বিধি বলে আটক পংকজ ভট্টাচার্য (ছাত্র ইউনিয়নের প্রাক্তন সহ সভাপতি ও সােনার বাংলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত), আল মুজাহিদী (ছাত্রলীগ) শেখ শহীদুল ইসলাম (ছাত্রলীগ), রফিকুল ইসলাম (ছাত্রলীগ), এ.কে আজাদ (ছাত্রলীগ), ও সুনীল কুমার বসুকে মুক্তি দেওয়া হলেও নির্দিষ্ট মামলা থাকায় তারা মুক্তি পান নি।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলার সময় ১৫ ফেব্রুয়ারি, শনিবার, ১৯৬৯ মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হক বন্দি অবস্থায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিহত হন।৮১ সরকারিভাষ্যে
======================================================
৮১ পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট জহুরুল হক (১৯৩৫-১৯৬৯) ১৯৩৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি নােয়াখালী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। উচ্চমাধ্যমিক পড়াশােনা শেষে ১৯৫৬ সালে তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যােগ দেন। সার্জেন্ট জহুরুল হক ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১৭ নম্বর আসামী। তিনি ছিলেন খেলাধূলায় পারদর্শী এবং খুব ভালাে ছবি আঁকতে পারতেন। তার কিছু
পেজ-৭১
বলা হয়, আসামী পালাতে চেষ্টা করলে প্রহরীর গুলিতে নিহত হয়। এই ঘটনা জনমনে এক দারুণ অবিশ্বাসের সৃষ্টি করে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌছে যে ১৬ ফেব্রুয়ারি, রবিবার, ১৯৬৯ মওলানার জনসভায় লক্ষাধিক লােকের সমাগম হয়। সভায় মওলানা বলেন, প্রয়ােজন হলে ফরাসী বিপ্লবের মতাে জেলখানা ভেঙ্গে মুজিবকে নিয়ে আসব। তিনি আরও বলেন, দু মাসের মধ্যে ১১ দফা কায়েম এবং রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া না হলে খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হবে। জনসভার শুরুতে মওলানা ভাসানী সার্জেন্ট জহুরুল হকের গায়েবানা জানাজা পরিচালনা করেন। আর আরিফ ইফতেখার ঘােষণা করেন জাতীয় পরিষদ থেকে তার পদত্যাগের কথা। জনসভার শেষ পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ জনতা প্রথমে প্রাদেশিক যােগাযােগ মন্ত্রী সুলতান আহম্মদ ও পূর্তমন্ত্রী মং শু প্রু’র আবদুল গণি রােডস্থ সরকারি বাসভবনে অগ্নিসংযােগ করে। এ অবস্থায় তাড়াহুড়াে করে সভার কাজ শেষ হয়। এছাড়া, আগরতলা মামলার জন্য গঠিত বিশেষ ট্রাইবুন্যালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এস এ রহমানের বাসভবন (স্টেট গেস্ট হাউজ), কেন্দ্রীয় তথ্য মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিনের পরিবাগস্থ বাসভবন, প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি খাজা হাসান আসকারীর বাসভবনসহ বিভিন্ন সরকারি বাসভবনে অগ্নিসংযােগ করা হয়।৮২
সন্ধ্যায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী তলব এবং সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। অপরদিকে সারা দেশ থেকে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার করেন প্রেসিডেন্ট। ১৮ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার, ১৯৬৯ রাজশাহীতে পুলিশের বেয়নেটের খোঁচায় নিহত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা ও নূরুল ইসলাম। এই খবর ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ার পর রাত এগারটায় সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। নাখালপাড়া থেকে সান্ধ্য আইন উপেক্ষাকারীদের মিছিল আসে নিউমার্কেট পর্যন্ত। রাতের অন্ধকারে গুলি করে সেনাবাহিনী বহু লােককে হত্যা করে।৮৩
=============================================================
পেইন্টিং জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। তার ভাই আমিনুল হক অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে এটর্নী
জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে মারা যান।
৮২ জনসভা সম্পর্কে দৈনিক ইত্তেফাকে ১৭ ফেব্রুয়ারি, সােমবার, ১৯৬৯ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়,“পল্টনের জনসভা – ভাসানীর চরম পত্র – গতকাল (রবিবার) বিকালে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঘােষণা করেন যে, আগামী ২ মাসের মধ্যে সরকার ছাত্র সমাজের তথা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণের প্রাণের দাবী ১১-দফা মানিয়া না লইলে, জনসাধারণ খাজনা ও ট্যাক্স বন্ধ করিবে। তিনি ঘােষণা করেন যে নিয়মতান্ত্রিক ও অহিংস আন্দোলনের দিন শেষ হইয়াছে। এখন অনিয়মতান্ত্রিক ও সহিংস আন্দোলন শুরু হইবে। মওলানা ভাসানী প্রস্তাবিত গােলটেবিল বৈঠক সম্পর্কে ড্যাক নেতাদের উদ্দেশ্য করিয়া বলেন যে, বর্তমান গােলটেবিল বৈঠকের ফলাফল বৃটিশ আমলে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন গােলটেবিল বৈঠকের চাইতেও খারাপ হইবে। তিনি বলেন, বৃটিশের গােলটেবিল বৈঠকের মারফত যেমন পাক-ভারত উপমাহদেশ স্বাধীন হইতে পারে নাই, ঠিক তেমনি বর্তমান গােলটেবিল বৈঠকেও জনসাধারণের দাবি আদায় সম্ভব নয়।”
৮৩ ড: শামসুজ্জোহা (১৯৩৪-১৯৬৯) পশ্চিম বাংলার বাঁকুড়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে রসায়ন শাস্ত্রে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৫৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। আন্দোলনের সময় তিনি তার ছাত্রদের বলেছিলেন, সেনাবাহিনী গুলি করবে না, যদি করে তাহলে
পেজ-৭২
সে রাতে মওলানা ভাসানী ইস্কাটনে মরহুম সাঈদুল হাসানের বাসভবনে অবস্থান করছিলেন। জনগণ সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে রাতে অস্ত্রের জন্য তার কাছে ধর্ণা দেয়। কিন্তু জনগণকে হতাশ করা ছাড়া মওলানা ভাসানীর গত্যন্তর ছিল না। সেনাবাহিনীর গুলিকে মােকাবেলা করার জন্য জনগণ টিন হাতে বেরিয়েছিল রাস্তায়। বিশ্বাস ছিল, এই ঢেউটিন ব্যারিকেড হিসেবে কাজ করবে। ২০ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটায় হঠাৎ করে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হলে শহরময় গুজব ছড়িয়ে পড়ে শেখ মুজিব মুক্তি পেয়েছেন। সঠিক সংবাদের জন্য হাজার হাজার জনতা ছুটে আসে ইকবাল হলে। এ দিন সন্ধ্যায় একুশে ফেব্রুয়ারির প্রস্তুতিকল্পে এক ঐতিহাসিক মশাল মিছিল বের হয়। সরকার ১৬ ফেব্রুয়ারি, রবিবার একুশে ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘােষণা করে। সে বারের একুশে ফেব্রুয়ারির আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল প্রচুর সংখ্যক সংকলনের প্রকাশ।৮৪
একুশে ফেব্রুয়ারি বিকেলে পল্টন ময়দানে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে জনসভা এবং সভাশেষে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কালাে ব্যাজ পরে, কালাে পতাকা কাঁধে নিয়ে খালি পায়ে শত শত মানুষ মিছিল করে দুপুর হতেই পল্টন ময়দানে সমবেত হতে থাকে। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই এক বিশাল জনসমুদ্রে রূপ নেয় পল্টন ময়দান । মাঠের মানুষ, কারখানার শ্রমিক, নৌকার মাঝি হতে শুরু করে সবাই এসেছিলেন এই জনসভায়। কারও হাতে ফেষ্টুন, কারও পতাকা। সদরঘাট হতে মিছিল করে নৌকার মাঝিরা এসেছিলেন কাঁধে বৈঠা নিয়ে। জনসভায় সভাপতিত্ব করেন তােফায়েল আহমেদ এবং বক্তৃতা করেন শহীদ আসাদুজ্জামানের ভাই ডাঃ রাশেদুজ্জামান, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য মাহবুবুল হক দোলন, সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক, আবদুর রউফ, মােস্তফা জামাল হায়দার, এবং নাজিম কামরান চৌধুরী। সভাপতির ভাষণে তােফায়েল আহমদ বলেন, এদেশের মুক্তি পাগল মানুষ আজ জেগে উঠেছে, ১১ দফা হচ্ছে তাদের মুক্তির সনদ।
শেখ মুজিবসহ আগরতলা মামলার অন্যান্য অভিযুক্ত ২২ ফেব্রুয়ারি, শনিবার সামরিক কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। একই সঙ্গে নিরাপত্তা আইনে আটক আরও ৩৪ জন বন্দী মুক্তি লাভ করেন। কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেই শেখ মুজিব ঘােষণা করেন, “সংগ্রামী ছাত্ররা যে ১১ দফা দিয়াছেন তার প্রতি আমারও সমর্থন রহিল। কারণ ১১ দফার মধ্যে ৬ দফার রূপরেখাও রহিয়াছে।”৮৫ এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদকীয় কলামে মন্তব্য করে:
===========================================================
প্রথম বুলেটটি আমাকেই আঘাত করবে, ছাত্রদের নয়। তিনি জীবন দিয়ে তার কথা প্রমাণ করে গেছেন। তাঁকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের সামনে সমাহিত করা হয়েছে। তার নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নামকরণ করা হয়েছে। ‘
৮৪এ রকম একটি সংকলনে ছাত্র ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নির্ভর মতভেদের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
আংশিক বিবরণের জন্য পরিশিষ্ট – দ দেখুন।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা একুশে ফেব্রুয়ারিকে ছুটির দিন হিসেবে ঘােষণা করেছিল এবং
১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারির পরের দিন এই ছুটি বাতিল হয়ে যায়।
৮৫ দৈনিক আজাদ, ২৩ ফেব্রুয়ারি, রবিবার, ১৯৬৯।
পেজ-৭৩
“ইতিহাসের গতি অনিরুদ্ধ। গণশক্তির বিজয় অপ্রতিরােধ্য। সফল সংগ্রামের এই চূড়ান্ত পর্যায়ে তাই আমরা আবার আমাদের লক্ষ্যের ধ্রুবতারা অন্বেষী হইয়াছি। বিজয়ের গৌববে আমরা যেন মােহাবিষ্ট না হই। পথভ্রষ্ট না হই। জনগণের বিজয়ের রথচক্রে সেই বজ্রের ভেরীই নিনাদিত হউক – যাহার মধ্যে দেশ দেশবাসীর প্রকৃত সার্থক ও অধিকার চেতনা জাগ্রত। জনগণের জয় সার্থক হউক। জনগণের উত্থান স্থায়ী ও সফল হউক।”
শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক মঞ্চের নেতৃত্ব তার হাতে চলে যায়। জনগণের মনে এই প্রতীতি জন্মে যে, তার পক্ষেই সম্ভব পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করা। রাজনৈতিক বাস্তবতার কাছে নতিস্বীকার করে পাকিস্তানী শাসকচক্র যখন তার বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা প্রত্যাহার করে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য গােলটেবিল বৈঠকে যােগদানের আমন্ত্রণ জানায় তখনই মুজিবের একচ্ছত্র নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথে শেষ প্রতিবন্ধকটুকু অপসারিত হয়। মুক্তির পর শেখ মুজিব বিকেলে মওলানা ভাসানী ও আতাউর রহমান খানের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। অপরদিকে কেন্দ্রীয় তথ্য মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন মওলানার সঙ্গে দেখা করে গােলটেবিল বৈঠকে যােগদানের আমন্ত্রণ জানালেও মওলানা তা প্রত্যাখ্যান করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার সম্পর্কে দৈনিক আজাদ ২৪ ফেব্রুয়ারি, সােমবার, ১৯৬৯ এক সম্পাদকীয় কলামে মন্তব্য করে:
“সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করিয়াছেন এবং আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সহ অপরাপর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মুক্তিদান করিয়াছেন। মামলা প্রত্যাহার প্রসঙ্গে সরকারী প্রেসনােটে বলা হইয়াছে যে, জরুরী অবস্থা তুলিয়া নেওয়ার পর মৌলিক অধিকার পুন:প্রবর্তিত হওয়ায় ইহার সহিত বিরােধ এড়াইবার জন্য এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য হইয়া উঠিয়াছে। জনসাধারণ ও জননেতাগণ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করার জন্য দাবী জানাইয়াছিলেন এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির সহিতও এ মামলার ভাগ্য অনিবার্যভাবে জড়াইয়া পড়িয়াছিল। তবে যে কারণেই এ মামলা প্রত্যাহার করা হইক না কেন, ইহা একটি শুভ ঘটনা এবং জনমনে ইহা গভীর আনন্দের সৃষ্টি করিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তান এমনকি গােটা পাকিস্তানের ভাগ্যকে নিছক রাজনৈতিক ভাবনা চিন্তার সহিত জড়াইয়া নেওয়ার বিপদ ও পরিণতি সম্পর্কে অত:পর যদি সকলে সতর্ক হইতে পারেন তাহা হইলে এই মামলা প্রত্যাহারের ফলাফল আরাে শুভ হইয়া উঠিতে পারিবে।
আগরতলা ষড়ডন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের ফলে রাওয়ালপিন্ডি সম্মেলনের সম্ভাবনা আরাে সম্প্রসারিত হইয়াছে এবং আওয়ামী লীগ প্রধানের পক্ষে সম্মেলনে যােগদানে পথের বাধা সম্পূর্ণ অপসারিত হইয়াছে। এই মামলা প্রত্যাহরের ফলে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদের বাহিরের অপরাপর অনেক নেতার পক্ষেই রাওয়ালপিন্ডি সম্মেলনে যােগদান করার ব্যাপারে আর কোন আপত্তি নাও থাকিতে পারে। ন্যাপ প্রধান মওলানা ভাসানী ও পিপল্স পার্টি প্রধান জনাব ভূট্টো অবশ্য অন্যদৃষ্টিতে সম্মেলনকে
পেজ-৭৪
দেখিতেছেন এবং তাঁহারা নিজস্ব দিক হইতে এ সম্পর্কে বিচার বিবেচনা করিতেছেন। জনাব ভাসানী নিজে রাওয়ালপিন্ডি যাইবেন না বলিয়া জানাইয়া দিয়াছেন। তবে তাহার দল প্রেসিডেন্টের দাওয়াত বিবেচনা করিলে তাহাদের কোন প্রতিনিধি রাওয়ালপিন্ডি যাইবেন। সম্মেলনের সকল পূৰ্ব্বশর্ত মানিয়া নেওয়া হইয়াছে বলিয়া শেখ মুজিবুর রহমান সম্মেলনে যােগদান করিতে যাইতেছেন, ইহা তিনি ঘােষণা করিয়াছেন। সমঝােতা ও সমন্বয়ের ভিত্তি ছাড়া শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নের শুভ সমাধান সম্ভব নহে বলিয়া সম্মেলনের বিশেষ গুরুত্ব রহিয়াছে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অবসানের আনন্দের মাঝে একটি করুণ সুর ধ্বনিত হইবে। সকলেই বাড়ি ফিরিলেন, কিন্তু ফিরিলেন না শুধু একজন। সার্জেন্ট জহুরুল হক আজ সকল আনন্দ বেদনার উর্ধ্বে। তাঁহার মৃত্যু সম্পর্কে উপযুক্ত তদন্তের ব্যবস্থা হইবে, এ উপলক্ষে ইহাই আমাদের কাম্য। ইহা ছাড়া তাঁহার শােকসন্তপ্ত পরিবারে পরিজনের প্রতি আমাদের আর কোন সান্ত্বনার ভাষা জানা নাই। আগরতলা মামলায় যাহারা বিপর্যস্ত তাহাদের পুনর্বসতির প্রশ্নটি যেন উপেক্ষিত না হয়। অভিনন্দন বাণীর মাঝে বাস্তব সমস্যাটি চাপা পড়া উচিত নহে।”
মুক্তির পর সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে সম্বর্ধনা জানানাের জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি, রবিবার, ১৯৬৯ বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয় । ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) বক্তব্য ছিল একই সভায় ভাসানী, শেখ মুজিব, ভূট্টো ও মনি সিংকে সংবর্ধনা জানানাে হােক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তখন ভূট্টো এ নিয়ে ঢাকায় দুপুর একটা পর্যন্ত সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলােচনা করেন। কিন্তু ছাত্রলীগ মনি সিংকে সংবর্ধনা দেওয়ার ব্যাপারে রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তা হয় নি।
সভায় ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র বিরুদ্ধেশেখ মুজিবকে সতর্ক করে দিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ বলেন, শেখ মুজিব যদি ১১ দফার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে গােলটেবিল বৈঠকে যােগদান করেন তাহলে জনগণ তাকে ক্ষমা করবে না। শেখ মুজিব বলেন, তিনি সরকারের সঙ্গে প্রস্তাবিত রাজনৈতিক আলােচনায় অংশগ্রহণ করে দেশের উভয় অংশের দেশবাসীর দাবি উত্থাপন করবেন এবং যদি সে দাবি গ্রাহ্য করা না হয় তবে বৈঠক হতে ফিরে এসে দাবি আদায়ের জন্য দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবেন। তিনি বলেন সংগ্রাম করে আমি আবার কারাগারে যাব, কিন্তু মানুষের প্রেম, ভালবাসার ডালি মাথায় নিয়ে দেশবাসীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।’ তিনি আরও বলেন, বাঙ্গালী, সিন্ধী, পাঞ্জাবী পাঠান আর বেলুচের মধ্যে কোনাে তফাৎ নেই। কায়েমী স্বার্থবাদীদের শােষণ হতে দেশের উভয় অংশের জনগণের মুক্তির একমাত্র পথ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন ও অর্থনৈতিক আজাদী।’
শেখ মুজিব বলেন, অতঃপর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ‘ইসলামাবাদ ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে অভিহিত হবে। রেসকোর্সের এই সমাবেশে আরও বক্তৃতা করেন, তােফায়েল আহমেদ, সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক (মতিয়া গ্রুপ), মাহবুবুল হক দোলন (জাতীয় ছাত্র
পেজ-৭৫
ফেডারেশন) ও খালেদ মােহাম্মদ আলী (ছাত্রলীগ)। এ দিন বিকেলে পুলিশের গুলিতে রেসকোর্সের কাছে তিনজন আহত হলে সভা ফেরত জনগণ মারমুখী হয়ে ওঠে। অবস্থা উপলব্ধি করে শেখ মুজিব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আহ্বান জানান। তার এই আহ্বান রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে বারবার প্রচারিত হয়।
রেসকোর্সের জনসভা সম্পর্কে ২৫ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার, ১৯৬৯ তারিখে প্রকাশিত দৈনিক পাকিস্তানের প্রতিবেদনে বলা হয়:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব
গত রবিবার ঢাকা রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সর্বদলীয় ছাত্র সগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক জনাব তােফায়েল আহমদ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পক্ষে থেকে মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দানের প্রস্তাব করলে সমবেত জনসমুদ্র বিপুল করতালিতে তা সমর্থন করে।
রেসকোর্সের সম্বর্ধনা সভায় প্রস্তাব
(স্টাফ রিপাের্টার)
সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ঐতিহাসিক ১১-দফা বাস্তবায়নের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। তারা ঘােষণা করেন, ১১-দফা দাবী পূরণের মধ্যেই শহীদদের রক্ত ও নির্যাতিত ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত ও মেহনতী জনতার দাবী পূরণ হতে পারে। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের পদত্যাগ, জনগণের হাতে আশু ক্ষমতা অর্পণ এবং বর্তমান শাসনতন্ত্র বাতিল করে ১১-দফার ভিত্তিতে নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবীতে সংগ্রাম গড়ে তােলার আহ্বান জানান। ১১-দফা দাবীকে শাসনতন্ত্রের কাঠামাের মধ্যে স্থান দেওয়ার জন্য দাবী জানান হয়। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক মধ্যবিত্ত ও মেহনতী মানুষ নির্বিশেষে পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামী জননেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি প্রাণঢালা শ্রদ্ধাঞ্জলী জানানাে হয়।
নিরাপত্তা আইন, প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স, হুলিয়া মামলা প্রত্যাহার এবং ১১-দফা বাস্তবায়নের দাবীতে আগামী ৪ঠা মার্চ প্রদেশব্যাপী পূর্ণ হরতাল পালনের পূর্ব সিদ্ধান্তের প্রতি সভায় পুনরায় সমর্থন জানান হয়। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে নিরাপত্তা আইন ও প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স বাতিল করে নিরাপত্তা আইনে জারীকৃত সকল হুলিয়া ও মামলা প্রত্যাহার এবং প্রগ্রেসিভ পেপার্স লিমিটেডকে তার নিজস্ব মালিকের হাতে প্রত্যার্পনের দাবী জানান হয়। বর্তমান গণঅভ্যুত্থানের কারণে জারীকৃত সকল মামলা ও সাজা প্রত্যাহারের দাবী জানান হয়। সভায় গৃহীত আরেক প্রস্তাবে ৪ঠা মার্চের মধ্যে বুনিয়াদী গণতন্ত্রী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের পদত্যাগের জন্য পুনরায় আহ্বান জানান হয়।
ঢাকায় পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্যদের এক যুক্ত সভা অনুষ্ঠিত হয় ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি, রবিবার-সােমবার। সভায়
পেজ-৭৬
১৯৬৮ সালের ৬ ও ৭ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কৃষক সমিতি ও পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের সম্মিলিত উদ্যোগে জঙ্গী গণসমাবেশ ও সাধারণ হরতালের মাধ্যমে গণ আন্দোলনের নব পর্যায়ের যে ঐতিহাসিক সূচনা হয়, তৎপরবর্তী আন্দোলন পরিস্থিতি এবং দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বিশদ আলােচনা অনুষ্ঠিত হয় এবং নীতি নির্ধারণী রাজনৈতিক প্রস্তাব গৃহীত হয়।৮৬
গােলটেবিল বৈঠকে যােগদানের জন্য শেখ মুজিব লাহােরের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন ২৪ ফেব্রুয়ারি, সােমবার, ১৯৬৯। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, মীজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মালেক উকিল, এম এ আজিজ, ময়েজউদ্দিন আহমদ ও মতিয়ুর রহমান। একই সঙ্গে অধ্যাপক মােজাফফর আহমদও লাহাের যান।৮৭ এই বৈঠকে যােগদানের জন্য বিচারপতি মােরদেশকে আমন্ত্রণ জানানাে হলেও আতাউর রহমান খানকে জানানাে হয় নি। ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে বিমানবন্দরে শেখ মুজিব বলেন, বৈঠকে বসার আগে তিনি নির্দলীয় বিশিষ্ট নেতা এয়ার মার্শাল আসগর খান, লে: জে: আযম খান (অবসরপ্রাপ্ত), বিচারপতি মােরশেদ, জনাব ভূট্টো এবং ব্যক্তিগত বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা করবেন। সেদিন একই বিমানে করাচী হয়ে লাহাের পৌছান জুলফিকার আলী ভূট্টো ও শেখ মুজিব। শেখ মুজিব লাহােরে আসগর খান, বিচারপতি, মােরশেদ ও আযম খানের সাথে পৃথক পৃথক বৈঠকে মিলিত হন।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের নেতৃত্বে ১৫ জন, ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির ১৬ জন প্রতিনিধি, এবং এয়ার মার্শাল আসগর খান ও বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মােরশেদ এর উপস্থিতিতে ২৬ ফেব্রুয়ারি, রবিবার, ১৯৬৯ সকাল সাড়ে দশটায় রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট গেস্টহাউসে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান কল্পে গােলটেবিল বৈঠক শুরু হয়। লে: জে: আযম খান (অবসরপ্রাপ্ত) বৈঠকে যােগ দেন নি। প্রায় ৪০ মিনিট বৈঠকের পর ২৭ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার ঈদুল আযহার কারণে ১০ মার্চ, সােমবার পর্যন্ত বৈঠক মূলতবী ঘােষণা করা হয়। এ সময়ে আইয়ুব খান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন।
============================================================
৮৬ পূর্ণ বিবরণের জন্য পরিশিষ্ট –ধ দেখুন।
৮৭ আবদুল মালেক উকিল ১৯২৪ সালের ১ অক্টোবর নােয়াখালী জেলার রাজাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ
করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষে তিনি আইন পেশায় যােগদান করেন। ভাষা আন্দোলনের সময় কারাবরণ করেন। ১৯৫৬ সালে উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেটে নােয়াখালী সদর থেকে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালে তৃতীয়বারের মতাে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের মনােনয়নে ১৯৭০ সালে তৎকালীন জাতীয় পরিষদে এবং ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের পর নিযুক্ত হন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। মুহম্মদুল্লাহ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯৭৪ সালের ২৮ জানুয়ারী জাতীয় সংসদের স্পীকার নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর তিনি মােশতাক সরকারের সঙ্গে হাত মেলান।
পেজ-৭৭
পহেলা মার্চ, শনিবার, সংগ্রাম পরিষদের সভায় এমএনএ ও এমপিএ-দের পদত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেখ মুজিব গােলটেবিল বৈঠকে যােগদান করায় ছাত্রলীগ আপত্তি তােলে। অবশেষে ৩ মে, শনিবার, ১৯৬৯ পর্যন্ত তাদের পদত্যাগের মেয়াদ বাড়ানাে হয়। ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) নােট অব ডিসেন্ট দিয়ে এ প্রস্তাব গ্রহণ করে।
সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ৪ মার্চ, মঙ্গলবার, ১৯৬৯ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালিত হয়। সেদিন বগুড়ায় সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় লােকের তেমন সমাগম হয় নি। সভায় সভাপতিত্ব করেন তােফায়েল আহমেদ, বক্তৃতা করেন মাহবুবুল হক (দোলন), মােস্তফা জামাল হায়দার, সাইফউদ্দিন আহমেদ (মানিক) ও আবদুর রউফ।
সভায় মােস্তফা জামাল হায়দার বলেন, বিশেষ কোনাে ব্যক্তিকে অপসারণ বা বিশেষ ব্যক্তিকে ক্ষমতায় বসানাের জন্য ছাত্র-জনতা এই আন্দোলন করে নি। অবাধ শােষণ, অত্যাচার ও নির্যাতনের অবসানের জন্য এই আন্দোলন এবং তারই ভিত্তিতে মুক্তি সনদ ১১ দফা রচিত হয়েছে। তিনি বলেন, ১১ দফার সংগ্রামে কিছুটা আংশিক বিজয় হয়েছে অথচ কৃষকদের দাবি, শ্রমিকের দাবি বিন্দুমাত্রও আদায় হয় নি। তাই বিভ্রান্ত হওয়া মারাত্মক হবে। শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য রাজবন্দীকে মুক্ত করে এনেছি, আগরতলা মামলা প্রত্যাহারে তারা বাধ্য হয়েছে। জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার করা হয়েছে কিন্তু কুখ্যাত নিরাপত্তা আইনে বিমল দত্ত, কৃষক নেতা ইলিয়াস ও নােয়াখালী গান্ধী আশ্রমের অধ্যক্ষ শ্ৰী চারু চৌধুরী আজও কারান্তরালে আটক আছেন। সুখেন্দু দস্তিদার, অনিল মুখার্জি, খােকা রায়, হেমন্ত সরকারসহ অনেকের নামে আজও হুলিয়া ঝুলছে।
জামাল হায়দার বলেন, আজকের গণআন্দোলন দেখে শােষকশ্রেণি তাদের খােলস পাল্টাবার চেষ্টা করছে মাত্র। ১১ দফা আন্দোলনের ফলে অনেকের ব্যক্তিগত সুবিধা হয়েছে। কেউ কেউ তাদের সম্পত্তি ফিরেও পেয়েছেন। তাদের কেউ কেউ আজ নানা সুরে গান গাইতেও শুরু করেছেন। মঞ্চের খেলা ও লেখা এদেশের মানুষ অনেক দেখেছে। জনগণকে তারা আজ আর বিভ্রান্ত করতে পারবে না। তিনি বলেন, ১৯৫৮ সালে এদেশের শােষকশ্রেণির সাথে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা মিতালী করে গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করেছিল। তিনি বলেন, সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে কোনাে আপােষ নেই। গণতন্ত্র হতে হবে সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবমুক্ত। আনন্দে আত্মহারা না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, রাজনৈতিক খেলা এখন আবার শুরু হয়েছে। তার অনেক আলামত আমরা লক্ষ্য করছি। পূর্ব বাংলার প্রাণের দাবি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনকে বিকিয়ে দিয়ে আইয়ুবের পরিবর্তন নিয়ে যদি কেউ আসেন এ দেশের মানুষ তাকে মেনে নেবে না।
সাইফুদ্দীন মানিক বলেন, আজ দেশে যে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়েছে তাতে প্রমানিত হয়েছে যে, আইয়ুবের হাতে ক্ষমতা নেই, ক্ষমতা জনগণের হাতে এবং জনগণ পুলিশ ছাড়াও শান্তি রক্ষা করতে জানে। তিনি বলেন, এ আন্দোলনে কিছু কিছু দাবি আদায় হয়েছে সত্য তবুও এখনও প্রধান দাবি আদায় হয় নি। কৃষক তার বকেয়া খাজনা মওকুফ পায় নি, সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল হয় নি, শ্রমিক তার সগ্রামের অধিকার পায় নি, ছাত্রদের
পেজ-৭৮
দাবি পূরণ হয় নি। তিনি বলেন, ১১ দফার দাবি সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সার্বভৌম পার্লামেন্ট গঠন ও ফেডারেল সরকার কায়েম না হলে গােলটেবিল হবে না। আমরা ১১ দফা হতে এক চুলও বিচ্যুত হব না। পূর্ব বাংলার মানুষের দাবির প্রতি যদি নেতারা বিশ্বাসঘাতকতা করেন তবে তারা যত বড়ই হােক না কেন ঢাকা বিমানবন্দরে তাদের অবতরণ করতে দেওয়া হবে না। তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, আইয়ুব শাহীকে খতম করার পর তাদের খতম করতেও ছাত্র জনতা পেছপা হবে না।
মাহবুবুল হক (দোলন) বলেন, আজকের হরতালের মধ্য দিয়ে একথা প্রমাণিত হয় যে, আন্দোলনের পথ হতে আমরা বিচ্যুত হই নি। আন্দোলনের পথ থেকে সংগ্রামী সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্র পরিষদ বিচ্যুত হয়েছে বলে যারা প্রচার করছেন তাদের উদ্দেশ্যে তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। সকল দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সংগ্রাম পরিষদের সংকল্প ঘােষণা করে তিনি বলেন, এটা কারও ঘােষণা, ব্যক্তিগত লাভ-লােকসান, ক্ষমতা লাভ বা ব্যক্তি বিশেষের মুক্তির আন্দোলন নয়, এই আন্দোলন হচ্ছে সমগ্র জনতার মুক্তির আন্দোলন। ছাত্র সংগ্রাম কমিটির নামে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন লােকের মিথ্যা প্রচারনা ও ভঁওতাবাজি সম্পর্কে তিনি জনসাধারণকে সতর্ক করে দেন এবং কেউ যেন প্রতারণা করতে না পারে সে ব্যাপারে জনগণকে সহযােগিতা করার আহ্বান জানান।
আবদুর রউফ বলেন, যতদিন না এদেশের মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফুটবে ততদিন আমাদের সংগ্রাম চলবে। তিনি বলেন, ১১ দফার অংশ বিশেষ আদায় হয়েছে, মূল দাবি আজও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। আংশিক দাবি পূরণে আমরা ক্ষান্ত হবাে না। তিনি বলেন, রােজ রােজ হরতাল করা যায় না। কিন্তু আন্দোলনের মনােভাবকে সবসময় জাগিয়ে রাখতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য তিনি আহ্বান জানান। পূর্ব পাকিস্তান হতে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থ এবং সােনা পাচারের অভিযােগ করে তিনি তাদের হুশিয়ার করে বলেন, আমরা বিভিন্ন ব্যাংকে যাব এবং কার কত টাকা আছে তা দেখব। সি.এস.পি. অফিসারদের সাবধান করে দিয়ে তিনি বলেন, জনগনের দুঃখ-দুর্দশা যদি তারা বােঝার চেষ্টা না করেন এবং জনগনের কাতারে শামিল না হন তাতে জনগণ জানে তাদের কিভাবে টেনে আনতে হবে।
সভাপতির ভাষণে তােফায়েল আহমেদ বলেন, সংগ্রাম পরিষদের নামে বিভিন্ন লােক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের হুমকি দিয়ে তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করছে বলে আমরা খবর পেয়েছি। এই সব ব্যক্তিদের সাথে আমাদের কোনাে সম্পর্ক নেই। যদি আমাদের অর্থের দরকার হয় তবে আমরা চাদার বই নিয়ে সংগ্রাম পরিষদের এক বা একাধিক সদস্য চাদার জন্য যাব, অন্য কেউ গেলে তাদের চাঁদা দেবেন না। পূর্ব পাকিস্তান হতে পশ্চিম পাকিস্তানগামী যাত্রীরা সােনা পাচার করছে কিনা সে ব্যাপারে তল্লাশী চালাবার জন্য শুল্ক বিভাগের প্রতি তিনি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, কোন ব্যক্তি যদি গােল টেবিল আলােচনার বাইরে না থেকে আলােচনায় যােগ দিয়ে ১১ দফার জন্য সংগ্রাম করেন তাহলে
পেজ-৭৯
আমরা বেশ খুশি হব। তিনি বলেন, আলােচনা আপােষের নয়, সেখানে দেশের মৌলিক দাবি নিয়ে আলােচনা হচ্ছে। সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে এতে অংশ নেয়ার জন্য তিনি অনুরােধ জানান এবং বলেন এতে করেই আইয়ুবের শক্তি নষ্ট হবে। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে ১১ দফার ২, ৩ ও ৪নং ধারার ভিত্তিতে শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা অবলম্বনের দাবি জানিয়ে বলা হয় যে, বিরােধীদলসমূহ এর অন্যথা করলে ছাত্র সমাজ ও দেশবাসী তাদের ক্ষমা করবে না।৮৮
মার্চের প্রথম সপ্তাহে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে জঙ্গী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নেওয়ার জন্য একটি বিপ্লবী সংগঠনের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে ছাত্র ইউনিয়নে (মেনন গ্রুপ) আলােচনার সূত্রপাত হয়। তখন অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, অলিখিতভাবে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ৭ মার্চ, শুক্রবার, সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে মৌলিক গণতন্ত্রীদের পদত্যাগের মেয়াদ বাড়ানাে হয়। এ নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক হয়। ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) কর্মীরা এ সমস্ত কারণে সংগ্রাম পরিষদ থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ৭ মার্চ, শুক্রবার, রাত ১১টায় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক আহ্বান করা হলেও শেষ পর্যন্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় নি।
পশ্চিম পাকিস্তান সফরের জন্য ৮ মার্চ, শনিবার, ১৯৬৯ লাহােরের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন মওলানা ভাসানী। এ সফরের সময় শাহিওয়ালে মওলানার উপর হামলা চালায় জামায়াতে ইসলামীর গুন্ডারা। ৯ মার্চ, রবিবার, দেশের বিরাজমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাপ প্রধান মওলানা ভাসানী ও পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভূট্টোর মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের স্বীকৃত দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তানের আদর্শের সঙ্গে সংগতি রেখে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং বৈদেশিক হস্তক্ষেপ অপসারণ এবং সকল প্রকারের উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদের বিরােধিতা ও সিয়েটো, সেন্টো থেকে সরে আসার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
ইতিমধ্যে পাকিস্তান সফরে আসেন লন্ডন প্রবাসী পাকিস্তানী ছাত্রনেতা তারিক আলী। তারিক আলীর আগমনকে কেন্দ্র করে পশ্চিম পাকিস্তানে বেশ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। ১২ মার্চ, বুধবার, ১৯৬৯ দুপুরে তারিক আলী ঢাকায় পৌঁছান। ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) কর্মীরা তাকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সম্বর্ধনা জানাতে চেয়েছিল কিন্তু তার ট্রটস্কীপন্থী মতাদর্শের কারণে বিতর্ক দেখা দেয়। বিতর্ক উপেক্ষা করেই তাকে স্বাগত জানাতে ছাত্ররা বিমানবন্দরে যায়।৮৯
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ১৩ই মার্চ, বৃহস্পতিবার আয়ােজিত সম্বর্ধনা সভায় তারিক আলী বলেন, পাকিস্তানের জাগ্রত ছাত্র জনতা স্বৈরাচারী শাসকচক্রের সামরিক আইন জারির
==============================================================
৮৮ সভার পূর্ণ বিবরণের জন্য দেখুন, দৈনিক পাকিস্তান, ৫ মার্চ, বুধবার, ১৯৬৯।
৮৯ সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকার সম্পাদক (মরহুম) এনায়েতুল্লাহ খান এর আমন্ত্রণে তারিক আলী ১৯৬৯ সালে ঢাকা আসেন।
পেজ-৮০
হুমকিতে আর ভীত নয়। ছাত্রজনতা তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য বদ্ধপরিকর। তিনি বলেন, আইয়ুব দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে সামরিক আইন জারি করতে চায়। কিন্তু পাকিস্তানের জনগণ প্রমাণ করেছে তারা সামরিক বাহিনীকে ভয় পায় না। তারা গত দু’মাসে সামরিক বাহিনীর সাথে মুখােমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। সামরিক আইন চালু করলে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে। তিনি বলেন, যদি একজন মানুষকে গুলি করে মারা হয় তবে সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী আন্দোলনকারী ছাত্ররা বিদেশের সকল পাকিস্তানী দূতাবাস ঘেরাও করবে।
তারিক আলী বলেন, জামায়াতে ইসলামী ও কনভেনশন মুসলিম লীগ- এ দুটো প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বর্তমান গণআন্দোলনকে নস্যাৎ করতে চাচ্ছে। আমরা এক আইয়ুবকে সরিয়ে অন্য আইয়ুবকে চাই না। কারণ এতে আসল সমস্যার সমাধান হবে না। তিনি বলেন, কেউ কেউ আবার ধর্মকর্ম নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের আন্দোলনকারীদেরও দুটো বিষয় মনে রাখতে হবে। এ আন্দোলন শুধু আইয়ুবের বিরুদ্ধে নয়। এছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানে সামন্তবাদ উচ্ছেদ ও ব্যাংক বীমা জাতীয়করণ এখনও হয় নি। পশ্চিম পকিস্তানে প্রাপ্ত ভােটাধিকার শুধুমাত্র সামন্তবাদী জোতদারদের নিজেদের আত্মীয় স্বজনদেরই পরিষদে পাঠাবে।
ঢাকার ছাত্র সমাজের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তিনি বলেন, ১৯৬১ সালে ঢাকার ছাত্ররাই সর্বপ্রথম সামরিক আইন বিরােধী শ্লোগান দেয়। তারাই প্রথম আইয়ুবের ভাঁওতা শাসনতন্ত্রের কপি পুড়িয়ে দেন। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররাই সকল আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, সংগ্রাম আমাদের শেষ হয় নি। ১১ দফা আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানীদের দাবি দাওয়া জানেন, তাই তিনি গােলটেবিলে ১১ দফা উত্থাপন করেছেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) আয়ােজিত এ সভার অনেক নেতা এখনাে ১১ দফায় আগ্রহী নন। সভার পর ছাত্ররা তারিক আলীর অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য তাকে ঘিরে ধরে। সংবর্ধনা সভায় সভাপতিত্ব করেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) ঢাকা শহর শাখার সভাপতি আবু হেনা ফিরােজ কবীর। সভার শুরুতে রাশেদ খান মেনন ও মােস্তফা জামাল হায়দার বক্তৃতা করেন। স্বল্প সময়ে আয়ােজন করা হলেও ব্যাপক সংখ্যক ছাত্রছাত্রী উপস্থিত হওয়ায় রেডিও ও টেলিভিশনে এ সভার সংবাদ প্রচারিত হয়।৯০
এগার দফার সংগ্রামকে বানচাল করার জন্য সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের বিভ্রান্তিকর প্রচারণার প্রতি কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করে তাদের প্রতিহত করার ও সংগ্রামী ঐক্য বজায় রাখার জন্য বার মার্চ, বুধবার এক যুক্ত বিবৃতিতে তােফায়েল আহমেদ, নাজিম কামরান চৌধুরী,
============================================================
৯০ তারিক আলী প্রশ্নে ১২ মার্চ, বুধবার, অনুষ্ঠিত ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের বৈঠকে মতভেদ প্রকাশ্য রূপ নেয়। বৈঠকে আর একটি প্রশ্ন আলােচনার জন্য উত্থাপিত হয়। সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ’র অনুসারীরা সংগঠনের নাম বদলে ‘পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন’ রাখার প্রস্তাব করেন। দীর্ঘ আলােচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে পরবর্তী কেন্দ্রীয় সম্মেলনে এ প্রস্তাব বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু পরবর্তী সম্মেলনে এ প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয় নি, সংগঠন দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যায়।
পেজ-৮১
সাইফউদ্দিন আহমেদ (মানিক), সামসুদ্দোহা, আবদুর রউফ, খালেদ মােহাম্মদ আলী, মােস্তফা জামাল হায়দার, মাহবুব উল্লাহ, মাহবুবুল হক দোলন ও ফখরুল ইসলাম দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। তারা বলেন, ‘ছাত্র-জনতার স্বৈরাচার উচ্ছেদের সংগ্রাম দেশব্যাপী যে মূহুর্তে তীব্রতর হয়ে উঠেছে, ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক জনতার প্রাণপ্রিয় এগার দফার আন্দোলন অব্যাহত, পূর্ব বাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায় ও পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বাতিলের দাবি জোরদার হয়েছে সেই মূহুর্তে আমরা লক্ষ্য করছি যে, শাষকগােষ্ঠী ও কায়েমী প্রতিক্রিয়াশীল মহল পরিকল্পিতভাবে নানা বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা ও চক্রান্তে মেতে উঠেছে। মেতে উঠেছে সংগ্রামী ছাত্র জনতার গণ-ঐক্যে ফাটল ধরাবার, সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত ফলগুলােকে নির্মূল করা ও পাকিস্তানে ১১ দফা ভিত্তিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে বানচাল করার, বিশেষত পুর্ব বাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামকে বিপথগামী করার জন্য একদিকে সরকার ও অন্যদিকে মহল বিশেষ নােংরা ও সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। সর্বদলীয় সংগ্রামী ছাত্র পরিষদ এই সব নােংরা ও সাম্প্রদায়িক প্রচারণার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছে এবং হুশিয়ারী জানাচ্ছে যে, ১১ দফার ভিত্তিতে ছাত্র জনতার যে সংগ্রামী ঐক্য গড়ে উঠেছে তাতে ফাটল ধরাবার জন্য ও গণ আন্দোলনকে বিপথগামী করার যে কোনাে ঘৃণ্য অপচেষ্টাকে আমরা প্রতিহত করবােই। দেশবাসীর প্রতি আমাদের আবেদন, গণদাবির সংগ্রামকে বানচাল করার সর্বপ্রকার চক্রান্ত সম্পর্কে সচেতন থাকুন ও সংগ্রামী ঐক্য বজায় রাখুন।’
গােলটেবিল বৈঠক পুনরায় শুরুর পর গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, বৈঠক ব্যর্থ হলে দেশে আবার সামরিক শাসন জারি হবে। দুটি জনসভায় আসগর খান এবং মওলভী ফরিদ আহমদ এ ধরনের ইঙ্গিতও দেন। গােল টেবিল বৈঠকে ৬ দফা কর্মসূচি বিশ্লেষণ করে শেখ মুজিব বলেন,
“যদি আমরা বাস্তব উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হই এবং যার ফলে দেশব্যাপী চরম সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তার সমাধান করতে না পারি তা হলে সর্বশক্তিমান আল্লাহ এবং ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। …আসুন আমাদের প্রিয় পাকিস্তান যে সংকটের আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়েছে আমরা তার সমাধান করি এবং এমন একটি শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতির ভিত্তি স্থাপন করি যাতে সত্যিকার ফেডারেল পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে এবং যা পাকিস্তানী জনসাধারনের জন্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের নিশ্চয়তা বিধান করবে। কেবলমাত্র শক্তিশালী এবং ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানই আশা ও আস্থার সাথে ভবিষ্যতে সব সমস্যার মােকাবিলা করতে পারে।”৯১
আওয়ামী লীগ ১৩ মার্চ, বৃহস্পতিবার, ১৯৬৯ ড্যাকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এর কারণ ব্যাখ্যা করে শেখ মুজিব বলেন, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং এক ইউনিট বাতিলের দাবির সমর্থনে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। গােলটেবিল বৈঠকে প্রদত্ত বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বলেন,
“এই সম্মেলনে বিভিন্ন নেতার বক্তব্য শােনার পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, সর্বসম্মত দাবী হচ্ছে দুটিঃ (ক) প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে
================================================
৯১ পাকিস্তান অবজারভার, ১৪ মার্চ, শুক্রবার, ১৯৬৯ (বাংলা অনুবাদ লেখকের)।
পেজ-৮২
জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন (খ) দেশে পার্লামেন্টারী ব্যবস্থা চালু করন। আপনারা সম্মত হলে অনুমােদনের জন্য এ দুটি বিষয় আমি জাতীয় সংসদে পেশ করব। …আমি শক্তিশালী ও স্থায়ী কেন্দ্রসহ একটি অখন্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী। বর্তমান আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আমাদের কাছে এক গভীর উদ্বেগের বিষয় হওয়া উচিৎ। অভিযােগ ও পাল্টা অভিযােগে সময় ও শক্তির অপচয় করা কোন মতেই উচিৎ হবে না। আমাদের অতি মূল্যবান একটি শিক্ষাবছর নষ্ট হয়েছে। …আমাদের সকলের বহুবিধ সমস্যা আছে এবং আমাদের সকলকে তা সমবেতভাবে মােকাবেলা করতে হবে। …পরিশেষে আমি উল্লেখ করতে চাই যে, ইসলামের ভিত্তিতেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ইসলামের নীতি ও অনুশাসন অনুযায়ী আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করব। জাতি ও আপনাদের নিকট বিবাচনার জন্য আমি আমার প্রস্তাব সমূহ পেশ করছি। আমি জানি যে, জনগণ এই বৈঠকটির ফলাফলের জন্য গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে এবং আমি প্রার্থনা করছি যে, বর্তমান সংকট মােকাবিলার জন্য খােদা আমাদের শক্তি ও সাহস দান করুন।”৯২
অমীমাংসিত গােলটেবিল বৈঠক শেষে ১৪ মার্চ, শুক্রবার, ১৯৬৯ ঢাকা ফিরে এসে এক সাংবাদিক সম্মেলনে হামিদুল হক চৌধুরী, আবদুস সালাম খান, মাহমুদ আলী এবং মওলভী ফরিদ আহমদের বিরুদ্ধে অভিযােগ উত্থাপন করে শেখ মুজিব বলেন, “বিগত ২১ বৎসরের ইতিহাসে যে সনাতন কুচক্রী মহল গণদাবির বিরুদ্ধে চিরন্তনভাবে চক্রান্ত করিয়া আসিতেছে সে মহল আজও সক্রিয় রহিয়াছে। যদি পূর্ব পাকিস্তানের দাবি দাওয়ার প্রশ্নে তাদের ঐক্যবদ্ধ সমর্থন পাওয়া যেত, তাহলে প্রেসিডেন্টের পক্ষে সে সব মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।” তিনি মওলানা ভাসানীকেও রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণের উপদেশ দেন। মওলানা ভাসানীকে রাজনীতি হতে অবসর গ্রহণের মন্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলী (মেনন গ্রুপ) এক বিবৃতিতে বলে,
“আমরা দেখিয়া অত্যন্ত বিস্মিত হইলাম যে, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে রাজনীতি হইতে অবসর গ্রহন করার উপদেশ প্রদান করিয়াছেন। দেশবাসী জানেন যে, মওলানা ভাসানী এদেশের সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী গণ-আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা। তাঁহাকে রাজনীতি হইতে দূরে সরাইয়া দেওয়ার প্রচেষ্টা পরােক্ষভাবে এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকেই কেবল ব্যাহত করিবে না বরং প্রতিক্রিয়াশীলতার হাতকেই শক্তিশালী করিবে। বর্তমানে যখন প্রতিক্রিয়াশীল চক্র গণ-আন্দোলনকে নস্যাৎ করিবার প্রচেষ্টায় মাতিয়া উঠিয়াছে, তখন গণতান্ত্রিক শক্তি সমূহের ঐক্য হওয়া প্রয়ােজন।”৯৩
পরবর্তীতে ঘটনা দ্রুত মােড় নিতে থাকে। ১৯ মার্চ, বুধবার এক বিবৃতিতে শেখ মুজিব বলেন “ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, মজদুর ভাই ও আওয়ামী লীগের প্রতিটি সদস্যের প্রতি আমার
============================================================
৯২ পাকিস্তান অবজারভার, ১৪ মার্চ, শুক্রবার, ১৯৬৯।
৯৩ দৈনিক আজাদ, ১৭ মার্চ, সােমবার, ১৯৬৯।
পেজ-৮৩
সনির্বন্ধ আহ্বান, অবিলম্বে আপনারা দেশের আপামর জনসাধারণের অধিকার সংরক্ষণ ও শান্তি বজায় রাখার জন্য সর্বশক্তি নিয়ােগ করে কর্মক্ষেত্রে ঝাপিয়ে পড়ন।”৯৪
সেনাশাসন জারি হওয়ার আগে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দশজন নেতা সর্বশেষ ঐক্যবদ্ধ বিবৃতি দেন ১৯ মার্চ, বুধবার, ১৯৬৯। বিবৃতিতে গণবিরােধী শক্র ও সমাজ বিরােধীদের হুশিয়ার করে দিয়ে তারা বলেন, অবিলম্বে গণবিরােধী কার্যকলাপ বন্ধ না করলে ছাত্ররা সমাজবিরােধী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়ােগ করবে। তারা বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী, হিন্দুমুসলমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রেখে ১১ দফার সগ্রাম অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।৯৫ পাকিস্তান ছাত্র শক্তি ১৯ মার্চ, বুধবার, গভর্নর মােনায়েমের অপসারণ ও ১১ দফা আদায়ের দাবিতে ২৫ মার্চ, মঙ্গলবার, হরতাল আহ্বান করে। পাকিস্তান ছাত্র শক্তির পক্ষে প্রেসিডেন্ট আখলাকুর রহমান আহ্বান জানিয়ে বলেন,
“যে ১১ দফা দাবীর জন্য এদেশের অগনিত ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক প্রাণ হারালাে সে ১১ দফা আদায় ভিন্ন ছাত্র সমাজের সংগ্রাম ক্ষান্ত হতে পারে না। তাই আগামী ২৫ মার্চ ১১ দফার দাবীতে সারা দেশে পূর্ণ ধর্মঘট ও হরতাল পালনের জন্য আমরা সর্বশ্রেণীর মানুষকে আহ্বান জানাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ সমর্থন ও সহযােগিতার জন্য বন্ধু প্রতিষ্ঠানগুলাে যথা ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও ফেডারেশনের (সংগ্রাম পরিষদ) ও বিরােধী দলীয় রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিও আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।”৯৬
মােনায়েম খানের পরিবর্তে ২১ মার্চ, শুক্রবার, ১৯৬৯ গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রাদেশিক অর্থমন্ত্রী, অর্থনীতিবিদ ড. এম এন হুদা। গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে শেখ মুজিব, আতাউর রহমান খান ও নূরুল আমীনের সঙ্গে ঘরােয়াভাবে আলােচনা করেন। সন্ধ্যায় এক বেতার ভাষণে সর্বমহলের সহযােগিতাও কামনা করেন।৯৭ এ পরিস্থিতিতে কাউকে কিছু না জানিয়ে ২৫ মার্চ, মঙ্গলবার সপরিবারে ঢাকা ত্যাগ করেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মােনায়েম খান।
পশ্চিম পাকিস্তানে ১৫ দিনের সফর শেষে ২৪ মার্চ, সােমবার, ১৯৬৯ ঢাকা ফেরেন মওলানা ভাসানী। বিমানবন্দরে তাঁকে যে সম্বর্ধনা জানানাে হয় তা ছিল অভূতপূর্ব।
================================================================
৯৪ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ মার্চ, শনিবার, ১৯৬৯।
৯৫ দৈনিক আজাদ, ২০ মার্চ, বৃহস্পতিবার, ১৯৬৯।
৯৬ ১৯৬৮ সালে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ছাত্র শক্তি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এক অংশের নেতৃত্ব দেন সভাপতি হিসেবে আখলাকুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মােজাফফর হােসেন পন্টু। (বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতা।) অন্য অংশের নেতৃত্ব দেন সভাপতি হিসেবে ফজলুল হক এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মােহাম্মদ হােসেন।
৯৭ ডঃ এম এন হুদা ও তার স্ত্রী কুলসুম হুদা উভয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন। বলা হয়, ৬ দফা কর্মসূচি প্রণয়নে অন্যদের সঙ্গে তিনিও জড়িত ছিলেন। ড. হুদা ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯৭৯ সালের ২৪ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট জিয়া তাকে অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। ১৯৮১ সালের ২৪ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট সাত্তার তাকে উপ-রাষ্ট্রপতি নিয়ােগ করেন এবং ঐ পদে তিনি ১৯৮২ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত অধিষ্ঠিত ছিলেন।
পেজ-৮৪
বিমানবন্দর থেকে ইস্কাটন গার্ডেন পর্যন্ত লক্ষাধিক সংগঠিত লােকের শােভাযাত্রা মওলানা ভাসানীকে অনুসরণ করে। ২৪ মার্চ, সােমবার সন্ধ্যায়ই মওলানা ভাসানী সন্তোষ চলে যান। যাওয়ার সময় আভাস দিয়ে যান যে, ২৫ মার্চ থেকেই সামরিক আইন জারি হচ্ছে। ২৫ মার্চ, মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত শেষ বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ঘােষণা করেন। সারা দেশে জারি হয় সামরিক শাসন।৯৮ পূনরায় বিপথগামী ও লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয় জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন।
.===============================================================
৯৮ ক্ষমতা হস্তান্তরের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে লেখা আইয়ুব খানের চিঠির পূর্ণ বিবরণের জন্য পরিশিষ্ট – ন দেখুন। পরবর্তী পর্যায়ে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্যে দেখা যায় ১৯৬৯ সালের ২০ মার্চ, বৃহস্পতিবার, সন্ধ্যা সাড়ে আটটায় দেশে সামরিক আইন জারির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সামরিক শাসন জারির জন্য পর্দার অন্তরালের বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জেনারেল পীরজাদা ও ভূট্টো সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তবে দেশের অন্যান্য রাজনীতিবিদদেরও বিষয়টি পূর্বাহ্নেই জানানাে হয়েছিল এবং এখন পর্যন্ত প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী একটি সমঝােতার জন্য তারা তাতে সমর্থন দিয়েছিলেন।
পেজ-৮৫
প্রত্যাশিত সংযােজন
চার দশক আগে, ১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ১৯৬৯ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে পৃথিবী জুড়ে ঘটে যাওয়া ছাত্র ও তরুণদের বিদ্রোহ এখনও গবেষণা ও বুদ্ধিবৃত্তিক তর্কের বিষয়। সমাজ ও রাষ্ট্রভেদে এ সময়ে অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক, মােদ্দাকথায়, এই দু’ধরনের ব্যবস্থায় বিদ্রোহের যে বহিঃপ্রকাশ তার মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত যােগসূত্র ছিল। আজকের মতাে সে সময়ে যােগাযােগ নেটওয়ার্ক এতটা বিস্তৃত ছিল না, কিন্তু রাষ্ট্রীয় সীমানা পেরিয়ে বিদ্রোহের চেতনা ও বর্ণনার বিস্তৃতিতে কোন ব্যত্যয় ঘটে নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর পরিস্থিতিতে তখন পর্যন্ত এমন কোনাে সক্রিয় আন্দোলন পৃথিবীকে নাড়া দেয় নি। জাতীয় পরিচয়ের বাইরে গিয়ে এ বিদ্রোহ পরিণত হয়েছিল মীথ এ। এ বিদ্রোহ নিয়ে প্রচুর তাত্বিক বিতর্ক, লেখালেখি এবং বেশক’টি চলচ্চিত্র নির্মিত হলেও বিভিন্ন দেশে এ বিদ্রোহ সম্পর্কে উল্লেখযােগ্য গবেষণা এখনও হয় নি। পাশ্চাত্যে কিছু বিশ্লেষণধর্মী লেখালেখি হলেও, বর্তমানের পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এ বিষয়টি রাজনৈতিক পর্যালােচনায়, লেখালেখি ও গবেষণায় প্রায় অনুপস্থিত থেকে গেছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, এ ঘটনা কী এদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক স্মৃতি থেকে মুছে গেছে?
রাজনীতিবিদরা নয়, সে সময়ে পৃথিবীতে আন্দোলনের অগ্রসৈনিক ছিল নােয়াম চমস্কীর ভাষায়, ‘বুদ্ধিজীবী সমাজের সংগঠিত ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ’ ছাত্রসমাজ। অবশ্য বর্তমানে অনেক দেশেই ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিপর্যয়, অথবা আদর্শের বিচ্যুতি ঘটেছে। কোথাও, কোথাও যুক্ত হয়েছে নুতন উপাদান, যা ঘটছে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। গত শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকে লাতিন আমেরিকার অনেক দেশেই ছাত্র ও তরুণরা জনারণ্যে হারিয়ে গিয়েছিল, কিউবার বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বেছে নিয়েছিল গেরিলা যুদ্ধের কৌশল। কিন্তু সেই গেরিলা যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত জয়যুক্ত হয় নি।
সাম্প্রতিক বছরগুলােতে বিশ্বজুড়ে ছাত্র, তরুণ ও জনতার বিক্ষোভ, বিদ্রোহ এক নতুন মাত্রা অর্জন করেছে। নেপালে ও ভারতের ছত্রিশগড়ে মাওবাদী আন্দোলন, ভারতের আসামে উলফার আন্দোলন, থাইল্যান্ডে লাল শার্টের আন্দোলন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বা জি-৮ শীর্ষ সম্মেলনের সময় দৃঢ় বিক্ষোভ, ভেনিজুয়েলায় নুতন সমাজতন্ত্র গড়ার আন্দোলন, ফ্রান্সে কৃষকদের সঙ্গে সংহতির আন্দোলন এ ধরনের অসংখ্য আন্দোলন অথবা বিক্ষোভ অব্যাহত থাকলেও এদের মধ্যে কোনাে যােগসূত্র প্রতিষ্ঠিত হয় নি। সকল ক্ষেত্রে দাবি দাওয়াও অভিন্ন নয়। তবে প্রায় প্রত্যেকটি আন্দোলনই কর্তৃত্ব, ক্ষমতাসীনদের ব্যর্থতা, যুদ্ধের ডামাডােল এবং অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে আন্দোলন। আন্দোলনের
পেজ-৮৬
এজেন্ডায় আরও অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়, অনেক বৈচিত্র্য ও উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া থাকে। কিন্তু অনেক ব্যবস্থাই এ বিক্ষোভকে প্রশমিত করতে পারে না।
আটষট্টি সালে ইউরােপে তারুণ্যের বিদ্রোহের যে এজেন্ডা ছিল গত দু’দশকে তাতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন বিশ্বায়নকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হয় তরুণদের বিদ্রোহ। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুদ্ধ বিরােধী আন্দোলন। অবশ্য জার্মানী ও ফ্রান্সে পরিস্থিতির চেহারাটা ভিন্ন। ১৯৬৯ সালে হার্বার্ট মারকুস মন্তব্য করেছিলেন, ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা না থাকলে মুক্ত সমাজ হতে পারে না, এবং ব্যক্তিগত জীবন, একাকীত্ব না থাকলে সমাজতান্ত্রিক সমাজ হতে পারে না।’ জার্মানী ও ফ্রান্সের তরুণরা গত কয়েক দশক ধরে বিশ্বাসের জগতে এই দ্বন্দ্বকে মােকাবেলা করছে। কিন্তু পাকিস্তানে কী ঘটেছিল বা বাংলাদেশে কী ঘটছে? তৎকালীন পাকিস্তানের উভয় অংশে প্রায় একই সময়ে আন্দোলনের সূত্রপাত না ঘটলে যে আইয়ুবী শাসনের অবসান ঘটানাে সম্ভব হত না একথা কোনাে কোনাে গবেষক মানতে চান না। কিন্তু এটাই বাস্তব – পূর্ব পাকিস্তানের ধূমায়িত বিক্ষোভ ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত সময়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কেন্দ্রে ক্ষমতার পরিবর্তন নিশ্চিত করতে পারে নি।
ঊনসত্তরের আন্দোলন এখন স্মৃতি, কারণ এ দেশে রাজনীতির কৌশল বদলে গেছে। সেদিন যারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন, তারাও রাজনৈতিক স্বকীয়তার কারণে সে ঐক্য টিকিয়ে রাখতে পারেন নি। মাত্র এক বছর পরেই এই গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে ছাত্র সংগঠনগুলাের পেছনে ফিরে তাকানাের অবকাশ হয় নি, কারণ আন্দোলনের অন্যতম অংশীদার পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কাছে তখন অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
উনসত্তরের আন্দোলন সম্পর্কে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কতগুলাে বিষয় বিবেচনায় নেওয়া প্রয়ােজন। সেদিন গণমাধ্যমের বিস্তৃতি এত ব্যাপক না থাকলেও প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার খবর সবচেয়ে কম সময়ে পৌছে যায় জনগণের কাছে, দেশের কেন্দ্র থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যােগাযােগ তত্ত্বের ক্ষেত্রে এটি একটি আকর্ষণীয় বিশ্লেষণের বিষয়। গণ সচেতনতা যে ব্যাপক জনগণকে একটি বিরাট পতাকার নীচে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে সেদিনের আন্দোলন সে বাস্তবতারও নির্দেশক। আন্দোলনের মাঝামাঝি পর্যায় থেকে জনগণ অনেক প্রশাসনিক দায়িত্ব নিজেদের ওপর অর্পণ করলেও বিশৃংখলা তৈরি করেন নি। তাদের কর্মকান্ড একদিকে ছিল বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, অন্যদিকে অপমানের প্রতিশােধ। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলাে জনচেতনার সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হয়।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকে অনেকেই ১৯১৯ সালের চীনের ৪ মে’র আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তুলনার বিষয়টি অতিশােয়ক্তি নয়। ৪ মে’র আন্দোলন সম্পর্কে মাও সে তুং লিখেছেন, “8 মে’র আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতার সরকার, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রকারী এবং জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়ার এবং জনগণকে নির্যাতনকারী সরকারের বিরুদ্ধে। এ ধরনের সরকারের বিরােধিতা করা কি প্রয়ােজন ছিল
পেজ-৮৭
না? যদি না হয়ে থাকে তাহলে ৪ মে’র আন্দোলন ছিল নেহায়েতই একটা ভুল।”৯৯ ৪ মে’র আন্দোলন যে ধরনের সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল সেদিন পাকিস্তানে এমন একটি সরকারই ক্ষমতায় আসীন ছিল। তখন বামপন্থীদের আয়ােজিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একটি গানের বানীতে মানুষের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠত: “যে দেশের শ্যামল মাটিতে সােনা ফলতে পারে, সে দেশ আজ ভিক্ষা মাগে মার্কিন দুয়ারে, মরি হায়, হায়, হায়।”১০০
পূর্ব পাকিস্তানে উনসত্তরের অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব ছিল সেই সব ছাত্র নেতৃবৃন্দের হাতে যারা মূলত ছিলেন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন নাজিম কামরান চৌধুরী। এই শ্রেণি অবস্থান তাদেরকে আপােষহীন ও আপােষকামী উভয়ই হতে সাহায্য করেছিল। তবে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অথবা জীবনবৃত্তান্ত সরবরাহের সময় প্রায় প্রত্যেকে নিজেকে এগার দফা কর্মসূচির অন্যতম রূপকার হিসেবে দাবি করেছেন। পাকিস্তানে এবং ইউরােপে সে সময় যে ছাত্র নেতারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বয়সের হিসেবে তারা ছিলেন কাছাকাছি, একই প্রজন্মের সন্তান।
অনেকে এই আন্দোলনের স্বত:স্ফূর্ততাকে দুর্বলতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু যে কথাটি মনে রাখা প্রয়ােজন তা হচ্ছে, এই স্বত:স্ফূর্ততা আন্দোলনে কোনাে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে নি। সারাদেশে সৃষ্ট পরিস্থিতি শাসকশ্রেণির কাছে বিশৃংখলা মনে হলেও, এটা ছিল গণবিরােধী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের শৃংখলা। সেই দিনগুলােতে শাসকশ্রেণির সদস্যরা বক্তৃতা, বিবৃতিতে এই ভেবে উৎকণ্ঠিত হয়েছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ প্রবণতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। আসলে তারা বুঝতে পেরেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানকে আর বেশি দিন শােষণ করা যাবে না। আন্দোলনের শুরু থেকেই ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক ও সদস্যদের অনেকেই দলত্যাগ করে গণবিরােধী অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ান।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পরিসমাপ্তি ছাত্র সংগঠনের একাংশের দোদুল্যমনতা ও আপােষকামিতার জন্ম দেয়। অনেকে ভাবতে শুরু করেন, ক্ষমতা হাতের মুঠোয় এসে গেছে। অবশ্য বিকল্প প্রশ্ন উঠতে পারে: আন্দোলনের শেষ পরিণতি কি হতে পারত? এত বছর পরেও এ প্রশ্নে জবাবের ভিন্নতা আছে। তবে অধিকাংশ বিশ্লেষকই স্বীকার করেন, ঊনসত্তরের আন্দোলন ড্রেস রিহার্সাল হিসেবে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামকে গতি দিয়েছিল এবং জনগণ আত্মশক্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পেরেছিলেন।
ঊনসত্তরের আন্দোলন সম্পর্কে ছাত্র সংগঠনগুলাের মূল্যায়নের একটি চিত্র পাওয়া যায় ১৯৭০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে প্রকাশিত বিভিন্ন সংকলনে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র
========================================================
৯৯ সিলেকটেড ওয়ার্কস অব মাও সে তুং, দ্বিতীয় খন্ড, ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজেস প্রেস, পিকিং, ১৯৭৫।
১০০ আবদুল মতিন, আগুন যেন নিভে না যায়, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) এর একুশে
সংকলন ‘হাতুড়ী থেকে অগ্নিবীনা, কাস্তে সূর্যমুখী,’ ১৯৬৭।
পেজ-৮৮
ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) প্রকাশিত ‘বিশে জানুয়ারি’ শীর্ষক সংকলনে জানুয়ারি আন্দোলনের প্রেক্ষিত শিরােনামের প্রবন্ধে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা মাহবুব উল্লাহ লিখেছেন, “১১ দফা কর্মসূচির ও নেতৃত্বের চরিত্র বিশ্লেষণ করার সাথে সাথে আমরা এই আন্দোলনে জনগণের যে সকল আকাংখার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল তারও বিশ্লেষণ করব। বাস্তবে আন্দোলনের কর্মকান্ডে শ্রেণি সংগ্রাম ও শ্রেণি বিদ্বেষ বেশ তীব্রভাবে প্রকাশ লাভ করেছিল – গ্রামাঞ্চলে আমলা, টাউট ও মৌলিক গণতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে জনগণের বিক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছিল গণ বিচারের মাধ্যমে। সমাজ বিরােধী ও দুর্নীতিপরায়ন ব্যক্তিদের শায়েস্তা করার জন্য গ্রামাঞ্চলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গণবিচার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অনেক গ্রাম থেকে খাস জমি ও শত্রু সম্পত্তি বন্টনের খবর শােনা গেছে। শহরের শ্রমিকরা তাদের দাবিদাওয়া আদায় করার জন্য ব্যাপকভাবে শিল্প মালিক ও সরকারি, আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে ঘেরাও অভিযান পরিচালনা করেছিল। অর্থাৎ এক কথায় বলা যায়, জনগণ শােষণ, পীড়নের অবসান কামনা করেছিল এবং এমন একটি সরকার গঠন করতে চেয়েছিল যা তাদের সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলা মুৎসুদ্দী পুঁজির কবল থেকে মুক্ত রাখবে। কিন্তু সকল জাতীয় নেতাই জনগণের সেই সব আকাংখাকে বিভিন্ন কৌশলে শাসকশ্রেণির কাছে আপােষে বিকিয়ে দিয়েছিল। শেখ মুজিব ও ড্যাক নেতৃবৃন্দ, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একটি বিরাট অংশ গােলটেবিল প্রহসনের মধ্য দিয়ে জনগণের ত্যাগ, তিতীক্ষার প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে। প্রগতিশীল নেতৃবৃন্দ তাদের স্বভাবসুলভ দুর্বলতা ও অকর্মণ্যতারই পরিচয় দিয়েছিলেন। এমন পরিস্থিতিতেই জানুয়ারি-মার্চের গণআন্দোলন তার যৌক্তিক পরিণতিতে পৌছতে ব্যর্থ হয়।” একই সংকলনে এগারাে দফা প্রসঙ্গে শীর্ষক প্রবন্ধে বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন, “এগারাে দফা আমাদের বর্তমান সমাজের ভিত্তিকে আমূলভাবে পরিবর্তিত করার কোনাে কর্মসূচি নয় এবং সেদিক থেকে তা অনেকাংশে অসম্পূর্ণ। কিন্তু এগারাে দফার এই অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগঠনের উদ্দেশ্যে তার ভিত্তিতে রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এই পর্যায়ের রাজনীতির ক্ষেত্রে এক প্রগতিশীল পদক্ষেপ।”১০১
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) কর্তৃক ১৯৭০ সালে প্রকাশিত ঐতিহাসিক এগারাে দফা কর্মসূচি ও এগারাে দফা প্রতিষ্ঠার পথ শীর্ষক পুস্তিকায় বলা হয়েছে, “১৭ই জানুয়ারি হইতে পূর্ব বাংলার সংগ্রামী ছাত্র সমাজ যে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম শুরু করিয়াছিল, আইয়ুব-মােনায়েম সরকার উহাকে রক্তের বন্যায় ভাসাইয়া দিতে চাহিয়াছিল। কিন্তু স্বৈরাচারী শাসক গােষ্ঠীর গুলি-লাঠি-বেয়ােনেট ভােলা করিয়া জাগিয়া উঠে গণ অভ্যুত্থানের উত্তাল তরঙ্গ। গণ অভ্যুত্থানের উত্তাল তরঙ্গ শহর ছাড়াইয়া গ্রামের কৃষকদের মধ্যেও সৃষ্টি করে জাগরণ। আইয়ুব শাহীর পতন ঘটে সত্য। কিন্তু দেশে কায়েম হয় দ্বিতীয়বারের জন্য সামরিক শাসন। বর্তমানে দেশে সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘােষিত হইয়াছে এবং
=================================================================
১০১ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পক্ষে সংকলনটি প্রকাশ করেন শাখার সভাপতি মীর্জা আলমগীর। তিনি বর্তমানে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ন মহাসচিব। মােহাম্মদ হাননান তার বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস বইয়ের ৩৮৫ পৃষ্ঠায় মন্তব্য করেছেন, “ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন পন্থী) কোনাে উপদলেরই উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মূল্যায়নের দলিল পাওয়া যায় নি।” বিষয়টি তথ্যগতভাবে সঠিক নয়।
পেজ-৮৯
পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের সম্ভাবনাও সৃষ্টি হইয়াছে। কিন্তু কায়েমী প্রতিক্রিয়াশীল গােষ্ঠীর ষড়যন্ত্র আজও অব্যাহত আছে। অপরদিকে গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে ভাঙ্গন এমন কি ১১দফা সমর্থক ছাত্র প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যেও সৃষ্টি হইয়াছে বিভেদ। এগারাে দফা পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। শহীদানের আরদ্ধ কাজ সমাপ্ত করার মহান দায়িত্ব আজ আমাদের স্কন্ধে অর্পিত হইয়াছে। আজিকার এই পটভূমিকায় এগারাে দফার সংগ্রামকে অগ্রসর করিবার নিমিত্তে আমাদের নতুনভাবে শপথ নিতে হইবে। যে কোনাে মূল্যে হােক কায়েম করিতেই হইবে ১১ দফা। আর তাই আসুন, আমরা শত শহীদের রক্তে গড়িয়া উঠা এগারাে দফা প্রতিষ্ঠার পথ খুজিয়া বাহির করি।”
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি নূর-এ-আলম সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত এবং বাংলা ১৩৭৭ সালের পহেলা আষাঢ় (১৯৭০) প্রকাশিত সংগঠনের ঘােষণাপত্রে বলা হয়, “১৯৬৯ সালে ঐতিহাসিক ১১-দফা দাবি আদায়ের জন্য যে গণঅভ্যুত্থান, তা শুধুমাত্র বাংলার ইতিহাসেই নয়, পৃথিবীতে নিরস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাসে চিরদিন স্মরণীয় হইয়া থাকিবে। ঐতিহাসিক ১১দফার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হইল ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক সমাজের দাবির অন্তর্ভুক্তি ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের ঘােষণাপত্রে উল্লেখিত বাংলার স্বায়ত্বশাসনের ৬-দফা দাবির হুবহু উল্লেখ। এই ১১-দফা দাবি আদায়ের সংগ্রামের মধ্য দিয়া প্রতিটি ছাত্র প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং ছাত্র-শ্রমিক – কৃষক – বুদ্ধিজীবি নির্বিশেষে আপামর বাঙালী ৬দফা দাবিকে স্বায়ত্বশাসনের একমাত্র দাবি হিসাবে গ্রহণ করিয়াছে। ইহা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের আদর্শগত জয় বলিয়া অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে।”১০২
১৯৭০ সালের ২৮ ও ২৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) এর কেন্দ্রীয় কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম প্রদত্ত বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, “বিগত ১১ দফা গণঅভ্যুত্থানের একটি মৌলিক দুর্বলতা ছিল স্বতঃস্ফূর্ততা। ছাত্র জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আইয়ুব-মােনায়েমী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাপিড়ে পড়ে। কিন্তু সাংগঠনিক শক্তির দুর্বলতার ফলে এবং ছাত্র জনতার সচেতনতার অভাবের ফলে শাসকগােষ্ঠী ও প্রতিক্রিয়াশীল মহলের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নি। বিগত গণঅভ্যুত্থানের দুর্বলতাগুলাে কাটিয়ে উঠতে পারলে আমরা সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজির শােষণ নির্মূল করার বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারবাে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিগত গণঅভ্যুত্থানের সবলতা ও দুর্বলতাগুলাে আমাদের মনে রাখা দরকার।”১০৩
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মােহাম্মদ ফরহাদ (মরহুম) ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত তার লেখা বই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এ প্রায় অভিন্ন মূল্যায়ন করেছেন। আন্দোলনের মূল দুর্বলতা হিসেবে তিনি দেখেছেন এর স্বতস্ফূর্ততার দিকটিকে। তিনি
=================================================================
১০২ নূর-এ-আলম সিদ্দিকী বর্তমানে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে সক্রিয় নন। তবে তিনি ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশন ও
নিজস্ব ব্যবসা নিয়েই সময় ব্যয় করেন।
১০৩ এই নূরুল ইসলাম বর্তমানের (২০১০) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের শিক্ষামন্ত্রী।
পেজ-৯০
বলছেন, ‘এই অভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে যে, সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবাদের প্রতিভূ পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী জনগণ থেকে নিদারুণভাবে বিচ্ছিন্ন। এই অভ্যুত্থান শাসকগােষ্ঠীর ভিত্তিকে আরও নড়বড়ে করে দিয়েছে।’ অভ্যুত্থানের অবদান সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের ফলে সারা পাকিস্তানের বিশেষত পূর্ব বাংলার জনগণের চিন্তা ও চেতনার প্রসার ঘটেছে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থার মূলগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। মানুষগুলি এক থাকলেও তারা সকলে বদলে গিয়েছে। এই অ্যুত্থানের এটাই সর্বপ্রধান স্থায়ী অবদান।’১০৪
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) এর একাংশ, যারা ১৯৭০ সালের ১ মে একাদশ প্রাদেশিক সম্মেলনের আয়ােজন করে, তারা সম্মেলনে উত্থাপিত রাজনৈতিক রিপাের্টে মন্তব্য করে, “প্রথমত, এই আন্দোলন কয়েকটি ছােটখাট দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। যদিও বাইরের দিক থেকে ১১ দফা ছিল এই আন্দোলনের মূল শ্লোগান, তথাপি এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল সমাজের একটি সার্বিক পরিবর্তনের দিকে যা একমাত্র সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই সম্ভব। দ্বিতীয়ত, এই আন্দোলনের একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের দিকে ঝােক ছিল। এই আন্দোলনের জঙ্গীত্ব এত বেশি ছিল যে একমাত্র বিপ্লবী কার্যক্রমের ভেতর দিয়েই তাকে ধরে রাখা সম্ভব। তৃতীয়ত, এই আন্দোলন কৃষক বিদ্রোহের ভেতর দিয়ে গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত যে ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছিল তা একমাত্র দেশজোড়া বিপ্লবী অবস্থা থাকলেই সম্ভব। চতুর্থত, শ্রমিকশ্রেণি অনেক ক্ষেত্রেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রধানের ভূমিকায় চলে এসেছিল। বিশেষত, শ্রমিক শ্রেণি যখন অভূতপূর্ব ঘেরাও আন্দোলন শুরু করে, তখন তাদের সংগ্রাম অর্থনৈতিক সংগ্রামের পরিসীমা থেকে রাজনৈতিক সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়েছিল এবং এই সময় সমস্ত রাজনীতি সংস্কারবাদী বুর্জোয়াদের নাগালের বাইরে চলে যায়। পঞ্চমত, এই আন্দোলনের সময় শুধু সমাজের সবচাইতে নিষ্পেষিত শ্রেণিগুলিই আসে নি, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধীজীবী শ্রেণির লােক যারা – যেমন: ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনজীবী, মাঝারী ব্যবসায়ীরাও সংগ্রামের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার ড: শামসুজ্জোহার বেয়নেটের আঘাতে প্রাণত্যাগ এর সবচাইতে বড় উদাহরণ। বিপ্লবী সংগ্রামের একটি উচ্চ পর্যায়েই এটা সম্ভব হয়ে থাকে। …তবু বলি, গত আন্দোলন বিপ্লব নয়, অথবা বিপ্লব এসেও আসে নি। অথবা বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, যে কৃষি বিপ্লবের পথ দিয়ে বিপ্লব সংগঠিত ও জয়যুক্ত হতে পারে, সেই পথে আন্দোলন অগ্রসর হয় নি। কারণ, কৃষি বিপ্লবের পথে কৃষক সমাজ তথা জনতাকে নিয়ে যেতে পারে যে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী পার্টি, তা অনুপস্থিত ছিল। তাই আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফুর্ত। তার স্বাভাবিক নেতা ছিল বুর্জোয়াশ্রেণি ও পেটি বুর্জোয়া ভাবধারা দ্বারা আচ্ছাদিত ছাত্রসমাজ।”
উল্লেখিত বিশ্লেষণগুলাের মধ্যে সাযুজ্য ও বৈপরীত্য স্পষ্ট। ছাত্রলীগের বিশ্লেষণের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তার রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রতিফলন। আর ছাত্র ইউনিয়নের দুই গ্রুপের
============================================================
১০৪ মােহাম্মদ ফরহাদ, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা, অক্টোবর ১৯৮৯ পৃঃ ১২০-১২৪
পেজ-৯১
পেজ-৯২
লােভ-লালসা ছিল না। তখন প্রতিবছর ছাত্র সংগঠন ও ডাকসুর নেতৃত্ব পরিবর্তিত হত, নতুন নেতৃত্ব তৈরি হত। ছাত্ররা ছাত্র রাজনীতি করত। এখনকার সঙ্গে তখনকার রাজনীতি মেলে না, তাই এমন একটি গণঅভ্যুত্থান আর হবে কিনা সন্দেহ আছে।”১০৬
ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক নাজিম কামরান চৌধুরী বলেন, “১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা ছিল ১১ দফা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাঙালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে, এবং ১১ দফা আন্দোলনে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে দেশকে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিয়ে যায় এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। দুটি আন্দোলনের চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এ আন্দোলনগুলাে কোনাে রাজনৈতিক দল, আদর্শ বা ব্যক্তিগত নেতৃত্বের ছিল না, এগুলাে ছিল দেশের জনগণের আন্দোলন। ১১ দফা আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালী জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। স্বাধীনতা যুদ্ধের বিনিময়ে একটি স্বাধীন দেশ পেলেও, সত্যিকারের গণতন্ত্র এখনও সুদূর পরাহত। ১১ দফা আন্দোলনের চল্লিশ বছর পরে আমার জীবন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, কিন্তু আমরা আমাদের সংগ্রামের ফল এখনও পাই নি। মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের সন্তানেরা ভাল কিছু দেখবে কিনা?”
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) সভাপতি মােস্তফা জামাল হায়দার বলেন, ‘উনসত্তরের গন অভ্যুত্থানের চল্লিশ বছর পর যদি এ বিষয়ে আমার অনুভূতির কথা বলতে বলা হয়, তাহলে সর্বপ্রথমেই আমি যে কথাটি বলব তা হল, আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ রােপিত হয়েছিল ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানে এবং অচিরেই তা ফুলে-ফলে বিকশিত হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে রূপ লাভ করে। ঊনসত্তরের সেদিনের সেই দিনগুলিতে মিছিলের শ্লোগান ছিল, বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর, পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর। পিন্ডি না ঢাকা – ঢাকা, ঢাকা। আসাদের মন্ত্র — জনগণতন্ত্র। ছাত্র-জনতার মেজাজ, সমগ্র জাতির লৌহদৃঢ় একতা – সবকিছু মিলিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের একটা ড্রেস রিহার্সাল যেন অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলার মাটিতে।
বস্তুত পক্ষে সেই গােড়া থেকে যদি হিসেব করে দেখা যায়, তাহলে আমরা দেখতে পাই পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রকাঠামােতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান তথা এই ভূখন্ডের মানুষ কখনােই সমানাধিকার বা স্বাধিকার ভােগ করে নি। শােষণ-বঞ্চনা, জুলুম-নির্যাতন ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। আর এসবের বিরুদ্ধে বারবার রুখে দাঁড়িয়েছে বাংলার মানুষ। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয় ও তৎপরবর্তীতে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর আচ্ছালামুআলাইকুম ঘােষণা, সাতান্ন সালের কাগমারী সম্মেলনে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের যুগান্তকারী প্রস্তাবনা – এ সবই পশ্চিম পাকিস্তানের এককেন্দ্রিক স্বৈরতান্ত্রিক শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে এই ভূখন্ডের মানুষের সুস্পষ্ট চেতনার রায়। দুর্ভাগ্য যে, স্বায়ত্তশাসন – তথা স্বাধিকারের এই দাবির উদ্যোক্তা মওলানা ভাসানী ও এদেশের বামপন্থী প্রগতিশীল শক্তি এর ধারাবাহিকতা রক্ষায় পরবর্তীকালে শােচনীয়ভাবে
============================================================
১০৬ লেখকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, ২০ আগস্ট ২০১০।
পেজ-৯৩
ব্যর্থ হয়। জাতীয় প্রশ্নের গুরুত্ব ও প্রাধান্যকে অবহেলা করে আন্তর্জাতিক প্রশ্ন, তথা সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদের বিশ্বজোড়া শোষণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে তারা সােচ্চার হয় এবং সেটাকেই তারা অগ্রাধিকার দেয়। এরই পটভূমিতে শেখ মুজিবুর রহমান যখন তার ঐতিহাসিক ৬-দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন তখন গােটা দেশের মানুষ তাদের মুক্তি সনদ হিসাবে তা মাথায় তুলে নেয়। ইতিমধ্যে অবশ্য প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তার প্রবর্তিত মৌলিক গণতন্ত্র – যা না ছিল মৌলিক, না ছিল গণতন্ত্র – এর মাধ্যমে ১৯৬৫ সালের প্রথম দিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন করেন এবং সম্মিলিত বিরােধী দল ‘কপ’ এর প্রার্থী মিস ফাতেমা জিন্নাহকে পরাজিত করে তার গদি পাকাপােক্ত করার প্রয়াস পান। এ বছরেরই শেষ দিকে সংগঠিত হয় পাক-ভারত যুদ্ধ। ফলশ্রুতিতে সারা দেশে নেমে আসে কঠিন নির্যাতন ও নিষ্পেষণের স্টীমরােলার। দেশরক্ষা আইন ও অন্যান্য অসংখ্য নিবর্তনমূলক আইনের বেড়াজালে শত শত দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে কারারুদ্ধ করা হল। ৬ দফা দাবির ভিত্তিতে সারাদেশে যখন আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমান জনগণকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হন তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশদ্রোহিতার অভিযােগে অভিযুক্ত করে গ্রেফতার করা হল। আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ কেউই সেদিনের স্বৈরশাসনের রােষানল থেকে রেহাই পায় নি। সারাদেশে নেমে আসে এক নিদারুণ নৈরাশ্য ও হতাশা। কবরের নিস্তব্ধতায় যেন ছেয়ে যায় সারা দেশ।
এই রাজনৈতিক স্থবিরতা ও হতাশা কাটাতে সেদিনের ছাত্রসমাজের ঐক্যবদ্ধ ১১-দফা আন্দোলনের কর্মসূচি ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। কিন্তু সেই ঐক্যও একদিনে গড়ে উঠে নি। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (উভয় গ্রুপ) ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতারা—সকলেই যেন নিজ নিজ দলীয় সংকীর্নতা ও কুপমন্ডুকতায় আচ্ছন্ন। একদিকে ছাত্রলীগ ৬-দফা ছাড়া কোনাে কর্মসূচিকেই গ্রহণ করতে নারাজ – অপরদিকে ছাত্র ইউনিয়ন সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদবিরােধী, মেহনতী মানুষের শ্রেণিগত স্বার্থের অনুকূল কর্মসূচি ছাড়া কোনাে আন্দোলনে শরীক হতে অপারগ। অবশেষে ৬-দফা কথাটির উল্লেখ না রেখে এর সবগুলাে দফা সন্নিবেশিত করে এবং পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল, সিয়েটো-সেন্টো ত্যাগ করা সহ সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী কতিপয় দাবি জুড়ে দিয়ে, সর্বোপরি শ্রমিক-কৃষক মেহনতী মানুষের ন্যায্য দাবির ভিত্তিতে রচিত হয় ঐতিহাসিক ১১-দফা কর্মসূচি। উনসত্তরের ৪ই জানুয়ারি ছাত্র নেতৃবৃন্দ এই ঐতিহাসিক দলিলে স্বাক্ষর করেন এবং ১৭ই জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় সাধারণ ছাত্রসমাজের সামনে এই কর্মসূচি পেশ করা হয়। শুরু হয় বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত সারাদেশে ছাত্র জনতার মিছিল আর উচ্ছ্বাস। মনে পড়ে ২০শে জানুয়ারি ছাত্র জনতার এক বিশাল মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাহাদুর শাহ পার্কের উদ্দেশ্যে যখন এগিয়ে যাচ্ছিল তখন মিছিলের মাঝামাঝি স্থানে শুরু হয় পুলিশের আক্রমণ। মেডিকেল কলেজের এমার্জেন্সী বিভাগ ছাড়িয়ে চান খা পুলের কাছাকাছি স্থানে পুলিশের গুলিতে শাহাদাৎ বরণ করেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের বিশিষ্ট নেতা মােহাম্মদ আসাদুজ্জামান মিছিলের অগ্রভাগ তখন বাহাদুর শাহ পার্কের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। গুলির খবর পেয়ে বাহাদুর শাহ পার্কের পূর্ব নির্ধারিত ছাত্রজনসভা ফেলে রেখে আমরা সবাই ছুটে এলাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। পরবর্তী তিনদিন
পেজ-৯৪
আমরা সারাদেশে সর্বাত্মক প্রতিরােধ ও আন্দোলনের কর্মসূচি ঘােষণা করলাম। সারা বাংলাদেশে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল বিদ্রোহের আগুন। আর সে আগুনে যেন ঘৃতাহুতি দিল ২৪শে জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে নবকুমার হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউরের মৃত্যু। এরপরে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের পতন একান্তই অবধারিত হয়ে পড়ে।
কিন্তু ইতিহাসের রেকর্ডকে নির্ভুল রাখতে এ প্রসঙ্গে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে যে বাংলার মানুষকে হতাশা আর নৈরাশ্যের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করতে ইতিমধ্যে সে দিন আর এক মহান নেতা বলিষ্ঠ পদভারে এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ভাসানীর নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার লাট-ভবন (আজকের বঙ্গভবন) ঘেরাও ও পরবর্তীতে সারা বাংলাদেশে হাট-হরতালের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের মেজাজ ফিরে পেয়েছিল বাংলার মানুষ। আজ যখন সেটাকে ভুলে যাওয়া অথবা সযত্নে এড়িয়ে যাওয়ার একটা অপপ্রয়াস কখনও কখনও দেখতে পাই তখন মনটা বিষাদ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে।
মনটা বিষাদে ছেয়ে যায় আরও যে কারণে তা হচ্ছে উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের চল্লিশ বছর পরে যখন পেছনের দিকে ফিরে তাকাই তখন দেখতে পাই যে এই আন্দোলনের পরবর্তী ধাপে আমরা যদিও একটি স্বাধীন মাতৃভূমি অর্জন করেছি, একটি নতুন পতাকা ও মানচিত্র অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি, কিন্তু আজও বাংলার মানুষের স্বাধীন অর্থনৈতিক বিকাশ অর্জিত হয় নি। সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদের আগ্রাসনে আমরা যেন আগের চেয়েও বেশি করে নিস্পিষ্ট। আমাদের জাতীয় অর্থনীতি, রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় বৈদেশিক প্রভাববলয় দ্বারা। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে সদাচরণের সবক নিতে হয় বিদেশী দুতাবাসের কুটনীতিকদের কাছ থেকে। কোন নির্বাচন বৈধ হােল – আর কোন নির্বাচন বৈধ হােল না, তার সার্টিফিকেট দেন তথাকথিত বৈদেশিক ‘উন্নয়ন সহযােগীরা।’ বিগত ওয়ান-ইলেভেনের প্রাক্কালে তাদের একরকম ভূমিকা, পরে ঠিক অন্যরকম ভূমিকা। মরমী কবির ভাষায় এ যেন “সর্প হইয়া দংশন করে, ওঝা হইয়া ঝাড়ে।” আই এম এফ, বিশ্ব ব্যাংক ও এডিবি’র খবরদারিতে আমাদের কৃষকদের জন্য সারের ভর্তুকি বা কোনাে ধরনের অনুদানের কর্মসূচী আজ না জায়েজ। আমাদের মন্ত্রীসভার কোনাে কোনাে সাহসী ব্যাক্তিত্ব যদিও পার্লামেন্টের ফ্লোরে দাঁড়িয়ে এসবের প্রতিবাদ করেছেন, কিন্তু তবুও কথা থেকে যায় কবে আমরা একটা সত্যিকারের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব।’১০৭
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ বলেন, “৬৯ এর আন্দোলন ছিল ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব ঘটনা, এবং ভবিষ্যতে আর এ ধরনের অভ্যুত্থান ঘটবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। এই আন্দোলন ছিল খাইবার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত এবং প্রায় পাঁচ মাস ধরে এ আন্দোলন অব্যাহত ছিল।
==================================================================
১০৭ লেখকের সঙ্গে ই-মেইলে যােগাযােগ, ৩০ আগস্ট, রবিবার, ২০১০।
পেজ-৯৫
পূর্ব পাকিস্তানে এ আন্দোলনের মূল ব্যপ্তি ছিল ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের মার্চ পর্যন্ত। এই অ্যুত্থানের সময় অসামরিক প্রশাসন ভেঙ্গে পড়েছিল। কিন্তু ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত এ আন্দোলন ছিল অন্তর্নিহিতভাবে দুর্বল, কারণ এ ধরনের একটি আন্দোলন রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। একটি পর্যায়ে ছাত্ররাও ভেবে পাচ্ছিল না কি করতে হবে? ২৪ জানুয়ারি অভ্যুত্থানের দিনে যখন শ্রমিকরা অংশগ্রহণ করে তখন ছাত্র নেতৃবৃন্দের কাজ ছিল অ্যুত্থানকারীদের শান্ত করা, ঐ পরিস্থিতিতে আমরা নতুন কোনাে কর্মসূচি দিতে পারি নি। একটি বিপ্লবী পার্টি থাকলে অভ্যুত্থানের সাহায্যে ক্ষমতা দখল করতে পারত, কিন্তু সেটা ছিল তাদের সীমাবদ্ধতা।
আন্দোলনের বিকাশের পর্যায়ে নেতৃত্ব জনগণের পেছনে পড়ে গিয়েছিলেন। শ্রমিক, কৃষকদের আন্দোলন ধারণ করার ক্ষমতা ছাত্রদের ছিল না। এই আন্দোলনে স্বাধীনতা ও শ্রেণি চেতনার বহি:প্রকাশ ঘটে। এ দু’ধরনের চেতনা ধারণ করার ক্ষমতা ছাত্র নেতৃত্বের ছিল না। আরেকটি বিষয় উল্লেখযােগ্য। দশ বছরের শাসনের সময় বিভিন্ন দ্বন্দ্বের কারণে আইয়ুব তার নিজস্ব শ্রেণি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন এবং এ কারণে পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠীর জন্য নতুন প্রভুর প্রয়ােজন ছিল। কিন্তু একটি বিপ্লবী পার্টির অনুপস্থিতির কারণ শাসক শ্রেণির দুর্বলতা সত্ত্বেও কোনাে গণতান্ত্রিক বিকল্পের বিকাশ ঘটে নি। জনগণের আশা আকাংখার মধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রতিফলন ঘটেছিল। সেদিনের আন্দোলন আন্তর্জাতিক প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল না। তাই সমাজতন্ত্রের দাবি রাজপথে অনেক বার উচ্চারিত হয়েছে। আবার গণতন্ত্রের জন্যও আন্দোলন ছিল, যে কারণে ড্যাক গঠিত হয়েছিল। সামাজিক শক্তিগুলাের দুর্বলতাও এই আন্দোলনে ফুটে ওঠে। এ আন্দোলনের বড় ব্যর্থতা ছিল স্বৈরতন্ত্রের পরাজয়ের পর নতুন স্বৈরতন্ত্রের আবির্ভাব – রিনিউয়াল অব ওল্ড অর্ডার ঠেকাতে না পারা। এই আন্দোলনের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতার চেতনা আরও প্রখর হয় এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবান্বিত করার ব্যাপারে এই আন্দোলনের প্রভাব আছে এবং ১৯৭০ এর নির্বাচনের ফল বাংলাদেশী বুর্জোয়ার লক্ষ্য অর্জনে সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলে।”১০৮
ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুর রউফ বলেন, “চল্লিশ বছর আগে তরুণ ছিলাম। তরুণ ছিলাম বলেই দেশের জন্য জীবন দিতেও কুণ্ঠাবােধ হয় নি। সে সময়ের বিভিন্ন ঘটনার প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ সাক্ষী হিসেবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সােচ্চার হতে সাহস জুগিয়েছে। ময়মনসিংহের আনন্দমােহন কলেজে পড়ার সময়ে একটি ঘটনা আমাকে মারাত্মকভাবে আহত করে। তখন দেশে আইয়ুব খানের সামরিক আইন চলছে। ক্লাসে সরকার পদ্ধতি নিয়ে আলােচনা করার সময় আমি এটাকে বলেছিলাম সামরিক একনায়কত্ব। এ কথা বলার অপরাধে এক সেনা মেজর কয়েকদিন পর কলেজের প্রিন্সিপালের রুমে ডেকে নিয়ে আমাকে ধমকে ছিলেন। এ ঘটনা আমাকে সাংঘাতিকভাবে তাড়িত করে। মনে হতে থাকে পুঁথিগত বিদ্যা সম্পর্কে বলার কারণে এরা আমাকে অত্যাচার করছে। সেই থেকে রাজনীতি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এর পরে অসংখ্য আন্দোলনে অংশ নেই। ১৯৬৪ সালের ১৪ মার্চ
==================================================================
১০৮ লেখকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, ১৪ আগস্ট ২০১০।
পেজ-৯৬
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভােকেশনে মােনায়েম খানের যােগদানের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয় তাতে রাকসুর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে আমি বহিষ্কৃত হই এবং পড়াশােনা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন যেমন একটি মাইলফলক, তেমনি আর একটি মাইলফলক এগার দফার আন্দোলন। আন্দোলনের নতুনভাবে অংকুরােদগম হয়েছে উনসত্তরের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। এই আন্দোলন না হলে ছয় দফা বাস্তবায়িত হত না, বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু হতেন না। তখন ছাত্রদের মধ্যে যে মূল্যবোেধ ছিল আজ চল্লিশ বছর পরে এসে দেখছি সেই মূল্যবােধের অবক্ষয় হয়েছে। এই অবক্ষয় দূর করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতেও ঊনসত্তরের মতাে আন্দোলন হবে, এবং আমরা দেশের নতুন চেহারা দেখতে পাব।”১০৯
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেদ মােহাম্মদ আলী বলেন, “তখন আমরা একটা মিশন নিয়ে কাজ করেছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদ, বাঙালীর একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা। ১৯৬২ সালে যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম দেখা হয় তখন তিনি এই লক্ষ্য নিয়েই আমাদের কাজ করতে বলেছিলেন। ১৯৬৯ এর আন্দোলনের একটা ভিশন ছিল।ছয় দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ৭ জুন হরতালের পর দিন ৮ জুন আর সেই উত্তাপ ছিল না। মনে হয়েছিল সব ব্যর্থ হয়ে গেছে। তখন আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা জেলে। তরুণ নেতারা কাজ চালাচ্ছেন। আমরা তখন ভাবতাম এককভাবে কিছু করা যাবে না, বিভিন্ন দলকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ১৯৬৮ সালের সম্ভবত ১৮-১৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের বর্ধিত সভায় সিদ্ধান্ত হল ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে সিরাজুল আলম খানের ভূমিকা ছিল বিরাট। এ ছাড়া, আমরা ভেবেছিলাম আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলার সময় আন্দোলনকে তুঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।
এখনও মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা কিভাবে ১১-দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করতে পারলাম? এই কর্মসূচিতে সমাজের সকলের দাবি দাওয়ার প্রতিফলন ঘটেছিল। তখন আমরা মনের দিক দিয়ে অনেক উদার ছিলাম। যে কারণে, পশ্চিম পাকিস্তানে বিরাজমান সমস্যা সম্পর্কে ছাত্র ইউনিয়নের যে সব দাবি দাওয়া ছিল তাও আমাদের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। সে সময় আমাদের মনে ভয় ছিল, আন্দোলন তুঙ্গে নিয়ে গেলে বিশৃংখলা দেখা দেবে। তখন কি করব? এ প্রেক্ষাপটে আমরা ভেবেছিলাম ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনকে তুঙ্গে নিয়ে যাওয়া হবে এবং সকল প্রতিষ্ঠান সহ সরকার তছনছ করে দেওয়া হবে। আমরা বেপরােয়া ছিলাম। মনে হত, মরে গেলে মরে যাব। এ জন্য প্রত্যেকের উপর নির্দেশ ছিল নিজের নাম, ঠিকানা লেখা কাগজ যেন পকেটে থাকে – যাতে মরে গেলেও সনাক্ত করতে অসুবিধা না হয়।
আজকে মনে হয়, সেদিন যে ভিশন নিয়ে আন্দোলন হয়েছিল এমন আর হবে কিনা সন্দেহ আছে। ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন, এবং গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার বিরােধী
===========================================================
১০৯ লেখকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১০।
পেজ-৯৭
পরিস্থিতির মুখে ১৯৬৯ এর আন্দোলনের প্রাপ্তি ছিল: পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা, প্রাপ্ত বয়স্কদের সার্বজনীন ভােটাধিকার এবং পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বিলােপ। এই এক ইউনিট বিলােপের ফলে আমরা পরবর্তী নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যাই।
এখনকার ছাত্র রাজনীতি বুঝি না। সে সময় দেশের জন্য, আদর্শের জন্য কাজ করার বিষয়টি প্রধান ছিল আর এখন সব কিছু ব্যক্তি কেন্দ্রিক, ব্যক্তি স্বার্থের প্রাধান্য সর্বত্র। আমি ১৯৬৮ সালে গােপন ব্যালটের মাধ্যমে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। আজ একথা কল্পনাও করা যায় না।”১১০
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া গ্রুপ) সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দোহা বলেন, “তখনকার দিনে ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকা ছিল ব্যাপক। সে আন্দোলনে দেশের ব্যাপক মানুষ অংশগ্রহণ করে। ছাত্ররা নিবেদিত প্রাণ, নি:স্বার্থ কর্মী হিসেবে এ আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। আজ পেছনের দিকে তাকালে মনে হয়, সেই আন্দোলন স্বাধীন। বাংলাদেশের নয় মাসের যে মুক্তিযুদ্ধ তার প্রাথমিক সূচনা করেছিল। ১৯৬৯ এর আন্দোলনের পটভূমিতে যে জাতীয় নির্বাচন হয় তাতে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এর পরেও ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। নির্বাচনে বিজয় ক্ষমতা দখলের একটি আইনগত ভিত্তি তৈরি করে দেয়। কাজেই সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে ১৯৬৯ এর অভ্যুত্থান ছিল মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্ব।”১১১
ঊনসত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারি সেনা শাসক আইয়ুব খান পাকিস্তানের রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করলেও তার প্রচলিত শাসন পদ্ধতির অবসান ঘটে নি। কিন্তু এটা ছিল এক অভাবিত রাজনৈতিক বিজয় এবং পাকিস্তানের জনগণকে তা এক অকল্পণীয় মানসিক শক্তি যুগিয়েছিল। পাকিস্তানের সামরিক রাজনৈতিক রাজধানী রাওয়ালপিণ্ডিতে যখন প্রথম বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে তখন সরকার ছিল নির্লিপ্ত। কিন্তু পরিস্থিতি যেভাবে মােড় নেয় তাতে সুবিধাভােগীদের সামনে একমাত্র রাস্তা ছিল দশ বছর ধরে ক্ষমতাসীন প্রভুকে বিসর্জন দেওয়া।
উনসত্তরের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের উভয় অংশে আন্দোলনের অভূতপূর্ব বিকাশের ফলে আইয়ুবী শাসনের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী দু’মাসে চলেছে ক্ষমতা বদলের প্রক্রিয়া নিয়ে গােপন শলাপরামর্শ। উনসত্তর সালের ২৫শে মার্চ সামরিক শাসন জারি হওয়ার পরদিনই পূর্ব পাকিস্তানের শ্রমিকরা তা অমান্য করে। শ্রমিক ধর্মঘটের ফলে চট্টগ্রামে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। সেনাবাহিনী কিছু কিছু ক্ষেত্রে দমননীতি চালালেও, কিছু কিছু ক্ষেতে নতি স্বীকারে বাধ্য হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের করাচী, কোয়েটা প্রভৃতি স্থানেও
=============================================================
১১০ লেখকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, ২১ আগস্ট ২০১০।
১১১ লেখকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাত্তার, ২৩ আগস্ট ২০১০।
পেজ-৯৮
একই ঘটনা ঘটে। সামরিক শাসন জারির পর পরই প্রচারিত এক প্রচারপত্রে ছাত্র নেতা তারিক আলী মন্তব্য করেন, “যে শান্তি ফিরে এসেছে মনে হয় তা প্রতারণামূলক হতে বাধ্য। দশ বছর পরে এক জোয়াল থেকে মুক্ত হবার পর পূর্ব পাকিস্তানীরা এক বছরের বেশি আরেকজন পশ্চিম পাকিস্তানী একনায়ককে মেনে নেবেন বলে মনে হয় না। সামান্যতম ঘটনাও আরেকটি অভ্যুত্থানের জন্ম দিতে পারে, যার পরিণতি হবে স্বাধীন এবং সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান,” এবং বাস্তবে তাই ঘটেছে।
পেজ-৯৯
পরিশিষ্ট – ক
ডানিয়েল মার্ক কোহেন ব্যান্ডিট ১৯৪৫ সালের ৪ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জার্মান রাজনীতিবিদ হলেও ফ্রান্স ও জার্মানীতে সমানভাবে সক্রিয়। ১৯৬৮ সালে ফ্রান্সে মে বিদ্রোহের তিনি ছিলেন অন্যতম নেতা এবং রাজনৈতিক বিশ্বাস ও চুলের রং এর জন্য তাকে ‘ড্যানি দ্য রেড’ বলা হত। পরিবেশ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার কারণে তিনি বর্তমানে ড্যানি দ্য গ্রীন নামে পরিচিত। জার্মান ইহুদী হওয়ার কারণে তার পিতামাতা ১৯৩৩ সালে জার্মানী থেকে পালিয়ে যান। ১৯৫৮ সালে তিনি আইনজীবী পিতার কাছে জার্মানীতে ফিরে আসেন। নানতেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য তিনি ১৯৬৬ ফ্রান্সে আসেন এবং এখানেই তার খ্যাতির সূত্রপাত ঘটে। অবশ্য তাদের আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল যৌন স্বাধীনতার দাবি নিয়ে, যেন ছাত্ররা ছাত্রী হােস্টেলে প্রবেশ করার অনুমতি পায়।।
১৯৬৮ সালের আন্দোলন যখন দ্য গল বিরােধী রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ লাভ করে তখন ফরাসী কমিউনিস্ট পার্টি তার বিরুদ্ধে সমালােচনা মুখর হয়ে ওঠে। ১৯৭০ এর দিকে এসে ড্যানি পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৯৪ সালে তিনি ইউরােপীয় পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৯ সালে ফরাসী গ্রীন পার্টির নেতা হিসেবে ফরাসী রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। অবাধ অভিবাসন, মাদকের অনুমােদন, পারমানবিক ক্ষমতা ত্যাগ, মুক্ত বাজার প্রভৃতি প্রশ্নে অবস্থানের জন্য তিনি গত শতাব্দীর শেষের দিকে ক্রমাগত সমালােচনার সম্মুখীন হন। ২০০১ সালে তার বিরুদ্ধে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের অভিযােগ এলেও তা শেষ পর্যন্ত টেকে নি। ২০০৯ সালের ৭ জুন অনুষ্ঠিত ইউরােপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন শতকরা প্রায় ১৭ ভাগ ভােট পেয়ে ফ্রান্সে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। ভাই গ্যাব্রিয়েল কোহেন ব্যান্ডিট এর সঙ্গে যৌথভাবে লেখা তার বইয়ের নাম অব অবসােলেট কমিউনিজম: দ্য লেফট উইং অলটারনেটিভ। স্টালিনবাদে কট্টর সমালােচনামূলক বইটি ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয়।
আলফ্রেড উইলী রুডি ডটস্কি বা রুডি ডটস্কি ১৯৪০ সালের ৭ মার্চ পূর্ব জার্মানীতে জন্মগ্রহণ করেন। জার্মানীর ছাত্র নেতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচে সােচ্চার। সরকার ও সমাজ বদলের জন্য সেদিনের আন্দোলনে তিনি লংমার্চের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ১৯৭০ এর দশকে তিনি পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৮ সালে আততায়ীর গুলির আক্রমণ থেকে বেঁচে যান। যৌবনে সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে রুডি ১৯৬১ সালে বার্লিন প্রাচীর তৈরির মাত্র একদিন আগে পালিয়ে পশ্চিম জার্মানী চলে যান। পশ্চিম জার্মানীতেও তিনি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরােধী সভা, সমাবেশ ও মিছিলে নেতৃত্ব দেন। তার চিন্তাধারার ক্ষেত্রে সবচে বেশি প্রভাব ছিল রােজা লুকসেমবার্গের।
তিনি ১৯৬৬ সালে মার্কিন মহিলা গ্রেটকেন ক্লোৎজকে বিয়ে করেন। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে তৃতীয়জন, রুডি মারেক ডটস্কি বর্তমানে জার্মান গ্রীন পার্টির অন্যতম নেতা। তিনি মনে করতেন তৃতীয় বিশ্বের মুক্তি আন্দোলনের পাশাপাশি এবং একই সঙ্গে পশ্চিমা সমাজেরও বদলে যাওয়া উচিত। তার সমাজতান্ত্রিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে খৃস্ট ধর্মের বিরাট প্রভাব ছিল। তিনি যীশু খ্রীস্টকে সবচে বড় বিপ্লবী মনে করতেন। আততায়ীর গুলিতে আহত হওয়ার পর পড়াশােনার জন্য তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালে এডওয়ার্ড হীথের
পেজ-১০০
নেতৃত্বাধীন সরকার রাষ্ট্রবিরােধী কর্মকান্ডের অভিযােগে তাকে যুক্তরাজ্য থেকে বহিষ্কার করে। এ সময় ডেনমার্কের আরহাউস বিশ্ববিদ্যালয় তাকে শিক্ষকতার একটি চাকরি দেয়। আততায়ীর আঘাত তিনি পুরােপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর ডেনমার্কের আরহাউসের বাড়িতে গােসল করার সময় মৃগী রােগে আক্রান্ত হয়ে বাথটাবে মৃত্যুবরণ করেন।
ছাত্রনেতা তারিক আলী ১৯৪৩ সালে পাকিস্তানের লাহােরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক এবং এক সময় পাকিস্তান টাইমস পত্রিকার সম্পাদক মাজহার আলী খান। তারিক আলী প্রথম এশীয় হিসেবে অক্সফোর্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং এ সময়ে তিনি মার্কসীয় চিন্তাধারার সংস্পর্শে আসেন ও রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। পড়াশােনা শেষে তিনি ভিয়েতনাম সংহতি আন্দোলন গড়ে তােলেন এবং এক পর্যায়ে বার্ট্রান্ড রাসেল পরিচালিত ভিয়েতনাম যুদ্ধ অপরাধ ট্রাইবুনালের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০’র দশকে তার মালিকানাধীন টেলিভিশন প্রযােজনা কোম্পানী বানদুং যুক্তরাজ্যের চ্যানেল ফোর এর জন্য অনুষ্ঠান নির্মাণ করত।
তারিক আলী একজন সব্যসাচী লেখক। উপন্যাস, রাজনৈতিক গ্রন্থ, জীবনী সব ধরনের লেখাতেই তিনি সিদ্ধহস্ত। এ পর্যন্ত প্রকাশিত তার বইয়ের সংখ্যা ৪১টি এবং প্রায় প্রত্যেকটি বই পাঠক মহলে সমাদৃত। ১৯৬০ এর দশকের বিপ্লবী আবহাওয়ার দিনগুলােতে তারিক আলী রাজনীতির সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন এবং মূলতঃ ঐটস্কীপন্থীদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তার লেখার আরেকটি উপজীব্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে বিরােধ এবং দ্বন্দ্ব। ইউরােপে আটষট্টির এবং পৃথিবীজুড়ে সে সময়কার ছাত্র ও তরুণদের বিক্ষোভ সম্পর্কে তারিক আলী অনেকগুলাে গবেষণাধর্মী বই লিখেছেন।
পেজ-১০১
পরিশিষ্ট – খ
এই তালিকায় অন্তর্ভুক্তদের মধ্যে একজন ব্যতীত অন্য প্রত্যেকে প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন অথবা আছেন। এদের রাজনৈতিক জীবন অত্যন্ত গৌরবময় এবং শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) বাংলাদেশের স্থপতির মর্যাদার আসনে আসীন। তাজউদ্দিন আহমেদ (১৯২৮-১৯৭৫) ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তিনি ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর ঢাকা কারাগারে নিহত হন। ১৯৫৪ সালে ছাত্র থাকাকালীন তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদে, ১৯৭০ সালের তৎকালীন জাতীয় পরিষদে এবং ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর পদত্যাগ করেন। উল্লেখিত বন্দিদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন আত্মগােপনকারী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। গ্রেফতারি পরওয়ানা নিয়ে যারা আত্মগােপন করেছিলেন তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। মতাদর্শগত সংগ্রামের পরিণতিতে যখন কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হয় তখন মস্কোপন্থী অংশের নেতৃত্ব দেন শ্রী মণি সিংহ এবং পিকিংপন্থী অংশের নেতৃত্ব দেন শ্রী সুখেন্দু দস্তিদার। দীর্ঘদিন আত্মগােপনে থাকার পর ১৯৬৮ সালে শ্রী মণি সিংহ আকস্মিকভাবে গ্রেফতার হয়ে যান। মনিরুজ্জামান (তারা) ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) এর পাবনা জেলা শাখার নেতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর রক্ষীবাহিনী তাকে হত্যা করে। বদিউজ্জামান বড় লস্কর ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সহ সভাপতি এবং ছাত্রজীবন শেষে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। নূরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন ১৯৭০-৭২ সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি এবং স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা। বর্তমানে তিনি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তিনি আওয়ামী লীগের টিকেটে ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। রাশেদ খান মেনন ছাত্রজীবন শেষে প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং বর্তমানে তৃতীয় বারের মতাে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য। রাশেদ খান মেনন যখন ডাকসুর সহ সভাপতি (১৯৬৩-৬৪) তখন মতিয়া চৌধুরী ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক। ছাত্রজীবন শেষে মতিয়া চৌধুরী মস্কোপন্থী ন্যাপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগে যােগ দেন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করলে তিনি কৃষিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানেও তিনি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের কৃষিমন্ত্রী। চিত্তরঞ্জন সুতার বর্তমানে কলকাতায় প্রবাসী জীবন যাপন করে স্বাধীন বঙ্গভূমি আন্দোলন পরিচালনা করছেন। যুক্তফ্রন্টের মনােনয়নে তিনি ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদে এবং ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের টিকেটে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন ১৯৬০-৬৩ সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের পর পর তিনবার সভাপতি এবং ১৯৫৮-৬০ সময়ে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। স্বাধীনতার পর মুজিব সরকার ও এরশাদ সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন। বর্তমানে তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের মনােনয়নে রেকর্ড সংখ্যক ভােট পেয়ে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদে এবং সর্বোচ্চ ভােট পেয়ে ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। এ সংসদে তিনি চীফ হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর তিনি খােন্দকার মােশতাক আহমদের সঙ্গে যােগ দেন। শেখ ফজলুল হক (মনি) ১৯৬০-৬৩ সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি দুটি দৈনিক পত্রিকা, বাংলার বানী ও
পেজ-১০২
বাংলাদেশ টাইমস প্রকাশ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, শুক্রবার পরিবারের অনেকের সঙ্গে তিনি নিহত হন। ওরায়দুর রহমান (মরহুম) ১৯৬৩-৬৫ সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। ১৯৬২-৬৩ সময়ে ছিলেন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক। ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ৭২-৭৫ পর্যন্ত তিনি মুজিব মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন। ১৯৭৮ সালে বিএনপিতে যােগ দেন এবং ৭৯ সালে বিএনপি মনােনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ৭৮-৮১ সালে তিনি জিয়াউর রহমান মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন। মােল্লা জালাল উদ্দিন এক সময় মুজিব সরকারের ডাক ও তার বিভাগীয় মন্ত্রী ছিলেন এবং বর্তমানে নিভৃতে দিন যাপন করছেন। সাংবাদিক ও লেখক রনেশ দাশ গুপ্ত (প্রয়াত) সাংবাদিক হিসেবে দীর্ঘদিন দৈনিক সংবাদ-এ কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর তিনি কলকাতা চলে যান এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। প্রতাপ উদ্দিন (মরহুম) ছিলেন লঞ্চ শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা। চৌধুরী হারুনুর রশীদ রাজনৈতিক বিরােধের পর মস্কোপন্থীদের সঙ্গে যােগ দেন। তিনি ১৯৫৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার, ১৯৫৬ সালে গঠিত মজদুর ফেডারেশনের সহ সভাপতি নির্বাচিত হন। ‘অভিশপ্ত নগরী’ গ্রন্থের লেখক সত্যেন সেন (১৯০৭-৮১) মস্কোপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯২৪ সালে এন্ট্রান্স পাশ করার পর তিনি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন যুগান্তর এ যােগ দেন। তিনি জীবনে ১৮ বছর জেল খেটেছেন। তার লেখা গ্রন্থের সংখ্যা ৪০টি এবং উপন্যাসের জন্য ১৯৭০ সালে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। সাংস্কৃতিক জগতে তার উল্লেখযােগ্য অবদান ১৯৬৮ সালে উদীচী’র প্রতিষ্ঠা। পিকিংপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন সিলেটের লালা শরদিন্দু দে, অজয় ভট্টাচার্য, আসদ্দর আলী, যশােরের অমল সেন, হেমন্ত সরকার, কিশােরগঞ্জের নগেন সরকার, যশােরের মােদাসসের আলী, চট্টগ্রামের সুধাংশু বিমল দত্ত। এদের প্রত্যেকেই এখন পরলােকগত। সুধাংশ বিমল দত্তের কন্যা দীপা দত্ত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) এর যুগ্ম সম্পাদক। ২০ জানুয়ারি, সােমবার, ১৯৬৯ আসাদের মৃত্যুর পর কালাে পতাকা। নিয়ে যে শােক মিছিল বের হয় দীপা দত্ত তাতে নেতৃত্ব দেন। সুখেন্দ দস্তিদার ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (পিকিংপন্থী) প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তিনি বশির ভাই নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তার অন্য দুভাই, পূর্নেন্দু দস্তিদার ও অর্ধেন্দু দস্তিদার মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মস্কোপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন মন্মথ নাথ দে, ফরিদপুরের আশু ভরদ্বাজ, সন্তোষ ভট্টাচার্য, পাবনার লাহিড়ী মােহনপুর গ্রামের অমূল্য লাহিড়ী, রনেন মৈত্র, জোতিষ মৈত্র, জোতিষ বােস, অজয় রায়, অধ্যাপক আবদুল হালিম, নরসিংদীর রায়পুরের কৃষক নেতা আবদুল হাই, শংকর বােস, নারায়নগঞ্জের হানিফ খান, রংপুরের আমজাদ হােসেন, জামালপুর জেলার শেরপুরের রবি নিয়ােগী, বিষ্ণু চ্যাটার্জী, রংপুরের মনি কৃষ্ণ সেন, সত্যরঞ্জন মৈত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা নুরুল ইসলাম, চট্টগ্রামের সুখেন্দু রায়, অনীল মুখার্জি, জ্ঞান চক্রবর্তী, এবং শচীন বােস। এদের প্রায় প্রত্যেকে পরলােকগত। ফেনীর সন্তান শফিকুর রহমান (মজুমদার) ছিলেন টঙ্গীর শ্রমিক নেতা এবং পিকিংপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত কোলকাতায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই কংগ্রেসে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যােগ দিয়েছিলেন মনি সিংহ, নেপাল নাগ, খােকা রায়, কৃষ্ণ বিনােদ রায় প্রমুখ। এই কংগ্রেসের পর পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ব
পেজ-১০৩
পাকিস্তান কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয় এবং সম্পাদক নির্বাচিত হন খােকা রায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি যুক্ত ফ্রন্টকে সমর্থন এবং ৭ জন প্রার্থীকে মনােনয়ন দেয়। এদের মধ্যে পূর্নেন্দু দস্তিদার (চট্টগ্রাম), সুধাংশু বিমল দত্ত (চট্টগ্রাম), প্রসূন কান্তি রায় (সিলেট) ও অভয় বর্মন (রংপুর) জয়লাভ করেন।
১৯৫৬ সালে কোলকাতায় গােপনে পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ব পাকিস্তান কমিটির প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই কংগ্রেসে উপস্থিত ছিলেন মনি সিংহ, খােকা রায়, নেপাল নাগ, বারীণ দত্ত, মােজাফফর আহমদ, সুকুমার ভাওয়াল, রােহিনী দাস, সুখেন্দু দস্তিদার, মনি কৃষ্ণ সেন, অমূল্য লাহিড়ী, মােহাম্মদ তােয়াহা, কৃষ্ণ বিনােদ রায়, ইলা মিত্র, আফতাব আলি, আবদুস সাত্তার, প্রমােদ লাহিড়ী, সত্য মিত্র, যুঁই ফুল রায়, চেধুরী হারুনুর রশিদ, নগেন দে ও দেবেন শিকদার প্রমুখ। এই কংগ্রেসে যে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়, তার মধ্যে ছিলেন মনি সিংহ, খােকা রায়, অনিল মুখার্জি, বারীণ দত্ত, নেপাল নাগ, সুখেন্দু দস্তিদার, আলতাফ আলী, শহীদুল্লাহ কায়সার, মােহাম্মদ তােয়াহা, সরদার ফজলুল করিম, চৌধুরী হারুনুর রশিদ ও আমজাদ আলী। সম্পাদক নির্বাচিত হন মনি সিংহ।
পেজ-১০৪
পরিশিষ্ট – গ
এ তালিকায় যাদের নামের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানিক পরিচয় দেওয়া হয় নি তারা প্রত্যেকেই ছিলেন সাংস্কৃতিক জগতের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার ধারক এবং দাবাগুরু হিসেবে পরিচিত ড: কাজী মােতাহার হােসেন (১৮৮৭-১৯৮১) ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক। তাঁর দুই কন্যা, সানজিদা খাতুন ও ফাহমিদা খাতুন রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী। মুক্ত চিন্তার অধিকারী আবুল হাশিম এক সময় মুসলীম লীগের সম্পাদক ছিলেন। বামপন্থী নেতা ও বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর তাঁর পুত্র। শামসুর রাহমান, ফজল সাহাবুদ্দীন, আহমেদ হুমায়ুন, সানাউল্লাহ নুরী, আফলাতুন, কালাম মাহমুদ এরা ছিলেন দৈনিক পাকিস্তানে কর্মরত। কবি সাইয়িদ আতিকুল্লাহ (১৯৩৩-১৯৯৮) ছিলেন জনতা বাংকে কর্মরত। ভাষা আন্দোলনের সময় তাকে জেল খাটতে হয়েছিল। কে জি মুস্তাফা ছিলেন পাকিস্তান অবজারভারে কর্মরত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সরকার তাঁকে লেবানন ও ইরাকে রাষ্ট্রদূত নিয়ােগ করে। ১৯৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর তিনি দীর্ঘদিন ইরাকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন। দেশে ফিরে আসার পর তিনি কলাম লিখতে শুরু করেন এবং একসময় বেক্সিমকো গ্রুপের অধুনালুপ্ত দৈনিক মুক্তকণ্ঠের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার, ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার মরহুম জহির রায়হান (১৯৩৫-৭২) ছাত্রজীবন শেষে কিছু দিন সাংবাদিকতা করার পর চলচ্চিত্র নির্মাণ ও পরিচালনায় আত্মনিয়ােগ করেন। ছাত্রজীবনে তিনি প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের পর ভাই, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে মিরপুর গিয়ে আর ফিরে আসেন নি। মনে করা হয়, লুকিয়ে থাকা পাক সেনারা তাকে গুলি করে হত্যা করে। কথিত আছে, তিনি হাত দেখে প্রায় নির্ভুল ভবিষ্যৎবানী করতে পারতেন। ইসহাক চাখারী ছিলেন সূর্য দীঘল বাড়ির লেখক। লেখক শওকত আলী ছিলেন অধ্যাপনা পেশার সঙ্গে জড়িত। সন্দীপের সন্তান, ছড়াকার আফলাতুন, প্রথম মহিলা সাংবাদিক ও ভাষা আন্দোলনের সৈনিক লায়লা সামাদ, দৈনিক বাংলার সম্পাদক হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত আহমেদ হুমায়ুন, সানাউল্লাহ নূরী, কে জি মুস্তাফা, চিত্রশিল্পী কালাম মাহমুদ, সঙ্গীত সংগঠক ওয়াহিদুল হক, কাজী মাসুম, আবদুল আউয়াল, জামাল উদ্দিন মােল্লা এবং এক সময়ে দৈনিক বাংলার সম্পাদক গােলামুর রহমান এখন পরলােকগত। লায়লা সামাদ (১৯২৮-১৯৮৯) সাপ্তাহিক বেগম দিয়ে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। এর পর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকীর সঙ্গে কাজ করেন। তিনি প্রচুর গল্প, উপন্যাস লিখেছেন, নাটক পরিচালনা করেছেন। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় তাঁর অনূদিত ও পরিচালিত লাল লণ্ঠন ও স্বেত কেশিনী বালিকা প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। মরহুম আনােয়ার জাহিদ সাংবাদিকতা ছেড়ে এরশাদ সরকারের আমলে জাতীয় পার্টিতে যােগদান করেন এবং তথ্য ও শ্রমমন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে মতভেদের কারণে এরশাদ মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি বিএনপিতে যােগদান করে দলীয় চেয়ারপার্সনের তথ্য উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়েছিলেন। পরে তাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। কবি শহীদ কাদরী বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী জীবন যাপন করছেন।
পেজ-১০৫
পরিশিষ্ট – ঘ
এই নেতৃবৃন্দের মধ্যে ভাষা আন্দোলনের সময় পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নুরুল আমিন। তিনি ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচনের সময় রাজনৈতিকভাবে অপরিচিত যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীর কাছে হেরে যান। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে বিরােধী দলের নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি পাকিস্তানের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পান। মৃত্যুর পর তাকে করাচীতে জিন্নাহ’র স্মৃতি সৌধে সমাহিত করা হয়। লায়লা সামাদ সম্পাদিত মাসিক চিত্রিতা’র ফাল্গুন ১৩৭৭ (ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯৭১) সংখ্যায় প্রকাশিত এই লেখকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নূরুল আমীন বলেছিলেন, “আমি কখনও শহীদ মিনারে যাই নি, দূর থেকে দেখেছি শহীদ মিনারকে। কোনাে অনুষ্ঠান উপলক্ষে ঠিক যাই নি।” সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া হিসেবে পরিচিত) ছিলেন কৃষক প্রজা পার্টির নেতা, খাজা খয়ের উদ্দিন ছিলেন কাউন্সিল মুসলীম লীগ ও মাহমুদ আলী ছিলেন গণতন্ত্রী পার্টির নেতা।
এনডিএফ নেতা আবু হােসেন সরকার (১৮৯৪-১৯৬৯) ১৯৫৫ সালের জুন মাসে যুক্ত ফ্রন্ট সরকারের আমলে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৫৬ সালের আগষ্ট মাস পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা শহরে ভুখা মিছিলের কারণে তিনি ১৯৫৬ সালের ৩০ আগস্ট পদত্যাগ করেন। পুনরায় ১৯৫৮ সালের জুন মাসে মাত্র দু’দিনের জন্য মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন।
আতাউর রহমান খান (১৯০৭-১৯৯১) ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসভার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং মাত্র দু’মাস এ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৮ সালের আগস্ট মাসে তিনি পুনরায় মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং অক্টোবর মাসে সামরিক শাসন জারি হওয়া পর্যন্ত সে পদে বহাল থাকেন। তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৬ সালের জানুয়ারি থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে বিরােধী দলের নেতা ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং এ দলের টিকেটে ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭৫ সালে বাকশালে যােগদান করেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন। বাকশাল বিলুপ্তির পর ১৯৭৬ সালে তিনি তার প্রতিষ্ঠিত দল জাতীয় লীগ পুনরুজ্জীবিত করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তার দল একসময় বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোটের অংশ হিসেবে জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। পরবর্তীতে তিনি ১৯৮৪ সালের মার্চ মাসে এরশাদের মন্ত্রীসভায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যােগ দেন এবং ১৯৮৫ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার লেখা দুটি উল্লেখযােগ্য বই স্বৈরাচারের দশ বছর এবং ওজারতির দুই বছর।
১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার আগে খাজা নাজিমুদ্দীন ছিলেন বাংলা সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পরবর্তী পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী। ১৯৪৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৪৮
পেজ-১০৬
সালে জিন্নাহ’র মৃত্যুর পর তিনি পাকিস্তানের দ্বিতীয় গভর্ণর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল, শুক্রবার পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ তাকে বরখাস্ত করেন।
প্রবীণ জননেতা অলি আহাদ এক সময় আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দীর্ঘ ৪০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ক্ষমতা কখনও তাকে আকৃষ্ট করে নি। ১৯৪৫ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৪৮ সালে প্রথম কারাবরণ করেন। ১৯৫০ সালে বি.কম পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেও আর এগুতে পারেন নি। মুজিব সরকার ৩০ জুন, ১৯৭৪ বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাকে গ্রেফতার করে এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর তিনি মুক্তি লাভ করেন। রাজনৈতিক জীবনে তিনি বহুবার জেল খেটেছেন। তিনি বাংলা জাতীয় লীগের প্রতিষ্ঠাতা। তার লেখা, জাতীয় রাজনীতি, ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫ এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক আকর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত।
পেজ-১০৭
পরিশিষ্ট – ৪
দু’জন ব্যতীত এখানে উল্লেখিত প্রত্যেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সরকারে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ছয় দফা আন্দোলনের সময় সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে আমেনা বেগম অস্থায়ী সম্পাদক হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও পরবর্তী পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয় এবং তিনি ভিন্ন দল গঠন করেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেটে যথাক্রমে পাকিস্তান জাতীয় সংসদ ও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। বাকশাল গঠিত হওয়ার পরে ১৯৭৫ সালের ২৬ জানুয়ারি উপ-রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন এবং ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর ৩রা নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত হন। ক্যাপ্টেন মনসুর আলি (১৯১৯-১৯৭৫) শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৪৫ সালে পাবনায় আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসভায় যােগদান করেন। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদে এবং ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হন। মুজিবনগর সরকারের সময় অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের পর স্বরাষ্ট্র ও যােগাযােগ মন্ত্রী এবং বাকশাল গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর ৩রা নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত হন।
খােন্দকার মােশতাক আহমদ (১৯১৯-১৯৯৬) ১৯১৯ সালে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার দশপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪২ সাল থেকে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন এবং পড়াশােনা শেষে আইন পেশায় যােগ দেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে জেল খাটেন এবং ১৯৫৪ সালে তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ গঠিত ‘ড্যাক’ এর পূর্ব পাকিস্তান শাখার আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৭০ সালে ও ১৯৭৩ সালে যথাক্রমে পাকিস্তান জাতীয় সংসদ ও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তবে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনী ফলাফল সম্পর্কে বিতর্ক আছে। তিনি মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র, আইন ও পার্লামেন্টারী দফতরের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের পর তিনি বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পল্লী উন্নয়ন ও বিদ্যুৎ শক্তি দফতরের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। বাকশাল গঠনের পর বানিজ্য ও বৈদেশিক বানিজ্য মন্ত্রী নিযুক্ত হন। তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিচালিত সেনা অভিযানে শেখ মুজিব সহ অন্যরা নিহত হন এবং বাকশাল পদ্ধতির সরকারের পতন ঘটে। পনেরােই আগস্টের পর তিনি ৮৩ দিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জয় বাংলা’র পরিবর্তে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ শ্লোগান চালু করেন এবং বাংলাদেশ বেতারের নামকরণ করেন রেডিও বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। ১৯৭৬ সালে ডেমােক্রেটিক লীগ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। একই বছর তৎকালীন সামরিক সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযােগে গ্রেফতার হন। এ
পেজ-১০৮
সময় দায়ের করা দুটি দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে পাঁচ বছর কারাদন্ড ভােগ করেন। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি পুনরায় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৯৬ সালের ৫ মার্চ ঢাকায় আগামাসিস্থ নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন।
মিজানুর রহমান চৌধুরী ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কুমিল্লা জেলার চাঁদপুরে অংশগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এবং ১৯৬২ সালে তৎকালীন জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের মনােনয়নে ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন প্রথম মন্ত্রীসভায় তথ্য ও বেতারমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং কিছুদিন পরে পদত্যাগে বাধ্য হন। তিনি এরশাদের অধীনে ১৯৮৬ সালের ৯ জুলাই থেকে ১৯৮৮ সালের ২৭ মার্চ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরশাদের সামরিক শাসন জারির পর তিনি এর প্রতি সমর্থন দিয়ে ১৯৮৪ সালে জাতীয় পার্টিতে যােগ দেন। ১৯৯০ সালে এরশাদের শাসনের অবসানের পর তিনি ২০০১ সালে আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত এ দলের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য ছিলেন। তিনি অনেকদিন বাকশাল এর রাজনীতিকে চালু রাখেন এবং মৃত্যুর কিছু আগে তাঁর আদি দল আওয়ামী লীগে ফিরে যান। তিনি ২০০৬ সালে মারা যান।
আবদুল মান্নান ১৯২৯ সালে টাংগাইল জেলার ভবানীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবন শেষে কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর আয়কর আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে যথক্রমে পাকিস্তান জাতীয় সংসদ ও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রীসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের পর স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন। সােহরাব হােসেন ১৯২৫ সালে মাগুরায় জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি আইন পেশায় যােগদান করেন। ১৯৫২ সালে আওয়ামী লীগে যােগদান করেন এবং ১৯৬২ সালে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় সংসদ ও ১৯৭৩ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বন, মৎস্য ও পশুপালন মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের পর পূর্ত, গৃহ নির্মাণ ও নগর উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী নিযুক্ত হন।
১৯৭৪ সালের ২৭ জানুয়ারি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পদত্যাগ করলে ঐ দিন মুহম্মদুল্লাহ বাংলাদেশের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী কার্যকর হলে শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে পুনরায় দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং মুহম্মদুল্লাহর দায়িত্বের অবসান ঘটে। পরবর্তী সময়ে মুহম্মদুল্লাহ ও ওবায়দুর রহমান উভয়েই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন।
পেজ-১০৯
পরিশিষ্ট – চ
১৯৬৫ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে যারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের প্রায় প্রত্যেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন। সে সময় এদের রাজনৈতিক পরিচয় ছিল, নূরুল আমীন (ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট), শাহ আজিজুর রহমান (মুসলিম লীগ), ডক্টর আলীম আল রাজী (স্বতন্ত্র), ইউসুফ আলী (আওয়ামী লীগ), মােহাম্মদ কামরুজ্জামান (আওয়ামী লীগ), মশিউর রহমান (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি), মিজানুর রহমান চৌধুরী (আওয়ামী লীগ), মাহমুদ আলী (ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট), আরিফ ইফতেখার (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি), ফরিদ আহমদ (নেজামে ইসলামী), খাজা খয়ের উদ্দিন (কাউন্সিল মুসলিম লীগ), পীর মােহসেন উদ্দিন (পিডিএম)। আরিফ ইফতেখার এর পিতা ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় নেতা মিয়া ইফতেখার উদ্দিন। শাহ আজিজুর রহমান বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মন্ত্রীসভায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মশিউর রহমান (১৯২৪-৭৯) রংপুর জেলার ডিমলা থানায় জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এক সময় নেতাজি সুভাষচন্দ্রের আহবানে বার্মা গিয়ে সেখানে মুক্তিফৌজ এ যােগ দেন। ১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান যুব উৎসবের প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ৬০ এর দশকের শেষ দিকে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মশিউর রহমান পাকিস্তান জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে বিরােধী দলীয় উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১১ দফা আন্দোলনের সময় মওলানা ভাসানীর আহ্বানে জাতীয় পরিষদ সদস্যপদে ইস্তফা দেন। ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগ তাকে বন্দী করে এবং ১৯৭৫ সালের পরিবর্তনের পর তিনি মুক্তি লাভ করেন। ১৯৭৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি’র বিজয়ের পিছনে তিনি বিরাট ভূমিকা পালন করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার মন্ত্রীসভায় তিনি সিনিয়র মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং মস্তিস্কে রক্তক্ষরণের কারণে আকস্মিকভাবে ১৯৭৯ সালের ১২ মার্চ মৃত্যু বরণ করেন। মাহমুদ আলী এক সময় প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ বিরােধী অবস্থান গ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর থেকে তিনি মৃত্যু পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রতিটি সরকারে দফতর বিহীন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অলি আহাদ তার ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘২৩ মার্চ, (১৯৬৯) ভােরবেলা ঢাকার লালমাটিয়ার নিজ বাড়ীর নিকট হইতে আওয়ামী লীগ কর্মীবৃন্দ কর্তৃক স্ত্রী, কন্যার চোখের সামনে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের নেতা মাহমুদ আলীকে জোরপূর্বক অপহরণ করিয়া ধানমন্ডী আবাসিক এলাকার ১৯ নং সড়কে অবস্থিত এক স্টুডিওতে আটক করা হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে কিছু বলিবে না, তাহাকে দিয়া এক অংগীকারপত্রেও বলপূর্বক সহি করানাে হয়।’ মাহমুদ আলী ১৯৫১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির প্রচেষ্টায় বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকায় গঠিত পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৫৮ পর্যন্ত যুবলীগ টিকে ছিল। ১৯৫৩ সালে ডেমেক্রেটিক পার্টি বা গণতন্ত্রী দল গঠিত হলে মাহমুদ আলী তার সম্পাদক নির্বাচিত হন। ডক্টর আলীম আল রাজী (১৯২৫ – ১৯৮৫)আইন পেশায় দেশজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ভাসানী) যােগদান করেন। ১৯৭২-৭৫ সময়ে
পেজ-১১০
আওয়ামী লীগ সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি সাহসী ভূমিকা পালন করেন এবং বাগ্নিতার সৌন্দর্যের কারণে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ভাসানী) সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন। কিছুকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনশঅস্ত্রে অধ্যাপনা করেন। ১৯৭৬ সালে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ পিপলস লীগ গঠিত হয়। তার সম্পাদনায় টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত হতাে সাপ্তাহিক ‘দূরবীন’ ও লন্ডন থেকে ‘দি ওরিয়েন্টাল টাইমস’। তিনি ‘মুসলমানের জেনে রাখা ভাল’ শীর্ষক একটি বইও লেখেন। ডাকসুর সহ সভাপতি আহমদুল কবির ১৯৪৬ সালে পদত্যাগ করলে শূণ্যপদে কক্সবাজারের সন্তান ফরিদ আহমদ নির্বাচিত হন। ইনিই পরবর্তীকালে মওলভী ফরিদ আহমদ নামে পরিচিত হন এবং নেজামে ইসলাম পার্টি করতেন। ফরিদ আহমদ দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। কথিত আছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরােধিতা করার অভিযােগে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা তাকে ঢাকায় হত্যা করে।
পেজ-১১১
পরিশিষ্ট – ছ
সিয়েটো, সেন্টো: দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ উত্তর পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট আগ্রাসনের ভীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পেয়ে বসে। বিশেষ করে উপনিবেশের জোয়াল থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্ত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলাে যাতে কমিউনিস্ট বলয়ের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে কমিউনিজমকে ঠেকানাের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইনস, থাইল্যান্ড এবং পাকিস্তান ১৯৫৪ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় সাউথ ইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সিয়েটো) চুক্তি স্বাক্ষর করে। নামে দক্ষিণ এশিয়া হলেও মাত্র দুটি দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্র এই জোটে অংশগ্রহণ করে। ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডের এই জোটে অংশগ্রহণের পক্ষে যুক্তি ছিল দেশের অভ্যন্তরে বিরাজমান গেরিলা যুদ্ধের হুমকি। প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থানের কারণে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড এই জোটে অংশগ্রহণ করে এবং অতীতের ঔপনিবেশিক অবস্থানের কারণে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স অংশগ্রহণ করে। এই জোটের প্রধান কার্যালয় ছিল ব্যাংককে। সিয়েটো নিজের কোনাে সৈন্যবাহিনী না রাখলেও সদস্য দেশগুলাের সেনাবাহিনীর উপর নির্ভরশীল ছিল। অপরদিকে কমিউনিস্টদের ঠেকানাের জন্য সিয়েটো বেশ কিছু অর্থনৈতিক কর্মসূচিও গ্রহণ করে। এই যুক্তির দোহাই দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫৬ সালে ভিয়েতনামের একত্রীকরণের জন্য অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন বয়কট করে। এত কিছুর পরেও পাকিস্তান ও ফ্রান্স ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি সমর্থন করে নি। পাকিস্তান ১৯৭৩ সালে ভূট্টোর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিয়েটো ত্যাগ করে এবং ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসানের পর ১৯৭৭ সালে এই সংস্থার বিলুপ্তি ঘটে। ১৯৫৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন আরেকটি সামরিক জোটে জড়িয়ে পড়ে পাকিস্তান। শুরুতে বাগদাদ চুক্তি হিসেবে পরিচিত এই জোট প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৫ সালে এবং প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিল তুরস্ক, ইরাক, যুক্তরাজ্য, পাকিস্তান এবং ইরান। বাগদাদ চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যে কমিউনিস্ট অনুপ্রবেশ ঠেকানাে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই জোটে একই সঙ্গে ইসরায়েল ও আরব দেশগুলােকে অন্তর্ভূক্ত করতে চেয়েছিল। কিন্তু সে সময়ে বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে তা সম্ভব হয় নি। এ প্রেক্ষিতে পাকিস্তান ও তুরস্ক সহযােগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। পরে এই সকল চুক্তিকে একটি জোটের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু সুয়েজখাল জাতীয়করণ করা নিয়ে সংকট, ১৯৫৮ সালে বিগ্রেডিয়ার করিম কাসেমের নেতৃত্বে ইরাকে রাজতন্ত্র বিরােধী সামরিক অভ্যুত্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্বিগ্ন করে তােলে। অবশ্য এর কিছুদিন আগে লেবাননে আগ্রাসন চালানাের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫৭ সালের আইজেনহাওয়ার ডকট্রিনের অজুহাত গ্রহণ করে। ১৯৫৯ সালে ইরাক এ চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়ায় এর নামকরণ করা হয় সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সেন্টো)। একই সঙ্গে সেন্টোর প্রধান দফতর বাগদাদ থেকে সরিয়ে তুরস্কের রাজধানী আংকারায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেন্টো যতদিন টিকে ছিল ততদিন এ চুক্তির অধীনে সদস্য রাষ্ট্রগুলাে কোনাে নিরাপত্তা সমর্থন পায় নি। ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর ইরান এ চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। কখনও নিরাপত্তা সমর্থন পায় নি বলে পাকিস্তানও ১৯৭৯ সালে সেন্টো থেকে সরে আসে। এ বছরই আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটে সেন্টোর।
ছয় দফা কর্মসূচি: উনসত্তরের আন্দোলনের সময় এবং অব্যবহিত পূর্বে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কাছে রাজনৈতিক ভাবে দুটি বিষয় ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর একটি ছিল ছয় দফা কর্মসূচির বাস্তবায়ন এবং অন্যটি ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রত্যাহার। ১৯৬৬ সালের ৬
পেজ-১১২
ফেব্রুয়ারি, রবিবার, লাহােরে অনুষ্ঠিত বিরােধী দলীয় নেতাদের সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি ঘােষণা করেন। ছয় দফা কর্মসূচি সম্পর্কে বিভিন্ন সমালােচনা সত্ত্বেও এই কর্মসূচি দ্রুত জনসমর্থন লাভ করে। অন্যদিকে, এই কর্মসূচির বাস্তবায়নকে ঠেকানাের জন্য পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগের প্রায় সকল নেতাকে গ্রেফতার করে। এ সময় আমেনা বেগম ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে টিকিয়ে রাখেন। ছয়দফা কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপ:
১। ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র করে সরকারের কার্যকরী পদ্ধতি গঠিত হবে সত্যিকার ফেডারেশন অব পাকিস্তান কাঠামাের ভিত্তিতে।
২। ফেডারেল সরকারের হাতে কেবল দুটি বিষয় থাকবে, যথা দেশরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয়।
৩। মুদ্রা বিষয়ে নিম্নোক্ত যে কোন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা যেতে পারে – ক) দুই প্রদেশের
জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময় যােগ্য মুদ্রা চালু করতে হবে। খ) অথবা সমগ্র দেশের জন্য একটি মুদ্রা চালু করা যেতে পারে – এ ক্ষেত্রে এমন কার্যকর শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তান হতে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার বন্ধ হয়, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভের ব্যবস্থা করতে হবে। গ) পূর্ব পাকিস্তানের
জন্য পৃথক অর্থনৈতিক ও মুদ্রানীতি গ্রহণ করতে হবে।
৪। ফেডারেল সরকারের ট্যাক্স আদায় করার কোনাে অধিকার থাকবে না, তবে কেবল মাত্র
প্রদেশের বা স্টেটের সঙ্গে আলােচনা সাপেক্ষে খরচপত্রাদি বহন করার জন্য প্রাদেশিক
ট্যাক্সের ওপর লােভ বসাতে পারবে।
৫। ক) প্রতিটি প্রদেশের জন্য পৃথক বৈদেশিক বানিজ্য একাউন্টের ব্যবস্থা করতে হবে। খ)
বৈদেশিক বানিজ্যের ফলে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা স্টেটের হাতে থাকবে। গ) প্রতিটি প্রদেশ বা স্টেটের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার একটি সমহার প্রদানের মাধ্যমে ফেডারেল সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়ােজন মেটানাে হবে। ঘ) দেশজাত দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানি রপ্তানি চলবে। ঙ) ব্যবসা বানিজ্য সম্পর্কে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানি রপ্তানি করার অধিকার
আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করে শাসনতান্ত্রিক বিধান করতে হবে।
৬। পূর্ব পাকিস্তানে মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারী রক্ষীবাহিনী গঠন করতে হবে।
ছয়দফা কর্মসূচি পঞ্চাশের দশকের স্বায়ত্তশাসন দাবির চেয়ে অনেক অগ্রগামী হলেও এতে কার্যত মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির আশা-আকাংখারই প্রতিফলন ঘটে এবং বৃহত্তর সমাজের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের কোন কর্মসূচি এতে ছিল না। এই কর্মসূচির বেশ কিছু দফা এগার দফা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা: ছয় দফা কর্মসূচিকে জনবিচ্ছিন্ন করার জন্য পরিচালিত আন্দোলনের এক পর্যায়ে পাকিস্তান সরকার ‘পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার একটি ভারতীয় ষড়যন্ত্র’ আবিষ্কার করে। এই ষড়যন্ত্র মামলাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে পরিচিত। বেশ কিছুদিন ধরেই এ বিষয়ে কানাঘুষা চললেও, ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার এ
পেজ-১১৩
বিষয়ে প্রকাশ্যে প্রথম বিবৃতি প্রদান করে। ১৯৬৮ সালের ৭ জানুয়ারি দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত রিপাের্টে বলা হয়ঃ “পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার একটি ভারত সমর্থিত ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযােগে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মােট ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একজন সরকারি মুখপাত্র সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে প্রকাশিত তালিকাটি এযাবৎ ধৃত ব্যক্তিদের পূর্ণ তালিকা।
আজকের ঘােষণায় সরকারের ইতিপূর্বেকার একটি প্রেসনােটকেই বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। আগের প্রেসনােটে রাষ্ট্রবিরােধী তৎপরতার দায়ে কতিপয় লােককে গ্রেফতারের কথা বলা হয়েছিল। সেই সংক্ষিপ্ত ঘােষণা দেশে নানা ধরনের জল্পনার সৃষ্টি করেছিল। আজকের ঘােষণায় ধৃত ব্যক্তিদের পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করায় সব রকম জল্পনার সমাপ্তি ঘটেছে। এদের সবাইকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ধৃত ব্যক্তিদের অধিকাংশই পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার এই ষড়যন্ত্রে তাদের নিজ নিজ ভূমিকার কথা স্বীকার করেছে। এদের কেউ কেউ, কমপক্ষে একজন ভারতীয় কূটনীতিক মিঃ ওঝার সাথে যােগাযােগ রেখেছিলেন। এরা আগরতলাস্থ ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মিশ্র এবং মেজর মেননের সাথে দেখা করেছিলেন। ভারতের কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ সংগ্রহই এই সাক্ষাতের উদ্দেশ্য ছিল। তবে আজ যে ষড়যন্ত্রের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে তাতে একথা স্পষ্ট হয়ে গেছে পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্বের কোন ইচ্ছা প্রকৃতপক্ষে ভারতের নেই। কাশ্মীর বিরােধ ও অন্যান্য বিরােধগুলাে পাকিস্তানের প্রতি একটি গভীর শত্রুতারই প্রকাশ। ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে দু’জন সিএসপি অফিসার জনাব আহমদ ফজলুর রহমান এবং জনাব রুহুল কুদ্দুসকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রসঙ্গত: উল্লেখযােগ্য, সামরিক শাসনামলে স্ক্রিনিং কমিটি এদের দু’জনের প্রতি নােটিশ দিয়েছিল। পরে প্রেসিডেন্ট উভয়কেই ক্ষমা করেন এবং আর একবার সরকারি কাজ করার সুযােগ দেন।
এপিপি পরিবেশিত সরকারি প্রেসনােটে বলা হয়, একটি রাষ্ট্রবিরােধী ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযােগে গত মাসে পূর্ব পাকিস্তানে ২৮ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ষড়যন্ত্রটি গত মাসে উদঘাটিত হয়। ধৃত ব্যক্তিগণ পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। ষড়যন্ত্র সফল করার জন্য প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ এবং অর্থ সংগ্রহ করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল। এরা প্রচুর পরিমাণ অর্থ পেয়েছিল তেমন সাক্ষাৎ প্রমাণও পাওয়া গেছে। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মিঃ ভূপতি ভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী সহ ধৃত আরাে কতিপয় ব্যক্তির মারফত তারা টাকা পেয়েছে। অস্ত্রশস্ত্রের তালিকা সহ (যার কথা আগরতলায় আলােচিত হয়েছে) বহু দলিলপত্র সরকারের হস্তগত হয়েছে।
প্রেসনােটে বলা হয়, বিশৃংখলা সৃষ্টির এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে স্বাভাবিকভাবে দেশের উভয় অংশের জনসাধারণের মধ্যে যে ঘূনার সৃষ্টি করেছে সরকার সে সম্পর্কে সচেতন। তাই সরকার তদন্তের ফলাফল, অগ্রগতি এবং এদের বিচার সম্পর্কিত সব তথ্য জনসাধারণকে জানাবে। প্রেসনােটে বলা হয় এ ব্যাপারে তদন্ত সমাপ্তির পথে এবং বিচার শীঘ্রই শুরু হবে। প্রেসনােটে ধৃত ব্যক্তিদের তালিকা দেওয়া হয়েছে, এরা হলেনঃ আভ্যন্তরীণ নৌচলাচল সংস্থার কর্মরত পাকিস্তান নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট
পেজ-১১৪
কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ্য ভূপতি ভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী, মি: বিধান কৃষ্ণ সেন, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ সহ সভাপতি ডাক্তার সাঈদুর রহমান, সার্ভিস সিভিল ইন্টারন্যাশনালের (সুইজারল্যান্ড) পাকিস্তান শাখার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য জনাব এম আলী রাজা, জনাব আহমদ ফজলুর রহমান, সিএসপি (স্বাস্থ্যগত কারণে ১৯৬৬ সাল থেকে ছুটি ভােগ করছেন), জনাব রুহুল কুদ্দুস, সিএসপি (অবসর গ্রহণের প্রস্তুতির ছুটি ভােগ করছিলেন এবং একটি ট্রেনিং কোর্স এর জন্য যুক্তরাষ্ট্র গমনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন), জনাব মুহিবুর রহমান (প্রাক্তন ন্যাভাল স্টুয়ার্ড), জনাব কামাল উদ্দিন আহমদ (প্রাক্তন ন্যাভাল পেটি অফিসার), জনাব সুলতান উদ্দিন আহমদ (প্রাক্তন ন্যাভাল লিডিং সী। ম্যান), মীর্জা এম, রমিজ (পিআইএ তে কর্মরত অবসরপ্রাপ্ত প্রাক্তন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট), জনাব আমীর হােসেন (পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রাক্তন কর্পোরাল), এ বি এম এ সামাদ (পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রাক্তন কর্পোরাল), জনাব খুরশীদ আলম (প্রাক্তন ন্যাভাল লিডিং সী ম্যান), লিডিং সী ম্যান পদের প্রাক্তন সার্জেন্ট ইত্যাদি পদের জনাব মােহাম্মদ মাহমুদ আলী, জনাব এ বি এম ইউসুফ, জনাব তাজুল ইসলাম, জনাব খুরশীদ মিয়া, জনাব দলিলুদ্দিন, জনাব মাসুদ আর চৌধুরী, জনাব আনােয়ার হােসেন, পাকিস্তান নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান, ডাক্তার ক্যাপ্টেন খুরশিদুদ্দিন, এ এম সি সুবেদার আবদুর রাজ্জাক (পাকিস্তান সেনাবাহিনী), সার্জেন্ট এ এম এফ হক (বিমান বাহিনী), সার্জেন্ট শাসুদ্দীন (পাকিস্তান বিমান বাহিনী) এবং হাবিলদার ইনসাফ আলী।”
এই ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযােগে পাকিস্তান সরকার ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারী মি: পি এন ওঝাকে বহিষ্কার করে। ভারতও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে নয়া দিলিস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের উপদেষ্টা জনাব এম আহমদকে বহিষ্কার করে।
সরকার ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে আগরতলা মামলা শুরু করে এবং ঐদিনই রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’র বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে চার্জশিট দাখিল করে। ঐ তারিখে দেশী-বিদেশী সাংবাদিক ও টেলিভিশন প্রতিনিধিদের সামনে কড়া নিরাপত্তায় কুর্মিটোলা সেনানিবাসের অভ্যন্তরেই বিচার কাজ শুরু হয়। আগরতলা মামলা শুরু হওয়ার পর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ একে নেহায়েতই একটি ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়। জনমনে এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে ওঠে যে পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবির কণ্ঠরােধ করার জন্য এই মামলা দায়ের করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ এই ঘটনাকে সত্য বলে দাবি করে।
ষড়যন্ত্র মামলার প্রথম যে বন্দিদের তালিকা প্রকাশ করা হয় পরে তার সঙ্গে প্রধান আসামী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম যুক্ত করা হয়। সরকারি ঘােষণায় বলা হয় “ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা ও পরিচালনার সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কাজেই অন্যান্যদের সাথে তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে তিনি পূর্ব থেকেই জেলে ছিলেন।” স্বীকারােক্তি আদায়ের জন্য বন্দীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন করা হয়।
পেজ-১১৫
এই মামলার বিরুদ্ধে ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জন বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। মামলা চলাকালীন প্রতিদিন সংবাদপত্রে পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হওয়ায় জনগণ এ বিষয়ে পুরাে বিষয়টি জানতে পারে। এই মামলার অন্যতম আসামী লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেনকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতে হত্যা করে। জনাব রুহুল কুদুস (মরহুম) স্বাধীনতার পর সরকারের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারী হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। আরেক আসামী, পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের ভাই শামসুর রহমান সিএসপি (মরহুম) স্বাধীনতার পর ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বন্ধুদের কাছে জনসন নামে অধিক পরিচিত ছিলেন। ক্যাপ্টেন শওকত আলী বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকার। এই মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন আবদুস সালাম খান এবং সরকার পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মনজুর কাদির।
পেজ-১১৬
পরিশিষ্ট – জ
ছাত্র নেতাদের জীবন বৃত্তান্ত
আবদুর রউফ
আবদুর রউফ ১৯৪২ সালের ২৫শে মার্চ, রংপুর জেলার বাগডােক্রা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৭ সনে ময়মনসিংহ শহরের মৃত্যুঞ্জয় হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা; ১৯৫৯ সনে ময়মনসিংহ আনন্দ মােহন কলেজ থেকে আই. এ. এবং ১৯৬১ সনে একই কলেজ থেকে বি. এ. পাস করেন। পরে ১৯৬২ সনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন কিন্তু কনভােকেশন আন্দোলনে জড়িত থাকায় বহিষ্কৃত হন, ফলে পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আবার ১৯৬৬ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়ায় পরীক্ষা স্থগিত রাখেন।
আবদুর রউফ ১৯৬৩-৬৪ সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৮-৬৯ সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি বিভিন্ন সমাজসেবা মূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন। ছয় দফা ও ১১ দফা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন। ১৯৭১ সালে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগের মনােনয়নে ১৯৭০ সালে তৎকালীন জাতীয় পরিষদে এবং ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়ে হুইপের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে পুনরায় জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বর্তমানে গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য। বিপত্নীক আবদুর রউফ দুই কন্যা ও এক পুত্রের জনক।
খালেদ মােহাম্মদ আলী
খালেদ মােহাম্মদ আলী ১৯৪৪ সালে লক্ষীপুর জেলার চরমনসা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম মৌলভী নাজাত উলাহ মিয়া এবং মা জাকিয়া খাতুন চৌধুরানী। তিনি পরিবারে শাহেদ ডাকনামে পরিচিত।
তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিজ এলাকায় ধর্মপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর লক্ষীপুর মডেল হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। নােয়াখালী জেলার চৌমুহনী কলেজ থেকে এইচএসসি ও স্নাতক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিন্তু ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ার কারণে স্নাতকোত্তর শেষ পর্ব শেষ করতে পারেন নি। কলেজ জীবন থেকেই তিনি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং ১৯৬০ সালে কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নােয়াখালী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালের মার্চ মাসে খালেদ মােহাম্মদ আলী পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
পেজ-১১৭
সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেটে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পূর্ব জোনের ডাইরেকটর (মটিভেশন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া, সাউথ ইস্ট জোন ২ এর মেম্বার ফাইনান্স এবং মুজিবনগর সরকারের অধীনে ২নং সেক্টরের সিভিল এফেয়ার্স এডভাইজরী কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। খালেদ মােহাম্মদ আলী বিবাহিত এবং দু সন্তানের জনক। তার স্ত্রী নুসরাত জাহান রেহানা শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িত। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে তিনি সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন, নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত।
তােফায়েল আহমেদ
তােফায়েল আহমেদ ১৯৪৩ খ্রীস্টাব্দের ২২শে অক্টোবর ভােলার কোড়ালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মৌলভী আজহার আলী ছিলেন এলাকার একজন সম্মানিত ব্যক্তি। মা ফাতেমা বেগম।
তোফায়েল আহমেদ ভােলা সরকারি হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। বরিশাল ব্রজমােহন কলেজ থেকে আইএসসি এবং বিএসসি পাশ করেন যথাক্রমে ১৯৬২ এবং ১৯৬৪ সনে। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৃত্তিকা বিজ্ঞানে এমএসসি পাশ করেন। কলেজ জীবন থেকেই সক্রিয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ব্রজমােহন কলেজ ছাত্র সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক পদে এবং কলেজের হােস্টেল অশ্বিনী কুমার হলের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন ১৯৬২ সনে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ১৯৬৪তে ইকবাল (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) হল ছাত্রসংসদের ক্রীড়া সম্পাদক, ১৯৬৫তে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের সহ-সভাপতি, ১৯৬৬-৬৭তে ইকবাল হল ছাত্র-সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।
ডাকসুর ভিপি থাকাকালীন (১৯৬৭-৬৯) তিনি ‘৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা ছিলেন। উল্লেখ্য তিনি ‘৬৯-এ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭০-এর সাতই জুন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যােগদান করেন। ১৯৭০ এর নির্বাচনে তিনি ভােলার দৌলত খাঁ-তজুমদ্দিন-মনপুরা আসন থেকে মাত্র ২৭ বছর বয়সে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন ১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং মুজিব বাহিনীর অঞ্চল ভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত চার প্রধানের একজন। ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদে এবং ১৯৭২-এ বাংলাদেশ গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২-এর ১৪ই জানুয়ারি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তাঁকে তাঁর রাজনৈতিক সচিব নিয়ােগ করেন। এ পদে তিনি ১৯৭৫ সন পর্যন্ত বহাল ছিলেন। ১৯৭৩-এ তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫-এ দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ঘােষণার পর তিনি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী নিযুক্ত হন। ১৯৭৫-এর
পেজ-১১৮
১৫ই আগস্ট জাতির জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর একই বছরের ৬ই সেপ্টেম্বর তােফায়েল আহমেদকে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘ তিন বছর তিনি কারান্তরালে ছিলেন। ১৯৭৯ তে কুষ্টিয়া কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৮৬, ‘৯১ এবং ‘৯৬ সনের সংসদ নির্বাচনে পরপর তিনি এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সনের নির্বাচনে ভােলা-১ ও ভােলা-২ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬-এ অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে শেখ হাসিনার জাতীয় ঐক্যমতের সরকারে তিনি শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি এরশাদ আমলে চার বার এবং ১৯৯৬-এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে যে আন্দোলন সংগঠিত হয় তাতে খালেদা জিয়ার আমলেও দীর্ঘদিন জেল খাটেন। এছাড়াও ২০০২-এ জোট সরকারের শাসনামলেও তিনি কারাবন্দী হন। রাজনৈতিক জীবনে সর্বমােট সাত বার তিনি কারাগারে অন্তরীণ থাকেন। ভােলা-২ আসন থেকে ২০০৮-এর ২৯শে ডিসেম্বরের নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেন। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি।
তােফায়েল আহমেদ ভারত, সােভিয়েত ইউনিয়ন, যুগােশাভিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, সুইজারল্যান্ড, দক্ষিণ ইয়েমেন, ইরাক, মিসর, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, জাপান, ফিলিপাইন, পশ্চিম জার্মানীসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন।
নাজিম কামরান চৌধুরী
নাজিম কামরান চৌধুরী ১৯৪৫ সালে সিলেট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। লন্ডন, শিলং ও ঢাকায় বিভিন্ন স্কুলে পড়াশােনা শেষে ১৯৬২ সালে ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৬৪ সালে সিলেটের এম সি কলেজ থেকে এইচ এস সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যথাক্রমে ১৯৬৭ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সম্মান সহ স্নাতক ও ১৯৬৮ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।
তিনি ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং ১১ দফা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ছাত্রজীবন শেষে ১৯৬৯ সালে তিনি একটি বহুজাতিক কোম্পানীর সিনিয়র ব্যবস্থাপনা পদে যােগদান করেন। এবং ১৯৭৪ সালে এই চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের ব্যবসা শুরু করেন। নাজিম কামরান চৌধুরী প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যােগ দেন এবং সিলেটের গােয়াইঘাট – জৈন্তাপুর নির্বাচনী এলাকা থেকে ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে বিএনপির মনােনয়নে পুনরায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করলেও জয়লাভ করতে পারেন নি।
ব্যবসা ছাড়াও নাজিম কামরান চৌধুরী সেন্টার ফর এনালিসিস এন্ড চয়েজ নামে একটি সংস্থার সঙ্গে জড়িত এবং জাতীয় রাজনীতি বিশেষ করে ২০০১ এবং ২০০৬ সালের নির্বাচন সম্পর্কে আগাম বিশেষণ দিয়ে পরিচিতি লাভ করেন। নাজিম কামরান চৌধুরীর স্ত্রী গীতিয়ারা সাফিয়া
পেজ-১১৯
চৌধুরী একজন সফল নারী উদ্যোক্তা এবং দেশের নেতৃস্থানীয় বিজ্ঞাপন সংস্থা এ্যাডকম এর চেয়ারম্যান। গীতিয়ারা চৌধুরী কিছুদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তাদের দুই সন্তান নাজিম ফারহান চৌধুরী ও ফাহিমা চৌধুরী উভয়েই বিজ্ঞাপনী ও অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
মাহবুব উল্লাহ
মাহবুব উল্লাহ ১৯৪৫ সালের ৯ ডিসেম্বর নােয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার তিতাহাজরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা, শিক্ষাবিদ মরহুম হাবীব উল্লাহ এবং মাতা মরহুমা ফয়জুন নিসা বেগম। বৈচিত্র্যময় বর্ণাঢ্য জীবনের মানুষ তিনি। সক্রিয় রাজনীতি থেকে অধ্যাপনা ও গবেষণা পর্যন্ত কর্মজীবন বিস্তৃত। ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা। ১৯৭০’র ২২ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা’র কর্মসূচি উত্থাপনের অপরাধে ইয়াহিয়ার সামরিক আদালতে কারাদন্ডে দন্ডিত হয়ে দীর্ঘ ২২ মাস কারারুদ্ধ থাকার পর ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ কারাগার থেকে মুক্ত হন। রাজনৈতিক জীবনে মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান খান, হাজী মােহাম্মদ দানেশ, মােহাম্মদ তােয়াহা, কমরেড আবদুল হক, কমরেড সুখেন্দু দস্তিদার ও দেবেন শিকদারের সাহচর্যে আসেন। ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সনে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। ছাত্র নেতাদের মধ্যে তিনি একমাত্র ব্যতিক্রম, যিনি ছাত্রজীবন শেষে কিছুদিন রাজনীতি করার পর শিক্ষকতা পেশায় যােগদান করেন।
শিক্ষাজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র, অর্থনীতিতে পিএইচডি মাহবুব উল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বােস্টন বিশ্ববিদ্যালয় ও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা ও গবেষণা করেছেন। ১৯৭৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। এছাড়া তিনি কানাডার ইন্টারন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (আইডিআরসি), ডেনমার্কের সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট রিসার্চ, নেপালের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইনটিগ্রেটেড মাউন্টেইন ডেভলপমেন্ট, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং ইউনাইটেড ন্যাশনস ইউনিভার্সিটির সহযােগিতায় গবেষণার কাজ করেছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রাে-ভাইস চ্যান্সেলর, সােনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং রাজস্ব সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা ১৩টি। দেশে ও বিদেশে তাঁর অনেকগুলাে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রফেসর মাহবুব উল্লাহ তিন কন্যা সন্তানের জনক। মিসেস উম্মে সালমা তার সহধর্মিনী। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগে প্রফেসর হিসেবে কর্মরত। ছাত্রজীবন থেকেই ইংরেজি ও বাংলা সংবাদপত্রে লেখালেখির সঙ্গে জড়িত মাহবুব উল্লাহ বর্তমানে তিনটি জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখছেন এবং টেলিভিশন টক শােতে অংশগ্রহণ করেন।
পেজ-১২০
মােস্তফা জামাল হায়দার
মােস্তফা জামাল হায়দার ১৯৪২ সালের ১০ ডিসেম্বর পিরােজপুর জেলার নাজিরপুর থানাধীন মাটিভাঙ্গা ইউনিয়নের বরইবুনিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মরহুম আলহাজ্জ আবদুল গনি, মাতার নাম মরহুমা বেগম মতিউন নিসা তিনি পিরােজপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে বরিশাল ব্রজমােহন কলেজ থেকে আই.এ. পাশ করেন। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে ইতিহাসে অনার্সসহ এম.এ. পাশ করেন। ছাত্রাবস্থাতেই মােস্তফা জামাল হায়দার সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৮-৬৯ এর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন ও ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুথ্যানের অন্যতম রূপকার ছিলেন তিনি।
হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে পরিচালিত স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতার পরে গঠিত ইউনাইটেড পিপলস পার্টির সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। অন্যদিকে বাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারন সম্পাদক হিসেবে ১৯৭৭ সালে ইটালির টুরিন শহরে ওখঙ আয়ােজিত এক বিশেষ প্রশিক্ষন কোর্সে অংশগ্রহণ করে সম্মানসূচক ডিপ্লোমা ডিগ্রী লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৭৮ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক এক কর্মশালায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভায় যােগদান করেন। শ্রম ও জনশক্তি, মৎস্য ও পশুসম্পদ, ভুমি মন্ত্রণালয়, পূর্তমন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী হিসেবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের ৪র্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও তৎপরবর্তীকালে ৫ম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে তিনি পিরােজপুর – নাজিরপুর নির্বাচনী এলাকা থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য।
সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক
সাইফ উদ্দিন আহমেদ মানিক ১৯৩৯ সালের ২৪ জুন পশ্চিম বাংলার জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম মৌলভী সিদ্দিক আহমেদ এবং মা মরহুমা আলিফা খাতুন। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালে পিতামাতা ও পরিবারের সঙ্গে ঢাকার গােপীবাগে এসে বসবাস শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে মুসলিম গভর্ণমেন্ট হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে কিছুদিন ঢাকা ইলেকট্রিক সাপাই এর এক ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানীতে চাকরি করেন।
খেলাধূলায় সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকা এবং রাজনৈতিক কারণে তাঁর লেখাপড়া বিঘ্নিত হয়। গ্রেফতারী পরােয়ানা মাথায় নিয়ে তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম এ ডিগ্রী লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন ১৯৬২-৬৩ সময়ে তিনি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন সংস্কৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় সংস্কৃতি সংসদের সম্পাদক ছিলেন ডাকসুর সহ-সভাপতি রফিকুল হক।
পেজ-১২১
ছাত্রজীবনে সামরিক শাসন বিরােধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রতি আন্দোলনে সংগ্রামে তিনি ছিলেন এক সাহসী যােদ্ধা। ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন দ্বিধা বিভক্ত হলে ১৯৬৬ সালে তিনি শ্রমিক রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়নে কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালে মােহাম্মদ ফরহাদের মৃত্যুর পর তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সােভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হলে তিনি ১৯৯৪ সালে গণফোরাম গড়ে তােলার ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। ২০০৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার সময় পর্যন্ত তিনি গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক ১৯৬৯ সালে সাবেক ছাত্র নেত্রী ডা: ফওজিয়া মােসলেমকে বিয়ে করেন। তাদের দুই কন্যা- স্থপতি জয়া এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গীতি।।
মাে. সামসুদ্দোহা।
মাে. সামসুদ্দোহা নীলফামারী জেলার সদর থানার চওড়াবড়গাছা ইউনিয়নের কাঞ্চনপাড়া গ্রামে ১৯৪৩ সালের ১৪ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতা প্রয়াত খােদেজা খাতুন এবং পিতা প্রয়াত মহিউদ্দিন আহমেদ।
১৯৬০ সালে ম্যাট্রিক ও ১৯৬৪ সালে বিএ পাশ করে সেই বছরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে সার্বক্ষণিক সক্রিয় ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল সময়কালে তদানিন্তন ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সাধারণ সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৯-এর ঐতিহাসিক ১১ দফার অন্যতম প্রণেতা এবং গণ অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ হলে দেশের উত্তরাঞ্চলের ছাত্র ইউনিয়ন-ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলা ট্রেনিংয়ে ভারতের তেজপুর পাঠানাে ও ট্রেনিং শেষে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য উক্ত অঞ্চলে বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের রেল শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক ছিলেন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির (সপিবি) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, সম্পাদক ও প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন।
কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে ১৯৯১ সালে তদানিন্তন ১৫ দলীয় জোট থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সােসাইটির কেন্দ্রীয় ম্যানেজিং বাের্ডের সদস্য এবং রেড ক্রিসেন্ট হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের ম্যানেজিং কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। তিনি রেড ক্রিসেন্ট সােসাইটির আজীবন সদস্য। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ডেলিগেট হিসেবে যােগদান করেন। সংসদীয় দলের সদস্য হিসেবে আন্তঃপার্লামেন্টারী ইউনিয়নের পিয়ং ইয়ং এবং মাদ্রিদ অধিবেশনে যােগদান
পেজ-১২২
করেন। তিনি বিভিন্ন সম্মেলন, সেমিনার ও শুভেচ্ছা সফরে রাশিয়া, বুলগেরিয়া, ইউক্রেইন, পােল্যান্ড, জার্মান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ইংল্যান্ড, উত্তর কোরিয়া, মালয়েশিয়া, স্পেন, সােয়াজিল্যান্ড, আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা ইত্যাদি দেশ সফর করেন।
সােভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কমিউনিস্ট পার্টিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় ড. কামাল হােসেনের নেতৃত্বে গণফোরাম গঠন ও প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডিয়াম সদস্য হন। বর্তমানে শারীরিক অসুস্থতার জন্য রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় নন।
স্ত্রী শেলীনা আখতার বানু শেলী চাকরি থেকে অবসরে আছেন। একমাত্র সন্তান সােমেন আহমেদ আই.বি.এম কোম্পানিতে আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে চেক রিপাবলিকের ব্রোনাে শহরে চাকরি করছে। ২০০৭ সালে সােমেনের সাথে নন্দিতা ফরহাদের বিয়ে হয় এবং নন্দিতাও একই কোম্পানিতে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চাকরি করছে।
(বর্ণানুক্রমে, ছাত্র নেতৃবৃন্দের সরবরাহকৃত জীবনবৃত্তান্ত থেকে ইষৎ সংক্ষেপিত)।
পেজ-১২৩
পরিশিষ্ট – ঝ
সংকটের আঘাতে আঘাতে জনতা আজ পিষ্ট। যে অস্বীকৃতির রাজনীতির শুরু হইয়াছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট আয়ুব শাহীর দশ বছরে আজ তাহা চরম আকার ধারণ করিয়াছে। দেশবাসীর গণতান্ত্রিক অধিকার বলিতে যাহা কিছু বুঝায় – ব্যক্তি স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সার্বজনীন ভােটাধিকার, প্রত্যক্ষ নির্বাচন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও জনতার শাসন – সমস্ত রকমের গণতান্ত্রিক অধিকারের পতাকা আজ ধূলায় অবলুষ্ঠিত। দেশ প্রেমিকদের দ্বারা আজ জেলগুলি ভর্তি এবং রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের মাথার উপরে ঝুলিতেছে গ্রেফতারী পরােয়ানার খড়গ। পূর্ব বাংলার বাঙ্গালী জাতির স্বাধিকারসহ পাঠান, বেলুচ, সিন্ধি ও পাঞ্জাবী জাতির স্বাধিকারের দাবি এবং অন্যান্য উপজাতি সমূহের বিকাশের দাবি আজ অস্বীকৃত। জনতার বৃহত্তম অংশ শ্রমিক, কৃষকের জমি, মজুরি, রুটি ও রুজির অধিকারকে নস্যাৎ করা হইতেছে। খাজনা, ট্যাক্স, মহাজনের জুলুম, ঘুষ ও দুর্নীতি আজ গ্রামাঞ্চলের বুকে কায়েম করিয়াছে এক বিভীষিকার রাজত্ব। পূর্ব বাংলার জীবনে বন্যা আজ নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হইয়াছে। বন্যা ডাকিয়া আনিতেছে অনাহার, দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যু। গ্রামাঞ্চলের গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের না আছে জমি, না আছে ধন। অনাহার হইল তাহাদের নিত্য সহচর। শ্রমিক জনতা উদয়াস্ত খাটিয়া না পায় বাঁচার মত মজুরি, না পায় পেটের ভাত। ট্রেড ইউনিয়ন গড়ার অধিকার পর্যন্ত নাই এই দেশের শ্রমিকদের। ছাত্রদের গণতান্ত্রিক শিক্ষার অধিকার এবং মধ্যবিত্ত জনতার সুখী জীবন যাপনের আকাংখাকে প্রতিদিন নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হইতেছে।
গণজীবনে সংকট আজ পরিব্যাপ্ত হইয়া সমাজের প্রতিটি স্তর এবং অংশকে গ্রাস করিয়াছে। অর্থনৈতিক সংকট জন্ম দিয়াছে সামাজিক সংকটের। অর্থনৈতিক সংকট ও সামাজিক সংকটের চাপে সৃষ্টি হইয়াছে রাজনৈতিক সংকট। আর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের সংমিশ্রণের ভিতর দিয়া উদ্ভুত হইয়াছে এক সার্বিক জাতীয় সংকট। এবং এই সার্বিক জাতীয় সংকট তথাকথিত স্থিতিশীলতার সমস্ত ঘােষণাকে অর্থহীন করিয়া তুলিয়াছে আর সঙ্গীন করিয়া তুলিয়াছে শাসক গােষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও বিরােধকে।
নিপীড়ন ও অত্যাচার, অবহেলা ও বঞ্চনা, সীমাহীন দুঃখ ও দারিদ্র আজ দেশের মানুষকে – শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, জনতাকে আন্দোলন মুখর করিয়া তুলিয়াছে। স্বৈরাচারী শাসকগােষ্ঠী ১৪৪ ধারা, লাঠি, গুলি, বুলেট, জেল ও উলঙ্গ দমননীতি দ্বারা এই আন্দোলনকে দাবাইয়া দিতে চেষ্টা করিতেছে। সরকারের দমননীতি সরকারের সবলতাকেই তুলিয়া ধরিতেছে না – সরকারের দুর্বলতাকেই প্রকাশ করিয়া দিতেছে। লাঠি, গুলি, উলঙ্গ দমননীতিকে উপেক্ষা করিয়া এই দেশের সংগ্রামী মানুষ আগাইয়া চলিয়াছে। ৭, ৮, ১০, ১৩ ও ২৯শে ডিসেম্বর মানুষের এই সংগ্রামী আকাংখার প্রকাশকেই আমরা প্রত্যক্ষ করি। ৬ ডিসেম্বর পূর্ব বাংলার ক্ষেত্রে এক নতুন সংগ্রামী পতাকা তুলিয়া ধরিয়াছে। আর এই ৬ই ডিসেম্বর জন্ম দিয়াছে ৭, ৮, ১০, ১৩ ও ২৯শে ডিসেম্বরকে। জনতার এই সংগ্রামী প্রকাশ উত্তরােত্তর আরও জঙ্গি রূপ ধারণ করিবে। সমগ্র পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান জুড়িয়া জাগিয়া উঠিয়াছে মানুষ – দেখা দিয়াছে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণ। এই গণজাগরণের সামনে আজ প্রধান প্রশ্ন আমাদের দেশের জনতার
পেজ-১২৪
তিন শত্রু সাম্রাজ্যবাদ – মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও বড় পুঁজি এবং এই তিন শক্তির পাহারাদার আয়ুব শাহীর হাত হইতে কোন পথে মুক্তি ?
এই পরিপ্রেক্ষিতে আজ ‘বুনিয়াদী গণতন্ত্র’ ভিত্তিক নির্বাচন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে হইবে। আমাদের দেশের উপর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের কবজা সুপ্রতিষ্ঠিত। আমাদের দেশের অর্থনীতি, শিল্প, বাণিজ্য গড়িয়া উঠিয়াছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির উপর নির্ভর করিয়া। আর এই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের দোসর হইল জোতদার, মহাজন অর্থাৎ সামন্তবাদ এবং আদমজী, ইস্পাহানি, দাউদ অর্থাৎ দেশীয় বড় পুঁজি। নিজেদের শােষণকে কায়েম রাখিবার জন্যই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী দস্যুরা জমিদার, জোতদার, মহাজনেরা এবং দেশীয় বড় পুঁজির মালিকরা ‘বুনিয়াদী গণতন্ত্র’ সৃষ্টি করিয়াছে। বুনিয়াদী গণতন্ত্র ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা হইল তাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও বড় পুঁজির একনায়কত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা। ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচন হইতে প্রেসিডেন্ট হইলেন সর্বময় কর্তা এবং তথাকথিত আইন সভাগুলি হইল প্রেসিডেন্টের হুকুম তালিম করিবার যন্ত্র। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর আমাদের জনতার বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের নেতৃত্বে কায়েম করা হয় গণবিরােধী সামরিক সরকার – ইহার নগ্ন প্রকাশ ঘটে জনতার তিন শত্রু কর্তৃক সামরিক একনায়কত্ব কায়েমের মধ্য দিয়া। ১৯৬২ সালে গণবিরােধী শক্তি সমূহের এই নগ্ন সামরিক একনায়কত্বকে তথাকথিত আয়ুবী শাসনতন্ত্রের পােষাক পরানাে হয়। জনতার শত্রু গণবিরােধী শক্তিসমূহ বুনিয়াদী গণতন্ত্রের মাধ্যমে ইউনিয়ন কাউন্সিল মারফত কায়েম করিয়াছে গ্রামে ও শহরে স্বৈরতন্ত্রের বুনিয়াদ। শাসক গােষ্ঠীর উদ্দেশ্য হইল এই ইউনিয়ন কাউন্সিলের সাহায্যে শহরে, গ্রামে বিশেষ করিয়া গ্রামাঞ্চলে গণবিরােধী শক্তির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি স্থাপন করা ও সুদৃঢ় করা। এই ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচনে জনগণের কোন অধিকার নাই। একমাত্র ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনেই জনগণের ভােটের অধিকার আছে। সেই অধিকারও অবাধ নহে। গােটা সরকারি যন্ত্র, জোতদার, মহাজন এবং টাউট ও গুন্ডারাই জনগণকে নানা উপায়ে নিজেদের স্বপক্ষে ভােট প্রদানে বাধ্য করে। তার পরের সমস্ত নির্বাচনে জনগণের কোনাে অধিকার নাই। বি. ডি মেম্বাররাই ক্ষমতাহীন আইন সভাগুলি এবং সর্বময় কর্তৃত্ব সম্পন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন। এই নির্বাচিত বি. ডি মেম্বারদেরকে গােটা সরকারি যন্ত্র কিভাবে শাসক গােষ্ঠীর মনােনীত প্রেসিডেন্ট ও আইন সভার প্রার্থীদেরকে ভােটদানে বাধ্য করে তাহা দেশবাসী গত নির্বাচনেই দেখিয়াছেন।
তাই, নিজেদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আজ প্রায় সর্ব শ্রেণির শােষিত মানুষ, শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী এবং সমাজের অন্যান্য অংশ মনে করে যে, বুনিয়াদী গণতন্ত্রের মাধ্যমে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও বড় পুঁজি এবং তাদের পাহারাদার আয়ুব শাহীকে অপসারণ করা যাইবে না – শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্যদের নিকট হইতে আজ প্রায়ই শােনা যায় যে, ‘এই নির্বাচন দিয়া কি হইবে? নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা হইতে জনতা এই শিক্ষাই গ্রহণ করিয়াছে যে, বুনিয়াদী গণতন্ত্র ভিত্তিক নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করিয়া দেশের মৌলিক কোনাে সমস্যার সমাধান করা যাইবে না।
তাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ নহে – নির্বাচন বর্জন – আপােষ নয় সগ্রামই হবে ন্যাপের রণধ্বনি। আন্দোলনের পথে আজ জনতার পদধ্বনি শােনা যাইতেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও হাতিরদিয়ার মাটিকে সিক্ত করিয়াছে শহীদের রক্ত। এই মাটিতে অংকুরিত হইয়া উঠিতেছে আন্দোলনের
পেজ-১২৫
বীজ। ইহা একদিন বিরাট মহীরুহ আকার ধারণ করিবে। আন্দোলনের কাফেলার যাত্রা শুরু হইয়াছে। পথে অনেক বাধা, অনেক মােড়। কিন্তু সমস্ত বাধা বিপত্তি, সমস্ত দমননীতিকে অতিক্রম করিয়া জনতার কাফেলা আগাইয়া চলিবেই। অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষ রুখিয়া দাঁড়াইবেই।
তাই, আমাদের দেশের জনতার তিন শত্রু, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও মুৎসুদ্দি আমলা পুঁজি ক্রমবর্ধমান গণ আন্দোলনকে বিপথগামী করিবার জন্য এক নতুন কৌশল গ্রহণ করিতে পারে। গণ আন্দোলনকে দমন করিবার জন্য তাহারা ব্যবহার করিতেছে উলঙ্গ দমননীতি। কিন্তু যখন তাহারা দেখিবে যে, সমস্ত রকমের দমননীতিকে পরাস্ত করিয়া সংগ্রামী জনতার কাফেলা আগাইয়া চলিয়াছে, আর পুরাতন পাহারাদার জনতার চরম ঘৃণার বস্তু হইয়া দাঁড়াইয়াছে তখন তাহারা সংগ্রামের পথ হইতে জনতাকে ফিরাইয়া আনিবার জন্য আয়ুবী পাহারাদারকে পরিবর্তন করিয়া নতুন পাহারাদার নিয়ােগ করিতে পারে। পাহারাদারের পরিবর্তনের ফলে তিন শত্রু যে শােষণের ইমারত গড়িয়া তুলিয়াছে তাহা অক্ষুন্ন থাকিয়া যাইবে – কেবলমাত্র পরিবর্তন হইবে পাহারাদারের। আমাদের দেশের সংগ্রামী মানুষ কেবলমাত্র পাহারাদারের পরিবর্তন চাহে না, তাহারা চাহে এই তিন শক্তি যে শােষণের ইমারত গড়িয়া তুলিয়াছে সেই ইমারতকে ধ্বংস করিয়া জনতার সাম্রাজ্যবাদ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী, সামন্তবাদ বিরােধী ও বড় পুঁজি বিরােধী আশা আকাংখার ধারক ও বাহক নতুন ইমারত।
জনতা তাই সক্রিয়ভাবে নির্বাচন বর্জনের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। নিষ্ক্রিয় বর্জনের নীতি হইবে আত্মঘাতী নীতি। এই নীতি জনতাকে নিষ্ক্রিয় ও হতাশ করিয়া ফেলিবে। আজ প্রয়ােজন জনতার সংগ্রামী চেতনার উদ্বোধন ও উহাকে অগ্রসর করিয়া নেওয়া। জনতা আজ চাপের রাজনীতির দাবার গুটি হিসাবে ব্যবহার হইতে চাহে না। তাই জনতার সংগ্রামী আন্দোলনকে যাহারা চাপের রাজনীতির অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করিতে চাহিবেন তাহাদের সমস্ত প্রচেষ্টাকে বানচাল করিতে হইবে। তাহাদের সমস্ত রকমের চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে হইবে। তাই সক্রিয়ভাবে নির্বাচন বর্জন করুন ইহাই হইল ন্যাপের রণধ্বনি। এই রণধ্বনিকে কার্যকরী করিবার পথে আমাদের মূল আওয়াজ হইবেঃ
(ক) পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বাধিকার।
(খ) পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বাতিল।
(গ) মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিসহ সমস্ত রকমের সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির বাজেয়াপ্তকরণ এবং উহাদের সহযােগী পুঁজি জাতীয়করণ।
(ঘ) শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র হইতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব মুক্তকরণ।
(ঙ) প্রত্যক্ষ নির্বাচন ও সার্বজনীন ভােটাধিকার।
(চ) রাজবন্দীদের মুক্তি, গ্রেফতারি পরওয়ানা প্রত্যাহার, জরুরী আইন বাতিল এবং সমস্ত নিপীড়নমূলক আইনের অবসান।
(ছ) জমির ও ফসলের উপর কৃষকদের অধিকার।
পেজ-১২৬
(জ) বন্যা নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ব্যবস্থা।
(ঝ) চলতি বছরের খাজনা, ট্যাক্স, ঋণ মওকুফ এবং সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল।
(ঞ) শ্রমিকদের বাঁচার মত মজুরি এবং ট্রেড ইউনিয়ন গড়ার অধিকার এবং শ্রমিক স্বার্থ
বিরােধী আইন সমূহের বাতিলকরণ।
(ট) হামিদুর রহমান কমিশনের রিপাের্ট বতিল। শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্ত অগণতান্ত্রিক আইনের বাতিলকরণ।
(ঠ) পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, সেন্টো, সিয়েটো এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহিত অনুষ্ঠিত অন্যান্য চুক্তির বাতিলকরণ।
(ড) সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী পররাষ্ট্র নীতির অনুসরণ, চীন ও অন্যান্য প্রগতিশীল দেশের সহিত
বন্ধুত্ব দৃঢ়করণ এবং দেশে-দেশে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন।
আন্দোলন ও সংগ্রামের এই রণধ্বনিকে কার্যকরী করিবার মধ্য দিয়াই কেবল মাত্র আমরা সক্রিয়ভাবে নির্বাচন বর্জনকে সফল করিয়া তুলিয়া তুলিতে পারি। আমাদের মনে রাখিতে হইবে যে, নির্বাচন বর্জন একটি মাত্র ধ্বনি নহে। ইহা আমাদের দেশে স্বৈরতন্ত্র, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও বড়পুঁজি বিরােধী সংগ্রামের এক সংগ্রামী প্রকাশ। এক মাস গণ আন্দোলন ও গণ সংগ্রামের মধ্য দিয়াই আমরা এই সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করিতে পারি। একমাত্র এই পথেই অর্থাৎ জনতার গণ আন্দোলন ও গণ সংগ্রামের মধ্য দিয়াই গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম করতে পারি। নির্বাচন বর্জনের পথ তাই সক্রিয় গণ আন্দোলন ও গণ সংগ্রাম গড়িয়া তুলিবার পথ।
সেই জন্য উপরােক্ত দাবি সমূহের ভিত্তিতে আন্দোলন ও সংগ্রাম গড়িয়া তুলিবার পথে আমাদের অগ্রসর হইতে হইবে। আমাদের মূল জোর দিতে হইবে গ্রামাঞ্চলের উপর। কারণ ৬২ হাজার গ্রামেই বাস করে আমাদের দেশের ১০০ জনের ৮৫ জন মানুষ। তাই, গ্রামাঞ্চলের এই কৃষক জনতাকে সংগ্রামের ময়দানে হাজির করিবার উপরই নির্ভর করিতেছে নির্বাচন বর্জন আন্দোলনের সাফল্য। গ্রামাঞ্চলের সবচাইতে নিপীড়িত অংশ হইল ভূমিহীন গরীব কৃষক। ইহারা হইল গ্রামাঞ্চলের একশত জনের ৭০ জন। এই গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের উপর নির্ভর করিয়া সমগ্র গ্রামাঞ্চলে এক দূর্বার গণ আন্দোলন সৃষ্টি করার দিকেই আমাদের সবচাইতে বেশি জোর দিতে হইবে। ২৯শে ডিসেম্বর প্রমাণ করিয়াছে যে গ্রামাঞ্চলে আন্দোলনের পতাকা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। এখন আমাদের প্রয়ােজন হইল বলিষ্ঠভাবে এই পতাকাকে অগ্রসর করিয়া নিয়া যাওয়া।
গ্রামাঞ্চলকে নির্ভর করিয়া সমগ্র দেশকে আন্দোলনের একই সূত্রে গাঁথিয়া ফেলিতে হইবে। নির্বাচন বর্জনের পতাকাকে সামনে রাখিয়া জনজীবনের বিভিন্ন সমস্যা, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সুনির্দিষ্ট দাবী দাওয়াকে কেন্দ্র করিয়া আন্দোলন গড়িয়া তােলা এবং এই আন্দোলনের সহিত জাতীয় দাবি আদায়ের সংগ্রামকে যুক্ত করিয়া সমগ্র দেশব্যাপী এক উত্তাল গণ সংগ্ৰাম গড়িয়া তােলার লক্ষ্য নিয়াই আমাদের মাঠে নামিতে হইবে। গণ সংগ্রামের মধ্য দিয়াই একমাত্র পাহারাদার আয়ুব শাহী ও জনতার তিন শত্রুকে উৎখাত করা সম্ভব।
পেজ-১২৭
আমরা জানি যে গণ আন্দোলন ও গণ সংগ্রাম আন্দোলনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়াই বিকাশ লাভ করে এবং ক্রমাগত উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়। তাই, বিভিন্ন জরুরী দাবি দাওয়া যেমন জুলুম ট্যাক্স, খাজনা, শ্রমিকের মজুরি, রাজবন্দিদের মুক্তি, গ্রেফতারি পরওয়ানা প্রত্যাহার, কালাকানুন বাতিল, বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার প্রভৃতির ভিত্তিতে আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে হইবে।
সর্বশেষ আসুন, নির্বাচন বর্জনের সক্রিয় গণ-সংগ্রামের পতাকাকে হাতে নিয়া আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হই। আসুন, সক্রিয় নির্বাচন বর্জনের পতাকা তলে আমরা দল-মত-ব্যক্তি নির্বিশেষে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তি, ব্যক্তি ও দল সমবেত হই।
শহীদের তাজা রক্ত পূর্ব বাংলার মাটিকে লাল করিয়াছে। আসুন, শহীদের রক্তের নামে আমরা মার্কিন সাম্রজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও বড় পুঁজি এবং ইহারা গড়িয়া তুলিয়াছে যে শােষণের ইমারত সেই ইমারতের পাহারাদার আয়ুব স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আপােষহীন সংগ্রামের শপথ নেই। আসুন, শহীদের রক্ত রাঙা নির্বাচন বর্জনের সংগ্রামী বৈপ্লবিক আন্দোলনের মধ্য দিয়া আমরা আমাদের দেশে কায়েম করি সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী গণতান্ত্রিক সরকার।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি
পেজ-১২৮
পরিশিষ্ট – ঞ
আজ গােটা পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ প্রতি মুহূর্তে নির্যাতিত ও নিপীড়িত ও লাঞ্চিত। আজকে বিদ্যায়তনে, ছাত্রাবাসে, পথে-ঘাটে সর্বত্র ছাত্ররা পুলিশী ও পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বাহিনীর অতর্কিত নগ্ন হামলা ও জুলুমের শিকার হইতেছে। তাহাদের নিরাপত্তা প্রতি মুহূর্তে বিঘ্নিত হইতেছে। গােটা ছাত্র সমাজকে দাবিয়ে রাখার জন্য কর্তৃপক্ষ অমানুষিক ও পৈশাচিক পন্থার আশ্রয় গ্রহণ করিতেছে। তাই পূর্ব পাকিস্তানের গােটা ছাত্র সমাজকে আজকে যােগ্যতার সাথে সম্পূর্ণ মােকাবেলা করিতে হইবে। প্রয়ােজন হইলে ১৯৫২ সাল ও ১৯৬২ সালের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করিতে হইবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২২ দফা দাবি আদায়ের জন্য আপনারা জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের সংগ্রামী পতাকাতলে সমবেত হউন। আওয়াজ তুলুন অবিচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে, রুখে দাঁড়ান জেল জুলুম ও বুলেট বেয়নেটকে।
আমাদের সংগ্রামী ২২ দফা নিম্নরূপঃ
১. ড. ওসমান গনির পদত্যাগ।
২. সাইদুর রহমানে উপর থেকে বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করা।
৩. ড. মফিজ উদ্দিনের পদত্যাগ।
৪. সাইদুর রহমান স্মৃতি সৌধ নির্মাণ।
৫. করিমের বহিষ্কার আদেশ কার্যকরী করা।
৬. সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচার।
৭. শিক্ষায়তনে পুলিশ ও ই পি আর বাহিনীর নির্যাতনের বিচার চাই।
৮. গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের বিনা শর্তে অবিলম্বে মুক্তিদান।
৯. বিদ্যালয় ও কলেজ সমূহের শিক্ষকদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দান।
১০. ছাত্রদের বেতন হ্রাস।
১১. বিনা বেতনে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার সুযােগ দান।
১২. বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স বাতিলকরণ।
১৩. ডাক্তারদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দান।
১৪. মেডিকেল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় হইতে অটোপ্রমােশন প্রথা বাতিল।
১৫. প্রদেশে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন।
১৬. রাজশাহী মেডিকেল কলেজের এন এস এফ নেতৃদ্বয়ের উপর থেকে বহিষ্কার আদেশ
প্রত্যাহার।
১৭. প্রেসিডেন্টের ঘােষণা মােতাবেক পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্রদের সুযােগ সুবিধা অবিলম্বে বাস্তবায়িত করা।
১৮. উভয় প্রদেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্থায়ী সমাধান।
১৯. পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা রােধ ক্ষেত্রে স্থায়ী সমাধান।
২০. পূর্ব পাকিস্তানকে সামরিক ক্ষেত্রে স্বয়ং সম্পূর্ণ করা।
২১. পলিটেকনিক ছাত্রদের জন্য কনডেন্সড কোর্স চালু করা।
২২. ছাত্রদের বৃত্তি বৃদ্ধি ও বেকার সমস্যার সমাধান।
পেজ-১২৯
পরিশিষ্ট – ট
২২ দফা জিন্দাবাদ ॥ এনএসএফ জিন্দাবাদ ॥ পাকিস্তান জিন্দাবাদ
এনএসএফ কেন্দ্রীয় সংসদ কর্তৃক প্রচারিত
পূর্ব বাংলার জনগণ আবার রুখে দাঁড়িয়েছে। মুক্তি আর স্বাধীনতার আহ্বানে পূর্ব বাংলার শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, জনতা আজ পথে নেমেছে। ১৯৫২ সালে মায়ের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হয়েছে আমাদের মুক্তি সংগ্রাম। যে সংগ্রাম সেদিন শুরু, বাঙালীর রক্তের বিনিময়ে তা আজো থামে নি। এদেশের মাটিকে সকল প্রকার পরাধীনতার গ্লানির হাত থেকে মুক্ত করার জন্য আজ আমরা বদ্ধপরিকর। ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে বছরে আমরা রক্ত দিয়াছি – রক্ত দিয়াছি ৬২ সালে, ৬৪ সালে, ৬৬ সালে ৬৮ সালে, ৭, ১৩ ও ২৯ ডিসেম্বরে। আজও আমাদের রক্ত ঝরছে। গতকাল ২০শে জানুয়ারিতে আমরা রক্ত দিয়াছি। আমাদের প্রিয় বন্ধু কৃষক কর্মী আসাদ পাকিস্তানী পুলিশের হাতে প্রাণ দিয়ে আবার প্রমাণ করলাে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাস রক্তের প্রচ্ছদে লেখা এক ইতিহাস।
পূর্ব বাংলা যখন বিক্ষুব্ধ, পূর্ব বাংলার শ্রমিক-কৃষক, ছাত্র-জনতা যখন মুক্তির নবদিগন্তে পৌঁছে যাবার জন্য বদ্ধপরিকর সেই সময় এদেশেরই কিছু বিশ্বাসঘাতক, হতাশ রাজনীতিবিদ পূর্ব বাংলার মুক্তির প্রশ্নকে বাদ দিয়ে এক ভূয়া ঐক্য ফ্রন্টে মিলিত হয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি এই দলের কুখ্যাত নেতা অথর্ব নুরুল আমিন আইয়ুব খানের সাথে সহযােগিতা ও আপােষের আলাপ চালাচ্ছে।
এমনি সময়ে পূর্ব বাংলার উপর ঝাপিয়ে পড়েছে আর এক শকুনী। এই শকুনী হল আমেরিকা। আমেরিকা চায় পূর্ব বাংলার জনগণের রক্ত। তাই সে সকল প্রকার অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে আইয়ুব সরকারকে।
তাই পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি আজ আমাদের আহ্বান-আসুন শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, জনতা সবাই মিলে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার জন্য মুক্তিফ্রন্ট গঠন করি। যে কোনাে ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করবােই – পাকিস্তানী উপনিবেশবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাত হতে গড়ে তুলবাে শ্রেণিহীন, শোষণহীন জনগণের স্বাধীন পূর্ব বাংলা।
পূর্ব বাংলার সংগ্রামী ছাত্র সমাজ
পেজ-১৩০
পরিশিষ্ট – ঠ
পূর্ব বাংলার সংগ্রামী ছাত্রসমাজ তােমাদের প্রতি আমাদের বিপ্লবী অভিনন্দন। পূর্ব বাংলার সংগ্রামী মানুষ আজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও বড় ধনিক এবং তাদের স্বার্থের পাহারাদার স্বৈরাচারী আয়ুব-শাহীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের যে পতাকা তুলে ধরেছে – সেই পতাকাকে তােমরা তােমাদের ১১ দফা কর্মসূচি ভিত্তিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৭, ১৮, ১৯, ২০ ও ২১শে জানুয়ারিতে আরও উর্ধ্বে তুলে ধরেছাে।
শহীদ হয়েছেন আসাদুজ্জামান। শহীদ আসাদুজ্জামান এবং অন্যান্য শহীদদানদের রক্ত নতুন শপথে মহীয়ান হয়ে উঠেছে। শহীদ বীর তােমরা – মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তােমরা মৃত্যুকে জয় করেছে। শহীদানদের আত্মদান শ্রমিক শ্রেণির লাল পতাকার রং’কে আরও লাল করে তুলেছে। কমরেড – তােমাদের জানাই সালাম, তােমাদের নামে আমরা শপথ নিচ্ছি – তােমাদের অসমাপ্ত কাজ আমরা করবােই, তােমাদের রক্তের প্রতিশােধ আমরা নেবই; আয়ুব স্বৈরাচারের সমস্ত রকমের অত্যাচারকে পরাস্থ করে আমরা তুলে ধরবাে সংগ্রামী জনতার বিজয় পতাকা। তােমাদের ১১ দফা কর্মসূচি ও সংগ্রামী বাণীকে আজ পৌছে দাও গ্রামে, শহরে, স্কুলে, কলেজে, কৃষকের ঘরে ও শ্রমিকের বস্তিতে।
০ আয়ুব শাহী ধ্বংস হােক
০ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হােক
০ নির্বাচন – বর্জন কর
০ সগ্রামী ছাত্র ও বীর জনতা – জিন্দাবাদ
০ জনগণের জয় – অনিবার্য
পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি
২১ জানুয়ারি ১৯৬৯
পেজ-১৩১
পরিশিষ্ট – ড
সমগ্র পাকিস্তানব্যাপী আজ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঢেউ উঠেছে। শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তিন শাকসগােষ্ঠী ও তাদের তলপীবাহক ছাড়া জনতার বাকি সকল অংশ আন্দোলনের কোনাে কোনাে স্তরে শরিক হচ্ছে। এর মধ্যে সংগ্রামী ছাত্র সমাজকের ভূমিকা সবচাইতে অগ্রসর। অন্যদিকে ভাসানী পন্থী ন্যাপ ছাড়া বাকি সকল বিরােধী দল ‘ড্যাক’ গঠন করেছে। বের করেছে ৮ দফা কর্মসূচি। এই ৮ দলের মধ্যে যারা সামিল হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে প্রাক্তন বিচারপতি, প্রাক্তন এয়ার মার্শাল, প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী, প্রাক্তন গভর্নর প্রমুখ সহ বহু প্রাক্তন প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী – এক কথায় গত একুশ, বাইশ বছরের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, বৃহৎ দুইশত আমলা, মুৎসুদ্দী ধনিক গােষ্ঠীর একান্ত বংশবদ সেবকবৃন্দ।
শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তিন শত্রুর এইসব সেবকবৃন্দ এবং তাদের রাজনৈতিক দলগুলির যে যখন ক্ষমতায় বিরাজমান ছিল, তখন তাদের সাথে আয়ুব ও ঐ তিন শ্রেণির কোনাে বিরােধ ছিল না। কেবলমাত্র ক্ষমতাচ্যুত হবার পরেই তাদের সাথে বিরােধিতা প্রকাশ পেতে থাকে। পূর্ব ও পশ্চিমের উক্ত ৮ দলের সমন্বয়ে গঠিত ‘ড্যাকের’ দলগুলির মধ্যে কিছু কিছু চিন্তাভাবনার তারতম্য থাকলেও মৌলিকভাবে তারা কয়েকটি গুরুতর বিষয়ে একমত। যেমনঃ (১) উভয় পাকিস্তানের তথা গােটা পাকিস্তানে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শােষণ, আধিপত্য অটুট ও অব্যাহত থাকবে। তার কোনাে ব্যতিক্রম হবে না। (২) উভয় অঞ্চলে সামন্তবাদী শােষণ তথা জোতদারী মহাজনী শােষণ অক্ষত থাকবে। ইহার কোনাে রদবদল হবে না। (৩) দেশের মধ্যে প্রচলিত ধনতান্ত্রিক শোষণের কোনাে রদবদল হবে না। সাদা কথায় ইহার ফল দাঁড়াবে, এরা শাসন ক্ষমতায় বসলে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কোনাে ক্ষেত্রেই কোনাে মৌলিক পরিবর্তন আসবে না।
এই রাজনৈতিক দলের নেতারা আরও একটি মৌলিক কারণে ঐক্য জোটে দ্রুত সামিল হতে পেরেছে; তা হলাে তাদের ও আইয়ুবের এই ২২ বছরের শাসনে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র ও মেহনতি জনগণের সর্বস্তরে তাদের জীবন সংগ্রামের তিক্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে এই উপলব্ধি এসেছে যে – শক্তি প্রয়ােগ ছাড়া আইয়ুব সহ তিন শােষণের অবসান, মুক্তি আসতে পারে না। যে বল প্রয়ােগের মাধ্যমে আইয়ুব ক্ষমতায় এসেছে জনগণকেও বল প্রয়ােগ করে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে। পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলের জনগণের উপরােক্ত বিপ্লবী অভিব্যক্তির ভয়ে ড্যাকের নেতারা আজ ভীষণভাবে আতংকিত। আতংকিত জোতদার মহাজন সামন্ত শ্রেণির বংশধর, বেশির ভাগ উকিল, মােক্তার, ব্যারিস্টার প্রমুখ আইনজীবী গােষ্ঠী, ভয়ে সন্ত্রস্ত বাঙালীর বড় বড় আমলা ও উদীয়মান বণিক গােষ্ঠী। মহান নেতা কার্ল মার্কস এর ভাষায় বলা যায়, ‘এরা নিজেদের উপর আস্থাহীন, উৰ্দ্ধতনের প্রতি অসন্তুষ্ট, অধঃস্তনের সম্মুখে কম্পমান, উভয় পক্ষের প্রতিই স্বার্থপর ও সে স্বার্থপরতা সম্বন্ধে সচেতন, রক্ষণশীলদের কাছে বিপ্লবী এবং বিপ্লবীদের কাছে রক্ষণশীল, নিজেদের আদর্শ সম্বন্ধে অবিশ্বাসী, আদর্শের বদলে বাগাড়ম্বর প্রিয়, বিশ্বঝঞায় আতংকিত, বিশ্বঝঞাকেই নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে তৎপর, কোনাে ব্যাপারেই উদ্বেগ নেই এবং প্রতি ব্যাপারেই “কুম্ভীলেকবৃত্তি,” মৌলিকতার অভাবে
পেজ-১৩২
মামুলী – আবার মামুলীপনার ক্ষেত্রে মৌলিক, নিজেদের উপর আস্থাহীন, জনগণের প্রতি আস্থাহীন, নিজেদের আকাঙ্খা সম্পর্কে দর কষাকষিতে মত্ত, উদ্বেগহীন এবং বিশ্ব ঐতিহাসিক ভূমিকাহীন একটি বলিষ্ঠ জাতির প্রথম যৌবনের উত্তেজনাকে পরিচালিত ও স্থায়ী স্থবির স্বার্থে তাকে বিচ্যুত করার দায়িত্ব দন্ডিত এক জঘন্য বৃদ্ধ চক্ষুহীন, কর্মহীন, দন্তহীন, সর্ব ইন্দ্রিয়হীন।’ (রচনা সংকলন, ১ম খন্ড, ১ম অংশ, ৬১ পৃষ্ঠা)।
এই ড্যাকের নেতৃত্ব আরও চেয়েছে নিজেদের একটি হাতও উত্তোলন না করে ছাত্র, শ্রমিক ও মেহনতি জনগণকে দিয়ে তাদের হয়ে লড়াইটা সম্পন্ন করতে। অতএব, ক্ষমতা হতে বহিষ্কৃত, বঞ্চিত, ক্ষুধার্ত, এইসব হিংস্র শার্দুলের গােষ্ঠী সম্পূর্ণ ঐক্যমতে এসেছে যে, দেশে যদি বণিক গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা না যায় তবে দেশে বিপ্লব হয়ে যাবে। সেই বিপ্লবের খরস্রোতে শুধু তিন শত্রুসহ আয়ুব ভেসে যাবে না ; ড্যাকের মধ্যে সন্নিবেশিত শ্রেণিগুলির স্বার্থও সম্পূর্ণ তলিয়ে যাবে। এই উপলব্ধি হতে নিজেদের শ্রেণি স্বার্থের তাগিদে প্রথমে তারা নির্বাচনে অংশ নেবার ঐক্য জোট গঠনের জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালায়। কোনাে কোনাে দল প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর নাম ঘােষণা করে। কেহ বা পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার জন্য পূর্বাঞ্চল হতে প্রার্থী মনােনয়নের কথা ঘােষণা করে। এক কথায় ১৯৬৪ সালের মত সাজ সাজ রব উঠে। চন্দ্রের ষােলকলার পূর্ণরূপ নেবার যেটুকু বাকি থাকে তাহলো মওলানা ভাসানী ও পিকিং পন্থী ন্যাপ। মওলানা ভাসানী ও ন্যাপের প্রভাবশালী নেতাদের সাথে উপরােক্ত দক্ষিণ পন্থী বিরােধী দলের প্রথম দিকে নির্বাচনে যােগদানের বিষয়ে মৌলিক কোনাে বিরােধ ছিল না, বিরােধ ছিল নির্বাচনের সাথে জনগণের দাবি নিয়ে আন্দোলনের বিষয় নিয়ে।
বিদ্যুৎ শক্তির মত বিপ্লবী প্রতিক্রিয়া
এই অবস্থায় পিকিং পন্থী ন্যাপের মূল পরিচালক শক্তি, পিকিং পন্থী কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যকার নয়া সংশােধনবাদী নেতৃত্বের সাথে বিপ্লবীদের বিরােধ তীব্র আকার ধারণ করে এবং জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যকে সামনে রেখে নতুন বিপ্লবী পার্টি জন্ম নেয়। পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি তার জন্মলগ্ন থেকেই দীপ্ত কণ্ঠে ঘােষণা করে, (ক) নির্বাচন বর্জন (খ) ধনিক শ্রেণির পার্লামেন্টারী সরকারের পরিবর্তে জনগণতান্ত্রিক সরকার গঠনের লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হও। জনগণের নির্বাচন বিরােধী মনােভাবের সঠিক মূল্যায়ন করে আমাদের উপরােক্ত সিদ্ধান্তই সমস্ত বিরােধী দলের নির্বাচন বর্জন সিদ্ধান্ত নিতে বিদ্যুৎ শক্তির মত ক্রিয়া করে।
প্রথমে মওলানা ভাসানীর উপর ইহার প্রভাব ভীষণভাবে ক্রিয়া করে। তিনি ভালভাবে জানতেন যে, পূর্ব বাংলার শ্রমিক কৃষকের মধ্যে যতটুকু প্রভাব ও সংগঠন রয়েছে তার নেতৃত্বে আছে বিপ্লবী শক্তি, তাই তিনি আবার নির্বাচনী মনােভাব পরিবর্তন করে নির্বাচন বর্জনের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন; গ্রহণ করেন রক্ত রাঙ্গা সংগ্রামের পথ। আজ এ কথা অবধারিত সত্য যে, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীই একমাত্র বুর্জোয়া জাতীয় নেতা যিনি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বন্ধ্যাত্ব ভেঙ্গে সংগ্রামের ডাক দিয়েছেন এবং নিজে সশরীরে সে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। জননেতা মওলানা ভাসানী আন্দোলনের সূচনাই শুধু করেন নাই, তিনি বুর্জোয়া নেতৃত্বের শহর ভিত্তিক আন্দোলনকে মােড় ঘুরিয়ে দিয়ে তাকে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল
পেজ-১৩৩
শক্তি বিশাল কৃষক সমাজের গ্রামবাংলার দিকে প্রবাহিত করেছেন। শেষ পর্যন্ত মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গত জানুয়ারি মাসে পিকিং পন্থী ন্যাপের পাঁচবিবির প্রাদেশিক কমিটির বৈঠকে সর্বসম্মত ঐতিহাসিক নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রসঙ্গত উলেখযােগ্য যে, উক্ত বৈঠকে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়ে যাবার পর হুলিয়াগ্রস্ত নয়া সংশােধনবাদী দুই নেতার এক যুক্ত চিঠি উক্ত বৈঠকে হাজির করা হয়। উক্ত চিঠিতে ন্যাপের ও কৃষক সমিতির প্রাদেশিক সেক্রেটারীদ্বয় মােহাম্মদ তােয়াহা ও জনাব হক লিখিতভাবে জানান যে, “অতঃপর জনতার মনােভাব অনুধাবন করিয়া আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, ন্যাপ ওয়ার্কিং কমিটির উচিত নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত করা।” যাই হউক, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ও মজলুম জননেতা ভাসানী পন্থী ন্যাপের নির্বাচন ও বর্জনের সিদ্ধান্ত যে কত সময়ােচিত ও সুদূর প্রসারী প্রতিক্রিয়া সাধন করছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় পরবর্তীকালের বিভিন্ন বিরােধীদল কর্তৃক নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ও ড্যাক গঠন। এটাই হল সংক্ষেপে নির্বাচন বর্জন আন্দোলন ও বিরােধীদলগুলির পার্লামেন্টারী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পটভূমিকা। উপরােক্ত পটভূমিকাকে সামনে রেখে গত ২২/১/৬৯ তারিখ পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। যথাঃ
(ক) বিরােধী দল সমূহ বা ‘ড্যাক’ এর নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত আন্তরিক কাম্য নহে। ইহারা যে কোন মুহূর্তে শাসক গােষ্ঠীর সাথে আপােষ করে “জাতীয় সরকার” গঠনের নামে
জনগণকে ধােকা দিতে পারে।
(খ) এ অবস্থায় আমাদের করণীয় – একদিকে “ড্যাকের” সাথে হাত মিলিয়ে নির্বাচন বর্জনের কাজ (আন্দোলন) জোরদার করা – অন্যদিকে ‘ড্যাকের’ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও
শ্রেণিচরিত্র সম্পর্কে ব্যাপক জনগণকে সচেতন করা।
(গ) বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শ্রেণিসংগ্রাম যে পরিমাণ তীব্র হয়েছে একে আরও
জোরদার করে গ্রামাঞ্চলে মুক্ত এলাকা গড়ে তুলতে না পারলে ‘ড্যাকের’ তথাকথিত
‘জাতীয় সরকার’ গঠনের ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করা যাবে না।
(ঘ) উপরােক্ত কর্মসূচিকে সাফল্য মন্ডিত করার জন্য সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলা মুৎসুদ্দী
পুঁজির শাসনমুক্ত একটি স্বাধীন, সুখী শিল্পায়িত পূর্ববাংলা গড়ে তােলার জন্য আমরা সমগ্র
গণতান্ত্রিক শক্তিকে এ মহান কাজে আত্মনিয়ােগ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
(ঙ) সর্বশেষে পার্টিতে অন্তর্ভুক্ত সকল স্তরের কর্মীদের প্রতি উপরােক্ত কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়ােগ করার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।
কমরেড,
বিপ্লবী ছাত্র ও যুব সমাজের নেতৃত্বে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার উচ্ছেদ আন্দোলন রাজধানী ঢাকা শহরে আজ সর্বোচ্চ শিখরে উন্নীত হয়েছে। এর ঢেউ গড়িয়ে চলেছে অন্যান্য শহরে ও বন্দরে। শহরের ব্যাপক শ্রমিক শ্রেণি এ আন্দোলনে যথাযথ ভূমিকা পালনে দৃঢ় পদক্ষেপে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু শহরের এই আন্দোলনের সাথে গ্রাম বাংলার বিশাল কৃষক সমাজকে দ্রুত সামিল করতে না পারলে, যে কৃষক সমাজ হল জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল শক্তি, সে কৃষক সমাজ ছাড়া এই শহুরে আন্দোলন দ্বিতীয় শিবিরের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ‘ড্যাকের’ নেতৃত্বকেই
পেজ-১৩৪
কেবলমাত্র ক্ষমতারােহনে সাহায্য করবে। অথচ যে ‘ড্যাক’ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ওৎ পেতে বসে আছে বর্তমান আন্দোলনে তাদের বিন্দুমাত্র ত্যাগ নেই। অন্যদিকে যাদের খুনের তপ্ত রক্তে এই আন্দোলন সন্নিবেশিত সেই ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, কৃষক ও বুদ্ধিজীবীদের মূল স্বার্থ ও দাবি তলিয়ে যাবে – রূপ পাবে না তাদের শ্রেণি স্বার্থরক্ষার দাবিদার সরকারের। তাই এ শহর ভিত্তিক আন্দোলনের ক্ষতির দিকটি আমাদের স্মরণ রেখে অগ্রসর হতে হবে। আমাদের সহজ, সরল, সত্য হিসেবে জেনে রাখতে হবে যে, বর্তমান যুগে আমাদের দেশের শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্ব ও কৃষক সমাজের বিপ্লবী অভ্যুত্থান ছাড়া অন্য কোনাে শ্রেণির নেতৃত্ব ও আন্দোলন জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজ করতে পারবে না। অতএব একদিকে শহরের আন্দোলনকে বিপ্লবী শক্তির নেতৃত্বে রেখে পরিচালিত করতে হবে; অন্যদিকে ছাত্র, যুব, বুদ্ধিজীবী ও শ্রমিক সমাজের সচেতন বিপ্লবী অংশকে অবিলম্বে সংগঠক হিসাবে গ্রামে পাঠিয়ে গ্রামের সাংগঠনিক পশ্চাদপদ অবস্থা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে হবে। একমাত্র এই পথেই শহর ও গ্রামের বিপ্লবী আন্দোলনে সংযোগ সাধিত হবে। এই সংযােগ সাধনই হবে এই মুহুর্তে পার্টি কর্মীর মূল কাজ। বিপ্লবী প্রেরণা নিয়ে সকলে এই কাজে আত্মনিয়ােগ করুন।
জয় আমাদের অবধারিত। মহান মার্কসবাদ আমাদের দিক দর্শন। মাও সে তুং এর চিন্তাধারা আমাদের পথ প্রদর্শক।
জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব দীর্ঘজীবী হােক।
প্রচার পত্র নং ১/৬৯ “মেঘনা সংঘ”
পেজ-১৩৫
পরিশিষ্ট – ঢ
গণ আন্দোলনের উত্তাল জোয়ারে পূর্ববাংলা আজ উদ্বেল। স্বৈরতান্ত্রিক শাসক গােষ্ঠীর মসনদ আজ টলায়মান। অশতিপর বৃদ্ধ অগ্নিপুরুষ মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী এ আন্দোলনের স্নায়ুকেন্দ্র। তাঁকে সামনে রেখে কাতারবন্দী হয়েছে পূর্ব বাংলার সাড়ে ছয় কোটি মানুষ স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, কাতারবন্দী হয়েছে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ আর নয়া উপনিবেশবাদকে কবর দিয়ে স্বাধীন, সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের অপ্রতিরােধ্য প্রত্যয় নিয়ে।
পূর্ব বাংলার মানুষের মুক্তি আন্দোলনের প্রতীক মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক অগ্নিমন্ত্রের দীক্ষা নিয়ে সংগ্রামী ছাত্র সমাজ আজ ১১ দফা দাবির স্বার্থবাদী গােষ্ঠী সরকার বিরােধিতার নামে জন্ম দিয়েছেন ‘ড্যাক’ নামধারী এক জারজ সন্তান। কুখ্যাত এই ড্যাক নেতৃবৃন্দ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বুলির অন্তরালে গােষ্ঠীগত ‘আনুকূল্য’ লাভের বিনিময়ে গণ আন্দোলনকে গােল টেবিল বৈঠকে নিয়ে যেতে চান। তারা স্বৈরতন্ত্রের বেদীমূলে গণমানুষের আশা আকংখা বলি দেবার চক্রান্তে মেতে উঠেছেন।
আজকের এই অনন্য সাধারণ পটভূমিকায় সংগ্রামের পতাকা সমুন্নত রাখতে হবে, ১১ দফার আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, জনগণের বিজয় অবধারিত। মওলানা ভাসানী যে অগ্নি মশাল প্রজ্জ্বলিত করেছেন তাকে কখনও নিভতে দেয়া যাবে না। জাতীয় জীবনে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব সামনে রেখে সংগ্রামী ছাত্র সমাজ ১১ দফার আন্দোলন আরাে দূর্বার করে তুলবে। তারা বিশ্বাস ঘাতক কৃতদাসদের ক্ষমা করবে না। চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
১১ দফা জিন্দাবাদ। সংগ্রামী ছাত্রসমাজ জিন্দাবাদ। মওলানা ভাসানী জিন্দাবাদ।
পেজ-১৩৬
পরিশিষ্ট – ণ
সুধী, সাংস্কৃতিক চলমান সমাজে লব্ধ প্রতিষ্ঠিত এবং আমলা মহলে অবাধ বিচরনকারী এককালীন লেডী এম এন রায়ের প্রাইভেট সেক্রেটারী, র্যাডিক্যাল হিউম্যানিষ্ট অধুনা আন্তর্জাতিক সহ অবস্থানের প্রবক্তা ও পাকিস্তানের বিশিষ্ট বামপন্থী সংবাদপত্র দৈনিক সংবাদের সুপরিচিত সম্পাদক জনাব জহুর হােসেন চৌধুরী সম্বন্ধে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম বিশিষ্ট অভিযুক্ত জনাব খান মােহাম্মদ শামসুর রহমান সিএসপি সাহেবের বিশেষ আদালতে প্রদত্ত জবানবন্দীর আলােকে আমরা সাড়ে ছয় কোটি জাগ্রত বাঙালী জনাব জহুর হােসেন চৌধুরী সাহেবকে অনুরােধ করিব, তিনি যেন প্রকাশ্য ময়দানে অর্থাৎ জনগণের আদালতে জনাব খান মােহাম্মদ শামসুর রহমান সাহেবের মােকাবেলায় ব্যাখ্যা দান করিয়া গণমনে উথিত লাখাে প্রশ্নের অবসান করিতে সাহায্য করেন।
এখানে স্মরণ করা যাইতে পারে যে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালীন জনাব শামসুর রহমান তাঁর লিখিত জবানবন্দীতে বলিয়াছেন, পাকিস্তান সরকারের কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা কর্তারা (বঙ্গভাষী নহে) জনাব জহুর হােসেন চৌধুরীর ‘সেবাকেও’ তাহার (শামসুর রহমান) নিকট হইতে জালেম সরকারে ষড়যন্ত্রের সুবিধা মত বিবৃতি আদায়ের জন্য লাগাইয়াছিল।
পাকিস্তানের আকাশে সংঘটিত বর্তমান দ্রুত পরিবর্তনশীল ঘটনাবলীর পটভূমিকায় বাঙালী জাতি আজ ন্যায়নীতি এবং সামাজিক সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে ইহাই কামনা করিতেছে যে, জনাব জহুর হােসেন চৌধুরী সাহেব তাহার কীর্তির একটি পরিস্কার ছবি লইয়া আগাইয়া আসিবেন। আমরা আরাে আশা করি যে, তিনি জনাব শামসুর রহমান সাহেবকে প্রকাশ্য ময়দানে আমন্ত্রণ জানাইয়া তাহার বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ খন্ডন করিবেন এবং তাহার (জনাব জহুর হােসেন চৌধুরী) সহিত আরাে যে সমস্ত বহুরূপী বাঙালী জড়িত হইয়া কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা কর্তাদের বি টিম (উপদল) হিসাবে সহযােগিতা করিয়াছিলেন তাহাদের নাম, পরিচয়, ঠিকানা ইত্যাদি বাঙলার জনগণের আদালতে হাজির করিতে সাহায্য সহযােগিতা করিবেন।
কারণ আজিকার জাগ্রত বাঙালী জাতি তীক্ষ্ণভাবে উপলব্ধি করিয়াছে যে, কেবল অ-বাঙালী (বঙ্গভাষী নহে) শত্রু ছাড়াও বহু বর্ণের এবং চরিত্রের বঙ্গভাষী এদেশীয় সুচতুর দালাল রূপে কাজ করিয়া যাইতেছে। পর্দার অন্তরালে মঞ্চের সাজঘরে কিংবা ময়দানে, বক্তৃতার আড়ালে যাহারা তাহাদের ক্রিয়ালাপ চালাইয়া যাইতেছে তাহার কোনাে ক্ষমা নাই। বাঙালী জাতির ইতিহাসে যে বহু মীরজাফরকে কতল করা হইয়াছে ইহা তাহাদের মনে রাখা প্রয়ােজন।
পূর্ব বাঙলাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়া বিভিন্ন জুলুম ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আরাে বিশ পঁচিশ বছর পর্যন্ত শােষণ অব্যাহত রাখার জন্যে দেশীয় মীরজাফর তৈয়ার এর মাধ্যমে যে মােটা অংকের খেলাধূলা চালানাে হইয়াছে তাহা যদি সুপথে খরচ করা হইত তবে ইতিমধ্যে বাঙালী জাতির দুঃখ এবং সাথী বন্যা সমস্যার হয়ত বা সমাধান হইয়া যাইত।
পেজ-১৩৭
জালেমের জুলুমবাজীর, ষড়যন্ত্রের মীরজাফরী তাসের ঘরে আজ আগুন লাগিয়াছে। এই আগুনের লেলিহান শিখার রােষ হইতে পর্দার বাহিরে হউক বা মঞ্চের সাজঘরেই হউক কিংবা বক্তৃতার আড়ালেই হউক জাগ্রত বাঙালীর আদালত বিচার করিতে আজ বদ্ধপরিকর। কাহাকেও ক্ষমা করিবে না। তাহার পরিচয় যাহাই হউক না কেন।
জাগ্রত বাঙালী জাতি
পেজ-১৩৮
পরিশিষ্ট – ত
স্বাধীনতা লাভের একুশ বছর পরেও আমাদের কোন সমস্যার সমাধান হয় নাই। বৃটিশের গােলামীর শৃঙ্খল হইতে মুক্তিলাভের পর এক স্বাধীন, সুখী, সমৃদ্ধিশালী গণতান্ত্রিক পাকিস্তান গঠনের স্বপ্ন আপনারা দেখিয়াছিলেন। যেখানে জুলুম-শােষণ, দুঃখ-দারিদ্র্য, বেকার-অশিক্ষা, রােগ-মহামারী থাকিবে না – সুখী ও সুন্দর জীবনের অধিকার প্রতিটি মানুষ লাভ করিবে। কোটি কোটি মানুষের সেই স্বপ্ন আজও স্বপ্ন রহিয়া গিয়াছে।
জনগণের ভাগ্যের কোনাে পরিবর্তন হয় নাই বটে কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের সহযােগিতায় সামন্তবাদী ও একচেটিয়া ধনীক শ্রেণি জনসাধারণকে নিষ্ঠুরভাবে শােষণ ও লুণ্ঠন করিয়া ফাপিয়া উঠিয়াছে। মাত্র বিশ বাইশটি পরিবারের হাতে দেশের ধন-দৌলতের চার ভাগের তিন ভাগ জমা হইয়াছে। একচেটিয়া পুঁজিপতি ও সামন্তবাদীদের ধন-দৌলত ও সম্পত্তির হেফাজত ও শােষণ ব্যবস্থাকে পাকাপােক্ত করিবার মতলবে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয়। অস্ত্রের জোরে আইনসম্মত সরকার ও শাসনতন্ত্র বাতিল করিয়া দিয়া স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা হয়। সার্বজনীন ভােটাধিকার, কথা বলার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ স্বাধীন জাতির সকল এখতিয়ার কাড়িয়া নেওয়া হইয়াছে। পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশের বিশেষতঃ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার অস্বীকার করা হইয়াছে। এইভাবে কার্যতঃ অশেষ ত্যাগ ও সাধনালব্ধ স্বাধীনতা হইতে পাকিস্তানী জাতিকে বঞ্চিত করিয়া একনায়কত্ববাদী শাসনের গােলামীর জিঞ্জিরে গােটা জাতিকে আবদ্ধ করা হইয়াছে।
গণজাগরণ-গণ আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গ প্রায় একযুগ ব্যাপী নির্মম শােষণ ও নিষ্ঠুর অত্যাচার, উৎপীড়নে জনসাধারণের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। এই অসহনীয় নির্দয় শাসন ও শােষণের কবল হইতে মুক্তিলাভের জন্য দেশ জোড়া স্বতঃস্ফুর্ত গণ আন্দোলনের সূচনা হইয়াছে। আয়ুবশাহীর গােলামীর জিঞ্জির হইতে মুক্তিলাভ করা ও দীর্ঘ আকাংখিত শােষণমুক্ত গণতান্ত্রিক শাসন ও সমাজ প্রতিষ্ঠাই এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। মুক্তিকামী জনতার আশা আকাংখা ও সাধ-স্বপ্নকে রক্তের বন্যায় ভাসাইয়া দিবার উন্মত্ত প্রয়াসে মাতিয়া শাসকচক্র ছাত্র-জনতার উপর নির্বিচারে লাঠি, টিয়ারগ্যাস, বুলেট, বেয়নেট, ১৪৪ ধারা, কারফিউ প্রয়ােগ করিয়াছে এবং অগণিত মানুষকে হত্যা, জখম ও গ্রেফতার করিয়াছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়নগঞ্জ, খুলনা, ময়মনসিংহ, লাহাের, করাচী, পেশােয়ার, রাওয়ালপিন্ডি প্রভৃতি সহ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন শহর, নগর, জনপদের পীচঢালা রাজপথ ও সবুজ মাটি শহীদের তাজা খুনে রাঙ্গা হইয়াছে। কিন্তু দমন নীতি ও নৃশংস হামলার মুখেও সংগ্রামী জনতার ইস্পাত কঠিন সংকল্প একটুও টুটে নাই। শত অত্যাচার, উৎপীড়ন, বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করিয়া আরাে দুর্বার গতিতে গণ আন্দোলন অগ্রসর হইয়া চলিয়াছে।
১৪ ফেব্রুয়ারি হরতাল
জনতার ঐক্য ও সংঘবদ্ধ আন্দোলনের সম্মুখে কোনাে গণবিরােধী শক্তি টিকিতে পারে না, ইহাই ইতিহাসের শিক্ষা। কিন্তু এই জন্য প্রয়ােজন যে গণঐক্য ও শৃঙ্খলাবদ্ধ গণআন্দোলন তাহা কোনাে দলের একক প্রচেষ্টায় গড়িয়া তােলা সম্ভব নয়। তাই আটটি রাজনৈতিক দল এই মহান দায়িত্ব পালনের জন্য আগাইয়া আসিয়াছে এবং যুক্তভাবে সংগ্রাম পরিচালনার জন্য
পেজ-১৩৯
“গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ” গঠন করিয়াছে। সংগ্রাম পরিষদ পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন গণবিক্ষোভ ও আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ গণ আন্দোলনে পরিণত করিবার পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিগত ১৭ জানুয়ারি সারা পাকিস্তানে তথা সারা পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলন এক নূতন মােড় নেয় এবং সারা দেশ একযােগে বিক্ষোভে ফাটিয়া পড়ে।
সংগ্রাম পরিষদ আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সারা পাকিস্তান ব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল পালনের ডাক দিয়াছে। একই দিনে দেশের উভয় অঞ্চলে হরতাল পালনের উদ্যোগ পাকিস্তানের ইতিহাসে ইহাই প্রথম। আমরা আশা করি, সকল বাধা বিপত্তি ও উস্কানীর মুখেও অসীম সংগ্রাম, ধৈর্য ও শৃংখলা বােধের সহিত জনগণ হরতালকে সর্বোতভাবে কামিয়াব করিবেন।
১৪ ফেব্রুয়ারি হরতালের কর্মসূচি
• শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ, হাট-বাজার, অফিস-আদালত, কল-কারখানা প্রভৃতিতে ও রেল স্টিমার, মােটরলঞ্চ, বাস-ট্রাক, মােটরগাড়ি, বেবী-ট্যাক্সি, রিক্সাসহ সকল প্রকার যানবাহন কর্তৃক সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত পূর্ণ হরতাল পালন।
• সর্বত্র জমায়েত, জনসভা ও মিছিল।
মুক্তিকামী ভাইসব,
আপনারা অকাতরে বুকের তাজা খুন ঢালিয়া হাসি মুখে জেল-জুলুম বরণ করিয়া একনায়কত্ববাদী শাসনের ভিত্তিমূল কাঁপাইয়া তুলিয়াছেন। কোনাে শক্তিই আপনাদের সুদৃঢ় সংকল্প ও নির্ভিক সংগ্রামী স্পৃহাকে দমন করিতে পারিবে না। বিগত ২১ মে হইতে ২৪ জানুয়ারি ঢাকা শহরে শহীদ আসাদুজ্জামানের হত্যার প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত গণ জমায়েত ও ঐতিহাসিক মিছিল তাহার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পুলিশ ও ইপিআর কর্তৃক একাধিকবার গুলি বর্ষণ সত্ত্বেও ১৪৪ ধারায় বাধা নিষেধ তুচ্ছ করিয়া ঢাকা শহরে লক্ষ জনতা শােভাযাত্রা বাহির করে। গােটা জাতিকে এই চারি দিনের ইতিহাস অফুরন্ত প্রেরণা যােগাইবে। ঢাকার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া সারা দেশে ও পশ্চিম পাকিস্তানেও গণ আন্দোলনের নতুন জোয়ার শুরু হইয়াছে। আমরা বিশ্বাস করি আগামীতে এই গণ আন্দোলন আরও জোরদার হইয়া উঠিবে।
কাজেই দেশবাসীর প্রতি আমাদের আরজ, আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখের হরতালকে সর্ব প্রকারে সফল করিয়া তুলুন। ব্যক্তিগত, দলগত ক্ষুদ্র স্বার্থ চিন্তাকে আমল দিবেন না। একথা মনে রাখিবেন – এই হরতালের সফলতার উপরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অনেক কিছুই নির্ভর করে। এই দিনের জমায়েত ও মিছিলে লাখে লাখে যােগদান করুন। এবং সংগ্রাম পরিষদের গৃহীত নীচের আটটি দাবির ভিত্তিতে আওয়াজ তুলুন:
১. ফেডারেল পার্লামেন্টারী সরকার কায়েম।
২. সার্বজনীন ভােটাধিকার ও প্রত্যক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তন।
৩. অবিলম্বে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার।
৪. নাগরিক অধিকার পুনরুদ্ধার। সকল কালাকানুন – বিশেষতঃ বিনা বিচারে আটক
আইন ও বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স বাতিল।
পেজ-১৪০
৫. শেখ মুজিবুর রহমান, খান আব্দুল ওয়ালী খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ সকল
রাজবন্দী, আটক ছাত্র-শ্রমিক ও সাংবাদিকের মুক্তিদান। আদালত ও ট্রাইবুনালে বিচারাধীন সকল রাজনৈতিক মামলা ও সকল গ্রেফতারি পরওয়ানা প্রত্যাহার।
৬. ১৪৪ ধারা বলে জারিকৃত সকল বিধি নিষেধ প্রত্যাহার।
৭. শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি, ধর্মঘটের অধিকার কায়েম, কৃষকের বর্ধিত ট্যাক্স-খাজনা ও
সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল।
৮. সংবাদপত্রের উপর আরােপিত সকল বিধি নিষেধ প্রত্যাহার ; ইত্তেফাক, চাত্তান এর
ডিক্লারেশন পুনঃপ্রদান ও প্রগ্রেসিভ পেপার্স লিমিটেডকে উহার সাবেক মালিকের নিকট প্রত্যার্পন।
উপরে উল্লেখিত দাবিগুলি আদায়ের জন্য আন্দোলনই হইতেছে একমাত্র পথ। সংগ্রাম পরিষদ আন্দোলনের ডাক দিয়াছে। সকল ভেদাভেদ ভুলিয়া ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শরীক হওয়া প্রত্যেক নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য। এবং এই সকল দাবি হাসিল না হওয়া পর্যন্ত সকল স্তরের ইলেকশন বয়কট করিয়া বিরামহীনভাবে আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে। হরতাল ও সভা, শােভাযাত্রার মূল আওয়াজের সহিত ইলেকশনের নামে প্রবঞ্চনাকে প্রতিরােধ করিবার সংকল্প গ্রহণ করিতে হইবে। যে স্থানে আইন পরিষদ ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনগণের ভােটের অধিকার নাই সেই ইলেকশন জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রেরই নামান্তর। পরােক্ষ পদ্ধতির ধােকাবাজির ইলেকশন বাতিল ও বরবাদ করিয়া সার্বজনীন ভােটাধিকার ও সরাসরি নির্বাচনের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে কামিয়াব করুন। ইনশাআল্লাহ্ সত্যের জয় ও অসত্যের পরাজয় অবধারিত।
(বিঃ দ্রঃ – ইলেকট্রিসিটি, পানি সরবরাহ, ডাক্তারী দোকান, ডাক্তার ও সাংবাদিকদের গাড়ি হরতালের আওতা হইতে বাদ থাকিবে)
স্বাক্ষরঃ
সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ
মােজাফফর আহমদ, সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি
আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (পিডিএম)
সৈয়দ মােসলেহ উদ্দিন, সভাপতি, পূর্ব পাক নেজামে ইসলাম পার্টি
মােহসেন উদ্দিন আহমদ, সভাপতি, পূর্ব পাক জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম
সৈয়দ খাজা খয়েরুদ্দীন, সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান মােসলেম লীগ
আবু হােসাইন সরকার, সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট
মুহম্মদ আবদুর রহীম, আমীর, জামায়াতে ইসলামী, পূর্ব পাকিস্তান
==================================================================
প্রকাশনার ঠিকানাঃ ১ নং মগবাজার, ঢাকা, যােগাযােগের ঠিকানাঃ ১৫ নং পুরানা পল্টন, ঢাকা, অন্তরীপ মুদ্রণালয়, ২৫৫ জগনাথ সাহা রােড, ঢাকা হইতে মুদ্রিত।
পেজ-১৪১
পরিশিষ্ট – থ
(১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) এর ভেতর যে মতাদর্শশত বিরােধ দেখা দেয়, পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি উপলব্ধিতে নিম্নাক্ত উদ্ধৃতি সাহায্য করবে। প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল, ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা শহর শাখার একুশের (৬৯) সংকলন কষ্টিপাথর-এ। মূল প্রবন্ধটির শিরােনাম ‘পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের মূল দ্বন্দ্বগুলাে সম্পর্কে।’ লিখেছেন আ কা ম ফজলুল হক। ছাত্র ইউনিয়ন সংকলনে ছাপা হলেও, মূলতঃ এটি ছিল কমিউনিস্ট পার্টির চিন্তাধারা যা পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টিরই বক্তব্য। অন্যান্য ছাত্র সংগঠনে তখন এ ধরনের কোনাে অভ্যন্তরীণ মতাদর্শগত সংগ্রামের অস্তিত্ব ছিল না।)
দ্বন্দ্বগুলাের বিশ্লেষণঃ
পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে উপনিবেশবাদের জাতীয় দ্বন্দ্ব, পাকিস্তান আন্দোলন পরিচালনাকারী অখন্ড ভারতের মুসলিম বুর্জোয়া ও সামন্ত ভূস্বামী শ্রেণির মাঝে পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ, বােম্বাই, দিল্লী, লক্ষ্ণৌ প্রভৃতি স্থানের বৃটিশ সমর্থক বুর্জোয়া সামন্ত ভূস্বামী ও শ্রেণি (যারা সংখ্যায় খুবই অল্প) চেয়ে বহুগুণ বিকশিত থাকায় স্বভাবতঃই পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্ব কুক্ষিগত করে।
পূর্ব বাংলার হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণি ও সামন্ত ভূস্বামী শ্রেণি মুসলিম বুর্জোয়া, সামন্ত ভূস্বামী কৃষক ও শ্রমিকের উপর অর্থনৈতিক শােষণ ছাড়াও ধর্মীয় নিপীড়ন চালাতাে। বঙ্গ ভঙ্গ আইনের মাধ্যমে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ একটি আলাদা প্রদেশ হলে অর্থনৈতিক শােষণ ও ধর্মীয় নিপীড়নের কিছুটা লাঘব হবে একারণে বাঙ্গালী মুসলিম বুর্জোয়া ও ভূস্বামীরা তা সমর্থন করে। কিন্তু হিন্দু বুর্জোয়া বিকাশ বাধা প্রাপ্ত হবে বলে হিন্দু বুর্জোয়া ও ভূস্বামীরা এ বিভাগের বিরােধিতা করে। ফলে বঙ্গ ভঙ্গ রদ হয়। কাজেই বাঙ্গালী মুসলিম বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশের দুটি বাধা ছিল, একটি হল বৃটিশ উপনিবেশবাদ আর একটি হল হিন্দু বুর্জোয়া ও ভূস্বামীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কাজেই স্বাধীনতা আন্দোলন প্রগতিবাদীদের দ্বারা পরিচালিত না হওয়ায়, পূর্ব বাংলার সৃষ্টি ঐতিহাসিকভাবে প্রয়ােজন ছিল। পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া শ্রেণি ও সামন্তবাদীরা পাকিস্তানের মাঝ দিয়ে নিজেদের শ্রেণি বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হবে মনে করেই পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করে এবং মুসলিম কৃষক, শ্রমিকদের পাকিস্তান আন্দোলনের পেছনে ঐক্যবদ্ধ করে। তারা পাকিস্তানে যােগ দেয় এবং পূর্ববাংলা পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হয়।
স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ, বােম্বাই, দিল্লী, লক্ষ্ণৌ প্রভৃতি স্থানের বৃটিশ সমর্থক বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীদের হাতে থাকায় বৃটিশ উপনিবেশবাদীরা রাষ্ট্রক্ষমতা তাদের নিকট দিয়ে যায়। কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচীতে স্থাপন, বৃটিশ উপনিবেশবাদের সামরিক আমলা দ্বারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান উপাদান সশস্ত্র বাহিনী গঠন এবং বেসামরিক আমলা দ্বারা রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যান্য অংশ চালু করা (এ সকল সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের অধিকাংশ বৃটিশ উপনিবেশবাদ সমর্থক পাঞ্জাবী ও বহিরাগত ছিল) প্রভৃতির মাধ্যমে প্রধানতঃ পাঞ্জাবী ও বহিরাগত বুর্জোয়া ও ভূস্বামীরা রাষ্ট্রযন্ত্রের একচ্ছত্র মালিকানা লাভ করে এবং নিজেদের শ্রেণি বিকাশের অবাধ সুযােগ পায়। এ শাসকশ্রেণি পূর্ব
পেজ-১৪২
বাংলার স্বতন্ত্র জাতীয় ও অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য স্বায়ত্তশাসন কিংবা স্বাধিকার প্রদান করার পরিবর্তে একে অবাধ শােষণের জন্য প্রথম থেকেই প্রচেষ্টা চালিয়ে আসে। এ শাসকশ্রেণি রাষ্ট্র ক্ষমতার মাধ্যমে পূর্ব বাংলার পাট, চা, চামড়া প্রভৃতির অর্থ দ্বারা বিকাশ লাভ করে এবং এ বিকাশ ত্বরান্বিত করার জন্য তারা সাম্রাজ্যবাদ বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে সিয়েটো, সেন্টো প্রভৃতি সামরিক চুক্তি এবং বিভিন্ন প্রকার অর্থনৈতিক চুক্তি সম্পাদন করে। সম্প্রতি তারা সংশােধনবাদ বিশেষতঃ সােভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে নানা প্রকার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদন করে। ফলে পাকিস্তান একটি আধা উপনিবেশে পরিণত হয়।
পূর্ব বাংলার পাট, চা, চামড়া, কাগজ প্রভৃতির অর্থ, সস্তা শ্রমশক্তি ও সাড়ে ছয় কোটি মানুষের বাজার দ্বারা এবং সাম্রাজ্যবাদীদের অর্থনৈতিক সাহায্যে পাকিস্তানী বুর্জোয়া শ্রেণি একচেটিয়া পুঁজিপতিতে পরিণত হয়। তারা পূর্ব বাংলাকে শাসন ও শােষণের একটি স্থায়ী ক্ষেত্রে পরিণত করে। পূর্ব বাংলাকে শাসন ও শােষণের একটি বিরাট বাধা তার স্বতন্ত্র জাতীয় সত্ত্বা এবং ভাষা, যা এ স্বাতন্ত্রের প্রধান উপকরণ। জাতি হিসেবে পূর্ব বাংলার স্বাতন্ত্র্য মুছে দেয়ার জন্য এ পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠী বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু প্রচলনের হীন প্রচেষ্টা চালায়। এ হীন প্রচেষ্টাকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন নস্যাৎ করে দেয়। বর্তমানেও এ শাসকশ্রেণি বাংলা ভাষা পরিবর্তনের হীন প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
পাকিস্তানী বুর্জোয়া ও ভূস্বামী শ্রেণির বিকাশের জন্য ক্রমশঃ পূর্ব বাংলার সম্পদ, সস্তা শ্রমশক্তি ও সাড়ে ছয় কোটি মানুষের বাজার অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এভাবে বৃটিশ উপনিবেশবাদের প্রত্যক্ষ উপনিবেশ থেকে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানী হিসেবে কিছু কালের জন্য আধা উপনিবেশে পরিণত হলেও এখানে প্রথম থেকেই পাকিস্তানী বুর্জোয়া ও ভূস্বামী শ্রেণির জাতীয় নিপীড়ন ও শোষণ বিদ্যমান ছিল। এ শাসকশ্রেণি নিজেদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার উপর জাতীয় নিপীড়ন বৃদ্ধি করে এবং তাদের বিকাশ একচেটিয়া রূপ গ্রহণের পর্যায়ে এলে শােষণ অব্যাহত রাখার স্বার্থে তারা শাসন ব্যবস্থা অধিকতর সমরবাদী করে এবং এভাবে জাতীয় নিপীড়ন ঔপনিবেশিক রূপ নেয়।
এই বুর্জোয়া ও সামন্তবাদী শাসকশ্রেণি পূর্ব বাংলার দালাল বুর্জোয়াদের মাধ্যমে ও সামন্ত বাদকে জিইয়ে রেখে এদেশে শাসন ও শােষণ চালিয়ে যাচ্ছে। পূর্ববাংলার এই উপনিবেশিক শােষণের ফলে গ্রামে সামন্তবাদী শােষণে কৃষক, শ্রমিক, ক্ষুদে বুর্জোয়া ও মাঝারী বুর্জোয়া শ্রেণির এক অংশ তথা সমগ্র পূর্ব বাংলার জাতি এ শােষণে শােষিত হচ্ছে। উপনিবেশ গােষ্ঠী ধর্মভিত্তিক এক জাতিত্বের তত্ত্ব, পূর্ব বাংলা একটি প্রদেশ, প্রভৃতি প্রচারের মাধ্যমে শােষণের উপনিবেশিক চরিত্র গােপন করার প্রয়াস পায়। ইতিহাস ঘােষণা করে যে, উপনিবেশবাদীদের এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
দ্বিতীয়তঃ পূর্ব বাংলার কৃষক জনগণের সাথে সামন্তবাদের দ্বন্দ্ব ও গ্রামে সরকারি কর্মচারীর, (পুলিশ, সার্কেল অফিসাররা) মৌলিক গণতন্ত্রী (বি ডি) ভূস্বামী, ধনী চাষী, অসৎ ভদ্রলােক (টাউট) ও মাঝারী চাষীর উপরের স্তর গ্রামের মজুর, গরীব চাষী ও মাঝারী চাষীর ব্যাপক
পেজ-১৪৩
অংশের উপর সামন্তবাদী শাসন ও শােষণ চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসক শ্রেণি গ্রামের সামন্তবাদীদের জিইয়ে রেখেছে এবং নিজেদের বিকাশের নিমিত্তে পুঁজি ও সস্তা শ্রমশক্তি সংগ্রহের জন্য সামন্তবাদী শােষণ তীব্রতর করছে।
গ্রামে সামন্তবাদী শােষণের প্রকাশ হল ভূমিকর ও অন্যান্য খাজনা বৃদ্ধি, গ্রামে রেশন প্রথা চালু
করা, বুনিয়াদী গণতন্ত্রের সৃষ্টি করা, বর্গা পত্তনী, ঠিকা ও সুদ ব্যবস্থার অবসান না করা, সুদ প্রভৃতির দ্বারা চাষীদের শৃংখলে আবদ্ধ করা, বন্যা নিরােধ না করা, সেচ ব্যবস্থা না করা, পােকা ধ্বংসের ব্যবস্থা না করা, সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু না করা প্রভৃতি।
তৃতীয়ঃ- (ক) পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে সাম্রাজ্যবাদ বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ একদিকে উপনিবেশবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক ও সহযােগিতা বজায় রাখছে, অন্যদিকে পূর্ব বাংলার বুর্জোয়াদের এক অংশের সাথে আঁতাত রাখছে এবং এদের মাধ্যমে পাকিস্তানী শাসক শ্রেণির উপর চাপ সৃষ্টি করছে। তারা ঋণ, প্রত্যক্ষ ব্যবসা, প্রভৃতির দ্বারা পূর্ব বাংলার জনগণকে শােষণ করছে। তার উপনিবেশিক ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের নিয়ে চীন বিরােধী ঐক্যজোট গঠনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু উপনিবেশবাদীরা নিজস্ব শ্রেণি স্বার্থেই ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সাথে বর্তমানে আঁতাত করতে পারছে না। এবং নিজেদের শ্রেণি বিকাশের একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে এসে সমাজতান্ত্রিক দেশ বিশেষতঃ চীনের সাথে বন্ধুত্ব করতে বাধ্য রয়েছে।
অন্যদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পূর্ব বাংলার উপর ঔপনিবেশিক শাসনও শােষণের সুযোেগ নিয়ে তাদের সমর্থক বাঙালী বুর্জোয়াদের সাহায্য ও সমর্থন করছে। সাম্রাজ্যবাদ সমর্থক এই দালাল বুর্জোয়ারা উপনিবেশিক শাসন বিরােধী আন্দোলন করছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এই আন্দোলনকে মূলধন করে দুইভাবে ব্যবহার করছে – একদিকে উপনিবেশবাদীদের উপর চাপ প্রয়ােগ করছে চীন বিরােধী পাক-ভারত যৌথ চুক্তি সম্পাদন করার জন্য; অন্যদিকে এই দালাল বুর্জোয়াদের দ্বারা পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করে চীন বিরােধী পূর্ব বাংলা-ভারত যৌথ সামরিক চুক্তি সম্পাদন ও পূর্ব বাংলাকে প্রত্যক্ষ মার্কিন উপনিবেশে পরিণত করার জঘন্য ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। বর্তমানে মার্কিন সমর্থক দালাল বাঙালী বুর্জোয়ারা ছয় দফা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব করছে। পাকিস্তানী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদীদের স্বার্থরক্ষাকারী ধর্মীয় পার্টিগুলিকে সমর্থন ও সাহায্য করছে। এরা সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে বড় মিত্র।
(খ) সংশােধনবাদ, বিশেষতঃ সােভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের দ্বন্দ্ব।
উপনিবেশবাদীদের সাথে আঁতাত রেখে পাকিস্তানসহ তার উপনিবেশের জনগণকে শােষণ করাই তাদের লক্ষ্য। পূর্ববাংলার মুক্তি সংগ্রাম তারা সমর্থন করবে না কারণ পাকিস্তান ও উপনিবেশকে শােষণ করাই তার মূল লক্ষ্য। পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম নস্যাৎ করার জন্য তারা উপনিবেশবাদীদের সাহায্য করবে যাতে পূর্ব বাংলাকে শােষণের একটা ভাগ পায়। প্রসঙ্গক্রমে বায়াফ্রা, বার্মা, ভিয়েতনাম ও অন্যান্য স্থানের কথা উল্লেখযােগ্য। বায়াফ্রার জনগণ
পেজ-১৪৪
জাতীয় নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তির জন্য সগ্রাম করছে। কিন্তু সােভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ নাইজেরীয় সামরিক সরকারকে অস্ত্র, অর্থ ও লােক সরবরাহ করে বায়াফ্রার জনগণের মুক্তির সংগ্রামকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে যাতে তারা সমগ্র নাইজেরিয়ায় সাম্রাজ্যবাদের সাথে একত্রে শােষণ চালাতে পারে। তারা বার্মায় মুক্তি সংগ্রামকে দাবিয়ে রাখা এবং ভিয়েতনামের মহান সংগ্রামকে মুছে দেয়ার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে।
(গ) ভারতীয় সম্প্রসারণবাদঃ ভারতীয় বৃহৎ পুঁজিবাদী ও সামন্তবাদী সরকার সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে পরিচালিত পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করবে না। তার উদ্দেশ্য হল বুর্জোয়ার নেতৃত্বে পূর্ব বাংলাকে শােষণ করা এবং চীন বিরােধী একটি মিত্র পাওয়া।
চতুর্থঃ পুর্ব বাংলার বুর্জোয়া শ্রেণির সাথে শ্রমিক শ্রেণির দ্বন্দ্বঃ পুর্ব বাংলার বুর্জোয়া শ্রেণি শ্রমিক শ্রেণিকে শােষণ করে। বুর্জোয়া শ্রেণির একটি অংশ উপনিবেশদের দালাল, একটি অংশ সাম্রাজ্যবাদ বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল এবং উপনিবেশবাদ বিরােধী, অপর একটি অংশ সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ উভয়েরই বিরােধী, যারা সত্যিকার জাতীয় বুর্জোয়া। বুর্জোয়াদের প্রথম অংশ দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক, দ্বিতীয় অংশ সাম্রাজ্যবাদের দালাল যারা ভারতের সাথে আঁতাত রেখে নিজস্ব শ্রেণি বিকাশের জন্য যতটুকু জাতীয় অধিকার প্রয়ােজন তার জন্য সংগ্রাম করতে ইচ্ছুক। এদের নেতৃত্বে জাতীয় বিপ্লব সম্পূর্ণ হতে পারে না। এদের সাথে জনগণের শত্রুতামূলক সম্পর্ক ছাড়াও তারা যতক্ষণ উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী সংগ্রাম করে ততক্ষণ একটি মিত্রতার সম্পর্কও রয়েছে।
প্রধান দ্বন্দ্বঃ উপরে উল্লেখিত দ্বন্দ্বগুলাে ছাড়াও বর্তমানে পূর্ববাংলার সমাজে আরও দ্বন্দ্ব রয়েছে, কিন্তু উপরােক্ত চারটি হচ্ছে মূল দ্বন্দ্ব। সভাপতি মাও সে তুং বলেছেন, “কোনাে প্রক্রিয়াতে যদি কতগুলাে দ্বন্দ্ব থাকে তাদের মধ্যে অবশ্যই একটা প্রধান দ্বন্দ্ব থাকবে যা নেতৃস্থানীয় ও নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহণ করবে ও অন্যগুলাে গৌণ ও অধীনস্থ স্থান নেবে। তাই দুই বা দুইয়ের অধিক দ্বন্দ্ব বিশিষ্ট কোনাে জটিল প্রক্রিয়ার পর্যালােচনা করতে গেলে আমাদের অবশ্যই তার প্রধান দ্বন্দ্বকে খুঁজে পাবার জন্য সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এই প্রধান দ্বন্দ্বকে আঁকড়ে ধরলে সব সমস্যাকেই সহজে মীমাংসা করা যায়।” তাই পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের জন্য দায়ী মূল দ্বন্দ্বগুলাের মধ্য থেকে আমাদেরকে অবশ্যই প্রধান দ্বন্দ্ব খুঁজে বের করতে হবে এবং তাকে আঁকড়ে ধরতে হবে। বর্তমানে উপনিবেশবাদ বিরােধী জাতীয় সংগ্রামে শ্রমিক, কৃষক, ক্ষুদে বুর্জোয়া, মাঝারী বুর্জোয়ার এক অংশ ও ভূস্বামী শ্রেণির এক অংশকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব। কাজেই সামাজিক বিকাশের প্রক্রিয়ায় বর্তমানে পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে উপনিবেশবাদের জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব।
কিন্তু উপনিবেশবাদ বিরােধী জাতীয় সংগ্রাম একটা নির্দিষ্ট স্তরে পৌছলে উপনিবেশিক শ্রেণিকে রক্ষার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ একযােগে অথবা আলাদাভাবে নিজেদের সৈন্য দ্বারা পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে নস্যাৎ করার প্রচেষ্টা চালাবে। এ অবস্থায় উপনিবেশিক শাসক শ্রেণি প্রধান গণবিরােধীর ভূমিকা থেকে ভূমিকা গ্রহণ করবে। পক্ষান্তরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কিংবা
পেজ-১৪৫
সােভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ অথবা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ পূর্ব বাংলার গণবিরােধী সংগ্রামে গৌণ ভূমিকা থেকে ক্রমশ মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করবে। এই অবস্থায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কিংবা সােভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ অথবা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্বে পরিণত হবে। এ প্রধান দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে নুতন করে ঐক্যফ্রন্ট প্রতিষ্ঠা করে জনগণকে সঠিক মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে পরিচালনা করতে হবে”
পেজ-১৪৬
পরিশিষ্ট – দ
“পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক কার্য নির্বাহক সংসদের এই যুক্ত সভা এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হইতেছে যখন সমগ্র জাতিই হইতেছে বিক্ষোভে উদ্বেল, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্রদের দাবি দাওয়া সহ গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য জাতি জোড়া আন্দোলন বিপুল বেগে সম্মুখে ধাবমান। সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এই ক্রমবর্ধমান জোয়ার প্রবাহ প্রতিহত করার জন্য স্বৈরাচারী সরকার বুলেট গ্রহণ করিয়াছে। কিন্তু আমাদের দেশের মৃত্যুঞ্জয়ী জনতা সরকারের সকল দমননীতিকে পরাস্ত করিয়া সম্মুখে অগ্রসর হইয়া চলিয়াছে। যেহেতু ব্যাপক দমননীতি আন্দোলনকে দমন করিতে ব্যর্থ হইয়াছে সেহেতু সরকার আন্দোলনকে খতম করার জন্য অন্য পন্থার আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে এবং একটি গােল টেবিল বৈঠক আহ্বান করিয়াছে। সরকার জরুরী অবস্থা এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হইয়াছে। জনগণ তাহাদের সংগ্রাম ও রক্তদানের মাধ্যমে এই দাবিগুলি সরকারের অনিচ্ছুক হাত হইতে ছিনাইয়া লইয়াছে। দেশের সামন্তবাদী, পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদ ঘেষা শক্তিগুলি গণ আন্দোলনের এই ক্রমবর্ধমান জোয়ার দেখিয়া আতংকিত হইয়া পড়িয়াছে। শহীদের রক্তের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়াছে ১১ দফা দাবি।
যেহেতু ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এগারাে দফা দাবির প্রতি উহার অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করিয়াছে ; যেহেতু সাধারণভাবে জনগণ এই ১১ দফা দাবিকে তাহাদের মুক্তির উপায় বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে ; যেহেতু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট অথবা ‘ডাক’ নেতৃবৃন্দ কেহই ১১ দফা গােলটেবিল বৈঠকে আলােচনার ভিত্তি হইবে বলিয়া ঘােষণা করেন নাই ; যেহেতু সকল গ্রেফতারী পরওয়ানা ও রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে সকল মামলা প্রত্যাহার করা সম্পর্কে সরকার কোনাে ঘােষণা প্রদান করেন নাই ; যেহেতু সরকার গণ হত্যার আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে এবং একটি মাত্র ব্যতিক্রম ছাড়া আহতদের এবং নিহতদের পরিবার বর্গকে ক্ষতিপূরণ দান করিতে অস্বীকৃতি জানাইয়াছে ; এবং যেহেতু পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে গােলটেবিল বৈঠকে আলােচনার ভিত্তি হিসাবে ১১ দফা দাবিকে গ্রহণের জন্য যে আহ্বান জানাইয়াছিলেন তাহার কোনাে সুস্পষ্ট জবাব পাওয়া যায় নাই ; সেহেতু এই সভা মনে করে যে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফলপ্রসূ গােলটেবিল বৈঠকের উপযােগী পরিবেশ সৃষ্টি করিতে ব্যর্থ হইয়াছেন। এই সভা মনে করে যে, নিম্নলিখিত ব্যবস্থাবলী গৃহীত হওয়ার পরই কোনাে একটি ফলপ্রসূ গােলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হইতে পারে;
(ক) ১১ দফা দাবিকে আলােচনার ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ
(খ) পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর গুলিবর্ষণের ফলে আহত ও নিহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ দান
(গ) পূর্ব পাকিস্তানে ৫ একর ও পশ্চিম পাকিস্তানে সাড়েবার একর জমির খাজনা সম্পূর্ণ
মওকুফ করা ; কৃষকদের সকল বকেয়া খাজনা ও ট্যাক্স সম্পূর্ণ মওকুফ করা, পশ্চিম পাকিস্তানে সরকারি জমির প্রজাদের মালিকানা সত্ত্ব প্রদান, সরকারি জমি গরীব কৃষকদের
মধ্যে বিতরণ এবং জমিদারগণ কর্তৃক কৃষক উচ্ছেদ বন্ধকরণ
(ঘ) শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী সর্বনিম্ন বাঁচার মত মজুরি নির্ধারণ এবং আইএলও কনভেশন পুনঃ প্রতিষ্ঠিতকরণ
পেজ-১৪৭
(ঙ) নিরাপত্তা আইন সমূহ এবং প্রেস এন্ড পাবলিকেশনস অর্ডিন্যান্স বাতিলকরণ এবং
প্রগ্রেসিভ পেপারস লিমিটেডকে উহার মূল স্বত্বাধিকারীদের নিকট প্রত্যার্পণ
(চ) জাতীয় সমস্যা হিসেবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ সমস্যাকে বিবেচনা করা এবং বন্যার্ত এলাকাগুলিকে
দুর্ভিক্ষ কবলিত এলাকা বলিয়া ঘােষণা করা
(ছ) ছাত্রদের আশু দাবি দাওয়া সমূহ অবিলম্বে মানিয়া লওয়া হইবে বলিয়া ঘােষণা করা (জ) কৃষক, মৎস্যজীবী ও ক্ষুদ্র কুটির শিল্পীদের নিকট হইতে ঋণ আদায় স্থগিত রাখা
এই সভা সরকার ও অন্যান্য বিরােধী দলের নিকট এই দাবিগুলি মানিয়া লইয়া যাহাতে ফলপ্রসূ গােলটেবিল বৈঠকের পরিবেশ সৃষ্টি করা যায় তজ্জন্য আবেদন জানাইতেছে। দুই মাসের মধ্যে ১১ দফা দাবি মানিয়া লওয়া না হইলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি খাজনা ট্যাক্স বন্ধের আন্দোলন শুরু করিবে বলিয়া পার্টি প্রধান মওলানা ভাসানী যে ঘােষণা প্রদান করিয়াছেন এই সভা সেই ঘােষণাকে সম্পূর্ণ অনুমােদন করিতেছে।”
.
পেজ-১৪৮
পরিশিষ্ট –ধ
গণসংগ্রাম ক্ষান্ত হইবে না, সংগ্রামী ছাত্র সমাজের রক্ত শপথ
পূর্ব বাংলার জনগণের গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান ঘটিতে শুরু করিয়াছে। স্বৈরাচারী শাসকগােষ্ঠী নির্মম গুলিবর্ষণের মাধ্যমে ব্যাপক ছাত্র ও জনসাধারণকে হত্যা করিয়া এবং সর্বপরি কারফিউ জারি করিয়াও এই গণ অভ্যুত্থানকে স্তব্ধ করিতে পারিতেছে না। শাসক গােষ্ঠির শত গুলিবর্ষণও এই অভ্যুত্থানকে ধ্বংস করিতে পারিবে না। জালেম শাহীকে অবিলম্বে উচ্ছদ করিয়া গণতান্ত্রিক রাজত্ব কায়েম ও পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, সাম্রাজ্যবাদ, সামন্ত্রবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবাদকে ধ্বংস করিতে না পারিলে এবং ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, চাকরীজীবী, মধ্যবিত্ত, ব্যবসায়ী, ছােট-মাঝারী, শিল্পপতিদের বিভিন্ন মুখী সমস্যার সমাধান তথা ছাত্র সমাজের ১১ দফা দাবি আদায়ের সুনিশ্চিত ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত গণ অভ্যুত্থান ক্ষান্ত হইবে না। যে সংগ্রাম আজ শুরু হইয়াছে তাহা শেষ না করিয়া তাহার বিরাম নাই। ছাত্র সমাজের পক্ষ হইতে আমরা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করিতেছি যে, এই সংগ্রামের শেষ না করিয়া আমরা থামিব না এবং অতি শীঘ্র আমরা সংগ্রামের পরবর্তী বৃহত্তর কর্মসূচি দেশবাসীর নিকট উপস্থাপিত করিব। তাই ছাত্র সমাজ ও দেশবাসীর নিকট সেই বৃহত্তর সংগ্রামের প্রস্তুতির জন্য নিম্নলিখিত কর্মসূচিগুলি বাস্তবায়িত করার জন্য আহ্বান জানাইতেছি ।
১। প্রদেশের সকল জেলায়, মহকুমায়, থানায়, প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, মহল্লায় এবং শ্রমিক অঞ্চলে সর্বদলীয় ছাত্র সমাজের উদ্যোগে সংগ্রাম কমিটি গড়িয়া তুলুন। এই সকল কমিটি হইতে আন্দোলনকে সুশৃঙ্খল ও সংগঠিত ভাবে পরিচালনা করুন। স্থানীয় কমিটিগুলি উপরের কমিটির সহিত যােগাযােগ করুন।
২। আন্দোলনের কর্মপন্থা ঘােষণার জন্য এই সকল কমিটি হইতে প্রচারপত্র, প্রাচীরপত্র, পথসভা, মাইক ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রচার করুন।
৩। সকল জনগণকে সংগঠিত করুন।
৪। গ্রাম অঞ্চলে গণঅভ্যুত্থানকে ছড়াইয়া দিন।
৫। সর্বত্র হাজার হাজার সুশৃঙ্খল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করুন।
৬। সংগ্রামকে সফল করার জন্য ছাত্র শ্রমিক স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে আগাইয়া আসুন।
৭। সকল সময় শৃঙ্খলা বজায় রাখুন। সকল প্রকার সরকারি উস্কানীর প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখুন।
৮। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখিয়া ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে সাহায্য করুন।
৯। সকল সময় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশাবলী বিনা প্রশ্নে মানিয়া চলুন।
দেশবাসীর নিকট আমাদের আহ্বান
১। গুলিবর্ষণ, বেয়নেট চার্জ ও লাঠির আঘাতে আহতদের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে রক্ত দান করুন। সান্ধ্য আইনের বিরতির মাঝে সম্ভবমত রক্ত দান করুন সাম্প্রতিক আন্দোলনে নিহত ও আহতদের পরিবার পরিজনকে সাহায্যার্থে এগিয়ে আসুন। এবং নিম্ম ঠিকানায়
পেজ-১৪৯
সম্ভবমত অর্থ প্রেরণ করুন। তােফায়েল আহমেদ, ৩১৩, ইকবাল হল, ঢাকা।
২। রিক্সা চালক, ক্ষুধে মজুর এবং দরিদ্র জনসাধারণকে বেশি করিয়া ভাড়া ও মজুরি দিন ও যথাসাধ্য সাহায্য করুন। রিক্সা মালিকদের নিকট আমাদের আবেদন তারা যেন পুরােদিনের ভাড়া গ্রহণ না করেন।
৩। দোকানদার ও ব্যবসায়ী ভাইয়েরা নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের অতিরিক্ত মূল্য গ্রহণ না করিয়া ন্যায্য মূল্য গ্রহণ করুন।
৪। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে অগ্রসর করুন। যে কোনাে প্রকার সরকারি উস্কানির প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখুন এবং শৃঙ্খলা রক্ষা করুন।
১। আবদুর রউফ, সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। ২। সাইফুদ্দিন আহমেদ, সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন। ৩। মােস্তফা জামাল হায়দার, সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন। ৪। খালেদ মােহাম্মদ আলী, সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাক ছাত্রলীগ। ৫। মাহবুবুল হক দোলন, জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন। ৬। ইব্রাহিম খলিল, জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন। ৭। সামসুদ্দোহা, সাধারণ সম্পাদক, ছাত্র ইউনিয়ন। ৮। মাহবুব উল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক, ছাত্র ইউনিয়ন। ৯।। তােফায়েল আহমদ, সহ সভাপতি, ডাকসু। ১০। নাজিম কামরান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক, ডাকসু।
পেজ-১৫০
পবিশিষ্ট -ন
প্রেসিডেন্ট ভবন, ২৪শে মার্চ, ১৯৬৯
প্রিয় জেনারেল ইয়াহিয়া,
গভীর বেদনার সাথে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, দেশে সমস্ত বেসামরিক প্রশাসন ও শাসনতান্ত্রিক কর্তৃত্ব কার্যকারিতা হারাইয়া ফেলিয়াছে। যদি বর্তমানের আশংকাজনক গতিতে অবস্থার অবনতি ঘটিতে থাকে তাহা হইলে সভ্যভাবে জীবনধারণ অসম্ভব হইয়া পড়িবে। ক্ষমতা ত্যাগ করিয়া দেশরক্ষা বাহিনীর কাছে ক্ষমতা প্রত্যর্পণ করা ছাড়া আমার কোনাে বিকল্প নাই। বর্তমান সময়ে দেশের পূর্ণ কর্তৃত্ব গ্রহণের জন্য দেশরক্ষা বাহিনীই একমাত্র কার্যকর ও আইনানুগ প্রতিষ্ঠান। খােদা চাহেত অবস্থার পরিবর্তন সাধনপূর্বক পরিপূর্ণ বিশৃংখলা ও ধ্বংসের হাত হইতে দেশকে রক্ষা করিবার ক্ষমতা তাহাদের রহিয়াছে। একমাত্র তাহারাই দেশে সুস্থতা ফিরাইয়া আনিতে পারে এবং বেসামরিক ও শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশকে অগ্রগতির পথে ফিরাইয়া নিতে পারে।
আমাদের বিশ্বাসের মৌলিক নীতিমালা এবং আমাদের জনগণের প্রয়ােজন মোতাবেক পূর্ণ গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ইহা বজায় রাখাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। ইহার মধ্যেই আমাদের জনগণের মুক্তি নিহিত। আত্মােৎসর্গের শ্রেষ্ঠতম গুণাবলীসমৃদ্ধ আমাদের জনগণের পৃথিবীতে একটি গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকা পালনের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রহিয়াছে। ইহা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, যখন আমরা সুখী ও সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যতের পথে অগ্রসর হইতেছিলাম তখনই আমরা কান্ডজ্ঞানহীন বিক্ষোভের শিকারে পরিণত হই। ইহাকে গৌরবান্বিত করিবার জন্য যে নামই ব্যবহার করা হইয়া থাকুক না কেন, সময়ে প্রমাণিত হইবে যে, এই বিক্ষোভ ইচ্ছাকৃতভাবে সেই সমস্ত ব্যক্তিদের দ্বারা সৃষ্ট হইয়াছে যাহাদিগকে বিপুলভাবে প্রণােদিত করা হইয়াছে এবং মদদ যােগান হইয়াছে। আইন ও শৃংখলার ন্যূনতম চিহ্ন বজায় রাখা কিংবা নাগরিক স্বাধীনতা এবং জনগণের জীবন ও সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ তাহারা অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছে। প্রশাসনের প্রতিটি অঙ্গ এবং সুস্থ জনমত প্রকাশের প্রতিটি মাধ্যমের উপর অমানবিক চাপ প্রয়ােগ করা হয়। ত্যাগী মনােভাবাপন্ন অথচ নিরাপত্তাহীন সরকারী প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানসমূহ জনগণের ক্রুর সমালােচনা অথবা ব্ল্যাকমেইলের শিকারে পরিণত হয়। ফলে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলি বিনষ্ট হইয়া পড়ে এবং সরকারি যন্ত্র কার্যকারিতা হারাইয়া ফেলে। দেশের অর্থনৈতিক জীবন সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়া গিয়াছে। আইন বহির্ভুত এবং নৃশংস কাজ করিবার জন্য কর্মচারী ও শ্রমিকদিগকে উত্তেজিত করা হইতেছে। একদিকে সন্ত্রাসের হুমকির মুখে অধিক পারিশ্রমিক, বেতন ও সুযােগ সুবিধা আদায় করা হইতেছে অন্যদিকে উৎপাদন হ্রাস পাইতেছে। রফতানি ক্ষেত্রে মারাত্মক অবনতি ঘটিয়াছে এবং আমার আশংকা অতিসত্ত্বরই দেশ মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতির কবলে নিপতিত হইবে। এইসব হইতেছে ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের নৈরাজ্যমূলক আচরণের ফল যাহারা গত কয়েক মাস ধরিয়া গণ আন্দোলনের নামে দেশের ভিত্তিমূলে একটির পর একটি আঘাত হানিতেছে। দুঃখের বিষয়, বিপুল সংখ্যক নির্দোষ লােক এই অসৎ পরিকল্পনার শিকারে পরিণত হইয়াছে।
পেজ-১৫১
সকল অবস্থার মধ্যে আমি আমার ক্ষমতা অনুযায়ী দেশবাসীর খেদমত করিয়াছি। অবশ্য যথেষ্ট ভুলভ্রান্তি রহিয়াছে কিন্তু যাহা অর্জন করা হইয়াছে তাহাও নগণ্য নয়। এমন অনেকে আছেন যাহারা আমি যাহা করিয়াছি এমনকি পূর্বতন সরকার যাহা করিয়াছে তাহাকে ব্যর্থ করিয়া দিতে চাহিবে। কিন্তু সবচাইতে দুঃখজনক ও হৃদয়বিদারক চিন্তা হইল যে, এমন অনেকে এখন ক্রিয়াশীল রহিয়াছে যাহারা কায়েদে আযমের অবদান অর্থাৎ পাকিস্তান সৃষ্টিকেও ব্যর্থ করিয়া দিতে চাহিবে। বর্তমান সংকট নিরসনের জন্য আমি সকল বেসামরিক ও শাসনতান্ত্রিক পন্থা প্রয়ােগ করিয়াছি। যাহারা জনগণের নেতা হিসেবে পরিচিত তাঁহাদের সহিত মিলিত হইবার প্রস্তাব দিয়াছি। সম্প্রতি তাঁহাদের অনেকে একটি কনফারেন্সে যােগ দিয়াছিলেন তখনই যখন আমি তাঁহাদের সকল পূর্বশর্ত পূরণ করিয়াছিলাম। কয়েকজন উক্ত কনফারেন্সে যােগ দিতে অস্বীকার করিয়াছেন, এই অস্বীকৃতির কারণ তাহাদেরই ভাল জানা। একটি সর্বস্বীকৃত ফর্মুলা উদ্ভাবন করিবার জন্য আমি তাহাদিগকে বলিয়াছিলাম। কয়েকদিনের আলােচনা সত্ত্বেও তাহারা উহা করিতে পারেন নাই। শেষ পর্যন্ত তাঁহারা দুইটি বিষয়ে একমত হইয়াছিলেন এবং আমি ঐ দুইটি বিষয়ই গ্রহণ করিয়াছিলাম। তারপরে আমি প্রস্তাব দিয়াছিলাম, যে সমস্ত বিষয়ে মতৈক্য হয় নাই সেইগুলি প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভােটের মাধ্যমে যখন জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হইয়া আসিবেন তখন তাঁহাদের বিবেচনার জন্য পেশ করা হইবে। আমার যুক্তি ছিল – এই কনফারেন্সে উপস্থিত প্রতিনিধিবৃন্দ, যাঁহারা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন নাই, তাহারা সকল বেসামরিক ও শাসনতান্ত্রিক বিষয় ও নিজেরদের মধ্যে যে সমস্ত বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় নাই সেইগুলির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দাবি করিতে পারেন না। যে দুটি বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে সেইগুলি বিবেচনার জন্য জাতীয় পরিষদ আহ্বান করিবার কথা আমি চিন্তা করিয়াছিলাম কিন্তু ইহা স্পষ্ট হইয়া উঠিল যে, ইহা নিরর্থক প্রচেষ্টা। পরিষদের সদস্যরা আর স্বাধীন প্রতিনিধি নন এবং যে দুইটি বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে সেইগুলি বিশ্বস্ততার সহিত গৃহীত হইবে এমন কোনাে সম্ভাবনা নাই। প্রকৃতপক্ষে পরিষদ সদস্যদেরকে এই মর্মে হুমকি প্রদানেও বাধ্য করা হইতেছে যাহাতে তাঁহারা হয় অধিবেশন বয়কট করেন অথবা এমন সংশােধনী প্রস্তাব আনয়ন করেন যাহাতে কেন্দ্রীয় সরকার বিলুপ্ত হইয়া যায়, সশস্ত্র বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ অসম্ভব হইয়া পড়ে, দেশের অর্থনীতি দ্বিধাবিভক্ত হইয়া পড়ে এবং পাকিস্তান ছােট ছােট খন্ডে বিভক্ত হইয়া পড়ে। এমন একটি বিশৃংখল পরিস্থিতিতে জাতীয় পরিষদ আহ্বান করিবার অর্থই হইতেছে পরিস্থিতিকে আরও সংকটাপন্ন করিয়া তােলা।
শুধু বিদেশী আগ্রাসনই নয় বরং আভ্যন্তরীণ গােলযােগ ও বিশৃংখলা হইতে দেশকে রক্ষা করিবার আইনগত ও শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব আপনার। জাতি আশা করে, দেশের নিরাপত্তা ও অখন্ডতা বজায় রাখা এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আপনি এই দায়িত্ব পালন করিবেন। ১২ কোটি মানুষের এই বিক্ষুব্ধ দেশে শান্তি ও সুখ ফিরিয়া আসুক। আমি বিশ্বাস করি, দেশের বর্তমান কঠিন সমস্যা মােকাবেলা করিবার মত ক্ষমতা, দেশপ্রেম, ত্যাগী মনােভাব ও প্রজ্ঞা আপনার রহিয়াছে। আপনি এমন এক বাহিনীর নেতা যার সমগ্র বিশ্বে সম্মান রহিয়াছে। পাকিস্তান বিমান বাহিনী ও নৌ-বহিনীর আপনার সহকর্মীদের অনেকেই সম্মানিত ব্যক্তি এবং আমি জানি, আপনি সব সময়েই তাঁহাদের সমর্থন পাইবেন। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীকে অবশ্যই বিচ্ছিন্নতার হাত হইতে পাকিস্তানকে রক্ষা
পেজ-১৫২
করিতে হইবে। প্রতিটি সৈনিক, নাবিক ও বৈমানিকের নিকট আপনি এই কথা পৌছাইয়া দিবেন যে, তাহাদের সুপ্রীম কমান্ডার হিসেবে তাহাদের সহিত সম্পর্কিত হওয়াতে আমি গর্বিত, সেই জন্য আমি আপনার নিকট কৃতজ্ঞ থাকিব। তাহাদের জানা উচিত, বর্তমান সংকটাপন্ন মুহূর্তে তাহাদিগকে পাকিস্তানের রক্ষক হিসাবে কাজ করিতে হইবে। তাহাদের আচরণ ও কাজ ইসলামের নীতিমালা ও জনগণের স্বার্থ রক্ষার মনােবৃত্তি দ্বারা অনুপ্রাণিত হইতে হইবে। দীর্ঘকাল ধরিয়া পাকিস্তানের সাহসী ও অনুপ্রাণিত জনগণের খেদমত করিতে পারিয়া আমি পরম সম্মানিত বােধ করিতেছি। আল্লাহ তাহাদিগকে অধিকতর অগ্রগতি ও গৌরবের পথে পরিচালিত করুন। আপনার দ্বিধাহীন আনুগত্যের কথাও আমি পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করিতেছি। আমি জানি, আপনার সমগ্র জীবনে দেশপ্রেমই হইতেছে সর্বময় প্রেরণার উৎস। আমি আপনার সাফল্য এবং আমার দেশবাসীর কল্যাণ ও সুখের জন্য দোয়া করি। খােদা হাফেজ।
আপনার বিশ্বস্ত
স্বা/এম, এ, খান
পেজ-১৫৩
পরিশিষ্ট – প
অভ্যুত্থানের দিনপঞ্জী / পূর্ব পাকিস্তান
|
নভেম্বর ১৯৬৮
১৯. পশ্চিম পাকিস্তানে নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঢাকায় ছাত্র ও আইনজীবীদের প্রতিবাদ।
ডিসেম্বর ১৯৬৮
৯, ঢাকায় ২ জন নিহত, বহু গ্রেফতার। যানবাহনে অগ্নিসংযােগ, ১২৮ জন গ্রেফতার, বহু
আহত।
১১. রাওয়ালপিন্ডিতে সাংবাদিকের উপর হামলার প্রতিবাদে ঢাকার সাংবাদিকদের ধর্মঘট
পালন।
১৩. চট্টগ্রামে পুলিশের গুলিবর্ষণে ১২ জন আহত। পূর্ব পাকিস্তানে ৭০০ এর বেশি গ্রেফতার।
৩০. হাতিরদিয়ায় পুলিশের গুলিবর্ষণে ৭ জন নিহত, ১৪ জন আহত, ৪ জন গ্রেফতার।
জানুয়ারি ১৯৬৯
১২. ঢাকায় ৪ জন গ্রেফতার।
১৭. ঢাকায় ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ।
১৯. ঢাকায় পুলিশের গুলিতে একজন নিহত, ৩ জন আহত, ৮ জন গ্রেফতার।
২০. ঢাকায় ইপিআরের গুলিতে ১ জন নিহত, ২৫ জন আহত।
২৪. চব্বিশ ঘন্টা সান্ধ্য আইনের জন্য ঢাকায় সেনাবাহিনী তলব। পুলিশের গুলিতে ৫ জন
নিহত, ১০০ জন আহত, ৬০ জন গ্রেফতার। দৈনিক পাকিস্তান, মর্নিং নিউজ অফিস, পূর্ব পাকিস্তান পার্লামেন্টের সদস্য, ১৫টি বাড়ি, রেল স্টেশন, ৪০টি দোকান, গাড়ি অগ্নি দগ্ধ ও ভষ্মীভূত। খুলনায় ৩ জন নিহত, ২৫ জন আহত, বহু দোকান ভস্মীভূত। ময়মনসিংহে
পুলিশের গুলিতে ২ জন নিহত ও ২০ জন আহত।
২৫. খুলনায় ৩১ ঘন্টার সান্ধ্য আইন। সেনাবাহিনীর গুলিতে ৫ জন নিহত, ১২ জন আহত। নারায়নগঞ্জে হরতাল পালনের সময় ১৬ জন ও ঢাকায় ২৩ জন আহত।
২৬. ঢাকা ও নারায়নগঞ্জে ৪ জন ও খুলনায় ১০ জন নিহত। ১৪৫ জন গ্রেফতার। পূর্ব
পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের বাড়ি ও ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্থ। সান্ধ্য আইন ভঙ্গের দায়ে ময়মনসিংহে ৭৪ জন গ্রেফতার। ২৪ শে জানুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে
সিলেটে পূর্ণ হরতাল পালিত।
২৭. ঢাকায় গ্রেফতার অব্যাহত। খুলনায় পুনরায় সান্ধ্য আইন জারি। ময়মনসিংহে একজন
নিহত।
২৮. ঢাকা ও বরিশালে প্রায় ১২০০ জন গ্রেফতার।
২৯. বরিশালে ১ জন নিহত, ৩ জন আহত। সারা দেশে প্রায় ২০০ জন গ্রেফতার। পূর্ব
পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ গ্রেফতার। ঢাকা হাইকোর্ট বার সমিতির জরুরী সভায় গুলিবর্ষণ ও সান্ধ্য আইন জারির তীব্র নিন্দা।
পেজ-১৫৪
৩০. ফরিদপুরে ১ জন নিহত, ৩ জন আহত। সারা দেশে প্রায় ২০০ জন গ্রেফতার।
৩১. চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও নারায়নগঞ্জে প্রায় ১৩০ জন গ্রেফতার। সান্ধ্য আইন সম্পর্কিত মওলভী ফরিদ আহমদের রীট নাকচ।
ফেব্রুয়ারি ‘৬৯
১. ফরিদপুরের গােপালগঞ্জে ১ জন নিহত, ৩ জন আহত। পাবনা, রাজশাহী ও বগুড়ায় ১২৭ জন গ্রেফতার। দেশ রক্ষা আইনে এনডিএফ নেতা অলি আহমদ গ্রেফতার।
২. সাতক্ষীরা ও নওগাঁয় ১৩ জন আহত। গ্রেফতার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে রংপুরে মহিলাদের
সভা ও মিছিল।
৪. সংবাদপত্র ও পেশাদার সাংবাদিকদের উপর পুলিশের বর্বরােচিত হামলা এবং প্রশাসনের নিপীড়নমূলক নীতির প্রতিবাদে প্রদেশের সর্বত্র চব্বিশ ঘন্টা ব্যাপী সাংবাদিক ধর্মঘট।
৫. টাঙ্গাইলে ১ জন নিহত ও ১০ জন আহত। মন্ত্রীর বাড়ি ভস্মীভূত।
৭. কুমিল্লায় ৩ জন নিহত ও বহু গ্রেফতার।
১৪. চট্টগামে ইনসাফ ও ইউনিটি পত্রিকা অফিসে অগ্নি সংযোেগ।
১৫. ঢাকায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার দু’জন অভিযুক্ত গুলিবিদ্ধ, একজন, সার্জেন্ট জহুরুল হক নিহত। নারায়নগঞ্জে ১ জন নিহত ও ২ জন আহত।
১৬. ঢাকায় সান্ধ্যআইন, ১ জন নিহত, ৩৫ জন আহত। মন্ত্রীদের বাড়িতে অগ্নি সংযােগ, প্রচুর সরকারি সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্থ।
১৭. চট্টগ্রামে দোকানপাট ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযােগ, রংপুরে ৪ জন গ্রেফতার।
১৮. ঢাকায় সান্ধ্যআইন অমান্য, অসংখ্য হতাহত। রাজশাহীতে ড. শামসুজ্জোহা সহ ২ জন
নিহত। দিনাজপুরে ১৩ জন আহত, গাড়ি ও বাড়িতে অগ্নিসংযােগ।
১৯. ঢাকায় সান্ধ্যআইন অমান্য, অসংখ্য হতাহত। চট্টগ্রামে ২টি গাড়িতে অগ্নিসংযােগ, ১০ জন
আহত। নােয়াখালিতে ৩ জন নিহত, ১৪ জন আহত, ৩২ জন গ্রেফতার। কুষ্টিয়ায় ১ জন
নিহত, ৪ জন আহত, দোকান পাট ভষ্মীভূত।
২১. খুলনায় ৯ জন নিহত, ৫০ জন আহত, সেনাবাহিনী তলব, খান এ সবুর সহ অন্যান্যদের
বাড়ি ভস্মীভূত। দৌলতপুরে ১ জন নিহত, বহু হতাহত। সংসদ সদস্যের বাড়ী ও তহসিল অফিসে অগ্নিসংযােগ। কুষ্টিয়ায় গণপিটুনিতে ইউনিয়ন কাউন্সিল চেয়ারম্যন নিহত। পাবনায় ২ জন নিহত।
২২. বরিশালের শিল্পাঞ্চলে ৩ জন নিহত, ৬ জন আহত।
২৩. ঢাকায় ইপিআর এর সঙ্গে সংঘর্ষে ৫ জন আহত। খুলনায় ২ জন আহতের মৃত্যু।
২৪. রংপুরে ইপিআরের গুলিতে ৩ জন আহত।
মার্চ ‘৬৯
৩. ঢাকায় ২ জন নিহত।
৪. বগুড়ায় সান্ধ্যআইন, সরকারি বাড়িঘর ভস্মীভূত। চাঁদপুরে ৩ জন নিহত, ৫০০ বাড়ি
ভস্মীভূত।
পেজ-১৫৫
৬. সিলেটের হবিগঞ্জে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের গুলিতে ২ জন নিহত।
৮. জামালপুরে ৮ জন নিহত। জনতার হাতে ৫ জন দাগী অপরাধী জীবন্ত দগ্ধ, ১৫টি নৌকা লুট। টাঙ্গাইলে ৫ ফেব্রুয়ারির গুলিতে আহত ১ জনের মৃত্যু।
৯. জামালপুরে ৮ জন নিহত, বাড়িঘর ভস্মীভূত।
১১. কুষ্টিয়ায় ২০টি বাড়ি ভস্মীভূত। দৌলতপুরে ১৪টি দোকান ভস্মীভূত। রাজশাহীতে ৪৭৮টি বাড়ি ভস্মীভূত।
১২. জামালপুরে ৫ জন নিহত।
১৩. ঢাকার মানিকগঞ্জে ৭৬ জন অপরাধী জনতার বিচারে নিহত, অপরাধীদের ১২৫টি বাড়ি ভষ্মীভূত।
১৫. নােয়াখালীতে ৪ জন পুলিশ নিহত, থানা আক্রান্ত। জামালপুরে ২ জন অগ্নিদগ্ধ সহ ৭ জন নিহত।
১৭. ঢাকায় পতিতালয়ে অগ্নিসংযােগ, ২টি সিনেমা হল ক্ষতিগ্রস্থ। চট্টগ্রামে দোকান-পাট তছনছ।
১৮. রাজশাহীতে গণপিটুনিতে ১ জন পুলিশ নিহত, ৬টি রাইফেল ছিনতাই। পার্বতীপুরে ৫ জন
নিহত, ৩০০ বাড়িঘর ভস্মীভূত, সান্ধ্যআইন জারী।
১৯. ঢাকায় ২ জন নিহত। জামালপুরে ১ জন জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ এবং অন্যান্যদের গাছে ঝুলিয়ে
হত্যা।
২০. ফরিদপুরে ২০ জন গ্রেফতার।
২১. রাজশাহীতে ৩ জন নিহত, ৯ জন গ্রেফতার। শ্রীমঙ্গলে ৩ জন অপরাধী নিহত।
২২. ঢাকায় ১৯ জন গ্রেফতার।
২৪. সিংগাইরে ১ জন নিহত, ২০০ বাড়ি ভস্মীভূত।
২৫. ঢাকায় ১ জন নিহত, ৩ জন আহত। কুষ্টিয়ায় ৩১ জন অপরাধী গ্রেফতার। সামরিক
আইন জারি।
(এ অসম্পূর্ণ তালিকা তৈরিতে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সাহায্য নেয়া হয়েছে। স্বভাবতঃই এতে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। উপরন্তু ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে সান্ধ্য আইন অমান্য করে মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণের ফলে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের সংখ্যা উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। যেখানে নিহত হওয়ার কারণ দেয়া হয় নি, সেখানে পুলিশের গুলি বুঝতে হবে।) এই তালিকা অনুযায়ী আন্দোলনে শহীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৪ জন। মােহাম্মদ হাননান তার বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (২০০৬) বইতে বলেছেন এই সংখ্যা বিভিন্ন পেশার ভিত্তিতে মােট ৬১ জন। মােহাম্মদ হাননান ১১ দফা আন্দোলনের শেষ শহীদ হিসেবে রাজশাহীর সপ্তম শ্রেণির ছাত্র আবদুস সাত্তারের নাম উল্লেখ করেছেন। সাত্তার ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আহত হন এবং সাত মাস মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ১৯৬৯ সালের ২৪ আগস্ট মারা যান।)