মুক্তিযুদ্ধে শিবালয় উপজেলা (মানিকগঞ্জ)
শিবালয় উপজেলা (মানিকগঞ্জ) পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দীর্ঘ দিনের শোষণ ও বঞ্চনায় জর্জরিত এদেশের মানুষের মধ্যে ক্রমে ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। ফলে তারা ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে সোচ্চার হয়ে ওঠে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এ আইয়ুব খানের পতনের প্রেক্ষাপটে নতুন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে স্বাধীনতার লক্ষ্যে চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দেন। তাঁর সে ভাষণে উদ্ধুদ্ধ হয়ে শিবালয় উপজেলার মানুষ যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণকল্পে সভা-সমাবেশ, প্রশিক্ষণ ও পাকসেনাদের মোকাবেলায় করণীয় নির্ধারণ শুরু করে।
২৭শে মার্চ অধ্যক্ষ আব্দুর রউফ খানের সভাপতিত্বে মালুচী উচ্চ বিদ্যালয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মো. রেজাউর রহমান খান জানু (মালুচী), আবুল কাশেম (নালী), চিত্ত রঞ্জন সাহা (উথলী), মধু সাহা (উথলী), নুর খাঁ (বোয়ালীপাড়া) প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যেক ইউনিয়নে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে মর্মে সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে অনুযায় ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বে ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরী (মানিকগঞ্জ), অধ্যক্ষ আব্দুর রউফ খান (মালুচী), মো. রেজাউর রহমান খান জানু (মালুচী), চিত্ত রঞ্জন সাহা (উথলী), এলমেছ, আব্দুল কাইয়ুম মোল্লা (শিবালয়), স্বদেশ বসু প্রমুখ এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।
শিবালয় উপজেলার যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন মো. আব্দুস সাত্তার এবং ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন মো. মোতাহার হোসেন। শিবালয় ছিল মানিকগঞ্জ পশ্চিম অঞ্চলের অধীন। এ অঞ্চলের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরী এবং সহকারী কমান্ডার ছিলেন অধ্যক্ষ আব্দুর রউফ খান। এঁদের তত্ত্বাবধানে শিবালয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়।
৭ই এপ্রিল সকালে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক পথে গাড়িযোগে পাকবাহিনী শিবালয়ে প্রবেশ করে শিবালয় থানা, উথলী, ডাকবাংলো, মহাদেবপুর গোডাউন এবং শিবালয় পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে (বর্তমান শিবালয় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) ক্যাম্প স্থাপন করে। এসব ক্যাম্প থেকে তারা শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর সহ এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় শিবালয়ের বিভিন্ন গ্রামে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ ও নারীধর্ষণসহ বিভিন্ন পৈশাচিক ক্রিয়াকলাপে লিপ্ত হয়।
আব্দুর রশীদ মিয়া (জাফরগঞ্জ)-কে চেয়ারম্যান করে অর্ধশতাধিক সদস্য নিয়ে শিবালয় থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়, যা রশীদ বাহিনী নামে পরিচিত ছিল। এ বাহিনী কর্তৃক হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগসহ নানা অত্যাচারে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এছাড়া রাজাকাররা হিন্দু সম্প্রদায়সহ মুক্তিকামী বহু পরিবারের বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। শান্তি কমিটির উল্লেখযোগ্য সদস্যরা হলো— বিশু ফকির (তেওতা, রশীদ বাহিনীর জল্লাদ হিসেবে পরিচিত), গোলাপ খাঁ (তেওতা), খোকন মুন্সী (টেপড়া), আব্দুস ছালাম সরকার (সভাপতি, উথলী ইউনিয়ন শান্তি কমিটি), আব্দুর রশীদ নওয়াব (কাতরাসীন; সেক্রেটারি, উথলী ইউনিয়ন শান্তি কমিটি) প্রমুখ। রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ছিল তেওতা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহাদাৎ ফকির এবং উথলী ইউনিয়নের হোসেন আলী (শশীনারা), ঈমান আলী (শশীনারা), জলিল মেম্বার (বাড়াদিয়া), ইন্তাজ মোল্লা (উথলী) প্রমুখ।
শিবালয়ে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা ময়ছের আলী (বড় আনুলিয়া), যতীন সাহা (কয়ড়া), শ্যামল সাহা (উথলী), মন্টু সাহা (উথলী) ও ডা. নিবারণ সাহাকে (অন্বয়পুর) গুলি করে হত্যা করে। ১০ই ডিসেম্বর মিরপুর যুদ্ধের পর পাকবাহিনী তাদের এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় আগুন দিয়ে মিরপুর গ্রামের ইসমাইল মোল্লার বাড়ি (মুক্তিবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প) সহ অর্ধ শতাধিক বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। রাজাকারদের সহায়তায় তারা আরিচা ঘাট সংলগ্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকটি বাড়ির জিনিসপত্র লুট এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। পাকসেনারা শিবালয়ের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক অধ্যক্ষ আব্দুর রউফ খানের বাড়িটি (মালুচী) জ্বালিয়ে দেয়।
রশীদ বাহিনীর সদস্যরা তেওতা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মালুচী গ্রামের তারা মিয়া এবং পয়লা গ্রামের আলীমুদ্দিন মোল্লার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। আলোকদিয়া চরের যোগেন্দ্র মণ্ডল, কার্তিক চ্যাটার্জী ও সরেন চ্যাটার্জীর বাড়ির সর্বস্ব তারা লুটে নেয়। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা তেওতা ইউনিয়নসহ শিবালয় উপজেলার অধিকাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে লুটপাট চালায়। এমনকি তারা তাদের অধিকাংশ ঘর ভেঙ্গে নিয়ে যায়। শিবালয় থানা, উথলী ডাকবাংলো ও শিবালয় পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় (বর্তমান শিবালয় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির।
শিবালয় পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের দক্ষিণ পাশে বিশাল এলাকা জুড়ে আবাদি জমি ছিল। মুক্তিকামী ও সাধারণ মানুষদের ধরে এনে এখানে জবাই ও গুলি করে হত্যার পর লাশ ফেলে রাখা হতো। এটি শিবালয় পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত।
শিবালয় উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। সেগুলো হলো- মিরপুর যুদ্ধ, মাচাইন বাজার যুদ্ধ, দাশকান্দি যুদ্ধ ও মহাদেবপুর যুদ্ধ। ১৫ই জুলাই পাকসেনাদের একটি ছোট দল ঢাকা- আরিচা মহাসড়কের মহাদেবপুর ব্রিজ ক্রস করার সময় পেছন দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর একটি দল তাদের ওপর আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। ১৮ই জুলাই পাকসেনারা শিবালয় থানা ক্যাম্প থেকে মালুচী মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণের উদ্দেশ্যে সড়কপথে যাত্রা করে। এ খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনী মাচাইন বাজার পয়েন্টে এম্বুশ করে। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পাকসেনারা পিছু হটে নিজস্ব ক্যাম্পে ফিরে যায়। ৮ই ডিসেম্বর দাশকান্দিতে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হয়। ১০ই ডিসেম্বর উথলী ইউনিয়নের মিরপুরে পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করলে যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে টিকতে না পেরে মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। ১৫ই ডিসেম্বর শিবালয় উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
এ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুস সাত্তার (শাকরাইল), দলিল উদ্দিন (নয়াকান্দি), দারোগালি খান (বোয়ালি) ও মনছুর আলী (সৈয়দাবাদ)।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও শহীদ স্বদেশ বসুর নামে টেপরা থেকে ঘিওর পর্যন্ত সড়কের নাম রাখা হয়েছে স্বদেশ বসু সড়ক। [নিরঞ্জন কুমার সাহা]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড