হালিশহর বধ্যভূমি ও গণকবর (চট্টগ্রাম)
হালিশহর বধ্যভূমি ও গণকবর (চট্টগ্রাম) চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত। ১৯৬৪ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ভারত থেকে আগত অবাঙালি মুসলিম শরণার্থীদের থাকার জন্য তিনটি এলাকায় বাঙালিদের জায়গা-জমি হুকুম দখল করেন। এলাকা তিনটি হলো- হালিশহর হাউজিং এস্টেট, ফিরোজ শাহ্ কলোনি ও শেরশাহ্ কলোনি। এ তিনটি এলাকায় শরণার্থীদের পুনর্বাসিত করা হয়। হালিশহরের বি-ব্লক, এইচ-ব্লক ও আই-ব্লক ছিল বিহারি অধ্যুষিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বিহারিরা এখানে বহু বাঙালিকে হত্যা করে।
মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে হালিশহরের বিহারি জনগোষ্ঠী বাঙালিদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে তাদের আচরণে পরিবর্তন ঘটে। তারা হয়ে যায় শতভাগ বাঙালিবিরোধী। ৩০শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী হালিশহর ইপিআর ক্যাম্প দখল করলে বিহারিরা পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে তাদের স্বাগত জানায়। সেদিনই তারা হালিশহর মধ্যম নাথ পাড়ায় এক গণহত্যা সংঘটিত করে। বাঙালিদের হত্যা ও নির্যাতন করার জন্য তিনটি নির্যাতনকেন্দ্র স্থাপন করে। সেগুলো হলো- হালিশহর বি-ব্লক ট্রেড স্কুল, হালিশহর বি-ব্লক জান মোহাম্মদ দিঘি ও হালিশহর বি-ব্লক সংলগ্ন রেললাইন। এ-তিনটি স্থানে বাঙালিদের নির্যাতন করে হত্যা করা হতো। প্রধানত বিহারিরাই কেন্দ্রগুলো পরিচালনা করত তবে মাঝে-মধ্যে ইপিআর ক্যাম্প থেকে হানাদার সৈন্যরা এসে এলাকা পরিদর্শন করত। হালিশহর, মইন্যাপাড়া, আনন্দবাজার, ফুল চৌধুরী পাড়া, মুন্সিপাড়া, জাইল্যাপাড়া, রামপুর, পাহাড়তলী ও সিএসডি গোডাউন এলাকার বাঙালিদের এখানে এনে নির্যাতন করে হত্যা করা হতো। প্রথমদিকে হত্যার পর লাশগুলো ফেলে দেয়া হতো রেল লাইনের পাশে ধানক্ষেতে, পরে ফেলা হতো জান মোহাম্মদ দিঘির পানিতে।
যেহেতু বৃহত্তর হালিশহর এলাকার মাঝখানে ছিল বি-ব্লক, সেহেতু পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ ছিল এলাকার বিহারিদের হাতে। আর বিভিন্ন ব্লকের বাইরে ছিল বাঙালিদের বসতি, তাই তারাই বেশি নির্যাতনের শিকার হয়। এলাকার সিএসডি গোডাউন ও ইপিআর ক্যাম্পে ছিল হানাদার বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিরা এলাকা ছেড়ে চলে যায়। তাই সিএসডি গোডাউনে একক আধিপত্য ছিল অবাঙালিদের। হানাদার বাহিনীর সমর্থনের কারণে বাঙালিদের নির্যাতন ও হত্যা তাদের কাছে ছিল একটা সাধারণ বিষয়।
ট্রেড স্কুলে বাঙালি নির্যাতনের কৌশল ছিল নানাবিধ। স্কুলের বিভিন্ন কক্ষে ছিল নানা ধরনের হুক। সেগুলোতে রশি লাগিয়ে বাঙালিদের লটকিয়ে রাখা হতো। হাঙ্গর মাছের লেজ দিয়ে পেটানো হতো। নির্যাতনে যারা মারা যেত, তাদের লাশ ইট বেঁধে জান মোহাম্মদ দিঘিতে ফেলে দেয়া হতো। নির্যাতনের মূল টার্গেট ছিল আশেপাশের এলাকার আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ সমর্থকরা। তাদের ধরে এনে এই নির্যাতনকেন্দ্রে পালাক্রমে নির্যাতন করা হতো। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় হালিশহর এলাকার বিভিন্ন ব্লকে বিহারি ও অবাঙালি ছাড়া আর কেউ অবস্থান করতে পারেনি।
ট্রেড স্কুলের পাশে ছিল একটি খোলা জায়গা। এখানে প্রতিদিন রান্নার আয়োজন চলত। এখান থেকে রান্না করা খাবার হানাদারদের বিভিন্ন পয়েন্টে পাঠানো হতো। বি-ব্লকের নির্যাতনকেন্দ্র থেকে ১৫টি পয়েন্ট নিয়ন্ত্রিত হতো। এই পয়েন্টগুলোতে বিহারি যুবকরা পালা করে ডিউটি করত। বাঙালিদের কে কি করছে, কোন এলাকায় বাঙালিরা পাকিস্তান সরকারের বিরোধিতা করছে, কোথায় মুক্তিযোদ্ধা আছে এসব তথ্য তারা ইপিআর ক্যাম্পে অবস্থানরত পাকিস্তানি অফিসারের নিকট পৌঁছে দিত।
রান্নার দায়িত্বে ছিলেন একজন বাঙালি। বিহারি নারীকে বিয়ে করার পর থেকে তিনি বি-ব্লকে স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন। সবাই তাকে মালেক বাবুর্চি নামে জানত। একদিন তিনি বাংলা ভাষায় কথা বলছিলেন। সেই অপরাধে তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। বিহারিদের অত্যাচার তিনি নীরবে সহ্য করেন। কিন্তু তার স্ত্রী বিহারি হলেও স্বামীর ওপর নির্যাতন তিনি সহ্য করতে পারেননি। তাই তিনি প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন।
এদিকে মালেক বাবুর্চি রান্নার কাজ চালিয়ে যান। বিহারিরা এলাকার মানুষের গরু-ছাগল যা পায় নিয়ে এসে জবাই করে এবং মালেক বাবুর্চি রান্না করেন। একদিকে বাঙালিদের ধরে এনে নির্যাতন করা, অন্যদিকে তাদের গরু-ছাগল জবাই করা। এসব ব্যাপার মালেক বাবুর্চিকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। তাছাড়া তাকে অপমান ও নির্যাতনের কথা তিনি ভুলতে পারেননি। তাই কৌশলে তিনি স্ত্রী- পুত্রকে পাঠিয়ে দেন আগ্রাবাদ বেপারিপাড়ার গোপন স্থানে। সেখানে তার স্ত্রী যোগাযোগ করেন বেপারিপাড়ার ডা. মুহাম্মদ শহীদ উল্লাহর সঙ্গে। তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন। মালেক বাবুর্চির স্ত্রীর নিকট থেকে হালিশহর এলাকার নির্যাতনের কথা শুনলেও তিনি বিহারি মহিলাকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। অনেক ভেবে-চিন্তে শেষপর্যন্ত তিনি মহিলার হাতে লবণজাতীয় কিছু পাউডার দেন। মহিলা পাউডারগুলো তার স্বামীর কাছে পৌঁছে দেন। পাউডারগুলো পেয়ে মালেক বাবুর্চি সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন।
একদিন বড় একটি ভোজের আয়োজন করা হয়। রান্নার শেষ পর্যায়ে মালেক বাবুর্চি ঐ পাউডার খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে দেন। সেই খাবার বিহারি ও সৈনিকদের পরিবেশন করা হয়। বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থানরত বিহারি ও পাকসেনাদেরও পাঠানো হয়। ইপিআর ক্যাম্প থেকে আগত অফিসার ও কয়েকজন সৈনিককেও আপ্যায়ন করা হয়। সবাই খাবার খেয়ে চলে যায়। বাবুর্চি নিজেও সবার সঙ্গে বসে খান। তবে তার খাবারগুলো তিনি পূর্বেই আলাদা করে রেখেছিলেন। খাবার খেয়ে তাৎক্ষণিক কারো কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। কিন্তু দুঘণ্টা পর প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। বমি ও পেটের ব্যথায় সবাই অস্থির। একে-একে অনেকে মারা যায়। যারা চিকিৎসা পেয়েছে তাদের কেউ- কেউ বেঁচে গেছে। ইতোমধ্যে বাবুর্চি মালেক পালিয়েছেন। তাঁর কৌশলের কাছে ঘাতকরা হার মানে, মারা যায় ৪8 জন ঘাতক।
এ ঘটনার পর থেকে ট্রেড স্কুল নির্যাতনকেন্দ্রে রান্নার কাজ বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধ হয় মানুষের গরু-ছাগল ধরে এনে জবাই করাও। বিহারিদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। নির্যাতনকেন্দ্রটি বন্ধ না হলেও বিহারিরা অনেকটা দমে যায়। এলাকার মানুষের মাঝে কিছুটা স্বস্তি নেমে আসে। সপ্তাহে দুদিন ফইল্যাতলীর হাট বসত। সেখানে হাটুরেরা বিহারিদের টাকা না দিয়ে পণ্য কেনাবেচা করতে পারত না। সে অত্যাচারও বন্ধ হয়। উল্লেখ্য যে, এ ঘটনার কিছুদিন পর ডা. শহীদ উল্লাহকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয় এবং সেখানে বসেও তিনি বাঙালি বন্দিদের চিকিৎসা করেন। স্বাধীনতার পরে জান মোহাম্মদ দিঘির পানি সেঁচে অসংখ্য কংকাল উদ্ধার করা হয়। [সাখাওয়াত হোসেন মজনু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড