স্বাধীনতা স্তম্ভ, স্বাধীনতা জাদুঘর ও শিখা চিরন্তন (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)
মুক্তিযুদ্ধের স্মারক সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের লক্ষ্যে একটি বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্বাধীনতার স্মৃতিবিজড়িত ঢাকার কেন্দ্রস্থল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৯৭-২০১৩ সময়ে স্বাধীনতা স্তম্ভ, ভূগর্ভস্থ স্বাধীনতা জাদুঘর ও শিখা চিরন্তন নির্মিত হয়। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের সময় এর পরিকল্পনা নেয়া হয়। তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের সরকারের সময় ২০১৩ সালে এটির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান একটি ঐতিহাসিক স্থান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের সঙ্গে এ স্থান অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়। ১৯৬৯ সালে আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি লাভের পর ২৩শে ফেব্রুয়ারি এ স্থানে এক বিশাল গণসম্বর্ধনা সভায় শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ৭০-এর নির্বাচনোত্তর ৩রা জানুয়ারি ১৯৭১ একই স্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান- নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ৬ দফার প্রশ্নে কোনোরূপ আপোষ না করার শপথ বাক্য পাঠ করান। এ সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যেখানে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বাঙালির অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালিদের ‘যার যা আছে তা-ই নিয়ে’ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী বাঙালি জাতি ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী র নিকট এ উদ্যানেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান একই উদ্যানে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি তাঁর ভাষণ দেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতা দানকারী, ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী- ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর প্রথম সফরকালে এ উদ্যানে ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে তাঁকে নাগরিক সম্বর্ধনা দেয়া হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের এতসব ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে উদ্যান, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তা তুলে ধরার জন্য ৭৫-পরবর্তী ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার একটি ব্যাপক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এখানে স্বাধীনতা স্তম্ভ, স্বাধীনতা জাদুঘর ও শিখা চিরন্তন নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উত্তরপ্রান্তে ১৯৯৭ সালের ৭ই মার্চ এক বিশাল জনতার সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে শিখা চিরন্তন প্রজ্জ্বলন করেন। সে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে প্যালেস্টাইনের রাষ্ট্রপতি ইয়াসির আরাফাত, দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলা ও তুরস্কের রাষ্ট্রপতি সোলেমান ডেমিরেল উপস্থিত ছিলেন। ১৯৯৭ সাল থেকে এ শিখা প্রজ্জ্বলিত রয়েছে। প্রতিদিন দেশ- বিদেশের অনেক মানুষ শিখা চিরন্তন দেখতে আসেন। প্রজ্জ্বলিত শিখার ঠিক দক্ষিণদিকে রয়েছে স্বাধীনতা স্তম্ভ। স্বাধীনতা স্তম্ভকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর একটি ম্যুরাল, তিনটি জলাধার, একটি অ্যাম্ফিথিয়েটার, দেড় শতাধিক আসনবিশিষ্ট একটি অডিটোরিয়াম নির্মাণ করা হয়। দেশের দুজন প্রখ্যাত স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ও মেরিনা তাবাসুম স্বাধীনতা স্তম্ভ ও জাদুঘরের স্থাপত্যিক নকশা তৈরি করেন। একটি উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এ দুই স্থপতিকে নির্বাচিত করে নকশা তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উত্তরদিকে অবস্থিত শিখা চিরন্তনের দক্ষিণদিকে ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ’ নির্মাণ করা হয়েছে। শিখা চিরন্তন ও স্তম্ভের বেদির মধ্যবর্তী স্থানে লাল সিরামিক ইটের তৈরি প্রশস্ত স্থান রয়েছে। এর দুই ধারে বৃক্ষের সারি। বৃক্ষের পেছনে বিস্তৃত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশবিশেষ। শিখা চিরন্তনের দক্ষিণ দিকের স্থান থেকে ১৪টি ধাপ ওপরে স্তম্ভের বেদি। উঁচু চারকোণা একটি বৃহৎ কংক্রিটের কাঠামোর ওপর স্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে। কংক্রিটের কাঠামোর তিনদিকে কৃত্রিম জলাধার। কংক্রিটের কাঠামোর পূর্বদিকে ১০ ফুট উঁচু একটি দেয়াল রয়েছে। এ দেয়ালে ২৭৩ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি ম্যুরাল রয়েছে। টেরাকোটার এ ম্যুরালে ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সময়ে সংঘটিত রাজনৈতিক সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি স্থান পেয়েছে। এ ম্যুরালের নাম ‘জনতার দেয়াল’। এ ম্যুরালের শিল্পীরা হলেন : মোহাম্মদ ইউনুস, মুকুল মুকসুদ্দীন, শিশির ভট্টাচার্য্য, ইফতেখারউদ্দিন আহমেদ ও শ্যামল চৌধুরী। ২০০০ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে এটি নির্মিত হয়। ম্যুরালের দক্ষিণদিকে স্তম্ভ। স্তম্ভের উচ্চতা ১৫০ ফুট। প্রশস্তে এটি ১৬ ফুট। এর নির্মাণ শৈলী অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইস্পাত দিয়ে নির্মিত কাঠামোয় স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে চারদিকে বেষ্টনী দেয়া হয়েছে। দিনের বেলা সূর্যের আলো স্বচ্ছ কাঁচে প্রতিফলিত হয়। কাঠামোর ভেতরে উচ্চ ক্ষমতার বৈদ্যুতিক বাল্ব স্থাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। রাতে এসব বাল্ব প্রজ্জ্বলিত হয়ে পুরো স্তম্ভ আলোকিত হয়। এ আলো সামনের জলাধারে যখন প্রতিফলিত হয় তখন এক মোহনীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। জলাধারের তিনদিকে দুই ফুট উঁচু পাকা বেঞ্চে অসংখ্য মানুষের বসার ব্যবস্থা। সন্ধ্যার পর আলো ও জলের সম্মিলন দর্শণার্থীদের জন্য খুব আকর্ষণীয়। ১৫০ ফুট উচ্চতার প্রজ্জ্বলিত স্তম্ভটি রাতে অনেক দূর থেকে দৃশ্যমান হয়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন যে বাঙালির হাজার বছরের সবচেয়ে আলোকোজ্জ্বল ঘটনা, – তারই স্মারক এ প্রজ্জ্বলিত স্তম্ভ।
ম্যুরালের পাশ দিয়ে ভূগর্ভস্থ স্বাধীনতা জাদুঘরে নামার সিঁড়ি। এ স্বাধীনতা জাদুঘর স্থাপন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সৃষ্টিশীল উদ্যোগ। ২০১৫ সালে জাদুঘরটির উদ্বোধন করা হয়। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় বাম পাশের দেয়ালে দেখা যায় ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার জন্য সমবেত ছাত্রছাত্রীদের একটি বিশাল আলোকচিত্র। নিচে নেমে পশ্চিম দিকের দেয়ালে চোখে পড়ে ৭ই মার্চ ভাষণরত বঙ্গবন্ধু ও লাখো জনতার সুবিশাল আলোকচিত্র। জাদুঘরটি মূলত চারটি ভাগে বিভক্ত। দুদিকে দুটি গ্যালারি। গ্যালারি দুটিতে ১৪৪টি প্যানেলে রাখা অসংখ্য আলোচকচিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রাচীন, মধ্যযুগ ও সমকালীন ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত সময়ের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া দুই গ্যালারির দেয়ালেও আছে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর সরকারের কৃতিত্ব ও অর্জন বিষয়ক আলোকচিত্র। দুই গ্যালারির মধ্যবর্তী একটি অংশের নাম ‘ব্লাকজোন’। এ অংশে পাকহানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ থেকে বাঙালিদের ওপর যে নারকীয় গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও নির্যাতন চালিয়েছে সেসবের আলোকচিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। এসব চিত্র সংবেদনশীল মানুষকে বিমর্ষ করে। এ অংশের বিপরীতে পূর্বদিকে রয়েছে ‘অশ্রুপ্ৰপাত’। এটি একটি বৃত্তাকার হলঘর। এখানে ছাদের ফোকর দিয়ে ক্রন্দনরত মায়ের অশ্রুধারা অনবরত নিচের একটি গোলাকার আধারে পড়ছে। এটি বাংলামায়ের দুঃখ ও বেদনা প্রকাশের একটি প্রতিকী রূপ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য মানুষের আত্মদান, এক সাগর রক্ত বিসর্জন, মা-বোনের সম্ভ্রম হারানো এবং বাংলামায়ের অশ্রু ঝরার প্রতীক হিসেবে স্থাপিত এ ‘অশ্রুপ্রপাত’ সকল দর্শকের মনে বেদনাবিধুর এক অনুভূতির জন্ম দেয়। একই সঙ্গে কত ত্যাগ ও মূল্যের বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হলো, তা দর্শকদের মনে জাগিয়ে তোলে।
জাদুঘরে ১৫৬ আসনের একটি মিলনায়তন রয়েছে। এখানে প্রতি শুক্র ও শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সিনেমা প্রদর্শিত হয়।
প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ স্বাধীনতা স্তম্ভ ও ভূ-গর্ভস্ত জাদুঘর পরিদর্শন করেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে একদিকে শিখা চিরন্তন, এর পাশে স্বাধীনতা স্তম্ভ, ভূগর্ভস্থ স্বাধীনতা জাদুঘর, স্তম্ভের উত্তর দিকে সুপ্রশস্ত জলাধার, জলাধারের পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর দিকে বিস্তৃত উদ্যান এবং এসব পরিদর্শনে আসা নানা স্তরের মানুষের সমাহার সবমিলে এখানে এমন এক পরিবেশ তৈরি হয় যা মানুষের চেতনা ও বোধে জাগরণ সৃষ্টি করে।
মুক্তিযুদ্ধের স্মারক স্বাধীনতা স্তম্ভের দক্ষিণ দিকে ২০১৪ সাল থেকে প্রতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষা আন্দোলনের স্মারক বাংলা একাডেমি অমর একুশে বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রতি সন্ধ্যায় স্বাধীনতা স্তম্ভের আলো যখন একুশের বইমেলায় বিচ্ছুরিত হয় তখন মেলায় আগত দর্শক-পাঠক-ক্রেতার মনন ও চেতনায় ভাষা-আন্দোলন- ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও স্মারকের অপূর্ব সম্মিলন ঘটে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে স্থাপিত এ পুরো স্থাপনাটি জাতীয় জাদুঘর ও গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। [জালাল আহমেদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড