মুক্তিযুদ্ধে রাণীশংকৈল উপজেলা (ঠাকুরগাঁও)
রাণীশংকৈল উপজেলা (ঠাকুরগাঁও) একটি সীমান্তবর্তী এলাকা। এ উপজেলার উত্তরে বালিয়াডাঙ্গী ও ঠাকুরগাঁও উপজেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণে পীরগঞ্জ উপজেলা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, পূর্বে পীরগঞ্জ এবং পশ্চিমে হরিপুর উপজেলা। ১৮৩৭ সালে গঠিত রাণীশংকৈল দেশের পুরনো থানাগুলোর একটি। উত্তরের একেবারে প্রান্তসীমায় অবস্থিত এ থানা পাকিস্তান আমলে যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষিসহ সব ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ অবস্থায় ছিল। ৫২-র -ভাষা-আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এ এলাকার মানুষকে পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে অনুপ্রাণিত করে। ৭০- এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এর জয়লাভ মানুষকে প্রচণ্ড আশাবাদী করে তোলে। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরে শাসকগোষ্ঠীর তালবাহানা অন্যান্য এলাকার মতো রাণীশংকৈলের প্রতিবাদী জনতাকেও সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বাধ্য করে।
পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে স্থানীয় পর্যায়ে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য আজিজুর রহমান এমএনএ-এর উদ্যোগে রাণীশংকৈলে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। থানার মডেল স্কুল মাঠে এ কমিটির প্রথম বৈঠক হয়। এখানে থানা আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত করার জন্য হোসেনগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলী আকবরকে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপর আলী আকবর রাণীশংকৈলে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠকে পরিণত হন। মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম সংগঠিত করার জন্য তাঁর সঙ্গে সম্পৃক্ত হন প্রগতি ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও রাণীশংকৈল থানার শিক্ষা-সংস্কৃতি ক্ষেত্রের পরিচিত ব্যক্তিত্ব নফিজউদ্দিন। এঁদের সঙ্গে যুক্ত হন স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চেয়ারম্যান ইমরান আলী, ছাত্রনেতা মিজানুর রহমান ও হামিদুর রহমান। এঁদের সকলের প্রচেষ্টায় রাণীশংকৈলে মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ব্যাপকতা লাভ করে।
২৭শে মার্চ থেকে থানার ডাক বাংলা মাঠে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এখানে এলাকার ছাত্র-যুবকদের সশস্ত্র যুদ্ধের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন আবু সুফিয়ান ও সাইফুল ইসলাম। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে রাণীশংকৈলের অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকেও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। রাণীশংকৈলে মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম ও সুরেশ চন্দ্র রায়।
মে মাসে পাকবাহিনী রাণীশংকৈলে অনুপ্রবেশ করে এবং থানায় স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। উপজেলা সদরের বন্দর এলাকার মহেন্দ্র নাথ বসাকের দোতলা বাড়ি দখল করে রাজাকাররা ক্যাম্প স্থাপন করে। কাশিপুরেও তাদের একটি ক্যাম্প ছিল। এছাড়া থানার বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনতাবিরোধী বিহারিদের ঘাঁটি ছিল। এসব ক্যাম্প ও ঘাঁটি থেকে তারা এলাকার মানুষের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন চালাত।
রাণীশংকৈলে বিহারিদের একটি বড় অংশের বসবাস ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী রাণীশংকৈলে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর স্থানীয় বিহারিদের অনেকে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করা শুরু করে। এরা শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করে। রহিম ম্যানেজার ও শামসুদ্দীন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এ থানায় যারা রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর নেতৃত্ব দেয় তারা হলো- পেশোয়ারী, দবির চেয়ারম্যান, আজলু বিশ্বাস, জাবেদ মাস্টার, আব্দুল, মজিবর (রাশু), আজিজুল, আলী বিহারি, রহমত উল্লাহ, জবদুল (মালদহিয়া), নঈমুদ্দিন, জমশেদ মাস্টার, বালা পিনা প্রমুখ।
পাকবাহিনী ও রাজাকাররা রাণীশংকৈলের বিভিন্ন স্থানে হত্যা, গণহত্যা, নারীনির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ করে। রাণীশংকৈলে সবচেয়ে বড় গণহত্যা সংঘটিত হয় বলিদ্বারা গ্রামে। ১২ই মে তারা এখানে ২০ জন মানুষকে হত্যা করে। এ ঘটনা বলিদ্বারা গণহত্যা নামে পরিচিত পাকবাহিনী ১৭ই মে কাশিপুরে ৯ জন মানুষকে হত্যা করে কাশিপুর গণহত্যায় এলাকার কয়েকজন গণমান্য ও নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। হরিনিয়া ও জোগাঁ গ্রামে রাজাকাররা অনেক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। থানার বিভিন্ন গ্রামে নারীরা পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা নির্যাতিত হন। পাকবাহিনী ও রাজাকাররা রাণীশংকৈল- হরিপুর রাস্তা-সংলগ্ন নলদীঘিতে দুই সহোদর নেকমরদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ডা. রহমান ও সহমানকে হত্যা করে একই গর্তে মাটিচাপা দেয়।
থানায় স্থাপিত ক্যাম্পটি ছিল রাণীশংকৈলে পাকবাহিনীর সবচেয়ে বড় নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। এখানে বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনকে ধরে এনে বন্দি করে রেখে নির্যাতন করা হতো।
রাণীশংকৈলের খুনিয়াদিঘি বধ্যভূমি ঠাকুরগাঁও জেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি। এখানে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা ২ হাজার মানুষকে হত্যা করে। এছাড়া থানার অপর একটি উল্লেখযোগ্য বধ্যভূমি হলো কাশিপুর বধ্যভূমি। রাণীশংকৈলের নলদিঘি, মমরেজপুর, শিয়ালগাজী পুকুর, নেকমরদ কুশুমউদ্দিন বালিকা বিদ্যালয়ের সম্মুখস্থ জায়গায় গণকবর রয়েছে।
পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো যুদ্ধ রাণীশংকৈলে হয়নি। জুলাই মাসে মুক্তিযোদ্ধারা শহরের বন্দর এলাকার পার্শ্ববর্তী কুলিক ব্রিজটি বম্বিং করে উড়িয়ে দিতে গেলে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দেয়। তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী কৌশলে ব্রিজে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে ফিরে আসেন। ৩রা ডিসেম্বর রাণীশংকৈল উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
রাণীশংকৈলের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আ. খালেক (রাণীশংকৈল) এবং ইসাহাক আলী (ধর্মগড়)।
রাণীশংকৈলের খুনিয়াদিঘি বধ্যভূমিতে একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ এবং রাণীশংকৈল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘চিরঞ্জীব ৭১’ নামে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। [মো. তাজুল ইসলাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড