বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিং
শচীন্দ্র লাল সিং (১৯০৭-২০০০) ভারতের ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী, ষাটের দশক থেকে বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক, বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ও শ্রদ্ধেয় বন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে সহায়তা প্রদানকারী। ৭১-এর ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করলে তিনি লাখ-লাখ আশ্রয় প্রত্যাশী মানুষের জন্য তাঁর রাজ্যের সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেন। সীমান্ত কেবল খুলে দেননি, তিনি শরণার্থী শিবির স্থাপন করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রিক্রুটিং ক্যাম্প ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন এবং অস্ত্রের যোগান দেন। এক সময় ১৫ লাখ লোকের ত্রিপুরায় বাংলাদেশের ১৬ লাখ লোক আশ্রয় নেয়। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স স্থাপিত হয়। শচীন্দ্র লাল সিং ও তাঁর সরকারের আন্তরিক সাহায্যে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন রাজধানী (War Capital)-তে পরিণত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শচীন্দ্র লাল সিং Friends of Liberation War সম্মাননা লাভ করেন।
শচীন্দ্র লাল সিং শচীন্দ্র লাল সিং ১৯০৭ সালের ৭ই আগস্ট আগরতলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা দীন দয়াল সিং ত্রিপুরার একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। শচীন্দ্র লাল সিং আগরতলায় স্কুলের অধ্যয়ন শেষে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন।
এখান থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। স্কুলজীবন থেকে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ‘ভাতৃ সংঘ’ নামে আগরতলার একটি যুব সংগঠনের তিনি সদস্য ছিলেন। কুমিল্লায় থাকাকালে তিনি বিপ্লবী ‘যুগান্তর’ দলের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি ও তাঁর ভাই অনন্ত সিং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তরুণ বয়স থেকে তিনি ত্রিপুরার জনগণের, বিশেষ করে পাহাড়ি মানুষের জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিতে মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহেরুর অনুসারী হিসেবে কংগ্রেসে যোগ দেন। তিনি ত্রিপুরায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দল গঠন ও সুসংগঠিত করেন। প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা ও মৃত্তিকাসংলগ্নতা ছিল তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ও কৌশল। পূর্ব বাংলার জনপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ও ত্রিপুরার জনপ্রিয় নেতা শচীন্দ্র লাল সিং তাঁদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ও গণমুখীনতার জন্য পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হন। ১৯৬২ সালে বঙ্গবন্ধু ত্রিপুয়ার গেলে শচীন্দ্র লাল সিং-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। ১৯৬৩ সালের জুলাই-এ শচীন্দ্র লাল ত্রিপুরার প্রথম মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭১- এর নভেম্বর পর্যন্ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। এক সময় তিনি কংগ্রেস ছেড়ে ‘কংগ্রেস ফর ডেমোক্রেসি’ পার্টিতে যোগ দেন। পরে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর আহ্বানে আবার কংগ্রেসে ফিরে আসেন।
শচীন্দ্র লাল সিং-এর সরকার ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে কোনো নির্দেশনা পাওয়ার পূর্বেই বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ত্রিপুরার সীমান্ত খুলে দেয়। ২৯শে মার্চ মুখ্যমন্ত্রীর আগ্রহে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ত্রিপুরা বিধান সভার বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করা হয়। এদিন বিধান সভায় শচীন্দ্র লাল সিং বাংলাদেশের স্বধীনতা ও বাংলাদেশের মানুষের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আবেগপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। ৩০শে মার্চ বিধান সভার সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণকে পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান ও তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাদের সঙ্গে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। একই সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য। ত্রিপুরা বিধান সভাই প্রথম বাংলাদেশের পক্ষে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে প্রেরণ করে। পাকিস্তানিরা মার্চ-এপ্রিলে বাংলাদেশের সর্বত্র যে গণহত্যা, নির্যাতন, ধ্বংসযজ্ঞ ও জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে, তাতে প্রতিদিন হাজার-হাজার মানুষ আশ্রয়ের জন্য ত্রিপুরায় প্রবেশ করতে থাকে। শচীন্দ্র লালের সরকার এসব মানুষের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে। অনেক স্থানীয় মানুষ তাদের নিজেদের বাড়িঘর শরণার্থীদের জন্য ছেড়ে দেয়। ত্রিপুরার স্কুল-কলেজ-মাঠ ও খোলা প্রান্তরে আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে ওঠে। এক সময় ১৫ লাখ লোকের ত্রিপুরা বাংলাদেশের ১৬ লাখ লোককে আশ্রয় দেয়। ছাত্র, শিক্ষক, তরুণ, কৃষক ও শ্রমিকরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাবদ্ধ হওয়ার জন্য ত্রিপুরায় যান। শচীন্দ্র লাল সিং সকল আশ্রয় কেন্দ্র ও মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটিং সেন্টার পরিদর্শন করে সবাইকে অনুপ্রাণিত করেন। তিনি তাঁর সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করেন। আস্তে- আস্তে ত্রিপুরায় মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন হেডকোয়ার্টার্স স্থাপিত হয়। ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্র ত্রিপুরার বিভিন্ন সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছানো হতো। বাংলাদেশ সরকার-এর প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী, সেনাপতি ও অন্য সমর নায়কদের সকলে শচীন্দ্র লাল সিং ও তাঁর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ ও সহযোগিতার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা, ভারতীয় সামরিক সাহায্য ও অস্ত্র সরবরাহ করার নীতি গ্রহণ করেন। এভাবে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন রাজধানী (War Capital)-র অনানুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়। শচীন্দ্র লাল সিং দলমত নির্বিশেষে ত্রিপুরার সকল মানুষ যাতে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়, তা নিশ্চিত করেন। তাঁর জনপ্রিয়তা, নেতৃত্ব, বাংলাদেশের পক্ষে অগ্রণী ও দৃঢ় অবস্থান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে। তিনি কেবল তাঁর নিজের সরকার, নিজের রাজ্যবাসীর সমর্থন ও সহযোগিতা নয়, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বাংলাদেশ-নীতিও মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে আনতে অনন্য অবদান রাখেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অগ্রবর্তী ও অগ্রণী ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালের ২৭শে মার্চ শচীন্দ্র লাল সিং-কে Friends of Liberation War সম্মাননা (মরণোত্তর) প্রদান করে। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ সফরে এলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানান। বাঙালিদের স্বাধীনতার দীর্ঘ সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তাঁকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান। বাংলাদেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এ বন্ধু ২০০০ সালের ৯ই ডিসেম্বর দিল্লিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। [জালাল আহমেদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড