মুক্তিযুদ্ধে প্রগতিশীল রাজনীতিক লুৎফুন নাহার হেলেন
লুৎফুন নাহার হেলেন (১৯৪৭-১৯৭১) স্কুল শিক্ষিকা, প্রগতিশীল রাজনীতিক, ৭১-এ মাগুরা শহরে পাকবাহিনীর নির্মম-নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের শিকার ও শহীদ। ১৯৪৭ সালের ২৮শে ডিসেম্বর মাগুরা শহরে এক রাজনৈতিক পরিবারে তাঁর জন্ম। হেলেনা নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। লুৎফুন নাহার ছিল তাঁর স্কুলে ভর্তির সময় দেয়া নাম৷ তাঁর পিতার নাম মুহাম্মদ ফজলুল হক ও মাতা মোসাম্মৎ সফুরা খাতুন।
মাগুরা জেলার মহম্মদপুর থানাধীন হরেকৃষ্ণপুর গ্রামে পিতা মাগুরায় ন্যাপকৃষক ছিল তাঁদের স্থায়ী নিবাস। সমিতির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন। হেলেনরা ৫ ভাই ও ৯ বোন ছিলেন। বড়ভাই মো. মাহফুজুল হক নিরো ছাত্রজীবনে মাগুরায় ন্যাপ ও পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন। হেলেন বোনদের মধ্যে ৬ষ্ঠ ছিলেন। তিনি মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি লাভের পাশাপাশি তিনি ডাবল প্রোমোশন পেয়ে সহপাঠীদের ডিঙ্গিয়ে ওপরের ক্লাসের শিক্ষার্থী হয়েছিলেন। ১৯৬৩ সালে তিনি মাগুরা গার্লস হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৬ সালে মাগুরা কলেজ (বর্তমান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ১৯৬৮ সালে মাগুরা কলেজ থেকে বিএ পাস করে মাগুরা গার্লস হাইস্কুল (বর্তমান মাগুরা সরকারি গার্লস হাইস্কুল)-এ সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি মাগুরায় বামপন্থী রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক প্রতিবাদী কণ্ঠ ।
১৯৬৫ সালে কলেজে অধ্যয়নকালে আপন চাচাতো ভাই ও বামপন্থী রাজনীতিক আলী কদর (পিতা মো. আবদুল মালেক)-এর সঙ্গে হেলেনের বিয়ে হয়। স্বামী আলী কদর ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়ন- এবং ১৯৬৫ সাল থেকে প্রথমে পুলুম (শালিখা) ও পরে ঝামা (মহম্মদপুর) হাইস্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি ন্যাপকমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৬৩-৬৪ সময়ে মাগুরা কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। ৭১-এ তিনি মাগুরা মহকুমা (বর্তমান জেলা)-র মহম্মদপুর থানা ও তৎসংলগ্ন এলাকায় বামপন্থীদের নিয়ে স্থানীয়ভাবে গঠিত মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। হেলেন ও আলী কদর দম্পতি তখন লুৎফে আলী দিলীর নামে একটি মাত্র শিশু পুত্রের জনক-জননী (বর্তমানে দিলীর সস্ত্রীক আমেরিকা প্রবাসী)।
লুৎফুন নাহার হেলেন স্কুল জীবন থেকেই প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬২ সালে আইয়ুব সরকারের গণবিরোধী ও বাংলা ভাষা বিদ্বেষী শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে ছাত্র-আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। আইয়ুব খানের একনায়কতান্ত্রিক শাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন হাতে তিনি মিছিলের অগ্রভাগে থেকেছেন। কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন মাগুরা শাখার নেত্রী এবং মাগুরা কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত মহিলা কমনরুম সম্পাদিকা ছিলেন। আইয়ুব শাসন আমলে সরকারি সিদ্ধান্তে ঢাকা রেডিও এবং টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ করা হলে তিনি এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হন। এ সম্বন্ধে ডায়েরিতে তাঁর প্রতিক্রিয়া এভাবে লিপিবদ্ধ করেন: সরকারের এক বিশেষ নির্দেশে রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ হয়ে গেছে। বাঙালীর ঐতিহ্যকে ভূলুণ্ঠিত করার জন্য আবার সরকারি মহল তৎপর হয়ে উঠেছে। এদের এ ধরনের ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয় একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনাপঞ্জিকে। আজ এরা রবীন্দ্রসঙ্গীত বাদ দিচ্ছে, কাল এরা বলবে রবীন্দ্রসাহিত্যই মুসলিম ‘ঐতিহ্যের’(?) অনুকূলে নয়। এদের এই বহুল ব্যবহৃত ‘মুসলিম ঐতিহ্যের’ দোহাই দিয়ে এরা আরো কত কি যে করবে তা ‘খোদাই মালুম’ না বলে বলতে হয় মনিবই মালুম। হঠাৎ স্বাধীনতা লাভের ২০ বছর পর মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথ ভারতের কবি। রবীন্দ্রনাথ তো শুধু পশ্চিম বাঙলার কবি নন। তিনি বাঙালীর কবি। তিনি বিশ্বকবি।
তাই সরকারের এ ধরনের আইন জারিকে আমরা তাদের অজ্ঞতা বলে উড়িয়ে দিতে পারিনে। এটা সম্পূর্ণরূপে বাঙালীকে খাটো করবার প্রচেষ্টা বাঙালীর অধিকারকে পদদলিত, বাঙালীর ঐতিহ্যকে পদদলিত করার প্রচেষ্টা আমরা জাতিগত দিক দিয়ে বাঙালী, আমরা বাংলা ঐতিহ্যে বিশ্বাসী। আমাদের সে ঐতিহ্যকে আমরা বুকের রক্ত দিয়ে টিকিয়ে রাখব যেমন করেছিলাম ২১শে ফেব্রুয়ারিতে। (ডায়েরি, ২৪শে আষাঢ়, ১৩৭৪ সাল)।
হেলেন মুক্তিযুদ্ধকালে আগস্ট মাস পর্যন্ত শিশুপুত্রকে নিয়ে কখনো মাগুরা শহরে পিতার বাসায় কখনো গ্রামের বাড়ি মহম্মদপুর থানার হরেকৃষ্ণপুর গ্রামে থাকতেন। মাগুরা শহরে থাকাকালে তাঁর প্রধান কাজ ছিল জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, তাদের দোসর জামায়াত, রাজাকার ও আলবদরদের গোপন কর্ম-পরিকল্পনা সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করে তাঁর মুক্তিযোদ্ধা স্বামী আলী কদরের কাছে পাঠানো। মাগুরায় রাজাকারআলবদরদের নেতৃত্বদানকারী জামায়াত চক্র পাকিবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর বড়ভাই মাহফুজুল হকসহ অন্যান্য ভাইদের হত্যার উদ্দেশ্যে একদিন তাঁর পিতার বাসা ঘেরাও করে, কিন্তু তারা ঠিক এর সামান্য পূর্বে অন্যত্র আত্মগোপন করে প্রাণে রক্ষা পান। তাঁর স্কুলপড়ুয়া (এসএসসি পরীক্ষার্থী) ছোটভাই জাহাঙ্গীর কবির দাদুকে ২০শে জুন রাজাকাররা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তারা তাকে মাগুরা শহরের নোমানী ময়দান সংলগ্ন জেলা পরিষদ ডাকবাংলোতে বন্দি করে রেখে ৪-৫ ঘন্টা ধরে অমানুষিক নির্যাতন শেষে দু হাত-পা ও চোখ বাঁধা অবস্থায় সন্ধ্যার পর হত্যার উদ্দেশ্যে বদ্ধ কামরার মেঝেতে ফেলে রাখে। সেখান থেকে বিকেলে কৌশলে পালিয়ে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এর পূর্বে তাঁর বৃদ্ধ পিতাকেও একাধিকবার রাজাকাররা ধরে নিয়ে শাসিয়ে ছেড়ে দেয়।
এমনি অবস্থায় ও মুক্তিযুদ্ধে আরো সক্রিয় ভূমিকা রাখার জন্য লুৎফুন নাহার হেলেন সেপ্টেম্বর মাসে কোলের শিশুকে নিয়ে মহম্মদপুর এলাকায় কখনো নিজেদের বাড়িতে কখনো পার্শ্ববর্তী অন্যদের বাড়িতে থাকা শুরু করেন। সেখানে নারীদের বিশেষত ভূমিহীন ও গরিব কৃষক পরিবারের নারী সদস্যদের মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেন। পাশাপাশি, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়া-দাওয়া, দেখাশুনা ও অসুস্থদের সেবা- যত্ন করেন। অক্টোবর মাসের শুরুতে সুলতানসি গ্রাম (থানা মহম্মদপুর) থেকে ঘাতক-দালালদের গুপ্তচরদের সহায়তায় লুৎফুন নাহার হেলেন ২ বছর ৫ মাস বয়সের শিশুপুত্র দিলীরসহ রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। সঙ্গে-সঙ্গে তাঁকে মাগুরা শহরে নিয়ে আসা হয়। এরপর পাকিস্তানি বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সোপর্দ করা হয়। হেলেনের এ দুঃসংবাদে তাঁর বৃদ্ধ পিতা ও আত্মীয়স্বজন দুগ্ধপোষ্য শিশুর মাতা হিসেবে হেলেনের মুক্তির জন্য সেনাকর্মকর্তার কাছে আবেদন করেন। কিন্তু পাকহানাদার বাহিনীর দোসর পীরজাদা ওবায়দুল্লাহ (মাগুরা মহকুমা শান্তি কমিটির সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ও পাকবাহিনীর দালাল সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের আপন চাচাত ভাই), কাজী মাহবুবুর রহমান ওরফে মাহবুব মৌলভী (সেক্রেটারি, মাগুরা মহকুমা শান্তি কমিটি; মাগুরা সরকারি গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষক ও শহীদ হেলেনের সহকর্মী; গ্রাম- উমেদপুর, থানা- মহম্মদপুর; বর্তমানে জীবিত), শামসুল হক মওলানা (মাগুরা একাডেমির ইসলামী শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক), কবির (পিতা আব্দুল হাফিজ, মাগুরা সদর; ইসলামী ছাত্র সংঘ -এর মাগুরা শাখার সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধকালে রাজাকার কমান্ডার), রেজাউল করিম রিজু (পিতা মৌলভী শামসুদ্দিন আহমেদ, মাগুরা সদর; রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর দুর্ধর্ষ কমান্ডার; স্বাধীনতাউত্তর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষকতায় যোগদান; রেজাউল করিম মামুন নাম ধারণ, বর্তমানে মৃত) প্রমুখ জামায়াতপন্থী ঘাতক-দালালরা তাঁর মুক্তির ব্যাপারে ঘোর বিরোধিতা করে। তারা পাকিস্তানি কর্মকর্তাকে জানায় যে, হেলেন মাগুরার বামপন্থী নেতা মাহফুজুল হক নিরোর বোন এবং মহম্মদপুর এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বামপন্থী নেতা আলী কদরের স্ত্রী। তাছাড়া সে নিজেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একজন সক্রিয় কর্মী। সুতরাং তাঁর মুক্তির প্রশ্নই ওঠে না।
পরের ঘটনা খুবই মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক ও একইসঙ্গে পৈশাচিক। ৭১-এর ৫ই অক্টোবর রাত। সেদিন ছিল পবিত্র শবেবরাত। ঐ রাতে পাকিস্তানি সেনারা অমানবিক ও নির্মম শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে লুৎফুন নাহার হেলেন- কে। এরপর হায়েনারা তাঁর মৃতদেহ জিপের পেছনে বেঁধে টেনে নিয়ে যায় শহরের অদূরে নবগঙ্গা নদীর ডাইভারশন ক্যানেলে। ঐ ক্যানেলে তাঁর ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ ফেলে দেয়া হয়। তাঁর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশের ডাকবিভাগ ১৯৯৫ সালে হেলেনের স্মরণে “শহীদ বুদ্ধিজীবী লুৎফুন নাহার হেলেনা’ নামে ডাকটিকেট প্রকাশ করে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: আলী কদর, ‘আমার স্ত্রী’, রশীদ হায়দার (সম্পাদিত), স্মৃতি : ১৯৭১ (অষ্টম খণ্ড), বাংলা একাডেমি, ঢকা ১৯৯৫, পৃ. ১৬-২৫; লেখকের সঙ্গে আলী কদর ও জাহাঙ্গীর কবির দাদুর সাক্ষাৎকার (১৪ই ও ২১শে ডিসেম্বর ২০১৮)
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড