মুক্তিযুদ্ধে হাইমচর উপজেলা (চাঁদপুর)
হাইমচর উপজেলা (চাঁদপুর) মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত। ১৯৭১ সালে চাঁদপুর মহকুমার অধীনে একটি থানা ছিল। পরে এটি উপজেলায় উন্নীত হয়। বর্তমানে এ উপজেলায় ১৫২ জন মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত রয়েছেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বাঙালিরা ছয়দফা কর্মসূচি-র ভিত্তিতে জাতীয় মুক্তির মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে আলোচনার আড়ালে নানারকম ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে এবং জনগণের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন চালাতে থাকে। এর ফলে সমগ্র পূর্ববাংলার মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনএ ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু ৭১-এর ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এ তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে জনগণকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করার নির্দেশ দেন। ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বন্দি হওয়ার পূর্বে তিনি স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা দিলে সমগ্র দেশের মানুষের ন্যায় হাইমচরবাসীও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
১৯৭১ সালের মধ্যমার্চ থেকে হাইমচরসহ চাঁদপুর মহকুমার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। প্রাথমিকভাবে আব্দুল্লাহ সরকার (হাইমচর; স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে জাসদ নেতা ও সংসদ সদস্য; বর্তমানে প্রয়াত), ডা. এম এ ছালাম (দক্ষিণ আলগী), সিরাজুল ইসলাম সরকার (হাইমচর), আ. মতিন (চরভৈরবী), ফজলুল হক সরকার (হাইমচর), মজিবুল হক সর্দার (হাইমচর), সুলতান আহমেদ মাস্টার (নীলকমল), আহম্মদ আলী মাস্টার (চরভৈরব), ছমিদ হাওলাদার (গন্ডামারা), ইদ্রিছ ছৈয়াল (উত্তর আলগী), মনছুর আলী গাজী (গাজীপুর) প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। এঁদের মধ্যে আব্দুল্লাহ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাছাড়া ছমিদ হাওলাদার মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ও ট্রেনিং প্রদানের জন্য চরভাঙ্গা হাইস্কুল (দক্ষিণ আলগী), মাদারবাড়ি (রফিক পাটোয়ারীর বাড়ি) ও হাজী মেজবাহ উদ্দিন (নীলকমল)-এর বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অস্ত্র বিতরণ, যুদ্ধসরঞ্জামঅন্যান্য মালামাল সংরক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন কমান্ডার সন্তোষ চন্দ্ৰ মজুমদার। শাহ্ আ. বারেক বকাউল ও সৈয়দ আহাম্মদ মাস্টার (সাবেক কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, হাইমচর) প্রাথমিক প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ দানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা ছিলেন ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এফএফ।
হাইমচরে মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন চাঁদপুর দক্ষিণের বিএলএফ কমান্ডার সৈয়দ আবেদ মুনছুর। সহকারী কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মো. রোস্তম আলী ও শাহ্ মো. বারেক বকাউল (চরভৈরবী)।
হাইমচর উপজেলাটি মেঘনাবিধৌত হওয়ায় এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকমান্ডো ইউনিট গড়ে ওঠে। মেঘনা নদী দিয়ে পাকসেনাদের যাতায়াত ছিল। তারা প্রায়শই যুদ্ধজাহাজ, গানবোট ও রসদবাহী জাহাজ নিয়ে এ পথে চলাচল করত। নৌকমান্ডোরা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেন। মুক্তিযোদ্ধারা সর্বদা মেঘনা নদীর পাড় সংলগ্ন এলাকায় পাহারা দিতেন, যাতে পাকবাহিনী নৌপথে এসে এলাকায় প্রবেশ করতে না পারে। পাকবাহিনী হাইমচরে কোনো ক্যাম্প স্থাপন করেনি। মাঝে- মধ্যে তারা অনুপ্রবেশ করে স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধীদের সহযোগিতায় হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নানা প্রকার অত্যাচার-নির্যাতন চালাত।
হাইমচরে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বা শান্তি কমিটির নিয়মিত কোনো সদস্য ছিল না। তবে স্বাধীনতাবিরোধী কতিপয় ব্যক্তি বেশ তৎপর ছিল এবং তারা এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অপতৎপরতায় লিপ্ত ছিল। তারা ছিল মুসলিম লীগ- ও ওলামায়ে ইসলামের নেতা-কর্মী তাদের মধ্যে বাদশা (পশ্চিম চরকৃষ্ণপুর), আবুল কালাম সরদার (নীলকমল), করিম পাটোয়ারী (পূর্ব চরকৃষ্ণপুর), আ. ছাত্তার মাস্টার (উত্তর আলগী), রাজ্জাক হাওলাদার (উত্তর আলগী), কাশেম (কমলাপুর), রসিদ মুন্সি (চরভৈরবী) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
২১শে সেপ্টেম্বর ভোরবেলা পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা বাখরপুর মজুমদার বাড়িতে স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে অতর্কিতে আক্রমণ করে। এতে মুক্তিযোদ্ধাসহ মোট ১৮ জন শহীদ হন। এটি বাখরপুর গণহত্যা নামে পরিচিত। মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান (ভিঙ্গুলিয়া) এ-যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন এবং দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে আবার যুদ্ধে যান। হানাদাররা বাজাপ্তী গ্রামের হিন্দু অধ্যুষিত দাসপাড়ায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে এবং অনেককে অত্যাচার করে। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা আব্দুল্লাহ সরকারের বাড়িতে রাতের বেলা আক্রমণ চালায়। তবে আব্দুল্লাহ সরকার ঘটনাক্রমে বেঁচে যান। পাকবাহিনীর অত্যাচারে এ বাড়ির বেশকিছু লোক আহত হয়।
বিচ্ছিন্ন দু-একটি ঘটনা ছাড়া হাইমচর উপজেলা ছিল মুক্তাঞ্চল। ৬ই ডিসেম্বর সমগ্র চাঁদপুর জেলা হানাদারমুক্ত হয়। তাই এ দিবসটিকেই হাইমচর উপজেলা হানাদারমুক্ত হওয়ার দিবস হিসেবেও পালন করা হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- এলাহী বক্স পাটোয়ারী, বীর বিক্রম (পিতা মফিজ উদ্দিন পাটোয়ারী, বাজাতি)।
বিভিন্ন রণাঙ্গনে হাইমচরের যেসব মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, তাঁরা হলেন- এলাহী বক্স পাটোয়ারী, বীর বিক্রম (২১শে সেপ্টেম্বর শহীদ), ইমদাদুল হক (চরশোলাদী), আদম আলী (চরশোলাদী), নায়েক সিরাজুল ইসলাম (দক্ষিণ আলগী), আ. গণি রাড়ী (দক্ষিণ আলগী), আব্দুল কাইয়ুম (হাইমচর), ইমাম হোসেন মোল্যা (হাইমচর), এলাহী বক্স পাটোয়ারী (মহজমপুর) ও সিপাহি সামছুল হক (হাইমচর)।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাইয়ুম স্মরণে হাইমচর উপজেলার পশ্চিম চরকৃষ্ণপুর গ্রামে অবস্থিত হাইমচর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন স্থানে ‘শহীদ কাইয়ুম স্মৃতি পাঠাগার’ নামে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আব্দুল কাইয়ুম কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় সংঘটিত বেতিয়ারা যুদ্ধে শহীদ হন। এছাড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নায়েক সিরাজুল ইসলামের নামে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে একটি সড়ক রয়েছে। [মো. মোকলেছুর রহমান মুকুল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড