স্থানীয় মুক্তিবাহিনী শামসু বাহিনী (চিতলমারী, বাগেরহাট)
শামসু বাহিনী (চিতলমারী, বাগেরহাট) একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী। এ বাহিনীর প্রধান ছিলেন শামসুল হক মল্লিক (পিতা গগন মল্লিক, আড়ুয়াবর্নি)। তাঁর নাম অনুসারে এ বাহিনীর নাম হয় শামসু বাহিনী। বাগেরহাট ও চিতলমারীর কয়েকটি যুদ্ধে শামসু বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
শামসু মল্লিকের পিতা গগন মল্লিক শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ঘনিষ্ঠ জন ছিলেন। তাঁর বড়ভাই সিরাজুল হক মল্লিক ছিলেন চিতলমারী আওয়ামী লীগ-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। শামসুল হক মল্লিক ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্পোরাল নন-কমিশন সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ১৯৭১ সালের মার্চে পশ্চিম পাকিস্তানের শিয়ালকোট ক্যান্টনমেন্টে আটকা পড়েন। সেখান থেকে কৌশলে আরো দুজন বাঙালি সৈনিকের সঙ্গে পালিয়ে ভারতের মধ্য দিয়ে দেশে আসেন ২৪শে এপ্রিল পাকসেনাদের হাতে বাগেরহাটের পতনের দিন তিনি চিতলমারীতে পৌছেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শামসু মল্লিক এলাকায় ঘুরে-ঘুরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে ছাত্র-যুবকদের সংগ্রহ ও উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে যাওয়ার খরচ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের কাছ থেকে যোগাড় করেন। ২৮শে জুন তিনি বেশ কয়েকজন ছাত্র-যুবককে নিয়ে ভারতে যান। হাসানাবাদ-টাকি ক্যাম্পে ১৮ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে ৩৫ জনের একটি দল নিয়ে ২২শে জুলাই তিনি চিতলমারী ফিরে আসেন। হাসনাবাদ থেকে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে ভাণ্ডারহাটের পাশ দিয়ে চিতলমারীতে পৌঁছেন। এখানে তিনি একটি বাহিনী গড়ে তোলেন। তাঁর নামে গঠিত শামসু বাহিনীর পদ-বিন্যাস ছিল এরকম- লেফটেন্যান্ট শামসুল হক মল্লিক (কমান্ডার), কাজী আনসার আলী (সেকেন্ড-ইন- কমান্ড), সিরাজুল হক মল্লিক (বেসামরিক প্রধান), শামসউদ্দিন আহম্মেদ ওরফে ছিকা মাস্টার (অর্থসচিব), মো. কায়েম আলী শেখ (রাজনৈতিক উপদেষ্টা), এডভোকেট মোহাম্মদ আলী (রাজনৈতিক উপদেষ্টা), ডা. মোক্তার সরদার (রাজনৈতিক উপদেষ্টা), সুরত আলী মুন্সী (রাজনৈতিক উপদেষ্টা), ফজলুর রহমান মল্লিক (প্লাটুন কমান্ডার), হাসান উদ্দিন শেখ (প্লাটুন কমান্ডার), মো. হানিফ শেখ (প্লাটুন কমান্ডার), মো. মহর আলী (প্লাটুন কমান্ডার), মো. আজিম উদ্দিন (প্লাটুন কমান্ডার), মো. আলমগীর হোসেন (প্লাটুন কমান্ডার), মো. নওশের আলী (ক্যাম্প প্রশিক্ষক) ও মো. জোনাব আলী শেখ (স্টোর কিপার)। এ বাহিনীর হাতে প্রচুর এসএমজি, এলএমজি, এসএলআর, চাইনিজ রাইফেল ও গ্রেনেড ছিল। প্রথমে তাঁরা শিবপুর গ্রামে শেখ শাহাবুদ্দিনের কাচারিতে ও পরে খলিশাখালীর সূর্যকান্ত মণ্ডলের বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করেন। এখান থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল শিবপুরের নিশিকান্ত ডাক্তার এবং পরে কুমুদ মণ্ডলের বাড়িতেও তাঁদের ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন। আগস্টের শেষদিকে চিতলমারী বাজারের পাশে খড়মখালী গ্রামে ষষ্টী হালদারের দোতলা বাড়িতে এ বাহিনীর স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপিত হয়। শামসু মল্লিক দ্বিতীয়বার ভারতে গিয়ে মুজিব বাহিনীর একটি দলের কমান্ডারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। উপর্যুক্ত বিভিন্ন ক্যাম্প ও ঘাঁটি থেকে শামসু বাহিনী এলাকার বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেয়। ৭ই আগস্ট মাধবকাঠির যুদ্ধ, ৮ই অক্টোবর মোল্লাহাটে হাড়িয়াদহের যুদ্ধ, কোদালিয়ার যুদ্ধ, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মোল্লাহাটের দত্তডাঙ্গার যুদ্ধ ও চরকুলিয়ার যুদ্ধে এ বাহিনীর অসামান্য অবদান ছিল। মোল্লাহাটের চরকুলিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে চিতলমারীর শামসু বাহিনীর যোগাযোগ ছিল। চিতলমারীর শামসু বাহিনীর সদস্যরা চরকুলিয়ার যুদ্ধে যে অসামান্য অবদান রাখেন তা বিশেষভাবে স্মরণীয়। শামসু বাহিনীতে আজিম উদ্দিন, মহর আলী, হাড়িয়াদহের যুদ্ধের অসীম সাহসী সৈনিক মো. হানিফ শেখ ও হাসান শেখ এ দুই সহোদরের মতো অনেক বীর যোদ্ধা ছিলেন। [মনীন্দ্র নাথ বোস]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড