You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে শ্যামনগর উপজেলা (সাতক্ষীরা) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে শ্যামনগর উপজেলা (সাতক্ষীরা)

শ্যামনগর উপজেলা (সাতক্ষীরা) বাংলাদেশের দক্ষিণে দেশের সর্ববৃহৎ উপজেলা। এখানকার রাজনৈতিক ঐতিহ্য বেশ পুরনো। এ উপজেলার জনগণ বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত সকল আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে খুলনার জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সবকটি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। এর ফলে সারা দেশের মতো শ্যামনগর উপজেলার জনগণও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকচক্রের ষড়যন্ত্রে তাদের সে স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। তারা বুঝতে পারে যে, নতুন করে সংগ্রাম ছাড়া তাদের স্বপ্নপূরণ সম্ভব নয়। তাই সেই সংগ্রামের জন্য তারা তৈরি হতে থাকে।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হঠাৎ করে ১লা মার্চ অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে ২রা মার্চ সারাদেশে হরতাল পালিত হয় এবং বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। শ্যামনগর থানায়ও এ কর্মসূচি পালিত হতে থাকে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এর আহ্বায়ক ছিলেন এস এম গোলাম মোস্তফা এবং সদস্য ছিলেন এস এম লিয়াকত আলী, নজরুল ইসলাম, আজিজ মীর, সামছুর রহমান, অচিন্ত্য কুমার দে, শেখ হারুন-অর-রশীদ প্রমুখ।
২রা মার্চের হরতালের মধ্য দিয়ে শ্যামনগর থানায় মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়। পাকিস্তানি শাসকদের একতরফা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ৬ই মার্চ নকিপুর শহীদ মিনারে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় এলাকার বড় হাটগুলোতে হাটবারে সভা করে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে অনুযায়ী ৮ই মার্চ ঈশ্বরীপুর, ৯ই মার্চ নওয়াবেঁকী এবং ১২ই মার্চ হরিনগরে সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৫ই মার্চ ঈশ্বরীপুরে অনুষ্ঠিত হয় বিশাল জনসভা।
২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের পর সারা দেশের মতো শ্যামনগরেও প্রতিবাদের আগুন জ্বলে ওঠে। বাংলার দামাল ছেলেরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য সংগঠিত হতে থাকে। এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গের বশিরহাটের জামরুলতলায় বদ্দি ময়রার দোকানের দোতলায় শ্যামনগর থানার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্প খোলা হয়। এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন এ কে ফজলুল হক, শেখ আতিয়ার রহমান, বিশ্বনাথ দাস প্রমুখ এডভোকেট নুরুল হক গাইন, শেখ হারুন-অর-রশীদ, মাখনলাল চট্টোপাধ্যায়, অনিমেষ ব্যানার্জী, এস এম আব্দুস শুকুর সরদার, ডা. আব্দুল জলিল, খাজা নাজিমুদ্দিন, আব্দুল লতিফ, হাসেম, বারেক, এন্তাজ, হাবিল, মজিদ, ডি এম ইব্রাহিম খলিল প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা এখান থেকে তফিপুর, চাকুলিয়া, পলাশী, দেরাদুন প্রভৃতি ক্যাম্পে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন।
শ্যামনগর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন— শেখ আতিয়ায় রহমান, ফজলুল হক, বিশ্বনাথ দাস, শেখ হারুন-অর-রশীদ, অনিমেষ ব্যানার্জী, আব্দুল জলিল, এস এম আব্দুস শুকুর সরদার, এস এম মিজানুর রহমান, ডি এম ইব্রাহিম খলিল, এম এ মজিদ, দেবী রঞ্জন মণ্ডল, গফুর মোল্লা, জি এম আব্দুল হক, ডা. এস এম আবু হাফিজ গাজী প্রমুখ। শ্যামনগর উপজেলায় নবাব্দী বাহিনী – নামে একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী ছিল। হরিনগরের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা নবাব্দী ফকির একক প্রচেষ্টায় এ বাহিনী গড়ে তোলেন। বাহিনীর মূল ঘাঁটি ছিল সুন্দরবনের অভ্যন্তরে। এ বাহিনীর সদস্যরা প্রধানত নৌপথে পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতেন।
শ্যামনগরের পার্শ্ববর্তী কালীগঞ্জ উপজেলায় পাকবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। সেখান থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পাকসেনারা শ্যামনগরে প্রথম প্রবেশ করে। এরপর বিভিন্ন সময়ে এসে অভিযান চালায়। তাই এখানে তাদের স্থায়ী কোনো ক্যাম্প ছিল না।
যুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শ্যামনগর উপজেলায় জামায়াতে ইসলামী – ও মুসলিম লীগ-এর নেতা-কর্মীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এখানকার প্রভাবশালী জামায়াত নেতা ছিল ছাত্তার মওলানা। তার নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয় এবং সে নিজে ছিল এর কমান্ডার। রাজাকার বাহিনীর আরেকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিল ছোরাপ। এরা রামজীবনপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। ঈশ্বরীপুর বাজারের নিকটবর্তী মাখনলাল চট্টোপাধ্যায়ের পরিত্যক্ত বাড়িটি দখল করে সেখানে তারা ক্যাম্প স্থাপন করে এবং হত্যা, নির্যাতন, নারীধর্ষণ ও লুণ্ঠনের মালামাল সংরক্ষণ করে। ভেটখালী ইউনিয়ন পরিষদ ভবন দখল করে সেখানেও তারা একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। এটি ছিল রাজাকারদের সবচেয়ে বড় ক্যাম্প। এখানে ৭০-৭৫ জন রাজাকারের সঙ্গে ৮-১০ জন পাঞ্জাবি মিলিশিয়া নিয়মিত অবস্থান করত। পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধারা এ ক্যাম্পটি দখল করে ভবনটি গুঁড়িয়ে দেন। নওয়াবেঁকী বাজার-সংলগ্ন ওয়াপদা ক্যাম্পেও রাজাকারদের অবস্থান ছিল। তারা হাটের দিন বাজারের ক্রেতা ও বিক্রেতাদের নিকট থেকে জোর করে চাঁদা আদায় করত। এখানে শান্তি কমিটিও গঠিত হয়। এর সেক্রেটারি ছিল গাবুরা গ্রামের আবদুস সালাম।
নদীবিধৌত সুন্দরবন অঞ্চলে রাজাকার ও পাকবাহিনীর নিরাপদ যোগাযোগের উপায় ছিল কৈখালী-হরিনগর নৌপথ। এখানে তারা নৌকা, লঞ্চ ও গানবোট নিয়ে টহল দিত। পাকবাহিনীর টহলের জন্য ছিল দুটি অত্যাধুনিক গানবোট। এতে করে এসে তারা নদীপাড়ের নিরীহ গ্রামবাসীদের নির্যাতন করত এবং কাউকে-কাউকে ধরে নিয়ে যেত। এছাড়া তারা নদীর দু-পাড়ের গ্রামগুলোতে লুট-তরাজ চালাত এবং অস্ত্র আনা-নেয়া করত।
উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে চেয়ারম্যান শেখ সামসুর রহমান, ছাত্তার মওলানা, ছোরাপ ও আবুল কাশেমের নাম উল্লেখযোগ্য। ছাত্তার মওলানার নির্দেশে এলাকার মুক্তিকামী জনগণের ওপর হত্যা-নির্যাতন চালানো হতো।
শ্যামনগর উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা একটি গণহত্যা চালায়, যা হরিনগর গণহত্যা নামে পরিচিত। ৪ঠা সেপ্টেম্বর (১৮ই ভাদ্র) নবাব্দী বাহিনী চুনকড়ি নদীতে পাকবাহিনীর গানবোট আক্রমণ করলে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ ঘটনার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ৯ই সেপ্টেম্বর (২৩শে ভাদ্র) হানাদাররা হরিনগর গ্রামে আক্রমণ চালায় এবং বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। এ-সময় অনেকে আহত হয়।
শ্যামপুর উপজেলায় দুটি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে- কাতখালি বধ্যভূমি ও শ্যামনগর থানা চত্বর বধ্যভূমি। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ-দুটি স্থানে বহু লোককে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীনের পর এখান থেকে মানুষের মাথার খুলি, হাড়, ছেঁড়া কাপড়-চোপড়, টুকরো শাঁখা, চুড়ি, মাথার ক্লিপ ইত্যাদি পাওয়া যায়। উপজেলায় একটি গণকবর রয়েছে গোপালপুর গণকবর। এখানে পাঁচজনকে কবর দেয়া হয়। এছাড়া হানাদারদের হাতে শহীদ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার কবর চিহ্নিত করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম কারিগরের কবর রয়েছে শ্যামনগর থানা চত্বরে। রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ার পর তাঁকে দিয়ে কবর খুড়িয়ে সেই কবরেই তাঁকে গুলি করে মাটিচাপা দেয়া হয়। শ্যামনগর উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কয়েকটি যুদ্ধ ও অপারেশন পরিচালনা করেন। সেগুলো হলো- হরিপুর যুদ্ধ, গাবুরাচর লঞ্চ যুদ্ধ, রামজীবনপুর যুদ্ধ, ভেটখালী যুদ্ধ, শ্যামনগর থানা অপারেশন, গোপালপুর যুদ্ধ এবং কৈখালী যুদ্ধ। হরিপুর যুদ্ধ সংঘটিত হয় এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে। এতে দুজন স্বাধীনতাবিরোধী নিহত হয়। গাবুরাচর লঞ্চ যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৬ই মে। মেজর এম এ জলিলের নেতৃত্বে সংঘটিত এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ ভর্তি দুটি লঞ্চ ডুবে যায় এবং ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা শান্তি কমিটির লোকজনদের হাতে ধরা পড়েন। রামজীবনপুর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১১ই আগস্ট কমান্ডার এস এম মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে। এতে দুর্ধর্ষ রাজাকার কমান্ডার মওলানা আব্দুস সাত্তার নিহত হয়। ভেটখালী যুদ্ধ সংঘটিত হয় আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। যুদ্ধে রাজাকার বাহিনী পিছু হটে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের একটি রাইফেল উদ্ধার করেন এবং ভেটখালী বাজারের রাজাকার ঘাঁটিটি ধ্বংস করে দেন। শ্যামনগর থানা অপারেশন পরিচালিত হয় ১৭ই ও ২০শে আগস্ট দুবার। কমান্ডার মিজানুর রহমান ও কমান্ডার সুবহানের নেতৃত্বে পরিচালিত এ অপারেশনের প্রথম দিনে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকজন রাজাকার ও দুজন পুলিশকে বন্দি করেন এবং দ্বিতীয় দিন থানা দখল করে বিপুল পরিমাণ কর্পূর উদ্ধার করেন। গোপালপুর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৮ই আগস্ট লেফটেন্যান্ট মাহফুজ বেগ ও এস এম মিজানুর রহমানের তেতৃত্বে। এ-যুদ্ধে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা ও কয়েকজন সাধারণ মানুষ শহীদ হন, কয়েকজন আহত হন এবং কয়েকজন পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। জল্লাদ কাশেম- বিরোধী অপারেশন পরিচালিত হয় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে। কৈখালী যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২২শে নভেম্বর। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনী পরাজিত হয়ে পলায়ন করে এবং এদিনই শ্যামনগর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
শ্যামনগর উপজেলায় একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা গেছে। তিনি হলেন নুরুল ইসলাম কারিগর (পিতা জবেদ আলী কারিগর, বাগমারী)।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এলাকাবাসী গোপালপুর যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবরের পাশে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে। পরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙ্গে একটি নতুন স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। [মিজানুর রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড