শরীয়তপুর গণহত্যা (শরীয়তপুর সদর)
শরীয়তপুর গণহত্যা (শরীয়তপুর সদর) সংঘটিত হয় ২২শে মে। এদিন পাকসেসনা ও রাজাকাররা শরীয়তপুর জেলার সদর উপজেলার (তৎকালীন পালং থানা) আঙ্গারিয়া, মধ্যপাড়া, কাশাভোগ, নীলকান্দি, পশ্চিম কাশাভোগ, মনোহর বাজার, রুদ্রকর প্রভৃতি হিন্দুপ্রধান গ্রামে হামলা চালিয়ে প্রায় ৩৫০ জন নর-নারীকে হত্যা করে। এ ঘটনা হানাদারদের পরিচালিত একটি লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত। হত্যার পাশাপাশি তারা গ্রামগুলোতে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন চালায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় শরীয়তপুরের হিন্দুপ্রধান গ্রামগুলো পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ২২শে মে পাকসেনারা পালং অঞ্চলের রাজাকার প্রধান সোলায়মান মোল্লা, মাওলানা ইদ্রিস আলী সরদার, মুজিবুর রহমান তালুকদার, রবুল্লা মাস্টার, আজিজ মোল্লা, ইউসুফ আলী মোল্লা, আবদুর রব সরদার, আরশেদ আলী চৌকিদার, ইসমাইল ব্যাপারী, আফতাব উদ্দিন দেওয়ান, হাসমত আলী খান, লাল চান মাতবর, লাল মিয়া প্রমুখের সহায়তায় আঙ্গারিয়া বাজারে হঠাৎ হানা দেয়। তারা নড়িয়া থানার ঘড়িশার অঞ্চলে হত্যা-নির্যাতন চালিয়ে ফেরার পথে আঙ্গারিয়া আসে। এদিন আঙ্গারিয়া, মধ্যপাড়া, কাশাভোগ, নীলকান্দি, পশ্চিম কাশাভোগ, মনোহর বাজার, রুদ্রকর-সহ হিন্দুপ্রধান এসব এলাকায় তারা নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালায়। তারা মর্টার, মেশিনগান, এসএমজি, চাইনিজ রাইফেল, থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ও ব্রাশ ফায়ারে প্রায় ৩৫০ জন হিন্দু নর-নারীকে হত্যা করে। এরপর গ্রামগুলোতে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ চালায়।
সেদিন পাকিস্তানি সেনারা রুদ্রকর গ্রামের জমিদার প্রমথ লাল চক্রবর্তীর বাড়িতে নবাব আমলে প্রতিষ্ঠিত প্রায় ১৫০ ফুট উঁচু মঠে মর্টার শেল নিক্ষেপ ও ব্রাশ ফায়ার করে। একই দিন মনোহর বাজারের সাথী বিড়ির মালিক রমণী সাহা, তার মেয়ে সোভা, সোভা রানীর দেবর, ননদসহ একই পরিবারের ৯ জনকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয়। মনোহর বাজারের রুহুল আমিন নিকারির বাড়ির সামনে একটি টিনের মসজিদের ভেতর ১০-১২ জন হিন্দু মহিলাকে ধরে এনে রাজাকারদের সহায়তায় পাকসেনারা পালাক্রমে ধর্ষণ করে। একই দিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রুদ্রকর নীলমণি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুখদেব সাহা, গৌরাঙ্গ চন্দ্র পোদ্দার, কানাই মালো, পার্শ্ব নাথ, নারায়ণ চন্দ্র, চিত্ত রঞ্জন সাহা, হরি সাহা, রামমোহন সাহা, উপেন্দ্র মোহন সাহা, মনোমোহন চক্রবর্তী, রুহিদাস, নীপা পোদ্দার, জয়দেব সাহা, মহাদেব সাহাসহ ৫০ জন পুরুষ ও ৫০ জন তরুণী ও গৃহবধূকে ধরে নিয়ে যায়। মধ্যপাড়া গ্রামের একটি পরিত্যক্ত ঘর ও মন্দিরে নিয়ে নারীদের পাশবিক নির্যাতন শেষে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। এছাড়া ২৫-৩০ জন তরুণীকে একত্রিত করে মাদারীপুর এ আর হাওলাদার জুটমিলসে নিয়ে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করে (দেখুন এ আর হাওলাদার জুট মিলস নির্যাতনকেন্দ্র বধ্যভূমি ও গণকবর )। তাদের মৃতদেহ মিলের পেছনে আড়িয়াল খাঁ নদীতে ফেলে দেয়। ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের শিকার একজন নারীর ১৩ দিনের শিশু সন্তানকে এক পাকসেনা লাথি মারলে শিশুটি সঙ্গে-সঙ্গে মারা যায়। হানাদাররা মধ্যপাড়া গ্রামের সখি বালা দাসকে ঘরের ভেতর আটকে রেখে বাইরে থেকে অগ্নিসংযোগ করে। রাতভর অগ্নিসংযোগ আর লুটতরাজ চালায় তারা। এদিন হানাদাররা রুদ্রকর গ্রামের প্রমথ লাল চক্রবর্তীর বাড়িতে হামলা চালিয়ে পূজারি ব্রাহ্মণ চন্দ্র মোহন চক্রবর্তীকে দু-পা ও দুহাত ধরে বিশাল মঠের পুকুরের মধ্যখানে ফেলে দিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
এদিন কাশাভোগ গ্রামের যারা নিহত হন, তারা হলেন— উপেন্দ্র লাল নাগ, তারুনী বালা নাগ, কালাচান পোদ্দার, শম্ভু কর্মকার ও আব্দুস সামাদ শিকদার; দক্ষিণ মধ্যপড়া গ্রামের গাপাল চন্দ্র সাহা, শিব নাথ সাহা, ব্রজ লাল সাহা, অংশু বালা সাহা, রাধিকা মোহন মালো, মাখন লাল মালো, শশিনাথ মালো, মহাদেব মালো, আদরী মোহন মালো, কুণ্ডেশ্বর মালো, গৌরাঙ্গ মালো, হীরা লাল মালো, বিনয়কৃষ্ণ মালো, কানাই লাল মালো, সখি দাস, ডা. চিত্তরঞ্জনসহ তাঁর পরিবারের ১০ জন, হরিদাস সাহা, কমলা রানী সাহা ও তাঁর শিশু পুত্র, কৃষ্ণ চন্দ্র সাহা, দশরথ চন্দ্র সাহা, উপেন্দ্র লাল দাস, ইন্দ্রজিৎ দাস, কিরণ বালা দাস, অভিমন্যু দাস, গৌরাঙ্গ পোদ্দার, উপেন্দ্র চন্দ্র সাহা, মাস্টার সুখদেব চন্দ্র সাহা, জয়দেব সাহা, মন্টু রঞ্জন সাহা, লক্ষ্মীনারায়ণ সাহা, মন্টু রঞ্জন শিকদার, বিশাই সাহা, রুপেন্দ্র দাস, মনোমোহন চক্রবর্তী, চিন্তাহরণ সাহা, মমতা রানী সাহা, রুহিদাস সাহা, শিবনাথ সাহা, নারায়ণ চন্দ্র সাহা, জয়ন্ত রানী সাহা, মাস্টার অভিক সাহা, মরণ ঋষি, মধু নাগারসি, হরিদাসি, মহাদেব মালো, কৃষ্ণপদ রায়, শৈলেশ রায়, অনিল পাল, পরেশ পাল, হারাধন পোদ্দার, সাধনা রানী পোদ্দার, রামমোহন সাহা প্রমুখ; উত্তর মধ্যপাড়া গ্রামের বাসুদেব সাহা, সুবল চন্দ্র পাল, তমাল পাল, রামমোহন সাহা, বিমল দেবনাথ, রণজিৎ ব্যানার্জী, সুকুমার ব্যানার্জীসহ আরো কয়েকজন; রুদ্রকর গ্রামের চন্দ্র মোহন চক্রবর্তী (পূজারি ব্রাহ্মণ) প্রমুখ। মধ্যপাড়াসহ এ অঞ্চলের যে-সকল গ্রামবাসী ঘটনাক্রমে প্রাণে বেঁচে যান, তারা নিজ-নিজ ঘরবাড়ি, সহায়- সম্বল ফেলে নৌকায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। নৌকায় পালিয়ে বেড়িয়েও তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। আগস্ট মাসে পাকবাহিনী এসে তাদের হত্যা করে। এছাড়া এ অঞ্চলে বরিশাল জেলার মূলাদী, উজিরপুর প্রভৃতি অঞ্চলের যেসব হিন্দু নর-নারী তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই এখানে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এ-ধরনের নিহত লোকের সংখ্যা অনেক। মনোহর বাজার গণহত্যায় যারা শিকার তাদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। [আবদুর রব শিকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড