You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে শরণখোলা উপজেলা (বাগেরহাট) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে শরণখোলা উপজেলা (বাগেরহাট)

শরণখোলা উপজেলা (বাগেরহাট) দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী একটি এলাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে পরিচালিত ৬-দফার আন্দোলনের প্রভাব এ উপজেলায়ও পড়ে। ছাত্রদের ১১- দফা ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এর পরে ৭০-এর নির্বাচনে এখানকার মানুষ পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন- শোষণের হাত থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ-এর পক্ষে রায় দেয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী শেখ আব্দুল আজিজ বিপুল ভোটে এমএনএ নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ১৯৭১-এর মার্চের শুরু থেকে শরণখোলায় অসহযোগ আন্দোলন-
চলতে থাকে। ৩রা মার্চ ন্যাপ প্রধান মওলানা ভাসানী- শরণখোলার রায়েন্দা স্কুল মাঠের জনসভায় ভাষণ দেন। ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু গ্রামে-গঞ্জে ও শহরে-বন্দরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেন। পাকিস্তানি বাহিনী ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে বাঙালি জাতির ওপর বর্বর হামলা চালায়। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এরপর দক্ষিণাঞ্চলে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা শেখ আবদুল আজিজ এমএনএ-এর অনুপ্রেরণা ও তত্ত্বাবধানে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। শরণখোলা উপজেলায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। শরণখোলার নিকটবর্তী সুন্দরবন অঞ্চলে ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী গড়ে ওঠে। হানাদারদের বিরুদ্ধে জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বাহিনী দক্ষিণাঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
শরণখোলার প্রাণকেন্দ্র রায়েন্দা বাজার পাইলট হাইস্কুল মাঠে সংগ্রাম পরিষদের নেতাকর্মীরা প্রথমে বাঁশের লাঠি নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। পরে রায়েন্দা বাজারের কাঠমিস্ত্রী মোতাহার মিয়ার তৈরি কাঠের রাইফেল দিয়ে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ আরম্ভ হয়। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন শরণখোলায় এসে থানা থেকে সংগৃহীত অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রাম কমিটির নেতাদের দেন। এসব অস্ত্র দিয়ে শরণখোলায় প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। বগিতে স্থাপিত ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিনের নিয়ন্ত্রণাধীন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পেও অনেককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
শরণখোলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠকরা হলেন- মাস্টার মফিজুল হক (আওয়ামী লীগ), শামছুল আলম তালুকদার (ন্যাপ), মোজাম্মেল হোসেন (আওয়ামী লীগ; নৈহাটী ইয়ুথ ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন), এম এ কাদের (ন্যাপ; সুন্দরবন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার), ডা. মোসলেম উদ্দিন জোমাদ্দার (আওয়ামী লীগ), নজরুল ইসলাম লাল (ন্যাপ, সুন্দরবন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার), এম আফজাল হুসাইন (ভাসানী ন্যাপ; কমান্ডার, সুন্দরবন সাব-সেক্টর), আ. ছত্তর চাপরাশি (আওয়ামী লীগ), আশ্রাফুল হক হাওলাদার (আওয়ামী লীগ), ইসাহাক আলী সরদার (আওয়ামী লীগ), আজাহার আলী বড় মিয়া (আওয়ামী লীগ), ইসমাইল হোসেন খলিফা (আওয়ামী লীগ), আব্দুস ছাত্তার হাওলাদার, প্রমুখ। তখন ছাত্র ও যুব নেতা হিসেবে গোলাম মোস্তফা তালুকদার (ছাত্রলীগ), হেমায়েত উদ্দিন বাদশা (২ছাত্র ইউনিয়ন ; কমান্ডার, সুন্দরবন সাব-সেক্টর) ও এ কে এম মনিরুজ্জামান বাবুল (ছাত্রলীগ) মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে অবদান রাখেন। মুক্তিযুদ্ধে শরণখোলা থানা এলাকায় প্রাথমিক পর্যায়ে আঞ্চলিক কমান্ডার ছিলেন আনোয়ার হোসেন (সেনাসদস্য), আ. আজিজ ফুল মিয়া (সেনা সদস্য) ও আ. গফফার (সুবেদার)। শরণখোলার ধানসাগর, খোন্তাকাটা, রায়েন্দা, সাউথখালী এ চারটি ইউনিয়নে সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বন্দুক ও দেশীয় লাঠিসোঁটা নিয়ে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য একাধিক মুক্তিযোদ্ধা দল গঠিত হয়। এখানে সেনাসদস্য ক্যাডেট অফিসার আনোয়ার হোসেন ও আ. আজিজ ফুল মিয়ার নেতৃত্বে একটি মুক্তিযোদ্ধা দল গঠিত হয়। সুন্দরবনের বগি এলাকায় এ বাহিনী বনরক্ষীদের কাছ থেকে সংগৃহীত অস্ত্র ও দেশীয় বন্দুক ব্যবহার করে। ধানসাগর-রাজাপুর এলাকায় আ. গফফার সুবেদারের নেতৃত্বে একটি মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়। খোন্তাকাটা ও ধানসাগরে সামছুল আলম তালুকদার, এম এ কাদের, এম আফজাল হুসাইন, নজরুল ইসলাম লাল, হেমায়েতউদ্দিন বাদশা, ইসাহাক আলী সরদারের নেতৃত্বে; সাউথখালীতে মোজাম্মেল হোসেন, সামুছুল হক বেপারী, লুৎফর রহমান, শেখ সামছুর রহমান, আলী হোসেনের নেতৃত্বে এবং রায়েন্দায় ডা. মোছলেম উদ্দিন, আ. ছাত্তার হাওলাদার, মোদাচ্ছের আলীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে গানবোট নিয়ে শরণখোলার রায়েন্দা বাজারের কাছে আসে। কিন্তু এদিন তারা বাজারে প্রবেশ করেনি। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের কোনো প্রতিরোধযুদ্ধ হয়নি। পরে জুন মাসের ১ তারিখ কোনো বাধা বা প্রতিরোধের মুখোমুখি না-হয়েই পাকবাহিনী শরণখোলায় অনুপ্রবেশ করে।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকবাহিনী গানবোট নিয়ে রায়েন্দা বাজার সংলগ্ন বলেশ্বর নদীতে কিছুক্ষণ টহল দিয়ে বরিশাল চলে যায়। পহেলা জুন তারা রাজাকারদের নিয়ে শরণখোলায় এসে থানার দোতলায় একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। এ সময় তারা রায়েন্দা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়েও একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। জুলাই মাসের শেষদিকে রায়েন্দা বাজারস্থ আওয়ামী লীগ নেতা নাছির উদ্দিন আকনের দোতলা বাড়ি দখল করে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী আরেকটি ক্যাম্প স্থাপন করে। এটি তাদের একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল।
শরণখোলায় স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ বেশি তৎপর ছিল। জামায়াত নেতা মাওলানা এ কে এম ইউসুফের নেতৃত্বে ২৮শে মে খুলনার আনসার ক্যাম্পে জামায়াত ও ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। এদেরই একটি দল ১লা জুন শরণখোলায় আসে। রাজাকার বাহিনী ছাড়া জামায়াত ও মুসলিম লীগের নেতাকর্মীরা শরণখোলায় আলবদর ও আলশামস বাহিনীও গঠন করে। এরা সমগ্র উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ব্যাপক অপকর্ম চালায়। তারা গ্রামেগঞ্জে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে।
মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে মাওলানা এ কে এম ইউসুফ (পিতা আজিমউদ্দিন, রাজৈর, রায়েন্দা), আ. রশিদ তালুকদার (পিতা মোবারক আলী তালুকদার, মালিয়া, জনতা; শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), আজিজ মাস্টার (পিতা মোতাহার মুন্সী, মঠেরপাড়, জানেরপাড়; জামায়েত ইসলামীর নেতা), আ. লতিফ পঞ্চায়েত (আমড়াগাছিয়া; মুসলিম লীগের নেতা), মাওলানা হাবিবুর রহমান মোল্লা (গোলবুনিয়া, রায়েন্দা), হাজী আ. ওহাব খান (রায়েন্দা বাজার), মো. নান্না তালুকদার (গোলবুনিয়া, রায়েন্দা; এনএসএফ-এর নেতা), মোদাচ্ছের হোসেন (আমড়াগাছিয়া; ইসলামি ছাত্র সংঘের নেতা), নুর মোহম্মদ তালুকদার (কদমতলা), আ. হামিদ মৌলভী (খাদা, রায়েন্দা), আ. ছত্তার তালুকদার (কদমতলা, রায়েন্দা), আবুল হোসেন শিকদার (এনএসএফ; উত্তর কদমতলা, রায়েন্দা) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। ১লা জুন শরণখোলার রায়েন্দা বাজারের কাছে বলেশ্বর নদীতে পাকবাহিনীর গানবোট আসতে দেখে আওয়ামী লীগ ও সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং অনেক হিন্দু পরিবারের লোকজন আত্মগোপন করে। এদিন রাজাকার ও আলবদররা কিছু হিন্দু বাড়িতে লুটপাট চালায়। মাওলানা এ কে এম ইউসুফের নির্দেশে রাজাকাররা পরিকল্পিতভাবে এ অঞ্চলে সংগ্রাম কমিটি ও মুক্তিবাহিনী গঠনকারী প্রায় সকল নেতার বাড়িতে আক্রমণ ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা খোন্তাকাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ও সংগ্রাম কমিটির নেতা মাস্টার মফিজুল হকের ঘর ভাংচুর করে। তাঁর ভাই মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হকের ঘরে অগ্নিসংযোগ করে। সংগ্রাম কমিটি ও ন্যাপ নেতা মুক্তিযোদ্ধা সামছুল আলম তালুকদারের বাড়ি তারা জ্বালিয়ে দেয়। রাজৈর গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা মহসিন উদ্দিন তালুকদারের ঘর ভাংচুর, লুটপাট এবং তাঁর লাইসেন্সকৃত বন্দুকটি নিয়ে যায়। রাজাকাররা সংগ্রাম কমিটি ও ন্যাপ নেতা মুক্তিযোদ্ধা এম এ কাদের, কেশব চন্দ্র হালদার (নলবুনিয়া) এবং মুক্তিযোদ্ধা কেশব চন্দ্র বেপারী (বানিয়াখালী)-র বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। ধানসাগর ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটির নেতা মুক্তিযোদ্ধা এম আফজাল হুসাইন, সংগ্রাম কমিটি ও ন্যাপ নেতা মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম লাল এবং মুক্তিযোদ্ধা সদানন্দ হালদারের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম হাবিবুর রহমান এবং তাঁর ছোট ভাই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা এ কে এম মনিরুজ্জামান বাবুলের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। তারা মুক্তিযোদ্ধা আ. রব ধলু, আ. মালেক জমাদ্দার এবং আ. খালেক বেপারীর ঘর ভাংচুর ও মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমানের ঘরে অগ্নিসংযোগ করে।
রাজাকার বাহিনী রায়েন্দা ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি ও আওয়ামী লীগ নেতা ডা. মোছলেম উদ্দিন জমাদ্দার, সংগ্রাম কমিটি ও আওয়ামী লীগ নেতা আ. ছত্তার চাপরাশি, আজিজ খান, আ. রশিদ সরদার, আ. রফিজ উদ্দিন এবং মদাচ্ছের আলীর ঘর পুড়িয়ে দেয়। তারা হেমায়েত উদ্দিন বাদশার রায়েন্দা বাজারস্থ বসত ঘর ভাংচুর ও লুটপাট করে। রাজাকাররা সাউথখালী ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি ও আওয়ামী লীগ নেতা সামছুল হক বেপারী, ফুল মিয়া সুবেদার, ইউসুফ আলী সিকদার, পুলিশ সদস্য আবু হানিফ মোল্লা, আ. হালিম খন্দকার, সামছু মুন্সি, মুক্তিযোদ্ধা আলী খান, হেমায়েত খান, সায়েদ খান ও আনোয়ার হোসেনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়া ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা শেখ সামছুর রহমানের বাবার বাড়িতে ভাংচুর করে এবং আগুন দেয়। আ. মজিদ ফকির ও মমিন জোমাদ্দারের ঘরে অগ্নিসংযোগ করে। রাজাকার বাহিনী শরণখোলা থানার প্রায় সকল হিন্দু পরিবারের বাড়িঘরে লুটপাট, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।
রায়েন্দা বাজারে মাওলানা এ কে এম ইউসুফ রাজাকার ক্যাম্প গঠন করার পরই এলাকার সকল হিন্দু বাড়ির মালামাল লুট করে নেয়া, হিন্দু নারীদের সম্ভ্রমহানি, পুরুষদের হত্যা, মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের হত্যা, হিন্দুদের ধর্মান্তরকরণ এবং মুক্তিবাহিনীর সহযোগীদের হত্যা করার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে খোন্তাকাটা, বানিয়াখালী, নলবুনিয়া, ধানসাগর- বাধাল, মালসা ও আমড়াগাছিয়াতে তারা অপারেশন পরিচালনা করে। তারা বাধাল গ্রামের গোপাল হালদার, বানিয়াখালী গ্রামের বিধান বালা এবং নলবুনিয়া গ্রামের বিমল গাইনকে হত্যা করে।
২৮শে জুন পাকবাহিনী ও রাজাকাররা রাজেশ্বর ও লাকুড়তলা গ্রামে গণহত্যা চালায়। অনেককে তারা বেঁধে জবাই ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। তারা নিহতদের লাশ নদীতে ও খালে ভাসিয়ে দেয়। এ ঘটনা রাজেশ্বর- লাকুড়তলা গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। কেবল গণহত্যা নয়, হানাদাররা এসব গ্রামে নির্বিচারে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারীনির্যাতন চালায়।
বাগেরহাটের কুখ্যাত রাজাকার রজ্জব আলী ফকিরের নেতৃত্বে একদল রাজাকার জুন মাসের শেষদিকে ধানসাগর-রাজাপুর গ্রামে লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। প্রথমে সর্বানন্দ রায়, এরপর সতীশ মণ্ডলকে তারা হত্যা করে। মাঠে কাজ করা অবস্থায় কৃষক কুঞ্জবিহারী শিকদার, মহেন্দ্র নাথ হালদার ও সুলতান মুন্সী রাজাকারদের গুলিতে প্রাণ হারান।
জুলাই মাসে আওয়ামী লীগ সমর্থক খলিফা বাড়িতে রাজাকার ইউসুফের নির্দেশে রাজাকার বাহিনী মো. চান মিয়া খলিফা ও আ. রশিদ খলিফা এ দুই সহোদরকে জবাই করে হত্যা করে। রাজাকার লুৎফর রহমান, আ. আউয়াল, আনছার মুন্সী, জহুর হোসেন, আ. রব গাজী, মোফাজ্জেল হোসেন প্রমুখ এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ২১শে অক্টোবর সাউথখালী ইউনিয়নের বগি গ্রাম ও গাবতলা বাজারে পাকসেনা ও রাজাকাররা অনেক মানুষকে হত্যা করে। বগি-গাবতলা গণহত্যার কারণে সমগ্র এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ১৩ই নভেম্বর রাজাকাররা উপজেলার রাজাপুরে ২০-৩০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। রাজাপুর গণহত্যায় রাজাকার কমান্ডার এ কে এম ইউসুফ নেতৃত্ব দেয়।
শরণখোলার রায়েন্দা বাজারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের দুটি ক্যাম্প ছিল। এখানে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী লোকজনকে ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। হানাদারদের এসব নির্যাতনকেন্দ্র থেকে বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে আসা লোকজনের কাছ থেকে বন্দিদের ওপর নির্যাতনের বীভৎস বর্ণনা পাওয়া যায়। এ দুই ক্যাম্পকে তারা বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। শরণখোলার সুন্দরবনে জিয়াউদ্দিনের মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকায় শত্রুরা গ্রামে বেশিক্ষণ অবস্থান করতে সাহস করত না। ঝটিকা হামলা চালিয়ে পালিয়ে যেত। সাধারণ লোকদের হত্যার পর অনেক সময় তারা লাশ নদীতে ও খালে ভাসিয়ে দিত। পরে গণহত্যার শিকার মানুষজনের লাশ আত্মীয়- স্বজনরা দাফন করত। উপজেলার রাজাপুরে একটি গণকবর রয়েছে। এছাড়া রাজেশ্বর ও লাকুড়তলা, বগি-গাবতলা, বাধাল গ্রামের পোল ঘাটা, মঠেরপাড় গ্রাম, রায়েন্দা বাজার, বলেশ্বর নদীর পুরানো স্টিমার ঘাটে অনেক শহীদের কবর রয়েছে।
১১ই জুলাই ক্যাডেট অফিসার আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে ৪৭ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল রায়েন্দা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে। রাজাকাররা পাল্টা আক্রমণ করলে দুই পক্ষে যুদ্ধ বাঁধে। এ-যুদ্ধে আঞ্চলিক কমান্ডার আনোয়ার হোসেন, আচমত আলী ও মো. ইসমাইল শহীদ হন।
১৮ই আগস্ট সুন্দরবন মুক্তিবাহিনী সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিনের পরিকল্পনায় শেলা নদীতে পাকিস্তানি হানাদার বহনকারী স্টিমারে আক্রমণ করা হয়। আক্রমণে স্টিমারের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয় এবং পাকসেনারা হতাহত হয়।
২০শে আগস্ট সুন্দরবন মুক্তিবাহিনী মো. হারুন অর-রশিদ খাঁনের নেতৃত্বে শেলা নদীতে টহলরত পাকিস্তানি গানবোট আক্রমণ করে। পাকসেনারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
২রা সেপ্টেম্বর সুন্দরবন মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটিতে হামলার উদ্দেশ্যে ছয়টি পাকিস্তানি গানবোটে আসা পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে প্রতিরোধযুদ্ধ সংঘটিত হয়। সুন্দরবন প্রতিরোধযুদ্ধ-এ হানাদারদের ৩ জন সৈন্য নিহত ও তাদের গানবোটের ব্যাপক ক্ষতি হলে তারা পশ্চাদপসরণ করে।
২২শে সেপ্টেম্বর সুন্দরবনের শেলা নদীতে পাকিস্তানি হানাদারদের গানবোটে হামলায় ৫০ জন পাকসেনা নিহত ও অনেকে আহত হয়।
১লা অক্টোবর থেকে সুন্দরবন মুক্তিবাহিনীর সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা সপ্তাহব্যাপী সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে সুন্দরবন মুক্তিবাহিনী ঐ আক্রমণ প্রতিহত করে।
১৫-২৬শে অক্টোবর পর্যন্ত সুন্দরবনে পাকবাহিনীর গানবোট হামলায় ৫ জন গ্রামবাসী শহীদ হন এবং বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়।
নূরুল ইসলাম ক্যাশিয়ার ও হাবিলদার আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ২১শে অক্টোবর সুন্দরবন অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর অগ্রবর্তী ঘাঁটি বগি বন্দরে পাকিস্তানি গানবোটের হামলা প্রতিরোধ করেন। ঐদিন সকালে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি গানবোট বরিশাল থেকে বগিতে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটিতে হামলা করার উদ্দেশ্যে আসে। বগি ঘাঁটির দুই মাইল উত্তরে গাবতলা ওয়াবদার সুইসগেট এলাকায় পাকিস্তানি গানবোট এলে পূর্ব থেকে সেখানে এম্বুশে থাকা মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ইউসুফ আলী শিকদারের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের একটি মুক্তিবাহিনী দল গাবতলা সুইসগেটে এম্বুশে ছিল। এ দলে আরও ছিলেন বেলায়েত হোসেন, আবু হানিফ মোল্লা, মমিন জোমাদ্দার, রত্তন মিয়া, রাঙা ইউসুফ, সামছু মুন্সী প্রমুখ। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী গানবোট থেকে ভারী গোলাবর্ষণ করে। গোলার মুখে মুক্তিবাহিনী টিকতে না পেরে পিছু হটে সুন্দরবনের ভেতরে চলে যায়৷
১০ই নভেম্বর এম আফজাল হুসাইনের নেতৃত্বে সুন্দরবন মুক্তিবাহিনী সুপতি নদী মোহনায় পাকিস্তানি গানবোটকে প্রতিরোধ করে। ১৩ই নভেম্বর সুন্দরবনের মুক্তিবাহিনী শরণখোলা ক্যাম্পে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারআলবদরদের দক্ষিণ রাজাপুর, উত্তর রাজাপুর ধানসাগর এলাকার দিক থেকে ঘেরাও ও আক্রমণ করে। এতে কয়েকজন পাকসেনা এবং দুজন রাজাকার গ্রেফতার হয়। এখানে আ. খালেক বেপারী ও আ. মালেক জোমাদ্দারসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা বিশেষ বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শন করেন।
৭ই ডিসেম্বর জিয়াউদ্দিন বাহিনী শরণখোলাকে হানাদারমুক্ত ঘোষণা করে। তবে থানা সদর রায়েন্দা তখনো রাজাকারমুক্ত হয়নি। সেখানে রাজাকার ক্যাম্প ছিল। তাছাড়া অন্য স্থান থেকে বিতাড়িত হয়ে রাজাকাররা এখানে এসে আশ্রয় নেয়। ১৪ই ডিসেম্বর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে রায়েন্দা বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে রাজাকারদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদুল আসাদ, টিপু সুলতান, আলাউদ্দিন, গুরুপদ বালা ও আলতাফ হোসেন শিকদার শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে সংঘটিত রায়েন্দা যুদ্ধ ছিল খুবই স্মরণীয় ঘটনা। শরণখোলা সম্পূর্ণরূপে হানাদারমুক্ত হতে ১৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগে।
শরণখোলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আনোয়ার হোসেন খান (পিতা আলেপ খান, উত্তর সাউথখালী; অফিসার ক্যাডেট, সেনাসদস্য), ইসমাইল হোসেন (পিতা আফেজ উদ্দিন, দক্ষিণ রাজাপুর), আছমত আলী (শরণখোলা), আলতাফ হোসেন শিকদার (পিতা আজাহার শিকদার, রাজাপুর), হাবিলদার আলাউদ্দিন (বরগুনা, সেনাসদস্য), শেখ আবদুল আসাদ (কচুয়া, বাগেরহাট), টিপু সুলতান (বরিশাল) ও গুরুপদ বালা (রামপাল, বাগেরহাট)। রায়েন্দায় সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ আলাউদ্দিন, শেখ আবদুল আসাদ, টিপু সুলতান ও আলতাফ হোসেন শিকদার এই ৪ মুক্তিযোদ্ধার সমাধিতে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। এর পাশে রয়েছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন, আলাউদ্দিন, আসাদ, টিপু সুলতান, আলতাফ হোসেন শিকদারের নামে শরণখোলায় সড়ক রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরপর শরণখোলা থানাকে আসাদনগর নামকরণ করা হয়েছিল। এছাড়া শরণখোলায় একটি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। [আবু জাফর জব্বার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড