You dont have javascript enabled! Please enable it! নারী মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল - সংগ্রামের নোটবুক

নারী মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল

শিরিন বানু মিতিল (১৯৫০-২০১৬) পুরুষের পোশাক পরে অস্ত্রহাতে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর নারী মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৫০ সালের ২রা সেপ্টেম্বর পাবনা শহরের দিলালপুর মহল্লার খান বাহাদুর লজ-এ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খন্দকার শাহজাহান মোহাম্মদ, মাতার নাম সেলিনা বানু। বাবা খন্দকার শাহজাহান মোহাম্মদ ছাত্রজীবন থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মাতা সেলিনা বানু পাবনা জেলা ন্যাপের সভানেত্রী এবং ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের এমএলএ ছিলেন।
সেলিনা বানু ১৯৩৯ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের সময় তিনি মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির লঙ্গরখানায় স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে বিশেষভাবে প্রশংসিত হন। তাঁর নানা খান বাহাদুর ওয়াসিম উদ্দিন আহমেদ পাবনার প্রথিতযশা আইনজীবী এবং পাবনা পৌরসভার প্রথম সভাপতি ও জেলা বোর্ডের আজীবন সভাপতি ছিলেন। এমন এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করে শিরিন বানু মিতিল ছোটবেলা থেকেই রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে শিরিন বানু মিতিল পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের বাংলা বিভাগের প্রথমবর্ষের ছাত্রী ছিলেন। ১৯৭০-১৯৭৩ সময়কালে তিনি পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী এবং কিছুদিনের জন্য জেলা মহিলা পরিষদের যুগ্ম- সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করলে অন্যান্য স্থানের মতো পাবনাও আক্রান্ত হয়। এদিন থেকে পাবনায় প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয়ে ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত চলতে থাকে। ২৭শে মার্চ পাবনা পুলিশ লাইন্সে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘটিত যুদ্ধ জনযুদ্ধ-এ রূপ নেয়। এ-সময় ঘরে-ঘরে নারীরাও যুদ্ধে অংশগ্রহণের চিন্তা করতে থাকেন। শত প্রতিকূলতার মাঝেও শিরিন বানু মিতিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। চাচাতো ভাই জিঞ্জিরের কাছ থেকে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে থ্রি- নট-থ্রি রাইফেল চালানো শিখে ফেলেন। চাচাতো ভাই জিঞ্জির ও জিন্দান মায়ের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এমতাবস্থায় ঘরে বসে না থেকে শিরিন বানু মিতিল চট্টগ্রামের বীরকন্যা প্রীতিলতাকে অনুসরণ করে পুরুষের পোশাক পরে কিশোর যোদ্ধা সেজে প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ২৮শে মার্চ পাবনা টেলিফোন এক্সচেঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে প্রতিরোধযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ৩৬ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। পাবনা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ যুদ্ধে শিরিন বানু মিতিল ছিলেন একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা।
৩১শে মার্চ পাবনার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে মুক্তিযোদ্ধারা একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করেন। ৯ই এপ্রিল উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার খ্যাত নগরবাড়ি ঘাটে প্রতিরোধযুদ্ধ হয়। এ-সময় সবচেয়ে কমবয়সী এবং নারী মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল কন্ট্রোল রুমের পুরো দায়িত্বে ছিলেন। কয়েকদিনের মধ্যে ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক মানস ঘোষ মিতিলের ছবিসহ পুরুষের বেশে যুদ্ধ করার ছবিটি উল্লিখিত পত্রিকায় প্রকাশ করলে তাঁর পক্ষে আর পুরুষের বেশে যুদ্ধ করা সম্ভব হয়নি।
১১ই এপ্রিল হানাদার বাহিনী পাবনা দখল করে নিলে শিরিন বানু মিতিল ন্যাপ নেতা আমিনুল ইসলামসহ কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা হয়ে ২০শে এপ্রিল সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যান। সেখানে বাংলাদেশ সরকার- পরিচালিত নারীদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গোবরা-য় যোগ দেন। এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। এখানে নাচোল বিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্রের সঙ্গে মিতিলের দেখা হয়, যোগাযোগ হয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ৯নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর জলিলের সঙ্গে। ৩৬ জন নারী নিয়ে গোবরা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প শুরু হলে ক্রমশ সদস্য সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৩০০-তে দাঁড়ায়। এ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পাশাপাশি কলকাতার বিভিন্ন সমাবেশে তিনি বক্তৃতা দিতে থাকেন। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি শরণার্থী ক্যাম্পে সেবাদান, মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর শিরিন বানু মিতিল দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশুনা করতে যান। সেখানকার পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি অব রাশিয়ায় ইতিহাস বিষয়ে পড়াশুনা শেষ করে ১৯৮০ সালে দেশে আসেন। ১৯৭৪ সালে তিনি মাসুদুর রহমানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দেশে ফিরে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিচালিত ‘ওরাল রিহাইড্রেশেন প্রজেক্ট’-এর রাজশাহী বিভাগের ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮২-১৯৮৭ পর্যন্ত পল্লি উন্নয়ন একাডেমিতে উপ- পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে প্রিপ ট্রাস্ট নামে একটি বেসরকারি সংস্থায় জেন্ডার ও গভর্নেন্স ইউনিট- এর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০১৬ সালের ২০শে জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্বামী, ২ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তান রেখে যান। [মনিরুজ্জামান শাহীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড