মুক্তিযুদ্ধে লালমাই উপজেলা (কুমিল্লা)
লালমাই উপজেলা (কুমিল্লা) কুমিল্লা জেলার সর্বনবীন উপজেলা। ২০১৮ সালের ৯ই জানুয়ারি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার ৮টি এবং লাকসাম উপজেলার একটি মোট ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে লালমাই উপজেলা গঠিত হয়। ৯টি ইউনিয়ন হলো- বাগমারা উত্তর, বাগমারা দক্ষিণ, ভুলুইন উত্তর, ভুলুইন দক্ষিণ, পেরুল উত্তর, পেরুল দক্ষিণ, বেলঘর উত্তর, বেলঘর দক্ষিণ এবং বাকুই উত্তর। উপজেলার উত্তরে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ, পশ্চিমে বরুড়া ও লাকসাম, দক্ষিণে লাকসাম এবং পূর্বে লাঙ্গলকোট উপজেলা। লালমাই উপজেলার সদর দপ্তর ফতেহপুর।
মুক্তিযুদ্ধকালে বর্তমান লালমাই উপজেলার রাজনীতি মূলত কুমিল্লা সদর উপজেলাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। ২৩শে জানুয়ারি ১৯৭১-এ কুমিল্লা টাউন হলে অনুষ্ঠিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ মানুষের সার্বিক মুক্তির কথা উল্লেখ করেন। এ ভাষণ জনগণকে মুক্তিসংগ্রামে উদ্দীপ্ত করে। অসহযোগ আন্দোলন-এ কুমিল্লা শহর হয়ে ওঠে উত্তাল। শহরের সন্নিহিত অঞ্চল হওয়ায় সেই আন্দোলনসংগ্রামের ঢেউ এসে লাগে লালমাই উপজেলার প্রতিটি ঘরে। আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সভা এবং সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর কুমিল্লা সদরে গঠিত হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ লালমাই উপজেলার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। এ অঞ্চলের আপামর জনগণের নেতা আবুল কালাম মজুমদার ছিলেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান এবং আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা। মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বার্তা তাঁর মাধ্যমে ঘরে-ঘরে ছড়িয়ে পড়ে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী কুমিল্লার ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করেন। শহরের নানা জায়গায় প্রশিক্ষণ চলছিল। বাগমারা হাইস্কুল মাঠ ও এর পাশাপাশি স্থানে আবুল কালাম মজুমদারের নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। বাগমারার রায়পুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সেনাসদস্য জহিরুল ইসলাম এ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। প্রশিক্ষণে এলাকার কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনা, ইপিআর ও পুলিশ সদস্য যোগদান করেন।
১৪ই মার্চ বাগমারা হাইস্কুল প্রাঙ্গণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার শপথ নিয়ে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাবাদর্শে দেশবাসীকে যে-কোনো প্রকার ত্যাগ স্বীকারের জন্য আহ্বান জানিয়ে বক্তৃতা করেন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আবদুল আউয়াল ও আবদুর রশিদ, অধ্যাপক আবদুর রউফ ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান আবুল কালাম মজুমদার। সভায় সভাপতিত্ব করেন বাগমারা হাইস্কুলের শিক্ষক আবেদ আলী। এভাবে লালমাই অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। পরবর্তী সময়ে এখানকার অনেক মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে গিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সংগঠক অধ্যক্ষ আবুল কালাম মজুমদার ভারতের নির্ভয়পুর ও মেলাঘর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন।
লালমাই উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন জ্যোতিঃপাল মহাথের (বরইগাঁও)। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য বহির্বিশ্বে বৌদ্ধদের মধ্যে এই ধর্মগুরুর অবদান সর্বাধিক। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকে শুরু করে শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, জাপান প্রভৃতি দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলোতে তাঁর ব্যাপক প্রচারণা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত অর্জনে প্রভূত সহায়তা করে।
অধ্যক্ষ আবুল কালাম মজুমদার (পিতা মিয়াজান মজুমদার, মেহেরকুল, দৌলতপুর) ষাটের দশক থেকে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সংগঠক ও স্থানীয় নেতা। ৭১-এ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান হিসেবে তিনি যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তিনি সাধারণ মানুষকে নেতৃত্ব দিয়ে সংগঠিত করেন। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর জেলা ও এ উপজেলার সকল আন্দোলন ও সভা-সমাবেশে ছিল তাঁর সংগ্রামী ভূমিকা।
আবু তাহের মজুমদার (পিতা আশরাফ আলী মজুমদার, আশকামতা, বাগমারা বাজার) ছিলেন লাকসাম এলাকার সাব-সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্বে।
২৫শে মার্চ সারাদেশের মতো কুমিল্লার পরিস্থিতিও ছিল খুবই আশঙ্কাজনক। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের খবর পেয়ে কুমিল্লার নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে টমছম ব্রিজে কাঁটাতারের বান্ডেল, গাছ, ড্রাম, ইট এবং বাস-ট্রাক রাস্তার ওপর ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। পদুয়ার বাজারে পিচের ড্রাম দিয়ে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়।
২৬শে মার্চ রাত ১টায় ২৪ ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্স রেজিমেন্ট ও ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারদের একটি অংশ এবং তাদের সঙ্গে ১২০ মিলিমিটার মর্টারবাহী ৮০ থেকে ১০০টি যানের একটি বিরাট কনভয় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে চট্টগ্রাম রওনা দিলে শুয়াগাজী ও পিপুলিয়া এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে রাস্তার পাশের গাছ কেটে ফেলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয় (দ্রষ্টব্য কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা)।
বাগমারা অঞ্চলে সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসা বাঙালি সেনা, পুলিশ ও ইপিআর সদস্যদের দলে অন্তর্ভুক্ত করেন। সুবেদার জলিলের নেতৃত্বে কুমিল্লা শহরের নিকটবর্তী জাঙ্গালিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পাহারারত এক প্লাটুন বেঙ্গল রেজিমেন্ট সদস্য বাগমারায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন।
৩১শে মার্চ নায়েব সুবেদার জলিলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা হালকা মেশিনগানের সাহায্যে পাকিস্তানি বাহিনীর মালবাহী কালো রঙের বৃহদাকার বিমানকে আক্রমণ করে। এ আক্রমণের পর ঐদিন দুপুরের দিকে বিমান বন্দর ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর আনুমানিক ৪ গাড়ি সৈন্য রাজাপাড়া ও দিশাবন্দে অগ্নিসংযোগ করতে-করতে অগ্রসর হয়। এ খবরে বিজয়পুর, বাগমারা ও লালমাই পাহাড় এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় একটি দল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে উত্তর রামপুর ও হিরাপুরের মধ্যবর্তী স্থানে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে দুপক্ষের কয়েকজন হতাহত হয়। এটি ছিল এ অঞ্চলের প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধ। পাকিস্তানি বাহিনী কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার রামমালায় ঘাঁটি স্থাপন করে বিমানবন্দর হয়ে পর্যায়ক্রমে দক্ষিণ দিকে লাকসাম ও নোয়াখালী অভিমুখে এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে চৌদ্দগ্রাম ও চট্টগ্রাম অভিমুখে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তী সময়ে তারা হরিশ্চর স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে কুমিল্লায় এবং শহিদুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে লাকসাম উপজেলায় শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির সদস্যরা লালমাই উপজেলায় তাদের তৎপরতা চালায়।
ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা আদম ছফিউল্লাহ (পিতা মোহাম্মদ জাকারিয়া মজুমদার, বরল) ছিল রাজাকার কমান্ডার। তার নেতৃত্ব ও ইন্ধনে সদর দক্ষিণ, লালমাই, লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলায় গণহত্যা, নির্যাতন ও লুটপাট সংঘটিত হয়।
পাকবাহিনী লালমাই উপজেলায় অনেকগুলো গণহত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট চালায়। সেগুলোর মধ্যে কাকসা গণহত্যা, পনকুছা-ফতেহপুর গণহত্যা ও নিশ্চিন্তপুর গণহত্যা উল্লেখযোগ্য। এপ্রিল মাসের ২য় সপ্তাহে লালমাই যুদ্ধের পর পাকবাহিনী বাগমারা দিয়ে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে কাকসার গ্রামে একদল নিরীহ মানুষকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে, যা কাকসার গণহত্যা নামে পরিচিত।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৫ই এপ্রিল আলীশ্বরের যুদ্ধের দিন পনকুছা-ফতেহপুর গণহত্যা চালায়। পনকুছা-ফতেহপুর গণহত্যায় ৩০ জনের অধিক শহীদ হন। পাকিস্তানি বাহিনী ১৫ই এপ্রিল দত্তপুর অঞ্চলের মুচিপাড়া পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। দত্তপুরের প্রায় সব বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।
পাকিস্তানি বাহিনী বরইগাঁও বৌদ্ধ বিহারের সমস্ত কিছু ধ্বংস করে দেয়। বিহারের অধ্যক্ষ জ্যোতিঃপাল মহাথের বিশ্বের নানা বৌদ্ধ রাষ্ট্রে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞের স্বীয় অভিজ্ঞতা তুলে ধরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করেছিলেন, যা পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর বিহারে ফিরে স্মৃতিচারণ করে তিনি লিখেছেন-
‘প্রথমত, মন্দিরে ঢু’কে দেখি খালি মন্দির। দেব-বেদীতে কোন নিদর্শন নেই। অনেক প্রকার মূল্যবান পূজোপকরণে সজ্জিত ছিল এই বেদী। কিন্তু আজ সর্বশূন্য দারিদ্র্যে ও সকরুণ দৃশ্যে পর্যবসিত। বালিকা বিদ্যালয়ের ঘর-দরজা কিছু নেই। শুধু ভিটা উন্মুক্ত আকাশ তলে লুটতরাজের সাক্ষী স্বরূপ বিরাজ করছে। সমাজকল্যাণ সংস্থার বয়ন বিদ্যার তাঁত, সূতার মিস্ত্রী, কাজের যন্ত্রপাতি, টাইপরাইটার মেশিন ও সীবন শিক্ষার সকল দ্রব্য সম্ভার, আসবাব-পত্র লুণ্ঠিত ও অপহৃত। অনাথ আশ্রমের অনাথ বালকদের ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী, বইপুস্তক, তৈজসপত্র ইত্যাদি সব কিছু নষ্টিকৃত ও অপহৃত। বাসগৃহসমূহের শুধু দেওয়ালগুলো দাঁড়িয়ে আছে। তাও নিখুঁত নহে। দরজা জানালা পর্যন্ত উধাও হয়ে গেছে।’
কয়েকজন রাজাকার দক্ষিণ ভুলুইন ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের আবিদুর রহমানকে পাশের গ্রাম কালিকাপুরে গভীর রাতে ধরে নিয়ে অমানুষিক অত্যাচার-নিপীড়ন করে। ছোরা দিয়ে ২২টি আঘাত করে তাঁকে জবাই করার চেষ্টা করে। সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। তাঁর ছেলে ফিরোজ মিয়া ছিলেন কুমিল্লায় পুলিশের কনস্টেবল। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি এজন্যই তাঁর ওপর চড়াও হয়েছিল।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের ইন্ধনে ২৩শে এপ্রিল জামুয়া গ্রামে গণহত্যানির্যাতন ও ধ্বসংসযজ্ঞ চালায়। তারা এ এলাকার বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। তাদের ছোড়া গুলিতে দুদু মিয়া নামে এক ব্যক্তি পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়। তারা মনসুর আলী (পিতা সমিরুদ্দীন)-কে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়াও তাদের হাতে আবদুল বারিক ও আবদুল গনি নামে দুজন গ্রামবাসী নিহত হন।
নভেম্বর মাসের পর কুমিল্লা-নোয়াখালী সড়কের নিশ্চিন্তপুরে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আগত শতাধিক মানুষ হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যার শিকার হন। হরিশ্চর স্কুল ক্যাম্প ছিল লালমাই এলাকায় হানাদার বাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্ৰ কুমিল্লা-লাকসাম সড়কের নিশ্চিন্তপুর নামক স্থানে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অসংখ্য মানুষকে গুলি করে হত্যা শেষে মাটিচাপা দেয়া হয়। এখানে গণকবর রয়েছে। লালমাই যুদ্ধে ৪ জন শহীদের কবর রয়েছে বাগমারা দক্ষিণ বাজারের বিদ্যুৎ অফিসের নিকট। ২৮শে অক্টোবর হাড়াতলী যুদ্ধে শহীদ ৫ জনের লাশ গ্রামবাসী একটি কবরে সমাহিত করে। মুক্তিযুদ্ধের অব্যহিত পর শহীদদের আত্মীয়-স্বজনরা গণকবর থেকে ৪ জনের লাশ উঠিয়ে নিয়ে যায়। শুধু হারুনুর রশীদের কবর এখানে থেকে যায়।
লালমাই উপজেলায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি যুদ্ধ। সেগুলোর মধ্যে লালমাই যুদ্ধ, বাগমারা যুদ্ধ, আলীশ্বর যুদ্ধ ও হাড়াতলী যুদ্ধ- উল্লেখযোগ্য। ৮ই এপ্রিল চাঁদপুরগামী পাকিস্তানি বাহিনীর এক রেজিমেন্টকে দুতিয়াপুর ও চণ্ডিমুড়া পাহাড় থেকে মুক্তিযোদ্ধারা বাধা দিলে প্রায় ৪-৫ ঘণ্টা গুলি বিনিময় হয়। ব্যাপক হতাহতের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়ে লালমাই ডাকবাংলোয় আশ্রয় নেয়।
১৯শে এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩৯ বেলুচ রেজিমেন্ট বাগমারা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে। অপ্রতুল অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দুদিন পর্যন্ত তীব্র প্রতিরোধ রচনা করেন। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা ও ভারী অস্ত্রশস্ত্রের কাছে টিকে থাকতে না পেরে তাঁরা পিছু হটেন। তবে মুক্তিযোদ্ধারা শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্যকে খতম করতে সক্ষম হন।
১৫ই এপ্রিল কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে লাকসামের উদ্দেশে পাকিস্তানি সেনাদের রওনা দেয়ার খবর আগে থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা পেয়ে যান। ক্যাপ্টেন ইমামুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মাহাবুবের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আলীশ্বর থেকে পশ্চিম দিকে ডাকাতিয়া নদী পর্যন্ত এম্বুশ করেন। দুপুরের দিকে সড়ক ও রেল লাইন ধরে পায়ে হাঁটা পাকসেনারা এম্বুশের সীমানায় পৌঁছলে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। দুঘণ্টা ব্যাপী এ-যুদ্ধে ৩ জন শহীদ হন।
২১শে নভেম্বর সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান ৩৪ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নিয়ে ২০০ জন পাকিস্তানি সেনার একটি কনভয়কে গৈয়ারভাঙ্গা পথে প্রতিরোধ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ বাতাবাড়িয়ার পুকুরপাড়ে এবং অন্য গ্রুপ হাড়াতলী গ্রামে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হাড়াতলী রাস্তায় পৌছার সঙ্গে- সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালান। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত উভয় পক্ষের তুমুল যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং মোখলেছুর রহমান, মনোরঞ্জন সিংহসহ ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৮ই ডিসেম্বর লালমাই উপজেলা হানাদারমুক্ত মুক্ত হয়।
লালমাই উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ২ জনের পরিচয় জানা গেছে। তাঁরা হলেন- মোখলেছুর রহমান আলফু (পিতা আজগর আলী, শাকেরা, পেরুল; হাড়াতলীতে ২১শে নভেম্বর সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ) ও মনোরঞ্জন সিংহ (পিতা বিপনীচন্দ্র সিংহ, দত্তপুর, বাগমারা; হাড়াতলীতে ২১শে নভেম্বর সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ)।
লালমাই উপজেলায় হাড়াতলী যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। নিশ্চিন্তপুর-হরিশ্চর বাজার সংলগ্ন স্থানে ৭১-এর গণকবরে স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। বাগমারার দত্তপুরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জন সিংহের নামে যুব উন্নয়ন পরিষদের নামকরণ করা হয়েছে। [মামুন সিদ্দিকী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড