মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ সাংবাদিক
শহীদ সাংবাদিক পাকিস্তানি শাসনপর্বে বাঙালির জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের পাশাপাশি এ দেশের সাংবাদিক সমাজও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে। ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অনেকে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসর জামায়াতে ইসলামী, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। মার্চে পাকহানাদার বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার পর এবং ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের প্রাক্কালে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এরূপ হত্যাকাণ্ডের শিকার ১৩ জন খ্যাতিমান সাংবাদিক হলেন- সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, খোন্দকার আবু তালেব, নিজামুদ্দীন আহমদ, এস এ মান্নান (লাডু ভাই), আ ন ম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, এ কে এম শহীদুল্লাহ (শহীদ সাবের), আবুল বাশার, শিবসাধন চক্রবর্তী, চিশতী শাহ হেলালুর রহমান, মুহম্মদ আখতার ও সেলিনা পারভীন। এঁদের মধ্যে ৪ জন মার্চের শেষদিকে, ১ জন যুদ্ধাহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হয়ে অক্টোবর মাসে এবং ৮ জন মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের প্রাক্কালে শহীদ হন।
সিরাজুদ্দীন হোসেন (১৯২৯-১৯৭১)-এর জন্ম বর্তমান মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার অন্তর্গত শরশুনা গ্রামে। তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী ছিলেন। তিনি ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার কার্যনির্বাহী ও বার্তা সম্পাদক। তিনি ঢাকা থেকে কলকাতায় বাংলাদেশ সরকার-এর দপ্তরে গোপনে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রেরণ করতেন। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার মাত্র ৬ দিন পূর্বে ১০ই ডিসেম্বর তাঁকে চামেলীবাগ বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাঁর আর কোনো খোঁজ মেলেনি।
শহীদুল্লাহ কায়সার (১৯২৭- ১৯৭১)-এর জন্ম বর্তমান ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) ডিগ্রি প্রাপ্ত। বাংলা সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও রাজনীতিতে তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল প্রতিভা। সংসপ্তক তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পাকিস্তান আমলে তাঁকে একাধিকবার কারাবরণ করতে হয়। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর পুরান ঢাকার কায়েতটুলীর বাড়ি থেকে তাঁকে আলবদর বাহিনীর কয়েকজন সশস্ত্র সদস্য ধরে নিয়ে যায়। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। এমনকি তাঁর লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান (যিনি দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর মিরপুরে একই ঘাতক-খুনি চক্রের হাতে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হন) ছিলেন তাঁর অনুজ।
খোন্দকার আবু তালেব (১৯২১-১৯৭১)-এর জন্ম সাতক্ষীরা সদর থানার সাতানি গ্রামে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিকম ডিগ্রি অর্জন করেন এবং এরপর সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। তিনি বিভিন্ন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি দৈনিক ইত্তেফাক-এর চিফ রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। লেখনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা কর্মসূচি প্রচারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি এক সময় পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ঢাকার মিরপুরে তাঁর বাড়ি ছিল। ২৯শে মার্চ সংবাদপত্রে চাকরিরত এক বিহারি কর্মকর্তা ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাঁকে পথিমধ্যে গাড়িতে তুলে ‘মিরপুরের কসাই’ নামে কুখ্যাত জামায়াতে ইসলামীর আবদুল কাদের মোল্লা (মানুষ হত্যাসহ যুদ্ধাপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারশেষে ২০১৩ সালের ১২ই ডিসেম্বর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর) ও তার সহযোগী আলবদররাজাকারদের হাতে তুলে দেয়। মিরপুর পাম্প হাউস জল্লাদ খানায় নিয়ে অমানবিক নির্যাতন শেষে অত্যন্ত পৈশাচিকভাবে খোন্দকার আবু তালেবকে জবাই করে হত্যা করা হয়। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে বিচারে প্রমাণিত অন্যান্য অভিযোগের মধ্যে সাংবাদিক আবু তালেবের হত্যাকাণ্ড ছিল অন্যতম।
নিজামুদ্দীন আহমদ (১৯২৯- ১৯৭১)-এর জন্ম মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার মাওয়া গ্রামে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন এবং সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি একাধিক বিদেশী সংবাদ সংস্থার স্থানীয় প্রতিনিধি ছিলেন। ৭১-এর ২৫শে মার্চের পূর্বে সোয়াত জাহাজে করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র আনার সংবাদটি বিদেশী তথ্যসূত্রে পেয়ে তিনিই সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি বিবিসি সহ বিদেশী প্রচার মাধ্যম ও সংবাদ সংস্থার কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক বাঙালিদের হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ এবং মুক্তিবাহিনীর তৎপরতার খবর পৌঁছে দিতেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাত্র ৪ দিন পূর্বে ১২ই ডিসেম্বর পরিবারের সদস্যসহ দুপুরের আহার গ্রহণ অবস্থায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও আলবদর বাহিনীর কয়েকজন সশস্ত্র সদস্য পুরান ঢাকার রোকনপুরস্থ নিজ বাসা থেকে নিজামুদ্দীন আহমদকে ধরে নিয়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় গাড়িতে তোলে। সে-সময় তাঁর ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। তখন থেকে তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এম এ মান্নান ওরফে লাডু ভাই (১৯২৮-১৯৭১)-এর জন্ম কলকাতা শহরে। সেখানেই তাঁর শৈশব ও শিক্ষাজীবন কাটে। তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি খেলাধুলার প্রতি উৎসাহী ছিলেন। কর্মজীবনে তিনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মাত্র ২দিন পূর্বে ১৪ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কারফিউর মধ্যে রাজাকারদের একটি সশস্ত্র দল পুরানা পল্টনের বাড়ি থেকে চোখে কালো কাপড় বেঁধে তাঁকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। এরপর রায়ের বাজার বধ্যভূমি-তে তাঁকে হত্যা করা হয়।
আ ন ম গোলাম (১৯৪৩-১৯৭১)-র জন্ম নীলফামারী জেলার পঙ্গা গ্রামে। তিনি দিনাজপুর সুরেন্দ্র নাথ কলেজ থেকে স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি এক সময় ছাত্র ইউনিয়ন-এর কেন্দ্রীয় পদে আসীন ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা শেষে তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি দৈনিক পূর্বদেশ-এর সহ-সম্পাদক ছিলেন। বাঙালির ন্যায্য অধিকার আদায়ের ব্যাপারে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি এর পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাত্র ৫ দিন পূর্বে ১১ই ডিসেম্বর খুব ভোরে আলবদর বাহিনীর শীর্ষ দুই কমান্ডার আশ্রাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মঈনুদ্দীনের নির্দেশে ৫-৬ জন সশস্ত্র আলবদর সদস্য গোলাম মোস্তফাকে তাঁর গোপীবাগের বাসা থেকে তুলে নেয়। এরপর থেকে তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালে যেসব অভিযোগের ভিত্তিতে উল্লিখিত ঐ দুই পলাতক আলবদর কমান্ডারকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেয়, তার মধ্যে আ ন ম গোলাম মোস্তফাকে হত্যা ছিল অন্যতম।
সৈয়দ নাজমুল হক (১৯৪১- ১৯৭১)-এর জন্ম খুলনা জেলার কসবা উপজেলাধীন পয়গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং পরবর্তীতে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রাবস্থা থেকে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি প্রবন্ধ লিখতেন। তিনি বিদেশী সংবাদ সংস্থার ঢাকাস্থ প্রতিনিধি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আব্দুল মোনায়েম খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান পণ্ড করতে শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক, রাশেদ খান মেনন প্রমুখের সঙ্গে নাজমুল হক সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ঐ ঘটনার কারণে তাঁকে চাকরিতে যোগ দিতে দেয়া হয়নি। এক পর্যায়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আসেন। আগরতলা মামলা- থেকে মুক্তি লাভের পর বঙ্গবন্ধু লন্ডন ও ইউরোপ সফরে গেলে নাজমুল হক তাঁর সঙ্গী হন। বঙ্গবন্ধু তাঁর সাতই মার্চের ভাষণ-এর যথাযথ রিপোর্টিং-এর জন্য নাজমুল হককে দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং তিনি সে দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও লেখনীর মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা, ধ্বংস ইত্যাদিসহ অবরুদ্ধ বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র বিদেশী গণমাধ্যমে তুলে ধরেন। এসব কর্মকাণ্ডের কারণে তিনি পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের শ্যেন দৃষ্টিতে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু বন্দি থাকাকালে তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য দুবার নাজমুল হককে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু অকথ্য নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অসত্য সাক্ষ্য দিতে রাজি হননি। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাত্র ৬ দিন পূর্বে ১০ই ডিসেম্বর গভীর রাতে সান্ধ্য আইনের মধ্যে আলবদর বাহিনীর শীর্ষ দুই কমান্ডার চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশ্রাফুজ্জামান খানের নেতৃত্বে একই বাহিনীর ৮-১০ জন অস্ত্রধারী নাজমুল হককে তাঁর পুরানা পল্টনের বাসা থেকে চোখ বাঁধা অবস্থায় বাইরে অপেক্ষমাণ পাক সামরিক জিপে তুলে নেয়। এরপর তাঁর আর কোনো সন্ধান মেলেনি। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্ক ছিন্ন করে যে-দুজন বাঙালি কুটনীতিবীদ সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন, তাঁদের মধ্যে নাজমুল হকের অগ্রজ আমজাদুল হক ছিলেন অন্যতম।
শহীদ সাবের (১৯৩০-১৯৭১)- এর জন্ম কক্সবাজারের ঈদগা গ্রামে। তাঁর প্রকৃত নাম এ কে এম শহীদুল্লাহ। তিনি শহীদ সাবের নামে সর্বমহলে পরিচিত ছিলেন। কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি -র ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। সে অবস্থায় তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। জেলে থাকাকালে পরীক্ষা দিয়ে তিনি আইএ পাস করেন। এরপর জগন্নাথ কলেজ থেকে তাঁর স্নাতক ডিগ্রি লাভ। তিনি একই সঙ্গে সাংবাদিক, গল্পকার, কবি, গীতিকার অর্থাৎ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তবে দৈনিক সংবাদ-ই ছিল শুরু থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁর কর্মক্ষেত্র। কর্মজীবন শুরুর প্রথমদিকে তাঁর সিজোফ্রেনিয়া রোগ ধরা পড়ে। শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে তিনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চা চালিয়ে যান। ‘ওরে মাঝি দে নৌকা ছেড়ে’ গানটি শহীদ সাবেরের রচিত এদিকে ক্রমে তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বংশাল রোডের সংবাদ অফিস হয় তাঁর বসবাসের ঠিকানা। ৭১-এর ৩১শে মার্চ রাতে পাকহানাদার বাহিনী বাঙালির জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের পক্ষের প্রগতিশীল দৈনিক সংবাদ-এর ভবনটিতে আগুন ধরিয়ে দিলে শহীদ সাবেরের শরীর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এভাবে মৃত্যু ঘটে অত্যন্ত প্রতিভাবান, মানবদরদী ও দেশপ্রেমিক এই সাংবাদিকের।
সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশার (মৃত্যু ১৯৭১)-এর জন্ম টাঙ্গাইল শহরে। সাংবাদিকতার প্রতি তাঁর ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। পাকিস্তানের করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় তিনি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ-এ যোগদানের মাধ্যমে তাঁর সাংবাদিকতা পেশার শুরু এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি এ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের শাসন-শোষণ ও নিপীড়ন তাঁর মনে গভীর দাগ কাটে। ৭১-এর মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন শেষে ২৬শে মার্চ তাঁর স্বাধীনতা ঘোষণার পরপর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে, সাংবাদিক আবুল বাশার তাতে যোগ দেন। তিনি ছিলেন ঢাকায় একটি গেরিলা গ্রুপের সদস্য। মগবাজারে তাঁর বন্ধু আজাদের বাড়িতে তিনি থাকতেন। এ বাড়িটিকে ঘিরেই মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা বাহিনীটি গড়ে উঠেছিল। তাঁরা ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক অপারেশন চালিয়ে যান। আবুল বাশারও সেসব অপারেশনে অংশ নেন। স্থানীয় কিছু আলবদর সদস্য পাকবাহিনীকে তাঁদের অবস্থান জানিয়ে দেয়। অক্টোবর মাসের একদিন পাকহানাদার বাহিনীর একটি দল আতর্কিতে মগবাজারের ঐ বাড়িটি ঘিরে ফেলে এবং গুলি করতে থাকে। আবুল বাশার ও তাঁর সহযোদ্ধারা আত্মসমর্পণের পরিবর্তে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। দীর্ঘক্ষণ উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে চার সহযোদ্ধাসহ আবুল বাশার গুরুতর আহত হন। সে অবস্থায় তাঁদের ধরে নিয়ে পাকিস্তান আর্মির টর্চার সেলে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন শেষে হত্যা করা হয়। তাঁদের কারো লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
শিবসাধন চক্রবর্তী (১৯৪৬-১৯৭১)-র জন্ম নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাধীন বিরাহীমপুর গ্রামে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শেষে তিনি কিছুদিন প্রথমে স্কুলে এবং পরে কলেজে শিক্ষকতা করেন। এরপর পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর সাংবাদিক জীবন শুরু হয়। এ পেশায় যোদানের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ছেড়ে প্রথমে ঢাকার গোপীবাগে এবং পরবর্তীতে রমনা কালীবাড়ির মেসে ওঠেন। ৭১-এর ২৭শে মার্চ গভীর রাতে সান্ধ্য আইন চলা অবস্থায় পাকিস্তানি সেনারা রমনা কালীমন্দির ও শ্রী শ্রী মা আনন্দময়ীর আশ্রম ঘেরাও করে গুলিবর্ষণ করতে থাকে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে প্রায় ৩০০ জনকে সেখান থেকে ধরে এনে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্র্যাশ ফায়ারে হত্যা করে। এরপর ঘাতকরা মৃত ও অর্ধমৃত মানুষগুলোকে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারে। এ নারকীয় হত্যাকাণ্ডের যারা শিকার, সাংবাদিক শিবসাধন চক্রবর্তী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। উল্লেখ্য, ২রা সেপ্টেম্বর তাঁর পিতা স্কুল শিক্ষক হরেন্দ্র কুমার চক্রবর্তী নিজ বাড়িতে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন।
চিশতী শাহ হেলালুর রহমান (১৯৪৯-১৯৭১)-এর জন্ম বগুড়া শহরের রহমান নগরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি একই বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।
সে-সময় তিনি দৈনিক আজাদ পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় তাঁর সাংবাদিকতা শুরু। তিনি একই সঙ্গে ছাত্র রাজনীতিতেও বেশ সক্রিয় ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ-এর কেন্দ্রীয় কমিটির তিনি সহকারী সম্পাদক ছিলেন। আবাসিক ছাত্র হিসেবে তিনি ইকবাল হল (বর্তমান জহুরুল হক হল)-এ থাকতেন। ৭১-এর ২৫শে মার্চ রাতে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ঢাকা শহরের যেসব স্থানে আক্রমণ চালিয়ে নির্বিচার গণহত্যা চালায়, তৎকালীন ইকবাল হল ছিল তার মধ্যে অন্যতম। সাংবাদিক ও ছাত্রনেতা চিশতী তখন হলেই ছিলেন। জানালা দিয়ে বেরিয়ে কার্নিসে সারারাত কাটিয়ে ২৫শে মার্চের হত্যাকাণ্ড থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হলেও, পরের দিন তিনি পাকিস্তানি এক সেনা সদস্যের নজরে পড়েন। তাঁকে নিচে নেমে আসতে বাধ্য করা হয়। সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পরও তিনি রেহাই পাননি। বুকে গুলি করে তাঁকে হত্যা করা হয়। শুধু হত্যা করেই হানাদাররা ক্ষান্ত হয়নি, তারা তাঁর নিথর দেহটি নীলক্ষেত পেট্রোল পাম্পে নিয়ে পুড়িয়ে দেয়। হানদাররা বগুড়ায় তাঁর পৈতৃক বাড়িটিও আগুনে জ্বালিয়ে দেয়।
মুহম্মদ আখতার (১৯৩৯-১৯৭১) মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী অপর এক সাংবাদিক। তাঁর জন্ম টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ী উপজেলার কিসামত গ্রামে। কলেজ জীবন থেকেই তিনি পত্র-পত্রিকায় লিখতে থাকেন। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগে ইত্তেফাক পত্রিকা দিয়ে তাঁর সাংবাদিক জীবন শুরু। তাঁর ব্যবস্থাপনায় পাক্ষিক ললনা ও মাসিক সাহিত্য পত্রিকা সমীপেষু প্রকাশিত হয়। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকার অনেক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। তিনি বিভিন্নভাবে তাঁদের সহযোগিতা করেন। তাঁর পুরানা পল্টনের বাসার পাশেই ছিল জামায়াতে ইসলামীর ঘাঁটি। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাত্র ২ দিন পূর্বে ১৪ই ডিসেম্বর আলবদর বাহিনীর কয়েকজন সশস্ত্র সদস্য বাসা থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে চোখ বেঁধে গাড়িতে তোলে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আরো কয়েকজন সাংবাদিককে ধরে আলবদর বাহিনীর হেডকোয়ার্টার্সে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৮ই ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে তাঁর আত্মীয়-স্বজন অন্যান্যদের সঙ্গে মুহম্মদ আখতারের বিকৃত মৃতদেহ খুঁজে পান, যার অর্ধেক মাটির নিচে চাপা দেয়া ছিল। হাত ছিল পিছমোড়া করে বাঁধা। আর বুকের এক পাশ থেকে গুলি প্রবেশ করে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।
সেলিনা পারভীন (১৯৩১-১৯৭১) ছিলেন স্বাধীনচেতা, প্রগতিশীল ও সংগ্রামী এক নারী। নোয়াখালী জেলার ছোট কল্যাণনগর গ্রামের এক রক্ষণশীল পরিবারে তাঁর জন্ম। ১৪ বছর বয়সে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে হয়, কিন্তু বেশিদিন টেকেনি। এক সন্তান জন্মের পর দ্বিতীয় বিয়েতেও বিচ্ছেদ ঘটে। নানা কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। ১৯৫৬ সালে ঢাকায় চলে আসেন। প্রথমদিকে শিশুদের পড়ানো, সেবিকার কাজ ইত্যাদি করেছেন। তাঁর ছিল লেখালেখি ও সাহিত্য-চর্চার প্রতি প্রচণ্ড অনুরাগ। অচিরেই তার প্রকাশ ঘটতে থাকে। বেগম পত্রিকায় যোগদানের মাধ্যমে তাঁর সাংবাদিক জীবনের শুরু। এরপর ক্রমান্বয়ে ঢাকার প্রায় সকল দৈনিকে তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ ও নিবন্ধ ছাপা হতে থাকে। ষাটের দশকে শহীদ সাংবাদিক মুহম্মদ আখতারের ব্যবস্থাপনায় প্রকাশিত পাক্ষিক ললনা-র সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তা অটুট থাকে। ললনা-য় কর্মরত অবস্থায় ১৯৬৯ সালে তিনি নিজেই শিলালিপি নামে বাঙালির জাতীয় মুক্তির পক্ষের একটি সাময়িকী সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, কবি, গল্পকার ও প্রবন্ধকার। ঐ সময়কার খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিল্পীদের নিকট সেলিনা পারভীন সুপরিচিত ছিলেন। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি তিনি রাজনীতি-সচেতন ও বাঙালির স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও তৎপরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামে অনেক সময় মহিলাদের মিছিলের অগ্রভাগে তাঁকে দেখা গেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সেলিনা পারভীন নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেন। তাঁর নিউ সার্কুলার রোড (বর্তমান শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক)-এর বাসায় মুক্তিযোদ্ধাদের যাওয়া-আসা ছিল। পাকিস্তানের দোসর ঘাতক রাজাকারআলবদর সদস্যরা তা জেনে যায়। মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের পূর্বমুহূর্তে বুদ্ধিজীবী হত্যা-র নীল নকশার তালিকায় তাঁর নাম যুক্ত হয়। নেমে আসে তাঁর জীবনের বিভীষিকাময় দিন। ১৩ই ডিসেম্বর আলবদর বাহিনীর একদল সশস্ত্র সদস্য কারফিউর মধ্যে তাঁকে বাসা থেকে তুলে গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে হাত পিছমোড়া অবস্থায় গাড়িতে করে নিয়ে যায়। মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজের টর্চার সেলে নিয়ে শহীদ মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীসহ আরো অনেকের সঙ্গে বন্দি করে রাখা হয়। সেখানে সকলেরই হাত ও চোখ বাঁধা। ১৪ই ডিসেম্বর গভীর রাতে সবাইকে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে একের সঙ্গে অন্যকে বেঁধে প্রথমে বুক ও পেটের মাঝখানে বেয়নেট চার্জ করা হয়। এরপর হায়েনারা গুলি করে একে-একে তাঁদের হত্যা করে কর্দমাক্ত জলাশয়ে ফেলে দেয়। সেলিনা পারভীনকে তাঁর মুখ, বুক ও গোপন অঙ্গে বেয়নেট চার্জ করে পৈচাশিকভাবে হত্যা করা হয়। সেখান থেকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসা মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেনের লেখা ‘বধ্যভূমিতে সেলিনা পারভীনের জীবনের শেষ মুহূর্ত’ থেকে এর লোমহর্ষক বিবরণ জানা যায়। ১৮ই ডিসেম্বর তাঁর আত্মীয়-স্বজন রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে তাঁর লাশ তুলে আজিমপুর নতুন কবরস্থানে শহীদদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে সমাহিত করেন। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: মো. শাহ আলমগীর (সম্পাদিত), বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট ২০১৫
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড