মুক্তিযুদ্ধে সাভার উপজেলা (ঢাকা)
সাভার উপজেলা (ঢাকা) আওয়ামী লীগের ৬-দফা ও ছাত্রদের ১১-দফা আন্দোলনে সাভার থানা ছাত্রলীগ-এর নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ সক্রিয় অংশগহণ করে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও ৭০-এর নির্বাচনেও তাদের জোরালো ভূমিকা ছিল। ১৯৭১-এর মার্চের গণআন্দোলনের আগেই সাভারে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, যার আহ্বায়ক ছিলেন আশরাফউদ্দিন খান ইমু এবং সদস্য ছিলেন খন্দকার ম হামিদ রন্জু, রফিকুল ইসলাম মোল্লা, ইউসুফ আহমেদ, পান্নালাল পোদ্দার, মোজাম্মেল হক প্রমুখ। এঁরা সাভারের প্রতিটি ইউনিয়নে স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে জনগণকে সচেতন করে তোলেন। রজুর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু – DUCSU)-এর ভিপি আ স ম আব্দুর রবের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সেই সূত্রে ডাকসু নেতাদের নির্দেশে এখানে সকল আন্দোলন পরিচালিত হতো। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সাভারে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরী হয়।
স্বাধীকার আন্দোলন যে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত হতে পারে এবং শেষপর্যন্ত তা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে রূপ নিতে পারে, তার পূর্বাভাস সাভার উপজেলার ছাত্রনেতৃবৃন্দ কেন্দ্ৰীয় নেতৃবৃন্দের নিকট থেকে পূর্বেই পেয়েছিলেন। তাই সাভারের ছাত্র-যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ দানের জন্য তাঁরা একাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে কাঠের ডামি রাইফেল সংগ্রহ করেন। রাইফেলগুলো পুরান ঢাকার মুসলিম হাইস্কুলের একটি কক্ষে রক্ষিত ছিল। এগুলো আনসার বা মুজাহিদদের প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হতো। কোর্টহাউজ স্ট্রিটের ঠান্ডু ও ফিরোজ মাহমুদের সহায়তায় খন্দকার ম হামিদ এগুলো সাভারে নিয়ে আসেন। ১লা মার্চ থেকে এগুলো দিয়ে খন্দকার ম হামিদ, আশরাফউদ্দিন খান এবং জনৈক মুজাহিদ সদস্যের সহায়তায় সাভার অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। একই দিন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষিত হলে ২রা মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। বাঙালি জাতি বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র-জনতার সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলে ধরা হয়। এ-সংবাদ সাভারে পৌঁছলে ৩রা মার্চ স্থানীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দেয়। ৫ই মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে আ স ম আব্দুর রব সাভারে এসে অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বিপুল ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এর আগে তিনি স্থানীয় যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ প্রত্যক্ষ করেন। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে সমগ্র দেশবাসীর মতো সাভারের মানুষও মুক্তিযুদ্ধের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা লাভ করে। ২৫শে মার্চ পর্যন্ত প্রশিক্ষণ অব্যাহত থাকে। এদিন রাতে পাকবাহিনীর গুলিতে আহত নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধসহ অসংখ্য মানুষ সাভার অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আশ্রয় নেয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা তাদের খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। ২৬শে মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে উপর্যুক্ত ব্যক্তিবর্গ সাভার উপজেলায় সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। আর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন আশরাফউদ্দিন খান (এফএফ – থানা কমান্ডার), আব্দুল কাদের (গ্রুপ কমান্ডার) এবং শফিউদ্দিন টুলু (বিএলএফ- গেরিলা ইউনিট কমান্ডার)।
মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন- চলাকালে সাভারের পার্শ্ববর্তী থানা গাজীপুরের চৌরাস্তায় ১৯শে মার্চ পাকবাহিনীর সঙ্গে বাঙালি সৈনিক ও সংগ্রামী জনতার যে সংঘর্ষ হয়, তা সাভারবাসীকে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। ২৬শে মার্চ সকালে আশরাফউদ্দিন খান, খন্দকার ম হামিদ, মোজাম্মেল হক, পান্নালাল পোদ্দার প্রমুখ সাভার ডেইরি ফার্মের একটি টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার জিপ নিয়ে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য বেরিয়ে পড়েন। প্রথমেই তাঁরা আমিন বাজারের লোহার ব্রিজটি বুলডোজার, মিক্সার মেশিন ও কাঠের গুঁড়ি দিয়ে বন্ধ করে দেন। হেমায়েতপুরে গাছ ফেলে ঢাকা- আরিচা মহাসড়ক বন্ধ করে দেন। নবীনগর-কালিয়াকৈর রাস্তাটি বাইপাইল নামক স্থানে মিক্সার মেশিন ও বুলডোজার দিয়ে বন্ধ করে দেন। নয়ারহাটের বংশী নদীর ফেরিগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। সাভার পাবলিক লাইব্রেরির ছাদের ওপর ইট ও মলটভ ককটেল জমা করে রাখা হয়। কিন্তু এত চেষ্টার পরেও পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি।
সকল প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ১লা এপ্রিল অপরাহ্ণে পাকবাহিনী সাভার থানায় প্রবেশ করে এবং থানা ও সার্কেল অফিসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এর পরপরই তারা মদনপুর রেডিও ট্রান্সমিটার, ডেইরি ফার্ম, আনসার ট্রেনিং ক্যাম্প, পোস্ট অফিস ভবন ও ডাকবাংলো দখল করে নেয় এবং ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে সাভার উপজেলায় মুসলিম লীগ- খুবই সক্রিয় ছিল। এর নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটির সভাপতি ছিল সাদেক উদ্দিন খান পুকু মিয়া (গেন্ডা; ডাক্তার সাদেক উদ্দিন নামে পরিচিত) এবং সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল হালিম (সাভার থানাসংলগ্ন দক্ষিণ দিকের বাড়ি); সদস্য আসগর হোসেন ওরফে আসগর উকিল (শিমুলিয়া; পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের ডেপুটি স্পিকার), মোফাজ্জল হোসেন মবু (সাভার উত্তরপাড়া; সাভার ইউনিয়ন পরিষদের সেক্রেটারি), আব্দুল গফুর (তালবাগ), আমীর হোসেন (ভাগলপুর), কামাল উদ্দিন (ব্যাংক কলোনী; শান্তি কমিটির উপদেষ্টা; অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাভার এলাকার শূন্য আসন থেকে জাতীয় সংসদে প্রার্থী), ফালান মিয়া (রাজাসন; ইউপি মেম্বার; নুরুল ইসলাম নামের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সে পাকবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেয় এবং পাকসেনারা তাঁকে হত্যা করে), সিদ্দিক মিয়া (ওয়াপদার প্রকৌশলী; চাকরিসূত্রে এখানে বসবাস করত), আয়েব আলী (ঘোড়াদিয়া), অনীল কুমার সাহা (সাভার উত্তরপাড়া), ফণীভূষণ ঘোষ (সাভার উত্তরপাড়া), মোহাম্মদ মজিবর রহমান (বিরুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান), ফিরোজ কবির (পিতা আসগর হোসেন উকিল), ইরন মুন্সী (চাইরা; দলিল লেখক এবং ভাকুর্তা ইউপি চেয়ারম্যান), পলু দাস (আনন্দপুর) প্রমুখ।
পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা ৫ই এপ্রিল সাভার বাজারের হিন্দু ব্যবসায়ীদের দোকানপাট লুট করে। শিমুলিয়া ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত রায়পাড়া এলাকায় আসগর হোসেনের নেতৃত্বে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালানো হয়। শান্তি কমিটির সভাপতি সাদেক উদ্দিন খান ও তার জামাতা আকবর আলী খান অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক অমর চাঁদ সাহার বাসভবন (গৌড় ভবন) মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস দখল করে রাখে। শান্তি কমিটির সম্পাদক মো. আব্দুল হালিম নৃপেন চন্দ্ৰ সাহা (পিতা হরিদাস সাহা) ও নবকুমার সাহা (পিতা কৃষ্ণচন্দ্র সাহা) নামে দুই ব্যক্তিকে পাকবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেয়। পাকবাহিনী তাদের বস্তায় ভরে ঘোড়াশাল রেললাইন ব্রিজ থেকে নদীতে ফেলে দিলে ভাগ্যক্রমে নবকুমার বেঁচে যান, কিন্তু নৃপেন চন্দ্ৰ মারা যান। ৯ই ডিসেম্বর ভাগলপুরের মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু তাহেরের পিতা শেখ আফসার উদ্দিনকে নিজগৃহে গুলি করে হত্যা করে পাকবাহিনী। সাভারের অধিবাসী হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে ঢাকায় চাকরিস্থলে ২৬শে মার্চ পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে ভারতে যাওয়ার সময় হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয় শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু। সাভার থানা ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র। এখানে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন করা হতো।
সাভারে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দুটি যুদ্ধ হয়। ১৪ই ডিসেম্বর পলায়নরত ও দিগ্ভ্রান্ত কিছু পাকসেনা ঢাকা বিমান বন্দরের দিকে যেতে থাকলে নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু (বর্তমানে বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ও সমাজকর্মী) ও কাদের কমান্ডারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল মধুরআঁটি নামক স্থানে তাদের আক্রমণ করে। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনী বেশ ক্ষয়- ক্ষতির শিকার হয়। এছাড়া বিরুলিয়া ইউনিয়নের রুস্তমপুর ও পাড়াগাঁও নদীর পাড়ে মিরপুরগামী কিছু দিকভ্রান্ত পাকসেনার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন মিরপুরের মোহাম্মদ হানিফ ও মোহাম্মদ আমির হোসেন মোল্লা। ১৫ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে সাভার থানার সকল পাকসেনা ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়। ফলে এদিনই সাভার উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- সাইদুল আলম, বীর প্রতীক (পিতা মো. ইসরাইল বিশ্বাস, ডেন্ডাবর পশ্চিম পাড়া)।
সাভার উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— নুরুল ইসলাম (পিতা লাল মিয়া, ধনাইদ), উমর ফারুক (পিতা মতিয়ার রহমান, গেন্ডা), মতিউর রহমান দুদু মিয়া (চাইড়া), রফিক চৌধুরী (পিতা নাজিম উদ্দিন চৌধুরী, পাহাড়িয়া বাড়ি) এবং গোলাম মোহাম্মদ দস্তগীর টিটো (১৪ই ডিসেম্বর আশুলিয়ায় সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ)।
সাভারে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদের স্মরণে সাভারে নির্মিত হয়েছে জাতীয় স্মৃতিসৌধ। এছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সংসপ্তক- ও ‘অমর একুশে’ এবং হেমায়েতপুর তিন রাস্তার মোড়ে ‘বিজয় যাত্রা’ নামে তিনটি ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। সাভারের ডেইরি ফার্ম গেইটে শহীদ গোলাম মোহাম্মদ দস্তগীর টিটোর সমাধিস্থলে ‘টিটোর স্বাধীনতা” নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সাভার উপজেলায় চারটি সরকারি স্টাফ কোয়ার্টার্সের নামকরণ করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-এর প্রথম ঘোষকের নামে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক থেকে সাভার থানা অভিমুখী সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে “বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম সন্দ্বীপ সড়ক’। উল্লেখ্য যে, চাকরিসূত্রে আবুল কাশেম সাভারে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন এবং ১৯৯৫ সালের ১০ই ডিসেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। [খন্দকার ম হামিদ রন্জু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড