মুক্তিযুদ্ধে রায়গঞ্জ উপজেলা (সিরাজগঞ্জ)
রায়গঞ্জ উপজেলা (সিরাজগঞ্জ) পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত এ-দেশে যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, তার সবগুলোতেই বৃহত্তর পাবনাবাসীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও তারা ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়ামী লীগ-কে সমর্থন করে। ফলে তৎকালীন পাবনা জেলার ৬টি জাতীয় পরিষদ ও ১২টি প্রাদেশিক পরিষদ আসনের সবকটিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। সারা পূর্ব বাংলায়ই আওয়ামী লীগ অনুরূপ বিজয় অর্জন করে। এর ফলে সারা বাংলার মানুষের মতো পাবনাবাসীরাও এই ভেবে আশান্বিত হয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে এবং বাঙালিদের দীর্ঘদিনের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটবে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক সরকার বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এর প্রতিবাদে ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে। এরূপ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু তাঁর সাতই মার্চের ভাষণ এ দেশবাসীকে মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সারা বাংলার মানুষের মতো রায়গঞ্জ উপজেলার মানুষও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথ নেয়।
২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনী ঢাকা শহরের ঘুমন্ত মানুষের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো রায়গঞ্জের আপামর জনতাও বিদেশী রেডিওর মাধ্যমে এ খবর প্রথমে জানতে পারে। পরে ঢাকা থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা মানুষদের কাছ থেকেও হানাদারদের এই গণহত্যার খবর প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে ইপিআর, সেনাবাহিনী, পুলিশ, মুজাহিদ, আনসার ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সশস্ত্র জওয়ানরা হানাদারদের রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। রায়গঞ্জ থানার ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মাহবুবুর রশীদ তাঁর অফিসে এসে সমবেত জনতার উদ্দেশে বলেন, তিনি আর পাকিস্তান সরকারের কর্মকর্তা নন। এদিনই রওশনুল হক মতি মিঞা এমপিএ-র নেতৃত্বে এবং তাঁর সহায়তায় রায়গঞ্জের মুক্তিকামী মানুষ এক সমাবেশে সমবেত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শপথ গ্রহণ করে। এরপর থেকে তিনি, পাবনার ডিসি নুরুল কাদের এবং সিরাজগঞ্জের এসডিও শামসুদ্দীন স্ব-স্ব এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে থাকেন।
রায়গঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে যাঁরা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন, তাঁরা হলেন- মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ এমএনএ (ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও ঐতিহাসিক সলঙ্গা বিদ্রোহের নায়ক এবং আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি), রওশনুল হক মতি মিঞা এমপিএ, মজিবর রহমান তালুকদার (রায়গঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি), নুরুল ইসলাম সরকার (ঐ, সাধারণ সম্পাদক; ‘আব্দুল্লাহ সরকার’ ছদ্মনামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-এর বাংলা সংবাদ পাঠক এবং স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা-র বাংলা সংবাদ এডিটর), মো. শামছুল হক সওদাগর ( লক্ষীকোলা, রাজনীতিবিদ), খ ম সাইফুল ইসলাম (রায়গঞ্জ থানা ছাত্রলীগ-এর সভাপতি), আব্দুল খালেক মন্টু (ঐ, সাধারণ সম্পাদক) এবং চান্দাইকোনার জয়নাল ডাক্তার, আনোয়ার, আবেদ, ছোবাহান, আজিজুল, গণি সরকার, বক্কার বিশ্বাস, রহমান আকন্দ, রাধারমণ দাস, গোপাল, রাধারমণ ঘোষ, দেলা, নুরু মাস্টার, আতাউর রহমান, তেলিজানার আব্বাস মন্ডল, ধানগড়ার কোবাদ, মমতাজ পাঠান, গোলাম মোস্তফা সরকার, কবি মহাদেব সাহা, কবি ময়নুল হক, রফিকুল ডাক্তার, দবির, আশরাফ, মোস্তফা, হযরত আলী, মোশারফ, বাতেন, এমদাদুল, বীরেন, দিলীপ, তাহের, ধামাইনগরের ধীরেন, সোনাখাড়ার আবুল কাশেম, গোপাল তালুকদার, সুশীল, ইনছাব, পিয়ার আলী, নলকার মোন্নাফ, মোজদার মাস্টার, মান্নান মাস্টার, পাঙ্গাশীর জহুরুল, ব্রহ্মগাছার আনিসুর রহমান বাদশা, নুরুল হুদা, ছামিদুল, কয়ড়ার হাফিজুর, রব্বানী, বারইভাগের মোজাম্মেল, ধুবিলের আক্তার, সলঙ্গার জিল্লুর, রশীদ, ঘুড়কার দুলাল, হামিনদামিনের আব্দুর রহিম প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রায়গঞ্জ ছিল ৭নং সেক্টরের অধীন। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন প্রথমে মেজর এম. নাজমুল হক এবং পরে সুবেদার মেজর আবদুর রব ও মেজর কাজী নূরুজ্জামান। সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স ছিল তরঙ্গপুরে। রায়গঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধকালীন কামান্ডার ছিলেন গাজী শেখ মো. আলাউদ্দীন (পিতা কাজী মো. ইসমাইল হোসেন, ধিতপুর)। যুদ্ধ শুরুর আগে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে এমএ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ছিলেন। যুদ্ধে যোগ দিয়ে তিনি ভারতের কুরমাইল ইয়ুথ ক্যাম্পে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে দেরাদুন মিলিটারি একাডেমিতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন।
২৫শে মার্চের পর থেকেই পাকবাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থান দখলের অভিযান শুরু করে। ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গ অভিযানের কথাও শোনা যেতে থাকে। এরই মধ্যে রেলপথে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট হয়ে বগুড়ার আড়িয়া বাজার ক্যান্টনমেন্টে পাকসেনাদের আসার খবর ছড়িয়ে পড়ে। এ খবর পেয়ে রায়গঞ্জের প্রতিরোধ যোদ্ধা এবং সর্বস্তরের মানুষ ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কে অবস্থান নেয়। ইসহাক হোসেন তালুকদার (পরবর্তীকালে জাতীয় সংসদ সদস্য), রেজাউল করিম তালুকদার, ওহিদুল ইসলাম আশরাফ, আব্দুল খালেক মন্টু, মোস্তফা সরকার, জয়নাল, সমুদ্র গুপ্ত, আজমল, মতি, ফিরোজ মাহমুদ, গোবিন্দ গোস্বামী, পাঁচকড়ি, নিখিল দাস এবং প্রফুল্ল সরকারের নেতৃত্বে সর্বস্তরের মানুষ ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কে গাছ ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। রায়গঞ্জের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মাহাতো ও উঁরাও গোত্রের লোকেরাও বল্লম-তীর-ধনু নিয়ে প্রতিরোধে অংশ নেয়। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন— ভূঁইয়টের পরি সিং মাহাতো, কালীচরণ মাহাতো, ক্ষিরিতলার নরেন মাহাতো, দত্তবাড়ির ধীরেন মাহাতো,, চিত্তরঞ্জন মাহাতো, নিমাই মাহাতো, নিমগাছীর পুণ্যচন্দ্র মাহাতো, উত্তর ফরিদপুরের আহল্লাদ মাহাতো, পশ্চিম আটঘরিয়ার সুশীল মাহাতো, ভাটারপাড়ার দীনেশ মাহাতো, ধলজানের যতীন সরকার (উঁরাও), রাজেন সরকার (উঁরাও), খৈচালার অতুল সরকার (উঁরাও) এবং অমূল্য সরকার (উঁরাও)। কিন্তু শক্তিশালী পাকবাহিনীর আগমনে শেষপর্যন্ত এ প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। পাকবাহিনী ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কে তাদের চলাচল নির্বিঘ্ন ও জনমনে ভীতি সঞ্চার করার জন্য সড়কের উভয় পাশের বাড়ি-ঘর ও বাজার জ্বালিয়ে দেয় এবং অনেক সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। এরূপ অবস্থায় প্রতিরোধ যোদ্ধাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে চলে যান। ২৫শে এপ্রিল পাকবাহিনী রায়গঞ্জ উপজেলায় প্রবেশ করে এবং রায়গঞ্জ থানা ও ডাকবাংলোয় ক্যাম্প স্থাপন করে। স্থানীয় মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা- কর্মীরা হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা দানে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে। মফিজ মওলানা (আকড়া; ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী) শান্তি কমিটির প্রধান নিযুক্ত হয় এবং আকড়া মাদ্রাসাকে এর কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। শান্তি কমিটির যাবতীয় অপকর্মের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। নরঘাতক মফিজ মওলানা লুটের মালামাল সংরক্ষণ, সন্দেহভাজন মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন-হত্যা, পাকবাহিনীর ক্যাম্পসমূহে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করাসহ যাবতীয় অপকর্ম এই আস্তানায় বসেই পরিচালনা করত। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস উপজেলার সর্বত্র মফিজ মওলানার পৈচাশিক কর্মকাণ্ডের কাহিনি এখনও এই জনপদের মানুষের মুখে উচ্চারিত হয়। হানাদার বাহিনী রায়গঞ্জ ছেড়ে ঢাকায় পালিয়ে যাওয়ার সময় সে উল্লাপাড়ায় গিয়ে তাদের আশ্রয় নেয়। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে পাকবাহিনী ঢাকার পথে রওনা দিলে সেও তাদের সঙ্গে যাওয়ার আকুতি জানায়। কিন্তু পাকসেনারা বিরক্ত হয়ে তাকে একটি গুদামে তালাবদ্ধ করে রাখে। পরবর্তীতে বিক্ষুব্ধ জনতা ঐ গুদামে আগুন দিলে মফিজ মওলানা ভস্মীভূত হয়ে সেখানে মারা যায়।
মফিজ মওলানা ছাড়াও হানাদার বাহিনীর আরেকজন সহযোগী ছিল আবু বক্কার মৌলভী। সে ছিল রাজাকার কমান্ডার। রয়হাটি মাদ্রাসা ছিল এ বাহিনীর হেডকোয়ার্টার্স। নারীনির্যাতন, হত্যা, ধর্মান্তর, লুটের মালামাল সংরক্ষণসহ নানাবিধ অপকর্ম এই মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হতো। সর্বক্ষণ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত থেকে আবু বক্কার হানাদার ক্যাম্পে যোগাযোগ রক্ষা করত এবং তার অনুসারীদের দিকনির্দেশনা দিত। পাষণ্ড এই মৌলভীর অসংখ্য দানবীয় কর্মকাণ্ডের মধ্যে একটি লোমহর্ষক ঘটনা আজও মানুষের স্মৃতিকে বেদনাতুর করে তোলে। তাড়াশের হীরালাল গোস্বামী মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও নিয়মিত খাবার যোগান দিতেন। এই অভিযোগে রাজাকার হরফ আলী মহুরী তাঁকে ধরে পৈচাশিক নির্যাতন চালায়। অর্ধচেতন অবস্থায় গরুর গাড়িতে উঠিয়ে তাঁকে নিয়ে আসা হয় বক্কার মৌলভীর আস্তানায়। তারপর নির্মম নির্যাতনের এক পর্যায়ে জীবন্ত অবস্থায় তাঁর মুখের চামড়া তুলে ভূইয়াগাঁতী মহাশ্মশানের পাশে হত্যা করা হয়। ঘুড়কার চকগোবিন্দপুর গ্রামের আবুল হোসেন ওরফে খোকা ফকিরের পুত্র এমাজুল করিম টুন্টুকে বক্কার মৌলভী রাজাকার প্রশিক্ষণের জন্য চাপ প্রয়োগ করে। কিন্তু টুন্টু প্ৰশিক্ষণ নিতে অসম্মতি জানায় এবং বক্কার মৌলভীকে গালাগালি করে। এর পতিশোধ নেয়ার জন্য মৌলভী তাকে ডাকবাংলোর ক্যাম্পে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করে। দেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর পলাতক বক্কার মৌলভী উল্লাপাড়ার ভেংড়ির বিলে ধরা পড়ে এবং বিক্ষুব্ধ জনতা পিটিয়ে তাকে হত্যা করে।
আরেকজন কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার ছিল ব্রহ্মগাছা ইউনিয়নের চকমোহনবাড়ি গ্রামের সেখ তমেজ উদ্দিন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এই সেনাসদস্য মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার কামান্ডার হয়ে পাকবাহিনীর দোসর হিসেবে হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে অংশ নেয়। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আনিসুর রহমান বাদশা এবং মুক্তিযোদ্ধা রফিকুলের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। রাজাকার কামান্ডার হিসেবে তার ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ড এ জনপদে বিস্তৃত ছিল। দেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর এলাকার মানুষ তাকে ধরে নিয়ে বাগবাটীতে হত্যা করে এবং তার লাশ জুতার মালা পরিয়ে আমগাছে ঝুলিয়ে রাখে।
পাক হানাদার বাহিনী রায়গঞ্জ উপজেলায় তিনটি গণহত্যা চালায়- ঘুড়কা গণহত্যা, ভূইয়াগাঁতী গণহত্যা ও মহেশপুর-গুণগাতী গণহত্যা। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে সংঘটিত ঘুড়কা গণহত্যায় ৮ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। ২৬শে এপ্রিল ভূইয়াগাঁতী গণহত্যায় ২০ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। এদিন হানাদাররা অনেক বাড়িঘর ও বাজার লুট করার পর জ্বালিয়ে দেয় এবং নারীনির্যাতন করে। ২০শে নভেম্বর মহেশপুর-গুণগাতী গণহত্যায় ১৯ জন গ্রামবাসী শহীদ হন এবং পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা অসংখ্য বাড়িঘর লুট করার পর জ্বালিয়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় হান্নান সেপাই (বরিশাল) নামে একজন পুলিশ রায়গঞ্জ থানায় কর্মরত ছিল। সে স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে রায়গঞ্জ থানা ক্যাম্পে রাজাকারদের প্রশিক্ষণ দিত নারীধর্ষণের মতো পাশবিক কর্মকাণ্ডেও সে জড়িত ছিল। তার ভয়ে এলাকার মানুষজন সর্বদা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকত। চায়ের দোকানে বসে সে দম্ভভরে বলত, ‘কোথায় মুক্তি? একটা মুক্তি পেলে চা দিয়ে খেতাম।’ তার এই দম্ভোক্তি এবং অত্যাচারের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ২০শে নভেম্বর কমান্ডার আলাউদ্দীনের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধা সমুদ্র গুপ্ত ও জয়নাল তাকে ধরে আনেন এবং মমিনসহ আরো দুজন মুক্তিযোদ্ধা লক্ষীকোলার নতুন দহে তাকে গুলি করে হত্যা করেন।
২৭শে নভেম্বর হানাদার বাহিনী সরাই হাজীপুর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। গ্রামবাসী প্রাণভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু সাহসী গণি সেখ (পিতা মনু সেখ), মজু আকন্দ (পিতা পাচু আকন্দ) ও জেনাত আলী (পিতা যদু সেখ) গ্রামেই থেকে যান। অগ্নিসংযোগের এক পর্যায়ে এ তিনজন পাশের গ্রাম শ্যামগোপে চলে যান এবং নদীর কূলঘেঁষা আমবাগান এলাকার গুড় তৈরির চুলার ভেতর লুকিয়ে থাকেন। পাকসেনাদের দুজন ঐ চুলার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অকুতোভয় এই তিন বাঙালি অতর্কিতে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। জেনাত আলী জাপটে ধরে এক হানাদারকে পার্শ্ববর্তী নদীতে ফেলে দেন। মজু ও গণি অপরজনকে জাপটে ধরে পানিতে নামানোর সময় ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে হানাদারের রাইফেল থেকে ফায়ারিং হয়। ফায়ারিং-এর শব্দ শুনে অন্য হানাদাররা এসে তিনজনকেই গুলি করে হত্যা করে। ভূইয়াগাতীতে অনেক নারী হানাদার বাহিনীর ধর্ষণের শিকার হন। তাঁদের মধ্যে গায়ত্রী চক্রবর্তী নামে একজন নারী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পরবর্তীকালে মারা যান। ২৬শে এপ্রিল চকগোবিন্দপুরের ১৫ বছর বয়সী কাঞ্চন মালাকে নিজ বাড়িতে হানাদার বাহিনী গণধর্ষণ করে বাড়িটি জ্বালিয়ে দেয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তিনি ২৭শে এপ্রিল মারা যান। রাজাকার বাহিনীর সহায়তায় পাকবাহিনী আটঘরিয়া গ্রামের আবুল বাশারের বাড়ি ঘেরাও করে তাঁর পুত্র মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল ইয়াসিনকে ডাকবাংলো ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। তাঁরা মনোয়ারা নামে এক কিশোরীকে ধর্ষণ করে। সেই থেকে মনোয়ারা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আজও বেঁচে আছেন। উপজেলায় পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে রায়গঞ্জ থানা ক্যাম্প, ডাকবাংলো, সোনাখাড়া ইউনিয়নের আকড়া মাদ্রাসা এবং ঘুড়কা ইউনিয়নের রয়হাটি মাদ্রাসা ব্যবহৃত হতো।
রায়গঞ্জ উপজেলায় স্থানীয় কোনো বিশেষ বাহিনী ছিল না। তবে পার্শ্ববর্তী উল্লাপাড়া উপজেলায় ছাত্রনেতা আব্দুল লতিফ মির্জার নেতৃত্বে পলাশডাঙ্গা যুবশিবির- নামে একটি স্থানীয় বাহিনী গঠিত হয়েছিল, যার তৎপরতা রায়গঞ্জ উপজেলায়ও বিস্তৃত ছিল।
রায়গঞ্জ উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি যুদ্ধ হয়। সেগুলো হলো— ব্রহ্মগাছার যুদ্ধ, রায়গঞ্জ থানা অপারেশন এবং রায়গঞ্জ সিও অফিস যুদ্ধ। ব্রহ্মগাছার যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৭ই অক্টোবর পলাশডাঙ্গা যুবশিবির ও পাকসেনাদের মধ্যে। এতে তিনজন পাকসেনা নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয় এবং দুজন গ্রামবাসী শহীদ হন। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপরসণ করলে পাকসেনারা স্থানীয় বাজারের দোকানপাট জ্বালিয়ে দেয়। রায়গঞ্জ থানা অপারেশন পরিচালিত হয় ২৮শে নভেম্বর কমান্ডার শেখ মো. আলাউদ্দীনের নেতৃত্বে। এতে বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। পরদিন ২৯শে নভেম্বর সকালে পাকসেনাদের বাকি সদস্যরা থানা ছেড়ে পালিয়ে যায়। রায়গঞ্জ সিও অফিস যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৩০শে নভেম্বর। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কমান্ডার আলাউদ্দীন সহযোদ্ধা মতি, আজমল, মন্টু, গোলজার, আশরাফ, মোস্তফা ও কোবাদকে নিয়ে সিও অফিস সংলগ্ন গোরস্থানের পাশের ঝোঁপঝাড়ে অবস্থান নেন৷ যথাসময়ে পাকবাহিনী ডাকবাংলো ক্যাম্প থেকে রাজাকারদের নিয়ে সেদিকে আসতে থাকে। কিন্তু ভুলবশত মুক্তিযোদ্ধা কোবাদ মিস ফায়ার করে ফেলেন। সঙ্গে-সঙ্গে পাকসেনারা সতর্ক হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে পজিশন নেয়। কমান্ডার আলাউদ্দীন কলাগাছের আড়াল থেকে এসএলআর চালাতে থাকেন। এতে কয়েকজন হানাদার আহত হয়। কিন্তু পাকসেনাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান তুলে নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণের সম্মুখীন হতে থাকে। বগুড়া পতনের পর বগুড়া-ঢাকা মহাসড়ক ধরে তাদের কনভয়গুলো মেশিন গান থেকে ব্রাশ ফায়ার করতে-করতে ঢাকার উদ্দেশে পালিয়ে যেতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে সিরাজগঞ্জেও তাদের কমান্ড ভেঙ্গে পড়ে। তারাও ঢাকায় পালিয়ে যেতে থাকে। রায়গঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের ক্যাম্পের আশপাশের গ্রামগুলোতে অবস্থান নিয়ে গুলি ছুড়তে থাকেন। এতে হানাদারদের মনোবল একেবারেই ভেঙ্গে পড়ে। এদিকে সিরাজগঞ্জের সঙ্গে তাদের যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমতাবস্থায় উপায়ান্তর না দেখে রায়গঞ্জের হানাদাররা ৩০শে নভেম্বর বগুড়া-ঢাকা মহাসড়ক ধরে ঢাকার উদ্দেশে পালিয়ে যায় এবং এদিনই রায়গঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
রায়গঞ্জ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেন আহমদ আলী (পিতা তাজউদ্দীন, নলকা, হোড়গাঁতী)। ২৮শে নভেম্বর রায়গঞ্জ থানা অপারেশনে তিনি শহীদ হন। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে রায়গঞ্জে ‘শহীদ আহমদ স্মৃতিসংঘ’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে সোনাখাড়া, হাজীপুর ও ধলজান গ্রামের ৮ জন শহীদের স্মৃতির উদ্দেশে সোনাখাড়া ইউনিয়নের নিমগাছী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি নামফলক নির্মিত হয়েছে। এই ৮ জন শহীদ হলেন— গোলাম মেহেদী তালুকদার (সোনাখাড়া), রিয়াজ উদ্দিন (হাজীপুর), কোরবান আলী (হাজীপুর), নওশের আলী (হাজীপুর), আকবর আলী (হাজীপুর), হরিপদ রায় (ধলজান), সমেশ্বর সিং (ধলজান) এবং পরেশ চন্দ্র তালুকদার (ধলজান)। [মো. ইকবাল হোসেন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড