You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে সিরাজদিখান উপজেলা (মুন্সীগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে সিরাজদিখান উপজেলা (মুন্সীগঞ্জ)

সিরাজদিখান উপজেলা (মুন্সীগঞ্জ) রাজধানী ঢাকার অদূরে মুন্সীগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত। এ উপজেলার উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে ধলেশ্বরী নদী এবং মধ্য দিয়ে ইছামতি নদী প্রবাহিত। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় এ জনপদ যেমন ছিল দুর্গম, তেমনি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল। ধলেশ্বরী ও ইছামতির তীরবর্তী সকল নৌবন্দর এবং উপজেলার সড়কপথ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পাকবাহিনী শুরু থেকেই সচেষ্ট ছিল।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-কে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু ১লা মার্চ তিনি গণপরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বঙ্গবন্ধু ২রা মার্চ ঢাকা শহরে এবং ৩রা মার্চ সারা পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহ্বান করেন। ২রা মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। তাদের আহ্বানে ৪ঠা মার্চ সারা দেশের মতো সিরাজদিখানেও অর্ধবেলা হরতাল পালিত হয়। ৫ই মার্চ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সিরাজদিখানের সকল ইউনিয়নেও সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে ঘরে-ঘরে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ আসে। ২১শে মার্চ লৌহজং-সিরাজদিখান আসনের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জামাল উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে বাসাইল মৌলভীর খিলে (মাঠে) এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় সিরাজদিখানে সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৫শে মার্চ ঢাকা শহরে পাকহানাদার বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর জামাল উদ্দিন চৌধুরী এমপিএ-কে উপদেষ্টা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদের সদস্য ছিলেন মাহফুজুর রহমান খান, শান্তিবোধ সরকার, হুমায়ূন কবির, শেখ আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, বিনয় কৃষ্ণ নাথ, হাবিবুল্লাহ বাহার, মহিউদ্দিন আহমেদ, মিয়া আব্দুল লতিফ, আলতাফ হোসেন, আলী আহমেদ বাচ্চু, আব্দুল কুদ্দুস ধীরন, মুহাম্মদ জহুরুল আলম বিমল প্রমুখ। ২৫শে মার্চ ঢাকায় গণহত্যার পর অসংখ্য মানুষ বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য চারদিকে ছুটতে থাকে। তাদের অনেকে সিরাজদিখানে এসে আশ্রয় নেয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সিরাজদিখানের জনতা এসব মানুষের সেবায় নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসে। তারা নদীর ঘাটে, পথের পাশে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাৎক্ষণিকভাবে লংগরখানা ও চিকিৎসাকেন্দ্র খোলে। এভাবে একদিকে চলে শরণার্থীদের আহার বিশ্রাম ও চিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা, অপরদিকে চলে প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রস্তুতি। অফিস- আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানো হয়। বঙ্গবন্ধু পাকহানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি হওয়ার পূর্বে ২৬শে মার্চ রাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাঁর সে ঘোষণা ওয়ারলেসের মাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর রাজদিয়া, ইছাপুরা, রসুনিয়া ও মালখানগর স্কুল মাঠে সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এসব সভায় বক্তারা মুক্তিযুদ্ধের জন্য সকলকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য সিরাজদিখানের তালতলা বাজার, মালখানগর, মালপদিয়া, মধ্যপাড়া, তেলিপাড়া, ইছাপুরা, শিয়ালদী, চামারদী, বাসাইল, পাথরঘাটা, ব্রজেরহাটি, চারিগাঁও, রসুনিয়া, ধামালিয়া, লক্ষ্মীবিলাস, সোলপুর, শেখরনগর, রাজানগর, চিত্রকোট, মরিচা প্রভৃতি স্থানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়। এসব কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দানের জন্য ২৭শে মার্চ জামাল উদ্দিন চৌধুরী এমপিএ-র নেতৃত্বে থানার মালখানা থেকে ১৮টি রাইফেল ও অন্যান্য অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়। অস্ত্র সংগ্রহের এ অভিযানে অংশ নেন ডা. শফি উদ্দিন আহমেদ, এ কে এম সামসুদ্দিন আহমেদ খায়ের, মো. আলী আকবর মিয়া, মহিউদ্দিন আহমেদ, এস এম শাহজাহান, আবদুল মজিদ, মুহাম্মদ জহুরুল আলম বিমল, মাহফুজুর রহমান খান, শেখ আনোয়ার হোসেন, শান্তিবোধ সরকার, হুমায়ূন কবীর প্রমুখ। বাসাইলের মৌলভীর খিল ও পোস্ট অফিস প্রাঙ্গণেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে চাকরিরত নায়েক আশরাফ শিকদার কালু ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে এসে ২৫শে এপ্রিল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন। তালতলা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ দেন এমপিএ জামাল উদ্দিন চৌধুরী এবং আনসার কমান্ডার আব্দুস সামাদ মিয়া। শ্রীনগর থানার মজিদপুর-দয়াহাটা গ্রামে কফিল উদ্দিন চৌধুরীর বাড়িতেও একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। এ কেন্দ্রটি সিরাজদিখান থানার বাইরে হলেও পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হতো সিরাজদিখানের মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা, কারণ কেন্দ্রটির অবস্থান ছিল সিরাজদিখান থানার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে। বাসাইল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা ডা. শফি উদ্দিন আহমদের পরামর্শে মো. আলী আহাম্মদ বাচ্চু ব্রজেরহাটি গ্রামের সন্তোষ দাসের বাড়িতে একটি অস্থায়ী কেন্দ্র স্থাপন করে নিজেই প্রশিক্ষণ দেন। এ কেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ছাত্রনেতা জামাল চৌধুরী ও আনোয়ার হোসেন। ইছাপুরা ক্যাম্পের প্রশিক্ষক ছিলেন আব্দুল জলিল। তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় ছুটিতে এসে আর ফিরে যাননি। সংগ্রাম পরিষদের আঞ্চলিক আহ্বায়ক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মোস্তাফিজুর রহমানের উদ্যোগে মধ্যপাড়া ইউনিয়নের তেলিপাড়া প্রাইমারি স্কুলেও একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল। কমান্ডার মোতালেব দেওয়ানের নেতৃত্বে ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৩২ জনের একটি গ্রুপ এ ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। চোরমর্দন গ্রামের ডা. মহিউদ্দিন (মহি ডাক্তার), সামসুল হক সামসু ও আজাহার এ গ্রুপের অধীনে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন এবং সিরাজদিখান থানা মুক্তকরণ অভিযানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। চোরমর্দন গ্রামটি ছিল ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়। ইছামতি নদীর তীরবর্তী পানের বরজঘেরা এ গ্রামটিকে বামপন্থীরা অস্ত্র মজুদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতেন। গ্রামের ‘বড়খাল’ নামে পরিচিত খালটি ইমামগঞ্জ বাজারের উত্তর দিকের বাসাইল খালের সঙ্গে যুক্ত। বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধারা এ খালটি অস্ত্র সরবরাহের রুট হিসেবে ব্যবহার করতেন। এসব ক্যাম্প ছাড়া সিরাজদিখানের অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকেও উন্নততর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
সিরাজদিখান থানায় যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন তাঁরা হলেন– আলী আহাম্মদ বাচ্চু, দেলোয়ার হোসেন মোল্লা, আবদুল লতিফ, মো. শাহজাহান মিয়া, মুহাম্মদ জহুরুল আলম বিমল, আব্দুর রশিদ, মো. ওয়াসেক হাওলাদার, হাবিলদার নাজিম উদ্দিন, আব্দুল করিম বিদ্যুৎ চৌধুরী, মো. জহুরুল হক হাওলাদার, আবদুল লফিত জমাদার, জাহাঙ্গীর আলম এবং মোতালেব দেওয়ান।
১২ই মে পাকবাহিনী সিরাজদিখান উপজেলায় প্রবেশ করে এবং থানা ও তালতলায় ক্যাম্প স্থাপন করে। এদিন ভোরে দুজন অফিসারের অধীনে ৬৪ জন পাকসেনা লঞ্চযোগে তালতলা ঘাটে এসে পৌছায়। এখান থেকে তালতলা- শ্রীনগর সড়ক ধরে তারা মালখানগরে যায়। সেখানে তারা দুটি দলে ভাগ হয়। একটি দল শিয়ালদী-রাজদিয়া সড়ক ধরে সিরাজদিখান থানায় যায়। অপর দলটি ইছাপুরা হয়ে শ্রীনগরের দিকে এগিয়ে যায়। সিরাজদিখানে পাকসেনাদের সংবর্ধনা জানায় মজিদ মুন্সী, চুন্নু ছৈয়াল, লাল মিয়া, রওশন আলী শিকদার প্রমুখ রাজাকার। ১২ই মে বিকেলে পাকবাহিনী শিয়ালদী গ্রামের নেকবর তালুকদারের ছেলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী আবদুল আজিজকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়ার অভিযোগে থানায় ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী একটি ছেলেকে এভাবে হত্যা করায় অত্র এলাকায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র গণরোষ তৈরি হয়।
১২ই মে মুন্সীগঞ্জ মহকুমা শান্তি কমিটির আহ্বায়ক আব্দুল হাকিম বিক্রমপুরীর উপস্থিতিতে সিরাজদিখান থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। সিরাজদিখান থানার শান্তিকমিটির সদস্য হলো— আব্দুন নাইম (বাসাইল), চুন্নু মিয়া (ফেগুনাসার), আব্দুল সাত্তার ভূয়া (জৈনসার), আব্দুল মজিদ (রাজানগর), আব্দুল মান্নান মোল্লা (মালখানগর), ইদ্রিস তালুকদার (ইছাপুরা), ইসমাইল হোসেন (রশুনিয়া), শরীফ নূরুল ইসলাম (রাজানগর), মেহের আলী শিকদার (রশুনিয়া), রফিউদ্দিন সরকার সোনামিয়া (বাসাইল), মতি কাজী (রশুনিয়া), রফিক সরকার (বাসাইল), রওশন আলী শিকদার (রশুনিয়া), আব্দুল আজিজ গোরাপী (বাহেরকুচী) প্রমুখ। সিরাজদিখান থানার রাজাকারদের মধ্যে ছিলেন- হারুন অর রশিদ (রাজানগর), ইয়াকুব আলী (রাজানগর), আজাহর আলী (রাজানগর), চুন্নু মিয়া (রাজানগর), ওমর আলী (শেখরনগর), নুরুল ইসলাম (রাজানগর), আজিজুল হক (মধ্যপাড়া), আব্দুল আউয়াল (কাকালদি, মধ্যপাড়া), আব্দুল হামিদ (মধ্যপাড়া), আব্দুল রউফ (মধ্যপাড়া), সামাদ মুন্সী (মধ্যপাড়া), আব্দুল বাসেত (মধ্যপাড়া), ফেলু মিয়া (মধ্যপাড়া), ইউনুস তালুকদার (বয়রাগাদী), হারুন রশিদ (বয়রাগাদী), গোলাম মাওলা (বয়রাগাদী), আব্দুল রউফ তালুকদার (বয়রাগাদী), জয়নাল আবেদিন (তাজপুর, রশুনিয়া), তাজল ইসলাম (রশুনিয়া), সিরাজুল হক (রশুনিয়া), আকবর রহমান (রশুনিয়া), আব্দুল হাই দিদার (রশুনিয়া), আউয়াল মিয়া (রশুনিয়া), আওলাদ হোসেন (রশুনিয়া), ফরমান আলী (ইছাপুরা), নূরুল ইসলাম (ইছাপুরা), লিয়াকত আলী (মধ্যপাড়া), আব্দুল সাত্তার (মধ্যপাড়া), মোহর আলী (মধ্যপাড়া), সিরাজুল ইসলাম (মধ্যপাড়া), আব্দুল রাজ্জাক (মধ্যপাড়া), আব্দুল আউয়াল (বাহেরকুচি, মধ্যপাড়া), কবির উদ্দিন (মধ্যপাড়া), আব্দুল মান্নান (মধ্যপাড়া), হামিদুল হক (মধ্যপাড়া), ইব্রাহিম (মধ্যপাড়া), নূর মোহাম্মদ (মধ্যপাড়া), মো. দেলোয়ার হোসেন (মধ্যপাড়া), মোবারক আলী (রশুনিয়া), আব্দুল আউয়াল (রশুনিয়া), জয়নাল আবেদিন (হিরনি খিলগাঁও, রশুনিয়া), আব্দুল মজিদ ওরফে মজিদ মুন্সী (রশুনিয়া), গিয়াস উদ্দিন (কেয়াইন), তোফাজ্জল হোসেন (মালখানগর), সরবত আলী (কেয়াইন), সায়েজ উদ্দিন মোল্লা (রাজানগর), সাহাজ উদ্দিন (রাজানগর), মো. কামাল উদ্দিন (মধ্যপাড়া), মো. নূর ইসলাম (মধ্যপাড়া), মো. আতাউল (মধ্যপাড়া) প্রমুখ।
সিরাজদিখান থানার রসুনিয়া গ্রামটি দুটি বিশেষ কারণে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। এ গ্রামটি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ-এর স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ও তাঁর সন্তানদের আশ্রয় দেয়। তাজউদ্দীন আহমদের পরিবারের সদস্যরা এ গ্রামের ভজহরি দে-র বাড়িতে কিছুদিন অবস্থান করেন। তারপর মে মাসের প্রথম দিকে তাঁরা ভারতে চলে যান। ২৫শে মার্চের পর হানাদার বাহিনীর গণহত্যা থেকে বাঁচার জন্য ঢাকার কয়েকজন হিন্দু ব্যবসায়ী এ গ্রামের বিশিষ্ট জোতদার নিবারণ দত্ত ওরফে রাম সিংএর বাড়িতে আশ্রয় নেন। ১২ই মে রাতে স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় পাকবাহিনী এ বাড়িতে একটি গণহত্যা চালায়। রসুনিয়া গণহত্যায় সেদিন ৯ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হন। পাকহানাদার বাহিনী এদিন রাতে সিরাজদিখান বাজারের অনেক দোকান পুড়িয়ে দেয়। পূর্ণ পাল ও শান্তি শীলের সেলুন ভাংচুর করে। নারায়ণ কর্মকার ও নারায়ণ দেবনাথকে তাঁদের দোকান থেকে বের করে অমানুষিক নির্যাতন করে। পান্নালাল দত্তের ফার্মেসিতে লুটপাট ও ভাংচুর করে।
যুদ্ধ শুরুর পর ইছামতি নদীর তীরবর্তী সন্তোষপাড়া, পাটিয়ালপাড়া, জেলেপাড়া এবং চোরমর্দন গ্রামের কুমারপাড়া ও ঋষিপাড়া একেবারে জনশূন্য হয়ে পড়ে। স্থানীয় রাজাকাররা এই সুযোগে সন্তোষপাড়ার অধিকাংশ বাড়ি লুট করে। এ পাড়ার অনিলচন্দ্র ঘোষ বেয়নেটের আঘাতে আহত হন। দানিয়াপাড়া গ্রামের বৃন্দাবন দত্তবণিকের বাড়িটিও লুণ্ঠিত হয়।
হানাদার বাহিনীর নিক্ষিপ্ত শেল ও বোমা থেকে বাঁচার জন্য সিরাজদিখান থানার লোকজন পানের বরজের উঁচু ভিটা, নিজ বাড়ি এমনকি কবরস্থানেও বৃহৎ সুড়ঙ্গ তৈরি করে খাদ্য, টাকা-পয়সা ও মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে দীর্ঘদিন বসবাস করে। রাজদিয়া গ্রামের হানিফ হাওলাদার নিজ বাড়িতে, সন্তোষপাড়ার দীনেশ ঘোষ, নিতাই ঘোষ ও টোকানি ঘোষ তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে শিয়ালদি কবরস্থানে, রসুনিয়া গ্রামের টোকানি দাস ও নারায়ণ চন্দ্র দে নিজ বাড়িতে, দক্ষিণ আবিরপাড়া গ্রামের মাখন দাস, বলাই দাস, সুনীল দাস, মতিলাল দাসসহ প্রায় সকল বারুজীবী তাদের পানের বরজে সুড়ঙ্গ বা লম্বা গুহা বানিয়ে অনেক দিন অবস্থান করেন। আবিরপাড়ার নিত্যানন্দ দাস (পিতা গোবিন্দ দাস)-কে ১৪ই নভেম্বর হানাদার বাহিনী সুড়ঙ্গের পাশে বরজে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে। এদিন হানাদার বাহিনী দক্ষিণ আবিরপাড়ার সুরেন্দ্র শীল ও তার ভাই নৃপেন্দ্র শীলের স্ত্রীকেও হত্যা করে। পাকসেনারা এসেছে জেনে সুরেন্দ্র শীল ভয়ে তুলসীতলায় ভক্তিরত অবস্থায় ছিলেন এবং নৃপেন্দ্র শীলের স্ত্রী ঘরের ভেতর চকির তলায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। হানাদাররা এ অবস্থায় তাদের গুলি করে হত্যা করে। রাজাকার মজিদ মুন্সি ও দক্ষিণ আবিরপাড়ার ছত্তর পাগলা পাকসেনাদের চিনিয়ে এ গ্রামে নিয়ে যায়।
হানাদার বাহিনী তাজপুর গ্রামের হিন্দু বাড়িগুলোতে ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এ গ্রামের এক বৃদ্ধা বৈষ্ণবীর পুত্র নারায়ণকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। কুসুমপুর গ্রামে লোহন মিয়ার দোকানে বসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র- শোনার সময় লোহন মিয়া ও নান্নু ভূঁইয়াকে পাক হানাদাররা ধরে নিয়ে যায়। নান্নু ভূঁইয়ার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তাঁকে মৃত মনে করে থানা থেকে দুমাইল দূরে ইছামতি নদীর ধারে ফেলে যায়। আর লোহন মিয়ার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। দানিয়াপাড়া গ্রামের কালীপদ পাল ও চন্দনধূলের ভাওয়াল বাড়ির নেপাল ভাওয়ালকে রাতের অন্ধকারে নৌকায় উঠিয়ে নিয়ে যায়। তাঁদের আর ফিরে পাওয়া যায়নি। আগস্ট মাসের কোনো একদিন বাহেরঘাটা গ্রামের যোগেশ চন্দ্র দাস, সুবল মিস্ত্রি ও অনিল পাল কোষা নৌকায় করে বড় পাউলদিয়ার দত্ত বাড়িতে গিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে র সংবাদ শুনতে। ফেরার পথে বাহেরঘাটা খাল দিয়ে তালতলা ক্যাম্প থেকে আসা পাকবাহিনীর নৌকার কাছাকাছি এলে পাকসেনারা যোগেশ চন্দ্র দাসকে নৌকা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে।
তালতলা ক্যাম্পে অবস্থানরত হানাদার বাহিনী তালতলা বন্দরের নিকটবর্তী ফুরসাইল, ফেগুনাসার ও গোরাপীপাড়া গ্রামে নারীনির্যাতন, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা গোরাপীপাড়ার দেওয়ান বাড়ির ১৪টি ঘর পুড়িয়ে দেয়। এতে ১০-১৫টি গবাদি পশু পুড়ে মারা যায়। গ্রামের মোতালেব মাঝি ঢাকা ওয়ান্ডার্স ক্লাবে চাকরি করতেন। তাকে তালতলা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়।
২৫শে মার্চ ঢাকার নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকা শহর থেকে আসা কয়েকটি পরিবার কোলা ইউনিয়নের গৌরীপুর গ্রামের শীতল গাঙ্গুলীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। আশ্রিত পরিবারগুলোর মধ্যে ইত্তেফাক-এর প্রধান হিসাবরক্ষক অনিল কুমার সরকার, শাঁখারি বাজারের স্বর্ণব্যবসায়ী নারায়ণ পোদ্দার, নিরঞ্জন পোদ্দার ও ঢাকার মানসী সিনেমা হলের ম্যানেজার তেজেন চক্রবর্তী ছিলেন। ২৬শে মে গভীর রাতে পাকবাহিনী এ বাড়িটি ঘিরে ফেলে। তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে পানির পাইপ বেয়ে কয়েকজন পুরুষ চিলেকোঠার ছাদে উঠে যান। পরদিন ২৭শে মে সকালে একজন পাকসেনা ঘটনাটি জানতে পেরে কৌশলে সেখানে যায়। তাকে দেখে ভয়ে অনিল কুমার সরকার বলেন, ‘আমি মুসলমান, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু। পাকসেনাটি তার গালে কষে এক থাপ্পর মারে। তিনি ভারসাম্য হারিয়ে ছাদ থেকে নিচে জঙ্গলের মধ্যে পড়ে যান। পাকসেনারা তার রক্তাক্ত দেহ জঙ্গল থেকে টেনে বাড়ির উঠানে এনে ফেলে রাখে। কিছু সময়ের মধ্যে তিনি মারা যান। তার গ্রামের বাড়ি ছিল চাঁদপুরে। পাকসেনারা এদিন গাঙ্গুলী বাড়ি থেকে শীতল গাঙ্গুলী, তার দুই পুত্র সুভাষ গাঙ্গুলী (দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা-র হিসাবরক্ষক) ও সুদর্শন গাঙ্গুলী, তেজেন চক্রবর্তী ও বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীকে ধরে সিরাজদিখান থানায় নিয়ে যায়। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা নারায়ণ চক্রবর্তী এবং থৈরগাও এলাকার রবীন্দ্র বাড়ৈকেও তাদের বাড়ি থেকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। তারপর তাদের লঞ্চে করে নিয়ে যায় মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ ক্যাম্পে। সেখানে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়।
২৭শে অক্টোবর পাকবাহিনী শেখরনগর বাজার জ্বালিয়ে দেয় এবং শেখরনগর-রাজানগর এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। রাজাকার ও পাকবাহিনী কর্তৃক বন্দি হয়ে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হন অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা. গোলাম মোস্তফা, ছাত্রনেতা তোফাজ্জল হোসেন, শিক্ষক খলিলুর রহমান খান, বজলুর রহমান খান, আবু সাইদ মৃধা প্রমুখ। আবিরপাড়ার আব্দুল হক চোকদারকে এবং রাজদিয়ার সপেজ্জল হোসেন বেপারীকে ঢাকার কলতা বাজার এলাকায় পাকবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে।
সিরাজদিখানের দুই কুখ্যাত রাজাকারের একজন ছিল হিরণী খিলগাঁওর রাজাকার কমান্ডার আ. মজিদ মুন্সী এবং অপরজন সিরাজদিখান থানার ওসি চেরাগ আলি। ১৯শে নভেম্বর পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণের সময় মজিদ মুন্সী বাধা দেয়। তখন হাবিলদার নাজিমউদ্দিন তাকে গুলি করে হত্যা করেন। থানা মুক্ত হওয়ার পর বিক্ষুব্ধ জনতা মজিদ মুন্সীর লাশ বের করে পথের ধারে জামরুল গাছে ঝুলিয়ে রাখে। আর চেরাগ আলি দারোগাকে জুতার মালা পরিয়ে সারা বাজার ঘোরানো হয়। থানা মুক্ত হওয়ার বেশকিছু দিন আগে হানাদার বাহিনীর আরেক দোসর রওশন আলী শিকদারকে বিক্ষুব্ধ জনতা প্রকাশ্যে হত্যা করে।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা অনেক নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে তাঁদের লাশ নদীতে ফেলে দিত। জোয়ারের সময় লাশগুলো নারায়ণগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জ থেকে ইছামতি নদী দিয়ে ভেসে এসে সিরাজদিখানে জমা হতো। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী অনেকের স্মৃতিতে অসংখ্য ভাসমান লাশের সেই দৃশ্য আজো অমলিন হয়ে আছে।
সিরাজদিখান উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি সম্মুখ যুদ্ধ হয় – তালতলা ক্যাম্প যুদ্ধ, সিরাজদিখান থানা যুদ্ধ ও সৈয়দপুর যুদ্ধ। তালতলা ক্যাম্প যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১২ই নভেম্বর। ঘটনার দিন সিরাজদিখান ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা তালতলা ক্যাম্পে অবস্থানরত পাকবাহিনীকে আক্রমণ করেন। তারাও পাল্টা জবাব দেয়। প্রায় পাঁচঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকবাহিনী ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। সিরাজদিখান থানা যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৮ই নভেম্বর ও ১৯শে নভেম্বর দুদিন। প্রথম দিনের যুদ্ধে পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করেন। পাকবাহিনীর ছোড়া শেলে দক্ষিণ কুসুমপুর গ্রামের ডা. ফজলুল হক ভূঁইয়ার বোন মমতাজ বেগম রেণু শহীদ হন। ১৯শে নভেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় থানা আক্রমণ করেন। এবার পরাজয় মেনে ৩৩ জন বাঙালি পুলিশ ও ইপিআর নিয়ে পাকসুবেদার মেজর আবদুর রউফ আত্মসমর্পণ করে। সৈয়দপুর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২৫ ও ২৬শে নভেম্বর দুদিন। যুদ্ধটি হয়েছিল গোয়ালখালী ও তৎসংলগ্ন এলাকায়। ঢাকার জিঞ্জিরা থেকে পাকবাহিনীর এক প্লাটুন সৈন্য গোয়ালখালীতে অবরুদ্ধ সৈন্যদের উদ্ধার করতে আসে। এ-সময় দুদিনব্যাপী উভয় পক্ষে ব্যাপক গুলি বিনিময় হয়। পাকবাহিনীর গুলিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক শহীদ হন। অপরপক্ষে ৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। এক পর্যায়ে রাতের অন্ধকারে পাকবাহিনী পালিয়ে যায়। ২৬শে নভেম্বর সিরাজদিখান উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
সিরাজদিখান উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- সামসুল হক হাওলাদার (মধ্যপাড়া), শেখ নজরুল ইসলাম (কুসুমপুর), মো. সালাউদ্দিন (মধুপুর), মইজউদ্দিন (চাইনপাড়া), ওয়াজেদ আলী (শিয়ালদী), হারুন-অর-রশিদ হাওলাদার (জৈনসার), শাহাবউদ্দিন হাওলাদার (বড় পাউলদিয়া) এবং তারা মিয়া (শিয়ালদী)। এছাড়া বরিশালের মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক এখানে শহীদ হন এবং নবাবগঞ্জ উপজেলার পারাগ্রামে তাঁকে সমাহিত করা হয়। [মো. শাহ্জাহান মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড