You dont have javascript enabled! Please enable it! শেরপুর গণহত্যা (ওসমানীনগর, সিলেট) - সংগ্রামের নোটবুক

শেরপুর গণহত্যা (ওসমানীনগর, সিলেট)

শেরপুর গণহত্যা (ওসমানীনগর, সিলেট) সংঘটিত হয় বিভিন্ন সময়ে। এতে বহু নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। ওসমানীনগর উপজেলার সাদিপুর ইউনিয়নের একটি প্রসিদ্ধ স্থান শেরপুর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শেরপুরের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের এ শেরপুর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি এলাকা। মুক্তিযুদ্ধকালে এখানে অবস্থিত কুশিয়ারা নদীতে কোনো সেতু ছিল না। ঢাকা-সিলেটগামী যানবাহন তখন ফেরির মাধ্যমে পারাপার হতো বিধায় সড়কপথের সকল যানবাহনই এখানে যাত্রা বিরতি করত। তখন এখানে একটি নদীবন্দর ছিল। ফলে সড়ক ও নদীপথে সমগ্র দেশের সঙ্গে শেরপুরের একটি সেতুবন্ধন ছিল। তাই যোগাযোগ ক্ষেত্রে শেরপুরের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে-কারণে মুক্তিযুদ্ধকালে শেরপুরের দখল নিয়ে মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে বারবার যুদ্ধ হয়।
হবিগঞ্জের গণবাহিনীর অধিনায়ক কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী ও মেজর সি আর দত্তের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা শেরপুরে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিকবার যুদ্ধ করেন। এখানে প্রথমে ৫ই এপ্রিল সংঘটিত যুদ্ধে পাকবাহিনী পরাজিত হয়ে তাদের নিহত ১২ জন সৈন্যের লাশ ফেলে রেখে সাদিপুরের দিকে পলায়ন করে। মুক্তিযোদ্ধারা অতঃপর সেখানেও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে প্রচণ্ড এ-যুদ্ধে টিকতে না পেরে যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে হানাদাররা সিলেটের দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ২২শে এপ্রিল হানাদার বাহিনী সিলেট থেকে ফিরে এসে প্রথমে সাদিপুরে প্রবল আক্রমণ রচনা করে। সে-সময় শত্রুরা জঙ্গি বিমান থেকে তাজপুর, গোয়ালাবাজার, সাদিপুর প্রভৃতি এলাকায় বোমা হামলা করে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালাতে-চালাতে সাদিপুর এসে আক্রমণ রচনা করে। বিমান আক্রমণসহ স্বয়ংক্রিয় এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রচিত এ আক্রমণ মুক্তিযোদ্ধারা ২৪ ঘণ্টা প্রতিরোধ করে শেষ পর্যন্ত শেরপুরে এসে পুনরায় যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন।
শেরপুরে নদীর দক্ষিণ দিকে অবস্থান নিয়ে মুক্তিবাহিনী শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শত্রুদের সঙ্গে সেখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী ক্যাপ্টেন আজিজ আহত হন। ফলে কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী নিজে তখন যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ পর্যায়ে পাকবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর যথেষ্ট ক্ষতি সাধিত হয়। এতে তাঁদের মধ্যে কিছুটা সমন্বয়হীনতাও দেখা দেয়। শত্রুরা নদী অতিক্রম করে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানকে প্রায় চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে। মানিক চৌধুরী শেষ পর্যন্ত পরিখায় আশ্রয় নিয়ে মাত্র ১৫ জন গণবাহিনীর সদস্য নিয়ে ৩৬ ঘণ্টা প্রতিরোধ করেন। ততক্ষণে তাঁদের গোলাবারুদ নিঃশেষ হয়ে আসে। অবশেষে বেগতিক দেখে সকলে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মরক্ষা করেন। শেরপুরের পতন ঘটে।
শেরপুর পাকবাহিনীর অধিকারে চলে গেলে তারা সেখানে একটি শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করে এর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে তৎপর হয়। উল্লেখ্য, শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর দক্ষিণ তীর মৌলভীবাজার মহকুমা (বর্তমানে জেলা) এবং উত্তর তীর সিলেট সদর মহকুমায় (বর্তমানে সদর জেলা) অবস্থিত। উত্তর তীরের অংশ থেকে বর্তমান ওসমানীনগর উপজেলার শুরু। শেরপুরে স্থাপিত (ওসমানীনগর অংশে) ক্যাম্প থেকে হানাদাররা ঐ অঞ্চলে হত্যা, অগ্নিসংযোগসহ জনসাধারণের ওপর নানারকম নির্যাতন চালায়।
সংশ্লিষ্ট ক্যাম্প থেকে পাকবাহিনীর সদস্যরা প্রতিদিনই আশপাশের গ্রামসহ মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামে হানা দিত। যাকে খুশি তাকেই ধরে এনে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিত। প্রায়ই আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে নারীনির্যাতন, বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরনের অপকর্ম চালাত। নদীপথে গিয়েও বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে সাধারণ নিরীহ মানুষের বাড়িঘরে লুটপাট, মানুষ হত্যা ও নারীনির্যাতনের মতো নানাধরনের অপকর্ম সংঘটিত করত। কত কন্যাকে তাদের মা-বাবার সামনে, কত স্ত্রীকে তাদের স্বামীদের সামনে ধর্ষণ করেছে তার ইয়ত্তা নেই।
একদিন হানাদার বাহিনী তাদের দোসরদের নিয়ে শেরপুর গ্রামের আকলু মিয়া মাস্টারকে তাঁর বাড়ি থেকে ধরে এনে হত্যা করে। সুভাষিণী রায়কেও একদিন বাড়ি থেকে ধরে এনে হত্যা করে। এভাবে হত্যা করে একই গ্রামের চন্দ্ৰ কিশোর আচার্য ও কুঞ্জবিহারী আচার্যকে। ব্রাহ্মণগ্রামের সুনীল ভৌমিক, মন্টু শুক্লা বৈদ্যকেও তারা একইভাবে ধরে এনে হত্যা করে। সালামতপুরের হবিব উল্লাহ, আলমপুর আখড়ার মোহান্ত, জনতৈলের এক শিক্ষক, ভূমির বাঁকের জনৈক কৃষক, ফোটার গ্রামে দুজন অজ্ঞাত পরিচয় গোয়ালা প্রমুখকে পাকহানাদাররা হত্যা করেছে।
জানা যায়, পাকসেনারা একদিন গোয়ালাবাজার ইউনিয়নে প্রবেশ করে ওমরপুর গ্রামের ওজীব উল্লাহ টেন্ডল ও মদরিছ আলী, ইজলশাহের শফিকুর রহমান, ইসবপুরের প্রমোদ মালাকার ও গুপ্তপাড়ার ভূতন মালাকারকে আটক করে তাদের গাড়িতে ওঠায়। এরপর বাজার থেকে ফেরার পথে পুরকায়স্ত পাড়ার রবীন্দ্র কুমার ধরকে ধরে গাড়িতে ওঠায় প্রমোদ মালাকার, ভূতন মালাকার ও রবীন্দ্র কুমার ধর এ তিনজনই ছিলেন দিনমজুর। তাদের সবাইকে গাড়িতে করে হানাদাররা নিয়ে আসে শেরপুর ফেরিঘাটে।
রবীন্দ্র কুমার ধর ছিলেন খুবই দরিদ্র। ছোট ৩ ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার। বাজার থেকে সারাদিন কাজ করে যে কয়টি পয়সা পেতেন তা দিয়ে সামান্য চাল-ডাল নিয়ে কোনোমতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসার চলাতেন। ঘটনার দিনও তিনি এক সের চাল নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। পথিমধ্যে গাড়ি থামিয়ে পাকহানাদাররা তাকেও পাকড়াও করে গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। গামছায় বাঁধা সামান্য চাল বাড়িতে না নিলে তার স্ত্রী-সন্তান উপোস থাকবে এ কথা বলে হাজার অনুনয়- বিনয় করলেও বর্বর হানাদারদের মন গলেনি গোয়ালাবাজার থেকে এই ৬ জনকে নিয়ে গাড়ি চলতে থাকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পথ ধরে ঢাকার দিকে। এক সময় গাড়ি এসে থামে শেরপুর ফেরিঘাটে। সেখানে রশি দিয়ে তাদের হাত-পা বেঁধে ফেরিতে ওঠায়। ফেরি মাঝ নদীতে আসার পর বর্বর হানাদাররা হাস্যোল্লাসের সঙ্গে তাদের হত্যা করে কুশিয়ারা নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দেয়। নিমিষে ডুবে যায় হাত-পা বাঁধা নিরীহ মানুষগুলো। নদীর স্রোত ভাসিয়ে নেয় বহু দূরে তাঁদের লাশ।
গোয়ালাবাজারের হাজীপুর গ্রামে একদিন পাকবাহিনীর কয়েকজন সদস্য হানা দেয়। গ্রামে জনৈক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন মশাখলা ও গলমুকাপন গ্রামের দুজন মানুষ। সে গ্রামের দালাল আব্দুল খালেক ও তার ছেলে তাদের দুজনকে ধরে নিয়ে যায় পাকবাহিনীর নিকট পাকসেনারা তাদের শেরপুর এনে গুলি করে হত্যা করে। শুধু তাই নয়, দূর-দূরান্ত থেকে মহাসড়কে চলমান আরো কত লোককে যে তারা হত্যা-নির্যাতন করেছে, তার সঠিক তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড