বীর প্রতীক শফিকুর রহমান
শফিকুর রহমান, বীর প্রতীক (১৯৪৭-২০১২) নায়েক সুবেদার ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৭ সালে যশোর জেলার সদর উপজেলার ইছালী ইউনিয়নের জোত রহিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম নওয়াব আলী বিশ্বাস এবং মাতার নাম জরিনা বেগম।
শফিকুর রহমান ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। চট্টগ্রাম ইবিআরসি থেকে ট্রেনিং শেষ করার পর তাঁকে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে পদায়ন করা হয়। ১৯৭১ সালে তিনি যশোর সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। ৩০শে মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি সৈনিকদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালালে শফিকুর রহমান পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু হানাদার বাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে কৌশলে সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে বনগাঁ-এ তাঁর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হন। এরপর শফিকুর রহমান ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে বেনাপোল, পেট্রাপোলসহ বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরে তিনি ভারতের তেলঢালায় চলে যান এবং সেখানে ‘জেড’ ফোর্সের সঙ্গে যুক্ত হন। তেলঢালায় কিছুদিন অবস্থান করার পর তিনি জুলাই মাসে ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে জামালপুরের সীমান্তবর্তী কামালপুরের সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ঘেঁষে কামালপুরের অবস্থান। কামালপুর বিওপি ও এর আশপাশের সীমান্ত বরাবর পাকবাহিনী এক দুর্ভেদ্য ঘাঁটি স্থাপন করে। ৩০শে জুলাই রাতে ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের নেতৃত্বে দুই কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনরি শক্তিশালী ঘাঁটি কামালপুর বিওপি-তে আক্রমণ চালান। এ-যুদ্ধে শফিকুর রহমান ও তাঁর সহযোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা কাঁটাতার ও মাইন ফিল্ড অতিক্রম করে পাকবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের কাছাকাছি পৌছে গুলি ছুড়তে থাকেন। পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা গুলি চালায়। একই সঙ্গে উভয় পক্ষ থেকে শুরু হয় আর্টিলারি শেলিং। গোলাগুলির বিকট শব্দে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। কমান্ডারের নির্দেশে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে শফিকুর রহমান পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যূহের ভেতরে ঢুকে পড়েন। এ-সময় হঠাৎ পাকবাহিনীর ছোড়া একটি গোলা এসে শফিকুর রহমানের পাশে বিস্ফোরিত হলে স্প্লিন্টারের আঘাতে তাঁর একটি হাত উড়ে যায়। এমতাবস্থায় সহযোদ্ধাদের কয়েজন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উদ্ধার করে তাঁকে ফিল্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে ভারতে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কামালপুরের এ ভয়াবহ যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজসহ ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৬০-৬৫ জন আহত হন। অপরদিকে ৪০-৫০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও সমসংখ্যক আহত হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে শফিকুর রহমানের সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। তাঁর স্ত্রীর নাম শাহনাজ বেগম। এ দম্পতি ২ পুত্র ও ২ কন্যা সন্তানের জনক-জননী। যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমান, বীর প্রতীক ২০১২ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। [শফিউদ্দিন তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড