You dont have javascript enabled! Please enable it! মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত আওয়ামী লীগ-এর মুখপত্র 'সাপ্তাহিক জয়বাংলা' - সংগ্রামের নোটবুক

মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত আওয়ামী লীগ-এর মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক জয়বাংলা’

সাপ্তাহিক জয়বাংলা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর বাংলা সাপ্তাহিক মুখপত্র। পত্রিকাটি ছিল কার্যত বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রচার মাধ্যম। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি ও মুক্তিযোদ্ধাদের কৃতিত্ব জনসমক্ষে তুলে ধরা।
জয়বাংলা পত্রিকা মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকারের প্রকাশনা, তথ্য, বেতার ও চলচ্চিত্র বিভাগের ব্যবস্থাপনায় প্রকাশিত হয়। এ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত টাঙ্গাইলের আবদুল মান্নান এমএনএ-এর ওপর পত্রিকাটির সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। তিনি ছিলেন পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি। সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য ছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইবনে গোলাম সামাদ, মাহমুদ উল্লাহ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী, মো. সলিমুল্লাহ, আসাদ চৌধুরী, আবুল মঞ্জুর, মোহাম্মদ খালেদ ও অনু ইসলাম (নজরুল ইসলাম)। মো. জিল্লুর রহমান এমপিএ ছিলেন সম্পাদক মণ্ডলীর উপদেষ্টা। পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন বাঙালি শিল্পপতি পত্রিকাটির প্রকাশনায় আর্থিক সহায়তা দান করতেন। কলকাতার বিখ্যাত আনন্দবাজার গ্রুপ পত্রিকাটির জন্য নিউজপ্রিন্ট কাগজের যোগান দিত এবং প্রায়শ মুদ্রণব্যয়ও বহন করত। পত্রিকাটির অফিস ছিল কলকাতার পার্ক সার্কাসের ২১/১ বালু হাক্কাক লেনে এবং এটি মুদ্রিত হতো শিয়ালদহ রেলস্টেশনের অদূরে অবস্থিত মুজিবনগর জয়বাংলা প্রেস থেকে।
সাপ্তাহিক জয়বাংলা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালের ১১ই মে (২৭শে বৈশাখ ১৩৭৮)। সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি আবদুল মান্নান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে ‘আহমদ রফিক’ ছদ্মনামে পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। ‘মতিন আহমদ চৌধুরী’ ছদ্মনামে পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন মাহমুদ উল্লাহ চৌধুরী। পত্রিকার বিংশ সংখ্যা (২৪শে সেপ্টেম্বর ১৯৭১) থেকে প্রকাশক ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের ছদ্মনামের পরিবর্তে প্রকৃত নাম মুদ্রিত হয়। সাপ্তাহিক জয়বাংলা ১৭”×১০%,” কলাম সাইজের দুই কলামবিশিষ্ট পত্রিকা। প্রথম সংখ্যা থেকে পত্রিকাটি ৮ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হতো, দ্বাদশ সংখ্যা থেকে পৃষ্ঠাসংখ্যা বাড়িয়ে ১২ করা হয়। অবশ্য পরবর্তী কোনো-কোনো সংখ্যায় পৃষ্ঠাসংখ্যার ব্যতিক্রম লক্ষণীয়। শুরুতে পত্রিকার প্রতিসংখ্যার মূল্য ছিল ২০ পয়সা, তৃতীয় সংখ্যা থেকে মূল্য নির্ধারিত হয় ২৫ পয়সা। পত্রিকার লেটারহেড ডিজাইন করেন পটুয়া কামরুল হাসান। পত্রিকাটি ছিল নিয়মিত এবং ১৯৭১ সালের ২৪শে ডিসেম্বর পর্যন্ত সর্বমোট ৩৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়।
জয়বাংলা পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় মুদ্রিত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ। এছাড়া পত্রিকায় বাংলাদেশ সরকারের নীতি ও যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজিও প্রকাশ করা হতো। মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি এবং শরণার্থীদের সার্বিক অবস্থার পর্যালোচনা ছাড়াও এ পত্রিকায় কয়েকটি নিয়মিত বিভাগ ছিল, যেমন- রণাঙ্গনে, বিশ্বজনমত, বুমেরাং ও শিল্প-সংস্কৃতি। এছাড়া ছিল ধারাবাহিক রচনা ‘একটি যুদ্ধ: বহু ইতিহাস’, ‘লাখো শহীদের লাশের তলায় পাকিস্তানকে কবর দিয়েছে কারা, আমরা না তোমরা’ (প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের লেখা), ‘হুঁশিয়ার! ইয়াহিয়া-টিক্কা হুঁশিয়ার’, ‘আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোর কয়েকটি দিক’ ইত্যাদি। এছাড়া ছিল বিভিন্ন প্রতিবেদন, যেমন— ‘মানবতার ক্রন্দনরোলে কাঁপছে আল্লাহর আরশ’, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের ঘরে ঘরে শুরু হয়ে গেছে কান্নার রোল’, ‘জবাব দাও ইয়াহিয়া : শোষণ বঞ্চনাই কি তোমাদের ইসলাম’, ‘পাঞ্জাবি পুঁজিপতি ও সেনাবাহিনীর স্বার্থেই চালানো হচ্ছে বাংলাদেশে গণহত্যা’ এবং ‘ভুলের মাশুল স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা’। পত্রিকার তিনটি সংখ্যায় মুদ্রিত হয়েছে কামরুল হাসানের বিখ্যাত পোস্টার ইয়াহিয়ার মুখমণ্ডলের হিংস্র প্রতিচ্ছবি ‘জানোয়ারের মুখ’। ক্যাপশনে ছিল ‘এই জানোয়ারটাকে হত্যা করতে হবে’, ‘এই জানোয়ারটি এখন মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে’ ‘এই জানোয়ারটি বিতাড়িত হয়েছে’।
জয়বাংলা পত্রিকার সম্পাদকীয় ও প্রশাসনিক দপ্তরে যাঁরা কর্মরত ছিলেন, তাঁরা হলেন আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী (সহকারী সম্পাদক, বার্তা), আসাদ চৌধুরী (সহকারী সম্পাদক, ফিচার), রণজিৎ নিয়োগী (সহকারী সম্পাদক, বার্তা), সংবাদ লেখক ডক্টর ইবনে গোলাম সামাদ, আবদুল মঞ্জুর, গোলাম সারোয়ার, রবীন্দ্র গোপ, অনু ইসলাম, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, ফজলে লোহানী, ফিচার লেখক সাজিউল হক, প্রকাশনা বিভাগের সহকারী এম এ মোহাইমিন, ফটোগ্রাফার রবিউল আলম, মুখ্য হিসাবরক্ষক অজিত কুমার দত্ত, হিসাবরক্ষক পার্থ ঘোষ, প্রচারকার্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত সারোয়ার জাহান, এবং পিয়ন রাখালচন্দ্র। [মুয়ায্যম হুসায়ন খান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড