মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। বেতারে এ-খবর শোনার পরপরই সমগ্ৰ বাংলাদেশের ন্যায় লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মানুষও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ৩রা মার্চ লক্ষ্মীপুর উপজেলায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। সর্বস্তরের জনতা রাস্তায় নেমে আসে। তাদের সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এম এ মোহাইমেন, খালেদ মোহাম্মদ আলী, সিরাজুল ইসলাম, এডভোকেট আক্তারুজ্জামান চৌধুরী, এ কে এম শাহজাহান কামাল, এম আলাউদ্দিন, আ ও ম সফিউল্লাহ, নবী নেওয়াজ করিম বকুল, মাওলানা সাইফুল আলম প্রমুখ। এডভোকেট আক্তারুজ্জামান চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় সংগ্রাম কমিটি। লক্ষ্মীপুর বার লাইব্রেরির দ্বিতীয় তলায় এর কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়। ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে উপজেলার সর্বত্র ওড়ানো হয় বাংলাদেশের পতাকা। ২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং দেশবাসীকে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। তাঁর এ ঘোষণাপত্র ইপিআর ওয়ারলেসের মাধ্যমে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল করিম পেয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিকদের অবহিত করেন। জেলা সংগ্রাম কমিটির পাশাপাশি লক্ষ্মীপুর সদরেও এ খবর পৌঁছানো হয়। অতঃপর বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার জনগণ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা এবং জেলা সংগ্রাম কমিটির নির্দেশে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা সংগ্রাম কমিটি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্র-যুবকরা কাঠের ডামি বন্দুক ও বাঁশের লাঠি নিয়ে সামাদ একাডেমি মাঠ, কলেজ মাঠ, দালাল বাজার, ঈদগাহ ময়দান, চন্দ্রগঞ্জ মান্দারীসহ বিভিন্ন খেলার মাঠে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অবসরপ্রাপ্ত ও ছুটিতে বা পালিয়ে আসা সেনাসদস্য এবং পুলিশবাহিনী ও ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা। এভাবে ২৩শে এপ্রিল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ চলে। এরপর এম আলাউদ্দিনসহ বহু মুক্তিযোদ্ধা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুর, চোত্তাখোলা, রাজনগর, তাকিয়াসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মো. নুরুল হক এমএনএ, অধ্যাপক মো. হানিফ এমএনএ, এডভোকেট আক্তারুজ্জামান চৌধুরী, ডা. আবুল বাসার, এডভোকেট তোফায়েল আহম্মদ চৌধুরী, এডভোকেট মুজাফফর আহম্মদ, রফিকুল হায়দার চৌধুরী, খালেদ মোহাম্মদ আলী, মাহমুদুর রহমান প্রমুখ নেতা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধবিষয়ক সার্বিক ব্যাপার তত্ত্বাবধান করেন। পরবর্তীকালে এঁরাসহ উপর্যুক্ত ব্যক্তিবর্গ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন এ কে এম শাহজাহান কামাল (এফএফ কমান্ডার), আ ও ম সফিউল্যাহ (বিএলএফ কমান্ডার) এবং মো. জয়নাল আবেদীন (বিএলএফ কমান্ডার)।
পাকবাহিনী যাতে লক্ষ্মীপুর সদরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য স্বাধীনতাকামী জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা নোয়াখালীর চৌমুহনী থেকে লক্ষ্মীপুর সদর পর্যন্ত প্রধান সড়কের মাদাম ব্রিজ, মান্দারী বাজার ব্রিজ ও চন্দ্রগঞ্জের পশ্চিম বাজার ব্রিজ ভেঙ্গে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
পাকিস্তানি বাহিনী ২৪শে এপ্রিল লক্ষ্মীপুর সদরে প্রবেশ করে এবং বাগবাড়িতে সার্কেল অফিসারের কার্যালয় ও বাসভবনে প্রধান ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীতে লক্ষ্মীপুর সদর বাজারের বটু চৌধুরীর বাড়ি, দালাল বাজার হাইস্কুল, মান্দারী হাইস্কুল, বাজারের বড় মসজিদ, প্রতাপগঞ্জ হাইস্কুল, পেয়ারাপুর, রসুলগঞ্জ ও আব্দুল্লাহপুরে শাখা ক্যাম্প স্থাপন করে।
পাকবাহিনী প্রবেশের পর স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধীরা তাদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং মে মাসের প্রথমদিকে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করে। শান্তি কমিটির প্রধান ছিল বটতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল (ননী চেয়ারম্যান) এবং রাজাকার কমান্ডার ছিল মাওলানা নূর মোহাম্মদ। এদের সহযোগী ছিল আব্দুল হাই, ইসমাইল মাওলানা প্রমুখ। পাকবাহিনীর সঙ্গে মিলে এরা এলাকার নিরীহ মানুষদের হত্যা করে এবং অন্যদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়।
পাকবাহিনী ২৪শে এপ্রিল লক্ষ্মীপুরে প্রবেশ করেই মজুপুর গ্রামে হামলা চালায় এবং ৩৫ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। লক্ষ্মীপুরের ইতিহাসে এ ঘটনা মজুপুর গণহত্যা নামে পরিচিত। পাকবাহিনী ১৫ই জুন আরেকটি গণহত্যা চালায় লতিফপুর গণহত্যা। এদিন তারা ৩০ জন নারী-পুরুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। মজুপুর গ্রাম ও চন্দ্রগঞ্জ বাজারের অনেক বাড়ি ও দোকানঘর তারা জ্বালিয়ে দেয়। এছাড়া শান্তি কমিটির প্রধান ননী চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে রাজাকাররা লক্ষ্মীপুর সদর থেকে প্রায় ৮ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে দিঘলী বাজারে ১৫-২০টি দোকান লুটপাট করে এবং পরে জ্বালিয়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা উপজেলার করইতলা ক্যাম্প, দালাল বাজার হাইস্কুল, লক্ষ্মীপুর আলীয়া মাদ্রাসা, বটু চৌধুরীর বাড়ি, বাগবাড়ি ক্যাম্প, মান্দারী হাইস্কুল ও প্রতাপগঞ্জ হাইস্কুল নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করে। এখানে সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ লোকদের ধরে এনে নির্মম নির্যাতন করে। ননী চেয়ারম্যানের সহায়তায় এলাকার বহু যুবতীকে ধরে এনে সে নিজে ও অন্যরা মান্দারী ক্যাম্পে তাদের ধর্ষণ করে।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় দুটি বধ্যভূমি ও তিনটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে – মাদাম ব্রিজ বধ্যভূমি ও গণকবর, মান্দারী বাজার ব্রিজ বধ্যভূমি, বাগবাড়ি গণকবর ও বাসুবাজার গণকবর। হানাদার বাহিনী মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে মাদাম ব্রিজে হত্যা করে খরস্রোতা খালে ফেলে দিত। অনেককে আবার ব্রিজের পাশে কবর দিয়েছে। এছাড়া ননী চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে মান্দারী বাজার ব্রিজে বহু লোককে হত্যা করা হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। সেগুলোর মধ্যে দালাল বাজার রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, মান্দারী বাজার রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, প্রতাপগঞ্জ হাইস্কুল আক্রমণ এবং বড়ালিয়া অপারেশন উল্লেখযোগ্য। দালাল বাজার রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন পরিচালিত হয় দুবার – ৯ই আগস্ট ১০ই নভেম্বর। হাবিলদার মতিনের নেতৃত্বে প্রথমবারের অপারেশনে ২০ জন রাজাকার নিহত হয়। দ্বিতীয়বার কমান্ডার সুবেদার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত অপারেশনে বহু রাজাকার নিহত হয় এবং তাদের বহু অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। মান্দারী বাজার রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন পরিচালিত হয় ১৯শে জুলাই ও ২৭শে নভেম্বর দুবার। প্রথমবার সুবেদার ওয়ালি উল্যাহ ও সুবেদার শামছুল হকের নেতৃত্বে সংঘটিত অপারেশনে ২৬ জন রাজাকার নিহত হয় এবং দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শত্রুবাহিনীর ৬টি চীনা রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। দ্বিতীয়বার সুবেদার লুৎফর রহমানের নেতৃতে পরিচালিত অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার ক্যাম্প দখল করেন। প্রতাপগঞ্জ হাইস্কুল ক্যাম্প অপারেশনও পরিচালিত হয় দুবার – ২২শে জুলাই ও ২৫শে আগস্ট। সুবেদার লুৎফর রহমান, সুবেদার ওয়ালি উল্যাহ, সুবেদার শামছুল হক ও হাবিলদার নূর মোহাম্মদের নেতৃত্বে প্রথমবারের যুদ্ধে তিনজন রাজাকার অস্ত্রসহ ধরা পড়ে। দ্বিতীয়বার সুবেদার লুৎফর রহমানের নেতৃতে পরিচালিত যুদ্ধে অর্ধশতাধিক রাজাকার ও মিলিশিয়া নিহত হয় এবং পাকসেনাসহ অবশিষ্ট রাজাকাররা পালিয়ে যায়। শত্রুদের ১০টি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধারা হস্তগত করেন। বড়ালিয়া অপারেশন পরিচালিত হয় দ্বিতীয়বার মান্দারীবাজার রাজাকার ক্যাম্প অপারেশনের সময় (২৭শে নভেম্বর)। সুবেদার ওয়ালি উল্যাহর নেতৃত্বে পরিচালিত এ অপারশনে পাকহানাদার বাহিনীর কুখ্যাত দালাল ননী চেয়ারম্যানসহ ৮৫ জন রাজাকার নিহত হয়। ৪ঠা ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. ছানাউল্লাহ, বীর বিক্রম (পিতা মো. সোলায়মান, গঙ্গাপুর), কী তোফায়েল আহমেদ, বীর প্রতীক (পিতা বশির উল্লাহ খান, মিরপুর) ও বাদশা মিয়া, বীর প্রতীক (পিতা মফিজ উল্লাহ, আলীদাদপুর)।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. ছানাউল্লাহ, বীর বিক্রম (৩০শে মার্চ সৈয়দপুর সেনানিবাস যুদ্ধে শহীদ), মো. সিরাজউল্লাহ (পিতা সেকান্দর মুন্সী, উশিয়ার কান্দি), আহম্মদউল্লাহ (পিতা গোলাম রহমান, উশিয়ার কান্দি), নবীউল্লাহ (পিতা শামছুল হক, চর পার্বতীপুর), মো. ছায়েদউল্লাহ (পিতা হাজী ননা মিয়া, দক্ষিণ মাস্তরী), মো. আব্দুল মতিন (পিতা আব্দুল মান্নান মুন্সী, বাঙ্গাখাঁ), আলী আজম (পিতা আলী আহম্মদ, গঙ্গাপুর), মো নুরুজ্জামান (পিতা ছায়েদুল হক, যাদৈয়া), মো. আব্দুল হাই (পিতা সুরত আলী, রোকনপুর), মাজহারুল মনির সবুজ (পিতা এ কে এম ছিদ্দিকউল্লাহ, আলীপুর), মো আব্দুল মমিন (পিতা হাজী নজরুল ইসলাম, রোকনপুর), চাঁদ মিয়া (পিতা পানা মিয়া, আলীপুর), লোকমান মিয়া (পিতা ছাবির মাস্টার, জামিরতলা), নায়েক আবুল হাসেম (পিতা আরব আলী, সমাসপুর), আবু ছায়েদ (পিতা আব্দুল বারিক, উত্তর সোনাপুর), নূর মোহাম্মদ (পিতা আনোয়ারুল হক, বড়ানিয়া) এবং এস এম কামাল (পিতা হাজী আযহার মাস্টার, পালপাড়া)।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। শহীদদের স্মরণে ২০০১ সালে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। ২০০৬ সালে লক্ষ্মীপুর জেলা জজ কোর্টের সামনে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে স্থানীয় গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নামফলক। এতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা রয়েছে। মাদাম ব্রিজের সামনের বধ্যভূমিতে পৌরসভার উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। এছাড়া লক্ষ্মীপুর সদরের প্রধান সড়কে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা নছির আহম্মদ পৌর মিলনায়তন। [মো. ফখরুল ইসলাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড