শ্রীরামসি গণহত্যা (জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ)
শ্রীরামসি গণহত্যা (জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ) সংঘটিত হয় ৩১শে আগস্ট। এতে রাজাকারদের সহযোগিতায় শতাধিক মানুষ পাকহানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যার শিকার হন। তন্মধ্যে ৩৮ জনের নাম পাওয়া গেছে। হানাদাররা শ্রীরামসি বাজারের দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করে এবং বেশ কয়েকজন নারীকে ধরে নিয়ে যায়।
সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার পূর্বপ্রান্তে শ্রীরামসি গ্রাম অবস্থিত। এ গ্রামের মধ্যস্থলে একটি পুরাতন বাজার, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পোস্ট অফিস, তহসিল অফিস ”ইত্যাদি থাকার কারণে গ্রামটির পরিচিতি রয়েছে। বিশ্বনাথ থেকে একটি খাল শ্রীরামসি গ্রামের ভেতর দিয়ে জগন্নাথপুর পর্যন্ত বয়ে গেছে। কাজেই ভৌগোলিক দিক দিয়ে শ্রীরামসি গ্রামের গুরুত্ব রয়েছে। এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ আওয়ামী লীগ-এর সমর্থক হওয়ায় সামরিক অভিযানের সূচনা থেকেই পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকাররা এ গ্রামটি আক্রমণের নীল নকশা এঁকেছিল। তাদের আঁকা সেই নীল নকশা বাস্তবায়নের জন্য ২৯শে আগস্ট চিলাউড়া গ্রামের রাজাকার আব্দুল ওয়াতির ও মছলম উল্যাহ শ্রীরামসি গ্রামে এসে আকর্ষণীয় বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে যুবকদের রাজাকার বাহিনীতে যোগদানের আহ্বান জানায়। কিন্তু গ্রামের মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ তাদের আহ্বান ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে এবং ঐ দুই রাজাকারকে তাড়িয়ে দেয়। এ-সময় তারা পাকবাহিনীর ভয় দেখিয়ে গ্রামবাসীকে শাসিয়ে চলে যায়। এতে গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেকেই গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। ৩১শে আগস্ট সকালে কয়েকটি নৌকাযোগে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা শ্রীরামসিতে নেমে পুরো গ্রামটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। গ্রামবাসীদের শ্রীরামসি হাইস্কুল মাঠে শান্তি কমিটির সভায় যোগদানের কথা বলে ধরে নিয়ে আসে। তারপর তাদের মধ্য থেকে যুবক ও বয়স্কদের আলাদা করে স্কুলের দুটি কক্ষে আটকে বেঁধে ফেলে। সেখানে তাদের ওপর নির্যাতনের পর যুবকদের নৌকাযোগে শ্রীরামসির রহিম উল্যাহর বাড়িতে এবং বয়স্কদের নজির মিয়ার বাড়ির পুকুর পাড়ে নিয়ে যায়। তারপর তাদের সবাইকে হাত বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি চালায়। এ-সময় রহিম উল্যাহর বাড়িতে লাইনে দাঁড়ানো পাঁচজন পাকবাহিনীর সমর্থক দাবি করে গ্রাণভিক্ষা চায়। স্থানীয় এক রাজাকার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে তাদের পাঁচ জনকে ছেড়ে দেয়ার সুপারিশ করলে শ্রীরামসি বাজার আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার শর্তে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। পরে তারা গ্রাম থেকে পালিয়ে যায়। এদিন পালিয়ে বেঁচে যান শ্রীরামসি গ্রামের হুসিয়ার আলী, ডা. আবদুল লতিফ, জওয়াহিদ চৌধুরী প্রমুখ।
এদিনের গণহত্যায় শহীদদের মধ্যে যাদের নাম পাওয়া গেছে, তারা হলেন- ছাদ উদ্দিন আহমদ (শ্রীরামসি হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক), মওলানা আবদুল হাই (শ্রীরামসি হাইস্কুলের হেড মওলানা), সত্যেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী (তহসিলদার), এহিয়া চৌধুরী (তহসিলদার), সৈয়দ আশরাফ হোসেন (পোস্ট মাস্টার), আবদুল বারী (মীরপুর ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বার), ফিরোজ মিয়া (কাদিপুর), এখলাসুর রহমান (দিঘীরপাড়), সামছু মিয়া (সাতহাল), আবদুল লতিফ (সাতহাল), ওয়ারিছ মিয়া (সাতহাল), আলী মিয়া (সাতহাল), ছুয়ার মিয়া (সাতহাল), আবদুল লতিফ-২ (সাতহাল), রইছ উল্যাহ (সাতহাল), মানিক মিয়া (সাতহাল), দবির মিয়া (আব্দুল্লাহপুর), মরম উল্যাহ (গদাভাট), মমতাজ আলী (রসুলপুর), আবদুল মজিদ (রসুলপুর), নজির মিয়া (রসুলপুর), সুনু মিয়া (রসুলপুর), ডা. আবদুল মান্নান (শ্রীরামসি বাজার), ছামির আলী (পশ্চিম শ্রীরামসি), রুপু মিয়া (শ্রীরামসি), আছাব মিয়া (শ্রীরামসি), রুস্তম আলী (শ্রীরামসি), তৈয়ব আলী (শ্রীরামসি), রোয়াব আলী (শ্রীরামসি), তোফাজ্জল আলী (শ্রীরামসি), মছদ্দর আলী (শ্রীরামসি), আবদুল মান্নান (হাবিবপুর), নূর মিয়া, জহুর আলী, শফিকুর রহমান, সমুজ মিয়া, বাক্কু মিয়া ও মোক্তার মিয়া। এদিন পাকবাহিনীর গুলিবর্ষণের সময় কয়েকজন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তাদের মৃত ভেবে হানাদাররা চলে যায়। তারা হলো- আবদুল লতিফ (শ্রীরামসি পোস্ট অফিসের নৈশ প্রহরী), জোয়াহির চৌধুরী (গদাভাট), ছকিল উদ্দিন (দিঘীরপাড়), তপন চক্রবর্তী (নিহত তহসিলদার সত্যেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর আত্মীয়), আমজাদ আলী, ইলিয়াছ আলী, এলকাছ আলী ও সুন্দর আলী।
এ গণহত্যায় পাকবাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে কুখ্যাত রাজাকার আহমদ আলী (হাবিবপুর), আছাব আলী (হাবিবপুর) ও জানু মিয়া (খাদিমপুর, বালাগঞ্জ)। তারা শ্রীরামসি বাজারটি লুণ্ঠন শেষে বাজারের দোকানগুলোতে কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। লুটপাটের পর শ্রীরামসি গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে। বেশ কয়েকজন নারীকে তারা নৌকায় তুলে নিয়ে যায়। ঐসব নারীদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এক বিরানভূমিতে পরিণত হয় ঐতিহ্যবাহী শ্রীরামসি গ্রাম।
গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু খালেদ চৌধুরীর সহযোগিতায় একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। শ্রীরামসি গ্রামের রহিমউল্যার বাড়িতে যেখানে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, সে বাড়িটিতে (বর্তমানে বিশ্বনাথ উপজেলার অন্তর্গত) সিরাজ উদ্দিন মাস্টারের নকশায় একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। নজির মিয়ার বড়িতে সংঘটিত গণহত্যার স্থানটি দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। [শফিউদ্দিন তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড