সাতক্ষীরা টাউন হাইস্কুল গণহত্যা (সাতক্ষীরা সদর উপজেলা)
সাতক্ষীরা টাউন হাইস্কুল গণহত্যা (সাতক্ষীরা সদর উপজেলা) সংঘটিত হয় ২০শে এপ্রিল। ২৫শে মার্চ কালরাত্রির নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর পূর্ব পাকিস্তানের দিশেহারা মানুষ অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল। তাদের কেউ-কেউ শরণার্থী হয়ে ভারতে যাচ্ছিল। সাতক্ষীরার ওপর দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার জন্য একাধিক বর্ডার ছিল। দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন এলাকার মানুষ এসব বর্ডার দিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরা টাউন হাইস্কুলে যাত্রা বিরতি করত। এজন্য এখানে একটি শরণার্থী শিবির স্থাপন করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ এর স্বেচ্ছাসেবকরা এ শিবির পরিচালনা করত। তাদের দায়িত্ব ছিল শরণার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা এবং তাদের নিরাপদে ভারতে যেতে সাহায্য করা। নিরাপদ আশ্রয় মনে করে এখানে শরণার্থীর সংখ্যা ছিল অন্যান্য শিবিরের তুলনায় অধিক।
১৮ই এপ্রিল পাকবাহিনী অতর্কিতে সাতক্ষীরা শহর দখল করে এবং টাউন হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরের দিন ১৯শে এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা সাতক্ষীরা ন্যাশনাল ব্যাংক অপারেশনের মাধ্যমে পৌনে দুকোটি টাকা নিয়ে গেলে ২০শে এপ্রিল রাতে পাকবাহিনী এ গণহত্যা চালায়। পাকবাহিনী স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করার পর শরণার্থীরা এখান থেকে চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু পাকবাহিনী বাধা দেয়ে। এরপর তারা নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়।
পাকবাহিনীর হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার আগে কিছু লোক বের হয়ে যেতে পেরেছিল। অনেকে ভবনের দোতলায় আশ্রয় নেয়। পাকবাহিনী সেখানে উঠে পৈচাশিক উল্লাসে মেতে ওঠে। তারা আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করা ছাড়াও মায়ের কোল থেকে শিশুদের ছিনিয়ে নিয়ে পাশের পুকুরে ফেলে দেয়।
পাকবাহিনী হত্যা অভিযান শুরু করেছিল স্কুল ভবনের দোতলা থেকে। নিচতলার আতঙ্কিত মানুষের কাছে এ দৃশ্য ছিল মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর! এ কাজে পাকবাহিনীকে সাহায্য করেছিল স্থানীয় রাজাকাররা। তাদের সহায়তায় পরদিন ২১শে এপ্রিল পাকবাহিনী স্কুলের উত্তর পার্শ্বস্থ দীনেশ কর্মকারের বাড়ি থেকে বেশ কয়েকজন শরণার্থীকে ধরে এনে প্রকাশ্যে দা-বটি দিয়ে জবাই করে এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যা করে। এছাড়া তারা স্কুল-সংলগ্ন বাড়িগুলোতে তল্লাসি চালিয়ে আরো কিছু লোককে হত্যা করে এবং তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। এর ফলে টাউন স্কুল ও তৎসংলগ্ন এলাকায় এক নারকীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ট্রাকে করে এখান থেকে নিহতদের কঙ্কালসহ গণত্যার অপরাপর নিদর্শনগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। মাটি খুঁড়ে কঙ্কাল উদ্ধারে সাহায্য করে সুখলাল ডোম ও তার সহযোগীরা। স্থানীয়দের মতে এ গণহত্যায় প্রায় সাড়ে চারশ লোক নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে খুলনা ও যশোর জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীরা ছিল। তবে মনিরামপুর, বটিয়াঘাটা, অভয়নগর, ফুলতলা, পাইকগাছা, ডুমুরিয়া, তেরখাদা, দাকোপ প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষই ছিল বেশি। [মিজানুর রহমান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড