শান্তি কমিটির অফিস ‘শান্তিভবন’ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর)
শান্তিভবন (ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর) ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কুমারশীল মোড়ে অবস্থিত ছিল। এটি ছিল শান্তি কমিটির অফিস। একটি হিন্দুবাড়ি দখল করে তার নাম দেয়া হয় ‘শান্তিভবন’। এখান থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গণহত্যা, নির্যাতন ও ধরপাকড়ের নীলনকশা তৈরি হয়। এখান থেকে রাজাকারদের ‘ডান্ডিকার্ড’ বা পরিচয় পত্র দেয়া হতো। বাধ্যতামূলকভাবে সকলকেই এ কার্ড সংগ্রহ করার নির্দেশ দেয়া হয়। হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে যাদের পরিচয়পত্র নেই তাদের ধরে এনে হত্যা ও নির্যাতন করত। অবশ্য পরিচয়পত্র দেখিয়েও অনেকে রক্ষা পায়নি। গ্রামের লোকজন শহরে যাওয়ার সাহস পেত না। কার্ড সংগ্রহের জন্য তারা দালাল ধরত। দালালরা (শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্য) অর্থের বিনিময়ে কার্ড করিয়ে দিত। শান্তি কমিটির সদস্য রবিউল ইসলাম ও তার ভাই ফারুকুল ইসলাম পরিচয় পত্রের ছবি উঠিয়ে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নেয়।
মে মাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শান্তি কমিটির কার্যক্রম শুরু হয়। এর আহ্বায়ক ছিল হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া এবং সদস্য- সচিব ছিল এ কিউ এম ওবায়দুল্লাহ। শান্তি কমিটির সদস্য ছিল আজিজুর রহমান মোল্লা ওরফে জারু মিয়া, সৈয়দ আহমদ মোহাম্মদ নাবালক মিয়া, জিল্লুর রহমান, সিরাজুল হক চৌধুরী, পিয়ারা মিয়া, তন্দুর হুজুর, আতিকুল ইসলাম খোকন, হামিদুল হক টুক্কু প্রমুখ। এরা কয়েকটি হিন্দুবাড়ি দখল করে নিয়েছিল।
শান্তি কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে জনগণকে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করত। তারা মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের তালিকা প্রস্তুত করে গণহত্যায় সহায়তা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে না পেলে তাঁদের পিতা-মাতা ও গ্রামবাসীকে ধরে এনে হত্যা করে। নারীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়।
শান্তি কমিটির লোকেরা শহরের পরিত্যক্ত হিন্দুবাড়ি লিজ দেয়ার নামে শান্তিভবন থেকে আট আনা করে দরখাস্তের ফরম বিক্রি করে। সেপ্টেম্বর মাসে শান্তি কমিটি বহু হিন্দুবাড়ি নিলামে বিক্রি করে দেয়। শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকাররা বাড়িগুলো কিনে নেয়।
৬ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা দিবস উপলক্ষে শান্তি কমিটির উদ্যোগে শান্তিভবন থেকে ‘সংহতি’ নাম দিয়ে একটি পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক ছিল ফারুকুল ইসলাম। সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্যদের মধ্যে একজন ছিল মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মিন্নাত আলী। মেজর আশরাফ চৌধুরীর নির্দেশে ফারুকুল ইসলাম কয়েকটি হিন্দুবাড়ি নিলামে বিক্রি করে পত্রিকা প্রকাশের অর্থ সংগ্রহ করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। পাকিস্তানি সামরিক সরকার ঘোষিত প্রতিটি কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের নাম পরিবর্তন করে ‘রহমান বাড়ি’ রাখে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের হিন্দু নিদর্শনগুলো ধ্বংস করে দেয়। শান্তিভবন থেকে এসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। [জয়দুল হোসেন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড