শ্রীনগর থানাযুদ্ধ (মুন্সীগঞ্জ)
শ্রীনগর থানাযুদ্ধ (মুন্সীগঞ্জ) সংঘটিত হয় ১৭ই নভেম্বর। ২৫শে অক্টোবর কামারখোলা যুদ্ধএ এবং ২৬শে অক্টোবর গোয়ালীমাদ্ৰা যুদ্ধএ মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রচণ্ড মার খায়। এরপর পাকিস্তানি সৈন্য (পাঞ্জাবি ও পাঠান), ইপিআর, পুলিশ ও রাজাকার মিলে ৬০ জন শ্রীনগর ডাকবাংলো ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। কিন্তু লৌহজং বা মুন্সীগঞ্জ থেকে তাদের বেতন ও রসদ না আসায় ১৭ই নভেম্বর ১০-১১টি কেরায়া নৌকায় করে ৬০ জন সৈন্য ও রাজাকার লৌহজং হয়ে মুন্সীঞ্জের উদ্দেশে রওনা দেয়। ঐদিন ছিল শ্রীনগরের হাট। শ্রীনগর থেকে দুমাইল দক্ষিণে যাওয়ার পরই মুক্তিবাহিনী তাদের ওপর আক্রমণ করে। ফলে উভয় পক্ষে যুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের কয়েকজনকে হত্যা করে এবং তাদের নৌকার দ্রব্যাদি ও অনেক অস্ত্র দখল করে নেন। পাকবাহিনীর কিছু সদস্য কোনোরকমে জীবন নিয়ে শ্রীনগরে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। শ্রীনগর তখন অরক্ষিত। এখানে উপস্থিত একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খান দুর্জয় সাহসের সঙ্গে তাদের মোকাবেলা করেন এবং থ্রিনটথ্রি রাইফেল চালিয়ে দুজন পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করে খালের পানিতে ভাসিয়ে দেন। তিনি নিহত সৈন্যদের নৌকা থেকে ওয়ারলেস সেট ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি দখল করে নেন। এরপর তিনি আটককৃত কয়েকজন রাজাকারকে নিয়ে নিজবাড়িতে চলে আসেন। এদিকে কয়েকজন পাঞ্জাবি সৈন্য ও রাজাকার শ্রীনগরে আশ্রয় নিতে আসে। তাদের সঙ্গে আরো কয়েকজন পাঞ্জাবি সৈন্য যোগ দেয় এবং চারদিকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। ততক্ষণে শ্রীনগরের হাট ভেঙ্গে গেছে। হাটুরিয়াদের অনেকে চলে গেছে এবং অনেকে পরিস্থিতি দেখার জন্য নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। এক পর্যায়ে জনসাধারণ যখন বুঝতে পারে যে, পাকসেনাদের গুলি ফুরিয়ে গেছে, তখন তারা লাঠি বৈঠা ও লগ্নি (চড়ৈ) নিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ৫ জনকে হত্যা করে খালের পানিতে ফেলে দেয়। এর কিছুক্ষণ পূর্বে পলায়নরত একজন রাজাকারকে উন্মত্ত জনতা গাছের সঙ্গে আছড়ে হত্যা করে। গ্রামের মধ্যে পলাতক অপর এক রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে আনেন। তাকেও গ্রামের লোকেরা মেরে ফেলে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে চারদিক থেকে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা রাইফেল নিয়ে শ্রীনগরে চলে আসেন। এ-সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণস্থল থেকে পালিয়ে চারদিকে দৌড়াতে থাকে। অনেকে শ্রীনগর থানা ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা তাদের লক্ষ্য করে পিছে-পিছে দৌড়াতে থাকেন। পাকসেনারা তাঁদের দেখে আরো দ্রুত গতিতে দৌড়াতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা দৌড়াতে-দৌড়াতে গুলি ছুড়ে তাদের অনেককে হত্যা করেন। চারদিক ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। আশপাশের গ্রামের লোকজন আনন্দে ফেটে পড়ে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতে-দিতে শ্রীনগরে চলে আসে। অনেক রাত পর্যন্ত কার্দমাক্ত মাঠের ভেতর দিয়ে মুক্তিবাহিনী ও জনগণ দৌড়াতে দৌড়াতে অবশিষ্ট পলায়নরত পাকসেনাদের হত্যা করে। পাকিস্তানি সৈন্যদের কেউ-কেউ রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে গৃহস্থ বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু পরের দিন তারা মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং নিহত হয়। এভাবে শ্রীনগরের জনগণ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী হাতের বৈঠা, লগ্নি ও লাঠি নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারদের মোকাবেলা করে এবং শ্রীনগরকে শত্রুমুক্ত করার সংগ্রামে অংশ নেয়। ১৯শে নভেম্বর শ্রীনগর উপজেলা শত্রুমুক্ত হয়। শ্রীনগর মুক্ত করার যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন কমান্ডার আতিউল্লাহ খান মাসুদ, কমান্ডার মোহাম্মদ সোলায়মান ও কমান্ডার আবদুশ শহীদ ভূঁইয়া। [মো. জয়নাল আবেদীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড