মুক্তিযুদ্ধে হাকিমপুর উপজেলা (দিনাজপুর)
হাকিমপুর উপজেলা (দিনাজপুর) ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ শোনার পর আওয়ামী লীগএর নেতৃবৃন্দ হাকিমপুরের বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন। এর ফলে তাদের মধ্যে স্বাধীনতার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়। ২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনী কর্তৃক গণহত্যার পর ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এ সম্বন্ধে প্রচারণা চালিয়ে সাধারণ জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণে আহ্বান জানান। রাস্তায় মিছিল, গ্রামে-গ্রামে প্রতিরোধ কমিটি গঠন, হাটে-বাজারে জনসভার আয়োজন, পথনাটক প্রদর্শন, বিপ্লবী গান পরিবশেন, দলবদ্ধভাবে বিবিসি-র সংবাদ শ্রবণ, ইয়াহিয়া খানের কুশপুত্তলিকা দাহ ইত্যাদি কর্মকাণ্ড চলতে থাকে। ৪ঠা এপ্রিল বর্তমান সরকারি বালিকা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে স্বাধীনতা সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্ববর্গের নির্দেশে বিভিন্ন জায়গায় পাক হানাদার বাহিনীর আগমন ঠেকাতে ছাত্র-জনতা দেশীয় অস্ত্র, ব্যক্তিগত দোনলা বন্দুক এবং সাঁওতালরা তীর-ধনুক নিয়ে প্রস্তুত হয়।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৪ঠা এপ্রিল গঠিত স্বাধীনতা সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন মীর সোলায়মান আলী, সেক্রেটারি আব্দুল কুদ্দুস (আওয়ামী লীগের হাকিমপুর থানা কমিটির সভাপতি) এবং সদস্য ছিলেন আব্দুল মজিদ চৌধুরী, ডা. ওয়াকিল, রফিক মাস্টার (ফুলবাড়ি), আব্দুল কুদ্দুস মুন্সী, মহির মুন্সী, মকবুল মল্লিক, খোকা মিয়া, মনি বাবু, শফি মন্ডল, কুমুরউদ্দিন চৌধুরী, নরেন পাল, যোগেন পাল, ডা. কাসেম আলী, খলিল মাস্টার, যদু মীর ওরফে গেটু মাস্টার প্রমুখ। তরুণ সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন হাসান চৌধুরী মধু, আখতার মুন্সী, মোস্তফা মুন্সী, রহমান মুন্সী, আবু ইসলাম, মুছা মুন্সী, মাহফুজার মুন্সী, মো. মোখলেসুর রহমান, আকরাম খান প্রমুখ। হিলি বাজারের কালিগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয়ের আমবাগানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এতে হাকিমপুরের বিভিন্ন এলাকার ছাত্র-যুবকরা অংশগ্রহণ করে। প্রশিক্ষণ দেন বাঙালি ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ এবং অবসরপ্রাপ্ত ও ছুটিতে আসা সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা। দেশীয় অস্ত্র, তীর-ধনুক, বল্লম, কোচা, ভোজালি, ব্যক্তিগত দোনলা বন্দুক, টুটুর, রাইফেল এবং ইপিআর ও আনসারদের অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এপ্রিলের ৯-১০ তারিখ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের নির্দেশে সরকারি গুদাম থেকে খাদ্যশস্য এনে সবার জন্য খিচুরি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। এ-সময় ভারতে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন হিলিতে এসে জমায়েত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হিলি সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মাহতাব এবং যুব কমান্ডার ছিলেন জয়নাল আবেদীন। উপজেলার পৌরসভা ও ইউনিয়ন ভিত্তিক কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা হলেন- হাকিমপুর পৌরসভা: মো. লিয়াকত আলী (পিতা রমজান আলী, ধরন্দা), মো. জয়নাল আবেদীন (পিতা আখের আলী মণ্ডল, মধ্য বাসুদেবপুর), মো. আনছার আলী (পিতা আজাহার আলী, ছাতনী), মো. সামছুল আলম মণ্ডল (পিতা মোরশেদ আলম, দক্ষিণ বাসুদেবপুর), মো. আফতাব উদ্দীন (পিতা মদন অলী, মুহাপাড়া), মো. সুরত আলী (পিতা ফয়েজ উদ্দীন, পালপাড়া), মো. তোফাজ্জল হোসেন (পিতা আ. গণি মণ্ডল, চণ্ডীপুর), নূর মোহাম্মদ (পিতা নওফেল আলী, দক্ষিণ চণ্ডীপুর), মো. কুদরতে আলী রিপন (পিতা মো. আবুল হোসেন খোকা, উত্তর বাসুদেবপুর); ১নং খট্টামাধবপাড়া ইউনিয়ন: মো. নওশাদ আলী (পিতা বদর আলী, মাধবপাড়া), মো. সাইফুল ইসলাম (পিতা ফাসির উদ্দীন, চকবিরভান), মো. বিরাজ উদ্দীন (পিতা ইজার উদ্দীন, ডাঙ্গাপাড়া), মো. আবেদ আলী (পিতা উমর আলী ফকির, লোহাচড়া), মো. আকবর আলী (পিতা শফির উদ্দীন, সাতকুড়ি), মো. জিল্লুর রহমান (পিতা আফছার আলী, হরেকৃষ্টপুর), মো. আমিরুল ইসলাম (পিতা আজিমুদ্দীন, ডাঙ্গাপাড়া), মো. নজরুল ইসলাম (পিতা কফিল উদ্দীন, মংলাপাড়া), মো. ইন্তাজ আলী, পিতা কুমর উদ্দীন, পাউশগাড়া), মো. হারেজ আলী (পিতা বিরাজ উদ্দীন, নওদাপাড়া), মজিবর রহমান (পিতা জহির উদ্দীন, দেবখণ্ডা), আলা উদ্দীন (পিতা আব্বাস আলী, চকভবানীপুর), যতীশ চন্দ্র রায় (পিতা যোগেন চন্দ্র রায়, খট্টা), সাইদুর রহমান (পিতা মিয়ার উদ্দীন, নন্দিপুর); ২নং বোয়ালদাড় ইউনিয়ন: মো. আবুল কাশেম (পিতা কাজেম আলী, বিশাপাড়া), মো. মোকলেছার রহমান (পিতা মনির উদ্দীন খান, বোয়ালদাড়), মো. আব্দুল হক (পিতা মজির উল্লা, বৈগ্রাম), মো. আব্দুস ছালাম (পিতা কসর উদ্দীন, সরঞ্জাগাড়ী), মো. গোলাম মোস্তফা (পিতা মফিজ উদ্দীন, পাইকপাড়া), মো. মোতালেব হোসেন (পিতা সবুর আলী, কাঁকড়াপালী), মো. আব্দুর রশিদ (পিতা ছবির উদ্দীন, ছোট চেংগ্রাম); ৩নং আলীহাট ইউনিয়ন: মো. কাজেম আলী (পিতা জোনাব আলী, জাংগই), বিশ্বনাথ সরকার (পিতা শ্যামল চন্দ্র রায়, জাংগই) প্রমুখ।
স্থানীয় যুবকরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পর নিজনিজ গ্রাম- মহল্লার প্রধান-প্রধান সড়কগুলোতে পাহারা দেয় এবং গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে, ব্রিজ ও কালভার্টের দুপাশে গর্ত করে প্রতিরোধ তৈরি করে। তারা পূর্বে ছাতনী গ্রাম, দক্ষিণে দক্ষিণপাড়া এবং উত্তর-পূর্বে ডাঙ্গাপাড়ায় এরূপ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। দেশীয় অস্ত্রের পাশাপাশি ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র এবং আনসার, ইপিআর ও থানার বাঙালি পুলিশ সদস্যরা তাদের অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধকারীদের সাহায্য করেন। প্রতিরোধে তাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন খলিল মাস্টার, কাজী দারোগা, ডা. কাশেম এবং আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা।
হিলি-ঘোড়াঘাট সড়কে হিলির ডাঙ্গাপাড়ায় বর্তমান বিজিবি চেক পোস্টের পাশে পাকবাহিনীর একটি টহল ক্যাম্প ছিল। সেখান থেকে তারা বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করত। এ ক্যাম্প থেকেই এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে তারা হাকিমপুর থানায় প্রবেশ করার চেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু স্থানীয়দের প্রতিরোধের মুখে তা ব্যর্থ হয়। ১৪ই এপ্রিল প্রবেশের জন্য তারা জোর চেষ্টা চালায়। কিন্তু এবারও ব্যর্থ হয়। ১৭ই এপ্রিল স্থানীয় জনগণ এবং নেতৃবৃন্দ ভারতে যাওয়া শুরু করেন। এই সুযোগে ১৯শে এপ্রিল হানাদার বাহিনী ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। এসময় হিলিতে অবস্থানরত ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আনোয়ারের আলফা কোম্পানি ও স্থানীয় ছাত্র-যুবকরা তাদের প্রতিরোধ করে। কিন্তু পাকবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে তারা পশ্চাদপসরণ করেন। এ-যুদ্ধে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ছয়জন সৈনিক শহীদ হন। অবশিষ্ট সৈনিকরা সন্ধ্যার দিকে ক্যাপ্টেন আনোয়ারের নেতৃত্বে ভারতের অভ্যন্তরে বকশীগঞ্জ আমবাগানে গিয়ে আশ্রয় নেন। এদিকে পাকবাহিনী প্রথমে ডুগডুগিহাট ও পরে হরিহরপুরে অবস্থান নেয়। ২১শে এপ্রিল তারা হাকিমপুর থানা পুরোপুরি দখল করে সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে।
পাকবাহিনী হিলি দখল করার পর স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধীদের দিয়ে শান্তি কমিটি গঠন করে। এ কমিটির সদস্য ছিল আছমান আলী (চেয়ারম্যান, হিলি), ইনতাজ বিহারী (ফকিরপাড়া), মোহাম্মদ আলী (ফকিরপাড়া), শরিফ কসাই (চুরিপট্টি, স্থায়ী বাড়ি জয়পুরহাটে), বৃনিয়া বিহারী (হিলি স্টেশন এলাকা), সোহরাব (কুষ্টিয়া), কাশেম (পাবনা) প্রমুখ। এদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী বিভিন্ন এলাকা থেকে যুবতী নারীদের ধরে ক্যাম্পে নিয়ে আসত। অনেককে ধর্ষণ করার পর মেরে ফেলত, অনেককে দীর্ঘদিন আটকে রাখত। তাদের পাশবিক নির্যাতনের হাত থেকে বয়স্ক মহিলারাও রেহাই পায়নি। এভাবে তারা এলাকায় নৃশংস অত্যাচার চালিয়েছে। শান্তি কমিটির লোকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের খবরাখবর পাকবাহিনীকে জানিয়ে দিত এবং সুযোগ পেলেই তাঁদের ধরিয়েও দিত। অন্যদিকে শরণার্থীরা হিলি সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় পাকবাহিনী তাদের অনেককে হত্যা করে। ২১শে এপ্রিল হাকিমপুর পুরোপুরি দখল করার পর তারা নিয়মিত হত্যাকাণ্ড চালায়। তাদের হাতে অন্তত ৩০০ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হন। ১৯শে এপ্রিল থেকে তারা প্রায় ২০০ বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং ৪০০ বাড়িঘর লুট করে।
হাকিমপুর উপজেলায় ১৮ই এপ্রিল একটি গণহত্যার ঘটনা ঘটে – পালপাড়া গণহত্যা। এতে ৭ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ এবং ৪ জন আহত হন।
উপজেলার ছাতনী, ডাঙ্গাপাড়া ও মুহাড়াপাড়ায় পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ছিল। হিলি রেলওয়ে স্টেশনের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে ব্রিটিশ আমলের তৈরি একটি বিশাল ইন্দিরা (কূপ) আছে। যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী বহু বাঙালিকে হত্যা করে ঐ ইন্দিরায় ফেলে দেয়।
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা ডিনামাইটের সাহায্যে ফকিরপাড়া (ধরন্দা) ব্রিজটি উড়িয়ে দেন। ২১শে নভেম্বর হিলির মুহাড়াপাড়ায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়, যা মুহাড়াপাড়া যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর বহু সৈন্য শহীদ হন। ডিসেম্বর মাসের ৯ ও ১০ তারিখ হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যৌথবাহিনীর যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর পরাজয় ঘটে এবং ১১ই ডিসেম্বর হাকিমপুর উপজেলা সম্পূর্ণ হানাদারমুক্ত হয়।
হাকিমপুর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— গোলাম মোস্তফা (পিতা আহম্মদ আলী সরদার, বোয়ালদাড়; খট্টামাধবপাড়া যুদ্ধে শহীদ), নজিব উদ্দিন (পিতা বাহার উদ্দিন শেখ, বানিয়াল; দিনাজপুর মহারাজা স্কুল ট্র্যাজেডি-তে শহীদ), একরামুল হক (পিতা কেফাতুল্লাহ, বোয়ালদাড়; ঐ), ইয়াদ আলী (পিতা তালেব আলী মুন্সী, বৈগ্রাম; ঐ), মমতাজ উদ্দিন মোল্লা (পিতা মজের আলী মোল্লা, ইসমাইলপুর; ভারতের হামজাপুরে শহীদ), মনির উদ্দিন (পিতা অছিম উদ্দিন, ইসমাইলপুর; হাবড়া ফুলবাড়িতে শহীদ) এবং অছিম উদ্দিন (পিতা সোলাইমান ফকির, চেংগ্রাম; ঐ)।
হাকিমপুর উপজেলায় ২০১৩ সালে সম্মুখ সমর স্মৃতিসৌধ নামে মুক্তিযুদ্ধের একটি ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। এছাড়া চারজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে চারটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো— শহীদ মুক্তিযোদ্ধা অছিম উদ্দিন সড়ক (হিলি-মুহাড়াপাড়া), শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নজিব উদ্দিন সড়ক (চেকপোস্ট-বাজার), শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ইয়াদ আলী সড়ক (দিনাজপুর টার্নিং রোড-বিজিবি ক্যাম্প) এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা সড়ক (বাসুদেবপুর বিজিবি মোড়-বোয়ালদাড় বাজার)। [মো. রবিউল হক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড