You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে শিবগঞ্জ উপজেলা (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে শিবগঞ্জ উপজেলা (চাঁপাইনবাবগঞ্জ)

শিবগঞ্জ উপজেলা (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) একটি ঐতিহাসিক স্থান। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে এখানে নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন-এ এখানকার ছাত্ররা সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। এ থানার সন্তান জিল্লুর রহমান টিপু, এডভোকেট ওসমান গনি, এডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু, ডা. মঈন উদ্দিন আহমেদ এমপিএ এবং বোনা বিশ্বাস ঢাকা ও রাজশাহীতে ভাষা-আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের প্রচেষ্টায় এ আন্দোলন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হয়ে শিবগঞ্জ, কানসাট, আদিনা, মনাকষা এবং বিনোদপুরে ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত স্বাধিকার আন্দোলনে এ উপজেলার মানুষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ঊনসত্তরের গণ- অভ্যুত্থান-এর সময় শিবগঞ্জ থানার বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কানসাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্ররা পুরো এক সপ্তাহ ধরে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল-সমাবেশ করে। জেলার সবচেয়ে প্রাচীন কলেজ আদিনা ফজলুল হক কলেজের ছাত্র মির্জা শাহরিয়ার কামাল, আব্দুল্লাহ গাজী খান, আব্দুল মজিদ, শাহজাহান মিঞা প্রমুখের নেতৃত্বে তখন মিছিল-সমাবেশ হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন শিবগঞ্জ থানার সন্তান মোহা. ইব্রাহিম (দোরশিয়া)। গণ-আন্দোলনে বিশেষ অবদান রাখেন এডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু, এডভোকেট নজরুল ইসলাম, এডভোকেট ওসমান গনি, ডা. মঈন উদ্দিন আহমেদ এমপিএ প্রমুখ।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে শিবগঞ্জ থেকে আওয়ামী লীগ- প্রার্থী মো. খালেদ আলি মিয়া এমএনএ, এডভোকেট রইস উদ্দিন আহমেদ এমএনএ, এন এ হামিদুর রহমান এমএনএ এবং ডা. মঈন উদ্দিন আহমেদ এমপিএ নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পর সামরিক জান্তা আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিতে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসবের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনের ডাক দেন। তাঁর নির্দেশে সারাদেশের মতো শিবগঞ্জেও ৩রা থেকে ৬ই মার্চ পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এ হরতাল পালন ও অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে শিবগঞ্জে নেতৃত্ব দেন ডা. মঈন উদ্দিন আহমেদ এমপিএ, আবেদ আলী (আওয়ামী লীগ), এডভোকেট নজরুল ইসলাম (ন্যাপ) প্রমুখ রাজনীতিক এবং ছাত্রলীগ-এর আব্দুল মজিদ, আব্দুল কুদ্দুস, হারুন অর রশীদ (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র), মোহা. হারুন অর রশীদ (শিবগঞ্জ), নেসার উদ্দীন, সাইফুল ইসলাম ( ছাত্র হডানয়ন, মেনন গ্রুপ), শাহজাহান মিঞা, আ ক ম হাসান খান (ছাত্র ইউনিয়ন, মতিয়া গ্রুপ) প্রমুখ ছাত্রনেতা। মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলন ও অন্যান্য কর্মসূচি পালিত হয়। ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষিত হওয়ার পর শিবগঞ্জে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সদস্য ছিলেন ডা. মঈন উদ্দিন আহমেদ (আহ্বায়ক), মোহা. আজিজুল হক (সদস্য-সচিব), মুহ. আজিজ-উদ-দৌলা, লোকমান খান, ফজলে রশীদ খান, আ ক ম হাসান খান, ময়েজ উদ্দীন মাস্টার, মোহা. নজরুল ইসলাম লালান, মোহা. জিয়াউল হক টুনু মিঞা, আব্দুল্লাহ গাজী খান, মোহা. ফাইজুর রহমান, আব্দুল কুদ্দুস, মোহ. হারুন অর রশীদ, রায়হানুল ইসলাম, মোহা. নজরুল ইসলাম, নেসার উদ্দীন, সাইফুল ইসলাম প্রমুখ। হরতাল ও আসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচিতে মোহা. জোবায়ের আলি, তামিজ উদ্দীনসহ ছাত্র-যুবকরা বিভিন্ন গ্রাম থেকে এসে অংশ নেয়।
সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি এ উপজেলায় কর্মরত অবাঙালি পুলিশ ও ইপিআর সদস্যদের অস্ত্র নিজেদের দখলে আনার উদ্যোগ নেয় এবং স্বল্প সময়েই অনেক অস্ত্র যোগাড় করতে সক্ষম হয় এ সময় ডা. মঈন উদ্দিন আহমেদ, মুজাহিদ কমান্ডার সুবেদ আলি বিশ্বাস, মোহা. আবদুল লতিফ ভুলু মণ্ডল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুজাহিদদের সংগঠিত করেন। আনসার কমান্ডার তোফাজ্জল হোসেন আনসারদের সংগঠিত করার দায়িত্ব পালন করেন।
সংগ্রাম কমিটির চেষ্টায় সীমান্তের ইপিআর সদস্যদের একত্রিত করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হয়। শিবগঞ্জ ও মনাকষায় যুবকদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ১লা এপ্রিল শিবগঞ্জ থানা চত্বরে এবং মনাকষার ফুটবল মাঠে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। শিবগঞ্জে হাবিলদার মালেক এবং সিপাহি সহিদুল্লাহ যুবকদের রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ প্রদান করেন এবং মনাকষায় ইপিআর সদস্য হাদি ও সাইদুর রহমান সাইদ প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১লা থেকে ৩রা এপ্রিলের মধ্যে শিবগঞ্জে ৬০ জন এবং মনাকষায় ৫০- ৬০ জন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। মনাষায় লাঠি দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। ১৩ই এপ্রিল পর্যন্ত এসব স্থানে প্রশিক্ষণ চলে।
শিবগঞ্জ ৭ নম্বর সেক্টরের অধীন ছিল। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে ২৩শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর নাজমুল হক। ২৩শে সেপ্টেম্বর থেকে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন লে. কর্নেল কাজী নূরুজ্জামান। অন্য যাঁরা বিভিন্ন পর্যায়ে শিবগঞ্জে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা হলেন- ক্যাপ্টেন ইদ্রিস (৫ই অক্টোবর পর্যন্ত), ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর, লে. আওয়াল চৌধুরী, লে. আব্দুল কাইউম খান, লে. রফিকুল ইসলাম, লে. এম আব্দুর রশীদ, লে. নাদিম, সুবেদার মেজর আব্দুল মজিদ, মেজর কুতুব উদ্দীন (আনসার বাহিনী), সুবেদার মেজর আব্দুর রব, নায়েক সুবেদার আনিসুর রহমান প্রমুখ।
শিবগঞ্জের বিভিন্ন সীমান্ত চৌকিতে অবস্থানকারী অবাঙালি ল্যান্স নায়েক, নায়েক, হাবিলদার, নায়েক সুবেদার, সুবেদার এবং সিপাহিরা যাতে পাকবাহিনীর পক্ষে শক্তি বৃদ্ধি করতে না পারে, সেজন্য কৌশলে তাদের নিরস্ত্র করা হয়। ৩রা মে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শিবগঞ্জে অনুপ্রবেশ করে, তখন মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিরোধ প্রচেষ্টা ছিল না। তবে শিবগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অন্যত্র প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এখানকার আনসার- মুজাহিদদের সমন্বয়ে গঠিত এক প্লাটুন প্রতিরোধ যোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে শিবগঞ্জ থানার মুজাহিদ বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার আব্দুল লতিফ ভুলু মণ্ডল রাজশাহীর প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাতে রাজশাহীর বেলপুকুরে আব্দুল করিম, খোদা বক্স, মোহা. জিব্রাইল মোমিন এবং আব্দুস সাত্তার শহীদ হন। শিবগঞ্জের আনসার কমান্ডার তোফাজ্জল হোসেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে ১লা থেকে ১৯শে এপ্রিল পর্যন্ত নবাবগঞ্জ থানার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। শিবগঞ্জের সন্তান এ আর আজম চৌধুরী সাহসিকতার সঙ্গে কুষ্টিয়ায় প্রতিরোধযুদ্ধ পরিচালনা করেন। ৩রা মে হানাদার পাকসেনারা ২টি খোলা মিলিটারি ভ্যানে মেশিনগান বসিয়ে এবং ২০-২১ ট্রাক ভর্তি সেনা নিয়ে শিবগঞ্জে অনুপ্রবেশ করে। এদিন তারা শিবগঞ্জ, কানসাট, মনাকষা ও বিনোদপুরে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ফিরে যায়। এর প্রায় দুসপ্তাহ পর পাকবাহিনী শিবগঞ্জের সিও অফিসে ক্যাম্প স্থাপন করে।
রাজাকার বাহিনী গঠিত হওয়ার পর মহাদেব শাহ ও ভুলু ঠিকাদারের পরিত্যক্ত বাড়িতে রাজাকারদের ক্যাম্প স্থাপিত হয়। জুলাইয়ের ১ম সপ্তাহে কানসাট উচ্চ বিদ্যালয়ে, ৭ই অক্টোবর কলাবাড়ি ও ধোবড়ায়, ১০ই অক্টোবর আদিনা কলেজ ও রাধাকান্তপুর মাদ্রাসায় এবং ২৫শে অক্টোবর আড়গাড়ায় তারা ক্যাম্প স্থাপন করে। আদিনা কলেজে ক্যাম্প স্থাপন করার দিন গোপালপুর-শিবগঞ্জ ফেরিঘাটে পাকবাহিনী তাদের প্রতিরক্ষা দুর্গ গড়ে তোলে। আর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা পূর্ব- পশ্চিমমুখী পাগলা নদীর দক্ষিণ পাড় ঘেঁষে উমরপুর ফেরিঘাটের পূর্ব-পশ্চিম পাশে দীর্ঘ এক মাইল জুড়ে বাংকার স্থাপন করে। লোকমান বিশ্বাস শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের বাড়িতে ও রাণীহাটিতে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প ছিল।
শিবগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও পিডিপি-র তৎপরতা ছিল। এসব দলের নেতা-কর্মীরাই প্রধানত থানায় শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করে। থানা ও বিভিন্ন ইউনিয়নের শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর কুখ্যাত নেতাদের মধ্যে ছিল মমতাজ উদ্দীন আহমেদ (রাণীবাড়ি চাঁদপুর; জেলা শান্তি কমিটির সদস্য; মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ইয়াহিয়া সরকার আয়োজিত জাতীয় পরিষদের প্রহসনমূলক উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত), মোহাম্মদ এরতাজ আলম (পিয়ালিমারী, মনাকষা; মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাদেশিক পরিষদের প্রহসনমূলক উপনির্বাচনে রাজশাহী-১ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত), আফতাব উদ্দীন (দৌলতপুর, প্রাক্তন চেয়ারম্যান, শিবগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ; শান্তি কমিটিতে যোগ দিতে অন্যদের উৎসাহিত করত), মাওলানা ময়েজ উদ্দীন (শিবগঞ্জ; মোহদিপুর গ্রামের যুবকদের রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়ার ব্যাপারে তৎপর ছিল), দাউদ মুন্সী (জালমাছমারী; নিজের ছেলেদের ও অন্যদের আলবদর বাহিনীতে ভর্তি করায় এবং পাকিস্তানের জন্য জীবনদানের ঘোষণা দেয়), ওয়াজিবুল ইসলাম ওয়াজেদ ডাক্তার (হাজারী ডাঙ্গা; আওয়ামী লীগের সমর্থকদের ওপর অত্যাচার চালাতে রাজাকার ও আলবদরদের উৎসাহিত করত; শিবগঞ্জ বাজার ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ তার অত্যাচারে আতংকে দিন কাটাত), রেজাতুল্লাহ কানা (শিবগঞ্জ; চাঁপাইনবাবগঞ্জ শান্তি কমিটির প্রভাবশালী সদস্য), মাওলানা মোজাফর হোসেন (শেরপুর ভাণ্ডার; তার নির্দেশে রাজাকাররা অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে আটক করে), নূরুল হোদা মিঞা ও মোহসিন মেম্বর (শরত্নগর, কানসাট; চাঁপাইনবাবগঞ্জে স্বাধীনতার পক্ষের মুনসুর আলি, মফিজ উদ্দীন, জালাল উদ্দীন প্রমুখকে ধরে নিয়ে শিবগঞ্জ পাকসেনা ক্যাম্পে দিয়ে আসার জন্য হাজারবিঘীর লোকজনদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে; গ্রামবাসী তার কথা শুনতে অস্বীকার করলে ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের ওপর নানা ধরনের অত্যাচার চালায়; শ্যামপুর ইউনিয়নে শান্তি কমিটি গঠনে কর্যকরী ভূমিকা রাখে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ করতে গ্রামের লোকজনকে রাতে পাহারা দিতে বাধ্য করত), লোকমান বিশ্বাস (বহলাবাড়ি রাণীহাটি; চাঁপাইনবাবগঞ্জ শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান; তার প্ররোচনায় পাকসেনারা ১০ই অক্টোবর দোরশিয়া গ্রামের মৌলবি মো. সোলাইমান, মো. জালাল উদ্দীন, আমজাদ আলি-সহ ৩৭ জনকে, পার ঘোড়াপাখিয়া গ্রামের মোহা. আরসাদ আলি, আফজাল বিশ্বাস, মো খলিলুর রহমান-সহ ১৪ জনকে, ছোট নম্পট গ্রামের আসফাকুর রহমান, কলিমুদ্দীন, তোফাজ্জল তোফা-সহ ১০জনকে, বড় নম্পট গ্রামের মো. মোয়াজ্জেম-সহ ৩ জনকে, রাধাকান্তপুর গ্রামের মো. গুদোড় আলি, মো. মুনসুর আলি-সহ ৩ জনকে, পাঁকা জকপাড়া ও মোল্লা টোলার ২ জন-সহ মোট ৫৯ জনকে বিভিন্ন সময়ে এবং তার একান্ত অনুগত সহযোগী বহলাবাড়ির যদু ও আব্দুল খালেক রাজাকারকে দিয়ে আরো ১৩ জনকে হত্যা করায়), হাবিবুল্লাহ চুড়িওয়ালা বিহারি (ভবানীপুর; ১০ই অক্টোবর রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে ভবানীপুর, কয়লাদিয়াড় প্রভৃতি গ্রামের বজলুর রহমান, লাল মোহাম্মদ-সহ ১০ ব্যক্তিকে ধরে আনে; তার ইঙ্গিতে কলাবাড়ির রাজাকার কমান্ডার আটককৃত সকলকে শারীরিক নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করে একই গর্তে মাটিচাপা দেয়), কাদির মিঞা (শান্তি কমিটির সদস্য, কানসাট বাজার; তার প্ররোচনায় রাজাকাররা মধ্য-নভেম্বরে আব্দুর রাজ্জাক ও আবু নসরকে আটক করে শিবগঞ্জ নিয়ে ইয়াকুব বিশ্বাসের আমবাগানে গুলি করে হত্যা করে; রাজাকারদের নিয়ে কানসাট ও কলাবাড়ির লোকজনের ওপর অত্যাচার ও লুটপাট চালায়), সালায়মান মিঞা (চাকলা, আড়গাড়াহাট; কাশিয়াবাড়ি ও আড়গাড়াহাটে পাকক্যাম্প স্থাপনে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের উৎসাহিত করে। ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকজনের ওপর নির্যাতন ও লুটপাট চালায়), সিদ্দিক বিশ্বাস (খড়িয়াল, মনাকষা; ছত্রাজিতপুরের বাহার আলি, সুকাম ও সেরাজুল হক এবং মনাকষার জিল্লুর, রফিক উদ্দীন-সহ ২২ জনকে বিভিন্ন সময়ে ধরিয়ে দেয়; রাজাকারদের লুটপাটে ইন্ধন যোগায়), মজিবুর রহমান মাস্টার (শেরপুর, শিবগঞ্জ; মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের ভীত-সন্ত্রস্ত করত) প্রমুখ।
শান্তি কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে আবুল হোসেন (ঝড়ু চামার, কালপুর), শামসুল হোদা মিঞা, (শিবগঞ্জ), আশু মণ্ডল (দুর্লভপুর), খলিল মিঞা (দাদনচক, আদিনা কলেজ), মাওলানা মোহা. ইসমাইল (পাঁকা, রাধাকান্তপুর), আতাউল্লাহ (পাকা, রাধাকান্তপুর), মো. জয়নুদ্দীন (দুর্লভপুর), সুলতান মাস্টার (দুর্লভপুর), মোহা. এসলাম (শেরপুর ভাণ্ডার), মাওলানা কামরুজ্জামান (পুখুরিয়া, কানসাট), রুস্তুম আলি (পাগলা, কানসাট), আজাহারুল হক চৌধুরী (বামুন গাঁ, ধাইনগর), সেকান্দার আলি মণ্ডল (মোবারকপুর), মো. বদিউজ্জামান (গঙ্গারামপুর, মোবারকপুর), আলহাজ্ব শামসুদ্দীন বিশ্বাস (মোবারকপুর), হাবিবুর রহমান (রসুনচক, বিনোদপুর), হাবিবুর রহমান চেয়ারম্যান (কালিগঞ্জ, বিনোদপুর), মোজাফর হোসেন ডাক্তার (রাণীহাটি), ফুটু ডাক্তার (লাভাঙ্গা, রাণীহাটি), মো. জয়নাল আবেদীন (কমলাকান্তপুর, রাণীহাটি), মো. হাবিবুর রহমান মাস্টার (সদাশিবপুর আজগবী, কানসাট), রবু মিঞা (সদাশিবপুর আজগবী, কানসাট) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মো. মোয়াজ্জেম হোসেন (পিতা কলিমুদ্দীন বিশ্বাস, বিশ্বনাথপুর, মনাকষা), আমিন উদ্দীন চুটু (সাতরশিয়া, মনাকষা; আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক আমৃত্যু জেলে দণ্ডিত), দীন মোহাম্মদ দেনা (পিয়ালিমারী, মনাকষা), মোহা. মাহিদুর রহমান (দাদনচক; আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক আমৃত্যু জেলে দণ্ডিত), গোফর জোলা (কানসাট), মো. কুতুব উদ্দীন কুবা কাতারী (হাসানপুর), আব্দুল্লাহ (কানসাট), এত্তাজ আলি (কলাবাড়ি ক্যাম্পের রাজাকার কমান্ডার), মঞ্জুর আলি (কানসাট), মোশাররফ হোসেন মেনা (কানসাট), সামু কসাই (চতুরপুর), মেহেরুল মিয়া (দৌলতপুর), শাহজাহান ঝন্টু (দৌলতপুর), আব্দুল খালেক (জালমাছমারী), রফিকুল ইসলাম (জগন্নাথপুর), ফাঁকী (লাগাদপাড়া), আলতাফ হোসেন (লাগাদপাড়া), মোসলেম উদ্দীন (চৌধুরীপাড়া), আব্দুল (চৌধুরীপাড়া), মোহম্মদ (চৌধুরীপাড়া), বাশির আলি (জালমাছমারী), রফিক মুহরি (গোয়ালপাড়া), হারু মোমিন (চতুরপুর), কয়েশ মোমিন (চতুরপুর), রইস উদ্দীন (গোয়ালপাড়া), সোহবুল (চক দৌলতপুর), মোফাজ্জল হোসেন সেন্টু (দাদনচক), লোকমান হোসেন মুহরি (বহলাবাড়ি), হুমায়ন মাস্টার (শরত্নগর), গোলাম মোস্তফা (পাঁকা ইউনিয়ন), শরিফ উদ্দীন, মুজিবুর রহমান (পাঁক ইউনিয়ন), দিয়ারুল (মিলক, কানসাট), পটা (মিলক, কানসাট), এসলাম (মিলক, কানসাট), সাইদুর রহমান সেন্টু (সহাড়াতলা), আমিরুল ইসলাম আমু (দৌলতপুর) প্রমুখ লুটেরা ও খুনি হিসেবে কুখ্যাত ছিল।
আলবদর বাহিনীর সদস্য হিসেবে মনিরুল ইসলাম মনি চৌধুরী (বাজিতপুর), মাওলানা আব্দুল মান্নান (ভবানিপুর), আব্দুল মজিদ (জালমাছমারী), আব্দুল হামিদ (জালমাছমারী), আশরাফ আলি (জালমাছমারী), সৈয়দ আহমদ (জালমাছমারী), সাহারুল ইসলাম (দৌলতপুর), নেফাউর রহমান (শিবগঞ্জ, বাবুপাড়া) প্রমুখ অত্যাচার, লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল।
৩রা মে পাকবাহিনী শিবগঞ্জে ঝটিকা আক্রমণ করে। তারা দালালদের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধা লোকমান খান, মিরাতুল ইসলাম, আব্দুল্লাহ গাজী খান, আব্দুল মজিদ, আফতাব উদ্দীন চেয়ারম্যান প্রমুখের বাড়িতে যায়। তারা মিরাতুল ইসলামের বাড়ি, ললিত কুণ্ডের দোকান, তাবল সাহা, তিনকড়ি সাহা, গোষ্ঠ বিহারীর মিষ্টির দোকান, রাধাই গোপাল সাহার দোকান ও বাড়ি এবং আব্দুল মজিদের বাড়িতে আগুন দেয়। পালপাড়, বাবুপাড়, হাজারি ডাঙ্গা দেওয়ার জায়গীর গ্রামের বেশকিছু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তারপর তারা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে এক দল কানসাট এবং অপর দল মনাকষায় যায়। কানসাট যাওয়ার পথে তারা পুকুরিয়ার কয়েকটি হিন্দুবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। কানসাটে পৌঁছে তারা অনেক হিন্দুর দোকান ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।
২৩শে মে পাকবাহিনীর একটি টহল দল সোনাপুর গ্রামে যায়। এ গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ডা. মফিজ উদ্দীন আহমেদের পিতার বাড়ি তারা পুড়িয়ে দেয়। এ আগুনে কালু, ইদু, গেদু, জালাল, খলিল, সেকান্দার ও মজনুর ঘরও পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
৪ঠা জুন অবাঙালি দালাল দুলু (মোহনবাগ), মাজুয়া খান (সেলিমাবাদ) ও মো. বরাকাত (সেলিমাবাদ)-এর প্ররোচনায় এক দল পাকসেনা পুলিশমাইলের মহিরুদ্দীন বিশ্বাসের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায় এবং তার বাড়িতে লুণ্ঠন চালিয়ে স্বর্ণালংকার ও নগদ অর্থ নিয়ে যায়। তারা লুণ্ঠিত মাল ও মহিরুদ্দীন বিশ্বাসকে নিয়ে শিবগঞ্জে যাওয়ার পথে পার্শ্ববর্তী তিন গ্রামের লোকদের দ্বারা ঘেরাও হলে লুণ্ঠন করা সম্পদ ও মহিরুদ্দীন বিশ্বাসকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এ অপমানের প্রতিশোধ নিতে পাকসেনাদের একটি বড় দল ও রাজাকাররা কয়েক ঘণ্টা পর গ্রামে আবার আক্রমণ করে। তারা মহিরুদ্দীন বিশ্বাসের সাহায্যে এগিয়ে আসা মানুষজনের নেতৃত্ব দানকারী মো. সাবদুল হক (পিতা মো. পোড়াই ঘরামু), মো. ইলিয়াস আলি (পিতা মো. সাকিম মহাজন) ও মো. শামসুদ্দীন (পিতা মো. রেশম মহাজন)-কে ধরে চরম শারীরিক নির্যাতন শেষে গুলি করে হত্যা করে। এদিন অনেকে এদের নির্যাতনে আহত হয়।
২০শে জুন শুক্রবার জুমার নামাজের সময় পাকবাহিনীর একটি দল হাজারবিঘী জামে মসজিদ ঘেরাও করে অনেক মুসল্লিকে পুকুরিয়া ফেরিঘাটের কাছে নিয়ে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করায়। তারপর তাদের এক-এক করে মুক্তিযোদ্ধা এরফান, মফিজ উদ্দীন মাস্টার, মুস্তাক মাস্টার, মুনসুর রহমান, লায়েশ উদ্দীন ও নজরুল সম্পর্কে জানতে চায়। কোনো উত্তর না পেয়ে সকলকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে লাঠি দিয়ে প্রহার করে। এরপর সবাইকে বেঁধে আবার গ্রামে নিয়ে যায়। পাকিস্তানি হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধা মফিজ উদ্দীন মাস্টার ও মুনসুর রহমানের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। আগুন লাগানোর আগে তারা এসব বাড়িতে লুণ্ঠন চালিয়ে স্বর্ণ, নগদ টাকা ও গবাদি পশু নিয়ে যায়। হানাদাররা সেদিন এখানে কয়েকজন নারীকে ধর্ষণ করে।
২০শে জুলাই আব্দুল লতিফের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক রাজাকারদের শিবগঞ্জ ক্যাম্প আক্রমণে ডা. আজাহার আলি তাঁদের সাহায্য করেন। এজন্য ক্ষিপ্ত রাজাকাররা মশাররফ হোসেন মেনার নেতৃত্বে ডা. আজাহারকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। তারা এদিন ফজলুর রহমান, সেতাউর রহমান, জয়নাল ও আতাউর রহমানকেও হত্যা করে। রাণীহাটির রাজাকার তসলিম উদ্দীন, আলবদর মফিজ উদ্দীন ও হেনা প্রায়ই কমলাকান্তপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে গিয়ে তাঁদের মা-বাবা, ভাই-বোনদের অত্যাচার করত। এসব বাড়ি থেকে তারা নগদ অর্থ ও গবাদি পশু নিয়ে যেত। রাজাকারআলবদররা আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে কমলাকান্তপুর গ্রামের ডা. আফতাব উদ্দিনকে হত্যা করে। পাকবাহিনী ৬ই অক্টোবর শ্যামুপর গ্রামে আক্রমণ চালায়। এখানে তারা ৯ জন গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে, শ্যামপুর গণহত্যা নামে পরিচিত। তারা এদিন সদাশিবপুর ও বাজিতপুর গ্রামের ১৪ জন নিরীহ মানুষকে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। এ হত্যাকাণ্ড সদাশিবপুর- বাজিতপুর গণহত্যা নামে পরিচিত। হানাদাররা চামার হাটের কাছে আমগাছে আশ্রয় নেয়া ১ জন নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর শরত্নগর গ্রামের মো. রুস্তুম আলি ও মো. তরিকুল আলম ঘুটু মিঞাকে গুলি করে হত্যা করে। এদের গুলিতে তাসাদেকুল আলমের মেয়ে গুরুতর আহত হয়। এছাড়া তারা ঢুলিপাড়া ও মিঞাপাড়ায় কয়েকটি বাড়িতে লুণ্ঠন চালিয়ে নগদ অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে যায়। লুটপাটের পর তারা বাড়িগুলো পুড়িয়ে দেয়।
দুর্লভপুরের আটবিঘীতে পাকবাহিনীর একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের এ প্রতিরক্ষায় আক্রমণ করলে দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে চলে যান। এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে পাকবাহিনী ৬ই অক্টোবর দুর্লভপুর গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তি সুবদার মণ্ডলের বাড়িসহ ৩টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। ৬ই অক্টোবর পাকবাহিনী বিনোদপুর মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্প দখল করে নেয়। এরপর রাজাকাররা চাঁদশিকারী, চামাটোলা, বিনোদপুর, একবরপুর, টাপ্পু, কালিগঞ্জ প্রভৃতি গ্রাম থেকে অনেক লোককে ধরে এনে বিনোদপুর উচ্চ বিদ্যালয় খেলার মাঠে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। এতে মো. ফজলুর রহমান (পিতা হাসিম উদ্দীন মোল্লা, চাঁদশিকারী), মো. আয়েশ উদ্দীন (পিতা মো. কসিম উদ্দীন, চাঁদশিকারী), মো. আফসার আলি (পিতা মো. নেশ মোহাম্মদ, চামা টোলা)-সহ ১৭ জন লোক প্রাণ হারান এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। ৭ই অক্টোবর মাহিদুর রহমান, তার সহযোগী আমিন উদ্দিন চুটু ও মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে এক দল রাজাকার বিনোদপুর ও এর পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রাম থেকে মো. এত্তাজ আলি (পিতা মো. ওয়াজেদ আলি), মো. তসলিম উদ্দীন (পিতা মো. ওয়াজেদ আলি), মো. গাজলুর রহমান-সহ ১২ জন নিরীহ মানুষকে ধরে এনে বর্তমান শহীদ মিনারের কাছে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। রাজাকার কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন নিজেই ব্রাশ ফায়ার করে। এ দুদিনের হত্যাকাণ্ড বিনোদপুর গণহত্যা নামে পরিচিত।
৬ই অক্টোবর দুর্লভপুর মুক্তিযোদ্ধাদের দখলমুক্ত হওয়ার পর রাজাকাররা দাদনচক হেমায়েত মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক ফাইজুর রহমানের বাবা হেরাস উদ্দীন মাস্টারকে আটক করে শিবগঞ্জ নিয়ে নির্যাতন করে। ৮ই অক্টোবর থানা থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফেরার পথে রাজাকাররা আবার তাঁকে আটক করে। ১০ই অক্টোবরের পর শিবগঞ্জ-বিনোদপুর রাস্তার উত্তর পাশের আখক্ষেতে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তারা তাঁকে হত্যা করে।
মনাকষা গণহত্যা সংঘটিত হয় ৭ই অক্টোবর। এদিন পাকবাহিনীর শিবগঞ্জ ক্যাম্পের একজন সুবেদারের নেতৃত্বে হানাদাররা মনাকষা ও পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে ১৭ জন সাধারণ মানুষকে ধরে আনে। তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায় এবং তাদের খোঁড়া কবরে ১৩ জনকে ফেলে গুলি করে হত্যা করে। ঐ কবরেই তাদের মাটিচাপা দেয়া হয়।
মোবারকপুর গণহত্যা সংঘটিত হয় ৬ই অক্টোবর। এদিন পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। এরপর কয়েকজন রাজাকারকে সঙ্গে নিয়ে মোবারকপুরের দিকে অগ্রসর হয়। পথে পড়ে একটি বিল। তারা বিলের পাড়ে পৌঁছে নৌকায় একজন জেলেকে দেখতে পায়। তাকে পার করে দিতে বললে সে তা না করে দ্রুত অপর পাড়ে চলে যায় এবং গ্রামের মানুষদের পাকসেনা আসার খবর দেয়। গ্রামের মানুষ প্রাণভয়ে পালিয়ে যায়, কেবল থেকে যায় কশিমুদ্দিন মণ্ডল নামে এক ব্যক্তি ও তার পরিবার। এর কারণ সে ছিল পিডিপি নেতা মমতাজ উদ্দিন আহমদ মিয়া (রাজশাহী-৪ আসন থেকে নির্বাচিত এমএনএ মো. খালেদ আলী মিয়া মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতে চলে গেলে তাঁর শূন্য আসনে ইয়াহিয়া সরকারের প্রহসনমূলক নির্বাচনে নির্বাচিত এমএনএ)-র একজন অনুগত কর্মী। পাকসেনারা এলে সে পাকিস্তানের পক্ষে স্লোগান দেয়। কিন্তু পাকসেনারা তাকে বিশ্বাস না করে তাকেসহ তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করে। ৬ই ও ৭ই অক্টোবর পাকবাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের সহযোগিতায় চাঁদশিকারি গ্রামে গণহত্যা চালিয়ে ২৪ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে, যা চাঁদশিকারি গণহত্যা নামে পরিচিত।
অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে বিনোদপুর গণহত্যার কুখ্যাত নায়ক মো. মাহিদুর রহমান (দাদনচক), কুবেদ আলি কুবা (পিয়ালিমারী), আমিন উদ্দীন চুটু (সাতরশিয়া) প্রমুখ শেরপুর ভাণ্ডারে আক্রমণ চালিয়ে এ গ্রামের ইলিয়াস মণ্ডল, গাজল, কালুমুদ্দীন মণ্ডল ও মিন্টুকে আটক করে শিবগঞ্জে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
২রা নভেম্বর রাজাকার বাহিনী ময়েজ মাস্টার (কালপুর), টুকু ডাক্তার (বাবুপাড়া), নজরুল ইসলাম লালান (জগন্নাথপুর), লোকমান খাঁ (সেলিমাবাদ) ও এত্তাজ (শেরপুর ভাণ্ডার)-কে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। প্রথম ৩ জনকে তারা সিও অফিসের পেছনের আমবাগানে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়। শেষের ২ জনকে নবাবগঞ্জ নিয়ে হত্যা করে।
৫ই নভেম্বর শিবগঞ্জ থানার রাজাকার কমান্ডার মাহিদুর রহমান দাদনচক রাজাকার ক্যাম্পের কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ও আরো কয়েকজন রাজাকার নিয়ে দাদনচক হেমায়েত মেমোরিয়ল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শরিফ উদ্দীন আহমদ (পিয়ালিমারী)-এর বাড়ি ঘেরাও এবং বাড়ি থেকে নগদ অর্থ ও সোনা লুট করে। লুণ্ঠনের পর শরিফ উদ্দীন আহমদকে বেঁধে তাঁর ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায়। তাঁকে চোখবাঁধা অবস্থায় রেখে তারা দাদনচক ক্যাম্পে ফিরে যায়।
সেন্টু রাজাকারের নেতৃত্বে একদল রাজাকার ৯ই নভেম্বর হাজারবিঘী গ্রামে গিয়ে আব্দুস সত্তার (পিতা আব্দুর রহমান মোল্লা), আব্দুর রাজ্জাক (পিতা আব্দুস সত্তার), সেরাজুল হক (পিতা আব্দুস সামাদ পণ্ডিত) ও ভুলু (পিতা সেকান্দার আলি)-কে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তারা বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাট করে শিবগঞ্জ ফিরে যায়।
কানসাট বাজারের শান্তি কমিটির সদস্য কুখ্যাত কাদির মিঞার প্ররোচনায় রাজাকাররা মধ্য-নভেম্বরে আব্দুর রাজ্জাক (পিতা সাইফুদ্দীন, গোপালনগর, কানসাট) ও আবু নসর (পিতা মৌলবি শামসুদ্দীন, কাঠগড়)-কে আটক করে শিবগঞ্জ নিয়ে ইয়াকুব বিশ্বাসের আমবাগানে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়াও সে আতাউর রহমান আতু, সেতাউর রহমান, মঞ্জুর প্রমুখকে রাজাকার বাহিনীতে নাম লেখাতে বাধ্য করে। কাদির মিঞা রাজকারদের দিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনের ওপর অত্যাচার চালত এবং অনেকের বাড়ি থেকে টাকা, সোনা, ধান-চাল ও গবাদি পশু লুণ্ঠন করাত।
কলাবাড়ি গণহত্যা সংঘটিত হয় ৬ই অক্টোবর, ১০ই অক্টোবর ও ২৭শে নভেম্বর। এতে মোট ২৪ জন গ্রামবাসী প্রাণ হারায়।
ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে শান্তি কমিটির সদস্যরা মতিউর রহমান (পিতা কয়েশ উদ্দীন)-কে শিবগঞ্জ বাজারের একটি দোকান থেকে ধরে পাকসেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্পের কমান্ডিং অফিসার তাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পাঠিয়ে দেয়। এরপর আর সে ফিরে আসেনি।
রাজাকারদের হামিদুর বাহিনী ও রাণহাটির হেন বাহিনী ভিন্ন- ভিন্ন তারিখে ছত্রাজিতপুরের ৭ জন এবং মনাকষার ৯ জনকে হত্যা করে।
আলবদর আশরাফ আলি ও তার বড়ভাই নেসার উদ্দীন পূর্ব শ্যামপুর ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামের মানুষের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন চালায়।
শিবগঞ্জ থানার কয়েদখানা, মনাকষার আফসার বিশ্বাসের বাড়ি, কলাবাড়ির রুহুল প্রফেসরের বাড়ি, আড়গাড়ার গুদাম প্রভৃতি বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করা হতো। আর সিও অফিসের পেছনের আমবাগান ও তথাকথিত পাকিস্তানের আমবাগান, আফসার বিশ্বাসের বাড়ির ছাদ, রুহুল প্রফেসরদের বাড়ির পাশের আমবাগান ও আড়গাড়ার আমবাগান-আখক্ষেত নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। শিবগঞ্জে কয়েকটি স্থানে গণকবর রয়েছে। স্থানগুলো হলো— শহরের তৈমুর রহমান মাস্টারের বাড়ির পেছনে জলার ধার, সিও অফিসের পেছনের আমবাগান, হুমায়ন রেজা উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে নদীর ধার, কলাবাড়ির আমবাগান, কলাবাড়ি ও মোবারকপুরের মধ্যবর্তী গড় এবং বিনোদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ। এছাড়া বালিয়াদিঘিতেও মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর রয়েছে।
১৩ই মে ডা. মঈন উদ্দিন আহমেদ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে মনাকষা থেকে পাকবাহিনীর দোসর রকিব বিশ্বাস ও আফসার বিশ্বাসকে গ্রেফতার করেন। এরা ছিল মুক্তিযুদ্ধের ঘোর বিরোধী এবং এলাকার মানুষের ওপর নানা রকম অত্যাচার চালাত। এ দুই কুখ্যাত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা ছিল শিবগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ও সফল অপারেশন।
১৯শে জুন পাকবাহিনীর একটি টহল দলের সঙ্গে জমিনপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩ ঘণ্টা স্থায়ী এক যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে শত্রুপক্ষের দুজন নিহত এবং একজন আহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা নব কুমার ব্যানার্জী (পিতা জানকীনাথ ব্যানার্জী, চৌকা, মনাকষা) এবং ওবায়দুল (ভোলাহাট) আহত হন। একই দিন রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গেরিলা দল কানসাট হয়ে পুকুরিয়া আসে এবং স্থানীয় দালালদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। মুক্তিযোদ্ধারা কানসাট উচ্চ বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মেহেদিপুর ফিরে যান। ১৫ই জুলাই ডা. মঈন উদ্দিন আহমেদ ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের নায়েক সুবেদার আনিসুর (দুর্লভপুর)-এর নেতৃত্বে এক দল মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনীর সিও অফিস ক্যাম্পে আক্রমণ চালান। পাকবাহিনী পাল্টা জবাব দেয়। কিছুক্ষণ পর মুক্তিযোদ্ধারা জমিনপুর ফিরে যান। এ-যুদ্ধে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
২০শে জুলাই আব্দুল কুদ্দুস ও আব্দুল লতিফ-সহ ৬ জন গেরিলা ভূষণ বৈরাগীর বাঁশ বাগানে অবস্থান গ্রহণ করে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে গুলি করেন। শত্রুপক্ষও পাল্টা জবাব দেয়। একঘণ্টা গুলি বিনিময়ের পর গেরিলা দল বিশ্বনাথপুর চলে যায়।
জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে হাবিলদার মোমতাজের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল কলাবাড়ির বেতবনে গোপন অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। পাকবাহিনীর একটি দল তাঁদের আওতার মধ্যে এলে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। এতে ২ জন পাকসেনা নিহত হয়। শত্রুসৈন্যরা পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকলে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান ত্যাগ করেন। পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে ১৩ জন সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার চালায়।
১লা আগস্ট অধ্যাপক শাহজাহান মিঞার নেতৃত্বে ২৯ জন মুক্তিযোদ্ধা আদিনা কলেজে স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে অবস্থান গ্রহণ করেন। পাকবাহিনী ক্যাপ্টেন শাহ আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে আদিনা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ করলে যুদ্ধ শুরু হয়। আদিনা যুদ্ধ-এ মুক্তিযোদ্ধা আ. লতিফ (বিশ্বনাথপুর) ও আনিসুর রহমান (নিয়ামতপুর) ঘটনাস্থলে শহীদ হন ৷ ১ জন গ্রামবাসীও শহীদ হন। এ-যুদ্ধে আহত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হক (কৃষ্ণগোবিন্দপুর) পরে শহীদ হন। এছাড়া আরো ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। অপরপক্ষে পাকবাহিনীর ৮ জন সৈন্য নিহত হয়।
১০ই আগস্ট মোহাম্মদ আলি কামালের নেতৃত্বে এক দল মুক্তিযোদ্ধা পাগলা নদীর পশ্চিম পাড়ে এসে কানসাটে অবস্থানরত পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি হানাদাররা পাল্টা আক্রমণ করে। এ-যুদ্ধে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
১১ই আগস্ট একজন সুবেদার মেজর ৬৪ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কলাবাড়ি পাকসেনা অবস্থানে দুঃসাহসিক অভিযান চালান। দুই ঘণ্টার অভিযানে পাকসেনারা কলাবাড়ি ছেড়ে কানসাট চলে যেতে বাধ্য হয়।
১৩ই আগস্ট ধোবড়া ও কলাবাড়িতে, ১৬ই আগস্ট দুর্লভপুরে এবং এর দুদিনের মধ্যে শরনগর ও পারকালপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। কানসাট জয়ের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের গোলন্দাজ বাহিনী ১৪ই আগস্ট থেকে কানসাটের ওপর গোলা বর্ষণ করতে থাকে। ২৩শে আগস্ট ক্যাপ্টেন ইদ্রিস, সুবেদার মেজর এম এ মজিদ ও শাজাহান মিঞা যৌথভাবে কানসাটে শত্রুদের অবস্থানে তীব্র আক্রমণ চালান। মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ আক্রমণে পাকবাহিনী কানসাট ছাড়তে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সামনে অগ্রসর হয়ে কানসাট কলেজ পর্যন্ত পৌছান। ৪ ঘণ্টা স্থায়ী এ-যুদ্ধ চলাকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা বিপুলসংখ্যক পাকসেনা যুদ্ধরত হানাদারদের সঙ্গে যুক্ত হয়। শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার পর শত্রুবাহিনী তীব্র পাল্টা-আক্রমণ চালালে মুক্তিযোদ্ধারা কলাবাড়িতে নিজেদের ক্যাম্পে ফিরে যান। এ- যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মিঞা আহত হন।
ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ও সুবেদার মেজর এম এ মজিদ ২৬শে আগস্ট পাকবাহিনীর কানসাট-অবস্থানে আবার আক্রমণ চালান। এবারও পাকবাহিনী পেছনে সরে যেতে বাধ্য হয়। কানসাট মুক্তিবাহিনীর দখলে এলেও তা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। শত্রুবাহিনী প্রচণ্ড পাল্টা-আক্রমণ চালিয়ে তা পুনর্দখল করে। মুক্তিযোদ্ধারা কলাবাড়ি ক্যাম্পে ফিরে যেতে বাধ্য হন। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ওমর আলি ১০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে নৌকায় পারকালপুর থেকে কালপুর পৌঁছান এবং পাকবাহিনীর কালপুর বাংকারে গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। এতে ভাদু নামে এক রাজাকার নিহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরার চেষ্টাকালে জয়নাল নামে আর এক রাজাকার নিহত হয়। এখান থেকে শত্রুপক্ষের দুটি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।
৬ই অক্টোবর পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কলাবাড়ি-ধোবড়া অবস্থানে আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা-আক্রমণ করলে দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এক সময় মুক্তিযোদ্ধারা পেছনে সরে যেতে বাধ্য হন। পাকসেনারা কলাবড়ি-ধোবড়া তাদের দখলে নেয়। কলাবাড়ি-ধোবড়া যুদ্ধে অন্তত ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
কলাবাড়ি-ধোবড়া দখলে নেয়ার পর পাকস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের বাজিতপুর প্রতিরক্ষাব্যূহ আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করে পেছনে সরে যান। শরত্নগর আক্রান্ত হলে এখানেও মুক্তিযোদ্ধারা এভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন। ফলে এ দুই স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো ক্ষতি হয়নি।
পাকসেনারা শরত্নগর দখল করার পর মুক্তিযোদ্ধাদের আটবিঘী প্রতিরক্ষাব্যূহ আক্রমণ করে। এখানে যুদ্ধ করার পর মুক্তিযোদ্ধারা সরে গিয়ে দুর্লভপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের শক্তি বৃদ্ধি করেন। তবু তাঁদের পক্ষে বেশিক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। কারণ বিনোদপুর জয় করে মনাকষায় আসা পাকবাহিনী পশ্চিম দিক থেকে এবং আটবিঘী থেকে শিবগঞ্জ ঘাট হয়ে অগ্রসর হতে থাকা পাকবাহিনী পূর্ব দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করে। বেগতিক দেখে মুক্তিযোদ্ধারা আমতলা নদীর দিকে সরে যান এবং পনেরশিয়া গ্রামে অবস্থান গ্রহণ করেন। ‘হিট এন্ড রান’ কৌশল অবলম্বন করায় মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো ক্ষতি হয়নি।
বিনোদপুর উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্প ছিল মূলত একটি রিক্রুটমেন্ট কেন্দ্র। এখানে মাত্র কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। পাকবাহিনী সহজেই এ ক্যাম্প দখল করে নেয়। চারজন মুক্তিযোদ্ধার একটি টহল দল ৭ই অক্টোবর বহলাবাড়ি ফেরিঘাটের পশ্চিম পাড়ে পৌঁছালে রাজাকাররা তাঁদের ওপর গুলি বর্ষণ করে। মুক্তিযোদ্ধারাও জবাব দেন। কিছুক্ষণ গুলি বিনিময়ের পর রাজাকাররা নীরব হয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পে ফিরে যান।
৮ই অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধা তাজেবুলের নেতৃত্বাধীন টহল দলের সঙ্গে শামসু মোল্লার টোলায় রাজাকারদের যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমানের মাথায় গুলি লাগে। তাঁকে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর হাসপাতালে নেয়া হলে ৯ই অক্টেবর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৯ই অক্টোবর মেজর গিয়াস ইসলামপুর থেকে রাধাকান্তপুর হয়ে দোরশিয়ায় পৌঁছে রাণীহাটি ও বহরম রাজাকার ক্যাম্পের ওপর বেশ কিছুক্ষণ বোম্বিং করেন।
১০ই অক্টোবরের পূর্ব পর্যন্ত শিবগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে ছিল। এ অঞ্চলের দৌরশিয়া, ছোট নম্পট, বড় নম্পট, মোল্লাটোলা প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ও প্রতিরক্ষা কেন্দ্র ছিল। পাকসেনারা ১০ই অক্টোবর এ অঞ্চলে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ প্রতিহত করলে যুদ্ধ শুরু হয়। দুঘণ্টা যুদ্ধ করার পর মুক্তিযোদ্ধারা পেছনে সরে পদ্মার চরে চলে যান। ৬ই অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা কলাবাড়ি-ধোবড়া থেকে সরে এসে সোনামসজিদ সংলগ্ন আমবাগানে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করেন। ১৪ই অক্টোবর পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের এ অবস্থানে আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ করেন। এতে ২ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলগত কারণে পশ্চাদপসরণ করলে ক্ষুব্ধ পাকসেনারা সালামপুর গ্রামে প্রবেশ করে ৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে ধোবড়া চলে যায়। ২১শে অক্টোবর আবার এখানে যুদ্ধ হয়। এতে ৭- ৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনারা ঐদিনই শক্তি বৃদ্ধি করে আবার আক্রমণ করলে ৮-১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ-যুদ্ধ আমবাগান যুদ্ধ নামে পরিচতি।
ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর, লে. রফিক ও লে. কাইউম ৮০-৮৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ২২শে অক্টোবর পাকসেনাদের আড়গাড়াহাট ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। প্রথম আঘাতে শত্রুপক্ষের অনেকে পালাতে শুরু করে। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ-কেউ বিজয় অর্জিত হয়েছে মনে করে নিজেদের অবস্থান ছেড়ে দাঁড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠেন। সঙ্গে-সঙ্গে বাংকার থেকে শত্রুরা গুলি ছুড়তে শুরু করে। এতে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং একবরপুরের নেসার উদ্দীন, শ্যামপুরের হেলাল উদ্দীন-সহ ৪ জন আহত হন। পরিস্থিতি প্রতিকূলে যাওয়ায় ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে সরার নির্দেশ দেন। আহতদের ১ জন ৩ দিন পর হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ যান।
আগড়াহাট আক্রান্ত হলে ধোবড়ার পাকসেনারা যাতে সেখানে যেতে না পারে, সেজন্য ১৯শে অক্টোবর তিন প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধাকে শত্রুদের প্রতিহত করতে পাঠানো হয়। পরিকল্পনা মোতাবেক এক প্লাটুন ধোবড়া বাজারে, এক প্লাটুন নামো ধোবড়ায় এবং অন্য প্লাটুন সন্ন্যাসীর দক্ষিণ দিকে অবস্থান গ্রহণ করে। আড়গাড়ায় যুদ্ধ (আড়গারার প্রথম যুদ্ধ) শুরু হলে এখানকার মুক্তিযোদ্ধারাও গুলতে ছুড়তে শুরু করেন। শত্রুপক্ষও পাল্টা গুলি করে। ফলে যুদ্ধ বেঁধে যায়। এ-যুদ্ধে ২ জন পাকসেনা নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। এখানে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ৩ জন আহত হন। সীমান্তবর্তী আজমতপুর গ্রামে দুই প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধার একটি ক্যাম্প ছিল। শাহজাহান মিঞা ও ইদ্রিস আহমদ প্লাটুন দুটির কমান্ডার ছিলেন। ৫ই অক্টোবর ইদ্রিস আহমদ আজমতপুর ছেড়ে তাঁর প্লাটুনের যোদ্ধাদের নিয়ে তেলকুপি বিওপি সংলগ্ন গ্রামে অবস্থান নেন। ৬ই অক্টোবর তেলকুপিতে আক্রমণ করার জন্য কলাবাড়ি-ধোবড়া থেকে একদল পাকসৈন্য শাহবাজপুর হয়ে ভাগুয়ার ঘাটে এবং আর একদল বিনোদপুর-ছোট টাপ্পু হয়ে তেলকুপির কাছাকাছি আসে। প্লাটুন কমান্ডার ইদ্রিস হানাদারদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তাঁর যোদ্ধাদের প্রস্তুত করেন। পূর্ব-দক্ষিণ দিক থেকে শুরু হওয়া আক্রমণ প্রতিহত করতে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা জবাব দেন। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা আজমতপুরের দিকে সরে তেলকুপির পানি নিষ্কাশন প্রণালি পার হয়ে উত্তর পাড়ে চলে যান। শাহজাহান মিঞার দল তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় শরসানী বিএসএফ ক্যাম্প থেকে মেশিনগানের কভারিং ফায়ার। উদ্দেশ্য সফল করা সম্ভব নয় বুঝে পাকসেনারা তেলকুপি ছেড়ে চলে যায়। এ-যুদ্ধে ৬-৭ জন শত্রুসেনা মারা যায়।
৬ই নভেম্বর তেলকুপি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে ৬-৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। এক পর্যায়ে তারা পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা ৪ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে এবং কয়েকটি বাড়িঘরে আগুন দেয়।
ধোবড়ায় শত্রুবাহিনীর একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ঘাঁটি ছিল। ৮ই নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা এ ঘাঁটিতে আক্রমণ করেন। পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ করলে দুপক্ষের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ চলে। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা কৌশল পরিবর্তন করে নিজেদের পূর্ববর্তী অবস্থানে ফিরে যান।
রাধাকান্তপুর ক্যাম্পে মেহেদিপুর ও ছত্রাজিতপুরের রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। এর কমান্ডার ছিল ছত্রাজিতপুরের সাইকেল মেকার হারুন। চরপাঁকায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প ছিল। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে প্লাটুন কমান্ডার মোহা. ইসমাইল ৩২-৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে রাধাকান্তপুর রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণে বের হন। চরিয়াপাড়ায় পৌঁছে তাঁরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে এক দল তাজেবুল তাজার নেতৃত্বে বড় নম্পটের উত্তরের ফাঁকা মাঠের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। অপর দল মোহা. ইসমাইলের নেতৃত্বে চরিয়াপাড়া রাধাকান্তপুর হাটের পশ্চিম দিক দিয়ে শত্রুদের ক্যাম্পের কাছে পৌঁছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে তার কেটে টেলিফোন সংযোগ বিছিন্ন করা হয়। তারপর মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। পাকিস্তানিরা পাল্টা আক্রমণ করলে যুদ্ধ শুরু হয়। এক সময় শত্রুরা গুলি ছোড়া বন্ধ করে দেয়। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা মো. মঞ্জুর আলি মাদ্রাসার জানালা দিয়ে গ্রেনেড চার্জ করার জন্য মাদ্রাসার দিকে এগিয়ে গেলে রাজাকারদের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হন। আর একটি গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা ওয়াহাবের ডান হাত ছিন্ন হয়ে যায়। পরে মুক্তিযোদ্ধা মো. মঞ্জুর আলি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল নূরুজ্জামানের সঙ্গে পরামর্শক্রমে মেজর গিয়াস ও ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর পাকবাহিনীর আড়গাড়াহাট ঘাঁটিতে আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯শে নভেম্বর আক্রমণ পরিচালিত হয়। বালিয়াদিঘি থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধা এবং বাটা ও কায়শিয়াবাড়িতে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা লে. কর্নেল জামান, ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর এবং মেজর গিয়াসের নেতৃত্বে তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে নির্দিষ্ট অবস্থানে পৌঁছে। গোলন্দাজ বাহিনীকে গোলা নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেয়া হয়। গোলন্দাজ বাহিনীর ছোড়া প্রথম গোলা শত্রুবাহিনীর বেজ ক্যাম্পের ছাদে পড়ে। গোলার আঘাতে ছাদ ধসে রাজাকার কমান্ডার ফরহাদ আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ১ জন রাজাকার মারা যায় এবং ১ জন জীবিত ধরা পড়ে। দ্বিতীয় গোলা পড়ে গোডাউনের ছাদে। এতে শত্রুসেনারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পালাতে শুরু করে। অল্পক্ষণের মধ্যেই আড়গাড়া শত্রুমুক্ত হয়।
ধোবড়া যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৭ই নভেম্বর, ১৯শে নভেম্বর, ২০শে নভেম্বর, ২৫শে নভেম্বর ও ৩০শে নভেম্বর। এসব যুদ্ধে ২ জন পাকসেনা নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। অপরপক্ষে ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৩ জন আহত হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ বালিয়াদিঘি গণকবরএ দাফন করা হয়।
শাহাপুর গড় দখল করে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর বালিয়াদিঘি সাব- সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সে এসে ধোবড়া আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। তিনি তিন প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ২৫শে নভেম্বর ধোবড়া আক্রমণ করেন। ঘণ্টাখানেক যুদ্ধ করার পর ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে রণাঙ্গন থেকে সরে আসেন। এ-যুদ্ধে প্লাটুন কমান্ডার ইসমাইল আহত হন। ধোবড়ায় চতুর্থবার আক্রমণ করা হয় ৩০শে নভেম্বর। শাহবাজপুর নলডুবরি হাট থেকে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা এ আক্রমণে অংশ নেন। মুক্তিযোদ্ধারা ভোরবেলা আক্রমণ করলে শত্রুরাও পাল্টা আক্রমণ করে। সকাল ৮ টার দিকে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা পেছনে সরে আসেন। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ৬ই ডিসেম্বর গাইডহারায় মুক্তিযোদ্ধা ও পাকসেনাদের মধ্যে এক যুদ্ধ হয়। গাইডহারা যুদ্ধ-এ ২০-২৫ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয়। ১১ই ডিসেম্বর প্রায় ৬০ জন রাজাকার ও আলবদর শিবগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে গ্রেফতার হয় এবং এদিনই শিবগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
শিবগঞ্জের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. আব্দুল করিম (পিতা মো. সহিমুদ্দীন, শিবগঞ্জ; ১৩ই এপ্রিল রাজশাহীর বেলপুকুর যুদ্ধে শহীদ), মো. খোদা বক্স (পিতা মো. শুকুরুদ্দীন, চতুরপুর; ১৩ই এপ্রিল রাজশাহীর বেলপুকুর যুদ্ধে শহীদ), মো. জিব্রাইল মোমিন (পিতা গিয়াস উদ্দীন, চতুরপুর; ১৩ই এপ্রিল রাজশাহীর বেলপুকুর যুদ্ধে শহীদ), মো. মফিজ উদ্দীন (পিতা মো. সিরাজ উদ্দীন, দেওয়ান জায়গীর; ১২ই ডিসেম্বর বারঘোরিয়ায় শহীদ), মো. আব্দুস সালাম (পিতা মো. সাজ্জাদ আলি, শাহবাজপুর; ১৯শে নভেম্বর ধোবড়া যুদ্ধে শহীদ), মো. মতিউর রহমান (পিতা আব্দুস সোবহান বিশ্বাস, চাঁদপুর; ১৯শে নভেম্বর ধোবড়া যুদ্ধে শহীদ), মো. আব্দুল মান্নান (পিতা মুর্তুজা আলম, আজমতপুর), মো. আব্দুল কুদ্দুস (পিতা মো. সেতাউর রহমান বিশ্বাস, কান্তিনগর; ২৫শে নভেম্বর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসে রাজাকারদের হাতে ধৃত, পরে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে শারীরিকভাবে নির্যাতিত ও গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ), আব্দুস সাত্তার (পিতা বিদু মণ্ডল, পুখুরিয়া, কানসাট রাজশাহী প্রতিরোধযুদ্ধে কাঁটাখালিতে শহীদ), আব্দুল লতিফ (পিতা জায়েদুর রহমান, বিশ্বনাথপুর; ১লা আগস্ট আদিনা কলেজ চত্বর যুদ্ধে শহীদ), নীলু (পিতা আফতাব উদ্দীন, শিবনগর; ১৪ই ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের রেহাইচরে শত্রুর ব্যাংকারে হাতবোমা ছোড়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ), আব্দুস সাত্তার (পিতা কাওসার আলি, কয়লাদিয়াড়, ভবানীপুর; ১৯শে নভেম্বর শহীদ), আনেশুর রহমান (পিতা হাজী আসাবুদ্দীন, কয়লাদিয়াড়, ভবানীপুর; ১৪ই ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের রেহাইচরে মারাত্মকভাবে আহত এবং পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে মৃত্যু), মো. মাহতাব উদ্দীন (পিতা মো. রুস্তুম আলি, হাজারবিঘী; দিনাজপুরের হিলি সীমান্ত এলাকার যুদ্ধে শহীদ), মো. নূরুল ইসলাম (পিতা এমাজুদ্দীন মোল্লা, হাদিনগর, ভবানীপুর; কলাবাড়ি যুদ্ধে শহীদ), আব্দুর রহমান রিপু (পিতা জহাক মণ্ডল, বাজিতপুর নতুন গ্রাম; ২০শে নভেম্বর ধোবড়া যুদ্ধে আহত হয়ে আটক, শত্রুরা নির্মম নির্যাতন শেষে হত্যা করে), বিশু মণ্ডল (পিতা হাবল মণ্ডল, বাজিতপুর নতুন গ্রাম; ২০শে নভেম্বর ধোবড়া যুদ্ধে শহীদ), আইনাল হক (পিতা কুড়ান মণ্ডল, বাজিতপুর; ২০শে ধোবড়া যুদ্ধে আহত হয়ে রাজাকারদের হাতে আটক, রাজাকাররা কলাবাড়ি নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে), আবুল হাসনাৎ বেনা মিঞা (পিতা এরত্তেজ আলি মিঞা, শরত্নগর; ২৫শে মার্চ ঢাকার পিলখানায় পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে শহীদ), মো. সামায়ন হোসেন (পিতা বেলাল হোসেন, রাধানগর; ৬ই অক্টোবর কলাবাড়ি যুদ্ধে শহীদ), মো. মোজাম্মেল হক (পিতা সুলতান মণ্ডল, আটরশিয়া; চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের রেহাইচর যুদ্ধে শহীদ), মো. নূরুজ্জামান (পিতা আফতাব উদ্দীন, খড়িয়াল; ১৩ই ডিসেম্বর বালুঘাট সংলগ্ন সীমান্ত এলাকার যুদ্ধে শহীদ), মো. নেফারুল হক (পিতা উমেদ আলিন, পারচৌকা, মনাকষা; প্রতিরোধযুদ্ধ চলাকালে নগরবাড়িতে পাকসেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ), মো. কুবোল আলি (পিতা আমজাদ আলি, পাচৌকা; সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে নভেম্বরে শহীদ), মো. ইলিয়াস আলি (পিতা সিদ্দিক আহমদ মণ্ডল, রাণীনগর; ইপিআর-এর সৈনিক, ১৯শে এপ্রিল শহীদ), মো. হাবিবুর রহমান (পিতা সাঈদ আলি, গঙ্গাধরপুর; ৮ই অক্টোবর টহলে গিয়ে দশলশিয়া গ্রামে রাজাকারদের গুলিতে আহত, পরদিন বহরমপুর হাসপাতালে মৃত্যু), মো. মফিজুল হক (পিতা মো. এজাবুল হক, রাণীনগর; ১২ই ডিসেম্বর শহীদ), মো. মজিবুল হক (পিতা এন্তাজ আলি, বড় নম্পট; ৬ই অক্টোবর কলাবাড়ি যুদ্ধে শহীদ), মো. মঞ্জুর আলি (পিতা সলিম উদ্দীন, বাবুপুর; রাধাকান্তপুর মাদ্রাসা যুদ্ধে আহত, পরে বহরমপুর হাসপাতালে মৃত্যু), আব্দুল মান্নান (পিতা রমজান আলি বিশ্বাস, কমলাকান্তপুর; ২০শে নভেম্বর ধোবড়া যুদ্ধে শহীদ) এবং মো. ইয়াসিন আলি (পিতা সেকান্দার আলি, রশিকনগর; ২২শে অক্টোবর আড়গাড়াহাট যুদ্ধে শহীদ)।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে উপজেলা পরিষদ মুক্তিযোদ্ধাদের বালিয়াদিঘি গণকবরকে প্রাচীরবেষ্টিত করেছে এবং মধ্যভাগে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করেছে। সোনামসজিদ চত্বরে অবস্থিত সেক্টর কমান্ডার নাজমুল হক (শুরু থেকে ২৩শে সেপ্টেম্বর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ৭ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার) ও মহদিপুর সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর, বীরশ্রেষ্ঠ-এর কবর বাঁধানো হয়েছে। মোবারকপুর ইউনিয়ন পরিষদ নিজস্ব চত্বরে একটি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছে। বিনোদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠের দক্ষিণ পাশে ৬ ও ৭ই অক্টোবর শত্রুবাহিনীর গুলিতে শহীদ ৩৯ জন মানুষের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। দোরশিয়া, ছোট নম্পট, বড় নম্পট প্রভৃতি গ্রামের ৫৯ জন শহীদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছিল। এটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সোনামসজিদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে। বিশ্বনাথপুরে প্রথমে শহীদ আব্দুল লতিফ ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং পরে এটিকে স্কুলে রূপান্তরিত করে শহীদ আব্দুল লতিফ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ধোবড়া বাজারে শহীদ আব্দুস সাত্তার স্মৃতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আদিনা কলেজ যুদ্ধে শহীদ আব্দুল লতিফ ও আনিসুর রহমানকে কলেজ-সংলগ্ন স্থানে কবর দেয়া হয়। আদিনা কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁদের কবর বাঁধিয়ে দিয়েছে। [তামিজ উদ্দীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড