বীর প্রতীক সদর উদ্দিন
সদর উদ্দিন, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৪১) বীর মুক্তিযোদ্ধা, ৬নং সেক্টরের অধীন ভজনপুর সাব-সেক্টর কমান্ডার, স্কোয়াড্রন লিডার, পরবর্তীতে এয়ার ভাইস মার্শাল ও বিমান বাহিনীর প্রধান। তিনি ১৯৪১ সালের ১লা জুলাই নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার বাইরপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সাদাত হোসেন ও মাতার নাম সৈয়দা আবেদা আক্তার। তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়ে প্রশিক্ষণ শেষে কমিশনপ্রাপ্ত হন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি ঢাকা এয়ার বেসে স্কোয়াড্রন লিডার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-এর বিজয় ও সে ফলাফল নস্যাৎ করতে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার নানা অপতৎপরতা তাঁকে অন্যান্য বাঙালি সৈনিকদের মতো ভীষণভাবে বিক্ষুব্ধ করে। মার্চের অসহযোগ আন্দোলন-এ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রতি তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে আসছিলেন। অপরদিকে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একজন দেশপ্রেমিক বাঙালি সৈনিকের করণীয় সম্বন্ধে তিনি সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা লাভ করেন। ২৫শে মার্চ অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকহানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর হত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়লে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। ১৫ই মে আরো কয়েকজন এয়ার ফোর্সের বাঙালি অফিসারসহ তিনি ভারতের সীমান্তবর্তী সোনামুড়া বিএসএফ ক্যাম্পে গিয়ে পৌঁছান। তখন পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠিত না হওয়ায় কর্নেল ওসমানীর নির্দেশক্রমে তাঁকে স্কোয়াড্রন লিডার এম কে বাশারের নেতৃত্বাধীন ৬নং সেক্টরে স্থলযুদ্ধে নিয়োজিত করা হয়। প্রথমে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ইনডাকশন ট্রেনিং দিয়ে বিভিন্ন অপারেশনে পাঠানোর দায়িত্ব পালন করেন। এর কিছুকাল পর তাঁকে ৬নং সেক্টরের ভজনপুর সাব-সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এ সাব-সেক্টরের অমরখানা ও বড়খাতায় পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে তিনি তাদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন শেষে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেন। অমরখানার নিকটবর্তী জগদল হাটে ছিল পাকবাহিনীর একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ঘাঁটি। এখানে বিএসএফ-এর সহায়তায় একাধিকবার মুক্তিযোদ্ধারা পাকহানাদারদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেন। ঐসব আক্রমণে সদর উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বাহিনী অংশগ্রহণ করে। অমরখানা ও বড়খাতা দখলে নেয়ার পর সদর উদ্দিন তাঁর বাহিনী নিয়ে পঞ্চগড়, বোদা ইত্যাদি দখল করে ঠাকুরগাঁও-এর দিকে অগ্রসর হন। শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধের পাশাপাশি এম্বুশ, রেইড ও অন্যান্য গেরিলা অপারেশনের কৌশল অবলম্বন করে তাঁর বাহিনী পাকহানাদারদের বিপর্যস্ত করে তুলতে সক্ষম হন। ১২ই ডিসেম্বরের মধ্যে একমাত্র রংপুর ও সৈয়দপুর সেনানীবাস ছাড়া ৬ নম্বর সেক্টরের অধিকাংশ এলাকা হানাদারমুক্ত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বীর মুক্তিযোদ্ধা সদর উদ্দিনকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতাপরবর্তীকালে ১৯৭৮ সালে তিনি এয়ার ভাইস মার্শাল পদে উন্নীত হন। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম নাসরিন জাহান বানু। [শেখ সাইয়েদুল ইসলাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড