মুক্তিযুদ্ধে হাটহাজারী উপজেলা (চট্টগ্রাম)
হাটহাজারী উপজেলা (চট্টগ্রাম) রাজনীতি সচতেন একটি এলাকা। এ এলাকার ওপর দিয়ে চট্টগ্রাম শহর থেকে রাঙ্গামাটি সড়ক ও ভারত সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত সড়ক এবং বড়দিঘির পাড় থেকে সীতাকুণ্ডু সড়ক চলে গেছে। এছাড়াও চট্টগ্রাম শহর থেকে নাজিরহাট পর্যন্ত রেল লাইন চলে গেছে। তাই এলাকাটি যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম সেনানিবাস ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানও হাটহাজারীতে। বাহান্নর ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তী সকল আন্দোলন-সংগ্রামেই এ এলাকার জনগণ সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মুরিদুল আলম (চন্দনাইশ) এখানে এসে মো. আব্দুল ওয়াহাব মিয়া, শের আলী চৌধুরী, এম এস ওবায়দুল্লাহ, আহমদ হোসেন প্রমুখকে নিয়ে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন করেন। এরপর ৬৬-র ছয়দফা আন্দোলন, ৬৮-র আগরতলা মামলা বিরোধী আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এ অত্র এলাকার জনগণ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এসব আন্দোলন-সংগ্রাম থানা ও ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এতে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতা-কর্মীরা ছিল খুবই সোচ্চার।
১৯৭০ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ এলাকায় জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণ ঘটে। জেলা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা পাকিস্তানি শাসনের স্বরূপ তুলে ধরে তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে জনগণকে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। ৭০-এর নির্বাচনে রাউজান-হাটহাজারী এলাকা থেকে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এমএনএ এবং হাটহাজারী এলাকা থেকে মো. আব্দুল ওয়াহাব মিয়া এমপিএ নির্বাচিত হন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি সামরিক সরকার তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। ফলে দেশপ্রেমিক বাঙালিরা চরমভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা বঙ্গবন্ধুর ডাকে ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে।
অন্দোলনকে বেগবান করার জন্য দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো হাটহাজারীতেও স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন এডভোকেট নুরুল আমিন, প্রদীপ দাশগুপ্ত, মো. মুসা, নুরুল আফসার প্রমুখ ছাত্রলীগ নেতা। এছাড়া থানা মোজাফ্ফর ন্যাপ- সভাপতি এডভোকেট সফিউল আলম ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবু তাহেরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সাংবাদিক মইনুল আলম (ফতেয়াবাদ), সাহিত্যিক মাহবুব-উল আলম (ফতেয়াবাদ) এবং ক্যাপ্টেন শওকত (ফতেয়াবাদ)-এর নামও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের ঘিরে হাটহাজারী জনপদ সবসময় সরগরম থাকত। মার্চের অসহযোগ আন্দোলনকে কেন্দ্ৰ করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গঠিত হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ, যার আহ্বায়ক ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ আর মল্লিক (আজিজুর রহমান মল্লিক), যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ফজলী হোসেন ও অধ্যাপক মাহবুব তালুকদার এবং সদস্য ছিলেন অধ্যাপক এখলাস উদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক হুজ্জাতুল ইসলাম লতিফি, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, খলিলুর রহমান, অধ্যাপক রশিদ চৌধুরী, আবু হেনা, ড. বদরুদ্দোজা, ড. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, সুধীর রঞ্জন সেন, ড. অনুপম সেন ও অধ্যাপক রফিক উদ্দিন আহমদ। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকেও একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
মার্চের শুরু থেকে ছাত্র-শিক্ষকদের সমন্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছাড়াও হাটহাজারী ছিল আন্দোলন-সংগ্রামে মুখর একটি এলাকা। এ কারণে ২৫শে মার্চের কালরাতে হাটহাজারীতে অবস্থিত চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে এক হৃদয়বিদায়ক ঘটনা ঘটে। এদিন মধ্যরাতে ২০নং বালুচ রেজিমেন্ট চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি সৈন্যদের ওপর গণহত্যা চালায়। এতে প্রায় এক হাজার সৈনিক শহীদ হন। এ ঘটনা চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট গণহত্যা নামে পরিচিত।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক বিশ্ববিদ্যালয় ও হাটহাজারী এলাকায় অসহযোগ আন্দোলন এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকগণ তাঁর আদর্শকে অনুসরণ করে অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ২৫শে মার্চের পর বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ঘাঁটিতে পরিণত হয়। ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে বাঙালি সৈন্য এবং নানা স্থান থেকে ইপিআর ও পুলিশ সদস্যরা এসে এখানে সমবেত হন। ১৭নং উইং-এর ‘এ’ কোম্পানির কমান্ডার সুবেদার আবদুল গনি চট্টগ্রাম সেক্টর থেকে বিদ্রোহের খবর পেয়ে সকল অবাঙালি সৈনিককে বন্দি করেন এবং রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমামের নিকট তাদের হস্তান্তর করে বাঙালি সৈন্যদের নিয়ে ২৬শে মার্চ রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অবস্থান নেন। উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান প্রমুখ তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। তাঁরা তাদের থাকা-খাওয়ার সার্বিক ব্যবস্থা করেন এবং পেট্রোল, গাড়ি ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করেন। এরপর তাঁরা পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার ব্যাপারে সুবেদার গনির সঙ্গে পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সুবেদার গনি চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে পাকিবাহিনীর অগ্রযাত্রাকে প্রতিরোধ করার জন্য ২৭শে মার্চ ভোরে ইপিআর সদস্যদের নিয়ে নতুনপাড়া সেনানিবাসের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব পাশে অবস্থান নেন। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আরো দুদল ইপিআর সদস্য এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সৈন্যও এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। ফলে, তাঁদের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে যায়। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স ট্রেনিং কোরের ক্যাডেটদের নিয়ে চট্টগ্রাম শহরস্থ চট্টগ্রাম কলেজে একটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। মো. আব্দুল ওয়াহাব মিয়া এমপিএ তাঁর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিয়ে উপাচার্য ও সুবেদার গনিকে সার্বিক সাহায্য করেন। উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটি সিগন্যাল স্টেশন স্থাপন করেন। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী এখানে একটি প্রতিরক্ষা ব্যূহও তৈরি করা হয়। স্থানীয় বিপুল সংখ্যক জনতা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয়। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পাকবাহিনীর আক্রমণ বাধাগ্রস্ত হয়।
এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী প্রতিরোধ ভেঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রবেশ করে। তাদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে বহু লোক হতাহত হয়। ২৯শে মার্চ উপাচার্য এ আর মল্লিক, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানসহ ৪৪ জন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছেড়ে রাউজানের নূতন চন্দ্ৰ সিংহ- প্রতিষ্ঠিত কুণ্ডেশ্বরী ভবনে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং ৭ই এপ্রিল সেখান থেকে তাঁরা ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেন। এদিকে পাকিস্তানি সৈন্যদের চাপ বাড়তে থাকলে ৩০ ও ৩১শে মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিবার-পরিজনদের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে সরিয়ে নেয়া হয়।
প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে রাজনৈতিক কর্মীরা ভারতের দিকে চলে যেতে থাকেন। তবে একদল কর্মী এলাকায় থেকে যান এবং মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করতে থাকেন। মুক্তিপাগল স্বাধীনতাকামী যুবকরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে ধলই ও ফরহাদাবাদে সংগঠিত হন এবং অত্র এলাকার সংগঠকদের সহযোগিতায় প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যেতে থাকেন। যেখান থেকে তাদের ভারতে প্রেরণ করা হতো, সে স্থানটির নাম বংশালঘাট। ধলই ও ফরহাদাবাদ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ।
প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার কাজ শুরু হয়। জুন মাসে অধ্যাপক মাহমুদুল আলম ভারত থেকে ফিরে এসে ফজলুল আমীন মাস্টার, মো. মুছা ও নুরুল আফসারের সহায়তায় স্থানীয় যুবকদের সংগঠিত করতে শুরু করেন। পরে সালাউদ্দিন আহমদ চৌধুরী, নুরুল হুদা, এস এম খোরশেদুল আলম, নুরুল আমিন, অধ্যাপক ফরিদ আহমদ, অধ্যাপক ফজলুল কাদের চৌধুরী, ইমদাদুল হক, ন্যাপ নেতা সফিউল আলম, এস এম জামাল উদ্দিন, আবদুল মোবারক, মাহবুবুল হক চৌধুরী প্রমুখ স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের বেইজ তৈরিতে সহায়তা করেন। বিশেষভাবে যাঁর নেতৃত্বে হাটহাজারীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হন তিনি হলেন ফজলুল আমীন মাস্টার। মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে এস এম ফজলুল হক, এস এম কামালউদ্দিন, মো. ইদ্রিস প্রমুখ কতিপয় দালালের বিরুদ্ধে অপারেশন চালান। পরবর্তীতে এঁরাও ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে এলাকায় ফিরে আসেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে হানাদার বাহিনী হাটহাজারী দখল করে নেয়। এসময় ফজলুল আমীন মাস্টারের নেতৃত্বে ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের চট্টন পুকুর পাড়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে গোলাম রব্বানী মনু, সিরাজুল ইসলাম, আবদুল হালিম চৌধুরী, নুরুল আফসার চৌধুরী, সেকান্দর, রুহুল আমিন চৌধুরী, তোফায়েল আহমদ চৌধুরী, ডা. আমীন শরীফ, আমীর হোসেন কোম্পানি, অধ্যাপক আবু তাহের, কাজী মহসিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ফটিকছড়ি ও পটিয়া অঞ্চলের লোকজনও এতে উপস্থিত ছিল। বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারপত্র বিলি করা, স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা, দালালদের সাবধান করা ইত্যাদি ব্যাপারে তৎপরতা শুরু হয়। একই সঙ্গে ফজলুল আমীন মাস্টার গোলাম রব্বানী মনুকে ভারতে পাঠান। পরে তিনিও ভারতে যান এবং সেখান থেকে ফিরে এসে এফএফ-ও বিএলএফ-এর পক্ষে ফটিকছড়ি, রাউজান ও রাঙ্গুনিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। ভারত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দল এলে তাঁদেরও দেখাশোনার দায়িত্ব নেন। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন থানা কাঠামোয় বিন্যস্ত করেন।
উপজেলার ইউনিয়ন পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা হলেন: ফরহাদাবাদ ইউনিয়ন- রুহুল আমীন চৌধুরী, মফজল আহমদ চৌধুরী, মীর হোসেন (বাবাজান), সাহাব মিয়া, আবুল বশর, আনু মিয়া মেম্বার; ধলই ইউনিয়ন- খোরশেদুল আনোয়ার চৌধুরী, জানে আলম চৌধুরী, আলী আকবর, আনু মিয়া মেম্বার, ডা. মাহমুদুল হক, মফিজুর রহমান; গুমানমর্দন ইউনিয়ন- মো. নবী হোসেন; মীর্জাপুর ইউনিয়ন- ফজুমিয়া মাস্টার, সৈয়দ মো. এয়াকুব, সৈয়দ মছউদউল্লাহ মাস্টার, ডা. সুলতান আহমদ।
ফরহাদাবাদ ইউনিয়নে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় ঘাঁটি ছিল। ঘাঁটির মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ১৪৫ জনের নাম পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন- মোহাম্মদ হোসেন, আলী মরতুজা, মো. রফিকুল আলম, আবদুল নবী, শামসুল আলম, মো. শাহ আলম, মোহাম্মদ আলী, মো. সেকান্দর চৌধুরী, মো. ইলিয়াস চৌধুরী, মো. ইউনুছ, ফজলুল আমিন, মো. জামাল, মো. শফিউল আলম, আবদুস ছালাম, ছালেহ আহমদ, মফিজুর রহমান, আবু তাহের, দিদারুল আলম, আবদুল হামিদ, হারুন, মো. ইউনুছ, আবু তালেব, মো. রফিকউদ্দিন, ফজল করিম, মাহবুবুল আলম, দিদারুল আলম, মো. কামালউদ্দিন, মো. মফিজ, মো. আলমগীর, জয়নাল আহমদ, নুরুল ইসলাম, মো. ইউছুপ, মো. ইয়াকুব, কাজী জহুর আহমদ, খলিলুর রহমান, শাহ আলম, বজল আহমদ, সোলতান আহমদ, গোলাম রব্বানী, হাবিবুর রহমান চৌধুরী, সিরাজুল হক চৌধুরী, আবু সৈয়দ, মো. ইউনুছ, নুরুল আবছার, আরিফুর রহমান, মোক্তারুল আলম, মো. জাহাঙ্গীর আলম, শহীদুল্লাহ, শফিউল আলম, আবুল কালাম, মো. ইসমাইল, মো. জামালউদ্দিন, আহমেদ ছফা, ফয়েজ আহমদ, আবদুল মালেক, আবদুল মোতালেব, ফরিদ আহমদ, আবু সৈয়দ, আবু তাহের ১, আবদুল হামিদ, মাহবুবুল আলম, সুনীল চন্দ্ৰ, আবুল কালাম, মো. ইউছুপ, মো. মুছা, আবদুল মান্নান, আবু তাহের ২, মনছুর আহমদ, নুরুল আবছার, আবুল বাশার, বাদশা মিয়া, মো. হারুনুর রশিদ চৌধুরী, মো. মুছা চৌধুরী, ফারুক ই আজম চৌধুরী, ছালেহ জহুর চৌধুরী, রফিকুল আলম চৌধুরী, অহিদুল আলম চৌধুরী, আবু তাহের চৌধুরী, আবু হানিফ, নুরুল আলম, মো. ইসহাক গুরা মিয়া, মো. নুরুল ইসলাম, আমির হোসেন ড্রাইভার, সফিকুল আলম হেলালী, জহুর আহমদ, আবুল হোসেইন, আবুল বাশার, মহিউদ্দিন, মাহবুবুল হক চৌধুরী, সেকান্দার মিয়া, ফরিদ আহমদ, আবদুল হালিম চৌধুরী, সৈয়দুর রহমান, শামসুল আলম, ফুল মিয়া, আবদুস শুক্কুর, আবুল কাশেম, আহমদ ছফা, শামসুল আলম, আহমদ হোসেন, আফজাল আহমদ, আবু আহমদ, সোলতান, আহমদ, রুহুল আমিন, আহমদ হোসেন, জাকির হোসেন, রফিকুল আলম, আলী হোসেন, দেলোয়ার হোসেন, জসিমউদ্দিন, দানা মিয়া, নুর আহমদ, জহুরুল আলম, আবু আহমদ, মো. আবছার, আলী হোসেন, মো. ইছহাক সিদ্দিকী, নুরুল আলম, আবুল মিয়া, রহমতউল্লাহ, আবদুল শুক্কুর, নজির আহমদ, মো. জানে আলম, আবদুল বারী, আবুল হাশেম, শামসুল আলম, নুরুল ইসলাম, আবুল হোসেন, নুর আহমদ, সাহাব মিয়া, সেকান্দর মিয়া, নুর হোসেন, কবির আহমদ, বাদশা আলম, সুলতান আহমদ চৌধুরী, সুশান্ত বড়ুয়া, মফজল হায়দার চৌধুরী, রুহুল আমিন চৌধুরী, ফয়েজুল আমিন, সিরাজুল হক চৌধুরী, আবদুল করিম, নূরুল ইসলাম, এয়াছিন মাস্টার ও গুমানমর্দন। এঁরা সকলেই সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
মীর্জাপুর ইউনিয়নে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি ঘাঁটি ছিল। এ ঘাঁটির যোদ্ধারা হলেন- ইফতেখার হোসেন, বাদল বড়ুয়া, সৈয়দ আবুল মনসুর (হাফেজবাড়ি, সৈয়দপাড়া), সৈয়দ মো. জাহাঙ্গীর, আবদুস সত্তার, আবুল বাশার (খিল্লাপাড়া), আমিনুর রহমান (দেয়ানআলী বাড়ি, মীর্জাপুর), রণজিৎ বড়ুয়া, সৈয়দ মো. কামাল উদ্দিন (সৈয়দপাড়া), মোহাম্মদ নূরুল আলম (বাকরআলী চৌধুরীবাড়ি) প্রমুখ। মীর্জাপুর ইউনিয়নে ছিল রাজাকারদের দৌরাত্ম্য। সে কারণে এই এলাকার লোকজন গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করে।
হাটহাজারী উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র ছিল। সেগুলো হলো- সৈয়দ কোম্পানির বাড়ি (ফরহাদাবাদ), পূর্ব সেয়ানবাড়ি (ফরহাদাবাদ), লাল মোহাম্মদ তালুকদারের বাড়ি (ধলই), তুফান আলী চৌধুরীর বাড়ি (হাটহাজারী), সায়ের মোহাম্মদ চৌধুরীর বাড়ি (উদালিয়া), উদালিয়া খামার, উদালিয়া ও এর পশ্চিমের এক জঙ্গল (গোলাম রব্বানী মনু ছিলেন এ আশ্রয়কেন্দ্র তৈরির অন্যতম সংগঠক। তুফান আলী চৌধুরীর বাড়ি (উদালিয়া), সিকদারপাড়া (উদালিয়া), ফয়েজ মেম্বারের বাড়ি (মাহমুদাবাদ), কালাগাজী তালুকদারের বাড়ি (মাদার্শা), উত্তর মাদার্শা ইউনিয়নের মো. আনোয়ার, মোজাম্মেল হোসেন, খুরশীদ আলম ও মো. সেলিমের বাড়ি (এখানকার অধিবাসী ওবায়দুল হকের বাড়িতে অস্ত্র রাখা হতো), আবদুল ছামাদ সওদাগরের বাড়ি (মেখল), গড়দুয়ারার ফয়েজ আহমদ, মনসুর মিয়া, রফিক কোম্পানি, ইব্রাহিম সওদাগর, আবদুছ ছালাম, কামাল উদ্দিন, আবুল মনসুর ও আবুল হাশেমের বাড়ি, আশকার আলী বলির বাড়ি (হাটহাজারী), মাহবুবুল আলম তালুকদারের বাড়ি (হাটহাজারী), উত্তর মাদার্শার বদিউল আলম সারাং, মোজাম্মেল হক ও নূর মোহাম্মদের বাড়ি, ফজুমিয়া মাস্টারের বাড়ি (মীর্জাপুর), সৈয়দ মো. এয়াকুবের বাড়ি (সৈয়দপাড়া), মোমেনশাহবাড়ি (মীর্জাপুর), চেয়ারম্যান মুছা চৌধুরী ও বাকর আলী চৌধুরীর বাড়ি (মীর্জাপুর) এবং সৈয়দপাড়ার হাফেজবাড়ি। উদালিয়া ও তদ্সংলগ্ন জঙ্গলের আশ্রয়কেন্দ্রে ২০০-৩০০ মুক্তিযোদ্ধা থাকতেন। এস এম ইউসুফ, সাবের আহমদ আসগরী, শওকত হাফিজ খান রুশ্মি, এস এম ফজলুল হক, ফজলুল আমিন মাস্টার প্রমুখ এখানে বৈঠক করতেন এবং এখানেই অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে স্থানীয় বিএলএফ কমান্ড চূড়ান্ত করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার অভিযোগে হাফেজবাড়ির সৈয়দ মছউদ্দৌলা মাস্টার, সার্জেন্ট সৈয়দ মো. আবদুল মান্নান এবং সৈয়দ আফতাব উদ্দিন আহমদকে পাকবাহিনী গ্রেপ্তার করেছিল।
হাটহাজারী উপজেলায় কমান্ডার ফজলুল আমীন মাস্টার, এফএফ- থানা কমান্ডার এস এম কামালউদ্দিন এবং বিএলএফ থানা কমান্ডার এস এম ফজলুল হকের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়। অন্য কমান্ডাররা হলেন- মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ চৌধুরী (ফরহাদাবাদ), মোক্তারুল আলম (ফরহাদাবাদ), এস এম ইলিয়াছ মিয়া চৌধুরী (ফরহাদাবাদ), আবুল মনসুর (ফরহাদাবাদ), ফজল করিম (ফরহাদাবাদ), ছালে জহুর চৌধুরী (ফরহাদাবাদ), মো. নূরুল আলম (ধলই), নৌকমান্ডো ফারুক-ই-আজম, বীর প্রতীক (ফরহাদাবাদ), “সিইনসি স্পেশাল’ আবদুল হালিম (ফরহাদাবাদ), আহমদ ছফা (ফরহাদাবাদ), মাহবুবুল আলম চৌধুরী (ফরহাদাবাদ), শামসুল হুদা (ধলই), ফরিদ আহমদ (ফরহাদাবাদ), বাদশা আলম (ফরহাদাবাদ), মো. ইউনুছ (ফরহাদাবাদ), মীর আহমদ (ধলই), ফজল বারী (ধলই), জহুরুল হক (ধলই), আমিনুল হক চৌধুরী (ধলই), আবু তাহের চৌধুরী (ধলই), আবদুল সত্তার (ছিপাতলী) এবং আবুল কদর (মাদার্শা)। পরে কমান্ডার ফজল আমিন, কমান্ডার এস এম ফজলুল হক, কমান্ডার মো. মুছা, কমান্ডার মোবারক হোসেন, কমান্ডার আনোয়ার, কমান্ডার ফয়েজ মাস্টার ও কমান্ডার আবুল কাসেমকে নিয়ে একটি থানা হাই কমান্ড গঠিত হয়। হাটহাজারীকে দুভাগে ভাগ করে উত্তর দিকের দায়িত্ব দেয়া হয় ফজল আমিনকে এবং দক্ষিণ দিকের দায়িত্ব দেয়া হয় এস এম ফজলুল হককে। উত্তর দিকের প্রধান অফিস স্থাপিত হয় বানচালারঘাট ও দক্ষিণ দিকের প্রধান অফিস হয় আবুরখিল বড়ুয়াপাড়ায়।
বিভিন্ন ইউনিয়নের দায়িত্বও বিভিন্ন জনকে ভাগ করে দেয়া হয়, যেমন– আহমদ ছফা – ধলই; জহুর, মুছা ও হারুন- ফরহাদাবাদ; মাসুদ ও লিয়াকত আলী – চিকনদণ্ডী; চিত্ত – রাঙ্গামাটিয়া; দিদার ও আবদুল কাদের ফতেয়াবাদ; আবদুল মোবারক – লাঙ্গলমোড়া; আনোয়ারুল ইসলাম ও মোজাম্মেল মাদার্শা; সামসুল আনোয়ার- ফতেপুর; আবদুল খালেক – হাটহাজারী; ফয়েজ মাস্টার – মেখল এবং আবুল কাসেম – গরদুয়ারার দায়িত্ব পান। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকবাহিনী হাটহাজারীতে প্রবেশ করে এবং এখানে চারটি ক্যম্প স্থাপন করে, যার একটি ছিল হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ডের দক্ষিণ পাশে অদুদিয়া সিনিয়র সুন্নিয়া মাদ্রাসায়। এটি তাদের টর্চার সেল’ নামে পরিচিত ছিল। অপর তিনটি ছিল কাটিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়, নাজিরহাট ডিগ্রি কলেজ ও উদালিয়া চা বাগানে।
হাটহাজারী উপজেলায় মুসলিম লীগ, নেজামী ইসলামী ও পিডিপি-র নেতা-কর্মীরা স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে তৎপর ছিল। তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছিল মুসলিম লীগের আবুল খায়ের সিদ্দিকী, জেবল হোসেন চৌধুরী, আহমদুর রহমান সওদাগর, আনোয়ারুল কাদের চৌধুরী, শামসুল আলম চৌধুরী, আলী আহমদ টি কে, নাদের আলী খান, আহমদুর রহমান চেয়ারম্যান, সিদ্দিক মেম্বার, চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, চেয়ারম্যান হাজী জালাল আহমদ, চেয়ারম্যান এডভোকেট এ এইচ বজল আহমদ চৌধুরী, নেজামী ইসলামীর আহমদউল্লাহ মিয়া (খুইল্ল্যা মিয়া), মাওলানা মুফতি ইউসুফ প্রমুখ। এদের মধ্যে শামসুল আলম চৌধুরী ও আলী আহমদ টি কে ছিল প্রধান। এরা পাকিস্তানিদের পক্ষে ঘাতকের ভূমিকা নিয়েছিল।
উপজেলায় রাজাকার, আলবদর ও আলশামস- সক্রিয় ছিল। কয়েকজন কুখ্যাত রাজাকার হলো— কমান্ডার এজাহার মিয়া সওদাগর (ফতেপুর), কমান্ডার আবদুচ ছোবহান ড্রাইভার (ফতেপুর), এডভোকেট এ এইচ বজল আহমদ (মির্জাপুর), মাস্টার আবদুল লতিফ তালুকদার (খিল্লাপাড়া; যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত), নূর আহমদ (মির্জাপুর), আবুল হোসাইন (মির্জাপুর), ফারুক আহমদ (মির্জাপুর), ছালে আহমদ (মির্জাপুর), তোফায়েল আহমদ (মির্জাপুর), মো. ইসহাক (মির্জাপুর), মো. মুছা (মির্জাপুর), বজল আহমদ (মির্জাপুর), জাফর আহমদ (মির্জাপুর), নূর আহমদ (মির্জাপুর), সেকান্দর মিয়া (মির্জাপুর), আবদুস ছোবান (মির্জাপুর), রাজা মিয়া (উত্তর মাদার্শা, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত), শামসুল হুদা চৌধুরী (বুড়িশ্চর), জেবল হোসেন (বুড়িশ্চর), আলী আহমদ (ফতেপুর), আবদুস ছোবহান (ফতেপুর), মো. আনোয়ার (ফতেপুর), আলী আহমদ (উত্তর মাদার্শা), আবদুল করিম (উত্তর মাদার্শা), কবির আহমদ (উত্তর মাদার্শা), সুলতান আহমদ (উত্তর মাদার্শা), আবুল বশর (উত্তর মাদার্শা), ফরিদুল আলম (উত্তর মাদার্শা), নূর আহমদ (মির্জাপুর), হাফিজুর রহমান (মেখল), আজিজুর রহমান (মেখল), বজলুর রহমান (মেখল), আমজাদ আলী (দেওয়ান নগর), জহির হোসেন, সাহেব মিয়া, সৈয়দ মো. আবছার (মীর্জাপুর), ইসহাক চৌধুরী (চৌধুরীবাড়ি, মীর্জাপুর), এস এম কামাল উদ্দিন আহমদ চৌধুরী (গুমানমর্দন; ইউনিয়ন পরিষদ সচিব), রমজান আলী (পশ্চিম মীর্জাপুর), বাদলা বলি (ফতেপুর), খলিলুর রহমান (ফতেপুর), মো. হোসেন (ফতেপুর), আলী আহমদ (ফতেপুর), আনোয়ার মিয়া (ফতেপুর), জাগের মিস্ত্রী (ফতেপুর)।
মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত রাজাকাররা হলো- উত্তর মাদার্শার রাজা মিয়া, ইসলাম, টুইক্যা, জালাল দফাদার, ইয়াকুব আলী দফাদার (ফতেপুর), আলী আহমদ টিকে, শামসুল আলম, মাস্টার আবদুল লতিফ তালুকদার (খিল্লাপাড়া, পশ্চিম মীর্জাপুর), তাজুল ইসলাম (গুমানমর্দন)। এরা বিভিন্ন অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়।
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকবাহিনী মন্দাকিনীতে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধা নূরুল আবছার (পিতা আমিনুল হক) ও মুজিবুর রহমান (পিতা হাবিবুর রহমান)-কে নির্মমভাবে হত্যা করে মৃতদেহ ফেলে রেখে যায়। স্থানীয় জনগণ তাঁদের সেখানেই দাফন করে। এপ্রিলের শেষদিকে সুগতি রঞ্জন বড়ুয়া ও মতিলাল চৌধুরী এবং নভেম্বরে মো. আবদুল কাদের ও ফয়েজ আহমদ এমএ নামে উপজেলার চারজন বুদ্ধিজীবীকে তারা হত্যা করে।
৯ই ডিসেম্বর পাকবাহিনী কাটিরহাটে চারজনকে গুলি করে হত্যা করে। নিহতরা হলেন- সিরাজুল হক ভোলা (পিতা মকবুল আহমদ সারাং, ধলই), ফোরক আহমদ (পিতা হাচি মিয়া, পূর্ব মন্দাকিনী), তার স্ত্রী আছিয়া খাতুন এবং কন্যা হাছিনা বেগম।
উপজেলায় তিনটি গণহত্যা সংঘটিত হয় ছড়ারকুল গণহত্যা, ফরহাদাবাদ গণহত্যা ও কাটিরহাট গণহত্যা। ১০ই এপ্রিল পাকবাহিনী ফতেয়াবাদের ছড়ারকুলে অতর্কিতে হামলা চালায়। এতে অর্ধশত নিরীহ লোক প্রাণ হারায় এবং শতাধিক আহত হয়। এ ঘটনা ছড়ারকুল গণহত্যা নামে পরিচিত। ৬ই ডিসেম্বর পাকবাহিনী ফরহাদাবাদে ৫ জনকে গুলি করে হত্যা করে। ৯ই ডিসেম্বর কাটিরহাট গণহত্যায় ৪ জন নিরীহ লোক শহীদ হন।
হাটহাজারী উপজেলার দেওয়াননগরে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের একটি ঘাঁটি ছিল। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে তারা অজ্ঞাত অনেক নারী-পুরুষকে এখানে ধরে এনে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে এবং এখানেই গণকবর দেয়। তাই এটি দেওয়াননগর গণকবর নামে পরিচিত।
হাটহাজারী উপজেলার প্রথম যুদ্ধ -চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যুদ্ধ। ২৮শে মার্চ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের উত্তর-পূর্ব পাশে পাকবাহিনীর সঙ্গে ইপিআর সুবেদার আবদুল গনির বাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এদিন দুপুরে পাকবাহিনী আর্টিলারি, ট্যাংক, মর্টার ও বিমান নিয়ে সুবেদার গনির অবস্থানের ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। কিন্তু তিন ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধের পর পাকবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ- যুদ্ধে ইপিআর প্লাটুন কমান্ডার নায়েব সুবেদার নাজির আহমদ এবং অপর ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ। পরবর্তীকালে এ উপজেলায় ছোট-বড় বেশ কয়েকটি অপারেশন ও যুদ্ধ হয়েছে। তন্মধ্যে মদুনাঘাট পাওয়ার হাউস অপারেশন— নাজিরহাট বাসস্ট্যান্ড যুদ্ধ এবং -কাটিরহাট যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। মদুনাঘাট পাওয়ার হাউস অপারেশন পরিচালিত হয় ৩রা অক্টোবর এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে। এ অপারেশনে ১১ জন পাকিস্তানি সৈন্য ও ৭ জন রাজাকার নিহত হয় এবং গেরিলা যোদ্ধাদের ছোড়া রকেট লাঞ্চারের আঘাতে পাওয়ার স্টেশনটি ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। হানাদার বাহিনীর গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল আবদুল মান্নান আহত হলে তাঁকে স্থানান্তরের পথে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নাজিরহাট বাসস্ট্যান্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৯-১১ই ডিসেম্বর পর্যন্ত। এতে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অপরপক্ষে অনেক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। কাটিরহাট যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৩ই ডিসেম্বর। এতে ৯ জন পাকসেনা নিহত ও কয়েকজন রাজাকার আহত হয়।
এসব ছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা আরো কয়েকটি অপারেশন পরিচালনা করেন। মাদার্শা হাইস্কুলে রাজাকারদের একটি ক্যাম্প ছিল। ইদ্রিস ও কামালের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এ ক্যাম্প আক্রমণ করলে রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে। পুনরায় তাঁদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা রামদাশ হাটের রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে রাজাকারদের বিতাড়িত করেন। রাজাকাররা কাটিরহাট বাজারে ২০ জন বাঙালিকে বন্দি করে রেখেছিল। এ খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ৪ঠা ডিসেম্বর অভিযান চালিয়ে ৬ জন রাজাকারকে হত্যা ও বন্দিদের মুক্ত করেন। একবার মুক্তিযোদ্ধারা নুরুল আলম মিয়ার হাট ঘেরাও করে সেলিম চৌধুরী, জামাল, ইসমাইল, ইউনুছ, আবুল কাসেমসহ আরো কয়েকজন রাজাকার ও তাদের সহযোগীদের গ্রেফতার করেন, যদিও ২রা ডিসেম্বর তাদের মুক্তি দেয়া হয়। ১৩ই ডিসেম্বর হাটহাজারী উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- সুবেদার মেজর সুলতান আহমেদ, বীর বিক্রম (পিতা মোখলেছুর রহমান, ফতেহাবাদ), লে. জেনারেল এম হারুন-আর-রশিদ, বীর প্রতীক (পিতা ডা. মাহমুদুল হক, ধলই), মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক (পিতা এস এম হাফেজ আহমেদ, উত্তর বুড়িশ্বর), ন্যাভাল কমান্ডো মোহাম্মদ হোসেন, বীর প্রতীক (পিতা আহাম্মদ মিয়া, পশ্চিম ধলই) এবং ন্যাভাল কমান্ডো ফারুক ই আজম, বীর প্রতীক (পিতা মনির আহাম্মদ চৌধুরী, ফরহাদাবাদ)। হাটহাজারী উপজেলার যেসব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা গেছে, তাঁরা হলেন— মোহাম্মদ হোসেন, বীর প্রতীক (২২শে সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের বহির্নোঙ্গরে অস্ত্রবোঝাই পাকিস্তানি জাহাজে অপারেশন চালিয়ে তীরে ফেরার সময় পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ), লে. ডা. এনামুল হক (পিতা মীর হোসেন, ফরহাদাবাদ; ২২শে মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসে পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ), অনিলচন্দ্র ঘোষ (পিতা তেজেন্দ্রলাল ঘোষ, ফরহাদাবাদ; ৫ই আগস্ট মিরসরাই থানা এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), দলিলুর রহমান (পিতা ছালেহ আহমদ, গুমানমর্দন; ১৭ই আগস্ট রামগড় সীমান্তে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), শেখ আলীম উল্লাহ (পিতা শেখ আমজাদ আলী, গুমানমর্দন; ১৭ই আগস্ট রামগড় সীমান্তে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), মৌলবি ইমাম উদ্দিন খান (পিতা ওয়াহেদ আলী শরীফ, ধলই; ২২শে অক্টোবর হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে হত্যা করে), মো. নোয়া মিয়া (পিতা আবদুল হাদি, পশ্চিম ধলই; ৯ই ডিসেম্বর পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), মো. নূরুল আবছার (পিতা আমিনুল হক, ফরহাদাবাদ; ১১ই নভেম্বর নাজিরহাট বাসস্ট্যান্ডে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), মুজিবুর রহমান (পিতা হাবিবুর রহমান, ফরহাদাবাদ; ঐ) এবং বাবুলচন্দ্র শীল (পিতা মণীন্দ্র শীল, পশ্চিম ধলই; ৯ই ডিসেম্বর নাজিরহাট বাসস্ট্যান্ডে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ)।
হাটহাজারী উপজেলার শহীদদের স্মরণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেইটের রেলস্টেশন সংলগ্ন গোল চত্বরে ‘স্মরণ’ নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। তাতে দুজন মুক্তিযোদ্ধাসহ মোট ৭ জন শহীদের প্রতিকৃতি ও নাম খোদাই করা আছে। এছাড়া একই সালে ধলই ইউনিয়নের ধলই গ্রামে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডো মো. হেসেন, বীর প্রতীকএর নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। তাঁর নামে ধলই গ্রামে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। [জামাল উদ্দিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড