মুক্তিযুদ্ধে সাঘাটা উপজেলা (গাইবান্ধা)
সাঘাটা উপজেলা (গাইবান্ধা) ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর সারা দেশের ন্যায় সাঘাটার মানুষের মনেও সন্দেহ ছিল যে, পাকিস্তান সরকার হয়তো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ তথা বাঙালিদের হাতে শাসন-ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষিত হওয়ায় তাদের সে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ভাষণ থেকে তারা বুঝতে পারে যে, মুক্তিযুদ্ধ আসন্ন। ঐ ভাষণ থেকে তারা সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে মাতৃভূমিকে পাকিস্তানি দখলমুক্ত করার প্রেরণা ও সাহস লাভ করে। ভাষণের পরপর সাঘাটার সর্বস্তরের মানুষ প্রতিরোধযুদ্ধ ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। এসব কর্মকাণ্ডকে সংগঠিত করার জন্য সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।
২৬শে মার্চ সকাল ১০টায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রেডিও পাকিস্তানে প্রচারিত ভাষণে সারা দেশে সামরিক বাহিনীকে একশনের নির্দেশদান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রদ্রোহী ও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তার এ ঘোষণা সাঘাটার লোকজনদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিকে বেগবান করে। তখন বোনারপাড়া ছিল সাঘাটা থানার হেডকোয়ার্টার্স এবং প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা থেকে রেলপথে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার। রেলওয়ে পুলিশের থানাও ছিল এখানে। উত্তরবঙ্গের সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, সান্তাহার ও লালমনিরহাটের ন্যায় বোনারপাড়াও ছিল ব্যাপক অবাঙালি অধ্যুষিত একটি জনপদ। জংশন-স্টেশনের বদৌলতে এখানে রেলওয়ে টেলিফোন ব্যবস্থাও ছিল যথেষ্ট উন্নত। রেলওয়ের কন্ট্রোল ফোনের মাধ্যমে সারা দেশের খবর বোনারপাড়ার মানুষ সঙ্গেসঙ্গে জানতে পারত। এখানকার মানুষ জয়দেবপুর ও রংপুরসহ অন্যান্য স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতার খবর তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারে। তারা খবর সংগ্রহের জন্য সবসময় উৎসুক হয়ে থাকত। বিশেষ করে ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে ঢাকায় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী যে নিমর্ম গণহত্যা চালায়, সে খবর পেয়ে এখানকার মানুষ আরো বেশি ফুঁসে ওঠে।
তৎকালীন গাইবান্ধা মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক আতাউর রহমান, সদস্য মুনসুর রহমান, এবারত আলী মন্ডল, মজিবুর রহমান মণ্ডল প্রমুখের নেতৃত্বে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য প্রাথমিক ব্যবস্থা নেয়া হয়। বোনারপাড়া হাইস্কুল মাঠে সহস্রাধিক ছাত্র-যুবকের প্রশিক্ষণ শিবির চালু হয়। বাঁশের লাঠির পাশাপাশি সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে সাঘাটা থানা ও বোনারপাড়া রেলওয়ে থানা থেকে সংগৃহীত ৩০৩ রাইফেল দিয়ে ছাত্র-যুবকের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আনসার কমান্ডার আফতাব হোসেন দুদু, জিআরপি পুলিশের হাবিলদার ও আনসার বাহিনীর কয়েকজন প্রশিক্ষক। প্রশিক্ষণ শিবিরের পাশাপাশি আফতাব হোসেন দুদুর নেতৃত্বে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসার সদস্যদের সমন্বয়ে ৩০ সদস্যের একটি সশস্ত্র মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়। এ বাহিনীর হাতে সাঘাটা থানা ও জিআরপি থানা থেকে সংগৃহীত রাইফেল তুলে দেয়া হয়। তাঁরা পালাক্রমে বোনারপাড়া হাইস্কুলের পশ্চিম পাশে গাইবান্ধা- বোনারপাড়া সড়কে স্থাপিত ডিফেন্সে দিনরাত পাহারা দিতেন। খাদ্যগুদামের ৩ নম্বর বাসাটি ছিল তাঁদের ক্যাম্প। মুক্তিযুদ্ধের সময় উপর্যুক্ত নেতৃবৃন্দ সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলা নিয়ে ৬নং সেক্টর গঠিত হয়। শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে রংপুর জেলার ব্রহ্মপুত্র নদবেষ্টিত কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা মহকুমাকে ১১নং সেক্টরের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। রোস্তম আলী খন্দকারের নেতৃত্বাধীন রোস্তম কোম্পানি – এ এলাকায় সকল যুদ্ধ পরিচালনা করে। রোস্তম আলী ছিলেন কোম্পানি কমান্ডার এবং গৌতম চন্দ্র মোদক ছিলেন কোম্পানির টুআইসি। এছাড়া শামসুল আলম, নাজিম উদ্দিন, মহসিন আলী, তছলিম উদ্দিন, রফিকুল ইসলাম ও এনামুল হক প্লাটুন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। আব্দুল জলিল তোতা, আবু বক্কর সিদ্দিক ও হামিদুল হক কাদেরী প্লাটুন কমান্ডারের মর্যাদায় সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন।
মাদারগঞ্জ উপজেলার যুদ্ধের পর পাকবাহিনী ১৭ই এপ্রিল গাইবান্ধা শহরে প্রবেশ করে এবং ভিএইড (বর্তমান এটিআই)-এ ক্যাম্প স্থাপন করে। গাইবান্ধা-সাঘাটা রাস্তার বোনারপাড়ায় গর্ত খুঁড়ে ও বড়বড় গাছ ফেলে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বক্ষণিক পাহারা দেয়ার কথা অবাঙালিদের মাধ্যমে গাইবান্ধা আমি ক্যাম্পে পৌঁছে যায়। এ খবর শোনার পর ২৩শে
এপ্রিল ট্যাঙ্ক, কামান ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকবাহিনী বোনারপাড়া অভিমুখে অগ্রসর হয়। ৩০৩ রাইফেল ও লাঠিসোটা দিয়ে তাদের প্রতিরোধ করা যাবে না, বরং এতে অযথা জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হবে– একথা বিবেচনা করে ২৩শে এপ্রিল ভোরবেলা প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রত্যাহার করা হয়৷ তবে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকজন ও সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে গিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
২৩শে এপ্রিল হানাদার বাহিনী ১৮ বাড়ি রেলগেট পার হয়ে বোনারপাড়ার দিকে ৩-৪টি কামানের গোলা ছোড়ে। এরপর বোনারপাড়া প্রবেশ করে তারা প্রথমে অবাঙালি অধ্যুষিত রেলওয়ে স্টেশন, জিআরপি থানা, লোকোসেড ও বিহারি কলোনিতে যায় এবং সেখানকার লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে। পরে খাদ্যগুদামের তালা ভেঙ্গে তাদের মধ্যে চাল ও গম বিতরণ করে। বিকেল ৪টার দিকে তারা বোনারপাড়া ত্যাগ করে। এর বেশ কয়েকদিন পর পুনরায় এসে তারা বোনারপাড়া রেলওয়ে এন এ খান ইনস্টিটিউটে ক্যাম্প স্থাপন করে।
জামায়াতে ইসলামী-র কেন্দ্রীয় নেতা ও গাইবান্ধা জেলা আমীর মওলানা আব্দুল গফুরের চাপে কতিপয় যুবককে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পর তারা সুযোগ বুঝে অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে যায় এবং অনেকে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়।
সাঘাটা থানা সদর বোনারপাড়ার চারপাশে প্রায় সহস্রাধিক বাড়িঘরে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর অবাঙালিরা অগ্নিসংযোগ, হত্যা, নির্যাতন ও লুটতরাজ করে। গাইবান্ধা মহকুমায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিক যুদ্ধ সাঘাটা থানায় সংঘটিত হওয়ায় এখানে পাকবাহিনীর অত্যাচারও ছিল বেশি। ২রা জুন বোনারপাড়ার পার্শ্ববর্তী দলদলিয়া গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী ঢুকে ২৩ জনকে আটক করে নিয়ে যায় এবং ফুলছড়ি থানা ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতনের পর তাদের হত্যা করে। এ ঘটনা ফুলছড়ি গণহত্যা নামে পরিচিত। ১৭ই নভেম্বর পাকবাহিনী ও অবাঙালিরা বোনারপাড়ার পার্শ্ববর্তী শিমুলতাইড় গ্রামের ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্য মজিবর রহমান সরকারের বাড়িসহ কয়েকটি বাড়ি ঘেরাও করে ২০ জনকে আটক করে। ৯ জনকে ছেড়ে দিয়ে ১১ জনকে রেলওয়ে ইনস্টিটিউট বন্দিশিবিরে নিয়ে যায়। সেখানে সারারাত চরম নির্যাতনের পর তাদের লোকোসেড স্টিম ইঞ্জিন ও পাম্প মেশিনের জ্বলন্ত বয়লারে নিক্ষেপ করে হত্যা করে। বোনারপাড়া রেলওয়ে লোকোসেড গণহত্যা ছিল খুবই বীভৎস। বোনারপাড়া এন এ খান রিক্রিয়েশন ক্লাব ও লোকোসেড ছিল পাকবাহিনীর প্রধান নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির।
সাঘাটা উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একাধিক যুদ্ধ হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কয়েকটি সফল অপারেশন পরিচালনা করেন। সেগুলো হলো- সন্যাসদহ রেলব্রিজ যুদ্ধ, সাঘাটা থানা রেইড, কাকড়াগাড়ী রেলব্রিজ যুদ্ধ, ভাঙ্গামোড়ের এম্বুশ, ত্রিমোহিনী ঘাটের যুদ্ধ, দেওয়ানতলা রেলব্রিজ অপারেশন, সিংড়া রেলব্রিজ অপারেশন এবং কুমারগাড়ী রেললাইন অপারেশন। সন্যাসদহ রেলব্রিজ যুদ্ধ সংঘটিত হয় এপ্রিলের শেষে হাবিলদার তছলিমের নেতৃত্বে। বোনারপাড়া-গাইবান্ধা রেলরুটের পদুম শহর ইউনিয়নে এ ব্রিজের অবস্থান। ব্রিজের নিরাপত্তায় ১০ জন রাজাকার নিয়োজিত ছিল। তারা আশপাশের লোকজনদের ওপর নানারকম অত্যাচার করত। তাদের বাড়ি থেকে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, চাল-ডাল ইত্যাদি জোর করে নিয়ে আসত। এলাকার কে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে, কারা আওয়ামী লীগ করে, কাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করেন এসব খবর তারা পাকবাহিনীকে দিত। রাজাকারদের এই অত্যাচার বন্ধ করার উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধারা হাবিলদার তছলিমের নেতৃত্বে ব্রিজটি আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে রাজাকাররা অস্ত্র ফেলে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যায়।
সাঘাটা থানা রেইড হয় দুবার ২০শে জুন ও ২৬শে নভেম্বর। প্রথমবার রেইড হয় রোস্তম আলী খন্দকারের নেতৃত্বে। রোস্তম আলী ভারতের তুরায় উচ্চতর সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২২ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নিয়ে জালালতাইড় গ্রামে আসেন এবং ফলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিরোধব্যূহ স্থাপন করেন। ২০শে জুন তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় ৬০ জন ছাত্র-যুবককে নিয়ে সাঘাটা থানা আক্রমণ করেন। এর জবাবে থানার পুলিশ তিন রাউন্ড গুলি ছুড়ে এক পর্যায়ে ওসিসহ পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা মালখানা ভেঙ্গে শতাধিক ৩০৩ রাইফেল, মাসকিট রাইফেল, পয়েন্ট টু-টু বোর রাইফেলসহ দুশতাধিক দোনলা ও একনলা বন্দুক এবং কয়েক বাক্স গুলি উদ্ধার করে নিয়ে যান। ভারতীয় সেনাবাহিনীর তুরা অঞ্চলের ব্রিগ্রেডিয়ার সানত সিং বাবাজি এ সফল অপারেশনের জন্য রোস্তম আলীর দলকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করেন। পুলিশ পুনরায় থানার নিয়ন্ত্রণ নিলে মুক্তিযোদ্ধারা ২৬শে নভেম্বর দ্বিতীয়বার থানা রেইড করেন। এর আগে গোপন সূত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর আসে যে, সাঘাটা থানায় রাজাকারদের ট্রেনিং- এর জন্য অনেক নতুন রাইফেল আনা হয়েছে। এ খবরের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধারা থানা আক্রমণ করলে ওসিসহ অন্যান্য পুলিশ সদস্য এবার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ঐসব পুলিশ এবং তাদের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্রসমূহ মানকার চর সাবসেক্টর হেডকোয়ার্টার্সে হস্তান্তর করা হয়। কাকড়াগাড়ী রেলব্রিজ যুদ্ধ সংঘটিত হয় রোস্তম আলীর নেতৃত্বে। ব্রিজটি বোনারপাড়া-তিস্তামুখ ঘাট রেলপথের ভরতখালী স্টেশনের উত্তরপার্শ্বে অবস্থিত। ব্রিজটির নিরাপত্তার দায়িত্বে পাকিস্তানি রেঞ্জার পুলিশসহ ২০ জন রাজাকার নিয়োজিত ছিল। পাকিস্তান সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস ছিল সোনালি আঁশখ্যাত পাট। স্থানীয় উল্যা বাজারে বেশ কয়েকটি সরকারি পাটের গুদাম ছিল। গুদামগুলোতে কয়েকশ কাঁচা পাটের বেল বিদেশে রপ্তানির জন্য প্রস্তুত ছিল। পাকিস্তান সরকারের অর্থনীতিকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে পাটের গুদামগুলো ধ্বংস করা রোস্তম আলী কোম্পানির জন্য অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। ঘটনার দিন রোস্তম আলী তাঁর দলকে তিন গ্রুপে ভাগ করে এক গ্রুপকে ব্রিজ আক্রমণ, এক গ্রুপকে ফুলছড়ির রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং অপর গ্রুপকে গুদাম ধ্বংসের দায়িত্ব দেন। ব্রিজে আক্রমণ করার সঙ্গেসঙ্গে রেঞ্জার ও পুলিশদের সঙ্গে পাল্টা গোলাগুলি শুরু হয়। একই সঙ্গে তিস্তামুখ ঘাট থেকে পাকবাহিনী ভরতখালীর উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী গ্রুপ তাদের আক্রমণ করে থামিয়ে দেয়। পাকবাহিনী ভরতখালীর ওপর ট্রেসার বুলেট নিক্ষেপ করে। এর ফলে ভরতখালীর আকাশ আলোকিত হয়ে ওঠে। এই গোলাগুলির মধ্যে বিস্ফোরক দল চারটি পাটের গুদামে আগুন লাগিয়ে ভস্মীভূত করে দেয়।
ভাঙ্গামোড়ের এম্বুশ করা হয় ১৭ই সেপ্টেম্বর শেষরাতে রোস্তম আলীর নেতৃত্বে। এতে মেজর শের খান ও অপর এক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। ত্রিমোহিনী ঘাটের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২৪শে অক্টোবর। এ-যুদ্ধে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ২৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। দেওয়ানতলা রেলব্রিজ অপারেশন পরিচালিত হয় ২রা নভেম্বর কোম্পানি কমান্ডার মোকলেছুর রহমান দুলু ও কোম্পানি কমান্ডার রোস্তম আলী খন্দকারের নেতৃত্বে। বোনারপাড়া-সান্তাহার রেলপথের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ ব্রিজটি রাজধানী ঢাকা হয়ে রংপুর অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ অঞ্চলের যোগাযোগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই কয়েকজন রাজাকার এর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করত। কিন্তু ব্রিজটি ধ্বংস করা গেলে শিল্পশহর বগুড়ার সঙ্গে উত্তরবঙ্গ ও ঢাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, ফলে হানাদারদের গতিবিধি সীমিত হয়ে পড়বে। এ কারণেই মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজটি ধ্বংস করে দেন। সিংড়া রেলব্রিজ অপারেশন পরিচালিত হয় ৬ই নভেম্বর রোস্তম আলী খন্দকারের নেতৃত্বে। এ ব্রিজটির নিরাপত্তার দায়িত্বে ২০ জন রাজাকার নিয়োজিত ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজ আক্রমণ করলে ১৭ জন রাজাকার নিহত হয় এবং ৩ জন পালিয়ে যায়। ২০টি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। কুমারগাড়ী রেললাইন অপারেশনও পরিচালিত হয় রোস্তম আলী খন্দকারের নেতৃত্বে। তিস্তামুখ ঘাট থেকে পাকবাহিনীর অস্ত্র ও গোলাবারুদ বোঝাই একটি বিশেষ ট্রেন রংপুর যাওয়ার সংবাদ পেয়ে রোস্তম বাহিনী ঐ লাইনে এন্টিট্যাংক মাইন পুঁতে রাখে। বিশেষ ট্রেনটি আসার পূর্বে ভরতখালী থেকে একটি মালবাহী ট্রেন এলে মাইনের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে ইঞ্জিনসহ ৫টি বগি ও রেললাইন দুমড়ে-মুচড়ে ছিটকে পড়ে। ফলে দুদিন এ রুটে রেল চলাচল বন্ধ ছিল। এরপর পাকবাহিনীর রংপুর বিগ্রেড সদর থেকে ব্রিগ্রেডের অধীনস্থ সকল এলাকায় চলাচলকারী প্রতিটি যাত্রীবাহী, মালবাহী বা বিশেষ ট্রেনের ইঞ্জিনের সম্মুখে তিনটি করে বালুভর্তি আনকভার্ড ভ্যান সংযোজন করার সার্কুলার জারি করা হয়। ৮ই ডিসেম্বর সাঘাটা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
সাঘাটা উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নাজিম উদ্দিন (পিতা ইয়াকুব আলী, হাসিলকান্দি), আনসার আলী (পিতা আব্দুল মজিদ প্রধান, থৈকরেরপাড়া, জুমারবাড়ী), আব্দুল হাই সর্দার (পিতা আব্দুল বাকী সর্দার, শ্যামপুর, মুক্তিনগর), মোবারক আলী (পিতা হোসেন আলী, মান্দুরা, ভরতখালী), আব্দুস সোবহান (পিতা ইয়াসিন আলী, আমদিরপাড়া, জুমারবাড়ী), ওসমান গনি (পিতা বাহাদুর শেখ, মামুদপুর, জুমারবাড়ী), আফজাল হোসেন (পিতা আব্দুল করিম, গরাবেড়া, হলদিয়া), মজিবর রহমান (পিতা নছির আলী, রামনগর, কচুয়া), হবিবর রহমান (পিতা নছির আলী, রামনগর, কচুয়া), কাবেজ আলী (পিতা কোমর উদ্দিন, কালপানি, বোনারপাড়া), মছির আলী (পিতা আব্দুল গনি মণ্ডল, শিমুলতাইড়, বোনারপাড়া) এবং আব্দুস সাত্তার (পিতা ফইম উদ্দিন, সাঘাটা)।
সাঘাটা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ৪ঠা ডিসেম্বর ফুলছড়ি থানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই কয়েকজন রাজাকার এর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করত। কিন্তু ব্রিজটি ধ্বংস করা গেলে শিল্পশহর বগুড়ার সঙ্গে উত্তরবঙ্গ ও ঢাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, ফলে হানাদারদের গতিবিধি সীমিত হয়ে পড়বে। এ কারণেই মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজটি ধ্বংস করে দেন। সিংড়া রেলব্রিজ অপারেশন পরিচালিত হয় ৬ই নভেম্বর রোস্তম আলী খন্দকারের নেতৃত্বে। এ ব্রিজটির নিরাপত্তার দায়িত্বে ২০ জন রাজাকার নিয়োজিত ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজ আক্রমণ করলে ১৭ জন রাজাকার নিহত হয় এবং ৩ জন পালিয়ে যায়। ২০টি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। কুমারগাড়ী রেললাইন অপারেশনও পরিচালিত হয় রোস্তম আলী খন্দকারের নেতৃত্বে। তিস্তামুখ ঘাট থেকে পাকবাহিনীর অস্ত্র ও গোলাবারুদ বোঝাই একটি বিশেষ ট্রেন রংপুর যাওয়ার সংবাদ পেয়ে রোস্তম বাহিনী ঐ লাইনে এন্টিট্যাংক মাইন পুঁতে রাখে। বিশেষ ট্রেনটি আসার পূর্বে ভরতখালী থেকে একটি মালবাহী ট্রেন এলে মাইনের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে ইঞ্জিনসহ ৫টি বগি ও রেললাইন দুমড়ে-মুচড়ে ছিটকে পড়ে। ফলে দুদিন এ রুটে রেল চলাচল বন্ধ ছিল। এরপর পাকবাহিনীর রংপুর বিগ্রেড সদর থেকে ব্রিগ্রেডের অধীনস্থ সকল এলাকায় চলাচলকারী প্রতিটি যাত্রীবাহী, মালবাহী বা বিশেষ ট্রেনের ইঞ্জিনের সম্মুখে তিনটি করে বালুভর্তি আনকভার্ড ভ্যান সংযোজন করার সার্কুলার জারি করা হয়। ৮ই ডিসেম্বর সাঘাটা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
সাঘাটা উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নাজিম উদ্দিন (পিতা ইয়াকুব আলী, হাসিলকান্দি), আনসার আলী (পিতা আব্দুল মজিদ প্রধান, থৈকরেরপাড়া, জুমারবাড়ী), আব্দুল হাই সর্দার (পিতা আব্দুল বাকী সর্দার, শ্যামপুর, মুক্তিনগর), মোবারক আলী (পিতা হোসেন আলী, মান্দুরা, ভরতখালী), আব্দুস সোবহান (পিতা ইয়াসিন আলী, আমদিরপাড়া, জুমারবাড়ী), ওসমান গনি (পিতা বাহাদুর শেখ, মামুদপুর, জুমারবাড়ী), আফজাল হোসেন (পিতা আব্দুল করিম, গরাবেড়া, হলদিয়া), মজিবর রহমান (পিতা নছির আলী, রামনগর, কচুয়া), হবিবর রহমান (পিতা নছির আলী, রামনগর, কচুয়া), কাবেজ আলী (পিতা কোমর উদ্দিন, কালপানি, বোনারপাড়া), মছির আলী (পিতা আব্দুল গনি মণ্ডল, শিমুলতাইড়, বোনারপাড়া) এবং আব্দুস সাত্তার (পিতা ফইম উদ্দিন, সাঘাটা)।
সাঘাটা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ৪ঠা ডিসেম্বর ফুলছড়ি থানা হানাদারমুক্ত করার যুদ্ধে শাহাদতবরণকারী ৫ জন মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ সাঘাটা উপজেলার সগুনা (বর্তমান মুক্তিনগর) ইউনিয়নের ধনারুহা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে কবরস্থ করা হয়। দেশ স্বাধীনের পর কোম্পানি কমান্ডার রোস্তম আলী খন্দকার ৫টি কবর পাকা ও পাশে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। ২০১৩ সালে এলজিইডি-র অর্থায়নে কবরের পাশে একটি দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিস্তম্ভ ও পাঠাগার নির্মিত হয়। উল্লেখ্য যে, ৫ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর থাকায় সগুনা ইউনিয়নের নাম পরিবর্তন করে ‘মুক্তিনগর ইউনিয়ন’ রাখা হয়। এছাড়া সাঘাটা উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের সামনে পুরাতন শহীদ মিনারের স্থলে স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবক্ষ ভাস্কর্যসহ ‘অনিরুদ্ধ’ নামে একটি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। সাঘাটা উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের সামনে শহীদ মিনারের পাশে ক্ষুদ্র আকারে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। তাতে ত্রিমোহিনী ঘাটের যুদ্ধে শহীদ ১২ জন ও ফুলছড়ি থানা মুক্ত করার যুদ্ধে শহীদ ৫ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম লিপিবদ্ধ আছে। বোনারপাড়া ইউনিয়নের দলদলিয়ায় ত্রিমোহিনী ঘাটের যুদ্ধে শহীদ ১২ জন মুক্তিযোদ্ধার কবরের পাশে ১২ স্তম্ভবিশিষ্ট স্মৃতি অম্লান- নামক একটি সৌধ নির্মিত হয়েছে। [গৌতম চন্দ্ৰ মোদক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড