You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.28 | হাড়াতলী যুদ্ধ (লালমাই, কুমিল্লা) - সংগ্রামের নোটবুক

হাড়াতলী যুদ্ধ (লালমাই, কুমিল্লা)

হাড়াতলী যুদ্ধ (লালমাই, কুমিল্লা) সংঘটিত হয় ২৮শে অক্টোবর। এতে ৭-৮ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং কয়েকজন রাজাকার পালিয়ে যাওয়ার সময় গণপিটুনিতে মারা যায়। অন্যদিকে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং কয়েকজন আহত হন।
লালমাই (তৎকালীন লাকসাম) উপজেলার বেলঘর উত্তর ইউনিয়নের হাড়াতলী গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ৩৫-৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন নির্ভয়পুর সাব- সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট মাহবুবুর রহমান, ইশরাক আহমেদ ও স্থানীয় কমান্ডার মো. জহিরুল ইসলাম। তাঁদের সহযোদ্ধা ছিলেন লাকসাম থানা কমান্ডার আবুল বাসার, মঈন সিনহা, মকবুল আহমেদ, আহছানুজ্জামান মীরন, আবু তাহের মজুমদার, মোহম্মদ আলী, আইয়ুব আলী, আবদুল মালেক প্রমুখ। বাতাবাড়িয়া ও হাড়াতলী গ্রামের মাঝামাঝি স্থানে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়। যুদ্ধের দুদিন পূর্ব থেকেই হাড়াতলী, কাকপতিয়া ও বাতাবাড়িয়া গ্রামে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেন। তাঁদের বেশির ভাগ সদস্যই ছিলেন বয়সে খুব তরুণ ও সদ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং শত্রুর সঙ্গে সম্মুখ সমরে লড়াই করার পূর্ব অভিজ্ঞতাহীন। ভারী অস্ত্র বলতে তাঁদের কাছে তেমন কিছুই ছিল না, ছিল হালকা প্রকৃতির দেশীয় অস্ত্র এবং কয়েকটি ব্রিটিশ এলএমজি ও এসএলআর।
যুদ্ধের দিন সকালে মুক্তিযোদ্ধারা খবর পান যে, রাজাকার- বাহিনীসহ প্রায় ২০০ সৈন্যের এক বিশাল বহর নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা লাকসাম থেকে বেলঘর হয়ে গৈয়ারভাঙ্গার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে এবং ইতোমধ্যে তারা বেলঘর গ্রামের পশ্চিমে এসে পড়েছে। এ খবর শোনামাত্র মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। পাকিস্তানি বাহিনীর তুলনায় নিজেদের অস্ত্র, লোকবল, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার স্বল্পতা বিবেচনা করে সহযোগিতার জন্য তাঁরা পার্শ্ববর্তী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে খবর পাঠান। খবর পেয়ে কিছু অভিজ্ঞ ও দক্ষ মুক্তিযোদ্ধা (যাঁদের মধ্যে ২-৩ জন ছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য) ভারী অস্ত্রসহ হাড়াতলীর দিকে এগিয়ে আসেন এবং হাড়াতলী রাস্তার মোড় থেকে অদূরে পুকুরপাড়, ধানক্ষেত ও রাস্তার পাশে অবস্থান নেন। দুপুর ১টার দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন বেলঘর অতিক্রম করে বাতাবাড়িয়া ও হাড়াতলীর মাঝামাঝি আসে, তখন মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা দুদলে বিভক্ত হয়ে একদল বুশ্চি বাজারের দিকে, অন্য দল হাড়াতলীতে অবস্থান করে। এত স্বল্প অস্ত্র নিয়ে বিপুল সংখ্যক পাকসেনার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় ২ ঘণ্টা যুদ্ধ চালিয়ে যান। এরপর বিশাল বাহিনীর সামনে টিকে থাকা সম্ভব হবে না বুঝতে পেরে তাঁরা নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে রাস্তার পশ্চিম পাশ থেকে পূর্ব পাশে অবস্থান নেন এবং গুলি ছুড়তে থাকেন। এ অবস্থায় পাকিস্তানি সৈন্যেরা তাঁদের ঘিরে ফেলে গুলি চালালে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অন্য ২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে হানাদাররা বুশ্চি বাজারের দিকে যেতে থাকে। পেছন থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ধাওয়া করতে থাকলে তারা ঐ ২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে। এতে মুক্তিযোদ্ধা মো. দেলোয়ার হোসেন (লাকসাম ঘটনাস্থলে শহীদ হন এবং আবু তাহের (ফুলরা) গুরুতর আহত হন। মুক্তিযোদ্ধা মো. হারুনুর রশিদ (১৬) রাস্তার পূর্ব পাশ দিয়ে ক্রলিং করে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে সামনে নিরাপদ মনে করে পালানোর চেষ্টা করলে শত্রুর গুলিতে শহীদ হন তারপর পাকিস্তানি সৈন্যরা কাকপতিয়ার একটি বাড়িতে ঢুকে অগ্নিসংযোগ করে এবং মোখলেছুর রহমান নামের আরেক জন মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া ইজ্জত আলী নামের অন্য একজন মুক্তিযোদ্ধাকেও পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে নিয়ে হত্যা করে। পাঁচ ঘণ্টা স্থায়ী এ-যুদ্ধে উপজেলার ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং কয়েকজন আহত হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. হারুনুর রশিদ (পদুয়া), মো. দেলোয়ার হোসেন (ভাবকপাড়া), মো. মোখলেছুর রহমান (শাকরা), মনোরঞ্জন সিংহ (আলীশ্বর), মো. ইজ্জত আলী (গৈয়ারভাঙ্গা) প্রমুখ। এ-যুদ্ধে ৭-৮ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। গ্রামের সাধারণ মানুষও লাঠি, কোচ, বল্লম ও দা নিয়ে এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়ায়। পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী কিছু রাজাকার অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যাওয়ার সময় গ্রামবাসীর হাতে গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা যায়। [ইমন সালাউদ্দিন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড