You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে রায়পুরা উপজেলা (নরসিংদী) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে রায়পুরা উপজেলা (নরসিংদী)

রায়পুরা উপজেলা (নরসিংদী) ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরুতে দেশব্যাপী যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়, তার প্রভাব পড়ে রায়পুরা উপজেলায়ও। স্থানীয় নেতৃবৃন্দের পরিচালনায় অবিরাম আন্দোলন চলতে থাকে। আওয়ামী লীগ, ভাসানী ন্যাপ ও মোজাফ্ফর ন্যাপের নেতৃবৃন্দ মিলে গঠন করেন সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ। এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ নেতা আফতাফ উদ্দিন ভূঁইয়া এমএনএ। প্রতিটি ইউনিয়নেও এর শাখা পরিষদ গঠিত হয়। উক্ত তিন দলের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে একটি সর্বদলীয় হাই কমান্ডও গঠিত হয়। হাই কমান্ডের সদস্য ছিলেন আফতাব উদ্দিন ভূঁইয়া এমএনএ, গয়েছ আলী মাস্টার (আওয়ামী লীগ), আবদুল হাই ফরাজী (ভাসানী ন্যাপ), ফজলুল হক খোন্দকার (মোজাফ্ফর ন্যাপ) প্রমুখ। এসব নেতা একাধিক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করেন। ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ভাষণ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইঙ্গিত পেয়ে তাঁরা রায়পুরার জনগণকে সম্ভাব্য মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেন।
পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য রায়পুরার সাধারণ জনগণ তীর, ধনুক, বল্লম, টেটা ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র তৈরি করে। ইপিআর ও সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যরা রাজপ্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, পিরিজকান্দি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, রায়পুরা গরুর বাজার, লক্ষ্মীপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, রাজারবাগ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, নারায়ণপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ এবং পলাশতলী বাজার মাঠে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দেন। এছাড়া পিরিজকান্দির তালেব হোসেন, কাঙালিয়ার লাল মিয়া, জালালাবাদের সার্জেন্ট (অব.) আবদুল কাদের ও বাহেরচরের ইদ্রিস কমান্ডারও প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। এপ্রিল মাসের শেষদিকে নেতৃবৃন্দের পরামর্শে ছাত্র-যুবকরা উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যায়।
রায়পুরা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা হলেন- আফতাফ উদ্দিন ভূঁইয়া এমএনএ (রামনগর), গয়েছ আলী মাস্টার, আবদুল হাই ফরাজী (চরসুবুদ্ধি বাহেরচর), ফজলুল হক খোন্দকার (বাহেরচর), রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু (আদিয়াবাদ), কমরেড শামছুল হক (ভাটের চর), কৃষকনেতা আব্দুল হাই (চর উজিলাব), বাবর আলী মাস্টার (নারায়ণপুর), নূরুল ইসলাম (রায়পুরা পূর্বপাড়া), সন্দু মিয়া (বাঁশগাড়ি), বাছেদ চৌধুরী (ভেলুয়ারচর), বজলুর রহমান (আলীনগর), সুবাস সাহা (রহিমাবাদ), রফিক উদ্দিন খোন্দকার (বাহেরচর) প্রমুখ। অক্টোবর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩নং সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন বিগ্রেডিয়ার (অব.) এ এন এম নূরুজ্জামান, বীর উত্তম এবং রায়পুরা থানা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন গয়েছ আলী মাস্টার। এছাড়া গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন সুবেদার আবুল বাশার, সুবেদার আব্দুল ওয়াহিদ, ইদ্রিস হাবিলদার, সুবেদার আজিম উদ্দিন চৌধুরী, জয়ধর আলী, শাহজাহান খান, আব্দুস ছালাম কাওসার, হাবিলদার মো. মোবারক হোসেন, বীর প্রতীক (কোম্পানি কমান্ডার), এ কে এফ এন শামসুল হক ডেপুটি কমান্ডার, জলিলুর রহমান মন্টু, গোপাল চন্দ্র সাহা, আবু সাঈদ সরকার, মজনু মৃধা, নজরুল ইসলাম এবং নূরুল ইসলাম কাঞ্চন।
৯ই এপ্রিল পাকবাহিনী রায়পুরা হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ ধরে ভৈরবের দিকে চলে যায়। পরের দিন তারা রায়পুরায় এসে মেথিকান্দায় রেল লাইনের পাশের কলোনিতে ক্যাম্প স্থাপন করে।
হানাদার বাহিনী রায়পুরায় প্রবেশ করে স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে ১১ই এপ্রিল রাতে মেথিকান্দা ক্যাম্পে ক্যাম্প-ইন-চার্জ মেজর মঞ্জুর আলমের নেতৃত্বে এক পরামর্শ সভা করে। সে সভায় উপস্থিত ছিল আবদুল মতলেব ভূঁইয়া (থানাহাটি), সাঈদ উদ্দিন চৌধুরী (শ্রীরামপুর), ময়ধর আলী দারোগা (কুঁড়েরপার) প্রমুখ। এদের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে আরো ছিল আবু সাঈদ পণ্ডিত (হরিপুর), মাওলানা খলিল উল্লাহ (চরবেলাব), মাওলানা মজিবর রহমান (মহিষমারা), জামাই জলিল (রামনগরহাটি), সামসু মিয়া (কান্দাপাড়া), জামু মিয়া (কুঁড়েরপাড়), রিক্সাওয়ালা তাহের (তাত্তাকান্দা), নান্নু মিয়া (সাহেরচর), মোছলেম মিয়া (মামুদপুর), আব্দুল হেকিম (তাত্তাকান্দা), আব্দুস সাত্তার (তাত্তাকান্দা), মোহাম্মদ আলী (বাঙালিনগর), আবদুল বাছেদ (মহিষমারা), লাল মিয়া (মহিষমারা), আবদুল বাছেদ মিয়া (চান্দেরকান্দি), সেলিম (রামনগরহাটি), ফজলু মিয়া (রামনগরহাটি) প্রমুখ। এদের সহায়তায় পাড়ায়-পাড়ায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গড়ে ওঠে। এরা পাকসেনাদের ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত এবং তাদের নানারকম তথ্য সরবরাহ করত। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের হত্যা, তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটাত।
১২ই এপ্রিল বিকেলে ক্যাম্প থেকে দুই মাইল পূর্বদিকে বাহেরচরের খোন্দকার বাড়িতে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা আগুন দেয় এবং লুটপাট চালায়। তারা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ফজলুল হক খোন্দকারের বাড়ির পাঁচটি ঘর সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে দেয় এবং ৬টি গরু ও ধান-চাল লুটে নেয়। পরের সপ্তাহে স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে হানাদার বাহিনী কড়ইতলা গ্রামে প্রবেশ করে। সেখান থেকে তারা দুজন হিন্দু সাধু ক্ষিতিশ চন্দ্র ও রমেশ চন্দ্রকে ধরে নিয়ে মেরাতলীর রেল ব্রিজের ওপর গুলি করে হত্যা করে। পাক- হানাদাররা বাহেরচর গ্রামের হাবিজ নামে এক গ্রামবাসীকে শ্রীরামপুর রেলক্রসিং থেকে ধরে মেথিকান্দা ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা করে। এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে পাকবাহিনী হাসিমপুর মৌলবী বাজার ও মামুদপুর ডাকের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা মেথিকান্দা রেল স্টেশনের অদূরে বড়জংগার ব্রিজ ভেঙ্গে ফেললে পাকসেনারা জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ব্রিজের পার্শ্ববর্তী শাওড়াতলী গ্রামে আগুন দেয় এবং লুটপাট চালায়। রায়পুরার কুখ্যাত রাজাকার আবু সাঈদ পণ্ডিত ও তার সহযোগীরা জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে রায়পুরা পশ্চিমপাড়ার চিত্তরঞ্জন সাহা ও মনোরঞ্জন সাহার বাড়ি লুট করে এবং মিষ্টি ব্যবসায়ী সুশীল ঘোষকে রায়পুরা বাজার থেকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে হত্যা করে। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকসেনারা আদিয়াবাদ, শেরপুর ও বাঙালিনগর গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে এবং লুটপাট চালায়। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মেরাতলীর রেলের পাশে মুক্তিযোদ্ধারা এ্যাম্বুশ করলে রাজাকারদের মাধ্যমে খবর পেয়ে পাকবাহিনী এসে মেরাতলী ও জয়নগরে আগুন দেয়। আগস্ট মাসে রাজাকারদের পরামর্শে হানাদার বাহিনী কান্দাপাড়া গ্রামের লাল মিয়া ও মনির উদ্দিন মনাকে হত্যা করে। একই গ্রামের মাহে আলম ও আবদুল আওয়াল মেম্বারকে মেথিকান্দা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে। রামনগরহাটির বড় হুজুর নামে পরিচিত মাওলানা মহিউদ্দিন এবং আবদুল মালেক মোল্লাকে ক্যাম্পে তুলে নিয়ে পৈশাচিক নির্যাতন করে এবং মুক্তিযোদ্ধা ডা. মো. মহসিন সরকারের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এর কয়েকদিন পর পাকসেনা ও রাজাকাররা রায়পুরা পূর্বপাড়াস্থ নূরুল ইসলাম মেম্বারের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
রায়পুরা উপজেলায় দুটি গণহত্যার ঘটনা ঘটে– রামনগর গণহত্যা ও গৌরীপুর গণহত্যা। ২৩শে সেপ্টেম্বর সংঘটিত রামনগর গণহত্যায় ১২ জন এবং নভেম্বর মাসে সংঘটিত গৌরীপুর গণহত্যায় বহু সাধারণ মানুষ প্রাণ হারায়। রায়পুরার বর্তমান ইউএনও-র বাসভবন ছিল পাকবাহিনীর ক্যাম্প-ইন-চার্জ মেজর মঞ্জুর আলমের বাসভবন। বিএডিসি- র কার্যালয় ছিল পাকসেনাদের আশ্রয়শিবির এবং পুরনো খাদ্যগুদাম ছিল নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী বিভিন্ন গ্রাম থেকে নারী-পুরুষদের ধরে আনত। পুরুষদের নেয়া হতো খাদ্যগুদামে আর নারীদের নেয়া হতো মেজরের বাসভবনে। এখানেই অধিকাংশ নারী নির্যাতিত হয়েছেন। নির্যাতিত অর্ধশতাধিক নারীর মধ্যে ১৭ জনকে হত্যা করা হয়। বন্দি পুরুষদের বিশেষত যুবকদের ওপর চালানো হয় পৈশাচিক নির্যাতন।
রায়পুরায় একটি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে মেথিকান্দা পাকবাহিনী ক্যাম্প বধ্যভূমি। এখানে বহু লোককে নির্যাতনের হত্যা করা হয়।
রায়পুরায় স্থানীয় কোনো বিশেষ বাহিনী ছিল না, তবে ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীর তৎপরতা ছিল উল্লেখযোগ্য।
রায়পুরায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সে-সবের মধ্যে রামনগর রেলব্রিজ যুদ্ধ, বড়িবাড়ির যুদ্ধ, রামপুর এম্বুশ, তেলিয়াপাড়ার যুদ্ধ, বাঙালি নগরের যুদ্ধ, নারায়ণপুরের যুদ্ধ, হাটুভাঙ্গার যুদ্ধ, রেলব্রিজ অপারেশন এবং রামনগর যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রামনগর রেলব্রিজ যুদ্ধ সংঘটিত হয় তিনবার- ১৩ ও ১৪ই এপ্রিল, ১০ই নভেম্বর এবং ২৬শে নভেম্বর। প্রথম ও দ্বিতীয়বারের যুদ্ধে কোনো পক্ষে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তৃতীয়বারের যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও দুজন আহত হন। অপরপক্ষে ২-৩ জন পাকসেনা নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। বড়িবাড়ি যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৪ই জুলাই গ্রুপ কমান্ডার সুবেদার আবুল বাশার, বীর প্রতীকএর নেতৃত্বে। এ-যুদ্ধে আবুল বাশারসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। রামপুর এম্বুশ করা হয় ১৬ই জুলাই। এতে ৩০-৪০ জন পাকসেনা হতাহত হয়। মাঈনুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে আগস্ট মাসে সংঘটিত তেলিয়াপাড়ার যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয় এবং দুজন গ্রামবাসী শহীদ হন। বাঙালি নগরের যুদ্ধ সংঘটিত হয় দুবার আগস্ট মাসের শেষদিকে এবং ৫ই ডিসেম্বর। প্রথমবারের যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও একজন গ্রামবাসী শহীদ এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। দ্বিতীয়বারের যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। নারায়ণপুরের যুদ্ধ সংঘটিত হয় সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে। গয়েছ আলী মাস্টার, জামাল উদ্দিন ভূঁইয়া প্রমুখের নেতৃত্বে সংঘটিত এ-যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। ১৭ই নভেম্বর সংঘটিত হাটুভাঙ্গার যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত এবং কয়েকজন গ্রামবাসী নিহত হন। বাদুয়ারচর রেলব্রিজ অপারেশন পরিচালিত হয় আগস্ট মাসে। এতে ব্রিজটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অপরদিকে পাকবাহিনী পরের দিন একজন গ্রামবাসীকে হত্যা ও কয়েকজনের ওপর অমানবিক নির্যাতন করে এবং ৬৭টি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। রামনগর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৯ই ও ১১ই ডিসেম্বর। এতে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ৫৭ ব্রিগেডের বেশ কয়েকজন সৈন্য আহত হন।
এছাড়া মে মাসের শেষদিকে রেলপথে পাকবাহিনীর যাতায়াত বন্ধ করার উদ্দেশ্যে রেলব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা জলিলুর রহমান মন্টুর নেতৃত্বে ও শ্রীনিধি রেলস্টেশন মাস্টার মওলা আলী দেওয়ানের সহযোগিতায় স্টেশনের অদূরে মুক্তিযোদ্ধারা মাইন স্থাপন করেন। ৩১শে মে পাকসেনারা ঐ পথে ভৈরবের দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে মাইন স্থাপনের খবর পেয়ে তারা আউট সিগনালে ট্রেন থামিয়ে স্টেশন মাস্টারের কাছে যেতে থাকে। এ খবর পেয়ে স্টেশন মাস্টার পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। হানাদার বাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করে আশুগঞ্জ নিয়ে পৈশাচিক নির্যাতনের পর ১লা জুন হত্যা করে। এ ঘটনার কয়েকদিন পর মুক্তিযোদ্ধারা মেথিকান্দা রেলস্টেশনের পশ্চিম পাশে বড়জংগা ব্রিজ ভেঙ্গে রেল যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।
নভেম্বরের শেষদিকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে পাকসেনারা দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই তারা ভৈরব ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় অবস্থান নিতে শুরু করে। ৬ই ডিসেম্বর যৌথবাহিনী রায়পুরা থানার পূর্বাঞ্চল ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার তীরবর্তী এলাকায় প্রতিরোধ ঘাঁটি স্থাপন করে তুমুল আক্রমণ চালায়। ৯ই ডিসেম্বর চতুর্থ গার্ড রেজিমেন্ট হেলিকপ্টারে করে রায়পুরার পূর্ব-দক্ষিণ এলাকায় অবতরণ করে। ১০ই ডিসেম্বর ভারতীয় ১০ বিহার রেজিমেন্ট ও ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট রায়পুরায় পৌঁছায় এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যৌথভাবে আক্রমণ চালায়। ফলে রায়পুরায় অবস্থানরত পাকসেনারা নরসিংদী হয়ে ঢাকার দিকে পলায়ন করে এবং রায়পুরা মুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান (পিতা মৌলভী আব্দুস সামাদ, রামনগর), মো. সাহাবুদ্দিন, বীর বিক্রম (পিতা কামাল উদ্দিন আহমেদ, দিপাড়া), মো. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া, বীর প্রতীক (পিতা ডা. আবুল হাকিম ভূঁইয়া, আমিরগঞ্জ) ও মোবারক হোসেন, বীর প্রতীক (পিতা হোসাইন আলী কারী, দক্ষিণ মির্জাপুর পূর্বপাড়া) রায়পুরার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান (পিতা মৌলভী আব্দুস সামাদ, রামনগর; ২০শে আগস্ট পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর একটি বিমান ছিনতাইয়ের সময় ভারতীয় সীমান্তের কাছে পাকিস্তানের তালাহারে বিমান দুর্ঘটনায় শহীদ), মো. সাহাবুদ্দিন, বীর বিক্রম (১৭ই জুলাই সিলেটের জামালগঞ্জে যুদ্ধরত অবস্থায় শহীদ), আব্দুস সালাম কাউসার (পিতা মো. আয়েত আলী, বড়ইপুর), মো. বশিরুল ইসলাম (পিতা মো. অলিউর রহমান, কান্দাপাড়া), জহিরুল হক ভূঁইয়া দুদু মিয়া (পিতা তালেব আলী, হাসিমপুর), সিপাহি মো. সোহরাব হোসেন (সরাফত আলী) (পিতা মো. আবদুল জব্বার, রাজনগর), আবুল ইসলাম (হাসিমপুর), মো. সামসুল হক টিপু (পিতা মো. আবুল হোসেন, নিলক্ষ্যা), সাদত আলী মুক্তার (জাহাঙ্গীরনগর), সিপাহি মো. রৌশন আলী (চরমধুয়া), নায়েক আলী আকবর (বেগমাবাদ), মো. দেলোয়ার হোসেন (পিতা আবদুল লতিফ, মুছাপুর), মো. কলিম উদ্দিন (পিতা মো. সুন্দর আলী, টেকপাড়া), আজিজুল হক সিকদার (পিতা হাজী আলতাফ আলী সিকদার, চরমধুয়া), মো. সুরুজ মিয়া (পিতা মো. আম্বর আলী সায়দাবাদ), মো. ছিদ্দিকুর রহমান (পিতা মো. মফিজ উদ্দিন, ভেলুয়ারচর), মো. হাবিবুল্লাহ (পিতা মো. সফিউল্লাহ, শ্রীনগর), আবুল কালাম আজাদ (হাসনাবাদ), মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া (পিতা মো. জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া, দক্ষিণ মির্জানগর), মো. নূরুল হক (পিতা আবদুল হাকিম, হাসিমপুর), মো. আবু তাহের মিয়া (পিতা মো. জমশের আলী, শাওরাতলী), মো. ইদ্রিস আলী (পিতা মো. বাবর আলী, খাকচর), মো. মজিবুর রহমান (পিতা আব্বাছ আলী, মির্জানগর), হানিফ সিকদার (আবদুল্লাপুর), মো. হিরন মিয়া (পিতা মো. রুস্তম আলী, আবদুল্লাপুর), মো. ফজলুর রহমান (পিতা মো. কালা গাজী ফকির, পাড়াতলী), মো. আব্দুল বারী (পিতা মো. কলিম উদ্দিন, চরমরজাল), মো. হারিজ উদ্দিন (পিতা মো. আবদুর রহমান, বাহেরচর), মো. আমান খান (পিতা মো. খলিলুর রহমান, নরিয়াবাদ), মোছলেহ উদ্দিন খান (পিতা নবী ওয়াজ খান, ফুলদী), মো. হাসান আলী (পিতা মো. সেকান্দার আলী, রহিমাবাদ) এবং মমতাজ উদ্দিন। রায়পুরা উপজেলার মাহমুদাবাদ বাসস্ট্যান্ডের পাশে নির্মিত হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্মৃতিফলক ‘বাংলার ঈগল’।
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের নামে তাঁর নিজ গ্রাম রামনগরে গড়ে তোলা হয়েছে একটি জাদুঘর ও পাঠাগার। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী এবং মতিউর রহমানের স্ত্রী মিলি রহমান এ জাদুঘর ও পাঠাগার উদ্বোধন করেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শীর্ষসংগঠক ফজলুল হক খোন্দকারের নামে একটি তোরণ নির্মাণ ও একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছে ফজলুল হক খোন্দকার স্মৃতি পরিষদ। মুক্তিযুদ্ধের আরেক সংগঠক রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর নামে রায়পুরা পৌরসভায় নির্মিত হয়েছে একটি তোরণ ও মিলনায়তন। শহীদ জহিরুল হক ভূঁইয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শহীদ জহিরুল হক দুদু স্মৃতি সংসদ। শহীদ বশিরুল ইসলামের নামে তাঁর গ্রাম কান্দাপাড়ায় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে। হাটুভাঙ্গায় মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল লাইনের পাশে নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। বীর মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক খান মুকুল তাঁর নিজগ্রাম নবিয়াবদে নিজ প্রচেষ্টায় নির্মাণ করেছেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিসৌধ। বীর মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ হোসেন ভূঁইয়া নিজগ্রাম রামনগরে নিজের বাসভবনটিকেই তৈরি করেছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধের আদলে। [মহসিন খোন্দকার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড