You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে লাকসাম উপজেলা (কুমিল্লা) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে লাকসাম উপজেলা (কুমিল্লা)

লাকসাম উপজেলা (কুমিল্লা) একটি প্রাচীন জনপদ। ব্রিটিশ শাসনামলের আগ থেকেই এ অঞ্চলের জনগণ শিক্ষানুরাগী ও স্বাধীনচেতা ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে লাকসামে আওয়ামী লীগ থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন আবদুল আউয়াল ও জালাল আহমেদ। তাঁদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের নিয়মিত যোগাযোগ থাকায় প্রতিটি আন্দোলনেই লাকসামবাসী সক্রিয় ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে। ৭০-এর দশকে লাকসাম রেলওয়ে জংশনের ১৭০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ১৪০০ জনই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। পশ্চিম পাকিস্তানের কম যোগ্যতাসম্পন্ন লোক পূর্ব পাকিস্তানের বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন লোকের চেয়ে ওপরের পদে চাকরি করত। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে লাকসামবাসীর মনে ক্ষোভ সঞ্চিত হতে থাকে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় ৭০-এর নির্বাচন-পরবর্তী ক্ষমতা হস্তান্তরে তাদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সমগ্র বাঙালি জাতির তীব্র ক্ষোভ। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন- ও সাতই মার্চের ভাষণ এর পর স্বাধীনতা যুদ্ধে এ অঞ্চলের সর্বস্তরের মানুষের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। ৭ই মার্চের ভাষণের পর থেকেই লাকসামে স্বাধীনতা যুদ্ধের কার্যক্রম শুরু হয়। এসব কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে অধ্যক্ষ আবুল কালাম মজুমদার, আব্দুল আউয়াল এমপিএ, জালাল আহমেদ এমপিএ, আবদুল করিম চৌধুরী মানু মিয়া, খোরশেদ আলম সুরুজ, চাঁন মিয়া (সমাজসেবক), আবদুল খালেক দয়াল, সুবল চন্দ্র সাহা, হাজী আলতাফ আলী, ছিদ্দিক মিয়া, আবদুল ওয়াদুদ ঠিকাদার, মোস্তফা কামাল খান, মঞ্জুর আলী মধুসহ বেশকিছু নেতা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। পাশাপাশি ২৬শে মার্চের কিছুদিন পূর্বে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে লাকসাম থানার ছাত্রসমাজ সংগঠিত হতে থাকে। ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- ছায়েদুল ইসলাম, নজির আহমেদ ভূঁইয়া, নুরুজ্জামান ভূঁইয়া, হাসান আহমেদ, আব্দুল বারী মজমুদার, আব্দুল মান্নান, সামছুল হক খান, লাকসাম কলেজের ভিপি আব্দুল বারী, জিএস মনির আহমেদ, মার্শাল সেলিম, আহছানুজ্জামান মীরন, হাসান আহমেদ, অমূল্য কুমার দাস, জাহাঙ্গীর মাওলা চৌধুরী, তাজুল ইসলাম, আবুল হোসেন ননী, এ টি এম আলমগীর, মোখলেছুর রহমান, আবু তাহের মজুমদার, আবদুল বাতেন চৌধুরী, আব্দুল মালেক ভূঁইয়া, মোহাম্মদ আলী প্রমুখ। লাকসাম থানার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১৪ জন সদস্য ছায়েদুল ইসলামের নেতৃত্বে এবং আব্দুল খালেকের তত্ত্বাবধানে মিশ্রি গ্রামের সাংবাদিক সিরাজুল ইসলামের বাড়ির পশ্চিম পার্শ্বে একটি নতুন কাটা শুকনো পুকুরে গোপনে অস্ত্র পরিচালনা ও লাঠির প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। এ প্রশিক্ষণে স্থানীয় অনেকে তাদের লাইসেন্সকৃত অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেন। প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে আব্দুল মান্নান, আব্দুল বারী, এ বি এম ইকবাল আহমেদ (চট্টগ্রামে যুদ্ধাহত), আবুল হোসেন ননী, আলী আশ্রাফ (গার্ড) ও অমূল্য কুমার দাসের নাম উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে বাগমারা হাইস্কুল মাঠ ও এর পার্শ্ববর্তী স্থানে কালাম মজুমদারের নেতৃত্বে অপর একটি দল অস্ত্রের প্রশিক্ষণ শুরু করে। বাগমারার নিকট রায়পুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সেনাসদস্য জহিরুল ইসলাম এ প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। প্রশিক্ষণে সাধারণ জনগণের সঙ্গে কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনা, ইপিআর ও পুলিশ সদস্য যোগদান করেন। এছাড়া আজরাতে আলতাফ আলীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
২৫শে মার্চের পর প্রাথমিক পর্যায়ে লাকসামের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যরা কৌশলে লাকসাম থানা ও রেলওয়ে থানা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করেন। সেখান থেকে কিছু অস্ত্র লাকসামের উত্তরে অবস্থিত বাগমারায় মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া হয়। ছাত্র নেতারা রেলওয়ে স্টেশন মাস্টারের কক্ষ দখল করে এটিকে কন্ট্রোল রুম হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন। চাঁদপুর থেকে মিজানুর রহমান চৌধুরী এমএনএ, ফেনী থেকে খাজা আহমেদ এমএনএ, চৌমুহনী থেকে অধ্যাপক মোহাম্মদ হানিফ এমএনএ প্রমুখ কিছু সেনা, পুলিশ ও ইপিআর সদস্যকে যুদ্ধ করার জন্য লাকসামে প্রেরণ করেন। এর পাশাপাশি ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি অংশ পালিয়ে এসে লাকসামের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগাদান করেন। লাকসামে একত্রিত বাহিনী রেলওয়ের ঠিকাদার আব্দুল ওয়াদুদের বাসাকে অফিস হিসেবে (অফিসে ব্যবহৃত ফোন নম্বরটি ছিল- ৫৫৫) এবং মিশ্রী গ্রামের আব্দুল করিম চৌধুরী (মানু মিয়া)-র বাড়ি তাঁদের গোপন ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন।
বাগমারায় সংগঠিত মুক্তিসেনারা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি সৈন্য, পুলিশ সদস্য ও ইপিআর সদস্যদের তাঁদের দলে অন্তর্ভুক্ত করেন। সুবেদার জলিলের নেতৃত্বে কুমিল্লা শহরের নিকট অবস্থিত জাঙ্গালিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পাহারারত এক প্লাটুন বেঙ্গল রেজিমেন্ট সদস্য বাগমারায় অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগদান করেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার ও নিপীড়নে হাজার- হাজার বৌদ্ধ শরণার্থী সীমান্ত অতিক্রম করে ত্রিপুরা রাজ্যের কাঁঠালিয়া, ধনপুর, মাছিমা, সোনামুড়া, চন্দননগর প্রভৃতি শিবিরে আশ্রয় নেয়। এ অঞ্চলের জ্যোতিঃপাল মহাথের এ- সময় আগরতলায় আশ্রয় নেন। তিনি অন্যান্য বৌদ্ধ ধর্মগুরুকে সংগঠিত করে ত্রিপুরায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। জ্যোতিঃপাল মহাথের বৌদ্ধ শরণার্থীদের জন্য আগরতলায় গঠিত ‘বৌদ্ধ সংকট ত্রাণ কমিটি’র সদস্য ছিলেন। সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি পাকবাহিনীর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ তুলে ধরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলেন। লাকসাম থানার যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন আবুল বাশার এবং টু-আইসি ছিলেন আবুল বাশার-২।
এপ্রিলের শুরুর দিকে লাকসামের ১৫০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লা এয়ারপোর্টে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। তাঁরা বিমানযোগে ঢাকা থেকে আগত পাকসেনাদের প্রতিরোধ ও বিমানবন্দর ধ্বংস করে দেয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু অত্যাধুনিক অস্ত্রের কাছে মুক্তিসেনারা বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেননি। কুমিল্লা এয়ারপোর্ট প্রতিরোধযুদ্ধ-এ দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
১৫ই এপ্রিল পাকসেনারা আলীশ্বর থেকে লাকসামে অনুপ্রবেশ করে রেলওয়ে জংশনসহ এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহ দখল করে নেয়। তারা রেলওয়ে জংশন সংলগ্ন লাকসাম-নোয়াখালী রাস্তার পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত থ্রি-এ সিগারেট ফ্যাক্টরিতে একটি মিনি ক্যান্টনমেন্ট স্থাপন করে। সেখান থেকে সৈন্য পাঠিয়ে হরিকোটের ব্রিজের নিকট, লাকসাম কলেজ, পশ্চিমগাঁও দরগা এলাকা, খিলা বাজার, নাথের পেটুয়া বাজার, হাসনাবাদ বাজার ও মুদাফ্ফরগঞ্জ বাজারে ক্যাম্প স্থাপন করে। মিনি ক্যান্টনমেন্টটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালকদের মধ্যে শেরে আলী ও ক্যাপ্টেন গাদ্দারজীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এটির সুরক্ষার জন্য এর কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে পরিখা খনন করে পাকসেনারা তাতে অবস্থান করত।
পাকবাহিনী লাকসামে এসে তাদের এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় রাজাকার বাহিনী এবং শান্তি কমিটি গঠন করে। লাকসামে শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিল শহিদউল্লাহ। রাজাকারদের মধ্যে সদর দক্ষিণের শানিচোঁর মাওলানা আবদুল ওয়াদুদ, বরলের আদম সফিউল্লাহ, লাকসাম রেলওয়ে স্কুলের শিক্ষক সামছুল হক, কুন্দ্রা গ্রামের বাদশা মিয়া ওরফে বাসু মিয়া পাকবাহিনীকে সহায়তা করে। পশ্চিম গাঁওয়ের রাজাকার শহিদ উল্লাহ অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে (পরে সে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়)।
১৪ই এপ্রিল পাকবাহিনী আলীশ্বরে আসার পথে নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা করে এবং রাস্তার দুই পাশের বাড়িঘর ও দোকানপাট আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। রাজাকারদের সহযোগিতায় তারা লাকসামের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে লুটতরাজ, ধর্ষণ ও হত্যা শুরু করে। আগুন দিয়ে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে তাদের অত্যাচারের মাত্রা ছিল বেশি। রাজাকাররা পাকসেনাদের ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রাম থেকে সাধারণ মানুষের ধন-সম্পদ লুট করত। গ্রাম থেকে নারীদের তুলে এনে পাকসেনাদের ভোগবিলাসের জন্য ক্যাম্পসমূহে সরবরাহ করত। পাকসেনারা তাদের দোসরদের গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে অতর্কিত আক্রমণ করে বহু মুক্তিসেনা ও তাঁদের সহযোগীদের হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অনেকের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যা করে। বরইগাঁওয়ে বৌদ্ধ মন্দিরের মূল্যবান বেদীসহ জিনিসপত্র লুণ্ঠন করে এবং ঘর-দরজা ধ্বংস করে দেয়।
৬ই এপ্রিল বিকালে লাকসাম উপজেলার আজগরা বাজারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বোমারু বিমান থেকে শেলিং করলে ৫০ জনের মতো লোক নিহত হয়। আহত হয় ২০০ জনের অধিক। এটি আজগরা গণহত্যা নামে পরিচিত। লাকসাম উপজেলা সদরের একটু দক্ষিণে বেলতলীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্মিত বাঙ্কারের পাশে মুক্তিপাগল অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে মাটির নিচে পুঁতে রাখে। বেলতলী বধ্যভূমিতে তারা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেককে হত্যা করে গর্তের মধ্যে মাটিচাপা দেয়। প্রাণের ভয়ে বাধ্য হয়ে গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দেয়ার কাজটি করতেন শ্রীদাম মালি ও তার মামা উপেন্দ্ৰ মালি। একদিন শ্রীদাম মালি স্থান সংকুলানের সমস্যার কথা বললে রাজাকাররা তাকে বেদম মারপিট করে।
নভেম্বর মাসে উপজেলার মোদাফফরগঞ্জের নগরীপাড়ার আরতী বালাকে ধরে নেয়ার জন্য রাজাকার ও পাকসেনারা কর্মকার বাড়িতে হামলা করে এবং পুরুষদের ওপর অত্যাচার করে। সেদিন টাকার বিনিময়ে তারা রক্ষা পান। এর কয়েকদিন পর ২৮শে নভেম্বর রাত ১১টায় কয়েকজন রাজাকার ও একজন পাকসেনা কর্মকার বাড়িতে ঢুকে ফাঁকা গুলির আওয়াজ করে। রাজাকাররা ঘরের দরজা ভেঙে উমেশ চন্দ্র কর্মকার ও তার পিতাকে বের করে উঠানে এনে রাইফেলের বাঁট দিয়ে প্রহার করতে থাকে। তারা বাড়ির মহিলাদের ওপর অত্যাচার শুরু করে। এরপর রাজাকাররা পাঁচ পরিবারের পুরুষদের ৫০০ গজ দূরে একটি বটগাছের কাছে হাত বেঁধে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে এবং রাস্তার উপর গর্ত করে মৃতদেহগুলো মাটিচাপা দেয়। এটি নগরীপাড়া গণহত্য হিসেবে পরিচিত। রাজাকাররা ভুবন চন্দ্র কর্মকারের ৮-৯ বছরের ছেলে মানিককেও গুলি করে হত্যা করে। কর্মকার বাড়ি থেকে আরতি বালাকে মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে তার ওপর হানাদাররা রাতভর পাশবিক নির্যাতন শেষে ছেড়ে দেয়।
লাকসাম রেলওয়ে জংশন সংলগ্ন লাকসাম-নোয়াখালী রাস্তার পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত থ্রি-এ সিগারেট ফ্যাক্টরি ছিল পাকসেনাদের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। থ্রি-এ সিগারেট ফ্যাক্টরি নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবিরে অসংখ্য লোককে ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। গ্রাম থেকে তুলে আনা এবং বাস, ট্রেন থেকে ধরে আনা বহু যুবতী ও মধ্য বয়স্ক নারীদের এখানে এনে নির্যাতন ও ধর্ষণের পর হত্যা করা হতো। লাকসাম রেলওয়ে জংশন চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও চাঁদপুরের রেল চলাচলের মধ্যবর্তী কেন্দ্র হওয়ায় এই তিন অঞ্চল থেকে রেলে যাতায়াত করা অনেক যাত্রীকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে নামিয়ে নির্যাতনকেন্দ্রে পাঠানো হতো। তাদের কাউকে সঙ্গে-সঙ্গে এবং কাউকে মুক্তিবাহিনীর গোপন তথ্যের জন্য অত্যাচার-নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। ফ্যাক্টরির পাশাপাশি দুটি বিশাল রুমে পুরুষ ও মহিলা বন্দিদের রাখা হতো। পুরুষদের রুমে ৫ শতাধিক বন্দি একত্রে রাখা হতো। প্রতিদিন সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য জানার জন্য নানা রকম অত্যাচার নির্যাতন করা হতো। কাউকে মাটিতে শুইয়ে পায়ের বুট দিয়ে মাড়িয়ে আবার কাউকে অস্ত্রের বাট দিয়ে আঘাত করে তথ্য আদায়ের চেষ্টা করা হতো। কখনো-কখনো লোহার রড আগুনে ঝলসিয়ে বন্দিদের গায়ে লাগিয়ে দেয়া হতো। নারী বন্দিশালায় আড়াই শতাধিক নারীকে রাখা হতো। অনেককে অর্ধবস্ত্র অবস্থায় আবার অনেককে প্রায় বস্ত্রহীন অবস্থায়। হঠাৎ-হঠাৎ ৩০-৪০ জন পাকসেনা একত্রে বন্দি নারীদের গণধর্ষণ করত। আবার কখনো মেয়েদেরকে বিবস্ত্র করে কারখানার রেলিংবিহীন ছাদে উঠিয়ে দুহাত উপরে তুলে সারাদিন হাঁটতে বাধ্য করত। এই নির্যাতনে যে সমস্ত মেয়ে মৃত্যুবরণ করত অথবা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ত তাদের মরদেহ কারখানার বিভিন্ন কোণায় পুঁতে ফেলা হতো।
থ্রি-এ সিগারেট ফ্যাক্টরিতে হত্যা করা অসংখ্য লাশ রেলওয়ে জংশনের পূর্ব পার্শ্বে বেলতলীতে মাটিচাপা দেওয়া হতো। এটি বেলতলী গণকবর হিসেবে পরিচিত।
লাকসামে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের যোগাযোগে বাঁধা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিজয়পুরের ব্রিজ, বাতাবাড়িয়ার সড়ক ব্রিজ ও রেল ব্রিজ এবং মুদাফ্ফরগঞ্জ ব্রিজসহ বেশ কয়েকটি ব্রিজ বোমা মেরে উড়িয়ে দেন। মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা, পাকসেনাদের চলাচলের সংবাদ ও পাকদোসরদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের জন্য অনেককে গোপনে নিযুক্ত করেন। তাদের কুরিয়ার বলা হতো। সমগ্র লাকসাম থানায় তখন চারজন প্রধান কুরিয়ারসহ বিভিন্ন সেক্টরে অসংখ্য কুরিয়ার নিযুক্ত ছিল। তাদের মধ্যে সিরাজ, মোস্তফা, এস এম লিয়াকত হোসেন, নুরুজ্জামান এবং আব্দুল জলিলের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কুরিয়াররা মুক্তিসেনাদের অস্থায়ী ক্যাম্পসমূহে রাজাকার ও পাকসেনাদের আক্রমণের অগ্রিম সংবাদ এবং তাদের গোপন আস্তানা সম্পর্কে তথ্য প্রদান করতেন। বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনার পূর্বে অপারেশনের স্থান, পাকসেনা ও রাজাকারদের সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে তারা তথ্য প্রদান করতেন। এসব তথ্যের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করতেন। তাদের যাতে সনাক্ত করা না যায় সে জন্য কৌশল হিসেবে এক অঞ্চলের অপারেশন অন্য অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা পরিচালনা করতেন।
এ উপজেলার মুক্তিবাহিনী বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা অপারেশন করে রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের বিপর্যস্ত করে তোলে। এপ্রিল মাসে লাকসাম, নোয়াখালী ও চাঁদপুর রোডের সংযোগস্থল লালমাই অঞ্চলে মুক্তিসেনারা ওঁৎ পেতে পাকসেনাদের আক্রমণ করতে থাকেন। পাকসেনারা ইস্ট পাকিস্তান রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের বাসে করে চাঁদপুর যাবার সময় মুক্তিবাহিনী অতর্কিতে তাদের আক্রমণ করে। ৩ ঘণ্টার মতো স্থায়ী লালমাই প্রতিরোধযুদ্ধ-এ মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। এটি ছিল চাঁদপুর, লাকসাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধ।
১৪ই এপ্রিল লাকসাম রেলওয়ে জংশনের সামান্য উত্তরে অবস্থিত আলীশ্বরে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। আলীশ্বর যুদ্ধে ৩ জন মুক্তিসেনা শহীদ হন এবং মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। ২৯শে এপ্রিল বড়বাম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে ১৫-২০ জন পাকসেনা নিহত হয়। ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ২ জন শিশুসহ গ্রামের ৩ জন সাধারণ মানুষ নিহত এবং ৮-১০ জন আহত হয়। ১৩ই সেপ্টেম্বর হাসনাবাদ বাজারের (বর্তমানে মনোহরগঞ্জ উপজেলা) নিকট পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হয়। ৩নং থানা সেক্টর কমান্ডার আবুল বাশার, বিএলএফ কমান্ডার সায়েদুল ইসলাম, বিএলএফ এর টু-আইসি এ টি এম আলমগীর, জহিরুল হক পাঠান এবং হাজীগঞ্জের কলিম উল্যাহর যৌথ নেতৃত্বে এ-যুদ্ধ পরিচালিত হয়। হাসনাবাদ যুদ্ধে আবুল কালাম নামে নিয়মিত আর্মির একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, অপরদিকে ১০ জনের অধিক পাকসেনা নিহত হয়। একই সময় উপজেলার চিতোষী নামক স্থানের খেয়াঘাটে কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধ হয়। চিতোষী যুদ্ধে কোনো পক্ষেরই তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
২৮শে অক্টোবর গৈয়ার ভাঙ্গার উত্তরে হাড়াতলী (বর্তমানে লালমাই উপজেলা) নামক স্থানে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। হাড়াতলী যুদ্ধ-এ ৭-৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা হোসেন, দেলোয়ার, মোখলেছুর রহমান, হারুন-অর-রশিদ ও মনোরঞ্জন সিংহ শহীদ হন এবং আবু তাহের মিয়া আহত হন। পাকসেনাদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এফএফ ৩-এর থানা সেক্টর কমান্ডার আবুল বাশারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা চন্দনা ব্রিজ অপারেশন পরিচালনা করেন। পাকসেনারা তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। এখানে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতীয় সৈন্যরা চৌদ্দগ্রাম সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রবেশ করার পর যৌথবাহিনীর সঙ্গে পাকসেনাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। চৌদ্দগ্রাম সীমান্ত যুদ্ধে যৌথবাহিনীর হাতে চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট, মিয়ার বাজার, নাথের পেটুয়া, খিলা বাজার ও হরিকোটের ব্রিজ সংলগ্ন পাকসেনাদের ক্যাম্পসমূহের পতন ঘটে। এরপর ৮ই ডিসেম্বর যৌথবাহিনী লাকসামস্থ মিনি ক্যান্টনমেট দখল করে।
১০ই ডিসেম্বর লাকসাম রেলওয়ে জংশন থেকে সামান্য পশ্চিমে চুনাতি নামক গ্রামে পাকসেনাদের সঙ্গে যৌথবাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। দুঘণ্টা স্থায়ী চুনাতি যুদ্ধ-এ ৫০ জনের অধিক পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে কয়েকজন ভারতীয় সেনা শহীদ হন। ১১ই ডিসেম্বর যৌথবাহিনী ভারতীয় জাট রেজিমেন্টের নেতৃত্বে মুদাফ্ফরগঞ্জ হয়ে চিতোষীতে লাকসামের সর্বশেষ পাকক্যাম্প আক্রমণ করে, যা চিতোষী ক্যাম্প অপারেশন নামে পরিচিত। বেশ কিছু সময় উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলার পর পাকসেনারা যৌথবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। সেই সঙ্গে পাকসেনাদের সর্বশেষ ঘাঁটির পতন ঘটে। ১১ই ডিসেম্বর লাকসাম উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নূরুল ইসলাম, বীর বিক্রম (পিতা সেকান্দর আলী, পূর্ব তালতলা) ও আবদুল খালেক, বীর প্রতীক (পিতা আমিন উদ্দিন ভূঁইয়া, পূর্ব বাতাবাড়িয়া)।
লাকসামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নূরুল ইসলাম, বীর বিক্রম (সালদা নদী যুদ্ধে শহীদ), বর্তমান সদর দক্ষিণ উপজেলার দত্তপুরের মনোরঞ্জন সিংহ (কলেজ ছাত্র), পেরুলের আবদুল বারী (কলেজ ছাত্র), শাকরার মোখলেছুর রহমান (কলেজ ছাত্র), ভাবকপাড়ার দেলোয়ার হোসেন (কলেজ ছাত্র), পুলুহারার আলী আক্কাস, কোমড্ডার আবুল খায়ের (কলেজ ছাত্র), তুলাতলীর কালা মিয়া, মনোহরগঞ্জের ফুলপুকুরিয়ার শামছুল হুদা (কলেজ ছাত্র), দক্ষিণ নারায়ণপুরের আবুল কালাম (সেনাসদস্য), বিপুলাসারের আবদুল আউয়াল (কলেজ ছাত্র), বাঁকরার শফিকুর রহমান (কলেজ ছাত্র), মিশ্রির মোবারক আলী (জেল পুলিশ) ও গোলাম কিবরিয়া (চিকিৎসক)। লাকসাম থ্রি-এ সিগারেট কোম্পানি বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। উপজেলা সদরে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবন।
লাকসামের কান্দিরপাড়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবুল খায়েরের নামে একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে এখানকার বেলতলী, হাড়াতলী ও লাকসাম মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সামনে স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়েছে। [মহিউদ্দিন মোল্লা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড