শাহপুর গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)
শাহপুর গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা) সংঘটিত হয় ১০ই নভেম্বর। এতে ১৫ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক শহীদ হন। খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার শাহপুর গ্রামের অবস্থান উপজেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তরে। শাহপুর গ্রামের কাছে ১৯৭১ সালে একটি বর্ধিষ্ণু বাজার ছিল। নভেম্বর মাসে এ বাজারে স্বাধীনতাবিরোধীদের একটি সভা আহ্বান করা হয়। প্রচার করা হয়েছিল যে, সভায় খুলনার
মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর আসবে। এ সভায় এলাকার হিন্দু অধিবাসীদের হাজির করার বিশেষ চেষ্টা নেয়া হয়। ভারতে শরণার্থী সমস্যার কারণে পাকিস্তান তখন আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক চাপের মধ্যে ছিল। হিন্দুদের সমবেত করে তারা দেখানোর চেষ্টা করছিল যে, যারা ভারতে শরণার্থী হয়ে গিয়েছিল তারা ফিরে আসছে। সভার বেশ কয়েকদিন আগে থেকে মুসলিম লীগের সদস্যরা হিন্দু বাড়িগুলোতে গিয়ে তাদের সভায় যেতে উদ্বুদ্ধ করে। হিন্দুদের অধিকাংশই তখন ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে। অত্যন্ত দরিদ্র বেতশিল্পী ও চর্মজীবী কিছু হিন্দু তখন শাহপুর গ্রামে ছিল।
১০ই নভেম্বর শাহপুর বাজারে স্বধীনতাবিরোধীরা মিছিল করে। মিছিল শেষে তাদের জনসভা হওয়ার কথা ছিল স্থানীয় গরুর হাটে। কিন্তু সেটি শুরু হয় শাহপুর গ্রামের রহমান বিশ্বাসের খেজুর বাগানে। সভায় উপস্থিত ছিল খুলনা জেলা শান্তি কমিটি-র চেয়ারম্যান আবদুল আহাদ খান, সেক্রেটারি মাওলা বখশ গোলদার (চিংড়া, শোভনা, ডুমুরিয়া) এবং খুলনা মহকুমার আলবদর কমান্ডার হাবুিল্লাহ হক (ফুলতলা)। বেশকিছু পাকিস্তানি সেনাও সেদিন সভাস্থলে আসে। এক পর্যায়ে আলবদর কমান্ডার হাবিবুল্লাহ হক যেসব হিন্দু ভারত থেকে ফিরে এসেছে, তাদের হাত তুলতে ও ভারতে অবস্থানের কাহিনি শোনাতে বলে। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৫ জনের মতো হিন্দু মঞ্চের কাছে পৌঁছালে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা অস্ত্রের মুখে তাদের দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। এরপর তাদের নিয়ে শাহপুর বাজারের দিকে রওনা হয়। আটক পঞ্চানন কুণ্ডু তার ৪টি শিশু সন্তানের দোহাই দিয়ে তাকে না মারার জন্য অনুনয় করেন। কিন্তু এতে তাদের মনে এতটুকু করুণার উদ্রেক হয়নি। হাশেম আলী সরদারের নারকেল বাগানে নিয়ে পঞ্চানন কুণ্ডুকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর একে-একে আটক সবাইকে গুলি করে হত্যা করে ফেলে রেখে যায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে দেবশূল নামের ৮ বছরের একটি শিশু পিতার কাছে জল চাচ্ছিল। কিন্তু পিতা নলিনীকান্ত তখন গুলিতে মৃত। এক পর্যায়ে শিশুটির এ ‘জল জল’ করে চিৎকার শুনে রাজাকাররা এসে তার পেটে বেয়নেট ঢুকিয়ে দেয়। নিথর হয়ে যায় শিশুটি।
শাহপুর গণহত্যায় নিহতদের মরদেহ একদিন ঐ নারকেল বাগানে পড়ে ছিল। কেউ এগুলোর সৎকার করতে সাহস পায়নি। পরের দিন স্থানীয় কিছু লোক পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে মৃতদেহগুলো পার্শ্ববর্তী নদীতে ফেলে দেয়। তখন থেকে স্থানটির নাম হয় ‘মরণতলা’। এ গণহত্যায় নিহত ১২ জনের নাম পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন- পঞ্চানন কুণ্ডু (পিতা দেবেন্দ্রনাথ কুণ্ডু, শাহপুর), নকুল দাস (পিতা ঠাকুর দাস, শাহপুর), অবিনাশ দাস (পিতা ঠাকুর দাস, শাহপুর), সখীচরণ বিশ্বাস (পিতা ক্ষিতীশ চন্দ্র বিশ্বাস, শাহপুর), নলিনীকান্ত বিশ্বাস (পিতা ক্ষিতীশ চন্দ্র বিশ্বাস, শাহপুর), দেবশূল বিশ্বাস (পিতা নলিনীকান্ত বিশ্বাস, শাহপুর), মান্দার বিশ্বাস (পিতা শ্রীদাম বিশ্বাস, শাহপুর), নীরোদ জোদ্দার (শাহপুর), ব্রজেন সাহা (শাহপুর), জ্ঞানেন্দ্ৰ মণ্ডল (পিতা চিন্তারাম মণ্ডল, আন্দুলিয়া), অনাথ মণ্ডল (পিতা জীবন মণ্ডল ওরফে পাঁচো, আন্দুলিয়া) এবং গুরুপদ বিশ্বাস (পিতা শ্রীকান্ত বিশ্বাস, হাসানপুর)। [দিব্যদ্যুতি সরকার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড