শাঁখারীকাঠি গণহত্যা (কচুয়া, বাগেরহাট)
শাঁখারীকাঠি গণহত্যা (কচুয়া, বাগেরহাট) সংঘটিত হয় ৫ই নভেম্বর। এতে অর্ধশতাধিক নিরীহ মানুষ শহীদ হন। কচুয়া থানার দক্ষিণ এবং মোড়লগঞ্জ থানার উত্তর প্রান্তে অবস্থিত দৈবজ্ঞহাট-বাজারের কাছে বিশ্বাস বাড়িতে ছিল একটি শক্তিশালী রাজাকার ক্যাম্প। এখানকার রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকবার যুদ্ধ হয়। একটি যুদ্ধ হয় ৪ঠা নভেম্বর বৃহস্পতিবার। সারারাত ধরে উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলে। এখানকার রাজাকার সংগঠকরা তখন বাগেরহাট ও কচুয়ার রাজাকার ক্যাম্পে সাহায্যের জন্য আবেদন জানায়। তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পরের দিন দুপুরের মধ্যে কচুয়া থানার রাজাকাররা সেখানে পৌঁছে যায়। কচুয়া থানার দুই কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত শাঁখারীকাঠি হাট। দৈবজ্ঞহাটের রাজাকাররা এ হাট আক্রমণ করে সেখানে আগত হিন্দু যুবকদের হত্যা করার নির্দেশ দেয়। ৫ই নভেম্বর শুক্রবার বিকেলে শতাধিক অস্ত্রধারী রাজাকার তিন দিক থেকে হাটটি ঘিরে ফেলে এবং রাইফেলের বাট দিয়ে হাটে আগত লোকদের প্রহার করতে থাকে। কিল-চড়-ঘুষি দিয়ে সবাইকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে মোট ৮২ জন লোককে তারা পাকড়াও করে। দড়ি ও গামছা দিয়ে বেঁধে আটককৃত লোকদেরকে রাজাকাররা রাইফেলের বাট এবং লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকে। পরে তাদের বাজারের পশ্চিম দিকে নিয়ে উত্তর-দক্ষিণ লম্বালম্বিভাবে বসায়। রাজাকার কমান্ডার সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার বাঁশি বাজিয়ে নির্দেশ দেয়ার সঙ্গে-সঙ্গে রাজাকার আকরাম খা, আব্দুল লতিফ তালুকদারসহ কয়েকজন রাজাকার একযোগে আটক ব্যক্তিদের ওপর গুলি চালায়। এ গণহত্যায় অর্ধশতাধিক লোক শহীদ হন। রাজাকাররা হত্যার পর লাশগুলো ফেলে রেখে সন্ধ্যার আগেই তাদের ক্যাম্পে ফিরে যায়। পরের দিন ৬ই নভেম্বর প্রাইমারি স্কুলের স্থানীয় শিক্ষক হাবিবুর রহমান লাশগুলোর সদগতির জন্য রাজাকারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। রাজাকারদের উপস্থিতিতে হাবিবুর রহমান স্থানীয় লোকদের সহায়তায় মৃতদেহগুলো নৌকায় তুলে বিষখালী নদীর পূর্ব তীরে ও রামচন্দ্রপুর গ্রামের প্রান্তে গর্ত খুঁড়ে গণকবরের ব্যবস্থা করেন।
শাখারীকাঠি গণহত্যায় শহীদদের মধ্যে যাদের নাম জানা গেছে, তারা হলেন— মঙ্গলময় দাস (পিতা কেদারনাথ দাস, আবেতা), অধীর কুমার দাস (পিতা ভুলুগোপাল দাস, আলোকদিয়া), উপেন দাস (পিতা সোনারাম দাস, আলোকদিয়া), মনিলাল দাস (পিতা সোনারাম দাস, আলোকদিয়া), মহাদেব দাস (পিতা মধুসূদন দাস, আলোকদিয়া), যতীন্দ্রনাথ দাস (পিতা অন্নদাচরণ দাস, আলোকদিয়া), রামকৃষ্ণ দাস (পিতা বাসুদেব দাস, আলোকদিয়া), কালীপদ সাহা (পিতা শরৎচন্দ্র সাহা, খালকুলিয়া), হরিমোহন সরকার (পিতা অপূর্ব সরকার, চানকাঠি), কৃষ্ণলাল চক্রবর্তী (পিতা কিশোর চক্রবর্তী, বলভদ্রপুর), কৃষ্ণলাল দাস (পিতা শশধর দাস, বাদোখালী), বিকাশ হালদার (বারনিপাড়া), ললিত হালদার (পিতা জীবন হালদার, বারনিপাড়া), কার্তিক দাস (পিতা কেদার দাস, মসনী), কালীপদ দাস (পিতা রামচরণ দাস, মসনী), কুঞ্জলাল দাস (পিতা কার্তিক দাস, মসনী), কৃষ্ণলাল দাস (পিতা ফটিক চন্দ্র দাস, মসনী), নিতাই চন্দ্র দাস (পিতা রামচরণ দাস, মসনী), বনমালী দাস (মসনী), বাসুদেব দাস (পিতা প্রিয়নাথ দাস, মসনী), রামকৃষ্ণ দাস (পিতা কার্তিক চন্দ্র দাস, মসনী), পবন সিকদার (মহিষপুরা), হারাধন মণ্ডল (পিতা ভুবন মণ্ডল, মহিষপুরা), নরেন্দ্রনাথ পাল (পিতা অবনী পাল, মিত্রডাঙ্গা), রমণী মৃধা (পিতা সূর্যকান্ত মৃধা, মিত্রডাঙ্গা), রাধাকান্ত দাস (পিতা সতীশ চন্দ্র দাস, মিত্রডাঙ্গা), সখিচরণ পাল (মিত্রডাঙ্গা), অমলকৃষ্ণ দত্ত (পিতা ধীরেন্দনাথ দত্ত, মোহনপুর), কৃষ্ণ দাস (পিতা ধীরেন্দ্রনাথ দাস, মোহনপুর), অনিলকৃষ্ণ দাস (পিতা যোগেশ চন্দ্র দাস, রঘুদত্তকাঠি), দ্বিজবর দাস (পিতা গণেশ চন্দ্ৰ দাস, রঘুদত্তকাঠি), বসন্ত কুমার দাস (পিতা যজ্ঞেশ্বর দাস, রঘুদত্তকাঠি), শৈলেন্দ্রনাথ দাস (পিতা প্রহ্লাদ দাস, রঘুদত্তকাঠি), পরামানিক (পিতা মনিলাল পরামানিক, রামচন্দ্রপুর), নারায়ণ চন্দ্র দাস (পিতা রামচন্দ্র দাস, রামচন্দ্রপুর), নিরঞ্জন দাস (পিতা শশীভূষণ দাস, রামচন্দ্রপুর), বাসুদেব দাস (পিতা কেশবলাল দাস, রামচন্দ্রপুর), বিনোদবিহারী দাস (পিতা প্রমথ দাস, রামচন্দ্রপুর), মতিলাল দাস (পিতা কানাইলাল দাস, রামচন্দ্রপুর), গণেশ চন্দ্র দাস (পিতা লক্ষণ চন্দ্ৰ দাস, শাঁখারীকাঠি), দুলাল চন্দ্র দাস (পিতা নটবর দাস, শাঁখারীকাঠি), নকুলচন্দ্র দাস (পিতা ভগবান দাস, শাঁখারীকাঠি), নিশিকান্ত সাহা (পিতা যোগেন্দ্ৰনাথ সাহা, শাঁখারীকাঠি), বনমালী দাস (পিতা সখীচরণ দাস, শাঁখারীকাঠি), মহাদেব দাস (পিতা শান্তিরাম দাস, শাঁখারীকাঠি), সতোরাম দাস (পিতা কেনারাম দাস, শাঁখারীকাঠি), হরিপদ দাস (পিতা কেনারাম দাস, শাঁখারীকাঠি), সাতো দাস (পিতা গোপাল দাস, শাঁখারীকাঠি), অতুল চন্দ্র সাহা (পিতা নকুল চন্দ্র সাহা, সাগরকাঠি), দেবেন্দ্রনাথ সাহা (পিতা মতিলাল সাহা, সাগরকাঠি), প্রফুল্ল কুমার সাহা (পিতা যোগেন্দ্রনাথ সাহা, সাগরকাঠি), সতীশ চন্দ্র সাহা (পিতা নকুল চন্দ্র সাহা, সাগরকাঠি), নীতীশ ভদ্র (পিতা অতুল ভদ্র, সিসটাকাঠি)। শাঁখারীকাঠি গণহত্যায় যারা শিকার তাদের স্মরণে কচুয়ায় নামসহ একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। [তাপস কুমার বিশ্বাস]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড