বীর প্রতীক সিরাজুল ইসলাম
সিরাজুল ইসলাম, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৪৮ ) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৮ সালের ১৯শে মার্চ সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলার দেওকলস ইউনিয়নের আগ্নপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আলফু মিয়া এবং মাতার নাম ছবরুন্নেছা বেগম। তিনি ১৯৬৫ সালে বিশ্বনাথ রামসুন্দর হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন, ১৯৬৭ সালে সিলেট এম সি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং একই কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে ডিগ্রি পাস করেন। এরপর তিনি সিলেটে আইন বিষয়ে ভর্তি হন। ছাত্র অবস্থায় তিনি ছাত্র ইউনিয়ন-এর রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। একজন সচেতন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তিনি পাকিস্তানি সরকারের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সব সময়ই ছিলেন প্রতিবাদী।
৭১-এর ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করলে সিলেট ল কলেজের শিক্ষার্থী সিরাজুল ইসলাম হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে যোগ দেন। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ডাউকি সীমান্ত পার হয়ে তিনি ভারতে যান এবং মুক্তিযোদ্ধা ইনামুল হক চৌধুরী, সদরউদ্দিন চৌধুরীসহ মেঘালয়ে ইকো- ১ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি এখানে বিশেষভাবে গ্রেনেড হামলা এবং গেরিলা যুদ্ধের ওপর প্রশিক্ষণ নেন।
এক মাস প্রশিক্ষণ শেষে সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ বাংলাদেশে প্রবেশ করে ৫নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর মীর শওকত আলীর অধীন বালাট সাব-সেক্টরে অবস্থান নেন। এ-সময় ভারতীয় মেজর ডি সুজার নেতৃত্বে এ দলটি মূলত ‘হিট এন্ড রান’ পদ্ধতিতে যুদ্ধ করছিল। পরবর্তী সময়ে এ দলটি মেজর সালাউদ্দীনের নেতৃত্বে পরিচালিত হতো। তাঁরা হঠাৎ করে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ করে দ্রুত সবে পড়তেন। তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল এর মাধ্যমে পাকিস্তানিদের মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়া।
পাকিস্তানি বাহিনী বেরিগাঁওয়ে শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করে। বালাট থেকে প্রায় ২৭-২৮ কিমি হাওড় পাড়ি দিয়ে বেরিগাঁও হয়ে সুনামগঞ্জ আসার একমাত্র পথ। বেরিগাঁওয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষার কারণে মুক্তিযোদ্ধারা সুনামগঞ্জে অপারেশন চালাতে পারছিল না। সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে ৫-৬ জনের একটি দল এভাবে কয়েকবার সুনামগঞ্জের বেরিগাঁও, ষোলঘর, মঙ্গলঘাটা, আমপাড়া ও পাগলা পাকসেনা ক্যাম্পে অপারেশন পরিচালনা করেন। বেরিগাঁওসহ অন্য পাকসেনা ক্যাম্পে তাঁরা ঠিক রাত ১২টা ১ মিনিটে একযোগে গ্রেনেড হামলা চালান। গ্রেনেড বিস্ফোরণের সঙ্গে-সঙ্গে হানাদার বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। পরক্ষণেই তারা বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে। কিন্তু ততক্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে চলে যান। ৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের এ দলটি সুনামগঞ্জ শহর পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত করে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য সিরাজুল ইসলাম-কে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে তিনি সিলেট শহরে ঠিকাদারি ব্যবসা করতেন। বর্তমানে তিনি স্ত্রী ফেরদৌসী চৌধুরী এবং ৩ পুত্র ও ১ কন্যা নিয়ে সিলেটের নূরানী সুবিদবাজারে বসবাস করছেন। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড