You dont have javascript enabled! Please enable it! শোলগাতিয়া বধ্যভূমি (ডুমুরিয়া, খুলনা) - সংগ্রামের নোটবুক

শোলগাতিয়া বধ্যভূমি (ডুমুরিয়া, খুলনা)

শোলগাতিয়া বধ্যভূমি (ডুমুরিয়া, খুলনা) খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার রুদাঘরা ইউনিয়নে অবস্থিত। এখানে জুন থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়। ডুমুরিয়া সদর থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থিত শোলগাতিয়ার দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার। শোলগাতিয়ার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ভদ্রা নদী। নদীর পশ্চিম তীরে যশোর জেলার কেশবপুর থানার আগড়হাটি ও ভরত ভায়না গ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় শোলগাতিয়া সংলগ্ন ভদ্রা নদীতে একটি খেয়া ছিল। এখান থেকে কিছুটা উত্তর দিকে পঞ্চানন তলা নামক একটি বৃহৎ শ্মশান রয়েছে। স্থানীয়ভাবে এটি পঞ্চানন তলা মহাশ্মশান নামে পরিচিত। এ শ্মশান-সংলগ্ন স্থানে পাকসেনা ও রাজাকাররা বহু মানুষকে হত্যা করে। রুদাঘরা ইউনিয়নের রাজাকার কমান্ডার রমজান, মতিন, ইমরান গাজি প্রমুখের নেতৃত্বে এখানে হত্যাকাণ্ড চলত। পার্শ্ববর্তী ধামালিয়া ইউনিয়নের রাজাকার নওশের বিশ্বাস এবং খর্নিয়া ইউনিয়নের রাজাকার বাচ্চু খাঁ-ও মাঝে-মাঝে রুদাঘরার রাজাকারদের সঙ্গে যোগ দিয়ে সাধারণ মানুষদের নির্যাতন ও হত্যা করত।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ডুমুরিয়ায় রাজাকারদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অভিযান পরিচালনা করেছিল মজিদ বাহিনী। জুলাই মাসের প্রথমার্ধে রুদাঘরার রাজাকার ক্যাম্পে মজিদ বাহিনীর পরিচালিত আক্রমণে রাজাকার ও শান্তি কমিটির ১৭ জন মারা যায়। এর প্রতিশোধ নিতে রাজাকাররা স্থানীয় স্বাধীনতাকামী মানুষদের হত্যা করতে শুরু করে। প্রথমে তারা রুদাঘরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল কাদের মোড়লকে হত্যা করে। রুদাঘরা ইউনিয়ন পরিষদের সামনে তাঁকে গুলি করা হয়। এরপর তাঁর পুত্র আবদুর রাজ্জাক মোড়লকে তারা হত্যা করে। রাজ্জাকের বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। এরপর ১৪ই জুলাই রুদাঘরা ও ধামালিয়া ইউনিয়নের রাজাকাররা বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে ধরে এনে শোলগাতিয়ার পঞ্চানন তলায় হত্যা করে।
পঞ্চানন তলায় তারা রুদাঘরা ইউনিয়নের মিকশিমিল গ্রামের অধিবাসী পঞ্চানন বসুকে হত্যা করে। মিকশিমিল বাজারে তাঁর একটি দোকান ছিল। এলাকার সম্পদশালী ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে তাঁর বিশেষ পরিচিতি ছিল। রুদাঘরা ইউনিয়নে রাজাকারদের শক্তিশালী অবস্থান থাকায় অত্যাচার ও নির্যাতন ছিল এখানকার নিত্যদিনের ঘটনা। এ কারণে মে মাসের শেষদিকে পঞ্চানন বসু সপরিবার ভারতে যাচ্ছিলেন। তাঁর দেশত্যাগের খবর পেয়ে মিকশিমিল বাজারের ইজারাদার হাজের আলী সরদার তাঁকে অভয় দিয়ে ফিরিয়ে আনেন। জুন মাসে মিকশিমিল বাজারের উত্তর দিকে মতলেব ডাক্তারের বাড়ির দোতলায় রাজাকার ক্যাম্প স্থাপিত হয়। ১৪ই জুলাই সকালে এ ক্যাম্পের রাজাকার মোফাজ্জেল গাজি বাড়ি থেকে পঞ্চানন বসুকে ডেকে নিয়ে যায়। বাড়ি থেকে কিছুদূর গিয়ে পঞ্চানন বসু বুঝতে পারেন, তাঁকে হত্যা করা হবে। খবর পেয়ে পঞ্চানন বসুর স্ত্রী ও জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজাকার মোফাজ্জেলের পায়ে ধরে তাঁর জীবন রক্ষার মিনতি জানান। কিন্তু রাইফেল তাক করে ভয় দেখিয়ে তাদের সরিয়ে দেয়া হয়। এর কিছুক্ষণ পর অল্প দূরের একটি জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পঞ্চানন বসুর ছেলেরা তাঁর মৃতদেহ নিয়ে পঞ্চানন তলা শ্মশানে মুখাগ্নি করে নদীতে ফেলে দেন। তখন শ্মশানের চারপাশে পিঠে হাতবাঁধা অনেক লাশ ছিল। ১৪ই জুলাইয়ের পর বিভিন্ন সময়ে এখানে আরো অনেককে হত্যা করা হয়।
শোলগাতিয়া বধ্যভূমিতে নিহতদের মধ্যে ২৭ জনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন- দেলোয়ার হোসেন তোতা (পিতা গোলাজার আহমেদ বিশ্বাস, ধামালিয়া), গোলাজার আহমেদ বিশ্বাস (পিতা জাফর আলী বিশ্বাস, ধামালিয়া), ফজর আলী সরদার (পিতা বাবর আলী, আন্দুলিয়া), মকবুল হোসেন সরদার (পিতা ফজর আলী, আন্দুলিয়া), ইউসুফ আলী সরদার (পিতা বাবর আলী সরদার, আন্দুলিয়া), পঞ্চানন বসু (পিতা জিতেন্দ্রনাথ বসু, মিকশিমিল), জ্যোতিন সাধু খাঁ (পিতা রাজেন্দ্র সাধু খাঁ, খরসঙ্গ), নজরুল সরদার (পিতা আকতার সরদার, খরসঙ্গ), রতন কুমার ধোপা (পিতা রজনীকান্ত ধোপা, রুদাঘরা), শুকুর সরদার (পিতা নেওয়াজ আলী সরদার, হাসানপুর), কেরামত আলী সরদার (পিতা ইউসুফ আলী সরদার, হাসানপুর), কালীদাসী পাটনি (পিতা পূর্ণচন্দ্র পাটনি), আবদুর রাজ্জাক খান (পিতা আবু জাফর খান, রুদাঘরা), আবু জাফর খান (পিতা কফিলউদ্দিন খান, রুদাঘরা), হাসান আলী ফকির (পিতা এবাদ আলী ফকির, রুদাঘরা, ডুমুরিয়া), হোসেন আলী ফকির (পিতা ইমরান ফকির, রুদাঘরা), আমজাদ আলী ফকির (রুদাঘরা), মনসুর আলী ফকির (রুদাঘরা), আজিজ আলী ফকির (রুদাঘরা), যশোর আলী শেখ (পিতা অমেদ আলী শেখ, রুদাঘরা), ইব্রাহিম মোল্লা (পিতা মোজাম মোল্লা, হাসানপুর), এনছার সরদার (পিতা সোনাই সরদার, হাসানপুর), আশকার সরদার (হাসানপুর), শের আলী গাজী (পিতা সাহেব আলী গাজী, হাসানপুর), আবদুল কাদের মোড়ল (পিতা হাকিম মোড়ল, হাসানপুর), আবদুর রাজ্জাক মোড়ল (পিতা আবদুল কাদের মোড়ল, হাসানপুর) ও নিমাই পোদ্দার (হাসানপুর)। [দিব্যদ্যুতি সরকার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড