মুক্তিযুদ্ধে শিবগঞ্জ উপজেলা (বগুড়া)
শিবগঞ্জ উপজেলা (বগুড়া) ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সাতই মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতিকে একটি সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের দিকে ধাবিত করে। তাঁর ভাষণের পর সারা দেশের ন্যায় শিবগঞ্জের মানুষও আন্দোলনমুখর হয়ে ওঠে এবং তারা দ্রুত সংগঠিত হতে থাকে। ২৩শে মার্চ শিবগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এতে নেতৃত্ব দেন শিবগঞ্জ থানা ছাত্রলীগ-র সাধারণ সম্পাদক এম এ মজিদ।
২৬শে মার্চ বিকেলে শিবগঞ্জের রেজিস্ট্রি অফিস চত্বরে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য দেন। সভার শেষে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক হন সাব-রেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান। ২৭শে মার্চ থেকে শিবগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেন মো. হাফিজার রহমান শেখ। এপ্রিল মাসের শেষদিকে মুক্তিযোদ্ধা বাদশার নেতৃত্বে শিবগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান এবং সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
শিবগঞ্জ উপজেলা ছিল ১১ নং সেক্টরের অধীন, যার কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন ইদ্রিস। ময়দানহাটা ইউনিয়নের মজুমদার পাড়া গ্রামে স্থাপিত মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হতো। এ ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন আব্দুস সাত্তার।
এলাকার ছাত্র-জনতা মহাস্থান থেকে শিবগঞ্জ পর্যন্ত গাছ কেটে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৪ঠা এপ্রিল গোবিন্দগঞ্জের কাঁটাখালি সেতু দিয়ে পাকবাহিনী শিবগঞ্জে অনুপ্রবেশ করে। এরপর তারা সাবেক সিও অফিস (বর্তমান উপজেলা পরিষদ), বিএডিসি অফিস এবং শিবগঞ্জ থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
পাকবাহিনীকে সহায়তার জন্য শিবগঞ্জে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। শান্তি কমিটির সভাপতি ছিল মো. মোবারক হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক দানিজ উদ্দিন ফকির। এখানে রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিল শতাধিক। তাদের মধ্যে শিবগঞ্জ ইউনিয়নের ৩৪ জন, দেউলির ২২ জন, রায়নগরের ২০ জন, মোকামতলার ১১ জন, আটমুলের ৫ জন, সৈয়দপুরের ৪ জন, বুড়িগঞ্জ ও ময়দানহাটার ৩ জন এবং বিহারের ১ জন ছিল। রাজাকারদের মধ্যে বেশি তৎপর ছিল— আবুল হোসেন, বাচ্চু মিয়া, মজিবর রহমান, হোলা মিয়া, মোখলেছার রহমান, রমজান আলী, ওয়াজেদ আলী, ছপি উদ্দিন, ছালাম উদ্দিন, তৈয়ব আলী, দবির উদ্দিন ও মমতাজ উদ্দিন। পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা এ উপজেলায় ব্যাপক হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারীনির্যাতন চালায়।
৪ঠা এপ্রিল স্থানীয় রাজাকার আবুল হোসেনের সহায়তায় পাকবাহিনী মজুমদার পাড়া গ্রামে ঢুকে বাড়িঘরে আগুন দেয় এবং সেখানকার মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করে। তারা ক্যাম্প দখল করে বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে তাতে আগুন দেয় এবং ক্যাম্পের কমান্ডার আব্দুস সাত্তারসহ ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ড মজুমদার পাড়া গণহত্যা পরিচিত। মে মাসের প্রথম রোববার এখানে পাকবাহিনী আরেকটি আক্রমণ চালায়। এতে একজন লোক শহীদ হন। একই দিন পাকবাহিনী শিবগঞ্জ সদরে বর্বরোচিত হামলা চালায়। এ-সময় তাদের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে আবুল হোসেন নামে একজন পানের দোকানদার নিহত এবং সরকারি কর্মচারী এমদাদুল হকসহ ৩ জন আহত হন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার অভিযোগে মোকামতলা এলাকায় আফজাল হোসেন, হরগোবিন্দ ও তারাজুল ইসলাম নামে ৩ ব্যক্তিকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যায়। তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা উপজেলার নারায়ণপুর, উথলী ও ধোন্দাকোলা গ্রামে গিয়ে বহু নারীকে নির্যাতন করে। পরবর্তীতে তারা লোকলজ্জার ভয়ে দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। পাকবাহিনী বানাইল গ্রামের স্বদেশ চন্দ্র মোহন্তের বাড়িতে লুটপাট চালায়। জুন মাসে তারা একই গ্রামের ব্যবসায়ী রবীন্দ্রনাথ মোহন্ত ওরফে বাদলের দোকান পুড়িয়ে দেয়। পোড়া দোকানটি মেরামত করে পুনরায় ব্যবসা শুরু করলে মুসলিম লীগ-এর কয়েকজন কর্মী তাকে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু বৃদ্ধা মা, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও ছোট ৪ ছেলেমেয়েকে নিয়ে তিনি যেতে রাজি হননি। এরপর শিবগঞ্জ থানার ক্যাম্প থেকে পাকবাহিনীর দোসররা এসে ১১ই জুন তাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর থেকে তার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। শিবগঞ্জ উপজেলার থানা ভবন এবং বিএডিসি ভবনের পেছনে পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ছিল। বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বাধীনতাকামী
মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে এ-দুটি স্থানে নির্যাতন করা হতো।
শিবগঞ্জ উপজেলার থানা ভবনের পেছনে ওয়াপদা ড্রেনের কাছে বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিকামী লোকজনদের ধরে এনে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়া হতো। তাই এ স্থানটি শিবগঞ্জ ওয়াপদা ড্রেন বধ্যভূমি ও গণকবর নামে পরিচিত শিবগঞ্জ উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হয়, যা শিবগঞ্জ হাট যুদ্ধ নামে পরিচিত। ৭ই ডিসেম্বর বিকেলে পাকসেনারা শিবগঞ্জ হাটে সমবেত হলে এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের ওপর বোমা হামলা চালালে যুদ্ধ শুরু হয়। এতে হাটুরেসহ ৫ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে হানাদার বাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ১৩ই ডিসেম্বর বগুড়া সদর উপজেলার টেংরা নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধা হাফিজার রহমান শেখ কয়েকজন সহযাদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে একদল পাকসেনাকে ধাওয়া করেন। এক পর্যায়ে পাকসেনারা একটি গাছে উঠে পড়লে হাফিজার ক্রলিং করে সেই গাছের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। এ-সময় পাকসেনারা গুলি চালালে হাফিজারের বুকে গুলি লাগে। এতে তিনি ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। ১৪ই ডিসেম্বর শিবগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। শিবগঞ্জের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- হাফিজার রহমান শেখ (পিতা মো. খেজমতুল্লাহ শেখ, সাদুল্লাপুর) এবং আব্দুস সাত্তার (পিতা আলিম উদ্দিন, শিহালী)।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হাফিজার রহমান শেখের নামে শিবগঞ্জ উপজেলা অডিটোরিয়াম এবং আমতলী থেকে দাড়িয়াদহ পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। [প্ৰদীপ মোহন্ত]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড