This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
১৯৭১ স্মৃতিখন্ড মুজিবনগর
শওকত ওসমান
১৯৭১ মে-জুন
কলকাতা সার্কাস এভিনিউয়ে অবস্থিত পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিস। তদানীন্তন প্রধান হােসেন আলী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন নিজপদে অধিষ্ঠিত থেকে। সুতরাং স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল ঘাঁটি হবে এই অকুস্থল। সেটুকু আমার জানা ছিল অনুমানের উপর। কিন্তু বাস্তবেও আর এদিক-ওদিক হয়নি। এইসব এলাকা আমার পুরাতন পরিচিত জায়গা। সুতরাং পরিবার নিয়ে আমাকে কোন আশ্রয়ের সন্ধানে বেগ পেতে হয়নি।
নিকটে ছিল জাস্টিস এস এ মাসুদের বাড়ি। রাজনৈতিকভাবে তার উদার অবস্থানে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের নিকট পরিচিত ব্যাপার। উপস্থিত ক্ষেত্রে কোন শিবিরে তার স্থান হবে, তা কল্পনা করতে হয়নি। সােজা তার বাড়ি গিয়ে পৌছেছিলম। বিচারপতির আতিথেয়তা প্রায় তখনই চুক্তিবদ্ধ হয় অন্তত আমার জন্যে। স্বাধীনতা সংগ্রামের নয় মাস আমি আর কোথাও যেতে পারিনি। আমার স্ত্রী পুত্র অবিশ্যি অন্যত্র গিয়েছিল। তাও জাস্টিস মাসুদের কল্যাণে এই জন্যে যে সে গােটা বাংলাদেশের ছিন্নমূলদের আশ্রয় দিতে পারলে মানসিকভাবে তৃপ্ত হতাে। তার নিজের বাড়ি ত সরাইখানায় তখন পরিণত। আমার গােটা পরিবার জায়গা পেয়েছিল আর এক ঐতিহাসিক বাড়িতে। বাঙালী ঐতিহ্যের প্রবাহ সেখানেও প্রবাহিত ছিল। বাড়িটি কাজী আব্দুল ওদুদ সাহেবের, যিনি জীবদ্দশায় তার উদার মতামতের জন্যে মুসলিম লীগ রাজনীতির হুজুগ কালে রীতিমত লাঞ্ছিত হন । আমার গােটা পরিবার স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ওই বাড়ির আশ্রয় লাভ করেছিল। ওদুদ সাহেব লােক গমন করেন ১৯৭০ সনে। আর এক বছর জীবিত থাকলে, তিনি তার ভবিষ্যদ্বাণীর সাফল্য দেখে যেতে পারতেন।
৪১
ধর্ম কোন দিন রাষ্ট্রীয় পতনের ভিত্তি হতে পারে না। তার সজোর প্রতিবাদ বাস্তবরূপ পেতে অবিশ্যি দুই দশক অতিবাহিত হয়েছিল।
স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম তিন মাস কর্মব্যস্ততার মধ্যে কাটে যে প্রতিদিন রােজনামচা লেখা সম্ভব হয়নি। তবে কিছু ঘটনা প্রবাহ আজও মনে দাগ রেখে গেছে। তারই অনুস্মরণে এই স্মৃতিচারণা।
মুজিবনগর পৌছানাের খবর সেই সময় দ্রুত চতুর্দিকে ধাইত।
বিবিসির ভূমিকা এই সঙ্গে স্মরণীয়। আমরা বলতাম, বিবিসি, মানে বাংলাদেশ বেতার সেন্টার। খবর ছড়ানাের দ্রুততর একটা উদাহরণ পরিবেশনের লােভ আমার পক্ষে সংবরণ অসম্ভব নানা কারণে। জলপাইগুড়ি শহরের দূরত্ব কলকাতা থেকে তিনশ’ কিলােমিটার। আমার মুজিবনগর পৌছানাের দিনেই বিবিসি তা প্রচার করে। জলপাইগুড়ি শহরের অধিবাসী শ্রী এম এন নন্দীর কাছে সংবাদ পৌছায়। তিনি তার জামাই সত্যরঞ্জন দে এবং কন্যা ইন্দিরার নিকট এত্তেলা পাঠান কলকাতায় যেন আমার “দেখু-ভাল্” এ কোন কার্পণ্য না ঘটে। পাঠকের কৌতুহল নিবারণে সংক্ষেপে আরাে কয়েকটি কথা বলতেই হয়। শ্রীযুক্ত এম এন নন্দী পেশায় চিকিৎসক এবং একদা ঢাকা মানিকগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। ১৯৬৪ সনে আত্মঘাতী দাঙ্গার পর তিনি তাঁর প্রধান কর্মস্থল ঢাকা শহর ত্যাগে বাধ্য হন। ডাঃ নন্দী (এম এন-উহ্য হয়ে গিয়েছিল কালে কালে) কেবলমাত্র নামধারী এক নাগরিক ছিলেন না। এম এন অর্থাৎ মন্মথনাথ প্রেমের দেবতার সঙ্গে নামের মিল। কিন্তু তার প্রেম মানবতার সঙ্গে। কল্যাণের কোন দেবতার উল্লেখ হয়ত পুরাণে থাকতে পারে, আমার জানা নেই। ডাঃ নন্দী ছিলেন সেই কল্যাণ দেবতার নররূপ প্রতিনিধি, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে নমস্য। এমন বিরল আত্মার সৌরভে শুধু তৃপ্ত হয়ে কে চুপচাপ বসে থাকবে, উৎসের কাছে দৌড়ে না গিয়ে? বলাবাহুল্য আমার সঙ্গে বিলক্ষণ পরিচয় ছিল এই ভিষগ-রত্নের।
খবর তখন এমনই দাবানল। চকিতে এক অঞ্চল থেকে আর এক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ত। নন্দীদুহিতা ইন্দিরা এবং জামাতা সত্যরঞ্জনকে দেখে আমি সেদিন তেমন বিস্মিত হইনি। কালের হাওয়ায় সব রকমের স্বাভাবিকতা মার খায়।
স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাল তুমুল স্রোতে নানা ঘটনার বুদ্বুদ দেখা দেবে, তা বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে একটি কথা সদা-স্মরণীয়।
অমন কালে যতাে রকমের দায়িত্ব থাক না কেন, ব্যক্তিজীবনে
৪২
প্রাত্যহিকতা ত শেষ হয়ে যায় না। তার ন্যূনতম চাহিদা না মিটিয়ে রেহাই পাওয়া দায়। অনেক রুটিন ত অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। এইসব যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধেও লড়াই অনিবার্য। অর্থাৎ বাইরে যেমন সংগ্রাম থাকে, ভেতরেও তেমন সংগ্রামের জের অপেক্ষার্থী। দুই সীমান্তে লড়তে হয়। আমার অনেক কালের অভ্যাস সকালে স্নান । জাস্টিস মাসুদের বাড়ি চারতলা। কিন্তু লােক বােঝাই । তাই পুরাতন অভ্যেস ছাড়তে হলাে। এই গীয়ার চেঞ্জ না করতে পারলে লড়াইয়ে জেতা সম্ভব নয়।
মােটামুটি মে মাসে আমার ঘাটি ঠিক হয়ে গিয়েছিল যেন যুদ্ধক্ষেত্রের সাহায্যে লাগতে পারি। কাজী আব্দুল ওদুদের বড় ছেলে কাজী হাসান তওফিক বােম্বাই পাের্ট ট্রাস্টের ইঞ্জিনিয়ার তিনি তার তিনতলায় একটি কামরায় চাবি রেখে যেতেন এক আত্মীয়ের কাছে। পত্র পেয়ে আত্মীয় ভদ্রলােক আমাদের চাবি দিয়ে দেন। সেখানে একটি কামরা এবং বারান্দাসহ ক্যাম্প তৈরি হয়ে যায়। অমি ত জাস্টিস মাসুদের অতিথি। সেখানেও লেখাপড়ার জন্যে একটি গুদাম ঘর (অবিশ্যি পরিষ্কৃত এবং বাসযােগ্য করে তােলেন বিচারপতি স্ট্যান্ডওয়ালা পাখা সহযােগে) তিনি বন্দোবস্ত করেন। সুতরাং লেখাপড়া অন্তত করা যাবে যতই ভিড়ের মধ্যে বসবাস করি না কেন। যুদ্ধক্ষেত্রে ক্যাম্প প্রস্তুত।
এই আশ্রয় পাওয়া গিয়েছিল। তাই “দেশ” পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘােষের ফাঁদে পা দিতে সাহস পাই পুজো সংখ্যার জন্যে উপন্যাস রচনায়। ফাঁদ এই জন্যে যে হাতে সময় তিন হপ্তাও নেই এবং প্রতিদিন কিস্তি সন্ধ্যায় পত্রিকার পিয়ন এসে নিয়ে যাবে। এক অধ্যায়ের সঙ্গে আর এক অধ্যায়ের মিল থাকছে কিনা রচনায় তাও মিলিয়ে দেখার সুযােগ নেই। আজও দিশা পাইনে, অমন চ্যালেঞ্জ কেন গ্রহণ করেছিলুম? ১৯৭১ সালে “দেশ” পুজো সংখ্যায় প্রকাশিত আমার উপন্যাস “জাহান্নম হইতে বিদায়” বইটির প্রশংসা না হােক, কেউ নিন্দা করেনি। এই সান্ত্বনার আবহে আজও নাক কানে খৎ দিই যেন কোন। সম্পাদকের ফাঁদে আর ভবিষ্যতে পা না দিয়ে বসি।
যুদ্ধক্ষেত্রে ক্যাম্প প্রস্তুত।
আমার লড়ায়ের অস্ত্র ত লেখনী। তা চালনার জন্যে সামান্য নিভূতি নির্জনতা পাওয়া গেছে। আর অন্য চাহিদা ত ন্যূনতম। হাইকমিশনার হােসেন আলী আমাকে চাকরি নিতে বলেছিলেন। সরকারী সব অফিসারদের তখন ঢালাও পাঁচশ’ টাকা বেতনের চাকরি দেয়া হতাে। আমি তাকে বলেছিলুম যে যেহেতু বাংলাদেশ সরকারের কোষাগার সম্পদ বােঝাই নয়, অন্য একজনকে চাকরিটা দেয়া হােক, আমি পাঁচশ’ টাকা লেখনীর সাহায্যে যােগাড় করে নিতে পারব।
উনিশ শ’ একাত্তর সালের মে মাসে ছােটখাট নােট রাখা সম্ভব হয়নি। অকারণ, ফুরসুত ছিল কম। এক কাজের ভেতর অন্য কাজ এসে পড়ত। তাছাড়া প্রথম সাত-আট দিন এমন আবেগ সংকুল মুহুর্তের ভেতর দিয়ে হাটতে হতাে যে অনেক সময় মন নির্বিকার বিষাদে বহুক্ষণ ভরে থাকত।
বন্ধুবর আশরাফ আলী চৌধুরী তালতলা লেনে-নম্বর বােধ হয় ছিয়াত্তর-ক্যাম্প পেতেছিলেন এক আত্মীয়ের বাড়িতে। এসব খবর তখন মুখে মুখে ফিরত। চেনা-জানাদের খোঁজ করতেই হয় বিপদের দিনে। দুই দশক ধরে আশরাফ আলীর সঙ্গে পরিচয়। তার হৃদয়ের পরিচয় ঢাকার সংস্কৃতি কর্মীরা। ভালরূপেই জানে। মুজিবনগর পৌছে তাঁর সঙ্গে দেখা করব, বিচিত্র কিছু নয়। অকুস্থলে পৌছতে মুখ খুলব কি, তিনি আমাকে যেভাবে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন তার বক্ষ স্পন্দন ত আমার কাছে তার আত্মার প্রতিধ্বনিরূপেই প্রতিভাত। পরে আমাকে বলেছিলেন, আমি বেঁচে আছি, এ-প্রত্যক্ষতায় উদ্বেল তার নিজের আচরণের উপর আর কোন হাত ছিল না।
সুহৃদ-বৎসল আশরাফ আলী চৌধুরী আত্মীয়-বৎসলও কম ছিলেন না। বাংলাদেশ থেকে সদ্য-প্রত্যাগত, কাজেই টাটকা সংবাদ-বাহক আমি নিশ্চয়। তিনি এক এক করে অনেকের খবর নিলেন। শিল্পী কামরুল হাসান পূর্বেই মুজিবনগর পৌছায় এপ্রিল মাসে। তার খবর পাওয়া গেল। পরবর্তী পর্যায়ে আত্মীয়দের কুশল জিজ্ঞাসা। নামের পর নাম। সকলেই আমার পরিচিত। ভাল আছে, সংক্ষিপ্ত জবাব।
কেমন আছে শােভা?
শােভা ভাগনী, সমীদা খাতুন।
ভাল আছে। জবাব দিয়েছিলুম। অজানিতে আমার কণ্ঠস্বর স্বাভাবিকতাচ্যুত, কেঁপে গিয়েছিল। শেষে জেরার মুখে উচ্চারণ করতে হলাে “এপ্রিলের শেষে শােভা চিরতরে চলে গেছে।”
বেগম সাহেরা চৌধুরানী ত আকা কান্না শুরু করে দিলেন। শােভার মাতুলের অশ্রু-ছাপানাে দুই চোখের দিকে একবার পলক তাকিয়ে অবনত মুখ অপরাধীর মত আমি পাথর মূর্তি। এমন শােকের আবহ থেকে বেরিয়ে এসেছিলুম এক পর্যায়ে কিন্তু দুর্মুখ দুঃসংবাদ বহনকারীর গ্লানি কি করে চেতনা থেকে দূরে ছুঁড়ে ফেলব?
৪৪
জাতীয় দুর্যোগ ব্যক্তি দুর্যোগকে চাপা হয়ত দিতে সক্ষম হয়। কিন্তু সময় লাগে। মুক্তিযােদ্ধা আশরাফ আলী চৌধুরীর সঙ্গে নয় মাস বিভিন্ন পর্যায়ে আবার সাক্ষাৎ ঘটেছে কিন্তু প্রথম দিনের পুরাতন দাগ নিশ্চিহ্ন হয়নি। আবেগ সংকুল সেইসব মুহূর্তরাজির পুরাে প্রবাহ বর্তমানে অতীতের প্রতিধ্বনি মাত্র পাঠকের নিকট হুবহু পৌছে দেয়া দুরূহ। সংক্ষেপে বলা যায়, দায়িত্ব ছিল মাথার উপর এবং জাতীয় দায়িত্ব। তাই বােধহয় ব্যক্তির পর্যায়ে অনেক কিছু সামাল দিয়ে উঠতে পারতুম। গৃহী জীবনের জন্যে প্রাণ মাঝে মাঝে উন্মুখ হলেও রণাঙ্গনের কথা ত ভােলা যায় না। তদানীন্তন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান তাজউদ্দীন সাহেব সেদিকে নমস্য। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তার কোন পারিবারিক জীবন ছিল না। বৈষ্ণব কবির “বাহির কৈনু ঘর ঘর কৈনু বাহির” পদের মত প্রধানমন্ত্রীর আপিস মানে গৃহ এবং গৃহ মানে প্রধানমন্ত্রীর আপিস। নয় মাস কোন ব্যত্যয় ঘটেনি, তাজউদ্দীন সাহেবের অঙ্গীকারে।
কিন্তু আমরা যারা গৃহীজন তাদের দোটানা পর্যায় খুব সুখের নয়। তবে মুক্তি সংগ্রামের পরােক্ষ-অপরােক্ষ শরীক হতে পারলেই আমি আনন্দিত হতাম। বয়সের প্রতি ধিক্কার দিতে হয়। জওয়ান থাকলে ত বন্দুক ধরতাম। একজন বাঙালী লেখকের পক্ষে এমন সুযােগ ত সহজে মেলে না। নজরুলের হাবিলদারী ঐতিহ্য আর কেউ বিস্তার করতে পারেনি আজও। কিন্তু আদিখ্যেতা করে লাভ নেই। বর্তমান যুগে লড়াই আর বিশেষ জায়গাভিত্তিক নয়। বর্তমান যুগের যুদ্ধকে বলা হয় TOTAL WAR বা সামগ্রিক সংগ্রাম। সৈনিকের লেবাস। যােগানে কারখানায় যে দরজী কাজ করছে সেও কিন্তু যােদ্ধা, যদিও রণাঙ্গন। থেকে দূরে । এমন সান্ত্বনাকে আমি খোড়া অজুহাত মনে করি। তবু মেনে নিয়েছিলুম, নেই মামার চেয়ে কানা মামা উত্তম, ষােল আনা দিতে অপরাগ তাই বলে নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী চার আনা না দেয়া তাে মূর্খতা বা নিষ্ক্রিয়তা। সব সময় মনে রাখা উচিত, নিষ্ক্রিয়তা শত্রুপক্ষের অনুকূলে যায় ।
এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি তখন প্রায় দিন-রাত কাজে মশগুল থাকতাম। আরাে কাজ ছিল বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে যােগাযােগ। তবে কয়েকটি ঘটনা আমার বেশ মানস-অনুকূল হয়ে পড়েছিল।
মুজিবনগরে তখন একটি সাপ্তাহিক প্রকাশ হতাে। নামঃ জয় বাংলা। এই পত্রিকার আপিস ছিল আমার ঠিকানার খুব নিকটে। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য পরিচালক তখন এম আর আখতার, নামের লেজাংশ দিয়েই যে এখন বাংলাদেশে সমধিক পরিচিত। মুকুল নামই এখন সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়। পরে
৪৫
আসে আসল রাম। “জয় বাংলার আপিস সর্বদা গমগমে থাকত। চেনা অচেনার সাক্ষাৎ-সংগম এই কেন্দ্র। পত্রিকার ব্যবস্থাপনায় ছিলেন আওয়ামী লীগের এম পি টাংগাইল নিবাসী আব্দুল মান্নান। তিনি মজলিসী বান্দা। সারাদিন কাজের পর এমন এক পরিবেশ উদ্যম-সঞ্চয়ের উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলাবাহুল্য। আরাে একটি কথা যােগ করতে হয়।
“জয় বাংলা” একটি পত্রিকার নাম। কিন্তু এই দুই শব্দ শ্লোগানরূপে কিরকম বিদ্যুত্বাহী ট্রানসমিটারে পরিণত হয়েছিল তা আজ ভুক্তভােগী ছাড়া কাউকে বােঝানাে দায়। বাংলাদেশের আশয়-সন্ধানী প্রত্যেক নাগরিক তখন সংক্ষেপে “জয় বাংলার লােক। কোন বাড়ির আশ্রিত জনের যতই নাম থাক, যতই আপন জন হােক না কেন, তার ডাক নাম তখন “জয় বাংলা।” জয় বাংলার লােক, বাংলাদেশের নয় । তখনও বাংলাদেশের জন্ম হয়নি রাজনৈতিক মানচিত্রে কিন্তু মানস চিত্রে তার রেখায়িত প্রতিকৃতি দুটি শব্দে প্রতিধ্বনিত হতাে। কিন্তু কিছু সাজ-সরঞ্জাম ভূষিত চা-খানা, কিন্তু নাম জয় বাংলা রেস্টুর্যান্ট। এমনও দেখা গেছে।
“মােল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত বাংলা প্রবাদ। লেখকদের দৌড় সম্পর্কে নীরব। বলাবাহুল্য, পত্রিকার আপিস স্বচ্ছন্দে জায়গা করে নিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। “জয় বাংলা” সাপ্তাহিকের আপিস আমার মত মােল্লার মসজিদে পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার তখন প্রচারের ক্ষেত্রে তেমন জুতসই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারেনি। এই পত্রিকাটি কিছু অভাব মিটিয়েছিল বৈকি। তদস্থলে পাকিস্তানের প্রচার (বরং প্রচারণা) যন্ত্র ছিল সর্বগ্রাসী। ছদ্মবেশী কতাে সমর্থক দালালের কাজ করেছে, তা ঘটনা থেকে অনুমান করা যায়। মে মাসের মাঝামাঝি খবর পাওয়া গেল, রিফিউজী ক্যাম্পে দাংগা লেগে যেতে পারে। পাকিস্তান সরকারের “কতন্তুে আম” পাইকারী গণহত্যা নীতির ফলে বাংলাদেশের লাখ লাখ হিন্দু ভাই রিফিউজী ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। সেখানে জীবন-যাপন স্বাভাবিক মনােমত হবে রােজকার মতাে, এমন কল্পনা করা চলে না। এইসব অসন্তোষ স্থানীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহজে পরিখায়িত করা যায়। সাম্প্রদায়িকতা যুক্তিবিরােধী যেহেতু মানবতা-বিরােধী। “ক” নামক। দেশে “খ” সম্প্রদায় ‘গ’ সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার করেছে। সুতরাং তার বদলা নেবে ‘চ’ নামক দেশের ‘গ’ সম্প্রদায় ‘খ’ সম্প্রদায়ের উপর। এই লজিক, “রাম গেল বনবাসে বেহুলা হৈল রাড়ী” গােছের নয় কি? অথচ সেই বিষবাষ্পে অনেকে ফুসফুস বােঝাই করে।
৪৬
পাকিস্তানের ছদ্মবেশী দালালেরা এসব প্রচেষ্টা চালিয়েছিল বৈকি। আখেরে কিছু কাজে লাগেনি।
মানসিক আবহাওয়া গঠনে বর্তমান যুগে প্রচারযন্ত্র ছাড়া চলে না।
বাংলাদেশের শিশু সরকার তখন সবদিকে মুখর হয়ে উঠতে পারেনি। আধাে আধাে বােল ত বহুদুর যায় না। এই জন্যে মুজিবনগরে একটি তারিখ। অবিস্মরণীয়ঃ
১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮ সাল।
খ্রীষ্টিয় সনে ২৫ মে ১৯৭১।
এই তারিখটি অবিস্মরণীয়। আজও হাঁক-ফুকার বলা যায়, যারা ওই দিনের সড়ক পথে হেঁটেছেন, তাদের মানসপট থেকে তা কোনদিন মুছে যেতে পারে না।
তারিখটি নজরুলের জন্মদিন।
সকলেই জানে, তারিখটি নজরুলের জন্মদিন। কিন্তু শুধু কি নজরুলের জন্মদিন? জীবদ্দশায় যৌবনেই তিনি বিদ্রোহী কবি’ আখ্যা পেয়েছিলেন। জীবদ্দশায় দুরন্ত ব্যাধির দৌরাত্মে বাণীর অগ্নিগিরি নিভে গিয়েছিল। কিন্তু জাতির মাঙ্গলিক ছিল যার নেশায় ভিত্তিমূল তাঁর কী নির্বাপণ হয় কোনকালে? তারই কণ্ঠ থেকে আর্তনাদ ফেটে পড়েছিল একদিনঃ
মূর্খেরা সব শােনাে
মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন ।
এই স্বর-লাভার প্রবাহ কি সহজে থেমে যেতে পারে? অগ্নিগিরি নির্বাপণ জানে না। তার বক্ষ-কন্দরে সুপ্ত থাকে শত সহস্র অশনির জ্বালা এবং সেই তপ্ত নাদ বাতাস আলিঙ্গন মারফৎ তুলে নেয় যুগযুগান্তের প্রান্তর ভাসিয়ে দেয়ার জন্যে ।
১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮। খ্রীষ্টিয় সনে ২৫ মে ১৯৭১, শুধু নজরুলের জন্মদিন ছিল না। বজ্রগর্ভ বাণীপুঞ্জের উৎস তিনি। আর এক উৎস প্রবাহিত হয়েছিল সেদিন, যেন নজরুলের অমরতা-অভিসারী নকীব। বিদ্রোহী কবির জন্মদিনের সঙ্গে সমাপতন ঘটে “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র” এর জন্মদিবস। তা নজরুলের ব্যক্তিত্বের বিস্তার ছাড়া আর কী? দ্রোহিতার স্বরে তখন দশদিক সচকিত হতে পারে।
এই ঘটনা আপতিক, আকস্মিক কিছু নয়। বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল
৪৭
যে মুজিবনগরে, নজরুলের জন্মদিন হবে বাংলাদেশ বেতারের ভূমিষ্ঠ-লগ্ন।
কোনকালে পৃথিবীর কোন কবির তরে এমন বিস্ময়কর গৌরবময় সম্মান পৌছেছে কি না আমার নিকট অজ্ঞাত। বিদ্রোহীরা জড়াে হয়েছিল বিদ্রোহীকে ঘিরে। ঘটনাটি নজরুলের জীবদ্দশায়, আমরা জানি, ঘটল । কিন্তু তিনি তখন আপন-রচিত অন্য ভুবনের নাগরিক। অকৃতজ্ঞ কওম ঋণশােধে কাছে গেলেও অভিমানী কবি নিজের কথার অনুগামী গন্ধবিধুর ধূপের মত একাকী নিঃশব্দ পুড়তেই থাকলেন।
“স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কী?
এই বাক-মিসাইল নিক্ষেপক কেন্দ্রের কাহিনী নতুন প্রজন্মের তরুণদের নিকট অজানা । তাই আরাে কিছু যােগ করতে হয় ।
আধুনিক যুদ্ধে মারণাস্ত্রই একমাত্র অস্ত্র নয়। আকাশে বিমানের লড়াই, জলে টর্পেডাে কি সাবমেরিনের হামলা, স্থলে ট্যাংক মাইন কি পদাতিক সৈন্যের আক্রমণ, আণবিক বােমা এবং এই জাতীয় শত্রু ও নগরধ্বংসী নানা হাতিয়ার ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় হাতিয়ার মনে করা হয় মনস্তাত্বিক যুদ্ধকে, ইংরেজী ভাষায় Psychological Warfare সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার । এখন লড়ায়ের প্রকৃষ্টতম বাহন প্রপাগান্ডা। শত্রুর শিবিরে হ্যান্ডবিল, লিফলেট, প্রচার-পুস্তিকা পৌঁছে দেয়া। তা অনেক সময় সহজ নয়। কারণ, শত্রুরাজ্যের সীমান্তে বা আকাশে পৌছানাে ছাড়া তা করা যায় না। বর্তমানে টেলিভিশন এবং রেডিও এই কাজ খুব সহজে করত সক্ষম। এখানে শত্রুর সীমানায় উপনীত হবার কোন প্রশ্নই উঠে না। বিভিন্ন তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যে বেতার বাণী প্রচারিত হলেই, শত্রু বিহ্বল হয়ে উঠে।
মােদ্দা কথা, বর্তমান যুদ্ধে শত্রুর মনােবল ভেঙে দেয়ার মােক্ষম অস্ত্র বেতারযন্ত্র।
১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় ২৫ মার্চে পাকিস্তানী সৈন্যদের বর্বরােচিত হামলার তিন হপ্তা পরে। ইসলামী আবাকাবা গায়ে ভাই রূপে যারা পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিল এবং চব্বিশ বছর চালিয়ে যাচ্ছিল অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লুটপাট, তারা হঠাৎ মানুষের খােলস খুলে ফেলে জন্তুবিলীশ (জন্তু ও ইবলিশ রূপে খাড়া হবে-কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। বলাবাহুল্য, হতচকিত হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল তদানীন্তন তামাম পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা, কতিপয় মাতৃহরণকারী দালাল ও প্রভুপদলেহী অমানুষ ছাড়া। দুশমনের মােকাবিলা করা যায় আচমকা মারের চোটপাট সামলে উঠার পর।
৪৮
১৯৭১ স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর বাংলাদেশ সরকার মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত হয় হামলার তিন হপ্তা পরে। তখনও পুরােপুরি সামাল দেয়া সম্ভব হয়নি। সরকার গঠিত, তখনও তার প্রচারব্যবস্থা উহ্য। জন্তুর মােকাবিলায় বুক-টান দাঁড়িয়ে যেতে আরাে পাঁচ হপ্তা অপেক্ষা করতে হলাে। হয়ত আরাে কিছু পূর্বে তা সম্ভব হতাে। আমার ধারণা, কর্তৃপক্ষ অপেক্ষা করেছিলেন নজরুল জন্মদিনের জন্যে। জোরে ঘুষি মারতে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত পিছিয়ে নিতে হয় এবং যতাে পিছিয়ে থাকে গতিবেগের সঞ্চয়ও তত বাড়ে। আমার মনে হয়, নতুন বাংলাদেশ সরকার এই বিলম্ব মারফৎ গভীর দেশাত্মবােধ এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল। গত আটশ’ বছরে নজরুলের মত সর্বকালের এমন বাঙালী ত মুসলমান সমাজে আর দ্বিতীয় জুনুগ্রহণ করেনি। ব্যাধির খপ্পরে অগ্নিবীণকার টংকর তুলতে অক্ষম কবির প্রতি। সম্মান এই ভাবেই প্রদর্শিত হওয়া উচিত ছিল। অভূতপূর্ব এই পরিকল্পনা।
“স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র” এর জন্ম হলাে। পাকিস্তানী পয়জারের ধুলাে গা থেকে ঝাড়তে–ঝাড়তে হৃৎ-ইজ্জত বাঙালী আবার ধীরে ধীরে খাড়া দাঁড়াল (মানুষের পাঞ্জা হয়) জন্তুর থাবার মােকাবিলায়। যাদের বয়স বর্তমানে তিরিশের নীচে তাদের বুঝানাে দায় বাংলাদেশ সরকারের এই প্রচার বিভাগ শত্রুর বুকে কী তীক্ষ্ণ লৌহ-কীলক ঢুকিয়ে গােল করে বার বার ঘােরাচ্ছিল, আর অন্যদিকে পাকিস্তানী সৈন্যদের ভয়ে সংকুচিত ভয়ে সংকুচিতপেশী বাংলাদেশের অধিবাসীদের বুকে যােগাচ্ছিল অমিত তেজ এবং ফিরিয়ে আনছিল তার হতচকিত দিশা সরিয়ে স্বতন্ত্র চেতনার বন্যা, যার প্লাবন-স্নিগ্ধ অবগাহনে তারা একদম নতুন মানুষ–যাদের বক্ষপটে প্রলয়-শিখা নর্তমান। নজরুলের অনুসরণে বিষের বাঁশি বাজাতে শুরু করল “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।”
এই সময় একদম জন্মলগ্ন থেকে উক্ত কেন্দ্র থেকে একটি কথিকা প্রচার হতাে এবং নিয়মিত তার কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। কথিকার নাম “চরমপত্র”। এই কথিকাটি কোন পণ্ডিতের ভাষণ নয়, কোন ধর্মগুরুর উপদেশ নসিহত নয় । কথিকাটি বলা যায়, বিদূষকের প্রলাপােক্তি। বক্তব্যটি রসিকতার রাংতা দিয়ে মােড়া। এই রীতি অবিশ্যি শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে নতুন নয়। মূল্যবােধ যখন সামাজিক রগড়ানিতে চারদিক থেকে মার খায়, তখন উন্মাদ বিদূষক এবং জাতীয় মানুষের মধ্যে তা আশ্রয় লাভ করে। এদেশে যাত্রার দলে মাঝে মাঝে বিবেকের গানের রেওয়াজ চালু ছিল। শেক্সপিয়রের Fools আহাম্মকেরা ত মানব-সত্তার আধার। “কিং লীয়ারের” বিদূষককে কি ভােলা যায়?
“চরমপত্রের” ঘােষক সেই ঐতিহ্য পালন করেছিলেন। রসিকতায় ভরপুর
৪৯
১৯৭১ স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর সমস্ত কথকতা। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ চমকের ভেতর দিয়ে একদা সমস্ত বাংলাদেশের অধিবাসী তাদের ভবিষ্যতের সড়ক দেখতে পেতাে। রণক্ষেত্রে মুক্তিযােদ্ধা, গৃহে নীচু-গ্রামে চালানাে রেডিও সেটের পাশে সন্তৰ্পিত গােটা পরিবার কান পেতে বসে আছে। মাসের পর মাস। কথকের ভাষা বাংলা অবিশ্যি। কিন্তু কোন পণ্ডিত বৈয়াকরণিক তা বাংলা বলবে না। বাংলাদেশে যতাে রকমের উপভাষা আছে মায় উত্তরবঙ্গের “বাহে” থেকে আরম্ভ করে ময়মনসিংহ, ঢাকা, সিলেট, চাটগাঁ, নােয়াখালী, খুলনা, বরিশাল-সকল জেলার তাবৎ উপভাষার সেই ভিয়েনেই তখন বাংলাদেশের অধিবাসী চরম সঞ্জীবনী মিষ্টত্বের স্বাদ পেতে। শেক্সপিয়রে আহাম্মকের মত ঘােষকের “ছক্ক মিয়ার সওয়াল জবাব এবং মাঝে মাঝে গানের ধুয়ার মত “ক্যামন বুঝতাছেন?” প্রশ্নটি তখন মুজিবনগর কেন গােটা পশ্চিমবঙ্গে বাঙালীদের মাতিয়ে রেখেছিল। ছক্ক মিয়ার ভাষা ছিল বাঙালীর অন্তরের ভাষা। তা বুঝে নিতে দেরী হতাে না। ভাষার এই সংজ্ঞা বহু কবি সাহিত্যিকের জানা নেই।
কামরুল হাসান তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের জন্তু-সুলভ যে প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন তা অনেকে আজও দেখছেন। কিন্তু “চরমপত্রের” ঘােষক বর্ণিত “মাচুয়া”র খোজ অনেকে জানে না। এহিয়া খান, টিক্কা খান প্রভৃতি হাইওয়ান (জন্তু) সর্দারদের লেলানাে জন্তুরা “ছক্কু মিয়ার কাছে “মাচুয়া” রূপে পরিচিত ছিল এবং অবিশ্যি শ্রোতাদের নিকট। মাচুয়া মানে মােচওয়ালা।
নতুন প্রজন্মের জন্যে প্রসঙ্গ এত লম্বা করতে হলাে। আমার প্রস্তাব তাদের জন্যে “চরমপত্রের একটি সম্পাদিত ভাষ্য এবং ক্যাসেট বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে বের হওয়া অবশ্য প্রয়ােজন। নতুন প্রজন্মের তরুণেরা ঐতিহ্যের সেই স্বাদ থেকে নচেৎ বঞ্চিত থাকবে।
“চরমপত্রের” ঘােষকের পরিচয় এখন সকলে জানে। তিনি এম আর আখতার, মুজিবনগর সরকারের তদানীন্তন তথ্য পরিচালক। সাংবাদিক হলেও মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে চরমতম গৌরবময় রাজনৈতিক অভিনয় তিনি করে গেছেন, তা হয়ত ঘােষকের নিকট আজও অজানিত। আমি হলফ করে বলতে পারি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শরীক দুটি নাম জেনারেল বা সেক্টর কমান্ডারের তালিকায় কোনদিন উঠবে না। কিন্তু তারা কয়েক ডিভিশন সেনানীর ফিল্ড মার্শালতুল্য। একজন “আকাশ বাণীর” দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি মিত্রশক্তির সহায়ক সংবাদ-পাঠক রূপে নিজের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে বাঙালীর আত্মার
৫০
সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। অন্যজন “চরমপত্র”-এর ঘােষক এম আর আখতার, বাষট্টি বছর বয়সেও মুকুল।
প্রচারের দাপট কি হতে পারে তা হানাদার পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ। বেশ ভালরূপে টের পেয়েছিল। বাংলাদেশে অধিবাসীদের মধ্যে মােকাবিলার চেতনা উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল ক্রমশ দৃঢ়, অটুট। দেশের অভ্যন্তরে সাধারণ মানুষ “চরমপত্রের” রসিকতায় যেন সঞ্জীবিত থাকত। স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়ায়ের জন্যে এমন মানসিকতা গড়ে তুলতে না। পারলে শক্রর প্রচারণার খপ্পরে পড়ে যাওয়া খুব সহজ। ‘কাপুরুষ কি যুদ্ধের মুখােমুখি হতে পারে? দুশমনদের তেমন প্রচেষ্টারও কমতি থাকে না। একটি সময়ের উদাহরণ আজও দেয়া যায়, আমার মনে আছে।
বিদেশী পত্রপত্রিকায় পাকিস্তানী সৈন্যদের লুটতরাজ, পাশবিক, ধর্ষণ, গ্রামের পর গ্রামে আগুন লাগানাে বর্বরতার সংবাদ ছাপা হতে থাকে। তখন পাকিস্তান সরকার অস্বােয়াস্তি দূর করতে দালাল সংগ্রহে মন দেয়। মনে রাখা দরকার প্রচারের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রচার না থাকলে একতরফা গােল হবার সম্ভাবনা। একাত্তর সালের জুন মাসের মাঝামাঝি বৃটিশ পার্লামেন্টের তিনজন সদস্য আসে বাংলাদেশের ঘটনা সরেজমিনে তদন্তের জন্যে। জেমস টিন বা ঐ জাতীয় নামের (ঠিক মনে নেই) এক সদস্য ঘােষণাটি করলেন যে বিদেশী পত্রিকায় যা ছাপা হচ্ছে তার সঙ্গে বাস্তব ঘটনার কোন সঙ্গতি নেই। ভারতের একতরফা প্রচার সব মিথ্যে। ওই দলে এক মহিলা ছিলেন, তিনি বলেন, দুস্কৃতকারীরা রাজনীতিবিদদের উস্কানিতে এমন নৈরাজ্যিক অবস্থা দেশের মধ্যে সৃষ্টি করেছে যে ওদের শিক্ষা দিতে নির্মমতা প্রয়ােজন। অবলা মহিলার নাম মিসেস নাইট। প্রচারণার জন্য এমন হৃদয়হীনা ও মহিলা পাওয়া যায়। চা। বাগানের এক ইংরেজ অফিসারকে পাকিস্তানী সৈন্যরা হত্যা করেছিল। অবলা। বললেন যে ওকে দুষ্কৃতকারীরা ভারতে নিয়ে গেছে। মুক্তিযােদ্ধাদের তখন ইংরেজীতে পাকিস্তানীরা বলত Miscreant তার বাংলা তর্জমায় দুস্কৃতকারী।
আধুনিককালে যে কোন যুদ্ধে প্রচারের ধরন সম্পর্কে প্রত্যেকের ধারণা থাকা উচিত। তবে ওই সময় টনি ম্যাসকারেনহাস নামক এক সাংবাদিক পাকিস্তানের করাচী শহর থেকে পালিয়ে গিয়ে “সানডে টাইমস” পত্রিকায় পাকিস্তানীদের বর্বরতার প্রাত্যহিক চিত্র দিনের পর দিন তুলে ধরেন। তখন জোকগুলাের মুখে বেশ কিছু লবণ ছিটিয়ে দেয়া হয়েছিল।
এই সব পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করা উচিত “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র”
৫১
এবং প্রচারিত কথিকা “চরমপত্রের ভূমিকা।
নজরুলের জন্মদিন বলে নয়, “বাংলাদেশ বেতার” এর ভূমিষ্ঠলগ্ন হিসেবে আমার অবশিষ্ট জীবনের জন্যে অবিস্মরণীয় হয়ে রইল তারিখঃ
১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮ সাল।
যুদ্ধের মধ্যে নানা ব্যাপার বিভিন্ন দিক থেকে জড়িয়ে আসে।
অবিশ্যি জার্মান জেনারেল ক্লসউইৎস যুদ্ধের যে সংজ্ঞা দিয়েছিলেন সেই ঠাই আজও কেউ নাড়াতে পারেনি। তিনি বলেছিলেন, War is extension of politics by other means অর্থাৎ যুদ্ধ হচ্ছে অন্য উপায়ে রাজনীতি বিস্তার ।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম যে রাজনীতিরই বিস্তার তার কোন ব্যাখ্যা আজ নিপ্রয়ােজন। কিন্তু মনে রাখা দরকার, রাজনীতির মধ্যে যেসব ফোর্স এবং কাউন্টার ফোর্স চালু থাকে, যুদ্ধের ভেতর গেলেও তা একদম শেষ হয়ে যায় না । আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিলেও তার মধ্যে বিরােধী শক্তি ছিল যা মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এগিয়ে যেতে চায়নি। কিন্তু স্রোতের টানে তাদের দল ছেড়ে কোথাও যাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। এই শক্তি ভেতর থেকে তখন মুক্তি সংগ্রাম বানচাল করার কৌশল গ্রহণ করে। বিভীষণের ভূমিকা সেখানে। আরাে স্মরণীয় ১৯৭১ সালে ভূমণ্ডলীয় রাজনীতি দুই শিবিরে বিভক্ত ছিল। একটি পুঁজিবাদ, অন্যটি সমাজতন্ত্রের সমর্থক। বাংলাদেশ ত আর পৃথিবীর বাইরের কোন দেশ নয়; সুতরাং শিবির রাজনীতির খোচা না খেয়ে উপায় ছিল না। সােজাভাবে বলা যায়, রাশিয়া এবং আমেরিকা তখন বিশ্ব রাজনীতির দুই কর্ণধার। আপন মণ্ডলের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা দুই দিকেই সমানভাবে নিয়ােজিত। এই টাগ.-অফ-ওয়ার থেকে কাছিটানাটানি থেকে কারাে রেহাই ছিল না। সমাজতন্ত্রী হলেও চীনের নেতাদের। তদানীন্তন ঘূণ্য ভূমিকা বহু বাংলাদেশীর সমর্থনপুষ্ট তখন।
তাই নানা চোটপাট যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর দিয়ে। কখনও ধুয়া উঠল, বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়া হােক, মুক্তিযুদ্ধের প্রয়ােজন নেই। তিনি রাজনৈতিক সমর্থনপুষ্ট তখন।
তিনি রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান দেবেন। নয় মাস ধরে মাঝে মাঝে নানা জিগীরের রূপ বদলাতে দেরী হতাে না। শেষ চেষ্টা বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের (রাষ্ট্রমৈত্রী) ভিত্তিতে সমঝােতায় আসা যাক এবং মুক্তিযুদ্ধের অবসান ঘটুক। এক কথায়, রাজনৈতিক চালের অভাব ছিল । কারণ, আন্দোলনের মধ্যে যুযুধমান সােশ্যাল ফোর্স।
৫২
এইসব রাজনৈতিক চড়াই-উত্রাইয়ের কাহিনী ঐতিহাসিক ও সমাজতত্ত্ববিদগণের নিরীক্ষার ব্যাপার। আমার নােটে মাঝে মাঝে সংক্ষেপে উল্লেখ আছে। তা এতই সংক্ষিপ্ত যে কুড়ি বছর পরে আর স্মৃতি উদ্ধার অসম্ভব। অনেক নাম লেখা আছে আদ্যাক্ষরে তাদের নাম এখন সবাই জানে। এদেশে মীর জাফরের পর ঘৃণ্য নামই সব নাম। আমার কলমের ডগায় তাদের তুলতে আমি অক্ষম। গায়ে কয়েকটা কেঁচো উঠলে যে শারীরিক প্রতিক্রিয়া ঘটে আমার প্রায় তেমনই হয়। মােদ্দা কথা মীর জাফরের বংশধরগণ ত নিশ্চিহ্ন হতে পারে না। অস্তিত্বের শর্তে বােধ হয়, আদম এবং শয়তান ছাড়া ইতিহাস অচল।
পুরাতন নােটগুলাে সামনে রেখে আজ অনেক কথা মনে পড়ে, আবার বিস্মৃতির অন্ধকারে কিছু কিছু হারিয়ে যায় ।
জুন মাসে আমার গতিবিধি বেশির ভাগ নিবদ্ধ ছিল লেখালেখির উপর। জুলাই মাসের স্মৃতি-চয়ন পাঠকের তরে পরিবেশিত।
১৯৭১
১ জুলাই
কাল সন্ধ্যায় শ্রদ্ধেয় সৈয়দ মুজতবা আলীর নিকট গিয়েছিলুম। বলে রাখা যায়, খ্যাতনামা রম্যরচনার যাদুকর হিসেবে পরিচিত হওয়ার ষােল বছর আগে থেকে আমি ওঁকে চিনি। আমি তখন মাত্র ক্লাস নাইনের ছাত্র ১৯৩২ সন। যােগসূত্র আবু সয়ীদ আইয়ুব। বর্তমানে নিকটে থাকেন, পাঁচ নম্বর পার্ল রােড, পার্ক সার্কাস এলাকা, আমার ডেরার সন্নিকট। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম তিন মাস ধরে চলছে। সিতুদা’ (মুজতবা আলীর ডাক নাম) কিন্তু একদম নীরব, নিঝুম। একই বাড়িতে ওঁরা দুই বন্ধু থাকেন। দোতলায় আবু সয়ীদ আইয়ুব, তেতলায় সৈয়দ সাহেব। দোতলার বন্ধু দেদার বাংলাদেশে মিলিটারী (Junta নয়) জন্তুদের বিরুদ্ধে সােচ্চার। কিন্তু সিতুদা চুপচাপ। কৌতূহল স্বাভাবিক। তাঁর মত নামী লেখকের ভার ত কম নয়। আমাদের বড় কাজে লাগে। সৈয়দ মুজতবা আলী বললেন, “আমার দুই ছেলে ওদিকে পড়ে আছে, ভাই।” পিতৃহৃদয় অন্যায়ের সম্মুখে নীরব । আমার কিছু মন্তব্য ছিল না। আমি তখনও বেতার বা সংবাদপত্রে বিবৃতি দান থেকে অনেক দূরে ছিলুম। অন্যান্য কাজ করতুম। কিন্তু বাংলাদেশ বেতারের কাছে ঘেঁষতে পারিনি। আমার মেজ ছেলে আসফাক ওসমান ওই দিকে পড়ে আছে। সে তখনও সীমান্ত পার হয়নি।
৫৩
১৯৭১
২ জুলাই
বুকে বল ক্রমশ ফিরে আসছে। রণাঙ্গন থেকে বাহিণীর অকুতােভয় গতিবিধির কাহিনী শুনে শুনে মনে হয় ক্রমশ বিস্তার এই প্রতিবাদ প্লাবনের মুখে জুলুমশাহী ভেসে যাবে, ভেসে যেতে বাধ্য….
প্রচুর চিঠি পাই হিতাকাক্ষীদের কাছ থেকে। তাদের সকলের জবাব দিতে পারিনি সময় মত। বিপদের দিনে যারা স্মরণ করে এবং সমব্যথীজনের সাড়া দেয়, তাদের চিঠির উত্তর না দেয়ার মত অশােভন অসৌজন্য আর কিছু হতে পারে না। তবু নাচার, মাঝে মাঝে লজ্জায় মাথা হেঁট করে থাকি। কাল কিছু পত্রের জবাব দেবই, কাজের চাপে যতই মুখ থুবড়ে পড়ি না কেন?
১৯৭১
৩ জুলাই
৩ জুলাই ‘৭১
মে মাসের ১১ তারিখে শ্রী গােপাল বিশ্বাস, যিনি চট্টগ্রামের অধিবাসী এবং সকল সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক কর্মে আমাদের দোসর ছিলেন, রিষড়া হুগলী থেকে লিখছেন, “আশীষ এবং তার ছােট ভাই ভিন্ন পথে সীমান্ত পেরিয়ে চাটগাঁ থেকে কাল আমার কাছে এসে পৌছেছে। ওদের বাড়িঘর লুটপাট এবং শেষ পর্যন্ত জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ঘরছাড়া করে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে। আরাে মর্মন্তুদ বর্ণনা গােটা পরিবারের কেন্দ্রে। গােপাল বাবুর চিঠির জবাব আগে দেয়া উচিত। দু’মাস হয়ে গেছে। তাই প্রথমে ওকে লিখলুম।
* (আশীষ বর্তমানে বাংলাদেশের সুপরিচিত শিল্পী আশীষ চৌধুরী)
……………………………………………………
কয়েকদিন পূর্বে পেয়েছি অধ্যাপক আমীর আলীর চিঠি । এই স্নেহভাজন, জগন্নাথ কলেজে ইংরেজীর অধ্যাপক ছিল। ইংলন্ডে যায়। কয়েক বছর পূর্বে । আমীর আলী লিখেছে যে মুক্তিযুদ্ধের জন্যে ওরা একটা বাংলা পত্রিকা বের করতে চায়। বাংলা টাইপরাইটারে টাইপ করে পরে অফসেট লিথাে প্রিন্টিংয়ে তা ছাপা যেতে পারে। ভারতে টাইপরাইটার পাওয়া যায়। তা পাঠাতে পারব কি না। ওরা কোন রকম Key Board ব্যবহার করে। আমি ১৯৬৪ সালে
৫৪
ইংল্যান্ডে থাকাকালীন রেমিংটন কোম্পানীর সঙ্গে যােগাযােগ করি। তখন আমি একটা Key Board-এর ছক কাটি যেন যুক্তাক্ষর ইত্যাদি ছাপার সুবিধা হয়। আমীর আলীকে তারই একটা কপি পাঠাব।…
আমীর আলী আর এক পত্রে জানাচ্ছে যে ওরাও ‘জয় বাংলা’ নামে এক পত্রিকা বের করেছে। তার হেতু নির্ণয়ে অধ্যাপক আমীর আলী লিখছে, “..এই সংগ্রাম দীর্ঘায়িত হতে পারে। প্রবাসী রাজধানীর মধ্যে সেই সংগ্রামী চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমরা নিয়েছি।”
স্নেহভাজনের আরাে কয়েকটি পংক্তি মনে রাখার মত… “চীনের কথা আর কী বলব? আমার অভিযােগ হচ্ছে যে, সমস্ত “মার্কসবাদী” চীনের সঙ্গে মার্কসবাদকে একাত্ম করে ফেলেছে। আর তারা এখানেও সক্রিয়। এই মুহুর্তে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি চীনের দৃষ্টিভঙ্গীর আর আচরণে কোন মার্কসবাদী নেই। মানবতা আছে বলেও মনে হয় না।”…
১৯৭১
৪ জুলাই
কাল আরাে কাজের চাপে সব চিঠির জবাব দিতে পারিনি। একটি চিঠি পেয়েছি। আমি ভদ্রলােককে চিনি নে। কিন্তু চট্টগ্রামের বাঁশপাড়া জমিদারদের এক বংশধরের সঙ্গে আমার বেশ পরিচয় ছিল। নাম বিনােদ বিহারী চৌধুরী। এই ভদ্রলােক তার সাক্ষাৎ ছােট ভাই। সব পরিচিতদের কুশল জানার কৌতুহল ত সেকালে অস্বাভাবিক ছিল না। তার উপরে পাকিস্তানের হিন্দু নাগরিক হলে ত কথাই নেই। ভদ্রলােক লিখছেন, “বিনােদদা’ ওরা সকালে ২৮ মার্চ চট্টগ্রাম শহর ত্যাগ করিয়া পটিয়ায় আমাদের এক চাকরের বাড়ি চলিয়া যায়। সেখানে ৮/১০ দিন থাকার পর নিরাপত্তার অভাব মনে করিয়া আমাদের এক কর্মচারীর বাড়ি চলিয়া যায়। ধলঘাট হইতে রামগড় হইয়া আগরতলা আসিবার চেষ্টা করিয়াছিল কিন্তু গহিরা পর্যন্ত আসিয়া আবার ফিরিয়া গিয়াছে। গােবির (দাদার ছেলে) ছেলে খুব অসুস্থ ছিল। ঝড় বৃষ্টি হইতেছিল। বােধ হয়, এই কারণে ফিরিয়া গিয়াছে। 18th April তাহাদের ধলঘাটে রাস্তার ধারে দেখিয়াছে, এমন একটি লােক আগরতলা আসিয়া আমাদের এই খবর দিয়াছে। গােবির সঙ্গে লােকটির কথাবার্তাও হইয়াছে। এই লােকটি বলিল, বিনােদ বাবুরা হাঁটিতে পারিতেছেন না-তাহারা গাড়ির সন্ধান করিতেছেন কিন্তু গাড়ি পাওয়া
৫৫
অসম্ভব ।… ভগবান তাদের রক্ষা করুন-এই প্রার্থনা করা ছাড়া আর কীই বা করিতে পারি আমরা…।”
১৯৭১
৫ জুলাই
আমীর আলীর জন্যে বাংলা টাইপরাইটারের কীবাের্ড (Key Board) স্মৃতি থেকে আবার ছকে গেল। এটা পাঠিয়ে দিতে হবে, যদি ওদের কোন কাজে লাগে। ১৯৬৪ সালে ইংলন্ড প্রবাসকালে রেমিংটন কোম্পানীর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলুম। তখন একটা PORTABLE বাংলা মেশিন ওদের বাজারে চালু ছিল। কিন্তু তার নানা অসুবিধা। তাই আমি একটা কীবাের্ড বানিয়ে ওদের দেখাই। তখন ওরা আর এসবে মাতল না। আমাকে স্তোক দিয়েছিল, যদি ওরা পুনরায় ম্যানুফ্যাকচার করে তাহলে আমার সঙ্গে যােগাযােগ হবে। কিন্তু ওরা চুপই থেকে গেল।
দেখা যাক, বাংলাদেশের তুমুল এই দুর্দিনে এবং বিশ্ববাসীর চোখের দিকে তাকিয়ে হয়ত কোম্পানী এগিয়েও আসতে পারে। মেশিনের যুগে শুধু হাতের উপর নির্ভর করা মূর্খতা। আমীর আলীকে ধন্যবাদ পুরাতন সমস্যা জাতীয় সংক্রান্তিকালে জিইয়ে তুলেছে।
১৯৭১
৭ জুলাই
সেজ ছেলে ইয়াফেস ওসমানের চিঠি পেলাম লােক মারফত। বাড়ির খবর
৫৬
পাওয়া গেল। মেজ ছেলে আসফাক আসতে রাজী হয়েছে। শিল্পী আলভির সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। আরাে কয়েকজনের খবর পাওয়া গেল। শুভ রহমান ও রশীদ সিনহা আগরতলা পৌঁছেছে। চিঠির ঠিকানা দিয়েছে ইয়াফেসঃ ক্রাফটস হস্টেল, মঠ চৌমুহনী, আগরতলা, ত্রিপুরা। এবং এই ঠিকানায় যােগাযােগ করতে বলেছে। ওর ত মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে অন্যত্র থাকার কথা। পত্রে লিখেছে, আসার সময় ট্রেনে বিশেষ অসুবিধা হয়েছে চোখ উঠায়। ওর শরীর কেমন কে জানে? ইয়াফেস আরাে লিখেছে, “বাংলাদেশ থেকে আমাদের সমর্থক ও কর্মী হাজারে হাজারে আসছে। গ্রামের দিকে অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। যুবকদের খুঁচিয়ে জ্যান্ত কবর দেয়ার ফলে অবস্থার আরাে অবনতি হয়েছে। ফলে সবাই আজ গ্রাম ছেড়ে এদিকে চলে আসছে।”
হত্যার এই দানবীয় পন্থা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হিটলারের সৈন্যদের কাছে খুব স্বাভাবিক ছিল। কবরে যাওয়ার পূর্বে কবরটা খুঁড়ে যাও যেন অন্যের আর কোন তকলীফ না হয়। কিন্তু পবিত্র ইসলামের নামে প্রতিদিন যারা শপথ নেয় তারাও এই পন্থা অনুসরণ করছেন। বর্বরতার এই নজির ইতিহাসে বিরল। ভণ্ডের ছদ্মবেশ অন্তহীন । জপমালা হাতে বেশ্যাদের দেখেছি গঙ্গাস্নানে যেতে।
১৯৭১
৮ জুলাই
গেরিলা যুদ্ধের কায়দায় বাংলাদেশে মুক্তি সংগ্রামের চাপ ক্রমশ দুশমনরা টের পাচ্ছে। বিদেশী সাংবাদিকদের কল্যাণেই এই খবর ছড়িয়ে পড়ছে। মুক্তিযােদ্ধারা আর যা-ই হােক দুষ্কৃতকারী নয়, বিশ্বের সৎ মানুষদের কাছে প্রতিভাত।
এগারােটি সেক্টরে বিভক্ত বাংলাদেশের রণাঙ্গন। প্রতিদিন যুদ্ধের খবরের দিকে প্রথমে মনােযােগ ধাবিত হয়। খারাপ খবর থাকে পাকিস্তানের বেতারে । মুক্তিযােদ্ধাদের তারা “হালাক” (ধ্বংস করছে। তাই শত্রুদের বেতার শােনা আজ কদিন ছেড়েই দিয়েছি।
……………………………………………
হঠাৎ “দেশ” সম্পাদক সাগরময় ঘােষের চিঠি পেলুম ডাকে। সাধারণত অফিসের পিয়ন নিয়ে আসে। দুর্দিনে স্বাভাবিকতা একটু চিড় খেলে আশংকা জাগে মনে। সম্পাদকের নিকট বিকেলে ছুটে গিয়েছিলুম। পুজোর উপন্যাসের
৫৭
কাজ যেন থেমে না যায়, তাই নিঃশংক হতে (অথবা আমাকে নিঃশংক করতে) সাক্ষাতের তাড়না।
……………………………………
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কিছুদিন হাওড়া শহরবাসী ছিলুম। সেখান থেকে আমরা কয়েকজনে একটি মাসিক পত্রিকা বের করতাম। নামঃ অভিবাদন–শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সম্পাদক। যথারীতি ছিল দেশবিভাগের পরও শান্তির সঙ্গে যােগাযােগ। ১৯৫৪ সনে ঢাকায় সাহিত্য সম্মেলনে তিনি যােগদান করেন। “আনন্দ বাজার পত্রিকায় বর্তমানে কর্মরত। ফেরার সময় শান্তিরঞ্জনের সঙ্গে কিছু কালক্ষেপ করে বাড়ি ফিরলুম।
১৯৭১
৯ জুলাই
নানা কাজে একসঙ্গে লিপ্ত থাকলে অনেক অস্বােয়াস্তি। পূজা সংখ্যার জন্যে উপন্যাস রচনা মাথার উপর বড় খাড়া। নিজের পারিবারিক পরিচর্যা ত একদম অবহেলা করা চলে না। দায়িত্ব কিছু কিছু পরিস্থিতি গুণে দেখা যায় ।
বড় খারাপ লাগল। এখানে আজ বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির উদ্যোগে মিছিল বেরুনাের কথা। উদ্দেশ্য মার্কিন দূতাবাসের সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শন। বর্তমানে হাে চি মীন স্ট্রীটে মার্কিন দূতাবাস অবস্থিত। ইতিহাস করােট ফেরে দেখা যায় অনেক সময় রাস্তাঘাটের নাম বদলের ভেতরে। পূর্বে ছিল ইংরেজ আমলে এক ইংরেজ ভদ্রলােকের নামে হ্যারিংটন স্ট্রীট। রাজনীতির স্রোতে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠিত। নাম তাই ভিয়েতনামী প্রেসিডেন্টের! সবচেয়ে পরিহাসের ব্যাপার মার্কিন সরকারকে প্রতিদিন হাে চি মীনের নাম উচ্চারণ করতে হয়, যিনি সাম্যবাদের উৎসর্গিত জন এবং বিপরীত মেরুতে অবস্থানকারী।
খবর পেলাম, কংগ্রেস, কম্যুনিস্ট এবং অন্যান্য পার্টির বিশিষ্ট নেতারা মিছিলে যােগদান করেন। দূতাবাসের প্রধানকে অভিযােগলিপি দেয়া হয়। গণহত্যা এবং পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার দাবি ছিল যেখানে বিশেষভাবে উল্লেখিত। বলাবাহুল্য মুজিবনগরের অনেক অধিবাসী মিছিলে যােগদান করে। আমিই গরহাজির।
৫৮
১৯৭১
১০ জুলাই
‘দন আগে টেলিগ্রাফিক লেনদেনে আবু রুশদ একশ’ পঁচিশ ডলার পাঠিয়েছিল। চারের দশকে একত্রে সাহিত্যসেবা শুরু করেছিলাম। বন্ধুত্বের গােড়া সেইখানে । তিরিশ বছরে গােড়াটা যথাস্থানে আছে। অসংখ্য শিকড়সহ । আমি সপরিবার পলাতক, নিরাশ্রয়। অতএব সাহায্য যতাে দ্রুত পৌছায়। বন্ধুবরের সিদ্ধান্ত ওই পথেই ধাইছে বেশ বােঝা যায়। আজ পেলাম ওর চিঠি।
সাহিত্য-সতীর্থরূপে ছাড়া মানুষ হিসেবে আবু রুশদকে ভালভাবে জানা। এখনও চাকরির ভেতরে আছে। পাকিস্তান দূতাবাসে সাংস্কৃতিক বিভাগ অ্যাটাচি। কিন্তু লেখকসত্তা তাকে কী যন্ত্রণার রগড়ানি দিচ্ছে তা আমি আঁচ করতাম সহজে। লেখক আবু রুশদের স্বীকারােক্তি পত্রে স্পষ্টঃ
‘এখানে আমরাও বড় মনের জ্বালায় আছি। প্রত্যেকে যতােটা পারি দেশের মঙ্গলের জন্যে পৃথক ও সম্মিলিতভাবে করে যাই। আমাদের প্রত্যেককেই সন্দেহের চোখে দেখা হয়। ইতিমধ্যে দুজন বাঙালী অফিসারকে বদলী করা হয়েছে। * করিম সাহেব, আমি ও এক বাঙালী অফিসার এখনও অক্ষত আছি। তবে করিম সাহেব বেচারা হৃদরােগে আক্রান্ত হয়ে আবার হাসপাতালে। এখানে খবরের কাগজে, রেডিও ও টেলিভিশনে আমাদের দেশ সম্বন্ধে খবর বেশ সহানুভূতির সঙ্গে পরিবেশিত হয়েছে ও হচ্ছে। ইউরােপে সহানুভূতি আরাে বেশি। জুলুমকে প্রতিরােধের জন্যে দেশের অভ্যন্তরে ও তােমাদের ওখানে কি প্রস্তুতি হচ্ছে জানি না।”
পত্রে বিদেশে আমাদের প্রতি মানুষের কি দৃষ্টিভঙ্গী, তা জানা যায়। মার্কিন সরকার ত পাকিস্তানের পোঁ ধরা গােলাম বলা চলে। তা নিয়ে আদিখ্যেতা করে কোন লাভ নেই। জনসাধারণ আমাদের দিকে আবু রুশদ প্রদত্ত এই সংবাদটি যথেষ্ট মন চাংগা করে রাখার জন্যে। বন্ধুও সেদিকে বিরাট নিসংশয়। লিখছে, “তবে আমার নিশ্চিৎ বিশ্বাস স্বাধীন ও মুক্ত পরিবেশে তােমার সঙ্গে আবার দেখা হবে। দেশের অভ্যন্তরে প্রতিরােধ কি স্তরে গেছে তার জন্যে রণাঙ্গন পত্রিকার রিপাের্টগুলাে রুশদকে রােজ দিতে পারতাম। এক এ্যামবুশে পাকিস্তানী জওয়ানরা নয়, কতো অফিসার প্রতিদিন মারা যাচ্ছে তারা ত জানে না।
————————————
* করিম, এনায়েত করিম । স্বাধীন বাংলায় বৈদেশিক সচিব।
————————————-
৫৯
১৯৭১
১১ জুলাই
** ডক্টর মজিবর রহমান খান জাতিপুঞ্জের উন্নয়ন বিভাগে উঁচু পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ৭১ সনে ওর কর্মস্থল ঃ এডেন নগর। দেশ-বিদেশের খবর সবই পান। আমার সঙ্গে জুন মাসে পত্র মারফত যােগাযােগ ঘটে। তিনিও ভয়ানক আশাবাদী। এডেন থেকে লিখছেন, “বাংলাদেশ শুধু আর নিছক স্বপ্ন নয়। তার অব্যর্থতা আজ বিশ্বমত স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছে। তবে রেহমান সােবহান জাতীয় লােকেরা আজও বৃথা স্বপ্ন দেখিতেছে যে, বিশ্বশক্তিরা আমাদিগকে উদ্ধার করিবে। আমাদের দাসত্বের শিকল আমাদেরই ছিড়িতে হইবে। আপনি নিশ্চয় মুক্তিফৌজের’ Offensive সংগ্রাম পর্যবেক্ষণ করিতেছেন। উৎপীড়িতের ক্রন্দনরােল আজও আকাশে-বাতাসে ধ্বনিতেছে বটে, তবে আজ হােক আর | কাল হােক অত্যাচারের খড়গহস্ত ভীম রণভূমে আর ধ্বনিতে সক্ষম হইবে না। মুক্তিফৌজের মাধ্যমে বাঙালী পুনর্জন্ম লাভ করিবে, সেইটা আমার বিশ্বাস।
**“একেয়েম দৈহিক নিরাপত্তায় আছে। গােলামির চাইতেও অপমানজনক জীবন। দুঃখ-রাত্রির অবসান না হওয়া পর্যন্ত যেন বিপদ না ডাকে সেই খবর পাঠাইয়াছি। ** রশীদ RASCHID কে STATE BANK গভর্নর পদ হইতে সরান হইয়াছে। এইভাবে আরাে অনেককে সরানাে হইতেছে… সীমান্তে র First hand খবরের একান্ত প্রয়ােজন।”…
আবার দুঃসংবাদও পেলাম আমীর আলী লিখছে লন্ডন থেকে “…আমরা জয় বাংলা নাম দিয়ে যে পত্রিকাটি বের করতাম সেটা নানা কারণে বন্ধ করে দিতে হয়েছে।”
বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন যে, বাঙালী যখন একা লড়ে সে একশ’ জনের মত লড়ে আর যখন একশ’ জন একত্রে লড়ে তখন সে একজনের সমানও সক্রিয় নয়। পুরাতন কথা আবার মনে পড়ল ।
** একেয়েম -প্রখ্যাত প্রশাসক একেয়েম আহসান
** RASCHID মাহবুব রশীদ খ্যাতনামা ব্যাংকার
** ডক্টর মুজিব। শেষােক্ত দুইজন বর্তমানে পরলােকবাসী।
১৯৭১
১২ জুলাই
আবু রুশদের পত্র থেকে জানা যায়, এনায়েত করিম হৃদরােগে শয্যাশায়ী। তাই
৬০
ওকে আজ পত্র লিখুলম। পাকিস্তানী বৈদেশিক বিভাগের মিনিস্টার করিম। চাকরির ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ কত উজ্জ্বল। স্নেহভাজনের মানসিক অবস্থা আমি আঁচ করতে পারি। ঢাকা বাের্ডে ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিল, মেধাবী ছাত্র! সেদিকেও উজ্জ্বল রেকর্ড। মধ্যবিত্ত জীবনের নিরাপত্তাভােগী কে ভবিষ্যতের তােয়াক্কা রাখে না? তবে মানুষ এনায়েত ৩ আমার চেনা। ওকে পত্রে নানা কথা বলার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের চারটি পংক্তি তুলে দিয়েছিলুম ঃ
জমা হয়েছিল আরামের লােভে
দুর্বলতার রাশি।
লাগুক তাহাতে লাগুক আগুন
ভষ্মে ফেলুক গ্রাসি।
**************
ভারতীয় পার্লামেন্ট খুব সরগরম। মার্কিন সিনেটর ফ্রাংক চার্চ তথ্য ফাঁস করে দেন যে প্রেসিডেন্ট নিক্সন পাকিস্তানকে ৩ কোটি ৫৫ লক্ষ ডলার মূল্যের যুদ্ধোপকরণ সাহায্য দেবে। ৭১-এর দান। ৭২ সনে দেবে ৫২ কোটি ডলার । ভারতীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা তাই আশংকা করেন যে এই যুদ্ধোপকরণ শুধু বাংলাদেশে গণহত্যা বৃদ্ধি করবে না ভারতের শান্তির প্রতিও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী উভয়ে প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়। একদা ফরিদপুর জেলা নিবাসী অর্থাৎ একদা-বাংলাদেশ নিবাসী, বর্তমানে ভারতীয় (লােকসভা) পার্লামেন্টের সদস্য শ্রীসমর গুহ এক প্রবন্ধই প্রকাশ করে বসলেন, রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্নে। তিনি লিখলেন সমস্ত ভারতবাসী যখন স্বীকৃতি দিতে একমত, তখন ভারত সরকার নীরব কেন? তিনি আরাে প্রস্তাব দিলেন যে, স্বীকৃতি দিলে আগত রিফিউজীদের ভেতর থেকে গেরিলা বাহিনী গড়ে তুললে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আরাে ত্বরান্বিত হবে।
এই নৈতিক সমর্থন দুর্দিনে বড় কাজে লাগবে। অবিশ্যি গেরিলা বাহিনী ইতােমধ্যেই পাকিস্তান সরকারের বেশ শিরঃপীড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে, বলা বাহুল্য।
১৯৭১
১৩ জুলাই
বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে মুক্তিবাহিনীর যেসব কাহিনী এসে পৌছাচ্ছে, তা
৬১
বুকে প্রচণ্ড আশার সঞ্চার করে। উত্তরবঙ্গে-দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট এবং দক্ষিণে বরিশাল ও অন্যান্য সকল এলাকায় মুক্তিবাহিনী সংঘটিত সেক্টরগুলাে শুধু নামমাত্র সেক্টর নয়। দেশপ্রেমের আগুন এইভাবে মানুষকে সংহত করে। ভিয়েতনামের জেনারেল গিয়াপ ছিলেন পেশায় স্কুল মাস্টার। ফরাসীদের মােকাবিলায় উত্তরকালে শুধু জেনারেল হলেন না, উন্নত সভ্যতার ও হাতিয়ারে ধ্বজাধারী ফরাসীদের দিয়েন বিয়েন ফু রণপ্রান্তরে এমনই মার দিলেন যে তিনি রণবিশারদগণের নিকট সর্বকালের জেনারেলরূপে পরিগণিত। জালেমেরা তা মনে রাখে না।
১৯৭১
১৬ জুলাই
সাপ্তাহিক “অমৃত” পত্রিকা থেকে কবি মনীন্দ্র রায় পুজোসংখ্যায় লেখার জন্যে পত্র দিয়েছেন। পঁচিশে জুলাইয়ের মধ্যে পাঠাতে হবে। অর্থাৎ নয় দিন হাতে সময়। কবি এখন সাপ্তাহিকের তত্ত্বাবধায়ক । ভাবলাম রসিকতা করেছেন তিনি নচেৎ মার্জিন অত কম কেন? দেখা গেল, দু-মাস আগের চিঠি আজ হাতে পৌছাল। ডাক-বিভাগ সর্বত্র ডাকিনী-বিভাগ। একদিক থেকে বাঁচা গেছে। এত লেখা সম্ভব হতাে না। অথচ অসম্মতি অসৌজন। খবর পেলাম, চীনপন্থী কয়েকটি দল সমন্বয় কমিটি গঠন করেছে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের জন্য। আল্লা, ওদের এতদিনে সুমতি দিয়েছে। প্রায় ডজন খানেক চীনাপন্থী দল। মৌলানা ভাসানী নাকি ইমাম। গণহত্যাকারীর সমর্থকরা যদি সমাজতন্ত্রী হয়, তাহলে শয়তানের পুণ্যবান হতে আর বেশী দেরী নেই। মানবতাবাদের শেষ বিন্দু যেখানে মুছে গেছে, সেখানে সমাজতন্ত্রের কথা আসে কীভাবে? চৈনিক নেতাদের এই চেলাসমূহকে জিজ্ঞেস করতে হয়, তারা কি মার্কসবাদের বিকাশের পটভূমি কিছু জানে?
মে মাস পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে সিপিয়েম সরকারের কিছু কিছু নেতা চৈনিক সাম্যবাদের দিকে ঈষৎ ঢলেছিল তখন নাকি এখানে শ্লোগান ছিল, “ইন্দিরা এহিয়া এক হ্যায়।” ইন্দিরা গণতান্ত্রিক (যত খারাপই হােক না কেন) নির্বাচনে রাষ্ট্রের প্রধান, এহিয়া খান স্বৈরাচারের নিদর্শন। দুই এক হয় কী করে? মার্কসবাদ কোথায় এলাে? শয়তান নাকি স্বার্থ উদ্ধারে বাইবেল আওড়ায়।
৬২
১৯৭১
১৭ জুলাই
মুক্তিযােদ্ধারা অ্যান্টি ট্যাংক মাইনও এখন ব্যবহার করছে। এসব হাতিয়ার সংগ্রহ ত রীতিমত যােগসাজশের ব্যাপার। বিস্তারিত খবর পেতে কৌতুহলী । তা না পাওয়া গেলেও আবহে আনন্দের রেশ বহুক্ষণ ধরে থাকে।
জয় বাংলা।
১৯৭১
১৮ জুলাই
কী কুক্ষণে পুজো সংখ্যায় উপন্যাস রচনার কথা দিয়ে এসেছিলুম। অনেক সময় আত্মস্থ হওয়া দায়! একদম নিরিবিলি ত থাকা যায় না। চার তলায় গুদাম:-সদৃশ ঘর, অবিশ্যি খােলামেলা। পুরাতন পরিচিত জন দেখা করতে আসে। যেমন পরশু আশিস ভট্টাচার্য এসেছিল। সেন্টজেভিয়ার্স কলেজে চার বছর ১৯৩৪-৩৮ বিএ পর্যন্ত সহপাঠী । তুই-তুকারি সম্পর্ক। আশিস ভট্টাচার্য সাংবাদিক। পেশা : সূত্রেও ত আসতে পারে। এমন অনেকে ঢু মেরে দেয়। কবি মহাদেব সাহা পরিবারের অন্যদের দিনাজপুর রেখে মুজিবনগর এসেছে। স্নেহভাজন। তবু তাকে কি পত্রপাঠ মাত্র বিদায় করা যায়? কাজ বন্ধ রাখতে হয়। পরে রচনার খেই ধরা কঠিন। তখন আবার সময় বৃথা যায়।
১৯৭১
১৯ জুলাই
কাল লন্ডনে হাইড পার্কে জনসভায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ভাষণ দেন। বাঙালী স্বভাবতই শান্তিপ্রিয়। এহিয়া খান তবু তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনিয়ে নিতে এই নিধনযজ্ঞে নেমেছে।
এই মর্মে চৌধুরী বক্তৃতা করেন। মােকাবিলা চলছে, চলবেই।
১৯৭১
২৩ জুলাই
বামপন্থী ছাত্রফ্রন্ট আজ মার্কিন তথ্য কেন্দ্রের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এই
৬৩
সমাবেশও বেশ বিরাট হয়। এখানেও প্রতিবাদের ধ্বনি ওঠে পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে।
১৯৭১
২১ জুলাই
দুই গােলার্ধে যেখানে যতাে দেশপ্রেমিক বাঙালী আছে তাদের সংগঠিত হওয়ার খবর নিয়মিত আসছে। তিন মাসের মধ্যেই প্রতিরােধের স্রোত এমন প্রবল ধারায় পরিণত। এই আশার উপর ভরসা করে থাকা যায়। বাংলাদেশের পরাধীনতা ঘুচতে বাধ্য।
১৯৭১
২২ জুলাই
আগরতলা থেকে ১৮ তারিখে লেখা সেজ ছেলে ইয়াফেসের পত্র আজ পেলাম। মন খারাপ হয়ে গেল। জানতে পারলুম, আমার মেজ ছেলে আসফাকের কাছে তিনবার লােক পাঠানাে হয়েছে, কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।
ইয়াফেস আরাে লিখেছে, “আমি দু-এক দিনের মধ্যে এখান থেকে চলে যাব Training শেষ করার জন্যে। কোথায় যাব জানি না। তবে আগরতলা থেকে ৪/৫ দিনের পথ। …মাকে চিন্তা করতে মানা করবেন। আমার শরীর বেশ ভালই আছে।… যেখানে যাব সেখান থেকে চিঠি লেখা সম্ভব নয়, যাওয়া যাবে না। হারুন চাচার সাথে দেখা হলে খবর পাবেন।” * হারুন : ন্যাপ হারুনর রশিদ
১৯৭১
২৩ জুলাই
কাদের সিদ্দিকীর কাহিনী নানা সূত্রে ভেসে আসে। এগারােটি সেক্টরের বাইরে তিনি নিজে উদ্যোগ নিয়ে টাঙ্গাইল এবং আশপাশের এলাকায় মুক্তিবাহিনীর দল সংগঠিত করেন। এই বাহিনীর অকুতােভয় নানা দুর্ধর্ষ হামলার কাহিনী
৬৪
১৯৭১ স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর অবিশ্বাস্য মনে হয়। আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়ানাে ত সহজ নয়। অবিশ্যি গেরিলা যুদ্ধ আর এক ধরনের যুদ্ধ। সেখানে সত্তাও অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণ যুদ্ধের নিয়ম এমন জায়গায় খাটে না। যুদ্ধবিজয়ী ইংরেজ নেতা ক্রমওয়েল গেরিলা বাহিনীর কাছে নাজেহাল হয়ে বলেছিলেন যে এমন যুদ্ধের সঙ্গে তার পরিচয় নেই, যদিও তিনি সৈনিক। কাদের সিদ্দিকী রণবিদ্যার গুরু হয়ে থাকলে, অবিশ্বাস্য নানা কাণ্ড ঘটতে পারে।
এবার বুঝা যায়, মারের পাল্টা মার শুরু হয়েছে। মুক্তিবাহিনী এখন রাজাকার এবং তথাকথিত শান্তি কমিটির সদস্য-এই জাতীয় দালাল নিধন শুরু করেছে। পাকিস্তানী সৈন্যের ভাষায় হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বীরের দল এবার মানসিক দিক থেকে মুক্তকচ্ছ হয়ে উঠবে। এবার বাছাধনেরা টের পাবে কতাে ধানে কতাে চাল।
কাদের সিদ্দিকী সম্পর্কে আরাে তথ্য জানার কৌতূহল রইল। ভিয়েতনামী জেনারেল গিয়াপের কথা মনে থাকলে, সিদ্দিকী সম্পর্কে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসা মানুষের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাগুরু, শ্রেষ্ঠ শিক্ষাদাতা।
১৯৭১
২৭ জুলাই
রাত্রে কাদের সিদ্দিকীর রণ-চাতুর্যের আরাে খবর পাওয়া গেল। তার বাহিনী নাকি রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানী ছাউনিতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং ওদের অনেকে পুড়ে মারা যায়। সংখ্যা তিরিশের কম নয়। সত্য যাচায়ের উপায় এই মুহুর্তে নেই। তবে গেরিলা বাহিনীর কর্মকাণ্ড সব সময় বৈচিত্র্যে ভরা থাকে।
১৯৭১
২৮ জুলাই
মার্কিন সিনেটর ফুলব্রাইট সাহেব এক অধিবেশনে মার্কিন সরকারের তীব্র সমালােচনা করেন। কমুনিজম ঠেকানাের নামে প্রেরিত অস্ত্রের অপপ্রয়ােগ ঘটছে সিনেটর সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ।
মার্কিন দেশের ভেতর থেকে এমন বিবেকের প্রতিধ্বনি মানসিক
৬৫
১৯৭১
২৯ জুলাই
নীরােদ সি চৌধুরীর চেহারা দেখা গেল আর এক দফা।
ভদ্রলােক পণ্ডিত লােক। শুনেছি, রণশাস্ত্রেও তার অধিক ইলেম আছে। তিনি ইংরেজদের চেয়ে বড় ইংরেজ, যেহেতু বিভিন্ন মাদক পানীয়ের ঠিকুজী গুণাগুণ, স্বাদ ইত্যাদি সম্পর্কে বিশারদ। ল্যাটিন ফ্রেঞ্চ অয়গরহ ভাষা জানেন। পাশ্চাত্য সংগীতের বড় সমঝদার। কিন্তু একি কাণ্ড! সংবাদপত্রে তিনি লিখেছেন, ভারত সরকারের গণহত্যা বন্ধ করার উপদেশ দান উচিত নয়। এ ত চ্যালেঞ্জস্বরূপ। দুই দেশকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে। চৌধুরী মশাই আরাে মুরুব্বিয়ানা করেছেন। ভারতের এসব গা-জুরি অন্যায়। যুদ্ধ করবে ভারত? তার মুরােদ তাে চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে দেখা গেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ স্রেফ পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়। ভারতীয় নেতারা কেউ চৌধুরীর কশাঘাত থেকে রেহাই পায়নি। শুধু তাই? বিদেশী সাংবাদিকদের উপর তিনি এক হাত নিয়েছেন। মিথ্যে বানােয়াট খবর দিয়ে তারা সাংবাদিকের সাধারণ সততা পর্যন্ত হরিয়েছে। গােস্বাময় নীরােদ সি চৌধুরী।
এই ভদ্রলােকের সঙ্গে মুখােমুখি দেখা হলে জিজ্ঞেস করতাম, “মিস্টার চৌধুরী, আপনি কৃতবিদ্যা এক বিশাল প্রতিভা। শুনিয়াছি আপনার কান আর কম্পিউটারে কোন তফাৎ নাই। বিটোফেনের সিমফনীর অনুসরণ কোন কোন জায়গায় কোন কোন কম্পােজার করিয়াছেন, তাহাও নাকি আপনি বলিয়া দিতে পারেন। এসব ত প্রায় অলৌকিক কেরামতির পর্যায়ে পড়ে। আমার মত ‘নেটিভ’ বাঙালী ত বিস্ময়ে ডাক-বাক্সের মত হাঁ করিয়া থাকিবে। এখন আপনি আমার সরল প্রশ্নের জবাব দিন।
“আপনার নিশ্চয় মনে আছে, আপনি এই দেশের ময়মনসিংহ জেলার কিশােরগঞ্জে জন্মিয়াছিলেন। মনে আছে তা? আপনার কি মনে আছে বৃটিশ আমলে উনিশ শতকের একদম শেষ পাদে আপনার জন্ম? তার সাদামাটা অর্থ আপনি slave গােলাম হইয়া ধরাধামে অবতীর্ণ হন। তাহা কি আপনি অস্বীকার করিতে পারেন? অবশ্যই পারেন না।
“এখন আপনি আমাকে প্রচণ্ড গােলক ধাধার মধ্যে নিক্ষেপ করিলেন।
৬৬
১৯৭১ স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর আপনি এক বিশাল প্রতিভা, বােধ হয় বাঙালীদের একমাত্র জ্ঞানী ব্যক্তি। অথচ আপনার আচরণের আমি কোন হদিস করিতে অক্ষম। হেতু আরাে উন্মােচন করিতেছি। অতঃপর ঈষৎ ধৈর্য ধারণের অনুরােধ শুধু।
“আপনি জানেন, যাহারা গােলাম হইয়া জন্মগ্রহণ করে, তাহাদের মত দুর্ভাগা কেহ পৃথিবীতে নাই। কারণ, গােলাম ত মানুষ নয়। মনুষ্যত্ব অর্জনের জন্যে তাহাদের জন্য দুটি পথ মাত্র উন্মুক্ত থাকে। প্রথম পথ, দ্রোহিতা। দ্বিতীয় পথ, আপােষ কামিতা। মনােযােগপূর্বক শব্দ যুগলের দিকে দৃষ্টিপাত করুন। আপনি অশেষ শক্তিধর ব্যক্তি জ্ঞানের ক্ষেত্রে। তাই আমার নিকট ধাধা। আপনি কেন দ্বিতীয় পথ নির্বাচন করিলেন? আপনি প্রভু-গােষ্ঠীভুক্ত হওয়ার আপ্রাণ প্রয়াসে মগ্ন হইলেন? আপনার প্রভুদের ভাষায় Social Climber হইলেন। যাহা এদেশে জাতে ওঠা বলিয়া কথিত। আপনার বিলক্ষণ জানা, বায়স কোনদিন ময়ুর হইতে পারে না, যতােই পুচ্ছ নিজ পালকের মধ্যে পুঁজিয়া ধরুক। অথচ আপনি তেমনই পথ নির্বাচন করিলেন। বাঙলা প্রবাদ আছে, পক্ষীকুলে বায়স সর্বাপেক্ষা চতুর কিন্তু বিষ্ঠাহারী । আপনার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তাহাই ঘটিয়া গেল।
“আমার দুঃখ কোথায় জানেন, আমরা দেশপ্রেমিক স্বজনের জায়গায় পাইলাম একজন অনাত্মীয়।অচেতনভাবে কিন্তু আপনি আত্মঘাতী হইলেন।
“বর্তমানে প্রায় নিরস্ত্র বাঙালীর দাসত্ব মােচনের সংকল্পে পাকিস্তানী গণহত্যাকারী বর্বর সৈন্যদের বিরুদ্ধে জীবন-মরণ সংগ্রামে লিপ্ত। সেক্ষণে আপনার সহযােগিতা-সহমর্মিতা পাওয়ার কথা। তদস্থলে আমরা পাইলাম ভ্রুকুটিময় অবহেলা। শুধু তাহাই নহে, আপনি ভারত সরকার এবং ভারতের খ্যাতনামা নেতাদের পর্যন্ত গালাগাল দিতে কসুর করিলেন না। যেহেতু তাহারা আমাদের সাহায্যদানে অগ্রগামী। অথচ আপনি দাসরূপেই বৃটিশ ভারতে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এই বাংলাদেশে কিশােরগঞ্জ শহরে। আমাদের মত দাসের দিকে আপনার মমতা বর্ষিত হইল না। কারণ, গােলামরূপে জন্ম লইলেও আপনি আপােষকামিতার পথ অবলম্বন করিয়াছিলেন। আপনার নজর প্রভু-পানে। কিশােরগঞ্জে জন্ম অথচ পুরাে ময়মনসিংহ অঞ্চলের নিমােক্ত প্রবাদ আপনি বিস্মৃত হইলেন কীরূপে?
“কত্তা কইছে (অমুদ্ৰিতব্য শব্দ) ইর’ ভাই
আনন্দের আর সীমা নাই।
গুড বাই, মিস্টার চড্রি।”
৬৭
১৯৭১
৩০ জুলাই
মহারাষ্ট্র থেকে আবেদা খতীবের চিঠি পেলাম। অনেক উদ্বেগ দূরীভূত। আবেদা খতীব মারাঠী সাংবাদিক বন্ধু এ, এল, খতীবের বেগম। খতীব সাহেব ১৯৫৪ সনে ঢাকা এসেছিলেন মুসলিম লীগের পত্রিকা “মর্নিং নিউজের” এডিটররূপে। ঠিক সতের বছর পূর্বে। এই কাল পরিসরে পূর্ব পাকিস্তান তাঁর দ্বিতীয় মাতৃভূমি হয়ে পড়েছে। বাঙালীদের সাংস্কৃতিক আবহাওয়ায় তিনি যেন আপন সত্তা খুঁজে পান। মূলত লেখক, কবি এবং পেশায় সাংবাদিক এই উদারচরিত মানুষটি আমার মত বহু বাঙালীর সুহৃদরূপে গণ্য হন। মহারাষ্ট্রের নীলগিরি জেলায় জন্ম। শিক্ষা। ইংলিশ স্কুলে। উর্দু জানতেন না। যদিও চাকরি শাসকশ্রেণীর পত্রিকায় তবু সর্বদা উদ্বিগ্ন থাকতে হতাে এই মানুষটির জন্যে বর্তমান সংকটকালে, যদিও খবর পেয়েছিলাম, “সংবাদ” পত্রিকার * সৈয়দ নুরউদ্দীনের সঙ্গে তিনি এখন থাকেন।
আজ বেগম খতীব লিখেছেন যে, দশদিন পূর্বে তিনি খতীব সাহেবের পত্র পেয়েছেন। আরাে যােগ করেছেন, “When I will receive his second letter I will write to you ওর দ্বিতীয় পত্র পেলে আমি আপনাকে জানাব।” এইভাবে খতীবের খবর রাখছিলুম। * মরহুম সাংবাদিক বন্ধু সৈয়দ নুরউদ্দীন।
১৯৭১
৩১ জুলাই
আরাে মার্কিন সিনেটর বাংলাদেশে পাকিস্তানী বর্বরতা সম্পর্কে সােচ্চার। বিভিন্ন রণাঙ্গনের খবরও আশাপ্রদ। কেবল এগারাে নম্বর সেক্টরের কামালপুরের অভিযান সফল হয়নি। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীনসহ আরাে বেশ কয়েকজন যুদ্ধে শহীদ হন। তাঁদের আত্মত্যাগ আমরা কি ভুলে যাব?
১৯৭১
১ আগস্ট
কাদের সিদ্দিকীর দুর্ধর্ষ রণকৌশলের কাছে পাকিস্তানী বাহিনী নাজেহাল থাকে।
৬৮
১৯৭১ স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর
টাংগাইল এলাকায় তার ফাঁদ শত্রুদের নিকট ত্রাসের ব্যাপার। দেশের ভেতর থেকে আরাে খবর আসে এই জাতীয়। প্রথম চোটের পর দিশাহারা মানুষ আত্মস্থ হচ্ছে ক্রমশ। এমন সংবাদের আশায় আশায় থাকি প্রতিদিন।
************
ঢাকার প্রকাশক অর্থাৎ পলাতক শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহাকে ধন্যবাদ যে তিনি এখানেও পেশা পরিত্যাগ করেননি। মুজিবনগরে আশ্রয়প্রাপ্ত লেখক সাংবাদিকদের বই ছাপা শুরু হয়েছে। যত স্বল্পই হােক উপার্জনের এই পথ খুলে তিনি দেশপ্রেমের ভূমিকা পালন করছেন বৈকি। মুজিবনগরে নবপ্রতিষ্ঠিত ফার্মের নাম রেখেছেন “মুক্তধারা” ও রবীন্দ্রনাথের নাটকের প্রতিধ্বনি।
১৯৭১
২ আগস্ট
চাটগাঁ পাের্টের মেডিক্যাল অফিসার ডাক্তার কামাল হঠাৎ এসে উপস্থিত। স্নেহভাজনদের সেই দুর্দিনে দেখা হলে মনে হতাে মৃত্যুর পর যেন আবার সাক্ষাৎ ঘটল। কামালের মুখে শােনা গেল, তার সীমান্ত পেরােনাের কাহিনী। আত্মগােপন করে যখন চট্টগ্রামে ছিল তখন কামালের পিতা মারা যান। জানাজায় শরীক হওয়া কি মরা বাবার মুখ দেখার সুযােগ আর হলাে না।
সবচেয়ে স্তম্ভিত হলুম ডাক্তার কামালের মুখে ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং তার দুই পুত্র সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরী ও গিয়াসউদ্দীন কাদের চৌধুরীর হিন্দুপল্লীর উপর জুলুমের বর্ণনা শুনে। ওদের অনুচরেরা জাতীয়তাবাদী মনােভাবাপন্ন ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে এসে নানা ধরনের নির্যাতন চালায়। লাঠি কি বেত পেটানাে ত তার তুলনায় কিছু না। চৌধুরীর নন্দনদ্বয় এবং চেলাচামুন্ডারা গাল দেয়, “তােরা হিন্দু হয়ে গেছিস।”
কামালের মুখেই শুনলাম, এখন মানুষের মধ্যে আর প্রথম দিকের সহানুভূতি নেই। বর্ডার পার হবে জানলে লুটপাট, সর্বস্বান্ত করে ছেড়ে দেয়।
১৯৭১
৩ আগস্ট
লন্ডনে বাংলাদেশ সহায়ক সমিতিগুলাে বেশ জোরদার হয়ে উঠছে খবর
৬৯
পেয়েছিলাম। আজ জেনেভা থেকে আমীর আলী কিছু প্রতিবেদন এবং চিঠি পাঠিয়েছেঃ
শওকত ভাই শ্রদ্ধাস্পদেষু,
জেনেভা ২৬-০৭-৭১
আজ দিন তিনেক হলাে এখানে এসে পৌঁছেছি। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সহকর্মী হিসেবে। কি করছি না করছি তা সঙ্গের দুটো বিবরণীতে পাবেন। এ রিপাের্ট দুটো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করতে পারলে ভাল হয়। বড় ব্যস্ত। ফিরে আবার লিখছি, শুভেচ্ছান্তে।
আমীর আলী।
পুনশ্চ : Committee for ihe Aid of the Bangladesh people এর খবরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ নয় শুধু সাহায্যের জন্যে বিচারপতি চৌধুরী তখন সফরে বেরিয়েছিলেন।
**********
বর্ষাকাল। আমরা যারা মােটামুটি আশ্রয় পেয়েছি, তারা কী আরামে আছি, কল্পনা করতে পারব না। সাহায্যের জিনিসপত্রও প্রচুর। কিছু নয়। বিদেশী জার্মান ডাক্তার ম্যাথিস ব্রোমবার্গার (Mathis Bromberger) কলকাতার নিকটস্থ এক শিবির থেকে লিখছেন ।
“There were thousands of people standing out in the open here all the night in the rain. Women with babies in their arīns. They could not lie down because the water came up to their knees in places. There was not enough shelter, and in the morning there were always many sick and dying of pneumonia. We could not get our serious cholera cases to the hospital. And there were no one to take away the dead. They just lay around on the ground or in the water. বৃষ্টির মধ্যে হাজার হাজার লােক খােলা জায়গায় সারা রাত বৃষ্টির মধ্যে দাড়িয়ে থেকেছে। মেয়েরা শিশুদের হাতের উপর নিয়ে খাড়া। তারা শুতে পারে না। কারণ কোথাও কোথাও হাঁটুর উপর পানি উঠেছে। আশ্রয় ত খুব বেশি নেই। সকালে অনেকে অসুস্থ এবং নিউমােনিয়ায় মারা যাচ্ছে। কলেরার গুরুতর
৭০
অবস্থার রােগীদের আমরা হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারছি না। মৃতদের নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই। তারা এখানে সেখানে জমিন অথবা জলের উপর পড়ে রয়েছে।”
আর এক ডাক্তার লিখছেন, “…The people are not even crying any imore.” এমনকি মানুষ আর এখানে কাঁদে না।
স্বাধীনতা অর্জনের পথ এমনই দুর্গম, অনেকের ত তেমন ধারণাই নেই।
১৯৭১
৪ আগস্ট
পশ্চিম বাংলায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্যে ছাত্ররা ধর্মঘট পালন করে গতকাল। ভারতীয় পার্লামেন্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন এবং তাকে হত্যার ভারতীয় আশংকা নিয়ে কয়েকজন সদস্যের আলােচনা দেখা গেল। শ্ৰীসমর গুহের ভূমিকা এই ক্ষেত্রে স্মরণীয়।
১৯৭১
৫ আগস্ট
ঘুমােতে বেশ দেরী হয়েছিল। প্রায় রাত্রি দেড়টা। সকালে উঠতে পারিনি। ঘুম ভাঙলেও চোখ রগড়াচ্ছিলাম। স্নেহভাজন চাচা জলী মুরশেদ (জাস্টিস মাসুদের ছােট ছেলে) এসে খবর দিলে হেডলাইন নিউজ ওয়াশিংটন দূতাবাসের তের জন অফিসার বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে-ডিফেক্ট করেছে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম, নাম দেখেছাে? “দেখেছি”। আবু রুশদ বলে কেউ আছে? “আমি অমন নাম তাে দেখিনি।” কাগজ কোথা? “হাতে হাতে ঘুরছে।” “এনায়েত করিম আছে?” “প্রথমেই আছে। দ্রুত নীচে নেমে এলাম কাগজের জন্যে হন্যে। একজনের কাছ থেকে প্রায় ছো-মেরে কাগজ নিয়ে বড় বড় টাইপে ছাপা নামের তালিকায় ঢুকে গেলুম। এস এম কিবরিয়া, এম এ মুহিত, এ আর মতিনউদ্দীন আরাে আরাে নাম। ওদের সকলকে ভাল চিনিনে। আমি এক দৌড়ে আবার বিছানায় শুয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। গর্বে বুক ভরে উঠল। লেখক আবু রুশদ সরকারী খাতায় এ আর মতিনউদ্দীন। এই বিভ্রান্তি থেকেই যায় সর্বত্র। আমার ধারণা
৭১
একদম খাপে খাপে খেটে গেছে। আবু রুশদ অপেক্ষা করছে ঝম্ফদানের সুযােগে। ঘাপটি মেরে বাঘকে তা করতে হয় শিকার আচ্ছামত পাকড়ানাের জন্যে।
জয় বাংলা! জয় বাংলা!
আজই অভিনন্দন পাঠাতে হবে বন্ধুবর ও এনায়েতের তরে।
***********
বিদেশী সাংবাদিকদের সহৃদয়তা কৃতজ্ঞতার দাবিদার। ডেলী টেলিগ্রাফের করেসপনডেন্ট ক্লারা হলিওয়ার্থ বিস্তারিত রিপাের্টে জানিয়েছেন, মানুষ নিরাপত্তার খোঁজে দূর-দূর অঞ্চলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। তবে গেরিলা বাহিনীর তৎপরতাও যে উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে তা প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। এই খবরই আমাদের চাংগা রাখার মত সংবাদ।
১৯৭১
৬ আগস্ট
পাকিস্তানী দুই সৈন্য ঢাকার নরসিংদী এলাকায় দুই যুবককে সন্দেহক্রমে কথা আদায়ের জন্যে বেয়নেটের খোচায় জখম করে ফেলে রাখলাে কাউকে কাছে আসতে দিলে না। ধুকে ধুকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তারা মরে গেল।
আরাে মর্মন্তুদ ঘটনা শুনলাম, গ্রামে চড়াও হলে প্রায় পঞ্চাশজন ভয়ে পাটক্ষেতে লুকিয়েছিল।
কচি বাচ্চা ত পরিস্থিতির ঊর্ধ্বে বসবাসকারী। হঠাৎ কান্না জুড়ে দেয়। শব্দে পাছে জল্লাদেরা টের পায় মা তাই তার মুখ চেপে ধরে। আততায়ীরা কিছু টের পেল না। ইতিমধ্যে শিশু মার কোলে মৃত। হতভাগিনী সন্তানের মুখ চেপেই বসে আছে।
***********
আজ রিফিউজীদের সাহায্য করার জন্যে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বাংলাদেশী কৃতী ফুটবল খেলােয়াড়দের সঙ্গে এক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের বিখ্যাত খেলােয়াড় গােষ্ঠপালের নামে বিপরীত দলের নামকরণঃ গােষ্ঠপাল একাদশ।
৭৩
বাংলাদেশ ২-৪ গােলে পরাজিত হয়।
*********************
অশ্রু রক্ত হাহাকারের বিশাল পটভূমি। তবু তার মধ্যে মানুষের ভবিষ্যৎ বাঁচার উপাদানগুলাে একদম বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়।
*********************
হিন্দু অর্থাৎ কাফের নিধনের যে পবিত্র দায়িত্ব পাকিস্তান সরকার ও তার উন্মত্ত বাহিনী গ্রহণ করেছে, সেই সম্পর্ক জনৈক মার্কিন সিনেটারের মন্তব্যঃ
“It is the most incredible, calculated think since the days of the Nazis in poland” নাৎসীদের পােল্যান্ডের পর এমন মাপজোক-কষা ব্যাপার সব চেয়ে অবিশ্বাস্য। ঢাকার শাখারি বাজার বহুকাল থেকেই হিন্দুপল্লী। সেখানে এখন গুণ্ডা-লুচ্চা এই জাতীয় সমাজবিরােধী জীব এবং আলবদর রাজাকারদের আস্তানা, পাছার নামই বদলে গেছে।
নতুন নাম ঃ টিক্কা খান রােড
১৯৭১
৭ আগস্ট
মাঝে মাঝে ঢাকা বেতার শােনার দুর্বুদ্ধি জাগে। প্রতিদিন বিভিন্ন প্রচারিত কথিকার একই চিৎকার এবং সেই স্বরগ্রামের অদল-বদল নেইঃ পাকিস্তানের অস্তিত্ব ছাড়া এই অঞ্চলের মুসলমানদের ধর্ম, তাহজীব-তমুদুন ইজ্জৎ সব লােপাট এবং দেশের মানুষ হিন্দুদের গােলাম হয়ে যাবে। মুক্তিবাহিনী আসলে দস্যুবাহি, হিন্দুর দাসত্বের দিকে রজ্জবদ্ধ ছাগলের মত মুসলমানদের টেনে
নিয়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে উন্নততর প্রপাগান্ডা ওদের মগজে ঢােকে না। মানুষে যারা বিশ্বাস হারায় তারা নিজেরাও মানবতা থেকে খারিজ হয়ে যায়।
*********************
এহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী মুসলমানদের বলে মচ্ছড় অর্থাৎ মশা। দেশের প্রেসিডেন্ট।
তার মানসিক বহর এমনই। সিন্ধী প্রবাদটা ভদ্রলােক জানে না। ধাবমান
৭৩
ঘােড়ার পিঠ থেকে সেনাপতি আর সহজে নামতে পারে না।
**************************
আজ এক মুক্তিযােদ্ধার মুখে যেসব ঘটনা শুনলাম তা বিশ্বাস করা দায়। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে স্বীকারােক্তি আদায় করতে শিকারী কুকুর ব্যবহৃত হয়। বাগে না এলে কুকুরগুলাে মজলুমকে ধীরে ধীরে ছিড়ে ফেলে।
**************************
ঢাকা শহরের বংশালের এক যুবককে স্বীকারােক্তি আদায়ে তিরিশ ঘণ্টা ঝুলিয়ে রেখেছিল। পা শূন্যে মাথা নীচে। মুখ দিয়ে রক্ত ঝরল ফেঁটা ফোঁটা। নামানাের পর মরে গেল। হাতেব নলী পর্যন্ত ছুরি দিয়ে চামড়া চেঁচে চেঁচে অন্যদের দেখালাে। কথা বলাে, না হয় ওই শাস্তি। নাৎসী বর্বরতাও ঢের মােলায়েম এর কাছে। পাঞ্জাবী মুসলমানেরা ও আমরা এক জাতি। যৌথ আন্দোলনে সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তান।
**************************
পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে আজ কলকাতায় মুজিব দিবস পালিত হয়। বিশাল সমাবেশ। সভার প্রস্তাব পাঠ করেন দুই বঙ্গের জনপ্রিয় খ্যাতনামা। গাল্পিক-ঔপন্যাসিক শ্রীতারাশংকর বন্দোপাধ্যায়।
প্রস্তাবটি এইরূপ ঃ
“এই সমাবেশ বিশ্বের সমস্ত জনগণ আর ছােটবড় শক্তির দরবারে এই ব্যগ্র উৎকণ্ঠিত দাবিটি পৌঁছে দিতে চায় যে, পাকিস্তানের নরহন্তা শাসকদের গুমঘর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্ত করে না আনলে ভবিষ্যতের কাছে আজকের জগৎ কখনও মুখ দেখাতে পারবে না।
তাই আমরা চাই মুজিবুর রহমানের প্রাণ-হননে উদ্যত পাকিস্তানী জল্লাদদের হাত বিশ্বমানবতার হস্তক্ষেপে স্তব্ধ হােক, অভিশাপে পাথর হােক, আমরা চাই অবিলম্বে নিঃশর্তে বঙ্গবন্ধু মুজিবের মুক্তি।”
১৯৭১
৮ আগস্ট
সংবাদ পেলাম, চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার “শিক্ষক সমবায় লাইব্রেরীর”
৭৪
১৯৭১ স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর শ্রীখগেন্দ্রনাথ সিংহ এবং তার স্ত্রী মিলিটারীদের হাতে নিহত হয়েছেন। লাইব্রেরী: মালিক কিন্তু তিনি প্রকাশকও বটে। আবুল ফজল সাহেবের অনেক বই খগেন বাবুর তাগিদেই প্রকাশিত হয়। আমার “কাকরমণি” নাটকের দ্বিতীয় সংস্করণ তিনি ছেপেছিলেন। ফর্সা, সুগঠিত তনু মানুষটি এমনিতেও গ্রাজুয়েট এবং পরিশীলিত আচার ব্যবহারের মানুষ। নিঃসন্তান ছিলেন তিনি। তারই অগ্রজ ইংরেজীর অধ্যাপক শ্রীযােগেশ সিংহ আদর্শ শিক্ষকরূপে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। ঠিক পাকিস্তান হওয়ার পর খগেন বাবু বিদেশী ভাল ভাল বই আমদানি করতেন। চকবাজারে বাড়ি তৈরি করেন। নৈশ আক্রমণে স্বামী স্ত্রী উভয়েই মত্যর শিকার হন। যােগেশ বাবুর সঠিক খবর পাওয়া গেল না।
স্তব্ধ বারবার অতীতের বহু স্মৃতি ফিরে আসতে লাগল । চন্দনপুরা থেকে সান্ধ্য ভ্রমণে বেরিয়ে আন্দরকিল্লার এই লাইব্রেরিতে কতাে সময় না আড্ডা দিয়েছি। চার্গার সাহিত্যমােদী অনেকেই এসে জুটতেন।
১৯৭১
৯ আগস্ট
ওয়াশিংটন থকে আজ বন্ধ আবু রুশদের চিঠি পেলাম। গত মাসে অর্থাৎ জুলাই মাসের ২৬ তারিখে লেখা। অর্থাৎ ডিফেক্ট’ করার এক হপ্তা পর্বে। চিঠিতে অবিশ্যি তার ইংগিত আছে। মতীন অর্থাৎ আবু রুশদ লিখছে, “আমরাও ভেগে পড়বার কথা ভাবছি। তবে বিদেশে পরিবার নিয়ে আবার অসুবিধায় পড়তে না হয় সেকথাও চিন্তা করি। দোটানায় মন বেজায় বিক্ষুব্ধ। প্রতি মুহুর্তে যন্ত্রণা । যে পথে আমাদের সকলের মঙ্গল নিশ্চিত সে পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছি।”
এই সময় পাকিস্তানের দালালী করার জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন অধ্যাপক সাজ্জাদ হােসেন ও শিক্ষক মােহর আলী দুইজনে আমেরিকা গিয়েছিল। বন্ধুবর পত্রে লিখেছে, “সাজ্জাদ আর মােহর আলীর সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্য দেখা হয়েছিলাে। মনের উত্তাপ কিছুতেই সামলাতে পারিনি। তবে ওদের কথা এখন ভেবে কি হবে।” এই পত্রে আবু রুশদের আরাে যন্ত্রণার কথা আছে। তবে আমার জন্য যন্ত্রণাহর। একটি খবর দিয়েছে। বন্ধুর বাক্যসুধায় করিম সাহেব ধকল কাটিয়ে উঠেছেন। এখন বিপদমুক্ত বলা যেতে পারে। তবে আরাে দুই মাস খুব সাবধানে থাকতে হবে। কোন কাজ করতে পারবেন না। তাঁর মনােবল অসাধারণ। এখনও আগেকার মত প্রফুল্ল আছেন।
৭৫
১৯৭১ স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর তােমার কথা তাকে ও তার * স্ত্রীকে বলেছি। দুজনেই তােমাকে খুব প্রীতির সঙ্গে স্মরণ করেছেন।
* হােসনা করিম
***********
আজ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রসঙ্গে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী শান্তিকামী বিশ্বের মানুষ পাকিস্তানের এই হীন আচরণের বিরােধিতা করবে, তিনি বিশ্বাস রাখেন।
পাকিস্তানের মত স্বৈরাচার শাসিত দেশে সভ্য সমাজের আবেদন কীভাবে গৃহীত হবে, খােদাকে মালুম।
দস্তার টুপি দিয়ে যখন মাথা ঢাকা থাকে, মগজ কি তখন বাদ যায়?
১৯৭১
১০ আগস্ট
চাটগাঁ শহরে একটানা এগারাে বছর ছিলাম। তখন অনেক সংস্কৃতি প্রেমিকজনের সঙ্গেই পরিচয় ঘটে। অ্যাডভােকেট চিত্ত দাস অন্যতম। তার খবর পেলাম ওঁর এক আত্মীয় মারফত। নিকটে লােয়ার রেঞ্জে উঠেছেন। ওঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ রীতিমত ভেতরের তাগিদ হয়ে দেখা দিল। এইসব ক্ষেত্রে আমার সবসময় মনে হয় যেন অলৌকিক কিছু ঘটেছে তাই পরিচিতদের মুখ আবার দেখতে পাই। চিত্তবাবু সর্বস্বান্ত। পথে লুটপাট করে নিয়ে গেছে সঙ্গে অর্থ সম্বল যেটুকু ছিল। তবে আবার আশ্রয়ও পেয়েছেন সীমান্ত অভিমুখে যাত্রাপথে । এক মুসলমান যুবক বাচ্চাদের দুধ যােগাড়ে যে আন্তরিকতা দেখালে তা স্মরণ করে অ্যাডভােকেট দাস রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃতি দিলেন “মানুষে বিশ্বাস হারানাে পাপ।”
***********
বাংলাদেশে জন্মানােই যেন অপরাধ। অপমৃত্যুর কতাে রকম সংবাদ না প্রত্যহ পাওয়া যায়। তখন মনে হয় হাতিয়ার হাতে যারা দানবদের বিরুদ্ধে লড়ছে
৭৬
তারাই ভাগ্যবান, প্রকৃত মানুষ।
***********************
ঢাকার নিকটেই ঘােড়াশাল। এখানে নদীর ধারে অপরাধীর (মানে ওদের চোখে অপরাধী) পেটে বেয়নেট দিয়ে তারপর নদীতে ফেলে দিলে দু’তিনজনকে। গুলী খরচ ত ব্যয়সাপেক্ষ। তার চেয়ে সস্তায় কাজ খতম করাে।
হায় বাঙালী, তােমাদের মৃত্যু এখন অপমৃত্যু, করুণও! তুচ্ছ এই ক্ষেত্রে।
চারমাস পরেও বাংলাদেশের পথে ঘাটে হয়রানি, অপমান করতে সিপাইরা আদৌ পিছপা হয় না। একটি পরিবারের দুর্দশা শুনলাম। কিন্তু মেয়েদের গায়ে হাত দেয়নি। তাই রক্ষা।
নিজের জন্মভূমিতে এ-ই সান্ত্বনার অবলম্বন। হায়, জননী বাংলাদেশ!
১৯৭১
১১ আগস্ট
গুজব হয়ে পারে, কিন্তু সংবাদটি আমাকে বেশ চমকে দিল। আমার এক পরিচিত মশার স্বামী বন্দী শিবিরে নিহত। তিনি আবার শাদী করেছেন।
ধৈবে ! আগুনে জল ঢালার শ্রেষ্ঠ পন্থা তার চেয়ে আর কী হতে পারে?
***********************
বর্তমান ডামাডােলে অনেকে আবার আক্রোশ মেটাচ্ছে মনের সুখে। অর্ডিংনাম কোম্পানীর জনাব আহাদের মৃত্যু নাকি এমনই মানসিকতার জের। আহাদ সাহেব খ্যাতনামা সাংবাদিক আব্দুল ওহাব সাহেবের ভাই। আমার সঙ্গে বেশ পরিচয় ছিল। ওমর এ্যান্ড সন্সের এক ছােকরার সঙ্গে নাকি আহাদ সাহেবের কিছু বৈরিতা হল ব্যবসা সংক্রান্ত।অবাঙালী প্রতিষ্ঠান ওমর এ্যান্ড সন্স। তাদের সঙ্গে মিলিটারীদের যােগাযােগ ঘন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। ওহাব সাহেব বাঙালী, কাজেই মাশুল দিতে হলাে। অথচ ওহাব মানসিকতার দিক থেকে পাকিস্তানের তরফে বেশি ঝুঁকে ছিলেন। এই প্রবণতা তাকে রেহাই দিল না । চট্টগ্রামের সার্জেন্ট খালেকের মৃত্যুও প্রতিশােধ পরায়ণতার জের।
***********************
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী আজ পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতি বার্তা
৭৭
পাঠিয়েছেন যেন পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারপর্ব থেকে। বিরত থাকে। এমনকি পাকিস্তান সরকারের নিকট আবেদনলিপি পৌছানাে হয়।
***************
ঠিক একই দিনে লন্ডনের এ্যাকশন (Action) কমিটি মুজিবের বিচারের প্রতিবাদে প্রতিরােধ দিবস” পালনের জন্য ডাক দিয়েছে। সভা হবে হাইড পার্কে।
***************
একটি সংবাদ বিশ্বাসযােগ্য নয়, তবু বিশ্বাস করতে হয়। কারণ, বাস্তব ঘটনা।
চাটগাঁ থেকে বােধ হয় বারাে-তেরাে মাইল দূরে কুমীরা স্টেশন। এখানে পাহাড়গুলাে আসলে উঁচু টিলা। তিন চার শ ফুটের বেশি নয় উচ্চতায়। সমুদ্র নিকটেই। স্বাস্থ্যকর আবহাওয়া দেখেই এখানে টিভি স্যানিটোরিয়াম তৈরি করা হয়। পাকিস্তানী সিপাইরা স্যানিটোরিয়াম দখল করে নেয়। তখন রােগী যারা ছিল তাদের ধাক্কা দিয়ে বা সােজা ঠ্যাং ধরে নিচে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। এরা কি বেঁচে ছিল কেউ? শুধু এই প্রশ্ন তুলে চুপ করে যাওয়া ছাড়া আর কী করার আছে?
১৯৭১
১২ আগস্ট
বাংলাদেশস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের ২৫৭ (দুশ’ সাতান্ন) জন কর্মচারী আজ ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার সুবিধা পায়। চার মাস এরা নরকে বাস করছিল বৈকি। আমি যে উপন্যাস লিখলাম পুজোসংখ্যা “দেশের জন্যে তার নাম ও জাহান্নম হইতে বিদায়। ওরা নিশ্চয় বইটা পড়ে দেখবেন।
***************
আজ শ্রীমতী গান্ধী রাজ্যসভায় শেখ মুজিবের প্রাণদণ্ড সম্বলিত সংবাদের আবহে এক বিবৃতি প্রদান করেন। পাকিস্তান সরকার যেন অমন পথে পা না বাড়ায়,
৭৮
১৯৭১ স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর শ্ৰীমতী গান্ধীর আহবানে তা বিশেষভাবে ফুটে উঠে। জাতিসংঘ এই ব্যাপারে তেমন সচেষ্ট নয়, সে অভিযােগও করেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী।
***************
ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট, রংপুর-দিনাজপুর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, যশাের, খুলনা-এক কথায় বিভিন্ন সেক্টরে আশাতীত সাফল্যের সংবাদ পাওয়া যায় ।
১৯৭১
১৩ আগস্ট
রিমােট কন্ট্রোল ট্যাংক বিধ্বংসী মাইনও মুক্তিবাহিনী এখন ব্যবহার করছে। অর্থাৎ এইসব আধুনিক মারণাস্ত্র ওরা সংগ্রহ করেছে। অমানবিক হিংস্রতার প্রতীক যে দুশমন তাদের কার্যকলাপের জবাব দিতে এমন অর্জন, আমার কাছে শুধু সংবা বয় বরং ভবিষ্যৎ ফলাফলের ঝলক।
১৯৭১
১৪ আগস্ট
“বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুবৃত্ত”
—- সুকান্ত ভট্টাচার্য
১৯৭১
১৫ আগস্ট
জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারে উদ্বিগ্ন হয়ে বার্তা পাঠিয়েছিলেন পাকিস্তান সরকার সমীপে। প্রতিবাদে এহিয়া খানে চামুন্ডারা জানিয়েছে যে, মুজিব দেশ ও জাতির শত্রু। জাতিসংঘ নাক গলিয়ে খামখা সীমা। ছাড়িয়ে গেছে।
৭৯
১৯৭১
১৬ আগস্ট
ক’দিন থেকে ভেতর থেকে তাে খাচ্ছিলাম। যে সমাজতন্ত্রে পৃথিবীর সর্বহারা এত আস্থাবান, এখন যা হাল দেখছি চীন দেশে, ক’দিন পরে মানুষ এমন আদর্শের মুখে থুতু দেবে। পৃথিবীর সকল সামাজিক রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিভূমি মানবপ্রেম এবং কল্যাণ-এষণা। যদি তা-ই গায়েব থাকে আদর্শ ভূতের কংকাল হয়ে দাঁড়াবে।
আজ তাই সকাল থেকে প্রায় সারাদিন সব লেখা বাদ দিয়ে চৈনিক নেতা চাউ এন-লাইকে একটা খােলা চিঠি লেখার উদ্দেশ্যে মুসাবিদা শুরু করলাম। অবিশ্যি প্রস্তুতির আর এক অধ্যায় গেছে। চৈনিক প্রবাদ কিছু জানা দরকার যেন মন্ত্রী মহােদয়ের কানে যথাযথ গরম সীসা ঢালা যায়। তার জন্যে পরশু দিন ইবনে ইমাম সাহেবের ঝাউতলা রােডের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলুম যদি কোন বই পাওয়া যায়। দৈবক্রমে Proverb বিভিন্ন দেশের প্রবাদের সংকলন একটা পাওয়া গেল। কিছু কপি করে আনলাম।
এখানে আর এক অসুবিধা। নকশাল আন্দোলন এখন পশ্চিমবঙ্গে তুঙ্গে। “চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান”-এই শ্লোগান যারা দিতে পারে তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে কি বলা যায়–স্থির করা দায়। এখন চীনের দু’নম্বরী নেতা চাউ সাহেব, মাও নাম্বার ওয়ান। এই দু’নম্বরের গায়ে বাণ নিক্ষেপ মানে এখানে সকল চরম বামপন্থীদের পায়ে টগবগে গরম পানি ঢালা। মার্কসবাদ কোন কোন সময় গুরু-ভজাবাদে পরিণত হয়।
এই অসুবিধা আবহে আছে জেনে চিঠির মুসাবিদা করতে বসেছিলুম। “তুমি হালা যে বিলের মাছ, আমি হালা সেই বিলের বগা।” নীতি পালন করতেই হয়।
আজ মােটামুটি পয়লা খসড়া হয়ে গেছে। তারপর টাইপ করার সময় কিছু এদিক ওদিক করা যাবে। আবুল হােসেন (মাসুদের শ্যালক) সাহেব তার ইংরেজী টাইপ রাইটারটি আমার হেফাজতে উৎসর্গ করেছিলেন। সেদিকে সুবিধা আছে। ইংরেজী লেখা কালে ভদ্রে। তবু এখানে পরিস্থিতি অনুযায়ী পত্র ইংরেজীতে লিখতে শুরু করি। এডগার স্নাের “Red star over China” পড়ার সময় জেনেছিলুম ভদ্রলােক ওই ভাষা জানেন।
বড় নির্বিবাদ দিন। সাক্ষাতের উৎপাত ছিল না আজ। তাই অনেক কাজ
৮০
করা গেল।
* পশ্চিমবঙ্গের লেখক সাংবাদিক ইমাম
১৯৭১
১৭ আগস্ট
স্থলে নয় শুধু জলেও শত্রুদের মােকাবিলা শুরু করেছে মুক্তিসংগ্রামের নৌ বিভাগ। নৌ কমান্ডােরা মাইন পেতে বিস্ফোরণ ঘটানাে শুরু করেছে। সােবহান আল্লা।
*************
বাংলাদেশের চিত্রনাট্যকার ইসমাইল মােহাম্মদ (উদয়ন চৌধুরী) সাহেবের স্ত্রী হিন্দু মহিলা। একদম সাবিত্রীর প্রতিনিধি বলতে হয়। মিলিটারী হামলার পর আবার মুজিবনগরে এসেছেন চার মাস ছাড়াছাড়ির পর। গহনা বেচেছেন, আরাে কি কি কাণ্ড না করেছেন। অরাজক দিনে সবচেয়ে প্রয়ােজন সাহস। ভদ্রমহিলা সেদিকে একদম শীর্ষে অবস্থান করেন বােধ হয়। নানা বিপদ সাঁতরে পৌঁছেছেন আগরতলায়। তারপর জনসমুদ্রের ভেতর থেকে বের করেছেন স্বামীরত্নকে মুজিবনগরে।
১৯৭১
১৮ আগস্ট
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে “Bleeding Bangladesh” এই শিরােনামায় এক চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হয়। যেসব অত্যাচার তখন দেশের বুকের উপর দিয়ে চলছিল, তার মানসিক পরিমাপ সহজ নয়। তবু এইসব ছবি নৈতিক সমর্থনের নিমিত্ত হবে বৈকি। এককালে বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকা ছিল সকাল-সন্ধ্যার আসর। স্মৃতিময় প্রাঙ্গণে সন্ধ্যা কেটে গেল।
*************
ফেউ যখন সিংহের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতায়, তখন মনে হয় জন্তু জগতে এমন হওয়া
৮১
সম্ভব। হামিদুল হক চৌধুরী এবং সিলেটের মাহমুদ আলী দুজনেই পাকিস্তানের দালাল। হামিদুল হক চৌধুরীর কথা বুঝা যায়। ওটা সিংহ। পাকিস্তানের সিংহ ভাগ পেয়েছে, খেয়েছে, পরেছে। কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্তের সন্তান মাহমুদ আলী উঞ্ছবৃত্তির সাধক। তার কী হলাে? এখন ওর বউ বিধবা হবে। মুক্তিফৌজ এই দালালদের নিশ্চয় ক্ষমা করবে না।
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় উপন্যাস লিখলে মাহমুদ আলীর মত চরিত্র থাকা প্রয়ােজন। প্রাণীটার হলাে কী? অথচ এককালে বড় অসাম্প্রদায়িক আদর্শবাদী সৎ মানুষ ছিল।
বেশ্যামাত্রেই একদা কুমারী থাকে। কথাটার মর্মোপলব্ধি এখন আমার পক্ষে সহজ।
১৯৭১
১৯ আগস্ট
আরাে একটি উপন্যাসের মুসাবিদা মনের ভেতরে ঘােরাফেরা করছিল। পটভূমি ১৯৫০ সনের দাংগা। স্বপ্নে নাম পেলাম ও অশ্রুবৃক্ষ। বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষের অনুষঙ্গ আছে। জাতিস্মর বাঙালীদের জন্যে নামটা কার্যকরী হতে পারে। আরাে কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখব।
*************
বিভিন্ন সীমান্তে নওজওয়ানদের রিপাের্ট পেলাম। মনােবল এতটুকু কারাে কমেনি। মৃত্যু যেন কিছু নয়। অনেকে বয়স বাড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিচ্ছে। বয়স জোর পনের। বলছে উনিশ।
*************
আজ হঠাৎ মনে পড়ল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনের মালিক * মধুর কথা। সব রাজনীতির ঊর্ধ্বে জেনে সবাই তাঁকে খাতির করত। সেবা দিয়ে হৃদয় জয়ের কাহিনী কে ভুলতে পারে? অনেক ছাত্রের বেতন বাকী পড়েছে, মধু ধার দিত, শােধের আশায় নিশ্চয় নয়।
২৬ মার্চের সকালে দেখা গেছে গােটা পরিবারসহ সে নিহত। তিন
৮২
১৯৭১ স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর বছরের ছােট ছেলেটা রক্ত পিচ্ছিল মেঝের উপর বসে বসে নীরবে কাঁদছে।
*************
হাতীরপুলের মসজিদের ইমাম ২৬ মার্চের ভােরে বেরিয়েছিল আজান দিতে। আজানই তার জীবিকা অর্জনের উপায়। মসজিদের প্রাঙ্গণেই তিনি গুলী খেয়ে লুটিয়ে পড়েন। ইসলামী রাষ্ট্রের ধার্মিক নাগরিক।
কী চমৎকার পরিণাম।
* মধুসূধন দাস
১৯৭১
২০ আগস্ট
আজ “Open letter to Chou En-Lai” (চাউ এন-লাইয়ের নিকট খােলা চিঠি’র কাজ শেষ করলুম। মায় টাইপ পর্যন্ত। কাল কলকাতার Hindustan Standard কাগজে ছাপতে দেব। ইংরেজী ভাষায় লেখা। দু’একদিনের মধ্যে বাংলা ভাষাও করতে হবে। সত্যি অবাক হতে হয়, ভদ্রলােক মার্কসবাদী। অথচ স্বৈরাচারী গণহত্যাকারী শাসকদের সমর্থন দিচ্ছেন। এই গৃহযুদ্ধ নাকি মুষ্টিমেয় সেশেশনিস্ট-বিচ্ছিন্নবাদীদের কাণ্ড । আমি তাই প্রধানমন্ত্রীকে লিখছি ঃ
This is an insult to a nation of 75 million people. Even politically your stand is untenable. How can the majority of a nation secede?
অবিশ্যি সঁড়ির সাক্ষী মাতাল জুটে যায়।
আমার পত্রে এক জায়গায় আছে–
Mr. Premier, the tragedy with this land is that the people who labored to establish Pakistan has no say now, whereas the ex-colonial military Personnel (Yahiya Khan and his gang) who could not go beyond their tummy and its lower region, now can dictate, what is good or bad for the country.
বাংলা তর্জমায় ঃ “জনাব প্রধানমন্ত্রী, এই দেশের ট্র্যাজেডি কোথায় জানেন? পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা যারা করেছিল তাদের কোন মতামত নেই আজ। অন্য পক্ষে একদা বৃটিশ উপনিবেশের সামরিক কর্মচারী যারা উদর এবং তনিম্ন এলাকার বাইরে যেতে পারত না, তারা এখন দেশের মঙ্গলামঙ্গলের ব্যাপারে
৮৩
সর্বেসর্বা।”
আমার চিঠিটার পরিসমাপ্তি এইভাবে টানা ঃ
I do not know, Sir, what is going to happen in future. But this much I can tell: rather than submit to those West Punjabi Muslim (?) barbarians, we would die to the last man with this solitary regret that a great country flying socialist banner aligned herself with the looters, rapists, murderers and marauders,
With thanks,
Yours faithfully,
Shaukat Osman
20.8.71
বাংলা তর্জমায়–
“প্রিয় প্রধানমন্ত্রী,
আমি জানি নে, ভবিষ্যতের অন্ধকারে কি সঞ্চিত আছে। তবে এটুকু আপনাকে বলতে পারি ঃ পশ্চিম জঙ্গি পাঞ্জাবী মুসলমান (?) জঙ্গীচক্রের নিকট আনুগত্য স্বীকারের পূর্বে বাঙালী শেষ ব্যক্তিটি সানন্দে মৃত্যুবরণ করবে, শুধু একটি মাত্র পরিতাপসহ যে, সমাজতন্ত্রের পতাকাবাহী চীনের মত এক মহান দেশ ধর্ষণকারী, লুটেরা, পাশব হত্যা-উন্মাদ এক সাময়িক দঙ্গলের সঙ্গে নৈতিকভাবে নিজেদের সামিল রেখেছিল।” তিন কপি টাইপ করলাম কার্বন দিয়ে। এক কপি কাল দিল্লীর চৈনিক দূতাবাসের ঠিকানায় পাঠাব। দ্বিতীয় কপি হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার জন্য। এক কপি নিজের কাছে। তর্জমা করে বাংলা কাগজে পাঠাতে হবে।
১৯৭১
২১ আগস্ট
দ্রুত যেন ঠিকরে এসে পড়ে, বিশেষত সংবাদ যদি শুভ হয়। একই মাসে যেন বিরাট ধস নেমেছে। ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে তেরজন পাকিস্তানী অফিসারের ‘ডিফেক্ট’ সংবাদের উত্তেজনা পনর দিনে কিছু ঢিমে হয়ে এসেছে, এমন সময় খবর এলাে ইরাকের রাষ্ট্রদূত বাগদাদ থেকে লন্ডনে পালিয়ে যেতে পেরেছেন
৮৪
১৯৭১ স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর সপরিবার। লেভেল-পর্যায় এবার আরাে উর্ধ্বে। সুতরাং মুজিবনগরের। অধিবাসীদের জন্যে তুমুল উত্তেজনাময় খবর বৈকি।
ইরাকের রাষ্ট্রদূতের নাম এ এফ এম আবুল ফতেহ। কয়েকদিন এই নাম জপমালার মতাে উচ্চারিত হবে। পরবর্তী খবরটি কাগজে ছিল না, কিন্তু শােনা গেল, মাত্র একটি সুটকেস হাতে তিনি নাকি পাকিস্তানী গােলামীর মুখে পদাঘাত করে এসেছেন। পাকিস্তানের দোস্ত ইরাক থেকে নিষ্ক্রমণ নিশ্চয় ঝুঁকিপূর্ণ। পরে বিস্তারিত জানা যাবে।
বেশ ভাল লাগছিল আজকেই পৌছাল জাতিপুঞ্জের এডেন অফিস থেকে ডক্টর এম আর খানের চিঠি । কিন্তু একটি সংবাদে বেশ মুষড়ে যাই। ডক্টর খান পত্রটি কিছু বাংলায় লেখা শেষাংশ ইংরেজিতে। তিনি লিখছেন,
“Shaikh Mujibar Rahman has perhaps been long dead. The iron secrecy of his pretended trial is only a vile but naive attempt at deceiving the world.
(শেখ মুজিবুর রহমান বােধ হয় অনেক আগেই মারা গেছেন। তার বিচারের ভান সম্পর্কে কট্টর গােপনীয়তা পৃথিবীকে ধোকা দেয়ার চেষ্টা মাত্র) অবিশ্যি ডক্টর এম আর খানের পত্রটি অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ভাষায় শাসকদের বিরুদ্ধে ঘৃণার প্রকাশ। তবে আমার মনে হয়, পাকিস্তান সরকার বিশ্ব জনমতের তােয়াক্কা রাখবে না, এমন হওয়া অসম্ভব। পত্রের শেষ পংক্তিতে লিখেছেন Salute to Enayet Karim এনায়েত করিমকে সালাম।
অবিশ্যি বন্ধুবর ক’দিন পূর্বে অনুষ্ঠিত ভারত-সােভিয়েতের মৈত্রী চুক্তির কথা উল্লেখে অবহেলা করেননি। এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশের ব্যাপার নতুন তাৎপর্যময় হবে বৈকি।
১৯৭১
২২ আগস্ট
ঢাকা পুঁথিঘর প্রকাশনীর ম্যানেজার ছিলেন পূর্বে প্রিয়লাল দাস। হঠাৎ কাল বিলােনিয়া থেকে তার পত্র পেলাম। আমাদের খবর দাস মশাই জেনেছেন। রামেন্দু মজুমদার ও আমার ছেলে ইয়াফেসের কাছ থেকে। ঠিকানা তারাই দিয়েছে।
প্রিয়লাল দাস পত্রে এক জায়গায় লিখছেন, “…আমি ৭ই এপ্রিল মাইজদী
৮৫
আসি। ২৩ তারিখ পর্যন্ত ছিলাম মাইজদীতে। তারপর গ্রামের দিকে চলে যাই। এরপর ১৪ই জুন এখানে এসেছি সর্বস্ব হারিয়ে। আমার শ্বশুর-শাশুড়ির একগুঁয়েমির জন্যে আমার স্ত্রীকে আনতে পারিনি এখনও। তারা মােটামুটি নিরাপদে আছে খবর পেয়েছি। তবে সহসাই আনাবার চেষ্টা করছি। দিন দিনই অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। জানি না আমাদের ভবিষ্যৎ কি । নেতাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখে আরাে হতাশ। এখানকার একটি youth camp political motivator হিসেবে কাজ করছি গত এক মাস যাবৎ। পরিবারের অন্যান্য সবাই মিলে রিলিফের দ্বারা জীবন যাপন করছি। কোন প্রকারে বেঁচে আছি বললেই বােধ হয় ঠিক হয়….।”
* প্রিয়লাল দাস বর্তমানে তুলারাম কলেজের অধ্যাপক।
** রামেন্দু মজুমদার ঢাকার খ্যাতনামা অভিনেতা।
১৯৭১
২৩ আগস্ট
গত রাতে স্বপ্ন দেখলাম স্বর্গীয় শরৎচন্দ্রকে। কার’-ঝােলানাে চশমা চোখে পাশে বসলেন। ওর প্রিয় কুকুর ভেলিকে নিয়ে উপন্যাস লেখবার বাসনা ছিল। আসল উদ্দেশ্য কুকুরের সঙ্গে সম্পর্ক মারফৎ লেখকের মানস আকৃতি ও জগতের স্বরূপ উদঘাটন। উপন্যাসের নামও ঠিক করেছিলাম। জিয়া-ভেলি। শরৎ বাবুকে ভাইপাে-ভাইঝিরা আদরে ডাকতঃ জিয়া। সেই সূত্রে নাম। আবার জিয়া-ভেলি মানে প্রাণ পাইলও হয়। জিজ্ঞেস করলুম এমন উপন্যাসে আপনার আপত্তি নেই ত? মাথা নেড়ে জানালেন, না। তারপর ঘুম ভেঙে গেল। উপন্যাস লেখার ইচ্ছে পুরাতন। অচেতন মনের বুদ্বুদ আবার ভেসে উঠল অনেকদিন পরে।
কিন্তু এই বই আমার পক্ষে লেখা সম্ভব হবে না, শুধু পরিশ্রমের অভাবে। শরৎচন্দ্রের ক্রমশ জীবনী, তার গল্প-উপন্যাসের কালানুক্রমিক ছবি একদম চোখের সামনে থাকা উচিত। আমার কি সময় হবে হাজার ঝঞাটের মধ্যে? এই বয়সে বাসনা যথাস্থানেই গুমরে-গুমরে স্তব্ধ হবে।
১৯৭১
২৪ আগস্ট
রণাঙ্গনের সংবাদ খুবই আশাপ্রদ।
৮৬
১৯৭১ স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর এক সাংবাদিক কিভাবে দু’কূল খুইয়েছে সেই কাহিনী শােনা গেল। বঙ্গবন্ধুর অসহযােগ আন্দোলনের সময় তার সমর্থন ছিল পুরােপুরি। বিশেষ সহানুভূতিশীল। কিন্তু শ্বশুর সাহেব বাঙালী আন্দোলনের বিরােধী। পঁচিশে মার্চের পর বেগতিক জামাইকে রক্ষা করা। মিলিটারী কর্তৃপক্ষ শর্ত দিলাে সাংবাদিক যদি বাইরে গিয়ে আর্মির অনুকূলে প্রচার চালায় ওকে মাফ করা যেতে পারে। যথাদেশ। জামাই বিদেশে গিয়ে মিলিটারীদের পো ধরলাে। হংকং থেকে B. B. C বিবিসির কাছে এক লম্বা ডিসপ্যাচ পাঠালাে। সাংবাদিকে স্ত্রী-পুত্র ঢাকায় পড়ে আছে। সে ওদের বাইরে যাওয়ার টিকেট পাঠিয়ে দিলে। কিন্তু আর্মি রাজি হয় না। ওর পরিবার জামিন থাক-পেছনে এমনই মতলব। সাংবাদিক আর ঘরে ফিরতে পারবে না মুক্তিফৌজের ভয়ে। মিলিটারীরা তাকে অবিশ্বাস করে বসে আছে। শ্বশুর কী সুখে থাকবে! লােকটা ইংরেজী লিখতে পারে সেই গুণে সাংবাদিক। নচেৎ পাকিস্তানের দালাল বহুকাল থেকে। ব্যুরাে অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন (B. N. R) নামে একটা প্রতিষ্ঠান ছিল বাঙালীদের মগজ ধােলাইয়ের জন্যে। প্রবল উত্তেজনা দেশময় এই সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে, কিন্তু শ্বশুর মশাই তখন দেদার লিখছেন, কেন অমন মহৎ প্রতিষ্ঠানটি দেশে থাকা উচিত। পারিবারিক অশান্তি ওকে ধ্বংস করুক।
*********************
মুনীর চৌধুরী বেড়ার উপর বসে থাকো নীতি পালন করলেও তার ছেলে ভাষণ মুক্তিফৌজে যােগ দিয়েছে। এমন লড়াইয়ে কি নিরপেক্ষ থাকা যায়?
১৯৭১
২৫ আগস্ট
পাকিস্তান সরকার বৃটিশ বৈদেশিক দপ্তরে প্রচণ্ড প্রতিবাদ জানিয়েছে। এ কী ধারা কাণ্ড? রাষ্ট্রদ্রোহী পাকিস্তানী ইংল্যান্ডে গেলেই আশ্রয় পেয়ে যায় এ কী ধারা লজিক?
কয়েকদিন পূর্বে ইরাকের রাষ্ট্রদূত এ এফ এম আবুল ফতেহর পলায়নের পর পাকিস্তানী সরকারে এই তপ্ত উম্মা-গােস্বা। এমন কী চাপ পর্যন্ত দিলে যেন ওঁকে interdict ফিরিয়ে দেয়া হয়। স্থানীয় সব সংবাদপত্রে খবরটি বেশ ফলাও
৮৭
১৯৭১ স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর প্রকাশিত। রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে পূর্বে কবে দেখা আজ ঠিক মনে পড়ে না। কিন্তু চাটগাঁয় পাচের দশকে ওর অগ্রজ তিনিও আর এ এ এফ এম (প্লাস) Plus আব্দুস সাত্তার, সততার কীর্তিমান, ইনকাম ট্যাক্স অফিসার ছিলেন তখনই পরিচয়। হাড়ইমানদার বলে খ্যাতি ছিল অগ্রজের। অনুজ আবুল ফতেহ দেখছি হাড়-বাঙালী। তিনি সত্যি ক’দিন আমাদের ফতে (আরবী ফতেহ শব্দ থেকে) করে রাখলেন। এ্যামব্যাসেডার সাহেব আর Embasstardized (শব্দটি কবি এজরা পাউন্ডের তৈরি) আবহাওয়া বরদাস্ত করতে পারছিলেন না, বেশ বুঝা গেল ।
জয় বাংলা। জয় বাংলা।
************************
১৯৪৫-৪৬ কমার্স ইন্সটিটিউটে আমার ছাত্র ছিল মােস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী। পলিটিক্যাল সার্কেলে এম আর সিদ্দিকী, বর্তমানে নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত, কানাডার টরােন্টো শহরে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়া আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যােগদান করেন। কানাডা পার্লামেন্টের এক সদস্য ভারতে আশ্রিত বাংলাদেশের নাগরিকদের দুর্দশাময় চিত্র বড় জোরেশােরে ফুটিয়ে তােলেন। পাকিস্তানী গণ্ডারের চামড়ায় তার আসর হবে কি?
১৯৭১
২৬ আগস্ট
ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সভায় আজ বাংলাদেশের ব্যাপারে চীনের ভূমিকার সমালােচনা সম্বলিত একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। পাকিস্তানের বর্বরােচিত গণহত্যার ক্ষেত্রে চৈনিক পার্টির নীরবতা বিস্ময়কর। বাংলাদেশকে অচিরে স্বীকৃতি দানের কথাও প্রস্তাবে উল্লেখিত।
আরাে বিশিষ্ট খবর, মার্কিন জাতীয় প্রেসক্লাবে টেড কেনেডীর বক্তৃতা। তিনি সিনেটের সদস্য। রিফিউজী ক্যাম্পগুলাে স্বচক্ষে দেখে গিয়ে সেখানকার দুর্দশাময় চিত্র দেশবাসীর কাছে তুলে ধরেন।
************************
বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধের বর্তমান রূপ অনুধাবনযােগ্য। মুসলিম লীগের দালালদের
৮৮
এখন মুক্তিফৌজ নিধন করছে। একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। একজনের বাপকে মুক্তিফৌজ নিধন করে। সে একদল মুক্তিফৌজকে ধরিয়ে দিয়েছিল মিলিটারীদের কাছে। বাপকে মারার পর সমস্যা। ছেলে অন্য সেক্টরে মুক্তিযােদ্ধা। কিন্তু তার পিতাকে না মেরে উপায় ছিল না।
গৃহযুদ্ধের এই রূপ আমি দেখে আসতে পারিনি। আমার মনে হয় গােড়া থেকে দালাল মারা নীতি গ্রহণ করলে হিন্দু ভাইদের এত বিপদে পড়তে হতাে
কিন্তু স্বাভাবিক জীবন থেকে কে অস্বাভাবিক জীবনে যেতে চায়?
ব্যক্তির জীবনে যা-ই হােক, সমাজ গােষ্ঠীতে কিন্তু বৃহত্তর কলাণে আমরা ছােটখাটো পাপ (হ্যা, অন্য শব্দ না থাকা বিধায়) করা উচিত। অখণ্ড শান্তিবাদ এখানে অচল। বাঘের সামনে কি বাইবেল আওড়ে বাঁচা যায়? নিজ দর্শনের দুর্বলতা দেখে গান্ধীজী একবার বলেছিলেন, “I never make a fetish of consistency সঙ্গতি রক্ষাকে আমি কখনও অন্ধ ভক্তির পর্যায়ে ফেলিনি।”
এক ছাত্রনেতার বিয়ে হয়েছে। বৌ-ভাত হচ্ছে কোন Posh ‘পশ’ হােটেলে। তার আগেকার বৌ আছে। পুলিশ সূত্রে খবর, সে নাকি নিষিদ্ধ আলয়েও গমন করে। সংগ্রামের এই কুরুক্ষেত্রে নানা ধরনের লােক জমায়েত হয়। মার বেইজ্জতির সামনে সন্তান রুখে উঠে। সন্তানদের মধ্যে দুর্জন-দুরাচারও থাকতে পারে সজ্জনের পাশাপাশি ।
কিন্তু সংগ্রামের নেতাদের যদি এই চেহারা হয়, আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
১৯৭১
২৭ আগস্ট
খবর পেলাম, রাজশাহীর ডিআইজি মামুন নিহত। এই স্নেহভাজন কিশাের বালক আমার সামনে বড় হয়েছে। বুলবুল’ পত্রিকা সম্পাদক হবিবুল্লা বাহারের ভাগিনা। সেই সূত্রে পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। বেশি বয়সে বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ এম এ পরীক্ষা দেন। আমার নােট সবাই ব্যবহার করেছিলেন। স্নেহভাজন মামুন অতি চরিত্রবান ছেলে। আজ মনে হয়, বাইবেলের কথা ফলে
৮৯
যায় ঃ এক পুরুষের পাপ আর এক পুরুষে বর্তায়। মামুনের মা বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ নারী-প্রগতির পথিকৃৎ, পাকিস্তান গঠনেও ভূমিকা নিয়েছিলেন। দ্বিজাতিতত্ত্ব জাত সেই পাপের প্রায়চিত্ত করে গেল মামুন মাহমুদ। বিস্ময়কর, আমি আবার এই নাটকের প্রথম অংকের সাক্ষী। মামুন পাকিস্তান সার্ভিসের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ । সে পুলিশের চাকরি নেবে না। ঘাের গররাজি। বাড়িতে আদর্শ আছে এবং পুলিশ ঘৃণার ঐতিহ্য। কিন্তু চাকরিটা পুলিশ সাহেবের চাকরি, চাট্টিখানি কথা নয়।
সৎ ও নিরীহ ছেলে মামুন। গুরুজনদের একদম অবাধ্য হয় না। শেষে চাকরি নিলাে। পরিণাম বিয়ােগান্ত বৈকি। শুনেছি, মামুন ইদানীং মদ ধরেছিল। মদ এমন কিছু অপাংক্তেয় দ্রব্য নয় । কিন্তু যতই বেতন পাক, সরকারী চাকুরের বেতন ত কম। তারা কীভাবে মদ খাবে? পেছনে নানা ফ্রাসট্রেশন (নিষ্ফলতাবােধ) ভারসাম্য কেড়ে নেয়।
এই অনুষঙ্গে আজ সজ্জন সৈয়দ মান্নান বখশের কথা মনে পড়ল। একদা রায়পন্থী, রেডিক্যাল ডেমােক্রেটিক পার্টি করত। মদ খায় না, ঘুষ খায় না। কিন্তু উত্তরােত্তর ধর্মীয় ক্রিয়াচারের দিকে ঝুঁকেছে। মার্কসবাদ থেকে চরম আস্তি কতামুখী। ফ্রাসট্রেশনের এ-ও এক রূপ। তের জন পুলিশ অফিসার মারা গেছে। তার মধ্যে মান্নান বখশ আছে কিনা, কে জানে? অনেককে জিজ্ঞেস করেছি। কেউ কিছু বলতে পারে না। সৎ লােক। তাই উদ্বেগ।
*************
বঙ্গবন্ধুর বিচার সম্পর্কে বিশ্বজনমত ক্রমশ সুগঠিত রূপ পাচ্ছে। আমার মনে হয় পাকিস্তান এই ব্যাপারে হঠকারিতা দেখাতে পারবে না।
১৯৭১
৩০ আগস্ট
খবরে প্রকাশ, দিনাজপুরে এক জায়গায় মানুষের হাজার হাজার কংকাল স্থূপীকৃত। সামরিক কর্তৃপক্ষ নিজেদের অপরাধ ঢাকা দিতে বলে, “এগুলাে অবাঙালীদের কংকাল।”
বাঙালী-অবাঙালীর প্রশ্ন অবান্তর। মানুষ মরেছে-এই কলংক ত আর ঢাকা দেয়া যাবে না। ইতিহাসের এ ঘৃণ্য অধ্যায়, হে জননী বাংলাদেশ, তােমার
৯০
শ্যামল বুকের উপর বর্বরেরা গেঁথে দিয়ে গেল।
*****************
টিক্কা খান শেষ বিদায় নিল। ডাঃ মালিক এখন গভর্নর। তবে প্রেসনােটে বলা হয় যে, সেনাবাহিনী পূর্বের মত কাজ করে যাবে। টিক্কা খানের মত জীবজন্তুরা ভাবে, হত্যা মারফৎ রাজনৈতিক সমাধান মেলে। তাহলে হিটলার জিতে যেত বৈকি। সব সেনাপ্রধান একই ধারায় চিন্তা করে এবং ভাবে সে হবে পূর্বেকার নিয়মের ব্যতিক্রম। কিন্তু মনুষ্যত্বের যদি এই পন্থায় পরাজয় ঘটত, তাহলে মানুষের সভ্যতা কিছুই এগােত না। প্রকৃতি ধ্বংস করে ! কিন্তু সৃষ্টি তার মূলমন্ত্র। অস্তিত্ব সৃষ্টি বৈকি। সুতরাং ধ্বংস শেষ কথা নয়। মূর্খেরা ও এহিয়াটিক্কা খানের মত জীবজন্তুরা তা বুঝতে অক্ষম। এমন নরাকার দানবেরাই বলতে পারে, “হাম আদমী নেহি জমিন দেখনে মাঙতা-(অর্থাৎ আমি মানুষ না জমিন দেখতে চাই)।” একটা দেশকে ছারখার করার প্রকৃষ্ট নীতি। গণহত্যা চলছে, তা প্রমাণ করার জন্যে টিক্কা খানের এই একটি বাক্যই ত যথেষ্ট। আন্ত র্জাতিক রাজনীতির ফের বড় জটিল। জাতিপুঞ্জের প্রধান উ থান্ট সাহেব বৌদ্ধ । প্রাণী হত্যা যে ধর্মে নিষিদ্ধ, সেখানে মানুষের ব্যাপারে পয়-পয় কতাে নিষেধ। অথচ উ থান্ট সাহেবের বাংলাদেশের ব্যাপারে দুই ঠোট ফাক হতে চার মাস লেগেছে। এতদিনে তিনি দু-চার বাক্য উচ্চারণ করেন। চৈনিক নেতাদের নাম উচ্চারণও আমি এখন অপরাধ মনে করি। ওদের ভেতর রাজনীতি থাকতে পারে, মনুষ্যত্ব নেই।
১৯৭১
৩১ আগস্ট
কলকাতার দৈনিক The Hindustan Standard পত্রিকায় আজ আমার An open letter to Chou-En-lai (চাউ এন-লাই-এর নিকট খােলা চিঠি) বেরিয়েছে। অবিশ্যি বাংলা অনুবাদটি পূর্বে প্রকাশিত। বাংলা পত্রিকায় দু’দিন পরে দিই, কিন্তু বেরুল আগে।
দিল্লীর চৈনিক দূতাবাসে কদিন আগে ডাকে পাঠাই চিঠিটি। এক হিতাকাঙ্ক্ষী বললেন, “কেন পয়সা খরচ করলেন এবং সময়ও? এখানে কিছু কোন কাগজে বেরুলে ওদের কাছে গিয়ে পৌছত। ওদের কাজই ত এসব।”
৯১
কলকাতার বাসিন্দা উর্দুভাষী কবি পারভেজ শাহেদীর সঙ্গে দেশ বিভাগের পর আর দেখা হয়নি। ওর মৃত্যু সংবাদ বেরিয়েছিল একমাত্র ঢাকার ইং-পত্রিকা The Morning News এ ফটোসহ। আমি তা আমার জার্নালে সেঁটে রাখি ।
কিছু মন্তব্য পাশে।
আবার ফিরে এলাম পরিচিত শহরে। কিন্তু কবির সঙ্গে আর দেখা হলাে । আজ ওর কয়েকটি কবিতা হাতে পড়ল। একটি কবিতায় লিখছেন–
বেকসীয়ে দীল্ আপনি দূর কি মাইনে
দুসরু কে গম কো ভি আপনা গম বানায়া হ্যায়।
বাংলা গদ্য অনুবাদে “নিজের মনের নিঃসঙ্গতা আমি দূর করলাম, অপরের দুঃখকে নিজের দুঃখ বানিয়ে নিয়ে।”
******************
আজ “বাংলাদেশ, বাংলাদেশ” করছি জাতীয়তাবাদের ডাকে, কিন্তু তা যেন আমাদের অন্ধ না করে দেয়। উর্দু ভাষার প্রতি ঘৃণা, উর্দুভাষীর প্রতি ঘৃণা আমাদের অন্ধ না করে রাখে। তা হবে এক চরম আধ্যাত্মিক মৃত্যু।
১৯৭১
১ সেপ্টেম্বর
এখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডাঃ মালিক। ডাক্তার না ‘ডিজিজ’ ইতিহাস রায় দেবে। তার আগেই রায় দেয়া যায়। কারণ, বাঙালীর বাচ্চার অতীতের ইতিহাস জানা। যৌবনে নাবিক আন্দোলন Seamens Union করত। শ্রমিক দরদী চিকিৎসক। এই ইউনিয়নের টাকা সাফায়ের ভেতর দিয়ে তার দুর্নীতির লগে প্রথম পরিচয়। লম্বা ইতহাস। এখন জনগণের শত্রুরূপেই চিহ্নিত হবে চিরকাল। পুরাতন পদবী ছিল মল্লিক। পাকিস্তান প্রভুদের কায়দায় মল্লিক হলাে মালিক। জাতে-ওঠা বাঙালী। প্রসেস process ঠিকই চলছে।
সে যা-ই হােক, মুক্তিযােদ্ধাদের সুগঠিত সংগত চাপ উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখানেই সকল ভরসা। অবিশ্যি দু’দিন পূর্বে মুক্তিবাহিনীর দুই ছেলের সঙ্গে দেখা। তারা কিছুটা Frustrated নেতৃত্বের দুর্বলতার ফলে নানা অব্যবস্থার
৯২
ফিরিস্তি তারা দিলে। অবিশ্যি দালাল নিধন অব্যাহত আছে।
********
প্রেসিডেন্ট এহিয়া ফরাসী কাগজের প্রতিবেদনকে বলেছে যে, বর্ডারে কিছু কিছু জায়গা ছাড়া গােটা দেশ তাদের নিয়ন্ত্রণে। যদি এমন চলতে থাকে তাহলে ভারতের যুদ্ধ ছাড়া অন্য পথ থাকবে না!
********
দেশের অভ্যন্তরে খাদ্য পরিস্থিতি বেশ নাজুক অবস্থায়। বৃটিশ পার্লামেন্টের সদস্য বার্নার্ড Bernard BRAIN বলেছেন যে, বাইরে থেকে সাহায্য না গেলে পূর্ব পাকিস্তানে দুর্ভিক্ষ অনিবার্য।
১৯৭১
২ সেপ্টেম্বর
ভাই সয়ীদুল হাসানের নিহত হওয়ার সংবাদ পেলাম আজ। সহজাত মানবতাবােধ তাকে সবসময় প্রগতিশীল রাজনীতির কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছিল। এমন মৃত্যু স্বভাবতই জাতির জন্যে দুঃখজনক অকল্যাণ। শ্রী হট্টের চা-বাগানের শ্রী নির্মল চৌধুরী ঢাকা এসেছিলেন দুই মেয়েকে নিয়ে ২৩ মার্চ। ২৫ মার্চ হত্যাযজ্ঞের পর সয়ীদ ভাইয়ের কাছে আশ্রয় পান তিনি। সামরিক কর্তৃপক্ষ দুজনকেই নিয়ে যায় এবং তারা আর ফিরে আসেননি।
সত্তর সনের ডিসেম্বরের ১৭/১৮ তারিখে সিলেট গিয়েছিলুম।
নির্মল বাবুর আতিথেয়তা স্মরণীয়।
হিন্দু এবং মুসলমান একত্রে রক্ত ঢেলে দিয়ে গেল। এই শ্রদ্ধায় স্বর্গীয়দের উদ্দেশ্যে সালাম জানাই আজ।
সাম্প্রদায়িকতার কলংক আরাে কতাে রক্ত দিয়ে ধুতে হবে ভবিষ্যই জানে। বাংলাদেশের ট্র্যাজেডিও সাম্প্রদায়িকতা-জাত। মুসলমানেরা বুঝলে না, উন্মত্তের মতাে মুসলিম লীগের আলেয়ার পাছে ছুটলাে। প্রায়শ্চিত্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে-লােকে করে। গােটা দেশ কওম এখন প্রায়শ্চিত্ত করছে। মুক্তিবাহিনীর শহীদরা আমাদের পানে চেয়ে আছে। সয়ীদুল হাসান, নির্মল চৌধুরী শহীদদের
৯৩
কাছেই ফিরে গেছেন আর নিশ্চয় তারা দেখছেন-আমরা কি করি । তাদের প্রদর্শিত পথে বহু তরুণ আজ হেঁটে চলেছে, আরাে বিশাল কাফেলা হবে বৈকি এই সড়কে।
১৯৭১
৩ সেপ্টেম্বর
বিদ্রোহীর পুত্র কাজী সব্যসাচী। পিতৃগৌরবে স্ফীত তার বুক নয় শুধু, তার কণ্ঠটিও অপূর্ব। পাকিস্তান সরকার নজরুলকে মাসহারা দিতাে অনেক বছর আগে থেকে। আজ কাজী সব্যসাচী তা প্রত্যাখ্যান করেছে। বিবৃতিতে তিনি বলেন, পাকিস্তানী ভাতা রক্তমাখা, তা কারাে স্পর্শ করা উচিত নয়। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এগিয়ে এসেছে ভাতা সম্পর্কে মঞ্জুরিদানে। ইতিহাস এইভাবে পুরাতন জঞ্জাল দূর করে। অবিশ্যি সব কিছু বিলম্বে ঘটে।
***********
ওরিয়েন্ট রােড। জনাব আবদুস সামাদ আজাদ আমার বাড়ির নিকটেই থাকেন। তার কাছে গিয়েছিলুম এক জরুরী ব্যাপারে। গতকাল আমার সঙ্গে সাক্ষাতে ইউরােপীয় বিদেশী ভদ্রলােককে নিয়ে এসেছিল কোন স্থানীয় প্রীতিভাজন সাংবাদিক। সেই সূত্রে জনাব আজাদ সমীপে। সাক্ষাৎকারী অবিশ্যি আমি একা। ইসরাইল রাষ্ট্র বাংলাদেশের সংগ্রামে অস্ত্র যােগাতে রাজি। প্রস্তাব লােভনীয় বৈকি। আলােচনায় ভ্রাতা সামাদের যুক্তি ঠেলে দেয়া গেল না। তিনি বললেন, কূটনৈতিক অসুবিধা প্রচণ্ড। নচেৎ মরণপণ রণে যে সাহায্য দেয়, সেই তাে দোসর । প্রথমত মুসলমান রাষ্ট্রগুলাে বাংলাদেশ বিরােধী। ইহুদী রাষ্ট্র থেকে অস্ত্র নিচ্ছে। এটুকু প্রকাশ পেলেই তাদের প্রচারের আরাে সুবিধা হবে। রাশিয়া এবং ইসরাইলে কোন কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই । রাশিয়া বাংলাদেশের মিত্র রাষ্ট্র। ভারত সরকারের মতামত কি হবে কে জানে। আন্তর্জাতিক পটভূমিকায় ব্যাপারটা আদৌ আমাদের অনুকূলে নয়। মেনে নিলাম।
অস্বাভাবিককালে অস্বাভাবিক কাণ্ড ঘটে
১৯৭১
৪ সেপ্টেম্বর
দুঃখিনী বাংলাদেশ।
দুঃখিনী আমার জননী। সারাজীবন একের পর এক বিপর্যয় সম্মুখীন কতাে কষ্ট
৯৪
না সয়ে তিনি বেঁচে আছেন। ন’জন ভাইবােন। একে একে চলে গেছে ছয় জন ওঁর বুক খালি করে। ছােট ভাই জিলানী বেঁচে আছে। সে বেকার শিল্পী। বড় নিরীহ। আমি এত দূরে। মার বয়স বর্তমানে চুয়াত্তর শেষ হবার পথে। কে তার খবরদারি করবে মাঝে মাঝে এই চিন্তা আমাকে মুষড়ে দেয়। গােটা বাংলাদেশের পটভূমির দিকে চেয়ে মনকে শান্ত করি।
হতভাগিনী কেন জন্মেছিলি এই দেশের নির্মম মাটিতে? তাের সহােদরা বাংলাদেশ মােহনীয়া, তবু দুঃখিনী। তােমাদের আলিঙ্গন আমাকে অস্থির করে তােলে।
১৯৭১
৫ সেপ্টেম্বর
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে বাঙালী শরণার্থীদের দুর্দশা বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দেন এবং সাহায্যের আবেদন জানান।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন জাতির উদ্দেশে বাংলাদেশ বেতার থেকে বলেন যে, স্বাধীনতার জন্যে বাঙালীরা বর্তমানে পাকিস্তানের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত। এই লক্ষ্য থেকে আর বিচ্যুতির কোন প্রশ্ন ওঠে না। তবু হানাদার বাহিনী যুদ্ধের মীমাংসার নানা প্রস্তাব আনে। পরিহাস বৈকি। ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার ও জীবন সম্পর্কে বিশ্বের সকল রাষ্ট্র এবং জাতিপুঞ্জের মহাসচিবের নিকট আবেদন জানান।
সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী শ্রীবসুধা চক্রবর্তী পত্রে জানিয়েছেন যে, তিনি। শান্তিনিকেতন ও অন্যান্য জায়গায় যাবেন, কলকাতায় থাকবেন না। দেশ বিভাগের অনেক পূর্বে থেকেই এই উদার সজ্জনের সঙ্গে পরিচয়। রাজনৈতিক কি সামাজিক আলােচনায় ওর মূল্যবান মতামত বড় কাজে লাগে। অনেক সময় ওঁর কাছে যাই বা ডেকে পাঠাই। উনি তা জানেন। তাই চিঠি লিখেছেন গরহাজিরের কারণ দর্শিয়ে, “আগামী সপ্তাহের শেষভাগের পূর্বে দেখা করতে পারবাে না। তুমি ইতিমধ্যে মন দিয়ে লেখাপড়া করাে ফিরে এসে দেখবাে।” “মাসুদ সাহেবকে আমার প্রীতি জানিও।”
মাসুদ—জাস্টিস মাসুদ।
দিল্লীতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মিশন খােলা হয়েছে। ভারতীয়
৯৫
হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র দপ্তরে ডেকে নেপথ্য ধমকসহ ঘাের প্রতিবাদ জানিয়েছে পাকিস্তান সরকার। ডিফেক্ট করা অনেক অফিসার এখন বাংলাদেশ মিশনে কার্যরত।
১৯৭১
৭ সেপ্টেম্বর
ভাই সয়ীদুল হাসানের মৃত্যুসংবাদ সত্য। আর হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যরা রীতিমত বিপর্যস্ত। দিল্লীর প্রেসক্লাবে এক ভাষণে বাংলাদেশ মিশনের তত্ত্বাবধায়ক বলেছেন যে, বাংলাদেশের শতকরা আশি ভাগ এখন গেরিলাদের হাতে। হানাদারেরা তাদের গর্ত ক্যান্টনমেন্টে ঢুকছে ক্রমশ। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্যে এখন চাপ সৃষ্টি করা উচিত। বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তি, সৈন্য প্রত্যাহার দাবিও ছিল।
গােরস্তানে পাকিস্তান।
জয় বাংলা!
১৯৭১
৯ সেপ্টেম্বর
আনন্দে নিজের মধ্যে লাফিয়ে উঠেছিলাম। সিকান্দার বন্ধু সিকান্দার অর্থাৎ সমকাল-সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর নিরাপদে পালিয়ে আসতে পেরেছে। প্রচণ্ড সাহসী সংগীতজ্ঞ সাংবাদিক কবি। কিন্তু আর থাকতে পারেনি বধ্যভূমে। রিপন স্ট্রীটে কোন এক আস্তানায় উঠেছে। আজই খোঁজে যেতে হবে। শােনা গেল, কিন্তু পালিয়ে আসার পূর্বে সিকান্দার “আমার অভিযােগ” নামে এক অনলবর্ষী পুস্তিকা ও কবিতার বই বের করে তবে সীমান্তের দিকে দৌড় দিয়েছে। ওর সঠিক ঠিকানা এখন প্রয়ােজন।
১৯৭১
১০ সেপ্টেম্বর
আরাে আনন্দ সংবাদ। চিঠির ঠিকানা ঃ এ আর মতীন উদ্দিন, বাংলাদেশ মিশন, ১২২৩ কানেকটিকাট এভিনিউ, ওয়াশিংটন ডিসি ২০০৩৬ ইউএসএ। চিঠি
৯৬
১৯৭১ স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর খােলার পূর্বেই বিদ্যুৎ খেলে গেল মাথায়। বাংলাদেশ মিশন তাহলে মার্কিন দেশেও খােলা হয়েছে। জয় বাংলা।
লেজে মতিনউদ্দীন লাগিয়ে আবু রুশদ কতাে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, অবিশ্যি আমার জন্যে নয়, অপরের জন্যে। ডিফেক্ট করেছে গত মাসে চার তারিখে। আমি তখনই অভিনন্দন পাঠাই। জবাব পেতে এক মাসের বেশি লেগে গেল। অবিশ্যি চিঠির যাতায়াতে ত বিশ দিন লেগে যায়। ক্ষমাহঁ সূত্রে পত্রারম্ভ ঃ “তােমার অভিনন্দনপত্র বেশ কয়েকদিন আগে পেয়েছি। নানা ঝামেলায় উত্তর দিতে দেরী হয়ে গেল বলে কিছু মনে করাে না। এখানে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে উপরের ঠিকানায় মিশন খােলা হয়েছে। আমি ও আমার সহধর্মিণী এখানে কাজ করছি। ভাতা যা পাব চলে যাবে। ওয়াশিংটনে অবশ্য খরচ খুব বেশি। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের অবদান কতটুকু?… আরাে আবু রুশদ লিখেছে, “শিরীন, জামাই ও ফয়সল* দেশ ছেড়ে এখানে চলে এসেছে। ওখানে পাঞ্জাবীরা জামাই-এর পেছনে লেগেছিল।”
পত্রে আরাে, “রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে এখানে কাগজপত্তর দিয়েছি। এখানে কাজ করার অনুমতি পাওয়া গেছে।” অন্যত্র “এনায়েত করিম সাহেবকে দ্বিতীয়বার হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। দিনদশ হলাে বাসায় ফিরেছেন। এখন তার পূর্ণ বিশ্রাম। তবে ভদ্রলােক উৎসাহের আধিক্যে মাঝে মাঝে বেশি কথা বলে ফেলেন।
আমার চেন হার্ট। রক্ত পাম্পের ক্ষমতা ঢের বেশি। ফলে জিভ আর না নড়ে পারে না!
লম্বা চিঠি, বন্ধুবর শেষে লিখছেন, “হাজারাে অসুবিধা সত্ত্বেও তােমরা কর্মক্ষেত্রে আছাে-আমরা কতদূর।” | আবু রুশদ ভুল করেছে। রণক্ষেত্র এখানে আসল কর্মক্ষেত্র। সেখানে সে কেন, আমার মত অনেকেই নেই।
* এনায়েত করিম স্বাধীন বাংলার বৈদেশিক সচিব। এখন জান্নাবাসী সহধর্মিণী আজিজা রুশদ শিরীন দুহিতা জামাই কাজী বাহারুল ইসলাম। বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের এম ডি । ফয়সল দৌহিত্র।
১৯৭১
১১ সেপ্টেম্বর
মুক্তিবাহিনীর যুবক সাজেদ আলীর সঙ্গে আজ পরিচয়। সে পুলিশে চাকরি
৯৭
করত। এবার ছুটি নিয়ে এসেছে মায়ের সঙ্গে সাক্ষাতে ঢাকা যাবে। ঝুঁকি আছে। কিন্তু সাজেদ কোন যুক্তির ধার ধারতে রাজি নয়। মার প্রতি তার ভক্তি অচল। যুক্তি আবেগের পাশে চিরদিনই কমজোর।
সাজেদের মুখে শুনলাম, তার সহযােদ্ধার কাধে গুলী লাগার পর সে বললে, “আমি মরে যাব ক্ষতি নেই। কিন্তু মেশিনগান না শত্রুর হাতে পড়ে। তাড়াতাড়ি ওটা সরাও।” তার নির্দেশ সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপালিত। আহতজন তারপর কোনরকমে গাঁয়ের দিকে চলে গেল। পাক সৈন্য সংখ্যায় বেশি। পরে তারা জায়গাটা দখল করে নেয় এবং রক্তের দাগ ধরে ধরে আহত সৈনিক যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল সেখানে পৌছায়। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে প্রথমে মুক্তিফৌজের চোখ দুটো উপড়ে নেয়। তারপর রাইফেলের কুঁদোর সাহায্যে এমন বাড়ি মারে যে একদিকের কান সুদ্ধ নেমে যায়। এভাবে তাকে হত্যা করে পাকিস্তানী সৈন্যরা। সভ্য মানুষের কি কোন চিহ্ন আছে ওই জন্তুদের গায়ে?
****************
আজ চিঠি পেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কালে অন্তরঙ্গ সহপাঠী জীবনবল্লভ চৌধুরীর কাছ থেকে। আমার চিঠির জবাব। লিখেছে, “তিরিশ বছর পরে সেই যৌবনের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বিশ্বাস যেন আবার পূরবীর ছন্দের ফাঁকে ফাঁকে আহীর ভৈরোর মীড় টানতে চাইছে।” | জীবন.-কে লিখতে হয়, “অতীত বর্তমানকে মাঝে মাঝে পরিহাস করতে যেন ফিরে আসে।” | শেরপুরের জমিদার বাড়ির সন্তান অস্তিত্বের সংগ্রামে আজ নিম্ন মধ্যবিত্ত। কিন্তু প্রাণের পাল্লায় পূর্বের অভিজাতস্য অভিজাত ডক্টর জীবন বল্লভ চৌধুরী।
১৯৭১
১৩ সেপ্টেম্বর
রণাঙ্গনের খবর অনেক সময় বিশ্বাস করতে দ্বিধা হয়। কারণ সাফল্যের পর সাফল্যে। মুক্ত এলাকার পরিধি বাংলাদেশে বাড়ছে। তবে স্বাধীনতায় উদ্বুদ্ধ জাতি অসম্ভব কিছু করে বসে ইতিহাসে দেখা যায়। এই জন্যে বিশ্বাস করতে হয় সানন্দে।
৯৮
আমার কাছে ব্যক্তিগত পর্যায়ে একটি ঘটনা বড় আনন্দদায়ক। আমার খালু আনােয়ারুল হক খান প্রাক্তন সিএসপি অফিসার। এখন অবিশ্যি মুক্তিযােদ্ধা। আগে বাণিজ্য বিভাগের উপসচিব ছিল। বাংলাদেশ সরকার আজ ওকে সচিবের মর্যাদায় উন্নীত করেছে। আনােয়ারুল হকের সঙ্গে সম্পর্ক দীর্ঘকালের। প্রথম বিয়ে করেছিল চল্লিশের যুগে সাহিত্য-সেবা নয় সাহিত্যিক–সেবার এক সংস্কৃতিপরায়ণ অগ্রজ বন্ধু আয়নুল খানের মেয়ে লুসি হককে। সেই সুবাদে আনােয়ার খালু। প্রগতিশীল চিন্তার আলােড়নে আলােড়িত দেশপ্রেমিক সুদর্শন এই তরুণ জাতিগঠনের সুযােগ্য স্থপতি হবে, তা বিনা পক্ষপাতে বলা যায় । দুঃখের বিষয় আমার লুসি খালা বিয়ের অল্প দিনের মধ্যে মারা যায়। আনােয়ার বহু দিন পরে দ্বিতীয় সংসার পাতে ।
আনােয়ার খান ছাত্র আন্দোলনেও শরীক থেকেছে স্কুল কলেজে। কাল একবার ওর সঙ্গে দেখা করতে যাবাে…।
*************
বিলােনিয়া থেকে স্নেহভাজন দাস প্রিয়লাল লিখেছে, “নানা দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি। আমার স্ত্রী এখনও ভেতর থেকে আসতে পারেনি। আমার ঢাকা থেকে আসার পরই তার পিত্রালয়ে যায়। মাইজদি বাসা থেকে আমরা যাই অন্যদিকে। ফলে যােগাযােগই করতে পারিনি। এখন নানা দিক থেকে চেষ্টা করছি। কিছুতেই আনানাে সম্ভব হচ্ছে না। অবিশ্যি তাদের ঐ দিকের অবস্থা মােটামুটি ভালই। তােয়াহা খ্যাতনামা কম্যুনিস্ট নেতা। তােয়াহা সাহেবের বাড়ির সন্নিকটে ওদের বাড়ি। তােয়াহা সাহেবের বর্তমান অভিযান জোতদার গুণ্ডাপাণ্ডার বিরুদ্ধে। ফলে সেখানে রাজাকারের উৎপাত নেই। কালসেনারা ঐদিকে যায়নি। অবস্থার চাপে পড়ে অদৃষ্টবাদী হয়ে গেছি। সব কিছু অদৃষ্টের উপর ছেড়ে দিয়ে বসে আছি।
নেতাদের হালচাল দেখে মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিরূপ নৈরাশ্যবােধ করছি। পায়ের নীচে নেই মাটি। উনারা দেশ উদ্ধারের চেয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের দিকেই বেশি মনােযােগী মনে হচ্ছে। এটা অবশ্য আমি স্থানীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি। কর্মীদের ভেতর ঐক্যের পক্ষে একটি জোরদার জনমত গড়ে উঠেছে। নেতাদের এখনও কিন্তু টনক নড়ছে না বলেই মনে হয়। অথচ ঐ যুক্তফ্রন্ট ছাড়া ভবিষ্যৎ কিছুই নেই।”
৯৯
কবি বন্ধু আবুল হােসেন ওইদিকে পড়ে আছে। জনসংযােগ বিভাগের পরিচালক। ওঁর পিতা ইসমাইল হােসেন ছিলেন পুলিশ অফিসার। রিটায়ার করার পর গ্রামে ছিলেন। কিন্তু আতংকে পরে বাগেরহাট চলে যান। খুলনা শহরের সংলগ্ন নদীর পাড়েই বাড়ি। নিরাপত্তার খোঁজে তিনি ঠাই নাড়া হলেন। কিন্তু সেখানেই মিলিটারী অপারেশনে মারা যান। বিস্তারিত খবর পাওয়া গেল না। আবুল হােসেনের সঙ্গে যােগাযােগ কঠিন। তবু মুক্তিযােদ্ধারা কেউ কেউ ঢাকায় যায়, এমন কাউকে পেলে কবির সঙ্গে যােগাযােগ করতে বলব ।
১৯৭১
১৪ সেপ্টেম্বর
দুর্ভাগ্য শ্রদ্ধেয় কথাশিল্পী শ্ৰীতারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় আজ সকালে পরলােকগমন করেছেন। বাংলাদেশ তার একজন অকৃত্রিম দরদী ও সাহিত্যিককে হারিয়ে ফেললে, এই সংকটকালে যার সাহায্য বড় কার্যকর ছিল।
লােকান্তরিত লেখকের বিদেহী আত্মার প্রতি আমার সশ্রদ্ধ সালাম।
****************
শরৎচন্দ্রের পর কথাসাহিত্য বাঙালীর মনকে কেউ আর এমন আচ্ছন্ন করে রাখেনি। তার কীর্তি বাঙালী হৃদয়ে যে জায়গা নিয়ে আছে, কালের ঝাপ্টার সেখানে কোন প্রবেশাধিকার নেই।
সন্ধ্যায় আকাশ বাণী থেকে শ্রীতারাশংকর বন্দ্যোপাধায়ের উদ্দেশে শ্রদ্ধা। নিবেদন করলুম আমিও অনেকের সাথে ।
সাক্ষাৎ ঘটল ভারতের অন্যান্য প্রদেশের সাহিত্যিকদের সঙ্গে। তারাও শ্রদ্ধা নিবেদনে জমায়েত হয়েছেন। এস-বি যােশী, গগই, চারী, উড়িষ্যার কবি অবকাশ জানা প্রমুখ।
১৯৭১
১৫ সেপ্টেম্বর
পাকিস্তানের আনুগত্য-ত্যাগী বাঙালী অফিসারদের বিরুদ্ধে ওদের পররাষ্ট্র দপ্তর
১০০
প্রায়ই বিষােদগার করে। বিশ্বাসঘাতক, তহবিল তছরূপকারী এবং এই জাতীয় নিন্দাবাদের কিছু ঘাটতি পড়ে না। আজ দেখলাম বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রণালয় বেশ চেতে উঠেছে ইরাকের রাষ্ট্রদূত এ এফ আবুল ফতেহর ব্যাপার নিয়ে। অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন জনাব ফতেহ। তাঁর স্বপক্ষে এমন কথা ত আছেই, তাছাড়া বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষের। মনােভাব সম্পর্কে বিশ্বের সকল মানুষকে সতর্ক থাকার আহবান জানিয়েছে।
ফতেহ সাহেব শুধু পালিয়ে আসেননি। রাষ্টদূত এমন ব্যবস্থা করেছিলেন, যেন বাংলাদেশ সরকারের তহবিলে ২৫০০০ (পঁচিশ হাজার) পাউন্ড জমা পড়ে। সরকারের বােধ হয় প্রথম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন। জয় বাংলা!
১৯৭১
১৮ সেপ্টেম্বর
স্বর্গীয় তারাশংকর বন্দ্যোপাধায়ের শােকসভায় শােক প্রস্তাবক আমি। সংক্ষিপ্ত ভাষণ । এইখানে দেখা হয়ে গেল ৩৩ (তেত্রিশ) বছর পরে আমার কলেজের সেন্ট জেভিয়ার্স বাংলার অধ্যাপক শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায়ের সঙ্গে। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষাদাতাদের অন্যতম তিনি। দুই বাংলার মধ্যে এমন অভাবনীয়তার কতাে যে কাহিনী রচিত হচ্ছে, খােদাকে মালুম!
আজ আরাে আশ্চর্য লাগলাে, অচেতন মনের উৎপাতের বহর দেখে। যৌবনে ধীরেন স্যার কবিতা লিখতেন। “কুটীরের গান” নামে একটি কবিতার বইও তার বেরিয়েছিল। রােমান্টিক নিসর্গ-বন্দনার কবিতা। একটি কবিতার প্রথম লাইন-“ভাদুরিয়া গাং উপছে উঠেছে ছলাৎ ছল।” ওকে দেখামাত্র আবৃত্তি করে বসলাম। উনিও অবাক।
এইভাবে মনের কন্দরে কতাে কী যে চাপা থাকে-আমি তাে জানিনি । যখন হঠাৎ বেরিয়ে পড়ে তখন বিস্ময় স্বাভাবিক। গল্প রচনার সময় ভেতরে তাগিদ বােধ সেই সব সংগতির দিকে ছােটে, স্মৃতি যেখানে বিশৃংখলভাবে সুপ্ত।
*********************
আজ থেকে শুরু হয়েছে, দিল্লীতে দেশের ১৪০ জন প্রতিনিধি নিয়ে বাংলাদেশের উপর আন্তর্জাতিক সম্মেলন। ছ’মাস পরে এমন সংগঠন থেকে বুঝা যায়, বাংলাদেশের ব্যাপার আর ছােটখাটো অবহেলাযযাগ্য পর্যায়ে নেই ।
১০১
মুক্তিযােদ্ধার সঙ্গে মিলে পাকিস্তানী মিলিটারী সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে একটি আন্তর্জাতিক বিগ্রেড গড়ে তােলা হােক। এই প্রস্তাব করেন প্রখ্যাত নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে বাণী পাঠান ফরাসী সাহিত্যিক আঁদ্রে মালরাে, এডওয়ার্ড কেনেডি, ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান ভিভি গিরি প্রমুখ জনেরা! বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন ডক্টর এ আর মল্লিক।
১৯৭১
১৯ সেপ্টেম্বর
“অমৃতবাজার” পত্রিকায় দিল্লীর সম্মেলনের বিস্তৃত রিপাের্ট ছেপেছে। ১৯৩৯ সালে স্পেনের বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে মিলিটারী ফ্যাসিস্টরা বিদ্রোহ করলে আন্তর্জাতিক বিগ্রেড গঠন করা হয়, স্পেনীয় সরকারের সাহায্যে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা-ই হওয়া উচিত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব সেই ধারায় প্রবাহিত হওয়া দরকার। এই সম্মেলনের গুরুত্ব বুঝা যায় আলােচিত বিষয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করলে। বাংলাদেশের স্বীকৃতিদান, শেখ মুজিবের মুক্তি, ইসলামাবাদে শান্তিমিশন পাঠানাে, অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ ইত্যাদি।
*******
আজ একটি মজার চিঠি পেয়েছি শ্রী সােমনাথ দ্বিবেদীর কাছ থেকে। মেদিনীপুর জেলার খড়গপুর শহরে ওরা একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। নাম ভাষান্তর কেন্দ্র। এখান থেকে বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য (প্রধানত ঃ গল্প-উপন্যাস, কবিতা) অনুবাদ করা হয়। আমার গল্প তামিল, তেলেগু, মালয়ালাম, কানাড়ী, মারাঠা, হিন্দী প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হয়েছে ভাষান্তর কেন্দ্রের কলাণে। অবিশ্যি ইংরেজী অনুবাদক আমার দুজন আছেন মাত্র কবির চৌধুরী ও ওসমান জামাল। ওসমান জামাল চাটগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল মিলিটারী হামলার সময়। সে মাবােন গােটা পরিবারসহ বর্ডার পার হয়ে যায় অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে। সেখান থেকে জামাল ইংল্যান্ড চলে যায় এবং মাঝে মাঝে তর্জমা পাঠায় ভারতীয় অন্যান্য ভাষায়। সে কথা থাক।
ভাষান্তর কেন্দ্রের প্রধান উদ্যোক্তা শ্রী সােমনাথ হিন্দীভাষী, বাংলায় লিখছেন ঃ–
“ভাই শওকত ওসমান জী, আপনার “গল্প গালিচা”তে ইকবালের
১০২
পােষ্টমর্টেমের জন্যে আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞতা বােধ করছি। আপনার দৃষ্টিভঙ্গির সুস্থতা এমনই বিকাশমান পথে অগ্রসর হােক-কামনা করি।
“আমরা ইকবালকে কবি-লােকের নেড়ি কুকুর এবং সাহিত্য-লােকের * গাণ্ডু মনে করি। ভাষার প্রখরতার জন্যে আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা।”
“এই গল্পটি হিন্দী ও মালয়ালাম ভাষায় অনুবাদ করতে আমরা আগ্রহী এবং চার-পাঁচ পাতা অনুবাদও করা হয়ে গেছে। আমাদের ভাষান্তর কেন্দ্র সম্পাদক বমেশ দুবে এই মাত্র আপনার প্রতীকী গল্প ‘নেকড়ে অরণ্য হিন্দী ভাষায় অনুবাদ সম্পূর্ণ করেছে। আপনার নবীন উপন্যাস ‘জাহান্নম হইতে বিদায়’ আমরা পড়লাম । যদি আপনি অনুবাদের অনুমতি দেন আমরা খুবই বাধিত হবাে।”
সােমনাথ দ্বিবেদী আরাে লিখছেন, “আপনার লেখাতে হাত দেয়ার আগে আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন লেখক ও কবিদের ক্রমশ ১৭/১৮ গল্প ও ৩০/৪০টি কবিতা অনুবাদ করেছি যা হিন্দী জগতে যথেষ্ট আলােড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছে ও সমাদৃত হয়েছে।” অবিশ্যি আমার জানা, ওই সময় বাংলাদেশের বহু লেখক ও কবি হিন্দী সাহিত্য জগতে পৌঁছেছেন। অনুমতি নেবে কার কাছ থেকে? কোন লেখক তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। শ্ৰী দ্বিবেদীকে ধন্যবাদ যে তিনি অন্তত অনুমতিটুকু চেয়েছেন।
* গাণ্ডু উর্দু শব্দ। অসৎ মতলবে রক্ষিত ছােকরা।
১৯৭১
২০ সেপ্টেম্বর
অনেকদিন ডাক্তারের সঙ্গে দেখা নেই। একদিন যেতে হয়। শুনলাম, বাংলাদেশ। সরকারের স্বাস্থ্য সচিব তাজুল হােসেন দশ দিন বিভিন্ন হাসপাতাল রিফিউজী ক্যাম্প, চিকিৎসা কেন্দ্র ঘুরে রিপাের্ট দিয়েছেন সরকারের কাছে। নানা অসুবিধা। অনেক কিছু নেই চিকিৎসাশাস্ত্রের চাহিদা অনুযায়ী, যথা ওষুধ, এ্যাম্বুলেন্স, আহতদের বিশ্রাম শিবির ইত্যাদি। তবু কর্মীদের মনোেবল নাকি সাংঘাতিক উচ্চগ্রামে অবস্থিত।
অভাব এমন জায়গায় মার খায়।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ টনিক মনােবল-জাত রসায়ন।
১০৩
আজ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে দুপুর বেলা পড়লুম আমার গল্প, “জন্ম যদি তব বঙ্গে।” আগেও পড়েছি তবে এই গল্পের আবেদন হবে মর্মস্পর্শী।
১৯৭১
২১ সেপ্টেম্বর
জাতিসংঘের সাধারণ সভা বসবে। যােগদানের জন্যে প্রতিনিধিদের নাম ঘােষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার । দলের নেতা হিসেবে থাকবেন আবু সয়ীদ চৌধুরী। তিনি এমনিতেও জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি। নিউইয়র্কে আছে। আমার প্রাক্তন ছাত্র এম আর সিদ্দিকী, প্রীতিভাজন এনায়েত করিম, এম এ মুহিত এবং অধ্যাপক রেহমান সােবহান। প্রতিনিধিদের অধিকাংশ রাজনীতিবিদ। ইরাকের প্রাক্তন রাষ্টদূত দাগী ডিপ্লোম্যাট এ এফ এম আবুল ফতেহ অবিশ্যি আছেন। বেশ জমজমাট দল। দেখা যাক, স্বাধীনতার সলিল কীভাবে কোথায় গড়ায়।
***************
মেজ ছেলে আসফাককে নিয়ে মসিবত। সে এখনও ওই দিকে থাকছে। জানি নে তার সাহসের উৎস কী? অথচ সে-ই প্রথমে মা, বােন, ভাই, বাপের নিষ্ক্রমণের রাস্তা বের করেছিল। ওখানে থাকা মানে মৃত্যুর খাড়া মাথার উপর ঝুলিয়ে থাকা। আমি এদিকে ভাল করে মুখ খুলতে পারছিনে। সেজ ছেলে ইয়াফেস কিছু করতে পারেনি। তার সঙ্গে এখন যােগাযােগ দুরূহ। বেশ মুশকিলে পড়লুম…
সংসারের জন্যে বহু আবিলতা মেখেছি আত্মার উপর। কিন্তু আর না।
১৯৭১
২২ সেপ্টেম্বর
আজ শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠি পেলুম। সে অসুস্থ। হৃদরােগের শিকার। সাঁতরাগাছিতে নিজের তৈরি বাড়িতে থাকে। আমি সাক্ষাতে যেতে চাই। শান্তি
১০৪
কিন্তু পয় পয় আগে জানিয়েছে আমি যেন তার বাড়ি না যাই। হেতু ভয়ংকর। পশ্চিমবঙ্গে নকশাল আন্দোলন তুঙ্গে। “শ্রেণী” শত্রু খতমের এমনই রােখ চেপেছে যে পাড়ায় কোন অচেনা লােক দেখলেই ভাবে সরকারি গােয়েন্দা। আর চ্যালেঞ্জ পর্যন্ত করে না, যমালয়ে পাঠানাের ব্যবস্থা করে। এক বেকার ইঞ্জিনিয়ার চাকরি নিয়ে, যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের বাইরে যেতে হবে, কলকাতার এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় দিদির সঙ্গে দেখা করতে যায়। তাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। সে সত্য কথাই বলে। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। মরতে হয়েছিল সেই ভাগ্যহত প্রকৌশলীকে। এসব ঘটনা আমি জানতুম। হত্যা যেখানে মূল চালিকাশক্তি সেখানে আর রাজনীতি থাকে কোথায়? রাজনীতিতে মানুষকে নিয়ে মানুষকে বাঁচানাের জন্যে, তাদের ভেতরের সব সম্ভাবনাকে বিকশিত করার জন্য।
কিন্তু নকশালী সেই তােড়ে সব প্রশ্ন ভেসে গিয়েছিল। আজ শান্তিরঞ্জনের পত্র পেয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়তে লাগলুম। শান্তি লিখেছে, “আজকাল-আজকাল করে ডাক্তার ভরসা দিচ্ছিলেন, তাই চিঠি দিইনি-অফিসে গিয়ে আচমকা তােমায় ফোন করে অবাক করে দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু আজ ডাক্তার বাবু বলে গেলেন আরাে দু’সপ্তাহ। এবার নাকি কথার আর নড়চড় হবে না। অতএব আগামী ৩ অক্টোবর দশটা নাগাদ তােমাকে ফোন করতে পারব আশা রাখছি-যদি না ইতিমধ্যে ইন্তেকাল হয়; তুমি তাে অনেক লিখেছ, আমার হাতের কাছে ‘আনন্দ বাজার’ ও ‘দেশ’ আছে। কোন লেখাপড়া হয়নি। এবার পড়বাে।
ভালবাসা নিও।
শান্তি।”
পুজো সংখ্যা “দেশ” এ প্রকাশিত আমার উপন্যাস “জাহান্নম হইতে বিদায়” ভয়ে আর চোখ বুলাইনি। পাঠক কি চোখে নেয় কে জানে। তবে মােস্তফা মনােয়ারের ইলাসট্রেশান সবাই পছন্দ করেছে।
**********
দুঃসংবাদ পেলাম, প্রতিবেশী সুরকার আলতাফ মাহমুদের উপর মিলিটারীরা। এমন নির্যাতন চালায় যে তিনি মারা যান। তাঁর উঠানে গর্তে অস্ত্র লুকানাে ছিল। এমন সাক্ষাৎ অপরাধ। আর রেহাই পাননি। একদম প্রতিবেশী। নাতি-উচ্চ দেওয়াল। সুরকার কারফিউ থাকলে দেওয়াল ডিঙিয়ে চলে আসতেন বা আমি যেতাম ওদিক ! আমার কাছে ইরানী ও তুর্কী গানের বেশ কিছু রেকর্ড ছিল।
১০৫
তিনি এসে মন দিয়ে শুনতেন।
বহুক্ষণ আলতাফ মাহমুদের আদল আমার চোখের সামনে গাথা রইল। একুশে ফেব্রুয়ারী প্রভাতফেরির সুরকার হিসেবে তিনি এদেশের অমর সন্তান। তাঁর এইভাবে অপঘাত মৃত্যুর কথা ত ছিল না।
রাক্ষুসী বাংলাদেশ। তাের প্রতিভাবান সন্তানদের তুই এইভাবে খাবি, খা রাক্ষুসী, তাের ক্ষুধা দূর হােক।
.**********
আগস্ট মাসের পর থেকেই অনেক পরিচিত জন ওদিক থেকে এসে পৌঁছেছেন মুজিবনগরে। রাজনীতিবিদ নন, নিছক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, শিয়ালদ’র কাছে এক হােটেলে আছেন। এই সৎ মানুষটির সঙ্গে সাক্ষাতে মন বড় আগ্রহী। কাল যেতে চাই।
১৯৭১
২৩ সেপ্টেম্বর
দুঃসংবাদের শেষ নেই। তিন ডক্টর হাবিবুল্লাহ, আহমদ শরীফ, বৃদ্ধ এনামুল হক সকলে এখন বন্দী শিবিরে। এই বয়সে মৃত্যু কি ওদের রেহাই দেবে জল্লাদের হাত থেকে? আবু জাফর শামসুদ্দিন পলাতক। এখানে দেখা যাচ্ছে, প্রগতিশীল চিন্তার বাহক কাউকে ওরা ছেড়ে দেবে না।
**********
জীবনের কৌতুক না ট্র্যাজেডি? সর্দার ফজলুল করিমকেও গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। একদা প্রখর কম্যুনিস্ট, পরে গােবর খেয়ে সংসার ও চাকরিতে ঢুকেছিল। কিন্তু একদম বশংবদ। কাজী দীন মােহাম্মদের মত জনশত্রুর সামনে পর্যন্ত যে অধীন হিসেবে স্যার-স্যার সম্বােধন (আমি সাক্ষী) দাস্যভাব প্রকাশ করত, তারও রেহাই নেই পাকিস্তানী ফ্যাসিস্টদের কাছে। কারণ, একদা-কম্যুনিষ্ট।
**********
হয়ত গুজব, মাহমুদ আলী ও কাজী দীন মােহাম্মদের গায়ের বাড়িতে
১০৬
মুক্তিযােদ্ধারা আগুন লাগিয়েছে। হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। রসাে, ভাইস চ্যান্সেলার বজ্জাৎ হােসেন, তুমিও বাদ যাবে না। লাখ লাখ লাশ তােমাদের চোখ যখন খুলতে পারেনি, বন্ধ–তা এখন সীলমােহর করে দেবে দেশের মানুষ।
গৃহযুদ্ধের আর একদিক লক্ষণীয়। রাজাকারগুলাে গ্রামের ছেলে ও বাঙালী । ওদের win over দলে টানা কি কঠিন হবে?
পাবনার এসপি আব্দুল গফফার সাহেব আজ দেখা করতে এসেছিলেন। হাড়ইমানদার মানুষ। জীবিকার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি। বিরাট পরিবার মাথার উপর বােঝা। চাকরি করে গেছেন।
আজ ওর মুখে শুনলাম, সৎ অবাঙালী কীভাবে মারা গেছে। এক একজন চোখের পানি ফেলেছে কতাে। সৎ মানুষের মৃত্যু এবং অসহায় মৃত্যু। কিন্তু বর্ণবিদ্বেষের আগুনের সামনে সৎ-অসৎ কাচা-পাকার বাছবিচার আছে? জিন্না সাহেবের তৈরি দোজখ ও মুসলিম ওয়াতান Homeland তার এইভাবে সইতে হবে বৈকি–যদ্দিন না আবার মুসলমানদের মােহমুক্তি ঘটে। গফফার সাহেবের কাছে শােনা গেল সৎ বিহারী কি+সৎ মানুষের কান্না এই দুর্বিপাকের দুর্দিনে।
১৯৭১
২৪ সেপ্টেম্বর
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এ জি ওসমানী এক ওজস্বীময় ভাষণ দেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। তিনি পাকিস্তানী সৈন্যদের হামলাকে বলেছেন বিধর্ম ও ওদের ক্রিয়াকলাপ বিধর্মীদের ক্রিয়াকলাপ। ইসলামী রাষ্ট্র সম্পর্কে ওসমানী সাহেবের এই মন্তব্য কৌতুকময় বৈকি। তিনি সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তি সম্পর্কে আর কোন শর্ত আরােপ চলবে না। ছয় মাস পরে ওসমানী সাহেবের বাণী আর বাগাড়ম্বর মনে হয় না। কারণ, পৃথিবীময় সমর্থনের জোয়ার উঠেছে নির্যাতিত জনের প্রতি। তার অভিঘাত আমরাও উপলব্ধি করছি, শুধু সর্বাধিনায়ক নন।
১০৭
১৯৭১
২৫ সেপ্টেম্বর
পূর্বেই কথা ছিল “আনন্দ পাবলিশার্সের সঙ্গে পুজো-সংখ্যার উপন্যাস পুস্তকাকারে তারা ছাপাবে। “জাহান্নম হইতে বিদায় সম্পর্কে মতামত চাওয়ার জন্যে আমি কৌতুহলী নই। প্রায় ভূতে ধরা অবস্থার মধ্যে রচনা এগােয়। বেশি ভাবনা-চিন্তার সময় ছিল না। পরিচিত যারা পড়েছেন তারা কোন মন্তব্য করুক, এই ভয়ে চুপ থাকতাম। পরিস্থিতি গুণে কতাে রকমের অস্বােয়াস্তি না সাহিত্যিকদের সইতে হয় । বহুদিন পরে মনে পড়ল এক পুরাতন সহপাঠী বিমলদের কথা। সে আমার লেখালেখির অভ্যেস আছে শুনে বলত, “আমি ওসবে নেই। ভাল বই কিছু নগদ টাকা দিয়ে কিনব-উপভােগ করব। লেখা মানে ঝামেলা। বাজার দর কি হবে সে অস্বােয়াস্তি নিতে যাব কেন?” বিমলের রসবােধ ছিল প্রখর। মাঝে মাঝে Tutorial খাতা দেখে অধ্যাপক প্রশংসা করতেন। দেশ বিভাগের পর বিমলের আর খোঁজ পাইনি। কে জানে বেঁচে আছে কি না। স্মৃতির দরজা খুললেও এক রকমের অস্বােয়াস্তি ছেয়ে আসে।
*********
আজ পাকিস্তানের বৈদেশিক সচিব সুলতান খান, বন্ধুবর সিকান্দার আবু জাফরের ভাষায় “ক্ষেপচুরিয়াস” (ক্ষ্যাপা+ইংরেজী Furious ফিউরিয়াস) হয়ে উঠে জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্ট সাহেবের কাছে লিখেছেন যে ভারত এক দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলিয়ে যতাে আপদ সৃষ্টি করেছে। আর তার সঙ্গে জুটেছে জাতিসংঘের কিছু সদস্য। তারা জাতিসংঘের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে না, বরং জাতিসংঘের আদর্শ জলাঞ্জলি দিচ্ছে।
*********
লিক ক্যাবিনেটে জামায়াতে ইসলামী কেন যােগ দিয়েছে মন্ত্রী আব্বাস আলী খান ও মৌলানা একেএম ইউসুফের এক সম্বর্ধনা সভায় আজম বলেছেন, “জামায়াতে ইসলাম পাকিস্তান এবং ইসলামকে এক ও অভিন্ন মনে করে।–সুতরাং পাকিস্তান যদি না থাকে তাহলে জামায়াত কর্মীরা দুনিয়ায় বেঁচে থাকার কোনাে সার্থকতা মনে করে না।”
১০৮
পাকিস্তান একটি রাষ্ট্র। ইসলাম একটি ধর্ম। দুটি সমার্থবাচক নয় কোনমতে। পাকিস্তান না থাকলে ইসলাম ধর্ম থাকবে না-এই যুক্তি কোন সুস্থ মস্তিষ্ক আগত নয়। ১৯৪৭ সনের ১৪ আগস্টের পূর্বে ত পাকিস্তান রাষ্ট্র নামে কোন রাষ্ট্র ছিল না। তখন কি পৃথিবীতে ইসলাম ধর্ম ছিল? এই ধার্মিকজনদের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়।
গণহত্যার সমর্থক, মানব-প্রেম-বর্জিত ধার্মিক বা ধর্মধ্বজীরা কখনও যুক্তির ধার ধারে না, যে-যুক্তিবিচার মানুষকে জানােয়ার থেকে আলাদা করে ।
১৯৭১
২৬ সেপ্টেম্বর
অমিয় সেনের অফিস রাইটার্স বিল্ডিংয়ে গিয়েছিলুম। ডালহৌসী স্কোয়ারের নাম বদলে গেছে স্বাধীনতার পর। এখন বিনয় বাদল দীনেশ বাগ, সংক্ষেপে । বিবাদীবাগ। তিন বিপ্লবীর স্মৃতি এইভাবে সম্মানিত।
অমিয় সেন আমার সহপাঠী ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ডাক নাম সুনু। আমি মিয়াযােগে ওকে সম্বােধন করতাম। বহুকাল পরে সাক্ষাৎ। ওর স্ত্রী শ্রীমতী নীলিমা সেন রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকাদের প্রথম সারির জন। প্রাচীন স্মৃতিচারণার ভেতর কথায় কথায় জানা গেল রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত চৌদ্দখণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী পাওয়া যেতে পারে। সরকারী গুদামে এখনও কিছু কপি আছে। তবে সেগুলাে হয়ত কোথাও কোথাও কীটদষ্ট, প্রচ্ছদ ময়লা হয়ে গেছে অথবা এই জাতীয় দূষিত কলেবরে বর্তমান। এক সেট পাওয়ার উদগ্র লােভ আমাকে পেয়ে বসল। চারশ’ টাকা দাম। কিছু কমে পাওয়া যেতে পারে সেকেন্ডহ্যান্ড সামগ্রীরূপে। তথাস্তু ।
অমিয়র ঐকান্তিক চেষ্টা থাকবে পেছনে, তা ওর আন্তরিকতা থেকে জানা যায়। প্রকাশনা কমিটিতেও অমিয় ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘূর্ণি আবর্তে পড়ে আছি! অথচ অর্জন-প্রবৃত্তির দশা দেখে হাসি পেয়ে গেল। অবিশ্যি রবীন্দ্র রচনাবলী এক সেট পাওয়ার কামনা কোন লােভের মধ্যেই গণ্য করা উচিত নয়।
১৯৭১
২৭ সেপ্টেম্বর
দশটার দিকে সিকান্দার আবু জাফরের সন্ধানে। প্রথমে উঠেছিল সদর স্ট্রিটের
১০৯
শিলটন হােটেলে, পরে রিপন স্ট্রিটে উঠে গেছে, খবর পাওয়া গেল!
সিকান্দার কোন হিতাকাক্ষীর সহৃদয়তায় জায়গা পেয়েছে এক দোতলায়। সেখানে টেলিফোনও আছে। সেদিক থেকে যােগাযােগের বড় সুবিধা হবে। সিকান্দার তার অভিযােগ” গ্রন্থ কয়েকখানা সঙ্গে আনতে ভােলেনি। চিরকালের বেপরােয়া দুঃসাহসী ডাকুবুকো এই বন্ধুজন। সবই তার স্বভাববাচিত ধারায় ঘটেছে। কিন্তু মােটর চালিয়ে যাতায়াত অভ্যেস কয়েক বছর থেকে। তাই হাঁটা তার পক্ষে এক বিষম ব্যাপার। চল্লিশ কদম হাঁটতে সে হাঁপিয়ে ওঠে। কিন্তু পলায়নকালে নৌকা মােটরবাস যতই সাহায্য করুক, হাঁটতে হয়েছে ওকে। তবে ধকল শেষ পর্যন্ত সইতে পেরেছে। সিকান্দারের প্ল্যান সে অচিরেই পত্রিকা বের করবে এখান থেকে। তার লেখা গান, “আমাদের সংগ্রাম চলবেই চলবে” এখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রচারিত হয়, সে কি জানে? সিকান্দার নিজের কানেই শুনেছে ঢাকা থেকে। এসব ঝুঁকি নেয়া ওর পক্ষেই সম্ভব।
বুকে বড় জোর পাওয়া গেল। নিপাট এবং বাঙলী এসে পৌঁছেছে আমাদের কাছে। সংগঠনের ক্ষমতার অধিকারী তদুপরি সে কবি এবং গান লিখতে পারে, সুর দিতে সক্ষম।
১৯৭১
২৮ সেপ্টেম্বর
রণাঙ্গনে বিভিন্ন সেক্টর আশাপ্রদ খবরই সরবরাহ করে বর্তমানে। মাঝে মাঝে দুঃসংবাদ থাকে তরুণ মুক্তিযােদ্ধাদের প্রাণ উৎসর্গের। সংগ্রামের এই শর্ত মেনে নিতে হয়। তবে স্পষ্ট বুঝা যায়, পাশার দান উল্টে গেছে। মার্চ এপ্রিলের একতরফা মার খাওয়ার আর দৃশ্য বাংলাদেশময় কোথাও অভিনীত হবে না।
১৯৭১
২৯ সেপ্টেম্বর
“জয় বাংলা” অফিসে গেলে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। এই জন্যে বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে ছুঁ দেয়া প্রায় অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী আগস্ট মাসে এদিকে চলে আসে। দেখা বেশ কয়েক হপ্তা পরে এই
১১০
আস্তানায়। এমন অনেক স্নেহভাজনের খবর-সংগ্রহে এই পত্রিকার আপিস ডাকঘর সদৃশ। কামরুল হাসান এহিয়া খানের যে জন্তুসুলভ প্রতিকৃতিটি এঁকেছে, তার সুখ্যাতি দেশ-বিদেশ থেকে আসছে। কলকাতা শহরের গােবরা গােরস্থানে কামরুলের জন্ম। বাবা ছিলেন কবরস্থানের সুপারিনটেনডেন্ট। গােরস্থানে জন্ম । কিন্তু জীবন-তপস্যায় মগ্ন একাগ্রচিত্ত দুর্জয় এক সন্ন্যাসী-আমার এই স্নেহভাজন অনুজপ্রতিম সহযাত্রী। একদা মুষ্টিযােদ্ধা। পেশল ওর দেহ, তেমনই মানসিক কাঠামাে।
১৯৭১
৩০ সেপ্টেম্বর
ফরাসী “লা ফিগারাে” পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে এহিয়া খান প্রতিবেদককে বলেছে যে শেখ মুজিব কোথা আছে, তার জানা নেই।
কিছুদিন পূর্বে বন্ধুবর ডক্টর মুজিবুর রহমানের যে আশংকা করেছিলেন তা সত্য হয়ে যাবে নাকি? তিনি পত্রে লিখেছিলেন মুজিবকে আগেই হত্যা করা হয়েছে। এখন বিচারের কথা তুলেছে শুধু নিজেদের অপরাধ ঢাকা দিতে।
পাকিস্তানের গণহত্যাকারী সিপাইদের প্রধান। তার পক্ষে জন্তুসুলভ সব আচরণই সম্ভব। কামরুল হাসান ওর যথার্থ মুখ এঁকেছে।
১৯৭১
১ অক্টোবর
সিকান্দার আবু জাফরের গুহায় গিয়েছিলুম। তার চিরাচরিত বেপরােয়াভাব এ্যাডভেঞ্চারের নেশা এতটুকু কমেনি। সে বললে সাপ্তাহিক একটা কাগজ শিগগিরই বের করবে। সংগঠক হিসেবে সিকান্দারের জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু বর্তমানে শারীরিকভাবে বেশ কাহিল। হাঁপানি ত চিরসঙ্গী। মাঝে মাঝে দেখা দেয়। কিন্তু সিকান্দার ত থেমে যাবার পাত্র নয়।
সীমান্ত পার হতে ওকে বেশ কষ্ট পেতে হয়েছে। কারণ হাঁটতে পারে না। কয়েক পা এগােলেই এমন হাঁপিয়ে যায় যে হঠাৎ মূৰ্ছায় মরার সম্ভাবনা থাকে। সেই দুঃখের বয়ানও করলে বন্ধুবর। টেলিফোন আছে ওর আস্তানায়। চিরকালের যােগাড়ে খেলােয়াড়, টেলিফোন দেখে আশ্বস্ত হলুম, কাগজও নিশ্চয়
১১১
সিকান্দার বের করে ছাড়বে। বড় উৎসাহ ভাণ্ডার ওর সাহচর্য।
১৯৭১
২ অক্টোবর
আমার বাল্যজীবনের বন্ধু বাশারত হােসেনের প্রৌঢ়কাল গ্রামেই কাটে। ওর দুই ছেলে খিদিরপুরে থাকে। তাদের সঙ্গে সাক্ষাতে বড় প্রীত হলুম ওদের আন্তরিকতা দেখে। আমার যে কোন সাহায্যে তারা প্রস্তুত, এমন ইঙ্গিত পেলুম।
বিপদ আপদ স্বজনের পরীক্ষা-কেন্দ্র।
১৯৭১
৩ অক্টোবর
আপার সার্কুলার রােডের সরস্বতী প্রেস বহুকাল থেকে প্রসিদ্ধ। দেশপ্রেমিক কিছু নির্যাতিত কংগ্রেস কর্মী মিলে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে পরােক্ষ-অপরােক্ষভাবে ওরা সাহায্য করে থাকে। ব্যবসা প্রধান লক্ষ্য ছিল না।
মহেন্দ্র দত্ত ছিলেন সন্ত্রাসবাদী আমলের কংগ্রেস কর্মী। পরলােকবাসী হবিবুল্লাহ বাহারের মারফত ওঁর সঙ্গে একদা পরিচয় হয়েছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল তিনি নানাভাবেই সাহায্য করেছেন। আজ আমাকে সরস্বতী প্রেস থেকে ছাপা তিনখানা অভিধান উপহার দিলেন। বাংলা অভিধান ছাড়াও ইংলিশ-বাংলা, বাংলা-ইংলিশ অভিধান। ভয়ানক কাজে লাগবে বলাবাহুল্য।
১৯৭১
৪ অক্টোবর
স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত আবদুল গাফফার চৌধুরী কলাম লিখে অল্প সময়ের মধ্যে খ্যাতি লাভ করেছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ওর কথিকাগুলাে জোরালাে যুক্তির শব্দ-লগুড় বলা উচিত। সংগ্রামের, প্রচার দিকও ক্রমশ জোরালাে হয়ে উঠেছে।
১১২
১৯৭১
৫ অক্টোবর
ডক্টর নীহাররঞ্জন রায়ের বাড়িতে প্রায় সারাদিন কেটে গেল। ওর বড় ছেলে প্রণব রঞ্জনের বিয়ে হয়েছে আমাদের চাটগাঁর অগ্রজবন্ধু বিনােদ চৌধুরীর মেয়ের সঙ্গে। তিনি ওদিকে পড়ে আছেন। ডক্টর রায় আমাদের প্রাক্তন শিক্ষক বলে নয়, প্রগতিশীল চিন্তার ক্ষেত্রে ওঁর অবদান আছে, যদিও তিনি ঘাের জাতীয়তাবাদী।
১৯৭১
৬ অক্টোবর
স্নেহাস্পদ আমির আলীর পত্র সব সময় চিন্তা-উদ্দীপক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার ঐকান্তিক সাহায্য অবিশ্যি অবধারিত। তবু তার ২৭ সেপ্টেম্বরের লেখা চিঠিতে কিছু শংকার উল্লেখ আছে। ওর ভাষায়, “সংগ্রামের চরিত্র বা objective আর নেতৃত্ব এক জিনিস নয়। এর নেতৃত্ব বুর্জোয়াদের হাতে থাকলে বাংলাদেশ আর একটি ইন্দোনেশিয়া হবে। পেটি-বুর্জোয়াদের হাতে থাকলে আর একটি আলজেরিয়া, আর কৃষক শ্রমিকদের হাতে থাকলে আর একটি চীন বা ভিয়েতনাম। বুর্জোয়া ডেমােক্রেটিক স্টেজকে Bypass না করেও Revolution এর এজেন্টদের পাল্টানো যেতে পারে।
আজকে যদি আমাদের দেশের কৃষক শ্রমিকদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হয় তা হলে এই স্বাধীনতা সংগ্রাম একটা New Democratic অথবা Peoples Democratic Revolution-এ পরিণত হতে পারে। বলছি, “পারে-পারবেই যে তার কোন স্থিরতা নেই। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে আরেকটি আলজেরিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে।”
দেখা যাক, আমির আলীর ভবিষ্যদ্বাণী কোথায় গিয়ে ঠেকে।
চাউ এন লাইকে যে “খােলা চিঠি লিখেছিলুম সেই সম্পর্কে স্নেহভাজনের মন্তব্য একাধিক ঃ “… ঐ চিঠির শতকরা ৯৯% ভাগের সঙ্গে আমি পরিপূর্ণরূপে একমত। যেখানে আমার সংশয় আছে সেটা হচ্ছে জাতীয় বুর্জোয়ার বিপ্লবী ভূমিকা নিয়ে। কোন রকমেই মনে করি না যে বুর্জোয়াদের জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোন রকমের বিপ্লবী বা সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী ভূমিকা অবশিষ্ট রয়েছে। যে ভুলটা আমার মনে হয় চীনও কিছুটা করছে। চীন হয়ত
১১৩
মনে করছে যে পাকিস্তানের জাতীয় বুর্জোয়ারা’ বর্তমানে একটি সাম্রাজ্যবিরােধী ভূমিকায় অবতীর্ণ আছে। তাই তাদের প্রতিভূ এহিয়া সরকারের প্রতি চীনাদের এত আনুগত্য। ঐ একই মানসিকতা থেকে তারা লিবিয়া, সিংহল আর সুদানের ঘােরতর ক্যুনিজম বিরােধী সরকারদের সমর্থন করছে। আর তাছাড়া ইন্দোনেশিয়ায় কম্যুনিস্টদের রক্তগঙ্গা বহানাের ব্যাপারে চীনের যে অবদান সেটা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদবিরােধী জাতীয় বুর্জোয়াদের লেজুড়বৃত্তিরই পরিচায়ক। অবিশ্যি মার্কিনদের সঙ্গে সমঝােতায় আসার ফলে চীনা থিয়ােরীর কি প্রকারান্তর ঘটবে সেটা বােঝা মুশকিল। এ যাবৎ ত তারা Imperialism আর Anti-Imperialism এর মধ্যে primary contradiction বলে মনে করে আসছিল। এখন হয়ত বলবে যে সেই Contradiction Revisionism এর সঙ্গে। নবম কংগ্রেসের লিন পিয়াওর রিপাের্টে তার ইঙ্গিত আছে। রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সঙ্গে বিশ্ব বিপ্লবের স্বার্থ একাত্ম করে ফেললে এই-ই হয়।” চৈনিক নেতাদের একদম খারিজ করতে আমির আলীর এখনও দ্বিধা আছে, বেশ বুঝা যায়। আমার কাছে কিন্তু ওদের ভেতর বিন্দুমাত্র মনুষ্যত্ব অবশিষ্ট আছে মনে হয় না। মনুষ্যত্বহীন রাজনীতি আমার কাছে শয়তানের মুখােশ-পরা তত্ত্ব-নৃত্য। ওদের মুখের কথা পশ্চাৎ দিয়ে বেরােয় এবং পশ্চাতের কথা মুখ দিয়ে ।…
১৯৭১
৭ অক্টোবর
সেজ ছেলে ইয়াফেস রণাঙ্গনে মনে হয়, কসবা অঞ্চলে কোথাও আছে। কিন্তু চিঠির জবাব পুরাতন ঠিকানায় দেয়ার নির্দেশ। পত্রে এক জায়গায় লিখছে, “হালে মেজদার কোন খবর আমার জানা নেই।” মেজদা মানে আমার মেজ ছেলে আসফাক। ও ছাড়া ইয়াফেস অনেকের খবর অনুসন্ধানী। তাদের সঙ্গে আমারও যােগাযােগ নেই। উদ্বেগের পথ অস্বাভাবিক কালে বহুধা হয়ে যায়।
* খালু স্নেহভাজন আনােয়ারুল হক খানকে সাময়িকভাবে তথ্য সচিব নিয়ােগ করা হয়েছে। যােগ্য দেশপ্রেমিকের যােগ্য সম্মান। কারাে কিছু বলার নেই।
* প্রায় দু’বছর হতে যায়, ক্যান্সার রােগে পরলােকবাসী। বঙ্গবন্ধু মুজিবের প্রয়াণের পর পরবর্তী দুই সরকার কর্তৃক নানাভাবে লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হওয়ার খেসারতসহ। দেশপ্রেমের খেসারত।
১১৪
প্রয়াত হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর পুত্র রাশেদ লন্ডনে এক বিবৃতিতে বলেন যে চব্বিশ বছর অর্থনৈতিক লুণ্ঠনের পর পাকিস্তান সরকার শুরু করেছে। গণহত্যা। কোন সন্দেহ নেই যে মুক্তিযােদ্ধারা জালেমের বিরুদ্ধে জয়ী হবে। উদ্বিগ্ন না হওয়াই উচিত।
১৯৭১
৮ অক্টোবর
জয়পুর থেকে “অনিমা” সম্পাদক শ্রীযুক্ত শরদ দেওড়া গত মাসে একটি গল্প চেয়ে পাঠিয়েছিলেন ওদের “বাংলাদেশ সংখ্যায় ছাপার জন্যে। অনিমা হিন্দী পত্রিকা । সুতরাং ছাপা বাংলা গল্প পাঠালেও চলে। ভারতের বিভিন্ন ভাষায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কাহিনী এখন পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। এই সংবাদ বড় আশাব্যঞ্জক। আমি গল্প পাঠাতে দেরী করিনি। সম্পাদক পুজো সংখ্যা “দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত উপন্যাস ‘জাহান্নম হইতে বিদায় থেকেও কিয়দংশ ছাপাতে চান। ওকে লিখলুম প্রয়ােজনমত ছাপুন তিনি। ছাপানোের অনুমতির অপেক্ষা না করে। আমি সমস্ত বাংলাদেশের লেখকদের প্রতিনিধি নই। তবু তাদের হয়ে বলতে পারি, বর্তমানে অনুমতি দিতে কেউ কার্পণ্য বা দেরী করবে না।
১৯৭১
৯ অক্টোবর
চাঁদপুরের ছেলে অরুণকুমার নন্দী গতকাল থেকে কলতাকার কলেজ স্কোয়ার ট্যাঙ্কে সাঁতার কাটছে বিশ্ব রেকর্ড করার প্রত্যাশায়। বেশ ভিড় জমে যায় চারদিকের পাড়ে। অনেকে ওকে উৎসাহ যােগাচ্ছে “জয় বাংলা” ধ্বনি দিয়ে। দেখা যাক কী হয় । অবিশ্যি অরুণ নন্দী পূর্বেও সাঁতারু হিসেবে খ্যাতনামা হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশে।
১৯৭১
১০ অক্টোবর
মহামান্য পােপ পল ভ্যাটিকান থেকে আবেদন জানিয়েছেন বাংলাদেশের
১১৫
শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্যে। তিনি বলেছেন যে পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের দুরবস্থার এমন দৃষ্টান্ত আর কখনও দেখা যায়নি।
সাধারণত ভ্যাটিকানও রাজনৈতিক আবহাওয়ার রকমসকম দেখে চলে । হিটলারের দাপটকালে পােপ মুখ খােলেননি। ষাট লাখ ইহুদী নিধনকালেও তিনি চুপ ছিলেন।
ঈশ্বর ওদের বােধ হয় এতদিনে সুমতি দিয়েছে। নচেৎ বাংলাদেশের দুঃখে কেন বিগলিত-প্রাণ?
১৯৭১
১২ অক্টাবর
জয় বাংলা।
জয় বাংলা।
সাঁতারু অরুণকুমার নন্দী এক বিশ্ব রেকর্ড করে বসে আছে। কাছে গিয়ে এই বীরকে অভিনন্দন জানাতে হয়। তার কৃতিত্ব স্বাধীনতা সংগ্রামে এক অমূল্য অবদান । একটানা লাগাতার সাঁতারে বিশ্ব রেকর্ড ছিল ৮৯ ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট। অরুণ নন্দী ৯০ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতরে সেই রেকর্ড চুরমার করে দিয়েছে। আর এক প্ৰজেন দাসকে পাওয়া গেল। বাংলাদেশের অধিবাসীর এই তাক-লাগানাে ম্যাজিক বিশ্ববাসীকে দুর্দিনে আরাে আমাদের কাছে টেনে আনবে। জয় বাংলা। জয় বাংলা।
* বিখ্যাত সাঁতারু। ইংলিশ-চ্যানেল পারাপারে বিজয়ী।
**********
লন্ডনে লেবার পার্টির কনফারেন্সে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি জানানাে হয়। ওদের প্রস্তাবে স্পষ্ট উল্লেখিত যে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং তার সঙ্গে আলাপআলােচনার মাধ্যমেই শুধু রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব।
মৃত পাকিস্তানের শবাধারে এইভাবে পেরেক পোতা হচ্ছে। লাশ আর উঠে ঘাস খাবে না ।
**********
অধ্যাপক মােজাফফর আহম্মদ চৌধুরীর (ন্যাপ নেতা নন, ঢাকা
১১৬
বিশ্ববিদ্যালয়ের) হােটেল থেকে ফিরছিলাম নিজ ডেরায়। উনিও বেশ কষ্ট করে সীমান্ত পার হয়েছেন। প্রগতিশীল চিন্তাধারার মানুষ, কাজেই স্বদেশে থাকতে পারেননি। এখানে ওঁকে উপদেষ্টার মর্যাদা দিয়েছে। রাজনৈতিক বিজ্ঞানের শিক্ষক। এখনও ডেরা মেলেনি। তাই হােটেলে আশ্রয় দেশ স্বাধীন হবেই, তবে কতাে ত্যাগ এবং সময় তার জন্যে দরকার বলা দায়।” অধ্যাপকের এই মন্তব্য যদিও হতাশাস্পৃষ্ট, তবু ভাল লাগল যে, উনি জল্লাদদের হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন।
ফেরার পথে পড়ে ধর্মতলা স্ট্রীট। ভাবলাম, পুরাতন জায়গাটা দেখে যাই! ধর্মতলা স্ট্রীট, বর্তমানে লেনিন সরণী । এইখানে ছিল বড় চাচাজী এরশাদ আলী সাহেবের লন্ড্রী। এইখানে কতাে দিন না কেটেছে। স্মৃতির তােড়ে অভিভূত। দেখলাম সেই ফুটপাত আর পানি কলের অবস্থিতি বর্তমানে মাথার কিনি গায়েব। মুণ্ডুহীন অবয়ব স্মৃতি… কতাে মুখ,.. বাসেদ… এলাহী মিস্ত্রী,.. স্তিরিওয়ালা, দপ্তরী চাচা… নাম মনে করতে পারলাম না। ওঁর কাছে বাঁধতে দেয়া বই পড়ার কতাে সুযােগ পেতাম। বাড়ি ছিল ফরিদপুর। ওঁর ছেলের নাম শামসুদ্দিন বেশ মনে আছে। ওঁর নাম মনে এলাে না মনে পড়ে বকরীওয়ালা ড্রাইভার চাচাকে। তিনি উর্দুভাষী পাটনাইয়ে খাসি পােষা সখ ছিল। নাম রহিম বখশ.. এমন কতাে না স্মৃতি দৌড়ে আসে…
১১৯ নং কুঠি এখন জেনারেল প্রিন্টার্স এ্যান্ড পাবলিশার্সের আপিস বেশ বড়সড়াে প্রতিষ্ঠান। আমাদের কৈশােরে ছিল Undertaker ((মুর্দাফরাস) লরেন্স কোম্পানীর সপরিবার থাকত।
এইখানে আধ ঘণ্টা এদিক-ওদিক ঘােরাঘুরি করলাম। ধর্মতলার মােড়ে দাস ব্রাদার্স তখন ছােট একতলা টিন ছাওয়া বাড়িতে স্টেশনারি দোকান। বর্তমানে পাঁচতলা ম্যানসন…ব্যাপারটা নিশ্চয় ওদের ব্যবসায়িক উন্নতির ফল…কাছে এসে দাঁড়াল চাচাতাে ভাই সিরাজুল ইসলাম ১৯৪০ সনে ১ জানুয়ারি মাত্র একুশ বছর বয়সে টিবি বােগে মারা যায়। একই রােগে গত লতিফ ইস্তিরিওয়ালা সিরাজের বন্ধু ইনামুল হক, একই গ্রামে বাড়ি। বহু মুখ দেখতে পাই বড় চাচাজীর দেবতা-সুলভ দাড়ি-শােভিত মুখ আর মৃদু হাসি …ওঁর নামটা বড় মধুর হয়ে বাজতে লাগল,… (শেখ ইরশাদ আলী)
হে অতীত,.. আর কথা কয়াে না…।
* অধ্যাপক মােজাফফর আহম্মদ চৌধুরী স্বাধীনতার অল্পদিন পরে লােকান্তরিত।
১১৭
১৯৭১
১৩ অক্টোবর
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে নিযুক্ত স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন বলেন যে, পাকিস্তান সমস্যাটা দ্বিপাক্ষিক করে তুলছে। সমস্যা সমাধানের আসল পথ পাকিস্তান সরকারের বুঝা উচিত, বাংলাদেশের অধিবাসীদের আশা-আকাঙ্ক্ষা মেনে নেয়া। তাছাড়া সবই ভাঁওতাবাজি।
**********
সিকান্দার আবু জাফর টেলিফোন যােগে বললে “সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কাল প্যারিসে হার্টফেল করে মারা গেছে।”
-না-না . . . . . . .
তা হতে পারে না …..
এই সংবাদ শােনার জন্যে কি পৃথিবীতে বেঁচে আছি এতদিন?…
দেশের এই দুঃখময়কাল। তােমাকে যে কতাে দরকার, বন্ধু…
তুমি কী করে এমন নিষ্ঠুর হলে?…
এই জখম কী করে কাটিয়ে উঠব?
**********
কোন কাজে মন বসে না।
* আন ম্যারীকে পত্র দেব।
কিন্তু কী লিখব?
এই দুর্বিপাক থেকে রেহাই পাওয়া দায়।
* আন ম্যারী ওয়ালীউল্লাহ, সৈয়দের স্ত্রী, ফরাসী মহিলা।
১৯৭১
১৪ অক্টোবর
প্রাক স্বাধীনতা যুগে কলকাতা পুজোর এত ঘটা দেখিনি। অবিশ্যি সামাজিকভাবে আড়ম্বরই বেশী। ধর্মীয় ক্রিয়াচার আছে। নামমাত্র। উৎসব
১১৮
উপলক্ষে গােটা সমাজ কীভাবে বিদ্যুতায়িত হয় তা দেখার মত। সমাজ-চৈতন্য (নিজেদের পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে সজাগ) এই প্রতিফলন কবে দেখব? এখন ত কতকটা অন্ধকারে অন্ধের হাতড়ানি… ভােরে পূজামণ্ডপ থেকে সানায়ের আওয়াজ ভৈরব-ঠুংরির আবরণে আকাশ আচ্ছন্ন করছিল। শােকের আবহে এই স্পর্শ বেদনাহর এক অনুভূতি…অবর্ণনীয়, অবক্ত্য-কথায় বলা দায়।
**********
রণাঙ্গনের খবর এখন সুসংবাদ। বিস্তারিত ধারায় মােকাবিলা চলছে। পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যদের নৈতিক সাহস চিড় খাচ্ছে পদে পদে। ওরা ত বাংলা প্রবাদ জানে না, ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়।
**********
ওয়ালীউল্লাহ কি সত্যিই লােকান্তরিত?
* সিমীন ও ইরাজকে ছ’বছর পূর্বে ১৯৬৫ সনে দেখে এসেছিলাম। এক মাস কেটেছিল প্যারিস শহরে বন্ধুর সাহচর্যে। ছেলেমেয়ে দুটো কৈশাের পার হয়নি এই বিপর্যয়ের মুখে পড়ল ।
* সিমীন দুহিতা। ইরাজ পুত্র। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর।
১৯৭১
১৫ অক্টোবর
নির্দয় কাল ওয়ালীউল্লাহকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল । বিস্তারিত কোন খবর আজও পেলুম না। জাতীয় দুর্বিপাকে ওর বড় ভাই সৈয়দ নসরুল্লার কী অবস্থা হবে খােদাকে মালুম। এমন ভ্রাতৃ-অন্তপ্রাণ অগ্রজ সংসারে খুব কম মেলে । দুই ভাই তনুশ্রী এবং চিত্তশ্রী উভয় দিক থেকে সত্যি অভিজাত। আজ বার বার ওদের কথাই মনে পড়তে লাগল। ফরাসী মহিলা আনম্যারী বাংলা শেখা শুরু করেছিল সােরবােনের এক শিক্ষক সঁসিয়ে ফিলিবের সাহেবের কাছে। প্যারিসে প্রবাস জীবনে ওরা ত ছিল প্রায় নিত্য মুহূর্তের সঙ্গী। আজ বার বার অতীত হানা দিতে লাগল।
১১৯
বাংলাদেশ সরকার ইন্দিরা গান্ধীর নিকট এক দীর্ঘ পত্র লিখেছে (বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের রাজনৈতিক পটভূমিসহ) ভারতীয় স্বীকৃতির অনুরােধে, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মণ্ডলে তার ফলে বাংলাদেশের পক্ষে অনেক অনুকূল আবহাওয়া সৃষ্টি হবে।
অন্যদিন হলে বড় আনন্দ পেতুম এমন সংবাদে। আজ মনে তা তেমন দাগ কাটল না। ব্যষ্টি ছাড়িয়ে সমষ্টির অন্তর্গত হওয়া বােধ হয় সব সময়ই দুরূহ।
১৯৭১
১৬ অক্টোবর
রেডিও পাকিস্তান আমি আদৌ শুনি না। ঢাকার বেতার কালেভদ্রে। আজ এক বন্ধুর কাছে জানা গেল, ওদের প্রচারণার ধারা। মুজিবনগরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন, নজরুল ইসলাম প্রমুখ নেতারা আদৌ নিরাপদ মনে করছেন না বর্তমানে। সুতরাং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম এবার সিকেয় উঠবে। তাজউদ্দীন প্রমুখরা নাকি আত্মসমর্পণের কথা ভাবছে।
গ্রামের মানুষ বলে, শকুন নাকি আকাশ থেকে ভাগাড়ের দিকে চেয়ে স্বপ্ন দেখে বহুৎ গরু মরেছে। কিন্তু শকুনের দোয়ায় গরুর লােমও খসে না।
পাকিস্তানী শকুনদের স্বপ্ন দেখতে দাও।
১৯৭১
১৭ অক্টোবর
প্যারিস শহরের নৈশ-জীবন বন্ধু ওয়ালীউল্লাহর কল্যাণে অনেক দেখা হয়েছিল। আজ কোন কাজে মন বসল না। অতীতে ঘুরতে লাগলুম স্মৃতির দংশন বুকে সয়ে।
১৯৭১
১৮ অক্টোবর
মাসুদ, জাস্টিস মাসুদ গিয়েছিল দিল্লী গেল হপ্তায়। বাংলাদেশের ব্যাপারে তার
১২০
ঐকান্তিকতা এসব থেকে বুঝা যায়। একদম খােদ ভারতের রাজধানী দিল্লী গেছে। হাঁড়ির খবর অনেক কিছু জানে। ইন্দিরা গান্ধী ওকে ব্যক্তিগতভাবে ভাল চেনেন, যেহেতু মাসুদ (শান্তিনিকেতন) বিশ্বভারতীর অনারারী ট্রেজারার । ট্রেজারারের বেতন দু’হাজার। মাসুদ এক পয়সা গ্রহণ করে না। বহু বছর ধরে আছে তহবিলদারীতে ।
মাসুদ লিখছে, “অনেকদিন আগে থেকে যে-কথা বলতাম তা-ই হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম বাংলাদেশের অধিবাসীদেরই চালাতে হবে। মুজিবকে যদি ক্ষমতাসীন করতে এহিয়া রাজী হয়, ভারত সরকার মেনে নেবে ও তােমাদের পূর্ব বাংলায় চলে যেতে হবে ও সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। অবশ্য এহিয়া বা মুজিব হয়ত বৃহৎ শক্তির এই শর্ত মেনে নেবে না। সেই পরিস্থিতিতে এই বর্তমান অবস্থা চলবে অর্থাৎ গেরিলা যুদ্ধ চলবে বহুদিন ধরে ভারতবর্ষের সাহায্য নিয়ে। পাকিস্তান কাশ্মীর বা ভারতবর্ষ আক্রমণ না করলে দুই দেশে যুদ্ধ হবে না। তবে ভারত সরকার গেরিলাদের সম্পূর্ণ ও প্রচুর অস্ত্র সাহায্য করার জন্যে পাকিস্তান যদি ভারতবর্ষে আক্রমণ করে তাহলে Total War হবে। Total War শুরু হলে ২/১ মাসের মধ্যেই Cease Fire হবে।”
কাজের চাপ আমাকে ধীরে ধীরে শেষ করে দিচ্ছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি আমার দিন ফুরিয়ে আসছে। বেঁচে থাকলে হয়ত অনেকের উপকারে আসতে পারতাম। কিন্তু সে সুযােগ আমার অদৃষ্টে নেই। আমার ভালবাসা নিও।
“কোন ব্যক্তির মৃত্যু কাম্য নয়। মোনেম খাঁর হত্যায় আশার আলাে পেলাম।..
ইতি
মাসুদ
* মােনেম খাঁ-কুখ্যাত গভর্নর।
১৯৭১
১৯ অক্টোবর
শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যেসব সমস্যা আছে, তা দ্বিপাক্ষিক আলােচনার বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশ ইস্যু পাক ভারতের আলােচনার প্রসঙ্গ নয়। পাকিস্তান সৈন্যের বর্বর হামলার
১২১
ফলে ভারতে লাখ লাখ রিফিউজী এসেছে। ফলে, ভারতের অর্থনীতির উপর প্রচণ্ড আঘাত পড়েছে। নির্বাচনের পরও বাল্লাদেশের জনমত উপেক্ষা এবং শাসকগােষ্ঠীর পদলেহী সরকার খাড়া করে কোন সমাধান সম্ভব নয়।
১৯৭১
২০ অক্টোবর
যুগােশ্লাভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান মার্শাল টিটো গত আগস্ট মাসে শেখ মুজিবের বিচার বন্ধ রাখার জন্যে এহিয়া খানের কাছে পত্র দিয়েছিলেন। আজ ভারতের সফর শেষে ফিরে যাওয়ার পূর্বে যুক্ত ইস্তাহারে ভারতে লাখ লাখ বাঙালী আশ্রয়প্রার্থীর উল্লেখ আছে। আরাে বলা হয় যে নিরংকুশ জনগণের রায়ে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ এবং বাঙালীর অবিসম্বাদিত নেতা মুজিব ছাড়া কোন সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের গুরুত্ব ক্রমশ অনুভূত।
*************
বাংলাদেশে মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা এখন কত? তাদের সম্পর্কে তথ্য থাকা উচিত। বাংলাদেশের শিক্ষা ও সমাজ বিভাগ থেকে খান সারওয়ার মুরশিদ একটি চিঠি লিখেছেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সমীপে।
কয়েক মাস হয়ে গেল, অথচ মুক্তিযােদ্ধাদের সম্পর্কে এখনও কোন সঠিক পরিসংখ্যান মেলে না। পদক্ষেপটি খুবই যুক্তিযুক্ত রণাঙ্গনের কলাকৌশলের দিক থেকে।
*************
আজ সন্ধ্যায় মুক্তিবাহিনীর এক যােদ্ধার কাছ থেকে একটি ঘটনা শুনলাম । অকুস্থল শেরপুর, ময়মনসিংহ। ধর্মপ্রাণ হাজী সাহেবের পুত্রবধূকে পাকিস্তানী মিলিটারীরা ধরে নিয়ে যায়। পরদিন তিনি গ্রামবাসীদের বললেন, “আল্লা আছেন কি না, আল্লা জানেন। এই জানােয়ারদের হত্যা করাই এখন ইসলাম।”
মুসলিম লীগের এই বৃদ্ধ এখন গেরিলা বাহিনীর প্রধান সাহায্যকারী।
১২২
সারাদিন প্রায় বৃষ্টি। জীর্ণদশ কলকাতা শহর। বৃষ্টি জমে চলাফেরা দায়। ওয়ালীউল্লাহর শােকসভার আয়ােজন করেছিল বঙ্গীয় সাহিত্য সমিতি তাদের আপার সার্কুলার রােডের (বর্তমানে আচার্য প্রফুল্ল রায় সরণী) আপিসে । জনসমাগম বেশ হয়েছিল, যদিও ওয়ালীউল্লাহ এদেশে তেমন পরিচিত নয়। অথচ তার প্রথম গল্পের বই “নয়ন তারা” প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা শহরে। প্রকাশক পুর্বাশা প্রেস, কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও সত্য প্রসন্ন দত্ত ছিলেন যার প্রধান কর্ণধার।
ভাগ্যহত আমরা। ভাগ্যহত বাংলাদেশ। নচেৎ এই দুর্দিনে ওকে হারাব কেন, যখন তার প্রয়ােজনীয়তা সবচেয়ে বেশি।
মনে পড়ল, ওর বড় ভাই নসরুল্লার কথা! বেচারা গত বছর হারিয়েছে স্ত্রীকে। এবার ছােট ভাইকে। ওর জীবনও না শেষ হয়ে যায় ধীরে ধীরে প্রদীপ নেভার মত।
১৯৭১
২১ অক্টোবর
পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী মরিয়া হয়ে উঠেছে। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ লাগিয়ে বাংলাদেশের আন্দোলন বানচাল করতে তৎপর। তাই সীমান্তে ভারতীয় গ্রামের উপর শেল বর্ষণ করে। গ্রামবাসী ও আশ্রিত রিফিউজীদের মৃত্যু হচ্ছে কাল থেকে প্রতিদিন। আরাে দুঃখের পসরা এইভাবে ভরে উঠেছে।
১৯৭১
২২ অক্টোবর
রাত্রে শােনা গেল, মুক্তিবাহিনীর বিরাট সাফল্যের খবর কসবা এলাকায়। ছাব্বিশ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত এবং বহু আহত। মরহুম কাজী আবদুল ওদুদের বড় ছেলে হাসান তওফিক সাহেব বােম্বাই থেকে এসেছেন। তিনি পাের্টের ইঞ্জিনিয়ার। ওর কল্যাণেই আমার গােটা পরিবারকে আর রিফিউজী ক্যাম্পে যেতে হয়নি।
ওদুদ সাহেব ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে চিরকাল সােচ্চার ছিলেন। ফলে
১২৩
পাকিস্তান আন্দোলন-বিরােধী। ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার মত তার কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে। চিন্তার ক্ষেত্রে এমন স্বচ্ছদৃষ্টি মানুষ কী অপমানিত না হয়েছেন “আজাদ” পত্রিকার মূর্খদের হাতে। অথচ সাম্প্রদায়িকতার পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক বাণী উচ্চারণে এতটুকু দ্বিধা করেননি।
নমস্য মনীষী। মহাকাল তাকেই বরণ করে নেবে। আর সবাই মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মত ইতিহাসে ‘ভিলেন’ নামেই ধিকৃত হবে।
১৯৭১
২৩ অক্টোবর
শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী ইউরােপের বিভিন্ন দেশ সফরে বেরিয়েছেন। রাজনীতিবিদ হিসাবে প্রজ্ঞাময়ী এই মহিলার ঝুলির ভেতর কি আছে, এখন বুঝা যাবে না, পরে তা জানা যাবে। বেতার ভাষণে অবিশ্যি তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন। শরণার্থীদের জন্যে সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় উত্তেজনার কথা বলতে ভােলেননি।
রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতার কথা ভাবলে ইতিহাসে ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ, রাশিয়ার ক্যাথরিন দি গ্রেট-এর কথা সহজে মনে আসে। তৃতীয় জন শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী। আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপককে চতুর্থ নাম খুঁজে দেওয়ার প্রস্তাব দিই। আর একটি নাম তিনি উল্লেখ করতে অসমর্থ হন।
১৯৭১
২৪ অক্টোবর
* ডক্টর অমিয় সেন খবর দিয়েছিল, রবীদ্র রচনাবলী পাওয়া যাবে। সুসংবাদ। কিন্তু দুঃসংবাদ। ৪০০/(চারশত) ভারতীয় রূপেয়া শুধু সখের জন্যে খরচ, যখন দৈনন্দিন অস্তিত্বের সমস্যাই প্রতিক্ষণে জানান দেয়।
চারশ’ রূপেয়া সঙ্গে অমিয়র দরবারে হাজির হই। প্রতি খণ্ড একদম নতুনের মত। আদৌ জীর্ণ কলেবর বা কীটদষ্ট নয়। চারশ’ টাকা বের করতে অমিয় বললে, “টাকা বের করছ কেন? দাম চারশ’ ঠিকই। তােমাকে দিতে হবে কে বলেছে? সেদিন আমি অন্তত বলিনি।”
১২৪
পুরাতন সহপাঠী সুনু মিয়া (মিয়া আমার যােগ ওর ডাক নামে) অন্তরের কপাট এমনভাবে খুলে ফে আমি রচনাবলীর দাম প্রসঙ্গ আর উত্থাপন করতে পারলাম না।
* প্রায় চৌদ্দ বছর পূর্বে স্বর্গবাসী আমার সহপাঠী ডক্টর অমিয় সেন। ট্যাক্সিযােগে কোথাও যাচ্ছিলেন, হৃদরােগে ট্যাক্সিতেই প্রাণত্যাগ করেন। সঙ্গে কেউ ছিল না। ড্রাইভার থানায় নিয়ে যায় গাড়ি। রবীন্দ্রসঙ্গীতের খ্যাতনামা গায়িকা শ্রীমতী নীলিমা সেন অমিয়র সহধর্মিণী। দুর্ভাগ্য শান্তিনিকেতনে নিজগৃহে বসবাসকারী সহপাঠী বন্ধুর আমন্ত্রণ আজও অরক্ষিত রয়ে গেল।
রণাঙ্গনে বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিবাহিনীর সাফল্য হতাশার দিক মুছে দিয়েছে। স্বাধীনতা সুনিশ্চিত। শুধু সময়ের অপেক্ষা। তাছাড়া পাকিস্তানের উপর রাজনৈতিক চাপ পৃথিবীর নানা দেশ ও প্রতিষ্ঠান থেকে আসছে। হতাশা স্বভাবতই মুছে যায়।
১৯৭১
২৫ অক্টোবর
শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী এখন বেলজিয়াম, ব্রাসেলসে। “রয়াল ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এ্যাফেয়ার্স” আয়ােজিত সভায় তিনি বলেন, ভারতে আগত রিফিউজী সমস্যায় স্বাভাবিক জীবন যাপন বেশ এলােমেলাে। পাকিস্তান যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে ভেতরে ভেতরে। আন্তর্জাতিকভাবে কেউ সেদিকে নজর দিচ্ছে না। এই হুমকি বিপজ্জনক। অবিশ্যি কয়েকদিন পূর্বে প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম জলন্ধরে এক অনুষ্ঠানে পাকিস্তানকে জানিয়ে দিয়েছে যে যুদ্ধ বাধালে তার পরিণাম খুব সুখের হবে না ।
১৯৭১
২৬ অক্টোবর
আজ মরহুম কাজী আব্দুল ওদুদের মাজারে গিয়েছিলুম ওঁর বড় ছেলে হাসান তওফিকের সঙ্গে। মরহুমের কাছে বাঙালী মুসলমান সমাজ ঋণী কৈ। ঠিক
১২৫
বলা হলাে না ভাষার দৈন্যে। ওঁর Creative Bengal বইটা পড়ে দেখতে হয়। নিজের প্রবন্ধ সংকলনের নাম করেছিলেন “শাশ্বত বঙ্গ।” কী দূরদৃষ্টি!
কলকাতা শহরে ওদুদ সাহেবের স্মৃতি পুনরুজ্জীবনের একটা উদযােগ নিতে হয়। বাঙালী মুসলমানের চেতনার সঠিক হদিস দানে ওর অবদান বাঙালী মুসলমান সমাজ ভুলতে পারে না। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে বাঙালী মুসলমান কতাে রক্ত, চোখের পানি দিয়ে !…
আহ, এ যে রক্তের দরিয়া, এ যে অশ্রুর সমুদ্র,..
নমস্য কাজী আব্দুল ওদুদ ! মহাকাল তাকেই ববণ করে নেবে। সাম্প্রদায়িকতার জল্লাদেরা ইতিহাসে ‘ভিলেন’ রূপেই ধিকৃত হবে।
শরৎ কালের উদাস বিকেল। কবরস্থানে দাঁড়িয়ে ওদুদ সাহেবেব মুখ, স্মৃতি কতাে কথা না ভেসে উঠতে লাগল।
গােবরা গােরস্থানের এই মাজার। এই গােরস্থানে শিল্পী কামরুল হাসানের পিতা। এই সমাধিভূমিতে সুপারিনটেনডেন্টের কোয়ার্টারে জন্মগ্রহণ করে অনুজ কামরুল হাসান ১৯২২ সালে। আজ কামরুলও ইতিহাসের ঘূর্ণিপাকে এই শহরে উপস্থিত হয়েছে।
* হাসান তওফিক সাহেব দু’বছর হলাে পরলােকে।
*************
Stanley Tigerman মার্কিন স্থপতি টাইগারম্যানের সঙ্গে আলাপ ১৯৬৭-৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ভ্রাতুস্পুত্র খ্যাতনামা মাজহারুল ইসলামের কল্যাণে। জাতিপুঞ্জের কাজেই মার্কিন স্থপতি ১৯৬৬ সাল থেকে এই এলাকায় ছিলেন। ওর সঙ্গে মুজিবনগরেও দেখা হলাে। এবারও নিমিত্ত মাজহারুল ইসলাম। সাংবাদিকদের কাছে টাইগারম্যান যে প্রতিবেদন দিয়েছেন তা সজ্জনের আত্মার প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের গণহত্যা থেকে বিভিন্ন ধরনের জুলুমের বিবরণ কিছুই বাদ যায়নি। ভাল স্থপতিরা সাধারণত ইতিহাস-সচেতুন হয়। এমন আচরণই টাইগারম্যানের নিকট থেকে প্রত্যাশিত ছিল।
মার্কিন সরকার বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামের বিরুদ্ধে। কিন্তু মার্কিন দেশের সাধাবণ মানুষ ক্রমশ এগিয়ে আসছে আমাদের পাশে।
এই আবহে স্ট্যানলী টাইগারম্যানের ভূমিকা স্মরণীয়।
সকল শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করাে, বন্ধু, বাংলাদেশের অধিবাসীদের পক্ষ থেকে।
১২৬
১৯৭১
২৭ অক্টোবর
জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনােসাইড” দেখলাম বহু বাংলাদেশী ও পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীসহ। পেঁকির পাড় দেয়া দৃশ্যের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে পাকিস্তানী হানাদারদের জুলুমের চিত্রপথে উঠে আসে মেশিনগানের শব্দ। গৃহত্যাগীদের মিছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরের মর্মযন্ত্রণা রূপে ফুটে ওঠে দক্ষ চলচ্চিত্রকারের কলাকৌশলে। ছােট ছবি। কিন্তু দুর্দিনে ভারত ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এই শর্ট ফিল্ম আমাদের দুর্দশা মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে।
ওদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ব সফরে বেরিয়ে এখন অস্ট্রিয়ায় পৌঁছেছেন। তাঁর আবেদন মর্মস্পর্শী ভাষায় বিচ্ছুরিত । বাংলাদেশ আর নিজ যন্ত্রণা নিয়ে একা থাকবে না। মানবতাবাদী বিশ্বের মানুষ আমাদের কাতারে এসে দাঁড়াবে বৈকি।
১৯৭১
২৮ অক্টোবর
সীমান্ত পার হওয়া আর তেমন বিপুল মিছিলে হচ্ছে না, কিন্তু প্রতিদিন কয়েক শ’ আশ্রয়প্রার্থী এসে পৌঁছেচ্ছে। এই চাপ ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কতাে দিন সহ্য করতে পারবে আল্লাকে মালুম। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধই হয়ত বাধবে। বর্ণবিদ্বেষের দাবানল ক্রমশ এই ভূখণ্ড গ্রাস করে ফেলেছে।
১৯৭১
২৯ অক্টোবর
সােভিয়েত ইউনিয়ন তার সমাজতান্ত্রিক আদর্শের পথ অন্তত বিসর্জন দেয়নি চৈনিক নেতাদের মত। প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন কানাডায় গিয়েছিলেন। সফর শেষে ইশতেহারে ঘােষণা করেছেন যে, ভারতে বাংলাদেশী শরণার্থীরা পূর্ণ
১২৭
মর্যাদায় ফিরে যাবে। তাছাড়া বর্তমান পরিস্থিতি সমাধান সম্ভব নয়।
১৯৭১
৩০ অক্টোবর
যুক্তরাজ্য সফররত মিসেস গান্ধী! এই মহিলা বিশ্বজনমত গঠনে বেরিয়েছে, তা তাঁর বক্তৃতার ধরন থেকে বুঝা যায়। মানবাধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি ঘােষণা, অভ্যন্তরে যতই রাজনৈতিক ফল্গুধারা থাক…।
বিদেশী পত্রিকা সানডে টাইমসের রিপাের্টার জানিয়েছে যে, ৮০০ মুক্তিযােদ্ধা এখন ঢাকা শহরে। বর্বর পাকিস্তান বাহিনীদের বেশ টেনশনে রেখেছে। ঢাকা কেন, সব রণাঙ্গন এখন সরগরম।
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুবৃত্ত।
-সুকান্ত ভট্টাচার্য
১৯৭১
৩১ অক্টোবর
গ্লাসগাে থেকে মােজাম্মেল হকের চিঠি। চুনুর (ওর ডাক নাম) সংস্পর্শে এলেই স্মৃতি দুদ্দাড় অতীতে নিয়ে আমাকে আছড়ে ফেলে দেয়। মরহুম গাল্পিক ফজলুল হক মােজাম্মেল হকের বড় ভাই। ১৯৪৯ সনের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকা নীলক্ষেতের নিকট ট্রেনের সম্মুখে ঝাঁপিয়ে নিজেকে বলি দেন এই প্রতিভাধর আত্মা। চারপাঁচটি উত্তম উত্তম গল্প কীর্তি হিসেবে রেখে গেলেন শুধু। কোন অনুষঙ্গে বন্ধুবর ফজলুল হকের নাম উঠলে বড় খারাপ লাগে।
মােজাম্মেল হক লিখেছে, “২৫ মার্চের খবর শুনে গ্লাসগােতে আমরা যে ক’জন বাঙালী ছিলাম তারা মিলিত হয়ে বাংলাদেশ এসােসিয়েশন গঠন করি। এডিনবরা ও গ্লাসগােতে দুটো প্রতিবাদ মিছিল বের করি। পরে গ্লাসগােতে আর একটা শােভাযাত্রা ও মিছিল করেছি। জাস্টিস চৌধুরীও আর একটা সভাতে বক্তৃতা দেন। আমরা যেহেতু তােক কম এবং টাকার অংকও অধিক নয় তাই প্রধানত প্রচারকার্য ও জনমত গঠন দুটো বিষয়ের উপর জোর দেই। আমাদের সঙ্গে আমেরিকাসহ পৃথিবীতে অন্যান্য জায়গার মােটামুটি সংযােগ হয়েছে।
১২৮
আমাদের কার্যকলাপের বিবরণ লিখে শিগগিরই আপনাকে পাঠাব।”
বড় আশান্বিত হলাম। মােজাম্মেল হক পেশায় ডাক্তার। কিন্তু গােড়া থেকে অগ্রজের মতই সামাজিক ব্যাধির দিকেও দৃষ্টি ছিল। ফলে, ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বহু দিন প্রবাসী সুদূর স্কটল্যান্ড থেকে জন্মভূমির পানে দষ্টি ঠিকই আছে। আজ ওর সুদীর্ঘ পত্রে স্পষ্ট। আমাকে আরাে লিখেছে, “আমরা এখানে কি করতে পারি, এ বিষয়ে উপদেশ দেবেন।”
১৯৭১
১ নভেম্বর
মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং তার চেলাচামুণ্ডারা যা খুশী করুক, আমেরিকার সাধারণ মানুষ যে জুলুমের আবেদনে সাড়া দিয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়, ওদেশ থেকে সাহায্যের অংক থেকে। হাজার হাজার ডলার এসে পৌছেছে বিভিন্ন রিলিফ প্রতিষ্ঠান মারফত। মার্কিন সরকার নৈতিকভাবে মার খেলে তার রাজনীতির ধার কমে যেতে বাধ্য। এমত দুঃখেই বােধ হয় জর্জ বার্নার্ড শ’ কোথায় যেন বলেছিলেন “Politics is shelter of all scoundrels রাজনীতি যত পাজি ছুঁচোদের আড়ৎখানা।”
১৯৭১
২ নভেম্বর
অসম যুদ্ধ। একদিকে ধর্মান্ধ নৃশংসতায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, অন্যদিকে কোন রকমে অস্ত্র সজ্জিত, দেশপ্রেমের উদ্দীপিত বাংলাদেশের তরুণেরা। সব সময় হামলায় সাফল্য লাভ হয় না।….
এক রিট্রিটের (পশ্চাৎপসরণের) সময় মুক্তিফৌজ একটি লাইট মেশিনগান-L. M. G এল এম জি পেছনে ফেলে রেখে আসতে বাধ্য হয়েছিল। গাঁয়ের বারাে বছরের একটি ছেলে সেটি কাঁধে তুলে নিয়ে হন্যে মুক্তিফৌজের সন্ধানে শেষে এক ক্যাম্পে সে পৌঁছায়। মুক্তিবাহিনীর শিবিরে ওকে রেখে দিয়েছে। ওর নাম দিয়েছে এল এম জি L. M. G.
১৯৭১
৩ নভেম্বর
১২৯
ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায়। প্যারেড গ্রাউন্ডে বক্তৃতা দিচ্ছেন জনসভায় বিকালের দিকে। সেই সময় পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে কয়েক জায়গায় হামলা চালায়। যুদ্ধ বাধানাের পাঁয়তারা। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়া স্বভাবতই তীব্র ঘৃণা। অবিশ্যি পৃথিবীময় এখন পাকিস্তানবিরােধী হাওয়া ক্রমশ গরম হয়ে উঠেছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ম্যাকমােহন, সিঙ্গাপুরেব প্রধানমন্ত্রী সকলের ভাষণের প্রচ্ছন্ন সুর ও বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা অচরিতার্থ রেখে কোন রাজনৈতিক ফয়সালা হতে পারে না।
*******************
আশ্চর্য স্মৃতিগহ্বর!
হঠাৎ আজ রাত্রে আশাবরী রাগের একটি গৎ কানে গুনগুন শুরু করল, প্রায় বাইশ বছর পূর্বে আমি এসরাজ বাজাতাম এবং চট্টগ্রাম আর্যসঙ্গীতের অন্যতম শিক্ষাগুরু শ্ৰীবিধুভূষণ চৌধুরী আমাদের দিয়েছিলেন।
স ঋ ম প / দ র্র র্স / র্র ণ দ প / ম প দ র্স / প ণ দ প/ ম-প-দ/ জ্ঞ-ম-/ ঋ-স-।
বিধুবাবু পঞ্চাশের দাঙ্গার পর দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান এবং আকাশ বাণীর গৌহাটি কেন্দ্রে (স্টাফ আর্টিস্ট) নিয়ােজিত হন। কয়েক বছর পূর্বে স্বর্গবাসী।
১৯৭১
৪ নভেম্বর
* মাস্টার মশাই সুনীতি চাটুৰ্য্যের বাড়িতে এক জাপানী মহিলার সঙ্গে আলাপ। নাম কাজুকো ইয়ামাদা। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা শেখান। তিনি নিজে যেভাবে বাংলা বলেন বােঝার উপায় থাকে না। মহিলা বিদেশিনী। আমার সঙ্গে খুব খাতির হয়ে গেল। তিনি বাংলাদেশের বহু লেখকের রচনার সঙ্গে পরিচিত। কবিদের মধ্যে শামসুর রাহমান তার প্রিয় কবি। অনেকের গল্প তিনি পড়েছেন, আমার ক্রীতদাসের হাসি’ পর্যন্ত। অবাক হওয়ারই কথা। কাজুকো ইয়ামাদা ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে রিপাের্টও দেশের সংবাদপত্রে পাঠিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা জানালাম বার বার।
১৩০
* বিখ্যাত ইস্তোলজিস্ট ও ভাষাতাত্ত্বিক। আমরা শিক্ষক ছিলেন।
**********
রাজাকার আলবদর বেশীর ভাগই বাঙালী মুসলমান। অবাঙালী কম। গ্রামের গুণ্ডাপাণ্ডা মাস্তান দুশ্চরিত্র বেকার এবং এই জাতীয় নরাধম নিয়ে গঠিত। হত্যা এদের পেশায় পরিণত হতে বেশি দেরী হয় না।
**********
স্নেহাস্পদ খালেকের সঙ্গে আমার দেখাই হয়নি আজ পর্যন্ত। অথচ সে বাংলাদেশ সরকারের পুলিশ প্রধান অর্থাৎ ইনস্পেক্টর জেনারেল অব পুলিশ। আজ শুনলাম, বিভিন্ন অঞ্চলভাগ এবং তদনুযায়ী ভার দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন পুলিশ অফিসারদের। স্বাধীনতার পূর্বাভাস পেতে ভাল লাগে বৈকি।
* এম এ খালেক।
১৯৭১
৫ নভেম্বর
কতাে নৃশংস হতে পারে আলবদর এবং রাজাকার জল্লাদেরা তার এব বিবরণ পেলাম সন্ধ্যায়। সতর জনের এক কাফেলাকে ওরা নিয়ে যায় নদীর ধারে এবং একে একে ওদের শেষ করে। মৃত বলে পরিত্যক্ত একজন রাত্রির অন্ধকারে হামাগুড়ি দিয়ে রক্তাক্ত দেহে সহৃদয় কিছু গ্রামবাসীর কাছে আশ্রয় পায়। তার কাছ থেকেই নৃশংতার বিবরণ মুখে মুখে ভিন্ন রণাঙ্গনে পৌঁছেছে।
শত্রুদের আচরণ হৃদয়কে পাষাণ করে তােলে। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা যদি হঠাৎ অমানববাচিত আচরণ করে বসে বিস্ময়ের কিছু নেই।
১৯৭১
৬ নভেম্বর
বেগম ইন্দিরা সফরে বেরিয়েছেন। বিভিন্ন জায়গায় তার ভাষণ যুক্তির বিদ্যুৎ এবং মানবিক আবেদনের ঝলকে ঝলকিত। কিন্তু অন্ধ এহিয়া খান। কুৎসিত
১৩১
ভাষা অর্থাৎ খিস্তি ব্যবহার করে রাষ্ট্রের প্রধান জনসমক্ষে। কামরুলকে ধন্যবাদ। জানােয়ারটার ভাল পােট্রেট এঁকেছে। আখাউড়ার কাছে এক গুদামে প্রায় পঞ্চাশ জনকে আটক রাখা হয়।
গুদামের জানালা অনেক উপরে। সেখান থেকে চোখ রেখে পাঞ্জাবী সিপাই ওদের পাহারা দিত। প্রথম চারদিন কিছু খেতে দেয়নি। ঐ ঘরেই পেসাব-পায়খানা। তিন-চার জন একেক দফায় বের করে নিয়ে যেত। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। হত্যা।
১৯৭১
৭ নভেম্বর
এক আট বছরের বালক পর্যন্ত রাজাকারদের শিকার। সে ঘাতকদের চোখে সােজা চোখ রেখে মৃত্যুবরণ করেছিল।
এমন বীরত্বের কাহিনী সংখ্যায় কম নয়।
১৯৭১
৮ নভেম্বর
রাজনৈতিক হতাশা আসে বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের চেহারা দেখে। এঁরা কেউ বিপ্লবী ছিলেন না। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করেছেন। তা সত্য। কিন্তু ইতিহাসের দায়িত্ব যখন কাঁধের উপর এসে পড়েছে, তখনও ইতিহাসের যােগ্য প্রতিনিধি হওয়ার আন্তরিকতাটুকু কেন নেই?
নাম করব না। কয়েকটা ত এলাকার বাঘ” ইংরেজদের ভাষায় Local Lion.
রাজনীতি করবাে না নিজের এলাকায় এম পি হবাে। তার বেশী দেশপ্রেমের কোন গন্ধ নেই ওদের লেবাসে। এখানে আন্তর্জাতিক রাজনীতি টোপ খেয়ে ওরা বােধ হয়, বাদশা হওয়ার খােয়াব দেখছে। ফলে ষড়যন্ত্র।
সুখের বিষয়, রাজনৈতিক স্রোত এমন গড়িয়েছে যে ওই দু-চার ডজন ষড়যন্ত্রী আর হাজার চেষ্টা করেও স্রোত বিপরীতমুখী করতে পারবে না ।
তবু ভয় হয়।
পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরু একবার প্রকাশ্য জনসভায় বলেছিলেন,
১৩২
International politics is a nuisance আন্তর্জাতিক রাজনীতি এক রকমের নােংরামি ।
******************
সিনেটর কেনেডী পাকিস্তানে প্রায় চল্লিশ লক্ষ ডলার মূল্যের সমরাস্ত্র পাঠানাে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য গভর্নমেন্টকে ধন্যবাদ জানান। বাংলাদেশ বেতার থেকে অবিশ্যি প্রচার করা হয় যে এই সিদ্ধান্ত কতখানি নির্ভেজাল তা বুঝা দায়। কারণ, গত ছ’মাস তুরস্ক এবং ইরানের কর্তৃপক্ষদের সঙ্গে যােগসাজশে মার্কিন সরকার বহু অস্ত্র পাঠিয়েছে পাকিস্তানে। সাম্রাজ্যবাদী এই ভণ্ডামি নতুন নয়।
প্রথম মহাযুদ্ধে তার Classical ধ্রুপদী উদাহরণ আছে। জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রথম তিন মাসে দেখা গেল, জার্মানদের পেট্রলের ঘাটতি প্রচণ্ড, প্রায় আত্মসমর্পণের দশা। কিন্তু জার্মানী এই সংকট কাটিয়ে উঠল। তারা পেট্রল পেতে লাগল নরওয়ে সুইডেনের ব্যবসায়ী মারফত। নরওয়ে সুইডেনের সঙ্গে ত যুদ্ধ নেই ইংরেজদের। ট্রেল এ্যাংলাে-পার্শিয়ান কোম্পানীর। তারা নরওয়ে সুইডেনকে সরবরাহ করতে লাগল প্রচুর পেট্রল। জার্মানীর সঙ্গে নরওয়ে সুইডেনের কোন বিরােধিতা নেই। তারা স্ট্রেল পেতে লাগল নরওয়ে সুইডেন থেকে।
অর্থাৎ জার্মানীরা যে ইংরেজ সৈন্যদের হত্যা করছিল রণক্ষেত্রে, তার পেট্রল যােগাচ্ছিল ইংরেজ ব্যবসায়ী। জাতীয়তাবাদী এই ভণ্ডামি অনেকে দেখে । কারণ, Business Is Business বিজনেস ইজ বিজনেস।
আমরা অবাক হবাে না, যদি বর্তমানে একই কাণ্ড ঘটতে থাকে মধ্যপ্রাচ্যে। ইসরাইল আরবদের ধ্বংস করছে। হয়ত তার পেট্রল যােগাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের কোন আমীর শাহীর যােগসাজশে ফন্দীবাজ তৈল বিক্রেতা। সরাসরি আরবদের সঙ্গে ব্যবসা না থাকলেও ইসরাইল পেট্রল পায় কোথায়?
মার্কিনদের Surplus বাড়তি তেল নেই। ওরা ইসরাইলদের দেয় এবং যা ঘাটতি পড়ে আরবদের কাছ থেকে কেনে। Business is Business
১৯৭১
৯ নভেম্বর
ধ্বংস হােক চৈনিক সাম্যবাদের নেতারা। ধ্বংস হােক। মানুষের দুঃখকষ্টের প্রতি যাদের অমনােযােগ প্রায় বর্বরতার পর্যায়ে পড়ে, তাদের মার্কসবাদী বলা,
১৩৩
মার্কসের চরম অবমাননা। আন্তর্জাতিক শক্তি রাজনীতির ভেতর চীনদেশ নাক গলাবে দুর্জনের আত্মা নিয়ে ভাবতে কষ্ট লাগে। জাতীয়তাবাদ প্রচ্ছন্ন ওদের মগজে, নচেৎ আন্তর্জাতিক মুখে এমন কালি দিত না ওরা। চটি জুতার ফিতা চৈনিক সাম্যবাদ।
১৯৭১
১০ নভেম্বর
রাজাকারদের উৎপত্তি এবং উচ্ছেদ যুগপৎ চলছে। অবাঙালী রাজাকারের সংখ্যা। নাকি নগণ্য নয়। দেশবিভাগের পর অনেকে ‘Promised Land’ মুসলিম ওয়াতান’-এ এসেছিল তারা এই অবস্থায় কী করতে পারে? নিরাপত্তার পথ খুঁজতে গিয়ে শাসকশ্রেণীর ফাঁদে পা দেওয়া স্বাভাবিক ।…পরিচিত কয়েকটি পরিবারের কথা মনে পড়ল। তখন দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবক্তাদের “শুয়ােরের বাচ্চা ছাড়া আর অন্য নামে ডাকা যায় না।
বন্ধু অধ্যাপক সায়ীদ হাসান সহকর্মী, উর্দু কবি। সেকেন্দ্রাবাদ থেকে এসেছিলেন। বর্তমানে অন্ধ। কি সৎ মানুষ। কোথায় অধ্যাপক খলীল আহমদ? যেমন মানুষ হিসেবে উত্তম তেমনই ভাষার দক্ষতায়। আমার সাহচর্যে বাংলাই শিখে ফেললেন, যেমন ওঁর সঙ্গদোষে আমার উর্দুর জ্ঞান বাড়তে লাগলাে। খুলনা গার্লস কলেজে ছিলেন। কে জানে বেঁচে আছেন কিনা।….আরাে আদল সামনে দাঁড়ায়-এমন বহু দুঃখের পশরার সম্মুখীন হতে হবে। বর্ণবিদ্বেষের খাড়ায় আরাে বলি বাকি আছে। পারব না এদের উদ্ধার করতে? এখন থেকেই। সচেষ্ট হওয়া দরকার…।
উপন্যাস লিখলে অবাঙালী কিছু চরিত্র আঁকতে হবে।… আজ মনে পড়ল, সহকর্মী নয়, সােদর–প্রতিম শরফুদ্দিনকে। সে কলকাতা থেকে আমার সহকর্মী। পিতামহ ছিলেন পাটনা হাইকোর্টের জাস্টিস ! খুবই অবস্থাপন্ন পরিবার। পাটনার ছ’লক্ষ টাকার বাড়ি, দু’লক্ষ টাকায় বেচে চাটগা এসেছিল। বাড়িও তৈরি করে। এখন কোথায় যাবে? অসহায় বহু অবাঙালী পরিবারের ভবিষ্যৎ কী?
১৩৪
১৯৭১
১১ নভেম্বর
আজও মনে পড়ল কয়েকজন অবাঙালী পরিবারের কথা। কিছু পরিবার আছে। বাঙালী কিন্তু মাতৃভাষা উর্দু। তারাও অবাঙালীরূপে চিহ্নিত। আমার কিছু সহপাঠী মানে একদম স্কুল পর্যায়ে যাদের মাতৃভাষা উর্দু তাদের কী দশা হবে? রঈস উদ্দীন হায়দার, আহসান আহমদ আক, আব্দুল লতিফ-বর্তমানে কর্নেল এবং বােধ হয়, বৃটিশ আমল থেকে। কারণ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বার্মা ফ্রন্টে সে ক্যাপ্টেন ছিল।…. এমন অনেক মুখ এবং স্বজন সৎ মানুষের মুখ আজ আমাকে। ঘিরে রইল।….
ধর্মের বিষবৃক্ষ কি উৎপাদন করে মুসলিম লীগের মূখদের চোখে আজও। তা ধরা পড়ল না। রেডিও পাকিস্তান থেকে এখনও সমান তালে হিন্দু বিদ্বেষ, ভারত বিদ্বেষ হিন্দুধর্ম বিদ্বেষ চলছে। দেশভাগের পূর্বে জিন্নাহ সাহেব তার চেলাবৃন্দ বলত ভারতীয় মুসলমানদের রক্ষাকবচ পাকিস্তান। আজ কী দেখা যাচ্ছে? হিন্দু বিদ্বেষ ছড়ালে ভারতীয় মুসলমানদের অবস্থা আরাে সঙ্গীন হয়ে উঠবে, সেদিকে নজর নেই পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের। কিন্তু ওদের চেয়ে নাদান (আহাম্মক) ভারতীয় মুসলমানেরা। তাদের অনেকের জান পাকিস্তানে পড়ে থাকে। ধর্মকে বিজ্ঞানের আলােয় দেখতে শেখার চেষ্টাও নেই শিক্ষিতদের। নিরক্ষর জনসাধারণ যদি মীথ’–এর আচ্ছন্নতা কাটিয়ে উঠতে না পারে, তা আর অস্বাভাবিক কি?
১৯৭১
১২ নভেম্বর
মার্কিন বুদ্ধিজীবীরা আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। ওঁদের অনেককেই চিনিনে। তাদের কাজ সম্পর্কেও ধারণা নেই। তবু অচেনা এই সব হৃদয়ের প্রতি, আর্ত মানবতার এই বন্ধুদের প্রতি সালাম জানাই। সমাজতাত্ত্বিক ক্লাইভ বেলের বইয়ের সঙ্গে শুধু আমার পরিচয় আছে।
১৩৫
১৯৭১
১৩ নভেম্বর
বিদেশ সফর শেষে মিসেস গান্ধী ফিরে এসেছেন। তার সফর বেশ ফলপ্রসূ তিনি জানিয়েছেন। আমরা এই সুদক্ষ রাজনীতিবিদের কথার উপর আস্থা রাখতে পারি। অবিশ্যি ওর আবেদনের একটা নকশা প্রায় ছক বাঁধা হয়ে গেছে। শরণার্থীদের কথা তুলে ধরতে আদৌ ভােলেন না।
**************
আজ ‘জয় বাংলা’ পত্রিকা অফিসে এক দুঃসংবাদ পেলাম। কুমিল্লার বেতিয়ার। গ্রামের জগন্নাথদিঘীর নিকটে মুক্তিবাহিনীর এক সম্মুখ মােকাবেলা ঘটে। কোন বিশ্বাসঘাতক পাকিস্তান বাহিনীকে পূর্বে নাকি ওদের গতিবিধির খবর দিয়েছিল । এই যুদ্ধে বেশ কিছু মুক্তিসেনা শহীদ হয়েছে। তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল ওদের। তবু অসীম নৈপুণ্যের বলে কিছু মুক্তিফৌজ বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। ইয়াফেসের (সেজ ছেলে) কথা মনে পড়ল। কোন অঞ্চলে সে আছে, এক মাস কোন খবর পাইনি। দুঃখ সমষ্টির। তবু ব্যক্তির দুঃখ তার নিজস্ব।
১৯৭১
১৪ নভেম্বর
উপন্যাস রচনার কথা ভাবি!
এই বিরাট সমাজ-কল্লোলের সকল ক্রেঙ্কার কী দিয়ে ধরব অক্ষরের জালে? মাঝে মাঝে গত দু’মাস সে চিন্তায় বেশ বিব্রত। কতাে না মানুষ জড়িত এই সামাজিক ঝটিকার মধ্যে। শত শত মানুষ, তাদের জীবনপ্রবাহ নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব, সৌজন্য ভণ্ডামি, আত্মত্যাগ, হাসি-কান্না দৈনন্দিনতা-এত বিচিত্র সমাহার। কল্পনা এগােয় না। ভয়ে পেছিয়ে যেতে হয় প্রতিদিন। অথচ দেশবাসীর সামনে তাদের চেতনা-গঠনে এসব তুলে ধরার দায়িত্ব প্রত্যেক দেশপ্রেমিক লেখকের উপর বর্তায় । বড় বিপন্ন বােধ করছি এমন বিরাট কর্তব্যের সামনে।
**************
১৩৬
স্থানীয় কাগজে পাক-ভারত যুদ্ধের আশংকা নিয়ে বেশ আলােচনা হচ্ছে। দিনের পর দিন উত্তেজনা বাড়ছে। মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম রজার্স যদিও আশ্বাস দিচ্ছেন যে তারা যুদ্ধ হতে দেবেন না। ওদের হেঁদো কথায় আস্থা রাখা দায়। কারণ মার্কিন অস্ত্র ব্যবসায়ীদের মুনাফার দিকে চোখ ফিরিয়ে বৈদেশিক নীতি পরিচালিত হবে-তা আমরা চোখ বুজে বলতে পারি।
১৯৭১
১৫ নভেম্বর
যুদ্ধ হয় ত আসন্ন।
পাকিস্তান ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করেছে। তা নিয়ে ভারতীয় পার্লামেন্টে তুমুল আলােচনা হয়। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বিষয়টি উত্থাপন করেন।
বাংলাদেশে মুক্ত অঞ্চল ক্রমশ বাড়ছে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এই পটভূমি । যুদ্ধের সব আলামত (চিহ্ন) পরিস্ফুট।
১৯৭১
১৬ নভেম্বর
বর্ণবিদ্বেষের নানা রকমের শিকার হতে পারে। কর্নেল মুস্তাফার কথা স্মরণ করা যায়। বাঙালী অফিসার হিসেবেই ক্যান্টনমেন্টে ওঁকে হত্যা করা হয়। অথচ বাইরে পরিবারের কাছে সংবাদ পাঠালে কর্তৃপক্ষ ও আত্মহত্যা করেছে। তাঁর স্ত্রীকে শুধু ওঁর মুখটুকু দেখতে দেয়া হয়। লাশ দাফনের ভারও কর্তৃপক্ষ নিলে পরিবারের কোন অনুরােধ রাখলে না।
ব্যাপারটা যে ঘােলাটে, সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় কর্তাদের আচরণে। এই শঠতা ত এক দিনের ব্যাপার নয়। বহু বছরের ধূমায়িত পরিণাম। বর্ণবিদ্বেষ শুরু হতে চলতেই থাকে। হিন্দু দিয়ে আরম্ভ, এবার ক্যুনাল সাম্প্রদায়িকতাবাদী হিন্দুদের ভাষায় নেড়ে দিয়ে শেষ হচ্ছে। পাঞ্জাবী মারছে বাঙালীকে যদিও দুই-ই মুসলমান। বাঙালীরা সুযােগ পেলে ভবিষ্যতে ছাড়বে না-আগে থেকেই বলা যায়।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এক কথিকায় ঘােষিত যে ঢাকার উত্তরাংশ এখন মুক্ত। অবিশ্যি ইংরেজী “নিউজ উইক” পত্রিকার সিনিয়র
১৩৭
এডিটর মিঃ বােচগ্রেভ বলেছেন যে, পাকিস্তান সরকার মুক্তিবাহিনীর সংবাদ গােপন করে রাখছে। তা থেকে মনে হয় বিচিত্র কিছু নয় যদি ঢাকার উত্তরাংশ মুক্ত এলাকা হয়ে যায়।
****************
মিসেস আবেদা খতীবের চিঠি পেলাম। মারাঠা বন্ধু এ এল খতীবের খবর যা লােকমুখে পাই, তা ওঁকে জানানাে হয়। ওদের গ্রামের নাম কনডিভরে, জেলা রত্মাগিরি। মারাঠী মহিলা লিখছেন ……….। (বাংলা তর্জমায়) ….আমার স্বামী সম্পর্কে আপনি যেসব খবর দিয়েছেন, তজন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এক হপ্তা আগে আমি আমার স্বামীর চিঠি পেয়েছি। তা করাচী থেকে ঘােরা পথে পৌছেছে। তিনি খােদার মরজীতে নিরাপদ আছেন। তার জন্যে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তিনি লিখেছেন যে যখন সম্ভব হবে, তিনি মৌকামত ভবিষ্যতে জায়গা। ছাড়বেন আমি ও আমার ছেলেমেয়েদের আদাব সালাম গ্রহণ করুন।…..।”
জায়গা মানে বাংলাদেশ। খতীব সাহেব মারাঠী। উর্দুভাষী। ওঁকে নিয়ে ভয় ত আছেই। তিনি মানুষ হিসেবে ফেরেশতা হলে কি হয়, বর্ণবিদ্বেষ ত জানােয়ার-সুলভ সকল লক্ষণে সজ্জিত। বর্ণ-বিদ্বেষের মূল উৎস identityর প্রতি অন্ধ আবেগতাড়িত প্রবণতা Identity তাদাত্ম-অভিন্নতা ইত্যাদি। হিন্দুর সঙ্গে কিছু ভিন্নতা আছে। সুতরাং বিদ্বেষ। মারাঠী, মুসলমান, বিহারী মুসলমান, পাঞ্জাবী মুসলমান, সিন্ধী মুসলমান ইত্যাদির মধ্যে ভিন্নতা থাকতে বাধ্য। মওকামত বিদ্বেষ পেঁজিয়ে ওঠার সম্ভাবনা। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর মগজে এসব বিচার ছিল না।
* এ এল খতীব-মারাঠী সাংবাদিক সুহৃদজন। ঢাকার Morning News পত্রিকার সহসম্পাদক ছিলেন ১৯৫৫-১৯৭১। চার বৎসর পূর্বে প্রয়াত ।
১৯৭১
১৭ নভেম্বর
শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী দেশে “জরুরী অবস্থা ঘােষণা করেছেন। স্বভাবতই ব্যক্তি স্বাধীনতার নানা সংকোচ ঘটবে। তবে পরিস্থিতি-পাঠে সুদক্ষ রাজনীতিবিদ এই মুহূর্তে ভাল- না মন্দ করলেন, বাংলাদেশের অধিবাসী হিসেবে আমি কিছু বলতে অক্ষম।
১৩৮
দুপুরের দিকে “রবীন্দ্র ভারতী” দেখতে গিয়েছিলুম।
জোড়া সাঁকো এলাকা। এত নােংরা উঠান। পরিবেশ শ্রীহীন। ভেতরে যাদুঘরে ঢুকলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত অভিঘাত কতাে বিস্তৃত এবং গভীর, বাংলাদেশবাসী হয়ে তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছি। পশ্চিমবঙ্গে এই উন্মাদনার অভাব। সমস্যা-জর্জরিত এই প্রদেশ মূল্যবােধের এমন সব সিঁড়ি হারিয়ে ফেলেছে, যার ফলে রবীন্দ্রনাথের স্বরূপ-নির্ণয়ে তেমন কেউ এগােয় না । বাঙালী মুসলমান ত স্রেফ অস্তিত্ব রক্ষার জন্যেই রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরতে বাধ্য হয়েছে। এই জাপটানি বড় দৃঢ়-যাকে বলে কষে জাপটে ধরেছে। তাই “সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি” তাদের জাতীয় সঙ্গীত। জীবনের কবি সজীবতার কাছে ফিরে যাবেন-বিচিত্র কী?
১৯৭১
১৮ নভেম্বর
ব্যক্তিগত মৃত্যু এবং গণহত্যা-জাত মৃত্যু-দুয়ের মুখােমুখি দাঁড়িয়ে একটা পেশাদার সিপাইয়ের কী প্রতিক্রিয়া ঘটে? | ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে শিক্ষাদীক্ষা অনুযায়ী তফাৎ থাকতে পারে। কিন্তু Abstract (নির্বস্তুক) বৈশিষ্ট্যের স্বরূপ কী হবে?
আমার মনে হয় এমন ক্ষেত্রে একটি সিপাই ব্যক্তির মৃত্যু দেখে যে ভয় পাবে বা মৃতের প্রতি শ্রদ্ধায় সরে যাবে-যদিও গণহত্যার সময় উল্লসিত সে জড়-যন্ত্রের মত হুকুম পালন করে যায়।
****************
বাংলাদেশ সরকারের প্ল্যানিং কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মােজাফফর আহম্মদ চৌধুরী একটি উন্নয়ন প্রকল্পের প্রতিবেদন রচনা করেছেন। বেশ বিস্তারিত ব্যাপার। অবিশ্যি অর্থনীতির উপরই জোর বেশি। অধ্যাপক ইংরেজ প্রবাদ জানেন ঃ Money is ready medicine. কড়ি ব্যামাের তৈরি বড়ি। আগে ওর সঙ্গে একদিন আলাপে বলেছিলাম।
প্রাগুক্ত। মরহুম ।
১৩৯
১৯৭১
১৯ নভেম্বর
মানব-গােষ্ঠীর মিল ত আছেই, শুধু দেহে তা সীমাবদ্ধ নয়।
আজ তথ্যকেন্দ্রের এক পােলিশ ফিল্ম দেখলাম। যেন শরৎচন্দ্রের উপন্যাস। বিধবা মহিলা চল্লিশ বছর সৈনিক-স্বামীর সঙ্গে দেখা নেই। স্বামীর বন্ধু ছদ্মবেশী সেখানে হাজির হলাে। বৃদ্ধকালে তারও আশ্রয় প্রয়ােজন। দুই নিঃসঙ্গ হৃদয়ের সান্নিধ্য। নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে বিবাহ-বন্ধন। আশপাশের লােকের কুৎসা রটানাে প্রবৃত্তি ও অন্যান্য চেহারা দেখা গেল। ঠিক যেন শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজ। পােল্যান্ড ত ইউরােপে। অথচ গ্রামভিত্তিক এই ফিল্ম যেন বাংলাদেশের কাহিনী। মানুষে মানুষে যদি সব ছাড়িয়ে ঐক্য না থাকত আমরা কী করে আন্তর্জাতিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম?
১৯৭১
২০ নভেম্বর
বাংলাদেশ জুড়ে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা আরাে বিস্তৃত। ঢাকা শহরের বুকেই নাশকতামূলক নানা কাজে গেরিলারা ব্যাপৃত। এই গতি অব্যাহত থাকলে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধাতে বাধ্য হবে পাকিস্তান।
কারণ, পাকিস্তান সুচারুরূপে জানে, গেরিলাদের টিকে থাকার উৎস এখন ভারত সরকার এবং বিশাল দেশের ভূখণ্ড। | আন্তর্জাতিক রাজনীতির দিকে তাকালে ঘেন্না ধরে যায়। স্বার্থ ছাড়া আর কিছুরই বালাই নেই।
১৯৭১
২১ নভেম্বর
আজ লন্ডন থেকে * মােজাম্মেল হকের পত্র পেলাম । চুনু লিখছে, “আমির আলী সাহেবের পরামর্শমাফিক আপনার নামে ৫০ কপি FRONT BANGLADESH (Vol NO 1) পাঠালাম। দয়া করে প্রাপ্তি-সংবাদ জানাবেন। আশা করি এগুলাে
১৪০
প্রচারিত হবে। ………..বাংলাদেশের জনসাধারণের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই মাসিক পত্রিকাখানি কিছুটা সাহায্য করবে এই বিশ্বাস নিয়েই এটা করছি। আমার ধারণা আমির আলী সাহেবের সঙ্গে পূর্বযােগাযােগ মারফত আপনি এর জন্মবৃত্তান্ত জানেন।…… আপনার মতামত ও উপদেশ কামনা করি।”
প্রচার যত বিস্তার লাভ করে তত মঙ্গল।
* প্রাগুক্ত
১৯৭১
২২ নভেম্বর
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং চৈনিক সাম্যবাদ এখন বিবাহ-বন্ধনের পূর্বে পূর্বরাগে আবদ্ধ।
ছেলেবেলা থেকে অনুন্নত দেশের নাগরিক হিসেবে ভেবেছিলুম, সমাজতন্ত্রবাদ মানুষের জন্য শুধু অর্থনৈতিক নয় নৈতিকতা-বিস্তারক এক মহান উপাদান। কিন্তু ক্রমশ এই আদর্শের প্রতি আস্থা রাখা দায়। পঞ্চাশ বছর ধরে বহু রক্তপাত ক্ষয়ক্ষতির পর দেখা যাচ্ছে নৈতিকতার প্রতিষ্ঠা এত টলমলে। তাই সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং সাম্যবাদী চাউ এন-লাই এক ঘাটে। জল খান । বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষকে সমূলে উচ্ছেদের জন্য গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে, সে-ব্যাপারে তাদের কোন উচ্চবাচ্য নেই। খলের ছুতাের অভাব হয় না। এরা পোঁ ধরে আছেন পাকিস্তান অখণ্ড রাখতে হবে। তা স্বাভাবিক কি অস্বাভাবিক তা নিয়ে ওদের কোন মাথাব্যথা নেই। স্বার্থের তাগিদে, শঠতাকে আদর্শের মুখােশ পরিয়ে হাত মিলিয়েছে সাম্যবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদ। এক কোটি রিফিউজী কেন ভারতে? কোন্ কোন্ রকম জুলুমের ধাক্কায় আতংকিত দিশাহারা এক বিশাল নরগােষ্ঠী এমনভাবে অনিশ্চয়তা সম্বল করে ভেসে চলেছে। খড়কুটোর মত দিগ্বিদিক? সেদিকে চোখ দেওয়া মনে করেন না কম্যুনিস্ট চাউ এন-লাই। শ্ৰেণী হিসেবে যিনি এক মান্দারিনের বাচ্চা। চৈনিক আমলাদের বলা হয় মান্দারিন ।
কার্ল মার্কস, হাইড গেটের কবরে, আপনি ঘুমােতে পারছেন ত? হাইড গেট লন্ডনের এক এলাকা। সেখানে গােরস্থানে মার্কস সমাহিত।
১৪১
১৯৭১
২৩ নভেম্বর
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেব অফিসকে বানিয়েছেন ঘর, ঘরকে বানিয়েছেন অফিস। সংসার আছে। কিন্তু সংসার করেন না। আজ এক ভাষণে খুব মজার কথা বলেছেন। তারই ভাষায়, “ইসলামাবাদের শয়তানরা” এখনও বাঙালী নিধন করছে। স্বাভাবিকভাবে এই উম্মার প্রকাশ আমাদের সন্তুষ্ট করতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রধানের ভাষা সব সময় শালীন হওয়া দরকার-যদিও পশ্চাতে নির্গলিত অর্থ এক। বলতে পারতেন, শয়তান যে-যে কাজ বা যে-জাতীয় কাজের প্ররােচনা যােগায় ইসলামাবাদের ফেরেস্তারা ঠিক তা-ই করে চলেছে। দুষ্কর্মের তালিকাভুক্ত প্রথমেই ঃ বাঙালী নিধন। আমার বক্তব্য অন্য রাষ্ট্রের শুয়াের-বাচ্চাদের শুয়ােরের বাচ্চা বলা শালীন ব্যাপার নয় আদৌ। ফেরেস্তা বলে নুনের ছিটা দিলে তা আরাে কার্যকর হয়।
১৯৭১
২৪ নভেম্বর
সাংবাদিক স্নেহভাজন আব্দুল মতিন বহুকাল ইউরােপ-প্রবাসী। আইয়ুব খানের সামরিক আইনের কালে দেশ ছেড়েছিল। আজ ওর খবর পেলাম। পেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে। সাংবাদিক ঠিকই আছে এই দুর্দিনে বাংলাদেশের পাশে। উড়াে খবর পেলাম। কিন্তু কেউ ওর ঠিকানা দিতে পারল না।
১৯৭১
২৫ নভেম্বর
পাকিস্তানের বিমান মাঝে মাঝে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে হানা দিয়ে যায়। এসবই যুদ্ধের লক্ষণ। তবে আগস্ট মাসে সােভিয়েত..ভারত চুক্তির ফলে আমেরিকা অন্তত জড়িয়ে পড়তে সাহস পাবে না সহজে। শীতকাল। চীনের হামলা হিমালয় পেরিয়ে সম্ভব নয় এই শীতকালে। তবে পাকিস্তানকে মদৎ দিতে কসুর করবে না। সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্যবাদের কোলাকুলি দেখে মার্কস সাহেব কী
১৪২
১৯৭১
২৬ নভেম্বর
সিকান্দার আবু জাফর সংগঠক হিসেবে বড় প্রশংসনীয় জন। সাপ্তাহিক কাগজ একটা সত্যি বের করে ক’মাস চালিয়ে যাচ্ছে। তার অভিযান পত্রিকায় আমি শরীক হতে পারিনি। এক হাতে কত আর চাহিদা মেটানাে যায়?
১৯৭১
২৭ নভেম্বর
ষড়যন্ত্র ঠিক চলছে ভেতরে ভেতরে। মুক্তিবাহিনীর সাফল্য এবং বিশ্বজনমতের বিস্তার দেখে পাকিস্তান এবং স্যাঙাতের দল আওয়ামী লীগের কিছু প্রচ্ছন্ন বিভীষণসহ জাল পাতা অব্যাহত। রাজনৈতিক ফয়সালার কথা আবার উত্থাপিত। কিন্তু কাদের সঙ্গে ফয়সালা? স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে একটা কথিকা পড়লুম। জীবজন্তুর সঙ্গে কী ফয়সালা করা যায়? যারা বিভিন্ন শিবিরে অসহায় মেয়েদের বিবস্ত্র আটক রাখে-(বস্ত্রহীন কারণ আত্মহত্যা করতে পারে) তাদের সঙ্গে ফয়সালা?
এই মর্মজ্বালার সুরেই এক জায়গায় বললুম, “পাকিস্তানের শাসকবর্গ বেইজ্জতির যে জগদ্দল বাংলাদেশবাসীর বুকের উপর চাপিয়ে দিয়েছে ইতিহাসে তার নজীর নেই। এই সামরিক জঙ্গী বা জন্তু-চক্র থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার পূর্বে বাংলাদেশবাসী আর কিছু ভাবতে নারাজ।”
১৯৭১
২৮ নভেম্বর
ধর্মবীর ভারতীর পত্র পেলাম। তিনি “The Illustrated weekly of India” এর হিন্দী ভাষ্য “ধর্মযুগ” পত্রিকার সম্পাদক। তিনি চিঠি লেখেন হিন্দীতে স্বাক্ষর করেন বাংলায়। ওরা আমার পূজাসংখ্যা দেশ-পত্রিকায় প্রকাশিত “জাহান্নম হইতে বিদায়” উপন্যাসের তর্জমা ছাপা শুরু করেছেন। আট দশ দিনের মধ্যে
১৪৩
সম্পাদক মুজিবনগরে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাত করার কথা জানিয়েছেন। তাঁর একটি পংক্তি বড় ভাল লাগল, “বাংলাদেশ কা যুদ্ধ কেবল বাংলাদেশ কা নেহি।” অনুবাদ নিপ্রয়ােজন।
১৯৭১
২৯ নভেম্বর
বােধ হয় মাস দুই পূর্বে “The illustrated weekly of India” র সম্পাদক খুশওয়ান্ত সিংহকে পত্র দিয়েছিলুম। সেই কথার উল্লেখসহ বােম্বাই থেকে * কুররাতুল আইন হায়দার লিখেছেন, (বাংলা তর্জমায়) আপনার পাঠানাে গল্প Not in a graveyard (গােরস্থানে নয়) আমাদের ডিসেম্বর ২৬ তারিখের স্পেশাল সংখ্যায় বের হবে। আপনার ছবি ও সংক্ষিপ্ত জীবনী-তথ্য পাঠান।
গল্পের অনুবাদক ওসমান জামাল।
* উর্দু সাহিত্যের বিখ্যাত বিধূষী ঔপন্যাসিকা। “আগ কি দরিয়া” নামক উপন্যাস লিখে পাকিস্তান থেকে ষাটের দশকে ভারতে পালিয়ে আসেন। ভারতের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য-পুরস্কার তিন লক্ষ রুপেয় মূল্য “জ্ঞানপীঠ” তিনি এই বছর লাভ করেছেন।
১৯৭১
৩০ নভেম্বর
ভাষান্তর কেন্দ্রের সােমনাথ দ্বিবেদী আমাকে হিন্দীতে পত্র লিখেছেন। ওরা জেনে গেছে হিন্দী ভাষার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। কিন্তু কেউ ত ভেতরের খবর জানে না। মুজিবনগরে এসে বেশ অনুভব করলাম, যদি পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে সাধারণ ছােটখাটো চিঠি হিন্দীতে লিখতে পারি, তাহলে বাংলাদেশের প্রচারকার্যে অনেক সুবিধা হবে । উর্দু সামান্য জানা আছে। তা দিয়েই কাজ চলতে পারে, যদি হিন্দীর বর্ণ পরিচয় থাকে। একটা হিন্দীর প্রাথমিক বই কিনে আনলাম। সাত দিনে অক্ষর পরিচয় শেষ। দশ দিনের দিন হিন্দীতে পত্র লিখতে শুরু করলাম। ভারতে ‘ধর্মযুগ’ সাপ্তাহিক হিন্দী পত্রিকা পাচ লাখ ছাপা হয়। সম্পাদক ধর্মবীর ভারতীকে যখন হিন্দীতে চিঠি লিখলাম,
১৪৪
তিনি ত ভয়ানক আনন্দিত। ভুল থেকে যাচ্ছে প্রচুর। কারণ, উর্দুর মত হিন্দীতেও লিঙ্গ পরিবর্তনের সঙ্গে ক্রিয়াপদে পরিবর্তন ঘটে। ধর্মবীর ভারতী আমাকে উৎসাহ দিলেন। কিন্তু সময় কোথায় ভাষায় ডুব দিতে? সে যা-ই হােক, হিন্দী পত্রিকার সম্পাদকদের পত্র আমি অন্য ভাষায় দিইনি। আমার ভাষা খোড়া, কিন্তু গন্তব্যে ঠিক পৌছে যেত। সাম্প্রতিক একটি চিঠিতে আমাকে লিখেছেন আমার গল্প ও বই তর্জমার ব্যাপারে। বইয়ের নামগুলাে কিন্তু বাংলায় লেখা, অবিশ্যি দ্বিবেদী মশাই ভারতীয় কয়েকটি ভাষা ভাল জানেন।
১৪৫
কিন্তু ভাষার ব্যাপারে আমাকে হতবাক করে দিয়েছে আমার জাপানী ভগিনী কাজুকো ইয়ামাদা। আমার মাস্টার মশাই সুনীতি চাটুয্যের বাড়িতে ওর সাথে পরিচয়। সে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা শেখায়, তা-ও জেনেছিলুম।
সুনীতিবাবুর বাড়িতেই আরাে কয়েকবার দেখা। কাজুকো আমাকে “দাদা” ডাকা শুরু করেছিল। পুতুলের মত তার নাতিদীর্ঘ কিশােরী-সুলভ মুখাবয়ব অল্পবয়সী অনুজাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। কাজুকোর সুবাদ-স্থাপনে খুশী হয়েছিলাম। বাংলা ভাষার প্রতি তার প্রীতির চেয়ে বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি তার দরদের আধিক্যে। শামসুর রাহমানের কবিতা সে শুধু পড়েনি কয়েক পংক্তি মুখস্থ শুনিয়ে দিলে । কিন্তু আমি হতবাক তার হস্তাক্ষর দেখে টোকিও থেকে লেখা চিঠি। পত্রের প্রথম এবং শেষাংশ তারই হস্তাক্ষরেজয় বাংলা! বিদেশিনী এই অনুজার প্রতি শত কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে থাকা যায় না। আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামে সে-ও শরীক বৈকি। পৃথিবীর দিকে দিকে আত্মজনের আর্তনাদ না পৌঁছে পারে না। মনুষ্যত্ব তাে বিলীন হয়ে যায়নি।
******************
অনেক ঘটনা আমরা জানিনে, কিন্তু বুদ্বুদ জানান দেয় কী ঘটছে। গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল। পুলিশের পােষাক কি হবে এবং তাড়াতাড়ি কি ব্যবস্থা নেয়া যায়, সে ব্যাপারে খালেকের উদ্যোগ দেখে মনে হয় দেশের স্বাধীনতা কি ত্বরান্বিত হচ্ছে? যুদ্ধ বাধতে পারে। তা বিচিত্র নয়। ভারতীয় সীমান্তে পাকিস্তানী খেচানি ত রােজ লেগেই আছে।
* পুলিশপ্রধান
******************
“জয় বাংলা” পত্রিকা আপিসে একজন বলছে কুমিল্লা জগন্নাথদীঘির অপারেশনে মুক্তিবাহিনীর বেশ ক্ষতি হয়েছে দালালদের কারসাজির ফলে। অপারেশনের কমান্ডারের নাম ইয়াফেস ওসমান। ভদ্রলােক অন্য একজনের সঙ্গে কথা বলছে। আমি উৎকর্ণ শুনছি। মুক্তির সংগ্রামে তরুণরা ঝাপিয়ে পড়বে, অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু ভয়ে ওঁকে আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়ে পিছিয়ে রইলাম। সন্ধ্যার পর বিষন্ন মনে বাড়ি ফিরলাম। সেজ ছেলে
১৪৬
ইয়াফেসের খবর অনেকদিন পাইনি। তারপর দুর্বিপাকের সঙ্গে জড়িত নাম। নানা উদ্বেগে ক্লান্তি বেড়ে যায়। ঘুম এসে যায় একসময়। আত্মােৎসর্গের মৌসুমে ব্যক্তি বিশেষের কথা ত ভাবা উচিত নয়। যুক্তি এ-ক্ষেত্রে অচল।
১৯৭১
১ ডিসেম্বর
যুদ্ধ নাকি আসন্ন। পুরাতন সাংবাদিক বন্ধু দেবশরণ ও পার্বতী দাশগুপ্তাদের বাড়ি গিয়েছিলুম। সেখানে জনরব সমর্থিত। ভাষা আন্দোলন-খ্যাত গাজীউল হকের কড়েয়া রােডের বাসায় গতকাল শােনা, যুদ্ধ আসন্ন। সীমান্তে গণ্ডগােল ত লেগেই আছে। তা থেকে যুদ্ধের পূর্বাভাস ভিত্তিহীন। কিন্তু বিশ্বাস না করেও উপায় নেই। বাংলাদেশ সরকার ভবিষ্যৎ প্রশাসন নিয়ে এত ব্যতিব্যস্ত কেন? এ এফ এম ফতেহ সাহেব রাজনৈতিক দায়িত্বের ভার নিয়েছেন। আকবর আলী খান ঢাকা কলেজে আমার প্রাক্তন ছাত্র পাকিস্তান সার্ভিসের অফিসার। ওর সঙ্গে দেখা হলে সােজা জিজ্ঞেস করতে হয়, আসল ব্যাপার কী? আনােয়ার খানের সঙ্গে অনেক দিন দেখা নেই।
১৯৭১
২ ডিসেম্বর
যুদ্ধ বাধা নয়, হয়ত বেধেই গেছে ঘােষণা ছাড়া। নচেৎ দর্শনার পাকিস্তানী ঘাঁটিতে ভারতীয় গােলাবর্ষণের কারণ দেখিনে। মুক্তিবাহিনীর চাপ এখন চতুর্দিকে বিস্তৃত এবং বেশ গভীরতর লেভেলে। বিদেশী সাংবাদিক এবং বিবিসির ভাষ্যে তা প্রকট। তবে কী ফোঁড়া মুখ নিয়েছে এবং বিদীরণের বিলম্ব নেই? আবহে উদ্বেগ। ইয়াফেসের কোন খবর পাচ্ছিনে।
দেশ বিভাগের সময় যুক্ত বাংলার গভর্নর ছিলেন এক অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলােক : আর জি কেসী। তিনি তখন একটা ছােট বই লেখেন। তিনি লিখেছিলেন, দেশটা ভাগ করার প্রস্তাব মেনে নিয়েছে নেতারা। কিন্তু কোন সমস্যারই সমাধান হবে না। হিন্দু-মুসলমান-এই সাম্প্রদায়িক বিরােধ ভিত্তি করেই ত দেশ-ভাগ। কিন্তু তার সমাধান হওয়া দূরের কথা আরাে বৃহত্তর এলাকায় বিস্তৃত হবে। বর্তমান যুদ্ধ তা স্পষ্ট করে দিচ্ছে।
১৪৭
১৯৭১
৩ ডিসেম্বর
সীমান্তে সৈন্য সমাবেশে ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই তৎপর ছিল। যুদ্ধ টিকিয়ে রাখা গেল না। ডেলি টেলিগ্রাফের প্রতিবেদক জানিয়েছে যে, চল্লিশ দল গেরিলা আছে এখন বাংলাদেশে এবং তারা বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে শত্রুর মােকাবিলায় রত।
ভারতবর্ষ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আজ যুদ্ধ ঘােষণা করল। ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। এই সীমান্তে যুদ্ধ বেশীদিন চলবে না। পশ্চিম সীমান্তে কী হয়, কে জানে। স্বাধীনতা সন্নিকট আজ অনুভব করা যায় হাজার আশংকা আন্দোলিত মন নিয়েও।
১৯৭১
৪ ডিসেম্বর
কাল বিকেল পাঁচটায় পাকিস্তান ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোট শহরে বিমান থেকে বােমা বর্ষণ করে। পাকিস্তানের উন্মাদ জেনারেলরা যে আগুন লাগিয়েছে, তার পরিণতি এই যুদ্ধ। এখন স্পষ্ট পিকিং ওদের সমর্থন দেবে। ঐ মুরুব্বিদের আস্কারাই পতঙ্গ-সুলভ মৃত্যুর দিকে পাকিস্তানকে ঠেলে দিয়েছে। বহু ক্ষয়ক্ষতি ত হবেই এবং তৎসঙ্গে প্রাণের আহুতি।
নাচার এমন অবস্থায়। দুর্জন প্রতিবেশী থাকলে গায়ে কাদা লাগবেই। তবে বােধ হয় দুরাশা নয় যে, জিন্নাহর তাসের ঘর উড়ে যাবে। এবং বসুন্ধরা সত্যি পাক (পবিত্র) হবে ।…
********
কাল সকালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এলপি সেনের একটা প্রবন্ধ পড়লাম। অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক দেখিয়েছেন শুধু লজিস্টিকের দিকে লক্ষ্য রাখলেই, পরিণতি কী হবে, তা উন্মাদ এহিয়া খানও জানে। সীমান্তে সৈন্য জমায়েত করতে গেলে মুক্তিবাহিনী বেপরােয়া কাজ চালাতে পারবে। আর মুক্তিবাহিনীর পেছনে গেলে বর্ডার অরক্ষিত। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল ত আর নেই। ফলে, রাজাকার দিয়ে কাজ চালানাে। এই জাতীয় ছােট ছােট দল আবার গেরিলাদের জন্যে তােফা
১৪৮
নাস্তা। পাকিস্তানের কামধেনু ছিল বাংলাদেশ। তা যখন নেই, শুধু রসদ ও অর্থাভাবে পাকিস্তান ধসে যেতে বাধ্য। এখানে মুরুব্বিরা আছেন-মার্কিন ও চীন । কিন্তু মরুব্বীরা কতাে যােগান দিতে পারবে তার উপর সব নির্ভর করছে। স্বাধীনতাকামী বিশাল ভূখণ্ডের উপর হামলা সাম্যবাদের মুখে থু থু ছিটিয়ে দিচ্ছে। চাউ-মাউ সাহেবরা তা বােঝেন না কী? হয়ত আর বােঝেন না। একদা বার্ট্রান্ড রাসেল লিখেছিলেন, সাম্যবাদের ভেতর একরকম ধর্মীয় উন্মাদনা আছে। আজ তা স্পষ্ট। শিয়াসুন্নীর মত পিকিং-মস্কো-এই হীনযান মহাযান ভেদ দেখা যাচ্ছে কেন? গােটা মার্কসবাদের গােড়ায় আবার যেতে হয়। এ মহৎ আদর্শের মধ্যে জীবজন্তু পয়দা হচ্ছে কেন? স্ট্যালিন সাহেব রুশ কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ৭২ জনের মধ্যে ৫৩ জনকে শুধু দৈহিক নির্যাতন মারফৎ অপরাধের স্বীকারােক্তি আদায়ের ফন্দী এঁটেছিল । “Beat, Beat and they will confess” শয়তান-সুলভ স্ট্যালিনের এই নির্দেশ সম্পর্কে কোন মন্তব্যও ঘৃণাই মনে হয়। শুধু তা-ই নয়, চৈনিক নেতা লি শাও চী ৪৫ বছর সাম্যবাদ করার পর এখন Running Dog of the capitalist? ওর How to be a good communist বইখানা পৃথিবীময় চালু ছিল। বৈজ্ঞানিক চিন্তায় প্রতিষ্ঠিত আদর্শের ভেতর গোঁড়ামি (ফ্যানাটিক) দেখা দেয় কেন? এসব প্রশ্ন নতুন করে উত্থাপন ও মােকাবিলার প্রয়ােজন।
********
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চীনের প্রতিনিধির পোঁ পুরাতন। বাংলাদেশের ব্যাপার পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। ভারতই যুদ্ধবাজ। এই জাতীয় ভাষণে ভদ্রলােক আসর মাৎ রাখেন।
********
আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে জানা যায় যুদ্ধের ব্যাপকতা। ঢাকা করাচী দুই শহরেই ভারতীয় বিমানবাহিনী বােমাবর্ষণ করেছে। ওদের পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক জগজিৎ সিংহ বলেছেন, সামরিক ঘাঁটির উপর চাপ অব্যাহত আছে।
১৪৯
১৯৭১
৫ ডিসেম্বর
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাব দেয়, অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং সৈন্য প্রত্যাহার করা হােক। সােভিয়েত রাশিয়ার “ভেটো” বাণে তা অচল হয়ে যায়। সাম্যবাদের মানবতাবাদী মানসিকতা কিছু বর্তমান আছে সােভিয়েত নেতৃবৃন্দের মধ্যে। এটুকুই সান্ত্বনা। পাকিস্তানকে চীনেরা অস্ত্র দিতে আদৌ কার্পণ্য করছে না……..
********
বাংলাদেশ থেকে মেয়েদের বীরত্ব কাহিনী কম কানে আসে না। এক গ্রাম পাকিস্তানী সিপাই, যদিও আসল উদ্দেশ্য ধর্ষণ, মেয়েদের ডাব কেটে দিতে বলে। ডাব খেতে গেলে গলা উঁচিয়ে ঠোট ছোয়ানাে-প্রায় মওকায় সৈন্যদের গলার দায়ের কোপ মারে মেয়েরা। অবিশ্যি অবশেষে ওদের হত্যা করা হয় ।
********
যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন অতিবাহিত। বাংলাদেশ রণাঙ্গনে পাকবাহিনী ত বিচিত্র কিছু নয়। উন্মাদ এহিয়া খান কিন্তু ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, “এ শেষ যুদ্ধ।”
ফলাফল জানাই আছে। হাতীর সঙ্গে লড়বে গিদধড়। তাও আন্তর্জাতিক । জানােয়ার প্রেসিডেন্টের মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। জঙ্গীশাহী মৃত্যু ত্বরান্বিত করছে। তাই জন্তুর মুখ দিয়ে সত্য কথা বেরিয়ে পড়ে।
********
মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় জওয়ানদের অগ্রগতির ফলে পরিত্যক্ত এলাকা থেকে জঙ্গী পাকিস্তান বাহিনীর অনেক ক্রিয়াকলাপের সংবাদ পাওয়া গেছে। যশােরের নিকটস্থ পােস্টাপিস থেকে এক ধর্ষণ-উন্মাদ অফিসারের চিঠি পাওয়া গেছে। বলাবাহুল্য, পােস্টাপিস বর্তমানে অধিকৃত। অফিসারের নাম আফজাল খান সাকীব। সে তার বন্ধু মেজর মােহাম্মদ ইকবাল খানকে লিখছে, “……….বাংলাদেশে বাঙালী মেয়েদের উপর বলাৎকার প্রশংসার কাজ বৈকি। ………এইভাবে এক প্রজন্মে ওদের জাতীয় চরিত্র বদলে দেওয়া যাবে।”….পত্রে অন্যত্র, “I was not surprised about the news of bengal tigress being
১৫০
tamed by rashid. It is a must to change their next generation. You must also plan carefully to tame bitches there. (বাংলা তর্জমায়ঃ এক বাঙালী বাঘিনীকে পােষ মানিয়েছে রশীদ। এই সংবাদে আমি অবাক হইনি। ওদের পরবর্তী প্রজন্ম বদলে দিতে এটাই হচ্ছে-একদম লাজেমী (অবশ্য-কর্তব্য) কাজ। তুমি কুত্তী পােষ মানাতে ওখানে খুব যত্নের সঙ্গে প্ল্যান করাে)।
মুসলিম লীগের রাজনৈতিক সাফল্যের একমাত্র পুঁজি ছিল বর্ণবিদ্বেষ। তার জের এখন এইভাবে প্রবাহিত।
একজন পশ্চিম পাকিস্তানী । সে ত অফিসার পর্যায়ের লােক। কোন সাধারণ অশিক্ষিত জওয়ান নয়।
এখন চোখ ভরে দেখুন, মহান ইসলামী আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের কী মহৎ প্রসব!
১৯৭১
৬ ডিসেম্বর
আজ আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের স্বীকৃতি প্রদত্ত। পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন। ইতিহাসে নতুন রাষ্ট্রের জন্মদিন এই তারিখকে ধরা উচিত। প্রতিবেশীর স্বীকৃতি ছাড়া যেমন ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোন মূল্য বিচার হয় না, রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও তা সহজে প্রযােজ্য।
জয় বাংলা।
জয় ইন্দিরা গান্ধী।
সকাল ১১টার সময় ভারতীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। নতুন রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দকে আমল দিলাম না। ভেতরে চাপা থাকাই মঙ্গল। চৈনিক দস্যু-যারা নিজেদের কম্যুনিস্ট বলে জাহির করেতাদের দাপাদাপি এবং সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনীদের জন্তুসুলভ আসুরিক শক্তি-এখন এক রশিতে বাঁধা। চীন সাগর থেকে মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের দিকে ধেয়ে আসছে। এসব আলামত ভাল নয়।
তাই হে জননী-বঙ্গ, কিছু অস্বােয়াস্তির সঙ্গে তােমার নব জন্মােৎসব পালন করলাম ।
১৯৭১
৭ ডিসেম্বর
দ্বিজাতিতত্ত্বের পরিণাম।
১৫১
ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানুষের ক্ষয়ক্ষতি, দুঃখ-বেদনার পরিমাপ কি সম্ভব? চতুর্দিকে দুশমন শত্রুরা পিছু হটছে আনন্দ-বার্তা। বাংলাদেশ মুক্ত হতে আর বেশিদিন লাগবে না। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর চাপে থেৎলে যাবে পাকিস্তান বাহিনী। কিন্তু বাংলাদেশে কয়েক লক্ষ অবাঙালী আছে এবং যারা মুসলিম ওয়াতান’ (আবাসভূমি। এর মরীচিকার পেছনে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে এখানে এসে জুটেছিল উজ্জ্বল স্বপ্ন চোখে, আজ এই পরিণাম।
কী হবে ওদের?
বাঙালীরাও বর্ণবিদ্বেষের জন্তুতে পরিণত হয়, অবাক হবাে না। কিন্তু এই পাপ থেকে সকলকে সতর্ক করে দিতে হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ধর্মনিরপেক্ষতার আহ্বান কাজ দেবে। কিন্তু তার মত জন-নায়ক আমরা ফিরে পাব কিনা কে জানে? এডেন থেকে মুজিবুর রহমান খান লিখেছিল কয়েক মাস পূর্বে যে পাকিস্তানীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। এখন বিচারের টালবাহানা খুন চাপা দেওয়ার কৌশল মাত্র।
আশংকা বহুক্ষণ মনে ছেয়ে রইল ।
******************
গত তিন দিন ধরে জাতিপুঞ্জে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে বচসা-রত যুধ্যমান দুই দেশ এবং তাদের সহযাত্রীরা। সােভিয়েতের হাতে তুরুপের তাস আছে। ভেটো দিয়ে সব বানচাল করে দিচ্ছে। যুদ্ধের পরিস্থিতি কোনদিকে মােড় নেবে ঈশ্বর জানেন। মার্কিন নৌবহর বঙ্গোপসাগরমুখী।
* আজই বাংলাদেশ সরকার রুহুল কুদ্স-কে মহাসচিবের (চিফ সেক্রেটারী) পদে নিয়ােজিত করেছে। আমাদের বাসস্থান পাঁচ মিনিটের পথ। সন্ধ্যার পর গিয়েছিলুম ওকে অভিনন্দন জানাতে। সীমান্ত পার হতে ভদ্রলােকের শরীরের উপর দিয়ে বেশ ঝড়-ঝাপ্টা গেছে। আরামপ্রদ জীবনযাপনে অভ্যস্ত অফিসারদের জন্যে তা অস্বাভাবিক নয়। তবে শেষ পর্যন্ত ভেতরে মনটা শক্ত থাকে যদি আদর্শের আকর্ষণে, সব সামলে নেওয়া যায়।
ওর একই ব্যাচের CSP সানাউল হকের কোন খবর দিতে পারলেন না রুহুল কুদ্স। একে বাঙালী তার উপর কবি। দড়ির উপর ভ্রাতা কীভাবে হাঁটছেন। ভেবে কোন লাভ নেই। কোনই সাহায্যে আসতে পারব না ওদের। আবুল হােসেনও পড়ে আছে ওদিকে।
* সানাউল-প্রশাসক, কবি।
১৫২
* আবুল হােসেন ও কবি তথ্য বিভাগের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত।
* রুহুল কুদ্স সম্প্রতি প্রয়াত।
১৯৭১
৮ ডিসেম্বর
আপিসেই দেখা হলাে অমিতাভ চৌধুরীর সঙ্গে। আনন্দ বাজারের বার্তা সম্পাদক তিনি। তিন দিন পূর্বে তার প্রদত্ত এক শিরােনাম দেখে আমি কেন আরাে পাশে দু-তিনজন ছিল আনন্দে হৈ হৈ করে উঠেছিলাম।
হেডিংটি হচ্ছে ঃ গাজী শহীদ।
পাকিস্তানের একটি রণতরী ভারত মহাসাগরে নৌযুদ্ধে কুপােকাৎ হয়ে গেছে। করাচী বন্দর ফলে অরক্ষিত হয়ে পড়বে। তরিটির নাম ঃ গাজী।
বার্তা-সম্পাদক তার আনন্দ মুজিবনগরের প্রত্যেক অধিবাসীর বুকে দুটি শব্দে ছড়িয়ে দিলেন। কাবেল আদমী ।
বিবিসির খবর, কুমিল্লা বিমানবন্দর মুক্তিবাহিনীর দখলে। পূর্ব রণাঙ্গনে সর্বত্র জয়রথ ঘর্ঘর-রবে গড়িয়ে চলেছে।
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুবৃত্ত।
-সুকান্ত ভট্টাচার্য
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের জাতির উদ্দেশে ভাষণটি ছিল বড় মর্মস্পর্শী।
১৯৭১
৯ ডিসেম্বর
যশাের থেকে দুশমন বাহিনী পশ্চাৎ অপসরণ করছিল পরশু থেকে। এখন শহর হাতছাড়া। যশােরের অবাঙালী অধিবাসীরা পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে পালাচ্ছে।
১৫৩
খুলনার দিকে। শহরে বাচ্চাকাচ্চাসহ অনেকে নীড় বেঁধেছিল দেশবিভাগের পর থেকেই। আজ আবার ছিন্নমূল। রিফিউজী হয়ে এসেছিল। আবার একই জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হচ্ছে। এবার আরাে বিষাদাত্মক, আরাে মর্মান্তিক। বর্ণবিদ্বেষ-আরাে সােজা কথা হিন্দু বিদ্বেষের রাজনীতি ওদের ঘরছাড়া করেছিল । এবার বর্ণবিদ্বেষ যথা আছে, তবে হিন্দু-ভীতি নয়, এবার ভয়ের উৎস মুসলমান। কোন ঔপন্যাসিক যেন এই ট্র্যাজেডির ভাজ উন্মােচন করেন ভবিষ্যতে ।
*********************
সংবাদপত্রে দেখলাম, নুরুল আমীন পাকিস্তানের নয়া প্রধানমন্ত্রী। মুসলিম। লীগ রাজনীতি করেছেন ভদ্রলােক। সেদিক থেকে ঈমানদার। কিন্তু একদাপ্রগতিশীল গণতন্ত্রের উঁাড়াদার মাহমুদ আলীটার হলাে কী? বাংলা প্রবাদ আছে, বেঁটে লােক খােদার দুশমন। চোস্ত পাজামা পরার ফলে, বেঁটেটাকে আরাে বেঁটে দেখাতাে। তখন স্পষ্ট রাজনীতি গ্রহণ করেছিল (Career) কেরিয়ার গঠনে । দালালির জন্যে বাঙালী দরকার পাকিস্তানে। জাতিসংঘে আর কাকে পাঠাবে?
বাঙালীদের মন ভেজাতে যে সুবিধাবাদের চাটিতে নুরুল আমীন প্রধানমন্ত্রী, সেই চাটি নয়-পদাঘাতে মাহমুদ আলী জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধি। নুরুল আমীনকে আমি ঈমানদারের সম্মান দেব, যা-ই হােক তার রাজনীতি। কিন্তু মাহমুদ আলী ত বেঈমান।
*********************
মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ শুধু চরমপত্র মারফৎ ঘােষিত হয় না। ব্যাপারটা স্বাধীন বাংলা। বেতার কেন্দ্রের প্রােগ্রাম চরমপত্র। ভারতীয় জেনারেল মানেকশ, একই পন্থা অবলম্বন করেছেন। দশ পনর মিনিট বাদে বাদে বেতার থেকে ঘােষণা ও আত্মসমর্পণ করাে। পরাজয় অবধারিত। নচেৎ মৃত্যুর সম্মুখীন হও-এই জাতীয় মর্মে উচ্চারিত হয়। অনেক হ্যান্ডবিলও বিমান থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে উর্দু ভাষায়। আরাে ঘােষণা করা হচ্ছে, সময়মত অস্ত্র সংবরণ করলে সৈনিকদের মর্যাদা দেওয়া হবে ।
অবিশ্যি দু’দিন আগে বিদেশী পত্রিকায় পড়েছিলাম, এক পাকিস্তানী অফিসার প্রতিবেদককে বলেছে যে তাদের অস্ত্রশস্ত্র প্রচুর মজুদ আছে কিন্তু মনােবল ভেঙে গেছে।
সৈনিক ভাই, ইরাবতীর কূলে তােমার জন্ম, এখন মরবে ইছামতির কূলে বা জলে।
১৫৪
১৯৭১
১০ ডিসেম্বর
প্যারিস থেকে * আনম্যারী ওয়ালীউল্লাহর (Anne marie Waliullah) পত্র পেলাম।.সমস্ত আবহ শােকের মূৰ্ছনায় আতুর। ওয়ালীউল্লাহ বনানী’ তে একটা বাড়ি কিনেছিল। আমরা কয়েকজন সৈয়দ নুরুদ্দীনসহ ভাবতাম, ওলির এখানে বাড়ি থাকলে পরে দেশে থিতু হবে। নচেৎ বিদেশী বউ, বৈদেশিক বিভাগে চাকরি-শেষে যাযাবর আর দেশে ফিরবে না। মৃত্যুর পর ভাবলুম, কাজটি বড় গর্হিত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা। অর্থ ওদিকে থাকলে বিধবা ও তার দুই সন্তানের কাজে লাগত। এ আমরা কী করলাম? কে জানত, ওলি মরে যাবে। আন ম্যারী লিখেছে যে আমাদের বিবেক পীড়িত হওয়ার কোন কারণ নেই। বৈদেশিক মুদ্রার কথাও লিখেছিলাম। তাই জবাব আন ম্যারীর ভাষায় পড়ন “…and the money involved would Mean nothing to me while it means much more as it is, and for the children. although it is more like keeping a dream alive, তখন ওলির মেয়ে সিমীনের বয়স নয়, ছেলে ইরাজ তিন। আন ম্যারীর পত্রের বাকী অংশ আরাে মর্মস্পর্শী । তারই ভাষায়, “Everything was so beautiful then life was so full of promises like the trees and the flowers around, and yet in the bottom of our hearts we all knew we lived on a volcano, and felt it threatening life as yours, but little did I know it would come this way to me, if anxiety is responsible Wali’s early death. Then he is also victim of this devastation in Bengal.’ pont অনুবাদে ঃ তখন সবকিছু এমন মােহনীয়। জীবন কতাে প্রতিশ্রুতিময় চারপাশের গাছপালা এবং পুষ্পগুচ্ছের মত। কিন্তু তবু আমরা হুদয়ের অন্তস্থলে জানতাম, আমাদের বসবাস একটি অগ্নিগিরির উপর । আমি অনুভব করতাম আগুনের এই পাহাড় তােমার জীবনের মত আমার জীবনকেও দাবড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমি ঘুণাক্ষরেও কী জানতাম তা এই পথ ধরে আসবে। উদ্বেগ যদি ওয়ালীর অকাল মৃত্যুর জন্যে দায়ী হয়, তাহলে সেও বাংলাদেশের সর্বনাশের বলি ।
তারপর বিদুষী মহিলার প্রশ্ন বহু বাঙালীর হৃদয় স্পর্শ করবে। আন ম্যারী F936, “I do not know where I belong and France without him is nothing to me.
তর্জমায় ও আমি জানিনে কোথায় আমার ঠাই? ওয়ালী ছাড়া ফ্রান্স আমার
১৫৫
কাছে কিছুই না।
* আন ম্যারী ওয়ালীউল্লাহর ফরাসী স্ত্রী।
**********
আকাশে এখন মিত্রশক্তির বিমানবাহিনীর একচ্ছত্র আধিপত্য। ফলে পাকিস্তান বাহিনী প্রচণ্ড মার খাচ্ছে। মেঘনা নদীতে বােমার আঘাতে জাহাজডুবির ফলে পাচশ’ পাকিস্তানী সৈন্য মারা যায়। এমন খবর অথবা জয়ের সংবাদে খবরের কাগজগুলাে একঘেয়ে লাগে ।
১৯৭১
১০ ডিসেম্বর
চীনের বর্ণবিদ্বেষ সত্যি সত্যি আজব ঠেকে। ১৯৪৯ থেকে ১৯৭১। বাইশ বছর পাওয়ারে এসেছে চীন কম্যুনিস্ট পার্টি। এক নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়ে গেছে ওই কাল-পরিসরে। কিন্তু কি পয়দা করেছে ওরা? বর্ণবিদ্বেষের সাহায্যে যদি জনসাধারণকে সমাজ গঠন বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে উদ্দীপিত করতে হয়, তাহলে মার্কস্বাদ আর টেকে কোথা? এসব সমস্যা নেই চৈনিক নেতাদের। মুখে বুলি, পেছনে গুলি। যুদ্ধের সমাপ্তি যত তাড়াতাড়ি ঘটে, ততই মঙ্গল। খামখা প্রাণের অপচয়ের প্রতি কারাে সমর্থন থাকা উচিত নয়।
“ঢাকা চলাে, চলাে।” ছাত্রদের এই শ্লোগান কানে বড় মধুর লাগল।
১৯৭১
১০ ডিসেম্বর
বিপর্যয়ের মুখে হানাদার দস্যুদল। পাকিস্তান বাহিনী বলতেও ঘৃণা হয়। আনন্দ লাগে বৈকি শত্রুর বিপর্যয়ে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ঘৃণা চাড়া দিয়ে উঠে। ঠিক আট মাস পূর্বে মার্চ থেকে এই জানােয়ারেরা কী প্রচণ্ড হত্যাকাণ্ডের তাণ্ডব চালিয়ে দিয়েছিল। এখন বিভিন্ন রণাঙ্গনে পালাচ্ছে। তাই বেসামরিক পােশাকে উর্দি ফেলে ওরা ঢুকে পড়ছে অবাঙালী পাড়ায়। অন্যায়ের শাস্তি এত জলদি শুরু হবে, হতভাগারা জানত না ।
দেশী দালাল, রাজাকার বাহিনী, আলবদর ইত্যাদি এখন প্রভুদের মত
১৫৬
দিশাহারা । এক রাজাকারের আত্মহত্যার সংবাদ পাওয়া গেল।
**********
শরণার্থীরা দেশে ফিরে যাচ্ছে।
খবরের কাগজে একটি ছবি বেরিয়েছে ঃ স্বামী সামনে, পেছনে স্ত্রী। ভেলা মার্কা একটা ব্রীজ পার হচ্ছে। মাঝখানে বালক-পুত্র। বয়স ৭/৮ বছর। তার হাতে বাংলাদেশের নিশান। শিশু রাষ্ট্রের পতাকা শিশুর হাতে। চোখ জুড়িয়ে যায়।
**********
ময়দানে শহীদ মিনারের (পূর্বে নাম ছিল অক্টারলােনী মনুমেন্ট) পাদদেশে বুদ্ধিজীবীদের সভা ছিলঃ বাংলাদেশের স্বীকৃতি উৎসব। বক্তৃতা দিলাম আরাে অনেকের সঙ্গে। চৈনিক নেতাদের সমালােচনা না করে উপায় নেই। আশ্চর্য, মার্কসবাদী এই রাষ্ট্রের কী নৈতিক অধঃপতন। ওরা কী করে বলে, ভারতের উস্কানিতে বাংলাদেশের আন্দোলন। দেশের ৭.৫০ সাড়ে সাত কোটি মানুষ কি গরু-গাধা যে তারা স্বাধীনতাকামী নয় তেইশ বছরের নিপীড়নের পর? চৈনিক নেতারা Racial complex এর শিকার। নচেৎ নিজেদের এত বড় মনে করে কীভাবে? আমাদের দিকে ওদের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক এহিয়া খানের মত। সাম্যবাদীর এই আজব নমুনারা দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় হনুমানের লংকাদহন পর্ব অভিনয় করবে । Racially উন্মাদ বৈকি ওরা।
**********
রণাঙ্গনে এবং আন্তর্জাতিক মানবতার সামনে আর মাথা তুলে দাড়াতে অক্ষম পাকবাহিনী। ঢাকা অধিকারের পর্যায় শুরু হয়েছে। মেঘনা নদী পার হতে পেরেছে মিত্রবাহিনী।
১৯৭১
১০ ডিসেম্বর
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উঠলে সােভিয়েত ইউনিয়ন ‘ভেটো দেয়। এই ভেটোর জোরেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ হালে পানি পাচ্ছে না।
১৫৭
বােম্বাই থেকে লেখা কুররাতুল আইন হায়দারের চিঠি দু’দিন পূর্বে পাই। ওর চিঠি থেকে জানা গেল, বাংলাদেশের ব্যাপারে বেশ বিচলিত। অনেক পুরাতন পরিচিত বন্ধুদের উল্লেখ করেছেন। এক জায়গায় লিখেছেন, “I was shocked to hear of Waliullah’s death. He was a good friend of mine. I was the only friend he had invited at his nikah with Anne Marie. I must be glad you have me her address, I must write to her.
এই খবরটি আমি জানতাম না। আরাে খবর দিয়েছেন কুররাতুল আইন হায়দার যা ওয়ালীউল্লাহর জীবনীকারদের জন্যে উল্লেখ্য সংবাদ। এ্যানী হায়দার (সংক্ষেপে ওর নাম) আরাে লিখেছেন, “I have condensed and published Waliullah’s novel (brought out by UNESCO) in “imprint”, a book magazine I used to edit here before joining the Times of India. I sent him a copy. He was most excited and happy to hear from me after all these years and wrote to say that he was most happy with my abridgement. That was in october, 1967. The same month I lost my mother and somehow afterwards I could not keep in touch with him.
After “Aag ka dariya” I wrote a novelette. “chai ka bagh” based on life in the tea garden of sylhet. I also started writing a novel Aakhir shab ke hamsafar (this is a line from Faij) also about East Bengal. It was serialized in Guftugu, a magazine published here by Sardar Jafri. But the magazine closed down and I got too involved in journalism to finish the novel.
বাংলা অনুবাদে ঃ আমি ওয়ালীউল্লাহর নভেল সংক্ষেপিত আকারে “ইমপ্রিন্ট” নামক কাগজে প্রকাশ করছিলাম “টাইমস অব ইন্ডিয়ায় যােগদানের পূর্বে। আমি তাকে এক কপি পাঠাই। তিনি উত্তেজিত এবং আনন্দ অনুভব করেন বহু বছর পরে এই যােগসূত্রের জন্যে। তিনি লেখেন যে সংক্ষেপ তার মন-মত হয়েছে। তা ১৯৬৭ সনে অক্টোবর মাসের কথা। ওই মাসে আমি আমার মাকে হারাই এবং যে-কোনভাবে হােক, ওয়ালীউল্লাহর সঙ্গে আমি যােগাযােগ রাখতে পারিনি।
“আগ কা দরিয়ার পর আমি আর একটি নভেল লিখি “চায়ে কা বাগ” নামে- সিলেটের চা বাগানের দৈনন্দিনতার উপর ভিত্তি করে। আমি আর একটি। উপন্যাস লেখা শুরু করি “আখেরী শাব কা হামসফর” শেষ রাত্রির সহযাত্রী (এই পংক্তিটি ফয়েজ থেকে নেওয়া) তাও পূর্ববঙ্গের উপর ভিত্তি করে। রচনাটি
১৫৮
গুফতগু (সংলাপ) নামে একটি পত্রিকায় ছাপা হচ্ছিল। পত্রিকার সম্পাদক সর্দার জাফরী।
এ্যানী হায়দারের পত্র থেকে জানা যায়, পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে, তার বাসনা আর পূর্ণ হয়নি।
শ্রীমতীর পত্রে পাকিস্তানের কিছু পুরাতন বন্ধুদের নাম উল্লেখ করেছেন। কিন্তু পত্রের একদম শেষে দুটি বাক্য বেশ মজার।
শ্ৰীমতী এ্যানীর ভাষায় ঃ I believe prof. Ali Ahsan is also here and has recently visited Bombay. I was quite surprised because as I remember he used to be quite rabid.
অনুবাদঃ জানতে পারলাম অধ্যাপক আলী আহসানও এখানে এবং বােম্বে ঘুরে গেছে। আমি তুমুলভাবে বিস্মিত। কারণ, যদুর মনে পড়ে ও ত ভয়ানক গোঁড়া, জলাতংক রােগগ্রস্ত। ক্ষিপ্ত প্রাণী। এই টাইপ কপিতে মন্তব্যের শ্ৰীমতী হায়দার পেন্সিলে লিখেছেন “Do keep in touch. যােগাযােগ রেখাে।”
* কুররাতুল আইন হায়দার। প্রাগুক্ত
* ফয়েজ-বিখ্যাত উর্দু কবি ফয়েজ * আন ম্যারী-প্রাগুক্ত
* প্রফেসর আলী আহসান-পাকিস্তান আমলে ঘাের পাকিস্তানী ছিলেন।
তাই পত্র–লেখিকার অমন মন্তব্য। পরে তিনি মুজিবনগর যান। ঘাের জাতীয়তাবাদী হন। পরে এরশাদ আমলে স্বৈরতন্ত্রের সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা। ব্যাপারটা, আবহ-কুকুটের দশা। যেদিকে বাতাস সেদিকে মুখ ফেরানাে।
১৯৭১
১৪ ডিসেম্বর
চতুর্দিকে রণাঙ্গনে জালেম গিদধড়ের দল পিছু হটছে। মনােবল ভেঙে গেছে। ওদের। বিদেশী কাগজে সােজা শিরােনাম : “বাংলাদেশে পাকিস্তানের পরাজয়।” যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ কোনদিন আমাকে টানে না। হত্যালীলায় মত্ত দুই দল মানুষ। এখানে আনন্দের কী থাকবে যে আমাকে আকর্ষণ করবে? মােটামুটি ফল জানলেই হলাে। তার বেশী না।
তাড়াতাড়ি কাগজে চোখ বুলিয়ে তৈরি হই। যশাের যেতে হবে। মুক্ত যশাের। জয় বাংলা।
১৫৯
১৯৭১
১৫ ডিসেম্বর
কাল যশাের এবং সাতক্ষীরা গিয়েছিলুম সাংবাদিক বন্ধুদের কল্যাণে। সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোন মন্ত্রী। কিন্তু তাদের সঙ্গে কিছু পরিবার পরিজন বা আত্মীয়স্বজন ছিল। তাদের বেশভূষা, ফ্লাক্স ইত্যাদি দেখে মনে হলাে যেন পিকনিক করতে যাচ্ছে। মন খারাপ হয়ে গেল। বিপ্লবজাত সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এমন লেজুড় দেখে। বাংলাদেশ আর কত দূর?
ভয়ানক অস্থিরতা অনুভব করছিলুম ভেতরে। বাস ছুটে চলেছে। বসিরহাট, অশােকনগর, হাবড়া প্রভৃতি অঞ্চল দিয়ে। একসময় বনগাঁ চেকপােস্টে পৌঁছলুম। ভারতীয় জওয়ানদের কর্মতৎপরতায় বেশী সময় লাগল না ছাড় পেতে।
বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকেই দেখা গেল চাঁদতারা-মার্কা রাষ্ট্রের সৈন্যদের বর্বরতার নানা নিশানা।…. গৃহদাহের নমুনা ভূরি ভূরি। গৃহে আর মানুষ নেই। ভিটে খাঁ খাঁ করছে।
সড়কের উপর দৈনন্দিন জীবন-লীলার অংকন শুরু হয়েছে। বেশ কিছু দলবাঁধা পথিক। পাকিস্তানী অবরােধকালে পাঁচ দিন পূর্বেও এমন দৃশ্য কল্পনার বাইরে ছিল। দু-পাশে বাঙ্কার, ভাঙা পুল ত কতই না চোখে পড়ল…. একদিকে চোখ পুড়ে যায়, অন্যদিকে জুড়িয়ে যায়। অনেক সর্ষে ক্ষেতের বিস্তার। ফাঁকা মাঠে ধূসরতার পাশাপাশি হঠাৎ এই গাঢ় হলুদ রঙের বিছানায় চোখ গড়াগড়ি দিয়ে ক্ষান্ত থাকতে কি বাজী হয়? কিন্তু আবহে বিভীষিকার ছায়া। তাই সহজে কিছু গ্রহণ যেন পাপবােধের সামিল।
এত অপমৃত্যু আর এমন নির্মম মৃত্যু বাংলাদেশ আর কোনদিন দেখেনি।… শার্শা থানার নাভারণ পৌছলাম। এখানে মহকুমা হাকিম এক সভার আয়ােজন করেছিলেন। তার আপিসে বিশ্রাম নিচ্ছি। নিকটে ফাইলের কাতার। উপরে এক ফাইলের দিকে চোখ গেল। অনধিকার প্রবেশের অপরাধ এই বয়সে রুচিবিরুদ্ধ। তবু আড়চোখে দেখে নিলুম। ইংরেজীতেই লেখা So far 94 Albadar Rajakar have been Killed by the angry people. (এ পর্যন্ত ৯৪ জন আলবদর রাজাকারকে ক্ষিপ্ত জনতা হত্যা করেছে। এটা চোখে পড়ে ভালই হলাে।
বক্তৃতার সময় সাবধান বাণী উচ্চারণ করতে পারলুম। আইন-শৃংখলার ভার প্রশাসনের উপর রেখে দেওয়া উচিত। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আইন হাতে তুলে
১৬০
নিলে অরাজকতা অবশ্যম্ভাবী। পাকিস্তান জংলী শুয়ােরদের ত নাশকতা ছাড়া আর কোন লক্ষ্য ছিল না। অনেক কিছু তারা ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। ঘরবাড়ি, পথঘাট, ব্রীজ, প্রাতিষ্ঠানিক ইমরাতসমূহ-যেমন স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল। এসব আবার গড়তে হবে । অরাজকতার পরিবেশে তা আদৌ সম্ভব নয়। এই মর্মে বেশ বক্তৃতা করলুম।
নাভারণ ছেড়ে সাতক্ষীরার দিকে। ত্রাসের থাবা কী নিদারুণ হতে পারে, এখানে এসে না শুনলে, জানত না সভ্য দেশের মানুষ-পশুত্বের পর্যায় কতাে নীচে নামতে পারে। মুসলিম লীগের পুঁজি ছিল বর্ণবিদ্বেষ। তার সঙ্গে মধ্যযুগীয় কৃষ্ণ প্রবৃত্তির (passion) তীব্র মিশ্রণ-দুই একত্র হলে যা ঘটে, তা-ই ঘটল। গণহত্যার জন্যে লােকালয় থেকে সামান্য দূরে হয়ত বধ্যভূমি তৈরি কোন পাকা বাড়ির কামরায়। মৃত্যুর মুখে বােধ হয় যে চিৎকার দেয়, তা সমস্ত সত্তাউৎসারিত এবং তার দূরত্ব পরিধি নিশ্চয় সাধারণ নয়। লােকে নিশীথে শুনতে পেত গগনভেদী আর্তনাদ। কতাে রকমের মর্মন্তুদ কাহিনী না শুনলাম ….
স্থানীয় ছাত্র অফিসার ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপ।….
সভা।…
ইটিন্দা ঘাটের পথে প্রত্যাবর্তন। পথে এক চেকপােস্ট। চোখে পড়ল মসজিদের গায়ে মেশিনগানের দাগ। মুসলিম লীগের স্বপ্ন এইভাবে যুদ্ধকালে রূপায়িত হয়। আসলে ভারতীয় মুসলমানদের জন্যে ওরা দুঃস্বপ্নের বৃক্ষ রােপণ করেছিল। তা-ই ফল দিচ্ছে। বিষময় ফল।
************
অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীতে ইতিহাস এখন তার রক্তাক্ত অধ্যায় শেষ করছে। খবর পাওয়া গেল খুনী নিয়াজি, ওমর, পীরজাদা, ফরমান আলি প্রভৃতি নরনারী শিশুঘাতকের দল আশ্রয় নিয়েছে হােটেল কন্টিনেন্টালে। সঙ্গে আছে ঠ্যাটা মালিকা। (চরমপত্রের ঘােষকের ভাষায়-গভর্নর মালিক) নৌ শ্রমিক আন্দোলন দিয়ে এই চক্ষু চিকিৎসকের রাজনৈতিক জীবন শুরু সততাহীন পদক্ষেপ-ধাপে ধাপে উন্নতি এবং শেষে এই পরিণতি।
************
ইতিহাস, আঁচলে মুখ ঢাকা হাসি বােধ হয় এইভাবে দেখায়। এখানে ব্যাপারটা
১৬১
ঢাকা-হাসিও বটে। এদের রক্ষা করতে হয়ত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ 7th flect diplomacy সপ্তম নৌবাহিনী কূটনৈতিকতা শুরু করেছে। ভিয়েতনামের পরও শাসকগােষ্ঠির কোন শিক্ষা হয়নি।
************
মালিক ক্যাবিনেটে এক মন্ত্রী শামসুল হক। ভেবেছিলুম আর কেউ হবে। না, আমাদের নিকটের অর্থনীতির সেই অধ্যাপক। চাটগা প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে ওর ওঠা-বসা কি তাহলে মুখােশ? Industry করার ইচ্ছায় বেশ দৌড়াদৌড়ি করত। কি ইন্ডাস্ট্রি গড়েছিল আমার জানা নেই। কিন্তু মটোর দৌড়াত শামসুল হক। হয়ত উপরে ওঠার অচেতন তাগিদ ছিল মনের তলায়। এখন ত আয়ু তলায় ঠেকতে পারে।
************
এই প্রসঙ্গে আর এক অধ্যাপকের কথা মনে পড়ল। ভদ্রলােক কৃচ্ছ্বতার চরম করত টাকা জমাতে। ওর পত্নীকে দেখে আমার প্রথমে মনে হয়েছিল কোন পরিচারিকা। ময়লা শাড়ি এবং সারা শরীর কৃঞ্ছতার দাগ। অপুষ্টির জের স্পষ্ট মুখাবয়বে দেখা যায়। অধ্যাপক বাড়ি ছিলেন না। অকালে মারা গেলেন। ব্যাধি টেনে নিয়ে গেল কৃঞ্ছতার কাটা খাল ধরে আগত কুমীর-রূপে।
************
আর এক অধ্যাপক, নিজের সন্তানদের ভালবাসায়, তাদের মানুষরূপে গড়ে তুলতে প্রচণ্ড পরিশ্রম করতেন। তার ফলে, মারা গেলেন। ব্যক্তি পর্যায়ে এই ট্র্যাজেডি ত শ্রদ্ধার দাবীদার। কিন্তু গােটা সমাজের দিক থেকে মনের, এই System কীভাবে না জীবন গুঁড়িয়ে দেয়। তখন ট্র্যাজেডির চেয়ে করুণার উদ্রেকই বেশী হয়।
মানব-চরিত্রের দিশা মন্থনে অনেকগুলাে চোখ পেতাম। একই সময়ে নানাদিকে প্রক্ষেপ করা যেত।
১৬২
আজ আরাে সংবাদ পেলাম, মুক্তিবাহিনী পিয়ার আলী নাজির নামক সিএসপি অফিসারকে মেরে ফেলেছে। ১৯৬৪ সনে ভদ্রসন্তান রাজশাহীতে ডেপুটি কমিশনার ছিলেন। কিন্তু হিন্দু নিধনের অন্যতম হােতা। ওদের কোন রক্ষণের দায়িত্ব নিলেন না, বরং যে প্রহরী ছিল তাদের হাতে তুলে নিলেন। পরে আরাে অনেক দুষ্কীর্তির নটগুরু। লাট মােনেম খাঁর পেটুয়া অফিসার। এই ভদ্রলােক মিলিটারীদের দোসর হবে-তা আর আশ্চর্য কী? এই ব্যক্তিত একদিক থেকে প্রথমে উল্লেখিত অধ্যাপকের ক্যাটাগরীতে পড়ে। গুলশানে সুরম্য প্রাসাদের মালিক। কিন্তু কোথায় গেল ভােগ:-যার জন্যে আত্মার উপর মালিন্যের পোঁচ টেনে টেনে মানুষ থেকে এমন অমানুষ হয়েছিল?
************
টলস্টয়ের War and Peace নভেলের চেয়েও বিশাল পটভূমি চোখের উপর দিয়ে আবর্তিত হচ্ছে। কী করে আঁকব এই ব্যাপক ঘূর্ণিঝড়ের চিত্র? তাই মনে এত অস্থিরতার কল্লোল ! সহজে এক ঠায় বসে থাকাও দায়। অনেক হাঁটলুম বিকেলে। খণ্ড খণ্ড ছবি হাতছানি দিয়ে পালায়। এই সামাজিক হিমবাহী ঝড়ের বিশালত্ব কী দিয়ে ধরব? দিশেহারার মত তাকাই চতুর্দিকে। কিন্তু আমি ছাড়া আর এই দায়িত্ব কে-ই বা পালন করবে? এই মুহূর্তে কাউকে চোখের সামনে পাচ্ছিনে। তাই আরাে অস্থিরতা।
************
কলকাতা শহরের আদিম অধিবাসী কয়েক পুরুষ থেকে, উর্দু মাতৃভাষা তবে বাংলা বলে চমকার। এই মুসলমান দ্রলােক আমাকে বললেন, “বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি দেওয়ার পর আমি দু’দিন ঠিকমত খেতে পারিনি। কেমন যেন মনের ভেতর অস্বােয়াস্তি।” ভারতীয় মুসলমান নাগরিক। পরিচিত মানুষ আমার কৈশাের কাল থেকে।
ওর এই সত্য ভাষণের জন্যে আমি মানুষটার প্রতি কোনাে বিরূপ মনােভাব পােষণ করতে পারলাম না। Myth (মীথ) এইভাবে অচেতন মনে সক্রিয় থাকে। গত তিরিশ বছর ধরে পাকিস্তান-পাকিস্তান শ্লোগান মূলত দ্বিজাতিতত্ত্ব (হিন্দুরা এক জাতি মুসলমানরা স্বতন্ত্র) যে-অলীক স্বপ্ন রচনা করেছে, তা সহজে মুছে যায়নি। মুছে যায় না। কারণ, এ.-টা নেহাৎ instinct উপজ্ঞার কাছে আবেদন মারফৎ তৈরি-বর্ণবিদ্বেষের পুঁজি যেখানে সম্বল। Myth মীথ মুছে ফেলতে প্রচণ্ড মানসিক
১৬৩
১৯৭১
১৬ ডিসেম্বর
খুব সকালে সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে যশাের-যাত্রা।
বনগ্রাম, নাভারন-পথের পুনরাবৃত্তি ।…. জুলুমের কাহিনী শত শত। পাকিস্তানী জওয়ানদের অমানুষিকতা আর কতাে শুনব?…. দরাটানা ব্রীজের সামনে মর্টার ছোঁড়া ধ্বংস–চিহ্ন।…. শহরে কিছু লােক ফিরে এসেছে। এতদিন ত ভুতুড়ে শহর ছিল যশাের ।
এক জায়গায় দেখলুম, হাড়ের স্তুপ এখনও পড়ে আছে। অবাঙালীদের অত্যাচার চরমে ওঠে, বিশেষত যারা রাজাকার হয়েছিল তাদের তরফ থেকে।…. বর্ণবিদ্বেষ আবহ। তখন জুলুমও সত্তার সঙ্গে সঙ্গতি প্রার্থনা করে। ধর্মযুদ্ধে একই কারণে পাশবিকতা চরমে পৌঁছায়। ইউরােপে ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট একই সম্প্রদায়ের দুই শাখায় জন্তু-পর্যায়ে পৌঁছানাের প্রতিযােগিতা চলে। এখনও ভারতের লাক্ষ্মৌ শহরে শিয়া-সুন্নী লড়ে এবং জানােয়ারের পর্যায়ে নেমে। সাধারণ যুদ্ধে সত্তা এমন স্তরে যায় না, তাই নির্যাতন, পাশবিকতা, হত্যা ইত্যাদির ধাক্কা তেমন হয় না।
শুনলাম দু-তিন শ’ অবাঙালী এখন জেলখানায় রক্ষিত, পাছে জনসাধারণ ওদের ছিড়ে ফেলে তাই মিত্র বাহিনী এই ব্যবস্থা করেছে। দুঃখ হয়, ভাগ্যহত এই সব মানুষ আবার নরক-কুণ্ডে পড়ল- জিন্নাহ যাদের মুসলিম ‘ওয়াতান’ (Homeland) এর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এদের এই ভূখণ্ডে টেনে এনেছিল একদিন…, বাসে বসে শােনা গেল পাকিস্তান বাহিনীর প্রধান নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেছে, এখন কথাবার্তা চলছে শর্ত নিয়ে। এখনও অনিশ্চয়তা। এই সব দোদুল্যমানতার মধ্যে চিন্তামগ্ন হঠাৎ বাসেই জানা গেল, নিয়াজি সব শর্ত মেনে নিয়েছে।
চোখে পানি এসে গেল। আনন্দের অভিঘাত আমাকে বিষন্ন করে তুলছিল। কতাে প্রাণের বিনিময়, কতাে বুক-ফাটা আর্তনাদ, কতাে শােকের মিছিল নেপথ্যে। তাই নিঃসাড় প্রাণ উল্লাসে লম্ফ দিয়ে ওঠে না, ঝম্ফ দিয়ে ওঠে না।….
বর্বর পাকিস্তানীদের পাশবিকতা ও ধ্বংস করার মনােবৃত্তি-জাত চিহ্নের ত
১৬৪
অন্ত নেই। ঝিকরগাছার ব্রীজ বেলসেতু ভাঙ্গা। বাঙ্কারগুলাে এখনও “হ” করে রয়েছে, এখনও গ্রাসের লালসা-সিক্ত জিহ্বা মেলে।….
“জয় বাংলা” আর শ্লোগান নয়, বরং বাংলাদেশের অধিবাসীদের বাঁচার মন্ত্র।
************
আহ এই সময় ঢাকায় থাকতে পারতাম!…. মানস-চক্ষে দেখা যায়, ন’মাসের জিন্দানখানা থেকে মানুষ কীভাবে বেরিয়ে আসছে। স্বােয়াস্তির নিঃশ্বাস শীতের ঠাণ্ডা দিনগুলাে উম-মুখর করে তুলছে। স্পর্শ পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল মন।
আত্মীয় স্বজন….
মা, ফনে… সকলকে দেখার জন্যে প্রাণের ব্যাকুলতা অন্তহীন. ..
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসের নতুন পরিচ্ছেদে প্রথম পৃষ্ঠা। সেই সঙ্গে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলামের ঘােষণা আবেদন স্মরণীয়। জয় বাংলা!
* ফনে : জিলানী ওসমান, আমার ছােট ভাই।
১৯৭১
১৭ ডিসেম্বর
কাল রাত্রে “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে একটি কথিকা বলেছিলাম যার শিরােনাম ছিল, যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল সে পথ দিয়ে ফিরল নাক তারা।”
রবীন্দ্রনাথ ত বাঙালী জীবনে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মত। উল্লাস প্রকাশেও যেন তাকে ছাড়া উপায় থাকে না।
কিন্তু মন কর্মবিমুখ। এমন কী মুজিবনগর থেকে ঢাকায় ফেরারও কোন চাড় ছিল না বুকে। বসুধা চক্রবর্তী এসেছিলেন। গােটা সকাল তার সঙ্গে কেটে গেল।…. দুপুর বিকেল এইভাবে মজলিসে মজলিসে বসে। কিন্তু প্রায় নির্বিকার। এই কালক্ষেপ যেন জন্মলগ্নে শিশুর অনুভূতি-পাই। সবই আছে, কিন্তু তার অর্থোদ্ধারের কোন চাবিকাঠি বা শক্তি নেই।.. সারাদিন কেটে গেল অভিভূতভাবে i….
চতুর্দিকে কর্তব্যের আহ্বান।
কতাে কাজ সামনে।
১৬৫
কিন্তু কী করব, এই ইতস্ততায় নিষ্ক্রিয় গােটা দিনের অপচয় অবিশ্যি অন্যায়। তা জানি। তবু, তবু……
শরীরের জন্যে বিশ্রাম দরকার। কিন্তু এইভাবে আলস্য-বিহার নিশ্চয় শােভন নয়। মনের রাশ টানা দরকার।
সংবাদপত্রও আজ ভাল করে পড়তে পারলাম না। আত্মসমর্পণের বিস্তারিত সংবাদ জানার কৌতুহল পর্যন্ত গায়েব। কেন?
অথচ আবহে হাজার হাজার মানুষ কাজ করে গেছে এই দিনটির জন্যে।
১৬৬
সেই সব কাজের ধারা কতাে বিচিত্র না হতে পারে। পৃথিবীর বহু শহরে স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্যের জন্যে বাঙালীর সংগঠন গড়ে উঠেছে। স্কটল্যান্ডের একটি প্রতিষ্ঠান মধ্যপ্রাচ্যে আরবী ভাষায় আবেদনের কৌশলও গ্রহণও করে । স্নেহভাজন ডাক্তার মােজাম্মেল হক প্রমুখরা পত্রিকা বের করা ছাড়াও আরবী ভাষায় প্রচারের মােক্ষমতা ভালই উপলব্ধি করেছিল। একটি প্রচারপত্রের নমুনা দেখুনঃ–
পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম নিধনের লড়াই
বাংলা অঞ্চলে (পূর্ব পাকিস্তানে) মুসলিম নিধনে তাদের যুদ্ধ সম্পর্কে ও
৮ এপ্রিল মুনাফিক এহিয়া খানের সৈন্যরা নােয়াখালী জেলার ফেনীর প্রধান মসজিদ ধবংস করে এবং সেখানকার ১১ জন মুসল্লীকে হত্যা করে।
১২ এপ্রিল চট্টগ্রামের প্রধান মসজিদের ইমাম মাওলানা ছফি উল্লাহকে হত্যা করে। এবং সাবেক মাওলানা ওলি আহমদ এবং চট্টগ্রামস্থ বাড়ি এবং মসজিদ ধ্বংস করে।
২১ এপ্রিল চট্টগ্রামের মিরেরসরাইয়ে পুলিশ লাইন কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম মাওলানা হাবিবুর রহমান সৈন্যদের খাদ্য দ্বারা সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসে। প্রতিদানে মুনাফিক এয়াহিয়ার সৈন্যরা জোর করে তার পুত্রবধূকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
বাংলাদেশ এসােসিয়েশন স্কটল্যান্ড ১৫ এভন স্ট্রীট গ্লাসগাে সি-৩, যুক্তরাজ্য।
অথচ আমি সব জেনেও আজ নিষ্ক্রিয়তার পূজারী
* মােজাম্মেল হক প্রাগুক্ত
১৯৭১
১৮ ডিসেম্বর
ঢাকায় বিজয়ােল্লাসের নানা ছবি চোখের উপর ভেসে ওঠে। এক দৌড়ে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজধানীতে পৌঁছে যেতে পারতাম।
কিন্তু আমি যে মুজিবনগরে নানা জনের আন্তরিকতার ঋণ-জালে জড়িয়ে আছি। অত সহজে পালানাের উপায় নেই। বিদায় নিতে হবে অনেকের কাছ থেকে। তারপর ছুটি পাব ঢাকায় ছুটে যেতে।….
১৬৭
আর্তনাদ, কতাে আর্তনাদ?
কী তার পরিধি, কী তার বিস্তার?
কেউ পরিমাপ করতে পারবে না। ব্যক্তিগত দিক থেকে অশ্রুও রক্তের দরিয়া বেবহা, অনন্ত।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে-ফেলেই জীবন ক্ষয় হয়ে গেল।
কতাে অবাঙালী বন্ধুদের মুখ আজ ভেসে ওঠে সামনে……..
উর্দুর অধ্যাপক সয়ীদ হাসান। চাটগাঁ কমার্স কলেজে দুজনে বহু দিন কাটিয়েছি। কবি মানুষ। সাম্প্রদায়িকতাকে মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন। চাকরি পাওয়ার জন্যে হায়দরাবাদ থেকে পূর্ব পাকিস্তান এসেছিলেন। ওঁর গােটা পরিবারের কী দশা, কে জানে। কলকাতায় একত্রে কাটিয়েছে অধ্যাপক আহমদ শরফুদ্দীনের সঙ্গে। পাটনার জাস্টিস শরফুদ্দীনের পৌত্র। বিহারে পঞ্চাশের দাঙ্গার পর পাটনার ছয় লক্ষ টাকার সম্পত্তি মাত্র দুই লক্ষ টাকায় বেচে দিয়ে চট্টগ্রামে ঘরদোর বেঁধে আস্তানা গেড়েছিল। আর খুলনা গার্লস কলেজের অধ্যাপক খলিল আহমদ,…
আমার সাহচর্যে বাংলা শিখে আমার “উপলক্ষ্য” বইটা তর্জমা করেন….
এখন কোথায় তিনি?
বর্ণবিদ্বেষের এই পরিণাম!
এত বর্বরতা যুদ্ধক্ষেত্রে হয় না। সেখানে বর্ণবিদ্বেষের মত আদিম প্রবৃত্তিজাত হিংস্রতা অনুপস্থিত থাকে। সেখানে মানুষে মানুষে লড়াই হয়। তখনও মানবিক সব সাদৃশ্য ঘুচে যায় না। কিন্তু যখন হিন্দু-মুসলমানে লড়ে অথবা বাঙালী-বিহারী কি পাঞ্জাবী-বেলুচী লড়ে তখন তারা সম্পূর্ণ পৃথক, সব মানবিক মিল গায়েব, অপরকে সে আর মানুষ বলে জানে না, বরং মনে করে তার অস্তিত্ব নিজের বাঁচার জন্যে ধ্বংস হওয়া উচিত। এমন ক্ষেত্রে মানুষ আর মানুষ থাকে না। তখন সে নরাকার জম্ভ ।
জিন্নাহ সাহেব এবং তার চামুণ্ডারা বর্ণবিদ্বেষের যে বিষবৃক্ষ রােপণ করেছিলেন তারই হলাহল-ফল ফলছে। গান্ধীজী জিন্নাহর উপাধি দিয়েছিলেন “কায়েদে আজম” বা “ঝানু রাজনীতিবিদ”। আমার মনে হয়, মহাত্মা গান্ধীর উক্তির মধ্যে কিছু শ্লেষ ছিল যা প্রচ্ছন্ন। সেই প্রচ্ছন্নতা এখন ভাঁজ খুলে খুলে প্রকাশিত হচ্ছে।
১৬৮
১৯৭১
১৯ ডিসেম্বর
সকালে সংবাদপত্র খুলে হতভম্ব
একী।
গত চৌদ্দ তারিখে স্বাধীনতার মাত্র দুই দিন পূর্বে জামায়াতে ইসলামীর পয়দায়েশ আল বদর রাজাকার, আশাস প্রভৃতি জীবজন্তুর দল দেশের খ্যাতনামা বহু বুদ্ধিজীবী এবং স্ব-স্ব পেশায় খ্যাতিমান ব্যক্তিদের হত্যা করেছে সুপরিকল্পিতভাবে। ….. ভাই মুনীর চৌধুরী আর ইহলােকে নেই নাট্যকার মুনীর, বাগ্মী মুনীর-যার হৃদয়বার্তা আজও আমার কাছে ঋণের পসরা….. নেই, নেই মুনীর ভাই? …..
কতাে নাম? সব ত শুধু নাম নয়, আমার কাছে প্রত্যক্ষ মানুষ এবং সান্নিধ্য বেষ্টিত।….. মফজ্জল হায়দার চৌধুরী……. গিয়াসুদ্দীন ইতিহাসের অধ্যাপক, সংক্ষেপে বাচ্চুভাই, যিনি আমাকে তাড়াতাড়ি বর্ডার পার হতে বারবার তাগিদ দিয়েছিলেন, তিনিও নৃশংসতার শিকার….. প্রিয় আনােয়ার পাশা….. স্নেহসিক্ত চোখে দেখার মত যুবক….. মাঝে মাঝে রাজনৈতিক মতভেদ থাকা সত্ত্বেও কতাে কাছাকাছি ছিলেন, …., নেই, আনােয়ার পাশা নেই। ডাক্তার মরতুজা পেশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তার, কী বিজ্ঞাননিষ্ঠ মন।….. নেই, ডাক্তার ফজলে রাব্বী…… কি সুন্দর কান্তি, তেমনই সুচিকিৎসক হিসেবে বিরল…… কে জানত অপমৃত্যুর নরকে তাঁর জীবনাবসান ঘটবে?….. শহীদুল্লাহ কায়সার । ভাই শহীদুল্লাহ, তুমি কোন সাহসে এতদিন ঢাকায় থাকলে? সারা জীবন জেলখাটা আর সমাজ-সেবার ব্রত এবং মার্কামারা সমাজতন্ত্রী…… তুমি কেন এইভাবে মৃত্যুববণ করলে? যেখানেই যাও ভাই শহীদুল্লাহ, তােমাদের স্মৃতি নিয়ে বাঁচব বাকী জীবন। মুসলমান সমাজে সমাজব্রতী হৃদয়ের পত্তনকার রূপে তােমার স্মৃতি চিরদিন অম্লান থাকবে।…. স্বাধীনতার যুপকাষ্ঠে প্রাণােৎসর্গকারী হে শহীদবৃন্দ, আমার সালাম গ্রহণ করাে।…. বাংলাদেশের অ্যুদয়ের পর এমন সংবাদের জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না ।
বর্ণবিদ্বেষের আগুন সহজে নিভবে বলে মনে হয় না। খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীদের মত প্রাণের অপচয় বাঙালীদের আরাে প্রতিশােধপরায়ণ করে তুলবে! বিচার-বুদ্ধি শুভবুদ্ধির অঙ্গ বিশেষ। তাই ভয় হয়, আরাে কতাে মৃত্যুর কারখানা অচিরে চালু হবে তার হিসেব থাকবে না। এই ভাবে চণ্ডনীতি আরাে
১৬৯
১৯৭১
২০ ডিসেম্বর
সকাল।
যশােরের স্মৃতি হঠাৎ হানা দিয়ে গেল। যশাের চাঁচড়া রাজবাড়ির কাছে। অবাঙালীরা একটা ঘাটি তৈরি করেছিল বাঙালী নিধনের। আশেপাশে গর্তে শত শত হাড়ের স্তুপ। এক দিকের দেওয়ালে রক্তে লেখা “যে পাপ করে নাই, তার ভয় নাই।”….. এমন আরাে হিজিবিজি কতাে লেখা। বুঝা যায়, বেয়নেটের খোচায় বিদ্ধ ভাগ্যহত অসহায় জনেরা এই ভাবে তাদের শেষ কামনা-বাসনার ‘দাগ রেখে গেছে।…… অত্যাচারের কাহিনীর শেষ নেই। সবই ত মানুষের মৃত্যু-সম্বলিত। সে সব লিখে ডায়েরী ও বুকের ভার বাড়িয়ে লাভ কী?
জুলাই মাসে পাকিস্তানী হাইওয়ানদের (জীবজন্তুর) অন্যতম রাও ফরমান আলী বলেছিল, আইয়ুব খান যে ভুল করেছিল, আমরা আর সেই ভুল করব না। বুদ্ধিজীবী কেনার চেষ্টা করেছিল আইয়ুব খান।
তারই লজিক সম্মত কার্যক্রম নিধন। জানােয়ারেরা এই ভাবে তা করে গেল!
খুলনার পতনের পর এক অবাঙালী গুণ্ডা রাতারাতি হেঁটে যশাের পৌঁছায়।
এখানে এক বাড়িতে সে কাজ করত, সেখানে আশ্রয়প্রার্থী। হাতে পায়ে ধরা থেকে কান্নাকাটি বাদ যায়নি। মিলিটারী হামলার পর সে এই বাড়ি ছেড়ে গুণ্ডামিতে ঢােকে। আঠার জন বাঙালী খুন করেছে বলে সে আফসােস করত। কারণ, এক কুড়ি হতে আরাে দুটো বাকী–যা এখনও সম্পন্ন হয়নি।…….
বাড়ির বুড়ী গৃহিণী ওকে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু এমন দয়া-প্রদর্শন বিপজ্জনক। শেষে লােকটাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
আপাতত “জানে” বাঁচুক।
কিন্তু বিচারের খাড়া ওর মাথায় পড়বে, তা নিশ্চিত।
সাময়িক সুবিধা ছেড়ে দেওয়া অনেক সময় সহজ হয় না। কারণ, ইতিহাসের ঘূর্ণি আবর্ত আর ক’জনেই বা দেখতে পায়। তখন চোখের সামনে যা ঠেকে তা-ই সত্য মনে হয়। ফলে, কার্যক্রম এগিয়ে চলে কিন্তু ভবিষ্যৎ বড়
১৭০
নির্মম তার চাকায় সব পরিষ্কার হয়ে যায়। যেমন, দ্বিজাতিতত্ত্বের যাচাই বর্তমানে । কিন্তু অনেকে বর্তমানকেই ভবিষ্যৎ মনে করে। তাদের মাশুল দিতেই হয়। বেচারা ভূত। জীবন যাপন ব্যক্তিস্বাধীনতা ছাড়াও নিশ্চয় কৃচ্ছুতামুখর। তদুপরি সে নিরক্ষর। যখন দেখলে অবাঙালী হলে বেশ কিছু সুখ-সুবিধা আরাম-আয়েশ মিলে যায়, সে সুযােগ ছাড়বে কেন? তার জন্যে খুন করতে হয়। হােক। বর্তমান থেকে ত রেহাই পাওয়া গেল।
ভবিষ্যৎ চিরকাল নির্মম। সত্যের নির্মম নিখাদ তারই বুকে লুকানাে থাকে।
ম্যাট্রিকুলেট ব্যারিস্টার জিন্নাহ । প্রায় মূখই বলা চলে। সেও বর্তমানে ঝাঁপ দিয়েছিল। বেচারা অবাঙালী ভৃত্যর আর কী দোষ?
১৯৭১
২১ ডিসেম্বর
সন্ধ্যায় নজরুলকে দেখতে গিয়েছিলুম। ছােট ছােট কামরার ফ্ল্যাট। তারি এক কোণে শুয়ে আছেন পুরুষ-সিংহ। সেই অপূর্ব চোখ কেমন যেন দিশাহারাভাবে নিস্প্রভ। তিন মিনিটের বেশী দাঁড়াতে পারলাম না, চোখে পানি এসে গেল। তাড়াতাড়ি বসার ঘরে, পালিয়ে বাঁচলাম। এই দৃশ্যের জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না।
দরিদ্র, কুসংস্কার–আচ্ছন্ন মুসলমান সমাজ। তারই ভেতর থেকে এমন একটি মানুষ জনেছি। ফলে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামেও কতাে সহায়তা না পেল।
বাংলার ঐতিহ্য মূর্ত হয়েছিল যার মধ্যে, তাঁর এই দশা, আমি চোখে দেখতে পারব না।
আর কোনদিন তােমাকে দেখতে আসব না, প্রিয়তম…… গন্ধবিধুর ধূপের মত পুড়তে চেয়েছিল একা একা । নিজের বাণীতে সার্থকতা দিতে কী তােমার এই ছদ্ম..অভিমান?
হ্যা, তাই না ।
তোমার কণ্ঠের ঝঙ্কার এখন বাংলাদেশের গেরিলা-বাহিনীর কণ্ঠে ঝকৃত।……
তুমি কোনদিন নিঃস্তব্ধ হতে পারাে না বাঙালীর আবাসভূমিতে। তােমাকে চোখে দেখার প্রয়ােজন কী?
১৭১
১৯৭১
২২ ডিসেম্বর
ঢাকায় ইতিহাস তৈরি হচ্ছে।
হানাদার পাকিস্তান:-বাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্য দেখতে পেলাম না। জিন্দানখানা থেকে ছাড়া পেয়ে মানুষ কী উল্লাসে না মেতে উঠবে । প্রেতনগরী আবার আলােক-মালায় সেজে উঠেছে। আফশােষ, এখনও এত দূরে পড়ে আছি।
অধ্যাপক কবির চৌধুরীও নৃশংসতার শিকার। মানিকভাই (ওর ডাক নাম) মুক্তি আন্দোলনের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের এক বিবৃতিতে সই দিতে রাজী হননি। তবু এত দিন বেঁচে ছিলেন। হানাদারেরা এবার ভুল করেনি।
কতাে স্মৃতিবিজড়িত মানিকভাই। ইরানে তুরস্কে দুজনে তিন হপ্তা কাটিয়েছি এই একাত্তর সনের গত জানুয়ারি মাসে। এই ডিসেম্বরে তাঁকে হারাতে হবে জানতাম না। যখন আমার ক্রীতদাসের হাসি (The Laughter of a slave) অনুবাদ করেন তখন কতাে সময় নানা আলােচনায় কেটেছে। জার্মানীতে আমার জার্মান পত্রিকায় যে গল্প বেরিয়েছে তার উৎস ত কবির চৌধুরীর ইংরেজী তর্জমা। পরে অন্যান্য ভাষান্তর । অনুজ ওসমান জামালের ইংরেজী অনুবাদ ত ভারতের অন্যান্য ভাষায় অনুপ্রবেশের চাবিকাঠি। দুজনের কাছেই আমি কৃতজ্ঞতায় বাঁধা। জামাল পাকিস্তানী হামলার সময় চট্টগ্রামে ছিল । সেখান থেকে মুজিবনগরে আসে পরে ইংল্যান্ড চলে যায়। সে সেখানে নিরাপদ। কবির ভাই কেন যে পালিয়ে এলেন না……… স্মৃতির কি অন্ত আছে?……. একবার এক বই উপহার দিয়েছিলুম। আর আমার যা অভ্যেস কিছু লিখে দেওয়া, সেই অনুসারে কলম থেকে বেরিয়েছিল to sister mary and her lamb……… মেরী অধ্যাপকের স্ত্রীর ডাকনাম। (ভাল নাম মেহের কবির)। আমার উক্তি বন্ধু মহলে বেশ কিছুদিন হাসির খােরাক হয়ে ছিল।..
বিদায়, মানিক ভাই।
মুনীর-মানিক-দুজনেই
চিরতরে চলে গেল।
ঢাকা ফিরে যাব । কিন্তু তা হবে আমার কাছে “স্মৃতির শ্মশান”…. শুনলুম, তরুণ অধ্যাপক কবি মনিরুজ্জামানও ইহলােকে নেই। পাকিস্তানী জল্লাদেরা রাজনীতি-নিরপেক্ষ অধ্যাপককেও রেহাই দেয়নি। বাঙালী হওয়াই ত অপরাধ।
১৭২
আরাে কতাে জনের সমাধির পাশে গিয়ে না দাঁড়াতে হবে। না, সমাধি ত নেই। অঙ্গচ্ছেদ কবে, যথা চোখ উপড়ে, হাত-পা ভেঙে কোথায় কোথায় না ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। বিদেহী আত্মাকে দেহহীন করার চেষ্টা পেয়েছে কসাইয়েরা….. কী নির্মম মৃত্যুর মুখােমুখি হয়েছে দেশের আত্মিক সম্পদ এই সব আত্ম…… জননী বাংলাদেশ, তােমার ক্ষত-জর্জরিত দেহের ওরাও শরীক। কারণ তারা ছিল তােমার সত্যিকার সন্তান! জননীর দুঃখভার সবাই নিজেদের অঙ্গে তুলে নিয়েছে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধায় এবং সম্মানে।
১৯৭১
২৩ ডিসেম্বর
দোলাচল উদ্বেগ রইল, তবু বুক কিছুটা হাল্কা। সংবাদপত্রে প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় সব নাম ঠিক নয়। কবির চৌধুরী, বাংলার মনিরুজ্জামান প্রমুখ অধ্যাপক আলবদর, আলশামস জল্লাদের হাতে পড়েনি। ওরা নিরাপদ আছেন। নীলিমা ইব্রাহিমের মৃত্যুসংবাদও মিথ্যা।
একটি খবর সংবাদপত্রে বেরােয়নি, বিশ্বস্ত সূত্রে শুনে বড় অস্বােয়াস্তি লাগল। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না, এক অসহায় মানসিক পীড়নভােগ করা ছাড়া। অসমর্থিত সংবাদে প্রকাশ ও শাঁখারি বাজারে যেসব অবাঙালী হিন্দুদের বাড়ি জবর দখল করেছিল, মুক্তিবাহিনী তাদের রেহাই দেয়নি। ২৫ মার্চের পর ২৮ (আটাশ) তারিখে গিয়েছিলুম সেই দৃশ্য চোখে দেখা যায় না। তখনও লাশের গন্ধ বাতাসে। অথচ অবাঙালী বেকুফ হতভাগারা হিন্দুদের ঘর দখল করে বসে গেছে।
সাত মাস পরে প্রায়শ্চিত্ত শুরু হলাে। অসহায়, হতভাগ্যের দল, ধর্মের অন্ধতা; অন্ধ-ভবিষ্যৎ দেখতে পায়নি। খােদ জিন্নাই দেখতে পায়নি। এরা ত সাধারণ, নিরক্ষর মানুষ।
১৯৭১
২৪ ডিসেম্বর
ইতিহাসের নব অধ্যায় যখন আরম্ভ হয়, তার পূর্বে অতীতের সব হিসেব নিকেশ পাই-পয়সায় মিলিয়ে মিলিয়ে হয়। তাই এক দিকে দেখা যায়, আলবদর,
১৭৩
আলশামস-প্রভৃতি ধর্মান্ধ লস্কর অন্যদিকে মুক্তিবাহিনী। দুই ভাবাদর্শের সংঘাত চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছে। এখানে রক্তেই তার তর্পণ ঘটবে। অবিশ্যি ধীরে ধীরে। প্রথমে সংখ্যাগতভাবে। তার প্রক্রিয়া চলে মনের অগােচরে-কখনাে সচেতন কখনাে অচেতন। কিন্তু এই পথেই গুণগত পরিবর্তন ঘটবে। আজ দুই শিবির তাই অস্ত্রধারী এবং ক্ষমা এখানে সম্ভব নয়। হেগেলের ভাষায় Super determination of history এইভাবেই বােধ করি, রূপায়িত হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার যদি প্রতিপক্ষ এই জাতীয় জন্তুদের প্রতি ক্ষমা দেখায়। বা ক্ষমাশীল হয়, তাহলে গুপ্তহত্যায় বহু মানুষের প্রাণ যাবে।
১৯৭১
২৫ ডিসেম্বর
আজ যীশুখ্রীস্টের জন্মদিন।
শান্তি, ক্ষমার সেই অবতার-মূর্তি কী কোথাও আছে? ধর্মকে যুগে যুগে আবিষ্কার করতে হয়। বহু নবীর অনুসারকেরা তা বােঝে না। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহাপুরুষের খােলস সাপের মত গােটা সমাজের দেহে লেপটানাে থাকে। ভীতির কারণ হয়ে ওঠে ক্ষমা প্রেম সুন্দরের সেই সব প্রতিমূর্তিবৃন্দ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন কি খ্রীস্টান নয়?
জাতিসংঘের প্রেসিডেন্ট উ থান্ট কি বৌদ্ধ? হয়ত খ্রীস্টান বা বৌদ্ধ। কিন্তু বর্তমানে এরা নরদানব ছাড়া আর কী?
বাংলাদেশের অসহায় নরনারী, দুর্দশা এদের স্পর্শ করেনি। মদমত্ত জড়দেবতার পূজক এই জন্তুরা একমাত্র ভাষা বােঝে-যা সিনাজুরি এবং গা জুরির ভাষা।
The meek shall inherit the earth… নিরীহ জনেরা পৃথিবীর উত্তরাধিকারী হবে… যীশুর বাণী ওদের বেশ সাহায্য করে। তাই ওরা খ্রীস্টান। নচেৎ লাথির ভাষা ছাড়া আর কোন ভাষাই ওদের বােধগম্য নয়। যীশুখ্রীস্ট যে জারজ ছিল, তা এখন বিশ্বাস হয়।
************
সংবাদপত্রে প্রতিদিন পাকিস্তানী সৈন্যদের বর্বরতার নানা কাহিনী বের হয়। এসব মন বড় বিষিয়ে তােলে। কতাে খালবিলের কিনারায় অসহায় ভাই বােনেরা প্রাণ দিয়েছে। খুলনার গল্লামারী বিলের ধারে অবাঙালীরা গরু ছাগলের
১৭৪
মত প্ৰতিপক্ষদের জবাই করতাে। ওদের মধ্যে মেয়ে রাজাকার পর্যন্ত ছিল।
বর্ণবিদ্বেষের স্তর কতাে গভীরে অনুপ্রবিষ্ট এ থেকে বুঝা যায়। অবলারা পর্যন্ত হিংস্র জন্তুতে পরিণত।
মনুষ্যত্বের এই সব কলঙ্ক ও অন্যান্য তাণ্ডব-কাহিনীর মধ্যে মাঝে মাঝে আলাের রেশও দেখা যায়। তা-ই একমাত্র ভবিষ্যতের সান্ত্বনা। বেলুচ সৈন্যরা কোথাও কোথাও মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের অর্থ-সাহায্য দিয়েছে অথবা মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছে এমন ঘটনাও পাওয়া যায় ।
এই সান্ত্বনা নিয়ে বাঁচব। মানুষে বিশ্বাস হারাব না কোনদিন।
***************
গায়ের চাষীরা কোথাও কোথাও পাকিস্তানী সেনাদের একা-একা পেলে পিটিয়ে মেরেছে, বিশেষত আত্মসমর্পণের পর যখন দিশাহারা এদিকওদিক ছিটকে পড়ছিল ।
যে-জুলুম চালিয়েছে ওরা ন’মাস ধরে তারপর প্রতিশােধ-পরায়ণতা রােধ করা সহজ নয়।
সরকারের বর্তমান নীতি এদিকে লক্ষ্যবদ্ধ তা আশার কথা।…….
****************
অনেক বিহার-আগত বন্ধুদের কথা মনে পড়ল। বিশেষ করে, সালাউদ্দীন মােহাম্মদেব কথা। এসেছিল জনদরদী সমাজতন্ত্রী মন নিয়ে। কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের চাপে শেষে সামরিক বিভাগের গােয়েন্দাগিরি করত। যদি করাচী পালিয়ে গিয়ে থাকে ‘জানে’ বাঁচবে। নচেৎ ওর রক্ষা নেই। কী জঘন্য ভূমিকায় না নেমেছিল। অবিশ্যি মূল কারণ দারিদ্র। দু’টি কামরার ভেতর গােটা পরিবার থাকত। যৌবন পার-হয় হয় কুমারী বােন মা ভাই ইত্যাদির জোট। শেষে বড় বাড়ি বিবর্তনের ধাপে ধাপে। একদিকে জাগতিক উত্থান অন্যদিকে নৈতিক পতন। উপন্যাসে এমন অবাঙালী চরিত্র থাকা অপরিহার্য।
****************
সৈয়দপুর এবং উত্তরবঙ্গে যে সব অবাঙালী ছিল, তাদের অনেকে চলে যাচ্ছে
১৭৫
পূর্ণিয়া জেলার দিকে। তেইশ বছর পর আবার অনিশ্চয়তার মুখে নিজেদের সঁপে দিয়েছে।
জিন্নাহ সাহেব, হুজুর, আপনার বেঁচে থাকা উচিত ছিল এই দৃশ্য দেখার জন্যে। নিজের চোখে দেখে যেতে পারতে বর্ণবিদ্বেষের হলাহল, সাম্প্রদায়িকতার চাকা ব্যক্তির আবাসভূমি, জীবন, মূল্যবোেধ কীভাবে শেষ পর্যন্ত গুঁড়িয়ে দিয়ে যায়। জিন্নাহ সাহেব তুমি সরীসৃপের মত বুকে হাঁটতে শিখেছিল, উন্মাদনা-তাও ধর্মীয় অন্ধ উন্মাদনার উপর ভর করে, তারই ফল এখন ফলছে। “মুসলিম ওয়াতান” “Promised Land” “প্রতিশ্রুতি দেশ” এখন দোজখ । তা তােমার মত মূখের চোখে ধরা পড়ার কথা নয়, যদিও এক বিদেশী সাংবাদিককে বলেছিল,” I look fifty years ahead. “পঞ্চাশ বছর আগেই দেখতে পাই।”
মূখ জিন্নাহজী, তুমি চব্বিশ বছর আগে কী ঘটবে, দেখতে শেখােনি।
১৯৭১
২৬ ডিসেম্বর
সহিংসতা বা চাচার violence নিয়ে তিন বৎসর পূর্বেই লিখেছিলুম উপন্যাসঃ রাজা উপাখ্যান।
আবার নতুন করে অন্য কাহিনী মারফৎ ব্যাপারটা তুলে ধরতে হবে।
খুলনার গল্লামারীর বিল এলাকায় অবাঙালী জল্লাদেরা কীভাবে শত শত অসহায় নরনারীকে কেবল জবাই করেছে, আজ হাড়ের বিপুল স্তৃপ তার সাক্ষ্য।
বিভিন্ন জেলা থেকে একই ধরনের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। এই হাড়ের স্কুপের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে স্বজনহারা জনেরা।
স্বাধীনতার দাম কতাে চড়া।
অথচ চৈনিক সাম্যবাদীদের আচরণ ঘৃণা ছাড়া আর কিছু উদ্রেক করে না। হয়ত পুনরুক্তি, তবু বলতে হয়, আদর্শের যখন যান্ত্রিক চিন্তার সঙ্গে সাযুজ্য ঘটে, তখন চোখের সামনে মানুষ আর থাকে না। তখন আদর্শের বিচ্যুতি ঘটতে বাধ্য। মার্কিন পীরিতের লালসায় চৈনিক নেতারা সাম্যবাদের আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে ডাহা জাতীয়তাবাদী সেজেছে।
এক কালে ধর্ম আবির্ভূত হয়েছিল মানব-কল্যাণ সাধনে। যখন তার অন্তর্নিহিত ভরবেগ (Momentum) থেমে যায়, শুরু হয় ভাষ্য, উপভাষ্য নিয়ে
১৭৬
মারামারি। শেষ পর্যন্ত পবিত্র কোরান নিয়ে তফসীরে এবং তা নিয়ে মুসলমানেরা আত্মক্ষয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ধর্মের আদর্শ নেপথ্যে পরিহাসের হাসি কি হাসে?
এখন দেখা যাচ্ছে, ইতিহাসে এমন পুনরাবৃত্তি বহুবার ঘটেছে। তবে কি মানুষের মুক্তি নেই? প্রগতির হাতছানি কি মরীচিকা?
সাম্যবাদ এখন লেনিনবাদ, মাওবাদে পরিণত। এবং দুই শিবিরে সমঝােতার কোন আশা দেখছিনে।
সমাজতন্ত্রের পরিণতি ভয়াবহ। মানুষ কোন আদর্শ নিয়ে থাকবে?
মূল্যবােধের ক্ষেত্র মরুভূমি। পিকিং রেডিও শােনাে, খিস্তি ছাড়া আর কিছু নেই। সমাজতন্ত্র যদি খিস্তিবাজ তৈরি করে, তবে এমন আদর্শ দিয়ে কী হবে।
চৈনিক প্রভুদের ভাষায় বাংলাদেশের নেতারা এখন Dogs of the Indian Lords “ভারতীয় শাসকদের কুত্তা।”
আর ওদের স্বদেশে লি শাও চী-র মত নেতা (How to be a good communist (গ্রন্থের বিখ্যাত রচয়িতা) Running dog of the capitalist. এখন মনে হয়, চাউ এন-লাই সাহেব অন্য কোন জন্তুতে পরিণত। অন্তত মানুষ নন।
আদর্শের সংকট পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংকট। যারা পথিকৃত তাদের মধ্যে ভবিষ্যত গড়পড়তা নাগরিকদের ছবি আভাস পাওয়া যাবে-এই ত ঘটে আসছে চিরদিন। সাম্যবাদের বয়স চুয়ান্ন বছর। তার মধ্যে নেতাদের সুরত দেখলে মনে হয়, বিশেষত চৈনিক নেতাদের, এগুলাের কোন বিবর্তন ঘটেনি।
ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের লিন পিয়াও উধাও। নেকড়ে অরণ্য কি কোন খারাপ জায়গা?
১৯৭১
২৯ ডিসেম্বর
বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে যা ঘটেছে তা আর কখনও ঘটেছে বলে ইতিহাসে জানা নেই। সমাজ-বিবর্তনের আর এক ধাপ ধর্মীয় অন্ধকূপ থেকে বেরিয়ে আসতে ইউরােপের তিন চারশ’ বছর লেগে গিয়েছিল। এখানে তারই পুনরাবৃত্তি। তাই কাণ্ড অত রােমহর্ষক।
১৭৭
প্রগতিবাদী ছাত্র ইউনিয়নের ছাত্র হামিদুর রহমান। তাকে পাঞ্জাবী সৈন্যরা গুলি মারতে ইতস্তত করছিল। তখন জামাতে-ইসলামপন্থী তার চাচাতাে ভাই নিজ হাতে গুলি মেরে হামিদ-কে পরপারের দিকে ঠেলে দিলে ।
সুতরাং সমস্যা শুধু বর্ণবিদ্বেষ নয়। আদর্শের সংঘাত জাত ব্যাপারটা এমনই রূপ নিতে বাধ্য। চিত্তের জানালা-দরজা খােলা না থাকলে, বিবর্তনের ধাপে এগিয়ে যাওয়া কঠিন। কিন্তু এমন মানসিক গঠন ক’জন আর রপ্ত করতে পারে? ফলে শেষ পর্যন্ত ইসপার উসপার-এমনই পরিস্থিতি দাঁড়ায়। আর মাঝপথ থাকে না।
উদারনৈতিকতার দৃষ্টান্ত সমাজ-ইতিহাসের মধ্য পর্যায়ে পাওয়া যায়। নচেৎ হেস্তনেস্ত মনােবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই থাকে না। গোঁড়ামি যতটা মানসসঞ্জাত ততখানি কাল-জাত বা যুগ-বিধৃত।
বাংলাদেশের গ্রাম তার ফিউডাল মােহ-চেতনা থেকে মুক্ত হচ্ছে। কিন্তু দামটা বড় চড়া। এত রক্ত এত অশ্রু…….
আর কিছু ভাবতে পারা দায়।
হে মহাকাল, তােমার চক্রনিনাদ এত প্রাণ আশা, আকাক্ষা-ভালবাসা, প্রেম-কমনীয় সবকিছু ঘেঁৎলে এগােয় কেন?
পাপী এবং সাধু উভয়েই একই শাস্তি পায় তােমার যূপকাঠে।
১৯৭১
৩০ ডিসেম্বর
ইতিহাসের রূপরেখা শেষ পর্যন্ত মানুষই বদলায়। কিন্তু ইতিহাসের ধারা-বিষয়ক নিয়ম যখন মানুষ সচেতনভাবে বুঝতে পারে এবং সেইভাবে ঘটনাকে প্রভাবান্বিত করে, তখনই তা সম্ভব।
এই রহস্য সমাজতাত্ত্বিকদের কাছে অজানা নয়।
কিন্তু চারুকলা অর্থাৎ শিল্পের মাধ্যমে তা প্রকাশ কতাে কঠিন, যতই ভাবছি, ততই ধাধা ঠেকছে। উপন্যাসে কিছু চরিত্র লাগে। আবছা ধারণা আছে ।
১৭৮
কিন্তু কীভাবে ঘটনাপ্রবাহের ঘাত-প্রতিঘাত তাদের চরিত্র-চিত্রনের সঙ্গে মেলাব (যা আদৌ সরল রেখায় ঘটে না) সেই সমস্যায় অস্থির।
একে জানাশােনা কতাে মৃত্যু বুকের ভেতর ত কোন প্রশান্তির স্পর্শ দিতে অক্ষম, তার উপর এই সব চিন্তা। স্বােয়াস্তি নেই, স্বােয়াস্তি নেই।
**********
মার্কিন দেশ থেকে বহুকালের সতীর্থ সুহৃদ আবু রুশদের পত্র পেলাম। বন্ধু দেশে ফিরে কাজে লাগার জন্যে আকুল। এক জায়গায় লিখছে, “দানবরা আত্মসমর্পণ করার আগে ঢাকার এবং বাংলাদেশের আরাে অনেক জায়গায় লেখক, ডাক্তার, উকিল, অধ্যাপক, সাংবাদিক পাইকারীভাবে হত্যা করে গেছে। হারামজাদারা দেশটাকে কী করে গেল।”
আবু রুশদ উত্তেজিত হলেও অশালীন শব্দ কখনও উচ্চারণ করে না। বহু কালের পরিচয় থেকে জানি। কিন্তু এবার দেখছি ঘৃণা ওকে বেসামাল করে। দিয়েছে। হারামজাদা শব্দ দিয়ে কি পাকিস্তানের শাসক ও সৈন্যদের গালাগাল সম্ভব?
রুশদ জানে না, আছেলা খিস্তিযােগেও ওদের স্পর্শ করা সম্ভব নয়। বিশেষত পাকিস্তানের Barrack-bred bastard গুলােকে গাল দেওয়ার মত খিস্তিও নেই পৃথিবীতে। এগুলাে আবার পাক্কা মুসলমান বলেও দাবী করে।
হায়, মুসলমান
১৯৭১
৩১ ডিসেম্বর
বৎসরের শেষ দিন। কতাে মুহূর্তে, প্রহর, প্রাণের সাধ-আহলাদ, রক্ত, রক্ততৃষ্ণা, ক্ষয়ক্ষতি ইতিহাসের প্রান্তরে বিলীন।… এত জগদ্দল স্মৃতিভার।
কোথায় রাখব, কী করে করব উজাড়?
১৯৭২
১ জানুয়ারি
কাল বিকেলে হাওড়া জেলার ঝামটিয়া গ্রামে পৌছেছিলাম, আত্মীয়স্বজনদের
১৭৯
হে নববর্ষ, ঘুমের মধ্যে তুমি কখন এসেছ জানি নে।
স্বাগতম! স্বাগতম!
**********
১৯৭১ সনের জানুয়ারি মাস কেটেছিল তুরস্কের রাজধানী আংকারায়। তুর্কী বন্ধুবান্ধব এবং বন্ধু বােরহান উদ্দিন ও কবির চৌধুরীর সঙ্গে।
বােরহান এখন হয়ত ইসলামাবাদের ghetto (ঘেটো) তে আছে। ব্যাপক ধ্বংসের মুখে কেবল বন্ধুদের মুখ চেয়ে এবং সংস্পর্শে শত যন্ত্রণা সইতে পারতাম। বন্ধু এ কে এম আহসানও নিশ্চয় ঐ ঘেটোয় আটক পড়ে আছে।
সব সুহৃদেরা দূরে। ওয়ালীউল্লাহ পরলােকে।
বাঁচার আস্বাদ আর কতটুকু আছে মনকে জিজ্ঞেস করিনি। যদি হিসাবে অনেক ঘাটতি থাকে। তার চেয়ে একুন-তেরিজ দূরে ঠেলে চুপচাপ বসে থাকাই ভাল।
একদম পাড়াগাঁয়ে পালিয়ে এসে ভালই করেছি। বাবলা গাছখােদাই মাঠ, সরিষার-হলুদ ক্ষেত, বেবহা চোখ যদ্দর খুশী ছেড়ে দাও আকাশের তটপ্রান্তে ধীরে ধীরে আলতাে পৌছে বড় শান্তি পায়। সকালে কুয়াশা গােটা ভূচিত্র রহস্যময় করে তােলে। রাত্রে শীতের জোছনায় মায়াপুরী মাঠ, তালগাছের খাড়া-খাড়া মূর্তিগুলাে উপরে ঝাঁকড়া চুল সন্ন্যাসীর মতাে এই ঔদাসীন্যের প্রতীক…. মনে কতাে প্রশান্তি খুঁজে পাই, যদিও স্মৃতির দাবাগ্নি কম নয়। পিতৃপ্রতিম কওসর আলী, ভাই আব্দুল করিম…. কতাে মুখের আদল খুঁজে খুঁজে হতাশ হই…..
**********
কবি সানাউল হক…. সংক্ষেপে মামুন ভাইয়ের কুশল-সংবাদ পেয়ে আনন্দিত। সৈয়দ নুরুদ্দিনের বেতার ভাষণ থেকে নিশ্চিন্ত সে নিরাপদ। সংবাদদাতা ভুল করবে বা আমাকে স্তোক দিতে কিছু বলবে, তা মনে হয় না।
ফিরে গেলে এমন সব মুখ..দর্শনের প্রত্যাশা করব। বাংলাদেশের মানসপটভূমি নচেৎ কী দিয়ে রচিত হবে?
* বােরহান উদ্দীন, খ্যাতনামা প্রশাসক
১৮০
* ওয়ালীউল্লাহ, প্রাগুক্ত
* এ কে এম আহসান, প্রাগুক্ত
* সানাউল হক, কবি-প্রশাসক
১৯৭২
২ জানুয়ারি
আরাে নিদারুণ ক্ষতির সংবাদ।
সুরকার আলতাফ মাহমুদের মৃত্যু সুনিশ্চিত। তার উঠানে অস্ত্র পোঁতা ছিল। হাতেনাতে ধরা পড়েন জল্লাদদের ফাঁদে।..
বন্ধু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মৃত্যুসংবাদ যেন আবার নতুন করে শুনলাম।
আলতাফ মাহমুদ। সমাজের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন এমন প্রতিভার সুরের সঙ্গে যার সহজাত যােগাযােগ সহসা আবার মুসলমান সমাজে দেখা দেবে, এমন আশা বাতুলতা। কিন্তু ভাবি কেন নেকড়ে অরণ্যে এতদিন সুরকার রইলেন? প্রতিবেশী, একদম পাশাপাশি প্রতিবেশী হিসেবে আমি তাকে দেশ ছাড়ার কথা বলেছি। জোর দিয়ে বলা উচিত ছিল।
এমন অমূল্য প্রাণের খোয়াড় আমরা। সুরে কতাে সহজে মানুষকে। জাতিস্মর করে তােলা যায়। জাতীয়তাবাদের বিকাশ এবং প্রতিষ্ঠার জন্যে সুরের আসন অনেক উপাদানের ঊর্ধ্বে।
এমন দিনে আলতাফ মাহমুদ থাকবেন না আমার পক্ষে চিন্তা অসম্ভব। এতদিন জঙ্গী শাহীর ভেতর নিজের প্রতিভা পূর্ণভাবে দেখাতে পারেননি। চাপা গলায় কি গান হয়? এবার ফীগ্রীবা গায়কের মত তিনি আসরে ঝাপিয়ে পড়তেন। তার আর সুযােগ পেলেন না। কী নির্মম নির্যাতনের যাঁতাকলে এমন প্রাণের অবসান ঘটেছে, কল্পনা করা যায়। তাই আরাে দুঃখ।
অপঘাত মৃত্যুর স্পর্শ সব স্তব্ধ করে দিল। অসুরের হাতে সুরের নিধন।
এই দুঃখ বহু দিন বিভীষিকার মত আমাকে ঘিরে থাকবে।
যাও, বন্ধু, প্রিয়তম সুরকার
যেখানে চিরপ্রশান্তি অপেক্ষার্থী
তােমার জন্যে খুলেছে দুয়ার।
১৯৭২
৪ জানুয়ারি
শহরে ফিরলুম।
একদিকে জীবনের জয়ােল্লাস; অন্যদিকে হাহাকার শুধু মৃত্যুর খবর। ডক্টর ফজলে রাব্বী আল-বদরের শিকার আর ইহলােকে নেই। ডক্টর রাব্বীর উপর আক্রোশের কারণ ত বহু। যেমন বিচক্ষণ চিকিৎসক, তেমনই হৃদয়বান। মুক্তিফৌজের আহত সদস্যদের গােপনে চিকিৎসা করতেন এবং অজস্র টাকা ঢালতেন ওদের সুখসুবিধার জন্যে। সমাজ-সচেতন দেশপ্রেমিক। তাঁকে জন্তুদের নিকট মানুষ হওয়ার অপরাধে বলি হতে হবে বৈকি। গােলগাল ফর্সা মুখ, বুদ্ধিদীপ্ত দুই চোখের ঝিলিক এবং মুখের হাসি দিয়েই তিনি রােগ অর্ধেক সারিয়ে ফেলতেন। এমন মানুষের অভাব সহজে পূরণ হবে না। বিশেষত মুসলমান সমাজে-যেখানে বৈজ্ঞানিক চেতনা সহজে শিকড় বাঁধে না, মধ্যযুগীয় মানসিকতায় কৈশাের যৌবন কাটে বিধায়। রসায়নের অধ্যাপককে দেখেছি হাতে মাদুলী বাঁধতে।
ডাঃ রাব্বীর কথা বার বার হানা দিতে থাকে।
যাও, বন্ধু। তােমার আত্মত্যাগ দেশবাসী সহজে ভুলবে না। অন্তত চিকিৎসকের কী ধর্ম হওয়া উচিত-তার আদর্শ তুমি রেখে গেলে। গুডবাই, ডক্টর রাব্বী ।
১৯৭২
৮ জানুয়ারি
মুজিবনগর পরিত্যাগ কি সহজ? আশপাশে প্রতিবেশীদের কতাে রকম আন্ত রিকতার ঋণ শােধ হবে কী দিয়ে? তাই সাক্ষাতে যাই। কাজী আব্দুল ওদুদের বাড়িতে আশ্রিত নয় মাস আমার পরিবার। এখানে ইউরােপে চিকিৎসায় নজরুলের সহযাত্রী রবি উদ্দীন আহমদ, তার ছােট ভাই রফিক উদ্দীন-রফিকের স্ত্রী আমার ভাইঝি মনসুরা লুসি, নীচের তলায় শুভেন্দু, * বিমলেন্দু সরকার প্রমুখ-সকলের কাছেই কিছু না কিছু খাতকতা আছে বৈকি সহৃদয়তার। আর ফার্ণ রােডের দেবশরণ ও পার্বতী দাশগুপ্তা, খিদিরপুরে বন্ধুপুত্র জালালউদ্দীন শাহাবউদ্দীন-কতাে মুখ, কতাে নাম। স্নেহভাজন নুরুল আলম যে ১০-১২-৭১
১৮২
তারিখের পত্রে লিখেছিল “পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের দুর্দশা সম্পর্কে,,… ধর্মটাকেও বুঝলে বুঝতাম অন্তত একটা কিছু বােঝে। না বােঝে ধর্ম না বােঝে সমাজের ভালমন্দ।” নুরুল আলম স্বগ্রামবাসী মরহুম মামা নুর মােহাম্মদের ছেলে…. এমন শত শত জন সামনে ভিড় করে। তাই ভাবলুম, আনন্দবাজার পত্রিকায় এক প্রবন্ধ লিখে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিই। জনে জনে সাক্ষাৎ শারীরিকভাবে সম্ভব নয়। “ভারতবর্ষ-বাংলাদেশের সীমান্তে দাঁড়িয়ে” শীর্ষক এক আহ্বানমুখর রচনা আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হলাে কাল।
* বিমলেন্দু সরকার গত বছর প্রয়াত।
*****************
পূর্বোক্ত প্রবন্ধের শেষাংশ ও “ভারতবর্ষের সকল নাগরিককে নমস্কার, বার বার নমস্কার।…
“পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জান কবুল লড়ায়ে আমার কুচকাওয়াজের রণসঙ্গীত এক মহান ভারতবাসী যুগিয়েছেন। নচেৎ অনুপ্রেরণার সঞ্জীবনীসুধা আমি কোথায় পেতাম? আমার জাতীয় সঙ্গীতও আমার প্রতিবেশীর দান। আত্মার রাখিবন্ধনের সঙ্গে এই পরম উপহার কে আমাকে দিতে পারত?
“মহামানবের সাগর-সৈকতে আহবান-কর্তা এবং সুরস্রষ্টা ঋষিকল্প কবি রবীন্দ্রনাথের বাণীই আজ আমার কণ্ঠে যাত্রাপথের সঙ্গীতঃ
মানুষকে গণ্ডীর মধ্যে হারিয়েছি
মিলেছে তার দেখা
দেশবিদেশের সকল সীমানা পেরিয়ে।
তাকে বলেছি হাত জোড় করে
হে চিরকালের মানুষ।
হে সকল মানুষের মানুষ।
পরিত্রাণ করাে।
ভেদ-চিহ্নের তিলক পরা
সংকীর্ণতার ঔদ্ধত্য থেকে।
হে মহান পুরুষ, ধন্য আমি
দেখেছি তােমাকে।
তামসের পরপার হতে
১৮৩
আমি ব্রাত্য আমি জাতিহারা।”
****************
প্রাণের কন্দরে গুঞ্জরণ, “হেথা নয় অন্য কোন খানে……….
বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র ,…………..
আমি আর পরাধীন নই…..
……. চলাে, ঢাকা ফিরে যাই।।”
—————————-