শিঙ্গারী গাঁ গণহত্যা (কাহারোল, দিনাজপুর)
শিঙ্গারী গাঁ গণহত্যা (কাহারোল, দিনাজপুর) ২৬শে মে সংঘটিত হয়। এতে ৪৭ জন লোক শহীদ হন।
ঘটনার দিন কাহারোল থেকে শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেবার জন্য বোচাগঞ্জ উপজেলার দমনীঘাট এলাকার তেতরা বর্ডার দিয়ে অসংখ্য মানুষ যাবার সময় শুকদেবপুর এলাকায় পাকসেনারা তাদের বন্দি করে। এ সময় শিঙ্গারী গাঁ গ্রামের ৪৭ জনকে তারা হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডের সময় দলের ৩ জনকে ক্যাম্পের একটি ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। তারা হলেন শিঙ্গারী গাঁয়ের অধিবাসী ললিত মোহন রায়ের ৩ পুত্র কিশোরী মোহন রায়, পঞ্চানন রায় ও অনিল চন্দ্র রায়। তিনজনই ঘরের জানালা ভেঙে পালাতে সক্ষম হলেও পরবর্তীতে তারা শহীদ হন। সেদিন গুলিতে আহত অনেকেই ভারতের রায়গঞ্জে গিয়ে চিকিৎসা নেন। শহীদদের মধ্যে একজন ভটরা শিং সম্পদশালী ছিলেন। এটা জানতে পেরে পাকসেনারা তার লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তরে শর্ত দেয় যে, শরীরের ওজনে টাকা দিতে হবে। কিন্তু টাকা না দেয়ায় পাকবাহিনী তার গলা কেটে রেখে যায়। মহেশচন্দ্র নামে একজনের শরীরের চামড়া কেটে লবণ দিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করে। মহেশচন্দ্র অত্যন্ত সৎ ও পরোপকারী মানুষ ছিলেন। স্থানীয় ডাক্তার তমিজউদ্দিন আহত অনেক মুক্তিযোদ্ধার সেবা করেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বোচাগঞ্জ উপজেলার সীমান্ত পাকুড়া বর্ডারে পাকসেনাদের ক্যাম্প ছিল। হিন্দু-মুসলিম, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে এ ক্যাম্পে ধরে এনে হত্যা করা হতো।
এক সঙ্গে ৪৭ জন মানুষের শহীদ হবার মর্মান্তিক স্মৃতিকে স্মরণ করে ২০১২ সালে শিঙ্গারী গাঁ গ্রামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয় (দেখুন শিঙ্গারী গাঁ স্মৃতিসৌধ)। এটিকে ঘিরে প্রতিবছর বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও ভাষা দিবস পালন করা হয়। স্মৃতিস্তম্ভের জন্য জায়গা দান করেন বালুরাম রায় (পিতা ললিত মোহন রায়)। শিঙ্গারী গাঁ যুব উন্নয়ন সংঘ এ উদ্যোগ গ্রহণ করে। এতে মোট ৬৫ জন শহীদের নাম খোদাই করা আছে। তারা হলেন- শিঙ্গারী গাঁয়ের কিশোরী মোহন রায় (পিতা ললিত মোহন রায়), পঞ্চানন রায় (পিতা ললিত মোহন রায়), অনিল চন্দ্র রায় (পিতা ললিত মোহন রায়), প্রমথ চন্দ্র রায় (পিতা ধনঞ্জয় বর্মণ), মহেশ চন্দ্র রায় (পিতা বনয়ারী বর্মণ), বিশু রাম রায় (পিতা মহেশ চন্দ্র রায়), বিনোদ চন্দ্র বর্মণ (পিতা গৌরী কান্ত রায়), মহেশ চন্দ্ৰ বৰ্মণ, মুনি বর্মণ (পিতা গৌরী কান্ত রায়), ঝকমকি রানী রায় (পিতা রমেশ চন্দ্র রায়), খুদুনী রানী রায় (পিতা রমেশ চন্দ্র রায়), বল রাম রায় (পিতা ললিত মোহন রায়), অনিল চন্দ্ৰ বৰ্মণ, ভূষেণ চন্দ্র রায় (পিতা রামকুমার রায়), কার্তিক চন্দ্ৰ বৰ্মণ (পিতা নালু রাম রায়), ঘনশ্যাম চন্দ্র বর্মণ, দরপ চাঁন, ফটক চাঁন বর্মণ, ফাকাশু বর্মণ (পিতা ফটক চন্দ্র রায়), উপেন্দ্র নাথ রায় (পিতা দরপ চাঁন), ভ্রমর দেবনাথ, সুরেশ (পিতা বিপিন চন্দ্ৰ রায়), পাতানু রায়, নিশারু চন্দ্র বর্মণ, শ্যামল চন্দ্র বর্মণ, খগেন্দ্র নাথ রায় (পিতা মুনি রাম রায়), বেরগাঁওয়ের হরকুমার রায় (পিতা গোপাল সাধু), ভরন্ডার কংশ রাম রায় (পিতা গঙ্গা রাম রায়), কিরেণ রায়, রাখাল, পবেন, আধু রাম, নিতাই রায় (পিতা ধরিনী কান্ত রায়), জামিনী কান্ত রায় (পিতা কংশ রাম রায়), গোলক (পিতা কৈলাশ চন্দ্র রায়), মেঘু রাম রায় (পিতা আমাশু দাশ), বিলাস (পিতা অঘু দাশ), শরৎ চন্দ্র রায় (পিতা আশানন দাশ), দ্বিজেন রায় (পিতা কালিপদ রায়), ভরভরু রায় (পিতা ভাবক মন্ডল), ফাকা রাম রায় (পিতা মনশা রাম), যোগীন্দ্র নাথ রায়, পহাতু রাম রায় (পিতা গাঠু রাম রায়), বাঙ্গুরু রাম রায় (পিতা মধুসূদন রায়), সুরেন্দ্র নাথ রায় (পিতা উজান), গৌরাঙ্গ রায় (পিতা দ্বিজেন্দ্র নাথ রায়), ফাগু রাম রায় (পিতা তারিণী রায়), তারাপুরের অনিল চন্দ্র রায়, ছাতইলের ঢেলা রাম রায়, নয়াবাদের গোবিন্দ, তরলার মহেশ বাবু, গঙ্গা রাম রায় (পিতা ফাগু রাম রায়), ওলনের যোগীন্দ্র বর্মণ, জঙ্গুলু, দীনা নাথ রায় (পিতা দীপ চরণ), গণেশ চন্দ্র রায় (পিতা শশী মোহন রায়), সুলতানপুরের অনিল চন্দ্ৰ বৰ্মণ (পিতা রুহি চান রায়), ধীরেন্দ্র নাথ শীল (পিতা ছত্রমোহন শীল), কাকোরের নাগর শাহা (পিতা বিভূতি শাহা), কাল্টাং (পিতা দোল গোবিন্দ শাহা), ডহচীর ভটরা সিং ওরফে খর্গমোহন রায় (পিতা দর্পনারায়ণ সরকার), বাহেরপুরের কৈলাশ চন্দ্র রায়, শাহাপুরের মন্টু মোহাম্মদ (পিতা মংলু মোহাম্মদ), নির্মইলের মাখন চন্দ্র রায় (পিতা মণ্ডল চন্দ্র রায়) এবং বাইশপুরের জাবিল।
পাকসেনাদের হাতে বন্দি অবস্থায় থেকে গুলিবদ্ধ হয়ে পালাতে সক্ষম হন বালুরাম রায় (পিতা ললিত মোহন রায়), ললিত মোহন বর্মণ (পিতা কান্ত বর্মণ), রমেশ চন্দ্র বর্মণ (পিতা ধনেশ্বর শাহা), দলি চাঁদ (পিতা বিনোদ বর্মণ) এবং মঞ্জুরু বর্মণ (পিতা অলি বর্মণ)। এরা সকলেই শিঙ্গারী গাঁয়ের অধিবাসী। অনিল চন্দ্র বর্মণ (পিতা পেয়ারী মোহন রায়, খোশালপুর) বন্দি অবস্থায় গণকবরের গর্ত করতেন এবং নিহতদের মাটিচাপা দিতেন। শিঙ্গারী গাঁয়ের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী মাস্টার বিজয় মোহন্ত এবং এই অনিল চন্দ্ৰ বৰ্মণ এখনো জীবিত রয়েছেন। [মারুফা বেগম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড