মুক্তিযুদ্ধে রূপগঞ্জ উপজেলা (নারায়ণগঞ্জ)
রূপগঞ্জ উপজেলা (নারায়ণগঞ্জ) ২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনী কর্তৃক ঢাকা অবরুদ্ধ হওয়ার পর বাঁচার তাগিদে দলে-দলে অসহায় মানুষ ঢাকার পূর্ব সীমানা রূপগঞ্জে আশ্রয় নিতে থাকে। তাদেরকে খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয় ও মানবিক সহযোগিতা দিতে এগিয়ে আসে রূপগঞ্জ থানার আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের নেতৃবৃন্দসহ রূপগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় রূপগঞ্জ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মুড়াপাড়া, কাঞ্চন হাইস্কুল ও কাঞ্চন জুটমিলের জনতা-ছাত্র-শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে এসে যোগদান করে। এরপর রূপগঞ্জের দাউদপুরে হাজী আবুল হোসেন মোল্লার নেতৃত্বে ৪০ সদস্য বিশিষ্ট বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ পরিষদের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সিরাজ উদ্দিন ভূঁইয়া (রূপগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা মফিজুল ইসলাম, আক্তারুজ্জামান, মুখলেসুর রহমান, মজিবুর রহমান ভূঁইয়া, মহিবুর রহমান ভূঁইয়া প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। রূপগঞ্জ থানায় এলাকার ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষক ছিলেন নজরুল ইসলাম। আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া এমএনএ এবং শাহাবুদ্দিন আহমেদ এমপিএ স্থানীয় আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রাথমিকভাবে ছাত্র-জনতা ও শ্রমিকদের সংগঠিত করেন। পরবর্তীতে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তাদেরকে ভারতে পাঠনো হয়। তাদের মধ্যে জামাল উদ্দিন, শামসুদ্দিন, ইব্রাহীম, গিয়াস উদ্দিন ভূঁইয়া, ডাক্তার রফিক উদ্দিন, শাহাবুদ্দিন মিয়া প্রমুখ অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। রূপগঞ্জ উপজেলায় যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন দুজন। তাঁরা হলেন— ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (পিতা তোরাব আলী, মুড়াপাড়া) ও আব্দুল জব্বার খান পিনু (পিতা আব্দুস সাত্তার খান, মুড়াপাড়া)।
২৬শে মার্চ রূপগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর আগমনের কথা শুনে সংগ্রাম কমিটির সহযোগিতায় স্থানীয় ছাত্র-জনতা মুড়াপাড়া ও ভুলতা সড়কের কয়েকটি স্থানে গর্ত খুঁড়ে তাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। এ ব্যাপারে রূপগঞ্জ থানার ওসি মোশারফ হোসেন প্রতিরোধকারী ছাত্র-জনতাকে সহযোগিতা করেন। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকবাহিনী রূপগঞ্জে অনুপ্রবেশ করে এবং রূপগঞ্জ থানা, মুড়াপাড়ার গাউসিয়া জুটমিল, ভুলতা ইউনিয়নের আউখার ব্রিজ, আসকারী জুটমিলস, আশরাফ জুটমিলস, পুবাইল রেলওয়ে স্টেশন ও কাঞ্চনের মাশিকী জুটমিলস-এ ক্যাম্প স্থাপন করে।
রূপগঞ্জের শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের মধ্যে গুল বখস্ ভূঁইয়া (রূপগঞ্জ থানা শান্তি কমিটির সভাপতি, মুড়াপাড়া জুটমিলস-এর মালিক), ডা. আব্দুর রহিম (রূপগঞ্জ থানা শান্তি কমিটির সেক্রেটারি ও হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার, মুড়াপাড়া), আমির হোসেন ভূঁইয়া (রূপগঞ্জ), মর্তুজা ইসলাম (রূপগঞ্জ), লাল মিয়া (মুড়াপাড়া), ইসহাক আলী (মুড়াপাড়া), সওদাগর ইজারাদার (মুড়াপাড়া), আব্দুর রহমান (মুড়াপাড়া), কবির কাজী (মুড়াপাড়া), আতর উদ্দিন মেম্বার (মুড়াপাড়া), মজিবর ভূঁইয়া (মুড়াপাড়া), আব্দুল লতিফ (মুড়াপাড়া), খোদা বখস ভূঁইয়া (মুড়াপাড়া টেক্সাটাইল মিলস-এর মালিক), মজিদ ভূঁইয়া (মুড়াপাড়া), রিয়াজ উদ্দিন খান (মুড়াপাড়া), মালেক চৌধুরী (গোলাকান্দাইল), আলাউদ্দিন (মাঝিনা নদীরপাড়), সিদ্দিকুর রহমান (মাঝিনা নদীরপাড়) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকবাহিনী এ উপজেলায় ব্যাপক হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। ১২ই এপ্রিল শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকার গুল বখস্ ভূঁইয়া, ডা. আব্দুর রহিম, আমির হোসেন ভূঁইয়া, আব্দুল লতিফ, লাল মিয়া এদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী মুড়াপাড়া ইউনিয়নের হিন্দুপাড়া ও ঋষিপাড়ায় আক্রমণ চালায়। সেদিন তারা হিন্দুপাড়া থেকে শিশুসহ পাঁচ-ছয়জন নারী-পুরুষকে একত্রে রশিতে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে এবং তাদের লাশ মুড়াপাড়ার প্রফুল্ল মাস্টারের বাড়ির বাঁশঝাড়ের সামনে মাটিতে পুঁতে রাখে। একই দিনে তারা মুড়াপাড়া হাইস্কুলের সংস্কৃত শিক্ষক পণ্ডিত রাধা বল্লভ দাশকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে বিবস্ত্র করে নির্যাতন শেষে গুলি করে হত্যা করে। একই সঙ্গে ঋষিপাড়ার আরো ১৬ জনকে পুকুরের পাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে এবং অনেককে মাটিচাপা দেয়, যা মুড়াপাড়া গণহত্যা ও গণকবর নামে পরিচিত। এদিন তারা মুড়াপাড়া হাইস্কুল সংলগ্ন মন্দিরটি গুঁড়িয়ে দেয়।
পাকবাহিনী ভুলতা ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত দিঘীরপাড় গ্রামের ১২ জন নিরীহ মানুষকে পাঁচইখাঁ গ্রামের কোনাখালী খালের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে, যা মাসুমাবাদ দিঘিরপাড় গণহত্যা নামে পরিচিত। এদিন তারা গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়। অক্টোবর মাসে তারা গোলাকান্দাইল বাজার ও জেলেপাড়া সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেয়। কাঞ্চন গ্রামেও তারা অগ্নিসংযোগ করে। নভেম্বর মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী বলাইখা গ্রামে আক্রমণ চালায় এবং ২০ জনের মতো নিরীহ লোককে হত্যা করে, যা বলাইখাঁ গ্রাম গণহত্যা নামে পরিচিত। সেদিন তারা গোলাকান্দা ঋষিপাড়া গ্রামটি পুড়িয়ে দেয়।
রূপগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ঘেঁষা পাকবাহিনীর ক্যাম্পগুলো বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তারা সেখানে মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে হত্যা করে শীতলক্ষ্যায় ফেলে দিত। রূপগঞ্জে গণকবর ছিল, কিন্তু তার কোনো চিহ্ন এখন আর নেই। রূপগঞ্জে পাকবাহিনীর প্রতিটি ক্যাম্পই ছিল তাদের নির্যাতনকেন্দ্র। সেখানে বাঙালিদের ধরে এনে নির্যাতন চালানো হতো।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল জব্বার খান পিনুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা শীতলক্ষ্যা নদীতে জাঙ্গীর গ্রামের পাশে নদীর তীরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রসদবাহী গানবোট আক্রমণ করে। জাঙ্গীর গ্রাম গানবোট অপারেশন-এ ১৮ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সেখান থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার শেষে গানবোটটি ডুবিয়ে দেন। অক্টোবর মাসে আসকারী জুটমিলস ও গাউসিয়া জুটমিলস-এ স্থাপিত হানাদার ক্যাম্পের পাওয়ার স্টেশনটি মুক্তিযোদ্ধারা ধ্বংস করে দেন। ১০ই নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী বালুনদী দিয়ে গানবোটযোগে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শামসুদ্দিনের ইসাপুরার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প আক্রমণ করে। পদাতিক বাহিনী তাদের কভার দেয়। মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধে ডেমরার আজিজ গ্রুপের একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন।
২৮শে নভেম্বর রূপগঞ্জের ভোলাবতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়, যা ভোলাব যুদ্ধ নামে খ্যাত। এ যুদ্ধে গোলাম রশিদ ভূঁইয়া ওরফে বকুল ও আবু সায়েম সরকার নামে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সেদিন আগস্টিন প্যারালা নামে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকবাহিনী নরসিংদীতে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ১৩ই ডিসেম্বর রূপগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম (পিতা কাজী মৌলভী মো. আব্দুল হামিদ, রূপগঞ্জ) ও মোহাম্মদ মতিউর রহমান, বীর প্রতীক (পিতা তোরাব আলী, মুড়াপাড়া)।
রূপগঞ্জ উপজেলায় ৬ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া যায়। তাঁরা হলেন— গোলাম রশিদ ভূঁইয়া ওরফে বকুল (পিতা মো. মোক্তার উদ্দিন ভূঁইয়া, রূপসী), শামসুল আলম খান (পিতা আব্দুর রাজ্জাক খান, ধামচি), মো. শহীদুল্লাহ (পিতা আবুল বরকত, আগলা), মো. হাবিবুর রহমান খান (পিতা মো. ফাইজ উদ্দিন, আগলা), মো. আবু সায়েম সরকার (পিতা মো. আব্দুল মালেক সরকার, ভোলাব) ও নূর মোহাম্মদ (পিতা মো. নেয়ামত আলী, ভাওলীয়াপাড়া)।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে রূপগঞ্জে তিনটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো- রূপসী হাইওয়ে থেকে মুড়াপাড়া বাজার পর্যন্ত শহীদ গোলাম রশিদ ভূঁইয়া ওরফে বকুলের নামে শহীদ বকুল সড়ক, আমদিয়া পুকুরপাড় থেকে বাগলা পর্যন্ত শহীদুল্লাহ সড়ক ও পুটিনা বাজার থেকে আগলা মোড় পর্যন্ত শহীদ হাবিবুর রহমান সড়ক। [জি এম সহিদুল ইসলাম সহিদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড