You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর বিক্রম হাফিজ উদ্দিন আহমেদ - সংগ্রামের নোটবুক

বীর বিক্রম হাফিজ উদ্দিন আহমেদ

হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম (১৯৪৪) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৪ সালের ২৯শে অক্টোবর ভোলা জেলার লালমোহনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আজহার উদ্দিন আহমেদ এবং মাতার নাম করিমুন্নেসা বেগম। তিনি বরিশাল জেলা স্কুল থেকে এসএসসি এবং বি এম কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে বিএ অনার্স শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬৪ সালে তিনি উক্ত বিভাগ থেকে বিএ অনার্স এবং ১৯৬৫ সালে এমএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন একজন কৃতী ফুটবল খেলোয়াড়। তিনি ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড় ছিলেন। পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মেজর মোহাম্মদ হোসেন মালিকের পরামর্শে তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর এডুকেশন কোরে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৮ সালের ১লা ডিসেম্বর পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষ করে তিনি কমিশনপ্রাপ্ত হন এবং “সিনিয়র টাইগার’ নামে পরিচিত ফার্স্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে পোস্টিং পেয়ে যশোর সেনানিবাসে যোগদান করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে হাফিজ উদ্দিন যশোর সেনানিবাসে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। ১৮ই মার্চ থেকে তিনি তাঁর ইউনিটের সঙ্গে যশোরের প্রত্যন্ত এলাকা জগদীশপুরে শীতকালীন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত ছিলেন। পাকবাহিনী ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে ঢাকা শহরের পিলখানাস্থ ইপিআর ক্যাম্প, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাঁখারি বাজার এলাকায় যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায়, সে সম্পর্কে তাঁরা তাৎক্ষণিকভাবে কিছুই জানতে পারেননি। ২৯শে মার্চ যশোর সেনানিবাস থেকে ১০৭ নং ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সরদার আব্দুর রহিম দুররানি ওয়ারলেসের মাধ্যমে হাফিজ উদ্দিনের ইউনিটকে প্রশিক্ষণ শেষ করে যশোর সেনানিবাসে রিপোর্ট করার নির্দেশ দেয়। ঐদিন রাতে তাঁর ইউনিট যশোর সেনানিবাসে পৌঁছলে সকল বাঙালি সৈন্যকে নিরস্ত্র করা হয়। এতে বাঙালি সৈন্যরা উত্তেজিত হয়ে অস্ত্রাগার ভেঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র বের করে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। এ-সময় তাঁদের নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন হাফিজ ও লেফটেন্যান্ট আনোয়ার। ৩০শে মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলে। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে এলে তাঁরা সেনানিবাস ত্যাগ করে ছোট-ছোট দলে বিভক্ত হয়ে চৌগাছায় মিলিত হবার সিদ্ধান্ত নেন। গোলাগুলির সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের ছোড়া মেশিন গানের গুলিতে লেফটেন্যান্ট আনোয়ার শহীদ হন। চৌগাছায় পৌছে হাফিজ উদ্দিন সৈন্যদের সংগঠিত করে প্রতিরোধযুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। এলাকার হাজার-হাজার ছাত্র- যুবকসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয়। এরপর ক্যাপ্টেন হাফিজ সীমান্ত বিওপি মাসলিয়ায় অবস্থান নিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সহায়তায় অস্ত্র সংগ্রহ করে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ২১শে এপ্রিল রাতে তিনি নাভারন বাজারে পাকবাহিনীর প্রতিরক্ষা ঘাঁটির ওপর আক্রমণ করে শত্রুসেনাদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন। পরবর্তীতে তিনি বেনাপোল বর্ডারের অদূরে কাগজপুকুর নামক স্থানে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে একটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি স্থাপন করেন। ২৩শে এপ্রিল পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ করলে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিআক্রমণ করেন। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পাকসেনারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে মে মাস পর্যন্ত এ এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে ছিল।
এদিকে ক্যাপ্টেন হাফিজ ভারতে প্রতিষ্ঠিত ইয়ুথ ক্যাম্প থেকে ছয়শত মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাটালিয়ন হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। মে মাসের শেষদিকে মুক্তিযুদ্ধের সদর দফতরের নির্দেশে তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে মেঘালয়ের তেলঢালায় যান এবং সেখানে একমাস থেকে ৬০০ সৈনিককে ট্রেনিং দিয়ে ফার্স্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাটালিয়নে পরিণত করেন। পরবর্তীতে ৭ই জুলাই ১ম, ৩য় ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নিয়মিত বাহিনী নিয়ে ব্রিগেড আকারে ‘জেড’ ফোর্স গঠন করা হলে এ ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব দেয়া হয় মঈনুল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রমকে। ক্যাপ্টেন হাফিজ এ ব্যাটালিয়নের ‘বি’ কোম্পানির কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। হাফিজ উদ্দিন বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে কামালপুর ধলই বিওপি, সিলেট এম সি কলেজসহ বহুযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সে-সবের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ধানুয়া-কামালপুর যুদ্ধ।
জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী কামালপুরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি সুরক্ষিত ঘাঁটি ছিল। ৩১শে জুলাই জেড ফোর্সের ক্যাপ্টেন হাফিজের ব্রাভো কোম্পানি ও ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ, বীর উত্তমএর ডেল্টা কোম্পানি এ ঘাঁটি আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সেনারাও আর্টিলারি ও মর্টারের সাহায্যে গোলাবর্ষণ শুরু করে যুদ্ধের এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন শত্রুর গোলার আঘাতে শহীদ হন। ক্যাপ্টেন হাফিজ দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁর কোম্পানির নেতৃত্ব দেন। এক পর্যায়ে শত্রুর মর্টারের স্প্রিন্টারে তিনি আহত হন। এমতাবস্থায় ব্রাভো ও ডেল্টা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা নেতৃত্বহীন হয়ে পড়েন। ফলে তাঁরা পিছু হটতে বাধ্য হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার হাফিজ উদ্দিন আহমদকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি তাঁর কর্মস্থল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে মেজর পদে উন্নীত হন।
১৯৭৬ সালে মেজর হাফিজকে সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়। ১৯৮৬ সাল থেকে তিনি সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং ভোলা-৩ আসন থেকে এ পর্যন্ত ৬ বার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সরকারের পানিসম্পদ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। হাফিজ উদ্দিন আহমেদ এক কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম দিলারা হাফিজ। [সাজাহান মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড